Table of Contents
ভূমিকা
বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি (Argument from Scientific Foreknowledge in Sacred Texts) দাবি করে যে পবিত্র গ্রন্থে এমন উন্নত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান রয়েছে যা মানব দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে আবিষ্কৃত হওয়ার আগে লেখা হয়েছিল। এই তথ্য হয় ঈশ্বর কর্তৃক পবিত্র গ্রন্থের লেখকদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল অথবা আদম ও হাওয়ার কাছ থেকে লেখকদের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রেরিত হয়েছিল।
আনুষ্ঠানিক যুক্তি (Formal Argument)
- একটি পবিত্র গ্রন্থে নির্দিষ্ট সঠিক জ্ঞান রয়েছে।
- এই জ্ঞান মানুষের দ্বারা অনুমান বা আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না।
- তাই সেই জ্ঞানের উৎস ঈশ্বর হতে পারে।
- ঐ জ্ঞানের অন্য কোন পরিচিত উৎস নেই।
- (1), (3) এবং (4) থেকে, জ্ঞান অবশ্যই ঈশ্বর থেকে এসেছে।
- (5) থেকে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।
নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উদাহরণ (Specific Instances of Scientific Knowledge)
অনেক দাবির মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হলো।
বাইবেল (The Bible)
- স্বাস্থ্যবিধির জন্য প্রবাহিত জল ব্যবহার।
- ডাইনোসরের অস্তিত্ব।
- পৃথিবী গোলাকার।
- মহাবিশ্বের একটি সীমিত বয়স আছে।
- গ্রহাণু দ্বারা সৃষ্ট ব্যাপক বিলুপ্তি।
- পৃথিবী একটি শূন্যস্থানে অবস্থিত।
- পদার্থ কণিকা দিয়ে গঠিত।
- স্থিতিশীলতার জন্য জাহাজ নির্মাণের মাত্রা।
- মহাসাগরের স্রোত এবং সমুদ্রের তলদেশের ঝর্ণা এবং পর্বতমালার অস্তিত্ব।
কুরআন (The Qur’an)
- মহাবিস্ফোরণ (The big bang)।
- মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ।
- পালসার (Pulsars)।
- আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণ।
- করোনারি বাইপাস সার্জারি।
বেদ এবং অন্যান্য হিন্দু গ্রন্থ (Vedas and other Hindu texts)
- মহাবিশ্বের জন্ম।
- মহাকর্ষ।
- আলোর গতি।
- স্টেম সেল গবেষণা।
এই উদাহরণগুলো দাবি করে যে পবিত্র গ্রন্থগুলোতে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা লেখার সময়ে মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, এবং সেই কারণেই এই তথ্য ঈশ্বর কর্তৃক প্রদান করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়।
সমালোচনা (Criticism)
অজ্ঞতার যুক্তি (Argument from Ignorance)
আগে অজ্ঞতার যুক্তি কী তা নিয়ে একটু আলোচনা করে নেয়া যাক। অজ্ঞতার যুক্তি (Argument from Ignorance) (লাতিন: argumentum ad ignorantiam) বা আপিল টু ইগনরেন্স (appeal to ignorance) হলো একটি লজিকাল ফ্যালাসি যা অনানুষ্ঠানিক যুক্তিবিদ্যার (informal logic) মধ্যে পড়ে। এই ভুলটি ঘটে যখন কেউ দাবি করে যে একটি প্রস্তাবনা সত্য কারণ এটি এখনও মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি অথবা একটি প্রস্তাবনা মিথ্যা কারণ এটি এখনও সত্য প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু একটি প্রস্তাবনা এখনও সত্য প্রমাণিত না হয়, তাহলে শুধুমাত্র এই ভিত্তিতে এটিকে মিথ্যা বলা যায় না, এবং যদি একটি প্রস্তাবনা এখনও মিথ্যা প্রমাণিত না হয়, তাহলে শুধুমাত্র এই ভিত্তিতে এটিকে সত্য বলা যায় না। অজ্ঞতার যুক্তি শব্দটি সম্ভবত ১৭শ শতাব্দীর শেষের দিকে দার্শনিক জন লক (John Locke) দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। উদাহরণ –
- প্রস্তাবনার সত্যতা প্রমাণের অভাব:
- “কোনও প্রমাণ নেই যে ভিনগ্রহের প্রাণী (aliens) আমাদের পৃথিবীতে এসেছে, তাই ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।”
- “কেউ এখনও ভূতদের (ghosts) অস্তিত্ব অপ্রমাণ করতে পারেনি, তাই ভূতদের অস্তিত্ব রয়েছে।”
- প্রস্তাবনার মিথ্যা প্রমাণের অভাব:
- “কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে ঈশ্বর (God) নেই, তাই ঈশ্বর আছেন।”
- “কেউ এখনও বলিনি যে এটি একটি ভাল ধারণা নয়, তাই এটি অবশ্যই একটি ভাল ধারণা।”
অজ্ঞতার আহ্বান প্রায়ই বিতর্কে প্রমাণের বোঝা বা বার্ডেন অফ প্রুফ (burden of proof) স্থানান্তর করার একটি প্রচেষ্টা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি দাবি করে যে ভিনগ্রহের প্রাণী বিদ্যমান এবং বলে যে “আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না যে তারা নেই,” তবে এটি প্রমাণের বোঝা স্থানান্তর করার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে। সারাংশে, অজ্ঞতার যুক্তি হল যখন কেউ প্রমাণের অভাবে একটি প্রস্তাবনার সত্যতা বা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। এটি একটি ভুল যুক্তি কারণ প্রমাণের অভাব নিজেই প্রস্তাবনার সত্যতা বা মিথ্যাকে প্রমাণ করে না।
তো ধর্মগ্রন্থে উপস্থিত বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের অন্য কোন উৎস পাওয়া যাচ্ছে না, সুতরাং এটা ঈশ্বরের দান – এটা আর্গুমেন্ট ফ্রম ইগরেন্সই হচ্ছে। এই জ্ঞানের উৎস্য যে ঈশ্বরই তার কোন সরাসরি প্রমাণ নেই। ঈশ্বরের ধারণা প্রমাণিত না করে এটিকে ঈশ্বর বলে দাবি করা হচ্ছে এখানে, তাই এটি একটি অজ্ঞতার যুক্তি (argument from ignorance) হচ্ছে। ঠিক একইভাবে এও দাবি করা যায় যে, এই ধর্মগ্রন্থগুলো এটি একটি হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা বা ভিনগ্রহের প্রাণীদেরও দান হতে পারে।
এর প্রতিক্রিয়ায় খ্রিস্টানরা বলে থাকেন যে, বাইবেলের লেখকরা বহু স্থানে দাবি করেছেন যে তারা যা লিখেছেন তা ঈশ্বরের কাছ থেকে শোনা। লেখকরাই আমাদের বলেন যে এই জ্ঞানের উৎস একটি উচ্চতর জ্ঞানের সত্তা, অর্থাৎ ঈশ্বর।
খ্রিস্টানদের মতে, বাইবেলের লেখকরা সেই সময়ের প্রচলিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিপরীতে কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। তারা বলেন, বাইবেলের লেখকরা যদি সেই যুগের প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু লিখে থাকেন, তবে এটি একটি বড় বিষয়। কারণ, সাধারণত মানুষ তাদের সময়ের প্রচলিত জ্ঞানের বিপরীতে কিছু লিখতে সাহস করে না। যদি লেখকরা এমন কিছু লিখে থাকেন যা তাদের সময়ে প্রচলিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে মেলে না, তবে তাদের এই জ্ঞান বাইরের কোনও উৎস থেকে আসতে পারে, যেমন ঈশ্বর।
সহজ ভাষায়, খ্রিস্টানদের যুক্তি হল যে বাইবেলের লেখকরা তাদের নিজের সময়ের প্রচলিত বিশ্বাস বা জ্ঞানের বিপরীতে কিছু লিখেছেন, যা তারা নিজেদের থেকে জানার কথা নয়। তাই, তাদের মতে, এই জ্ঞান বাইরের কোনও উচ্চতর উৎস থেকে, অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে।
তাদের মতে, বাইবেলের লেখকরা সত্যিই তাদের সময়ের প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু লিখে থাকেন, তবে এটি প্রমাণ করে যে তারা বাইরের কোনও উচ্চতর জ্ঞানের উৎস থেকে এই তথ্য পেয়েছিলেন।
কিন্তু এরও সমালোচনা করা যেতে পারে –
- পূর্বধারণার প্রভাব: বাইবেলের লেখকদের বৈজ্ঞানিক তথ্য বা ধারণা লিখতে হলে সেগুলোকে সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি। অনেক সময়, নতুন বা ভিন্ন ধারণা প্রকাশ করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হতে পারে যেখানে লেখকরা নিজেদের পর্যবেক্ষণ এবং চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তাদের লেখায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এর অর্থ এই নয় যে এটি বাইরের কোনো উর্ধ্বতন সত্তার কাছ থেকে এসেছে।
- ভুল ব্যাখ্যার সম্ভাবনা: বাইবেলের অনেক তথ্য পরে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এর অনেক অর্থই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার সাথে মিলে যায় না। একে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে বিশ্লেষণ করা উচিত নয়। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, সেই সময়ের লেখকরা তাদের উপলব্ধি এবং সীমিত জ্ঞান অনুযায়ী তাদের লেখায় তথ্য অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
- যৌক্তিক উপসংহার নয়: বাইবেলের লেখকদের বৈজ্ঞানিক তথ্য যদি তাদের সময়ের প্রচলিত জ্ঞান বা বিশ্বাসের বিপরীতে হয়, তবে এর মানে এই নয় যে এটি নিশ্চিতভাবে বাইরের কোনো উচ্চতর উৎস থেকে এসেছে। উদ্ভাবনী চিন্তা বা সৃজনশীলতা যেকোনো সময় এবং যেকোনো স্থানে উত্থান হতে পারে, এবং এটি কোনো অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ নয়।
- প্রমাণের অভাব: উচ্চতর উৎস থেকে তথ্য এসেছে এ ধরনের দাবি করতে হলে কঠোর প্রমাণ দরকার। শুধুমাত্র লেখকদের ভাষ্যকে সত্য বলে মেনে নেয়া যৌক্তিক নয়, বিশেষ করে যখন লেখাগুলো ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবেচিত হয়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষাযোগ্য ও যাচাইযোগ্য প্রমাণ ছাড়া, এমন দাবিগুলি যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
- বিকল্প ব্যাখ্যা: লেখকদের নতুন বা অপ্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণা তাদের সময়ের বাহিরে কোনো উৎস থেকে এসেছে বলার চেয়ে, এটি সম্ভাব্য যে তারা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার মাধ্যমে নতুন ধারণা উদ্ভাবন করেছেন। অনেক সময়, স্বাধীনভাবে ভাবনা-চিন্তা করা এবং পর্যবেক্ষণ করা নতুন আবিষ্কারের পথ তৈরি করতে পারে।
কিছু দাবির ভুল (Errors in Some Claims)
বাইবেল এবং কুরআন অনেক দাবি করে, কিন্তু তাদের কিছু দাবি মিথ্যা হিসাবে যাচাই করা যেতে পারে। এটি ইঙ্গিত করে যে বইগুলির উৎসগুলির মধ্যে এক বা একাধিক উৎস ত্রুটিযুক্ত। যদি জ্ঞানের উৎস একটি নিখুঁত ঈশ্বর হত, তাহলে আমরা আশা করতাম যে সমস্ত জ্ঞান সঠিক হবে, যা বাস্তবতা নয়। সঠিক দাবিগুলিকে চেরি পিকিং (cherry picking) করে জোর দেওয়া হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিবাদকে সমর্থন করে, তবে সেই তত্ত্বটি মূলধারার বিজ্ঞান দ্বারা ভুল বলে বিবেচিত হয়।
সাধারণ জ্ঞান (Common Knowledge)
পবিত্র গ্রন্থগুলো সাধারণত একটি গোষ্ঠীর রীতি এবং জ্ঞানের রেকর্ড। সঠিক অংশগুলি সম্ভবত লেখার সময় সাধারণ জ্ঞান ছিল এবং কোনও বাইরের অনুপ্রেরণার প্রয়োজন ছিল না। এখন কোন কালচারেই যে কোন না কোন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছিলনা এটা প্রমাণ করা তো কঠিন, কেননা যদি কোন একটি কালচারের ধর্মগ্রন্থে কোন বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভুল বের করাও যায়, তার মানেও তো এটা দাঁড়ায় না যে সেই গ্রন্থটা রচিত হবার সময় সেই কালচারের সকলেই ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত সেই ভুলটাই মানত। অন্য লোকেরা সঠিকটা জানতেও পারত, যা লিখিত আকারে রেকর্ডেড হয়নি। তো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগুলো সাধারণ জ্ঞান হিসেবেই সেই কালচারগুলোতে উপস্থিত থেকে যেতে পারে, সেটার বাইরের কোনো উৎস থেকে আসা জরুরি নয়।
পবিত্র গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান হিসাবে যা বিবেচনা করা হয় তা প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট সময় এবং সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল। এই ধরনের তথ্যগুলি প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট কৌশল, পর্যবেক্ষণ বা প্রবৃত্তি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যা তখনকার সময়ে বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যবিধির জন্য প্রবাহিত জল ব্যবহার একটি সাধারণ জ্ঞান ছিল যা শুধুমাত্র পবিত্র গ্রন্থে নয়, অন্যান্য সমসাময়িক লিখিত রেকর্ডেও পাওয়া যায়।
প্রমাণের অনুপস্থিতিতে, একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কেবল অনুমান হতে পারে। জ্ঞানটি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে বলে দাবিটি সমানভাবে শক্তিশালী অন্য কোনও সম্ভাব্য উৎসকেও অন্তর্ভুক্ত করে না, যেমন একটি প্রাচীন সভ্যতা বা স্বতন্ত্র উদ্ভাবন।
Leave a Reply