ধর্মীয় গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞানের যুক্তি (Argument from Scientific Foreknowledge in Sacred Texts)

ভূমিকা

বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি (Argument from Scientific Foreknowledge in Sacred Texts) দাবি করে যে পবিত্র গ্রন্থে এমন উন্নত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান রয়েছে যা মানব দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে আবিষ্কৃত হওয়ার আগে লেখা হয়েছিল। এই তথ্য হয় ঈশ্বর কর্তৃক পবিত্র গ্রন্থের লেখকদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল অথবা আদম ও হাওয়ার কাছ থেকে লেখকদের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রেরিত হয়েছিল।

আনুষ্ঠানিক যুক্তি (Formal Argument)

  1. একটি পবিত্র গ্রন্থে নির্দিষ্ট সঠিক জ্ঞান রয়েছে।
  2. এই জ্ঞান মানুষের দ্বারা অনুমান বা আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না।
  3. তাই সেই জ্ঞানের উৎস ঈশ্বর হতে পারে।
  4. ঐ জ্ঞানের অন্য কোন পরিচিত উৎস নেই।
  5. (1), (3) এবং (4) থেকে, জ্ঞান অবশ্যই ঈশ্বর থেকে এসেছে।
  6. (5) থেকে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।

নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উদাহরণ (Specific Instances of Scientific Knowledge)

অনেক দাবির মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হলো।

বাইবেল (The Bible)

  • স্বাস্থ্যবিধির জন্য প্রবাহিত জল ব্যবহার।
  • ডাইনোসরের অস্তিত্ব।
  • পৃথিবী গোলাকার।
  • মহাবিশ্বের একটি সীমিত বয়স আছে।
  • গ্রহাণু দ্বারা সৃষ্ট ব্যাপক বিলুপ্তি।
  • পৃথিবী একটি শূন্যস্থানে অবস্থিত।
  • পদার্থ কণিকা দিয়ে গঠিত।
  • স্থিতিশীলতার জন্য জাহাজ নির্মাণের মাত্রা।
  • মহাসাগরের স্রোত এবং সমুদ্রের তলদেশের ঝর্ণা এবং পর্বতমালার অস্তিত্ব।

কুরআন (The Qur’an)

  • মহাবিস্ফোরণ (The big bang)।
  • মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ।
  • পালসার (Pulsars)।
  • আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণ।
  • করোনারি বাইপাস সার্জারি।

বেদ এবং অন্যান্য হিন্দু গ্রন্থ (Vedas and other Hindu texts)

  • মহাবিশ্বের জন্ম।
  • মহাকর্ষ।
  • আলোর গতি।
  • স্টেম সেল গবেষণা।

এই উদাহরণগুলো দাবি করে যে পবিত্র গ্রন্থগুলোতে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা লেখার সময়ে মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, এবং সেই কারণেই এই তথ্য ঈশ্বর কর্তৃক প্রদান করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়।

সমালোচনা (Criticism)

অজ্ঞতার যুক্তি (Argument from Ignorance)

আগে অজ্ঞতার যুক্তি কী তা নিয়ে একটু আলোচনা করে নেয়া যাক। অজ্ঞতার যুক্তি (Argument from Ignorance) (লাতিন: argumentum ad ignorantiam) বা আপিল টু ইগনরেন্স (appeal to ignorance) হলো একটি লজিকাল ফ্যালাসি যা অনানুষ্ঠানিক যুক্তিবিদ্যার (informal logic) মধ্যে পড়ে। এই ভুলটি ঘটে যখন কেউ দাবি করে যে একটি প্রস্তাবনা সত্য কারণ এটি এখনও মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি অথবা একটি প্রস্তাবনা মিথ্যা কারণ এটি এখনও সত্য প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু একটি প্রস্তাবনা এখনও সত্য প্রমাণিত না হয়, তাহলে শুধুমাত্র এই ভিত্তিতে এটিকে মিথ্যা বলা যায় না, এবং যদি একটি প্রস্তাবনা এখনও মিথ্যা প্রমাণিত না হয়, তাহলে শুধুমাত্র এই ভিত্তিতে এটিকে সত্য বলা যায় না। অজ্ঞতার যুক্তি শব্দটি সম্ভবত ১৭শ শতাব্দীর শেষের দিকে দার্শনিক জন লক (John Locke) দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। উদাহরণ –

  1. প্রস্তাবনার সত্যতা প্রমাণের অভাব:
    • “কোনও প্রমাণ নেই যে ভিনগ্রহের প্রাণী (aliens) আমাদের পৃথিবীতে এসেছে, তাই ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।”
    • “কেউ এখনও ভূতদের (ghosts) অস্তিত্ব অপ্রমাণ করতে পারেনি, তাই ভূতদের অস্তিত্ব রয়েছে।”
  2. প্রস্তাবনার মিথ্যা প্রমাণের অভাব:
    • “কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে ঈশ্বর (God) নেই, তাই ঈশ্বর আছেন।”
    • “কেউ এখনও বলিনি যে এটি একটি ভাল ধারণা নয়, তাই এটি অবশ্যই একটি ভাল ধারণা।”

অজ্ঞতার আহ্বান প্রায়ই বিতর্কে প্রমাণের বোঝা বা বার্ডেন অফ প্রুফ (burden of proof) স্থানান্তর করার একটি প্রচেষ্টা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি দাবি করে যে ভিনগ্রহের প্রাণী বিদ্যমান এবং বলে যে “আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না যে তারা নেই,” তবে এটি প্রমাণের বোঝা স্থানান্তর করার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে। সারাংশে, অজ্ঞতার যুক্তি হল যখন কেউ প্রমাণের অভাবে একটি প্রস্তাবনার সত্যতা বা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। এটি একটি ভুল যুক্তি কারণ প্রমাণের অভাব নিজেই প্রস্তাবনার সত্যতা বা মিথ্যাকে প্রমাণ করে না।

তো ধর্মগ্রন্থে উপস্থিত বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের অন্য কোন উৎস পাওয়া যাচ্ছে না, সুতরাং এটা ঈশ্বরের দান – এটা আর্গুমেন্ট ফ্রম ইগরেন্সই হচ্ছে। এই জ্ঞানের উৎস্য যে ঈশ্বরই তার কোন সরাসরি প্রমাণ নেই। ঈশ্বরের ধারণা প্রমাণিত না করে এটিকে ঈশ্বর বলে দাবি করা হচ্ছে এখানে, তাই এটি একটি অজ্ঞতার যুক্তি (argument from ignorance) হচ্ছে। ঠিক একইভাবে এও দাবি করা যায় যে, এই ধর্মগ্রন্থগুলো এটি একটি হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা বা ভিনগ্রহের প্রাণীদেরও দান হতে পারে।

এর প্রতিক্রিয়ায় খ্রিস্টানরা বলে থাকেন যে, বাইবেলের লেখকরা বহু স্থানে দাবি করেছেন যে তারা যা লিখেছেন তা ঈশ্বরের কাছ থেকে শোনা। লেখকরাই আমাদের বলেন যে এই জ্ঞানের উৎস একটি উচ্চতর জ্ঞানের সত্তা, অর্থাৎ ঈশ্বর।

খ্রিস্টানদের মতে, বাইবেলের লেখকরা সেই সময়ের প্রচলিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিপরীতে কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। তারা বলেন, বাইবেলের লেখকরা যদি সেই যুগের প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু লিখে থাকেন, তবে এটি একটি বড় বিষয়। কারণ, সাধারণত মানুষ তাদের সময়ের প্রচলিত জ্ঞানের বিপরীতে কিছু লিখতে সাহস করে না। যদি লেখকরা এমন কিছু লিখে থাকেন যা তাদের সময়ে প্রচলিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে মেলে না, তবে তাদের এই জ্ঞান বাইরের কোনও উৎস থেকে আসতে পারে, যেমন ঈশ্বর।

সহজ ভাষায়, খ্রিস্টানদের যুক্তি হল যে বাইবেলের লেখকরা তাদের নিজের সময়ের প্রচলিত বিশ্বাস বা জ্ঞানের বিপরীতে কিছু লিখেছেন, যা তারা নিজেদের থেকে জানার কথা নয়। তাই, তাদের মতে, এই জ্ঞান বাইরের কোনও উচ্চতর উৎস থেকে, অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে।

তাদের মতে, বাইবেলের লেখকরা সত্যিই তাদের সময়ের প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু লিখে থাকেন, তবে এটি প্রমাণ করে যে তারা বাইরের কোনও উচ্চতর জ্ঞানের উৎস থেকে এই তথ্য পেয়েছিলেন।

কিন্তু এরও সমালোচনা করা যেতে পারে –

  1. পূর্বধারণার প্রভাব: বাইবেলের লেখকদের বৈজ্ঞানিক তথ্য বা ধারণা লিখতে হলে সেগুলোকে সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি। অনেক সময়, নতুন বা ভিন্ন ধারণা প্রকাশ করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হতে পারে যেখানে লেখকরা নিজেদের পর্যবেক্ষণ এবং চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তাদের লেখায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এর অর্থ এই নয় যে এটি বাইরের কোনো উর্ধ্বতন সত্তার কাছ থেকে এসেছে।
  2. ভুল ব্যাখ্যার সম্ভাবনা: বাইবেলের অনেক তথ্য পরে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এর অনেক অর্থই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার সাথে মিলে যায় না। একে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে বিশ্লেষণ করা উচিত নয়। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, সেই সময়ের লেখকরা তাদের উপলব্ধি এবং সীমিত জ্ঞান অনুযায়ী তাদের লেখায় তথ্য অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
  3. যৌক্তিক উপসংহার নয়: বাইবেলের লেখকদের বৈজ্ঞানিক তথ্য যদি তাদের সময়ের প্রচলিত জ্ঞান বা বিশ্বাসের বিপরীতে হয়, তবে এর মানে এই নয় যে এটি নিশ্চিতভাবে বাইরের কোনো উচ্চতর উৎস থেকে এসেছে। উদ্ভাবনী চিন্তা বা সৃজনশীলতা যেকোনো সময় এবং যেকোনো স্থানে উত্থান হতে পারে, এবং এটি কোনো অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ নয়।
  4. প্রমাণের অভাব: উচ্চতর উৎস থেকে তথ্য এসেছে এ ধরনের দাবি করতে হলে কঠোর প্রমাণ দরকার। শুধুমাত্র লেখকদের ভাষ্যকে সত্য বলে মেনে নেয়া যৌক্তিক নয়, বিশেষ করে যখন লেখাগুলো ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবেচিত হয়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষাযোগ্য ও যাচাইযোগ্য প্রমাণ ছাড়া, এমন দাবিগুলি যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
  5. বিকল্প ব্যাখ্যা: লেখকদের নতুন বা অপ্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণা তাদের সময়ের বাহিরে কোনো উৎস থেকে এসেছে বলার চেয়ে, এটি সম্ভাব্য যে তারা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার মাধ্যমে নতুন ধারণা উদ্ভাবন করেছেন। অনেক সময়, স্বাধীনভাবে ভাবনা-চিন্তা করা এবং পর্যবেক্ষণ করা নতুন আবিষ্কারের পথ তৈরি করতে পারে।

কিছু দাবির ভুল (Errors in Some Claims)

বাইবেল এবং কুরআন অনেক দাবি করে, কিন্তু তাদের কিছু দাবি মিথ্যা হিসাবে যাচাই করা যেতে পারে। এটি ইঙ্গিত করে যে বইগুলির উৎসগুলির মধ্যে এক বা একাধিক উৎস ত্রুটিযুক্ত। যদি জ্ঞানের উৎস একটি নিখুঁত ঈশ্বর হত, তাহলে আমরা আশা করতাম যে সমস্ত জ্ঞান সঠিক হবে, যা বাস্তবতা নয়। সঠিক দাবিগুলিকে চেরি পিকিং (cherry picking) করে জোর দেওয়া হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিবাদকে সমর্থন করে, তবে সেই তত্ত্বটি মূলধারার বিজ্ঞান দ্বারা ভুল বলে বিবেচিত হয়।

সাধারণ জ্ঞান (Common Knowledge)

পবিত্র গ্রন্থগুলো সাধারণত একটি গোষ্ঠীর রীতি এবং জ্ঞানের রেকর্ড। সঠিক অংশগুলি সম্ভবত লেখার সময় সাধারণ জ্ঞান ছিল এবং কোনও বাইরের অনুপ্রেরণার প্রয়োজন ছিল না। এখন কোন কালচারেই যে কোন না কোন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছিলনা এটা প্রমাণ করা তো কঠিন, কেননা যদি কোন একটি কালচারের ধর্মগ্রন্থে কোন বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভুল বের করাও যায়, তার মানেও তো এটা দাঁড়ায় না যে সেই গ্রন্থটা রচিত হবার সময় সেই কালচারের সকলেই ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত সেই ভুলটাই মানত। অন্য লোকেরা সঠিকটা জানতেও পারত, যা লিখিত আকারে রেকর্ডেড হয়নি। তো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগুলো সাধারণ জ্ঞান হিসেবেই সেই কালচারগুলোতে উপস্থিত থেকে যেতে পারে, সেটার বাইরের কোনো উৎস থেকে আসা জরুরি নয়।

পবিত্র গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান হিসাবে যা বিবেচনা করা হয় তা প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট সময় এবং সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল। এই ধরনের তথ্যগুলি প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট কৌশল, পর্যবেক্ষণ বা প্রবৃত্তি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যা তখনকার সময়ে বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যবিধির জন্য প্রবাহিত জল ব্যবহার একটি সাধারণ জ্ঞান ছিল যা শুধুমাত্র পবিত্র গ্রন্থে নয়, অন্যান্য সমসাময়িক লিখিত রেকর্ডেও পাওয়া যায়।

প্রমাণের অনুপস্থিতিতে, একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কেবল অনুমান হতে পারে। জ্ঞানটি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে বলে দাবিটি সমানভাবে শক্তিশালী অন্য কোনও সম্ভাব্য উৎসকেও অন্তর্ভুক্ত করে না, যেমন একটি প্রাচীন সভ্যতা বা স্বতন্ত্র উদ্ভাবন।

ধর্মীয় গ্রন্থের অর্থকে প্রত্যাশার সাথে মেলানোর চেষ্টা (Stretching Scriptural Meaning to Fit Expectations)

অনেক উদাহরণ কাব্যিক রূপক (poetic metaphors) যা বর্তমান বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির সাথে মেলানোর জন্য উল্লেখযোগ্য পরবর্তী ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয়। এটি নিশ্চিতকরণ বায়াস বা কনফারমেশন বায়াসের (confirmation bias) একটি উদাহরণ।

উদাহরণস্বরূপ, “বাতাসের ওজন আছে (Job 28:25)। একসময় মনে করা হতো যে বাতাসের ওজন নেই। কিন্তু ৪,০০০ বছর আগে জব ঘোষণা করেছিলেন যে ঈশ্বর ‘বাতাসের জন্য ওজন নির্ধারণ করেছেন।’ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আবহাওয়াবিদরা গণনা করেছেন যে গড় বজ্রঝড়ে হাজার হাজার টন বৃষ্টি থাকে। এই বোঝা বহন করতে, বাতাসের অবশ্যই ভর থাকতে হবে।”

তবে, এখানে একটি ত্রুটি আছে। বাতাসের ওজন এবং বাতাসের গতির (যেমন বাতাস বইছে) কারণে সৃষ্ট বল (force) দুটি ভিন্ন বিষয়। বাতাসের ওজন নির্ধারণ করা হয় বাতাসের ঘনত্ব এবং বায়ুচাপের (air pressure) মাধ্যমে, যা বাতাস চলমান (যেমন বাতাস বইছে) কিনা তার ওপর নির্ভর করে না। বাতাস চলমান না থাকলেও এর ওজন থাকে।

যদি উল্লিখিত অংশটি উচ্চ উচ্চতায় নিম্ন বায়ুচাপের (low air pressure) কথা বলত, তবে এটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত। কারণ উচ্চতায় বায়ুচাপ কমে যায় এবং বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়, যা বাতাসের ওজন কমিয়ে দেয়। এই ধরনের উল্লেখ আরও সুনির্দিষ্ট এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক হতে পারত।

তরুণ পৃথিবী (young earth) এবং প্রাচীন পৃথিবী সৃষ্টিবাদীরা (old earth creationists) দাবি করেন যে বাইবেল তাদের অবস্থান সমর্থন করে কিন্তু উভয় মতামত সঠিক হতে পারে না। বাইবেলকে নির্বাচনীভাবে বা সিলেক্টিভলি (selectively) ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করা যেতে পারে এবং এর খুব কম নির্দিষ্টতা বা স্পেসিফিক আছে। একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বের জন্য যদি পুরো একটি অধ্যায়কে উৎসর্গ করা যায় তাহলে সেই দাবির একটি শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু সেই তত্ত্বের জন্য ধর্মগ্রন্থের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সিলেক্টিভলি কিছু গসপেল বা আয়াত বা শ্লোককে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের রেফারেন্স হিসেবে তুলে ধরা, যেটারও আবার সিলেক্টিভ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়, সেটা নির্ভরযোগ্য হয়না।

বিজ্ঞান এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। যদি পবিত্র গ্রন্থগুলিতে অতিরিক্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকে, তাহলে সেই জ্ঞানগুলো পরীক্ষা করার জন্য পবিত্র গ্রন্থগুলি থেকে অনুমান তৈরি করা সম্ভব, যার দ্বারা বিজ্ঞানের উপকৃত হবার কথা। কিন্তু সেটাও কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ ধর্মগ্রন্থগুলোর ভাষা সাধারণত অস্পষ্টই থাকে। যদি পবিত্র গ্রন্থগুলি এমন কিছু পরীক্ষাযোগ্য অনুমান (testable hypothesis) সরবরাহ করতে না পারে যা বৈজ্ঞানিক উপায়ে আবিষ্কারের আগে থেকেই যাচাই করা যায়, তাহলে সেই জ্ঞানগুলিকে বৈজ্ঞানিক হিসাবে গণ্য করা যায় না। বরং, এগুলোকে প্রোটো-বৈজ্ঞানিক (proto-scientific) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার অর্থ এই জ্ঞানগুলি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরে রয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও পবিত্র গ্রন্থে বলা হয় “আলো দ্রুতগামী,” এটি একটি অস্পষ্ট বক্তব্য। বৈজ্ঞানিক উপায়ে এটি পরীক্ষা করার জন্য আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন, যেমন আলো কিভাবে এবং কত দ্রুতগামী। পবিত্র গ্রন্থে সাধারণত এই ধরনের নির্দিষ্টতা থাকে না, যা তাদের জ্ঞানকে পরীক্ষাযোগ্য করে তোলে না।

অনুমানের সাথে যৌক্তিক জ্ঞানের পার্থক্য করা (Distinguishing Guesses from Justified Knowledge)

আমাদের পবিত্র গ্রন্থে অনুমান এবং যৌক্তিক জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করার একটি উপায় প্রয়োজন। এটি ছাড়া, আমরা এই ধারণা করতে পারি না যে জ্ঞানের দাবি একটি সঠিক অনুমান ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, ডেমোক্রিটাস (Democritus) (৪৬০ খ্রি.পূ. – ৩৭০ খ্রি.পূ.) ভেবেছিলেন যে সবকিছু কণিকা দিয়ে তৈরি। যদিও এই তত্ত্বটি সত্য, তার এটি যাচাই করার কোন উপায় ছিল না এবং এটি কিছুটা একটি সঠিক অনুমান ছিল।

একাধিক ধর্মের বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান দাবী (Multiple Religions Claim Foreknowledge)

বিভিন্ন ধর্ম তাদের পবিত্র গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান থাকার দাবি করে থাকে। কিন্তু এই দাবিগুলি প্রায়ই একে অপরের সাথে অসঙ্গত বা বিরোধপূর্ণ হয়। যখন একাধিক ধর্ম একই সময়ে বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান দাবি করে এবং তাদের দাবিগুলি একে অপরের সাথে মেলে না, তখন এই দাবিগুলি নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য হয় না। এটি একটি অবিশ্বাস্য পরীক্ষা (unreliable test) হয়ে যায় কারণ আমরা জানি না কোন ধর্মের দাবি সঠিক। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ধর্ম দাবি করে যে তাদের গ্রন্থে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য রয়েছে, এবং অন্য একটি ধর্মও একই দাবি করে কিন্তু তাদের তথ্য প্রথম ধর্মের তথ্যের সাথে মেলে না, তাহলে এই পরিস্থিতিতে আমরা বুঝতে পারি না কোন দাবিটি সঠিক। তাই, একাধিক ধর্মের বৈজ্ঞানিক পূর্বজ্ঞান দাবী করার কারণে এই দাবিগুলি নির্ভরযোগ্যতা হারায় এবং আমরা শুধুমাত্র এই ভিত্তিতে কোন ঈশ্বর বৈধ তা নির্ধারণ করতে পারি না।

সংশ্লিষ্ট যুক্তি (Related Arguments)

বাইবেল সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ করে লেখা হয়েছিল (The Bible was Simplified by its Authors for a General Audience)

এপোলজেটিক বা ধর্মের পক্ষে যারা যুক্তি দেয় (apologists) তারা দাবি করেন যে বাইবেলের কিছু অংশ সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ করে লেখা হয়েছিল। তাই, এই বিষয়বস্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির সাথে পুরোপুরি মিল নাও করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জেনেসিস (Genesis) এর সৃষ্টির গল্প আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের (cosmology) সাথে কিছুটা মিল রাখলেও এটি তার পাঠকদের জন্য অনেক সহজ করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তবে এই যুক্তির কিছু সমালোচনা আছে –

  • বিজ্ঞান ও সরলীকরণ: বিজ্ঞানসম্মত তথ্য সাধারণত নির্ভুল এবং পরীক্ষাযোগ্য হয়। যদি কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ সাধারণ পাঠকের জন্য তথ্য সরলীকরণ করে উপস্থাপন করে, তবে তা বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক তথ্যের নির্ভুলতা ও প্রমাণযোগ্যতার অভাব একটি ধর্মীয় গ্রন্থকে বিজ্ঞানসম্মত করার পরিবর্তে প্রাথমিক বা আদি ধাপের জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
  • প্রাসঙ্গিকতা ও নির্ভুলতা: সরলীকৃত উপস্থাপনা প্রায়ই নির্ভুলতা ও প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে। যদি বাইবেলের সৃষ্টির গল্প সরলীকৃত হয়, তবে তা আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের (cosmology) সাথে পুরোপুরি মিল না করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য সবসময় নির্ভুল এবং প্রসঙ্গানুযায়ী হওয়া উচিত।
  • পাঠকের বোঝাপড়া: ধর্মীয় গ্রন্থের সাধারণ পাঠকরা যদি সরলীকৃত তথ্যের মাধ্যমে বিষয়বস্তু বুঝতে পারেন, তবে সেই তথ্যটি স্বচ্ছ এবং প্রমাণযোগ্য হওয়া উচিত। সরলীকরণ যদি তথ্যের নির্ভুলতা নষ্ট করে, তবে তা বিজ্ঞানসম্মত দাবি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
  • প্রমাণের অভাব: সরলীকৃত তথ্যের ভিত্তিতে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর বৈজ্ঞানিক দাবিগুলি প্রমাণের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানসম্মত দাবি সবসময় পরীক্ষা ও প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হয়, যা সরলীকরণ প্রক্রিয়ায় সাধারণত হারিয়ে যায়।
  • ব্যাখ্যার সংকট: সরলীকৃত উপস্থাপনার ফলে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো প্রায়ই বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এই বহুমুখী ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের নির্ভরযোগ্যতা হ্রাস করে এবং প্রমাণের অভাবজনিত সমস্যাগুলির সৃষ্টি করে।
  • আধুনিক বিজ্ঞান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির সাথে ধর্মীয় গ্রন্থের মিল বা অমিল আলোচনা করতে গেলে সেই গ্রন্থের ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। বাইবেলের লেখা সময়কাল এবং প্রেক্ষাপট আধুনিক বিজ্ঞান থেকে ভিন্ন, যা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র –

Scientific foreknowledge in sacred texts – Religions Wiki

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.