প্রবলেম অফ ইভলের ধার্মিকদের দেয়া সমাধান – ফ্রি উইল ডিফেন্স, সোল মেকিং থিওডিসি, এবং স্কেপটিক্যাল থিওডিসির সমালোচনা

প্রবলেম অফ ইভল ও ধার্মিকদের দেয়া তার সমালোচনা

ঈশ্বর যদি থেকে থাকে তাহলে দুনিয়ায় এত দুঃখ, অশান্তি কেন? – এই প্রশ্নটা খুব কমন। দার্শনিকভাবে একে প্রবলেম অফ ইভল বা অশুভ সমস্যা বলা হয়। দার্শনিকভাবে দুরকম প্রবলেম অফ ইভল রয়েছে –

  • ১। লজিক্যাল প্রবলেম অফ ইভল (Logical Problem of Evil): এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং অশুভের অস্তিত্ব দুটি বিষয় একসাথে সত্য হতে পারে না। যদি ঈশ্বর সত্যিই সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, এবং সর্বোত্তম হন, তবে কোনভাবেই অশুভের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
  • ২। ইভিডেনশিয়াল প্রবলেম অফ ইভল (Evidential Problem of Evil): এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, অশুভের অস্তিত্বের কারণে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। অশুভের মাত্রা এবং প্রকার বিবেচনায়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং অশুভের অস্তিত্ব একসাথে থাকার সম্ভাবনা কম।

এখন এই প্রবলেম অফ ইভলের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনাও রয়েছে, বিশেষ করে ধার্মিকদের তিন ধরণের সমালোচনা দিতে দেখা যায় –

  • ১। ফ্রি উইল ডিফেন্স (Free Will Defense): এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ঈশ্বর মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং এই স্বাধীনতার কারণে মানুষ ভুল করতে পারে বা অশুভ কাজ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে, অশুভের অস্তিত্ব ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ এবং মানুষের স্বাধীনতার প্রমাণ।
  • ২। সোল মেকিং থিওডিসি (Soul-Making Theodicy): এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, দুঃখ-কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতা মানুষের চরিত্র এবং আত্মার উন্নতির জন্য প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতাগুলি মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশে সহায়তা করে।
  • ৩। স্কেপটিক্যাল থিওডিসি (Skeptical Theodicy): এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, মানুষের জ্ঞান এবং উপলব্ধি সীমাবদ্ধ, তাই ঈশ্বরের পরিকল্পনা বা অশুভের কারণ সম্পূর্ণরূপে বোঝা সম্ভব নয়।

আমি এই লেখায় এই ধার্মিকদের এই তিন রকম ডিফেন্সেরই সমালোচনা করতে যাচ্ছি। কিন্তু খুবই সংক্ষেপে করা হবে।

ফ্রি উইল ডিফেন্স এর সমালোচনা

  • ১. স্বতন্ত্র স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং নির্ধারিত ভবিষ্যত (Free Will vs. Determinism): ফ্রি উইল ডিফেন্স অনুযায়ী, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ। তবে, ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞ হন, তাহলে সব কিছু পূর্বেই নির্ধারিত। এই ক্ষেত্রে, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকলে ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা কিভাবে সম্ভব? যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ হন, তাহলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আসলেই স্বাধীন নয়, বরং ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ মাত্র। এই ক্ষেত্রে, মানুষের অশুভ কাজের দায় ঈশ্বরের উপরও আসে।
  • ২. অশুভের মাত্রা (Magnitude of Evil): পৃথিবীতে এত বেশি এবং এত নির্দয় অশুভ কেন আছে, যদি ঈশ্বরের পরিকল্পনা থাকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি যাচাই করার জন্য? উদাহরণস্বরূপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, মহামারী ইত্যাদি। এসব ঘটনা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বাইরে, তাই ঈশ্বর কেন এসব অশুভকে প্রতিহত করেন না?
  • ৩. স্বৈরাচারী স্বাধীনতা (Libertarian Free Will): ফ্রি উইল ডিফেন্স অনুযায়ী, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তবে, স্বৈরাচারী স্বাধীনতা না থাকলেও মানুষ এখনও নৈতিক এবং দায়িত্বশীল হতে পারে। ঈশ্বর যদি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তবে অশুভের মাত্রা কমানো সম্ভব।
  • ৪. নৈতিক উন্নতি (Moral Improvement): ফ্রি উইল ডিফেন্স অনুযায়ী, অশুভ এবং কষ্ট মানুষের নৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন। তবে, কিছু কষ্ট এবং অশুভ এমন যে এগুলি মানুষের নৈতিক উন্নতি নয় বরং বিপরীত প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, শিশু নির্যাতন, গণহত্যা ইত্যাদি।
  • ৫. অন্যান্য সৃষ্টিকর্তার বিকল্প (Alternative Creations): ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ হন, তাহলে তিনি এমন একটি জগৎ তৈরি করতে পারতেন যেখানে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে কিন্তু অশুভের অস্তিত্ব নেই। যেমন, মানুষ যদি শুধু ভালো কাজ করার ইচ্ছা পেত, তাহলে অশুভের অস্তিত্ব থাকার প্রয়োজন হতো না।
  • ৬. ফ্রি উইল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ নৈতিকতাবোধ (Free Will and Moral Autonomy): মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও ঈশ্বর একটি এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারতেন যেখানে নৈতিক এবং দায়িত্বশীল আচরণ বৃদ্ধি পায় এবং অশুভের মাত্রা কম থাকে। এই ক্ষেত্রে, মানুষের নৈতিকতাবোধ ঈশ্বরের পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বিত হতে পারত।
  • ৭. মুক্তির উদ্দেশ্য (Purpose of Freedom): ফ্রি উইল ডিফেন্স অনুযায়ী, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ঈশ্বরের একটি উপহার। তবে, এই মুক্তির উদ্দেশ্য যদি শুধুই অশুভ কাজ করা হয়, তাহলে এই মুক্তির মূল্য কি?

সোল মেকিং থিওডিসি এর সমালোচনা

  • ১. অশুভের মাত্রা এবং অনুপাতে সমস্যা (Magnitude and Disproportion of Evil): পৃথিবীতে এত বেশি অশুভ এবং কষ্ট কেন আছে, যা একেবারেই অতিরিক্ত মনে হয়। যেমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, মহামারী ইত্যাদি। এত বেশি কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতা আসলে মানুষের আত্মার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় নয়। অনেক সময় খুব বেশি কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতা মানুষের মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পরিবর্তে তাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারে এবং হতাশা, অবসাদ এবং নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিতে পারে।
  • ২. নিরপরাধদের কষ্ট (Suffering of the Innocent): শিশু এবং নিরপরাধ মানুষের উপর অশুভের প্রভাব কিভাবে তাদের আত্মার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে? নিরপরাধ মানুষের এত কষ্ট ভোগ করা অযৌক্তিক এবং এর কোন নৈতিক ভিত্তি নেই। অনেক সময় এমন কষ্ট থাকে যা মানুষের আত্মার উন্নতির পরিবর্তে তাদের মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে এবং তারা আর কোন উন্নতির পথে যেতে পারে না।
  • ৩. বিকল্প উন্নতির পদ্ধতি (Alternative Methods for Improvement): ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ হন, তবে তিনি মানুষের আত্মার উন্নতির জন্য অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারতেন যা অশুভ এবং কষ্টের প্রয়োজনীয়তা দূর করে। উদাহরণস্বরূপ, নৈতিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের আত্মার উন্নতি করা সম্ভব। অশুভ এবং কষ্ট ছাড়াও মানুষ আত্মিক উন্নতি করতে পারে। ঈশ্বর যদি চেয়েছিলেন, তবে তিনি এমন একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারতেন যেখানে মানুষের আত্মিক উন্নতি হত, কিন্তু অশুভের উপস্থিতি থাকত না।
  • ৪. নৈতিক দায়বদ্ধতা (Moral Responsibility): যদি ঈশ্বর মানুষকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেন যেখানে তারা কষ্ট এবং অশুভের সম্মুখীন হয়, তবে এর নৈতিক দায় ঈশ্বরের উপর বর্তায়। একটি সর্বশক্তিমান এবং সর্বোত্তম সত্তার পক্ষে এই ধরনের কাজ করা কতটা নৈতিক? মানুষের আত্মিক উন্নতির জন্য নিজস্ব প্রচেষ্টা এবং দায়িত্ববোধই যথেষ্ট। ঈশ্বরের পক্ষে মানুষের উপর কষ্ট চাপিয়ে তাদের উন্নতি করানো নৈতিক নয়।
  • ৫. অহিংস সমাধান (Non-Violent Solutions): সোল মেকিং থিওডিসি অনুযায়ী, কষ্ট এবং অশুভ মানুষের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয়। তবে, অহিংস পদ্ধতির মাধ্যমেও মানুষের আত্মিক উন্নতি সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ভালো শিক্ষা, নৈতিক প্রশিক্ষণ, এবং সামাজিক সমর্থন। ঈশ্বর যদি চেয়েছিলেন, তবে তিনি এমন প্রাকৃতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা স্থাপন করতে পারতেন যেখানে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে আত্মিক উন্নতি করতে পারত।
  • ৬. তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক সঙ্গতি (Theoretical and Practical Consistency): তাত্ত্বিক অসঙ্গতি: সোল মেকিং থিওডিসি তাত্ত্বিকভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জগতে এর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। মানুষ বাস্তবে এত কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় যে এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। বাস্তব জীবনে মানুষের কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতা অনেক সময় এত গুরুতর হয় যে সোল মেকিং থিওডিসি তত্ত্বটি এর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়।

স্কেপটিক্যাল থিওডিসি (Skeptical Theodicy) এর সমালোচনা

  • ১. গোঁড়ামি এবং অজ্ঞেয়বাদ (Dogmatism and Agnosticism): স্কেপটিক্যাল থিওডিসি প্রায়ই গোঁড়ামির দিকে ঝুঁকে থাকে, যেখানে ঈশ্বরের পরিকল্পনাকে প্রশ্ন করা বা বিশ্লেষণ করা নিষিদ্ধ বলে মনে হয়। এটি যুক্তিসঙ্গত তদন্তের পথে বাধা সৃষ্টি করে। স্কেপটিক্যাল থিওডিসি যদি মানে যে ঈশ্বরের পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে বোঝা সম্ভব নয়, তবে এটি একটি ধরনের অজ্ঞেয়বাদ হয়ে দাঁড়ায়, যা ঈশ্বরের পরিকল্পনা নিয়ে কোন নিশ্চিত জ্ঞান বা বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই বলে নির্দেশ করে।
  • ২. নৈতিক দায়বদ্ধতা (Moral Responsibility): স্কেপটিক্যাল থিওডিসি ঈশ্বরের উপর নৈতিক দায় থেকে রেহাই দেয়। যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং সর্বোত্তম হন, তাহলে তার পরিকল্পনা এবং অশুভের উপস্থিতি বোঝা ধর্ম অনুসারে মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি তারা ঈশ্বরের পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে না পারি, তবে তারা কিভাবে আমাদের নিজস্ব নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্ব পালন করবে?
  • ৩. ন্যায়বিচারের সমস্যা (Problem of Justice): স্কেপটিক্যাল থিওডিসি অনুযায়ী, আমরা ঈশ্বরের পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারি না, তবে এটি ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, শিশু নির্যাতন বা গণহত্যার মত ঘটনা কিভাবে ন্যায়বিচারমূলক হতে পারে তা বোঝা আমাদের জন্য জরুরি। কিন্তু ধর্ম অনুসারেই, ঈশ্বরের ন্যায়ের মানদণ্ড বোঝা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্ম অনুসারে, যদি আমরা এটি বুঝতে না পারি, তাহলে নৈতিকতা এবং ন্যায়বিচারের ধারণাগুলি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
  • ৪. সীমিততা এবং ঈশ্বরের প্রকৃতি (Limitation and Nature of God): স্কেপটিক্যাল থিওডিসি মানুষের জ্ঞান এবং উপলব্ধির সীমিততার উপর জোর দেয়। তবে, ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান হন, তাহলে তিনি মানুষের কাছে তার পরিকল্পনা এবং অশুভের কারণগুলি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবেন। যদি ঈশ্বরের পরিকল্পনা স্বচ্ছ এবং বোধগম্য না হয়, তাহলে ঈশ্বরের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। ঈশ্বরের স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারের ধারণা এই ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে।
  • ৫. বাস্তব জীবনের প্রয়োগ (Practical Application): স্কেপটিক্যাল থিওডিসি বাস্তব জীবনে অশুভ এবং কষ্টের সমস্যার কার্যকর সমাধান প্রদান করতে ব্যর্থ। এটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, তবে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে এটি অকার্যকর হতে পারে। কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতার মানসিক প্রভাব খুব গুরুতর হতে পারে, এবং স্কেপটিক্যাল থিওডিসি এই সমস্যাগুলির কার্যকর সমাধান বা ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে না।
  • ৬. মানবিকতা এবং সংবেদনশীলতা (Humanity and Empathy): স্কেপটিক্যাল থিওডিসি মানুষের কষ্ট এবং অশুভ অভিজ্ঞতাগুলিকে উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখায়। এটি মানুষের সংবেদনশীলতা এবং সহানুভূতির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। স্কেপটিক্যাল থিওডিসি অনেক সময় অতি নৈর্ব্যক্তিক হয়ে পড়ে এবং মানবিক অভিজ্ঞতার গভীরতা এবং তাৎপর্য উপেক্ষা করে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.