জেমস র্যান্ডি ৭ অগাস্ট, ১৯২৮ সালে কানাডার টরোন্টোতে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জেমস র্যান্ডি বিজ্ঞানী নন, তারপরও তিনি বিজ্ঞানের জগতে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তিনি নিজেকে একজন বাটপার এবং মিথ্যাবাদী দাবি করেন, যার মানে তিনি পেশায় একজন “যাদুকর”। তিনি স্বীকার করেন তিনি ভ্রম আর চাতুরি দিয়ে মানুষকে বোকা বানান। অন্য “যাদুকর”দের সাথে র্যান্ডির পার্থক্য এখানেই। তাঁর মঞ্চ-নাম ছিল “The Amazing Randi”।
তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, কারণ তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন কথিক ‘অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতাধর যাদুকর’দের বাটপারী ধরিয়ে দিতে। র্যান্ডি বলেন- “তাঁরা দাবি করেন তাদের অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে, আমি দাবি করি আমার অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা নাই। তারা যা অতিপ্রাকৃতের সাহায্য নিয়ে করেন আমি সেটা করি চাতুরি আর ভ্রম দিয়ে, আপনাদের কি মনে হয়, কোন ব্যাখ্যাটা বেশী যৌক্তিক? তাদের অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে, না তারাও আমার মতো চাতুরিই করছেন?”
আমি নিজেও প্রথম মনে করেছিলাম র্যান্ডী হয়তো Now You See Me এর মর্গ্যান ফ্রীম্যানের মতো ব্যর্থ যাদুকর ছিলেন, তাই অন্যদের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে না পেরে হয়তো তিনি… কিন্তু না, তিনি সফল যাদুকর ছিলেন। হ্যারি হুডিনির অনেক রেকর্ড তিনি অনেক কম বয়সে ভেঙ্গেছেন। উদাহরণ হিসেবে- ৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৬তে NBC এর Today শো-তে হ্যারি হুডিনির পানির নিচে ধাতব কফিনে ৯৩ মিনিট বন্দী থাকার রেকর্ড ভেঙ্গে ১০৪ মিনিটের নতুন রেকর্ড গড়েন। তিনি এরপর অনেক টিভি প্রোগ্রামে কাজ করেন আর সেখানে তিনি মানুষকে বুঝান কিভাবে তাঁরা বোকা হন।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি- র্যান্ডি যেকোনো বক্তব্যের প্রথমেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বিভিন্ন অপবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেন, আর মানুষকে বোঝান অন্যরা খুব সহজেই বোকা বনছে।
তবে…শিক্ষিত হলেই যে মানুষ বোকা বনবেনা সেই ভুলটাও র্যান্ডী ভালো করেই বুঝিয়ে দেন! র্যান্ডীর দর্শকরা যেটাকে মাইক্রোফোন মনে করছিলেন, সেটা আসলে ছিল দাড়ি ছাঁটার যন্ত্র!
তিনি খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দেন Assumptions ব্যাপারটা খুব সহজেই আমাদের মধ্যে চলে আসে, সেটা ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক।
দ্বিতীয়ত, র্যান্ডি সাধারণত যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন সেগুলো যাদুর কাতারে পড়ে না। র্যান্ডি স্বীকার করেন যাদু বা ছল চাতুরি জিনিসটা ভালো, এটা মানুষকে ভাবতে শেখায়। র্যান্ডির সমস্যা হচ্ছে যখন মানুষ এই যাদুকরদের বিশ্বাস করতে শুরু করে আর যাদুকররা এদের থেকে অর্থ আত্মসাৎ করা শুরু করে।
উদাহরণস্বরুপ- র্যান্ডি বলেন Dowsing Rod বা Dowsing Machines এর কথা। Dowserরা দুইটা রড ব্যবহার করে তাদের মনের শক্তির সাহায্যে হারানো জিনিস, পানি এমন কি স্বর্ণখনি পর্যন্ত খুঁজে দেয়ার দাবি করে। ব্যাপারটা এতো চরম আকার ধারণ করেছিলো যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরাক যুদ্ধের সময় রাস্তার পাশে পেতে রাখা মাইন বোমা খুঁজতে ১.২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে Dowsing Machines Model ADE 560 ব্যবহার করা শুরু করলো।
তারপরও প্রতিদিনই আমেরিকান সৈন্য মারা যাচ্ছিল এইসব বোমা বিস্ফোরণে! র্যান্ডি ব্যাখ্যা করলেন Dowsing Machines কাজ করে Ideomotor phenomenon এর মাধ্যমে। হালকা করে ধরে থাকা কোনো বস্তু আপনার হাতের সামান্যতম নড়াচড়ার দিকে ঘুরে যাবে। Dowserরা যতক্ষণ জানে তাঁরা যা খুঁজছে সেটা কোথায় আছে ততক্ষণ পর্যন্ত Dowsing Machines কাজ করে। একজন সৈনিক জানে না মাইন কোথায় পুঁতা আছে, সে নিঃসন্দেহে মারা পড়ে। অথচ ছবিতে যে Dowsing Machines দেখতে পাচ্ছেন সেটা এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে ইরাকে, ADE651 যার দাম ১৬,৫০০ ডলার থেকে ৬০,০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে! কিছু মানুষের সূক্ষ্ম প্রতারণার জন্য হাজারো মানুষের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে র্যান্ডি সেটা ভাবতেও পারছিলেন না!
সূক্ষ্ম প্রতারণা! আচ্ছা, কারা প্রতারণার শিকার হয়? অল্প শিক্ষিতরা? বোকারা? অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতে ইচ্ছুকরা? আপনার উত্তর যদি এইগুলোর মধ্যে একটি হয় র্যান্ডি আপনার জন্য খারাপ খবর নিয়ে আসছেন। বিজ্ঞানীরাও প্রতারিত হতে পারেন! বিশেষ করে তাঁরা যারা নিজেদের জ্ঞানকে নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী।
ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ল্যাবরেটরি থেকে একবার র্যান্ডির কাছে ফোন আসে। তাঁরা এক ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন যিনি তাঁর হাতের উল্টো পিঠে রাখা ম্যাচের বাক্সকে “মনের শক্তি” তাঁর কথামত দাঁড় করাচ্ছে এবং শোয়াচ্ছে! ল্যাবরেটরির পদার্থবিদরা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন, তাঁরা Double Blind Experiment করলেন, ২ ডজন ম্যাচের বাক্স থেকে দৈবাৎভাবে নেয়া ম্যাচের বাক্স সেই লোকের হাতে দিলেন, সেই ম্যাচের বাক্সও ঐ লোকের কথা মানছে! কী আজব ব্যাপার স্যাপার! তাঁরা র্যান্ডিকে ফোন করলেন, বিষয়টি জানালেন, র্যান্ডি তাদেরকে ফ্যাক্সের মাধ্যমে একটি কাগজ পাঠালেন, আর জোরে জোরে পড়তে বললেন।
“এই যাদুটি করা খুব সহজ, ম্যাচের বাক্স হাতের উপর রাখার সময় বাক্সটি একটু খুলে হাতের একটু চামড়া বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। মাংসপেশী সম্প্রসারণ আর সঙ্কুচনের প্রভাবে এমনিতেই ম্যাচের বাক্সটি দাঁড়াবে এবং শুয়ে পড়বে।” লাইন শেষ হতে খট করে ফোন কেটে দিলেন সেই পদার্থবিদ ভদ্রলোক! তিনি কি বোকা ছিলেন? না। তিনি বিকল্প তত্ত্বের ব্যাপারে ভাবেননি।
জেমস র্যান্ডি একজন সংশয়বাদী, তিনি ১৯৬৪ সালে ১০০০ ডলারের একটি পুরষ্কার ঘোষণা করেন প্যারানরমাল ক্ষমতার প্রমাণের বিনিময়ে, সময়ের সাথে সেই পুরষ্কারের পরিমাণ এক মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, আজ পর্যন্ত কেউ এই পুরষ্কারের দাবি করতে পারেননি, যারা করেছেন, তারাও দুই পক্ষের সম্মতিতে ঠিক করা উপায়ে প্রাথমিক পরীক্ষা পার করতে পারেননি। ২০০১ সালে সাইকিক সিলভিয়া ব্রাউন, যিনি মৃত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলতে পারেন বলে দাবি করেন, আর সে জন্য তিনি প্রতি ২০ মিনিটে ৭০০ ডলার করে নিতেন, তিনি ল্যারী কিংয়ের শো তে এই চ্যালেঞ্জ নিতে রাজী হন, কিন্তু তিনি পরে টালবাহানা শুরু করেন। তিনি বলেন র্যান্ডিকে নাকি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না! একজন সাইকিক যিনি মৃতদের সাথে কথা বলতে পারেন তিনি র্যান্ডিকে খুঁজে পাচ্ছেন না! শেষমেষ তিনি অস্বীকৃতি জানান এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে।
র্যান্ডির সবচেয়ে বড় “প্রতিপক্ষ” ছিলেন ইসরাইলি উইরি গ্যালার। তিনি নিজেকে সাইকিক দাবি করতেন। কয়েকবার র্যান্ডি তাঁকে ডিবাংক করার পরও তিনি মানুষের কাছে জনপ্রিয়তার জন্য ফিরে আসতে পারছিলেন। তিনি বলতেন তিনি চামচ বাঁকাতে পারেন তাঁর মনের শক্তি দিয়ে। ছবিতে দেখুন-
আচ্ছা, তা যাই হোক, জনি কারসনের টুনাইট শো তে উইরি গ্যালারকে চ্যালেঞ্জ করা হয়, তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শন করতে। বলা বাহুল্য, তিনি পারেন নি। জেমস র্যান্ডির সাহায্যে জনি কারসন উইরি গ্যালারকে ধরাশায়ী করে দিয়েছিলেন। আরেকজন ফেইথ হিলারের কথাও আগে বলেছিলাম, পিটার পপফ। তাঁর চাতুরীও র্যান্ডি ধরিয়ে দেন, পপফ দেউলিয়া হয়ে যান।
১৯৬৪ থেকে আজ পর্যন্ত The James Randi Educational Foundation (JREF) এর এই অফার এখনো পর্যন্ত চালু আছে। তো আপনাদের পরিচিত কোনো “অতিপ্রাকৃত” থাকলে পাঠিয়ে দিন, এক মিলিয়ন নিয়ে নিন।
– স্যাগানিস্ট
Leave a Reply