কসমোপলিটানিজম বা বিশ্বমানববাদ

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

কসমোপলিটানিজম (Cosmopolitanism) বা বিশ্বমানববাদ এমন একটি ধারণা যা বলে যে সব মানুষই একটি একক সম্প্রদায়ের সদস্য। এর অনুসারীরা কসমোপলিটান বা কসমোপোলাইট নামে পরিচিত। কসমোপলিটানিজম একই সাথে বিধানিক (prescriptive) এবং আকাঙ্ক্ষাসূচক (aspirational), যা মনে করে যে মানুষ “বিশ্ব নাগরিক” হতে পারে এবং মানুষের একটি “সর্বজনীন সম্প্রদায়ে” পরিণত  হওয়া উচিত। এই ধারণাটি বিভিন্ন মাত্রা এবং সম্প্রদায়ের পথকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন সার্বজনীন নৈতিক মান প্রচার, বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামো স্থাপন, বা পারস্পরিক সাংস্কৃতিক প্রকাশ এবং সহনশীলতার জন্য একটি প্ল্যাটফর্মের প্রস্তুত।

উদাহরণস্বরূপ, কোয়ামি অ্যান্থনি আপিয়া (Kwame Anthony Appiah) একটি কসমোপলিটান সম্প্রদায় বর্ণনা করেছেন যেখানে বিভিন্ন স্থান (ভৌত, অর্থনৈতিক, ইত্যাদি) থেকে আসা ব্যক্তিরা নিজেদের বিভিন্ন বিশ্বাস (ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ইত্যাদি) সত্ত্বেও পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্ক স্থাপন করেন। একটি অপেক্ষাকৃত শিথিল কিন্তু সম্পর্কিত অর্থে, “কসমোপলিটান” শব্দটি সেই স্থানগুলোকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় যেখানে বিভিন্ন জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং/অথবা ধর্মীয় পটভূমির মানুষ একসাথে বসবাস করে এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে।

ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা

ব্যুৎপত্তি

শব্দটি প্রাচীন গ্রিক: κοσμοπολίτης, বা কোসমোপোলিটেস (kosmopolitês) থেকে উদ্ভূত, যা “κόσμος”, কোসমোস (kosmos) থেকে গঠিত, অর্থাৎ “বিশ্ব”, “ব্রহ্মাণ্ড”, বা “কসমস”, এবং πολίτης, “পোলিটেস” (politês), অর্থাৎ “নাগরিক” বা “শহরের ব্যক্তি”। আধুনিক ব্যবহার এই শব্দটিকে “বিশ্বের নাগরিক” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে।

সংজ্ঞা

কসমোপলিটানিজমের সংজ্ঞা সাধারণত “বিশ্বের নাগরিক” এর গ্রিক ব্যুৎপত্তি দিয়ে শুরু হয়। তবে, আপিয়া নির্দেশ করেছেন যে, “কসমস” প্রাচীন অর্থে “ব্রহ্মাণ্ড” বোঝায়, বর্তমানে এর দ্বারা যেমন “পৃথিবী” বা “গ্লোব” বোঝায় তা নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে কসমোপলিটানিজমের দুটি রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি হলো একটি রাজনৈতিক কসমোপলিটান জাতীয়তাবাদ, যা অন্যান্য জাতিসমূহকে সংজ্ঞায়িত এবং নির্মাণ করেছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বহুসংস্কৃতিবাদ উদযাপনকারী একটি জাতিগত-সাংস্কৃতিক কসমোপলিটানিজমের উত্থান লাভ করেছে। রাজনৈতিক বিশ্বায়ন সম্পর্কে সাম্প্রতিক একটি বইয়ে কসমোপলিটানিজমের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে:

কসমোপলিটানিজমকে একটি বৈশ্বিক রাজনীতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যা, প্রথমত, সারা বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে সাধারণ রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার একটি সামাজিকতাকে নির্দেশ করে এবং, দ্বিতীয়ত, এই সামাজিকতাকে অন্য সামাজিকতার রূপগুলির উপর নৈতিক বা সাংগঠনিকভাবে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দেয়।

প্রাচীন চীনা দার্শনিক মোজি (Mozi) তার সংরক্ষিত লিপিতে বলেছিলেন যে “সর্বজনীন প্রেম এবং পারস্পরিক সুবিধা” অর্জন করা যেতে পারে “অন্যদের দেশকে নিজের দেশের মতো করে দেখার মাধ্যমে”। চীনা শব্দ তিয়ানশিয়া (tianxia) (সব কিছু আকাশের নিচে), একটি সাম্রাজ্যের জন্য একটি মেটোনিম, যা আধুনিক যুগে কসমোপলিটানিজমের একটি ধারণা হিসাবে পুনঃব্যাখ্যা করা হয়েছে, এবং ১৯৩০-এর দশকের আধুনিকতাবাদীরা এটিকে একটি সাংহাই-ভিত্তিক, ইংরেজি ভাষার বিশ্ব শিল্প ও সাহিত্য জার্নালের নাম হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন, যার নাম ছিল T’ien Hsia Monthly।

দর্শন

দার্শনিক শিকড়

কসমোপলিটানিজমের শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিসের সিনিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সিনোপের ডায়োজেনিস (Diogenes of Sinope) (প্রায় ৪১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর মধ্যে। বলা হয় যে, যখন ডায়োজেনিসকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি কোথা থেকে এসেছেন, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: ‘আমি বিশ্বের নাগরিক (কোসমোপোলিটেস)’। সেই সময়ে, গ্রিকদের মধ্যে সামাজিক পরিচয়ের সর্বোচ্চ ভিত্তি ছিল হয় একক শহর-রাষ্ট্র বা সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগতভাবে সমজাতীয় হেলেনিক গোষ্ঠী।

স্টোইসিজম (Stoicism) হলো আরেকটি গ্রিক চিন্তাধারা যা প্রায় এক শতাব্দী পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এটি ডায়োজেনিসের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যার অনেক চিন্তাবিদ এবং অনুসারীরা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে প্রতিটি মানুষ দুটি সম্প্রদায়ে বসবাস করে—আমাদের জন্মের স্থানীয় সম্প্রদায় এবং মানব যুক্তি ও আকাঙ্ক্ষার সম্প্রদায়। স্টোইক কসমোপলিটানিজম বোঝার একটি সাধারণ উপায় হল হিয়েরোক্লেসের (Hierocles) বৃত্ত মডেল (circle model) যা বলে যে, মানুষের নিজেদেরকে একাধিক এককেন্দ্রিক বৃত্ত হিসাবে বিবেচনা করা উচিত: প্রথমটি নিজ আবা আত্মকে ঘিরে, তারপরে নিকট আত্মীয়, বর্ধিত পরিবার, স্থানীয় গোষ্ঠী, নাগরিক, দেশবাসী, মানবতা। এই বৃত্তগুলির মধ্যে মানবরা একে অপরের প্রতি “স্নেহ” বা “ভালোবাসা” অনুভব করে, যাকে স্টোইকরা ওয়াইকেইওসিস (Oikeiôsis) বলতেন। বিশ্ব নাগরিকদের কাজ তখন হয় বৃত্তগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা, সকল মানুষকে আরও বেশি করে আমাদের সহ-নাগরিকদের মতো করে তোলা।

আধুনিক কসমোপলিটান চিন্তাবিদ

ইমানুয়েল কান্টের কসমোপলিটানিজম

১৭৯৫ সালে তার প্রবন্ধ “পারপেচুয়াল পিস: এ ফিলোসফিকাল স্কেচ” (Perpetual Peace: A Philosophical Sketch) এ, ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) কসমোপলিটান আইন (ius cosmopoliticum) কে একটি নির্দেশিকা নীতিরূপে উপস্থাপন করেছেন যা বৈশ্বিক সমাজকে স্থায়ী শান্তি অর্জনে সহায়তা করবে। কান্টের কসমোপলিটান অধিকার সমস্ত মানুষকে একটি সর্বজনীন সম্প্রদায়ের সমান সদস্য হিসেবে বিবেচনা করার একটি উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে। কসমোপলিটান অধিকার তাই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অধিকার এবং মানবতার যৌথ, সার্বজনীন অধিকারগুলির সাথে একসাথে কাজ করে।

কান্টের কসমোপলিটান অধিকার মূলত সার্বজনীন আতিথেয়তা এবং আশ্রয়ের অধিকার শর্তাবলীর সাথে যুক্ত। সার্বজনীন আতিথেয়তা সংজ্ঞায়িত করা হয় বিদেশী অঞ্চলে আগমনের সময় স্বাগত জানানোর অধিকার হিসাবে, তবে এটি অতিথির শান্তিপূর্ণ আগমনের উপর নির্ভরশীল। কান্ট আরও বলেন যে সকল মানুষের আশ্রয়ের মৌলিক অধিকার রয়েছে: যা একটি বিদেশী ভূমিতে নিজেকে উপস্থাপনের অধিকার। এই অধিকার কান্টের পৃথিবীর পৃষ্ঠকে মৌলিকভাবে যৌথ হিসাবে উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে নির্মিত, এবং সমস্ত মানুষের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা সার্বজনীন অধিকারের উপর তার দাবিগুলি জোরদার করে।

ইমানুয়েল লেভিনাস এবং জ্যাক দেরিদার চিন্তা

ইমানুয়েল লেভিনাস (Emmanuel Levinas) এর নৈতিকতা এবং জ্যাক দেরিদা (Jacques Derrida) এর আতিথেয়তা সম্পর্কিত দার্শনিক ধারণাগুলি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সম্পর্কের জন্য একটি তাত্ত্বিক কাঠামো প্রদান করে যা কোন লিখিত আইন বা কোড ছাড়াই। লেভিনাসের জন্য, নৈতিকতার ভিত্তি হল অন্যের প্রতি সাড়া দেওয়ার বাধ্যবাধকতা। “বিয়িং ফর দ্য আদার” (Being for the Other) এ তিনি লেখেন যে কোনও “সার্বজনীন নৈতিক আইন” নেই, শুধুমাত্র দায়িত্বের অনুভূতি (দয়া, করুণা, দান) আছে যেগুলো অন্যের দুর্বল অবস্থায় উদ্ভূত হয়। অন্যের নৈকট্য লেভিনাসের ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা অন্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রতিক্রিয়াকে বাধ্য করে।

দেরিদার জন্য, নৈতিকতার ভিত্তি হল আতিথেয়তা, অন্যকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি এবং আগ্রহ। তিনি দাবি করেন যে, নৈতিকতা হল আতিথেয়তা। বিশুদ্ধ, শর্তহীন আতিথেয়তা হল সেই ইচ্ছা যা আমাদের অন্যদের সাথে সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তযুক্ত আতিথেয়তা সমর্থন করে। লেভিনাস এবং দেরিদার নৈতিকতা এবং আতিথেয়তার তত্ত্বগুলি অন্যকে ভিন্ন কিন্তু সমান মর্যাদার হিসেবে গ্রহণ করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। বিচ্ছিন্নতা বিশ্বে একটি সম্ভাব্য বিকল্প নয়, তাই আমরা এই মিথস্ক্রিয়াগুলির প্রতি সর্বোত্তমভাবে কীভাবে যোগাযোগ করতে পারি সেটা এবং আমাদের এবং অন্যদের জন্য কী কী ঝুঁকির সেগুলো বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ, আতিথেয়তার শর্তাবলী চাপিয়ে দেওয়া উচিত কিনা, এবং আমরা অন্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি কিনা সেসবও বিবেচনা করা উচিৎ। এছাড়াও, উভয় তত্ত্বই প্রকাশ করে যে কীভাবে অন্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে হবে এবং কী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা বিবেচনা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৯৭ সালে বেনিংটন (Bennington) এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে দেরিদা কসমোপলিটানিজম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেন:

“কসমোপলিটানিজমের একটি ঐতিহ্য রয়েছে, এবং যদি আমাদের সময় থাকত আমরা এই ঐতিহ্যটি অধ্যয়ন করতে পারতাম, যা আমাদের কাছে এসেছে, একদিকে, স্টোইকদের সাথে গ্রিক চিন্তা থেকে, যাদের একটি ‘বিশ্ব নাগরিক’ ধারণা রয়েছে। এছাড়াও খ্রিস্টান ঐতিহ্যে সেন্ট পল রয়েছেন, যিনি একটি নির্দিষ্টভাবে ‘বিশ্ব নাগরিক’ এর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যেমনটি তিনি বলেছিলেন আমরা সবাই ভাই, অর্থাৎ আমরা ঈশ্বরের সন্তান, তাই আমরা বিদেশী নই, আমরা বিশ্বের নাগরিক হিসেবে বিশ্বে অন্তর্ভুক্ত; এবং এই ঐতিহ্যটি আমরা কান্ট পর্যন্ত অনুসরণ করতে পারতাম, যার কসমোপলিটানিজম ধারণায় আমরা আতিথেয়তার শর্তাবলী খুঁজে পাই। কিন্তু কান্টের কসমোপলিটিক ধারণায় অনেকগুলি শর্ত রয়েছে: প্রথমত, অবশ্যই, আপনাকে অপরিচিত, বিদেশীকে স্বাগত জানাতে হবে, যতক্ষণ তিনি অন্য দেশের নাগরিক, তাকে পরিদর্শন করার অধিকার দিতে হবে, কিন্তু থাকার অধিকার নয়, এবং আরও কিছু শর্ত রয়েছে যা আমি এখানে দ্রুত সংক্ষেপে করতে পারি না, কিন্তু এই কসমোপলিটিক ধারণাটি খুব নতুন, খুব সম্মানের যোগ্য (এবং আমি মনে করি কসমোপলিটানিজম একটি খুব ভালো জিনিস), এটি একটি খুব সীমিত ধারণা।”

বেনিংটন, পলিটিক্স এন্ড ফ্রেন্ডশিপ : এ ডিসকাশন উইথ জ্যাক দেরিদা, ১৯৯৭

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কসমোপলিটানিজম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কসমোপলিটানিজমের আরেকটি নতুন অবস্থার আগমন ঘটে। হলোকাস্ট এবং অন্যান্য নৃশংসতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ধারণাটি আন্তর্জাতিক আইনে সাধারণত গ্রহণযোগ্য একটি বিভাগ হয়ে ওঠে। এটি স্পষ্টভাবে মানবতার প্রতি বিদ্যমান একটি ব্যক্তিগত দায়িত্বের ধারণার উদ্ভব এবং গ্রহণযোগ্যতার দিকটিকে তুলে ধরে।

দার্শনিক কসমোপলিটানরা নৈতিক সার্বজনীনতাবাদী (moral universalists), তারা বিশ্বাস করেন যে, শুধুমাত্র সহকর্মী বা সহ-নাগরিকরা নয়, বরং সমস্ত মানুষ একই নৈতিক মানদণ্ডের অধীনস্ত। জাতি, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি বা সমাজের সীমানা তাই নৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক। সমসাময়িক কসমোপলিটানদের একটি ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত উদাহরণ হল কোয়ামি অ্যান্থনি আপিয়া (Kwame Anthony Appiah)।

কতিপয় দার্শনিক এবং পণ্ডিতরা যুক্তি দেন যে আজকের অনন্য ঐতিহাসিক মুহুর্তে উদ্ভূত বস্তুগত এবং বিষয়গত শর্তাবলী, সভ্যতার একটি উদীয়মান গ্রহীয় পর্যায়ে (planetary phase of civilization), বৈশ্বিক নাগরিকদের একটি কসমোপলিটান পরিচয় এবং একটি বৈশ্বিক নাগরিকদের আন্দোলনের সম্ভাব্য গঠনের জন্য একটি সুপ্ত সম্ভাবনা তৈরি করে। এই উদীয়মান বস্তুগত এবং বিষয়গত শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে উন্নত এবং সাশ্রয়ী টেলিযোগাযোগ; মহাকাশ ভ্রমণ এবং মহাকাশের বিশালতায় ভাসমান আমাদের ভঙ্গুর গ্রহের প্রথম ছবি; বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং আমাদের যৌথ অস্তিত্বের প্রতি অন্যান্য পরিবেশগত হুমকির উদ্ভব; জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রপুঞ্জ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মতো নতুন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্ভব; বহুজাতিক কর্পোরেশনের উত্থান এবং বাজারের একীকরণ যা প্রায়শই অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন হিসাবে অভিহিত হয়; বৈশ্বিক এনজিও এবং ট্রান্সন্যাশনাল সামাজিক আন্দোলনের উদ্ভব, যেমন ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম; ইত্যাদি। বিশ্বায়ন, একটি আরও সাধারণ শব্দ, সাধারণত অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে সংকীর্ণভাবে ইঙ্গিত করে এবং চলমান সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত, জনসংখ্যাগত, মূল্যবোধ এবং জ্ঞান পরিবর্তনগুলি অগ্রাহ্য বা মিস করে।

সমকালীন কসমোপলিটান চিন্তাবিদ

থিচ নাত হান (Thich Nhat Hanh) “ইন্টারবিয়িং” (Interbeing) নামে যা বর্ণনা করেছেন তা এক ধরনের জীবনযাত্রার পথ যা অন্যদের সাথে সম্পর্কিত। “ইন্টারবিয়িং” সহজেই কসমোপলিটানিজমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। নাত হানের দার্শনিক বিশ্বাসগুলি বৌদ্ধ শিক্ষার মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যা সহানুভূতি এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে সকল মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং খনিজ এর সাথে সুরক্ষিত এবং সম্প্রীতিতে বসবাস করার উপর জোর দেয়। তিনি আরও বর্ণনা করেন যে “মাইন্ডফুলনেস ট্রেনিং অফ দ্য অর্ডার অফ ইন্টারবিয়িং” (Mindfulness Training of the Order of Interbeing) এর মতো উপায়ে নিম্নোক্ত কারণগুলির দ্বারা সৃষ্ট দুর্ভোগের সচেতনতা অর্জন করা যায় – উগ্রবাদ এবং অসহিষ্ণুতা যা সহানুভূতি এবং অন্যদের সাথে সম্প্রীতিতে বসবাসকে ব্যাহত করে; সংকীর্ণমনা বিশ্বাসের প্ররোচনা; দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ; রাগ; এবং ভুল বোঝাবুঝি।

অন্যান্য তত্ত্ববিদ, দার্শনিক এবং কর্মী দাবি করেন যে কষ্ট স্বীকার করা প্রয়োজন সহিংসতা শেষ করার জন্য। “সারেড স্যাক্রেড” (Scared Sacred)-এ ভেলক্রো রিপার (Velcrow Ripper) ভিন্ন ভিন্ন কষ্টের স্থানে যাত্রা করেন যা শেষ পর্যন্ত তাকে করুণা বিকাশের দিকে নিয়ে যায়। “দ্য প্ল্যানেট” (The Planet)-এ পল গিলরয় (Paul Gilroy) অন্বেষণ করেন কীভাবে জাতি এবং পার্থক্য দ্বারা উত্পন্ন শ্রেণীবিন্যাস অন্যদের প্রতি ঘৃণা গঠন করে। এই মতাদর্শগুলির বিনির্মাণের মাধ্যমেই অন্যদের প্রতি করুণা ও মানবীকরণ সম্ভব। তাই ব্যক্তিগত দায়িত্ব হল সেটাই যেটাকে জুডিথ বাটলার (Judith Butler) “জীবনের অনিশ্চয়তা” (precariousness of life) হিসাবে বর্ণনা করেন, তা নিজে এবং অন্যদের মধ্যে সচেতন থাকা; কসমোপলিটান হওয়া, যাকে সর্বোপরি একটি সামাজিক, নৈতিক উদ্যোগ বলে মনে করা হয়।

“কসমোপলিটানিজম: এথিকস ইন আ ওয়ার্ল্ড অফ স্ট্রেঞ্জার্স” (Cosmopolitanism: Ethics in a World of Strangers) বইতে কোয়াম অ্যান্থনি আপিয়া (Kwame Anthony Appiah) নোট করেছেন কীভাবে সামাজিক নীতি কাজ করে: কারও মধ্যে যে কোনো ব্যক্তির প্রতি বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে, বিশেষ করে একজন বিদেশীদের প্রতি, কিন্তু সেই বাধ্যবাধকতা নিজেকে সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিদের প্রতি থাকা বাধ্যবাধকতার চেয়ে অগ্রাধিকার পায় না। তবে, জুডিথ বাটলার প্রশ্ন করেন, “কোন মূল্যে আমি পরিচিতকে মূল্যায়নের মানদণ্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা করি?” যদি কেউ পরিচিতকে বিদেশীর চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেন, এর ফলাফল কী হতে পারে? পল গিলরয় একটি সম্ভাব্য বিকল্প প্রস্তাব করে এই পরিচিতির উপর জোর দেওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বলেন, “পদ্ধতিগতভাবে  নিজের সংস্কৃতি এবং ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্নতার একটি মাত্রা গড়ে তোলা কসমোপলিটান প্রতিশ্রুতির জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে।” এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে “ভিন্নতার প্রতি নিজেকে উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়ার” ব্যাপারটি জড়িত থাকে, যাতে সেই ব্যক্তি “এককতার মধ্যেই ভিন্নতার মূল্যকেও” লালন করতে পারে।

গিলরয়ের জন্য, কসমোপলিটান হওয়া মনে হয় একই সাথে একটি সামাজিক, নৈতিক উদ্যোগ এবং একটি সাংস্কৃতিক উদ্যোগ। “দ্য প্ল্যানেট”-এ গিলরয় টম হার্নডাল (Tom Hurndall) এবং র‍্যাচেল কোরি (Rachel Corrie) এর ঘটনা বর্ণনা করেন; প্রত্যেকটি গিলরয়ের কসমোপলিটানের চিত্র হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। হার্নডাল এবং কোরি উভয়ই তাদের বাড়ির সংস্কৃতি থেকে (ভৌগলিকভাবে) নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন, সম্ভবত শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিজেদের সংস্কৃতি এবং ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। হার্নডাল এবং কোরি উভয়েই ২০০৩ সালে (বিভিন্ন ঘটনায়) নিহত হন। গিলরয়ের বিচ্ছিন্নতার মডেল নিজেই তার উদাহরণগুলির মাধ্যমে নিজেকে অকার্যকর করতে পারে; এটি গিলরয়ের তত্ত্বের একটি ব্যর্থতা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যেখানে এরা পরিচিত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বাস্তব সমস্যাগুলি সমাধান করতে ব্যর্থ হন।

ভেনাস প্রজেক্ট (The Venus Project) ছিল জ্যাক ফ্রেসকো (Jacque Fresco) দ্বারা নির্মিত একটি আন্তর্জাতিক, বহুত্ববিষয়ক শিক্ষা সংস্থা, কসমোপলিটান ধারণাগুলি প্রচারের জন্য কাজ করে কৃত্রিম সীমানা অতিক্রম করে বর্তমানে মানুষকে পৃথক করা এবং আমাদের প্রাকৃতিক এবং পরস্পরের উপর নির্ভরতা বোঝার উপর জোর দেয়।

কিছু ধরনের কসমোপলিটানিজম অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের (economic colonization) সম্ভাবনা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় যখন শক্তিশালী দেশগুলি কম শক্তিশালী দেশগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফ্রান্টজ ফ্যানন (Frantz Fanon) “দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ” (The Wretched of the Earth) এ পর্যবেক্ষণ করেন যে, যখন দেশগুলি ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন প্রায়শই তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না, এবং তারা “পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার” হয়ে যায়। যখন “তৃতীয় বিশ্বের” দেশগুলি প্রাথমিকভাবে তাদের জাতীয় জীবনের মান উন্নত করার জন্য বিশ্বব্যাপী পুঁজির সাথে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে প্রবেশ করে, প্রায়শই এই অংশীদারিত্ব থেকে জাতি নিজে নয়, বরং লাভবান হন শুধুমাত্র ভাল অবস্থানে থাকা ব্যক্তিরাই।

মাহমুদ মামদানি (Mahmood Mamdani) “গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম” (Good Muslim, Bad Muslim) এ আরও বলেছেন যে, পশ্চিমা সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের আরোপ, যেমন গণতন্ত্র এবং খ্রিস্টধর্মের আরোপ, ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী সহিংসতার কারণ হয়েছে; তবে, আপিয়া (Appiah) পরোক্ষভাবে বলেছেন যে গণতন্ত্র হল উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কসমোপলিটান হস্তক্ষেপের পূর্বশর্ত।

গত দুই শতকের রাজনৈতিক চিন্তার অনেকটাই জাতীয়তাবাদ এবং সার্বভৌম জাতির রাষ্ট্রের কাঠামোকে ফর-গ্রান্টেড বা অভিয়াস ধরে নিয়েছে। বিশ্বায়নের অগ্রগতি এবং ভ্রমণ ও যোগাযোগের সুবিধা বৃদ্ধির সাথে সাথে, কিছু চিন্তাবিদ মনে করেন যে জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরানো হয়ে গেছে এবং একটি উন্নত এবং আরও কার্যকর বিকল্পকে ডিজাইন করার সময় এসেছে। জেসুস মোস্টেরিন (Jesús Mosterín) বিশ্লেষণ করেন কীভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সুযোগকে সর্বাধিক করতে বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংগঠিত হওয়া উচিত। স্বাধীন ইচ্ছার ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা অস্বীকার করে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন, যেখানে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলিতে অন্যদের দ্বারা জোর বা হস্তক্ষেপ থাকবে না। তবে মানব প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সহিংসতা ও আগ্রাসনের প্রবণতার কারণে, শান্তিপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য কিছু বাধা প্রয়োজন।

বিশেষ করে, জাতি, গির্জা বা দলের নামে সংস্কৃতির স্বাধীনতা (ভাষা, ধর্ম এবং রীতিনীতির) সীমাবদ্ধ করার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ইন্টারনেট জাতিরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মডেল প্রদান করে। মানুষ, ধারণা বা পণ্যের মুক্ত চলাচল সীমাবদ্ধ করার জন্য কোনো ন্যায্য কারণ নেই। মোস্টেরিন মনে করেন যে জাতিরাষ্ট্র পূর্ণ স্বাধীনতার বিকাশের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যার প্রস্ফুটন প্রয়োজন কসমোপলিটান লাইনে বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন। তিনি একটি বিশ্ব প্রস্তাব করেন যেখানে সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র নেই, ভূখণ্ডগতভাবে সংগঠিত ছোট স্বায়ত্তশাসিত কিন্তু অসার্বভৌম ক্যান্টনাল রাজনীতি রয়েছে যেগুলো শক্তিশালী বিশ্ব সংস্থাগুলির সম্পূরক হিসেবে কাজ করে।

চার্লস ব্ল্যাটবার্গ (Charles Blattberg) সমালোচনা করে বলেন, বেশিরভাগ কসমোপলিটানিজম আসলে বিমূর্ত প্রকৃতির, ও তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, যে কোনো কার্যকর কসমোপলিটানিজম অবশ্যই “মূলভিত্তিক” বা রুটেড হতে হবে, যার মানে একটি “বিশ্বব্যাপী দেশপ্রেম” (global patriotism) এর উপর একে নির্ভর করতে হবে।

কসমোপলিটানিজম এবং বহুসাংস্কৃতিকতাবাদের (multiculturalism) সাধারণ দার্শনিক পর্যালোচনাও উপলব্ধ। ক্যারল নিকলসন (Carol Nicholson), জন সার্ল (John Searle)-এর মাল্টিকালচারালিজমের বিরোধিতার সাথে চার্লস টেলর (Charles Taylor)-এর মালটিকালচারালিজমের প্রশংসার তুলনা করেছেন। তিনি রিচার্ড রর্টি (Richard Rorty)-কে একটি ত্রিভুজীকরণ বিন্দু হিসাবে ব্যবহার করেন যেখানে তিনি মাল্টিকালচারালিজমের বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকেন, তবে তার দার্শনিক বিশ্লেষণ সত্য এবং অনুশীলন সার্লের বিরুদ্ধে এবং টেলরের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। “বহুসাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে দর্শন” (Philosophy in a Multicultural Context) নামে একটি সম্মেলনে রাসমুস উইনথার (Rasmus Winther) কসমোপলিটানিজম এবং মাল্টিকালচারালিজমের সাথে যুক্ত দার্শনিক অনুমান এবং অনুশীলনগুলি তুলে করেছেন। তিনি দার্শনিককে জন-কূটনীতিক (public diplomat) হিসাবে দেখা নিয়ে ব্রুনো লাতুরের (Bruno Latour) ধারণার বিকাশ ঘটিয়েছেন।

রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কসমোপলিটানিজম

এমিল দুরখেইম (Emile Durkheim) (১৮৫৮–১৯১৭) লক্ষ করেছিলেন, মানুষের মর্যাদার পবিত্রতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া যে কাল্টকে তিনি ‘ব্যক্তি পূজা’ (cult of the individual) বলে অভিহিত করেছিলেন, তা খ্রিস্টধর্মের পরিবর্তে একটি নতুন ধর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এই নতুন ধর্ম পশ্চিমা সমাজের নতুন ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে এবং এই ভিত্তিগুলি মানবাধিকার এবং পৃথক জাতির সংবিধানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ব্যক্তির মানব মর্যাদা একটি সমাজের পবিত্র বস্তু হবে এবং সমাজকে পরিচালিত করার নৈতিক কোডটি পাওয়া যাবে সেই দেশের মানব মর্যাদা এবং মানবাধিকার ব্যাখ্যার উপায়ে। অতএব, মানুষ জাতীয় সংস্কৃতি বা একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্যগত ধর্মীয় মতবাদের মাধ্যমে সংহতি খুঁজে পাবে না, বরং সমাজ রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের আনুগত্যের মাধ্যমেই মানুষ একত্রিত হবে, অর্থাৎ, ব্যক্তিগত অধিকার এবং মানব মর্যাদার প্রতিরক্ষার ব্যাপারটিই মানুষের কাছে প্রধান হয়ে উঠবে। দুরখেইমের ব্যক্তি পূজার সাথে জন রলসের (John Rawls) রাজনৈতিক উদারনীতির অনেক মিল রয়েছে, যা রলস প্রায় এক শতাব্দী পরে বিকাশ করেছিলেন।

দুরখেইম তাঁর মরণোত্তর প্রকাশিত (১৯৫৭) “প্রফেশনাল এথিক্স অ্যান্ড সিভিক মোরালস” (Professional Ethics and Civic Morals) বইতে লিখেছেন, “যদি প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য তার সীমান্ত প্রসারিত বা দীর্ঘ করা, বরং তার নিজস্ব গৃহকে সুশৃঙ্খল করা এবং একটি উচ্চতর নৈতিক জীবনের জন্য তার সদস্যদের কাছে সর্বাধিক আবেদন করা না হতো তাহলে জাতীয় এবং মানবিক নৈতিকতার মধ্যে সমস্ত বৈষম্য বাদ দেওয়া যেত। … সমাজগুলি যত বেশি তাদের শক্তি অভ্যন্তরে কেন্দ্রীভূত করবে, অভ্যন্তরীণ জীবনে, তত বেশি তারা সেই বিরোধগুলি থেকে বিভ্রান্ত হবে যা কসমোপলিটানিজম – বা বিশ্ব দেশপ্রেম এবং দেশপ্রেমের মধ্যে সংঘাত ঘটায় … সমাজগুলি সবচেয়ে বড় বা সবচেয়ে ধনী হওয়া নিয়ে গর্ব করতে পারেনা, বরং সবচেয়ে ন্যায়বান, সর্বোত্তম সংগঠিত এবং সর্বোত্তম নৈতিক সংবিধানের অধিকারী হওয়া নিয়েই তারা গর্ব করতে পারে।”

উলরিচ বেক (Ulrich Beck) (মে ১৫, ১৯৪৪ – জানুয়ারি ১, ২০১৫) ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী যিনি ঐতিহ্যবাহী জাতিরাষ্ট্রের রাজনীতির সরাসরি বিরোধিতা করে নতুন কসমোপলিটান সমালোচনামূলক তত্ত্বের ধারণা প্রবর্তন করেন। জাতিরাষ্ট্র তত্ত্ব শুধুমাত্র বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তাদের (state actors) মধ্যে শক্তি সম্পর্কগুলি দেখে এবং একটি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বাদ দেয় বা একে জাতিরাষ্ট্র মডেলের অধীনস্ত করে। কসমোপলিটানিজম বৈশ্বিক পুঁজিকে জাতিরাষ্ট্রের জন্য একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে দেখে এবং এটিকে একটি মেটা-পাওয়ার গেমের মধ্যে স্থাপন করে যেখানে বৈশ্বিক পুঁজি, রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজ এর খেলোয়াড় বা প্লেয়ার।

বেকের কসমোপলিটানিজম এবং বিশ্ব রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। বেকের জন্য, একটি একক বিশ্ব ব্যবস্থা চাপানো সর্বোচ্চ আধিপত্যবাদী এবং সবচেয়ে খারাপভাবে জাতিগতভাবে কেন্দ্রীভূত হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। বরং, রাজনৈতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কসমোপলিটানিজম নিম্নলিখিত মৌলিক ভিত্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে :

  1. “সংস্কৃতিগতভাবে ভিন্ন যারা তাদের অন্যত্বকে (Otherness) স্বীকার করা”
  2. “ভবিষ্যতের অন্যত্বকে স্বীকার করা”
  3. “প্রকৃতির অন্যত্বকে স্বীকার করা”
  4. “বস্তুর অন্যত্বকে স্বীকার করা”
  5. “অন্য যুক্তিবাদী মতবাদকে স্বীকার করা”

কতিপয় দার্শনিক, যেমন এমমানুয়েল লেভিনাস (Emmanuel Levinas), “অন্য” (Other) ধারণাটি প্রবর্তন করেছেন। লেভিনাসের জন্য, অন্য হচ্ছে নৈতিকতা এবং দায়িত্বের ক্ষেত্রে একটি প্রদত্ত কনটেক্সট; আমরা নিজে না, এমন যে কাউকে, মানে নিজেকে ছাড়া অন্য যে কাউকে আমাদের অন্য হিসেবে ভাবা উচিৎ। লেভিনাসের মতে, আমাদের ইচ্ছা গঠন করা বা চয়েস করার ক্ষমতা লাভের আগেই অন্য এর সাথে আমাদের প্রাথমিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। অন্য আমাদের ডাকে, এবং আমরা সাড়া দিই: প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতিও একটি প্রতিক্রিয়া। এইভাবে আমরা অন্যের ডাকের দ্বারা প্রভাবিত হই এবং সংস্কৃতি ও পরিচয় গঠন করতে শুরু করি। ইচ্ছার গঠনের পরে, আমরা অন্য এর  এই ডাকগুলোর সাথে নিজদেরকে আইডেন্টিফাই করব বা একাত্ম করব কিনা, এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের আইডেন্টিটি বা পরিচয় গঠনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাই। এই প্রক্রিয়ার সময়, অন্য এর সাথে মিথস্ক্রিয়াগুলির মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে চিনতে পারি। এমনকি সবচেয়ে ন্যূনতম মিথস্ক্রিয়ায় আমরা অন্যদের এবং একই সাথে নিজেদের ওপর পরিচয় আরোপ করি। ভাষা, সংস্কৃতি, এবং পরিচয়ের ক্রমাগত গঠনের জন্য আমাদের অন্য এর উপর নির্ভর করতে হয়, আমরা অন্যদের কাছে দায়বদ্ধ থাকি এবং তারা আমাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এছাড়াও একবার আমরা ইচ্ছা গঠন করলে, এই সামাজিক আন্তঃনির্ভরতা স্বীকার করা সম্ভব হয়। যখন আমরা স্বীকৃতির ক্ষমতা অর্জন করি, তখন আমাদের সেই স্বীকৃতিকে পারফর্ম করা চালিয়ে যেতে হয়, এবং এর মাধ্যমে আমরা বিবেকের মাধ্যমে সেই অন্য এর প্রতি নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ হই।

কসমোপলিটানিজম ও নৈতিক সার্বজনীনতাবাদ বা মোরাল ইউনিভার্সালিজমের মধ্যে কিছু মিল আছে, যেখানে মোরাল ইউনিভার্সালিজম বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য মানব মর্যাদার ধারণাকে নির্দেশ করে যাকে আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত হওয়া উচিত। তবে বিশ্ব সংস্কৃতির পার্থক্যগুলিকে স্বীকৃতি দেয়া দিয়ে এই দুই এর মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়।

কসমোপলিটানিজম প্রযুক্তিগত বিকাশের নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির বিরুদ্ধে পরিবেশের সমান সুরক্ষার আহ্বান জানায়। তবে মানব মর্যাদার ব্যাপারটি জটিল কারণ সেক্ষেত্রে প্রথমে নির্ধারণ করা প্রয়োজন যে কারা সম্মানিত হওয়ার অধিকারী এবং দ্বিতীয়ত কোন অধিকারগুলি সুরক্ষিত। কসমোপলিটানিজমের অধীনে, সমস্ত মানুষের অধিকার রয়েছে; তবে, ইতিহাস দেখায় যে এই অধিকারগুলির স্বীকৃতি নিশ্চিত নয় বা সবাই সেগুলো নিয়ে একমত নয়। এর একটি উদাহরণ হিসাবে, জুডিথ বাটলার (Judith Butler) তার “প্রিক্যারিয়াস লাইফ: দ্য পাওয়ারস অফ মর্নিং এন্ড ভায়োলেন্স” (Precarious Life: The Powers of Mourning and Violence) এ “মানব” ধারণাটি আলোচনা করেছেন। বাটলার “মানব” ধারণার মধ্য দিয়ে কাজ করেন এবং লক্ষ্য করেন যে “মানব” তার ‘পশ্চিমা’ ছাঁচে প্রাকৃতিকীকৃত (naturalized) হয়েছে আধুনিক মানবতাবাদ (humanism) সম্পর্কিত ধারণাগুলোর মাধ্যমে। অতএব, এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত যে, সমস্ত “মানব” জীবন একইভাবে সমর্থিত হবে না, প্রকৃতপক্ষে, কিছু মানব জীবন অন্যদের চেয়ে বেশি সুরক্ষার যোগ্য হবে। অন্যরা এই ধারণাটিকে বর্ধিত করে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে প্রাণীদের কসমোপলিটান হিসাবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে, যেখানে প্রাণীগুলোকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিচয় দেয়া হয়।

এই ধারণাটি পুনরায় ব্যক্ত করা হয়েছে সুনেরা থোবানির (Sunera Thobani) “এক্সাল্টেড সাবজেক্টস: স্টাডিজ ইন দ্য মেকিং অফ রেস অ্যান্ড নেশন ইন কানাডা” (Exalted Subjects: Studies in the Making of Race and Nation in Canada) এ, যেখানে তিনি আলোচনা করেন এমন একটি বক্তৃতা যেখানে মুসলিমরা একটি ভাল/খারাপ দ্বৈতবিভাজনে পড়ে: একটি “ভাল মুসলিম” হল একজন যিনি পশ্চিমীকৃত হয়েছেন এবং একটি “খারাপ মুসলিম” হল একজন যিনি দৃশ্যত পশ্চিমা সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলি প্রত্যাখ্যান করেন। থোবানি উল্লেখ করেন যে এই ধারণাগুলি মিডিয়া উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রাকৃতিকীকৃত হয়েছে। যারা পশ্চিমা আদর্শ গ্রহণ করে তারা সম্পূর্ণ “মানব” হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তাদেরকে যারা তাদের অ-পশ্চিমীকৃত সাংস্কৃতিক পরিচয়গুলি রক্ষা করে তাদের তুলনায় বেশি মর্যাদা এবং সুরক্ষা প্রদান করা হয়।

বেকের যুক্তি অনুসারে যারা অনুসরণ করেন তাদের মতে, একটি কসমোপলিটান বিশ্ব বহু রাষ্ট্রের (plurality of states) সমন্বয়ে গঠিত হবে, যা প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর দর-কষাকষির ক্ষমতা অর্জনের জন্য বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ঐকমত্যকে ব্যবহার করবে। রাষ্ট্রগুলি একটি কসমোপলিটান এজেন্ডা অনুসরণ করার জন্য তাদের বৈধতা শক্তিশালী করতে ও বিনিয়োগকারীদের সাহায্য গ্রহণ করতে এনজিও (Non-governmental organizations) এর মতো নাগরিক সমাজের কর্তাদের ও ভোক্তাদের কাজে লাগাবে নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করবে।

অন্যান্য লেখকরা আজকের জাতির রাষ্ট্র ধারণার বাইরে একটি কসমোপলিটান বিশ্ব কল্পনা করেন। এই পণ্ডিতরা যুক্তি দেন যে, বৈশ্বিক নাগরিকত্বের মধ্যে একটি সত্যিকারের কসমোপলিটান পরিচয় থাকবে, যা জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্বকে হ্রাস করবে। একটি বৈশ্বিক নাগরিক আন্দোলনের গঠন গণতান্ত্রিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং সিদ্ধান্তের জন্য স্থান তৈরি করবে, যা পালাক্রমে বৈশ্বিক স্তরে নাগরিকত্বের ধারণাটিকে শক্তিশালী করবে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক আদেশের ভিত গঠন করবে সেইসব শাসন কাঠামোর সমন্বিত কাঠামো, যেগুলো অহ্রাসযোগ্য নীতিগুলোকে (principles of irreducibility) (যেখানে সমস্যাগুলিকে শুধুমাত্র বৈশ্বিক স্তরেই সমাধান করা যেতে পারে, যেমন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন) এবং সাবসিডিয়ারিটি (Subsidiarity) (যেখানে সমস্যাগুলো কেবল স্থানীয় স্তরেই সমাধান করা যেতে পারে) এর ব্যাপারের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করবে।

দানিয়েলে আর্চিবুগি (Daniele Archibugi) বৈশ্বিক নাগরিকত্বের জন্য একটি নতুন মডেল প্রস্তাব করেন যা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কসমোপলিটানিজম (institutional cosmopolitanism)। এটি বৈশ্বিক শাসনে কিছু সংস্কারের পক্ষে যুক্তি দেয় যাতে বিশ্ব নাগরিকরা রাজনৈতিক জীবনে আরও সরাসরি অংশ নিতে পারে। এটি সম্ভব করার জন্য কিছু প্রস্তাবনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কসমোপলিটান গণতন্ত্র জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দেয় একটি বিশ্ব সংসদীয় পরিষদ (World Parliamentary Assembly) তৈরি করে।

সমালোচনা

“কসমোপলিটানিজম” (Cosmopolitanism)-কে জাতীয়তাবাদীরা একটি বক্তৃতাগত অস্ত্র (rhetorical weapon) হিসেবে ব্যবহার করেছে, যাকে যা প্রচলিত মতবাদের বিপরীতে দাঁড়ায় এমন যেকোন “বহিরাগত” (alien) ধারণাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপীয় ইহুদিদের প্রায়ই “মূলহীন কসমোপলিটান” (rootless cosmopolitans) হিসাবে অভিযুক্ত করা হত। জোসেফ স্টালিন (Joseph Stalin) ১৯৪৬ সালের মস্কোর একটি ভাষণে এমন লেখাগুলির আক্রমণ করেছিলেন যেখানে “ইতিবাচক সোভিয়েত নায়ককে উপহাস করা হয় এবং সকল বিদেশী এবং কসমোপলিটানিজমের সামনে নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়, যেগুলোর বিরদ্ধে আমরা লেনিনের সময় থেকে লড়াই করেছি, যা রাজনৈতিক বর্জ্যের বৈশিষ্ট্য, যাকে অনেক প্রশংসিত করা হচ্ছে।”

জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক (German Democratic Republic)-এ, কসমোপলিটানিজমকে একটি বুর্জোয়া-সাম্রাজ্যবাদী মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল যা জাতির স্বাধীনতা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে। বলা হয়েছিল যে কসমোপলিটানিজম জাতীয় ও দেশপ্রেমিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় সংস্কৃতির ধ্বংস সাধন করে। এটি অ্যাংলো-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা বিশ্ব আধিপত্য (World Government) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচারিত হয়েছিল, যা একচেটিয়া পুঁজিবাদের স্বার্থে পরিচালিত হয়। শভিনিস্ট বুর্জয়া জাতীয়তাবাদ এর বিপরীত ছিলনা, বরং এর বিপরীত ছিল দেশপ্রেম; নিজের জন্মস্থান, নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাকে বলা হয়েছিল কর্মজীবী মানুষের গভীরতম অনুভূতিগুলির একটি, যা বিজেতাদের এবং নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রকাশিত হয়।

টেলিভিশন সাংবাদিক জেফ গ্রিনফিল্ড (Jeff Greenfield) বিশ্বাস করেন যে ২১শ শতকে ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin) কসমোপলিটানিজমকে রাশিয়ান জাতীয়তাবাদের জন্য একটি হুমকি হিসাবে দেখেছেন, এবং একইভাবে হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীরাও একে একইভাবে দেখেছে। আধুনিক সময়ে, স্টিফেন মিলার (Stephen Miller), ট্রাম্প প্রশাসনের একজন সিনিয়র নীতি উপদেষ্টা, নতুন অভিবাসন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার সময় সিএনএন রিপোর্টার জিম আকোস্টা (Jim Acosta)-কে প্রকাশ্যে “কসমোপলিটান বায়াস” (cosmopolitan bias) প্রদর্শন করার জন্য সমালোচনা করেছিলেন।

তথ্যসূত্র

  • Appiah, K. A. (1997). Cosmopolitan Patriots. Critical Inquiry, 23(3), 617–639. doi:10.1086/448846. S2CID 224798936.
  • Appiah, K. A. (2006). Cosmopolitanism: Ethics in a World of Strangers. W.W. Norton & Co.
  • Appiah, K. A. (2006). Kindness to Strangers. In Cosmopolitanism: Ethics in a World of Strangers (pp. 155–174). New York: W. W. Norton & Co. ISBN 9780393061550. OCLC 475363652.
  • Appiah, K. A. (2006). Moral Disagreement. In Cosmopolitanism: Ethics in a World of Strangers (pp. 45–68). New York: W. W. Norton & Co. ISBN 9780393061550. OCLC 475363652.
  • Archibugi, D. (2003). Debating Cosmopolitics. London: Verso.
  • Archibugi, D. (2009). The Global Commonwealth of Citizens: Toward a Cosmopolitan Democracy. Princeton University Press.
  • Barua, M. (2013). Circulating Elephants: Unpacking the Geographies of a Cosmopolitan Animal. Transactions of the Institute of British Geographers, 39(4), 559. Bibcode:2014TrIBG..39..559B. doi:10.1111/tran.12047.
  • Beck, U. (2006). The Cosmopolitan Vision. Cambridge: Polity Press.
  • Bennington, G. (1997, December 1). Politics and Friendship: A Discussion with Jacques Derrida. Sussex, UK: Centre for Modern French Thought, University of Sussex. Archived from the original on 14 June 2014. Retrieved 16 July 2012.
  • Blattberg, C. (2012). We Are All Compatriots. In W. Kymlicka & K. Walker (Eds.), Rooted Cosmopolitanism. Vancouver: UBC Press. ISBN 9780774822626. OCLC 886376838. SSRN 2034932.
  • Butler, J. (2004). Precarious Life: The Powers of Mourning and Violence. New York: Verso. ISBN 9781844670055. OCLC 803802111.
  • Cladis, M. (1992). A Communitarian Defense of Liberalism: Emile Durkheim and Contemporary Social Theory. Stanford University Press.
  • Corradetti, C. (2017, November). Constructivism in Cosmopolitan Law. Global Constitutionalism, 6(3), 412–441. doi:10.1017/S2045381717000028. hdl:2108/316903. S2CID 151523474.
  • Delanty, G. (2006, September 27). Handbook of Contemporary European Social Theory. Routledge. ISBN 978-0-203-08647-6.
  • Diogenes Laërtius. (1998). The Lives of Eminent Philosophers (Book VI, passage 63). Translated by A. Lingis. Pittsburgh, PA: Duquesne University Press.
  • Durkheim, E. (1898). Individualism and Individuals. Revue bleue, 4e serie, 10, 7-13. Translated by M. Traugott. Retrieved from https://www.scribd.com/document/85771137/Durkheim-Individualism-and-the-Intellectuals
  • Fanon, F. (1963). The Pitfalls of National Consciousness. In The Wretched of the Earth (pp. 148–205). Translated by C. Farrington. New York: Grove Press. ISBN 9780802150837. OCLC 817260777.
  • Giselle, L. A., Lozano, J. C., Berkin, S. C., Thies, S., & Raussert, W. (2020). The Routledge Handbook to the Culture and Media of the Americas. Taylor & Francis. ISBN 9781351064682.
  • Greenfield, J. (2017, August 3). The Ugly History of Stephen Miller’s ‘Cosmopolitan’ Epithet. Politico.
  • Greenfield, J. (2017, August 2). What ‘Cosmopolitan Bias’ Really Means. Bloomberg.com. Retrieved 22 October 2017.
  • GTI Paper Series. (2008, February 11). Dawn of the Cosmopolitan: The Hope of a Global Citizens Movement, paper #15, and Global Politics and Institutions, paper #3. Archived at Wayback Machine.
  • James, P. (2014). Political Philosophies of the Global: A Critical Overview. In Globalization and Politics Vol. 4: Political Philosophies of the Global. London: Sage Publications. ISBN 9781412919555.
  • Kleingeld, P., & Brown, E. (2019, October). Cosmopolitanism. In E. N. Zalta (Ed.), Stanford Encyclopedia of Philosophy. Center for the Study of Language and Information. Archived from the original on 14 January 2020.
  • Kwame, A. A. (2006). Cosmopolitanism: Ethics in a World of Strangers. London: Penguin Books.
  • Mamdani, M. (2004). Good Muslim, Bad Muslim: America, the Cold War, and the Roots of Terror (1st ed.). New York: Pantheon Books. ISBN 978-0-375-42285-0. OCLC 53315228.
  • Merriam-Webster. (n.d.). Definition of COSMOPOLITAN. Retrieved 2021-05-25 from www.merriam-webster.com.
  • Mosterín, J. (2005). A World without Nation States. Acta Institutionis Philosophiae et Aestheticae, 23, 55–77.
  • Mosterín, J. (2008). La cultura de la libertad (in Spanish). Madrid: Espasa-Calpe. ISBN 9788467026979. OCLC 693823808.
  • Müller, B. E. (2021). Cosmopolitanism as Nonrelationism: Who is Cosmopolitan Now?. Springer International Publishing. ISBN 9783030834579.
  • Nhất Hạnh, T. (1996). Being Peace. Edited by A. Kotler. Illustrations by M. Oda. Berkeley: Parallax. ISBN 9780938077978. OCLC 36745774.
  • Nicholson, C. (1998). Three Views of Philosophy and Multiculturalism: Searle, Rorty, and Taylor. Twentieth World Congress of Philosophy.
  • Nussbaum, M. C. (1997). Kant and Stoic Cosmopolitanism. The Journal of Political Philosophy, 5(1), 1–25.
  • Online Etymology Dictionary. (n.d.). Cosmopolitan. Retrieved from www.etymonline.com.
  • Ruck, D. J., Bentley, R. A., & Lawson, D. J. (2020). Cultural prerequisites of socioeconomic development. Royal Society Open Science, 7(2), 190725. Bibcode:2020RSOS….790725R. doi:10.1098/rsos.190725. PMC 7062048. PMID 32257300.
  • Shen, S. (2009). Cosmopolitan Publics: Anglophone Print Culture in Semi-Colonial Shanghai. Rutgers University Press. ISBN 9780813546995.
  • Stojadinović, M. (2014). Universalism Revived: Needs-Based Cosmopolitanism as a Foundation of Global Democracy. Facta Universitatis, Series: Philosophy, Sociology, Psychology and History, 13, 78–80. Retrieved 18 April 2017.
  • Taschenkalender der Kasernierten Volkspolizei 1954. Berlin : Verl. d. Minist. d. Innern, pp. 248-249.
  • Taylor, R. S. (2010). Kant’s Political Religion: The Transparency of Perpetual Peace and the Highest Good. The Review of Politics, 72, 1–24. doi:10.1017/S0034670509990945. S2CID 145681255.
  • Winther, R. G. (2012). Free to Universalize or Bound by Culture? Multicultural and Public Philosophy (PDF). White Paper.
  • WikipediA. (n.d.). Trieste. Retrieved 15 December 2023.
  • WikipediA. (n.d.). Ulysses. Retrieved 15 December 2023.
  • WikipediA. (n.d.). Finnegans Wake. Retrieved 15 December 2023.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.