Table of Contents
ভূমিকা
কনফার্মেশন বায়াস অনেক নামেই পরিচিত, যেমন কনফার্মেটরি বায়াস, মাইসাইড বায়াস, কনজেনিয়ালিটি বায়াস। বাংলায় একে নিশ্চিতকরন পক্ষপাত বলা যায়, তবে অধিক পরিচিতির জন্য এই লেখায় একে কনফার্মেশন বায়াসই বলা হবে। কনফার্মেশন বায়াস হচ্ছে মানুষের মধ্যে থাকা সেই প্রবণতা যার কারণে সে এমন সব তথ্যেরই অনুসন্ধান করে বা সেগুলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে, বা সেগুলোকে সিলেক্ট করে, বা এমনভাবে স্মরণ করে যেগুলো তার মধ্যে থাকা বিশ্বাস ও মূল্যবোধকেই সাপোর্ট করে। অনেককেই দেখা যায় এমন সব তথ্য নির্বাচন করছেন যেগুলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে, বা সেই সব তথ্যকে অগ্রাহ্য করছেন যেগুলো তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে যায়, বা ধরুন কোন দ্ব্যর্থতামূলক বা অস্পষ্ট বা এম্বিগুয়াস এভিডেন্স পাওয়া গেছে যেখান থেকে নিশ্চিত কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়না, কিন্তু ব্যক্তি সেই এভিডেন্স থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসছেন যা তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বলতে হয় যে ব্যক্তির মধ্যে কনফার্মেশন বায়াস রয়েছে। ব্যক্তির মধ্যে এই কনফার্মেশন বায়াসের মাত্রা সব সময় একই রকম থাকেনা। এটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয় যখন ব্যক্তি কোন কিছুর নির্দিষ্ট ফল বা আউটকাম আকাঙ্ক্ষা করে, বা আবেগের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যায় বা এমন কিছু সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয় যা সে গভীরভাবে বিশ্বাস করে যেমন ধর্মসম্পর্কিত বিষয়। বেশিরভাগ লোকের পক্ষে কনফার্মেশন বায়াস থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়, কিন্তু তারা এটাকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যেমন শিক্ষার দ্বারা ও ক্রিটিকাল থিংকিং এর দক্ষতায় নিজেকে প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে।
তথ্য অনুসন্ধানে বায়াস, এই সব তথ্যের ব্যাখ্যায় বায়াস, এবং কোন কিছু স্মরণ করার ক্ষেত্রে বায়াস – এগুলোকে নির্দিষ্ট চারটি সাইকোলজিকাল এফেক্টকে ব্যাখ্যা করার কাজে নিয়ে আসা হয়েছে –
- ১। এটিচুড পোলারাইজেশন (যেখানে বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ পক্ষের সামনে একই তথ্য বা এভিডেন্স নিয়ে আসার পর তাদের মধ্যকার মতানৈক্য আরও বেড়ে যায়)
- ২। বিলিফ পারসেভারেন্স (যেখানে ব্যক্তির সামনে এমন কোন এভিডেন্স যদি তুলে ধরা হয় যেটা তার মধ্যে থাকা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তাহলেও তার বিশ্বাসটা থেকে যায়)
- ৩। ইর্যাশনাল প্রাইমেসি এফেক্ট (যেখানে ব্যক্তি তার সাথে পূর্বে কয়েকবার ঘটা বিষয়ের তথ্যের উপর বেশি নির্ভর করে)
- ৪। ইল্যুসরি কোরিলেশন (যেখানে ব্যক্তি ভুলভাবে দুটো ঘটনা বা পরিস্থিতিকে সম্পর্কিত করে বা এদের মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে মনে করে)
১৯৬০ এর দশকে সংঘটিত হওয়া বেশ কিছু সাইকোলজিকাল এক্সপেরিমেন্ট থেকে দেখা যায় যে, মানুষের মধ্যে একটি বায়াস কাজ করে যার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে থাকা বিশ্বাসগুলোকে কনফার্ম বা নিশ্চিত করতে চায়। পরে এই গবেষণাগুলো নিয়ে কাজ হয় এবং এই বায়াসকে ব্যক্তির মধ্যে কাজ করা এমন প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার জন্য ব্যক্তি কোন ধারণাকে একপাক্ষিকভাবে টেস্ট করে, অন্যান্য বিকল্পগুলোকে অগ্রাহ্য করে একটি সম্ভাবনায় ফোকাস করে। এই নতুন বায়াসের ব্যাখ্যা হিসেবে কেউ কেউ উইশফুল থিংকিং বায়াসের কথা আনেন, বার কেউ কেউ মানুষের ইনফরমেশন প্রোসেস করার সীমাবদ্ধ ক্ষমতার কথা আনেন। কিন্তু আরেকটা নতুন প্রস্তাবও চলে আসে, আর তা হচ্ছে, মানুষ একটি কনফার্মেশন বায়াস প্রদর্শন করে, কারণ মানুষ একটি স্বাভাবিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কোন কিছু নিয়ে তদন্ত না করে নিজেদের ভুল হবার ক্ষতির দিকটা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে।
যাই হোক, কনফার্মেশন বায়াসের কারণে আসা ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক, অরগানাইজেশন-সংক্রান্ত, আর্থিক (Financial) ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয় সহ বিস্তৃত ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। এই বায়াস ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওভারকনফিডেন্স বা অতিআত্মবিশ্বাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে এবং বিরোধপূর্ণ এভিডেন্স বা প্রমাণ দেখার পর সেই বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। যেমন ইন্ডাক্টিভ রিজনিং বা আরোহী যুক্তির উপর ভিত্তিতে তৈরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে। ইন্ডাক্টিভ রিজনিং এর ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সাপোর্টিভ এভিডেন্সগুলো জমা করা হয়। এক্ষেত্রে যদি বায়াস কাজ করে তাহলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সিস্টেমিক এরর দেখা যায়। একইভাবে একজন পুলিস ডিটেক্টিভ কোন তদন্তের শুরুতে একজন সাসপেক্টকে সনাক্ত করতে পারেন, কিন্তু এরপর তিনি তার এই সাসপেক্ট এর সাথে সম্পর্কিত ডিসকনফার্মিং এভিডেন্স, মানে যেসব এভিডেন্স সাসপেক্টের দোষী সাব্যস্ত হবার বিরুদ্ধে যায় সেগুলোকে অগ্রাহ্য করতে পারেন, ও কেবল কনফার্মিং এভিডেন্স, মানে যেসব এভিডেন্স তাকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে যায় সেগুলোকে গ্রহণ করতে পারেন। একজন চিকিৎসক তার ডায়াগনোস্টিক সেশনে শুরুতে একটা ডিজর্ডারের কথা ভাবতে পারেন ও এরপর এমন সব এভিডেন্সই সিলেক্ট করতে পারেন যেগুলো তার প্রাথমিক ডায়াগনোসিসের পক্ষে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই কনফার্মেশন বায়াস অনেক বেড়ে গেছে এতে ফিল্টার বাবল বা এলগোরিদম এডিটিং এর জন্য, যার ফলে ব্যক্তির সামনে মূলত সেই সব বিষয়ই আসে যেগুলোর সাথে তার সম্মত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, আর যেসব বিষয়ের তার বিরুদ্ধে যাবে সেগুলো তার সামনে আনা হবেনা।
সংজ্ঞা এবং কনটেক্সট
ইংলিশ সাইকোলজিস্ট পিটার ওয়াসন প্রথম কনফার্মেশন বায়াস নামটি প্রণয়ন করেন। তিনি বলেন এই কনফার্মেশন বায়াস হচ্ছে এমন একটি প্রবণতা যেখানে মানুষ সেই সব তথ্য পছন্দ করে যা তার বিশ্বাসসমূহ ও মূল্যবোধগুলোকে শক্তিশালী করে এবং একবার সেই তথ্য দ্বারা তাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধসমূহ শক্তিশালী হলে তাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যায়।
কনফার্মেশন বায়াসগুলো হলো ইনফরমেশন প্রোসেসিং এর একটি সমস্যা। এটি বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্ট (সেলফ-ফুলফিলিং প্রোফেসি এর একটি প্রকরণ) থেকে আলাদা। সেলফ ফুলফিলিং প্রোফেসি হয় যখন ব্যক্তি কোন কিছু ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এরপর এমন আচরণ করেন যা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হওয়ায় অবদান রাখে। এটি বায়াস হয় কারণ ব্যক্তি মনে করেন তার কাজের জন্য নয় বরঙ তিনি এটি ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলেই এটি ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ, এক ব্যক্তি একটি গাছ লাগিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করল যে গাছটি খুব ভাল ভাবে বেড়ে উঠবে ফল দেবে। এর পর সেই ব্যক্তি নিজেই সেই গাছটির যথেষ্ট যত্ন নেয়া শুরু করল, ফলে গাছটিও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল, আর এরপর সেই ব্যক্তি ভাবলো সে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই ফলেছে। বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্ট একটি বিশেষ ধরনের সেলফ-ফুলফিলিং প্রোফেসি যেখানে ব্যক্তি গাছের মতো কোন বস্তুর বদলে কোন ব্যক্তিকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এরপর তিনি এমন কোন আচরণ করেন যা যেই ব্যক্তিকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হলো তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যার ফলে সে নিজেই তার উপর করা ভবিষ্যদ্বাণী যাতে সত্য হয় তার জন্য কাজ করা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক তার একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে সে পরের পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করবে। শিক্ষক এই কথাটি সেই শিক্ষার্থীকে বললেনও। এরপর সেই শিক্ষার্থী সেই শিক্ষকের এই ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজে খুব ভালো করে পড়াশুনা শুরু করল, সেই সাথে শিক্ষক নিজেও সেই শিক্ষার্থীর উপর বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করলেন। এসবের প্রভাবে শেষ পর্যন্ত সেই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খুব ভাল ফলাফল করল, আর শিক্ষক মনে করলেন সেই শিক্ষার্থীকে নিয়ে তার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে। কনফার্মেশন বায়াস এই বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্টের থেকে ভিন্ন কেননা, বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে ভূমিকা রাখে তার নিজস্ব বিশ্বাস বা মূল্যবোধের পক্ষে আউটকাম যাতে আসে সেজন্য, কিন্তু কনফার্মেশন বায়াসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কেবল তার বিশ্বাস বা মূল্যবোধের পক্ষে তথ্য নির্বাচন, স্মরণ ও ব্যাখ্যা করেন, নিজে কোন আচরণের মাধ্যমে কোন কিছু তার পক্ষে নিয়ে আসেননা।
কনফার্মেশন বায়াস এর পরিসর কতটা তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কতিপয় মনোবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসের পক্ষে এভিডেন্স সংগ্রহ করা ও তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় এমন উপসংহারের সাথে সম্পর্কিত এভিডেন্সগুলোকে অগ্রাহ্য করেন। কিন্তু অন্যান্য মনোবিজ্ঞানীগণ কনফার্মেশন বায়াসকে আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন। তাদের মতে, কনফার্মেশন বায়াস হলো কোন এভিডেন্স সংগ্রহের সময়, সেগুলোকে ব্যাখ্যা করার সময়, বা স্মৃতি থেকে এভিডেন্সগুলো স্মরণ করার সময় ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসসমূহকে রক্ষা করার প্রবণতা। যাই হোক, মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কনফার্মেশন বায়াস কোন ইচ্ছাকৃত প্রতারণা নয় বরং স্বয়ংক্রীয়, অনিচ্ছাকৃত কৌশলের ফল।
Leave a Reply