প্রাক-স্কলাস্টিক মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় দর্শন

ভূমিকা

খ্রিস্টীয় আট শতকের শেষ এবং ন’শতকের শুরুকে সাধারণত মধ্যযুগের সূত্রপাত বলে চিহ্নিত করা হয়। এলকুইন নামক এক ইংরেজকে কেউ কেউ মধ্যযুগের প্রথম উল্লেখযোগ্য দার্শনিক বলে মনে করে থাকেন। মধ্যযুগের দার্শনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রথমে আমরা মধ্যযুগে ব্যবহৃত দার্শনিক উপাদান পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোতে কী করে সংগৃহীত হয়েছিল, তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে হবে। প্রথমে উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন মানুষ গ্রিকভাষা পঠনপাঠনের ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিল। মৌলিক গ্রিক দর্শন ও গ্রিক গ্রন্থাবলির সাথে যোগাযোগের জন্য মধ্যযুগীয় মানুষ ল্যাটিন অনুবাদসমূহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অনুবাদসমূহের মধ্যে ক্যালসিডিয়াস অনূদিত ‘টাইমীয়ুস’সহ প্লেটোর অন্যান্য কিছু সংলাপও বিক্ষিপ্তভাবে সংরক্ষিত ছিল। ক্যালসিডিয়াসের ভাষ্য থেকে প্রাক্-সক্রেটিস দর্শন, এরিস্টটল, স্টোয়িক দর্শন এবং নব-প্লেটোবাদী দর্শন সম্পর্কে কিছু জানা যেত। এরিস্টটলের গ্রন্থাবলির মধ্যে শুধু তার লজিক বা যুক্তিবিদ্যাবিষয়ক গ্রন্থাবলিই তখন পরিচিত ছিল। মধ্যযুগের চিন্তায় এসব গ্রন্থের প্রভাব ছিল ব্যাপক। রোমান দার্শনিকদের মধ্যে সিসেরো, সেনেকালিউক্রেটিয়াসের গ্রন্থাবলির কিছু কিছু অংশ এবং পরফিরি ও নব-প্লেটোবাদীগণের কিছু ল্যাটিন ভাষ্যও তখন প্রচলিত ছিল। অগাস্টিনের কিছু কিছু গ্রন্থও তখন বেশ প্রভাবশালী ছিল। তবে বিথিয়াস ও ক্যাসিওডোরোসের অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সংকলনের প্রতিই পণ্ডিতব্যক্তিদের ঝোঁক ছিল সবচেয়ে বেশি।

এই ছিল খ্রিস্টীয় নয় ও দশ শতকের মানসিক ও দার্শনিক পরিবেশ। এরিস্টটলের অর্গানন-এর কিছু অংশ কতিপয় বাইজেন্টাইন ও মুসলিম দার্শনিকের রচনা এবং গেলেনহিপোক্রেটিসের চিকিৎসাশাস্ত্রবিষয়ক রচনাবলির ল্যাটিন অনুবাদ ছাড়া পরবর্তী দুইশ’ বছরে তেমন কোনো দার্শনিক কাজ এর সাথে সংযোজিত হয় নি। নতুন যুগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত দেয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। খ্রিস্টীয় আট শতকে শার্লাম্যান রোমান সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সাম্রাজ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই শান্ত ও সুশৃঙ্খল পরিবেশেই আধুনিক মহাদেশীয় ইউরোপের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ইংল্যান্ডেও বিবদমান স্যাক্সন রাজ্যগুলোর মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ডেনদের ধ্বংসলীলা সত্ত্বেও পরবর্তী একশ’ বছরের মধ্যে সম্রাট আলফ্রেডের পুত্র এডওয়ার্ডের শাসনকালে সমগ্র ব্রিটেনকে সংযুক্ত করা হয়।

এলকুইন (৭৩৫-৮০৪ খ্রি.) ও র‍্যবন (৭৮০-৮৫৬ খ্রি.) 

এলকুইন (Alcuin) ছিলেন সম্রাট শার্লম্যানের একজন অন্যতম উপদেষ্টা। তার জন্মভূমি ছিল ইংল্যান্ড। এলকুইনের মধ্যে দার্শনিক ধ্যান-অনুধ্যানের পুনর্জাগরণের তেমন কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। মধ্যযুগের দার্শনিকদের মধ্যে তাকে প্রথম দার্শনিক বলার যদি কোনো যুক্তি থেকে থাকে তা হলো এই যে, শার্লাম্যানের সময়কালে তার জন্মগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রধানত শিক্ষাক্ষেত্রেই তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। ফ্রান্সের যাজকদের নিরক্ষরতার ব্যাপারে বিস্মিত ও মর্মাহত হয়ে এবং ফ্রান্স থেকে শিক্ষক সংগঠক বাছাই করতে না পেরে শার্লাম্যান ইংল্যান্ড ও ইটালি থেকে বেশ কিছুসংখ্যক পণ্ডিতব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে আনেন। এদের কাজ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং যাজকদের প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন। এলকুইন ছিলেন এসব পণ্ডিতদেরই একজন।

সাত প্রকার লিবেরাল আর্টস বা উদারনৈতিক কলাকে এলকুইন ‘কোয়াড্রিভিয়াম’ (quadrivium) ও ‘ট্রিভিয়াম’ (trivium)-এ দু’ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। পাটিগণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, সংগীত-এ চারটি বিষয়ের সমন্বয়ে ‘কোয়াট্রিভিয়াম’ এবং ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র ও তর্কবিজ্ঞান-এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে ‘ট্রিভিয়াম’ গঠিত ছিল। উদারনৈতিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে এসব বিষয় পরবর্তী পাঁচশ’ বছর প্রচলিত এবং স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। রেনেসাঁ-উত্তরকালে ক্রমশ এ প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এলকুইন তার পরবর্তী জীবনে নৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাত্যহিক জীবনে সৎ এবং পার্থিব প্রলোভন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন: “যিনি সবসময় ঈশ্বরের সঙ্গে থাকতে চান, তার উচিত নিয়মিত উপাসনা করা এবং নিয়মিত পাঠ করা; কারণ আমরা যখন উপাসনা করি, তখন আমরা ঈশ্বরের সাথে কথা বলি, আমরা যখন পাঠ করি, ঈশ্বর তখন আমাদের সাথে কথা বলেন।” এলকুইন তার বেশিরভাগ কাজই বাইবেল পাঠ ও অন্যান্য ধর্মীয় চর্চায় নিয়োজিত করেন।

এলকুইনের ছাত্র র‍্যবন ম্যাওরুস (Rabanus Maurus, ৭৮০-৮৫৬ খ্রি.) ছিলেন ওই যুগের অপর এক প্রতিনিধি। এলকুইন তাকে গভীরভাবে স্নেহ করতেন। আর তিনিও তার গুরুকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন এবং এলকুইন প্রাচারিত আদর্শ অনুশীলনের সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। তবে জ্ঞানের পরিসরের কথা বিবেচনা করলে বলা যায় যে, র‍্যবন তার শিক্ষককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

সে যুগের অন্যান্য সব শিক্ষিত লোকের ন্যায় র‍্যবন ধর্মপুস্তককেই জ্ঞানের ভিত্তি বলে গ্রহণ করেন। প্রাচীন ও নতুন বাইবেলের ওপর তিনি বিস্তৃত ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞানসম্বলিত একটি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। অবশ্য এর জন্য তিনি উদারনৈতিক কলার প্রতি কোনো উপেক্ষা প্রদর্শন করেন নি। প্যাগান দর্শন সম্পর্কে তিনি এলকুইনের চেয়ে উদারভাবাপন্ন ছিলেন। তার মতে খ্রিস্টীয় দর্শনে যেমন, প্যাগান দর্শনেও তেমনি জ্ঞান নিহিত থাকতে পারে। দর্শনকে তিনি জগতবিষয়ক এবং পারমার্থিক-এ দু’ভাগে বিভক্ত করেন। শিক্ষা সমস্যাকে তিনি দেখেছিলেন ব্যাপক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

এরিজেনা (৮০০-৮৭৭ খ্রি.)

জন স্কোটাস এরিজেনা ছিলেন মধ্যযুগের প্রথম মৌলিক দার্শনিক। ৮১০ খ্রিস্টাব্দে আয়াল্যান্ডে তার জন্ম, এবং সেখানকার স্কুলেই তিনি শিক্ষা লাভ করেন। তার মৃত্যুর তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবে অনেকের মতে ৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে। তার প্রতিষ্ঠিত মঠগুলাে শিক্ষাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। অন্যান্য পণ্ডিতব্যক্তিদের ন্যায় তিনিও প্যারিসে গমন করেন, ফরাসিরাজ চার্লস তাকে রাজকীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। সেখানে তিনি তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তার জন্য অচিরেই সুখ্যাতি অর্জন করেন। ল্যাটিন ছাড়াও তিনি গ্রিক ও আরবি ভাষা জানতেন। গ্রিক দর্শননব-প্লেটোবাদী দর্শনের সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। মধ্যযুগের অন্যান্য দার্শনিকের ন্যায় এরিজেনা ধর্মের সবকিছুকে অন্ধভাবে সমর্থন করেন নি, এবং তিনি তার প্রতিটি মতে বিচারশীল মনােবৃত্তির পরিচয় দেন। যদিও তিনি সরকারিভাবে চার্চের অনুশাসনে আস্থাশীল ছিলেন, তবু তিনি এমন সব মতবাদ প্রচার করেন, যেগুলাে ছিল মধ্যযুগীর দর্শনের মর্মবিরােধী। পূর্ব-নিয়ন্ত্রণ (predestination) নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে প্রচলিত গোঁড়া মত সমর্থন না করার ফলে তার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। স্বাধীন ইচ্ছার সমর্থন করে তিনি অন ডিভাইন প্রিডেস্টিনেশন (On Divine Pre-destination) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রমাণের জন্য প্রত্যাদেশের ওপর নির্ভর না করে তিনি নিরপেক্ষ যুক্তির অবতারণা করেন।

এরিজেনার ধর্মতাত্ত্বিক মত নব্যপ্লেটোবাদীঅগাস্টিনীয় মতের সদৃশ। তার মতে, ঈশ্বর সব সবকিছুর উৎপত্তি, স্থিতি ও সমাপ্তির কারণ। ঈশ্বর থেকে সবকিছুর উদ্ভব, ঈশ্বরেই সবকিছু থাকে এবং ঈশ্বরেই সব ফিরে যাবে। ঈশ্বর শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর অসৃষ্ট স্রষ্টা, অদৃষ্ট সৃজনীশক্তি, তিনি তার মনের পরিকল্পনা বা চিরন্তন আদর্শ (লােগােস) অনুসারে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। লােগােস তার সত্তারই প্রকাশ। সব জাগতিক শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার মূলে ক্রিয়াশীল ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা। স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বর সব জিনিসেই বিরাজমান এবং তিনি সব জিনিসের অস্তিত্বের ভিত্তি। সবকিছু ঈশ্বর থেকে আগত এবং সবকিছু ঐশ্বরিক প্রকৃতিকেই ব্যক্ত করে, ঈশ্বর ও তার সৃষ্টি অভিন্ন। তিনি তার সৃষ্টিতে আছেন, আর তার সৃষ্টিও তার মধ্যেই আছে। জগৎ মানুষের কাছে বিভক্ত ও বহু বলে প্রতীত হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা এমন এক অবিভক্ত জগৎ যেখানে সব বিরােধের সমন্বয় ঘটে।

এ থেকে বােঝা যায় যে, ঈশ্বর জগতে অনুস্যূত (immanent); কিন্তু তিনি আবার জগতের অতিবর্তী (transcendent)। অর্থাৎ, জগতে ঐশ্বরিক সত্তা সম্পূর্ণরূপে উজাড় হয়ে যায় – একথা মানতে এরিজেনা নারাজ। জগতে ঐশ্বরিক সত্তা আংশিকভাবে প্রতিফলিত; জগতের বাইরেও ঈশ্বরের অনন্ত সত্তা পরিব্যাপ্ত। একই আলােকে একইসঙ্গে অনেক লােক যেমন দেখতে পারে, একই শব্দ বহু লােক যেমন শুনতে পারে, অথচ তাতে আলাে বা শব্দের যেমন হ্রাস হয় না, ঠিক তেমনি সব জীব ঈশ্বরের সত্তার অংশীদার হলেও তাতে ঈশ্বরের কিছু আসে যায় না। তার মতে, ঈশ্বর নিজেকে চারটি পৃথক স্তরে প্রকাশ করেন। প্রথম স্তরে তিনি নিজে অসৃষ্ট হয়েও সৃজনশীল। এ অর্থে তিনি সবকিছুর কেন্দ্র, অন্তঃসার ও সূত্র। তিনি সসীম অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে এবং তাকে আমাদের সীমিত ভাষায় ব্যাখ্যা করা চলে না। তিনি চেতনার এত ঊর্ধ্বে যে, তাকে আত্মসচেতন বলা চলে না, তার আত্মজ্ঞান বলতে কিছু নেই। এর কারণ, চেতনা ও জ্ঞান সসীম পরিস্থিতিতেই অর্থবহ। উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বর যদি নিজেকে জানতেন, তাহলে জ্ঞানের প্রচলিত শর্তাবলির অধীনে তাকে নিজের সম্পর্কে ভাবতে হতাে এবং নিজেকে শ্রেণীবিভক্তও করতে হতাে; কেননা জ্ঞানের জন্য শ্রেণীবিভাগ অপরিহার্য। অথচ ঈশ্বর এক এবং তাকে অনেক ঈশ্বরের মধ্যে একজন বলে শ্রেণীবিভক্ত করা চলে না। দ্বিতীয় স্তরে ঈশ্বর একাধারে সৃষ্ট ও সৃজনশীল। তিনি যদিও সম্পূর্ণরূপে জগতের অতীত, তবুও তিনি অস্তিত্বের অসীম সম্ভাবনার বাহক। আর এই সম্ভাবনা নিরন্তর বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ থেকে সৃষ্টি হয় তৃতীয় স্তরের যেখানে জগতের বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার ব্যক্ত হয় এবং যেখানে ঈশ্বর প্রথমবারের মতাে আত্মসচেতন হন এবং নিজেকে জানেন। এখানে ঈশ্বর নিজে সৃষ্ট অথচ সৃজনশীল নন। দেশ-কালে অবস্থিত যাবতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বস্তু এই প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। এ থেকে বােঝা যায় যে, সমগ্র বিশ্বরাচর ঐশ্বরিক দ্রব্য থেকে উদ্ভূত। জগৎকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর নিজেকেও সৃষ্টি করেছেন।

তার মতে, অস্তিত্বের সব সম্ভাবনাকে উজাড় করে এবং আত্ম-অভিব্যক্তি সমাপ্ত করে ঈশ্বর সবশেষে নিজের দিকে ফেরেন এবং নিজের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করেন। আবর্তনের শুরুতে তিনি যেমন ছিলেন নিজে অসৃষ্ট অথচ সৃজনশীল প্রকৃতি, ঠিক তেমনি আবর্তনের শেষে এখন তিনি এমন এক স্থিতিশীল প্রকৃতি যা সৃজনশীল নয়, আবার সৃষ্টও নয়। ঈশ্বর থেকেই মানুষের উদ্ভব, ঈশ্বরের কাছে মানুষ ফিরে যাবে এবং বর্ণনাতীত ঐশ্বরিক সত্তার সাথে মানুষ মিশে যাবে। এতেই মানুষের পরিত্রাণ। শুধু মানুষই নয়, সৃষ্টির সকল জীবের সাথেই এটা ঘটে। চিরন্তন ‘লােগােস’-ই বহুকে ‘এক’-এ ফিরিয়ে আনে, মানুষকে ঈশ্বরে ফিরিয়ে নেয়। যিশুই দেশ-কালে ঈশ্বরের প্রকাশ, এবং যিশুর সাহায্যেই সবকিছু ঈশ্বরে ফিরে যায় ও ঈশ্বরের সাথে পুনর্মিলিত হয়।

এরিজেনার মতানুসারে, স্বাধীনতা থেকেই পাপের উৎপত্তি। মানুষ স্বাধীন। ঈশ্বরের দিকে না তাকিয়ে মানুষ নিজের দিকে তাকিয়েছিল বলেই তার পাপের উৎপত্তি, এবং এজন্যই মানুষের পতন। মুক্তি ও পরিত্রাণের জন্য মানুষকে এক উর্ধ্বমুখী পথ অতিক্রম করতে হবে। পতনের ফলে মানুষ রক্তমাংসের যে দেহের অধিকারী হয়, মৃত্যুর ফলেই সে এ দেহ থেকে মুক্ত হতে পারে। গ্রিক ধর্মযাজকদের ন্যায় এরিজেনা বলেন, অশুভের কোনাে পরাতাত্ত্বিক বাস্তবতা নেই । ঈশ্বরে অশুভের কোনাে স্থান নেই। সুতরাং ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে অশুভমুক্ত। অশুভ অসৎ প্রভৃতির কোনাে ভিত্তি নেই। সেন্ট অগাস্টিনের মতের প্রতিধ্বনি করে এরিজেনা বলেন, শুভের অভাবই অশুভ।

বিশ্বাস ও বুদ্ধির বিতর্কে এরিজেনা যে বুদ্ধির সমর্থক, এ কথা আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। এক দিক থেকে তার দার্শনিক মত খ্রিস্টীয় মতবাদকে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করারই প্রচেষ্টা। তার মতে, প্রকৃত প্রত্যাদেশ বিচারবুদ্ধিপরিপন্থী হতে পারে; কেননা প্রত্যাদেশ সত্যের বাহক, আর সত্য স্বভাবতই বুদ্ধিভিত্তিক। দার্শনিক ও ধর্মীয় সত্য এক ও অভিন্ন। বুদ্ধির মাধ্যমে এবং বুদ্ধির পক্ষে গ্রহণযােগ্য ভাষায় ধর্মগ্রন্থকে ব্যাখ্যা করতে হবে। যুক্তিযুক্ত না হলে ধর্মযাজকদের কথাও গ্রহণযােগ্য নয়, হতে পারে না। সত্যের কর্তৃত্বই একমাত্র কর্তৃত্ব; আর ঈশ্বর ও বিশ্বসম্পর্কিত সত্যকে শুধু যুক্তিসম্মত চিন্তার মাধ্যমেই আবিষ্কার করা যায়।

জন স্কোটাস এরিজেনা প্রদত্ত খ্রিস্টীয় মতবাদের এই ব্যাখ্যা কোনােদিনই ব্যাপক সমর্থন পায় নি। পক্ষান্তরে একে দাবিয়ে রাখার সুপরিকল্পিত চেষ্টা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তবু প্রকাশ্যে না হলেও চুপিসারে এ মত প্রচলিত ছিল। নানাভাবে বহুবার এর প্রকাশ্য পুনরাবির্ভাব ঘটে। শেষ পর্যন্ত প্রায় চারশ বছর পরে জার্মান মরমিবাদী দার্শনিক মেইস্টার একহার্ট এ মতের জোর সমর্থন করেন।

সার্বিক প্রসঙ্গ

৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে এরিজেনার মৃত্যুর পর খ্রিস্টীয় দর্শন পুনরায় নিস্তব্ধ হয়ে যায়, এবং এই নিস্তব্ধতা প্রায় দু’শ বছর স্থায়ী ছিল। ইতোমধ্যে অবশ্য এরিস্টটলের ‘ক্যাটেগোরিজ’-এর ভূমিকায় পরফিরি উত্থাপিত একটি সমস্যা নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়। ‘ক্যাটেগোরিজ’-এর ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে পরফিরি প্রাণিকুল, মানবজাতি, ন্যায়পরতা প্রভৃতি সার্বিক (universal), সাধারণ ধারণা এবং সারধর্ম (essence) -এর স্বরূপ ও স্থান সম্পর্কে পুনরায় প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত মীমাংসা দেয়ার চেষ্টা না করে গোটা ব্যাপারটিকেই তিনি উন্মুক্ত রেখে যান। অর্থাৎ সার্বিক কি দ্রব্য, না নিছক ধারণা, যদি দ্রব্য হয়ে থাকে তা হলে তারা কি দেহধারী, না অশরীরী; আর তারা কি বিশেষ বস্তুতে, না বস্তুর বাইরে অধিষ্ঠিত-এসব ব্যাপারে তিনি কোনো চূড়ান্ত মত প্রকাশ করেন নি।

এখানে উল্লেখ্য যে, সক্রেটিস, সিনিকগণ, সিরেনাইকগণ, প্লেটো এরিস্টটল যে সমস্যাটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছিলেন, পরফিরি এখানে সেই একই সমস্যার পুনরূল্লেখ করেছেন। প্রত্যেক মানুষই তার নিজস্ব সত্যের পরিমাপক, সুতরাং সার্বিক, অনপেক্ষ সত্য কিংবা শুভ বলে কিছু নেই-সোফিস্টদের এ উক্তি থেকেই আলোচ্য সমস্যাটির উৎপত্তি। ক্ল্যালিক্লিস ও থ্র্যাসিম্যাকাস এ মতটিকে রাজনীতি ও নীতিশাস্ত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। ক্ল্যালিক্লিসের মতে, শক্তিশালীদেরই শাসন করার এবং তাদের ইচ্ছাকে দুর্বলদের ওপর প্রয়োগ করার অধিকার রয়েছে। থ্রাসিম্যাকাসের মতে, ঠিক- বেঠিক, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি সম্পূর্ণরূপে মনগড়া ও গতানুগতিক ব্যাপার। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের খেয়ালখুশিই প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সুতরাং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এসব ধারণার পরিবর্তন সম্ভব।

সোফিস্টদের এ মতের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সক্রেটিস। তার মতে, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সুবিচার-অবিচার প্রভৃতি কোনোমতেই কারো মনগড়া ব্যাপার নয়, বরং এদের অস্তিত্বের ভিত্তি অনপেক্ষ ও সার্বিক। তিনি বলেন, সুবিচার, মিতাচার ও পুণ্য-এরা স্বগুণে ও স্বমহিমায় বিরাজমান। বিভিন্ন ব্যক্তির পরিবর্তনশীল বিভিন্ন মত ও ধারণানিরপেক্ষভাবেই এরা নিজ সত্তা নিয়ে বিরাজমান। এরা ব্যক্তিমনোনিরপেক্ষ, সার্বিক, সর্বজনগ্রাহ্য ও স্থায়ী অস্তিত্বের অধিকারী। সর্বজনগ্রাহ্য এবং সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞার মাধ্যমে এদের স্বরূপ বোঝা যায়।

সক্রেটিস প্রকল্পিত এসব সার্বিকের অস্তিত্ব প্লেটো স্বীকার করেন এবং এদের বাস্তবতার সমর্থনে এক বিস্তৃত অধিবিদ্যক মত দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। প্লেটোর মতে, সার্বিকগুলো শুধু অস্তিত্বশীলই নয়, বিশেষ বস্তুসমূহের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবও বটে। বস্তুত, প্লেটো সার্বিক প্রত্যয়সমূহকে বিশেষ বস্তুর চেয়ে উচ্চমানের এবং শাশ্বত অস্তিত্বের অধিকারী বলে মত প্রকাশ করেন।

সিনিক ও সিরেনাইকগণ প্লেটোর মতের বিরোধিতা করেন। তাদের মতে, বিশেষ বস্তুসমূহ আমাদের মনের ওপর যে ছাপ ফেলে, তথাকথিত সার্বিকগুলো তারই নামান্তর। অর্থাৎ সার্বিকের অধিষ্ঠান আমাদের মনে। এ ছাড়া মনোনিরপেক্ষ বাহ্য অস্তিত্ব বলতে তাদের কিছু নেই। সিরেনাইকরা আরও মনে করতেন যে, যেহেতু আমরা একে অন্যের সংবেদন ও চিন্তার সাথে সরাসরিভাবে পরিচিত নই, সুতরাং বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বস্তু থেকে একই সংবেদন পাচ্ছে-একথা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। যেমন: আমি যে বস্তুটিকে ‘লাল’ বলছি, তা আমার মনে যে বর্ণের সংবেদন সৃষ্টি করছে, অন্য একজনের মনেও যে তা একই সংবেদন সৃষ্টি করছে, একথা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। আবার আমার দৃষ্টিতে যেসব গুণের কল্যাণে একজন মানুষ অন্যান্য জীবজন্তুর চেয়ে স্বতন্ত্র, অন্য একজনের দৃষ্টিতেও যে একই গুণাবলি মানুষের স্বাতন্ত্র্যের কারণ বলে বিবেচিত হবে, তা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। এ যুক্তিতেই সিনিক্স ও সিরেনাইকগণ বলেন: সক্রেটিসীয় সার্বিক এবং প্লেটোনিক প্রত্যয়সমূহের যে মনোনিরপেক্ষ বাহ্য অস্তিত্ব নেই তা-ই নয়, মানসিক ধারণা হিসেবে এরা সব মানুষের বেলায় একই অর্থ বহন করে কি-না, তা-ও আমরা জানি না।

এরিস্টটল প্লেটোর প্রত্যয়বাদের বিরোধিতা করেছিলেন। তার মতে, বিশেষ বস্তুর বাইরে কোনো সার্বিক গুণ বা ধর্ম থাকতে পারে না। একমাত্র ব্যক্তি ও মূর্ত সত্তাই বাস্তব অস্তিত্বের অধিকারী। অবশ্য বিশিষ্ট ও মূর্ত দ্রব্যসমূহ আমাদের বুদ্ধির ওপর তাদের সাদৃশ্যের যে ছাপ রেখে যায়, সার্বিক দ্রব্য বলতে শুধু সেই ছাপকেই বোঝায় না। যে দ্রব্য তার নিজ প্রজাতি ও জাতির পার্থক্য নির্দেশ করে, সার্বিকগুলো সেই একই দ্রব্যের অখণ্ড অংশবিশেষ। মূর্ত জিনিসমাত্রই একটি প্রজাতি বা শ্রেণী; এবং একটি অভিন্ন সাধারণ আকারের অধিকারী বলেই তা এই জাতি বা শ্রেণীর সব সদস্যের সাথে যুক্ত। আর এই আকার নিছক একটি সাধারণ সম্প্রত্যয় হিসেবে কেবল আমাদের মনেই থাকে না; বরং একটি আবশ্যিক ধর্ম বা সারধর্ম হিসেবে একই জাতির সব সদস্যের মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান থাকে।

পরবর্তী গ্রিক এবং গ্রিক-রোমান দর্শনে সার্বিকের সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো গভীর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় নি। প্লেটো, এরিস্টটল কিংবা সোফিস্টগণ, সিনিকগণ ও সিরেনাইকদের মতবাদই তখন বিভিন্ন মহলে গৃহীত হয়। আদি খ্রিস্টান দার্শনিকগণ প্লেটো ও নব-প্লেটোবাদীদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন বলে তারা সাধারণ সম্প্রত্যয়ের স্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে এক অতিবাস্তববাদী মনোভাব পোষণ করেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, সার্বিকসমূহ এক ধরনের বাস্তব অতীন্দ্রিয় সত্তা, এবং এগুলো ব্যক্তিমন বা বিশেষ বস্তুর বাইরে স্বাধীনভাবে বিরাজমান। প্লেটোর সাথে তাদের পার্থক্য ছিল এখানে যে, তাদের মতে এসব সত্তা অসৃষ্ট ও স্বয়ং-অস্তিত্বশীল নয়, বরং ঈশ্বরই তাদের স্রষ্টা, তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।

এখানে উল্লেখ্য যে, অগাস্টিন বিথিয়াস সার্বিকের দ্রব্যাত্মক স্বরূপ ও অস্তিত্ব সম্পর্কে প্লেটোর মত স্বীকার করেন নি। তাদের মতে, সার্বিকসমূহ আসলে বাস্তব নয়, সম্ভাব্য সত্তাবিশেষ-এমন সম্ভাব্য সত্তা যেগুলো বিশেষ মূর্ত বস্তুতে প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। এ সব মতবিরোধ সত্ত্বেও সার্বিক-এর স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেদিন তেমন কোনো তিক্ত মতবিরোধ দেখা দেয় নি। কিন্তু খ্রিস্টীয় এগারো শতকের দিকে এ সমস্যাটি এতই গুরুত্বলাভ করল যে, এর তুলনায় অন্যান্য দার্শনিক সমস্যা গৌণ বলে বিবেচিত হলো এবং একে নিয়ে প্রবল মতবিরোধের সৃষ্টি হলো। এগারো শতকের শেষের দিকে অতি-বাস্তববাদীদের মতের বিরুদ্ধে রসেলিন যে আক্রমণ পরিচালনা করেন, সেটি থেকেই শুরু হয় এ বিতর্ক।

রসেলিন (১০৫০-১১২২ খ্রি.)

রসেলিন (Roscelin) কমপিয়েন নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সার্বিক-এর অস্তিত্ব প্রসঙ্গে তিনি বাস্তববাদীদের মতের বিরোধিতা করেন। তার মতে, সার্বিক মনোনিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল-উগ্র বাস্তববাদীদের এ মত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। সার্বিকসমূহের আসলে মানোবহির্ভূত কোনো সত্তাই নেই। এমনকি তারা বিশেষ বস্তুতেও অবস্থান করে না। কেননা বাস্তব দ্রব্য বা অস্তিত্বমাত্রই মূর্ত ও বিশেষ প্রকৃতির, সার্বিক নয়। তবে বিশেষ দ্রব্যসমূহ পরস্পর পরস্পরের সদৃশ বলে মনের কাছে ধরা দেয়, আর তাদের এই সাদৃশ্য তাদের সকলের মধ্যে সমানভাবে বর্তমান একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য বলে প্রতীয়মান হয়। এভাবেই আমরা বস্তুর শ্রেণীবিভাগ করি, বিশেষ বস্তুসমূহকে একটি ব্যাপক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি এবং ‘লালত্ব’ ‘মানবজাতি’ প্রভৃতি জাত্যার্থক (generic) ও সাধারণ নামের অবতারণা করে থাকি। তবে ‘নাম’ আসলে একটি ‘ধ্বনি’ এবং (বিথিয়াস যেমন বলেছিলেন) ধ্বনি জিহবা দ্বারা উৎপন্ন বায়ুর গতি মাত্র। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যে, সার্বিকগুলো আসলে দ্রব্য নয়। বিশেষ দ্রব্যসমূহের সদৃশ দিক ও গুণাবলির নির্দেশক কণ্ঠস্বরই সার্বিক। বাস্তব বলে তাদের কিছুই নেই।

রসেলিনের দার্শনিক মতের বর্ণনা দিতে গিয়ে দর্শনের কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ‘নামবাদ’ (nominalism) কথাটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু অন্য কারো কারো মতে কথাটি রসেলিনের বেলায় প্রযোজ্য নয়, কেননা তারা মনে করেন, ‘নামবাদ’ কথাটি পরবর্তীকালে প্রচারিত একটি মতবাদের নির্দেশক। এ মতবাদ অনুসারে, প্রকৃত সার্বিক ও সাধারণ সম্প্রত্যয়গুলো আসলে মনের মধ্যে থাকে না। প্রতিমূর্তির (imagery) সাহায্য ব্যতিরেকে বুদ্ধি চিন্তা করতে অক্ষম; আর এ জন্যই বুদ্ধি সবসময় কোনো এক জাতির অন্তর্ভুক্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ ও মূর্ত বস্তুতে সে জাতির একটি তথাকথিত অমূর্ত ও সার্বিক ধারণার চিত্র এঁকে থাকে। আলোচ্য প্রতিমূর্তিটির সর্বজনীন ও অভিন্ন বৈশিষ্ট্য এই যে, তা অনেকগুলো সদৃশ প্রাত্যক্ষিক বস্তুর একটি মিশ্র আলোকচিত্রবিশেষ, এবং একে মন উক্ত প্রাত্যক্ষিক বস্তুসমূহের সবগুলোর প্রতীক ও নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করে।

খ্রিস্টীয় ত্রিমূর্তিকে রসেলিন তিনজন স্বতন্ত্র পুরুষ বলে মনে করেন। তার মতে, ঈশ্বর একজন নন, তিনজন। তা না হলে পিতা, পুত্র ও পবিত্রাত্মা-এই তিনজনকেই সসীমরূপে অবতীর্ণ বলে ধরে নিতে হয়। এক ঈশ্বরের স্থলে তিনজন ঈশ্বরের কথা প্রচার করার দায়ে তদানীন্তন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে রসেলিনকে অভিযুক্ত করেন। ফলে তাকে তার ধর্মবিরুদ্ধ মত পরিহার করতে হয়।

আনসেল্ম (১০৩৫-১১০৯ খ্রি.)

রসেলিনের তীব্র সমালোচকদের মধ্যে ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক আনসেল্ম (Anselm of Canterbury) ছিলেন অন্যতম। তিনি রসেলিনকে তিন ঈশ্বরের ধারণা প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করেন। নব-প্লেটোবাদীঅগাস্টিনীয় প্রভাবে তিনি মনে করতেন যে, সাধারণ সম্প্রত্যয়মাত্রই বাস্তব ও সার্বিক স্বভাববিশিষ্ট সারধর্মবিশেষ, এবং এরা মনোনিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। তার মতে, বিশেষ দ্রব্যসমূহের সাদৃশ্যের মূলে যে মানবত্ব ত্রিভুজত্ব লালত্ব প্রভৃতি সার্বিক সারধর্ম বিদ্যমান এবং এদের উপস্থিতির জন্যই যে এক জাতির অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিশেষ বস্তু সদৃশ হয়ে থাকে, একথা রসেলিন উপলব্ধি করতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষেই সদৃশ না হলে বিভিন্ন বিশেষ বস্তুকে সদৃশ দেখাতো না, এবং এরা সবাই যদি একটি অভিন্ন গুণের অধিকারী না হতো, তা হলে এরা প্রকৃতপক্ষে সদৃশ হতো না। অধিকন্তু, প্রতিটি বিশেষ দ্রব্য একদিকে যেমন একটি সার্বিক গুণের অধিকারী (যার ফলে তাকে একই জাতীয় অন্যান্য বিশেষ বস্তুর ন্যায় দেখায়), অন্যদিকে আবার তা একই জাতীয় অন্যসব বিশেষ বস্তুর চেয়ে স্বতন্ত্র একটি বিশেষ বস্তু। তা হলে বোঝা যায় যে, দ্রব্য মানেই সার্বিক ও বিশেষের সংযোগ, এবং এর অস্তিত্বের পক্ষে দুটোই সমানভাবে আবশ্যিক। ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে দ্রব্যের মধ্যে সার্বিকতা ও বিশিষ্টতার এই সংযোগের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, ত্রিমূর্তির তিনটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব তিনটি পৃথক ঈশ্বর নয়, একই ঈশ্বর। একে অন্যের চেয়ে স্বতন্ত্র হলেও এরা একই ঐশ্বরিক প্রকৃতির প্রকাশ।

সার্বিকসমূহ সাধারণ সম্প্রত্যয় হিসেবে শুধু আমাদের মনেই নয়, বিশেষ বস্তুসমূহের অভিন্ন গুণ হিসেবে মনের বাইরেও অবস্থান করে। এরা অনাদিকাল থেকে বিশ্বের সাধারণ পরিকল্পনা ও ধারণার উপকরণ হিসেবে ঈশ্বরের মনে উপস্থিত ছিল। এই পরিকল্পনা ও ধারণার ভিত্তিতেই ঈশ্বর পরে জগৎ ও জগতের বিশেষ বস্তুসমূহকে সৃষ্টি করেন। এ জগৎ প্রথমে ঈশ্বরের অব্যক্ত এবং পরে ব্যক্ত শব্দ হিসেবে অস্তিত্বশীল ছিল। এই অব্যক্ত শব্দই সার্বিকসমূহের আকর, এদের সমন্বয়েই ঐশ্বরিক মন পূর্ণ এবং এদের নিয়েই গঠিত ঈশ্বরের আত্মজ্ঞান। বিশ্বাস ও বুদ্ধি সম্পর্কবিষয়ক সমস্যা নিয়েও আনসেল্ম যথেষ্ট চিন্তা করেছেন। তার মতে, বিশ্বাস ও বুদ্ধির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, বরং শেষ বিশ্লেষণে এরা এক ও অভিন্ন। তার মতে খ্রিস্টধর্মে বর্ণিত সত্যসমূহকে নির্বিচারে সত্য বলে গ্রহণ করা দরকার। প্রত্যাদেশের সত্যতা বুদ্ধির সাহায্যে প্রতিষ্ঠা বা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করার জন্য জানতে চাই না, বরং জানার জন্যই বিশ্বাস করে থাকি।” অবশ্য বিশ্বাস করার মানে এই নয় যে, আমরা যা বিশ্বাস করি তাকে কখনো বুঝতে চাইব না। আসলে বিশ্বাস যে বুদ্ধিসম্মত তা বুঝিয়ে দেয়া এবং প্রত্যাদেশের সত্যতার দাবিকে জোরদার করাই বুদ্ধির মূল কাজ। আনসেল্ম-এর মতে, কোনো অবস্থাতেই বুদ্ধির পক্ষে খ্রিস্টীয় মতবাদকে সমালোচনা করা উচিত নয়। কোনো প্রত্যাদিষ্ট সত্য বুদ্ধির সাহায্যে বোধগম্য না হলে তাকে সন্দেহ করা চলে না, বিশ্বাসের ওপর গ্রহণ করতে হয়।

এভাবে প্রত্যাদেশের ওপর বুদ্ধি প্রয়োগের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার পর আন্সে তার ‘মনোলজিয়াম’ গ্রন্থে বুদ্ধির সাহায্যে কতিপয় জটিল ধর্মীয় রহস্যের বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেন। ঈশ্বর যে আছেন তা আমরা শুধু প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই জানি না, যুক্তি-বিচারের মাধ্যমেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। প্রথমত, নৈতিক জীবন বলতে কোনো-না কোনো শুভ বা মঙ্গলের অনুসন্ধানকে বোঝায়। শুভ বিভিন্ন প্রকার ও বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে ঠিক, কিন্তু বিভিন্ন শুভ বস্তুর মধ্যে একটা অভিন্ন শুভ গুণ আছে বলেই মানুষ এদের প্রত্যাশা করে। তা হলে দেখা যায়, যেকোনো শুভ জিনিসকে পেতে হলে সে জিনিসটির মূলে একটি অনপেক্ষ ও সার্বভৌম শুভধর্ম বা পূর্ণতার অস্তিত্ব থাকা দরকার।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য আনসেল্ম তার ‘প্রস্লজিয়াম’-এ যে বলিষ্ঠ যুক্তির অবতারণা করেন, সেজন্য দর্শনের ইতিহাসে তার নাম সুপরিচিত। তত্ত্ববিষয়ক (ontological) যুক্তি বলে পরিচিত এই যুক্তিটিতে ঈশ্বরের ধারণা থেকে তার অস্তিত্ব নিষ্কাশনের চেষ্টা করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে যে, ঈশ্বরের ধারণা তার অস্তিত্বের নির্দেশক। ঈশ্বরের ধারণা বলতে এমন একটি ধারণাকে বোঝায় যার চেয়ে বড় অন্যকিছুর কল্পনা করা যায় না। অর্থাৎ ঈশ্বরের ধারণা একটি পরিপূর্ণ সত্তার ধারণা। ঈশ্বর যদি অস্তিত্বশীল না হতেন, তা হলে এই ধারণা সর্ববৃহৎ চিন্তনীয় সত্তার ধারণা হতো না। তখন এর চেয়েও বড় অন্যকিছুর অস্তিত্বশীল হওয়া সম্ভবপর হতো। অস্তিত্ব আছে এমন একটি সত্তার ধারণা, অস্তিত্ব নেই এমন সত্তার ধারণার চেয়ে অধিকতর পূর্ণসত্তার ধারণা, সুতরাং একটি পরিপূর্ণ সত্তা হিসেবে ঈশ্বর অবশ্যই অস্তিত্বশীল। এভাবে আনসেলূম প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ঈশ্বরের পূর্ণতা তার অস্তিত্বের নির্দেশক।

এই সিদ্ধান্ত অবশ্য আনসেল্ম-এর হেতুবাক্য (permise) থেকে স্বাভাবিকভাবে নিঃসৃত হয় না। তার যুক্তি থেকে শুধু এটুকুই প্রমাণিত হয় যে, আমরা যখন একটি বস্তুকে অস্তিত্বশীল বলে ভাবি, তখন এই অস্তিত্বশীল সত্তাটি অস্তিত্বশীল নয় এমন একটি সত্তার চেয়ে বেশি পূর্ণ। একটি অস্তিত্বশীল সত্তার ধারণা বলতে এমন একটি সত্তার ধারণাকে বোঝায় যার গুণাবলি অস্তিত্বশীল নয় বলে কল্পিত বস্তুর গুণাবলির চেয়ে বেশি। আনসেল্ম প্রমাণ করেন নি যে, ঈশ্বর অস্তিত্বশীল, তিনি শুধু এটুকুই প্রমাণ করেছেন যে, অস্তিত্বশীল ঈশ্বরের ধারণা, কাল্পনিক ঈশ্বরের ধারণার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অস্তিত্বের ধারণা ঈশ্বরের ধারণার অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু একটি পরিপূর্ণ সত্তার ধারণা থেকে (অস্তিত্ব যে ধারণার অন্তর্ভুক্ত) অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না যে, সেই সত্তা প্রকৃতপক্ষেই অস্তিত্বশীল। তবে মনে রাখা দরকার যে, এই যুক্তি শুধু তাদের কাছেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হবে, যারা সার্বিকের মনোনিরপেক্ষ অস্তিত্ববিষয়ক বাস্তববাদী মতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ সার্বিকবিষয়ক বাস্তববাদী মতবাদ ঈশ্বরের তত্ত্ববিষয়ক প্রমাণের ভিত্তি।

গৌনিলো (Gaunilo, খ্রিস্টীয় ১১শ শতক) নামক এ সন্ন্যাসী আনসেল্ম-এর প্রলজিয়াম-এর যুক্তির বিরুদ্ধে নামক এক বেনামী গ্রন্থে আসেল্মের যুক্তির অন্তর্নিহিত অনুপপত্তি তুলে ধরেন। তার মতে, চিন্তার দিক থেকে মনস্থিত ঈশ্বরের সত্তা, মনস্থিত অন্যান্য যে কোনো সত্তারই মতো। আনসেল্ম যেভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন, ঠিক একইভাবে একজন একটি পরিপূর্ণ দ্বীপের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন। একটি পরিপূর্ণ দ্বীপকে যদি চিন্তনীয় সর্ববৃহৎ দ্বীপ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা হলে আনসেল্মের যুক্তি অনুসারে উক্ত দ্বীপটি অস্তিত্বশীল হবে। এর একশ’ বছরেরও পরে টমাস একুইনাস আনসেল্ম-এর যুক্তির বিশ্লেষণ করেন এবং একে ভ্রান্ত বলে মত প্রকাশ করেন। তবে স্কলাস্টিক দার্শনিকদের কেউ কেউ এর সমর্থন ও ব্যবহার করেন।

আনসেল্ম মনে করতেন যে, ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণনাতীত এবং তা মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ক্ষমতাবহির্ভূত। আমরা ভাষার সাহায্যে ঈশ্বরের সত্তাকে সন্তোষজনকভাবে ব্যক্ত করতে পারি না। জগৎসৃষ্টি প্রসঙ্গে আনসেল্ম আকস্মিক সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। ঈশ্বর শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

ঈশ্বর মানবরূপে অবতীর্ণ হলেন কেন? শীর্ষক গ্রন্থে আনসেল্ম অবতার ও পাপমুক্তির ব্যাখ্যা দেন। স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করে আদম ও ইভ্ ইচ্ছাকৃতভাবে ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে যে পাপ করেছিল, তার ফলে গোটা মানবজাতির জন্য শাস্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর এই পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজনই অবতার গ্রহণের কারণ ও উদ্দেশ্য। পাপ অনুষ্ঠানের কর্তা ছিল মানুষ; সুতরাং প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে মানুষকেই। এজন্যই ঈশ্বর মানুষের রূপ ধারণ করেছিলেন। যিশু তার সমগ্র জীবনকে ঈশ্বরের আদেশ দ্বারা পরিচালিত করে মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ক্রুশ কাষ্ঠে যন্ত্রণা ভোগ করে যিশু মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ করেন। যিশুর যন্ত্রণা ছিল প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরেরই যন্ত্রণা; আর এই যন্ত্রণার প্রতিদানে ঈশ্বরের প্রাপ্যও ছিল এক অনন্ত পুরস্কার। কিন্তু নিজের জন্য পুরস্কারের কোনো প্রয়োজন ছিল না বলে ঈশ্বর সে পুরস্কার প্রদান করলেন তার সৃষ্ট মানুষকে। এভাবেই সম্ভব হলো মানুষের পাপমুক্তি।

উইলিয়াম অব স্যাম্পো (১০৭০-১১২১ খ্রি.)

সার্বিক-বিষয়ক প্রশ্নটির ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব স্বীকৃত হওয়ার পর সার্বিকসমূহের স্বভাব নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। উইলিয়াম অব স্যাম্পো (William of Champeaux) রসেলিনের মতের বিরোধিতা করার ফলে এই বিতর্ক প্রবলতর হয়ে ওঠে। উইলিয়াম ঘোষণা করেন যে, একমাত্র সার্বিকই বাস্তব অস্তিত্বের অধিকারী, এবং তা তার অন্তর্গত প্রতিটি বিশেষ বস্তুর মধ্যে বর্তমান। বিশেষ বস্তুসমূহের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা আসলে তাদের মধ্যে এই সার্বিক গুণের উপস্থিতির আপতিক তারতম্য ছাড়া আর কিছু নয়। করিম ও রহিমের মধ্যে পার্থক্য শুধু চামড়ার পার্থক্য, চামড়ার গভীরে উভয়েই একই মানুষ। এই মত রসেলিনের মতের মতোই উগ্র বলে বিবেচিত হয়। ত্রিমূর্তির তিনটি ব্যক্তি একই ঈশ্বরের তিনটি অনাবশ্যক দিক বলে এককালে যে স্যাবেলীয় ধর্মবিরুদ্ধ মত প্রচলিত ছিল, উইলিয়ামের এ মত সে মতকেই পুনর্জীবিত করার ইঙ্গিত বহন করে।

পিটার এবেলার্ড (১০৭৯-১১৪২)

পিটার এবেলার্ড (Peter Abelard) ছিলেন মধ্যযুগের ঋষিদের মধ্যে অন্যতম। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার কোনো মৌলিক অবদান ছিল না। অন্যদিকে আবার যে দার্শনিক রেনেসাঁ বারো শতককে আলোকিত করেছিল, তিনি ছিলেন সেটির অংশবিশেষ। তিনি ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাবার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তদানীন্তন বিশিষ্ট পণ্ডিতদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে রসেলিন ছিলেন অন্যতম। রসেলিনের কাছ থেকে তিনি লজিক বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু রসেলিন প্রচারিত ব্যক্তিবাদের প্রতি তার এতই বিতৃষ্ণা ছিল যে, তিনি যে রসেলিনের ছাত্র ছিলেন, একথা তিনি তার ‘হিস্টোরিয়া ক্যালমিটেটাম’ শীর্ষক আত্মজীবনীতে উল্লেখই করেন নি। প্যারিসে ফিরে এসে এবেলার্ড উইলিয়াম অব স্যাম্পোর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তবে উইলিয়ামের উগ্র বাস্তববাদ তিনি গ্রহণ করেননি।

যৌবনে এবেলার্ড হেলইজ নামক এক যুবতীর প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন এবং তাকে গোপনে বিয়ে করেন। হেলইজের বাবার অভিযোগের ফলে শাস্তিস্বরূপ এবেলার্ডকে অস্ত্রোপচার দ্বারা পুরুষত্ববর্জিত করা হয়। একই কারণে তাকে সেন্ট ডেনিস মঠে এবং হেলইজকে অপর এক মহিলা মঠে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণে বাধ্য করা হয়। এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও আজীবন দু’জনের মধ্যে পত্রযোগাযোগ অব্যাহত থাকে। এসব পত্র পরে প্রকাশিত হয়। এসব পত্রের মাধ্যমে এবেলার্ড প্রেমের ইতিহাসে যেমন, দর্শনের ইতিহাসেও তেমনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।

উইলিয়ামের মতের বিরুদ্ধে এবেলার্ড দ্রব্যমাত্রকেই বিশিষ্ট ও মূর্ত বলে ঘোষণা করেন এবং বলেন, বিশেষ বস্তুসমূহকে সার্বিকের নিছক দৃষ্টান্ত বলা চলে না। বিশেষ বস্তুসমূহের অস্তিত্ব সার্বিকের ওপর নির্ভরশীল নয়। বিশেষ বস্তুমাত্রই এমন স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী যে, এর ফলে তা একই জাতীয় অন্যান্য বিশেষ বস্তু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। অন্যদিকে এবেলার্ড রসেলিনের মতকেও সমানভাবে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, একথা অবশ্য ঠিক যে সার্বিকসমূহ এমনিতে কোনো দ্রব্য নয়। এ কথাও ঠিক যে, সার্বিক বলতে বিশেষ বস্তুসমূহের বর্ণনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কতিপয় নামকে বোঝায় না। আমরা যখন একটি বিশেষ নামকে কতকগুলো বিশেষ বস্তুর ওপর আরোপ করি, তখন এ নামটি দ্বারা আমরা এমন একটি শ্রেণী বা জাতির নির্দেশ করি, আলোচ্য বিশেষ বস্তুগুলো যার অন্তর্ভুক্ত। আর শ্রেণী বা জাতি (সার্বিক) বলে আসলেই যদি কিছু না থাকতো, তা হলে আমরা এভাবে বিভিন্ন বস্তুতে একই নাম আরোপ করতে পারতাম না। যেমন: মানবজাতি বলে যদি প্রকৃতপক্ষে কিছু না-ই থাকত, তা হলে বেলি, লিলি, জলি প্রভৃতি ব্যক্তিকে মানুষ বলার কোনো অর্থই হতো না। বিশেষ দ্রব্যসমূহে অভিন্ন গুণ বা ধর্ম (সার্বিক) বলে যদি কিছু প্রকৃতপক্ষে না-ই উপস্থিত থাকত, তা হলে আমরা কখনো একই অভিন্ন গুণ বা ধর্মকে অনেকগুলো বিশিষ্ট বস্তুতে আরোপ করতে পারতাম না। বস্তুত, সার্বিক বলে বহির্জগতে যদি কিছু নাই থাকত, তা হলে আমরা আমাদের চিন্তায় কোনো সাধারণ সম্প্রত্যয়ের, আলাপ আলোচনায় কোনো অভিন্ন নামের ব্যবহার করতে পারতাম না। তবে এবেলার্ড একথা বলেই ক্ষান্ত হন নি। আনসেল্মের ন্যায় তিনি বলেন যে, সার্বিকসমূহ তাদের অন্তর্ভুক্ত বিশিষ্ট বস্তুসমূহের আগেই এবং তাদের বাদ দিয়েও থাকতে পারে। মানবমন সাধারণ ধারণা হিসেবে সার্বিকসমূহের কল্পনা করে সন্দেহ নেই; কিন্তু এ-ও স্বীকার করতে হবে যে, মনোনিরপেক্ষভাবেও তারা টিকে থাকতে পারে। সার্বিকসমূহ ঈশ্বর কল্পিত বিশ্বের আকারস্বরূপ এবং তাদের অনুকরণেই বিশিষ্ট দ্রব্যসমূহের সৃষ্টি।

এবেলার্ডের মতবাদকে উইলিয়াম অব স্যাম্পো এবং রসেলিনের উগ্র মতের মধ্যবর্তী বলা চলে। কেউ কেউ তার এ মতকে সম্প্রত্যয়বাদ (conceptualism) বলে অভিহিত করেছেন। তবে নামবাদের ন্যায় সম্প্রত্যয়বাদও পরবর্তীকালের মতবাদ। এ জন্যই দর্শনের ইতিহাসবিদদের অনেকের মতে, এবেলার্ডের মতকে সম্প্রত্যয়বাদ না বলে পরিমিত বাস্তববাদ বলাই বোধ করি সঙ্গত। পরবর্তীকালে কিছু পরিবর্তনসহ টমাস একুইনাস তার মত গ্রহণ করেন। একুইনাস এ মতের যে ভাষ্য দিয়েছেন ক্যাথলিক চার্চ তা-ই গ্রহণ ও প্রচার করেছে। একুইনাস কর্তৃক এ মতের চূড়ান্ত রূপ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত সার্বিকের স্বরূপ ও মর্যাদা নিয়ে তীব্র বিতর্ক অব্যাহত ছিল।

সার্বিক-বিষয়ক মতবাদের ন্যায় এবেলার্ডের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক মতও ছিল উদার ও উগ্রতামুক্ত। তিনি প্রত্যাদেশের অকাট্যতার সমর্থক ছিলেন। তার মতে প্রত্যাদেশ ও যুক্তিবুদ্ধির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। প্রত্যাদেশে যে সত্য নিহিত, যুক্তির মাধ্যমে তাকে জানা ও প্রতিষ্ঠা করা যায়। দর্শনের মূল কাজ যুক্তির সাহায্যে সত্যকে জানা এবং খ্রিস্টীয় মতবাদকে বোধগম্য করে তোলা। তবে এ কাজ করতে হলে ধর্মতত্ত্বকে সমালোচনা করার স্বাধীনতা দর্শনের থাকা চাই; কেননা একমাত্র স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমেই অযৌক্তিক বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব।

এবেলার্ড ‘নিজেকে জানো’ শীর্ষক একটি নৈতিক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি বলেন, কাজের প্রকৃতি ও পরিণতির সাথে কাজটির নৈতিকতা বা অনৈতিকতার কোনো সম্পর্কে নেই। অভিপ্রায়ের ওপরই আচরণের নৈতিক মূল্য নির্ভরশীল। শুভ অভিপ্রায় দ্বারা পরিচালিত হলে আচরণ শুভ এবং অশুভ অভিপ্রায় দ্বারা পরিচালিত হলে আচরণ অশুভ বলে বিবেচিত হবে। তবে একটি বিশেষ অভিপ্রায় শুভ কি অশুভ, তা নির্ণয়ের জন্য কোনো-না কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকা আবশ্যক। তা না হলে একটি অশুভ কাজ করেও একজন দাবি করতে পারে যে, তার অভিপ্রায় শুভ ছিল।

এবেলার্ডের মতে, এই মানদণ্ড হলো এমন একটি প্রাকৃতিক নৈতিক বিধি, যার ভিত্তি ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং যা প্রতিটি মানুষের বিবেকে প্রতিফলিত। এই নেতিক বিধির ব্যাখ্যা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র হতে পারে এবং এক ব্যক্তির বিবেক যে আচরণ অনুমোদন করে, অন্য একজনের বিবেক তা অনুমোদন না-ও করতে পারে। এমতাবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তিরই উচিত তার নিজ বিবেকের নির্দেশ মেনে চলা। এভাবে ব্যক্তি যদি সততার সাথে নিজ বিবেকের বিধান অনুসারে কাজ করে, তা হলে সে নিশ্চিত হতে পারে যে, সে কোনো পাপ করে নি, বরং ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারেই কাজ করেছে। পক্ষান্তরে, একটি কাজ অন্যের বিবেক দ্বারা অনুমোদিত হলেও ব্যক্তি যদি তা তার নিজ বিবেকের বিরুদ্ধে করে, তা হলে তা-ও পাপাচার বলে গণ্য হবে।

বারো শতকে সেন্ট ভিক্টর মঠের হুগো, গিল্বার্ট ডি ল্যা পরে, এলান অব লিলি এবং সেলিসবেরির জন্ এবেলার্ডের মতের সমর্থন করেন। কিন্তু ক্রমশ এরিস্টটলের মত সম্পর্কে অধিকতর পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভের ফলে এ মত নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলতে থাকে এবং অবশেষে একুইনাসের মতে তা চূড়ান্ত রূপলাভ করে। এ মতের অব্যবহিত প্রভাবসমূহের মধ্যে উইলিয়াম অব স্যাম্পোর উগ্র বাস্তববাদী মত পরিহারই উল্লেখযোগ্য। তবে তিনি এবেলার্ডের মতকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করে এমন এক পরিবর্তিত মত হাজির করেন যা অনেকটা রসেলিনের ব্যক্তিবাদের কাছাকাছি। যেমন: তিনি মনে করেন, কোনো কোনো দিক থেকে প্রতিটি বিশেষ বস্তুই অন্যান্য বিশেষ বস্তুর সদৃশ। এদিক থেকে সার্বিক বিশেষের অগ্রগামী। কিন্তু তিনি একথা স্বীকার করতে নারাজ যে, সার্বিক প্রতিটি বিশেষ বস্তুতে এক ও অভিন্নভাবে আছে। যেমন, নীল রঙের দুটি স্বতন্ত্র বস্তুর রঙ একই, অর্থাৎ ‘নীল রঙ’। রঙ-এর দিক থেকে এরা একে অপরের সদৃশ। কিন্তু তাই বলে এদের দুটির নীলত্বকে এক ও অভিন্ন বলা চলে না। প্রত্যেকটি বিশেষ বস্তুর রঙ তার নিজস্ব বিশিষ্ট রঙ, অপরটির নয়। সুতরাং নীলত্ব নামক অভিন্ন রঙটি প্রকৃতপক্ষে দুটি পৃথক বস্তুতে অভেদ ও অভিন্নভাবে থাকে না।

জন ও লম্বার্ড

ইংরেজ চিন্তাবিদ স্যালিসবারির জন (১১১৫-১১৮০) ছিলেন একাধারে একজন উদারপন্থী শিক্ষাবিদ, দর্শনের ইতিহাসবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ। তিনি পর পর তিনবার ক্যান্টারবারির আর্চবিশপের সচিব নিযুক্ত হন এবং শেষ বয়সে আর্চবিশপের পদে উন্নীত হন। নিষ্ফল দার্শনিক বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত থাকার জন্য তিনি স্কলাস্টিক দার্শনিকদের সমালোচনা করেন। তিনি এবেলার্ড ও রসেলিন, এঁদের উভয়ের সার্বিকবিষয়ক মতবাদেরও সমালোচনা করেন। প্লেটোকে তিনি দার্শনিকদের সম্রাট বলে অভিহিত করেন। ‘মেটালজিকাস’ শীর্ষক গ্রন্থে তিনি লজিক-এর সংস্কারের দাবি করেন। তার মতে, লজিক জ্ঞানানুশীলনের উপায়মাত্র, আর দর্শনের অন্যান্য শাখার সমবায়েই তা ফলপ্রসূ ও অর্থবহ। শুধু লজিক দিয়েই সত্যের সন্ধান মেলে না।

সালিসবেরির জন তার ‘পলিক্র্যাটিকাস’ গ্রন্থে মানুষের সরকারকে প্রাণিদেহের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তার মতে, ধর্মযাজকরা হলেন রাষ্ট্রের আত্মা, রাজা রাষ্ট্রের মাথা, এবং সিনেট এর হৃৎপিণ্ডবিশেষ। ‘পলিক্রাটিকাস্’ গ্রন্থে তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তববাদী পঠনপাঠনের এবং চার্চের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতার সমর্থন করেন। তার মতে, সৎ ও পুণ্যময় জীবনেই যথার্থ শুভ নিহিত। যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করা না গেলেও চার্চের শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা উচিত।

পিটার লম্বার্ড (মৃ. ১১৬৪ খ্রি.) খ্রিস্টীয় সঙ্ঘের প্রচলিত ধর্মমতগুলোকে সুসংবদ্ধভাবে সাজিয়ে দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তার গ্রথিত মতাবলিতে অতীতের দার্শনিকগণ যেসব দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছিলেন, সেগুলোরে একটি তালিকা রয়েছে। এসব প্রশ্নের কতকগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: যে ঈশ্বর আগে থেকেই জানেন যে তিনি জগৎ সৃষ্টি করবেন, তিনি সৃষ্টিকর্মের জন্য নিয়ন্ত্রিত কি-না, এ প্রশ্ন এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মধ্যে অন্যতম। আবার ঈভকে আদমের দেহের অন্য কোনো অঙ্গ থেকে সৃষ্টি না করে, পাঁজরা থেকে সৃষ্টি করা হলো কেন? অবতারের ঈশ্বর মহিলা না হয়ে পুরুষ হলেন কেন?-ইত্যাদি প্রশ্ন ছিল তার তালিকার প্রশ্নাবলির মধ্যে মামুলি। ত্রয়ীবাদ বিষয়ক তার মতকে ধর্মবিরুদ্ধ মত বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।

মরমিবাদ

মধ্যযুগের দার্শনিক বিতর্ক ও মতবিরোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার জন্য তদানীন্তন ধর্মের মরমি আবেদন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা দরকার। প্রেমমিশ্রিত ধ্যান ও স্বজ্ঞা দ্বারা পরমসত্তার সাথে মানুষের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের অভিজ্ঞতাকেই মরমিবাদ (mysticism) বলা হয়। এই অভিজ্ঞতার মাত্রার বিভিন্নতা সত্ত্বেও মরমিবাদীদের সবাই বিশ্বাস করেন যে, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ জ্ঞানলাভ সম্ভব। মধ্যযুগের ইহুদি ধর্ম ও ইসলামে মরমিবাদ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বস্তুত, মরমিবাদ ছিল অতীন্দ্রিয় ও অতিপ্রাকৃত জগতের বিশ্বাস ও আকর্ষণের প্রতীক। মধ্যযুগের প্রায় সব খ্রিস্টান চিন্তাবিদের মধ্যেই মরমি রেশ লক্ষণীয়।

মধ্যযুগের মরমিবাদীগণ সংখ্যার মধ্যে মরমি মাধ্যমে খুঁজে পান। যেমন: সেন্ট অগাস্টিন বিশ্বাস করতেন যে, সংখ্যার সমন্বয়েই ঈশ্বরের চিন্তা গঠিত। মধ্যযুগে তাই সংখ্যাবিজ্ঞানকেই বিশ্ববিজ্ঞানে পরিণত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বারো শতকের দিকে আধ্যত্মিক ব্যাপারাদির ওপর প্রতিষ্ঠিত এক সুসংবদ্ধ সংখ্যাতত্ত্ব গড়ে ওঠে। যেমন: বারো ছিল চার্চের প্রতীক; আর তাই বলা হতো ধর্ম প্রচারের জন্য যিশুখ্রিস্ট বারো জন শিষ্য নির্বাচিত করেছিলেন। তিন ও চারের গুণফল বারোকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হতো। ‘তিন’ ছিল পবিত্র ট্রিনিটি বা ত্রিত্বের প্রতীক এবং আধ্যাত্মিক ব্যাপারাদির তাৎপর্যের বাহক। ‘চার’ চারটি উপাদানের প্রতীক এবং জড়বস্তুর বেলায় প্রযোজ্য। এই সংখ্যাবিজ্ঞান অনুসারে, তিনকে যখন চার দিয়ে গুণ করা হয়, তখন চিৎ ও জড়ের মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়, এবং তা খ্রিস্টের বারোজন নির্বাচিত শিষ্যের-প্রতিনিধিত্বে খ্রিস্টীয় চার্চের প্রত্যাদেশে সুস্পষ্টরূপ গ্রহণ করে। সাত সংখ্যাটিও অনুরূপভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাত মানুষের প্রতীক। যেহেতু চার ও তিনের যোগফল সাত, সুতরাং মানুষ চিৎ ও জড়ের সমন্বয়ে গঠিত। মধ্যযুগের প্রায় সব বড় বড় রচনায় সংখ্যার এই মরমি তাৎপর্যের ব্যাখ্যা ও গুণগান লক্ষ করা যায়।

বারো শতকে মরমিবাদের যেসব কেন্দ্র গঠিত হয় সেগুলোর মধ্যে সিস্টেরসীয় মঠগুলো এবং প্যারিসের সেন্ট ভিক্টর মঠটি ছিল অন্যতম। এ দুই কেন্দ্রের একটি অপরটির চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। সিস্টেরসীয় মরমিবাদীদের নেতা ছিলেন সেন্ট বার্নার্ড।

সেন্ট বার্নাড (১০৯১-১১৫৩)

সেন্ট বার্নাড (১০৯১-১১৫৩) ২৪ বছর বয়সে ক্লেইরভ্যাক্স মাটের কর্তা নিযুক্ত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বারো শতকের ধর্মীয় চিন্তায় বার্নার্ডের গুরুত্ব এতই বেশি যে, লুথারকে বাদ দিয়ে যেমন ষোলো শতকের কথা ভাবা যায় না, তেমনি বার্নার্ডকে বাদ দিয়েও বারো শতকের কথা ভাবা যায় না। তার চিন্তা ছিল বহুমুখী ব্যক্তিত্বের একটি দিকবিশেষ। একদিকে তিনি দ্বিতীয় ক্রুসেডের প্রস্তুতির নেতৃত্ব দেন, অন্যদিকে আবার তারই অভিযোগের ফলে এবেলার্ডের ধর্মতাত্ত্বিক মত ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং এবেলার্ডকে দণ্ড দেয়া হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মপ্রচারের জন্য তিনি ঈশ্বরের একজন প্রেরিতপুরুষ। এ জন্যই তিনি সমকালীন সামাজিক দুর্নীতি অন্যায় অবিচার প্রভৃতি সংশোধন করাকে তার কর্তব্য বলে মনে করতেন।

বার্নার্ড ছিলেন মধ্যযুগীয় মরমিবাদের প্রবর্তক। যুক্তিতর্কের স্থলে হৃদয়াবেগ ও মরমি স্বজ্ঞাকে তিনি ঐশ্বরিকজ্ঞানের সার্থক উপায় বলে মনে করতেন। আর এ জন্যই যুক্তির সাহায্যে ঈশ্বরের জ্ঞান সম্ভব বলে এবেলার্ড যে মত পোষণ করেছিলেন তিনি সে মতের বিরোধিতা করেন। যিশুকে জানাই তার দর্শনের মূল উদ্দেশ্য বলে তিনি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, প্লেটোর দর্শনপাঠ কিংবা এরিস্টটলের সূক্ষ্মতর্কের পর্যালোচনার কথা ধর্ম আমাদের বলে নি। আমাদের আসল কাজ হলো সত্যের অনুসন্ধান এবং ঐশ্বরিক জ্ঞান অর্জন। এ জন্যই আমরা মানুষ হিসেবে বেঁচে আছি, এবং এখানেই বাঁচার সার্থকতা। ঐশ্বরিক জ্ঞানের জন্য লজিকের সাহায্য না নিয়ে বার্নার্ড তাকালেন তার নিজ আত্মার দিকে, সংগ্রহ করলেন এমন সুগভীর অভিজ্ঞতা যার সাহায্যে সন্ধান পাওয়া যায় নিগূঢ় জ্ঞানের।

প্রকৃত জ্ঞানের প্রথম ধাপ বিনয়; কেননা বিনয়ের মাধ্যমেই আমরা আমাদের অসহায় অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে পারি, অন্যের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে শিখি। এ থেকে আবার আমরা আমাদের নিজ পাপকে অপছন্দ করতে এবং সত্য আবিষ্কারের জন্য ধ্যান-অনুধ্যানের সাহায্য নিতে পারি। ধ্যান-অনুধ্যানের শেষ পরিণতি হলো সমাধিভাব, অর্থাৎ আত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে সমাধিপ্রাপ্ত আত্মা ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে পারে। বার্নার্ড এখানে সেন্ট অগাস্টিনের মতেরই প্রতিধ্বনি করেছেন। মানুষ শুধু ধ্যান-অনুধ্যান বা স্বজ্ঞার মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন ঈশ্বরের কৃপা।

উইলিয়াম অব সেন্ট থিয়েরি (মৃ. ১১৪৮)

উইলিয়াম অব সেন্ট থিয়েরি (মৃ. ১১৪৮) ছিলেন সেন্ট বার্নার্ডের বন্ধু ও শিষ্য। যুক্তিবাদীদের, বিশেষ করে এবেলার্ডের বিরুদ্ধে যারা অভিযান চালান, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সেন্ট বার্নার্ডের কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এবেলার্ডের ভ্রান্তিসমূহের বিশদ বর্ণনা দেন। তার মতে, স্মৃতির সাহায্যে আত্মা তার স্বর্গীয় উৎপত্তির কথা জানতে পারে। তার এ মতে প্লেটো ও অগাস্টিনের মতের প্রভাব সুস্পষ্ট। স্মৃতি আবার বুদ্ধি ও ইচ্ছাকে প্রভাবিত করে। এই তিনটি খ্রিস্টীয় ত্রিমূর্তির নির্দেশক-স্মৃতি পিতার, বুদ্ধি পুত্রের এবং ইচ্ছা পবিত্রাত্মার নির্দেশক। সেন্ট বার্নার্ডের ন্যায় উইলিয়ামও ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভে ঈশ্বরের কৃপার ওপর জোর দেন।

আইসাক অব স্টেলা (১১৪৭-১১৬৯)

সিস্টেরসীয় সম্প্রদায়ের অপর এক চিন্তাবিদ হলেন আইসাক অব স্টেলা (১১৪৭-১১৬৯)। সেন্ট বার্নার্ডের ন্যায় তিনি তার চিন্তাকে বক্তৃতা ও চিঠিপত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। তিনি দেহ, আত্মা ও ঈশ্বরকে মৌল বাস্তবসত্তা বলে মনে করেন। সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায় তিনি বলেন যে, এক অর্থে আত্মা ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবিবিশেষ এবং দেহের ও ঈশ্বরের মধ্যবর্তী হিসেবে এর একটি নিম্নভাগ, একটি মধ্যভাগ ও একটি শীর্ষভাগ আছে। আত্মার নিম্নভাগ কল্পনার সাহায্যে দেখা যায়। আত্মার শীর্ষভাগ বুদ্ধি, আর এই বুদ্ধি ঈশ্বরের সাথে যুক্ত।

হুগো (১০৯৬-১১৪১)

মরমিবাদের অপর এক কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল সেন্ট ভিক্টর মঠ। ১১০৮ খ্রিস্টাব্দে এই মঠটি উইলিয়াম অব স্যাম্পো দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে হুগো (১০৯৬-১১৪১)-এর আবির্ভাবের পূর্বে এর তেমন কোনো প্রসিদ্ধি ছিল না। হুগো সেন্ট ভিক্টর মঠের অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রথমে তিনি এবেলার্ডের ছাত্র ছিলেন; কিন্তু পরে তিনি তার গুরুর মতের বিরোধিতা করেন। তার রচনাবলির মধ্যে ‘ডি ড্যাসকালিওন’, ‘ডি মেক্সামেনটিস’ ও ‘সামা সেনটেন্সিয়‍্যারাম’ ছিল প্রধান।

স্কলাস্টিক মত ও বুদ্ধির প্রতি বার্নার্ডের যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস ছিল, হুগোর মধ্যে তা ছিল না। তাই দেখা যায়, মরমি অনুধ্যানের স্তরসমূহ সম্বন্ধে তার মতাবলি ছিল সুসংবদ্ধ এবং ‘ডি সেক্সামেনটিস’ গ্রন্থে তিনি তেরো শতকের স্কলাস্টিক চিন্তাপদ্ধতির অগ্রদূত। ‘কজিটেসিও’, ‘মেডিটেসিও’ এবং ‘কন্টেপ্লেসিও’-কে হুগো অতিপ্রাকৃত সত্তার জ্ঞানের তিনটি স্তর বলে বর্ণনা করেন। তার মতে, প্রত্যেক মরমি সাধক এসব স্তর অতিক্রম করে পরিণামে ঐশ্বরিক স্বজ্ঞা লাভ করে থাকেন। কজিটেসিও বলতে তিনি বুঝেছেন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কোনোকিছু প্রত্যক্ষ করাকে। মেডিটেসিও হলো প্রকৃতি ও মানবজীবনের প্রচ্ছন্ন অর্থ আবিষ্কার করা, আর কন্টেমপ্লেসিও হচ্ছে বাস্তবসত্তার প্রকৃত রূপ জানার অন্তর্দৃষ্টি।

যোকোনো বিষয় স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল হুগোর। তিনি বিশ্বাসের মধ্যে দুটি পৃথক উপকরণের পার্থক্য দেখান। এদের একটি জ্ঞান এবং অপরটি অনুরাগ। অনুরাগের গুরুত্ব এখানে যে, এর দ্বারা ইচ্ছাশক্তি জাগতিক ব্যাপারাদি থেকে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত হয়ে থাকে।

রিচার্ড অব সেন্ট ভিক্টর (মৃ. ১১৭৩)

রিচার্ড অব সেন্ট ভিক্টর (মৃ. ১১৭৩) ছিলেন হুগোর পরবর্তী মঠাধ্যক্ষ। তিনিও হুগোর ন্যায় তার মরমি অভিজ্ঞতার এক প্রায়োগিক ভিত্তি প্রদান করেন। তার ‘ডি ট্রিনিট্যাইট’ শীর্ষক গ্রন্থটি ছিল তেরো শতকের স্কলাস্টিক রচনাবলির মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। এ ছাড়া ‘বেনজামিন মেজর’ ও ‘বেনজামিন মাইনর’ তার দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ।

সব সত্যকে আবশ্যিক বুদ্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার রিচার্ডের প্রচেষ্টার সাথে আন্সেলের মতের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, যেসব সত্তার ধর্ম আবশ্যিক (যেমন: ত্রিমূর্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব) তাদের ব্যাখ্যার মূলে শুধু সম্ভাব্য যুক্তিই নয়, আবশ্যিক যুক্তি রয়েছে, যদিও এ যুক্তি কখনো কখনো আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।” আনসেল্ম-এর ন্যায় তিনি ইন্দ্রিয়জগৎ থেকে আবশ্যিক সত্তাবলি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন এবং একই যুক্তিবাদিতার পরিচয় দেন। তার দেয়া ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক প্রমাণসমূহ থেকেই এ বিষয়টি দেখা যায়। ইন্দ্রীয়জগৎ আমাদের নিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তুসমূহের চিত্র প্রদান করে। যেসব জিনিস নিজেরাই সবসময় বদলায় তারা চিরন্তন হতে পারে না। আবার তারা তাদের নিজেদের অস্তিত্বের কারণও হতে পারে না। যার স্বভাব চিরন্তন নয়, তা কখনো স্বয়ম্ভু হতে পারে না। সুতরাং এমন একটি চিরন্তন অপরিবর্তনীয় সত্তা অবশ্যই আছে, যে সত্তা থেকে সব সসীম বস্তুর উৎপত্তি। আর সেই চিরন্তন নিত্যসত্তাই ঈশ্বর।

জ্ঞানের বিভিন্ন মাত্রার কথা বলতে গিয়ে রিচার্ড হুগোর অনুসরণ করেন এবং কল্পনা (যার লক্ষ্যবস্তু ইন্দ্রিয়জগৎ) ও বুদ্ধির (যার আলোচ্য বিষয় বুদ্ধিজগৎ) মাধ্যমে অনুধ্যানের (যার লক্ষ্যবস্তু ঈশ্বর) স্তরে পৌছান। হুগোর মতের প্রতিধ্বনি করে তিনি অনুধ্যান (contemplation)-কে জ্ঞানের উচ্চতম ধাপ বলে বর্ণনা করেন। তার মতে, ঈশ্বরের স্পষ্ট জ্ঞানলাভের জন্য আত্মাকে ন’টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। কল্পনা তার বিভিন্ন ধাপে বুদ্ধির সাহায্য লাভ করে; আবার বুদ্ধিও কল্পনার সাহায্য পেয়ে থাকে। এভাবে অগ্রসর হয়ে ব্যক্তি তার অনুধ্যানের উচ্চতম ধাপে সমাধিভাবাপন্ন অবস্থায় নির্মল সত্য আবিষ্কার করে। এ পর্যায়ে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে এবং সবকিছুকে এক এবং এককে সব বলে মনে করে।

সেন্ট ফ্রান্সিস (১১৮২-১২২৬)

রিচার্ড অব সেন্ট ভিক্টরের চেয়েও প্রসিদ্ধ ছিলেন সেন্ট ফ্রান্সিস। তিনি ১১৮২ খ্রিস্টাব্দে আসেনি নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কাপড়ের ব্যবসায়ী। যৌবনে ফ্রান্সিস ছিলেন উচ্চাভিলাষী। ইন্দ্রিয়সুখ ও আমোদ-প্রমোদের প্রতি তার অতিশয় আকর্ষণ ছিল। পেরুগিয়ার নাগরিকদের সাথে এক সংঘর্ষের ফলে তাকে এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। কিন্তু তাতেও তার উৎসাহ ও আশাবাদ এতটুকু হ্রাস পায়নি। তখনও তিনি সর্বজন সম্মানিত ব্যারন হওয়ার উচ্চাশা পোষণ করতেন। কিন্তু কারাগার থেকে ফিরে আসার পর তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এরপর হঠাৎ তার মনে এক বিরাট আধ্যাত্মিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের দিকেই ইন্দ্রিয়সুখ ও সংসারের প্রতি তার বিতৃষ্ণা শুরু হয়। তখন তিনি দুঃখকষ্ট ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করেন।

কথিত আছে যে, এক ভোজসভার পর ফ্রান্সিসকে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন দেখে তার বন্ধুবান্ধবরা বিস্মিত হয়েছিলেন; কেননা এ জাতীয় অনুষ্ঠানে সচরাচর তাকে আনন্দ উপভোগ করতে ও নেতৃত্ব দিতেই দেখা যেত। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কেউ একজন নাকি মন্তব্য করেছিলেন, “সম্ভবত ফ্রান্সিস একজন স্ত্রী গ্রহণের কথা ভাবছে।” একথা শুনে ফ্রান্সিস নাকি বিরক্তির সাথে চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, “আমি এমন একজন স্ত্রীর কথা ভাবছি, যে হবে তোমরা যা চিন্তা কর তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী, অনেক বেশি ধনী, অনেক বেশি পবিত্র।”

সেন্ট ফ্রান্সিসের প্রামাণিক জীবনীকার বোনাভেন্টুরে বলেন, একদা ঘোড়ায় চড়ে পথে চলার সময় ফ্রান্সিসের সাথে হঠাৎ এক কুষ্ঠরোগীর দেখা হয় এবং তিনি তার সাথে আলিঙ্গন করেন। এরপর কুষ্ঠরোগী যখন ভিক্ষার জন্য তার হাত বাড়িয়ে দেয় তিনি প্রথম তাতে চুম্বন করেন এবং পরে টাকা রাখেন। সেন্ট ফ্রান্সিস মনে করতেন যে, সামরিক ও দৈহিক শক্তি আসলে ক্ষণস্থায়ী। দয়া ও করুণা ব্যতিরেকে মানবজীবন অর্থহীন।

অচিরেই ফ্রান্সিসের কাছে বহু শিষ্যের আগমন শুরু হয় এবং তারা ধর্ম প্রচারের এক বিধান তৈরি করে পোপের অনুমতি প্রার্থনা করে। এই বিধান পোপের অনুমোদন লাভ করে। জীবনের শেষের দিকে (মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তার মৃত্যু ঘটে) তার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় এবং তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তখনই একদিন এলভেরনু পর্বতে তিনি এক মরমি অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাতে খ্রিস্টের প্রতি তার বিশ্বাস ও ভক্তি বৃদ্ধি পায়। এই অভিজ্ঞতার ফলে তার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায় যে, স্বর্গের রাজত্ব তার প্রতি উন্মুক্ত হবে। অতীন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা ও দর্শন তার মনে এক নির্ভেজাল প্রশান্তি ও আন্তরিকতার ভাব সৃষ্টি করে। এ জন্যই তার শিষ্যরা তাকে অসাধারণ জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ভক্তি করত।

উপসংহার

মরমিবাদের প্রভাবে মধ্যযুগীয় চিন্তায় এক মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। মরমিবাদীদের চিন্তায় ব্যক্তিবাদের বীজ নিহিত ছিল। যাজকীয় কর্তৃপক্ষের মুখে তারা ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা ও সম্ভাবনার সমর্থন ও জয়গান করেন। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার স্থলে তারা মানুষের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মরমিবাদীরা মরমি অভিজ্ঞতার ওপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেন, এবং তার ফলে দার্শনিক বিচার- বিশ্লেষণের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ্বাসকে তারা জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও হাতিয়ার মনে করতেন বলে তাদের মধ্যে এ ধারণা ক্রমশ বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, জ্ঞানের বাহন হিসেবে বুদ্ধির কার্যকারিতা নিতান্তই গৌণ।

মরমিবাদী চিন্তায় সর্বেশ্বরবাদের বীজ নিহিত ছিল। মরমিবাদীদের অনেকেই চার্চের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন ঠিক, কিন্তু তাদের মধ্যে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার দূরত্ব অগ্রাহ্য করা এবং ব্যক্তিকে ঈশ্বরের অংশ হিসেবে গণ্য করার এক বিশেষ প্রবণতা উপস্থিত ছিল। তাই দেখা যায়, মানুষের অন্তরে কী করে ঐশ্বরিক আলোকচ্ছটা উপস্থিত আছে, তা দেখাবার ব্যাপারে তারা বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। গোটা জগৎসংসারকে তারা এক সর্বব্যাপক একত্বের প্রতীক বলে মনে করতেন; আর তা করতেন বলেই তারা ইন্দ্রিয়ের দেয়া পরিবর্তন ও বহুত্বের ধারণাকে বাস্তব বলে গ্রহণ করেন নি।

মুসলিম দর্শন

খ্রিস্টীয় পাঁচ শতকের শেষের দিকে এরিস্টটলের কয়েকটি গ্রন্থ মূল গ্রিক ভাষা থেকে আর্মেনীয় ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। এরপর অর্গানন ও নব-প্লেটোবাদী রচনাবলি সিরীয় ভাষায় অনূদিত হয়। মুসলিম পণ্ডিতগণ প্রথমেই এসব রচনাকে সিরীয় ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করেন। পরে মূল গ্রিক ভাষা থেকে এরিস্টটলের গ্রন্থাবলি, এফ্রোডিসিয়াস, পরফিরি এমোনিয়াস প্রমুখ ভাষ্যকারের রচনাবলি এবং প্লেটোর ‘রিপাবলিক’, ‘টাইমীয়ুস’ ও ‘লজ’ আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের এসব গ্রন্থের আরবি অনুবাদ ও ভাষ্য স্পেনদেশেও বিস্তারলাভ করে। শুধু দার্শনিক গ্রন্থাবলিই নয়, গণিত জ্যোতির্বিদ্যা চিকিৎসাশাস্ত্র ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনেক গ্রন্থকেই মুসলমান পণ্ডিতগণ মূল গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। একমাত্র লজিক ব্যতীত এরিস্টটলের অন্য কোনো গ্রন্থের সাথে খ্রিস্টীয় চিন্তাবিদদের পরিচয় ছিল না। মুসলিম পণ্ডিতগণ মূল গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় যেসব গ্রন্থ অনুবাদ করেন, সেসব অনুবাদ গ্রন্থকে আরবি ভাষা থেকে ল্যাটিন ভাষায় পুনরায় অনুবাদ করেই খ্রিস্টান দার্শনিকগণ বারো শতকে এরিস্টলের মেটাফিজিক্স, ফিজিক্স, মনোবিদ্যা ও নীতিবিদ্যার সাথে পরিচয়লাভ করেন। সেন্ট বোনাভেন্সার, সেন্ট টমাস একুইনাস ডান্‌স্ স্কোটাসের মতো খ্রিস্টীয় চিন্তাবিদদের মতসমূহ সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, তারা ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রমুখ চিন্তাবিদের কাছে যথেষ্ট ঋণী ছিলেন।

মুসলিম দার্শনিকগণ যে শুধু এরিস্টটলের জ্ঞান সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন, তা নয়। এরিস্টটলের দর্শনকে ধর্মবিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার চেষ্টাও তারা করেছিলেন। দার্শনিক আলোচনার এমন এক পদ্ধতি তারা উদ্ভাবন করেছিলেন, যা-কিনা খ্রিস্টীয় চিন্তাবিদদের নিজেদের সমস্যাদির আলোচনায়ও বিশেষ সহায়ক ছিল। বস্তুত, মুসলিম দার্শনিকদের উদ্ভাবিত অনেক ধারণা ও যুক্তি খ্রিস্টীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এ জন্যই মুসলিম দার্শনিক চিন্তার সাহায্য ব্যতিরেকে স্কলাস্টিক চিন্তাকে যথার্থভাবে বোঝা যায় না।

উমাইয়া শাসনের পতনের ফলে তাদের একজন ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনদেশে পালিয়ে যায় এবং সেখানে বসতি স্থাপন করেন। এভাবে স্পেনে আব্বাসীয়দের পাশাপাশি একটি পাল্টা উমাইয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়, এবং এ সরকার আব্বাসীয়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্পেনে উমাইয়া ইসলামে এক নতুন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অধ্যায় রচনা করে। তাদের মাধ্যমেই গ্রিক-আরবীয় বিদ্যা পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশ করে।

ইউরোপের মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ইবনে হাজাম (৯৯৪-১০৬৪), ইবনে বাজা (১০৮৫-১১৩৮), ইবনে তুফায়েল (১১১০-১১৮৫) ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) বিখ্যাত। এদের মধ্যে আবার ইবনে রুশদই সর্বাধিক পরিচিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি এরিস্টটলকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন এবং বলেন, এরিস্টটলকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলে পরমসত্তা ও সত্যকে যথার্থভাবে জানা সম্ভব। অবশ্য এর জন্য তিনি সমালোচিতও হন। বিরুদ্ধবাদীদের নালিশ, এরিস্টটল ও ইসলামের সমন্বয়বিধানের নামে ইবনে রুশদ ইসলামের মৌলিকতা ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। এ যুক্তিতেই তার বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধিতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়।

ইবনে রুশূদ প্রাচ্যদেশসমূহে যতটুকু পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন মধ্যযুগের ইউরোপে। এর প্রধান কারণ এই যে, তার বেশকিছু রচনা অনূদিত হয়েছিল ল্যাটিন ভাষায় এবং সেগুলোর ব্যাপক বিতরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল চমৎকার। তবে বিরোধিতার কারণে ইবনে রুশদ-এর মূল আরবি গ্রন্থসমূহকে হয় ভস্মীভূত, নয়তো নিষিদ্ধ করা হয়। ইবনে রুশদ-এর দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক মতের বিস্তৃত প্রকাশ ঘটেছে তার তাহাফুতুল তাহফা গ্রন্থে। দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল-গাজালি (১০৫৮-১১১১) যেসব যুক্তি দিয়েছিলেন, ইবনে রুশদ এ গ্রন্থে সেগুলো এক এক করে খণ্ডনের চেষ্টা করেন। এছাড়াও গ্রন্থটিতে তার মৌলিক চিন্তা প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত হয়েছে।

ইহুদি দর্শন

মধ্যযুগের ইহুদি দর্শনে মুসলিম দার্শনিক চিন্তার প্রভাব ছিল অসামান্য। ধর্মীয় মতের সাথে ধর্মনিরপেক্ষ দার্শনিক মতাবলির সমন্বয়বিধান ছিল ইহুদি দর্শনের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে মাইমোনাইড্‌স এর মতবাদসমূহে যে সমন্বয়ধর্মী মনোভাব লক্ষ করা যায়, তা একুইনাসের দার্শনিক মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মধ্যযুগের ইহুদি দার্শনিকদের অনেকের মধ্যেই এ বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল যে, হিব্রু ধর্ম অন্যান্য সব ধর্মের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ইহুদি আইন-কানুনের মাধ্যমেই কেবল সত্য অর্জন সম্ভব। মুসলিম ও খ্রিস্টীয় দর্শনে যেমন, মধ্যযুগের ইহুদি দর্শনেও তেমনি ধর্মীয় অনুশাসন ও আপ্তবাক্যসমূহের সমর্থন ও ভাষ্যপ্রদানকেই দার্শনিকদের মূল কাজ বলে মনে করা হতো। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে অকাট্য বুদ্ধির অধিকারী বলে মেনে নেয়া হতো, এবং যেকোনো যুক্তি-প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রাচীন অথরিটির উদ্ধৃতি দেয়া হতো। ইহুদি দার্শনিকদের মধ্যে নব-প্লেটোবাদ এবং এরিস্টটলের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। খ্রিস্টীয় ও মুসলিম দর্শনের ন্যায় ইহুদি দর্শনেও বিশ্বাস ও বুদ্ধির বিরোধ ছিল প্রবল। ইহুদি দার্শনিকদের অনেকের মতে দর্শনমাত্রই, সময়ের অপচয়। দর্শন মানসিক কলুষতার উৎস, এবং তা মানুষের মনে প্রত্যাদেশের যথার্থতা সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করে। ইহুদি দার্শনিকগণ তাদের পূর্ববর্তী দার্শনিকদের চেয়ে অতিপ্রাকৃতের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন।

মধ্যযুগে ইহুদি ধর্মকে সুসংবদ্ধ করার এক জোর প্রচেষ্টা চলে। এই প্রচেষ্টা মাইমোনাইড্সে‌র দর্শনে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। মাইমোনাইড্‌স ইহুদি আইনতত্ত্বের ৬১৩টি আইনকে ১৩ টি অনুচ্ছেদে প্রকাশ করেন। এই ১৩ টি অনুচ্ছেদই ইহুদি ধর্মের ভিত্তি। এ সময় ইহুদি পণ্ডিতদের অনেকেই ইহুদি প্রত্যাদেশকে খ্রিস্টীয় ও মুসলিম প্রত্যাদেশের চেয়ে উচ্চ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া ইহুদিদের তারা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি বলেও প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।

সোলোমন ইবনে গ্যাবিরল (১০২০-১০৭০) বা এভিসেব্রন

ইহুদি দর্শন যার চিন্তায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে বিবৃত, তিনি হলেন সোলোমন ইবনে গ্যাবিরল (১০২০-১০৭০)। তিনি এভিসেব্রন নামেই বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি স্পেনের মালাগাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে শুধু দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তা-ই নয়, কবি হিসেবেও তিনি যথেষ্ট সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন। তিনি একত্ববাদের অনুসারী। তার মতে, ঈশ্বর ও জড় দুটি পৃথক সত্তা নয়। জড় ঈশ্বরেরই অংশ। প্লোটিনাসের ন্যায় তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, সত্তার ভিত্তি হিসেবে ঈশ্বর বোধাতীত। ঈশ্বর থেকে পর্যায়ক্রমে আধ্যাত্মিক দ্রব্য আত্মা জড় প্রভৃতির বিকিরণ হয়ে থাকে। এভিসেব্রনের মতে, জগতের সর্বত্র রূপ ও উপাদানের সংযোগ দেখা যায়। একই ব্যক্তিতে বহুরূপের সমাবেশ হতে পারে, এবং শুধু দেহধারী বস্তুতেই নয়, আধ্যাত্মিক দ্রব্যেও উপাদান ও রূপ উপস্থিত থাকে। বিকিরণের এই ধারায় ঈশ্বরের আন্তঃসার পরিবর্তিত হয় না। ঈশ্বরের পবিত্রতা ও পূর্ণতা অপরিবর্তিত থেকে যায়। ফলে জগতে শুধু ঈশ্বরের প্রতিফলনই ঘটে, কিন্তু ঈশ্বরের অন্তঃসার দুরধিগম্যই থেকে যায়।

এভিব্রেনের দর্শনে মরমিবাদের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেন: মানুষের পক্ষে জড়জগৎ থেকে সরে থাকা এবং ইন্দ্রিয়সুখ বর্জন করা আবশ্যক। এ সবের পরিবর্তে মানুষের উচিত নির্লিপ্ত থাকা এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবসত্তাকে জানার চেষ্টা করা। স্বর্গীয় উৎপত্তিস্থলসমূহের সাথে আত্মার মিলনই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। ইন্দ্রিয়গুলো মানুষের যথার্থ জ্ঞানদৃষ্টি লাভের পথে প্রতিবন্ধকস্বরূপ। তবে জ্ঞান ও ধর্ম অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ তার নিম্নতন প্রবৃত্তিসমূহকে জয় করে পরিণামে মুক্তিলাভে সক্ষম।

জুডাহ হ্যালেভি (১০৭৫-১১৪১)

এভিসেব্রনের ন্যায় জুডাহ হ্যালেভি একাধারে একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন। ইহুদি জাতীয়তাবাদ ছিল তার চিন্তার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারাজীবন তিনি প্যালেস্টাইনে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন। জেরুজালেম যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি একবার যাত্রা করেছিলেন; তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পেরেছিলেন কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। আল-গাজালির (১০৫৮-১১১১ খ্রি.) ন্যায় হ্যালেভি বিশ্বাস করতেন যে, বুদ্ধি বিশ্বাসের চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ, বুদ্ধি জীবনের শুধু পরিমাণগত ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। বুদ্ধি ঈশ্বরের প্রাণবন্ত সত্তাকে দেখতে পায় না; আর তা নয় বলেই তা শুধু যুক্তির কসরতের ওপর নির্ভর করে থাকে। যুক্তির কসরত প্রায়শই যথার্থ বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করে থাকে। হ্যালেভির মতে প্রেম, আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া যায়।

ইহুদি জাতির এক গৌরবময় ভবিষ্যৎ রয়েছে-এই ছিল হ্যালেভির দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি প্রশ্ন করেন: ইহুদিরা কি পাশ্চাত্য জগতের নৈতিক ঐতিহ্যের সূত্রপাত করে নি? যুগ যুগ ধরে ইহুদিদের অব্যাহত দুঃখ-দুর্দশা কি তাদের এক ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যের নির্দেশ করে না? ফিলোর ন্যায় হ্যালেভি দিব্যজ্ঞানকে দর্শনের চেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে করতেন। তার মতে, দর্শন জগতের যে ব্যাখ্যা দেয় তা অসম্পূর্ণ; কিন্তু দিব্যজ্ঞানের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব। হ্যালেভি ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে, পরলোকে পুরস্কারের আশায় নৈতিক কাজ করা ঠিক নয়। পুণ্যের খাতিরে পুণ্যের অনুষ্ঠানই হওয়া উচিত প্রতিটি মানুষের নৈতিক আদর্শ; কেননা এর দ্বারাই প্রকৃত মহৎ জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়। হ্যালেভি জগতের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন নি। ইহুদি ঐতিহ্য অনুসারে তিনি ঈশ্বরকে জগতের সর্বময় শাসক বলে ঘোষণা করেন। তার মতে, প্রত্যেক মানুষের উচিত বাইবেলের ঐতিহ্যকে অকাট্য বলে গ্রহণ করা।

মোসেস মাইমোনাইড্‌স (১১৩৫-১২০৪)

মোসেস মাইমোনাইড্‌স (১১৩৫-১২০৪) স্পেনের কর্দোবায় জন্মগ্রহণ করেন। যৌবনে তিনি একবার প্যালেস্টাইন গিয়েছিলেন। পরে তিনি কায়রোতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। প্রথমে তিনি স্বর্ণের ব্যবসা শুরু করেন, কিন্তু পরবর্তীকালে চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কায়রোতে তিনি তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দার্শনিক বুদ্ধির জন্য ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মিসরের ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন মহলে মাইমোনাইড্‌স এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তার মৃত্যুতে ইহুদি মুসলমান নির্বিশেষে সবাই সমানভাবে শোক প্রকাশ করে।

মাইমোনাইড্‌স মুসার শিক্ষার সাথে এরিস্টটলীয় দর্শনের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি ইহুদি ধর্মের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যা সম্পর্কে মাইমোনাইড্‌স এতই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন যে, একে তিনি ঐশ্বরিকজ্ঞানের সমতুল্য বলে মনে করতেন। অধিবিদ্যার পাঠ ও অধ্যয়নকে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধিৎসার ব্যাপার বলে মনে করতেন। তার মতে, অধিবিদ্যার পঠনপাঠনে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ একান্ত আবশ্যক। যারা এ বিষয় অধ্যয়নে আগ্রহী বিজ্ঞান, লজিক ও বাইবেল সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেয়া উচিত। অধিবিদ্যাকে মাইমোনাইড্‌স একটি অতীব দুরূহ বিষয় বলে অভিহিত করেন। তার মতে, অজড়ীয় কারণ কাকে বলে, তা অধিকাংশ মানুষই উপলদ্ধি করতে পারে না। তার ওপর এরিস্টটলের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। অবশ্য এই এরিস্টটল ছিলেন আরবদের, বিশেষ করে ইবনে রুশদ ধরনের এরিস্টটল। ইবনে রুশদ-এর ন্যায় তিনিও দার্শনিক চিন্তার ফলাফলের সাথে প্রত্যাদিষ্ট সত্যের সমন্বয়বিধানের চেষ্টা করেন। তার মতে, প্রত্যাদেশকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার, যাতে এর সাথে নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত তথ্য বা সত্যের কোনো সংঘাত না ঘটে। তবে একটি দার্শনিক সিদ্ধান্তকে যদি প্রত্যাদিষ্ট সত্যের চেয়ে বেশি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা না যায়, তা হলে প্রত্যদিষ্ট সত্যকেই গ্রহণ করতে হবে। এ যুক্তিতেই মাইমোনাইড্‌স জগৎ ও জড়ের অনাদিত্ববিষয়ক দার্শনিক মত স্বীকার না করে জগৎ ও জড়ের একটি শুরু আছে এবং ঈশ্বরই তাদের সৃষ্টি করেছেন বলে প্রাচীন বাইবেলে বর্ণিত মতকে স্বীকার করে নেন।

যেহেতু আমরা একথা প্রমাণ করতে পারি না যে, জগৎ সৃষ্ট, সুতরাং জগতের অস্তিত্ব থেকে আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারি না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের তথাকথিত বিশ্বতাত্ত্বিক প্রমাণ তাই দার্শনিক দিক থেকে অনিশ্চিত। অন্য যেকোনো সংশয়াত্মক দার্শনিক ব্যাপারের ন্যায় এখানেও আমাদের উচিত যুক্তিতর্কের স্থলে ধর্মপুস্তকের রায় মেনে নেয়া। তবে এরিস্টটলের অনুসরণে আমরা এ-ও দেখাতে পারি যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করা না গেলেও পৃথিবীর অব্যাহত গতি ও পরিবর্তনের পেছনে যে কোনো-না-কোনো বুদ্ধির স্পর্শ রয়েছে, তা অবশ্যই প্রমাণ করা যায়। এদিক থেকে বলা যায়, ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে দার্শনিক ও প্রত্যাদিষ্ট, এ উভয় ধরনের আশ্বাসই রয়েছে। ঈশ্বর অতিবর্তী, অর্থাৎ জগতের বইরেও পরিব্যাপ্ত, কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, তিনি জগতের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, কিংবা তিনি মানুষের প্রার্থনার প্রতি উদাসীন। জগতের ব্যাপারে ঈশ্বর নির্লিপ্ত- একথা বলার জন্য নয়, ঈশ্বরের পূর্ণতার ওপর গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যেই মাইমোনাইড্‌স ঈশ্বরের অতিবর্তনের সপক্ষে যুক্তি দেন।

নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে মাইমোনাইড্‌স সংযমের ওপর বিশেষ জোর দেন। তিনি বৈরাগ্যবাদের সমর্থন করেন নি। তার মতে, আমরা নৈতিক নিয়মাবলি অবশ্যই মেনে চলবো, কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, দেহকে কষ্ট দিতে হবে। ঈশ্বরকে জানাই মানুষের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যেই আমাদের যাবতীয় ধ্যান-ধারণা ও প্রয়াস-প্রচেষ্টা পরিচালিত হওয়া উচিত। কাজকর্মের কথাই বলি, আর অবসর বিনোদনের কথাই বলি, এদের কোনোটিরই কোনো স্বকীয় মূল্য নেই। নৈতিক নিয়মের অনুশীলন এবং ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের সার্থক উপলব্ধির মাধ্যমেই কেবল যেকোনো পার্থিব উদ্যোগকে অর্থবহ ও মূল্যবান করে তোলা সম্ভব।

মাইমোনাইড্‌স চার প্রকার পূর্ণতার কথা বলেছেন –

  • এদের প্রথমটি টাকাপয়সা, পোশাকপরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, চাকরবাকর, জমিজমা প্রভৃতি সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত। একজন শ্রেষ্ঠ নৃপতি একটি বিশেষ উপাধি লাভের মাধ্যমে যে পূর্ণতা লাভ করেন, তা-ও এ শ্রেণীর পূর্ণতার অন্তর্ভুক্ত। এ জাতীয় পূর্ণতায় মালিকানা ও মালিকের মধ্যে কোনো নিকট সম্পর্ক নেই। এ সম্পর্ক নিতান্তই একটি কাল্পনিক সম্পর্ক। কেননা ব্যক্তি যখন নিজেকে পরীক্ষা করে তখন সে বুঝতে পারে যে, এ সবই বাহ্য ব্যাপার, এবং এদের গুণাগুণ কেবল বাহ্যিকভাবেই মালিকদের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং এ সম্পর্ক যখন ছিন্ন হয়ে যায়, এতদিন যিনি রাজা ছিলেন তিনিও একদিন বুঝতে পারবেন যে, তার এবং একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অথচ তার পরিবর্তনের পরও এতদিন তিনি যেসব সম্পদকে তার নিজের বলে গর্ব করতেন, তাদের কোনো পরিবর্তন হয় নি। সুতরাং বলা চলে যে, বাহ্য সম্পদ মানুষকে যে পূর্ণতা দেয় তা প্রকৃত পূর্ণতা নয়। সারাজীবন এসব সম্পদের অধিকারী হয়েও মানুষ পূর্ণ হতে পারে না।
  • দ্বিতীয় প্রকারের পূর্ণতা জৈবিক। আর জৈবিক বলেই একে মানবজীবনের পরম লক্ষ্যবহির্ভূত বলা যায়। মানুষ হিসেবে নয়, জীব হিসেবেই আমরা এ পূর্ণতার অধিকারী। শুধু মানুষই নয়, ইতরপ্রাণীরাও এ জাতীয় পূর্ণতার অধিকারী হয়ে থাকে। একথা মনে রাখা দরকার যে, একজন মানুষ যতই শক্তিশালী হোক-না কেন, সিংহ বা হাতি দূরের কথা সে একটি খচ্চরের মতো শক্তিশালীও হতে পারবে না। সুতরাং দৈহিক শক্তি নিয়ে গর্ব করা মানুষের শোভা পায় না। দৈহিক শক্তি কখনো মানুষকে যথার্থ পূর্ণতা দিতে পারে না।
  • তৃতীয় প্রকারের পূর্ণতা বলতে মাইমোনাইড্‌স বুঝেছেন নৈতিক পূর্ণতাকে। মানুষের চারিত্রিক উন্নতি ও উৎকর্ষসাধনই এর উদ্দেশ্য। যেকোনো হিতোপদেশ ও নীতিবাক্যের উদ্দেশ্যেও এই নৈতিক পূর্ণতা। এই পূর্ণতাকেও তার নিজের জন্য চাওয়া হয় না; এটিও অন্য এক পূর্ণতার জন্য প্রস্তুতিবিশেষ। নৈতিক নিয়মমাত্রই ব্যক্তি ও তার প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্কবিষয়ক। এক অর্থে ব্যক্তিবিশেষের নৈতিক পূর্ণতামাত্রই মানবজাতির ব্যাপক পূর্ণতার লক্ষ্যে নিয়োজিত। মানুষ যদি সম্পূর্ণ একা থাকত, সমাজ বলে যদি কিছু না-ই থাকত, তা হলে নৈতিক নিয়মাবলির কোনো প্রয়োজন ছিল না, এবং নৈতিক নিয়মাবলি মানুষকে পূর্ণতাও প্রদান করত না। কোনো মানুষ যখন অন্যান্য মানুষের সংস্পর্শে আসে, তখনই এসব নীতির প্রয়োজন।
  • চতুর্থ প্রকারের পূর্ণতার নাম মাইমোনাইড্‌স দিয়েছেন পরাতাত্ত্বিক পূর্ণতা। এ পূর্ণতাই মানুষকে যথার্থ ঐশ্বরিকজ্ঞানের দিকে পরিচালিত করে। এ পূর্ণতালাভের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হয়। এটিই তাকে প্রকৃত মানবিক পূর্ণতা প্রদান করে। এ পূর্ণতাই কেবল মানুষের স্থায়ী সম্বল। এটিই তাকে অমরত্ব প্রদান করে। এ পূর্ণতার জন্যই মানুষকে মানুষ বলা হয়। প্রথম তিন প্রকারের পূর্ণতাকে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, এদের মালিক হয়েও মানুষ এদেরকে তার নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করতে পারে না। চতুর্থ প্রকারের পূর্ণতা এদিক থেকে একটি ব্যতিক্রম। কেননা তা পুরোপুিরি ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ; অন্য কেউ এর অংশ দাবি করতে পারে না। মাইমোনাইসের মতে, এ ধরনের স্বকীয় পূর্ণতার সন্ধান করা প্রতিটি মানুষের পক্ষে একান্ত কাম্য।

অশুভের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মাইমোনাইড্‌স পূর্ববর্তী দার্শনিকদের অনুসরণ করেন। তার মতে, অশুভ মানেই পূর্ণতার অভাব বা অনুপস্থিতি। সুতরাং এদিক থেকে অশুভের কোনো পরাতাত্ত্বিক বাস্তবতা নেই। মানুষের কাজকর্ম বা আচার- আচরণে আমরা সচরাচর যে অশুভ লক্ষ করে থাকি, তা আসলে তাদের বুদ্ধির অভাবেরই নির্দেশক। এ ছাড়া অশুভ বলে আসলে কিছু নেই। অশুভ জগৎ শাসন করছে-একথাও আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। আংশিক ও অসম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এ বিশ্বাসের সৃষ্টি। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশুভ জগতের সামগ্রিক পূর্ণতার সহায়ক। অধিকাংশ অশুভের জন্য আমাদের নিজেদের স্বভাবই দায়ী। অধিকাংশ অশুভ মানুষের নিজের সৃষ্টি। যেমন: আমরা কামুক স্বভাব অর্জন করি; ফলে ক্রমশ আমাদের দেহ দুর্বল হতে থাকে, এবং পরিণামে আমাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। যারা বুদ্ধিমান, তারা তাদের দৈহিক কামনাসমূহকে সংযত এবং ঈশ্বরের দেয়া সবকিছুর যথার্থ মূল্যায়ন করে থাকে। বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই যথার্থ মূল্য অর্জনের এবং অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত জিনিস বর্জনের চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে মানুষ প্রায়শই প্রয়োজনীয় জিনিস হারিয়ে ফেলে। বস্তুত, অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য মানুষ যতই চেষ্টা করে, ততই সে প্রয়োজনীয় জিনিস অর্জনের ক্ষমতা হারায়।

আত্মার অমরত্বের ব্যাপারে মাইমোনাইড্‌স মুসলিম দার্শনিকদের মত অনুসরণ করেন। ইবনে রুশদ-এর ন্যায় তিনি সক্রিয় বুদ্ধির অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে, সক্রিয় বুদ্ধি একদিকে বিশ্বের সব পদার্থের রূপপ্রদান করে এবং অন্যদিকে মানব বুদ্ধিকে সক্রিয় করে তোলে। ইবনে রুশদ-এর সুরে সুর মিলিয়ে মাইমোনাইড্‌স বলেন, একমাত্র সক্রিয় বুদ্ধিই প্রকৃতপক্ষে অমর; কেননা এটিই বুদ্ধির স্থায়িত্বের প্রতীক। দেহ বিনাশের সঙ্গে সব অস্থায়ী গুণেরও অবসান ঘটে। এ পরিস্থিতিতে মানুষের উচিত ঈশ্বরের সন্ধানে ব্রতী হওয়া, আইনকানুন মেনে চলা এবং তার নিজস্ব বুদ্ধির বিস্তারসাধনে আত্মনিয়োগ করা।

তথ্যসূত্র –

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪, পৃ: ২৬০-৮৫

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.