মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত দ্রব্যাদির মধ্যে মৃৎপাত্রের কথাই সবার আগে আসে। তবে মানুষ ঠিক কখন এগুলোর ব্যবহার শুরু করেছিল তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। অবশ্য উপমহাদেশের বেশ কয়টি প্রাগৈতিহাসিক যুগীয় প্রত্নস্থলে মধ্য পাথর পর্যায়ের ক্ষুদ্রাকার হাতিয়ারের সাথে অত্যন্ত ক্ষয়িষ্ণু মৃৎপাত্রের খোলামকুচি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে আজ অবধি যদিও মধ্য পাথর পর্যায়ের কোন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় নি তথাপি কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি প্রত্নস্থলে প্রস্তরীভূত কাঠের তৈরি প্রাগৈতিহাসিক যুগীয় হাতিয়ারের সাথে কিছু খোলামকুচির সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এগুলোর প্রকৃতি নির্ণয় করার মতো কোন উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট প্রত্নতত্ত্বকর্মীর নিকট থেকে অদ্যাবধি পাওয়া যায় নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক যুগীয় প্রত্নস্থলগুলো থেকে প্রচুর মৃৎপাত্র ও খোলামকুচি আবিষ্কৃত হয়েছে।
মৃৎপাত্র আলোচনার প্রাথমিক শর্ত ওয়্যার (ware) নির্ধারণ। এ উপমহাদেশে এ যাবৎ একাধিক নমুনার ওয়্যারের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে হরপ্পা ওয়্যার, কালো ও লাল ওয়্যার, লাল ঔজ্জল্যময় ওয়্যার, পিঙ্গল রং-এর মৃৎপাত্র (ও.সি.পি.), জরওয়ে ওয়্যার, মালয় ওয়্যার, চিত্রিত ধূসর ওয়্যার (পি.জি. ডাবলিউ) ও উত্তরদেশীয় কালো পালিশকৃত ওয়্যার (এন. বি.পি.) এবং দগ্ধপূর্ব কালো প্রলেপযুক্ত ওয়্যার বহুল আলোচিত। এগুলোর সাধারণ পরিচিতিমূলক সংক্ষিপ্ত বিবরণ –
- হরপ্পা ওয়্যার (আ. খ্রি.পূ. ২১৫০-১৮৫০): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় দগ্ধ অথবা অদগ্ধ ইটে তৈরি ইমারত, নালা, পয়ঃপ্রণালি, রাস্তা ও শৌচাগার সমেত নগরায়ন, ভাবলিপি সংবলিত সীলমোহর ও সীলছাপ, তামা ও ব্রোঞ্জ নির্মিত দ্রব্যাদি, হাতির দাঁত, হরিণের শিং, শঙ্খ, খড়িপাথর, অঙ্গারপাথর, অলঙ্কার ও ত্রিকোণাকার অদপ্ত মাটির পিষ্টক ইত্যাদি।
- লাল ঔজ্জ্বল্যময় ওয়্যার (আ. খ্রি.পূ. ১৮০০- ১২০০): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় উচ্চ-হরপ্পা সভ্যতার সকল নিদর্শন ও হাড়ের তৈরি প্রত্নবস্তু।
- পিঙ্গল বর্ণের মৃৎপাত্র (আ. খ্রি.পূ. ১৬০০- ১৩০০): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় তামা পর্যায়ের প্রায় সব প্রত্ননিদর্শন ও হাড়ে তৈরি প্রত্নবস্তু। তবে এ পর্যায়ে স্থাপত্যিক অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।
- জরওয়ে ওয়্যার (আ. খ্রি.পূ. ১৬০০-১৩০০): ঐ
- মালয় ওয়্যার (আ. খ্রি.পূ. ১৭০০-১৪০০): ঐ
- চিত্রিত ধূসর ওয়্যার (আ. খ্রি.পৃ. ১০০০-৭০০): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় চওড়া মাটির প্রাচীর (নগরায়ণের পুনঃ আবির্ভাব) ও লোহার পিণ্ড।
- উত্তরদেশীয় কালো পালিশকৃত ওয়্যার (আ. খ্রি.পৃ. ৬০০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দ): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, লিপিবিহীন ছাঁচে ঢালাই মুদ্রা, লোহা নির্মিত প্রত্নবস্তু ইত্যাদি। এ পর্বে নগরায়ণ পুনরুজ্জীবিত হয় ও রাজতন্ত্র বিকাশ লাভ করে। এছাড়া স্থাপত্যিক কার্যাদিতে শৈল্পিক চেতনার স্ফুরণ শুরু হয়। এই ওয়্যারটি চলতি শতকের প্রথম অর্ধাংশ পর্যন্ত কেবল উত্তর ভারতীয় অঞ্চলসমূহের প্রত্নস্থলগুলোতে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তাই তৎকালে এ নামেই এর পরিচিতি ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এটি দাক্ষিণাত্য, মধ্যপ্রদেশ এবং পূর্বাঞ্চলেও প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং বর্তমান প্রত্নচর্চার অঙ্গনে এ নামটি ব্যবহারের প্রসঙ্গে নতুন চিন্তা-চেতনা সূচিত হচ্ছে।
- কালো ও লাল ওয়্যার (আ. খ্রি.পূ. ২২০০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দ): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় পুরা ঐতিহাসিক যুগের তামা পর্যায় ও আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ের লোহা পর্বের সকল নিদর্শন।
- দগ্ধপূর্ব কালো প্রলেপযুক্ত ওয়্যার (আ. খ্রি.পূ. চার থেকে খ্রিস্টীয় সাত-আট শতক): সাথি-প্রত্নবস্তু হিসেবে পাওয়া যায় আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ের সকল নিদর্শন।
বাংলাদেশে একমাত্র মহাস্থানগড় এবং ওয়ারিবটেশ্বরে আদর্শ উত্তরদেশীয় কালো পালিশকৃত ওয়্যারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ওয়্যার আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ের সূচনালগ্নের স্মৃতির ধারক। মৌর্য শাসনামলে এটা উৎকর্ষতার চরম শিখরে পৌঁছেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এ যাবৎ এ ওয়্যারের নিদর্শনাদি স্তর বিন্যাসের মূল অবস্থা থেকে এর সাথি-প্রত্নবস্তুর সাথে অনাবৃত হয় নি।
ওয়্যার নির্ণয়ের জন্য পাত্রের গড়ন, রূপ, পরিমাপ, অলঙ্করণ, বয়ন, কাঠামো ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনা করতে হয়। অপরদিকে পাত্রের গড়ন নির্ধারণের জন্য একটি পাত্রকে যথাক্রমে কানা, কাঁধ, গলা, ধড় এবং তলা ইত্যাদি ভাগে ভাগ করে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আবার মৃৎপাত্রের অলঙ্করণ সম্পর্কে অবহিতির জন্য অলঙ্করণের ধরনগুলোকে চার ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে; যথা-আঁচড় কাটা, অঙ্কখচিত, রঙিন প্রলেপযুক্ত ও অ্যাপ্লিক (applique)।
এবার ওয়্যারের বয়ন এবং কাঠামো সংক্রান্ত বিষয়ের আলোচনায় উপনীত হওয়া যাক। এ আলোচনায় মৃৎপাত্র তৈরির উপকরণগুলোর প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং দগ্ধকরণ পদ্ধতি নির্ধারণই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এরজন্য সর্বপ্রথম মৃৎপাত্র তৈরির কৌশল আলোচনা করা প্রয়োজন।
মৃৎপাত্র তৈরি করতে প্রথম প্রয়োজন আটালো ধরনের মাটি সংগ্রহ করা। এরপর এ মাটিকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে খুব ভালভাবে মন্থন করে মাটি থেকে উচ্ছিষ্ট অপসারণ করা হয়। অতঃপর এ মাটির সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, লোহা ও সিলিকা বাহিত পদার্থ মিশিয়ে ছোট ছোট দলা তৈরি করতে হয়। এবার প্রতিটি দলাকে একটি পাত্রের গড়ন প্রদানের পালা শুরু হয়। গড়ন প্রদানের ক্ষেত্রে চারটি পদ্ধতি সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি প্রচলিত আছে; যথা-চাকিতে ঘোরানো, হাতের প্রক্ষালন, কয়লিং (coiling) এবং ছাঁচে ঢালাই।
গড়ন তৈরির পর পাত্রগুলোকে আগুনে পোড়ানোর জন্য দু’ধরনের চুল্লি ব্যবহৃত হতে পারে; যথা-বদ্ধচুল্লি ও খোলাচুল্লি। খোলাচুল্লিতে দগ্ধ পাত্রের সর্বাঙ্গ অধিকাংশ সময় সমান তাপ পায় না। ফলে পাত্রের সর্বত্র তাপ বিস্তারের তারতম্যজনিত কারণে পাত্রের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রং ও বয়ন অর্জন করে থাকে। এ ধরনের ওয়্যার অসহিষ্ণুভাবে দগ্ধ বলা যেতে পারে। খোলা চুল্লিতে পোড়ানোর ফলে তাপমাত্রাও যথেষ্ট হয় না। ফলে ওয়্যার নিম্নমান লাভ করে থাকে। কিন্তু বদ্ধচুল্লিতে পাত্রগুলো পোড়ানো হলে দগ্ধ পাত্রগুলো উল্লিখিত ত্রুটিমুক্ত থাকে, অর্থাৎ উন্নতমান সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ইতিহাসের গোড়ার পর্বে ঝুড়িতে ভরে রোদে শুকিয়ে মৃৎপাত্র ব্যবহার উপযোগী করা হতো।
পাত্র তৈরির পূর্বে মাটিকে যদি খুব ভালভাবে মন্থন করে পঙ্কিলতা মুক্ত করা হয় এবং মাটিতে যদি কোন জৈবপদার্থের অস্তিত্ব না থাকে এবং বদ্ধচুল্লিতে সমানভাবে বিচ্ছুরিত উপযুক্ত তাপমাত্রায় পোড়ানো হয় তবে এর কাঠামো, বয়ন ও মৃৎপাত্রের কোন অংশে রং-এর ক্ষেত্রে তারতম্য সৃষ্টি হয় না। এমনকি সেকশনেও কোন রন্ধ বা কণার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। এ ধরনের পাত্র বা খোলামকুচিকে আঙ্গুল দিয়ে টোকা প্রদান করলে ধাতু নিঃসৃত সুরেলা ধ্বনির মতো শব্দ উৎপন্ন হয়। এসবই হলো উন্নত মানসম্পন্ন ওয়্যারের বৈশিষ্ট্য। তবে ধাতু ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন শুরু হলে ওয়্যারের ধরন ক্রমেই অবনতির দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছিল। এসব বিবেচনায় ওয়্যারের ধরনকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়; যথা- উত্তম, মধ্যম ও নিম্নমান সম্পন্ন। মধ্য ঐতিহাসিক পর্যায়ে অলঙ্করণের জন্য রং-এর ব্যবহারের তুলনায় আঁচড় কাটা রীতি অধিক হারে অনুসৃত হতে শুরু করেছিল। এছাড়া মুসলমানদের শাসনামলের প্রথম দিকে মৃৎপাত্রের গায়ে ধাতু বা কাচ জাতীয় রঙিন পদার্থের একপ্রকার মোটা প্রলেপ আরোপের রীতি প্রচলিত হয়। এ ধরনের প্রলেপযুক্ত মৃৎপাত্র গ্রেইজড (glazed) ওয়্যার নামে পরিচিত।
সবচেয়ে বড় কথা এই যে, মৃৎপাত্র ভঙ্গুর। তাই পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় পাওয়া মৃৎপাত্রের সংখ্যা খুবই কম। যা কিছু পাওয়া যায় তার সিংহভাগ জুড়ে থাকে খোলামকুচি। এগুলোর মধ্যে কানা অংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এক-কেন্দ্র এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যাসবিশিষ্ট একাধিক বৃত্তের সমন্বয়ে গঠিত মানচিত্রের উপর কানা অংশটি বসিয়ে একটি ভেঙে যাওয়া মৃৎপাত্রের আকার ও আকৃতি সম্পর্কে ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব। আবার প্রত্যেক পর্যায় ও পর্বের ওয়্যার ও মৃৎপাত্রগুলো কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ধারক। এ বৈশিষ্ট্যগুলো পাত্রের গড়ন এবং অলঙ্করণের রূপচিহ্ন বিন্যাসের মধ্যে সুস্পষ্ট থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আপাতত আদর্শ নমুনার উত্তরদেশীয় কালো পালিশকৃত ওয়্যার শনাক্তকরণের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো উদ্ধৃত করা হলো:
- এর সেকশন অত্যন্ত শীর্ণ, নিচ্ছিদ্র ও পিচ্ছিল। রং ধূসর, হালকা লালচে বা নীলাভ প্রভাযুক্ত;
- মৃৎপাত্রের এক অথবা উভয় পিঠে কালো চকচকে রং-এর বিচ্ছুরণ বজায় থাকে;
- পাত্রগুলো চাকিতে ঘুরিয়ে তৈরি;
- বদ্ধচুল্লিতে পাত্র দগ্ধ করা হতো;
- সর্বাঙ্গে রং বিভাজনের ক্ষেত্রে কোন তারতম্য বজায় থাকে না;
- মৃদু টোকা দিলে সুমিষ্ট শব্দ উচ্চারিত হয়;
- মাঝারি আকৃতি, কানাবিহীন এবং তলা ও শরীর গোলাকার এবং
- ওজন অত্যন্ত হালকা।
বাংলাদেশের আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ের প্রত্নস্থলগুলোতে একাধিক নমুনার ওয়্যারের উপস্থিতি দেখা যায়। এরমধ্যে চারটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে –
- লালচে বাদামি রং-এর ওয়্যার: সংখ্যার বিচারে এ ওয়্যারভুক্ত পাত্রের সংখ্যা সর্বাধিক। এগুলোর সেকশন গড়ে ২ মিমি. থেকে ৫-৬ মিমি. পুরু। বয়ন ও কাঠামোর দিক থেকে পাত্রগুলো মধ্যমান সম্পন্ন। সাধারণত পাত্রের উপরাংশে গৈরিক-বাদামি অথবা ধূসর-বাদামি রং-এর দগ্ধপূর্ব প্রলেপ বজায় থাকে। কোন কোন পাত্রের গলায় অথবা কাঁধে বা তলদেশে নকশাও বিধৃত পাওয়া যায়। নকশার প্রধান প্রধান মোটিফ হলো জালি, ঢেউ, বরফি, চোখ, হেলান গোঁজ, সমান্তরাল রেখা, আম্রমঞ্জুরি, বহু পেঁচযুক্ত বলয় ইত্যাদি। পাত্রগুলোর মধ্যে সঞ্চয়াধার, সুবাসিত তরল পদার্থ সিঞ্চনাধার, পুষ্পাধার, তৈলপ্রদীপ, বাটি, সরপোশ, হাতাওয়ালা ধূপদান, চেটালপাত্র ইত্যাদির সংখ্যাই বেশি।
- ধূসর রং-এর ওয়্যার: এগুলোর সেকশনের পুরুত্ব উপরিল্লিখিত ওয়্যারের অনুরূপ। তবে পাত্রগুলোকে বয়ন-প্রকৃতি বিচারে তিনটি মানে ভাগ করা যেতে পারে; যথা-উত্তম, মধ্যম ও নিম্ন। উত্তম মানের ধূসর ওয়্যারে তৈরি পাত্রগুলো সাধারণত ক্ষুদ্রাকার হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে সঞ্চয়াধার, দোয়াত ইত্যাদির সংখ্যাই বেশি। এগুলোর উপরের অর্ধাংশের সর্বত্র কালচে-বেগুনি রং-এর দগ্ধপূর্ব প্রলেপ বজায় থাকে। মাঝারি আকারের পাত্রগুলোর মধ্যে হাঁড়িকুড়ির সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে নিম্নমান সম্পন্ন পাত্রের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি। সাধারণত রান্নার জন্য ব্যবহৃত হাঁড়িকুড়ি জাতীয় পাত্রগুলোর ক্ষেত্রেই এ ওয়্যারের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। এগুলোর ক্ষেত্রে অলঙ্করণের উপস্থিতি প্রায় দুর্লভ বললেই চলে। তবে কোন কোন পাত্রের উপরাংশে তামাটে-লাল রং-এর দগ্ধপূর্ব প্রলেপ আরোপিত হয়েছিল এমন নিদর্শনের অভাব নেই।
- সাদাটে আভাযুক্ত ওয়্যার: কাঠামো ও বয়ন প্রকৃতি বিচারে এটি উত্তম মানের পর্যায়ভুক্ত। এটির সেকশন গড়ে ৩ থেকে ৪ মিমি। তবে এ ওয়্যারের নিদর্শন খুব নগণ্য সংখ্যায় পাওয়া গেছে। এ যাবৎ কেবল ঢাকার অদূরবর্তী সাভারের হরিশচন্দ্র রাজার ঢিবির সবচেয়ে উপরের স্তরে একটি অর্ধভাঙা ছোট বাটি এবং স্তর (২)-এ কয়েকটি তাৎপর্যবিহীন খোলামকুচি পাওয়া গেছে। এ খোলামকুচিগুলো ছিল সর্বপ্রকার অলঙ্করণ বর্জিত। মহাস্থানেও এ ধরনের একটি খোলামকুচির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এর বহিরাবরণে বেগুনি প্রভাযুক্ত দগ্ধপূর্ব রঙিন প্রলেপ এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে বাগেরহাটের সুন্দরঘোনা মৌজার খান জাহানের বসতবাটি নামের প্রত্নঢিবিতেও অনুরূপ একটি খোলামকুচি খননের প্রাক্কালে আবিষ্কৃত হয়েছে।
- ঔজ্জ্বল্যময় ওয়্যার: এ ওয়্যার অত্যন্ত চকচকে বহিরাবরণসহ বাদামি ও কালো উভয় রঙেই পাওয়া যায়। তাই এর নাম ঔজ্জ্বল্যময় ওয়্যার রূপে ধরে নেওয়া যায়। এ জাতীয় খোলামকুচির সেকশন গড়ে ৪ মিমি, পুরো এবং দানাদার কণিকা মুক্ত ও অঙ্গারের চিহ্নবিহীন হয়। তাই এগুলোকে উত্তমমানের ওয়্যারের শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে। আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ ওয়্যারের কালো রং-এর খোলামকুচিগুলোর উভয়পিঠেই অত্যন্ত ঔজ্জ্বল্যময় একটি অতিরিক্ত প্রলেপ দেখা যায়। অন্যদিকে বাদামি আভাযুক্তগুলোর ক্ষেত্রে কেবল বহিরাবরণে তামাটে-লাল রং-এর প্রলেপ দেখা যায়। কালো রং-এর ঔজ্জ্বল্যময় শ্রেণীর পাত্রগুলোর অলঙ্করণের জন্য কেবল ক্যারিনেসন (carination) ব্যবহৃত হয়েছে। এ নমুনার নিদর্শন হিমালয়ের তরাই অঞ্চলের গাহড়ওয়াল থেকে শুরু করে মহাস্থানগড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রত্নস্থলগুলোতে উত্তরদেশীয় কালো পালিশকৃত ওয়্যারের সাথি নিদর্শন হিসাবে পাওয়া গেছে। অন্যদিকে তামাটে লাল আভার ঔজ্জ্বল্যময় ওয়্যারের উপস্থিতি কেবল আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ে দেখা গেছে। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত এ জাতীয় একটি খোলামকুচিতে মাছের আঁশ মোটিফ বিধৃত থাকতে দেখা গেছে।
মৃৎপাত্র সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রত্নতত্ত্বের ‘ক-খ-গ’ বলে বিবেচিত হয়। কারণ প্রায় সকল প্রত্নস্থলেই এ নিদর্শনটি বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র
- প্রত্নতত্ত্ব : উদ্ভব ও বিকাশ, মোঃ মোশারফ হোসেন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১১
Leave a Reply