থিওরি অফ ইভুলুশ্যন বাই দ্যা মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন– কথাটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়- “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তনের তত্ত্ব” অথবা যেভাবে বললে সহজে বোঝা যায়- “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব“। কথাটির দুটি ভাগ আছে-
১) বিবর্তনের তত্ত্ব, আর
২) প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে।
প্রথম ভাগ – বিবর্তনের তত্ত্ব
প্রথম ভাগটি বোঝা সহজ- বিবর্তন হচ্ছে অবস্থার পরিবর্তন। লোহায় মরিচা পড়াও এক প্রকার বিবর্তন। কারণ এতে লোহার পরিবর্তন ঘটে।
অজানা তথ্য হচ্ছে চার্লস ডারউইন আর আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসই প্রথম বিবর্তনের কথা বলেন নি। এছাড়াও ডারউইন তাঁর “The Descent of Man, and Selection in Relation to Sex” যা কিনা “অন দ্যা অরিজিন অফ স্পিসিস” এর পর প্রকাশিত হয়, সেখানে প্রচুর রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন, যা দিয়ে আমরা ডারউইনের পূর্বের বিজ্ঞানীদের মতবাদ জানতে পারি।
অনেকে বৈজ্ঞানিক “থিওরি”কে দৈনন্দিন ভাষার কাজে ব্যবহৃত শব্দ “থিওরি” এর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। বিবর্তন “ফ্যাক্ট” না, তারা বলেন। উনাদের নিকট, সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক, একটা বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনার নাম জানতে চাই – যা “ফ্যাক্ট” শব্দটি দিয়ে শুরু বা শেষ হয়েছে।
বিবর্তন ফ্যাক্ট- এই ফ্যাক্টকে ব্যাখ্যা করে “ন্যাচারাল সিলেকশন” বা প্রাকৃতিক নির্বাচন।
উদাহরণ- চার্লস ডারউইন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপভেদে (অন্যকথায় খাদ্যভান্ডার ভেদে) ভিন্ন ১৩ প্রকার ফিঞ্চ পাখির স্যাম্পল সংগ্রহ করেছিলেন। একই পাখির ১৩টা প্রকার- এইটা ফ্যাক্ট – অন্য কথায় – একক এক প্রজাতির পাখি থেকে এদের বিবর্তন- ফ্যাক্ট। সেই বিবর্তন কেন হয়েছে সেটা বিশ্লেষণ করে তাঁর থিওরি।
বিবর্তনের ধারণা প্রথম দেন প্রাচীন গ্রীসের আয়োনিয়ান দার্শনিক এনাক্সিম্যান্ডার, তাও খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে! তাঁর মতে মহাবিশ্ব এবং পৃথিবী “এপেরিয়ন” নামের প্রাথমিক এক বস্তু থেকে সৃষ্ট, আর প্রাণের জন্ম হয়েছিল পানিতে। মানুষের জন্ম হয়েছে অন্যান্য প্রাণী থেকে, বিশেষ কোনো ভাবে নয়।
তাঁর এবং আয়োনিয়ান (Ionian) দার্শনিকদের পর্যবেক্ষণলব্ধ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় প্লেটোর কল্পনা আর চিন্তালব্ধ প্রক্রিয়া দিয়ে। ফলে, এনাক্সিম্যান্ডারের কাজ কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। তবে তাঁর কাজ লুক্রেশিয়াস, জেনোফেনিস, হেরোডোটাস, আর পশ্চিমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এরিস্টটলকে অনুপ্রানিত করে। সময়ের সাথে প্রাণীর পরিবর্তন এখন সর্বজন গ্রাহ্য বিষয়। বিবর্তন ঘটছে – এর প্রমাণ অজস্র।
ভ্রুণ অবস্থায় সকল প্রাণীর বংশধরেরা প্রথম কয়েক সপ্তাহ প্রায় একই রকম দেখতে হয়।
পৃথিবীপৃষ্ঠের যত গভীরে যাওয়া যায় ততই সরলতর প্রাণের ফসিল পাওয়া যায়। এটা প্রমাণ করে অতীতে প্রাণীরা গাঠনিকভাবে সরল ছিল। এবং তারা সময় এবং পরিবেশের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে।
এছাড়াও একই পর্বের দুটি প্রাণীর মাঝে জিনগত-কঙ্কালগত গঠনের সাদৃশ্যও দেখায় একক পূর্বপূরুষ থেকে ধীর বিবর্তনের প্রমাণ। উদাহরণ- শিম্পাঞ্জী ও মানুষের কার্যকর জিন ৯৮.৬% একই রকম। যা প্রমাণ করে এদের একক পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তন।
আবার দুইটি ভিন্ন পর্বের প্রাণীর জিনগত সাদৃশ্য ইঙ্গিত করে আরো প্রাচীন এক পূর্বপুরুষের দিকে। উদাহরণ- পাখি আর সরীসৃপ প্রজাতির জিনগত সাদৃশ্য আছে, যা ইঙ্গিত করে পাখি আর সরীসৃপের একক পূর্বপুরুষের দিকে।
এছাড়াও পরীক্ষাগারে বিবর্তনের চাক্ষুস প্রমাণ পেয়েছেন রিচার্ড লেনস্কি- ই কলাই ব্যাকটেরিয়ার উপর পরীক্ষা করে।
গ্রান্ট & গ্রান্ট গ্যালাপাগোস দ্বীপের ফিঞ্চের বিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন।
প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক বানানো হচ্ছে- কারণ পুরোনো এন্টিবায়োটিকসের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে! এসব কিছুই বিবর্তনের সন্দেহাতীত প্রমাণ।
এবার আসি দ্বিতীয় ভাগে- “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে”।
হুমায়ুন আহমেদের গল্পে “প্রকৃতি”কে মানবীয় অথবা অতিমানবীয় ক্ষমতা দেয়া অনেকের হয়তো মনে আছে। হিমুতে আর মিসির আলিতে প্রায়ই “প্রকৃতি পছন্দ করেন না” আর “প্রকৃতি ক্ষমতা দেন না” বর্ণনা পেয়েছি আমরা। একই ভাবে ইংরেজী রোমান্টিক কবিরাও প্রকৃতিকে অতিমানবীয় সত্তা দিতে চেয়েছেন।
তবে “প্রকৃতি” জিনিসটা আসলে কী?
সহজ কথায় প্রকৃতি হচ্ছে পরিবেশ। ধরুন- পৃথিবী কার্বনসৃষ্ট প্রাণের উপযোগী- পৃথিবীর প্রকৃতি (পরিবেশ) উদার; ভেনাস কার্বনসৃষ্ট প্রাণের উপযোগী নয়- ভেনাসের প্রকৃতি (পরিবেশ) কঠোর। যে প্রাণের কথা হচ্ছে এখানে, সেটা হচ্ছে সরলতম প্রাণ- যা নিজের অনুরুপ সৃষ্টি করতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ শুরু করে প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার পর।
পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো সময়ে বেঁচে থাকা প্রজাতির চেয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির সংখ্যা বেশী। কারণ তারা টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে গেছে- আর প্রাকৃতিক নির্বাচন হেরে যাওয়াদের রাখে না।
কার্ল সেগানের বই “দ্যা কসমিক কানেকশন” এর প্রথম অধ্যায়ে সেগান লিখেন-
“…পরিবেশ পরিবর্তিত হলো। যে সব প্রাণী বিশেষত আগের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বিবর্তিত হয়েছিলো, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলো। যারা, অন্যদিকে, বিশেষত্বহীনভাবে টিকে ছিলো যারা তারা আবারো খাপ খাইয়ে নিতে পারলো। পৃথিবীতে যে কোনো সময়ে বেঁচে থাকা প্রজাতির চেয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির সংখ্যা বহু গুণে বেশি।“
অথবা নীল ডিগ্রাস টাইসনের Cosmos এর ২য় পর্বে চোখের বিবর্তন নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছেন। কিভাবে আলোক সংবেদীতা বিলিয়ন বছরের বিবর্তনে দৃষ্টি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে নীল টাইসন সেটা দেখিয়েছেন।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি-
ধরে নিই একটা এলাকায় দুই গোত্রের মানুষ আছে। এক গোত্রের মানুষের পা অন্য গোত্রের পায়ের চেয়ে লম্বা। ফলে লম্বা পা ওয়ালা মানুষদের চলাফেরার গতি অন্য গোত্রটির চেয়ে বেশী। এবার ধরে নিই সেই এলাকায় একটা শিকারী প্রাণী আছে যেটা মানুষ শিকার করে। বেশি গতিওয়ালা মানুষদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি হবে- এটা কমন সেন্স। ফলে লম্বা পাওয়ালা গোত্রটি বেশি বংশধর রেখে যেতে পারবে, সময়ের সাথে সাথে এদের জনসংখ্যা বাড়বে। অন্যদিকে ছোট পাওয়ালা গোত্রটি শিকার হবে- এবং তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
যারা বলেন- “প্রাণের সৃষ্টি অনেক অসম্ভাব্য ঘটনা, নিজে থেকে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বিলিয়নে একটা”, তাদের জন্য উত্তর-
আমাদের ছায়াপথে ২০০-৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে – আমাদের সূর্যের মত। তাদের যদি গড়ে ৩টা করে গ্রহ আছে ধরে নেই, তবে আমরা পাচ্ছি ন্যূনতম ৬০০-১২০০ বিলিয়ন গ্রহ, এখন যদি প্রাণের সম্ভাবনা বিলিয়নে একটা হয় – তারপরও আমরা আমাদের ছায়াপথেই পাচ্ছি নূন্যতম ৬০০ থেকে ১২০০টি প্রাণসমৃদ্ধ গ্রহ। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ছায়াপথে আছে কয়েক বিলিয়ন বিলিয়ন, আর গ্রহ? ৫৬ ট্রিলিয়ন মাত্র।
এই হিসাবটা শুধু কার্বন বেইসড প্রাণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কারণ আমরা জানি না আর কী কী মৌলের উপর ভিত্তি করে প্রাণের সৃষ্টি সম্ভব। এছাড়াও ড্রেকের সমীকরণ রয়েছে- যা দিয়ে আমরা প্রাণের সম্ভাব্যতার গাণিতিক ধারণা পাই। তবে সেখানে অনেকগুলো বিবেচ্য আছে, যেগুলো প্রাণের সহজলভ্যতার সংখ্যাকে তাত্ত্বিকভাবে কমিয়ে একটা সমীহকৃত ধারণা দেয়।
আমি জানি ড্রেকের সমীকরণ বিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত ভাববেন না অনেকেই। কিন্তু, ড্রেক সমীকরণ দিয়ে আমরা প্রাণের সহজলভ্যতার একটা সম্ভাব্য সংখ্যা বের করে বুঝতে পারি- আমরা মোটেই বিশেষত্ব সম্পন্ন কিছু নই।
ড্রেকের সমীকরণ হচ্ছে-
N= R*.fp.Ne.fl.fi.fc.L
এখানে,
N হচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সীতে যোগাযোগ স্থাপনের মত এলিয়েন সভ্যতার অস্তিত্বের প্রকাশক
R* হচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সীতে প্রতি বছর জন্ম নেয়া প্রাণের সহায়ক নক্ষত্রের সংখ্যা
fp হচ্ছে ঐ প্রাণ সহায়ক নক্ষত্রগুলোর মধ্যে কতটির চারপাশে গ্রহ আছে সে সংখ্যা
Ne গড়ে কতটি গ্রহের প্রাণের উপযোগী পরিবেশ আছে তার সংখ্যা
fl সেই প্রাণের উপযোগী পরিবেশসম্পন্ন গ্রহগুলোর মধ্যে কতটিতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে সে সংখ্যা
fi সেই প্রাণের উদ্ভব হওয়া গ্রহগুলোর মধ্যে কতটি গ্রহে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণের অস্তিত্ব আছে সে সংখ্যা
fc সেই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী থাকা গ্রহগুলোর মধ্যে কতটি যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে সে সংখ্যা
L সেই যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম প্রাণীদের সভ্যতার এবং যোগাযোগ স্থাপনের আয়ু
ড্রেক সমীকরণ নিয়ে কার্ল সেগানের কসমসের এপিসোডের অংশটুকু দেখে নিতে পারেন এখানে…
কসমসে প্রাণ থাকাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না, আর যদি কোথাও প্রাণ থেকে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন মেনেই টিকে থাকতে হবে। কারণ?
কারণ, প্রাকৃতিক নির্বাচন এই মূহুর্তে জীববিজ্ঞানীদের জানা একমাত্র তত্ত্ব যা প্রাণের জটিলতাকে খুব কার্যকরীভাবে ব্যাখ্যা করে। যদি নতুন কোন actual তত্ত্ব – ধারণা বা বিশ্বাস নয় – তত্ত্ব প্রাণের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, তবে সেই তত্ত্ব প্রাকৃতিক নির্বাচনের জায়গা করে নেবে। আর আমরা সেটাকে মেনেও নেবো, কারণ বিজ্ঞান ভুল স্বীকার করে নেয় – নতুন তথ্য উপাত্তের উপস্থিতিতে কোনো কিছু যদি গ্রহণযোগ্যতা হারায়, বিজ্ঞান সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে না। এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য।
মহান শিক্ষক কার্ল সেগানের একটা উক্তি দিয়ে শেষ করবো-
তথ্যসূত্র:
http://darwin-online.org.uk/content/frameset?pageseq=1&itemID=F937.1&viewtype=text
http://www.pbs.org/wgbh/nova/evolution/guess-embryo.html
http://www.prehistoricplanet.com/news/index.php?id=48
http://www.scientificamerican.com/article/tiny-genetic-differences-between-humans-and-other-primates-pervade-the-genome/
http://evolution.berkeley.edu/evolibrary/article/evograms_06
http://myxo.css.msu.edu/ecoli/
http://www.nature.com/news/2009/091116/full/news.2009.1089.html
http://bigganjatra.org/evidence_of_evolution/
– স্যাগানিস্ট
Leave a Reply