আবু হানিফা
ভূমিকা
মুসলিম আইনের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৭) ছিলেন এক অসাধারণ পণ্ডিতব্যক্তি। শুধু আইনজ্ঞ হিসেবেই নয়, ধর্মবেত্তা হিসেবেও তার অবদান অসামান্য। শৈশবেই তিনি ইসলামি আইন (ফিকহ) অধ্যয়নের পাশাপাশি গভীর আগ্রহের সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন, সমকালীন ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন এবং এর ফলে দ্বান্দ্বিক ধর্মতত্ত্বের (dialectical theology) ক্ষেত্রে সুপণ্ডিত ও সিদ্ধহস্ত বলে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামি আইন ব্যাখ্যায় প্রথমেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন রক্ষণশীলপন্থীদের (আহলে হাদিস) নির্বিচার বিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্রতী হন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যার ব্যাখ্যায় যৌক্তিক পদ্ধতি প্রয়োগে। এই যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ও তার অনুসারীরা ‘যুক্তি ও অভিমতের মানুষ’ (আসহাব আল-রায় ওয়াল কিয়াস) নামে পরিচিত।
ধর্মবিশ্বাস
ইমাম আবু হানিফার মতে জ্ঞান, বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তি (confession)—এ তিনটি নিয়েই যথার্থ ধর্মানুভূতি গঠিত। এদের কোনো একটি কখনো একচেটিয়াভাবে সেই পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি সৃষ্টি করে না, করতে পারেই না। বিশ্বাস ও কর্মের সম্বন্ধ আলোচনা প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেন একজন পরিপূর্ণ মুসলমানের পক্ষে বিশ্বাস ও অনুশীলন দুটোই অপরিহার্য। পিঠ ও পেট যেভাবে অঙ্গের সঙ্গে যুক্ত, ঠিক তেমনি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত বিশ্বাস ও অনুশীলন। কিন্তু তাই বলে এ দুটি যে এক ও অভিন্ন তা বলা চলে না। এরা একে অপর থেকে স্বতন্ত্র এবং স্বতন্ত্র হয়েও এরা ইসলামের দুটি অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে স্বীকৃত। ‘দ্বীন’ (ধর্ম) কথাটি বিশ্বাস ও কর্ম উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। (আল-ফিক্হ আল-আকবর, পৃ ১০-১১) বিশ্বাস বলতে বোঝায় অন্তঃকরণের এক সজীব ও সুদৃঢ় প্রত্যয়ভাবকে। এই বিশ্বাসের হ্রাস বা বৃদ্ধি হয় না। তবে সংশয় একে ব্যাহত করে। বিশ্বাসে সমান ব্যক্তিরাও আচরণের বৈষম্যের কারণে উৎকৃষ্টতর বা নিকৃষ্টতর হতে পারে। কোনো পাপের অভিযোগে একজন মুসলমানকে অবিশ্বাসী বলা ঠিক নয়। আচরণ খারাপ হওয়া সত্ত্বেও একজন মুসলমান বিশ্বাসী হতে পারেন। অনুশোচনা না করে যে বিশ্বাসী মৃত্যুবরণ করে, বিভিন্ন পাপানুষ্ঠানের ফলেও তাকে অনন্তকাল দোজখে রাখা হবে না। আল্লাহ তাকে তার পাপানুযায়ী মাফ করতে পারেন, কিংবা শাস্তি দিতে পারেন। (মসনাদ আল-ইমাম আল-আজম, পৃ ১১) তার নিজের ও মুরজিয়াদের মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা করতে গিয়ে আবু হানিফা বলেন : পাপ বিশ্বাসী ব্যক্তির ক্ষতিসাধান করে না, কিংবা বিশ্বাসী ব্যক্তি দোজখে যায় না- একথা আমরা বলি না। আমরা এ-ও বলি না যে, বিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে পাপ সত্ত্বেও সে সারাজীবন দোজখে থাকবে। আবার মুরজিয়াদের মতো আমরা একথাও বলি না যে, আমাদের ভালো কাজ গৃহীত হয় এবং পাপ মাফ করে দেয়া হয়। আমরা একথা বলি যে, যে ব্যক্তি অন্যায় বা অবিশ্বাসের আশ্রয় না নিয়ে পবিত্র মনে কাজ করে, সেই ব্যক্তি কখনো আল্লাহ কর্তৃক উপেক্ষিত হবে না। যে ব্যক্তি পাপকর্ম অনুষ্ঠানের পর অনুশোচনা না করেই মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে দোজখে শাস্তি দিতে পারেন, কিংবা বেকসুর খালাস করতে পারেন।
খারিজি ও মুতাযিলারা এমন এক ‘হুমকি’ (ওয়ায়িদ) মতবাদের ব্যাখ্যা দেন যাতে বিশ্বাসীরা হতাশা ও বিষণ্নতার দিকে চালিত হয়। অন্যদিকে মুরজিয়ারা যে, ‘প্রতিশ্রুতি’ (ওয়াদ) মতবাদের ওপর জোর দেন তাতে বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে ইসলামের নৈতিক ভিত্তি। ইমাম আবু হানিফা অবলম্বন করলেন এ দুই উগ্রপথের মাঝখানে অবস্থিত এক সুবর্ণ মধ্যক বা মধ্যবর্তী পথ। তার মতে, পাপের অবশ্যই ফলাফল রয়েছে। পাপীমাত্রই দোজখের বা শাস্তির যোগ্য। কিন্তু পাপের কারণে কাউকে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করা সেই ব্যক্তিকে অবিশ্বাসী নাস্তিক বলারই নামান্তর। কিন্তু কাউকে অনন্ত শাস্তি দেয়ার বিধান স্বর্গীয় ন্যায়পরতার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। আবু হানিফার এই উদার সহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ ও যুক্তিসঙ্গতভাবে অব্যাহত রাখেন আল-মাতুরিদি ও আল-তাহাবি।
ঐশী অন্তঃসার ও গুণ
আল্লাহর অন্তঃসার (essence) ও গুণ (qualiues)-এর সম্বন্ধ প্রসঙ্গে অহেতুক তর্ক-বিতর্কে প্রবৃত্ত না হয়ে আল্লাহ নিজের ওপর নিজে যেসব গুণ আরোপ করেছেন, সেগুলোকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার জন্য আবু হানিফা তার শিষ্যদের পরামর্শ দেন। আল্লাহয় গুণারোপের সঙ্গে জড়িত অসুবিধা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই তিনি সোজাসুজি বলেন : “এগুলো ‘তিনি’ নয়, আবার ‘তার’ থেকে স্বতন্ত্রও নয়।” এদের অর্থ সম্ভবত এই যে, আল্লাহর গুণাবলি তার নির্যাসে র্থক নয়। আল্লাহর চোখ হাত প্রভৃতি অঙ্গ সম্পর্কিত কোরআনের কিছু কিছু বাণী প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেন: এগুলো আল্লাহর গুণকেই নির্দেশ করে বটে; কিন্তু এ স্বীকৃতিকে তিনি তার্কিক আলোচনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী নন। কারণ, তাতে এসব গুণ অস্বীকার করার দিকে চালিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য “তার হাত, মুখমণ্ডল ও আত্মা আছে বলে কোরআনে ঠিকই বলা হয়েছে; আর মুখমণ্ডল, হাত ও আত্মা হিসেবে আল্লাহ কোরআনে যা-ই উল্লেখ করেছেন তা নিঃসন্দেহে তারই গুণ। কাদরিয়া ও মুতাযিলাদের মতো একথা বলা ঠিক নয় যে, তার হাত বলতে তার শক্তি ও প্রাচুর্যকে বোঝায়; কারণ তা কিছু কিছু গুণ প্রত্যাখ্যানেরই নামান্তর। বস্তুত, তার হাত কোনো ব্যাখ্যা ব্যতিরেকেই তার গুণ।” (আল-ফিক্হ আল-আকবর, পৃ. ৬)। কোরআনের দুর্বোধ্য ও দ্ব্যর্থক আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আবু হানিফা কোনো মন্তব্য না করে সেগুলোর বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়ার নীতি (তাফয়িদ) অনুসরণ করেন।
আল্লাহর সিংহাসন (আরশ) সম্পর্কিত কোরআনের উক্তি সম্পর্কে আবু হানিফা বলেন : একে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত বলে আক্ষরিক অর্থে বুঝলে চলবে না। আল্লাহ স্থানের স্রষ্টা হয়ে নিজেই সেই স্থানে অবস্থিত, একথা অচিন্তনীয়। স্থানসৃষ্টির আগে তিনি যেখানে ছিলেন, এখনও তিনি সেখানেই আছেন। আবু মুক্তি আল-বালকি নামক জনৈক শিষ্য তাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেন : “কেউ যদি আপনাকে মহান আল্লাহ কোথায়? এ প্রশ্ন করেন, তা হলে আপনি কী জবাব দেবেন?” উত্তরে ইমাম আবু হানিফা বলেছিলেন: “ঐ প্রশ্নকর্তাকে একথা বলা উচিত যে, জগৎসৃষ্টির আগে স্থান বলতে যখন কিছু ছিল না, তখন থেকেই আল্লাহ আছেন। ‘কোথায়’ (আয়না), কোনো সৃষ্টজীব এবং অন্য কোনোকিছুই যখন ছিল না, তখন থেকেই তিনি অস্তিত্বশীল। তিনি সবকিছুর স্রষ্টা।” (আল-ফিক্হ আল-আবসাত, পৃ. ৫৭)।
আল্লাহর বাণী ও কোরআন
আবু হানিফার মতে বাণী (কালাম) আল্লাহর অন্তঃসারের সঙ্গে যুক্ত একটি গুণ, এবং তা অন্যান্য ঐশী গুণের মতোই শাশ্বত। এই শাশ্বত বাণীর কল্যাণেই আল্লাহ কথা বলেন। (আল-ফিক্হ আল-আকবর, পৃ. ৫)। আল্লাহর কালাম ও কোরআনের সম্বন্ধ বিষয়ে তিনি বলেন: “কোরআন আল্লাহর অসৃষ্ট বাণী, একথা আমরা স্বীকার করি। তার কাছ থেকে আবির্ভূত ভাববিধুরতা বা প্রত্যাদেশ ‘তিনি’ নয়, আবার তার চেয়ে স্বতন্ত্র কিছু নয়, বরং তার এমন বাস্তব গুণ, যা অনুলিপিতে লিপিবদ্ধ, জিহ্বা দ্বারা উচ্চারিত এবং অন্তঃকরণে সংরক্ষিত। কালি, কাগজ, লিখন এ সবই সৃষ্ট। কারণ, এগুলো মানুষের কাজ। অন্যদিকে আল্লাহর বাণী অসৃষ্ট। লিখন, শব্দ, অক্ষর ও আয়াতসমূহ মানুষের প্রয়োজনের কারণে ব্যবহৃত কোরআনের প্রতীক (দালালত) মাত্র। আল্লাহর বাণী স্বয়ং অস্তিত্বশীল, এবং এর অর্থ বোঝা যায় এসব প্রতীকের মাধ্যমে। আল্লাহর বাণী সৃষ্ট—যে ব্যক্তি একথা বলে সে একজন অবিশ্বাসী। আল্লাহর বাণী যদিও লিখিত, উচ্চারিত এবং অন্তঃকরণে সংরক্ষিত, তবু তা কখনো তার অন্তঃসার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। (আল-ওয়াসিয়াহ, পৃ. ৪)।
আবু হানিফার এ মত একই বিষয়ে মুতাযিলা মতের বিরোধী। মুতাযিলারা আল্লাহর বাণীকে তার অন্তঃসারের সমার্থক বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং কোরআনকে সৃষ্ট বলে ঘোষণা করেন। অন্যদিকে গোঁড়া রক্ষণশীল মহল অভিমত দেয় যে, মানুষের কথার মতো আল্লাহর বাণী শব্দ ও ধ্বনির সমবায়ে গঠিত, এবং যে হরফে কোরআন লেখা হয়েছিল তা কোরআনের মতোই অনন্ত। কিন্তু আবু হানিফার মতে, আল্লাহর কালাম তার সত্তার সমার্থক নয়, কারণ তা হলে এর অর্থ হবে তার সত্তাকে জটিল বা মিশ্র বলে মনে করা এবং প্রকারান্তরে ঐশী সত্তায় বহুত্ব আরোপ করা। অন্যদিকে আবার আল্লাহর কালাম তার সত্তা থেকে স্বতন্ত্রও নয়; কারণ তা হলে বোঝা যাবে যে, কালক্রমে তিনি একটি নতুন গুণ অর্জন করেছিলেন এবং তিনি আগে যা ছিলেন না পরে তা হয়েছেন। এ ধারণা ঐশী স্বরূপে অপূর্ণতা ও পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। তা নিঃসন্দেহে উদ্ভট ও অগ্রণযোগ্য। সুতরাং ঐশীবাণী অবশ্যই শাশ্বত। আর কোরআন যেহেতু আল্লাহর বাণী হিসেবে সব মহলে স্বীকৃত, সেকারণে তা অবশ্যই অসৃষ্ট।
ইচ্ছার স্বাধীনতা
ইচ্ছার স্বাধীনতা ও পূর্বনিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের মধ্যে প্রচুর বাগ্বিতণ্ডা ও তর্কবিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা কাদরিয়া, জাবরিয়া, মুতাযিলা ও আশারিয়া প্রভৃতি মত আলোচনা করেছি। বিষয়টি নিয়ে ইমাম আবু হানিফার মত আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক। আবু হানিফার প্রধান লক্ষ্যই ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণবাদী ও পূর্বনিয়ন্ত্রণবাদীদের পরস্পরবিরোধী মতের সমন্বয়সাধন; এবং তা তিনি করার চেষ্টা করেছেন ঐশী শক্তি, ইচ্ছা ও নির্দেশাবলি ব্যাখ্যার আলোকে। তার মতে, বস্তুসৃষ্টির আগে এদের সম্পর্কে অনাদিকাল থেকে আল্লাহর জ্ঞান ছিল, এবং আল্লাহর ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত ও ডিক্রি প্রভৃতি সবই এই পূর্বজ্ঞানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সুতরাং শাশ্বত ডিক্রি কথাটি বর্ণনামূলক, সিদ্ধান্তমূলক নয়।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেন কিছু স্বভাবসিদ্ধ প্রবণতাসহ, তাদের প্রদান করলেন বুদ্ধি এবং তার প্রেরিতপুরুষ মারফত তাদের আদেশ করলেন বিশ্বাস করতে এবং অবিশ্বাসে বিরত থাকতে। এদিক থেকে আল্লাহর ধর্ম যথার্থই একটি স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম। কিন্তু এর পরও কিছু লোক বিচ্যুত হলো এই স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম থেকে, পরিহার করলো সত্যকে এবং গ্রহণ করলো অবিশ্বাসকে। এ অবিশ্বাস তাদের নিজেদেরই কাজ, স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা নির্বাচিত তাদেরই অর্জিত আচরণ। এই ইচ্ছা তাদের মধ্যে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন, তবে বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দিয়ে নয়, বরং তাদের নিজেদেরই ইচ্ছার প্রত্যুত্তরে। যারা তাদের স্বভাবপ্রসূত ইচ্ছার প্রতি আস্থাশীল রইলেন এবং সেইমতো আচরণ করলেন, তারাই পেলেন স্বর্গীয় সাহায্য ও অনুপ্রেরণা। আল্লাহ তার কোনো সৃষ্টজীবকে ধর্মহীন হতে যেমন বাধ্য করেননি, তেমনি আবার ধর্মপ্রাণ হতেও বাধ্য করেননি। আবার কাউকে তিনি বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী হিসেবে সৃষ্টি করেননি। তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন ব্যক্তি হিসেবে। এসব ব্যক্তির বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও কার্যকলাপ তাদের নিজেদেরই অর্জন। (আল-ফিক্হ আল-আকবর, পৃ ৭৮)
মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও আইনের ইতিহাসে ইমাম আবু হানিফা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। তার মতবাদ মুতাযিলা মুরজিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ে, এমনকি রক্ষণশীল মহলে বিপুল কৌতূহল ও প্রেরণা সৃষ্টি করে। ফলে এ নিয়ে অনেকেই গভীর অধ্যয়নে নিয়োজিত হন এবং তার মত স্পষ্টায়ন ও সম্প্রসারণে প্রয়াসী হন। ইমাম আবু হানিফার প্রখ্যাত ছাত্র ও শিষ্যগণ ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গুরুতর অধ্যয়নে নিয়োজিত হন এবং আব্বাসীয় শাসনামলে, এমনকি পরবর্তীকালে তার শিষ্যরাই আদালতের বিচারক ও আইন পরমর্শকের অধিকাংশ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। তবে আবু হানিফা নিজে এবং তার মতাবলম্বীরা আইন বিষয়ে এত বেশি আগ্রহী ছিলেন যে, অনুধ্যানিক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বিস্তৃত চিন্তাভাবনার সময় তাদের বড় একটা ছিল না। আর বিমূর্ত বিশুদ্ধ ধ্যান-অনুধ্যানে তাদের তেমন একটা আগ্রহ ছিল বলেও মনে হয় না। তাদের সময়, শক্তি ও মেধার বেশিরভাগ তারা নিয়োজিত করেন আইন অধ্যয়নে। তারা ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে গুরুতর আলোচনা ছেড়ে দেন অন্যান্য ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়সমূহের কাছে। এজন্যই দেখা যায় ইমাম আবু হানিফা আইনবিজ্ঞানে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন, সেই তুলনায় তার ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার পরিসর ও গুরুত্ব ছিল অকিঞ্চিৎকর ।
আল-তাহাবি
আবু জাফর আহমদ আল-তাহাবি (৮৫৩-৯৪৫) ইমাম আবু হানিফার অনুগামীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। মিশরে যেসব কৃতী আইনবিদের আবির্ভাব ঘটেছে, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম বলে স্বীকৃত। এ ছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবেও তিনি ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী। তাহাবি নামটি উদ্ভূত ‘তাহা’ নামক মিশরের একটি গ্রামের নাম থেকে। তার পূর্বপুরুষরা ইয়েমেন থেকে মিশরে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ক্রমশ মিশরের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষত তার পিতামহ সালামা ছিলেন মিশরের এক অতিপরিচিত বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
শৈশবে তাহাবি প্রথম শিক্ষালাভের সুযোগ পান তার মামা আবু ইব্রাহিম ইসমাঈল আল-মুজানির আশ্রয়ে ও তত্ত্বাবধানে। মুজানি ছিলেন ইমাম শাফির একজন বিশিষ্ট ছাত্র। তার লেখাপড়ার অগ্রগতিতে তার মামা অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি মামার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান এবং প্রথমে শাফি আইন এবং পরে হানাফি আইন অধ্যয়ন করে তিনি হানাফি আইনে শিক্ষাগ্রহণ করেন আবু জাফর বিন ইমরানের কাছে। ৮৮১/৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিরিয়ায় যান এবং হানাফি প্রধান কাজি আবু কাজম আবদুল হামিদ বিন জাফর ও অন্যান্য মনীষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
আগেই বলা হয়েছে, তাহাবি ছিলেন একজন বিখ্যাত আইনবিদ, এবং বৈধ চুক্তি প্রণয়ন কৌশলে দক্ষতার জন্য তিনি ছিলেন সব মহলের প্রশংসার পাত্র। কিন্তু হাদিস সাহিত্যেও তার অবদান অসামান্য। তার বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, তিনি আইনবিষয়ক হাদিস সংগ্রহের, বিভিন্ন বিরোধী হাদিসের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা ও সম্বন্বয়বিধানের এবং সেগুলো মূলায়নের একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তার রচনাবলিতে হাদিস থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি এবং সেগুলোর আইনি তাৎপর্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। (জীবনীকারগণ তার যেসব গ্রন্থের তালিকা দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মানিল আঘার (চার খণ্ড), ইখতিলাফ আল-ওলামা, আখাম আল-কোরআন ও মুখতাসার ফিল-ফিকহ।)
তিনি আইনসংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ বিষয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের ভাষ্যসংবলিত হাদিস এবং সেসব হাদিস সম্পর্কে মহানবীর সহচর, তাদের উত্তরসূরি ও অন্যান্য আইনবেত্তার অভিমত সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি এসব হাদিস বিশ্লেষণ করেন এবং প্রমাণাদির মাধ্যমে এদের কোন্গুলো খাঁটি, তা তুলে ধরেন। এভাবে তিনি তার সংগৃহীত হাদিসসমূহকে বিদ্বৎসমাজের কাছে হাজির করেন, যেন তারা সেগুলোর উপকারিতা বা অপকারিতা সম্পর্কে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সাধারণত হাদিসের যথার্থতা বিচারের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হতো ‘ইসনাদ’ (ভাষ্যকারদের অনুক্রম), এবং এজন্যই হাদিসের ‘মাতন’ (বিষয়বস্তু)-এর চেয়ে ইসনাদ পরীক্ষা করে দেখাই ছিল প্রচলিত রীতি। কিন্তু হাদিস পরীক্ষা করতে গিয়ে তাহাবি ইসনাদ ও মাতন উভয়টিকেই বিবেচনা করতেন। এ ছাড়া পরস্পরবিরোধী হাদিসের সমন্বয়ধর্মী ব্যাখ্যা দেয়াও ছিল তার আরো একটি লক্ষ্য।
ধর্মতত্ত্ব ও আইনবিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই তাহাবি ছিলেন ইমাম আবু হানিফার অনুসারী। ধর্মতত্ত্ববিষয়ক একটি গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও মোহাম্মদ আল-শায়বানিসহ প্রখ্যাত আইনবেত্তাদের অভিমতের আলোকেই তার নিজস্ব মত উপস্থাপিত করবেন বলে জানান। (আল-আকিদাত আল-তাহাবিয়াহ)। তাহারি পুরনো ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যাদির সমাধানে কোনো নতুন যুক্তির অবতারণা করেননি। আবু হানিফার মতের নতুন ব্যাখ্যা বা ভাষ্যপ্রদানেরও তিনি কোনো চেষ্টা করেননি। ইমামের মতাবলির সারসংক্ষেপ প্রদান এবং এসব মত যে পরম্পরাগত রক্ষণশীল মতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, প্রকারান্তরে তা নির্দেশ করাই ছিল তার লক্ষ্য।
ধর্মবিশ্বাস
আল-তাহাবি ছিলেন রক্ষণশীলপন্থী, এবং এজন্য ধর্মের মৌল বিশ্বাসের বিষয়াবলিকে তিনি কখনো বিচারশীল আলোচনার আওতায় আনার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই তার বক্তব্যে আলোচনার পদ্ধতি, তথ্যাবলির উৎস এবং জ্ঞানের বাহন কিংবা ভিত্তি সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। তার পদ্ধতিকে যথার্থই অভিহিত করা যায় বিচারবিযুক্তবাদী বা নির্বিচার বিশ্বাসের পদ্ধতি বলে। হাদিস বিশ্লেষণ ও পরীক্ষায় তিনি যে বিচারশীল। পদ্ধতির অনুশীলন করেন, ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে সেটিকে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যান বলে মনে হয়।
আবু হানিফার মতে জ্ঞান, বিশ্বাস ও স্বীকৃতি—এ তিনটি নিয়েই ধর্মবিশ্বাস গঠিত। কিন্তু তাহাবি তার ধর্মবিশ্বাসের ধারণায় জ্ঞানের কোনো স্থান রাখেননি। তার মতে, ধর্মবিশ্বাসের অধিষ্ঠান অন্তরে, আর এর প্রকাশ ঘটে জিহ্বার মাধ্যমে। তাহাবি মুসলিম ও মুমিনের প্রচলিত পার্থক্যের ওপর জোর দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। মানুষ কী করে মুসলমান বা মুমিন হতে পারে, তিনি তার ব্যাখ্যা দেন। তার মতে, যে ব্যক্তি কেবলাকে অনুসরণ করে তাকেই আমরা মুসলমান বা মুমিন বলে থাকি। রসুলুল্লাহ মানুষের জন্য যে বাণী নিয়ে এসেছিলেন এবং যা মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করেছেন তাতে যতক্ষণ আমরা আস্থাশীল থাকি, ততক্ষণই আমরা মুসলমান বা মুমিন। আল্লাহয় বিশ্বাস পাপীকে অনন্ত শাস্তি থেকে মুক্ত রাখতে পারে, আল্লাহ মানুষকে যে-কোনো সময় মাফ করে দিতে পারেন।
জ্ঞানকে ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত না করলেও তাহাবি বিশ্বাসের জ্ঞানীয় দিকটি সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। ইমাম আবু হানিফা মধ্যস্থতার ক্ষমতা ও অধিকারকে শুধু নবীদের মধ্যে, বিশেষত মহানবী মোহাম্মদ (স.)-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু তাহাবি এ অধিকারকে সম্প্রসারিত করেছেন সকল সৎ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান পর্যন্ত। বিশ্বাস ও বিশ্বাসীদের সমতা প্রসঙ্গে তাহাবি বলেন : বিশ্বাস এক ও অভিন্ন এবং বিশ্বাসীরা সমান মর্যাদার অধিকারী। তাদের তুলনামূলক খ্যাতি নিহিত আল্লাহর ভয় ও ন্যায়নিষ্ঠায়, লোভ মোহ প্রভৃতি পরিত্যাগে এবং সর্বোত্তম জীবন অনুশীলনে। বিশ্বাসী ব্যক্তিরা আল্লাহর বন্ধুস্বরূপ। আল্লাহর দৃষ্টিতে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত হলেন তারাই যাঁরা সবচেয়ে বেশি বাধ্য এবং যারা পবিত্র কোরআনের যথার্থ অনুসারী।
ঐশী গুণ ও দিব্যদর্শন
আল্লাহর অন্তঃসার ও গুণের পার্থক্য বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা মুতাযিলা, আশারিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। কিন্তু তাহাবি সেরকম বিস্তৃত আলোচনার অবতারণা করেননি এবং দুয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট পার্থক্য করেও দেখাননি। তবে তিনি আল্লাহর গুণাবলির অনাদিত্বের জোর সমর্থন করেন। তার মতে, জগৎসৃষ্টির আগে থেকেই আল্লাহ অনন্তকাল তার গুণাবলি নিয়ে ছিলেন এবং জগৎসৃষ্টির পর সেসব গুণে নতুন কিছুই সংযোজিত হয়নি। তিনি অনাদিকাল থেকে এসব গুণের অধিকারী এবং অনন্তকাল থেকেও এগুলোর অধিকারী।
আল্লাহয় যারা নরত্বারোপ করে, তাহাবি তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার মতে, যে ব্যক্তি আল্লাহয় মানবিক গুণ (মানি) আরোপ করে, সে একজন পৌত্তলিক। মহান আল্লাহ নিঃসন্দেহে এক ও অদ্বিতীয়, এবং অনন্যতা ও অনুপমতা তার গুণস্বরূপ। সৃষ্টির অন্য কোনো জীব তার এসব গুণের অধিকারী নয়, হতে পারে না। আল্লাহর কোনো সীমা নেই, শেষ নেই, উপাদান নেই, অঙ্গ-প্রতঙ্গ কিংবা হাতিয়ার নেই। এ বিষয়ে আবু হানিফাও মনে করতেন যে, আল্লাহ যেহেতু অনাদি ও অদেহধারী, সেজন্যই তাকে স্থান-কাল-দিক প্রভৃতির আলোকে চিন্তা করা যায় না। আল্লাহর সিংহাসন ও চেয়ারের বাস্তবতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন: আল্লাহ তার পবিত্র গ্রন্থে যেভাবে এগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে এদের বাস্তবতা সুস্পষ্ট। কিন্তু তিনি এই সিংহাসন কিংবা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য কোনোকিছুরই প্রয়োজন বোধ করেন না। সবকিছুই তার অন্তর্ভুক্ত, অথচ তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
ইমাম আবু হানিফা আল্লাহর দিব্যদর্শনের নরত্বারোপী ও রূপক ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, বিশ্বাসীরা আল্লাহকে দেখবেন তাদের দৈহিক চোখ দিয়ে; কিন্তু তাদের এই দর্শন স্থান দূরত্ব বর্ণনা প্রভৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। তাহাবিও এ মতের সমর্থন করেন এবং বলেন : দিব্যদর্শন নিতান্তই একটি বিশ্বাসের ব্যাপার। একে গ্রহণ করতে হবে নিঃসংশয়ে, বিনা ব্যাখ্যায় এবং কোনোরকম নরত্বারোপী ধারণা ব্যতিরেকে। আল্লাহর বাণী এবং কোরআন প্রসঙ্গে তর্কমূলক বা দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে তাহাবি অস্বীকৃতি জানান। তিনি শুধু একথা বলেন যে, আল্লাহর কালাম হিসেবে কোরআনের উৎপত্তি যে আল্লাহ থেকে, এ সত্য মেনে নিতেই হবে। এ সত্যকে গ্রহণ করতে হবে একটি অবর্ণনীয় বিষয় হিসেবে। কোরআন আল্লাহ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে; আর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা একে বিশ্বাস করেছে সেভাবে: এবং তারা নিশ্চিতভাবে জানে যে, এটি আল্লাহর পরম অকাট্য কালাম।
তথ্যসূত্র
- মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ওদর্শন, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯
Leave a Reply