মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব ও সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)

Table of Contents

মনোসমীক্ষণ-তত্ত্ব পরিচিতি

ভূমিকা

মনোবিজ্ঞানের মতবাদগুলোর মধ্যে মনোসমীক্ষণই সবচেয়ে বেশী পরিচিত ও প্রচারিত মতবাদ। বিশেষ করে মনোবিজ্ঞানী ছাড়া অন্যান্য শিক্ষিত লোকদের মধ্যে মনোসমীক্ষণ মতবাদ যত বেশী লোকে জানে, অন্য কোন মতবাদ তত বেশী লোকে জানে না। যদিও বহু সংখ্যক পেশাজীবী মনোবিজ্ঞানী মনোসমীক্ষণ মতবাদকে একটি প্রণালীবদ্ধ মতবাদ হিসাবে বর্জন করেছেন, তবু বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মধ্যে এ মতবাদ খুব জনপ্রিয়। তাছাড়া মানুষের যৌনজীবন সম্পর্কে নতুন দিক উন্মোচিত করার দরুণ এ মতবাদ সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। অতি সাম্প্রতিক কালে অনেক বিরুদ্ধবাদীও আবার মনোসমীক্ষণ মতবাদের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

ফ্রয়েড নামে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা নগরের একজন মনোচিকিৎসক প্রথম মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের অবতারণা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর সূচনা কাল পর্যন্ত তিনি তার এই অভিনব তত্ত্বের রূপরেখা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেছেন। ডারউইন যেমন মানুষকে ইতর প্রাণীর বংশধর রূপে চিহ্নিত করে মানুষের মান মর্যাদার হানি ঘটিয়েছেন, ফ্রয়েডও তেমনি তার তত্ত্বে মানুষের হেয় পশুত্বের দিকটিকে উদ্ঘাটিত করে মানুষের আত্মশ্লাঘায় চরম আঘাত হেনেছেন। ফলে উভয় মনীষীই পণ্ডিত সমাজে বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন এবং তাদের তত্ত্ব সমস্ত জগত জুড়ে মানুষের মনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ যেমন জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বও ঠিক তেমনি সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় প্রভাব বিস্তার করেছে। মানব প্রকৃতি সংক্রান্ত ফ্রয়েডের অভিনব তত্ত্ব শুধু তার সমসাময়িককালের চিন্তাধারাকেই নয়, তার পরবর্তীকালের চিন্তাধারাকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে। এমন কি যারা ফ্রয়েডের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তারাও ফ্রয়েডের তত্ত্বের দ্বারা উদ্দীপিত হয়েই তাদের স্বকীয় ধ্যান ধারণায় উপনীত হয়েছেন। মনোসমীক্ষণ মতবাদ সম্পর্কে প্রচুর লেখা হয়েছে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নিজের রচনাই ২৪ খন্ডে সংকলিত হয়েছে। মনোসমীক্ষণ মতবাদের কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে।

নিউরোসিস, সাইকোসিস, হিস্টিরিয়া ও স্কিজোফ্রেনিয়া

আলোচনার শুরুতেই নিউরোসিস, সাইকোসিস, হিস্টিরিয়া ও স্কিজোফ্রেনিয়া বলতে কী বোঝায় সেই ব্যাপারে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

নিউরোসিস (Neurosis)

নিউরোসিস (neurosis) শব্দটি প্রধানত ফ্রয়েডীয় চিন্তার (Freudian thinking) অনুসারীদের দ্বারা ব্যবহার করা হয়, যা অতীতের উদ্বেগ দ্বারা সৃষ্ট মানসিক ব্যাধিগুলিকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যেগুলোকে প্রায়ই অবদমিত রাখা চেপে রাখা হয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে, শব্দটি সাধারণভাবে উদ্বেগ-সম্পর্কিত অবস্থা বা এনজাইটি-রিলেটেড কন্ডিশনসমূহকে (anxiety-related conditions) উল্লেখ করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) আন্তর্জাতিক রোগ শ্রেণীবিভাগ (International Classification of Diseases, ICD) বা আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের (American Psychiatric Association) ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, DSM)-এ কন্ডিশন বা বিকৃতির নাম বা বিভাগগুলিতে “নিউরোসিস” শব্দটি আর ব্যবহৃত হয় না। আমেরিকান হেরিটেজ মেডিকেল ডিকশনারি (American Heritage Medical Dictionary) ২০০৭ অনুসারে, এই শব্দটি “আর মানসিক রোগের নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় না।”

নিউরোসিসকে সাইকোসিস (psychosis) থেকে পৃথক করা হয়, যেখানে সাইকোসিস দ্বারা বাস্তবতার সাথে সংযোগ হারানোর দিকে ইঙ্গিত করে। এর উৎপত্তিক শব্দ, নিউরোটিসিজম (neuroticism), উদ্বিগ্নতা এবং মানসিক ভাঙনের প্রবণতা প্রকাশকারী একটি ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। নিউরোটিসিজম শব্দটি আর DSM বা ICD অবস্থার জন্য ব্যবহৃত হয় না; তবে এটি বিগ ফাইভ ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য বা পারসোনালিটি ট্রেইটসমূহের (Big Five personality traits) মধ্যে একটি সাধারণ নাম। অনুরূপ একটি ধারণা আইসিডি-১১ (ICD-11) এ “নেগেটিভ অ্যাফেকটিভিটি” (negative affectivity) কন্ডিশন হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সাইকোসিস (Psychosis)

সাইকোসিস (psychosis) হলো মনের একটি অবস্থা যা বাস্তব এবং অবাস্তবের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে অসুবিধা তৈরি করে। এর উপসর্গগুলোর মধ্যে বিভ্রম (delusions) এবং অলীক প্রত্যক্ষণ বা হেলুসিনেশন (hallucinations) অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এছাড়াও, অসংলগ্ন বক্তৃতা এবং পরিস্থিতির সাথে বেমানান আচরণও এর লক্ষণ হতে পারে। এছাড়া, ঘুমের সমস্যা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অনুপ্রেরণার অভাব এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধা দেখা দিতে পারে। সাইকোসিস গুরুতর প্রতিকূল ফলাফল আনতে পারে।

সাইকোসিসের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন:

প্রসূতিপর সাইকোসিস (postpartum psychosis) নামে এক ধরনের সাইকোসিস সন্তান জন্মদানের পর দেখা দিতে পারে।

ডোপামিন (dopamine) নামক নিউরোট্রান্সমিটারটি সাইকোসিসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়। তীব্র সাইকোসিসকে প্রাথমিক (primary) বলা হয় যখন এটি মানসিক অবস্থার ফলাফল হিসেবে দেখা দেয় এবং গৌণ (secondary) বলা হয় যখন এটি অন্য কোনো শারীরিক অবস্থা বা মাদকের কারণে ঘটে। মানসিক স্বাস্থ্য শর্তের নির্ণয় করার সময় অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম রোগ, টক্সিন, বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পরীক্ষা করা হতে পারে।

সাইকোসিসের চিকিৎসায় এন্টিসাইকোটিক ওষুধ (antipsychotic medication), মনোচিকিৎসা (psychotherapy), এবং সামাজিক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসা ভালো ফলাফল দিতে পারে। ওষুধগুলো সাধারণত মাঝারি প্রভাব ফেলে। ফলাফল নির্ভর করে অন্তর্নিহিত কারণের উপর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩% মানুষ তাদের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সাইকোসিসের শিকার হয়। এই অবস্থাটি কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে হিপোক্রেটিস (Hippocrates) দ্বারা এবং সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে মিশরীয় ইবার্স প্যাপিরাসে (Ebers Papyrus) বর্ণনা করা হয়েছে।

স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)

স্কিজোফ্রেনিয়া (schizophrenia) একটি মানসিক রোগ যা পুনরাবৃত্ত সাইকোসিসের (psychosis) পর্বগুলির মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয় এবং বাস্তবতার সাধারণ ভুল ধারণার (misperception of reality) সাথে সম্পর্কিত। অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে অলীক প্রত্যক্ষণ বা হেলুসিনেশন (hallucinations) (সাধারণত কণ্ঠ শোনা), বিভ্রম (delusions) (যেমন, প্যারানয়া বা ভ্রান্ত বিশ্বাস), বিশৃঙ্খল চিন্তা এবং আচরণ (disorganized thinking and behavior), এবং ফ্ল্যাট বা অযথাযোগ্য আবেগ (flat or inappropriate affect) অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং সাধারণত তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় শুরু হয় এবং কখনও সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয় না। স্কিজোফ্রেনিয়ার নির্ণয়ের জন্য কোনো বস্তুগত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই; নির্ণয়টি পর্যবেক্ষিত আচরণ, ব্যক্তির মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস এবং পরিচিতদের প্রতিবেদনগুলির উপর ভিত্তি করে করা হয়। স্কিজোফ্রেনিয়ার নির্ণয়ের জন্য DSM-5 অনুযায়ী বর্ণিত লক্ষণগুলি অন্তত ছয় মাস এবং ICD-11 অনুযায়ী এক মাস ধরে উপস্থিত থাকতে হবে। অনেক স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর অন্যান্য মানসিক রোগ যেমন হতাশা (depressive disorders), উদ্বেগজনিত ব্যাধি (anxiety disorders), এবং অবসেসিভ–কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (obsessive–compulsive disorder) থাকে।

প্রায় ০.৩% থেকে ০.৭% মানুষ তাদের জীবদ্দশায় স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। ২০১৭ সালে, আনুমানিক ১.১ মিলিয়ন নতুন রোগী ছিল এবং ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মোট ২৪ মিলিয়ন রোগী ছিল। পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয় এবং গড়ে নারীদের চেয়ে আগে রোগের সূচনা ঘটে। স্কিজোফ্রেনিয়ার কারণগুলির মধ্যে জিনগত (genetic) এবং পরিবেশগত (environmental) কারণ থাকতে পারে। জিনগত কারণগুলির মধ্যে বিভিন্ন সাধারণ এবং বিরল জিনগত বৈচিত্র্য অন্তর্ভুক্ত। সম্ভাব্য পরিবেশগত কারণগুলির মধ্যে শহরে বড় হওয়া, শৈশবের প্রতিকূলতা, কৈশোরে গাঁজা সেবনের (cannabis use) সময়কাল, সংক্রমণ, মায়ের বা বাবার বয়স, এবং গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকের দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় এবং তারা পুনরায় আক্রান্ত হয় না, এবং এদের মধ্যে একটি ছোট অংশ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্য অর্ধেকের আজীবন প্রভাব থাকে। গুরুতর ক্ষেত্রে, মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্ব, দারিদ্র্য, গৃহহীনতা, শোষণ এবং শিকার হওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা সাধারণত স্কিজোফ্রেনিয়ার সাথে সম্পর্কিত। সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আত্মহত্যার হার (প্রায় ৫% মোট) এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি, যা গড়ে ২০ থেকে ২৮ বছরের আয়ুষ্কাল হ্রাস করে। ২০১৫ সালে, আনুমানিক ১৭,০০০ মৃত্যুর সাথে স্কিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কিত ছিল।

স্কিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার মূল উপাদান হলো এন্টিসাইকোটিক ওষুধ (antipsychotic medication), যেমন ওলানজাপিন (olanzapine) এবং রিসপেরিডোন (risperidone), পাশাপাশি কাউন্সেলিং, চাকরির প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক পুনর্বাসন। এক-তৃতীয়াংশ লোক প্রাথমিক এন্টিসাইকোটিকগুলির জন্য সাড়া দেয় না, এই ক্ষেত্রে ক্লোজাপিন (clozapine) মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন দ্বারা চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত। একটি নেটওয়ার্ক তুলনামূলক মেটা-বিশ্লেষণে ১৫টি এন্টিসাইকোটিক ওষুধের মধ্যে, ক্লোজাপিন সব অন্যান্য ওষুধের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর ছিল, যদিও ক্লোজাপিনের ব্যাপক বহুমুখী কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যেখানে ডাক্তাররা নিজের বা অন্যদের ক্ষতির ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন, সেখানে তারা স্বল্পকালীন অনৈচ্ছিক হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদী হাসপাতালে ভর্তি সামান্য সংখ্যক গুরুতর স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর জন্য ব্যবহার করা হয়। কিছু দেশে যেখানে সমর্থনমূলক সেবা সীমিত বা অনুপলব্ধ, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী হাসপাতালে অবস্থান বেশি সাধারণ।

হিস্টিরিয়া (Hysteria)

হিস্টিরিয়া (hysteria) এমন একটি পরিভাষা যা নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের মাত্রাতিরিক্ততার (ungovernable emotional excess) বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় এবং এটি মনের বা আবেগের একটি সাময়িক অবস্থাকে বোঝাতে পারে। উনিশ শতকে নারীর হিস্টিরিয়াকে নারীদের মধ্যে নির্ণয়যোগ্য শারীরিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনুমান করা হয় যে এই নির্ণয়ের ভিত্তি এমন বিশ্বাসের ওপর কাজ করেছিল যে, নারীরা মানসিক এবং আচরণগত অবস্থার প্রতি পূর্বনির্ধারিত; যা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় লিঙ্গ-সম্পর্কিত পার্থক্যের একটি ব্যাখ্যা।

বিশ শতকে এটি মানসিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি, যেমন সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) এবং জ্যঁ-মার্টিন শারকোট (Jean-Martin Charcot) হিস্টিরিয়া রোগীদের উপর গবেষণায় মনোনিবেশ করেছিলেন।

বর্তমানে বেশিরভাগ চিকিৎসক হিস্টিরিয়াকে একটি চিকিৎসাগত নির্ণয় হিসেবে গ্রহণ করেন না। হিস্টিরিয়ার সাধারণ নির্ণয়টি বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন চিকিৎসাগত বিভাগ যেমন: মৃগী (epilepsy), নাটকীয় ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Histrionic personality disorder), কনভার্শন ডিসঅর্ডার (conversion disorders), ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার (dissociative disorders), বা অন্যান্য চিকিৎসাগত অবস্থার মধ্যে স্থান পেয়েছে।

অতিরিক্তভাবে, বিয়ে না করার মত জীবনধারার পছন্দগুলিকে আর হিস্টিরিয়া এর মতো মানসিক ব্যাধির লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

মনোসমীক্ষণ

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। ফ্রয়েড প্রণীত তত্ত্বের নাম মনোসমীক্ষণ (psycho-analysis)। মনোসমীক্ষণ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মনের বিশ্লেষণ। মানুষের আচার আচরণের পেছনে চালিকা শক্তি রূপে যে প্রেষণা কাজ করে, সেটাকে উদ্ঘাটন করার জন্য তিনি বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে মানব মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করেছেন এবং গভীর স্তরের বিষয়সমূহ বিশ্লেষণ করে ব্যক্তির সামনে তুলে ধরেছেন। সেজন্যই তিনি তার তত্ত্বকে “মনোসমীক্ষণ” নামে আখ্যায়িত করেছেন। মনোসমীক্ষণ কথাটি সাধারণতঃ দুটো অর্থে ব্যবহৃত হয় –

  • প্রথমতঃ মানব প্রকৃতি সম্পর্কে ফ্রয়েড যে তত্ত্ব দিয়েছেন, সেই তত্ত্বকে মনোসমীক্ষণ বলা হয়। উল্লেখ্য যে মানুষের চেতনার স্তর, ব্যক্তিত্বের কাঠামো, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, উদ্বেগ ও নিউরোসিস, স্বপ্ন ব্যাখ্যা, আত্মরক্ষামূলক কৌশল প্রভৃতি সম্পর্কে ফ্রয়েড একটি অত্যন্ত সুসংবদ্ধ তত্ত্ব দিয়েছেন। তার প্রদত্ত তত্ত্বকে মনোসমীক্ষণ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
  • দ্বিতীয়তঃ মানসিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য ফ্রয়েডের ব্যবহৃত পদ্ধতিকেও মনোসমীক্ষণ বলা হয়। অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি, স্বপ্ন ব্যাখ্যা, প্রতিরোধ বিশ্লেষণ, অভিসঞ্চালন বিশ্লেষণ, প্রভৃতি কৌশল প্রয়োগ করে ফ্রয়েড মানসিক গোলযোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করেছেন।

মূলতঃ মানসিক রোগের, বিশেষ করে হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা করতে গিয়েই ফ্রয়েড বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করেছেন এবং গভীর মনের যে রহস্য তিনি উদ্ঘটন করেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই তিনি মানব প্রকৃতি সম্পর্কে তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব প্রণয়ন করেছেন। যেহেতু মানুষের আচার আচরণ ব্যাখ্যার জন্য তিনি মানুষের মনের গভীর স্তর বিশ্লেষণ করেন, সেহেতু তার এই মতবাদকে “গভীর স্তরীয় মনোবিজ্ঞান” (Depth Psychology) নামে আখ্যায়িত করা হয়।

মনোসমীক্ষণের পূর্বগামী প্রভাব, পথিকৃৎ, প্রতিষ্ঠাতা ও বিকাশ সাধনকারীগণ

পূর্বগামী প্রভাব সমূহ:

  • জি, ডব্লু, লিবনিজ (GW Leibniz. 1646-1715)
  • গ্যেয়টে (Johann Wolfgang Goethe, 1749-1832)
  • গাস্তাভ থিওডোর ফেকনার (Gustav Theodore Fechner. 1801- 1887)
  • চার্লস ডারউইন (Charles Darwin, 1809-1882)

পথিকৃৎ:

  • জোহান ফ্রেডরিখ হার্বাট (Johann Friedrich Herbart. 1776-1841)
  • আর্থার শোপেনহাওয়ার (Arthur Schopenhauer. 1788-1860)
  • জী মার্টিন সার্কো (Jean Martin Charcot. 1825-1893)
  • জোসেফ ব্রয়ার (Joseph Breuer, 1842-1925)

প্রতিষ্ঠাতা:

  • সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud, 1856-1939)

বিকাশ সাধনকারী:

  • আলফ্রেড এডলার (Alfred Adler, 1870-1937)
  • সি, জি ইয়ুং (C G. Jung, 1875-1961)
  • স্যান্ডর ফেরেজি (Sandor Ferenczi. 1873-19331
  • অটো র‍্যাঙ্ক (Oto Rank, 1884-1939)
  • ক্যারেণ হর্নি (Karen Horney. 1885-1952)
  • হ্যারি, এস, সুলিভান (Harry S. Sullivan, 1892-1949)
  • এরিখ ফ্রম (Erich Fromm, 1900-)

উৎস: Marx and Hillix. 1973. Page 241.

মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের ঐতিহাসিক পটভূমি

মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের প্রবর্তক সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud-১৮৫৬-১৯৩৯) একজন বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা ফ্রয়েডের মন মানসিকতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। শক্তির নিত্যতা সংক্রান্ত পদার্থবিদ্যার ধারণা, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞানের অগ্রগতি, লজিক্যাল পজিটিভিজমের ধারণা ফ্রয়েডের মননশক্তি ও চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ ও শাণিত করে তুলেছে। কিন্তু সমসাময়িক এই প্রভাবসমূহ ছাড়াও অতীতের কিছু ঘটনা প্রবাহ ও ধ্যান ধারণা ফ্রয়েডের তত্ত্ব সৃষ্টির মূলে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রূপে কাজ করেছে। মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের মূল উৎস জানার জন্য সেই অতীত ইতিহাসের ওপর কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন।

মনোসমীক্ষণ একটি মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব রূপে মনোবিজ্ঞনের, বিশেষ করে অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের, একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেও, এর বিকাশ কিন্তু মনোবিজ্ঞান থেকে ঘটেনি। এর উৎপত্তি ঘটেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শাখা সাইকিয়াট্রি (Psychiatry) বা মনোরোগবিদ্যা থেকে। মনোরোগের চিকিৎসা প্রচেষ্টা সেই প্রাচীন কাল থেকে পরিলক্ষিত হলেও মনোরোগের প্রকৃত বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা প্রক্রিয়ার উন্মেষ ঘটেছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। মনোরোগের চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে শাখার উৎপত্তি হয়েছে, সেটাকেই সাইকিয়াট্রি বলা হয়। যেহেতু সাইকিয়াট্রিস্টরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, সেহেতু তারা মনোরোগকে শারীরবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থাৎ দেহের ত্রুটি বিচ্যুতি ও গোলযোগ থেকেই মনোরোগের উৎপত্তি হয় বলে তারা মনে করতেন। মনোরোগ সংক্রান্ত এই দেহভিত্তিক ব্যাখ্যাকেই দেহতাত্ত্বিক মতবাদ (somatogenic viewpoint) বলা হয়। চিকিৎসক মহলে প্রথম দিকে দেহতাত্ত্বিক মতবাদ প্রাধান্য বিস্তার করলেও অধিকাংশ মনোরোগেরই দৈহিক কোন কারণ সে সময়ে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কিছু কিছু মনোচিকিৎসক মনোরোগের মনোস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মনোরোগের এই মনো-ভিত্তিক ব্যাখ্যাকেই মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ (psychogenic viewpoint) বলা হয়। এই মনস্তাত্ত্বিক মতবাদের বিকাশ তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালে ঘটেছে। উল্লেখ্য যে, এই মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের সাথে জড়িত হয়েই মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে।

হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসাকে কেন্দ্র করেই চিকিৎসক মহলে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে। এই হিস্টিরিয়া রোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে অনেক বিজ্ঞানীর বহু প্রচেষ্টা জড়িত রয়েছে। ফলে এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। প্রাচীন কাল থেকেই হিস্টিরিয়া রোগটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। তবে এ রোগের যথার্থ প্রকৃতি ও কারণ দীর্ঘকাল মানুষের কাছে অজ্ঞাত থেকে গিয়েছে। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে হিপোক্র্যাটস এ রোগটিকে শনাক্ত করে প্রথম এর নামকরণ করেন হিস্টিরিয়া (hysteria)। Hysteria শব্দটি গ্রীক hystero শব্দ থেকে এসেছে। Hystero শব্দের অর্থ হচ্ছে জরায়ু। হিপোক্র্যাটসের ধারণা অনুযায়ী মেয়েদের সন্তান কামনা ব্যর্থ হলেই তার জরায়ু স্থানচ্যুত হয়ে দেহের যে অংশে স্থানান্তরিত হয়, দেহের সেই অংশ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময় থেকেই হিস্টিরিয়াকে একটি দৈহিক রোগ রূপে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকরা দীর্ঘকাল এ রোগের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করতে ও এর কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হন এবং এ রোগ ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রহস্যাবৃত থেকে যায়।

হিস্টিরিয়া রোগের প্রথম সাফল্যজনক চিকিৎসার সাথে যে চিকিৎসকের নাম জড়িত রয়েছে, তাকে ইতিহাসে একজন কুখ্যাত ব্যক্তি রূপে গণ্য করা হয়। তার নাম এন্টনি মেসমার (Antony Mesmer, ১৭৩৪- ১৮১৫খৃঃ)। মেসমার ১৭৭৬ খৃস্টাব্দে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রী লাভ করেন। রোগের কারণ সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পোষণ করতেন, সেটাকে “জৈব চুম্বক তত্ত্ব” (Animal magnetism) নামে আখ্যায়িত করা হয়। তার মতে সমস্ত বিশ্ব চরাচর চুম্বক শক্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে এবং প্রাণীর অভ্যন্তরেও চুম্বক শক্তি রয়েছে। প্রাণীদেহের চুম্বক শক্তি কোন কারণে হ্রাসপ্রাপ্ত হ’লেই প্রাণীর অভ্যন্তরীণ চুম্বক শক্তি ও বহির্বিশ্বের চুম্বক শক্তির মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং তখন প্রাণীদেহে নানারূপ রোগের উৎপত্তি হয়। এরূপ অবস্থায় চিকিৎসক যদি রোগীর দেহে অতিরিক্ত চুম্বক শক্তি সঞ্চারিত করতে পারেন, তাহলেই রোগী রোগমুক্ত হবে বলে তিনি মনে করতেন। এই ধারণা অনুযায়ী মেসমার ভিয়েনায় তার চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করলেও তার চিকিৎসা পদ্ধতি সেখানে ফলপ্রসূ হয়নি। অতঃপর তিনি ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের আমন্ত্রণক্রমে ১৭৭৮ খৃস্টাব্দে প্যারিস গমন করেন এবং সেখানে চিকিৎসক রূপে তিনি অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন।

তার চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল এরকম – নানাবিধ রাসায়নিক তরল পদার্থে পরিপূর্ণ একটি বিরাট গামলার চারপাশ ঘিরে অনেক রোগী একটা ঘরে বসে থাকত। অনেকগুলো লৌহদণ্ডের এক প্রান্ত গামলার রাসায়নিক দ্রব্যে নিমজ্জিত থাকত এবং অপর প্রান্ত বাইরে বেরিয়ে থাকত। লৌহদণ্ডের বাইরে বেরিয়ে থাকা প্রান্তের সাথে রোগীরা নিজ নিজ অসুস্থ অঙ্গ স্পর্শ করিয়ে রাখত। অতঃপর মেসমার যাদুকরের বেশে ঘরে প্রবেশ করতেন এবং তার যাদুদণ্ড অথবা হাত দিয়ে প্রতিটি রোগীকে তিনি স্পর্শ করতেন ও ঘোষনা করতেন যে তার রোগ সেরে গিয়েছে। সাধারণ এই প্রক্রিয়া প্রয়োগের ফলেই দেখা গেল যে হিস্টিরিয়ার বহু রোগী আশ্চর্যজনকভাবে রোগমুক্ত হয়ে গিয়েছে। মেসমার তার ‘জৈবচুম্বক তত্ত্ব’ অনুযায়ী তার এই অসামান্য সাফল্যকে ব্যাখ্যা করলেন। অর্থাৎ তিনি রোগীর দেহে স্পর্শের মাধ্যমে অতিরিক্ত চুম্বক শক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন বলেই রোগী রোগমুক্ত হয়েছে বলে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তার প্রদত্ত এই ব্যাখ্যা প্যারিসের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী মহলে তীব্র সমালোচনা ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে। ফলে মেসমারের কর্যকলাপ পরীক্ষা করার জন্য রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের আদেশক্রমে ১৭৮৪ খৃস্টাব্দে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের রিপোর্টে মেসমারের কর্যকলাপকে সম্পূর্ণ ভুয়া ও প্রতারণামূলক বলে রায় দেয়া হয় এবং মেসমারকে প্রতারক সাব্যস্ত করা হয়। কমিশনের এই বিরূপ রায়ের জন্য মেসমার গোপনে প্যারিস ত্যাগ করেন এবং এরপর ইতিহাসে তার আর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।

মেসমারের চিকিৎসা পদ্ধতি (ইতিহাসে মেসমেরিজম নামে পরিচিত) কুখ্যাতি অর্জন করলেও তার চিকিৎসায় যে রোগীরা রোগমুক্ত হযেছে, তা তদন্ত কমিশনও অস্বীকার করতে পারেনি। ফলে এই বিষয়টি বিজ্ঞানী মহলে একটি রহস্য হয়ে থেকে যায়। দীর্ঘকাল পর ইংল্যান্ডের সাইকিয়াট্রিস্ট জেমস ব্রেইড (James Braid) এই রহস্যের আবরণ উন্মোচন করেন। ১৮৪২ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত “The Rational of Nervous Sleep” নামক পুস্তকে তিনি মেসমেরিজমকে এক ধরনের তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা বলে ব্যাখ্যা করেন। দীর্ঘক্ষণ অনুভূতি ও মনোযোগের একাগ্রতার ফলে যে পেশীগত ক্লান্তি ও দৈহিক অবসাদের সৃষ্টি হয়, তা থেকেই এরূপ তন্দ্রচ্ছন্ন অবস্থার উৎপত্তি ঘটে। এই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় চিকিৎসক যে নির্দেশ, উপদেশ বা অভিভাবন (suggestion) প্রদান করেন, তা রোগীর ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং রোগীর দেহ ও মনে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এই অভিভাবনের ফলেই হিস্টিরিয়ার রোগীদের দৈহিক গোলযোগ অপসারিত হয়। জেমস ব্রেইড এই অবস্থার নতুন নামকরণ করেন সংবেশন বা hypnosis (গ্রীক ঘুমের দেবতা Hypnos এর নামানুসারে তিনি এই নামকরণ করেছেন)।

হিস্টিরিয়া রোগ চিকিৎসার জন্য হিপনোসিস বা সংবেশন পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে শারকো (Charcot, ১৮২৫-১৮৯৩) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৮৬২ খৃস্টাব্দে ফ্রান্সের সালপিয়াট্রে হাসপাতালের দায়িত্ব পেয়েই শারকো হিস্টিরিয়া রোগীদের ওপর ব্যাপক অনুসন্ধান চালান এবং তিনিই প্রথম হিস্টিরিয়া রোগের বহুবিধ শারীরিক লক্ষণগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে শ্রেণীবদ্ধ ও লিপিবদ্ধ করেন। তিনিই প্রথম দেখান যে হিস্টিরিয়া রোগে সংবেদনহীন অঙ্গের প্রতিবর্ত ক্রিয়া (reflex action) অক্ষুণ্ণ থাকে বা ঘুমন্ত অবস্থায় রোগীর পঙ্গু অঙ্গ স্বাভাবিকভাবে সঞ্চালিত হয়। তিনি হিস্টিরিয়া ও হিপনোসিসের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন যে, সংশেনমূলক অভিভাবন (hypnotic suggestion বা সংবেশিত অবস্থায় প্রদত্ত অভিভাবন) দিয়ে হিস্টিরিয়া রোগের লক্ষণ যেমন দূর করা যায়, তেমনি আবার অভিভাবনের মাধ্যমে রোগীর মধ্যে নতুন নতুন লক্ষণ সৃষ্টি করাও যায়। ফলে তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেন যে হিপনোসিস ও হিস্টিরিয়া একই কারণে সংঘটিত একই ধরনের ব্যাপার। তবে এ বিষয়ে তিনি দেহতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। স্নায়ুতন্ত্রের দুর্বলতা ও শারীরিক প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের অভাবের জন্যই হিস্টিরিয়া রোগ ও সম্মোহিত অবস্থা (hypnotic state) এর সৃষ্টি হয় বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। তার এ ধারণা যে ভুল ছিল, তা অবশ্য অচিরেই প্রমাণিত হয়।

ঐ সময়েই ফ্রান্সের ন্যান্সী নামক স্থানে চিকিৎসক লাইবল্ট (Liebeault ১৮২৩- ১৯০৪) ও অধ্যাপক বার্নহেইম (Bernheim ১৮৪০-১৯১৯) একত্রে হিপনোসিস ও হিস্টিরিয়ার ওপর গবেষণা করছিলেন। তারা অভিমত প্রকাশ করেন যে হিস্টিরিয়া ও হিপনোসিস পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ঘটনা এবং উভয় ঘটনাই অভিভাবন (suggestion) এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়। তাদের গবেষণায় তারা দেখান যে একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক ব্যক্তিকেও অভিভাবন দিয়ে সংবেশিত করা যায় এবং সংবেশিত অবস্থায় অভিভাবন দিয়ে তাদের মধ্যে হিস্টিরিয়া রোগের লক্ষণগুলো সৃষ্টি করা যায়। আবার বিপরীত অভিভাবন দিয়ে এই কৃত্রিম লক্ষণগুলো দূর করাও যায়। তাদের গবেষণার মাধ্যমে তারা উপলব্ধি করেন যে হিস্টিরিয়া রোগটিই একটি সংবেশিত বা মোহচ্ছন্ন অবস্থা এবং এই মোহচ্ছন্ন অবস্থায় রোগী নিজেই নিজেকে অভিভাবন দিয়ে তার রোগ সৃষ্টি করে। সেজন্যই তারা হিস্টিরিয়াকে এক ধরনের আত্ম-সংবেশন (self-hypnosis) বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের এই অভিমতকে ইতিহাসে ন্যান্সী মতবাদ (Nancy viewpoint) রূপে আখ্যায়িত করা হয়। অভিভাবনের মত মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় যে শারীরিক লক্ষণযুক্ত হিস্টিরিয়া রোগের উৎপত্তি হয়, তা ন্যান্সী মতবাদ দ্বারাই প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শারকো প্রথমে এই মতের বিরোধিতা করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি তার ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং হিস্টিরিয়া রোগের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। শারকোর মত একজন প্রগতিশীল বিজ্ঞানী যে হিপনোসিস নিয়ে কাজ করেছেন এবং মনোরোগের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন, সেটাই ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রূপে পরিগণিত হয়েছে।

শারকোর দুজন স্বনামধন্য শিষ্য হচ্ছেন পিয়ারে জ্যানে (P. Janet ১৮৫৯-১৯৪১) ও সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud ১৮৫৬-১৯৩৯)। এরা উভয়েই শারকোর শিষ্য হলেও এরা কেউই শারকোর অনুসারী ছিলেন না। এরা উভয়েই তাদের চিন্তাধারায় মৌলিক স্বকীয়তা প্রদর্শন করেছেন। পিয়ারে জ্যানে মনোরোগ, বিশেষ করে বিচ্ছিন্নতামূলক গোলযোগ, ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তবে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের ওপর জ্যানের কোন প্রভাব ছিল না। ফ্রয়েড সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছেন।

১৮৮৩ খৃস্টাব্দে ফ্রয়েড ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রী লাভ করেন। কয়েক বছর তিনি হাসপাতালে ও একটি গবেষণাগারে কাজ করেছেন। তারপর ১৮৮৫ খৃস্টাব্দে তিনি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ রূপে ভিয়েনায় চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন। ঐ সময়েই তিনি একটি বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যান এবং হিপনোসিস ও হিস্টিরিয়া সম্পর্কে শারকোর অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ভিয়েনায় ফিরে আসেন। ভিয়েনায় কাজ করার সময় তিনি যোসেফ ব্রয়ার (J. Breuer) নামে এক প্রবীণ চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসেন। ব্রয়ার তখন এক অভিনব পন্থায় হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা করছিলেন। তিনি রোগীকে সংবেশিত করে তার মনের দুঃখ কষ্টের কথা বর্ণনা করতে বলতেন। সংবেশিত অবস্থায় রোগী তার রোগের সাথে জড়িত ও অবদমিত আবেগ অনুভূতি স্মরণ করতে ও বর্ণনা করতে পারে। আবেগের এই নিষ্ক্রমণের ফলে রোগীর মন কিছুটা হালকা হয় এবং তার রোগের লক্ষণ অপসারিত হয়। ব্রয়ারের এই পদ্ধতিকে “অভিস্ফোট” (abbreaction) বা “কথায় ব্যক্তকরণ পদ্ধতি” (talking out method) নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ফ্রয়েড কিছুদিন ব্রয়ারের সাথে একযোগে কাজ করেন।

শারকোর কাছে প্রশিক্ষণ লাভের সময়েই ফ্রয়েড ন্যান্সী মতবাদ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। বার্নহেইম ও লাইবল্টের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের জন্য ফ্রয়েড ১৮৮৯ খৃস্টাব্দে পুনরায় ফ্রান্সের ন্যান্সীতে যান। ঐ সময বার্নহেইম “সংবেশনোত্তর অভিভাবন” (post- hypnotic suggestion) নিয়ে কাজ করছিলেন। সংবেশিত অবস্থায় রোগীকে যে নির্দেশ দেয়া হয়, পরবর্তী স্বাভাবিক অবস্থায় রোগী তা নিষ্ঠার সাথে পালন করে, যদিও সে ঐ নির্দেশের উৎস সম্পর্কে কিছু মনে করতে পারে না। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেই ফ্রয়েড অচেতন মন সম্পর্কে প্রথম ধারণা লাভ করেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে মানুষের একটি শক্তিশালী অচেতন মন রয়েছে। আর এই অচেতন মন মানুষের অজ্ঞাতসারে তার আচার আচরণকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে।

এই নতুন ধারণা নিয়ে তিনি ভিয়েনায় ফিরে আসেন এবং ব্রয়ারের সাথে আগের মতই কাজ করতে থাকেন। “The Psychical Mechanisms of Hysterical Phenomena” নামক প্রবন্ধটি ১৮৯৩ খৃস্টাব্দে ফ্রয়েড ও ব্রয়ার কর্তৃক যৌথভাবে রচিত ও প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধেই অচেতন প্রেষণা ও অবদমন প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রথম ব্যাখ্যা দেয়া হয়। যৌনতার ওপর ফ্রয়েডের অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ ও অভিসঞ্চালন সংক্রান্ত সমস্যার জন্য ব্রয়ার হিস্টিরিয়া রোগ চিকিৎসার কাজ পরিত্যাগ করেন। কিন্তু ফ্রয়েড অব্যাহতভাবে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। অচিরেই তিনি সংবেশন পদ্ধতির ত্রুটিগুলো উপলব্ধি করতে পারেন। যেমন, সব রোগীকে সংবেশিত করা যায় না বা সংবেশিত অবস্থায় রোগী যা স্মরণ করতে পারে, স্বাভাবিক অবস্থায় তা সে মনে করতে পারে না। এছাড়া সংবেশনের মাধ্যমে যে রোগ নিরাময় হয়, তা স্থায়ী হয় না। সেজন্য ফ্রয়েড সংবেশনের কোন বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন এবং ১৮৯৬ খৃস্টাব্দে তিনি তার বিখ্যাত “অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি” (free association method) উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফ্রয়েড রোগীদের অচেতন মনের দ্বন্দ্ব, হতাশাপ্রেষণাকে উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণ করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তার এই অনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি মানব প্রকৃতি সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটন করেন এবং ১৮৯৮ খৃস্টাব্দে তিনি প্রথম “মনোসমীক্ষণ” শব্দটি ব্যবহার করেন। অচিরেই তিনি “স্বপ্ন বিশ্লেষণ” (dream analysis) পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন। অবাধ অনুষঙ্গ ও স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানসিক রোগীদের মনের গভীর স্তর সমীক্ষণ করে তিনি যে তথ্যসমূহ উদ্ঘাটন করেছেন, সেটার ওপর ভিত্তি করেই তিনি ব্যক্তিত্বের তত্ত্ব প্রদান করেন। সেজন্যই তার তত্ত্ব ও পদ্ধতিকে মনোসমীক্ষণ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯০২ সালে ভিয়েনা মনোসমীক্ষণ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯০৮ সালে মনোসমীক্ষণের ওপর প্রথম আন্তর্জাতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রয়েড আমৃত্যু বহু প্রবন্ধ ও পুস্তক রচনা করে তার অভিজ্ঞতা ও তত্ত্ব সংক্রান্ত ধারণাসমূহ উপস্থাপন করেছেন। “An Outline of Psycho-analysis” নামক তার শেষ পুস্তকটি তার মৃত্যুর পর ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

ফ্রয়েডের মৃত্যুর পরও তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে কিছু নতুন ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটেছে। ফ্রয়েডোত্তরকালের মনোসমীক্ষণমূলক চিন্তার বিকাশকে তিনটি ধারায় বিভক্ত করা হয়।। প্রথম ধারাটিকে বলা হয় সনাতনপন্থী ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ (Orthodox Freudian Psycho-analysis)। সনাতনপন্থী ফ্রয়েডবাদীরা ফ্রয়েডের তত্ত্বকে সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখে কিছু নতুন তথ্য এখানে সেখানে সংযোজন করেছেন বা ফ্রয়েডের ধারণাকে কোথাও কোথাও আরও বিশদ করেছেন। আনা ফ্রয়েড (Anna Freud), ক্লাইন (Klein), হার্টম্যান (Hartman), আলেকজান্ডার (Alexander), প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সনাতনপন্থীদের মধ্যে অন্যতম।

মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের দ্বিতীয় ধারাটিকে বলা হয় ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষণ (Deviant Psycho-analysis) । যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ প্রথমে ফয়েডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রূপে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীকালে মতবিরোধের জন্য ফ্রয়েড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন, তাদের মতবাদকে ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষন রূপে আখ্যায়িত করা হয়। আলফ্রেড আডলার (A.Adler), কার্ল গুস্টাভ ইয়াং (C G.Jung). অটো র‍্যাংক (Otto Rank), প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এদের মধ্যে অন্যতম। এসব ব্যক্তি স্বতন্ত্র মতবাদ দিলেও এদের ধ্যান ধারণা মূলতঃ ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই উৎপত্তি লাভ করেছে।

মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব সংক্রান্ত তৃতীয় ধারাটিকে নব্য-ফ্রয়েডীয় মতবাদ (Neo- Freudian viewpoints) রূপে আখ্যায়িত করা হয়। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা ফ্রয়েডের যৌনতত্ত্ব ও জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছেন। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা মূলতঃ নৃবিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং তারা মানব প্রকৃতি ও আচরণকে সমাজ, সভ্যতা ও কৃষ্টির প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এরা ফ্রয়েডের তত্ত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটালেও, এদের ধ্যান ধারণাও ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রেক্ষিতেই উৎপত্তি লাভ করেছে। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা মনোসমীক্ষণ পদ্ধতি, অচেতন প্রেষণা, আত্মরক্ষামূলক কৌশল, প্রভৃতি ফ্রয়েডীয় ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। সেজন্যই এদেরকে নব্য-ফ্রয়েডীয় রূপে আখ্যায়িত করা হয়, যাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন  এরিক ফ্রম, কারেন হর্নি, এরিক এরিকসনসুলিভ্যান

‘আন্না ও’ কাহিনী

‘আন্না ও’ এর কেস-হিস্ট্রিটিকে মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির সূচনাবিন্দু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং তার জ্যেষ্ঠ সহযোগী যোসেফ ব্রয়ার-এর যৌথ গবেষণাকর্ম Studies on Hysteria (1895) গ্রন্থের সবচেয়ে বিস্তারিত কেস-হিস্ট্রি এটি। ‘আন্না ও’ হচ্ছে কেস-হিস্ট্রির ছদ্মনাম। তার আসল নাম বার্থা পাপেনহেইম (১৮৫৯-১৯৩৬)। ভিয়েনার রক্ষণশীল ইহুদি পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা ছিলেন সচ্ছল ব্যবসায়ী। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত তিনি স্কুলে যেতে পেরেছেন। তারপর বাড়িতে সূচিকর্ম শেখেন এবং মাকে গৃহকর্মে সাহায্য করেন।

১৮৮০ সনে বার্থার পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লে বার্থা তার শুশ্রূষার দায়িত্ব নেন এবং নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বাবা পরের বছর মারা যান। এতে তার অসুখের প্রকোপ আরো বাড়ে। তাকে চিকিৎসার জন্যে ভিয়েনার নামকরা চিকিৎসক যোসেফ ব্রয়ারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তার রোগের লক্ষণ বহুবিধ, এবং একটির উপশম হলে অন্যটি দেখা দিত। তীব্র কাশি, মুখমণ্ডলের ব্যথা, শরীরের ডানপাশের অবশতা, দৃষ্টি ও শ্রবণের সমস্যা, কথা আটকে যাওয়া, গায়েবী আওয়াজ শোনা, কখনো বা বেহুঁশ হয়ে যাওয়া, এসকলই ছিল তার অসুখের প্রকাশ। ব্রয়ার রোগটিকে ‘হিস্টেরিয়া’ বলে শনাক্ত করেন এবং সম্মোহন প্রক্রিয়ায় তার চিকিৎসা শুরু করেন। এ প্রক্রিয়ায় রোগীকে সম্মোহিত করে তার মনের কষ্ট ও দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে বলতে উৎসাহিত করা হয়। রোগী সম্মোহিত থাকার জন্যে, মনের বাধা কাজ করে না। এ অবস্থায় বেদনাদায়ক কিংবা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য স্মৃতি ও চিন্তাকেও বর্ণনা করা তার জন্য সহজ হয়। ব্রয়ার লক্ষ করেন, এতে রোগীর রোগলক্ষণের উপশম হয়। তবে সমস্যা হলো আন্নার ক্ষেত্রে রোগলক্ষণগুলি ফিরে ফিরে আসছিল, পুরো নিরাময় হচ্ছিল না। আন্না নিজেই লক্ষ করেন, তিনি সম্মোহন ছাড়াও নির্বাধভাবে তার স্মৃতি বর্ণনা করতে পারেন। আন্না ব্রয়ারকে একথা জানালে, ব্রয়ার তাকে সম্মোহিত না করেই অবাধে কথা বলার সুযোগ দেন। ফলাফল সম্মোহনের মতোই। এই প্রক্রিয়াটি সম্মোহনের বিপরীতে অবাধ-অনুষঙ্গ (free association) নামে খ্যাত।

ফ্রয়েড সে-সময় ব্রয়ারের সঙ্গে কাজ করছিলেন। পরে তিনি এই পদ্ধতিটিকে বিকশিত করেন এবং মনঃসমীক্ষণের মূল পদ্ধতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘আন্না ও’ এবং আরো কিছু সংখ্যক রোগীর কেস-হিস্ট্রি বিশ্লেষণ করে ব্রয়ার ও ফ্রয়েড সিদ্ধান্তে আসেন, মনের অচেতন দ্বন্দ থেকেই হিস্টেরিয়ার রোগলক্ষণের উৎপত্তি। সম্মোহন বা অবাধ-অনুসঙ্গের মাধ্যমে যদি রোগী তার মনের দ্বন্দ্বটিকে উগরে দিতে পারেন এবং দ্বন্দ্বটি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেন, তাহলে রোগলক্ষণের উপশম হয়। ব্রয়ার আন্নাকে নিয়ে দুই বছর লেগে ছিলেন এবং থেরাপিতে মোট ১,০০০ ঘণ্টা সময় ব্যয়িত হয়েছিল। কেস-হিস্ট্রিতে দাবি করা হয়, আন্না রোগ মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। আন্নার রোগলক্ষণগুলো পরিবর্তিত হচ্ছিল কিংবা যাওয়া-আসা করছিল। রোগ বৃদ্ধি পেলে ব্রয়ার তাকে ক্রেউজলিঙ্গেল-এ অবস্থিত বেলভিউ ক্লিনিকে রেফার করেন। তার পর তিনি আর আন্নার চিকিৎসা করেননি। বার্থা (আন্না) বেলভিউতে চিকিৎসাধীন থাকার সময় কার্ল-তে তার কাজিনদের কাছে বেড়াতে যান। তার এক কাজিন (দিদি) সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি বার্থাকে এসব কাজে উৎসাহিত করেন। বার্থা সেখানে কিছুদিন নার্সিং-এও প্রশিক্ষণ নেন। কিছুটা আরোগ্য হলে তিনি ক্লিনিক ছেড়ে ভিয়েনা চলে আসেন। সেখানে তিনি কয়েক বছর মায়ের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি পুরো আরোগ্য লাভ করেননি।

বার্থার পরিবার ১৮৮৮ সনে ভিয়েনা ছেড়ে মেইন তীরস্থ ফ্রাঙ্কফোর্ট নগরে চলে আসে। এখানে তাদের রক্ষণশীল এবং উদার, দুধরনের ইহুদিদের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরিবারটি সেখানকার বিজ্ঞান চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা, সমাজসেবা প্রভৃতি কার্যক্রমে জড়িত হয়ে পড়ে। বার্থা নিজেও সাহিত্য রচনা শুরু করেন এবং সমাজসেবায় নিয়োজিত হন। তিনি আর কখনো হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হননি। অনাথ ইহুদি বালিকা ও নারীরাই ছিল তার কাজের ক্ষেত্র। সমাজসেবামূলক কাজের পাশাপাশি তিনি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও শরিক হন। তিনি International Council of Women-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারী পাচারের রিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রথম জার্মান সম্মেলন (১৯০২) থেকে দায়িত্ব পেয়ে, নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত সামাজিক কারণগুলো চিহ্নিত করতে, তিনি নারী পাচারের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল গেলাসিয়া-তে সরেজমিন তদন্তে যান। তারপর নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তি রোধের জন্য কলম ধরেন এবং আন্দোলন সংগঠিত করেন। জার্মানিতে ‘ইহুদি নারী সমিতি’র তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

সামাজিক কর্মের সঙ্গে বার্থার সাহিত্য-সাধনাও এগিয়ে চলে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ কর্মেও হাত লাগান। তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ রচনা Mary Wollstonecraft এর A Vindication of the Right of Women (1790) গ্রন্থটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। ইহুদি সমাজে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক যেসব প্রথা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তিনি এসবের বিরোধিতা করে, ইহুদি সমাজে নারীদের সমানাধিকার দাবি করেন। এ-তে রক্ষণশীল ইহুদিরা তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয় এবং তার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। অনাথ ইহুদি বালিকা ও কুমারী মাতাদের জন্য তিনি ‘নিউ-ইসেনবুর্গ’ নামে একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল আশ্রিতদেরকে শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা। রক্ষণশীল ইহুদিরা এরও বিরোধিতা করেছিল। তাদের ধারণা, এতে সমাজের পাপকর্মকেই উৎসাহিত করা হয়। সে সময় ইউরোপের ইহুদিদের মধ্যে জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তিনি এটি সমর্থন করতেন না। ইহুদিরা যে দেশ ও সমাজে বেড়ে উঠেছে, সেই সমাজের মধ্যেই আত্মীকৃত হওয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি। জায়নবাদীরা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, প্যালেস্টাইনকে তাদের পিতৃপুরুষের দেশ আখ্যা দিয়ে, সেখানে ইউরোপ থেকে ইহুদিদের অভিবাসনকে উৎসাহিত করত। বার্থা এর বিরোধিতা করতেন। অবশ্য নাৎসিদের ইহুদিবিরোধিতা তীব্র হয়ে উঠলে তিনি তার অবস্থান পাল্টান। নাৎসি উত্থানের সময়টাতে ১৯৩৬ সনেই তার মৃত্যু হয়। ১৯৩৮ সনে নাৎসিরা তার অনাথ আশ্রম ‘নিউ ইসেনবুর্গ’ আক্রমণ করে, এবং ১৯৪২ সনে আশ্রমের সবাইকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়।

বার্থা বিবাহ করেননি। ১৯০৫ সনে তার মায়ের মৃত্যুর পর তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তার এই বেদনা ১৯১১ সনে রচিত তার একটি কবিতায় ধরা পড়েছে –

Love did not come to me-
So I vegetate like a plant,
In a cellar, without light.
Love did not come to me-
So I resound like a violin,
Whose bow has been broken.
Love did not come to me-
So I immerse myself in work,
Living myself sore from duty.
Love did not come to me-
So I gladly think of death,
As a friendly face.”

(প্রেম আমার কাছে আসেনি- তাই আমি উদ্ভিদের মতো জীবন কাটাই, এক তমসাচ্ছন্ন তলঘরে, আলো বিহীন। প্রেম আমার কাছে আসেনি- তাই আমি ভেঙে যাওয়া ধনুর সাথে বেহালা হয়ে বাজি। প্রেম আমার কাছে আসেনি- তাই আমি কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি, কর্তব্যে নিজেকে ক্লান্ত করে তুলি। প্রেম আমার কাছে আসেনি- তাই আমি মৃত্যুকে সুখের চিন্তা ভাবি, যেন এক বন্ধুর মুখ।)

১৯৫৪ সনে জার্মান পোস্টাল বিভাগ তাদের ‘মানবহিতৈষী’ সিরিজের ডাকটিকেটের একটি, বার্থার প্রতিকৃতি সহ প্রকাশ করে, তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তার মৃত্যুর ৫০ তম বার্ষিকীতে জার্মানিতে সেমিনারের মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ডকে স্মরণ করা হয়। ১৯৯৭ সনে তার প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ ইসেনবুর্গ’ অনাথ আশ্রমটিতে তার নামে সেমিনার রুম ও স্মারক চিহ্ন উদ্বোধন করা হয়।

বার্থা তার অনাথ আশ্রমের বাসিন্দাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। তিনি সেখানে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে মনঃসমীক্ষণ প্রয়োগের অনুমতি দিতেন না। তিনি তার নিজের মনঃসমীক্ষিত হওয়া নিয়ে কোনো গল্পও করতেন না। তার মতে, ‘একজন ক্যাথলিক যাজকের হাতে কনফেশন যা, একজন ডাক্তারের হাতে মনঃসমীক্ষণও তাই। এটি একটি ভাল যন্ত্র হয়ে উঠবে না দুধারি তলোয়ার হয়ে উঠবে তা নির্ভর করে, কে এটি ব্যবহার করছেন এবং কী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর।’

‘আন্না ও’ কাহিনীটি যেমন মনঃসমীক্ষণ সূচনার কাহিনী, তেমনি এর সীমাবদ্ধতার কাহিনীও। মনঃসমীক্ষণ যে সমস্যাটির সমাধান করতে পারেনি, সেটি সমাধান করেছিল সমাজমুখি আদর্শ এবং সে অনুযায়ী কাজ। মনঃসমীক্ষণ রোগীর অচেতনের ও অতীতের ঘাটাঘাটিতে নিয়োজিত থাকায়, বর্তমান জীবন ও সমাজ এবং এ-তে ব্যক্তির ভূমিকাটি ভুলে যায়।

মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব ও অন্যান্য জ্ঞানের শাখা

মনোসমীক্ষণ মূলতঃ ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত একটি বিশেষ মতবাদ ও মনোরোগ চিকিৎসার একটি বিশেষ পদ্ধতি। তবে ফ্রয়েড কর্তৃক প্রবর্তিত এই তত্ত্ব বিভিন্ন জ্ঞানের শাখাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব বিবিধভাবে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে জড়িত হয়ে রয়েছে।

মনোসমীক্ষণ ও মনোবিজ্ঞান: মনোবিজ্ঞান হচ্ছে মানুষ ও প্রাণীর আচরণের বিজ্ঞান। সুতরাং মনোবিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে মানুষের আচরণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যসমূহ উদ্ঘাটন করে এবং মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা করে। মনোসমীক্ষণও ব্যক্তিত্বের তত্ত্ব রূপে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের স্বভাবী ও অস্বভাবী উভয়বিধ আচরণ ব্যাখ্যা করে। ফলে মনোসমীক্ষণ ও মনোবিজ্ঞান পরস্পরের সাথে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। চিন্তন, শিক্ষণ, স্মৃতি, বিস্মৃতি, প্রেষণা, প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে মনোবিজ্ঞান যে ব্যাখ্যা দান করে, সেক্ষেত্রে মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অনেক ধারণাকেই মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বিশেষ করে অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের ওপর মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের প্রভাব অপরিসীম। মনোবৈকল্যের মনস্তত্ত্বিক কারণতত্ত্ব (psycho-dynamics) মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের দ্বারাই প্রথম উদ্ঘাটিত হয়েছে। ফলে অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রে মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের বহুবিধ ধ্যান ধারণাই মনোসমীক্ষণ মতবাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব মানুষের স্বভাবী ও অস্বভাবী আচরণকে একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে। অপরপক্ষে মনোবিজ্ঞান বা অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি অধিকতর ব্যাপক ও বিস্তৃত। মনোবিজ্ঞানীরা উদারভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও তত্ত্বের অবতারণা করে মানব আচরণ ব্যাখ্যার চেষ্টা করে।

মনোসমীক্ষণ ও সাইকিয়াট্রি (psychiatry) : চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখাকে সাইকিয়াট্রি বা মনোরোগবিদ্যা বলা হয়। মনোরোগ নির্ণয় ও মনোরোগের চিকিৎসাকে কেন্দ্র করেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই শাখার উৎপত্তি হয়েছে এবং সাইকিয়াট্রি থেকেই মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব বিকাশ লাভ করেছে। ফ্রয়েড সাইকিয়াট্রিস্ট রূপে কাজ করতে গিয়েই তার তত্ত্ব ও চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। সুতরাং মনোসমীক্ষণকে সাইকিয়াট্রি বা মনোরোগবিদ্যারই একটি অংশ রূপে মনে করা হয়। কিন্তু সাইকিয়াট্রি ও মনোসমীক্ষণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্টরা মনোরোগের দেহতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং মনোরোগ চিকিৎসার জন্য দেহভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। অপরপক্ষে মনোসমীক্ষকরা মনোরোগের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং মনোরোগ চিকিৎসার জন্য মনোচিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তবে সাইকিয়াট্রিস্টরা মনোরোগের বিষয়ে মূলতঃ দেহতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলেও, তারা মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকেন এবং প্রয়োজন অনুসারে তারাও মনোসমীক্ষণ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

মনোসমীক্ষণ ও সমাজকর্ম : সমাজে বসবাসরত সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্য নিয়ে যে জ্ঞানের শাখার উদ্ভব হয়েছে, সেটাকেই সমাজকর্ম বলা হয়। সমাজের বিবিধ সমস্যা ও সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করার উদ্দেশ্য নিয়েই সমাজকর্মীরা জনের এই শাখায় প্রশিক্ষণ লাভ করে। ব্যক্তির সমস্যাকে যথার্থভাবে অনুধাবন করার জন্য মানুষের প্রকৃতি ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভের প্রয়োজন হয়। সেজন্যই সমাজকর্মীরা মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। ব্যক্তিত্বের গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে মনোসমীক্ষণ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা একজন সমাজকর্মীকে তার পেশাগত কাজে গুরুত্বপূর্ণভাবে সহায়তা করে। মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের ভিত্তিতেই একজন সমাজকর্মী সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং তাকে কার্যকরভাবে সেবা প্রদান করতে পারে। এছাড়া মনোরোগ বিষয়ক সমাজকর্ম (psychiatric social work) সমাজকর্মেরই একটি বিশেষ শাখা। সমাজে বসবাস রত মানসিক রোগীদের সেবা প্রদান করার বিষয়ে শিক্ষাদান করাই এই শাখার উদ্দেশ্য। মনোরোগ বিষয়ক সমাজকর্মীরা মনোসমীক্ষণ সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন এবং মনোসমীক্ষণের বিভিন্ন ধ্যান ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সুতরাং সমাজকর্ম বিভিন্ন দিক দিয়ে মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়ে রয়েছে।

মনোসমীক্ষণ ও সমাজবিজ্ঞান : মানুষের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক দল- উপদল, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, সমাজবদ্ধ জীবনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যে জ্ঞানের শাখা পর্যালোচনা করে, সেটাকেই সমাজবিজ্ঞান বলা হয়। মানুষের দ্বারাই যেমন সমাজ গঠিত হয, তেমনি একটি সমাজও মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব ও সমাজ পরস্পর ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও ধ্যান ধারণাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। “গোষ্ঠী মনস্তত্ত্ব” (Group Psychology) সম্পর্কে ফ্রয়েড যে ধারণা দিয়েছেন, তা সমাজবিজ্ঞানের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। সামাজিক রীতিনীতি, সমাজের ক্রমবিবর্তন, প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের ধ্যান ধারণায় মনোসমীক্ষণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাপ পড়েছে। ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান, তা নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের সাধারণ কাঠামোর ভিত্তিতেই ব্যাখ্যা করেছেন।

মনোসমীক্ষণ ও নৃবিজ্ঞান (anthropology): যে জ্ঞানের শাখা মানুষ সম্পর্কে সুশৃঙ্খল তথ্য আহরণ করে, সেটাকেই নৃবিজ্ঞান বলা হয়। আর নৃবিজ্ঞানের যে শাখা মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে, সেই শাখাকেই কৃষ্টিমূলক নৃবিজ্ঞান (cultural anthropology) বলা হয়। এই কৃষ্টিমূলক নৃবিজ্ঞান বিভিন্ন আদিম মানবগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, মানব প্রকৃতি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। সামাজিক পরিবেশগত পার্থক্য মানুষের ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সুতরাং নৃবিজ্ঞানীদের তথ্যানুসন্ধান দ্বারা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের কিছু সীমবদ্ধতা প্রমাণিত হয়। ফলে নৃবিজ্ঞানীদের তথ্যের আলোকে ইদানিং ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের কিছু সংশোধন ও পরিমার্জন করা হচ্ছে। অপরদিকে নৃবিজ্ঞানীরা মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের আলোকে ও মনোসমীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে নিত্য নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করছে। সুতরাং নৃবিজ্ঞান ও মনোসমীক্ষণের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘনিষ্ঠ সংযোগ ঘটছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা তাদের তত্ত্বের মাধ্যমে মনোসমীক্ষণ ও নৃবিজ্ঞানের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করেছেন।

ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯ খ্রি.) মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব

ভূমিকা

সিগমুন্ড ফ্রয়েড

উনিশ শতকের যে তিনজন চিন্তাবিদ চিন্তার জগতে আলোড়ন তুলেছেন, এরা চার্লস ডারউইন, কার্ল মার্ক্স সিগমুন্ড ফ্রয়েড। যারা নতুন চিন্তা নিয়ে আসেন তারা স্বভাবত বিতর্কিতও হয়ে ওঠেন, এ-তিনের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ক্রমে ডারউইন জীববিজ্ঞানে আত্মীকৃত হয়ে গেছেন। বিবর্তন-তাত্ত্বিক দবঝানস্কির ভাষায়, ‘বিবর্তন-তত্ত্বের আলো ছাড়া জীববিজ্ঞানে কিছুই অর্থবহ নয়।’ মার্ক্সের বেলায় এমনটি ঘটেনি, কারণ সামাজিক বিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের মতো মতাদর্শমুক্ত বিজ্ঞান নয়। সমাজ যেহেতু বিবাদমান শ্রেণিতে বিভক্ত, তাই একটি শ্রেণির স্বার্থরক্ষক কোনো দর্শন, বিরুদ্ধ শ্রেণিটির বিরোধিতাকে উসকে দেয়। কিন্তু যখন বিরোধী শিবিরের তাত্ত্বিকরাই স্বীকার করেন, পুঁজিবাদকে বোঝার জন্যই মার্ক্স পাঠ আবশ্যক, তখন একজন মৌলিক চিন্তাবিদ হিসাবে মার্ক্সের গুরুত্ব সর্বসম্মতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) বেলায় ব্যাপারটি ভিন্ন। মনোবিজ্ঞান একক প্যারাডাইম বা প্রত্যয়-কাঠামোর বিজ্ঞান নয়। এখানে রয়েছে অনেকগুলো ধারা। ফ্রয়েড সূচিত সাইকো ডায়নামিক ধারাটি (এটির অনেক উপধারা সমেত) মনোবিজ্ঞানের অনেক ধারার একটি ধারামাত্র। মনোবিজ্ঞানে অনবহিত কারো কারো কাছে ফ্রয়েডবাদ ও মনোবিজ্ঞান সমার্থক। অন্যদিকে এমন অনেকে রয়েছেন, যারা ফ্রয়েডের তত্ত্বকে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের স্বীকৃতি তো দেনই না, এটিকে মনোবিজ্ঞান বিকাশের বাধা মনে করেন। এই দুই বিপরীত মেরুর মাঝামাঝি আরো অনেক অবস্থান রয়ে গেছে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তিনি একজন মনোচিকিৎসক রূপে বহু সংখ্যক মানসিক রোগীর চিকিৎসা করেছেন। তিনি বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে মানসিক রোগীদের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং মানব মনের গভীরতম প্রদেশের রহস্যময় তথ্যসমূহ উদ্ঘাটন করেছেন। তার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন।

ফ্রয়েডের সংক্ষিপ্ত জীবনী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড জন্মেছিলেন মোরাভিয়া অঞ্চলের প্রিবর-ফ্রেইবুর্গ গ্রামে, ১৮৫৬ সনে। (গ্রামটির চেক নাম প্রিবর, জার্মান নাম ফ্রেইবুর্গ।) অঞ্চলটি তখন অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। বর্তমানে তা চেকপ্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত। ফ্রয়েডরা জার্মানভাষী ইহুদি। তাদের পারিবারিক উপাধি ‘ফ্রয়েড’, অস্ট্রীয় নাম। কর- সংগ্রাহকদের থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য অস্ট্রীয় ইহুদিরা অস্ট্রীয় নাম গ্রহণ করত। ফ্রয়েডের পিতৃদত্ত নাম Sigismund Schlomo Freud; এর স্বকৃত সংক্ষেপ Sigmund Freud। এ নামেই তিনি পরিচিত। Sigismund পুরানো জার্মান নাম, এর অর্থ বিজয়ের মাধ্যমে সুরক্ষা। অনেক জার্মান রাজা Sigismund নাম ধারণ করতেন। ফ্রয়েডের পিতা জেকব ফ্রয়েড এবং মাতা আমালিয়া নাথানসন। আমালিয়া জেকবের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী দুই পুত্রসন্তান রেখে মারা যাওয়ার পর জেকব দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিয়ের সময় জেকবের বয়স ছিল ৪০ বছর এবং আমালিয়ার ২০। আমালিয়া ছিলেন তার সতীনের বড় ছেলের বয়সী। আমালিয়ার বিয়ের সময় তার সতীন-ছেলে একটি এক বছর বয়সী ছেলের বাবা। সব মিলে ফ্রয়েডের আরও পাঁচটি বোন ও দু’টো ভাই ছিল। জেকব ছিলেন উলের পোশাকের ব্যবসায়ী। তার নিযুক্ত দুজন কারিগর বাড়িতে পোশাক তৈরি করত। জেকব বড় ছেলেকে নিয়ে এসব হাটে হাটে বিক্রি করতেন। কারখানায় তৈরি পোশাকে বাজার ছেয়ে গেলে তার ব্যবসা মার খায়। ফ্রয়েডের জন্মের তিন বছর পর ১৮৫৯ সালে তার পরিবার জার্মানীর লাইপজিগে গমন করে। ১৮৬০ সনে তিনি জীবিকার খোঁজে সপরিবারে ফ্রেইবুর্গ ছেড়ে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ভিয়েনাতে পাড়ি দেন। ফ্রয়েড সেই সময় থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ভিয়েনা নগরেই জীবন যাপন করেছেন। শৈশবকাল থেকে প্রায় সারাটা জীবন ফ্রয়েড, মহাদেশীয় (continental) ইউরোপের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ভিয়েনাতেই কাটিয়েছেন। ফ্রয়েডের তত্ত্ব নির্মাণে জার্মান-সংস্কৃতির নির্ণায়ক প্রভাব ছিল।

ভিয়েনায় ফ্রয়েডরা বাসা নেন লিওপোলস্ট্যাড নামক ইহুদি বস্তিতে। বস্তিটি ‘ভিয়েনা খাল’ দিয়ে মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। তৎকালীন অস্ট্রীয় সম্রাট প্রথম ফ্রাঞ্জ জোসেফ (রা. ১৮৪৮-১৯১৬ খ্রি.) রাজধানীতে সমস্ত ইহুদিদের জন্য সাম্য ঘোষণা করেছিলেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় ইহুদি ছাত্রদের প্রবেশাধিকার দিচ্ছিল। তাই বস্তির নিষ্প্রভ দোকানিরা সেই দিনটির স্বপ্ন দেখছিল, যখন তাদের ছেলেরা চিকিৎসক, আইনজ্ঞ, বিজ্ঞানী এবং বিখ্যাত লেখক হয়ে উঠবে। গোলমেলে ভিড়াক্রান্ত অলিগলিতে, যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, স্বেদ এবং আবর্জনা পরস্পর মিলেমিশে আছে, সেখানেই সিগমুন্ড ফ্রয়েড বড় হচ্ছিলেন। তার বাবা পশমি বস্ত্রের ফেরী করতেন, মা একটি স্যাঁতস্যেতে বাড়িতে গেরস্থালী সামলাতেন। স্কুলে ফ্রয়েড ভাল ফল করছিলেন। মা তার প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন। কিছুদিন পর তারা একটি দুই কামরার নতুন বাড়িতে উঠেছিলেন। ফ্রয়েডের ছোট পাঁচ বোন এবং একটি ভাইকে নিয়ে মা-বাবা এক কামরায় থাকতেন। অন্য কামরাটি ছেড়ে দিয়েছিলেন ফ্রয়েডের জন্য। যেখানে অন্য শিশুগুলি মোমবাতির আলোয় পড়াশোনা করত, সেখানে সিগমুন্ডকে তিনি দিয়েছিলেন একটি দামী আচ্ছাদনের কেরোসিন বাতি, একটি টেবিল ও বই রাখার তাক। ফ্রয়েডের সঙ্গে তার মায়ের মধুর সম্পর্কটি আজীবন বহাল ছিল। ফ্রয়েডের বাবা ছিলেন রাশভারী লোক। তিনি অন্তরে ছেলেকে ভালবাসলেও বাইরে তার সমালোচনা করতেন। তাই ফ্রয়েডের সঙ্গে তার বাবার সম্পর্কটা দাঁড়াল ভালবাসা ও ঘৃণার। বাবা ছিলেন মুক্ত চিন্তক। তিনি সিনাগগে যেতেন না, মুক্ত চিন্তকদের দলে যোগ দিয়ে মুক্ত চিন্তার প্রচার করতেন। ফ্রয়েড তার কাছেই মুক্তচিন্তানিরীশ্বরবাদের দীক্ষা নেন। ফ্রয়েড নিজের ইহুদি পরিচয়টিকে বড় করে দেখতেন না। কিন্তু তার সহপাঠীরা তাকে ইহুদি বলে হীন দৃষ্টিতে দেখত। এতে তার মনে হীনমন্যতা জন্মে। ক্রমে তা কাটিয়ে তিনি আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠেন। তার এই চারিত্রিক গড়ন, প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তার সহায় হয়েছিল।

স্কুল জীবনে গ্যেয়টে (তার প্রকৃতিবিষয়ক রচনা মাধ্যমে) এবং ডারউইন তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন প্রকৃতিবিজ্ঞান অধ্যয়নে। সেজন্য তিনি ১৮৭৩ সালে তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নের জন্য চিকিৎসা শাস্ত্রকে বেছে নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত শারীর-বিজ্ঞানী ব্রুক (Ernst Brucke) । ব্রুক-এর সহযোগী ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হেমহোৎস (Hermann von Helmholtz) । হেল্মহোৎস ছিলেন ফ্রয়েডের আইডল। হেলমহোৎস ও তার সহযোগীরা সেই সময়কার ভাববাদী দর্শনে অনুপ্রাণিত বিজ্ঞানীদের ‘জীবনশক্তি’, ‘ভাইটাল ইলান’, ‘আত্মা’ ইত্যাদি পরীক্ষা নিরীক্ষার অনুপযোগী ধারণার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালাচ্ছিলেন। নিরীশ্বরবাদী ফ্রয়েড এদের প্রভাবে বস্তুবাদীতে রূপান্তরিত হন। তিনি যে মনকে একটি শক্তিতন্ত্র কল্পনা করে এর গতিবিদ্যা (dynamics) রচনা করেছেন, এতেও এ প্রভাব কার্যকর। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আর এক শিক্ষক ছিলেন ফ্রান্জ ব্রেন্টানো (Franz Brentano), যার মন সম্পর্কিত দার্শনিক ধারণাবলী, উত্তরসূরি তাত্ত্বিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রয়েড শুধু শারীরতত্ত্ব নয়, মনস্তত্ত্বেও পাঠ নিয়েছিলেন।

১৮৮১ সনে ফ্রয়েড চিকিৎসাশাস্ত্রে এম ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এম. ডি. ডিগ্রী পরীক্ষা দেওয়ার পূর্বে তিনি স্নায়ুবিদ্যা (neurology) এবং সাইকিয়াটি (মনোচিকিৎসার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তার এসব অনুভূতিগুলি পুরস্কৃত হয়। ১৮৮০ সাল থেকে পরবর্তী বেশ ক বছর তিনি শারীর সংস্থান এবং স্নায়ুতত্ব অথবা মনোচিকিৎসা এ দুটোর মধ্যে কোন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেবেন তা স্থির করতে পারেন নি। তার আগ্রহের বিষয় ছিল স্নায়ুতন্ত্র। তিনি ব্রুকের ল্যাবরেটরিতে স্নায়ুতন্ত্রের গবেষণা শুরু করেন। এ সময়ে তিনি শারীরসংস্থান (Anatomy) এর উপরে কয়েকটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যার একটি ছিল স্নায়ুবিক টিস্যু রঙ করার পদ্ধতি সংক্রান্ত আর অন্যটি ছিল স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত একক বিষয়ে। সুষুমা কাণ্ডের (spinal cord) জাতিজনিক (phylogenic) এবং সুষুমা শীর্ষের (medulla oblongata) ব্যক্তিজনিক (ontogenic) বিকাশ নিয়েই ছিল তার গবেষণাগুলো। কোকেনের (Cocaine) স্নায়ু অবশকারী (local anesthetic) গুণটি ফ্রয়েডের আবিষ্কার। কিন্তু এটি তার এক ঘনিষ্ট বন্ধু নিজের নামে চালিয়ে দেয়। এখানে যেটা হয়েছিল তা হলো, তিনি কোকেনের (Cocaine) নিদ্রাকারী প্রভাব আবিষ্কারের পর তিনি এটি তার বন্ধুদের এটা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে তার এক সহকর্মী কোকেন এর অসারকারী প্রভাব আবিষ্কার করেন। যাই হোক, অচিরেই তার সহকর্মীদের নিকট কোকেন এর ক্ষতিকারক দিকগুলো ধরা পড়ে এবং ফ্রয়েডকে তার অসাধনতার জন্য তাদের দ্বারা তিরস্কৃত হতে হয়।

যাই হোক, ফ্রয়েড কিছুদিন সাধারণ হাসপাতালে কাজ করেন এবং প্রখ্যাত শারীরতত্ত্ববিদ বার্কি (Berkey) এর গবেষণাগারে কাজ করতে শুরু করেন। ফ্রয়েডের ইচ্ছা ছিল গবেষণাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেয়া। এতে তার পিতারও সম্মতি ছিল। কিন্তু তার ইহুদি পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক পদ লাভে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। বর্তমানে যেমন, সে সময়েও কোনো ধনী কন্যার পাণিগ্রহণ ছিল আর্থিক সমস্যার একটি সমাধান। কিন্তু ফ্রয়েড পছন্দ করেছিলেন নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে মার্থা বার্নেজকে (Martha Barnays)। প্রেমিকাটির অর্থ না থাকলেও সামাজিক সম্মান ছিল। ফ্রয়েডের এ দুটির কোনটাই ছিল না। এসব বিবেচনা করে তার শুভানুধ্যায়ী শিক্ষক ব্রুক, তাকে গবেষকের পেশা ছেড়ে ডাক্তারী প্র্যাকটিস করতে জোর পরামর্শ দেন। ফ্রয়েডের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। স্বউদ্যোগে ব্যবসা করাই ইহুদিদের জন্য বরাবর অনুমোদিত ছিল। অগত্যা ফ্রয়েড ল্যাবরেটরি ছেড়ে ক্লিনিক্যাল মেডিসিনে যোগ দেন ও ১৮৮৫ সালে তিনি স্বাধীনভাবে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন। এবার তার গবেষণার ক্ষেত্র হয় ক্লিনিক্যাল বিষয়।

অতঃপর ভিয়েনায় ফিরে এসে তিনি আগের মতই চিকিৎসা কর্মে লিপ্ত হন। ১৮৮৬ খৃস্টাব্দে ফ্রয়েড মার্থা বার্নেজ (Martha Barneys) এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। চিকিৎসক রূপে কাজ করতে গিয়েই তিনি যোশেফ ব্রয়ার (Joshef Breuer) নামক এক প্রবীণ চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসেন। ব্রয়ার তখন তার উদ্ভাবিত “অভিস্ফোট পদ্ধতি” (abbreaction method) প্রয়োগ করে সাফল্যের সাথে হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা করছিলেন। ফ্রয়েড ব্রয়ারের কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং একযোগে তার সাথে কাজ করতে শুরু করেন। ফ্রান্সের ন্যান্সী নামক স্থানে প্রফেসর বার্নহেইম ও লাইবল্ট হিপনোসিস ও হিস্টিরিয়ার ওপর যে গবেষণা করছিলেন, তা প্রত্যক্ষ করার জন্য ফ্রয়েড ১৮৮৯ সালে পুনরায় ফ্রান্স গমন করেন। সেখানে তিনি প্রফেসর বার্নহেইমের “সংবেশনোত্তর অভিভাবন” (Post-hypnotic suggestion) সংক্রান্ত গবেষণা প্রত্যক্ষ করেন এবং এই পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি অচেতন মন সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। তিনি ভিয়েনায় ফিরে এসে ব্রয়ারের সাথে কাজ করতে থাকেন এবং তার সাথে যৌথভাবে ১৮৯৩ সালে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধেই অচেতন মন ও অবদমন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ধারণা প্রথম প্রকাশিত হয়। অতঃপর ব্রয়ার ও ফ্রয়েড “Studies on Hysteria” নামক পুস্তকটি ১৮৯৫ খৃস্টাব্দে প্রকাশ করেন। ব্রয়ার ফ্রয়েডকে অর্থ এবং উপদেশ দিয়েছিলেন এই সময়েই ফ্রয়েডের সঙ্গে উইলহেলম ফ্লাইয়েস (Wilhelm Fliess) নামে আরেকজন চিকিৎসকের পরিচয় হয়। এই সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট হয়ে উঠে যে সময়ে ফ্রয়েড তার মনোসমীক্ষণের প্রাথমিক ধারণাগুলি গঠন করেছিলেন।

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ (neurologist) রূপে তাকে প্রায়ই হিস্টিরিয়া রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। ১৮৮৬ সনে তিনি বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিতে যান তৎকালীন শ্রেষ্ঠ স্নাযুরোগ বিশেষজ্ঞ শার্কো-র (Jean Martin Charcot) ‘সালপেত্রিয়ের’ ক্লিনিকে প্রশিক্ষণ নিতে। পেশাগত জীবনে তার উপর শার্কোর প্রভাব ছিল সবচেয়ে গভীর। শারকোর অধীনেই তিনি হিস্টিরিয়া ও হিপনোসিস সম্পর্কে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। শারীরিক আঘাতে স্নায়ুতন্ত্রের কাজ ব্যাহত হয়, এটি চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রমাণিত। শার্কো লক্ষ করেন ‘হিস্টিরিয়ার’ রোগীদের ক্ষেত্রে এরকম কোন শারীরিক রোগ খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং মানসিক আঘাতের ইতিহাস পাওয়া যায়। তাই হিস্টিরিয়ার কারণ হিসাবে শার্কো মানসিক আঘাতজনিত dynamic trauma বা ‘গতিশীল আঘাত’- এর ওপর গুরুত্ব দিতেন। এর স্বরূপ বা কর্মপ্রক্রিয়া কী, তা তার জানা ছিল না। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, এটি সবসময়ই যৌনতার সঙ্গে জড়িত। ‘গতিশীল আঘাত’ ও ‘যৌনতা’, ফ্রয়েডের মনে শিকড় গেড়ে বসে।

১৮৮৬ সনেই ভিয়েনায় ফিরে তিনি শিশু হাসপাতালে যোগ দেন এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। এ হাসপাতালে তিনি কাজ করেন ১৮৯৬ সন পর্যন্ত। তারপর প্রাইভেট প্র্যাকটিস-ই হয় তার জীবিকা। আর্থিক অনটনে ফ্রয়েডের বিয়ে চার বছর আটকে ছিল। অবশেষে মার্থার আত্মীয়দের অমতে, মার্থার দেয়া পণের টাকায় তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে ফ্রয়েডকে প্র্যাকটিসেই বেশি সময় দিতে হয়। কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি আসার পর ফ্রয়েডরা ‘ব্যর্গগাসে’-র ১৯ নম্বর বাড়িটিতে স্থায়ীভাবে বাস শুরু করেন। ১৮৯৭ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত এটিই ছিল তার বাসা এবং চেম্বার। (বর্তমানে এটি ফ্রয়েড মিউজিয়াম।) ভিয়েনা নগরকেন্দ্রের উচ্চভূমি থেকে যে পথটি ঢাল বেয়ে লিওপলস্ট্যাডকে বিচ্ছিন্নকারী খালে গিয়ে পড়েছে, এটিই ব্যর্গগাসে। মধ্যবিত্ত ইহুদিদের বাসায় ঘেরা ছিল ব্যর্গগাসে-র দুপাশ। এখানে মধ্যবিত্ত ইহুদিদের দোকানগুলোর উপরের ঘরগুলোতে ইহুদি চিকিৎসক ও উকিলরা প্র্যাকটিস করতেন। ব্যর্গগাসে লিওপোলস্ট্যাড-এর পাশে; কিন্তু সামাজিক অবস্থানের দিকে সামান্য উচ্চশ্রেণির। একে বলা হত ‘সম্ভ্রান্ত সংখ্যালঘু বস্তি’।

ফ্রয়েডের রোগীদের উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল হিস্টিরিয়ার রোগী। ব্যেরনহাইম (Hippolyte M. Bernheim) হিস্টিরিয়া চিকিৎসায় ‘সম্মোহন অভিভাবন’ (hypnotic suggestion) পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এ পদ্ধতি শেখার জন্য ফ্রয়েড ১৮৮৯ সনে ফ্রান্সের নন্সিতে যান। শার্কোর ক্লিনিকে কাজ করার সময়ই তার ‘ডিনামিক ট্রমা’র কর্মপ্রক্রিয়া হিসাবে মনের অচেতন প্রক্রিয়ার কথা মনে এসেছিল। বার্নহেইমের চিকিৎসা-পদ্ধতি দেখার সময়, শক্তিশালী অচেতন মানসিক প্রক্রিয়ার সম্ভাব্যতার ব্যাপারে তার প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয়।

এসময় তিনি তার বয়োজ্যেষ্ঠ, ভিয়েনার প্রখ্যাত চিকিৎসক যোসেফ ব্রয়ার-এর (Josef Breuer) সঙ্গে চিকিৎসা বিষয়ে মতবিনিময় শুরু করেন। ব্রয়ার হিস্টিরিয়া চিকিৎসায় রোগীকে সম্মোহিত করে রোগীর মনে চেপে রাখা কথা প্রকাশ করার অভিভাবন দিতেন। রোগী চাপা কষ্টকে উগরে দিতে পারলে (catharsis বা বিরেচন) রোগ সেরে যেত। তাদের দুজনের যৌথ গবেষণার ফল ১৮৯৫ সনে ‘Studies on Hysteria’ নামে প্রকাশিত হয়। এটি ফ্রয়েডের গবেষণা ধারায় নতুন বাঁক। এখানেই তিনি স্নায়ুতন্ত্রের উপর অচেতন মানসিক ক্রিয়ার প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং তার নতুন চিন্তাধারার সূচনা হয়। উপরিউক্ত রচনার ভূমিকায় বলা হয়, মানসিক শক্তি (psychic energy) যদি প্রকাশের পথ না পায়, তাহলে তা মনোবিকারের উপসর্গে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তিকে নিজস্ব পথে চালিত করতে পারলে রোগ-উপসর্গ দূর হয়।

১৮৯৫ সালের দিকে ফ্রয়েড শরীরসংস্থান বিদ্যা (Anatomy) এর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। এই সময় তিনি ব্রয়ারের সাথে যৌথভাবে “Studies in lysteria” শিরোনামে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধটিকেই মনোসমীক্ষণ বাদের আনুষ্ঠানিক সূচনা বলা যেতে পারে। এরপর ১৮৯৭ সালে এনসাইক্লোপেডিয়ার কোন প্রবন্ধ লিখেন নি। জন্য লিখিত একটি প্রবন্ধ ছাড়া স্নায়ুতত্বের উপরে ফ্রয়েড আর অল্পদিন পরেই ফ্রয়েড এর সঙ্গে ব্রয়ারের মনোমালিন্য হয়। তখন তিনি ফ্লায়েস (Fliess) এর শরণাপন্ন হন। এ সময়ে ফ্রয়েড শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ফ্লায়েসের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ছিলেন। এসময়ে তার মধ্যে রোগবাতিক, মৃত্যুভয়, অতি নির্ভরশীলতা, ইর্ষাকাতরতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। এসব লক্ষণের কয়েকটি থেকে তিনি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাননি।

১৮৯৭ সালে ফ্রয়েড তার বন্ধু বার্লিন-এর চিকিৎসক ফ্লিস-এর (Wilhelm Fliess) সহযোগিতায় ‘আত্ম-সমীক্ষণ’ (self analysis) সম্পন্ন করেন। ফ্লিসও ছিলেন জার্মানভাষী ইহুদি এবং যৌনতার ব্যতিক্রমী তত্ত্ব গঠনে তৎপর। পরবর্তী কালে ফ্রয়েড প্রবর্তিত সাইকোথেরাপির থেরাপিস্টদের জন্য ‘আত্ম-সমীক্ষণ’ একটি পূর্বশর্ত রূপে প্রযোজ্য হয়। ফ্রয়েড তার তত্ত্ব গঠনে আত্মসমীক্ষণে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেন এবং আত্মসমীক্ষণের অভিজ্ঞতাকেই তার তত্ত্বের সঠিকতার প্রমাণ বলে গণ্য করেন। ফ্রয়েড ফ্লিস-এর সঙ্গে তাত্ত্বিক ভাবনা নিয়ে মত বিনিময় করতেন। এ-পর্বেই তিনি তিন স্তর বিশিষ্ট মন, মনের চালিকাশক্তি হিসাবে লিবিডো, অবদমন সহ মনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা-এসব ধারণা গঠন করতে থাকেন। ফ্রয়েডের তত্ত্ব গঠনে ফ্লিস-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০০ সালে ফ্লিসের (Fliess) এর সঙ্গে আবার বিচ্ছেদ দেখা দেয়। আপাতঃ দৃষ্টিতে এই বিচ্ছেদের কারণা ছিল ফ্লায়েসের কিছু মনগড়া ধারণা যেমন- আচরণের কালানুক্রমিকতা সম্পর্ক নিয়ে মতভেদ। ফ্রয়েড পরে বলেছেন যে, তাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ ছিল ফ্রয়েড কর্তৃক ফ্লায়েসের পেশা নির্বাচনের কারণ বিশ্লেষণ নিয়ে মতদ্বৈততা। ফ্লায়েসের সঙ্গে ফ্রয়েডের মতপার্থক্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পেছে একটি প্রবন্ধ চুরিকে কেন্দ্র করে। উভলিঙ্গতা (bisexuality) সম্পর্কিত ফ্লায়েসের কিছু ধারণা ফ্রয়েডের একজন রোগী চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করে। এজন্য ফ্রয়েডকে দায়ী করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন।

ব্রয়ার-এর সঙ্গে কাজ করার সময় ফ্রয়েডের কাছে সম্মোহন পদ্ধতিতে চিকিৎসার কিছু সমস্যা ধরা পড়ে। যেমন, সব রোগীকে সম্মোহিত করা যায় না এবং অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ‘সম্মোহন অভিভাবন’-এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ব্রয়ারের বিখ্যাত রোগী ‘আন্না ও’-কে চিকিৎসার সময়, ব্রয়ার রোগীর পরামর্শ অনুযায়ীই, তাকে সম্মোহিত না করেই তার মনের ভাব উগরে দিতে বলেন। তিনি লক্ষ করেন, এত সম্মোহনের মতোই কাজ হচ্ছে। এটি ফ্রয়েডের মনোযোগ আকর্ষণ করে। যৌনতার ওপর ফ্রয়েডের অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান এবং অভিসঞ্চালন সংক্রান্ত সমস্যার জন্য ব্রয়ার অচিরেই হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা পরিত্যাগ করেন। এরপর ফ্রয়েড একাই হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা ও তার অনুসন্ধানমূলক কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি সম্মোহন-অভিভাবন পদ্ধতির ত্রুটি কাটানোর জন্য নতুন পদ্ধতিটিকে অবাধ ভাবানুষঙ্গ বা অবাধ অনুষঙ্গ (free association) পদ্ধতি হিসাবে বিকশিত করেন। এই পদ্ধতির সাহায্যে তিনি রোগীদের অচেতন মন উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন এবং ১৮৯৮ সালে তিনি প্রথম “মনোসমীক্ষণ” শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি এ পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন।

সম্ভবতঃ ফ্রয়েডের সবচেয়ে বড় কীর্তি ১৯০০ সালে প্রকাশিত তার Interpretation of dreams” বা স্বপ্নের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থ। অবাধ অনুষঙ্গেরই অঙ্গ হিসাবে তিনি যুক্ত করেন স্বপ্ন সমীক্ষণ (dream analysis) । স্বপ্ন নিয়ে তার গবেষণার ফলশ্রুতি ‘Interpretation of Dreams’ বের হয় ১৯০০ সনে। এটিই ‘ফ্রয়েডবাদের’ প্রথম প্রকাশ। এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার পিতার মৃত্যুর ২ বৎসর পরে। জোনস্ (Jones, 1953) এবং ফ্রয়েডের নিজের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ফ্রয়েডের পিতার মৃত্যুর পর ফ্রয়েডের অচেতন মন যথার্থভাবে মুক্তি পায় এবং তিনি তার পেশাগত জীবনে সাহসী ও আত্মপ্রতিষ্ঠামূলক ভূমিকা পালন করেন। এ সময়ে তার খ্যাতি বেড়ে যায় এবং তার বহু সংখ্যক অনুসারী তৈরী হয়। অচিরেই তিনি পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। হিস্টিরিয়া সম্পর্কে তত্ত্বায়নে, তিনি মানসিক আঘাতকে বাস্তব কোনো যৌন নিপীড়নের অবদমিত স্মৃতি হিসাবেই চিহ্নিত করেছিলেন। তা seduction hypothesis নামে পরিচিত। স্বপ্ন সম্পর্কে তত্ত্বায়নে তিনি সে অবস্থান ত্যাগ করেন। তিনি বলেন, অবদমিত স্মৃতি কোনো বাস্তব ঘটনার স্মৃতি নয়; শিশুর উৎকল্পনার (fantasy) স্মৃতি। মানস জগতে, বাস্তব ঘটনার স্মৃতি আর উৎকল্পনার স্মৃতি সমতুল্য। শৈশব যৌনতা মানুষ মাত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাই শৈশবের যৌন উৎকল্পনার অবদমিত স্মৃতি, সব মানুষের মাঝেই সক্রিয়, এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে ও এর চালিকা শক্তিরূপে নির্ণায়কের ভূমিকা নেয়। এখানে তিনি গবেষণার প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি, যা তিনি নিউরোলজিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল গবেষণায় প্রয়োগ করেছিলেন, তা থেকে সরে এসেছেন। তার পরবর্তী গবেষণাসমূহ যা ফ্রয়েডবাদের অঙ্গ, সে সবেও তিনি এ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। উল্লেখ্য ফ্রয়েড প্রবর্তিত এ গবেষণা পদ্ধতি, যা মনোবিজ্ঞানের সাইকোডাইনামিক (psychodynamic) ধারার অঙ্গ, এখনো পরীক্ষাভিত্তিক মনোবিজ্ঞানে স্বীকৃত নয়।

১৯০২ সনে ফ্রয়েড ‘College of Professors of the Faculty of Medicine’-এর অনুমোদনক্রমে অস্ট্রিয়ার সম্রাট কর্তৃক ‘Professor Extra Ordinaries’ (Associate Professor) পদে বৃত হন। অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট তার ‘সাইকো-এনালাইটিক’ চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯০৩ সনে তার Psychopathology of Everyday Life এবং ১৯০৫ সনে Jokes and their Relation to the Unconscious গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ফ্রয়েড-তত্ত্বের অবৈজ্ঞানিক প্রকৃতির জন্য বিজ্ঞানীমহলে তার কদর হয়নি। কিন্তু স্বপ্ন সম্বন্ধে এবং প্রাত্যহিক জীবনের ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধে তার লেখা বইগুলি জনপ্রিয়তা পায়। কারণ মানুষের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাকে নিয়ে সহজবোধ্যভাবে এমন ব্যাখ্যামূলক মনস্তত্ত্বের বই তার আগে কেউ লেখেননি। এসব বইয়ে তিনি শুধু রুগ্ন মনের কথাই লেখেননি- একটা সার্বিক ও সর্বজনগ্রাহ্য মানসিক দর্শন প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন। তিনি ব্যক্তি-মন থেকে সমাজ-মানস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি সর্ব ব্যাপারের মনস্তাত্ত্বিক কারণ নির্ণয়ে মন দিয়েছেন। অবশ্য শুরুতে তার সর্বগ্রাসী যৌনতার তত্ত্ব, তার জন্য সুখ্যাতির চেয়ে বরং কুখ্যাতিই ডেকে এনেছিল। তবে তিনি আর অখ্যাত রইলেন না।

একাডেমিক পদোন্নতি, চিকিৎসায় সাফল্য এবং জনপ্রিয় লেখার জন্য ফ্রয়েডের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ শিক্ষার্থীরা তার পাশে জড়ো হয় এ ধারায় গবেষণা করতে, প্র্যাকটিস করতে, কিংবা প্রচার করতে। এ শিষ্যবর্গের মধ্যে কেবল ডাক্তাররাই ছিলেন না-ছিলেন শিল্পী, কবি, লেখক প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার লোক। তার শিষ্য নিউইয়র্কবাসী অস্ট্রীয় চিকিৎসক ব্রিল (Abraham Brill) তার জার্মান ভাষায় লেখাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার পরিচিতির পথ সুগম হয়। ক্রমে তিনি কুখ্যাত থেকে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ইয়্যুৎ, এডলার, র‍্যাঙ্ক, এবং ফেরেঞ্জি ছিলেন তার প্রথম শিষ্য। কিন্তু পরে তারা তার প্রতি বিদ্রোহ করেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিভিন্ন জটিলতা থেকেই প্রথমে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তার পর তাদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল গড়ে ওঠে।

১৯০৫ সনে প্রকাশিত হয় তার নতুন ধারার গবেষণা সমীক্ষণ ‘Three Contributions to the Sexual Theory’। ১৯০৯ সনে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট স্টানলি হল-এর (Stanly Hall) আমন্ত্রণে ফ্রয়েড তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও শিষ্য ইয়াং এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোসমীক্ষণের ওপর তিনি তার বক্তৃতামালা ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করেন। এতে দূতিয়ালি করেন তার ইংরেজি-ভাষী শিষ্য আর্নেস্ট জোন্স (Ernest Jones) । তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকায়, ইউরোপের চেয়েও বেশিমাত্রায় এবং বেশি স্থায়ীভাবে। তবে আমেরিকার সাইকোএনালাইসিস চর্চাকে তিনি অগভীর মনে করতেন। তার মতে, ‘আমেরিকানরা চালাকি করে সব কিছুকে সাধারণ স্তরে নিয়ে আসতে পারে’।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের প্রমাণ স্বরূপ স্টেনলী হল তাকে ১৯০৯ সালে ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ করেন। উক্ত বার্ষিকীতে ইয়্যুৎ ও বক্তৃতা করেন। এই সভায় ফেরেজি (Ferenczi), জোনস (Jones), এবং ব্রিল (Brill) প্রমুখ মনোসমীক্ষণবাদীরা উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া ছিলেন টিচেনার, ক্যাটেল, জেমস প্রমুখ একাডেমিক মনোবিজ্ঞানী। উক্ত মিটিংএ জেমস পুটনাম (James Putnam) নামক একজন স্নায়ুতত্বের অধ্যাপক মনোসমীক্ষণের পৃষ্ঠ পোষক হন।

১৯১০ সনে বিভিন্ন স্থানে যেসব সাইকোএনালাইটিক সোসাইটি গড়ে উঠেছিল সেসবের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল সাইকোএনালাইটিক এসোসিয়েশন’ বা আন্তর্জাতিক মনোসমীক্ষণ সমিতি। বলতে গেলে ফ্রয়েড তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে এটি গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল মনোসমীক্ষণের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই কমিটির কাজের ফলে এবং বহু সংখ্যক রচনা প্রকাশিত হওয়ার ফলে ফ্রয়েড সাফল্য লাভ করেন এবং তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সংগঠনটি যেন ইহুদিদের সংগঠন বলে চিহ্নিত না হয়, সেজন্য খ্রিস্টান কার্ল ইয়ুংকে (Carl Gustav Jung) সভাপতি মনোনীত করা হয়।

১৯১১ সনে তার প্রথম দিককার গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী এডলার (Alfred Adler) তার সঙ্গ ত্যাগ করে নিজস্ব ধারা ‘Individual Psychology’ গড়ে তোলেন। অবশ্য এটি ফ্রয়েডীয় মূল প্রত্যয়-কাঠামোর (paradyme) বাইরে নয়। এদিকে মনোসমীক্ষণের উপরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ইয়্যুৎ (Yung) আমেরিকায় যান এবং বিবৃতি দেন যে, যৌনতার উপর গুরুত্বারূপ কমিয়ে দেওয়া হলে আমেরিকায় মনোসমীক্ষণবাদ সহজে গ্রহণযোগ্য হবে। এনিয়ে ইয়্যুঙ্গের সঙ্গে ফ্রয়েডের মতপার্থক্য আরও বৃদ্ধি পায়। ফ্রয়েডের এই বিরাট সাফল্য এবং স্বীকৃতি সত্ত্বেও তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল কন্টকময়। ফ্রয়েডের ছয় সন্তান ও এক শ্যালিকা নিয়ে বড় সংসারে আর্থিক সংকট তো ছিলই, তাছাড়া তার প্রিয় কয়েকজন ছাত্র মতপার্থক্যের দরুণ তাকে ছেড়ে চলে যান। এর পরে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মন্দা। কিন্তু এর মধ্যেও তার কাজ চলতে থাকে। তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। এ সময়ে তার ব্রিটিশ ও আমেরিকান ছাত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই ছাত্ররাই তাকে যুদ্ধের মন্দার মধ্যে বাঁচতে সাহায্য করেন। মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের বিস্তৃতি ও জনসমর্থন সৃষ্টি করার জন্য ফ্রয়েড তার তত্ত্বকে মার্জিত ও পরিশোধিত করতে থাকেন। তার তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা উপায় হিসাবে তিনি প্রচুর চিঠিপত্র লিখতেন, এসব চিঠিতে মনোসমীক্ষবাদীদের তিনি পরামর্শ দিতেন এবং প্রশংসা করতেন।

১৯১৩ সনে প্রকাশিত হয় ‘Totem and Taboo’। এখানে ফ্রয়েড তার তত্ত্বকে নৃতত্ত্বে ও সমাজতত্ত্বে বিস্তৃত করেন। ১৯১৪ সনে তার আরেক গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য ইয়ং তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজস্ব ধারা ‘Analytical Psychology’ গড়ে তোলেন। এটিও প্রত্যয়-কাঠামোতে ফ্রয়েডীয়।

১৯১৪-১৯১৮ কালপর্বে ইউরোপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবলিত হয়। ফ্রয়েডের এক জামাই সহ তিন ছেলেকেই ফ্রন্টে যেতে হয়। যুদ্ধে যেতে হয় ফ্রয়েডের কয়েকজন শিষ্যকেও, তাও পরস্পরবিরোধী শিবিরে। ফ্রয়েড ভেতর থেকে যুদ্ধের নৃশংসতাকে প্রত্যক্ষ করেন। ১৯১৪ সনেই বের হয় তার Narcissism (আত্মরতি) বিষয়ে প্রবন্ধ। ১৯১৫ সনে তিনি metapsychological papers নামে পরিচিত বারোটি প্রবন্ধ লিখেন। এর উদ্দেশ্য মনঃসমীক্ষণের ভিত্তিস্থিত তাত্ত্বিক অনুমিতিসমূহকে গভীরতর ও সম্পষ্টতর করা। এসবের পাঁচটিকে তিনি প্রকাশ করেন। এগুলি: ‘Instincts and their Vicissitudes’, ‘Repression’, ‘The Unconscious’, ‘A Metapsychological Supplement to the Theory of Dreams’, ‘Mourning and Melancholia’। বাকি সাতটি তিনি কখনোই প্রকাশ করেননি। এগুলি লেখা হয়েছিল ফ্রয়েডের প্রিয় হাঙ্গেরীয় শিষ্য সান্দর ফেরেঞ্চির (Sandor Ferenczi) নিকট পত্রাকারে। ফ্রয়েড গবেষক Grubrich-Simitis ১৯৮৩ সনে পাণ্ডুলিপিটির জার্মান সংস্করণ প্রকাশ করেন। এর ইংরেজি অনুবাদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে A Phylogenetic Fantasy নামে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সনে। নামটি অনুবাদকদের দেয়া।

১৯২০ সনে বের হয় Beyond the Pleasure Principle। এতকাল তার তত্ত্বে মানুষের মূল চালিকাশক্তি ছিল ‘Libido’ বা যৌনাকাঙ্ক্ষা। যা তত্ত্ব বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে ‘Eros’ বা ‘জীবনাকাঙ্ক্ষা’র ধারণায় প্রসারিত হয়। এবার তার তত্ত্বে এল ‘Eros’-এর বিপরীত প্রবণতা ‘Thanatos’ বা ‘মরণাকাঙ্ক্ষা’র ধারণা। জীবনাকাঙ্ক্ষা জীবন্ত বস্তুকে একত্রে ধরে রাখতে চায়, মরণাকাঙ্ক্ষা জৈব বস্তুকে অজৈব বস্তুতে বিচ্ছিন্ন করে। ‘অতএব বলা যায় সকল মৃত্যুই আসলে ছদ্মবেশী আত্মহত্যা।’ আগে তিনি আগ্রাসনকে (aggression) একটি মৌলিক প্রেষণা হিসাবে স্বীকার করতে চাননি। এবার আগ্রাসনের গুরুত্বকে স্বীকার করে বললেন, ‘আগ্রাসন’-এর মূলে রয়েছে ‘মরণাকাঙ্ক্ষা’।

১৯২০ সনে তার দ্বিতীয় মেয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে মারা যান। সে বছরই তিনি ‘Professor’ পদে বৃত হন। তার পরবর্তী রচনা ‘Group Psychology and the Analysis of the Ego’ বের হয় ১৯২১ সনে। এতে তিনি মনঃসমীক্ষণের ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি-মনস্তত্ত্বের ধারণার সাহায্যে গোষ্ঠী এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, আন্তঃব্যক্তি আবেগগত বন্ধন ‘সমষ্টি মনস্তত্ত্বের’ও সারমর্ম।

তার তত্ত্বীয় কর্মের শেষ গুরুত্বপূর্ণ বই The Ego and the Id, প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সনে। এতে তিনি Id, Ego, Superego সংবলিত প্রকোষ্ঠ ভিত্তিক মনের তত্ত্বগত ভিত্তিটি সম্পন্ন করেন। Superego উদ্ভবের প্রক্রিয়াটিও এতে বিকশিত করেন তিনি। এ বছরই তার চোয়ালে ক্যান্সারের জন্য প্রথম অপারেশন হয়। এ জন্য তার মোট ২৩ বার অপারেশন হয়েছে। সেই বছরেই ক্যান্সার ধর পড়েছিল। খুব সম্ভবতঃ এই ব্যাধির জন্য তার দৈনিক ২০টি করে সিগার পানের অভ্যাসই দায়ী। অপারেশন করে তার তালু ও উপরের মাড়ির কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। মুখ থেকে নাকের গহ্বরকে আলাদা রাখার জন্য এবং খাদ্য গ্রহণ ও কথা বলার জন্য তাকে একটি নকল তালু লাগাতে হয়। এভাবেই তার জীবনের শেষ ১৬ বৎসর প্রচন্ড ব্যাথা বেদনা, আর আশা নিরাশা ও বাস্তবতার সংমিশ্রনে কাটে।

১৯০৮ সনে ফ্রয়েড ভিয়েনা নগর কর্তৃপক্ষের নিকট স্থায়ী অভিবাসিত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন। তার জন্মস্থানটি যেহেতু অস্ট্রোহাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের সীমার মধ্যেই, তাই তার আবেদন গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু তিনি ভিয়েনার অভিবাসিত্ব পেলেও নাগরিকত্ব পাননি। ১৯২৪ সনে ভিয়েনার নগর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘সম্মানিত নাগরিক’-এর সনদ দিয়ে নিজেরা সম্মানিত বোধ করেন।

১৯২৬ সনে বের হয় তার প্রবন্ধ ‘Inhibitions, Syptoms and Anxiety’। এতে তিনি উদ্বেগ বিষয়ে তার তত্ত্ব বিবৃত করেছেন। ১৯২৭ সনে প্রকাশিত হয় ধর্ম বিষয়ে তার বই The Future of an Illusion। ফ্রয়েডের মতে ধর্মের ভিত্তি ইচ্ছাপূরণের আবেগ, বিজ্ঞানের ভিত্তি বাস্তববোধ ও যুক্তিবুদ্ধি। দুই ভিন্ন প্রকার ভিতের উপর নির্মিত ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্কটা প্রতিযোগিতার নয়; বৈরিতার। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু ধর্ম। ফ্রয়েড বলেন, শিশু যখন মা থেকে তার নিজের পৃথক অস্তিত্ব বুঝতে পারে, তখনই বুঝতে পারে মা তার আশ্রয় এবং রক্ষক। ক্রমে শিশুটি বোঝে, তার মায়ের রক্ষাকর্তা ও আশ্রয়দাতা তার বাবা। পিতা শক্তিশালী, কিন্তু তার সামর্থ তো সীমিত। তাই অমিত শক্তিধর এক পিতার জন্য তার আর্তি। এই ব্যাকুল চাহিদা থেকেই সে অমিত শক্তিধর এক পিতার কল্পনা করে। শিশুর মনে কল্পনা ও বাস্তবের ফারাক খুব কম। তাই তার কল্পনাকেই সে সত্য বলে ধরে নেয়। এভাবেই সে তার অভীষ্ট আশ্রয় ও রক্ষাকর্তার সৃষ্টি করেছে। ঈশ্বর ও তার অনুষঙ্গ ধর্ম একটি কল্পসৃষ্টি, একটি নির্মাণ, যার বাস্তব ভিত্তি নেই। বয়স্করাও বহুবিধ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে তাদের শৈশবের সেই সৃষ্টিকেই আঁকড়ে রেখেছেন। ধর্মীয় সংস্থাগুলি (গির্জা-আশ্রম, যাজক-পুরোহিত) এই বিশ্বাসের পৃষ্ঠপোষক ও প্রচারক। তাদের দাবি ধর্মই জীবের একমাত্র আশ্রয়। ঈশ্বর তাদের সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন, যে কোনো বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। সভ্যতার স্বার্থে তারা যে বাসনাগুলিকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তার পূর্তি ঘটবে পরবর্তী জীবনে। ধর্ম মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করে। কারণ ধর্মমতে মৃত্যুই শেষ নয়, মৃত্যুপরবর্তী জীবন রয়েছে।

ফ্রয়েডের মতে, ‘বস্তুসত্তার যথার্থ স্বরূপ মানুষের অগম্য’। তাই ‘আমাদের মনের সাংগঠনিক কাঠামোর মারফৎ জগতের স্বরূপ নির্ণয় করাই বৈজ্ঞানিক কার্যাবলীর সীমারেখা। … আমাদের মানসিক সরঞ্জামের সঙ্গে সঙ্গতিহীন যে জগৎ, তার স্বরূপ নির্ণয়ের সমস্যাটি একটি প্রয়োজনহীন অসার বিমূর্তকরণ ছাড়া কিছু নয়। … বিজ্ঞানের পক্ষে যা অসাধ্য তাকে লভ্য মনে করা কল্পনা মাত্র’।

ফ্রয়েড ১৯৩০ সনে প্রকাশ করেন Civilization and Its Discontents. এতে তার ‘Eros-Thanatos’ দ্বন্দ্বের তত্ত্বটিকেই সভ্যতার ইতিহাস ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, ‘যদি অল্পসংখ্যক ব্যক্তি আক্রমণবৃত্তির লক্ষ্য হিসাবে থেকে যায়, তবেই বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব’। কাজেই মনস্তাত্ত্বিক বিবেচনায় সাম্যবাদের ধারণাকে তিনি ‘ভিত্তিহীন ও ভ্রান্তিকর’ মনে করেন। সে-সময়টাতে তার ব্যক্তি-জীবনের তিক্ততা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল এর কিছু আঁচ করা যায় তার সে-সময়ের একটি সাক্ষাৎকার থেকে। তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমার ভাষা জার্মান, আমি মানসিকভাবে নিজেকে জার্মানই মনে করতাম, যতদিন না জার্মান ও অস্ট্রিয়ান জার্মানদের মধ্যে সেমেটিক বিরোধী সংস্কার গড়ে উঠতে দেখেছি। এর পর থেকে আমি আর নিজেকে জার্মান মনে করি না। আমি নিজেকে ইহুদি বলতেই পছন্দ করি।’

১৯৩৩ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ প্রতিরোধে গঠিত হয় বুদ্ধিজীবী সংঘ। সংঘের পক্ষে আইনস্টাইনের আহ্বানে ‘যুদ্ধ কেন হয়’ এ ব্যাপারে তার মত জানিয়ে ফ্রয়েড একটি নিবন্ধ লিখেন। সংঘের পক্ষ থেকে আইনস্টাইনের চিঠি এবং ফ্রয়েডের উত্তর Why War নামক পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়। তার মতে মনের অন্তর্নিহিত মরণাকাঙ্ক্ষাই যুদ্ধের কারণ। এটি মানব-প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র সভ্যতা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়ে, মরণাকাঙ্ক্ষার বিপরীত প্রবৃত্তি জীবনাকাঙ্ক্ষাকে পুষ্ট করে এবং মানুষের আত্মবোধের বিস্তার ঘটিয়েই যুদ্ধ বন্ধের আশা করা যেতে পারে।

১৯৩৮ সনে নাৎসিরা অস্ট্রিয়া দখলের পর ফ্রয়েডের প্রকাশনালয় সমেত সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, তাকে গৃহবন্দি করে। ফয়েডের অবিক্রীত পুস্তকগুলো তারই সম্মুখে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এমন কি তার জীবনের উপরেও হুমকি দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক সাইকোএনালাইটিক এসোসিয়েশন ফ্রয়েডের মুক্তির জন্য তীব্র আন্দোলন করে। তার শুভানুধ্যায়ীরা নাৎসিদের সঙ্গে দেন-দরবার করেন। আর্নষ্ট জোন্স ফ্রয়েডের জীবনের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তাকে ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করেন। মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের বিনিময়ে নাৎসিরা ফ্রয়েডের পরিবারকে লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ফ্রয়েডের এক বোন ভিয়েনা থেকে পালাতে সক্ষম হন। বাকি চার বোনকে ফ্রয়েড সঙ্গে নেননি কিংবা নিতে পারেননি। জোনস্ যে আশঙ্কা করেছিলেন তা যে সত্যি ছিল তা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছিল। ফ্রয়েডের চার বোন, যারা অষ্ট্রিয়াতে ছিলেন, তাদের সবাইকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়।

ইংল্যান্ডে ফ্রয়েডকে সাদরে অভ্যর্থনা করা হলেও তিনি তার জীবন উপভোগ করতে পাচ্ছিলেন না। তার মুখে ত্রিশবার অপারেশন করা হয়েছিল। তিনি খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। তার জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত শেষ গ্রন্থ Moses and Monotheism প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সনে। এতে তিনি তার তত্ত্বীয় অবস্থান থেকে সাধারণভাবে ধর্মের উৎপত্তি এবং বিশেষভাবে ইহুদি একেশ্বরবাদের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি তার ২৫ বছর আগে প্রকাশিত Totem and Taboo গ্রন্থেরই সম্প্রসারণ। তার জীবনের শেষ লেখাটি অসম্পূর্ণ। এটি তার মৃত্যুর পর An Outline of Psychoanalysis নামে প্রকাশিত হয়।

ফ্রয়েড ১৯৩০ সনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিজের অহম আর পরিবেশের মধ্যকার অবিরাম সংগ্রামই তো জীবন। একে অহেতুক দীর্ঘায়িত করার চিন্তা উদ্ভট মনে হয় আমার।’ তিনি ১৯২৩ সন থেকে চোয়ালে ক্যানসারের যন্ত্রণা নিয়ে শান্তভাবে তার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্রমেই তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়। একটি নিষ্ক্রিয় যন্ত্রণাকাতর জীবনের চেয়ে মৃত্যুকেই তিনি শ্রেয় মনে করেন। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও গবেষণার উত্তরসূরী, কনিষ্ঠ কন্যা, চিরকুমারী আন্না তাকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। আন্নার উপস্থিতিতে ফ্রয়েডের প্রিয় চিকিৎসক তাকে মরফিন ইনজেকশন দিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত করে দেন। তারিখটি ১৯৩৯ সনের ২৩ সেপ্টেম্বর।

ফ্রয়েডের রচনাবলি : ফ্রয়েড এর তত্ত্বটি মোটামুটিভাবে প্রথম সর্বসাধারণের মনোযোগের বিষয় হয় যখন তার প্রথম বই ‘The Interpretation of Dreams’ (1899-1900) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ফ্রয়েড আরো কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • 1. The Interpretation of Dreams (1900),
  • 2. The Pschopathology of everyday (1901),
  • 3. Jokes and their Relation to the Unconscious: A Case of Hysteria (1905).
  • 4. Three Essay on Sexuality (1905),
  • 5. Totem and Taboo (1913),
  • 6. On the History of the Psycho-analytical Movement (1914).
  • 7. Group Psychology and the Analysis of the Ego (1921).
  • 8. An Autobiographical Study (1925),
  • 9. The Future of an Illusion (1927),
  • 10. Civilization and Its Discontents (1930),
  • 11. Moses and Monotheism (1934-1938)।

ফ্রয়েডের ওপর বিভিন্ন দার্শনিক প্রভাব

পূর্বগামী প্রভাব সমূহ (Historical Antecedents) ও সমকালীন ইউরোপীয় চিন্তাধারা

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। এই তত্ত্বের কতগুলো ধারণা এবং সূত্র এত অভিনব ছিল যে অনেকেই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। তারা এ ধারণাগুলোকে সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে ফ্রয়েড যখন জানালেন যে প্রত্যেক মানুষের মনে একটি আদিম যৌন কামনা লুকিয়ে আছে-ফ্রয়েড যাকে “লিবিডো” বলে অভিহিত করেন, তখন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং প্রাচীন পন্থী মনোবিজ্ঞানী সম্প্রদায় তা মোটেই গ্রহণ করতে চাননি। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে ফ্রয়েডের ও কয়েকজন পূর্বসূরী ছিলেন যারা ফ্রয়েডের ধারণার মতই কিছু ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের বিকাশের জন্য দু’ ধরনের প্রভাবকে দায়ী করা চলে।

  • (১) সেই সময়ে ইউরোপে বুদ্ধির চর্চার যে পরিবেশ ছিল, সেই পরিবেশ মনোসমীক্ষণবাদের বিকাশকে সাহায্য করেছে।
  • (২) কয়েকজন পূর্বসূরীর চিন্তাধারা ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বগঠনে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লিবনিজ (Leibniz 1646-1715) বাস্তব সত্তা সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। লিবনিজের এই তত্ত্বকে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের পূর্বসূরী বলা চলে। লিবনিজের তত্ত্বে বস্তুর আদিম উপাদান হলো মোনাড (monads) এবং এই মোনাড ডেমোক্রিটাসের যান্ত্রিক শক্তি সম্পন্ন ‘অণু’ বা এটমের ধারণা থেকে বহুলাংশে পৃথক। মোনাডগুলি প্রকৃতপক্ষে কোন পদার্থ নয়, এগুলোকে বরং শক্তি কেন্দ্র বলা চলে। প্রত্যেকটি শক্তি কেন্দ্র অন্যটির চেয়ে পৃথক ও স্বাধীন এবং এগুলোর ভিতর থেকে শক্তির উৎসারণ ঘটে। এগুলো প্রেষণার কেন্দ্র বা স্বয়ংচালিত শক্তি সম্পন্ন অস্তিত্ব। সক্রিয়তাই হল অস্তিত্বের মূল শর্ত। ফ্রয়েড তার শিক্ষাজীবনে যান্ত্রিক শক্তির ধারণার যে পরিবেশে গড়ে উঠেছিল তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে লিবনিজ এর গতিশীল শক্তির ধারণা গ্রহন করেন। লিবনিজ অচেতন (unconscious) এবং চেতনার বিভিন্ন পর্যায় বা মাত্রার কথাও বলেছিলেন। লিবনিজের প্রায় এক শতাব্দী পরে হার্বার্ট (Herbart) লিবনিজের কিছু ধারণা নিয়ে ধারণার দ্বন্দ্বের একটি গাণিতিক তত্ত্ব গঠন করেন। এই তত্ত্বে তিনি দ্বন্দুরত ধারণাগুলোর সচেতন স্তরে আত্ম প্রকাশ করার গাণিতিক সূত্র প্রণয়ন করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফ্রয়েড ‘অচেতন’ মন সম্পর্কে ধারণাটি সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন নি। তবে ফ্রয়েডের অবদান হলো এই যে, তিনি অচেতন এর বৈশিষ্ট্যগুলির বিশদ বর্ণনা দেন এবং এগুলোর কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করেন। তবে অবদমন (repression) এর ধারণাটি ফ্রয়েডের আগে শোপেনহাওয়ার আবিষ্কার করেছিলেন। শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন যে মানুষ কতগুলো অভিজ্ঞতাকে অচেতন মনের গভীরে অবদমন করে এবং এগুলোর সচেতন স্তরে আগমনে, অর্থাৎ স্মৃতিতে বাধা সৃষ্টি হয়। তবে ফ্রয়েড বলেন যে, এসব ধারণা আবিষ্কার করার আগে তিনি শোপেনহাওয়ারের লেখা পড়েন নি।

ভিয়েনায় ফ্রয়েড ফ্রেঞ্জ ব্রেন্টানোর বক্তৃতা শুনেছিলেন। কারণ সে সময় ব্রেন্টানো সেখানে খুব নামকরা অধ্যাপক ছিলেন। সুতরাং ব্রেন্টানোর মাধ্যমেই লিবনিজের ধারণাগুলোর সাথে ফ্রয়েডের পরিচয় ঘটে। ব্রেন্টানো নিজেও তার মনোবৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ উপাদান (elements) তত্ত্বের উপরে ভিত্তি না করে লিবনিজের ক্রিয়া সম্পর্কিত ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন।

ফ্রয়েডের চিন্তাধারার বিকাশে জার্মানীর রোমান্টিক-বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রত্যক্ষ অবদান লক্ষ্য করা যায়। এই ধারার সবচেয়ে বিখ্যাত দুজন ব্যক্তি হলেন গ্যেয়টে এবং শেলিং। ফ্রয়েড কর্তৃক বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য গ্যেয়টের একটি রচনাকে দায়ী করা হয়; এই রচনাটি ছিল প্রকৃতি (nature) সম্বন্ধে। জোনস (Jones, 1953) বলেন ফ্রয়েড মানুষের আচরণের যে চালিকাশক্তি আবিষ্কার করেছিলেন তার মূলে ছিল প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও সহমর্মিতা।

ফ্রয়েডের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অবশ্য তাকে অন্য একটি ঐতিহ্যে স্থাপন করেছিল। সেটি হলো হেলমজের যান্ত্রিক চিন্তাধারা। ফ্রয়েড আর্নস্ট ব্রুক (Brucke) এর মাধ্যমে হেলমজের চিন্তা ধারার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই সময় ব্রুক ভিয়েনার ফিজিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। ব্রুক (Brucke), লাদউইগ (Ludwig) এবং দ্যু বয়েজ-রেমন্ড হেলমজের সঙ্গে একটি এন্টিভাইটালিষ্টিক জোটগঠন করেন। এরা সবাই তখন ২০-২৫ বৎসরের যুবক। তারা এটা সবাইকে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে লাগলেন যে, পদার্থের মধ্যে যে ধরণের শক্তি নিহিত রয়েছ তার বাইরে অন্য কোন শক্তি জীবন্ত প্রাণীর শরীরে নেই। এই তত্ত্বটি প্রমাণ করার জন্যই হেলমজ শক্তির অবিণাশিতা সম্পর্কে “Conservation of energy” বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সম্ভবতঃ এই ঐতিহ্যের সংস্পর্শে আসার দরুণই ফ্রয়েড স্বপ্ন, দিবাস্বপ্ন, উপস্থিত বুদ্ধি এবং ভুল সম্পর্কে নির্ধারণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করেন। অর্থাৎ এসব ঘটনাবলীও যে কতগুলো মনস্তাত্ত্বিক শর্তের দ্বারা নির্ধারিত এ তত্ত্ব প্রচার করেন। ফ্রয়েডের এ নীতিটিকে “Psychic determinism” বলা হয়। সম্ভবত ফ্রয়েডের অচেতন (unconscious) প্রক্রিয়ার ধারণাটি তিনি হেলমজ এর অচেতন অনুমান (unconscious inference) এর ধারণা থেকেই তৈরী করেছিলেন। প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে সনাক্তকরণযোগ্য জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে আমরা কিভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হই, তা ব্যাখ্যা করার জন্য হেলমজ অচেতন অনুমান প্রক্রিয়ার ধারণাটির সাহায্য নিয়েছিলেন।

ডারউইনের তত্ত্ব ফ্রয়েডের নির্ধারবাদী চিন্তাধারাকে শক্তিশালী করেছিল বলে মনে হয়। ফ্রয়েড যখন চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেন তখন কলেজে ও হাসপাতালে ডারউইনের বিবর্তনবাদী তত্ত্বের আলোচনা শুনেছেন। তিনি মানুষকে জীববিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন এবং তার অনেকগুলো ধারণা তিনি বিবর্তনবাদের উপর ভিত্তি করে তৈরী করেন। জীবনের আবির্ভাব সম্পর্কে তার জীবনপ্রবৃত্তি ও মরণপ্রবৃত্তি সম্পর্কিত ধারণাগুলো বিবর্তনবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

হাফলিংস জেকসন (Huglings Jackson) এর মধ্যে শারীরবৃত্তীয় ও বিবর্তনবাদী চিন্তাধরার সমন্বয় ঘটে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিবর্তনের ফলে স্নায়ুতন্ত্রের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ঘটে এবং উন্নত স্নায়ুসংগঠন অপেক্ষাকৃত বেশী জটিল হয়। তবে উন্নততর প্রাণীদের স্নায়ুসংগঠন জটিল হলেও সাংগঠনিকভাবে সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত নয়। স্নায়ুতন্ত্রের উন্নত সংগঠনগুলির মধ্যকার স্নায়বিক সংযোগগুলো প্রাণীর জন্মের পরে আস্তে আস্তে বিকাশ লাভ করে। জ্যাকসন মনে করতেন যে, স্নায়বিক রোগে স্নায়ু ব্যবস্থার অপচয় ঘটে। এই প্রক্রিয়াটি দ্বারা তিনি বিবর্তনের বিপরীত প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করেন। হার্নষ্টাইন এবং বোরিং (১৯৬৫) মনে করেন যে, ফ্রয়েড প্রত্যাবৃত্তি (regression) এর ধারণাটি জ্যাকসনের ওই ধারণাটির আদলে গঠন করেছিলেন।

ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের বিকাশের জন্য ধর্মীয় ঐতিহ্যকেও দায়ী করা হয়েছে। মার্কস ও হিলিক্স বলেছেন যে, পরস্পরবিরোধী দুটি ধারার অবদানের ফলে ফ্রয়েডের চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে। একটি হলো রোমান্টিক অতিন্দ্রীয়বাদী ভাবধারা, অন্যটি হলো যান্ত্রিক মতবাদ। ফ্রয়েডের রোমান্টিক এবং অতিন্দ্রীয় মতবাদ প্রাণশক্তি আহরণ করেছিল ফ্রয়েডের ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে। ইহুদী ধর্মে ও সাহিত্যে যৌন ক্রিয়াকলাপকে অতিন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়। এই প্রসঙ্গটি নিয়ে ব্যাকান (Bakan, 1958) বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।

দেহ-মন সম্পর্কে যে অতিন্দ্রীয় ও রোমান্টিক ধারণা প্রচলিত ছিল তার সাথে গুস্তাভ ফেকনারের যান্ত্রিক ধারণার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্ব ফেকনার ও ফ্রয়েড উভয়ের মধ্যেই দেখা দেয়। তবে ফেকনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এই সমস্যাটির সমাধান করেন। আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী ইতিপূর্বে অতিন্দ্রীয় সমস্যা বলে বিবেচিত কতগুলো সমস্যা প্রাকৃতিক নিয়মাবলী দ্বারা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন, যেমন ডারউইন (প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং বিবর্তন), এবিংহস (স্মৃতি), প্যাভলভ (আচরণের সাপেক্ষণ), স্কিনার (কুসংস্কারমূলক আচরণ), ইত্যাদি। এলেনবার্জার (Ellenberger. 1956) দেখিয়েছেন যে, ফেকনারের সাথে ফ্রয়েডের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। ফ্রয়েড ফেকনারের লেখা পড়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। ফ্রয়েডের কয়েকটি ধারণা, যেমন, উদ্দীপনার তীব্রতা, মানসিক শক্তি (mental energy) মনের ক্রিয়া সমূহের স্থানীয়করণ (Topographical concept of mind) এগুলো ফেকনারের রচনার সঙ্গে সম্পর্কিত।

অচেতন

প্রথমেই আসা যাক মনের অসচেতন দিকটি প্রসঙ্গে। ফ্রয়েড-পূর্ব মনোবিজ্ঞানে মনের অসচেতন দিকটি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হত না। ফ্রয়েড শুধুমাত্র এর গুরুত্বকে তুলে ধরেননি; একেই মানুষের আচরণের নির্ধারকের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। এর নজির মনোবিজ্ঞানে না থাকলেও দর্শনে রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লিবনিজ (Leibniz 1646-1715) বাস্তব সত্তা সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। লিবনিজের এই তত্ত্বকে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের পূর্বসূরী বলা চলে। তারপর থেকে অচেতন মন জার্মান সংস্কৃতি বলয়ে বিভিন্নভাবে আলোচিত হতে থাকে। লিবনিজের সেই তত্ত্বকে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের পূর্বসূরী বলা চলে। লিবনিজের তত্ত্বে বস্তুর আদিম উপাদান হলো মোনাড (monads) এবং এই মোনাড ডেমোক্রিটাসের যান্ত্রিক শক্তি সম্পন্ন ‘অণু’ বা এটমের ধারণা থেকে বহুলাংশে পৃথক। মোনাডগুলি প্রকৃতপক্ষে কোন পদার্থ নয়, এগুলোকে বরং শক্তি কেন্দ্র বলা চলে। প্রত্যেকটি শক্তি কেন্দ্র অন্যটির চেয়ে পৃথক ও স্বাধীন এবং এগুলোর ভেতর থেকে শক্তির উৎসারণ ঘটে। এগুলো প্রেষণার কেন্দ্র বা স্বয়ংচালিত শক্তি সম্পন্ন অস্তিত্ব। সক্রিয়তাই হল অস্তিত্বের মূল শর্ত। ফ্রয়েড তার শিক্ষাজীবনে যান্ত্রিক শক্তির ধারণার যে পরিবেশে গড়ে উঠেছিল তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে লিবনিজ এর গতিশীল শক্তির ধারণা গ্রহন করেন। লিবনিজ অচেতন (unconscious) এবং চেতনার বিভিন্ন পর্যায় বা মাত্রার কথাও বলেছিলেন। লিবনিজের প্রায় এক শতাব্দী পরে হার্বার্ট (Herbart) লিবনিজের কিছু ধারণা নিয়ে ধারণার দ্বন্দ্বের একটি গাণিতিক তত্ত্ব গঠন করেন। এই তত্ত্বে তিনি দ্বন্দুরত ধারণাগুলোর সচেতন স্তরে আত্ম প্রকাশ করার গাণিতিক সূত্র প্রণয়ন করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফ্রয়েড ‘অচেতন’ মন সম্পর্কে ধারণাটি সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন নি। তবে ফ্রয়েডের অবদান হলো এই যে, তিনি অচেতন এর বৈশিষ্ট্যগুলির বিশদ বর্ণনা দেন এবং এগুলোর কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করেন। তবে অবদমন (repression) এর ধারণাটি ফ্রয়েডের আগে শোপেনহাওয়ার আবিষ্কার করেছিলেন। শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন যে মানুষ কতগুলো অভিজ্ঞতাকে অচেতন মনের গভীরে অবদমন করে এবং এগুলোর সচেতন স্তরে আগমনে, অর্থাৎ স্মৃতিতে বাধা সৃষ্টি হয়। তবে ফ্রয়েড বলেন যে, এসব ধারণা আবিষ্কার করার আগে তিনি শোপেনহাওয়ারের লেখা পড়েন নি।

শোপেনহাওয়ার (Schopenhauer) বলেন, কান্ট কথিত বস্তুসার বা স্বগত বস্তু (Thing in itself) বা নাউমেনন (noumenon) একটি অন্ধ অযৌক্তিক ইচ্ছা (Will)। এই দৃশ্যমান জগৎ (phenomenon) সেই ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। বিপরীতে হেগেল-এর (Hegel) তত্ত্বে দৃশ্যমান জগৎ ‘পরমভাব’-এর (Absolute Idea) প্রকাশ। হার্টমেন (Eduard von Hartmann) তার Philosophy of the Unconscious বইয়ে বলেন, বস্তুসার শোপেনহাওয়ার বর্ণিত ইচ্ছা ও হেগেল বর্ণিত ভাব/বুদ্ধি (Idea) সমন্বয়ে গঠিত। এদের একটি অন্যটির অধীন নয়। শোপেনহাওয়ার-শিষ্য নীৎশে (Nietzsche) ঘোষণা দেন, শোপেনহাওয়ার বর্ণিত অন্ধ ইচ্ছাটি, যেটিকে তিনি ‘বাঁচার ইচ্ছা’ (Will to Live) বলে চিহ্নিত করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ (Will to Power)। ফ্রয়েড, নীৎশেকে প্রথম মনঃসমীক্ষকের মর্যাদা দিয়েছেন। মন সম্পর্কিত ধারণা গঠনে ফ্রয়েড সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলেন, তার সমসাময়িক দর্শনের অধ্যাপক থিওডর লিপ্স-এর (Theodor Lipps) ধারণা দ্বারা। ফ্রয়েড ছিলেন, অচেতন মনের প্রবক্তা এই প্রভাবশালী জার্মান অধ্যাপকের গুণগ্রাহীদের একজন।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় দর্শনে ‘সচেতন যৌক্তিক মন’-এর জয় জয়কার। ঊনবিংশ শতকে এসে তা ‘অচেতন অযৌক্তিক মন’-এর বিজয় ঘোষণায় পর্যবসিত হয়। এর গভীরে আর্থসামাজিক কারণ রয়েছে। উপরিউক্ত প্রথম দুই শতক ছিল পুঁজিবাদের বিকাশ এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে তার বিজয়ের কাল। কিন্তু উনবিংশ শতকে বিজয়ী পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংকটের রূপ নিতে থাকে, যা প্রকাশিত হয় সামাজিক অসন্তোষ ও আন্দোলনে। পুঁজিবাদ ক্রমেই সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অর্জিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহকে সংকুচিত করে স্বৈরাচারী রূপ নিতে থাকে। বিশ শতকের নাৎসি জার্মানিতে নীৎশের দর্শনই হয়ে দাঁড়ায় প্রধান দর্শন। উল্লেখ্য, মনের অসচেতন কাজের প্রতি গুরুত্বদানকারী উপরিউক্ত দার্শনিকগণ সকলেই জার্মান। ফ্রয়েড নিজেও জার্মানভাষী। তার জীবন অতিবাহিত হয়েছে জার্মান সংস্কৃতি বলয়ে।

প্রকোষ্ঠভিত্তিক মন

মনের তিন প্রকোষ্ঠের ধারণা ইউরোপীয় দর্শনে অতি পুরাতন। প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থের চতুর্থ পুস্তকে মানসসত্তাকে তিনটি স্বাধীন অংশে ভাগ করেছেন – desiring, reasoning, spiritual। অর্থাৎ একটি ‘অন্ধ-কামনা’ একটি ‘বিচার-বিবেক’ এবং আরেকটি ‘সংগ্রামী’। সংগ্রাম মানে, বেঁচে থাকার জন্য একান্তই যা করণীয়, তাই। দীর্ঘ তর্ক তুলে প্লেটো প্রমাণ করতে চাইছেন এ তিনটি অংশ স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনটি অংশের মধ্যে প্রবল বিরোধ ও দ্বন্দ্ব। বিরোধটা অবশ্য সবচেয়ে তীব্র ওই অন্ধ কামনা আর বিচার-বিবেক এর মধ্যেই। সংগ্রামী অংশটাকে তাই প্রায়ই এ বিরোধের মধ্যস্থতা করতে হয়। আমরা যদি প্লেটোর মনের এ তিনটি অংশকে যথাক্রমে ইদ্, সুপারইগো এবং ইগো দ্বারা প্রতিস্থাপিত করি, তাহলেই ফ্রয়েড- তত্ত্বের প্রকোষ্ঠভিত্তিক মনের ধারণাটি পেয়ে যাই।

এ প্রকোষ্ঠভিত্তিক মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের কর্মাঞ্চল ও কর্মপ্রক্রিয়ার সম্বন্ধ কী, তা ফ্রয়েড-তত্ত্বে অনুল্লিখিত। তাই তার মনটি আপাত মস্তিষ্ক ভিত্তিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে অবলম্বনহীন। আমরা জৈব ও অজৈব পদার্থের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য জানি। যদিও জৈব পদার্থ অজৈব পদার্থ দিয়েই গঠিত, তবু গঠন বিন্যাসে জটিলতার জন্য সেখানে এমন কিছু গুণের উদ্ভব হয় যা জৈব বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত। নতুন গুণের উদ্ভব ঘটলেও জৈব পদার্থের ভিত্তিতে কিন্তু রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যার নিয়মাবলী কার্যকর থাকে। একই কথা রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানের সম্পর্কের বেলাতেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ বস্তু বিভিন্ন স্তরের সংগঠনে বিন্যস্ত হয়, রূপান্তরিত হয়। সংগঠনের প্রতিটি স্তরের বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু গুণাবলী থাকে। আবার সংগঠনের অপেক্ষাকৃত সরলতর ও জটিলতর পর্যায়ের মধ্যে একটি সম্পর্কও থাকে। মনের কিছু গুণাবলী রয়েছে যা জৈব পদার্থের গুণাবলী থেকে ভিন্ন ও নতুন। কিন্তু এ গুণাবলীর সঙ্গে মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়ার একটি সম্বন্ধও রয়েছে। কারণ মন মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়ার প্রকাশ। এ সম্বন্ধটি ফ্রয়েড-তত্ত্বে অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে ফ্রয়েড প্রতিটি জীবকোষের জীবন্ত সবকিছুকে একত্রে ধরে রাখতে চাওয়ায় এবং জীবন্ত বস্তুর অজৈব বস্তুতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রবণতায় মনের দুই বিপরীতমুখী চালিকাশক্তির সন্ধান করেছেন। এসব দার্শনিক দূর-কল্পনার প্রকাশ, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বপ্রস্তাব (hypothesis) নয়। ব্যক্তি-মনসমূহের মিথস্ক্রিয়াতে উদ্ভূত সমষ্টিমন বা সমাজমনস্তত্ত্বে যে নতুন গুণের উদ্ভব ঘটে, সে ধারণাও ফ্রয়েডতত্ত্বে অনুপস্থিত। বিপরীতে ফ্রয়েড ব্যক্তিমনস্তত্ত্ব দিয়েই সমষ্টিমনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রেষণা

ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল নিউরোটিক রোগীদের আচরণ। এর উদ্দেশ্য ছিল এসব অস্বাভাবিক আচরণের কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা। তা করতে গিয়ে তিনি যে তত্ত্ব গড়েন, তাকেই তিনি প্রসারিত করেন সব যুগের সব মানুষের সাধারণ মনস্তত্ত্বে। এজন্য তিনি তার পর্যবেক্ষণকে শিশুদের লালন-পালন এবং মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি তত্ত্ব রচনায় স্বীকার্য হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন সে সময়ের প্রকৃতিবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের প্রচলিত কিছু ধারণাকে।

তার সময় প্রকৃতি-বিজ্ঞানে ভৌত ও রাসায়নিক শক্তির ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দুয়ের অনুকরণে জীববিজ্ঞানেও ‘প্রাণশক্তি’র ধারণাটি তত্ত্বপ্রস্তাব আকারে চালু ছিল। পরে এটি পরিত্যক্ত হয়। ফ্রয়েড এসবের অনুকরণে ‘মানসিক শক্তি’র (psychic energy) কল্পনা করে এ শক্তির চলন-প্রক্রিয়া (psychodymics) নিয়েই তত্ত্ব রচনা করেন। মনোবিজ্ঞানে তার প্রবর্তিত ধারাটি ‘সাইকোডিনামিকস’ নামেই পরিচিত। কিন্তু এ মানসিক শক্তির প্রকৃতিটি কী, তা তিনি কখনোই ব্যাখ্যা করেননি।

তত্ত্ব রচনার প্রথম পর্যায়ে ফ্রয়েড একটিমাত্র এষণাকে চিহ্নিত করেছিলেন, এটি যৌনাকাঙ্ক্ষা (libido)। শুধুমাত্র একটি এষণা দিয়ে সব মানবিক আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, তিনি লিবিডো তত্ত্বকে সর্বরতিবাদ (pansexualism) পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার মতে, লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের মূল চালিকাশক্তি, ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে খাদ্য উৎপাদনের সচেতন ইচ্ছা নয়; তা ইডিপাস কমপ্লেক্স বা মায়ের সঙ্গে সংগম করে তাকে গর্ভবতী করার অচেতন আকাঙ্ক্ষা। ফ্রয়েড যে এ উদ্ভট তত্ত্ব প্রণয়নে সাহসী হয়েছিলেন, এর পিছনে শুধু তার সাইকোথেরাপিতে লব্ধ অভিজ্ঞতাই কাজ করেনি; কাজ করেছিল শোপেনহাওয়ার-এর দর্শন এবং জীববিজ্ঞানে ডারউইন-তত্ত্বের সফলতার উদাহরণ। তাছাড়া তার মনোবিজ্ঞানের তত্ত্বটিকে জীববিজ্ঞানের তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার তাগিদও ছিল। শোপেনহাওয়ারের মতে সব কিছুর মূলে যে ‘ইচ্ছা’ বর্তমান, তা ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’। জীবের বেলায় এ ইচ্ছাটি কার্যকর হতে পারে সন্তানের জন্ম দিয়ে। তাই শোপেনহাওয়ারের মতে যৌনতাই মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী ইচ্ছা। যৌনতাকে তত্ত্বালোচনায় অবহেলা করার দায়ে তিনি দার্শনিকদেরকে অভিযুক্ত করেছেন। স্বয়ং ডারউইন এক্ষেত্রে শোপেনহাওয়ারের নিকট তার ঋণ স্বীকার করেছেন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে প্রজনন সফলতার ভাষ্যেও প্রকাশ করা যায়। যে জীব যত বেশি প্রজনন সফল অর্থাৎ যত বেশি বংশধর রেখে যেতে পারে, প্রাকৃতিক নির্বাচনে তার বংশাণুর টিকে থাকার সম্ভাবনা ততোধিক। এ তত্ত্বটি থেকে ফ্রয়েড অচেতন যৌনাকাঙ্ক্ষাকে মানুষের একমাত্র চালিকাশক্তি হিসাবে কল্পনার সাহস পেয়েছিলেন। কিন্তু ‘ভৌত শক্তি’র ধারণাটিকে যেমন ‘মানসিক শক্তি’র ধারণায় রূপান্তরিত করা যায় না, তেমনি জীব বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বকে সরাসরি মনোবিজ্ঞানে আরোপ করা যায় না।

যৌনাকাঙ্ক্ষার পর ফ্রয়েড আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ এষণাকে চিহ্নিত করেন, তা আগ্রাসী মনোভাব (aggression)। তবে এ স্বীকৃতিটি এসেছে ঘুর পথে। তার প্রথম দিককার সহযোগী এডলার-ই প্রথম আগ্রাসনকে গুরুত্বপূর্ণ এষণা বলে ঘোষণা করেন। এতে ফ্রয়েড রুষ্ট হন। আগ্রাসন দ্বারা যৌনাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিস্থাপন করা মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের বিরোধী, এ ছিল তার দৃঢ় প্রত্যয়। ১৯১১ সনে তিনি এডলারের কঠোর সমালোচনা করে তার বার্লিনস্থ শিষ্য আব্রাহামকে (Karl Abraham) চিঠি লেখেন। এডলার, এ বিতর্কের জেরে মনঃসমীক্ষণ সমিতি ত্যাগ করেন, নিজের তত্ত্ব ত্যাগ করেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা ফ্রয়েডকে আগ্রাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে। কিন্তু তার কাছে দৃশ্যমান আগ্রাসী কর্মকাণ্ড ধরা দেয় মানুষের অন্তঃস্থিত আত্মধ্বংসী প্রবণতা হিসাবে। তিনি এষণা সম্পর্কিত তার তত্ত্বীয় কাঠামোটিকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজান। তিনি দেখান যৌনাকাঙ্ক্ষা, জীবনাকাঙ্ক্ষা (eros) নামক মৌলিক এষণা এবং আগ্রাসন, মরণাকাঙ্ক্ষা (thanatos) নামক মৌলিক এষণার প্রকাশ। এ-মৌলিক এষণা দুটি পরস্পর বিরোধী।

ফ্রয়েড উদ্ভাবিত লিবিডো-তত্ত্ব যেমন তার সময়ের মনস্তত্ত্বে সাহসী উদ্ভাবন; তার থেনাটস-তত্ত্ব শুধু তেমন সাহসীই নয়, রহস্যময়ও বটে। এ ‘তত্ত্ব-প্রস্তাব’-এর উৎস কোথায়? ‘মরণ বলে আমি তোমার জীবন-তরী বাই’-এমন ভাবধারা ফ্রয়েডের সংস্কৃতি বলয়ে ছিল কি না কে জানে, তবে তার গুরুস্য গুরু শোপেনহাওয়ার, আত্মহত্যা করাকে আদর্শ বলে প্রচার করেছিলেন। (অবশ্য তিনি নিজে সে চেষ্টা করেননি।) কারণ, শোপেনহাওয়ারের মতে ‘বাঁচার ইচ্ছা’ চালিত প্রতিটি স্বতন্ত্র সত্তাই একে অন্যের বিরদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। তাই বিশ্ব হিংসা ও দুঃখে পূর্ণ। মানুষ বাস্তব জগৎ ছেড়ে শিল্পকলার জগতে আশ্রয় নিয়ে সাময়িক শান্তি পেতে পারে। কেবল আত্মহত্যার মাধ্যমেই অশান্তির মূল কারণ ‘বাঁচার ইচ্ছা’র কবলমুক্ত হওয়া সম্ভব।

অতএব, জীবনের আদর্শ নয়, জীবনের চালিকাশক্তি হিসাবে মরণাকাঙ্ক্ষার ধারণা ফ্রয়েডেরই উদ্ভাবন। ফ্রয়েড মরণাকাঙ্ক্ষার মূলে পুনবৃত্তি-সূত্র (repetition compulsion) বলে আরেকটি তাড়না বা নোদনাকে (drive) চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, প্রথম নোদনার বশে আমরা ভাল মন্দ বিচার না করে সুখান্বেষণে ধাবিত হই। দ্বিতীয় নোদনার সাহায্যে বাস্তব পরীক্ষা করে করণীয় নির্ধারণ করি। তৃতীয় নোদনা পুনবৃত্তির বশে বার বার একই অবস্থা অনুভবের চেষ্টা করি। এই পুনবৃত্তি নোদনাই প্রাণীদের বার্ষিক পরিযানের (migration) কারণ। এরই বশে শিশুরা একই গল্প বার বার শোনতে চায়। টিকটিকির লেজ খসে গেলে যে আবার লেজ গজায়, তা এই পুনবৃত্তিরই ফল। অচেতন পদার্থ থেকে জীবের উৎপত্তি এবং মৃত্যুর পর জীব আবার অচেতন পদার্থে রূপান্তরিত হয়, এও পুনবৃত্তি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মরণাকাঙ্ক্ষার মূলেও রয়েছে এই পুনবৃত্তি নোদনা। ফ্রয়েডের মতে পুনবৃত্তি, সুখৈষণা অপেক্ষাও শক্তিশালী নোদনা। এই পুনবৃত্তি-সূত্রের ব্যাপারে তিনি ভরসা রেখেছেন, তার সময়ে শারীরবিজ্ঞান-এ (Physiology) প্রচলিত, ফেকনার (Gustav Fechner) প্রস্তাবিত ‘স্থিরতার নীতি’তে (Constancy Principle)। এ নীতি অনুযায়ী সকল জীবন প্রক্রিয়াই অজৈব জগতের স্থিরতায় প্রত্যাবর্তন করতে চায়। (আমরা জানি অজৈব জগৎও স্থির নয়। বস্তুত কোনো জগৎই স্থির নয়। স্থিরতার নীতিও আজ পরিত্যক্ত।)

এ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব-প্রস্তাব ছাড়াও ফ্রয়েডের সামনে আরো একটি সর্বব্যাপী দার্শনিক তত্ত্ব বর্তমান ছিল। তা নীৎশে-র ‘চির পুনরাবৃত্তি’ (eternal recurrence) তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের সবকিছুরই অনন্ত কাল ধরে পুনরাবৃত্তি ঘটছে এবং ঘটবে। এ তত্ত্বের মাধ্যমে নীৎশে দেখাতে চাইলেন, শোপেনহাওয়ার যেভাবে আত্মহত্যার মাধ্যমে ‘বাঁচার ইচ্ছাকে’ এড়াতে চাইছেন, তা সম্ভব নয়। তাই জীবনকে বরণ করাই কর্তব্য। নীৎশে-র ‘চির পুনরাবৃত্তি’ তত্ত্বের সঙ্গে ফ্রয়েডের ‘পুনবৃত্তি-সূত্র’-র সাদৃশ্য রয়েছে। তবে তত্ত্ব গঠনে এসব ছাড়াও অন্য একটি বিবেচনা ফ্রয়েডকে চালিত করেছিল, তা হেগেল-এর দ্বন্দ্বতত্ত্ব (dialectics)। (যদিও ফ্রয়েডের তত্ত্বটি খাঁটি হেগেলীয় ধারার তত্ত্ব নয়। হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বে কোনো বিষয় শুধু পরিবর্তিত হয় না, বিকশিতও হয়। এতে নতুন গুণের উদ্ভব ঘটে। ফ্রয়েডের তত্ত্ব এমন ঐতিহাসিকতা মুক্ত; ফ্রয়েডের ব্যক্তি প্রাগৈতিহাসিক কালে যেমন ছিল বর্তমান কালেও সে রকম।) দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুযায়ী কোনো বিষয়ের চালিকাশক্তি এর অন্তঃস্থিত বিপরীত প্রবণতার দ্বন্দ্ব। এ বিবেচনায় আগ্রাসন, লিবিডো কিংবা জীবনাকাঙ্ক্ষার বিপরীত হতে পারে না। জীবনাকাঙ্ক্ষার বিপরীত হতে পারে কেবল মরণাকাঙ্ক্ষা; এবং এ দুই বিপরীত প্রবণতার দ্বন্দ্বেই কেবল জীবন গতিশীল হতে পারে। হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুযায়ী বিকাশের ধারায়, কোনো বিষয় এর বিপরীত বিষয়ে পরিণত হয়। আমরা ফ্রয়েডের তত্ত্বেও দেখি, ভালবাসা ঘৃণায় এবং ঘৃণা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হতে। দ্বন্দ্বতত্ত্বে, বিপরীত বিষয় দুটি তৃতীয় বিষয়ে সমাকলিত হয়। ফ্রয়েডের তত্ত্বে ইদ এবং এর বিপরীত সুপার ইগো, ইগো-তে সমাকলিত হয়।

ফয়েরবাখ (Ludwig Feuerbach) হেগেল-উত্তর জার্মান দার্শনিক। তার প্রথম জীবনের দর্শন মার্ক্স-এঙ্গেলসকে প্রভাবিত করেছিল। তার পরবর্তী জীবনের দর্শন প্রভাবিত করেছিল নীৎশে, ফ্রয়েড সহ আরো অনেককে। ফ্রয়েড, ফয়েরবাখকে নিজেদের দলের লোক মনে করতেন। ফয়েরবাখের মতে আমাদের তাড়না/নোদনা (drive) বা ইচ্ছার (will) উৎস, সংবেদন (sensation)। অর্থাৎ ফয়েরবাখ আদি তাড়নার উৎস হিসাবে দেহকেই নির্দেশ করেন; কোনো অশরীরী আত্মাকে নয়। আমাদের মূল তাড়নাটি ‘সুখী হওয়ার তাড়না’ (drive to happiness) । অন্যসব তাড়নাই ‘সুখী হওয়ার তাড়না’র প্রকাশ। যেমন ‘আত্ম রক্ষার তাড়না’, ‘যৌন তাড়না’, ‘আনন্দ লাভের তাড়না’, ‘কর্মের তাড়না’, ‘জ্ঞানার্জনের তাড়না’। আমরা যখন এই তাড়নাটি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠি, তখনই তাকে ‘ইচ্ছা’ বলে চিহ্নিত করি। সুখ অর্জনে বাধা পেলেই মানুষ ক্রোধান্বিত ও আক্রমণাত্মক হয়। যদিও ফয়েরবাখ তাড়না প্রসঙ্গে অচেতন শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু উপরের বর্ণনা থেকে এটি মনে হয়, তাড়নাকে ফয়েরবাখ অসচেতন ক্রিয়া হিসাবেই বিবেচনা করেছেন। ফয়েরবাখের ‘সুখী হওয়ার তাড়না’র সঙ্গে ফ্রয়েডের ‘এরস বা জীবানাকাঙ্ক্ষা’ এবং ‘pleasure principle’ বা ‘সুখনীতি’র সাদৃশ্য চোখে পড়ে। আগ্রাসন নিয়ে ফ্রয়েডের প্রথম দিককার ধারণার সাথেও ফয়েরবাখের ধারণার মিল রয়েছে।

ফয়েরবাখের বিশেষজ্ঞতা ধর্মতত্ত্বে। তিনি যুক্তি দেন, মানুষের চালিকা শক্তি তার ‘সুখী হওয়ার তাড়না’। কিন্তু মানুষের ক্ষমতা সীমিত। তার অস্তিত্ব নির্ভর করে অন্য কিছুর উপর। এ-পরনির্ভরশীলতার চেতনা তার মধ্যে জন্ম দেয় অসহায়তার। তার ‘সুখী হওয়ার তাড়না’ পূর্ণ হতে পারে না। এই অতৃপ্ত তাড়নাই জন্ম দেয় একজন ঈশ্বরের। মানুষ তার আকাঙ্ক্ষাকে ঈশ্বর নামক এক কল্পসত্তায় অভিক্ষিপ্ত (projection) করে; যিনি সর্বশক্তিমান এবং বিশ্বাসীদের কামনা পূর্ণ করেন। অতএব, বিশ্বাসীদের নিকট ঈশ্বর হচ্ছেন ‘সুখী হওয়ার তাড়না’র বাস্তবায়ন। ফয়েরবাখ সিদ্ধান্তে আসেন, ব্যক্তির এই নির্ভরশীল মানসিকতাই হচ্ছে ধর্মের অগোচর ভিত্তি। ধর্মবিশ্বাসের জন্য সত্যের তেমন প্রয়োজন নেই, যেমন প্রয়োজন নির্ভরশীল মানসিকতা প্রসূত ধর্মভীরুতার। এ ধারণার সঙ্গে ফ্রয়েডের ধর্ম সম্পর্কিত ধারণার মিল রয়েছে।

বিকাশ

ফ্রয়েডের ব্যক্তিত্ব বিকাশের তত্ত্বে বিকাশের মুখ, পায়ু ও শিশু পর্যায় কল্পনার মূলে কিছু পর্যবেক্ষণ নিশ্চয়ই রয়েছে। প্রথম দেড় বছর চোষণ এবং কামড়ানো ক্রিয়াটি শিশুর প্রধান ক্রিয়া বলেই চোখে পড়ে। দেড় থেকে তিন-চার বছর বয়সে নাগরিক সমাজে শিশুকে মলমূত্র ত্যাগের সামাজিক নিয়মে অভ্যস্ত করানো হয়। চার- পাঁচ বছর বয়সে শিশুর শিশ্নের প্রতি কৌতূহল জাগে। এ সময়ে শিশুর ব্যক্তিত্বের কিছু লক্ষণও দেখা দেয়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের বিকাশ যে এ পথ ধরেই অগ্রসর হয়, তা কি করে নিশ্চিত হওয়া যায়? ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব বিকাশের তত্ত্ব রচনায়, এ অনুমানটি একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বপ্রস্তাব এবং একটি নৃতাত্ত্বিক মিথ থেকে আহরণ করেন।

সে সময় জার্মান জীববিজ্ঞানী আর্নস্ট হেকেল-এর (Ernst Haeckel) একটি তত্ত্বপ্রস্তাব চালু ছিল। বিবর্তন সমর্থক এ তত্ত্বপ্রস্তাবটি- ‘ব্যক্তিজনিতে জাতিজনি পুনরাবৃত্ত হয়’ (ontogeny recapitulates phylogeny) । অর্থাৎ কোনো প্রাণী ভ্রূণ পর্যায়ে, তার প্রজাতিটি বিবর্তনের যেসব পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে সেসব অতিক্রম করে। যেমন একটি মানবশিশু ভ্রূণাবস্থায় প্রথমে এককোষী, তারপর বহুকোষী গোলাকার, তারপর মৎসাকার, তারপর লেজবিশিষ্ট সরীসৃপাকার, তারপর বানরাকার এবং শেষে মানুষাকার ধারণ করে। এ তত্ত্বের সঙ্গে মিল রেখে মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বে একটি ধারণা চালু ছিল: ‘মানব শিশু মানসিক বিকাশের প্রথম পর্যায়ে, মানুষ তার ইতিহাসে যেসব পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে, সেসব পর্যায়গুলো অতিক্রম করে।’ ফ্রয়েডের ভাষায়, প্রতিটি ব্যক্তি তার বৃদ্ধি বিকাশের সময় কমবেশি তার জাতির বৃদ্ধি বিকাশের পর্যায়গুলো অতিক্রম করে, পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্ত হয়। ফ্রয়েডের ব্যক্তিত্ব বিকাশের তত্ত্বের ভিত্তি এই অনুমান।

হেকেল-তত্ত্বের আপাত দৃশ্যমান কিছু প্রমাণ থাকলেও, গভীর পর্যবেক্ষণে এর অসারতা ধরা পড়ে এবং পরিত্যক্ত হয়। মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানেও হেকেল- তত্ত্বের অনুসরণে রচিত তত্ত্বটি প্রমাণাভাবে পরিত্যক্ত। একটি শিশু জন্মায় পুরোপুরি পরনির্ভর হয়ে। জন্মের পর শুধু স্তন শোষণ ছাড়া, জীবন ধারণের অন্য কোনো কাজেই সে অপারগ। দীর্ঘ সামাজিক লালনেই সে স্বনির্ভর মানুষ হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে মানবসমাজ কখনোই পরনির্ভর নয়। উদ্ভবের সময় থেকে অস্তিত্বের সংগ্রামে জয়ী হয়েই সে বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে আছে। তাই মানবসমাজের বিকাশ ও ব্যক্তির বিকাশ সমতুল নয়।

এবার আসা যাক মানব সমাজের ইতিহাসের পরিবর্তে, ফ্রয়েড যে নৃতাত্ত্বিক মিথকে অবলম্বন করে তার বিকাশ তত্ত্ব রচনা করেছেন সে প্রসঙ্গে। এ মিথ তিনি গ্রহণ করেছেন রবার্টসন স্মিথ-এর (Robertson Smith) কাছ থেকে। বর্তমানের কোনো নৃতত্ত্ববিদই একে সত্য মনে করেন না। এতে ফ্রয়েড নিবৃত্ত হননি। তার তত্ত্বের জন্য যা মানানসই তাই গ্রহণ করেছেন। ‘Moses and Monotheism’-এ তিনি লিখছেন, ‘আমার বইয়ের (Totem and Taboo) পরবর্তী সংস্করণে আমার অভিমত পরিবর্তন করিনি বলে, আমাকে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ, সম্প্রতি নৃতত্ত্ববিদরা বিনা ব্যতিক্রমে রবার্টসন স্মিথের তত্ত্বসমূহ পরিত্যাগ করেছেন এবং যথেষ্ট ভিন্নরকম তত্ত্ব দ্বারা এসবের আংশিক প্রতিস্থাপন করেছেন। কিন্তু সর্বোপরি, আমি নৃতত্ত্ববিদ নই। আমি একজন মনঃসমীক্ষক। মনঃসমীক্ষণের প্রয়োজনে নৃতত্ত্ব থেকে আমার প্রয়োজনমত তথ্য নির্বাচনের অধিকার আমার রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের বিশ্লেষণে স্মিথের তথ্যসমূহ আমাকে মূল্যবান সংযোগসূত্র যোগায়। তার বিরোধীদের লেখা সম্বন্ধে আমি এটা বলতে পারি না।’

স্মিথ কথিত মিথটির ফ্রয়েডীয় ভাষ্য এরকম- ‘অনেক অনেক দিন আগে প্রাগৈতিহাসিক মানুষ নির্মম অত্যাচারী দলপতির কঠোর শাসনে দিন কাটাত। গোষ্ঠী গড়ে উঠেনি, টোটেম চালু হয়নি, ট্যাবুর বালাই নেই। দলের সমস্ত মেয়েদের ভোগের একমাত্র স্বত্ত্বাধিকারী দলপতি বা পিতা। ছেলেদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা দল থেকে বিতাড়িত হত; পাছে পিতার ভোগদখলে তারা বাধা সৃষ্টি করে। মানবমন সেসময় পশুমনের মতোই অসংগঠিত। চেতন তখনও অচেতন থেকে আলাদা হয়ে যায়নি, সুপারইগোর আভাস নেই, মনের মধ্যে কর্তব্য-অকর্তব্য, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আদর্শ বলে কোনো কথাই তৈরি হয়নি। প্রবৃত্তির অন্ধ আবেগকে বাধা দেবার বা অবদমনের কোনো আন্তর্মানসিক বিধি ব্যবস্থাই নেই। প্রবৃত্তি আর আবেগকে বশীভূত করতে পারে একমাত্র দলপতির শাসন। মন অখণ্ড অবিভক্ত-জড় জগতের সঙ্গে একাত্ম। মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ অজানা। যা কিছু দ্বন্দ্ব, বাইরের। সংঘর্ষ লড়াই নিজেদের মধ্যে অথবা পশুর সঙ্গে। অন্তর্দ্বন্দ্বহীন এই যুগকে ফ্রয়েড অলীক বিশ্বাসের যুগ বলেছেন। তারপর ঐসব খেদিয়ে দেয়া ছেলের দল একদিন দল বেঁধে ফিরে এল। দলপতি পিতাকে হত্যা করে অত্যাচারের প্রতিশোধ নিল। শুধু তাই নয়, তার মাংস দিয়ে করল বিরাট ভোজের ব্যবস্থা। এতেই মনে প্রথম পাপবোধের সঞ্চার ঘটল মানবমনে। ইদ্ আর ইগোর মধ্যে প্রথম পাচিল আদিম পাপবোধ। এই পাপবোধ জন্ম দিল সেন্সর সুপারইগোর। ন্যায়-অন্যায়, পাপপুণ্য ইত্যাদির বিচার শুরু হলো মানুষের মনে। অবদমন হয়ে উঠল শক্তিশালী মনন ক্রিয়া।’ এ হল প্রকোষ্ঠভিত্তিক মন উদ্ভবের কাহিনী। আদমের স্বর্গচ্যুতির কাহিনীর সঙ্গে এর পার্থক্য শুধু বিষয়বস্তুতে। আর জুডিও-খ্রিস্টান আদি পাপের ধারণাটি তো নগ্নভাবেই প্রকাশিত। ফ্রয়েডের মতে শিশু তার বিকাশের সময় মানবেতিহাসকে সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করে। বিকাশের মুখপর্ব স্বগোত্র ভোজনকারী মানসিকতার অভিব্যক্তি স্তর, পায়ুপর্ব পূর্বপুরুষের হিংস্রতা ও উগ্রতার স্তর, আর শিশ্নপর্ব তো ইডিপাস ও ইলেকট্রা নামাঙ্কিত গ্রীক ট্র্যাজিক কাহিনীতে বিধৃত পৌরাণিক স্তরের পুনরাবৃত্তি।

‘বিকাশ অবরুদ্ধতা’র ধারণা হেকেলের ‘পুনরাবৃত্তি তত্ত্বের’-ই অনুসিদ্ধান্ত। হেকেল-তত্ত্বের এ-অনুসিদ্ধান্তটিও দ্রুতই জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানে ছড়িয়ে পড়ে, সাহিত্যও এতে প্রভাবিত হয়। হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer) প্রস্তাবিত সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism) যেমন প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, বিকাশ অবরুদ্ধতার ধারণাটিও তাই হয়ে উঠল। এক শ্রেণির জীববিজ্ঞানী ঘোষণা করলেন, মানব প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ বিকশিত রূপ শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। শ্বেতাঙ্গ স্ত্রীলোক এবং শিশু এর পূর্ববর্তী স্তর। মানব বিকাশের নিম্নতম স্তরে আটকে রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গরা। ফ্রয়েডের ‘বিকাশ অবরুদ্ধতা’র ধারণার মূলেও রয়েছে হেকেলের ‘বিকাশ অবরুদ্ধতা’র অনুসিদ্ধান্ত। ফ্রয়েড তার বিকাশের ৫টি ধাপে বিকাশ অবরুদ্ধতার ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে তা দেখিয়েছেন। মনোরোগের ব্যাখ্যার জন্যও ফ্রয়েড ‘পুনরাবৃত্তি’ এবং ‘বিকাশ অবরুদ্ধতার’ তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন। তার ‘A Phylogenetic Fantasy’-তে এসবের বর্ণনা রয়েছে। ১৯১৫ সনের ১২ই জুলাই ফ্রয়েড পত্রাকারে ফেরেঞ্চিকে লিখেছেন, ‘ইদানিংকালে বায়ুরোগ বলতে আমরা যা দেখি, তা একসময় মানবসমাজের ইতিহাসে মানবীয় আচরণ ছিল। বায়ুরোগ হলো মানব সভ্যতার মানুষের মনের বিকাশের সাক্ষী।’ ব্যক্তিত্ব বিকাশের সমস্যার বেলায় শুধুমাত্র ‘বিকাশ অবরুদ্ধতাই’ দায়ী। সুস্থ ব্যক্তির মানসিক রোগ হওয়ার পিছনে, আত্মরক্ষা কৌশলের প্রত্যাবৃত্তি (regression) প্রক্রিয়াটি কার্যকর। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ব্যক্তির বিকাশের আগের স্তরটিতে অবনমন হয়।

হেকেলের পুনরাবৃত্তি তত্ত্বটিকে জীববিজ্ঞানের বাইরে এনে, মানুষের মনের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য, লামার্কের (Lamarck) তত্ত্বটি স্বীকার করা প্রয়োজন। অর্থাৎ স্বীকার করা প্রয়োজন, মানুষের অর্জিত বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ মানুষের সংস্কৃতিও বংশগতিতে স্থানান্তরিত হয়। নতুবা মানব ইতিহাস কিভাবে ব্যক্তির বিকাশের সময় পুনরাবৃত্ত হবে? তাই ফ্রয়েড A Phylogenetic Fantasy-তে লিখছেন, ‘আমরা সঠিক যুক্তির ভিত্তিতে দাবি করতে পারি, কোনো ব্যক্তি তার জীবনকালে অর্জিত গুণাবলী বংশগতিতে তার সন্তান-সন্ততির মারফত প্রবাহিত করে।’ যদিও আমরা জানি, ফ্রয়েড যখন এসকল তত্ত্ব রচনা করছেন, তখন জীববিজ্ঞানে লামার্কের তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়েছে। ১৯৩৫ সনে বংশগতি এবং ডারউইন তত্ত্বের সংশ্লেষণে ‘বিবর্তনের সংশ্লেষিত তত্ত্ব’ প্রকাশিত হয়ে দ্রুতই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তবু ফ্রয়েড ১৯৩৯ সনে প্রকাশিত Moses and Monotheism বইতে লিখেছেন, ‘অর্জিত গুণাবলি প্রাণীর বংশগতি মারফত সঞ্চারিত হয়, এই তত্ত্ব বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্ত কিছু বিবেচনা করে আমার মনে হয়, জীববিজ্ঞানের বৃদ্ধি-বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে এ তত্ত্বটি বাতিল করা উচিত নয়।’

ফ্রয়েডের তাত্ত্বিক ধারণা

ফ্রয়েড তার তত্ত্ব গড়েছেন মনঃসমীক্ষণের (psychoanalysis) মাধ্যমে রোগী চিকিৎসায় অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন ‘প্র্যাকটিসিং ডাক্তার’ হিসাবে। ৪১ বছর বয়স থেকে বাকি জীবনে ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’-ই হয় তার পেশা। তার রোগীরা বায়ুরোগের (neurotic disorder) এবং হিস্টিরিয়ার (dissociative disorder) রোগী। তার চিকিৎসা পদ্ধতি মনঃসমীক্ষণ। চিকিৎসার প্রয়োজনেই তিনি এসব রোগের কারণ এবং এসব নিরাময়ের উপায় বের করার চেষ্টা করছিলেন। তার সময়ে এ ক্ষেত্রগুলো ছিল সম্পূর্ণ অজানা এক রাজ্য। এজন্য তাকে মানুষের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, ব্যক্তিত্বের প্রেষণা এবং ব্যক্তির বিকাশের সমস্যা-যা রোগ আকারে প্রকাশিত হয়, এসব সম্বন্ধে একটি সার্বিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে হয়। তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব মানব প্রকৃতি সংক্রান্ত একটি সুবিস্তৃত মতবাদ। মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করে তিনি যে তথ্যসমূহ উদ্ঘাটন করেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। মানব প্রকৃতির বহু দিক তার তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় ও চমকপ্রদ ধারণার অবতারণা করে তিনি মানুষের বৈশিষ্ট্য ও আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন। সেজন্যই সাধারণ মানুষও অনেক সময় তার তত্ত্বের দ্বারা চমৎকৃত হয়ে পড়ে। ব্যক্তিত্বের কাঠামো, ব্যক্তিত্বের চালিকাশক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, স্বপ্ন, উদ্বেগ, নিউরোসিস, প্রভৃতি সম্পর্কে ফ্রয়েড তার তত্ত্বে স্বকীয় ধারণা উপস্থাপন করেছেন। এ বিষয়গুলো তার তত্ত্বের বিভিন্ন দিক হলে, এগুলো সুসংবদ্ধভাবে সমন্বিত হয়েই তার তত্ত্বে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু ফ্রয়েড এখানেই থেমে থাকেননি। তত্ত্ব গড়ে তোলার পর এ তত্ত্বকে তিনি চিকিৎসার গণ্ডিতে সীমিত না রেখে প্রয়োগ করেন নৃতত্ত্ব, ধর্ম, সমাজতত্ত্ব- এসব বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের ব্যাখ্যার কাজে।

সর্বাগ্রে ফ্রয়েডের তত্ত্বের তিনটি দিক পৃথক করার দরকার:

  • (১) তাত্ত্বিক ধারণা সমূহের সংগঠন বা অবকাঠামো (Theoretical superstructure of constructs)
  • (২) চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে মনোসমীক্ষণ এবং
  • (৩) অভিজ্ঞতালব্ধ উপাত্তের উৎস হিসাবে মনোসমীক্ষণ।

মনোসমীক্ষণের এই তিনটি দিক আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। কারণ তার তাত্ত্বিক। পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো চিকিৎসা প্রণালীর বেলায় প্রযোজ্য নয়, আবার চিকিৎসা প্রণালীর সাফল্য তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রতি সমর্থন নির্দেশ করেনা।

ফ্রয়েডের তত্ত্বের আলোচনায় প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, ফ্রয়েড হঠাৎ করে বা রাতারাতি তার তাত্ত্বিক ধারণাগুলো গঠন করেন নি এবং তার নিজের অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত তথ্যের পরিপন্থী হলে তিনি তার ধারণাগুলো পরিবর্তন বা সংশোধন করতে দ্বিধা করতেন না। যেমন বেদনাদায়ক যৌন অভিজ্ঞতা অনিবার্যভাবে হিস্টিরিয়ার জন্য দায়ী – এ বিশ্বাস তিনি পরিবর্তন করেছিলেন যখন তিনি আবিষ্কার করেন যে, অনেক রোগীর জীবনে এ অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা এ ধরণের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ফ্রয়েড বাইরের সমালোচনায় কান না দিলেও নিজের অনুসন্ধানের প্রতি তিনি সৎ ছিলেন এবং উপযুক্ত তথ্য পেলে তার মতবাদ তিনি পরিবর্তন করতেন। ফ্রয়েডের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এখানে আলোচনা করা উচিত। তা হলো, ফ্রয়েড তার ধারণাগুলোকে সত্য এবং বাস্তব অস্তিত্ব সম্পন্ন বলে মনে করতেন। জেনেট (Janet) একবার অচেতন (unconscious) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন এটি বিশেষভাবে কথা বলার একটি পদ্ধতি (manner of speaking)। এতে ফ্রয়েড মন্তব্য করেন যে জেনেট-এর বুদ্ধি কম এবং তিনি ফ্রয়েডের ধারণাটি বুঝতে পারেন নি। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ব্যাপার স্মরণীয় যে, ফ্রয়েডের মূল শিক্ষা ছিল স্নায়ুতত্ত্বে। সেজন্য তার পক্ষে তার তাত্ত্বিক সংগঠনগুলোকে বাস্তব ভাবে গ্রহণ করাই সম্ভব।

মানসিক যন্ত্র (The Psychic apparatus) ফ্রয়েড মানব মনের দুটি স্তর আবিষ্কার করেনঃ একটি হলো চেতন (Conscious), আরেকটি অচেতন (unconcious)। দুটি স্তর আলাদা নিয়মে পরিচালিত হয়। অচেতন মন পরিচালিত হয় কতকগুলো নিয়মের দ্বারা যাদের ফ্রয়েড প্রাথমিক প্রক্রিয়া (Primary process)। বলেছেন; আর চেতন মন পরিচালিত হয় গৌণ প্রক্রিয়া (Secondary processes) সমূহের দ্বারা। সচেতন মনের কার্যকারিতার ব্যাপারে সাধারণ যুক্তিবিদ্যার নিয়মগুলো খাটে, কিন্তু অচেতন মনের ক্রিয়াকলাপের ব্যাপারে এসব নিয়ম খাটেনা। প্রাথমিক প্রক্রিয়া সমূহের কার্যপদ্ধতি বুঝবার জন্য স্বপ্নের প্রক্রিয়াগুলো লক্ষ্য করা যেতে পারে। স্বপ্নে যেসব প্রক্রিয়া ঘটে সেগুলোর একটি হলো অনেকগুলো চিন্তার ঘনীভূত (Condensation) বা সংক্ষিপ্ত হয়ে একটি মাত্র সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া। আরেকটি প্রক্রিয়া হলো একটি কর্ম প্রবণতা (impulse) অথবা একটি আবেগ একটি সংকেত থেকে স্থানচ্যুত (displacement) হয়ে অন্য একটি সংকেতের প্রতি সংযুক্ত হওয়া। স্বপ্নের অযৌক্তিক বিন্যাস সামগ্রিকভাবে প্রাথমিক প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য।

মানসিক ক্রিয়ার শক্তির প্রধান উৎস হলো লিবিডো (Libido)। লিবিডো শব্দের নিকটতম প্রতিশব্দ হলো আদিম কামনা বাসনার আধার। এই লিবিডোর শক্তি আসে জৈবিক চাপ বা টান (Biological tension) থেকে। এসব শক্তির উৎসের মধ্যে মানসিক প্রক্রিয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যৌনকামনা। বেশীর ভাগ যৌন-শক্তি সৃষ্টি হয় শরীরের বিভিন্ন যৌনকেন্দ্রের উত্তেজনা থেকে যেমন- যৌনাঙ্গ, স্তন, চিবুক ইত্যাদি। শরীরের যেসব স্থান বিশেষভাবে উত্তেজনার প্রতি সংবেদনশীল সেগুলোকেই ফ্রয়েড যৌন কেন্দ্র (erogenous zones) বলেছেন। লিবিডো (কামপ্রেষণার) উৎস বা ভান্ডার হলো ইদ (Id) অর্থাৎ আমাদের জৈবিক সত্ত্বা। ইদ অচেতন বলে এটা প্রাথমিক প্রক্রিয়াসমূহের মাধ্যমে কাজ করে। মানুষের যেসব জন্মগত তাগিদ রয়েছে সেগুলো ইদে অবস্থান করে এবং কামশক্তি (Libidinal energy) কে বহিঃ প্রকাশের জন্য চাপ দেয়। প্রতিটি জন্মগত তাগিদের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বর্তমান:

  • (১) একটি উৎস (source) আছে: প্রতিটি জন্মগত তাগিদ (Instinct)-এর একটি উৎস আছে এবং সেটি হলো জৈবিক পরিবর্তন বা চাপ (Biological tension)
  • (২) প্রতিটি তাগিদের একটি উদ্দেশ্য (aim) বা লক্ষ্য রয়েছে এবং সেটি হলো একটি বিশেষ ধরণের কাজের মাধ্যমে এটির পরিতৃপ্তি সাধন,
  • (৩) একটি বস্তু (object)-যা উক্ত চাপ বোধকে লাঘব করতে সাহায্য করে।

ইদ সুখনীতি (Pleasure principle) মেনে চলে। অর্থাৎ ইদ সব সময় সুখ খুঁজে। এই সুখের উৎস হলো চাপ বা তাগিদের অবসান। তবে চাপের অবসানই কি সুখপ্রদ না কি কিছুটা উত্তেজনা বজায় রাখা সুখ? যদিও এ নিয়ে মতদ্বৈত রয়েছে। নীচুপর্যায়ের টানভাব থেকে বিচ্যুতি অথবা অতি উচু মাত্রায় টানভাব বেদনাদায়ক। ইদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এটি সুখনীতি অনুসারে কাজ করে, আর এটি কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করতে পারে না। যেমন ক্ষুধার বেলায় কল্পনায় ভোজ্য গ্রহণ এবং বাস্তব খাদ্য গ্রহণের মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত বস্তু না পাওয়া পর্যন্ত চাপবোধ বেশীক্ষণ স্তিমিত থাকতে পারে না। অর্থাৎ চাপ প্রশমনের জন্য তাগিদের বাস্তব পরিতৃপ্তি চাই।

কালক্রমে আরেকটি মানসিক সংগঠনের উদ্ভব ঘটে যাকে বলা হয় ইগো। আমরা ইগোকে বলব অহংবোধ। ইগোর কাজ হলো ইদের কাজকে বাস্তবমুখী করা। ইগো বাস্তবের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলে। অন্য কথায় বলা চলে যে, ইগো বাস্তব নীতি (reality principle) মেনে চলে। ইগো বাস্তবভাবে এমন একটি কর্মপন্থা নির্বাচনে ব্যক্তিকে সাহায্য করে যা দুঃখকে হ্রাস করে এবং সর্বোচ্চ সুখ পেতে পারে। অর্থাৎ ইগো বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আনন্দ পেতে চায়। ইগো অনেকসময় ভবিষ্যতে আরো বৃহত্তর আনন্দের আশায় কিছুকালের জন্য প্রেষণার তৃপ্তিকে দমিয়ে রাখে।

সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংস্পর্শে এসে মনের আরেকটি স্তর গড়ে ওঠে যাকে বলা হয় অতি অহং বা বিবেক (superego)। বাইরের জগতের ঘটনাবলী যেভাবে ব্যক্তির আনন্দ দায়ক কাজ সমূহকে দমন করতো, বিবেক সেই প্রহরীর কাজ করতে শুরু করে। অতি-অহং এর দুটো ভাগ: একটি বিবেক–যা শাস্তি দেয় এবং আরেকটি ইগো-আদর্শ যা পুরস্কার দেয়। বিবেক অপরাধবোধ সৃষ্টি করে, আর আদর্শ গৌরবের অনুভূতি সৃষ্টি করে। বিবেক এবং অহং-এর মধ্যে পার্থক্য হলো, অহং বোধ বাস্তবতার আলোকে ইচ্ছাকে অপেক্ষা করতে বলে কিন্তু বিবেক কতকগুলো নীতি বহির্ভূত ইচ্ছাকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দেয়। বিবেক বা অতি অহং-এর কাজ বেশীর ভাগ অচেতন; অর্থাৎ এর কার্যাবলী বেশীর ভাগই প্রাথমিক প্রক্রিয়ার (Primary process) অধীনে।

ফ্রয়েড এক সময় সিদ্ধান্তে আসেন যে, মানুষের সব রকম আদি প্রবৃত্তিকে দু ভাগে ভাগ করা যায়ঃ এক ভাগ হলো জীবন প্রবৃত্তি (Life instincts), আরেক ভাগ হলো মরণ প্রবৃত্তি (death instincts)। ফ্রয়েড আদিম প্রবৃত্তি (instinct) গুলোকে মনে করতেন রক্ষণশীল ও প্রত্যাবৃত্তিমূলক চরিত্রের। এদের কাজ হলো মানুষকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর ফলেই মানুষের মধ্যে বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে। জীবন্ত পদার্থ (যেমন প্রাণী) যেমন মৃত পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়, সেহেতু মানুষের পূর্ববর্তী অবস্থা মানে হলো সম্পূর্ণ শান্তি বা মৃত্যুতে ফিরে যাওয়া। জীবন প্রবৃত্তির কাজ হলো সৃজনধর্মী আর মরণপ্রবৃত্তির কাজ হলো বিশৃঙ্খলা ও বিচ্যুতি এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটানো। তবে ফ্রয়েডের মরণকাম (death instinct) এর ধারণাকে অনেক মনোসমীক্ষণবাদী গ্রহণ করেন নি। তার এই ধারণার বিরোধিতা করে বহু সংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে। তবে ফ্রয়েডের জীবনপ্রবৃত্তি-মরনপ্রবৃত্তি সম্পর্কিত ধারণা দুটো একটি মেরু জনন (polarity) সৃষ্টি করে যা তার দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। জোনস (1957) দেখিয়েছেন যে ফ্রয়েড একত্ববাদ (monistic) অথবা বহুত্ববাদী (pluralistic) ধারণার বদলে দ্বিমেরু বিশিষ্ট ধারণাগুলোকে বেশী পছন্দ করতেন।

জন্মগত প্রবনতা সমূহের মূলে যে শক্তি কাজ করে তাকে ফ্রয়েড লিবিডো নামে অভিহিত করেছেন। তবে মরণ প্রবৃত্তির পেছনে যে শক্তি কাজ করে তাকে তিনি কোন বিশেষ নাম দেননি। যাই হোক, ব্যক্তির বয়স যতই বাড়তে থাকে, ততই তার অহং বাস্তব জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে বিকশিত হতে থাকে। অহং বিকশিত হওয়ার ফলে ক্রমশঃ বেশী পরিমাণ মানসিক শক্তি অহংএর আওতায় চলে আসে। অহং তখন এই শক্তিকে বাইরের জগতের বস্তু সমূহের মানসিক প্রতীক বা সংকেত সমূহের উপরে স্থাপন করে। বাইরের বস্তু সমূহের মানসিক প্রতিরূপের সঙ্গে এরূপ সম্পর্ক স্থাপনকে বলা হয় কেথেক্সিস (cathexis)। অহং কোন্ ধরনের বস্তুর প্রতি তার শক্তিকে সংযুক্ত করবে তা নির্ভর করে কোন প্রবৃত্তি শক্তির সরবরাহ পাচ্ছে তার উপর। অর্থাৎ ফ্রয়েড মনে করতেন, বিভিন্ন প্রবৃত্তি (instinct)র মধ্যে শক্তির বন্টন পরিবর্তনশীল।

ব্যক্তির বিকাশের এক পর্যায়ে বেশীর ভাগ আদিম শক্তি (Libidinal energy) পিতামাতার উপরে স্থানান্তরিত হয়। এর ফলে ছেলেদের মধ্যে ইডিপাস কমপেক্স (ইডিপাস গৃঢ়েষা) তৈরী হয়। গ্রীক পুরানে আছে ইডিপাস তার মায়ের প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন, অবশ্যই নিজের অজান্তে। তিনি তার মাকে চিন্তে পারেন নি। ছেলে মায়ের প্রতি কামাসক্ত হয় ও পিতাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সমাজের শাস্তির ভয়ে, বা লিঙ্গচ্ছেদের ভয়ে সে তার আকাঙ্খাকে অবদমিত করে। এই সময়ে সে তার যৌনকামনাগুলোকে এত গভীরভাবে অবদমন করে যে, সে তখন সুপ্তিকালে প্রবেশ করে। অবশ্য বয়ঃসন্ধিতে তার যৌনকামনা এত বেশী প্রবল হয় যে অচেতনের সমস্ত বাধা কাটিয়ে সে আবার প্রকাশিত হয়। অবশ্য যদি ইডিপাস কমপ্লেক্স এর সফল পরিণতি হয় তখনই ব্যক্তি সুস্থ স্বাভাবিক যৌন ক্রিয়ার অংশগ্রহণ করতে পারে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালবাসা স্থাপনের মাধ্যমে।

ফ্রয়েড কর্তৃক ইডিপাস গৃঢ়ৈষণার আবিষ্কার মনোসমীক্ষণের একটি বড় অবদান। তবে এ ধারণাটিকে যথার্থ বলে গ্রহণ করতে হলে আরেকটি অনুমানকেও স্বীকার করে নিতে হবে যে, অতি শৈশবেই যৌনকামনা বিদ্যমান থাকে। অনেক মনোবিজ্ঞানী শিশুদের মধ্যে যৌনকামনার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।

ব্যক্তিত্বের কাঠামো (structure of personality)

মনোবিজ্ঞানীরা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের এই দিকটিকে ব্যক্তিত্বের কাঠামো নামে উল্লেখ করলেও, ফ্রয়েড নিজে কিন্তু এটাকে ‘মানব মনের আঙ্গিক গঠন’ (anatomy of human mind) নামে আখ্যায়িত করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ফ্রয়েড শারীরবিদ্যা (anatomy) এর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই মানব মনের গঠনপ্রণালী ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

চেতনার স্তর

প্রথমেই আসা যাক সচেতনতার প্রেক্ষিতে মনের কাজের বিভাজনের বিষয়টি। মানব মনের গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফ্রয়েড প্রথমেই চেতনার স্তর সম্পর্কে তার ধারণার অবতারণা করেছেন এবং মানুষের মনকে তিনি ভাসমান হিমশৈলের সাথে তুলনা করেছেন। হিমশৈলের এক-তৃতীয়াংশ যেমন জলের ওপর থাকে এবং বাকী দুই-তৃতীয়াংশ জলের নীচে থাকে, তেমনি মানব মনেরও সামান্য কিছু অংশ চেতন পর্যায়ে থাকে এবং বাকী অংশ অচেতন পর্যায়ে থাকে। মনের কিছু কাজ সম্বন্ধে আমরা সচেতন এবং কিছু কাজ সম্বন্ধে অসচেতন। মনের কাজের সচেতন-অসচেতন ভাগ বহু পুরানো ও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু ফ্রয়েড- পূর্ববর্তী মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় মনের অসচেতন দিকটি গুরুত্ব পায়নি। ফ্রয়েড মনের কাজের এই সচেতন ও অসচেতন দিককে মনের স্তর হিসাবে কল্পনা করেন। তিনি মনের অসচেতন কাজকে আবার দুভাগ করেন, অচেতন এবং প্রাকচেতন। অচেতন তাই, চেষ্টা করেও যা সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যায় না। আবার প্রাকচেতন তা, যা সম্বন্ধে আমরা অসচেতন থাকলেও, চেষ্টা করলে সচেতন হতে পারি। এভাবে ফ্রয়েডের তত্ত্বে মন তিন স্তর বিশিষ্ট, অচেতন/অবচেতন/নির্জ্ঞান (Unconscious), প্রাকচেতন/আসংজ্ঞান (Preconscious) এবং চেতন/সচেতন/ সংজ্ঞান (Conscious)। ফ্রয়েড শুধু অচেতন মনকে গবেষণায় নিয়ে আসেননি, তিনি একে মানুষের আচরণের চূড়ান্ত নির্ধারকের ভূমিকায় বসিয়েছেন। তবে, মনের অসচেতন কাজ বা অসচেতন দিক মাত্রই ফ্রয়েডীয় অচেতন নয়। মনের অচেতন এষণা (drive) এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অচেতন কর্মপ্রক্রিয়াই (যেমন ইগোর আত্মরক্ষা কৌশল) ফ্রয়েডীয় অচেতন। তাই ফ্রয়েডীয় অচেতন, প্রাকচেতন ও চেতনের যথাযথ পরিভাষা, যথাক্রমে নির্জ্ঞান, আসংজ্ঞান ও সংজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের অন্য ধারায় মনের অসচেতন কাজের গুরুত্ব স্বীকৃত, কিন্তু এর চূড়ান্ত নির্ধারক ভূমিকা স্বীকৃত নয়। চেতনার স্তর অনুসারে ফ্রয়েড কর্তৃক মানুষের মনের তিনটি অংশ –

  • চেতন স্তর (conscious level): মনের প্রথম স্তরটি হচ্ছে চেতন স্তর। এটি মনের উপরি ভাগে অবস্থিত। একটি বিশেষ মুহূর্তে ব্যক্তি যে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, কামনা-বাসনা, স্মৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকে, সেগুলো নিয়েই চেতন মন গঠিত। চেতন মনের পরিধি অবশ্য অত্যন্ত সীমিত। সেজন্যই ব্যক্তি একযোগে খুব বেশী বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে না। মনের এই চেতন স্তরের মাধ্যমেই ব্যক্তি বহির্বিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং পরিবেশের সাথে মিথষ্ক্রিয়া (interaction) করে।
  • প্রাক-চেতন স্তর (pre-conscious level): চেতন স্তরের নীচেই থাকে প্রাক-চেতন স্তর। প্রাক-চেতন স্তরে সেই বিষয়গুলো বিরাজ করে, যেগুলো সম্পর্কে ব্যক্তি এই মুহূর্তে সচেতন নয়, কিন্তু ভবিষ্যতে যে কোন সময় সে এ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে। সেজন্যই এটাকে প্রাক-চেতন স্তর বলা হয়। অর্থাৎ মনের এই বিষয়গুলো চেতনার পূর্ব অবস্থায় রয়েছে। যেমন এই মুহূর্তে হয়ত মায়ের কথা আমার মনে নেই; কিন্তু পরবর্তীতে যে কোন সময় আমি মা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারি। চেতন মন ও প্রাক-চেতন মনের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ রয়েছে। অর্থাৎ চেতন মনের বিষয় প্রাক-চেতন মনে নেমে আসতে পারে এবং প্রাক-চেতন মনের বিষয় চেতন মনে প্রবেশ করতে পারে। চেতন মন ও প্রাক-চেতন মনের মধ্যে বিষয়সমূহের এরূপ পারস্পরিক বিনিময় প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। মনের এ দু’টো স্তরের পারস্পরিক লেন-দেনের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ফ্রয়েড একটি উপমার সাহায্য নিয়েছেন। কোন চাকরিতে কর্মচারী বাছাইয়ের জন্য যখন তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তখন নিয়োগকর্তা সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য একটি কক্ষে বসেন এবং চাকরিপ্রার্থীরা তার পাশের কক্ষে অপেক্ষা করে। নিয়োগকর্তা একবারে একজন করে চাকরিপ্রার্থীকে তার কক্ষে ডেকে পাঠান এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণের শেষে তাকে বিদায় দিয়ে পরবর্তী প্রার্থীকে ডেকে পাঠান। এভাবেই একজন একজন করে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তিনি কর্মচারী বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। এখানে সাক্ষাৎকার গ্রহণের কক্ষকে বলা যায় চেতন স্তর এবং প্রার্থীদের অপেক্ষা করার ঘরকে বলা যায় প্রাক-চেতন স্তর। অর্থাৎ প্রাক-চেতন মনের বিষয়গুলো চেতন মনে প্রবেশ লাভ করার জন্য ওখানে অপেক্ষা করে। চেতন মন প্রয়োজন অনুসারে ওগুলোকে এক এক করে ডেকে পাঠায় এবং কার্য সমাধা হ’লেই ওগুলোকে আবার প্রাক-চেতন স্তরে ফেরত পাঠায়। চেতন স্তরে একসঙ্গে যদি অনেক বিষয় ঢুকে পড়ে, তা’হলে সেখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে এবং চেতনার পক্ষে সুনিপুণভাবে তার কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। সেজন্যই চেতন মনের বিস্তৃতি অত্যন্ত কম এবং ব্যক্তি খুব অল্প সংখ্যক বিষয় সম্পর্কেই একযোগে সচেতন হতে পারে। বাকি বিষয়গুলো প্রাক-চেতন স্তরে অপেক্ষা করতে থাকে।
  • অচেতন স্তর (unconscious level): প্রাক-চেতন মনের নীচেই অচেতন মনের অবস্থান। অচেতন মনের বিস্তৃতিই অনেক বেশী। মনের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়েই এই অচেতন মন। ব্যক্তির জন্মগত আদিম কামনা, বাসনা ও প্রবৃত্তিসমূহ এই অচেতন স্তরে বিরাজ করে। এছাড়া ব্যক্তির লজ্জাজনক, ঘৃনাজনক ও পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতাসমূহ এই অচেতন স্তরে থাকে। অচেতন মনের বিষয়গুলো এতই অসামাজিক, পাপপূর্ণ, পীড়াদায়ক ও জঘন্য প্রকৃতির যে, ব্যক্তির নিজের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে অচতন মনের বিষয়গুলো সাধারণভাবে কোনসময়ই চেতন স্তরে প্রবেশ লাভ করতে পারে না। চেতন বা প্রাক-চেতন স্তরের সাথে অচেতন মনের কোন সংযোগ থাকে না। ফ্রয়েডের মতে প্রাক-চেতন ও অচেতন মনের মাঝখানে একটি প্রতিবন্ধক রয়েছে। এই প্রতিবন্ধকের দ্বিবিধ কাজের জন্য ফ্রয়েড এটাকে অবদমন-প্রতিরোধ রেখা (repression-resistance line) নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথমতঃ এর দ্বারাই প্রাক-চেতন মনের অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর বিষয়গুলোকে জোরপূর্বক অচেতন মনে দাবিয়ে রাখা হয়। এ কাজকে অবদমন (repression) প্রক্রিয়া বলা হয়। দ্বিতীয়তঃ এটার দ্বারাই অচেতন মনের অবাঞ্ছিত বিষয়গুলোকে প্রাক-চেতন স্তরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হয়। এ কাজকে প্রতিরোধ (resistance) প্রক্রিয়া বলা হয়। সুতরাং অবদমন-প্রতিরোধ প্রক্রিয়া সতর্ক প্রহরীর ন্যায় কাজ করে। এই সতর্ক প্রহরাকার্যের জন্যই অচেতন মনের অবাঞ্ছিত কোন উপাদান প্রাক-চেতন মনে প্রবেশ করতে পারে না ও প্রাক-চেতন মনের অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো নির্বাসিত হয়ে অচেতন স্তরে প্রেরিত হয়।

ব্যক্তিত্বের কাঠামোগত উপাদান

ভূমিকা

ফ্রয়েড তত্ত্ব রচনার শুরুতে মনকে স্তরভিত্তিক বলে কল্পনা করেন। তারপর তিনি যুক্ত করেন প্রকোষ্ঠভিত্তিক মনের ধারণা। ব্যক্তিত্বের কাঠামো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফ্রয়েড এর তিনটি প্রকোষ্ঠের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলোকে কোন কোন সময় মানব প্রকৃতির তিনটি সত্তা রূপেও বর্ণনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলোকে স্বতন্ত্র সত্তা রূপে গণ্য করা যায় না। কারণ স্বতন্ত্রভাবে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো আসলে মানুষের তিন রকমের প্রবণতা, যা ভিন্ন ভিন্ন শক্তি রূপে মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং এই ত্রিশক্তির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল রূপেই ব্যক্তিত্বের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারিত হয়। সুতরাং কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলোকে সত্তা রূপে নির্দেশিত করা হলেও একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এগুলো স্বতন্ত্র অস্তিত্বময় কোন বিষয় নয়। এই প্রকোষ্ঠ তিনটি, অভিঅহম/অপ্স/ইদ্ (Id = It), অস্মিতা/অহম/ইগো (Ego-The me) এবং অধিঅহম/অধিশাস্তা/সুপারইগো (Superego-The Conscience) । এখানে এগুলোকে ইদ (id), অহম (ego) ও অতি-অহম (super-ego) বলা হচ্ছে। ইগো ও সুপার ইগো অচেতন, প্রাক চেতন ও চেতন তিন প্রকোষ্ঠতেই কাজ করতে পারে, কিন্তু ইদ কেবল অচেতনেই কাজ করে।

ইদ (id)

ইদ মনের অচেতন স্তরে অবস্থিত। এটি মনের চালিকাশক্তি, মানসিক শক্তির (psychic energy) আধার। এখান থেকেই মানসিক শক্তি অন্য প্রকোষ্ঠে চালিত হয়। ইদ্-এ মানসিক শক্তি বিভিন্ন এষণা/তাড়না/নোদনার (drive) আকারে সঞ্চিত থাকে। ইদ হচ্ছে মানুষের জন্মগত আদিম দিক বা আদিসত্তা। মানুষের জন্মগত কামনা, বাসনা ও প্রবৃত্তিসমূহ এই ইদের অন্তর্ভুক্ত। জন্মসূত্রে মানুষ যে পশুসুলভ বৈশিষ্ট্যসমূহ লাভ করে, সেগুলো নিয়েই তার ইদ গঠিত। এটা আসলে মানুষের পশুসত্তার দিক। এমন সব ঘৃণ্য, জঘন্য ও ন্যক্কারজনক পাশব উপাদান ইদে থাকে যা ব্যক্তির নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয় না। সেজন্যই ইদ সম্পূর্ণরূপে মনের অচেতন স্তরে থাকে। ইদের কোন উপাদানই সাধারণভাবে মনের চেতন স্তরে প্রবেশ করতে পারে না। ফ্রয়েড ইদকেই মনোশক্তির ভাণ্ডার রূপে বর্ণনা করেছেন। কারণ মানুষের প্রবৃত্তিসমূহ এই ইদেই অবস্থিত এবং এগুলোই যাবতীয় মনোশক্তির উৎস। সুতরাং সব রকম মানসিক কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য ইদই প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।

ইদ যে নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়, ফ্রয়েড সেটাকে সুখনীতি বা সুখ-সূত্র (pleasure principle) নামে আখ্যায়িত করেছেন। ফ্রয়েড সহজাত এষণা হিসাবে একটি এষণাকেই চিহ্নিত করেছিলেন, তা যৌনাকাঙ্ক্ষা বা কাম (libido)। তারপর তিনি আরেকটি এষণার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন, তা আগ্রাসন (aggression)। তত্ত্ব বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যৌনাকাঙ্ক্ষাকে প্রসারিত করেন জীবন- এষণা/জীবনাকাঙ্ক্ষায় (eros) যা প্রতিটি জীবকোষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। আর আগ্রাসন রূপান্তরিত হয় জীবনাকাঙ্ক্ষার বিপরীত মরণ- এষণা/মরণাকাঙ্ক্ষায় (thanatos)। যে আকাঙ্ক্ষা জৈব বস্তুকে অজৈব বস্তুতে রূপান্তরিক করতে চায়। ফ্রয়েড ব্যাখ্যা দেন, মরণাকাঙ্ক্ষা নিজের দিকে ধাবিত হলে ইগোর আত্মরক্ষা কৌশলে তা স্থানান্তরিত হয় অন্যের প্রতি আগ্রাসনে।

যাই হোক, সর্বোচ্য মাত্রায় সুখ অর্জন করা এবং ন্যূনতম মাত্রার দুঃখকেও পরিহার করা এই সুখনীতির মূল লক্ষ্য। সুতরাং ইদ সর্বতোভাবে সুখ ভোগ করতে চায় এবং ন্যূনতম দুঃখও সে পরিহার করে চলতে চায়। সেজন্যই ইদ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবাস্তবধর্মী হয়। ইদ যুক্তিহীন বলেই ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বা পাপ-পূণ্য বিচার করার ক্ষমতা এর নেই। আবার এটা অবাস্তবধর্মী হওয়ায় বাস্তবকে অনুধাবন করার ক্ষমতাও এর নেই। বাস্তবে কোন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব বা কোনটা পূরণ করা সম্ভব নয়, তা ইদ বুঝতে পারে না। ইদ সর্বদা তাৎক্ষণিকভাবে সুখভোগের জন্য তৎপর থাকে। তার ভোগস্পৃহা পূরণের জন্য ইদ বিন্দুমাত্র বিলম্ব করতে রাজী নয় এবং সুখভোগের পরিণাম শুভ হবে কি অশুভ হবে তা বিবেচনা করার ক্ষমতাও এর নেই।

সুখ ভোগ করা ও দুঃখকে পরিহার করার জন্য (ইদ্-এর এষণা বা আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হলে মনে যে পীড়ন (tension) থাকে তাও এই দুঃখের অন্তর্গত) ইদের অধীনে দুটো প্রক্রিয়া কাজ করে। এর একটি হচ্ছে প্রতিবর্ত ক্রিয়া (reflex action) (যেমন শিশুর মায়ের স্তনবৃন্ত চোষা) ও অপরটি হচ্ছে মুখ্য প্রক্রিয়া (primary process) (কল্পনার মাধ্যমে ইচ্ছাপূরণ)। দেহের কোথাও উত্তেজনার ফলে যে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা হ্রাস করার জন্য এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন নাকে কিছু প্রবেশ করলে তৎক্ষণাৎ হাঁচি হয়; বা হাত কোন উষ্ণ বস্তুর সংস্পর্শে এলেই হাতটি তাৎক্ষণিকভাবে অপসারিত হয়। মানুষের দেহে এ ধরনের বহু প্রতিবর্ত ক্রিয়া রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদিত হয়ে দেহের উত্তেজনা প্রশমিত করে ও অস্বস্তি দূর করে।

যে বস্তু ব্যক্তির কোন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে, সেই বস্তুর মানসিক প্রতিরূপ (mental image) সৃষ্টি করাকেই মুখ্য প্রক্রিয়া বলা হয়। যেমন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির মনে ভাল ভাল খাবারের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। যেহেতু ইদের কোন বাস্তবতাবোধ নেই, সেহেতু ইদ বাস্তবের প্রকৃত বস্তু ও এর মানসিক প্রতিচ্ছবির মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারে না। সেজন্যই কাম্যবস্তুর মানসিক প্রতিরূপ গঠনের মাধ্যমেই ইদ সুখানুভূতি লাভ করে। ফ্রয়েডের মতে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মধ্যেও এরূপ মানসিক প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে তার অচেতন মনের প্রেষণা পরিতৃপ্ত করার চেষ্টা করে। তবে কোন বস্তুর মানসিক প্রতিচ্ছবি ইদকে সাময়িক কিছুটা সুখ দিলেও তা ব্যক্তির প্রকৃত চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ব্যক্তির প্রকৃত চাহিদা পূরণের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তবভিত্তিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় এবং এই দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রক্রিয়াকে গৌণ প্রক্রিয়া (secondary process) নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই গৌণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অহমের উৎপত্তি ঘটে।

অহম (ego)

ইগোর বিস্তার মনের চেতন, প্রাকচেতন ও অচেতন স্তর জুড়ে। ইদ্-এর আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে তা জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। সব খাদ্যই স্তনবৃন্তের মতো সহজলভ্য নয়; কল্পনায় পোলাও খেলেও পেট ভরে না। তাই ইগোর প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক চিন্তা (secondary process thinking)। যা ইদ-এর আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য কার্যকর পথ স্থির করবে, আবার সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে মানানসইও হবে। হয় খেটে খাওয়ার টাকা জোগার করবে, নয় রাজনৈতিক দলের মিছিলে যোগ দিয়ে পোলাও খাবে। তাই ইগোর কর্মনীতি বাস্তবতার নীতি বা বাস্তব-সূত্র (reality principle)। ইদ্-এর প্রয়োজন মেটাতে ইগো যে বাস্তব কর্মনীতি গ্রহণ করে, তার প্রক্রিয়া চলে মনের সচেতন স্তরে। এসব মেটাতে গিয়ে সমাধান অযোগ্য দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ইগো যে আত্মরক্ষা কৌশল অবলম্বন করে, তার অবস্থান মনের প্রাকচেতন বা অচেতন স্তরে।

সব মিলে ইদের যে অংশটুকু বাস্তবের সংস্পর্শে এসে সুসংগঠিত ও বাস্তবানুগ হয়ে ওঠে, সেটাই অহম। বাস্তবে যতটুকু সুখ ভোগ করা সম্ভব, তা বিবেচনা করেই অহম ব্যক্তির কামনা বাসনাগুলো পূরণের চেষ্টা করে। অর্থাৎ অহম বাস্তবনীতির (reality principle) দ্বারা পরিচালিত হয়। সেজন্য অহমকে বাস্তবসত্তা রূপেও গণ্য করা যায়। অহম মূলতঃ সচেতন স্তরে বিরাজ করলেও এর বেশ কিছু অংশ অচেতন স্তরেও থাকে। অহমের সচেতন অংশটুকু যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব ভিত্তিক হয়; কিন্তু এর অচেতন অংশটুকু কিছুটা অযৌক্তিক ও বাস্তব-বোধহীন হয়।

ফ্রয়েডের মতে, ব্যক্তির প্রকৃত চাহিদা পূরণের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তব ভিত্তিক গৌণ প্রক্রিয়া (secondary process) এর উৎপত্তি হয়। মুখ্য প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত মানসিক প্রতিচ্ছবির বস্তুটিকে বাস্তবে খুঁজে বের করা এবং ওটাকে অর্জন ও ভোগ করার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকেই গৌণ প্রক্রিয়া বলা হয়। কাম্য বস্তুটিকে কোথায় পাওয়া যাবে ও কিভাবে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে অহম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে বাস্তবে কাম্য বস্তু লাভের প্রচেষ্টা চালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাম্য বস্তু লাভে ব্যর্থ হলে, অহম বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার লক্ষ্যবস্তু অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যায়। অহমের এই পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবে পরখ করে দেখার প্রক্রিয়াকে ফ্রয়েড বাস্তবতা পরখ বা যাচাইকরণ (reality testing) নামে আখ্যায়িত করেছেন। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবে পরখ করার জন্য অহম চিন্তন, যুক্তিকরণ, কল্পনা, শিক্ষণ, প্রভৃতি উচ্চতর মনোবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো ব্যবহার করে এবং এগুলো অহমের অধীনে ন্যস্ত থাকে।

অহমের নিজস্ব কোন শক্তি নেই। একাত্মভবন (identification) এর মাধ্যমে অহম ইদের নিকট থেকে শক্তি লাভ করে। ইদের মুখ্য প্রক্রিয়ার মানস প্রতিরূপ (mental image) এর সাথে বস্তুর প্রকৃত রূপের সাদৃশ্যকরণ (matching) করা, প্রকৃত বস্তুকে শনাক্ত করা ও অর্জন করার যাবতীয় কাজ অহম কর্তৃক সম্পাদিত হয়। এর ফলে অহমও ইদের কাছে তার কাম্য বস্তুর মতই সুখকর হয়ে ওঠে এবং কাম্যবস্তুর সাথে অহমের এই অভিন্নতার ফলে ইদের কিছু শক্তি অহমের প্রতিও নিয়োজিত হয়। যেহেতু অহম ইদেরই কিছু কামনা বাসনা বাস্তবে পূরণ করে, সেহেতু অহমের সাথেও ইদের কিছুটা একাত্মভবন ঘটে এবং ইদ স্বেচ্ছায় তার কিছু শক্তি অহমের অধীনে ন্যস্ত করে। এভাবে ইদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অহম একই প্রক্রিয়ায় যথেষ্ঠ পরিমাণে মনোশক্তির অধিকারী হয়ে উঠতে পারে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে অহম তার শক্তি ব্যবহার করতে পারে। উল্লেখ্য যে ইদের বিরুদ্ধেও অহম এই অর্জিত শক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। পরিণামে অহমের দ্বারাই ব্যক্তিত্ব পরিচালিত হয়। সেজন্য অহমকেই ব্যক্তিত্বের নির্বাহী কর্মকর্তা বলা হয়।

নির্বাহী কর্মকর্তা রূপে অহমের বহুবিধ কার্যাবলী রয়েছে। ইদের কামনা বাসনা পরিতৃপ্ত করার জন্য অহমকে বাস্তবতা অনুযায়ী আসক্তি (cathex) গঠন করতে হয়। বাস্তবের যে বস্তুর দ্বারা কোন তাড়নার নিবৃত্তি ঘটে, সেই বস্তুটি লাভের জন্য যখন নিয়মিতভাবে প্রবৃত্তিগত শক্তি ঐ বস্তুর প্রতি চালিত হয়, তখন সেটাকে আসক্তি গঠন বলা হয়। অর্থাৎ কোন প্রবৃত্তি থেকে উত্তেজনা সৃষ্টি হলেই, সেই প্রবৃত্তিগত শক্তি ঐ নির্দিষ্ট বস্তুটির প্রতি ধাবিত হয় এবং বস্তুটি অর্জনের মাধ্যমে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটে। ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করার জন্য বাস্তবতা অনুযায়ী এরূপ আসক্তি গঠন করা অহমের একটি কাজ। কোন কোন আক্রোশমূলক বা যৌনমূলক তাড়না ব্যক্তির নিজের জন্যই চরম ক্ষতিকর হতে পারে। যেমন কাউকে হত্যা বা কাউকে ধর্ষণ করার ইচ্ছা ব্যক্তির নিজের জন্যই চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের বিপজ্জনক তাড়নাকে দমন করে রাখার জন্য অহম আসক্তি-প্রতিরোধ (anti-cathex) গঠন করে। অর্থাৎ ইদের কিছু প্রবৃত্তিগত তাড়নাকে স্থায়ীভাবে রোধ করে রাখার জন্য অহম নিয়মিত যে শক্তি নিয়োগ করে, সেটাকেই আসক্তি-প্রতিরোধ গঠন বলা হয়। ইদ ও অতি-অহম পরস্পরবিরোধী দাবী নিয়ে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ওদের এই দ্বন্দ্ব নিরসন করা এবং ওদের পরস্পর-বিরোধী তাগিদগুলোর একটি বাস্তবভিত্তিক সমন্বয় সাধন করাও অহমের কাজ। চেতন ও অচেতন মনের প্রান্তসীমায় অহমই প্রহরীর ন্যায় কাজ করে এবং চেতন মনের অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো অবদমন করে ও অচেতন মনের অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো প্রতিরোধ করে রাখে। অর্থাৎ অবদমন-প্রতিরোধ রেখার কাজও এই অহমের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। এছাড়া বাস্তবকে মোকাবেলা করা এবং বাস্তব পরিবেশের সাথে সুষ্ঠু অভিযোজন করে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কাজও অহমের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। সুতরাং অহমের বহুবিধ কার্যাবলী রয়েছে। কোন কারণে অহম দুর্বল হয়ে পড়লেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিপর্যস্ত হয় এবং ব্যক্তি নানাবিধ মানসিক গোলযোগে আক্রান্ত হয়।

ফ্রয়েড সুখ-সূত্র ও বাস্তব-সূত্রের অতিরিক্ত পুনবৃত্তি-সূত্র /বাধ্যতামূলক পুনবৃত্তি (repetition compulsion) বলে আরেকটি এষণা বা নোদনাকে (drive) চিহ্নিত করেছেন। তার মতে প্রথম নোদনার বশে আমরা ভাল মন্দ বিচার না করে সুখান্বেষণে ধাবিত হই। দ্বিতীয় নোদনার সাহায্যে বাস্তব পরীক্ষা করে করণীয় নির্ধারণ করি। তৃতীয় নোদনা পুনবৃত্তির বশে বার বার একই অবস্থা অনুভবের চেষ্টা করি। এই পুনবৃত্তি নোদনাই প্রাণীদের বার্ষিক পরিযানের (migration) কারণ। এরই বশে শিশুরা একই গল্প বার বার শোনতে চায়। টিকটিকির লেজ খসে গেলে যে আবার লেজ গজায়, তা এই পুনবৃত্তিরই ফল। অচেতন পদার্থ থেকে জীবের উৎপত্তি এবং মৃত্যুর পর জীব আবার অচেতন পদার্থে রূপান্তরিত হয়, এও পুনবৃত্তি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মরণাকাঙ্ক্ষার মূলেও রয়েছে এই পুনবৃত্তি নোদনা। ফ্রয়েডের মতে পুনবৃত্তি, সুখৈষণা অপেক্ষাও শক্তিশালী নোদনা।

অতি-অহম (super-ego)

সুপার ইগো বা অতি-অহমের বিস্তার মনের চেতন, প্রাকচেতন এবং অচেতন স্তরে। ‘কী করা অনুচিত’ সামাজিক এ শিক্ষাকে আত্মস্থ করে যে ‘বিবেকবোধ’ গড়ে উঠে এবং ‘কী করা উচিত’ সামাজিক এ শিক্ষাকে আত্মস্থ করে ‘আদর্শবোধ’ গড়ে উঠে; এ দুয়ের সমাকলনেই সুপার ইগো গঠিত। শিশুর জীবনের প্রথম ভয়, ঘৃণা ও ভালবাসার ব্যক্তিকে (ছেলেদের ক্ষেত্রে বাবা, মেয়েদের ক্ষেত্রে মা) আত্মীকরণ (internalization) করেই সুপার-ইগোর সূচনা হয়।

মনের যে প্রকোষ্ঠ সামাজিক ন্যায়নীতি ও আদর্শের সংস্পর্শে এসে সুসংগঠিত ও আদর্শানুগ হয়ে ওঠে, সেটাকেই অতি-অহম বলা হয়। অতি-অহম হচ্ছে মানুষের নৈতিকতা ও নীতিবোধের ধারক ও বাহক। অর্থাৎ অতি-অহম ন্যায়- নীতি (morality principle) এর দ্বারা পরিচালিত হয়। সুতরাং এটাকে মানুষের নৈতিক সত্তা রূপেও গণ্য করা যায়। সামাজিক শিক্ষা-দীক্ষা, রীতি-নীতি ও আদর্শই অতি-অহমে প্রতিফলিত হয়। অতি-অহম আংশিক চেতন ও আংশিক অচেতন। চরম নৈতিক আদর্শকে অনুসরণ করাই অতি-অহমের লক্ষ্য। এদিক দিয়ে ইদের মতই অতি-অহমও অযৌক্তিক ও অবাস্তবধর্মী হয়। অতি-অহমও আদর্শ অনুসরণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ছাড় দিতে রাজী নয়। ইদ যেমন চরম মাত্রায় সুখভোগ করতে চায়, অতি-অহমও তেমনি চরম মাত্রায় আত্মত্যাগ করতে ও পরম উৎকর্ষ সাধন করতে চায়। ইদের মতই অতি-অহমও তার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কোনরূপ যুক্তিতর্ক বা বাস্তবতা মানতে চায় না।

চার পাঁচ বছর বয়স থেকে এই অতি-অহমের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ইডিপাস গৃঢ়ৈষার নিরসন হওয়া থেকেই অতি-অহমের সূচনা ঘটে বলে ফ্রয়েড অভিমত প্রকাশ করেছেন। ছেলেদের মায়ের প্রতি আসক্তি ও পিতার প্রতি বিরাগবোধ এবং মেয়েদের পিতার প্রতি আসক্তি ও মায়ের প্রতি বিরাগবোধ সংক্রান্ত আবেগীয় জটিলতার পরিসমাপ্তি এ পর্যায়েই ঘটে। সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই জটিলতার নিরসন হয় বলে এ সময় থেকেই শিশুদের মধ্যে সামাজিক ভাল-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় বিচার বিবেচনার উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। এ পর্যায়েই ছেলেদের মায়ের প্রতি যৌন বিমুক্ত ভালবাসার সৃষ্টি হয় এবং পিতাকে তারা অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। মেয়েদের এ সময়ে পিতার প্রতি যৌন বিমুক্ত ভালবাসার সৃষ্টি হয় এবং মাতাকে তারা অনুসরণীয় আদর্শ রূপে গ্রহণ করে। এ সময়ে মাতা পিতা সন্তানদের যে সামাজিক ন্যায়-নীতি ও আদর্শ শিক্ষা দেয়, সেটাই শিশুদের মধ্যে অতি-অহম রূপে গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে মাতা পিতা নিজেদের বাস্তব চরিত্র অনুযায়ী শিক্ষা না দিয়ে নিজেদের অতি-অহমের আদর্শ অনুযায়ী সন্তানদের শিক্ষা দেয়। ফলে মাতা পিতার শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজের চিরাচরিত রীতি-নীতি ও আদর্শসমূহ বংশপরম্পরায় সন্তানদের মধ্যে হস্তান্তরিত হতে থাকে।

অতি-অহমেরও নিজস্ব কোন শক্তি নেই। অহমের মত অতি-অহমও একাত্মভবন প্রক্রিয়ায় ইদের নিকট থেকে শক্তি লাভ করে। যেহেতু মাতা পিতা শিশুদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান করে, সেহেতু মাতা পিতাও শিশুদের কাছে তৃপ্তিদায়ক হয়ে ওঠে। ফলে মাতা পিতার প্রতিও শিশুর প্রবৃত্তিগত কিছু শক্তি নিয়োজিত হয় এবং মাতা পিতার প্রতি শিশুর আসক্তি সৃষ্টি হয়। মাতা পিতা শিশুর যে কাজের জন্য শিশুকে প্রসংশা করে ও পুরস্কৃত করে, সে কাজগুলোর প্রতিও শিশুর আসক্তি সৃষ্টি হয়। মাতা পিতা যে কাজের জন্য শিশুকে তিরস্কার করে ও শাস্তি দেয়, সেগুলোর প্রতি শিশুর মনে বিরাগবোধ ও আসক্তি-প্রতিরোধের সৃষ্টি হয় এবং শিশু ওগুলো বর্জন করে। এভাবেই শিশুর মধ্যে ন্যায়- অন্যায় বোধের সৃষ্টি হয় ও অতি-অহম গঠিত হয়। সুতরাং মাতা পিতার সাথে একাত্মভবন (identification) ও মাতা পিতার আদর্শ অন্তঃক্ষেপণ (introjection) এর মাধ্যমে অতি-অহম গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে অতি-অহমই মানুষের মধ্যে মাতা পিতার প্রতিভূ রূপে কাজ করে এবং মাতা পিতার অনুপস্থিতিতে অতি-অহমই মাতা পিতার দায়িত্ব পালন করে।

ফ্রয়েড অতি-অহমের দু’টো দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে বিবেক (conscience), যা মন্দ কাজ করা থেকে ব্যক্তিকে বিরত রাখে। এটা অতি-অহমের নঞর্থক দিক। কোন কাজটা করা যাবে না, তা এই বিবেক দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং এর দ্বারাই ব্যক্তি আত্ম-সংযম শেখে। অতি-অহমের অপর দিকটি হচ্ছে আদর্শ-অহম (ego- ideal), যা ব্যক্তিকে ভাল কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। এটা অতি-অহমের সদর্থক দিক। কোন কাজটা ব্যক্তিকে অবশ্যই করতে হবে, সে বিষয়ে এই আদর্শ-অহম ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদান করে। আদর্শ-অহমের নির্দেশেই ব্যক্তি ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। মাতা পিতার তিরস্কার ও শাস্তি থেকে বিবেকের উৎপত্তি হয় এবং মাতা পিতার প্রশংসা ও পুরস্কার থেকে আদর্শ-অহমের উৎপত্তি হয়।

অতি-অহম কর্তৃক বিভিন্ন রকম কার্যাবলী সাধিত হয়। ইদের ভোগলিন্সাকে রোধ করে রাখার জন্য অতি-অহম সর্বদা তৎপরতা চালিয়ে যায়। ফলে ইদের গর্হিত দাবীগুলো দমন করে রাখা অহমের পক্ষে সহজ হয়। বাস্তবনীতির পরিবর্তে ন্যায়নীতি অনুসরণের জন্য অতি-অহম সর্বদা অহমকে প্ররোচিত করে। এছাড়া নিখুঁত উৎকর্ষ সাধনের জন্য অতি-অহম ব্যক্তিকে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করে এবং উচ্চ মানবীয় গুণ অর্জনের জন্য মানুষকে প্রেরণা যোগায়। অতি-অহম বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠলে ব্যক্তি অতিরিক্ত আত্মসমালোচনায় লিপ্ত হয়। অতিরিক্ত কঠোর অতি-অহম ব্যক্তির মধ্যে চরম মাত্রায় আত্ম-পীড়নের সৃষ্টি করতে পারে, মনের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করতে পারে এবং বিভিন্ন মনোবৈকল্যের উৎপত্তি ঘটাতে পারে। সুপারইগোর মূল এষণা মরণাকাঙ্ক্ষা। এটি ইদ-ইগোর যৌনাকাঙ্ক্ষা ও আগ্রাসনের অভ্যন্তরীণ শাস্তিদাতা। এজন্যই এর বাংলা প্রতিশব্দ অধিশাস্তা।

উপসংহার

ইদ, অহম ও অতি-অহম আসলে মানব প্রকৃতির তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিক। ইদকে মানুষের জৈবিক দিক বলা যায়; অহমকে মানুষের মনস্তাত্বিক দিক বলা যায় এবং অতি- অহমকে মানুষের সামাজিক দিক বলা যায়। মানুষের এই তিনটি দিকের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে এই পরস্পর বিরোধী দিকগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমেই সুস্থ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমেই ব্যক্তি একটি অভিন্ন একক সত্তা রূপে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজের অস্তিত্বকে সার্থকভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে।

ব্যক্তিত্বের চালিকাশক্তি ও প্রবৃত্তি তত্ত্ব

মনের গতিবিদ্যা

ফ্রয়েড মানুষকে একটি জটিল শক্তিতন্ত্র (complex energy system) হিসাবে কল্পনা করতেন। তার ধারণা, খাদ্যে সঞ্চিত শক্তি বিপাক প্রক্রিয়ায় শারীরিক শক্তিতে পরিণত হয়। সেই শারীরিক শক্তি আবার রূপান্তরিত হয় মানসিক শক্তিতে। এই মানসিক শক্তি দুটি এষণা আকারে প্রকাশ পায়, জীবনাকাঙ্ক্ষা ও মরণাকাঙ্ক্ষা। ইদ্ (Id) হল শারীরিক শক্তির মানসিক শক্তিতে রূপান্তরের স্থান। প্রবৃত্তি চরিতার্থকারী কোনো বস্তু কিংবা এর রূপকল্পের প্রতি ইদ নিয়োজিত মানসিক শক্তিকে ফ্রয়েড বলেন প্রবৃত্তির বিষয়-নিযুক্তি (object-cathexis) কিংবা বিষয়কে কামনায় আধানিত/আধানযুক্ত করা। ইদ্ এর কামনার রাশ টানার জন্য ইগোকে যে শক্তি নিয়োগ করতে হয় তা বিষয়-বিযুক্তি (anti-cathexis) বা বিষয়কে কামনার আধানমুক্ত করা। সীমিত মানসিক শক্তি তিনটি প্রকোষ্ঠে বিভাজিত হয়। তাই এক প্রকোষ্ঠে শক্তির বৃদ্ধি অন্যটিতে শক্তির ঘাটতি ফেলে।

ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন বাইরের জগৎ যেমন, অন্তর্জগৎও তেমনি কার্যকারণ নিয়মাধীন। তিনি বাইরের জগৎকে বলতেন বস্তুগত বাস্তবতা (material reality) এবং অন্তর্জগৎকে মানসিক বাস্তবতা (psychical reality)। তিনি বিশ্বাস করতেন ভৌত বিজ্ঞানের কাজ যেমন বাইরের জগতের নিয়ম আবিষ্কার, তেমনি মনোবিজ্ঞানের কাজ অন্তর্জগতের নিয়ম আবিষ্কার। কিন্তু তিনি বাইরের জগৎ ও অন্তর্জগতের পারস্পরিক বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটিকে বাদ দিয়ে, কেবলমাত্র অন্তর্জগতের মধ্যেই অন্তর্জগতের নিয়ম অনুসন্ধানে রত হন। তার মতে অন্তর্জগতের নিয়ম আবিষ্কারে ‘বাস্তবের বোধ’ ও ‘কল্পনা’ উভয়কেই সমান হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। মনোজগতের কার্যকারণ নিয়মকে তিনি মানসিক নির্ধারণবাদ (psychic determinism) বলে আখ্যায়িত করেন। যেহেতু তিনি মানসিক শক্তির গতি প্রক্রিয়ার রূপক-এ মানসিক ক্রিয়ার বর্ণনা করেন, তাই মনোবিজ্ঞানে তার সূচিত ধারাটি সাইকোডায়নামিক (psychodynamic) ধারা নামে পরিচিত।

মনোনিয়ন্ত্রণবাদ ও প্রবৃত্তি তত্ত্ব

ব্যক্তিত্বের চালিকাশক্তি ব্যাখ্যা করার জন্য ফ্রয়েড তার প্রবৃত্তি তত্ত্ব (instinct theory) এর অবতারণা করেছেন। ফ্রয়েডের মতে প্রবৃত্তিই মানুষের যাবতীয় আচরণের পেছনে চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে ও ব্যক্তিকে গতিশীল করে তোলে। ফ্রয়েডের চিন্তাধারা ঊনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষবাদ (positivism) নিয়ন্ত্রণবাদ (determinism) ফ্রয়েডের চিন্তা ভাবনার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। সুশৃঙ্খলভাবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করার দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রত্যক্ষবাদ বলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ফ্রয়েড তার সুদীর্ঘ জীবনে চিকিৎসামূলক (clinical) অনুসন্ধান চালিয়েছেন এবং প্রাপ্ত তথ্যসমূহ সুশৃঙ্খলিত করে তার তত্ত্বে উপস্থাপন করেছেন।

জাগতিক কোন ঘটনাই বিনা কারণে বা অলৌকিক কারণে ঘটে না। প্রতিটি ঘটনার পেছনেই কোন পার্থিব শক্তি কারণ রূপে কাজ করে। পূর্ববর্তী কোন শর্ত, অবস্থা বা ঘটনা শক্তি রূপে কাজ করে পরবর্তী ঘটনার উৎপত্তি ঘটায়। জাগতিক যাবতীয় ঘটনাবলীই একটি সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ সূত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে যে ধারণা পোষণ করা হয়, সেটাকেই নিয়ন্ত্রণবাদ বলা হয়। ফ্রয়েড এই নিয়ন্ত্রণবাদের প্রেক্ষিতেই মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ যাবতীয় মানসিক ক্রিয়াকলাপের পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে এবং প্রাকৃতিক কোন শক্তির দ্বারাই মানসিক কার্যকলাপ সংঘটিত হ’চ্ছে। যে শক্তির দ্বারা মানসিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালিত হয়, সেই শক্তিকেই তিনি মনোশক্তি (psychic energy) রূপে আখ্যায়িত করেছেন। এই মনোশক্তির দ্বারা মানসিক কার্যাবলী নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ধারণাকেই মনোনিয়ন্ত্রণবাদ (psychic determinism) বলা হয়। এই ধারণা অনুযায়ী পূর্ববর্তী কোন শর্ত, অবস্থা বা ঘটনা মনোশক্তি রূপে কাজ করে পরবর্তী মানসিক ক্রিয়াকলাপের উৎপত্তি ঘটায়। এই মনোশক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই ফ্রয়েড তার প্রবৃত্তি সংক্রান্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন।

ফ্রয়েড শক্তির নিত্যতা (conservation of energy) তত্ত্বেও বিশ্বাস করতেন। পদার্থবিদদের মত তিনি মনে করতেন যে জাগতিক শক্তির কোন ক্ষয় বা বিনাশ নেই। একস্থানে শক্তি ব্যয় হতে শুরু করলে, সেই ব্যয়কৃত শক্তি ভিন্ন স্থানে বা ভিন্ন রূপে জমা হ’তে থাকে। ফলে সামগ্রিক শক্তির পরিমাণ কোন সময়ই হ্রাসপ্রাপ্ত হয় না। তবে শক্তির রূপ পরিবর্তিত হয় এবং শক্তি এক রূপ থেকে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। শক্তির এই রূপান্তর সংক্রান্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ফ্রয়েড বলেছেন যে দৈহিক শক্তিই রূপান্তরিত হয়ে মনোশক্তির উৎপত্তি ঘটায়। আবার মনোশক্তিও পুনরায় দৈহিক শক্তিতে রূপান্তরিত হ’তে পারে। দৈহিক শক্তি ও মনোশক্তির মধ্যে সংযোগকারী প্রক্রিয়া রূপে ফ্রয়েড এই প্রবৃত্তির ধারণা দিয়েছেন এবং প্রবৃত্তিকেই তিনি যাবতীয় মনোশক্তির উৎস বলেছেন।

দৈহিক কোন অস্বস্তিকর উত্তেজনা থেকেই প্রবৃত্তির উৎপত্তি হয়। দেহের কোন অভাবজনিত চাহিদা থেকে দেহে অস্বস্তিকর উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং এই অস্বস্তিকর উত্তেজনা প্রবৃত্তির উৎপত্তি ঘটায়। সুতরাং দেহের অভাবজনিত চাহিদা হচ্ছে প্রবৃত্তির শারীরবৃত্তীয় রূপ। আর এই অস্বস্তিকর উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কাম্যবস্তু লাভের যে ইচ্ছা জাগে, সেই ইচ্ছা হচ্ছে প্রবৃত্তির মনোবৃত্তীয় রূপ। অর্থাৎ দেহের কোন চাহিদা যে দৈহিক শক্তি সৃষ্টি করে, তা প্রবৃত্তির মাধ্যমে কোন বস্তু লাভের ইচ্ছা বা মনোশক্তিতে পরিণত হয়। এভাবে দৈহিক শক্তি মনোশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবতীয় মানসিক ক্রিয়াকলাপের পেছনে চালিকা শক্তি রূপে কাজ করে। যেমন পুষ্টির অভাবজনিত কারণে দেহে যে অস্বস্তিকর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তা ক্ষুধা প্রবৃত্তির উৎপত্তি ঘটায়। এই ক্ষুধা প্রবৃত্তির দৈহিক দিক হচ্ছে দেহের খাদ্য চাহিদা এবং এই খাদ্য চাহিদা পক্ষান্তরে খাদ্যলাভের ইচ্ছায় পরিণত হয়। এই খাদ্যলাভের ইচ্ছা যে মনোশক্তি সৃষ্টি করে, তা খাদ্য অন্বেষণ, অর্জন ও ভোগ করার বিষয়ে চিন্তন ও পরিকল্পনা প্রণয়নের পেছনে চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে। অতঃপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষুধার্ত ব্যক্তি বিভিন্ন আচরণ সম্পাদন করে। অর্থাৎ মনোশক্তি পুনরায় দৈহিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে দৈহিক আচরণের উৎপত্তি ঘটায়। সুতরাং ফ্রয়েডের মতে প্রবৃত্তিই হচ্ছে মনোশক্তির উৎস এবং প্রবৃত্তির মাধ্যমেই দৈহিক শক্তি মনোশক্তিতে পরিণত হয়। যেহেতু প্রবৃত্তি ইদে অবস্থান করে, সেহেতু ইদকেই যাবতীয় মনোশক্তির ভাণ্ডার রূপে গণ্য করা হয়। প্রবৃত্তি

প্রবৃত্তির বৈশিষ্ট্য

ফ্রয়েড প্রবৃত্তির চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে প্রবৃত্তির উৎস, প্রবৃত্তির লক্ষ্য, প্রবৃত্তির বস্তু ও প্রবৃত্তির শক্তি। ফ্রয়েডের মতে শারীরিক কোন চাহিদা থেকেই দেহের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে অস্বস্তিকর উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং এই শারীরিক উত্তেজনা থেকেই প্রবৃত্তির উৎপত্তি ঘটে। সুতরাং দেহের কোন অস্বস্তিকর উত্তেজনাই হচ্ছে প্রবৃত্তির উৎস (source of instinct)। প্রবৃত্তির এই উৎসসমূহ মোটমুটি অপরিবর্তিত থাকে। তবে দৈহিক পরিপক্কতা অর্জনের ফলে দেহের নতুন নতুন স্থানে উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে এবং নতুন নতুন প্রবৃত্তির উৎপত্তি ঘটতে পারে।

যে শারীরিক উত্তেজনাময় অবস্থা থেকে প্রবৃত্তির উৎপত্তি হয়, সেই উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে পূর্বের প্রশান্তিময় অবস্থায় ফিরে যাওয়াই হচ্ছে প্রবৃত্তির লক্ষ্য (aim of the instinct)। প্রবৃত্তি হচ্ছে একটি উত্তেজনাময় অস্থির অবস্থা (state of disequilibrium)। এই অস্থির অবস্থার অবসান ঘটিয়ে পূর্বের প্রশান্তিময় স্থির (equillibrium) অবস্থা ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে প্রবৃত্তির লক্ষ্য। যেহেতু পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়াই প্রবৃত্তির লক্ষ্য, সেহেতু ফ্রয়েড এটাকে পশ্চাৎগামী প্রক্রিয়া (regressive process) রূপে আখ্যায়িত করেছেন। মানুষের জীবনে বিভিন্ন প্রবৃত্তির উদয় ও অবসান অনবরত চলতে থাকে। একটি প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটলেই আর একটি প্রবৃত্তির উৎপত্তি হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একই প্রবৃত্তি বার বার উৎপত্তি লাভ করে। যেমন দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার আমাদের মধ্যে ক্ষুধা প্রবৃত্তির পুনরাবৃত্তি ঘটে। সুতরাং প্রবৃত্তির উৎপত্তিতে অস্থির অবস্থার সৃষ্টি এবং প্রবৃত্তি নিবৃত্তির মাধ্যমে প্রশান্তিময় স্থির অবস্থা অর্জন এই ঘটনাদ্বয় পালাক্রমে মানুষের জীবনে অনবরত ঘটতে থাকে। সেজন্যই ফ্রয়েড মানুষকে ‘উত্তেজনা হ্রাসকরণ তন্ত্র’ (tension reduction system) রূপে বর্ণনা করেছেন। প্রবৃত্তির জন্যই মানুষের জীবন জুড়ে প্রেষণাচক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। মানুষের অভাবজনিত চাহিদা এক উত্তেজনাময় অস্থির অবস্থা সৃষ্টি করে এবং চাহিদা পূরণের মাধ্যমে প্রশান্তিময় স্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াকেই ফ্রয়েড পুনরাবৃত্তিমূলক বাধ্যবাধকতা (repitition compulsion) রূপে আখ্যায়িত করেছেন।

প্রবৃত্তির বস্তু কথাটিকে ফ্রয়েড বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। প্রবৃত্তির উৎপত্তি থেকে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনাবলীকে ফ্রয়েড প্রবৃত্তির বস্তু রূপে বর্ণনা করেছেন। কাম্য বস্তু (যা প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটায়), কাম্য বস্তু লাভের পথ ও প্রক্রিয়া ও পরিণামে কাম্য বস্তু ভোগ করা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কেই ফ্রয়েড প্রবৃত্তির বস্তু (object of instinct) বলেছেন। পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রবৃত্তির বস্তু পরিবর্তিত হতে পারে। যদি প্রবৃত্তির মূল বস্তু (যা প্রবৃত্তির মতই জন্মগত হতে পারে) না পাওয়া যায়, তবে বিকল্প কোন বস্তু অর্জনের মাধ্যমে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটে। যদি বিকল্প বস্তুও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, তবে অন্য কোন বিকল্প বস্তু অর্জনের মাধ্যমে প্রবৃত্তির সন্তুষ্টিবিধান করা হয়। দুষ্প্রাপ্যতার জন্য বিকল্প বস্তুরও অসংখ্য পরিবর্তন ঘটতে পারে। উল্লেখ্য যে প্রবৃত্তির বস্তু বলতে এখানে কাম্য বস্তু, কাম্য বস্তু লাভের পথ ও প্রক্রিয়া, প্রভৃতি সব কিছুই বোঝানো হয়েছে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী এগুলোর যে কোনটি পরিবর্তিত হতে পারে। অপস্থাপন (displacement) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এরূপ পরিবর্তন ঘটে। কাম্য বস্তু লাভে বাধার সৃষ্টি হলেই প্রবৃত্তিগত শক্তি অপস্থাপন প্রক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হয়ে বিকল্প পথ বা বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়। যখন প্রবৃত্তিগত শক্তি আদি বস্তু থেকে স্থানান্তরিত বা অপস্থাপিত হয়ে কোন নির্দিষ্ট বিকল্প বস্তুর প্রতি নিয়মিত ধাবিত হয়, তখন সেটাকে প্রবৃত্তি উপজাত (instinct derivative) বলা হয়। মানুষের অনেক আচরণই এরূপ প্রবৃত্তি উপজাত। ফ্রয়েডের মতে প্রবৃত্তিগত শক্তির অপস্থাপন ঘটার জন্যই অসংখ্য প্রবৃত্তি উপজাত সৃষ্টি হয় এবং সেজন্যই মানুষের চরিত্রে পরিবর্তনশীলতা এসে যায় ও মানুষে মানুষে অসীম পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

দৈহিক চাহিদার তীব্রতার ওপরই প্রবৃত্তির শক্তি (impetus) নির্ভর করে। দেহের চাহিদা যত তীব্র হয়, প্রবৃত্তির শক্তিও তত বেশী হয়। বিশেষ মুহূর্তে কোন প্রবৃত্তি ব্যক্তির মধ্যে উৎপত্তি লাভ করবে, তা এই প্রবৃত্তির শক্তির ওপর নির্ভর করে। সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী প্রবৃত্তি ব্যক্তির মধ্যে প্রথম সক্রিয় হয়ে ব্যক্তিকে চালিত করে এবং এটার নিবৃত্তি ঘটলেই পরবর্তী শক্তিশালী প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুতরাং কোন প্রবৃত্তি কখন সক্রিয় হয়ে উঠবে, তা উপস্থিত প্রবৃত্তিসমূহের আপেক্ষিক শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়।

প্রবৃত্তির প্রকারভেদ

দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টির ফলে মানুষের মধ্যে অসংখ্য প্রবৃত্তির উৎপত্তি হতে পারে। এরূপ কতগুলো প্রবৃত্তি আছে, বা কি কি প্রবৃত্তি আছে সে সম্পর্কে ফ্রয়েড সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। তবে তিনি দু’ধরনের প্রবৃত্তির কথা বলেছেন। তার মতে এই দু’ধরনের প্রবৃত্তিই মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের পেছনে চালিকা শক্তি রূপে কাজ করে। এ দু’টো হচ্ছে জীবন প্রবৃত্তি ও মরণ প্রবৃত্তি।

জীবন প্রবৃত্তি : ফ্রয়েড জীবন প্রবৃত্তির দু’টো অংশের কথা বলেছেন। একটিকে বলা হয়েছে আত্ম-সংরক্ষণ (self- preservation)। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত। অপরটিকে বলা হয়েছে বংশবিস্তার (self-reproduction)। যৌনতা সংক্রান্ত প্রবৃত্তিগুলো এর অন্তর্গত। সুতরাং নিজেকে রক্ষা করা ও বংশবিস্তার করার তাগিদকেই ফ্রয়েড জীবন প্রবৃত্তি (life instinct or erros) নামে আখ্যায়িত করেছেন। জীবন প্রবৃত্তির মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেকে রক্ষা করা এবং বংশবিস্তার করা। প্রথম দিকে ফ্রয়েড জীবন প্রবৃত্তির এই দু’টো দিকের কথা বললেও, পরবর্তীকালে বংশবিস্তার করা বা যৌনতার ওপরই তিনি সম্পূর্ণ গুরত্ব আরোপ করেছেন এবং জীবন প্রবৃত্তি বলতে তিনি শুধু যৌনতাকেই বুঝিয়েছেন। জীবন প্রবৃত্তির শক্তিকে তিনি লিবিডো (libido) বা কামশক্তি নামে অভিহিত করেছেন এবং জীবন প্রবৃত্তি কথাটিকে কাম প্রবৃত্তির সমার্থক রূপে ব্যবহার করেছেন। কামশক্তি বিশেষ পাত্র পাত্রী বা আসক্তির বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়ে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। প্রবৃত্তির আদি বস্তু লাভের পথে যদি বাধার সৃষ্টি হয়, তবে প্রবৃত্তিগত শক্তি বিকল্প কোন বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়। ফ্রয়েডের মতে, অপস্থাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অসংখ্য বিকল্প বস্তু প্রবৃত্তি উপজাত রূপে ব্যক্তির তৃপ্তি সাধন করতে পারে। এদিক দিয়ে বিচার করেই ফ্রয়েড বলেছেন যে মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপ যৌন তাড়নার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন পন্থায় তাদের যৌন তাড়না পরিতৃপ্ত করে। সেজন্যই মানুষে মানুষে অসীম পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। শিশুদের স্ট্যাম্প সংগ্রহ, শিল্পীর শিল্পকর্ম, সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম, বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার, প্রভৃতি যাবতীয় নির্দোষ ও নিষ্কাম কার্যাবলীকেও ফ্রয়েড কাম প্রবৃত্তি উপজাত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ যৌন তাড়নার তৃপ্তি সাধনে ব্যর্থ হয়েই মানুষ বিকল্প কর্মে আত্মনিয়োগ করে। সুতরাং কামশক্তির দ্বারা তাড়িত হয়েই মানুষ বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মে লিপ্ত হয়। মানুষের প্রবৃত্তিগত শক্তি বিভিন্ন পন্থায় ও বিভিন্ন বস্তুতে অপস্থাপিত হয় বলেই ফ্রয়েডের মতে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে।

যৌন প্রবৃত্তি কিন্তু একটি প্রবৃত্তি নয়। অনেকগুলো প্রবৃত্তির সমষ্টিকে ফ্রয়েড যৌন প্রবৃত্তি রূপে উল্লেখ করেছেন। এই প্রবৃত্তিগুলোর উৎস হচ্ছে দেহের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্দীপনা, যা সুখানুভূতির সৃষ্টি করে। দেহের বিভিন্ন অঞ্চলের সূক্ষ্ম ত্বক ও ঝিল্লি উদ্দীপিত হলেই ব্যক্তি সুখানুভূতি লাভ করে। দেহের যে অঞ্চলের উদ্দীপনা সুখানুভূতির সৃষ্টি করে, সেই অঞ্চলগুলোকে ফ্রয়েড কামাঞ্চল (erogenous or erotic zone) নামে আখ্যায়িত করেছেন। দেহে এরূপ কতগুলো সুখদায়ক কামাঞ্চল আছে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা দুষ্কর। তবে দেহের তিনটি অঞ্চলের সুখদায়ক ক্রিয়া বেশ স্পষ্ট এবং ফ্রয়েড এই তিনটি অঞ্চলের কথাই তার তত্ত্বে তুলে ধরেছেন। এগুলো হচ্ছে মুখ, পায়ুদ্বার ও যৌনাঙ্গ। স্পর্শন, চোষণ ও চর্বণের মাধ্যমে মুখে সুখানুভূতির সৃষ্টি হয়; রেচন ক্রিয়ার মাধ্যমে পায়ুদ্বারে সুখানুভূতির সৃষ্টি হয় এবং ঘর্ষণ ও মর্দনের মাধ্যমে যৌনাঙ্গে সুখানুভূতির সৃষ্টি হয়। মুখ, পায়ুদ্ধার ও যৌনাঙ্গের কামাঞ্চলগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ব্যক্তির মধ্যে বিকাশ লাভ করে এবং ব্যক্তির বিকাশপর্বে এগুলো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। কিন্তু ব্যক্তি পরিপক্কতা অর্জন করলেই এই অঞ্চলগুলো পরস্পর একত্রিভূত হয়ে যায় এবং সম্মিলিতভাবে এগুলো বংশবিস্তারের কাজে সহায়তা করে।

মরণ প্রবৃত্তি : মানুষের মধ্যে একটি শক্তিশালী বিনাশক প্রবৃত্তিও আছে বলে ফ্রয়েড মনে করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসলীলা দেখে এ বিষয়ে ফ্রয়েডের ধারণা দৃঢ়বদ্ধ হয়ে যায়। তার প্রণীত “Beyond the Pleasure Principle” নামক গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে তার ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। মানব প্রকৃতির এই ধ্বংসাত্মক দিকটিকেই ফ্রয়েড মরণ প্রবৃত্তি (death instinct or thanatos) নামে আখ্যায়িত করেছেন। ফ্রয়েডের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘মৃত্যুই মানুষের অন্তিম লক্ষ্যস্থল’ (death is the final goal of life)। এই মৃত্যুর ইচ্ছাই হচ্ছে মরণ প্রবৃত্তি। মরণ প্রবৃত্তির দৈহিক উৎস সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। তবে ধরে নেওয়া যায় যে, দেহ কোষ ও কলায় যে ভাঙ্গন প্রক্রিয়া (katabolic process) চলতে থাকে, সেটাই হয়ত মরণ প্রবৃত্তির দৈহিক উৎস।

মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে বলে যে ধারণা ফ্রয়েড দিয়েছেন, তা তিনি ফেকনারের তত্ত্ব থেকে পেয়েছেন বলে মনে করা হয়। জীবের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার সম্পর্কে ফেকনার তার তত্ত্ব দিয়েছেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী অজৈব পদার্থের ওপর জাগতিক শক্তির ক্রিয়ার ফলেই বিশ্বে প্রথম প্রাণ সঞ্চার ঘটেছে। প্রথম দিকে এই প্রাণশক্তি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ছিল। বিবর্তনের মাধ্যমে কালক্রমে এই প্রাণশক্তির স্থায়িত্ব বেড়েছে এবং বিভিন্ন জীবের উৎপত্তি হয়েছে। কালক্রমে জীবকুল বংশবিস্তারের ক্ষমতাও লাভ করেছে। তবুও প্রাণীকুলের আদি উৎস হচ্ছে সেই প্রাণহীন অজৈব অবস্থা। সুতরাং প্রানীর জৈব অবস্থা হচ্ছে একটি উত্তেজনাময় সাময়িক অস্থির অবস্থা (state of disequilibrium) এবং তার আদি অজৈব অবস্থা হচ্ছে একটি স্থায়ী প্রশান্তিময় স্থির অবস্থা (state of equilibrium) । সুতরাং প্রাণী তার আদি প্রশান্তিময় ও স্থিতিশীল অজৈব অবস্থায় ফিরে যাওয়ার তাগিদ বোধ করে। এ থেকেই প্রাণীর মধ্যে মৃত্যুর কামনা সৃষ্টি হয়।

জীবন প্রবৃত্তির শক্তি সম্পর্কে ফ্রয়েড যেমন লিবিডোর কথা বলেছেন, মরণ প্রবৃত্তির জন্য সে রকম কোন শক্তির কথা তিনি বলেননি। তবে এই মরণ প্রবৃত্তি যে সর্বদা মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল, সে কথা তিনি বলেছেন। এই মরণ প্রবৃত্তির মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ব্যক্তি স্বয়ং। সুতরাং নিজেকে বিনাশ করা বা আত্ম-বিনাশ করাই মরণ প্রবৃত্তির মূল লক্ষ্য। তবে মানুষের মধ্যে জীবন প্রবৃত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় মরণ প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়ে মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। অর্থাৎ শক্তিশালী জীবন প্রবৃত্তির প্রভাবে আত্ম-বিনাশের পথ রুদ্ধ হয়ে থাকে এবং মরণ প্রবৃত্তির অস্তিত্ব ও কার্যকলাপ সম্পর্কে মানুষের কোন উপলব্ধি ঘটে না। তবে মরণ প্রবৃত্তি প্রত্যক্ষভাবে কোন কাজ না করলেও পরোক্ষভাবে এর কাজ সব সময় চলতেই থাকে। আত্ম-বিনাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে মরণ প্রবৃত্তির শক্তি অপরকে ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তি অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মরণ প্রবৃত্তি এর আদি বস্তু (নিজেকে ধ্বংস করা) লাভে ব্যর্থ হয়ে বিকল্প বস্তুর (অপরকে ধ্বংস করার) প্রতি ধাবিত হয় এবং ব্যক্তি আগ্রাসী (aggressive) হয়ে ওঠে এবং নানাবিধ ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হয়।

দুই প্রবৃত্তির সম্মিলিতভাবে কাজ : জীবন প্রবৃত্তি ও মরণ প্রবৃত্তি পরস্পর বিরোধী দু’টো শক্তি। তবে কোন কোন সময় এ দু’টো শক্তি পরস্পর সম্মিলিতভাবে কাজ করে। খাদ্য গ্রহণ যেমন রসনার তৃপ্তি সাধন ও দেহের পুষ্টি সাধনের মাধ্যমে জীবন প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করে, তেমনি তা খাদ্যবস্তু চর্বণ ও ধ্বংস করার মাধ্যমে মরণ প্রবৃত্তিকেও পরিতৃপ্ত করে। আবার কোন কোন সময় এ দু’টো প্রবৃত্তি পরস্পরের শক্তি হ্রাস করতে পারে। যেমন ঘৃণা ভালবাসার শক্তি কমাতে পারে, বা ভালবাসা ঘৃণার শক্তি কমাতে পারে। কোন কোন সময় এক প্রবৃত্তি অপর প্রবৃত্তির স্থলাভিষিক্ত হয়ে পড়তে পারে। যেমন ঘৃণা ভালবাসার স্থান দখল করতে পারে, অথবা ভালবাসা ঘৃণার স্থান দখল করতে পারে।

ইদ, অহম ও অতি-অহমের মধ্যে প্রবৃত্তির ফলে সৃষ্ট  মনোশক্তি বিতরণ হয়। সকল মনোশক্তির ভাণ্ডার হচ্ছে ইদ। অর্থাৎ ইদই মূলতঃ সকল মনোশক্তির অধিকারী। তবে অহম ও অতি-অহম একাত্মভবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইদের নিকট থেকে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি অর্জন করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে ওরা তা ব্যবহার করতে পারে। উল্লেখ্য যে মনোশক্তির ওপর নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইদ, অহম ও অতি-অহমের মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চলে এবং ব্যক্তির মধ্যে আসক্তি গঠন ও আসক্তি-প্রতিরোধ গঠনের ক্রিয়া-প্রকিক্রিয়া সর্বদাই চলতে থাকে। শক্তি লাভের এই প্রতিযোগিতায় ইদ বেশী সাফল্য অর্জন করলে ব্যক্তি অতিরিক্ত ভোগবিলাসী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে ওঠে। এই প্রতিযোগিতায় অতি-অহম বেশী সাফল্য অর্জন করলে ব্যক্তি কঠোর নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এ দুটোর কোনটাই বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্তির টিকে থাকার জন্য উপযোগী নয়। অহম শক্তিশালী হয়ে উঠলেই, তা ব্যক্তির জন্য মঙ্গলজনক হয়। কারণ একমাত্র অহমই ইদ ও অতি-অহমের পরস্পর-বিরোধী শক্তির মধ্যে সমঝোতা ও সমন্বয় সাধন করে মানসিক ঐক্য অর্জন করতে পারে এবং বাস্তবকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে পারে।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ

ব্যক্তিত্বের বিকাশকে ফ্রয়েড তার নিজের ভাষায় মনোযৌন বিকাশ (psycho-sexual development) নামে বর্ণনা করেছেন। তিনি মানুষের জন্মগত যৌন-প্রবৃত্তির শক্তিকে লিবিডো (libido) বা কামশক্তি রুপে আখ্যায়িত করেছেন। জন্মের মুহূর্ত থেকেই কামশক্তির বিকাশ ঘটতে থাকে এবং এই বিকাশের সাথে জড়িত হয়েই ব্যক্তির মন মানসিকতার বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ যৌনতার বিকাশ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ফলে একটির বিকাশকে অপরটির বিকাশ থেকে আলাদা করা যায় না। সেজন্যই ফ্রয়েড তার তত্ত্বে ব্যক্তিত্বের বিকাশকে মনোযৌন বিকাশ নামে উপস্থাপন করেছেন।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রক্রিয়া

জন্মের পর থেকেই মানুষের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। ফ্রয়েড মনে করেন, ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরণের মানসিক চাপ বা টেনশন-এ ব্যক্তিটির সাড়া দেয়ার ক্রমিক প্রক্রিয়া। ফ্রয়েডের মতে চার রকমের উৎস থেকে উদ্দীপনা লাভের ফলেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। এই চার রকমের উৎস হচ্ছে ১. শিশুর বেড়ে ওঠার শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, ২. কামনা পূরণের ব্যর্থতাজাত হতাশা, ৩. মনের ভিতরে বিভিন্ন কামনার দ্বন্দ্ব, ৪. কামনা পূরণের পথে পরিবেশগত বাধার হুমকি (threat)। ব্যক্তিটি শেখে কিভাবে এসব মানসিক চাপ লাঘব করতে হয়। শারীরিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার ফলে ব্যক্তির দেহ ও মনে পরিপক্কতা আসে এবং এই পরিপক্কতার জন্যই ব্যক্তি নিত্য নতুন আচরণগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। ব্যর্থতা, দ্বন্দ্ব ও হুমকি মোকাবেলা করার জন্যও ব্যক্তিকে নিত্য নতুন আচরণগত কৌশল আয়ত্ব করতে হয় এবং এর জন্যও ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। অবদমন (repression), একাত্মভবন (identification) এবং অপস্থাপন (displacement) চাপ মোকাবেলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক উপায়। তবে সাধারণতঃ একাত্মভবন ও অপস্থাপন এই দু’রকম প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি নিত্য নতুন আচরণগত কৌশল ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। ফ্রয়েড তার তত্ত্বে এ দু’টো প্রক্রিয়ার অবতারণা করে মানব প্রকৃতির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। অহম ও অতি-অহমের গঠন এবং ইদের চাহিদা পূরণের সাথে যেমন এ দু’টো প্রক্রিয়া জড়িত, তেমনি ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও গঠনও এ দু’টো প্রক্রিয়ার দ্বারাই সংঘটিত হয়। নিচে অবদমন (repression), একাত্মভবন (identification) এবং অপস্থাপন (displacement) এর বর্ণনা দেয়া হলো :

অবদমন (repression): যে সমস্ত অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতা ব্যক্তির কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে, সেগুলো সে জোরপূর্বক ভুলে থাকে বা অচেতন মনে দাবিয়ে রাখে। এই জোরপূর্বক ভুলে থাকা বা অচেতন মনে দাবিয়ে রাখার প্রক্রিয়াকেই অবদমন বলা হয়। সুপার-ইগো বা অতি অহমের অংশ হিসেবে বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কামনা বা বিবেককে পীড়িত করে এমন স্মৃতিকে অহম অবদমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনের সচেতন স্তর থেকে অচেতনে পাঠিয়ে দেয়। অবদমন মনের একটি আদিমতম প্রক্রিয়া। ফ্রয়েড হিস্টিরিয়ার রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে এই অচেতন মন ও অবদমন প্রক্রিয়ার সন্ধান লাভ করেন। মানুষ যে কোন পীড়াদায়ক বিষয়কে এই কৌশলের মাধ্যমে অচেতন মনে দাবিয়ে রেখে পীড়ন ও উদ্বেগের কবল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। ইদের অংশ হিসেবে ব্যক্তির জন্মগত আদিম কামনা, বাসনা ও প্রবৃত্তিসমূহ মানুষের অচেতন স্তরে বিরাজ করে। এছাড়া ব্যক্তির লজ্জাজনক, ঘৃনাজনক ও পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতাসমূহ এই অচেতন স্তরে থাকে। অচেতন মনের বিষয়গুলো এতই অসামাজিক, পাপপূর্ণ, পীড়াদায়ক ও জঘন্য প্রকৃতির যে, ব্যক্তির নিজের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে অচতন মনের বিষয়গুলো সাধারণভাবে কোনসময়ই চেতন স্তরে প্রবেশ লাভ করতে পারে না।

প্রাক-চেতন ও অচেতন মনের মাঝখানে অবদমন-প্রতিরোধ রেখা (repression-resistance line) নামের প্রতিবন্ধকটি প্রাক-চেতন মনের অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর বিষয়গুলোকে জোরপূর্বক অচেতন মনে দাবিয়ে রাখে যাকে অবদমন (repression) প্রক্রিয়া বলা হয়। সেই সাথে এটি অচেতন মনের অবাঞ্ছিত বিষয়গুলোকে প্রাক-চেতন স্তরে প্রবেশ করতে বাধা দেয় যাকে প্রতিরোধ (resistance) প্রক্রিয়া বলা হয়। তাই অবদমন-প্রতিরোধ প্রক্রিয়া সতর্ক প্রহরীর ন্যায় কাজ করে। এই সতর্ক প্রহরাকার্যের জন্যই অচেতন মনের অবাঞ্ছিত কোন উপাদান প্রাক-চেতন মনে প্রবেশ করতে পারে না ও প্রাক-চেতন মনের অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো নির্বাসিত হয়ে অচেতন স্তরে প্রেরিত হয়। চেতন ও অচেতন মনের প্রান্তসীমায় প্রহরীর ন্যায় কাজ করে মনের অহম বা ইগোই এই অবদমন-প্রতিরোধ এর কাজ করে।

ফ্রয়েডের মতে শিশুকালে শিশ্নচ্ছেদ সংক্রান্ত তীব্র উদ্বেগের জন্য ছেলেরা মায়ের প্রতি যৌন আকর্ষণ ও পিতার প্রতি আগ্রাসী মনোভাবকে জোরপূর্বক অবদমন করে এবং সামগ্রিকভাবে তার যৌনলিপ্সা অবদমিত হয়ে মনের অচেতন স্তরে চলে যায়। এর ফলে তারা প্রসুপ্তিকালে প্রবেশ করে। ছেলেদের ইডিপাস গৃঢ়ৈষার এরূপ আকস্মিক ও নাটকীয় অবদমনের ফলেই তাদের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। সেজন্যই যৌন সংক্রান্ত বিষয়ে পুরুষরা অধিকতর স্পর্শকাতর ও আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে।

একাত্মভবন (identification): অপর কোন ব্যক্তির সাথে নিজেকে একাত্ম বলে অনুভব করা এবং নিজের মধ্যে ঐ ব্যক্তির আদর্শ, মূল্যবোধ ও আচরণগত বৈশিষ্টের প্রতিফলন ঘটানোকেই একাত্মভবন (identification) বলা হয়। যেমন শিশুরা মাতা পিতার সাথে নিজেকে একাত্ম বলে অনুভব করে এবং মাতা পিতার আদর্শ ও আচরণ অনুকরণ করে। মাতা পিতার সাথে একাত্মভবনের ফলেই শিশুর মধ্যে অতি-অহমের বিকাশ ঘটে এবং অতি-অহম শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং একাত্মভবনের প্রক্রিয়ায় শিশু তার মাতা পিতার বহুবিধ আচার আচরণ ও মন মানসিকতা অনুকরণ করে, যা তার ব্যক্তিত্বের স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। শুধু শৈবকালেই নয়, সমস্ত জীবন ধরেই একাত্বভবন প্রক্রিয়া চলে এবং মাতা পিতা ছাড়াও অপর যে কোন ব্যক্তির সাথেই একাত্মভবন হ’তে পারে। মানুষ তার পারিপার্শ্বিক জগতের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে তার আদর্শ রূপে গ্রহণ করতে পারে ও তার সাথে নিজেকে একাত্মবোধ করতে পারে এবং আদর্শ ব্যক্তির আচার আচরণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজের মধ্যে অন্তঃক্ষেপণ করে। আদর্শ ব্যক্তির চাল-চলন, রীতি- নীতি ও মূল্যবোধ নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করা এবং ওগুলোকে নিজের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যে পরিণত করাকেই অন্তঃক্ষেপণ (introjection) বলা হয়। একাত্মভবন প্রক্রিয়ার জন্যই মানুষের মধ্যে এরূপ অন্তঃক্ষেপণ ঘটে এবং সেভাবেই তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে।

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করেছে, তারাই সাধারণত মানুষের কাছে আদর্শ ব্যক্তি হয়ে ওঠে। কৃতি খেলোয়ার, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ মানুষের কাছে অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে ওঠে। যে সব ক্ষেত্রে ব্যক্তি সাফল্য লাভের প্রয়াসী হয়ে ব্যর্থ হয়, সে সব ক্ষেত্রে যারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে, তাদেরকেই সে আদর্শ রূপে গ্রহণ করে এবং তাদের দৃষ্টান্ত অনুসারেই সে নিজেকে গড়ে তোলে।

অপস্থাপন (displacement): মানব প্রকৃতির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করার জন্য ফ্রয়েড এই অপস্থাপন প্রক্রিয়ার অবতারণা করেছেন। প্রবৃত্তিগত শক্তি যখন আদি কাম্যবস্তু লাভে ব্যর্থ হয়ে বিকল্প কোন বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়, তখন সেটাকে অপস্থাপন (displacement) বলা হয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী এক বিকল্প বস্তু থেকে ভিন্ন কোন বিকল্প বস্তুতেও প্রবৃত্তিগত শক্তি অপস্থাপিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে এবং এ ধরনের অপস্থাপন সারা জীবন ধরে চলতে থাকে। সুতরাং মানুষ বিভিন্ন পন্থায় ও বিভিন্ন বস্তু অর্জনের মাধ্যমে একই প্রবৃত্তির তৃপ্তি সাধন করে। প্রবৃত্তিগত শক্তির এই অপস্থাপনের জন্যই প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব পন্থায় বিভিন্ন প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটায়। সেজন্যই প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয় এবং সেভাবেই তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে।

আবেগের অপস্থাপনের কথাও ফ্রয়েড বলেছেন। এক বস্তুর সাথে যুক্ত আবেগ ভিন্ন বস্তুতে অপস্থাপিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে। যেমন মায়ের প্রতি ভালবাসা অন্য কোন মহিলার প্রতি স্থানান্তরিত হতে পারে, বা একজনের প্রতি ক্রোধ অন্যের প্রতি স্থানান্তরিত হতে পারে। স্বপ্নে ব্যবহৃত একটি কৌশল রূপেও অপস্থাপনের কথা ফ্রয়েড বলেছেন। এই অপস্থাপন কৌশল ব্যবহারের জন্যই স্বপ্নের মূল কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং কোন তুচ্ছ আনুষঙ্গিক বিষয় স্বপ্নের মূলকেন্দ্রে পরিণত হয় ও মূল বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ফলে স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নের আসল তাৎপর্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়।

একটি আত্মরক্ষামূলক কৌশল রূপেও ফ্রয়েড অপস্থাপনের কথা বলেছেন। অনেক সময় মানুষের মধ্যে এমন কিছু সমস্যাজনক আবেগের সৃষ্টি হয়, যা প্রকাশিত হলে ব্যক্তি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং ব্যক্তি এগুলো অবদমন করে রাখে। কিন্তু এগুলো অবদমিত থাকলেও ব্যক্তি মনে তীব্র অস্বস্তি ও অশান্তি বোধ করে। এরূপ অবস্থায় ব্যক্তি অপস্থাপন প্রক্রিয়ার সাহায্যে তার অবদমিত আবেগ ভিন্ন কোন নিরাপদ পরিস্থিতিতে ব্যক্ত করে টেনশন মুক্ত হয়। যেমন অফিসে বড়সাহেবের বকুনি খেয়ে প্রচণ্ড রাগ হলেও ব্যক্তি তা অবদমন করে রাখতে বাধ্য হয়। অতঃপর গৃহে ফিরে সে অহেতুক স্ত্রী পুত্রের ওপর প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে পারে। অর্থাৎ অপস্থাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সে তার অবদমিত ক্রোধ (যা তার কাছে অস্বস্তিকর) নিরপরাধ স্ত্রী পুত্রের ওপর প্রকাশ করে কিছুটা স্বস্তি লাভ করে। সুতরাং অপস্থাপন প্রক্রিয়া বিভিন্নভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশধারায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া রূপে কাজ করে।

ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্তর

ফ্রয়েডের মতে, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও যৌন বিকাশ পরস্পর ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ সাধারণতঃ মনে করে যে শিশুরা নিষ্কাম ও নিষ্কলুষ। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে জন্ম থেকেই মানুষ যৌন প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়, এবং জন্ম থেকেই শিশুদের মধ্যে কামশক্তির বিকাশ ঘটতে থাকে। এই কামশক্তির বিকাশকে কেন্দ্র করেই শিশুর মন মানসিকতা গড়ে ওঠে। সেজন্যই ব্যক্তিত্বের বিকাশকে ফ্রয়েড মনোযৌন বিকাশ (psycho-sexual development) নামে আখ্যায়িত করেছেন। মনোযৌন বিকাশকে ফ্রয়েড প্রথমতঃ প্রধান দু’টো ভাগে বিভক্ত করেছেন। একটিকে তিনি বলেছেন প্রাক-যৌনাঙ্গমূলক স্তর (pre-genital stage) ও অপরটিকে বলেছেন যৌনাঙ্গমূলক স্তর (genital stage)। এ দুটো স্তরের মাঝখানে রয়েছে প্রসুপ্তি কাল (latency period)।

প্রাক-যৌনাঙ্গমূলক স্তর: প্রাক-যৌনাঙ্গমূলক স্তরকে শৈশবকালীন যৌনতা (infantile sexuality) রূপেও আখ্যায়িত করা হয়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে ফ্রয়েড শৈশবকালীন যৌন বিকাশের ওপরই অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই শৈশবকালীন যৌন বিকাশ জন্ম থেকে পাঁচ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত চলতে থাকে। এই বয়সের মধ্যেই ব্যক্তিত্বের মূল কাঠামো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়ে যায় বলে ফ্রয়েড অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রাক-যৌনাঙ্গমূলক স্তরে দেহের বিভিন্ন কামাঞ্চলগুলো স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করে এবং এই কামাঞ্চলগুলোকে কেন্দ্র করেই কামশক্তির বিকাশ ঘটে। দেহের তিনটি প্রধান কামাঞ্চল অনুসারে ফ্রয়েড প্রাক-যৌনাঙ্গমূলক স্তরকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হচ্ছে মুখকাম পর্ব, পায়ুকাম পর্ব ও শিশ্নকাম পর্ব। বিশেষ পর্বে বিশেষ কামাঞ্চলকে কেন্দ্র করে যৌনতার বিকাশ ঘটে বলেই ফ্রয়েড কামাঞ্চল অনুসারে এগুলোর নামকরণ করেছেন।

মুখকাম পর্ব (oral phase) : জন্মের পর থেকে এক বছর বা দেড় বছর বয়স কাল পর্যন্ত এই পর্বের স্থায়িত্ব। এই পর্বে কামশক্তি মুখ অঞ্চলে অবস্থান করে। এ সময়ে ওষ্ঠাধর, জিহ্বা ও মুখবিবরে উদ্দীপনা লাভের মাধ্যমে শিশু কামসুখ লাভ করে এবং মুখকেই শিশু যাবতীয় সুখ লাভের কেন্দ্র বলে মনে করে। মাতৃস্তন্য চোষণের মাধ্যমে শিশু যেমন যৌন সুখ লাভ করে, তেমনি তার দেহেরও পুষ্টি সাধিত হয়। এই পর্বে মুখই শিশুর কাছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে। সেজন্যই শিশুরা এ বয়সে নাগালের মধ্যে যা কিছু পায়, তা সবই মুখে ঢুকিয়ে দেয়। এই পর্বের আবার দু’টো ভাগ আছে। একটিকে বলা হয় চোষণ (sucking) পর্যায় ও অপরটিকে বলা হয় কামড় (biting) পর্যায়। প্রথমে চোষণ পর্যায় শুরু হয় এবং এ পর্যায়ে শিশু মাতুস্তন্য চোষনের মাধ্যমে তৃপ্তি লাভ করে। শিশুর দাঁত ওঠার পর কামড় পর্যায় শুরু হয় এবং এই পর্যায়ে কামড় দিয়ে খাদ্যবস্তু ধ্বংস করার মাধ্যমে শিশু তৃপ্তি লাভ করে। চোষণ পর্যায়ে যদি কামশক্তি সংবদ্ধ (fixation) হয় বা আটকিয়ে যায় বা বিকাশ অবরুদ্ধ হয়, তাহলে সিগারেট খাওয়া, তর্ক করা, পরমুখাপেক্ষী হওয়া, প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। কামড় পর্যায়ে যদি কামশক্তি সংবদ্ধ হয়, তা’হলে বক্রোক্তি করা, ব্যঙ্গ করা, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা, আগ্রাসী হওয়া, প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। সব মিলে এ পর্যায়ে বিকাশ অবরুদ্ধ হলে শিশু হতে পারে আশাবাদী, নির্ভরশীল, উদার কিংবা নাছোরবান্দা, কুটিল।

পায়ুকাম পর্ব (anal phase): এক বছর দেড় বছর বয়স থেকে দু বছর আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত এই পর্বের স্থায়িত্বকাল। এই পর্বে কামশক্তি পায়ু অঞ্চলে অবস্থান করে। খাদ্য গ্রহণের ফলে অন্ত্রে যে বর্জ্য পদার্থ জমে ওঠে, তা এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মাধ্যমে অন্ত্রের বর্জ্য পদার্থ যখন পায়ুপথে নিষ্কাশিত হয়, তখন শিশু তৃপ্তি বোধ করে। সুতরাং মলত্যাগের প্রক্রিয়াও তৃপ্তিদায়ক হওয়ায়, তা শিশুর কাছে ক্রমশঃ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এছাড়া এ বয়সে শিশুদেরকে মাতৃস্তন্য পান করা থেকেও বিরত রাখা হয়। ফলে মাতৃস্তনের বিকল্প বিষয় রূপেও পায়ুদ্বার ও মলত্যাগ শিশুদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। সুতরাং তারা মলত্যাগ প্রক্রিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ঘন ঘন মলত্যাগ করে অথবা মলত্যাগের সময়কে দীর্ঘায়িত করে শিশুরা এ পর্যায়ে যৌন সুখ লাভ করে।

এ সময়েই শিশুদের শৌচ-প্রশিক্ষণ (toilet training) শুরু হয়। অর্থাৎ এ সময়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে শিশুদের কিছু নিয়ম নীতি শিক্ষা দেয়া হয় এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসারে মলত্যাগ, প্রস্রাব করার জন্য শিশুদের অভ্যস্ত করে তোলা হয়। অর্থাৎ এ পর্যায়েই বর্জ্য পদার্থ ত্যাগের জন্য শিশুদের ওপর কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করা হয় এবং এভাবেই শিশুদের আচরণের ওপর প্রথম বাহ্যিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। ফ্রয়েডের মতে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠনের ওপর এই শৌচ-প্রশিক্ষণের সুদূর প্রসারী প্রভাব রয়েছে। শৌচ-প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বাপ মা যদি কঠোর মনোভাবপন্ন হয়, তবে তা শিশুর মধ্যে দু রকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা শিশুর মধ্যে মাতা পিতার প্রতি বিরাগ সৃষ্টি করে এবং শিশু মাতা পিতার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করে। এ ধরনের শিশুরাই অসময়ে ও অস্থানে ঘন ঘন মলত্যাগ করে মাতা পিতাকে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে এবং ঘন ঘন মলত্যাগের মাধ্যমে এরা যৌন সুখ লাভ করে। এই শিশুদেরকেই ফ্রয়েড মলবর্জনকারী চরিত্র (anal expulsive character) রূপে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের শিশুরাই বড় হয়ে অমিতব্যয়ী, অগোছালো, শৃঙ্খলাহীন, ও আইন অমান্যকারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

দ্বিতীয়তঃ মাতা পিতার কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার জন্য শিশু তার মলত্যাগের তাগিদকে স্থগিত রাখে এবং অস্ত্রে মল আটকিয়ে রাখে। ফলে এবা কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত হয় এবং মলত্যাগের সময় শুষ্ক মল নির্গত হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। ফ্রয়েডের মতে এ ধরনের শিশুরা মলত্যাগের প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে যৌন সুখ ভোগ করে। এই শিশুদেরকেই ফ্রয়েড মলসংরক্ষণকারী চরিত্র (anal retentive character) রূপে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের শিশুরাই বড় হয়ে অত্যন্ত কৃপণ, একগুঁয়ে, কঠোর নিয়মানুবর্তী ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার রাতিকসম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

শিশুর মলত্যাগের প্রতি মা যদি সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং নিয়ম অনুসারে শিশুকে মলত্যাগের জন্য উৎসাহিত করে ও মলত্যাগ সুসম্পন্ন হ’লে শিশুকে প্রশংসা করে, তা’হলে শিশু মলত্যাগের কাজটিকে গুরুত্বপূর্ণ ও সৃজনশীল কাজ বলে মনে করে। ফলে তারা কাজটিকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করে এবং কাজটা সুসম্পন্ন হওয়াকে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি বলে মনে করে। এ ধরনের শিশুরাই সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় এবং পরিণত জীবনে এরাই বিভিন্ন সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী হয়। ফ্রয়েড এদেরকেই সৃজনশীল চরিত্র (productive character) রূপে আখ্যায়িত করেছেন। সব মিলে এ পর্যায়ে বিকাশ অবরুদ্ধ হলে শিশু হতে পারে শৃঙ্খলাপরায়ণ, মিতব্যয়ী, সময়ানুবর্তী কিংবা একগুঁয়ে, বিদ্রোহী।

শিশ্নকাম পর্ব (phallic phase): দু’বছর আড়াই বছর বয়স থেকে চার বছর সাড়ে চার বছর বয়স পর্যন্ত এই পর্বের স্থায়িত্ব। এই পর্বে কামশক্তি যৌনাঙ্গে অবস্থান গ্রহণ করে। এ পর্বের প্রথম দিকে ছেলে মেয়েরা ওদের যৌনাঙ্গের পার্থক্য বুঝতে পারে না এবং উভয় দলই পুরুষ যৌনাঙ্গের অধিকারী বলে ওরা মনে করে। মেয়েদের ভগাঙ্কুর (clitoris) পুরুষ যৌনাঙ্গের অনুরূপ বলে ওদের মনে হয় এবং এই পুরুষাঙ্গ অর্থাৎ শিশ্নকে কেন্দ্র করেই এ সময়ে ওদের যৌনতার বিকাশ ঘটে। সেজন্যই ফ্রয়েড এই পর্বকে শিশ্নকাম পর্ব বলেছেন। উল্লেখ্য যে ইংরেজী phallic শব্দটি গ্রীক phallas শব্দ থেকে এসেছে এবং phallas শব্দের অর্থ শিশু বা পুরুষ যৌনাঙ্গ। যৌনাঙ্গ স্পর্শ করে, ঘর্ষণ বা মর্দন করে শিশুরা এ পর্যায়ে যৌন তৃপ্তি লাভ করে।

শিশ্নপর্বের শেষ ভাগে অবশ্য ছেলে মেয়েরা নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে এবং তখন থেকেই ছেলে ও মেয়েদের বিকাশ ধারায় পার্থক্য এসে যায়। প্রথমে মায়ের প্রতিই ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই অধিক আকর্ষণ থাকে। কারণ মায়ের মাধ্যমেই ওদের যাবতীয় চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটে। কিন্তু শিশুপর্বের শেষ ভাগে ছেলে ও মেয়েদের আকর্ষণের পাত্র পাত্রী পরিবর্তিত হয়ে যায়। ছেলেরা যখন নারী ও পুরুষ যৌনাঙ্গের পার্থক্য বুঝতে পারে, তখন তারা মায়ের প্রতি অধিক আকর্ষণ বোধ করে। কারণ ছেলেরা ঐ সময় মাকে ওদের যৌনসঙ্গী রূপে পেতে চায় এবং মায়ের মাধ্যমেই ওরা যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করতে চায়। কিন্তু মাকে একান্তভাবে পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় এবং সেজন্য ওরা পিতাকে প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে ভাবতে শুরু করে। ফলে পিতার প্রতি ছেলেদের মনে তীব্র আক্রোশবোধের সৃষ্টি হয় এবং পিতাকে সম্পূর্ণ অপসারণ করে মাতাকে একান্তভাবে ভোগ করার ইচ্ছা তাদের হয়। মাতার প্রতি আকর্ষণমূলক ও পিতার প্রতি আক্রোশমূলক এই জটিল আবেগীয় অবস্থাকে ফ্রয়েড ইডিপাস গৃঢ়ৈষা (edipus complex) নামে আখ্যায়িত করেছেন।

গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর নায়ক রাজা ইডিপাসের নামানুসারে ফ্রয়েড এই নামকরণ করেছেন। জ্যোতিষীরা ইডিপাস সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিল যে, এই ছেলে বড় হয়ে আপন পিতাকে হত্যা করে তার আপন মাতাকে বিবাহ করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য তিনি তার পিতা কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন এবং শিশু অবস্থায় তাকে গভীর জঙ্গলে ফেলে আসা হয়। তারপর ভাগ্যক্রমে তিনি সেখান থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী এক রাজার গৃহে আশ্রয় লাভ করেন এবং রাজার পালিত পুত্র রূপে সেখানে তিনি লালিত পালিত হন। কিন্তু পরবর্তীকালে সেখানেও তিনি জ্যোতিষীদের নিকট থেকে তার সম্পর্কে সেই একই ভবিষ্যদ্বাণী জানতে পারেন। ফলে পালক মাতা পিতাকে তিনি নিজ মাতা পিতা মনে করে গৃহত্যাগ করেন এবং ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তিনি নিজ পিতার রাজ্যে উপস্থিত হন। সেখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধে তিনি পিতাকে নিহত করেন এবং মাতাকে বিবাহ করেন। এভাবেই তার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়ে ওঠে তবে ঘটনাটা ইডিপাসের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে ঘটেছে এবং এটা তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ভয়ঙ্কর দৈব দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে প্রতিটি ছেলের মধ্যেই পিতাকে হত্যা করে মাতাকে একান্তভাবে ভোগ করার কামনা এই শিশুপর্বে জাগ্রত হয়। তবে এ অবস্থা তার মধ্যে বেশীদিন স্থায়ী হতে পারে না। ক্রমশঃ বোধশক্তি বিকাশের ফলে সে অচিরেই বুঝতে পারে যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ তার পিতা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তিনিই পরিবারের সর্বেসর্বা। সুতরাং মায়ের প্রতি তার যৌনলিপ্সা ঘুণাক্ষরে প্রকাশ হয়ে পড়লেও পিতা তাকে কঠোর শাস্তি দেবে। যেহেতু যৌনাঙ্গটাই যৌনলিপ্সার জন্য দায়ী, সেহেতু পিতা শান্তি রূপে তার ঐ অঙ্গটাই কর্তন করে দেবে বলে তার মনে তীব্র আশঙ্কাবোধের সৃষ্টি হয়। শিশ্ন কর্তনের এই তীব্র আশঙ্কাবোধকেই ফ্রয়েড শিশ্নচ্ছেদ উদ্বেগ (castration anxiety) রূপে আখ্যায়িত করেছেন। শিশ্নচ্ছেদ সংক্রান্ত তীব্র উদ্বেগের জন্যই ছেলেরা মায়ের প্রতি যৌন আকর্ষণ ও পিতার প্রতি আগ্রাসী মনোভাবকে জোরপূর্বক অবদমন করে এবং সামগ্রিকভাবে তার যৌনলিপ্সা অবদমিত হয়ে মনের অচেতন স্তরে চলে যায়। এর ফলে তারা প্রসুপ্তিকালে প্রবেশ করে। ছেলেদের ইডিপাস গৃঢ়ৈষার এরূপ আকস্মিক ও নাটকীয় অবদমনের ফলেই তাদের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। সেজন্যই যৌন সংক্রান্ত বিষয়ে পুরুষরা অধিকতর স্পর্শকাতর ও আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে।

শিশ্নকাম পর্বে মেয়েরা যখন নারী ও পুরুষ যৌনাঙ্গের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে, তখন প্রথমেই তাদের মধ্যে শিশ্নচ্ছেদ গৃঢ়ৈষা (castration complex) এর উৎপত্তি হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে শিশ্নচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়; কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে শিশ্নচ্ছেদ আগেই ঘটে গিয়েছে বলে এক জটিল আবেগীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেজন্যই মেয়েদের অবস্থাকে উদ্বেগ (anxiety) না বলে গৃঢ়ৈষা (complex) বলা হয়। মেয়েরা শিশ্নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে মনে করে এবং তাদের শিশ্নচ্ছেদ ঘটার জন্য তারা মাকেই দায়ী করে। যেহেতু মায়ের ঐ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি নেই, সেহেতু মা-ই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের শিশ্নচ্ছেদের ব্যবস্থা করেছে বলে মেয়েদের মনে হয়। মায়ের এই গর্হিত আচরণের জন্য মায়ের প্রতি ওদের তীব্র আক্রোশের সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে পিতার ঐ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি আছে বলে পিতার প্রতি ওরা আকর্ষণ বোধ করে এবং পিতার মাধ্যমে শিল্প লাভের কামনা বোধ করে, অর্থাৎ পিতার প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে। ফলে মেয়েদের মধ্যেও ছেলেদের অনুরূপ ইডিপাস গৃঢ়ৈযার উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ পিতার প্রতি আকর্ষণ বোধ ও মাতার প্রতি আক্রোশ বোধের এক জটিল আবেগীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। মেয়েদের এই আবেগীয় অবস্থাকে কেউ কেউ ইলেক্ট্রা গৃঢ়ৈষা নামে অভিহিত করলেও, ফ্রয়েড কিন্তু ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই ইডিপাস গৃঢ়ৈষা শব্দটিই বেশী ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, ইডিপাস কমপ্লেক্সের বিপরীতে, ইলেকট্রা কমপ্লেক্স-এর ধারণাটি প্রস্তাব করেন ফ্রয়েডশিষ্য ইয়ং। ফ্রয়েড সেটি গ্রহণ করেননি। তার মতে মেয়েদের মানসিক বিকাশে শিশ্ন ঈর্ষাই কেন্দ্রীয়। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই জনক জননীর বিপরীত লিঙ্গধারীর প্রতি আকর্ষণ ও সমলিঙ্গধারীর প্রতি আক্রোশ বোধের এক মিশ্র আবেগীয় অবস্থাকেই ইডিপাস গুঢ়ৈযা বলা হয়। তবে উল্লেখ্য যে ফ্রয়েডের মতে মানুষ উভলিঙ্গ জীব এবং নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই বিপরীত লিঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। ফলে ছেলেদের মধে অবস্থিত নারীসুলভ বৈশিষ্ঠ্যের জন্য তারা পিতার প্রতিও কিছু যৌনাকর্ষণ বোধ করে এবং মেয়েদের মধ্যে অবস্থিত পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্যের জন্য তারা মায়ের প্রতিও কিছুটা যৌনাকর্ষণ বোধ করে। ছেলে ও মেয়েদের এ ধরনের প্রবণতা পরবর্তীকালে তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রভাব বিস্তার করে।

ইডিপাস গৃঢ়ৈষার সাথে জড়িত হয়েই মেয়েদের মধ্যে আরও একটি আবেগীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। মেয়েদের পিতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির সাথে সাথে কিছু ঈর্ষাবোধেরও সৃষ্টি হয়। কারণ সেই মূল্যবান অঙ্গটি (অর্থাৎ শিশু) পুরুষদের আছে, যা তার নেই। এর ফলে মেয়েদের মধ্যে যেমন একটি অভাববোধ ও হীনমন্যতাবোধের সৃষ্টি হয়, তেমনি তার মধ্যে পুরুষদের প্রতি একটি ঈর্ষাবোধেরও সৃষ্টি হয়। এটাকেই ফ্রয়েড শিশ্ন ঈর্ষা (penis envy) নামে আখ্যায়িত করেছেন। শিশ্ন ঈর্ষা থেকেই মেয়েদের মনে যে হীনতা বোধের সৃষ্টি হয়, তা থেকেই তাদের মধ্যে কিছু মেয়েলী বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয়। তাদের হীনতাকে পূরণ করার জন্যই মেয়েরা নানাভাবে ছলা-কলাময়ী হয়ে পুরুষদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। মেয়েদের ইডিপাস গৃঢ়ৈষার অবসান ছেলেদের মত আকস্মিকভাবে ঘটে না। বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে বোধশক্তির বিকাশ ঘটে এবং তারা ক্রমশঃ উপলব্ধি করে যে সামাজিক কারণে পিতার সাথে তাদের যৌনকামনা পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে ধীরে ধীরে তারা তাদের ইডিপাস গুঢ়ৈষাকে অবদমন করে এবং প্রসুপ্তিকালে প্রবেশ করে। ইডিপাস গৃঢ়ৈষা ধীরে গতিতে অবদমিত হওয়ার জন্যও তাদের মধ্যে কিছু মেয়েলী বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয়। যৌন বিষয়ে মেয়েরা অনেক বেশী আবেগমুক্ত ও বাস্তববাদী হয়।

প্রসুপ্তি কাল (latency period): সাড়ে চার পাঁচ বছর বয়স থেকে বার তের বছর বয়স পর্যন্ত প্রসুপ্তিকালের স্থায়িত্ব। এ সময়ে যৌনকামনা সম্পূর্ণ অবদমিত হয়ে প্রসুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং ছেলে ও মেয়েরা যৌনমূলক উত্তেজনা থেকে মুক্ত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে পিতার সাথে ছেলেরা একাত্মতা বোধ করে ও মায়ের প্রতি তাদের যৌনমুক্ত ভালবাসার সৃষ্টি হয়। ফলে ছেলেরা মাতা পিতাকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করে এবং ওদের আচরণ অনুকরণ করতে থাকে। মেয়েরা মায়ের সাথে একাত্মতা বোধ করে এবং পিতার প্রতি যৌনমুক্ত ভালবাসার সৃষ্টি হয়। ফলে মেয়েরাও মাতা পিতাকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করে এবং ওদের আচরণ অনুকরণ করতে থাকে। সাধারণতঃ ছেলেদের পিতার সাথে বেশী একাত্মভবন হয় এবং পিতার মত নিজেদের তারা গড়ে তোলে। তবে কোন ছেলের মধ্যে যদি মেয়েলী প্রবণতা থাকে, তবে মায়ের সাথে তার একাত্মভবন বেশী হয় এবং তার মধ্যে কিছু মেয়েলী বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয়। অপরদিকে মেয়েদের মায়ের সাথেই বেশী একাত্মভবন হয়। তবে কোন মেয়ের মধ্যে যদি পুরুষালী প্রবণতা থাকে, তবে পিতার সাথেই তার একাত্মভবন বেশী হয় এবং তার মধ্যে কিছু পুরুষালী বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয়। সুতরাং প্রসুপ্তিকালে ছেলে ও মেয়েরা কামজ উত্তেজনা থেকে মুক্ত হয়ে মাতা পিতার নির্দেশ, উপদেশ ও আদর্শ অনুসারে নিজেদের গড়ে তোলে এবং সামাজিক ও পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জন করে। ইডিপাস গূঢ়ৈষা অবদমনের মাধ্যমে যে অতি-অহমের বিকাশ শুরু হয়, তা এই পর্যায়ে মাতা পিতার আদর্শ অনুসারে গড়ে উঠতে থাকে। এ পর্যায়ে বিকাশ অবরুদ্ধতার জন্য শিশু হয় সমকামী।

যৌনাঙ্গমূলক স্তর (genital stage): বার তের বছর বয়সে যখন ছেলে ও মেয়েদের যৌনাঙ্গ পরিপক্কতা লাভ করে এবং যৌনগ্রন্থির সক্রিয় কার্যাবলী শুরু হয়, তখনই এই যৌনাঙ্গস্তর শুরু হয় এবং বার্ধক্যকাল পর্যন্ত এই স্তর চলতে থাকে। উল্লেখ্য যে বার্ধক্যকালে মানুষের মধ্যে পুনরায় প্রাক-যৌনাঙ্গস্তরের বৈশিষ্ট্য কিছুটা ফিরে আসে। সুতরাং যৌনাঙ্গস্তরেই বংশবিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক সামর্থ্য ও পরিপক্কতা মানুষ অর্জন করে। এ পর্যায়ে প্রসুপ্ত কাম প্রবৃত্তি পুনরুজ্জীবিত হয় এবং দীর্ঘদিন অবদমিত হয়ে থাকা যৌনতাড়নার বহিঃপ্রকাশ এ পর্যায়ের প্রথম দিকে প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে।

প্রাক-যৌনাঙ্গস্তর ও যৌনাঙ্গস্তরের যৌনতাড়নার মধ্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। প্রথমতঃ যৌনাঙ্গস্তরের যৌন তাড়নায় যে ধরনের শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি থাকে, প্রাক-যৌনাঙ্গ পর্যায়ে তা থাকে না। যেমন প্রাক-যৌনাঙ্গ পর্যায়ে যৌনাঙ্গের পরিপক্কতা ঘটেনা এবং যৌন গ্রন্থিও সক্রিয় হয়ে ওঠে না ও গৌণ-যৌন বৈশিষ্ট্যেরও উৎপত্তি হয় না। দ্বিতীয়তঃ প্রাক- যৌনাঙ্গ পর্যায়ে ছেলে মেয়েরা নিজের দেহকে কেন্দ্র করেই আত্মসুখ লাভের চেষ্টা করে এবং নিজের কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উদ্দীপনার প্রতিই তাদের মূল আগ্রহ সীমাবদ্ধ থাকে। শিশ্ন পর্বে শিশুরা মাতা পিতার প্রতি আকৃষ্ট হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা শুধু আত্মসুখ অর্জনের জন্যই মাতা পিতাকে উপকরণ রূপে ব্যবহার করতে চায়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে প্রকৃত বস্তুকাম (object love) এর উৎপত্তি হয় না এবং তাদের প্রবৃত্তিগত শক্তি বা কামশক্তি ঐ পর্যায়ে মাতা পিতা বা বাহ্যিক কোন বস্তুতে নিয়োজিত না হয়ে নিজের প্রতিই নিয়োজিত থাকে। ফলে নিজেকে কেন্দ্র করেই তারা আত্মসুখ লাভ করে। উল্লেখ্য যে যৌনাঙ্গমূলক স্তরেই প্রকৃত বস্তুকামের উৎপত্তি ঘটে এবং বাহ্যিক বস্তুর প্রতি প্রকৃত প্রবৃত্তিগত আসক্তির সৃষ্টি হয়।

প্রাক-যৌনাঙ্গমূলক স্তরের এই আত্মকেন্দ্রিক সুখ লাভের প্রবণতাকেই ফ্রয়েড মুখ্য আত্মকাম বা প্রাইমারী নারসিসিজম (pripiary narcicism) নামে আখ্যায়িত করেছেন। এই নামটিও ফ্রয়েড গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী থেকে নিয়েছেন। নারসিসাস নামে এক দেবী নিজের রূপে মুগ্ধ হয়ে এমন আত্মবিভোর হয়ে থাকতো যে কোন পুরুষের প্রতি সে কখনও আকৃষ্ট হ’ত না। ফলে দেবরাজের অভিশাপে সে নারসিসাস ফুলে পরিণত হয়। এই ফুল জলাশয়ের পাশে জন্মায় এবং জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখেই এই নারসিসাস ফুল আত্মবিভোর হয়ে থাকে। প্রাক-যৌনাঙ্গ স্তরে এই মুখ্য আত্মকাম প্রতিটি শিশুর মধ্যেই দেখা যায় এবং যৌনাঙ্গস্তরেই মানুষের মধ্যে প্রকৃত বস্তুকামের উৎপত্তি হয়। তবে যৌনাঙ্গস্তরেও কারো কারো মধ্যে অতিরিক্ত আত্মসচেতনতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের প্রবণতাকে গৌণ আত্মকাম (secondary narcicism) নামে আখ্যায়িত করা হয়।

যৌনাঙ্গস্তরে যৌন উত্তেজনার প্রচণ্ডতা ছেলে মেয়েদের অত্যন্ত বিব্রত ও বিপর্যস্ত করে তোলে। যৌন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে তাদের মধ্যে এ সময়ে আশঙ্কা বোধের সৃষ্টি হয়। ফলে এ বয়সে কিশোর কিশোরীদের মধ্যে অত্যন্ত আবেগপ্রবণতা ও উত্তেজনশীলতা দেখা যায় এবং সেজন্যই এ সময়টাকে ঝড় ও ঝঞ্ঝার কাল (period of storm and stress) বলে অভিহিত করা হয়। বিপজ্জনক যৌন তাড়না থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কিশোর কিশোরীরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। আদর্শের অনুসারী হয়ে, পরার্থবাদী হয়ে, বিভিন্ন সামাজিক ও বিনোদনমূলক ক্রিয়া-কর্ম ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে তারা যৌনমূলক উত্তেজনাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে। অন্ত্য তারুণ্যকালে (late adolescence period) যৌন তাড়না নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে এবং তরুণ তরুণীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফলে এ বয়সেই তারা বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি আগ্রহ বোধ করতে শুরু করে এবং তাদের সাথে মেলামেশা শুরু করে। এ সময় থেকেই তারা জীবনসঙ্গী বাছাই ও পেশা নির্বাচনের বিষয়ে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। যৌবনের প্রারম্ভকালেই তারা দেহ ও মনের দিক দিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। ফলে তারা পেশা গ্রহণ, বিবাহ বন্ধন ও পরিবার স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে একজন পূর্ণাঙ্গ সদস্য রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তারা সামাজিক রীতি অনুসারে বংশবিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করে।

শিশুর প্রয়োজন-নিরপেক্ষ কেবল সুখানুভূতির প্রতি যে কামজ ভালোবাসা, তাকে স্বতঃকাম (auto eroticism) বলে। বিভিন্ন কামস্থানে সুখবোধ নির্দিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ অঙ্গবিশেষের প্রতি শিশুর যে ভালোবাসা জন্মে, তাকে স্বকাম (narcissism) বলে। স্বকাম উৎপন্ন হওয়ার পর বস্তুকাম (object love) জন্মে, তখন শিশু মায়ের স্তন, নিজের মলমূত্র প্রভৃতি বস্তু ভালোবাসে। মায়ের প্রতি ভালোবাসাই শিশুর ব্যক্তিবিশেষের প্রতি প্রথম ভালোবাসা। এই ভালোবাসা আবার প্রথম অবস্থায় সমকামী (homosexual)। স্ত্রীপুরুষের লৈঙ্গিক পার্থক্য বুঝতে আরো কিছুদিন সময় যায়। তারপর দেখা দেয় ইতরকামিতার (heterosexuality)। স্বভাবী ব্যক্তির কামপরিণতিতে ইতরকামিতার প্রাধান্য লক্ষিত হলেও স্বতঃকাম, স্বকাম, সমকাম, বস্তুকাম অল্পবিস্তর থেকে যায়। স্বতঃকাম না থাকলে কেউ সুখের জন্য চেষ্টা করত না। স্বকাম আছে বলেই আমরা নিজের শরীর ও স্বার্থরক্ষার জন্য উৎসুখ হই। বন্ধুবান্ধবের প্রতি ভালোবাসার ও আমাদের সমাজপ্রীতির মূলে সমকামিতা বর্তমান। অর্থোপার্জন ইত্যাদি চেষ্টায় ও নানাবিধ কান্তরসের অনুশীলনে বস্তুকাম সহায়ক। পারিবরিক জীবন ইতরকামিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

ব্যক্তিত্ব বিকাশে শৈশবের গুরুত্ব বিকাশ মনোবিজ্ঞানে (Developmental Psychology) স্বীকৃত। কিন্তু বিকাশ মনোবিজ্ঞানের কোনো ধারাই ফ্রয়েডের মডেলটি গ্রহণ করেনি। ফ্রয়েডীয় ধারার মনোবিজ্ঞানেও বর্তমান বিকাশ মডেলটি ভিন্ন।

সারণি: ফ্রয়েডের ব্যক্তিত্ব বিকাশ স্তর

স্তর (Stage) কাছাকাছি বয়স (Approxim ate ages) যৌন তৃপ্তির কেন্দ্র (Erotic Focus) মূল কার্যাবলি এবং অভিজ্ঞতাসমূহ (Kye tasks and experiences)
মুখকাম (Oral) ০-১ মুখ (Mouth, sucking. bitting) স্তন্যপান অভ্যাস ছাড়ানো (Weaning from breast or bottle)
পায়ুকাম (Anal) ১-৩ পায়ুদ্ধার (Anus: expelling or retaining feces) টয়লেট অভ্যাস করানো (Toilet training)
আত্মরতি (Phallic) ৩-৬ যৌনাঙ্গ (Genitals: mastur- bating) প্রাপ্তবয়স্ক ভূমিকার সঙ্গে একাত্মতা, এবং ইডিপাস সংকট কাটিয়ে ওঠা (Identifying with adult role models: coping with Oedipus crisis)
সুপ্তিকাল (Latency) ৬-১২ কিচ্ছু না (None: Sexually repressed) সামাজিক সংশ্রব বৃদ্ধি (Expanding Social contacts)
যৌনকাম (Genital) বয়ঃসন্ধির সম্মুখে (Puberty onward) যৌনাঙ্গ (Genitals: being sexually intimate) অন্তরঙ্গ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা (Establishing relationships: intimate contributing to society through working)

Source: Weiten W. Psychology: Themes and Variation 1989, P-438.

ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্ব

স্বপ্নের স্বরূপ

ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের চিন্তা ভাবনাগুলো যখন মানসিক চিত্ররূপ (mental image) ধারণ করে, তখনই মানুষ স্বপ্নের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী দেখে। স্বপ্নের অকল্পনীয় দৃশ্যাবলী মানুষকে অভিভূত করে বলেই স্বপ্ন প্রক্রিয়া একটি চিত্তাকর্ষক বিষয় রূপে চিরকাল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেজন্যই প্রাচীন কাল থেকেই স্বপ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন লৌকিক ও অতিলৌকিক ব্যাখ্যা প্রচলিত হয়েছে। তবে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে স্বপ্ন সম্পর্কে ফ্রয়েড যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তা অভিনবত্বের দিক দিয়ে এক অনন্য ধারণা রূপে বিবেচিত হয়।

১৯০০ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত “The Interpretation of Dream” নামক গ্রন্থে ফ্রয়েড স্বপ্ন সংক্রান্ত তার তত্ত্ব বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেন। তার মতে স্বপ্ন হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা পূরণের একটি প্রয়াস মাত্র (Dream is an attempted wish fulfillment)। বাস্তবে যে সব আশা পূরণ করতে ব্যক্তি ব্যর্থ হয়, সেগুলো পূরণ করার দৃশ্যই সে স্বপ্নে দেখতে পায়। ফ্রয়েডের মতে ইদ তার কাম্য বস্তু লাভের জন্য মুখ্য প্রক্রিয়া (primary process) এর আশ্রয় গ্রহণ করে; অর্থাৎ কাম্যবস্তুর মানসিক চিত্ররূপ গঠন করে ইদ তৃপ্তি লাভ করে। সুতরাং ঘুমন্ত অবস্থায় ইদ তার আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি লাভের জন্য মুখ্য প্রক্রিয়ায় কাম্য বস্তুর যে মানস-চিত্র গঠন করে, সেটাই হচ্ছে স্বপ্ন এবং এই মানস-চিত্র গঠনের মাধ্যমেই ইদ কিছুটা তৃপ্তি লাভ করে। সেজন্যই স্বপ্নকে আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস বলা হয়েছে।

ফ্রয়েডের মতে স্বপ্নের মাধ্যমে দু’ভাবে  আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস ঘটে এবং এদিক দিয়ে ফ্রয়েড দু’রকম স্বপ্নের কথা বলেছেন। একটিকে তিনি বলেছেন প্রত্যক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণ (direct wish fulfillment) এর প্রয়াস ও অপরটিকে তিনি বলেছেন পরোক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণ (indirect wish fulfillment) এর প্রয়াস। যে সব স্বপ্নে সরাসরি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভের দৃশ্য দেখা যায়, সেগুলোকেই প্রত্যক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস বলা হয়। যেমন পদোন্নতি লাভে ব্যর্থ চাকরিজীবী স্বপ্নে পদোন্নতি লাভের দৃশ্যাবলী দেখতে পারে: কিংবা কোন আকর্ষণীয় খেলনা লাভে ব্যর্থ শিশু স্বপ্নে সেই খেলনা পাওয়ার দৃশ্য দেখতে পারে। যেহেতু শিশুদের চিন্তা-ভাবনা ও কামনা-বাসনাগুলো সরল ও নিষ্পাপ প্রকৃতির হয়, সেহেতু শিশুদের অধিকাংশ স্বপ্নেই এ ধরনের প্রত্যক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণ ঘটে। কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকাংশ কামনা বাসনাই এমন ঘৃণ্য, জঘন্য ও নিষিদ্ধ প্রকৃতির হয় যে, ওগুলো ব্যক্তির নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে এ ধরনের কামনা বাসনাগুলো অবদমিত হয়ে মনের অচেতন স্তরে আশ্রয় লাভ করে এবং অহমের বিবাচন ক্রিয়া (censorship) বা কঠোর প্রহরার জন্য এগুলো সরাসরি সচেতন স্তরে প্রবেশ করতে পারে না। সেজন্যই এ ধরনের নিষিদ্ধ কামনাগুলো ব্যক্তির ঘুমন্ত অবস্থায় ছদ্মবেশ ধারণ করে চেতন স্তরে প্রবেশ করে এবং স্বপ্ন সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। এই অবদমিত কামনাগুলো পরিবর্তিত রূপ নিয়ে স্বপ্নে আসে বলেই এই স্বপ্নকে পরোক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস বলা হয়।

বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকাংশ স্বপ্নই হচ্ছে পরোক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস। এই অবদমিত কামনাগুলো এমন কদর্য প্রকৃতির যে এগুলো স্বীয় কদর্য রূপ নিয়ে স্বপ্নে আত্মপ্রকাশ করলে অহম সচকিত হয়ে উঠবে এবং ব্যক্তির নিদ্রাভঙ্গ হবে। সেজন্যই অবদমিত কামনাগুলো ছদ্মরূপ ধারণ করে স্বপ্নে আত্মপ্রকাশ করে এবং পরোক্ষভাবে তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। ফ্রয়েডের মতে স্বপ্ন হচ্ছে ইদ ও অহমের মধ্যে সম্পাদিত একটি আপসরফা। ইদ যেমন ছদ্মরূপ ধারণ করে নিজেকে কিছুটা শালীনতার আবরণে ঢেকে রাখে, অহমও তেমনি তার প্রহরা কার্য কিছুটা শিথিল করে স্বপ্ন সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়। ফলে স্বপ্ন সৃষ্টির মাধ্যমে ইদের কামনাগুলো যেমন তৃপ্তি লাভের সুযোগ পায়, ব্যক্তিও তেমনি নির্বিঘ্নে নিদ্রাসুখ ভোগ করে। স্বপ্নের মাধ্যমে ইদ ও অহমের এই সমঝোতা না হ’লে ইদের কামনাগুলো যেমন আংশিক তৃপ্তি লাভে ব্যর্থ হ’ত, ব্যক্তিও তেমনি নিদ্রাসুখ থেকে বঞ্চিত হ’ত। কারণ অবদমিত কামনাগুলোর কদর্য রূপ দেখে অহম মুহূর্তে মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠত এবং ব্যক্তির নিদ্রাভঙ্গ হ’ত। অনেক সময় স্বপ্ন দেখে আমরা আচমকা জেগে উঠি; স্বপ্নের ছদ্মরূপ ধারণ ব্যর্থ হওয়ার জন্যই এরূপ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকাংশ স্বপ্নই এই পরোক্ষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস এবং এ রকম স্বপ্নের দু’টো দিক থাকে। একটিকে ফ্রয়েড বলেছেন ব্যক্ত স্বপ্নরূপ (manifest dream content) এবং অপরটিকে তিনি বলেছেন সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা (latent dream thought) । ব্যক্তি স্বপ্নে যে সব দৃশ্য অবলোকন করে এবং জাগ্রত হয়ে অন্যের কাছে বর্ণনা করতে পারে, সেটাকেই ফ্রয়েড ব্যক্ত স্বপ্নরূপ বলেছেন। স্বপ্নে দৃশ্যমান ঘটনা ও দৃশ্যাবলী আসলে অবদমিত কামনা বাসনারই ছদ্মরূপ। অর্থাৎ অবদমিত কামনা বাসনা ছদ্মরূপ ধারণ করে ব্যক্ত স্বপ্নরূপে পরিণত হয়। সেজন্যই ব্যক্ত স্বপ্নরূপের কোন অর্থ বা তাৎপর্য ব্যক্তি খুঁজে পায় না। স্বপ্নের আসল তাৎপর্য সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষায় নিহিত থাকে। যে অবদমিত আকাঙ্ক্ষা ছদ্মরূপ নিয়ে ব্যক্ত স্বপ্নে পরিণত হয়, সেই আকাঙ্ক্ষাকেই সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা বলা হয়। সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষাই ছদ্মরূপে কাম্যবস্তুর মানসিক প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। যেহেতু সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা ছদ্মরূপ নিয়ে স্বপ্নে উপস্থিত হয়, সেহেতু ব্যক্তি এটাকে শনাক্ত করতে পারে না এবং স্বপ্নের প্রকৃত তাৎপর্যও তার কাছে অনুদঘাটিত থেকে যায়।

স্বপ-কৌশল

সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার ছদ্মরূপ ধারণ করা ও ব্যক্ত স্বপ্নরূপে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে স্বপ্ন প্রক্রিয়া (dream process) বলা হয় এবং যে পন্থা ও কৌশলের মাধ্যমে স্বপ্নের এই রূপ পরিবর্তিত হয়, সেটাকে স্বপ্নের কারুকার্য (dream works) নামে অভিহিত করা হয়। যে বিভিন্ন কলা কৌশল স্বপ্নের কারুকার্যে ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকেই ফ্রয়েড স্বপ্ন-কৌশল (dream mechanism) নামে আখ্যায়িত করেছেন। ফ্রয়েড চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন-কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে প্রতীকীকরণ, ঘনীভূতকরণ, অপস্থাপন ও গৌণ অনুযোজনা। এগুলো নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।

  • প্রতীকীকরণ (symbolisation): ফ্রয়েডের মতে, অবদমিত কামনা বাসনাগুলো যৌনমূলক ও আগ্রাসী প্রকৃতির হয়। ফলে এগুলো সরাসরি স্বপ্নে না এসে কোন প্রতীকের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। কোন চিহ্ন, বস্তু, ক্রিয়া বা পরিস্থিতি যখন অন্য কোন বিশেষ বিষয়ের ইঙ্গিত বহন করে, তখন সেটাকে প্রতীক বলা হয়। ফ্রয়েড তার তত্ত্বে বহু যৌনমূলক প্রতীকের কথা উল্লেখ করেছেন। কলা, লাঠি, কলম, প্রভৃতি পুরুষ যৌনাঙ্গের প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়। দরজা, গুহা, ফাটল, প্রভৃতি স্ত্রী যৌনাঙ্গের প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়। পাহাড়ে ওঠা, আকাশে ওড়া, ঘোড়ায় চড়া, প্রভৃতি রতিক্রিয়ার প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়। পৌরাণিক কাহিনী, প্রাচীন গল্পকথা, রূপকথা, দৈনন্দিন কথোপকথন, প্রভৃতি বিভিন্ন উৎস থেকে এ ধরনের প্রতীক সংগৃহীত হয়। দৈনন্দিন কথোপকথনেও অনেক সময় মানুষ অশালীন বিষয় প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করে। স্বপ্ন দেখার সময় মানুষ এগুলোকে প্রতীক অর্থে না নিয়ে সাধারণ ব্যক্ত অর্থে গ্রহণ করে। ফলে স্বপ্নের প্রকৃত অর্থ ব্যক্তির কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়।
  • ঘনীভূতকরণ (condensation) : যখন একই ধরনের একাধিক কামনা বাসনা পরস্পর সংবদ্ধ হয়ে একটি একক চিত্ররূপ ধারণ করে, তখন এটাকে ঘনীভূতকরণ বলা হয়। কামনাগুলো পরস্পর ঘনীভূত হয়ে এমন একটি সংক্ষিপ্ত রূপ ধারণ করে যে, ওগুলোর কোনটিকেই আর পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায় না। ফলে ব্যক্তি স্বপ্নের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যেমন কোন ব্যক্তি স্বপ্নে দেখছে যে, সে একজন বৃদ্ধকে প্রচণ্ড প্রহার করছে। স্বপ্নদ্রষ্টার কোন সময় মনে হচ্ছে যে ঐ বৃদ্ধের সাথে তার পিতার কিছু মিল আছে; আবার কোন সময় মনে হচ্ছে যে ঐ বৃদ্ধের সাথে তার শিক্ষকের কিছু মিল আছে। কিন্তু স্বপ্নদ্রষ্টার মনে হচ্ছে যে ঐ বৃদ্ধ তার পিতাও নয়, কিংবা তার শিক্ষকও নয়। ঐ বৃদ্ধ অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে অহেতুক পিটিয়ে সে তৃপ্তি পাচ্ছে। এখানে আসলে দু’টো অবদমিত ও সামাজিকভাবে নিন্দিত ইচ্ছা ঘনীভূত হয়ে একটি চিত্ররূপ ধারণ করেছে। পিতাকে মারার ইচ্ছা ও শিক্ষককে মারার ইচ্ছা পরস্পর সংবদ্ধ হয়ে এমন একটি একক চিত্ররূপ ধারণ করেছে যে, ঐ দু’টো ইচ্ছার কোনটিকেই আর পৃথকভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। অথচ ঐ দু’টো ইচ্ছাই স্বপ্নে পরোক্ষভাবে তৃপ্তি লাভ করছে।
  • অপস্থাপন (displacement) : ফ্রয়েডের মতে স্বপ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে অপস্থাপন। স্বপ্নের মূল কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকেই অপস্থাপন বলা হয়। স্বপ্নের মুখ্য বিষয়ের সাথে জড়িত আবেগ যখন অপসারিত হয়ে ব্যক্ত স্বপ্নের কোন গৌণ বা তুচ্ছ বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখনই স্বপ্নের মূল কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেজন্যই কোন তুচ্ছ বিষয় ব্যক্ত স্বপ্নে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয় এবং সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার মূল বিষয়টি একটি গুরুত্বহীন আনুষঙ্গিক বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত স্বপ্নে অলক্ষিত অবস্থায় থেকে যায় এবং স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নের আসল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য বুঝতে পারে না। যেমন স্বপ্নে এক ব্যক্তি দেখছে যে সে সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করছে। নির্জন সৈকতে একজন মাত্র মহিলা সংক্ষিপ্ত সাঁতারের পোষাক পড়ে ব্যক্তির অনতিদূরে বালুর ওপর শুয়ে আছে। কিন্তু ব্যক্তির কাছে ঐ মহিলার কোন গুরুত্ব তখন নেই। অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার পুলক তাকে একেবারে মোহিত করে রেখেছে। আসলে এই স্বপ্নের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ঐ সংক্ষিপ্ত পোষাক পরিহিতা মহিলা যার সাথে ব্যাক্তির মায়ের কিছু মিল রয়েছে এবং মায়ের প্রতি তার যৌন কামনার পরোক্ষ তৃপ্তি ঘটার জন্যই সে পুলও বোধ করছে। মায়ের সাথে তার যৌন কামনা পূরণের পুলক মূল বিষয় থেকে বিচ্যুত হয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্যের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে স্বপ্নের মূল কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এবং স্বপ্নের প্রকৃত তাৎপর্য ব্যক্তির কাছে অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে।
  • গৌণ অনুযোজনা (secondary elaboration) : মানুষের অচেতন মনের কামনা বাসনাগুলো খাপছাড়া, অসঙ্গতিপূর্ণ ও পরস্পর বিরোধী হয়। ফলে স্বপ্নের দৃশ্যাবলীও এমন বেখাপ্পা ও উদ্ভট প্রকৃতির হয়, যা মানুষকে হতচকিত করে তুলতে পারে এবং তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সেজন্যই স্বপ্নে দেখা দৃশ্যাবলীর ফাঁকগুলো পূরণ করার জন্য এবং স্বপ্নের ঘটনাবলীকে ধারাবাহিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য স্বপ্নে কিছু নতুন নতুন দৃশ্য সংযোজন করা হয়। ধারাবাহিকতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে স্বপ্নে এই নতুন কিছু সংযোজন করাকেই গৌণ অনুযোজনা বলা হয়। সাধারণতঃ সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার কিছু অংশকেই স্বপ্নের ফাঁক পূরণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এদিক দিয়েও স্বপ্নদ্রষ্টা বিভ্রান্ত হয়। স্বপ্নকে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার প্রতিফলন বলেই ব্যক্তি মনে করে এবং স্বপ্নের আসল অর্থ তার অলক্ষ্যে থেকে যায়। এই গৌণ অনুযোজনার সাথে জড়িত হয়ে আরও একটি প্রক্রিয়া স্বপ্নে অনেক সময় ব্যবহৃত হয়। যখন স্বপ্নের ঘটনাবলীকে মঞ্চে ঘটে যাওয়া নাটকের সুসজ্জিত ঘটনার মত উপস্থাপন করা হয়, তখন সেটাকে নাটকীয়করণ (dramatization) বলা হয়। এক্ষেত্রে স্বপ্নদ্রষ্টা নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকা নিয়ে নাটকের দৃশ্যাবলী অবলোকন ও উপভোগ করে এবং এ ঘটনাগুলোর সাথে তার নিজের জীবনের কোন যোগসূত্র আছে বলে সে মনে করতে পারে না।

ওপরে আলোচিত স্বপ্ন-কৌশলগুলো সাধারণতঃ সম্মিলিতভাবে স্বপ্নের কারুকার্য সম্পন্ন করে। অর্থাৎ একই স্বপ্নে একাধিক বা সবগুলো কৌশলই যুগপৎ ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে স্বপ্নের আসল তাৎপর্য আরও দুর্বোধ্য ও দুর্জেয় হয়ে ওঠে। তবে একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ সমীক্ষক স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটন করতে পারেন। ব্যক্ত স্বপ্নের বিভিন্ন উপাদানকে বিশ্লেষণ করে সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটন করার প্রক্রিয়াকেই ফ্রয়েড স্বপ্নব্যাখ্যা (dream interpretation) নামে আখ্যায়িত করেছেন। স্বপ্নব্যাখ্যা স্বপ্ন প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়া। স্বপ্ন প্রক্রিয়ায় সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা ছদ্মবেশ ধারণ করে ব্যক্ত স্বপ্নরূপে পরিণত হয়। অপর দিকে স্বপ্নব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ব্যক্ত স্বপ্নরূপ থেকে বিশ্লেষণ শুরু করে ক্রমশঃ পেছন দিকে গিয়ে সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটন করতে হয়। সেজন্যই ফ্রয়েড স্বপ্নব্যাখ্যাকে পশ্চাৎগামী প্রক্রিয়া বলেছেন।

স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জন্য একজন মনোসমীক্ষক ব্যক্ত স্বপ্নরূপের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রথমে বাছাই করেন। অতঃপর প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে তিনি স্বপ্নদ্রষ্টার অবাধ অনুষঙ্গ গ্রহণ করেন। অর্থাৎ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে স্বপ্নদ্রষ্টার মনে যা আসে, তা ব্যক্ত করতে বলেন। স্বপ্ন সংক্রান্ত অবাধ অনুষঙ্গ থেকে যে ইঙ্গিতগুলো পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করে এবং স্বপ্নে ব্যবহৃত কৌশলসমূহ শনাক্ত করে একজন অভিজ্ঞ মনোসমীক্ষক সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটন করতে পারেন। সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটনের মাধ্যমে ব্যক্তির নির্জ্ঞান মনে, অবদমিত কামনা- বাসনা ও দ্বন্দ্ব-হতাশাসমূহ জানা যায়। সেজন্যই ফ্রয়েড মানুষের নির্জ্ঞান মনে প্রবেশের একটি রাজকীয় পথ রূপে স্বপ্নকে অভিহিত করেছেন।

ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্ব অবশ্য অনেক ভাবে সমালোচিত হয়েছে। স্বপ্ন ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ফ্রয়েড যেভাবে যৌনকামনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন, তা মনোবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন না। স্বপ্নে ব্যবহৃত যে সব প্রতীকের কথা ফ্রয়েড বলেছেন, সেগুলো সবার ক্ষেত্রে একই রকম অর্থবহ নাও হতে পারে। ফলে ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়তে পারে।

ফ্রয়েডের দুজন সহযোগী আডলার ইয়াং স্বপ্ন সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আডলারের মতে স্বপ্নে মানুষের জীবন ভঙ্গি (style of life) এর প্রতিফলন ঘটে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কোন ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তির মনে যে প্রত্যাশা ও মনোভাব থাকে, সেটাই স্বপ্নে প্রতিফলিত হয়। ইয়াং এর মতে স্বপ্নে যৌথ নির্জ্ঞান মনের প্রতিফলন ঘটে। ব্যক্তির বর্তমান জীবনের কোন সমস্যার যে সমাধান তার যৌথ নির্জ্ঞান মনে নিহিত থাকে, স্বপ্ন সেই সমাধানেরই ইঙ্গিত বহন করে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে যৌন কামনা ছাড়াও অনেক ধরনের কামনা বাসনা স্বপ্ন সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় শারীরবৃত্তীয় সংবেদন ও অনুভূতিও স্বপ্ন সৃষ্টির কারণ রূপে কাজ করতে পারে। যেমন কোন ব্যক্তি যদি ঘুমন্ত অবস্থায় অত্যন্ত শৈত্য বোধ করে, তবে সে বরফের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে স্বপ্ন দেখতে পারে। সুতরাং মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে ফ্রয়েডের তত্ত্বে কিছু সত্য থাকলেও, বিভিন্ন স্বপ্ন বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করার প্রয়োজন রয়েছে।

উদ্বেগ

ফ্রয়েড-তত্ত্বে আচরণের নির্ণায়ক হিসাবে ব্যক্তির অন্তঃস্থ এষণাকেই (জীবন ও মরণ আকাঙ্ক্ষা) বা প্রবৃত্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জন্মগত কিছু প্রবৃত্তি ব্যক্তিত্বের চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে। তবে তিনি আচরণের বহিঃস্থ নির্ণায়ককে একেবারে খারিজ করে দেননি। ফ্রয়েডের মতে, প্রবৃত্তি ছাড়াও যে আরও এক ধরনের শক্তি কাজ করে, যা বহিঃস্থ নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে তা হচ্ছে উদ্বেগ (anxiety)। উদ্বেগ এমন একটি পীড়াদায়ক মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে, যা ব্যক্তির কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং এ অবস্থার অবসান ঘটাবার জন্য সে প্রচণ্ড তাড়না বোধ করে। ফলে উদ্বেগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য ব্যক্তি বিভিন্ন আচরণ করে। সুতরাং মানুষের অনেক আচরণের পেছনে উদ্বেগই চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে এবং অস্বভাবী আচরণের জন্য ফ্রয়েড উদ্বেগকেই মূলতঃ দায়ী করেছেন।

মানুষ ও প্রাণীর জীবন ধারণের ক্ষেত্রে পরিবেশ দ্বিবিধ ভূমিকা পালন করে। মানুষের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন পরিবেশে আছে, তেমনি জীবন হরণের কিছু উপকরণও পরিবেশে আছে। জীবন হরণের উপকরণগুলো মানুষের অস্তিত্বের বিনাশ ঘটাতে পারে। ফলে এগুলো মানুষের কাছে জীবননাশক হুমকি হয়ে ওঠে। এই বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হলেই মানুষের অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্রে এক উত্তেজনাময় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী স্নায়ু- শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। এ ধরনের পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা সংঘটিত হয় বলে এগুলোর ওপর মানুষের কোন ঐচ্ছিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। হুমকির সম্মুখীন হ’লে যে দৈহিক পরিবর্তন ও মানসিক অস্বস্তির সৃষ্টি হয়, সাধারণ ভাষায় সেটাকে শঙ্কা বা ভয় (fear) বলা হয়। কিন্তু ফ্রয়েড উদ্বেগ (anxiety) শব্দটিকে আরও একটু ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। সাধারণ ভীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তি ভীতির বস্তু বা পরিস্থিতি থেকে পলায়ন করে অথবা ভীতির বস্তুকে বিনাশ করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কোন একটা পথ খুঁজে পায়। কিন্তু উদ্বেগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ভীতির বস্তু বা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের কোন পধ খুঁজে পায় না। ফলে ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিরুপায় ও অসহায় হয়ে পড়ে। সুতরাং শঙ্কাবোধের সাথে যখন একটা অসহায়ত্ব বোধ যুক্ত হয়, তখনই সেটাকে উদ্বেগ বলা হয়।

অসহায়ত্ব বোধ উদ্বেগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। স্নায়ু-শারীরবৃত্তীয় অতিরিক্ত উদ্দীপনা ও উত্তেজনা যখন দেহে শক্তিসঞ্চারের আধিক্য ঘটায়, তখন অহম তা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অক্ষম হয়েই অসহায় বোধ করে এবং এর ফলেই উদ্বেগের উৎপত্তি হয়। উদ্বেগের মূল উৎস রূপে ফ্রয়েড জন্মাঘাতের কথা উল্লেখ করেছেন। জন্মকালে সরু নালীপথে নির্গত হওয়ার সময় জাতকের এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এছাড়া ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে চতুর্দিক থেকে বোমাবর্ষণের মত পার্থিব উদ্দীপকসমূহ অকস্মাৎ নবজাতকের দেহে যে প্রচণ্ড উদ্দীপনা ও আলোড়ন সৃষ্টি করে, তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে নবজাতক সম্পূর্ণ নিরুপায় ও অসহায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থার তীব্র পীড়ন নবজাতকের জন্য একটি প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের সৃষ্টি করে। জন্মকালীন এই ঘাতমূলক অভিজ্ঞতাকেই জন্মাঘাত (birth trauma) বলা হয়। ফ্রয়েডের মতে এই জন্মাঘাতই হচ্ছে সকল প্রকার উদ্বেগের মূল উৎস। পরবর্তীকালে কোন বিপদের সম্মুখীন হ’লেই ব্যক্তি যখন জন্মকালীন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা বোধ করে, তখনই তার মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এরূপ আশঙ্কাজনক অবস্থায় মাতৃগর্ভের সেই নিরাপদ পরিবেশে ফিরে যাওয়ার প্রতীকধর্মী ইচ্ছাও মানুষের মধ্যে জেগে উঠতে পারে।

সুতরাং ফ্রয়েডের মতে জন্মাঘাতের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা বোধই উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এদিক দিয়ে বিচার করে উদ্বেগকে একটি বিপদসূচক সংকেত রূপেও ব্যাখ্যা করা হয়। উদ্বেগের সূচনা ব্যক্তিকে সতর্ক করে দেয় যে, তার অহম যদি অবিলম্বে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে, তবে এ পরিস্থিতিতে তার মধ্যে সেই জন্মকালীন অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং তার অহমশক্তি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে ও তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। সুতরাং উদ্বেগ একটি বিপদসূচক সংকেত রূপে কাজ করে। ফ্রয়েড তার তত্ত্বে তিন ধরনের উদ্বেগকে শনাক্ত করেছেন। এদের প্রথমটি বাস্তব বিপদজনিত উদ্বেগ বা বাস্তব উদ্বেগ, দ্বিতীয়টি কাল্পনিক বিপদজাত উদ্বেগ বা নিউরোটিক উদ্বেগ, তৃতীয়টি নৈতিকতা রক্ষা হচ্ছে কি না এর উদ্বেগ বা নৈতিক উদ্বেগ। ফ্রয়েড বলেন, যদিও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় জাতের উদ্বেগের আপাত বাহ্যিক কারণ নেই, কিন্তু এসবের পিছনে শিশুর বাস্তব অভিজ্ঞতা অস্বাভাবিক ভাবে কাজ করে। ফ্রয়েডের মতে ব্যক্তির প্রথম উদ্বেগ তার জন্মাঘাত (birth trauma) । জন্ম মুহূর্তে অসহায় শিশু একটি নিরাপদ আশ্রয় থেকে হঠাৎ একটি বিরূপ পরিবেশে পতিত হয়। এগুলোর বর্ণনা দেয়া হল –

  • বাস্তব উদ্বেগ (reality anxiety): বাস্তবের কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতি যখন ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে, তখন সেটাকে বাস্তব উদ্বেগ বলা হয়। উল্লেখ্য যে এরূপ পরিস্থিতি থেকে ব্যক্তি যখন রেহাই পাওয়ার কোন পথ সহজে খুঁজে না পায়, তখনই এ ধরনের উদ্বেগের উৎপত্তি হয়। স্বল্প মাত্রার বাস্তবধর্মী উদ্বেগ ব্যক্তিকে কর্মে অধিক প্রেরণা যোগায়। উদ্বেগের জন্যই ব্যক্তি অধিক সক্রিয় ও তৎপর হয়ে ওঠে এবং অধিকতর শক্তি ও নৈপুণ্য প্রয়োগ করে তার সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তি সচেষ্ট হয়। সুতরাং জীবনে সাফল্য অর্জন ও সার্থক আত্মবিকাশের জন্য স্বল্প মাত্রার বাস্তবধর্মী উদ্বেগ সহায়ক শক্তি রূপে কাজ করে। কিন্তু এরূপ উদ্বেগের মাত্রা তীব্র হ’লেই, তা ব্যক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। উদ্বেগের মাত্রা তীব্র হ’লে ব্যক্তি দিশেহারা ও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অপারগ হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় ব্যক্তি মাতৃজঠরে অবস্থান করার মতই নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব হয়ে পড়ে।
  • নিউরোটিক উদ্বেগ (neurotic anxiety): মনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা থেকে এই নিউরোটিক উদ্বেগের উৎপত্তি হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ইদের এমন অনেক কামনা বাসনা বা তাড়না রয়েছে, যা ব্যক্তির নিজের জন্যই ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক। যেমন কাউকে হত্যা করার ইচ্ছা বা কাউকে ধর্ষণ করার ইচ্ছা ব্যক্তির নিজের জন্যই বিপজ্জনক পরিণতি ঘটাতে পারে। অহম এ ধরনের তাড়নাকে স্বভাবতই অবদমন করে রাখে। যখন এই অবদমিত তাড়না অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তা অবদমন বাঁধ বিদীর্ণ করে মনের চেতন স্তরে ঢুকে কার্যে পরিণত হওয়ার উপক্রম করে, তখন ব্যক্তির মধ্যে যে আশঙ্কা বোধের সৃষ্টি হয়, সেটাকেই নিউরোটিক উদ্বেগ বলা হয়। এই উদ্বেগের মূল উৎস হচ্ছে ইদের কোন অবদমিত বিপজ্জনক তাড়না। যেহেতু উদ্বেগ সৃষ্টির জন্য দায়ী বিপজ্জনক তাড়নাটি তখনও অবদমিত থাকে, সেহেতু উদ্বেগের প্রকৃত কারণ ব্যক্তির কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়। একটি অজানা বিপদের আশঙ্কায় ব্যক্তি একটি দুর্বোধ্য উদ্বেগ অনুভব করে। সুতরাং এ উদ্বেগের কোন কারণ ব্যক্তি খুঁজে পায় না। যেহেতু এই উদ্বেগের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই, সেহেতু এটাকে অস্বভাবী উদ্বেগ রূপে গণ্য করা হয় এবং এ ধরনের উদ্বেগই অস্বভাবী আচরণের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রূপে কাজ করে। সুতরাং এক্ষেত্রে কোন বিপজ্জনক তাড়না কার্যে পরিণত হয়ে পড়বে বলে অহম শঙ্কিত হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে অহম বিপজ্জনক তাড়নাটিকে যতটা ভয় করে, তার থেকে বেশী ভয় করে এই তাড়নার পরিণতি রূপে শাস্তিভোগ করাকে। এদিক দিয়ে নিউরোটিক উদ্বেগের সাথে বাস্তবের কিছু পরোক্ষ যোগসূত্র রয়েছে। এ ধরনের কাজের জন্য ব্যক্তি অতীতে শাস্তি ভোগ করেছে অথবা অন্যদের শাস্তি ভোগ করতে দেখেছে। সেজন্যই অহম শঙ্কিত হয়। তবে অহমের এই শঙ্কাবোধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি মনের অচেতন স্তরে সংঘটিত হয় বলে অহম সচেতনভাবে এর কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পায় না এবং এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে পারে না।
  • নৈতিক উদ্বেগ (moral anxiety): এই উদ্বেগও মনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা থেকে উৎপত্তি লাভ করে। ব্যক্তির নীতিবোধ বা নৈতিকতা বিরোধী কোন কাজ বা কাজের চিন্তা যখন ব্যক্তির মধ্যে তীব্র অনুতাপ বা অনুশোচনার সৃষ্টি করে, তখন সেটাকে নৈতিক উদ্বেগ বলা হয়। সাধারণভাবে আমরা এটাকে বিবেকের দংশন বলে থাকি। এ উদ্বেগের মূল উৎস হচ্ছে অতি-অহম। অতি-অহম যখন কোন নৈতিকতা বিরোধী, অসামাজিক বা গর্হিত কাজের জন্য ব্যক্তির মনে তীব্র পীড়নের সৃষ্টি করে, তখনই নেতিক উদ্বেগের উৎপত্তি হয়। নৈতিক উদ্বেগেরও উৎস মনের অভ্যন্তরে নিহিত রয়েছে। তবে এ উদ্বেগের সাথেও বাস্তবের কিছু পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে। গর্হিত কাজের জন্য ব্যক্তি অতীতে বাপ মায়ের কাছে শাস্তি ভোগ করেছে এবং বর্তমানেও অতি-অহম বাপ মায়ের ভূমিকা নিয়ে মানসিক পীড়ন সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করছে। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে একই কাজ বা কাজের চিন্তা সবার মধ্যে একই রকম নৈতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে না। কারণ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে নীতিবোধের পার্থক্য রয়েছে। ফলে বিশেষ ব্যক্তির নীতিবোধের তীক্ষ্ণতার ওপর এই নৈতিক উদ্বেগের মাত্রা নির্ভর করে। এই নৈতিক উদ্বেগও কোন কোন ক্ষেত্রে অস্বভাবী আচরণের উৎপত্তি ঘটায়।

এই তিন ধরনের উদ্বেগের মধ্যে নিউরোটিক উদ্বেগই অধিকতর সমস্যাজনক। বাস্তব উদ্বেগ ও নৈতিক উদ্বেগ কোন কোন সময় নিউরোটিক উদ্বেগে পরিণত হতে পারে। বাস্তব উদ্বেগ ও নৈতিক উদ্বেগ তীব্র ও অসহনীয় হয়ে পড়লে, তা সাধারণ নিয়মে অবদমিত হয়ে মনের অচেতন স্তরে প্রেরিত হয়। কোন কোন সময় এরূপ অবদমিত উদ্বেগ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে অবদমন বাঁধ বিদীর্ণ করে চেতন স্তরে প্রবেশ করতে পারে এবং উদ্বেগ রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এরূপ উদ্বেগের প্রকৃত কারণ তখনও অবদমিত থাকে বলে এর কোন কারণ ব্যক্তি খুঁজে পায় না। ফলে বাস্তব ও নৈতিক উদ্বেগ নিউরোটিক উদ্বেগে পরিণত হয়।

উদ্বেগজনিত ভীতি বা এনজাইটি ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জানতে এখানে যান।

অহমের আত্মরক্ষা কৌশল

মনের এ ধরনের কর্মপ্রক্রিয়াকে আবিষ্কার এবং লিপিবদ্ধ করেন বিভিন্ন সাহিত্যিক। ফ্রয়েড এসবকে সূত্রবদ্ধ করে তার তত্ত্বের অঙ্গ করেন। এসবকে পদ্ধতিবদ্ধ রূপ দেন তার ছয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আন্না ফ্রয়েড, ১৯৩৬ সনে প্রকাশিত Ego and the Mechanism of Defense বইয়ে। বাস্তবের দাবি মিটিয়ে, সুপারইগোর নজরদারিকে এড়িয়ে, ইদ্-এর এষণাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে, ইগো যাতে অতিরিক্ত উদ্বেগ, অপরাধবোধ, ক্রোধ, দ্বন্দ্ব প্রভৃতিতে ভারাক্রান্ত না হয়ে পড়ে, সেজন্য ইগো নিম্নবর্ণিত আত্মরক্ষা কৌশলগুলো ব্যবহার করে। এসব কৌশল ব্যক্তি অসচেতনভাবেই ব্যবহার করে। তবে মনঃসমীক্ষণ কিংবা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে তাকে এ ব্যাপারে সচেতন করা যায়।

অহম যখন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ও উদ্বেগ নিরসন করতে পারে না, তখন সে কতকগুলো প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়াগুলোর সাহায্যে অহম বাস্তবতাকে কিছুটা বিকৃত করে উদ্বেগের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করে। শুধুমাত্র উদ্বেগ নিরসন করার জন্যই এগুলো ব্যবহৃত হয় না। যে কোন প্রকার মানসিক উত্তেজনা ও অশান্তি দূর করার জন্য ও নিজের আত্ম-মর্যাদাবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যও মানুষ প্রায়ই এই কৌশলগুলোর আশ্রয় গ্রহণ করে। বাস্তবতাকে কিছুটা বিকৃত করে ব্যক্তি স্বীয় ব্যর্থতা ও অক্ষমতাকে ঢেকে রাখে এবং নিজের অহংবোধকে অক্ষুণ্ণ রেখে কিছুটা সান্ত্বনা বা প্রবোধ লাভ করে। ফ্রয়েড এগুলোকে মনোকৌশল (mental mechanisms) নামে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এগুলো বর্তমানে আত্মরক্ষা কৌশল (ego-defense mechanisms) বা প্রতিরক্ষা কৌশল (defense mechanism) নামে অধিক পরিচিত। ফ্রয়েডই প্রথম এই কৌশলগুলো সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেছেন এবং তার এই ধারণাকে সব মনোবিজ্ঞানীরাই একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রূপে স্বীকার করেন।

প্রতিরক্ষা কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতাকে বিকৃত করে ব্যক্তির ব্যর্থতা ও অক্ষমতাকে ঢেকে রাখা এবং ব্যক্তির অহংবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখা। এর ফলে ব্যক্তি কিছুটা সান্তনা ও স্বস্তি বোধ করে। প্রতিরক্ষা কৌশল অবলম্বনের প্রক্রিয়াটি অচেতন স্তরে সংঘটিত হয়। ফলে ব্যক্তি নিজের অজ্ঞাতেই বাস্তবকে বিকৃত করে নিজেকে ধোকা দিতে পারে ও মানসিক পীড়ন থেকে নিস্তার লাভ করতে পারে। সেজন্যই এগুলোকে আত্ম-প্রতারণামূলক ও আত্ম- প্রবোধমূলক প্রক্রিয়া রূপে গণ্য করা হয়।

প্রতিরক্ষা কৌশল বাস্তবতাকে বিকৃত করলেও এটাকে অস্বভাবী প্রকিয়া মনে করা হয় না। কারণ সকলেই কোন না কোন সময় এই আত্ম-প্রতারণামূলক প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বরং এগুলো আছে বলেই মানুষ প্রচণ্ড পীড়ন থেকে নিস্তার লাভ করতে পারে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। এগুলো আছে বলেই মানুষ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে ও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। তবে প্রতিরক্ষা কৌশল যখন তীব্র রূপ ধারণ করে, তখন তা মনোবৈকল্যের লক্ষণে পরিণত হয়।

ফ্রয়েড এ ধরনের অনেকগুলো প্রতিরক্ষা কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে আরও কিছু নতুন নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল উদ্ঘাটিত হয়েছে। তবে এখানে শুধু ফ্রয়েড বর্ণিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল আলোচনা করা যাক –

আচরণকে ভিন্ন খাতে চালিত করার কৌশলসমূহ (Behavior-Channeling Defense):

  • একাত্মভবন ও অন্তঃক্ষেপণ (identification and introjection): ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রক্রিয়ায় একাত্মভবন ও অন্তঃক্ষেপণ প্রক্রিয়া আলোচিত। বিকাশের শিশ্ন পর্যায়ে শিশু তার সমলিঙ্গের পিতা বা মাতার সঙ্গে একাত্মবোধ করে পিতা বা মাতার প্রতি তার ঘৃণা ও ভয়কে প্রশমিত করে যা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের অংশ। পরিণত বয়সেও মানুষ তার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা বোধকে অচেতনে পাঠিয়ে দিয়ে সচেতনভাবে তার প্রতি একাত্মবোধ করে নিজের মধ্যে এসব গুণের বিকাশ ঘটায়। কোন বিষয়ে ব্যর্থ হয়ে ব্যক্তি যখন অস্বস্তি ও অশান্তি বোধ করে, তখন সে এমন একজনের সাথে নিজেকে অভিন্ন বলে ভাবে, যে ঐ বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছে। অন্যের সাথে নিজেকে অভিন্ন বলে মনে করাকেই একাত্মভবন বলা হয়। এই একাত্মভবনের মাধ্যমে ব্যক্তি অন্যের সাফল্যের অংশীদার হয়ে ওঠে এবং এভাবেই সে তার ব্যর্থতাজনিত অশান্তি থেকে মুক্তি লাভ করে। যেমন ক্রিকেট খেলায় অপারদর্শী কোন ব্যক্তি তার প্রিয় ক্রিকেট দলের সাথে একাত্মভবন করে ঐ দলের সাফল্যে আনন্দ বোধ করে এবং এভাবেই সে তার অক্ষমতাজনিত অস্বস্তি থেকে মুক্তি লাভ করে। অন্যদিকে অন্যের উচ্চ আদর্শ ও নীতি নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করা ও এগুলোকে নিজের মনে করে অনুসরণ করাকেই অন্তঃক্ষেপণ বলা হয়। অন্তঃক্ষেপণ প্রক্রিয়া প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত। এখানে অন্যের বিষয়গুলো নিজের মধ্যে আরোপ করা হয়। ব্যক্তি অন্যের আদর্শ নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করে নিজের আত্মসম্মানবোধ বা আত্মশ্লাঘাকে বৃদ্ধি করে ও নিজেকে হীনমন্যতাবোধের অস্বস্তি থেকে মুক্ত করে। ফ্রয়েড শিশুর অতি-অহম ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে এই একাত্বভবন ও অন্তঃক্ষেপন প্রক্রিয়ার ওপর বেশ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
  • অপস্থাপন/স্থানান্তরণ/অভিক্রান্তি/বিক্ষেপণ/বিসরণ (displacement): প্রতিরক্ষা কৌশল রূপে অপস্থাপন কাজ করে। এর অর্থ সোজা বাংলায় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো। যেমন আপনার আত্মীয় মারা গেলে দোষ চাপালেন ডাক্তারের অবহেলার উপর। আপনি যে এ ব্যাপারে যথাযথ মনোযোগ দেননি সেটা মনে করতে চাইলেন না। কামনার এক বস্তুকে অন্য বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপনও স্থানান্তরণ। যেমন দুধের বোঁটা না পেয়ে শিশু আঙ্গুল চোষে। কোন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত আবেগ যদি ব্যক্তি বাস্তব বিবেচনা অনুসারে দমন করে রাখতে বাধ্য হয়, তবে স্বভাবতই তার মধ্যে তীব্র অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিরাপদ কোন পরিস্থিতিতে ঐ আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে কিছুটা স্বস্তি লাভ করে। আবেগের এই স্থানান্তরণকেই অপস্থাপন কৌশল বলা হয়। অফিসে ওপরওয়ালার কাছে তিরস্কৃত হয়ে ক্রোধান্বিত ব্যক্তি গৃহে ফিরে অহেতুক স্ত্রী পুত্রের সাথে ক্রুদ্ধ আচরণ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার মনের সব রকম ক্ষোভ, আক্রোশ ও ক্রোধকে কোন নির্দিষ্ট নিরপরাধ ও দুর্বল পক্ষের ওপর স্থানান্তরিত করে। এই অহেতুক আক্রোশের শিকার দুর্বল পক্ষকে বলির পাঁঠা (scape-goat) বলা হয়। প্রাচীনকালে কোন কোন সমাজের জনগণ তাদের সব দোষ, অপরাধ ও পাপ কোন একটি বিশেষ প্রাণীর ওপর আরোপ করত ও প্রাণীটিকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে নিজেদেরকে কলুষ মুক্ত করত। এখানেও ব্যক্তি তার যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট ও বিড়ম্বনার জন্য কোন বিশেষ দুর্বল পক্ষকে দায়ী করে এবং দুর্বল পক্ষের ওপর আক্রোশ প্রকাশ করে সে অস্বস্তি ও অশান্তি থেকে মুক্তি লাভ করে।
  • উদ্গতি (sublimation): প্রবৃত্তির কাম্যবস্তু অর্জনে ব্যর্থ হলে ব্যক্তি বিকল্প কোন বস্তু লাভের মাধ্যমে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটায় এবং নিজেকে হতাশার কবল থেকে রক্ষা করে। এই বিকল্প বস্তুর সামাজিক মূল্য যখন মূল বস্তু থেকে বেশী হয়, তখন সেটাকে উদ্গতি বলা হয়। যেমন যৌনাকাঙ্ক্ষা ও আগ্রাসী মনোভাবকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য চিত্রকলা ও খেলাধুলায় রূপান্তরিত করা। কোন নারীর ভালবাসা লাভে ব্যর্থ হয়ে ব্যক্তি কবিতা রচনা করে খ্যাতি অর্জন করতে পারে। উদ্‌গতিকে স্থানান্তরণ এর বিশেষ রূপও বলা হয়। বিকল্প বস্তুর মূল্য যখন মূল বস্তু থেকে কম হয়, তখন সেটাকে মনোবিজ্ঞনীরা প্রতিকল্পন বলেন। তবে ফ্রয়েড তার তত্ত্বে উদ্গতির ওপরই বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ তার মতে মানুষের সব রকম প্রবৃত্তিগত তাড়নাই অসামাজিক ও পাশবিক প্রকৃতির হয়। ফলে এগুলোকে পরিতৃপ্ত করার জন্য মানুষকে সব সময়ই সমাজ অনুমোদিত কিছু বিকল্প পন্থার আশ্রয় নিতে হয়। ফ্রয়েডের মতে মানুষ মূলতঃ কাম প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। সুতরাং মানুষের অধিকাংশ আচরণই তার কাম প্রবৃত্তি নিবৃত্ত করার বিকল্পপন্থা মাত্র এবং এই বিকল্পপন্থাগুলো সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত হয় বা এগুলোর সামাজিক মূল্য বেশী হয়। সুতরাং ফ্রয়েডের মতে মানুষের অধিকাংশ আচরণই উদ্গতিমূলক। তার মতে উদ্গতি আছে বলেই মানুষ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করে এবং এগুলোর উৎকর্ষ সাধন করে। উদ্গতি আছে বলেই মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ ও ক্রমোন্নতি সাধিত হয়।

প্রথম পর্যায়ের বাস্তব বিকৃতকারী কৌশলসমূহ (Primary Reality Distorting Defense): কোনো উদ্বেগ উদ্রেককারী অনুভূতি বা ঘটনা সম্বন্ধে সচেতন না হওয়াই এর লক্ষ্য।

  • অবদমন (repression): মনের যেসব কামনা বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় কিংবা যেসব স্মৃতি বিবেককে পীড়িত করে সেসব কামনা ও স্মৃতিকে মনের সচেতন স্তর থেকে অচেতনে চালান করে দেয়াই এর কাজ। যে সমস্ত অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতা ব্যক্তির কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে, সেগুলো সে জোরপূর্বক ভুলে থাকে বা অচেতন মনে দাবিয়ে রাখে। এই জোরপূর্বক ভুলে থাকা বা অচেতন মনে দাবিয়ে রাখার প্রক্রিয়াকেই অবদমন বলা হয়। অবদমন মনের একটি আদিমতম প্রক্রিয়া। যে কোন অপ্রীতিকর বিষয়কে মানুষ প্রথমেই তার চেতন মন থেকে বিতাড়িত করে অচেতন মনে প্রেরণ করে। মানুষ তার মনের বিপজ্জনক ইচ্ছাকেও (যেমন কাউকে হত্যা করার ইচ্ছা বা কাউকে ধর্ষণ করার ইচ্ছা) একইভাবে অবদমন করে অচেতন মনে প্রেরণ করে। ফ্রয়েডই প্রথম অচেতন মন ও অবদমন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দান করেছেন। তিনি হিস্টিরিয়ার রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে এই অচেতন মন ও অবদমন প্রক্রিয়ার সন্ধান লাভ করেন। মানুষ যে কোন পীড়াদায়ক বিষয়কে এই কৌশলের মাধ্যমে অচেতন মনে দাবিয়ে রেখে পীড়ন ও উদ্বেগের কবল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।
  • অস্বীকৃতি (denial): বহিঃ বাস্তবের যেসব বিষয় উদ্বেগ উদ্রেক করে, সেসবকে মনের অচেতন স্তরে পাঠিয়ে দেয়া। যেমন, ডাক্তার ঘোষণা করার পরও আপনি অস্বীকার করলেন আপনার বড় কোনো অসুখ হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তব বিকৃতকারী কৌশলসমূহ (Secondary Reality Distorting Defense): এ কৌশলসমূহ মনের দ্বন্দ্বগুলোকে অচেতনে চাপা দিয়েই ক্ষান্ত হয় না; এর উপর আরো নতুন কৌশল যুক্ত করে।

  • সংবন্ধন ও পশ্চাৎগমন/প্রত্যাবৃত্তি (fixation and regression): ফ্রয়েডের মতে কামশক্তি বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে বিকাশ লাভ করে। ব্যর্থতা, উৎকণ্ঠা বা উদ্বেগজনিত কারণে এই বিকাশ প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে এবং কামশক্তি বিশেষ স্তরে আবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। নির্দিষ্ট কোন স্তরে কামশক্তির বিকাশ আবদ্ধ হয়ে যাওয়াকেই ফ্রয়েড সংবন্ধন (fixation) বলেছেন। কোন স্তর অতিক্রম করার সময় উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাত্রা বেশী হ’লেই এই সংবন্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তির বিকাশ ধারা স্থগিত বা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আবার কোন কোন সময় ব্যক্তি হতাশা ও উদ্বেগের সম্মুখীন হ’লে তার কামশক্তি ও ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ববর্তী বিকাশের স্তরে ফিরে যায়। যেমন শিশ্নকাম পর্বে কোন শিশু যদি ব্যর্থতা ও হতাশার সম্মুখীন হয়, তবে তার মধ্যে মুখকাম পর্ব বা পায়ুকাম পর্বের আচরণগত বৈশিষ্ট্য প্রত্যাবর্তন করবে। বিকাশের পূর্ববর্তী স্তরে ফিরে যাওয়াকেই ফ্রয়েড পশ্চাৎগমন (regression) বলেছেন। বিকাশধারায় কামশক্তি যে স্তরে বেশী সংবদ্ধ হয়, পশ্চাৎগমন ঘটলে ব্যক্তি সাধারণতঃ সেই স্তরেই ফিরে যায়। সুতরাং ফ্রয়েডের মতে বিকাশের পূর্ববর্তী স্তরে ফিরে যাওয়াই হচ্ছে পশ্চাৎগমন। তবে মনোবিজ্ঞানীরা অতীত জীবনের যে কোন অবস্থায় ফিরে যাওয়াকেই পশ্চাৎগমন রূপে আখ্যায়িত করেন। যেমন কেউ চাপে পড়লে বাচ্চাদের মতো পরনির্ভরশীল আচরণ করে। আবার, কলেজ ক্যাম্পাসে খাপ খাওয়াতে অসুবিধায় পড়লে নবাগত ছাত্র গৃহের নিরাপদ পরিবেশে ফিরে যাওয়ার তাগিদ বোধ করে এবং ঘন ঘন বাড়ী যায়। এই গৃহ কাতরতা (home sickness) পশ্চাৎগমনের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বিষম সঙ্কটের মুখে একজন বয়স্ক ও পরিপক্ক ব্যক্তিও যে কোন রকম শিশুসুলভ আচরণ করতে পারে। যেমন দুঃখে অভিভূত হয়ে একজন পরিণত বয়সের ব্যক্তিও শিশুর মত কান্না শুরু করতে পারে। শৈশবকালে প্রত্যাবর্তনের ফলেই সে এরূপ আচরণ করে।
  • প্রক্ষেপন/আরোপ/প্রক্ষেপ/অভিক্ষেপ (projection): নিজের অভ্যন্তরীণ আবেগ, অনুভূতি, বৈশিষ্ট্য বা প্রবণতা বাইরের কোন কিছুতে আরোপ করাকেই প্রক্ষেপণ বলা হয়। কৌশলে নিজের অন্তঃস্থিত নিজেরই অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীকে শুধু অস্বীকার করা হয় না-তা আরোপ করা হয় অন্যের উপর। সিনেমার পর্দায় বা স্ক্রিনে যেমন ছবি নিক্ষেপ করে ফুটিয়ে তোলা হয়, তেমনি এখানে ব্যক্তি নিজের মনের বিষয়গুলো বাইরের কোন বস্তু, ব্যক্তি বা অবস্থায় নিক্ষেপ করে তা প্রতিফলিত করে। পীড়ন ও উদ্বেগের কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য ব্যক্তি দু’ভাবে প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে পারে। প্রথমতঃ ব্যক্তি নিজের অক্ষমতা বা ব্যর্থতার কারণ বাইরের কোন অবস্থার ওপর আরোপ করতে পারে। অর্থাৎ নিজের ব্যর্থতার জন্য বাইরের কোন বস্তু, ব্যক্তি বা বিষয়কে সে দায়ী করতে পারে। যেমন পরীক্ষায় ফেল করা কোন ছাত্র মনে করতে পারে যে, কোন শিক্ষক আক্রোশবশতঃ ইচ্ছা করে তাকে ফেল করিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ব্যক্তি নিজের দোষ ত্রুটিগুলো অন্যের ওপর প্রতিফলন করতে পারে এবং সে তখন ঐ দোষ ত্রুটিগুলো অন্যদের মধ্যে বেশী পরিমাণে দেখতে পায়। যেমন কোন ঘুষখোর ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে অন্যেরা অনেক বেশী পরিমাণে ঘুষ খায়। অর্থাৎ অন্যদের তুলনায় তার ঘুষ খাওয়াটা এতই নগন্য যে, এটাকে কোনক্রমেই দোষ বলে ধরা যায় না। এভাবেই ব্যক্তি অপরাধবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে এবং নিজের আত্মসম্মানকে অক্ষুণ্ণ রাখে। সুতরাং প্রক্ষেপণ কৌশলের মাধ্যমে অহম মানসিক অশান্তি ও অস্বস্তির কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে।
  • বিপরীত-ক্রিয়া গঠন (reaction formation): ব্যক্তির অবাঞ্ছিত আবেগ অনুভূতি বা চিন্তা ভাবনাগুলো যদি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে তা সাধারণ অবদমন প্রক্রিয়ায় দাবিয়ে রাখা যায় না। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি বিপরীত-ক্রিয়া গঠনের আশ্রয় নিতে পারে। ব্যক্তি যখন অবাঞ্ছিত আবেগ অনুভূতির ঠিক বিপরীতধর্মী আবেগ অনুভূতি চেতন মনে বোধ করে ও সেগুলোই বাইরে প্রকাশ করে, তখন সেটাকে বিপরীত-ক্রিয়া গঠন বলা হয়। যেমন কোন বিবাহিতা মহিলা যদি কোন পরপুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে, তবে তা গর্হিত ও পাপপূর্ণ বলে মহিলার নিজের কাছেই তা অবাঞ্ছিত ও পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে মহিলার মনে ঐ পরপুরুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞার উদ্রেক হবে এবং সেভাবেই সে তার মনের আবেগ বাইরে প্রকাশ করবে। এভাবেই সে তার অবৈধ ও অসামাজিক যৌন আকর্ষণকে রোধ করতে পারবে। আবার, যেমন নিজের যৌনাকাঙ্ক্ষা নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, তখন বেছে নিলেন কঠোর পর্দা। উল্লেখ্য যে প্রকাশিত আবেগ অনুভূতি শুধু লোক দেখানো বিষয় নয়; প্রকৃতই ব্যক্তি বিপরীত আবেগ অনুভূতি চেতন মনে অনুভব করে এবং এর ফলেই অবাঞ্ছিত আবেগ অনুভূতিগুলো অচেতন মনে চলে যায়। অবশ্য প্রকাশিত আবেগ অনুভূতি অত্যন্ত তীব্র ও অতিরঞ্জিত হয় এবং এই অতিরঞ্জিত ভাব থেকেই এটাকে বিপরীত-ক্রিয়া গঠন রূপে শনাক্ত করা যায়। উদ্বেগের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি উদ্বেগের বিপরীতধর্মী কিছু আবেগ অনুভূতি চেতন মনে অনুভব করে এবং এভাবেই উদ্বেগকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
  • যুক্তাভ্যাস/যুক্তিসিদ্ধকরণ (rationalization): অযৌক্তিক আচরণকে যুক্তি দিয়ে সামাজিক ভাবে এবং নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য করা। হয়তো কাউকে আপনি আক্রমণ করলেন ক্রোধান্ধ হয়ে। কিন্তু যুক্তি দাঁড় করালেন, এ শাস্তি তার প্রাপ্য।

ফ্রয়েড ইগোর আত্মরক্ষা কৌশলসমূহ সূত্রবদ্ধ করেছিলেন ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মনোরোগের কারণ ব্যাখ্যায়। এসব ক্ষেত্রে তা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে কৌশলসমূহ চাপে পড়া মানুষের দৈনন্দিন আচরণ বুঝতে সাহায্য করে। অর্থাৎ ‘আত্মরক্ষা কৌশল’ ধারণাটি প্রয়োগের জন্য ইদ্, ইগো, সুপারইগো এ তিন প্রকোষ্ঠভিত্তিক মন এবং ইদ্‌স্থিত যৌন কিংবা আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুপার ইগোর দ্বন্দ্ব কল্পনার প্রয়োজন নেই। মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব বা বাইরের চাপ থেকে উদ্ভূত নেতিবাচক আবেগ নিরসনে ব্যক্তির তাৎক্ষণিক স্বয়ংক্রিয় অসচেতন প্রতিক্রিয়া বুঝতে ‘আত্মরক্ষা কৌশল’ ধারণাটি প্রয়োগ করা যায়। মনোবিজ্ঞানীগণ পরীক্ষা করে দেখেছেন, মানুষ ‘আত্মরক্ষা কৌশল’ ব্যবহার করে। তবে অবদমন নিয়ে পরীক্ষার ফলাফল অপ্রত্যাশিত। অবদমনকে সবচেয়ে ব্যাপক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্মরক্ষা কৌশল বলে বিবেচনা করা হয়। কৌতূহলের ব্যাপার হলো, যেসব ক্ষেত্রে মানুষ এটি ব্যবহার করে বলে মনে করা হয়, গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ কদাচিৎ সেসব ক্ষেত্রে অবদমন ব্যবহার করে।

ফ্রয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতি

ফ্রয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতি আলোচনা করার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ফ্রয়েডের ব্যক্তিত্বের সংগঠন এবং মানসিক উপাদানগুলোর যে বর্ণনা ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে তা তার চিকিৎসা পদ্ধতির উপরে ভিত্তি করে তৈরী হয়েছে।

ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতি এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই অভিনব এবং চিত্তাকর্ষক। প্রথমতঃ ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং নিউরোসিস (স্নায়ুরোগ) এর উৎপত্তির কারণগুলো সাধারণ পদ্ধতিতে জানা যাবে না। কারণ, বাস্তবতার চাপে অথবা বিবেকের পরিপন্থী হওয়ায় অনেক কামনা বাসনা এবং অনেক বেদনাময় অভিজ্ঞতা আমরা অবদমন করে থাকি। এগুলো মনের নিজ্ঞান স্তরে (unconscious) জমা থাকে। এগুলো এমন কি প্রাচেতন মনেও থাকেনা যাতে করে একটু চেষ্টা করলেই মনে করা যাবে। নিজ্ঞান মনে থাকে বলে এসব দুঃখময় স্মৃতি বা অবদমিত কামনাবাসনাগুলোর কথা ব্যক্তি জানতে পারে না। সুতরাং এসব অবদমিত অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মরণে আনতে গেলে বাধার (Resistence) সৃষ্টি হয়। এই বাধা অপসারণ করে অচেতনের অভিজ্ঞতা সমূহকে চেতন স্তরে আনতে গেলে কৌশলের প্রয়োজন। এই কৌশলগুলো হলো:

  • হিপনোসিস বা নিদ্রাবেশ (Hypnosis):
  • মুক্ত অনুষঙ্গ (Free association)
  • স্বপ্ন বিশ্লেষণ, ইত্যাদি।

স্বপ্ন যেহেতু যথেষ্ট পরিমানে প্রাথমিক প্রক্রিয়া সমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু স্বপ্নগুলোকে যদি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে সেগুলোর মাধ্যমে অচেতন মন সম্পর্কে জানা যায়। ফ্রয়েড আবিষ্কার করেন যে, স্বপ্নের মাধ্যমে ব্যক্তি তার অবদমিত কামনা বাসনা পূরণ করে থাকে। অর্থাৎ ইদ যেহেতু অলীক কল্পনার মাধ্যমে কোন ইচ্ছা পূরণ এবং বাস্তবে ইচ্ছা পূরণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না সেজন্য বর্তমান মানসিক তাগিদ এবং চাপগুলো স্বপ্নের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ পায়। একটি স্বপ্নের বাহ্য অর্থ ও অন্তর্নিহিত অর্থ এক নয়। স্বপ্নের অন্তর্নিহিত বা প্রচ্ছন্ন (Latent) অর্থ জানতে হলে অর্থাৎ স্বপ্নের মাধ্যমে কোন অতৃপ্ত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা আবিষ্কার করতে হলে স্বপ্নের বিভিন্ন উপাদানের প্রতি ব্যক্তির অনুষঙ্গগুলি জানতে চাওয়া হয়। এইভাবে স্বপ্নের বিভিন্ন সংকেত (Symbol) এর অর্থ আবিষ্কার করা হয় এবং অবদমিত অভিজ্ঞতা বা বিষয়গুলি চেতনায় প্রতিফলিত করাহয়। অবদমিত ঘটনাবলীর স্মৃতি পুনরুদ্ধারের বাধা দূর করা বেশ কঠিন ব্যাপার এবং এটিই মনোসমীক্ষকের প্রধান কর্তব্য। অনেক সময় ব্যক্তিকে তার অবদমিত ঘটনাবলীর কথা মৌখিক ভাবে বললেও সে তা গ্রহণ করতে চায়না। রোগী যখন তার অবদমিত ঘটনাগুলোকে গ্রহণ করার জন্য বিবেকের বাধাগুলো দূর করতে পারে তখনই তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বিবেকের বাধাগুলো দূর হয়ে যাওয়ার ফলে, সে অচেতনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে চেতন স্তরে নিয়ে আসতে পারে এবং ইগো বা অহং এর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এভাবে যখন ইগোর নিয়ন্ত্রণের পরিধি ব্যাপকতর হয়, তখন ইগোর শক্তি বৃদ্ধি পায়। এবং রোগী তার আকাঙ্খা বা প্রবৃত্তিগুলোকে যুক্তির শাসনে রাখতে পারে। যদিও রোগী কখনও সুখ নীতি থেকে মুক্ত হতে পারে না, তবু ও সে বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার বেশীর ভাগ প্রেষণার একটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সন্তুষ্টি পেতে শিখে। এটাই মনোচিকিৎসার লক্ষ্য।

মনোচিকিৎসার একটি পর্যায়ে, বিশেষ করে রোগী যখন তার অবদমিত আভ্যন্তরীণ জটিলতাগুলোকে প্রকাশ করতে চায়না, তখন স্থানান্তর করণ (Transferance) এর সাহায্য নেওয়া হয়। রোগী অনেক সময় তার আদিম কামনাগুলিকে (Libidinal energy) চিকিৎসকের উপরে স্থানান্তর করে। চিকিৎসক এই শক্তিটাকে অবদমনের বাধা কাটিয়ে উঠার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া স্থানান্তরকরণ নিজেই মনোসমীক্ষণের একটি বিশ্লেষণের বিষয়। স্থানান্তর করণে রোগী তার জটিল অনুভূতিগুলি এবং অপূর্ণ আকাঙ্খাগুলি চিকিৎসকের উপরে আরোপ করে। যেমন সে চিকিৎসককে প্রেমিক/প্রেমিকা বা পিতার আসনে বসায়। এই সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করতে হবে। রোগী যখন চিকিৎসককে চিকিৎসক হিসাবে ভাবতে শুরু করবে তখনই শুধু সে স্বাধীনভাবে তার সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারবে। স্থানান্তর করণ থেকে মুক্তি লাভ করলেই শুধু রোগীর অসুখ সেরেছে বলে মনে করতে হবে। অনেক সময় দেখা গেছে, নিউরোসিসের মূল কারণ হলো শৈশবকালীন যৌন অভিজ্ঞাতার অথবা অযাচিত যৌন কামনার অবদমন। সুতরাং রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে তাকে সেই সুদূর অতীতের স্মৃতিগুলো মনে আনতে হবে। শৈশবের দিনগুলো ব্যক্তির বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় কঠিন শাস্তির দরুন বা ব্যর্থতার দরুণ শিশুর বিকাশ এই পর্যায়ে থেমে যায়, যাকে বলা হয় স্থিরীভবন (Fixation)। আবার অনেক সময় স্বাভাবিক বিকাশ হলেও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির চাপে সে তার শৈশবকালে ফিরে যায়, শৈশবের আচরণের পুনরাবৃত্তি করে। এটাকে বলা হয় প্রত্যাবৃত্তি (regression) যে সব শৈশবকালীন অভিজ্ঞতার শাস্তি পাওয়ার এবং অবদমন করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী সেগুলো হলো যৌনতা সংক্রান্ত সুতরাং মনোচিকিৎসার একটি প্রয়োজনীয় কৌশল হলো সমীক্ষণের মাধ্যমে শৈশবের যৌন অভিজ্ঞতাগুলো অচেতনের স্তর থেকে চেতন স্তরে নিয়ে আসা। অর্থাৎ অন্য কথায় বলা চলে, মনোবিশ্লেষণের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য হলো ইডিপাস কমপ্লেক্স ও এর সফল সমাধান করতে রোগীকে সাহায্য করা। রোগীর অন্তর্দৃষ্টি লাভ তখনই হবে যখন রোগী তার সমস্যাটিকে বুঝতে পারবে এবং নিজের তার ইডিপাস কমপ্লেক্স ও অন্যান্য যৌনতা সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে।

ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের একটি উল্লেখযোগ্য ধারণা হলো মানসিক নির্দ্ধারণবাদ (Psychic determinism)। মানসিক রোগের লক্ষণগুলো যেমন শৈশবের যৌন অভিজ্ঞতাগুলির দ্বারা নির্ধারিত, ঠিক তেমনিভাবে প্রতিটি ব্যক্তির ভুলগুলি–লেখার ভুল, বা কথার ভুল, বা কাজের ভুল, ইত্যাদি বিস্মৃতিগুলিও মানসিকভাবে নির্ধারিত। এ ধরণের ভুলগুলিকে দৈব ঘটনা বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এগুলোর কারণ ব্যক্তির অচেতন মনে লুক্কায়িত কিছু প্রেষণা। এ সম্পর্কে ফ্রয়েড একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন (১৯৩৮)। একটি সংস্থার (united daughters of the confederacy) একজন মহিলা সদস্যা তার বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিসকে প্রশংসা করতে গিয়ে বলেনঃ “The great and only president of the confederate states of America Abraham Lincoln.” অর্থাৎ এই মহিলা তার নিজে সংস্থার প্রেসিডেন্টের নামের বদলের আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিংকনের নাম বলে ফেলেন। এতে স্পষ্টতঃই মনে হচ্ছে মহিলা তার নিজের সংগঠনে না থেকে অন্য সংগঠনে থাকতে চান।

ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের একটি বিশেষত্ব হলো এই যে তার তত্ত্বে এটী দেখানো হয়েছে যে, যদি আদিম প্রবণতাগুলোকে (impulse) গৌণ প্রক্রিয়া সমূহের নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাহলে নির্ধারণবাদকে বাতিল করা যায়। এভাবে রোগী প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। গৌণ প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে নির্ধারণবাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি এতটা সচেতন ছিলেন না। তবে তার অনুসারীদের মধ্যে অনেকেই ‘ইগো’ প্রক্রিয়া সমূহ অনুধ্যান করার জন্য প্রচুর সময় দিয়েছেন। ফ্রয়েড মনে করতেন যে, মানুষকে প্রকৃত পক্ষে যুক্তিবাদী হতে হবে, তাহলেই তার উন্নতি সম্ভব। ফ্রয়েড ও তার সঙ্গীদের কেউই মনে করতেন না যে, অন্তদৃষ্টি লাভ নিউরোসিস থেকে আরোগ্য লাভের একমাত্র উপায়, তবে তারা মনে করতেন এটা একটা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। তাছাড়া তারা মনে করতেন যে, অন্তর্দর্শন খুব গভীর হওয়া দরকার, তা না হলে চিকিৎসায় কোন উপকার হবেনা। রোগীকে বিশ্লেষণের ফলাফল আবেগীয়ভাবে গ্রহণ করতে হবে, শুধুমাত্র কথার কথা হিসাবে ভাসাভাসাভাবে বিশ্লেষণের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করলেই চলবে না।

মনোরোগের কারণ

ফ্রয়েড প্রবর্তীত সাইকোথেরাপি পদ্ধতি মনঃসমীক্ষণ/মনোবিকলন/ মনোবিশ্লেষণ (psychoanalysis) নামে পরিচিত। তার তত্ত্বও একই নাম ধরে। নিউরোটিক ও হিস্টিরিয়ার রোগীদের সাইকোথেরাপি করতে গিয়েই ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব গড়ে ওঠে এবং সাইকোথেরাপিতেই তার প্রথম প্রয়োগ ঘটে। ফ্রয়েডের মতে রোগলক্ষণসমূহ রোগীর মনের অচেতন স্তরস্থিত অসমাধিত দ্বন্দ্বের প্রকাশ।

অহম ইদের সঙ্গত চাহিদাগুলো পূরণের জন্য যেমন আসক্তি গঠন করে, তেমনি ইদের অসঙ্গত চাহিদাগুলো দমন করে রাখার জন্য অহম আসক্তি-রোধকও গঠন করে। আসক্তি-রোধকের ক্ষেত্রে ইদ্‌স্থিত আকাঙ্ক্ষাসমূহ সুপার ইগোর অনুমোদনযোগ্য না হওয়ায় ইগো তার ‘আত্মরক্ষা কৌশল’ প্রয়োগে এসব অচেতন স্তরে চাপা দিয়েছে। এই আসক্তি গঠন ও আসক্তি-রোধক গঠনের বিপরীতমুখী ক্রিয়া প্রতিনিয়ত ব্যক্তির মধ্যে চলতে থাকে। অহম তার বিবিধ কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য ইদের নিকট থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি লাভ করে। এই সীমিত শক্তির অধিকাংশই যদি আসক্তি-রোধক গঠনের কাজে ব্যয় হয়ে যায়, তবে অহম-শক্তির অপচয় ঘটে এবং আসক্তি গঠন ও বাস্তবকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে অহম-শক্তির ঘাটতি হয়ে যায়। এর ফলে অহম যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে, অচেতন উপাদানগুলোও তেমনি অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই অচেতন উপাদানগুলো প্রত্যক্ষভাবে চেতনায় আসতে না পারলেও, মনোরোগের লক্ষণ রূপে পরোক্ষভাবে এগুলো ব্যক্তির আচরণে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে ব্যক্তির আচরণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ব্যক্তির নিজের কাছেও এরূপ আচরণের কারণ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও দুর্বোধ্য থেকে যায়।

আসক্তি গঠন ও আসক্তি-রোধক গঠনের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব এসব দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করে এসবের নিরসনের মাধ্যমে রোগীকে রোগলক্ষণমুক্ত করা সম্ভব। সচেতন মন-ই যখন এসব দ্বন্দ্বকে চাপা দিয়ে রেখেছে, তাই সচেতন কিংবা যুক্তিযুক্ত চিন্তার মাধ্যমে অচেতনস্থিত এসব দ্বন্দ্বের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। মন যেহেতু মানসিক নির্ধারণবাদী (psychic deterministic) নীতি মেনে চলে, তাই আমাদের কথাবার্তার ভুলচুকে, ভুলে যাওয়ার, স্বপ্নে কিংবা রোগলক্ষণের মতো অযৌক্তিক, অর্থহীন বিষয়গুলোর পিছনেও মনের কার্যকারণ নিয়মটি কার্যকর। অর্থাৎ উপরিউক্ত আপাত অর্থহীন, যুক্তিহীন, উদ্ভট কিংবা তুচ্ছ বিষয়গুলোও অর্থবহ। প্রকৃতপক্ষে এসবের মাধ্যমেই অচেতন আকাঙ্ক্ষা ছদ্মবেশে সচেতন প্রহরীকে (censor) ফাঁকি দিয়ে বাইরে প্রকাশিত হয়। তাই অচেতন দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করার জন্য এসব আপাত অর্থহীন, যুক্তিহীন, উদ্ভট, তুচ্ছ বিষয়াবলীকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

ফ্রয়েড মানুষের আচরণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যৌনতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার মতে মনের অবদমিত উপাদানগুলোর অধিকাংশই যৌনমূলক। যখন ব্যক্তির অহম-শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন অবদমিত হয়ে থাকা শক্তিশালী যৌনমূলক দ্বন্দ্ব বা হতাশা মনোরোগের লক্ষণ সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং মনোরোগ সৃষ্টির জন্য এই অবদমন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আসক্তি-রোধক গঠনের মাধ্যমে অহম যত বেশী অবাঞ্ছিত কামনা বাসনা অবদমন করে, নির্জ্ঞান মন তত বেশী শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং চেতন অহম পক্ষান্তরে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ব্যক্তিত্বের পরিচালনা ক্ষমতা ক্রমশঃ নির্জ্ঞান মনের অধীনে চলে যায় এবং ব্যক্তি তখন উদ্ভট আচরণ করে। তার আচরণের সাথে বাস্তবের আর কোন যোগসূত্র থাকে না।

সুতরাং ফ্রয়েডের মতে মনোবৈকল্যের উৎস মানুষের নির্জ্ঞান মনে নিহিত রয়েছে। সেজন্যই তিনি রোগীর মন সমীক্ষণ বা বিশ্লেষণ করেন। অর্থাৎ রোগীর নির্জ্ঞান মন উদ্ঘাটন করে তা রোগীর কাছে ব্যাখ্যা করে দেয়াই হচ্ছে ফ্রয়েডের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যার ফলে রোগী যতই তার নির্জ্ঞান মনকে উপলব্ধি করে সচেতন মনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, ততই তার অহম শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এভাবে ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে অহম ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ফিরে পায় এবং বাস্তব নীতি অনুসারে নিজেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক পথে পরিচালনা করতে পারে। নির্জ্ঞান মনকে উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণ করার জন্য ফ্রয়েড কতিপয় কৌশল অবলম্বন করেছেন। কৌশলগুলো আলোচনা করা হ’ল।

অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি (free association method)

ফ্রয়েড যখন সাইকোথেরাপি শুরু করেন, তখন এর পদ্ধতি ছিল ‘সম্মোহন অভিভাবন’ (hypnotic suggestion) বা সংবেশন পদ্ধতি। নির্জ্ঞান মনকে উদ্ঘাটন করার জন্য ফ্রয়েড প্রথম দিকে সংবেশন পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। কিন্তু অচিরেই তিনি এ পদ্ধতির অসুবিধা বুঝতে পারেন। এর দুটি সীমাবদ্ধতা ছিল। সব রোগীকে সম্মোহিত করা যায় না এবং অনেক রোগীর ক্ষেত্রে সম্মোহন অভিভাবনের ফল দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সংবেশিত অবস্থায় রোগী যা মনে করতে পারে, স্বাভাবিক অবস্থায় তা সে মনে করতে পারে না। সুতরাং তিনি এমন একটি পদ্ধতির প্রয়োজন বোধ করছিলেন, যার সাহায্যে স্বাভাবিক অবস্থায় রোগীর অচেতন মনের বিষয়গুলো উদ্ঘাটন করা যায় এবং রোগীর কাছে তা ব্যাখ্যা করে দেয়া যায়। তাই সম্মোহন বা সংবেশনের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে ফ্রয়েড উদ্ভাবন করেন ‘অবাধ অনুষঙ্গ’ এবং ‘স্বপ্ন সমীক্ষণ’ পদ্ধতির। ১৮৯৮ সালে তিনি তার বিখ্যাত অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই ‘অবাধ অনুষঙ্গ’ এবং ‘স্বপ্ন সমীক্ষণ’ পদ্ধতির মাধ্যমে ‘সম্মোহন অভিভাবন’-এর সমস্যাগুলোর অনেকটা সমাধান হয়েছে। কিন্তু ‘সম্মোহন অভিভাবন’-এর কার্যকর দিকটির পূর্ণ প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়নি। এ বোধ ফ্রয়েডের শেষ জীবন পর্যন্ত বহাল ছিল।

অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে তিনি রোগীকে সম্পূর্ণ জাগ্রত ও স্বাভাবিক অবস্থায় তার মনের চিন্তাধারাকে অবাধে ব্যক্ত করতে বলেন। সাধারণতঃ একটি সোফায় বা আরাম কেদারায় রোগীকে শয়ন অথবা উপবেশন করতে বলা হয় এবং তার দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ রূপে শিথিল করতে বলা হয়। থেরাপিস্ট রোগীর দৃষ্টিরেখার বাইরে পাশের চেয়ারে বসে এসব মনোযোগের সঙ্গে শোনেন এবং প্রয়োজনীয় নোট নেন। শিথিল অবস্থায় রোগীর মনে যে স্বতঃস্ফুর্ত চিন্তাধারার উদয় হয়, সেগুলো তাকে অবাধে ও নির্দ্বিধায় বর্ণনা করতে বলা হয়, রোগী তার মনে যা আসে তাই বর্ণনা করতে থাকেন-যেমন তার স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনা, অনুভব। রোগী কোন রূপ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বা পাপ-পূণ্য বিচার বিবেচনা না করেই তার মুক্ত চিন্তাধারাকে ব্যক্ত করবে। রোগীর চিন্তা ভাবনাগুলো যতই ঘৃণ্য, অযৌক্তিক, অসঙ্গত বা অবান্তর হোক না কেন, ওগুলো রোগীকে হুবহু ব্যক্ত করে যেতে হবে। তার সকল বক্তব্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে বলে আগেই অবশ্য রোগীকে আস্থাজনক প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখতে হয়।

এরূপ অবাধ চিন্তাধারা ব্যক্ত করার সময় রোগীর অচেতন মনের কিছু উপাদান স্বাভাবিকভাবেই উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। থেরাপিস্ট লক্ষ করেন, কোনো বিষয় বর্ণনায় রোগী বাধা (resistance) বোধ করছেন। থেরাপিস্ট ধরে নেন রোগীর অচেতন মানসিক দ্বন্দ্বটির হদিস এখানেই পাওয়া যাবে। এখানেই তিনি তার অনুসন্ধানকে কেন্দ্রীভূত করেন। সাইকোথেরাপির সময় থেরাপিস্ট বুঝতে পারেন, রোগী থেরাপিস্টকে পেশাগত সম্পর্কের বাইরেও অন্য একটি সম্পর্কে সম্পর্কিত করতে চাইছে। রোগী থেরাপিস্ট-এর মধ্যে তার অতীত অভিজ্ঞতার অন্য কোনো ব্যক্তিত্বকে আরোপ করছে; যেমন পিতা, মাতা বা প্রেমাস্পদ। সাইকোথেরাপির ভাষায় এটি অধ্যারোপ/পাত্রান্তরণ (transference)। থেরাপিস্ট এটিও বুঝতে পারেন তিনি নিজেও রোগীর উপর তার নিজের অভিজ্ঞতার কাউকে আরোপ করছেন। এটি প্রতি-পাত্রান্তকরণ (counter transference) । থেরাপিস্ট তাদের পারস্পরিক সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করে রোগীর অতীত সম্পর্কের ধরন ও তার আচরণের ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করতে পারেন। তিনি মনঃসমীক্ষণের এই অভিজ্ঞতাকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব ও প্রতীকার্থের সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করেন। এভাবে তার মনে রোগীর ব্যক্তিত্বের বিকাশের বাধাগুলো সম্বন্ধে এবং রোগীর বর্তমান সমস্যাগুলোর গূঢ় অর্থ প্রসঙ্গে একটি অন্তর্দৃষ্টি জন্মায়। থেরাপিস্ট এ অন্তর্দৃষ্টির আলোকে রোগীর নিকট তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সমস্যা এবং এরই প্রকাশ বর্তমান সমস্যাসমূহের একটি ব্যাখ্যা (interpretation) হাজির করেন। ব্যাখ্যাটি রোগীর কাছে গ্রহণযোগ্য হলে রোগী তা গ্রহণ করেন। তখন উভয়ে মিলে এ থেকে উত্তরণের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। রোগী তার সমস্যাসমাধানে এসব প্রয়োগ করেন। এভাবে থেরাপির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।

উল্লেখ্য যে আমাদের মনের চিন্তা ভাবনাগুলো পরস্পর অনুষঙ্গবদ্ধ হয়ে থাকে। সেজন্যই আমাদের মনে এক চিন্তা থেকে আর এক চিন্তা উদিত হয় এবং এভাবেই আমাদের মনে একটি চিন্তাস্রোতের (train of thoughts) সৃষ্টি হয়। অচেতন মনের কিছু উপাদান অনুষঙ্গবদ্ধ হয়ে এই সচেতন চিন্তাধারার মধ্যে ঢুকে পড়ে। সাধারণ অবস্থায় অবশ্য ব্যক্তির অহম সচেতন চিন্তাধারাকে তীক্ষ্ণভাবে বিবাচন (censor) বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং অচেতন মনের অবাঞ্ছিত উপাদানগুলোকে শক্তিশালীভাবে অবদমন ও অবরুদ্ধ করে রাখে। সেজন্যই অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে রোগীকে ভাল-মন্দ বিচার বিবেচনা করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ রোগীর অহমের বিবাচন ক্রিয়াকে (ego) (ego censorship) শিথিল করার চেষ্টা করা হয়। ফলে নির্জ্ঞান মনের কিছু কিছু উপাদান রোগীর অবাধ বর্ণনার মধ্যে ব্যক্ত হয়ে পড়ে এবং চিকিৎসক রোগীর অচেতন মন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত লাভ করেন। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে এই ইঙ্গিতগুলো সম্পর্কে রোগীকে আরও চিন্তাধারা ব্যক্ত করতে বলা হয় এবং এ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এভাবে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য দীর্ঘদিন রোগীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই মনোসমীক্ষণমূলক চিকিৎসা প্রক্রিয়া দীর্ঘকালীন হয় এবং কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে তা তিন চার বছরও স্থায়ী হয়।

অবাধে ব্যক্ত চিন্তাধারা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসক রোগীর নির্জ্ঞান মন সমীক্ষণ করেন এবং রোগের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে তা রোগীর কাছে ক্রমান্বয়ে ব্যাখ্যা করেন। ব্যাখ্যাদানেরও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। নির্জ্ঞান মনের অবদমিত উপাদানগুলো স্বভাবতই রোগীর কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়। সুতরাং এগুলো উদ্ঘাটিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই রোগী উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ফলে বেশী মাত্রায় ব্যাখ্যা দিলেই তা রোগীর কাছে এমন পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে যে প্রদত্ত ব্যাখ্যা তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না এবং সে পুনরায় বিভিন্ন আত্মরক্ষা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। সেজন্যই মনোসমীক্ষণ চলাকালে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। রোগীর অহমের বর্তমান ধারণ শক্তি ও সহন শক্তি বিবেচনা করেই এককালীন ব্যাখ্যা দানের মাত্রা স্থির করা হয়। ক্রমানুসারে ব্যাখ্যা দেয়ার ফলে রোগী যতই প্রাথমিক স্তরের ব্যাখ্য উপলব্ধি করতে পারে, ততই তার অহম গভীরতর ব্যাখ্যা গ্রহণের উপযোগী হয়ে ওঠে। এই ব্যাখ্যা উপলব্ধি করার মাধ্যমেই রোগী অন্তর্দৃষ্টি (insight) লাভ করে এবং নিজেকে ও নিজের আচরণকে বুঝতে পারে। এ যাবৎ তার যে সব আচরণ ও মানসিকতাকে অজ্ঞাত অচেতন শক্তি নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেগুলোর ওপর ক্রমান্বয়ে তার সচেতন অহমের নিয়ন্ত্রণ এসে যায়। ফলে রোগী মনোবৈকল্যের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।

ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে যেমন বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ বিচ্ছিন্ন এবং বিচ্ছিন্ন অন্তর্জগৎ নিয়েই তত্ত্ব গড়া হয়েছে। তেমনি ফ্রয়েডীয় থেরাপিতেও থেরাপিস্টের নজর রোগীর অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতি, পরিবেশের প্রতি নয়। সুতরাং পরিবেশের পরিবর্তন থেরাপির উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্ত হয়ে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া। অন্য ভাষায় বললে, যন্ত্রণার বাইরের কারণটিকে দূর করা নয়, বরং যন্ত্রণার বোধটিকে ভোঁতা করে দেয়া।

ফ্রয়েডের সাইকোথেরাপি পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদী। সব রোগীও এতে অংশ নেয়ার উপযুক্ত নন। তাই পরবর্তীতে স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছে। এসবে ফ্রয়েড-তত্ত্ব ছাড়াও এই ধারার অন্য তত্ত্ব যুক্ত হয়েছে। এসব থেরাপিতে সমগ্র জীবনের চাইতে বর্তমান সমস্যার প্রতিই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা হয়। এসব পরিবর্তনের পরও ফ্রয়েডীয় ধারার সাইকোথেরাপি বর্তমানে সাইকোথেরাপির মূল ধারা নয়। ‘আন্তঃব্যক্তি সাইকোথেরাপি’ (interpersonal psychotherapy), ‘জ্ঞানাত্মক-আচরণবাদী থেরাপি’ (cognitive behavior therapy)-এসবই বর্তমানে বেশি ব্যবহৃত হয়। সাইকোথেরাপিতে ফ্রয়েডের পথিকৃতের ভূমিকা স্বীকৃত। তার উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রকরণ পরিবর্তিত রূপে বর্তমানেও ব্যবহার করা হয়।

স্বপ্ন বিশ্লেষণ (dream analysis)

স্বপ্ন সমীক্ষণ ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ। ফ্রয়েডীয় ধারার লেখায় একটি বড় অংশ স্বপ্ন সমীক্ষণ। রোগীর নির্জ্ঞান মন উদ্ঘাটনের জন্য ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশ্লেষণকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল রূপে ব্যবহার করেছেন। মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েড-ই প্রথম স্বপ্নের গুরুত্ব সম্বন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে স্বপ্নের উদ্দেশ্য ‘ইচ্ছাপূরণ’। যদিও আমাদের অভিজ্ঞতা, বেশির ভাগ স্বপ্নই ‘ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন’ নয়। এ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানও দেখিয়েছে, মানুষের স্বপ্নের সামান্য অংশই ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন।

ফ্রয়েড বয়স্ক মানুষের প্রায় সব স্বপ্নকেই অচেতন মনের অবদমিত ও নিষিদ্ধ কামনা বাসনা পূরণের প্রয়াস রূপে ব্যাখ্যা করেছেন (ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্ব দ্রষ্টব্য)। অবদমিত কামনা বাসনাগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ছদ্মরূপ ধারণ করে স্বপ্নে আত্মপ্রকাশ করে। স্বপ্নের এই ছদ্মরূপকেই ফ্রয়েড ব্যক্ত স্বপ্নরূপ বলেছেন এবং যে নিষিদ্ধ কামনা এই ব্যক্ত স্বপ্নরূপ সৃষ্টি করেছে, সেটাকে তিনি সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা বলেছেন। উল্লেখ্য যে ব্যক্তি ব্যক্ত স্বপ্নরূপকেই স্মরণ করে বর্ণনা করতে পারে এবং সুপ্ত স্বপ্নাকাংখা তার কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়। ব্যক্ত স্বপ্নরূপকে বিশ্লেষণ করে সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটন করার প্রক্রিয়াকেই ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশ্লেষণ বলেছেন। অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি প্রয়োগ করেই স্বপ্ন বিশ্লেষণ করা হয়। ব্যক্ত স্বপ্নরূপের বিশেষ বিশেষ উপাদানকে কেন্দ্র করে স্বপ্নদ্রষ্টাকে তার অবাধ চিন্তাধারা বর্ণনা করতে বলা হয়। এরূপ অবাধ চিন্তাধারা বর্ণনা করার সময় এর সাথে জড়িত হয়ে সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার কিছু অচেতন উপাদানও ইঙ্গিত আকারে ব্যক্ত হয়ে পড়ে। এই ইঙ্গিতগুলোকে বিশ্লেষণ করে এবং স্বপ্নে ব্যবহৃত কৌশলগুলোকে শনাক্ত করে একজন অভিজ্ঞ মনোসমীক্ষক স্বপ্নের প্রকৃত তাৎপর্য বা সুপ্ত স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা (অর্থাৎ অবদমিত কামনা বাসনা) উদ্ঘাটন করতে পারেন। চিকিৎসক স্বপ্নের এই প্রকৃত তাৎপর্য রোগীর কাছে ব্যাখ্যা করেন। যেহেতু স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে অচেতন মনের কামনা বাসনাগুলো সরাসরি উদ্ঘাটন করা যায়, সেহেতু তিনি নির্জ্ঞান মনে প্রবেশের জন্য স্বপ্নকে একটি রাজকীয় পথ রূপে অভিহিত করেছেন এবং স্বপ্ন বিশ্লেষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল রূপে তার চিকিৎসা পদ্ধতিতে তিনি ব্যবহার করেছেন।

ফ্রয়েডের মতে ইদ্-এর যে কামনাসমূহ সুপারইগোর নজরদারী এড়িয়ে মনের চেতন স্তরে উঠে আসতে পারে না, তারাই ঘুমন্ত সুপারইগোর নজর এড়িয়ে স্বপ্ন আকারে দেখা দেয়। এজন্য ফ্রয়েডের মতে ‘স্বপ্ন অচেতনে পৌছানোর সদর রাস্তা’। স্বপ্নেও ইদ্-এর যে কামনাটি প্রকাশিত হয় তা খোলামেলা নয়, ছদ্মবেশী। তাই প্রতিটি স্বপ্নেরই রয়েছে একটি ‘প্রকাশিত রূপ’ (manifest content) এবং একটি ‘প্রচ্ছন্ন মর্মকথা’ (latent content)। স্বপ্নের প্রকাশিত রূপে একটি কাহিনী একটি বাস্তব ঘটনার মতো ‘স্থান-কাল-পাত্র’ এ তিনটি বিষয় দ্বারা সমন্বিত রূপে প্রকাশিত হয় না। সেখানে এক ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনা জট পাকিয়ে যায়, স্থান ও কাল যায় উল্টেপাল্টে জট পাকিয়ে। স্বপ্নদর্শী তার স্বপ্নটিকে ভাষায় বর্ণনা করার সময়, স্বপ্নের ভুলে যাওয়া অংশ পূরণ করতে গিয়ে, কিংবা স্বপ্নের ঘটনার অসংলগ্নতা কিছুটা যুক্তিগ্রাহ্য করতে গিয়ে, নিজের অজ্ঞাতসারেই স্বপ্ন বর্ণনায় কিছু যুক্ত করে দেন। একে বলে অনুযোজনা (secondary elaboration)। ফ্রয়েডীয়রা তত্ত্বের আলোকে এগুলোকে গুছিয়ে নেন। যেমন, স্বপ্নে ভীতিজনক কোনো ব্যাপার দেখে ভয় হলো না; ভয় হলো সামান্য এক জিনিস দেখে। এখানে এক বিষয়ের ভয় অন্য বিষয়ে গিয়ে পড়ল। এ প্রক্রিয়াটি অভিক্রান্তি/স্থানান্তরণ (displacement)। হয়ত দেখলেন নিজের ঘরে বসে আছেন, কিন্তু আসবাবপত্র আপনার কর্মক্ষেত্রের। এখানে ঘর ও কর্মক্ষেত্র একসঙ্গে নির্দেশিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপণ/ ঘনীভবন (condensation)। এভাবে কাহিনীটি পুনর্নির্মাণের পরও যা দাঁড়ায় তা প্রতীকী মাত্র। প্রকাশিত রূপের প্রতীকগুলোর ব্যাখ্যার মাধ্যমেই শুধুমাত্র স্বপ্নের প্রচ্ছন্ন মর্মকথা বুঝা সম্ভব। স্বপ্নের কোনো প্রকাশিত রূপের প্রতীকী তাৎপর্য কি, এ সম্বন্ধেও ফ্রয়েডীয়দের নিজস্ব উদ্ভাবন রয়েছে-যা তাদের তত্ত্ব নির্দেশিত।

সাধারণভাবে স্বপ্নে দেখা প্রতীকগুলো ফ্রয়েডের মতে যৌনাঙ্গ বা যৌনকার্যের প্রতীক। দুনিয়ার যা কিছু লম্বা শক্ত জিনিস যেমন ছাতা, লাঠি, পেন্সিল, কলম-সবই পুরুষাঙ্গের প্রতীক। তীক্ষ্ণ ধারালো জিনিস, ছুরি, বর্শা, তলোয়ার; আঘাত করার ক্ষমতা আছে যা কিছুর যেমন বন্দুক পিস্তল-সবই পুরুষাঙ্গের ছদ্মবেশ। এরোপ্লেন, রকেট এগুলো অভিকর্ষকে তুচ্ছ করে আকাশে উঠতে পারে, সুতরাং এগুলোও ঐ গোত্রে পড়ে। দুনিয়ার সব মাছ ও সরীসৃপ এই আওতায় পড়ে। বাড়ি পুংলিঙ্গ, কিন্তু বাড়িতেই যদি তাক-বারান্দা ইত্যাদি থাকে তবে সেটা স্ত্রীলিঙ্গ। অন্যদিকে, শিশি বোতল, খানাখন্দ, বাক্সপেটরা, অলিগলি, গুহা, নৌকা, জাহাজ-স্ত্রীযৌনাঙ্গের প্রতীক। আপেল, পীচ ইত্যাদি বর্তুলাকার ফল নারীবক্ষের প্রতীক। ল্যান্ডস্কেপের দৃশ্য স্ত্রীঅঙ্গ নির্দেশক। আবার জটিল যন্ত্রপাতি পুরুষাঙ্গের প্রতীক। প্রতীকগুলো আবার সুবিধামতো অদলবদল করা যেতে পারে। প্রতীকগুলোর কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণের তো সম্ভাবনাই নেই; উপরন্তু এসবের পিছনে কোনো একক যুক্তিও কার্যকর নয়। ফ্রয়েডের লিবিডো-তত্ত্ব থেকে প্রতীকগুলো উদ্ভাবিত হয়েছে। আবার প্রতীকগুলোকে স্বপ্ন সমীক্ষণে ব্যবহার করে লিবিডো-তত্ত্ব প্রমাণ করা হয়। এটি বৃত্তাকার যুক্তির (circularity of logic) দোষে দুষ্ট।

স্বপ্নকে পুনর্নির্মাণের পর প্রতীকার্থের সাহায্যে যে ব্যাখ্যা দাঁড়াল তাই যথাযথ কি না, এর বক্তানিরপেক্ষ (objective) মাপকাঠি কী-এর উত্তর ফ্রয়েড-তত্ত্বে নেই। ফ্রয়েড স্বপ্নের প্রকাশিত রূপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, স্বপ্নের ঘটনাসমূহ বাস্তব ঘটনার তুলনায় অতিরিক্ত প্রসারিত বা সংকোচিত, বিকৃত বা স্থানান্তরিত-এসব পরিবর্তিত রূপে প্রকাশিত হয়। স্বপ্নের এ প্রপঞ্চমূলক (phenomenal) বর্ণনাটি যথাযথ। স্বপ্নের কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন স্বপ্ন ইচ্ছাপূরণ করে। এডলার বলেছেন স্বপ্ন বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের সহায়ক। ইয়ং বলেছেন স্বপ্ন মানসিক ভারসাম্য আনে। স্বপ্নের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তাদের এ ধারণাগুলো কোনো কোনো স্বপ্নের বেলায় সত্য; সব স্বপ্ন প্রসঙ্গে সাধারণ সত্য নয়। তাদের এসব ধারণা একত্র করলেও স্বপ্ন সংগঠনে ক্রিয়াশীল সাধারণ প্রক্রিয়ার কোনো হদিস মেলে না। স্বপ্নকে ঘুমন্ত মস্তিষ্কের বিশেষ প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করলেই কেবল এ সাধারণ প্রক্রিয়ার হদিস মিলতে পারে। স্বপ্ন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পাভলভ (IP Pavlov) প্রদর্শিত এ পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

প্রতিরোধ বিশ্লেষণ (analysis of resistance)

চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগী কর্তৃক কোন রূপ বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকেই প্রতিরোধ বলা হয়। ফ্রয়েডের মতে, কোন পীড়াদায়ক বিষয়কে অবদমন করার জন্যই মনোবৈকল্যের উৎপত্তি হয়। মনোসমীক্ষণের মাধ্যমে সেই পীড়াদায়ক বিষয়টিকে উদ্ঘাটন করা হয় এবং পীড়াদায়ক বিষয়টি চেতন স্তরে আসার উপক্রম করলেই রোগীর অহম এক অজানা ভয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ফলে অহম জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে বিভিন্ন প্রক্রিয়া বা কৌশল প্রয়োগ করে চিকিৎসার অগ্রগতিকে প্রতিহত করে। অবাধ অনুষঙ্গ চলাকালে রোগীর হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা, কোন প্রসঙ্গকে অবান্তর বা তাৎপর্যহীন বলে এড়িয়ে যাওয়া, কোন কিছুই মনে আসছে না বলা, চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎকারের তারিখ ভুলে যাওয়া বা বিলম্বে সাক্ষাৎকারের জন্য উপস্থিত হওয়া, প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রতিরোধের লক্ষণ। এছাড়া স্বীয় বক্তব্য বা আচরণ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে ও বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক কৌশল ব্যবহার করেও ব্যক্তি চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিরোধকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে রোগীকে বুঝিয়ে দেয়া। প্রতিরোধ তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেয়া হ’লে রোগীর চেতন অহমের যুক্তিপূর্ণ অংশটুকু ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তা চিকিৎসকের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে। চিকিৎসক প্রথমে প্রতিরোধ সম্পর্কে রোগীকে সজাগ করে তোলেন এবং কোথায় প্রতিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে তা রোগীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। কিভাবে রোগী বাধা দিচ্ছে বা কোন প্রক্রিয়া সে ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে পরবর্তী ধাপে রোগীকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। অতঃপর রোগী কেন এরূপ বাধার সৃষ্টি করছে (অর্থাৎ সে যে কিছু পীড়াদায়ক বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে), তা তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। সব শেষে প্রতিরোধের উৎস কোথায়, বা কোন পীড়াদায়ক বিষয়ের বিরুদ্ধে সে বাধা সৃষ্টি করছে, সে সম্পর্কে তাকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে ব্যাখ্যা ধাপে ধাপে দেয়া হয় এবং প্রথমে চেতন মনের কাছাকাছি থেকে শুরু করে ক্রমশঃ মনের গভীরতর স্তরের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মনোসমীক্ষণ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যাখ্যাদানের এটি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি।

অভিসঞ্চালন বিশ্লেষণ (analysis of transference)

ফ্রয়েড মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করার সময লক্ষ্য করেন যে রোগিনীরা (তার অধিকাংশ রোগীই মহিলা ছিলেন) প্রায়ই চিকিৎসকের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসকের প্রতি রোগিনীদের এরূপ আসক্তি ঘটার সঙ্গত কোন কারণ না থাকায় তিনি এ বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন এবং বিষয়টি নিয়ে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমেই তিনি অভিসঞ্চালন প্রক্রিয়ার ধারণা লাভ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, রোগিনীর ব্যর্থ প্রেম প্রকৃত প্রেমের পাত্র থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চিকিৎসকের ওপর আরোপিত হয়। ফ্রয়েড আরও লক্ষ্য করেন যে এরূপ আবেগের সঞ্চালন প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রেই ঘটে এবং রোগী ও চিকিৎসকের লিঙ্গগত পার্থক্যের ওপর এটা নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ রোগী ও চিকিৎসক উভয়ই পুরুষ বা উভয়ই স্ত্রীলোক হলেও রোগীর মধ্যে এরূপ আসক্তির সৃষ্টি হবে।

পূর্ববর্তী কোন পরিস্থিতিতে উদ্ভুত রোগীর আবেগ অনুভূতি যখন প্রকৃত পাত্র থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চিকিৎসকের ওপর আরোপিত হয়, তখনই সেটাকে অভিসঞ্চালন বলা হয়। চিকিৎসা চলাকালে রোগীর মনের অবরুদ্ধ আবেগের যখন বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখন ভাবাবেগে অন্ধ হয়ে সে চিকিৎসককেই তার আবেগের পাত্র রূপে মনে করে। ফলে চিকিৎসকের প্রতিই তার অবরুদ্ধ আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং অভিসঞ্চালনের উৎপত্তি হয়। চিকিৎসকের প্রতি রোগীর প্রকৃত আবেগ ও তার সঞ্চালিত আবেগের মধ্যে সহজেই পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। সঞ্চালিত আবেগ অস্বাভাবিক তীব্র রূপ ধারণ করে এবং এর মধ্যে শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে ওঠে। এছাড়া সঞ্চালিত আবেগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবাস্তব প্রকৃতির হয়। চিকিৎসকের পক্ষ থেকে কোন সাড়া না পেয়েও সে তার তীব্র আবেগ প্রকাশ করতে থাকে।

প্রেম, প্রীতি, ভালবাসার মত সৌকর্ষক আবেগগুলো যেমন সঞ্চালিত হয়, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরাগবোধের মত অপকর্ষক আবেগগুলোও তেমনি সঞ্চালিত হয়। যখন প্রেম, প্রীতি, প্রভৃতি সঞ্চালিত হয়, তখন সেটাকে সদর্থক অভিসঞ্চালন (positive transference) বলা হয়। যখন বিদ্বেষ ও বিরাগবোধ সঞ্চালিত হয়, তখন সেটাকে নঞর্থক অভিসঞ্চালন (negative transference) বলা হয়। ফ্রয়েডের মতে মাতা পিতার প্রতি শিশুর প্রাথমিক আবেগ অনুভূতিই এই সঞ্চালিত আবেগের মূল উৎস। শৈশবকালে মাতা পিতার সাথে শিশুর যে আবেগমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে (যেমন শিক্ষা জীবনে শিক্ষকের প্রতি, যৌবনে প্রেমিক প্রেমিকার প্রতি, কর্মজীবনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি, চিকিৎসাকালে চিকিৎসকের প্রতি, ইত্যাদি) সেই একই আবেগমূলক অবস্থার প্রতিফলন ঘটে। শৈশবকালে ঈডিপাস গৃঢ়ৈষা (edipus complex) ঘটার সময় মাতা পিতার প্রতি শিশুর যে আসক্তিমূলক ও আক্রোশমূলক আবেগের সৃষ্টি হয়, তা অসামাজিক হওয়ায় অবদমিত হয়ে থাকে। সেই অবদমিত আবেগগুলোই পরবর্তীকালে সদর্থক বা নঞর্থক অভিসঞ্চালনের সৃষ্টি করে।

যখন সদর্থক অভিসঞ্চালন ঘটে (সাধারণতঃ চিকিৎসার প্রথম দিকেই তা ঘটে), তখন রোগী চিকিৎসকের প্রতি আসক্ত হয় এবং সর্বতোভাবে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। এ পর্যায়ে রোগীর লক্ষণসমূহ অলৌকিকভাবে দূর হয়ে যায় এবং রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হয়। কিন্তু এই রোগমুক্তি প্রকৃত রোগ নিরাময় নয়। রোগের প্রকৃত কারণ তখনও অনুদঘাটিত থেকে যায়। সেজন্য ঐ পর্যায়ে চিকিৎসকের কর্তব্য হচ্ছে সঞ্চালিত আবেগের প্রকৃত উৎসকে বিশ্লেষণ করা, অভিসঞ্চালনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভুত রোগীর আচরণ ব্যাখ্যা করা এবং অভিসঞ্চালনের শক্তিকে যথার্থ গঠনমূলক কাজে প্রয়োগ করা।

সাধারণতঃ সদর্থক অভিসঞ্চালনের শেষেই নঞর্থক অভিসঞ্চালনের উৎপত্তি ঘটে। রোগীর তীব্র ভালবাসার প্রেক্ষিতে চিকিৎসকের অব্যাহত নিরপেক্ষতা ও নির্বিকারভাব রোগীর মনে ব্যর্থতাবোধের সৃষ্টি করে। এই ব্যর্থতাবোধ যত তীব্র হয়, ততই তার মনে চিকিৎসকের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমশঃ তার মনে অনুরাগের পরিবর্তে বিরাগ ও বিতৃষ্ণাবোধের সৃষ্টি হয়। এই বিতৃষ্ণা বোধ এত তীব্র হতে পারে যে, রোগী চিকিৎসা প্রচেষ্টা ও চিকিৎসককে ত্যাগ করতে পারে। সেজন্যই চিকিৎসক নঞর্থক অভিসঞ্চালন সম্পর্কে পূর্বেই রোগীকে সতর্ক করে রাখেন এবং যখনই এরূপ আবেগের অভিব্যক্তি ঘটে, তখনই তিনি সেদিকে রোগীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও নঞর্থক অভিসঞ্চালন যথাযথভাবে তাকে ব্যাখ্যা করে দেয়ার চেষ্টা করেন।

শৈশবকালের সমস্যাজনক ও অবদমিত আবেগগুলোই চিকিৎসা চলাকালে চিকিৎসকের প্রতি সঞ্চালিত হয় এবং এই সমস্যাজনক আবেগগুলোই রোগীর মনোবৈকল্যের মূল কারণ। সেজন্যই চিকিৎসকের প্রতি রোগীর এই অবাস্তব আবেগীয় সম্পর্ককে “অভিসঞ্চালন নিউরোসিস” নামেও আখ্যায়িত করা হয়। ফ্রয়েডের মতে শৈশবকালের সমস্যাজনক আবেগগুলোর বহিঃপ্রকাশ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অভিসঞ্চালন নিউরোসিসের নিরসন ঘটাতে পারলেই মনোবৈকল্যের স্থায়ী নিরাময় হবে। সেজন্যই ফ্রয়েড অভিসঞ্চালনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অভিসঞ্চালন ঘটার ফলেই একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর মাতা পিতার ভূমিকা নিয়ে তার শৈশব জীবনের আবেগমূলক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে তাকে সাহায্য করেন এবং এভাবে তার রোগমুক্তি ঘটাতে পারেন।

প্রসঙ্গক্রমে “পাল্টা অভিসঞ্চালন” (counter transference) এর কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। রোগীর অভিসঞ্চালনের প্রেক্ষিতে চিকিৎসকের নিজের অতীত জীবনের আবেগ অনুভূতি যদি রোগীর প্রতি সঞ্চালিত হয়, তবে সেটাকে পাল্টা অভিসঞ্চালন বলা হয়। পাল্টা অভিসঞ্চালন পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে নিষ্ফল করে দেয়। সুতরাং রোগীর ফলপ্রসূ চিকিৎসার জন্য পাল্টা অভিসঞ্চালনকে অবশ্যই রোধ করে রাখতে হবে। চিকিৎসকের নিজের মন আগেই সমীক্ষিত করা থাকলে, তিনি তার নিজের অযৌক্তিক আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন থাকেন এবং সেগুলোকে রোধ করে রাখতে পারেন। ফলে পাল্টা অভিসঞ্চালন ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। সেজন্যই মনোসমীক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দানের প্রথম ধাপেই শিক্ষার্থীদের মন সমীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে নেয়া হয়।

অবাধ অনুষঙ্গ ও স্বপ্ন বিশ্লেষণ, প্রতিরোধ ও অভিসঞ্চালন ব্যাখ্যা, প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগী যে জ্ঞান লাভ করে, তা সরাসরি রোগ নিরাময় করতে পারে না। রোগীর যথার্থ রোগ নিরাময়ের জন্য তার প্রাপ্ত জ্ঞানের সাথে উপযোগী আবেগের সংযোগ ঘটা প্রয়োজন। এজন্য রোগীকে নতুনভাবে আবেগমূলক মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া চিকিৎসা প্রক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টিকে বাস্তবে কাজে লাগাবার অনুশীলনও রোগীকে বার বার করতে হয়। ক্রমান্বয়ে আবেগের পুনর্শিক্ষণ ও বাস্তব পদক্ষেপ অনুশীলনের জন্যও রোগীকে দীর্ঘদিন চিকিৎসকের সাথে কাজ করতে হয়। মনোসমীক্ষণের ভাষায় এটাকে “কার্যকরকরণ প্রক্রিয়া” (working through) বলা হয়।

ফ্রয়েডের সমাজতত্ত্ব

সমাজতত্ত্বে ফ্রয়েড

“I think, the meaning of the evolution of civilization is no longer obscure to us. It must present the struggle between Eros and Death, between the instinct of life and the instinct of destruction, as it works itself out in the human species. This struggle is what all life essentially consists of, and the evolution of civilization may therefore be simply described as the struggle for life of the human species. And it is this battle of the giants that our nurse-maids try to appease with their lullaby about Haven…..”

“আমি মনে করি, সভ্যতার বিবর্তনের অর্থ এখন আর আমাদের কাছে অস্পষ্ট নয়। এটি অবশ্যই ইরোস এবং মৃত্যুর মধ্যে, জীবনের প্রবৃত্তি এবং ধ্বংসের প্রবৃত্তির মধ্যে সংগ্রামকে উপস্থাপন করে, যেমনটা মানব প্রজাতির মধ্যে দেখা যায়। এই সংগ্রামই মূলত সমস্ত জীবনকে নিয়ে গঠিত, এবং সভ্যতার বিবর্তনকে তাই কেবল মানব প্রজাতির জীবনের সংগ্রাম হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। আর এই দৈত্যদের লড়াই, যা আমাদের নার্স-মেইডরা আমাদেরকে হ্যাভেন সম্পর্কে তাদের ঘুমপাড়ানি গান দিয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা করে…..”

মনঃসমীক্ষণের জনক হিসেবে পরিচিত অস্টিয়ান চিন্তাবিদ সিগমন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) (১৮৫৬-১৯৩৯) ছিলেন মূলত একজন মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস যেরূপ খ্যাতি অর্জন করে পাঠক সমাজে বিশেষ অবস্থান করে নেন, ঠিক সেরূপ অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী সিগমন্ড ফ্রয়েড মনস্তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও ধর্মের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক প্রতিভারূপে আবির্ভূত হন এবং প্রায় একই আসনে পাঠক মনে স্থান করে নেন। মনোবিশ্লেষণের রাজত্বে এই প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সিগমন্ড ফ্রয়েড কালক্রমে তার অসাধারণ প্রতিভা দ্বারা মনোবিশ্লেষক, মনস্তত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার গবেষণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psycho-analysis Theory)। এখানে তিনি মানব মনের তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেন। যথা: সজ্ঞান স্তর (Conscious stage); অর্ধ-সজান স্তর (Unconscious stage) এবং নির্মান স্তর (Subconscious stage)। ফ্রয়েড বলেন, মানুষের যৌন চিন্তাই সকল কর্ম ও ব্যবহারের ভিত্তিভূমি। ফ্রয়েড তার আলোচনায় আদিম মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে টোটেমবাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। এছাড়াও তিনি আধুনিক সভ্যতার সংকট দেখে হতাশ হয়েছেন। তিনি মনে করেন, আধুনিক সভ্যতা মানুষের সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে তিনি মানবসমাজের সংকটের মনঃসমীক্ষণ রচনা করেন। ফ্রয়েড আরো উল্লেখ করেন, মানুষের মধ্যে রয়েছে জীবন প্রবৃত্তি (Life instinct) এবং মরণ প্রবৃত্তি (Death instinct)। জীবন প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে সৃষ্টির প্রেরণা যোগায় এবং মরণ প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে ধ্বংসের প্রবণতা সৃষ্টি করে। বস্তুত আধুনিক সমাজচিন্তায় ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

আধুনিক সমাজচিন্তার জগতে যে বিভিন্ন মতবাদগুলো বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে তার মধ্যে বিশ্ববরেণ্য মনঃসমীক্ষক সিগমন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার তত্ত্ব বর্ণনায় ‘Civilization and Its Discontents’ (১৯৩০) গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (From Sigmund Freud, Civilization and Its Discontents, trans. James Strachey (New York: Norton. 1961). Chapters 6 and 7. PP-64-80.)। এই গ্রন্থে তিনি মানবসভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তার মতবাদের প্রধান বিষয় হলো Sex is the determinant factor of society, অর্থাৎ, মানবসমাজ যৌনপ্রবৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন সভ্যতা মানুষের জন্য অভিশাপ হিসেবে অভিভূত হয়েছে। মানুষের সকল অশান্তির মূলে রয়েছে এ সভ্যতা। আর এ সভ্যতাই মানুষের সকল সুখ- শান্তি ও আনন্দ-অনুভূতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

সভ্যতার উদ্ভব ও পরিবার গঠন 

ফ্রয়েড এর মতে, মানুষ যখন সমষ্টিগতভাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াসে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হয় তখনই সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ফ্রয়েড বলেন, সমাজ বিকাশের অতি আদিম পর্যায়ে পুরুষজাতি নারী জাতির প্রতি তার কাম প্রবৃত্তি অনুভব করেছে। নারীকে সারাক্ষণ কাছে রেখে পুরুষরা যৌন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করেছে। যৌন প্রবৃত্তির তাড়না যেমন পুরুষরা অনুভব করেছে, তেমনি অসহায়বোধ ও সন্তানের নিরাপত্তার ধারণা পুরুষের সাথে নারীকে ঘনিষ্ঠ করতে সহায়তা করেছে। এমনিভাবে নারী ও পুরুষের ভালোবাসা এবং সন্তানদের প্রতি ভালোবাসাও স্নেহের মাধ্যমে পরিবার সৃষ্টি হয়েছে।

ফ্রয়েড বলেন, ভালোবাসা হলো কৃষ্টি বা Culture এর প্রধান উৎস। এ ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে সমাজের যথেষ্ট পরিবর্তন সূচিত হয়। সমাজের সাথে সাথে মানুষ পরিবারবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে এবং অস্তিত্ব রক্ষায় সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করে জাতিকে প্রগতির পথে পরিচালিত করে। তার মতে, সভ্যতা দু’টি উদ্দেশ্য সাধন করে – ১. প্রতিকূল অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষা করে, ২. পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে।

সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে গড়ে উঠে হৃদ্যতা, যা তাদের দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করতে প্রেরণা যোগায়। বাঁচার তাগিদে ধারণার পিছনে রয়েছে আত্মরক্ষার আকাঙ্ক্ষা। পক্ষান্তরে, ভালোবাসার চেতনা নিয়েছে সর্বজনীন রূপ। এ প্রত্যয়টিকে তিনি প্রকাশ করেছেন কবি গিলাবের অনুকরণে দু’টি প্রতীকের মাধ্যমে। যথাঃ 1. Hunger and 2. Love. -What makes the world? এখানে Hunger বা ক্ষুধা ব্যক্তিসত্তা এবং Love বা ভালোবাসা সর্বজনীন সত্তা সংরক্ষণের চেতনাতে তিনি জীবন প্রবৃত্তি হিসেবে সূচিত করেছেন। আর এর পাশাপাশিই বিরাজ করেছে ধ্বংস বা মরণ প্রবৃত্তি।

জীবন ও মরণ প্রবৃত্তি

ফ্রয়েড মানবসভ্যতার জীবনী শক্তি হিসেবে কাম প্রবৃত্তি বা লিবিডোকে উল্লেখ করেন। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা ভালোবাসা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা ইত্যাদি জীবন প্রবৃত্তির অন্তর্গত। আর হিংসা ধ্বংসাত্মক প্রবণতাই হলো মরণ প্রবৃত্তি। জীবন প্রবৃত্তি আর মরণ প্রবৃত্তির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য। মানুষের অবদমিত জীবন প্রবৃত্তি ও মরণ প্রবৃত্তি হতাশা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে যার মধ্য দিয়ে জাগ্রত হয় ধ্বংস চেতনা। ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ। জীবন প্রবৃত্তির সাথে মরণ প্রবৃত্তির বিরোধের ফলশ্রুতিতে সমাজ ও সভ্যতা নতুন নতুন স্তরে উপনীত হয়। এ সম্পর্কে ফ্রয়েড তার ‘Totem and Taboo’ (1913) ও ‘Moses and Monotheism’ (1934-1938) গ্রন্থ দু’টিতে বলেন, “আদি যুগে আদি পিতা বা গোত্রপতি পুত্রদের বঞ্চিত করে তারা নারীদের উপর একচ্ছত্র অধিকার ‘ভোগ’ করতো।” অবদমিত পুত্ররা যৌন তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পিতার প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠে এবং এক সময় পিতাকে হত্যা করে পিতার প্রতীক হিসেবে একটি Totem প্রাণীকে নিয়ে যায়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় নতুন সমাজচেতনা। Totem প্রাণীকে কেন্দ্র করে আদিম বিচ্ছিন্ন সমাজব্যবস্থার বদলে তারা প্রতিষ্ঠিত করে সুখবন্ধ সমাজজীবন। এ প্রসঙ্গে ফ্রয়েড বলেন, এমন করে মানুষ ধ্বংসের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রাণের তথা সভ্যতা বিকাশের প্রয়াস পেয়েছে।

অবাধ যৌনাচার ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তিগুলোতে বাধা প্রদানের মাধ্যমে সভ্যতা কর্তৃক মানুষকে বাধাদান

আদিম সমাজে মানুষের মূল যৌনাচার প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত ও প্রশমিত ছিল না। ফলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ কম ছিল। কিন্তু ক্রমাগত মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের ফলে আরোপিত হয় কতকগুলো অনুশাসন ও অনুমোদন। ফলশ্রুতিতে মানুষের যৌনাচার প্রবৃত্তির উপর বাধা আসে। সভ্যতার বিকাশ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও গোপনীয়তা আরোপিত হওয়ায় মানুষ হতাশাগ্রস্ত, কলহপ্রিয়, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। ফ্রয়েডের মতে, সমাজ অনুমোদিত কার্যাবলি এবং ব্যক্তির নিজস্ব মনের তাগিদের নিয়ত সংঘাত চলেছে।

ফ্রয়েড দেখিয়েছেন, আদিম ব্যবস্থা থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সমাজ সভ্যতায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনের পিছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো সুখ কামনা করা এবং দুঃখ এড়ানো। মানুষের সকল কাজের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এ সুখ লাভের কামনার মাধ্যমে। কিন্তু সুখ-দুঃখ জীবনের চালিকাশক্তি হলেও সুখ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সভ্যতা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তিগুলোকে অবদমিত করে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষ যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মধ্য দিয়েই সুখ আসে। কিন্তু সভ্যতাই নানা বিধিনিষেধের মাধ্যমে মানুষকে যৌন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং অবাধ সুখ কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সভ্যতা মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধেরও জন্ম দিয়েছে এবং তা ব্যক্তি জীবনকে দারুণ অসন্তোষের মধ্যে নিক্ষিপ্ত করে। ফ্রয়েড এর মতে, এ অসন্তোষ সৃষ্টির কারণ তিনটি- ১. দৈহিক নশ্বরতা, ২. প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতা, ৩. সামাজিক সম্পর্ক। উল্লিখিত কারণ তিনটির মধ্যে প্রথম দু’টি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষ এর কবলে পড়তে বাধ্য। কিন্তু শেষের কারণটি মানুষের সকল দুঃখ ও অসন্তোষের মূল কারণ। সামাজিক সম্পর্কের রীতিনীতি, আচার-আচরণ এবং আইন মানুষের ব্যক্তিচেতনাকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। ব্যক্তির বুদ্ধির চিন্তাকে তিনি সভ্যতা বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন।

সভ্যতা মানুষের শত্রুতা ও বৈরিতার জন্ম দিয়েছে যার জন্য যুদ্ধ ও সংঘর্ষ অনিবার্য। ফ্রয়েড মার্কস ও অন্যান্যদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তিই সমাজের পারস্পরিক শত্রুতার জন্য দায়ী নয়। কারণ আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, কিন্তু তখনও মানুষের মধ্যে অশান্তি, শত্রুতা এবং সংঘর্ষ ছিল। তার মতে, সভ্যতা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মানুষকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সত্য নয়। শিশু যা ইচ্ছে করে কিন্তু তা তার মায়ের জন্য করতে পারে না। মানুষ তার সুখের জগৎ বিশ্বাসকে নির্মাণ করতে চাইলেও আইনের জন্য তা পারে না।

সমাজতত্ত্বে ফ্রয়েডবাদের সার হচ্ছে –

  • ১. সভ্যতার সামাজিক প্রথা বা ঐতিহ্যকে বজায় রাখার ফলে স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছাকে সবলে দমন করতে হয়। ফ্রয়েডের মতে, সভ্যতা মানুষের ইচ্ছাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হতে সাহায্য না করে, বরং বাধা দেয়। ফলে ব্যক্তির সুখানুভূতি নষ্ট হয়ে যায়।
  • ২. ফ্রয়েড বলেন, মানুষ যতদিন পর্যন্ত আদিম স্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ততদিন পর্যন্ত মানুষ শান্তিতে ছিল। কিন্তু সভ্যতা সমাজের সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশের গোপনীয়তা আরোপিত হওয়ায় মানুষ অনিবার্যভাবে হতাশাগ্রস্ত, কলহপ্রিয়, আবেগপ্রবণ ও স্নায়ুবিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
  • ৩. উপরের আলোচনায় দেখা যায়, জীবন ও মরণ প্রবৃত্তি কাম বস্তু হতে বঞ্চিত হওয়ায় সভ্যতাই মানুষের মধ্যে সংঘাত ও অসন্তোষের মূল কারণ। ফ্রয়েডের মতে, সুখ আসে যৌন তৃপ্তি থেকে। তিনি বলেন, জীবন বৃত্তির অর্থাৎ যৌন তৃপ্তির অপরিপূর্ণতার ফলে সৃষ্টি হতাশা, মরণ প্রবৃত্তির ফলে সৃষ্টি বিদ্বেষ মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • ৪. সভ্যতা মানুষকে যৌন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে। অথচ এ যৌন প্রবৃত্তিই সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল। ফ্রয়েড বরেছেন, সমাজ কর্তৃক মানুষের মূল প্রবৃত্তিগুলো যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন সে হিংস্র হয়ে উঠে এবং সৃজনশীলতা সৃষ্টির ব্যাপারে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যার প্রমাণস্বরূপ যুদ্ধের ধ্বংসের মধ্যে নতুনের জন্ম হয়। একের সৃষ্টি অন্যের ধ্বংস।

ফ্রয়েডের পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায়, সভ্যতা মানুষের জন্য কতবড় অভিশাপ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষকে সুখী করার এবং স্বাধীনতা দানের পরিবর্তে নিক্ষেপ করেছে বিভিন্ন যন্ত্রণা ও দুর্দশার মধ্যে, তা কেবল শোধরানো সম্ভব যদি মানুষ আদিম অবস্থায় ফিরে যায়।

সমালোচনা

  • ১. ফ্রয়েড মূলত একজন মনোবিজ্ঞানী। সামাজিক বিষয়গুলোকে তিনি একপেশে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন।
  • ২. সভ্যতা বিকাশে যৌনাভূতির যে একক ভূমিকা তিনি দেখিয়েছেন তা নিরপেক্ষভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক সমালোচক বলেছেন, তিনি মানুষের যৌনকামনাকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ বিকাশের অন্যান্য মূল্যবান উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করেছেন।
  • ৩. অনেকে বলেছেন, তার বক্তব্যের সমর্থনে তিনি যে সমস্ত কাল্পনিক বা পৌরাণিক তথ্য প্রদান করেছেন তা যদি বিজ্ঞানের বিচারে বাতিল হয়ে যায় তাহলে সমস্ত তত্ত্বই ভ্রান্ত বলে ধরে নিতে হবে।

ফ্রয়েডের তত্ত্বের যথেষ্ট ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সমাজবিজ্ঞানে তার কর্তৃত্বের অস্বীকার করা যায় না। কেননা সমাজ ও মনের গভীরতম যোগসূত্র বিষয়টি মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতিতে বিচার করে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশকে একজন মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন। যৌন চরিত্র কিভাবে সমাজ ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তা থেকে সামাজিক পরিবর্তন ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটে তা ফ্রয়েডই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। যৌন জীবনের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র নির্ণয়ে তার ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞানকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। “The Civilization and Its Discontents’ গ্রন্থের অনুবাদক James Strachey লিখেছেন, “The civilization and its discontents is a work whose interest regards beyond sociology.” (সভ্যতা এবং এর অসন্তোষ এমন একটি কাজ যার পরিসর সমাজবিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে।) এ উক্তি থেকে তার এ তত্ত্বের গুরুত্ব সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপলব্ধি করা যায়। আধুনিক চিন্তাজগতে ফ্রয়েড যে মূল্যবান তত্ত্ব দিয়েছেন একথা অনেক চিন্তাবিদই স্বীকার করেছেন। সমাজবিজ্ঞানে তার যৌন সম্পর্কিত তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। পরিশেষে বলা যায়, তিনি বর্তমানের দুঃখকষ্টের জন্য আধুনিক সভ্যতাকে দায়ী করেছেন, কিন্তু এ দুঃখকষ্ট মোচনের জন্য সার্বিক প্রতিকার ও সুপারিশমালা প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছেন।

ফ্রয়েডের মূল্যায়ন

বিংশ শতাব্দীর বিতর্কিক ব্যক্তিদের মধ্যে ফ্রয়েডকে একজন অন্যতম ব্যক্তি রূপে গণ্য করা হয়। ফ্রয়েডের তত্ত্বের অভিনবত্ব যেমন সারা বিশ্বে মানুষের মনে সাড়া জাগিয়েছে, তেমনি তার তত্ত্ব তিক্ত সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছে এবং তার তত্ত্ব বিভিন্ন মহলে তীব্র ক্ষোভ ও বিরাগের সৃষ্টিও করেছে। তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টির দু’টো মূল কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ ফ্রয়েড মানুষের আত্মাভিমানে কঠোর আঘাত হেনেছেন। মানুষ নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব বলে ভাবে, নিজেদেরকে মনুষত্বের উচ্চ গুণে ভূষিত এক অনন্য ও অতুলনীয় সত্তা রূপে মনে করে। কিন্তু ফ্রয়েড মনুষত্বের এই সুদৃশ্য আবরণটিকে উন্মোচিত করে মানুষের কদর্য পশু রূপটিকে তুলে ধরেছেন। ফলে যে ব্যক্তি মানুষকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে মানুষের তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়তঃ ফ্রয়েডের তত্ত্ব মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত হেনেছে। প্রায় সকল ধর্মেই যে বিষয়গুলোকে নিষিদ্ধ ট্যাবু রূপে বর্জন করা হয়, সেগুলোকে ফ্রয়েড খোলাখুলি তার তত্ত্বে উপস্থাপন করেছেন। ফলে মানুষের চিরাচরিত ধর্মবোধ ও ধর্মীয় ধ্যান ধারণা ফ্রয়েডের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে এবং এদিক দিয়েও অনেকের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণেই ফ্রয়েড বিভিন্ন মহল থেকে প্রায় নির্মমভাবে সমালোচিত ও ধিকৃত হয়েছেন।

ফ্রয়েডের পদ্ধতির মূল্যায়ন 

ভৌত-জীব-নৃ এ-তিনটি বিজ্ঞানের কতকগুলো অপ্রমাণিত ও পরে পরিত্যক্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে ফ্রয়েড তার তত্ত্ব রচনা করেছেন। কাজেই যৌক্তিক বিচারে তা ভুল হতে বাধ্য। কিন্তু একটি তত্ত্বের প্রকৃতিটি বৈজ্ঞানিক কি না, তা তত্ত্বটির ভুল কিংবা সঠিকতা দ্বারা নির্ণিত হয় না। একটি তত্ত্বের প্রকৃতি বৈজ্ঞানিক কি না, তা নির্ণিত হয় তত্ত্বটি রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে কি না এর দ্বারা। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (theory) কোনো ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ কিংবা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে অন্তর্লীন সম্পর্ক বিষয়ে একটি বিবৃতি। একটি তত্ত্বপ্রস্তাব (hypothesis) রচিত হয় এসব ঘটনা পর্যবেক্ষণ/পরীক্ষণে (observation/experiment) প্রাপ্ত যাচাইযোগ্য তথ্য/উপাত্তের (fact/data) উপর ভিত্তি করে। তত্ত্বপ্রস্তাব থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে যেসব অনুপ্রস্তাব (inferance) গ্রহণ করা সম্ভব, যদি সেসব পর্যবেক্ষণ/পরীক্ষণে সত্য প্রমাণিত হয়, তবে তত্ত্বপ্রস্তাবটি তত্ত্বের মর্যাদা পায়।

এই নিরিখে ফ্রয়েডের তত্ত্ব বিচার করতে হবে। ফ্রয়েড সাইকোথেরাপির সময় অবাধ অনুসঙ্গে কথিত রোগীর স্মৃতি, চিন্তা, অনুভব, স্বপ্ন রোগীর পাশে বসে শুনতেন। থেরাপির পর তিনি তার শ্রুত বিষয়গুলোর মধ্যে যেসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হত তা টুকে রাখতেন। রোগীর ‘পাত্রান্তরিত’ আচরণকে বিশ্লেষণ করে তাও তিনি নথিভুক্ত করতেন। সুতরাং তার সংগৃহীত তথ্য কতটুকু তার পর্যবেক্ষণ, কতটুকু তার ব্যাখ্যা, তা নিশ্চিত হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় এসব তথ্য যাচাই করে দেখা। ফ্রয়েড তার সংগৃহীত তথ্য থেকে কিভাবে তার তত্ত্বে পৌঁছেছেন তার বর্ণনা দেননি। তত্ত্ব থেকে কিভাবে অনুপ্রস্তাব টানা যাবে এবং সেসব কিভাবে যাচাই করা যাবে, সেসবও তার লেখায় অনুপস্থিত। ফ্রয়েডীয়রা, যেসব তথ্য থেকে ফ্রয়েড তত্ত্ব রচনা করছেন, সে সবকেই তত্ত্বের প্রমাণ হিসাবে হাজির করতে চান। এটি বৃত্তাবদ্ধ যুক্তির দোষে দুষ্ট। কাজেই পদ্ধতিগত বিবেচনায় ফ্রয়েড-তত্ত্ব কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়।

ফ্রয়েড-তত্ত্ব বিজ্ঞান সম্মত না হলেও মনোবিজ্ঞান বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিজ্ঞানের প্রতিটি মৌলিক শাখা বিকাশেরই তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমটি দর্শনমূলক বা অধিবিদ্যক (metaphysical), দ্বিতীয়টি গুণাত্মক পর্যবেক্ষণমূলক (qualitative observational), তৃতীয়টি পরিমাণাত্মক পরীক্ষামূলক (quantitative experimental) । মনোবিজ্ঞান এখন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরে ক্রিয়াশীল। তাই এখন ফ্রয়েডের অধিবিদ্যক তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজন নেই। এজন্য ব্রিটিশ Oxford Textbook of Psychiatry ফ্রয়েড-তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না বলে সাহিত্য হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে সাহিত্য যেমন মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি যোগায়, ফ্রয়েড-তত্ত্বও তাই। বিজ্ঞানের তত্ত্ব যেমন ঘটনার কার্যকারণকে বিবৃত করে, এটি এমন নয়। অন্যদিকে আমেরিকান Kaplan & Sadock’s Synopsis of Psychiatry ফ্রয়েড প্রবর্তিত মনঃসমীক্ষণ ধারাটিকে ‘Science of Psychoanalysis’ নামে অভিহিত করে। কিন্তু প্রচলিত বিজ্ঞানের সঙ্গে এই বিশেষ বিজ্ঞানটির সম্বন্ধ কি তা ব্যাখ্যা করে না। ফ্রয়েড-তত্ত্বের প্রভাব তার উৎপত্তিস্থল ইউরোপ থেকে আমেরিকাতেই বেশি বিস্তৃত হয়েছিল। American Psychiatric Association-এর মানসিক রোগের শ্রেণিবিভাগ সংক্রান্ত বই Diagnostic and Statistical Manual-এর প্রথম দুটি সংস্করণের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল ফ্রয়েড-তত্ত্ব। কিন্তু এটি বাস্তবে কর্মোপযোগী না হওয়ায় তৃতীয় সংস্করণ থেকে ফ্রয়েডবাদের পরিবর্তে এর ভিত্তি হয় অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism)। পরবর্তী সংস্করণগুলিতেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

ফ্রয়েড যখন তার সাইকোথেরাপি শুরু করেন, তখন মানসিক রোগের কোনো কার্যকর ভৌত চিকিৎসা (যেমন, ঔষধ, ECT) ছিল না। কিন্তু ১৯৫০ এর দশক থেকে ভৌত চিকিৎসার সুযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ভৌত প্রণালীই মনোরোগ চিকিৎসায় প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। সাইকোথেরাপিতেও বিভিন্ন তত্ত্বভিত্তিক সাইকোথেরাপি চালু হয়েছে। ফলে বর্তমানে মনোরোগ চিকিৎসায় ফ্রয়েড-তত্ত্বের স্থান প্রান্তীয়। এখনো সারগ্রাহী (eclectic) একাডেমিশিয়ানগণ মনে করেন ফ্রয়েড-তত্ত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। কোনো গবেষক তার তত্ত্ব রচনায় ফ্রয়েড-তত্ত্ব থেকে কোন অন্তর্দৃষ্টি পেতেও পারেন। কিন্তু তার তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে তাকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে তত্ত্ব রচনা করতে হবে। ফ্রয়েড প্রথম জীবনে বৈজ্ঞানিক ধারার গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সুতরাং তার তত্ত্ব যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হয়ে উঠেনি, এটা তিনি জানতেন। তবু তিনি যে আমৃত্যু এ কাজে নিয়োজিত রইলেন, এর সমর্থনে তার যুক্তি, ‘আমি মনে করি, সৃষ্টিশীল কল্পনা ছাড়া মনোবিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের বিকাশ হতে পারে না। তাই আমি এইসব সৃষ্টিশীল কল্পনার খেলা খেলেছি, যাতে নিরন্তর গঠনমূলক সমালোচনার মধ্য দিয়ে আসল সত্যটা বেরিয়ে আসে।’ কিংবা, ‘মানসিক ক্ষেত্রটিকে জৈবিক ভিত্তিহীন, বায়ুতে ভাসমান বিষয় হিসাবে রেখে দেয়ার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার এ বিশ্বাসটুকু ছাড়া কোনো তত্ত্বীয় বা চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান নেই। কাজেই আমাকে এভাবে এগোতে হয়েছে, যেন আমার সামনে শুধু মানসিক ক্ষেত্রই রয়েছে।’ ফ্রয়েডের সাফাইটি আংশিক সত্য। কারণ, ফ্রয়েডের তত্ত্ব রচনার কালেই, পাভলভ মস্তিষ্কের উচ্চতর ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে তার গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন। ফ্রয়েড যে অচেতন মানসিক প্রেষণাকেই মানুষের প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, তার পিছনে ক্রিয়াশীল জার্মান দর্শনের একটি ধারা কাজ করেছিল। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে যে তিনি তত্ত্ব রচনায় অগ্রসর হয়েছেন, তার পেছনেও একটি জার্মান ভাবাদর্শ ক্রিয়াশীল। সেটি ব্যাখ্যাতত্ত্ব বা Hermeneutic। সে ধারায় বলা হয়, কার্যকারণ সম্পর্ক না পাওয়া গেলে, সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তি দিয়ে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করতে হবে।

ফ্রয়েডের প্রয়োগের মূল্যায়ন 

মানসিক রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে ফ্রয়েড তত্ত্ব রচনা করলেও, তার তত্ত্বকে তিনি প্রয়োগ করেছেন মানুষের প্রাত্যহিক আচরণ থেকে শুরু করে ধর্মতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রতিটি ক্ষেত্রেই। ব্যক্তিমনের কার্যপ্রণালি একবার ঠিক করার পর, তিনি শুধু এর মাধ্যমে সমস্ত মানবিক বিষয়াবলীকে ব্যাখ্যার প্রয়াস পেয়েছেন। চির অচেতনস্থিত অন্ধ এষণাই ব্যক্তির চালিকাশক্তি, সমাজ ব্যক্তির বৈরী, অচেতন সচেতনের দ্বন্দ্ব উদ্গতির মাধ্যমেই সভ্যতার উদ্ভব-এই হচ্ছে তার প্রত্যয় কাঠামো।

যুদ্ধের পেছনে ব্যক্তির মনস্থিত দ্বন্দ্বের বাইরে, কোনো কারণই তিনি দেখতে পান না। এভাবে ফ্রয়েড মানুষের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আশাবাদী হতে পারেন না। কারণ মানুষের চালিকাশক্তি অচেতন এষণা এবং সমাজের দ্বন্দ্ব সনাতন-অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে। তার ফলশ্রুতিতে দুটি সম্ভাবনা প্রকট, হয় সমাজের চাপে ব্যক্তি নিউরোটিক হবে, নতুবা ব্যক্তির আগ্রাসী ভূমিকায় সমাজ লণ্ডভণ্ড হবে। একটিমাত্র ক্ষীণ আশার রেখা আছে, এ দ্বন্দ্বকে উদ্গতির (sublimation) মাধ্যমে সভ্যতা নির্মাণে বা রক্ষায় নিয়োজিত করা। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন প্রতিটি ব্যক্তির মনঃসমীক্ষণ। কিন্তু ফ্রয়েডই স্বীকার করেছেন, এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তিনি Civilization and Its Discontents বইয়ে লিখেছেন, ‘সামাজিক উদ্বায়ুতার প্রখরতম বিশ্লেষণ-ই বা কী কাজে লাগবে, যখন সমাজকে সে থেরাপি নিতে বাধ্য করতে পারে, এমন ক্ষমতা কারো নেই।’ আর মনঃসমীক্ষণও কি খুব কার্যকর দাওয়াই? ফ্রয়েডের জীবনীকার এবং আন্তর্জাতিক সাইকোএনালাইটিক সমিতির একসময়ের সভাপতি আর্নেস্ট জোন্স হতাশ কণ্ঠেই স্বীকার করেছেন, ‘পক্ষপাতহীন পর্যবেক্ষক এই বিচলিতকারী তথ্য দ্বারা আহত না হয়ে পারেন না যে, বুদ্ধির ব্যবহারের ক্ষেত্রে, মনঃসমীক্ষক ও সমীক্ষিত ব্যক্তির সঙ্গে অসমীক্ষিত ব্যক্তিদের পার্থক্য বিস্ময়করভাবে নগণ্য।’

ফ্রয়েড যখন তার তত্ত্বকে মানবসমাজের ইতিহাস ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন, তখনও তা হতাশাব্যঞ্জক। অবশ্য নৃতত্ত্ববিদগণ তাদের গবেষণায় ফ্রয়েড বর্ণিত এ ব্যাখ্যার সমর্থন পান না। নৃতত্ত্বে ফ্রয়েড-তত্ত্বের প্রয়োগ সম্বন্ধে নৃতাত্ত্বিক মেলিনস্কি (Malinowski) মন্তব্য করেছেন, ‘ফ্রয়েড তার খুবই আকর্ষণীয় কিন্তু উৎকাল্পনিক তত্ত্বে, একটি আদিম নরগোষ্ঠীকে (উনবিংশ শতাব্দীর) ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সব ধরনের প্রবণতা, অসমন্বয়তা এবং বদমেজাজে সাজিয়ে, প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন।’ লিন্টন (Linton), মীড (Mead) প্রমুখ কৃষ্টিবাদী সাইকোএনালিস্টরা ফ্রয়েডের বহু মত খণ্ডন করেছেন। আদিম গোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা করে অনেক মূল্যবান তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু তারা ফ্রয়েডীয় প্যারাডাইমটি ত্যাগ করতে পারেননি। তাই তাদের গবেষণা সীমিত রয়েছে শিশুদের স্তন্যপান, স্তন্যপান ত্যাগ, মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস ইত্যাদি কয়েকটি সামাজিক ক্রিয়ার মধ্যে। এতে তাদের তথ্যের উপযোগিতা হ্রাস পেয়েছে, সামাজিক নৃতত্ত্ব বা মনস্তত্ত্বের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব গড়ে উঠেনি।

ফ্রয়েড সামাজিক সংহতি কিংবা সামাজিক সংগঠনকে ব্যাখ্যা করেছেন ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব দিয়ে। এজন্য তিনি যেমন শিশুর বিকাশ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছেন, তেমনি ব্যবহার করেছেন তার কল্পিত, মানুষের আদিম ইতিহাসকে। তার মতে আদিম গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীপতি পিতাকে তার পুত্ররা ভয় করত, কারণ তিনি তার পরাক্রমে দলকে রক্ষা করেন। কিন্তু তাকে ঘৃণা করত, কারণ তিনি দলের নারীদেরকে একা ভোগ করেন। পিতার প্রতি পুত্রদের ভয় ও ঘৃণা পুত্রদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষকে কাটিয়ে একাত্ম হতে সাহায্য করে। পিতার প্রতি ঘৃণাপ্রসূত আক্রমণাত্মক মনোভাবকে তারা পিতার ভয়ের জন্য অবদমিত করতে বাধ্য হয়। তারপর তারা প্রতিক্রিয়া গঠনের মাধ্যমে পিতার প্রতি ঘৃণাকে ভালোবাসায় রূপান্তর করে। এরপর এই রূপান্তরিত ভালোবাসাকে পিতার উপর অভিক্ষেপ করে এবং সচেতনভাবে অনুভব করে যে, পিতা সব সন্তানকে সমভাবে ভালোবাসেন। তাই তাদেরও পিতাকে ভালোবাসা উচিত। আদিম গোষ্ঠীতে এভাবেই অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পরিবর্তে সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমান সমাজে গোষ্ঠীর স্থান নিয়েছে পরিবার এবং দলপতির স্থান নিয়েছে পিতা। কিন্তু গোষ্ঠীর দলপতি ও সদস্যদের মধ্যে ক্রিয়াশীল মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া পরিবারের পিতা ও পুত্রদের মধ্যেও কার্যকর। শিশুর বিকাশে ইডিপাস কমপ্লেক্সে তা বিধৃত। শিশু সাবালক হওয়ার পরও তার শৈশবে গঠিত মনের কাঠামোটি বজায় থাকে। সুতরাং সমাজের সদস্য হিসাবে সে নেতার প্রতি ভয় ও ঘৃণার অনুভূতিকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করে নেতাতেই তা অভিক্ষেপ করে। অর্থাৎ নেতাকে আদর্শমণ্ডিত করে তোলে। অন্যদিকে নেতার প্রতি ভয় ও ঘৃণা সমাজের সদস্যদেরকে পারস্পরিক বিদ্বেষ ভুলে একাত্ম হতে সহায়তা করে। এ ব্যাপারে তাদেরকে আরো সাহায্য করে, নেতা তাদের সবাইকেই সমভাবে ভালোবাসেন এমন আদর্শমণ্ডিত বিশ্বাস। যদিও নেতা আদর্শের ব্যাপারে নির্বিকার এবং সমাজের সদস্যদের ঘৃণাই করেন। ফ্রয়েডের ধারণায়, নেতা সম্পূর্ণ স্বমহিমায় বিরাজমান এক সত্তা, আর তার অধিকার মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই সদস্যদের মধ্যে গড়ে উঠে সামাজিকতা ও সভ্যতার বোধ।

ফ্রয়েডের যুক্তিতে একজন আদর্শ নেতা তার প্রিয় দার্শনিক নীৎশে-র সুপারম্যানের মতো এক সত্তা। ফ্রয়েডের ভাষায়, ‘তিনি হতে পারেন কর্তৃত্বপরায়ণ প্রকৃতির, চরম আত্মরতিসম্পন্ন (narcisasistic), আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীন। তিনি জানেন ভালোবাসা আত্মরতিতে লাগাম টেনে দেয়। তাই নেতার কাউকে ভালোবাসার প্রয়োজন নেই।’ কিন্তু নেতাকে আদর্শমণ্ডিত করা ছাড়া (যা প্রকৃতপক্ষে একটি অধ্যাস বা illusion মাত্র) কোনো সংগঠন টিকতে পারে না। অর্থাৎ সামাজিক সংহতির মূলে রয়েছে একটি সর্বজনমান্য পিতৃ-চরিত্র। সামাজিক ঐক্য ও সামাজিক নেতৃত্বের মূলসূত্র এটি। ফ্রয়েড লক্ষ করেন, তার সমসাময়িক সমাজে ঐক্য বিধায়ক ও নেতৃত্ব দানকারী এমন পিতৃ-চরিত্র নেই। এ সমাজের সদস্যরা শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে একাত্মবোধে সংগঠিত। ফ্রয়েড মনে করেন সমসাময়িক সমাজের অসন্তোষের অন্যতম কারণ এটি। একটি পিতৃ-চরিত্রের প্রয়োজনকামী তত্ত্বের ফল অচিরেই ফলল; তবে তত্ত্বরচয়িতার জন্য বুমেরাং হয়ে। পিতৃ-চরিত্র ‘ফুয়েরার’ হিটলারের উত্থান হল। এ পিতৃ-চরিত্রর মাধ্যমে সংগঠিত সমাজ ফ্রয়েডকে তার আজন্মের বাসস্থান থেকে বিতাড়িত করল, তার চার বোনকে হত্যা করল।

সমালোচনার মুখে ফ্রয়েডের পক্ষে কিছু ডিফেন্স

ফ্রয়েড বিভিন্নভাবে সমালোচিত হলেও তার অনেক ধারণাই কিন্তু জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রতিফলিত হয়েছে। মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফ্রয়েডের ধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। তবুও পণ্ডিত মহল ফ্রয়েডের তীব্র সমালোচনা করে। মনে হয় যে ফ্রয়েড পরবর্তী পণ্ডিতগণ ফ্রয়েডের তত্ত্বকে নাকচ করার মাধ্যমেই নিজেদের পাণ্ডিত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। ফ্রয়েডের তত্ত্ব সম্পর্কে যে সব সমালোচনা সাধারণতঃ করা হয়, সেগুলো নিম্নে পর্যালোচনা করা হ’ল –

  • ফ্রয়েড মূলতঃ অস্বভাবী ব্যক্তিদের ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে স্বাভাবিক মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তত্ত্ব দিয়েছেন। সুতরাং তার তত্ত্বের পদ্ধতিগত বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। একথা সত্য যে ফ্রয়েড চিকিৎসক রূপে অস্বভাবী ব্যক্তিদের চিকিৎসা করতে গিয়ে যে সব তথ্য পেয়েছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার মতবাদ প্রণয়ন করেছেন। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, ফ্রয়েড অস্বভাবী ব্যক্তিদের বিকাশধারা অনুসন্ধান করে কোথায় ত্রুটি ঘটেছে, তা শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। আর বিকাশমূলক ত্রুটি যদি শনাক্ত করা যায়, তবে ত্রুটিমুক্ত অবস্থা কিরূপ হবে, সে সম্পর্কে ধারণা গঠন করাটা বোধ হয় একবারেই অযৌক্তিক হবে না। এছাড়া ত্রুটিমুক্ত বা রোগমুক্ত হওয়ার পরও তিনি ব্যক্তির আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং ব্যক্তির স্বাভাবিক অবস্থা সম্পর্কেও তিনি কিছু ধারণা লাভ করেছেন। সুতরাং ফ্রয়েডকে সমালোচনার সময় এ দিকটিও বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে স্বভাবী ও অস্বভাবী আচরণের মধ্যে গুনগত পার্থক্য নেই, পার্থক্য মূলতঃ পরিমাণগত। সুতরাং অস্বভাবী আচরণ অধ্যয়ন করে স্বভাবী আচরণ সম্পর্কেও মৌলিক কিছু ধারণা লাভ করাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়। এখানে আরও উল্লেখ্য যে রোগীদের মন বিশ্লেষণ করা ছাড়াও ফ্রয়েড নিজের মনকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং রোগীদের চিকিৎসার সময় প্রাপ্ত প্রতিটি তথ্যকে তিনি নিজের মন বিশ্লেষণ করে যাচাই করে নিয়েছেন।’ আরও উল্লেখ্য যে অনেক সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মনও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে সমস্ত চিকিৎসক মনোসমীক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, তাদের প্রত্যেকের মন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, অনেক সুস্থ মানুষের মন বিশ্লেষণ করার মাধ্যমেও তার তত্ত্বের সপক্ষে উপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে।
  • ফ্রয়েডের তত্ত্বে যে সর্বকামবাদ (pan-sexualism) পরিলক্ষিত হয়, সেটারও কঠোর সমালোচনা করা হয়। মানুষের প্রায় সব আচরণকেই ফ্রয়েড যৌন তাড়নাপ্রসূত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফ্রয়েড যৌনতা শব্দটিকে বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। যে কোন সুখদায়ক কার্যকলাপকেই ফ্রয়েড যৌনমূলক বলে অভিহিত করেছেন। বই পড়া, গান শোনা, ভ্রমন করা, প্রভৃতি কাজগুলো যদি ব্যক্তির কাছে সুখদায়ক হয়, তবে তা যৌনমূলক বলে ফ্রয়েড আখ্যায়িত করবেন। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে ফ্রয়েড যৌনতার ধারণাটিকে বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। কেন তিনি যৌনতাকে এই ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন, সে ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। কামশক্তি বিকল্প কোন নিষ্কাম বস্তু বা ক্রিয়ায় অপস্থাপিত হয়ে আসক্তি গঠন করে বলেই তা সুখদায়ক হয়ে ওঠে এবং সেজন্যই ওটাকে যৌনমূলক বলা হয়। এ কথা অবশ্য অনস্বীকার্য যে ফ্রয়েড প্রদত্ত এই ব্যাখ্যাকে কোন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির দ্বারা যাচাই করা যায় না। তবে তার তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সব রকম সুখদায়ক কার্যকলাপকেই যৌনমুলক বলার কিছু যৌক্তিকতা পাওয়া যায়।
  • ফ্রয়েডের জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গিও পণ্ডিত মহলে সমালোচিত হয়েছে। ফ্রয়েড মানুষের আচরণকে কিছু জৈবিক বৈশিষ্ট্য ও সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন এবং মানুষের সামাজিক দিকটিকে উপেক্ষা করেছেন। তবে ফ্রয়েড মানুষের সামাজিক দিকটিকে একেবারে উপেক্ষা করেছেন বলাটা ঠিক নয়। তার প্রদত্ত অতি-অহমের ধারণায় মানুষের সামাজিক দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। অতি-অহমই সমাজের প্রতিভূ রূপে মানুষের আচরণকে প্রতি মুহূর্তে প্রভাবিত করছে। তার তত্ত্ব অনুযায়ী প্রবৃত্তিগত শক্তির অপস্থাপনের ফলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার যে উন্নতি ঘটছে, সেটাও মানুষের সামাজিক দিকেরই পরিচায়ক। ফ্রয়েড এ কথাও বলেছেন যে, মানুষের চরিত্র অসীমভাবে পরিবর্তনশীল। প্রবৃত্তি উপজাত (instinct derivatives) গঠনের মাধ্যমে মানব চরিত্রে অসীম পরিবর্তন এসে যায়। তবে কিভাবে মানুষের প্রাণীসত্তা এই সামাজিক পরিমণ্ডলের সংস্পর্শে এসে স্বতন্ত্র একটি সামাজিক সত্তায় পরিণত হয় সে বিষয়ে অবশ্য ফ্রয়েডের তেমন বিশদ বক্তব্য নেই। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরাই মানুষের এই সামাজিক দিকের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তারাই বিভিন্ন সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, সমাজ ও সংস্কৃতি মানব চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
  • ফ্রয়েডের প্রবৃত্তি তত্ত্বও আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মতে মানব প্রকৃতি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল এবং মানব আচরণ এত জটিল ও বহুমাত্রিক যে এটাকে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রবৃত্তির ছাঁচে ফেলে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্যই আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা প্রবৃত্তি তত্ত্বের পরিবর্তে প্রেষণাতত্ত্বের অবতারণা করেছেন। বহুবিধ সহজাত ও অর্জিত, জৈবিক ও সামাজিক প্রেষণাবলীর একটি জটিল বিন্যাস মানব আচরণকে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এদিক দিয়ে বিচার করে দেখলে ফ্রয়েডের প্রবৃত্তি তত্ত্ব সত্যই অচল হয়ে পড়ে। তবে এ কথা এখানে বলা প্রয়োজন যে ফ্রয়েড মানব প্রকৃতির কিছু মৌলিক দিক উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। ফ্রয়েড মানুষের সেই আদি ও মৌলিক দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যার ওপর ভিত্তি করে সভ্য ও মার্জিত মানুষের অর্জিত প্রেষণাতন্ত্র গড়ে ওঠে। মানুষের আদি মৌলিক দিকটি অকৃত্রিম ও অপরিবর্তনীয়, তবে তা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। অপরদিকে মানুষের অর্জিত প্রেষণাতন্ত্র কৃত্রিম ও পরিবর্তনশীল এবং তা প্রকাশ্য অবস্থায় থাকে। প্রেষণাতন্ত্রকে কৃত্রিম বলা হচ্ছে এই অর্থে যে এগুলো মানুষ নিজেরাই নিজেদের জীবন যাপন প্রণালী থেকে গড়ে তুলেছে। প্রেষণাতন্ত্রকে কৃত্রিম বলা হলেও অবশ্য এগুলো সম্পূর্ণ বাস্তব এবং এগুলো সক্রিয়ভাবে মানব আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং আধুনিক মনোবিজ্ঞানে প্রেষণতন্ত্রের গুরুত্ব কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মানুষের আদি ও অকৃত্রিম দিক নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তবে ফ্রয়েডের তত্ত্বকে একেবারে বাতিল করাটা বোধ হয় সঙ্গত হবে না।
  • মানুষের সুকুমার দিকগুলোকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে ফ্রয়েড শুধু মানুষের পশুসুলভ দিকটিকে তার তত্ত্বে তুলে ধরেছেন। এটাও ফ্রয়েডের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ। উল্লেখ্য যে মানবীয় মনোবিজ্ঞানীরা (Humanistic Psychologists) মানুষের মঙ্গলময় সুকুমার ও সৃজনশীল দিকটির ওপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে অবশ্যই সু-বৃত্তি ও কু-বৃত্তি উভয় দিকই রয়েছে। উচ্চ বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন মানুষ অবশ্যই তাদের সু-বৃত্তিগুলোর অনুশীলন করে এগুলোর বিকাশ ঘটাবে এবং তাদের সৃজনশীল শক্তিকে মানব কল্যাণে নিয়োগ করবে। এটাই হবে সভ্য মানব জীবনের অনুসরণীয় আদর্শ। সভ্য জগতের প্রায় সকল মানুষই এরূপ আদর্শের কথা বলে; তবে বাস্তবে কিন্তু সীমিত সংখ্যক মানুষের আচরণেই এরূপ আদর্শের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে এবং আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটার দৃষ্টান্ত বোধ হয় নেই বললেই চলে। অর্থাৎ মানুষের অধিকাংশ আচরণই তার জৈবিক তাড়নার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে মানুষ সামাজিক জীব রূপে তাদের পশুসুলভ নগ্নতাকে সুদৃশ্য সামাজিক আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে পারে। এ বিষয়ে আরও বলা যায় যে মানুষের সু-বৃত্তিগুলোর এমন কোন শক্তি নেই, যা দিয়ে কু-বৃত্তিগুলোকে দমন করে রাখা যায়। সকলের ক্ষেত্রে না হ’লেও, অনেকের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। মানুষের নিজস্ব কোন দিক যদি তার পাশবিক দিকটিকে দমন করে রাখতে পারত, তবে আর দেশে দেশে হরেক রকমের আইন কানুন প্রণয়ন ও শান্তি বিধানের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হ’ত না। যে দেশে আইনের প্রয়োগ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে, সে দেশে অরাজকতা ও অপরাধপ্রবণতা মাত্রাহীনভাবে বেড়ে যায়। এই একবিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতেও এরূপ দেশের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাত্রা ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা স্ফীতির কারণে মানুষের জীবনধারণের সুযোগ সুবিধা সীমিত হয়ে পড়ছে বলে মানুষ ক্রমশঃ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং সেজন্যই হয়ত তাদের মধ্যে আদিম সন্ত্রাসী প্রবৃত্তি জেগে উঠছে। এই সন্ত্রাসী প্রবৃত্তি অবশ্যই মানুষের কদর্য দিক এবং মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য অবশই এটাকে দমন করে রাখা প্রয়োজন। তবে এটাও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে সন্ত্রাস যখন ঘটতে থাকে, তখন সেটাকে সন্ত্রাসের মাধ্যমেই দমন করতে হয়। অর্থাৎ মানুষের কদর্যতাকে কদর্যতা দিয়েই রোধ করতে হয়। এর আর কোন বিকল্প পন্থা আপাততঃ মানুষের জানা নেই। মানুষের মধ্যে যেমন সু-বৃত্তি রয়েছে, তেমনি কিছু কু-বৃত্তিও রয়েছে। এর মধ্যে কোন দিকটি মানুষের প্রকৃত সত্তার পরিচায়ক তা নিয়ে এখানে বিতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন। তবে একথা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না যে, প্রাণী হিসাবে মানুষের জীবন অবশ্যই কিছু জৈবিক নিয়মানুসারে পরিচালিত হবে এবং মানুষের মধ্যে অবশ্যই কিছু প্রাণীসুলভ বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম থাকবে। তবে উচ্চ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সামাজিক বিভিন্ন নিয়ম নিগড়ের মাধ্যমে তার পাশবিক দিকটিকে সংযত করে মার্জিত রূপ ধারণ করতে পারে। কিন্তু তাই বলে তার আদিম পাশবিক দিকটি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে না। আর ফ্রয়েড মানুষের এই অন্ধকার দিকটি তার তত্ত্বে তুলে ধরেছেন বলেই তার তত্ত্বকে একেবারে নির্বিচারে বাতিল করে দেয়াটা বোধ হয় সঙ্গত হবে না।
  • ফ্রয়েড মানব আচরণের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং মানুষকে যন্ত্রবৎ বিবেচনা করেছেন বলেও তার সমালোচনা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ফ্রয়েড ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েছেন। জাগতিক সকল ঘটনাই সুনির্দিষ্ট কার্য-কারণ সূত্র অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত ও সংঘটিত হয় বলে বিজ্ঞানে যে ধারণা রয়েছে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণবাদ (determinism) বলা হয়। ফ্রয়েড এই নিয়ন্ত্রণবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সেজন্যই তিনি মানব আচরণকে কার্য-কারণ সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যেহেতু তিনি কার্য-কারণ সূত্রের নির্দিষ্ট ছকে ফেলে মানব আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন, সেহেতু তার ব্যাখ্যার ধরনে যান্ত্রিকতা এসে গিয়েছে। তবে ফ্রয়েড মানুষকে একটি যন্ত্র না ভেবে একটি জটিল তন্ত্র (system) রূপে বর্ণনা করেছেন। বহুবিধ কারণগত উপাদানের মিথস্ক্রিয়া (interaction) বা যৌথক্রিয়ার ফল রূপে মানব আচরণের উৎপত্তি হয় বলে তিনি ধারণা পোষণ করেছেন। এই বহুবিধ উপাদানের মিথষ্ক্রিয়ার প্রেক্ষিতে ব্যক্তি ঠিক কোন আচরণটি করবে, তা নিখুঁতভাবে বলা যায় না বলেও তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। সুতরাং ফ্রয়েড মানুষকে একেবারে যন্ত্রবৎ ভেবেছেন বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। তবে তিনি অবশ্যই মানব আচরণকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
  • কুষ্টিমূলক নৃবিজ্ঞানীরা (cultural anthropologists) ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে অনেক আদিম উপজাতির জীবনধারা সম্পর্কে গবেষণামূলক অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তাদের গবেষণায় ফ্রয়েডের অনেক ধারণাই সমর্থিত হয়নি। বিশেষ করে তারা দেখেছেন যে ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্তর সম্পর্কে ফ্রয়েডের তত্ত্ব সার্বজনীন নয়। সব সমাজেই ব্যক্তিত্বের বিকাশধারা একই রকম হয় না। অনেক আদিম গোষ্ঠীর সমাজে ইডিপাস গুঢ়ৈষার উৎপত্তি হয় না। অনেক সমাজে আদ্য তারুণ্য কাল (early adolescence) ঝড় ঝঞ্ঝাপূর্ণ হয় না। ফ্রয়েড কিন্তু তার নিজের ধারণা সম্পর্কে একেবারে অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তার এই অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গিই তার তত্ত্বের সব চেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা।
  • বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও ফ্রয়েডের তত্ত্বে কিছু অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। ফ্রয়েড তার তত্ত্বে ঘটনোত্তর যুক্তি (post hoc arguements) উপস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তিনি ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করেছেন। এ ধরনের ঘটনোত্তর যুক্তি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতে পারে। কারণ একই ঘটনা যুক্তি দিয়ে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সেজন্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটার পূর্বেই কোন বিষয়ে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয় এবং ঘটনা ঘটার প্রেক্ষিতে উক্ত ব্যাখ্যার যথার্থতা যাচাই করে দেখা হয়। সুতরাং ফ্রয়েডের ব্যাখ্যার ধরন অনুসারে তার প্রদত্ত ব্যাখ্যা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে এবং তার তত্ত্ব পক্ষপাত যুক্ত হতে পারে।
  • ফ্রয়েডের তত্ত্বে প্রদত্ত অনেক বিষয়ই বাস্তবে যাচাইযোগ্য নয়। ফ্রয়েড তার তত্ত্বে এমন অনেক ধারণা উপস্থাপন করেছেন, যেগুলোর সত্যতা বাস্তবে যাচাই করে দেখা যায় না। যেমন জন্মাঘাতের অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন প্রক্রিয়া, কামশক্তির বিকাশ, জীবন ও মরণ প্রবৃত্তি, প্রভৃতি বিষয়গুলো বাস্তবে যাচাই করে দেখার কোন উপায় নেই। এছাড়া ফ্রয়েড তার অনেক ধারণা ও শব্দ রূপক অর্থে (figurative sense) উপস্থাপন করেছেন। ইড, ইগো, সুপার ইগো, নারসিসিজম, ঈডিপাস কমপ্লেক্স, প্রভৃতি শব্দগুলো বিশেষ রূপক অর্থ বহন করে। এসব শব্দের সাহিত্যিক মূল্য থাকলেও বৈজ্ঞানিক পরিভাষা রূপে এগুলোর মূল্য সন্দেহজনক। কারণ বিজ্ঞানে ব্যবহৃত পরিভাষার মত এগুলোর কোন প্রায়োগিক সংজ্ঞা (emperical definition) নেই। অর্থাৎ এ সব পরিভাষার বিষয়গুলো যাচাই করার জন্য কোন প্রয়োগমূলক প্রক্রিয়ার উল্লেখ এগুলোর সংজ্ঞায় দেয়া নেই। সুতরাং ফ্রয়েডের তত্ত্বের অনেক বিষয়ই চিন্তা প্রসূত ধারণা মাত্র এবং এগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে যাচাই করে দেখার কোন উপায় নেই। ফলে তার তত্ত্বে ব্যক্তিনিষ্ঠ সীমাবদ্ধতা ও পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে।

বিজ্ঞানের কঠোর দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করলে ফ্রয়েডের তত্ত্বে বেশ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ও অসম্পূর্ণতা দেখা যাবে। তবে ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিঃসন্দেহে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছে। বিশেষভাবে তার তত্ত্ব অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই ফ্রয়েডের তত্ত্বের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তার অনেক ধারণাকে পরীক্ষণ নকশার ছকে ফেলে যাচাই করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য যে এরূপ পরীক্ষণমূলক যাচাইয়ের দ্বারাও ফ্রয়েডের বেশ কিছু ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ফ্রয়েডের তত্ত্বের যথেষ্ট ব্যবহারিক মূল্যও প্রমাণিত হয়েছে। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ফ্রয়েডের বিভিন্ন ধারণার ব্যবহার দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, ঔপনাসিক, নাট্যকার, সমাজকর্মী, শিল্পী, প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় বিভিন্ন ধারণার অবতারণা করে থাকেন। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে ফ্রয়েডের তত্ত্ব মানুষের চিন্তার জগতে নিঃসন্দেহে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফ্রয়েডের তত্ত্বকে হয় সমর্থন করার জন্য অথবা নাকচ করার জন্য পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য চিন্তাবিদ নিত্য নতুন তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থাপনের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। চিন্তার জগতে মানুষকে উদ্দীপিত করাটাই ফ্রয়েডের সব চেয়ে বড় অবদান। পরিশেষে বলা যায় যে ফ্রয়েডকে একেবারে শুরুতেই বাতিল না করে দিয়ে তার তত্ত্বকে আরও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখার প্রয়োজন হয়ত মানুষের এখনও আছে।

ফ্রয়েডের দার্শনিক বিচার

ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের অন্যতম পথিকৃৎ রেনে দেকার্ত (Rene Descartes) । তিনি বিশ্বকে দুভাগে ভাগ করেছেন, বস্তুর জগৎ এবং আত্মার জগৎ। বস্তুর জগতে যান্ত্রিকতার নিয়ম (mechanism), আর আত্মার জগতে ‘অভিজ্ঞতা ঊর্ধ্ব বুদ্ধিবাদে’র (rationalism) নিয়ম কার্যকর। অভিজ্ঞতা ঊর্ধ্ব বুদ্ধিবাদ মনে করে, কোনো বিষয়ে গূঢ় জ্ঞান আত্মায় বর্তমান রয়েছে। স্বজ্ঞা-র (intuition) মাধ্যমে এ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। এ জন্য কোনো প্রাক্ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। স্বজ্ঞালব্ধ জ্ঞান থেকে অবরোহী যুক্তি প্রয়োগ করে আমরা অন্য ব্যবহার্য জ্ঞানে পৌছাতে পারি। দেকার্তের বিশ্বাস, স্থানাঙ্কের ধারণাটি তার স্বজ্ঞালব্ধ। তিনি এ ধারণাটি থেকে অবরোহী যুক্তি প্রয়োগে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি রচনা করেছেন, যা অভিজ্ঞতার দুনিয়ায় কাজে লাগে। দেকার্তের মতে আত্মা শুধু মানুষেরই রয়েছে, মানুষের মনন ক্রিয়ায় তা প্রকাশিত। অন্য প্রাণীরা জটিলতর যন্ত্রমাত্র। মানুষেরও আত্মা ছাড়া মস্তিষ্ক সমেত শরীর প্রাণীদের মতোই যন্ত্রবৎ। তাই মানুষের মস্তিষ্কেও যান্ত্রিকতার নিয়ম কার্যকর। মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়া হিসাবে পরাবর্ত-র (reflex) ধারণাও দেকার্তের উদ্ভাবন। তার মতে দেহের সঙ্গে আত্মার সংযোগ ঘটে মস্তিষ্কস্থিত পিনিয়াল গ্রন্থিতে (pineal gland)। এভাবে দেকার্ত বস্তুর জগৎ সম্বন্ধে যান্ত্রিক বস্তুবাদ (mechanical materialism), আত্মা বা মনের জগৎ সম্বন্ধে ভাববাদ (idealism) এবং এ দুটি জগৎকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন স্বাধীন সত্তার স্বীকৃতি দিয়ে, দার্শনিক দ্বয়বাদ (dualism)-এ তিনটি দার্শনিক ধারা সমর্থন করেন।

ফ্রয়েডও বাস্তবতাকে ‘বস্তুগত বাস্তবতা’ ও ‘মানসিক বাস্তবতা’ এ দুভাগে ভাগ করেছেন। তার মতে ‘শারীরিক শক্তি’ ইদ-এ ‘মানসিক শক্তিতে’ রূপান্তরিত হয়। যদিও ফ্রয়েড দেকার্তের মতো মস্তিষ্কের কোনো অঞ্চলকে নির্দেশ করেননি, তিনি শক্তির রূপান্তরের কথা বলেছেন এবং মনের নিয়ম হিসাবেও বস্তুজগতের নিয়ম যান্ত্রিকতাকে (mechanism) ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তিনি দ্বয়বাদী নন, অদ্বয়বাদী (monist)। কিন্তু তিনি বাস্তবের ধারণা এবং কল্পনাকে সমতুল্য বিবেচনা করেছেন, প্রতীক ও মিথ-এর যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এভাবে প্রয়োগক্ষেত্রে মনের নিয়মটিকে বস্তুজগতের নিয়মের মতো বক্তানিরপেক্ষ (objective) না রেখে বক্তাসাপেক্ষ (subjective) করে ফেলেছেন। ফলে তা দেকার্তের অভিজ্ঞতা ঊর্ধ্ব বুদ্ধিবাদের মতোই ভাববাদী রূপ নিয়েছে।

দার্শনিক বিবেচনায় ফ্রয়েড-তত্ত্ব জৈব নির্ধারণবাদী (biological deterministic)। এতে জন্মলব্ধ অচেতন জৈবিক এষণাই মানুষের একমাত্র চালিকাশক্তি। সামাজিক শিক্ষা এতে পরিবর্তন আনতে পারে না। এটি একই সঙ্গে খণ্ডতাবাদী (reductionist)। মানুষের বিচিত্র জটিল সামাজিক আচরণকে তা ব্যাখ্যা করেছে সমসত্ত্ব (homogeneous) দুটি জৈবিক প্রেষণা দিয়ে। মনের অধঃস্তর মস্তিষ্কের গড়নে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ জন্মগতভাবে ব্যক্তিগণ অসমসত্ত্ব (heterogeneous)। সামাজিক শিক্ষায় ব্যক্তির মধ্যে নতুন গুণের উদ্ভব ঘটে। একাধিক ব্যক্তির সমাকলনে গঠিত সমষ্টি-মন বা সমাজ-মনস্তত্ত্বেও নতুন গুণের উদ্ভব ঘটে। ফ্রয়েডবাদে এ গুণগত পরিবর্তনের ধারণাটি অনুপস্থিত। যদিও ফ্রয়েড-তত্ত্বে প্রকোষ্ঠ ভিত্তিক মনটির আধার যে মস্তিষ্ক তা ধরে নেয়া হয়েছে, কিন্তু এর সঙ্গে মস্তিষ্কের শারীরস্থানিক-শারীরবৃত্তিক সম্পর্ক কী তা বর্ণিত হয়নি। এটি অবলম্বনহীন, রহস্যময়। এভাবে তার তত্ত্বটি জৈব নির্ধারণবাদী হয়েও বস্তুসম্পর্কহীন ভাববাদী (idealist)।

ফ্রয়েডবাদ ইউরোপের চেয়ে আমেরিকায় বেশি প্রভাব বিস্তার করল কেন?

ফ্রয়েডবাদ ইউরোপের চেয়ে আমেরিকায় বেশি প্রভাব বিস্তার করার পেছনে বিভিন্ন কারণ দায়ী। এখানে দার্শনিক কারণটি বিবেচনা করা যাক। আমেরিকায় ফ্রয়েডবাদ আমদানির আগেই প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছে। শুরুতে তা ছিল ডারউইন এবং উইলিয়াম জেমস (William James) প্রভাবিত কার্যবাদী (functionalist) ধারায়। ক্রমে তা আচরণবাদী (beheviourist) ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমেরিকাতে আচরণবাদ ও ফ্রয়েডবাদের প্রসার ঘটেছে সমতালে। দার্শনিক বিচারে এ দুটি ধারা পরস্পরের বিপরীত হয়েও পরস্পরের পরিপূরক। আচরণবাদ অতিমাত্রায় বিষয়নিষ্ঠ (objective)। তারা মনকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় না বলে মন (mind) বা বিষয়ীকে (subject) আলোচ্যসূচি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। পক্ষান্তরে ফ্রয়েডবাদ অতিমাত্রায় বিষয়ীনিষ্ঠ (subjective)। এখানে মানসিক জগৎকে বস্তুর জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এবং তা গবেষণা করার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে বিষয়ীনিষ্ঠ অন্তর্দর্শন/অন্তর্বীক্ষণ (intro- spection) পদ্ধতির।

ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে বস্তু কিংবা বস্তুকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি নিয়ে গবেষণা করা পক্ষপাতদুষ্টতা বলেই আমেরিকাতে আচরণবাদ ও ফ্রয়েডবাদ পরস্পরের পরিপূরক হয়েছে। বস্তু (বিষয়) ও ভাবের (বিষয়ীর) সমন্বয়কারী কোনো দর্শন ও পদ্ধতি সেখানে গড়ে ওঠেনি বলে গবেষকরা হয় বস্তুবাদী (যেমন আচরণবাদী) কিংবা ভাববাদী (যেমন ফ্রয়েডবাদী) মডেল ব্যবহার করেন। প্রয়োগের প্রয়োজনে একাডেমিক বিশেষজ্ঞরা সারগ্রাহী পদ্ধতিতে দু’ধারার সারমর্ম নিয়ে টেক্সটবই রচনা করেন। এভাবে আমেরিকার একাডেমিক মহলে বস্তুবাদী বা ভাববাদী (উভয়ই একই সঙ্গে খণ্ডতাবাদী বা রিডাকশনিস্টও বটে), এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সারগ্রাহী ভাবধারারই প্রাধান্য। কিন্তু সেখানে সামাজিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যশীল দর্শন কার্যসিদ্ধিবাদ বা প্র্যাগমেটিজম (pragmatism)। অর্থাৎ কোনো মতবাদের সত্যতার মাপকাঠি হচ্ছে তা দিয়ে কার্যসিদ্ধি হয় কিনা সেটাইই। তাই শাসকরা জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে যেমন আচরণবাদী ওপারেন্ট কন্ডিশনিং (operent conditioning) ব্যবহার করেন, তেমনি ব্যবহার করেন ‘কামনার অবিচ্ছেদ্য কারাগারে বন্দি মানুষের অসহায়ত্বের’ ফ্রয়েডীয় ধারণার। দীর্ঘকালই শাসকদের সহায় ধর্মীয় নিয়তিবাদ; যা জনগণকে প্রচলিত ব্যবস্থা মেনে নিতে প্ররোচিত করে। বর্তমানে জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশে ধর্মের প্রভাব কমে আসায়, ধর্মীয় নিয়তিবাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে জৈব নির্ধারণবাদ।

মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কথা বিবেচনা করলে সমস্ত পুঁজিবাদী দুনিয়াতেই যান্ত্রিক বস্তুবাদ, ভাববাদ, খণ্ডতাবাদ, সারগ্রাহিতা, কার্যসিদ্ধিবাদ-এসব দার্শনিক ধারাগুলোর প্রাধান্য, আর তার কারণ সামাজিক। তাদের মতে উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে গড়া, মুনাফাজীবী ও শ্রমজীবী এই দুই ভাগে গভীরভাবে বিভক্ত এ সমাজে, কোনো ঐক্যবদ্ধ দর্শন প্রাধান্য লাভ করতে পারে না। তাই মার্ক্সবাদের মতে এসব আপাত বিরোধী এসব দার্শনিক ধারা একত্রে এ সমাজে স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। তাই মার্ক্সবাদ অনুসারে আমেরিকার মত পুঁজিবাদী সমাজে ফ্রয়েডবাদের মত খণ্ডতাবাদী বা রিডাকশনিস্ট দর্শন জনপ্রিয় হয়।

তবে, অনেক সমালোচক বিশ্বাস করেন যে দার্শনিক বহুমুখিতা (philosophical pluralism) সমাজের স্বাভাবিক বিবর্তনের ফলাফল। মার্ক্সবাদ এই জটিল বিবর্তনশীলতা এবং প্রগতির গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রয়েডবাদের মত দর্শনগুলি শুধুমাত্র সমাজের স্থিতাবস্থার প্রতিফলন নয়, বরং মানব মনের গভীর অন্বেষণের মাধ্যমেও উদ্ভূত হয়। সেই সাথে, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং অর্থনৈতিক প্রভাবগুলি মানুষের চিন্তাভাবনা এবং দর্শনের উপর প্রভাব ফেলে। মার্ক্সবাদ এই জটিলতাকে উপেক্ষা করে এবং সবকিছুকে উৎপাদনের উপকরণের উপর নির্ভরশীল হিসেবে দেখে। তাছাড়া যে মার্ক্সবাদ পাশ্চাত্যের দার্শনিক ধারাসমূহকে খণ্ডতাবাদ বা রিডাকশনিজমের দায়ে অভিযুক্ত করে সেই মার্ক্সবাদকেও অর্থনৈতিক খণ্ডতাবাদ বা ইকোনমিক রিডাকশনিজমের দায়ে অভিযুক্ত করা যায়, কেননা মার্ক্সবাদ ব্যক্তিগত মালিকানাকে (private ownership) সমাজের সকল সমস্যার মূল হিসেবে চিহ্নিত করে, যা অনেক সময় অতিরঞ্জিত হতে পারে। ব্যক্তিগত মালিকানার মাধ্যমে সৃষ্ট উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির ভূমিকা বিবেচনা না করে শুধু তার নেতিবাচক দিকগুলি উল্লেখ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক উদ্ভাবন এবং সমাজের অগ্রগতি ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং মালিকানার ফলে সম্ভব হয়েছে, যা মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে উপেক্ষিত হতে পারে।

ফ্রয়েডবাদ জনপ্রিয় কেন?

ফ্রয়েড-তত্ত্ব একাডেমিক মহলে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই সাধারণ্যে আলোড়ন তুলেছে। সে সময় প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের কোনো যোগ ছিল না। ফ্রয়েডই প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যা-তা হোক রোগচিকিৎসা কিংবা ব্যক্তির আচরণের অনুধাবন-তার আলোচনায় নিয়ে আসেন। তার রচনা নীরস একাডেমিক নিবন্ধের মতো নয়; সরস সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ। (রচনার সাহিত্যগুণের জন্য তিনি গ্যয়টে পুরস্কার পেয়েছেন।) এতে বৈজ্ঞানিকতার ঘাটতি থাকলেও সাহিত্যের ঘাটতি নেই। শিল্প, সাহিত্য, পুরাণ, প্রাত্যহিক দিনযাপন, এসবের অপূর্ব সংশ্লেষ ঘটেছে তার রচনায়। শুধু একাডেমিক মহল নয়, সকলের উদ্দেশ্যে প্রচারিত তার রচনায়, সে সময়ের প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জও ছিল। ফ্রয়েড যেসব মূল্যবোধের বিরোধিতা করেছিলেন (যেমন যৌনতা বিষয়ে অতিরিক্ত বাধানিষেধ), সেসব ছিল তৎকালীন ধর্মপ্রভাবিত সামন্তবাদী সংস্কৃতির অবশেষ। যদিও তার তত্ত্বেও এর কিছু চিহ্ন বর্তমান (যেমন পুরুষতান্ত্রিকতা)। তবু স্থিতাবস্থার সমর্থকরা এতে রুষ্ট হয়। ফ্রয়েড-তত্ত্ব পরিবর্তনকামীদের প্রতিবাদের ভাষা যুগিয়ে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

ফ্রয়েডবাদের সে বিপ্লবী পর্যায় বহু পূর্বেই চলে গেছে। একাডেমিক ও শাসক মহলে তার স্বীকৃতি জুটে গেছে অনেক আগেই। তবুও তা সাধারণ্যে জনপ্রিয় কী কারণে? প্রথমেই বলা দরকার, সাধারণের মধ্যে মনোবিজ্ঞানের অন্য ধারাগুলো পরিচিত নয়। তাই অনেকের কাছে মনোবিজ্ঞান এবং ফ্রয়েড-তত্ত্ব সমার্থক। অন্য একটি কারণ ফ্রয়েডবাদের সহজবোধ্যতা। ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ মাৎসর্য) আমাদের তাড়না করে। বিবেক আমাদের সুপথে চলতে বলে। আমাকে বেছে নিতে হবে আমি কোন পথে যাব। এসবই আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার সারাৎসার। এর সঙ্গে ফ্রয়েডের ইদ্, সুপারইগো এবং ইগোকে মিলিয়ে দেখুন। আমাদের ধর্মীয় নিয়তিবাদের সঙ্গে ফ্রয়েডীয় জৈব-নির্ধারণবাদেরও সাদৃশ্য রয়েছে। ইগোর আত্মরক্ষা কৌশলগুলো আমরা একটু আত্ম-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। ফ্রয়েড-তত্ত্বের এসব উপকরণ সাক্ষাৎ বোধগম্য হয়ে গেলে, তার অচেতন মনের ক্রিয়াকলাপকে বৈজ্ঞানিক সত্য বলে মেনে নিতে আপত্তি থাকে না। আমাদের মনের যে একটা অসচেতন দিক রয়েছে, তাও তো আমরা উপলব্ধি করি। এভাবে এ সমাজের মানুষ ফ্রয়েড-তত্ত্বে যেন তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। একবার ফ্রয়েড-তত্ত্বের কাঠামোটা আয়ত্ত হয়ে গেলে, নিজেকে মনোবিদ ভাবতেও অসুবিধা হয় না। কারণ তখন মনে হয়, আমরা যে কোনো মানবিক বিষয়কেই এর দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারি। ‘আত্মরক্ষা কৌশল’ ও ‘প্রতীক’ এর যথেচ্ছ ব্যবহারের উদাহরণ তো ফ্রয়েডীয়রাই রেখে গেছেন। তারপরও যা ব্যাখ্যা করা যায় না, তা অচেতনের ক্রিয়া বলে চালিয়ে দিলেই হলো।

এ ‘সহজ-যান’ এর বিকল্প পথটি কঠিন। এ জন্য মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যের চর্চা আবশ্যক। এসব তত্ত্বের আলোকে কোনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করেই সন্তুষ্ট থাকা যায় না। দেখতে হয় তা বাস্তবের সঙ্গে মেলে কি না। কিন্তু সত্য সব সময়ই কঠিন। সাক্ষাৎ উপলব্ধি সত্যের নিশ্চয়তা দেয় না। সূর্য যে পূর্বে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়, এ সাক্ষাৎ উপলব্ধি আমাদের প্রতিদিনই হয়। তবু তা সত্য নয়। পৃথিবী যে নিজ অক্ষের চারপাশে ঘোরে, এটা কখনো উপলব্ধ না হলেও সত্য। একই ভাবে অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে আমরা মনের যেসব বিষয় উপলব্ধি করি, তাও আংশিক সত্য মাত্র। যা অন্তর্দর্শনে উপলব্ধ হচ্ছে না, তা মনের অচেতনে এবং জানা যাবে না, এমন ভাবাও ঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগে তাও জানা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থার খবর নিলে জানা যাবে আমরা এসব কতটুকু জানি। সহজতার কারণ ছাড়াও সাধারণের মাঝে ফ্রয়েডবাদ টিকে থাকার আরো কারণ রয়েছে। স্থিতাবস্থার সমর্থকরা সব সময় প্রচার করেন, মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে অন্ধ অযৌক্তিক আবেগ চালিত জীব। কাজেই মানুষের পক্ষে পরিকল্পিত ন্যায়ানুগ সমাজ গড়া সম্ভব নয়। যারা প্রচলিত ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট, তারাও পরিবর্তনের দিশা কিংবা সাহস না পেয়ে, স্থিতাবস্থার সমর্থকদের প্রচারিত আপ্তবাক্যে আস্থা রেখে সান্ত্বনা খোঁজেন। ফ্রয়েড সহ মনঃসমীক্ষণ ধারার অনেক তাত্ত্বিকই (উদাহরণ হিসাবে ইয়ংলাকাঁর নাম উল্লেখই যথেষ্ট), যেমন তাদের তত্ত্ব রচনায়, তেমনি তত্ত্বের সত্যতা প্রদর্শনে, শিল্প-সাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানকে ব্যবহার করেছেন। এভাবে তারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমালোচনায় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব ও পদ্ধতি প্রয়োগের একটি মসৃণ পথ নির্মাণ করেছেন। কাজেই সহজ পথের পথিকরা যে এ বাঁধানো পথেই হাঁটবেন, তাতে আশ্চর্য কি! তবু শিল্প-সাহিত্য রচনা কিংবা সংস্কৃতি-সমালোচনায় (Cultural Criticism) ফ্রয়েডবাদের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে ‘সহজযান’ এবং ‘সান্ত্বনা’ তত্ত্ব আংশিক কার্যকর। সহজপন্থীরা এবং সান্ত্বনা পিয়াসিরা বিষয়টি টের না পেলেও, ভাবাদর্শগত সংগ্রামের এ ক্ষেত্রগুলোতে শাসকশ্রেণির প্রতিনিধিরা নিজেদের স্বার্থে ফ্রয়েডবাদকে সচেতনভাবেই প্রয়োগ করেন।

উপসংহার

ফ্রয়েড উদ্ভাবিত সাইকোথেরাপির কিছু প্রত্যয় ফ্রয়েড-তত্ত্ব-নিরপেক্ষভাবে সাইকোথেরাপিতে গৃহীত হয়েছে। তার সূত্রায়িত ‘ইগোর আত্মরক্ষা কৌশল’ও তার তত্ত্ব-নিরপেক্ষভাবে মনোবিজ্ঞানে অঙ্গীকৃত। মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে ফ্রয়েডের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনোবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসেন; যেমন অচেতন এষণা, স্বভাবী ও অস্বভাবী মানসিক ক্রিয়ার সম্পর্ক, মনের আত্মরক্ষা কৌশল, ব্যক্তিত্ব গঠনে শৈশবের ও যৌনতার ভূমিকা, বয়স্কদের আচরণে শৈশবের মানসিক আঘাতের প্রভাব, ব্যক্তিত্বের জটিল গঠন এবং ব্যক্তির মানসিক কাঠামোর অভ্যন্তরস্থ দ্বন্দ্ব-সংঘাত। কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তিনি যে তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, তাতে ধরে নেয়া হয়েছে, মন সমাজ বিযুক্ত, জৈব প্রকৃতির অধীন এবং চেতন ও অচেতন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী (antagonistic)। এ দুটি ধারণাই বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার তত্ত্বপ্রস্তাবে ফ্রয়েড অসম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যাত একটি মানসিক নির্ণায়ক (factor), ‘অচেতন জৈবিক এষণা’কে ব্যক্তির জৈবিক ও সামাজিক উভয় জীবনের নির্ধারকের (determinant) ভূমিকায় বসিয়ে দিয়েছেন। মানব সমাজের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকেও সে নির্ণায়কের অধীন করে, ফ্রয়েড মানুষের প্রেষণা (motivation) এবং মানব সমাজের ইতিহাস উভয়কেই রহস্যাবৃত করেছেন। এভাবে তার তত্ত্ব প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের সহায়ক হয়েছে।

পুরাণ, দর্শন, বিজ্ঞান-এ সবই সামাজিক চেতনার প্রকাশ। এ সবগুলিতেই বাস্তবতার এক ধরনের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু সত্যের মাপকাঠিতে সবই তুল্যমূল্য নয়। ফ্রয়েডের আকাঙ্ক্ষা মনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রচনা। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তিনি তা রচনা করেছেন তা বৈজ্ঞানিক নয়। ফ্রয়েড-তত্ত্বের বয়ানটিও পৌরাণিক। মনের বিভিন্ন কাজকে তিনি তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। তারপর এ তিন শ্রেণির কাজকে তিনি তিনটি চরিত্ররূপে কল্পনা করে, মনের গতিবিদ্যাকে এ তিন চরিত্রের নাটকরূপে উপস্থাপন করেছেন। বর্ণনাকারী হিসাবে ফ্রয়েডের ভূমিকাটি নাট্যকারের মতোই নিরপেক্ষ। তাই এ নাটকে ইদ্‌-এর সংলাপে, সুপারইগো তার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের পথে বাধা। বিপরীতে সুপারইগোর সংলাপে, ইদ আদিম অন্ধ ধ্বংসাত্মক শক্তি। ইগো ইদ-এর চালাক ম্যানেজার। সে বিভিন্ন কূটকৌশলে সুপারইগো ও সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে, ইদ্-এর কামনা চরিতার্থ করার পথ করে দেয়। অন্তর্বস্তুর দিক দিয়ে এটি পুরাণ-আশ্রিত দর্শন। তাই মনোবিজ্ঞান বিকাশে ফ্রয়েড- তত্ত্ব একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও মনোবিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থায় তা কার্যকর তত্ত্ব নয়।

ইয়ুং (Jung), এডলার (Adler), ফ্রম (Fromm), লাকাঁ (Lacan) প্রমুখ মনঃসমীক্ষকগণ ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে ফ্রয়েড থেকে স্বতন্ত্র হয়ে তাদের তত্ত্ব রচনা করেছেন। যে মনোরোগ চিকিৎসার জন্য ফ্রয়েডবাদের জন্ম, সেখানে তার অবস্থান প্রান্তীয়। কিন্তু নৃতত্ত্ব-সমাজতত্ত্ব, শিল্প-সংস্কৃতি-সমালোচনা এসব ভাবাদর্শগত ক্ষেত্রে ফ্রয়েডবাদ এখনো প্রভাবশালী। এ কথাটি উপর্যুক্ত মনঃসমীক্ষকদের প্রসঙ্গে ফ্রয়েড থেকেও বেশি সত্য। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বাইরে ফ্রয়েডীয় ধারায় প্রথম তত্ত্ব রচনা করেন, কলকাতার গিরীন্দ্রশেখর বসু। তার তত্ত্বটি ফ্রয়েডের তত্ত্ব থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও পদ্ধতিগত ও দার্শনিক বিচারে উপরিউক্ত অফ্রয়েডীয়রা ফ্রয়েডবাদের বাইরে যেতে পারেননি।

পরবর্তী ফ্রয়েডবাদী বা মনোসমীক্ষণবাদীগণ

ফ্রয়েড নিয়ে একটু রিভিশন

ফ্রয়েড সচেতনতার নিরিখে মানুষের মনটি তিন স্তর বিশিষ্ট বলে কল্পনা করেছেন। এগুলি সচেতন, প্রাকচেতন (যে অচেতন সম্পর্কে আমরা সচেতন হতে পারি) এবং অচেতন (যা সম্বন্ধে কখনই সচেতন হওয়া যায় না)। তিনি আবার মনকে তিনটি প্রকোষ্ঠ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এসব ইদ, ইগো, সুপার ইগো। ইদ এর অবস্থান অচেতন স্তরে। বাকি দুটির ব্যাপ্তি তিন স্তর জুড়ে। ফ্রয়েড মনকে একটি শক্তিতন্ত্র হিসাবেও বিবেচনা করেছেন। তার মতে ইদ্-এ শারীরিক শক্তি মানসিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ইগো ও সুপার ইগো তাদের শক্তি আহরণ করে ইদ থেকে।

ইদ মনের চালিকা শক্তির আধার। জন্মলব্ধ কামনা পূরণই যার একমাত্র তাড়না। সুপার ইগো সামাজিক শিক্ষায় গঠিত উচিত-অনুচিত বোধের ধারক। এটি ইদ্ এর কামনা পূরণের বাধাস্বরূপ। ইগো, ইদ্‌-এর চালাক ম্যানেজার। সে সুপার ইগো ও সামাজিক বিধিনিষেধের ফাঁক গলিয়ে, ইদ্ এর কামনা চরিতার্থ করার পথ করে দেয়। ফ্রয়েড প্রথমে যৌনাকাঙ্ক্ষাকেই (libido) ইদ্ এর একমাত্র চালিকাশক্তি বলে বর্ণনা করেছিলেন। পরে তিনি এটিকে প্রসারিত করেন জীবনাকাঙ্ক্ষায় (eros)। তিনি কল্পনা করেন জীবনাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি মরণাকাঙ্ক্ষা (thanatos) বলে একটি বিপরীতধর্মী চালিকা শক্তিও ইদ্‌-এ বর্তমান। ইদ্‌স্থিত এই ইরস্-থেনাটস্ দ্বন্দ্বই ব্যক্তির এবং সমাজের চালিকা শক্তি।

ফ্রয়েড ব্যক্তিত্বের বিকাশকে মুখ (oral), পায়ু (anal), শিশ্ন (phallic), প্রচ্ছন্ন (latency) এবং জননেন্দ্রিয় (genital) এ-পাঁচটি পর্বে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে শিশ্নপর্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ বছর বয়সের কাছাকাছি সময় ছেলেরা মায়ের প্রতি এবং মেয়েরা বাবার প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা বোধ করে। ছেলেরা উপলব্ধি করে তাদের বাবা এবং মেয়েরা উপলব্ধি করে তাদের মা, তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাধা। তাই তাদের মনে পিতা বা মাতাকে হত্যার আকাঙ্ক্ষা জন্মে। এটিই যথাক্রমে ইডিপাস ও ইলেকট্রা কমপ্লেক্স। ছেলেরা ভয় পায়, বুঝি বাবা তাদের মনোভাব জেনে, তাদের খাসি বানিয়ে দেবে। এটি মুষ্কচ্ছেদের ভয় (Castration anxiety)। মেয়েরা দেখে তাদের বাবার মতো শিশ্ন নেই। এতে তাদের মনে বাবার প্রতি শিশ্ন ঈর্ষার (penis envy) সঞ্চার ঘটে। শিশুরা এটিও উপলব্ধি করে বাবা কিংবা মাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ হতাশা কাটাতে, তারা তাদের ক্রোধ ভয় ঈর্ষা কে অবদমিত করে। ছেলেরা বাবার মতো হয়ে এবং মেয়েরা মায়ের মতো হয়ে, যথাক্রমে মা ও বাবার ভালোবাসা পেতে চায়। এভাবেই তাদের ব্যক্তিত্বের কাঠামোটি একটি নির্দিষ্ট রূপ নেয়।

ইদ-এর তাড়া এবং সুপার ইগোর চাপ সামলাতে গিয়ে, ইগো বেচারা উদ্বেগ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ থেকে মুক্তি পেতে সে বিভিন্ন আত্মরক্ষামূলক কৌশল গ্রহণ করে (ego defence mechanism)। যেমন একাত্মবোধ (identification), স্থানান্তরণ (diplacement), অবদমন (repression), উদ্‌গতি (sublimation) ইত্যাদি। এগুলো কাজ করে মনের অচেতন কিংবা প্রাকচেতন স্তরে।

ফ্রয়েডের মতে ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি হচ্ছে, তার অচেতন বা প্রাকচেতন দ্বন্দ্বগুলোকে ব্যক্তির সচেতন উপলব্ধির সীমানায় নিয়ে আসায়। এজন্য তিনি অবাধ অনুষঙ্গ (free association) এবং স্বপ্ন সমীক্ষণ (dream analysis) বলে দুটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে, ব্যক্তি তার মনে যা আসে (চিন্তা, স্মৃতি, স্বপ্ন, অনুভব) তাই নির্দ্বিধায় বলে যায়। সমীক্ষক তার তত্ত্বের কাঠামোতে এসব বিশ্লেষণ করে, অচেতনস্থিত দ্বন্দ্বটি আবিষ্কার করেন। তারপর এটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্যক্তিটির উপলব্ধিতে নিয়ে আসেন। ফ্রয়েডের মতে স্বপ্ন অচেতন ইচ্ছা পূরণের উপায়। অবশ্য স্বপ্নে ইচ্ছাটি সরাসরি প্রকাশিত হয় না; হয় রূপান্তরিত রূপে। ফ্রয়েড তার উদ্ভাবিত প্রতীক ব্যাখ্যার পদ্ধতির সাহায্যে, স্বপ্নটির গূঢ় অর্থ আবিষ্কার করে তা ব্যক্তিটিকে বুঝিয়ে দেন। এভাবে ব্যক্তিটি তার মনের অচেতনস্থিত দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে সজাগ হয়ে তা নিরসন করতে পারে। অর্থাৎ সে সমস্যা কিংবা রোগমুক্ত হয়।

ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষণ, নব্য-ফ্রয়েডীয় মতবাদ ও এর তাত্ত্বিকগণ

ফ্রয়েডের মৃত্যুর পরও তার মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে কিছু নতুন ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটেছে। ফ্রয়েডোত্তরকালের মনোসমীক্ষণমূলক চিন্তার বিকাশকে তিনটি ধারায় বিভক্ত করা হয়। প্রথম ধারাটিকে বলা হয় সনাতনপন্থী ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ (Orthodox Freudian Psycho-analysis)। সনাতনপন্থী ফ্রয়েডবাদীরা ফ্রয়েডের তত্ত্বকে সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখে কিছু নতুন তথ্য এখানে সেখানে সংযোজন করেছেন বা ফ্রয়েডের ধারণাকে কোথাও কোথাও আরও বিশদ করেছেন। আনা ফ্রয়েড (Anna Freud), ক্লাইন (Klein), হার্টম্যান (Hartman), আলেকজান্ডার (Alexander), প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সনাতনপন্থীদের মধ্যে অন্যতম।

মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের দ্বিতীয় ধারাটিকে বলা হয় ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষণ (Deviant Psycho-analysis) । যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ প্রথমে ফয়েডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রূপে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীকালে মতবিরোধের জন্য ফ্রয়েড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন, তাদের মতবাদকে ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষন রূপে আখ্যায়িত করা হয়। এখানে রয়েছেন ফ্রয়েডের দলের চারজন সদস্য, যারা প্রথমে ফ্রয়েডের অনুসারী ছিলেন এবং প্রিয়পাত্র ছিলেন, তারা পরবর্তীকালে ফ্রয়েডের তত্ত্বের কতগুলো বিষয়ের প্রতি দ্বিমত পোষণ করেন এবং পৃথক সম্প্রদায় গঠন করেন। এরা হলেন আলফ্রেড আডলার (A.Adler), কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং (C G.Jung). অটো র‍্যাংক (Otto Rank) এবং ফেরেঞ্জি (Ferenczi)। এই চারজন যে ফ্রয়েডীয় মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, তার জন্য অনেকেই ফ্রয়েডকে দায়ী করেন। তারা বলেন, ফ্রয়েড সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না এবং তিনি ছিলেন অনেকটা স্বৈরাচারী নেতৃত্বের অধিকারী। কিন্তু অনেকেই বলেন, এই সব নব্য চিকিৎসাবিদদের সঙ্গে ফ্রয়েডের কিছু কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল, সেকারণেই তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। ফ্রয়েডের তত্ত্বের ত্রুটি ছিল; এবং কিছু কিছু বিষয়ে নতুন মূল্যায়ন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এসব ব্যক্তি স্বতন্ত্র মতবাদ দিলেও এদের ধ্যান ধারণা মূলতঃ ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই উৎপত্তি লাভ করেছে।

মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব সংক্রান্ত তৃতীয় ধারাটিকে নব্য-ফ্রয়েডীয় মতবাদ (Neo- Freudian viewpoints) রূপে আখ্যায়িত করা হয়। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা ফ্রয়েডের যৌনতত্ত্ব ও জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছেন। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা মূলতঃ নৃবিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং তারা মানব প্রকৃতি ও আচরণকে সমাজ, সভ্যতা ও কৃষ্টির প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এরা ফ্রয়েডের তত্ত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটালেও, এদের ধ্যান ধারণাও ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রেক্ষিতেই উৎপত্তি লাভ করেছে। নব্য-ফ্রয়েডবাদীরা মনোসমীক্ষণ পদ্ধতি, অচেতন প্রেষণা, আত্মরক্ষামূলক কৌশল, প্রভৃতি ফ্রয়েডীয় ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। সেজন্যই এদেরকে নব্য-ফ্রয়েডীয় রূপে আখ্যায়িত করা হয়, যাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন  এরিক ফ্রম, কারেন হর্নি, এরিক এরিকসনসুলিভ্যান

ফ্রয়েড মনোরোগ চিকিৎসার প্রয়োজনে তার তত্ত্বের বিকাশ ঘটালেও, শীঘ্রই এর প্রয়োগ করেন মানুষের প্রাত্যহিক আচরণ, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি সব ধরনের মানবীয় আচরণের ব্যাখ্যায়। ফ্রয়েডবাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত দিকের চেয়ে এ ভাবাদর্শগত দিকটিই সাধারণ্যে পরিচিতি পায়। ভাবাদর্শগত কারণে আর যেসব মনঃসমীক্ষক সাধারণ্যে পরিচিতি পেয়েছেন এরা-ইয়ুং, এডলার, ফ্রম, লাকাঁ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এদের অবদান তাৎপর্যপূর্ণ নয়। ব্রিটিশ-ভারতে মনঃসমীক্ষণের সূচনা করেন গিরীন্দ্রশেখর বসু। তিনিই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বাইরে মনঃসমীক্ষণের সূচনাকারী। তার তত্ত্বটি ফ্রয়েডের তত্ত্ব থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের।

মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েড সূচিত ধারাটি, সাইকোডায়নামিক বা সাইকোএনালাইটিক ধারা। মনোরোগের কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে এর সূচনা। মনোরোগের কারণ নির্ণয়ে তা ব্যর্থ হয়েছে। মনোরোগ চিকিৎসায় সাইকোথেরাপিতে এর একটি ভূমিকা এখনও আছে। তবে ফ্রয়েড প্রবর্তিত সাইকোথেরাপি রূপান্তরিত রূপে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এ ধারার সাইকোথেরাপিতে ‘ইগো-সাইকোলজি‘ (ego psychology) এবং ‘বিষয়-সম্পর্ক’ বা অবজেক্ট-রিলেশন তত্ত্বের (object-relation theory) ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি উপধারাই ফ্রয়েড-পরবর্তী সাইকোডায়নামিক ধারার বিকাশ। ইগো-সাইকোলজিতে ইগোকেই ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রীয় বিষয় মনে করা হয়, এবং ইগোর সঙ্গে সমাজের সম্পর্কটিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। অবজেক্ট-রিলেশন তত্ত্বে, ব্যক্তিত্ববিকাশে গুরুত্ব দেয়া হয়, ব্যক্তির সঙ্গে পরিবেশস্থ বস্তু বা ব্যক্তির সম্পর্কটিকে। এ উভয় তত্ত্বই বিকশিত হয়েছে পদ্ধতিবদ্ধ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু সাধারণ্যে ফ্রয়েড পরবর্তী এ কার্যকর ধারাগুলোর পরিচিতি নেই।

যাই হোক, এখানে ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিয়ে যা আলোচনা হলো সেটাই আসলে সনাতনপন্থী ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ (Orthodox Freudian Psycho-analysis)। অর্থাৎ আনা ফ্রয়েড (Anna Freud) (১৮৯৫ – ১৯৮২), মেলানি ক্লেইন (Melanie Klein) (১৮৮২ – ১৯৬০), হেইঞ্জ হার্টম্যান (Heinz Hartmann) (১৮৯৪ – ১৯৭০) ও ফ্রাঞ্জ আলেকজান্ডার (Franz Alexander) (১৮৯১ – ১৯৬৪) তাত্ত্বিক অবস্থান এরকমই। কিন্তু মনোসমীক্ষণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভের জন্য ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষণ (Deviant Psycho-analysis) ও নব্য-ফ্রয়েডীয় মতবাদ (Neo-Freudian viewpoints) সম্পর্কে জানতে হবে। সেক্ষেত্রে যাদের তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আসতে হবে তারা হচ্ছেন –

ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষণ (Deviant Psycho-analysis):

  1. আলফ্রেড অ্যাডলার (Alfred Adler) (১৮৭০ – ১৯৩৭)
  2. কার্ল ইয়ুং (Carl Jung) (১৮৭৫ – ১৯৬১)
  3. অটো রাঙ্ক (Otto Rank) (১৮৮৪ – ১৯৩৯)
  4. শান্দোর ফেরেঞ্জি (Sándor Ferenczi) (১৮৭৩ – ১৯৩৩)
  5. গিরীন্দ্রশেখর বসু (Girindrasekhar Bose) (১৮৮৬ – ১৯৫৩)

নব্য-ফ্রয়েডীয় মতবাদ (Neo-Freudian viewpoints):

  1. কারেন হর্নি (Karen Horney) (১৮৮৫ – ১৯৫২)
  2. হ্যারি স্ট্যাক সুলিভ্যান (Harry Stack Sullivan) (১৮৯২ – ১৯৪৯)
  3. ডোনাল্ড উইননিকট (Donald Winnicott) (১৮৯৬ – ১৯৭১)
  4. এরিক ফ্রম (Erich Fromm) (১৯০০ – ১৯৮০)
  5. জ্যাক লাকাঁ (Jacques Lacan) (১৯০১ – ১৯৮১)
  6. এরিক এরিকসন (Erik Erikson) (১৯০২ – ১৯৯৪)

তথ্যসূত্র –

  • মনোসমীক্ষণ মতধারা (ফ্রয়েড ও ফ্রয়েদোত্তর), মঞ্জুর আহমদ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬
  • সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং অফ্রয়েডীয় ফ্রয়েডবাদীগণ, বিরঞ্জন রায়, সংহতি, ঢাকা, ২০২১
  • মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস ও মতবাদ, নীহাররঞ্জন সরকার, মনুরুল হক, ডঃ আবদুল খালেক, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২২
  • আধুনিক ও ধ্রুপদী সামজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা, ড. মোঃ আহসান হাবিব, গ্রন্থ কুটির, জানুয়ারি, ২০১৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.