Table of Contents
ভূমিকা
জগৎ দর্শনের অন্যতম প্রধান আলোচনা হচ্ছে বিশ্ব জগতের গঠন ও সংগঠনের সমস্যা বা বিশ্বতত্ত্বের সমস্যা (Problems of Cosmology)। এ পরিদৃশ্যমান জগৎ কি আসল জগৎ? এ জগতের পেছনে কি কোনো পরম সত্তার অস্তিত্ব আছে যার থেকে এ জগতের বিভিন্ন বস্তুর উদ্ভব হয়েছে? যদি কোনো পরম সত্তার অস্তিত্ব থেকে থাকে তবে তা কি এক, না দুই না বহু? তার স্বরূপ কি? বিশ্ব তত্ত্বের এসব নানা প্রশ্ন নিয়ে আবহমানকাল থেকে দার্শনিকদের মধ্যে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি সত্তার সংখ্যা নির্ণয় করতে গিয়ে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনাদি, অনন্ত সত্তাকেই স্বীকার করেছেন। কেউ কেউ বলেন-এক নয়, দুই সত্তা থেকেই এ জগৎ সৃষ্টি। আবার কেউ বা বলেন, বহু সত্তা থেকে বিশ্ব জগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি হয়েছে। অতএব আমরা সত্তার সংখ্যা সম্পর্কীয় মোটামুটি তিনটি মতবাদ পাইー(১) একত্ববাদ, (২) দ্বৈতবাদ ও (৩) বহুত্ববাদ। আবার সত্তার প্রকৃতির প্রশ্নে আমরা দুটি মতবাদ পাই-জড়বাদ ও ভাববাদ। এখানে সত্তার সংখ্যা সম্পর্কীয় মতবাদগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
বহুত্ববাদ (Pluralism)
বহুত্ববাদের মূলকথা-সত্তা এক নয়, দুইও নয়, বহু। পরিদৃশ্যমান জগৎ হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিশ্বের এ বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে এর বহু সত্তাকে। কেবল আত্মা বা কেবল বস্তু অথবা এরা উভয়ে বিশ্বের বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা করতে পারে না। বিশ্বের বৈচিত্র্য যে মানুষের মনে নানা সত্তার অস্তিত্বের প্রেরণা যোগায় তা অনস্বীকার্য। নদীর কলতান, সাগরের ভৈরবনাদ, সূর্যের প্রখর কিরণ, চাঁদের রূপালী জ্যোৎস্না, শস্য সবুজ মাঠ, নীল আকাশ, ধূসর মরুভূমি, গগনচুম্বী পর্বতচূড়া, কোকিলের মধুর কণ্ঠ, আর কাকের কঠোর রব ইত্যাদি বহু অসম সত্তা ও বৈচিত্র্য মানুষের মনে প্রতীতি জন্মিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কল্পনা করে একের পরিবর্তে বস্তুর। দর্শনের ইতিহাসের পাতার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, আধ্যাত্মিকতার প্রভাবের ফলে মানুষ এক চরম সত্তার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে আপন সত্তাকেও হারিয়ে ফেলে। তাই বহুত্ববাদ অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে এক কঠোর প্রতিবাদ। বহুত্ববাদের এ দিকটি হলো নঞর্থক দিক। এর একটি সদর্থক দিকও অবশ্যই আছে। এর সদর্থক দিক হলো দৃশ্যমান জগতের আড়ালে বহু সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে প্রথম বহুসত্তার প্রচার করেন এম্পিডোক্লিস্। তিনি জল, বায়ু, অগ্নি ও মাটি-এ চারটি আদি সত্তার নাম করেন। সত্যের সন্ধান দিতে গিয়ে প্লেটো বহুধারণার সত্যতায় বিশ্বাস করেন। গ্রিক পরমাণুবাদীরাও বস্তুর জয়গান করেন। বহুসত্তাবাদের ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে আমরা এর পাঁচটি ধারার সাথে পরিচিত হই –
- (ক) জড়াত্মক বহুত্ববাদ বা পরমাণুবাদ : পরমাণুবাদ বা জড়াত্মক বহুত্ববাদ অনুসারে পরিদৃশ্যমান জগতের মূলে রয়েছে অসংখ্য জড়াত্মক সত্তা বা পরমাণু। পরমাণুবাদীদের মতে, জড় ও বস্তুকে যদি ক্রমাগত ভাগ করা যায় তাহলে আমরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর, তারপর আরো ক্ষুদ্র কণিকায় এসে উপনীত হই যাকে আর কোনো ভাগ করা সম্ভব নয়। এই ক্ষুদ্রতম বা অবিভাজ্য জড় কণিকাগুলো হলো পরমাণু। পরমাণুর সংমিশ্রণ ও বিমিশ্রণের ফলেই আমাদের অভিজ্ঞতার জগতের সৃষ্টি। ডিমোক্রিটাস্ তার পরিমাণমূলক পরমাণুবাদে এবং অ্যানাক্সাগোরাস্ তার গুণমূলক পরমাণুবাদে মূলত সেই একই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। ডাল্টনও পরমাণুকে নিশ্চল জড় বলে ক্ষান্ত হননি। আসল কথা হলো বহুত্ববাদ অনুসারে জগতের অসমতা ও বৈচিত্র্য কেবল পরমাণুর সংমিশ্রণ ও বিমিশ্রণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। পরমাণুবাদ এক প্রকার জড়বাদ, তাই জড়বাদের সমালোচকেরা এরও সমালোচনা করে,তাদের মতে এই মতবাদ স্বভাববাদ ভিত্তিক হওয়ায় এটি প্রাণ ও মনের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
- (খ) আধ্যাত্মিক বহুত্ববাদ বা মোনাডবাদ : জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ হচ্ছেন এ মতের প্রবর্তক। লাইবনিজের মতে, আমাদের এ পরিদৃশ্যমান জগতের মূলে রয়েছে অসংখ্য চিৎ পরমাণু। এই চিৎ পরমাণুগুলো অবিভাজ্য। জড়াত্মক পরমাণু অবিভাজ্য হতে পারে না। সুতরাং আধ্যাত্মিক সত্তাসম্পন্ন চেতন ও সক্রিয় পরমাণু হলো আদর্শ উপাদান। এ পরমাণুর প্রকৃতি বিচার করলে দেখা যায় যে, তাদের সাথে গাণিতিক ও জড়বিন্দুর যথেষ্ট পার্থক্য আছে। পক্ষান্তরে, চিৎ পরমাণু গাণিতিক বিন্দুও নয়, জড়বিন্দুও নয়। এগুলো বিস্তৃতিবিহীন মূর্ত আধ্যাত্মিক বিন্দু। লাইবনিজের মতে, চিৎ পরমাণুগুলো গবাক্ষবিহীন। কিন্তু তারা স্ব-নির্ভর, সক্রিয় ও আত্মকেন্দ্রিক। জগতের প্রত্যেকটি বস্তুই একটি গবাক্ষবিহীন মোনাড। প্রত্যেকটি চিৎ পরমাণুই চেতনধর্মী। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের মধ্যে চৈতন্য সমানভাবে উপস্থিত নেই। সে কারণে চিৎ পরমাণুগুলো আবার চার প্রকারের- আত্মসচেতন, চেতন, অচেতন, নির্জ্ঞান। কিন্তু চিৎ পরমাণুগুলো সংখ্যায় অসংখ্য। এখন প্রশ্ন ওঠে – যদি চিৎ পরমাণুগুলো আত্মকেন্দ্রিক এবং গবাক্ষশূন্য হয় তবে তাদের মধ্যে সম্পর্ক কি করে স্থাপিত হতে পারে? অথচ তাদের সৃষ্ট জগতের বস্তুই একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ সমস্যা সমাধানকল্পে লাইবনিজ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। তার মতে, ঈশ্বর হলো সর্বশ্রেষ্ঠ চিৎ পরমাণু। তিনি সমস্ত চিৎ পরমাণুগুলোর মধ্যে একটা পূর্বপ্রতিষ্ঠিত বা পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলা স্বীকার করেছেন। সেজন্যই আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ সুশৃঙ্খল, সুসংবদ্ধ, সূক্ষ্ম কলাকৌশলপূর্ণ। এ জগৎ এক পরম ঐক্য। এই মতবাদও সমালোচনার স্বীকার হয়। মোনাডবাদ বা চিৎ পরমাণুবাদ জড়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। জড়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার অন্য অর্থ হলো আমাদের দৈনন্দিনের অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করা। তাছাড়া চিৎ পরমাণুগুলো অসংখ্য, স্বতন্ত্র, স্বনির্ভর ও গবাক্ষশূন্য, যেখানে ঈশ্বর তাদের মধ্যে পূর্ব থেকে শৃঙ্খলা স্থাপন করে তাদেরকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। যদি তাই হয় তবে বহুত্ববাদের বিলোপ হয়ে একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা হবার কথা। তাছাড়া এই মতবাদ অনুসারে, চিৎ পরমাণুগুলো গবাক্ষহীন বলে একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু সেটা হলে ঈশ্বররূপ শ্রেষ্ঠ চিৎ পরমাণুরও অন্য পরমাণুগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে পারার কথা না। তাছাড়া যদি পরমাণুগুলো পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা মেনে নেয় তবে তারা আর স্বনির্ভর থাকতে পারে না।
- (গ) প্রয়োগবাদী বহুত্ববাদ : প্রয়োগবাদীদের মুখপাত্র জেমসের মতে, হেগেলের একত্ববাদ জগতে বৈচিত্র্য ও অভিনবত্বের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রাকৃতিক ঘটনাবলিতে পার্থক্য, নতুনত্ব, স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, অসামঞ্জস্য ইত্যাদি বিদ্যমান। যদি এ জগৎ এক আংশিক ঐক্য বা পরব্রহ্মের সৃষ্টি হয় তবে জগৎ তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে জগতে অসাম্য ও বৈচিত্র্যের কোনো স্থানই থাকবে না। বস্তুত জগৎ হচ্ছে অসংখ্য স্বনির্ভর বস্তুর সমষ্টি। বস্তুগুলোর জাগতিক ঘটনাগুলোর কোনো ঐক্য বা আন্তর সম্পর্ক নেই। সুতরাং জগৎ এক নয়, বহু, জগতের ঈশ্বর-নিরপেক্ষ স্বাধীন অস্তিত্ব আছে। জগৎ ব্যক্তি মন নিরপেক্ষ। এ জগৎ ‘বদ্ধ জগৎ’ (Block Universe) নয়। জগতের নতুন সৃষ্টি ও তাদের ক্রমোন্নতির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। প্যাট্রিক Introduction to Philosophy গ্রন্থে সুন্দরভাবে জেমসের এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “জেমস একটিতে নয়, বহুতে আগ্রহী ছিলেন। বহুগুলোর সার্বিক রূপ থেকে তাদের পৃথক রূপ, তাদের স্বাতন্ত্র্য, বিচ্ছিন্নতা, তাদের স্বনির্ভরতা, তাদের অভিনবত্ব, তাদের স্বাধীনতা, তাদের অনিশ্চয়তা, তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, তাদের বহুত্ব এমনকি তাদের বিশৃঙ্খল প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করেছিল; পূর্ণ ঐক্য সমন্বিত কোনো যুদ্ধ বিশ্বজগতের সাক্ষাৎ তিনি পাননি।” বস্তুত জেমসের মতে, সত্তা বীণার তার বা পিয়ানোর কর্ডের মত। নানা সুর ও ঝঙ্কার বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। আসল কথা হলো বস্তুর ভেতর একের পরিবর্তে তিনি একের ভেতরে বস্তুর অস্তিত্বের জয়ধ্বনি করেছেন। সমালোচকদের মতে, প্রয়োগবাদী বহুত্ববাদ বহু জগৎকে এলোমেলো বিশৃঙ্খলার স্তূপমাত্র করে তোলে। একত্ববাদী সমালোচকদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে জগৎ বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও জগতে এক নিয়মের রাজত্ব চলছে, জগৎ এক সুসংহত, সুসংবদ্ধ পরম ঐক্য, এখানে বিশৃঙ্খলার ভেতর শৃঙ্খলা আছে ও জগতের সূক্ষ্ম কলা-কৌশল, গঠন- নৈপুণ্য জগতের মূলে কোনো বুদ্ধির অস্তিত্ব স্বীকার করে, তাদের মতে বহু জগৎ এলো- মেলো বিশৃঙ্খলার স্তূপ মাত্র নয়।
- (ঘ) নব্য বাস্তববাদী বহুত্ববাদ : নব্য বাস্তববাদীরাও ভাববাদীদের একত্ববাদকে মেনে নিতে রাজী নন। তারা আমাদেরকে এক নতুন ধরনের বহুসত্তাবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের মতে, জড়বস্তুর চেতনা নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তা আছে। তবে জগতের বৈচিত্র্যের চেয়ে মনোজগতের অগণিত চিত্রই তাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রভাবশালী মননশীলতা তাদের কাছে বেশি চমকপ্রদ। কিন্তু বস্তুগুলোর ও মনগুলোর কোনো আন্তর সম্পর্ক নেই। তাদের কেবল বাহ্য সম্পর্ক আছে। দেশ ও কালে অবস্থিত বস্তুর সত্তা (Existence) আছে। সংখ্যা, ন্যায়, সৌন্দর্য যেগুলো জড়াত্মকও নয়, মানসিকও নয়, সেগুলোর শুদ্ধ সত্তাও আছে। জড়, প্রাণ, মন বিভিন্ন স্তরের সত্তা, প্রাণ জড় থেকে এবং মন প্রাণ থেকে উচ্চতর সত্তা। স্নায়ুতন্ত্র থেকে মন উদ্ভূত হয়েছে। নব্য বাস্তববাদীরা উন্মেষবাদ সমর্থন করেন। এ বিশ্ব জগৎ বহু বস্তুর সৃষ্টি। এই জগতের কোনো আঙ্গিক ঐক্য নেই। নব্য বাস্তববাদীদের মধ্যে স্পলডিং এ মতবাদের নামকরা সমর্থক। এই মতবাদের একত্ববাদী সমালোচকেরা বলেন, নব্য বাস্তববাদীদের মতবাদ গ্রহণ করলে জগতের ঐক্য, শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য ব্যাখ্যা করা যায় না। জগৎ কেবল এলোমেলো নয়, আবার কেবল ঐক্যপূর্ণ নয়। জগতে ঐক্য ও বিশৃঙ্খলা উভয়ই আছে।
- (ঙ) বহুদেববাদ (Polytheism): তত্ত্ব ছাড়া ধর্মের ক্ষেত্রেও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। হিন্দুদের মধ্যে বহুদেবতাবাদ দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও মিশরবাসীরা বহুদেববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রাকৃতিক শক্তির পশ্চাতে তারা একাধিক দেবতার সত্তায় বিশ্বাস করতেন। বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন বিভাগের কার্য সম্পাদন করতেন। সূর্যদেবতা, সমুদ্রদেবতা, অগ্নিদেবতা প্রভৃতি বিভিন্ন দেবতা নিজ নিজ বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে জগৎকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দেবতার অধীন করা হয়। দেবতার মধ্যে মনুষ্যোচিত গুণাবলি ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও অনুভূতি ইত্যাদি আছে বলেও বিশ্বাস করা হয়। একত্ববাদী সমালোচকেরা বলেন, বহুদেববাদও জগতের ঐক্যের ব্যাখ্যা করতে পারে না। এ মতবাদ আবার বিচার-বুদ্ধির ওপর বস্তুদেববাদ যুক্তি-ভিত্তিক নয়, বিশ্বাস- প্রতিষ্ঠিত নয়। বিশ্বাসই এ মতবাদের প্রধান হাতিয়ার। বিভিন্ন দেবতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও বিভিন্ন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
বহুত্ববাদের মূল সূত্র ও বিভিন্ন ধারার আলোচনাতেও এই কথা পরিষ্কার হয় যে, এ মতবাদ অনুসারে জগৎ অসংখ্য বিচ্ছিন্ন সত্তার সমষ্টি। এর সমালোচকেরা বলেন, অন্তর্নিহিত ঐক্য ছাড়া এসব বিচ্ছিন্ন সত্তার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। তারা বলেন, জগৎ অভিনব বস্তুর বিচিত্র সমাবেশ হলেও জগতে শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য বিদ্যমান, আর তাই বৈচিত্র্য এবং সামঞ্জস্য হচ্ছে একই জগতের দুটি ভিন্ন দিক, একের মধ্যে বহু এবং বস্তুর মধ্যে একের অস্তিত্ব, এটাই জগতের প্রকৃত পরিচয়। আর কাজেই তাদের মতে, ঐক্য ছাড়া বৈচিত্র্য অথবা বৈচিত্র্য ছাড়া ঐক্যের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। তাদের মতে বহুত্ববাদ জগতের কেবল বৈচিত্র্যের ওপর জোর দিয়ে একটা চরমপন্থী মতবাদে পর্যবসিত হয়েছে, ফলে এ মতবাদ জগতের আসল মরূপ ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু একত্ববাদী সমালোচনাসমূহ সত্ত্বেও বহুত্ববাদ একত্ববাদের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপ হয়ে রয়েছে।
দ্বৈতবাদ (Dualism)
দ্বৈতসত্তাবাদ এক ও বহুর পরিবর্তে দ্বি-সত্তার কথা ঘোষণা করেছে। এই মতবাদের মূল কথা জগতে মন ও জড় বলে দুটি মৌলিক বা আদিম উপাদান আছে। এ উপাদান দুটি পরস্পর স্বতন্ত্র সত্তা। এদের একটিকে অন্যটিতে পরিবর্তন করা চলে না। জগতের সব অস্তিত্বশীল বস্তুকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-জড়াত্মক এবং মনাত্মক। জগতের সমস্ত ঘটনাবলির উৎপত্তি এ দুয়ের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়। দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, দর্শনের জগতে দ্বৈতবাদের একটা স্থায়ী আসন আছে। এর দ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠার মূলে আছে দুটি বিশেষ কারণ। প্রথমত, দ্বৈতবাদ একটি মৌলিক মতবাদ। এ মতবাদ সাধারণ লোকের কাছে বেশ প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য। কেননা, এর সাহায্যে সুন্দর-অসুন্দর, ভাল- মন্দ, শান্ত-অশান্ত ইত্যাদি বিষয় সহজে বিশ্লেষণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দর্শনের জনক ডেকার্টের প্রভাবের ফলে দ্বৈতবাদ পাশ্চাত্য দর্শনে এক স্থায়ী আসন করে নেয়। তাই অনেক সময় ডেকার্টেকে বলা হয় দ্বৈতবাদের প্রবর্তক।
যদিও ফরাসি দার্শনিক ডেকার্টেকে দ্বৈতবাদের প্রবর্তক বলা হয়, আসলে তিনি ছিলেন দ্বৈতবাদের সফল সাধক এবং আধুনিক পাশ্চাত্য দ্বৈতবাদের প্রবর্তক। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের পাতায় এ দ্বৈতবাদের অনেক সাক্ষ্য মেলে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের জনক থেলেস্ ও তার পরবর্তীকালের দার্শনিক অ্যানাক্সিমন্ডার ও অ্যানাক্সিমেনিস্ যদিও জড়কে একমাত্র সত্তা বলে মনে করতেন তবুও তারা বস্তুতে প্রাণের অস্তিত্বকে স্বীকার করে বা জগতের নিয়ন্ত্রণকর্তাকে স্বীকার করে একত্ববাদের পরিবর্তে দ্বৈতবাদের প্রচার করেন। এম্পিডোক্লিস্ জল, বায়ু, অগ্নি এবং পৃথিবী এ চারটি উপাদানের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এ চারটি উপাদানের সংমিশ্রণ, লোপ ও পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি অনুরাগ এবং বিরাগ এ দুটি মনস্তাত্ত্বিক শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। অ্যানাক্সাগোরাস্ জড় ও মানস সত্তার কল্পনা করেন। প্লেটো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ও ইন্দ্রিয়াতীত জগতের সামান্যের এবং বিশেষের দ্বৈততা স্বীকার করেন। অ্যারিস্টোটল উপাদান এবং আকারের দ্বৈততা স্বীকার করেন। মধ্যযুগের দর্শনে দেহ ও মনের দ্বৈততার একাধিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সেন্ট অগাস্টাইনের দর্শনে বিশেষ করে দেহ ও মনের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। দেহ বা বস্তু নশ্বর আর আত্মা অবিনশ্বররূপেই এসব মতবাদে স্থান পেয়েছে।
আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তাধারায় রেনে ডেকার্টের দর্শনে দ্বৈতবাদ সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। ডেকার্টে তার ‘মেডিটেশন্স্’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে বলেছেন, বিশ্বের সমস্ত কিছু দুটি মৌলিক সত্তার সৃষ্টি-জড় ও মন। জড় হচ্ছে চেতনাহীন বিস্তৃত পদার্থ আর মন হচ্ছে বিস্তৃতিহীন চেতন পদার্থ। জড় ও মন তাই পরস্পর স্বতন্ত্র ও বিরোধী সত্তা। এখন প্রশ্ন হলো, এ দুটি বিপরীত সত্তার মধ্যে কি করে সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে? ডেকার্টের মতে, এ দুটি সত্তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঈশ্বররূপ চরমসত্তা দ্বারা। দর্শনের ইতিহাসে এরূপ দ্বৈতবাদের নাম নিয়ন্ত্রিত দ্বৈতবাদ। এছাড়া আর এক প্রকার দ্বৈতবাদ আছে যাকে বলা হয় চরম দ্বৈতবাদ। চরম দ্বৈতবাদ জড় ও মনের কোন রকম নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে না। এ জগতের মূলে দুটি পরস্পরবিরোধী সমান মূল্যের সত্তাকে কেবল স্বীকার করে।
চরম দ্বৈতবাদে আমরা এক বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হই। যদি জড় ও মন বা দেহ ও আত্মা সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা হয় তবে কখনও এ দুয়ের মিলন ও সংমিশ্রণ সম্ভব নয়। অথচ আমরা দৈনন্দিন এদের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার সম্পর্ক দেখতে পাই। ডেকার্টের মতে, পিনিয়াল গ্রন্থির (Pineal gland) সাহায্যে এ সম্পর্কের ব্যাখ্যা করা যায়। আসলে তা ঠিক নয়। পিনিয়াল গ্রন্ধিও একটি জড়বিশেষ। কাজেই কেবল জড় দিয়ে জড় ও মনের সম্পর্কের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তাছাড়া তিনি ঈশ্বরকে জড় ও মনের নিয়ামক বলেও জড় ও মনের স্বাধীনতা হরণ করেছেন। ডেকার্টের মতবাদের অসুবিধা দূর করার জন্য তার দুজন শিষ্য জিউলিঙ্ক্স ও ম্যালব্রাঞ্চ প্রয়োজনবাদ বা উপলক্ষবাদের প্রবর্তন করেন। প্রয়োজনবাদ অনুসারে, ঈশ্বর দৈহিক পরিবর্তনের অনুরূপ মানসিক পরিবর্তন বা মানসিক পরিবর্তনের অনুরূপ দৈহিক পরিবর্তন সাধন করেন। কাজেই কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে দেহ-মনের সম্পর্ক ঈশ্বর স্থাপন করেন। এদিকে ঈশ্বরবাদীরা এর সমালোচনা করে বলেন, এই মতবাদে ঈশ্বর প্রয়োজনের আজ্ঞাবহ দাস হয়ে যাচ্ছে। স্পিনোজার মতে, জড় ও মন ঈশ্বররূপ দ্রব্যের অসংখ্য গুণের দুটি গুণ। বিস্তৃতি ও চেতনা পাশাপাশি থাকে। কাজেই কোনো দৈহিক পরিবর্তন দেখা দিলে মানসিক পরিবর্তনও দেখা দেয়। এ মতবাদ সমান্তরবাদ (Theory of Parallelism) নামে পরিচিত। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় বিস্তৃতি ও চৈতন্যের পাশাপাশি না। তাছাড়া জড়ে কোনো চৈতন্য দেখা যায় না। তত্ত্বের ন্যায় ধর্মের ক্ষেত্রেও দ্বিশ্বরবাদ (Ditheism) দেখা যায়। দুটি স্বতন্ত্র ঈশ্বর-একটি কল্যাণের বা শুভের স্রষ্টা, আরেকটি অশুভ ও অকল্যাণের স্রষ্টা। কিন্তু কি করে এ দুই ঈশ্বর জগতে ঐক্য স্থাপন করে তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা এ মতবাদে পাওয়া যায় না। এর একেশ্বরবাদী সমালোচকদের মতে কল্যাণ ও অকল্যাণের জন্য এক ঈশ্বরই যথেষ্ট, ঈশ্বর দুটি হলে তারা সসীম হয়ে পড়বে ও সসীম ঈশ্বর দ্বারা অনন্তের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
এসব সমালোচনার পরও দ্বৈতবাদের দার্শনিক ও লৌকিক মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না। এই মতবাদও বহুত্ববাদের মত একত্ববাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, সেই সাথে দ্বৈত সত্তার সাহায্যে জাগতিক বস্তুর ও ঘটনাবলির ব্যাখ্যা সহজ সরল বলে সাধারণ লোকের কাছে এ মতবাদের আবেদন অনেক বেশি।
একত্ববাদ (Monism)
একত্ববাদ অনুসারে জগতের কেবল একক মৌলিক উপাদান বা সত্তা আছে। বিশ্বের যাবতীয় ঘটনা কেবল একটা আদি বস্তু হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। একত্ববাদের প্রকৃতি আলোচনা করলে নঞর্থক ও সদর্থক দুটি দিক পাওয়া যায়। প্রথমত, একত্ববাদ চায় বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করতে। দ্বিতীয়ত, একত্ববাদ বিশৃঙ্খল জগতের ভেতরে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করে এক পরম সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়।
একত্ববাদ বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করতে গিয়ে উল্লেখ করে যে, বহুত্ববাদ বিচিত্র সত্তার অস্তিত্বের মধ্যে জাগতিক বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে বটে, কিন্তু বিভিন্ন সত্তার অনিবার্য ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কাজেই বহুত্ববাদ ঐক্যপূর্ণ জগতের ব্যাখ্যা হিসেবে সার্থক সত্তা মতবাদ নয়। আবার দ্বৈতবাদ দুটি বিপরীতধর্মী সত্তার প্রকল্পের মাঝে জগৎকে দ্বিখন্ডিত ও পরস্পর সম্পর্ক-বিযুক্ত করে তুলেছে। সুতরাং এ মতবাদ পরম সত্তার সঠিক প্রকৃতি নির্ণয় করতে পারে না। দার্শনিক হোয়াইটহেডের মতে, ডেকার্টের দ্বৈতবাদ পরবর্তী দার্শনিক চিন্তাতে এক বিষাক্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। জগতের বিভিন্ন বস্তু যদি বিচ্ছিন্ন হয় তবে তাদের স্বরূপ কখনও জানা যাবে না।
দ্বৈতবাদের এবং বহুত্ববাদকে এভাবে অসার দাবি করে যে সত্তা মতবাদ উৎপত্তি লাভ করেছে তা হলো একক সত্তাবাদ বা একত্ববাদ। বস্তুত মানুষ বস্তুর মধ্যে এক, বিভেদের মধ্যে ঐক্য সন্ধান করতে চায়। মানুষ আপাতত জগৎকে ঐক্যহীন দেখলেও জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরে অনিবার্য ঐক্য খুঁজে পেতে চায়। তাদের মতে, জগতের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কহীন নয় বরং পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। এ সম্পর্ক কেবল বাহ্য সম্পর্ক নয়, তারা জগতে আন্তর সম্পর্কের অস্তিত্বও প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একত্ববাদ অনুসারে বিশ্বের সব বস্তু পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং এভাবেই বিশ্বজগৎ এক আঙ্গিক ঐক্য। মন ও জড় একই ঐক্যের বিভিন্ন প্রকাশ। বিচিত্র জগৎ সে একই ঐক্যের অবভাস। এর আসল কথা হচ্ছে এক হলো সত্তা, দুই অথবা বহু হলো তার অবভাস।
এই মতবাদ অনুসারে জগতের পশ্চাতে এক পরম সত্তার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এ পরম সত্তার প্রকৃতি নিয়ে একত্ববাদীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। ফলে একত্ববাদের বহু রূপ দেখা যায়। পরম সত্তার মূর্ততা ও অমূর্ততা নিয়ে একত্ববাদী দর্শনে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। অমূর্ত একত্ববাদ এবং মূর্ত একত্ববাদ –
অমূর্ত একত্ববাদ (Abstract Monism)
এ মতবাদ অনুযায়ী এক বা পরম সত্তাই একমাত্র সত্য। এ জগতের বহুত্ব হলো মিথ্যে। বহুত্ব অবভাস মাত্র। বহুত্বের কোনো পরমার্থিক সত্যতা নেই। পাশ্চাত্য বুদ্ধিবাদী দার্শনিক স্পিনোজা এ মতবাদ প্রচার করেন। ভারতীয় দার্শনিক শংকরও এ একত্ববাদ প্রচার করেন। স্পিনোজার মতে, কেবল এক পরম সত্তা সত্য। জগৎ মিথ্যে। জগতে আর পরম সত্তায় কোনো প্রভেদ নেই। জগৎ হলো পরম সত্তা আর পরম সত্তাই জগৎ। পরম সত্তার বাইরে কোনো স্ব-অস্তিত্বশীল জগৎ নেই। স্পিনোজার এ মতবাদ নিরপেক্ষ একত্ববাদ নামেও পরিচিত।
স্পিনোজার মতে, সত্তা একটা একক উপাদান। বস্তু এবং আত্মা একই আদি বস্তুর দুটি দিক মাত্র। এ আদি বস্তু হলো দ্রব্য। দ্রব্য হলো স্বনির্ভর। দ্রব্যকে অন্য কোনো ধারণার সাহায্য ছাড়াও ভাবা যায়। দ্রব্যের অসংখ্য গুণ আছে। ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। আছে। আমরা কেবল এর দুটি গুণকে জানতে পারি। এরা হলো বিস্তৃতি ও চেতনা। জগতের সমস্ত বস্তু এ গুণের এবং তাদের প্রত্যংশের (Mode) মিলিত প্রকাশ। এ দু’য়ের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। সারবত্তার দিক থেকে তাদের কোনো তফাৎ নেই। তবে গুণ এবং প্রত্যংশের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। তারা স্বাধীন সত্তা দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল। আর এ দ্রব্য হলো ঈশ্বর। ঈশ্বর সব। ঈশ্বরের বাইরে কোনো কিছু নেই। ঈশ্বর ব্যতীত কোনো কিছু সত্য নয়।
স্পিনোজার এ মতবাদ নিরপেক্ষ একত্ববাদ। কেননা তিনি এক নিরপেক্ষ স্বাধীন দ্রব্য বা ঈশ্বর সত্তায় নিরপেক্ষ বা অমূর্ত বিশ্বাসী। এ সত্তা নিজ রূপের মধ্যেই বিরাজ করে। এ সত্তাকে নির্ণয় করা যায় না। এ সত্তা জাগতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে নিজকে প্রকাশ করে না। অভিজ্ঞতার জগৎ হচ্ছে বৈচিত্র্যের জগৎ। এ জগৎ একক পরম সত্তার জগৎ নয়। পরম সত্তাকে অভিজ্ঞতার জগতে মেলে না বলে এ সত্তা অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই অমূর্ত। এজন্য স্পিনোজার একত্ববাদকে অমূর্ত একত্ববাদও বলা হয়। ভারতীয় দার্শনিক শংকরের মতে, ব্রহ্মই একক পরম সত্তা। জগৎ মিথ্যা। জগৎ হলো মায়া। আসলে জীব ও শংকরের মত ব্রহ্ম অভিন্ন।
এই মতবাদের সমালোচকদের মতে, সূক্ষ্মভাবে একত্ববাদের পর্যালোচনা করলে স্পিনোজার এ মতবাদে ধর্মীয় ছাপ পাওয়া যায়, ও তার দ্রব্য সংক্রান্ত আলোচনায় আনা ঈশ্বরের সাথে ধর্মীয় ঈশ্বরের মিল রয়েছে। তার দার্শনিক মতের সমালোচকেরা বলেন, এককে বহু থেকে পৃথকভাবে দেখা যায় না, কারণ বহুর মধ্যেই একের প্রকাশ। তাদের মতে একত্ব ও বহুত্ব পরস্পর সাপেক্ষ ধারণা ও এর একটা সত্য হলে অন্যটা অবশ্যই সত্য হবে। সমালোচকেরা এও বলেন, বহু ছাড়া শুধু ঐক্য অমূর্ত ও অর্থহীন ধারণা মাত্র, বিভেদের মধ্যে ঐক্য (Identity in difference) হলো যথার্থ ধারণা। তাদের মতে, পরম সত্তা ঐক্য বিভেদের মাধ্যমে নিজকে হলো সে ঐক্য যা বিভেদের মধ্য দিয়ে নিজকে প্রকাশ ও উপলব্ধি করে। সমালোচকেরা এও বলেন যে, যদি কেবল পরম সত্তা সত্য হয়, তবে আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ অলীক ও মিথ্যা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ অভিজ্ঞতার জগৎকে অভীকার করা যায় না। চোখের সম্মুখে জগৎ দেখছি, জগতে বিভিন্ন জীবাত্মার অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। জোর করে এগুলোকে অস্বীকার করা যায়না। তারা এও বলেন, একত্ববাদ সত্য হলে নৈতিক আদর্শ মূল্যহীন হয়ে পড়ে, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ, ঠিক-বেঠিক এসবের কোনো পার্থক্য থাকে না। ফলে আমাদের নৈতিক জীবন ভ্রান্ত ও কাল্পনিক হয়ে দাঁড়ায়, ভাল-মন্দ মিশ্রিত আমাদের সমাজের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। আমাদের জীবনের আদর্শ মূল্যহীন হয়ে পড়ে, ও এরূপ আদর্শ পরিপন্থী সত্তা শূন্যগর্ভ ছাড়া আর কিছু নয়।
মূর্ত একত্ববাদ (Concrete Monism)
এ মতবাদ অনুসারে এ জগতের পশ্চাতে পরম-সত্তার অস্তিত্ব আছে আর জগৎ হচ্ছে এ পরম-সত্তার প্রকাশ। এ সত্তা বহুর মাঝে নিজকে প্রকাশ ও উপলব্ধি করছে। সুতরাং জগৎ অলীক নয়, জগতেরও সত্তা আছে। জগৎ ও পরমসত্তা একটি ছাড়া আরেকটি অর্থহীন। প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক হেগেল এ মতবাদের সার্থক প্রবর্তক। কেয়ার্ড, রয়েস প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিক ও ভারতীয় দার্শনিক রামানুজ এ মতবাদের সমর্থক।
হেগেল তার দার্শনিক আলোচনায় ঈশ্বরকে পরব্রহ্ম বা পরমাত্মারূপে কল্পনা করেছেন। পরম সত্তা হলো বিভেদের মধ্যে ঐক্য, বৈচিত্র্যের মধ্যে সামঞ্জস্য, বস্তুর মাঝে এক। প্রকৃতি ও সসীম মন সত্য। প্রকৃতি হলো পরম সত্তার প্রকাশ মাত্র। পরম সত্তা ছাড়া কোনো জগৎ নেই। জগৎ ছাড়া আবার কোনো পরম সত্তা নেই। জগৎ অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট এবং স্পষ্টতর হয়ে চলছে। অর্থাৎ জগতে বিবর্তন চলছে। পরম-সত্তা জগতে ও জগতের বাইরে আছেন। সসীম মন অসীম মনের সৃষ্টি এবং অসীম মনের চিন্তা এবং স্বাধীনতার অংশীদার। সসীম মনের সাপেক্ষ, সীমিত স্বাধীনতা আছে। কিন্তু স্বাধীনতা যে আছে তাতে সন্দেহ নেই। এ মন সচেতন এবং সৃষ্টিধর্মী। এরা স্বাধীনভাবে নৈতিক মূল্য সৃষ্টি করতে ও নৈতিক আদর্শ উপলব্ধি করতে পারে। পরম-সত্তা হলো অসীম ধীশক্তি। তার ইচ্ছা, প্রতীতি ইত্যাদি আছে। মানুষ তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, তার কাছে প্রার্থনা জানাতে এবং তাকে পূজা করতে পারে। সে নীতি এবং ধর্মকে অস্বীকার করে না। সে ব্যক্তিত্বহীন পরম সত্তা নয়। সে অমূর্ত নয়। জাগতিক বৈচিত্র্যের মাঝে নিজকে প্রকাশ করাই হলো তার ধর্ম।
হেগেলের এবং স্পিনোজার মতবাদের মধ্যে পার্থক্য হলো স্পিনোজার মতে, পরম-সত্তা একক, স্বনির্ভর, এ সত্তা নিজ রূপের মধ্যে বিরাজ করে। এ সত্তা নিরপেক্ষ এবং অমূর্ত। পক্ষান্তরে, হেগেলের মতে, পরম-সত্তা নিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। নিজকে প্রকাশ ও উপলব্ধির মাঝে তার প্রকৃত পরিচয় মেলে। আর এ প্রকাশ এবং উপলব্ধির মাধ্যম হিসেবে সে ব্যবহার করে জগৎকে।
হেগেলের মতে, জড় হলো পরম-সত্তার প্রকাশের সর্বনিম্ন স্তর। জীবন বা প্রাণ হলো উচ্চতর স্তর। জীবাত্মা হলো আরো উচ্চতর স্তর। মানবাত্মা হলো পরম সত্তার প্রকাশের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে উচ্চতম স্তর। ব্যক্তিমন হলো ব্যক্তিগত এবং সমাজ হলো বস্তুগত মন। পরমাত্মা হলো ঈশ্বর। রামানুজের মতে, ব্রহ্ম পুরুষোত্তম। ব্রহ্ম কেবল সত্য নয়। জীব ও জগৎ সত্য তবে তারা ব্রহ্মের অধীন। তত্ত্বের ক্ষেত্র থেকে আমরা ধর্মের ক্ষেত্রের দিকে তাকালে একেশ্বরবাদকে পাই। এই মতবাদ মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনি সর্বব্যাপ্ত, অনন্ত, অসীম ও পূর্ণ জগতের দ্বারা তিনি সীমিত নন।
হেগেলের এ একত্ববাদ একক বা ঈশ্বরের এবং বস্তুর বা প্রকৃতির সত্যতা স্বীকার করে। হেগেল সসীম জীবাত্মার সত্যতাও অস্বীকার করেননি। তিনি জগৎ ও সসীম মনকে অস্তিত্বহীন মনে করেননি। তিনি ব্যক্তিমনের আপেক্ষিক স্বাধীনতা যাধীনতা স্বীকার করেন বলে তার মতবাদকে অনেকে প্রশংসা করেন। তিনি তাদের নৈতিক জীবন ও ধর্মকে অস্বীকার করেননি। তিনি জগতের সত্তার অভিব্যক্তিতে ও উদ্দেশ্যে বিশ্বাস করেন। তিনি বাস্তবিক সঠিকভাবেই বলেছেন যে, ঈশ্বর প্রকৃতি ও ব্যক্তিমনের সাথে তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে, তিনি তাদের মধ্যে আছেন এবং তাদের বাইরেও আছেন। এদিকে সমালোচকেরা বলেন, হেগেল কখনও কখনও প্রকৃতিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বেশি জোর দেন। কখনও তিনি সসীম জীবাত্মার স্বাধীনতাকে সীমিত করে তোলেন এবং তাদের ঈশ্বরের হাতের পুতুল করে তোলেন। তিনি মানুষ এবং ঈশ্বরের বুদ্ধির দিকের ওপর বেশি জোর দেন, অথচ তিনি তাদের ঐচ্ছিক প্রবৃত্তি ও প্রবণতার দিকের প্রতি তত জোর দেননি।
তথ্যসূত্র
- দর্শনের সমস্যাবলি, প্রফেসর মোহাম্মদ নুরনবী, কামরুল বুক হাউজ, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ২০১৭
Leave a Reply