রাশিয়া (১৮৭৪-১৯৩৯): নারদনিক আন্দোলন, ১৯০৫ এর বিপ্লব ও ব্যর্থতা, ১৯১৭ এর বিপ্লব, লেনিন ও স্ট্যালিনের কাল, সোভিয়েত বিদেশনীতি

রাশিয়ার নারদনিক বা জনতাবাদী আন্দোলন

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক জীবনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এই পরিবর্তনমুখী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সংস্কারের মধ্য দিয়ে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক ভাবধারার প্রভাব পড়েছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে একটি চরমপন্থী মতবাদের উদ্ভব হয়। তুর্গেনিভ জানিয়েছেন যে ষাটের দশকে রাশিয়ায় নৈরাজ্যবাদী চিন্তাভাবনার সূচনা হয়েছিল। রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল মানুষরা রোমান্টিকতা থেকে সরে গিয়ে বাস্তববাদী জীবনধারার দিকে ঝুঁকেছিল, রাজনীতিতেও বাস্তববাদী চিন্তার প্রসার ঘটে। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এই বাস্তববাদী রাজনীতির পটভূমি রচনা করেছিল। শাসন, বিচার, আইন ও ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংস্কার প্রবর্তিত হয়, ভূমিদাসরা মুক্তি পেয়েছিল কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি। রাশিয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছিল। রাশিয়ায় রেলপথ স্থাপিত হয়, বৈদেশিক পুঁজির সহায়তার ভারী ও মাঝারি শিল্প স্থাপিত হয়, এই পটভূমিকায় রাশিয়ায় নারদনিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন নারদনিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। চেরনিশেভস্কি, পিসারেভ, হার্জেন, বাকুনিন প্রভৃতি চিন্তানায়করা নতুন আদর্শের প্রতিষ্ঠা করেন, এরা ছিলেন জড়বাদী, উপযোগবাদী চরমবাস্তববাদী। এই চিন্তানায়করা প্রচলিত রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এদের কাছে পুরোনো রাশিয়ার কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিজ্ঞান, সহজ, সরল, মানবিক সম্পর্ক, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও শোষণ থেকে মুক্তি ছিল এদের কাম্য। এরা জ্ঞান ও বুদ্ধিকে আশ্রয় করে অবাধ, মুক্ত, স্বাধীন মানবজীবন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ষাট ও সত্তরের দশকে রাশিয়ায় বৈপ্লবিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, এর আগে অবশ্য রাশিয়ায় সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম বিক্ষিপ্তভাবে চলেছিল। এই বিপ্লবী আন্দোলনের একটি ধারা হল নৈরাজ্যবাদ, অন্যটি নারদনিক বা জনতাবাদী আন্দোলন। জনতাবাদী আন্দোলনের মধ্যে নৈরাজ্যবাদ অনেকখানি মিশে গিয়েছিল। সত্তরের দশকে একটি সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে সব বিচ্ছিন্ন বিপ্লবীগোষ্ঠীগুলি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল। জনতাবাদের একটি বিশেষ আবেদন ছিল, ব্যাপকতর অর্থ ছিল। এজন্য রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, পিটার লাভারভমিখাইলোভস্কি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রের অস্তিত্বহীন এক কাল্পনিক জগতের কথা বলেছিল, ব্যক্তিগত মুক্তি ও স্বাধীনতা চেয়েছিল। জনতাবাদীরা তাকিয়েছিল জনতার দিকে, রাশিয়ার কৃষকদের কথা তারা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেছিল। বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন কৃষকদের ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে তারা শিক্ষিত হয়েছেন, কৃষকদের কাছে তাদের ঋণ আছে। কৃষকদের আছে নৈতিক বিশ্বস্ততা ও সততা, জাতীয় জীবনে এগুলির পুনর্বাসন প্রয়োজন। সামাজিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কে বুদ্ধিজীবীদের অতিরঞ্জিত ধারণা ছিল। এরা মনে করেন স্বশাসিত কৃষক কমিউন গঠন করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব। কৃষক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে জারতন্ত্রের উচ্ছেদ করে তারা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন।

জনতাবাদী আন্দোলনের নেতারা মনে করেন সমগ্র রাশিয়া বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হল কৃষকদের সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য তৈরি করা। বিচ্ছিন্ন কৃষক বিদ্রোহগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে তারা দেশব্যাপী অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা করেন। বিপ্লবের কৌশল নিয়ে জনতাবাদী নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। বাকুনিনপন্থীরা তখনই বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন কারণ দেশ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়েছে, অপর দিকে লাভারভপন্থীরা মনে করেন বিপ্লবের জন্য আরও দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন। অন্য একটি বিপ্লবীগোষ্ঠীর নেতা টকাচেভ মনে করেন যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি সংখ্যালঘুগোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। মতপার্থক্য সত্ত্বেও এদের মধ্যে এক বিষয়ে মিল ছিল, কৃষকের স্বার্থরক্ষার জন্য এরা বদ্ধপরিকর ছিল। সত্তরের দশকে এদের মধ্যে আরও একটি নতুনগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। প্লেখানভ মার্কসবাদের আদর্শ গ্রহণ করেন এবং তার আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার সহকর্মীদের অনেকে মার্কসবাদী হয়ে যান। এরাও জনতাবাদী আন্দোলনের মধ্যে সক্রিয় ছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গ, মস্কো, কিয়েভ, ওডেসা ও অন্যান্য শহরে জনতাবাদী গোষ্ঠী স্থাপিত হয়। জনতাবাদীরা কৃষক বিপ্লবের আদর্শ গ্রহণ করলেও শ্রমিক শ্রেণিকে অবহেলা করেননি। শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের কথা তারা তুলেছিলেন এবং কৃষক বিপ্লবের সঙ্গে তাদের যুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। জনতাবাদী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মসূচির দুটি দিক হল ভূমি ও স্বাধীনতা, রাশিয়ার ইতিহাসে এই আন্দোলন জমি ও স্বাধীনতার আন্দোলন নামে পরিচিত। জনতাবাদী আন্দোলন দাবি করেছিল সব কৃষিজমির জাতীয়করণ, কৃষকের মালিকানা, কৃষক কমিউনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও সর্বশ্রেণির মানুষের নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা।

বিপ্লবী প্রচারের সাফল্য এবং বিপ্লবীদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে উৎসাহিত হয়ে জনতাবাদী আন্দোলনের নেতারা যথাশীঘ্র কৃষক অভ্যুত্থান ঘটানোর কথা ভেবেছিলেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে রাশিয়ায় জনতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। মধ্যাঞ্চল ও ইউক্রেনের হাজার হাজার মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এই আন্দোলনের একটি বড়ো ত্রুটি হল বিভিন্ন গোষ্ঠী স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলন শুরু করেছিল। বিপ্লবীরা কৃষকের পোশাক পরে কৃষকদের দাবিগুলি প্রচার করতে থাকে। সরকার দমনপীড়ন শুরু করলে এই আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়, সরকারি দমনপীড়ন প্রতিরোধ করা হয়। অল্পকাল পরে নেতৃবৃন্দ অনুভব করেন গ্রামের বাস্তব কৃষক জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় নেই। নেতারা ধরে নিয়েছিলেন কৃষকরা যেহেতু নিগৃহীত ও শোষিত তারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে, এই ধারণা ছিল ভ্রান্ত, সমাজতন্ত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য আন্তরিক বা গভীর ছিল না। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য দেখা দেয়। ঐ বছর জমি ও স্বাধীনতা আন্দোলন দুভাগে ভাগ হয়েছিল। আন্দোলনের মধ্যে দুটি নতুন গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়-ভূমির পুনর্বণ্টন ও জনতার ইচ্ছা। জনতার ইচ্ছা ধরে নিয়েছিল বিপ্লবীদের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যের প্রয়োজন নেই, সমাজ বিপ্লব ঘটানো হল তাদের আসল লক্ষ্য। বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে এরা আস্থা রেখেছিল, এই গোষ্ঠীর অনেকে মার্কসবাদী ছিলেন। এই দল একটি কেন্দ্রীভূত, জঙ্গি, বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিতে পরিণতি লাভ করে। একটি কর্ম পরিষদ একে পরিচালনা করত, সযত্নে দলের গোপনীয়তা রক্ষা করা হত। নতুনভাবে সংগঠিত জনতার ইচ্ছা দল সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালিয়েছিল।

জনতাবাদী আন্দোলনের কৃষক অভ্যুত্থানের কর্মসূচি ব্যর্থ হলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। জনতাবাদী তাত্ত্বিক নেতা পিটার টকাচেভ ও সার্জ নেচায়েভ এই তত্ত্ব প্রচার করেন যে কৃষকরা যদি বিদ্রোহ না করে তাহলে বিপ্লবীদের উচিত যুদ্ধ করে সরকারের পতন ঘটানো। জনতার ইচ্ছা সংগঠিতভাবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু করার আগেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক বছর ধরে ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যা চলতে থাকে। সেন্ট পিটার্সবার্গের সামরিক গভর্নর সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন। রুশ সাম্রাজ্যের ওপর সন্ত্রাসবাদ প্রভাব বিস্তার করেছিল, কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায় সন্ত্রাসবাদ প্রচণ্ড ক্ষতি করতে পারে। সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে তারা গুপ্তহত্যার জন্য বেছে নিয়েছিল। জনতার ইচ্ছা কার্যত সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, সম্রাট ভাগ্যবলে কয়েকবার বেঁচে যান। তিনি মধ্যপন্থী সংস্কার নীতি অনুসরণ করতে থাকেন, জনতার কিছু দাবিও তিনি মেনে নিতে চেয়েছিলেন। এসব সত্ত্বেও ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জনতার ইচ্ছা কর্মীদের বোমার আঘাতে তিনি নিহত হন।

উনিশ শতকে রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসন, উৎপীড়ন, শোষণ ও হতাশা থেকে নারদনিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। রাশিয়ার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকের মুক্তি ও জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। জনতাবাদী দল সারা দেশে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু সমস্যা হল কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনার অভাব ছিল। বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলি বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন করেছিল, তাদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ের অভাব ছিল। এজন্য দেশব্যাপী কৃষক বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু এই জনতাবাদী আন্দোলন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। এর প্রভাব পড়েছিল রাশিয়ার কৃষক সমাজের ওপর, কৃষকরা সংগঠিত হতে শিখেছিল। কৃষকদের দাবিগুলি জাতীয় কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়, জার সরকার এগুলিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। নারদনিক আন্দোলন চলাকালীন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার সংস্কার প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর জার তৃতীয় আলেকজান্ডার দ্বিতীয় নিকোলাস সংস্কারের ধারা অব্যাহত রাখেন।

স্টোলিপিন সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকদের ওপর থেকে কমিউনের প্রভাব প্রত্যাহার করা হয়, কৃষকরা জমির অধিকার পেয়েছিল। সরকারি উদ্যোগে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে কৃষকদের ঋণের বোঝা কমানোর চেষ্টা হয়েছিল। এই আন্দোলন চলাকালীন রাশিয়ার বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকেছিল। প্লেখানভ ও তার অনুগামীরা মার্কসবাদে দীক্ষিত হলে রাশিয়ার জনতাবাদী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করেছিল। এরপর থেকে নারদনিক আন্দোলন শুধু কৃষকদের মুক্তির কথা ভাবেনি, সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কথা ভেবেছিল। নারদনিক আন্দোলন রাশিয়ার মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা তুলেছিল। নির্বাচন, ভোটাধিকার, স্বায়ত্তশাসন, নাগরিক অধিকার, শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার ইত্যাদি দাবি উঠেছিল। নারদনিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, মার্কসবাদের বিস্তার ঘটেছিল।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব

লিও ট্রটস্কি লিখেছেন যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব ছিল আসলে মহান অক্টোবর বিপ্লবের মহড়া। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ার জার সরকার ক্রমশ প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যাচারী হয়ে উঠতে থাকে। মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিল। রাশিয়ার সরকার জনগণকে কোনো রাজনৈতিক অধিকার দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিপ্লবী ও সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীগুলি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার (১৮৮১-১৮৯৪) এবং দ্বিতীয় নিকোলাসের (১৮৯৪-১৯১৭) দমন- পীড়নমূলক শাসন, বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্যাতন, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারহীনতা, অর্থনৈতিক মন্দা, কৃষকদের দুর্দশা এবং সরকারের রুশীকরণ নীতি সমস্ত জারবিরোধী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সৈন্যবাহিনীও জার শাসনের প্রতি খুব প্রসন্ন ছিল না। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীর জার বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছিল। বলা যায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ায় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়ে যায়। তবে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের এই বৈপ্লবিক পরিস্থিতি জারতন্ত্রের পতন ঘটাতে পারেনি।

রোমানভ বংশীয় সম্রাটরা রাশিয়ায় আড়াইশো বছর ধরে দায়িত্বহীন, স্বেচ্ছাচারী নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বজায় রেখেছিল। রাশিয়ার জারদের উপাধি ছিল ‘সমগ্র রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসক’ (autocrat of all Russias), আর এই স্বৈরতন্ত্র ছিল দৈবানুগৃহীত ও দায়িত্বহীন। লিও ট্রটস্কি তার হিস্ট্রি অব দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশনে লিখেছেন যে রুশ সরকারের চরিত্র ও গঠন পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে একে প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরাচার ছাড়া আর কিছু আখ্যা দেওয়া যায় না। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেট দেশের অভিজাততন্ত্রের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব পর্যন্ত সেই শাসন কাঠামো অটুট ছিল। রাশিয়ায় স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকার দুটি ঐতিহাসিক কারণ ছিল। রাশিয়ার সামন্ততন্ত্রের সংগঠন ছিল খুবই দুর্বল, আর পূর্ব ও পশ্চিমদিক থেকে এই দেশের ওপর বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। দুর্বল সামন্ততন্ত্র ও দেশের নিরাপত্তার অভাব স্বৈরতন্ত্রকে সজীব রেখেছিল। রাশিয়ার গোঁড়া গ্রিক চার্চ সম্রাটের সহযোগী ছিল, এরা রাজানুগত্য প্রচার করত। রাশিয়ার সম্রাটরা অভিজাত, সৈন্যবাহিনী, পুলিশ, গুপ্তচর বিভাগ এবং চার্চের সহায়তা নিয়ে দেশ শাসন করতেন। রাশিয়ায় আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন, নির্বাচন বা জনগণের ব্যক্তিগত নাগরিক অধিকার ছিল না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক কার্যকলাপ সরকারের স্বীকৃতি পায়নি। এই স্বৈরাচারী কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা সচল রাখতে পারত একজন অসাধারণ প্রতিভাশালী সম্রাট। জারতন্ত্রের শেষপর্বে সম্রাটরা ছিলেন দুর্বল, রানি আলেকজান্দ্রা বা রাসপুটিনের মতো সন্ন্যাসীরা সম্রাট ও শাসনব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

জারতন্ত্রের শেষ পর্বে রাশিয়ায় রাজনৈতিক কার্যকলাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। অনেকগুলি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়-উদারপন্থী, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট সোশ্যাল রেভেল্যুশনারি। উদারপন্থীদের মধ্যে নরমপন্থী ও চরমপন্থী নামে দুটি গোষ্ঠী ছিল। নরমপন্থীরা জার ও জনগণের মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছিল। উভয় গোষ্ঠীর সাধারণ দাবি ছিল গণতান্ত্রিক সংবিধান, রাজনৈতিক অধিকার এবং প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ। উদারপন্থীরা শান্তিপূর্ণ পথে বা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিল। উদারপন্থীদের আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল জনপ্রতিনিধিত্বমূলক জেমস্টোভোগুলি। দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি ছিল মার্কসবাদী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। এরা মনে করত শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির জন্য বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পতন ঘটানো দরকার। এই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন অধিবেশনে মেনশেভিক ও বলশেভিক নামে দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের মধ্যে চরমপন্থী বলশেভিকরা প্রলিতারিয়েত বিপ্লবের ওপর জোর দিয়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণিকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। জারতন্ত্র বিরোধী তৃতীয় দলটি হল সোশ্যাল রেভল্যুশনারি। জনতাবাদী (populist) বা নারদনিক নামে পরিচিত এই আন্দোলন মার্কসবাদ থেকে অনেক আদর্শ গ্রহণ করেছিল তবে মার্কসবাদীদের সঙ্গে এদের পার্থক্য হল এই আন্দোলনের নেতারা কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক জীবনে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। কৃষকদের মুক্তির জন্য তারা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। নারদনিক আন্দোলনের মূল দাবিগুলি ছিল নাগরিক অধিকার, সম্পদ অনুযায়ী কর, জমির জাতীয়করণ, শ্রমিক আইন এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা।

বিপ্লবের আগে বহু বছর ধরে রাশিয়াতে সামাজিক কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল। রুশ সমাজে দুটি প্রধান সামাজিক গোষ্ঠী হল অভিজাত ও সাধারণ মানুষ, এই সাধারণ মানুষদের বেশিরভাগ ছিল কৃষক। রাশিয়ার তিরিশ হাজার অভিজাত ৭০ মিলিয়ন দেশাতিন (এক দেশাতিন সমান ২.৭ একর) জমি ভোগ করত, আর ১০.৫ মিলিয়ন কৃষকের অধীনে ছিল মাত্র ৭৫ মিলিয়ন দেশাতিন জমি। রাশিয়ার কৃষকদের এক-তৃতীয়াংশ ছিল সম্পূর্ণ ভূমিহীন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে কৃষকরা ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামীণ কমিউন বা মিরের অধীনে স্থাপিত হয়। আগের মতো জমির সঙ্গে কৃষকের বন্ধন রয়ে যায় কিন্তু জমির মালিকানা কৃষক পায়নি। কৃষকরা স্বাধীনভাবে মিরের জমি চাষ করতে পারত না, জমি বন্ধক দেওয়া বা বিক্রি করার অধিকারও তাদের ছিল না। উৎপন্ন ফসলের ওপর কৃষকের মালিকানা ছিল না। এককথায় রাশিয়ার কৃষকদের দুর্দশার অবসান হয়নি, কৃষি ছাড়াও অন্যান্য কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হত। এযুগের রাশিয়ায় একটি ক্ষুদ্র শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল, এদের মধ্যে ছিল শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সৈন্যবাহিনীর অফিসার, প্রযুক্তিবিদ ও চিকিৎসক। এই সামাজিক গোষ্ঠী কৃষক ও শ্রমিকের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করত।

রাশিয়ার সদ্যোজাত শিল্প শ্রমিকদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। শিল্পবিপ্লবের গোড়ার দিকে পশ্চিমের শ্রমিক শ্রেণিকে যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় রাশিয়াতে তার সব বর্তমান ছিল। শ্রমিকদের দৈনিক ১৪-১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হত, বেতন ছিল খুব কম। সদ্য গড়ে ওঠা কলকারখানাগুলিতে স্বাস্থ্যরক্ষার কোনো বিধিনিয়ম ছিল না, কাজের পরিবেশ বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা উন্নত ধরনের ছিল না। শ্রমিকরা এত কম বেতন পেত যে পরিবারের আয় বাড়ানোর জন্য শিশু ও মহিলাদেরও কাজ করতে হত। বার্ধক্য, রোগ বা দুর্ঘটনাজনিত কোনো বিমা ব্যবস্থা ছিল না। রাশিয়ার আধুনিক যন্ত্রশিল্পগুলি কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে দ্রুত গড়ে ওঠার জন্য শ্রমিকরা দ্রুত সংঘবদ্ধ হবার সুযোগ পেয়েছিল। পুঁজিবাদী সামাজিক গোষ্ঠী ছাড়া রুশ সমাজে আর একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী হল চার্চ ও যাজকতন্ত্র। রাশিয়ার গোঁড়া গ্রিক চার্চ ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝখানে অবস্থিত এই সামাজিক প্রতিষ্ঠান রাজতন্ত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। রাজতন্ত্র ও চার্চ ছিল পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল (A close alliance between throne and altar)। চার্চের যাজকররা স্বৈরতন্ত্রকে অটুট রাখার জন্য জনগণের মধ্যে আনুগত্য প্রচার করত। বলা যায় চার্চের প্রচার এবং এর বিশাল সামাজিক প্রভাব রাশিয়ায় জারতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছিল।

রাশিয়ার কৃষি অর্থনীতি ছিল অনুন্নত, অনগ্রসর। এই অনগ্রসরতার প্রধান কারণ হল গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সমস্যা জটিলতর হয়েছিল অন্য কারণে। গ্রামীণ মির কৃষি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করত, উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কম কারণ কৃষককে নতুন কৃষি প্রযুক্তি শেখানো হয়নি। আধুনিক ইউরোপীয় কৃষিবিজ্ঞান থেকে রাশিয়া শিক্ষা নেয়নি। মধ্যযুগীয় পদ্ধতিতে চাষ করে রাশিয়ার কৃষক মাথাপিছু উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। রাশিয়ার কৃষি অর্থনীতির তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-ঋণগ্রস্ত কৃষক, চাষযোগ্য জমির অভাব এবং জীবিকার জন্য কৃষকের অন্য পেশা গ্রহণ। শুধু চাষ করে কৃষক জীবিকা নির্বাহ করতে পারত না। রাশিয়ার বেশিরভাগ কৃষক ছিল দরিদ্র, হতাশার মধ্যে বাস করত। জার সরকার কৃষি ঋণ দিয়ে কৃষকদের সাহায্য করেনি, আর ভূস্বামীরা কড়াকড়ি করে সব পাওনা আদায় করে নিত। যদিও সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ করা হয়েছিল রাশিয়ার বহুস্থানে কৃষকদের সামন্তপ্রথা উদ্ভূত বহু অসুবিধা ভোগ করতে হত। এর একটি হল ভাগচাষিদের উৎপাদনের ৫০ শতাংশ ভূস্বামীকে দিতে হত। যেসব কৃষক ঋণের দায়ে ব্যাংকের কাছে জমি বন্ধক রেখেছিল তারাও উৎপন্ন ফসলের ৫০ শতাংশ ব্যাংকে জমা দিত। এসব ছাড়া সামন্ততান্ত্রিক অনেকগুলি কর কৃষককে বহন করতে হত। এরকম পরিস্থিতিতে রাশিয়ার কৃষক দাসত্বের অবসান ও কর ভার লাঘবের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে কৃষকদের বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। এতে কৃষকদের হতাশার পাত্র পরিপূর্ণ হয়েছিল, তাদের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে।

কৃষির তুলনায় রাশিয়ার শিল্পে উন্নতি হয়েছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাশিয়ায় শিল্পায়ন শুরু হয়, তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন রাশিয়ার শিল্পের এমন বিস্তার ঘটেনি যাতে কৃষকদের জীবিকার সংস্থান হতে পারে। রাশিয়ায় বস্ত্র ও ধাতু শিল্পের উন্নতি হয়েছিল, লোহা, কয়লা, তেল ও রেলপথ স্থাপনে অগ্রগতি ঘটেছিল। জারতন্ত্র রাশিয়ায় বিদেশি মূলধন আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এসময়ে বারোশো মিলিয়ন রুবলের অধিক বিদেশি মূলধন রাশিয়ায় লগ্নি করা হয়। এজন্য কয়েক মিলিয়ন রুবল রুশ সরকারকে বিদেশিদের সুদ হিসেবে প্রতিবছর দিতে হত। সরকারি প্রয়াস সত্ত্বেও পশ্চিমি দেশগুলির তুলনায় রাশিয়া শিল্পে অনগ্রসর রয়ে যায়। শিল্পায়নের ফলে রাশিয়ার জনগণের জীবনযাত্রার মানে তেমন উন্নতি হয়নি। রাশিয়ায় মাথাপিছু লোহা, কয়লা, ও বস্ত্র ব্যবহারের হার ছিল বেশ কম। রাশিয়ায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ নির্মাণের কারখানা বেশি গড়ে ওঠেনি। রাশিয়ায় বড়ো রাসায়নিক কারখানা বা মোটর তৈরির কারখানা ছিল না। রাশিয়ার শিল্পায়নের এক বৈশিষ্ট্য হল এর অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। রাশিয়ার মোট শিল্প শ্রমিকের ৫০ শতাংশের বেশি বড়ো বড়ো কারখানায় কাজ করত। অল্প সময়ের মধ্যে বৃহৎ আধুনিক শিল্পগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়, কৃষি ও অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাশিয়ার অসংখ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বন্ধ হয়ে যায়, এসব শিল্পে নিযুক্ত হাজার হাজার কৃষক-শিল্পী বেকার হয়ে যায়। রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নতি হয়নি কারণ বিদেশে রপ্তানি করার মতো ভোগ্যপণ্য রাশিয়ায় ছিল না। রাশিয়ার শিল্পপণ্য বিদেশের বাজারে সমাদর পায়নি। বিপ্লবের আগে সারা পৃথিবীর বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ৪ শতাংশ ছিল রাশিয়ার, আর এই বৈদেশিক বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ রপ্তানি পণ্য হল খাদ্যশস্য। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের আগে জার্মানি রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি বন্ধ করেছিল, এর ফলে রাশিয়ার অভিজাত ও কৃষকরা অসুবিধায় পড়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিককার সর্বাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের মন্দা রাশিয়ার সর্বত্র দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও হতাশার সৃষ্টি করেছিল। অর্থনৈতিক মন্দা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

আইজাক ডয়েশ্চার (Isaac Deutscher) লিখেছেন যে বিপ্লবের আগে রাশিয়ার কৃষকদের অবস্থা এমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল যে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ ছিল অবশ্যম্ভাবী। এর কারণ চিহ্নিত করা মোটেই কঠিন নয়। রাশিয়ার জার সরকার সামরিক শক্তি ও রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ক্রমাগত অর্থ ব্যয় করে চলেছিল। তাছাড়া সারাদেশে রেলপথ স্থাপনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। সরকার দেশকে আধুনিক করার জন্য শিল্পায়নের পথ ধরেছিল, এজন্য বিদেশিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে হয়। এই বিশাল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের একটি বড়ো অংশ কৃষকদের কাঁধে চাপানো হয়। হিউ সেটন ওয়াটসন ডয়েশ্চারের বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত হয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে রাশিয়ার অভিজাত বর্গের সম্মান, সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির আধুনিকীকরণের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা পরোক্ষভাবে এসেছিল বিদেশি পুঁজিপতিদের ঋণ এবং শস্য রপ্তানি থেকে। রাশিয়ার কৃষক ও শ্রমিকদের ওপর স্থাপিত প্রত্যক্ষ কর থেকে সম্রাটের কোষাগার পূর্ণ হয়েছিল।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ সম্মিলিতভাবে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রাশিয়ার দ্বিতীয় রাজধানী সেন্ট পিটারসবার্গে ধর্মঘট হয়। ৯ জানুয়ারি রবিবার গ্রেগরি গ্যাপন নামক এক ধর্মযাজকের নেতৃত্বে শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবে রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যায়। প্রাসাদরক্ষীরা আতঙ্কিত হয়ে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে শত শত শ্রমিক নিহত হয়। এই ঘটনাটি বিপ্লবের ইতিহাসে রক্তাক্ত রবিবার (Bloody Sunday) নামে পরিচিত। এই রক্তাক্ত রবিবারের পরদিন থেকে সারা দেশে ধর্মঘট ও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আন্দোলনকারীরা জার সরকারের কাছে কতকগুলি দাবি রেখেছিল। এরা দাবি করেছিল সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ইতিমধ্যে রুশ-জাপান যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয় ঘটলে রুশ সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে থাকে। সারাদেশের সর্বত্র কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। শহরে শ্রমিক ও পেশাদারি মানুষজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তুলেছিল।

এই সংকটজনক মুহূর্তে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাস মনস্থির করে উঠতে পারেননি। তিনি একসময় মনে করেন দেশে সামরিক একনায়কতন্ত্র স্থাপন করে বিপ্লবকে ধ্বংস করবেন। জনগণকে সীমিত ভোটাধিকার দিয়ে আইনসভা গঠনের কথাও তিনি ভেবেছিলেন। ইতিমধ্যে ধর্মঘট রেলপথ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে (October Manifesto) এক রাজনৈতিক ঘোষণায় তিনি বিরোধীদের দাবিগুলি মেনে নেন। এগুলির মধ্যে ছিল কেন্দ্রে নির্বাচিত আইনসভা গঠন, দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণকে মৌলিক অধিকার দান। জারের অক্টোবর ঘোষণা অনুযায়ী দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়, কেন্দ্রীয় আইনসভা ডুমা (Duma) গঠন করা সম্ভব হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠিত হবার পর বিরোধিরা দেখলেন সম্রাট তাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলির বেশিরভাগ বাস্তবায়িত হয়নি। সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি বাতিল করা হয়, জনগণকে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়নি। বলা যায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবে জারতন্ত্র বিরোধীরা বিশেষ কিছু লাভ করতে পারেনি। বিক্ষুব্ধ সমাজতন্ত্রী ও সন্ত্রাসবাদীরা আবার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু করেছিল। অল্পকিছু সংস্কার প্রবর্তিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু পুরোনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো অটুট রয়ে যায়।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের ব্যর্থতা

ডেভিড টমসন লিখেছেন যে একটি বিপ্লব তখনই সফল হয় যখন বিরোধী শক্তি প্রতিষ্ঠিত শক্তির চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়। বিরোধীরা যদি শক্তিকে সংহত করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে না পারে তাহলে বিপ্লব সফল হয় না। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিরোধীরা শক্তিশালী হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙে দিতে পারেনি। রাশিয়ার প্রশাসন, পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী অটুট ছিল। বিপ্লবের প্রথম ধাক্কায় অপ্রস্তুত সম্রাট কিছুকাল অপেক্ষা করলেন। যে মুহূর্তে বিপ্লবের উচ্ছ্বাস, আবেগ প্রশমিত হয়ে এল সম্রাট তার প্রশাসন যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের দমন করলেন। নিষ্ঠুর দমনপীড়নের মাধ্যমে বিপ্লবী শক্তিকে পরাস্ত করা হল।

সেন্ট পিটার্সবার্গের শ্রমিকদের দাঙ্গার মধ্য দিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার রাশিয়ার এই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কখনো ঐক্যবদ্ধ ছিল না। তারা একসঙ্গে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল কারণ এরা সকলে ছিল জারতন্ত্র বিরোধী। এদের মধ্যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও সোশ্যাল রেভেল্যুশনারি, কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্র্যাট বা ক্যাডেটদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মসূচি ছিল। সরকার রাজনৈতিক দলগুলির এই মতপার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব ছিল, কর্মসূচি ও শৃঙ্খলা না থাকায় বিপ্লব সফল হতে পারেনি। রাশিয়ার জনগণের বেশিরভাগ ছিল কৃষক। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। এই বিদ্রোহগুলি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বিক্ষিপ্ত ও অনিয়ন্ত্রিত। কোনো কোনো স্থানে বিদ্রোহী কৃষকরা কর্তৃপক্ষকে তাদের কতকগুলি দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। এই দাবিগুলির মধ্যে ছিল ঋণ পরিশোধের ওপর স্থগিতাদেশ, ভূমিকর ও অন্যান্য কর হ্রাস বা মকুব করা এবং কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা। কৃষকরা স্থানীয়ভাবে এসব সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হলেও সারাদেশের কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে পারেনি। এই সময়কার রাশিয়ায় আর একটি শক্তিশালী বিপ্লবী সামাজিক গোষ্ঠী হল শিল্প শ্রমিক। শোষিত, লাঞ্ছিত কৃষক ও শ্রমিকের যৌথ আন্দোলন জারতন্ত্রের পতন ঘটাতে পারত। এই দুই গোষ্ঠী বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করার জন্য বিপ্লব সফল হয়নি।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবে সৈন্যবাহিনী সরাসরি অংশ নেয়নি। জার শাসিত রাশিয়ায় সৈন্যবাহিনী ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সৈন্য ও নৌবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল, সৈন্যবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিপ্লব থেকে দূরে সরে ছিল। জার দ্বিতীয় নিকোলাস বিপ্লব দমনের কাজে সৈন্যবাহিনীর আনুগত্য ও সহায়তা পেয়েছিলেন। স্বৈরাচারী সরকারের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী অটুট থাকলে তার পতন ঘটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিপ্লবের সময় দেশি ও বিদেশি পুঁজিপতিরা সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। ফরাসি পুঁজিপতিরা অকাতরে সম্রাটকে অর্থ জুগিয়ে গিয়েছিল, অভিজাতরা নানা কারণে জারকে সাহায্য দিয়ে যান। বিপ্লব দমনের সময় জার সরকারকে কোনো অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়নি। সবশেষে বলা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও হিংসার ব্যাপক বিস্তৃতি অভিজাত, উদারপন্থী রাষ্ট্রনেতা এবং যাজক সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। দেশে শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য এসব লোকেরা জার প্রশাসনের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিল। শুধু অভিজাত ও যাজকরা নন, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন এবং সংবিধানপন্থী রাষ্ট্রনেতারা ব্যাপক দাঙ্গা- হাঙ্গামায় ভয় পেয়ে যান। এদের সহযোগিতা জারকে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী করেছিল। বিপ্লব দমন করতে জারকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।

রুশ বিপ্লব ও এর কারণ (১৯১৭)

মহাযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপের ইতিহাসের একটি বড়ো ঘটনা হল রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার তিনশো বছরের পুরোনো রোমানভ রাজবংশের পতন ঘটে, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে পুঁজিবাদ থেকে উদ্ভুত আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রথম বাস্তবায়িত হয় শিল্পে অনুন্নত রাশিয়ায়, পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে নয়। বলশেভিক বিপ্লব হল ঐদেশের বহুযুগের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীরা পরিবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীর দুর্বলতা, সরকারের অপদার্থতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি প্রকটভাবে ধরা পড়েছিল (The losses and defeats of Russia’s armies had been more catastrophic, the breakdown of her government more complete, the collapse of her social and economic structure more disastrous, than that of any other state)। ডেভিড টমসনের মতে, এটাই হল বিপ্লবের সাফল্যের সবচেয়ে বড়ো কারণ।

রাশিয়ার রোমানভ বংশীয় শাসকরা দীর্ঘকাল ধরে স্বৈরাচারী, দৈবানুগৃহীত বংশানুক্রমিক শাসন বজায় রেখেছিলেন। এই শাসন আদৌ যুগোপযোগী ছিল না (The fundamental cause of the Russian Revolution was the incompatibility of the tsarist state with the demands of modern civilization)। রাজতন্ত্রের সুশাসনের কোনো দায়িত্ব ছিল না, জনগণের কোনো অধিকার ছিল না। বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম কর্ণধার লিও ট্রটস্কি তার বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাসে লিখেছেন যে, রাশিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন ও প্রকৃতিতে ছিল প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরাচারের মতো। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেট অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করে অতিকেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলেন। রানি ক্যাথারিন অভিজাতদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাতে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। বলশেভিক বিপ্লব পর্যন্ত এই রাষ্ট্রযন্ত্র অটুট ছিল। রাশিয়ার স্বৈরাচার পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ও ক্ষমতাশালী ছিল কারণ এখানে অভিজাতরা রাজতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। পশ্চিম ইউরোপে ভূমি-নির্ভর অভিজাতরা রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। জারের স্বৈরাচারের প্রধান উৎস ছিল সৈন্যবাহিনী। পূর্ব ও পশ্চিম থেকে রাশিয়ার ওপর আক্রমণের আশঙ্কা সবসময় ছিল, এজন্য রাশিয়ার সম্রাটরা নিয়মিতভাবে বিশাল সৈন্যবাহিনী পোষণ করতেন। রাশিয়ার গোঁড়া গ্রিক চার্চ ছিল রাজতন্ত্রের সহযোগী, রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, চার্চ রাজানুগত্য প্রচার করত।

প্রশাসনিক কাঠামোয় রাশিয়ার জাররা ছিলেন সর্বেসর্বা (the autocrat of all Russias)। জার মন্ত্রীদের নিয়োগ করতেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে জারের কাছে দায়বদ্ধ থাকত, মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্ব ছিল না, ক্যাবিনেট প্রথা গড়ে ওঠেনি। ভোটাধিকার, নাগরিক অধিকার বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রাশিয়ায় ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠান জেমস্টোভো গঠিত হয়, জাতীয় আইন সংসদ ডুমা স্থাপিত হয়। সীমিত পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর এগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল, এদের বিশেষ কার্যকর ক্ষমতা ছিল না। জারের প্রশাসন যন্ত্রটির সম্প্রসারণ ঘটেছিল, একজন দক্ষ, পরিশ্রমী সম্রাট একে পরিচালনা করতে পারতেন, অপদার্থ অযোগ্যরা মন্ত্রীদের ওপর নির্ভর করতেন, শাসনক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। রোমানভ বংশের শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনকালে অব্যবস্থা দেখা দিয়েছিল। জারের অযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে রানির আস্থাভাজন সন্ন্যাসী রাসপুটিন ক্ষমতার অপব্যবহার করেন।

রাশিয়ার জাররা প্রাদেশিক গভর্নর, সৈন্যবাহিনী, পুলিশ, গুপ্তচর বিভাগ ও আমলাদের নিয়ে দেশ শাসন করতেন। কাউন্সিল অব স্টেট নামে একটি সংস্থা জারকে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে পরামর্শ দিত, সেনেট সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করত। প্রশাসন যন্ত্রটি পরিচালনা করত জারের সচিবালয় বা চ্যান্সেলারি। এই সচিবালয় তিনভাগে বিভক্ত ছিল-প্রথম বিভাগের কাজ ছিল আইনের খসড়া তৈরি করা, দ্বিতীয় বিভাগ এটি নথিবদ্ধ করে প্রচার করত, আর তৃতীয়টি ছিল পুলিশ ও গুপ্তচর বিভাগ। প্রায় বিনাবাধায় রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসকেরা দেশ শাসন করতেন, জার ইচ্ছামত ডুমা বা জেমস্টোভো ভেঙে দিতে পারতেন। সরকারি কর্মচারী ও পুলিশ বিভাগ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর প্রভাব বিস্তার করত। রাশিয়ায় কোনো প্রকৃত গণ- প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ছিল না, জনমত প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মতো রাশিয়ার সমাজে ছিল দুটি শ্রেণি-অভিজাত এবং কৃষক-শ্রমিক। অভিজাতদের বেশিরভাগ ছিল ভূমির ওপর নির্ভরশীল, দেশের বেশিরভাগ জমি ছিল এদের দখলে। বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার মাত্র তিরিশ হাজার জমিদার ৭০ মি. দেশাতিন (২.৭ একর) জমি ভোগ করত, অপরদিকে ১০.৫ মি. কৃষকের অধিকারে ছিল মাত্র ৭৫ মি. দেশাতিন জমি, রাশিয়ার কৃষকদের মধ্যে এক- তৃতীয়াংশের কোন জমি ছিল না, এরা ছিল ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। রাশিয়ার কৃষি অর্থনীতির দুরবস্থা ও কৃষকদের দারিদ্র্য রুশ বিপ্লবের একটি প্রধান কারণ। রাশিয়াতে ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ হলেও এই প্রথার অনেক ত্রুটি রয়ে যায়। কৃষকের ওপর করের চাপ ছিল খুব বেশি। ভূমিহীন কৃষক ভূস্বামী বা ব্যাংকের কাছ থেকে বন্ধকী জমি নিয়ে ভাগচাষি হিসেবে চাষ করত, এতে বেশিরভাগ কৃষকের লাভের পরিমাণ হত সামান্য। কৃষককে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যের জোতে কাজ করে আয় বাড়াতে হত। এসময় রাশিয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল খুব বেশি, চাপ পড়েছিল কৃষি অর্থনীতির ওপর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবার জন্য কৃষকের জোতের আয়তন ক্রমশ ছোটো হতে থাকে, জমির চাহিদার সৃষ্টি হয়। রাশিয়ার কৃষক ভূস্বামীর জমি অধিগ্রহণ করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের দাবি তুলেছিল, কৃষক করভার থেকে অব্যাহতি চেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের একটি অংশ এই দরিদ্র কৃষকদের বহন করতে হত।

প্রাক-বিপ্লব যুগের ফরাসি ও রুশ কৃষকের মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। রুশ বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার আইজাক ডয়েসচার (Issac Deutscher) জানিয়েছেন যে, বলশেভিক বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তে রাশিয়ার কৃষকদের মধ্যে অগ্নিগর্ভ বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি অর্থনীতি ভেঙে পড়তে থাকে। কৃষকদের বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে হত, এজন্য ৫০ শতাংশ কৃষক ভূমি থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যুদ্ধের প্রয়োজনে কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় পশু হত্যা করা হয়। শিল্পগুলি যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে নিযুক্ত থাকায় কৃষি যন্ত্রপাতির উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমেছিল। এসবের ফলে রাশিয়ার কৃষিতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। কৃষি উৎপাদন কমার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের করের বোঝা বেড়েছিল, সরকার কৃষি অর্থনীতির সংস্কারের দিকে নজর দেয়নি। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে স্টোলিপিন যেসব সংস্কার প্রবর্তন করেন তাতে সম্পন্ন কৃষকরা লাভবান হয়েছিল, কৃষি অর্থনীতির মৌল সমস্যাগুলির সমাধান হয়নি। কৃষি অর্থনীতিতে ছিল অপরিসীম দারিদ্র্য, হতাশা ও ক্ষোভ। হিউ সেটন-ওয়াটসন জানিয়েছেন যে, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, সৈন্যবাহিনী ও আধুনিকীকরণের জন্য রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়েছিল। রাষ্ট্র দুভাবে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিল-শস্য রপ্তানি, বিদেশি ঋণ ও কৃষক-শ্রমিকের ওপর স্থাপিত করের বোঝা থেকে।

উনিশ শতকে রাশিয়ায় শিল্পায়ন শুরু হয়েছিল, শতকের শেষদিক থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পোন্নয়নের হার বাড়ানো হয়। বস্তু, লোহা, ইস্পাত, কয়লা, তেল ও রেলপথে বিদেশি পুঁজি লগ্নি করা হয়। শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পুঁজিপতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা ছিল কম। রাশিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি দ্রুত যন্ত্রশিল্পগুলি গড়ে তোলা হয়। শিল্প-শহরগুলিতে কারখানা শ্রমিকরা কেন্দ্রীভূত হয়, রাশিয়ার বিপ্লবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ছিল। রাশিয়ায় শিল্পপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল সীমিত, কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি ছিল না। বিদেশের বাজারে রাশিয়ার শিল্পপণ্য প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারেনি। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের সঙ্গে তুলনায় রাশিয়ায় শিল্পোন্নয়নের হার ছিল কম, উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ ছিল কম। রাশিয়ার শিল্প শ্রমিকরা কম বেতন পেত, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের কাজ করতে হত, কাজের সময় ছিল দীর্ঘ। শ্রমিকদের ক্ষোভ ও হতাশা বলশেভিক বিপ্লবের একটি প্রধান কারণ (The deteriorating standard of living inevitably fuelled popular discontent and was the most important factor in the February (March) Revolution of 1917)।

ফরাসি বিপ্লবের মতো রুশ বিপ্লবের মনোলোক গঠন করেন রুশ লেখক, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা। জার প্রথম নিকোলাস রাশিয়ায় পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। তার সযত্ন প্রয়াস সত্ত্বেও রাশিয়ায় পশ্চিমের ভাবধারা, মানবতাবাদ, উদারনৈতিক আদর্শ ইত্যাদির প্রভাব পড়েছিল। রাশিয়ার কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা এই ভাবধারার প্রসারে সহায়তা দেন। টলস্টয়, তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি, পুশকিন গোর্কি রুশ সাহিত্যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। কার্ল মার্কস, বাকুনিন ক্রোপটকিনের লেখা রাশিয়ায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নৈরাজ্যবাদী চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছিল। রাশিয়ার নিহিলিস্টরা রাশিয়ার পুরোনো সমাজ কাঠামো ভেঙে ফেলে নতুন সমাজ গঠনে কথা বলেছিল, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ার কৃষকদের মধ্যে নারদনিক আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। এই আন্দোলন কৃষি অর্থনীতির সমস্যার সমাধানের ওপর জোর দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিল। রাশিয়ায় ঘন ঘন কৃষক বিদ্রোহ হত, বুদ্ধিজীবীরা এইসব বিদ্রোহকে সমর্থন করত। তবে কৃষক বিদ্রোহ বা কৃষক আন্দোলন রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, পরিবর্তনমুখী মানসিকতা তৈরি করেছিল।

স্বৈরাচারী দেশ রাশিয়ায় আইনানুসারে রাজনৈতিক দল গঠন বা রাজনৈতিক আন্দোলন নিষিদ্ধ ছিল। জারতন্ত্র রাজনৈতিক দলকে স্বীকৃতি না দিলেও রাশিয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। বিপ্লবের প্রাক্কালে রাশিয়ায় রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছিল চারটি-উদারনৈতিক, সমাজবাদী গণতান্ত্রিক, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী ও ছাত্র সংগঠন। উদারনৈতিক দলের সদস্যরা গণতান্ত্রিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছিল। এদের দাবির মধ্যে ছিল লিখিত সংবিধান, গণতান্ত্রিক অধিকার, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এবং দৈহিক শাস্তির অবসান। সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দলের সদস্যরা ছিল মার্কসবাদী। মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অনুসরণ করে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে এরা বর্তমান ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে সমাজতন্ত্রীরা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি গঠন করেছিল। এই দলের নরমপন্থীরা মেনশেভিক ও চরমপন্থীরা বলশেভিক নামে পরিচিত ছিল, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে এই দুই গোষ্ঠী পৃথক হয়ে যায়। লেনিনের নেতৃত্বে এই বলশেভিক দল রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল। তৃতীয় গোষ্ঠীটি ছিল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল, সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকদের মুক্তি অর্জন করা ছিল এই দলের আদর্শ। এদের অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার, শ্রমিক আইন, কর ব্যবস্থায় সাম্য, অধীনস্থ জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং কৃষি জমির জাতীয়করণ। চতুর্থ রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি ছিল ছাত্রদের, ছাত্র অধিকার রক্ষার জন্য এগুলি গঠিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ার দুর্বলতা প্রকাশ পায় কারণ রাশিয়া এই যুদ্ধের জন্য অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না (Russia was unprepared agriculturally, industrially, or financially to fight a long war)। যুদ্ধ রাশিয়ার সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছিল, জনগণ দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় (the war threw a glaring light on its inadequacies, at the sametime exposing the Russian people to hardships and suffering that made them increasingly intolerant of their lot)। যুদ্ধের অভিঘাতে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রথম তিনবছর রাশিয়ার সৈন্যরা সকলে যুদ্ধাস্ত্র পায়নি, সেই সঙ্গে ছিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। সাধারণ মানুষ, কৃষক ও সৈন্যবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছিল। রণাঙ্গনে অভুক্ত, অস্ত্রহীন, পোশাকহীন সৈন্যবাহিনী পরপর পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় আইনসভা ডুমাতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রী দল, সমাজতন্ত্রী ও নরমপন্থীরা একটি বিরোধী ফ্রন্ট গঠন করেছিল। এই ফ্রন্ট জারের কাছে আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ সরকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার দাবি করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনী শান্তির জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিল, দেশের সর্বত্র দাবি উঠেছিল খাদ্যের। কৃষকরা সামন্তব্যবস্থা থেকে মুক্তি ও জমির অধিকার দাবি করেছিল। রাজধানী পেত্রোগ্রাদ শহরে শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছিল, সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছিল। জার দ্বিতীয় নিকোলাস সৈন্যবাহিনী দিয়ে এই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করেন। সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ জার পদত্যাগ করেন। তার ভ্রাতা মাইকেল জার পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে রাশিয়ায় কার্যত এক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।

অস্থায়ী সরকারের প্রধান হন প্রিন্স লভ (Lvov)। তার সরকারে সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন, সমাজতন্ত্রী আলোকজান্ডার কেরেনস্কি এর সদস্য ছিলেন। মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত (১৯১৭) এই অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেছিল। মেনশেভিক, বলশেভিক ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা এই সরকারের সঙ্গে অল্পকাল সহযোগিতা করেছিল। আইজাক ডয়েসচার একে বলেছেন, ‘প্রজাতন্ত্রের মধুচন্দ্রিমা পর্ব’ (honeymoon of the March republic)। প্রজাতন্ত্রের সামনে অনেকগুলি সমস্যা ছিল, প্রথমটি ছিল যুদ্ধ ও শান্তির সমস্যা। জনগণ যুদ্ধ বিরোধী হয়ে উঠেছিল, অথচ সরকারের কয়েকজন সদস্য যুদ্ধ চালানোর পক্ষপাতী ছিল। জুলাই মাসে (১৯১৭) লভকে সরিয়ে কেরেনস্কি প্রধানমন্ত্রী হন, তিনি যুদ্ধ চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন। ইতিমধ্যে বলশেভিক দলের প্রধান লেনিন দেশে ফিরে এসে তার বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ ঘোষণা করেন। এপ্রিল থিসিসে তিনি বলেছিলেন, কৃষকদের জমি দিতে হবে, শ্রমিকদের কারখানা এবং সব ক্ষমতা থাকবে সোভিয়েতের হাতে (Land to the tillers, factory to the workers and all powers to the Soviets)। অস্থায়ী সরকারের সমালোচনা করে লেনিন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপন করতে বলেন, ভূমি সংস্কার ও অধীনস্থ জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলেছিলেন। কেরেনস্কি সরকার খাদ্য, ভূমি, শ্রমিক ও জাতীয়তাবাদের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

যুদ্ধের ধাক্কায় কেরেনস্কির অস্থায়ী, বুর্জোয়া, প্রজাতন্ত্রী সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেনাপতি কর্নিলভ বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখলের প্রয়াস চালিয়েছিলেন, এতে এই সরকার আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কর্নির্লভ বিদ্রোহের সময় বলশেভিক দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল, বলশেভিক দল নিজেকে খাঁটি বিপ্লবী দল বলে জনমনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোর সোভিয়েতগুলিতে বলশেভিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল আর রাজধানীতে মোতায়েন করা সৈন্যবাহিনী বলশেভিকদের সমর্থন করেছিল। বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তে লেনিনের সহযোগীরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন (a leap in the dark)। রাশিয়াতে পুঁজিবাদ বা বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তারা মনে করেন যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় হয়নি। লেনিন তত্ত্বের চেয়ে বাস্তব পরিস্থিতির ওপর বেশি জোর দেন। তার নেতৃত্বে বলশেভিক দল অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রী সরকারের পতন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর (ইংরেজি ৭ নভেম্বর) বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে লেনিনের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করেছিল।

বলশেভিকদের সাফল্য: লেনিনের ভূমিকা

বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত অক্টোবর বিপ্লব নানাকারণে সাফল্যলাভ করেছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাশিয়ায় সেসব রাজনৈতিক দল ছিল তাদের মধ্যে বলশেভিক হল একমাত্র দল যার জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এই দল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ঠিকমতো বুঝে নিয়ে তাদের কর্মসূচি তৈরি করেছিল। এই দলের কর্মসূচির পেছনে বিপুল গণসমর্থন ছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দেশে ফিরে এসে লেনিন এপ্রিল থিসিসে কৃষকদের হাতে জমি, শ্রমিকদের কারখানা এবং সব ক্ষমতা সোভিয়েতগুলির হাতে তুলে দিতে বলেন। লেনিন আরও বলেছিলেন এসব সংস্কার কার্যকর করার আগে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। জনগণের সব দাবিগুলিকে নিয়ে লেনিন তার বিপ্লবী কর্মসূচি প্রণয়ন করেন, এই কর্মসূচির ভিত্তিতে রাশিয়ার কৃষক, শ্রমিক ও সৈন্যরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

ট্রটস্কি তার রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে (History of the Russian Revolution) জানিয়েছেন যে, একটি সফল বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন হয় তিনটি জিনিসের- অগ্নিগর্ভ বাস্তব পরিস্থিতি (objective condition), একটি সুগঠিত, সুদক্ষ বিপ্লবী রাজনৈতিক দল, এবং তৃতীয়টি হল যোগ্য নেতৃত্ব। যুদ্ধের শুরু থেকে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। সুদক্ষ, সুগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে ছিল বলশেভিক দল, এই দলে ছিল কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা। লেনিন চেয়েছিলেন একটি ছোটো বিপ্লবী রাজনৈতিক দল যার সদস্যরা হবেন অভিজ্ঞ বিপ্লবী, এই দলকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন। দলের মধ্যে নেতৃত্ব, নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে কোনো মতবিরোধ থাকবে না। মতবিরোধের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখা দিলে লেনিন কঠোরভাবে তা দমন করেন। দোদুল্যমান, সন্দেহপরায়ণ অবিশ্বাসী সদস্যদের দল থেকে নির্দয়ভাবে বহিষ্কার করা হয়, এটি ছিল এই দলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এভাবে বলশেভিক দল একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দলে পরিণত হয় আর এই বিপ্লবী দল পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।

লিও ট্রটস্কি বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখছেন: ‘বিপ্লব চলাকালীন দেখা গেল ব্যক্তির ভূমিকা কিছুমাত্র কম নয়। ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় ব্যক্তি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে থাকে।’ ঐতিহাসিকরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, লেনিনের নেতৃত্ব না পেলে বলশেভিক দল অক্টোবর বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নিত না। একটি রাজনৈতিক দলের তত্ত্ব যতই সঠিক হোক না কেন, গৌরবোজ্জ্বল অতীত থাক না কেন, সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সে দল ব্যর্থ হতে পারে। জাতীয় জীবনের বাস্তব পরিস্থিতি বিপ্লবের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে, বিপ্লবী দল ও নেতৃত্ব সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব ঘটাতে পারে। মার্কসের নিজের দেশ জার্মানিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ঐ দেশ রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি শিল্পোন্নত ছিল, কিন্তু সেখানকার সমাজতন্ত্রী দল স্পার্টাকাস বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। স্পার্টাকাস বলশেভিক দলের মতো সুগঠিত ও সুদক্ষ ছিল না, আর এই দলের নেতা কার্ল লিবনেক্ট লেনিনের মতো প্রতিভাবান ছিলেন না। লিবনেক্ট ও রোজা লুক্সেমবার্গ দুজনেই অভ্যুত্থানে নিহত হন। বলশেভিক বিপ্লবে বাস্তব পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।

ফরাসি বিপ্লবের মতো রুশ বিপ্লবের সময় রোমানভদের শাসন, নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের নানা দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল। জার দ্বিতীয় নিকোলাস ছিলেন দুর্বল চরিত্রের অপদার্থ শাসক, রানি ও সন্ন্যাসী রাসপুটিন তাকে পরিচালনা করতেন। সৈন্যবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে এজন্য বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। অপরদিকে বলশেভিক দল তাদের দক্ষতা, কৌশল ও প্রচারের মাধ্যমে বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিল। জার শাসনব্যবস্থায় যত অপদার্থতা দেখাতে থাকেন বলশেভিকরা ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শেষ মুহূর্তে জার সৈন্যবাহিনীর ওপর নির্ভর করেছিলেন, ডুমা ভেঙে দিয়ে রাজধানী পেত্রোগ্রাডে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর) সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করেন। বলশেভিক দল এই সৈন্যবাহিনীর সমর্থন লাভ করেছিল, অনন্যোপায় হয়ে জার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জার পদত্যাগ করার পর প্রিন্স লভের নেতৃত্বে অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই সরকারের নেতৃত্ব দেন কেরেনস্কি। এই অস্থায়ী সরকার জনগণের দাবি অনুযায়ী কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। জনগণের দাবি ছিল যুদ্ধের অবসান, খাদ্য, ভূমিসংস্কার, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি এবং অধীনস্থ জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। রাশিয়ার বুর্জোয়া অস্থায়ী সরকার এইসব মৌল সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, অস্থায়ী সরকার সফল হলে বিপ্লব ঘটানো সহজ হত না। অস্থায়ী সরকারের ব্যর্থতা বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের আর একটি বড়ো কারণ হল সারাদেশে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে লেনিন ও তার দল একে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। লেনিন মনে করেন যে, এই যুদ্ধ থেকে শুধু পুঁজিপতিরা লাভবান হবে। তিনি রাশিয়াকে এই যুদ্ধ থেকে সরে আসার পরামর্শ দেন। যুদ্ধের শুরু থেকে রুশ সৈন্যবাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। ক্রমাগত সামরিক বিপর্যয়ের ফলে সৈনিকদের মনোবল ভেঙে যায়, দেশের সর্বত্র হতাশা ও অবসাদ দেখা দিয়েছিল। জার পদত্যাগ করার পর অস্থায়ী সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বলশেভিক দল অস্থায়ী সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছিল। বলশেভিক দল প্রস্তাব দিয়েছিল ‘ভূমিখণ্ড নয়, ক্ষতিপূরণ নয়’ এই শর্তে জার্মানির সঙ্গে শান্তি স্থাপন করা যেতে পারে (No annexations, no indemnity)। লেনিনের যুদ্ধবিরোধী নীতির জন্য জার্মান সৈন্যবাহিনী তাকে দেশে ফিরতে সহায়তা দিয়েছিল। রাশিয়ার অভুক্ত, নিরস্ত্র, পরাজিত, বিধ্বস্ত সৈন্যরা শান্তি চেয়েছিল, যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্য বলশেভিক দল সৈন্যবাহিনীর সমর্থন লাভ করেছিল। সৈন্যবাহিনীর সমর্থন না পেলে বিপ্লব ঘটানো সহজ হত না। সৈন্যবাহিনীর সমর্থন নিয়ে লেনিন ও বলশেভিক দল অক্টোবরের বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়।

রুশ বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় বিপ্লব কখনো আকস্মিকভাবে ঘটে না, একটিমাত্র কারণে বিপ্লব হয় না। একটিমাত্র অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বিপ্লব ঘটাতে পারে কিন্তু তার পশ্চাতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অভিযোগ ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখে (Revolution rarely come suddenly and never by a chance. A single spark may fire the train but the train must have heen long and carefully laid)। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর বিপ্লব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, কোনো একটি কারণে হঠাৎ করে ঘটেনি। রাশিয়ার জারতন্ত্রের দীর্ঘদিনের অপশাসন এবং কৃষক ও শ্রমিকদের দুরবস্থা বিপ্লবের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল। রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষকেরা ছিল শোষিত ও উৎপীড়িত, শ্রমিকদের জীবনযাত্রাও উন্নতমানের ছিল না, কাজের সময় ছিল বেশি, মজুরি ছিল কম। রাশিয়ার সদ্যোজাত মধ্যবিত্তের গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন লাভ করেনি। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে রাশিয়ায় নৈরাজ্যবাদী, জনতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চলেছিল। পশ্চিমি ভাবধারায় পুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা ভোটাধিকার, নির্বাচন, নির্বাচিত আইনসভা, দায়িত্বশীল সরকার ইত্যাদির দাবি তুলেছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধ রাশিয়ার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সব দুর্বলতা প্রকাশ করে সৈন্যবাহিনী খাদ্য, পোশাক ও অস্ত্র পায়নি, দেশে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব ছিল, ভোগ্যপণ্য দুষ্প্রাপ্য হয়েছিল। সৈন্যবাহিনী এই যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি, বিভিন্ন যুদ্ধে পরাস্ত হতে থাকে, সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব দেখা দিয়েছিল। লেনিন এই বাস্তব পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি গঠিত হয়, লেনিন এই দলের সদস্য ছিলেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে এই দল লন্ডন অধিবেশনে দুভাগে ভাগ হয়ে যায়-মেনশেভিক ও বলশেভিক। লেনিন বলশেভিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। লেনিন এই দলকে নেতৃত্ব দেন, একটি যথার্থ বিপ্লবী দল হিসেবে তিনি একে গড়ে তোলেন। দলের কর্মপদ্ধতি ও কৌশল তিনি ঠিক করে দেন। লেনিন রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে একটি ছোটো, সুগঠিত বিপ্লবী দল গঠনের কথা বলেছিলেন। দলের মধ্যে নীতি ও শৃঙ্খলা নিয়ে কোনোরকম মতভেদ থাকবে না, দোদুল্যমান ব্যক্তিদের তিনি দল থেকে সরিয়ে দেন (The revolutionary party should be dominated by a trained group of professional revolutionaries whose one objective was to given leadership in the inevitable proletarian revolution)। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অভ্যুত্থানের পর জার দ্বিতীয় নিকোলাস পদত্যাগ করেন, দেশে বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এই প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার মৌল সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারেনি। এই সরকার (লভ ও কেরেনস্কি) যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করেছিল। দেশের ভূমি সংস্কার, শ্রমিক বিক্ষোভ, খাদ্যাভাব ইত্যাদি সমস্যার সমাধান হয়নি, সীমান্তে যুদ্ধরত সৈনিকরা শান্তি চেয়েছিল।

রাশিয়াতে যখন রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে লেনিন তখন সুইজারল্যান্ডে ছিলেন। তিনি ধীর ও স্থিরভাবে রাশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে বিপ্লবের মুহূর্ত সমাগত। তিনি জার্মান কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়ে রাশিয়ায় ফিরে আসেন, জার্মানরা তাকে সাহায্য করেছিল কারণ তারা তার যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কথা জানত। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দেশে ফিরে লেনিন তার বিখ্যাত এপ্রিল থিসিসে বললেন যে কৃষকদের জমি, শ্রমিকদের কারখানা এবং সব ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সোভিয়েতের হাতে তুলে দিতে হবে (lands to the peasants, factories to the workers and all powers to the Soviets)। এই তিন দাবির সঙ্গে লেনিন আরো দুটি দাবিকে যুক্ত করেছিলেন-জনগণকে এখনই যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে, আর যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। লেনিন মহাযুদ্ধের শুরু থেকে যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। তার মতে, এই যুদ্ধ হল পুঁজিবাদীদের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, এতে রাশিয়ার জনগণের কোনো লাভ নেই। লেনিনের এই পাঁচটি মূল দাবির ওপর ভিত্তি করে বলশেভিক দলের কর্মসূচি তৈরি হয়। রাশিয়ার সর্বশ্রেণির মানুষের সব দাবি এতে স্থান পেয়েছিল, সাধারণ দাবির ভিত্তিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। লেনিন অধীনস্থ জাতিগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়ার কথাও বলেছিলেন।

লেনিনের কাজ মোটেই সহজ ছিল না, দলের মধ্যে বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়ে মতবিরোধ ছিল। একদল সহযোগী মনে করেন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। মার্কসীয় দর্শনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধাপ রাশিয়া অতিক্রম করেনি। বুর্জোয়া বিপ্লব না ঘটলে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে এরা মনে করেন। লেনিন মনে করেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মুহূর্ত হাজির হয়েছে (Socialist revolution now or never)। এই সিদ্ধান্ত যদি তারা না নিতে পারেন ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। লেনিনের সিদ্ধান্তের বিরোধীরা বলেছিলেন, তিনি ‘অন্ধকারে ঝাঁপ’ দিচ্ছেন (a leap in the dark)। লেনিন তাতেও দমেননি। লেনিন মার্কসবাদী হলেও অত্যন্ত বাস্তববাদী, সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন। তিনি মনে করেন রাশিয়াতে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, পরিবর্তন ঘটবে। লেনিনের একটি অকাট্য যুক্তি হল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে রাশিয়া হল সবচেয়ে দুর্বল। সাম্রাজ্যবাদী পরম্পরার সবচেয়ে দুর্বল অংশে আঘাত করে তিনি বিপ্লব ঘটাবেন, তারপর বিশ্ব বিপ্লব ঘটানোর পথে অগ্রসর হবেন। লেনিন সেদিন অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়ে অক্টোবর বিপ্লব ঘটালেন। কেরেনস্কি সরকারের পতন হয়, বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করেছিল।

লিও ট্রটস্কি তার বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাসে লিখেছেন যে এই বিপ্লবে ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় ব্যক্তি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে থাকে। লেনিনের নেতৃত্ব না পেলে বলশেভিক দল হয়ত বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নিত না (The role of personality arises before us here on a truly gigantic scale. It is necessary only to understand that role correctly taking personality as a link in the historic chains)। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পরিচয় পত্রিকায় লিখেছিলেন: ‘ইতিহাসের গতিচ্ছন্দ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা লেনিন আয়ত্ত করেছিলেন মার্কস-এঙ্গেলসের শিক্ষা থেকে। সকল অনন্যসাধারণ ব্যক্তির মতোই তিনি একযোগে ছিলেন ইতিহাস কর্তৃক গঠিত ও সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের নির্মাতা- যে সামাজিক শক্তিপুঞ্জ দুনিয়ার চেহারা আর মানুষের চিন্তাধারাকে পাল্টে দেয়, একাধারে তার প্রতিনিধি ও তার স্রষ্টা ছিলেন’। মার্কসের নিজের দেশ জার্মানিতে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে, লিবনেক্ট ও রোজা লুক্সেমবার্গ সেখানে ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করে নিহত হন। বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায়, অথচ রাশিয়াতে লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লব সফল হয়। এর কারণ হল লিবনেক্টের দল স্পার্টাকাস বলশেভিক দলের মতো সুগঠিত ও সুশৃঙ্খল ছিল না, আর লিবনেক্ট লেনিনের মতো প্রতিভাবান ছিলেন না। রুশ বিপ্লবে বাস্তব পরিস্থিতি, দল ও নেতৃত্বের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।

১৯১৭-১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত লেনিন ছিলেন সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান। বিপ্লব সফল হলেও বিপ্লবের অনেক শত্রু ছিল, দেশের সব মানুষ সমাজতন্ত্রের আদর্শে দীক্ষিত ছিল না। দেশের মধ্যে প্রতিবিপ্লবী ও সৈন্যবাহিনীর অফিসাররা ক্ষমতা দখলের প্রয়াস চালিয়েছিল। লেনিন এদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখেন এবং সেই সঙ্গে নতুন প্রলিতারিয়েত রাষ্ট্র কাঠামো ও দলীয় ব্যবস্থার পত্তন করেন। দল ও শাসনব্যবস্থায় তিনি ছিলেন প্রধান। বিপ্লবের গোড়ার দিকে ভূস্বামী, চার্চ ও পুঁজিপতিদের জমি ও কারখানা তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে অধিগ্রহণ করেন, বাজার অর্থনীতি তুলে দেন, দেশের সকলকে খাদ্য ও পরিষেবা সরবরাহের দায়িত্ব নেন (War communism), এর নাম হল যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ। পরে তিনি এই ব্যবস্থা থেকে সরে গিয়ে মিশ্র অর্থনীতির পথ ধরেন (নতুন অর্থনীতি NEP)। ছোটো কারখানার মালিকানা ও ক্ষুদ্র চাষিদের জমির অধিকার মেনে নেওয়া হয়। মুদ্রা অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থা ফিরে আসে, তবে ব্যাংক, পরিবহন, বৈদেশিক বাণিজ্য, ভারী শিল্প, রেলপথ ইত্যাদির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখা হয়। লেনিন রাশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিদেশি পুঁজিপতিদের আহবান করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ক্ষতি না করে তিনি বাজার অর্থনীতির আংশিক পুনঃপ্রতিষ্ঠা মেনে নিয়েছিলেন। এর ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে স্ট্যালিন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

রুশ বিপ্লবের তাৎপর্য

রুশ বিপ্লবের পর রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় গিয়ে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিপুল বিস্ময়কর উন্নতি দেখে মুগ্ধ হন। শোষিত, সর্বহারা মানুষ ‘হল সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাঁড়া দাঁড়িয়ে থাকে-উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’ রাশিয়ায় তিনি দেখলেন শোষিত সর্বহারা মানুষ শোষণ ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পেয়েছে, কোথাও এদের অপমান নেই অসম্মান নেই। ‘ইতিমধ্যে এদের যে দুই-একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ করেছি এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্ম মর্যাদার আনন্দ। আমাদের দেশের জনসাধারণের তো কথাই নেই, ইংল্যান্ডের মজুর শ্রেণির সঙ্গে তুলনা করলে আকাশপাতাল তফাত দেখা যায়। এখানে এসে যেটা সবচেয়ে আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে, এই ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা একমুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভুষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনি আনন্দিত হয়েছি।’ রবীন্দ্রনাথ বিপ্লোবত্তর রাশিয়ার বিপুল পরিবর্তনকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছেন, এর অপূর্ণতার কথা, দুর্বলতার কথা তার দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন আধুনিককালে তিনটি বিপ্লব সভ্যতার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। এই তিনটি বিপ্লব হল শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে গেছে, বিপুল পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, কৃষি নির্ভর সমাজ শিল্প নির্ভর হয়েছে। সমাজে নতুন শ্রেণি পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। ফরাসি বিপ্লব গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করেছে। আর এই দুই বিপ্লবের ফলে সমাজে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে-পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ফরাসি বিপ্লব থেকেই সামাজিক চিন্তা-ভাবনার সূচনা হয়েছে, সমাজের বৈষম্য দূর করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয়েছে, ধনের সুষম বণ্টনের কথা উঠেছে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্র এবং মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সামাজিক দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় অন্বেষণ করেছে। মার্কস মনে করেন ইউরোপীয় সমাজে সবচেয়ে বিপ্লবী সম্ভাবনাময় সামাজিক শ্রেণি হল শিল্প শ্রমিক কারণ এরা ছিল সবচেয়ে শোষিত, এদের হারাবার কিছুই ছিল না। মার্কস ও এঙ্গেলস এদের নেতৃত্বে সাম্যবাদী সমাজ গঠনের কথা বলেছিলেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা লেনিন ও তার অনুগামীরা মার্কসের দর্শনে আস্থাবান ছিলেন। লেনিন মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়েও নিজের মতো করে বিপ্লব তত্ত্ব নির্মাণ করেন (State and Revolution)। মার্কসের তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো শিল্পে উন্নত দেশে প্রলিতারিয়েত বিপ্লব ঘটার কথা। বাস্তববাদী লেনিন রাশিয়ার মতো শিল্পে অনুন্নত কৃষিনির্ভর দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়ে পৃথিবীতে প্রথম প্রলিতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। রাশিয়ার পরিস্থিতিকে বৈপ্লবিক সম্ভাবনাপূর্ণ বলে গণ্য করেন। উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়েছিল।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়ে লেনিন বলশেভিক দলের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। তার রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে এটি ছিল একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র কিন্তু বুর্জোয়ারা শক্তিশালী ছিল না (the bourgeois state without the bourgeoisie)। শ্রমিক শ্রেণির সহায়তা নিয়ে দলের নেতৃত্বে লেনিন বিপ্লব পরিচালনা করেন। বিপ্লবের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা উবে যায়নি, বরং সর্বশক্তি নিয়ে টিকে ছিল, বিরোধীদের দমন করেছিল, বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করেছিল। স্ট্যালিন দেশে কার্যত একনায়কতন্ত্র স্থাপন করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংহত করার চেষ্টা করেন। পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা থেকে রাশিয়া সরে দাঁড়িয়েছিল যদিও কমিন্টার্ন-এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বৈপ্লবিক কাজকর্মকে উৎসাহ দেওয়া হয়। লেনিন ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশগুলিকে মুক্তিলাভে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি এই বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। বিপ্লব ঘটিয়ে তিনি সাম্যবাদের ইতিহাসে নতুন নজির স্থাপন করেন। রুশ বিপ্লবের মহাভাষ্যকার ই. এইচ. কার এই বিপ্লবের চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন যে যথেষ্ট স্পষ্টতা ছিল না, বিপ্লব ছিল মিশ্র ধরনের। শুধু শ্রমিক শ্রেণি এই বিপ্লব ঘটায়নি, এই বিপ্লবে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যোগ দিয়েছিল। বলশেভিক দল এই বিপ্লব ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়েছিল। রাশিয়ার শিল্প-শ্রমিকের সংখ্যা বেশি ছিল না, তারা যথেষ্ট সংগঠিত ছিল না, কৃষকদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি, তারা অনেকটা উদাসীন ছিল। বিপ্লবীরা অবশ্যই সন্ত্রাসের ব্যবহার করেছিলেন, রক্তপাত ঘটেছিল, কিন্তু হিংসার পাশাপাশি এদের কৃতিত্বও কম নয়।

অল্প সময়ের মধ্যে রাশিয়ার নিপীড়িত কৃষক ও শ্রমিক যে সুযোগসুবিধা পেয়েছিল, তাদের জীবনে যে বিস্ময়কর উন্নতি ঘটেছিল তার তুলনা অন্য কোনো দেশে নেই। এই বিপ্লবের অন্য তাৎপর্য হল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠী ভয় পেয়েছিল, জনগণের দাবিদাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছিল। পশ্চিমের দেশগুলিতে পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের দাবিদাওয়াকে আর অগ্রাহ্য করতে পারেননি। সমগ্র পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি, কৃষক ও শোষিত মানুষ অবশ্যই উপকৃত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক দেশগুলির শোষিত মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখতে থাকে, তারা সাগ্রহে রাশিয়ার দিকে তাকিয়েছিল। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে রুশ বিপ্লব শোষিত, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কাছে মুক্তির বাণী বহন করে এনেছিল। পৃথিবীর সর্বত্র বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা এই বিপ্লব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। অক্টোবর বিপ্লব পৃথিবীতে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত রেখেছিল, পৃথিবীর সর্বত্র শোষিত মানুষ এর মধ্যে আশার আলো দেখেছিল। পৃথিবীর সর্বত্র শোষিত, নির্যাতিত মানুষ লেনিন পরিচালিত অক্টোবর বিপ্লবকে আলোর দিশারী হিসেবে গণ্য করেছিল।

লেনিনের নেতৃত্ব (১৯১৭-১৯২৪)

বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন ছিলেন বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান (পুরোনাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ, লেনিন তার ছদ্মনাম)। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তিনি দল ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত। সেই সময় সোভিয়েত রাষ্ট্র বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। দেশের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ছিল, সরকার ছিল দেউলিয়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, শিল্প কারখানাগুলি বন্ধ হয়েছিল, দেশের সর্বত্র ছিল চরম খাদ্যাভাব ও গৃহযুদ্ধ, শহরগুলিতে চরম নৈরাজ্য তৈরি হয়েছিল (He took over a country in chaos, the government bankrupt, transport collapsed, industry paralysed, the countryside torn by civil war and hunger, the towns seething with revolution)। লেনিনের সামনে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছিল বিশ্বযুদ্ধ এবং দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বন্ধু হিসেবে রাশিয়া যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু রুশ সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে পরাস্ত হয়। লেনিন মনে করেন যে, বিশ্বযুদ্ধ হল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, এযুদ্ধে শুধু সাম্রাজ্যবাদীদের লাভ হবে, সমাজতান্ত্রিক দেশের পক্ষে এ যুদ্ধ ক্ষতিকারক (In 1917 his main contention had been that Russia could not sustain both war and revolution at the same time)। একসঙ্গে যুদ্ধ ও বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তিনি যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন, জার্মানির সঙ্গে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রেস্ট-লিটোভস্কের চুক্তি করে শান্তি স্থাপন করেন। এই চুক্তি রাশিয়ার পক্ষে ছিল অসম্মানজনক, রাশিয়া পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের ওপর অধিকার হারিয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের স্বার্থে লেনিন এই ক্ষতি মেনে নেন। যুদ্ধ বন্ধ করে লেনিন দূরদর্শিতা ও বাস্তববোধের পরিচয় দেন। রাশিয়া মহাযুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ালেও সেখানে শান্তি আসেনি, সেখানে বৃহৎ আকারে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, বৈদেশিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছিল (Revolution brought civil war, and civil war brought foreign intervention)।

১৯১৮-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলেছিল। গর্ডন ক্রেগ জানিয়েছেন যে অন্তত বিশটি বিদ্রোহী সরকার গঠিত হয়েছিল, এদের মদত দিয়েছিল ইংল্যান্ড ফ্রান্স, জাপান ও ইতালি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মনে করে যুদ্ধ বন্ধ করে লেনিন ত্রিশক্তি আঁতাত ভঙ্গ করেছেন, এবং জার সরকারের আমলের ঋণ অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছেন। সাইবেরিয়া থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে গৃহযুদ্ধ চলেছিল। এই সরকারগুলি হল বিপ্লব বিরোধী শ্বেত সরকার, সৈন্যবাহিনী শ্বেতবাহিনী (white governments and white armies)। লেনিন এই সংকট মুহূর্তে অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কিছুকাল বলশেভিক সরকারের ভাগ্য ছিল দোদুল্যমান (There were moments in 1919 when the fate of Bolshevism trembled in the balance)। ট্রটস্কি শক্তিশালী লালফৌজ গঠন করে বিদ্রোহ দমন করেন (The unity of command and the dynamic energy of the defence brought the Bolshevik victory against all their opponents, whom they were able to defeat separately)। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে বিদেশি ও শ্বেত সৈন্যবাহিনী পরাস্ত হয়, রাশিয়া বিদেশি সৈন্য মুক্ত হয়েছিল, শুধু উপকূলভাগে অল্প কিছু অঞ্চল জাপানের অধিকারে ছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের সঙ্গে রিগা চুক্তি করে লেনিন পোল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত নির্দিষ্ট করে নেন।

গৃহযুদ্ধ দমন করে লেনিন রাশিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে ঘোষণা করেন। বিনা ক্ষতিপূরণে ভূস্বামী, চার্চ ও মঠের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের অধীনে স্থাপন করা হয়। ব্যাংক, রেল ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। লেনিন রাশিয়ার জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা গঠন করেন। লেনিন প্রবর্তিত নতুন শাসনতন্ত্র ছিল পিরামিডের আকৃতি বিশিষ্ট (The Soviet system was great pyramidal structure with its base resting on the villages), গ্রাম থেকে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত সোভিয়েত গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির নাম হল সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি বা সুপ্রিম সোভিয়েত। কাউন্সিল অব পিপলস কমিসারকে শাসনের ভার দেওয়া হয়, এই কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন লেনিন। সোভিয়েত শাসনব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকায় ছিল রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি, এর গঠনও ছিল অনেকটা সোভিয়েতের মতো (Its structure was similar to that of the Soviets)। পলিটব্যুরো ছিল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, শাসনতন্ত্রের আর দুটি প্রধান অঙ্গ হল গোপন পুলিশ বাহিনী ও সামরিক বাহিনী। পুরোনো বিচার ব্যবস্থা বাতিল করে বিপ্লবী কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বিচারালয় গঠন করা হয়।

১৯১৮-১৯২১ পর্যন্ত লেনিন রাশিয়ায় যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন তার নাম হল ‘যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ’ (war communism)। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ায় খাদ্য, কাঁচামাল ও তেলের ভয়ানক অভাব দেখা দিয়েছিল, বিদেশ থেকে সমস্ত শিল্পজাত ও ভোগ্য পণ্যের আমদানি বন্ধ হয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই পটভূমিকায় সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত জমি অধিগ্রহণ করেছিল, কিন্তু রাষ্ট্রের অধিকৃত সব জমিতে যৌথ খামার ব্যবস্থা (collective farming) প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এজন্য রাষ্ট্র কৃষকদের উৎপাদিত সব শস্য অধিগ্রহণ করেছিল। মরিস ডব (Dobb) জানিয়েছেন যে, এটি ছিল যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের মূল ভিত্তি। দেশের সাঁইত্রিশ হাজার শিল্প কারখানা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছিল। শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটির হাতে এগুলির পরিচালন ভার তুলে দেওয়া হয়। উৎপাদন, সরবরাহ, বণ্টন সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি ছিল না। অনেকে এই সময়কালকে ‘চরম সাম্যবাদী পর্ব’ বলে উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মজুরি তুলে দেওয়া হয়েছিল, ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও মালিকানা ছিল না। প্রত্যেক ব্যক্তি রাষ্ট্র থেকে বিনামূল্যে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অন্যান্য পরিষেবা পেত, সমগ্র অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ভার পেয়েছিল ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব ন্যাশনাল ইকোনমিকস’। বাধ্যতামূলক শ্রমদানের আইন গৃহীত হয়। সরকার সাময়িকভাবে ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগ্নিকারক প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছিল। বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্প, উৎপাদন, সরবরাহ, রেল ইত্যাদির ওপর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। বাজার অর্থনীতি ও মুদ্রায় লেনদেন ব্যবস্থা উঠে যায়। লেনিনের যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ নীতি রাশিয়ার অর্থনীতির পক্ষে মঙ্গলজনক হয়নি। জবরদস্তি করে কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল অধিগ্রহণের ফলে অনেক প্রদেশে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়, সামগ্রিকভাবে কৃষিতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। কৃষকরা জবরদস্তির ভয়ে চাষ বন্ধ করেছিল, গবাদি পশু নষ্ট করে ফেলা হয়। খাদ্যাভাব দেখা দিলে শ্রমিকরা উৎপাদন বন্ধ করেছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ হয়, এই দুর্ভিক্ষে বহু লোক মারা যায়। লেনিন নিজে যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ নীতির ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পার্টির দশম কংগ্রেসে তিনি নতুন অর্থনীতির প্রস্তাব দেন (New Economic Policy)।

মার্কসবাদী হলেও লেনিন ছিলেন একজন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাস্তববাদী রাষ্ট্রনেতা। তিনি যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে সরে এসে মিশ্র অর্থনীতির পথ ধরেন যা পরবর্তীকালে রাশিয়াকে শক্তিশালী করেছিল। লেনিন তার নতুন অর্থনীতিকে যুগ সন্ধিক্ষণের মিশ্র ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন (Transitional Mixed system)। এই ব্যবস্থার মধ্যে ছিল রাষ্ট্রীয় সমাজবাদ, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও ব্যক্তিগত মালিকানা। এই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের তিনটি উদ্দেশ্য ছিল। এই তিনটি উদ্দেশ্য হল রাশিয়ার পতনোন্মুখ অর্থনীতির পুনর্গঠন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রস্তুতি গ্রহণ এবং শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন। কৃষকের উদ্বৃত্ত অধিগ্রহণের নীতি পরিত্যক্ত হয়, এর পরিবর্তে কৃষককে উৎপন্ন শস্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে বলা হয়। কৃষক স্বাধীনভাবে তার জমি চাষ করার অধিকার পেয়েছিল, সরকার কৃষিজ পণ্যের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করেছিল। কৃষিখামারের বিকাশের দিকে নজর দেওয়া হয়, গ্রামাঞ্চলে সমবায় প্রথাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। সমবায় নানা কর থেকে অব্যাহতি পায়, ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পায়। সরকার কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।

সরকার শিল্প সম্পর্কে নতুন নীতি গ্রহণ করেছিল। ছোটো শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা ফিরিয়ে আনা হয় (commercial incentives were restored in industry and trade. Small industries were permitted and even encouraged and trading for private profit revived)। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কৃষিজ উৎপাদন ভাল হলে অর্থনীতি অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল (the good harvest of 1922 brought the beginning of real recovery)। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমেছিল, বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা হয়েছিল। জোর করে শ্রমিকদের শ্রমদানে বাধ্য করার নীতি পরিত্যক্ত হয়। কর্মসংস্থান কেন্দ্রের মাধ্যমে নথিভুক্ত শ্রমিকদের নিয়োগের ব্যবস্থা হয়েছিল। কাজের পরিমাণ ও গুণগত উৎকর্ষের ভিত্তিতে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের নীতি গৃহীত হয়, এর ফলে শ্রমিকের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষমতা দুই-ই বেড়ে যায়।

লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাজার অর্থনীতি ফিরে এসেছিল। বাজারে টাকার জোগান বাড়ানোর জন্য মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়, স্বর্ণ ভাণ্ডারকে ভিত্তি করে কাগজি মুদ্রা রুবল বাজারে ছাড়া হয়। স্টেট ব্যাংক শিল্প ও বাণিজ্যে ঋণ সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছিল। বিদেশি পুঁজিপতিদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের সহজ শর্তে শিল্প স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়। রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তাদের লাভের একাংশ তারা দেশে নিয়ে যেতে পারবে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিদেশিদের স্থাপিত শিল্প অধিগ্রহণ করা হবে না। সব অর্থনৈতিক কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ‘জেনারেল প্ল্যানিং কমিশন’ গঠন করা হয়। ছোটো শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা ফিরে এসেছিল তবে বৃহৎশিল্প, পরিবহন, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংকিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অধিকার বজায় রাখা হয়। কৃষির উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় কৃষি ব্যাংক স্থাপিত হয়। ১৯২৩-২৫ মধ্যে সরকারি ঋণদানের পরিমাণ বেড়েছিল একাশি গুণ, কৃষি উৎপাদন ও কৃষি শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা দুই-ই বেড়েছিল।

লেনিন প্রবর্তিত নতুন অর্থনীতির ফলে রাশিয়ায় দ্রুত ও অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল। শিল্পের ক্ষেত্রে উন্নতির হার ছিল চমকপ্রদ-১৯২১-২৫ মধ্যে শিল্পক্ষেত্রে বার্ষিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৪১ শতাংশ। শ্রমিকরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে নিজেদের বলে ধরে নিয়েছিল, এজন্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ১৯১৫-১৯২৫ মধ্যে রাশিয়ায় শিল্প শ্রমিকের মজুরি বেড়েছিল ৩৪ শতাংশ। লেনিনের নতুন অর্থনীতির ফলে রাশিয়ায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছিল, পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়েছিল। রাশিয়ার শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছিল ১০ শতাংশ, উৎপাদন ব্যয় কমেছিল ৬ শতাংশ। সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পরিবহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছিল। এতে রাশিয়ার জনগণের জীবনযাত্রার মানে উন্নতি ঘটেছিল। এসব সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা লেনিনের নতুন অর্থনীতির সমালোচনা করেছেন (The New Economic Policy was reversal of the policies of war communism. It was presented as a temporary halt in the revolutionary policy of collectivization)। এদের মতে, লেনিন যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে সরে এসে ভুল করেছিলেন। নতুন অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পাশে পুঁজিবাদকে স্থান দেওয়া হয়। বাজার অর্থনীতি, ব্যক্তিগত পুঁজি ও মালিকানা, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ফিরে এসেছিল। কৃষিতে যৌথ সরকারি খামারের সংখ্যা ছিল নগণ্য, সেখানেও ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রাধান্য পেয়েছিল।

মরিস ডব জানিয়েছেন যে, লেনিনের চিন্তাভাবনার সঙ্গে তার মিশ্র অর্থনীতি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি মনে করেন পুঁজিবাদ থেকে সমাজবাদে উত্তরণের যুগ সন্ধিক্ষণে দুই ব্যবস্থার মিশ্র রূপকে স্বীকার করে নিলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকে, এটা হল অবশ্যম্ভাবী। একে অনেকে পশ্চাদপসরণ বলেছেন, তবে এটি ছিল পরিকল্পিত। এতে সাম্যবাদী অর্থনীতির বিশেষ ক্ষতি হয়নি, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলির ওপর (ব্যাংক, বিমা, রেল, বৃহৎশিল্প, মাঝারি শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য) রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল আর এই রাষ্ট্র ছিল অবশ্যই প্রলিতারিয়েত রাষ্ট্র। সরকার সমাজবাদী প্রবণতাকে উৎসাহ দিয়েছিল, পুঁজিবাদী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করে ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছিল। নতুন অর্থনীতির জন্য বিদেশি পুঁজিপতিরা রাশিয়ায় নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছিল যা থেকে রাশিয়া লাভবান হয়েছিল। রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে বিপুল অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান সংগৃহীত হয় তা পরবর্তীকালে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজে ব্যবহার করা হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের মৃত্যুর সময় রাশিয়ায় সাম্যবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, দুর্ভিক্ষ থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছিল, গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল। সোভিয়েত নেতারা সমগ্র দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভিত্তি স্থাপিত হয় (When Lenin died in 1924 the new regime had survived. It had weathered famine as well as civil and foreign war, and had tightened its control upon the whole country. The basis of large-scale economic planning had been laid)।

স্ট্যালিনের ভূমিকা

রাশিয়ার সংহতি সাধন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে লেনিনের পরেই ছিল স্ট্যালিনের স্থান (১৮৭৯-১৯৫৩) (স্ট্যালিনের নাম হল জোসেফ ভিসারিওনোভিচ জুগাসভিলি (Joseph Vissarionovich Dzugashvily))। বলশেভিক বিপ্লবের পর তিনি লেনিনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন লালফৌজের সংগঠক লিও ট্রটস্কি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে জর্জিয়া প্রদেশে স্ট্যালিনের জন্ম হয়, যৌবনে তিনি সমাজতন্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের লন্ডন অধিবেশনে দুভাগে বিভক্ত হলে তিনি বলশেভিক দলে যোগদান করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের সময় তিনি বাকু তৈলখনি অঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার ছিল অদম্য উৎসাহ ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লব ব্যর্থ হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাননি, দেশের মধ্যে থেকে বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজে মন দেন। জার সরকারের পুলিশ তাকে কয়েকবার বন্দি করেছিল, তিনি কৌশলে নিজেকে মুক্ত করেন, শেষে তাকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের সময় তিনি লেনিনের পাশে থেকে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন (In 1917 he returned to play a prominent role in the revolution and the civil war)।

নেতা হিসেবে তিনি শাসন, রাজনীতি ও কূটনীতিতে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। বিপ্লবের পর রাশিয়ার পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। সেনাপতি ও সাম্রাজ্যবাদীরা দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল। গৃহযুদ্ধ দমনে স্ট্যালিনের অবদান অস্বীকার করা যায় না, তার ছিল আমলাতান্ত্রিক তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও রাজনৈতিক দক্ষতা। ধীরে ধীরে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যান। লেনিনের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল বিখ্যাত ত্রয়ী স্ট্যালিন, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভের হাতে (Zinoviev, Kamenev)। এরা তিনজনেই ট্রটস্কির বিরোধী ছিলেন, ট্রটস্কির বিরুদ্ধে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ (factionalism) এনে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্ট্যালিন মনে করেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কাজ হল দেশের মধ্যে সমাজতন্ত্রকে সংহত করা (socialism in one country), ট্রটস্কি বিশ্ব বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন (Permanent revolution)। ট্রটস্কি মনে করেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্প্রসারণ না ঘটলে রাশিয়ার সমাজতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ট্রটস্কি শুধু দল থেকে নয়, দেশ থেকেও বিতাড়িত হন, মেক্সিকোয় অবস্থানকালে এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হন। ট্রটস্কির পতনের পর (১৯২৭) স্ট্যালিন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি হন। তিনি তার দুই সহকর্মী জিনোভিয়েভ ও কামেনেভের বিরুদ্ধে পার্টির শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে দল থেকে তাদের বহিষ্কার করেন। তিরিশের দশকে বহু কমিউনিস্ট নেতা দল ও প্রশাসন থেকে বহিষ্কৃত হন (The great purges), সরকার ও শাসনব্যবস্থায় স্ট্যালিন কার্যত ছিলেন সর্বেসর্বা।

সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিনের একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হয়, ক্ষমতা দখলের পর তিনি দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে মন দেন। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন লেনিন যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ এবং পরে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেন। স্ট্যালিন মিশ্র অর্থনীতি থেকে সরে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ ধরেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চালু হয়, যুদ্ধের আগে তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজ শেষ হয়েছিল (১৯২৮-১৯৪২)। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার শিল্পায়ন দ্রুতগতিতে এগিয়েছিল, সেই সঙ্গে তিনি সৈন্যবাহিনীর পুনর্গঠনের কাজও শেষ করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ১২.৫ মি. সশস্ত্র সৈন্য ছিল। লোহা, ইস্পাত, তেল, কয়লা ইত্যাদির উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে তিনি যৌথ খামার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছিল। স্ট্যালিনের এই যৌথ খামার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ হয়, স্ট্যালিন এসব বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন। স্ট্যালিন শিল্পক্ষেত্রে ২০০-৪০০ শতাংশ উন্নয়নের লক্ষ্য ধার্য করেন, কৃষিক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫০ শতাংশ। এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি তবে পরিকল্পনার ফলে রাশিয়া ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। স্ট্যালিনের এই অসাধারণ সাফল্যকে সোভিয়েত ঐতিহাসিকরা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।

স্ট্যালিন উপলব্ধি করেন যে, ইউরোপে যুদ্ধ আসন্ন, এজন্য তিনি দেশবাসীকে প্রস্তুত করেছিলেন। বিশ্ব বিপ্লবের আদর্শ থেকে সরে এসে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিরক্ষার দিকে নজর দেন। তিনি পশ্চিমের সঙ্গে সহাবস্থান চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে বুঝিয়েছিলেন যে, রাশিয়া শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাস করে। জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান হলে তিনি পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। ঠিক এই কারণে তিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে লিগের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। কিন্তু পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, স্ট্যালিনকে বিশ্বাস করতে পারেনি। রাশিয়াকে বাদ দিয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি হিটলারের সঙ্গে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ চুক্তি করেছিল। প্রত্যুত্তরে স্ট্যালিন জার্মানির সঙ্গে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিলেন। আসন্ন জার্মান আক্রমণ থেকে তিনি এভাবে রাশিয়াকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। জার্মান আক্রমণ থেকে রাশিয়াকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি তবে অনাক্রমণ চুক্তির ফলে তিনি প্রায় বাইশ মাস সময় পেয়েছিলেন, রাশিয়া তার সামরিক প্রস্তুতি সেরে নিতে পেরেছিল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে রুশ সৈন্যবাহিনী লেনিনগ্রাদ ও স্ট্যালিনগ্রাদে তার যোগ্য জবাব দিয়েছিল। বহু ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সোভিয়েত রাশিয়া তার ঐক্য ও স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল।

যুদ্ধের সময় (১৯৩৯-৪৫) স্ট্যালিন অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে তিনি গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মহাজোট গঠিত হয়। যুদ্ধ চলাকালীন মিত্রশক্তির নেতাদের মধ্যে যে বৈঠকগুলি হয়েছিল (ইয়াল্টা, পট্সডাম, তেহেরান ও কায়রো) সেখানে তিনি তীক্ষ্ণ কূটকৌশলের পরিচয় দেন। চার্চিলরুজভেল্টের মতো ধুরন্ধর নেতারা চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে কোনো সুবিধা আদায় করে নিতে পারেননি। যুদ্ধ শেষে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন, জাতিপুঞ্জ স্থাপিত হয়। ট্রুম্যান ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু করলে তিনি দমেননি, সমগ্র পূর্ব ইউরোপের ওপর সোভিয়েত প্রাধান্য স্থাপিত হয়। মার্কিন আণবিক বোমার ভয়ে তিনি পিছু হটেননি। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর আগে সোভিয়েত রাশিয়া ছিল একটি সমৃদ্ধ সুরক্ষিত মহাশক্তিধর দেশ। সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাসে এটি হল স্ট্যালিনের স্থায়ী অবদান।

সোভিয়েত বিদেশনীতি (১৯১৭-১৯৩৯)

বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্ব ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামোটিকে অস্বীকার করেছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিল যে বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতন ঘটানো হল তার লক্ষ্য। ক্ষমতা দখলের আগেই লেনিন বলেছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত মানুষদের মুক্তির লক্ষ্যে তারা বিপ্লবে উৎসাহ জুগিয়ে যাবেন। ক্ষমতা দখলের পর শান্তির ঘোষণায় লেনিন বিশ্বের সবজাতিকে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রেস্ট-লিটোভস্কের সন্ধি করে তিনি যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন যদিও এই সন্ধিটি ছিল রাশিয়ার পক্ষে অসম্মানজনক। জার শাসিত রাশিয়ার এক-চতুর্থাংশ ভূমি তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে তিনি মনে করেছিলেন সোভিয়েত স্বার্থবিরোধী। এর সঙ্গে অন্য ধরনের সমস্যা ছিল। রাশিয়া ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের চুক্তিবদ্ধ বন্ধু, বিদেশি পুঁজিপতিরা রাশিয়ায় বহু অর্থ লগ্নি করেছিল। লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া বিদেশিদের প্রাপ্য অর্থ ও সম্পত্তি ফেরত দিতে অস্বীকার করেছিল। পশ্চিমি শক্তিগুলির উৎসাহে রাশিয়ার মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, সোভিয়েত রাশিয়াকে এই গৃহযুদ্ধ দমন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। সোভিয়েত রাশিয়া ইস্টোনিয়ার সঙ্গে টারটু (১৯২০) শান্তি চুক্তি করে বিরোধ মিটিয়ে নিয়েছিল, পোল্যান্ডের সঙ্গে স্বাক্ষর করেছিল রিগা চুক্তি (১৯২১)। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মস্কোতে স্থাপিত হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক (কমিন্টার্ন) এর কাজ হল বিশ্বের সর্বত্র, বিশেষ করে যেখানে অসন্তোষ রয়েছে, বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যত্র বিপ্লব ঘটানোর প্রয়াস শুরু হয়েছিল। জিনোভিয়েভ ছিলেন কমিন্টার্নের প্রধান, এই সংস্থার কাজ ছিল অনুপ্রবেশ, অন্তর্ঘাত ও প্রচার চালিয়ে বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করা। বিপ্লবের গোড়ার দিকে সোভিয়েত নেতারা বিপ্লবের ওপর এতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে তারা প্রথাগত কূটনীতি বা বিদেশ নীতিকে অনুসরণ করার কথা ভাবেননি।

বলশেভিকরা যা আশা করেছিলেন তা কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। ইউরোপের দেশে দেশে বিপ্লব হয়নি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় বিপ্লব হয়েছিল, তাতে বুর্জোয়া মধ্যপন্থী সমাজতন্ত্রীরা ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাভেরিয়া ও হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত স্থাপিত হয় কিন্তু জনসমর্থন না থাকায় সেগুলি সহজে দমিত হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে রেড আর্মির পোল্যান্ডের দিকে অভিযান স্তব্ধ করে দিয়েছিল। পুঁজিবাদী দেশগুলির শক্তি ও সামর্থ্যের অভাব ছিল না, অপরদিকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত এবং অর্থনৈতিক সংকটে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত নেতৃত্ব বিদেশ নীতি ও কূটনীতির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ভেবেছিল। ট্রটস্কি সামরিক বিভাগের কমিশনার হলেন, নতুন বিদেশমন্ত্রী হন জর্জেই চিচেরিন। এই নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাষ্ট্রনায়ক। সোভিয়েত রাশিয়ার দুর্বলতা তিনি উপলব্ধি করে তার স্বার্থ রক্ষার জন্য পশ্চিমের সঙ্গে অস্থায়ী শান্তি স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিমি দেশগুলি যৌথভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করে লগ্নিকৃত মূলধন, সম্পত্তি ও বাণিজ্যিক অধিকার আদায়ের কথা ভেবেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জেনোয়াতে লয়েড জর্জের নেতৃত্বে এসব সম্ভাবনা দিয়ে আলোচনা হয়। এই জেনোয়াতে চিচেরিন কূটনীতির প্রয়োগ করে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা এবং পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবেন। তিনি জেনোয়ো সম্মেলনে হাজির হয়ে ক্ষুদ্র দেশগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে অনেকখানি সাফল্য লাভ করেন। বৃহৎ দেশগুলির বিরুদ্ধে এদের ঈর্ষাকে তিনি জাগিয়ে তোলেন। তিনি লগ্নিকৃত মূলধন ও যৌথ প্রয়াসের ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় (NEP) রাশিয়া বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলবে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। তিনি নিজেই বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব তোলেন, বিশ্ব প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা বলেন। জেনোয়ার কাছে র‍্যাপালোতে জার্মানির সঙ্গে একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি করে (১৯২২) তিনি সোভিয়েত রাশিয়াকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত করলেন।

ধুরন্ধর কূটনীতিবিদ চিচেরিন পশ্চিমি দেশগুলির রুঢ় অভিযানের সময় জার্মানিকে শস্য পাঠিয়ে সাহায্য করলেন। ক্ষুদ্র দুর্বল দেশগুলির নেতাদের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক গড়ে তুললেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে হল তার সাফল্যের বছর, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (1924 came to be known as the year of recognitions)। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, গ্রিস, মেক্সিকো এবং চিন প্রজাতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত রাশিয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পুরোনো বলশেভিক নেতৃত্ব কূটনীতিতে আস্থা রাখতে পারেনি। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কমিনটার্ন বুলগেরিয়া ও জার্মানিতে বিপ্লব ঘটানোর প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বোঝানোর চেষ্টা করলেন এইসব অভ্যুত্থানের জন্য রাশিয়া দায়ী নয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়ায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলাকালীন ‘একদেশে সমাজতন্ত্র’ (Socialism in one country) ও বিশ্ব বিপ্লবের আদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলেছিল। স্ট্যালিন একদেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শে আস্থা রেখেছিলেন, তিনি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জয়ী হলে বিপ্লবপন্থীরা পরাস্ত হন। কমিন্টার্নের কাজকর্ম কমে আসে। এই সময় তিনটি ঘটনা ঘটেছিল যাতে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, শান্তি ও সহাবস্থানের নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশ্চিমি দেশগুলি সোভিয়েত রাশিয়ার মতিগতি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর একটি চিঠি প্রকাশ করে দেয় যাতে জিনোভিয়েভ ব্রিটেনের কমিউনিস্টদের স্থল ও নৌবাহিনীতে অনুপ্রবেশ ঘটানোর পরামর্শ দেন। এই চিঠি প্রকাশিত হলে ইংল্যান্ডের শ্রমিক দলের সরকারের পতন ঘটে। ঐ বছর জিনোভিয়েভ কমিউনিস্টদের নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইস্টোনিয়ার বন্দর টালিন দখলের পরিকল্পনা করেন। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়, সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে পশ্চিমে অবিশ্বাস ও সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। কমিন্টার্ন বুলগেরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছিল সোফিয়ার ক্যাথলিক চার্চে যাতে ১২৮ জন লোক নিহত হয়।

সোভিয়েত রাশিয়ার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে লোকার্নো চুক্তির সময় সোভিয়েত রাশিয়াকে ডাকা হয়নি যদিও এর সঙ্গে সোভিয়েত স্বার্থ জড়িত ছিল। এসব ও অন্যান্য ঘটনা পশ্চিমের সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। সোভিয়েত রাশিয়া কুয়োমিনটাং চিন, জাপান ও কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এসব দেশে কমিন্টার্ন কাজ করে চলেছিল। কুয়োমিনটাং দলের মধ্যে বামপন্থীদের সংগঠিত করার চেষ্টা হলে চিয়াং কাইশেক এদের ধ্বংস করেন। তিনি এরপর থেকে সাম্যবাদ বিরোধী নীতি অনুসরণ করে চলেছিলেন। জাপানে সোভিয়েত বিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করে মাঞ্চুরিয়ায় আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করেছিল। এতে সোভিয়েত স্বার্থ অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, জাপান সোভিয়েত বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। অপরদিকে ইংল্যান্ড সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছিল কারণ সেদেশের পুলিশ সোভিয়েত বাণিজ্যিক মিশনের কাজকর্মের মধ্যে অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মের নজির পেয়েছিল। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স সোভিয়েত দূতকে ফিরিয়ে নেবার নির্দেশ দিয়েছিল। জার্মানিতেও সোভিয়েত অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মের নজির মিলেছিল।

এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে স্ট্যালিন ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যান, জিনোভিয়েভের নীতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। বিশ্ব বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, স্ট্যালিনের একদেশে সমাজতন্ত্রের নীতি সফল হয়। স্ট্যালিনের আমলে কমিন্টার্নের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। স্ট্যালিনের নির্দেশে বিদেশে অবস্থিত সোভিয়েত দূতরা শান্তি ও সহযোগিতার নীতির কথা বলেন। অনেক দেশে জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের সূচনা হলে সোভিয়েত রাশিয়া এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার প্রয়াস চালিয়েছিল। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়াকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী লিটভিনভ সেদেশে প্রচার চালাবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলেন এবং রাশিয়ায় অবস্থিত মার্কিন নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার মেনে নেন।

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ও তার নাৎসি দল জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করলে সোভিয়েত রাশিয়ার বিদেশ নীতিতে নতুন পর্বের সূচনা হয়েছিল। পশ্চিমি দেশগুলিও দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল, নাৎসিবাদ না সাম্যবাদ কাকে তারা বিশ্বাস করবে বুঝে উঠতে পারেনি। অনেকে মনে করেন পশ্চিমি দেশগুলি সাম্যবাদের ঘোষিত শত্রু ফ্যাসিবাদ দিয়ে সাম্যবাদকে প্রতিহত করার কথা ভেবেছিল। হিটলার পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণের কথা আগেই প্রচার করেছিলেন।

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে সোভিয়েত বিদেশ নীতির নতুন পর্ব শুরু হয়েছিল। হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তিনি ছিলেন সাম্যবাদের ঘোষিত শত্রু, সম্প্রসারণে বিশ্বাসী। রাশিয়ার নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে দূর প্রাচ্যে জাপানের অগ্রগতি রোধ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে লিগে যোগ দিয়ে রাশিয়া যৌথ নিরাপত্তার সুবিধা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু লিগ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না, সেজন্য সোভিয়েত নেতারা একটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি চেয়েছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে নাৎসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা খুঁজলেন ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি করে (Each undertook to come to the assistance of the other if attacked by any European power)। নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের তাৎক্ষণিক ফল হল ফ্রান্স ও রাশিয়া যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থার মৈত্রী চুক্তিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমশ সংকটজনক হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালি আগ্রাসন শুরু করে স্বাধীন দেশ আবিসিনিয়া অধিকার করে নিয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইতালির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। হিটলার অস্ত্রসজ্জা শুরু করেছিলেন, রাইনল্যান্ড অধিকার করেনস্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া শুরু হয়ে যায়। বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে হিটলার তার বিমানবহর এবং মুসোলিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। রাশিয়া বামপন্থী সরকারের পক্ষ নিয়ে অল্প সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছিল। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও জাপান অ্যান্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট স্বাক্ষর করেছিল, পরের বছর ইতালি এতে যোগ দিয়েছিল। সাম্যবাদের বিরুদ্ধে তিন শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রায় বিনাবাধায় হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে নেন। ঐ বছর তিনি চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদেতেন অঞ্চল দাবি করেন কারণ ঐ অঞ্চলে জার্মানরা বাস করত। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি মিউনিখে হাজির হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সুদেতেন অঞ্চল হিটলারের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, স্বাক্ষরিত হয় মিউনিখ চুক্তি (১৯৩৮)। হিটলার এতে সন্তুষ্ট হননি, তিনি ভয় দেখিয়ে সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া অধিকার করে নেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স বাধা দিতে পারেনি, তারা তোষণনীতি তখনও আঁকড়ে ছিল।

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ারদিক থেকে হিটলার পোল্যান্ডের ওপর চাপ দিতে থাকেন। পোলিশ করিডর ও ডানজিগ বন্দর নিয়ে পোল্যান্ডের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল। সেই মুহূর্ত থেকে পশ্চিমি দেশ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও সোভিয়েত রাশিয়াকে নিয়ে যৌথ প্রতিরক্ষার কথা ভেবেছিল, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে পশ্চিমি নেতাদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছিল। এর সুযোগ নিয়ে হিটলার তার বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপকে মস্কো পাঠিয়ে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট অনাক্রমণ চুক্তির ব্যবস্থা করলেন। হিটলার একই সঙ্গে দুই সীমান্তে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাননি, সোভিয়েত নেতারা হিটলারকে বিশ্বাস করেননি, শুধু দেশের নিরাপত্তার কথা ভেবে এমন সিদ্ধান্ত নেন। এই চুক্তি করে তারা যুদ্ধকে প্রায় তেইশ মাস ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এজন্য পশ্চিমি ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধের জন্য স্ট্যালিনকে দায়ী করে থাকেন। সোভিয়েত রাষ্ট্র বিশ্বে বিপ্লব ঘটাতে পারেনি, রাশিয়ার নেতারা পশ্চিমের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। বাস্তববাদী নীতি তারা অনুসরণ করেন, ‘একদেশে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নীতি জয়ী হয়। স্ট্যালিন এধরনের নীতি অনুসরণ করে জাতির স্বার্থরক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন, তার প্রখর বাস্তব বুদ্ধি এব্যাপারে তার সহায়ক হয়।

তথ্যসূত্র 

  • আধুনিক ইউরোপ : ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৭৮৯-১৯৪৫), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, মিত্রম, কলকাতা, ২০১৩, পৃ ২৮২-২৯৩, ৪২২-৪৩৬, ৪৫৩-৪৬৫

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.