রিপাবলিকান পার্টি কি একটি উল্লেখযোগ্য রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে? নিকি হ্যালির রাজনৈতিক প্রচারণা এ ধরনের পরিবর্তনের একটি অনুঘটক হয়ে থাকতে পারে। ২০২৪ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও রিপাবলিকান মনোনয়নের জন্য ফেভারিট হিসাবে এগিয়ে রয়েছেন, আর ট্রাম্পের বিরোধিতাকারী রিপাবলিকানরা সীমিত সংখ্যক প্রার্থীর চারপাশে সমর্থন একত্র করছেন। আসন্ন প্রাইমারিতে ট্রাম্পকে পরাজিত করার সম্ভাবনা বাড়ানোই এই কৌশলের লক্ষ্য। বর্তমান জরিপ ইঙ্গিত দেয় যে নিকি হ্যালি তাদের সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিকল্প হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছেন। প্রাথমিক জরিপ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের জরিপে তার সাম্প্রতিক সাফল্য ইঙ্গিত দেয় যে হ্যালি প্রতিটি সুইং রাজ্যে বাইডেনকে উল্লেখযোগ্যভাবে ছাড়িয়ে যেতে পারেন। এই আর্টিকেলে আমি নিকি হ্যালির পটভূমিতে প্রবেশ করব, কীভাবে তার নীতি এজেন্ডা রিপাবলিকান রাজনীতিতে বিপ্লব আনতে পারে তা পরীক্ষা করব এবং কেবল ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নয় বরং রিপাবলিকান রাজনীতিকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার জন্য তার সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় অভিবাসী বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া নিকি হ্যালির রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তার জন্মগত নাম নিম্রতা নিকি রান্ধাওয়া। ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়থেকে অ্যাকাউন্টিং ডিগ্রি শেষ করার পরে এবং বিয়ে করার পরে, হ্যালি হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস থেকে শুরু করে একটি রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন। ২০১০ সালে গভর্নর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগে তিনি দক্ষিণ ক্যারোলিনার জন্য দুটি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, রাজ্যের প্রথম মহিলা গভর্নর এবং সেই পদে ছিলেন প্রথম কালারড বা অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি। টি পার্টি আন্দোলন (Tea Party movement) দ্বারা চিহ্নিত ২০১০ সালের নির্বাচনে অসংখ্য, বেশিরভাগই অধিকতর মৌলবাদী, রিপাবলিকানরা রাজ্য এবং ফেডারেল পদে নির্বাচিত হয়েছিল। হ্যালির নির্বাচন ছিল এই ঢেউয়েরই একটি অংশ। দায়িত্ব গ্রহণের পরে, তিনি জাতীয় মনোযোগ অর্জন করেছিলেন, বিশেষত দক্ষিণ ক্যারোলিনার একটি আফ্রিকান আমেরিকান মেথোডিস্ট চার্চে মর্মান্তিক মাস শুটিং এর প্রতিক্রিয়ার পর (যেখানে জাতিগত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলায় নয় জন নিহত হয়েছিল) তিনি বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন।
সাউথ ক্যারোলিনায় জাতিগত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা এবং অনুরূপ ঘটনা, সরকারী জমিতে কনফেডারেট পতাকা এবং স্মৃতিসৌধ প্রদর্শন নিয়ে একটি জাতীয় বিতর্ককে উস্কে দেয়। দক্ষিণ ক্যারোলিনা, ঐতিহাসিকভাবে ইউনিয়ন থেকে পৃথক হওয়া প্রথম রাজ্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এখানে এই জাতীয় অনেক প্রতীক রয়েছে। বিতর্কটা ছিল বিশেষত রাজ্য আইনসভার বাইরে প্রদর্শিত কনফেডারেট যুদ্ধের পতাকাকে ঘিরে। এই জায়গায় গভর্নর নিকি হ্যালি একটি আশ্চর্যজনক পদক্ষেপ হিসেবে পতাকাটি অপসারণের আদেশ দিয়েছিলেন, ও এই কাজটিকে পুনর্মিলনের দিকে একটি পদক্ষেপ হিসাবে সমর্থন করেছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই কাজ ঐক্যকে উত্সাহিত করবে এবং গির্জায় মাস শুটিং এর শিকারদের সম্মান করবে।
এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে নিকি হ্যালির রাজনৈতিক পরিচয় আকার নিতে শুরু করে। দক্ষিণের একটি রাজ্যে রক্ষণশীল সংখ্যালঘু মহিলা গভর্নর হিসাবে, তিনি মতাদর্শগত এবং জাতিগত বিভাজন দূর করার জন্য একটি অনন্য অবস্থানে ছিলেন, কনফেডারেট পতাকা অপসারণ তারই উদাহরণ। তার ক্যারিয়ারের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি তাকে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ইউনাইটেড ন্যাশন্স-এ মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসাবে তার পরবর্তী ভূমিকার জন্য মঞ্চ তৈরি করেছিল। এই অবস্থানে, হ্যালি তার বৈদেশিক নীতির প্রমাণপত্র তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন, যা ছিল সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের জন্য একটি সাধারণ উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি বৈদেশিক নীতিতে, বিশেষত ইউক্রেনের মতো ইস্যুতে সবচেয়ে সোচ্চার ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন, আর এর মাধ্যমে তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় প্রার্থীদের থেকে নিজেকে আলাদা করেছিলেন।
ট্রাম্প ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথিত ব্যবসায়িক লেনদেনের তথ্য সরবরাহ না করা পর্যন্ত ইউক্রেনকে সহায়তা বন্ধ রাখার পক্ষে ছিলেন, এদিকে হ্যালি ইউক্রেনকে সামরিক ও বস্তুগত সহায়তা বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন। তিনি প্রায়শই এই সংঘাতকে রাশিয়া, চীন, ইরান এবং উত্তর কোরিয়া সহ আমেরিকাবিরোধী অক্ষের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সংগ্রামের অংশ হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ইসরায়েল এবং তাইওয়ানের প্রতি সামরিক সমর্থন বাড়ানোর পক্ষে সমর্থন করতে পরিচালিত করেছিল, কারণ উভয়ই যথাক্রমে ইরান এবং চীনের চাপের মুখোমুখি হয়েছিল। নিজের অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হ্যালি চীনের একজন সোচ্চার সমালোচক ছিলেন, যা ইউনাইটেড ন্যাশন্স-এ তার মেয়াদ এবং তার উদীয়মান রাষ্ট্রপতি প্রচারাভিযানের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। উল্লেখ্য, তিনি চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিরোধিতা করেন। চলতি বছরের শুরুতে তিনি অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনের কাছে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে নিজের সংশয় প্রকাশ করেন।
হ্যালির রাজনৈতিক গতিপথ তার রক্ষণশীল অবস্থানের সাথে জটিল জাতিগত ও মতাদর্শগত ইস্যুগুলি হ্যান্ডল করার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে, আর এটাই তাকে আমেরিকান রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। বৈদেশিক নীতিতে তার অবস্থান, বিশেষ করে চীনের প্রতি তার কঠোর অবস্থান এবং ইউক্রেনকে সহায়তা বাড়ানোর সমর্থন তার বিস্তৃত রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিফলিত করে এবং সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের থেকে তাকে আলাদা করে তোলে। ২০২৪ সালের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, হ্যালির নীতি ও কর্মকাণ্ড রিপাবলিকান পার্টির দিকনির্দেশনা এবং জাতীয় রাজনৈতিক আলোচনাকে তত বেশি প্রভাবিত করে চলেছে।
নিকি হ্যালি এমন একজন প্রার্থী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন যিনি বৈশ্বিক মঞ্চে সংঘাতপূর্ণভাবে জড়িত হওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার কঠোর পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে তিনি ইরাক যুদ্ধের যুগের পর থেকে সবচেয়ে হস্তক্ষেপকারী আমেরিকান রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে একজন হতে পারেন। পররাষ্ট্র নীতির বাইরে, বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হ্যালির অবস্থান উল্লেখযোগ্য। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে, হ্যালির অবস্থান রিপাবলিকান পার্টির অনেকের থেকে কিছুটা আলাদা। তিনি ১৫ সপ্তাহ পরে জাতীয় গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞা (national abortion ban) লাগু করার পক্ষে এবং এর আগে দক্ষিণ ক্যারোলিনায় ২০ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞায় স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু তিনি গর্ভনিরোধক এবং গর্ভপাত-প্ররোচিত ওষুধের অ্যাক্সেস বাড়ানোর পক্ষে পরামর্শ দিয়ে নিজেকে অন্যান্য প্রার্থীদের থেকে আলাদা করেছেন।
বন্দুক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে, হ্যালি ফৌজদারি বিচার সংস্কারের জন্য উন্মুক্ত ছিলেন তবে ধারাবাহিকভাবে নতুন বন্দুক আইনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বিশেষত রেড ফ্ল্যাগ আইনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন, যেগুলো সাময়িকভাবে নিজের বা অন্যের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে বন্দুক বাজেয়াপ্ত করে। উল্লেখ্য এই ধরনের আইনকে অনেক রক্ষণশীলগণ মাস শুটিং এর পর জনসাধারণের নিরাপত্তা উদ্বেগ ও বন্দুকের অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যুক্তিসংগত কম্প্রোমাইজ হিসেবে দেখেন।
অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে, হ্যালি স্ট্যান্ডার্ড রিপাবলিকান নীতিগুলির সাথেই একমত, তার নিজের কিছু ইউনিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সামাজিক নিরাপত্তার সলভেন্সি নিশ্চিত করতে বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ বছরে যারা আছে তাদের অবসরের বয়স বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি সংশ্লিষ্ট বাজেট হ্রাস ছাড়াই বড় স্পেন্ডিং বিল পাশ করানোর রিপাবলিকান প্রবণতারও সমালোচনা করেন। সামগ্রিকভাবে, হ্যালির অভ্যন্তরীণ নীতির অবস্থানগুলি ট্রাম্প এবং ডিসান্টিসের নেতৃত্বাধীন এমএজিএ গোষ্ঠীর তুলনায় আরও মধ্যপন্থী হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তার হস্তক্ষেপবাদী পররাষ্ট্র নীতিও এমএজিএ উইংয়ের অধিকতর আইসোলেসনিস্ট প্রবণতার থেকে তীব্রভাবে বিপরীত।
হ্যালি নিজেকে এই প্রতিযোগিতায় বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞ হিসাবে স্থান দিয়েছেন, যা এমন একটি ভূমিকা যা তার প্রচারাভিযানের অগ্রগতির সাথে সাথে সম্ভবত আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। রিপাবলিকান পার্টির মধ্যপন্থী শাখায় তার নেতৃত্ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বিশেষত নির্বাচনের জন্য ক্যান্ডিডেটদের দৌঁড়ে নতুন পট পরিবর্তনের সাথে সাথে। সম্প্রতি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো মধ্যপন্থী ভোটারদের মধ্যে পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরেছে, যারা ট্রাম্প বিরোধী প্রার্থীদের সমর্থন করতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। প্রাইমারি সিজন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে, রাজনৈতিক দৃশ্যপট অত্যন্ত তরল বলে মনে হচ্ছে, যা আমেরিকান রাজনীতিতে একটি সম্ভাব্য রূপান্তরমূলক সময়ের ইঙ্গিত দেয়।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.thetrafalgargroup.org/news/nat-gop-pres-1106/
2 – https://thehill.com/homenews/campaign/4295627-trump-biden-haley-2024-swing-state-poll/
3 – https://www.britannica.com/biography/Nikki-Haley
4 – https://www.nytimes.com/interactive/2015/06/22/us/Transcript-Gov-Nikki-R-Haley-of-South-Carolina-Addresses-Removing-the-Confederate-Battle-Flag.html
5 – https://thehill.com/homenews/campaign/4127166-donald-trump-urges-pause-on-ukraine-aid-amid-biden-probe/
6 – https://www.nytimes.com/interactive/2023/08/18/us/politics/nikki-haley-republican-candidates-2024-issues.html
Leave a Reply