ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্বগুলো (১৭৮৯-১৭৯১)

অভিজাততন্ত্রের বিদ্রোহ

পটভূমি : ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্ব হল অভিজাত বিদ্রোহ (১৭৮৭-৮৮)। উনিশ শতকের ফ্রান্সের রাষ্ট্রনেতা ও ঐতিহাসিক শাতোব্রিয়া লিখেছেন যে প্যাট্রিসিয়ানরা বিপ্লব শুরু করেছিল, সম্পূর্ণ করেছিল প্লেবিয়ানরা (The Patricians began the revolution and the Plebeians completed it)। বুরবোঁ রাজা ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) সংস্কার শুরু করলে অভিজাতরা তাদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বিপন্ন হতে চলেছে আশঙ্কা করে বিদ্রোহ করেছিল (It was set in motion by the aristocracy in the years 1787 and 1788 in the attempt to defend its own fixed political privileges which were threatened by the reforming policy of the Bourbon monarchy)। সমকালীন রাষ্ট্রনেতা রোবসপিয়ের জানিয়েছেন যে অভিজাত, যাজক ও বিচারকেরা প্রথম বিপ্লবের পরিমণ্ডল তৈরি করেছিল, জনগণ পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। রাজার অর্থনৈতিক সংকট হল এই অভিজাত বিপ্লবের তাৎক্ষণিক কারণ। জর্জ লেফেভর অভিজাত বিদ্রোহকে অভিজাত বিপ্লব বলে উল্লেখ করেছেন (The French Revolution was started and led to victory in its first phase by the aristocracy) । রাজতন্ত্রের সঙ্গে অভিজাততন্ত্রের সংঘাত কোনো নতুন ঘটনা নয়, মধ্যযুগ থেকে অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে রাজতন্ত্রের সংঘাত চলেছিল, রাজতন্ত্র এই গোষ্ঠীকে পরাস্ত করে নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেছিল। অষ্টাদশ শতকে রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়লে এই সংঘাত নতুন রূপে ও নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়েছিল।

ষোড়শ লুই এর সংস্কার প্রস্তাব : রাজা ষোড়শ লুই-এর চারজন অর্থমন্ত্রী তুর্গো, কালোন, ব্রিয়েন ও নেকার রাজার অর্থনৈতিক সংকট মোচনের জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব রেখেছিলেন, অভিজাত ও যাজকেরা এসব প্রস্তাবগুলিকে তাদের অধিকারের ওপর আঘাত বলে গণ্য করেছিল –

  • ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে কালোন লবণ ও তামাকের ওপর একচেটিয়া বাণিজ্য সারাদেশে সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
  • মাথাপিছু কর ও ভাতিয়েমের পরিবর্তে সকলের ওপর ভূমির পরিমাণ অনুযায়ী কর ধার্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
  • খাদ্যশস্যের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব ছিল।
  • অভ্যন্তরীণ শুল্ক ও পরোক্ষ কর তুলে দেবার প্রস্তাব ছিল।
  • প্রাদেশিক সভাগুলিকে কর ধার্যের অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব ছিল।

পার্লেমোর বিরুদ্ধে কালোনের সভা গঠনের প্রচেষ্টা ও ব্যর্থতা : কালোন বড়ো রকমের সংস্কার পরিকল্পনা করেননি, তবুও অভিজাত ও যাজকেরা এর বিরোধিতা করেছিল। কালোন এজন্য শক্তিশালী পার্লেমোগুলিকে বাদ দিয়ে সামন্তপ্রভু, যাজক, উচ্চপদস্থ কর্মচারী, ইনটেনড্যান্ট ও প্রাদেশিক সভার সদস্যদের নিয়ে একটি সভা গঠন করেন (council of notables) । এদের কালোন নিজে মনোনীত করেন। কিন্তু কালোনের পরিকল্পনা সফল হয়নি কারণ অভিজাতদের এই সভা নিজেদের অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, সংস্কারের বিরোধিতা করেছিল (The scope and significance of these plans were far-reaching. Calonne’s proposals would have radically altered the political, social and economic structure of the ancient regime and, if implemented, could have anticipated a good deal of legislative reform of the Constituent Assembly) ।

ব্রিয়ানের কর আরোপের প্রস্তাবে পার্লেমোর বিরোধিতা, রাজার দ্বারা এর বিতাড়ন ও পুনরায় ফেরানো : ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ষোড়শ লুই কালোনকে পদচ্যুত করে ব্রিয়েনকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেন। ব্রিয়েন প্রধানদের সভা স্থগিত রেখে প্যারিসের পার্লেমোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ব্রিয়েন প্রাদেশিক সভা পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেন, কর্ভি তুলে দেবার প্রস্তাব করেন, অবাধ শস্য ব্যবসায়ের কথা বলেন। এগুলি সম্পর্কে প্যারিসের পার্লেমোর বিশেষ আপত্তি ছিল না। কিন্তু ব্রিয়েন নতুন ভূমিকর ও স্ট্যাম্পকর স্থাপনের প্রস্তাব দিলে পার্লেমো আপত্তি জানিয়েছিল। পার্লেমোর বক্তব্য হল রাজা আদেশ জারি করে নতুন কর স্থাপন করতে পারেন না, নতুন কর স্থাপন করতে হলে রাজাকে স্টেট্স-জেনারেলের অনুমোদন নিতে হবে। পার্লেমোর সঙ্গে আলোচনা ভেঙে যায়, কালোনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আলোচনা শুরু করলে রাজা পার্লেমোর সদস্যদের ট্রয়তে নির্বাসিত করেন। অন্যান্য পার্লেমো প্যারিসের পক্ষ নিয়ে রাজকীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। রাজা বিশেষ ক্ষমতা লিট দ্য জাস্টিস (Lit de Justice) প্রয়োগ করে কর প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নেবার চেষ্টা করলে পার্লেমো এই কাজকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিল। রাজা প্যারিস পার্লেমোর সদস্যদের প্যারিস থেকে বিতাড়িত করেন। ব্রিয়েন রাজাকে বুঝিয়ে পার্লেমোর সদস্যদের আবার প্যারিসে ফিরিয়ে আনেন কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। পার্লেমো রাজাকে স্টেট্স- জেনারেল ডেকে অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের পরামর্শ দিয়েছিল।

নতুন বিচারালয় গঠন করে সামন্তদের বিচারের অধিকার খর্ব করা ও প্রতিক্রিয়ায় অভিজাতদের সংঘবদ্ধ হওয়া : ইতিমধ্যে রাজার অর্থ দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ল্যামোইগনন (Lamoignon) দুটি আদেশ জারি করে একটি নতুন বিচারালয় গঠন করে তাকে রাজকীয় আদেশ নিবন্ধীকরণের অধিকার দিয়েছিল, ৪৭টি নতুন বিচারালয় গঠন করেছিল, আর সেই সঙ্গে সামন্তদের বিচারের অধিকার খর্ব করেছিল। এই আদেশের বিরুদ্ধে অভিজাতরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। শুধু পার্লেমো নয়, প্রাদেশিক সভাগুলি থেকেও প্রতিবাদ এসেছিল। যেসব প্রদেশে পুরোনো প্রাদেশিক সভা সরিয়ে রাজা নতুন সভা গঠন করেন সেসব স্থান থেকে আপত্তি উঠেছিল। ফ্রাসকতে, দোফিনে ও প্রভস প্রভৃতি প্রদেশে পুরোনো প্রাদেশিক সভা ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছিল। আন্দোলন ক্রমশ বিদ্রোহে পরিণতি পেয়েছিল। দিজ ও তুলুজে নতুন বিচারালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, সরকারি কর্মচারী ও সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল। রেনে রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে পার্লেমো পক্ষীয়দের লড়াই বেধে গিয়েছিল। দোফিনে বড়ো রকমের সংঘাত বেধেছিল, শিল্পশহর দোফিনে আন্দোলন হয়। গ্রেনোবলে জনতার সঙ্গে সরকারি সৈন্য ও কর্মচারীদের সংঘর্ষ হয়েছিল। জনতা ছাদ থেকে টালি ছুঁড়েছিল সৈন্যদের লক্ষ করে, ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুনের এই ঘটনা ‘টালির দিন’ নামে পরিচিত (In 1788, Lamoignon’s coup de etat came too late, and its result was to provoke widespread revolt in the provinces)।

রাজার স্টেটস জেনারেল আহ্বান করতে বাধ্য হওয়া : টালির দিনের পর জুলাই মাসে ভিজিয়ের সভায় মুনিয়ে যে প্রস্তাব নেন তার মূল কথা ছিল পার্লেমোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দোফিনে পুরোনো প্রাদেশিক সভার প্রতিষ্ঠা। ভিজিয়ের সভা হল স্টেট্স জেনারেলের পূর্বসূরি। এই সভা ফরাসিদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল, জাতির দুর্দশা দূর করার জন্য স্টেট্স জেনারেল আহ্বান করতে বলেছিল। প্রাক্-বিপ্লব যুগের সামাজিক ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুলাই ব্রিয়েন প্রতিশ্রুতি দেন ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে স্টেট্স-জেনারেল আহ্বান করা হবে। জর্জ লেফেভর লিখেছেন যে স্টেট্স জেনারেল আহ্বান করতে রাজি হয়ে রাজা অভিজাততন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন, তাদের অগ্রাহ্য করে চলা রাজার পক্ষে সম্ভব হয়নি (The calling of an assembly was an initial surrender; the king was consulting his aristocracy rather than notifying it of its will)।

রাজার সংস্কারে ব্যর্থতা, অভিজাতদের বিজয় : রাজা অর্থনৈতিক সংকটের সমাধানকল্পে অনেকগুলি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তার সব প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি ব্রিয়েনকে পদচ্যুত করে নেকারকে আবার অর্থমন্ত্রীর পদে ফিরিয়ে আনেন। পার্লেমোকে ফিরিয়ে আনা হল, স্ট্যাম্পকর ও ভূমিকর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অভিজাতরা রাজার সঙ্গে সংঘাতে জয়ী হয়, তার চেয়ে বড়ো কথা সারা দেশে বিপুল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। দার্শনিকদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রাজকীয় স্বৈরাচারকে আক্রমণ করা হয়। জাতি, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির কথা উঠেছিল। স্টেট্স জেনারেলের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ রাজাকে স্মারকলিপি পাঠিয়েছিল (Cahiers), এগুলিতে করভার, পরোক্ষ করের বোঝা, সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার, কর সাম্য, আইনের সাম্য ও নাগরিক অধিকারের কথা স্থান পেয়েছিল। প্যারিসের অ্যাকাডেমি, কৃষিসভা, পাঠচক্র, জনকল্যাণকামী নানা গোষ্ঠী, মেসনিক আবাসসমূহ সকলে এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। কোনো কোনো শহরে (যেমন দোফিনে) বুর্জোয়ারা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহের সময় লাফায়েত, তালেরাঁ, কন্দরসে, আবে সিয়েস ও অন্যান্যরা প্রেটিয়ট গোষ্ঠী গঠন করেছিল, ফ্রান্সের সার্বিক উন্নতি ঘটানো ছিল এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য।

বিদ্রোহের সময় বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের লক্ষণ স্পষ্ট হওয়া, অভিজাততন্ত্রের দুর্বল হওয়া : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে স্টেট্স জেনারেলের নির্বাচন হয়। নির্বাচন পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত জটিল। নির্বাচন চলাকালীন নেকার অভিজাতদের সঙ্গে আপস করে চলার নীতি অনুসরণ করেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অভিজাতরা রাজা লুই এর কাছে অভিযোগ করেছিল যে সংস্কারের নামে তাদের সম্পত্তির অধিকারের ওপর আক্রমণ হানা হয়েছে। অভিজাততন্ত্রের বিদ্রোহের সময় বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে ঐক্যের সাধারণ সূত্র হল তারা আইনানুগ শাসনব্যবস্থা চেয়েছিল, চেয়েছিল ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক সংস্কার। কিন্তু এদের মধ্যে স্বার্থদ্বন্দ্বও ছিল, অভিজাততন্ত্র নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থান বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। রাজতন্ত্রকে দুর্বল করে দিয়ে অভিজাততন্ত্র নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল ও শিথিল করে ফেলেছিল। তৃতীয় এস্টেট স্বাধীনতা ও অধিকারের সমতার ওপর জোর দিয়েছিল, এদের মধ্যে স্বার্থ সংঘাত ছিল অনিবার্য।

বুর্জোয়া বিপ্লব

স্টেটস জেনারেল আসন বিন্যাস ও পটভূমি : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্টেট্স-জেনারেলের অধিবেশন বসেছিল, ৯ জুলাই জাতীয় সভা সংবিধান রচনার কাজ শুরু করেছিল। এই দুমাস সময়কালে ফ্রান্সে বুর্জোয়া বিপ্লব ঘটেছিল। সাধারণভাবে বলা হয় ফ্রান্সের বিপ্লব হল বুর্জোয়া বিপ্লব। বুর্জোয়ারা এই বিপ্লবকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সংবিধান সভায় এরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়ারা লাভবান হয়েছিল (It was a revolution of the bourgeois by the bourgeois, and for the bourgeois)। বুর্জোয়া বিপ্লবের মূলকথা হল অন্য দুই সম্প্রদায়ের সঙ্গে (যাজক ও অভিজাত) বুর্জোয়াদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। স্টেট্স জেনারেলের তিনটি কক্ষে যাজক, অভিজাত ও তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিদের আসন গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল। নির্বাচন পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত জটিল ও পরোক্ষ। যাজকদের সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০০, অভিজাতদের ২৯৯ এবং তৃতীয় কক্ষের ৬১০। রাজা তৃতীয় কক্ষের দ্বিগুণ প্রতিনিধিত্বের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সাধারণ মানুষের দাবি ও তৃতীয় স্টেটের সাথে অন্যদের দ্বন্দ্ব : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ ছিল। এই পটভূমিকায় স্টেট্স-জেনারেলের নির্বাচন হয়। রাজার নির্দেশে প্রতিনিধিরা কাইয়ে (Cahiers) নিয়ে এসেছিল। এই স্মারকলিপিগুলিতে সাধারণ মানুষের দাবিগুলি স্থান পেয়েছিল। জনগণের দাবিগুলির মধ্যে ছিল শাসনতন্ত্রের অভাব, রাজার মন্ত্রীদের স্বৈরাচারী আচরণ, পরোক্ষ কর হ্রাসের দাবি এবং জাতীয় সভায় আলোচনার মাধ্যমে কর ধার্যের প্রস্তাব। দাবি সনদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল অভ্যন্তরীণ শুল্ক চৌকির বিরোধিতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (They (Cahiers) not only demand liberty of speech, writing and assembly, freedom of trade and freedom from arbitrary arrest, but they generally insist on the complete civil equality of all three esteates-that is, that the clergy and nobility must surrender not only utterly discredited relics like serfdom, but they must give up such age-old privileges as tithe, banalites (local monopolies). champart (feudal rent in kind), hunting rights and seigneurial jurisdiction) । তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কাইয়েগুলিতে জনগণের সব দাবি- দাওয়া স্থান পায়নি, স্টেট্স জেনারেলে এগুলি নিয়ে আলোচনাও হয়নি (The more immediate discontents of the rural population got eliminated from many of the cahiers and were scarcely voiced in the assembly)। এই গণবিক্ষোভ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে গ্রামাঞ্চলে গণবিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তৃতীয় এস্টেটের সদস্যদের বেশিরভাগ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, তারা পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিল। অভিজাত ও যাজকেরা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিল, এজন্য তৃতীয় এস্টেটের সঙ্গে এদের সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। প্রগতিশীল অভিজাতরা বুর্জোয়া নেতাদের পরিবর্তনের দাবি মেনে নিয়েছিল। প্রথম এস্টেটের যাজকদের মধ্যে মাত্র ৪৬ জন ছিলেন উচ্চ যাজক শ্রেণির, বাকি আর সকলে ছিল নিম্ন যাজকদের প্রতিনিধি, এরা পরিবর্তন চেয়েছিল। স্টেট্স-জেনারেলের মধ্যে পরিবর্তনকামী, উদারনৈতিক সদস্যরা ‘পেট্রিয়টিক পার্টি” গঠন করে স্টেট্স-জেনারেলের গঠন ও ভোটদান পদ্ধতির পরিবর্তন দাবি করেছিল।

তৃতীয় এস্টেটের নিজেদের জাতীয় সভা হিসেবে ঘোষণা করার বৈপ্লবিক পদক্ষেপ : অভিজাততান্ত্রিক বিদ্রোহের সময় বুর্জোয়ারা আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু স্টেট্স জেনারেলের অধিবেশনের দিন থেকে তারা অভিজাততন্ত্র বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। কন্দরসে, তালেরাঁ, মিরাবো ও সিয়েসের মত অভিজাত ও যাজকেরা তৃতীয় এস্টেটের দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। তৃতীয় এস্টেটের নির্বাচিত সদস্যদের বেশিরভাগ ছিল আইনজীবী, শিল্পপতি, ব্যাঙ্কার ও পেশাদার মানুষ, অল্প কয়েকজন ছিল কৃষিজীবী। ৫ মে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে স্টেট্স-জেনারেলের অধিবেশন বসার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। তৃতীয় এস্টেটের সদস্যরা দুটি পরিষ্কার দাবি রেখেছিল— সভার যৌথ অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটদানের ব্যবস্থা। রাজা ও রানী তৃতীয় এস্টেটের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় এস্টেটের সঙ্গে আপস করলে হয়তো রাজতন্ত্র রক্ষা পেত (only a king prepared to be a revolutionary could have escaped from the dilemma)। রাজা তৃতীয় এস্টেটের দাবি মানেননি, অপর দিকে বুর্জোয়ারাও নিজেদের দাবিতে অটল ছিল। আবে সিয়েস ‘হোয়াট ইজ দ্য থার্ড এস্টেট’ (What is the Third Estate?) পুস্তিকা লিখে জানালেন যে তৃতীয় এস্টেট হল আসল ফরাসি জাতি। অভিজাত ও যাজকরা হল জনসংখ্যার ভগ্নাংশ মাত্র। প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেটের সদস্যদের বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তৃতীয় এস্টেটের সঙ্গে যৌথ অধিবেশনে বসতে তারা রাজি হয়নি। এই পটভূমিকায় ১৭ জুন ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় এস্টেট নিজেকে জাতীয় সভা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এই সময় প্যারিসের অবস্থা ছিল অগ্নিগর্ভ, খাদ্যাভাব ও বেকারত্ব জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল। তৃতীয় এস্টেটের নেতারা জানতেন যে তারা প্যারিসের সমর্থন পাবেন। তৃতীয় এস্টেট নিজেকে জাতীয় সভা হিসেবে ঘোষণা করে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল কারণ এই ঘোষণা ছিল সংবিধানবিরোধী ও প্রচলিত আইন বিরোধী। এই ঘোষণার মাধ্যমে তৃতীয় এস্টেট রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরোধিতা করেছিল, এই সভা যে জাতীয় সার্বভৌমত্বের উৎস তার ইঙ্গিত দিয়েছিল।

তৃতীয় এস্টেটের সাথে রাজার বিরোধ, রাজার দাবি মেনে নেয়া, সংবিধান রচনা : এই ঘটনার পর রাজা স্টেট্স জেনারেলের অধিবেশন স্থগিত করে দেন, তৃতীয় এস্টেটের দাবি তিনি মেনে নিতে চাননি। ২০ জুন তৃতীয় কক্ষের সদস্যরা পাশের টেনিস কোর্টে মিলিত হয়ে শপথ নিয়েছিল যে দেশের জন্য সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবে। তৃতীয় এস্টেট এবার প্রত্যক্ষভাবে রাজতন্ত্রের বিরোধিতায় নেমেছিল। রাজা ২৩ জুন রাজকীয় অধিবেশন আহ্বান করে তৃতীয় এস্টেটের কার্যকলাপকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেন, তৃতীয় কক্ষের সদস্যদের সভাকক্ষ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। মিরাবোর নেতৃত্বে তৃতীয় এস্টেট রাজার আদেশ অমান্য করেছিল। তাদের বক্তব্য হল রাজার ইচ্ছায় তারা নির্বাচিত হননি, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তারা আইন সভায় এসেছেন। শক্তি প্রয়োগ করে রাজা শুধু তাদের বহিষ্কার করতে পারেন। আলফ্রেড কোবান মনে করেন তৃতীয় এস্টেটের বিরোধিতা করে রাজা জাতির সঙ্গে আপস করার সুযোগ হারিয়েছিলেন। সুবিধাভোগীদের সঙ্গে তিনি গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন (It was in the royal session that the monarchy sacrificed the possibility of alliance with the nation and bound its fate to that of the privileged order)। রাজা শেষপর্যন্ত তৃতীয় এস্টেটের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। স্টেট্স-জেনারেলের বেশিরভাগ সদস্য জাতীয় সভার পক্ষে ছিল আর গুজব ছিল যে রাজা তৃতীয় এস্টেটের দাবি না মানলে জনতা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করতে পারে। রাজা ৩০ জুন জাতীয় সভার যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন, তৃতীয় সম্প্রদায়ের জয় হয়, জয় হয় বুর্জোয়া বিপ্লবের। ৯ জুলাই এই জাতীয় সভা জাতীয় সংবিধান রচনার কাজ নিজের হাতে নিয়ে সংবিধান সভায় পরিণত হয়।

বিপ্লবের প্রথম পর্বে বুর্জোয়ারা জয়ী হলেও পুরাতনতন্ত্র পুরোপুরি অটুট ছিল, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও যাজকতন্ত্র তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। এরা আপস করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়নি, এজন্য ফরাসি বিপ্লবে নতুন শক্তির আবির্ভাব হয় – এই নতুন শক্তি হল সাঁকুলোৎ, শ্রমিক ও কৃষকদের বিদ্রোহ।

জনতা ও কৃষক বিদ্রোহ

জনতা ও কৃষকদের বিদ্রোহের সূচনা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কাল হল জনতা ও কৃষক বিদ্রোহর যুগ। ডেভিড টমসন জানিয়েছেন যে খাদ্যাভাব ও বেকারত্ব, স্বৈরাচার ও সামন্ততান্ত্রিক উৎপীড়ন সাধারণ মানুষকে পরিবর্তনকামী করে তুলেছিল। আর্থার ইয়াংকে একজন দরিদ্র স্ত্রীলোক বলেছিলেন যে তারা প্রত্যহ পরিবর্তন আশা করছেন কারণ রাজকীয় ও সামন্ততান্ত্রিক করভারে তারা পীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত। জাতীয় সভা গঠিত হলেও স্বৈরাচার ও অভিজাততন্ত্র পরিবর্তনকে মেনে নেবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। রাজা ও তার পরামর্শদাতারা বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন, প্যারিসের জনতাও বসে ছিল না। জনতা একটি জাতীয় রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলেছিল কারণ প্যারিসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজকীয় সৈন্যবাহিনী ও লুটপাটকারীরা প্যারিস আক্রমণ করতে পারে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। প্যারিসের জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে অস্ত্র সংগ্রহের দিকে নজর দিয়েছিল। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে জনপ্রিয় মন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করলে জনতা এর মধ্যে অভিজাততন্ত্রের ষড়যন্ত্র লক্ষ করেছিল। জাতীয় সভার বুর্জোয়া সদস্যরা মনে করেন রাজা অভিজাতদের চাপে সভা ভেঙে দিতে পারেন।

বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ : ১৪ জুলাই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের এক বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করেছিল। বাস্তিল ছিল স্বৈরাচার ও সামন্ততান্ত্রিক অপশাসনের প্রতীক। এই দুর্গের গভর্নর ছিলেন দ্য লোনে, বন্দী ছিলেন মাত্র সাত জন। বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য জনতা বাস্তিল আক্রমণ করেনি, এখানে কিছু অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ মজুদ করা হয়েছিল, এগুলি হস্তগত করার জন্য বাস্তিল আক্রমণ করা হয়। এর আগে জনতা সেন্ট লাজারের মঠ আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছিল। বহু শুল্ক চৌকি ভেঙে ফেলা হয়, কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়, জনতা কর সংগ্রাহকদের ওপরে আক্রমণ চালিয়েছিল। প্যারিস ও অন্যান্য শহরে খাদ্যের গাড়ি লুট করা হয়, রুটির কারখানায় হামলা হয়।। বাস্তিলের গভর্নর আত্মসমর্পণ করেন, কিন্তু তার প্রাণরক্ষা হয়নি। জনতার কয়েকজন রক্ষীদের হাতে নিহত হন, বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটে। এই ঘটনার সামরিক গুরুত্ব খুবই সামান্য, এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অসাধারণ। গুডউইন জানিয়েছেন যে বাস্তিলের পতনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, বাস্তিলের সঙ্গে ফ্রান্সে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। (Though of little military importance its fall had far-reaching consequences) ।

বাস্তিলের পতনের পর অস্থিরতা, কর প্রদান বন্ধ : বাস্তিলের পতন জাতীয় সভাকে শক্তিশালী করেছিল, ক্ষমতা হস্তান্তর পর্ব শুরু হয়ে যায়। রাজা এর যথার্থ তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেননি। তিনি ১৭ জুলাই নেকারকে মন্ত্রীসভায় ফিরিয়ে আনেন, কিন্তু জনতা আশ্বস্ত হয়নি। অভিজাতরা এই ঘটনার পর ফ্রান্সকে আর নিরাপদ মনে করেনি, তারা দলে দলে দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে থাকে। বাস্তিল দুর্গের পতন ফ্রান্সের কৃষকদের বিদ্রোহে উৎসাহ দিয়েছিল। জাতীয় সভা ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেবার জন্য লাফায়েতের নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিল। ফ্রান্সে পৌর বিপ্লব শুরু হয়ে যায়, পৌরসভাগুলি শাসনের সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, ইনটেনড্যান্টরা পদচ্যুত হন। ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়েছিল। বাস্তিল দুর্গের পতন ফ্রান্সে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। বাস্তিল দুর্গের পতন ফ্রান্সের কৃষক বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। ফ্রান্সের গ্রামীণ মানুষের বহু ধরনের ক্ষোভ ছিল, তাদের বহু ধরনের কর দিতে হত, অজন্মা চলেছিল, খাদ্যাভাব ছিল। সামন্তপ্রভুদের বেগার শ্রম কর্ভি ও সামন্তকর দিতে হত, রাজাকে তেই ও চার্চকে টাইথ দিতে হত। ফ্রান্সের কৃষকরা সামন্তকর ও টাইথ দেওয়া বন্ধ করেছিল। জর্জ লেফেভর জানিয়েছেন যে গ্রামে এক বিষম ভীতি (great fear) ছড়িয়ে পড়েছিল। কৃষকদের মধ্যে গুজব ছড়িয়েছিল যে ভূস্বামীরা গুণ্ডা প্রকৃতির লোকদের সংগঠিত করে তাদের ওপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পটভূমিকায় ৪ আগস্ট অভিজাতরা স্বেচ্ছায় তাদের সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করেছিল। ৪-১১ আগস্টের মধ্যে টাইথ, কর্ভি ও সার্ফ প্রথার অবসান ঘটে, কিন্তু সামন্তপ্রথার সব কিছুর অবসান ঘটানো সম্ভব হয়নি। বাকি করের পরিবর্তে ভূস্বামীকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়, বুর্জোয়া নেতারা সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রাজা এই গ্রামীণ বিপ্লবকে স্বীকার করেননি, কৃষকরাও পুরোপুরি খুশি হয়নি। তাদের প্রধান দাবি ছিল দুটি – ভূমির পুনর্বণ্টন এবং বকেয়া ঋণের অবসান, এদুটি দাবির কোনোটাই জাতীয় সভা গ্রহণ করেনি। ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে অস্থিরতা ও অশান্তি চলেছিল। বিষম ভীতির সঙ্গে ছিল মত্ত আশা (great hope)। দুর্দিনের অবসান ঘটবে এই আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে কৃষকেরা দলবদ্ধভাবে ভূস্বামীদের প্রাসাদ (শাতো) আক্রমণ করেছিল। শস্যগোলা লুট করা হয়, দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে জর্জ লেফেভর জানিয়েছেন গ্রামীণ বিপ্লবে রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনা ছিল খুব কম। বুর্জোয়ারা শহর ও গ্রামীণ বিপ্লবের ফলে লাভবান হয়েছিল, কারণ এসব বিদ্রোহ জাতীয় সভার প্রতি অনুগত ছিল। তবে বুর্জোয়া, জনতা ও কৃষকের স্বার্থ এক ছিল না, বুর্জোয়া নেতারা ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখে দেওয়ার জন্য প্রয়াস চালিয়েছিল।

রাজপ্রাসাদ অবরোধ : ৫ অক্টোবর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। ঐদিন এক বিশাল জনতা যার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ছিল বেশি প্যারিস থেকে ভার্সাই শহরে গিয়ে রাজার প্রাসাদ অবরোধ করেছিল। সঙ্গে লাফায়েত তার জাতীয় রক্ষী বাহিনী নিয়ে হাজির ছিলেন। রাজা প্যারিসে না থাকার জন্য অভিজাততন্ত্রের পরামর্শ মতো চলছেন। এমন ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজা সৈন্য তলব করে বিপ্লবকে ধ্বংস করতে পারেন এমন সম্ভাবনাও ছিল। জনতার দাবি মেনে নিয়ে রাজা ৪ আগস্টের আইনগুলি মেনে নিলেন, ভার্সাই ছেড়ে প্যারিসে এসে বাস করতে রাজি হলেন। পরের দিন রাজার রক্ষীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ হয়, লাফায়েত তা সামাল দেন। শহর ও গ্রামীণ বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের মুখবন্ধ হিসেবে কাজ করেছিল, অক্টোবরের পর কৃষকেরা ধরে নিয়েছিল যে বিপ্লব শেষ হয়েছে যদিও তাদের মূল দাবিগুলি গৃহীত হয়নি। এই দুই বিপ্লবের অভিঘাতে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও যাজকতন্ত্র অবশ্যই দুর্বল হয়েছিল। বুর্জোয়াদের হাত শক্তিশালী হয়েছিল, তারা নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য অনুযায়ী সংবিধান রচনার কাজে এগিয়ে গিয়েছিল।

সংবিধান সভা ও তার কার্যাবলি (১৭৮৯-১৭৯১)

সংবিধান রচনায় প্রভাব : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সংবিধান সভা সংবিধান রচনার কাজ শুরু করেছিল, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তা শেষ হয়। এই সভার সদস্যদের বেশিরভাগ ছিলেন বুর্জোয়া, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, প্রাক্তন সরকারি কর্মচারী, প্রগতিশীল অভিজাত ও যাজক। সংবিধান সভার নেতৃত্ব ছিল মুনিয়ে, মোলেৎ, বার্নেভ, ডুপো, চার্লস লামেথ, সিয়েস, লাফায়েত, মিরাবো ও তালেরাঁর হাতে। এই সভায় একটি ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্রী গোষ্ঠীও ছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামটি হল রোবসপিয়ের। এই সংবিধান সভার ওপর সমকালীন স্বাভাবিক অধিকার দর্শন (Natural Rights school) ও আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত টমাস জেফারসন এই সময় প্যারিসে ছিলেন, ধরে নেওয়া হয় মার্কিন সংবিধানের অন্যতম রূপকার এই রাষ্ট্রনায়কের প্রভাব পড়েছিল সংবিধান রচয়িতাদের ওপর। আসলে সংবিধান সভার সদস্যরা সমকালীন রাজনৈতিক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, ফরাসি দার্শনিকদের রচনার দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিপ্লবের প্রথম ধাক্কায় স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, সুবিধাভোগী অভিজাততন্ত্র ও যাজকতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এই পটভূমিকায় সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য নতুন ধরনের রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের কাজে হাত দিয়েছিল।

সংবিধানের বিষয়বস্তু : সংবিধান সভা সংবিধানের মুখবন্ধ হিসেবে মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের কথা (Declaration of the Rights of Man and Citizen ) ঘোষণা করেছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট। এই ঘোষণাটি নানাদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ, এই ঘোষণা হল নতুন সংবিধানের ভিত্তি। রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকারের এই ঘোষণাটি সংবিধানের কাঠামো রচনায় সহায়ক হয়। এর অন্যদিক হল সর্বদেশের সর্ব মানুষের জন্য এই ঘোষণাটি প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। কাইয়েতে অনেক দাবি তুলে ধরা হয়েছিল, সংবিধান রচনাকারী বুর্জোয়াদের নিজস্ব কিছু দাবি ছিল, এগুলি সব ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত হয়। আইন, কর ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সকলের সমতার নীতি ঘোষিত হয়। এই ঘোষণাপত্রে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা দেওয়া হয়। সংবিধান সভা মূল নীতি হিসেবে গণসার্বভৌমত্ব ও আইনের উৎস হিসেবে গণইচ্ছাকে মেনে নিয়েছিল (The principle of all soverignty rests essentially in the nation and that law is the expression of general will)। সবচেয়ে বিপ্লবী অনুচ্ছেদটি হল অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের অধিকার (the right of resistance to oppression)।

সংবিধানের সীমাবদ্ধতা : ঐতিহাসিক অলার (Aulard) বলেছেন যে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি হল পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা (the death certificate of the old regime)। সমগ্র উনিশ শতক ধরে এই ঘোষণাটিকে উদারনীতিবাদের মূল দলিল হিসেবে গণ্য করা হত। স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, নিরাপত্তা ও অপশাসনের বিরোধিতা এতে স্থান পেয়েছিল (liberty, property, security and resistance to oppression)। কিন্তু মানবাধিকারের এই ঘোষণাপত্রটি ছিল অসম্পূর্ণ। অর্থনৈতিক কাজকর্মের স্বাধীনতা বা বাণিজ্যের স্বাধীনতার কথা এতে বলা হয়নি। সভা-সমিতি করার অধিকার, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার কথা এই ঘোষণায় উল্লিখিত হয়নি। এই ঘোষণা বিশ্বজনীন আবেদন রেখেছিল, কিন্তু সব অধিকারের কথা বলেনি। অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বের কথা ছিল না। স্বাভাবিক অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক শর্ত আরোপ করে তাদের সীমিত করে রাখা হয়েছিল। জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টনের কথা ছিল না। রুদে ও কোবান প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানবাধিকারের ঘোষণাটি পুরাতনতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ফ্রান্সে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের কালজয়ী আবেদনের সূচনা হয়েছিল এই ঘোষণাপত্রটির মাধ্যমে (The mythic character of the French Revolution unfolded)।

রাজার সীমাবদ্ধতা : সংবিধান সভার সদস্যরা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও অনিয়ন্ত্রিত, উচ্ছৃঙ্খল গণতন্ত্র উভয়কে ভয় পেয়েছিল। এই সভায় কয়েকজন গণতন্ত্রী সদস্য ছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কেউই প্রজাতন্ত্রের কথা বলেননি, বেশিরভাগ সদস্য নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। ফ্রান্সে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র বজায় রাখার পক্ষে তারা মত দেন তবে এই রাজতন্ত্র হবে নিয়মতান্ত্রিক, রাজাকে সংবিধান মেনে চলতে হবে। ফ্রান্সের নিয়মতান্ত্রিক রাজার নতুন উপাধি হবে ‘ফরাসিদের রাজা’, ‘ফ্রান্সের রাজা’ নয়। রাজা সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে সরকার, আইনসভা, সৈন্যবাহিনী ও বিচার বিভাগ পরিচালনা করবেন। রাজা মন্ত্রী, সেনাপতি ও রাষ্ট্রদূতদের নিযুক্ত করতে পারবেন, কিন্তু তিনি দৈবানুগৃহীত অধিকার দাবি করতে পারবেন না। তিনি হবেন রাষ্ট্রের প্রথম সেবক (first servant of the state), সংবিধান অনুযায়ী তিনি রাজকোষ থেকে বার্ষিক বেতন পাবেন ২৫ মিলিয়ন লিভর। রাজা আইনসভা ভেঙে দিতে পারবেন না, তবে কোনো আইন তার অপছন্দ হলে ভিটো প্রয়োগ করে তিনি তাকে সর্বাধিক দুটো আইনসভার আয়ুষ্কাল চার বছর অবধি স্থগিত করে রাখতে পারবেন (suspensive veto)। পরপর দুটি আইনসভা যদি একই আইন পাস করে তাহলে রাজার সম্মতি ছাড়াই তা আইনে পরিণত হবে। আইনসভার সম্মতি ছাড়া রাজা কোনো কর ধার্য করতে পারবেন না। ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব অনুসরণ করে রাজার মন্ত্রীদের আইনসভার সদস্য করা থেকে বিরত রাখা হয়। অথচ তারা তাদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ ছিল। রাজা যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি চুক্তি করতে পারবেন তবে এসব ক্ষেত্রে তাকে আইনসভার সম্মতি নিতে হবে। সৈন্য বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা রাজার প্রতি নয়, জাতির প্রতি আনুগত্যের শপথ নেবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল গার্ড গঠন করতে পারবে।

আইনসভার গঠন ও নিয়ম : সংবিধানে ৭৪৫ জন সদস্যবিশিষ্ট এক কক্ষের আইনসভা গঠন করা হয়, সদস্যরা দুবছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। এই আইনসভাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বলে ঘোষণা করা হয়, কর স্থাপন ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই সভাকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রতি দুবছর অন্তর আইনসভার নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সংবিধান সভার সদস্যরা গণবিপ্লবের স্বরূপ দেখে ভয় পেয়ে যান, এজন্য আবে সিয়েসের পরামর্শ অনুযায়ী শুধু সম্পত্তিবান লোকদের ভোটদানের অধিকার দেওয়া হয়। নাগরিকদের দুটি স্তর—সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় এইভাবে ভাগ করে শুধু করপ্রদানকারী (প্রথম পর্বে তিনদিনের অদক্ষ শ্রমের মূল্য) সক্রিয় নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে যারা দশ দিনের মজুরি কর হিসেবে দেন তাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়, আইনসভার সদস্যপদ প্রার্থীকে কমপক্ষে ৫২ লিভর কর দিতে হত। সেযুগে যারা কর দেয় তাদের শুধু দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত। অধ্যাপক পামার নতুন সংবিধানের নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে প্রাথমিক স্তরে ৭০ শতাংশ, দ্বিতীয় স্তরে ৫০ শতাংশ এবং তৃতীয় স্তরে মাত্র ১ শতাংশ নাগরিক নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার পেয়েছিল। সেযুগে পৃথিবীর কোনো দেশে অবাধ, বিশ্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না, ইংল্যান্ডেও ভোটাধিকার ছিল সীমিত। ইংল্যান্ডের সঙ্গে তুলনায় ফ্রান্সের নতুন নির্বাচন ব্যবস্থা বেশি গণতান্ত্রিক ছিল।

শাসন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন : সংবিধান সভা দেশের শাসন ও স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিল। প্রশাসন ও বিচার বিভাগে যারা রাজকীয় পদ কিনেছিল তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুরোনো ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ইনটেনড্যান্ট, কর সংগ্রাহক, পার্লেমোর সদস্য সকলে পদ হারিয়েছিল। শাসনের সব পদ সর্বশ্রেণির মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পুরোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থার অসুবিধাগুলি দূর করার জন্য নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। সারা দেশকে ৮৩টি ডিপার্টমেন্টে ভাগ করা হয়, এগুলি আবার জেলা, ক্যান্টন ও কমিউনে বিভক্ত হয়। পিরামিডের আকৃতিবিশিষ্ট এই কাঠামোর একেবারে নিম্নস্তরে ছিল চুয়াল্লিশ হাজার কমিউন। কমিউন থেকে ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত সর্বস্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন পরিষদ গঠন করা হয়। নির্বাচিত মেয়র, ডেপুটি মেয়র, প্রিফেক্ট ও সাব-প্রিফেক্টরা শাসনের অধিকার পেয়েছিল, কেন্দ্রীভূত রাজকীয় শাসন বিকেন্দ্রীভূত হয়েছিল। নির্বাচিত শাসকেরা শাসনের প্রায় সব কাজ করত। শাসন, বিচার, জনহিতকর কাজ, শিক্ষা, কর স্থাপন, কর সংগ্রহ, নির্বাচন পরিচালনা প্রভৃতি কাজ এরা করত। স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে ফ্রান্সে নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা : নতুন সংবিধানে ফরাসিদেশের জন্য স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা গঠন করা হয়। বিচার বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মডেলটি এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। রাজকীয় আদালত, পার্লেমো, যাজকদের আদালত, ভূস্বামীদের আদালত, লেটার দ্য ক্যাশে সব তুলে দেওয়া হয়। আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমতার নীতি ঘোষিত হয়। কমিউন থেকে জেলা স্তর পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলি বিচারের অধিকার পেয়েছিল। জেলা স্তর থেকে ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচারের জন্য আদালত গঠন করা হয়। এক জেলা আদালত থেকে পার্শ্ববর্তী আদালতে আপিল করা যেত। ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে জুরি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ডিপার্টমেন্ট, মিউনিসিপ্যালিটি ও জাতীয় স্তরে আদালত গঠন করা হয়। জাতীয় স্তরে দুটি আপিল আদালত গঠন করা হয়েছিল। কোর্ট অব আপিল ও হাইকোর্ট গুরুতর অপরাধের বিচারের অধিকার লাভ করেছিল, হাইকোর্টে মন্ত্রী, উচ্চ রাজকর্মচারী ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিচারের ব্যবস্থা ছিল।

অর্থনৈতিক পরিবর্তন : ফরাসি বিপ্লবের শুরু থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। জনগণ সরকারি কর তেই, গাবেল, অ্যাদ, ভাতিয়েম, কাপিতাসিও ইত্যাদি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। চার্চের প্রাপ্য টাইথও বন্ধ হয়েছিল। অভিজাতরা করের ক্ষেত্রে যে ছাড় পেত তা বাতিল হয়, ফার্মিয়ের জেনারেলরা কর স্থাপন ও সংগ্রহের অধিকার হারিয়েছিল। ফ্রান্সের পুরোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। সারাদেশে নতুন করে ভূমিকর স্থাপন করা হয়, অভিজাত, যাজক, কৃষক সকলকে ভূমিকর দিতে বাধ্য করা হয়। ব্যক্তিগত আয়, অস্থাবর সম্পত্তি, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদির ওপর নতুন করে কর স্থাপন করা হয়। ভূমি থেকে ২৪০ মিলিয়ন লিভর আয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। ফ্রান্সের অভিজাততন্ত্র তাদের অনেকগুলি অধিকার হারিয়েছিল। ভূস্বামীদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়নি কারণ সম্পত্তি ছিল মৌল অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের উপাধি, সামন্তকর ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাতিল করা হয়। কৃষকেরা সব ধরনের সামন্তকর—ময়দাকর, মদকর, নদী, বাজার ঘাট কর ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেয়েছিল। ভূস্বামী কোনো কৃষককে ভূমিদাস হিসেবে রাখতে পারবেন না, কৃষকের পুকুরে মাছ ধরা বা বাগানে শিকারের অধিকার পাবেন না। বেগার শ্রম কর্ভি বেআইনি ঘোষণা করা হয়। তবে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা, বকেয়া ঋণ ইত্যাদি আদায়ের অধিকার ভূস্বামীর রয়ে যায়। জমিদারের বর্গাদার কৃষক কিস্তিতে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমির অধিকার পেতে পারে, বকেয়া ঋণ বার্ষিক কিস্তিতে পরিশোধ করার অধিকার কৃষককে দেওয়া হয়।

অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সীমাবদ্ধতা : সংবিধান সভার এই ব্যবস্থা সত্ত্বেও ফ্রান্সের কৃষক জমিদারকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। কৃষকদের টাইথ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, চার্চের জমি অধিগ্রহণ করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়, ধনী কৃষকরা শুধু এর সুযোগ নিতে পেরেছিল। বর্গাদার, প্রান্তিক চাষি বা ভূমিহীন কৃষকদের এই ব্যবস্থা সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতির মৌল সমস্যার সমাধান হয়নি, দরিদ্র কৃষক জমি পায়নি, ঋণ থেকে তাদের মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে সংকট থেকে বিপ্লব শুরু হয়েছিল। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমতা ছিল না, সমভার বাজেট তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সংবিধান সভা সংস্কারের কাজে হাত দিলে সমস্যা তীব্রতর হয়েছিল। অভিজাতদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে বংশানুক্রমিক পদগুলি মুক্ত করা হয়েছিল, অনেক সরকারি বিভাগকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে স্থাপন করার জন্য ব্যয় বেড়েছিল। প্রশাসনিক ব্যয়, ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ ও বুরবোঁ রাজাদের ঋণ রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়িয়েছিল। মিরাবোর প্রস্তাব অনুযায়ী দেশপ্রেমী ধনী নাগরিকদের স্বেচ্ছাকর দিতে বলা হয় (Patriotic tax), এ থেকে রাষ্ট্রের আয় বেড়েছিল ১০০ মিলিয়ন লিভর কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। তখন চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কাগজি মুদ্রা ‘আসিঞা’ (Assignat) বাজারে ছাড়া হয়, এতে আপাতত সুরাহা হল, তবে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা রয়ে যায়।

বাণিজ্য, শিল্পে সীমাবদ্ধতা : সংবিধান সভা ছিল বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে তারা অনেকখানি সাফল্য পেয়েছিল। অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ দেশবাসী পছন্দ করেনি, আইন করে গিল্ড, করপোরেশন, শুল্কচৌকি ইত্যাদি তুলে দেওয়া হয়। সারাদেশে একই ধরনের ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অবাধ, মুক্ত পরিবেশ গঠন করা হলেও, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের নীতি ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। যেসব কোম্পানি বিদেশে বাণিজ্য করত তারা একচেটিয়া অধিকার হারিয়েছিল। ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে ফ্রান্স অবাধ বাণিজ্যনীতি অনুসরণ করেনি, সংরক্ষণ শুল্ক নীতি চালু ছিল। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম করা হয় কারণ ঐ দেশের সঙ্গে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি ছিল। সংবিধান সভা শ্রমিকদের সম্পর্কে উদার, গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেনি। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে লা শাপেলিয়ের আইন (Le Chapelier law) পাস করে সংবিধান সভা শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়া বা ধর্মঘট করার অধিকার বাতিল করেছিল। আইনসভা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেনি, খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যুগে শ্রমিকদের প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে অমানবিক কাজ করেছিল।

ধর্ম নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব : সংবিধান সভার সামনে সবচেয়ে জটিল প্রশ্নটি ছিল ধর্ম ও চার্চ সংক্রান্ত। বিপ্লবের আগে থেকে সারা ফ্রান্সে চার্চ ও যাজক বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছিল। ফ্রান্সের চার্চ প্রভূত সম্পদ, কর্তৃত্ব ও সুযোগের অধিকারী ছিল। বিপ্লবের সময় চার্চের বার্ষিক আয় ছিল ৫০-১০০ মিলিয়ন লিভর, চার্চের ভূসম্পত্তি ও ধর্মীয় কর থেকে এই আয় হত। এজন্য চার্চ রাষ্ট্রকে কোনো কর দিত না, যদিও তার স্বেচ্ছাকর দেবার কথা ছিল। চার্চ ফ্রান্সের শিক্ষা ও জনকল্যাণকর কাজগুলি পরিচালনা করত। চার্চের অনেক সমস্যা ছিল। উচ্চশ্রেণির যাজকেরা বিলাস-ব্যসনের মধ্যে থাকত, ধর্মীয় কাজ করত না, নিম্নশ্রেণির যাজকেরা ছিল দরিদ্র ও অশিক্ষিত। এরাই সংস্কারের দাবি তুলেছিল। ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে চারটি গোষ্ঠী ছিল—গলিকান, জেসুইট, জ্যানসেনিস্ট ও রিচারিস্ট, এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। রিচারিস্ট গোষ্ঠী চার্চের সংস্কারের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সংবিধান সভা সিভিল কনস্টিটিউশন অব দ্য ক্লার্জি (Civil Constitution of the Clergy) গ্রহণ করে চার্চকে রাষ্ট্রের একটি বিভাগে পরিণত করেছিল। যাজকরা হন সরকারি কর্মচারী, চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। চার্চের বিচার বিভাগীয় ও কর স্থাপনের অধিকার বাতিল করা হয়। বিশপের পদ ১৩৫ থেকে কমিয়ে করা হয় ৮৩। পোপ এই সংবিধান গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে যাজকদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে বলা হয়। পোপের অনুমোদন ছাড়াই যাজক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। ফ্রান্সের বিশপদের মধ্যে মাত্র সাতজন এবং নিম্ন যাজকদের ৫০ শতাংশ আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল। ধর্মীয় প্রশ্নে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, বিদ্রোহী যাজকদের অনেকে দেশত্যাগ করে পালিয়ে যায়। যাজকেরা অনুগত (juring) এবং বিদ্রোহী (non-juring) এই দুইভাগে ভাগ হয়েছিল। বিদ্রোহী যাজকেরা ফ্রান্সের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে বিপ্লব বিরোধিতায় নেমেছিল। নেপোলিয়নের আপস পর্যন্ত ফ্রান্সে ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব চলেছিল।

নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, দুর্বল সরকার ও শাসনতন্ত্র : সংবিধান সভা বুরবোঁঁ রাজবংশের নেতৃত্বে একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছিল, স্বৈরাচার ও দৈবানুগৃহীত রাজতন্ত্রের ধারণা বাতিল করা হয়। জর্জ লেফেভর মনে করেন, একটি বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এর সরকার ছিল দুর্বল (This constitutional monarchy was a bourgeois republic but it was republic with no real government)। সংবিধানের রচয়িতারা রাজাকে বিশ্বাস করতে পারেননি, এজন্য তার মন্ত্রীদের আইনসভায় স্থান দেওয়া হয়নি। ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব আক্ষরিকভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে এই সমস্যা দেখা দিয়েছিল, শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাজা তার ক্ষমতার এই সংকোচন ভাল মনে গ্রহণ করেননি, রানির পরামর্শে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেশবাসীকে সাম্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু নির্বাচন সম্পর্কিত যে নিয়মকানুন তারা তৈরি করেন তাতে এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিষ্ক্রিয় নাগরিক করে রেখে তারা গণতন্ত্রের ভিতকে দুর্বল করেছিলেন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের যে ব্যবস্থা তারা করেছিলেন তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যুদ্ধ শুরু হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল।

সংবিধান সভার ব্যর্থতাসমূহ : এই সংবিধানে শাসন ও আইনসভার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়নি (There was too much republic for a monarchy and too much monarchy for a ‘ republic)। আইনসভার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাজতন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছিল, সেজন্য সমভার শাসনতন্ত্র একে বলা যায় না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংবিধান দেশের মৌল সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারেনি। চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কাগজি মুদ্রা চালু করে তারা সাময়িক সাফল্য পেয়েছিলেন, যুদ্ধ শুরু হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, কাগজি মুদ্রা বাতিল করতে হয়। ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতির সংকটের সমাধান হয়নি। সামন্তপ্রথার অবসান ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ কৃষক জমি পায়নি, ঋণ থেকে মুক্তি পায়নি। চার্চের বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি সম্পন্ন কৃষকেরা কিনেছিল। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট হল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বেকারত্ব, সংবিধান সভা নতুন শিল্প ও বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন করে এর সমাধানের চেষ্টা করেনি। এক্ষেত্রে তাদের গৃহীত পদক্ষেপ ছিল দ্বিধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত। কয়েকটি সরকারি কারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, অল্পকাল পরেই এগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে যুদ্ধ শুরু হলে বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। সংবিধান সভার চার্চ সম্পর্কিত বিধানগুলি বিপ্লবের মধ্যে নতুন সংকট নিয়ে এসেছিল। পোপ সিভিল কনস্টিটিউশনকে নিন্দা করলে নিম্নশ্রেণির যাজকেরা যারা এতকাল সংস্কার দাবি করে এসেছিল বিপ্লব বিরোধিতায় নেমেছিল। সংবিধান রচয়িতারা বাস্তব পরিস্থিতিকে শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে এমন সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যার কতকাংশ স্থায়ী হয়নি (It was for reflecting circumstances too closely that part of their work were to prove ephemeral).

সংবিধানের গুরুত্ব : সংবিধান সভা কিন্তু একেবারে ব্যর্থ হয়নি। সদস্যদের সংবিধান রচনার অভিজ্ঞতা ছিল না, খুব বেশি তত্ত্ব দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়েছিল। তাদের রচিত সংবিধানের নানা ত্রুটি ছিল, কিন্তু এই সংবিধানের অবদানও কম নয়। এই সংবিধান ফ্রান্সে নতুন রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিল (It gave birth to political life in France)। এই সংবিধান হল বিপ্লবের প্রস্তাবনা যা রোবসপিয়েরের নেতৃত্বে শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল। এর সবচেয়ে বড়ো অবদান হল ফ্রান্সের আইন ও বিচার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার হয়েছিল (Perhaps the greatest glory of the Constituent Assembly was its reform of the legal system)। এই সভা প্রাক্-বিপ্লব ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে এবং মানবাধিকারের ঘোষণা জারি করে যুগান্তকারী পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। নির্বাচন ব্যবস্থা, সীমিত ভোটাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী অপশাসন ও উৎপীড়ন থেকে মুক্তি ইত্যাদি হল এই সংবিধানের স্থায়ী অবদান। এই সংবিধান মাত্র একবছর টিকেছিল কারণ ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পরিস্থিতি জটিল, অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠেছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ : ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ১৭৮৯-১৯৪৫, সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা – ৫৭-৭৩

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.