সুইডেনের ইতিহাস (১৫৩৩-১৭২১ খ্রি.)

সুইডেন উত্তর ইউরোপের একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে সুইডেন ডেনমার্কের অধীনে ছিল। পরবর্তী প্রায় ১৫০ বছর ডেনমার্ক সুইডেনের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ষোড়শ শতকে সুইডেনের অবস্থার পরিবর্তন আসে। ১৫২৩ সালে গুস্টাভাস ভ্যাসা নামে একজন নেতার নেতৃত্বে সুইডেনের জাতীয় পুনরুজ্জীবন দেখা দেয় এবং সুইডেন ডেনমার্কের অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে সুইডেনে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচলিত থাকায় সুইডেনে পোপের প্রভাব ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন দেখা দিলে সে আন্দোলনের প্রভাবে সুইডেনে পুধারবাদ প্রচারিত হয়। ফলে সুইডেন প্রোটেস্ট্যান্টধর্মী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

গুস্টাভাস ভ্যাসা থেকে নবম চার্লস (১৬০৪-১৬১১)

গুস্টাভাস ভ্যাসা (১৫২৩-১৫৬০): ষোড়শ শতাব্দীর সুইডেনের ইতিহাসে গুস্টাভাস ভ্যাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তিনি সুইডেনের ভাসা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। গুস্টাভাস ভ্যাসা সুইডেনকে ডেনমার্কের অধীনতা থেকে মুক্ত করে একে একটি জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তিনি সুইডেনকে শক্তিশালী করার জন্য রাজতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ এবং জাতীয় প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুইডেনের জাতীয় উত্থানে যে নীতি ও আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন তাই পরবর্তী দুইশ বছর ধরে সুইডেনের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ১৫৬০ সালে গুস্টাভাস ভ্যাসা মৃত্যুবরণ করেন। তবে তিনি জীবিতকালে সুইডেনকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করে গিয়েছিলেন যা পরবর্তী সময়ে তার বংশধর গুস্টাভাস এডোলফাসের সময় বাল্টিক অঞ্চল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।

চতুর্দশ এরিক (১৫৬০- ১৫৬৯): গুষ্টাভাস ভ্যাসার মৃত্যুর পর চতুর্দশ এরিক সুইডেনের সিংহাসনে বসেন। এ সময় সুইডেনের ইতিহাসে যোগা শাসকের অভাবে রাষ্ট্র একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে। চতুর্দশ এরিক ছিলেন বদমেজাজি, হিংস্র প্রকৃতির, অপব্যয়ী এবং মানসিক ভারসাম্যহীন। তার স্বল্পকালীন রাজত্বকাল বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। ১৫৬১ সালে এস্তোনিয়া সুইডেনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাল্টিক অঞ্চলে সুইডেন শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয় কিন্তু চতুর্দশ এরিকের ভ্রান্তনীতি পার্শ্ববর্তী ডেনমার্ক ও পোল্যান্ড সুইডেনের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়। ডেনমার্ক, পোল্যান্ড এবং লিবেক (Liibeck) সুইডেন আক্রমণ করে।

সুইডেনের নৌবাহিনী সমুদ্রে সাফল্য দেখালেও ডেনিশ সৈন্যবাহিনী সুইডেনের অনেক অঞ্চল ধ্বংস করে। এরিকের ভ্রান্তনীতি তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ডিউক জন এবং চার্লসকে বিক্ষুব্ধ করে। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে নিচু বংশজাত জর্জ পার্সনকে (George persson) অযাচিত গুরুত্ব প্রদান এবং তার স্ত্রী কেরিন ম্যানসডটারের (Karin Mansdotter) সাথে বিয়ে তার সর্বনাশ ডেকে আনে। ডিউক জন এবং চার্লসের নেতৃত্বে একটি বিদ্রোহী সৈন্যবাহিনী রাজাকে বন্দি করে এবং তাকে ১৫৬৯ সালে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়।

তৃতীয় জন (১৫৬৯–১৫৯২): চতুর্দশ এরিকের পর তৃতীয় জন সুইডেনের সিংহাসনে বসেন। তিনি সামরিক বিষয়ের চেয়ে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বেশি সময় কাটাতেন। তিনি ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। তার রাণী ছিলেন পোল্যান্ডের রাজকন্যা। চরিত্রগত দিক থেকে রাণী ব্যক্তিত্বশীল ও রোমান ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তার পুত্র ও সিংহাসনে উত্তরাধিকারী সিগিসমান্ড মাতার প্রভাবে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসে লালিত-পালিত হন। এ কারণে সুইডেনের অনেক সভাসদ ও রাজপুরুষ বিক্ষুব্ধ ছিল এবং তৃতীয় জনের শত্রুতে পরিণত হয়। তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সোডারম্যানল্যান্ডের (Sodermanland) ডিউক চার্লস সুইডেনে প্রতিসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে সুইডেনের লুথারবাদকে পরিবর্তন করে ক্যাথলিকবাদ প্রবর্তনের রাজকীয় চেষ্টায় খুন হন। তৃতীয় জন উত্তরাধিকারী হিসেবে তার পুত্র সিগিসমান্ডকে তৃতীয় সিগিসমান্ড (১৫৯২-১৫৯৯) নামে সুইডেনের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে যান। ১৫৮৭ সালে পর্যন্ত তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ ত্যাগ করেন। তিনি পোল্যান্ডের শাসক হলেও তার পিতৃব্য নবম চার্লস রাজপ্রতিনিধি হিসেবে সুইডেন শাসন করতেন। সিগিসমান্ড একজন ক্যাথলিক হিসেবে লুথারপন্থী সুইডেন শাসন করবেন তা ছিল সুইডেনের জনগণের কাছে অসহনীয়। নতুন যুবক রাজা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছিলেন অনভিজ্ঞ এবং একদল অসহিষ্ণু উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও অভিজাত দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। এদের অনেকেই প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে একনিষ্ঠ ছিলেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৫৯৮ সালে সিগিসমান্ডের পিতৃব্য ডিউক চার্লস যুদ্ধে জয়লাভ করে নবম চার্লস (১৬০৪-১৬১১) নাম সুইডেনের সিংহাসনে বসেন।

নবম চার্লস (১৬০৪-১৬১১): নরম চার্লস সিংহাসনে বসেই সুইডেনকে বাল্টিক অঞ্চলে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেন। সুইডেন এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ড অধিগ্রহণের পদক্ষেপ নিলে ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান (১৫৮৮-১৬৪৮) প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ান। তিনি নিজে সুইডেনের সিংহাসনের ওপর অধিকার দাবি করেন। সুইডেনের সিংহাসনচ্যুত রাজা সিগিসমান্ডও সুইডেনের সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করেন। পোল্যান্ডের স্থানীয় জনগণ এবং সুইডেনের অভিজাতরা নবম চার্লসকে রাজা হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি করে। এ অবস্থায় রাশিয়া রোমানভ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। তখন উত্তর ইউরোপে শক্তিসাম্য বজায় রাখার জন্য সুইডেনের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র হওয়া প্রয়োজন ছিল। এসময় নবম চার্লস প্রতিরক্ষা নীতির ক্ষেত্রে যে কৌশল অবলম্বন করেন তার মধ্যেই সুইডেনের আগ্রাসী নীতির বীজ নিহিত ছিল যা দ্বিতীয় গুস্টাভাস বা গুস্তাভাস এডলফাস (১৬১১-১৬৩২) এবং দশম চার্লসের (১৬৫৪-১৬৬০) সময় পরিণতি লাভ করে।

নবম চার্লসের শাসনকাল অনেকটা সফল ছিল। তিনি তার ভ্রাতুষ্পুত্র পোল্যান্ডের রাজা সিসিমান্ডের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সুইডেন থেকে পোল্যান্ড সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেছিলেন। এ সময় সুইডেন ও পোল্যান্ডের রাজবংশ রাশিয়ার সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা কেউ এ বিষয়ে সফলতা লাভ করেন নি। তবে সুইডেনের হস্তক্ষেপের কারণে জার মাইকেল রোমানভ বা প্রথম মাইকেল (১৬১৩-১৬৪৫) ইনগ্রিয়া (Ingira) এবং কেক্সহোমের (Kexholm) ওপর সুইডেনের আধিপত্য ১৬১৭ সালে স্টোলবোতা সন্ধির (Treaty of Stolbova) মাধ্যমে মেনে নেন। রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ সমাপ্তির পূর্বেই নবম চার্লস ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের (১৫৮৮-১৬৪৮)  সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ অবস্থায় ১৬১১ সালে নবম চার্লস মৃত্যুবরণ করেন।

গুস্তাভাস এডলফাস (১৬১১-১৬৩২)

গুস্তাভাস এডোলফাস সুইডেনের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। তাকে ‘উত্তর ইউরোপের সিংহ’ বলা হত। ১৬১১ সালে নবম চার্লস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তার পুত্র গুস্টাভাস এডোলফাস সুইডেনের সিংহাসনে বসেন। আধুনিক সুইডেনের ইতিহাসে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ বীরপুরুষ। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। তৎকালীন ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের নিকট তিনি ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ শাসকদের অত্যাচার থেকে প্রোটেস্ট্যান্টদের রক্ষার জন্য তিনি ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে (১৬১৬-১৬৪৮) অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের জন্যই তাকে “উত্তর ইউরোপের সিংহ” বলা হতো।

প্রারম্ভিক জীবন, সিংহাসনারোহন ও সমস্যাসমূহ

জন্ম ও শিক্ষা : গুস্টাভাস এডোলফাস ১৫৯৪ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সুইডেনের রাজা নবম চার্লসের জ্যৈষ্ঠ পুত্র। তার বুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ণ। ১২ বছর বয়সে তিনি সুইডিশ, জার্মান, ইতালিয়ান, ডাচ, ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। উল্লিখিত ভাষাসমূহ ছিল তৎকালীন আন্তর্জাতিক ভাষা এবং সকল উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত মানুষের ভাষা। পরবর্তী সময়ে তিনি স্প্যানিশ, রুশ এবং পোলিশ ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তার পিতা বাল্যকালেই তাকে রাজনীতি এবং প্রশাসনিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত করেছিলেন। তৎকালীন সুইডেনের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিমনা প্রাজ্ঞ জন স্কাইটি (John Skytte) তার প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রোটিয়াসের সকল রচনা পাঠ করেছিলেন। তিনি শারীরিক গঠনের দিক থেকে ছিলেন সুদর্শন এবং তার তামাটে বাদামি চুল ও দাড়ির জন্য তাকে ইতালীয় ভাড়াটে সৈনিকরা ‘ইল রি ডোবো’ (il de d’oro) বলত, ইংরেজি ভাষায় এর উপনাম ‘উত্তরের সিংহ’ (The lion of the north)। তার নেতৃত্ব ও ঔদার্য তার সৈনিকদের মধ্যে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার উদ্রেক করত। তিনি ভ্যাসা রাজবংশের ধীর মেজাজ এবং দুঃসাহসিকতা ও ভালবাসা লাভ করেছিলেন যা সকলকে আকৃষ্ট করত।

১৬১১ সালে পিতার মৃত্যুর পর সকল যোগ্যতা নিয়ে সিংহাসনে বসেন। এ সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর। সিংহাসনে বসেই তিনি পিতার আমলে শুরু হওয়া ডেনমার্ক এবং রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেন। তিনি ডেনমার্ক ও রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে বাল্টিক অঞ্চলে সুইডেনের আধিপত্য স্থাপনের জন্য দূরদর্শী নীতি গ্রহণ করেন। ১৬১৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজকীয় অভিষেক করেন। এ সময় তার বয়স ছিল ২৩ বছর। তিনি এ সময় সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করেন। সুইডেনের জনসংখ্যা কম থাকায় বিদেশী ভাড়াটে সৈন্য সুইডিশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে অধিকাংশ সৈন্য ছিল সুইডিশ। ১৬২০ সালে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্রোহ দেখা দিলে তা দমন করা হয়। এসব সমস্যা মোকাবেলা করে গুস্টাভাস এডোলফাস একটি দক্ষ ও চৌকস শৃঙ্খলাপূর্ণ সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

গুস্টাভাস এডোলফাসের সমস্যাসমূহ : গুস্টাভাস এডোলফাসের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সমস্যা ছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুইডেনের প্রধান সমস্যা ছিল জনসংখ্যার স্বল্পতা। সুইডেনের আয়তন বিশাল হলেও এর জনসংখ্যা ছিল কম। তাই সৈন্যবাহিনী গঠনের জন্য লোকবলের অভাব, বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরিতে অনেকের যোগদানের অনীহা এবং সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য কৃষকের ওপর করের হার বৃদ্ধি এবং রাজকোষে যথেষ্ট অর্থের অভাবও ছিল। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ডেনমার্ক ও রাশিয়া বাল্টিক অঞ্চলে সুইডেনের প্রভুত্ব বিস্তারে প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল। ডেনমার্ক তখন দক্ষিণ সুইডেনের হল্যান্ড, স্কানিয়া ও ব্রেকিং নামক স্থানগুলো দখল করে সুইডেনের উত্তর সাগরে (North Sea) প্রবেশপথ বন্ধ করে রেখেছিল। একমাত্র গোটা নদীপথে সুইডেন উত্তর সাগরে প্রবেশ করতে পারত।

গুস্টাভাস এডোলফাসের অভ্যন্তরীণ সংস্কার

রাজনৈতিক সংস্কার : গুস্টাভাস এডোলফাস সুইডেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেন। গুস্টাভাস এডোলফাস অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা আধুনিক সুইডেনের সমৃদ্ধির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

  • তিনি সুইডেনের অভিজাতদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। অভিজাতদের অধিকাংশকে পরামর্শ সভা (Rad) এবং আইনসভায় (Riksdag) অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন।
  • সে সময় শহর এবং কৃষকদের পক্ষ থেকে আইনসভায় অভিজাত ও যাজকরা প্রতিনিধিত্ব করতেন। গুস্টাভাস এডোলফাস এ দু শ্রেণীকে রাজতন্ত্রের অনুগত করেছিলেন।
  • পিতা নবম চার্লসের সময় বিরোধী ভাবাপন্ন পরামর্শসভার (Rad) অনেক অভিজাত পোল্যান্ডের রাজদরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নতুন যুবক রাজার সিংহাসন লাভে অভিজাতরা তাদের হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য এক্সেল ওকসেন্সটিয়েরনার (Axel oxenstierna) নেতৃত্বে কতগুলো অধিকার দাবি করে। এর মধ্যে ছিল ল্যুথারবাদকে জাতীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্র জমিদারদের স্বার্থরক্ষা এবং সরকারের পদগুলোতে অভিজাতদের নিয়োগ ছিল। গুস্টাভাস এভোলফান এসব দাবি মেনে নেন এবং অভিজাতদের নেতা ওকসেন্সটিয়েরনাকে চ্যান্সেলর (Chancellor) নিয়োগ করেন। এভাবে তিনি অভিজাতদেরকে রাজার অনুগত সেবকে পরিণত করেন।
  • ১৬২৬ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে অভিজাতদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার এবং অধিবেশন স্থান মঞ্জুর করা হয়।
  • অভিজাতদেরকে রাজার নিয়ন্ত্রণে এনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। তিনি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় বিভাগ (Kollegia) প্রতিষ্ঠা করে এর একজন সভাপতি নিয়োগ দেন। তিনি রাষ্ট্রের সব প্রশাসনিক বিষয় দেখাশুনা করতেন। ৫ জন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী (Chancellor), অ্যাডমিরাল, ট্রেজারার, রাজকীয় গৃহস্থালি তত্ত্বাবধায়ক, সামরিক বাহিনীর প্রধান এ প্রশাসনিক বিভাগ পরিচালনা করতেন। ওকসেন্সটিয়েরনার তত্ত্বাবধানে সুইডেনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এ বিভাগগুলো অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল।
  • গুস্টাভাস এডোলফাস সুইডেনের আইনসভাকে (Riksdag) আধুনিকীকরণ করেন। পূর্বে আইনসভাকে সুইডেনের রাজারা জনমত আদায়ে ব্যবহার করলেও এর ক্ষমতা এবং কার্যপ্রণালী বিধিবদ্ধ ছিল না। ১৬১৭ সালে আইনসভার কার্যপ্রণালীর অধিবেশন ও রাজার সাথে সম্পর্ক আইনবদ্ধ হয়। আইনসভার চারটি শ্রেণীর (estates) অংশগ্রহণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যথা অভিজাত, যাজক, নগরের বার্গার শ্রেণী এবং কর প্রদানকারী কৃষক (Skattesbonder)। রাজা এবং আইনসভার সম্পর্ক একটি লিখিত দলিলে নির্দেশ করা হয়। এর ফলে আইনসভা (Riksdag) সত্যিকার সুইডিশ গণপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং এটা আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করত। আইনসভার একটি গোপন কমিটি ছিল যা বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করত। পরামর্শসভা (Rad) এবং আইনসভা (Riksdag) এবং রাজা দেশের স্বার্থে কাজ করত। গুস্টাভাস এডোলফাসের প্রশাসনিক সংস্কার শাসনতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা তৈরি করে যা গুস্টাভাস এডোলফাসকে বৈদেশিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা করে।

অর্থনৈতিক সংস্কার : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেছিলেন –

  • গুস্টাভাস এডোলফাস উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রশাসনের সৃষ্ট জটিলতা এবং যুদ্ধ রাজকোষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং এজন্য দেশের সমৃদ্ধি বৃদ্ধির প্রয়োজন। এজন্য তিনি নগরের ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহ দেন এবং সমুদ্রবন্দর ও বাজার শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে গোথেনবার্গ বন্দরের ভিত্তি স্থাপন করে সুইডেনের সাথে ইংরেজ ও ডাচ বাণিজ্যের উৎসাহ দেন। ইংরেজ ও ডাচরা সুইডিশ কাঠের ক্রেতা ছিল এবং তারা জাহাজ তৈরিতে সুইডিশ কাঠ ব্যবহার করত। ডাচরা সুইডেনের শিল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করত।
  • গুস্টাভাস এডোলফাস সুইডেনের খনিজসম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নতি সাধন করেছিলেন। ডাচ বিনিয়োগকারী লুই ডি গিয়ার (Louis de Geer) সুইডেনের খনিজসম্পদ বিশেষ করে লৌহ খনি থেকে আকরিক উত্তোলন করে লৌহ শিল্পের বিকাশ ঘটান। ফিনসপং (Finspong), লিউফসটা (Leufsta) এবং নরকওপিং (Norrkoping) লৌহ, তামা, আকরিক উত্তোলনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। গুস্টাভাস এডোলফাস ডাচ শ্রমিকদের সাহায্যে কাচ, চিনি, শ্বেতসার (starch), তামা, লৌহ প্রভৃতি শিল্প গড়ে তোলেন।
  • গুস্টাভাস এডোলফাস নৌবাহিনীর প্রয়োজনে সুইডেনে নৌশিল্পের উন্নতি সাধন করেন। এ শিল্পের কারিগররা সুইডেনের জন্য যুদ্ধ জাহাজ এবং বাণিজ্য জাহাজ তৈরি করত। তার আমলে উসেলিংক্স নামে জনৈক ব্যবসায়ী ‘সাউথ সি কোম্পানি’ নামে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ কোম্পানি আফ্রিকা, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাথে বাণিজ্য করত।
  • এডোলফাস সুইডেনে মুদ্রা সংস্কার করেছিলেন। ১৫৯৯ সালে স্পেন তাম্রমুদ্রা প্রবর্তন করেছিল। সুইডেনে প্রচুর তামার খনি ছিল। এগুলোর উন্নতি করে এবং বিদেশে তামা রপ্তানি করে সুইডেন সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হয়।
  • গুস্টাভাস এডোলফাস সুইডেনে সামরিক শক্তির উন্নতি সাধন করেন। তিনি মনে করতেন যে, সামরিক শক্তির উন্নতির জন্য অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ১৬৩০ সালে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধকে তিনি সুইডেনের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন।

পররাষ্ট্রনীতি

ডেনমার্কের সাথে যুদ্ধ : গুস্টাভাস এডোলফাস সুইডেনকে বাল্টিক অঞ্চলে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে গিয়ে ডেনমার্ক, পোল্যান্ড ও রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৬১১ সালে ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান (১৫৮৮-১৬৪৮) সুইডিশ উপকূলে কালমার বন্দর দখল করলে গুস্টাভাস ডেনমার্কের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান সুইডেন দখল করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সুইডেনের রাজা জন কোপিং আক্রমণ করতে গিয়ে পরাজিত হন। এরপর ডেনমার্কের নৌবাহিনী সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের পূর্বে অবস্থিত ভ্যাক্সহোম দুর্গ দখলের চেষ্টা করে বিফল হয়। ইতোমধ্যে ডেনমার্কের রাজা সুইডেনের সাথে শান্তি আলোচনা করে ১৬১৩ সালে ২১ জানুয়ারি সুইডেন-ডেনমার্কের মধ্যে কর্নাড শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরও দু দেশের মধ্যে শত্রুতা অব্যাহত। ছিল। ডেনমার্ক ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে এবং সুইডেন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় উভয় দেশ যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে ১৬১৯ সালে একটি সমঝোতায় আসে। ১৬২৪ সালে ২৯ জুন ডেনমার্ক- সুইডেনের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে পূর্বেকার কর্নাড চুক্তির পারস্পরিক মুক্তবাণিজ্য সম্পর্কিত ধারা পুনঃনিশ্চিত করা হয়। সাউন্ড জলভাগে (The sound) সুইডেনের জাহাজ বিনা শুল্কে চলাচলের অধিকার লাভ করে। গুষ্টাভাস বাল্টিক সাগরে আটটি যুদ্ধ জাহাজ সর্বদা মোতায়েন রেখে ক্যাথলিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ডেনমার্কের নিরাপত্তার ভার গ্রহণ করেন।

রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ : গুস্টাভাস এডোলফাস বাল্টিক অঞ্চলে সুইডিশ আধিপত্য বিস্তার নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ১৬১১ সালে উত্তর-পশ্চিম রাশিয়ার কেকসহোম, নোভগোরড, ল্যাডোগা, চিচভিন, জামা ও গোড প্রভৃতি অঞ্চল সুইডেনের দখলে ছিল। ১৬১৩ সালে রাশিয়া গোড, চিচভিন দখল করে নেয়। এ অবস্থায় গুস্টাভাস এডোলফাস দু হাজার চৌকস সৈন্য নিয়ে ১৬১৪ সালে জুন মাসে রুশ সৈন্যদের পরাজিত এবং ঐ বছর গোড় পুনঃঅধিকার করেন। রাশিয়ায় সুইডেন কর্তৃক অধিকৃত স্থান দখল স্থায়ী রাখার জন্য এসব এলাকায় সুইডিশ সামরিক ক্যাম্প স্থাপন করেন। ভোলচোভ ও নারভা নদী অববাহিকায় সামরিক অবস্থান সুদৃঢ় করা হয়। ১৫১৬ সালে জুন মাসে সুইডিশ বাহিনী স্কোভ দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ সময় রাশিয়া ও সুইডেনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য ইংল্যান্ডের মধ্যস্থতায় স্টোলবোভ (stolbov) সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে রাশিয়ার জার প্রথম মাইকেল (১৬১৩-১৬৪৫) সুইডেনকে ইভানগোরড, জামা, গোড, কোপরি, নোটেবুর্গ ও কেকসহোম ছেড়ে দেন। এ সন্ধির পর রাশিয়ার সাথে সুইডেনের সম্পর্কের উন্নতি হয়। সুইডেন রাশিয়ার মুক্ত শস্যবাজারে প্রবেশাধিকার পায় এবং রাশিয়া সুইডেনের সামরিক সহায়তা ও যুদ্ধাস্ত্র লাভ করে। এ সন্ধির ফলে সুইডেন ফিনল্যান্ড উপসাগর পর্যন্ত আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়। রাশিয়া ইংরিয়া ও কেরেলিয়া নামক বাল্টিক সাগর উপকূলস্থ বন্দর সুইডেনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং এস্তোনিয়া ও লিভোনিয়া প্রভৃতি বন্দরের ওপর আক্রমণ করবে না এ প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলে বাল্টিক অঞ্চলে সুইডেন আধিপত্য স্থাপন করে।

পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ : পোল্যান্ডের সাথে পূর্ব থেকেই সুইডেনের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। পোল্যান্ডের রাজা একসময় সুইডেনের রাজা ছিলেন। এজন্য পোল্যান্ডের রাজা তৃতীয় সিগিসমান্ড (পোল্যান্ড – ১৫৮৭-১৬৩২) গুষ্টাভাসকে সুইডেনের রাজা হিসেবে স্বীকার করতেন না। পোল্যান্ডের রাজা সুইডেনের রাজা গুস্টাভাসকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন। পোল্যান্ডের রাজা এ উদ্দেশ্যে সুইডেনের চারশ উদ্বাস্তুদের ষড়যন্ত্রে ব্যবহার করেন। পোল্যান্ডের রাজা সুইডেনে ক্যাথলিক ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি ক্যাথলিক সংঘ গঠন করেন। মেসেনিয়া নামে একজন রোমান ক্যাথলিক এ বিষয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। হাম্মেরান নামে একজন সুইডিশ ক্যাথলিক গুস্টাভাসকে হত্যার পরিকল্পনা করে গ্রেপ্তার হন। ইতপূর্বে সুইডেন ও পোল্যান্ডের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর ছিল এবং ১৬১২ সালে ১ জুন এ চুক্তির মেয়াদ ছিল। পোল্যান্ড রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় সুইডেনের সাথে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর রাখতে সক্রিয় ছিল। কিন্তু গুস্টাভাস নিজ নিরাপত্তার জন্য পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ব্রান্ডেনবুর্গ, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশের মধ্যস্থতায় ১৬১৪ সালে জানুয়ারি মাসে ওয়েলজে সুইডেন ও পোল্যান্ডের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৬১৬ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুইডেন ও পোল্যান্ডের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে কিন্তু ইতোমধ্যে উভয় পক্ষই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। ১৬১৭ সালে ৯ জুন সুইডিশ সেনাপতি স্কিয়ার্নস্কল্ড ডুইনা নদীর মোহনায় স্থলে অবতরণ করে সেখান থেকে সামরিক অভিযান চালিয়ে ডুনামুন্ড দখল করেন। স্কিয়ার্নস্কল্ড ২৩ জুলাই রেডআউট ও ৮ আগস্ট পেরুন দখল করেন কিন্তু পোলিশরা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ডুনামুন্ড ও রেডআউট থেকে সুইডিশদের বিতাড়িত করে। তবে পেরুন সুইডিশদের দখলে ছিল। ১৬১৮ সালে পোল্যান্ড ও সুইডেনের মধ্যে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলে। তবে ১৬১৮ সালে ২৮ নভেম্বর উভয় পক্ষ টোলসবার্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু ১৬২০ সালে নভেম্বর মাসে টোলসবার্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে গুস্টাভাস এডোলফাস পোল্যান্ডের অনুগত শহর রিগা দখলের পরিকল্পনা করেন। ১৬২১ সালে ২৪ জুলাই গুস্টাভাস এডোলফাস ১৫৪টি যুদ্ধজাহাজ ও ১৪,০০০ সৈন্য নিয়ে রিগা অবরোধ করেন। ১৬২১ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর রিগা অধিকার করে এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল শুরু করেন। ওয়ালমার সুইডেনের দখলে আসে। ১৬২১ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর সুইডেনের সৈন্যবাহিনী কুরল্যান্ডের রাজধানী মিটা অবরোধ করেন। তবে পোলিশদের প্রতিরোধে সুইডিশ বাহিনী মিটা দখল করতে ব্যর্থ হয়। গুস্তাভাস এডোলফাস রাজনৈতিক কারণে সুইডেনে প্রত্যাবর্তন করে। তবে তার সেনাবাহিনীকে দখলকৃত অঞ্চলে রেখে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় পোল্যান্ড ও সুইডেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৬২২ সালে ৩১ জুলাই মিটায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে। দু পক্ষ স্থায়ী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে ব্যর্থ হয়। তবে ২২ নভেম্বর সম্পাদিত ওগ্রা যুদ্ধবিরতি সন্ধি ও মিটা যুদ্ধবিরতি চুক্তির মেয়াদ ১৬২৩ সালে ২১ এপ্রিল থেকে ১৬২৫ সালে জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

পোল্যাড ও সুইডেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি : চুক্তি থাকলেও পোল্যান্ডের রাজা সিগিসমান্ড সুইডেন আক্রমণের পরিকল্পনা করলে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেজন্য গুষ্টভাস এডোলফাস এক নৌবাহিনী নিয়ে পোল্যান্ডের শহর ডানজিগ অবরোধ করেন। ডানজিগ বন্দর পোল্যান্ডের অনুগত ছিল। অবরোধের ভয়ে ডানজিগের রাজা সুইডেনের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং ডানজিগ বন্দর সুইডেনের বিরুদ্ধে অভিযানের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে না – এ আশ্বাস দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ১৬২৪ সালে ডেনমার্ক ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে জড়িত হলে গুস্টাভাস এডোলফাস ১৬২৫ সালের ১৬ আগস্ট লিভোনিয়া দখল করেন। সুইডিশ বাহিনী বির্জি, মিটা ও বসকি দখল করে। তবে পোল্যান্ড ইউস্টের দিকে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে সুইডিশদের বিপর্যস্ত করে। এ অবস্থায় গুষ্টাভাস এডোলফাস পোল্যান্ডের ওয়ালহোফ আক্রমণ করে তা দখল করেন। ১৬২৯ সাল পর্যন্ত সুইডেনের সাথে পোল্যান্ডের যুদ্ধ হয়। পোল্যান্ডের এ সংকট মুহূর্তে ফরাসি মন্ত্রী রিশল্যুর (১৬২৪-১৬৪২) মধ্যস্থতায় ছয় বছরের জন্য আল্টমার্ক নামক এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি (Truce of Altmark) (১৬২৯) স্বাক্ষরিত হয়। পোল্যান্ড রাজ সিগিসমান্ড গুস্টাভাস এডোলফাসকে সুইডেনের রাজা হিসেবে স্বীকার করে নেন এবং ইলবিং, পিলো, মেমেল নামক বন্দরগুলো সহ লিভোনিয়া সুইডেনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ডানজিগ বন্দরের শুল্ক থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় আয় সুইডেন পাবে তা মেনে নেওয়া হয়।

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে গুস্টাভাস এডোলফাসের যোগদান : গুষ্টাভাস এডোলফাস সুইডেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে এবং তার স্বধর্মী প্রোটেস্ট্যান্টদের স্বার্থে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উত্তর জার্মানিতে রোমান সম্রাটের আধিপত্য নির্মূল এবং সুইডেনের আধিপত্য বিস্তারের জন্য গুস্টাভাস এডোলফাস বিশেবর্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রথমদিকে উত্তর জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা গুস্টাভাস এডোলফাসের সামরিক হস্তক্ষেপ গ্রহণ করেননি কিন্তু ফরাসি মন্ত্রী রিশল্যু গুস্টাভাস এডোলফাসকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। প্রথমদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা গুষ্টাভাসকে সমর্থন না করলেও ক্যাথলিক সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি টিলি ১৫৩১ সালে ম্যাগডেবার্গ শহর আক্রমণ করে সেখানকার প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের নির্বিচারে হত্যা করলে প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা গুস্টাভাস এডোলফাসকে সাহায্য করতে আহ্বান করেন। স্যাকসনির ইলেক্টর গুস্তাভাসের সাথে এক চুক্তি করে সুইডিশ বাহিনীকে স্যাকসনির ভূমি যুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ দেন। গুষ্টাভাস এডোলফাস ১৬৩১ সালে ৭ সেপ্টেম্বর ক্যাথলিক বাহিনীর সেনাপতি টিলিকে লিপজিগের উত্তরে ব্রেইটেনফিল্ড (Breitenfield) নামক যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এ যুদ্ধে ক্যাথলিক বাহিনীর ৬,০০০ সৈন্য নিহত হয়। সেনাপতি টিলি দ্বিতীয়বার বেভেরিয়াতে গুস্টাভাস এডোলফাসের নিকট যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। সুইডিশ বাহিনী মিউনিক দখল করে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখলের উপক্রম হলে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ (১৬১৯-১৬৩৭)  ওয়ালেনস্টিনকে ক্যাথলিক পক্ষের সেনাপতি নিযোগ করেন। ওয়ালেনস্টিন স্যাকসনি আক্রমণ করলে গুস্টাভাস এডোলফাস ১৬৩২ সালে ১৬ নভেম্বর লুজেনে ওয়ালেনস্টিনকে মোকাবেলা করেন। গুস্টাভাস এডোলফাস সব সময় যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখভাগে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। ক্যাথলিক বাহিনীর প্রতি আক্রমণে তিনি নিহত হন। তবে গুস্টাভাসের সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে। তার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য মন্ত্রী অক্সেনস্তিয়েরনা প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের অবসান ঘটে। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি অনুসারে সুইডেন পশ্চিম পমেরেনিয়া, ব্রিমেন, ভার্ডেন প্রভৃতি স্থান লাভ করে। এ ছাড়া স্টেটিন, উইজমার নামক দুটি শহর ও ওলিন নামক দ্বীপ সুইডেন লাভ করে। এসব অঞ্চল লাভের ফলে জার্মানির তিনটি নদী ওয়েসার, এলবা ও অডারের মোহনা সুইডেনের নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে বাল্টিক সাগরের উভয় তীরে সুইডেনের আধিপত্য স্থাপন হলে বাল্টিক সাগর সুইডেনের লেকে পরিণত হয়।

কৃতিত্ব বিচার

গুস্টাভাস এডোলফাস সপ্তদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাজা, সুদক্ষ যোদ্ধা, দূরদর্শী কূটনীতিবিদ এবং সুইডেনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।

  • তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, ধর্মপ্রাণ ও জনকল্যাণকামী। সুইডেনের এক ক্রান্তিলগ্নে সিংহাসন লাভ করে সুইডেনের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী শাসক।
  • তিনি সুইডেনকে একটি সুশিক্ষিত দেশে পরিণত করার জন্য শিক্ষার সংস্কার করেছিলেন। তিনি প্রাচীন ল্যাটিন স্কুলকে ক্যাথেড্রাল স্কুল এবং প্রাদেশিক স্কুল এই দু ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। ক্যাথেড্রাল স্কুলে ধর্মশিক্ষা এবং প্রাদেশিক স্কুলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা দেওয়া হত। সুইডেনের প্রাথমিক স্কুলগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখা হয়েছিল। তিনি জিমনেসিয়া নামে মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তার শাসনামলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় এবং সেগুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম আধুনিকীকরণ করা হয়েছিল। শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। বিদ্যালয়, জিমনেসিয়া (মাধ্যমিক স্কুল) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য ও শিক্ষিত সুইডিশদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
  • সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইতিহাস শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যাতে সুইডিশদের দেশপ্রেম জাগরিত হয়। বিদেশী ভাষার মূল্যবান গ্রন্থ সুইডিশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
  • গুস্টাভাস এডোলফাস পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে শক্তিশালী নীতি অনুসরণ করে রাশিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ডকে পরাজিত করেছিলেন এবং জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার প্রভাব বিলুপ্ত করে উত্তর। জার্মানিতে সুইডেনের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিলেন। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে তার নেতৃত্বে প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষ জয়লাভ করে। তার সুদক্ষ সামরিক নেতৃত্বের জন্য সুইডেন উত্তর ইউরোপে শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
  • যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ হলেও তিনি সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী। তিনি অনেক ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তার রাজত্বকালে সুইডেন স্থাপত্যশিল্প, চিত্রশিল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্যে উন্নতি লাভ করে। তিনি ধর্মসঙ্গীত ও ধর্মনিরপেক্ষ সঙ্গীতচর্চায় উৎসাহ দিতেন।

আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুইডেনের জাতীয় উন্নতি ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় গুস্টাভাস এডোলফাসের অবদান ছিল চিরস্মরণীয়।

ক্রিস্টিনা (১৬৩২-১৬৫৪)

গুস্টাভাস এডোলফাসের মৃত্যুর পর তার শিশুকন্যা ক্রিস্টিনা সুইডেনের সিংহাসন লাভ করেন। তার অভিভাবক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এক্সেল অক্সেনস্টিয়েরনা (Axel oxenstierna) রাজসভাসদের (Regency) সভাপতি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এক্সেল অক্সেনস্টিয়ের্না ছিলেন দেশপ্রেমিক এবং দূরদর্শী। তিনি গুস্টাভাস এডোলফাসের নীতি অনুসরণ করে জার্মানিতে সুইডেনের আধিপত্য বজায় রাখেন এবং অনেক অঞ্চল সুইডেনের শাসনভুক্ত করেন। ক্রিস্টিনা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে রাজপ্রতিনিধি অক্সেনস্টিয়েরনার হাত থেকে ১৬৪০ সালে ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন।

ক্রিস্টিনা সুইডেনের ভ্যাসা রাজবংশের শ্রেষ্ঠ বিদুষী মহিলা শাসক ছিলেন। তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। তিনি সংস্কৃতিমনা ছিলেন। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, ললিতকলা ইত্যাদি বিষয়ে অনুরাগী ছিলেন। হিউগো প্রোটিয়াস (Hugo Protius), ডেকার্ট (Descartes), স্যামাসিয়াস (Samasius) প্রমুখ সমকালীন পণ্ডিতদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তৎকালীন সময়ে ইউরোপে তার ন্যায় কৃষ্টি ও রুচিসম্পন্ন শাসক বিরল ছিল। তিনি ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের (১৫৫৮-১৬০৩) ন্যায় খেয়ালি হলেও রাজকার্যে পারদর্শী ছিলেন না। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা অন্তর্দৃষ্টি ছিল না। তার স্বভাব ছিল পুরুষোচিত। তার সময় থেকে সুইডেনের পতন শুরু হয়।

ক্রিস্টিনার রাজত্বকালে সুইডেন ও ডেনমার্কের মধ্যে ব্রমসেরোর (Bromschro) সন্ধির ফলে সাউন্ড জলপথে সুইডেনের জাহাজ বিনাশুল্কে যাতায়াতের সুবিধা লাভ করে। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির মাধ্যমে সুইডেন ব্রিমেন, ভার্ডেন, পশ্চিম পোমেরেনিয়া লাভ করে। সুইডেন বাল্টিক সাগর অঞ্চলে প্রাধান্য লাভ করে। উত্তর জার্মানিতে সুইডেন অধিকার বিস্তারের সুযোগ পায়। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি ক্রিস্টিনার অভিভাবক ও মন্ত্রী অক্সেনস্টিয়েরনার শেষ কূটনৈতিক কীর্তি। এর পর থেকে সুইডেনের পতন শুরু হয়। ১৬৫১ সালে আর্নল্ড নামে এক ব্যক্তি ক্রিস্টিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেন। ক্রিস্টিনা এ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কঠোর হস্তে দমন করেন। তার সময় ব্রিমেন সুইডেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ক্রিস্টিনা সামরিক ব্যবস্থা নেন। কিন্তু এ যুদ্ধ চলা অবস্থায় ১৬৫৪ সালে স্বেচ্ছায় তার ভ্রাতা চার্লস গুস্টাভাসের (১৬৫৪-১৬৬০) অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন।

দশম চার্লস (১৬৫৪-১৬৬০)

১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে সুইডেনের শাসক ক্রিস্টিনা স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করলে তার ভ্রাতা চার্লস ওষ্টাভাস দশম চার্লস উপাধি গ্রহণ করে। সুইডেনের সিংহাসনে বসেন। দশম চার্লস ছিলেন যোদ্ধা ও সাহসী। তার চরিত্রে ভ্যাসা পরিবারসুলত ধর্মপ্রবণতা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ছিল। সামরিক যোগ্যতার ক্ষেত্রে তাকে সুইডেনের শ্রেষ্ঠ রাজগণের অন্যতম বলা যায়। সিংহাসনে বসেই চার্লস অভ্যন্তরীণ ব্যয় সংকোচন করে আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেন। তিনি অভিজাতদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিলুপ্ত করে রাজকোষের অর্থের ব্যয় হ্রাস করেন। অভিজাতদের ভোগকৃত অনেক সরকারি জমি উদ্ধার করে সেগুলো থেকে রাষ্ট্রীয় আয় প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করেন।

দশম চার্লস ছিলেন সৈনিক রাজা। যুদ্ধাভিযান ছিল তার একমাত্র আসক্তি। সিংহাসন লাভ করেই তিনি ব্রিমেনের সঙ্গে চলে আসা যুদ্ধের অবসান ঘটান এবং ব্রিমেন সুইডেনের আনুগত্য মেনে নেয়। দশম চার্লস সুইডেনকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং রাজ্যবিস্তার তার পররাষ্ট্রনীতির অংশ ছিল। এই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, রাশিয়া, ব্র্যান্ডেনবার্গ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে দশম চার্লসের যুদ্ধ দেখা দেয়।

পোল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ : পোল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ দশম চার্লসের রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পোল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জন ক্যাসিমির (১৬৪৮-১৬৬৮) নিজেকে পোল্যান্ডের শাসক হিসেবে ঘোষণা করলে দশম চার্লস পোল্যান্ড আক্রমণ করে ক্যাসিমিরকে পরাজিত করে পোল্যান্ড দখল করেন। দশম চার্লসের এই সামরিক সাফল্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোকে উৎকণ্ঠিত করে। বিশেষ করে জার্মানির ব্রান্ডেনবার্গ রাজ্যটি আতঙ্কিত হয়। ব্রান্ডেনবার্গের ইলেক্টর ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের সঙ্গে সুইডেনের বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা করলে দশম চার্লস ব্রান্ডেনবার্গ আক্রমণ করেন। ব্রান্ডেনবার্গের গ্রেট ইলেক্টর ফ্রেডারিক উইলিয়াম (১৬৪০-১৬৮৮) পরাজিত হয়ে কনিসবার্গে (Kenigsberg) সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। পূর্ব প্রাশিয়া নামে ব্রান্ডেনবার্গের একাংশের জন্য গ্রেট ইলেক্টর পোল্যান্ডের অনুগত ছিলেন। এই সন্ধি দ্বারা এই স্থানের জন্য ব্রান্ডেনবার্গ সুইডেনের আনুগত্য স্বীকার করে। সুইডেনের যুদ্ধনীতির কারণে ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ব্রান্ডেনবার্গ প্রভৃতি দেশ ঐক্যজোট গঠন করে। এই ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দশম চার্লস ডেনমার্ককে পরাজিত করে এবং রোয়েস্কিলডির (Roeskilde) সন্ধি দ্বারা ডেনমার্কের অনেক স্থান অধিকার করেন। ডেনমার্ক বাল্টিক সাগর সুইডেনের শত্রুপক্ষের জন্য রুদ্ধ করে রাখতে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি স্থায়ী হয় নি। অল্পকালের মধ্যেই পোল্যান্ড, রাশিয়া, ব্রান্ডেনবার্গ প্রভৃতি দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে সুইডেন আক্রমণ করে দশম চার্লসকে পরাজিত করে। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ওলিভার (Oliva) সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে। পোল্যান্ড দশম চার্লসকে সুইডেনের রাজা স্বীকার করে নেয়। সুইডেন লিভোনিয়া ও পোমেরেনিয়া লাভ করে। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে কোপেনহেগেনের (Copenhegen) সন্ধি দ্বারা সুইডেন ও ডেনমার্কের মধ্যে পূর্বেকার রোয়েস্কিলডির সন্ধির শর্তগুলো পুনরায় অনুমোদিত হয়। রাশিয়ার সঙ্গে কার্ডিসের (Kardis) সন্ধি দ্বারা সুইডেন ও রাশিয়া একে অপরের অধিকৃত স্থান ফিরিয়ে দেয়। দশম চার্লসের সামরিক অভিযান সুইডেনের জন্য খুব একটা সাফল্য নিয়ে আসে নি। তিনি পোল্যান্ড ও ডেনমার্ককে সুইডেনের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেন নি। উপরন্তু পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুইডেন তার সর্বশক্তি নিযোগ করলেও লাভের ফসল ঘরে তুলতে পারে নি। এতে লাভবান হয় ব্রান্ডেনবার্গের ইলেক্টর। তিনি কিছুমাত্র ঝুঁকি না নিয়ে বিনা প্রচেষ্টায় প্রুশিয়া নামক ভাড়ি অর্জন করেন পূর্ণ সার্বভৌমত্ব সহ। চার্লস যদি পোলান্ডের ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ করতেন তাহলে পোল্যান্ডের ক্যাথলিক ধর্মানুরাগী ভূমিদাসরা দশম চার্লসের অত্যাচার মেনে নিতেন। তিনি এক্ষেত্রে নেপোলিয়নের মতো কৌশলী ছিলেন না। তাই পোল্যান্ডে জাতীয়তাবাদ জেগে ওঠে এবং তারা অস্ট্রিয়ার সহায়তায় সুইডিশদের পোল্যান্ড থেকে বিতাড়িত করে।

পোল্যান্ডের রাষ্ট্রশক্তি টিকিয়ে রাখা অস্ট্রিয়ার প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তেমনি সুইডেনের নিয়ন্ত্রণ থেকে ডেনমার্ককে মুক্ত রাখা হল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের স্বার্থে জরুরি ছিল। একটি ওলন্দাজ নৌবহর কোপেনহেগেন সংরক্ষার ব্যবস্থা করে। ওলন্দাজ, দিনেমার, পোল ও অস্ট্রিয় যৌথবাহিনী সুইডিশদের পরাজিত করে। বাল্টিক সাগর বাণিজ্য আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়। দক্ষিণ সুইডেনের স্কানিয়ান প্রদেশগুলো এবং বর্মহোম দ্বীপ সুইডেনের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয় এবং সাউন্ডের দক্ষিণে স্বাধীন ডেনমার্ক রাজ্য আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে টিকিয়ে রাখা হয়।

একাদশ চার্লস (১৬৬০-১৬৯৭)

১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে দশম চার্লস মৃত্যুবরণ করলে একাদশ চার্লস সুইডেনের সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনারোহণের সময় একাদশ চার্লস ছিলেন নাবালক। তার নাবালকত্বে প্রতিনিধি সরকার দশম চার্লসের রিডাকশন নীতি অনুসরণ করে অভিজাতদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি হ্রাস করে। একাদশ চার্লসের নাবালক অবস্থায় সুইডেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের (১৬৩৮-১৭১৫) বিরুদ্ধে ডিভল্যুশনের ত্রিশক্তি চুক্তিতে (Triple Alliance) যোগদান করেছিল। ফলে যুদ্ধে সুইডেনের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল। ১৬২৭ সালে একাদশ চার্লস যখন সাবালক হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেন তখন সুইডেনের রাজকোষ ছিল শূন্য। অভিজাত শ্রেণীর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করেও রাজকোষে অর্থসংকট দূর করা সম্ভব হয় নি। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে চতুর্দশ লুইয়ের যুদ্ধে একাদশ চার্লস ফরাসি রাজের পক্ষ গ্রহণ করেন এবং এর বিনিময়ে ফরাসিরাজ চতুর্দশ লুয়ের নিকট থেকে প্রচুর অর্থ লাভ করেন। ফরাসি রাজ চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে মিত্রতা চুরি অনুসারে একাদশ চার্লস ব্রান্ডেনবার্গ আক্রমণ করেন। কিন্তু ফোরবেলিনের (Pehrbellin) যুদ্ধে, তিনি ব্রান্ডেনবার্গের গ্রেট ইলেক্টরের নিকট পরাজিত হন। এই পরাজয়ের ফলে সুইডেনের মর্যাদা ও শক্তি বিনষ্ট হয়। এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে ডেনমার্ক সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সুইডেনকে লাভ (Lund) নামক সন্ধি স্থাপনে বাধ্য করে। এই সন্ধির ফলে সুইডেন ডেনমার্ককে কতকগুলো বাণিজ্য অধিকার প্রদানে বাধ্য করে। এই যুদ্ধের পর একাদশ চার্লস সুইডেনের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। যাজক সম্প্রদায় ও জনসাধারণের সহায়তায় তিনি অভিজাত সম্প্রদায়কে পদানত করে রাজশক্তিকে শক্তিশালী করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেন। ফলে সুইডেন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করে। ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে একাদশ চার্লস মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বাদশ চার্লস (১৬৯৭-১৭১৮)

একাদশ চার্লসের মৃত্যুর পর দ্বাদশ চার্লস পনের বৎসর বয়সে ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে সুইডেনের সিংহাসনে বসেন। দ্বাদশ চার্লস তার সমকালীন ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রের শাসক ছিলেন। বাল্যকালে তাকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়েছিল। তিনি গণিত ও ইতিহাস পছন্দ করতেন। তবে তার চরিত্রে উদ্যম ও বীরত্ব, ঔদ্ধত্য ও একদেশদর্শিতার এক অতি অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তিনি নেপোলিয়নের ন্যায় যুদ্ধপ্রিয়, আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়া দেশীয় উপকথার নায়কসুলভ সামরিক দক্ষতা, অদম্য উৎসাহ এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি সুইডেনবাসীর নেতৃত্বে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি নিস্কুলষ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তার চরিত্রের অনেক ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল। ধৈর্যহীনতা, হঠকারিতা এবং যুক্তিহীন একদেশদর্শিতা তার অনেক কর্মকাণ্ডকে ব্যর্থ করেছিল। স্বৈরাচারী মনোবৃত্তির সঙ্গে যুক্তিহীন ও একগুঁয়েমি মিশ্রিত হলে যে সর্বনাশ ঘটতে পারে তা দ্বাদশ চার্লসের রাজত্বকালে সুইডেনের ইতিহাসে প্রকটিত হয়েছিল। তিনি ‘উত্তর ইউরোপের পাগল’ (Mad man of the North Europe) ‘ডন কুইজোট’ (Don Ouixote) প্রভৃতি অপমানসূচক নামে অভিহিত হয়েছেন। দ্বাদশ চার্লসের বীরত্ব ছিল সর্বনাশাত্মক। এই কারণে তার মৃত্যুতেই সুইডেন সর্বাপেক্ষা অধিক লাভবান হয়েছিল।

দ্বাদশ চার্লসের কার্যাবলি

১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বাদশ চার্লস যখন মাত্র পনের বৎসর বয়সে সুইডেনের রাজা তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ডেনমার্ক, রাশিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ বালক রাজা দ্বাদশ চার্লসের সিংহাসনারোহণকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অপূর্ব সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করে সুইডেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পাটকুল নামে লিভোনিয়ার জনৈক অভিজাত ব্যক্তি রাশিয়া, ডেনমার্ক ও পোল্যান্ডের সাহায্য নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। এই অবস্থায় ষড়যন্ত্রের বিষয় জানতে পেরে দ্বাদশ চার্লস কালবিলম্ব না করে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্ক আক্রমণ করেন এবং ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ফ্রেডারিককে ট্রাভেন্ডাল (Travendal) নামক সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। ডেনমার্ক রাশিয়া ও পোল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ সুইডেনকে অনেক অর্থ প্রদান করে। ডেনমার্ক আরও প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে ভবিষ্যতে সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান : ডেনমার্কের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করে দ্বাদশ চার্লস রাশিয়ার জার প্রথম পিটারের (১৬৮২-১৭২৫) বা পিটার দ্য গেইটের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে নার্ভার যুদ্ধে রাশিয়ার জার পিটারকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন। দ্বাদশ চার্লস নার্ভার যুদ্ধে মাত্র আট হাজার সৈন্য নিয়ে রাশিয়ার পিটারের ষাট হাজার সৈন্যকে পরাজিত করেন।

পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান : ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে নার্ভার যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করার পর দ্বাদশ চার্লস ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। পোল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাস (১৬৯৭-১৭০৬) সুইডেনের ভয়ে পোল্যান্ড ত্যাগ করে স্যাক্সনিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দ্বাদশ চার্লস থর্ন, ডানজিগ এই দুটি স্থান অধিকার করেন এবং তিনি নিজ মনোনীত প্রার্থী স্টানিসল্যাসকে পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসান। তিনি লিথুনিয়া থেকে রুশদের বিতাড়িত করে সেটা সুইডেনের রাজ্যভুক্ত করেন। এরপর দ্বাদশ চার্লস অগাস্টাসকে দমন করার জন্য স্যাক্সনিতে সৈন্যসহ প্রবেশ করেন। অগাস্টাস ছিলেন স্যাক্সনির ডিউক (১৬৯৪-১৭৩৩)। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের রাজা জন সোবিয়েস্কি বা তৃতীয় জনের (১৬৭৪-১৬৯৬) মৃত্যু হলে অগাস্টাসকে পোল্যান্ডের রাজপদে নির্বাচন করা হয়েছিল। দ্বাদশ চার্লস স্যাক্সনীতে প্রবেশ করে অগাস্টাসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এই চুক্তি অনুযায়ী অগাস্টাস পোল্যান্ডের সিংহাসনের ওপর দাবি ত্যাগ করে স্টানিসল্যাসকে সেখানকার রাজা হিসেবে স্বীকার করে নেন। দ্বাদশ চার্লস বিজিত স্থানের মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেন।

রাশিয়া কর্তৃক বাল্টিক বন্দর কেরেলিয়া ও ইংরিয়া দখল : দ্বাদশ চার্লস যখন পোল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধরত তখন ঐ সুযোগে রাশিয়ার জার পিটার শক্তি সঞ্চয় করে বাল্টিক উপকূলে কেরেলিয়া ও ইংরিয়া দখল করে নেন। সামরিক সাফল্যের নিরিখে বিচার করলে দ্বাদশ চার্লস ডেনমার্ক, রাশিয়া ও পোল্যান্ডকে পরাজিত করলে সুইডেন গৌরবের চরম শিখরে পৌঁছেছিল। কিন্তু দ্বাদশ চার্লসের অদূরদর্শিতার জন্য তা স্থায়ী হয় নি। তিনি পোল্যান্ড ও স্যাক্সনিতে যখন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত তখন রাশিয়ার জার পিটার বাল্টিক অঞ্চলে সামরিক অভিযান করে কেরেলিয়া ও ইংরিয়া দখল করে নেন। দ্বাদশ চার্লস পিটারের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য পোল্যান্ড ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বাদশ চার্লসের পোল্যান্ডের প্রতিনিধি স্টানিসল্যাসকে বিতাড়িত করে অগাস্টাস পোল্যান্ডের সিংহাসন দখল করে নেন। ফলে সামরিক শক্তি ব্যয় করে অর্জিত পোল্যান্ড বিজয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

দ্বাদশ চার্লসের মস্কো অভিযান : দ্বাদশ চার্লস রাশিয়ার পিটারকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাশিয়ার রাজধানী মস্কো অভিযানে যান। তিনি পিটার কর্তৃক অধিকৃত বাণ্টিক উপকূলে কেরেলিয়া ও ইংরিয়া পুনরুদ্ধার না করে মস্কো অভিযান করে মারাত্মক ভুল করেন। ১৭০৮- ০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সুইডিশ সেনাবাহিনী মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়। এ বিপুল অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে পিটার পোল্টাভার যুদ্ধে (Paltava) সুইডিশ বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই পরাজয়ে সুইডেনের সামরিক গৌরব মাটিতে মিশে যায়। পোল্টাভার যুদ্ধে জয়লাভের ফলে রাশিয়া বাল্টিক উপকূলে আধিপত্য স্থাপন করে।

নিস্ট্যাডেটের সন্ধি (১৭২১ খ্রি.): পোন্টাভার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দ্বাদশ চার্লস তুরস্কে আশ্রয় নেন। তিনি তুর্কি সুলতানকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচনা দেন। রাশিয়া তুর্কি সুলতান তৃতীয় মেহমেদকে (১৭০৩-১৭৩০) আজফ (Azov) বন্দরটি ফিরিয়ে নেওযায় তুরস্ক বাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে অস্বীকৃতি জানায়। তুরস্কের সুলতান দ্বাদশ চার্লসকে নিরাপদে সুইডেনে পৌঁছার ব্যবস্থা করেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করে দ্বাদশ চার্লস রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বাদশ চার্লস মৃত্যুবরণ করলে সুইডেন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দের নিস্ট্যাডেটের (Nystadt) সন্ধির মাধ্যমে রুশ সুইডিশ যুদ্ধের অবসান হয়। চুক্তি অনুসারে রাশিয়া কেরেলিয়া, ইংরিয়া, এস্তোনিয়া, লিভোনিয়া, দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের একাংশ এবং ভিবর্গ নামক দুর্গটি লাভ করে। ফলে বাল্টিক উপকূলের প্রাধান্য সুইডেনের নিকট থেকে রাশিয়ার হাতে চলে যায়।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুইডেনের পরাজয়ের কারণ

দ্বাদশ চার্লস একজন যোদ্ধা ও শক্তিশালী শাসক হলেও তিনি বিভিন্ন কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। নিম্নে সুইডেনের পতনের কারণগুলো আলোচনা করা হল :

  • (১) দ্বাদশ চার্লসের অনুরদর্শিতা : দ্বাদশ চার্লস সুইডেনের ইতিহাসে এক যুদ্ধরাজ শাসক হিসেবে পরিচিত। তিনি অদম্য সাহসী ও বীর হলেও তার মধ্যে দূরদৃষ্টির অভাব ছিল। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে নার্ভার যুদ্ধে মাত্র আট হাজার সৈন্যের সাহায্যে রাশিয়ার ষাট হাজার সৈন্যকে পরাজিত করলেও তিনি রাশিয়ার প্রকৃত শক্তি এবং জার পিটারের দক্ষতা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন।
  • (২) রাশিয়াকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দান : ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে নার্ভার যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাশিয়াকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ না নিয়ে রাশিয়ার শত্রু তুর্কি শক্তির রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে পোল্যান্ড ও স্যাক্সনির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে রাশিয়াকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দেন।
  • (৩) দ্বাদশ চার্লসের নিষ্ঠুরতা : দ্বাদশ চার্লসের সৈন্যরা রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং স্যাক্সনির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহে দ্বাদশ চার্লসের প্রতি চরম ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তারা সুইডেনের পতনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
  • (৪) সামরিক কৌশলে ভুল নীতি অনুসরণ : দ্বাদশ চার্লস একই সঙ্গে রাশিয়া ও পোল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজের পতন ডেকে এনেছিলেন। তার উচিত ছিল প্রধান শত্রু রাশিয়াকে আগে পরাজিত করা এবং পরে পোল্যান্ডকে কৌশলে ভয় দেখিয়ে কাবু করা। তিনি যদি পোল্যান্ডকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে এককভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান করতেন তবে ইতিহাস হয়তো ভিন্ন রকম হতে পারত।
  • (৫) সরাসরি মস্কো অভিযান : দ্বাদশ চার্লস বাল্টিক উপকূলে পিটারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না করে সরাসরি মস্কো অভিযান চালিয়ে মারাত্মক ভুল করেছিলেন। তার মস্কো অভিযান সুইডেনের পতন ডেকে এনেছিল।
  • (৬) রাশিয়ার উত্থান এবং পিটারের ন্যায় শক্তিশালী শাসকের আবির্ভাব : অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাশিয়ার উত্থান এবং পিটারের ন্যায় শক্তিশালী শাসকের আবির্ভাব ইউরোপের রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তন এবং সে সম্পর্কে উপযুক্ত পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক কৌশলের পন্থা দ্বাদশ চার্লস গ্রহণ করতে অজ্ঞ ছিলেন। উল্লিখিত কারণে উত্তর ইউরোপের নবজাগ্রত সুইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২২২-২৩৭

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.