২০২১ সালের আগস্টে, তালেবানরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় গ্রহণ করে। এই আফগানিস্তান ছিল এমন একটি দেশ যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ২০ বছর ধরে তালেবানদের হাতে পড়া রোধ করার চেষ্টা করছিল। এরপর সেনা প্রত্যাহারের বিতর্কিত মার্কিন সিদ্ধান্ত এটি ঘটতে দেয়। এরপর থেকে অনেক দেশ তালেবানকে হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা করছে, গুরুত্বপূর্ণ তহবিল এতে রেখেছে। একদিক দিয়ে এটির মাধ্যমে তারা দেখিয়েছে যে তারা অ-উদারপন্থী এবং নিপীড়ক শাসনকে সমর্থন করে না, এটি আন্তর্জাতিকভাবে তালেবানের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে, এটির জন্য আফগানিস্তানের বেসামরিক নাগরিকরা ভুগছে, যাদের বেঁচে থাকার জন্য এই সহায়তাগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যাই হোক না কেন, তালেবানরা তাদের এই গভীরভাবে দরিদ্র পেরিয়াহ স্টেইটটি শাসন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে এটি সর্বোপরি কাজ করবে না, এবং এমনও নয় যে তালেবানরা তাদের আমলাতান্ত্রিক দক্ষতার ক্ষেত্রে সেভাবে ভাল। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, তালেবানরা এখনও আফগানিস্তানের ক্ষমতায় রয়েছে। অনেকে যেমনটা আশা করেছিলেন, সেভাবে দেশটি ভেঙে পড়েনি বা কলাপ্স করেনি। এই লেখাটিতে আমরা দেখব কেন এমনটা হলো, তালেবানরা কীভাবে দেশটি ধরে রেখেছে, এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে।
এই মুহুর্তে পরিস্থিতি কেমন চলছে তা জানার আগে, আমাদের প্রথমে দেখা উচিত ঠিক কোন কারণগুলির জন্য অনেক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন যে তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগান রাষ্ট্র আবার ভেঙে পড়বে। যেসব কারণে তালেবান শাসনের পতন সম্পর্কে অনেকে ধারণা করেছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল পশ্চিমাদের দ্বারা তাদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো, সেই নিষেধাজ্ঞাগুলোর মাত্রা এবং সংখ্যা। ২০২১ সালে তালেবানরা যখন আফগানিস্তান দখল করে, তখন এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হয়নি। তারা যখন শেষবার ক্ষমতায় ছিল তখন থেকেই অনেক নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। এগুলো আবার আরোপনের প্রয়োজন ছিল না। ১৯৯৮ সালে আল-কায়েদা আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালানোর পর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য সরকার কর্তৃক এগুলোকে আপডেট করা হয়।
এই নিষেধাজ্ঞাগুলির একটি ভাল উদাহরণ হ’ল লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ নিষিদ্ধ করা। ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি আফগান ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সাথে জড়িত লেনদেনগুলি প্রক্রিয়া করতে অস্বীকার করেছে কারণ নিষেধাজ্ঞাগুলি অনুসারে তারা এটি করার জন্য জরিমানা বা বিচারের মুখোমুখি হতে পারে। এখন, পশ্চিমা সরকারগুলি কেবল ইতিমধ্যে জারি করা নিষেধাজ্ঞাগুলি আরোপ করেই ক্ষান্ত হয়নি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আরও এগিয়ে গেছে। এর একটি ভাল উদাহরণ ছিল যখন ১১ই ফেব্রুয়ারী তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের সমস্ত ৭ বিলিয়ন ডলার জব্দ করে এবং ফেডারেল রিজার্ভে একটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করে। বলা হয়, এর অর্ধেক তালেবানরা ব্যবহার করতে পারবে যদি তারা আফগান জনগণের সুবিধার জন্য এটি ব্যবহার করে। বাকি অর্ধেক ৯/১১-এর ভুক্তভোগীদের জন্য একটি ফ্রিজ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়।
তো মোট কথা হলো, অর্থনৈতিকভাবে তালেবানরা পশ্চিমাদের দ্বারা শাস্তি পাচ্ছে। তো এরকমটা আশা করে স্বাভাবিক ছিল যে, গভীরভাবে দরিদ্র একটি দেশের সরকার হিসাবে দেশটির অর্থনৈতিক বাস্তবতা খুব কঠিন হয়ে উঠতে পারে এবং তালেবানরা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়বে। কিন্তু এটা হয়নি।
আফগানিস্তান কলাপ্স করবে ভাবার আরেকটি কারণের দিকে যাই। কারণটি হচ্ছে মাদকের উপর ইউ-টার্ন। তালেবানের ২০২১ সালের বিদ্রোহের সময়, এটি স্পষ্ট ছিল যে তারা মাদক, বিশেষত আফিম থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করছে। তবে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তালেবান মাদক নিষিদ্ধ করে। স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে বিশ্লেষকরা দেখেছেন যে হেলমান্দে আফিম তৈরিতে ব্যবহৃত পপি বা পোস্ত ক্ষেতের পরিমাণ ২০২২ সালের এপ্রিলে ১,২০,০০০ হেক্টর থেকে কমে এই বছরের এপ্রিলে ১,০০০ হেক্টরেরও কম হয়েছে। একইভাবে, গত বছরের এপ্রিলে নানগারহার অঞ্চলে ৭,০০০ হেক্টরের পোস্ত ক্ষেত ছিল, যেখানে এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৬৫ হেক্টরে।
তালেবানদের জন্য মাদক ব্যবসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ। তালেবানরা যখন ক্ষমতা দখল করে তখন এটি আফগানিস্তানের জিডিপির ৯ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ছিল, যা ছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এটি নিষিদ্ধ করার অর্থ হ’ল তারা এই রাজস্ব হারাবে। যেমনটা আমরা আগেই ব্যাখ্যা করেছি, ইতিমধ্যে তালেবানদের মজুদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এবং দেশটি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। সব মিলে এটা ভাবা যুক্তিসঙ্গতই ছিল যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণেই তালেবানরা শীঘ্রই ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু তারা তা করেনি। তালেবানরা এখনও ক্ষমতায় রয়েছে এবং তাদের অর্থনীতি এখনও কাজ করছে।
তো, এবার আসুন আলোচনা করা যাক, কেন দেশটি এতো কিছুর পরও ভেঙ্গে পড়ল না। যদিও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি তালেবানের শাসনকে আঘাত করার লক্ষ্যে ছিল, তবে কয়েকটি কারণে এটি সত্যিই কার্যকর হয়নি। প্রথমত, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অভাবের কারণে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি ততটা কার্যকর নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক অ্যাটর্নি ওয়াজমা সাদাত (যিনি নিজেই তালেবান শাসনের অধীনে বাস করতেন) দাবি করেছেন যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি জনগণকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, শাসকদের নয়। যদি তালেবানের কাছে অর্থ না থাকে, তাহলে তারা তাদের শাসনাধীন জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতি করতে পারবে না। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি একটি সমস্যা হবে কারণ জনগণ প্রতিবাদ করতে পারে, বিরোধী দলগুলি সংগঠিত করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের অকার্যকর নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে গণতন্ত্র নেই, তালেবানরা জোর করে শাসন করে এবং ভিন্নমতকে দমন করে।
দ্বিতীয়ত, সাদাত যুক্তি দেখান যে, আফগানিস্তানে যারা পশ্চিমা সহায়তা সবচেয়ে বেশি ডিজার্ভ করে সেই অভুক্ত ও দরিদ্র লোকেদেরকে সহায়তা ও ফুড সাপ্লাই না দিয়ে তালেবানরা নিজেদের সদস্য ও সমর্থকদেরকে এগুলো সরবরাহ করে। আবার, এটি ক্ষমতার উপর তাদের দখল বজায় রাখতে সহায়তা করে। তৃতীয়ত, তিনি যুক্তি দেখান যে নিষেধাজ্ঞার অর্থ হ’ল তালেবানরা তহবিলের জন্য অন্য কোন উৎস্যের সন্ধান করেছে। হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, কিন্তু রাশিয়া ও চীন তা করছে না। আর এ কারণেই আবার ক্ষমতায় আসার এক বছর পর তালেবান রাশিয়া থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য ও গম আমদানি শুরু করে। একইভাবে, এ বছর তারা একটি চীনা কোম্পানির সাথে একটি আন্তর্জাতিক জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যা তাদের দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে তেল উত্তোলনের অনুমতি দেয়। আজকে দেখলাম দেশটি বিভিন্ন দেশের সাথে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলারের মাইনিং কন্ট্রাক্টে গেছে।
এটা স্পষ্ট যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি এত ভালভাবে কাজ করেনি। শেষ পর্যন্ত, গড় আফগানদের জন্য পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। ২০২২ সালে দেশটির জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল এবং বেসামরিক নাগরিকরা এটি পেতে আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে তালেবানরা এর দ্বারা প্রভাবিত নয় বলে মনে হচ্ছে এবং ভিন্নমতকে দমন করে মূল ক্ষমতাধরদের খুশি রেখে ক্ষমতার উপর তাদের দখল বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও কেউ কেউ ধরে নিয়েছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে যাবার পর, তালেবানরা পূর্ববর্তী শাসনের সাথে কাজ করা সকলকে নির্মূল করবে, আসলে তা পুরোপুরি ঘটেনি। বেশিরভাগ নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সরকারী কর্মচারীরা তাদের চাকরি ধরে রেখেছেন এবং এখনও বেতন পাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা মুদ্রাকে স্থিতিশীল করেছে এবং দেশটির সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক পতন রোধ করেছে।
বিষয়টা হলো, সাধারণ নাগরিকদের জন্য জীবন কোনোভাবেই ভালো না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তালেবানের পতন বা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.hrw.org/news/2022/08/04/economic-causes-afghanistans-humanitarian-crisis
2 – https://www.hrw.org/news/2022/08/04/economic-causes-afghanistans-humanitarian-crisis
3 – https://www.economist.com/asia/2023/06/22/the-taliban-have-launched-an-impressive-new-war-on-drugs
4 – https://www.economist.com/asia/2023/06/22/the-taliban-have-launched-an-impressive-new-war-on-drugs
5 – https://foreignpolicy.com/2023/06/29/taliban-sanctions-act-us-afghanistan/
6 – https://www.rescue.org/uk/article/afghanistan-entire-population-pushed-poverty
Leave a Reply