মহাবিশ্ব, যেখানে স্থান-কাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়

lights_620.jpg

স্পেসটাইম বা স্থানকালকে আমরা একটি অনবরত বা কনটিনিউয়াস অবস্থায় দেখি যেখানে কোন ডিসকন্টিনিউইটি বা বিচ্ছিন্নতা নেই। ক্লাসিকাল ফিজিক্স অনুসারে স্থান কালকে কন্টিনিউয়াস অবস্থাতেই দেখা হয়। কিন্তু কিছু কোয়ান্টাম গ্রেভিটি মডেল অনুসারে স্পেস টাইম এর আকৃতি খুব ছোট স্কেলের হয়ে থাকে যেকারণে একে ‘গ্র্যান্যুলার বা দানাদার’ বলা হয় (এই স্কেলটি প্লাংক স্কেল ১০-৩৩ সেন্টিমিটারের চেয়েও ছোট)। মডেলগুলো অনুসারে স্পেসটাইম হল সলিড এবং ফাঁকা স্থানের একটি জালিকা (অথবা একটি কমপ্লেক্স ফোম)। আধুনিক পদার্থবিদ্যার অনেকগুলো বড় সমস্যার মধ্যে একটি হল এই কনটিনিউয়াস স্পেসটাইম থেকে ডিসক্রিট স্পেসটাইমের ট্রাঞ্জিশন বা রূপান্তরটা ঠিক কিভাবে এবং কোথায় হল। এই ট্রাঞ্জিশনটি কি হঠাৎ করে ঘটে নাকি ধীরে ধীরে ঘটে? আর কোথায়ই বা এই পরিবর্তনটা ঘটে?

একটি মহাবিশ্বের সাথে আরেকটি মহাবিশ্বের বিচ্ছেদ পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য অনেক সমস্যার তৈরি করেছে। যেমন কিভাবে আমরা গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষকে বর্ণনা করব এটা একটি বড় সমস্যা। ক্লাসিকাল ফিজিক্স বা চিরায়ত পদার্থবিদ্যায় খুব ভালভাবেই গ্র্যাভিটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি একটি শাখা যেখানে এখন পর্যন্ত দৃঢ় কোন থিওরি বা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় নি। এর বদলে সেখানে বেশ কিছু “সিনারিও” বা দৃশ্যকল্প আছে যা বিভিন্ন শর্তের জন্য কোয়ান্টাম গ্রেভিটির সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। অবশ্য এখনও এগুলোর এক্সপেরিমেন্টাল কনফারমেশন বা পরীক্ষালব্ধ নিশ্চয়তা নেই।

যদি স্পেস টাইম একটি নির্দিষ্ট স্কেলের পরে গ্র্যান্যুলার বা দানাদার হয়ে যায় তাহলে একটি ‘বেসিক স্কেল’ এর অস্তিত্ব থাকবে, যার চেয়ে ছোট আকার এর স্পেসটাইমের এর অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রতম এককের একটি স্পেসটাইম থাকবে যাকে আর ভাঙ্গা যায় না বা যার চেয়ে ছোট কোন স্পেসটাইম এর অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। এখানে একটি সমস্যা তৈরি হয়।  এটা আইনস্টাইনের থিওরি অব স্পেশাল  রিলেটিভিটি এর বিরুদ্ধে চলে যায়।

কিভাবে ডিসক্রিট স্পেসটাইম এর ধারণাটি আইনস্টাইন এর স্পেশাল রিলেটিভিটি এর বিরুদ্ধে যায় এটা দেখা যাক। ধরুন, আপনি হাতে একটি রুলার বা স্কেল ধরে আছেন, স্পেশাল রিলেটিভিটি অনুসারে একজন পর্যবেক্ষক যদি সমান বেগে সরল রেখা বরাবর আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে গমন করেন তাহলে আপনার হাতের রুলারটিকে তার কাছে ছোট বলে মনে হবে। কিন্তু যদি এই রুলারটির দৈর্ঘ্য স্পেস টাইমের সেই মৌলিক স্কেল বা মৌলিক ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যের সমান হয় তাহলে কী হবে? স্পেশাল রিলেটিভিটি অনুসারে তখনও রুলারটি ছোট হবে যেটা ডিসক্রিট স্পেসটাইমের বেলায় হবার নয়। আর তাই স্পেশাল রিলেটিভিটি স্পেসটাইম এর বিচ্ছিন্ন হবার মৌলিক ভিত্তিটির সাথেই খাপ খায় না। সুতরাং স্পেস টাইম এর ক্ষেত্রে একটি মৌলিক স্কেলের অস্তিত্ব লরেঞ্জ এর ইনভেরিয়েন্সকে (যার উপর স্পেশাল রিলেটিভিটি দাঁড়িয়ে আছে) লঙ্ঘন করে।

তাহলে এই দুটোকে কি করে একত্রিত করা যায়? পদার্থবিজ্ঞানীরা এটা করার জন্য এই লরেঞ্জ এর ইনভেরিয়েন্স এর ভায়োলেশন মেনে নিয়েই আগাতে পারেন, কিন্তু এক্ষেত্রে খুব স্ট্রিক্ট কনস্ট্রেইন্ট বা কড়া সীমাবদ্ধতায় কাজ করতে হবে (আর এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পছন্দের পথ)। আরেকটি উপায় হল এই স্পেশাল রিলেটিভিটি ও ডিসক্রিট স্পেসটাইমের মধ্যকার সংঘাতকে এড়িয়ে গিয়ে কিছু সিনারিও বা দৃশ্যপট খুঁজে বের করা যেগুলো গ্র্যান্যুলারিটি ও স্পেশাল রিলেটিভিটি দুটোর সাথেই মিলে যায়। এই সিনারিওগুলো পাওয়া যায় কিছু কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি মডেল থেকে যার মধ্যে আছে স্ট্রিং ফিল্ড থিওরি এবং ক্যাজুয়াল সেট থিওরি।

সমস্যাটি ছিল, কিভাবে এই প্রেডিকশনগুলোকে বা সিনারিওগুলোকে পরীক্ষা করে সত্যতা যাচাই করা যায়। এটা কঠিন কারণ এর এফেক্টগুলোকে স্পেশাল রিলেটিভিটিকে ভায়োলেট করা মডেলগুলো থেকে অনেক কম প্রতীয়মান হয়। এই কঠিন সমস্যার একটি সমাধান সম্প্রতি দিয়েছেন SISSA এর প্রফেসর স্টেফানো লিবারাতি ও তার সহকর্মীগণ। গবেষণাটিতে ফ্লোরেন্স এর LENS ও পাদুয়ার INFN এর গবেষকগণও অংশগ্রহণ করেন। লিবারাতি ছাড়াও SISSA এর অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন পিএইচডি ছাত্র আলেসিও বেলেনচিয়া ও পোস্টডক্টরেট দিওনিগি বেনিনিকাসা। গবেষণাটিতে অর্থায়ন করে জন টেমপ্লেটন ফাউন্ডেশন।

লিবারাতি বলেন, “আমরা লরেঞ্জের ইনভেরিয়েন্সকে সম্মান করি, কিন্তু সবকিছুই কোন না কোন মূল্যের বিনিময়ে আসে। আর এক্ষেত্রে সেটা হল নন-লোকাল এফেক্টস”। লিবারাতি ও তার সহকর্মীদের দ্বারা স্টাডি করা সিনারিওগুলো স্পেশাল রিলেটিভিটিকে রক্ষা করে কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা নন লোকাল এফেক্টকে টেনে এনেছেন। নন লোকালিটি অনুসারে, স্পেস টাইমের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে পদার্থবিদ্যা শুধুমাত্র কাছের ঘটনা দ্বারাই প্রভাবিত হতে পারে তা নয়, বরং এর চেয়ে অনেক দূরবর্তী ঘটনা দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, “পরিষ্কারভাবেই আমরা কজালিটি বা কার্যকারণকে ভায়োলেট করি নি আবার ইনফরমেশন আলোর চেয়ে বেশি বেগে গমন করে এরকমও বলতে পারিনা। আমরা বরং লোকাল লেভেলে কি ঘটে তা বোঝার জন্য এবং গ্লোবাল স্ট্রাকচারকে জানার জন্য একটি প্রয়োজন সবার সামনে তুলে ধরেছি”।

থিওরি থেকে ফ্যাক্ট

আরেকটি জিনিস আছে যা লিবারাতি ও তার সহকর্মীদের তৈরি মডেলটিকে প্রায় ইউনিক বা অনন্য করে তুলেছে, এবং কোন সন্দেহই নেই যে এই মডেলটিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এর এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট করা সম্ভব হয়। “আমরা আমাদের যুক্তিগুলোকে ফ্লোরেন্সের LENS এর এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স এর সাথেই সাজিয়েছি। আমরা এখন এর এক্সপেরিমেন্ট ডেভেলপ করার জন্য কাজ করছি”। এই এক্সপেরিমেন্টগুলোর মাধ্যমে লিবারাতি আর তার সহকর্মীগণ হয়তো বাউন্ডারি বা ট্রাঞ্জিশন জোনটি চিহ্নিত করতে সক্ষম হবেন যেখানে স্পেস টাইম কন্টিনিউয়াস থেকে ডিসক্রিট বা গ্র্যন্যুলার ও পদার্থবিদ্যা লোকাল থেকে নন লোকাল হয়ে যায়।

লিবারাতি বলেন, “LENS এ একটি কোয়ান্টাম হারমোনিক অসিলেটর তৈরি করা হচ্ছে। এটা সামান্য কিছু মাইক্রোগ্রাম ভরবিশিষ্ট একটি সিলিকন চিপ যা ঠাণ্ডা করা হলে তাপমাত্রা এবসোল্যুট জিরো এর কাছাকাছি চলে আসে। এবং তখন লেজার লাইট দিয়ে একে আলোকিত করা হলে এটা হারমোনিকালি কম্পিত হতে থাকে। আমাদের থিওরেটিকাল মডেলটি কোন নন নেগলিজিবল ভরের (যে ভরকে নগন্য ধরা যায় না যেমন এই সামান্য কিছু মাইক্রোগ্রাম বিশিষ্ট কোয়ান্টান হারমোনিক অসিলেটরের বেলায়) কোয়ান্টাম অবজেক্টে নন লোকাল এফেক্ট পরীক্ষা করার একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে”। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। একটি থিওরেটিকাল সিনারিও যা স্পেশাল রিলেটিভিটি ভায়োলেট করা ছাড়াই কোয়ান্টাম এফেক্ট তৈরির জন্য দায়ী থাকে তা এটাও বলে যে, আমাদের স্কেলগুলো অবশ্যই অনেক ছোট হতে হবে (না হলে আমরা ইতিমধ্যেই সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে ফেলতাম)। এদেরকে পরীক্ষা করার জন্য আমাদের সেগুলোকে কোন না কোনভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হতে হবে। আমাদের মডেল অনুসারে বর্ডারলাইন অবজেক্টগুলোতে এই এফেক্টগুলো দেখা সম্ভব। বর্ডারলাইন অবজেক্ট বলতে সেইসব অবজেক্টকে বোঝায় যেগুলো অবশ্যই কোয়ান্টাম অবজেক্ট কিন্তু এদের আকার এমন যেখানে এদের ভর গ্র্যাভিটি বা অভিকর্ষের সাথে সম্পর্কযুক্ত (ঠিক যেমনটা ইলেক্ট্রিকাল চার্জ ইলেক্ট্রিক ফিল্ড এর সাথে সম্পর্কিত) এবং যেখানে ভরকে নেগলেক্ট করা যায় না।

লিবারাতি বলেন, “প্রস্তাবিত মডেলটির ক্ষেত্রে, কিভাবে সিস্টেমটি অসিলেট বা কম্পন করবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে দুটো প্রেডিকশন আছে। এর মধ্যে একটি, সিস্টেমটিকে নন লোকাল এফেক্ট ছাড়াই বর্ণনা করে আর একটি লোকাল এফেক্ট নিয়ে একে ব্যাখ্যা করে”। লিবারাতির মতে এই মডেলটি যথেষ্ট শক্তিশালী। তিনি জানান,“এই দুটি ক্ষেত্রে বর্ণনা করা প্যাটার্নের মধ্যে পার্থক্যটা অসিলেটরের এনভায়রনমেন্টের প্রভাব দ্বারা তৈরি করা যায় না। আর তাই এটা একটা উইন উইন সিচুয়েশন। যদি আমরা এফেক্ট না দেখতে পারি তাহলে ট্রানজিশনটি কোথায় হয় এটা দেখতে আমরা আমাদের এনার্জির সীমানাকে আরও উন্নীত করতে পারব। মোটের উপর, এই এক্সপেরিমেন্টগুলো নন লোকালিটি স্কেল থেকে প্লাংক স্কেলের দিকে কনস্ট্রেইন্ট বা সীমাবদ্ধতাকে ঠেলে দেবে। এক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত না নন লোকালিটি দিয়ে এই সিনারিওকে বাতিল করা না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এগোতেই থাকব। আর যেহেতু আমরা এভাবে পসিবল থিওরেটিকাল সিনারিও কমাতে কমাতে একটি নির্দিষ্ট রেজাল্টের দিকে ধাবিত হব, তাই এটা এমনিতেই আমাদেরকে একটা সময় সঠিক রেজাল্ট দেবে। অন্যদিক যদি আমরা এফেক্টটি ধরেই ফেলি তাহলে আমরা নন লোকাল এফেক্ট এর অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারব এবং একটি নতুন ফিজিক্স এর দিকে অগ্রসর হব”।

https://www.sissa.it/news/where-space-time-becomes-discrete

– ভেলোসিটি হেড

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.