ওয়াগনার গ্রুপটি কেবল ইউক্রেনে তার ক্রিয়াকলাপের জন্য নয়, সেই সাথে এটি অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ক্রিয়াকলাপের জন্যও কুখ্যাত। কিন্তু সম্প্রতি ওয়াগনার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহের প্রচেষ্টায় এই মার্সেনারি বাহিনীর প্রধান প্রেগোজিন ভ্লাদিমির পুতিনকে চ্যালেঞ্জ করেন, কিন্তু পরে পিছু হটেন। এই ব্যাপারটি ওয়াগনারের বিদেশী মিশনগুলিকে বিপদে ফেলার ঝুঁকিতে ফেলেনি কি? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বিশেষ করে সেই দেশগুলোর জন্য যেসব দেশে ওয়াগনারের মিশন রয়েছে। এখানে তাই আফ্রিকায় ওয়াগনার অপারেশন নিয়ে ও তাতে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো কী মিন করে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
আফ্রিকায় ওয়াগনারের কার্যক্রম
ওয়াগনার কীভাবে আফ্রিকায় প্রবেশ করেছিল তা ব্যাখ্যা করে শুরু করা যাক। ভাড়াটে গোষ্ঠীটির উৎপত্তি ২০১৪ সালে যখন দিমিত্রি উটকিন নামে একজন নব্য-নাৎসি রাশিয়ান সেনা কর্মকর্তা এটি গঠন করেছিলেন। ওয়াগনার ক্রেমলিনের পরোক্ষ সহায়তায় রাশিয়াপন্থী দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্র দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের লড়াইয়ে সহায়তা করেছিলেন, যা পুতিনকে কিছুটা প্লসিবল ডিনায়াবিলিটি বা একরকম দায়মুক্তি দিয়েছিল, এবং তাকে আন্তর্জাতিক সমালোচনা থেকে রক্ষা করেছিল। এর মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য অংশে এই মার্সেনারি গ্রুপটি ব্যবহার করার সুযোগ শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া কয়েকটি আফ্রিকান দেশের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে, মূলত এজন্য যে এই দেশগুলিতে পূর্বে সোভিয়েত-এলাইনড নেতৃত্ব ছিল এবং এই দেশগুলো সোভিয়েত অস্ত্র ক্রয় করত। অতি সম্প্রতি, এই দেশগুলিতে ক্রেমলিনপন্থী বা অন্তত পশ্চিমা-বিরোধী শাসকদের ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়লে রাশিয়া তাদের রক্ষা করার জন্য এইসব দেশে ওয়াগনারকে প্রেরণ করে।
সেই সময়, ওয়াগনার বেশিরভাগ প্রাক্তন রাশিয়ান এবং মধ্য এশীয় সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল, ক্রিমিয়ার মতো পেনাল কলোনির আসামীদের দ্বারা গঠিত ছিলনা। আর ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের আগে আফ্রিকায় আনুমানিক ৫,০০০ ওয়াগনার সৈন্য মোতায়েন ছিল। এখন, এটা ঠিক যে, আফ্রিকায় ওয়াগনার অভিযানের সম্পূর্ণ বিবরণ জানা সম্ভব নয়, তবে কিছু ব্যাপারে অন্তত জানা যায়। যেসব দেশে তারা সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষভাবে সামরিক সম্পৃক্ততা দেখিয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণগুলো হলো – মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মালি, সুদান এবং লিবিয়া।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনরের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশটির প্রেসিডেন্ট ২০১৮ সালে বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ওয়াগনার ভাড়াটে সৈন্যদের ব্যবহার করেছিলেন, যার পরে তারা রাষ্ট্রপতির ইনার সার্কেলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, রাশিয়াকে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের নিকটতম মিত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়, রাশিয়ার পতাকাগুলি রাস্তায় সজ্জিত করা হয় এবং এমনকি সেখানকার স্কুলগুলিতে রাশিয়ান ভাষা শেখানো হয়। সাপোর্ট এবং সুরক্ষার বিনিময়ে, ওয়াগনার দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের থেকে ছাড় বা কনসেশন লাভ করে। এই কারণেই প্রিগোজিন একটি মধ্যে আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র-ভিত্তিক খনি সংস্থা, মাইডাস রিসোর্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা দেশটিতে স্বর্ণ উত্তোলনের জন্য অনুমোদন রয়েছে। এটি যে সাইটটি পরিচালনা করে তার আনুমানিক মূল্য এক বিলিয়ন ডলার। ওয়াগনারের সাথে সংযুক্ত আরেকটি সংস্থা হচ্ছে ডায়ামভিল, মধ্যে আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইউরোপে সোনা এবং হীরা পাঠানোর একটি প্রকল্পে অংশ নিয়েছিল। ওয়াগনার কোম্পানি কাঠ শিল্প বা টিম্বার ইন্ডাস্ট্রি থেকেও লাভ করে, এটি ১৮৭,০০০ হেক্টর বনাঞ্চল থেকে বাধাহীনভাবে কাঠ প্রস্তুতি বা লগিং-এর অধিকার লাভ করে।
এখন পশ্চিম আফ্রিকায় যাওয়া যাক। মালিতে, রাশিয়া পশ্চিমাদের, বিশেষ করে ফ্রান্সকে দুর্বল করার জন্য ওয়াগনারকে ব্যবহার করেছে, যেখানে ফ্রান্সের সৈন্যরা এখন মালির সামরিক সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরে দেশটি থেকে সরে গেছে। ২০১৩ সাল থেকে মালিতে আইএস ও আল-কায়েদা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী এমআইএনইউএসএমএ (MINUSMA) মোতায়েন করেছে। গত এক দশকে প্রায় ৩০০ শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছে এবং সেই মিশন বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন মালিয়ানরা শান্তিরক্ষীদের খুব একটা পছন্দ করেনা, এবং প্রায়শই এদেরকে ফরাসি শক্তির গোপন সম্প্রসারণ হিসাবে দেখে। এসব কারণে মালি এখন জাতিসংঘের কাছে দেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের অনুরোধ করছে এবং এর পরিবর্তে ওয়াগনার ভাড়াটে সৈন্যদের সহায়তা চাইছে। ওয়াগনারের নৃশংসতা এবং আক্রমণাত্মক কৌশল ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা যা প্রত্যাশা করে তার সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি স্থানীয়দের ইচ্ছার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। একটি জার্মান জরিপ অনুযায়ী, ৯০ শতাংশেরও বেশি মালিয়ান ওয়াগনারের উপর আস্থা রাখে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ওয়াগনার সৈন্যরা মোরুয়া শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংসতায় জড়িত ছিল, যার মধ্যে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে হত্যা বা এক্সেকিউশন, নির্যাতন এবং ধর্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তবুও মালিতে ওয়াগনারের জনপ্রিয়তা এতো বেশি।
এখন সুদানের দিকে তাকালে দেখা যায়, চলমান গৃহযুদ্ধও এই গোষ্ঠীর জন্য রাশিয়ার প্রভাব জোরদার করার একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুদানের কর্তৃপক্ষের মতে, ওয়াগনার এখানে জেনারেল মোহাম্মদ হামদান ডি গ্যালোর নেতৃত্বাধীন আরএসএফ আধাসামরিক যোদ্ধাদেরকে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সরবরাহ করছে। এখানেও মস্কো দেশটির রিসোর্স অ্যাক্সেস পাওয়ার প্রচেষ্টায় ওয়াগনারের সমর্থনকে কাজে লাগাতে চায়।
তবে সম্ভবত আফ্রিকার বৃহত্তম ওয়াগনার অভিযানটি ঘটে লিবিয়ায়, যেখানে তারা রাশিয়াপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ সামরিক নেতা এবং লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সুপ্রিম কমান্ডার জেনারেল খলিফা হাফতারকে সমর্থন করার জন্য আনুমানিক ২,০০০ যোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ এবং প্রশাসক মোতায়েন করেছিল। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে হাফতারের তোব্রুক-ভিত্তিক সরকার পশ্চিমা সমর্থিত ত্রিপোলি-ভিত্তিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরে, একটি সমঝোতা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠিত হয়। হাফতার ওয়াগনারকে দেশটির পূর্ব এবং দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ তেল ক্ষেত্রগুলি রক্ষা করার জন্য পুনরায় নিযুক্ত করেন, এর মাধ্যমে হাফতার আলোচনায় উল্লেখযোগ্য সুবিধা লাভ করেন এবং তার সামরিক বাহিনীর জন্য তহবিলও অর্জন করেন।
অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর আফ্রিকায় ওয়াগনার নিয়ে সমস্যা ও সম্ভাবনা
সুতরাং ওয়াগনার প্রভাব আফ্রিকা জুড়ে কতটা ছড়িয়ে কতটা ছড়িয়ে পড়েছে তা বুঝতেই পারছেন। আর এখানেই আসছে এই আলোচনাটির মূল প্রশ্ন – আফ্রিকায় ওয়াগনার কার্যক্রমের জন্য তাদের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের অর্থ কী হবে? আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলি রাশিয়ার সাথে একটি ভাল সম্পর্ক রাখার প্রতিশ্রুতি হিসেবে ওয়াগনারের পরিষেবাগুলি ব্যবহার করে, কেননা তারা রাশিয়াকে এখনও একটি উল্লেখযোগ্য বিশ্ব শক্তি হিসাবে বিবেচনা করে। ওয়াগনার এবং ক্রেমলিনের মধ্যে ফাটলের অর্থ হ’ল এই রাজ্যগুলিকে বেছে নিতে হবে যে তারা কার পক্ষে রয়েছে। যদি এভাবে দুটোর মধ্যে একটি বেছে নেবার পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবে ওয়াগনার তার লাভজনক চুক্তিগুলো হারাতে পারে, আর রাশিয়া হারাতে পারে আফ্রিকায় তার সামরিক অবস্থানগুলো, আর অন্যদিকে আফ্রিকান নেতারা আরও দুর্বল হয়ে পড়বেন এবং নিজ নিজ দেশের অস্থিরতা দমন করতে অক্ষম হবেন। যেহেতু এই ক্ষমতার শূন্যতা বা পাওয়ার ভ্যাকুয়াম এদের করোও জন্যই সুখকর নয়, বরং পশ্চিমাদেরই সহায়তা করতে পারে এই অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টির জন্য, তাই রাশিয়া ওয়াগনারের উপর আর নির্ভর করতে না পারলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সব কিছু যেমন ছিল তেমনই থাকবে।
ওয়াগনার অভ্যুত্থানের কয়েক দিন পরে, একজন রাশিয়ান দূত হাফতারের সাথে দেখা করে তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে অভ্যুত্থানের সময় প্রায় ২,০০০ ওয়াগনার কর্মী সেখানে থাকবে। জুন মাসে, আফ্রিকায় ওয়াগনার সৈন্যরা অবস্থান করেছিল, মালিতে এবং মধ্যে আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ভাড়াটে সৈন্যরা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আগের মতোই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, প্রচুর অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে কারণ কেউ জানে না যে পুতিন এবং প্রিগোজিনের মধ্যে শত্রুতা আবশ্যিকভাবে শেষ হয়েছে কিনা এবং ওয়াগনার ভাড়াটে সৈন্যদেরকে পুরোপুরিভাবে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে অধিগ্রহণ করা হবে কিনা। আফ্রিকায় ওয়াগনারের পার্টনারদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে যে বর্তমান ব্যবস্থাটি স্থায়ী হবে কিনা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল আফ্রিকায় রাশিয়াকে তার শক্তি প্রদর্শন ও প্রক্ষেপণের ক্ষমতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। পুরো বিষয়টি পুতিনকে দুর্বল করে তোলে এবং এর মধ্যে কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ওপর আগের মতো এককভাবে আর নির্ভর না করে নিজেদের ইন্টারন্যাশনাল পার্টনারদের পুলকে আরও বেশি বৈচিত্র্যময় করতে পারে, কারণ যদি একটির বদলে একাধিক রাষ্ট্রের ওপর তারা নির্ভর করে তবে যেকোনো একটি রাষ্ট্রের দুর্দশায় তাদের ক্ষতি কম হবে।
বিশ্লেষকরা আরও আশা করছেন যে, এই দেশগুলি এখন ওয়াগনার নিয়ে অন্ততপক্ষে আগের থেকে বেশি সতর্কতার সাথে আচরণ করবে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত আফ্রিকান যুদ্ধবাজ শাসক এবং স্বৈরশাসকদের নিজেদের সমর্থনের জন্য সশস্ত্র ভাড়াটে সেনার প্রয়োজন হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়া সম্ভবত দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে নিজেদের দেশের ভাড়াটে সেনাদলকে সেইসব দেশে সরবরাহ করার চেষ্টা করবে, কারণ এটি রাশিয়ার জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা, এবং সেই সাথে এটি বিশ্বব্যাপী তাদের প্রভাব জোরদার করতে সহায়তা করে। কিন্তু এই ভাড়াটে সৈন্যরা ওয়াগনারের ব্যানারে বেশিদিন থাকবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র
1 – https://foreignpolicy.com/2023/06/28/will-wagner-stay-in-africa/
2 – https://www.aljazeera.com/news/2023/7/1/after-mutiny-clouds-hover-over-wagners-operations-in-africa
3 – https://qz.com/wagner-group-us-treasury-sanctions-illegal-gold-mining-1850585049
4 – https://www.thehindu.com/news/international/explained-the-wagner-groups-actions-in-africa/article66775177.ece
5 – https://edition.cnn.com/2023/04/20/africa/wagner-sudan-russia-libya-intl/index.html
6 – https://www.newarab.com/analysis/how-wagners-revolt-could-impact-russias-influence-libya
7 – https://www.theguardian.com/world/2023/jul/06/putin-wagner-africa-business-yevgeny-prigozhin-kremlin
8 – https://www.aljazeera.com/news/2023/7/1/after-mutiny-clouds-hover-over-wagners-operations-in-africa
Leave a Reply