Table of Contents
কার্চ সেতুতে ইউক্রেইনের করা বিস্ফোরণ
১৭ই জুলাই, সোমবার ভোরের দিকে, রাত ৩টার দিকে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযোগকারী কার্চ (Kerch) ব্রিজটিতে ১২ মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কার্চ ব্রিজ বা ক্রিমিয়ান ব্রিজ ক্রিমিয়া এবং রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের মধ্যে একমাত্র প্রধান পরিবহন সেতু। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০১৮ সালে সেতুটি চালু হয়। ক্রিমিয়ার কার্চ উপদ্বীপ থেকে রাশিয়ার তামান উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার ফলে এটি ইউরোপের দীর্ঘতম সেতু, এবং উদ্বোধনের পরে এটি পুতিন একে রাশিয়ান শক্তির প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন।
একটু ভাল করে নজর দিলে দেখা যাবে, এটি আসলে দুটো সেতু। এক্ষেত্রে একটি চার লেনের সড়ক সেতু এবং একটি ডাবল ট্র্যাক রেলপথ বিশিষ্ট রেইল সেতু একে অপরের সমান্তরালে রয়েছে। সোমবার যেটাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা হচ্ছে চার লেনের সড়ক সেতুটি। ওয়াগনার-অনুমোদিত গ্রে জোন টেলিগ্রাম চ্যানেলের মতে, এখানে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে, একটি ভোর ৩টা ৪ মিনিটে এবং আরেকটি ভোর ৩টা ২০ মিনিটে। মনে হচ্ছে এটি একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বা নৌবাহিনীর ড্রোন হামলা ছিল। তবে নৌবাহিনীর ড্রোন হামলা হবার সম্ভাবনা দুটি কারণে বেশি। প্রথমত, সেখানে বেশ ভাল অ্যান্টি-এয়ার ডিফেন্স রয়েছে, যা ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে মোটামুটি কঠিন করে তোলে। এবং দ্বিতীয়ত, সেতুর সমান্তরালে চলা ট্রেন ব্রিজ থেকে নেওয়া ভিডিওগুলি দেখায় যে সেতুটি জলে ডুবে যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে, বেস বা ফাউন্ডেশনগুলিতে আক্রমণ করা হয়েছিল।
এই ঘটনায় আপাতদৃষ্টিতে দু’জন নিহত হয়েছেন এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম অনুযায়ী ক্রাসনোদার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, মনে হচ্ছে সেতুর ওপর দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিকে কিয়েভ এই ঘটনা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেনি এবং ইউক্রেনের দক্ষিণ সামরিক কমান্ড বলেছে যে এটি একটি ফলস ফ্ল্যাগ হামলা হতে পারে, মানে তারা কিছু করেনি, অন্য কেউ করে তাদের নাম দোষ চাপাচ্ছে – এরকম একটা ভাব নিয়েছিল। কিন্তু পরে তারা স্বীকার করে যে হামলাটি তারাই করেছে। তবে তারা স্বীকার না করলেও বোঝাই যাচ্ছিল যে এটা ইউক্রেইনেরই করা। কারণ ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের থেকে সেই ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে। হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইউক্রেনের গ্রাউন্ড ফোর্সেস কমান্ডার টেলিগ্রামে বলেন, তিনি রাশিয়ানদের জন্য একটি “লুলাবাই” (বাচ্চাদের ঘুমপাড়ানি গান) তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত বছরের অক্টোবরে বিস্ফোরক ভর্তি একটি ট্রাক সেতুটি উড়িয়ে দেয়, যার ফলে আগুন ধরে যায়, যা পরে রেল সেতুটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রেও ইউক্রেনীয়রা প্রাথমিকভাবে তার দায় অস্বীকার করেছিল, তবে এর অল্প সময় পরেই তারা ক্রিমিয়ার সেতুর ঘটনাকে মস্কোতে যা ঘটেছিল তার সাথে তুলনা করে একটি টুইট প্রকাশ করে, আর তার মাধ্যমে তারা দৃঢ়ভাবে বোঝায় যে ইউক্রেনই এই হামলা চালিয়েছিল। এর কয়েকদিন পর ইউক্রেনের কর্মকর্তারা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের কাছে স্বীকারও করে যে, তারাই সেই হামলার আয়োজন করেছিল।
যাই হোক, এর সেতুটিতে বিস্ফোরণের ফল কী হবে? কৌশলগতভাবে এই আক্রমণটি সম্ভবত চলমান কাউন্টার-এটাকে খুব বেশি পার্থক্যের সৃষ্টি করবে না, অন্তত স্বল্পমেয়াদে তো নয়ই। এটি দক্ষিণে রাশিয়ার লজিস্টিক অপারেশনে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে ঠিকই, কিন্তু রাশিয়ানরা এখনও রাশিয়া থেকে ডোনেটস্ক ওব্লাস্ট হয়ে রাশিয়ান অধিকৃত মেলাটোপোতে যাওয়া রেলপথের মাধ্যমে জ্যাপরিঝিয়ায় তাদের সৈন্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। আর এটি দক্ষিণাঞ্চলে রাশিয়ার লজিস্টিককে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চাপ দিলেও দক্ষিণ নিয়ে ইউক্রেনের বাধা থাকছেই। প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে প্রথমটি হল বিমান সহায়তা বা এয়ার সাপোর্টের অভাব এবং দ্বিতীয়টি হলো, রাশিয়ার ডিফেন্সিভ লাইন। স্যাটেলাইট চিত্রগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায়, গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া জ্যাপরিঝিয়ার পূর্বে দুটি ও পশ্চিমে তিনটি ডিফেন্সিভ লাইন তৈরি করেছে। এই ডিফেন্সিভ লাইনগুলোতে বিভিন্ন রকমের ফোর্টিফিকেশন আছে, এগুলো ট্রেঞ্চ বা পরিখা, শেল্টার, এন্টি-ট্যাংক অবস্ট্যাকলস, মাইনফিল্ড-এ পরিপূর্ণ, সেই সাথে এখানকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে ঘিরে এমন বৃত্তাকার খাদ তৈরি করা হয়েছে যে, সেগুলোতে এন্টি-ট্যাংক টিমগুলো অবস্থান নিতে পারে।
এখন এটা বলা যায় না যে, সেতুটির উপর এই আক্রমণ যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও প্রভাব ফেলবে না। এটি রাশিয়ার লজিস্টিকের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে এবং রাশিয়ান বাহিনীর মনোবলকে দুর্বল করবে। কিন্তু কথা হল রাশিয়ার দুর্দান্ত লজিস্টিকস ইউক্রেনের প্রধান বাধাগুলির একটি নয়, ইউক্রেইনের আসল সমস্যা হলো রাশিয়ার তৈরি ডিফেন্সিভ লাইনগুলো, আর যেহেতু ইউক্রেনের বিমান সহায়তা বা এয়ার সাপোর্টের অভাব রয়েছে, তাই সেতুতে বিস্ফোরণে ইউক্রেইন ফ্রন্ট লাইনে তেমন লাভ করতে পারবে না। কিন্তু সম্প্রতি যুদ্ধে ইউক্রেইন নতুন যে এট্রিশন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে বলে দেখা যাচ্ছে এটা সেটার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। আর তাই এটা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অগ্রগতি না নিয়ে এলেও ইউক্রেইন এখন যা চায় সেই লক্ষ্য পূরণ হতে পারে। এই ব্যাপারে একটু পরে আলোচনা করছি।
যাই হোক, প্রত্যক্ষ প্রভাব না ফেললেও পুতিনের জন্য এটি খারাপ খবর, কারণ এটি তাকে আরও বেশি রাজনৈতিক চাপের মধ্যে ফেলবে। এবং গত মাসে ওয়াগনার অভ্যুত্থানের চেষ্টার পরে পুতিন ইতিমধ্যে কিছু গুরুতর রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছেন এবং এমন খবর পাওয়া গেছে যে তিনি বর্তমানে তার শাসনকে রক্ষা করার চেষ্টা করার জন্য তার সামরিক কমান্ডটিকে পুনর্গঠন করছেন। এই কার্চ ব্রিজ যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইন থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে হতে পারে, কিন্তু এটি রাশিয়ার ক্ষমতা ও মস্কোর ক্রিমিয়া অধিকারের প্রতীক। আর তাই ক্রেমলিনের জন্য খুব অপমানজনক, বিশেষ করে যখন এরকম হামলা দ্বিতীয়বার সংঘটিত হয়। রাশিয়ার টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলি ইতিমধ্যেই পুতিনকে এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার দাবি করছে।
শেষবার যখন কার্চ সেতুতে বিস্ফোরণ হয়েছিল তখন পুতিন তার প্রতিশোধ নিতে ইউক্রেইনের অবকাঠামোগুলোতে বারবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন, এবং তার জেনারেলদেরকে সরিয়ে সের্গেই সুরোভিকিনকে নিয়োগ করেছিলেন। এই সুরোভিকিন ছিলেন একজন কট্টরপন্থী, যিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার দক্ষিণ সামরিক কমান্ডের প্রধান ছিলেন এবং সিরিয়ায় রাশিয়ার অভিযান পরিচালনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সুরোভিকিনকে বেশি কার্যকরী ছিলেন ঠিক, কিন্তু তিনি তিনি বেশি নিষ্ঠুর স্ট্র্যাটেজিস্টও ছিলেন। যাইহোক, ওয়াগনারের অভ্যুত্থানের পর তার সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কারণে তাকে আটক করা হয়। যাইহোক, এবারে পুতিন আর আগের মতো রিটেলিয়েট করতে পারবেন না, কারণ তিনি ইতিমধ্যে ইউক্রেনে নজিরবিহীন সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছেন এবং তাকে তার সবচেয়ে অনুগত কমান্ডারদের নিয়েই থাকতে হবে।
এটি তাকে কিছুটা ডিলেমার মধ্যে ফেলে দেয়। হয় তাকে কিছুই করা যাবে না, কিন্তু তাতে তাকে দুর্বল দেখাবে। নয় তাকে কোন রকম এস্কেলেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, মানে নিউক্লিয়ার এস্কেলেশন বা নতুন ওয়েভের সেনা-সমাবেশ না করলেও অন্তত ইউক্রেইনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও শহরে তাকে ড্রোন এটাক ও মিসাইল এটাক করতে হবে, যদিও তাতে কতটা লাভ হবে সন্দেহ আছে। এদিকে নতুন ওয়েভের সেনাসমাবেশ বা নিউক্লিয়ার এটাকে রিস্ক আছেই। প্রথমত, তাতে পুতিনের “স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন তেমন বড় কিছু না” এই ন্যারেটিভটা ভেঙ্গে পড়ে, আর দ্বিতীয়ত, এটা, বিশেষ করে নিউক্লিয়ার এস্কেলেশনের ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে ন্যাটোর খুব একটা ভাল লাগবে না। তো সব মিলে পুতিন ইউক্রেইনের কিছু শহরে ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে মিসাইল এটাক করার পথটিকেই বেছে নেন। কিয়েভ সহ ইউক্রেইনের বিভিন্ন শহরে মিসাইল এটাক করা হলো। আবার এর প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেইনও মস্কোতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। আর তাতে পুতিন আরও বেশি চাপে পড়েছেন।
ইউক্রেইনের ধীর গতির কৌশল কিন্তু বাখমুতে সাফল্য
ইউক্রেনে এই মুহুর্তে সামনের সারিতে খুব বেশি কিছু ঘটছে না। দেখে মনে হচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী বড় আকারের কম্বাইন্ড আর্মস অফেন্সিভ থেকে সরে এসেছে, সম্মিলিত অস্ত্র আক্রমণ থেকে দূরে সরে এট্রিশনাল স্ট্র্যাটেজির দিকে সরে গেছে। মানে, পূর্বে তারা বৃহৎ আকারের সম্মিলিত অস্ত্র আক্রমণে নিযুক্ত ছিল, যেখানে তারা পদাতিক, আর্মার্ড এবং আর্টিলারির মতো বিভিন্ন ধরণের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে সমন্বিত এবং তীব্র আক্রমণ জড়িত ছিল, যাতে দ্রুত ভূমি পুনরুদ্ধার এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা যায়। কিন্তু এবারে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী অ্যাট্রিশনাল কৌশল গ্রহণ করেছে। “অ্যাট্রিশনাল” বলতে ধীর এবং সাসটেইনেবল পদ্ধতি বোঝায়, যেখানে দ্রুত অগ্রগতির চেয়ে আস্তে আস্তে শত্রুকে দমন করার দিকে মনোনিবেশ করা হয়। এই কৌশলে, প্রতিপক্ষের উপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করা হয়, তাদের সম্পদ শেষ করা হয় এবং তাদের বাহিনীতে বিরক্তি সৃষ্টি করার উপর জোর দেওয়া হয়। এখানে লক্ষ্য হ’ল উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্য চাপ দেওয়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে ভূমি পুনরুদ্ধার করা এবং ফ্রন্ট-লাইনে স্থিতিশীলতা বা স্ট্যাবিলিটি বজায় রাখা। আর সেটাই দেখা যাচ্ছে এখন, কারণ যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনগুলো সাম্প্রতিক সময়ে পূর্বের চেয়ে তুলনামূলভাবে বেশি স্থিতিশীল দেখা যাচ্ছে। তবে একটি জায়গা আছে যেখানে ইউক্রেনীয়রা ছোট হলেও কৌশলগতভাবে উল্লেখযোগ্য অর্জন অব্যাহত রেখেছে, আর তা হচ্ছে বাখমুত, যার উত্তর এবং দক্ষিণে ইউক্রেন অবিচ্ছিন্নভাবে অগ্রগতি লাভ করছে, রাশিয়ান টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলো এবং সম্প্রতি এই অঞ্চলে মোতায়েন রাশিয়ান সৈন্যদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তাই এখন আলোচনা করা হবে যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বশেষ আপডেটগুলি কী, এবং ব্যাখ্যা করা হবে কেন যুদ্ধ ধীর গতিতে চলছে।
বাখমুতে কী ঘটছে তা জানার আগে ফ্রন্ট লাইনের অন্যান্য অঞ্চলে কী ঘটছে তা একবার দেখে নেওয়া যাক। সাধারণভাবে বলতে গেলে ফ্রন্ট লাইনে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি, এবং মনে হচ্ছে এর প্রধান কারণ হল এই যে, ইউক্রেন তার যুদ্ধের কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। প্রচুর সৈন্য এবং ট্যাঙ্কের সাথে জড়িত বড় কম্বাইন্ড আর্মস টাইপ স্ট্র্যাটেজি কম দেখা যাচ্ছে, এবং মনে হচ্ছে ইউক্রেন এখন রাশিয়ার লজিস্টিকসের ওপর নতুন করে মনোনিবেশ করেছে আর আগের চেয়েও বেশি এট্রিশনাল স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে। এটাই দেখা গেছে কার্চ ব্রিজে হামলায়, যা দক্ষিণে রাশিয়ার লজিস্টিকসের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং সম্ভবত এই কারণেই ইউক্রেন এই মুহুর্তে এর পশ্চিমা মিত্রদের কাছে ট্যাঙ্কের পরিবর্তে আর্টিলারি এমিউনিশন চাইছে। ইউক্রেইন এভাবে তার কৌশলের দুটি কারণে। প্রথমত, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষের প্রত্যাশার চেয়ে ভাল কাজ করছে, আর তাই ইউক্রেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পুনরায় চেষ্টা করার আগে রাশিয়ার এই প্রতিরক্ষাগুলিকে নরম করা দরকার। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন এই মাসের শুরুতে আমেরিকান ক্লাস্টার মিউনিশনের প্রথম ব্যাচ পেয়েছে এবং এই বছরের শেষের দিকে আরও ক্লাস্টার মিউনিশন পাবে, সেই সাথে তাদের এফ -16-ও পাবার কথা রয়েছে। ইউক্রেইন সম্ভবত রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার জন্য এই ক্লাস্টার মিউনিশনগুলো ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এবং যদি এফ -16 শীঘ্রই আসে তবে ইউক্রেন রাশিয়ার এয়ার সুপিরিয়রিটি বা বিমান শ্রেষ্ঠত্বের দিকটাকেও ট্যাকল করতে পারবে, উল্লেখ্য, ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার এয়ার সুপিরিয়রিটি গেল কয়েক মাসে রাশিয়ার পক্ষে বেশ কার্যকর বলেই প্রমাণিত হয়েছে। এই নতুন কৌশল নিয়ে ইউক্রেনীয়রা রোবটিনের চারপাশে কিছু অগ্রগতি লাভ করেছে, রাশিয়ার প্রথম ডিফেন্স লাইনে পৌঁছেছে, তবে তারা এখনও রোবোটিনেতে প্রবেশ করতে পারেনি।
বাখমুত ও রোবোটিনে ছাড়া ফ্রন্ট লাইনকে কিছুটা সরানো হয়েছে এরকম অন্যান্য অঞ্চল হচ্ছে উত্তর-পূর্বে কুপিয়ানস্ক এর আশেপাশে। কুপিয়ানস্ক খার্কিভ ওব্লাস্টের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি ছোট শহর যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনীয়রা তাদের খার্কিভ কাউন্টার-অফেন্সিভের সময় পুনরুদ্ধার করে, আর সেটা করার আগে পর্যন্ত শহরটি রাশিয়ানদের জন্য লজিস্টিক হাব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যদিও ইউক্রেনীয়দের শহরটির উপর বেশ শক্ত দখল রয়েছে, রাশিয়ানরা এখনও বেলগোরদ ওব্লাস্ট থেকে শহরে আসা পি-৭৯ রাস্তাটি নিয়ন্ত্রণ করে। গত কয়েক দিন ধরে রাশিয়ানরা এই রাস্তা দিয়ে দক্ষিণে শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে ও কিছুটা সাফল্যও লাভ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়ানরা গত কয়েক দিনে এই রাস্তা দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে এবং ইউক্রেনের ইস্টার্ন আর্মি কমান্ড দাবি করেছে যে রাশিয়া এই অঞ্চলে প্রায় ১ লক্ষ সেনা, ৯০০টি ট্যাঙ্ক এবং ৫৫৫টি আর্টিলারি সিস্টেম মজুদ করেছে।
ক্রেমেনা কুপিয়ানস্ক থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে খার্কিভ এবং লুহানস্ক ওব্লাস্টের সীমান্তে অবস্থিত একটি শহর। গত বছর থেকেই ইউক্রেইনীয়রা এখানে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে, কারণ এখানে রাশিয়া-ইউক্রেইনের ফ্রন্টলাইনটি পি-৬৬ মহাসড়ক বরাবর অবস্থিত, যা ক্রস করলেই ক্রেমেনা। আর এই মহাসড়কটি হয়েই বেলগোরদ এবং পশ্চিম রাশিয়ার অন্যান্য সাপ্লাই ডিপো থেকে রাবিসনে, সেভেরোডোনেটস্ক, লিসিচানস্ক এবং বাখমুতের মতো জায়গায় সাপ্লাই প্রেরণ করা হয়। তবে প্রায় এক সপ্তাহ আগে, রাশিয়ানরা এখানে ইউক্রেইনীয় বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল, আর রুশ বাহিনী ক্রেমেনার পশ্চিমে জঙ্গলে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু ভূ-অবস্থানগত ফুটেজ থেকে জানা যায় যে কয়েক দিন পরে ইউক্রেনীয়রা রুশদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
এবারে আসা যাক বাখমুতের আলোচনায়। আগেই লিখেছিলাম, মে মাসে ওয়াগনার বাখমুত শহরটি দখল করার পর থেকে ইউক্রেনীয়রা উত্তর এবং দক্ষিণ দিক দিয়ে রুশদেরকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। আরো লিখেছিলাম, রাশিয়ায় ওয়াগনার-সম্পর্কিত বিশৃঙ্খলার সময়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা এখানে ভাল অগ্রগতি অর্জন করেছিল, বিশেষত ক্লিশিভকার শহরতলির পাশ দিয়ে দক্ষিণে। তারপর থেকে, তারা অগ্রসর হতে থাকে, এবং এই সপ্তাহের শুরুতে, তারা ক্লিশিভকার আশেপাশের উচ্চতর স্থানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। শহরতলির ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত এই অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ মূলত ইউক্রেনীয়দের ক্লিশিভকায় অবস্থান নেয়া রাশিয়ানদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণে সহায়তা করবে। আর যদি তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন না হয় তবে ইউক্রেনীয়দের নিকট ভবিষ্যতে এই সাবার্ব বা শহরতলি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হওয়া উচিত।
এই মাসের শুরুতে, ক্লিশিভকা থেকে রাশিয়ান সৈন্যদের পিছু হটার খবর পাওয়া গিয়েছিল এবং কয়েক দিন পরে, রাশিয়ান টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলিতে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে সম্প্রতি মোবিলাইজড হওয়া রাশিয়ান সৈন্যরা এই অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিযোগ করেছিল এবং তাদের ওপর উপর মহল থেকে আসা “আত্মঘাতী” আদেশ অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছিল। ইউক্রেনীয়রা বাখমুতের উত্তরেও কিছু সাফল্য পেয়েছে, তারা বুর্কিভকা শহরতলিতে পৌঁছেছে। ইউক্রেনীয়রা এখন রাশিয়ানদেরকে ভাসিলিভকার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা আরও কয়েক কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এবং এটা করা হলে রাশিয়ানদের পক্ষে ইউক্রেনের নতুন অবস্থানগুলি ঘিরে ফেলা কঠিন হবে। তবে ভাসিলিভকার আশেপাশে বাখমুতের উত্তরে ইউক্রেনের এই অর্জন সাকুল্যে মাত্র কয়েক কিলোমিটার, এবং ইউক্রেনীয়দের আসল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটা আসলে বাখমুতের উত্তরে নয়, বরং দক্ষিণে, ক্লিশিভকার আশপাশের এলাকায়। সেখানেও অবশ্য ইউক্রেইনের অর্জন কয়েক কিলোমিটারই, আর তারা এখনোও সেই ক্লিশিভকা সাবার্ব পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
তবুও, বাখমুতের চারপাশে ইউক্রেনের সাফল্য দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, জ্যাপরিঝিয়ার মতো ফ্রন্ট লাইনের অন্যান্য অংশে যা ঘটেছে তার সাথে এটি তুলনা করা উচিত, যেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য এগিয়ে যাওয়া বেশি কঠিন। কঠিন হবার প্রধান কারণ হল এখানে রাশিয়া গ্রামীণ যুদ্ধ বা রুরাল কম্ব্যাটের জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুত। যেমন তারা জ্যাপরিঝিয়ার ফিল্ডে মাইনিং করেছে, যা এই অঞ্চলে ইউক্রেইনের জন্য মেকানাইজড অফেন্স বা ট্যাংক বা আর্মার্ড ভেহিকল মতো মেশিন নিয়ে এখান দিয়ে আক্রমণ করাটা কঠিন করে তোলে এবং সেই সাথে গ্রামাঞ্চলে রাশিয়ার এয়ার সুপিরিয়রিটি বা বিমানশ্রেষ্ঠত্ব বেশি কার্যকর হয়. কেননা এখানে সৈন্য এবং ট্যাঙ্কগুলিকে খোলা জায়গায় খালি মাঠ অতিক্রম করতে হয়। আর তাই এই অঞ্চলগুলোতে ইউক্রেইনকে আক্রমণের দিক দিয়ে ধীর হতে হচ্ছে। সুতরাং এই ধীর যুদ্ধের সময়কালেও যদি ইউক্রেইন অন্তত বাখমুতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারে ও সেই সাফল্য বিশ্বকে, বিশেষ করে পশ্চিমকে দেখতে পারে, সেটা তাদের জন্য অনেক কিছু।
দ্বিতীয়ত, এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাখমুতের খুব বেশি কৌশলগত মূল্য না থাকলেও এর প্রতীকী মূল্য বা সিম্বোলিক ভেল্যুজ আছে বলেই এটি একটি এফেকটিভ প্রেশার পয়েন্ট। ইউক্রেনীয় বাহিনী যদি বাখমুত পুনরুদ্ধার করে তবে এর ফলে তারা যে ডনবাসে আরও ব্যাপক অগ্রগতির করবে মানে বেশি অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে [আরবে এমন সম্ভাবনা কম, কারণ এর খুব বেশি কৌশলগত মূল্য নেই। কিন্তু, এটি ক্রেমলিনের জন্য গভীরভাবে অপমানজনক হবে, যারা গত এক বছরে বাখমুতকে রাশিয়ার একমাত্র উল্লেখযোগ্য সামরিক সাফল্য হিসাবে অভিহিত করেছে। আর এজন্যেও বাখমুতে ইউক্রেইনের সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রেইন ডিল থেকে রাশিয়ার সরে আসা
১৭ই জুলাই, সোমবার রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ বা শস্য উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে আসে। উল্লেখ্য, এই গ্রেইন ডিল ছিল জাতিসংঘ এবং তুরস্কের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি যা কৃষ্ণ সাগরের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় শস্য রফতানির অনুমতি দেয়। এরকমটা যে হবে তা একেবারে বিস্ময়কর কিছু ছিল না, ক্রেমলিন গত অক্টোবর থেকে চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে অভিযোগ করে আসছিল, আর এটি অবশ্যই বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি দুঃসংবাদ। তো প্রশ্ন হচ্ছে, পুতিন কেন এই গ্রেইন ডিল থেকে সরে এলেন, এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে।
চুক্তিটির সংক্ষিপ্ত ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়েই শুরু করা যাক। যুদ্ধের আগে, ইউক্রেন বিশ্বের বৃহত্তম কৃষি উত্পাদনকারীদের মধ্যে একটি ছিল, এর ডাক নাম ছিল “ইউরোপের রুটির ঝুড়ি”। এর কারণ হচ্ছে, রাশিয়াকে বাদ দিলে ইউক্রেইনেরই রয়েছে সমস্ত ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদযোগ্য জমি। যুদ্ধের আগে, ইউক্রেনের খাদ্য রফতানি প্রায় ৪০০ মিলিয়ন লোককে খাওয়ানোর জন্য ক্যালোরি সরবরাহ করতো, এই রফতানি ছিল বিশ্বের গমের ১০%, ভুট্টার ১৬%, এবং সূর্যমুখী তেলের প্রায় ৫০%। এখন ইউরোপের মানচিত্র দেখে আপনি মনে করতেই পারেন যে, দেশটি তার খাদ্যশস্যের বেশিরভাগ ইউরোপে রফতানি করে, কেননা ইউক্রেনের সাথে চারটি ইইউ রাষ্ট্রের বর্ডার আছে, সেই সাথে দেশটির সাথে ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের সাথে খুব ভাল রেইল ও সড়ক সংযোগ রয়েছে। কিন্তু কাহিনী হলো, ইইউ এর প্রটেকটিভ এগ্রিকালচারাল পলিসি সহ বেশ কিছু কারণে ইউক্রেইন আসলে এর বেশিরভাগ শস্য উত্তর আফ্রিকায় রফতানি করে। আর সেটা হয় কৃষ্ণসাগর হয়ে, বিশেষ করে ইউক্রেইনের ওডেসা থেকে। উল্লেখ্য, ওডেসা থেকেই দেশটির ৯৮% গম রফতানি হয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় রাশিয়ান নৌবাহিনী কৃষ্ণ সাগর অবরোধ করায় ইউক্রেনীয় কৃষকরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল এবং ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী রাশিয়ার নৌ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বন্দরের ভিতরে এবং বাইরে যাওয়ার পথগুলিতে মাইন পুঁতে রেখেছিল। যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাসে, রফতানি ৭৫% হ্রাস পেয়েছিল, এবং এপ্রিলের মধ্যে, দেশে প্রায় ২০ মিলিয়ন টন উত্পাদন আটকে যায়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, যা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলির জন্য বিশেষ ভাবে খারাপ খবর ছিল, কেননা তারা কৃষ্ণ সাগরের মাধ্যমে ইউক্রেনের রফতানির উপর নির্ভরশীল ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এটি বিশ্বের দক্ষিণের অনেক দরিদ্র দেশকে বিরক্ত করেছে, যাদেরকে রাশিয়া যুদ্ধের পক্ষে রাখার চেষ্টা করছিল। রাশিয়া দ্রুত বুঝতে পেরেছিল যে তাদের সম্ভাব্য মিত্রদের ক্ষুধার্ত করাটা ঠিক হবেনা। তাই গত বছরের জুলাই মাসে তুরস্ক ও জাতিসংঘের সহায়তায় ইউক্রেন ও রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর শস্য উদ্যোগ বা গ্রেইন ইনিশিয়েটিভের বিষয়ে একমত হয়। এই উদ্যোগটি মূলত ইউক্রেনীয় কৃষকদের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের তিনটি বন্দরের মাধ্যমে তাদের শস্য রফতানি করার অনুমতি দেয়। চুক্তি অনুসারে, এই বন্দরগুলি থেকে আসা এবং যাওয়া জাহাজগুলি তুর্কি কর্তৃপক্ষের দ্বারা তুর্কি প্রণালীতে চেকিংয়ের অধীনে থাকবে, যারা নিশ্চিত করেছিল যে তারা অস্ত্র রফতানি বা আমদানির জন্য জাহাজগুলি ব্যবহার করবে না।
চুক্তিটি দুর্দান্তভাবে সফল হয়। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে, ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরের মাধ্যমে যুদ্ধ-পূর্ব সময়কালের মতো প্রায় একই পরিমাণ শস্য রফতানি করেছিল, যদিও ইউক্রেনীয় কৃষকরা ইতিমধ্যে তাদের কিছু পণ্য তার ইইউ প্রতিবেশী এবং দানিউব নদীর মাধ্যমে রফতানি করার জন্য রিডিরেক্ট করে ফেলে (কেননা ইউক্রেইনও কৃষ্ণসাগরের ওপর তাদের রফতানি নির্ভশীলতা কমিয়ে ফেলতে চায়)। সব মিলিয়ে ইউক্রেন এই চুক্তির আওতায় ৩৩ মিলিয়ন টন পণ্য রফতানি করেছে, যার বেশিরভাগই ভুট্টা এবং গম। আর এটি কেবল ইউক্রেনকেই সহায়তাই করেনি বরং জাতিসংঘের খাদ্য মূল্য সূচক অনুসারে গত বছর খাদ্যের দামকে তাদের উচ্চতা থেকে নামিয়ে আনতেও সহায়তা করেছে। শস্য চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এক বছরে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ৩৩% এর মতো হ্রাস পেয়েছে, যার মূল কারণ ছিল ভোজ্য তেলের দামের তীব্র পতন, যেখানে ভোজ্য তেল ইউক্রেইনের অন্যতম প্রধান রফতানি ছিলই না।
তবে গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া এই চুক্তি নিয়ে অভিযোগ করে আসছে এবং চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে আসছে। এখানে রাশিয়ার প্রধান অভিযোগ ছিল নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংকসন নিয়ে। রাশিয়া দাবি করে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন স্যাঙ্কশনগুলো রাশিয়ার জন্য কৃষ্ণ সাগরের মাধ্যমে তার কৃষিপণ্য, বিশেষত সার রফতানি করা কঠিন করে তুলছে (যদিও পশ্চিমা পদক্ষেপগুলোতে রাশিয়ার খাদ্য এবং সারের জন্য ছাড় দেয়া হয়েছে)। ক্রেমলিনের যুক্তি হচ্ছে , সুইফট ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বহিষ্কৃত রুশ নাগরিক এবং এর রাষ্ট্রীয় কৃষি ব্যাংককে লক্ষ্য করে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো এখনো তাদের রফতানিতে বাধার সৃষ্টি করছে।
এখন, জাতিসংঘ এবং ইইউ এই উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে ব্যাংকে একটি নতুন বিশেষ ইউনিটের মাধ্যমে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, তবে রাশিয়া বলেছে যে এটি যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, পুতিন আরও যুক্তি দিয়েছি বলেন, এমনকি শস্যগুলো সঠিক জায়গায় যাচ্ছে না। তবে এটি সত্য যে কৃষ্ণ সাগরের রফতানির প্রায় অর্ধেক উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে প্রেরণ করা হয়েছে, কারণ খাদ্য একটি বৈশ্বিক শিল্প, বিশ্বব্যাপী সরবরাহের যে কোনও রকমের বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী ব্যয় হ্রাস করবে, এ কারণেই জাতিসংঘ এই চুক্তিটিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি লাইফলাইন হিসাবে বর্ণনা করেছে।
যাই হোক, পুতিনের উদ্বেগ সত্ত্বেও রাশিয়া এর আগে দু’বার এই চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার পুতিন বলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে’ এবং রাশিয়া সোমবার চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। এখন, রাশিয়ার পূর্ববর্তী অভিযোগের কারণে এবং ইউক্রেন আপাতদৃষ্টিতে একই দিনে ক্রিমিয়ার সেতুটিতে বিস্ফোরণ করেছে বলে রাশিয়ার এই চুক্তিটির মেয়াদ বাড়ানোতে অস্বীকারের ব্যাপারটা খুব বেশি বিস্ময়কর নয়। তবে ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা এটার জন্য রাশিয়াকে সমালোচনা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেছেন। ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন একে নিন্দনীয় পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং জাতিসংঘ প্রধান বলেছেন, তিনি রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের জন্য গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। রাশিয়ার জন্য আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এমনকি চীনও পুতিনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছে, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা প্রকাশ করেছে যে চুক্তিটি অব্যাহত থাকবে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী হবে? প্রথমে যে জিনিসটি বলতে হবে, তা হচ্ছে, এটি কেবলই একটি ব্লাফ বা ভাওতা হতে পারে। অদূর ভবিষ্যতেই রাশিয়া চুক্তিতে ফিরে আসতে পারে। গত নভেম্বরের শুরুতে রাশিয়া ৪৮ ঘণ্টার জন্য চুক্তি থেকে সরে আসার পর এরদোয়ান পুতিনকে চুক্তিতে ফিরে আসার জন্য চাপ প্রয়োগ করে সফল হন। তবে সুসংবাদটি হ’ল, পুতিন যদি এবার আসলেই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন, তবে এটি আগের মতো, মানে রাশিয়ার আক্রমণের সূচনার সময়ের মতো বিশ্বব্যাপী খাদ্য-মূল্যের উপর তীব্র প্রভাব ফেলবে না। এটা ঠিক যে, এই ঘটনার সাথে সাথে খাদ্য দ্রব্যের দাম কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু রাশিয়া চুক্তিটি থেকে সরে আসার আগেই গমের দাম কয়েক শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। আর রাশিয়া সরে আসার আগেই চুক্তিটি তার কার্যকারিতা একরকম হারিয়ে ফেলেছিল। কেন? কারণ রাশিয়ান নৌবাহিনী তাদের পরিদর্শন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছিল, তাদের ইন্সপেকশন বা পরিদর্শন বেশি বেশি সময় নিয়ে হচ্ছিল, বেশি বেশি পরিমাণে হচ্ছিল। আর এর ফলে চুক্তিতে যে ৩টি বন্দর থেকে রফতানি হবার কথা ছিল তার একটি থেকে রফতানি বন্ধই হয়ে যায়। এর ফলে কৃষ্ণ সাগর থেকে রফতানির জন্য যাওয়া জাহাজের সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় একটি করে হ্রাস পেয়েছে, মে মাসে রফতানি হয়েছে মাত্র ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন শস্য, এবং চুক্তির অধীনে কোনও নতুন জাহাজকেই নিবন্ধিত করা হয়নি হয়নি। ফলে কৃষ্ণসাগর দিয়ে রফতানির পরিবর্তে ইউক্রেনীয় কৃষকরা দানিউব নদীর মধ্যে দিয়ে তাদের ইইউ প্রতিবেশীদের কাছে তাদের শস্য রফতানি করতে শুরু করেছে। আর তাই রাশিয়ার এই চুক্তি থেকে সরে আসাটা তেমন কোন পরিবর্তন আনবে না, কেবল এখন যা চলছে, মানে এখন যেভাবে ইউক্রেইন আফ্রিকার দেশগুলির বদলে ইইউ এর দেশগুলোতে শস্য রফতানি করছে, সেটাই বৃদ্ধি পাবে। ক্ষতিটা কেবল গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলোর হবে, আর তাতে রাশিয়ারই ক্ষতি, কারণ এরফলে এইসব দেশ রাশিয়ার ওপর অসন্তুষ্ট হবে।
আর তাই বোঝা যাচ্ছে যে, রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হল পুতিনের অগ্রাধিকার বা প্রায়োরিটি। আগে পুতিন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন কারণ তিনি গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণকে নিজের পক্ষে রাখতে চেয়েছিলেন। এখন তার চুক্তিটি থেকে সরে আসা নির্দেশ করছে যে তিনি আর সেটা নিয়ে চিন্তিত নন, তিনি বিশ্বে তার ভাবমূর্তি বজায় রাখার ব্যাপারেও আর চিন্তিত নন। আর তার চিন্তিত না হবার পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে – এক. তিনি স্বীকার করছেন যে, আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে গেছেন, আর দুই. তিনি যে কোনও উপায়ে ইউক্রেনকে পরাজিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, আর সেজন্য এখন তিনি ইউক্রেনে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ হ্রাস করতে ইচ্ছুক, তাতে বিশ্বে তার ভাবমূর্তি যতই নষ্ট হোক না কেন।
তথ্যসূত্র
কার্চ সেতুতে ইউক্রেইনের বিস্ফোরণ
1 – https://twitter.com/Tendar/status/1680784369860870149?s=20
2 – https://www.theguardian.com/world/live/2023/jul/17/russia-ukraine-war-live-crimean-bridge-emergency-traffic-stops-explosion?page=with:block-64b4cd408f080a06e3061160&filterKeyEvents=false
3 – https://www.ft.com/content/4efddb55-010e-4e91-92ad-61afd54abd68
4 – https://www.ft.com/content/4351d5b0-0888-4b47-9368-6bc4dfbccbf5
5 – https://www.economist.com/europe/2023/06/09/ukraines-assault-in-zaporizhia-may-be-the-focus-of-its-offensive
6 – https://www.aljazeera.com/news/2022/10/9/who-is-surovikin-the-russian-commander-for-the-war-in-ukraine
ইউক্রেইনের ধীর গতির কৌশল কিন্তু বাখমুতে সাফল্য
1 – https://www.nytimes.com/2023/07/15/us/politics/ukraine-leopards-bradleys-counteroffensive.html
2 – https://www.theguardian.com/world/2023/jul/13/us-cluster-bombs-arrive-ukraine
3 – https://twitter.com/NOELreports/status/1678517000463589376/photo/1
4 – https://twitter.com/TheStudyofWar/status/1681504140931768320
5 – https://www.politico.eu/article/russia-troops-kharkiv-kyiv-ukraine-war-kupiansk
6 – https://twitter.com/Maks_NAFO_FELLA/status/1609850386629771265/photo/1
7 – https://twitter.com/NOELreports/status/1674329533497896960?s=20
8 – https://twitter.com/wartranslated/status/1680533457385013248
গ্রেইন ডিল থেকে রাশিয়ার সরে আসা
1 – https://www.economist.com/leaders/2022/05/19/the-coming-food-catastrophe
2 – https://www.economist.com/the-economist-explains/2022/06/27/where-will-ukraine-store-its-grain
3 – https://www.economist.com/briefing/2022/05/19/a-world-grain-shortage-puts-tens-of-millions-at-risk
4 – https://theconversation.com/how-the-war-in-ukraine-will-affect-food-prices-178693
5 – https://www.aljazeera.com/news/2023/7/17/as-russia-exits-grain-deal-which-countries-will-be-affected
6 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-07-17/ukraine-grain-deal-collapses-as-russia-refuses-to-extend-it
7 – https://www.fao.org/worldfoodsituation/foodpricesindex/en/
8 – https://www.fao.org/worldfoodsituation/foodpricesindex/en/
9 – https://www.zerohedge.com/commodities/russia-terminates-black-sea-grain-deal-wheat-prices-spike-extent-crimea-bridge
10 – https://twitter.com/NOELreports/status/1680908984604131328
11 – https://www.ft.com/content/c0c62c3c-54fa-49c7-9d5c-53deb91bf989
12 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-07-17/ukraine-grain-deal-collapses-as-russia-refuses-to-extend-it
13 –https://www.reuters.com/markets/commodities/ukraine-says-russia-has-blocked-black-sea-grain-export-deal-again-2023-06-01/
14 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-07-06/as-ukraine-grain-deadline-approaches-pact-is-already-broken
Leave a Reply