বছরের শুরুতে দেখে মনে হচ্ছিল, মহামারী-পরবর্তী সময়ে চীনের অর্থনীতি প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল ডিফল্টের ঝামেলায় থাকা প্রপার্টি মার্কেটে আবাসন বিক্রয় আশাব্যঞ্জকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দুর্বল বৈশ্বিক চাহিদা সত্ত্বেও মার্চ মাসে চীনা রফতানি বেড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.৫%, বা আগের বছরের তুলনায় ২.২%। এটি বিশ্লেষকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ছিল, এবং এই স্ট্যাটিস্টিক্সগুলো ইঙ্গিত দেয় যে চীন এই বছরের জন্য সিসিপির ৫% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হতে পারে।
তবে চীনের সাম্প্রতিকতম অর্থনৈতিক তথ্য এই ন্যারেটিভের সত্যতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। যদিও এই ত্রৈমাসিকের শেষ পর্যন্ত দেশটির জিডিপি নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যাবেনা, তবে মে মাস নিয়ে গত সপ্তাহে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, এই বছরের শুরুর তুলনায় চীনের বিষয়গুলো ভাল যাচ্ছে না। চীনা ভোক্তারা কম ব্যয় করছে, চীনা কারখানাগুলি কম উত্পাদন করছে, এবং চীনের ঋণে জর্জরিত প্রপার্টি মার্কেট যা কিনা চীনের সমস্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ৩০% এর মতো তা আরেকটি মন্দার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই মন্দা চীনের যুব বেকারত্বের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং মে মাসে চীনের শহুরে যুব বেকারত্বের হার ২০.৮%-এ পৌঁছেছে, যা ২০১৮ সালে এ নিয়ে রেকর্ড করা শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক মন্দার প্রতিক্রিয়ায় গত সপ্তাহে পিপলস ব্যাংক অফ চায়না সুদের হার হ্রাস করেছে এবং অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার প্রয়াসে ব্যবসায়ের জন্য নতুন কর ছাড় উন্মোচন করেছে। এখন দেখতে হবে যে, এটি কতটা অস্বাভাবিক। বাকি বিশ্ব বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলার জন্য সুদের হার বাড়াচ্ছে, তবে চীনে চাহিদা এত দুর্বল যে তারা সম্প্রতি সক্রিয়ভাবে সুদের হার হ্রাস করছে। এই পদক্ষেপগুলি সত্ত্বেও, বিশ্লেষকরা এখনও আশাবাদী নয়, এবং গত সপ্তাহে মরগান স্ট্যানলি ঘোষণা করেছে যে তারা এখন আশা করছে, চীন দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কোনও প্রবৃদ্ধি দেখতে পাবে না। তাই এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে, চীনা অর্থনীতিতে কোথায় সমস্যা হয়েছে, এটি সম্পর্কে কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত এবং এটি ঠিক করার জন্য সিসিপি কী করতে পারে।
চীনে কোথায় সমস্যা হয়েছে?
সাম্প্রতিক ডেটা ইঙ্গিত দেয় যে চীনা অর্থনীতি তিনটি জায়গায় দুর্বলতার সম্মুখীন হচ্ছে: সম্পত্তি খাত বা প্রপার্টি সেক্টর, রফতানি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বা ডোমেস্টিক ডিমান্ড। সম্পত্তি খাত দিয়ে শুরু করা যাক। মূলত দেশটির অভূতপূর্ব মাত্রায় নগরায়নের জন্য ৮০’র দশকে চীনা বাড়ির দাম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। আরও বৃদ্ধির প্রত্যাশায় চীনের রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা ক্রমবর্ধমান পরিমাণে অর্থ ধার করেছিল এবং চীনা ক্রেতারা মূলত তাদের সমস্ত অর্থ আবাসনে ঢেলে দিয়েছিল। ওভার-লিভারেজড ডেভেলপার এবং আবাসনে অন্তহীন অনুমানমূলক বিনিয়োগের এই সংমিশ্রণটি শেষ পর্যন্ত একটি বিশাল প্রপার্টি বাবল তৈরি করেছিল। বড় চীনা শহরগুলিতে সম্পত্তির দাম ছিল মিডিয়ান স্যালারি, মানে দেশের মধ্যক বেতনের ৪০ গুণ, যার মানে হচ্ছে চীনের আবাসনের দাম হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে দামি আবাসন। আর বর্তমানে প্রপার্টি চীনের সকল হাউজহোল্ড ওয়েলথ বা পারিবারিক সম্পত্তির প্রায় ৭৫%, এবং চীনের সকল অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের প্রায় ৩০%।
তবে সিসিপি বুঝতে পেরেছিল যে চীনের প্রপার্টি মার্কেট বিপজ্জনকভাবে বড় বাবলি পরিণত হয়েছে এবং ২০২০ সালের শেষের দিকে তারা তথাকথিত ‘থ্রি রেড লাইন’ চালু করেছে যা মূলত চীনা ডেভেলপারদের ঋণের পরিমাণকে সীমাবদ্ধ করে। এর ফলে ওভার-লিভারেজড ডেভেলপাররা ডিফল্ট হতে শুরু করে, যেগুলোর মধ্যে বিশেষত এভারগ্র্যান্ড উল্লেখযোগ্য। তবে এতে বাড়ির দাম তেমন কমেনি। এই বছরের শুরুতে বাড়ির দাম বাড়তে পারে বলে মনে হলেও গত কয়েক মাসে প্রপার্টির দাম আবার কমতে শুরু করেছে। স্পষ্টতই, প্রপার্টি মার্কেটে মন্দা চীনের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের জন্য বিপর্যয়কর খবর, কারণ এটি সমস্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের প্রায় ৩০% এর প্রতিনিধিত্ব করে।
চীনের দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি। চীনের অর্থনীতি রফতানির উপর নির্ভরশীল। চীন মূলত অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় বিদেশে বেশি জিনিস বিক্রি করে, যা বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বা ট্রেড সারপ্লাসের একটি কারণ। স্পষ্টতই, মহামারীর সময় রফতানি হ্রাস পেয়েছিল যখন লকডাউনের কারণে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কম ছিল, এবং একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছিল, আর তা হল চীনের রফতানি কখনও প্রাক-মহামারী স্তরে ফিরে আসবে কিনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের বৃহত্তম রফতানি বাজার, সুতরাং তারা যদি সত্যিই চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তবে চীনের রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। তবে এই বছরের শুরুতে, সিসিপির জন্য ভাল সংবাদ আসতে থাকে। বিচ্ছিন্নতা বা ডিকাপলিং এর সমস্ত আলোচনা সত্ত্বেও মার্চ মাসে চীনের রফতানি প্রায় ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিসিপির জন্য এই উত্থানটি স্থায়ী হয়নি এবং মে মাসে রফতানি বছরে ৭.৫% হ্রাস পেয়েছে।
চীনের তৃতীয় এবং চূড়ান্ত দুর্বলতা হচ্ছে দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা। জিডিপি চারটি জিনিস নিয়ে গঠিত: বিনিয়োগ, সরকারী ব্যয়, নিট রফতানি এবং অভ্যন্তরীণ খরচ। চীনে ভোগ বা কনজাম্পশন চীনের জিডিপির প্রায় এক তৃতীয়াংশ, যা যে কোনও প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। বাস্তবে একজন গড়পড়তা চীনা ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে বেশি জিনিস কেনেন না বা গ্রহণ করেন না, বরং চীনা অর্থনীতির বেশিরভাগ চালিত হয় চীনা ব্যবসা দ্বারা যা বিদেশীদের কাছে তাদের জিনিস বিক্রি করে। আংশিকভাবে এর কারণ হচ্ছে, সিসিপি বা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয়ভাবে এমন নীতিগুলোকে উৎসাহিত করে যার ফলে দেশটির বিজনেসগুলিকে তাদের কর্মীদের কম বেতন দেওয়ার সুযোগ দেয়, কারণ এর মাধ্যমে চীনের রফতানি আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে এবং সিসিপি কৌশলগত কারণে চীনা রফতানির উপর নির্ভরশীল অন্যান্য দেশকে পছন্দ করে।
তবে গত এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে, সিসিপি তাদের বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ ভোগ বা ডোমেস্টিক কনজাম্পশন বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছে, যাতে চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার একদিন চীনা ব্যবসায়ের জন্য পর্যাপ্ত কনজিউমার বেস সরবরাহ করতে পারে যা বর্তমানে বিদেশী বাজারে রফতানির উপর নির্ভরশীল। যাই হোক, যদিও মনে হচ্ছিল যে এই বছরের শুরুতে জিনিসগুলি ভাল চলছে, মে মাসে দেশটির ইয়ার অন ইয়ার রিটেইল সেল বা ইয়ার অন ইয়ার খুচরা বিক্রয় (যা অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে সবচেয়ে ভালভাবে রিপ্রেজেন্ট করে) এপ্রিলের ১৮.৪% থেকে ১২.৭%-এ হ্রাস পেয়েছে।
সমস্যাগুলো কতটা উদ্বেগের ও সিসিপি কী করতে পারে?
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, চীনা অর্থনীতি কমপক্ষে তিনটি দিক দিয়ে সমস্যায় আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী হবে? সুদের হার কমানো এবং ঋণ প্রদানকে শিথিলতর বা সহজ করার ব্যাপারটা দেশটির ইকোনোমিক কিছুটা চাঙ্গা করতে পারে, কিন্তু এর কোন সহজ উত্তর নেই। প্রপার্টি সেক্টর এমন একটি বাবল যাকে দিফ্লেটিং করা প্রয়োজন। আর এখানে আরো স্টিমুলাস দিলে তা অল্প কিছুদিনের জন্য সমস্যা এড়িয়ে রাখলেও তা কেবল অনিবার্য যন্ত্রণার আগমনকে পিছিয়ে দেবে, নির্মূল করবে না। একইভাবে, রফতানি সম্পর্কে সিসিপির বেশি কিছু করার নেই, কেননা এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে চীনের এক্সপোর্ট মার্কেট ইউএস ও ইউকে এর মতো পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তি ও এরা কতটা চীন থেকে বিচ্ছন্নতা বা ডিকাপলিং চায় বা ঝুঁকিমুক্ত হতে চায় – এরমকম ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টরগুলোর ওপর।
পরিশেষে, যদিও সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং পদক্ষেপগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, চীন তার অর্থনীতিকে ভোগ বা কনজাম্পশনের দিকে রিব্যালেন্স করতে চাইলেও তা সহজ হবে না এবং এর জন্য চীনের অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-04-13/chinese-exports-unexpectedly-rise-in-positive-sign-for-economy
2 – https://www.ft.com/content/e2aaaa56-5dee-41be-9ed4-181496de6bf3
3 – https://www.researchgate.net/publication/277941900_Household_Wealth_in_China
4 – https://www.cnbc.com/2021/11/09/chinas-property-market-debt-an-issue-for-the-economy-george-magnus.html
5 – https://www.economist.com/finance-and-economics/2023/06/18/chinas-economy-is-on-course-for-a-double-dip
6 – https://www.statista.com/statistics/256642/the-20-countries-with-the-highest-trade-surplus/
7 – https://www.ft.com/content/0ae934ac-29c6-4ac0-aea2-a33e9388f47e
8 – https://jobenomics.com/consumption-based-economy/
9 – https://www.ft.com/content/7925920c-2f76-4452-ba26-b66d5bdefd51
Leave a Reply