কী হচ্ছে?
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর মতে, ফ্রান্সে বর্তমান রায়ট বা দাঙ্গার মাত্রা আনচার্টেড টেরিটোরিতে চলে গেছে, মানে এমন জায়গায় চলে গেছে যেখানে দেশটি আগে কখনো যায়নি। সেখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তা ইতিমধ্যে ২০০৫ সালের কুখ্যাত ফরাসি দাঙ্গার চেয়েও খারাপ। প্রায় ৫০০ টি সরকারী ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এক হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং শত শত পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ৪৫,০০০ পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে দুই পুলিশ কর্মকর্তা গুলি করে হত্যা করেছে – এমন খবরের কারণে দাঙ্গা শুরু হয়। কিশোরটি কিছু ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করার পরে একটি ট্র্যাফিক স্টপে এটি ঘটে। প্রাথমিকভাবে, কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন যে ছেলেটি সরাসরি অফিসারদের দিকে গাড়ি চালাচ্ছিল বলে তারা গুলি চালিয়েছিল, তবে পথচারীদের ধারণ করা ভিডিওগুলি পরিস্থিতিকে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখায়। এটি বর্তমানে ইন্টারনেটের সবচেয়ে পপুলার ভিডিও, তাই একটু খুঁজলেই আশা করি পেয়ে যাবেন। ক্লিপের প্রথম কয়েক সেকেন্ডে দেখা যাচ্ছে, ট্রাফিক স্টপে দু’জন অফিসার ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন চালকের দিকে অস্ত্র দেখিয়েছিলেন। রেকর্ডিং-এ একটা ভয়েস শোনা যায়, যেখানে বলা হয়, ‘তোমার মাথায় বুলেট আঘাত করবে।’ অফিসার যখন কথাটি বলেন, তখনই ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করে। এরপর সেই দুজনের মধ্যে একজন পুলিশ গাড়িটি চালনার সময় চালকের দিকে গুলি ছোড়েন। দুর্ঘটনার আগে গাড়িটি কয়েকশ ফুট পর্যন্ত চলতে থাকে। পরে জানা যায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে চালক নাহেল মারা যায়।
এই ঘটনাই দাঙ্গার জন্ম দিয়েছে। অনেকে এই দাঙ্গাকে ২০০৫ সালের সাথে তুলনা করেছেন, যখন ইলেক্ট্রিসিটি সাবস্টেশনে পুলিশের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকা দুই কিশোরের মৃত্যুর পরে সপ্তাহব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। যাই হোক, নাহেলের হত্যার ফলে প্যারিস, মার্সেল, লিওন, টুলুজ, স্ট্রাসবুর্গ ও লিলসহ ফ্রান্সের প্রধান শহরগুলোতে টানা কয়েক দিন ধরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ভবনগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং দোকানপাট লুট করা হয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখোমুখি হয়ে ফরাসি সরকার শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য নজিরবিহীন ৪৫,০০০ পুলিশ কর্মকর্তা মোতায়েন করেছে। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ২০১৮ সালে দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়া ইয়েলো ভেস্ট বিক্ষোভের পর সবচেয়ে গুরুতর নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
ম্যাক্রোঁ বলছেন, ‘আমাদের এক কিশোর কে হত্যা করা হয়েছে। এটা অবর্ণনীয়, ক্ষমার অযোগ্য। প্রথমত, আমি তার পরিবার এবং প্রিয়জনদের জন্য আমার দুঃখ ও সমর্থন প্রকাশ করতে চাই। দ্বিতীয়ত, মামলাটি তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে পাঠানো হয়। আমি আশা করি যে এটি এই কাজের জন্য যতটুকু দরকার শান্তভাবে কাজটি দ্রুত সম্পাদন করা হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হবে। এটা অবশ্যই আমাদের সবাইকে অবহিত করা হয়েছে এবং ন্যায়বিচার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে সিদ্ধান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা সহ কোনও পদক্ষেপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি।”
তবে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ রয়ে গেছে এবং ফ্রান্সের প্রধান শহরগুলির কেন্দ্রস্থলেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলন থেকে দুই দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় সংকট বৈঠকে যোগ দেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে সংবেদনশীল ভিডিওগুলি সরানোর এবং সহিংসতায় উস্কানি দেওয়া ব্যক্তিদের সনাক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। দাঙ্গা কেবল রাস্তায় প্রভাব ফেলেছে তা নয়, দৈনন্দিন জীবনকেও ব্যাহত করেছে। স্ট্যাড ডি ফ্রান্সে দুটি কনসার্ট সহ বিভিন্ন কনসার্ট এবং ইভেন্টগুলি বাতিল করা হয়েছে। এমনকি আসন্ন ট্যুর ডি ফ্রান্সের আয়োজকরা যে কোনও সম্ভাব্য বিঘ্নের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে উচ্চ সতর্কতায় রয়েছেন।
উত্তেজনা বাড়তে থাকায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেন্ট্রাল প্যারিস স্কয়ার প্লেস দে লা কনকর্ডে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দোকানপাট ভাংচুর করা হয়েছে এবং স্কুল ও টাউন হলসহ সরকারি ভবনে হামলা চালানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের ফ্রান্স-ভ্রমণকারী নাগরিকদের জন্য সতর্ক বার্তা জারি করেছে। জাতিসংঘ শান্তিপূর্ণ সমাবেশের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে এবং ফরাসি কর্তৃপক্ষকে পুলিশ কর্তৃক বৈষম্যহীন বা নন-ডিস্ক্রিমিনেটোরি বল প্রয়োগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
কেন হচ্ছে?
কিশোর-মৃত্যুই দাঙ্গার সূত্রপাত হলেও দাঙ্গার আসল কারণটি আরও গভীর। দাঙ্গার পিছনে প্রধান কারণ হ’ল ফ্রান্সে পুলিশের কৌশল নিয়ে বিস্তৃত ইস্যুতে মনোযোগ আকর্ষণ করা। যদিও প্রসিকিউটর ইতিমধ্যে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যানস্লটারের তদন্ত শুরু করেছেন, অনেকে বিশ্বাস করেন যে এই ঘটনার মূলে রয়েছে ফরাসি সমাজে বিদ্যমান গভীর সমস্যা। অভিযুক্ত অফিসার অবশ্য দাবি করেছেন যে ছেলেটি গাড়ি দিয়ে কাউকে চাপা দেবে এই ভয়ে তিনি গুলি ছুড়েছিলেন।
গত বছর রেকর্ড ১৩ জনের মৃত্যুর পর এ বছর পুলিশের ট্রাফিক স্টপেজে এটি তৃতীয় হত্যাকাণ্ড। নিহতদের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ বা আরব। এখন, ফরাসি সমাজে সমস্যার কারণটি সত্যিকার অর্থে বোঝার জন্য আমাদের ফ্রান্সের জনসংখ্যার দিকে নজর দিতে হবে। এই সমস্যাটিকে বুঝতে হলে আমাদের ফ্রান্সের জাতিগত ডেমোগ্রাফিককে বুঝতে হবে যাতে আমরা সত্যিই বুঝতে পারি যে আজ সেখানে কী ঘটছে।
ফরাসি বর্ণগত জনসংখ্যা বা রেশিয়াল ডেমোগ্রাফিক নিয়ে একটি সম্পূর্ণ চিত্র পেতে, আমাদের কিছুটা অতীতে যেতে হবে এবং ১৯২০ এর দশক থেকে শুরু করতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে, ফরাসি নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, কে যুদ্ধে জিতবে তা ঠিক করে দেবার ক্ষেত্রে জনসংখ্যার আকার একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে, কিন্তু ফ্রান্সের জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সুতরাং, নেতারা আরও বেশি জন্মকে উত্সাহিত করার মাধ্যমে এবং দেশকে অভিবাসনের জন্য উন্মুক্ত করার মাধ্যমে জনসংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এবং সেজন্য বিশাল চাপ প্ৰায়োগ করেছিলেন। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে হাজার হাজার পোলিশ, বেলজিয়ান এবং ইতালীয় ফ্রান্সে বসবাস করতে এসেছিল।
একইভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের বছরগুলির পরে, তীব্র শ্রম ঘাটতি শুরু হয়, আর তাই অভিবাসন আবার একটি উচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। কিন্তু এবার অভিবাসীরা এসেছিল উত্তর আফ্রিকা, বিশেষ করে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ আলজেরিয়া থেকে, এবং মরক্কো ও তিউনিসিয়ার প্রাক্তন প্রটেক্টরেট থেকে। মধ্য আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকার ফরাসি বা প্রাক্তন ফরাসি অঞ্চলগুলি থেকেও অভিবাসীরা ফ্রান্স এসেছিল।
প্রাথমিকভাবে, এই অভিবাসীদেরকে অস্থায়ী অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে দেখা হত। তবে ধীরে ধীরে এদেরকে ফ্রান্সে স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। অনেকে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে এবং পরিবার নিয়ে আসে বা ফ্রান্সে সন্তানের জন্ম দেয়। এটি ফ্রান্সকে একটি বহু-বর্ণগত বা মাল্টি-রেশিয়াল সমাজে রূপান্তরিত করেছে, যদিও অনেকেই অ-শ্বেতাঙ্গদেরকে অভিবাসী বা ইমিগ্রেন্ট হিসাবে উল্লেখ করতে থাকে, সে তারা ফ্রান্সেই জন্মগ্রহণ করুক বা অন্য কোথাও জন্মগ্রহণ করুক।
এখানেই একটি ইউনিক ফরাসি আইন প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, যেটা সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করা দরকার। অন্যান্য অনেক পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো ইংরেজিভাষী অভিবাসী সমাজে বর্ণ-সচেতন নীতি বা রেইস-কনসার্ন পলিসিগুলোর বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স সেই দিকে যায়নি। দেশটি ইচ্ছাকৃতভাবে রেইস-কনসার্ন পলিসিগুলোর বাস্তবায়ন এড়িয়ে গেছে। ফ্রান্সে রেইস বা বর্ণ নিয়ে এমন কোনও সরকারী নীতি নেই যা রেইস বা বর্ণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত গোষ্ঠীগুলোর সুবিধাগুলোকে টার্গেট করবে বা এগুলোকে স্বীকৃতি দেবে। অনেক ফরাসিদের জন্য, ‘রেইস’ শব্দটি তাদের মেরুদণ্ডে কাঁপুনির সৃষ্টি করে, কারণ এটি তাদের নাৎসি জার্মানির নৃশংসতা এবং ইহুদিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্বাসনে ফ্রান্সের ভিচি শাসনের (Vichy regime) জড়িত থাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। দেশটিতে “রেইস” এমন একটি ট্যাবু শব্দ, যার জন্য ১৯৭৮ সালে একটি আইন তৈরি হয়েছিল, যে আইনের মাধ্যমে ইন্টারভিউইদের স্পষ্ট সম্মতি বা কোনও স্টেইট কমিটির অনুমতি ব্যতীত রেইস বা বর্ণ-ভিত্তিক ডেটা সংগ্রহ এবং এর কম্পিউটারাইজড স্টোরেজ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অতএব, ফ্রান্স তার নাগরিকদের বর্ণ বা এথনিসিটি সম্পর্কে কোনও রকম তথ্য সংগ্রহ করেন।
এর অর্থ হ’ল আজ, ফ্রান্স একটি জাতিগতবৈচিত্র্যময় দেশ, তবে এর নেতাদের কাছে সেই বৈচিত্র্য সম্পর্কে খুব বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। আর যথেষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত নেই বলেই ফ্রান্সের নেতারা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আরও শিক্ষিত হতে এবং তাদের উপার্জনের সম্ভাবনা বাড়াতে সহায়তা করার জন্য দেশের রিসোর্স বা সম্পদকে যথাযথ উপায়ে বণ্টন করা নিশ্চিত করতে সক্ষম হননি। সাধারণত, এই নন-এথনিক ফরাসিরা, যারা এথনিক ফরাসিদের মতো স্বচ্ছল ভাল নয় তারা সকলেই এথনিক-ফরাসিদের থেকে দূরে শহরের বাইরে সাব-আরবান এলাকায় একত্রিত হয়। (এটি সম্পর্কে আগের একটি পোস্টেও লিখেছি)। উচ্চ অপরাধের হারের কারণে এই সাব-আরবান অঞ্চলে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর উপস্থিতি সাধারণত বেশি থাকে, যার ফলে এই এলাকাগুলোর বাসিন্দারা পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি অবন্ধুত্বপূর্ণ বা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। এবং এর ফলে এখানকার বাসিন্দাদের এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এরকম সহিংসতার ঘটনাগুলোও বেশি করে ঘটছে।
Leave a Reply