ওয়াগনার বিদ্রোহের চেষ্টা পুতিনের পক্ষে ভাল ছিল না। তিনি কেবল কয়েক হাজার প্রিজনার সহ একজন “লুনাটিক শেফের” দ্বারা প্রায় ক্ষমতাচ্যুতই হননি, সেই সাথে বেলারুশের প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো তাকে একটি চুক্তির মাধ্যমে জামিন দিয়েছিলেন যার ফলে মূলত ওয়াগনার গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিনকে কোনোরকম বিচার ছাড়াই ছেড়ে দিতে হয়, যেখানে সেই প্রেগোজিন একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের তত্ত্বাবধান করেছিলেন এবং বেশ কয়েকটি রাশিয়ান হেলিকপ্টার ভূপতিত করেছিলেন। তাই প্রশ্ন আসছে এই বিদ্রোহ রাশিয়ায় পুতিনের কর্তৃত্বে কী প্রভাব ফেলছে, কেন পুতিনের জন্য পরিস্থিতি কেবল আরও খারাপ হতে চলেছে এবং এটি সত্যিই এটি তার জন্য শেষের শুরু হতে পারে কিনা। উত্তর খোঁজা যাক…
এই সমস্ত কিছু পুতিনের কর্তৃত্বকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা জানার আগে, এটি তার উপর সমর্থন সম্পর্কে আমাদের কী বলে তা দিয়ে শুরু করা যাক। রাশিয়ার কোনো পর্যবেক্ষক স্বীকার করেন না যে, তিনি নির্বাচনে কারচুপি করলেও পুতিন রাশিয়ায় সত্যিকার অর্থেই অজনপ্রিয়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং সম্ভবত একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য পোলিং সংস্থা হিসাবে বিবেচিত হওয়া লেভাদা সেন্টার পুতিনের পার্সোনাল এপ্রুভাল রেটিংকে পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ ৮২% শতাংশে রাখে, যেখানে মাত্র ১৪% রাশিয়ান তাকে অপছন্দ করে।
এখন, যদি আমরা এই নাম্বারগুলোকে যদি একটু সন্দেহের চোখেও দেখি, তাও এটা বলা বেশ নিরাপদ হবে যে বেশিরভাগ রাশিয়ান পুতিনের নেতৃত্বকে সমর্থন করে এবং তার ক্ষমতার বেশিরভাগ সময়, ডেটা ইঙ্গিত দেয় যে রাশিয়ানরা পুতিনকে সত্যিকার অর্থে সমর্থন করেছে। আর এক অর্থে, এটি আশ্চর্যজনক নয়। তিনি তেলের ক্রমবর্ধমান দামের বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন, যার ফলে ৯০ এর দশকের অর্থনৈতিক সংকটের পরে তিনি রাশিয়ার পুনর্গঠনে অর্থায়ন করতে এবং নিজেকে একজন দক্ষ টেকনোক্র্যাট হিসাবে চিত্রিত করার সুযোগ পান। তবে এটা তার সৌভাগ্য ছিল যে তিনি এমন এক সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন যখন তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অন্যদিকে মিখাইল গর্ভাচেভ ছিলেন দুর্ভাগ্যবান যার টাইমে তেলের দাম কমে যায়। পুতিনের এরকম জনপ্রিয়তার পেছনে আরও একটি সহায়ক ফ্যাক্টর হচ্ছে এই যে, তার মিডিয়ার উপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাগারে পাঠানোর অভ্যাস রয়েছে।
যাইহোক, ওয়াগনার অভ্যুত্থানের চেষ্টা, এবং বিশেষত রোস্তোভে রাশিয়ান নাগরিকদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি বেশ ইন্টারেস্টিং কেননা এটি ইঙ্গিত দেয় যে রাশিয়ায় পুতিনের ব্যাপক সমর্থন থাকতে পারে, কিন্তু তবুও তার সমর্থন কম। এর দ্বারা যেটা বোঝাতে চাইছি সেটা হ’ল বেশিরভাগ রাশিয়ানরা মনে করে যে তিনি ঠিকঠাক কাজ করছেন, কিন্তু তারা স্পষ্টতই তাকে খুব বেশি পছন্দ করে না। এই কারণেই ওয়াগনারকে মূলত কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই এক মিলিয়নেরও বেশি রুশ জনসংখ্যার একটি শহরে আকস্মিকভাবে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। রাশিয়ানরা মনে করে পুতিন ঠিকাছে, কিন্তু তারা তার পক্ষে লড়াই করার জন্য তাকে যথেষ্ট পরিমাণে পছন্দ করে না।
এর সাথে ২০১৬ সালে তুরস্কে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার তুলনা করা যায়। তুরস্কে সেনাবাহিনী যখন এরদোয়ানকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল, তখন হাজার হাজার নাগরিক তাদের প্রতিহত করার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল। এখন, স্পষ্টতই, এই তুর্কিরা কেবল এরদোয়ানকে রক্ষা করার জন্য সেখানে আসেনি, তারা তুর্কি গণতন্ত্রকেও রক্ষা করছিল এবং তুরস্কে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বা পলিটিকাল পার্টিসিপেশনের ইতিহাস রয়েছে যা রাশিয়ার নেই, কিন্তু তবুও, জনগণের প্রতিক্রিয়ার এই পার্থক্যটি লক্ষণীয়। রোস্তোভের নাগরিকরা যে কেবল কোনও প্রতিরোধই করেনি তা নয়, সেই সাথে শনিবার সন্ধ্যার ভিডিওগুলিতে দেখা যাচ্ছে, তারা আসলে ওয়াগনারকে চিয়ার করছিল, তাদের নিয়ে উল্লাস করছিল, আর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে বিদ্রূপ করছিল। তবে একটি ডেটাপয়েন্ট মাত্র, তবুও এর থেকে পুতিনের প্রতি রাশিয়ার সাধারণ জনতার মতামত সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এবং এক অর্থে, এটিও বিস্ময়করই বটে।
পুতিন একজন দক্ষ টেকনোক্র্যাট হিসাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং টেকনোক্র্যাটরা খুব কমই সেভাবে আগ্রহের সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তিনি রাশিয়ার জনগণকে ব্যাখ্যা করার জন্যও রীতিমত লড়াই করেছেন যে কেন তাদের ইউক্রেন সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। তিনি ক্রমাগত রাশিয়ায় আক্রমণকে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসাবে উল্লেখ করে এর গুরুত্বকে উপেক্ষা করছেন এবং রাশিয়া কেন ইউক্রেনে রয়েছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি লক্ষ লক্ষ কারণ দিয়েছেন, যেমন নভো রাশিয়া পুনরুদ্ধার করা, ডনবাসে রাশিয়ান ভাষাভাষীদের রক্ষা করা, ন্যাটো সম্প্রসারণকে প্রতিরোধ করা, আমেরিকান একমেরুত্বের অবসান ঘটানো, আইকিয়াকে (IKEA) নিন্দা করা, ইউক্রেনীয় স্যাটানিস্ট বা শয়তানবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, এবং সর্বোপরি, তিনি এমনকি দাবি করেছেন যে রাশিয়া ইউক্রেনে ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ান সংস্কৃতিকে এলজিবিটিকিউ+ অধিকার দ্বারা মুছে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা। এখন, এই সমস্ত বাগাড়ম্বর সাধারণ রাশিয়ানদের পক্ষে পুতিন বা ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ পিছনে দাঁড়ানো কঠিন করে তোলে। শেষ পর্যন্ত তারা জানে না যে এটি আসলে কতটা গুরুতর বা এটি আসলে কী নিয়ে। ইউক্রেন নিয়ে ক্রেমলিনের বিভ্রান্তিকর জনসংযোগ এমন একটি বিষয় যা নিয়ে রুশ জাতীয়তাবাদীরা কয়েক মাস ধরে ক্ষুব্ধ।
ওয়াগনারের অভ্যুত্থান কেবল তিনটি প্রধান কারণে পুতিনকে আরও দুর্বল করতে চলেছে –
১. প্রথমত, স্পষ্টতই, পুরো বিষয়টি তাকে সত্যিই দুর্বল দেখায়। কয়েক হাজার অপরাধী সহ প্রিয়জিন কেবল তাকে প্রায় ক্ষমতাচ্যুতই করেননি, একই সাথে মিত্র লুকাশেঙ্কোর কাছ থেকে একটি চুক্তির মাধ্যমে তাকে এদেরকে অব্যাহতি দিতে হয়েছিল যা আক্ষরিক অর্থে ওয়াগনার এবং প্রিগোজিনকে নির্বিঘ্নে চলে যাবার সুযোগ করে দেয়, যেখানে তারা কেবল ক্রেমলিনকে উৎখাত করার হুমকিই দেয়নি, সেইসাথে বেশ কয়েকটি এয়ারক্রাফটকেও ভূপতিত করেছিল। এ কারণেই হয়তো সোমবার বিকেল পর্যন্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, প্রিগোজিনকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দায়ে অভিযুক্ত করা হবে, যার সর্বোচ্চ সাজা হবে ২০ বছর। পুতিন হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে প্রিগোজিনকে চলে যেতে দেওয়া তাকে অবিশ্বাস্যভাবে দুর্বল দেখায় এবং ক্রেমলিন যদি সত্যিই তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে তবে প্রিগোজিন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান তা দেখতে ইন্টারেস্টিং-ই হবে।
২. দ্বিতীয় বিষয়টি হল যে এই পর্বটি রাশিয়ানদের যুদ্ধকে কীভাবে দেখতে হবে তা পরিবর্তন করবে। রাশিয়ানদের সাধারণত যুদ্ধপন্থী হওয়া, মানে ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে থাকার অন্যতম কারণ এই যে, এখনও পর্যন্ত তারা মূলত এর প্রভাব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল। একটি যুদ্ধকে সমর্থন করা সহজ যখন আপনি কেবল টিভিতে এটি সম্পর্কে শোনেন, যেখানে রাষ্ট্রীয় মিডিয়া আপনাকে বলে যে আপনার দেশ মাদকাসক্ত, নাৎসি, স্যাটানিস্টদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত কাজ করছে। কিন্তু মস্কোর ওপর এই অভিযান এবং ইউক্রেনপন্থী গোষ্ঠীগুলোর রাশিয়ার বেলগোরদ ওব্লাস্টে নিয়মিত অনুপ্রবেশের অর্থ হচ্ছে, সাধারণ রুশরা এখন যুদ্ধকে এমনভাবে অনুভব করছে যা তারা আগে কখনো অনুভব করেনি। ইউক্রেনের হাই কমান্ড গত বছর থেকে যুদ্ধকে সাধারণ রাশিয়ানদের খুব কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং এটি পুতিনের উপর আরও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে যাতে যুদ্ধটি কোনওভাবে শেষ করা যায়, হয় তা উত্তেজনা বাড়িয়ে বা শান্তি প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
৩. তৃতীয় ইস্যুটি হ’ল ওয়াগনারের কার্যকর বিলুপ্তি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর আক্রমণাত্মক সম্ভাবনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে, যার অর্থ পুতিন যদি সত্যিই ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো দখল করতে চান তবে সম্ভবত আরও একটি ওয়েভের মোবিলাইজেশনের প্রয়োজন হবে। পুতিন এখন পর্যন্ত এটি করা থেকে বিরত রয়েছেন, সম্ভবত এই কারণে যে রাশিয়ান জনগণের মধ্যে তার সমর্থন কম, যার অর্থ হ’ল আরেকটি সমাবেশের জন্য সমর্থনও কম থাকবে। কিন্তু ওয়াগনারের বিলুপ্তি তাকে এক্ষেত্রে তার অপশনও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আবার, এটি পুতিনের জন্য একারণেও রাজনৈতিকভাবে কঠিন হবে কারণ এটি তার একটি নীরব স্বীকারোক্তি প্রকাশ করবে, যা হচ্ছে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ আসলে পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে না।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.levada.ru/en/ratings/
2 – https://www.weforum.org/agenda/2016/12/155-years-of-oil-prices-in-one-chart/
3 – https://www.theguardian.com/world/2016/jul/16/turkey-failed-coup-attempt-public-resistance-president-erdogan
4 – https://www.bostonreview.net/articles/putins-anti-gay-war-on-ukraine/
5 – https://www.losangelesblade.com/2022/10/01/putin-slams-lgbtq-people-in-ukrainian-annexation-speech/
6 – https://twitter.com/powerfultakes/status/1607761296761708546?s=20
7 – https://twitter.com/leonidragozin/status/1673247334291914753?s=20
8 – https://www.ukrinform.ua/rubric-ato/3566162-ak-zabezpeciti-voennu-kampaniu-u-2023-roci-ukrainskij-poglad.html
Leave a Reply