২০১৬ সালে প্রথম দিকে, বিশ্বের প্রায় শত শত সংবাদমাধ্যম একটি বিষয়ে রিপোর্ট করে। রিপোর্টটি বলে, সম্প্রতি পাঠোদ্ধার করা ট্যাবলেটগুলো অনুসারে, আমরা ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদদেরকে যতটা উন্নত ভাবতাম, তারা তার চাইতেও বেশি উন্নত ছিল। কিউনিফর্ম নামে পরিচিত এই ট্যাবলেটগুলোর লেখা প্রমাণ করে, এই প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জ্যামিতিক গণনার মাধ্যমে বৃহস্পতি গ্রহের গতিবেগ নির্ণয় করেছিলেন। পূর্বে ধারণা ছিল ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে এই কৌশল ইংরেজ এবং ফরাসি গণিতবিদরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করেননি। কিন্তু এই লেখাগুলো প্রমাণ করছে, প্রায় ২০০০ বছর আগের জ্যোতির্বিদরা এক্ষেত্রে রেনেসাঁ যুগের পন্ডিতদের থেকে উন্নত ছিল।
কিউনিফর্ম ট্যাবলেটগুলো শুধু সাধারণ হিসাব, শস্য গণনার জন্য নয়, বরং জটিল জ্যোতির্বিদ্যার গণনায় ব্যবহৃত হতো। যদিও বেশির ভাগ ট্যাবলেট আসলে, সাংসারিক হিসাবরক্ষণ বা লেখার অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হতো। তাদের মধ্যে কিছু শিলালিপিতে প্রাচীন মেসোপটেমীয় জীবনের সূক্ষ্ম এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।
কোন ট্যাবলেট বা ফলকে এধরণের কীলকাকৃতির লেখা থাকলেই তাকে কিউনিফর্ম বলা হয়। ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে প্রাচীন নগর-রাষ্ট্র উরুকে (আধুনিক ইরাক) সুমেরীয় পণ্ডিতেরা প্রথমে হিসাব-লেনদেনের একটি মাধ্যম হিসেবে কিউনিফর্ম ব্যাবহার করেন। তারা স্টাইলাসের সাহায্যে কাদামাটি ট্যাবলেটে কীলক আকৃতির (wedged shape) খাঁজ কেটে লিখতেন। পরবর্তীতে পণ্ডিতেরা বিভিন্ন পাথরেও কিউনিফর্ম খোদাই করেছিলেন। এই চিহ্ন বিভিন্ন ভাবে সমন্বয় করে সিলেবাল বা শ্বব্দাংশ গঠন করা হতো, যা পর্যায়ক্রমে শব্দ গঠন করে।
একটি বলিষ্ঠ লিখনপদ্ধতি হিসেবে কীলকলিপি বা কিউনিফর্ম ৩,০০০ বছর টিকে ছিল। সুমেরীয় ছাড়াও একাধিক সংস্কৃতির পণ্ডিতেরা এই লিপি ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাষা লিখতেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আক্কাদীয় (একটি সেমিটিক ভাষা) যা আসিরিয় এবং ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে প্রধান ভাষা ছিল।
পরে যখন কীলকলিপি খিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে বর্ণামালা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তখন শত হাজার কাদামাটির ট্যাবলেট এবং অন্যান্য খোদাইকৃত বস্তু প্রায় ২,০০০ বছর অপঠিত রয়ে গেল।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা উনিশ শতকের প্রথম দিকে ট্যাবলেটগুলো খনন শুরু করেন। এর পর থেকে
পণ্ডিতেরা এই লিপি বোঝার চেষ্টা শুরু করেন। এক ধরনের কীলকলিপি, Rosetta stone এর আবিষ্কার এই লিপির পাঠোদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে কাজ করে। এই ত্রিভাষিক শিলালিপি ইরানের বিসিটানে আবিষ্কৃত হয়। এতে ফার্সি, আক্কাদীয় ও এক ধরনের ইরানী ভাষা এলামাইটে আখেমেনীয় রাজা মহান দারিয়াসের (খিষ্টপূর্ব ৫২১-৪৮৬) কীর্তি খোদাই করা আছে। পুনরাবৃত্তিমূলক শব্দের যেমন “দারিয়াস” ও “রাজা” শব্দগুলোর ফার্সিতে পাঠোদ্ধার দ্বারা গবেষকেগণ কিভাবে কিউনিফর্ম লেখা হত তা বুঝতে পারেন। আসিরিওলজিস্টগণ (যেসকল আর্কিওলজিস্টগণ প্রাচীন আসিরিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন) অবশেষে বিভিন্ন যুগে ব্যবহৃত লিপির অনুবাদ করতে পেরেছেন। যদিও এই লিপির প্রথম দিকের কিছু সংস্করণের এখনো পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
আজ, কিউনিফর্ম পড়তে পারার ক্ষমতা প্রাচীন প্রাচ্যের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করছে। তখনকার জ্যোর্তিরবিজ্ঞান থেকে শুরু করে আসিরিয়ান রাজাদের জীবন, ব্যাবিলনীয় স্টিউ তৈরীর গোপন প্রণালী ইত্যাদি অনেক কিছু এর অনুবাদ থেকে জানা গেছে। খননকৃত আনুমানিক অর্ধ কোটি কিউনিফর্মের মধ্যে এখনো অনেক কিউনিফর্ম অনুবাদ ও বিন্যাস করা বাকি রয়েছে। উদাহারণস্বরূপ একটি ব্যাবিলনীয় রন্ধন-প্রণালী নিম্নে ব্যাখ্যা হলো:
প্রাচীন ব্যাবিলনীয় যুগের তিনটি কিউনিফর্ম থেকে সবচেয়ে প্রাচীন রন্ধন-প্রণালীর সন্ধান পাওয়া যায়।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে সহজ, তবে নির্দেশাবলীগুলো শুধুমাত্র সমাজের অভিজ্ঞ স্তরের রাধুনি দ্বারা অনুসৃত হতো। এই বিশেষ শিলালিপিতে স্টিউ এবং সুপের জন্য ২৫টি রেসিপি (মাংস এবং নিরামিষ উভয়), কিছু নির্দেশাবলী সহ উপস্থাতিত রয়েছে। তবে কোনো পরিমাপ বা কত সময় রান্না করতে হবে, তা লেখা নেই।
একটি আমুরসানু পায়রার স্টিউ তৈরি করার রেসিপি:
প্রথমে পায়রাটিকে মাঝ বরাবর কেটে, অন্যান্য মাংস যোগ করুন। পানি প্রস্তুতি করে নিন। এরপর চর্বি ও স্বাদ অনুযায়ী লবণ; ব্রেডক্রাম্ব, পেঁয়াজ, সামিডু, লিকস, এবং রসুন (প্রথমে দুধে ভিজিয়ে রাখুন) যোগ করুন। এটি রান্না হয়ে গেলে, পরিবেশন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
এখানে আমুরসানু পায়রা (সম্ভবত কবুতরের একটি প্রজাতি) এবং সামিডু (samidu, একটি অজানা মসলা) বাদে অন্যান্য উপাদানগুলো অবশ্যই আমাদের সবার জানা।
আর্টিকলটির মূল লিংক: http://www.archaeology.org/issues/213-1605/features/4326-cuneiform-the-world-s-oldest-writing
–সুস্মিতা দেব
Leave a Reply