মহিষ্মতী (আদি) ও ত্রিপুরির (উত্তরকালীন) কলচুরি রাজবংশের রাজবৃত্ত

মহিষ্মতীর কলচুরি রাজবংশ (৫৫০-৬২৫ খ্রি.)

কলচুরিরা একটি ভারতীয় রাজবংশ ছিল যা ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম-মধ্য ভারতে শাসন করেছিল। পরবর্তী কলচুরি, বিশেষ করে ত্রিপুরির কলচুরিদের থেকে আলাদা করার জন্য তাদের হৈহয় বা প্রারম্ভিক কলচুরিও বলা হয়। কলচুরি অঞ্চলটির মধ্যে বর্তমান গুজরাট, মধ্য প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের রাজধানী সম্ভবত মহিষ্মতীতে অবস্থিত ছিল। লেখমালা ও মুদ্রাভিত্তিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে ইলোরা এবং এলিফ্যান্টা গুহাসৌধগুলোর মধ্যে প্রাচীনতমটি কলচুরি শাসনের সময় নির্মিত হয়েছিল। রাজবংশের উৎপত্তি অনিশ্চিত। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে কলচুরিরা পূর্বে গুপ্ত, বাকাটক এবং বিষ্ণুকুণ্ডিদের দ্বারা শাসিত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। লেখভিত্তিক প্রমাণ থেকে কেবল তিনজন কলচুরি রাজাকে জানা যায় – শঙ্করগণ, কৃষ্ণরাজ এবং বুদ্ধরাজ। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে বাতাপির চালুক্যদের কাছে কলচুরিরা তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। একটি তত্ত্ব ত্রিপুরি ও কল্যাণীর পরবর্তী কলচুরি রাজবংশকে মহিষ্মতীর কলচুরিদের সাথে সংযুক্ত করে। কলচুরি শিলালিপি অনুসারে, রাজবংশটি উজ্জয়িনী, বিদিশা এবং আনন্দপুরকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। সাহিত্যের উল্লেখগুলো থেকে জানা যায় যে তাদের রাজধানী মালব অঞ্চলের মহিষ্মতীতে অবস্থিত ছিল। এই রাজবংশ বিদর্ভকেও নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যেখানে তারা বাকাটক এবং বিষ্ণুকুণ্ডি রাজবংশের উত্তরাধিকারী হয়েছিল। উপরন্তু, কলচুরিরা খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর কোঙ্কন জয় করেছিল। এখানে, তারা ত্রৈকুটক রাজবংশের উত্তরাধিকারী হয়েছিল।

কলচুরিদের উৎপত্তি অনিশ্চিত। কৃষ্ণরাজ (৫৫০-৫৭৫) এই রাজবংশের প্রাচীনতম শাসক। তিনি ত্রৈকুটক এবং গুপ্ত রাজাদের দ্বারা জারি করা পূর্ববর্তী মুদ্রাগুলোর নকশা অনুকরণ করে ব্রাহ্মী লিপিতে কিংবদন্তী খোচিত মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছিলেন। একটি ষাঁড়ের চিত্র খোচিত তার মুদ্রাগুলো স্কন্দগুপ্তের উৎকীর্ণ মুদ্রাগুলোর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তার রৌপ্যমুদ্রাগুলো তার রাজত্বের পরে প্রায় ১৫০ বছর ধরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। কৃষ্ণরাজের মুদ্রাগুলোতে তাকে পরম-মহেশেশ্বর (শিবের ভক্ত) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর পুত্র শঙ্করগণের একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে তিনি জন্মের পর থেকেই পশুপতি (শিব) এর প্রতি নিবেদিত ছিলেন। ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে তিনি সম্ভবত এলিফ্যান্টা গুহায় শৈব স্মৃতিসৌধগুলো এবং ইলোরার ব্রাহ্মণ্যবাদী গুহাগুলোর প্রথম দিকেরগুলো উদ্বোধন করেছিলেন, যেখানে তার মুদ্রাগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে।

শঙ্করগণ (৫৭৫-৬০০ খ্রি.) এই রাজবংশের প্রাচীনতম শাসক যিনি তার নিজস্ব শিলালিপি দ্বারা সত্যায়িত হন, যা উজ্জয়িনী এবং নির্গুণ্ডিপদক থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর উজ্জয়িনী অনুদান রাজবংশের প্রাচীনতম লেখমালার রেকর্ড। এ প্রসঙ্গে ৫৭৫ সালে ঔলিকরদের পতন সম্পর্কে বলতে হবে। আনু. ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভাস্করবর্মা নামে জনৈক রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী ঔলিকরদের পরাজিত করে পশ্চিম মালব অধিকার করেন, যার পর পশ্চিম মালবের রাজপদে অভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র কুমারবর্মা (আ. ৫৮০-৬১০ খ্রি.)। কলচুরিরাজ শঙ্করগণ কুমারবর্মাকে পরাজিত করে উজ্জয়িনী অধিকার করেন। শঙ্করগণের রাজ্যে সম্ভবত বর্তমান গুজরাটের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর পিতার মতো তিনিও নিজেকে পরমা-মহেশ্বর (শিবের ভক্ত) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

বুদ্ধরাজ হলেন এই রাজবংশের শেষ পরিচিত শাসক। তিনি শঙ্করগণের পুত্র ছিলেন। বুদ্ধরাজ পূর্ব মালব জয় করেছিলেন, তবে তিনি সম্ভবত বল্লভী বা মৈত্রক শাসকের কাছে পশ্চিম মালব হারিয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে, চালুক্যরাজ কীর্তিকর্মার মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী জীবিত থাকলেও তিনি নাবালক থাকায় ছোট ভাই মঙ্গলেশ (আ. ৫৯৭-৬১১ খ্রি.) আনু. ৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি উত্তর দিকে রাজ্যজয়ে বহির্গত হয়ে বর্তমান গুজরাট, মধ্য প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত কলচুরি রাজ্যের রাজা বুদ্ধরাজকে ৬০০-৬০২ সালের মধ্যে পরাজিত করেন এবং তাঁর ধন সম্পদ অধিগ্রহণ করেন ও যুদ্ধে বুদ্ধরাজ পলায়ন করেন বলে উল্লেখ আছে। বুদ্ধরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও মঙ্গলেশ কলচুরি রাজ্য জয় করেননি, অন্তত পূর্ণাঙ্গ রাজ্য জয় করেননি। লেখ থেকে জানা যায় ৬১১ সালেও বুদ্ধরাজ সেখানে রাজত্ব করেন এই প্রমাণ আছে। এদিকে তার রাজত্বের শেষ পর্বে মঙ্গলেশ ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। নিজ পুত্রের রাজপদ প্রাপ্তির পথ সুগম করতে তিনি সচেষ্ট হয়ে তিনি সম্ভবত তাঁর পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু দক্ষতা ও দাবির দিক দিয়ে দ্বিতীয় পুলকেশী এগিয়ে থাকায় তিনি মঙ্গলেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে ৬১১ খ্রিস্টাব্দে তাকে পরাজিত ও নিহত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কলচুরির রাজা বুদ্ধরাজ সম্ভবত দ্বিতীয় চালুক্য আক্রমণের সময়, মঙ্গলেশ বা তার ভাগ্নে দ্বিতীয় পুলকেশির দ্বারা তার সার্বভৌমত্ব হারিয়েছিলেন। চালুক্য শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মঙ্গলেশ কলচুরিদের পরাজিত করেছিলেন, কিন্তু এই কৃতিত্বের জন্য পুলকেশিকে কৃতিত্ব দেয়া যায়না; সুতরাং, সম্ভবত মঙ্গলেশ ছিলেন সেই চালুক্য শাসক যিনি কলচুরি শক্তি শেষ করার কৃতিত্ব পান। সম্ভবত ৬১১ সালে দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাজয়ের কিছুকাল পূর্বে মঙ্গলেশ কলচুরিদের ওপর দ্বিতীয় অভিযান চালিয়ে তাদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য দখল করে থাকবেন। পিতা ও পিতামহের মতো, বুদ্ধরাজও নিজেকে পরম-মহেশ্বর (শিবের ভক্ত) হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর রানী অনন্ত-মহায়ী পাশুপত সম্প্রদায়ের ছিলেন।

বুদ্ধরাজের উত্তরসূরিদের সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না, তবে এটি জানা যায় যে ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, কলচুরিরা চালুক্যদের সামন্ততন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। সানখেদায় তরলস্বামী নামে এক রাজপুত্রের উৎকীর্ণ একটি লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তিনি নিজেকে শিবের ভক্ত এবং তার পিতা মহারাজ নান্নাকে “কাটাচ্চুরি” পরিবারের সদস্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। লেখটি একটি অজানা অব্দের ৩৪৬ সালের। একে কলচুরি অব্দ হিসাবে যুগকে ধরে নিলে, তরলস্বামী শঙ্করগণের সমসাময়িক হতেন। যাইহোক, তরলস্বামী ও নান্নাকে অন্য কোন কলচুরি লেখে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়াও, অন্যান্য কলচুরি লেখের বিপরীতে, এই লেখটির তারিখটি দশমিক সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি, শিলালিপিতে কিছু অভিব্যক্তি খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর সেন্দ্রক লেখ থেকে ধার করা হয়েছে বলে মনে হয়। এই প্রমাণগুলোর কারণে, ভি. ভি. মিরাশি তরলস্বামীর লেখকে একটি নকল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। ভি. ভি. মিরাশি ত্রিপুরির কলচুরিদের প্রথম দিকের কলচুরি রাজবংশের সাথে সম্পর্কিত করেছিলেন। তিনি তত্ত্ব দেন যে এই কলচুরিরা তাদের রাজধানী মহিষ্মতী থেকে মধ্যপ্রদেশের কালঞ্জরে এবং সেখান থেকে ত্রিপুরিতে স্থানান্তরিত করেছিল।

ত্রিপুরির কলচুরি রাজবংশ (আ. ৭ম শতক – ১২১২ খ্রি.)

ত্রিপুরীর কলচুরি রাজবংশ চেদির কলচুরি নামেও পরিচিত। রাজবংশটি ৭ম থেকে ১৩শ শতাব্দীতে মধ্য ভারতের কিছু অংশ শাসন করেছিল। তাদেরকে একই নামের পূর্ববর্তী রাজবংশ, বিশেষ করে মাহিষ্মতীর কলচুরি রাজবংশ থেকে আলাদা করার জন্য পরবর্তী কলচুরি রাজবংশও বলা হয়। তাদের মূল অঞ্চলটির মধ্যে ঐতিহাসিক চেদি অঞ্চল (দহলমণ্ডল নামেও পরিচিত) অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদের রাজধানী ত্রিপুরিতে (বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের কাছে তেওয়ার) অবস্থিত ছিল। এই রাজবংশের উৎপত্তি অনিশ্চিত, যদিও একটি তত্ত্ব তাদেরকে মহিষ্মতীর কলচুরিদের সাথে সংযুক্ত করে। ১০ম শতাব্দীর মধ্যে, ত্রিপুরির কলচুরিরা প্রতিবেশী অঞ্চলগুলিতে সমরাভিযান চালিয়ে এবং গুর্জর-প্রতীহার, চান্দেল্ল এবং পরমারদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের ক্ষমতা সুসংহত করেছিল। কল্যাণীর রাষ্ট্রকূট ও চালুক্যদের সঙ্গে তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। ১০৩০-এর দশকে কলচুরিরাজ গঙ্গেয়দেব (আ. ১০১৫-৪১ খ্রি.) তার পূর্ব ও উত্তর সীমান্তে সামরিক সাফল্য অর্জনের পরে রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পুত্র লক্ষ্মীকর্ণের (আ. ১০৪১-১০৭৩ খ্রি.) রাজত্বকালে রাজ্যটি তার শিখরে পৌঁছেছিল, যিনি বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পরে চক্রবর্তী উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অল্প সময়ের জন্য পরমার এবং চান্দেল্ল রাজ্যের একটি অংশও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। লক্ষ্মীকর্ণের পরে রাজবংশের ধীরে ধীরে পতন ঘটে, যার উত্তরসূরিরা গহড়বালদের কাছে তাদের উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ত্রৈলোক্যমল্ল (আ. ১২১০-১২ খ্রি.) এই রাজবংশের শেষ পরিচিত শাসক, যিনি কমপক্ষে ১২১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, তবে কীভাবে এবং কখন তার রাজত্ব শেষ হয়েছিল তা নিশ্চিত নয়। ১৩শ শতাব্দীর শেষার্ধে, প্রাক্তন কালাচুরি অঞ্চলগুলো পরমার ও চান্দেল্লদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং শেষ পর্যন্ত দিল্লি সালতানাতের অধীনে আসে। এই রাজবংশের একটি শাখা রত্নাপুরের কলচুরিরা বর্তমান ছত্তিশগড়ের রত্নাপুরে (বর্তমান রতনপুর) শাসন করেছিল।

প্রথম কোক্কলের (আ. ৮৫০-৯০ খ্রি.) পুত্র রাজকুমার বল্লেকের গ্যরসপুর লেখের মত কলচুরি লেখগুলোতে এই রাজবংশের পূর্বপুরুষকে কার্তবীর্যার্জুনের সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে্‌ যিনি মহিষ্মতী থেকে শাসন করা একজন কীংবদন্তী হৈহয়রাজ। ১২শ শতাব্দীর কবিতা পৃথ্বীরাজ বিজয়া অনুসারে, সাহসিকা নামে এক নারীর দ্বারা কার্তবীর্যের ঔরসে রাজবংশটির জন্ম হয়, যেখানে সেই সাহসিকা হচ্ছে কবিতার নায়ক তৃতীয় পৃথ্বিরাজের মাতৃ পূর্বপুরুষ। কবিতাটিতে কার্তবীর্যার্জুনের পৌরাণিক পূর্বপুরুষ হিসেবে চন্দ্রদেব ও তার পুত্র বুধকে দাবি করা হয়েহচে। ঐতিহাসিক ভি. ভি. মিরশী ত্রিপুরির কলচুরিদেরকে মহিষ্মতীর কলচুরির সাথে সম্পর্কিত করেছেন, যারা মধ্য-পশ্চিম ভারতে শাসন করতেন। মিরশী তত্ত্ব দেন যে, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে মহিষ্মতীর কলচুরিরা তাদের রাজধানীকে মহিষ্মতী থেকে সরিয়ে কালঞ্জরে নিয়ে আসেন, এবং শেষ পর্যন্ত তারা ত্রিপুরিতে সরে যান। কিন্তু এই দুই রাজবংশের এই সম্পর্ক নিয়ে কোন নিশ্চিত সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই।

রাষ্ট্রকূট ও প্রতীহারদের সামন্ত হিসেবে

কলচুরি রাজবংশের প্রাচীনতম শাসকদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, যাদের উল্লেখ তাদের অভিলেখের বংশানুক্রমে পাওয়া যায়। রাজবংশের প্রাচীনতম বিদ্যমান লেখগুলি ছোটি দেওরি এবং সগরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখগুলো প্রথম শঙ্করগণের (আ. ৭৫০-৭৭৫ খ্রি.) রাজত্বকালে উৎকীর্ণ হয়েছে, এবং এগুলোর সময়কাল খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দী।

প্রথম লক্ষ্মণরাজের (আ. ৮২৫-৮৫০ খ্রি.) কারিতলাই লেখে একজন রাষ্ট্রকূট রাজার (যার নাম হারিয়ে গেছে) প্রশংসা করা হয়েছে এবং একজন নাগভটের (সম্ভবত গুর্জর-প্রতীহাররাজ দ্বিতীয় নাগভট (আ. ৮০০-৩৩ খ্রি.)) পরাজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে এই সময়ে, কলচুরিরা তাদের দক্ষিণের প্রতিবেশী রাষ্ট্রকূট সম্রাটদের অধীনস্থ ছিল এবং তাদের উত্তরের প্রতিবেশী প্রতিহার সম্রাটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। রাষ্ট্রকূটদের সাথে তাদের একাধিক বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। তবে লক্ষ্মণরাজের পুত্র বা পৌত্র প্রথম কোকল্লের (৮৫০-৮৯০ খ্রি.) সময় তারা প্রতীহারদের অনুগত হয়।

প্রথম কোক্কল্লকে এই রাজবংশের প্রথম শক্তিশালী শাসক বলে মনে হয়, কারণ পরবর্তী কলচুরি শাসকদের বংশানুক্রমে নিয়মিত তার উল্লেখ পাওয় যায়। রত্নপুর কলচুরি লেখ অনুসারে, তার ১৮ জন পুত্র ছিল, যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় শঙ্করগণ (আ. ৮৯০-৯১০ খ্রি.) সিংহাসনে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন ও অন্যরা প্রাদেশিক গভর্নর হয়েছিলেন। এই ১৮ সংখ্যাটি সম্ভবত আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ এটি একটি শুভ সংখ্যা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল, এবং এর দ্বারা কোক্কল্লের অনেক পুত্র থাকার বিষয়টি নির্দেশ করা হয়ে থাকতে পারে। দ্বিতীয় শঙ্করগণকে আধুনিক পন্ডিতরা বিভিন্ন উৎসে “প্রসিদ্ধ-ধবল”, “মুগ্ধ-তুঙ্গ” এবং “রানা-বিগ্রহ” নামে উল্লিখিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যান্য পুত্রদের মধ্যে, নামহীন এক রাজকুমার কলচুরিদের রত্নপুর শাখার পূর্বপুরুষ হয়েছিলেন। কোক্কল্লের অন্যান্য পুত্রদের একজন ছিলেন প্রথম অর্জুনকে রাষ্ট্রকূট লেখে উল্লেখ করা হয়েছে; অন্য দেকজন ছিলেন বল্লেক বা বল্লবতী যাকে তার গ্যরসপুর লেখ থেকে জানা যায়। বল্লেকের লেখটি অনুসারে, তিনি রানী নটার পুত্র ছিলেন, যাকে চান্দেল্ল রাজকুমারী নট্টার সাথে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যাকে পরবর্তী শাসক লক্ষ্মীকর্ণের বারাণসী লেখে প্রতমকোক্কল্লের স্ত্রী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। বল্লেক মনে হয় গ্যরসপুরের আশেপাশের এলাকার সর্বশেষ (বা শেষগুলির মধ্যে একটি) কলচুরি প্রদেশপাল ছিলেন, যা পরবর্তীকালে চান্দেল্ল অঞ্চলের একটি অংশ হয়ে ওঠে। লেখে বলা হয়েছে যে বল্লেক রাজা ভোজের সেবা করেছিলেন, যাকে পৃথিবীর শাসক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে যে বল্লেক ভোজের সেবায় আরও বেশ কয়েকজন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এই রাজা ভোজ অবশ্যই গুর্জর-প্রতীহার সম্রাট মিহির ভোজ বা প্রথম ভোজ (আ. ৮৩৬-৮৫ খ্রি.), যাকে অন্যান্য কলচুরি লেখেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই অন্যান্য লেখগুলোর মধ্যে বিলহারি লেখ অন্তর্ভুক্ত যা ভোজকে প্রথম কোকল্লের (৮৫০-৮৯০ খ্রি.) দ্বারা নির্মিত “গৌরবের স্তম্ভ” হিসাবে বর্ণনা করে; এবং সেই সাথে এখানে বারাণসী লেখ অন্তর্ভূক্ত যা ভোজকে কোক্কল্লের সুরক্ষাপ্রাপ্ত হিসাবে বর্ণনা করে। এই দুটি লেখের বর্ণনা ও বল্লেকের লেখ অনুসারে বোঝা যায়, কলচুরিরা প্রতীহার সম্রাট প্রথম ভোজের অধীনস্থ ছিল, এবং প্রথম কোক্কল্লের সময় থেকে কলচুরিরা প্রতীহারদের অনুগত হয়। বল্লেকের লেখের ওপর ভিত্তি করে, এপিগ্রাফিস্ট রিচার্ড জি. সালোমন তত্ত্ব দিয়েছেন যে প্রথম কোক্কল্ল ভোজের অধীনস্থ ছিলেন এবং প্রতিহার সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানাকে প্রসারিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভোজের কাছে তাঁর আনুগত্য নামমাত্র হতে পারে, এবং তিনি প্রতীহার সাম্রাজ্যের দক্ষিণ অংশে তার নিজস্ব প্রভাবের ক্ষেত্র প্রসারিত করে কলচুরি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন বলে মনে হয়। পরবর্তী কলচুরি লেখগুলি কোক্কল্লের মহিমাকে ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত করে এবং কলচুরিদের অধীনস্থ অবস্থানকে হ্রাস করে এমন শব্দগুলি ব্যবহার করে।

স্বাধীন হিসেবে

সম্ভবত প্রথম যুবরাজদেবের (৯১৫-৯৪৫ খ্রি.) রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূট ও প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের পর কলচুরিরা স্বাধীনতা লাভ করে ও কলচুরি রাজ্য সার্বভৌম রাজ্যে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

তৃতীয় শঙ্করগণ (আ. ৯৭০-৮০ খ্রি.)

৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তৃতীয় শঙ্করগণ কলচুরিরাজ লক্ষ্মণরাজের স্থলাভিষিক্ত হয়ে মধ্য ভারতের বর্তমান মধ্যপ্রদেশের চেদি বা দহল অঞ্চলকেন্দ্রিক ত্রিপুরির কলচুরি রাজবংশের শাসক হন। তিনি একজন দুর্বল গুর্জর-প্রতীহার শাসককে পরাজিত করেছিলেন এবং চান্দেল্লদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন বলে মনে হয়। তিনি তার প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে একটি আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। জব্বলপুরের একটি লেখ অনুসারে, তিনি সমসাময়িক গুর্জর-প্রতীহার রাজাকে পরাজিত করেছিলেন, তিনি সম্ভবত বিজয়পাল ছিলেন। শঙ্করগণ চান্দেল্লদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন বলে মনে হয়। একটি ভিলসা লেখে গর্ব করে যে চান্দেল্ল মন্ত্রী বাচস্পতি চেদির রাজা (শঙ্করগণ হিসেবে চিহ্নিত) এবং তার সহযোগীকে (একজন শবর নেতা) পরাজিত করেছিলেন। বাচস্পতি ছিলেন চান্দেল্লরাজ ধঙ্গের ভাই কৃষ্ণপার অধস্তন। একটি মাসের লেখ অনুসারে, সুলকি বংশের নরসিংহ কলচুরি রাজার স্ত্রীদের বিধবাতে পরিণত করেছিলেন। এটি চান্দেল্লদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শঙ্করগণের পরাজয়ের একটি সূত্র বলে মনে করা হয়। ছোট ভাই দ্বিতীয় যুবরাজদেব (আ. ৯৮০-৯৯০ খ্রি.) শঙ্করগণের স্থলাভিষিক্ত।

দ্বিতীয় যুবরাজদেব (আ. ৯৮০-৯৯০ খ্রি.)

দ্বিতীয় যুবরাজদেব তার বড় ভাই তৃতীয় শঙ্করগণের স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি সম্ভবত চান্দেল্লদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। এর মধ্যমে তিনি মধ্য ভারতে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের চেদি বা দহলভিত্তিক ত্রিপুরির কলচুরি রাজবংশের শাসক হন। তিনি কল্যাণীর চালুক্যদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, পরমাররাজ মুঞ্জের কাছে পরাজিত হন। যুবরাজদেবের বংশধরদের করণবেল লেখ অনুসারে, তিনি বেশ কয়েকটি দেশে সমরাভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং লুণ্ঠিত সম্পদ প্রভু সোমনাথের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ দ্বিতীয় লক্ষ্মণরাজকেও (আ. ৯৪৫-৭০ খ্রি.) একই রকম কৃতিত্ব দেয়া হয়। ঐতিহাসিক ভি. ভি. মিরশির মতে, এগুলো স্থানীয় প্রশংসা মাত্র, এবং এগুলোকে বাস্তব বর্ণনা হিসাবে গ্রহণ করা উচিৎ নয়। করনবেল লেখে গর্ব করে আরও বলা হয়েছে যে, যুবরাজদেব একবার একটি বাঘের সাথে লড়াই করেছিলেন এবং তাকে হত্যা করেছিলেন। যুবরাজদেবের বোন বোনাদেবী বৈবাহিক জোটের অংশ হিসাবে কল্যাণীর চালুক্য শাসক দ্বিতীয় তৈলপাকে বিয়ে করেছিলেন। তৈলপাার শত্রু পরমাররাজ মুঞ্জ কলচুরি রাজ্য ও তাদের রাজধানী ত্রিপুরিতে আক্রমণ করেছিলেন। পরমারদের উদয়পুর প্রশস্তি অনুসারে, মুঞ্জ যুবরাজদেবকে পরাজিত করেছিলেন, কলচুরি সেনাপতিদের হত্যা করেছিলেন এবং ত্রিপুরিতে “তার তলোয়ারটি উঁচু করে রেখেছিলেন”। মুঞ্জ পরে তৈলপাার দ্বারা পরাজিত এবং বন্দী হন। পরবর্তী চালুক্য লেখে তৈলপাকে “চেদিরাজের ধ্বংসকারী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে তৈলপাার বিজয় বর্ণনা করা হয়েছিল। ভি. ভি. মিরশির মতে মুঞ্জের বিরুদ্ধে ত্রিপুরিকে রক্ষা করার সময় সম্ভবত যুবরাজদেব মারা যান, এবং পরে তৈলপা মুঞ্জকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে, আর তাই এই বর্ণনায় চেদিরাজ বলতে মুঞ্জকেই বোঝানো হয়েছে। যুবরাজদেবের মৃত্যুর পর কলচুরির মন্ত্রীরা তাঁর মৃত্যুর পর, রাজ্যের মন্ত্রীরা তাঁর পুত্র দ্বিতীয় কোকল্লাকে ত্রিপুরির সিংহাসনে বসিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় কোক্কল্ল (আ. ৯৯০-১০১৫ খ্রি.)

কলচুরিরাজ দ্বিতীয় যুবরাজদেবের (আ. ৯৮০-৯৯০ খ্রি.) মৃত্যুর পর দ্বিতীয় কোক্কল্ল মধ্য ভারতের ত্রিপুরির কলচুরি রাজ্যের শাসক হন। তাঁর রাজ্য ছিল বর্তমান মধ্যপ্রদেশের চেদি বা দহল অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। তাঁর গুর্গী লেখ অনুসারে, তিনি গুর্জর-প্রতীহার, পাল এবং কল্যাণীর চালুক্য অঞ্চলে সমরাভিযান পরিচালনা করেছিলেন। কোক্কল্লের গুর্গী লেখে গর্বের সাথে বলা হয়েছে যে, অন্যান্য রাজারা তাকে ভয় পেত, তার ভয়ে গুর্জররাজ হিমালয়ে, গৌড়রাজ জলময় দুর্গে এবং কুন্তলরাজ বনে লুকিয়েছিলেন। এই দাবিগুলি ইঙ্গিত করে, কোক্কল্ল সম্ভবত এই অঞ্চলগুলিতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এখানে উল্লিখিত গুর্জররাজ সম্ভবত চৌলুক্যরাজ মূলরাজ বা চামুণ্ডরাজ ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন, তবে কলচুরি লেখ অনুসারে হিমালয় এই রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে তিনি কোন দুর্বল গুর্জরা-প্রতীহার শাসক ছিলেন বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে তিনি রাজ্যপাল হয়ে থাকতে পারেন। লেখে উল্লিখিত গৌড়রাজকে পাল শাসক প্রথম মহীপালের (আ. ৯৭৭-১০২৭ খ্রি.) বলে মনে করা হয়। কুন্তলরাজকে কল্যাণীর চালুক্যরাজ পঞ্চম বিক্রমাদিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বৈবাহিক জোট হিসেবে কোক্কল্লের পিসির সাথে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় তৈলপাার বিয়ে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে মনে হয়, তৈলপাার মৃত্যুর পর চালুক্য-কলচুরি সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। কোক্কল্লের বংশধর যশকর্ণের জব্বলপুর ও খয়রা লেখ অনুসারে, কোক্কল্ল চার মহাসাগরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত চার দিক দিয়ে বিভিন্ন দেশে সমরাভিযান পরিচালনা করেন, তবে এটিকে কেবলই একটি স্থানীয় প্রশংসা বলে মনে হয়, যাকে সঠিক বলে ধরা যায়না। পরমারদের উদয়পুর ষষ্ঠী লেখ অনুসারে, পরমাররাজ ভোজ টোগলাল নামে একজনকে পরাজিত করেছিলেন, যাকে দ্বিতীয় কোক্কল্ল বলে মনে করা হয়। এর ফলেই সম্ভবত কোক্কল্লের পর ক্ষমতায় আসা তার পুত্র গাঙ্গেয়দেব (আ. ১০১৫-৪১) তার রাজত্বের প্রথম কয়েক বছর পরমাররাজ ভোজের সামন্ত হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

গাঙ্গেয়দেব (আ. ১০১৫-৪১ খ্রি.)

গাঙ্গেয়দেব মধ্য ভারতের ত্রিপুরির কলচুরি রাজবংশের শাসক ছিলেন। তিনি ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ত্রিপুরির সিংহাসনে তার পিতা দ্বিতীয় কোক্কল্লের (আ. ৯৯০-১০১৫ খ্রি.) স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর রাজ্য ছিল বর্তমান মধ্যপ্রদেশের চেদি বা দহল অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। তিনি বারাণসীকে কলচুরি আধিপত্যে নিয়ে আসেন বলে মনে হয়। তাঁর ১০১৯ সালের মুকুন্দপুর লেখে তিনি মহার্হ-মহা-মহাত্তক এবং মহারাজা উপাধি গ্রহণ করেন। এই উপাধিটি রাজকীয় উপাধি মহারাজাধিরাজার মতো উচ্চতর নয় বলে প্রস্তাব করা হয় তিনি রাজত্বের প্রথম দিকে সম্ভবত পরমার রাজা ভোজের সামন্ত ছিলেন। সম্ভবত অধিরাজ ভোজের সাথে জোট বেঁধে তিনি কল্যাণীর চালুক্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ভোজ, গাঙ্গেয়দেব এবং রাজেন্দ্র চোলের ত্রিমুখী জোট চালুক্য রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহকে একাধিক সীমান্তে সৈন্য নিযুক্ত করতে বাধ্য করে। কলচুরি লেখগুলোতে গর্বের সাথে বলা হয় যে, কুন্তলের রাজা জয়সিংহ গঙ্গেয়দেবের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তার বর্শাটি ত্যাগ করেছিলেন। চালুক্য লেখগুলোও তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাফল্য দাবি করে। তাই মনে হয় যে গাঙ্গেয়দেব এবং তার মিত্ররা শুরুতে কিছু সামরিক সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

কল্বন লেখ, উদয়পুর প্রশস্তি লেখ ও মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধ-চিন্তামণি অনুসারে ভোজ চেদির শাসককে পরাজিত করেছিলেন। বালা সরস্বতী মদনের পারিজাত-মঞ্জরীতে (আ. ১২১৩ খ্রি.) পরাজিত শাসককে গঙ্গেয়দেব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভোজশালায় একটি পাথরের স্ল্যাবে খোদাই করা একটি শ্লোকও ইঙ্গিত দেয় যে ভোজ ত্রিপুরীর গাঙ্গেয়দেবকে পরাজিত করেছিলেন। ভোজের বংশধর অর্জুনবর্মণের ১২২৩ খ্রিস্টাব্দের ধর লেখেও গাঙ্গেয়দেবের ওপর ভোজের বিজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কল্যাণীর চালুক্যদের বিরুদ্ধে যৌথ যুদ্ধের পূর্বে না পরে ভোজ গাঙ্গেয়দেবকে পরাজিত করেছিলেন তা নিশ্চিত নয়। একটি তত্ত্ব অনুসারে, ভোজ তার চালুক্য অভিযানের আগে গাঙ্গেয়দেবকে পরাজিত করেছিলেন, যেখানে গাঙ্গেয়দেব অবশ্যই পরমারদের সামন্ত হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। ভি. ভি. মিরশি মনে করেন, ভোজ সম্ভবত ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে গাঙ্গেয়দেব তার মুকুন্দপুর লেখ জারির পূর্বে গঙ্গেয়দেবকে পরাজিত করেছিলেন। একটি পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব হ’ল চালুক্যদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযানের পরে দুজনেই শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। মাহোবাতে পাওয়া একটি লেখের উপর ভিত্তি করে কে এম মুন্সি তত্ত্ব দিয়েছিলেন, এই দুজন কমপক্ষে ১০২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিত্র ছিলেন। ১০২৮ সালের কুলেনুর লেখের উপর ভিত্তি করে কে. এন. শেঠ এবং মহেশ সিংহ ধারণা করেন, ১০২৮ থেকে ১০৪২ সালে চালুক্যরাজ সোমেশ্বরের মালব আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত চালুক্যদের সাথে পরমারদের কোন যুদ্ধ হয়নি ও ভোজ সম্ভবত এই সময়টিতে গাঙ্গেয়দেবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় ব্যয় করেছিলেন।

রাজত্বের পরবর্তী অংশে গাঙ্গেয়দেব তার পূর্ব ও উত্তর সীমান্তে সামরিক সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর ১০৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পিয়বন প্রস্তর লেখে গঙ্গেয়দেব পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে সার্বভৌম শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপাধি বিক্রমাদিত্যও গ্রহণ করেছিলেন। ফার্সি লেখক আল-বিরুনি তাকে দহল দেশের শাসক হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং তার রাজধানীর নাম দিয়েছেন “তিয়াউরি” (ত্রিপুরি)। তিনি পূর্ব দিকের উৎকল অঞ্চল আক্রমণ করেছিলেন, বলা হয় সেখানে পূর্ব উপকূলে গিয়ে বিজয়ের স্তম্ভ হিসেবে নিজের হাতকে উত্থিত করেছিলেন। এই সমরাভিযানে তিনি সম্ভবত তার রাজবংশের রত্নপুর শাখার সহায়তা লাভ করেছিলেন, যার শাসক কমলরাজ উৎকলের শাসককে পরাজিত করেছিলেন বলে মনে করা হয়। পরাজিত শাসক সম্ভবত ভৌমকররাজ দ্বিতীয় শুভকর ছিলেন। কলচুরি লেখগুলো অনুসারে, গাঙ্গেয়দেব দক্ষিণ কোশল অঞ্চলের শাসককেও পরাজিত করেছিলেন। পরাজিত রাজা সম্ভবত সোমবংশী রাজবংশের দ্বিতীয় যযাতি। তবে যযাতি চেদির রাজাকে পরাজিত করেছেন এবং তার দহল দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন বলে মনে করা হয় কোনও পক্ষই এই যুদ্ধে একটি নির্ণায়ক বিজয় অর্জন করতে পারেনি। তার মৃত্যুর এক বছর পর পুত্র লক্ষ্মীকর্ণের (১০৪১-১০৭৩ খ্রি.) প্রকাশিত একটি লেখে দেখা যায় লক্ষ্মীকর্ণ ত্রি-কলিঙ্গধিপতি (“তিন কলিঙ্গের প্রভু”) উপাধি গ্রহণ করেছেন। সম্ভবত তিনি পিতার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে উপাধিটি পেয়েছিলেন, যিনি কলিঙ্গ অঞ্চলে তার সফল অভিযানের পরে এটি গ্রহণ করেছিলেন।

মাহোবায় আবিষ্কৃত একটি খণ্ডিত চান্দেল্ল লেখ অনুসারে, ভোজ এবং “কলচুরি-চন্দ্র” ভীত ছাত্রদের মতো চান্দেল্লরাজ বিদ্যাধরের উপাসনা করেছিলেন। ঐতিহাসিকরা গাঙ্গেয়দেবকে “কলচুরি-চন্দ্র” (“কলচুরিদের চাঁদ”) চিহ্নিত করেছেন। একটি তত্ত্ব অনুসারে, গঙ্গেয়দেবের সহায়তায় ভোজ চান্দেল্ল রাজ্য আক্রমণ করে, কিন্তু বিদ্যাধর তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। তবে কে. এম. মুন্সীর মতো কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে মাহোবা লেখটির বক্তব্য কেবলই একটি অহঙ্কারমূলক অতিরঞ্জন। পরে গজনাভিদ আগ্রাসনের কারণে চান্দেল্লরা দুর্বল হয়ে পড়ায় গাঙ্গেয়দেব উত্তরে তার রাজত্ব প্রসারিত করেছিলেন ও চান্দেল্লদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন বলে মনে হয়। এমনকি চান্দেল্ল লেখগুলোতেও গাঙ্গেয়দেবকে জিত-বিশ্ব (“বিশ্ব-বিজয়ী”) হিসাবে বর্ণনা করা হয়। চান্দেল্লদের একটি খণ্ডিত মাহোবা লেখ অনুসারে, তাদের রাজা বিজয়পাল একটি যুদ্ধে গাঙ্গেয়দেবের গর্ব চূর্ণ করেছিলেন। গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার প্রয়াগ ও বারাণসীর পবিত্র শহরগুলোর ওপর গাঙ্গেয়দেব তার নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করেছিলেন বলে মনে হয়। কলচুরি লেখগুলো অনুযায়ী, তিনি প্রয়াগে মারা যান। মুসলিম ইতিহাসবিদ বৈহকির (Baihqui) লেখাগুলি ইঙ্গিত করে যে, ১০৩৩-১০৩৪ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী গঙ্গেয়েদেবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১০১৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ প্রথম মহীপালের (আ. ৯৭৭-১০২৭ খ্রি.) সারনাথ প্রস্তরলেখ থেকে বোঝা যায়, ১০৩৩-৩৪ এ গাঙ্গেয়দেবের দখলে যাবার পূর্বে অন্তত ১০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বারাণসী পাল শাসনের অধীনে ছিল, কমপক্ষে ১০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (মহিপাল থেকে সারনাথ পাথরের লেখটি এই বছর পর্যন্ত তারিখযুক্ত)। মুসলিম বংশানুক্রম অনুসারে, ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন পাঞ্জাবের গজনাভিদ গভর্নর আহমদ নিয়ালতিগিন বারাণসী আক্রমণ করেন, তখন শহরটি গাঙ্গেয়দেবের শাসনের অধীনে ছিল। গজনাভিদরা দুপুর পর্যন্ত শহরটি লুণ্ঠন করেছিল, ও সম্ভবত গাঙ্গেয়দেবের কলচুরি বাহিনীর আগমনের পর তারা পশ্চাদপসরণ করেছিলেন। কলচুরি লেখগুলো অঙ্গ এবং কীরে সফল অভিযানের জন্য গাঙ্গেয়দেবকে কৃতিত্ব দেয়। অঙ্গ পালদের দ্বারা শাসিত ছিল, আর কীরকে (কার) কাংড়া উপত্যকার সাথে চিহ্নিত করা হয়, যা গজনভিদদের দ্বারা শাসিত ছিল। কলচুরিদের কীরে সাফল্যের দাবিটি গাঙ্গেয়দেবের দ্বারা গজনাভিদের পিছু হটতে বাধ্য করার রেফারেন্স বলে মনে হয়। রামায়ণ পাণ্ডুলিপির কলোফন বা শেশ পৃষ্ঠা অনুসারে এটি গঙ্গেয়দেবের রাজত্বকালে ত্রিহুতে (বর্তমান বিহারে) অনুলিপি করা হয়েছিল। পাণ্ডুলিপিতে রাজাকে গরুড়ধবজ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা থেকে মনে করা হয় গাঙ্গেয়দেব বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, কিন্তু এই গৌড়-ধ্বজ শব্দটি ইংরেজ পণ্ডিত সিসিল বেন্ডলের ভুল পাঠ ছিল, প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা গাঙ্গেয়দেবের গৌড় বিজয়ের কথা বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক ভি. ভি. মিরশি বলেন রামায়ণের কলোফনের এই গাঙ্গেয়দেব কলচুরিরাজ নন, বরং রাষ্ট্রকূট শাখার কোন সদস্য।

গাঙ্গেয়দেব পিয়বনে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন, যা তার শৈব হবার ইঙ্গিত দেয়। কলচুরি লেখসমূহ অনুসারে, গাঙ্গেয়দেব প্রয়াগে অক্ষয়বত (পবিত্র বটবৃক্ষ) এর অধীনে পরিত্রাণ লাভ করেছিলেন। তার শত শত স্ত্রী তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতায় আত্মহুতি দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন পুত্র লক্ষ্মীকর্ণ (আ. ১০৪১-৭৩ খ্রি.)। লক্ষ্মীকর্ণের ১০৪২ খ্রিস্টাব্দের বারাণসী লেখে তার পিতার প্রথম বার্ষিক শ্রদ্ধা (মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান) উপলক্ষে জারি করা হয়েছিল যা অনুসারে, গঙ্গেয়দেব ১০৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি মারা যান। গাঙ্গেয়দেব একদিকে তাঁর নাম এবং অন্য দিকে দেবী লক্ষ্মীর একটি মূর্তি সহ মুদ্রা জারি করেছিলেন। এই নকশাটি বেশ কয়েকটি উত্তর ভারতীয় রাজবংশ অনুকরণ করেছিল।

লক্ষ্মীকর্ণ (আ. ১০৪১-১০৭৩ খ্রি.)

লক্ষ্মীকর্ণ বা কর্ণ মধ্য ভারতের ত্রিপুরির কলচুরি রাজবংশের শাসক ছিলেন। তিনি ১০৪১ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরির সিংহাসনে তার পিতা গাঙ্গেয়দেবের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর রাজ্য ছিল বর্তমান মধ্যপ্রদেশের চেদি বা দাহাল অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। তিনি তাঁর রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি চন্দ্র, চোল, কল্যাণী চালুক্য, চালুক্য, চান্দেল এবং পাল সহ বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী রাজ্যের অঞ্চলগুলিতে অভিযান চালান ও বেশ কয়েকটি সামরিক সাফল্যের পর, তিনি ১০৫২-১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে চক্রবর্তী উপাধি গ্রহণ করেন।

১০৪৮-৪৯ রেওয়া পাথরের লেখে পূর্বাঞ্চলে বঙ্গ ও অঙ্গে লক্ষ্মীকর্ণের সামরিক সাফল্যের বর্ণনা রয়েছে। বঙ্গে কর্ণ সম্ভবত গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন। তিনি দখলকৃত অঞ্চলের গভর্নর হিসাবে বজ্রদমনকে নিযুক্ত করেছিলেন, যার পুত্র জাতবর্মণ লক্ষ্মীকর্ণের মেয়ে বীরশ্রীকে বিয়ে করেছিলেন এবং পরে লক্ষ্মীকর্ণকে তার অঙ্গ অভিযানে সহায়তা করেছিলেন। লেখটি অনুসারে লক্ষ্মীকর্ণ দক্ষিণে কাঞ্চিকে আক্রমণ করেছিলেন, যা থেকে বোঝা যায় যে তিনি চোল রাজা রাজাধিরাজের সাথে লড়াই করেছিলেন। লেখে তিনি দাবি করেছেন যে তিনি কুন্তলের কল্যাণী চালুক্য রাজা প্রথম সোমেশ্বরকে পরাজিত করেছেন, তবে চালুক্য সভাকবি বিলহন বলেন, সোমেশ্বর লক্ষ্মীকর্ণের শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, কাজেই এই বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই লেখ ও প্রাকৃত-পইঙ্গলে উল্লিখিত একটি অপভ্রংশ শ্লোক অনুসারে লক্ষ্মীকর্ণ গুর্জর দেশে আক্রমণ করে একজন গুর্জর রাজাকে পরাজিত করেছিলেন, যিনি সম্ভবত চৌলুক্যরাজ প্রথম ভীম। পরে ভীম লক্ষ্মীকর্ণের একটি সমরাভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বলে এই দুই রাজ্যের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে হয়।

১০৫২-১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মীকর্ণের চক্রবর্ত্তী হিসেবে দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ সেনাধ্যক্ষ বাপ্পুল্লার রেওয়া লেখ অনুসারে, লক্ষ্মীকর্ণ নিজেকে চক্রবর্তী (সার্বজনীন শাসক) হিসেবে অভিষিক্ত করেছিলেন। তিনি সাধারণ রাজকীয় উপাধি হিসেবে পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ এবং পরমেশ্বর অভিধা গ্রহণ করেন। পিতার কাছ থেকে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে ত্রিকালীধিপতি উপাধি লাভ করেন। সেই সাথে, তিনি রাজাত্রয়ধিপতি উপাধিও গ্রহণ করেছিলেন (ঘোড়া, হাতি এবং মানুষ: তিনটি শক্তির প্রভু)। তাঁর উত্তরসূরিরা লক্ষ্মীকর্ণের মতো শক্তিশালী না হলেও এই উপাধিগুলি ব্যবহার করতে থাকেন।

মালবের পরমাররাজ ভোজ লক্ষ্মীকর্ণের পিতা গঙ্গেয়দেবকে পরাজিত করেছিলেন। ১০৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, লক্ষ্মীকর্ণ এবং চৌলুক্যরাজ প্রথম ভীম ভোজের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠন করেন, এবং ভীম পশ্চিম দিক থেকে আর লক্ষ্মীকর্ণ পূর্ব দিক থেকে মালব আক্রমণ করেন। খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক মেরুতুঙ্গার মতে, দুই রাজার আক্রমণে মালবরাজ ভোজ মারা যান। ভীম ও লক্ষ্মীকর্ণ ভোজের রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে রাজি হলেও ভোজের মৃত্যুর পর লক্ষ্মীকর্ণ সমগ্র মালব অঞ্চলকে দখল করে নিলে ভীম লক্ষ্মীকর্ণের রাজ্য আক্রমণ করে তার রাজধানী ত্রিপুরি পর্যন্ত অগ্রসর হন, আর লক্ষ্মীকর্ণ তাকে হাতি, ঘোড়া এবং ভোজের সোনার মন্ডপিক উপহার দিয়ে একটি শান্তি চুক্তি করেন। এদিকে ভোজের উত্তরসূরি জয়সিংহ মালব পুনরুদ্ধারের জন্য কল্যাণীর চালুক্য রাজা প্রথম সোমেশ্বর কাছ থেকে সহায়তা চাইলে সোমেশ্বর তাঁর পুত্র ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যকে জয়সিংহকে সাহায্য করার জন্য পাঠান। লক্ষ্মীকর্ণ বিক্রমাদিত্যের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন, আর তাই দখলের কয়েক মাসের মধ্যেই লক্ষ্মীকর্ণ মালবের নিয়ন্ত্রণ হারান ও জয়সিংহ ১০৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পৈতৃক সিংহাসন ফিরে পান।

চান্দেল্ল রাজসভার পণ্ডিত কৃষ্ণ মিশ্র রচিত রূপক নাটক প্রবোধ-চন্দ্রোদয় অনুসারে লক্ষ্মীকর্ণ চান্দেল্লরাজ দেববর্মণকে (আ০ ১০৫০-১০৬০ খ্রি.) পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত করেন। বিলহনের বিক্রমাঙ্কা-দেব-চরিত অনুসারে, লক্ষ্মীকর্ণ কালাঞ্জরের প্রভূ দেববর্মণের কাছে কাল ছিলেন। পরবর্তী চান্দেল্ল লেখে দেববর্মণের উত্তরসূরি কীর্তিবর্মণকে চান্দেল্ল শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তাই মনে হয় যে দেববর্মণ লক্ষ্মীকর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। মনে হয়, লক্ষ্মীকর্ণ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চান্দেল্ল অঞ্চলের একটি অংশের উপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত ১০৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে কীর্তিবর্মণ তাকে বিতাড়িত করেন।

লক্ষ্মীকর্ণ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পাল-শাসিত গৌড় অঞ্চল আক্রমণ করেন। বীরভূম জেলার পাইকারে (বা পাইকোর) প্রাপ্ত একটি স্তম্ভলেখে লক্ষ্মীকর্ণের আদেশে একটি চিত্র তৈরির রেকর্ড থেকে বোঝা যায়, লক্ষ্মীকর্ণ বীরভূম জেলা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছেন। নয়পাল (আ. ১০২৭-৪৩ খ্রি.) রাজত্বকালে উৎকীর্ণ সিয়ান পাথরের স্ল্যাব লেখ অনুসারে, লক্ষ্মীকর্ণ এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন ও তিব্বতি বিবরণ অনুসারে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অতিশ নয়পাল এবং “পাশ্চাত্যের কর্ণ্য রাজার” মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি করেছিলেন, যিনি রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে লক্ষ্মীকর্ণ। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর জৈন লেখক হেমচন্দ্র বলেছেন যে লক্ষ্মীকর্ণ গৌড়ের রাজাকে পরাজিত করেছিলেন এবং গৌড়ের রাজা লক্ষ্মীকর্ণকে তাঁর জীবন ও সিংহাসন বাঁচানোর জন্য একটি ভারী নজরানা নিবেদন করেছিলেন। ভি. ভি. মিরাশির মতে, এই রাজা সম্ভবত নয়পালের উত্তরসূরি তৃতীয় বিগ্রহপাল (আ. ১০৪৩-৭০ খ্রি.)। দুই রাজা শেষ পর্যন্ত একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করেন, লক্ষ্মীকর্ণের কন্যা যুবনাশ্রীর সাথে পাল রাজার বিয়ে হয়।

কল্যাণী চালুক্য রাজা প্রথম সোমেশ্বরের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র দ্বিতীয় সোমেশ্বর এবং বিক্রমাদিত্য সিংহাসন অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ দ্বিতীয় সোমেশ্বরের সাথে জোট বেঁধেছিলেন, অন্য দিকে যখন পরমার রাজা জয়সিংহ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের পক্ষে ছিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ এবং দ্বিতীয় সোমেশ্বরের যৌথ বাহিনী মালব ও পরমার রাজ্য আক্রমণ করে এবং জয়সিংহকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে এটি দখল করে নেয়। তবে ভোজের ভাই উদয়াদিত্য লক্ষ্মীকর্ণকে পরাজিত করেন এবং ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে পরমার রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।

লক্ষ্মীকর্ণ আভাল্লা-দেবী নামে এক হূণ রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। কলচুরি লেখ অনুসারে, লক্ষ্মীকর্ণ তার পুত্র যশকর্ণকে রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেছিলেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি তার পুত্রকে ক্ষমতায় বসিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। এটি অবশ্যই ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল, কারণ ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে যশকর্ণের একটি লেখে নতুন রাজার কিছু সমরাভিযানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও তাঁর আরও দুই বড় মেয়ে বীরশ্রী এবং যুবশ্রী ছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের স্ত্রী ছিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ তাঁর রাজবংশের সবচেয়ে পরিচিত রাজা ছিলেন এবং একজন মহান যোদ্ধা হিসাবে খ্যাত ছিলেন। তবে তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ বেশ কয়েকজন সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ পণ্ডিতকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রখ্যাত সংস্কৃত কবি বিলহন, যার বিক্রমঙ্কদেবচরিত বলেছে যে তিনি লক্ষ্মীকর্ণের রাজসভায় অনুষ্ঠিত একটি কাব্যিক প্রতিযোগিতায় গঙ্গাধর নামে একজনকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর রাজসভার অন্যান্য কবিদের মধ্যে ছিলেন বিলন, নচিরাজ, কর্পুর, এবং বিদ্যাপতি। লক্ষ্মীকর্ণ বারাণসীতে কর্ণমেরু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যা সম্ভবত একটি শিবমন্দির ছিল। তিনি প্রয়াগে (আধুনিক এলাহাবাদ) কর্ণতীর্থ ঘাট চালু করেন। তিনি ব্রাহ্মণদের জন্য কর্ণাবতী অগ্রহার (গ্রাম) প্রতিষ্ঠা করেন।

পতন

যশকর্ণ (আ. ১০৭৩-১১২৩ খ্রি.)

লক্ষ্মীকর্ণের পর তার পুত্র যশকর্ণ সিংহাসনে বসেন। তিনি সিংহাসনে বসার কিছু পরেই অন্ধ্র অঞ্চলে আক্রমণ করেন। সেখানে যশকর্ণ শৈব মন্দির দ্রক্ষরামে পূজা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়, সেই অঞ্চলের সমসাময়িক রাজা ছিলেন বেঙ্গী চালুক্যরাজ সপ্তম বিজয়াদিত্য। তিনি চম্পারণ্যে আক্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায় যাকে ভি. ভি. মিরশী বিহারের চম্পারন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তার রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের কিছু অঞ্চল হারান, যেমন গাহারবালরাজ চন্দ্রদেব (আ. ১০৮৯-১১০৩ খ্রি.) তার রাজ্যের বারাণসী দখল করে নেন। পরমাররাজ লক্ষ্মণদেব (আ. ১০৮৬-৯৪ খ্রি.) তার তার রাজ্যে আক্রমণ করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। চান্দেল্লরাজ সলক্ষণবর্মণ (আ. ১১০০-১০ খ্রি.) যশকর্ণকে পরাজিত করেছিলেন। পুরুষ-শিব ছিলেন যশকর্ণের রাজগুরু।

পরবর্তী

যশকর্ণের পুত্র গয়কর্ণ (আ. ১১২৩-৫৩ খ্রি.) পরমাররাজ উদয়াদিত্যের নাতনিকে বিবাহ করেছিলেন, যার ফলে দুই রাজ্যের মধ্যে শান্তি বজায় ছিল। তবে তিনি চান্দেল্লরাজ মদনবর্মণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হন বলে মনে হয়। রত্নাপুরের কলচুরিরা পূর্বে ত্রিপুরির কলচুরিদের সামন্ত ছিল, কিন্তু গয়কর্ণের শাসনামলে তারা তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। গয়কর্ণ তাদের পুনরায় অনুগত করতে ব্যর্থ হন। গয়কর্ণের পুত্র নরসিংহ (আ. ১১৫৩-৬৩ খ্রি.) চান্দেল্লরাজ মদনবর্মণের কাছে হারিয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। নরসিংহ উত্তরাধিকারীহীনভাবে মারা গেছেন বলে মনে হয়, কারণ তার পর তার ভাই জয়সিংহ (আ. ১১৬৩-৮৮ খ্রি.) ক্ষমতায় আসেন। চান্দেল্লরাজ পরমর্দির বিরুদ্ধে জয়সিংহ পরাজিত হন। তিনি রত্নপুর কলচুরিদের পুনরায় অনুগত করতে তাদের বিরুদ্ধেও একটি সমরাভিযান পাঠিয়ে ব্যর্থ হন। জয়সিংহের উত্তরসূরি বিজয়সিংহের (আ. ১১৮৮-১২১০ খ্রি.) রাজত্বকালে সল্লক্ষণ নামে উত্তরের এক সামন্ত কলচুরি আধিপত্যকে উৎখাত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। বিজয়সিংহের উত্তরসূরি ত্রৈলোক্যমল্ল (আ. ১২১০-১২ খ্রি.) কমপক্ষে ১২১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি “কান্বকুব্জের প্রভু” উপাধিটি দাবি করেছিলেন, তবে কোনও প্রমাণের অভাবে, তিনি আসলেই কান্যকুব্জ দখল করেছিলেন কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ত্রৈলোক্যমল্ল তাঁর রাজবংশের শেষ পরিচিত রাজা। তার শাসনকাল কখন এবং কিভাবে শেষ হয়েছে তা জানা যায়নি। এটা জানা যায় যে ১৩শ শতাব্দীর শেষার্ধে, প্রাক্তন কলচুরি অঞ্চলগুলি পরমার, চান্দেল্ল, দিল্লি সালতানাত এবং সেউনাদের (দেবগিরির যাদব) নিয়ন্ত্রণে আসে

চিত্র – দুই রাজবংশের ক্ষমতার গ্রেটেস্ট এক্সটেন্ট

তথ্যসূত্র

  • Durga Prasad Dikshit (1980). Political History of the Chālukyas of Badami.
  • Alaka Chattopadhyaya (1999). Atisa and Tibet.
  • R. K. Dikshit (1976). The Candellas of Jejākabhukti.
  • V. V. Mirashi (1957). “The Kalacuris”. In R. S. Sharma (ed.). A Comprehensive history of India: A.D. 985-1206. Vol. 4 (Part 1).
  • Om Prakash Misra (2003). Archaeological Excavations in Central India: Madhya Pradesh and Chhattisgarh.
  • Richard Salomon (1996). “British Museum stone inscription of the Tripurī Kalacuri prince Valleka”. Indo-Iranian Journal. 39 (2): 133–161. doi:10.1163/000000096790084999. JSTOR 24662062.
  • Krishna Narain Seth (1978). The Growth of the Paramara Power in Malwa.
  • R. K. Sharma (1980). The Kalachuris and their times.
  • Singh, Mahesh (1984). Bhoja Paramāra and His Times.
  • Rajiv Kumar Verma (2015). “Kalachuri Inscriptions : A Reflection of Dwindling Political Power”

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.