হিন্দু শাহী বা ব্রাহ্মণ শাহী (৮২২-১০২৬ খ্রিস্টাব্দ) একটি রাজবংশ ছিল যা ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগের প্রথম দিকে কাবুলিস্তান, গান্ধার এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই শাসকদের সম্পর্কে বিশদ বিবরণ শুধুমাত্র বিভিন্ন ক্রনিকল, মুদ্রা এবং শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়।
Table of Contents
প্রতিষ্ঠা (৮২২ খ্রিস্টাব্দ): তুর্কি শাহীদের উৎখাত
খলিফা আল-মামুনের (Al-Ma’mun) নেতৃত্বে আব্বাসীয়রা ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি শাহীদের কাবুল শাখাকে পরাজিত করে, যারা খোরাসান আক্রমণ করেছিল। এই পরাজয়ের পরে, তুর্কি শাহীদের শুধু ইসলামই গ্রহণ করতে হয়নি, সেই সাথে তাদেরকে মূল শহর এবং অঞ্চলগুলিও ছেড়ে দিতে হয়েছিল। গান্ধার শাখার বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযান শীঘ্রই অনুসরণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়, আব্বাসীয়রা সিন্ধু নদীর মতো সুদূর প্রাচ্যে পৌঁছেছিল এবং একটি গুরুতর বিজয় লাভ করে। উভয় অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের অধিকারের বিনিময়ে একটি মোটা বার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হয়েছিল।
তুর্কি শাহীদের একটি অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হয়, এবং ৮২২ খ্রিস্টাব্দে এর শেষ শাসক লাগাতুরমানকে (Lagaturman) কাল্লার (Kallar) নামে তার একজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত করেন। ঘটনার একমাত্র বিবরণ আল-বিরুনির লেখা থেকে পাওয়া যায়। তিনি লেখেন, “লাগাতুরমানের অশোভন আচরণ স্পষ্টতই তার প্রজাদের কাল্লারের কাছে একাধিক অভিযোগ দায়ের করতে পরিচালিত করেছিল, যিনি অর্থের সুযোগ পেয়ে দ্রুত ক্ষমতায় আসার পথ করে নেন। কাল্লার সংশোধনের জন্য রাজাকে বন্দী করেছিলেন এবং স্থায়ীভাবে সিংহাসন দখল করার আগে রাজার ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হয়েছিলেন।” এইভাবে গান্ধার এবং কাবুলে নতুন “হিন্দু শাহী” রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তুর্ক শাহীদের জাবুলিস্তান শাখা (জুনবিলস) আল-মামুনের অভিযান দ্বারা প্রভাবিত হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত যে সংঘাতে তাদের পতন ঘটে সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগে প্রায় দুই দশক ধরে নিজেদের শাসন অব্যাহত রেখেছিল। আল-বিরুনি ব্যতীত অন্য কেউ কাল্লারের উল্লেখ করেন নি; তার শাসন বা আঞ্চলিক বিস্তৃতি বা এমনকি তার রাজকীয় তারিখ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক প্রস্তাব করেছেন যে “কাল্লার” নামটি “লালিয়া” (Lalliya) নামটির ভুল পাঠ। কলহনের বর্ণনায় লালিয়া যিনি একজন হিন্দু শাহী শাসক, যার বিবরণ তিনি দিয়ে যান। তবে ঐতিহাসিক আব্দুর রহমান কালানুক্রমিক সঙ্গতির অভাবের কারণে এই অনুমানটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
১৮৪৮ সালে, টমাস প্রস্তাব করেছিলেন যে অপ্রচলিত কিংবদন্তি “স্পলাপতি” (“ওয়ারলর্ড”) বহনকারী মুদ্রাগুলি কাল্লার দ্বারা উৎকীর্ণ হয়েছিল; কানিংহাম প্রায় ৫০ বছর পরে থমাসের যুক্তি গ্রহণ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ এডওয়ার্ড ক্লাইভ বেইলির ব্যাকট্রিয়ান লিজেন্ডের ক্ষয়প্রাপ্ত অবশিষ্টাংশকে আরবি সংখ্যা হিসাবে ভুলভাবে বোঝার উপর নির্ভর করে প্রস্তাব করেছিলেন যে “সামন্ত” লিজেন্ড যুক্ত মুদ্রাগুলিও কাল্লার দ্বারা উৎকীর্ণ হয়েছিল। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে “স্পলাপতি” সিরিজটি তার অঞ্চলের ফার্সি অঞ্চলের জন্য ছিল, আর সংস্কৃতভাষী অঞ্চলের জন্য “সামন্ত” সিরিজটি প্রচলন করা হয়েছিল। মিশ্র স্মিথের সাথে একমত পোষণ করেন এবং যোগ করেন যে বন্দী তুর্কি শাহী শাসক লাগাতুরমান যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন কাল্লার তার শাসনের বৈধতা সম্পর্কে অনিরাপদ বোধ করেছিলেন এবং তাই এই ধরনের পরোক্ষ উপাধি দ্বারা নেতৃত্বের দাবিকে নিশ্চিত করেছিলেন।
রহমান এই সমস্ত অনুমান প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এই মুদ্রা সিরিজের বিপরীতে ঘোড়ায় চড়ার চিত্রগুলি বিভিন্ন তুপি পরেছিল, ফলে তারা ভিন্ন শাসক ছিল। এছাড়াও, স্মিথের যুক্তিটি আরও বর্ধিত করলে, অন্য একজন সু-নথিভুক্ত শাসক ভীমদেবকে কালারের আরেক উপাধি বলা উচিৎ। “স্পলাপতি” সিরিজটি প্রকৃতপক্ষে শেষ তুর্ক শাহী শাসকদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। মা’মুনের কাছে পরাজিত হওয়া তুর্ক শাহী শাসক “পতি দুমি”-কে আল-আজরাকি এবং আল-বিরুনি “ইস্পাহবাদ” (ফার্সি: স্পাবাদ অর্থ “সেনাপতি”) হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা “স্পলাপতি” উপাধির সমতুল্য (সংস্কৃত: সমরপতি “ওয়ারলর্ড”)। তাই তিনি মনে করেন, কাল্লার শেষ তুর্কি শাহীদের মুদ্রা ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন শুরু করেননি এবং সামন্ত সিরিজটি পরবর্তী হিন্দু শাহী শাসকদের দ্বারা উৎকীর্ণ হয়েছিল। ২০১০ সালে সংখ্যাবিদ এবং ইতিহাসবিদ মাইকেল আলরামের প্রকাশনাগুলি এই দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ করে; কিন্তু ২০২১ সালে আলরাম “স্পলাপতি” সিরিজটি সহ সকল ষাঁড়/ঘোড়ার মুদ্রাকেই হিন্দু শাহীদের বলে উল্লেখ করেন।
আল-বিরুনি উল্লেখ করেছেন যে, সামন্ত ছিলেন কাল্লারের উত্তরসূরি, তবে তাদের সুনির্দিষ্ট বংশানুক্রমিক সম্পর্কটি বর্ণনা করা হয়নি। কাল্লারের মতো সামন্তের শাসন বা এমনকি তার আসল নাম সম্পর্কে তথ্যের অভাব রয়েছে। ম্যাকডোওয়াল যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আল-বিরুনি সামন্ত সিরিজের মুদ্রার প্রাচুর্যের কারণে তার শাসনের কথা ধারণা করেছিলেন, কিন্তু রহমান উল্লেখ করেছেন যে যদি এটাই সত্যি হয় তবে আল-বিরুনির একই পরিমাণে ভেক্কা সিরিজের জন্যেও আরেক জন চরিত্রের উদ্ভব ঘটানোর কথা ছিল।
সামন্ত সিরিজের প্রোটোটাইপটি সকল ভবিষ্যত হিন্দু শাহী শাসকরা অনুসরণ করেছিলেন – এমনকি হিন্দু শাহীদের স্থলাভিষিক্ত হওয়া মুসলিম গজনবীরাও তা অনুসরণ করে। আর তাই থমাস তাকে হিন্দু শাহীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। রহমান অনুমান করেন যে, সামন্তের অধীনেই হিন্দু শাহীরা কাবুল হারায়, কেননা কাল্লার সেই সময়ের মধ্যে খুব বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ইয়াকুবের কাছে কাবুলের হারানো (৮৭০ খ্রিস্টাব্দ)
৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে জুনবিলরা ইয়াকুবের কাছে পরাজিত হয়। ইয়াকুব সম্প্রতি সাফফারিদ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে আমির হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তার নিয়োগকর্তা থেকে শত্রু বনে যাওয়া সালিহ নাসর (Salih Nasr) জুনবিলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর তাই তিনি এক বছর পরে তাদের সম্মিলিত বাহিনী রুখখাজে ইয়াকুবের তুলনামূলকভাবে ছোট সেনাবাহিনীর দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়। তুর্ক শাহীদের মতো, জুনবিলদেরও সাফাররিদদের ভাসল হিসেবে শাসন চালিয়ে যাবার সুযোগের বিনিময়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল এবং তারপরেও, তৎকালীন শাসকের পুত্র কবরকে (Kbr) বুস্তে বন্দী করা হয়েছিল। ৫ বছর পর কবর পালিয়ে যান এবং রুখখাজ পুনর্দখল করেন। তবে ইয়াকুব পুনরায় এসে রুখখাজ দখল করেন, এবং এর ফলে কবর কাবুলে হিন্দু শাহীদের এলাকায় পালিয়ে যান।
৮৭০ সালের শেষের দিকে ইয়াকুব কাবুলের দিকে অগ্রসর হন এবং বিভিন্ন শহরে ধাওয়া করে কবরকে বন্দী করেন। এই ধাওয়ায় ইয়াকুব কর্তৃক অতিক্রম করা শহরগুলির তালিকা এবং তাদের সুনির্দিষ্ট ক্রমটি একেক সূত্রে একেক রকম। তবে খিলাফতের জন্য উপহার হিসেবে তিনি যে ব্যাপক আকারে পৌত্তলিক মূর্তি এবং হাতি নিয়ে এসেছিলেন, তার থেকে বোঝা যায় যে তার সাথে হিন্দু শাহীদের সংঘাত ঘটেছিল।
ইয়াকুব তার বিজয় এবং তৎকালীন শাসকের কারাবাসের পরে কাবুল শাসনের জন্য কী সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করেছিলেন তা অজানা; আমাদের কাছে কেবল তারিখ-ই-সিস্তানের বিবরণ আছে, যাতে উল্লেখ রয়েছে যে কাবুল ৮৭৮/৮৭৯ সালের শেষের দিকে ইয়াকুবের অধীনস্ত একজন নাম না জানা গভর্নরের অধীনে ছিল। রহমান অনুমান করেন যে এই গভর্নর সামন্তের রক্তের সম্পর্কের কেউ ছিলেন যিনি ইসলামের দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং মুদ্রার দ্বিভাষিক সিরিজ থেকে বোঝা যায় তিনি খুদারায়াকা (Khudarayaka বা ছোট রাজা) উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। পূর্ববর্তী শাসকদের মতো তার বেলাতেও তার প্রকৃত নাম বা শাসনের গতিপথ বা তার চূড়ান্ত ভাগ্য সহ যে কোন তথ্যের অভাব রয়েছে। গান্ধার অঞ্চলে বা তার আশেপাশে তার মুদ্রার অনুপস্থিতি সম্ভবত সেই অঞ্চলগুলির উপর তার নিয়ন্ত্রণের অভাবকে নির্দেশ করে, যা থেকে এও বোঝা যায় যে, গান্ধারে ইয়াকুবের আক্রমণ হয়নি, বা ইয়াকুবের আক্রমণে গান্ধারের কোন ক্ষতি হয়নি। গান্ধার অঞ্চল সম্ভবত সামন্তের আত্মীয়দের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল।
কাবুল পুনরুদ্ধার এবং উৎপলদের সাথে সংঘাত (আনু. ৯০০ খ্রিস্টাব্দ)
জাওয়ামি উল-হিকায়াত মন্তব্য করেছেন যে ইয়াকুবের উত্তরসূরি আমর আল-লাইথের (Amr al-Layth) রাজত্বের (৯০১) শেষের দিকে লোগার উপত্যকা (কাবুলের নিকটবর্তী) হিন্দু শাহীদের কাছে ফিরে আসে। সুতরাং, হিন্দু শাহীরা ৮৭৯ থেকে ৯০১ সালের মধ্যে তাদের অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করেছিল বলে মনে করা হয়। কলহন লালিয়া নামে একজনকে একজন ভয়ংকর হিন্দু শাহী হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন, যিনি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু সহজেই কাশ্মীরের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। রহমান কলহমনের এই বর্ণনাটিকে স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া শাসকের গুণাবলীর অতিরঞ্জন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের রাজধানীটি সম্ভবত উদাভান্দায় স্থানান্তরিত হয়েছিল কারণ এটি আরবি সীমান্ত থেকে অনেক দূরে ছিল এবং রক্ষা করা সহজ ছিল; তবে কাবুলে তাদের একটি শাখা স্থাপন করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
তারিখ-ই-সিস্তানে দুই জন ভারতীয় “রাজার” কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে – যাদেরকে রহমান তোরমান (Toramana) এবং অসত (Asata) নামে পুনর্নির্মাণ করেছেন। খোরাসানে বিদ্রোহ দমন করার জন্য আমর আল-লেইথের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ৯০০ খ্রিস্টাব্দে তারা ফারদাঘান নামে এক গভর্নরের দায়িত্বে থাকা গজনাকে সফলভাবে আক্রমণ করেছিযেন। কিন্তু জাওয়ামি উল-হিকায়াত একটি ভিন্ন বিবরণ দেন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ফারদাঘান গজনার মন্দিরগুলি অপবিত্র করায় হিন্দুস্তানের রাই কমল (Kamala) তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন কেননা রিইনফোর্সমেন্ট পাবার আগে পর্যন্ত তিনি ফারদাঘানের সাথে যুদ্ধ এড়াতে ব্যর্থ হন। ফলাফল যাই হোক না কেন, তোরমান এবং অসত উভয়ই সম্ভবত রাজা না হয়ে লালিয়ার অধীনে পরিচালিত হিন্দু শাহী গভর্নর ছিলেন।
কলহন আরও উল্লেখ করেছেন যে, উৎপল রাজবংশের শঙ্করবর্মণ গুজরাট শাসক অলক্ষণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন, এবং তার বিরুদ্ধে লালিয়া আলখনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন। আর শঙ্করবর্মণ শেষ পর্যন্ত ৯০২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু শাহীদের আক্রমণ করেছিলেন। তিনি সফল হন, কিন্তু কাশ্মীরে ফেরার পথে একটি বিপথগামী তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। এক বছর পরে, তার উত্তরসূরি গোপালবর্মণ হিন্দু শাহীদের পুনরায় আক্রমণ করে তাদের রাজাকে (লালিয়া বা অসত বা অন্য কেউ) পদচ্যুত করেন এবং লালিয়ার পুত্র তোরমানকে নতুন নাম “কমলুক” (Kamaluka) দিয়ে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেন।
হিন্দু শাহী শাসক কমলুকের রাজত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না। তার পুত্র ভীমদেব তার স্থলাভিষিক্ত হন। তার রাজত্বের সাথে সাথে, সাফারিদরা দ্রুত সামানিদের কাছে তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং ৯১৩ খ্রিস্টাব্দের কিছু পরে, ক্ষমতা শূন্যতার ফলে গজনা প্রদেশে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ শক্তির উত্থান ঘটে, লৌইক (Lawik) রাজবংশ, যা ৯৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিকশিত হয়েছিল এবং হিন্দু শাহীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। কমলুকের রাজত্বের সমাপ্তির তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন অপ্রমাণিত জল্পনা রয়েছে, যেগুলো ৯১৩ থেকে ৯৬২ সালের মধ্যেই।
ভীমদেব: আলপ-তেগিনের সাথে সংঘর্ষ এবং কাবুল হারানো (৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ)
আল-বিরুনির তালিকায় “ভীম” হিসাবে একজন শাসকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি শ্রী ভীমদেব মুদ্রা সিরিজের সাথে সম্পর্কিত, এবং তিনিই সম্ভবত হিন্দু শাহীদের সবচেয়ে দক্ষ শাসক ছিলেন। তার ক্ষমতায় উত্থানের কালে প্রতিবেশী হিন্দু শক্তিগুলোরও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যাদের সাথে তার দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। এই সময়ে পাল সাম্রাজ্যের মহিপাল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছিলেন, যদিও তিনি হিন্দু শাহীদের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই পরিস্থিতি সম্ভবত ভীমদেব এবং কাশ্মীরের উৎপলদের মধ্যে বৈবাহিক জোটকে পরিচালিত করেছিল, যারা এরপর থেকে হিন্দু শাহীদের সর্বকালের মিত্র হিসেবে কাজ করবে। ভীমদেবের নাতনি দিদ্দাকে ক্ষেমগুপ্তের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সম্মানে একটি মন্দির চালু করা হয়েছিল। কলহনের মতে তাদের একটি কন্যা ছিল, যিনি লোহারার প্রধান সিংহরাজের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
প্রায় ৯৬২ সালে সামানি সাম্রাজ্যের বিদ্রোহী তুর্কি প্রধান আলপ-তেগিন (যিনি উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়েছিলেন) খোরাসান থেকে হিন্দু কুশের দক্ষিণে চলে যান এবং হিন্দের “কাফেরদের” বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ (জিহাদ) করার অঙ্গীকার করে কাবুল আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কাবুলের গভর্নর পরাজিত হন, এবং হিন্দু শাহীদের সাহায্য করার জন্য আবু আলী লাউইক তার যে পুত্রকে একটি সেনাদল সমেত পাঠিয়েছিলেন, তাকে বন্দি করে শান্তি আলোচনার জন্য পাঠানো হয়। লউইক অনুকূল প্রতিক্রিয়া জানায়নি এবং তেগিনের কাছে পরাজিত হওয়ার পরে তাকে গজনার মূল ভূমিতে ফিরে যেতে হয়েছিল। সেখানে, তাকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল এবং নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল তবে শীঘ্রই তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
লৌইক ভীমদেবের কাছে যাত্রা করেছিলেন এবং অতিরিক্ত সৈন্য পেয়ে ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে গজনা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সম্মিলিত আক্রমণ চালিয়েছিলেন। তারা যোজনা দখল করার পর সেখানে তেগিনের উত্তরসূরি আবু ইসহাক ইব্রাহিমকে গজনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, এবং কাবুল এবং সংলগ্ন অঞ্চলে শাহী-লৌইকের দুর্গ পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। এই বিজয়টি হুন্ড স্ল্যাব শিলালিপিতে (এইচএসআই) স্মরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
তবে এই বিজয়ের ফল স্বল্পস্থায়ী ছিল। ইব্রাহিম ৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে সামানিদের সহায়তা নিয়ে ফিরে আসেন এবং লউইককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। ভীমদেব সম্ভবত এই দ্বন্দ্বে বা তার খুব কম সময় পরই মারা গিয়েছিলেন। হুন্ড স্ল্যাব শিলালিপিতে শত্রুর পরিবর্তে শিবের ইচ্ছায় কীভাবে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল সে সম্পর্কে রহস্যময় মন্তব্যটি সম্ভবত কোনও ধরণের ধর্মীয় আত্মহত্যার উল্লেখ করে।
ভীমদেবের উত্তরসূরিদের প্রত্যেকেরই “পাল” উপাধি ছিল, এবং মুসলিম সূত্রগুলি ভীমদেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের অস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, যার ফলে অনেকে পরামর্শ দেয় যে এই রাজবংশ আর অবিরত থাকেনি, বরং নতুন রাজবংশ এসে শাসন শুরু করে। তবে রহমান দ্বিমত পোষণ করে বলেন, এই জাতীয় অনুমান বা উপসংহারের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।
বিজয়পালদেব (রাজত্বকাল ৯৪২ বা ৯৬৩) নাম একজন শাসকের কথা রত্নমঞ্জরী শিলালিপি থেকে পাওয়া যায় যেখানে তাকে মহারাজাধিরাজ (সর্বোচ্চ সার্বভৌম শাসক) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রহমান প্রস্তাব করেছিলেন যে বিজয়পালদেবকে হয় কাবুল শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, নয়তো কোনও স্থানীয় শাহী জমিদার ছিলেন। খাও আবার দ্বিমত পোষণ করেছেন, কারণ সেটা হলে তার উপাধি মহারাজাধিরাজ হতো না। পরিবর্তে তিনি বিজয়পালদেবকে এক থাক্কানা শাহীর মতো একজন শাসকের দাবিদার হিসেবে বর্ণনা করেন। উল্লেখ্য, কলহনের বর্ণনা অনুসারে থাক্কানা শাহী একজন সমসাময়িক বিদ্রোহী ছিলেন, যাকে কাশ্মীরের রানী দিদ্দা বন্দী করেছিলেন। খাওয়ের মতে, এই পরিচয়টি মুসলিম উৎসগুলোর বিবরণগুলোর সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেগুলোর অনুসারে ভীমদেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ঘটে। আর এই দ্বন্দ্ব শেষ হবার পরই জয়পাল সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
গজনভিদের উত্থান (৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে)
৯৬৯ সালে, ইবনে হাওকাল উল্লেখ করেছিলেন যে আল্প-তেগিনের আগ্রাসনের পরে “শ্রদ্ধার্ঘ” ছাড়াও কাবুলের বাসিন্দাদের উপর নতুন কর আরোপ করা হয়েছিল। ৯৬৬ সালের নভেম্বরে আবু ইসহাক ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর বিলগেতেগিন তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং প্রায় নয় বছর শাসন করেন, ও এর পর তিনি লউইকদের শেষ ঘাঁটি গার্ডিজ আক্রমণের সময় নিহত হন। তার উত্তরসূরি পিরি ছিলেন একজন মদ্যপ ব্যক্তি যার নিপীড়নমূলক শাসনের কারণে গজনার নাগরিকরা লাউইকদেরকে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানায়।
লউইক হিন্দু শাহীদের অধীনে কাবুলের গভর্নরের সহায়তায় আরও একটি অভিযান চালান এবং চরখ (Charkh) অঞ্চলে গজনি, গার্ডেজ, বুস্ট এবং বামিয়ানের মুসলিম বাহিনীর সম্মুখীন হন। উভয়ই যুদ্ধে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এবং মুসলিম বাহিনী সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও একটি অপ্রতিরোধ্য বিজয় অর্জন করেছিল। এরপর সাবুকতেগিন গজনি অঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন, কারণ তিনি শীঘ্রই পিরিকে উৎখাত করেন। এরপর হিন্দু শাহীরা কাবুলকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে এবং গজনবী সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সাথে সাথে শাহীদের সাথে তাদের চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, যা শাহীদের পতনের আগ পর্যন্ত চলতে থাকে।
জয়পাল (৯৬৪ – ১০০১ খ্রি.)
৯৮৬-৮৭ সালে, জয়পাল গজনির দিকে যাত্রা করেছিলেন এবং ঘুজাকে (Ghuzak) সবুকতেগিনের বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছিলেন। যুদ্ধটি অনেক দিন যাবৎ অমীমাংসিত ছিল, কিন্তু শেষে যুদ্ধটি শাহীদের বিরুদ্ধে যায়। ফলে জয়পাল একটি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিতে বাধ্য হন। সবুকতেগিনের পুত্র এবং যুদ্ধের একজন কমান্ডার মাহমুদ একটি চূড়ান্ত পরাজয় ঘটাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জয়পাল যখন সমস্ত মূল্যবান জিনিসপত্র পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন তখন তাকে শান্তিচুক্তি স্বীকার করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। শান্তিচুক্তি হিসেবে জয়পাল এক মিলিয়ন শাহী দিরহাম এবং পঞ্চাশটি যুদ্ধহস্তী ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হন এবং সেই সাথে তিনি সীমান্তের কিছু দুর্গ গজনবিদের কাছে হস্তান্তর করেন। জয়পালের সাথে কয়েকজন গজনভি কমান্ডার এসেছিল যাদেরকে হস্তান্তরিত দুর্গগুলির দায়িত্ব দেবার কথা ছিল, অন্যদিকে জয়পালের তার কিছু আত্মীয় এবং কর্মকর্তাকে সবুকতেগিনকে জিম্মি হিসেবে রাখা হয়েছিল। জয়পাল তার নিজের অঞ্চলে পৌঁছানোর পরে চুক্তিটি বাতিল করেছিলেন এবং কমান্ডারদের কারাগারে ফেলে দিয়েছিলেন, সম্ভবত সবুকতেগিনকে জিম্মি বিনিময়ে বাধ্য করার আশায়।
সবুকতেগিন বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন যে চুক্তিটি লঙ্ঘন করা হয়েছে, তবে একবার এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, তিনি সীমান্ত শহর লামঘান লুন্ঠন করেছিলেন: মন্দিরগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জবাবে, জয়পাল অজ্ঞাত রাজাদের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করেন, এবং কিন্দির (বর্তমান কান্দিবাগ – ?) কাছে গজনভিদের সম্মুখীন হন। গজনবীরা বারবার হালকা আক্রমণ ব্যবহার করে শত্রুসীমা লঙ্ঘন করেছিল এবং এরপর সর্বাত্মক আক্রমণ করে শাহীদের পরাজিত করেছিল, অন্যদিকে শাহীরা সংখ্যায় বেশি হলেও তারা পরাজিত হয়ে সিন্ধু নদীর ওপারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে শাহীরা পেশোয়ার পর্যন্ত পুরো অঞ্চলটি হারায় এবং সবুকতেগিন সেখানে তার নিজস্ব কর সংগ্রহকারী স্থাপন করেছিলেন; সাথে স্থানীয় উপজাতি বা ট্রাইবাল গোষ্ঠীকে তিনি গজনবী বাহিনীতে নিযুক্ত করেছিলেন। গজনবিদের বিজয়ের স্মরণে কিন্ডিতে একটি রিবা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু পেশোয়ার এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি শীঘ্রই শাহীসের কাছে ফিরে আসে, যা সম্ভবত গজনভিদ-শাহী সংঘাতের একটি দীর্ঘ বিরতির সময় ঘটেছিল।
প্রায় ৯৯০-৯৯১ সালে, বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার অভিযোগে মাহমুদকে তার বাবা সবুকতেগিন কারারুদ্ধ করেছিলেন। জয়পাল সম্ভবত মাহমুদকে উদ্ধার, নিজ কন্যাকে তার সাথে বিয়ে দেওয়ার এবং আরও পর্যাপ্ত সম্পদ ও সৈন্য বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার পক্ষে ফাটলটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। মাহমুদ অনুকূল প্রতিক্রিয়া জানায়নি এবং শাহীকে একটি কাফের কুকুর হিসেবে উল্লেখ করে সবুকতেগিনের প্রতি তার নিরঙ্কুশ আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন এবং মুক্তির পরে জয়পালকে আক্রমণ করার অঙ্গীকার করেছিলেন। একই সময়ে, জয়পালকে লাহোরের রাজা ভরত চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, যিনি নন্দন, জয়লাম এবং তাকেশারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন। পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর আনন্দপালকে ভরতের বাহিনীকে প্রতিরোধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তী যুদ্ধে ভরতকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল, সেই সাথে হিন্দু শাহী অঞ্চলে লাহোরকে সংযুক্ত করা হয়েছিল; তবে লাহোরের অভিজাতরা তাদের পুরানো রাজার পক্ষে আবেদন করেছিল, যাকে শ্রদ্ধার্ঘ জানানোর পরে সামন্ত হিসাবে পুনর্বহাল করা হয়েছিল। প্রায় এক বছর পরে, ভরতের পুত্র চন্দ্রক শাহীদের বিরুদ্ধে ভরতের একটি সমরাভিযান পরিচালণার কারণে তাকে পদচ্যুত করেন এবং নতুন সামন্ত হয়ে ওঠেন। ৯৯৮-৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে (দখলের আট বছর পর) জয়পাল তার অধীনস্ত ভরতকে রক্ষার অজুহাতে লাহোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং আনন্দপালকে প্রেরণ করেন। সামুতলার যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশে চন্দ্রককে আক্রমণ ও অপহরণ করা হয়েছিল এবং লাহোর শাহীদের দ্বারা সংযুক্ত করা হয়েছিল। রহমান অনুমান করেন যে শাহীরা যে কোনও অজুহাতে গজনভিদের কাছে তাদের ক্ষতির ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছিল।
৯৯৮ সালে মাহমুদ গজনিতে গজনবী সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং নিজ রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য সমরাভিযান শুরু করেন। শীঘ্রই মাহমুদ শাহীদের দিকে দৃষ্টি ফেরান, এবং কথিত আছে যে, তিনি প্রতি বছর তাদের অঞ্চল আক্রমণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। জীবনের শেষ যুদ্ধে জয়পাল ১০০১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পেশোয়ারের যুদ্ধে মাহমুদের সম্মুখীন হন; আদিরা আফগান নামে বারদারি প্রদেশের একজন শাহী গভর্নর দল পরিবর্তন করেছিলেন এবং শাহী প্রদেশ জুড়ে মাহমুদের সৈন্যদের নিরাপদ ও দ্রুত যাতায়াতে সহায়তা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। জয়পাল আরও রিএনফোর্সমেন্টের আশায় সংঘাতকে বিলম্বিত করার কৌশল গ্রহণ করেন, এবং সেটা বুঝে গিয়ে মাহমুদ অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শীঘ্রই শাহীরা ছত্রভঙ্গ হয়, আর জয়পাল এবং তার পনেরজন আত্মীয়কে বন্দী হিসাবে নেওয়া হয়। প্রায় দশ লক্ষ শাহী সেনাবাহিনীকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই যুদ্ধ-লুণ্ঠন সমসাময়িক ইতিহাসবিদদের বিস্মিত করেছিল: কেবল রাজকীয় নেকলেসগুলির মূল্য ছিল ছয় মিলিয়নেরও বেশি শাহী দিরহাম। মাহমুদ হুন্ড পর্যন্ত তার অভিযান চালিয়ে যান, কারণ তার বাহিনী পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদের তাড়া করে এবং প্রতিরোধের পকেটগুলি ধ্বংস করে দেয়। কয়েক মাসের মধ্যেই সিন্ধু নদীর পশ্চিমে সমগ্র শাহী অঞ্চল মাহমুদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১০০২ সালের এপ্রিলের মধ্যে মাহমুদ গজনিতে ফিরে আসেন।
জয়পালকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তবে মুসলিম ইতিহাসবিদরা কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। মাহমুদের সভা-কবি উনসুরি উল্লেখ করেছেন যে তাকে ক্রীতদাসের বাজারে বিক্রি করা হয়েছিল; মিনহাজ আদ-দ্বীন এবং আল-মালিক ইসামি সেখানে ৮০ দিরহাম/দিনারের মূল্য যোগ করেন। আল-আনসাবের মতো অন্যরা উল্লেখ করেছেন যে মাহমুদ তার ক্ষমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তবে ১০০২ সালের মার্চের দিকে ২.৫ মিলিয়ন দিরহাম এবং ৫০ টি যুদ্ধ-হাতি প্রদানের বিনিময়ে তাকে মুক্ত হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, যাকে রহমানও অধিকতর সম্ভাব্য বলে মনে করেছেন। জয়পাল হুন্ডে ফিরে আসেন এবং আনন্দপালকে সিংহাসন দান করে চিতায় আত্মহুতি দেন।
আনন্দপাল (১০০১-১০১০ খ্রি.) : মাহমুদের সাথে যুদ্ধ ও শান্তি
আনন্দপাল ১০০২ সালের এপ্রিলের দিকে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজধানী শহরটি অজানা রয়ে গেছে তবে সম্ভবত তা নন্দন ছিল। আনন্দপাল কাশ্মীরের তৎকালীন শাসক দিদ্দার প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং তার কমপক্ষে দুটি পুত্র ছিল। তিনি পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে উল্লেখযোগ্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যদিও তার সভার গ্রন্থগুলি পাওয়া যায়নি।
১০০৬ সালের এপ্রিল মাসে মাহমুদ আনন্দপালকে মুলতানের শাসক দাউদকে আক্রমণ করার জন্য তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে পথ দেবার অনুরোধ করেন। আনন্দপাল এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং এমনকি মাহমুদের পারাপার রোধ করার জন্য সিন্ধুর তীরে সৈন্য মোতায়েন পর্যন্ত করেছিলেন। ক্রুদ্ধ মাহমুদ শাহীদের বিরুদ্ধে একটি প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ শুরু করেছিলেন এবং আনন্দপালকে কাশ্মীরে (সোধরা হয়ে) পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন এবং শেষ পর্যন্ত মুলতান জয় করার মূল লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন। “হিন্দ” এর এই সমস্ত অঞ্চলগুলি একটি নব-ধর্মান্তরিত সুখপালের অধীনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
তবে কয়েক বছর পরে, সুখপাল ইসলাম ত্যাগ করেন (আনুমানিক ১০০৬ সালের শেষের দিকে) এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সময়ে আনন্দপাল মাহমুদকে তার সাম্রাজ্যের ওপারে তুর্কি বিদ্রোহ দমনে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন; স্পষ্টতই, তিনি চাননি যে, যে শাসক তাকে পরাজিত করেছিলেন, অন্যের কাছে পরাজিত হন। আনন্দপালের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা তা অজানা, তবে মাহমুদ ইলাক খানকে ধাওয়া করা বন্ধ করে দিয়ে শাহীদের দিকে মনোনিবেশ করেন; সুখপাল সামান্য প্রতিরোধ করেন, কিন্তু তা ব্যর্থ হলে তিনি কাশ্মীরে পালিয়ে যান। কাশ্মীরে তাকে বন্দী, জরিমানা ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত এরপর আনন্দপালকে পরবর্তী গজনবী ভাসল হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
১০০৮ সালের ডিসেম্বরের দিকে মাহমুদ হিন্দু শাহীদের আক্রমণ শুরু করেন, যার কারণ স্পষ্ট নয়। আনন্দপাল তার পুত্রের (ত্রিলোচনপাল) কমান্ডারশিপের অধীনে একটি বিশাল সৈন্যদল প্রেরণ করেছিলেন – সম্ভবত প্রতিবেশী সৈন্যদের সাথে তিনি যোগ দেন। তিনি চাচের সমভূমিতে পৌঁছেছিলেন তবে মাহমুদের সৈন্যদের সিন্ধু নদী অতিক্রম করতে বাধা দিতে ব্যর্থ হন। মাহমুদ কয়েক মাস ধরে পলাতক সৈন্যদের ধাওয়া করেছিলেন – এই প্রক্রিয়ায় তার যুদ্ধ-লুণ্ঠন সংগ্রহের জন্য নগরকোট দখল করেছিলেন এবং এমনকি আনন্দপালের এক পুত্রকে জিম্মি করেছিলেন। বিজিত প্রদেশগুলিতে গভর্নর স্থাপন করা হয়েছিল এবং মাহমুদ পরের বছরের জুনের মধ্যে গজনিতে ফিরে আসেন।
এটি হবে আনন্দপালের শেষ সামরিক সংঘাত; পরের বছর আনন্দপাল মাহমুদের কাছে শান্তির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠান। এই শান্তির প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং বিনিময়ে হিন্দু শাহীদের অধিনস্ততার মর্যাদা গ্রহণ করতে হয়েছিল, তাদেরকে (সীমিত) সামরিক সহায়তা প্রদান করতে হয়েছিল, তাদের ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে গজনভিদ সৈন্যদের অতিক্রমের গ্যারান্টি দিতে হয়েছিল, এবং বার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ জানাতে হয়েছিল। মাহমুদ শান্তি চুক্তির প্রয়োগের তদারকির জন্য তার নিজস্ব এজেন্ট প্রেরণ করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যে স্বাভাবিক বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরায় শুরু হয়েছিল। আনন্দপালের মৃত্যু কোনও ক্রনিকলে লিপিবদ্ধ করা হয়নি; তবে এটি ১০১০ এর শেষের দিক থেকে ১০১১ সালের প্রথম দিকে হয়ে থাকবে। গজনিতে তার যে পুত্রকে জিম্মি করা হয়েছিল তার ভাগ্য অজানা রয়ে গেছে।
ত্রিলোচনপাল (১০১০-১০২১ খ্রি.) এবং ভীমপাল (১০২১-১০২৬ খ্রি.) : মাহমুদের দ্বারা অপ্রতিরোধ্য হার এবং পতন
আল-বিরুনি উল্লেখ করেছেন, ত্রিলোচনপালের তার পিতার মতো ছিলেন না, বরং তিনি তার মুসলিম প্রজাদের প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করেন। ত্রিলোচনপাল আনন্দপালের চুক্তিকে অসম্মান করেননি, তবে মাহমুদ যখন হিন্দু শাহী অঞ্চল দিয়ে থান্বশ্বরের দিকে যাত্রা করতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে সেখানে আক্রমণ না করে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি চুক্তি করতে। মাহমুদ এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং শাহী অঞ্চলের মধ্য দিয়ে একটি নির্বিঘ্ন পথ দিয়ে থানেশ্বরকে লুণ্ঠন করেন। তবে এর ফলস্বরূপ ত্রিলোচনপাল শীঘ্রই মাহমুদের প্রতি বার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন বন্ধ করে দেন এবং যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
১০১৩ সালের নভেম্বরে মাহমুদ ত্রিলোচনপালকে প্রতিহত করতে হিন্দের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু তুষারে ভরা পথ অতিক্রম করতে ব্যর্থ হন। এই বিলম্বের সুযোগ নিয়ে ত্রিলোচনপাল তার পুত্র ভীমপালকে শাহী সৈন্যদের সাজানোর দায়িত্ব দেন এবং কাশ্মীরে যান, যেখানে তিনি তুঙ্গার নেতৃত্বে লোহারা রাজবংশের রাজা সংগ্রামরাজের কাছ থেকে একটি ব্যাটালিয়ন পেয়েছিলেন। পরের বছরের মাঝামাঝি সময়ে মাহমুদের বিরুদ্ধে তার সংঘর্ষ ঘটেছিল। ভীমপাল প্রাথমিকভাবে তার অনুকূলে একটি সংকীর্ণ গিরিপথের স্থানীয় ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগাতে শুরু করেছিলেন এবং মাহমুদের সৈন্যদের উপর তীব্র গেরিলা আক্রমণ শুরু করেছিলেন। তবে এরপর তিনি তার সৈন্যের সংখ্যা অধিক হওয়ায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উন্মুক্ত যুদ্ধে চলে যান; এই কৌশলগত ভুলের কারণে শাহীরা পরাজিত ও বিতাড়িত হয় ও ভীম পালতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধ-লুণ্ঠনের নন্দনেই দুর্গটিকে লুণ্ঠন করা হয়, এবং সেখানে একজন গজনবী গভর্নরকে স্থাপন করে মাহমুদ ত্রিলোচনপালকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ত্রিলোচনপালা পুঞ্চ নদীর তীরে কাশ্মীরি বাহিনীর সাথে তার সেনাঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। এই গজনভিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক সাফল্যের পর তুঙ্গা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে শাহী সেনাপতিদের সাথে আলোচনা না করেই গজনবিদদের আক্রমণ করে বসে, এর ফলে তুঙ্গা পরাজিত হন এবং কাশ্মীরে তৌসির পশ্চিম পর্যন্ত অনেক হারান। রহমান এই অভিযানকে হিন্দু শাহীদের জন্য প্রাণঘাতী আঘাত হিসাবে উল্লেখ করে বলেন- “এর পর থেকে শাহীদের পতন হবে কিনা তা নিয়ে আর প্রশ্ন ছিল না, বরং প্রশ্ন ছিল কখন শাহীদের পতন ঘটবে।”
ত্রিলোচনপাল তার শাসনের শুরু থেকেই গজনভিদের বিরুদ্ধে তার পূর্বসূরীদের দ্বন্দ্বে হারিয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলি পুষিয়ে নিতে সিওয়ালিক পাহাড় পর্যন্ত প্রসারিত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি শারওয়ার চন্দর রাই এর সাথে একাধিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মাহমুদের হাতে এই পরাজয়ের ফলে ত্রিলোচনপালের সিওয়ালিকদের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। এর ফলে তিনি একটি শান্তি চুক্তিতে প্রবেশ করতে বাধ্য হন, এবং এমনকি তার ছেলেকে চন্দরের কন্যার সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছিল তবে ভীম যখন কনেকে বাড়িতে আনতে গিয়েছিলেন তখন তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং চন্দর ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন। এর ফলে নিম্ন হিমালয়ে ত্রিলোচনপালের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটে, যদিও ছোটখাট সংঘাত অব্যাহত ছিল।
মাহমুদ যখন তার কানৌজ অভিযান (আনুমানিক ১০১৭) থেকে ফিরে আসার সময় শারওয়াকে লুণ্ঠন করেছিলেন, তখন ত্রিলোচনপাল পরমার ভোজের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। শীঘ্রই, দোয়াবের উল্লেখযোগ্য রাজশক্তিগুলো একে অপরের সাথে এবং হিন্দু শাহীদের সাথে একই মাত্রার ভবিষ্যত আক্রমণ এড়াতে চুক্তিতে প্রবেশ করে। মাহমুদ এই জোটগুলিকে সদয়ভাবে গ্রহণ করেননি এবং ১০১৯ সালের অক্টোবরে ফিরে এসেছিলেন। চান্দেলার বিদ্যাধর ত্রিলোচনপালের সৈন্যদেরকে মাহমুদের সৈন্যদের রামগঙ্গা (বুলন্দশহরের আশেপাশে কোথাও) অতিক্রম করতে বাধা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং তারা পূর্ব তীরে অবস্থান নিয়েছিলেন কিন্তু কাজটি সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে, ত্রিলোচনপাল সম্ভবত প্রধান লড়াইয়ে বিদ্যাধরের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তবে মাহমুদের সৈন্যদের দ্রুত আক্রমণের ফলে তাদের আরও একটি দুর্দান্ত পরাজয় ঘটে। বুলন্দশহরকে লুণ্ঠন করা হয় এবং তার দুই স্ত্রী ও কন্যাকে কারারুদ্ধ করা হয়। তিনি একটি শান্তি-চুক্তিতে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হন, যার ফলে তিনি বিদ্যাধরের কাছে পালিয়ে যান। তিনি শিবিরে এসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি তবে বিদ্যাধর ততক্ষণে তার সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন বলে জানা যায়।
১০২১ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিলোচনপাল অজ্ঞাত কারণে তার বিদ্রোহী হিন্দু সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন। ভীমপাল অবশ্যই এর মধ্যে চন্দর রাই এর রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তিনি ত্রিলোচনপালের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১০২৬ সাল পর্যন্ত শাসন চালিয়ে যান; তার শাসন বা অঞ্চল সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।
পরবর্তী অবস্থা
ইলতুৎমিশের সময়ে উত্পাদিত রাষ্ট্রীয় কারুশিল্পের একটি ম্যানুয়াল হল আদব আল-হারব। এখানে গজনভিদের সম্পর্কে অনেক অনন্য তথ্য রয়েছে। এখানে উল্লেখ আছে যে, ১০৪০ সালে কাবুল শাহের নাতি স্যান্ডবাল প্রথম মাসউদের কারাবাস এবং এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে তার অনুকূলে ব্যবহার করার জন্য লাহোরের দিকে যাত্রা করেছিলেন। সৈন্যরা কাদার জুরে (বা কালাচুর) মিলিত হয়েছিল এবং শাহীদের অধিকতর সংখ্যা থাকা সত্ত্বেও তারা পরাজিত হয়েছিল কারণ তুর্কি তীরন্দাজ দ্বারা সান্দবাল নিহত হবার পর তার সৈন্যরা আতঙ্কিত অবস্থায় যুদ্ধ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তিনি সিওয়ালিকদের আশেপাশে রাজত্ব করতেন বলে মনে করা হয় এবং সম্ভবত তিনি একজন শাহী উত্তরাধিকারী ছিলেন। অনেক সমসাময়িক মুসলিম ইতিহাসে একই সময়ে গজনভিদের ব্যর্থ আক্রমণ করার জন্য দুজন হিন্দু শাসকের কথা উল্লেখ করেছেন। দুজনই ক্ষুদ্র সিওয়ালিক সর্দার ছিলেন, কিন্তু এদের মধ্যে সান্দবাল নাম কেউ ছিলনা।
কিছু শাহী কাশ্মীরে পাড়ি জমান এবং তাদের সভায় বিশিষ্ট পদ লাভ করেন।
Leave a Reply