আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তুরস্কে নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দুই দশকের বেশির ভাগ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং পশ্চিমে তিনি খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও তার ইসলামপন্থী পপুলিজম তুরস্কে সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়েছে। তবে জরিপ থেকে জানা যায় গত কয়েক মাস ধরে এরদোয়ানের আবেদন হ্রাস পেতে শুরু করেছে, ও তিনি এখন প্রধান বিরোধী প্রার্থীর পেছনে অবস্থান করছেন। তো এই লেখায় এমন তিনটি কারণের দিকে নজর দেয়া হবে যেগুলির কারণে এরদোয়ান এই নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। কারণ তিনটি হচ্ছে, তুরস্কের বাজে অর্থনীতি, দেশটিতে নতুন একীভূত বিরোধী দল, এবং ভূমিকম্পের পর তার সরকারের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া। একে একে সব আলোচনা করা যাক… (বিশেষ করে শেষেরটা খুব ইন্টারেস্টিং)
১। তুরস্কের অর্থনীতি মূলত আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার গত ১৮ মাস ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে (কেন তা নিয়ে আগেই লিখেছি)। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়ায়, তবে এরদোয়ান মনে করেন এই ধারণাটি তথাকথিত সুদের হার লবির দ্বারা পরিচালিত একটি ষড়যন্ত্র ( সেইসাথে উল্লেখ্য, ইসলামে সুদ হারাম, আর তিনি ইসলামিক পপুলিজমের রাজনীতি করেন), তাই পরিবর্তে তিনি সুদের হার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং এর জন্য দরকার পড়লে তিনি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করা যে কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এই নীতির ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২১ সালের মার্চ মাসে সুদের হার ১৯ থেকে কমিয়ে আজ, মানে ২০২৩ এর মার্চে ১০.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং অর্থোডক্স অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন ২০২১ এর ডিসেম্বরে দেশটির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি যে ২০ শতাংশ ছিল তা ২০২২ এর ডিসেম্বরে ৮০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসল ফল হয়েছে এর চেয়েও বাজে। ইস্তাম্বুলের চেম্বার অফ কমার্স দ্বারা সংকলিত মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপকারী একটি অনানুষ্ঠানিক সূচক অনুসারে দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার হয়েছে ১০৭ শতাংশ, অন্যদিকে একটি স্বাধীন মুদ্রাস্ফীতি গবেষণা গ্রুপ দ্বারা বিকশিত আরেকটি অনানুষ্ঠানিক সূচক অনুসারে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে ১৮৫শতাংশ!
যাইহোক, এই ফেব্রুয়ারিতে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি কমে ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে, আর দেশটির জিডিপিও স্পষ্টতই তুলনামূলকভাবে ভাল কাজ করছে, তবুও সাধারণ তুর্কি জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, ২০২২ সালে তুর্কি অর্থনীতি ৫.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও, এই প্রবৃদ্ধির কারণ ছিল – প্রথমত, তুর্কি পরিবারগুলির মরিয়া ভোগের বা ডেসপারেট কনজাম্পশন বিঞ্জ দ্বারা চালিত হওয়া, এবং দ্বিতীয়ত, তুরস্কের তাদের দুর্বল মুদ্রা দ্বারা সক্ষম শক্তিশালী রফতানি। দুটোই ব্যাখ্যা করছি। তুর্কি পরিবারগুলো বুঝতে পেরেছিল যে তাদের মুদ্রা লিরা এভাবে আস্তে আস্তে মূল্যহীন হওয়ার আগেই এগুলো খরচ করে ফেলা দরকার। ফলে মুদ্রার মান কমতে থাকায় তারা বেশি করে ব্যয় করতে থাকে ও বিভিন্ন প্রোডাক্ট বা সার্ভিস ভোগ করতে থাকে, আর সেজন্যই দেশটির জিডিপি অনেক গ্রোথ বাড়ে। অন্যদিকে, মুদ্রার মান কমলে দেশের রফতানি বাড়ে, কারণ অন্যান্য দেশ কম খরচেই সেই দেশ থেকে আমদানি করতে পারছে। সহজ কথা হল, মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে জিডিপি বাড়ানো সম্ভব, কিন্তু সেটা কখনোই কাম্য নয়, কারণ তাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক কমে যায়, কারণ জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়, কিন্তু ইনকাম বাড়ে না। সুতরাং প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি গ্রোথ ভাল মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত কারণগুলি ইতিবাচক নয়। এটা ঠিক যে, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ক্রমাগত তুরস্কে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু সেই মজুরি বৃদ্ধি বরাবরই দেশটির মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে অনেক পিছিয়েই রয়েছে, এবং এভাবে তুর্কিদের একটি বিশাল অংশ তাদের জীবনযাত্রার মানের তীব্র পতনের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে।
২। তবে অর্থনীতিই এরদোয়ানের একমাত্র সমস্যা নয়। পরবর্তী নির্বাচনে তার সম্ভাব্য পরাজয়ের দ্বিতীয় কারণ হ’ল তুরস্কের নতুন একীভূত বিরোধী দল। তুরস্কের বিরোধী দলগুলি কিছুদিন আগে উপলব্ধি করেছে যে, তারা যদি এরদোয়ানকে পরাজিত করতে চায়, তবে তার একমাত্র উপায় হ’ল তাদের একটি অভিন্ন জোট গঠন করতে হবে। এজন্য গত বছরের ডিসেম্বরে ছয়টি প্রধান বিরোধী দল (যা টেবিল অফ সিক্স নামে পরিচিত) ঘোষণা করে যে, তারা সাংবিধানিক সংস্কারের একটি প্যাকেজ নিয়ে একসাথে চলবে, যার প্রাথমিক লক্ষ্য হবে দেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনা। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে একটি বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে এরদোয়ান নিজেই বর্তমান নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, যা দেশের রাষ্ট্রপতিকে, মানে এরদোয়ানকে ব্যাপক সাংবিধানিক ক্ষমতা দান করে।
তবে এখানে প্রাথমিকভাবে এরদোয়ানের সৌভাগ্য ছিল এখানে যে, এই ছয় সদস্যের মধ্যে যে প্রধান হবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই প্রার্থী হলেন যথাক্রমে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের বিরোধী মেয়র মানসো ইয়াবাশ ও একরাম ইমামোগুল। কিন্তু, তাদের এহেন জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও প্রধান বিরোধী দলের নেতা কেমাল কিলিচদারোলু স্পষ্টতই তার চান্স ছাড়তে চাননি। কিন্তু সমস্যা হল, এই কিলিচদারোলু ছিলেন অন্য দুই প্রার্থীর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম জনপ্রিয়, এবং অতীতে তিনি একাধিকবার এরদোয়ানের কাছে পরাজিতও হয়েছেন। গত সপ্তাহে ইস্যুটি এতটাই বড় আকার ধারণ করে যে, জোটটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে ছিল, আর তুরস্কের ডানপন্থী গুড পার্টির নেতা তো বলেই বসেছিলেন যে, তিনি জোটটি ত্যাগ করতে চান, কারণ মূলত তিনি মনে করেন না যে, কিলিচদারোলু জোটটি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। তবে শেষপর্যন্ত সোমবার জোটটি অবশেষে ঘোষণা করে যে, তারা একটি নতুন হায়ারার্কি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিলিচদারোলুই তাদের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বা প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট হবেন, আর ইয়াভাশ ও ইমামোগু হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট। আদৌ এদের জেতার চান্স আছে তো? আছে, কারণ এই নতুন সিদ্ধান্ত এরদোয়ানের জন্য আরও খারাপ খবর, কারণ বিভক্ত বিরোধী দলের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দল স্পষ্টতই বেশি কার্যকরী, সেই সাথে জরিপ থেকে জানা যায় যে, কিলিচদারোলু অন্যান্য প্রার্থীদের মতো অতটা জনপ্রিয় না হলেও তিনিএরই মধ্যে এরদোয়ানের চেয়ে ১৫ পয়েন্ট এগিয়ে আছেন।
৩। তবে এরদোয়ানের সমস্যায় পড়ার আরেকটি কারণ রয়েছে। এই তৃতীয় কারণটি হচ্ছে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে এরদোগানের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া। আপনি সম্ভবত জেনে থাকবেন, গত মাসে তুরস্ক এবং সিরিয়ায় যে ভূমিকম্পগুলি আঘাত হেনেছে সেগুলো, বিশেষ করে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি সত্যিই বিপর্যয়কর ছিল। ভূমিকম্পের ফলে ৫৩,৩৬৩ লোক মারা গেছে, যাদের মধ্যে ৪৬,১০০ জনই ছিল তুরস্কের, আর তাই এটি স্থান করে নেয় একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চম মারাত্মক ভূমিকম্প হিসেবে। উপরন্তু, এর ফলে ১.২৫ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে, এবং সেই সাথে ইউনাইটেড ন্যাশনস অনুমান দিয়েছে যে, ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা তুরস্কের জিডিপির ১০ শতাংশেরও বেশি। এখন, কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন চলমান সরকারের জন্য খারাপ খবর হয়না, তুরস্কের ক্ষেত্রেও সেটা হতো না, কেননা ভূমিকম্পটা তো আর এরদোয়ানের দোষে হয়নি। কিন্তু ভূমিকম্পের পর ও আগে এরদোয়ান এই ব্যাপারে যা যা করেছেন, তার পেছনে এরদোয়ানের দোষ আছেই। ভূমিকম্পের পর কেডিয়ানের প্রতিক্রিয়া এবং ভূমিকম্পের আগে এরদোয়ানের কিছু নীতি বেশ সমালোচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কের অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দলগুলি দুর্যোগ-স্থানে পৌঁছতে দেরি করে, এবং ভূমিকম্পে যে পরিমানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেই তুলনায় তাদের অবদান খুব কমই ছিল। এখন অবস্থা যদি এই হয়, তবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের যা করা উচিত তা হলো নাগরিকের কাছে এই গাফলতির জন্য ক্ষমা চাওয়া, কিন্তু এরদোয়ান তার প্রতিক্রিয়ার জন্য কোনও সমালোচনা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সূষ্টি হল, আর পরে তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন, আর স্বীকার করলেন যে, “আমরা প্রথম কয়েক দিনে যেভাবে কাজ করতে চেয়েছিলাম সেভাবে কাজ করতে পারিনি এবং এর জন্য আমি ক্ষমা চাইছি”। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এবারে ভূমিকম্পের পূর্বে এরদোয়ানের সরকারের নেয়া নীতিগুলোর দিকে তাকানো যাক। এখানে তিনি বেশ কিছু কারণে সমালোচিত হয়েছেন। প্রথমত, তুরস্কে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক কর রাজস্ব ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যা এরদোয়ানের সরকার ব্যয় করেনি, মানে প্রাকৃতিক সম্পর্কিত বিষয়ে এই অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এরদোয়ানের সরকার সেটা করেনি। দ্বিতীয়ত, আগে বলে নেই ১৯৯৯ সালেও তুরস্কে একটি বড় আকারের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল, আর সেই ভূমিকম্পে যে ব্যাপক আকারে ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হয়, সেগুলো যেন আর না ঘটে সেজন্য বেশ কিছু সুরক্ষা বিধি তৈরী করা হয়, কিন্তু এরদোয়ান সরকার এইসব সুরক্ষা বিধিগুলি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিভাবে ব্যর্থ হল? এরদোয়ান দ্রুত তুরস্কে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি গ্রোথ চাচ্ছিলেন, আর সেজন্য তিনি জোর দেন রিয়্যাল এস্টেটে। এর জন্য খুব দ্রুত প্রচুর দালান নির্মাণ করার উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু এত দ্রুত ও কম খরচে এইসব দালান তৈরী করার চাপের জন্য অনেক বিল্ডিং-এই ভূমিকম্প প্রতিরোধী সেই সব সুরক্ষা বিধিগুলো ঠিকঠাক পালন করা হয়নি। আর এরদোয়ানও এই দোষগুলো ধরেননি, এগুলোর জন্য বরং তিনি এমনেস্টি বা ক্ষমা কার্যকর করেছেন। তো এবারের ভূমিকম্পে যে বিল্ডিংগুলো ভেঙ্গে পড়ে সেগুলোর কিছু ছিল এইসব ক্ষমাপ্রাপ্ত বিল্ডিং, যেখানে সুরক্ষাবিধিগুলো ঠিকঠাক পালন করা হয়নি। আর ভূমিকম্পের ফলে ধ্বসে পড়তে হলো কিনা এগুলোর কয়েকটিকেই। ব্যাস, সমালোচনার বন্যা শুরু। কিন্তু এখানেও আরেকটি ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট আছে। সেই ১৯৯৯ সালে ঘটে ভূমিকম্পের পরও তদকালীন তুর্কি সরকারের প্রতিক্রিয়া বেশ নিষ্ক্রিয় ছিল, আর সেই সাথে ভূমিকম্পের ফলে দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি। আর তুরস্কের এই সংকটকে উপজীব্য করেই ২০০৩ সালে ক্ষমতায় এসেছিল এরদোয়ানের একেপি পার্টি। নির্বাচনে জিতবার জন্য এই এর্দোয়ানই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি তার সরকারের দক্ষতা এতটা বৃদ্ধি করবেন যাতে এরকম ঘটনা আর দ্বিতীয়বার না ঘটে! কিরকম আয়রনি খেয়াল করুন, সিচুয়েশন একই, কিন্তু তিনি এবার অপোজিট সাইডে…
(তথ্যসূত্র – প্রচুর, সবই সার্চ ইঞ্জিন দ্বারা উপলভ্য)
Leave a Reply