তিন সপ্তাহ আগে সোমবার, চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন গর্ব করে বলেছে যে এই বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের জন্য দেশের জিডিপি নাম্বারগুলো খুবই ভাল। চীনের অর্থনীতি এই বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের নিম্নের ফলে তাদের জিডিপি সেবার ২৬% সংকুচিত হয়েছিল, এবারে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, এই ত্রৈমাসিকে তারা রিটার্ন করেছে। যাইহোক, এই মন্তব্যগুলো করার মাত্র এক দিন পরে, চীনের সরকারী পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ নীরবে ঘোষণা করে যে, দেশটির এই ত্রৈমাসিকের পরিসংখ্যান প্রকাশে দেরি হবে, যেখান থেকে অনুমান করা যায় যে, চীনা অর্থনীতি প্রত্যাশার তুলনায় খারাপই আছে। যাই হোক লেখায় চীনের স্ট্রাগলিং ইকোনমি ও এর কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করা হবে। সেই সাথে এও আলোচনা করা হবে যে কেন অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে, চীনের পক্ষে প্রাক-মহামারি গ্রোথ রেট (বছরে প্রায় ৮%) যাবার সম্ভাবনা নেই তা নিয়েও আলোচনা হবে।
হেডলাইন স্টোরি দিয়ে শুরু করা যাক। মঙ্গলবার, চীন তৃতীয় ত্রৈমাসিকের জন্য তার জিডিপি পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। এখন, কেউই এখানে খুব একটা ব্রিলিয়েন্ট নাম্বার এক্সপেক্ট করে বসে নেই। ইকোনমির ব্লুমবার্গ চীনের ৩.৩% জিডিপি গ্রোথের ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিল, যা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির টারগেট ৫.৫% এর চেয়ে অনেক কম। আর সেই সাথে চীনের এই গ্রোথ রেইটের বেশিরভাগই আসলে গত ত্রৈমাসিকের সংকোচন থেকে পুনরুদ্ধারের কাজে করছে। উল্লেখ্য, এই তিন পারসেন্টের হিসেবটা আসলে কোয়ার্টারলি হিসাব। যদি গত ছয় মাসের গ্রোথ রেইটের কথা বিবেচনা করা যায়, মানে আগের ত্রৈমাসিকের কন্ট্রাকশনের ব্যাপারটা বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে ছয় মাসে গ্রোথ রেইট দাঁড়াচ্ছে ০.৪%-এ, মানে যেটা বললাম, এই ত্রৈমাসিকের গ্রোথ রেইটটা জাস্ট আগের ত্রৈমাসিকের কন্ট্রাকশনকে পুনরুদ্ধার করছে। চীনের এই পরিসংখ্যান প্রকাশের ডিলে হবার একটি কারণ হতে পারে যে, তারা চায়না মানুষের নজর এখন চীনের চলমান পার্টি কংগ্রেস থেকে দূরে সরে যাক। কিন্তু তারপরও এটি সাজেস্ট করছে যে চীনের জিডিপি নাম্বারগুলো এক্সপেক্টেশনের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
যদি চীনের জিডিপি নাম্বার তেমন ভাল না হয়, তবে এর অর্থ সম্ভবত এই যে, দেশটির রিয়াল ইকোনোমি খারাপের দিকেই আছে। এর কারণ হল চীন সম্ভবত তার জিডিপি পরিসংখ্যানকে অতিরঞ্জিত করে, এবং এটি কোন ফোবিক ষড়যন্ত্রেরও লক্ষণ নয়। ২০০৭ সালে উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত মার্কিন কূটনৈতিক ক্যাবলের মতে, চীনের বর্তমান প্রিমিয়ার আমেরিকান কূটনীতিকদের বলেছিলেন যে চীনের জিডিপি পরিসংখ্যান “শুধুমাত্র রেফারেন্সের জন্য” এবং আঞ্চলিক জিডিপি ডেটাকে তিনি মনুষ্যসৃষ্ট হিসাবে বর্ণনা করেন। তদনুসারে, গবেষকরা চীনের ঘোষিত জিডিপি পরিসংখ্যানকে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য বিভিন্ন প্রক্সির সাথে তুলনা করেছেন এবং উভয়ের মধ্যে বড় অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০২-২০১২ সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইট দ্বারা পরিমাপ করা হিসাবে রাতে দেশের আলোর উজ্জ্বলতার সাথে জিডিপি পরিসংখ্যানের তুলনা করার গবেষণার দিকে তাকানো যাক। এটিকে উদ্ভট শোনাতে পারে, কিন্তু রাতে একটি দেশের আলোর উজ্জ্বলতা আসলে দেশটির জিডিপি কত তার জন্য বেশ ভাল একটি প্রক্সি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, তথাকথিত মুক্ত দেশগুলিতে যেখানে জিডিপি ডেটা প্রায়শই কিছু পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে যায়, এবং তাই জিডিপি নিয়ে মিথ্যা বলা অনেক কঠিন, সেখানে রাতে কোন দেশের আলোর উজ্জ্বলতা দিয়ে প্রায় পুরোপুরিভাই তাদের জিডিপি পরিসংখ্যানকে ট্র্যাক করা যায়। পরে এই গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে গবেষকগণ অংশিকভাবে মুক্ত ও মুক্ত নয় এমন দেশগুলোর জিডিপি দেখেন। দেখা যায়, কোন দেশ জোট কম স্বাধীন বা মুক্ত, তা তত বেশি তাদের জিডিপিকে অতিরঞ্জিত করে, আর চীন হলো এই অফেন্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপগুলোর মধ্যে একটি। রাতে আলোর উজ্জ্বলতা অনুসারে, গত ২০ বছরে চীনে জিডিপি বেড়েছে ১৭৫ শতাংশের মতো, কিন্তু চীন দাবি করেছে এদের ইকোনোমি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৭৫ শতাংশ। এখন রাতে আলোর উজ্জ্বলতাই একমাত্র প্রক্সি নয়, আরও অনেক রকমের গবেষণা হয়েছে, কিন্তু সবেতেই যেটা হবার কথা তার সাথে যেটা পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে পার্থক্য পাওয়া গেছে। তো চীনের অফিশিয়াল ফিগারটাই বাজে হচ্ছে বলে তা ডিলে করছে, কিন্তু অফিশিয়াল ফিগারেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ভেবে দেখুন চীনের রিয়্যাল ইকোনমি এর কি অবস্থা। তো চীনের ইকোনমির এই বাজে অবস্থার কারণটা কি?
চীনের এই বাজে ইকোনমি এর পেছনে মোটামুটি কারণ তিনটি – সমকালীন প্রপার্টি ক্রাইসিস, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি এর জিরো কোভিড পলিসি, এবং তাদের বর্ধিষ্ণু জিওপলিটিকাল টেনশন। চলুন ওদের প্রপার্টি ক্রাইসিস নিয়ে শুরু করা যাক। এই বিষয়ে বলতে গেলে অনেক কিছুই বলতে হয়, কিন্তু এখানে সংক্ষেপে কিছু বলব। চীনের ডেট ফুয়েলড প্রপার্টি বাবল নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। তো চীনা সরকার সেটাকে ডিফ্লেট করার জন্য গত দুবছর আগে তথাকথিত তিনটি রেড লাইন টেনে দেয়, যেগুলো প্রপার্টি ডেভেলপাররা কতটুকু অর্থ ঋণ নিতে পারবে তাতে সীমাবদ্ধতা টেনে দেয়। কিন্তু ভাল মনে করে এটি চালু করা হলেও এর ফলে চীনের প্রপার্টি সেক্টরে ধ্বস নামে, এভারগ্র্যান্ডের মতো বড় বড় ডেভেলপাররাও ডিফল্ট করে। কিন্তু এখানেই শেষ ছিল না, এরপর থেকে চীনের প্রপার্টির অবস্থা খারাপ হতেই থাকে, আর গত কয়েক দিন আগে চাইনিজ ডেভেলপারদের বরোয়িং কস্ট রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতায় উঠেছে। এটি একটি খারাপ খবর, কারণ চিপ ক্রেডিট ছাড়া আরও বেশি করে প্রপার্টি ডেভেলপারদেরকে স্ট্রাগল করতে হবে, তারা আরও বেশি করে ডিফল্ট করবে। আর এর মানে হচ্ছে সামনের মাসগুলোতে চীনের ইকোনমির অবস্থা আরও খারাপ হবে।
এবারে জিরো-কোভিড এর দিকে যাওয়া যাক. কোভিড এর অধিকতর সংক্রামক ওমাইক্রন ভেরিয়েন্টের প্রাদুর্ভাবের পর সিসিপি দেশে জিরো-কোভিড পলিসি নিয়ে আসে, যা চীনের ইকোনোমিতে বাজে এফেক্ট ফেলে। গোটা দেশ জুড়ে অব্যাহত লক ডাউনের ফলে দেশের অর্থনীতিতে ক্যাপ পড়ে, এবং বিজনেস ও কনজিউমার কনফিডেন্স – দুটোর অবস্থায় খারাপ করে দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণগুলোর জন্যই সিসিপি এই পলিসি থেকে সরে আসতে পারছে না। এমন নয় যে, এই পলিসিটি আবশ্যিকভাবে একটি খারাপ পলিসি, কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনের পার ক্যাপিটা কোভিড মৃত্যু অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, এবং দেশটিতে বয়স্কদের মধ্যে ভ্যাক্সিনেশন রেইট অন্যান্য দেশের তুলনায় কমই, আর এটাকেও বিবেচনায় আনতে হবে। কিন্তু সিসিপি গত দুই বছর ধরে প্যানডেমিকে তাদের রেকলেসনেসের সমালোচনা করে এসেছে, এবং এখন শি চিনফিং এর জন্য একটি হলমার্ক পলিসি হয়ে উঠেছে, ফলে এখন এটিকে রিভার্স করা রাজনৈতিকভাবে কঠিন, এমনকি এর বাজে ইকোনোমিক কন্সিকুয়েন্স থাকলেও।
চীনের ইকোনমির ফাইনাল ইস্যুটি হচ্ছে এর জিওপলিটিক্স। চীনের সাথে আমেরিকার মধ্যকার রাইভালরি, ও আরও জেনারেলি বললে পাশ্চাত্যের সাথে অধিকতর অথরিটেরিয়ান রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার রাইভালরি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর অবশ্যই এই জিওপলিটিকাল টেনশনের ইকোনমিক কন্সিকুয়েন্স আছে। চীন আরও আক্রমনাত্মকভাবে তার কৌশলগত শিল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যেগুলোর মধ্যে ক্রিপ্টোর মতো ইন্ডাস্ট্রি আছে, এবং এর বিপর্তিতে আমেরিকা চীন-আমেরিকান বাণিজ্যের উপর ক্রমবর্ধমান কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করছে, বিশেষ করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, সাম্প্রতিক সেমিকন্ডাক্টর সানক্শনের কথাই ধরা যাক। সব মিলিয়ে এটি বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে, যার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখন রেকর্ড হারে চীনা ঋণ এবং ইক্যুইটিগুলি অফলোড করছে। একইভাবে, পশ্চিমা দেশগুলি চীনা বিনিয়োগের বিষয়ে ক্রমবর্ধমানভাবে সতর্ক হয়ে উঠছে, এবং এমনকি ছোট ছোট জোটবদ্ধ দেশগুলিও আনসাস্টেইনেবল পরিমাণে চীনা ঋণ গ্রহণের বিষয়ে দুবার ভাবছে। এখন, এর আংশিক কারণ এই যে, চীন ঋণ পুনর্গঠন বা ঋণ ক্ষমা খুব একটা করতে চায়না, এমনকি দুর্দশার সময়েও। যেমন, রাজনীতিবিদরা চীনের তথাকথিত ঋণ ফাঁদ কূটনীতি বা ডেট ট্র্যাপড ডিপ্লোমেসি সম্পর্কে ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্বিগ্ন, আর অভিযোগ করা হয় যে, চীন তাদের কৌশলগত সুবিধাগুলো আদায় করে নেবার জন্য তাদের ফাইনান্সিয়াল লেভারেজগুলো ব্যবহার করে। ২০০৭ সালে শ্রীলংকার সাথে এমনটাই ঘটেছিল। চীন একটি নতুন বন্দর নির্মাণের জন্য শ্রীলঙ্কাকে প্রকার অর্থ ঋণ দিয়েছিল, এটি একটি গভীর জলের বন্দর যা সামরিক জাহাজকে হোস্ট করতে সক্ষম। এদিকে শ্রীলংকা সেই ঋণ ফেরত দিতে না পারলে চীন বন্দরটি ৯৯ বছরের লিজের বিনিময়ে ঋণটি মওকুফ করে দেয়। এখন এই অভিযোগটির বিরুদ্ধেও যুক্তি আছে। কারণ চীনের সমস্ত ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে রোডিয়াম গ্রুপ এবং সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট দ্বারা পরিচালিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ঋণ ফাঁদ কূটনীতি যদি থেকেও থাকে তবুও তা খুব বিরল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋণগুলি রিটেন অফ বা স্থগিত করা হয়। এখন অভিযোগটি ঠিক ভুল যায় হোক, এটা ঠিক যে, অন্তত কিছু রাজনীতিবিদের মধ্যে ধারণা কাজ করছে যে চীন ঋণ ফাঁদ কূটনীতিতে জড়িত এবং এটি তাদের চীনা বিনিয়োগ সম্পর্কে সতর্ক করে তুলেছে। এই অবস্থায় জিওপলিটিকাল টেনশন বা ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার সাথে সাথে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে তাদের অর্থ উত্তোলন করছে এবং বিভিন্ন দেশ চীনের সাথে ডিল করার জন্য কম ইচ্ছুক হয়ে উঠছে।
তো এই তিনটিই হচ্ছে চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ। আর এই তিনটির মধ্যে কোনোটারই খুব শীঘ্রই হ্রাস পাবার সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে, আর তাই অনেক বিশ্লেষক চীনের নিয়ে তাদের গ্রোথ ফোরক্যাস্টকে সংশোধন করছেন, উদাহরণস্বরূপ, ব্ল্যাকরক এখন আশা করে যে আগামী দশকের জন্য চীনা প্রবৃদ্ধির গড় হবে তিন শতাংশের মতো, যা বেইজিং ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অর্জন করা ৭.৭ শতাংশ গড়ের অর্ধেকেরও কম। এখন, তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি এখনও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির চেয়ে অনেক বেশি। সর্বোপরি, ওইসিডি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতিটি জি-৭ দেশে প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশের নিচে নেমে আসবে। কিন্তু তারপরেও, এই সামান্য উচ্চতর বৃদ্ধির হার সম্ভবত চীনকে বিশ্ব পরাশক্তি হবার মর্যাদার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য যথেষ্ট নয়, যেটা সিসিপির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a Reply