দাঁশায় উৎসব বা দাসাই উটসব হলো খেরোয়াল সাঁওতাল দের একটি শরৎকালের বাৎসরিক উৎসব। কেউ কেউ বলেন, এই সময়ে সাঁওতালদের অনার্য রাজা হুদূর দুর্গার পূজা হয়, এক আর্য গণিকা এই অনার্য রাজাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল বলে দাঁশায় উৎসবে সাঁওতালরা শোক প্রকাশ করে। দুর্গা পূজা এদের মতে আর্যদের দ্বারা অনার্যদের দমন করার সিম্বলিজম। কিন্তু এসব কথা এভিডেন্স নির্ভর বলে মনে হয়না। কেন আমি এই ন্যারেটিভকে ভুল বলে মনে করি তার পেছনে কয়েকটা যুক্তি তুলে ধরছি…
(১) সাঁওতালদের নিয়ে যতগুলো ক্ষেত্রসমীক্ষা হয়েছে, এথনোগ্রাফিক কাজ হয়েছে, কোনটিতেই হুদুড় দুর্গা নামে কারও উল্লেখ্য নেই, তার উদ্দেশ্যে পূজার কথাও উল্লেখ নেই। ১৯শ শতকের সাঁওতাল গবেষক মাঝি রামদাস টুডু রেস্কার “খেরওয়াল বংশা ধরম পুথি” গ্রন্থে (খেরোয়ালদের ধর্ম সহ সংস্কৃতি নিয়ে লেখা), ধুনি সোরেনের “History of Santhals” গ্রন্থে, রেভারেন্ড P.O. Bodding এর “Traditions and Institutions of the Santhals” গ্রন্থে, সুরেন্দ্রমোহন ভৌমিকের “সাঁওতালী কথা” (১৯৫৫) গ্রন্থে, বুদ্ধেশ্বর টুডুর “অথ সাঁওতাল কথা” গ্রন্থে, ই.টি. ডাল্টনের “The Tribal History of Eastern India” (1978) গ্রন্থে, সি.এল. মুখার্জির “The Santal” (1962), এইচ. এইচ. রিসলি এর “The Tribes and Castes of Bengal” (1981), জে. ট্রইসি এর “Tribal Religion, Religious Belief and Practices Among the Santals.” (1979) সহ ক্ষেত্রসমীক্ষা করা ও গবেষণাধর্মী কোন গ্রন্থে হুদুর দুর্গার কোন উল্লেখ পাওয়া যায়না।
(২) সাঁওতালি ভাষায় হুদুড় শব্দটি মেঘ ও বজ্র অর্থে পাওয়া যায়, এবং দুর্গা শব্দটি সাঁওতালি ভাষায় পুরুষের নাম হিসেবে পাওয়া যায় (এই দাবি নিয়ে সন্দেহ আছে) বলেই হুদুড় দুর্গা নামে যে একটি সত্তা সাঁওতালিদের মধ্যে থাকবে তা দাবি করা যায়না।
(৩) প্রাক-খ্রিস্টান ও অ-খ্রিস্টান সাঁওতালদের ধর্ম হলো এনিমিজম বা সর্বপ্রাণবাদ। দৈব, অতিপ্রাকৃতিক বা আত্মা-শক্তিকে তারা বোঙ্গা বলে। (১) নং-এ যে সূত্রগুলোর কথা বলা হলো, সেগুলো অনুসারে সাঁওতালদের বেশ কয়েকজন উপাস্য বোঙ্গা রয়েছে। তারা মানুষের অমঙ্গল করার ক্ষমতাসম্পন্ন মারাং বুরুকে (সম্ভবত মুণ্ডাদের থেকে পাওয়া দেবতা), সৃষ্টিকর্তা ঠাকুর জিউকে, সূর্যদেব সিং বোঙ্গা, চন্দ্রদেব চান্দু বোঙ্গা (সিং বোঙ্গা ও চান্দু বোঙ্গা আসলে একজন বোঙ্গাই, সিং ও চান্দু তার দুটো রূপ), বনের দেবী জাহের এরা ও গোসাই এরা (বাহা উৎসবে পূজিত), সীমা বোঙ্গা (ধান কাটার পর পূজিত), বুরু বোঙ্গা (অজানা পর্বত দেবতা), সাকেত বোঙ্গা, সুনুম বোঙ্গা ইত্যাদি বোঙ্গার পূজা করে। কিন্তু হুদুর দুর্গার কথা কোথাও পাওয়া যায়না।
(৪) দাঁশায় উৎসবের সঙ্গীতগুলো থেকে কখনই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে এগুলোতে হুদুড় দুর্গার কথা বা হুদুড় দুর্গার মৃত্যুতে শোকের কথার উল্লেখ আছে। দাঁশায় এর কয়েকটি গানের লিরিক্সের বঙ্গানুবাদ করে দেয়া হলো –
ক. “প্রচন্ড অনাবৃষ্টির ফলে দেশ দিশম জ্বলে পুড়ে যায়, হে ঠাকুর বৃষ্টি দাও”
খ. “কতো দূরে গো গিরু নদী, কতো দূরে গো বাহা নদী হায়রে। হায় ওই যে দেখা যায় গো ওই দেখা যায় গিরু নদী তে জুয়া খেলা হয়, বাহা নদী তে ধুলো উড়ে যায়।”
গ. “কাশ মাঠে কাকী মানুষে মানুষে তীরঃবিদ্ধ করে/কদমক্ষেতে কাকী মানুষে মানুষে কাটাকাটি করে/ কি জন্য কাকী মানুষে মানুষে তীরঃবিদ্ধ করে?/ কি জন্য কাকী মানুষে মানুষে কাটাকাটি করে?/ দেশের সীমানার জন্য কাকী মানুষেমানুষে লড়াই করে/ ঘরের জন্য কাকী মানুষে মানুষে কাটাকাটি করে/ মা যদি আমার থাকত আমি চাক্ষর মেপে নিতাম/ বাবা যদি থাকত আমার হাতে মেপে নিতাম।”
ঘ. “অনাবৃষ্টির ফলে মানভূমের(পুরুলিয়া) জঙ্গল এবং সিমভূমের জঙ্গলও যেন জ্বলে পুড়ে গেছে। ছিতা- কাপরা (ছিতা ও কাপরা জাহের দেবীদের অন্যতম দুই দেবী) আপনারা বৃষ্টি দিন।”
ঙ. “দেবী দুর্গা বাহির হলেন, আয়নম, কাজল (আয়নম ও কাজল দেবীর সহচর, লক্ষ্মী, সরস্বতীর প্রতিরূপ ও বলা যেতে পারে) বাইরে এলেন, দেশের জন্য, দিশমের জন্য এবং সিঁদুর-তেল-পুস্পের জন্য। অর্থাৎ পূজা পাবার জন্য এরা বাহির হলো, এসো দুর্গা বাতাস হয়ে, এসো আয়নম কাজল ঘুর্ণি হয়ে সুদূর মহাকাশের স্বর্গপুরী থেকে। এটাই সাঁওতালদের দেবী আবাহন। দেবী বন্দনা বা পুজো করার ফলে ভালো বৃষ্টি হয়েছিল- তাই “বঠেল বঠেল” আনন্দসূচক ধ্বনি প্রয়োগ হয়।”
এই গানগুলোর কোনটি থেকেই হুদুড় দুর্গা সম্পর্কে কোন কিছু ধারণা করা যায়না।
(৫) দেখা যাচ্ছে (ঙ) নং গানটিতে সরাসরি দেবী দুর্গার কথা বলা হয়েছে। যারা হুদুড় দুর্গার তত্ত্ব দিচ্ছেন তারা একই সাথে বলছেন যে খেরোয়ালি সাঁওতালদের কাছে দেবী দুর্গা খলনায়িকা, কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে সাঁওতালরাই দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে ভাল ফসল ও সমৃদ্ধির জন্য আহ্বান করছে, আর সেটা দাঁশায় এর সময়ই, যখন দুর্গা পূজা হয়। এটা হুদুড় দুর্গা তত্ত্বের বিরুদ্ধেই যায়। উল্লেখ্য, এই দুর্গার কনসেপ্টটাও সম্ভবত সর্বপ্রাণবাদী সাঁওতালরা হিন্দুদের থেকেই পরবর্তী কালে গ্রহণ করে থাকবে। কেননা ১৯৬২ সালেই মুখার্জি উল্লেখ করেছিলেন, খরা থেকে বাঁচতে সাঁওতালরা সীমা বোঙ্গার উদ্দেশ্যে আচার অনুষ্ঠান পালন করে। হতে পারে, হিন্দুদের দেবী দুর্গা আর সাঁওতালদের সীমা বোঙ্গার ধারণা একটা সময়ে এসে মিশে যায়, আর তার ফলে দাঁশায় এর মত উৎসবের গানে দুর্গার প্রবেশ ঘটে।
(৬) যারা হুদুড় দুর্গার ধারণা কল্পনা করেন, তারা দাঁশায় এর গানগুলো থেকেই অনুমান করেন। যেমন এদের কিছু গানে “হায়রে, হায়রে” শব্দ পাওয়া যায়। এরা বলেন এই “হায়রে” শব্দগুলো আসলে দাঁশায় এর শোককে নির্দেশ করছে যা হচ্ছে আর্য গণিকার হাতে হুদুড় দুর্গার মৃত্যুর শোক। কিন্তু (ঙ) নং এর দেবী দুর্গা নিয়ে এদের গানটিতেই কয়েকবার “হায়রে” বলা হয়েছে (“হায়রে হায়রে দিবি দুর্গা দয় ওডোক এনা রে আয়নম কাজল দকিন বাহের এনা রে হায়রে হায়রে…”)। সেই সাথে (ঘ) নং এর অনাবৃষ্টি নিয়ে গানে “হায়রে” বলা হয়েছে (“হায়রে হায়রে অকয় যাপে জুঁডিয়াদা হায়রে হায সিঞবির দ ল: কান দ হায়রে…”)। এখানে হায়রে শব্দ দ্বারা অনাবৃষ্টির দুঃখের দিকটাই নিয়ে আসা হয়েছে।
(৭) হুদুড় দুর্গার তাত্ত্বিকদের বলতে দেখা যায়, দাঁশায় এর অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র হলো ভুয়ৌং, যার কথা দাঁশায় এর গানে আছে – “তকারে দ ভুয়াং এম জানামলেনা রে?/ তকারেদ ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে?/…”। তারা বলছেন, ভূয়ৌং সাধারণত শুকনো লম্বা লাউ এর খোল দিয়ে তৈরি হয়, যার ভেতরে তীর- ধনুক সহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুকনো থাকে। তাদের মতে ভুয়ৌং এর সাথে এই অস্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে, এটাই হুদুড় দুর্গার প্রামাণ্য নির্দেশ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা কিছুই প্রমাণিত হয়না।
(৮) হুদুড় দুর্গার তাত্ত্বিকগণ বলেন, সাঁওতাল সামাজিক প্রথায় গৃহ দেবতা, গ্রামের দেবতা, পূজা পদ্ধতি প্রভৃতির মূল জিনিস বা রীতিনীতি নারী বা নারীভিত্তিক নয়। এদের মতে সাঁওতালদের এই নারীবিদ্বেষী সামাজিক রীতির কারণ হচ্ছে আর্য গণিকার হাতে হুদুড় দুর্গার মৃত্যু। কিন্তু কথা হচ্ছে সাঁওতালরা যে তাদের বাহা উৎসবের সময় জাহের এরা ও গোসাই এরা নামক বনদেবীদেরকে পূজা করে, সেই সব নারী দেবীদের কথা এরা ধর্তব্যেই আনলেন না, আর ডিরেক্টলি বলে দিলেন সাঁওতালদের নারী দেবী নেই ও তারা নারীবিদ্বেষী।
(৯) এথনোগ্রাফিক স্টাডিগুলোতে দাঁশায় সম্পর্কে অনেক কথাই উঠে এসেছে। কিন্তু যারাই এটি নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা এটি নিয়ে হুদুড় দুর্গা সম্পর্কে কিছুই পাননি, বরং সাঁওতালদের দুর্গা পূজার ব্যাপারটাই উঠে এসেছে। যেমন Bodding তার “Studies in Santhal Medicine and Folklore” (Asiatic Society) বইতে দাঁশায় সম্পর্কে লিখেছেন, “This is a common name among the Santhals for the Durga Puja. This is naturally not a Santhal Festival – it is celebrated by the many Bengalis living in the country, the Santhals participating as active spectators.”
(১০) যে ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে ১৯৯২ সালের দিকে এই আর্য গণিকার হাতে অনার্য হুদুড় দুর্গার মৃত্যুর তত্ত্বটি দান করেন, তিনিও অন্য একটি প্রবন্ধে দাঁশায় সম্পর্কে হুদুড় দুর্গা সম্পর্কে তো কিছু লেখেনই নি, বরং উৎসবটির শোকের মত হবারও কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি। একে একটি আনন্দ উৎসব বলেই মনে হয়, যেখানে হুদুড় দুর্গার ধারণার লেশমাত্র নেই। তিনি সাঁওতালদের দাঁশায় উৎসব সম্পর্কে লিখছেন, “শরৎকালে সাঁওতাল ছেলেরা দল বেঁধে দাঁসায়” নৃত্যগীত বাড়ি বাড়ি প্রদর্শন করে থাকে। এ নৃত্যের সাজসজ্জা ও উপকরণ দেখার মতো। মাদল, ধামসা ব্যবহৃত হয় না, তার বদলে লাউয়ের খোল দিয়ে তৈরি “ভুয়াং” নামক বাদ্যযন্ত্র, কাঁসর ও বাঁশি তারা ব্যবহার করে। মেয়েদের রঙিন শাড়িকে ধুতি ও পাগড়ি করে পাগড়িতে ময়ূরের পালক গুঁজে শরীরে পরে মেয়েদের অলঙ্কার। কখনও যদি দু’দলের সাক্ষাৎ ঘটে যায় তখন উভয় দলের প্রীতি সৌহার্দ্য বিনিময়ের পর উভয়পক্ষই রাজি থাকলে দাঁসায় তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। এটাও একধরণের লোকনাট্য। অঙ্গভঙ্গিসহ প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্তরের পর উত্তর দিয়ে তর্ক, গ্রামের সবাই এই তর্কযুদ্ধ দেখা ও শোনার জন্য উপস্থিত হয়। তবে উভয় দলের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ দেখা দিলে উভয় দলকে সরিয়ে দেওয়া হয়।”
এসব কারণে আমি মনে করি, হুদুড় দুর্গার ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে কোন ঐতিহাসিকতা থাকা দূরের কথা, এর পূজার বাস্তবতা পর্যন্ত একটি মিথ, যেটা পালন করা হয় সেটা অর্বাচীন বা নতুন। এই বিশেষ ন্যারেটিভটির উদ্দেশ্য পুরোপুরি রাজনৈতিক, ও সম্ভবত ভারতের মূলনিবাসী আইডেন্টিটি পলিটিক্স থেকে এর জন্ম।
Leave a Reply