রাশিয়া ইউক্রেইনের যুদ্ধের একটি ফল ছিল যে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট ন্যাটোর শক্তিশালী হয়ে ওঠা। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দুটো দেশ, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডও এর ফলে ন্যাটোর সদস্য হতে চায়, যারা মে মাসের মাঝামাঝিতে ন্যাটোতে অন্তর্ভূক্ত হবার এপ্লিকেশন পাঠায়। কিন্তু এপ্লিকেশন আসার কয়েক দিন পরেই তুরস্ক জানায় যে তারা এই এপ্লিকেশনকে ভিটো করবে ও তাদের মেম্বারশিপকে আটকে দেবে। তবে এরপর বেশ কিছু রেশারেশির পর জুনের শেষের দিকে শেষ পর্যন্ত তুরস্ক ঘোষণা করে যে, দেশ তিনটি তাদের মধ্যকার পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব রিজল্ভ করে নিয়েছে ও দেশটি ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানকে সমর্থন করে।
তো তুরস্ক কেন প্রথম দিকে দেশ দুটোর ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে রাগান্বিত ছিল? সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সাথে এরদোয়ানের সমস্যার মূল কারণ ছিল কুর্দিশ জাতীয়তাবাদ, আরও বিশেষভাবে বললে পিকেকে পার্টি। গত চার দশক ধরে তুরস্ক পিকেকে বা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এরা পূর্ব তুরস্কে কুর্দিশ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছে, আর এর ফলে তুরস্কের সরকার এদেরকে টেরোরিস্ট বলে দাবি করছে। এই অবস্থায় সুইডেন ও ফিনল্যান্ড – এই দুই দেশের পিকেকে-কে সাপোর্ট করার কোন প্রমাণ না থাকার পরও তুরস্ক এই দুটো দেশকে পিকেকে এর প্রতি বেশি সফট হবার জন্য অনেক দিন ধরেই অভিযুক্ত করে আসছে। এদিকে বরং সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আসলে পিকেকে-কে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসেবেই বিবেচনা করে, আর সুইডেনই ছিল ইউরোপের প্রথম দেশ যারা পিকেকে-কে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন ঘোষণা করেছিল, পিকেকে এর বিরুদ্ধে ২০০২ সালে ইইউ এর স্যুটেরও প্রায় ২০ বছর পূর্বে দেশটি সেটা করে।
তাহলে কেনই বা তুরস্ক মনে করেছিল যে এরা পিকেকে এর প্রতি বেশি নরম? প্রথমত, উভয় দেশেই বেশ ভাল পরিমাণে কুর্দরা বসবাস করে। সেই সাথে দেশগুলোতে বসবাসরত কুর্দরা প্রায়ই কুর্দদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ক্যাম্পেইন করে। দ্বিতীয়ত, তুরস্ক দাবি করে যে, ইউরোপের টার্কিশ গ্রুপগুলো পিকেকে ফান্ডিং করে সহায়তা করছে। তৃতীয়ত, সুইডেন কিছু প্রো-পিকেকে মিডিয়া আউটলেট হোস্ট করে, যেগুলোর মধ্যে একটি হলো সারদাশ টিভি। চতুর্থত, তুরস্ক দেশ দুটোকে কতিপয় কুর্দকে তুরস্কে পাঠিয়ে দিতে বলেছে, যাদেরকে তুরস্ক পিকেকে এর সদস্য বা পিকেকে এর সদস্যদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে, কিন্তু দেশ দুটো তাতে অসম্মত হয়েছে। টার্কিশ জাস্টিস সেক্রেটারি অনুসারে, গত ৫ বছরে তুরস্কের এই এক্সট্রাডিশনের রিকোয়েস্ট ছিল ৩৩টি, যেগুলোর একটিও অনুমোদিত হয়নি। তুরস্ক থেকে বলা হয়েছে এই ৩৩ জনের সাথে হয় পিকেকে এর সম্পর্ক রয়েছে, অথবা তারা তুরস্কে ২০১৬ সালের মিলিটারি ক্যুতে কোনভাবে জড়িত ছিল। এদের এক্সট্রাডিশন না হওয়ায় তুরস্ক সবসময়ই আপসেট ছিল। শুধু এখানেই শেষ নয়। ইইউ, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড – সকলেই ২০১৯ সালে নর্দার্ন সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর জন্য তুরস্কের সমালোচনা করেছিল। এমনকি সুইডেন এর জন্য তুরস্কের ওপর পারশাল আর্ম এম্বার্গোও বসিয়েছিল। ইইউ যেখানে সিরিয়ায় তুরস্কের ইন্টারফিয়ারেন্সকে ফরেইন ইনভ্যাশন হিসেবে দেখে, সেখানে এরদোয়ান বলেন, সিরিয়ায় কাজ করা কুর্দিশ গ্রুপ আসলে পিকেকে-এরই এক্সটেনশন, যাকে আবার তুরস্ক টেরোরিস্ট সংগঠন বলে মনে করে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপারটা আরও দূরে চলে গেছে। তুরস্ক ইরাকি সিকিউরিটি ফোর্সের সাথে মিলে এখন উত্তর ইরাকে পিকেকে-দেরকে টারগেট করতে শুরু করেছে। এসব ছাড়াও সুইডেনে ২০১৮-২২ মেয়াদের সরকারের পার্লামেন্টে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট কুর্দিশ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট ছিলেন (এখন নেই)। তিনি হচ্ছেন আমিনেহ্ কাকাবাভেহ্। তাকে এরদোয়ান টেরোরিস্ট বলে বর্ণনা করেছেন, এবং তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী তাকে তুরস্কে পাঠিয়ে দেবার দাবি করে। একজন একক এমপি হিসেবে তিনি গত বছরে সুইডেনের সরকারকে কনভিন্স করিয়েছিলেন যাতে সুইডেন নর্দার্ন সিরিয়ার অটোনোমাস রেজিয়ন নিয়ন্ত্রণ করা “ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি”-কে দেয়া সহায়তা বৃদ্ধি করে, যারা হলো সেই অঞ্চলের কুর্দিশ পলিটিকাল পার্টি, যারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পিপলস প্রোটেকশন ফোর্স বা YPG এর সাথে সম্পর্কিত। স্বাভাবিকভাবেই এটাকে এরদোয়ানের ভাল লাগার কথা নয়, কারণ তুরস্ক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই YPG এর ঘোরতর বিরোধী এবং তাদের বিরুদ্ধেই দেশটি সিরিয়ায় মিলিটারি পাঠায়। বলতে গেলে তুরস্কে PKK যা, সিরিয়াতেও YPG ঠিক তাই। তুরস্ক এই YPG-কেও একটি টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন বলেই মনে করে। কিন্তু কিছুদিন আগেও ফিনল্যান্ড ও সুইডেন এদেরকে তেমন কোন তকমা দেয়নি।
তাহলে এতক্ষণে আসল ঘটনাটা বুঝে গেছেন নিশ্চই। তুরস্ক পিকেকে-কে সাংঘাতিকভাবে ঘৃণা করে, কিন্তু সুইডেন-ফিনল্যান্ড সহ অন্যান্য অনেক ওয়েস্টার্ন রাষ্ট্রই পিকেকে নিয়ে অত দ্রুত নিজেদের সিদ্ধান্ত দানে অপারগ, তারা এদের নিয়ে তেমন ভাবিতও নয়, তার ওপর এরা মনে করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর তুরস্কের নাক গলানোটাও মাত্রাতিরিক্ত। আর এই মতানৈক্যই তুরস্ক ও নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গুরুতর উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আর ঠিক এই কারণেই যখন সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদান করতে চায়, যেখানে জয়েন করতে ন্যাটোর এক্সিস্টিং মেম্বারদের সকলেরই ভোটের প্রয়োজন হয়, এরদোয়ান সেখানে ন্যাটোতে তার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজের পক্ষে লাভের একটা সুযোগ পেয়ে যায়। তিনি তাই পিকেকে ইস্যুকে কেন্দ্র করে এদের মেম্বারশিপ ব্লক করে দেন। আর কয়েক সপ্তাহ ধরে দর কষাকষির পর এরদোয়ান তাতে সফলও হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত, ন্যাটো ঘোষণা করে যে, তুরস্ক, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড তাদের মধ্যকার ইস্যুকে রিজল্ভ করে ফেলে, সেই সাথে বলা হয় তিনটি দেশ একটি ট্রাইল্যাটারাল মেমোরেন্ডামেও সাইন করেছে।
তো সেই মেমোরেন্ডামে কী ছিল? নর্ডিকরা তুরস্কের চাপে ঠিক কোন ব্যাপারগুলোকে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হলো? আসলে এই এগ্রিমেন্টের শুরুতে বেশ কিছু অস্পষ্ট ব্যাপার স্যাপার দেখা যায়, যেখানে বিভিন্ন নীতিকে জাস্ট রিঅ্যাফার্ম করা হয়। কিন্তু প্রথম কনক্রিট একশনটা পাওয়া যায় পেইজের মাঝামাঝিতে এসে, যেখানে লেখা হয়, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড “YPG বা PYD-কে কোন সাপোর্ট দান করবে না” যারা হচ্ছে নর্দার্ন সিরিয়ার পিকেকে এর এফিলিয়েট। এখন এর মধ্যে হয়তো এই উভয় অর্গানাইজেশনকেই টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসেবে ডেজিগনেশন দেয়াটাও জড়িত থেকে থাকবে, সেই সাথে হয়তো এই সংগঠনগুলোর সাথে সম্পর্কিত যেসব লোক ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে বাস করছে তাদের এক্সট্রাডাইট করার ব্যাপারটাও হয়তো এখানে জড়িত থাকবে। এরপর মেমোরেন্ডামে দেখা যায়, উভয় দেশই পিকেকে এর বিরুদ্ধে তুরস্ককে সমর্থন করায় সম্মত হয়েছে, সেই সাথে তুরস্কে আরোপ করা যেকোন আর্মস এম্বার্গোও তুলে নিতে সম্মত হয়েছে। বলা হয়েছে, এই তিনটি দেশ কো-অপারেশনের জন্য একটি জয়েন্ট কমিটি তৈরি করবে, এবং এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন “তুরস্কের পেন্ডিং ডিপোর্টেশন ও এক্সট্রাডিশন রিকুয়েস্টগুলোকে অ্যাড্রেস করবে।” মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষরিত হবার পর, টার্কিশ জাস্টিস মিনিস্ট্রি স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে, এখন তিনি আশা করেন যে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড এখন তাদের পূর্বে অনুরোধকৃত ৩৩ জন লোকের সকলকেই এক্সট্রাডাইট করার কথা বিবেচনা করবে, যা নিঃসন্দেহেই একটা বিগ মুভ। সেই সাথে মেমোরেন্ডামে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন সম্মত হয়েছে যে, তারা তুরস্কের ইইউ এর কমন সিকিউরিটি ও ডিফেন্স পলিসিতে তুরস্কের ফুলেস্ট পসিবল এংগেজমেন্টকে সহায়তা করবে, যাদের মধ্যে একটি হচ্ছে মিলিটারি মোবিলিটিতে PESCO প্রোজেক্ট।”
সব মিলিয়ে বলতে হয়, দেশ দুটিকে ন্যাটোতে ঢুকবার জন্য তুরস্কের অনেক কিছুকেই হজম করতে হয়েছে। কিন্তু ন্যাটোর ক্ষেত্রে এর অর্থ কী? স্বাভাবিকভাবেই এই এগ্রিমেন্টটা কুর্দিশ কজের প্রতি সিম্প্যাথেটিক এমন কারও জন্য খুব একটা ভাল খবর নয়, বিশেষ করে যারা সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে বাস করছে তাদের জন্য। কিন্তু অন্যদিকে এটা আবার ন্যাটোর ইউনিটির জন্য ভাল খবর। খুব কম মানুষই আশা করেছিল যে, দেশ তিনটি একটি এগ্রিমেন্টে পৌঁছতে পারবে। দেশ দুটোর সাথে যে তুরস্কের সংঘাতের অবসান হলো, তাকে ন্যাটোর জন্য একটি সাফল্যই বলতে হয়। একই সাথে এটা ন্যাটোর ইস্টার্ন ফ্ল্যাংককেও শক্তিশালী করছে। কেন? এটা ঠিক যে সুইডেনের ডিফেন্স বাজেট অত বেশি না, তাদের বাজেটের মাত্র ১.৩% মিলিটারি স্পেন্ডিং-এ যায়, যা তারা বাড়িয়ে ২% করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হবে। কিন্তু ফিনল্যান্ডের ব্যাপারটা পুরো ভিন্ন। এদের মিলিটারি গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ইম্প্রেসিভগুলোর মধ্যে একটি। তাদের প্রায় ৯ লক্ষ রিজার্ভ পারসোনেল আছে, যেখানে তাদের জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লক্ষ! এদের এক্টিভ ফাইটিং ফোর্স ২২ হাজার লোকের। আর ফিনল্যান্ডের ডিফেন্স ১.৫% হলেও (ওরাও তা বাড়িয়ে ২% করতে যাচ্ছে) এদের আর্টিলারি সিস্টেম ইউরোপের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী, সেই সাথে এদের এয়ারফোর্সও খুব শক্তিশালী যেখানে প্রায় ১৬০টি প্লেইন আছে। তাই বলতেই হয় যে, দেশ দুটো ন্যাটোর ইস্টার্ন ফ্ল্যাংকের শক্তি অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে, আর তাই তারা ন্যাটোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসেটও হবে।
বিভিন্ন দেশে কুর্দদের সাম্প্রতিক ইতিহাস ও সংগ্রাম নিয়ে জানতে কমেন্ট সেকশনে একটা লিংক দিয়ে দেব, সেটা পড়ে দেখতে পারেন। ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে কাজে দেবে –
Leave a Reply