আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, তাইওয়ানে এই মুহূর্তে উত্তেজনা চলছে। আগস্টের প্রথম দিকে পেলোসির সফরের প্রতিক্রিয়ায়, চীনের সেনাবাহিনী, পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ তাইওয়ানের চারপাশে অভূতপূর্ব সামরিক মহড়া আয়োজন করে এবং মে মাসে চাইজিন কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি এর জেনারেলদের মধ্যে একটি বৈঠক থেকে একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং দৃশ্যত ইঙ্গিত দেয় যে পিএলএ তাইওয়ানে ভবিষ্যতে একটি ফুল-স্কেল আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য ১৪০.০০০ সেনার একটি সেনাবাহিনীকে সমাবেশ করছে। তো দেখার বিষয় হচ্ছে চীন কি আদৌ তাইওয়ানে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, এবং আক্রমন করলে কখন আক্রমণ করতে যাচ্ছে?
তাহলে, সিসিপি কি আসলেই তাইওয়ান আক্রমণ করতে চায়? আসলে চীন-তাইওয়ানের আধুনিক ইতিহাস নিয়ে ঘাটলে দেখা যায়, বেশিরভাগ সময় জুড়েই আসলে একটি ফুল স্কেল যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। কারণ চাইনিজ সিভিল ওয়ারের শেষ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তাইওয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এটা শুরু হয়েছিল কোরিয়ান যুদ্ধের ফলে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ঠিক করেছিলেন, তাইওয়ানকে সুরক্ষিত করা সেই যুদ্ধের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, আর তাই তিনি ১৯৫০ সালে সেখানে পেট্রোল করার জন্য একটি নেভাল ফ্লিট পাঠিয়েছিলেন। এরপর ১৯৫৪ সালে ইউএস-তাইওয়ান ম্যুচুয়াল ডিফেন্স প্যাক্ট দ্বারা তা আনুষ্ঠানিকীকৃত করা হয়। এই সময়েই তাইওয়ানের ইকোনমি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, বিশেষ করে ৬০ ও ৭০ এর দশকে, যার অর্থ ৫০ এর দশক থেকে ৭০ এর দশক পর্যন্ত তাইওয়ান ইউএস দ্বারা সুরক্ষিত ছিল, এবং মেইনল্যান্ড চীনের চেয়ে এটি অনেক বেশি প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর ছিল, যা তাইওয়ানের ওপর চীনের আক্রমণকে অসম্ভব করে তোলে। কিন্তু ৮০ এর দশকে সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়ে যায়, ইউএস তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর তাইওয়ান ও চীনের ইকোনমিক গ্রোথ এক্সিলারেট করে। তাই এই দুই দিকের মধ্যে ব্যালেন্স অফ পাওয়ার সমান হয়ে যায়। তবে সৌভাগ্যবশত তাইওয়ানের ট্ষ্হিয়াং ট্ষ্হিং-খুও (Chiang Ching-kuo) এবং চীনের তেং শিয়াওফিং (Deng Xiaoping) তার পূর্বসুরীদের তুলনায় কূটনৈতিক সম্পর্কে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন, ফলে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকে। ১৯৮৭ সালে ট্ষ্হিয়াং মারশাল ল এর অবসান ঘটান এবং মেইনল্যান্ড চীনের সাথে বাণিজ্য ও ভ্রমণের বিধিনিষেধগুলো লঘু করেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালে টেনশন আবার বৃদ্ধি পায় যখন লি থেং-হুই (Lee Teng-hui) তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট হন। এর কারণ ছিল লি তার সঙ্গীদের মতো রিইউনিফিকেশনে তেমন আগ্রহী ছিলেন না, এবং ১৯৯৬ সালের প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনের সময় তার ইউএস-এ গমন চীনের পিএলএ-কে বেশ রাগিয়ে তোলে, যার ফলে তৃতীয় তাইওয়ান স্ট্রেট ক্রাইসিস শুরু হয়। কিন্তু ২০০০ সালে ট্ষ্হেন ষুই-পিয়ানের (Chen Shui-Bian) এর ক্ষমতায় আসার পর তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, মেইনল্যান্ড চায়না তার সামরিক শক্তির ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলে তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করবে না। এদিকে মেইনল্যান্ড চায়নার সরকারও সিদ্ধান্তে আসে যে, ইকোনমিক ডিপেন্ডেন্সের মধ্য দিয়ে রিইউনিফিকেশনের দিকে ধীরে ধীরে যাওয়াই তাদের জন্য সবচেয়ে ভাল রাস্তা। এটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কারণ তখন স্বাধীনতা তেমন সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছিল না, এবং তাইওয়ান মেইনল্যান্ড চায়নার সাথে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে জড়িয়ে পড়ছিল, এদের মধ্যে ট্রেড বাড়তে থাকে, এবং এক্সপোর্ট ১৯৮৭ সালের ১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০০২ সালে ৩২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। আর ২০০২ সাল চীন তাইওয়ানের সর্ববৃহৎ ট্রেডিং পার্টনারে পরিণত হয়।
৫০ থেকে ৮০ এর দশকের মধ্যে তাইওয়ানের চীনে আক্রমণ সম্ভবপর ছিলনা, কারণ পিএলএ-এর কাছে তখন ক্ষমতা ছিলনা। এবং ৮০ এর দশক থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত আগ্রাসন সম্ভবপর ছিলনা কারণ পেইচিং (Beijing) তখন ইকোনমিক ইন্টারডিপেন্ডেন্সের মাধ্যমে গ্র্যাজুয়াল রিইউনিফিকেশনের এপ্রোচের নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে ৎসাই ইং-ওয়েন (Tsai Ing-wen) এর ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির ক্ষমতায় আসার পরই এই গ্র্যাজুয়ালিস্ট এপ্রোভে ফাটল ধরে। কেননা নতুন প্রেসিডেন্ট দুই দেশের মধ্যে অব্যাহত আলোচনার ক্ষেত্রে আর ওয়ান-চায়না ফরমুলেশনকে মেনে নেননি। এরপর ২০২০ সালে ৎসাই আবার জয়ী হন, আর তার ক্যাম্পেইনে খুব গভীরভাবেই হংকং-এ পেইচিং এর ক্র্যাকডাউনকে খুব ভালভাবেই ফোকাস করা হয়েছিল। এরপর থেকে তাইওয়ানের সাথে চীনের সম্পর্ক খুব খারাপের দিকে চলে যায়, এবং পিএলএ-ও তাইওয়ান স্ট্রেইটে আরও বেশি করে জাহাজ পাঠায়, তাইওয়ানের এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোনে (ADIZ) নিয়মিত অনুপ্রবেশ করে, এবং তাইওয়ানকে ক্ষীয়মান সংখ্যার ইকোনমিক পার্টনারদেরকে পেইচিং-কে স্বীকৃতি দেবার জন্য চাপ দেয়া শুরু করে। কিন্তু এর মানে এই ছিলনা যে সিসিপি আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। রেটরিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও, পেইচিং সবসময়ই আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছে। এটাই প্রথম তাইওয়ান স্ট্রেইট ক্রাইসিস না, আর কর্কশ রেটোরিক ও পিএলএ এর প্রোভোকেশনগুলো কেবলই তাইপে-কে স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত রাখবার ইনশিউরেন্স পলিসি হয়ে থাকতে পারে। তবুও চীন যে মেইনল্যান্ড ট্যুরিস্টের সংখ্যা কমিয়ে ফেলছিল এবং তাইওয়ানের সাথে ইকোনমিক টাই কমানোর চেষ্টা করছিল, এই ব্যাপারগুলো এটাই সাজেস্ট করে যে, তারা তাদের পূর্বের গ্র্যাজুয়ালিস্ট এপ্রোচ ত্যাগ করেছে।
তো যদি পেইচিং আক্রমণের পরিকল্পনা করেই থাকে, তাহলে তা কখন হবার কথা? এটা নিয়ে দুরকম চিন্তাধারা আছে। প্রথমটি বলে নিকট ভবিষ্যতে আক্রমণ সম্ভব না, দ্বিতীয়টি বলে আক্রমন হবে আর তা ২০২৭ সালের পূর্বে কোন এক সময়েই হবে। প্রথম দলটির মতে নিকট ভবিষ্যতে আক্রমণ সম্ভবপর নয় কারণ আক্রমণে আসলে চীনের আগ্রহ নেই। এখন চীনের ইকোনমির অবস্থা ভাল নয়, এবং পিএলএ তাদের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়িত করছে, আর ইউএস এখনও এশিয়ায় সামরিক দিক দিয়ে প্রতিযোগিতা করছে। এই অবস্থানের লোকেরা এও বলেন যে, চীনের এন্টাই-সিসেশন আইনগুলো (রাষ্ট্র ত্যাগ করে বিচ্ছিন্ন হওয়া-বিরোধী আইন) অনুসারে, তাইওয়ানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনমূলক উপায় তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন অন্য সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া এই আক্রমণের কস্টও বেনিফিটের চেয়ে অনেক বেশি, যেখানে সাফল্যের গ্যারান্টিও নেই।
দ্বিতীয় চিন্তাধারাটি অবশ্য বলছে তাইওয়ান একটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর চীনের সুযোগও কমে যাচ্ছে। তাদের যা করার খুব শীঘ্রই করে ফেলতে হবে। চীনের ইকোনমি ধীর হচ্ছে, এর জনসংখ্যা বয়স্ক হয়ে যাচ্ছে,আর প্রশান্ত মহাসাগরে ইউএস এর বিরুদ্ধে চীনের মিলিটারি এডভান্টেজও ২০২৭ সাল পর্যন্ত কমতে কমতে প্রায় শেষ হয়ে যাবে। সেই সাথে তাইওয়ানের লোকেদের মধ্যেও মেইনল্যান্ড চায়না সম্পর্কে ধারণা খারাপ হচ্ছে, এবং নিজেদের চাইনিজ বলে চিহ্নিত করা তাইওয়ানিজদের সংখ্যা প্রতি বছর কমে যাচ্ছে। এর সাথে আছে ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি এর অব্যাহত সাফল্য এবং তাইওয়ান ও মেইনল্যান্ড চীনের মধ্যকার বর্ধিষ্ণু আদর্শিক ব্যবধান। এর অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে চীনের সাথে তাইওয়ানের ব্যবধান সব দিক দিয়েই বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ইউক্রেইন নিয়ে ইউএস এর মনোযোগের ফলে ইউএস এর মিলিটারি সাপ্লাই কমে গেছে। আর তাই এই অবস্থানের লোকেদের মতে, সম্ভবত এখনই পেইচিং এর জন্য তাইওয়ানে আক্রমণ করার সবচেয়ে ভাল সময়।
যদি ধরেই নেই চীন তাইওয়ানে আক্রমন করতে যাচ্ছে, তাহলে কি আক্রমণটা এখনই করতে হবে? ধরে নেই, আপনি উপরের দুটি যুক্তির মধ্যে দ্বিতীয় যুক্তিটিই গ্রহণ করলেন, এবং ধরে নিলেন সামনের কয়েক বছরের মধ্যেই চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হবে, আক্রমণটা ঠিক কখন হবে। আসলে, তাইওয়ানে আক্রমণ করাটা সহজ কাজ নয়। এটা ঠিক যে তাইওয়ান চীন থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে, কিন্তু তাইওয়ান একটি পর্বতময় দ্বীপ, এবং এখানে ল্যান্ডিং স্পটের সংখ্যাও সীমিত, যেগুলর বেশিরভাগই দেশটির উত্তর দিকে, তাইপেই এর নিকটে। তাইওয়ানের বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতিতে রয়েছে জলাভূমি, পর্বতমালা, এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, এর অর্থ হচ্ছে দেশটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে দখলে নেবার জন্য বিশাল মাত্রায় বিভিন্ন কম্ব্যাট স্কিল দরকার, আর দরকার পিএলএ ফোর্সসমূহকে সাপ্লাই দেবার জন্য বিশাল মাত্রায় লজিস্টিক্স অপারেশন। এর মানে হলো পিএলএ চাইলেই তাইওয়ানে আক্রমণ করতে পারেনা, আর তারা যদি সর্বোচ্চ পরিমাণে সাফল্য লাভ করতে চায় তবে এর কন্ডিশনগুলোকেও ঠিকঠাক হতে হবে। কিন্তু পিএলএ এর জন্য দুঃখের কথা যে, তাইওয়ানে দুটো মৌসুমী ঋতু বা মনসুন সিজন আছে, এবং তাইওয়ানের আবহাওয়ার কারণে কেবল মাত্র দুটো সময়েই চীনের পিএলএ তাইওয়ানের ওপর আক্রমণ করতে পারে – একটি হলো এপ্রিল-মে মাসে, আরেকটি হলো অক্টোবরে। আর এজন্য সামনের কয়েকটি মাস গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। তাই যদি আপনি মনে করেন যে, খুব দ্রুত চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, যেমনটা অনেক ইউএস অফিশিয়ালই মনে করে থাকেন, তবে অক্টোবরই হবে সম্ভাব্য সময়…
Leave a Reply