ভারতবর্ষে ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণের (“আর্য” আগমনের) বিভিন্ন দিক (ও প্রমাণ)

ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণ তত্ত্ব বা ইন্দো-এরিয়ান মাইগ্রেশন থিওরি একটি বৃহত্তর তাত্ত্বিক কাঠামোর অংশ। এই কাঠামোটি  সমসাময়িক এবং প্রাচীন ভাষাগুলোতে পাওয়া যায় এমন বিস্তৃত পরিসরের সাদৃশ্যকে ব্যাখ্যা করে, মানে ব্যাখ্যা করে যে কেন বর্তমানে অনেক ভাষার মধ্যে, এমনকি বর্তমানের ভাষাগুলোর সাথে প্রাচীন কিছু ভাষার এত মিল, কিভাবে এই মিলগুলো কাজ করছে। এই জায়গায় ভাষাগত, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নজিনতাত্ত্বিক ইত্যাদি গবেষণাগুলো সব একত্র হয়। এই তত্ত্বটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর বিকাশ, এবং অভিপ্রায়ণ ও সংস্কৃতায়নের (acculturation) মাধ্যমে এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীসমূহের ছড়িয়ে পড়ার ব্যাখ্যা এবং বিবরণ প্রদান করে।

ভাষাতত্ত্ব : ভাষার মধ্যে সম্পর্ক

এই তাত্ত্বিক কাঠামোটির ভাষাগত অংশটি বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মধ্যে সংযোগগুলোকে চিহ্নিত করে এবং প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার পুনর্নির্মাণ করে। এটা করা সম্ভব কারণ সময়ের সাথে ভাষার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলো এলোমেলো নয়, বরং সুনির্দিষ্ট প্যাটার্নসমূহ অনুসরণ করে। সাউন্ড শিফট, স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের পরিবর্তন এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যদিও ব্যাকরণ (বিশেষ করে মরফোলজি) এবং শব্দকোষও (লেক্সিকন বা ভোকাবুলারি) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবদান রাখে। ঐতিহাসিক-তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান (Historical-comparative linguistics) এর স্টাডিজ এভাবেই সম্পর্কিত ভাষাগুলোর মধ্যে দুর্দান্ত মিল দেখতে পায়, যেখানে প্রথম দর্শনে ভাষাগুলোকে খুব আলাদা বলে মনে হতেই পারে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তাই ভারতবর্ষের অনেক ভাষারই (ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ) একটি ভারতীয় উৎসের বিরুদ্ধে যুক্তি দেয় এবং ইঙ্গিত করে যে এগুলোর উৎপত্তি ছিল স্তেপে।

প্রত্নতত্ত্ব : স্তেপ উরহাইমাট থেকে অভিপ্রায়ণ 

এই তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রত্নতাত্ত্বিক অংশটি দাবি করে যে, পন্টিক-কাস্পিয়ান স্তেপে (কৃষ্ণসাগরের উত্তরে ইউক্রেইন ও রাশিয়ার অঞ্চল) ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের একটি উরহাইমেট বা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের উৎপত্তিস্থল ছিল, যা প্রায় ৫,২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্তেপ অঞ্চলে গবাদি পশুর প্রবর্তনের পরে বিকশিত হয়েছিল। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষেরা সংগ্রাহক বা ফোরেজিস্ট থেকে পশুপালক বা প্যাস্টোরালিস্ট সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে, একই সাথে এই অঞ্চলেই চিফটেইন (সর্দার) এবং প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সিস্টেম, এবং পণ্য ও উপহারের বিনিময় সংবলিত একটি শ্রেণিবদ্ধ সামাজিক ব্যবস্থা বা হায়ারার্কিয়াল সোশ্যাল সিস্টেমের বিকাশ ঘটে। (প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সিস্টেম দুধরণের মানুষ – প্যাট্রন ও ক্লায়েন্ট নিয়ে গঠিত, প্যাট্রনরা তারা যাদের কাছে অথোরিটি, সোশ্যাল স্ট্যাটাস, সম্পদ ইত্যাদি আছে, আর ক্লায়েন্ট তারা যারা এই প্যাট্রনদের সাপোর্ট ও ইনফ্লুয়েন্স দ্বারা উপকৃত হয়। প্যাট্রনরা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বৃদ্ধির জন্য ক্লায়েন্টদেরকে তাদের সুবিধাদির কিছু অংশ দান করে ও প্রভাব বিস্তার অরে। এভাবেই এই পলিটিকাল সিস্টেম কাজ করে।) যাই হোক, এদের প্রাচীনতম নিউক্লিয়াসটি সম্ভবত সামারা কালচার (খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৫ম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে) ছিল, যার অবস্থান ছিল ভলগার একটি বাঁকে। এরপর একটি বৃহত্তর প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে, যার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল, ১৯৫০-এর দশকে মারিয়া গিম্বুটাস (Marija Gimbutas) এর নাম দেন কুরগান কালচার। তিনি এই “কুরগান কালচারের” মধ্যে বেশ কয়েকটি কালচারকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যেগুলোর মধ্যে সামারা কালচার, এবং ইয়ামনা কালচার অন্তর্ভুক্ত ছিল, যদিও ইয়ামনা কালচার (খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০০-২২০০) বা “পিট গ্রেভ কালচার”-কেই অধিকতর প্রকৃষ্টভাবে প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার “নিউক্লিয়াস” বলা যেতে পারে।

এই অঞ্চলে পরে অনেকগুলো সাবকালচার তৈরি হয়। যাই হোক, এখান থেকে প্রোটো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীরা প্রায় ৪,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পশ্চিম, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, যারা বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার বিকাশ ঘটায়। প্রোটো ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা পুরুষদের ছোট ছোট দল দ্বারা বাহিত হয়ে থাকতে পারে, আর প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে এই ছোট ছোট দলের কালচারাল সিস্টেমে অন্যান্য গোষ্ঠী প্রবেশ করে, যারা তাদের ভাষা গ্রহণ করে ও তার এদের মিথোস্ক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার বিকাশ ঘটে। পূর্ব দিকে গিয়েছিল সিনতাশতা কালচার (২০৫০-১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এরা সাধারণ ইন্দো-ইরানীয় ভাষায় কথা বলা হত। সিন্তাশতা সংস্কৃতির বাইরের দিকে অ্যান্দ্রোনোভো সংস্কৃতি (২০০০-১৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বিকশিত হয়েছিল, যা ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা সংস্কৃতির (২২৫০-১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সাথে মিথোস্ক্রিয়া করেছিল। এই মিথস্ক্রিয়া ইন্দো-ইরানীয়দের আরও আকৃতি দান করে, যার ফলে ২০০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইন্দো-আর্য এবং ইরানীয়রা বিভক্ত হয়ে যায়। ইন্দো-আর্যরা লেভান্ট এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে। উত্তর ভারতে অভিপ্রায়ণটা একটি বড় আকারের অভিপ্রায়ণ ছিল না, এটি জিনগতভাবে বৈচিত্র্যময় ছোট ছোট গ্রুপগুলো নিয়ে গঠিত হতে পারে। তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষা উত্তর ভারতে সংস্কৃতায়ন (acculturalization) কোন প্রক্রিয়া ও প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সিস্টেমে অন্যান্য গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

নৃবিজ্ঞান: অভিজাত নিয়োগ (elite recruitment) এবং ভাষা পরিবর্তন (language shift)

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো সম্ভবত ভাষার পরিবর্তন বা ল্যাঙ্গুয়েজ শিফটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছোট দলগুলো একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঞ্চল পরিবর্তন করতে পারে, এবং ছোট দলগুলোর দ্বারা অভিজাত পুরুষ আধিপত্য (elite male dominance) উত্তর ভারতকে একটি ভাষা-পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করতে পারে। ডেভিড অ্যান্টনি, তার “সংশোধিত স্তেপ হাইপোথিসিস”-এ উল্লেখ করেছেন যে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর বিস্তার সম্ভবত “চেইন-টাইপ ফোক মাইগ্রেশন” এর মাধ্যমে ঘটেনি, বরং ঘটেছে আচার বা রিচুয়াল এবং রাজনৈতিক অভিজাতদের দ্বারা এই ভাষাগুলোর প্রবর্তনের মাধ্যমে, যা সেখানকার বৃহৎ গোষ্ঠীগুলো অনুকরণ করেছিল। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া ছিল যাকে তিনি “অভিজাত নিয়োগ” বা এলিট রিক্রুটমেন্ট বলে অভিহিত করেন। আস্কো পারপোলার মতে, স্থানীয় অভিজাতরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী অভিবাসীদের “ছোট কিন্তু শক্তিশালী গোষ্ঠীতে” যোগ দিয়েছিল। এই অভিবাসীদের একটি আকর্ষণীয় সামাজিক ব্যবস্থা ছিল, এবং সেই সাথে ছিল ভাল অস্ত্র, এবং বিলাসবহুল পণ্য, যেগুলো তাদের উন্নততর অবস্থা এবং ক্ষমতাকে চিহ্নিত করেছিল। এই গ্রুপগুলোতে যোগদান স্থানীয় নেতাদের জন্য আকর্ষণীয় ছিল, কারণ এটি তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিল এবং তাদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করেছিল। বৈবাহিক জোট দ্বারা এই নতুন সদস্যদেরকে আরও বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জোসেফ স্যামন্সের মতে, ভাষা-পরিবর্তন বা ল্যাংগুয়েজ শিফট সহজতর হয় স্থানীয় ভাষিক সম্প্রদায়সমূহের “স্থানচ্যুতি” বা ডিজলোকেশনের ফলে, যেখানে এই নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন এলিটরা বসতিস্থাপন করে। স্যামন্সের মতে, এই পরিবর্তনটি সহজতর হয় “কমিউনিটি স্ট্রাকচারে আনা সিস্টেমেটিক পরিবর্তনগুলোর” মধ্য দিয়ে, যার মধ্যে একটি স্থানীয় সম্প্রদায়কে একটি বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জেনেটিক্স: প্রাচীন পূর্বপুরুষত্ব (ancestry) এবং একাধিক জিন প্রবাহ (gene flow)

বাধ্য হয়েই এটা নিয়ে একটু বেশি লিখছি। ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থান থেকে জেনেটিক কম্পোনেন্ট এসে মিশেছে, যেসব কারণে ভারতবর্ষে মানুষের এই বৈচিত্র্য দেখা যায় তার একটি হলো এই ইন্দো-আর্য মাইগ্রেশন। গবেষণায় দেখা গেছে যে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে একটি সাধারণ মাতৃ-পূর্বপুরুষত্ব রয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতীয় উপমহাদেশে দুটি প্রধান পৈতৃক উপাদান রয়েছে, যথা – অ্যান্সেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান (এএনআই) যা “জেনেটিক্যালি মধ্য প্রাচ্যীয়, মধ্য এশীয় এবং ইউরোপীয়দের কাছাকাছি”, এবং অ্যান্সেস্ট্রাল সাউদ ইন্ডিয়ান (এএসআই) যা এএনআই থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা। এই দুটি গোষ্ঠী ৪,২০০ থেকে ১,৯০০ বছর আগে (২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ১০০ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে ভারতে মিশ্রিত হয়েছিল, যার পর এদের মধ্যে এন্ডোগ্যামি ঘটেছিল। এটা হয়েছিল সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কার “সামাজিক মূল্যবোধ এবং নিয়ম” এর বলবৎকরণের মাধ্যমে। মুরজানি এট আল. (২০১৩) দুটি গোষ্ঠীর একত্রিত করার বিষয়ে তিনটি দৃশ্যকল্প বর্ণনা করেছেন: (১) ৮,০০০-৯,০০০ বছর পূর্বে কৃষির বিকাশেরও আগের মাইগ্রেশন; (২) কৃষির বিস্তারের সাথে সাথে পশ্চিম এশীয় জনগণের অভিপ্রায়ণ, যা সম্ভবত ৪,৬০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ঘটে; এবং (৩) ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ বছর পূর্বের পশ্চিম ইউরেশীয়দের মাইগ্রেশন। যদিও রাইখ উল্লেখ করেছেন যে, এই মিশ্রণের সূচনা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার আগমনের সাথে মিলে যায়, মুরজানি এট আল(২০১৩) এর মতে, ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণের আগে এই গোষ্ঠীগুলো ভারতবর্ষে অমিশ্রিত অবস্থায় ছিল। গ্যালেগো রোমেরো এট আল. (২০১১) প্রস্তাব করেছেন যে, ১০,০০০ বছরেরও কম সময় পূর্বে এএনআই উপাদানটি ইরান এবং মধ্য প্রাচ্য থেকে এসেছে, এদিকে লাজারিদিস এট আল (২০১৬) এর মতে এএনআই হচ্ছে “পশ্চিম ইরানের প্রাথমিক কৃষক” এবং “ব্রোঞ্জ যুগের ইউরেশীয় স্তেপের লোকেদের” মিশ্রণ। বেশ কয়েকটি গবেষণায় পরবর্তীকালের মাতৃত্ব ও পিতৃত্বভিত্তিক জেনেটিক উপাদানের আগমন চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলো এএনআই এর সাথে সম্পর্কিত এবং ইন্দো-ইউরোপীয়দের থেকে আসা।

ল্যাজারিডিস এট আল. (২০১৬) গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার উপর স্তেপ সম্পর্কিত জনসংখ্যার জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণেইই ছিল এবং উত্তর ভারতে এটি একটি প্রধান উপাদান গঠন করে। গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে যে সমস্ত আধুনিক দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে ৬.৫ থেকে ২০.২% স্তেপ সম্পর্কিত সংমিশ্রণের আছে, আর উচ্চতর বর্ণ এবং ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যদের তুলনায় এটি বেশি রয়েছে। পূর্বে যে ANI বা অ্যান্সেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান কম্পোনেন্টের কথা বলা হলো তা আসলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী (IVC-people) এবং স্তেপ থেকে আসা জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে গঠিত হয়। আর ASI আর অ্যান্সেস্ট্রাল সাউদ এশিয়ান অ্যান্সেস্ট্রি গঠিত হয়েছে সেই সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে স্থানীয় শিকারী-সংগ্রাহকদের সাথে মিশ্রণের ফলে।

নরসিমহান এট আল. (2019) গবেষণা অনুসারে, ASI উপাদানের জেনেটিক মেকাপের প্রায় ৭৩%-ই আসলে AASI, অর্থাৎ অ্যানশিয়েন্ট অ্যান্সেস্ট্রাল সাউদ এশিয়ান, বা আন্দামানিজ হান্টার গ্যাদারার, যারা সবার পূর্বে, ৫০ হাজার বছর পূর্বের দিকে হোমো সেপিয়েন্সের সাউদার্ন ডিসপার্সালের সময় ভারতবর্ষে আসে, বর্তমানে যাদেরকে ওঙ্গে-দের মত আন্দামানিজ দ্বীপপুঞ্জবাসীদের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। ASI উপাদানের বাকি ২৭% ইরানীয় অ্যান্সেস্ট্রি সম্পর্কিত। (উল্লেখ্য IVC অ্যান্সেস্ট্রি নিজেই এই AASI ও ইরানীয় রিলেটেড অ্যান্সেস্ট্রি নিয়ে গঠিত, সুতরাং ANI এর মধ্যেও AASI আছে)। নরসিমহান এট আল. এর এই ফলাফল পূর্বের যেটায় ২০১৮ সালে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ASI-তে একটি পশ্চিম-ইউরেশীয় পূর্বপুরুষত্বের উপাদান রয়েছে যা ইরানী-সম্পর্কিত কৃষকদের থেকে উদ্ভূত, রাইখের মতে তা ছিল ২৫%, যা বাকি ৭৫% গ্রহণ করেছে স্থানীয় শিকারী সংগ্রাহকদের থেকে। অন্যদিকে ANI ছিল ব্রোঞ্জ এইজের স্তেপ থেকে আসা লোকেদের ও সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কিত লোকেদের মিশ্রণ। এখন পূর্ব এশীয় কম্পোনেন্ট ও আরও ছোট খাটো কিছু কম্পোনেন্ট বাদ দিলে ভারতবর্ষের লোক মোটামুটি ANI ও ASI এর মিশ্রণে গঠিত। রাইখের গবেষণা বলে উত্তর থেকে দক্ষিণে ANI এর ক্লাইন আছে, আর তা ৭১%-৩৯% রেঞ্জে। মানে ধরুন, ভারতের উত্তর দিকে ANI বেশি, তা সর্বোচ্চ ৭১% হয়েছে, এরপর দক্ষিণ দিকে যেতে যেতে ANI উপাদান কমতে শুরু করেছে আর বেশি দক্ষিণে গিয়ে তা সর্বনিম্ন ৩৯% হয়েছে, বাকিটা ধরুন ASI, মানে যেখানে ANI ৩৯% হয়েছে, সেখানে ৬১% এর মত ASI উপাদান আছে। মানে সবার মধ্যেই ANI এর উপাদান আছে, আর ANI-তে যেহেতু স্তেপ অ্যান্সেস্ট্রি আছে, তাই ভারতবর্ষের সবার মধ্যেই স্তেপ অ্যান্সেস্ট্রি আছে। কারও কম বেশি। ল্যাজারিডিস এট আল. এর ২০১৬ এর গবেষণার কথা আগেই বলেছি যা দক্ষিণ এশিয়ার লোকেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্রোঞ্জ যুগীয় স্তেপ অ্যান্সেস্ট্রির কথা বলে। এখানে স্তেপ অ্যান্সেস্ট্রি নিয়ে একটি  ক্লাইনের কথা বলা হয়। ক্লাইনের প্রসঙ্গ তখনই আসে যখন একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন জেনেটিক পূর্বপুরুষত্বের উপাদান কারও ক্ষেত্রে কম ও কারও ক্ষেত্রে বেশি থাকে, মানে সবার ক্ষেত্রে মোটামুটি সমান থাকেনা। ভারতবর্ষে তা আছে। এখানে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে স্তেপ অ্যান্সেস্ট্রির বেশি থেকে কম হবার একটা ক্লাইন দেখা যায়। পাকিস্তানের কালাশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় স্তেপ রিলেটেড অ্যান্সেস্ট্রি আছে ৫০% এর মত, আর দক্ষিণ ভারতের দলিত গোষ্ঠী মালাদের মধ্যে স্তেপ রিলেটেড অ্যান্সেস্ট্রি প্রায় ১৮%।

সাহিত্যভিত্তিক গবেষণা : সাদৃশ্য, ভূগোল, এবং অভিপ্রায়ণের উল্লেখ

ওল্ড ইন্ডিক ভাষার প্রাচীনতম অভিলেখ উত্তর সিরিয়ায় হুরিয়ান-ভাষী মিতান্নী সম্পর্কিত হিট্টাইট রেকর্ডগুলোতে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে এবং জরাথুস্ত্রবাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থ আবেস্তায় চিত্রিত ধর্মীয় অনুশীলনগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে সরস্বতীর কিছু উল্লেখ ঘাগগার-হাকরা নদীকে নির্দেশ করে, যেখানে আফগানিস্তানের নদী Haraxvaiti বা Harauvati হেলমান্দকে কখনও কখনও প্রাথমিক ঋগ্বৈদিক নদীর স্থান হিসাবে উদ্ধৃত করা হয়। ঋগ্বেদে স্পষ্টভাবে বাইরের হোমল্যান্ড বা অভিপ্রায়ণের কথার উল্লেখ নেই, তবে পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থগুলোতে এবং পুরাণে ইন্দো-আর্যদের পরবর্তী কালের গাঙ্গেয়ভূমিতে অভিপ্রায়ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।

পরিবেশগত গবেষণা : ব্যাপক খরা, নগরের পতন, এবং পশুপালকদের অভিপ্রায়ণ

জলবায়ু পরিবর্তন এবং খরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের প্রাথমিক বিস্তার এবং স্তেপ থেকে দক্ষিণ মধ্য এশিয়া ও ভারতের ইন্দো-ইউরোপীয়দের অভিপ্রায়ণ দুটোকেই ট্রিগার করে থাকতে পারে। প্রায় ৪২০০-৪১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি জলবায়ুগত পরিবর্তন ঘটে, যা ইউরোপে প্রকাশিত হয় শীতলতর শীতকালের মধ্য দিয়ে। স্তেপ পশুপালকরা বা প্রাচীন প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীরা প্রায় ৪২০০-৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিম্ন দানিউব উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। ওল্ড ইউরোপের পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই এরা এই সুযোগটা নিতে পারে। ইয়ামনা কালচারে একটি জলবায়ুগত পরিবর্তনের অভিযোজন সংঘটিত হয়, যে পরিবর্তনটা ছিল ৩৫০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। আর এর ফলেই স্তেপ অঞ্চলগুলো শুষ্ক এবং শীতল হয়ে ওঠে। এর ফলে পশুদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার দেবার জন্য তাদেরকে ঘন ঘন স্থানান্তরিত হবার দরকার ছিল। ওয়াগন বা ঘোড়ার গাড়ি এবং অশ্বারোহনের ফলে তাদের পক্ষে এভাবে স্থানান্তরন সম্ভব হয়। এর ফলে এরা পশুপালনের একটি অধিকতর মোবাইল ফর্মে এডপ্ট করে। মানে বলতে গেলে, স্তেপে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে বলেই এরা ক্রমশ অশ্বভিত্তিক পশুপালনের রীতি গ্রহণ করে ও ঘোড়ার সাথে নিজেদেরকে বেশি সম্পর্কিত করে। আর এটাই আরও বেশি প্রয়োজনে তাদের ছড়িয়ে যাওয়া ও বিস্তৃত হবার ব্যাপারটাকে সহজতর করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দে ব্যাপকভাবে শুষ্কতার ফলে ইউরেশীয় স্তেপ এবং ভারতীয় উপমহাদেশ উভয়ক্ষেত্রেই জলের অভাব এবং পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটে। স্তেপে আর্দ্রীকরণের ফলে উদ্ভিদের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে শুরু হয় উচ্চতর গতিশীলতা বা বারবার স্থান পরিবর্তন, এবং যাযাবর গবাদি পশুর প্রজননের দিকে ট্রাঞ্জিশন। এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশেও জলের ঘাটতির একটি শক্তিশালী প্রভাব ছিল, যার ফলে দক্ষিণ মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান এবং ভারতের শহুরে সংস্কৃতির পতন ঘটে (যেগুলোর মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা ও ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিকাল কমপ্লেক্স রয়েছে) এবং বড় আকারের অভিপ্রায়ণ শুরু হয়।

তথ্যসূত্র (একটু বেশিই হচ্ছে)

  1. Witzel, Michael (2005), “Indocentrism”, in Bryant, Edwin; Patton, Laurie L. (eds.), The Indo-Aryan Controversy. Evidence and inference in Indian history, Routledge
  2. Anthony, David W. (2007), The Horse The Wheel And Language. How Bronze-Age Riders From the Eurasian Steppes Shaped The Modern World, Princeton University Press
  3. Anthony, David W. (2007), The Horse The Wheel And Language. How Bronze-Age Riders From the Eurasian Steppes Shaped The Modern World, Princeton University Press
  4. Beckwith, Christopher I. (16 March 2009), Empires of the Silk Road: A History of Central Eurasia from the Bronze Age to the Present, Princeton University Press, ISBN 978-1400829941, retrieved 30 December 2014
  5. Muller, Max (1988), Biographies of words and the home of the Aryas, Longmans
  6. Parpola, Asko (2015), The Roots of Hinduism. The Early Aryans and the Indus Civilization, Oxford University Press
  7. Mallory, J.P. (2002), “Archaeological models and Asian Indo-Europeans”, in Sims-Williams, Nicholas (ed.), Indi-Iranian Languages and Peoples, Oxford University Press
  8. Salmons, Joseph (2015), “Language shift and the Indo-Europanization of Europe”, in Mailhammer, Robert; Vennemann, Theo; Olsen, Birgit Anette (eds.), Origin and Development of European Languages, Museum Tusculanum Press
  9. Basu (2003), “Ethnic India: A Genomic View, With Special Reference to Peopling and Structure”, Genome Research, 13 (10): 2277–2290, doi:10.1101/gr.1413403, PMC 403703, PMID 14525929
  10. Pereltsvaig, Asya; Lewis, Martin W. (2015), The Indo-European Controversy, Cambridge University Press
  11. Kivisild; et al. (1999), “Deep common ancestry of Indian and western-Eurasian mitochondrial DNA lineages”, Current Biology, 9 (22): 1331–1334, doi:10.1016/s0960-9822(00)80057-3, PMID 10574762, S2CID 2821966
  12. Sharma, S.; Saha, A.; Rai, E.; Bhat, A.; Bamezai, R. (2005), “Human mtDNA hypervariable regions, HVR I and II, hint at deep common maternal founder and subsequent maternal gene flow in Indian population groups”, Journal of Human Genetics, 50 (10): 497–506, doi:10.1007/s10038-005-0284-2, PMID 16205836.
  13. Sahoo, Sanghamitra; et al. (January 2006), “A prehistory of Indian Y chromosomes: Evaluating demic diffusion scenarios”, Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America, 103 (4): 843–848, Bibcode:2006PNAS..103..843S, doi:10.1073/pnas.0507714103, PMC 1347984, PMID 16415161.
  14. Reich, David; Thangaraj, Kumarasamy; Patterson, Nick; Price, Alkes L.; Singh, Lalji (2009), “Reconstructing Indian population history”, Nature, 461 (7263): 489–494, Bibcode:2009Natur.461..489R, doi:10.1038/nature08365, ISSN 0028-0836, PMC 2842210, PMID 19779445
  15. Metspalu, Mait; Gallego Romero, Irene; Yunusbayev, Bayazit; Chaubey, Gyaneshwer; Mallick, Chandana Basu; Hudjashov, Georgi; Nelis, Mari; Mägi, Reedik; Metspalu, Ene; Remm, Maido; Pitchappan, Ramasamy; Singh, Lalji; Thangaraj, Kumarasamy; Villems, Richard; Kivisild, Toomas (2011), “Shared and Unique Components of Human Population Structure and Genome-Wide Signals of Positive Selection in South Asia”, The American Journal of Human Genetics, 89 (6): 731–744, doi:10.1016/j.ajhg.2011.11.010, ISSN 0002-9297, PMC 3234374, PMID 22152676
  16. Moorjani, P.; Thangaraj, K.; Patterson, N.; Lipson, M.; Loh, P. R.; Govindaraj, P.; Singh, L. (2013), “Genetic evidence for recent population mixture in India”, The American Journal of Human Genetics, 93 (3): 422–438, doi:10.1016/j.ajhg.2013.07.006, PMC 3769933, PMID 23932107
  17. Basu, Analabha; Sarkar-Roya, Neeta; Majumder, Partha P. (9 February 2016), “Genomic reconstruction of the history of extant populations of India reveals five distinct ancestral components and a complex structure”, Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America, 113 (6): 1594–1599, Bibcode:2016PNAS..113.1594B, doi:10.1073/pnas.1513197113, PMC 4760789, PMID 26811443
  18. Moorjani, P.; Thangaraj, K.; Patterson, N.; Lipson, M.; Loh, P. R.; Govindaraj, P.; Singh, L. (2013), “Genetic evidence for recent population mixture in India”, The American Journal of Human Genetics, 93 (3): 422–438, doi:10.1016/j.ajhg.2013.07.006, PMC 3769933, PMID 23932107
  19. Lazaridis, Iosif (2016), “The genetic structure of the world’s first farmers”, bioRxiv 10.1101/059311
  20. Jones, Eppie R. (2016), “Upper Palaeolithic genomes reveal deep roots of modern Eurasians”, Nature Communications, 6: 8912, Bibcode:2015NatCo…6.8912J, doi:10.1038/ncomms9912, PMC 4660371, PMID 26567969
  21. Mallory, J. P.; Mair, Victor H. (2000), The Tarim Mummies: Ancient China and the Mystery of the Earliest Peoples from the West, London: Thames & Hudson, ISBN 978-0-500-05101-6
  22. Mallory, J.P. (1989), In Search of the Indo-Europeans: Language, Archaeology, and Myth, London: Thames & Hudson, ISBN 978-0-500-27616-7
  23. Majumdar, R. C.; Pusalker, A. D., eds. (1951), The History and Culture of the Indian People. Volume I, The Vedic age, Bombay: Bharatiya Vidya Bhavan
  24. Cardona, George (2002), The Indo-Aryan languages, RoutledgeCurzon, ISBN 978-0-7007-1130-7
  25. Demkina, T.S. (2017), “Paleoecological crisis in the steppes of the Lower Volga region in the Middle of the Bronze Age (III–II centuries BC)”, Eurasian Soil Science, 50 (7): 791–804, Bibcode:2017EurSS..50..791D, doi:10.1134/S1064229317070018, S2CID 133638705
  26. Narasimhan; et al. (2019), “The formation of human populations in South and Central Asia”, Science, 365 (6457): eaat7487, doi:10.1126/science.aat7487, PMC 6822619, PMID 31488661
  27. da Silva; et al. (2017), “A genetic chronology for the Indian Subcontinent points to heavily sex-biased dispersals”, BMC Evolutionary Biology, 17 (1): 88, doi:10.1186/s12862-017-0936-9, PMC 5364613, PMID 28335724
  28. Hock, Hans (1991), Principles of Historical Linguistics, Walter de Gruyter

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.