হ্যাঁ, চীনের রিয়াল এস্টেট বা ফিনানশিয়াল ক্রাইসের জন্য দায়ী হলো দেশটিতে গণতন্ত্রের অভাব

চীনের রিয়াল এস্টেট সংকটকে কেবল রিয়াল এস্টেট সংকট হিসেবে দেখা যাবে না, দেখলে আসল সমস্যাটা এড়িয়ে যাবে। চীনের মূল সমস্যাটা রিয়াল এস্টেটে না, বরং সমগ্র ফিনানশিয়াল সিস্টেমে। তাই শুরু করতে হবে এখান থেকেই। চীনে মানুষ ব্যাংকে ফিক্সড ডেপোজিটও করে, আবার রিয়াল এস্টেটেও পয়সা লগ্নি করে। তাই এদের ব্যাংকিং সমস্যা আর রিয়াল এস্টেট সমস্যা দুটোই ফিনানশিয়াল সেক্টরের সমস্যা। আর সমস্যাটা দুটোতেই দেখা যায়, জমিতে টাকা আর ব্যাংকে টাকা সেই সাধারণ মানুষের হাত থেকেই আসছে। আর তাই একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিতও হচ্ছে অনেক বেশি। তাই একই সাথে দুটো বিষয়, অর্থাৎ চীনের সমগ্র ফিনানশিয়াল সিস্টেমের পচন নিয়েই আলোচনাটা করতে হবে। শুরুটা ব্যাংকিং প্রবলেম আর সাধারণ মানুষের ডিপোজিট ফ্রিজিং নিয়েই করতে হবে।

অন্যান্য দেশের মত চীনেও সাধারণত কৃষিক্ষেত্রে ক্রেডিট এবং গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য রিজিওনাল রুরাল ব্যাঙ্ক চালু করা হয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে দেখা গেল হেনান প্রদেশের রুরাল ব্যাংক সাধারণ জনগণের জমানো ৬ বিলিয়ন ডলার ফ্রিজ করে দিয়েছে। চীনে এরকম রুরাল ব্যাঙ্কের সংখ্যা মোটামুটি ১৬৫০ এর কাছাকাছি এবং এদের মিলিত ব্যাঙ্কিং অ্যাসেট সম্পূর্ণ দেশের ব্যাঙ্কিং অ্যাসেটের ১২ শতাংশ, অর্থাৎ অনেক বেশি। এই ব্যাঙ্কগুলো মূলত সেক্টর স্পেসিফায়েড যেমন, কৃষি বা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এগুলো নিয়ে ব্যাংকের ব্যবসা চলে মূলত গ্রাম্য এলাকায়, সেই সাথে এগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবও অত্যন্ত বেশী। আর তাই এগুলোর বিজনেস গ্রোথও খুব কম। এদিকে এগুলো গ্রাম্য এলাকায় হওয়ায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতেই মনোনিবেশ করায় এগুলোতে ডিপোজিট বা আমানতও (রিটেল বা সাধারণ মানুষ বা কোম্পানির তরফ থেকে) কম। ফলে সবসময়ই এই ব্যাংকগুলোতে ফান্ডিং-এ সমস্যা থাকে। ফলে এগুলোর ফিনান্সিয়াল কন্ডিশনও দুর্বল হয়, আবার ব্যাংকের লস হবার, অর্থাৎ দেউলিয়া হবার প্রবণতাও বেশি থাকে। এখন এই দেউলিয়া হবার সমস্যা থেকে এই ব্যাংকগুলোর মুক্তির উপায় কী? সেটা হলো চিটফান্ডগুলোর মত লোভনীয় স্কিম চালু করা, যেমন ফিক্সড ডিপোজিটে হাই ইন্টারেস্ট রেট, এক থেকে পাঁচ বছরে ম্যাক্সিমাম রিটার্ন ইত্যাদি। আর এই সব লোভনীয় অফারের ফলে একটা সময় এই রুরাল ব্যাংকগুলোর হাতে প্রচুর ফান্ডিং আসতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এগুলো কাস্টমারদেরকে বিভিন্ন রকম ইনসেন্টিভও দেয়া শুরু করে। আবার অনলাইনেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা দেয়া হয়। এর ফলে কাস্টমারও দ্রুত বাড়তে থাকে। কিন্তু রুরাল ব্যাংক মানেই পলিটিকাল ইনভলভমেন্ট, আর নিয়ন্ত্রণের অভাব, তাই আমানত যত বাড়তে থাকল, বাড়তে থাকল প্রচণ্ড রকমের দুর্নীতিও। কিছু অসাধু লোক জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে নিল। কিন্তু এই দুর্নীতিগুলোর ডিরেক্ট কন্সিকুয়েন্স থাকে, ফলে চাপা থাকে না। ব্যাঙ্কের এই দুর্নীতি প্রকাশ্যে এলে অনেক উচ্চপদস্থ লোককেই গ্রেফতার করা হয়। আর দুর্নীতির ফলে ফান্ডের সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে প্রাথমিকভাবে কাস্টমারদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। বিপদে পড়ল সাধারণ মানুষ, বিক্ষুব্ধ জনতা সারা দেশে আন্দোলন শুরু করল, ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট। পুলিশের তদন্তে উঠে এলো, যারা দুর্নীতি করেছে, বিশাল অর্থ আত্মসাৎ করেছে, তারা কেবল অর্থই আত্মসাৎ করেনি, সেই সাথে সেই দুর্নীতির অর্থকে ব্যবহার করে অন্যত্র স্থানে অবৈধ লোন দিয়েছে, শেল কোম্পানিতে ফান্ড ট্রান্সফার করেছে, আর এর মাধ্যমেও তারা প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

২০১৫ সালে চীনে ডিপোজিট ইনসিওরেন্স রেগুলেশন নামে একটি আইন চালু করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, ৫ লাখ উয়ান পর্যন্ত ডিপোজিট অ্যামাউন্ট রিস্ক ফ্রি, এক্ষেত্রে অর্থ ফেরত দেয়া হবে। সবার জন্য এই আইন প্রযোজ্য হলেও বাস্তবে দেখা যায় পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে যেমন যেখানে আন্দোলন বেশি,পলিটিক্যাল ইনভলভমেন্ট বেশি, বা সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে এমন সম্ভাবনা বেশী, আমানতকারীরা পয়সাওয়ালা মানুষ – বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদেরকেই এই আইনের সুবিধা দেয়াটা দেয়া হচ্ছে, আর অন্যেরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে আসলে অবাক হবারও কিছু নেই। আইন সবার জন্য সমান – এই নীতিটা এভাবেই একটি একনায়কতান্ত্রিক পলিটিক্যাল সিস্টেমে কম্প্রোমাইজড হয়ে থাকে। এজন্য আন্দোলনই হয় গরিবের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার। এজন্য আন্দোলনের ফলে সরকারও বাধ্য হয় আমানতকারীদের অর্থের কিছুটা হলেও ফেরত দিতে। আন্দোলন বাড়তে থাকলে চীনা সরকার ঘোষণা দিয়ে বলে আমানতকারী বা ডেপোজিটরদেরকে তাদের দেয়া অর্থের আংশিক অর্থ ফিরিয়ে দেয়া হবে, কিছুক্ষেত্রে অল্পবিস্তর পেমেন্ট করাও হয়। কিন্তু আইন অনুসারে কেবল ৫ লাখ উয়ানের মধ্যে ডেপোজিট করলেই তা রিস্ক ফ্রি, ৫ লাখের বেশি যাদের ডেপোজিট রয়েছে তারা তো অর্থ ফেরত পাবে না (যেখানে ৫ লাখের নিচের আমানতকারীরাই ঠিক মত ফেরত পায়না)। ফলে যাদের আমানত ৫ লাখ উয়ানের বেশি ছিল তারা লোকসানের ভয়ে বেশী সচেতন হয়ে পরে। আর এই বিত্তবান আমানতকারীরাই চীনের ফিনানশিয়াল সিস্টেমে ফান্ড প্রোভাইডার। এরাই লোকসানের ভয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্ক থেকে নিজেদের ডিপোজিট তুলে ফেলতে শুরু করে, সাডেন প্যানিক হলে যা হয়। এই অবস্থায় চীনের সরকারের পক্ষেও তাদের ফিসকাল ডেফিসিট বাড়িয়ে এতো বড় অঙ্কের ভর্তুকি দেয়া সম্ভব ছিলনা। চীনা সরকারের উচিৎ ছিল শুরুতেই তাদের রুরাল ব্যাঙ্কগুলোর চিটফান্ডের মতো আচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা, কিন্তু তারা তা এড়িয়ে গেছে। ফলে পাবলিকও বেশি রিটার্নের আশায় প্রচুর ডিপোজিট করে ফেলেছে। আর তাতেই এই এত বড় মাপের দুর্নীতি। দোষটা তাই চীনা সরকারেরও। আর এর ফল হলো মারাত্মক। ব্যাঙ্কের এই দুর্নীতি কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই এতো বড় মাপের ব্যাঙ্ক দুর্নীতি হয়। এই ব্যাঙ্ক দুর্নীতির ফলে যে সাডেন প্যানিক আর ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট শুরু হলো তার প্রভাবেই পাবলিক এবারে তাদের রিয়াল এস্টেট প্রোপার্টির মর্টগেজেও পেমেন্ট দেয়া বন্ধ করে দেয়। আর এভাবেই শুরু হলো চীনের বিখ্যাত রিয়াল এস্টেট সংকট। এখন সেই আলোচনায় যাওয়া যাক…

আপনাদের মনে এখন প্রশ্ন আসবে, রিয়াল এস্টেটে এই মর্টগেজ পেমেন্ট আবার কী জিনিস? আগে তো কখনও শুনিনি। আর ব্যাংকিং-এ দুর্নীতির ফলে যদি সাডেন প্যানিক ও ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট শুরু হয়ও, তাতে রিয়াল এস্টেট সেক্টরে প্রভাব পড়বে কেন? এখানেই আছে নতুন টুইস্ট। চীনের রিয়াল এস্টেট সেক্টরও ব্যাংকিং এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চীনে রিয়েল এস্টেট সেক্টরের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলো জানলে এই সমস্যাটা বুঝতে সুবিধা হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেসিডেনশিয়াল কি কমার্সিয়াল স্পেস হোক, রিয়েল এস্টেট প্রপার্টি কিনতে হলে প্রথমেই একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট, যেমন টোটাল প্রপার্টি প্রাইসের ১% থেকে ৫% অ্যাডভান্সড পেমেন্ট করে বুকিং করতে হয়, আর তারপর সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ হলে বাকি পেমেন্ট ক্লিয়ার করলে রেজিস্ট্রেশন হয় ও বাড়ি বা দোকানের চাবি হাতে পাওয়া যায়। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে ফুল পেমেন্ট করে নির্মাণ শুরুর আগেই বুকিং করতে হয়। টাকা আগেই হাতে পেয়ে কাজ শুরু করলে অবশ্যই ডেভলপারদের সুবিধা, তা ছাড়া ডেভলপাররা শুরুতেই হাতে টাকা পেলে সেই টাকাটা অন্য খাতে ইনভেস্ট করতে পারবে আর তাতে তার ও সরকারেরও বেশি লাভ হতে পারে। (যদিও তাতে কিছুটা রিস্ক থাকেই)। কিন্তু সারা বিশ্বে এটা হয়না কেন? কারণ ডেভলপাররা আগেই সব পয়সা পেয়ে গেলে কাজ শেষ করতে গরিমশি করে, আর চাপে পড়লে তখন কাস্টোমারকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছুকালের জন্য সেখানে একটু কাজ দেখায়, আর তারপর আবার সেই গরিমশি। কাজটা যেহেতু ধীরে ধীরে হয় আর জনগণকে এভাবে প্রতারিত করার সুযোগও অনেক বেশি, তাই আইডিয়াটা লুক্রেটিভ হলেও স্বাভাবিকভাবেই আইন করে ডেভলপাররা যাতে পুরো টাকাটা কাজ শেষ হবার পরই পায় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে, কারণ জনগণের চাপ, জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা। কিন্তু চীনের কথা আলাদা। দেশটা স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক। এরা এইসব পাত্তা দেয়না। সেখানকার ডেভলপাররা ফুল পেমেন্টের পরেই কাজ শুরু করবে। রেটিং এজেন্সি নমুরার মতে, চীনের ডেভলপাররা ২০১৩ থেকে ২০২০ মধ্যে অ্যাডভান্সড ফুল পেমেন্ট নেওয়া প্রপার্টির শুধু ৬০ শতাংশ কমপ্লিট করে এখনও পর্যন্ত হ্যান্ডওভার দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে হ্যাঁ, এখানে ব্যাংকিং এর একটা ব্যাপার আছে। কাস্টোমারকে পুরো টাকাই এডভান্সড পেমেন্ট করতে হবে ঠিকই। কিন্তু পুরোটা তার নিজের পকেট থেকে না। নিজের পকেট থেকে খুব ছোট অংশই তারা দেবে। বাকি সিংহভাগ অংশটা দিতে পারবে সে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে রিয়াল এস্টেটে পুরো টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে তারপর সে ব্যাংকে ইএমআই বা ইকুয়েটেড মানি ইনস্টলমেন্ট পরিষোধ করবে। সোজা কথা হলো, এখনও যে প্রোপার্টি সে বুঝে পায়নি, নির্মাণ কাজ চলছে, সেই প্রোপার্টিই সে ব্যাংকে মর্টগেজ রাখলো, আর মাসে মাসে ব্যাংকে সেই মর্টগেজের পেমেন্ট করতে থাকলো। আর ডেভলপাররা তাদের রিয়াল এস্টেটের কাজের জন্য সব পয়সা পেল আসলে ব্যাংক থেকেই। তো এখানে প্রশ্ন করতেই পারেন, ব্যাংক থেকে যদি ডেভেলপাররা সব টাকা পেয়েই যায় তবে তারা গড়িমশি করে কেন, মাত্র ৬০% কমপ্লিট কাজ কাস্টোমারকে বুঝিয়ে দেয়া হয় কেন, কেনই বা সরকার এদেরকে চাপ দেয় না? এখানে আরেকটা টুইস্ট আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

আইন থাকা সত্ত্বেও চীনের লোকাল গভর্নমেন্ট ডেভলপারদের ফ্রিহ্যান্ড দিয়ে রেখেছিল যে, কনস্ট্রাকশনের জন্য ব্যাংক ও মানুষের থেকে তোলা অর্থকে তারা যেকোন কাজে ব্যবহার করতে পারবে। শুধু লোকাল গভর্নমেন্ট? চীনের মত কেন্দ্রীভূত দেখে সেন্ট্রাল গভার্নমেন্টের ইচ্ছা ছাড়া লোকাল গভর্নমেন্ট এক চুলও নড়বে না। এদের ইচ্ছা ছিল বলেই ডেভলপাররা কনস্ট্রাকশনের টাকা অন্য খাতে খরচ করা শুরু করে। কিন্তু সরকারী লোকজন কেন এটা চাইবে? তাদের লাভ কী? এই ডেভলপাররা ঠিক কোথায় জনগণের রিয়াল এস্টেটের টাকাটা খরচ করেছে তা দেখলেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন। ডেভলপাররা এই অর্থগুলো খরচ করেছে নতুন জমি লিজ নিতে আর হাইগ্রোথ ওয়ালা এক্সপোর্ট বিজনেসে। এই দুই খাতে টাকা ঢাললেই সরকারের রাজকোষে একটা বড় অংশ চলে যায়, লোকাল ও সেন্ট্রাল উভয়েরই। আর তাই ডেভলপাররা যখন আইন অমান্য করে জনগণের টাকা এইসব খাতে ঢালে আর কনস্ট্রাকশনকে ড্যাম কেয়ার করে, তখন লাভের একটা বড় অংশ সরকারেরই হয়। আর ডেভলপার, লোকাল গভর্নমেন্ট ও সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এগুলো করতে পারে কেননা সাধারণ মানুষের থেকে কোন চাপ নেই, গণতন্ত্র নেই, একটা পার্টিই সব নিয়ন্ত্রণ করে। সিম্পল… কিন্তু এখানেই শেষ না। একটা বিষয় দেখতে হবে, ব্যাংক থেকে মর্টগেজ পেমেন্টের ঋণের দিকটাও সস্তা, দেশটির সেন্ট্রাল ব্যাংকের এক্সপানশনারি মনিটারি পলিসির জন্যই। ইচ্ছা করেই ইন্টারেস্ট রেটটা কমিয়ে রাখা হয় যাতে মানুষ বেশি করে রিয়াল এস্টেটে টাকা ঢালে, আর তাতেই নিশ্চিত হয় ডেভলপারদের হাতে বিশাল পরিমাণে অর্থ আসাটা। আর তাতে মানুষ রিয়াল এস্টেটে টাকা ঢালতেই থাকে, আর রিয়াল এস্টেট বুমিং করতে থাকে। প্রশ্ন করতে পারেন, কিন্তু অন্যান্য দেশে তো এমন রিয়াল এস্টেট বুমিং হয়না। অন্য দেশে যদি পরিকাঠামোর অভাবনীয় উন্নয়ন হয়ও তবুও রিয়াল এস্টেট হাই ভ্যালু অ্যাসেট ক্লাসের অন্তর্গত হওয়ায় তাতে হাই ডিমান্ড তৈরি হবে। এখন কম ইন্টারেস্টে হাই রিটের্নের ফলে এই বর্ধিষ্ণু ডিমান্ড ফ্রি মারকেটের নিয়মে ইকুইলিব্রিয়াম তৈরি করে আর কম্পিটিশনের ফলেই এর প্রাইস স্ট্যাবল হয়ে যায়, ডিমান্ড সীমিত হয়। কিন্তু চীনে তো সেটা হবেনা। এখানে সেন্ট্রালাইজড প্ল্যানিং এর মাধ্যমে সিস্টেমে সাপ্লিমেন্ট আর ইনসেন্টিভ দেয়া হতে থাকে, আর এভাবে মার্কেট ম্যানিপুলেশন চলতে থাকে। এর ফলে মর্টগেজ ইএমআই থেকে রিটার্ন হাই হতেই থাকে, ডিমান্ডও বাড়তেই থাকে, রিয়াল এস্টেট সেক্টরে বিশাল বুম আসতেই থাকে। কিন্তু এই রিয়াল এস্টেটের বুমিংটাতো আর্টিফিশিয়াল, মার্কেট ম্যানিপুলেশনে তৈরি। রিয়াল এস্টেট পড়ে ভিশিয়াস সাইকেলে। প্রচুর টাকা ডেভলপারদের হাতে আসে। কিন্তু তারা এখানেও শুরু করে দুর্নীতি। কিছুটা সরকারের রাজকোষে যায়, আর সিংহভাগ আত্মসাৎ করে ডেভলপাররাই। মানুষকে কিছুটা কাজ দেখাতেই হবে ফলে যখনই নির্মাণকাজ এগিয়ে নেবার জন্য ফান্ডের দরকার পড়তো ডেভলপাররা পুরোনো প্রজেক্টের গতি স্লথ করে নতুন প্রজেক্টে হাত দিত এবং মার্কেট থেকে অ্যাডভান্সড টাকা তুলতো। এই করে একসময় অ্যাডভান্সড বরোইং প্রজেক্ট কম্লেশনের থেকে অনেক বেশী বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ব্যাংকিং দুর্নীতির মত এই দুর্নীতিও তো আর চাপা থাকতে পারেনা।

এই দুর্নীতি ফাঁসে কী হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে ব্যাংকিং দুর্নীতির ঝামেলাটা সামলানোর জন্য সরকার কী করল সেই প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এই অবস্থায় যখন রুরাল ব্যাঙ্কগুলোর বিশাল দুর্নীতি ফাঁস হয়ে গেল, তখন চীনা সরকারের পক্ষেও জনগণকে টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তখন সরকার আমানতকারীদের কিছু টাকা সহ এই রুরাল ব্যাংকগুলোকে ক্লিয়ার ব্যালেন্স শীটওয়ালা দেশের বড় বড় ব্যাংকের সাথে মার্জ করে দেয়। আর মানুষকেও তো আর বেশি দিন ক্ষেপিয়ে রাখা যায়না, এর সোশ্যাল, পলিটিকাল, ইকোনমিকাল ইম্প্যাক্ট আছে। ২০২৩ সালে নির্বাচনে ষি চিনপিং ৩য় বারের মত দাঁড়াচ্ছেন, রাইভালরা তার পদ দখলের জন্য মুখিয়ে আছে, নিজের পপুলারিটিও তাকে মেইনটেইন করতে হবে। তাই সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল বড় ব্যাঙ্কের খাতা কলমে এই ফ্রড অ্যামাউন্টকে চাপা দিয়ে সেই ফ্রড এমাউন্টকে ইনসিগনিফিকেন্ট দেখানো, যাকে বলা write off করা। এর অর্থ হলো, পাবলিককে তাদের ডেপোজিটের টাকা ফেরত না দিয়ে সেই ফ্রড এমাউন্টের বোঝা বড় ব্যাংকগুলোর কাঁধে ছেড়ে দেয়া। এরপর সরকার ট্যাক্স পেয়ারদের টাকা ব্যাঙ্কে রিক্যাপিটালাইজেশন করে বা বড় ব্যাঙ্কের ফান্ড ডাইভার্ট (ব্যাঙ্ক মার্জিং) করে ব্যাঙ্কগুলোকে লিকিউডিটি বা ফান্ডের ঘাটতি থেকে মুক্তি দেয়। রিক্যাপিটালাইজেশন মানে হল সরকার নিজস্ব টাকাই ব্যাংকগুলোতে দিয়ে তাদেরকে ফান্ড বা লিকুইডিটির ঘাটতি থেকে মুক্ত করল। অর্থাৎ এটার জন্য সরকার ব্যবহার করল ট্যাক্সপেয়ারদের টাকাই, মানে মানুষের টাকাই। এভাবে ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে যত বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয় তত বেশি ব্যাংকে রিক্যাপিটালাইজ করা হয়। ফলে ব্যাঙ্ক গুলো পুনরায় চাঙ্গা হয় এবং দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বেচে যায়, সাধারণ মানুষের আমানত সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু সমস্যাটা হলো এই রিক্যাপিটালাইজেশনের ফলে ঋণ বাড়তে থাকে, ঋণের ওপর সুদের বোঝা চাপে, আর আল্টিমেটলি দেশের উন্নয়ন ব্যহত হয়। এভাবে ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হওয়ার প্রসেস কিছুটা ডিলে হয় বা তারা আরেকটা চান্স পায় যাতে রিক্যাপিটালাইজড অ্যামাউন্ট ইনভেস্ট করে রিটার্নের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক গুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আর গভর্মেন্টের বাজেট অ্যামাউন্ট বা ডেব্ট অ্যামাউন্ট তাৎক্ষনিকভাবে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে ডাইভার্ট করা যায়। চীনের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিকে করোনার পর চাঙ্গা করার জন্য স্টিমুলাস প্যাকেজের প্রয়োজন ছিল। তাই আমানতকারীদের টাকা সরাসরি মেটানোর রাস্তায় চীন হাঁটেনি। একটা কথা বলতে হয়, তা হচ্ছে এই পুরো প্রোসেসটার মাধ্যমে চীনা সরকার দুর্নীতির ক্রাইসিসটাকে সরিয়ে ফেলল কিন্তু সিস্টেমের কোন পরিবর্তনই হয়নি, দুর্নীতি কিন্তু ফের হবে, আর সেটা হলে যদি পাবলিক আবার প্রোটেস্ট করে সেক্ষেত্রেও সরকার এই পথেই হাঁটবে। শুনতে খারাপ লাগতেই পারে, কিন্তু সত্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক দেশে এটা হবার চান্স কম থাকে, কারণ সেখানে ব্যাংকগুলোর একটা বড় অংশ প্রাইভেটাইজড থাকে, আর সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে এরকম পলিটিকাল ইনভলভমেন্টও থাকে না, এরকম দুর্নীতিও থাকেনা। ফলে এরকম ঝামেলাতেও যেতে হয়না। এগুলো হয় যখন লোকাল গভর্নমেন্ট নিজেদের স্বার্থের জন্য ব্যাংককে, অর্থাৎ সাধারণের অর্থকে লুট করতে শুরু করে। বলতেই পারেন, এটা গণতান্ত্রিক দেশের পলিটিকাল পার্টিও করে। হ্যাঁ, করে, কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাইভেটাইজড সেক্টরের জন্য, অপোজিশনের জন্য, পাবলিকের প্রতি মিনিমান দায়বদ্ধতার জন্য ও নিজেদের পার্টির পক্ষে পলিটিকাল ক্যাপিটাল তৈরির জন্য সেটা কম হয়। চীনের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন, একটা গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থার সাথে এটাকে আপনি মেলাতে পারবেন না।

আরেকটা ইম্পরটেন্ট দিক হচ্ছে, এভাবে ফ্রড এমাউন্টটা বড় ব্যাংকে মার্জ করার মাধ্যমে কিন্তু সরকারকেও আর আমানতকারীদেরকে টাকা ফেরত দেয়া লাগল না। এখন তাদের আমানতটা চলে গেছে বড় ব্যাংকে, সেখান থেকেই তারা রিটার্ন পাবে। শুধু তাই নয়, ওই যে রিয়াল এস্টেটের জন্য ব্যাংক লোন নেয়া হয়েছিল, সেটাও একাউন্টও বড় ব্যাংকে চলে গেছে। এখন নির্মীয়মান কনস্ট্রাকশনের মর্টগেজের পেমেন্টও করতে হবে সেই ব্যাংকেই। কিন্তু আসল সমস্যাটা গেল না, সেটা হলো সাধারণ মানুষের প্যানিক। রুরাল ব্যাংকের দুর্নীতি এতটাই বেশি ছিল যে ব্যাংক মার্জ করার পর মানুষ আরও ভয় পেয়ে যায়। এই বিশাল দুর্নীতির জন্য তারা ভাবতে থাকে যে এবারে বড় ব্যাঙ্কগুলোও এবার লসে রান করবে এবং সব শেষে সাধারণ মানুষের টাকাই মার যাবে। আর যদি তাই হয় তাহলে ব্যাঙ্ককে দেয়া মান্থলি ইনস্টলমেন্টের টাকাও মার যাবে, সেই সাথে রিয়াল এস্টেট প্রপার্টির ওনারশীপও আর পাওয়া যাবে না। এর সাথে যোগ হলো একটু আগে উল্লেখ করা ডেভলপারদের দুর্নীতি। ডেভলপাররা তো তাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্যের জন্যই কনস্ট্রাকশনের কাজ শেষ করছে না। মানুষ কেন আর তাদের ভরসা করবে? কেনই বা তারা সাডেন প্যানিকে যাবে না? সাধারণ মানুষ ভয় পেল আর এই উদ্বেগের ফলেই তারা ব্যাঙ্কগুলোর মর্টগেজ বয়কট করে এবং ইএমআই দেয়া বন্ধ করে দেয়।

মারকেট ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে বুমিং রিয়াল এস্টেটের বাবল ফুলছিল তো ফুলছিলই। কিন্তু বাবল ছিল আর্টিফিশিয়াল। হাইরিস্ক বাবল, বার্স্ট হওয়া ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। বুমের সময় অ্যাডভান্সড সেল বৃদ্ধির জন্য সস্তার পুঁজির জোগান বৃদ্ধি সঙ্গে মনিটারি পলিসির জন্য সস্তার পুঁজির ডিমান্ড বৃদ্ধি। কিন্তু সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া, ব্যাঙ্কের দুর্নীতি, প্রটেস্ট ইত্যাদির ফলে মর্টগেজ বয়কট, প্রিবুকিং এ অনীহা ফান্ডের অভাব প্রকট করে তোলে ফলাফল বাবল ভেঙে ক্রাইসিস শুরু হয়। চায়নার রিয়েল এস্টেট সেক্টর বর্তমানে ধ্বংসের মুখোমুখি। এই ধ্বংসের কারনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লোয়ার অ্যান্ড মিডিল ইনকাম গ্রুপ। চায়নায় যে ‘উই নিড হোম’ আন্দোলন চলে তার আন্দোলনকারীদের সিংহভাগই ওয়ার্কিং ক্লাস মানুষ। আর এই সমস্ত ক্রাইসিসের জন্য দায়ী ছিল জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার অভাব, তাদের স্বার্থ বিবেচনা না করে সরকারের লোকেদের, পার্টির স্বার্থের চিন্তা, চিন্তা করতে সক্ষম হওয়াটা, গণতন্ত্রের অভাব। বাংলাদেশও এর থেকে শিক্ষা নিতে পারে…

(রোহিত সরকারের লেখার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছি)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.