স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার

স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার এমন একটি যুদ্ধ ছিল যা বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদ, মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। স্প্যানিয়ার্ডদের যুদ্ধ হিসেবে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরে ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্টরা তাদের শক্তির মেরিট তুলে ধরার জন্য, তাদের মতাদর্শের গুণাবলী দেখানোর জন্য এই যুদ্ধকে ব্যবহার করেছে। এই যুদ্ধের বীজ কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের শাসনের আগেই ১৯শ শতকে রোপণ করা হয়ে গিয়েছিল। ১৯শ শতাব্দী স্পেনের জন্য একটি অশান্ত সময় ছিল; রাজতন্ত্রের বিরোধিতার ফলে সাংবিধানিক অধিকার, উদারতাবাদ এবং এমনকি একটি স্বল্পকালীন প্রজাতন্ত্রের জন্য জনগণের মধ্যে চাপ দেখা দেয়। এগুলর সাথে যুক্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রেভোল্যুশনারিদের দ্বারা স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন। সব মিলে স্প্যানিশ রাষ্ট্র দুর্বল এবং জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফনসো ১৯২০-এর দশকে মরোক্কোর বিরুদ্ধে একটি বিপর্যয়কর যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এর ফলে তিনি ও তার সেনাবাহিনী জনসমর্থন হারায়, সাধারণ জনতা বিক্ষুব্ধ হয়, আর তাই রাজতন্ত্রের অবসানের মাধ্যমে উপরে যে সাংবিধানিক অধিকার, উদারতাবাদ ইত্যাদির কথা বললাম সেগুলো জনগণকে দেয়াটা প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা যায়। আলফনসো এগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৩১ সালে দেশ ত্যাগ করেন। আর তখন স্থানীয় সরকার নিজেদেরকে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন নিসেতো আলকালা-জামোরে।

নিসেতো এবং তার কমিটি  পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা ছিল বিংশ শতাব্দীর দিকে উত্তোরন। পরিবর্তনগুলোর মধ্যে ছিল ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষি সংস্কার, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী মুক্তি এবং কাতালোনিয়া ও বাস্কের স্বায়ত্তশাসন। এই সব বৈপ্লবিক ধারণাগুলোর ফলে দক্ষিণপন্থীরা বিচ্ছিন্নতা বোধ করতে শুরু করে।  এই রেভোল্যুশনারি আইডিয়াগুলোর একচুয়াল ইমপ্লিমেন্টেশন বেশ ধীর ছিল। ধীর ছিল কেননা প্রতিটি সামান্য পরিবর্তনই দক্ষিণপন্থীদেরকে আরও উদ্বিগ্ন করে তোলে এবং তাতে বামপন্থীরা আরও হতাশ হয়। সেই সাথে তখন গ্রেট ডিপ্রেশন যুক্ত হয়, আর তাতে পরিবর্তনগুলো আরও ধীর হয়ে যায়। সিএনটি নামে একটি নৈরাজ্যবাদী কনফেডারেশন এর ফলে ধর্মঘট ডাকে, আর রিপাবলিকান সরকার এদেরকে ক্র্যাক ডাউন করলে এরা ফার লেফট হিসেবে এলিয়েনেটেড হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে সিএনটি ১৯৩৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়, আর সেই নির্বাচনের ফলাফল দেখে তারা আরও অসন্তুষ্ট হয়। দক্ষিণপন্থী ক্যাথলিক কনজারভেটিভ CEDA বা সেডা পার্টি এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে, আর ক্ষমতায় এসে তারা পূর্বের সংস্কারগুলোকে প্রতিহত করা শুরু করে। সেই সাথে তারা মন্ত্রিসভা ও সামরিক বাহিনী থেকে বামপন্থীদের সরিয়ে দিতে থাকে।

১৯৩৪ সালে সিএনটি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় যখন নৈরাজ্যবাদী এবং কমিউনিস্টরা আস্তুরিয়াসে উঠে দাঁড়ানোর জন্য একত্রিত হয়।  তরুণ জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোকে এই বিপ্লবকে চূর্ণ করার জন্য আফ্রিকার প্রতিভাবান সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। রাস্তাগুলি যুদ্ধ শিবিরে পরিণত হয়েছিল, শ্রমিকরা অবশেষে পরাজিত হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এটি জনতার মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল এবং বামপন্থীদের একত্রিত করতে সহায়তা করেছিল। কমিউনিস্ট, নৈরাজ্যবাদী, সমাজতন্ত্রী এবং উদারপন্থীরা বুঝতে পেরেছিল যে অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হলে তাদের একসাথে লড়াই করতে হবে। পপুলার ফ্রন্ট তৈরি করা হয়েছিল; ডানপন্থীদের প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হয়, কেউ কেউ মনে করত যে কমিউনিজম ছড়িয়ে দেবার জন্য একরকম ইহুদি-বলশেভিক ষড়যন্ত্র চলছে।

হোসে অ্যান্টোনিও প্রিমো ডি রিভেরা স্প্যানিশ ফালাঙ্গে পার্টি গঠন করেন। রাজনীতি দ্রুত আরও হিংস্র এবং পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে আর ভিন্নমতকে সহ্য করা হচ্ছিল না, ভিন্নমত দেখলেই চুপ করিয়ে ফেলা হতো। ১৯৩৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পপুলার ফ্রন্ট একটি সংকীর্ণ বিজয় লাভ করে, যার ফলে সরকার বামপন্থীদের পক্ষে চলে যায়। প্রেসিডেন্ট নিসেতোর জায়গায় ম্যানুয়েল আজাঞা ক্ষমতায় আসেন। প্রিমো দে রিভেরাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং একটি অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দমন করার জন্য সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হয়। হোসে সানহুরো পূর্বে ১৯৩২ সালে একটি অভ্যুত্থান চালানোর চেষ্টা করেছিলেন, এবারে তিনি আবারও ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন, আর তার জন্য তিনি রাজতন্ত্রবাদী, ঐতিহ্যবাদী, ফ্যাসিবাদী, জাতীয়তাবাদী – যে কোন রকম ডানপন্থীদের সাথে চুক্তি করেছিলেন। অবিশ্বস্ততার সতর্কবার্তা প্রকাশ্যে আসে; বাম, ডান এবং সেন্টার সব দলে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় ও সরকার পুনরায় অস্থির অবস্থায় চলে যায়। ১২ই জুলাই রাতে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যায়। মাদ্রিদে একজন ফালাঙ্গে বন্দুকধারী একজন সমাজতান্ত্রিক পুলিস অফিসারকে হত্যা করে, তার সাথে দূরবর্তীভাবে সম্পর্ক আছে এমন কাউকে পেলেও পুলিশ গ্রেফতার করতে শুরু করে। তারা রাজতন্ত্রবাদী বা মোনার্কিস্ট হোসে কালভো সোটেলোকে তাদের সাথে স্টেশনে যেতে বলে, আর সেটা ছিল এমন একটি স্টেশন যেখানে তিনি আর পৌঁছন নি। এসব হত্যাকাণ্ড স্পষ্ট করে দেয় যে, এই সংকটের অবসান রাজনৈতিকভাবে হবে না।

অভ্যুত্থান প্রস্তুত ছিল, কিন্তু সরকার প্রস্তুত ছিলনা। জনগণ সশস্ত্র হবার দাবি করেছিল, কিন্তু সরকার তা চায়নি। সরকার এও স্বীকার করতে চায়নি যে সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে দেখে জনগণ নিজেরাই সশস্ত্র হয়ে ওঠে। ফ্রাঙ্কোর কমান্ডের অধীনে মরোক্কোতে সামরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল: স্পেন জুড়ে জেনারেলরা প্রতিটি শহরে উঠে আসে, আর পুলিশ অনিচ্ছাকৃতভাবে বামপন্থীদের সাথে কাজ করে। প্রজাতন্ত্রের শহরগুলি তারা পতিত হোক বা না হোক, এগুলো একটি নতুন রক্তপিপাসু গৃহযুদ্ধের লাইন আঁকতে শুরু করে। জাতীয়তাবাদী এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। জাতীয়তাবাদীরা সেভিল, ক্যাস্টিল এবং লিওনকে দখল করেছিল, কিন্তু সরকার ভ্যালেন্সিয়া, বার্সেলোনা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে মাদ্রিদকে ধরে রেখেছিল। অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীদের বের করে আনা হয়। সামরিক বা বেসামরিক, পুরুষ বা নারী, সবাই যুদ্ধ করছিল, সেই যুদ্ধকে তারা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই-ই ধরুক, বা নিষ্ঠাবান খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরহীন কমিউনিস্টদের লড়াইই ধরুক।

পরিস্থিতি বেশ পরাবাস্তব ছিল, আপনি ঘুম থেকে উঠবেন, প্রাতঃরাশ করলেন, এরপর সামনের সারিতে লড়াই করলেন এবং তারপরে ডিনার করবেন ও শেষ ঘুমের জন্য বাড়িতে যাবেন। এছাড়াও, এর একটি অন্ধকার দিক ছিল। জাতীয়তাবাদীরা পদ্ধতিগতভাবে ভিন্নমতের যে কোনও সন্দেহভাজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং বামপন্থী রিপাবলিকানরা পুরানো পদ্ধতির প্রতিনিধিত্বকারী যে কোনও ব্যক্তিকে বা যে কোনও কিছুকে ধ্বংস করতে শুরু করে। এতে করে রিপাবলিকান দলের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। সরকার কেবল টিকে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু কমিউনিস্ট এবং নৈরাজ্যবাদীরা এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও ইউটোপিয়া সম্পর্কে তাদের ধারণাগুলি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। জাতীয়তাবাদীদের প্রতি ঘৃণাই ছিল তাদের একমাত্র সাধারণ আগ্রহ। জাতীয়তাবাদীদের ক্ষেত্রে বিমান দুর্ঘটনায় তাদের মাস্টারমাইন্ডের মৃত্যু পরিস্থিতিকে আরও কিছুটা নাড়া দেয়। একটি জান্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মেজর জেনারেল মিগুয়েল কাবানেয়াস এটি পরিচালনা করেছিলেন। এ সবই ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। একটু পেছনে ফিরে গেলে, উভয় পক্ষকেই খুব সমান বলে মনে হয়েছিল: জাতীয়তাবাদীদের বিজয়ী কার্ড ছিল আফ্রিকার তাদের সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী, যারা তখন মরোক্কোতে ছিল। তাহলে তারা কীভাবে সেনাবাহিনীকে সঠিকভাবে স্পেনে নিয়ে যাবে? অবশ্যই ইতালীয় এবং জার্মান পরিবহন। এই বিদ্রোহে নাৎসি জার্মানির ও ফ্যাসিস্ট ইতালির সমর্থন ছিল এবং কিছুটা হলেও পর্তুগালেরও সমর্থন ছিল। তারা প্রথমে সরবরাহকারী হিসেবেই যুদ্ধে ভূমিকা পালন করছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা যুদ্ধটিতে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ওঠে। ফ্রাঙ্কোর আফ্রিকান সেনাবাহিনী সেভিলে পৌঁছয় এবং মাদ্রিদের দিকে উত্তরে অগ্রসর হয়। তারা শত্রু অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রস্র হয় এবং আগস্টে মেরিদার যুদ্ধে তাদের নির্মমভাবে চূর্ণ বিচূর্ণ করে। এভাবে তারা জাতীয়তাবাদীদের দুটো অঞ্চলকে সংযুক্ত করে।

ফ্রাঙ্কোকে কমান্ডার-ইন-চিফ উপাধিতে পুরস্কৃত করা হয়। যখন তিনি আলকাজারের অবরোধ থেকে তার মিত্রদের উদ্ধার করেন, তখন তিনি কডিও (Caudillo) উপাধি গ্রহণ করেন, যার অর্থ হলো “প্রশ্নাতীত সামরিক প্রধান”। ফ্রাঙ্কো এরপর জাতীয়তাবাদীদের অনেক উপাদানকে একত্রিত করা শুরু করেন ও তাদের মধ্যে ঐক্য নিয়ে আসেন। রিপাবলিকানদের এই ঐক্যের অভাব ছিল, কমিউনিস্টরা পুরানো সরকারের মন্ত্রিসভাকে বহিষ্কার করে, তারা তাদের নিজস্ব চিত্রে প্রজাতন্ত্রকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। নৈরাজ্যবাদীরা এটিকে তাদের বিপ্লবের বিরুদ্ধে একটি অপমান হিসাবে দেখেছিল। নভেম্বরে মাদ্রিদকে অবরুদ্ধ করা হয় এবং এই নতুন কমিউনিস্ট সরকার ভ্যালেন্সিয়াতে পশ্চাদপ্রসরণ করে। শুধুমাত্র উৎসাহী পুরুষ ও নারীরাই লড়াই করতে থাকে, ফলে জাতীয়তাবাদীরা আর অভ্যন্তরে যেতে পারেনি। এবারে এদের এই যুদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের আদর্শের লোকদেরকে আকৃষ্ট করল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নও এতে আকৃষ্ট হয় ও তাদের নিজস্ব সহায়তা পাঠাতে শুরু করে। যুদ্ধটি দ্রুত একটি প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হচ্ছিল, এবং যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স এতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। তাই তারা নিজেদের মধ্যে একটি নন-ইন্টারভেনশন চুক্তিতে সাক্ষর করতে সম্মত হয়। তবুও, মাদ্রিদ বছরের পর বছর ধরে অবিচল ছিল।

জাতীয়তাবাদীরা অবরোধ বজায় রেখেছিল, কিন্তু সেই সাথে তাদের বাহিনী মাদ্রিদের চারপাশের সমস্ত কিছু দখল করার প্রচেষ্টা হাতে নেয়। তারা দক্ষিণে প্রসারিত হয় এবং ১৯৩৭ সালে বিচ্ছিন্ন বাস্ক কান্ট্রিতে অভিযান পরিচালনা করে। এই অঞ্চলটি লুফটওয়াফ বোমারুদের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এই পরাজয়ের পরে রিপাবলিকানরা ব্যাপকভাবে অসুবিধার মধ্যে পড়েছিল, তারা ১৯৩৮ সালে কিছু আক্রমণ করেছিল, কিন্তু প্রতি ১০ মিটারে তাদের ১০ গ্যালন রক্ত খরচ হয়েছিল। ফ্রাঙ্কো রিপাবলিকানদের উত্তর দিকে তাদের পেছনে ধাওয়া করে ও তাদের সমুদ্রের দিকে ঠেলে দেয় এবং তাদের অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। রিপাবলিকানরা এপ্রিলের যুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করেছিল, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। সম্ভবত তারা অনিবার্য বিশ্বযুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখতে পারবে, আর সেক্ষেত্রে তারা মিত্রপক্ষের সমর্থনও পাবে। ঠিক আছে… ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য তখন তাদের হিটলারকে তুষ্টিকরণ নীতিতে ছিল, ফলে কোন কাজ হয়নি। (উল্লেখ্য ১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানি অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করলেও ব্রিটেইন ও ফ্রান্স কোন পদক্ষেপ নেয়নি, তারা তাদের আপিসমেন্ট নীতিতেই চলছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সালের ১ম সেপ্টেম্বরে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ও তার জন্য ব্লিৎসক্রেগ ট্যাকটিক্স অবলম্বন শুরু করলেই ব্রিটেইন ও ফ্রান্স ৩রা সেপ্টেম্বরে যুদ্ধে যোগদান করে।)

যাই হোক, রিপাবলিকানরা কোনঠাসা হয়ে পড়াতেও তখন ব্রিটেইন ও ফ্রান্সের কোন সাড়া পাওয়া না গেলে তাদের মনোবল নড়বড়ে হয়ে যায়, ও আরও পিছু হটে। তারা শেষ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে হার অবশ্যম্ভাবী ছিল। ১৯৩৯ সালে নৈরাজ্যবাদীদের মাতৃভূমি কাতালোনিয়ায় একটি আগ্রাসনের মাধ্যমে সেই পরাজয়ের সূত্রপাত হয়। ২৬শে জানুয়ারী বার্সেলোনার পতন ঘটে এবং এদিকে মাদ্রিদে নৈরাজ্যবাদীরা তখনও কমিউনিস্টদের সাথে ঐক্য স্থাপন করতে পারেনি। শান্তি চুক্তি নিয়ে নৈরাজ্যবাদী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে শত্রুতা ছড়িয়ে পড়ে। এই গৃহযুদ্ধের মধ্যেই আরেকটি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। নৈরাজ্যবাদী সেগিজমুন্দো কাসাদো কমিউনিস্ট হুয়ান নেগ্রিনকে বহিষ্কার করেন এবং প্রজাতন্ত্রের পক্ষে আলোচনা শুরু করেন, কিন্তু ফ্রাঙ্কো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করবেন না। ২৬শে মার্চ মাদ্রিদের পতন ঘটে এবং ফ্রাঙ্কো ১লা এপ্রিল বিজয় ঘোষণা করেন।

কিছু রিপাবলিকান ভাগ্যবান ছিল, তারা পালিয়ে গিয়েছিল বা কোনওভাবে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু পালায়নি, তারা হয় আত্মহত্যা করে, নয়তো অন্য সৈন্যের হাতে মারা পড়ে। ফ্রাঙ্কো পরম স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, এবং জাতীয়তাবাদী হিসেবে তিনি যে যুদ্ধের সময় অনেকগুলো গোষ্ঠীকে একত্রিত করেছিলেন তা নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তিনি তাদের সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করতেন, কিন্তু অবশ্য চাপের মুখে। আর চাইলেই তিনি তাদেরকে নির্মূল করে দিতে পারতেন। তার অধীনেই দেশটি কেন্দ্রীভূত ছিল। ঐতিহ্য ও ধর্ম ছিল তার কাছে সর্বাগ্রে। শ্রমিকদের শোষণ করে দেশটির অর্থনীতি পুনর্নির্মাণ এবং পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশটিতে রাজতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হয়, আর অবশ্যই ফ্রাঙ্কোই জন এর আজীবনের জন্য রিজেন্ট। কী ভেবেছেন, তিনি পদটি ছেড়ে দেবেন? তিনি ১৯৬৯ সালে হুয়ান কার্লোস ডি বোরবোনকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন এবং ১৯৭৫ ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর প্রথম হুয়ান কার্লোস সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সেই রাজা স্পেনের সংস্কার করেন, গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং দেশের আধুনিকীকরণ করেন। গৃহযুদ্ধের পরিণতি আর কোথাও এত জোরালোভাবে স্থায়ী হয়নি। অবশেষে সূর্য উদিত হয়। কিন্তু যুদ্ধের বেদনা এখনও গভীরভাবে স্মরণ করা হয় আর তা অনুভূত হয় আজও, অবশ্যই সাথে কিছু ঘৃণা অব্যাহত রেখে। বামপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যে সহিংস বিভাজন কেবল স্পেনেই নয়, সারা বিশ্বেই রয়ে গেছে। প্রতিপক্ষকে “বিপজ্জনক কমিউনিস্ট” বা “দুর্নীতিগ্রস্ত ফ্যাসিস্ট” বলা খুব সহজ। যাই হোক, আমরা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করতে পারি, বিতর্কের নৈতিকতাকে শ্রদ্ধা করেই কোনও ধরণের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারি, অথবা কারও মুখে ঘুষি মেরে গালি দিয়ে বলতে পারি “এই ফ্যাসিস্ট!!”, “এই কমিউনিস্ট!!”…

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.