রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বে রোমান প্রজাতন্ত্র ছিল। রোমানদের উদ্ভব থেকে রোমান প্রজাতন্ত্রের সমাপ্তি পর্যন্ত জানতে এখানে যান।
Table of Contents
অগাস্টাসের শাসন (রা. খ্রি.পূ. ২৭ – খ্রি. ১৪ অব্দ)
একনায়ক হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ ও সংস্কারসমূহ
ভূমিকা : ইতিহাসের লিপি অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে ইতালির টিবার নদীর পাশে ছােট্ট একটি গ্রাম থেকে রােমের উত্থান শুরু হয়। শত শত বছর ধরে রােমানরা একটি দক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তারা প্রাচীন রাজতন্ত্রের হাত থেকে মুক্ত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজ্য শাসন আরম্ভ করেছিল। আইনের একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থার মাধ্যমে আশেপাশের এলাকার উপরেও তারা কব্জা করতে যাচ্ছিল। যুদ্ধে কয়েকবার তারা হেরে গিয়েছিল। একসময় এমন হলাে যে অতর্কিতে আসা কিছু দস্যুর হাতে শহরটা প্রায় ধ্বংসই হতে বসেছিল। কিন্তু রােমানরা লড়ে গেছে। তখন তাদের শহর হয়ে গিয়েছিল প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনাে আর পুরাে ইতালির উপরে তাদের কর্তৃত্বও ততদিনে চালু হয়ে গেছে। রোম তখন ইতালি ছাড়িয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অন্য দেশগুলাে দখল করতে শুরু করেছে। আবারও শহরটি প্রায় ধ্বংসের দরজায় দাঁড়িয়ে চুড়ান্ত বিজয় লাভ করেছিল। তখন রােম ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ক্ষমতা আর উন্নয়নের পথে অনেক বাধার সৃষ্টি হয়। দাসবিদ্রোহ আর জাতিগত বিদ্রোহ তাে ছিলই, তার চেয়েও ভয়াবহ ছিল সেনাপ্রধানদের মধ্যে প্রতিযােগিতামূলক যুদ্ধ। কিছুদিনের জন্য মনে হয়েছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান জুলিয়াস সিজারের সময়টাই ছিল সবচেয়ে শান্তির। তিনি পুরাে সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে সিজারকে হত্যার মাধ্যমে আবার অরাজকতা শুরু হয়ে গেল। এবারে প্রতিপক্ষ খুব অল্প সময়ই টিকে থাকল। জুলিয়াস সিজারের ভাইপাের ছেলে অক্টাভিয়ান ক্রমে সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তিকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করলেন। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ২৯ সালে সত্যিই শেষ পর্যন্ত শান্তি এসেছিল রােমে। সাতশ বছরের ভয়াবহতা আর ক্ষমতা দখলের যুদ্ধের অবসান হয়েছিল। সীমানার দিকে রােম থেকে দূরবর্তী এলাকায় তখনও একটুআধটু যুদ্ধ চলছিল; কিন্তু ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে সভ্য জায়গাগুলাে একেবারে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। আর সেখান থেকেই এই নতুন কাহিনীটি শুরু হলাে।
সিনেটের ব্যর্থতা : জয়লাভের পরে অক্টাভিয়ান সরকার গঠন করা শুরু করলেন। তার সময় পর্যন্ত রােমের শাসনব্যবস্থা সিনেটের মাধ্যমে চালানাে হতাে। সিনেট হলাে শহরের ধনী আর বিখ্যাত পরিবারের কিছু সদস্য নিয়ে গঠিত একটি দল। রােম যখন ছােট একটি শহর ছিল তখন এই সিনেট পদ্ধতি বেশ সফলভাবে কাজ করত। কিন্তু এবারে হাজার মাইল বিস্তৃত রাজ্যের পরিচালনায় সিনেট খুব সহজেই ব্যর্থ ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত হলাে। সিনেটের সদস্য, যারা বেশির ভাগই ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত, দেশের বিভিন্ন স্থানে যারা অর্থ আত্মসাৎ করছিলেন তারা নতুন সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি। সরকার ব্যবস্থা আর সামাজিক পরিবর্তনগুলাে নিজেদের এলাকায় কার্যকর করতে অপারগ ছিলেন বলে তাদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল। সিনেটের সদস্যদের সমর্থনকারী দলের লােকেরা, যারা ক্ষমতা আর লুটপাটে ভাগ বসাতে চাচ্ছিলেন, প্রায় একশ বছর ধরে তাদের বিরােধীদলও সক্রিয় ছিল। (অবশ্য দুই দলেই আদর্শবান কিছু লােক ছিল যারা সৎ ও দক্ষ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় দিন গুনত।) দুই দলই বলপ্রয়ােগ করাতে প্রায় অর্ধশতাব্দীর জন্য যুদ্ধ বেঁধে গেল।
সিনেটের আইনে সিজারের পরিবর্তন ও একনায়কতন্ত্র সংস্কৃতির সূচনা : জুলিয়াস সিজার সিনেটের আইনে কিছু পরিবর্তন এনে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কেবল ইতালিতে জন্মালে আর বেড়ে উঠলেই একজন মানুষ সিনেটের সদস্য হতে পারবে, এই বাধ্যবাধকতা তিনি উঠিয়ে দিলেন। দেশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে সদস্য নির্বাচন করে তিনি নতুন সিনেট গড়তে আরম্ভ করলেন। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচন হয়তাে দেশের সব সেনাপ্রধানের মনরক্ষার জন্য ভালােই ফল এনেছিল। কোনাে সন্দেহ নেই, তিনি ভেবেছিলেন যে ইতালির বাইরে থেকে আসা সিনেট সদস্যদের মাথার ওপরে প্রধান হয়ে থাকাটা তার জন্য খুব সহজ হবে। ইতালিতে জন্মানাে সদস্যদের রাজার প্রতি অনীহা থাকলেও, অন্য বিভাগ থেকে আসা মানুষদের জন্য জুলিয়াস সিজারই ছিলেন তাদের সর্বাধিনায়ক বা রাজা। এভাবেই রােমে একনায়কতন্ত্রের সংস্কৃতি চালু হলাে। একজন মানুষ, যিনি কিনা তার দক্ষতা দিয়ে প্রমাণ করতে পারেন যে রােমকে নিয়মকানুনে বেঁধে আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব, নিঃসন্দেহে জুলিয়াস সিজারই ছিলেন সেই মানুষ। পশ্চিমা সভ্যতার কাছে এটি হয়তাে একটি আদর্শ সরকার পরিচালনা ব্যবস্থা কিন্তু বিভিন্ন জাতিকে সমান কাজের আওতায় আনার ব্যবস্থাটি সেখানে সফল হয়নি। অনেক রােমানই ছিল যারা নিজেদেরকে রাজ্যের নেতা মনে করত আর অন্যদের পাত্তাই দিত না। কোনাে সন্দেহ নেই, এই অহংকারই জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করার প্রথম উসকানি হিসেবে কাজ করেছিল।
অক্টাভিয়ানের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ইতালিয়ান-ভিত্তিক সিনেট প্রতিষ্ঠা করে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ : অক্টাভিয়ান দায়িত্বে আসার পরপরই বুঝতে পেরেছিলেন যে সরকারকে আবার ঢেলে সাজাতে হলে একনায়কতন্ত্র দরকার। কিন্তু জুলিয়াস সিজারের পরিণতি দেখে তিনি এটুকু বুঝতেন যে বিষয়টি খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। তাই তিনি ক্ষমতা পুরােপুরি কুক্ষিগত করে রাখতেও চাননি আবার একেবারে তা ইতালির বাইরে ছড়িয়ে দিতে চাননি। দুটো পদক্ষেপই তার জনপ্রিয়তা ক্ষুন্ন করেছিল এবং তাকে হত্যাকারীদের ছুরির কাছাকাছি টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তবু প্রজাতন্ত্রটিকে সুগঠিত করতে রােমানরা সবসময় যে শাসনব্যবস্থায় অভ্যস্ত ছিল, তাও বজায় রাখতে চাইতেন তিনি। আর প্রকৃতপক্ষে তিনি সেটাই করেছিলেন। তিনি জুলিয়াস সিজারের বসানাে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সিনেট সদস্যদের উঠিয়ে দিলেন আর শুধু যারা রােমের কায়দাকানুনে অভ্যস্ত তাদেরই রাখলেন। এরপর থেকে সিনেটরদের তিনি নিজের মত অনুযায়ী চালাতেন। আর এভাবেই সিনেটের পুরাে কর্তৃত্বটা চলে এলাে ইতালিয়ানদের হাতে। অক্টাভিয়ান সরকার চালানাের জন্য সিনেটে বিতর্কসভার আয়ােজন করতেন। আগের সমস্ত কাঠামাে নিয়ে সেখানে আলােচনা হতাে, সে সবের ব্যাপারে সবার মতামত জানতেন, সিদ্ধান্ত নিতেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমস্যা জানার জন্য সেখানকার নিম্নস্তরের কিছু কর্মচারির সাহায্য নিতেন। কিন্তু যতই দায়িত্ব যার ওপরেই থাকুক না কেন, সবাই জানত, অক্টাভিয়ানই সব সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক। (তিনি নিজেই সব সরকারি দপ্তরের কলকাঠি নাড়েন।) তিনি নিজে ঠিক করতেন কে কখন সিনেটর হবেন আর কে সে পদ থেকে নেমে যাবেন। খােদ সিনেটের সকলেও তা জানত। যদিও দেখা যেত সিনেটের সদস্যরা বিতর্কসভায় বেশ মন খুলে কথা বলছেন কিন্তু তর্কের শেষে অক্টাভিয়ান যা সিদ্ধান্ত নিতেন, সেটাই বাস্তবায়িত হতাে।
মধ্যম আয়ের অশ্বারোহীদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন : অক্টাভিয়ান দেশের সমস্ত সম্পদ নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে রেখেছিল। তার এই চালে দেশের সব মধ্যম আয়ের মানুষেরা ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে লাগল। সম্পদ বলতে তারা ল্যাটিন ভাষায় ঘােড়াকে বুঝত। এই ঘােড়ার জন্যই মধ্যম আয়ের মানুষদের ডাক পড়ত। সেনাবাহিনীতে যােগদানের জন্য আহ্বান করলে নিজেদের ঘােড়া আর যুদ্ধ সরজ্ঞাম নিয়ে তাদের আসতে হতাে। তারা তখন হয়ে যেত অশ্বারােহী সেনাদলের অংশ। নিম্ন আয়ের মানুষেরা পায়ে হেঁটে দলের সাথে যুদ্ধে যেত। ল্যাটিনে ঘােড়ার প্রতিশব্দ অনুযায়ী তাদের দলটিকে ‘ক্যাভালিয়র’ বলে ডাকা হতাে। কখনও আবার মধ্যযুগীয় সেনাবাহিনীর মতাে তাদের ‘নাইট’ নামেও ডাকা হতাে। কিন্তু মধ্যযুগীয় নাইটরা রােমান যােদ্ধাদের থেকে অনেক অন্যরকম ছিল। তাই এখানে তাদের নাইট বলে উল্লেখ করা হবে না। ঘােড়ার মালিকদের সম্পত্তি এত বেড়ে গেল যে তারা সিনেটর হবার যােগ্যতা অর্জন করে ফেলল। কিন্তু তারা সিনেটরের পরিবারভুক্ত ছিল না। অক্টাভিয়ান তাদের কাউকে কাউকে সিনেটর পদে বসালেন আর বাকিদের শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে। তারা রাজ্যের সরকারি কর্মচারি হয়ে গেল। বিভিন্ন সুযােগ সুবিধা পেয়ে এভাবে মধ্যম আয়ের মানুষেরা অক্টাভিয়ান আর তার বংশধরদের অনুগত হয়ে গেল।
সেনাবাহিনী সংস্কার ও রোমের বাইরের অঞ্চলে সিনেটরদের অর্থাৎ অক্টাভিয়ানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : সেনাবাহিনীর ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল অক্টাভিয়ানের শক্তির পরিচয়। সেনাবাহিনী তাকে সবসময় সম্মান করত কারণ একমাত্র তার কাছেই সেনাবাহিনীকে চালানাের মতাে পয়সা ছিল। অক্টাভিয়ান সতর্কভাবে সেনাবাহিনীর দশ হাজার সদস্যদেরকে ইতালির দৈর্ঘ্য প্রস্থ অনুযায়ী ছড়িয়ে রাখলেন। এই দলটিই হয়ে দাঁড়াল অক্টাভিয়ানের প্রিতােরিয়ান বাহিনী (আগের দিনে সেনাপ্রধানদের দেহরক্ষী বাহিনীকে প্রিতোরিয়ান নামে ডাকা হতাে)। প্রিতােরিয়ান বাহিনী হয়ে গেল অক্টাভিয়ানের নিজস্ব সেনাবাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা হাতে ভেলভেটের দস্তানার নিচে আরেকটি লােহার দস্তানা পরা শুরু করল। এছাড়া শুধু রােমের আইনকানুন রক্ষার জন্য ১৫০০ সদস্যের একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী ছিল। অক্টাভিয়ানের আমলের আগের পুরাে শতাব্দী ধরে রাস্তাঘাটে যে হানাহানি আর মারামারি চলে আসছিল, বিশেষ পুলিশবাহিনী সেই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি সাধন করল। ইতালিতে সেনাবাহিনীর যে অংশটা থাকত, তারা অবশ্য সেনাবাহিনীর বৃহৎ অংশ নয়। সেখানে ত্যক্তবিরক্ত সেনাপ্রধানেরা ইচ্ছে করলে সিনেটের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে আকস্মিক বিদ্রোহের সৃষ্টি করতে পারত। রােমান বাহিনীর প্রায় পুরােটাই (আঠাশটি দল, প্রতি দলে ছয় হাজার করে যােদ্ধা ছাড়াও আরও কিছু সাহায্যকারী দল মিলে চার লাখেরও বেশি মানুষ) সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে পাহারারত ছিল। সীমানার পাশের দুর্ধর্ষ উপজাতিদের আক্রমণের আশঙ্কায় তাদের সেখানে রাখা হয়েছিল। এভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখতেন অক্টাভিয়ান, তাদের যখন যেখানে খুশি যেতে বলতেন। নিজের ইচ্ছেমতাে অক্টাভিয়ান বাহিনীটিকে ইতালিয়ান উচ্চবর্ণের মানুষের একটি দল বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। বলা হতাে, এমন মানুষদেরই তিনি বেছে নিয়েছেন যেন সেনাবাহিনীতে থাকার কারণে রােমের জন্য তাদের আলাদা টান থাকে। কিন্তু আসলে অন্য সব দূরবর্তী অঞ্চলের উপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারপর আর কী, রােম ছাড়াও অন্য সব অঞ্চলের উপরে ছড়ি ঘােরানাের দায়িত্ব সিনেটই পেয়ে গেল। অবশ্য এই আইন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য শিথিল ছিল যেখানে কিনা কোনাে সেনাসদস্যকে বসানাে হয়নি। দেশের সীমানায় অবস্থানকারী সেনাসদস্যরা সরাসরি অক্টাভিয়ানের অধীনে ছিল। এমনকি তাদের ব্যাপারে যেসব সিদ্ধান্ত সিনেট নিত, সেখানেও অক্টাভিয়ান নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করতে ভুলতেন না। প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর কোনাে অংশকে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ করার কথা নয়। সিনেটের সদস্যরা জানত যে সেনাবাহিনীর কাজে নাক গলাতে গেলে তারা নিজেরাই অরক্ষিত হয়ে যাবে। সেনাবাহিনীর স্বার্থে আঘাত লাগলে সেনা সদস্যরা তাদের মেরে ফেলতে কোনাে দ্বিধা করবে না। তবে সিনেটররাও নিতান্ত ভদ্র ছিলেন বলে কোনাে ঝামেলা হয়নি।
জরুরি অবস্থা শেষে তার দায়িত্ব গ্রহণ, তার প্রিন্সেপ, অগাস্টাস ও সম্রাট হয়ে ওঠা : খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে অক্টাভিয়ান ঘােষণা দিলেন যে দেশে আর কোনাে জরুরি অবস্থা নেই। শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর সমস্ত উত্তেজনাও শেষ হয়েছে। এ কারণে তিনি সেনাবাহিনীর তদারকিসহ অনেকগুলাে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন। অবশ্য সিনেটের সদস্যরা জানত, এটা লােকদেখানাে কাজ। অক্টাভিয়ান আসলে চাইতেন যে সিনেটের ইচ্ছেতেই যেন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়। তাহলে আইনত তিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আর অনধিকার চর্চা করা হচ্ছে বলে কেউ তার দিকে আঙুল ওঠাতে পারবে না। সিনেট চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যাচ্ছিল। তারা বিনয়ের সাথে অক্টাভিয়ানকের সেনাবাহিনীর দেখাশােনাসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতে অনুরােধ করল। তাকে “প্রিন্সেপ” মানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকের উপাধি গ্রহণ করতেও অনুরােধ করা হলাে। (এই ‘প্রিন্সেপ’ শব্দটি থেকেই ‘প্রিন্স বা ‘রাজকুমার’ শব্দটি এসেছে।) খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে, সে সময় তিন শতাব্দীর রােমান আইনকানুনের সূচনা হয়েছিল। একে বলা হয় “প্রিন্সিপেট”। সে বছরই অক্টাভিয়ানকে “অগাস্টাস” উপাধি দেয়া হয় যা আগে শুধুমাত্র দেবতাদের নামে ব্যবহার করা হতাে। এই নামটি দেয়ার পেছনে কারণ ছিল যে মানুষটি ঠিক দেবতার মতাে করেই পৃথিবীর ভালত্ব আরও বাড়িয়ে তুলবে অথবা তাতে আরও নতুন মাত্রা যােগ করবে। অক্টাভিয়ান উপাধিটি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন আর ইতিহাসে তিনি অগাস্টাস নামেই সুপরিচিত। এর মধ্যে সেনাবাহিনী তাকে কমান্ডার বা নেতা বলে ডাকা শুরু করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালে সিজারকে আটক করে বিজয় ছিনিয়ে আনার পর থেকেই যেন উপাধিটি তিনি অর্জন করেছিলেন। এর থেকেই আধুনিক ইংরেজিতে তাকে “এমপেরর,” মানে, “সম্রাট” বলে ডাকা শুরু হয়েছিল। তাই অগাস্টাসই প্রথম রােমান সম্রাট হিসেবে কথিত আর তার রাজ্যকে বলা হয় রােমান সাম্রাজ্য।
কাউন্সিল ও কনসলের পদের ওপর পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস পদ সৃষ্টি : জুলিয়াস সিজারের ভাইয়ের নাতি বা গ্রেট নেফিউ তিনি, সুতরাং এমনিতেই তিনি রাজকুমার ছিলেন, তারপরে আবার সম্রাট হলেও অগাস্টাস নিজেকে রাজা মনে করতেন না। তিনি সবসময় ভাবতেন এই রােমান সাম্রাজ্য বেশিদিন টিকবে না। যদিও তিনি ছিলেন সর্বেসর্বা কিন্তু ক্ষমতার তেমন অপব্যবহার করতেন না। নিজের নামের জোরে রাজা হয়ে বসে না থেকে তিনি প্রতিবছর নির্বাচনের মাধ্যমে কনসল (প্রাচীন রােমের শাসক) হতে পছন্দ করতেন। (রােমের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর একবার করে কাউন্সিলের নির্বাচন হতাে।) অগাস্টাস নিজের সাথে আরও একজনকে নির্বাচনে রাখতেন। কাগজে কলমে তার আর অগাস্টাসের ক্ষমতা একরকমের হলেও বাস্তবে তা ছিল না। অন্য কনসল কোনাে স্বপ্নের মধ্যে থাকত না, এই বাস্তবতাটি সে জানত। পরবর্তীকালে অগাস্টাস রােমের কনসল পদ থেকে অব্যাহতি নেন। একেক বছরে একেকজন সিনেটরকে পুরস্কারস্বরূপ তিনি কনসল বানাতেন। কনসল হয়ে দেশের আইনকানুন নিয়ে কাজ করার চেয়ে আজীবন রােমের লােকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােজিত থাকার জন্য অগাস্টাস নিজেকে ওই পদ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে “পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস” বা সর্বোচ্চ পুরােহিত হিসেবে ঘােষণা করলেন। তারপর একটার পর একটা পৃথক দপ্তরের দায়িত্ব নিতে থাকলেন।
একনায়কতন্ত্র বিরোধী চিন্তা : যেহেতু বেশিরভাগ দপ্তরই ছিল সম্রাটের নিজের অধীনে, তাই সরকারের নীতি নির্ধারণের বেলায় তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন। খুব সামান্য কিছু মানুষ মনে করত যে দেশের সরকার ব্যবস্থায় নতুন কোনাে পরিবর্তন এসেছে। কেবল কোথাও কোনাে যুদ্ধ চলছিল না – এটাই এক কথায় ভালাের দিকে যাত্রার পক্ষে বিরাট বড় একটি বিষয় ছিল। শুধু সিনেটররা সেই সময়কে আবার ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখে যেত যখন কিনা তারাই ছিল নেতা। কেবল সামান্য কিছু বুদ্ধিজীবী সরকারের চালটি ধরতে পেরেছিল। তারা মাঝে মধ্যে আবার আগের মতাে সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাত যে পদ্ধতিটা তাদের স্মৃতি থেকে অথবা ইতিহাস জেনে বেশি সঠিক বলে মনে হতাে। যতই দিন যেতে লাগল ততই যেন তাদের কাছে প্রাচীন পদ্ধতির মূল্য বেড়ে যেতে লাগল।
আর্থিক অবস্থার অবনতি ও প্রাদেশিক গভর্নরদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা : কেবল অগাস্টাসের একনায়কতন্ত্রই যে তাকে রােমের শাসনকর্তা বানিয়ে রেখেছিল, তা নয়। কিছু টাকাপয়সার ব্যাপারও ছিল। রােমান প্রজাতন্ত্রে সবসময়ই সরকার চালানাের জন্য টাকার জোগাড় করার অদক্ষ এক নিয়ম ছিল। প্রজাদের দেয়া কর বেশিরভাগ সময়ে যারা আদায় করছে তাদের পকেটেই চলে যেত আর সরকার পরিচালিত হতাে চারদিকের দখলকৃত এলাকার লুটপাটের টাকা দিয়ে। কোনাে প্রজা যদি দেশের বাইরের কোনাে জায়গা দখল করতে পারত, তবে পুরস্কার হিসেবে তার কর মওকুফ করে দেয়া হতাে। অনেক প্রজার জীবন এভাবে রাখঢাকহীনভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের লুটের টাকায় চলত। অগাস্টাসের আমলের আগের শতাব্দীতে প্রাদেশিক শক্তিগুলােকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথমত অতিরিক্ত কর বসিয়ে আর তার ওপরে দখল ও ডাকাতি করে তাদের একেবারে পথে বসানাে হয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের লােকেরা নিজেদের পকেট ভারী করেছে। তারপর সবশেষে বিভিন্ন প্রদেশের সাথে যুদ্ধরত সেনাপ্রধানদের চাপের মুখে তাদের চরম ক্ষতি করা হয়েছিল। অর্থের প্রয়ােজন চার দিকে এমনভাবে উথলে উঠছিল আর সেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকার পরিমাণ এতই কম ছিল যে যখন যুদ্ধ জয়ের উল্লাসের শেষের পর্যায়ে তখন ছিনিয়ে আনা রসদও ফুরিয়ে এসেছে। সে সময়ে রােমান সাম্রাজ্য দেউলিয়া হতে বসল। অর্থনৈতিক এই ধস থেকে দেশকে বাঁচাতে এমনকি অগাস্টাসও নতুন কোনাে যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হলেন। রােমের সেনাবাহিনীর হাতের নাগালে থাকা সব সভ্য আর ধনী জায়গাগুলােকে ততদিনে তারা গিলে খেয়ে ফেলেছে। এরপর আর যা কিছু বাকি ছিল তা হলাে কিছু অসভ্য জাতি, যাদের দখল করে যতই অমানবিকভাবে চেপে পয়সা বের করতে চাওয়া হােক না কেন, তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা বেশ স্পষ্ট ছিল যে আগের মতােই যদি ভােগদখলের রাজনীতি চলতে থাকে তাে রােম নির্ঘাত বিশৃঙ্খল একটা জাতিতে পরিণত হবে। সেনাসদস্যদের যদি কোনাে কারণে যথাযােগ্য পারিশ্রমিক না দেয়া যায় তাে তারা সাথে সাথেই বিদ্রোহ করে বসবে। এভাবে রােম হয়তাে লড়তে লড়তেই ধ্বংস হয়ে যাবে যেমন তিন শতাব্দী আগে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের আমলে হয়েছিল। অগাস্টাস বাধ্য হয়ে সৎ একটি উপায়ে রাজ্য পরিচালনার কথা ভাবলেন। প্রদেশের গভর্নরদের একটি নির্দিষ্ট বেতন বেঁধে দেয়া হলাে। কোনােরকম অসাধু উপায়ে সেই বেতনের সাথে যদি একটি টাকাও যােগ করা হয়, তবে সাথে সাথে তার উৎস খতিয়ে দেখা হবে। তবে যারা বেআইনীভাবে কাজ আদায় করত, তারা জানত যে সিনেটরদের আগেও সহজে পটিয়ে ফেলা যেত আর ভবিষ্যতেও যাবে। সম্রাটের অবশ্য অসাধু আয়ের প্রয়ােজন ছিল না, কারণ তিনিই ছিলেন দেশের সবচেয়ে ধনী। কোষাগার থেকে একটি পয়সাও যদি কোনাে সরকারি কর্মচারী চুরি করত, তাে সে সম্রাটের তহবিল থেকেই চুরি হতাে। তাই অগাস্টাস সেসব ব্যাপারে এক চুল নরম হবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আর্থিক সমস্যা সমাধান এবং সেনাবাহিনী ও সংস্কারের খরচের জন্য কর আদায়ের নতুন পদ্ধতি ও মিশর থেকে সম্পদ আহরণ : অগাস্টাস কর আদায়েরও নতুন পদ্ধতি চালু করলেন যাতে করে করের সিংহভাগ সরাসরি চলে যায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আর আদায়কারীর পকেটে যায় খুবই সামান্য। এ ধরনের নতুন নিয়মকানুন প্রদেশগুলােকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিলাে। জুলিয়াস সিজারের আমলে তারা রাজনৈতিকভাবে যতটা নিগৃহীত হয়েছিল, সেটা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারল। অবশ্য রােমের অভিজাত মানুষদের হাতেও কোনাে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। তবু প্রদেশগুলাে আগের হতাশা কাটিয়ে এখন অন্তত একটা সৎ আর নিষ্ঠাবান সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিল। তারা সরকার প্রধানের অধীনে সামনের দিনগুলােতে আশু উন্নতির দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কর আদায়ে নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা বা দুনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সত্ত্বেও রাজ্যের সব প্রয়ােজন মেটানাে সম্ভব হচ্ছিল না। বিশেষ করে যখন থেকে অগাস্টাস রােম শহরকে ঢেলে সাজানাের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। (ইতিহাসে বলা হয় তিনি শহরটি পেয়েছিলেন ইটের তৈরি আর বদলে ফেলেছিলেন মার্বেলে।) আগুন প্রতিরােধের জন্য তিনি একটি বাহিনী গঠন করছিলেন আর রাজ্য থেকে বিভিন্ন দিকে যাতায়াতের জন্য তৈরি করছিলেন রাস্তাঘাট। অগাস্টাস নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাজ্যের সম্পদ ব্যবহার করছিলেন। এ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রাকে হারানাের পরে তিনি এমনভাবে মিশরের দখল নিয়ে নেন যেন মিশর কেবল রােমের দখলকৃত একটি অঞ্চলই নয়, বরং তার নিজস্ব সম্পত্তি। তার কাছে বিশেষ অনুমতি না নিয়ে কোনাে সিনেটরও মিশরে ঢুকতে পারত না। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মিশরই ছিল সে সময় সবচেয়ে ধনী দেশ। বছরে একবার নীলনদের বন্যায় পুষ্ট মিশর তখন আশাতীত ফসল উৎপাদন করত। তাই স্বভাবতই মিশর হয়ে দাঁড়াল ইতালির শস্যভাণ্ডার। আরেক দিকে মিশরের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকের দেয়া কর সরাসরি অগাস্টাসের কোষাগারে জমা হতে লাগল। আরও অনেক উপায়েই অগাস্টাসের কোষাগার সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। (অনেক ধনী মানুষ নিজেদের জমাজমি, বাড়িঘর ছেড়ে অভিবাসী হয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের সম্পত্তির কিছু অংশ অগাস্টাসকে দিয়ে যেতে লাগল ঘুষ হিসেবে। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কখনও কৃতজ্ঞতায় আবার কখনও নিজেদের উত্তরাধিকারীরা যেন ঠিকমতাে সম্পত্তি ভােগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে।)। রাজ্যের বিভিন্ন প্রয়ােজনে অগাস্টাস নিজের পকেট থেকে খরচ করতে পারতেন। সরাসরি তার হাত দিয়ে প্রয়ােজনীয় অর্থ বিভিন্ন খাতে প্রেরিত হলে তার প্রতি সকলের আস্থাও বেড়ে যাবে। তাই তিনি নিজেই সেনাবাহিনীর সব খরচ নিজের তহবিল থেকে দেয়া আরম্ভ করলেন আর সেনাবাহিনীও একমাত্র তারই অনুগত হয়ে থাকল।
সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন : অগাস্টাস ইতালিকে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। ধর্মীয় যেসব আচার আচরণ প্রাচ্য দেশগুলাে থেকে অনুপ্রবেশ করেছিল, বিশেষ করে খুবই জমকালাে আর নাটকীয় নিয়মকানুনগুলাে সুচারুভাবে পালনে অগাস্টাস রােমের অধিবাসীদের উৎসাহিত করছিল। রােম প্রাচ্যের যে দেশগুলাে দখল করে সেখান থেকে দাস হিসেবে বন্দী মানুষ এনেছিল তারাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সেই ধর্মীয় অনুশাসন। রােমে নিয়ে আসার পরে তাদের মুক্ত করা হলে রােমের সংস্কৃতির বাইরে পৃথক সংস্কৃতির রীতিনীতি চালু করতে তারা তৎপর হয়ে উঠল। রােমের প্রাচীন রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মানুষ নতুন সংস্কৃতির মােহে ডুবে যাক, অগাস্টাস তা চাইতেন না। আবার মুক্তি পাওয়া প্রাচ্য দাসদের স্বাধীনতা হরণেও তিনি তেমন কোনাে পদক্ষেপ নেননি। এভাবেই ক্ষমতায় আসার পর থেকে অগাস্টাস রােম শাসন করলেন ৪৫ বছরব্যাপী। এর মধ্যে রােমের উন্নতি হলাে, শান্তিও প্রতিষ্ঠিত হলাে।
অগাস্টাসের মূল্যায়ন : প্রশ্নাতীতভাবে অগাস্টাসের শাসন ইতিহাসের পাতায় রােমের ঘুরে দাঁড়ানাে হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রাজ্য শাসনের বিষয়ে যে গভীর প্রজ্ঞা তার ছিল তা যদি না থাকত আর এতদিন জীবিত থেকে শাসনকাজ চালিয়ে যেতে না পারতেন, তবে রােমে প্রাদেশিক যুদ্ধ লেগেই থাকত। অগাস্টাসের বিচক্ষণ শাসন না পেলে হয়তাে কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই ইতালি টুকরাে টুকরাে হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ত। কেবল কঠোর শাসনের জোরেই রাজ্যটি চারশ বছর ধরে অটুট শক্তিধর হয়ে টিকে রইল। সমস্ত ইউরােপের উপরে রােমান সংস্কৃতির দৃঢ় প্রভাব ফেলার জন্য যথেষ্ট সময় তারা পেয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেক উল্টোস্রোত এলেও সেই প্রভাব ছিল অটুট। আমরা নিজেরাও যেন সেই সংস্কৃতিরই ধারক। মনে রাখতেই হবে যে, আজ পাশ্চাত্য দেশগুলােতে প্রধান ধর্ম হিসেবে খ্রিস্টধর্ম যেভাবে প্রসার পেয়েছে, রােমান রাজ্যের অধীনে তারা যে ব্যাপক আর স্বাধীনভাবে রাজ্যের আনাচেকানাচে নির্বিশেষে ধর্ম প্রচারে নিযুক্ত ছিল, রােমান সাম্রাজ্য ছাড়া সম্ভব হতাে না। এমনকি আজও ক্যাথলিক চার্চ রােমের ভাষা থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে।
সীমানায় প্রতিবেশী মিত্র ও শত্রু রাজ্যগুলো
আশপাশের অধীনে থাকা রাজ্যগুলো : খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে যখন রােমের সম্রাট ছিলেন অগাস্টাস, সে সময়ে রােমের আশেপাশের রাজ্যগুলাের অবস্থা কেমন ছিল, এবারে এক নজরে সেটা দেখে নেয়া যাক। আশেপাশের ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্রউপকূলবর্তী দেশগুলাে হয় খােদ রােমের অধীনে ছিল, নয়তাে সাদাচোখে তাদের স্বাধীন মনে হলেও তারা আসলে চূড়ান্তভাবে রােমের শক্তির কাছে বশ মেনেই চলত। সেসব রাজ্যের রাজারা রােমের সম্রাটের অনুমতি ছাড়া তলােয়ার হাতে তুলে নিতে পারত না আর সম্রাটের ইচ্ছেতে তাদের জন্ম-মৃত্যুও নির্ধারণ করা হতাে। সরাসরি রােমের অধীনে চলে না এসে যে তারা দূরবর্তী প্রদেশ হয়ে রােমান সাম্রাজ্যের একটি অলিখিত অংশ হয়ে বেশ নিরাপদে দিন কাটাতে পেরেই শান্তি পেত। আশপাশের রাজ্যগুলো ছিল –
- মিশর, কার্থেজ ও মৌরিতানিয়া : ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলের সর্বপূর্বের দেশ মিশরের (অগাস্টাসের ব্যক্তিগত প্রদেশ) কথা দিয়ে শুরু করা যায়। মিশরের পশ্চিম দিকটা ছিল সিরেনাইকা, আফ্রিকা আর নামিবিয়ার অঞ্চল। আফ্রিকার ওই অঞ্চলটি, যেটি আগে কার্থেজ রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিল, দুই শতাব্দী আগে একসময় রােমকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিল। পুরনাে কাজে শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সালে রােমানরা পুরােপুরি ধ্বংস করে ফেলেছিল কিন্তু জুলিয়াস সিজারকে আটক করে হত্যা করার আগে সেখানেই পাকাপােক্তভাবে তিনি রােমান কলােনি স্থাপন করে যান। কার্থেজ শহর সম্পূর্ণভাবে নতুন রােমান শহর হিসেবে জেগে উঠেছিল আর তারপর বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে ছয়শ বছরব্যাপী দাঁড়িয়ে ছিল। জায়গাটা ছিল নিউমিডিয়ার পশ্চিম দিকে যেখানে বর্তমানে আলজেরিয়া, মরােক্কো আর মৌরিতানিয়ার মতাে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলাে রয়েছে। মৌরিতানিয়ার এরকম নামকরণের কারণ, সেখানে যে উপজাতি বসবাস শুরু করত, তারা নিজেদের মৌরি বলে পরিচয় দিত। (পরবর্তীকালে স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের নিজেদের পছন্দ মতাে “মরােস” শব্দটি, আফ্রিকার অধিবাসীদের বােঝাতে ব্যবহার করত। ইংরেজিতে সেখান থেকেই একই জনগােষ্ঠীকে বােঝাতে “মুর” শব্দটি ব্যবহার করে আর মরােক্কোকেও একই নামে ডাকে।) মৌরিতানিয়ার রাজা বিয়ে করেছিলেন ক্লিওপেট্রা আর মার্ক এন্টনির কন্যা ক্লিওপেট্রা সিলিনকে। তাদের দুজনের সন্তান ছিল টলেমি। (ক্লিওপেট্রার আগের চৌদ্দ জন রাজা এই নামেই পরিচিত ছিল।) টলেমি ১৮ সালে রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন।
- স্পেন ও গাউল : উত্তরে ভূমধ্যসাগর আর পশ্চিমে ইতালি পর্যন্ত স্পেন আর গাউল ছিল দুটো সমৃদ্ধ দেশ। অগাস্টাসের ক্ষমতায় আসার দুই শতাব্দী আগে রােমানরা স্পেন (আধুনিক স্পেন আর পর্তুগাল এক সাথে) জয় করেছিল। পুরাে সময়টা অবশ্য স্পেনের অধিবাসীরা রােমানদের অস্ত্রের ঝনঝনানি প্রতিহত করতে চেষ্টা করত। তারা ধীরে ধীরে রােমানদের হটাতে চেষ্টা করছিল। অগাস্টাসের সময় পর্যন্ত স্পেনে কখনােই পুরােপুরি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্পেনের উত্তরে ক্যান্টাব্রি নামে একটি উপজাতি, যারা স্পেনের সীমানা জুড়ে বসবাস করত, তারা বহু বছর ধরে অগাস্টাসের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৯ অব্দের আগে স্পেন সম্পূর্ণভাবে রােমানদের আয়ত্তে আসেনি। একমাত্র তারপর স্পেনে শান্তি ফিরে এসেছিল আর অগাস্টাসের রাজ্যের একটি সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে স্পেন সুপরিচিত হয়েছিল। অগাস্টাস স্পেনে শান্তিপূর্ণ শাসনকাজ চালাতেন। আবার কখনও বেশ উদ্ধত যুদ্ধের আয়ােজনেও নেমে পড়তেন। কতকগুলাে শহরের পত্তনও করেছিলেন যেগুলাের মধ্যে দুটির নাম উল্লেখযােগ্য। দুটো শহরের নামই তার নিজের নামে রেখেছিলেন, “সিজার অগাস্টা” আর “অগাস্টা এমেরিতা” (যার অর্থ হলাে, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক অগাস্টাস)। সে শহরগুলাে অবশ্য এখনও দাঁড়িয়ে আছে তবে পুরনাে নাম ঝেড়ে ফেলে তাদের নতুন নাম হয়েছে যথাক্রমে, সারাগােসা আর মেরিদা। গাউল (রাইন নদীর পশ্চিমে আধুনিক ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানির কিছু অংশ, নেদারল্যান্ড আর সুইজারল্যান্ড) স্পেনের পরে জুলিয়াস সিজারের রাজ্যের অন্তর্গত হয়েছিল তবে তা বেশ ভালােভাবেই দখল করা হয়েছিল। গাউল আর ইতালির মধ্যে সীমানায় একটি মুক্ত দেশ ছিল অ্যালপাইন, অগাস্টাস সম্রাট হওয়ার পরেও জায়গাটি স্থানীয় আদিবাসীদের দখলে ছিল।
- ইলিরিয়া, থ্রেস ও মেসিডোনিয়া : ইতালির পূর্বদিকে ছিল অ্যাড্রিয়াটিক সাগর। তার উল্টোদিকের তীরে ছিল আরেক দেশ যাকে রােমানরা বলত “ইলিরিকাম” আর ইংরেজরা ডাকত “ইলিরিয়া”। আসলে সেটাই বর্তমানের যুগােশ্লাভিয়া। অগাস্টাস সম্রাট হওয়ার পরে রােমের সমুদ্রতীর বলতে ছিল শুধু ইলিরিয়ান তীর। তার কিছু অংশকে আবার ড্যালমাশিয়া বলে ডাকা হতাে। ইলিরিয়ার দক্ষিণপূর্বদিকে ছিল ম্যাসিডােনিয়া আর থ্রেস যেগুলাের দুটো রাজ্যই ছিল রােমানদের দখলে।
- এশিয়া মাইনোর, সিরিয়া ও জুডিয়া : গ্রিসের পূর্বদিকে ঈজিয়ান সাগর আর তারপরেও এশিয়া মহাদেশের অংশ (আধুনিক টারকিসহ)। যে সময়ে রােমান সাম্রাজ্য পূর্বদিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, এশিয়া মাইনর ছিল গ্রিক ভাষাভাষীদের রাজ্য। অগাস্টাস ক্ষমতায় আসতে আসতে এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ আর পশ্চিম অংশ রােমান রাজ্যের অংশ হয়ে গিয়েছিল। বাকি অংশটুকুও বলতে গেলে রােমানদের দখলেই ছিল। এশিয়া মাইনরের দক্ষিণদিকে যেখানে সিরিয়া যা কিনা আগেই রােমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর ছিল জুডিয়া যার নিজস্ব একজন রাজা থাকলেও রােমান সম্রাটের অনুমতি নিয়ে তিনি রাজ্য পরিচালনা করতেন। জুডিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে আবার পাওয়া যায় মিশর।
একটানা রাস্তা ও নিরাপত্তা : সম্পূর্ণ রাজ্যটি ঘুরে ফিরে দেখার জন্য অগাস্টাস একটানা রাস্তা বানিয়েছিলেন। বিস্তৃত আর প্রতিটি জায়গা চমৎকারভাবে সংযুক্ত রাস্তা ধরে তিনি সহজেই দেখাশােনা করতে পারতেন। রাজ্যের সীমানা জুড়ে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে রাজ্যটি ছিল বিদেশিদের আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কারণ রাজ্যের পরিধি বাড়তে বাড়তে এই দুদিকে তা একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলেছিল। পশ্চিম দিকে সীমাহীন অ্যাটলান্টিক মহাসাগর আর দক্ষিণে একইরকম অসীম রােমান আফ্রিকান সাহারা মরুভূমি (অন্তত রােমানরা নিজেদের রাজ্যকে এমনই মনে করত)।
ইথিওপিয়া, আরব ও সাহারা মরুভূমি : মিশরের দক্ষিণে নীলনদ যে কোথায় বয়ে গেছে তা নিয়ে তখনকার কেউ মাথা ঘামায়নি। মিশরের ঠিক দক্ষিণে নীল নদের তীরবর্তী যে ইথিওপিয়ান আদিবাসীদের বাস ছিল তারা অগাস্টাসের আমলের হাজার বছর আগে মিশরের সাথে যুদ্ধ করেছিল। সেসব অনেক অনেকদিন আগের কথা। যাই হােক, ইথিওপিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলই তখন শান্ত। মিশরের টলেমিরা (মিশরের গ্রিক শাসক) ইথিওপিয়ায় উপনিবেশ গেঁড়ে বসলেও রাজ্যটি দখলের কোনাে চেষ্টা সেভাবে করেনি। রােমানরা মিশর দখল করে নিলে, খ্রিস্টপূর্ব পঁচিশ সালে সেখানকার গভর্নর গেইয়াস পেট্রোনিয়াস ইথিওপিয়ান হামলার জবাবে পাল্টা আক্রমণ চালান। তিনি সদলবলে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে ইথিওপিয়ার কিছু অংশ দখল করে নেন। কিন্তু অগাস্টাস সে দখলকে পাত্তা দেননি। তিনি মনে করতেন ইথিওপিয়া রােম থেকে এত দূরে যে সেটি দখল করে রােমের জন্য তেমন কোনাে সুফল আসতে পারে না। বরং এই হামলায় এত মানুষ আর পয়সা খরচটাই মাটি হবে। তিনি সেনাবাহিনীকে হামলায় অংশ নিতে বাধা দিয়েছিলেন। আর তাই মিশরের দক্ষিণ সীমানায় সবসময়ের জন্যই শান্তি ছিল অটুট। মিশর থেকে লােহিত সাগর পেরিয়ে আরবের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ দখলের চেষ্টাও সংশয়ে ভুগে অগাস্টাস শেষ পর্যন্ত বাতিল করেন। সিরিয়া আর জুডিয়ার দক্ষিণপূর্ব প্রান্তেও সাহারার মতাে বিশাল আরব মরুভূমি। সেই মরুভূমি যেমন রাজ্যের সীমানা বােঝাত তেমনি সেদিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কাও কমিয়েছিল। পরবর্তীকালে রােমান রাজ্য সেদিকে কিছুটা বেড়ে এসেছিল তবে বেশিদূর যেতে পারেনি।
পার্থিয়া : রাজ্যের পূর্বদিকের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। রােমান রাজ্যের সেদিকের সীমানায় ছিল একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র যা তাদের প্রতি বিদ্বেষী। সেটি ছিল পার্থিয়া। সেই রাজ্য আধুনিক ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পার্থিয়া আসলে পারস্যের আদি নাম। তিন হাজার বছর আগে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট সেই রাজ্যে হামলা করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। (সুতরাং পারখিয়া আর পারস্য একই দেশ) আলেক্সান্ডারের উত্তরাধিকারীরা পারস্যে জোর করে গ্রিক সংস্কৃতি প্রচার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কখনােই সফল হয়নি। আলেক্সান্ডারের দখলকৃত এশিয়ার বেশিরভাগ অংশ তার মৃত্যুর পরে জেনারেল সেলুকাসের হাতে চলে যায়। তাই এই অংশকে সেলুসিড সাম্রাজ্য বলে ডাকা হতাে। সেলুসিড সাম্রাজ্য যতই দুর্বল হতে লাগল, পশ্চিম দিকে পারস্যের আধিপত্য ততই বাড়তে লাগল। একসময় তাদের অভিজ্ঞ নেতাদের হাত ধরে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে পারস্যের জাতি স্বাধীন হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে রােম সেলুসিড সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ (যেটি ততদিনে সিরিয়া নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল) দখল করে নিজের রাজ্যের আয়তন বাড়াতে লাগল। সিরিয়াকে তখন রােমেরই একটি বিভাগ হয়ে যেতে হলাে। এখন রােম রাজ্যের ঠিক পূর্বদিকে পড়ল পারস্য। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালে রােমের একদল সেনা পারস্যে হামলা করে দখল করে নিতে চাইল। কিন্তু তারা ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে হেরে গেল। পার্থিয়ার অধিবাসীরা পরাজিত দলের পতাকা ছিনিয়ে নিলাে। এটা ছিল রােমের জন্য ভীষণ অপমানজনক। পনেরাে বছর পরে রােমের সেনাবাহিনী আবারও পার্থিয়ায় আক্রমণ করেছিল। সেবারে কিছু কিছু জায়গায় তারা জয়ী হলাে। এই আক্রমণ নিঃসন্দেহে ছিল পার্থিয়ার প্রতি প্রতিশােধমূলক। অবশ্য পার্থিয়ার কাছে তখনও ছিনিয়ে নেয়া রােমের পতাকাগুলাে ছিল।
আর্মেনিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পার্থিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব ও শান্তিচুক্তি স্থাপন : এবারের আক্রমণের পরে দুটো দেশের মধ্যে এক দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু হলাে। তাদের সাথে যােগ দিলাে আর্মেনিয়া। দড়ি টানাটানি খেলার মতাে আর্মেনিয়া একবার রােমের সাথে তাে আরেকবার পার্থিয়ার সাথে জোট বাঁধত। এশিয়া মাইনরের পূর্বপ্রান্তে ককেশাস পর্বতের দক্ষিণে ছিল আর্মেনিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে রােমের সেনাবাহিনী প্রথমে আর্মেনিয়ার যতদূর পারে দখল করে নিলাে। তারপর পুরাে রাজ্য জুড়ে চালাতে লাগল তাদের প্রচার। তবে যতবারই রােমানরা আর্মেনিয়ায় দূরবর্তী একটি শাসন কেন্দ্র খােলার চেষ্টা করেছিল, পার্থিয়া ততবারই সেটা নাকচ করে দিয়ে নিজেদের একটি উপনিবেশ সেখানে গড়ে তুলেছিল। প্রতিহিংসামূলকভাবে এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অগাস্টাসের তেমন কোনাে আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। বরং তিনি ধীরগতিতে রাজ্যের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বেশি মগ্ন ছিলেন। পারস্যের সাথে শুধু শুধু যুদ্ধে গেলে যে ধ্বংস হতে পারে আর নিজের হেরে যাবারও যে বিপুল সম্ভাবনা আছে, তাতে করে সেটা কেবল হয়রানিই হতাে। তাই তিনি পার্থিয়ায় আর তেমন বড়সড় কোনাে আক্রমণ না চালিয়ে কেবল দেশটির ব্যাপারে একটু সতর্ক নজর রেখেছিলেন। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে যা হয়, রােমের আর পারস্যের পুতুল শাসকেরা বছরের পর বছর আর্মেনিয়ার সিংহাসন নিয়ে মৃদু লড়াই চালিয়েই গেল। নিজেদের অসহায়ত্বের জন্য সাহায্য চেয়ে অগাস্টাস তার সৎ ছেলের নেতৃত্বে একদল সেনা আর্মেনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। ফলে পারস্যের পুতুল সেনাবাহিনী হেরে গেল আর মারা পড়ল। পার্থিয়ার সেনাবাহিনী অবশ্য এমনিতেও আর আক্রমণ করার অবস্থায় ছিল না। কারণ তারা দেশের ভেতরেই নানান সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তাই অগাস্টাস যখন শান্তিচুক্তির জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, পার্থিয়া সে আহ্বান সাদরে গ্রহণ করল। তাই খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে আবার দুটি রাজ্যের অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাপ্তি হয়। শান্তিচুক্তির সময়ে পার্থিয়ার কাছে রােমের যে যুদ্ধ পতাকা গচ্ছিত ছিল তা তেত্রিশ বছর পরে তারা সসম্মানে ফেরত দিয়েছিল। রােমের মান রক্ষা হয়েছিল আর অগাস্টাসের বুদ্ধিও প্রশংসা পেয়েছিল। (যদিও আর্মেনিয়া রােমের হাতে কখনােই নিরাপদ ছিল না। হাজার বছর ধরে রােমকে বিভিন্ন যুদ্ধে সহযােগিতা করাই যেন ছিল দেশটির কাজ। যুদ্ধের পরে যুদ্ধের অত্যাচারে দেশটি ছিল ত্যাক্তবিরক্ত।)
জার্মান জাতি ও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা
পূর্বে জার্মান আক্রমণ প্রতিহতকরণ : উত্তর দিকে রােম রাজ্যের ইউরােপের অংশে অবস্থা ছিল অন্যরকম। সেদিকে কোনাে জনমানবহীন মরুভূমিও ছিল না, আবার সভ্যতায় পিছিয়ে আছে এমন কোনাে জাতির কোনাে দেশও ছিল না। থাকলে তাদের সাথে যুদ্ধ করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যেত। সেদিকে বরং ছিল জঙ্গল আর এলােমেলাে পাহাড়ের সারি। অসভ্য কিছু মানুষ তার ভেতরে বসবাস করলেও করতে পারে। রােমানরা তাদের “জার্মানি” বলে ডাকত। তাদের হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে পৌছতে শব্দটা হয়ে গেছে “জার্মান”। জার্মানদের সাথে রােমানদের প্রথম সংঘর্ষ হয় খ্রিস্টপূর্ব ১১৩ সালে। কিম্ব্রি আর টিউটনস জাতি জার্মানির উত্তর দিকের সমুদ্র সৈকতে তাদের নিজস্ব জায়গা ছেড়ে দক্ষিণ দিকে সরে যায়। দক্ষিণ গাউলে সমুদ্রের দিকে আর ইতালির উত্তর দিকে তারা জার্মানদের কাছে পরাজয় বরণ করে। এটা ছিল রােমের জন্য প্রচণ্ড একটা শিক্ষা। রােম জেনেছিল যে উত্তর দিকে তার জন্য ভীষণ বিপদ সব সময় ওত পেতে আছে। এই বিপদ থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে যখন জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৫১ সালে গাউল দখল করে নেন আর রাইন নদীর উপরে রােমের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। রােমের বিশাল সেনাবাহিনী যদি রাইনের দৈর্ঘ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তবে তারা নিজেরা আর রাইনের তীর মিলেই তাে জার্মানদের জন্য বিকট এক প্রাচীর হয়ে উঠত। আর সত্যিকার অর্থে, সামান্য কিছু জায়গা ছাড়া বাকি অংশে তারা সেভাবেই বেষ্টনি তৈরি করে দাঁড়িয়েছিল তার পরের চারশ বছরেরও বেশি। সিজার পরে আরও অগ্রসর হয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ আর ৫৩ সালে দু’দুবার তিনি রাইন নদী অতিক্রম করে জার্মানির ভেতরে দুটো ছােট দলের সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন। সেসব অবশ্য জার্মানি হামলা করে দখল করার জন্য নয়, তাদের পাঠানাে হয়েছিল কেবল জার্মানদের রােমের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করার জন্য। নিজেদের যেন ভুলেও কখনও তারা রােমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত না করে।
দানিউব নদী পর্যন্ত সম্প্রসারণ : গাউলের পূর্বদিকে রােমের সীমানা ছিল বেশ অরক্ষিত। বিক্ষিপ্ত কতকগুলাে পাহাড় দিয়ে ঘেরা সেই সীমানার আসলে কোনাে নির্দিষ্ট কোনাে আকৃতি ছিল না। তাই সেটা ধরে রাখাও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। সীমানার ১৫০ মাইল উত্তরে ছিল বিশাল দানিয়ুব নদী। নদীটি ইউরােপকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পর্যন্ত ঘিরে রেখেছিল। তাই মনে হতাে যেন রােম রাজ্যের উচিত দানিয়ুব নদী পর্যন্ত ধেয়ে যাওয়া। যাতে করে নদীর মাধ্যমে সহজেই রাজ্যের একটা সীমানা নির্ধারণ করা যায় আর উত্তর দিকে অবস্থান করা অসভ্য জাতিদের থেকেও নিজেদের পৃথক রাখা যায়। অগাস্টাস ভয়ানক আক্রোশ নিয়ে তার সেনাবাহিনীকে উত্তরের দিকে পাঠালেন। এটা ছিল তার রাজ্যের জন্য বিরাট এক আগ্রাসী পদক্ষেপ। তবে শুরুর দিকে এটা কেবলই একটা সাম্রাজ্যবাদের চিন্তা থেকে করেছিলেন, তা নয়। এটা ছিল নিতান্তই একটা সীমারেখায় পৌছানাের আপ্রাণ চেষ্টা যতদূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব। এভাবে দখলের আর নিজের প্রভাব বিস্তারের ভয়াবহ প্রচেষ্টা তিনি কিছুটা কমিয়ে আরও নিরাপদে থাকতে পারতেন। ধীরে ধীরে রােমান সেনাবাহিনী অ্যালপাইন পর্বতের ওপর দিয়ে উত্তর ইতালির চারদিকে বৃত্তাকারে দখল করে ফেলল। খ্রিস্টপূর্ব ২৪ সালে অগাস্টাস “অগাস্টা প্রিটোরিয়া” (সর্বাধিনায়ক অগাস্টাস) নামে শহরটি স্থাপন করেন। সেই শহরটিই এখন আয়ােস্টা নামে পরিচিত। আল্পসের উত্তর আর পূর্ব দিকটাও দখল করা হয়ে গেল। ইলিরিয়া হয়ে গেল রােমান সাম্রাজ্যের অংশ আর পূর্ব দিকে শেষ মাথায় ছিল রােমের আরেকটি অঞ্চল মােয়েশিয়া (এই অঞ্চলগুলাে বর্তমানে দক্ষিণ যুগােস্লাভিয়া আর উত্তর বুলগেরিয়ার অন্তর্গত)। দানিয়ুবের পার্শ্ববর্তী এলাকা, ইতালির উত্তর দিক আর ইলিরিয়া তিনটি আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বলতে গেলে, রাশিয়া, নােরিকাম আর প্যানােনিয়া। এই তিনটি অঞ্চল বর্তমানে আধুনিক বােভারিয়া, অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরির পূর্বভাগকে বােঝায়। খ্রিস্টপূর্ব ৯ সাল আসতে আসতে দেখা যায় রােমান সাম্রাজ্য দানিয়ুবের উৎস থেকে মােহনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে। কিছু কিছু বিদ্রোহী জাতিরও সৃষ্টি হয়েছিল, এর মধ্যে যাদের সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে। পুরাে এলাকাটিতে যে একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল তার নাম থ্রেস (বর্তমানে বুলগেরিয়ার দক্ষিণাংশ)। থ্রেস যেহেতু সরাসরি দানিয়ুবের তীরবর্তী না, আর দেশটির পক্ষ থেকে রােমের কোনাে বিপদের আশঙ্কাও ছিল না, এ কারণে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীজুড়ে সেটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই রয়ে গিয়েছিল। অগাস্টাসের জন্য বিষয়টি সেভাবে ফেলে রাখাই ভালাে ছিল। হয়তাে সেভাবে চলতে থাকলেই তিনি ভালাে থাকতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কথায় কথায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলা, শান্তি স্থাপন করার চেয়ে অনেক সহজ। গাউলে রােমের ক্ষমতার বিস্তার জার্মানের লােকেরা পছন্দ করেনি। রােমের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তারা সহজেই অনুধাবন করেছে যে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হবে জার্মানি দখল।
জার্মান জাতির আক্রমণ ও গাউল হারাবার আশঙ্কা : ওদিকে জার্মানির বিভিন্ন উপজাতি মিলে তারা নিজেদের ভেতরে একটি দল গড়ে তােলে। তারা সকলে মিলে একসাথে রােমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একাত্মতা ঘােষণা করে। গাউলে একটা অতর্কিত হামলার ব্যাপারেও তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিছু কিছু জায়গায় তারা সফলও হয়। জার্মানির এতগুলাে উপজাতিকে একসাথে পরিচালনা করা আসলে বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল। তার মধ্যে কিছু কিছু জাতি আবার দলের সাথে না গিয়ে নিজেরাই হামলা করতে চাইল। যেমন গ্যালিক বিদ্রোহীরা হামলা করল এবং ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই মারা পড়ল। এরকম অবস্থায় রােমান শাসকেরা মনে করলেন যে পরবর্তী আক্রমণ জার্মানিতে পরিচালনা করা জরুরি। গাউল যেন রােমের হাতছাড়া হয়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য এটাই ছিল রােমের একমাত্র উপায়। আর তাছাড়া জার্মানিতে যে একটি ভয়াবহ জাতিগত সংগঠন গড়ে উঠছে তাকে শুরুতেই বিনষ্ট করার প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। বলা তাে যায় না কখন উপজাতিদের মধ্যে ভীষণ সম্ভাবনাময় কোনাে নেতার আবির্ভাব ঘটে আর সেই নেতা সকল উপজাতিকে এক করে ফেলে রােমের বিপক্ষে বিশাল এক শক্তি হিসেবে দাঁড় করায়!
অগাস্টাসের স্ত্রী ও দুই সৎ পুত্র : অগাস্টাসের দুই সৎ ছেলে বাহিনী গঠন করে। অগাস্টাসের কখনােই নিজের সন্তান ছিল না। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৮ সালে, ক্ষমতায় আসার আগে, লিভিয়া ড্রুসিলা নামে এক বিবাহিত মহিলার প্রেমে পড়েন তিনি। তিনি ছিলেন ভীষণ মুখরা আর সব দিক দিয়ে সম্রাজ্ঞী হওয়ার উপযুক্ত। তার বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর। অগাস্টাসের বিবাহিত স্ত্রী হওয়ার যােগ্য ছিলেন তিনি। অগাস্টাস যখন (তখনও তিনি ছিলেন অক্টাভিয়ান) ড্রুসিলার প্রেমে পড়েন তখন তিনি আরেকজনের সাথে সংসার করছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে, বিশেষ করে রােমে এটা কোনাে সমস্যা ছিল না। অগাস্টাস ক্ষমতা দেখিয়ে ড্রুসিলাকে তালাক দিতে তার স্বামীকে বাধ্য করে। ব্যস, তারপর আর কোনাে অসুবিধা ছিল না। (অগাস্টাসের অবশ্য আগেরও দুই স্ত্রী ছিলেন। দু’জনকেই তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন। রােমে সে সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ কোনাে বড় ব্যাপার ছিল না। বরং উচ্চ শ্রেণির মধ্যে সেটা ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা।)। লিভিয়া ড্রুসিলাকে যখন অগাস্টাস বিয়ে করেছিলেন তখন লিভিয়ার ছিল চার বছরের একটি ছেলে। আর দ্বিতীয় ছেলেটি তখন তার গর্ভে। তারা দু’জনই একসময় রােমের শাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বড় ছেলের নাম ছিল টিবারিয়াস (টিরিয়াস ক্লডিয়াস নিরাে সিজার), যিনি মাত্র বিশ বছর বয়সে উত্তর স্পেনে ক্যান্টাব্রির বিপক্ষে লড়তে গিয়েছিলেন। তার মাত্র দুই বছর পরে, খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে সেই ছেলেই রােমান সেনাবাহিনী নিয়ে আর্মেনিয়ায় আক্রমণ করেছিলেন আর পার্থিয়ানদের হাত থেকে অতীতের খােয়ানাে যুদ্ধপতাকা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। পরে তাকে তার ছােট ভাই ড্রুসাসকে (ক্লডিয়াস নিরাে ড্রুসাস) সাহায্য করার জন্য ইতালির উত্তরে পাঠানাে হয়। ড্রুসাস তখন দানিয়ুবের তীর জুড়ে রােমান আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল।
ড্রুসাসের এলবি নদী পর্যন্ত সম্প্রসারণ ও মৃত্যু : খ্রিস্টপূর্ব ১৩ সালে টিবারিয়াস আর ড্রুসাসকে রাইনের তীরবর্তী সীমানা পাহারা দেয়ার জন্য গাউলে পাঠানাে হয়। কিন্তু তখন দানিয়ুবের তীরে বিদ্রোহ চলছিল। তাই টিবারিয়াসকে গাউল থেকে নাটকীয়ভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। ড্রুসাস রাইনের তীরের যুদ্ধ একাই বেশ ভালােভাবে সামলাতে থাকেন। জার্মানির এক উপজাতি যখন খ্রিস্টপূর্ব ১২ সালে গাউলে অতর্কিতে ঢুকে পড়ে ড্রুসাস তার বাহিনী নিয়ে তাদের তাড়া করেন। তাদের ঠেলে রাইনের অন্য তীরে পাঠিয়ে দেন তিনি। পরের তিন বছর ড্রুসাস কেবলই এগিয়ে গেছেন। একটার পর একটা জয়ের মাধ্যমে সীমানা আরও অনেকটা বাড়িয়েছেন (যদিও বেশিরভাগ সময়েই তিনি ছিলেন চাপের মুখে। জার্মানরা তাকে পরাজিত করতে পারত। যুদ্ধের সাথে সাথে তিনি জার্মানদের পরাজিত করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন আর ব্যস্ত ছিলেন তাদের লুটপাট ঠেকাতে।) খ্রিস্টপূর্ব ৯ সালের মধ্যে ড্রুসাস রাইনের ২৫০ মাইল পূর্বে এলবি নদীর কাছে পৌছে গেলেন। সেই স্থানে বর্তমানে পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির সীমানা। এমন মনে করা হয় যে ড্রুসাস যদি আরও কিছুদিন নেতৃত্বে থাকতেন, তাহলে রােমানরা হয়তাে জার্মানি দখল করে নিত। সেরকম হলে পৃথিবীর পরবর্তীকালের ইতিহাসটাও অন্যরকম হতাে। রােমের পক্ষে বাড়তে বাড়তে বালটিক সাগর আর কৃষ্ণ সাগরের দিকে ধাবমান ভিশচুলা আর নিয়েস্টার নদী পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া অবাস্তব কিছু ছিল না। সেদিক পর্যন্ত গেলে সীমানার দৈর্ঘ্য দানিয়ুবের তীরের চেয়ে ছােট হতাে আর সহজে তা রক্ষা করা যেত। জার্মানরাও নিজেদের জায়গায় বসে থেকেই হয়তাে সভ্য রােমান সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হতাে। তবে সে যাই হােক, এমন যখন হয়নি। রাইন থেকে এলবি আসার পথে ড্রুসাসের ঘােড়া হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়। তিনি আহত হন। আঘাতটা ছিল ভয়ংকর। মৃত্যুর সময়ে তার বয়স হয়েছিল মাত্র একত্রিশ। তার মৃত্যু রােমের জন্য ছিল অপূরণীয় ক্ষতি।
টিবারিয়াসের পারিবারিক সমস্যা ও স্বেচ্ছানির্বাসন : অগাস্টাস সাথে সাথেই ড্রুসাসের জায়গায় টিবারিয়াসকে বসিয়ে দেন। তারপরেও সবকিছু ভালােই চলছিল। টিবারিয়াস তার বাহিনী নিয়ে আরও কিছুটা এগােতে চাচ্ছিল যেন জার্মানরা ড্রুসাসের মৃত্যুকে পুঁজি করে আবার বেশি সাহসী না হয়ে ওঠে। জার্মানদের ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখতে তিনি তার ভাইয়ের মতােই রাইন আর এলবির মাঝামাঝি ক্রমাগত যাতায়াত করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও টিবারিয়াস একটা ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত ছিল সে সময়ে। শােনা গেছে অগাস্টাসের প্রথম স্ত্রীর একটি মেয়ে ছিল, যার নাম ছিল জুলিয়া। যেহেতু তিনিই ছিলেন অগাস্টাসের একমাত্র সন্তান তাই তার গর্ভে কোনাে ছেলের জন্ম হওয়া মানে সে-ই হবে অগাস্টাসের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। জুলিয়ার পাঁচ সন্তান ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন পুত্র। খ্রিস্টপূর্ব ১২ সালে জুলিয়ার স্বামী মারা যান আর ২৭ বছর বয়সে তিনি বিধবা হয়ে যান। তার সৎ মা লিভিয়া তখন নিজের সন্তানের জন্য একটা সুবর্ণ সুযােগ দেখতে পান। মনে করেন তিনি যদি তার ছেলে টিবারিয়াসের সাথে তরুণী বিধবা জুলিয়ার বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন আর অগাস্টাসের মৃত্যু পর্যন্ত জুলিয়ার ছেলেরা নাবালক থাকে তাহলে পরবর্তীকালে টিবারিয়াসের সিংহাসন পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। কারণ টিবারিয়াস তাে তখন কেবল সৎ ছেলে নন, হয়ে যাবেন অগাস্টাসের মেয়ের স্বামী। লিভিয়া অগাস্টাসকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে বাধ্য করেন (অগাস্টাসের ওপরে তার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক)। লিভিয়ার এই পরিকল্পনায় কেবল একটিমাত্র সমস্যা ছিল। টিবারিয়াস ততদিনে ছিল বিবাহিত আর তার স্ত্রীকে ভালােবাসতেন ভীষণ। অগাস্টাস লিভিয়ার কথা অনুযায়ী টিবারিয়াসকে বাধ্য করেন নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করতে। তারপর জোরপূর্বক জুলিয়ার সাথে বিয়েও দেন। টিবারিয়াস জুলিয়াকে কখনও ভালােবাসতে পারেননি কারণ তার দৃষ্টিতে জুলিয়া ছিলেন খুবই জেদি আর একরােখা। এভাবে জোর করে বিয়ে দেয়াতে টিবারিয়াস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই অসুখী বিবাহিত জীবন তাকে এতই ভয়াবহ বেদনা দেয় যে সেটা থেকে তিনি কখনােই বেরিয়ে আসতে পারেননি। জার্মানিতে রােমের ক্ষমতা বিস্তারের কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই টিবারিয়াস বােধ করলেন যে তার পক্ষে এভাবে নিজের ওপরে জোর করা আর সম্ভব নয়। তিনি এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গ্রীসের রােডস দ্বীপে চলে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। ভাবলেন সেখানে গিয়ে একা পড়ে থাকলে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর হাত থেকে বাঁচবেন আর সবকিছু থেকে দূরে থাকলে তার কষ্টও কমবে। নিজের বেদনায় ডুবে থেকে যেন তার মুক্তি ঘটবে। অগাস্টাস তার নতুন জামাতা টিবারিয়াসের এই ব্যবহারে ভীষণ রেগে যান। তার কাছে মনে হয় এটা রােমের সার্বভৌমত্বের প্রতি বিদ্রোহের মতাে একটি আচরণ। পাশাপাশি নিজের মেয়েকে এভাবে অপমানিত হতে দেখে তার বিরক্তি আরও বেড়ে যায়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই টিবারিয়াস যখন স্বেচ্ছানির্বাসনের জন্য রােমে ফেরত আসার অনুমতি চাইল তখন তার আবেদন ভীষণ বিরক্ত হয়ে তিনি নাকচ করে দেন। পরে একান্তই বাধ্য হয়ে তা মেনে নেন। তারপর পাঁচ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই টিবারিয়াস রাজ্য পরিচালনার কোনাে কাজে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু পাঁচ সালে প্যানােনিয়ায় বিদ্রোহী দমনের জন্য টিবারিয়াসের ডাক পড়লে তিনি সাড়া দেন। টিবারিয়াস আবার যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আর সততার সাথে বিদ্রোহীদের হটিয়ে ৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্যানােনিয়ায় শান্তি স্থাপন করেন। যে পনেরাে বছর টিরিয়াস স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন, সে সময়ে জার্মানি ভয়ংকর নেতার হাতে চলে যায়। তার ফল শুধু রােম কেন, সারা পৃথিবী ভােগ করেছে। তাই টিবারিয়াসকে জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনায় মানুষ তখনও ভুগেছে, এখনও “ভুগছে”।
জার্মানিতে ভ্যারাস ও বিদ্রোহী আর্মিনিয়াসের কাছে শোচনীয় পরাজয় : ৭ খ্রিস্টাব্দে অগাস্টাস ভাবলেন, গত বিশ বছরে রােমান সাম্রাজ্য যে রাইন থেকে এলবি পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে, বিস্তৃত এলাকা হাতের মুঠোয় এসেছে, এটা বিরাট অর্জন। ওই পুরাে এলাকাটাই এখন রােমান সাম্রাজ্যের নিজস্ব। তিনি এলাকাটিকে রােমের একটি পৃথক বিভাগ হিসেবে ঘােষণা করতে চাইলেন। সে কারণে তিনি পাবলিয়াস কুইনটিলাস ভ্যারাসকে জার্মানিতে পাঠালেন। ভ্যারাস খ্রিস্টপূর্ব ১৩ সাল পর্যন্ত কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন আর তারপরে সিরিয়ায় শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। একজন সাধারণ কর্মীর কাছে অগাস্টাস যতটা আশা করতেন ভ্যারাসের কাছে তার চেয়েও বেশিই পেয়েছিলেন। ভ্যারাস জার্মানিতে গিয়ে রােমান সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাটি কোনাে কৌশলবিহীনভাবে, কেবল আগ্রাসী ভূমিকার আশ্রয়ে জাহির করলেন। তার কাজকর্মের প্রতিক্রিয়ায় জার্মানরা বিদ্রোহের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করল। বিদ্রোহ সংগঠিত হতে হতে তারা একজন বলিষ্ঠ নেতাও পেয়ে গেল, তার নাম আর্মিনিয়াস (জার্মান নাম “হারম্যান”-কে ল্যাটিন ভাষায় “আর্মিনিয়াস” বলা হতাে)। আর্মিনিয়াস অল্পবয়সে রােমান সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়েছিলেন। তিনি ল্যাটিন ভাষা শিখেছিলেন, রােমান সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন এবং তারপরে রােমের নাগরিকত্বও পেয়েছিলেন। এত কিছুর পরেও তিনি ভ্যারাসের আকস্মিক আগ্রাসন মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। আর্মিনিয়াস এক অদ্ভুত কৌশলে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন। তিনি প্রথমে ভ্যারাসের সাথে এক দলে মিলে গিয়ে তার বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। ৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভ্যারাসকে রাজি করিয়ে ফেললেন রাইনের তীরবর্তী অঞ্চলের ভার আর্মিনিয়াসের ওপরে ছেড়ে দিয়ে জার্মানির ভেতরের দিকে গিয়ে নতুন উপনিবেশ সৃষ্টি করতে। ভ্যারাস সরে গেলে আর্মিনিয়াস ছােট একটি বিদ্রোহ ঘােষণা করে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ভ্যারাস তার বাহিনী নিয়ে জার্মানির জঙ্গল ধরে ভেতরের দিকে এগােচেছ। তারপর আর্মিনিয়াস নিজেই তার বিদ্রোহী দল নিয়ে ভ্যারাসকে ধাওয়া করে। ভ্যারাস যখন রাইন থেকে আশি মাইল দূরে চলে এসেছে, যেখানে গহীন জঙ্গলটি টিউটোবার্গার ওয়াল্ড নামে পরিচিত, সেখানে এসে চারদিক থেকে আর্মিনিয়াসের বাহিনী তাদের ঘেরাও করে। আগে থেকেই সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সব খবরাখবর দেয়া ছিল। সুতরাং একসাথে সবদিক থেকে বিদ্রোহীরা ধেয়ে আসে আর ভ্যারাস বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। একেবারেই একটি অপ্রত্যাশিত বিদ্রোহের কবলে পড়ে ভ্যারাস বাহিনী। ভ্যারাস বাহিনী সাহসিকতার সাথে লড়ে যায় কিন্তু তাদের আর কিছুই করার ছিল না। তিন দিনে সেখানে তিন থেকে ছয় হাজার রােমান সেনার তিনটি বাহিনী (লিজান) করুণভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়। এই খবর রােমকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। রােমান সেনাবাহিনীকে এরকম করুণ পরাজয় তার আগের দুশ বছরের বেশি সময়েও বরণ করতে হয়নি। অগাস্টাস আফসােসে ভেঙে পড়ছিলেন বারবার। তিনটি বড় বাহিনীর ক্ষতি সামলাতে তার পক্ষে মানুষের উপরে অতিরিক্ত করের বােঝা চাপিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না। রােমান সেনাবাহিনীর তিন থেকে ছয় হাজার সেনার আঠাশটি দল (লিজান) রাতারাতি পঁচিশে নেমে এলাে। লিজানের সংখ্যাটা তার পরের অনেক বছর পঁচিশই ছিল। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি ছিল এরকম যে, অগাস্টাস তার রাজপুরির দেয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদতেন আর চিৎকার করে বলতেন, “ভ্যারাস, ভ্যারাস, আমার লিজানগুলাে ফিরিয়ে এনে দাও!”। কিন্তু ভ্যারাস আর কখনােই সেসব তাকে ফেরত এনে দেননি। কারণ ভ্যারাস নিজেও তার বাহিনীর সাথেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
টিবারিয়াসের ব্যর্থতা, রাইন নদীতে রোমান সাম্রাজ্যের সীমাবদ্ধতা ও জার্মান স্বাধীনতা : টিবারিয়াস তখন কোনাে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে আসেন। তিনি জার্মানদেরকে রােমের ক্ষমতা দেখাতে তাড়াতাড়ি বাহিনী নিয়ে রাইনের অপর তীরে অগ্রসর হন। তিনি দেখাতে চান যে নােম দুর্বল হয়ে পড়েনি। গাউলে হামলা করে তিনি বুঝিয়ে দেন যে জার্মানরা যেন ভুলেও সেখানে বিদ্রোহ করার দুঃসাহস না দেখায়। কিন্তু টিবারিয়াসের এই উত্তেজনা সত্ত্বেও রােমের পক্ষে জার্মানি দখল করার কোনাে লক্ষণ দেখা যায় না; না তখন, না তার পরে, কখনও। তাই এই হুংকারের বাড়তি কোনাে মূল্য নেই। রােমান যােদ্ধারা এলবির আশেপাশেই পড়ে রইল আর রাইনের তীর আঁকড়ে ধরে বসে থাকল। (তারা অবশ্য তীর ধরে আরেকটু এগিয়েছিল যে জায়গাগুলাে এখন হল্যান্ড আর রাইনের পূর্বদিকে ফ্রিসিয়া নামে পরিচিত।) টিউটোবার্গার ওয়ার্ল্ডের যুদ্ধ তাই পৃথিবীর ইতিহাসে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। তারপর থেকে জার্মানরা চিরকাল তাদের স্বাধীনতা ধরে রেখেছিল। কখনােই নিজেদের রােমান সমাজ-সংস্কৃতির সাথে জড়ানাের কথা ভাবেনি। তারপর চারশ বছর ধরেও জার্মান জাতি স্বাধীন ছিল বটে তবে অসভ্যই ছিল। তখনও তারা রােমের দিকেই তাকিয়ে ছিল আর সেখান থেকে ছিড়েখুড়ে কিছু নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
অগাস্টাসের সময় সাহিত্যচর্চা
স্বর্ণযুগ : অগাস্টাসের সময়ে ইতালির যেসব জায়গায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে রােমান সংস্কৃতি প্রস্ফুটিত হয়েছিল। অগাস্টাসের যুগে ল্যাটিন সাহিত্যে নতুন মাত্রা আসে। তার আগের সময়টা, যেখানে সিসেরাে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই দুইয়ে মিলে অগাস্টাসের সময়টাই ছিল রােমের সংস্কৃতিতে স্বর্ণযুগ। অগাস্টাস নিজেও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন আর লেখক সম্প্রদায়কে নানাভাবে উৎসাহিত করতেন।
মিসিনাস : এই প্রসঙ্গে বলা খুব প্রয়ােজন যে অগাস্টাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন সিলনিয়াস মিসিনাস। মিসিনাস অগাস্টাসের সাথে সেই স্কুলজীবন থেকেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যুদ্ধের শেষ কয়েকটা বছর মিসিনাস রােমেই ছিলেন। অগাস্টাস যখন শেষ যুদ্ধটি পরিচালনা করছিলেন তখন তার অবর্তমানে তিনিই রােমের দেখাশােনা করছিলেন। যুদ্ধ শেষে শান্তি এলে মিসিনাস অগাস্টাসকে চিরকালের জন্য যুদ্ধ বন্ধ করতে অনুরােধ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬ শতাব্দীর দিকে, ততদিনে মিসিনাস অনেক ধনী হয়ে উঠেছেন, দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি তার ধনদৌলত রােমের শিল্প সাহিত্য চর্চায় ব্যয় করতেন। তার এই কাজের জন্য তিনি এতই বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে সেখান থেকেই মিসিনাসের মতাে কথাটি ব্যবহার হতে লাগল। কোনাে ধনী ব্যক্তি যখন তার টাকাপয়সা শিল্পের জন্য অকাতরে বিলান, তখনই তাকে ‘মিসিনাসের মতাে’ বলা হয়ে থাকে।
ভারজিল :
- পরিচয় : পাবলিয়াস ভারগিলিয়াস মারাে হলেন সবচেয়ে বড় লেখক যিনি মিসিনাসের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছিলেন। পাবলিয়াসকে সাধারণত ইংরেজিতে ভারজিল নামে ডাকা হয়। ভারজিল খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে মানতুয়ার কাছে একটি খামারে জন্মেছিলেন। ফিলিপির যুদ্ধের পরে, যেখানে অগাস্টাস জুলিয়াস সিজারের হত্যাকারীদের হত্যা করে তার সর্বশেষ বিজয় অর্জন করেন, তখন বিজয়ী দলের সেনাদের ইতালিতে বসবাস করার জন্য জায়গা উপহার দেয়া হয়। (এটা ছিল যুদ্ধ জয়ের পরে বিজয়ীদের কৃতজ্ঞতা জানানাের সাধারণ নিয়ম।) খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে সেরকম যুদ্ধজয়ী সেনাদের জন্য জায়গা করে দিতে ভারজিলের বাবাকে তার নিজের খামার থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ভারজিলের ততদিনে কবি হিসেবে বেশ নাম-ডাক হয়েছে। আবার অগাস্টাসের শাসনকালের একজন প্রধান ব্যক্তি হিসেবেও সবাই তাকে চেনে। তখন গ্যানিয়াস আসিনিয়াস পােলিও (তিনিও ছিলেন একজন কবি আর শাসক) ইতালির সেই অংশে দায়িত্বরত ছিলেন। আসিনিয়াস পােলিও, ভারজিলের জায়গা হাতছাড়া হওয়া থেকে রক্ষা করেন আর সে সময়ে তাকে মিসেনিয়াসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
- শান্তি-সমৃদ্ধি নিয়ে আসা শিশু ও খ্রিস্টানদের চোখে যিশু : একলগ নামে পরিচিত ছােট ছােট লেখাগুলাের মধ্যে ভারজিলের কাজ ছিল একেবারে প্রথম দিকের। সেসবের মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালে তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত সেই একলগ, যাতে একটি আসন্ন জন্মগ্রহণকারী শিশুকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। সেই শিশুটি পৃথিবীতে শান্তি আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। কেউ অবশ্য সঠিক বলতে পারেনি কাকে নিয়ে এই লেখাটি তিনি লিখেছিলেন। হতে পারে তিনি তারই কোনাে পৃষ্ঠপােষককে খুশি করার জন্য এটা লিখেছিলেন যার স্ত্রী ছিলেন তখন গর্ভবতী। পরে অবশ্য খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ধরে নিয়েছেন যে ভারজিল যিশুখ্রিস্টের কথা আগে আগেই জানতেন আর তাই লিখে গিয়েছিলেন, হয়তােবা না জানলেও তিনি ধারণা করেছিলেন। এই কারণে খ্রিস্টধর্মে ভারজিল একজন জনপ্রিয় আরাধ্য মানুষ। তিনশ বছর পরে দান্তের লেখা ডিভাইন কমেডিতে ওই চরিত্রটি ছিল ভারজিলই, যে কিনা দান্তেকে নরকের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
- জারজিকস কাব্য এবং বিপরীতে ইতালির অভিজাত ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের জীবন : মিসিনাসের উপদেশ শুনে ভারজিল ‘জারজিকস’ নামে কাব্য রচনা করেছিলেন যেখানে ইতালির গ্রামের কৃষিকাজের বর্ণনা এসেছে। (জারজিস নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে যার মানে হলাে কৃষক।) এই লেখার পেছনে হয়তাে অগাস্টাসের একটা উদ্দেশ্য ছিল যে তিনি চাইতেন ইতালিতে কৃষিকাজের প্রসার ঘটুক। (অগাস্টাস অবশ্যই চাইতেন যে রােমানদেও দৈনন্দিন জীবনে সবরকমের কল্পিত সৎ চরিত্রের বিকাশ ঘটুক। তাদের সম্মানিত পূর্বপুরুষেরা যেমন সত্যবাদিতা, সততা, সাহসী, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমের প্রতীক ছিল, আবার একই সাথে তারা ছিল বিশ্বাসী স্বামী, অমূল্য পিতা আর জীবন উৎসর্গকারী দেশপ্রেমিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে অগাস্টাস তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাই তার সময়ের ইতালি ছিল আমাদের আজকের যে কোনাে একটি দেশের মতােই কেবল নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য ব্যস্ত একটি সমাজ। আভিজাত্য যে রাজ্যের প্রতিটি কোণে ঢেলে দেয়া হয়েছিল। আর উচ্চ শ্রেণির মানুষদের করার মতাে তেমন কোনাে কাজ ছিল না বলে তারা আমােদপ্রমােদেই নিজেদের ডুবিয়ে রাখত। তারা সুযােগ পেলেই বিয়ে করত, সহজেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারত, প্রচুর খেত আর পান করত। তারা তাদের অবসর সময় চমৎকারভাবে উপভােগ করত। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণির জন্য ছিল বিনামূল্যে খাদ্য, নানারকমের জমকালাে প্রদর্শনী আর আনন্দদায়ক খেলাধুলার আয়ােজন। নীতি বিশারদেরা এই অবস্থার সমালােচনা করতেন। অন্য জাতির সাথে, এমনকি তাদের নিজেদের পূর্বপুরুষদের সাথে তুলনা করে তারা বলতেন যে তাদের দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। কিন্তু এসব কটু সমালােচনায় কোনাে কাজ হয়নি। দেশের সামাজিক পরিস্থিতি একই রকমের ছিল। ভারজিলের ‘জারজিকস’ তাই ল্যাটিনের শুদ্ধতম রূপ হিসেবে গ্রহণযোেগ্য হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কেবল ধনী শ্রেণিই অবসরে সে ধরনের সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকত। তাই ওরকম আরামের জীবনধারা ফেলে কৃষিকাজের দিকে ফিরে আসার কোনাে প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।)
- ভার্জিলের এনিয়েড : ভারজিলের সাহিত্যচর্চার পরবর্তী বছরগুলাে এনিয়েড (Aeneid) নামে বারাে বণ্ডবিশিষ্ট এক মহাকাব্য রচনায় কেটে যায়। ধরে নেয়া হয় এটাও তিনি শুরু করেছিলেন অগাস্টাসের অনুরােধেই। পটভূমির দিক দিয়ে চিন্তা করলে এনিয়েড, হােমারের সাহিত্যের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। ট্রয়ের যােদ্ধা এনিয়েড, অ্যানিয়াস হলাে সেই কাব্যের নায়ক। এটা তার পুড়তে থাকা ট্রয়ের থেকে পালিয়ে যাওয়ার কাহিনী। তার যাত্রা আর ভ্রমণ ছিল নানারকম উত্তেজনায় ভরা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি ইতালিতে এসে উপস্থিত হন। কাহিনীতে দেখানাে হয় যে তিনিই রােমের পত্তন করেন আর তার উত্তরাধিকারীদের জন্য সমৃদ্ধ করে গড়ে তােলেন। সেখানে অ্যানিয়াসের ছেলের নাম থাকে জুলুস, যার ঔরসে জুলিয়ান পরিবারের (জুলিয়াস সিজার আর অগাস্টাসের) জন্ম হয়। কবি তার কাব্যের উপরে বহুবছর ধরে কাজ করে গেছেন। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব উনিশ সালে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় তখনও এটার উপরে কাজ করছিলেন। শুদ্ধতা আর সৌন্দর্যের চরম মাপকাঠিতে পৌঁছেনি ভেবে তিনি মৃত্যুর আগে পুরাে পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে যান। অগাস্টাস সেই নির্দেশ সফল হতে দেননি। যাই হােক, শেষ পর্যন্ত অন্য কাউকে দিয়ে আরও কিছু কাটাছেড়ার পরে অগাস্টাস সেটি প্রকাশ করেন। ভারজিল রােমান কবিদের মধ্যে সবচেয়ে মহান হিসেবে পরিচিত।
হােরেস : তারপরেই যার নাম উল্লেখযােগ্য, তিনি হলেন হােরেস (কুইনটাস হােরাটিয়াস ফ্ল্যাকাস)। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ ঘরের ছেলে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫ সালে ইতালির দক্ষিণ দিকে তার জন্ম হয়। তিনি রােম আর অ্যাথিনায় লেখাপড়া করেন। তিনি যেন জ্ঞানচর্চার জন্যেই জন্মেছিলেন। তাই সেনা হিসেবে রােমান বাহিনীতে যােগদান করা তার জন্য ছিল ভয়ংকর বিপর্যয়ের মতাে। তিনি অ্যাথিনায় থাকতে জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করা হয়। গ্রিসে সিজারের হত্যাকারীর বাহিনীতে তিনি যােগদান করেন। ফিলিপির যুদ্ধে একজন পরিচালক হিসেবে তিনি সশরীরে যােগ দেন। সেখান থেকে জীবন বাঁচাতে তিনি পালিয়ে আসেন। হােরেস পরাজিত দলের অংশ হয়েও জীবন হারাননি। শুধু ইতালিতে নিজের পারিবারিক সম্পত্তি হারান। তিনি জীবিকার জন্য সােজা রােমে চলে যান। সেখানে তিনি ঘটনাচক্রে ভারজিলের সংস্পর্শে আসেন। ভারজিল তাকে মিসেনাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মিসেনাস তাকে একটি খামারের দায়িত্ব দেন যাতে তার আর্থিক কোনাে অনটন না থাকে। তার সাহিত্য সহজে অগাস্টাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সত্যি বলতে তার ছােট কবিতা আর রম্য রচনা আজও সমাদৃত। মিসেনাসের মৃত্যুর পরপরই খ্রিস্টপূর্ব আট সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ওভিড : অগাস্টাসের সময়কার শেষ কবি ছিলেন ওভিড (পাবলিয়াস ওভিডয়াস নাসাে)। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালে রােমের সত্তর মাইল পূর্বে তিনি জন্মেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা কবি। নিজের জীবদ্দশায় তার কবিতা ধনী শ্রেণির কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাই তার রচনাও বাধাহীনভাবে এগিয়ে গেছে। ওভিডের কবিতায় প্রেম-ভালােবাসার বিষয়টি এত খােলাখুলিভাবে এসেছিল যে মাঝে মধ্যে সেসব অগাস্টাস আর শাসক শ্রেণির কোনাে কোনাে ব্যক্তি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা চাইতেন রােমে কেবল অতীতের রােমান সংস্কৃতিই বজায় থাকুক। ওভিডের বিখ্যাত বইয়ের নাম “রূপান্তর” (মেটামরফোসেস) যেখানে ল্যাটিন ভাষায় গ্রিসের পুরনাে কাহিনীগুলাে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই প্রাচীন গ্রিসের কাহিনীর মধ্যেও ছিল বিদ্রোহের ছোঁয়া যা ওভিডের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতাে। পরবর্তীকালে ওভিড অগাস্টাসের মেয়ে জুলিয়ার সাথে বদনামে জড়িয়ে পড়েন। অগাস্টাস মেয়ের ওপরে ভীষণ রেগে যান। তিনি তাকে নিজের কাছে থেকে সরিয়ে দেন। তারপর জুলিয়া হাজার অনুরােধ করলেও তিনি তাকে কিছুতেই আর ক্ষমা করেননি। ওভিডের প্রতিও অগাস্টাসের আক্রোশ ছিল সাংঘাতিক। ৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাকে নির্বাসনে যেতে আদেশ করেন। দানিয়ুবের মােহনায় ওভিড জীবনের শেষ আট বছর নিতান্তই গেঁয়াে এক জায়গায় পার করে দেন। অগাস্টাসের মন জয় করার চেষ্টায় সেখানে বসে তিনি পাতার পর পাতা বিষাদে ভরা কবিতা লেখেন। কিন্তু অগাস্টাস আর তাকে রােমে ফিরে আসার অনুমতি দেননি। সেই নির্বাসনে থাকাকালীন সময়ে ১৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
লিভি : অগাস্টাসের সময়কার শ্রেষ্ঠ গদ্যকার ছিলেন লিভি (টিটাস লিভিয়াস)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৯ সালে পাদুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সরাসরি রাজ্য ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে লিখতেন। তবে অগাস্টাস তাকে সহ্য করতেন কারণ তিনি সরাসরি কখনও রাজনীতিতে অংশ নেননি। আবার তার রাজনৈতিক লেখাগুলাের মধ্যে ভালাে হাস্যরসও থাকত। তিনি সারাজীবন রাজনীতির বাইরে থেকেই সেসব নিয়ে লেখালেখি করে কাটিয়েছেন। অগাস্টাসের অনুরােধে তিনি রােমের পত্তন থেকে শুরু করে ড্রুসাসের সময়কাল পর্যন্ত পুরাে ইতিহাস এক অমূল্য রচনায় তুলে ধরেছিলেন। এই একই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপরে তিনি ১৪২টি বই লিখেছিলেন। তার ইচ্ছে ছিল ইতিহাসটি তিনি অগাস্টাসের মৃত্যু পর্যন্ত লিখে যাবেন। কিন্তু অগাস্টাসের আগেই তার নিজের মৃত্যু ১৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে সেই কাজে সমাপ্তি টানতে বাধ্য করে। লিভি ছিলেন রােমান ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তখনও, এমনকি আজও। তবে দুঃখের বিষয় হলাে তার ১৪২টি বইয়ের মধ্যে মাত্র ৩৫টি বই পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে। বাকিগুলাের সম্পর্কে কোথাও কোথাও সংক্ষিপ্ত আকারের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে তা যথেষ্ট নয়। লিভি জনপ্রিয় হওয়ার আশায় লিখতেন, এটাই ছিল তার সাহিত্যচর্চার সবচেয়ে দুর্বল দিক। পাঠককে আকর্ষণ করতে গিয়ে তিনি মজার মজার গল্প বারবার লিখতেন আর একই ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা বারবার করে করতেন। মুখেমুখে ফেরা কিছু প্রাচীন রােমান গল্প তিনি লিখেছেন কেবল পাঠককে ভােলাবার জন্য কিন্তু খতিয়ে দেখেননি সেসবের আদৌ কোনাে বাস্তব ভিত্তি আছে কি না। রােমান ইতিহাসের সবটুকুই উন্মােচিত হয়েছে রােমের নিজস্ব সাহিত্যিকদের মাধ্যমে যারা রােমের সৃষ্টি থেকে যা দেখেছেন তা লিখে গেছেন। বেশির ভাগের মতো, লিভির লেখারও সেই রােমান ইতিহাসের অংশগুলাে পুনরুদ্ধার করা গেছে। তাই আকস্মিকভাবে সেগুলাে পেয়ে যাওয়াতে আমরা রােমের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। অন্যান্য যেসব উৎস থেকে জানা গেছে তা খুব বিচ্ছিন্ন, একটানা নয়।
ইহুদি জাতি ও যিশুখ্রিস্ট
রোমান নিয়ন্ত্রণের পূর্বে ইহুদি জাতি : সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে অসাধারণ যে ঘটনাটি অগাস্টাসের শাসনামলে ঘটেছিল, তা হলাে শিল্প আর সাহিত্যের বিকাশ। সেই শিল্পের সাথে যুদ্ধের হার জিত বা রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ার কোনাে সম্পর্ক ছিল না। এটা কেবলই আড়ালে থাকা একজন মানুষের, রাজ্যের কোণে কোথাও আড়ালে বসে একমনে করে যাওয়া কাজের ফল আসার মতাে। এমনকি বেশির ভাগ মানুষ সেই জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে সে সময় জানতও না। সিরিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত জুডিয়া। সেখানকার অধিবাসীদের বলে জুডিয়ানস বা জিউইশ বা ইহুদি। তারা ভয়ংকর একেশ্বরবাদী জাতি। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৬০০ সাল পর্যন্ত তারা তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে গর্বের সাথে টিকেছিল। প্রথমদিকে দেশটি রাজা ডেভিডের শাসনে বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যাবিলনের অধিবাসীরা রাজ্যটি সাবাড় করে ফেলে। তারপর একশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পারস্যের লােকেরা তাদের দখল করা রাজ্য আবার দখল করে নেয়। তারপরে জেরুজালেমে ইহুদিরা আবার তাদের নিজস্ব মন্দির বানাতে সক্ষম হয়। জেরুজালেম ছিল তাদের প্রাচীন রাজধানী। ইহুদিরা জুডিয়ায় থেকে গেল বছরের পর বছর। তারা ছিল পারস্যের অধীনে। তাদের না ছিল কোনাে রাজা আর না ছিল কোনাে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা সংগঠিত সেনাবাহিনী। কিন্তু তারা ছিল তাদের ধর্মের প্রতি ভয়াবহ নিষ্ঠাবান। আর তাদের অন্তরে আগের দিনের স্বাধীনতার স্মৃতি জ্বলজ্বল করত সারাক্ষণ। পারস্যের লােকেরা সম্রাট আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনে ছিল। আর তারপরে সেলুকাসের আবিষ্কৃত সেলুসিড রাজ্যের অধীন হয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৮ সালে সেলুসিড রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক চতুর্থ অ্যান্টিওকাস ইহুদিদের ধর্মকে অনৈতিক ঘােষণা দেন। তার ইচ্ছে ছিল ইহুদিদের সবাইকে তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে গ্রিসের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবেন। তাদের জীবনাচরণ পুরােপুরি বদলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করবেন। ইহুদিরা তখন বিদ্রোহ করে। তাদের নেতা জুডাস ম্যাকাবিয়াস আর তার ভাইয়ের নেতৃত্বে তারা শেষ পর্যন্ত সেলুসিড রাজ্যের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়। প্রায় একশ বছরব্যাপী ম্যাকাবিসের অধীনে সেই রাজ্যের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন ছিল। ইহুদিরা তাদের নিজস্ব রুচিতে নিজেদের জীবন পরিচালনা করতে পারত।
রোমানদের দ্বারা ম্যাকাবিসের উচ্ছেদ, ক্ষমতায় অ্যান্টিপ্যাটার ও তারপর হেরোডের নিষ্ঠুর শাসন : খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রােমানরা পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ততদিনে ম্যাকাবি পরিবারের লােকেদের মধ্যে কারা ইহুদিদেরকে শাসন করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছে। যারা হেরে গিয়েছিল তারা রােমানদের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। রােমান শাসকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ম্যাকাবিয়ান রাজ্যকে পুরােপুরি ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে ইহুদিদের শাসন করার জন্য এমন কাউকে তারা বসাবে যে কিনা পরবর্তীকালে রােমের শাসকের ইচ্ছানুযায়ী চলবে। জুডিয়ায় তারা নেতার বিরুদ্ধশক্তি তৈরি করে শেষে অ্যান্টিপ্যাটারকে বসিয়েছিল। এই পরিকল্পনার মধ্যে যেটুকু চালাকি ছিল, তা হলাে অ্যান্টিপ্যাটার ইহুদি ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইডিউমিয়ান (অথবা বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী যাকে বলে এডোমাইট), ইডুমিয়া অথবা এডােম। তারা ছিলেন জুডিয়ার দক্ষিণ দিকের বসবাসকারী। ম্যাকাবিস তাদেরকে জোর করে ইহুদি ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। তাই তাদের আর ইহুদিদের মধ্যে হাজার বছর ধরে এক ধরনের শত্রুতা ছিল। অ্যান্টিপ্যাটারকে ইহুদিরা কিছুতেই মানতে পারছিল না। তারা সবসময় তাকে একজন বহিরাগত মনে করত। তিনি ইহুদি ধর্মের সাথে যতই ঘনিষ্ঠ হয়েছেন বা যতই বিচক্ষণভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছেন, সেসব কিছুই ইহুদিরা পাত্তা দেয়নি। তখন রােমানরা বুঝতে পেরেছিল যে অ্যান্টিপ্যাটার কখনও এই রাজ্যটাকে নিজের মতাে করে পাবে না আর সবসময়ই রােমের উপরে নির্ভর করে থাকবে। অ্যান্টিপ্যাটারের দ্বিতীয় পুত্র ছিল হেরােডস (তিনি ইংরেজদের কাছে হেরােড বলে পরিচিত), খ্রিস্টপূর্ব ৩৭ সালে তিনি জুডিয়া দখল করে নেয়। যদিও দখল করা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু হেরােড তারপর বুঝতে পারল যে সেখানে শাসনকাজ চালানাে তত সহজ নয়। তিনি ইহুদিদের মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ইহুদি ধর্ম পালন শুরু করলেন। তিনি জেরুজালেমের মন্দিরের উন্নতিসাধন করেছিলেন। যেহেতু এটা প্রকৃত সলমনের মন্দির থেকে দূরে তাই ইহুদিদের সুবিধার জন্য তিনি সেটা করেছিলেন। যাই হােক, তিনি ছিলেন খুব নিষ্ঠুর এবং সন্দেহপ্রবণ মানুষ। তিনি অন্তত দশবার বিয়ে করেছিলেন। স্বার্থে আঘাত লাগলে, কথায় কথায় নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে পর করে দিতে তার কখনও কোনাে সমস্যা হয়নি। শােনা যায় একবার তার ছেলে অগাস্টাসের কাছে এসে বলেছিল, “আমি হেরােডসের ছেলে না হয়ে তার পােষা শূকর হলেও ভালাে হতাে”।
ইহুদিদের একজন মাহিসার স্বপ্ন : ইহুদিরা হেরােডকে ঘৃণা করা শুরু করে। তাদের মনে অবশ্য অন্য রকম এক আশাও ছিল। শত শত বছর পেরিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সামনে ব্যাবিলনিয়রা এলাে, পারস্যের, গ্রিসের, রােমের মানুষেরা ছড়ি ঘােরাল, তবু তাদের জীবনে শান্তি আসেনি। তারা স্বপ্ন দেখত, কোনাে একদিন ডেভিডের কোনাে উত্তরাধিকারী আসবে তাদের রাজা হয়ে। তারপর তাদের সব অশান্তি দূর হবে। তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, পৃথিবীতে নিজেদের জীবনযাপনের স্বাধীনতা পাবে। ইহুদিরা রাজার মাথার উপরে তাদের পবিত্র তেল ঢেলে তাকে শুদ্ধ করে নেয়। এরপর রাজা হয়ে যায় তাদের কাছে পবিত্র। তারপর তারা নিজেদেরকে রাজার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। আধুনিক সমাজে যেমন দেখা যায়, রাজাকে মুকুট পরানাের অনুষ্ঠান। রাজাকে মুকুট পরানাে হলে তারপর তিনি হয়ে ওঠেন সবার মধ্যমণি। হিব্রু ভাষায় পবিত্রকরণের পরে সেই রাজাকে তারা ডাকে মাসিহা। ইহুদিরা বছরের পর বছর কল্পিত একজন মাসিহার অপেক্ষায় ছিল। যেমন অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ইহুদি ম্যাকাবিউস যেভাবে সেলুসিড রাজাকে পরাজিত করেছিলেন, সেরকম একটা স্বপ্ন তাদের চোখে সবসময় ছিল। তারা জানত, তার মতাে আরেকজন মানুষ, এখনও যদি তাদের নেতা হয়ে আসে তাবে রােমকে পরাজিত করতে পারবে নিশ্চয়ই। অন্যান্য ইহুদিরা, যারা বুঝতে পেরেছিল যে অগাস্টাসের সময়ে রােম আসলে সেলুসিড রাজ্যের তুলনায় হাজার গুনে শক্তিশালী, চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের সময়ে তারা নিজেদের মুক্তির বিষয়ে ততটা নিশ্চিত ছিল না। অবশ্য তারাও এক ধরনের অতি অলৌকিক স্বপ্নের ঘােরে দিন কাটাত। তারা ভাবত একজন আসবেন, যিনি শুধু ইহুদি রাজ্যকেই বাঁচাবেন তা নয়; সেই মাসিহা তাদের রাজ্যে সুবিচার আর পবিত্রতা কায়েম করবেন, পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করবেন আর সমস্ত পৃথিবীকে এক এবং অদ্বিতীয় বিধাতার বিশ্বাসে ফিরিয়ে আনবেন। জুডিয়ায় সে সময়ে অনেকেই সে রকমের মাসিহা হয়ে ওঠার আশ্বাস দিয়েছেন। অনেকে জাতিকে সেভাবে সাহায্য করার জন্য সবার সমর্থন চেয়েছেন। সে ধরনের লােকদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযােগ দেখা গেছে। হেরােড আর রােমানরা চুপচাপ তাদের এই ভুইফোড় মাসিহা হয়ে ওঠা আর দেশের ভেতরে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হওয়ার কাণ্ডকারখানা দেখছিল।
যিশু খ্রিস্টের জন্ম : তারপর বাইবেলের নতুন বিভাগের গসপেল দ্য সেইন্ট ম্যাথিউ-এর দ্বিতীয় পর্বের কাহিনী অনুযায়ী একটি শিশুর জন্ম হলাে যার নাম যিশু (গ্রিকে যাকে বলে যশােয়া)। তার জন্ম হলাে হেরােডের রাজ্যের শেষ প্রান্ত, বেথেলহামে। এই মাসিহার ব্যাপারে যাবতীয় অলৌকিক তথ্য এখানে সেখানে পাওয়া যায়, যেমন পাওয়া যায় বাইবেলের পুরনাে বিভাগে। হােরােড সদ্য জন্মানাে এই শিশুর কথা জানতে পারার পরে, বেথেলহামের দুই বছরের কম বয়সী সব শিশুকে মেরে ফেলার আদেশ দেন। কিন্তু শিশু যিশুকে ততক্ষণে মিশরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাইবেলের দ্বিতীয় বিভাগ ছাড়া এই ঘটনার উল্লেখ অন্য আর কোথাও নেই। তবু এর উল্লেখ করা হলাে এই কারণে যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সময়ের সাথে ঘটনাটিকে সম্পর্কযুক্ত করার প্রয়ােজন আছে। হােরােডের শাসনামলের পাঁচশ বছর পরে সিরিয়ার ধ্যানী ডিওনিসিয়াস এক্সিগিউয়াস বাইবেল আর রােমান ইতিহাস ঘেটে সিদ্ধান্ত নেন যে রােমান ক্যালেন্ডার (এইউসি) অনুযায়ী যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেন ৭৫৩ সালে। পরে ইউরােপের সাধারণ মানুষেরা এই হিসাব মেনে নেন। সুতরাং রােমান ক্যালেন্ডার ৭৫৩ সালটি ১ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে দেখানাে হয়। তাই রােমের পত্তনের সালটি দাঁড়ায় খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সাল। যাই হােক ডিওনিসিয়াস তার গণনায় নিশ্চয়ই কোনাে ভুল করেছিলেন কারণ এটা সত্য যে রােমের ক্যালেন্ডারের ৭৪৯ সালে তিনি মারা যান, যেটা ছিল তার হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ৪ সাল। যদি হেরােড যিশুর জন্মের কারণে ওই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে যিশু নিশ্চয়ই জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালের আগে অথবা তারও আগে। (এটা ভাবা আসলে খুবই হাস্যকর যে যিশু জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে বা তারও আগে, কিন্তু ডিওনিসিয়াসের গণনা ইতিহাসের বইগুলােতে এতই পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে এটা বদলানাে বেশ কঠিন আর অসম্ভব একটা ঘটনা হবে।)
হেরোডের উত্তরাধিকারীগণ ও রাজ্যের ভাগাভাগি : হেরােড যখন মারা যান, তখন তার তিন পুত্র বর্তমান ছিল যাদের তিনি রাজ্যটি ভালােভাবে ভাগাভাগি করে দিয়ে যেতে পারেননি। তারা প্রত্যেকেই রাজ্যের বিভিন্ন অংশের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন। হেরােড আর্কেলাস জুডিয়ায় আর জুডিয়ার উত্তরে সামারিয়ায় শাসন করেছিলেন। হেরােড অ্যান্টিপাস শাসন করেছিলেন গ্যালিলি আর সামারিয়ার উত্তরে পেরিয়ায়, যেটা ছিল জর্ডান নদীর পূর্বদিক। আর হেরােড ফিলিপ শাসন করেছিলেন ইটুরিয়া যেটা গ্যালিরির উত্তরপূর্ব অংশ। অ্যান্টিপাস আর ফিলিপ তাদের জীবদ্দশায় ক্ষমতায় ছিল কিন্তু আর্কেলাস থাকতে পারেননি। ইহুদিদের রাজধানী জেরুজালেমেই আর্কেলাসের ক্ষমতার পতন হয়। তাই ইহুদিরা রােমের অন্যায় হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সবসময় অভিযােগ করত। ৬ খ্রিস্টাব্দে অগাস্টাস আর্কেলাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে গাউলে নির্বাসন দেন। তার বেশ কিছু কাল পরে জুডিয়া আর সামারিয়া রােমের শাসকদের নির্ধারিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে।
যিশুর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা : আবার এদিকে যিশুর জন্মস্থান হিসেবে বেথেলহামকে ভাবা হয় যেটা কিনা জেরুজালেমের দক্ষিণ দিকের ছােট্ট একটি শহর। আর তাদের প্রাচীন কল্পকথা অনুযায়ী সে জায়গাটিকেই কোনাে একজন মাসিহার জন্মস্থান হবে বলে ধারণা করা হতাে। (যদিও হাজার বছর আগে সেখানেই জন্মেছিলেন ডেভিড।) যিশুর পরিবার গ্যালিলির একটি শহর নাজারেথে বাস করত। তখন জায়গাটির নাম গ্যালিলিই ছিল। সেটা ছিল অ্যান্টিপাসের রাজত্ব। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন যিশু। তিনি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলেন তখন তার ছিল অনেক অনুসারী। তার আদর্শ, শিক্ষা আর ব্যক্তিত্ব মানুষকে তার দিকে চুম্বকের মতাে টানত। তার কিছু কিছু অনুসারী তাকে সেই প্রাচীন কল্পকথার মাসিহাই মনে করেছিল। (আর এখন তার বিষয়ে বলতে গেলে মাসিহা শব্দটি আসবেই। তিনি তার জীবন দিয়ে সেটি অর্জন করেছিলেন। তখন থেকেই শত শত, হাজার হাজার মানুষ তাকে মাসিহা রূপে দেখে আসছে। তখন থেকেই তার স্বর্গীয় স্বভাবের জন্য তিনি মানুষের প্রিয়।) গ্রিক ভাষায় পবিত্রকরণ আসলে ‘খ্রিস্টিয়করণ’। আর হিব্রুতে ‘মাসিহা যশােয়া’ ইংরেজিতে হয়ে দাঁড়ালাে ‘জিসাস ক্রিস্ট’ বা যিশুখ্রিস্ট। এটাই ছিল তার গ্রিক থেকে পাওয়া ইংরেজি নাম। হেরােড আর রােমের কর্তৃপক্ষ লক্ষ করেছিল যে যিশুখ্রিস্টের মধ্যে আস্তে আস্তে মাসিহার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর থেকে তাদের জন্য বিপদ ধেয়ে আসতে পারে এটা তারা অনুমান করতে পেরেছিল। ইহুদি ধর্মের লােকেরাও বুঝতে পারছিল, যে কোনাে সময়ে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে আর পুরাে বিষয়টি তাদের আওতার বাইরে চলে যেতে পারে। রােমের সামান্য আক্রমণের প্রত্যুত্তরে তাদের ইহুদি জাতি যেভাবে জেগে উঠবে তাতে রাজ্যকে পুরােপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে। (অর্ধশত বছর পরে এমনই ঘটেছিল। তাই তাদের তখনকার ভয় আসলে অমূলক বা বােকামি ছিল না।) যিশুর জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখন তিনি জেরুজালেমে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেও ততদিনে একজন মাসিহার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই তিনি একটি গাধার পিঠে চেপে শহরে প্রবেশ করেন। এভাবেই বাইবেলের প্রথম বিভাগে মাসিহার আগমনের কথা বর্ণনা করা আছে। তাই শহরের বাসিন্দারা সাথে সাথে তাকে মাসিহা হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ : রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে সেটুকুই ছিল যথেষ্ট। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা যিশুকে নীরবে গ্রেফতার করল। তারা মনে করেছিল যিশুর অনুসারী লােকদের আর জেরুজালেমে বসবাসকারী ইহুদি জাতির মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে আগেভাগেই তাকে গ্রেফতার করেছিল। যিশুর অনুসারীদের মধ্যে একজন, যার নাম ছিল জুডাস ইসকারায়ট, তিনি তার লুকিয়ে থাকার জায়গার সন্ধান দিয়ে দেন। এজন্যই কোনাে গােলমাল ছাড়া তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। ইহুদিরা তাদের ক্ষমতা দেখাতেই এমনটা করে। ইহুদি নেতাদের কাছে যিশুর অপরাধ ছিল তাদের ধর্মের প্রতি এক ধরনের কটাক্ষ করা। তারা মনে করত যিশু নাস্তিক। তাই নিজেকে মাসিহা বলে প্রচার করছে। তাদের বিশ্বাস ছিল যিশু যা বলছে তা সত্য নয়। রােমানদের কাছে যিশুর অপরাধ ছিল কেবল রাজনৈতিক। তাদের মতে মাসিহা সেই হতে পারে যে কিনা ইহুদিদের রাজা হবে। আর যিশু যদি নিজেকে মাসিহা বলে পরিচয় দেন তবে তিনি আসলে ইহুদিদের রাজা হতে চাচ্ছেন। সুতরাং সেভাবে দেখলে তিনি আসলে রােমান শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। কারণ রােমান শাসকরা মনে করত, ইহুদিদের জন্য একজন রাজা নির্বাচন করে দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই আছে। সম্ভবত ২৯ সালে (রােমান ৭৮২ সালে) যিশুকে বিচারের জন্য পন্টিয়াস পাইলেটের সামনে আনা হয়। আর্কেলাসের অপসারণের পর থেকে পন্টিয়াস ছিলেন ষষ্ঠ শাসক। তাকে এই ঘটনার মাত্র তিন বছর আগে নিয়ােগ দেয়া হয়। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, পন্টিয়াস যিশুকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। কেবল ইহুদিদের চাপে পড়েই তিনি বিচারকাজ চালাতে বাধ্য হন। ইহুদিদের ধর্মীয় নেতারা মনে করেছিলেন যে যিশুকে ছেড়ে দেয়া মানে ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা আর এর ফলে দেশের ভেতরে বিদ্রোহের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যদিকে রােমান আক্রমণের আশঙ্কাও ছিল অবশ্যম্ভাবী। বাইবেলে আছে ধর্মীয় নেতা কাইয়াপাস বলেছেন, “এটা খুবই যুক্তিযুক্ত যে বহু মানুষের ভালাের জন্য একজন মানুষকে মরতে হবে। এভাবে যদি পুরাে জাতি রক্ষা পায় তাে তাও গ্রহণযােগ্য।” পাইলেট যদি যিশুকে বিচারব্যবস্থার অধীনে আনতে চাইতেন তাহলে তার অপরাধ রােমান আইনের আওতায় ফেলা ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না। কারণ তার এখতিয়ারের মধ্যে ছিল কেবল রােমান আইন প্রয়ােগ করা। তাই যিশুর আগমন রােমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবেই ধরে নেয়া হলাে। তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত হলাে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা। এ ধরনের শাস্তি পূর্বদিকের প্রদেশগুলােতে আর রােমে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ইহুদি বা গ্রিকরা কখনও এই শাস্তি কোথাও প্রয়োগ করেনি। তবে রােমে অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে ইতালির স্পার্টেকাসের পক্ষে লড়া মৃত্যুপণকারী বিদ্রোহীদের নির্বিশেষে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। ইতালির প্রধান সড়ক অ্যাপ্লিয়ান ওয়ের দুপাশে, মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে অন্তত ছয় হাজার ক্রুশে ধরা পড়া বিদ্রোহীদের শরীর ঝুলছিল। এভাবে শেষে যিশুকেও ক্রুশে ঝােলানাে হলাে। কেবল এক সাধারণ বিদ্রোহীর মতাে তার জন্যও একই শাস্তি বহাল হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল, এভাবেই যিশুর কাহিনী শেষ হয়ে গেল। কোনাে রােমানরা তখন ভুলেও ভাবেনি যে এই অন্তিম শাস্তি যে তলে তলে একটি নতুন যুগের ভূমিকা।
অগাস্টাসের বংশ বা জুলিও-ক্লডিয়ান রাজবংশ (২৭ খ্রি.পূ. – ৬৮ খ্রি.)
অগাস্টাসের উত্তরাধিকারী সমস্যা
অগাস্টাসের উত্তরাধিকার নিয়ে সংকট : অগাস্টাসের বয়স তখন সত্তর। তিনি স্বাভাবিকভাবেই তখন নিজের পরে ক্ষমতার উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। প্রশ্ন ছিল তার পরে কে তার আদর্শের জায়গাটিতে অধিষ্ঠিত হবেন। তিনি যদি একজন সাধারণ রাজা হতেন তাহলে নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সবচেয়ে কাছের সদস্য তার উত্তরাধিকারী হতাে। কিন্তু তিনি কেবল একজন রাজা ছিলেন না, তিনি ছিলেন তার ধারার প্রথম প্রবর্তক। তাই প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে এমন কোনাে উদাহরণ তার সামনে ছিল না যে সে অনুযায়ী বিষয়টি মীমাংসা হবে। অগাস্টাস বুঝতে পারছিলেন যে তিনি উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করার আগে মৃত্যুবরণ করলে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হবে। তার মৃত্যুর পরে ক্ষমতার লােভে সেনাপ্রধানদের মধ্যে অনেকে সম্রাট হতে চাইতে পারে। তারা হয়তাে নিজেদের বাহিনী নিয়ে একে অন্যের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলতে পারে। তাই দেশে আবার গৃহযুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অগাস্টাস জানতেন যে মৃত্যুর আগে তার উচিত একজন উত্তরাধিকারীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে অধিষ্ঠিত করা। তার মাধ্যমে ব্যাপারটি মিটে গেলে মানুষ নতুন উত্তরাধিকারীকে সহজে গ্রহণ করতে পারবে। উত্তরাধিকারী হিসেবে অধিষ্ঠিত করার জন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি তার নিজের পরিবার থেকেই কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। অগাস্টাসের নিজের কোনাে পুত্র সন্তান থাকলে এক্ষেত্রে খুব অবশ্যম্ভাবী উত্তরাধিকারী তিনি হতেন। কিন্তু নিজের কোনাে ছেলে না থাকায় অগাস্টাসের জন্য বিষয়টি জটিল হয়েছিল।
অগাস্টাস-কন্যা জুলিয়া ও জুলিয়ার পুত্র ও কন্যারা : অগাস্টাসের ছিল একটি মাত্র কন্যা সন্তান, জুলিয়া। স্বেচ্ছাচারী স্বভাবের কারণে অগাস্টাস জুলিয়ার উপরে খুব বিরক্ত ছিলেন তখন। জুলিয়া নিজের খেয়াল খুশিমতাে রােমানদের জীবনকে ঢেলে সাজানাের এক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। অগাস্টাস সে কথা জানতে পেরে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। জুলিয়ার প্রথম স্বামী মার্কাস ডিপস্যানিয়াস অ্যাগ্রিপা ছিলেন অগাস্টাসের স্কুল জীবনের বন্ধু আর পরবর্তীকালে তার উপদেষ্টা। অগাস্টাস আর অ্যাগ্রিপা একসাথেই পড়াশােনা করেছিলেন। শুরুর দিকে অগাস্টাসের যখন যুদ্ধজয়ের আর বাহিনী সংগঠনের তেমন কোনাে কৌশল জানা ছিল না, অথচ রােমের সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে ছিল ষােলআনা, তখন অ্যাগ্রিপাই তার হয়ে প্রাণপণ লড়াই করে তাকে যুদ্ধে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধজয়ের পরে যখন শান্তি এসেছিল সেখানে রােমকে নতুন করে গড়ার ক্ষেত্রে অ্যাগ্রিপা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। রােমের সবচেয়ে সুদৃশ্য উপাসনালয় (তাবৎ ঈশ্বরের) প্যান্থিয়ন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অ্যাগ্রিপা। এছাড়াও তিনি অনেকগুলাে কূপ খনন করে শহরে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১২ সালে অ্যাগ্রিপার মৃত্যুর আগে তার ঔরসে অগাস্টাসের কন্যা জুলিয়ার গর্ভে পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়। তাই এটা সত্য যে অগাস্টাসের নিজের ছেলে না থাকলেও তার মেয়ের পাঁচজন সন্তান ছিল যাদের মধ্যে তিনজন পুত্র সন্তান। আর তারা সবাই ছিল অগাস্টাসেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যাগ্রিপার সন্তান। বড় দুই পুত্র সন্তান গেইয়াস সিজার আর লুকিয়াস সিজার ছিল দায়িত্বের ব্যাপারে একনিষ্ঠ। ২ খ্রিস্টাব্দে লুকিয়াস ম্যাসিলিয়ায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তরুণ যােদ্ধা হিসেবে গেইয়াসকে এশিয়া মাইনরে সেনাবাহিনীর তৎপরতা সচক্ষে দেখার জন্য পাঠানাে হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের মধ্যে তিনি ভয়াবহভাবে আহত হন। ৪ খ্রিস্টাব্দে বাড়িতে ফেরার পথে তিনি মারা যান। জুলিয়ার সবচেয়ে ছােট ছেলে জন্মায় অ্যাগ্রিপার মৃত্যুর পরে। তিনি সুস্থ মস্তিষ্কের ছিলেন না। তাকে সবসময় পাহারা দিয়ে একাকি কোনাে এক জায়গায় রাখা হতাে। অগাস্টাসের দুই নাতনির মধ্যে একজন ছিল জুলিয়া। তিনি যেমন তার মায়ের নাম গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি তার স্বভাবও ছিল তার মা জুলিয়ার মতাে। আমােদ প্রমােদেই তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। প্রাচীনপন্থী অগাস্টাস তাই তাকেও শাস্তি দিতে বাধ্য হন। অগাস্টাস নিজের মেয়ে জুলিয়ার মতাে নাতনি জুলিয়াকেও নির্বাসনে পাঠান। নাতনি জুলিয়া জীবনের বিশ বছর কাটান নির্বাসনে। এর মধ্যে একবারও তিনি রােমে ফেরার অনুমতি পাননি। বাকি ছিল কেবল অগাস্টাসের আরেক নাতনি অ্যাগ্রিপিনা; তার গল্প পরে বলা যাবে।
উত্তরাধিকারী হিসেবে টিবারিয়াস : ব্যক্তিগত জীবনে এরকম পােড় খাওয়া অগাস্টাস শেষপর্যন্ত উত্তরাধিকারীর খোঁজে সৎ ছেলে টিবারিয়াসের দিকে ফিরে তাকান। টিবারিয়াসের সাথে অগাস্টাসের কোনাে রক্তের সম্পর্ক ছিল না। অগাস্টাস তাকে দত্তক নিয়েছিলেন (সে সময়ে রােমে দত্তক পুত্রকে নিজের সন্তানের মতােই সম্মান দেয়া হতাে)। টিবারিয়াস অবশ্য অগাস্টাসের প্রিয় স্ত্রীর নিজের ছেলে ছিল। ওদিকে টিবারিয়াস তার নিজের বাবার দিক থেকে অভিজাত ক্লডিয়ান পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবার অগাস্টাসের দিক দিয়ে তিনি একই রকম অভিজাত জুলিয়ান পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে দুইটি অভিজাত বংশ এক হয়ে যাওয়াতে তার বংশকে ইতিহাসে ‘জুলিও ক্লডিও’ বংশ বলে উল্লেখ করা হয়। টিবারিয়াসের জন্য আরও একটি ইতিবাচক দিক ছিল, অগাস্টাসের জীবন শেষের সময়টিতে তিনি ছিলেন একেবারে পরিণত বয়সের উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। তার বয়স তখন পঞ্চাশের ঘরে। তিনি ছিলেন সৎ, জ্ঞানী আর ভীষণ দায়িত্বপরায়ণ। তিনি যে অগাস্টাসের যােগ্য উত্তরসূরী হবেন, এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ছিলেন জেদি, একরােখা আর হতাশ চরিত্রের মানুষ (বিশেষ করে তার প্রিয় স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদের ব্যাপারে যখন অগাস্টাস তাকে বাধ্য করে)। তাই তাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেকেই পছন্দ করত না। পরবর্তীকালে কিছু ঐতিহাসিক টিবারিয়াসকে ধূর্ত পরিকল্পনাকারী হিসেবেও বর্ণনা করেন। তাদের বর্ণনায় টিবারিয়াস তার মা লিভিয়ার সাথে মিলে কূটচালের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন। সে সব প্রাচীন কাহিনীতে বিস্তারিত জানা যায় যে, টিবারিয়াস তার মা লিভিয়ার সাথে মিলে অগাস্টাসের নাতিদেরকে বিষ খাইয়েছিলেন আর কৌশলে অগাস্টাসের মৃত্যুও ত্বরান্বিত করার চেষ্টায় ছিলেন। এভাবে নানান কাহিনীর মাধ্যমে তার চরিত্র জঘন্য হিসেবে তুলে ধরা হয় আর তাকে ফুটিয়ে তােলা হয় রােমের একজন নিষ্ঠুর দৈত্য হিসেবে। আসলে এসব কাহিনীর কোনােটাই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা যেতে পারে। যাদের বর্ণনা থেকে আমরা এসব জানতে পারি তারা বেশিরভাগই হয়তাে বহুবছর পরে রােমের শাসকদের কোনাে সভাকে স্মরণ করে কিছু লিখেছেন। তারা হয়তাে কেবল স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যেই লিখেছেন সেসব গল্প। তারা সম্রাট আর ম্রাটের আশেপাশের মানুষদের নিয়ে লিখতে ভালােবাসতেন। তাদের জড়িয়ে বিভিন্ন বদনাম আর গুজবের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। এইসব ঐতিহাসিকদের লেখায় ভরসা করা প্রকৃতপক্ষে ট্যাবলয়েড পত্রিকার সুযােগসন্ধানী সাংবাদিকদের কথা বিশ্বাস করার মতাে, যারা দিনরাত বিখ্যাত মানুষদের স্থলন নিয়ে নানান মতবাদ দিয়ে থাকেন।
অগাস্টাসের মৃত্যু : শেষ পর্যন্ত ১৪ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ৭৬৭ সালে) অগাস্টাস মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন ৭৭ বছর বয়সী আর ৪৩ বছর ধরে রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। তার চারপাশে তখন যারা ছিল, তাকে তার শেষ বাক্য বলতে শুনেছে, “তােমরা কি মনে কর না যে আমি আমার জীবনটা চরমভাবে কাজে লাগিয়েছি? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে তােমরা আমাকে হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানাও।” অবশ্যই তার এক জীবনে যা যা করার ছিল সব তিনি সুচারুভাবে করে গেছেন। অগাস্টাসের হাত ধরে সাম্রাজ্যটি চমৎকারভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সাম্রাজ্যের পঞ্চাশ লক্ষ নাগরিক আর প্রায় দশ কোটি অনাগরিক মােটামুটি শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছিল। প্রাচীন কালের যাবতীয় সংগ্রাম, শত বছরের যুদ্ধের পর সবকিছু যেন একটি চরম বিন্দুতে পৌঁছেছিল তখন। সমাপ্তিতে যেন শান্তি আর আলােয় ছেয়ে গিয়েছিল বিশ্ব। সেই শান্তি তারপরেও বহুদিন যাবৎ টিকেছিল।
টিবারিয়াস (রা. ১৪ – ৩৭ খ্রি.)
টিবারিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ : অগাস্টাসের মৃত্যুর সাথে সাথে লিভিয়া (যে কিনা অগাস্টাসের মৃত্যুর পরে আরও পনেরাে বছর বেঁচে ছিলেন। মারা যান ২৯ খ্রিস্টাব্দে ছিয়াশি বছর বয়সে। সেই সময়ের বাঁচার গড় বয়স হিসেবে বিস্ময়কর বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচেন তিনি।) টিবারিয়াসের কাছে খবর পাঠান। টিবারিয়াস সে সময়ে ইলিরিয়ার পথে রাজ্য বাড়ানাের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই টিবারিয়াস সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিয়ে রােমের দিকে রওনা দেন। চলে আসেন সােজা সম্রাটের কার্যালয়ে। অগাস্টাস একসময় যা করেছিলেন ঠিক সেভাবেই তিনি সিনেটের হাতে সব ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এটা ছিল আসলে সিনেটের মাধ্যমে নতুন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কৌশল। এমন হলেই একমাত্র তার অবস্থানটা দৃঢ় হয় আর সিনেট এবং অগাস্টাসের আইনের মাধ্যমে তা মনােণীত হয়। সিনেটের সদস্যরা টিবারিয়াসের কৌশল বুঝতে পারছিলেন আর পাশাপাশি এছাড়া অন্য রাস্তায় গেলে যে অরাজকতা হতে পারে সেটাও অনুধাবন করেছিলেন। তাই সিনেটের সদস্যরা তাড়াহুড়াে করে টিবারিয়াসকে ভােটের মাধ্যমে সমর্থন জানালেন।
ড্রুসাসের পুত্র জার্মানিকাস : এই সুবাদে টিবারিয়াসকে রাইন আর দানিয়ুবের তীরে বিদ্রোহী সেনার বিশাল দলের মুখােমুখি হতে হলাে। দানিয়ুবের তীরের বিদ্রোহী বাহিনীর দায়িত্ব নেয়ার জন্য তিনি তার পুত্র ড্রুসাস সিজারকে পাঠালেন (ড্রুসাস সিজার টিবারিয়াসের ভাই ড্রুসাসের সাথে যেন গুলিয়ে না যায় তাই তাকে ‘ছােট ড্রুসাস’ বলে ডাকা হতাে।) ছােট ড্রুসাস বিদ্রোহী সেনাদের শায়েস্তা করে সােজা রাস্তায় নিয়ে আসে। রাইনের তীরবর্তী এলাকার অবস্থা বেশি খারাপ ছিল। রাইনের তীরে ভ্যারাস যখন পরাজিত হলাে তখন সেখানে প্রকৃতপক্ষে ভয়াবহ দুযোর্গ চলছিল। সেখানে রােমান রাজ্যের নাম টিকিয়ে রাখতে হলে প্রচণ্ড ক্ষমতা আর ত্রাসের প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। সেখানকার রােমান সেনারা বড় ড্রুসাসকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ১৫ খ্রিস্টাব্দে ড্রুসাসের এক পুত্র সন্তান জন্মায় যার নাম ছিল জার্মানিকাস সিজার। বাবার জার্মান বিজয়ের স্মারক হিসেবে তার নামকরণ করা হয়। ছেলেটি তার বাবার মৃত্যুর সময়ে মাত্র ছয় বছর বয়সের ছিল। কিন্তু আর্মিনিয়াসের হাতে ভ্যারাসের মৃত্যুর সময়ে জার্মানিকাস সিজারের বয়স ছিল ২৪। তিনি তখন টগবগে যুবক এবং আদর্শ রােমান তরুণ। তার উপরে তিনি বিয়ে করেছিলেন অ্যাগ্রিপিনাকে। অ্যাগ্রিপিনা ছিলেন অগাস্টাসের নাতনি। অগাস্টাস জার্মানিকাসের উপরে এতই সস্তুষ্ট ছিলেন যে ভ্যারাসের পরাজয় আর মৃত্যুর পরে তিনি টিবারিয়াসের সাথে তাকে রাইনের তীরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পাঠান। তারা সেখানে একসাথে কাজ করে রােমের জন্য সুফল বয়ে এনেছিলেন। তাই অগাস্টাস যখন টিবারিয়াসকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাবছিলেন তখন অভিজ্ঞ সম্রাট টিবারিয়াসকে পরামর্শ দেন জার্মানিকাসকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করতে। তাতে করে টিবারিয়াসের নিজের ছেলের উত্তরাধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। টিবারিয়াস অগাস্টাসের কথা অনুযায়ী সেটাই করেছিলেন।
জার্মানিকাসের জার্মানিয়ার সফল অভিযান : ১৪ সালে জার্মানিকাসকে দ্বিতীয়বারের মতাে রাইনের তীরে পাঠানাে হলাে। সেবারে তাকে যেতে হয়েছিল একা। কারণ টিবারিয়াস তখন ইলিরিয়ায় শাসনকাজে ব্যস্ত ছিলেন। যখন অগাস্টাসের মৃত্যুর পরপর টিবারিয়াস সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ছুটে আসছিলেন তখন জার্মানিকাস ছিলেন তার যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে আকস্মিক সেনাবিদ্রোহ দমনের চেষ্টায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সেখানকার সেনারা আরও বেশি ভাতার জন্য দাবি করছিল। কাজের সময় কমাননার দাবিতেও তারা বিদ্রোহ করছিল। জার্মানিকাসের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের জোরে সেই সেনা বিদ্রোহ দমন করা গিয়েছিল। কৌশলে তিনি সেনাদের ভাতা বাড়ানাের আশ্বাস দিয়ে সেনাবিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তাদের ব্যস্ত রাখতে আর উত্তেজিত করতে তিনি আবার তাদের নিয়ে জার্মানি আক্রমণের কথা ভাবেন। তিনি জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় ছােটখাটো যুদ্ধে জয়ী হন। তিনি জার্মানদের দেখাতে সক্ষম হন যে ভ্যারাসকে হারিয়ে দেয়াই শেষ কথা নয়। আর চাইলেই রােমের জন্য সেই পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি করা যায় না। তিনি তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে হতে টিউটোবার্গার ওয়ার্ল্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন, যেখানে এসে ভ্যারাসের পরাজিত সেনাবাহিনীর ফ্যাকাশে সাদা হয়ে যাওয়া হাড়গােড়ের স্তুপ খুঁজে পেলেন। কঙ্কালগুলােকে সসম্মানে মাটির নিচে চাপা দিয়ে তারা আবার এগিয়ে গেল। জার্মানিকাস যেন আর্মিনিয়াসকে পরাজিত করার শক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। সেবারে জার্মানিতে অনুপ্রবেশ করে তিনি তার বাহিনীসহ জার্মানির এত বিপুল ক্ষতি করলেন যে ভ্যারাসের পরাজয়ের গ্লানি অনেকটা প্রশমিত হলাে। টিবারিয়াসও মনে করল যে রােমের জন্য অনেকটা জার্মানি জয়ের মতােই ঘটনা হয়েছে। এবারে জার্মান অধিবাসীরা নিশ্চয়ই তাদের উচিত শিক্ষা পেয়েছে। আর কোনােদিন রােমের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
সমস্যার কারণে জার্মানিকাসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা : কিন্তু অগাস্টাসের মতােই কিছুদিন পরে টিবারিয়াসেরও বােধধাদয় হলাে। তিনি বুঝতে পারলেন যে এভাবে এলবি ধরে এগিয়ে রােম থেকে আরও দূরে গিয়ে কোনাে লাভ নেই। এক্ষেত্রে যতটা অর্থ আর মানুষের জোগান লাগছে সেটা রােমের উপরে খুবই ভয়ানক চাপ। টিবারিয়াস একথা বুঝতে পারার পরপরই, ১৬ খ্রিস্টাব্দে রাইনের তীরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জার্মানিকাসকে রােমে ডেকে আনেন। পরে অবশ্য সেই ঘটনা নিয়ে সিনেটে নানারকমের সমালােচনা হয়। সবাই মনে করেন যে টিবারিয়াস জার্মানিকাসকে হিংসা করেন বলে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন। টিবারিয়াস চান না যে জার্মানিকাস তার নিজের চেয়ে তেজি আর বীর প্রমাণিত হােক। মনে করা হয়েছিল, জার্মানিকাস তার পরে এই সিংহাসনে বসবেন তাই নিজের জনপ্রিয়তা জার্মানিকাসের জন্য একটুও কমাতে রাজি নন টিবারিয়াস। কিন্তু এসব আলােচনার আসলে দৃঢ় কোনাে ভিত্তি ছিল না। বাস্তবে টিবারিয়াসের দূরদৃষ্টি সঠিক ছিল। জার্মানদের আসলেই শিক্ষা হয়েছিল আর তার পরের দুইশ বছরেও রাইনের তীরের অবস্থা একই ছিল। একেবারে শান্ত। আর অন্যদিকে জার্মানিকাস অনেক সেনা জার্মানদের হাতে হারিয়েছিল। জয়ের জন্য তাকে যে দাম দিতে হয়েছিল তা রােমের জন্য নেহায়েত কম ছিল না। তিনি যদি লড়তেই থাকতেন তবে হয়তাে একসময় জার্মানরা তাদের সবাইকে মেরে জয়ী হয়ে যেত। আর দ্বিতীয়বার জয়ী হলে গাউলে জার্মানদের অনুপ্রবেশ রােমের কারও পক্ষে ঠেকানাে সম্ভব হতাে না। তাই তাদের আর না ক্ষেপিয়ে জার্মানিকাসকে রােমে ডেকে এনেছিলেন টিবারিয়াস। তাতে করে পরের অনেকগুলাে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল রোম।
জার্মানিকাসের মৃত্যু : টিবারিয়াস যে আসলে জার্মানিকাসকে হিংসা করতেন না সেটা প্রমাণিত হলাে। কারণ রােমে ফেরত এনে তাকে রাজ্যের পূর্বদিকের অংশের সর্বেসর্বা করে বসিয়ে দিলেন টিবারিয়াস। পূর্বদিকের ওই অংশে তার প্রধান কাজ ছিল আর্মেনিয়ার সাথে সমঝােতায় আসা। পার্থিয়াও সেদিকে হামলার নানান পায়তারা করছিল। পরে আসলেও সেই হামলাগুলাে রােমের জন্য বেশ গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে জার্মানিকাস এই সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কিছুই করতে পারেননি। ১৯ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। এতে সাংঘাতিকভাবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকাল আধুনিক যুগে নানান রােগজীবাণুর হাত থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু এখন যেসব জীবাণু আমরা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করছি সেসব সেই যুগে মারাত্মক জীবন বিনাশকারী ছিল। রােমান সাম্রাজ্যের আমলে এখনকার চেয়ে তাদের গড় আয়ু অনেক কম ছিল। যদিও তখনও কিছু ব্যতিক্রম দেখা গেছে। অগাস্টাস আর লিভিয়া তাদের বার্ধক্যে বহুদিন বেঁচে ছিলেন কিন্তু সাধারণ একজন রােমান খুব কমই চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচত। তবু যদি কোনাে বিখ্যাত মানুষ হঠাৎ করেই মৃত্যুবরণ করত তবে তাকে সাধারণ মৃত্যু বলে কেউ মেনে নিতে পারত না। বিশেষ করে সেই মানুষটির যদি কিনা পরবর্তীকালে সিংহাসনে বসার সুযােগ এবং সম্ভাবনা থাকত। তখনই মানুষের মুখে মুখে ফিরত নানান গুজব আর নিন্দা। সেবারে এমন গুজব শােনা গেল যে টিবারিয়াস জার্মানিকাসকে মেরে ফেলতে বিষ খাইয়েছেন। জার্মানিকাসের স্ত্রী অ্যাগ্রিপিনা এই গুজবকে সত্য বলে ধরে নিলেন। কিন্তু অগাস্টাসের মতাে টিবারিয়াসের তাে উত্তরাধিকার হিসেবে জার্মানিকাস ছাড়া আর কেউ ছিল না। টিবারিয়াস যদি তার নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসানাের জন্য জার্মানিকাসকে মেরে ফেলতে চান, সেটা বিশ্বাসযােগ্য নয়। কারণ তার নিজের ছেলে ছােট ড্রুসাস ২৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
অগাস্টাসের অনুকরণে টিবারিয়াস ও ক্যাপ্পাডোকিয়া অধিকার : টিবারিয়াস আসলে কোনাে ঝুঁকিতে না পড়ার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অগাস্টাসের উপদেশ মেনে চলতেন, শান্তিতেও তেমনই। যুদ্ধের ক্ষেত্রে অগাস্টাস যতটুকু ব্যয় করতে চেয়েছেন তার থেকে বেশি ব্যয় টিবারিয়াস কখনও করেননি। শুধু যুদ্ধের খাতিরে যুদ্ধ চালিয়ে যাননি তিনি কখনও শাসনকাজ চালানাের সময়ে অগাস্টাসের যে সততা আর কর্মদক্ষতা ছিল, টিবারিয়াস তাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন সবসময়। কখনও অগাস্টাসের ইচ্ছেকে তিনি অবহেলা করতেন না। তিনি রােম থেকে দূরে দখলকৃত কোনাে রাজ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। আর অগাস্টাসের মৃত্যুর পর তিনি রাজ্য নিয়ে সিদ্ধান্তে আরও সাবধানে পা ফেলেছেন। ১৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্পাডােকিয়ার রাজার মৃত্যু হলে টিবারিয়াস সে রাজ্যকে রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন।
প্রধানমন্ত্রী সেজানাস : টিবারিয়াস যখন সম্রাটের আসনে বসলেন ততদিনে তিনি বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। তখন তার বয়স বেড়ে দাঁড়িয়েছিল পয়ষট্টি। সাম্রাজ্য নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। এই বিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব তিনি নবীন আর তরুণ সেনাদের উপরে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলেন। অন্য কথায় বলতে গেলে তিনি আসলে একজন যােগ্য তরুণ প্রধান মন্ত্রী খুঁজছিলেন। তিনি এই দায়িত্ব লুকিয়াস এইলিয়াস সেজানাসকে দিতে আগ্রহী হন। সেজানাস ছিল অগাস্টাসের অধীনে প্রিতােরিয়ান বাহিনীর প্রধান। বাহিনীটি দলে দলে বিভক্ত হয়ে পুরাে ইতালিতে ছড়িয়ে ছিল। সেজানাস টিবারিয়াসকে বুঝিয়ে তাদের সবাইকে একত্র করে রােমের কাছে একটি জায়গায় আনার অনুমতি গ্রহণ করেন। এভাবে সেজানাসের ক্ষমতা বেড়ে যায়। কারণ হাতের কাছে পুরাে সেনাবাহিনী একসাথে থাকায় যে কোনাে জরুরি অবস্থায় তাদের ব্যবহার করার সুযােগ নিশ্চিত থাকে। (এটা যে রােম রাজ্যকে আরও হুমকির মুখে ফেলেছিল, তা পরের বছরগুলিতে প্রমাণিত হয়েছে।)। পরের কয়েক বছরে মানুষের মুখে মুখে শােনা গেছে সেজানাসের অপ্রত্যাশিত ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠার গল্প। প্রকৃতপক্ষে সিংহাসনের লােভে তিনিই ড্রুসাসকে বিষ খাইয়েছিলেন। মনে করা হয় সিনেটের উপরে টিবারিয়াসের সর্বময় ক্ষমতাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেই সেজানাস এ কাজ করেছিলেন।
টিবারিয়াসের বিরোধিতা : অগাষ্টাসের মতাে সকল মানুষের মন জয় করার ক্ষমতা টিবারিয়াসের ছিল না। অগাস্টাস যেখানে রাস্তাঘাটে ইচ্ছেমতাে একাই ঘােরাফেরা করতে পারতেন, সেখানে টিবারিয়াসকে সবসময় নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে চলাফেরা করতে হতাে। রাজ্যটি যতই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল ততই আবার তার সম্পর্কে বিরুদ্ধ মতবাদও বেড়ে গিয়েছিল। বেশিরভাগ সিনেটরই মনে করতেন যে অগাস্টাসের শাসন আমলটা তখনকার চেয়ে বেশি শান্তির ছিল। সেই ধরনের সমালােচক সিনেটরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সেজানাস টিবারিয়াসকে বাধ্য করে। পরবর্তীকালে সিনেটের কাহিনী নিয়ে যেসব ঐতিহাসিক লিখেছেন তারা সেজানাস আর টিবারিয়াসকে ঘৃণার যােগ্য করেই তুলে ধরেছেন। কেবল সিনেটই যে তাদের প্রতি বৈরী ছিল তা নয়। জার্মানিকাসের বিধবা স্ত্রী অ্যাগ্রিপিনাও টিবারিয়াসের বিরুদ্ধে সবসময় সােচ্চার ছিলেন। তিনি মনে করতেন তার স্বামীকে বিষ খাওয়ানাের পেছনে টিবারিয়াসেরই হাত আছে। তিনি টিবারিয়াসকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে নিজের কোনাে সন্তানকে সেখানে অধিষ্ঠিত করার আশায় দিন গুনছিলেন। সেজানাস টিবারিয়াসকে বুঝিয়ে তিরিশ বছর বয়সে তাকে নির্বাসনে পাঠান। আর নির্বাসনে থাকাকালীন তার তিন বছর পরে টিবারিয়াস মারা যান।
টিবারিয়াসের অবসর গ্রহণ : ২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টিবারিয়াস ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ভালােভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। সেজানাসের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কেও এর মধ্যে তার ধারণা হয়েছে। নিজের সন্তানের মৃত্যুর ব্যথা আর ক্ষমতার ভার দুটো থেকেই তিনি মুক্ত হতে চাচ্ছিলেন। তিনি তাই সবকিছু সেজানাসের উপরে ছেড়ে দিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। ন্যাপলিসের তীরে ক্যাপরি নামের একটি দ্বীপে তিনি অবসরে থাকার মতাে একটি বাড়িতে চলে যান। টিবারিয়াসের ব্যাপারে খুব প্রচলিত একটি গুজব ছিল যে, অবসর গ্রহণের পরে তিনি ওই নিঃসঙ্গ দ্বীপে লাগামহীন আনন্দোৎসব আর নানা রকমের নিষ্ঠুর কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু যুক্তি দিয়ে ভাবলে বােঝা যায় যে এরকম ভিত্তিহীন গুজবের কোনাে অর্থ হয় না। প্রথমত টিবারিয়াস সবসময় ভীষণ সাধারণ এক জীবন কাটাতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই আকস্মিক তার জীবনযাপন প্রণালী পুরােপুরি বদলে যাবে এটা আশা করা পুরােপুরি যুক্তিযুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত দ্বীপে চলে যাওয়ার সময়ে তার বয়স ছিল আটষট্টি। এরকম বয়সে চাইলেও আর কতই কামুক তিনি হতে পারতেন।
সেজানাসের বিরুদ্ধে টিবারিয়াস : তার অবর্তমানে এদিকে সেজানাস ভীষণভাবে চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক সমালােচনার বিরুদ্ধে আইন তখন এত কড়াকড়ি হলাে যে টিবারিয়াস কিংবা তার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কটাক্ষ করে বলা যে কোনাে মানুষের যে কোনাে একটি বাক্যও সহ করা হতাে না। কেউ এসবের বিরুদ্ধে কোথাও কিছু বলেছে বলে জানালে তাকে পুরস্কৃত করা হতাে। এই ধরনের নালিশগুলাে বেশিরভাগ সময়েই হতাে মিথ্যে, বানােয়াট। পেশাদার সাংবাদিকরা সেই সময়ে সবচেয়ে ভয়ংকর ত্রাস হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল। সেজানাস নিজেই সে সময় চাইতেন যে সাম্রাজ্যটি সবার কাছে একটি ত্রাস হিসেবে পরিচিতি পাক। সিনেটের যদি এতে আপত্তি থাকে তবে সিনেট ভেঙে তিনি আবার নতুন করে গড়বেন, এরকম ইচ্ছাও পােষণ করেছিলেন। এ অবস্থা যখন চলতে থাকল তখন টিবারিয়াস সেজানাসের ব্যাপারে হতাশা আর দ্বিধায় পড়লেন। প্রধানমন্ত্রী তখন চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কী করে টিবারিয়াসের নাতনিকে বিয়ে করা যায়। উত্তরাধিকারের বিষয়টি নিশ্চয়ই তার মাথায় ছিল। কিন্তু টিবারিয়াস এই প্রস্তাব পছন্দ করেননি। পরে আরও নানান বিষয় মিলে সম্রাট টিবারিয়াস ৩১ খ্রিস্টাব্দে সেজানাসের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে ক্যাপ্রির কাছে চিঠি লেখেন। তার চিঠির সূত্র ধরে সেজানাসসহ অন্য অনেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ক্যালিগুলা (রা. ৩৭ – ৪১ খ্রি.)
গেইয়াস সিজার বা ক্যালিগুলার বাল্যকাল : ৩৭ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ৭৯০ সালে) টিবারিয়াসের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি টানা তেইশ বছর রােম শাসন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পরে যথারীতি আবার উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। টিবারিয়াসের নিজের কোনাে সন্তান ছিল না। আর একমাত্র ভাগ্নে জার্মানিকাস যে কিনা স্ত্রী লিভিয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিল। অবশ্য জার্মানিকাসের নিজের কয়েকজন সন্তান ছিল। কেউ কেউ ততদিনে মরে গেছে তবে একজন পুত্র সন্তান তখনও বেঁচে ছিল। তার নাম গেইয়াস সিজার। সম্পর্কে তিনি টিবারিয়াসের নাতি, অগাস্টাসের প্রপৌত্র। গেইয়াস সিজার জন্মেছিলেন ১২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি জন্মেছিলেন জার্মানির যুদ্ধক্ষেত্রের ক্যাম্পে। তার বাবা জার্মানিকাস আর মা অ্যাগ্রিপিনা তখন সেখানে ছিলেন। তিনি তার জীবনের প্রথম কয়েক বছর সেনাদের সাথে কাটান। কঠোর সংকল্পবদ্ধ গম্ভীর সেনারা একসময় তাদের নেতার শিশুর সাথে হেসে খেলে দিন কাটাতে লাগল। সেনাদের সংকল্প আরও দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জার্মানিকাস তার ছােট্ট ছেলেকে দিয়ে নানান উৎসাহব্যঞ্জক কাজ করাতেন। গেইসার সিজারকে সেনাদের মতাে কাপড় পরাতেন, এমনকি সেনাদের মতাে ছােট্ট একজোড়া জুতােও পরাতেন তাকে। সেনারা তাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠত। আদর করে তাকে ক্যালিগুলা (ছােট্ট জুতাে) বলে ডাকত। তখন থেকে সেটাই তার ডাকনাম হয়ে গেল। আর একমাত্র সে আত নামেই তিনি পরবর্তীকালে ইতিহাসে পরিচিত হলেন। ক্যালিগুলা একেবারেই অগাস্টাস আর টিবারিয়াসের মতাে ছিলেন না। রােমের প্রাচীন ঐতিহ্যের ব্যাপারে তার কোনাে মায়া মমতা তৈরি হয়নি। তাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখে এমন করে মানুষ করা হয়েছিল যেখানে তিনি কেবল নিজেকে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে বুঝতে শিখেছিলেন। যতরকম সম্ভব সবরকম আরাম আয়েশের ব্যবস্থা তার জন্য করা হয়েছিল। আরও একটা জিনিস তিনি জেনেছিলেন তখন, তা হলাে তার জীবন সবসময় একরকম হুমকির মুখে আছে। এভাবে থাকতে থাকতে তিনি শিখেছিলেন কেবল ভয় পাওয়া আর মানুষকে সন্দেহ করা। তারপর আস্তে আস্তে রােম রাজ্যের পূর্বদিকের দূরবর্তী প্রদেশগুলাের রাজপুত্রদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রাজপুত্রেরা রােমে কোনাে না কোনাে কাজে আসা-যাওয়া করত। তাদের মধ্যে একজন হলেন হেরােড অ্যাগ্রিপা। জুডিয়ার প্রথম হেরােড রাজার নাতি। এইসব বন্ধুদের কাছ থেকে গল্প শুনে শুনে ক্যালিগুলা পূর্বের রাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বােধ করতেন।
খরুচে ক্যালিগুলা : ক্যালিগুলার শাসনামল শুরু হলাে খুব নীরবে। চারদিকের পরিস্থিতি ছিল শান্তিপূর্ণ। সবাই তাকে বিপুল আনন্দের মধ্যে দিয়ে বরণ করে নিল। বিচারকাজ অগাস্টাস কিংবা টিবারিয়াসের সময়ে যেমন ঘটনাবিহীন আর নীরস ছিল তেমন আর রইল না। ম্লান হয়ে যাওয়া সব জায়গা ঝকমক করতে লাগল। সবাই বুঝতে পারল, এই সম্রাট খুব স্বাধীনচেতা আর প্রাণবন্ত। কিন্তু তিনি এতই স্বাধীনচেতা ছিলেন যে আনন্দে কাটাতে গিয়ে, অগাস্টাস আর টিবারিয়াস সত্তর বছর হিসেবি হয়ে রাজ্যশাসন করে রাজকোষে যে ধনদৌলত জমা করেছিলেন, সেসব উড়াতে তার বড়জোর এক বছর লাগল। ৩৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিগুলার মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলাে। তারপরে তিনি যখন সুস্থ হলেন ততদিনে সবকিছু বদলে গেছে। দীর্ঘ অসুস্থতা তার মানসিক অবস্থা বদলে দিয়েছিল আর এটাও সত্য যে তার আগের কয়েক বছরও তিনি ভালাে অবস্থায় ছিলেন না। সিনেটের ঐতিহাসিকরা তার এই মানসিক অসুস্থতার কথা খুব বাড়িয়ে লিখেছেন। নির্দ্বিধায় তারা লিখেছেন যে ক্যালিগুলা আসলে এক খারাপ শক্তি ছিল পুরাে পরিবারটির জন্য আর রাজ্যের জন্যও। তারা যতই বাড়িয়ে লেখেন না কেন, সত্য আসলে ছিল অন্যরকম। ৩৮ সালের পরে ক্যালিগুলার খরচের বাতিক মারাত্মকভাবে বেড়ে গেল। তিনি যেভাবে পারেন অর্থের জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য অর্থ প্রাপ্তির আশায় তিনি নানারকম নিপীড়ন আর জুলুম শুরু করলেন। তখন এমন ব্যবস্থা ছিল যে কোনাে ধনী লােকের বিরুদ্ধে কোনােরকমে রাজনৈতিক প্রতারণার অভিযােগ আনতে পারলেই তার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি সম্রাটের কোষাগারে চলে আসত। অভিযােগ অমূলক হলেও কোনাে হেরফের হতাে না। যেমন একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোেগ্য যে ক্যালিগুলা মৌরিতানিয়ার রাজা টলেমির সমস্ত সম্পত্তি হরণ করেছিলেন। নিরপরাধ রাজা টলেমিসহ তার উত্তরাধিকারী মার্ক অ্যান্টনিকে রােমে ডেকে এনে হত্যা করেন। আর তারপর মৌরিতানিয়ার কোষাগার পুরােপুরি চলে আসে ক্যালিগুলার হাতে।
নিজেকে দেবতা ভাবা ক্যালিগুলা ও প্রিতোরিয়ান গার্ডের হাতে মৃত্যু : ক্যালিগুলা অগাস্টাসের আইন-কানুন বদলানাের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি পূর্বের দেশগুলাের রাজতন্ত্রের অনুকরণে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নতুন একটা চেহারা দিতে চাইতেন। এজন্য তিনি চাইতেন প্রজারা তাকে স্বর্গীয় দেবতার মতাে আরাধনা করুক। প্রকৃতপক্ষে তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী এরকম উপাসনা কেবল মৃত মানুষদেরই করা হতাে। খুব প্রাচীন কিছু সভ্যতায় জীবিতদের জন্যে সে ধরনের আয়ােজন দেখা যেত। (ইহুদিরা এই ধরনের বিপক্ষে ছিল বরাবর।) রােমান সম্রাটদের মৃত্যুর পরে তাদের দেবতার মতাে পূজা করা হতাে। নির্দিষ্ট নিয়মে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আর সম্মান প্রদর্শন করা হতাে। কিন্তু বহু ঈশ্বরবাদী সমাজে এসবের কোনাে অর্থ হয় না। সিনেটের সদস্যরা অবশ্য এ ব্যাপারে স্বস্তি বােধ করছিলেন যে জীবিত সম্রাটকে সেরকম দেবতার মর্যাদা দেয়া হবে কি না, এই সিদ্ধান্ত তাদের ভােটাভুটির উপরে নির্ভর করবে। তখনকার দিনে সিনেটের জন্য একজন অত্যাচারী, জুলুমকারী সম্রাটকে শায়েস্তা করার মতাে একটিই পদ্ধতি ছিল; তা হলাে তাকে জানিয়ে দেয়া যে মৃত্যুর পরে তাকে তার যােগ্য সম্মান দেয়া হবে না। এরকম করলে মৃত সম্রাটের কোনাে ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না কিন্তু সিনেটের সদস্যরা অবশ্যই শান্তি পায়। ক্যালিগুলা নিজের এই অতি সম্মানিত বা অতি আদরণীয় হওয়ার বাতিকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন। জীবিত অবস্থায়ই তিনি মৃতের মতাে আরাধনা দাবি করছিলেন। এই দাবি রােমান সংস্কৃতি অনুযায়ী অবান্তর হলেও অন্য অনেক সংস্কৃতিতে বহাল ছিল। যেমন মিশরের ফারাও রাজারা জীবিত অবস্থায় বিধাতার মতাে সম্মান পেতেন। তাদেরকে চলমান, জীবন্ত বিধাতা হিসেবে দেখা হতাে। এই চিন্তাধারা তখনকার মিশরিয়দের কাছে একবারেই অস্বাভাবিক ছিল না। একজন মানুষ এটা স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিকভাবে নেবে সেটা আসলে নির্ভর করে, বিধাতাকে সে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে, তার ওপরে। আধুনিক রাষ্ট্র তার পত্তনকারী বা প্রধান নাগরিকদের যতই নিরাপত্তা আর সুযােগসুবিধা দিক না কেন, মানুষ তাদের বিধাতা মনে করে না। প্রাচীন সভ্যতায় যখন তাদের কাছে বিধাতার সংখ্যা ছিল অশেষ আবার কখনও কখনও বিধাতার মধ্যে মানুষের মতাে দুর্বল গুণাবলিও থাকত, তখনকার দিনে এভাবে ভাবা হয়তাে স্বাভাবিক ছিল।রােমানদের কাছে সত্যিকার অর্থে একজন তরুণ সম্রাটকে তাদের দেবরাজ জুপিটারের মতাে পােশাক পরতে দেখা আর জুপিটারের মন্দিরে মূর্তি সরিয়ে দিয়ে নিজের মূর্তি স্থাপন করার আদেশ খুবই অদ্ভুত ঠেকছিল। তারা সবাই ছিল সম্রাটের উপরে যারপরনাই বিরক্ত। অগাস্টাস আর টিবারিয়াসকে সাধারণভাবে কেবল “প্রথম শ্রেণির নাগরিক” বলা হতাে। তাদের উপাধি ছিল প্রিন্সেপ। তাদের হাতে ক্ষমতা যা-ই থাকুক, নিজেদের তারা কেবলই রােমান নাগরিক মনে করতেন। সাধারণ মানুষেরাও তাদের রােমান নাগরিক হিসেবেই দেখত। যদিও এসব একেবারেই অবাস্তব আর যুক্তির কথা। ক্যালিগুলা যদি বিধাতাতুল্য সম্রাট হয়ে যান তবে তিনি আর সাধারণ কোনাে নাগরিক থাকেন না। তিনি হয়ে ওঠেন আর সব নাগরিকদের থেকে উচ্চমানের, অসাধারণ। তখন রােমান নাগরিক আর অনাগরিকদের কাছে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান আর প্রজারা সব হয়ে যায় তার দাস। রােমান নাগরিকদের যেসব অধিকার ছিল, তা আর চর্চা হতে পারে না। রাতারাতি তারা সবাই অনাগরিকের মতাে হয়ে যায়। ক্যালিগুলার বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। এর মধ্যে একটি ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত সফল হলাে। ৪১ খ্রিস্টাব্দে (৭৯৪ রােমান সালে) ক্যালিগুলা তার স্ত্রী আর কন্যাসহ খুন হলেন। একদল বিদ্রোহী প্রিতােরিয়ান পাহারাদারের হাতে তাদের মৃত্যুবরণ করতে হলাে। তখন তার বয়স তিরিশও হয়নি।
ক্লডিয়াস (রা. ৪১ – ৫৪ খ্রি.)
ক্লডিয়াসের সিংহাসনে আরোহন : এভাবে প্রথমবারের মতাে একজন সম্রাটকে হত্যার ঘটনা ঘটায় সিনেটের সদস্যরা যা খুশি তাই করার ক্ষমতা পেয়ে গেল। একজন অপ্রকৃতিস্থ সম্রাট তাদের ততদিনে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে সম্রাটের পক্ষে কতদূর কী করা সম্ভব। সত্তর বছর ধরে যে পদটির আবেদন মানুষের কাছে ভয়ানক উঁচু ছিল সেই পদ একদিনেই যেন তাদের চোখে নিচে নেমে গেল। সত্তর বছর ধরে কঠোর আইনের প্রয়ােগের মধ্যে থাকা মানুষগুলাে যেন সুযােগ পেয়ে রাজ্যের যেখানে সেখানে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াতে লাগল। তাই সম্রাটের হত্যার পরে সিনেট প্রথমেই মনে করল যে আইনের প্রয়ােগ আবার কঠোর হওয়া উচিত। কিন্তু পরে দেখা গেল সিনেট কোনাে সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না। কারণ যে সেনার দল সম্রাট ক্যালিগুলাকে হত্যা করেছিল তারাই সব কর্তৃত্ব নিতে চাইছে। তারা নিজেরাই যা করার করে নতুন একজন সম্রাটকে অধিষ্ঠিত করার স্বঘােষিত দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটার সময়ে ক্যালিগুলার আংকল তার সাথে ছিলেন। এই আংকলের নাম ক্লডিয়াস (টিবারিয়াস ক্লডিয়াস ড্রুসাস নিরাে জার্মানিকাস)। তিনি ছিলেন রােমের পূর্ববর্তী বড় দুই নায়ক, জার্মানিকাসের ছােট ভাই আর বড় ড্রুসাসের পুত্র। ক্লডিয়াস অবশ্য তার ভাই বা বাবার মতাে শক্তিশালী ছিলেন না। বরং বেশ দুর্বল আর দেখতে শুনতে একেবারেই আকর্ষণীয় ছিলেন না। তাই কেউ তাকে তেমন পাত্তা তাে দিতই না, বরং বেশ অবহেলার চোখে দেখত। তাই তিনি সবসময় মানুষের আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন। তিনি কারও আগেপিছে থাকতেন না। কারও কোনাে ব্যাপারে নাক গলাতেন না। তার এই স্বভাবই তাকে ক্যালিগুলাকে হত্যার সময়ে সাহায্য করেছিল। তাকে কেউ নিজেদের জন্যে হুমকি মনে করেনি। কিন্তু ক্লডিয়াস সেরকম আত্মভােলা ছিলেন না। ভেতরে ভেতরে তিনি বেশ জ্ঞানী ছিলেন। তিনি অনেক ঐতিহাসিক গবেষণাও করেছিলেন। এট্রুসকানস আর কার্থেজিনিয়ানদের নিয়ে তিনি ইতিহাসের কিছু বইও লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে রােমান রাজবংশ তাকে অভিজাত আর বুদ্ধিমান হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ক্যালিগুলা তার এই নির্দোষ আংকলকে খুব পছন্দ করতেন। অথবা তিনি তাকে কেবল রাজসভার ভাড় বলে মনে করতেন। ক্যালিগুলার শাসনামলের প্রথম দিকে তিনি সম্রাটের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ক্যালিগুলাকে আক্রমণ আর হত্যার সময়ে তিনি সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। ভয়ার্ত ক্লডিয়াস আক্রমণের সাথে সাথেই একটা কোনাে আসবাবের পেছনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আক্রমণকারী সেনারা যখন পাগলের মতাে কেবল আঘাত করে চলছিল তখন সামনে কে আছে না আছে খেয়াল করেনি। তারপর যখন তাদের উত্তেজনা কমে আসে তখন তারা ক্লডিয়াসকে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে লুকানাের জায়গায় তারা তাকে পেয়েও যায় আর টেনে-হিচড়ে বের করে আনে। বােকার মতাে তিনি কেবল তাদের কাছে নিজের প্রাণভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আসলে তাকে হত্যা করার তেমন কোনাে ইচ্ছেই সেনাদের ছিল না। সম্রাটকে মেরে ফেলার পরে সেনারা সাথে সাথেই সম্রাটের শূন্য সিংহাসনের কথা ভেবেছিল। সেই শূন্যস্থান পূরণের তাগিদ অনুভব করেছিল। তারা জানত যে ক্লডিয়াস রাজকীয় পরিবারের বংশধর। তাই কোথায় ক্লডিয়াস তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে, তার আগে তারাই ক্লডিয়াসের পায়ে পড়ে তাকে সম্রাট হওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। ক্লডিয়াস হয়তাে অনুরােধটা ততটা পছন্দ করেননি। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী সেনাদের সাথে তর্ক করবেন এতটা বােকাও তিনি ছিলেন না। তিনি শুধু রাজিই হলেন, তা নয়; এই আক্রমণ আর বিদ্রোহের জন্য তাদের পুরস্কারও দেবেন ঠিক করলেন। সেনাদের জন্য এটা খুব খারাপ একটা উদাহরণ হয়ে গিয়েছিল। তারা শিখে গেল যে এভাবে সিংহাসন ছিনিয়ে নেয়া যায় আর তার জন্য তিরস্কারের বদলে পুরস্কার প্রাপ্য। তিনি যত দিতে চেয়েছিলেন, সেনারা তার চেয়েও বেশি দাবি করছিল। তারপর তাদের দাবি বাড়তেই থাকল। আবার আগের মতাে রাজ্য ফিরিয়ে আনার যে স্বপ্ন সিনেটের সদস্যরা দেখছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। ক্লডিয়াস হলাে সম্রাট আর বিদ্রোহী সেনাদের দাবি মেটাতে মেটাতে তারা কাহিল হয়ে গেল।
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি : ক্লডিয়াসের বয়স তখন পঞ্চাশ বছর। তিনি তার জীবন ব্যয় করেছিলেন জ্ঞানার্জনের জন্য। রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ তার জন্য ছিল খুবই কঠিন কাজ। কোনাে সিদ্ধান্তই তিনি নিতে পারতেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন খুবই শান্ত আর দুর্বল মনের মানুষ। যাই হােক, তিনি একজন ভালাে সম্রাট হওয়ার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি রােমে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে লাগলেন। প্রধান সড়কের দৈর্ঘ্য আরও বাড়ালেন যাতে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি হলাে। লেকের জল সেচ করে চাষাবাদের সুবিধা করে দিলেন। সিনেটের প্রতি দায়িত্ব প্রদর্শন করে তিনি সম্রাট হিসেবে স্বর্গীয় দেবতার সম্মান দাবি না করে অগাস্টাসের মতাে কেবল একজন প্রথম শ্রেণির নাগরিক থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্লডিয়াস সম্রাট হিসেবে খুব শান্তশিষ্ট হলেও তার সময়ে রােমান সাম্রাজ্যের আয়তন কিছু না কিছু বৃদ্ধি পেয়েছিল। ক্লডিয়াস এক দিক দিয়ে অবশ্য টিবারিয়াসের পথ অনুসরণ করেছিলেন, তা হলাে সাম্রাজ্যের দূরের বিচ্ছিন্ন সব অংশে, যেসব জায়গায় শান্তি বজায় ছিল, সেগুলাে পুরােপুরি রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেললেন। ক্যালিগুলা টলেমিকে হত্যা করার পর থেকে মৌরিতানিয়ায় কোনাে শাসক ছিল না। তবে ক্যালিগুলার এই অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে মৌরিতানিয়ার মানুষেরা প্রতিবাদ করেছিল। ৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্লডিয়াস সেই বিদ্রোহ দমন করে মৌরিতানিয়াকে রােমের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘােষণা করে। এশিয়া মাইনরের দক্ষিণপশ্চিমে লিসিয়াও ৪৩ খ্রিস্টাব্দে রােমের আরেকটি প্রদেশ হিসেবে পরিচিত হয়। আর ৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঈজিয়ান সাগরের উত্তর দিকে থ্রেসও রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাম্রাজ্যে দু’একটি দূরবর্তী কোণ কেবল স্বাধীন ছিল। যেমন এশিয়া মাইনরের পূর্বদিকে কমাজিন নামে একটি রাজ্য ছিল যেটি কোনাে কারণে ক্যালিগুলা একটু অবহেলা করেই রােমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীন করেই রেখেছিলেন। বহু প্রজন্ম ধরে এখানে রাজ্যের নিজস্ব রাজা ছিল।
গাউলে রোমান প্রভাব ও রোমানদের ব্রিটেইন আক্রমণ : এখানে আরও উল্লেখযােগ্য যে ক্লডিয়াসের সময়ে রােমান রাজ্য গাউল থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে যায়। বৃটেন দ্বীপটি (ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর স্কটল্যান্ড নিয়ে, এখন যেটিকে গ্রেট বৃটেন বলা হয়) গাউলের অপর দিকে সমুদ্রের সরু একটা অংশ দিয়ে বিচ্ছিন্ন। এই অংশটিকে বর্তমানে বলা হয় ইংলিশ চ্যানেল। প্রাচীন কালে, জুলিয়াস সিজারের আমলের আগে এই জায়গাগুলাের কোনাে নির্দিষ্ট নাম ছিল না। ফিনিশিয়া আর কার্থাজিনিয়ানরা নিশ্চয়ই টিনের খোঁজে ব্রিটেনের উদ্দেশে জাহাজ পাঠিয়েছিল। টিন এমন এক ধাতু যা ব্রোঞ্জ তৈরিতে লাগে। তারা তাদের টিনের উৎসের খবর অন্য সবার কাছে গােপন রাখতে চেয়েছিল। সিজার যখন গাউল জয় করেছিলেন, তখন তিনি ব্রিটেনের ব্যাপারে জানতেন। সেখানকার কেলটিক জাতি গাউলের ভাষা আর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ছিল। তাই যখন রােমানদের ব্রিটেন আক্রমণ করার সম্ভাবনা দেখা দিলাে তখন তারা গাউলের সাহায্য প্রার্থনা করল। এই অবস্থা বন্ধ করার জন্য সিজার ৫৫ আর ৫৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন দুবার হামলা চালালেন। তিনি সেখানে কিছুটা সফল হয়েছিলেন। রােমান বাহিনী টেমস নদী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। সেই দূরবর্তী দ্বীপে রাজ্য স্থাপনের কোনাে ইচ্ছা সেই সময় তার ছিল না। তাই সেখানে এত কষ্ট করে না গিয়ে রাজ্যের অন্যান্য জরুরি কাজে মনােনিবেশ করেন। ব্রিটেনের লােকেরা প্রায় একশ বছর ধরে স্বাধীন ছিল। তারা চুপচাপ গাউলে রােমান আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা দেখছিল। আর গাউল ধীরে ধীরে রােমান সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। তবে ব্রিটেনের লােকেরা ভেতরে ভেতরে বেশ ভয়ে ছিল রােমান আগ্রাসন নিয়ে। গাউলে নানান সমস্যা তৈরির ব্যাপারে ভূমিকা রাখাকে তারা রােমানদের বিরুদ্ধে নিজেদের একরকম প্রতিবাদ হিসেবে মনে করত। ক্লডিয়াসের সময় গাউল ভালােভাবে রােমের পক্ষে আসে। অবশ্য বলাবাহুল্য তারা ব্রিটেনের প্রতি ততটা সদয় ছিল না। অগাস্টাস আর টিবারিয়াসের সময়কার নাগরিকত্ব নিয়ে আইনকানুনের জটিলতা ক্লডিয়াসের সময় অনেক কমে আসে। গাউলের লােকদের রােমান নাগরিকত্ব দেয়া হয়। এই দূরদর্শী পদক্ষেপ গাউলের জনগণকে পরবর্তীকালে অন্য কোনাে ক্ষমতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সােচ্চার করে। (৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অগাস্টাসের মৃত্যুর পরে এক প্রজন্ম অতিক্রান্ত হলে সেখানে রােমের নাগরিকের সংখা বেড়ে দাঁড়ায় ষাট লাখ)। দেখতে দেখতে ব্রিটেনের ভেতরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এমনভাবে বদলে গেল যা তখনকার সময়ের জন্য খুব প্রয়ােজন ছিল। ব্রিটেন একজন রােম সমর্থক শাসক কিউনােবেলিন (শেক্সপিয়ারের নাটকের “সিমবেলিন” চরিত্রটি এসেছে তার থেকে) মৃত্যুবরণ করেছিলেন আর মৃত্যুর সময়ে রেখে গিয়েছিলেন রােমান সাম্রাজ্যবিরােধী কয়েকজন পুত্র সন্তান। রােম সমর্থক একজন ব্রিটিশ নেতা ব্রিটেন আইনকানুন আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে রােমের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। রােম তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। রােমান সেনাবহিনী ৪৩ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ৭৯৬ সালে) ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পূর্বদিকে ঘাঁটি গাড়ে যেখানে রােমের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল। জায়গাটি এমনিতেও রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ক্লডিয়াস নিজেও সেনাবাহিনীর সাথে সেখানে গিয়েছিলেন আর তার ছােট ছেলে, যে এক বছর আগে জন্মেছিল, তার নাম রাখা হয়েছিল ব্রিটানিকাস। ব্রিটেনের লােকেরা জোর যুদ্ধ শুরু করল। বিশেষ করে ব্রিটেনের উত্তর আর পশ্চিমের পাহাড়ী অঞ্চলে। ব্রিটিশ নেতা কারাকটাকাস ৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। তারপরে ৬১ খ্রিস্টাব্দে বউডিকার (সাধারণত ভুল করে boadicea বানান করা হয়) একটা অংশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। টেমসের উত্তর দিকের রাজ্য ইংল্যান্ডের রানী রােমান রাজ্যের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে রােমের সব আইন বদলে দেয়া শুরু করলেন। আজকের ইংল্যান্ড বা ওয়েলসের যে চেহারা আমরা দেখি, রােমের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে তা তৈরি করতে মােটামুটি তিরিশ বছর লেগেছিল।
ক্লডিয়াসের পরিবার, মৃত্যু ও উত্তরাধিকারী নিরো : পরিবারের ভেতরে ক্লডিয়াস ছিলেন নারীপরিবেষ্টিত। সম্রাট হওয়ার পরপর তিনি যাকে বিয়ে করেছিলেন তার নাম ছিল ভ্যালেরিয়া মেসালিনা। তিনি তার তৃতীয় স্ত্রী। তিনি ছিলেন ব্রিটানিকাসের মা। পরবর্তীকালে সিনেটের ঐতিহাসিকরা ভ্যালেরিয়া মেসালিনার জীবন এমন কুৎসিতভাবে বর্ণনা করে যে “মেসালিনা” শব্দটি এখন কেবল একজন অত্যাচারী নারীর ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। শেষ পর্যন্ত ক্লডিয়াস নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে মেসালিনা আসলে তাকে হত্যা করতে চাচ্ছিলেন। তিনি ভাবতেন তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে মেসালিনা হয়তাে তার একজন প্রেমিককে সেখানে বসাতে চায়। তাই ৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেসালিনার ফাঁসির আদেশ দেন। তারপর তিনি বিয়ে করেন অ্যাগ্রিপিনাকে। অ্যাগ্রিপিনা ছিল ক্যালিগুলার বােন আর তার নিজের ভাগ্নি। অ্যাগ্রিপিনা ক্লডিয়াসকে বিয়ে করার আগেই তার একটি পুত্র সন্তান ছিল। নাম ছিল ডমিশিয়াস। বিয়ের পরে ক্লডিয়াসের পারিবারিক নাম সে গ্রহণ করে। মা সম্রাজ্ঞী হয়ে গেলে রাজপরিবারের সাথে মিলিয়ে তার নাম হয় নিরাে ক্লডিয়াস সিজার ড্রুসাস জার্মানিকাস। ইতিহাসে তিনি নিরাে নামেই পরিচিত। নিরাে ছিল জার্মানিকাসের পৌত্র আর অগাস্টাসের প্রপৌত্র। অ্যাগ্রিপিনার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল নিরােকে সম্রাটের সিংহাসনে বসতে দেখা। তাই তিনি নিরােকে দত্তক গ্রহণের জন্য ক্লডিয়াসকে বুঝিয়ে রাজি করান। নিরােকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলে পরবর্তী সম্রাট তার হওয়ার কথা কারণ ক্লডিয়াসের নিজের ছেলে ব্রিটানিকাস নিরাের চেয়ে বয়সে ছিল ছােট। ৫৩ খ্রিস্টাব্দে নিরাে ক্লডিয়াসের কন্যা অক্টাভিয়াসকে বিয়ে করে তার সম্রাট হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তােলেন। সে সময়ে নিরাের বয়স ছিল পনেরাে আর অক্টাভিয়াসের এগারাে। এই সমস্ত করা হলে ক্লডিয়াসকে অ্যাগ্রিপিনার আর কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। পরবর্তীকালে সিনেটের ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় দেখা যায় যে, ৫৪ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ৮০৭ সালে) অ্যাগ্রিপিনা ক্লডিয়াসকে বিষ প্রয়ােগে হত্যা করে। আগে থেকেই প্রিতোরিয়ান গার্ডদের বলা ছিল যে ক্লডিয়াস মৃত্যুবরণ করলে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নিরােকে যেন চিহ্নিত করা হয়। এজন্য অ্যাগ্রিপিনা তাদের মােটা অঙ্কের বখশিশ দেয়ার কথা ঘােষণা করে রেখেছিলেন। সেনারা যখন এই বিষয়ে মত প্রদান করে তখন সিনেটের আর দ্বিমত পােষণের কোনাে সুযােগ থাকে না। এভাবে নিরাে রােমের পঞ্চম সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আসীন হন।
নিরাে (রা. ৫৪ – ৬৮ খ্রি.)
নিরোর সিংহাসনে আরোহন ও তার পরিচয় : সিংহাসনে আসীন হওয়ার সময়ে নিরাের বয়স ছিল মাত্র ষোল। তিনিও ক্যালিগুলার মতাে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করলেন। যে বয়সে একটি মানুষ অন্য কারও কাছে আব্দার করে কাটায় সে বয়সে নিজেকে গুছিয়ে একটা পুরাে রাজ্য পরিচালনার ভার হাতে তুলে নিতে হয়েছিল তাকে। খুব তাড়াতাড়ি নিরো নিজের ইচ্ছের বাস্তবায়ন ঘটাতে শিখে ফেললেন। তার শখ পূরণের পথে যত বাধা বিপত্তি আসছিল সব তিনি মাড়িয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ব্রিটানিকাসকে বিষ প্রয়ােগে হত্যা করেন। তারপর নিজের তরুণী স্ত্রীকে বিচ্ছেদের মাধ্যমে দূরে সরিয়ে দেন। বস্তুত রাজ পরিবারের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাকে সাধারণ জীবনযাপন করতে বাধ্য করেন। ৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি এত ভয়ানক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন যে নিজের মাকেও ফাঁসিতে ঝােলাতে পিছপা হন না। তার মায়ের দোষ ছিল তিনি ক্লডিয়াসের উপরে যেমন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তার উপরেও তেমনই ছড়ি ঘােরাতে চাচ্ছিলেন। আরও একটা ভয়ংকর ব্যাপার ছিল যে নিরাে কখনােই সরকারি কাজকর্ম করতে পছন্দ করতেন না। তিনি আসলে মঞ্চাভিনেতা হতে চাইতেন। আজকের দিনে, দিনরাত মঞ্চে পড়ে থাকা বলতে আমরা যা বােঝাই, তিনি আসলে ছিলেন ঠিক তেমন। তিনি কবিতা লিখতেন, ছবি আঁকতেন, গ্রিসের তৈরি বীণের মতাে এক বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, সংগীত সাধনা আর আবৃত্তি করতেন। দর্শকের সামনে একটা কিছু করে দেখিয়ে প্রচুর তালি আর অভিনন্দন পেতে তার ভালাে লাগত। তবে এখন এটা বিবেচনা করার কোনাে উপায় নেই যে তার সেসব পরিবেশনা কতটুকু শিল্পসম্মত ছিল। কারণ তার কোনাে নমুনা আজ আর কোথাও নেই। শােনা গেছে তিনি সবসময়ই এসব পরিবেশনার জন্য প্রচুর অভিনন্দন পেতেন। অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু সেসব কি তিনি পেয়েছিলেন তার মনােমুগ্ধকর পরিবেশনার জন্য নাকি সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য, সেটা একটা প্রশ্ন। প্রায় সকলেই মনে করেন পরের কারণটিই সঠিক। পরে সিনেটের ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় জানা গেছে, তাকে যতটা গুণী শিল্পী হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল, তিনি ততটা যােগ্য ছিলেন না। হয়তাে নিরাে একজন শিল্পী না হলে সম্রাটের দায়িত্বটা ভালােভাবে পালন করতেন, তাহলে তার জীবনও যেমন সুন্দর হতাে, ইতিহাসও তাকে সম্মানের সাথে স্মরণ করত। ইতিহাসে তিনি সম্মানিত একজন ব্যক্তি যেমন হতে পারতেন, পারতেন নিজস্ব জীবনেও হয়তাে একজন ভালাে মানুষ হতে। যাই হােক, সম্রাট হিসেবে তার অবস্থানকে রােমান ইতিহাস একজন ভিলেনের অবস্থান হিসেবেই দেখতে পছন্দ করে।
আর্মেনিয়া নিয়া রোমান ও পার্থিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধ : কিন্তু নিরাে যতই অবহেলা আর অরাজকতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন না কেন, রাজ্য তার নিজস্ব গতিতে ঠিকই এগিয়ে গিয়েছিল। তখন রাজ্যের পূর্বদিকে আবার সমস্যা শুরু হলাে। আর সমস্যা সেই আগের মতােই রােম আর পার্থিয়ার মধ্যে কথায় কথায় যুদ্ধ লেগে রইল। তাদের দুই দেশেরই আকর্ষণ ছিল মধ্যখানের উৎপাদনশীল রাষ্ট্র আর্মেনিয়ার দিকে। ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পরপরই রােমান সাম্রাজ্যের বসানাে শাসককে সীমান্তবর্তী উপজাতির লােকেরা হত্যা করল। আর পার্থিয়ার রাজা সেই সুযােগে আর্মেনিয়ায় ঢুকে পড়ল। সেখানে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে তার ভাই টিরিডেটসকে সেখানকার রাজা বানিয়ে দিলাে। নিরাে নিয়াস ডমিশিয়াস করবুলােকে আর্মেনিয়ায় পাঠালেন সেখানে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের আশায়। করবুলাে ক্লডিয়াসের অধীনে জার্মানিতে দক্ষতা নিয়ে শাসনকাজ পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই উপযুক্ত একজন সেনাপ্রধান। তাই সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করে প্রস্তুত করতে টানা তিন বছর সময় নিলেন। ৫৮ সালে তারা আর্মেনিয়ায় অভিযান চালায়। তারপর যুদ্ধের মাধ্যমে এক বছর পরে আর্মেনিয়া দখল করে নেয়। পার্থিয়া দখল করে সেখানে রােম রাজ্যের মনমতাে একজন শাসককে বসিয়ে দেয়। করবুলাের অধীনে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকলে তিনি হয়তাে পার্থিয়াও দখল করে নিতেন। কিন্তু কোনাে সেনাপ্রধান যেন এত বেশি সফল প্রমাণিত না হয় তাই নিরাে দ্রুত করবুলােকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সেখানে অভিজ্ঞতায় অপেক্ষাকৃত কম, এমন একজনকে বসিয়ে দেন। ৬২ খ্রিস্টাব্দে নতুন সেনাপ্রধান ভয়াবহভাবে পরাজয় বরণ করে। করবুলােকে তখন আবার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি নতুন করে সেনাবাহিনীকে সংগঠিত আর উৎসাহিত করতে থাকেন। আর্মেনিয়ায় তখনও রাজা ছিলেন টিরিডেটস। কিন্তু ৬৩ সালে তিনি রােমে এসে নিরাের হাত থেকে রাজার মুকুট গ্রহণ করেন। এভাবেই শেষ পর্যন্ত আর্মেনিয়া রােমের প্রদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
জুডিয়ায় ইহুদিদের বিদ্রোহ : এর মধ্যে জুডিয়ায় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ইহুদিরা হেরােডসের আর তার পরিষদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল। তার শাসনে অনাস্থা পােষণ করছিল। একজন মাসিহার জন্য তাদের আজীবনের অপেক্ষা খুব সাংঘাতিক পর্যায়ে উপনীত হলাে। কিন্তু এর জন্য নিজেদের ধর্মের সাথে কোনাে সমঝােতা করতেও তারা ছিল নারাজ। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের ম্যাকাবিস আর তার ভয়ংকর শক্তিশালী বিদ্রোহী সাথীদের তাদের ধর্মের প্রতি সহৃদয়তা আর চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে মতবাদ তাদের হৃদয়ে তখনও জ্বলজ্বল করছিল। সম্রাটের প্রতি যে কোনাে ধরনের সম্মান প্রদর্শন যা কিনা ইহুদিদের দৃষ্টিতে সম্রাটকে বা তার কোনাে চিহ্নকে পূজা করা হচ্ছে মনে হলেই তারা ক্রমাগত সেই আচরণ প্রদর্শন করতে অস্বীকৃতি জানাত। পন্টিয়াস পাইলেট যখন যথােপযুক্ত সাজসজ্জা করে জেরুজালেমে প্রবেশ করেন তখন তার বাহনের উপরে সম্রাট টিবারিয়াসের একটি ছবি আঁকা ছিল। সেই ছবিকে তারা এক ধরনের উপাসনার বস্তু বলে মনে করে। তাই পন্টিয়াস শহরে ঢােকার সাথে সাথেই সেখানে দারুণ বিদ্রোহ দেখা দেয়। পন্টিয়াস পাইলেটের যুদ্ধ পতাকার মধ্যে সম্রাট টিবারিয়াসের ছবি ছিল। সেই সময়ে টিবারিয়াস কোনাে ধরনের উটকো ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তখনই সবকিছু থেকে তার ছবি অপসারণের আদেশ দেন। ইহুদিরা মনে করত তাদের বিধাতাই এক এবং অদ্বিতীয়। তাদের বিধাতা ছাড়া বাকি সব উপাসনার জিনিস তাদের কাছে ছিল বিরক্তিকর আর পরিত্যাজ্য। বিধাতার প্রশ্নে এরকম আপােষহীন ব্যবহারের কারণে ইহুদিদের প্রতি রাজ্যের মানুষের সমর্থন দিন দিন কমে যেতে লাগল। কারণ পুরাে রাজ্যে একমাত্র ইহুদিরা ছাড়া বাকি সবার একের অধিক উপাসনার বিষয়বস্তু ছিল। আর তারা অন্য ধর্মবিশ্বাসের প্রতিও সহনশীল ছিল। গ্রিকদের কাছে ইহুদিরা বেশি অপছন্দের হয়ে উঠল কারণ তারা একাধিক বিধাতার উপাসনা করত আর তাদের জীবনাচরণও ছিল ভিন্ন। ইহুদিরা তাদের নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বাইরে অন্য কোনাে মানুষের সংস্কৃতি বা আচরণের প্রতি এতটুকু আগ্রহী ছিল না। অন্যদের আরাধনার বস্তু সম্পর্কে জানতেও তাদের কোনাে আগ্রহ ছিল না।
ক্যালিগুলার সময়ে ইহুদিদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা : আলেক্সান্দ্রিয়া সে সময়ে মিশরের রাজধানী। শহরটিতে তখন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গ্রিক মানুষের বাস আর সেদিক দিয়ে রােম ছিল দ্বিতীয়। কিন্তু আলেক্সান্দ্রিয়ার ভেতরে ইহুদিদের একটি বড় কলােনি ছিল যেটিকে মনে হতাে শহরের ভেতরেই আরেকটি অন্য রকমের শহর। অগাস্টাস তাদের বিশেষ সুযােগ সুবিধা প্রদান করেছিলেন। (কারণ অগাস্টাসের শেষ যুদ্ধে তারা তাকে সমর্থন দিয়েছিল ও সাহায্য করেছিল।) সুবিধাগুলাের মধ্যে ছিল, দেশের নানারকম আচার ব্যবহারে অংশগ্রহণের থেকে তাদের অব্যহতি দেয়া, সেনাবাহিনীতে যােগদানের ব্যাপারে কোনাে বাধ্যবাধকতার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। এদিকে এই দুই কারণে গ্রিকরা রুষ্ট হয়েছিল। আলেক্সান্দ্রিয়ায় গ্রিকরা তাদের থেকে পৃথক ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল। তাই ইহুদিরা ক্যালিগুলার কাছে সুবিচারের আশায় আবেদন পাঠিয়েছিল। গ্রিকরা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল যে বােধহীন সম্রাট ইহুদিদের কোন কথায় কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বসেন তার কোনাে ঠিক নেই। তাই গ্রিকরা তাড়াহুড়াে করে সম্রাটের কাছে ইহুদিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি আবেদন পাঠাল। তারা সম্রাটকে জানাল যে ইহুদিরা সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানানাের সভায় ইচ্ছে করে উপস্থিত হয়নি তাই তারা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহী। ক্যালিগুলা চাইতেন সম্রাট হিসেবে রাজ্যের সব জায়গায় তার খুব আরাধনা হােক। তাই তিনি রাজ্যের বিভিন্ন মন্দিরে তার মূর্তি স্থাপনের আদেশ দিয়েছিলেন। রাজ্যের অনেক জায়গায় তার আদেশ সাথে সাথে পালন করা হলাে। মন্দিরে অনেক মূর্তির সাথে আরেকটি পাথরের টুকরাে স্থাপন করার মধ্যে নতুন কী? এখন তারপর যেটা হলাে, ক্যালিগুলা তার মূর্তি জেরুজালেমের মন্দিরে স্থাপনের আদেশ দিলেন। সম্রাটের ধারণা ছিল, একেশ্বরবাদী ইহুদিরা একটিমাত্র মানুষের মূর্তি মন্দিরে দেখলে খুশি হবে। কিন্তু আসলে এ রকম একটি ব্যাপার ইহুদিদের জন্য এতটাই অপছন্দের ছিল যে তারা এটি মেনে নেয়ার আগে মৃত্যুবরণ করতেও রাজি ছিল। সিরিয়ার গভর্নর ক্যালিগুলাকে চিঠি লিখে জানালেন ইহুদিদের প্রতিক্রিয়ার কথা। আর সম্রাটের আদেশটি মানতে শুধু শুধুই দেরি করতে থাকলেন। ক্যালিগুলা এই খবর জানার পরে ইহুদিদের রাজ্যে হামলা করাটাই ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঠিক তখনই তিনি নিজেই নিহত হন। যাই হােক ইহুদিদের অভূত্থান না ঘটানাের জন্য ক্যালিগুলার মৃত্যু যথা সময়ে হয়েছিল বলে তার পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত ইহুদিদের উপরে হামলা ঠেকিয়ে রাখা গেল।
ক্লডিয়াস ও হেরোড অ্যাগ্রিপার সময়ের সুশাসন : ক্লডিয়াস সম্রাটের আসনে আসীন হওয়ার পর ক্যালিগুলার পুরনাে বন্ধু হেরােড অ্যাগ্রিপাকে ইহুদিদের রাজা বানিয়ে জুডিয়ায় বসালেন। এভাবে জুডিয়া আবারও তাত্ত্বিকভাবে রােমের অধীনে চলে এলাে। হেরােড অ্যাগ্রিপা ইহুদিদের মন জয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। আর সত্যিই ইহুদিদের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে সফল এবং জনপ্রিয় একজন শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। (এরকম গল্প শােনা যায় যে একবার এক সভায় তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন যে, তার দুর্ভাগ্য যে তিনি একজন ইহুদি নন। এটাই ছিল তার প্রতি ইহুদিদের ভালােবাসার মূল কারণ। সেই সভায় তিনি আরও বলেছিলেন যে “আমি ইহুদি না হলেও, তােমরা ইহুদি আর তােমরা আমার ভাই।”) দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার রাজত্ব ছিল খুব অল্প দিনের। মাত্র তিন বছর পরেই তা ফুরিয়ে যায় তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। ৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নিরো ও দ্বিতীয় হেরোড অ্যাগ্রিপার সময় সম্পদ লুণ্ঠন ও ইহুদিদের বিদ্রোহ : তার পুত্র দ্বিতীয় হেরােড অ্যাগ্রিপা কিছুদিনের জন্য জুডিয়ার কিছু অংশে শাসনকাজ চালান। তারপর জুডিয়াকে আবারও একটি প্রদেশ হিসেবে রােমের যথােপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। সেই কর্তৃপক্ষের সদস্যরা ছিল নেহায়েত লােভী। তাদের একজনকে সম্রাট নিরাে ইহুদিদের মন্দিরের কোষাগার লুট করতে পরামর্শ দিলাে। তখন ইহুদিদের মধ্যে রােমের বিপক্ষের মৌলবাদী শক্তির (যাদের বলা হয় জেলটস) প্রভাব খুব বেড়ে যাচ্ছিল। ফলে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয় হেরােড অ্যাগ্রিপ্পা সে সময়ে জেরুজালেমেই ছিলেন। সবাইকে তিনি শান্ত হতে বলছিলেন। কিন্তু তার কথা কেউ শােনেনি। ৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে (৮১৯ রােমান সাল) ইহুদিরা রােমের বিরুদ্ধে ভয়ংকর শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। রােমান নাগরিকরা কিছুদিনের মধ্যেই ইহুদিদের বিদ্রোহের ভয়ানক শক্তি আঁচ করে বিস্মিত হলাে। জুডিয়ায় উপস্থিত সেনাবাহিনীরা অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না।
ইহুদিদের বিদ্রোহ দমন ও মন্দির ভাঙ্গন : নিরাে তাই তিনটি বড় সেনাবাহিনীর দলকে সেখানে পাঠালেন। সেনাবাহিনী ভেসপাসিয়ানের (টাইটাস ফ্লেভিয়াস সাবিনাস ভেসপাসিয়ানাস) নেতৃত্বে পূর্বদিকে রওনা দিলাে। ক্লডিয়াসের অধীনে তিনি জার্মানিতে কাজ করেছিলেন আর দক্ষিণ ব্রিটেনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ে তিনি সেনাবাহিনীকে অগ্রসর করিয়ে উইট দ্বীপ দখল করেছিলেন। ৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনসল হিসেবে আর তারপর আফ্রিকা প্রদেশের গভর্নর হিসেবে কাজ করেন। তাকে যে নতুন দায়িত্ব দেয়া হলাে তা তিনি খুব দক্ষতার সাথেই পরিচালনা করছিলেন। কাজ ঠিকঠাক মতাে এগােচ্ছিল তবে ইহুদিরা মৃত্যু পর্যন্ত লড়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। ৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভেসপাসিয়ান জুডিয়া থেকে রােমে ফিরে যান। কিন্তু তার পুত্র টাইটাস (টাইটাস ফ্লেভিয়াস সাবিনাস ভেসপাসিয়ানাস) তার বাবার মতােই ছিলেন। তিনি তার বাবার অর্ধসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। ৭০ খ্রিস্টাব্দের এই সেপ্টেম্বর তিনি জেরুজালেমের দখল নিয়ে নিলে মন্দিরটি দ্বিতীয়বারের মতাে ভাঙা হয়। (প্রথমবার ব্যাবিলনীয়রা ভেঙেছিল প্রায় পাঁচশ বছর আগে।) টাইটাস পরের বছর রােমে গিয়ে এই বিজয় উদ্যাপন করেন। টাইটাসের সেই বিজয় স্মরণে বানানাে তােরণ এখনও রােমের বুকে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও লােকে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে টাইটাসকে স্মরণ করে। যেসব ইহুদিরা তখনও বেঁচে ছিল আর সেখানেই ছিল, তারা ভীষণ হতাশ হয়ে গেল। আকস্মিকভাবে দেখল জুডিয়ায় তারা পড়ে রয়েছে অসীম ধ্বংসের মুখে। তাদের প্রাণপ্রিয় মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে, থামিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ধর্মীয় উপাসনার পদ্ধতি। আর তাদের চোখের সামনে জেরুজালেমে রােমান সেনাবাহিনীকে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
তদকালীন রোমান সমাজের আদর্শ এবং ধর্মীয় প্রথা
রোমানদের ধর্ম, রাজার প্রতি শ্রদ্ধা ও গ্রিক প্রভাব : সেই থেকে রােমান আর ইহুদি সংস্কৃতির মধ্যে লড়াই চলতেই থাকল। লড়াই এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে চলতেই থাকল। এই লড়াই যেন চলতেই থাকবে, কেবল স্থান-কাল-পাত্র বদলে যাবে। রােমানদের ধর্ম বেশিরভাগ এট্রুস্কানদের কাছে ধার করা, শুরু থেকে বলতে গেলে মূলত কৃষিভিত্তিক। তাদের অসংখ্য দেবদেবীর আত্মা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিরই বিভিন্ন শক্তির বাহক। তাদের বেশিরভাগ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে, আর চাষের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনায় নিবেদিত। সাধারণত সব ধর্মীয় আচার শেষ পর্যন্ত কৃষিকে আরও উন্নত করার উদ্দেশে ছিল নিবেদিত। যে সমাজে কৃষিকাজে উন্নতিসাধন না করলে মানুষকে না খেয়ে থাকতে হতাে সেখানে ধর্মীয় আচার ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে কৃষির উন্নতি করার চেষ্টা অবশ্যই অনুধাবনযােগ্য। তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানান নিয়ম রীতির জন্যও অনেক দেবতা ছিল। সেই দেবদেবীদের আদর্শ অনুযায়ী তাদের জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অনায়াসে কেটে যেত। ধর্মীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠান ছিল তুলনামূলকভাবে খুবই সাধারণ। সে রকম একটা ব্যাপারের জন্য একজন ব্যস্ত আর ক্লান্ত কৃষক যতটুকু সময় ব্যয় করতে পারে ঠিক ততটুকুই করত। এই প্রাচীন ধর্মে রাজ্যের হস্তক্ষেপে একটিই মাত্র নতুন নিয়ম সংযােজিত হয়েছিল, তা হলাে রাজকীয়ভাবে সম্রাটের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এই সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে তাদের মৃত্যু পরবর্তীকালের জন্য একরকম ধরাবাধা আন্তরিকতাবিহীন শ্রদ্ধার প্রতিশ্রুতি দেয়া হতাে। একই অনুষ্ঠানে মৃত সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে স্বর্গীয় দেবতা হিসেবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হতাে। রােমের উচ্চ শ্রেণির মানুষেরা যখন গ্রিক সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা ঘােষণা করল, গ্রিসের প্রথাগত ধর্ম তখন যেন রােমের ধর্মের মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করল। রােমের ধর্মীয় দেবতা জুপিটার আর গ্রিসের জিউস একই দেবতা। আবার রােমানদের মিনার্ভা আর গ্রিসের এথেন্স একই দেবী। যাই হােক, কাগজে কলমে গ্রিস আর রােম, দুই রাজ্যেরই ধর্মের কঠোর অনুশাসন আসলে ততদিনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রােমের উচ্চশ্রেণির মানুষেরা ধর্মীয় অনুশাসনগুলাে কেবল যন্ত্রের মতাে, কিছুটা উদাসীনভাবে পালন করে আসছিল।
শিক্ষিত শহুরে এলিটদের বিশ্বাস : প্রাচীন কোনাে ধ্যান ধারণা এ ধরনের কোনাে সমাজের জন্য উপযুক্ত নয় যেখানে কেবল সংস্কৃতিবর্জিত কৃষিজীবীরাই বাস করে না, যেখানে বাস করে অভিজাত, শিক্ষিত, শহুরে যারা পৃথিবীতে এসেছে তাদের সভ্য মন নিয়ে, সুরুচিসম্পন্ন কিছু করার জন্য। সেই শ্রেণির আগ্রহ কেবল একটি ভালাে ফলনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার থেকে অনেক বড় কিছুতে। তাদের ভাবনায় ছিল একটি সুখী জীবনের স্বপ্ন; চমৎকারভাবে অবসর কাটানাের, তাদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটানাে আর জাগতিক জীবনের যাবতীয় প্রয়ােজন মেটানাের স্বপ্ন। গ্রিকরা এই আদর্শের একটি জীবনাচরণের মাধ্যমে সুখ হাতড়ে বেড়াচ্ছিল আর রোমানরাও তাদের সাথে অলিখিতভাবে যােগ দেয়।
এপিকিউরাস : এক ধরনের অদ্ভুত আদর্শের প্রবক্তা ছিলেন এপিকিউরাস। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১ সালে গ্রিসের সামােস দ্বীপে বাস করতেন তিনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৬ সালে তিনি এধিনায় একটি স্কুল স্থাপন করেন। সেই স্কুল খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঠিক তেমনই ছিল। এপিকিউরাস তার আগের কিছু গ্রিক দার্শনিকের দর্শন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবী কতকগুলাে ছােট ছােট পরমাণু দিয়ে তৈরি। এই পরমাণু বা একগুচ্ছ পরমাণুর পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের উপরেই পৃথিবীর যাবতীয় পরিবর্তন নির্ভর করে। এপিকিউরিয়ান আদর্শের এই জায়গায় পৃথিবীর যাবতীয় পরিবর্তন আর মানুষের বেড়ে ওঠার রহস্য নির্ভর করে দেবদেবীর ইচ্ছার উপরে, এই ধরনের বিশ্বাসের জন্য তেমন কোনাে স্থান ছিল না। এই আদর্শটি এক ধরনের নাস্তিকতা, সেই সাথে গোঁড়ামি মুক্তও বটে। তারা নিজেদের শুধু শুধু ঝামেলায় ফেলার চেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় অনুশাসনগুলাে বেশ আনন্দ নিয়েই পালন করত। এরকম একটি মহাজাগতিক অবস্থায়, যেখানে পরমাণুগুলাে সবসময় এদিক সেদিকে ছােটাছুটি করছে, সেখানে মানুষ দুটো জিনিসের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারে: আনন্দ এবং বেদনা। এই আবিষ্কারের কারণ ছিল মানুষকে বোঝানাে যে মানুষ যেন আনন্দের পুরােটা উপভােগ করে আর বেদনায় যতটা পারে কম মুষড়ে পড়ে। তাই এপিকিউরাসের মতে, কোনাে কিছুর সামান্য অংশ যদি কাউকে ব্যাপক আনন্দ দিতে পারে তবে সেই একই জিনিসের প্রচুর লভ্যতা যে আরও বেশি আনন্দ দেবে তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। না খেতে পেয়ে উপােস থাকা যেমন কষ্টকর তেমনি অতিরিক্ত খেয়ে হজমের গণ্ডগােল করে ফেলাও একই রকমের বেদনাদায়ক। পরিমিত খাদ্য গ্রহণের মধ্যেই খাবার খাওয়ার আনন্দ লুকিয়ে আছে। একইভাবে জীবনের আর সব আনন্দের উপকরণের ক্ষেত্রেও তাই। অন্যদিকে মানুষের নিজের মনের শান্তি মেটানাের কথা ভুললেও চলবে না। শেখার ও জানার আনন্দ, বন্ধুত্বের আবেগ, ভালােবাসার প্রশান্তি, এসবের মধ্যেই মানুষের মানসিক মুক্তি লুকিয়ে আছে। এপিকিউরাসের মতে শুধু শরীরের আনন্দ-উত্তেজনার চেয়ে এই সব জাগতিক আনন্দের মধ্যে ঢের বেশি লাভ।
পরবর্তী প্রজন্মের বিকৃত এপিকিউরিয়ানিজম : পরবর্তী প্রজন্মের তার মতাদর্শী সব মানুষ এপিকিউরাসের মতােই জ্ঞানী আর ধৈর্যশীল ছিল না। কারণ শরীরের চাওয়া-পাওয়াকে প্রধান্য দেয়া ছিল খুব সহজ আর সেসবের উপরে কোনাে বিধিনিষেধ আরােপ করা ছিল খুব কঠিন। যে যাই বলুক, আজ যে আরাম আয়েশ হাতের কাছে বিদ্যমান তাকে অবহেলা করার কোনাে যুক্তি আছে? পরের জন্য অপেক্ষা করে থাকলে হয়তাে খুব দেরি হয়ে যেতে পারে। তাই এই “এপিকিউরান” শব্দটি পরবর্তীকালে ভাষায় সংযােজিত হয় “আভিজাত্যে অবগাহন” করার অর্থ নিয়ে। আলেক্সান্ডারের আমলের পরের শতাব্দীতে এই এপিকিউরিয়ান মনােভাব ইহুদি আর গ্রিকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে গেল। যেসৰ ইহুদিরা গ্রিক সংস্কৃতিকে ভালােবেসে নিজেদের ধর্ম বিসর্জন দিয়েছিল তাদের বলা হতাে “এপিকিউরিয়ান”। আর আজকের দিনে কোনাে অন্য ধর্মের মানুষ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে বলে “এপিকরস”। রােমানরা এপিকিউরিয়ান ধারায় বিশ্বাসী হয়ে গেল। রােম গ্রিসের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদশালী ও শক্তিশালী ছিল। রােমের যে কোনাে শহর গ্রিসের যে কোনাে শহরের চেয়ে বেশি অভিজাত সাজসজ্জায় সজ্জিত ছিল। দেখতে দেখতে রােমের এপিকিউরিয়ানিজম খােদ গ্রিসের তুলনায় বিশাল হয়ে দেখা দিল। রাজ্যের ভেতরে সব জায়গায় নিজেকে যে কোনাে রকম আরাম আয়েশে ডুবিয়ে দেয়ার সময়ে এপিকিউরিয়ানিজমের দোহাই দেয়া হতাে।
পেট্রোনিয়াস ও তার এপিকিউরিয়ানিজম : রােমান এপিকিউরিয়ানের জলন্ত উদাহরণ হতে পারেন হেইয়াস পেট্রোনিয়াস। তিনি রােমে কনসল হিসেবে কাজ করেছিলেন। আবার এশিয়া মাইনরে বিথিনিয়ায় তিনি গভর্নর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি তার সারা জীবনই আভিজাত্য আর আরাম আয়েশে কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু এভাবে জীবন কাটানাের পরেও তিনি সেই জীবনযাপন পদ্ধতিকে নানান রকম কটাক্ষ করতেন। তার লেখা “স্যাটিরিকন” বইয়ে তিনি তার বিশ্বাসের কথা লিখে গেছেন। এই বইয়ে তিনি আভিজাত্যে জীবন কাটানােকে এক ধরনের ভুল বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল লােকেদের চেয়ে যাদের হাতে বেশি টাকা আছে, তারা আরাম আয়েশের পেছনে যে ধন দৌলত খরচ করে তা কেবলই অপচয়। যাই হােক, তার এই নতুন তত্ত্ব এতই প্রশংসিত হলাে যে এই বিষয় নিয়ে কথা উঠলে তিনি নিরাের সহচর হয়ে গেলেন। নিরাে তার উপরে এই ব্যাপারে যে কোনাে মতবাদ দেয়ার জন্য নির্ভর করতেন। তার সাহায্যে নিরো আরও নিত্যনতুন সময় কাটানাের খেলা আর মজার কাজকর্ম আবিষ্কার করতে লাগলেন। তাকে ডাকা হতাে “আর্বিটার এলেগ্যানটিয়ারাম” (রুচি আর স্বকীয়তার প্রতীক)। কখনও আবার তার নামের সাথে মিলিয়ে তাকে “পেট্রোনিয়াস আর্বিটারও” বলা হতাে। নিরোর অনেক বন্ধু আর অধস্তনদের মতাে পেট্রোনিয়াসের শেষটাও হলাে বেশ খারাপ। নিরাে যখন-তখন যার-তার ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতেন। পেট্রোনিয়াসকেও সন্দেহ করা শুরু করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পেট্রোনিয়াস অন্যের হাতে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আত্মহত্যা করেন।
জেনো অফ সাইপ্রাস ও তার স্টয়সিজম : গ্রিক দর্শনের দ্বিতীয় বিখ্যাত স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন জেনো। (ধরে নেয়া হয় যে তিনি ফিনিশিয়ান পরিবারের।) তিনি জন্মেছিলেন আধা গ্রিক আর আধা ফিনিশিয়ান হয়ে। প্রায় এপিকিউরাসের জন্মের সময়ের কাছাকাছি সাইপ্রাস দ্বীপে তিনি জনুগ্রহণ করেন। জেনাে, এপিকিউরাসের মতােই অ্যাথিনায় একটি স্কুল তৈরি করেন। বাজারের মাঝখানে এক জায়গায় তিনি তার স্কুল স্থাপন করেন। তার স্কুলের বারান্দা আর করিডাের ট্রোজান যুদ্ধের নানান দৃশ্যের আঁকা ছবি দিয়ে ভরা ছিল। একে বলা হতাে “স্টোয়া পইকিল” (ছবি আঁকা বারান্দা)। আর সেখানে জিনাের পড়ানাের পদ্ধতিকে বলা হতাে “স্টয়সিজম”। স্টয়সিজমেও একজন মাত্র দেবতার কথা বলা হয়। একেও তাই একরকমের একেশ্বরবাদ বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু আরও কিছু ছােটখাটো দেবদেবীর উপরেও যে স্বর্গীয় কিছু কিছু ক্ষমতার জন্য নির্ভরতা ছিল সেটা অবশ্য দেখা গেছে। কোনাে কোনাে মানুষকেও আবার দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করার কাহিনী শােনা যায়। এভাবেই হয়তাে তারা তাদের কট্টরপন্থী ধর্মীয় আচার আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক হতে চেয়েছিলেন। স্টয়সিজম মানুষকে দুঃখবেদনায় অহেতুক ডুবে থাকতে নিরুৎসাহিত করত। তবে বিষাদ থেকে উতরানাের জন্য ফুর্তি করে সময় কাটাতে কখনও বলেনি। কারণ মানুষ তার জন্য সঠিক আনন্দ খুঁজে পায় না; যদিও বা পায়, সেই আনন্দ কেবল মানুষের জন্য আরেকরকম ব্যথার সৃষ্টি করে। মানুষের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ফুরিয়ে গেলে সেই স্মৃতি নিয়ে সে কেবল হা-হুতাশ করে। ধনসম্পদ একসময় খরচ হয়ে যায়, স্বাস্থ্য নষ্ট হয় আর ভালােবাসা মরে যায়। তাই স্টয়সিজমে উদ্বুদ্ধ স্টয়িকরা নিজেদেরকে আনন্দ ও বেদনার উর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করত। নিজেদের এভাবেই তারা তৈরি করত যেন সুখ বা দুঃখের দাস না হয়ে পড়ে। সুখ-দুঃখের মােহ আর যন্ত্রণা থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। কেউ যদি কিছু আশা না করে তবে তার আশাহত হওয়ারও কোনাে ভয় বা দুশ্চিন্তা থাকে না। একজন মানুষের সব ধরনের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক সে নিজে। তাই তারা মনে করত মানুষ যদি নিজের প্রভু হয় তাহলে আর অন্য কারও দাস তাকে হতে হবে না। কেউ যদি এরকম আদর্শ একটি জীবনযাপন করে তবে দৈনন্দিন জীবনের অনিশ্চয়তা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আজকের দিনে ইংরেজি ভাষায় “স্টইক” শব্দটি “আনন্দ-বেদনার প্রতি নির্লিপ্ত” অর্থে ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিকভাবে এরকম একটি আদর্শ এপিকিউরিয়ানের মতাে অত বেশি জনপ্রিয় হলাে না। কিন্তু কিছু কিছু রােমানের কাছে মনে হলাে এটা রােমের প্রাচীন ধর্ম অনুযায়ী পরিশ্রমের প্রতি সৎ হওয়া, ভয়-ভীতির উর্ধ্বে উঠে যাওয়া, এসবের মতােই। তারা স্টয়সিজমের আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করল। সেই ভয়ংকর বিলাসে গা ভাসানাের দিনেও রােমের কিছু কিছু মানুষ স্টয়সিজমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল।
স্টয়িক সাহিত্যিক সেনেকা : সে সময়ের রােমান স্টয়িকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলেন সেনেকা (লিউসিয়াস অ্যানাউয়াস সেনেকা)। তিনি জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে স্পেনের করবা (বর্তমানে করডােভা) অঞ্চলে। তার বাবা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী আর তরুণ সেনেকাও আইন নিয়ে পড়াশােনা করেছিলেন। তিনি রােমে একটি স্টয়িক স্কুলে পড়েন আর একজন সুবক্তা হিসেবে এতই পরিচিত হন যে ক্যালিগুলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ক্যালিগুলার মৃত্যুর পরে সেনেকার সাথে ক্লডিয়াসের স্ত্রী মেসালিনার কিছু কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে সম্রাট ক্লডিয়াস ৪১ খ্রিস্টাব্দে তাকে রােম থেকে বহিষ্কার করেন। অবশ্য মেসালিনাকেও পরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ক্লডিয়াসের পরের স্ত্রী অ্যাগ্রিপিনা সেনেকাকে আবার সাম্রাজ্যে ডেকে নিয়ে আসেন তার ছােট ছেলে নিরােকে পড়ানাের জন্য। সেনেকা নিরােকে স্টয়িক মতে পরিচালনা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু হায়, সেই শিক্ষা নিরাের জীবনে কোনাে ছাপ ফেলতে পারেনি। সেনেকা স্টয়িক দর্শনের উপরে প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন। গ্রিক সাহিত্যিক ইউরিপিডিসের অনুকরণে তিনি গ্রিসের প্রাচীন কাহিনীগুলাে বহুবার লিখেছিলেন। কিন্তু পুরােপুরি স্টয়িক চিন্তাভাবনার না হয়ে সেগুলাে এত বেশি আবেগে পরিপূর্ণ আর ভালােবাসায় সিক্ত ছিল যে সেগুলােকে স্টয়িক লেখা হিসেবে পরেও তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সেসবই একমাত্র রােমান বিয়ােগান্তক কাহিনী যা আজ এই আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। তার নিজের সময়েও তিনি এত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন যে সহজেই নিরাের বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। নিরাে তার নিজের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। রােমানরা অনেকে যেমন মনে করত যে নিরাের বেশিরভাগ লেখা আসলে সেনেকা লিখে দেন, এই ভাবনাটা নিরােকে খুব বিরক্ত করে রাখত সারাক্ষণ। কিন্তু সত্যিই তিনি নিরাের নামে কিছু লেখা লিখেছিলেন। সেনেকাকে গৃহবন্দী হতে হয়েছিল। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ তুলে তাকে নিজের বাড়িতেই নির্বাসিত করা হয়। তারপর তাকে সে অবস্থায়ই আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়।
দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের চিন্তাধারা ও রহস্যবাদী ধর্ম : রােমের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা এপিকিউরিয়ানিজম অথবা স্টয়সিজম, কোনাে মতবাদের সাথেই নিজেদের একাত্ম করতে পারেনি বা করবে এমন আশা করা যায়নি। তাদের সম্পদের এবং অবসরের এতই অভাব ছিল যে তারা প্রকৃত এপিকিউরিয়ানস বা স্টয়িক কী করে হয়ে উঠবে তা ভাবার সুযোগ পায়নি। এছাড়া তাদের আর করারই বা কী ছিল। কারণ তাদেরকে সুখকে অবজ্ঞা করতে বলা হতাে নিতান্তই হাস্যকর। যাদের জীবনে ন্যূনতম আমােদপ্রমােদ অনুপস্থিত তাদেরকে সেটা অবজ্ঞা করতে বলার কোনাে মানে হয় না। তাদের জন্য সামান্য সান্তনাই ছিল যথেষ্ট। একজন দ্ররিদ্র মানুষ যতটুকু পর্যন্ত কল্পনা করতে পারে। তাদের জন্য এমন কোনাে পথের কল্পনাই যথেষ্ট ছিল যে পৃথিবীর এই দুর্বিষহ জীবনের পরে, মৃত্যুপরবর্তীকালে কেবলই শান্তি অপেক্ষা করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিসের রহস্যবাদী বা মিস্টিক ধর্মে, যেখানে শেষকৃত্যানুষ্ঠানও সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না, কেবল আয়ােজকরাই সেখানে অংশ নিতে পারত; এমনকি যারা সেখানে অংশগ্রহণ করত তারাও ফিরে এসে সেখানে কী হলাে না হলাে, সেসব কিছুই কাউকে বলতে পারত না। তাদেরকে একরকমের বােবা হয়ে যেতে হতাে। এখান থেকেই তাদের ধর্মের ব্যাপারে “মিসটিক রিলিজিয়ন” বা “রহস্যবাদী ধর্ম” কথাটি প্রচলিত হয়েছে। এখনও ইংরেজিতে এই অতীন্দ্রিয়তাকে গােপন, ব্যাখ্যার অতীত বা ব্যাখ্যার অযােগ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই ধরনের গােপন শেষকৃত্যানুষ্ঠান, তখন যেমনই হােক, খুব আবেগ আর গাম্ভীর্যের সাথে পালিত হতাে। উপস্থিত সবাই একই ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতাে। তারা আয়ােজকদের সাথে এক হয়ে মৃত্যুপরবর্তী নতুন জীবনে প্রবেশের শপথ নিত। এই কৃত্যানুষ্ঠান থেকে তারা তাদের জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হতাে। তারা অনুভব করত যে এখানে, এই পৃথিবীতেই তাদেরকে এক হতে হবে। এক হয়ে তারা শপথ গ্রহণ করত যে মৃত্যু তাদের পৃথক করতে পারবে না। তারা নিজেদের ভেতরে বিশ্বাস আনত যে এই পৃথিবী তাদের জন্য শেষ গন্তব্য নয়, এটি একটি রাস্তা মাত্র। তাদের জন্য মৃত্যুর পরে আরও ভালাে কিছু অপেক্ষা করছে। গ্রিক আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন বা অতীন্দ্রিয় বা রহস্যবাদী ধর্মগুলাের মধ্যে সবচেয়ে পুজনীয় ছিল এলিউসিনীয় রহস্যবাদ। এই ধর্মের কেন্দ্রে ছিল এলিউসিস। এটি ছিল এথেন্স শহর থেকে কয়েক মাইল উত্তরপশ্চিমে। গ্রিক প্রাচীন কাহিনী ডিমিটার ও পার্সিফোনের উপর নির্ভর করে এই ধর্ম গড়ে উঠেছিল। পার্সিফোন হেউডের লুক্কায়িত রাজ্যের আড়ালে ছিল বহুদিন। আবার তাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা হলাে। এই ধর্মের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, এই ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করত শরতের শস্যভরা ক্ষেতে কোনাে মানুষ মারা গেলে আবার বসন্তের কোনাে দিনে ফিরে আসবে। মূল কথা হলাে এই ধর্ম ভীষণ সম্মানজনক পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিল। আরেকটি রহস্যবাদী ধর্ম ছিল “অর্ফিক রহস্যবাদ”। এই ধর্মের প্রবক্তা ছিলেন অর্ফিউস, যিনি হেইডের একজন উত্তরাধিকারী। এই ধর্মের মাধমেই তিনি পরিচিত হন। গ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার পতনের পরেও তাদের এই প্রাচীন ধর্মগুলাে একই রকম গুরুত্ব নিয়ে পালন করা হতাে।
নিরো ও রহস্যবাদী ধর্ম : এলিউসিনিয়ান ধর্মের জনপ্রিয়তা এতই প্রবল ছিল যে খােদ সম্রাট নিরাে ৬৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসে সফরে এলে তিনি এই ধর্ম গ্রহণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু নিরাের সেই ইচ্ছাকে গ্রহণ করা হয় না। কারণ নিরােকে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হতাে। এই ক্ষমার অযােগ্য অপরাধ তাকে চিরদিনের জন্য সেই ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের অংশ হতে বাধা প্রদান করেছিল। এভাবে এই আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ধর্মের প্রতি মানুষ তার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিল। বিষয়টি ছিল, যারা এই ধর্মের নিয়মকানুন সৃষ্টি করেছে তারা কখনও কারও জন্য এই নিয়মের কাছে হার মানবে না। সে সম্রাট নিরােই হােক আর যে-ই হােক না কেন। অবশ্য অন্য সবকিছুতেও নিরােকে নিয়ে গ্রিসের মানুষেরা হাসাহাসি করত। কবিতা আবৃত্তি, সংগীত আর নাট্টাভিনয়ের বিশেষ প্রতিযােগিতার ব্যবস্থা তারা সবসময় করত সম্রাট নিরাের জন্য। আর সবসময় খেয়াল রাখত যে নিরাে যেন সেসব প্রতিযােগিতায় সর্বোচ্চ সম্মানের প্রাইজ পেতে পারে। ধর্মীয় নেতাদের পক্ষ থেকে এগুলাে ছিল নিরাের জন্য আরও বেশি সম্মান প্রদর্শন। কারণ নিরাে, যে কিনা নিজেকে কখনও নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে দেখা সহ্য করতে পারেন না, ধর্মে অংশগ্রহণের আবেদন খারিজ করাতে তার মনে ভয়ানক কোনাে কষ্ট যেন না আসে। গ্রিসের এসব আধ্যাত্মিক ধর্মই সেখানকার প্রাচীনতা আর উন্নতির চিহ্ন বহন করত।
হেলেনিস্টিক জগতের বাইরের ধর্মের প্রভাব :
- এশিয়া মাইনোরের দেবী সিবেলি : রােম সাম্রাজ্য তারপর পূর্বদিকে বর্ধিত হতে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে রােম একসময় পূর্বের আবেগী আর উৎসবের আমেজপূর্ণ ধর্মগুলাের সান্নিধ্যে আসে। সেগুলাের মধ্যে অনেকগুলােতে আবার সেই জন্ম-মৃত্যু আর পুনর্জন্মের বিশ্বাস আছে। দেখলে মনে হতাে সেগুলো গ্রিসের আধ্যাত্মিক ধর্মের সেই এক ঋতুতে মৃত্যুবরণ করে আরেক ঋতুতে জেগে ওঠার বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত। এশিয়া মাইনরের দিকে সিবেলি (Cybele) নামে দেবীর আরাধনা তখন খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। একে অনেকাংশে গ্রিক ডেমিটারের মতাে লাগত। সিবেলির আরাধনার আধিপত্য একসময় গ্রিস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০৪ সালে রােমানরা যখন কার্থেজীয় সেনাপ্রধান হানিবেলের বিপক্ষে তাদের দীর্ঘ যুদ্ধ লড়ছে, তখন তারাও সিবেলির কাছে প্রার্থনা করত। স্বর্গ থেকে সিবেলির হাত দিয়ে পৃথিবীতে গড়িয়ে পড়া একটি পবিত্র পাথর এশিয়া মাইনর থেকে রােমে বিশেষ উৎসবের মধ্যে দিয়ে বয়ে আনা হয়। প্রথম দিকে এই কথিত পবিত্র পাথর, তার সাথে উপস্থিত একগাদা ধর্মযাজক আর তাদের জড়িয়ে নানান উৎসবে রােমানরা একটু বিব্রত বােধ করে। কিন্তু শুরুর দিকের বছরগুলােতে সিবেলির পূজা বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল।
- মিশরের আইসিস, ও অসিরিস থেকে সেরাপিস : মিশরীয় দেবত্ববাদও একসময় রােমে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। গ্রিক সভ্যতার সময়ে মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেব আর দেবী ছিল অসিরিস আর আইসিস। অসিরিস দেবতা একবার মৃত্যুবরণ করে আবার পুনর্জন্ম লাভ করেন। তিনি নিজের আকৃতি পরিবর্তন করে একটি পবিত্র ষাঁড় এপিসের মাধ্যমে আবার পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন। গ্রিকদের কাছে অসিরিস-এপিস দেবতার নাম হলাে “সেরাপিস”। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে গ্রিসে সেরাপিসের পূজা খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। এক শতাব্দী পরে এই পূজার নিয়ম রােমে প্রবেশ করা শুরু করল। অগাস্টাস প্রাচীনপন্থী ছিলেন বলে এই পূজা বন্ধ করার আদেশ দিলেন। কিন্তু পরে ক্যালিগুলা একে উৎসাহ দান করেন। ডিমিটার, সিবেলি আর আইসিসের মতাে দেবীরা বিশেষ করে মহিলাদের কাছে ছাড়াও বাকি সকলের কাছেও বেশ সমাদৃত ছিল, বিশেষ করে যারা ভালােবাসা আর সহমর্মিতার প্রতি দুর্বল। দেবতারা বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধ আর রােষের। আর তাই যুদ্ধরত সেনারা করত দেবতার আরাধনা।
- পারস্যের মিথ্রাস : রােমান সাম্রাজ্যের পূর্ব দিক থেকে, পার্থিয়া অথবা পার্সিয়া (পারস্য) থেকে মিথ্রাস নামে এক স্বর্গীয় দেবতার আবির্ভাব হলাে। মিথ্রাস সূর্যের দেবতা ছিল। তার ছবিতে সবসময় দেখা যেত যে তিনি একটি ষাঁড়কে ছুরিবিদ্ধ করছেন। ছবিতে তিনি ছিলেন পূর্ণ তরুণ। আর তাই তার অনুসারীরা ষাড় বধ করে তার পূজার ব্যবস্থা করত। মহিলারা এই পূজায় অংশগ্রহণ করত না। কারণ মিথ্রাস ছিল শক্তি আর বীর্যের প্রতীক। মিথ্রাসের পূজা বেশিরভাগ করত সেনারা। টিবারিয়াসের শাসনামলে প্রথম রােমে মিথ্রাসের আগমন ঘটে।
খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব, তদকালীন বিকাশ এবং রোমে প্রতিক্রিয়া ও সংঘর্ষ
ইহুদিদের গ্রিক ভাষা গ্রহণ ও রোমে বসবাস : ইহুদি রাজ্য জুডিয়ার প্রথম ধর্মটি ছিল ইহুদি ধর্ম যেটি জুডিয়া থেকে ইহুদিদের মাধ্যমেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইহুদিরা রাজ্যের বিভিন্ন দিকে, বিশেষ করে পূর্বদিকে গিয়ে থাকা শুরু করল। রােমের ভেতরেও তাদের বিশাল এক কলােনি গড়ে তুলেছিল। একসময় এমন হলাে যে জুডিয়ার বাইরে অবস্থানরত ইহুদিদের সংখ্যাই জুডিয়ার চেয়ে বেড়ে গেল। তারা একসময় হিব্রু ভাষা ভুলে গিয়ে গ্রিক শেখা শুরু করল, কিন্তু তাই বলে তাদের ধর্ম ভুলে গেল না। তাদের পবিত্র বই বাইবেল গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল যেন তারা তা পড়তে পারে। কারণ খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ সালে এমন অনেক ইহুদি ছিল যারা তখন আর প্রাচীন হিব্রু ব্যবহার করে যােগাযােগ করতে পারত না। সে সময়ে এমনও ইহুদি ছিল যারা গ্রিক ভাষায় নিজেদের শিক্ষিত করে তুলেছিল কারণ যেন নিজেদের ধর্ম নিয়ে গ্রিকে তর্ক করতে পারে। তখন রােম অথবা গ্রিসে গ্রিকে কথা বলাই ছিল স্বাভাবিক। গ্রিক ভাষায় শিক্ষিত ইহুদিদের মধ্যে অসাধারণ ছিলেন ফিলাে জুডাইয়াস (ফিলাে দ্য জিউ)। ফিলাে জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ায়। পূর্ণবয়সে তিনি রােমে আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ক্যালিগুলার সাথে ইহুদিদের সমস্যা সমাধানই ছিল সেই আবেদনের উদ্দেশ্য।
রোমান সমাজে ইহুদিদের অবস্থা : স্বাধীন রাষ্ট্র থাকার শেষের দিকে আর সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যাওয়ার প্রথম দিকে রােমের অনেক অধিবাসীদের মধ্যেও ইহুদি ধর্ম কিছু পরিবর্তন এনেছিল। এমনকি সমাজের উঁচু অবস্থানে আছেন এমন অনেকেও ইহুদি ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ইহুদি ধর্ম যদি তাদের গোঁড়া মনােভাব থেকে কিছুটা ছাড় দিত তবে তা আরও দ্রুত ছড়িয়ে যেত। অন্যান্য ধর্মেও নানান ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছিলাে কিন্তু তাদের অনুসারীদের কখনও সম্রাটের ধর্মীয় বন্দনায় অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়নি। ইহুদিরা তাদের অনুসারীদের নিশ্চিত করত যে তারা সমাজের অন্যান্য ধর্মের সবচেয়ে নির্দোষ কোনাে অনুষ্ঠানেও যেন যােগদান না করে। সুতরাং রােমানদের মধ্যে কেউ যদি ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে চাইত তবে তাকে রাষ্ট্রের মূল ধর্ম প্রত্যাহার করতে হতাে। তারা বস্তুত সমাজ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হতাে আর অনেক সময় ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রতারণার দায়ে শাস্তি পেত। এত কিছুর পরে ইহুদিদের ধর্মপালন এতই কঠিন ছিল যে যদি কেউ ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তার ভেতরে থেকে শিক্ষা নিতে থাকে তাে তার পক্ষেই কেবল তা সঠিক ভাবে পালন করা সম্ভব। গ্রিক সভ্যতায় লালিত হয়ে এই ধর্মের কিছু অংশ পালন করা কারও জন্য খুব অযৌক্তিক আর বিব্রতকর হতে পারে। তারপর আবার কেউ যদি ইহুদি হতে চাইত তাে তাকে খত্না করার ব্যথাটা সহ্য করতে হতাে। শেষ পর্যন্ত ইহুদিদের প্রধান ধর্মীয় কার্যালয় হিসেবে জুডিয়াই টিকে রইল। বিষয়টি এমন ছিল যে জেরুজালেমের মন্দিরই সেই কেন্দ্র যেখানে তাদের বিধাতাকে পাওয়া যাবে। জুডিয়ায় ভয়াবহ বিদ্রোহ হওয়াতে ইহুদিরা, যারা ধর্মান্তরিত হতে চেয়েছিল তা আর হতে পারল না। ইহুদিরা তখন রােমের বড় শত্রু হয়ে উঠল। পুরাে রাজ্যের মধ্যে তারা তাদের জনপ্রিয়তা হারাল।
খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব : যাই হােক ইহুদি ধর্ম ততদিনে আর একটি মাত্র অভিন্ন ধর্ম নেই। সেখানে নানান দলাদলি হয়ে গেছে। কিছু কিছু দল আবার রােমেরই অন্যান্য ধর্মের মত কাজকর্ম করতে শুরু করে দিয়েছে। এদের মধ্যে একটি দল যিশুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গেল। যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার পরে মনে হয়েছিল যে তার অনুসারীরা তখনই যিশুর আদর্শ থেকে বেরিয়ে আসবে, অন্তত তার মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের কাছে এটুকু প্রমাণিত হবে যে তিনি কোনাে মাসিহা জাতীয় কিছু ছিলেন না। সে জন্যেই এত সহজে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাই হােক, ক্রুশে বিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পরে তাকে আবার দেখা গেছে বলে একটি গল্প চারদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। ধরে নেয়া হয়েছিল যে তিনি মৃত্যুর পরে আবার ফিরে এসেছেন। তিনি আসলে কোনাে সাধারণ মানব মাসিহা ছিলেন না, তিনি স্বয়ং রাজা যিনি ইহুদি রাজ্যে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। তিনি ছিলেন একজন স্বর্গীয় মাসিহা, ঈশ্বরের পুত্র। তার রাজ্য ছিল স্বর্গে আর তিনি শিগগির সেখানেই আবার ফেরত যাবেন (যদিও কেউ জানত না কবে)। তিনি সেখানে ফিরে যাবেন মানুষের পার্থিব জীবনের হিসাবনিকাশ করতে আর বিধাতার রাজ্যে নিজেকে আবার অধিষ্ঠিত করতে।
ইহুদিদের বিদ্রোহে খ্রিস্টানদের অনীহা ও জুডিয়ায় খ্রিস্টানদের জনপ্রিয়তা হারানো : খ্রিস্টানরা (এভাবেই যিশুর আদর্শে অনুপ্রাণিত মানুষ আর অনুসারীদের ডাকা হতাে) প্রাথমিকভাবে ইহুদি ধর্মে আর আচার আচরণেই বিশ্বাসী থাকল তারপর ধীরে ধীরে তারা সেখান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলাে। অনেক ইহুদি জুডিয়ার জাতীয়তাবাদে তীব্রভাবে বিশ্বাসী ছিল। যে মাসিহা তার অনুসারীদের কষ্টভােগের জন্য রেখে গিয়ে নিজে মৃত্যুবরণ করেন এমন কোনাে নেতা তারা চায়নি। তারা চেয়েছিল সাহসী, বীর কোনাে মাসিহা যিনি কিনা রােমের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে। এটা রােমের বিরুদ্ধে তাদের হঠাৎ করে জেগে ওঠার পেছনে এক ধরনের অনুপ্রেরণা ছিল। কিন্তু ইহুদিদের এই রোম-বিরোধী বিদ্রোহে খ্রিস্টানরা অংশগ্রহণ করেনি। তারা তাদের মনমতাে মাসিহা ততদিনে পেয়ে গেছে। তারা মনে করত, রােম রাজ্য আর কতদিন টিকবে? আর ইহজাগতিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রবর্তনের ব্যাপারে ঈশ্বরের যে পরিকল্পনার গল্প তারা শুনেছে তা ততদিনে মিথ্যে হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। খ্রিস্টানদের ধর্ম ছিল আক্রমণ বর্জিত। শত্রুকেও ভালােবাসতে শেখানাে হতাে। কেউ এক গালে আঘাত করলে তাকে আরেকটা গাল পেতে দেয়াই ছিল তাদের শিক্ষা। তাই সিজারের বিরুদ্ধে বা সিজারের অধীন কোনাে মানুষের বিরুদ্ধে লড়ার কোনাে তাগিদ তারা বােধ করেনি। এই ধরনের মনােভাব তাদের ইহুদি বিদ্রোহে অংশগ্রহণে বাধা দেয়। ইহুদি রাজ্যে বসবাস করে, নিজেদের স্বার্থে রােমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ না করার দায়ে তাদেরকে সবাই আলাদা চোখে দেখে। বিদ্রোহের পরে বেঁচে থাকা ইহুদিদের মাঝে তারা ব্যাপক হারে তাদের জনপ্রিয়তা হারায়। তাই সব ইহুদিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম আর ছড়িয়ে যেতে পারে না। সর্বোচ্চ সম্ভব চাপ দেয়া সত্ত্বেও, ইহুদিদের মধ্যে একজনও আজ পর্যন্ত যিশুকে তাদের মাসিহা হিসেবে মেনে নেয়নি।
পলের খ্রিস্টান হয়ে ওঠা ও তার সংস্কারসমূহ : কিন্তু ইহুদিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রচার হচ্ছে না বলে যে আর কোথাও হয়নি, তা নয়। ধর্মের এই প্রসারের জন্য খ্রিস্টানরা একজন প্রগতিশীল ইহুদির কাছেই ঋণী, যার নাম সাওল। ইহুদি রাজ্য ছাড়া বাইরে তিনি সাওল নামেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু রােমান উচ্চারণে তাকে বলা হতাে পল। এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ সমুদ্রতীর ঘেঁষে টারসাস নামের এক শহরে পল জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন রােমান নাগরিক। তাই জন্মসূত্রে তিনিও রােমান নাগরিক হয়ে যান। তিনি জেরুজালেমে ইহুদি শিক্ষায় শিক্ষিত হন। আর তাই তিনি হয়ে ওঠেন গোড়া ইহুদি। তিনি এতটাই গোঁড়া ছিলেন যে প্রথম প্রথম যখন খ্রিস্টানরা জেরুজালেমে তাদের ধর্ম প্রচার শুরু করেছিল তিনি তাদের “নাস্তিক” আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ব্যস্ত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে উঠতি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি ছিলেন প্রগতিশীলদের নেতা। খ্রিস্টানবিরােধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি দামাস্কাসে আন্দোলনের কার্যকলাপে অংশ নিতে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, দামাস্কাসের পথে যিশুর ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তিনি সবকিছু যিশুর চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেন। আর ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তিনি হয়ে যান একজন অতি ভক্ত খ্রিস্টান। ইহুদি ধর্মের বাইরে অন্যান্য মানুষকে পল প্রাণপণে খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা দিয়ে যেতে থাকেন। শিক্ষা দান করতে করতে তিনি অনুভব করেন যে ইহুদি ধর্মের অন্তর্নিহিত জটিল নিয়মকানুনগুলাে ধার্মিক থাকার জন্য জরুরি নয়। বরং অনেক বাড়তি নিয়মনীতি মানতে গিয়ে মানুষ এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ধর্মের মূল বিষয়টি থেকে সরে যায়। (বাইবেলের ভাষায় “ফর দ্য লেটার কিলেথ বাট দ্য স্পিরিট গিভেথ লাইফ”।) খ্রিস্টান হতে চাইলে একজন অন্য ধর্মের মানুষকে নতুন করে খত্না করতে হতাে না। আবার ইহুদিদের ধর্মের কঠোর অনুশাসন অনুযায়ী নানান নিয়মের আওতায় আসতে হতাে না। এমনকি নিজের স্বকীয়তা ইহুদি রাজ্যের জাতীয়তাবাদের কাছে বিকিয়ে দিতে হতাে না। এমনকি জেরুজালেমের মন্দিরের কাছে দায়বদ্ধ হওয়ার মতােও কোনাে ব্যাপার ছিল না।
এশিয়া মাইনোর, গ্রিস ও ইতালিতে খ্রিস্টধর্মের ছড়িয়ে পড়া : প্রায় হঠাৎ করেই খ্রিস্টধর্ম এশিয়া মাইনর আর গ্রিসের সব শহরগুলােতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এমনকি খােদ ইতালিতেও এই ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। যিশুর ক্রুশে বিদ্ধ হওয়া আর পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফিরে আসা, এই পুরাে বিষয়টি জড়িয়ে যাবতীয় কাহিনী আধ্যাত্মিক ধর্মটিকে বারবার আরও বেশি স্মৃতিবহ এবং ঈঙ্গিতপূর্ণ করে তুলেছে। যিশুর মা মেরির মােলায়েম মুখ এই ধর্মকে দিয়েছে আরও কোমলতা। ভেতরের নির্দিষ্ট ভাবধারাটি অনেকটা স্টয়িক আদর্শের সাথে মিলে যায়। মানুষের মনে হলাে, এই ধর্ম এমন, যে তৈরি হয়েছে সবাইকে একটু শান্তি দেবার জন্য। এটা তাে সত্যি যে, ইহুদি ধর্মে নিয়মকানুন নিয়ে যত কড়াকড়ি, খ্রিস্টধর্মে তা কখনােই ছিল না। খ্রিস্টধর্ম ইহুদিদের সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষদের মধ্যেই বেশি করে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যারা এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা বেশিরভাগ পৃথিবীর জনপ্রিয় ধর্মগুলাের কোনােটাই অনুসরণ করত না (পাইন কাস্টমস)। গ্রিক সভ্যতায় অভ্যস্ত অনেক মানুষও এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
স্থানীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা, মিথ্রেইজমের উৎসবের দিন ২৫শে ডিসম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে গ্রহণ : মিথ্রাইজম বা মিথ্রবাদ ছিল খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে বড় প্রতিযােগী ধর্ম। কয়েকশ বছরব্যাপী তারা ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পালন করছিল। মিথ্রেইজম এক ধরনের সূর্য উপাসনাকারী ধর্ম। আর ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে সূর্য নিরক্ষরেখার থেকে দূরবর্তী অবস্থানে চলে যায় বলে সেই দক্ষিণায়নের সময়ে তারা তাদের উৎসব পালন করত। দুপুর বেলা সূর্য নামতে নামতে দক্ষিণের শেষ প্রান্তে চলে যায় আর তারপর ধীরে ধীরে আবার উত্তর দিকে হেলতে থাকে। একেই মনে করা হতাে সূর্যের পুনর্জন্ম। এটাই যেন তাদের নিশ্চয়তা দিত যে এই প্রবল শীত মিলিয়ে যাবে আর সূর্য আবার নতুন বসন্তের দিন সাথে নিয়ে আসবে। সেই বসন্ত তাদের কাছে হবে নতুন জীবনের পরিচায়ক। বছরের এই সময়টা অন্য অনেক ধর্মের লােকেরাও পালন করত। প্রাচীন রােমের মানুষেরা এই সময় কৃষির দেবতাকে স্মরণ করত। দেবতার নাম ছিল স্যাটার্ন আর উৎসবটির নাম হলাে স্যাটার্নালিয়া। স্যাটার্নালিয়া ছিল পুরুষদের (এমনকি দাসেরাও সেই সময়ে সাময়িকভাবে একই আসনে বসার সুযােগ পেত) মনােবলের প্রতীক। এই উৎসবে তারা ভােজন আর উপহার বিতরণে ব্যস্ত থাকত। খ্রিস্টানরা ঋতুর উপরে নির্ভর করে সূর্যের এই পুনর্জন্মকে অবজ্ঞা করতে পারল না। এর বিরুদ্ধে না গিয়ে তারা একে গ্রহণ করল। এই নতুন উৎসবের কাছে তারা আবেগী হার মানল। বাইবেলে যেহেতু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, তাই তারা এমনিতেও জানত না যে যিশু কোন দিন জন্মেছিল। তারা ধরে নিলাে যে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্ম হয়েছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তারা বড়দিন হিসেবে তা পালন করছে। আর তাই তখন থেকেই খ্রিস্টমাস পালনের আচারের মধ্যে একটা স্যাটার্নালিয়ার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।
খ্রিস্টানদের প্রতি রোমে বিদ্বেষ ও হানাহানি : রােমানদের কাছে অন্তত যিশুর জন্মের অর্ধ শতাব্দী পরেও খ্রিস্টধর্ম ইহুদি ধর্মের একটি শাখামাত্র বলে মনে হতাে। আসলে তারা এই বিশেষ শাখাটির উপরে একটু বিরক্তই ছিল যেহেতু এই ধর্মে প্রবেশ করার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। যেহেতু খ্রিস্টানরা রােমের প্রকৃত দেবতাদের আরাধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিত না তাই তাদেরকে নাস্তিক মনে করা হতাে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহণ করছে না তাই তাদেরকে মনে করা হতাে রােমানদের জন্য বিপজ্জনক আর পরিত্যাজ্য। তখনকার দিনে রােমানদের মনােভাব খ্রিস্টানদের প্রতি এমন উগ্র ছিল ঠিক যেমন আমেরিকানদের কমিউনিস্টদের প্রতি। ৬৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই রেষারেষি এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যে রােমে ভয়ানক গণ্ডগােল লেগে গেল। ছয়দিনব্যাপী চলতে থাকা সেই হানাহানিতে রােম শহর প্রায় ধ্বংস হতে বসল। এরকম একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার সূত্রপাত যে কী করে হলাে তা আর কারও বুঝতে বাকি রইল না।
রোমে অগ্নিকাণ্ড ও নিরো : রােমের দরিদ্র মানুষেরা দুর্বল কতকগুলাে ভাঙাচোরা কাঠের তৈরি পাঁচিল বানিয়ে নিজেদের নিরাপদে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু তখনকার দিনে আজকের মতাে আগুন প্রতিরােধ করার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না, আবিষ্কারও হয়নি। তখন শহরের এক জায়গায় আগুন লাগলে দেখতে দেখতে পুরাে শহর অনায়াসে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। নিরাে ক্ষমতায় আসার আগে আর পরে শহরে বেশ কয়েকবার আগুন লেগেছিল। কিন্তু সেবারের ৬৪ খ্রিস্টাব্দের এই আগুনের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য। শহরে যখন আগুন লাগল, সম্রাট নিরাে তখন ছিলেন রােমের দক্ষিণে তিরিশ মাইল দূরে অ্যান্টিয়াম সমুদ্র বন্দরে (বর্তমানে অ্যানজিও)। রােমে আগুন লাগার খবর যখন নিরাের কাছে পৌঁছল তখন তিনি আগুন প্রতিহত করার জন্য যতরকম ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব তা করতে লাগলেন। যারা ততক্ষণে গৃহহীন হয়ে পড়েছে তাদেরকে সাময়িকভাবে নতুন জায়গায় ঠাঁই দিলেন। প্রকৃতপক্ষে লােকদেখানাে চাকচিক্য প্রদর্শন করার নেশা একসময় তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। হতবুদ্ধি হয়ে দিগন্ত রেখায় আগুনের হলকার দিকে তিনি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। চারদিকে আগুনের আগ্রাসন দেখে তার পুড়তে থাকা ট্রয়ের কথা মনে পড়েছিল। তিনি তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র (লাইর) হাতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। ট্রয়ের আগুনের সামনে সেই গান গাওয়া থেকে নিজেকে নিবৃত করতে পারেননি। এই দৃশ্য আজও মানুষ কথায় কথায় মনে করে যে রােম যখন পুড়ছিল, নিরাে তখন বেহালা (যদিও তার পরের কয়েক শতাব্দীতেও বেহালা আবিষ্কার হয়নি) বাজাচ্ছিলেন। যে কারণে আগুন লেগেছিল, তাকে প্রতিহত করতে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলাে। ধ্বংসের প্রাথমিক ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠা গেলে, বাসস্থানগুলাে নতুন করে তৈরি করা শুরু হলাে। এবারে ইমারতগুলাের উচ্চতা আরও বাড়িয়ে নেয়া হলাে আর নিচের তলাগুলােতে আগুন যেন না ধরে সেরকম অদাহ্য পদার্থের ব্যবহার শুরু হলাে। এটা রােমকে নতুন করে একটি আধুনিক নগরী হিসেবে ঢেলে সাজানাের একটা সুবর্ণ সুযােগ ছিল। কিন্তু মালিকেরা আগের মতাে করে যার যা ছিল তেমনই আবার বানাতে লাগলেন। সুতরাং রােম আবারও সেই আগের মতােই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠল। শুধু সম্রাট নিরাে নিজের জন্য একটি নতুন ইটে মােড়ানাে কংক্রিটের তৈরি চাকচিক্যময় প্রাসাদ বানানাের সুযােগ লুফে নিলেন। আগুন প্রতিরােধকারী পদার্থের তৈরি শক্তপােক্ত প্রাসাদটি পরবর্তীকালে যারা অনুকরণ করতে সমর্থ ছিল তাদের জন্য একটি আদর্শ ইমারত হয়ে উঠেছিল।
অগ্নিকাণ্ডের জন্য খ্রিস্টানদের দোষারোপ, তাদের শাস্তি এবং পল ও পিটারের মৃত্যুদণ্ড : রােমের মানুষেরা মনে করেছিল যে নিরাে নিজেই শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তাে শহরে তার শত্রু বেড়ে যাওয়ার খবর শুনে দিশেহারা হয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নিরাে বুদ্ধি খাটিয়ে তখন এই দোষটা খ্রিস্টানদের উপরে চাপিয়ে দিলাে। মানুষের রােষ আগে থেকে এমনিতেই তাদের দিকে ছিল। তাই এভাবেই প্রথম তাদের আনুষ্ঠানিক বিচার আচার শুরু হলাে। তাদের একে একে হত্যা করা হলাে। তাদের কাউকে কাউকে নিরস্ত্র অবস্থায় সিংহের খাঁচায় ঠেলে দেয়া হলাে। অন্যদের জন্যও নানান ভয়ংকর মৃত্যু নিশ্চিত করা হলাে। খ্রিস্টানদের নিয়ম অনুযায়ী তাদের নেতা পল তখন রােমেই ছিলেন। আরেক নেতা পিটারও ছিলেন। অনুসারীরাও প্রায় সবাই সেখানে ছিলেন। (পিটারকে রােমের প্রথম বিশপ হিসেবে নির্বাচন করা হয় তাই তিনিই রােমের প্রথম পােপ ঘোষিত হন।) পল এবং পিটার দুজনকেই ধর্মের কারণে ভয়ানক মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাদের দুজনের জন্য বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থা এত কঠোর হয়েছিল যে এমনকি খ্রিস্টান নয় এমন মানুষও তাদের জন্য প্রার্থনা করেছিল। রােমের সাধারণ মানুষদের পক্ষ থেকে তাদের শাস্তি মওকুফের আবেদন উচ্চারিত হয়েছিল। এই ধরনের ভয়াবহ পরিণতি পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্মের জন্য কুফলের বদলে সুফল বয়ে আনে। এই ঘটনার সূত্র ধরেই খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার অরম্ভ হয়।
নিরাের সমাপ্তি
নিরোর বিরুদ্ধে ব্যর্থ ষড়যন্ত্র ও এর ফল হিসেবে সিনেটর ও জেনারেলদের মৃত্যু : পূর্বের সব সম্রাটের মতােই নিরােও রােমের অভিজাত শ্রেণিকে সন্দেহ করতেন আর ভয়ও পেতেন। তিনি সবসময়ই ভয় পেতেন যে সিনেটররা রােমের আগের সমৃদ্ধ দিনগুলাের সাথে তুলনা করে তার আমলের সমালােচনা করবে। তাই তিনি সবসময় তাদের প্রতি কড়া নজর রাখতেন আর তাদের গতিবিধি সতর্কভাবে অনুসরণ করতেন। নিরাের শত্রুতামূলক আচরণই সিনেটের সদস্যদের বারবার বর্তমানের বিশ্রী সময়ের চাপে অতীতের গৌরবময় সময়ের স্মৃতিচারণে বাধ্য করত। এক পর্যায়ে তারা সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে চেষ্টা করতে বাধ্য হলাে। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সত্যি সত্যি নিরাের বিরুদ্ধে একটি গােপন ষড়যন্ত্র দাঁড়িয়ে গেল। সিনেটের সদস্যরা নিরােকে সরিয়ে দিয়ে সে জায়গায় সিনেটর গেইয়াস ক্যালপুর্নিয়াস পিসোকে বসানাের জন্য পায়তারা শুরু করল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ষড়যন্ত্রকারীরা কাজের সুফল দেখতে পেল না। ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হওয়ার আগেই একজনের মাধ্যমে সংবাদটি নিরাের কানে পৌঁছে গেল। সেনেকা এবং পেট্রোনিয়াসকে সে সময় ষড়যন্ত্রের দায়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হলাে। তার কিছুদিন পরে পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে জয়লাভকারী সেনাপ্রধান করবুলুকেও আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসান করতে হলাে। করবুলুর হত্যাকাণ্ড হয়তােবা সেনাবাহিনী কিংবা সেনাপ্রধানদের মধ্যে তেমন কোনাে ছাপ ফেলত না। দু-চারজন সিনেটর আর অভিজাত লােকের মৃত্যুও হয়তাে তেমন কোনাে বড় বিষয় হতাে না। কিন্তু যখন একে একে অনেক সেনাপ্রধান আর সিনেটর মারা পড়তে লাগল তখন বিষয়টি খুব জটিল হয়ে পড়ল।
নিরোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তার মৃত্যু : অন্যদিকে তখন জুডিয়ায় ইহুদিদের বিদ্রোহ রােমের আবহাওয়া আরও ভারী করে তুলেছিল। কয়েকজন দুর্গত ইহুদি কৃষক রােমান সেনাবাহিনীর মূল অংশকে অকার্যকর করতে সমর্থ হয়েছিল। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল এসব অরাজকতার জন্য তখন সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়াই সবচেয়ে সহজ। এটা আরও সহজ হয়েছিল যখন একদিকে সেনারা ক্রমাগত মৃত্যুবরণ করছে আর আরেকদিকে নিরাে সেসব উপেক্ষা করে গ্রিসে গেছেন সম্রাট হিসেবে নিজের বন্দনা অনুষ্ঠানে যােগ দিতে। (তখনই যেন সেই “রােম পুড়ছে আর নিরাে বেহালা বাজাচ্ছে” কথার যথার্থ প্রয়ােগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল)। সেই সময় গ্রিসে বিভিন্ন প্রতিযােগিতামূলক খেলায় নিরাের পরাজয়ও ছিল খুব লজ্জাজনক। যারা তখনও মনে করতেন যে রােমের সম্রাটকে হতে হবে একজন বিজয়ী যােদ্ধা, কোনােমতেই কেবল একজন অভিনেতা বা শিল্পী নয়, তারা খুব হতাশ হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় কার্যরত বড় বড় সেনাবাহিনীরা বিদ্রোহ শুরু করল। তারা তাদের নিজ নিজ সেনাপ্রধানকে সম্রাটের আসনে বসাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ৬৮ সালে (রােমান ৮২১ সাল) নিরাে তাড়াহুড়াে করে ইতালিতে ফিরে আসেন। কিন্তু ততদিনে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। স্পেনে অবস্থানকারী সেনাবাহিনী তাদের সেনাপ্রধান সার্ভিয়াস গালবাকে সম্রাট বানাতে বদ্ধপরিকর হয়ে গিয়েছিল। প্রিতােরিয়ান গার্ডেরা তাকে সম্রাট হিসেবে মেনে নিলাে আর নিরােকে দেশের শত্রু ঘােষণা দিয়ে দিলাে। নিরোর সামনে তখন বিচারের সম্মুখীন হওয়া আর নিজেকে ফাঁসির দড়িতে ঝােলানাে ছাড়া আর কোনাে পথ খােলা ছিল না। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভােগার পরে নিরাে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধারালাে তলােয়ারে বিদ্ধ করেন। তলােয়ারের ফলা শরীরে প্রবেশের পরপর নিরাে চিৎকার করে বলছিলেন (প্রচলিত কাহিনী অনুসারে), “তােমরা দেখ, আমার ভেতরে কী ভীষণ এক শিল্পীর মৃত্যু হলাে!” মৃত্যুর সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র একত্রিশ।
সিজারের শেষ বংশধর নিরো, সিজারের নামের লেগেসি : নিরােই ছিলেন শেষ সম্রাট যিনি অগাস্টাসের বংশধর। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সাল থেকে যদি আমরা ধরি, তাহলে দেখা যায়, জুলিয়াস সিজার যখন পম্পেইকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তারপর থেকে ওই জুলিও ক্লডিয়ান পরিবার রােমকে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছিল। এই বংশটি একজন স্বৈরশাসকসহ পাঁচ পাঁচজন সম্রাট দিতে পেরেছিল রােমকে। নিরাের মৃত্যু জুলিও ক্লডিয়ান পরিবারের আধিপত্য পুরােপুরি ধ্বংস করে দিতে পারেনি। তার পরে প্রায় ডজনখানেক সম্রাট এসেছিলেন যাদের শরীরে এক বিন্দুও সিজার বা অগাস্টাসের পারিবারিক রক্ত ছিল না কিন্তু তারা প্রত্যেকে সজ্ঞানে জুলিও-ক্লডিয়ান পরিবারের পারিবারিক নাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে “সিজার” শব্দটি “সম্রাট” শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। আধুনিক যুগে জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরির সম্রাটদের “কেইসার” বলে ডাকা হতাে। এটা আসলে জার্মান ভাষায় (আর সঠিক উচ্চারণে) ল্যাটিন “সিজার”। রুশ শব্দ Tsar আর Czar, দুটোই এসেছে ল্যাটিন “সিজার” থেকে। ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে বুলগেরিয়ার শাসক ছিলেন দ্বিতীয় জার (Tsar) দ্বিতীয় সেমিওন আর ১৯৪৭ সালে ইন্ডিয়ায় একজন ব্রিটিশ সম্রাট ছিলেন যার নামের উপাধি ছিল “কেইসার-ই-হিন্দ” (Keisar-e-Hind)। সুতরাং জুলিয়াস সিজারকে বন্দী করে হত্যা করার পরে আরও দুই হাজার বছরব্যাপী পৃথিবীতে শাসকশ্রেণির মধ্যে তার নাম সম্মানের সাথে টিকেছিল।
ভেস্পাসিয়ানের বংশ বা ফ্লেভিয়ান রাজবংশ (৬৮ – ৯৬ খ্রি.)
চার সম্রাটের বছর (রা. ৬৮ – ৬৯ খ্রি.) এবং সম্রাট ভেম্পাসিয়ান (রা. ৬৯ – ৭৯ খ্রি.)
এক বছরেই গ্যালবা, অথো ও ভিটেলিয়াসের পতনের পর সিংহাসনে ভেস্পাসিয়ান :
- ক্ষমতায় গ্যালবা : নিরাের ক্ষমতার সমাপ্তি রােমের ইতিহাসে একটি ভয়ানক অধ্যায়। এই পতন রােমের সাধারণ মানুষের সামনে এটাই প্রমাণ করে যে রােমের শাসন শুধু একটি অভিজাত পরিবারের হাতে বন্দী নয়। এই ক্ষমতা অন্য মানুষের হাতেও চলে যেতে পারে। যে কোনাে যােগ্য ব্যক্তি অথবা বিশেষ করে সেনাপ্রধানদের হাতে চলে যেতে পারে। সেনাবাহিনীরা এই শিক্ষা শিরােধার্য হিসেবে গ্রহণ করল। কিন্তু গ্যালবার বিষয়ে একটা সমস্যা ছিল যে তিনি ছিলেন একজন সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ। সেনাপ্রধানকে সরকারপ্রধান বানানাের প্রথম পছন্দ হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই দুর্বল। বয়সের ভারে তিনি কুঁজো হয়ে গিয়েছিলেন আর মাঝে মধ্যে তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ধরাধরি করে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হতাে। তার ওপরে তিনি আবার কিছুটা কৃচ্ছতা সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হিসেবী হয়ে যাওয়া হয়তাে কখনও কখনও ভালােই কিন্তু একজন নতুন অভিষিক্ত সম্রাটের কাছে সেনাদের কিছু আব্দার থাকে। তারা আশা করে রেখেছিল যে সম্রাট হয়ে তিনি তাদের বােনাস বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু তার আগেই এর ঠিক উল্টো সিদ্ধান্ত নেয়াটা গ্যালবার জন্য আত্মহত্যার মতােই একটি পদক্ষেপ হয়েছিল।
- অথোর সিংহাসনে আরোহন : অন্য সেনাবাহিনীরাও তাদের নিজ নিজ প্রধানকে সরকার প্রধান হিসেবে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মার্কাস সালভিয়াস অথো ছিলেন গ্যালবার অধীনে একজন সেনা। তিনি সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে একটি বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নেন। কারণ গ্যালবা নিজের উত্তরসূরী হিসেবে তাকে ছাড়া অন্য আরেকজনের কথা ভাবছিল। প্রিতােরিয়ান গার্ডদেরও সমর্থন পান অথো। কারণ আশাপ্রদ বােনাস কেটে নেয়ার জন্য তারা এমনিতেই গ্যালবার উপরে ক্ষেপে ছিল। মাত্র সাত মাস রাজত্ব করার পরে গ্যালবা নিহত হন। অথােকে সিনেটের সদস্যরা (যাদের অন্য কিছু করার ছিলও না) মেনে নিলাে। যদিও সিনেট তাকে সমর্থন করল কিন্তু সেনাবহিনীর একটি অংশ তাকে কিছুতেই মেনে নিলাে না। তাই মাত্র তিন মাসের মাথায় তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলাে।
- ভিটেলিয়াসের সিংহাসনে আরোহন : জার্মানির সেনাপ্রধান আউলুস ভিটেলিয়াস ছিলেন সেই মানুষ যিনি গ্যালবার জায়গায় সেনাপ্রধান হিসেবে যােগদান করেছিলেন। সেই সেনাবহিনীর কাছে যখন গ্যালবার মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছাল তখন সাথে সাথে সেনারা অথােকে সম্রাট হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালাে। তারা ভিটেলিয়াসকে সম্রাট হিসেবে দেখতে চাইল। তারা ইতালির দিকে যাত্রা শুরু করল। যুদ্ধে তারা অথোর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করল। অথাে আত্মহত্যায় বাধ্য হলে তারা ভিটেলিয়াসকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করল। তখন সিনেটের মত না পাওয়ার আর কোনাে কারণ ছিল না।
- ভেস্পাসিয়ানের সিংহাসনে আরোহন : এরই মধ্যে ভেস্পাসিয়ান, যে সেনাপ্রধান কিনা ধীরে ধীরে ইহুদিদের বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়েছিলেন, নিজেও সম্রাটের আসনে বসার স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি মিশর দখল করেছিলেন যেটা ছিল রােমান সাম্রাজ্যের শস্যক্ষেত্র। এই দখল তাকে রােমে খাদ্য সরবরাহের উপরে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়েছিল। তিনি ইতালিতে প্রবেশ করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ভিটেলিয়াসের বাহিনীকে পরাজিত করেন। মাত্র আধা বছর শাসন করার পরে ভিটেলিয়াসকে হত্যা করা হয়। ৬৯ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ৮২২ সালে) ভেস্পাসিয়ান সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত হন। যে বছর ভেস্পাসিয়ান সম্রাটের আসনে বসেছিলেন তখন এক বছরের সামান্য কিছু বেশি সময়ে রােম পরপর চার জন সম্রাটকে পেয়েছিল। ৬৮ থেকে ৬৯ সালের ওই সময়টিকে তাই বলা হয় “চার সম্রাটের বছর”। নিজস্ব জাতির মধ্যে ভেম্পাসিয়ানের নাম ছিল ফ্লেভিয়াস। তাই রােমান সম্রাটদের মধ্যে তিনি ফ্লেভিয়াস বংশের প্রবক্তা।
নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন : ভেস্পাসিয়ানও গ্যালবার মতাে অনেক বেশি বয়সে সম্রাট হয়েছিলেন। ক্ষমতায় বসার সময়ে তার বয়স ছিল ৬১। কিন্তু গ্যালবার মতাে অসুস্থ নয়, বরং তিনি ছিলেন মানসিক এবং শারীরিকভাবে বেশ শক্ত সমর্থ । তিনি সেনাবাহিনীর উপরে একছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করলেন যেন তাদেরকে সবসময় তার সমর্থনে পাওয়া যায়। যাই হােক, তিনি নিজেকে অগাস্টাসের অনুসারী বলেই ভাবতেন। তাই রােমের সেই আগের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রােমে বসে দূরবর্তী রিপাবলিক দেশগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করা, তিনি অব্যহত রাখলেন। তবে তার প্রথম কাজ ছিল নতুন কিছু নিয়মের প্রবর্তন করা। নিরাে আর ক্যালিগুলার মতাে বিলাসী দুজন সম্রাটের হস্তক্ষেপে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন ভয়াবহ হুমকির মুখে ছিল। ভেস্পাসিয়ান তাই তখন দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানাের চেষ্টা করছিলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি করের ক্ষেত্রে কিছু পবিবর্তন আনলেন। দেশের অর্থনীতি কঠোর একটা অবস্থানে এলাে তখন। ভেস্পাসিয়ান নিজে ছিলেন একজন সাধারণ, নিরাভরণ মানুষ। তাই রাষ্ট্রকেও সাধারণভাবে সাজাতে চাচ্ছিলেন। তিনি যে খুবই সাধারণ একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন, এ নিয়ে তার কোনাে দুঃখবােধ বা লজ্জা ছিল না। (তিনিই ছিলেন রােমের প্রথম সম্রাট যিনি অভিজাত কোনাে পরিবার থেকে আসেননি।) তবে সিনেটের যেসব ঐতিহাসিকরা নিরােকে বিলাসী আখ্যা দিয়েছিলেন তারাই ভেস্পসিয়ানকে কৃপণ বলতে ছাড়েননি। কিন্তু ভেস্পসিয়ানের এই হিসেবী স্বভাব রােমের জন্য সুদিন বয়ে এনেছিল। কারণ সেই সময়টা বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভেস্পাসিয়ানের তদারকিতে রােমের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন হয়েছিল।
সেনাবাহিনীর সংস্কার ও এর ইতিবাচক ফল : ভেস্পাসিয়ান সেনাবাহিনীকেই একটি নতুন চেহারা দেয়ার চেষ্টা করতেন। তার সিংহাসনে বসার আগে যেসব সেনাবাহিনী কিছুটা বিশৃঙ্খল ছিল তাদের তিনি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসেন। সেনাবাহিনীকে পুনরায় শৃঙ্খলাবদ্ধ করা সে সময়ে জরুরি প্রয়ােজন ছিল। কারণ অগাস্টাসের আমলের পর থেকেই সেনাবাহিনী একটু একটু করে নিয়মনীতি থেকে সরে যাচ্ছিল। ভেস্পাসিয়ানের সময়ের আগে আগে তাদের ইতালিয় জাতীয়তাবাদ থেকে সরে যেতে দেখা গেছে। এর কারণ অবশ্য একটু মাথা ঘামালেই বােঝা যায়। তিনি রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশগুলাের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চাচ্ছিলেন। তারা যেসব অংশে কার্যকলাপ চালাচ্ছিলেন সেখানে তাদের কী করে আরও বেশি সংগঠিত হতে হবে, এ বিষয়ে ভেস্পাসিয়ান নতুন নীতিমালা তৈরি করলেন। গাউলস, প্যানােনিয়াস আর থ্রেসিয়ানস সেনাদের মধ্যে পালাক্রমে কাজ করার নিয়ম তৈরি করাতে তারা স্বস্তি পেয়েছিল। সুনাগরিক হিসেবে মাঝে মধ্যে তাদের পুরস্কৃতও করা হতাে। সুতরাং এইসব নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অনেক সুফল পাওয়া গিয়েছিল। রাজ্যের দূরবর্তী অংশগুলাের সাথে কেন্দ্রের সংযােগটি দৃঢ় হলাে। এর ফলে রােমান সংস্কৃতি আরও দ্রুত বিস্তার লাভ করল। ল্যাটিন ভাষা আর গ্রিক-রােমান সংস্কৃতির মিশ্রণ ইউরােপের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
অ-ইতালীয় সেনাদের ইন্টিগ্রেশন সমস্যা : কিন্তু এভাবে প্রতিটি অঞ্চলের সেনাবাহিনীকে সেই অঞ্চলের উপযুক্ত করে তােলায় কিছু বিপত্তিও দেখা দিলাে। গাউলের একজন মানুষ হয়তাে ল্যাটিন বলতে শিখতে পারে, রােমান দেশি কাপড়, তােগা পরতে পারে, আবার গ্রিক বা ল্যাটিন সভ্যতার সাহিত্যও পড়তে পারে কিন্তু কিছুতেই রােমের ইতিহাস বা ঐতিহ্যের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারে না। যার নিজের পূর্বপুরুষ বলতে রােমে কেউ নেই কিংবা প্রকৃতপক্ষে নিজের পূর্বপুরুষকে সে নিজেই হত্যা করে তাদের জায়গা জমি সব খুইয়েছে, এরকম একজনের পক্ষে রােমের আদি বাসিন্দাদের সাথে একাত্ম হওয়া সম্ভব নয়। সে যদি কেবল একজন সেনা হয় তবে সে বড়জোর তার সেনাপ্রধানের কাছে বিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করে। নিজের জায়গা থেকে একটা দূরবর্তী শহরে থেকে তার আর কী করার আছে! সে সিনেটের লােকজনকেও ঠিকমতাে চেনে না। তার কমান্ডার যদি তাকে নিজের শহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার আদেশ দেন তবে সে তা-ই করতে বাধ্য থাকে। এরকম অদ্ভুত ব্যাপার একবার প্রমাণিত হলাে। ৬৯ সালে যখন স্পেন, গাউল আর সিরিয়া থেকে সেনাবাহিনী রােমের দিকে একযােগে আসতে লাগল, সবাই তাদের নিজ নিজ সেনাপ্রধানের জন্য লড়তে আসছিল। এছাড়া তাদের অন্য কোনাে জাতীয়তাবােধ ছিল না। ভেস্পসিয়ানও এই অবস্থার কোনাে পরিবর্তন করতে পারেননি। সেনাবাহিনীগুলাে ইতালির লােকদের দিয়ে ভরে দেবার ক্ষমতা তার ছিল না। আর তাছাড়া হাজার হাজার সেনার বাহিনীতে কেবল ইতালিয়দের নিয়ে গঠন করার মতাে কোনাে ঘটনা ঘটতই না। কারণ তত বেশি ইতালিয় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিলনা। তাই বিভাগীয় পর্যায়ে আঞ্চলিক লােকজনকে দিয়ে যুদ্ধ চালাননাই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। প্রিতােরিয়ান গার্ডেরা ছিল কেবল ইতালিকেন্দ্রিক। তারা ছিল কেবল রােমের স্থানীয় গুরুতর সমস্যা সামলানাের দায়িত্বে নিয়ােজিত এই দলটির প্রতিটি সদস্য ইতালিয় হতে বাধ্য ছিল। ভেস্পাসিয়ান তার নিজের ছেলে টাইটাসকে এই দলের প্রধান করে দিয়েছিলেন। তাদের নিজেদের দায়িত্বের প্রতি আরও সচেতন করতেই ভেস্পসিয়ান এটা করেছিলেন।
সিনেটে ও কর্মসংস্থানে পরিবর্তন : ভেম্পাসিয়ান সিনেটেও কিছু রদবদল করেছিলেন। অপ্রয়ােজনীয় কিছু সদস্যকে হেঁটে ফেলে নতুন দক্ষ মানুষকে যােগ দিতে সুযােগ করে দিয়েছিলেন। তারপর তাদেরকে সতর্কতার সাথে সরকারি সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিলেন। খরচের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে যথেষ্ট কাজ করেছিলেন। শহরের উন্নতি সাধনে জায়গায় জায়গায় তিনি স্থানীয় রােমানদের কাজ দিয়েছিলেন। এতে তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান হয়েছিল আর পুরাে শহরটির চেহারা গিয়েছিল বদলে।
বিদ্রোহ দমন, আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ও শত্রুদের নিরুৎসাহিতকরণ : নিরাের হঠকারিতা আর আত্মমগ্নতার কারণে তারা এই পদটির উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। ভেস্পাসিয়ানের সুযােগ্য নেতৃত্বে সম্রাটের প্রতি রােমের মানুষের আস্থা ফিরে এলাে। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ও বাইরে সকল ক্ষেত্রেই তিনি সাফল্য নিয়ে আসেন, যেমন –
- গাউল ও জেরুজালেমে বিদ্রোহ দমন : গাউলে কিছু ছােটখাটো বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল সে সময়ে। আর টাইটাস জুডিয়ায় ঝটিকা হামলা চালিয়ে জেরুজালেম দখল করে ফেলেছিলেন। টাইটাস রােমে ফেরত এসেছিলেন ৭১ সালে। টাইটান জুডিয়ার বিদ্রোহ দমন করে সেখানকার দখল নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। এই বিজয় ছিল রােমান সাম্রাজ্যের জন্য বিশাল ঘটনা। এই বিজয়ের কৃতিত্ব ছিল তাদের পিতা-পুত্রের। তখন থেকেই এই নতুন বংশের শাসন কাজের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে।
- পূর্ব দিকে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও নিরুৎসাহিত পার্থিয়া : ভেম্পাসিয়ান পূর্বদিকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব দখল করেছিলেন। সেদিকের এশিয়া মাইনরের স্বাধীন অঞ্চলগুলাে দখল করে রােমের বিভাগ হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সিরিয়ার বিভাগ পূর্বদিকে বাড়তে বাড়তে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র পালমিরাকে পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। সেদিকে রােমের জন্য ছিল ব্যাপক সম্ভাবনা। আর তাই পার্থিয়ানরা তাদের শক্তিকে খাটো করে দেখার সাহস পায়নি। রোমে ৬৮ সালে যে অরাজকতা শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে একটা যুদ্ধ লেগে যেতে পারত। কিন্তু পার্থিয়া তখন রােমের ভয়ংকর শক্তির আন্দাজ পেয়েছিল বলে একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিল।
- ব্রিটেইন দখলের উদ্যোগ ও নতুন পরিকল্পনা : নিরাের আমলে ব্রিটেন হামলার সময়ে রােমে যে আগুন লেগেছিল সে ক্ষয়ক্ষতি ৭৭ খ্রিস্টাব্দে পুরােপুরি পুষিয়ে নতুন করে গড়ার কাজ শেষ হয়। নেইয়াস জুরিয়াস অ্যাগ্রিকোলা নামে একজন কাজপাগল জেনারেলের তত্ত্বাবধানে ওয়েলসে হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়া হয়। তারপর ৭৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তর দিকে আরও অগ্রসর হয়ে আধুনিক অ্যাবার্ডিন পর্যন্ত তারা দখল করে নেয়। রােমের একটি যুদ্ধজাহাজের বহর স্কটল্যান্ডের উত্তর তীর ঘেঁষে মহড়া দিতে থাকে আর আয়ারল্যান্ড দখলের পরিকল্পনা করে। অ্যাগ্রিকোলার বিশেষ চেষ্টায় ব্রিটেনের দখলকৃত অংশে দ্রুত রােমান সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে।
ভেস্পাসিয়ানের মৃত্যু : কিন্তু ব্রিটেনের পুরােটা রােম সাম্রাজ্যের দখলে আসতে না আসতেই ভেম্পাসিয়ানের সময় ফুরিয়ে আসে। তিনি জানতেন যে তিনি মারা যাচ্ছেন। মৃত সম্রাটের প্রতি দেবতার সম্মান প্রদর্শনের রােমান আইনের দিকে কটাক্ষ করে তিনি হতাশ হয়ে বলেন,“আমি বুঝতে পারছি যে আমি একজন দেবতায় পরিণত হতে যাচ্ছি।” জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে তিনি আশেপাশের লােকজনকে ডেকে বলেছিলেন তাকে ধরে ধরে দাঁড় করিয়ে দিতে। বলেছিলেন, “দাড়িয়ে থাকতে থাকতেই একজন সম্রাটের মৃত্যু হওয়া উচিত।” ৭৯ খ্রিস্টাব্দে রােমান ৮৩২ সালে) যখন তিনি মারা যান, তখন তিনি সত্যি সত্যিই রােমের শাসন ব্যবস্থা আর সাম্রাজ্যের অবস্থা তুঙ্গে তুলে ধরে তারপর মৃত্যুবরণ করেন। নিরাের সময়ে রােমের যে ভয়ানক ক্ষতি হয়েছিল, ভেস্পসিয়ান তার দশ বছরের শাসনামলে তা পুষিয়ে এনেছিলেন।
টাইটাস (রা. ৭৯ – ৮১ খ্রি.)
টাইটাসের ক্ষমতায় আরোহন ও একজন আদর্শ সম্রাট হিসেবে টাইটাস : কোনােরকম বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই টাইটাস তার বাবার আসনে অধিষ্ঠিত হন। ভেস্পাসিয়ান প্রথম থেকেই উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তাই নিজের ছেলেকে নিয়ে সরকার পরিচালনার কাজ করতেন। সম্রাটের আপন ছেলে উত্তরাধিকারী হওয়ার ব্যাপারে এটাই ছিল রােম সাম্রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম উদাহরণ। টাইটাস এমনিতেই চমৎকার জীবনযাপন করতেন। আর সিংহাসনে আসীন হবার পরে তিনি আরও বেশি অমায়িক আর প্রজাকাতরতা দেখিয়ে মানুষের মন জয় করে নিলেন। সিংহাসনে বসে তিনি আরও কঠোর পরিশ্রমী হয়ে গেলেন। রােমের অধিবাসীরা সম্রাট হিসেবে তার একটিমাত্র দোষের কথা উল্লেখ করতে পারে। তা হলাে তিনি ইহুদি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছেন। জুডিয়ায় যুদ্ধ চলাকালিন টাইটাস হেরােড দ্বিতীয় অ্যাগ্রিপার বােন বেরেনিসের সংস্পর্শে আসেন। তারা দুজন দুজনের প্রতি আসক্ত হন। যুদ্ধ জয়ের পরে টাইটাস যখন রােমে ফিরে আসছিলেন তখন সিদ্ধান্ত নেন যে বেরেনিসকে সাথে নিয়ে যাবেন আর তাকে বিয়ে করবেন। রােমের অধিবাসীরা এই অসম বিবাহ কিছুতেই মেনে নিতে রাজি হয়নি। তাদের অবিবেচকের মতাে মতের কারণে টাইটাস তাকে সাথে নিয়ে এলেও আবার জুডিয়ায় ফেরত পাঠাতে বাধ্য হন। টাইটাসের শাসনামল ব্রিটেন রােমের প্রচারণা চালানাে ছাড়া মােটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। তার বিরুদ্ধে কোনাে পক্ষপাতিত্বের অভিযােগ না এনে বলা যায় যে তিনি ছিলেন একবারে আদর্শ একজন সম্রাট। কিন্তু দুভার্গজনকভাবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র দুই বছর। ৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৪০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ভিসুভিয়াসের লাভায় বিধ্বস্ত পম্পেই : তার ক্ষণস্থায়ী রাজত্ব রােমের ইতিহাসে একটি আকস্মিক বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নেপলসের কাছাকাছি একটি পর্বত আছে যার নাম ভিসুভিয়াস। জ্ঞানী ব্যক্তিরা একে আগ্নেয়গিরি বলে মনে করতেন। কিন্তু তখন বিদ্যমান মানুষের স্মৃতিতে কেউ কখনও এত লাভা উদগিরণ করতে দেখেনি। এর কোল ঘেঁষে দুটো ছিমছাম শহর পম্পেই আর হারকিউলেনিয়াম। এই শহর দুটোর ঢালে ছিল ছােট ছােট খামার। পম্পেই ছিল অভিজাত রােমানদের ছুটি কাটানাের জায়গা। রােমান সুবক্তা সিসেরাে ছিলেন সেই অভিজাতদের মধ্যে একজন যিনি সেখানে এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে একটি বিশাল বাড়ির মালিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। ৬৩ খ্রিস্টাব্দে, নিরাের শাসনামলে, সেই পুরাে অঞ্চলটাতে একটি ভূমিকম্প হয়ে যায়। ভূমিকম্পে পম্পেই আর নিয়াপােলিসের অনেক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর সেখানে ক্ষতিপূরণের কাজও হয়ে যায়। যাই হােক ৭৯ সালের নভেম্বর মাসে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি ভয়ানকভাবে লাভা উদ্গিরণ শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই পম্পেই আর হারকিউলেনিয়াম শহর লাভার নিচে তলিয়ে যায়। এই দুঃখজনক বিপর্যয় আধুনিক ইতিহাসবিদদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আঠারশ শতকের শুরুর দিকে পম্পেই শহরে ধীরে ধীরে খনন কাজ শুরু হলাে। পাওয়া গেল একটি সম্পূর্ণ শহর যা কিনা ফসিল হয়ে মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে সেই রােমান সময় থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত। মন্দির, থিয়েটার, ব্যায়ামাগার, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, সবকিছু পাওয়া গেল। সে শহরের চিত্রকলা, সাহিত্য এমনকি সামান্য টানাহেঁচড়ার দাগ পর্যন্ত পাওয়া গেল। মানুষের জীবন ধ্বংস না হতে হলে ইতিহাসবিদেরা এরকম দুর্ঘটনা বারবার ঘটুক, এমনটাই চান। যেখানে লাভা উত্থিত হচ্ছিল, টাইটাস দ্রুত সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন উদ্ধার অভিযান জোরদার করে বেঁচে যাওয়া মানুষদের দ্রুত সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে। তিনি যখন সেখানে গিয়েছিলেন তখন রােমে তিন দিনের জন্য আগুন লেগে যায়। তিনি আবার সেখানেও ছুটে এসেছিলেন।
হাম্মামখানা ও অ্যাম্ফিথিয়েটার স্থাপনা : সবচেয়ে সুখের কথা স্বলাে টাইটাস রোমে বিশাল এবং নতুন হাম্মামখানা স্থাপন করেছিলেন যেই কাজ শুরু করেছিলেন তার বাবা ভেস্পাসিয়ান। তার সময়ে রােমে প্রথম এবং বিরাট অ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি হয়। ভেস্পাসিয়ান এই থিয়েটারের কাজ শুরু করেছিলেন নিরোর প্রাসাদে। তিনি প্রাসাদের তােরণ খুলে দেন যেন জনগণ ভেতরে গিয়ে দেখতে পারে। অ্যাম্ফিথিয়েটারটি ছিল পাঁচ হাজার মানুষ একসাথে বসে দেখার মতাে বড়। পাথরের তৈরি থিয়েটারটি সে যুগে এবং এই আধুনিক যুগেও একটি বিশাল স্থাপনা। এটা ছিল রােমানদের জন্য রথের প্রতিযােগিতা, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই আর পশুর লড়াই দেখার যথার্থ জায়গা। ওই অ্যাম্ফিথিয়েটারকে ফ্লেভিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার নামকরণ করলেই ভালাে হতাে। কিন্তু সেটির অবস্থান ছিল নিরাের একটি বিশাল মূর্তির পাশে। সাধারণ আকৃতির চেয়ে বড় সেই মূর্তিকে রােমের লােকেরা বলত “কলােসি” (এখান থেকেই কলোসাল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল)। আর এভাবেই সেই অ্যাম্ফিথিয়েটারের নাম হয়ে গিয়েছিল “কলােসিয়াম” ।এখন পর্যন্ত এটি কলােসিয়াম নামেই পরিচিত। যদিও অনেকটা ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু এখনও রােমের আদি ঐতিহ্য বলতে এই অ্যাম্ফিথিয়েটারের কথাই প্রথমে মনে আসে।
ডমিশিয়ান ( রা. ৮১ – ৯৬ খ্রি.)
ক্ষমতায় আরোহন ও উন্নয়ন : টাইটাসের মৃত্যুর পরে তার ছােট ভাই ডমিশিয়ান (টাইটাস ফ্লেভিয়াস ডমিশিয়ানাস) সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলেন। এটা ছিল এমন যে ইতিহাস যেন আবার ফিরে ফিরে আসছে। ভেস্পাসিয়ানের পরে টাইটাস আর তারপরে আবার ডমিশিয়ান, দেখে মনে হচ্ছিল অগাস্টাসের সময় যেন আবার ফিরে এসেছে। এই বংশের সকলে ছিলেন ভালাে ভালাে আইনের প্রবক্তা সুতরাং তারা সিনেটের পক্ষ থেকে সম্মানও পেয়েছিলেন প্রচুর। সিনেটের সদস্যরা সবসময় তাদের সুনাম করত আর পরবর্তীকালে সিনেটের ঐতিহাসিকেরা তাদের সম্পর্কে অনেক ভালাে কথা লিখে গেছেন। ডমিশিয়ান ক্ষমতায় আসার পরে মনে হয়েছিল যেন অগাস্টাসের পরে টিবারিয়াস ক্ষমতায় আসার সেই ঘটনারই পূনরাবৃত্তি হলাে। কারণ টিবারিয়াসের মতাে ডমিশিয়ানও ছিলেন খুব চুপচাপ, শান্ত আর জনপ্রিয়তার জন্য মােটেও কাঙাল নয়। তিনি শুধুশুধু সিনেটের সদস্যদের অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনের রীতি বন্ধ করেন। এসব নিয়ে বেশি মাতামাতি তার পছন্দ ছিল না। তিনি সিনেটের সদস্য এবং অন্য সবার কাছেও কঠিন নিয়মনীতি অনুসারী একজন সম্রাট ছিলেন। তিনি রােমের প্রাচীন সংস্কৃতি ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করতেন। পারিবারিক জীবনে শান্তির প্রয়ােজনীয়তা মানুষকে বােঝাতেন। ৮০ খ্রিস্টাব্দে আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির তিনি আবার নতুন করে তৈরি করেছিলেন। বড় ভাই সম্রাট টাইটাসের স্মরণে তিনি তােরণ নির্মাণ করেন। তিনি জনগণের ব্যবহারের জন্য লাইব্রেরি স্থাপন করেন আর তাদের বিনােদনের জন্য জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের নিয়মিত আয়ােজন করতে থাকেন। দূরবর্তী প্রদেশগুলােতে আইনকানুনে কড়াকড়ি আনেন তিনি। আবার রােমের ভেতরেও রাজকীয় সেনাদের সংগঠিত করেন।
জার্মানিয়ার সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও চাট্টি উপজাতিদের দমন : রাইন আর দনিয়ুবের তীর ধরে সাম্রাজ্যের উত্তর সীমানায় দুই নদীর উৎসের মুখে নিরাপত্তা বেশ শিথিল ছিল। যে জায়গাটির কথা বলছি সেটি বর্তমানে জার্মানির দক্ষিণপশ্চিমে ব্যাডেন আর উরটেমবার্গ শহর। নদীদুটির উৎসের কাছে তারা আরও বেশি দক্ষিণপশ্চিমে সরে গিয়েছিল। জার্মানির উপজাতি মানুষেরা সেখানে চেষ্টা করলেই ইতালি আর গাউলের মাঝখানের জায়গাটা বিচ্ছিন্ন করে রােমানদের জন্য ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারত। ডমিশিয়ানের সময়ে এই দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে খুব গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়েছিল। সেই উপকূলের জার্মান চাট্টি উপজাতি সেই অগাস্টাসের সময় থেকেই রােমানদের সাথে থেমে থেমে যুদ্ধ করেই আসছিল। তাই ডমিশিয়ান চিন্তা করলেন যে এই সমস্যার একটা সমাপ্তি প্রয়ােজন। ৮৩ সালে একটি সেনাদলের প্রধান হয়ে তিনি রাইন পেরিয়ে গেলেন। তিনি সেনাবাহিনীর সহায়তায় চাট্টিদের পরাজিত করলেন আর সে জায়গা রােম সাম্রাজ্যের দখলে চলে এলাে। টিবারিয়াসের মতাে তিনিও খরচ বাঁচানাের জন্য রােম থেকে অনেক দূরের কোনাে স্থান দখলের পরিকল্পনা হাতে নেননি। চাট্টিদের তাড়িয়ে জার্মানির জায়গাটা দখলের পরে তিনি অবশ্য প্রশান্তি পেয়েছিলেন। তবে আর বেশিদূর এগােবেন না বলে সীমানা হিসেবে জার্মানির দক্ষিণপশ্চিম দিক ঘেঁষে দুর্গের একটি সারি তৈরি করেছিলেন। সেদিকের সীমানায় পুরােটা ঘেরা দেয়া হয়ে গেলে আর কোনাে আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল না।
ব্রিটেন থেকে এগ্রিকোলাকে ফিরিয়ে আনা : এছাড়া তিনি ব্রিটেন থেকে অ্যাগ্রিকোলাকে ডেকে আনিয়েছিলেন। সিনেটে ডমিশিয়ানের শত্রুরা বলেছিল যে তিনি একাজ করেছেন কেবল হিংসার বশে। কিন্তু এটা ছিল কেবলই অ্যাগ্রিকোলার প্রতি তার স্বাভাবিক ব্যবহার। কারণ দীর্ঘ দিন ধরে রােমের বাইরে অবস্থানরত অ্যাগ্রিকোলাকে তিনি মুক্তি দিতে চাচ্ছিলেন। স্কটল্যান্ডের উত্তর দিকের পাহাড়ী অঞ্চল আর আয়ারল্যান্ডের অসভ্য আইরিশ মুর জাতিকে দখল করতে তখন অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হয়েছিল। বহু রক্ত আর গচ্ছিত সােনার অপচয়ের দিকেও ডমিশিয়ান ফিরে তাকাননি। কারণ রােমের এত কাছের অঞ্চলে যে করেই হােক, ক্ষমতার বিস্তৃতি তার মতে খুব জরুরি ছিল।
সেনাবাহিনীর সন্দেহ, ব্যর্থ ষড়যন্ত্র, প্রতিক্রিয়ায় দার্শনিক ও ইহুদি-খ্রিস্টান হত্যা : ডমিশিয়ানের অন্তর্মুখী স্বভাব তাকে বারবার একাকিত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যেত। একই ঘটনা অর্ধশতাব্দী আগে টিবারিয়াসের সাথেও ঘটেছিল। যেহেতু তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না তাই কারও সাথে সহজ, স্বাভাবিক হতে পারতেন না। আর তাই তিনি যতই নিজের ভেতরে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন, কোর্টের সদস্যরা, সেনাবাহিনীর প্রধানেরা তার প্রতি ততই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠত। তারা সবসময়ই ডমিশিয়ান কী ভবছেন, এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগত। প্রায়ই তারা একে-ওকে ফাঁসিতে ঝােলানাে হবে, এ ধরনের গুজবে কান দিয়ে আশঙ্কায় ভুগতেন। ডমিশিয়ানের এ ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা তাকে জেনারেলদের কাছে জনপ্রিয় হতে বাধা দিয়েছিল। তাই জেনারেলরা একসাথে হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলাে। জার্মান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান অ্যান্টোনিয়াস স্যাটার্নিয়াস তার বাহিনীসহ ৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে নিজেকে সম্রাট ঘােষণা করল। স্যাটার্নিয়াস জার্মানির কিছু অসভ্য উপজাতির কাছে সাহায্য চাইলেন। সেই অসভ্য জাতিগুলাের উপর নির্ভর করলে তাকে রােমান সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হতাে। সুসংগঠিত রােমান বাহিনীর হাতে মারা পড়ে সাম্রাজ্যের আনাচেকানাচে তাদের মৃত শরীরগুলাে পড়ে থাকতে দেখা যেত। অসভ্য জাতিরা সামনে এগিয়ে আসতে সাহস পেল না। ডমিশিয়ান প্রাথমিক অবস্থায়ই বিদ্রোহ দমন করে ফেললেন। ডমিশিয়ানের সন্দেহপ্রবণ মন এই ঘটনার পর থেকে আরও বেশি সতর্ক হয়ে গেল। তিনি এই বিদ্রোহে কলকাঠি নাড়ার ক্ষেত্রে যাদের হাত আছে বলে মনে করলেন সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার শান্ত স্বভাব এই ঘটনার পরে একেবারে বদলে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন প্রতিশােধপরায়ণ। তিনি রােমের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিককে ফাঁসিতে ঝােলালেন। তিনি মনে করেছিলেন, যেহেতু তারা একটি আদর্শ মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেন, সুতরাং তারা সব সম্রাটের বিপক্ষের শক্তি। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত ইহুদিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিলেন কারণ তার মনে হয়েছিল তারা ইহুদি হওয়াতে কখনােই কোনাে ফ্লেভিয়ানের পক্ষের হতে পারেন না। খ্রিস্টানদের উপরেও নানান অত্যাচারের কথা শােনা গেছে কারণ রােমানরা তখনও তাদেরকে ইহুদিদেরই একটি অংশ বলে মনে করত।
সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা, ডেসিয়ান উপজাতির কাছে পরাজয়, এবং স্বাধীন ডাসিয়া : এর পরে আর কখনও যেন কোনাে সেনাবিদ্রোহ না ঘটে সেজন্য ডমিশিয়ানস বড় বড় সেনাবাহিনীকে চারটি অংশে বিভক্ত করে চার স্থানে রাখার হুকুম দিলেন। পৃথকভাবে থাকলে তারা আর এক হয়ে বিদ্রোহ সংঘটন করতে পারবে না বলেই তিনি মনে করতেন। এভাবে বড় বাহিনী কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছিল। রােমের বিশাল সেনাশক্তি এভাবে টুকরাে টুকরাে হয়ে গিয়ে তাদের মিলিত ক্ষমতা হারিয়েছিল। সে অবস্থায় যুদ্ধে অন্য কাউকে পরাজিত করা অথবা কেবল সামান্য কোনাে অসভ্য জাতিকে পরাজিত করাও তাদের জন্য বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াতাে। যেমন ধরা যাক, ডমিশিয়ানের সময়ে ডেসিয়ানদের সাথে বেশ যুদ্ধ বেঁধে গেল। ডেসিয়ান উপজাতিরা থাকত দানিয়ুবের নিচে, উত্তর দিকে। ওই জাতিই পরবর্তীকালে স্বাধীন রাষ্ট্র রােমানিয়া তৈরি করেছিল। ৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে ডেসিয়ান জাতি, তাদের নেতা ডেসিবালাসের নেতৃত্বে যুদ্ধংদেহী হয়ে শীতকালের বরফ জমা দানিয়ুব পাড়ি দিয়ে রােমান সাম্রাজ্যের দক্ষিণে মােয়েশিয়ার দখল নেয়ার জন্য আক্রমণ করল। ডমিশিয়ান বাধ্য হয়ে তাদের তাড়া করেন। তিনি বাহিনীসহ তাদের মােয়েশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেন আর ডেসিয়ার দখলও নিয়ে নেন। তার পরের কয়েক বছর রােমানরা সেখানে বেশ গর্বের সাথে রাজত্ব করেছে। যাই হােক, স্যাটার্নিনাসের বিদ্রোহ ডমিশিয়ানকে কিছুটা মনােবলহীন করে দেয়। রােমান সেনাবাহিনী ডেসিয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ডেসিয়ানরা তাদের এমনভাবে হারিয়ে দেয় যে ডমিশিয়ান বুঝতে পারেন, এরপরে আরও হামলা চালানাের শক্তি তাদের নেই। যদিও এটা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য কিন্তু তবু ডমিশিয়ান ডেসিবালাসের ইচ্ছা মেনে নেন। ডেসিবালাস স্বাধীন দেশের নেতা ছিলেন অথচ ডমিশিয়ানের হাতে মুকুট পরতে চাচ্ছিলেন। ৯০ খ্রিস্টাব্দে ডমিশিয়ান ডেসিবালাসের দাবির মুখে তাকে ডেসিয়ায় শান্তি বজায় রাখার পরিবর্তে বাৎসরিক হারে টাকা দিতেও রাজি হন। এটা করা ডমিশিয়ানের জন্য যুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করার চেয়ে সহজ ছিল। কিন্তু সিনেটের সদস্যরা একে রােমান ইতিহাসে প্রথম অসম্মানজনক আঁতাত হিসেবে চিহ্নিত করে।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফ্লেভিয়ান রাজবংশের সমাপ্তি : শেষ পর্যন্ত ৯৬ খ্রিস্টাব্দে (৮৪৯ রােমান সালে) ডমিশিয়ানের শেষ বছরগুলাে, যেগুলােকে ঐতিহাসিকেরা সন্ত্রাসের রাজত্ব বলে বর্ণনা করেছেন, তার সমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেল। প্রাসাদে ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। আশেপাশের কিছু মানুষ আর সম্রাজ্ঞী নিজেও এই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করলেন। ডমিনিয়াসকে বন্দী করে হত্যা করা হলাে। এভাবেই ভেস্পাসিয়ানের বংশের শাসন শেষ হলাে। তারা রােমের বুকে সাতাশ বছরব্যাপী শাসন চালিয়েছিল। এই বংশের কাছে রােম পরপর তিনজন শাসক পেয়েছিল।
নার্ভা-অ্যান্টোনাইন রাজবংশ (৯৬ – ১৯২ খ্রি.)
নার্ভা (রা. ৯৬ – ৯৮ খ্রি.)
নার্ভার ক্ষমতায় আসা ও তার পরিচয় : ষড়যন্ত্রকারীরা, যারা ডমিশিয়ানকে হত্যা করেছিল তারা এক প্রজন্ম আগে নিরাের হত্যাকারীদের কাছেই বিষয়টি শিখেছিল নিশ্চয়। তারা নিজেদের মধ্যে তর্কে ব্যস্ত জেনারেলদের মাঝখানের ফাঁকটুকু নিয়ে একটুও সময় নষ্ট করেনি। তাদের কাছে তাদের প্রার্থী তৈরি ছিল। তারা যেহেতু সেনাবাহিনীর লােক নন তাই তারা কোনাে জেনারেলকে পছন্দ করেননি। (তা ভাদের পেছনে প্রিতোরিয়ান গার্ডদের সমর্থনও আশা করেছিলেন)। তারা নির্বাচন করেছিলেন একজন সিনেটরকে। তাদের পছন্দ ছিল প্রচণ্ড সম্মানিত একজন সিনেটর নার্ভা (মার্কাস ককেসিয়াস নার্ভা)। নার্ভার বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত আইনজীবী আর সম্রাট টিবারিয়াসের বন্ধু। নার্ভা নিজেও ভেস্পসিয়ান আর টাইটাসের অধীনে ট্রাস্টে কাজ করেছিলেন। ৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডমিশিয়ানের সাথে রােমান সাম্রাজ্যের দুজন প্রধান প্রশাসকের মধ্যে একজন হিসেবে কাজও করেছিলেন। পরে অবশ্য ডমিশিয়ানের সুনজর থেকে তিনি বঞ্চিত হন আর সম্রাট তাকে দক্ষিণ ইতালিতে নির্বাসনে পাঠান। ডমিশিয়ানের মৃত্যুর সময়ে নার্ভার বয়স ছিল ষাটের ঘরে। আর তাকে দেখে মনে হতাে না যে তিনি অনেকদিন বাঁচবেন। কোনাে সন্দেহ নেই যে যাৱা তাকে সমর্থন দিয়েছিল তারা সেই আশাতেই ছিল যে তার শাসনামল হবে খুব ছােট আর ওইটুকু সময়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে পারবে।
নার্ভার উন্নয়নসমূহ : নার্ভা সিনেট আর সম্রাটের মধ্যে যে ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্ক তা শেষ করার কাজে মনােযােগ দিয়েছিলেন। কাগজে কলমে লিখিত নিয়মটাকে তিনি বাস্তবে রূপ দিতে চাইতেন। তিনি দেখাতে চাইতেন যে রাজ্য চলে সিনেটের কথায় আর সম্রাট আসলে সিনেটের নিয়ােগকৃত একজন সরকারি কর্মচারি মাত্র। কোনােদিন কোনাে সিনেটরকে ফাঁসিতে ঝােলাবেন না বলে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা তিনি রক্ষা করেছিলেন। তিনি কঠোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবাইকে অভ্যস্ত করান। রাজনৈতিক অপরাধে মানুষকে শাস্তি দেন তিনি। সাম্রাজ্যের অধীনে একটি ডাকবিভাগ চালু করেন। রাজ্যের শিশুদের জন্য তিনি একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। তিনি নিজের মানবীয় গুণাবলি আর সাধারণ মানুষের প্রতি দয়া প্রকাশের জন্য প্রচুর পদক্ষেপ নেন।
প্রাচীনপন্থী সমাজ ও প্রিতোরিয়ান গার্ডদের বিরোধিতা : যদিও মানুষের জীবনে আরাম আয়েশ এনে দেবার এই প্রচেষ্টা নার্ভার সরকারের একটি প্রশংসার যােগ্য পদক্ষেপ কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরকম প্রাচীনপন্থী একটি সমাজে সেটাকে অলক্ষুনে একটা ব্যাপার বলেই ধরে নেয়া হতাে। তার ওপরে স্থানীয় সরাকারও অসহযােগিতা শুরু করেছিল। তার চেয়েও বড় কথা যে তারা সম্রাটের মুখাপেক্ষী হয়েই অপেক্ষা করছিল। রােমের মহান সম্রাট সবার জন্য সহৃদয় হবেন এমনটাই সবাই প্রত্যাশা করত। তিনি ছিলেনও তাই। কিন্তু এমন একটা সময় এলাে যখন কেন্দ্রীয় সরকার হয়ে পড়ল দুর্নীতিগ্রস্ত আর অযােগ্য। তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য ভালাে কিছু করতে পারছিল না, সে জায়গায় স্থানীয় সরকারের পৃষ্ঠপােষকতা করবে কী করে? কিন্তু তখনকার জন্য শুধু প্ৰিতােরিয়ান গার্ডরাই ছিল ভীষণ অসন্তুষ্ট। ডমিশিয়ান তাদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন কারণ তিনি কোনাে একসময় তাদের সাহায্য করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন যে ক্ষমতায় থাকতে হলে প্রিতােরিয়ান গার্ডদের হাতে রাখতে হবে। পাশাপাশি তিনি তাদের ভাতাও ভালােভাবে বুঝিয়ে দিতেন আর এছাড়াও নানারকম স্বাধীনতা ভােগ করতে দিতেন। নার্ভার কঠোর অর্থনীতি আর সিনেটের প্রতি নির্ভরতা প্রিতােরিয়ান গার্ডদের বিরক্তি বাড়িয়ে তুললেও, হতাশার সাথেই তারা ডমিশিয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা আর তাদের নিজস্ব প্রধান যে কিনা সেই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন, দুজনেরই ফাঁসি চাইল। নার্ভা দেখলেন যে তিনিও গ্যালবার মতাে একই পরিণতির দিকে যাচ্ছেন। কিন্তু সাহস নিয়ে তিনি প্রিতোরিয়ান গার্ডদের মুখােমুখি হয়ে তাদের দাবি নিয়ে কাজ করতে চাইলেন। নার্ভা নিজের জীবন হারাননি তবে তাদের কাছে একরকম অপমানিত হয়েছিলেন। তিনি দেখলেন যে তার কাছে সুবিচার না পেয়ে তারা নিজেরাই ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যা করেছে। আর এজন্য তারা সিনেটের মাধ্যমে “ধন্যবাদ” ছিনিয়ে নিতে নার্ভাকে বাধ্য করেছিল। নার্ভা বুঝতে পারছিলেন যে তিনি প্রিতােরিয়ান গার্ডদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন।
ট্রাজানকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন ও তার সিংহাসনে আরোহন : তার মৃত্যুর মাধ্যমে পুরাে সাম্রাজ্যে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসতে পারে, এরকম তিনি সন্দেহ করছিলেন। তার কোনাে সন্তান ছিল না যার উপরে তিনি নির্ভর করতে পারেন যেমন ভেস্পাসিয়ান করেছিলেন টাইটাসের উপরে। অগত্যা তিনি কিছু ভালাে জেনারেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেন যাদের কাউকে তিনি দত্তক নিতে পারেন আর পরবর্তীকালে তার উত্তরাধিকারীর মর্যাদা দিতে পারেন। টাইটাসের মতাে ভক্ত পুত্র সন্তান না হলেও অন্তত টিবারিয়াসের মতাে পুত্র তাে তিনি পেতে পারেন। অনেক হিসাবনিকাশ করে শেষে তিনি পছন্দ করলেন ট্রাজানকে (মার্কাস উল্পিয়াস ট্রাজানাস)। ৫৩ খ্রিস্টাব্দে ট্রাজান আধুনিক শহর সেভিলের কাছে স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম সম্রাট যিনি ইতালির বাইরে জন্মেছিলেন (অবশ্য তিনি ইতালিয়ান সংস্কৃতিতে শিক্ষিত ছিলেন)। তিনি নিজেও একজন সেনা ছিলেন আর একজন সেনার পুত্র ছিলেন। সুতরাং সারাজীবন দক্ষতা আর যােগ্যতার বলেই রাজ্যের সেবা করে গেছেন। তাকে দত্তক নেয়ার তিন মাসের মাথায় নার্ভা মৃত্যুবরণ করেন। নার্ভা প্রায় দেড় বছর সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। এর পর ট্রাজান শান্তিপূর্ণভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ট্রাজানকে নার্ভার সব আদর্শ মেনে চলতে হয়েছিল। তাকেও প্রতিজ্ঞা রাখতে হয়েছিল যে কখনও কোনাে সিনেটরকে ফাঁসিতে ঝোলানাে যাবে না আর সিংহাসনের জন্য সবচেয়ে যােগ্য কাউকে বেছে নিয়ে তাকে দত্তক নিতে হবে যাতে পরবর্তীকালে সে সিংহাসনে বসতে পারে। আর সত্যি হয়েছিলও তাই। তারপর থেকে বেশ কয়েকজন সম্রাট একজন আরেকজনকে দত্তক নিয়ে উত্তরাধিকারী বানিয়েছিলেন আর সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। কোনাে কোনাে সময় তাদের পারিবারিক উপাধির পরে “অ্যান্টনিজ” যােগ করে তাদের ডাকা হয়।
ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞান-প্রকৌশল চর্চায় রৌপ্যযুগ
ইতিহাস চর্চা : নার্ভার মাধমে রােমান রাজ্যে যে শান্তি, নিরাপত্তা উন্নতির ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল, তাতে রােমের অভিজাত শ্রেণি যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। রােমান ঐতিহাসিকেরাও নার্ভার পরের সব সম্রাটদের বর্ণনা করতে গিয়ে আগের সব সম্রাটের আমলকে অন্ধকার যুগ বলে বর্ণনা করেছেন। সিনেটের প্রতি সহনশীলতা দেখানােই এর মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা হয়তাে সেভাবে নজর দেননি। সে যুগে প্রতিশােধপরায়ণতা ছিল অনেক প্রকট। ঐতিহাসিকদের লেখা যে কয়েকটি বই বেঁচে গেল, তাতে দেখা গেল যে আগের সমস্ত সম্রাটেরা সবাই ছিলেন অন্ধকার যুগের প্রবক্তা। কিন্তু তখনকার এক একজন সম্রাট যতই খারাপ হােন না কেন, সিনেটের ঐতিহাসিকদের লেখায় তাদের যত খারাপ বর্ণনা করা হয়েছে, বাস্তবে তারা আদৌ সেরকম ছিলেন কি না সন্দেহ। তদকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদগণ হলেন –
- টেসিটাস : ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন কর্নেলিয়া টেসিটাস। ফ্লেভিয়ানদেৱ সময় থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল আর ডমিশিয়ানের সময় পর্যন্ত বেশ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি ছিলেন অ্যাগ্রিকোলার মেয়ের স্বামী। ব্রিটেনে রোমান সংস্কৃতি প্রচারের ব্যাপারে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি অগাস্টাসের মৃত্যুর সময় থেকে শুরু করে ডমিশিয়ানের সময় পর্যন্ত সম্রাটদের ইতিহাস রচনা করেছিলেন। সিনেটের প্রতি প্রজাতন্ত্রীয় মতবাদে বিশ্বাসী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি ইতিহাসগুলাে লিখেছিলেন। তাই ওই সময়টাতে কোনো সম্রাটের মধ্যেই তিনি ভালাে কিছু দেখতে পাননি। বিশেষ করে তিনি সাংঘাতিকভাবে টিবারিয়াসের নিন্দা করেছিলেন। হয়তো টিবারিয়াসের চরিত্রের সাথে ডমিশিয়ানের মিল পাওয়া যায় সেজন্য। টেসিটাস অ্যাগ্রিকোলার একটি জীবনী গ্রন্থ লিখেছিলেন। ব্রিটেনের ইতিহাসের উপরে আলােকপাত করেছে বলে বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৮৯ থেকে ৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টেসিটাস রােমে ছিলেন না। সেই সময়টায় মাঝে মাঝে তিনি জার্মানিতে থাকতেন। জার্মানির ইতিহাস নিয়ে তখন তিনি একটি বই লিখেছিলেন। জার্মানির সেই শুরুর দিনগুলাের বিষয়ে যদি আমরা জানতে চাই তাহলে বলা যেতে পারে তার বইটি অবশ্যই প্রয়ােজনীয়। বইটি পড়লে অবাক হতে হয় যে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা কত নিখুঁত। টেসিটাস প্রতিটি ঘটনার বর্ণনায় পারতপক্ষে নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া তিনি ওই বইয়ে জার্মানির লােকদের সাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত জীবনাচরণের সাথে রােমের মানুষদের আকণ্ঠ বিলাসিতায় ডুবে থাকা জীবনের তুলনা করেছেন। তবে নিজের মতামত জাহির করার জন্য তিনি হয়তাে একটি পরিস্থিতিকে অনেক বেশি উপরে তুলে আরেকটিতে অনেক বেশি নিচে নামিয়ে এনেছেন।
- স্যুটোনিয়াস : আফ্রিকার সমুদ্রতীরে ৭০ খ্রিস্টাব্দে আরেকজন তরুণ ইতিহাসবিদের আবির্ভাব হয়েছিল। তার নাম গেইয়াস স্যুটোনিয়াস ট্র্যাঙ্কুইলাস। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম “বারােজন সম্রাটের জীবন”। এই বইটি জুলিয়াস সিজারসহ ডমিশিয়ান পর্যন্ত তার পরের এগারাে জন সম্রাটের জীবনের গল্প। স্যুটোনিয়াস গুজবে রটা গল্প মজা করে লিখতে পছন্দ করতেন। সাধারণ ঐতিহাসিকেরা যেসব ঘটনা এড়িয়ে গেছেন, তিনি সেগুলাে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। যাই হােক, সেসব মজাদার গুজবের বর্ণনার কারণে তার বইটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল আর আজও একই আগ্রহ নিয়ে পঠিত হচ্ছে।
- জোসেফ : তখনকার যুগে রােমান নন কিন্তু জনপ্রিয় এমন একজন ইতিহাসবিদ হলেন ইহুদি জোসেফ। তিনি নিজের নামের রােমানিয় রূপ দিয়েছিলেন ফ্লেভিয়াস জোসেফাস। তিনি ৩৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। কেবল ইহুদি শিক্ষায়ই শিক্ষিত নন, রােমান শিক্ষাও গ্রহণ করেন জোসেফাস। তাই দুই সংস্কৃতিতেই সমানভাবে বিচরণ করতেন তিনি। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রােমে যান রােমান সংস্কৃতি আরও ভালাে করে শিখতে। আবার জুডিয়ায় ফিরে এসে সেখানকার সংস্কৃতির সাথেও তাল মেলান। দুই জায়গার জাতীয়তাবাদের উন্নতিকল্পে তিনি সমানভাবে কাজ করে যান। তবে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি: ইহুদিদের মধ্যে যখন বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল তখন রােমের বিরুদ্ধে একটি সেনাদল নিয়ে তিনিও রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। তিনি অনেকটা সময় ধরে শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে সফলতার সাথে লড়ে গিয়েছিলেন। যখন শেষ সময়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে তখন অন্য আর সব পরাজিত কাপুরুষ নেতার মতো তিনি আত্মহত্যা করেননি। বরং সে জায়গায় তিনি ভদ্রভাবে মাথা নত করে ভেস্পাসিয়ান আর টাইটাসের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই সে শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি রােমান নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে রােমে বসবাস করে কাটিয়েছেন। তিনি ৯৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের জাতিকে ত্যাগ করার বিষয়টি নিয়ে তিনি মর্মাহত হননি, তা নয়। ইহুদি বিদ্রোহের স্মৃতিচারণ করে তাই বই লিখেছিলেন। নাম ছিল “ইহুদিদের যুদ্ধ”। ভেস্পসিয়ানের শাসনামলের শেষের দিকে বইটি ছাপা হয়। ইহুদি বিদ্রোহী হিসেবে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযােগ আনা হয়েছে, আত্মজীবনী গ্রন্থে সেসব যুক্তি খণ্ডন করেছেন। আরেকটি বইয়ে তিনি বর্ণনা করেছেন কেন এবং কীভাবে ইহুদিরা বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে গেছে, কতটা অত্যাচারিত হয়ে, কী বিপর্যয়ের মুখে তারা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছে। তার বিখ্যাত বই হলাে “ইহুদিদের স্বর্ণযুগ” (দ্য জুইশ অ্যান্টিকুইটিস) যাতে ইহুদিদের প্রাচীন ইতিহাস (বাইবেলকে নতুন করে বর্ণনা করাসহ) থেকে শুরু করে তাদের বিদ্রোহের সূচনা পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। বইটিতে একটি প্যারাগ্রাফে নাজারেথের যিশুর কথা বলা হয়েছে। এটাই বাইবেলের দ্বিতীয় পর্বের বাইরে অন্য কোথাও যিশুর সম্বন্ধে নতুন কোনাে তথ্যসমৃদ্ধ বই। অবশ্য বেশিরভাগ জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা মনে করেন যে বাইবেলের বাইরে যিশুর সম্পর্কে এসব বর্ণনা পুরােপুরি সত্য নয়। পরে টিবারিয়াসের সময়ে আবার কিছু খ্রিস্টানের সহায়তায় জোসেফাসের বর্ণনা যে ভিত্তিহীন আর যথেষ্ট নয়, এ নিয়ে জুডিয়ায় আলােচনাও হয়েছে।
রম্য রচনা : ফ্লেভিয়ানদের রাজত্বের সময়টায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য সমালােচকরা এইসব সাহিত্যকে অগাস্টাসের সময়কার সাহিত্যের সাথে তুলনা করে খুব উচ্চমানের বলে মনে করেন না। তারা ফ্লেভিয়ানের সময়কে সাহিত্যের “রৌপ্যযুগ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই রৌপ্যযুগে জনপ্রিয় ছিলেন তিনজন অসাধারণ রম্যলেখক। রম্যলেখকরা সব খারাপ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাসিঠাট্টা মিলিয়ে গল্প লিখতেন। ঠাট্টার মাধ্যমে খোঁচা দিয়ে তারা মানুষকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করতেন। রম্যলেখক তিনজন হলেন পার্সিয়াস (আউলাস পার্সিয়াস ফ্ল্যাকাস), মার্শাল (মার্কাস ভ্যালেরিয়াস মার্শালিস) আর জুভেনাল (ডেসিমাস জুনিয়াস জুভেনালিস) –
- পার্সিয়াস : পার্সিয়াস ছিলেন প্রথম আর প্রকৃতপক্ষে এসেছিলেন ফ্লেভিয়ান আমলের আগে। সে কারণে তিনি ক্লডিয়াস আর নিরােকে নিয়েও রম্যরচনা লিখেছিলেন। জেনারেলরা কেউ যখন তাদের আদর্শ থেকে এতটুকু নেমে গেছেন তখনই পার্সিয়াস সেই ঘটনা নিয়ে রম্য লিখেছেন। প্রতিদিন এরকম লিখতে লিখতে এই বিষয়ে তিনি দক্ষ হয়ে উঠলেন। তিনি মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মারা যান। এত অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ না করে তিনি যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন তবে তার রম্য সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হতাে আর তার আরও বেশি নামডাক হতাে।
- মার্শাল : খ্রিস্টাব্দে স্পেনে জন্মেছিলেন মার্শাল। নিরাের আমলে তিনি রােমে আসেন আর সেখানেই ১০৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার রম্যকবিতা, ছড়া, বিশেষ করে খুবই ছােট আকৃতির দুই থেকে চার লাইনের অনুকাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি ওই ধরনের ১৫০০ ছড়া লিখেছিলেন যেগুলাে চৌদ্দটি বইয়ে ছাপানাে হয়েছিল। তার চোখের সামনে যতরকম অসঙ্গতি তিনি দেখতে পেতেন, তাই নিয়েই লিখে যেতেন। তারপরে ছাপা হওয়ার সাথে সাথেই তার অনুকাব্য সকলের মুখে মুখে ফিরত। হয়তাে যাদের নিয়ে সেসব লেখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার রম্যের খোঁচা বছরের পর বছর ধরে খেয়ে এসেছেন। মার্শাল তার সময়ে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। টাইটাস আর ডমিশিয়ান দুজনেই তার পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। এটা কিছুটা হতাে এই কারণে যে তার রচনা ছিল খুবই মজার আর কিছুটা এই কারণে যে তিনি তার রম্য রচনায় কিছু অসামাজিক বা অসভ্য বিষয়ের অবতারণা করতেন। তাই তার রম্য কৌতুক বেশিরভাগই ছিল কিছুটা আদি রসাত্মক। একটি স্বাভাবিক রসবােধপূর্ণ কৌতুক-কবিতার উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে – “Non amo te, Sabidi, nec possum dicere quare;/ Hoc tantum possum dicere, non amo te.” এর অর্থ হলাে, “তােমাকে ভালােবাসতে পারি না, সাবিডিয়াস, বলতেও পারি না কেন; শুধু এটুকু জানাে, পারি না ভালােবাসতে।” এই অনুকাব্যটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল থমাস ব্রাউনের আধুনিক সংস্করণে। ১৭৮০ সালে থমাস ব্রাউন যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন তার ডিন ডক্টর ফেলকে নিয়ে এই ছড়াটির প্যারােডি করে লিখেছিলেন: “ডক্টর ফেল, ভালােবাসি না তােমায়।/ কারণ শুধায়াে না আমায়;/ এ শুধু আছে আমার জানায়,/ ডক্টর ফেল, ভালােবাসি না তােমায়।”
- জুভেনাল : জুভেনাল ছিলেন রম্যলেখকদের মধ্যে হয়তােবা সবচেয়ে বড় কিন্তু কিছুটা রসহীনও। মাঝে মাঝে সমাজের মধ্যে ঘটা দুর্বিষহ ঘটনায় তিনি এতটা বিমর্ষ হয়ে পড়তেন যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। তখন তিনি তার লেখায় হাস্যরসবােধের পরিবর্তে কঠোর কঠিন ভাষার প্রয়োেগ করতেন। তিনি রােমের লােকদের অযথা বিলাসিতা আর লােক দেখানাের স্বভাবকে ঘৃণা করতেন। তার লেখার মাধ্যমে স্বৈরাচারী কোনাে মানুষ বা একদল স্বেচ্ছাচারী লােককে একইরকমের প্রবল আক্রোশ নিয়ে আক্রমণ করতেন। তিনি রােমের মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে নানা কটাক্ষ করতেন। তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে তারা কেবল খাওয়া আর খেলার প্রতিযােগিতা উপভােগ করতে পারে। কিন্তু এটাই প্রমাণ করে না যে সম্রাটদের আমলে রােম পৃথিবীর আর সব সভ্য দেশের চেয়ে জঘন্য কোনাে জায়গা ছিল। সন্দেহ নেই যে আজ যদি জুভেনাল বেঁচে থাকতেন তবে এখনও তিনি একইরকমের রম্য কবিতা লিখে যেতেন, কঠিন হলেও সত্যি যে লিখতেন নিউইয়র্ক, প্যারিস, লন্ডন কিংবা মস্কোকে নিয়ে। এটা মনে রাখা দরকার যে খারাপ একটা পরিস্থিতিতে মানুষ অনেক পাপকাজে লিপ্ত হতে পারে কিন্তু আড়ালে আবডালে যে অনেক ভালাে ও দয়ালু মানুষ কিংবা ভদ্রলােকেরা থাকেন তারা তাদের মতাে কাজ করেই যান। সেসব খবর কখনও পত্রিকার প্রথম পাতায় আসেও না আর কেউ জানতেও পারে না।
স্পেইনভিত্তিক কবি ও অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ :
- কবি লুকান : একটু প্রাচীন ধরনের কবিতা লিখতেন লুকান (মার্কাস অ্যানাইয়াস লুকানাস)। তিনি ৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের করডােবাতে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ নিরাের শিক্ষক সেনেকার ভাগ্নে ছিলেন তিনি। তার সবচেয়ে আলােচিত কাজ হলাে জুলিয়াস সিজার আর পম্পেইয়ের মধ্যেকার যুদ্ধ নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ। তার কাজের মধ্যে বলতে গেলে এটাই পুরােপুরি অক্ষত আছে। তিনি নিরাের বন্ধু ছিলেন। তবে এই বন্ধুত্ব যেমন তার জন্য তেমনই তার মামা সেনেকার জন্য গুরুতর হয়ে দেখা দেয়। নিরাে লুকানের কবিতার ব্যাপারে খুব হিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন আর তাকে জনসমক্ষে আবৃত্তি করতে বাধা দেন। একজন কবির জন্য এটা ছিল চরমতম শাস্তি। তার সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হলে তিনি নিরাের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। ধরা পড়লে লুকান আদালতের পক্ষের রাজসাক্ষী হয়ে যান আর তার সাথে ষড়যন্ত্রকারী বাকিদের পরিত্যাগ করেন। কিন্তু তার পরেও লুকানকে ধরে নিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়।
- শিক্ষাবিদ ও অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ কুইন্টিলিয়ান : এরপরে রােমে আরও একটি স্প্যানিশ স্কুল গড়ে ওঠে। রৌপ্যযুগের দার্শনিকদের আদর্শ অনুযায়ী সেনেকা, মার্শাল আর লুকানের কথা মাথায় রেখে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন কুইন্টিলিয়ান। মার্কাস ফেবিয়াস কুইন্টিলিয়ান ৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে জন্মান। তিনি গ্যালবার সাথে কাজ করেছিলেন আর রােমে এসেছিলেন গ্যালবা যখন সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি রােমেই থাকা শুরু করেন। ছাত্রদের ভাষা ও বক্তৃতা দেয়ার কায়দা শেখান। তিনিই প্রথম শিক্ষক যিনি সম্রাটের অনুমােদন অনুয়ায়ী শিক্ষাদান করার সুযােগ পান। ভেস্পাসিয়ানের তরফ থেকে তাকে এজন্য সাহায্য করা হয়। কুইন্টিলিয়ান সিসেরোর ঘাের সমর্থক ছিলেন। তিনি গ্রিক ভাষার ব্যবহার ফিরিয়ে আনতে আর গ্রিসের ধরন অনুযায়ী রচনায় বেশি বর্ধনা আর অতি কাব্যিক বিষয়গুলাে পরিহার করার চেষ্টা করেন।
বিজ্ঞান ও প্রকৌশল চর্চা : রােম কখনােই বিজ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিল না। সেটি ছিল গ্রিকের লােকদের জন্য প্রথম প্রশংসার বিষয়। রােমান সাম্রাজ্যের প্রথম শতাব্দীতে রােমানরা এসে বিজ্ঞানের প্রতি যে অবদান রেখেছিল তা পৃথিবীর যে কোনাে বিজ্ঞানের ইতিহাস বইয়ে বর্ণনা করা হয়। সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা হলেন –
- প্লিনি : সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন প্লিনি (গেইয়াস প্লিনিয়াস সেকানডাস)। তিনি ২৩ খ্রিস্টাব্দে ইতালির উত্তর দিকে নােম কোমাম শহরে (আধুনিক কোমাে শহর) জনুগ্রহণ করেন। তিনি ক্লডিয়াসের সময়ে সেনাবাহিনীর দল নিয়ে জার্মানির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা ছিল ভেস্পসিয়ান সাম্রাজ্য হারাবার পরের ঘটনা। তিনি ভেস্পাসিয়ানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সে সময় তিনি গাউলের কিছু অংশে আর স্পেনে গভর্নর হিসেবে কাজ করেন। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, পৃথিবীর সব বিষয়ে যার ছিল অপার আগ্রহ আর অনুসন্ধিৎসা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন জ্ঞানার্জনে। তার প্রধান রচনা “প্রাকৃতিক ইতিহাস” ৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল সাইত্রিশ খণ্ডে লিখিত আর টাইটাসকে উত্সর্গীকৃত। এটা কোনাে মৌলিক রচনা ছিল না। দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন বই থেকে সংগ্রহ করে পাঁচশ লেখকের লেখাকে একত্র করে তিনি এই বিশাল রচনাটির আয়ােজন করেছিলেন। রচনা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই নিরপেক্ষ আর রসবােধসম্পন্ন। বইটি মহাকাশ বিজ্ঞান এবং ভূগােল নিয়ে যথেষ্ট আলােচনা করেছে। তবে এর মূল বিষয় ছিল জীববিজ্ঞান। এখানে তিনি অসংখ্য পরিব্রাজকের রচনা থেকে উল্লেখযােগ্য অংশ লিপিবদ্ধ করেছেন। এখানে পঙ্খীরাজ ঘােড়া, মৎস্য কন্যা, এক শিংওয়ালা ঘােড়া, মস্তকবিহীন মানুষ, দীর্ঘ পা-বিশিষ্ট অবাস্তব মানুষ আরও অনেক কিছুর মজাদার বর্ণনা আছে। বইটি ছিল মনােমুগ্ধকর আর এত বেশি কপি ছাপানাে হয়েছিল যে বহুদিন পর্যন্ত সব জায়গায় পাওয়া যেত। বাস্তবধর্মী সমস্যা নিয়ে লেখা বই কখনও এত বেশি বিক্রি হতে দেখা যায়নি। প্লিনির রচনার খ্যাতি মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের প্রথম দিকে পর্যন্ত সমানভাবে জনপ্রিয় এবং একটি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি হিসেবে সমাদৃত ছিল। একে সবসময়ে একটি পৃথক ঐতিহ্যবাহী কাজ হিসেবেই দেখা হতাে। প্লিনি জীবনের শেষে একটি ভয়াবহ নাটকীয় পরিণতির দিকে যান। টাইটাসের অধীনে তিনি নেপলসে একটি যুদ্ধজাহাজ বহরের দায়িত্বে ছিলেন। তার জায়গায় বসেই তিনি ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত হতে দেখছিলেন। অগ্ন্যুৎপাত কাছে থেকে দেখে লেখার মধ্যে নিখুঁতভাবে ঘটনাটি ফুটিয়ে তােলার জন্য তিনি সেটির কাছে গেলেন। কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করার কারণে লাভার ছাই আর ধোঁয়ার মধ্যে বন্দী হয়ে যান তিনি। পরে সেখানেই তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।
- সেলসাস : অন্য জনপ্রিয় লেখকদের, যাদের লেখা অনেকদিন বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে একজন হলেন আউলাস কর্নেলিয়াস সেলসাস। টিবারিয়াসের সময়ে তিনি যেখানে যা পেয়েছেন তাই দিয়ে মানুষকে গ্রিক শেখানাের চেষ্টা করেছেন। গ্রিক ঔষধের উপরে লেখা তার যে বইটা তিনি লিখেছিলেন সেটি আধুনিক যুগের প্রারম্ভে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তখন সেলসাসকে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল। সেটি ছিল তাকে দেয়া চরম সম্মান। ক্যালিগুলার আমলে পম্পােনিয়াস মেলা (সে সময়কার আরেকজন স্প্যানিশ জ্ঞানী ব্যক্তি) গ্রিক মহাকাশ বিজ্ঞানের উপরে নির্ভর করে একটি জনপ্রিয় ছােট ভূগােল বই লিখেছিলেন। তিনি সতর্কতার সাথে সেটি থেকে জটিল গাণিতিক বিষয়গুলাে বাদ দিয়েছিলেন যেন মানুষের জন্য পড়তে সহজ হয়। সে সময়ে তার এই মহাকাশবিজ্ঞানের বই খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি মধ্যযুগেও খুব সমাদৃত ছিল। মানুষের প্রাচীন ভূগােলের জ্ঞান বলতে যা বােঝায়, তা বইটিতে ছিল।
- ভিট্রুভিয়াস : প্রকৌশল বিদ্যা, যাতে রােমানরা সবসময় এগিয়ে ছিল, সেই ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় কাজ হয় সে সময়ে। অগাস্টাসের আমলে ভিট্রুভিয়াস (মার্কাস ভিট্রুিভিয়াস পােলিও) একটি বিশাল আকৃতির স্থাপত্যবিদ্যার বই লেখেন আর সম্রাটকে উৎসর্গ করেন। বহু বছর তার বইটিই ওই বিষয়ে একটি আদর্শ লেখা হিসেবে গণ্য হতাে।
- ফ্রন্টিনাস : বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় অবদান রাখার জন্য স্মরণ করা যেতে পারে সেটাস জুলিয়াস ফ্রন্টিনাসকে। তিনি ৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভেস্পাসিয়ানের অধীনে তিনি ব্রিটেন গভর্নরের কাজ করেন। তিনি সেনাবিজ্ঞান আর ভূমিজরিপের উপরে বই লেখেন। কিন্তু দুঃখজনক হলাে, তার বইগুলাে অবিকৃতভাবে পাওয়া যায়নি। ৯৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট নার্ভা তাকে রােমের জল সরবরাহের কাজ দেখাশােনা করার দায়িত্ব দেন। এর ফলে তিনি রােমের জল সরবরাহের বিভিন্ন দিক নিয়ে দুই ভলিউমে লেখা বইয়ের কাজ শেষ করেন। এটিই সম্ভবত মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন প্রকৌশল বিদ্যার বই। তিনি রােমান প্রকৌশলীদের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। কিন্তু মিশরিয় আর গ্রিক প্রকৌশলীদের সাথে তুলনা করলে সেটা তেমন কোনাে কৃতিত্বই নয়।
- ডিওসকরিডেস : গ্রিসের বিজ্ঞানচর্চার আলাে কমে এলেও তা সাম্রাজ্যের প্রাচীন পথপ্রদর্শক ছিল। নিরাের অধীনে সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন গ্রিক ডাক্তার ডিওসকরিডেস। তিনি গাছগাছড়া থেকে ঔষধ তৈরি করতে পছন্দ করতেন। এই সুবাদে গাছপালা ব্যবহার করে ঔষধ তৈরির পদ্ধতি বিষয়ে তিনি পাঁচটি বই লেখেন। এটিই হয়তাে ঔষধ তৈরির পদ্ধতি বিষয়ে সবচেয়ে প্রাচীন বই যা মধ্যযুগ পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
- হিরো : বলতে গেলে একই সময়ে, অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার আমলে একজন মহান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়। তার নাম ছিল হিরাে অথবা হিরােন। তিনিই ছিলেন প্রাচীন যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকৌশলী আর আবিষ্কারক। তিনি একটি শূন্য গােলাকার ফাঁপা বস্তু তৈরি করেছিলেন যার একটি বাঁকানাে হাতল ছিল। তাতে জল ফোটানাে যেত। হাতলের ভেতর দিয়ে বাষ্প বেরিয়ে এসে গােলাকার অংশটিকে ঘােরাত (আজকাল মাঠে জল দেয়ার জন্য এই সূত্রের ব্যবহার হয়)। এটিকে খুব প্রাচীন একটি স্টিম ইঞ্জিন বলা যেতে পারে। তখন যদি সমাজটা ততটা এগিয়ে থাকত যে তার এই আবিষ্কারের কদর জানত তবে সেখানে একটি শিল্প বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু সমাজের শিক্ষাদীক্ষা সেই পর্যায়ে ছিল না আর তাই সেই সূত্র কাজে কর্মে লাগাতে আরও সাতটি শতাব্দী লেগে গেছে। হিরাে বলবিদ্যা নিয়েও গবেষণা করতেন। তিনি বাতাসের গতিবিধি আর আচরণ নিয়ে গবেষণার পরে ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই কাজটি ছিল তার সময়ের জন্য অত্যন্ত আধুনিক।
উপসংহার : ক্যালিগুলা, নিরাে আর ডমিশিয়ানের সময়ে অস্থির অবস্থার মধ্যেই সাহিত্য আর বিজ্ঞানচর্চা অস্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলছিল। সে সময়ে দপ করে যে আলাে জ্বলে উঠেছিল, কেন যেন নার্ভা বা তার পরের যে সকল সম্রাট নার্ভার অনুসারী ছিলেন তাদের শাসনামলের শান্ত সময়ে আর সেভাবে জ্বলে ওঠেনি। বরং যেন সুস্থ সুন্দর নিয়মের আড়ালে সৃষ্টিশীলতায় ভাটা পড়েছিল।
ট্রাজান (রা. ৯৮ – ১১৭ খ্রি.)
ট্রাজানের উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও শান্তি : সত্যি কথা বলতে কী, ট্রাজানের মতাে রােমান নন এমন একজন প্রাদেশিক মানুষের পক্ষে সম্রাট হওয়া আর জনপ্রিয় হওয়া অসম্ভব হয়নি। এটাই প্রমাণ করে যে ইতালিতে জন্মানাে মানুষের শাসনের ব্যাপারে রােমে যে অগ্রাধিকার ছিল তা তখন শিথিল হয়ে এসেছিল। অগাস্টাস এই ইতালিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। একটির পরে একটি ঘটনার চাপে জুলিয়াস সিজারের পরিকল্পনার রােম যেন ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছিল। রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশের মানুষেরা শাসনকাজে অংশগ্রহণ করবে আর সবার মিলিত প্রচেষ্টায় সাম্রাজ্য পরিচালিত হবে এমন স্বপ্ন দেখতেন তিনি। নার্ভার মৃত্যুর সময়ে ট্রাজান রাইন আর দানিয়ুবের তীরবর্তী অঞ্চল সামলাচ্ছিলেন। ডমিশিয়ান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তিনি সেখানেই ছিলেন। একমাত্র যখন সেই এলাকায় রােমান আধিপত্য পুরােপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন তিনি রােমে ফেরত এসেছিলেন। তার অবর্তমানেও সেখানে তেমন কোনাে বিপর্যয় ঘটেনি। এটাই প্রমাণ করে যে নার্ভার আমলে ইতালিতে একটি অনাবিল প্রশান্তি বিরাজ করছিল যাতে একজন প্রাদেশিক প্রধানের অবর্তমানেও কোথাও কোনাে আঁচ লাগেনি। সব জায়গায়ই প্রশান্তি বজায় রাখার চেষ্টা দেখা যাচ্ছিল। ৯৯ খ্রিস্টাব্দে ট্রাজান বিপুল পরাক্রমে রােমে প্রবেশ করেন। তার ব্যক্তিত্ব আর বীরত্ব এক পলকে রােমের প্রিতােরিয়ান গার্ডদের মন জয় করে ফেলে।
রোমান সংস্কৃতির বিস্তৃতি ও ডেসিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা : ট্রাজান রােমের বাইরে রােমান সংস্কৃতির বিস্তৃতির জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। নব্বই বছর আগে জার্মানিতে ভ্যারাসের হত্যার পর থেকে রােমের নিয়ম কানুন প্রতিরক্ষামূলক ছিল। নতুন এলাকা দখলের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক আয়ের উপরে নির্ভরশীল ছিল তারা। কখনও ব্রিটেন বা রাইন-দানিয়ুবের তীর থেকে আসা অর্থও ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু তাতেও বিপক্ষ শক্তিগুলাের সাথে যে আর কোনাে ধরনের ঝামেলা হবে না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। ট্রাজানের চরিত্র এরকম ছিল না। তার চোখে, যথাযথ শত্রুর অভাবে রােম যেন একেবারে মিইয়ে পড়েছিল। ডমিশিয়ানের সময় ঝিমিয়ে পড়া যেন চরমে পৌঁছেছিল। ডমিশিয়ান ভালােমানুষি দেখানাের পরিবর্তে ডেসিয়ানদের ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্তি কায়েম করলেন। ট্রাজান এই অবস্থা বদলাতে চাইলেন। তিনি রােমের সেনাবাহিনীকে নতুন করে তৈরি করলেন। তাদের মনােবল দৃঢ় করার কাজে মনােযােগ দিলেন। তিনি রােমে ভালাে করে গেঁড়ে বসতে না বসতেই ডেসিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে লাগলেন। প্রথমত তিনি তার সংবর্ধনায় অংশ নিলেন। ১০১ খ্রিস্টাব্দে ডেসিবালাস (তখনও সেখানে একজন ডেসিয়ান রাজা ছিলেন) থেকে যখন হামলার হুমকি দেয়া হলাে, তখন দানিয়ুবের তীর ধরে ট্রাজান তার বাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। দানিয়ুবের তীর বেয়ে আরও উত্তরদিকে এগিয়ে যেতে যেতে রােমান সেনারা ভয়ংকর হয়ে উঠল। একসময় তারা ডেসিয়ানের ভেতরে প্রবেশ করে ফেলল। দুই বছরের মধ্যে ডেসিবালাসকে পুরােপুরি পরাস্ত করল তারা। তারপর তাকে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করল। চুক্তির ফলে সেখানে রােমান রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প খােলা হলাে। ডেসিবালাসের কাছে এর পরে রাজ্য পরিচালনা করা খুব অসম্মানজনক ছিল। ঠিক যেমন ডমিশিয়ানের শান্তিচুক্তি ছিল রােমের জন্য অসম্মানজনক। সুতরাং রােমানদের সবাই খুশিই হলাে। ডেসিবালাসের অপমানিত মুখ তাদের কারও মধ্যে কোনাে বেদনার উদ্রেক করেনি। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে ডেসিবালাস আবার রােমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। এবারে ডেসিয়ানরা আগের চেয়েও ভয়াবহ পরাজয় বরণ করে। ডেসিবালাস হতবুদ্ধি হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এবারে ট্রাজান আর কোনাে সুযােগ নেননি, কাজটি আধাআধি রাখেননি। ১০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডেসিয়ার পুরােটা দখল করে নেন আর সেটিকে রােমান প্রদেশ বানিয়ে ফেলেন। তারপরে তিনি সেখানে রােমান বাড়িঘর, শহর বানানাের কাজে হাত দেন যেন শহরটি দ্রুত রােমান সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কৃষ্ণসাগরের উত্তর তীর ঘেঁষে ডেসিয়ার অংশটি প্রকৃতপক্ষে রােমের মতাে করে সাজানাে যায়নি। এটি বহুদিন ধরে গ্রিসের মতােই ছিল। গ্রিক ভাষাভাষীদের বসবাস ছিল সেখানে। তখন রােমের অধীনে চলে গেল। সেইদিকের সমুদ্রতীরবর্তী প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তখন একটি মাত্র সরকারের অধীনে চলে গেল। রােমান সাম্রাজ্য উত্থানের আগে এরকমটা মানব সভ্যতার অন্য কোনাে ইতিহাসে দেখা যায়নি।
ডেসিয়ার রোমানাইজেশন, রোমানিয়া, আর ট্রাজানের কৃতিত্ব : ডেসিয়া কখনােই বিপদমুক্ত প্রদেশ ছিল না। এছাড়াও উত্তর আর পূর্বদিকে ছিল দলে দলে অসভ্য উপজাতির মানুষ। ডেসিয়া বলতে গেলে কোনাে দিক থেকেই সুরক্ষিত ছিল না। তাই সেখানে বারােমাসই হামলা, আক্রমণ লেগে থাকত। দেড়শ শতাব্দী ধরে রােমের অধীনে রাখার জন্য রােমকে ডেসিয়ার পেছনে এত বেশি অর্থ বিসর্জন দিতে হয় যে জায়গাটির কথা ভাবলে তা যেন হয়ে দাঁড়ায় খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। অবশ্য দানিয়ুবের দক্ষিণে ধনী দেশগুলােতে কিছু সরবরাহের ব্যাপারে ডেসিয়া সাহায্য করেছিল। একসময় দেখা গেল বহুবছর যাবৎ রােমের অধীনে থাকা দক্ষিণের ধনী প্রদেশগুলাের তুলনায় ডেসিয়াই বেশি রােমান হয়ে উঠেছে। তখনকার ডেসিয়া পরবর্তীকালে রুমানিয়া নাম পেয়েছে। বর্তমানে আমরা যাকে রােমানিয়া বলে জানি। নিজের নামের ভেতর দিয়েও দেশটি যেন রােমের স্মৃতি বহন করে চলেছে। আর সেখানকার বর্তমান অধিবাসীরাও নিজেদের ট্রাজানের সময়কার সেই রােমান উপনিবেশিকদের বংশধর বলেই মনে করে। বিষয়টি আরও নিশ্চিতভাবে বােঝা যায় কারণ রােমানিয়ার যে নিজস্ব ভাষাটি আছে তা প্রায় ল্যাটিনের মতাে। এটাকে এক ধরনের রােমান ভাষাই বলা যেতে পারে। (যদিও কিছু ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ আর পর্তুগিজ শব্দ ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করেছে)। তার পরের শত শত বছরে ভাষাটি হাজার হাজার দাসের মুখের সমুদ্রপ্রমাণ ভাষার সাথে মিলে গিয়ে, একবার উত্তরের প্রভাব, আরেকবার দক্ষিণের প্রভাব নিয়ে আজও টিকে আছে। ডেসিয়া জয়ের চিহ্নস্বরূপ ট্রাজানকে রােমে চিরকাল দাঁড় করিয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল। ১১০ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভের মধ্যে তার মূর্তি স্থাপন করে জয়ের মহিমা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই স্তম্ভের মধ্যে ডেসিয়া জয়ের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে খােদাইকৃত ২৫০০ মানুষের আকৃতি তৈরি করা হয়েছে। খােদাই কাজের এই বিশাল পরিসরে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে বন্দীদের হত্যা আর জয়ী হয়ে রােমে ফিরে আসা পর্যন্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
শিশুদের জন্মহার বৃদ্ধি : ব্যক্তিগত জীবনে ট্রাজান নার্ভার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তার ভেতরে এক দয়াশীল পিতা বাস করত। সরকারিভাবে দরিদ্র শিশুদের জন্য সাহায্য বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এটা যে কেবল মানবিক ব্যবহারের জায়গা থেকে করেছিলেন, তা নয়। সাম্রাজ্যে শিশু জন্মহার দিনদিন কমে যাচ্ছিল। তাই ভবিষ্যতে সেনার অভাব হতে পারে, এই বিষয়টি তাকে চিন্তায় ফেলেছিল। তিনি জানতেন, দরিদ্র পরিবারগুলােকে যদি সহায়তা দেয়া যায় তবে সেটাই ভবিষ্যতে প্রচুর সেনা তৈরি নিশ্চিত করবে। এটা মনে রাখা প্রয়ােজন যে, দুঃখজনক হলেও সত্যি, সে সময়ের রােমে মানুষের মৃত্যুর হার ছিল আজকের দিনের মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক বেশি। আজকের বিজ্ঞানে আর চিকিৎসায় উন্নত দেশগুলাের চেয়ে সেদিনের রােম অনেক পিছিয়ে ছিল। তাই মানুষের জীবনকালও ছিল কম। তাই জন্মহারে সামান্য উন্নতি সেদিনের রােমে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আজ সমস্ত পৃথিবীর কোথাও তার তত গুরুত্ব নেই। রােমের মতাে জন্মহার যদি ততটা কমে যেত তবে আজকের দিনে একটি পুরাে জাতি হয়তাে নিঃশেষ হয়ে যেত।
পূর্বাঞ্চলে দুর্নীতি বৃদ্ধি ও প্লিনির গভর্নর হওয়া : কিন্তু রােমে ট্রাজানের দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতি, যদিও সে সময়ে রােমের জন্য তিনি সুনামই বয়ে এনেছিলেন কিন্তু তবু রােমের জন্য সময়টা ততটা সুখকর ছিল না। তার অবর্তমানে সরকারের বিভিন্ন স্তরে অরাজকতা আর দুর্নীতি শুরু হয়েছিল। শহরগুলাে, বিশেষ করে পূর্বদিকের অঞ্চলগুলাে এত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গেল যে তাদের অর্থনীতি প্রায় ভেঙেই পড়ল। কেবল অর্থনৈতিক বিষয়েই নয়, রাস্তাঘাট বানানােসহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। ১১১ খ্রিস্টাব্দে ট্রাজান ছােট প্লিনিকে (গেইয়াস প্লিনিয়াস সিসিলিয়াস সেকুনডাস) বিথিনিয়াসের গভর্নর করে সেখানকার দায়িত্ব বুঝে নেবার জন্য পাঠান। (ছােট প্লিনি ছিলেন প্লিনির ভাগ্নে যিনি ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের সময় মারা যান আর তাকে একসময় বড় প্লিনি বলে ডাকা হতাে।) ছােট প্লিনি সেই সময়কার সাহিত্যের কিছু মহারথীর বন্ধু ছিলেন। বিশেষ করে তিনি মার্শাল আর ট্যাসিটাস ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ। তিনি নিজেও কখনও কখনও লেখালেখি করতেন।
খ্রিস্টানদের ওপর অনাচারের বিপক্ষে প্লিনি ও ট্রাজান : প্লিনি তার চিঠির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি সেই একচোখা চিঠিগুলাে ছাপিয়ে ছিলেন যেন মানুষ তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারে। সেগুলাের মধ্যে একটি চিঠি আজও মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চিঠিটি তিনি বিধিনিয়া থেকে ট্রাজানকে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি পড়লে মনে হয়, খ্রিস্টানরা যেন কেবল খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধেই শাস্তি পেয়ে যাচ্ছিল। এমনকি প্লিনি অনুভব করেছিলেন যে কোনাে খ্রিস্টান যদি স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয় তবে যেন তার সাত খুন মাফ হয়ে যাবে। সে আগে ধার্মিক খ্রিস্টান থাকলেও কোনাে ক্ষতি নেই, তাকে মাফ করে দেয়া হবে। এছাড়াও প্লিনি মানুষকে যত্রতত্র বিনাদোষে শাস্তি দেবার ব্যাপারটি নিয়েও খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। নানান ঘটনা দেখে শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে খ্রিস্টানদের জীবনযাপন মােটেও অপরাধীর জীবনযাপন নয়। বরং তারা খুব শান্তিপূর্ণ কাজেকর্মে অভ্যস্ত। তাদের আদর্শ অত্যন্ত উচ্চমানের। আর তখন প্লিনি তার এই অনুভূতিকে চিঠির মাধমে জনসমক্ষে উপস্থিত করেন। সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে খ্রিস্টধর্ম একটি শান্তির ধর্ম বলেই এত দ্রুত প্রচার পাচ্ছে। নমনীয় না হয়ে এটি যদি মানুষে মানুষে হানাহানি আর মারামারি বাড়িয়ে দিত তাহলে বিস্তৃতির ক্ষেত্রে এর পথ রুদ্ধ হতােই। ট্রাজান প্লিনির আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। খ্রিস্টানদের যেন অপরাধী হিসেবে বেছে বেছে ধরে আনা না হয় আর তাদের ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য না করা হয়, এ ব্যাপারে তিনি আদেশ দেন। ট্রাজান বলেন, একমাত্র তারা যদি সত্যি কোনাে অপরাধ করে থাকে আর আইনত তাদের শাস্তিবিধান হয় তবেই যেন তাদের শাস্তি দেয়া হয়। (প্রশ্নাতীতভাবে প্লিনি আর ট্রাজানকে আধুনিক যুগে “খ্রিস্টানদের প্রতি দয়ালু” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।) ছােট প্লিনি চিঠিগুলাে লেখার পরে খুব বেশিদিন বাঁচেননি। হয়তাে তিনি বিথিনিয়ার গভর্নর থাকা অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন।
আর্মেনিয়া ও পার্থিয়ার একাংশ দখল : ডেসিয়া দখলের পরে সেখানে স্বাধীনতা খুব বেশি দিন বজায় থাকেনি। কারণ পূর্বদিক থেকে ক্রমাগত হামলা হচ্ছিল। ডেসিয়ানরা রােমের পুরনাে শত্রু পার্থিয়ার কাছে সাহায্য চেয়েছিল, ট্রাজান সেটা ভােলেননি। তার উপরে এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে বিশাল উর্বর জমি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আর্মেনিয়া। সেই নিরাের আমলে রােমের সাথে একবার যুদ্ধ হয়েছিল। তারপর থেকে আর্মেনিয়ার সাথে বেশ বুঝেশুনেই চলছিল তারা। ১১৩ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য পার্থিয়ার রাজা প্রথম খোসরয়েস বা প্রথম খশরু আর্মেনিয়ায় একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন আর পঞ্চাশ বছরের সাময়িক যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভঙ্গ করলেন। পার্থিয়ার জন্য এরকম একটি কাজ করা ছিল সে সময়ে নিতান্তই বােকামি। কারণ কয়েক যুগ ধরেই তারা মােটামুটি বিপর্যয়ের মুখে ছিল। তাদের সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ির সাধারণ গণ্ডগােলে নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল আর রােম তখন ছিল পুরােপুরি শক্তিশালী আর সংগঠিত। সত্যি কথা বলতে কী, তার আগের বিশ বছরব্যাপী রােমান সেনাবাহিনী পুর্বদিকে এগােতে এগােতে আরবের সীমানা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। বাণিজ্যিক শহর পেত্রা, জুডিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ আর তার সাথে জুডিয়া আর মিশরের মাঝখানের সিনাই পেনিনসুলা রােম আগেই দখল করে ফেলেছিল এবং ১০৫ খ্রিস্টাব্দের ভেতরেই আরবীয় প্রদেশে পরিণত করেছিল। এটা প্রমাণ করে, পূর্বদিকে রােমের অবস্থান এতটাই পাকাপােক্ত ছিল যে পার্থিয়াকে হারিয়ে দেয়া তাদের জন্য তখন কোনাে বড় ব্যাপার নয়। খশরু হয়তাে সাথে সাথেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই দ্রুত ট্রাজানকে বােঝানাের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি খুব দেরি করে ফেলেছিলেন। ট্রাজান সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। তিনি বাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে হাঁটা শুরু করেন আর বলতে গেলে একেবারে লড়াইবিহীনভাবে আর্মেনিয়া দখল করে নেন। এটিকে রােমের দূরবর্তী একটি প্রদেশে পরিণত হতে হয়। তার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল আরও দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হওয়া। আরও এগিয়ে তারা পার্থিয়ার রাজধানী টেসিফোনে পৌঁছে গেলেন। সে শহর দখল করে মেসােপটেমিয়ার কাছাকাছি পার্সিয়ান সমুদ্রের তীরে উপস্থিত হন ট্রাজান। এটাই ছিল পূর্বদিকে রােমান সেনাবহরের দূরতম সফর। ষাট বছর বয়সী ট্রাজান সমুদ্রের তীরে পার্সিয়া আর ইন্ডিয়ার দিকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকিয়ে ছিলেন। ঠিক ওইখানে সাড়ে চারশ বছর আগে অ্যালেক্সান্ডার বিশাল জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। হতাশায় তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, “ইস্ আজ যদি আমার বয়স আরও কম থাকত!”
সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি : সেই সময়ে রােমান সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি পেয়েছিল। ১১৬ খ্রিস্টাব্দে (৮৬৯ রােমান অব্দে) ট্রাজান আসিরিয়া আর মেসোপটেমিয়াকেও রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। দুটোই রােমের প্রদেশ হয়ে যায় আর টাইগ্রিস নদী সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সীমানা হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ে রােমান সাম্রাজ্যে একদিকে ১৮০,০০০ মাইল, অন্যদিকে ৩,৫০০,০০০ মাইল রাস্তা দিয়ে ঘেরা ছিল। বলতে গেলে বর্তমান আমেরিকার আয়তনের সমান। তখন জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০০,০০০,০০০ এর কিছু বেশি। কেবল রােমেই ছিল ১,০০০,০০০ মানুষ। এখনকার হিসেবেও এটি ছিল একটি বিশাল সাম্রাজ্য। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এ পর্যন্ত যত সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়েছে (তুলনামূলকভাবে ক্ষণস্থায়ী পারস্য সাম্রাজ্য ছাড়া) তার মধ্যে এটি ছিল বিস্ময়কর। কোনাে সন্দেহ নেই, এই সাম্রাজ্য অগাস্টাসের পরবর্তী শতাব্দীর মানুষের মনে এমন ছাপ ফেলেছিল যে সাম্রাজ্যটি স্থাপনের পথে যত মৃত্যু আর হাহাকার ছিল তার সবটা এর বিশালতার কাছে উবে গেছে।
ট্রাজানের ফিরে যাওয়া ও মৃত্যু : কিন্তু পার্থিয়ানদের হার মানিয়ে রাখা রােমান সাম্রাজ্যের কাছে সহজ ছিল না। একবার প্রায় তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছিল। ট্রাজান সে সময়ে রােমের ভেতরে কোথাও অরাজকতার খবর পেয়ে সেখানে মনােনিবেশ করেন। পার্থিয়ার দিকে বহুদূর এগিয়েও আবার ফিরে আসেন। ১১৭ খ্রিস্টাব্দে ট্রাজান দক্ষিণ এশিয়া মাইনর থেকে রােমে ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন। .
হাড্রিয়ান (রা. ১১৭ – ১৩৮ খ্রি.)
সিংহাসনে আরোহন : সম্ভবত ১০৬ খ্রিস্টাব্দে ট্রাজান তার উত্তরাধিকারীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। উত্তরাধিকারী ছিলেন হ্যার্ডিয়ান (পাবলিয়াস এইরিয়াস হাড্রিয়ানাস)। তিনি ট্রাজানের ভাগ্নে ছিলেন। হাড্রিয়ান ডেসিয়ান যুদ্ধের সময়ে প্রবলভাবে লড়াই করেছিলেন। তারপর ট্রাজানের এক নাতনিকে বিয়ে করেন। ট্রাজানের মৃত্যুর পরে কোনাে দ্বিমত ছাড়াই তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন। শুরুতেই সেনাদের বাড়তি বােনাস দিয়ে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেন। তিনশ বছর ধরে চলে আসা রােমান সাম্রাজ্যে দাড়ি-গোঁফ চেছে ফেলার নিয়ম উড়িয়ে দেন তিনি। তিনিই ছিলেন রােমান সাম্রাজ্যে প্রথম সম্রাট যার মুখভরা দাড়ি-গোঁফ ছিল।
অর্থনৈতিক ক্ষতি, সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিকে আটকে দেয়া : যে সাম্রাজ্যে তিনি অধিষ্ঠিত হলেন সেটি যত শান্তিময় আর বিশাল মনে হয়েছিল, আদতে ঠিক ততটা ছিল না। ট্রাজানের একের পর এক আক্রমণের নেশা, যদিও সেগুলাে রােমান দেশপ্রেমিক আর ঐতিহ্যপ্রেমি মানুষদের জন্য ছিল খুবই প্রিয় উদ্যোগ, কিন্তু এই উদ্যোগগুলাে সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলেছিল। জায়গায় জায়গায় অর্থ নিয়ে এত টানাটানি পড়ে গিয়েছিল যেন আর কোনােদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। যেখানে যত সেনাবাহিনী সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে যুদ্ধে কিংবা পাহারায় লিপ্ত ছিল, তাদের যদি সেখানেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হতাে তবে তাদের খাবার আর অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহ করার জন্য যত অর্থ ব্যয়ের প্রয়ােজন, তা দেশের কেন্দ্রীয় অর্থ ব্যবস্থাকে দুর্বলতর করে ফেলবে, কোনাে সন্দেহ ছিল না। হাড্রিয়ান সেই ঝুঁকি নেয়ার সাহস পেলেন না। ট্রাজান যেমন জুলিয়াস সিজারের নীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন, হাড্রিয়ান তেমনি অগাস্টাসের আদর্শ ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় নিয়ােজিত হলেন। তিনি রােমকে একটি নতুন লক্ষ্য দিতে চাইলেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে চাইলেন যেন সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করার পরে এমনভাবে তাকে রক্ষা করেন যে ভেতরে কোনােরকমের উত্তেজনার সৃষ্টি না হয় আর বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি ট্রাজানের পূর্বদিকে দখলের লড়াই বন্ধ ঘােষণা করলেন। আর সিদ্ধান্ত নেয়ার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে রােমান সাম্রাজ্য যতটুকু পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল সেই আয়তন নিয়েই পরবর্তী তেরােটি শতাব্দীব্যাপী দাঁড়িয়ে রইল। রােমান সাম্রাজ্যের শেষ শহরটি বেদখল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তের আর পরিবর্তন হয়নি। পুরাে মেসােপটেমিয়ান অঞ্চল পর্থিয়ার হাতে চলে গেল। ইউফ্রেটিসের উপরের দিকটা রক্ষা করা ততটা কঠিন ছিল না। তাই টাইগ্রিস আবার রােমান সাম্রাজ্যের সীমানা হয়ে রইল। পার্থিয়ার সাথে আর কোনাে যুদ্ধের কোনাে ইচ্ছে ছিল না। পার্থিয়া নিজেই খুব ভেঙে পড়েছিল। অবশ্য হাড্রিয়ান নিজেই আর্মেনিয়াকে রােমের প্রদেশ করতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। আর বিনা চেষ্টাতে এটি রােমের একটি প্রদেশ হয়ে বহুকাল টিকেছিল। এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে রােম থেকে পাঁচশ মাইল দূরেও তাদের রাজত্ব বহাল ছিল। কাস্পিয়ান সাগর আর পার্সিয়ান সাগরের তীরে বিপুল গর্ব নিয়ে রােম দাড়িয়ে ছিল।
ডেসিয়ার অবস্থা, দাসদের অবস্থার উন্নয়ন, কর আদায় বৃদ্ধি ও মন্দিরের সংস্কার : হাড্রিয়ান ডেসিয়ায় অসভ্য কিছু জাতির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধের দায়িত্ব তিনি কোনােরকমে পালন করেন। যদিও তিনি মনে মনে বেশ অস্থিরতার মধ্যে থাকতেন যে ট্রাজানের মতাে পরাক্রম দেখাতে পারছেন কি না। ডেসিয়া ছিল এমন একটা জায়গা যেখানে রােমানরা দলে দলে বারবার এসেছে। যতবার তারা এর দখল নিয়েছে তার চেয়ে এটাকে অসভ্য উপজাতিদের মধ্যে ছেড়ে দিলেই ভালাে হতাে। নার্ভা আর ট্রাজানের মানুষকে খুশি করা আর আনন্দে রাখার প্রচেষ্টাগুলাে হাড্রিয়ান চালু রেখেছিলেন। তিনি রােমে অবস্থানকারী দাসদের অল্প খরচে চিকিৎসা ব্যবস্থা দেয়ার জন্য আইনও করেছিলেন। সে সময়ে শুধু রােমেই ৪০০,০০০ দাস ছিল। অবশ্য তাদের সংখ্যা দিনদিন কমছিল। হাড্রিয়ান দরিদ্র শিশুদের পড়াশােনার জন্য স্কুল বানিয়েছিল। তিনি এই ধরনের পদক্ষেপগুলাে সিনেটে আলােচনার মাধ্যমে নিতেন। এসব কাজ করার জন্য তিনি অনেক সমালােচনার মুখে পড়েন। প্রিতোরিয়ান গার্ডদের মধ্যে একজন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে তাকে হত্যা করা হয়। করের কিছু নিয়মকানুন পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের কর আদায় বৃদ্ধি করেন। যদিও তিনি অতিরিক্ত কোনাে কর আরােপ করেননি বরং কমিয়েছিলেন। তিনি সকল দেবতাদের মন্দিরের (প্যান্থিয়ন) নতুন করে সংস্কার করেন। রােমে আগুন লাগার সময়ে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
ভূমিদাস প্রথার সূত্রপাত : তখনও রােমান অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপই ছিল। বিশেষ করে কৃষিকাজে। অগাস্টাস যখন রােমের আইনকানুন তৈরি করেন, শত শত বছরের দেশ দখলের নেশা তখন কিছুটা কমে আসে। দখলকৃত দেশগুলাে থেকে হাজার হাজার দাসের আগমনও তখন বন্ধ হতে থাকে। বন্দী দাসদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করে নিয়ে যাওয়া হতাে। তারা যেহেতু স্থির কোনাে সম্পত্তি ছিল না, বহনযােগ্য উপাদান ছিল, তাই যেখানে যখন কাজ পাওয়া যেত, তাদের সেখানেই নিয়ে যাওয়া হতাে। শহরে সেনা আর সাধারণ বসবাসকারীর সংখ্যা (যারা খাদ্য উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে না) বেড়ে যাচ্ছিল কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছিল। তাই খামারে কাজ করার জন্য মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল। আর তাদের কাজের বিনিময়ে নিলাম ডাকা দাম খুব বেড়ে গিয়েছিল। এই মূল্য এতই বেড়ে যাচ্ছিল যে আইন করে দাসদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকতে বাধ্য করা হলাে। এটাই ছিল মধ্যযুগে প্রচলিত ভূমিদাসপ্রথার মােটামুটি প্রারম্ভ।
সিনেটের অবস্থা : এমনকি হাড্রিয়ানও সিনেটকে অনেক সম্মান প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু সিনেট নিজেই ধীরে ধীরে নিজের সম্মান খুইয়েছে। ততদিনে সিনেট যে আইন প্রণয়নে কোনাে ভূমিকা রাখে এমন চিহ্নই ছিল না। কেবল সম্রাটের ইচ্ছাতেই আইন হয়ে যেত। অবশ্য হাড্রিয়ান মনে করতেন, একজন সজাগ সম্রাট যেমন তেমনভাবে অধ্যাদেশ জারি করতে পারে না। কারও সাথে সাধারণ আলােচনার ভিত্তিতেও কোনাে আইন পাশ হওয়া উচিত নয়। কিছু আইনজীবী নিয়ে একটি কমিটি করে তাদের সাথে পরামর্শ করে যা ভালাে মনে হতাে, তিনি তাই করতেন।
ব্রিটেইনে ভ্রমণ ও সংস্কার, এবং পার্থিয়ারাজের সঙ্গে বৈঠক : হাড্রিয়ান ছিলেন বুদ্ধিমান এবং প্রাচীনপন্থী। তিনি কেবল রােমের ব্যাপারে নয়, বরং সমগ্র সাম্রাজ্যের বিষয়ে একইরকম চিন্তিত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার একুশ বছরের শাসনামলের বেশিরভাগ বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণে ব্যস্ত থাকতেই কেটে গেছে। তিনি প্রজাদের দেখতে আর নিজেকে প্রজাদের কাছে তুলে ধরতে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন। ১২১ সালে তিনি রাজ্যের পশ্চিম আর উত্তর দিকে সফরের উদ্দেশ্যে গাউল আর জার্মানিতে যান। সেখান থেকে তিনি ব্রিটেন প্রবেশ করেন। ব্রিটেন ততদিনে পুরােপুরি রােমান হয়ে গিয়েছিল। কম করে হলেও, ব্রিটেন তখন রােমের হাতে চলে আসার আশি বছর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উত্তর দিকের দ্বীপগুলাে তখনও রােমের অধীন হয়নি। সেখানে কিছু বন্য জাতির বসবাস ছিল যারা তখনও রােমের হস্তগত হয়নি। হাড্রিয়ান সেখানে গিয়ে ভীষণভাবে সেনাবাহিনী নিয়ে নতুন কিছু করার জন্য উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি সেখানে তাদের দিয়ে একটি দেয়াল (হাড্রিয়ানের দেয়াল) নির্মাণ করলেন। সেই দেয়ালটিই বর্তমানে ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডকে পৃথক করেছে। দেয়ালের দক্ষিণদিকে রােমানরা অবস্থান নিয়েছিল। অসংগঠিত কিছু উপজাতীয় দলের লােকজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের জন্য সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। রােমের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ব্রিটেন তারপর থেকে শান্তিতেই দিন কাটাতে লাগল। তার পরের তিনশ বছরে সেখানে কেবল উন্নতি ছাড়া কোনাে অবনতি হয়নি। হাড্রিয়ান তারপরে স্পেন আর আফ্রিকা সফর করেন। তারপর আরও পূর্বদিকে যেতে থাকলেন। পার্থিয়ার সাথে সমস্যা আবারও ঘনীভূত হয়ে আসছিল দেখে হাড্রিয়ান সেখানকার রাজার সাথে একটি বৈঠক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেখানে তাদের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ নিয়ে আলােচনা করে তিনি তাদের সাথে সকল ঝুলতে থাকা সমস্যার সমাধান করেন।
গ্রিস ও এশিয়া মাইনোরে সংস্কার : শেষ পর্যন্ত তার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল যেখানে যাওয়ার, সেই গ্রিসে তিনি পৌঁছান। হাড্রিয়ানের সময় পর্যন্ত গ্রিসের সভ্যতার বয়স তখন সাড়ে পাঁচশ বছর। এথেন্স তখন তার কাছে এতটাই পুরনাে যেমন আমাদের কাছে পুরনাে রেনেসাঁর জাগরণ। জ্ঞানী লােকেরা তখন জেনে গেছে যে গ্রিসের সেই সময়টাই ছিল তার স্বর্ণযুগ। সেটি পৃথিবীর আদি সভ্যতার ইতিহাসেও ছিল এক বিশাল এবং অন্যরকমের ঘটনা। হাড্রিয়ান, যিনি কিনা গ্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন, এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন। ১২৫ খ্রিস্টাব্দে (৮৭৮ রােমান সাল) হাড্রিয়ান যখন গ্রিস সফর করেন তখন সেখানে তার পক্ষে এমন কিছুই করার ছিল না যা গ্রিসকে আরও উন্নত করতে পারে। তিনি তাই সেখানে অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক কিছু পরিবর্তন আনেন। পুরনাে কিছু ইমারতের ক্ষয় ঠিকঠাক করান আর নতুন কিছু ইমারত তৈরি করান। তিনি এলিউসিনিয়ান ধর্মের অনুষ্ঠানগুলােতে অংশগ্রহণের অনুমতি পান যেখানে কিনা নিরােকে পরিত্যক্ত ঘােষণা করা হয়েছিল। তিনি নতুন করে শহর তৈরি করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর যেটি তার হাত ধরে দাঁড়ায় তা হলাে থ্যারাস, যাকে তার সম্মানে হাড্রিয়াননাপলিস (হাড্রিয়ানের শহর) বলা হয়ে থাকে। এই নামটিই ইংরেজিতে অ্যাড্রিয়ানােপােল হয়ে যায়। এখন শহরটি টার্কির একটি অংশ যাকে এডিন নামে ডাকা হয়। ১২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এথেন্সে আবার এসেছিলেন আরও লম্বা সফরের পরিকল্পনা নিয়ে। তিনি সেবারে আরেকবার মিশর আর পূর্বদিকটা ঘুরে যান।
জুডিয়ায় সংস্কার, বার কোচাবার বিদ্রোহ ও বিদ্রোহ-দমন : কেবল জুডিয়ায় গিয়ে তিনি একটি মহাভুল করে বসেন। তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত জেরুজালেম নতুন করে রােমের মতাে করে বানানাের আদেশ দেন। আবার ইহুদিদের মন্দিরের জায়গায় জুপিটারের একটি মন্দিরও নির্মাণের নির্দেশ দেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে ইহুদিদের মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই ঘটনার কারণে হতাশ হয়ে ইহুদিদের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর হওয়া সত্ত্বেও ইহুদিদের কাছে তার পবিত্রতা একই রকম ছিল। তাই তাদের প্রিয় শহরের পরিবর্তনের পরিকল্পনায় তারা রুখে দাঁড়িয়েছিল। এটা স্বীকার করতেই হবে যে ইহুদিরা বহুবছর ধরে খুব অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। তবে ট্রাজান কিংবা নার্ভা যে তাদের প্রতি কোনাে অবিচার করেছে, তা নয়। তাদের একজন নেতার অপেক্ষা আর ক্রমাগত নিজেদের মন্দিরের উপরে হামলা এর কারণ হতে পারে। ট্রাজান যখন পূর্বদিকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, ইহুদিরা তখন মিশরের পশ্চিম দিকে সাইরেন শহরে বিদ্রোহ শুরু করে। ট্রাজানের পূর্বদিকে আর বেশি অগ্রসর না হওয়ার জন্য এটি একটি মূল কারণ। সাইরেনের বিদ্রোহ দমন করা হয় ঠিকই কিন্তু হাড্রিয়ানের আদেশ নির্দেশ যে তারা খুব একটা মানত তা প্রমাণ হয় না। জুডিয়ার ইহুদি বিদ্রোহের নেতা, বার-কোচাবা (সূর্যের পুত্র) ছিলেন অসম্ভব সাহসী। তিনি সেই সময়ের নামকরা ইহুদি শিক্ষক রাব্বি আকিবাহর কাছে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনিই বার-কোচাবাকে একজন মাসিহা হিসেবে তৈরি কব্রার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত চেষ্টাই ছিল বৃথা। আকিবাহকে বন্দী করে অত্যাচার করে মারা হয়। তার পরের তিন বছর ধরে যেখানে যখন একজন ইহুদি বিদ্রোহী নেতা জেগে উঠেছিল, অনেক সাহস আর সংকল্প থাকা সত্ত্বেও তাকেই বন্দী করা হয়েছে। এভাবে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ৮৮৮ সালে) বার-কোচাবাকেও বন্দী করে হত্যা করা হয়। জুডিয়া থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। জেরুজালেমের মন্দিরের আশেপাশে তাদের নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। প্রায় দুই হাজার বছর তারা জাতি হিসেবে ইতিহাসে কোনাে ছাপ রাখতে পারেনি। এই সময়টা ছিল তাদের জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মতাে। বহু শতাব্দীব্যাপী পৃথিবীর সব জায়গায় তাদের সংখ্যালঘু হিসেবে দেখা হয়েছে। সবখানে তারা পেয়েছে কেবল দুর্ব্যবহার আর ঘৃণা। তারা প্রায়শই শিকার হয়েছে আক্রমণ আর হত্যার। এত সব কিছু হওয়ার পরেও তাদের নিজস্ব বিধাতার প্রতি বিশ্বাস ছিল অটুট। সেই বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে কোনােরকমে পৃথিবীর আনাচেকানাচে তারা ঠিকই বেঁচে ছিল।
সাহিত্যচর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা : হাড্রিয়ান সাহিত্যের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। সালটানিয়াস তার ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে অনেকদিন কাজ করেছিলেন। হাড্রিয়ানের সময়কার বিখ্যাত সাহিত্যিকগণ –
- প্লুটার্ক: বিখ্যাত গ্রিক সাহিত্যিক প্লুটার্কও একসময় সম্রাট হাড্রিয়ানের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিলেন। সম্রাট তাকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গ্রিসের প্রতিনিধি বানিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য এভাবে হাড্রিয়ান গ্রিসকেও বশ করে রেখেছিলেন যে সেখানে একজন দেশি গভর্নর নিয়ােজিত আছেন। গ্রিসের সভ্যতা বিকাশের উষালগ্নে প্লুটার্ক ছিলেন একজন মূল বাস্তব রূপদানকারী। সাম্রাজ্যের দখলে থাকা অবস্থায় গ্রিসকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। গ্রিসের নিজের শহরগুলাের উপরেও চলেছে তাণ্ডব। ম্যাসিডােনিয়ান আর রােমান হামলার ধকল তাে গ্রিসকে নিতেই হয়েছে তাছাড়া রােমান সাম্রাজ্যের ভেতরের অস্থিরতারও অনেক চিহ্ন আছে শহরটিতে। গ্রিসের জনসংখ্যা কমে এসেছিল! আর প্রতাপও এসেছিল কমে। কিন্তু দেশটির প্রভাব প্রতিপত্তি কমে এলেও, গ্রিস স্থাপত্য, কৃষি আর শিল্পে যে অবদান রেখেছিল তার স্মৃতিচিহ্ন সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে যে পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছে তা গ্রিসের জন্য ছিল গর্বের আর সৌভাগ্যের বিষয়। প্লুটার্কের রচনার মধ্যে এই গর্বের কথা স্পষ্ট উঠে এসেছিল। তার লেখার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলাে সমান্তরাল জীবন। এই লেখায় একজন গ্রিক ও একজন রােমানের জীবনযাপন নিয়ে তুলনা করা হয়েছে। জোড়াটি এমনভাবে বেছে নেয়া বেহয়েছিল যেন এদের জীবনাচরণের মধ্যে মিল খুঁজে বের করাই ছিল উদ্দেশ্য। কোরিওলানাস আর অলসিবিয়াডিস (প্রথমজন রােমের আর দ্বিতীয়জন এথেন্সের বিশ্বাসঘাতক) ছিল ওই সাহিত্যে দুটি চরিত্র। রচনাটি এতই উপভােগ্য আর চরিত্রগুলাের দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা এতই বাস্তবসম্মত ছিল যে এটি তখন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখনও মানুষ তার রচনা পড়ছে।
- আরিয়ান : হাড্রিয়ানের সময়ে আরেকজন গ্রিক লেখকের খুব নামডাক হয়েছিল, তিনি হলেন আরিয়ান। তিনি তার রােমান নাম প্লেভিয়াস আরিয়ানাস নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিথিনিয়ায় ৯৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। হাড্রিয়ান তাকে ১৩১ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্পাডোকিয়ার গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ দেন। তিনি আর্মেনিয়ায় অনুপ্রবেশকারী আলানি উপজাতিকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালান। এটাই ছিল একজন গ্রিকের রােমান বাহিনী নিয়ে প্রথম আক্রমণ। অনেক বই রচনা করেছিলেন তিনি। তার কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলাে অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের জীবনী। ধরে নেয়া হয়, এটি লেখা হয়েছিল সমসাময়িক বিভিন্ন লেখাকে উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। অ্যালেক্সান্ডারের বন্ধু জেনারেল টলেমি, যিনি অ্যালেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরে মিশরের রাজার সিংহাসনে বসেছিলেন, তিনি তাকে নিয়ে একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন। সেই জীবনী থেকে আরিয়ান তার বিখ্যাত লেখায় অনেক তথ্য ব্যবহার করেন।
- হাড্রিয়ান নিজে : হাড্রিয়ান নিজেও লেখার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তিনি নিজের সৃষ্টিকে অভিজ্ঞদের সৃষ্টির সাথে তুলনা করতে পছন্দ করতেন। নিরাের মতাে নিজের রচনার ব্যাপারে একচোখা ছিলেন না। মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে তিনি নিজের আত্মার উদ্দেশ্যে একটি কীর্তন কবিতা লিখেছিলেন। এই ধরনের মহিমা কীর্তন অনেক রকমের কবিতার জগতে একটি পৃথক জায়গা করে নিয়েছে। তার সেই শেষ লেখাটিকে একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি বলে ধরে নেয়া হয়। ল্যাটিন ভাষায় এটি, “Animula, vagula, blandula,/ Hospes conesque corporis,/ Quae nunc abibis in loca/ Pallidula, frigida, nudula, Nec,/ ut soles, dabis joka.” এর অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: “ধীর হও প্রিয় আত্মা,/ নশ্বর এ শরীরের অতিথি, সঙ্গী আমার,/ এবারে কোথায় যাও ছুটে?/ দুর্বল, শীতল আর নগ্ন তুমি,/ শান্তি বিলানােই কি তােমার লক্ষ্য নয়?”
অ্যান্টোনিনাস পায়াস (রা. ১৩৮ – ১৬১ খ্রি.)
সিংহাসনে আরোহন : হাড্রিয়ানেরও নার্ভা আর ট্রাজানের মতাে কোনাে পুত্রসন্তান ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর আগেই একজন উত্তরাধিকারীকে খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। তার প্রথম পছন্দ ততটা যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু সৌভাগ্যবশত হাড্রিয়ান মারা যাবার আগেই উত্তরাধিকারীর মৃত্যু হয়। আর তখন হাড্রিয়ানকে আরেকজন উত্তরাধিকারীর খোঁজ করতে হয়। দ্বিতীয়বারে হাড্রিয়ানের ভাগ্য ভালাে ছিল। হাড্রিয়ান অ্যান্টেনিনাসকে (টাইটাস অরেলিয়াস কালভাস ইওনাস আরিয়াস অ্যান্টোনিনাস) উত্তরাধিকারী হিসেবে স্থির করলেন। ১২০ খ্রিস্টাব্দে কনসল হিসেবে কাজ করা সহ তিনি বিভিন্ন সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এশিয়ায় প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবেও বেশ উল্লেখযােগ্য সময় কাজ করেছেন। হাড্রিয়ান যখন তাকে নির্বাচন করেছিলেন ততদিনে অ্যান্টোনিনাসের বয়স বাহান্নো বছর হয়ে গেছে। তাই অ্যান্টোনিনাসকেও নিজের উত্তরাধিকারী খোঁজার কাজ শুরু করতে হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরাধিকারী হিসেবে দুইজন মানুষকে ঠিক করা হলাে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যান্টোনিনাসের স্ত্রীর ভাগ্নে। সেই তরুণটি ছিলেন সাহসী আর দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ১৩৮ খ্রিস্টাব্দে (৮৯১ সালে) হাড্রিয়ান মৃত্যুবরণ করেন। তারপরে অ্যান্টোনিনাস কোনােরকম ঝামেলা ছাড়াই সিংহাসনে আরােহণ করেন।
তদকালীন খ্রিস্টধর্মের বিকাশ : অ্যান্টোনিনাস হয়তােবা সমস্ত রােমান সম্রাটের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে ভদ্র আর মানবিক। পিতৃঋণ শােধ করার মতাে আগের সব সম্রাটের তৈরি ভালাে ভালাে নিয়মকানুন তার অধীনে চমৎকারভাবে চলতে লাগল। তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি নমনীয় ভাব প্রদর্শনের জন্য আইন করেন। ততদিনে ইহুদি আর খ্রিস্টধর্মের মধ্যে সম্পর্কটি অন্য ধর্মাবলম্বী রােমানদের কাছে কিছুটা পরিস্কার হয়েছে। একই বৃন্ত থেকে জন্মগ্রহণকারী দুইটি ধর্মকে তখন মানুষ শত্রু মনে করত। যেহেতু হাড্রিয়ানের সময় পর্যন্ত ইহুদিরা জুডিয়ায় বিদ্রোহ জারি রেখেছিল, তাই খ্রিস্টানরা স্বাভাবিকভাবেই রােমের বন্ধু হয়ে গেল। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতাে, “শত্রুর শত্রু তাে আমার বন্ধুই হবে।” মানুষকে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান করে ফেলা ইহুদি বানানাের চেয়ে সহজ ছিল। আর সেটা সফলভাবে করাও গেছে। তাই খ্রিস্টধর্ম খুব দ্রুত মহিলা, দাস আর দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এই মানুষেরা তাদের নিজের জীবনের জটিলতা নিয়েই ব্যস্ত থাকত যদিও দেশে শান্তি বিরাজ করছে অথবা দেশে একটি সুস্থ সরকার ব্যবস্থা আছে। খ্রিস্টানদের পরকালে বিশ্বাস, যার কারণে তারা মনে করত যে এই নশ্বর পৃথিবী প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় জন্মের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জায়গা, এখানকার কাজের ভিত্তিতে কেবল মানুষকে বিচার করা হবে যে সে পরকালে কতটা সুখী হওয়ার যােগ্যতা রাখে, এই শ্রেণির মানুষের জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় তথ্য। তবু বহুদিন যাবৎ খ্রিস্টধর্ম কেবল শহুরে ধর্মই থেকে গেল। খামারে কাজ করা মানুষেরা এই নতুন ধ্যান ধারণার বাইরে রয়ে গেল। তারা তাদের জীবনে নতুন কিছু গ্রহণ করতে ভরসা পেত না। নিজেদেরকে প্রাচীন পদ্ধতির আওতায় রাখতেই বেশি শান্তি পেত। তাই তারা তাদের প্রাচীন ধর্মগুলাে নিয়েই বসে থাকল। সেই সময় “প্যাগান” শব্দটি সেরকম মানুষের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতাে, যারা না ইহুদি আর না খ্রিস্টান। কিন্তু তারা তাদের দেশীয় প্রাচীন কোনাে ধর্মে বিশ্বাসী। প্যাগান শব্দটি ল্যাটিন শব্দ “পিজ্যান্ট” অথবা কৃষক থেকে এসেছে। আর “পাগাস” শব্দের অর্থ, যারা গ্রামে বাস করে। একইভাবে “হিথেন” শব্দের অর্থ যে হিথে বসবাস করে। হিথ মানে হলাে দূরবর্তী কোনাে অঞ্চল। কিন্তু তবু খ্রিস্টধর্মকে শহুরে পুঁজিবাদীদের নিজস্ব ধর্ম মনে করার কোনাে কারণ ছিল না। শিক্ষিতদের মধ্যেও এই ধর্ম একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল।
জাস্টিন মার্টার : এমনকি কিছু দার্শনিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জাস্টিনের কথা (যাকে সাধারণত তার মৃত্যুর ধরন অনুযায়ী জাস্টিন মার্টার বলা হয়ে থাকে)। তিনি ১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জুডিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও রােমে তার “প্যাগান” ধর্মাবলম্বী পিতামাতা ছিলেন তার আর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন গ্রিক ভাষায়, কিন্তু যিশুর মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের বিষয়ে ইহুদিদের জ্ঞানগর্ভ রচনাগুলাে এড়াতে পারেননি। তিনি নিজের আদর্শ বিসর্জন না দিয়েই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। তিনি তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার বলে খ্রিস্টধর্মের গােড়ার কথা আলােচনা করতেন। তাই তিনি হয়ে ওঠেন একজন বিখ্যাত খ্রিস্টান “অ্যাপােলজিস্ট”। (অ্যাপােলজিস্ট হলাে তিনি, যিনি কোন কিছুর পক্ষে থেকে তার রক্ষা করার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেন।) জাস্টিন মার্টার ইহুদিদের সাথে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক করতেন। রােমে তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে খ্রিষ্ঠান ধর্মের ব্যাপারে শিক্ষা প্রদান করা হতাে। তার রচনা হাড্রিয়ান আর অ্যান্টোনিনাস পর্যন্ত পৌঁছানাে উচিত ছিল যারা কিনা খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি অতি উদার মনােভাব দেখিয়ে এসেছেন। অবশ্য ইহুদিদের বিদ্রোহ সত্ত্বেও অ্যান্টোনিনাস তাদের প্রতি সদয় ছিলেন।
ঘুরে বেড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান ও ধার্মিকতা : অ্যান্টোনিনাস তার মধ্যবয়সে সিংহাসনে আরােহণের সময়ও সুস্থ ছিলেন। তার পর থেকে পচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত তিনি তেইশ বছরব্যাপী রাজত্ব করেন। তার রাজত্বকাল ছিল রােমে একটি শান্তির শাসনামল। অ্যান্টোনিনাস হাড্রিয়ানের মতাে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানাের বাতিক গ্রহণ করেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিভিন্ন প্রদেশে হাড্রিয়ান নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আশায় যেভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন তাতে করে সেই অঞ্চলের প্রাদেশিক কোষাগারের জমা রা অর্থই শুধু খরচ হয়েছে। তাছাড়া এভাবে বেরিয়ে পড়লে খােদ রােমেই দীর্ঘদিনের জন্য সম্রাটের অভাব হয়। এভাবে বারবার রাজকার্যে বাধা পড়ে। আর তাতে সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি যা হয় তা হলাে, পুরাে সাম্রাজ্যের উপরে ইতালির প্রভাবটা কমে আসে। এত কিছুর পরেও হাড্রিয়ানের মৃত্যুর সময়ে সিনেট যুক্তিহীনভাবে ইতালি কেন্দ্রিক লােকদেখানাে আচার অনুষ্ঠান করছিল। মৃত সম্রাটকে স্বর্গীয় দেবতার সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে দ্বিমত পােষণ করেছিল। অ্যান্টোনিনাসকে তারপরেও সিনেটকে খুশি করার জন্য ব্যক্তিগত চেষ্টা করতে হয়েছে। অ্যান্টোনিনাসকে এজন্য ভীষণ ধার্মিক আর মৃত পিতার প্রতি নিজ সন্তানসুলভ আচরণ দেখাতে হয়েছে। এরকম অতিরিক্ত ধার্মিক আচরণ প্রদর্শনের জন্য তার নাম হয়ে গিয়েছিল অ্যান্টোনিয়াস পায়াস। ইতিহাসে এই নামেই তিনি সুপরিচিত।
ব্রিটেইনে দেয়াল নির্মাণ ও মৃত্যু : তার রাজত্বের সময়ে কেবল একটি মাত্র সীমানায় সমস্যা হচ্ছিল, সেটি হলাে ব্রিটেন। হাড্রিয়ান দেয়ালের উত্তর দিকে চরমভাবাপন্ন উপজাতিরা আক্রমণ করে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু রােমান সরকার তাদের বাধা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিল। তাদের আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্য বাঁচানাের জন্য তিনি সীমানা ঘেঁষে আরেকটি দেয়াল নির্মাণ করেন। এই দেয়ালটি পড়েছে বর্তমানের স্কটল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডের নদীর মােহনা থেকে শুরু করে আরও সামনে যতদূর চোখ যায়। এই দেয়ালটির নাম “অ্যান্টোনাইনের দেয়াল”। দুর্দমনীয় উপজাতিদের জন্য এটি ছিল দ্বিতীয় বাধা। জীবিত অবস্থায় যেমন শান্তি বিলিয়েছেন, শেষ সময়েও তেমনই শান্তিতে অ্যান্টোনিনাস মৃত্যুবরণ করেন ১৬১ খ্রিস্টাব্দে (৯১৬ রােমান সাল)। তার জীবনের শেষ দিনটিতে যখন রাজপুরির দারােয়ান এসে তার কাছ থেকে সেদিনের পাসওয়ার্ড জানতে চান, তিনি কেবল “প্রশান্তি” (“ইকোয়ানিমিটি”) বলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
মার্কাস অরেলিয়াস (রা. ১৬১ – ১৮০ খ্রি.)
মার্কাস অরেলিয়াস ও লুসিয়াস ভেরাসের ক্ষমতায় আরোহন : হাড্রিয়ানের নির্দেশে অ্যান্টোনিনাস যে দুজন ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীকে খুঁজে বের করেছিলেন, হাড্রিয়ানের মৃত্যুর সামান্য আগে তাদের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করা হয়। তিনি ছিলেন মার্কাস অরেলিয়াস (মার্কাস এইলিয়াস অরেলিয়াস অ্যান্টোনিনাস)। তিনি ছিলেন অ্যান্টোনিনাসের মেয়ের স্বামী। অপরজন ছিলেন লুসিয়াস অরেলিয়াস ভ্যারাস (রা. ১৬১ – ১৬৯ খ্রি.), যাকে অ্যান্টোনিনাস সিংহাসনের উপযুক্ত বলে মনে করেননি। যাই হােক, মার্কাস অরেলিয়াস ভাবতেন যে লুসিয়াস ভ্যারাসেরও সিংহাসনে বসার যথেষ্ট অধিকার আছে। আর তাই তিনি তার সাথে এমন ব্যবহার করতেন যেন সিংহাসনটি তিনি তার সাথে একসাথে ভােগ করতে চান। তিনি দেখাতে চাইতেন যে ক্ষমতার প্রতি লুসিয়াসেরও তার মতােই অধিকার আর কর্তব্য আছে। এভাবেই সেবারে ইতিহাসে প্রথম দুজন ম্রাট একসাথে শাসনকাজ পরিচালনা করছিলেন। এই ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য একটি অন্যরকম উদাহরণ হয়ে রইল। আরও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, লুসিয়াস ভ্যারাস আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি কেবল সম্রাট হওয়ার সুযােগসুবিধাগুলাে ভােগ করতে পছন্দ করতেন। তাই যাবতীয় সুখ সাচ্ছন্দে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। মার্কাস অরেলিয়াস একাই সাম্রাজ্যের সকল সমস্যা সমাধান করতেন। আর তাই তাদের সেই দ্বৈত শাসনামলের মধ্যে মার্কাস অরেলিয়াসকেই সকলে মনে রেখেছে। লুসিয়াস ভ্যারাস বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন।
এপিকটেটাস ও মার্কাস অরেলিয়াসের স্টয়সিজম : মার্কাস অরেলিয়াস ছিলেন তাকে দত্তক গ্রহণকারী পিতার পরে একজন আদর্শ শাসক। পাঁচশ বছর আগে প্লেটো বলেছিলেন যে পৃথিবী কখনও ঠিকঠাকমতাে চলবে না যতক্ষণ না রাজারা সব দার্শনিক হয়ে যাবে কিংবা দার্শনিক রাজপুত্র জন্মাবে। মার্কাস অরেলিয়াসের ক্ষেত্রে প্লেটোর এই কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। মার্কাস একাধারে ছিলেন একজন শক্তিশালী শাসক আর সম্মানিত দার্শনিক। তার রচনা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। প্রকৃতপক্ষে মার্কাস অরেলিয়াস ছিলেন জোনাের আদর্শে বিশ্বাসী একজন স্টয়িক (জীবনের যাবতীয় অর্জন আর ব্যর্থতার প্রতি উদাসীন)। এমনিতে অ্যান্টোনিনাসের সময়েও স্টয়সিজম কিছুটা প্রশ্রয় পেয়ে আসছিল। রােমান সাম্রাজ্যের সেই সময়টিতে এর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এপিকটেটাসের মাধ্যমে। তিনি একজন গ্রিক যিনি জন্ম (৬০ খ্রিস্টাব্দে) থেকেই দাস ছিলেন। তার স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল আর একটি পা ছিল খোড়া (সম্ভবত কোনাে নিষ্ঠুর মনিবের রাগের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাকে খুব অল্পবয়সে রােমে আনা হয়। সেখানে তিনি স্টয়িক মতবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকদের বক্তৃতা শােনার সুযােগ পান। তিনি তাদের আদর্শে ভীষণভাবে প্রভাবিত হন। দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করার পরে তিনি একজন শিক্ষক হয়ে যান। নিজের মতাদর্শ শিক্ষা দিতে থাকেন। ডমিশিয়ানের সময় যখন দার্শনিকদের রােম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তখন এপিকটেটাসকেও রােম ছাড়তে হয়। এটা ছিল ৮৯ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। তিনি অবসর গ্রহণ করে নিকোপেলিসে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। নিকোপেলিস হলাে অগাস্টাসের পত্তন করা শহর, অ্যাক্টিয়ামের কাছে মার্ক অ্যান্থনির সাথে শেষ যুদ্ধ জয়ের পরে অগাস্টাস এই শহরটি বানিয়েছিলেন। নিকোপােলিসে এপিকটেটাস জীবনের শেষ দিনগুলােতে শিক্ষা দান করে কাটান। এপিকটেটাস তার নিজহাতে কিছু না লিখলেও, তার শিক্ষা গ্রহণকারী অনেকের মধ্যেই তার আদর্শ লিপিবদ্ধ করা হয়ে গেছে। তার সবচেয়ে নামকরা ছাত্র ছিলেন আরিয়ান (অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের জীবনী লেখক)। তিনি এপিকটেটাসের আদর্শ দুইটি খণ্ডে লিপিবদ্ধ করেছিলেন যার কিছু অংশ উদ্ধার করা গেছে। এপিকটেটাসের দর্শন ছিল দয়ার আর মানবিকতার। যেমন তিনি বলতেন, “বাঁচ আর বাঁচতে দাও” এবং “সহ্য কর আর সংযম কর”। মার্কাস অরেলিয়াস যখন তরুণ ছিলেন তখনই স্টয়িক মতবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আর পরবর্তীকালে সম্রাট হওয়ার কারণে স্টয়সিজমের শিক্ষা দান করতে করতে একজন বিশিষ্ট স্টয়িক হিসেবে পরিচিতও হয়েছিলেন। মার্কাস অরেলিয়াস সুখ ভােগে বিশ্বাস করতেন না, বরং তার বিশ্বাস ছিল উত্তেজনাবিহীন প্রশান্তিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা আর সংযমে। নিজের জীবনের পথে কোনাে কষ্টকর দায়িত্ব পালন থেকে তিনি পিছ পা হননি। তার জীবন যেমন যুদ্ধে যুদ্ধে এগিয়ে গেছে, তার মধ্যে নিজের সব চিন্তা ভাবনাকে একটি নােটবুকে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন তিনি। উদ্ধারকৃত ছােট্ট এ বইটির নাম তিনি দিয়েছিলেন “ধ্যান” (“মেডিটেশন”)। এই গ্রন্থটি আজও ব্যাপক জনপ্রিয় এজন্য যে, তার মতাে বিলাসবহুল জীবনে আর সম্মানিত অবস্থানে একজন মানুষ কী করে এত জ্ঞানপিপাসু আর ধৈর্যশীল হতে পারে।
পার্থিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় : কিন্তু মার্কাস অরেলিয়াস জীবনে ততটা শান্তি পাননি যতটা তিনি পেতে পারতেন। অ্যান্টোনিনাসের শান্তিপূর্ণ রাজত্ব যেন তার মৃত্যুর মাধ্যমেই সমাপ্ত হয়েছিল। তার পর থেকেই রােমের বিভিন্ন দিক থেকে নানারকম সমস্যার উদ্ভব হয়। রােমের বিরুদ্ধে কিছু শত্রু রাতারাতি তৈরি হয়ে যায়। পূর্বদিকে রােমের পুরনাে শত্রু পার্থিয়ানরা হঠাৎ করে জেগে ওঠে। তারা আকস্মিক আর্মেনিয়া দখলের জন্য মরিয়া হয়ে যায়। তারা সিরিয়ায় প্রবেশ করে যুদ্ধ ঘােষণা করে। রােমান সেনাবাহিনী যুগ্ম সম্রাট লুসিয়াস ভ্যারাসের নেতৃত্বে পূর্বদিকে ছুটে যায়। পার্থিয়ানরা পরাজিত হয়। রােমানরা উল্টো মেসােপটেমিয়ায় গেঁড়ে বসে আর তাদের রাজধানী টেসিফোনে আগুন লাগিয়ে দেয়। ১৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুনরায় রােমে শান্তি স্থাপিত হয় আর তার তিন বছরের মাথায় লুসিয়ান ভ্যারাসের মৃত্যু হয়। মার্কাস অরেলিয়াস তখন রােমের একক সম্রাট হয়ে যান। পার্থিয়ানরা হয়তাে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল রােম দখলের জন্য কিন্তু হেরে গেলে কী হবে সেটা ভেবে দেখেনি।
মহামারী, রোমের জনসংখ্যা হ্রাস ও বার্বারিয়ানদের শহরে নিয়ে আসা : পূর্বদিকে ভারত আর চীনের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা আজীবনই কলেরা আর প্লেগের মতাে ভয়াবহ অসুখের প্রকোপে নাজেহাল ছিল। ওইসব দেশের মানুষ এই অসুখগুলাের সাথেই ওঠাবসা করত, মানে সেখানে সবসময়েই কোনাে না কোনাে এলাকায় এগুলাে লেগে থাকত। এক একবার এক একটি অসুখের প্রকোপ বেড়ে যেত, মহামারী আকারে একটি বিশেষ জীবাণুর নাম শােনা যেত। তারপর সেই মহামারী ভ্রমণকারী, সেনা বা ভয়ার্ত রিফিউজিদের শরীরে বাহিত হয়ে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। অন্য সববারের মতােই সেবার প্লেগ অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। অসুখটি ইউরােপে প্রবেশ করল। এটি এতই ভয়াবহ ছিল যে এথেন্সকে ঘায়েল করে ফেলল। এই ঘটনাটি মার্কাস অরেলিয়াসের ক্ষমতায় আসার ছয়শ বছর আগের। গ্রিসের সাথে স্পার্থার যখন লম্বা যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তখনকার ঘটনা এটি। রােগটি গ্রিসের মানুষকে এমনভাবে অসুস্থ করে ফেলে যেন মনে হয় এথেন্স যুদ্ধে হেরেই যাবে। এই প্লেগ অনেকটা এথেন্সের প্রতাপ কমিয়ে গ্রিসের ধ্বংস শুরুর জন্য দায়ী। মার্কাস অরেলিয়াসের শাসনামলের বারাে শতাব্দী পরে আরেকরকমের প্লেগ (বিখ্যাত কালাজ্বর) ইউরােপকে সাবাড় করে দিয়েছিল। সেবারে এই কালাজ্বর ইউরােপের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা কমিয়ে দেয়। এই দুই ভয়াবহ প্লেগের মাঝখানে একটি এসেছিল, মার্কাস অরেলিয়াসের সময়ে, সেটির গুরুত্বও কম নয়। এটা গুটি বসন্তের মহামারী হতে পারে। পার্থিয়ায় যেসব সেনা যুদ্ধে রত ছিল তারা অনেকে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হলাে। এই মহামারী তাদের ক্রমশ দুর্বল করে দিলাে। সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা শরীরে জীবাণু বয়ে রােমে আর অন্যান্য প্রদেশে নিয়ে এলাে। পুরাে সাম্রাজ্যের মানুষের মধ্যে ভয়াবহভাবে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ল। যােদ্ধা আর কৃষকের সাম্রাজ্যে এমন ছাপ ফেলে গেল যে চিরকালের জন্য সেটি দুর্বল হয়ে গেল। গুটি বসন্তের প্রকোপে রােম শহরের জনসংখ্যা সেই যে কমে গেল, বিংশ শতাব্দীর আগে সেই সংখ্যা আর অগাস্টাস কিংবা ট্রাজানের সময়ের সমান হয়নি। এভাবে জনসংখ্যা কমে যাওয়াটা সাম্রাজ্যের জন্য একরকম ভয়ংকর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তাই মার্কাস অরেলিয়াস উত্তর দিক থেকে অসভ্য কিছু জাতিকে সেখানে এসে থাকার আহ্বান জানালেন। এটাই ছিল রােমান পেন্ডুলামের সর্বপ্রথম জার্মানির দিকে ঝুঁকে যাওয়া।
মহামারীর ফলে খ্রিস্টানদের ওপর হামলা ও বিদ্রোহের আশঙ্কা ইতালির ভয়ার্ত জনগােষ্ঠী ওই মহামারীর জন্য কাউকে না কাউকে দোষ দিতে উদ্যত হলাে। তারা একাধারে খ্রিস্টানদের উপরে এর দোষ চাপিয়ে দিলাে। আর তখনই আরম্ভ হলাে ধর্মের কারণে মানুষের উপরে অত্যাচার। সেই সময়ে ডাইনি খুঁজে বের করার ঘটনায় যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন জাস্টিন মার্টার। কোনাে সন্দেহ নেই যে মার্কাস অরেলিয়াস তার আদর্শ অনুযায়ী এ ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছিলেন মানুষকে বিরত করতে। কিন্তু গুজবে কান দেয়া মানুষের উদভ্রান্ত আক্রোশ সামলানাে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এটা নিশ্চিত ছিল যে মার্কাস অরেলিয়াস সাম্রাজ্যের আদর্শ এবং লক্ষ্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাজ্যের ধর্ম আর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি আর সবার থেকে চিন্তায় আর চেতনায় অন্যরকম ছিলেন। তার কাছে নিশ্চয়ই খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা তখন হয়ে উঠেছিল দেশের শান্তি হরণকারী এক জাতি। তার শাসনামলের সেই সময়টাতে রােমে অশান্তি আর হানাহানি এতই বেড়ে গেল যে তার আগের কয়েক সম্রাটের আমলে এমনটা দেখা যায়নি। তিনি বুঝতে পারলেন যে দেশে বিদ্রোহের আশঙ্কা বাড়ছে আর তার পক্ষে সেটা সামাল দেয়া দুঃসাধ্য হবে। তাই খ্রিস্টানদের উপরে অত্যাচার যেটা তিনি অন্যায় হিসেবেই জানতেন, তা বন্ধ করার আইনানুগ উদ্যোগ নিলেন।
মার্কোম্যানির নেতৃত্বে জার্মানিক উপজাতিদের আক্রমণ ও মৃত্যু : রােমের বাইরে রােমের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় ছিল মার্কোম্যানির নেতৃত্বে জার্মানির উপজাতি দল। তারা এখনকার উত্তর বেভারিয়ায় বাস করত। দানিয়ুবের উত্তর দিকে আরও কিছু উপজাতির সাথে যুক্ত হয়েছিল তারা। পার্থিয়ার সাথে রােমের পুরনাে শত্রুতার সুযােগ নিয়ে তারা উত্তর দিক থেকে রােমে আক্রমণ করল। প্রায় পনেরাে বছরব্যাপী মার্কাস অরেলিয়াস এই ম্যাকোম্যানিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গেলেন। নিজের জায়গা থেকে যাত্রা করে তাদের হটিয়ে দেয়ার জন্য অনেকদূর পর্যন্ত যাত্রা করলেন। জার্মানিকে বারবার পরাজিত করার পরেও তারা ক্রমাগত জেগে উঠছিল। মােটের উপরে রােমের সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আগের কয়েকশ বছরে রােমকে আশেপাশের উপজাতিদের সাথে এত যুদ্ধ করতে হয়েছে আর তাদের এত জায়গা রােম দখল করেছে যে তখন ওই যুদ্ধে জিত ছাড়া কিছুতেই হার মানা যেত না। কিন্তু রােমের অবস্থা অটুট রাখার জন্য যেটুকু সংযমের দরকার ছিল তা কখনও পালন করা হয়নি। সেভাবে চলতে চলতে যা হওয়ার তাই হলাে, পরের শতাব্দীর মানুষদের কপালে যে ক্ষয়প্রাপ্ত রােমের চেহারা অবশ্যম্ভাবী ছিল, তাই দেখল তারা। মার্কাস অরেলিয়াস ১৮০ খ্রিস্টাব্দে (৯৩৩ রােমান সালে) মারা যান। তার রাজত্বকাল ছিল ১৯ বছর। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন । আর সত্যি বলতে কী, তিনি তখনও জার্মানির বিরুদ্ধেই লড়ছিলেন। তার মৃত্যুর স্থানটি আধুনিক ভিয়েনার কাছে একটি জায়গা।
অ্যান্টোনাইনদের আমল
শান্তির কাল : ৯৬ খ্রিস্টাব্দে নার্ভার মৃত্যু থেকে শুরু করে ১৮০ খ্রিস্টাব্দে মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যু পর্যন্ত চুরাশি বছর ধরে রােমান সাম্রাজ্যে মানুষ মূলত শান্তিতেই ছিল। ওই বছরগুলােতে সরকার ব্যবস্থাকে ভদ্র আর ন্যায়পরায়ণ খেতাবই দেয়া চলে। সেই সময়ে পার্থিয়া, ডেসিয়া আর ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ লেগেছিল বটে, তবে সেসব রোম থেকে অনেক দূরে। সেসব যুদ্ধ হয়েছিল সাম্রাজ্যের বাইরের মাটিতে। আর তাই রােমান প্রদেশগুলােতে তেমন প্রলয়ঙ্করী কোনাে ছাপ ফেলতে পারেনি। বিদ্রোহীও কম ছিল না সে সময়টাতে। যেমন হাড্রিয়ানের সময়ে ছিল ইহুদি বিদ্রোহীরা। এসেছিল হঠাৎ করে জেগে ওঠা একজন জেনারেলের বাহিনী, সিরিয়ার যুদ্ধের সময়কার ঘটনা। ঘটনাটি ছিল ১৭৫ সালে আর তারা বিদ্রোহ সংগঠনের আশায় গুজব রটিয়েছিল যে জেনারেল মার্কোম্যানির হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যু হয়েছে। এই সমস্ত বিদ্রোহীদের দমন করা হয়েছিল অত্যন্ত নিপুণভাবে। এসব দুর্ঘটনা সেই সময়ের বিরাজমান শান্তির ক্ষেত্রে খুবই ছােট ছােট উপদ্রব। বলে রাখা ভালাে যে ১৮শ শতাব্দীর ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন তার বিখ্যাত বাণীতে বলেছেন যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত জাতির যত কালের যত রাজত্বের ইতিহাস আছে, তার মধ্যে রােমান সাম্রাজ্যের অ্যান্টোনাইনদের সময়ের মতাে এরকম সময় আর কখনও আসেনি। একই সাথে অসংখ্য মানুষ সে আমলে আশাতীত দীর্ঘ সময়ের জন্য শান্তিতে ছিল। একভাবে চিন্তা করলে তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কারণ আমরা যদি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে ভাবি, তাহলে অ্যান্টোনাইনরা ছিল সবচেয়ে সফল শাসক। অন্যান্য শতাব্দীতে যখন রাজ্যে রাজ্যে লাগাতার যুদ্ধ লেগে ছিল, তার চেয়ে সে সময়টা অনেক ভালাে ছিল। এমনকি তাদের শাসনামলের পরের কয়েকটি বছর, যখন কিনা নানারকম অসভ্য জাতির উৎপাত লেগে ছিল, সে সময়টার চেয়েও অ্যান্টোনাইনদের সময়টা ভালাে ছিল। আর তখন যখন অসংখ্য ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত সরকারের সৃষ্টি হয়েছিল, তার চেয়ে তাে সে সময়টা ভালাে ছিলই। যে কেউ বলতে পারে যে আজকের এই উত্তপ্ত পৃথিবীটা (রােমসহ বাকি পুরাে পৃথিবী) যে অ্যাটম বােমার ভয়ংকর ছায়ায় ছেয়ে আছে, তার চেয়ে বরং সে সময়টা অনেক অনেক ভালাে ছিল।
এই কালের সমস্যা : এটা সত্য যে অ্যান্টোনাইনের সময়টা যদি শান্তি আর স্থিরতার হয়ে থাকে তবে তা ছিল রােমান সাম্রাজ্যের জন্য অস্বাভাবিক ধকলের পরে এক টুকরাে শান্তি আর স্থিরতা। কারণ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল গ্রিক আর রােমানদের উপর্যুপরি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। একটি সাম্রাজ্য যখন এত বিশাল আর এত ভয়ংকর শক্তিশালী হয়, তখন তাকে অনেক ধাক্কা আর দুর্যোগ সহ্য করেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রােমান সাম্রাজ্য একটি বীরের মতো তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ােজিত করে দাঁড়িয়ে ছিল। এটা যেন এক অতিমানব যােদ্ধার মতাে নিজের অস্তিত্ব জাহির করা। কিন্তু তারপরেও এর অবস্থা এতই আশঙ্কাজনক ছিল যে জয়ের পক্ষে যথেষ্ট নয়। ১৬৬ খ্রিস্টাব্দের মহামারী হয়তােবা সাম্রাজ্যের মানুষের মধ্যে যেটুকু সাহস আর ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল তাও কেড়ে নিয়েছিল। একের পর এক সম্রাটের রােমকে দেখার মতাে আকর্ষণীয় একটি স্থানে পরিণত করতে চাওয়ার উদ্যোগ সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থাকে আরও ধসিয়ে দিয়েছে। অ্যান্টোনাইনদের সময়ে শতশত, হাজার হাজার রােমান নাগরিককে বিনা খরচে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। তখন প্রতি তিন দিনের মধ্যে একদিন থাকত ছুটি। আর সেই ছুটির দিনটিতে তাদের বিনােদনের জন্য রথের প্রতিযােগিতা, গ্ল্যাডিয়েটরে যুদ্ধ আর নানারকমের পশুপাখির খেলার ব্যবস্থা থাকত। এগুলাের সবই ছিল মারাত্মক ব্যয়সাপেক্ষ। তাছাড়া অল্পদিনের জন্য মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য অর্থনীতিকে দীর্ঘদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে এসব বিনােদনের ব্যবস্থা করাটা ছিল খুবই অবিবেচকের মতাে কাজ। (প্রকৃতপক্ষে সে সময়ে যেসব রোমান ওই ধরনের বিনােদনে আগ্রহী ছিল, তারা খুব উপভােগ করত। নিজেদের উত্তরাধিকারীদের কথা তেমন একটা ভাবেনি তারা। তাদের জন্য কোনাে কিছুই রেখে যেতে চায়নি। এখন আমাদের এই প্রজন্ম যারা যথেচ্ছা পৃথিবীকে দূষিত করছে আর পৃথিবীর সীমিত সম্পদ ধ্বংস করছে তারাও একই ধরনের অপরাধে অপরাধী। তাই কেবল সেই যুগের রােমান নাগরিকদের দিকে আঙুল তােলার কোনাে অধিকার অন্তত আমাদের নেই।)
অ্যান্টোনাইন আমলের কতিপয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব :
- সাহিত্যিক লুসিয়াস অ্যাপােলেইয়াস : অ্যান্টোনাইনদের আমলের অতিরিক্ত বিনােদনে ভােগা জাতির একঘেয়ে জীবনে সাহিত্যের ভাণ্ডার দিনদিন কমে আসছিল। অ্যান্টোনাইনদের সময়ের শেষের দিকের একমাত্র উল্লেখযােগ্য সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হলেন লুসিয়াস অ্যাপােলেইয়াস, যিনি জন্মেছিলেন ১২৪ খ্রিস্টাব্দে নিউমিডিয়ায়। তিনি এথেন্সে শিক্ষা গ্রহণ করেন আর রােমে কিছুদিনের জন্য বসবাস করেন। কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান কার্থেজে। “সােনার গাধা” (দ্য গােল্ডেন অ্যাস) বইয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। রচনাটিতে একজন মানুষের কল্পনার জগৎ দেখানাে হয়। একজন মানুষ হঠাৎ গাধায় পরিণত হয়ে যায় এবং তারপরে তার পশুজীবনে নানান মজাদার ঘটনা ঘটতে থাকে। “কিউপিড অ্যান্ড সাইক” নামে বিখ্যাত গল্পটি ওই বইয়েরই অন্তর্ভুক্ত। এটি প্রাচীন গল্প বলার ঢঙে লেখা অদ্ভুত এবং অসাধারণ একটি রচনা।
- জ্যোতির্বিদ টলেমি : বিজ্ঞানচর্চা কমে আসছিল সে সময়ে। অ্যান্টোনাইনদের শাসনামলে বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে কেবল দুটো নাম উল্লেখযােগ্য। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন গ্রিক (অথবা মিশরিয়ও হতে পারেন) মহাকাশ বিজ্ঞানী। তিনি হাড্রিয়ান আর অ্যান্টোনিনাসের আমলে মিশরে বাস করতেন। তিনি হলেন ক্লডিয়াস টলেমিয়াস। ইংরেজি ভাষায় তিনি কেবল টলেমি, নামে পরিচিত। তিনি সমস্ত গ্রিক মহাকাশবিজ্ঞানীর কাজকে একত্র করে একটি এনসাইক্লোপেডিয়ার মতাে সংকলন তৈরি করেছিলেন। সেই বইটি মধ্যযুগেও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। তিনি যদি ওই সংকলনটি না করতেন তবে প্রাচীন যুগের সমস্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণার ইতিহাস একরকম হারিয়েই যেত। এটি যেন তার আগের পরে শত বছরের মহকাশ গবেষণার ইতিহাস। যেহেতু টলেমির আঁকা মহাবিশ্বের ছবিতে পৃথিবীকে কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, সেহেতু এই ধরনের মডেলে কেন্দ্রে পৃথিবী সম্পন্ন ছবিটিকে বলা হয় “টলেমির সিস্টেম”।
- চিকিৎসক গ্যালেন : টলেমির চেয়ে বয়সে কিছুটা ছােট ছিলেন গ্যালেন। তিনি ছিলেন একজন গ্রিক চিকিৎসক যিনি এশিয়া মাইনরে জন্মগ্রহণ করেন ১৩০ খ্রিস্টাব্দে। ১৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রােমে বসবাস করা শুরু করেন এবং মার্কাস অরেলিয়াসের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তিনি ঔষধের উপরে গবেষণা গ্রন্থ লেখেন। তার বইগুলাে মধ্যযুগেও মানুষ পড়েছে। এমনকি আধুনিক যুগ পর্যন্ত সেসব ঔষধের প্রয়ােগ দেখা গেছে।
ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ও খ্রিস্টধর্মে দলাদলির সৃষ্টি : সে সময়ে সাম্রাজ্যের বােঝা বাড়ছিল আর স্বেচ্ছায় সেসব বােঝা বহনের মানুষের সংখ্যা দিনদিন কমছিল। মনে হচ্ছিল এভাবেই যেন বােঝার ভারে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে। আর হয়েছিলও তাই। যদিও এসব একঘেয়েমি আর ক্লান্তি সব ধরনের প্রচেষ্টাকে ঘায়েল করতে পারে না। তারপর একসময় পৃথিবীকে অটুট রাখার বাস্তব প্রয়ােজনীয়তা মানুষের মনে নাড়া দেয়। মানুষ নিজের সাথে বসবাসরত এই গ্রহটির সম্পর্ক গভীরভাবে বুঝতে শেখে। অবশ্য সে সময়ে বিজ্ঞান, শিল্পচর্চা আর সাহিত্যের যে তেমন কোনাে উন্নতি হয়নি এর সপক্ষে একটি যুক্তি দেয়া যায় যে বুদ্ধিমান মানুষেরা তখন একটি নতুন প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তা হলাে ধর্মতত্ত্ব (থিওলজি)। শুধু যে ইহুদি আর খ্রিস্টানরা নিজেদের ধর্ম নিয়ে তর্কে লিপ্ত ছিল তাই নয়। আবার তারা একসাথে হয়ে যে রােমের প্রাচীন ধর্মগুলাের বিরুদ্ধে লড়ছিল তাও নয়। কেবল খ্রিস্টানদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের অনেক দল হয়ে গেল। (একটি দল প্রাচীন মতে বিশ্বাসী হলে তাদের বলা হলাে “গোড়া” (অর্থোডক্স)। গ্রিক ভাষায় অর্থোডক্সের অর্থ হলাে “সরল বিশ্বাসী”। আরেকটি দল প্রাচীন ধর্মকে খারিজ করে দিয়ে নতুন নিয়মকানুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বলে তাদের বলা হলাে “নব্যতান্ত্রিক” (হেরেসিস)। গ্রিক ভাষায় হেরেসিস শব্দের অর্থ হলাে “নিজের জন্য বেছে নেয়া”।
নস্টিসিজমের উদ্ভব ও অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের সাথে সংঘাত : খ্রিস্টধর্মের প্রথম দিকের দশ বছর ধরে একদল খ্রিস্টান তাদের নিজস্ব এক ধরনের মতামত আঁকড়ে নিয়ে বসে ছিল। তাদের আদর্শকে বলা হয় “নস্টিসিজম”। এটা প্রাথমিক হেরেসিস দলের শুরু বলা যেতে পারে। নস্টিসিজম একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ হলাে জ্ঞান। নস্টিসিজম দাবি করত যে জ্ঞানই মুক্তি যা একমাত্র পৃথিবীকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। এখানে জ্ঞান বলতে আমরা পরিবর্তন আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যা অর্জন করি তাকে বােঝায়। প্রকৃতপক্ষে নস্টিসিজমের আবির্ভাব হয়েছিল খ্রিস্টধর্মেরও আগে। সেই মতাদর্শের মধ্যে পার্সিয়ান ধর্মের কিছু ছায়া ছিল। মূলত পার্সিয়ান ধর্মের আদর্শে ভালােমন্দের বিচার আরেকটি অশুভ শক্তির বর্ণনা একইরকমের ছিল। ভালাে আর খারাপের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তার বিষয়গুলােও ছিল একইরকম। খ্রিস্টধর্ম আসতে আসতে বেশ কিছু নস্টিসিজম অনুসারী খ্রিস্টধর্মের প্রতিপাদ্য বিষয়টি গ্রহণ করে নিলাে। কিছু কিছু খ্রিস্টান নস্টিসিজম অনুসারী বিধাতাকে সব শুভ শক্তির আধার বলে স্বীকার করত। কিন্তু মনে করত যে বিধাতার সাথে মানুষের যে দূরত্ব তা মানুষ কখনােই অতিক্রম করতে পারবে না। আসলে একটি অশুভ শক্তির প্ররােচনায় এই পৃথিবীর সৃষ্টি আর বাইবেলের প্রাচীন পর্যায় হিসেবে তার নাম হলাে জিহােভা। যিশু হলেন বিধাতার সন্তান যিনি জিহােভার হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে এখানে নেমে এসেছেন। সাধারণভাবে নস্টিসিজমের অনুসারীরা ছিলেন কিছুটা উগ্র। অন্যদিকে বাইবেলের পুরনাে পর্যায়ের স্বর্গীয় বিচার অনুযায়ী আজকে যাদের আমরা অর্থোডক্স মনে করি, সেই একই বর্ণনার জায়গা থেকে জিহােভাকে মনে করা হয় বিধাতা। জিহােভাকে অশুভ শক্তি মনে করা মানে তাদেরকে ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়া। এটাই প্রথম এমন ঘটনা যা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলল। আর এই ঘটনার ভয়াবহতা এতটাই প্রকট হয়ে উঠল যে এই মতপার্থক্য খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মের মানুষদের বিদ্বেষের চেয়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের বিদ্বেষই বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠল।
মন্টানাস, মাহিহার আগমনে বিশ্বাস ও পৃথিবীকে নেতিবাচক বলে ভাবা : খ্রিস্টধর্মের শিক্ষকেরাও তাদের নিজস্ব জ্ঞান আর মতবাদ জাহির করতে লাগলেন। তবে তারা অনুতপ্ত লোকেদের শিক্ষা আর সহযােগিতা করে যাচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন যার নাম মন্টানাস, তিনি অ্যান্টোনিনাস পায়াসের সময় নিজেকে বিধাতার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত বিশেষ একজন দূত হিসেবে দাবি করেন। তিনি মানুষকে ধর্মশিক্ষা দিতে থাকেন আর যিশুর দ্বিতীয় আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। এটাও বিশেষ মাসিহার জন্য এক ধরনের অপেক্ষা। ইহুদিরাও এরকম একজন মাসিহার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অপেক্ষা করে ছিল। কিছু ইহুদি শিক্ষকেরা তাদের বুঝিয়েছিলেন যে একজন বিশেষ মাসিহা আগমন অবশ্যম্ভাবী। তাদের বক্তব্য যারা শুনেছিল, সবাই বিশ্বাস করেছিল। যিশুর আবির্ভাবের পর যখন কিছু ইহুদি আর বেশিরভাগ অন্য ধর্মের মানুষেরা তাকে মাসিহা হিসেবে ধরে নিলো, আর অন্তর্ধানের পরে আরেকজন মাসিহার আগমনের প্রতীক্ষায় প্রজন্মের পরে প্রজন্ম বসে রইল। অনেক প্রজন্ম পরেও তাদের মধ্যে হতাশা দেখা যায়নি। তারা একজন আরেকজনকে খবর পৌঁছে দিয়েছে যে আরেকজন মাসিহা আসবেন, আর এভাবেই প্রতি প্রজন্মে বিশ্বাসটি প্রবাহিত হয়েছে। (“জিহােভার সাক্ষী” (Jehovah’s Witnesses) দলটি আসলে তারাই যারা বিশ্বাস করে যে পুনরায় আরেকজন মাসিহার আগমন ঘটবেই ঘটবে।) মন্টানাস একটি বিশেষ ধর্মীয় দলের সৃষ্টি করেন যারা বিশ্বাস কত্রে যে যিশু আবার আবির্ভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষকে পার্থিব সবকিছু বর্জন করে, পাপ চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একটি রক্ষণশীল জীবনযাপন করতে হবে। তিনি সেই ধর্মোপদেশই দিয়েছিলেন যাকে আজকের জগতে আমরা বলি “কঠোর নীতির অনুসারী” (“পিউরিট্যানিক্যাল”)। আর এভাবেই বেশিরভাগ মানুষ এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে নিজেদের সমস্ত শক্তি আর ক্ষমতা অন্য আরেকটি উন্নত পৃথিবীর আশায় নিয়োজিত কবুল। তারা এই পৃথিবীর উন্নয়নসাধন করতে ভুলে গেল। আর ধীরে ধীরে বিদ্যমান পৃথিবীকে হয় মূল্যহীন না-হয় শয়তানের আখড়া ভেবে নিলাে।
কমােডাস (রা. ১৮০ – ১৯২ খ্রি.)
সিংহাসনে আরোহন : কিন্তু সবকিছু এতটা খারাপের দিকে যেত না যদি কিনা মার্কাস অরেলিয়াস আর আগের চারজন সম্রাটের আদর্শ মেনে চলতেন। তিনি যদি তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী একজন উপযুক্ত উত্তরাধিকারী, যিনি যুদ্ধ আর সেনা দায়িত্বে সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, এমন কাউকে খুঁজে বের করতেন। তিনি সেরকম কিছু করেননি। আর তাই এই অদূরদর্শিতা সাম্রাজ্যের জন্য এতটাই ভয়বহ ছিল যে সেখানে আগের সমস্ত সম্রাটেরা ভালাে যা কিছু করেছেন, সব ভেস্তে গিয়েছিল। মার্কাস অরেলিয়াস কোনাে চিন্তাভাবনা ছাড়াই নিজের ছেলেকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে ফেলেছিলেন। ১৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাকে (তার পুত্রের বয়স তখন মাত্র ষােল) যুগ্ম সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। সে সময়ে যেটি খুব চিন্তার বিষয় ছিল তা হলাে, যে ছেলেটি সিংহাসনের উপরেই জন্মেছে, তার অতি আদরে বখে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। সিংহাসনে বসতে না বসতেই ছেলেটি অতিরিক্ত প্রশংসা পেয়ে গেল। অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেল। যেমনটি হয়েছিল ক্যালিগুলা আর নিরাের সাথে, একই ঘটনা আবার ঘটতে লাগল। যুবক সম্রাটের নাম ছিল কমোডাস (মার্কাস লুসিয়াস এলিয়াস অরেলিয়াস কমোডাস অ্যাটোনিনাস) মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে সম্রাটের আসনে বসলেন।
আমলাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া ও জনগণের রায়ের ওপর ভরসার জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি : কমোডাস কোনাে যােদ্ধা ছিলেন না। তিনি জার্মানির মার্কোম্যানির সাথে তাড়াহুড়াে করে একটি শান্তিচুক্তি করে ফেললেন আর নিজেকে বিলাসের মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন। তিনি সরকারি কাজের বােঝা সব চাপিয়ে দিলেন সরকারি কর্মচারিদের উপরে। এটা ছিল একরকমের বিপজ্জনক। মানুষ সহজে সম্রাটকে দোষও দিতে পারছিল না কারণ তাদের সবসময় শেখানাে হয়েছিল সম্রাটকে পবিত্র একটি অস্তিত্ব হিসেবে কেবল শ্রদ্ধা করতে। বরং কোনাে সরকারি আমলাকে কোনাে সমস্যার জন্য দায়ী করা তার চেয়ে অনেক সহজ। নিজের অধীনে থাকা সরকারি কর্মচারিদের যুক্তি দিয়ে পরাজিত করার ক্ষমতাও কমােডাসের ছিল না। তাই কারাে কাজ যখন কোনাে বিতর্কের সৃষ্টি করত, সম্রাট তাকে জনগণের রায়ের উপরে ছেড়ে দিতেন। এভাবেই তিনি নিজে যে কোনাে ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময়ে দুর্বল শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যা হয়, এখানেও তেমন সম্রাট সিনেটের হাতে বন্দী কিংবা মৃত্যুবরণ করতে ভয় পেতেন। তিনি মনে করতেন সাম্রাজ্যে সিনেটই তার একমাত্র প্রতিপক্ষ। এতে করে এমনই মনে হচ্ছিল যে সাম্রাজ্যে সিনেটের সাথে একযােগে সম্রাটের শাসনের যে প্রচলনটি ছিল, সেটি যেন একটি সমাপ্তির দিকে চলে এলাে। সেই আগের মতাে আবার রাজ্যে সন্ত্রাস আর ষড়যন্ত্রের অমানিশা ঘিরে এলাে।
সিনেটের সম্মানের অভাব : সিনেট অবশ্যই সেই আগের মতাে আর ছিল না। বিশেষ করে অগাস্টাসের সময়ে যেমন ছিল তেমনও নয় যে একাই তিনি পুরাে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। এটি আর সেই প্রাচীন রােমান ঐতিহ্যের ধারক হয়ে থাকতে পারছিল না। রােমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে করতে যত যুদ্ধের প্রয়ােজন হয়েছিল, তাতেও তার ঐতিহ্য কমে গিয়েছিল কিছুটা। যা বাকি ছিল তাও যেন ক্যালিগুলা, নিরাে আর ডমিশিয়ান নষ্ট করে দিলাে। অ্যান্টোনাইনদের মধ্যে সিনেটে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ অন্তর্ভুক্ত করা হতাে। এটাও সিনেটের সম্মান কমিয়ে দেয়ার আরেকটি কারণ। নিরাের মতাে কমোডাসও ছিলেন সাম্রাজ্যের জন্য দানবের মতাে। শেষ সময় পর্যন্ত নিজের বিলাসী জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি। নিরাে অন্তত তার সঙ্গীত চর্চা কিংবা অভিনয়, গান এসবের মধ্যে দিয়ে কিছু নামডাক কামিয়েছিলেন। কমােডাসের সম্রাট শরীরের মধ্যে ছিল কেবল একজন গ্ল্যাডিয়েটরের হৃদয়। তার জন্য বিনােদন ছিল অ্যাম্ফিথিয়েটারে কোনাে জকে নিরাপদ অবস্থান থেকে হত্যা করা। আর তিনি প্রকৃত গ্ল্যাডিয়েটরের প্রতিযােগিতাও করতে চাইতেন। যদিও রােমানরা অ্যাম্ফিথিয়েটারে বসে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই করতে করতে, রক্তাক্ত হয়ে শেষে নিষ্ঠুর মৃত্যু দেখতে পছন্দ করত কিন্তু এমনিতে সমাজে গ্ল্যাডিয়েটরদের তেমন কোনাে কদর ছিল না। তাই একজন সম্রাট যখন গ্ল্যাডিয়েটরের মতাে আচরণ করছে, তখন তা খুবই অসম্মানজনক।
মৃত্যু ও রাজবংশের সমাপ্তি : এভাবে আবারও সম্রাটের অতিরিক্ত ব্যয়ের স্বভাবের কারণে রাজ্যের কোষাগার শূন্য হতে লাগল। ফলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট সাম্রাজ্যকে ছেয়ে ফেলল। এই নবরূপী নিরোর সমাপ্তিটাও আগের নিরাের মতােই হলাে। তার সবচেয়ে কাছের যারা ছিল তারা সম্রাটের অতি আবেগী চরিত্রকে ভয় পেত। তাই একরকম নিজেদের বাঁচানাের জন্যই সম্রাটকে সেসব আবেগ প্রবণতা থেকে দূরে রাখতেন। ১৯২ খ্রিস্টাব্দে (৯৪৫ রােমান সাল) সম্রাটের রক্ষিতা মার্সিয়া আর বিশেষ কিছু সরকারি কর্মচারি মিলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে একজন পেশাদার মুষ্ঠিযােদ্ধার সাথে প্রতিযােগিতায় নামান। সেখানে লড়াই করতে করতে তিনি গ্ল্যাডিয়েটরের মৃত্যুবরণ করেন। নিরাের মতােই মৃত্যুর সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র তিরিশ বছর। কমোডাস ছিলেন নার্ভা বংশের (দত্তক গ্রহণ এবং প্রকৃত উত্তরাধিকারীসহ) শেষ সম্রাট। এই বংশ রােমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ঠিক একশ বছর রাজত্ব করে। যুগ্ম সম্রাট লুসিয়াস ভ্যারাসসহ এই বংশ রােমকে সাতজন সম্রাট উপহার দিয়েছে।
সেভেরাসের বংশ (১৯৩ – ২৩৫ খ্রি.)
সেপটিমিয়াস সেভেরাস (রা. ১৯৩ – ২১১ খ্রি.)
পার্টিন্যাক্সের ক্ষমতায় আগমন : ১৯২ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপট। এত গুরুত্বপূর্ণ এক সাম্রাজ্য হলো রোমান সাম্রাজ্য, অথচ দুই দুইবার সাম্রাজ্যটি ভাঙনের মুখে পড়ল। একবার নিরাের হাতে, আব্রেকবার ডমিশিয়ানের হাতে। প্রথমবার অপ্রস্তুত সিনেটকে একটি গৃহযুদ্ধও সামলাতে হলাে। যাই হােক যুদ্ধের সমাপ্তিটা ভালােই হয়েছিল। দ্বিতীয়বারে সিনেট প্রস্তুত ছিল আর প্রথম থেকেই সবরকম প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হলাে। সিনেট আইনের দ্বিতীয় সংশােধনীর উপরে আস্থা রাখত। ডমিশিয়ানকে যেমন বয়স্ক আর সম্মানিত নার্ভাকে অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তেমনি কমোডাসকে অনুসরণ করতে হয়েছিল পার্টিন্যাক্সকে (পাবলিয়াস হেলভিয়াস পার্টিনাক্স)। হ্যাড্রিয়ানের আমলে ১২৬ খ্রিস্টাব্দে বেশ শান্তিপূর্ণ একটি অবস্থার সময়ে পার্টিন্যাক্সের জন্ম। কমোডাসের মৃত্যু পর্যন্ত পার্টিন্যাক্স কষ্ট করে সরকারি চাকরিতে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলেন। সে সময়ে তিনি ছিলেন আজকের দিনের রােমের মেয়রের মতাে একটি অবস্থানে। নার্ভার মতাে পার্টিন্যাক্সও সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নেয়ার পক্ষে ছিলেন খুবই বয়স্ক। সাম্রাজ্য নিয়ে কঠিনভাবে নাড়াচাড়া করার শক্তিও তার ছিলনা। অবশ্য প্রিতােরিয়ান গার্ডরা তাদের নেতার (কমোডাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন) প্রভাবে পার্টিন্যাক্সকে সম্রাট হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। পার্টিন্যাক্স তাদের সব শর্ত দুঃখিত চিত্তে মেনে নিয়েছিলেন।
প্রিতোরিয়ান গার্ডের হাতে সাম্রাজ্যের নিলাম ও মার্কাস ডিসিয়াসের ক্ষমতায় আসা : প্রিতোরিয়ান গার্ডরা কমোডাসের পতনের পর যখন নতুন করে সরকার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চাইল তখন খুব দ্রুত আবার মত বদলেও ফেলেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, ঠিক গ্যালবা নিরাের মৃত্যুর পরে যা করেছিলেন, সেরকম ইতিহাসই আবার ফিরে আসছে। প্রিতোরিয়ান গার্ডরা হঠাৎ খুব ক্ষেপে গিয়ে বিদ্রোহ করে বসল। পার্টিন্যাক্স তাদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের সাথে মিলিত হতে চাইলেন। পার্টিন্যাক্স দেখা করতে গেলে প্রিতােরিয়ান গার্ডরা তাকে হত্যা করল। ১৯২ এর ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩ এর ২৮ মার্চ – এই মোটে দুই মাস ২৮ দিন পার্টিন্যাক্স রোমান সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। এরপর এমন সব দৃশ্যের অবতারণা হতে লাগল যেগুলাের ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে রােম কত তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যাচ্ছে। আরও বােঝা যাচ্ছিল কী করে সাম্রাজ্যটি পুরােপুরি সেনাদের হাতে চলে গেল আর তারা প্রত্যেকে এই রাজ্যের ব্যাপারে কতটা উদাসীন। প্রিতােরিয়ান গার্ডেরা এমন অবস্থা করল যেন সাম্রাজ্যটি তারা দাম হেঁকে বিক্রি করে দেবে। পার্টিন্যাক্স যেমন এক ধাক্কায় তাদের অতিরিক্ত দাবি নাকচ করে দিয়েছিলেন, তাই তারা সতর্ক ছিল যেন পরের সম্রাট এসে সেরকম কিছু করতে না পারে। তারা খােলাখুলি জানিয়ে দিলাে, যিনি তাদের চাওয়া অনুযায়ী সব দাবি মেটাতে পারবেন তিনিই হবেন পরবর্তী সম্রাট। একজন ধনী সিনেট, মার্কাস ডিডিয়াস জুলিয়ানাস এটা জানতে পেরে দাবি মেটানাের সেই নিলামে (প্রথম প্রথম বেশ কৌতুকপূর্ণই মনে হয়েছিল বটে) যােগ দিলেন। তিনি নিলামে সবচেয়ে বেশি দাম পরিশােধ করার প্রস্তাব দিলে তাকেই সম্রাট ঘােষণা করা হয়। ২০২১ সালের হিসেবে এক একজন প্রিতােরিয়ান গার্ডকে তিনি সাড়ে নয় হাজার মার্কিন ডলার দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর আগেও রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিরা দামের বিনীময়ে কেনা-বেচা করেছেন নিজেদের, কিন্তু এত আকাশচুম্বী মূল্য পরিশােধ করতে কাউকেই দেখা যায়নি।
সেভেরাসের ক্ষমতায় আরোহন ও ডিসিয়াসের মৃত্যু : যাই হােক ডিডিয়াস জুলিয়ানাস প্রকৃতপক্ষে খুব চড়া দামে নিজের মৃত্যু কিনেছিলেন। নিরােকে বন্দী করে হত্যা করার পরে যেমন রােমের দিকে সমস্ত সেনাবাহিনী ধেয়ে আসছিল, নিজ নিজ প্রধানকে সিংহাসনে বসানাের পাঁয়তারা করছিল, এখনও ঠিক তেমনটাই হতে লাগল। ব্রিটেনের সেনাবাহিনী সিরিয়ার দানিয়ুবের তীরে সেই আশায় জটলা বাঁধতে লাগল।দানিয়ুবের তীরের সেই জেনারেল সবচেয়ে দ্রুত কাজটি করে ফেলল। তিনি ছিলেন লুসিয়াস সেপটিমিয়াস সেভেরাস। ট্রাজানের মতাে তিনিও ছিলেন একজন রাজকর্মচারি। তিনি ১৪৬ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকায় জন্মেছিলেন। তার মার দিকের পূর্বপুরুষরা ছিল রোমান বা ইতালিয়ান, আর বাবার দিকের পূর্বপুরুষ ছিল কার্থেজিয়ান বা পিউনিক। তিনি কখনােই ভদ্র ইতালিয়ানদের সমকক্ষ হতে পারেননি। জীবনে বেশ দেরি করে ল্যাটিন শিখেছিলেন আর বলতেন এক ধরনের আফ্রিকার কথা বলার ধরণে। তিনি বাহিনী নিয়ে রােমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি ইতালিতে পৌঁছলে ১৯৩ সালেই প্রিতোরিয়ান গার্ডরা তাকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তার বংশ পরিচয় যাই হোক না কেন, পেছনে যখন বিশাল সেনাবাহিনী আছে তখন প্রিতোরিয়ান গার্ডদের আর কিছুই করার ছিলনা। সিনেটও আগবাড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে। অবশ্য তাদের আগেই প্যানোনিয়ান লেজিওন সেভেরাসক সম্রাট ঘোষণা করেছিল, তাই তাদের ঘোষণার দিন ১৯৩ এর ৯ এপ্রিল থেকেই সেভেরাসের রাজত্বকাল ধরা হয়। ২১১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৮ বছর রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। যাই হোক এবার সেসময় ইতিমধ্যে ঘোষিত রোমান সম্রাট জুলিয়ানাসের কী অবস্থা ভেবে দেখুন। হতভাগ্য জুলিয়ানাস দুই মাস রাজত্ব করার পরেই মারা পড়লেন। তিনি হত্যার শিকার হওয়ার আগপর্যন্ত চিৎকার করে বলছিলেন, “আমি কার কী ক্ষতি করেছি?” “কিন্তু আমি কার কী ক্ষতি করেছি?” অবশ্যই কারােরই তিনি কোনাে ক্ষতি করেননি। কিন্তু জীবনে যখন কেউ ওপরে ওঠার জন্য সবচেয়ে বেশি দাম দেয় তখন কষ্টও তাকে সবচেয়ে বেশিই ভােগ করতে হয়। ১৯৩ সালের ২৮ মার্চ থেকে ১ জুন, এই দুই মাস চার দিন তিনি রোমান সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। আগের সম্রাট পার্টিন্যাক্সের চেয়েও কম সময়!
প্রতিযোগী জেনারেল নিগারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাকে হত্যা : সম্রাট হিসেবে সেভেরাস তখন সম্রাটের সিংহাসনের জন্য আগত অন্যান্য প্রতিযােগী জেনারেলদের সাথে লড়াই করতে শুরু করেন। একবার যদি কোনাে জেনারেলকে সিংহাসনের প্রস্তাব দেয়া হয় আর তিনি সেটি গ্রহণ করে ফেলেন, তবে তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। একজন সফল প্রতিযােগী কখনােই চাইত না যে ব্যর্থ প্রতিযােগীরা বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকুক। একবার যদি কেউ সিংহাসনের ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায় তবে সেই মানুষকে আর বিশ্বাস করার কোনাে উপায় থাকে না। ব্যর্থ প্রতিযােগীরা তার প্রতি ভরসা রাখা যাবে না জেনেই তার সাথে লড়তে থাকে। এর ফলে সেভেরাসের সিংহাসনে বসার পরে যে গৃহযুদ্ধটি হয়েছিল সেটি রােমের দুইশ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ। নিরাের মৃত্যুর পরে গৃহযুদ্ধটি কেবল এক বছর স্থায়ী হয়েছিল আর লড়াইটিও ছিল সাধারণ। কিন্তু কমোডাসের মৃত্যুর পরে সেবারের গৃহযুদ্ধ চার বছরব্যাপী চলেছিল। এর মধ্যে অনেক উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ আছে। সেভেরাস সবার আগে পূর্বদিকে এগিয়ে যান। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর নেতা নিগারের (গেইয়াস পিসিনিয়াস নিগার জাস্টাস) সাথে তলােয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হতে তিনি যাত্রা করেছিলেন। নিগার ছিলেন সেভেরাসের পুরনাে রাজকর্মচারী। দুজনে মিলে একসাথে একসময় রাজকার্য পরিচালনা করেছেন। যাই হােক, তখন প্রতিযােগী জেনারেলদের মধ্যে নিগার ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। পূর্বদিকের প্রদেশগুলােতে তার আধিপত্য ছিল সবচেয়ে বেশি। তার অবস্থানের কারণেই তার পক্ষে মিশর দখল করে রােমে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। সেভেরাস সেই সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পুরনাে বন্ধুত্ব সে ক্ষেত্রে তেমন কোনাে ভূমিকা রাখেনি। নিগারের জনপ্রিয়তা ছিল না-চাইতেই পাওয়ার মতাে। পূর্বদিকের প্রদেশগুলােতে সাধারণ মানুষ তার পক্ষে রায় দিয়েছিল। তাই চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া তার আর অন্য কিছু করার তাড়াও ছিল না। তিনি সিরিয়ায় সাজানাে নিরাপত্তার মধ্যে বসে সেভেরাসের আগমনের প্রতীক্ষা করছিলেন। সেভেরাস এসেছিলেন। এশিয়া মাইনরে কিছু ছােটখাটো যুদ্ধে তার জয় হয়েছিল। নিগার ১৯৪ খ্রিস্টাব্দে বন্দী হলেন। পার্থিয়ায় পালিয়ে যাবার সময়ে তাকে বন্দী করে সেখানেই হত্যা করা হয়।
প্রতিযোগীয় জেনারেল আলবিনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় : এরপর বাকি ছিল ব্রিটেনের সেনাপ্রধান অ্যালবিনাস (ডেসিমাস ক্লডিয়াস সেপটিমাস অ্যালবিনাস)। যেখানে “নিগার” শব্দের অর্থ “কৃষ্ণাঙ্গ” আর অ্যালবিনাসের মানে “শেতাঙ্গ,” তাই বলা যায় সেভেরাসকে কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গ দুই ধরনের প্রতিযােগীর মুখােমুখি হতে হয়েছিল। সেভেরাস অ্যালবিনাসকে নিজের উত্তরাধিকারী ঘােষণা করে প্রথমত নিজের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে চেয়েছিলেন। এটা তাকে নিগারের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য খানিকটা সময় দিয়েছিল। অ্যালবিনাস চেষ্টা করছিলেন দুজন শত্রুর মধ্যে একটা অদ্ভুত চাল দেবেন যেন দুজনই কুপােকাত হয়। কিন্তু তখন সেভেরাস তার দিকে ধেয়ে আসাতে ভাবলেন তাকে আক্রমণ করার আগেই সেভেরাসকে তার আক্রমণ করতে হবে। তিনি সেভেরাসকে আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৭ খ্রিস্টাব্দে (৯৫০ রােমান সালে) তিনি নিজেকে সম্রাট ঘােষণা করে দক্ষিণ দিকে গাউলে (বর্তমান ফ্রান্স) যাত্রা করলেন। সেভেরাসের নেতৃত্বে ভয়াবহ শক্তিশালী বাহিনীটি উত্তর দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে লাগল প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার জন্য। সে সময়ের গাউলের সবচেয়ে বড় শহর লুগডুনামে (আধুনিক লিওঁ শহর) বাহিনীটি তাদেরকে পেয়ে গেল। সেই জায়গায় রােমের বাহিনীর বিরুদ্ধে রােমেরই বাহিনীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হলাে। এই যুদ্ধ দেড়শ বছর আগের ফিলিপির যুদ্ধের পরে নিজেদের ভেতরে ঘটা সবচেয়ে বড় লড়াই। সেখানে সেভেরাসের সেনাবাহিনীর বিপুল জয় হলাে। লুগডুনাম শহরের এতই ক্ষতি হলাে যে সেই পুরাে প্রাচীন যুগ জুড়ে এটি আর কখনােই মেরামত করা সম্ভব হয়নি। সেই শহর ধ্বংসের পরিবর্তে ১৯৭ খ্রিস্টাব্দে সেভেরাস রােমের একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়ে গেলেন।
সেনাবাহিনীকে সুবিধা দান, প্রিতোরিয়ান গার্ডদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া ও ইতালি সাথে অন্যান্য প্রদেশের বিভেদ মোচন : এবারে রােমান সাম্রাজ্য সেভেরাসের হস্তক্ষেপে আরেকবার যেন থিতু হলাে, সােয়া একশ’ বছর আগে একবার যেমন হয়েছিল ভেস্পসিয়ানের শাসনে। এবারে রােম ছিল আগের চেয়েও দুর্বল। কারণ এই সাম্রাজ্যের ওপর দিয়ে তখন মহামারীর ঝড় বয়ে গেছে আর এর জনসংখ্যা ক্রমশ কমছে। এমনকি রােম বাহ্যিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ দুটি গৃহযুদ্ধের কবলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেভেরাস সাম্রাজ্যের জন্য কিছুই করতে পারছিলেন না। তাই হয়তাে নিরুপায় হয়ে তিনি ভেস্পাসিয়ানের মতােই অগাস্টাসের আইনের বাস্তবায়ন করতে আরম্ভ করলেন। সেভেরাস ঠিক তেমনটা হয়তাে চাননি। অর্থাৎ এটা যে ইচ্ছে করে করা হয়েছিল তাও বলা যাবে না। হয়তাে ভেবেছিলেন যে রােমের সেনাবাহিনীর মন জয় করতে পারলে তিনি রােমের প্রভু হয়ে থাকতে পারবেন, সিনেট বা সাধারণ মানুষ, কারােই বলার কিছু থাকবে না। তাই সেভেরাস তখন সেনাবাহিনীতে অতিরিক্ত আদর যত্ন করা আরম্ভ করলেন। তিনি সেনাবাহিনীর বেতন বাড়িয়ে দিলেন আর তাদের দিলেন নানারকমের সুযােগ সুবিধা। তিনি সেনাদের কর্মরত অবস্থায় বিয়ে করার স্বাধীনতা দিলেন এবং অবসর গ্রহণের সময়ে তাদের অন্তত মধ্যবর্তী একটা উপাধি দেয়া হবে – এ আশ্বাস দিলেন। তিনি পুরাে সেনাবাহিনীকে নিজের অধীনে নিয়ে চলে এলেন। তিনি তেত্রিশটি লিজিয়ন গঠন করলেন যেখানে কিনা অগাস্টাসের মৃত্যুর সময়ে লিজিয়নের সংখা ছিল পঁচিশটি। সাহায্যকারী অন্যান্য দলের সংখ্যাও ২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে ফেললেন তিনি। তখন অস্ত্রধারী রােমানের সংখ্যা চল্লিশ লক্ষে পৌছল। এছাড়া সেভেরাস আরও যে কাজটি করলেন তা হলাে, সাম্রাজ্যটিকে নিলামে উঠিয়ে দেয়া আর দানিয়ুবের তীরের এক সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দেয়া প্রিতােরিয়ান গার্ডদের থেকে তিনি অস্ত্র কেড়ে নিলেন। বাস্তবিক অর্থে তাদের নিষ্ক্রিয় করে দিলেন তিনি। আর তাই একদল সেনাসদস্যকে প্রিতােরিয়ান গার্ড হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হলাে। আর এবারে তাদের মধ্যে কেবল ইতালির লােক নয়, তার বাইরের সেনারাও অন্তর্ভুক্ত হলাে। একটি মাত্র বড় লিজনকে ইতালিতে অবস্থান দিয়ে তিনি অন্যান্য প্রদেশের সাথে ইতালির প্রতি মনােযােগে যে বিস্তর পার্থক্য ছিল, অগাস্টাসের আদর্শে সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। সেই সময় থেকে বলতে গেলে ইতালির সাথে সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশে বস্তুত কোনাে পার্থক্য ছিল না। সাম্রাজ্যের প্রতিটি অংশ সেনাবাহিনীর আয়তন আর তাদের নেতাদের ক্ষমতা অনুযায়ী একই রকমের ছিল।
শাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, অরাজকতা ও পার্থিয়ার বিরুদ্ধে জয় : সেভেরাসের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের শাসনের বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়। তিনি প্রদেশগ্রলােকে ছােট ছােট গুচ্ছে ভাগ করেন আর সেই অনুযায়ী প্রত্যেক ভাগে গভর্নর নিয়ােগ করেন। তাদের কিছুটা কম ক্ষমতা প্রদান করেন। সর্বময় ক্ষমতাটি ইতালিতে নিজের হাতে রেখে দেন। মােটের উপরে এই ব্যবস্থা সাম্রাজ্যের শক্তিকে আরও স্থিতিশীল করেছিল। এই নতুন ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীও আগের চেয়ে ভালােভাবে পরিচালিত হচ্ছিল কিন্তু পাশাপাশি রাজ্যে অরাজকতাও বেড়ে গিয়েছিল খুব। সেভেরাসের সময়ে রােমের নিজস্ব সেনাবাহিনীই একে অন্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধ আর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল যে সীমানার নিরাপত্তার দিকে নজর দেয়ার সময় তাদের হয়নি। তাই সীমানা হয়ে পড়েছিল পুরােপুরি অরক্ষিত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত রােমের চিরশত্রু পার্থিয়া নিজেদের ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর গৃহযুদ্ধের কারণে খুব দ্রুত এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তখন সুযােগ থাকা সত্ত্বেও রােমের দিকে তারা হাত বাড়াতে পারেনি। সেভেরাসের শাসনামলের ভয়াবহ ক্ষতির পরও তখন রােম পার্থিয়ার চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানেই ছিল। এভাবে একসময় বহু হিসাবনিকাশ করে আবার পার্থিয়া সামান্য হামলার সুযােগ নিচ্ছিলাে, সেভেরাস প্রচণ্ড আক্রোশে পাল্টা হামলা করলেন। বিদেশী শক্তির সাথে যুদ্ধের অর্থই হলাে পুরাে দেশ এক হয়ে রুখে দাঁড়ানাে। তাই ১৯৭ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে অ্যালবিনাস বিশাল বিজয় অর্জন করলেন। পূর্বদিকে বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে তিনি পার্থিয়াকে ভয়ানক পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করলেন। ২০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন রােমে ফেরত এসেছিলেন, পার্থিয়াকে পরাজিত করার জন্য নিজের বিজয় উদযাপন করেছিলেন। সেই বিজয় উৎসবের স্মৃতিস্বরূপ রােমে তিনি একটি তােরণ নির্মাণ করেন যা এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে তার বিজয়ের কথা ঘােষণা করছে।
হিসাবনিকাশ ব্যবস্থায় পরিবর্তন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও প্যাপিনিয়ান : এই সময়ে যখন কিছুটা শান্তি বজায় ছিল, সেভেরাস দেশের হিসাবনিকাশ ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনেন। সেভেরাসের এই কাজে সহায়তা করেছিলেন সম্মানিত আইনজীবী প্যাপিনিয়ান (এমিলিয়াস প্যাপিনিয়ান)। প্যাপিনিয়ান ছিলেন এমন একজন মানুষ যার রােমান আইন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা ছিল। আর সত্যিই তিনি আইনের যে দৃষ্টান্তগুলাে স্থাপনে সাহায্য করেছিলেন তা তার পরের তিনশ বছর পর্যন্ত বহাল ছিল। যদিও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানাের একটি পরিকল্পনা সফলভাবে নেয়া হয়েছিল কিন্তু তাতে করে সেভেরাসের শাসনামলের ক্রমাবনতির কথা ঢাকা থাকেনি। সেভেরাস যে মুদ্রার মধ্যে রূপার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিলেন তাতেই সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল।
ডায়োজেনিস লিয়ার্টিয়াসের লেখা দার্শনিকদের জীবন : সেভেরাসের স্ত্রী, সম্রাজ্ঞী জুলিয়া ডােমনা দর্শনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তিনি বিদেশী সভ্যতা থেকে বিভিন্ন কায়দাকানুন সাম্রাজ্যে প্রচলনের চেষ্টা করতেন। তিনি প্রায়শই গ্যালেন নামে একজন চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থাকতেন। সেসব অবশ্য ছিল গ্যালেনের জীবনের শেষ দিন, কারণ তিনি ২০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার আরেকজন সহচর ছিলেন ডায়োজেনিস। তাকে সাধারণত ডায়োজেনিস লিয়ার্টিয়াস (Diogenes Laërtius) বলে ডাকা হতাে, কারণ তিনি এশিয়া মাইনরের লিয়ার্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বেশ বিখ্যাত ছিলেন এজন্য যে বিভিন্ন প্রাচীন দার্শনিকদের জীবনী তিনি ছােট ছােট আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তার লেখা বই খুব বিক্রি হতাে। তিনি দার্শনিকদের জীবনের নানান নাটকীয় দিক নিয়ে লিখতেন। তাদের অপ্রকাশিত মজার উক্তিগুলাে তিনি জনসমক্ষে এনেছিলেন। তার বইগুলাে ভদ্রলােকদের অবসরের আড্ডার প্রধান আলােচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। মানুষ একজন দার্শনিকের দীর্ঘ জীবনের কাহিনী না পড়েও তাদের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিষয়গুলাে জানতে পারত, সেগুলাে নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে পারত। কিন্তু সে সময়ের প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে তার বইগুলাে ছিল একেবারেই মূল্যহীন। কিন্তু তার পরেও ডিওজিনস লার্টিয়াসের সেই সারাংশ গ্রন্থ সাধারণ মানুষের কাছে এত বেশি সমাদৃত হয়েছিল আর এত বেশি সংখ্যায় বিক্রি হয়েছিল যে আধুনিক যুগ পর্যন্ত রচনাগুলাে বেঁচে আছে। আর সে জায়গায় বড় বড় দার্শনিকেরা, যারা ডায়োজেনিসের কাজের ব্যাপক সমালােচনা করেছিলেন তাদের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রচনাও তত বেশি সমাদৃত হয়নি বা বেঁচেও থাকেনি ততদিন। আজকের দিনে এটই বলা যেতে পারে যে বড় বড় দার্শনিকদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বা নিজস্ব চিন্তাভাবনার বিষয়ে যতটুকু জেনেছি, তার জন্য ডায়োজেনিস লিয়ার্টিয়াসের কাছে আমরা ঋণী।
ঐতিহাসিক ডিও ক্যাসিয়াস : সেভেরাসের একজন বন্ধু ছিল ডিও ক্যাসিয়াস (ডিওন ক্যাসিয়াস কোশিয়ানাস)। তিনি ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। তিনি এশিয়া মাইনরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে তার বাবা মার্কাস অরেলিয়াসের অধীনে গভর্নর হিসেবে কাজ করতেন। ডিও ক্যাসিয়াস ১৮০ খ্রিস্টাব্দে রােমে ফেরত এলেন। কমােডাসের অধীনে তিনি একজন সিনেটর হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। সে সময়ে ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ তাকে স্পর্শ করেনি। সেভেরাসের আমলে তিনি উচ্চ পর্যায়ের একজন রাজকর্মী ছিলেন। ডিও ক্যাসিয়াস রােমের উপরে একটি ইতিহাস বই লেখেন। তার লেখা ইতিহাসের বইগুলাে অনেকদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। এগুলাে প্রজাতন্ত্রের শেষের অর্ধশত বছর আর সাম্রাজ্যে অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকে। যদিও এভাবে বইগুলাে রক্ষা পাওয়াটা ছিল নিতান্তই অস্বাভাবিক। তবে সেসবের মধ্যে দিয়েই আমরা সিজার আর অগাস্টাসের সময়কার মূল চিত্রটি খুঁজে পাই।
ব্রিটেন নিয়ে সেভেরাস ও ব্রিটেনেই মৃত্যু : সেভেরাসের শাসনামলের শেষ বছরগুলাে ব্রিটেনের সাথে নানান রকমের মতপার্থক্যের ঘটনায় ভরা। ব্রিটেনের গভর্নর অ্যালবিনাসের ক্ষমতা এতই বেড়ে যাচ্ছিল যে মনে হতাে তিনিই যেন রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে উঠছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সেভেরাস ব্রিটেনকে দুটো প্রদেশে ভাগ করে দিলেন। এই ব্যবস্থাটি ব্রিটেনকে একটি বিদ্রোহ সংগঠনের পক্ষে বেশ দুর্বল করে দিলাে। ২০৮ খ্রিস্টাব্দে সেভেরাস নিজেই ব্রিটেন যেতে বাধ্য হন। জংলা উত্তর দিকের কিছু পাহাড়ী উপজাতিদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নেন। যদিও এর জন্য তাকে অনেক বেশি দাম দিতে হয়। গেরিলা আক্রমণ ঝিমিয়ে পড়ল। আর তারপরে যে আয়তনের সেনাবাহিনীর সেখানে প্রয়ােজন ছিল, তা নিয়ােগ করতে গেলে রােম থেকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে বাধ্য হয়ে সেভেরাসকে স্থানীয় নিয়মকানুন মেনে নিতে হয়। সেভেরাস তাড়াহুড়াে করে তেমন কিছু করতে না পেরে অ্যান্টোনাইনের দেয়ালকেই মানুষের মধ্যে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা শুরু করলেন, যেটি কিনা অর্ধ শতাব্দী আগে মধ্য স্কটল্যান্ডে তৈরি হয়েছিল। আর তারপর হ্যাড্রিয়ানের দেয়ালের সীমানার মাহাত্য অধিবাসীদের কাছে নতুন করে তুলে ধরতে চাইলেন। কিন্তু সেভেরাস ব্রিটেন ছেড়ে নড়তে পারলেন না। তার বয়স ছিল ষাটের দশকে আর তিনি ভয়াবহ গাউটের ব্যথায় ভুগছিলেন। ২১১ খ্রিস্টাব্দে সেই অসুখেই এবােরাকামে (আধুনিক ইয়র্ক শহর) মৃত্যুবরণ করেন।
ক্যারাকালা (রা. ২১১-২১৭ খ্রি.)
সেভেরাসের পুত্রের ক্যারাকালা হিসেবে পরিচিত হওয়া : রােমান সাম্রাজ্যের মানুষদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সেভেরাস নিজের সম্পর্কে মনগড়া কাহিনী ছড়িয়েছিলেন। তার প্রতি মানুষের আস্থা আনার জন্য ঘােষণা করেছিলেন যে তিনি মার্কাস অরেলিয়াসের সন্তান আর কমােডাসের ভাই। তিনি চেয়েছিলেন এই সম্পর্ক তার নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নামের ওপরেও প্রতীয়মান হোক। তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের আসল নাম ছিল ব্যাসিয়ানাস, কিন্তু তার পিতা যখন সম্রাটের আসনে আসীন তখন নামটি বদলে রাখা হলাে মার্কাস অরেলিয়াস অ্যান্টোনিনাস। যাই হােক, ক্যালিগুলার মতাে সেভেরাসের বড় ছেলেও অদ্ভুতভাবে এক ধরনের পােশাকের নামে ইতিহাসে পরিচিত হন। তিনি গাউল দেশের অনুকরণে রােমে একটি লম্বা ঝুলওয়ালা পােশাকের প্রবর্তন করেন। পরে সেটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পােশাকটির নাম ছিল ক্যারাক্যালাস। আর সেই পােশাকের জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে সেভেরাসের পুত্র ক্যারাক্যালা নামে পরিচিতি লাভ করেন।
ক্যারাকালার ক্ষমতা গ্রহণ, বিরোধী সন্দেহে অনেককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান ও বাজে শাসন : ক্যারাক্যালা আর তার ছোট ভাই গেটা (পাবলিয়াস সেপটিমিয়াস অ্যান্টোনিনাস গেটা), দুজনেই ব্রিটেনে তাদের বাবার শেষ সময়ে সাম্রাজ্যের মহিমা প্রচারণার কাজে অংশ নিয়েছিলেন। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে দুই ভাই একসাথে ২১২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারিতে সিংহাসনের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হলেন। সেই অর্ধ শতাব্দী আগের মার্কাস অরেলিয়াস আর লুসিয়াস ভ্যারাসের মতাে রােমে আবার যুগ্ম সম্রাটের ব্যবস্থা হলাে। অবশ্য ক্যারাক্যালা মার্কাস অরেলিয়াসের মতাে ছিলেন না। এই দুই ভাই একজন আরেকজনকে ভয়ংকর ঘৃণা করতেন। তারা তাড়াতাড়ি ব্রিটেনে শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজ শেষ করে একরকম নিজ নিজ মাহাত্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রােমে রওনা দিলেন। শেষ পর্যন্ত ক্যারাক্যালার বিজয় হলাে। ২১২ খ্রিস্টাব্দে গেটাকে বন্দী করে নিজেই রােমের একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়ে গেলেন। নিজের শাসন নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তিনি গেটার সহযােগী হিসেবে যাদের সন্দেহ করেন সবাইকে হরেদরে ফাঁসিতে ঝােলাচ্ছিলেন। সাহায্যকারী সেনাদের পেছনে অনেক পয়সা ঢেলে তিনি তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। এর বাইরে আর কোথায় কী হতে পারে, এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। রােমানদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা যিনি ক্যারাক্যালার অন্যায় অবিচারে ফাঁসিতে ঝুলতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি হলেন প্যাপিনিয়ান, একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। তিনি সেভেরাসের সাথেই ব্রিটেনে গেছেন। সম্রাটের মৃত্যুর পরে তিনি ক্যারাক্যালা আর গেটার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সমঝােতা করিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাদের দুজনের বয়সই ছিল বিশের সামান্য বেশি। তাদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখার যতই চেষ্টা করেন না কেন, তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। একজন মধ্যস্থতাকারীর জীবনে যে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটতে পারে, তার বেলায়ও তাই হয়েছিল। তিনি উভয় পক্ষেরই শত্রু হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন। তাই যদি গেটাকে জিতিয়ে দেন, সেই ভয়ে তাকে আগেভাগেই হত্যা করা হয়। ক্যারাক্যালা ক্যালিগুলা বা কমােডাসের মতােই সম্রাটের আশেপাশে বড় হওয়ার জন্য বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই সম্রাট হিসেবেও ছিলেন খুব নিম্নমানের। যাই হােক, তিনি টানা ছয় বছর রাজত্ব করেছিলেন।
স্নানাগার : ক্যারাকালার শাসনামলে ক্যালিগুলার আমলের মতােই “ক্যারাক্যালার স্নানাগার” তৈরি হয়েছিল। স্নানাগারের আয়তন ছিল ৩৩ একর জায়গা। এখনও কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই জায়গাটি উৎসুক মানুষদের জন্য একটি বিশেষ দর্শনীয় স্থান হয়ে আছে। মানুষের স্নান করার অভ্যাস বলতে গেলে রােমান ইতিহাসের মধ্য দিয়েই জনপ্রিয় হয়েছে। তখনই বলতে গেলে স্নান করাটা একটা আভিজাত্যের পর্যায়ে পৌঁছে গেল। জনসাধারণের জন্য স্নান করার জায়গাটা এমন করে সাজানাে যে পাশাপাশি অনেকগুলাে স্নানাগার, একজন মানুষ সেখানে ঘুরেফিরে স্নান সারতে পারে। অর্থাৎ, গরম জল, হালকা গরম জল এবং শীতল জলের ব্যবস্থা সেখানে থাকত। সেখানে বাষ্পে অবগাহনের জন্যও জায়গা ছিল। এছাড়া ছিল শরীরে তেল মাখানাে বা শরীর চর্চা করারও জায়গা। সেখানে এমনও জায়গা ছিল যে একজন অতিথি সেখানে আরাম করতে পারে, বিশ্রাম নিতে পারে, পড়তে বা গল্পগুজব করতে পারে, এমনকি চাইলে বসে কিছুক্ষণ আবৃত্তিও উপভােগ করতে পারে। এসব সুযােগসুবিধার জন্যে যে অনেক দাম দিতে হতাে তা না, বরং রােমানদের কাছে বেশ সুলভ ছিল ব্যাপারটা। এই স্নানাগারের জনপ্রিয়তা কিছুদিনের মধ্যেই তুঙ্গে পৌছল। অন্তত মৃত্যু পর্যন্ত মারামারি করে মরতে চাওয়া গ্ল্যাডিয়েটরের যুদ্ধ আর পশুপাখির যুদ্ধ দেখার চেয়ে এর জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। অবশ্য বলা বাহুল্য যে রােমান রম্য লেখক, স্টয়িক দর্শনের অনুসারী আর বেশিরভাগ খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে এসব স্নানাগার ছিল খুবই বিরক্তিকর আর এড়িয়ে চলার মত বিষয়। বিশেষ করে সেখানকার উদার নিয়মকানুনগুলো, যেমন নারী ও পুরুষের একসাথে স্নানের জন্য হাজির হবার ব্যাপারটা গোড়া চিন্তার লােকদের জন্য সহ্য করা কষ্টকর ছিল। তারা মনে করতেন যে সেখানে নানারকমের ব্যভিচার হতে পারে কিন্তু সম্ভবত এমনটি হওয়ার কথা কখনও শােনা যায়নি।
রোমের বিদেশীদের রোমান নাগরিকত্ব প্রদান, কর আদায় বৃদ্ধি ও সামরিক অভিযান : ক্যারাক্যালার কাজের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযােগ্য কাজ হলাে ২১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি রােমে অবস্থানকারী অন্য দেশের মানুষদের জন্য রােমান নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করেন। অবশ্য সেভাবে ভাবতে গেলে নাগরিক আর অনাগরিকদের মধ্যে এই সাম্য তৈরি করা যে খুব লাভজনক হয়েছিল তা নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সাম্রাজ্যে একজন নাগরিক আর কতইবা অধিকারচর্চা করতে পারে। আসলে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রব্যবস্থাটা কী দাঁড়াবে, এ বিষয়ে ক্যারাক্যালার দূরদর্শিতা ছিল। রােমে বিশেষ কিছু ধরনের কর ছিল যা কেবল রােমান নাগরিকদের পরিশােধ করতে হতাে। এভাবে নাগরিকের সংখ্যা বাড়িয়ে সম্রাট বলতে গেলে করের পরিমাণই বাড়াচ্ছিলেন। ক্যারাক্যালা নতুন প্রদেশ দখলের ব্যাপারে তার অভিযান অব্যাহত রেখেছিলেন। ২১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দানিয়ুবের তীর ধরে বাহিনীসহ এগিয়ে গেলেন। জার্মানির উপজাতিদের আগ্রাসন তিনি নদীর তীরেই আটকে রাখলেন। তারপর পূর্বদিকে আরও অগ্রসর হয়ে তিনি তার বাবার মতােই পার্থিয়ার সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কিছুটা সমাধান করলেন। সেখানে সফলভাবে তিনি সেনাবাহিনীসহ মেসােপটেমিয়ায় আসন গেঁড়ে বসলেন।
ক্যারাকালার নিষ্ঠুরতা ও অধীনস্তদের ষড়যন্ত্রে মৃত্যু : যাই হােক, ক্যারাক্যালার নিষ্ঠুরতা একসময় তার অধীনদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সামান্য অসন্তোষের জের ধরে তিনি অ্যালেক্সান্দ্রিয়া শহর ধ্বংস করে দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। সেই শহর তখন ছিল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। সেখানে অত্যাচার চালানােতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যে কোনাে কাল্পনিক অপরাধের চিন্তায় যে কোনাে অধীনকে ফাঁসিতে ঝােলাতে পিছপা হতেন না। অধীনরা আগে কোনাে অপরাধ না করলেও পরে করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা ২১৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যারাক্যালাকে বন্দী করে ফেলে। মার্কাস অপিলিয়াস ম্যাক্রিনাস ছিলেন সেই ষড়যন্ত্রকারী দলের নেতা। নিরাে আর কমােডাসের মতােই ক্যারাক্যালাকেও মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে একটি ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হয়।
সেভেরাস আলেক্সান্ডার (রা. ২২২-২৩৫ খ্রি.)
ম্যাক্রিনাসের ক্ষমতা গ্রহণ : সম্রাটকে বন্দী করে হত্যা করার পরে ম্যাক্রিনাস (রা. ২১৭-১৮ খ্রি.) স্বঘােষিত সম্রাট বনে যান। তিনি ছিলেন মৌরিতানিয়ায় জন্মগ্রহণকারী, মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন মানুষ। তিনি কখনও সিনেটরও হতে পারেননি। তিনিই ছিলেন রােমের প্রথম সম্রাট যিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে সরাসরি সম্রাটের সিংহাসনে আসীন হয়েছেন। ম্যাক্রিনাসকে সম্রাট হিসেবে সাদা চোখে ভালােই মনে হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় বসে প্রথমে কিছু জিনিসের ওপরে করের হার কমিয়ে দিলেন। আরেকটি কাজ তিনি করলেন যেটি সবসময় ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি সেনাবাহিনীর ভাতা কমিয়ে দিলেন। কিন্তু শৃঙ্খলার দায়িত্ব খানিকটা বাড়িয়ে দিলেন। দুর্ভাগ্যবশত অনেক কিছুই ঠিকমতাে চলছিল না। পার্থিয়ানরা ক্যারাক্যালার মৃত্যুর পরে সাম্রাজ্যে কিছুটা অরাজকতার সুযােগ পেয়ে সিরিয়ায় অনুপ্রবেশ করল। তারা রােমানদের মােটামুটি হারিয়েই দিলাে। ম্যাক্রিনাস এমন সব শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হচ্ছিলেন যা সেনাদের মধ্যে ভীষণ রােষের সৃষ্টি করল। এই অসন্তোষ যথারীতি তাদের সিংহাসনের দিকে নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ে আন্দোলনের জোগাড় করতে লাগল।
এলাগাবেলাসের ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসন (রা. ২১৮-২২২ খ্রি.) : যারা সেভেরাসের বংশের সাথে কোনাে না কোনাে সম্পর্কের মাধ্যমে যুক্ত তাদেরই যৌক্তিক ভবিষ্যৎ সম্রাট বলে মেনে নেয়া যাবে বলে মনে হচ্ছিল। ক্যারাক্যালার কোনাে পুত্রসন্তান ছিল না, তবে তার আত্মীয়ের মধ্যে কন্যাসন্তান ছিল। ক্যারাক্যালার মা, যেন তার হত্যাকাণ্ডের পরপরই মৃত্যুবরণ করেন, তার জুলিয়া মেইসা নামে একজন বােন ছিল। জুলিয়া মেইসার ছিল দুই কন্যাসন্তান, জুলিয়া সোইমিস আর জুলিয়া মামিয়া। মৃত সম্রাট ক্যারাক্যালার এই দুইজন কাজিন বোনের প্রত্যেকের ছিল একটি করে পুত্রসন্তান। বড় জনের ছেলের নাম ব্যাসিনাস আর ছােট বােনের ছেলে অ্যালেক্সিয়ানাস। ব্যাসিনাস সিরিয়ার এমিসায় নিজের মাকে নিয়ে থাকতেন। সে সময়ে তার বয়স ছিল সতের। সেখানে সূর্যমন্দিরে পূজারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। স্থানীয়ভাবে সেই সূর্যদেবতাকে এলাগাবাল বলে ডাকা হতাে। পরবর্তীকালে সেই তরুণ সূর্যদেবতা পূজারীকে তার নামের রােমান সংস্করণে এলাগাবেলাস (Elagabalus) বলে ডাকা হতাে। এই নামটিকে আবার কোথাও কোথাও হেলিওগ্যাবালাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ “হেলিও” বলতে গ্রিক ভাষায় সূর্যকে বােঝায়। এলাগাবেলাসের মাতামহী জুলিয়া মেইসা কিছু সেনাকে টাকার লােভ দেখিয়ে, এলাগাবেলাসকে ক্যারাক্যালার সন্তান বলে গুজব ছড়াতে প্রতিজ্ঞা করান। এলাগাবেলাস পরে মার্কাস অরেলিয়াস অ্যান্টোনিনাস নাম গ্রহণ করেন এবং ২১৮ সালের ১৬ই মে-তে রােমের সম্রাটের আসনে আসীন হন। ম্যাক্রিনাস এই ঘটনাকে ঠেকানাের আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তবে ছােটখাটো একটি যুদ্ধে লড়ার পরে তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে আবার ম্যাক্রিনাস ধরাও পড়েন। এলাগাবেলাস ক্ষমতায় আসার বছরখানেকের মধ্যে ম্যাক্রিনাসকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। এলাগাবেলাস সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরে রােমে যান এই আনন্দ উদযাপন করতে। সাথে করে তিনি জুলিয়া নামধারী তার মাতামহী, মা এবং মাসিকে নিয়ে যান। বলতে গেলে তার রাজত্বে এই জুলিয়ারাই ছিলেন মূল শাসনের মালিক। সম্রাটকে তার কাজিন আই অ্যালেক্সিয়ানাসকে উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এলাগাবেলাস রােমে সম্রাট হিসেবে একেবারেই অকার্যকর প্রমাণিত হন। রােমের সম্রাট হওয়ার পরেও তিনি সিরিয়ার রীতিনীতিতে অভ্যস্ত ছিলেন, যেটা রােমের অধিবাসীদের বেশ বিস্মিত এবং বিরক্ত করত। তিনি রাজধানী রােমে সূর্যদেবতা এলাগাবালের পূজার প্রচলন করার উদ্দেশ্যে দেবতার প্রতিকৃতি হিসেবে সিরিয়া থেকে একটি কালাে পাথর নিয়ে আসেন। দিনে দিনে তিনিও রােমের আগের সমস্ত তরুণ সমাটের মতাে আবেগী কাজকর্মে অভ্যস্ত হয়ে যান। ২২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রিতােরিয়ান গার্ডরা বিলাসী সম্রাটের ওপরে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা সম্রাটের মা সহ তাকে হত্যা করে। এরপর সিরিয়ার সেই কালাে পাথরটি আবার সিরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আলেক্সিয়ানাসের সেভেরাস আলেকজান্ডার নাম নিয়ে ক্ষমতায় আরোহন : এলাগাবেলাসের কাজিন ভাই এবং তার উত্তরাধিকারী অ্যালেক্সিয়ানাস এরপর যথারীতি ২২২ সালের ১৩ই মার্চ সিংহাসনে আসীন হলেন। সম্রাট হয়ে তিনি মার্কাস অরেলিয়াস সেভেরাস আলেক্সান্ডার নাম গ্রহণ করলেন। এর মাধ্যমে মার্কাস অরেলিয়াস এবং সেপটিমিয়াস সেভেরাসের সাথে তার পারিবারিক সম্পর্কের একটি ইঙ্গিত দেয়া হলাে। আর তার নামের মধ্যে আলেক্সান্ডার শব্দটি আসার কারণ হলাে তিনি ফিনিশিয়ায় আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটকে উৎসর্গ করা মন্দিরের কাছে জন্মেছিলেন। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি সেভেরাস আলেক্সান্ডার নামে পরিচিত। কিন্তু নামে কী আসে যায়, সেভেরাস আলেক্সান্ডার আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটও ছিলেন না, আবার সেপটিমিয়াস সেভেরাসও ছিলেন না। তিনি বাস্তবে ছিলেন কেবলই একটি সতের বছর বয়সী যুবক যে কিনা তার মা এবং মাতামহীর কথায় ওঠাবসা করত। ২২৬ খ্রিস্টাব্দে তার মাতামহী মৃত্যুবরণ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি মৃত্যুর সময়ে তার মেয়ে জুলিয়া মামিয়াকে রােমের ক্ষমতা হস্তান্তর করে যান।
শান্তিপূর্ণ শাসন, বাজে অর্থনৈতিক অবস্থা ও উলপিয়ান : সেভেরাস আলেক্সান্ডার মােটামুটি সৎ এবং শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকাজ চালিয়ে গেছেন। রােমে অ্যান্টোনাইনদের আমলে যে শান্তি বজায় ছিল, তা ফিরিয়ে আনার কিছু চেষ্টা তিনি করেছিলেন। আলেক্সান্ডারের মা সিনেটর এবং আইনজীবীদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করেন যা সরকারকে সবরকম সহায়তা প্রদান করবে। এই কমিটির একজন সদস্য ছিল উলপিয়ান (ডমিশিয়াস উলপিয়ান), যিনি প্যাপিনিয়ানের সহকর্মী ছিলেন আর নিষ্ঠার সাথে সেপটিমিয়াস সেভেরাস এবং ক্যারাক্যালার অধীনে কাজ করেছিলেন। এলাগাবেলাসের সময় তাকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। কিন্তু তখন রাজ্য পরিচালনার প্রাথমিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে আবার ডেকে আনা হয়। যাই হােক, সময়কে তাে আর পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায় না। অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল আর মুদ্রার মূল্যের অবনতি হলাে আরেকবার।
পারস্যে পার্থিয়ার পতন ও সাশানিড সাম্রাজ্যের উত্থান : সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে আবার বিদ্রোহও ঘনীভূত হয়ে উঠল। ক্যারাক্যালার মৃত্যুর পরে পার্থিয়ার সিরিয়ায় অনুপ্রবেশ রােম সাম্রাজ্যের দিকে শেষ সেনা অভিযান হিসেবে প্রমাণিত হলাে। পার্থিয়ায় তখন ভেতরের প্রদেশগুলােতে শান্তি বজায় রাখাই মূল চ্যালেঞ্জ ছিল। আর ওদিকে রােমের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে এবং একই সাথে ভেতরের নানান অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে মেটাতে পার্থিয়া নিজেই নিজেকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। তিনশ বছরব্যাপী পার্থিয়া রােমের বিরুদ্ধে ছােট বড় যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছিল। সেই সময় মনে হয়েছিল তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। যদিও এর মানে এই নয় যে পূর্বদিকে রােমের জন্য অবারিত পৃথিবী উন্মুক্ত ছিল। ২২৪ খ্রিস্টাব্দে ফার্স নামক দেশের আর্দাসির নামে (পারস্য সাগরের তীরের একটি প্রদেশ, গ্রিকদের কাছে পার্সিস এবং আমাদের কাছে পারস্য বলে পরিচিত) শাসনকর্তা পার্থিয়ান রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি পার্থিয়ার সিংহাসনে আসীন হন। এবারে পার্থিয়া সাম্রাজ্যের জায়গায় পারস্য সাম্রাজ্য জেগে উঠল। নতুন এই সাম্রাজ্যটি নব্য পারস্য সাম্রাজ্য কিংবা আধুনিক পারস্য সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হলাে। কারণ আগের সব রীতিনীতি ভুলে নতুন রাজা তার অধীনদের মধ্যে থেকে সাশান নামে একজনকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিলেন। এই রাজপরিবার সাশানিড নামে পরিচিতি লাভ করল। এদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে সাশানিড সাম্রাজ্য বলে অনেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ২২৪ সাল থেকে ৬৫১ সালে পারস্যে ইসলামের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এই সাশানিড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।
পারস্যের বিরুদ্ধে সেভেরাস আলেকজান্ডারের সম্ভাব্য বিজয় : পূর্বদিকে সাম্রাজ্যে এই বিপুল পরিবর্তন রােমে তেমন কোনাে ঢেউ আনতে পারেনি। পূর্বদিকের রাজ্যের মানুষেরা তখনও রােমের শত্রুই ছিল, কে তাদের বর্তমান রাজা অথবা তাদের নাম পার্থিয়া নাকি পারস্য, তাতে তাদের ভাবমূর্তির কোনাে পরিবর্তন হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তখন শত্রুতা ক্রমে বেড়েই চলেছিল। সাশানিড পরিবার নিজেদের প্রাচীন পারস্যের রাজার উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাবত এই কারণে তারা সবসময় মনে করত যে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট তাদের সাম্রাজ্য থেকে যেটুকু ছিনিয়ে নিয়েছিলেন একসময়, তা তাদের আবার ফিরে পেতে হবে। এই হারিয়ে ফেলা অঞ্চলের মধ্যে তারা এশিয়া মাইনর, সিরিয়া এবং মিশরকে বিশেষ করে স্মরণ করত। ২৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পারস্য জাতি সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের প্রদেশগুলােতে অনুপ্রবেশ শুরু করে। ফলে সেভেরাস আলেক্সান্ডার সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করতে বাধ্য হন। তিনি পারস্যের বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজের বাহিনীকে লেলিয়ে দেন। সেই যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু আলেক্সান্ডার একসময়ে রােমে ফিরে আসেন এবং পারস্যের বিরুদ্ধে বিজয় উদযাপন করেন। যতরকমের বিজয়ই তখন অর্জিত হয়ে থাকুক না কেন, তারপরেও নিশ্চিত মনে হচ্ছিল যেন সামনে আরও যুদ্ধ আছে।
জার্মানিকদের আক্রমণ, সেনাদের হাতে আলেকজান্ডার মৃত্যু ও সেভেরাসের বংশের পতন : এদিকে আলেক্সান্ডার রােমে ফিরে চলে আসার পরেই পশ্চিমদিকে জার্মানরা রাইন নদী অতিক্রম করে গাউলে প্রবেশ করে। এবারে আলেক্সান্ডারকে পশ্চিম দিকে ছুটে যেতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত তিনি এবং তার মা মিলে সেনাদের ভাতা থেকে বড় অংশ কেটে নিয়ে দেশের কোষাগার শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আসলে তারা সেনাদের মধ্যে বিদ্রোহ ঘনীভূত হওয়ার সুযােগ করে দিয়েছিলেন। তবু সেনারা মুখ বন্ধ করে ছিল প্রায় পুরাে রাজত্বকাল জুড়েই। ২২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের আদেশে বয়স্ক আইনজীবী উলপিয়ানকেও তারা মুখ বুজে হত্যা করেছিল। কিন্তু তখন তারা হয়তাে কিছু একটা করার কথা ভাবছিল। গাউলে আলেক্সান্ডার জার্মানের অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি সেনাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে যুদ্ধের জন্য সেখানে আত্মত্যাগের জন্য এক ধরনের কৃত্রিম দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়ে তােলার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সেনারা জয়ের পক্ষে আলেক্সান্ডারকে তার অসামর্থ্যের দোহাই দিয়ে (হয়তােবা নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করে তারা সঠিকই ভেবেছিল) ২৩৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট এবং তার মাকে বন্দী করে হত্যা করে। আলেক্সান্ডার সেভেরাসের রাজত্বকাল ছিল সাধারণ মানুষের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আদর্শে গড়া শেষ শাসনকাল। এর পর থেকেই নির্লজ্জ এবং অনুতাপহীন সেনা শাসন আমল ধেয়ে এসেছিল। এভাবেই ৪২ বছরব্যাপী (মাঝখানে মাত্র একটি বছর ম্যাক্রিনাস রােমে শাসন করেন) রােমকে শাসন করে সেভেরাস রাজবংশের শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে। যুগ্ম সম্রাট গেটাসহ হিসেব করলে এই বংশ রােমকে পাঁচজন সম্রাট দিতে পেরেছিল।
খ্রিস্টান লেখক বা চার্চ ফাদারগণ
চার্চ ফাদাররা : অর্ধশতাব্দী ধরে সাম্রাজ্যে যখন কেবল হানাহানি বেড়েই চলেছিল, এমনকি সেই সূত্র ধরে মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুও হলাে, খ্রিস্টধর্ম কিন্তু ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে শহরে এবং আরও বেশি করে গ্রিক ভাষাভাষীদের শহরে ধর্মটি বেশি প্রসার পাচ্ছিল। একইসাথে খ্রিস্টধর্মের উপরে লেখালেখিরও যেন উর্ধ্বস্রোত বইছিল। খ্রিস্টধর্মের কোনাে বিশেষ দিক নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য থাকাকালে কিংবা পরে মধ্যযুগেও যারা লিখেছিলেন, তাদের বলা হয় “চার্চ ফাদার”। তারা আবার যে ভাষায় লেখালেখি চর্চা করেছিলেন তার উপর নির্ভর করে এই চার্চ ফাদারগণ গ্রিক ফাদার এবং ল্যাটিন ফাদার নামে দুটো অংশে বিভক্ত। অবশ্য এটা বলা যাবে না যে, কোনাে কোনাে লেখক সেই ফাদারদের মধ্যে থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার এটাও বলা যায় না যে, কোনাে কোনাে ফাদার লেখালেখি করেছিলেন। আসলে চার্চ ফাদাররা এই দুই দলের যে কোনাে একটিতে ছিলেন।
ক্লিমেন্টস অফ অ্যালেক্সান্দ্রিয়া : পূর্বদিকে ক্লিমেন্টস অফ অ্যালেক্সান্দ্রিয়া (টাইটাস ফ্লেভিয়াস ক্লিমেনস) ছিলেন সে সময়ের চার্চ ফাদারদের মধ্যে অন্যতম। তার উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্মের উপরে গ্রিক জ্ঞানের আলােকপাত করা। এই ধর্মযাজক ১৫০ খ্রিস্টাব্দে এথেন্সে জন্মেছিলেন। তার পিতামাতা ছিল প্যাগান ধর্মের অনুসারী। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পূর্বেই হয়তাে কিছু প্যাগান শাস্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই যেখান থেকে তার উদ্ভব, সেই অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই থাকতেন। তার শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতিটিকে তাই বলা হতাে অ্যালেক্সান্ড্রিয়ান ধর্মীয় ধারা। ক্লিমেন্ট খ্রিস্টধর্মকে দেখেছিলেন একটি দর্শন হিসেবে। তার মতে এটি কেবল গ্রিক ধর্মীয় পদ্ধতির পরের বিষয় ছিল না, বরং ছিল অনেক উর্ধ্বে। তিনি ইহুদি রচনা থেকে প্রয়ােজনীয় অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে সেগুলাে গ্রিক রচনার চেয়েও প্রাচীন। তিনি এটিও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেন যে গ্রিক ধর্ম ছিল প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীন ইহুদি ধর্মেরই একটি অংশ মাত্র। তার মতে প্রাচীন কালের ফাদারদের মধ্যে অন্য কেউ গ্রিক দর্শনের ব্যাপারে এত বিস্তারিত পড়াশােনা করেননি।
অরিজেন : ক্লিমেন্টের শিষ্যদের মধ্যে এখনও যার নাম উল্লেখযােগ্য মনে করা হয়, তিনি হলেন অরিজেন (অরিজিনেস)। ১৮৫ খ্রিস্টাব্দে অরিজেন অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। অরিজেন এসেছিলেন অ্যালেক্সান্ড্রিয়ার একটি খ্রিস্টান পরিবার থেকে। তার বাবা খ্রিস্টান হিসেবে শহীদ হন। ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণের জন্য তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি নিজেকে এমনভাবে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন যেন নারীর সান্নিধ্য কিংবা সংসারের মােহ তাকে মাঝপথে বিরত করতে না পারে। তার এই প্লেটোনিক দর্শন এবং তার রচনা মানুষের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তাকে আগের সব দার্শনিকসহ ধর্মযাজকদের জনপ্রিয়তার উর্ধ্বে তুলে ধরল। সে যাই হােক, তিনি প্রচুর লিখেছিলেন আর বিশেষ করে তাকে সবসময় গ্রিক লেখক সেলসাসের বিপক্ষে সমান একটি প্রতিভা হিসেবে স্মরণ করা হয়। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পরের প্রথম শতাব্দীর বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার জন্য সেলসাস যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন তা নয়, কিন্তু অরিজেনের দেড় শতাব্দী পরে প্লেটোর দর্শনে বিশ্বাসী হিসেবে তার নামভাক হয়েছিল। সেলসাস খ্রিস্টধর্মের বিপক্ষে একটি সাধারণ এবং অগভীর বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ের দর্শন তখন অল্প কিছু মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। এটাই ছিল প্যাগানদের মধ্যে একজনের লেখা প্রথম একটি বই যেখানে খ্রিস্টধর্মকে খুব বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেলসাসের যুক্তিগুলাে ছিল খুবই সাধারণ, যেসব বিষয় নিয়ে আজকের দিনে মুক্তচিন্তার যে কোনাে মানুষ ভাবে। তার উত্থাপিত বিষয়গুলাের মধ্যে কুমারী তরুণীর মা হওয়া, মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফিরে আসা, আর এছাড়াও বিভিন্ন অসম্ভব ঘটনা যেসব ব্যাখ্যার অতীত। এছাড়াও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কী করে খ্রিস্টধর্ম গ্রিক ধর্মের আদর্শকে ভেঙে ভেঙে তৈরি হলাে এবং পরবর্তীকালে নিজেদের প্রসারের জন্য গ্রিক ধর্মের প্রতিই হুমকি হয়ে দাঁড়াল। বইটি ছিল প্রচণ্ড বাস্তববাদী। সেই সাথে তা ভীষণ জনপ্রিয় একটি সাহিত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বইটি টিকে থাকতে পারেনি। তাই বইটির কথা তেমন শােনাও যায় না। অরিজেন সেলসাসের জনপ্রিয় বইটিতে যত যুক্তি ছিল তা খণ্ডন করার জন্য “সেলসাসের বিপক্ষে” নামে আরেকটি বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ে অরিজেন সেলসাসের লেখা বইয়ের নয় দশমাংশই তুলে দিয়েছিলেন যুক্তি খণ্ডনের জন্য। তাই বলতে গেলে অরিজেনের মাধ্যমেই সেলসাসের বইটি টিকে ছিল। অরিজেনের রচনাটি খ্রিস্টধর্মের সপক্ষে লেখা সবচেয়ে জোরালাে একটি বই।
টারটুলিয়ান ও সিপ্রিয়ান : মার্কাস অরেলিয়াসের আমলের (১৬১-১৮০ খ্রি.) পরপর পশ্চিম দিকের প্রদেশগুলােতেও চার্চের লেখকদের উদ্ভব হয়েছিল। তখন প্রকৃতপক্ষে দর্শনচর্চা যেন কেন্দ্র গ্রিস ছেড়ে সারা সাম্রাজ্যের উর্বর মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। পশ্চিমা প্রদেশের লেখকদের মধ্যে প্রথমেই যার কথা বলতে হয় তিনি হলেন টারটুলিয়ান (কুইন্টাস সেপটিমিয়াস প্লেরেন্স টারটুলিয়ানাস)। তিনি ১৫০ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রিক ভাষা পড়তে ও লিখতে পারা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে লেখালেখি করেছিলেন ল্যাটিন ভাষায়। তিনি প্যাগান পিতামাতার ঘরেই জন্মেছিলেন এবং একটি ভালাে কাজের আশায় রােমে এসেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি ১৯৭ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজে ফিরে আসেন। আর তারপর থেকে বাকি জীবন সেখানেই বসবাস করেন। তার রচনার মূল দিক ছিল তিনি নস্টিক দর্শনকে জনপ্রিয়তার তালিকা থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই বাস্তবিকভাবে নস্টিক দর্শনের ক্রান্তিকাল আরম্ভ হয়েছিল। টারটুলিয়ান ছিলেন একজন মন্টানিস্ট যিনি জীবনভর খ্রিস্টানদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের ব্যাপারে গোঁড়ামির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। পরে কার্থাজিনিয়ান চার্চ থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি নিজের অনুসারী ব্যক্তিদের নিয়ে কাছাকাছি একটি মন্টানিস্ট লােকালয়ে গিয়ে থাকা শুরু করেন। সেখানে তার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। ২২২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন আফ্রিকার সিপ্রিয়ান (থেসিয়াস সিসিলিয়াস সিপ্রিয়ানাস)। তিনি প্রায় ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কার্থেজে জন্মগ্রহণ করেন । তিনিও প্যাগান পিতামাতার ঘরে জন্মেছিলেন এবং পরে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তিনি অবশ্য কার্থেজে চার্চের বিশপ হিসেবেও কাজ করেন। তিনি তার রচনার মধ্যে টেরুলিয়ানের লেখার ধরনটি অবিকৃত রেখেছিলেন। ২৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি শহীদ হন।
নব্যপ্লেটোবাদের জনপ্রিয় হয়ে ওঠা : খিস্টধর্মের ক্ষমতা দিনদিন এতই বেড়ে যাচ্ছিল যে সে সময় আলেক্সান্ডার সেভেরাসের রােমে সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা যে ইচ্ছে ছিল তা নেই হয়ে গেল। ধীরে ধীরে প্যাগান ধর্মের অনুসারী দার্শনিকেরা খ্রিস্টধর্মের বর্ধিষ্ণু জনপ্রিয়তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। এর আগে ছিল স্টয়সিজম বা স্টোইকবাদ যা কিনা অভিজাত শাসক শ্রেণির অল্প কিছু মানুষকে তার আদর্শের দিকে টেনে আনতে পেরেছিল। কিন্তু মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই আদর্শের জনপ্রিয়তাও যেন হঠাৎ করেই মরে যায়। এরপর যে দর্শন সফলতার মুখ দেখেছিল, তা হলাে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দর্শন। তার নতুন ধরনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। জীবন এবং ধর্মকে তিনি নিজস্ব দর্শনে বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন। তখন দার্শনিকদের কাছে নব্য প্লেটোনিক দর্শন এমনই একটি আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশ্বাস আর না বাড়িয়ে তারা প্লেটোর মতবাদগুলােতেই নিজেদের আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেত। প্লেটোর অনুসারী নব্য দার্শনিকদের মধ্যে যার নাম সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য, তিনি হলেন প্লটিনাস। ২০৫ খ্রিস্টাব্দে রােমান পিতামাতার পরিবারে মিশরে তার জন্ম হয়েছিল। তিনি অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং রােমে আসেন ২৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তার মৃত্যুর আগে ২৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জটিল দর্শনের শিক্ষাদান করতে থাকেন। যদিও এই নব্য প্লেটোনিজম রােমান সাম্রাজ্যে বিশাল কোনাে প্রতিষ্ঠিত দর্শন হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে সফল হয়নি, কিন্তু প্লেটোর নানান দর্শন কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে খ্রিস্টান চার্চে প্রচলিত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে যেখানে খ্রিস্টধর্ম বেশি প্রসার পেয়েছে, সেখানে প্লেটোর দর্শনও জনপ্রিয় হয়েছে।
খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের সংকট
ম্যাক্সিমিনাস, তিন গর্ডিয়ান ও আরবের ফিলিপের শাসন (রা. ২৩৫ – ২৪৯ খ্রি.)
রোমের বাজে অবস্থা, একের পর এক সম্রাটের আগমন, রোমান সেনাবাহিনীতে জার্মানিকদের আগমন : ইতিহাসে এর আগেও দুই দুবার রােম দেখেছে কী করে এক একটি রাজবংশ কেবল যুদ্ধের কারণে পুরােপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে। ৬৮ খ্রিস্টাব্দে নিরােকে বন্দী করার পরে সাম্রাজ্যে হালকা একটি যুদ্ধ চলে আসছিল। ১৯২ খ্রিস্টাব্দে কমােডাসকে বন্দী করে হত্যার পরে সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ প্রবল আকার ধারণ করে। সেবারে যুদ্ধ স্থায়ী হয় চার বছরব্যাপী। এবারে ২৩৫ খ্রিস্টাব্দে আলেক্সান্ডার সেভেরাসের হত্যার পরে রােম ছিল খুব দুর্বল একটি সাম্রাজ্য আর যা ছিল উপর্যুপরি যুদ্ধের ফসল। কারণ তার আগের পঞ্চাশ বছর ধরে কেবল সাম্রাজ্যের বাইরে থেকে আক্রমণ হয়ে আসছিল। সেসব আক্রমণে রােম বলতে গেলে জায়গায় জায়গায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই অর্ধশতাব্দীতে অন্তত ছাব্বিশজন মানুষ সম্রাটের আসনে আসীন হতে পেরেছিলেন। তাদের কেউ কেউ বেশ সমর্থনও পেয়েছিলেন, কেউ বেশ সফলও হয়েছিলেন। কারও কারও সফল হবার চেষ্টা ছিল। তবে তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া বাকিরা সব ভয়ংকর মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন। দেশে এই ক্রমাগত অরাজকতার মূল হিসেবে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে দায়ী করা যেতে পারে। সেনাবাহিনীর বিশাল বাহিনীকে কিছুতেই তখন আর একক রােমান বাহিনী বলে মনে করার কোনাে উপায় ছিল না। বাহিনীতে দূর দূরান্তের প্রদেশগুলাে থেকে সেনা এসে যােগদান করতে লাগল। বিভিন্ন প্রদেশের দরিদ্র শ্রেণি, যারা কখনও সরকারি কোনাে কাজে অংশগ্রহণের কোনাে আশা রাখেনি, সেরকম মানুষেরাই তখন সেনা সদস্য হওয়ার জন্য অগ্রাধিকার পাচ্ছিল। তাই তখন হু হু করে উত্তর দিকের জার্মানি থেকে অসভ্য উপজাতিরা দলে দলে এসে রােমান সেনাবাহিনীতে যােগ দিলাে। তারা মােটামুটি ভালাে যােদ্ধা ছিল আর রােমান বাহিনীতে যােগদানের ব্যাপারে তাদের একমাত্র কারণ ছিল উচ্চমানের ভাতা। যেখানে খােদ রােমানরা সেনাবাহিনীতে থাকার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত বােধ করছিল, সেখানে তাদের জন্য সেটা ছিল ভীষণ লােভনীয় একটি সুযােগ।
আলেকজান্ডারকে হত্যা করে ম্যাক্সিমিনাসের ক্ষমতা গ্রহণ (রা. ২৩৫ – ২৩৮ খ্রি.) : যে কোনাে বাহিনীর প্রধান নিজেকে সিংহাসন পর্যন্ত ঠেলে উঠিয়ে দেয়ার জন্য সেই বাহিনীর সেনাদের অনায়াসে ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু সিংহাসনটি হয়ে পড়েছিল আত্মহত্যার আরেক নাম। এমনটা তারা কখনও চেয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য যে মানুষই যখন সিংহাসনে বসতে সফল হয়েছে, চেষ্টা করেছে যেন সাম্রাজ্যের হাজার পাহাড় প্রমাণ সমস্যাগুলাের সমাধান হয়। অর্ধশতাব্দীর অরাজকতা শুরু হয়েছিল যখন কিনা ম্যাক্সিমাস নামে একজন গ্রেসিয়ান কৃষক (গেইয়াস জুলিয়াস ভ্যারাস ম্যাক্সিমিনাস) কিছু সংখ্যক বিদ্রোহীদের উস্কে দিয়ে গাউলে সেভেরাস আলেক্সান্ডারকে হত্যা করেছিলেন এবং সেখানেই নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম রােমান সম্রাট যার একজন সেনার চেয়ে উঁচু সামাজিক সম্মান প্রাপ্য ছিল না। তাই ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরেও তার আদেশ নির্দেশ সেনাবাহিনীরা তেমন একটা গায়ে লাগাত না। দক্ষিণ দিকের শেষ প্রান্তে আরও একজন দেড়শ বছর আগে নার্ভাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘােষণার চেষ্টা করেছিলেন।
পিতা-পুত্র প্রথম ও দ্বিতীয় গর্ডিয়ানের ক্ষমতা গ্রহণ (রা. ২৩৮ খ্রি.) : যাই হোক, গর্ডিয়ান (মার্কাস অ্যান্টোনিনাস গর্ডিয়ানাস) নামে একজন বয়স্ক, সম্মানিত ব্যক্তি নিজেকে সম্রাট ঘােষণা করেছিলেন। গর্ডিয়ান ১৫৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজেকে ট্রাজানের বংশধর বলে দাবি করতেন। তিনি বাস্তবে এমন নীতিবােধসম্পন্ন এবং পরিশ্রমী জীবনযাপন করতেন, যেন মনে হতাে তিনি অ্যান্টোনাইনদের মধ্যে একজন। আলেক্সান্ডার সেভেরাসের অধীনে তিনি আফ্রিকার গভর্নর ছিলেন। যখন সেখানকার স্থানীয় বাহিনী তাকে সম্রাট হিসেবে দেখতে চেয়েছিল, তখনও তিনি সেখানকার গভর্নরের পদেই বহাল ছিলেন। গর্ডিয়ান যে কেবল নার্ভাকে স্মরণ করে এমনটা করেছিলেন, তা নয়, তিনি অসফল সম্রাট পার্টিন্যাক্সের কথাও উল্লেখ করে বলেছিলেন যে তার পক্ষে এই বৃদ্ধ বয়সে সাম্রাজ্যের এই অবস্থার উন্নতি করা এবং আইন রক্ষা করা প্রায় দুঃসাধ্য। তার বয়স ছিল প্রায় আশি বছর। তার অনুগত সেনাবাহিনী তাকে সিংহাসনে আসীন হতে বাধ্য করার জন্য হুমকি দিয়েছিল। নিজেকে সম্রাট ঘােষণা না করলে তাকে সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। তাই তিনি ভয়ে ভয়ে নিজের সন্তানকে পাশে রেখে কাজটি করেছিলেন। তারা দুজনেই সম্রাটের আসনে বসেন এবং ইতিহাসে যথাক্রমে প্রথম গর্ডিয়ান এবং দ্বিতীয় গর্ডিয়ান হিসেবে পরিচিত হন। (দ্বিতীয় গর্ডিয়ান একজন বিখ্যাত সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে পরিচিত হন। তিনি ৬২০০০ ভলিউমের একটি পাঠাগার স্থাপন করেন।) তাদের দুজনকেই সিনেট স্বাগতম জানিয়েছিল কিন্তু কোনােরকমে তারা মাসখানেকের বেশি শাসনকার্য চালাতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় গর্ডিয়ান নিজেদের ভেতরে সেনাদের সাথে এক সামান্য যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলে প্রথম গর্ডিয়ান ক্ষোভে, দুঃখে আত্মহত্যা করেন।
তৃতীয় গর্ডিয়ানের ক্ষমতা গ্রহণ (রা. ২৩৮ – ২৪৪ খ্রি.), পারস্যের সাথে যুদ্ধ ও ফিলিপাসের হাতে মৃত্যু : এর মধ্যে ম্যাক্সিমিনাসও তার নিজের বাহিনীর হাতে মারা পড়েছিলেন। আর গর্ডিয়ানরা এমনিতেই তখন সেনাদের পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে পড়েছিলেন। মাত্র বারাে বছর বয়সী প্রথম গর্ডিয়ানের এর নাতি, কেবল নামের জোরে রােমে সিনেটের সমর্থনে নতুন সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। তিনি হলেন তৃতীয় গর্ডিয়ান। ২৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজত্ব শুরু করেন। তারপর কয়েকবছর পর পর্যন্ত অবস্থা মােটামুটি ভালােই চলতে লাগল। মাঝখানে কিছুদিন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া গেলেও হঠাৎ করে আবার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলােতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ২৪১ খ্রিস্টাব্দে সাশানিড রাজপরিবারের দ্বিতীয় রাজা প্রথম শাপুর পারস্যের রাজা ছিলেন। তিনি পাশের সাম্রাজ্যের প্রদেশ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছিলেন। ভেবেছিলেন ইচ্ছে করলেই অনায়াসে তিনি সেখানকার কিছু অংশ নিজের দখলে নিতে পারেন যারা কিনা অতীতে তাদের অনেক ভুগিয়েছে। তিনি সিরিয়ায় বাহিনীসহ প্রবেশ করে সেখানকার রাজধানী অ্যান্টিওক ঘেরাও করে রাখেন। রােমের বালক সম্রাট তৃতীয় গর্ডিয়ান অবশ্যই একজন যােদ্ধা হয়ে ওঠেননি তখনও। কিন্তু তিনি ততদিনে বিবাহিত হয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলে তার শ্বশুর গেইয়াস ফিউরিয়াস টাইমিসিথিয়াস সেই অক্ষমতার জায়গাটা পূরণ করে দিয়েছিলেন। তিনি রােমান বাহিনীকে দক্ষতার সাথে পথ দেখিয়ে সিরিয়া থেকে পারস্যের সেনাদের হটিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যবশত টাইমিসিথিয়াস গুরুতর অসুখে ভুগে ২৪৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব মার্কাস জুলিয়াস ফিলিপাসের হাতে চলে যায়। তার হাতে তৃতীয় গর্ডিয়ান মৃত্যুবরণ করেন। ২৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করেন।
ফিলিপাস বা ফিলিপ অফ অ্যারাবিয়ানের শাসন (রা. ২৪৪ – ২৪৯ খ্রি.) ও সেক্যুলার গেমস : ফিলিপাস আরব প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। আর তাই ইতিহাসে তিনি ফিলিপ অফ অ্যারাবিয়ান বলে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি পারস্যের সাথে একটি লােক দেখানাে শান্তির ব্যবস্থা করেন। আর সেটি আসলে করেন ঘুষ দিয়ে। তিনি তাদেরকে যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে কিছু অর্থ সাহায্য করেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে রােমে ফিরে আসেন। এই নিয়মটি পাঁচ বছরব্যাপী চলতে থাকে। এবং এটি এই জন্য বিশেষ করে উল্লেখযােগ্য যে সে সময়ে রােমান সাম্রাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পার করছিল। ২৪৮ খ্রিস্টাব্দে রােম সাম্রাজ্যের এক হাজার বছর পূর্তি উৎসব হয়েছিল। অগাস্টাস শহরের ইতিহাসে কোনাে একটা যুগের সমাপ্তি উদযাপন করার প্রচলন করেছিলেন। সেই উৎসবের মধ্যে নানারকমের ধর্মনিরপেক্ষ (সেকুলার গেমস) খেলাধুলার আয়ােজন করা হতাে। সেকুলার শব্দটি এসেছিল ল্যাটিন থেকে। এর অর্থ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের পুনরাবর্তন অথবা পৃথিবীর বয়স। পরে এই শব্দটি পার্থিব বা ধর্মনিরপেক্ষতা বােঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শতাব্দীর শেষে অথবা কোনাে শহরের পত্তনের সময় এই ধরনের খেলাধুলার আয়ােজন খুব স্বাভাবিক ছিল। ক্লডিয়াস শহরের ৮০০ তম বছর এবং অ্যান্টোনিনাস পায়াস ৯০০ তম বছর উদ্যাপন করেছিলেন। এবারে ফিলিপ দ্য অ্যারাবিয়ান ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য এবং বিস্তারিত সেকুলার গেমসের আয়ােজন করেন রােমের ১০০০ তম বছর উদযাপনের জন্য। এটা যে কেবল অনেক দিনব্যাপী হয়েছিল তা নয়, এটাই ছিল এ ধরনের শেষ উৎসব। কারণ ওই সেকুলার গেমস আর কোনােদিন উদযাপিত হয়নি।
ডেসিয়াস (রা. ২৪৯-২৫১ খ্রি.) ও খ্রিস্টান নির্যাতন
ফিলিপাসকে হত্যা করে ডেসিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ : সেই হাজারতম বছরটি ফিলিপের জন্য কোনাে সৌভাগ্য বয়ে আনেনি। সাম্রাজ্যের চারদিকে বিভিন্ন বাহিনী বিদ্রোহ করছিল। ফিলিপ তার পক্ষের লােকদের মধ্যে একজন, ডেসিয়াসকে (গেইয়াস মেসিয়াস কুইনটাস ট্রাজানাস ডেসিয়াস) দানিয়ুবের তীরে পাঠিয়ে দেন সেখানকার বিদ্রোহ মেটানাের জন্য। সেখানে যাওয়ামাত্রই বিদ্রোহী সেনারা ডেসিয়াসকে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেয়ার অনুরােধ করে। ডেসিয়াস এই দায়িত্ব নিতে চাননি এবং তাদের বুঝিয়ে শান্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেনারা যখন তাকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করে দিয়েছে তখন তার আর কিছুই করার ছিল না। এরপর সেই সময়ে সেখানে যা যৌক্তিক, সেই ক্ষমতার জন্য লড়াই করা ছাড়া তার সামনে অন্য কোনাে রাস্তা খােলা ছিল না। বাধ্য হয়ে তাকে বিদ্রোহীদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পুরাে বাহিনী নিয়ে ইতালির দিকে রওনা দেন তিনি। ২৪৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ইতালিতে যুদ্ধ শুরু হয়। সেখানে সম্রাট ফিলিপকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। অবশ্যম্ভাবীভাবে তারপর রােমান সম্রাট হন ডেসিয়াস। ততদিনে ক্রমবর্ধমান খ্রিস্টানরা রােমান সাম্রাজ্যের সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করছিল। রোমানদের কাছে তারা ধীরে ধীরে বিরক্তিকর এবং ধ্বংসাত্মক উপাদানে পরিণত হচ্ছিল।
খ্রিস্টানদের স্টেইট রেলিজিয়ন পালন ও সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদানে অনীহা : এ প্রসঙ্গে খ্রিস্টানদের প্রতি রোমানদের অসন্তোষের ব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার। ২৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন সাম্রাজ্য জুড়ে সেভাবে দেখা যেত না। সেই সময় খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন ছিল স্থানীয় আকারে ও মূলত জনতার দ্বারা, স্থানীয় শাসক কর্তৃপক্ষ খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন করেছে এরকম ঘটনা হাতে গোনা ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা একই সাথে পাবলিক কাল্ট লিডারও ছিলেন। রোমান ধর্মগুলো গণ অনুষ্ঠান ও উৎসর্গ অনুষ্ঠানকে ঘিরেই আবর্ত হতো। আধুনিক ধর্মগুলোতে যেরকম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার দেখা যায়, সেসময় এরকম ছিলনা। তাই খ্রিস্টানদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে রোমান এলিটরা কখনও গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে রোমান সমাজের পাবলিক রিলিজিয়াস প্র্যাক্টিসগুলোই ছিল লোকাল কমিউনিটি ও সাম্রাজ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য উপাদান। এরকম ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে সম্মান দেয়া ছিল তাদের কাছে স্থিতিশীলতা ও সাফল্যের চাবিকাঠি। রোমান সাম্রাজ্যে রিলিজিয়াস সিনক্রেটিজম বা ধর্মীয় সমন্বয়বাদের চর্চা ছিল। সেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করতে পারত। কোন এক ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা সেখানে ছিল না। কিন্তু রোমান শাসকগণ রাষ্ট্রের উপর জনগণের আনুগত্য দবি করত। আর প্রজাদেরকে এই আনুগত্য প্রদর্শন করতে হতো সারা বছর জুড়ে এই পাবলিক সেরেমনিরগুলোর মাধ্যমে, অর্থাৎ বিভিন্ন রকম পান-ভোজনোৎসব ও অনুষ্ঠান উদযাপনের সাথে সাথে স্টেট রিলিজিয়নের চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের প্রকৃতিই এমন যে, তাতে অন্য কোন “ঈশ্বর” জড়িত থাকে এমন কোন আচার পালন করা যাবে না। এজন্য খ্রিস্টানরা ফিস্ট ডেগুলোতে, শোভাযাত্রায়, বলিদান বা ধূপ জ্বালানোর মতো কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করতো না। এটা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্নতার জন্ম দেয়। তারা রোমান সম্রাটের প্রতিও ধূপ দান করতো না, যেখানে সাধারণ জনগণের মনে সম্রাটকে দেবতার মতই দেখা হতো, আর যখন তাকে দেবতার মত করে দেখা হতো তখন তিনি হয়ে উঠতেন সমগ্র সাম্রাজ্যের মানবরূপ। তাই ধর্মীয় কারণে খ্রিস্টানরা সম্রাটের উপরেও আনুগত্য দেখাতো না। রোমান সাম্রাজ্য চাইত না যে রাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোন সত্তা প্রজার আনুগত্যের ক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াক। প্রজার কাছে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থানই হবে সর্বাগ্রে। কিন্তু খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় সর্বোত্তম।
খ্রিস্টানদের প্রাইভেট পরিসরে ধর্ম পালন ও সভা এবং যিশুর রক্ত-মাংস খাবার সিম্বলিজমের কারণে রোমানদের সাথে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি : এদিকে খ্রিস্টানরা তাদের কার্যক্রমকে রাজপথ ছাড়িয়ে বাড়িঘর-দোকানপাটের মত প্রাইভেট পরিসরে নিয়ে যায়, আর ধর্ম, ঐতিহ্য এবং নগর ও জাতির মতো পাবলিক ইনস্টিটিউশনের মধ্যে যে স্বাভাবিক বন্ধন ছিল তাতে ভাঙ্গন ধরাতে শুরু করে। এভাবে তাদের দ্বারা “ধর্মের প্রাইভেটাইজিং” ছিল তাদের উপর নির্যাতনের আরেক কারণ। তারা কখনও কখনও গোপনে রাতের বেলায় মিলিত হতো, যা পাবলিক ইভেন্টে অভ্যস্ত প্যাগান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। এর ফলে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে যায় যে তারা গোপনে অপরাধমূলক কাজ, লজ্জাজনক পাপ, নরভক্ষণ বা অজাচারের মত কার্যের সাথে জড়িত। এদিকে খ্রিস্টধর্মের ইউক্যারিস্ট আচারের মধ্যে মদকে যিশুর রক্ত ও রুটিকে যিশুর মাংস ভাবার একরকম সিম্বলিজম রয়েছে, এটা এই গুজবকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেয়। এছাড়া খ্রিস্টানদের অনেক রীতিনীতি ও ধ্যানধারণাই রোমান ঐতিহ্যের সাথে মিলত না। গিবন বলেন, খ্রিস্টীয় ধর্মান্তরিতগণ তাদের পরিবার ও অঞ্চল ত্যাগ করত, এবং বারবার ভবিষ্যতে দুর্দশা আসতে চলেছে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে তাদের প্যাগান প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করত। প্যাগানদের মধ্যে এরকম ভয় ঢুকে যাবার ফলে যেটা হয়, তারা রোমান সাম্রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, মহামারী সহ যেরকম ডিজাস্টারই আসুক না কেন সব দোষ চাপাতো খ্রিস্টানদের ওপর। আমরা দেখি খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষের দিকে টারটুলিয়ান লিখছেন, খ্রিস্টানরা দুর্যোগের জন্য দায়ী নয়, এথেকে তখনকার দিনে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে প্যাগানদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে অনুমান করা যায়।
নতুন ধর্ম খ্রিস্টধর্মকে হানিকর বলে ভাবা ও রোমান আচারপ্রথা নিয়ে কটূক্তি : রোমানরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাল্টের ইন্টিগ্রিটির সম্মান দিত, তাদের পূর্বপুরুষগত ঐতিহ্যকে সম্মান দিত। আর তাই দীর্ঘদিন ধরে রোমানরা খুবই এক্সক্লুসিভ ইহুদি সম্প্রদায়কে সহ্য করে এসেছে। সাধারণ রোমান জনগণ ইহুদিদেরকে পছন্দ না করলেও রোমান শাসকগণ ইহুদি ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছে। ইহুদিরা তাদের ইহুদি ট্যাক্স দিয়ে তাদের ধর্ম-কর্ম সব পালন করতে পারতো। কিন্তু খ্রিস্টানদের বেলায় তাদের প্রতি সেরকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিলনা। যতদিন খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরই অংশ ছিল ততদিন কোন সমস্যা ছিলনা, ইহুদিদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, আর ঐতিহ্যকে রোমানরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কিন্তু ৯৬ সালের পর রোমানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে খ্রিস্টান আর ইহুদিরা আলাদা। ইহুদিদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, কিন্তু খ্রিস্টানরা সেই ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্পূর্ণ নতুন এক সংস্কৃতি। এই নতুন উদ্ভূত সংস্কৃতিকে রোমানরা সুপারস্টিশাস বা কুসংস্কারমূলক হিসেবে দেখত। সেই সময় তাদের কাছে “সুপারস্টিশন” আমাদের কাছে যা কুসংস্কার যেরকম ঠিক সেরকমটা ছিলনা। এর দ্বারা রোমানরা এমন এক ধর্মীয় বিশ্বাসকে বোঝাতো যা সমাজের জন্য হানিকর। তাছাড়া এই খ্রিস্টানরা এমন একজনকে পূজা করত (যিশু) যে কিনা ছিল রোমানদের দ্বারাই এক সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তাদের ধর্মগ্রন্থে ছিল রোমানদের বিরুদ্ধে কটূক্তি। তৃতীয় শতকের প্রথম দিকে দেখা যায় একজন রোমান মেজিস্ট্রেট বলছেন, “আমি সেইসব লোকের কথা অত শুনতে পারব না যারা রোমান ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে কটূ কথা বলে”। এ থেকে এই মনে হয় যে, খ্রিস্টানরা সেসময় রোমান ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে কটূ কথা বলত। এভাবে খ্রিস্টানদের সাজাপ্রাপ্ত আসামীর পূজা করা, রোমান সম্রাটের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য প্রদর্শন ও শপথ না করা, ধর্মগ্রন্থে রোমানদের নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা, আর সন্দেহজনকভাবে গোপনে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার কারণে রোমান শাসক ও প্রজাগণ উভয়পক্ষই খ্রিস্টানদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হতে শুরু করে। উত্তাল জনতা কর্তৃক খ্রিস্টানদের উপর চড়াও হবার ঘটনাও দেখা যেতে থাকে, আর এমন ক্ষেত্রে জনগণকে শান্ত করার জন্য শাসকেরা তাদের ইচ্ছানুসারেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। সব মিলে এসব ঘটনাই খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্টানদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
ডেসিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণের পর সাম্রাজ্য জুড়ে জুপিটারের প্রতি সকলের বাধ্যতামূলক উৎসর্গের আদেশ : ২৪৯ সালে ডেসিয়াস রোমান সম্রাট হলেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যপন্থী টাইপের লোক। এসেই তিনি রোমের “স্বর্ণযুগকে” পুনর্জাগরিত করার কাজ শুরু করলেন। তিনি সেন্সরের প্রাচীন কার্যালয় পুনরায় চালু করলেন, কলোসিয়ামও পুনর্নির্মাণ করলেন। এবার তিনি ঐতিহ্যবাহী রোমান রীতিনীতিও চালু করার কাজে হাত দিলেন। শুরুটা হলো ২৫০ সালের ৩ জানুয়ারিতে জুপিটার দেবতার প্রতি বার্ষিক উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। তিনি একটি অনুশাসন জারি করেন, যেখানে বলা হয় সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়েই দেবতাদের প্রতি উৎসর্গ দিতে হবে, সাথে দেবতার উদ্দেশ্য ধূপ জ্বালাবার কথাও বলা হয়। তবে ইহুদিদেরকে এই কার্য থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এখন এরকম কোন সাক্ষ্যপ্রমাণও নেই যে এই ডিক্রি ধার্য করার সময় খ্রিস্টানদেরকে টারগেট করা হয়েছিল বা তাদেরকে নির্যাতন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বরং ডেসিয়াসের এই আদেশকে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে একতাবদ্ধ করার একটি উপায় হিসেবেই দেখা হয়েছিল। সম্রাটের এই আদেশ পালনকে তার প্রতি একরকম আনুগত্যের শপথ গ্রহণ হিসেবেই দেখা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সম্রাটের এই আদেশের ফলে খ্রিস্টানরা প্রথম তাদের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় চাপের স্বীকার হয়, সম্রাটের আদেশ পালনের এই অর্থ ছিল যে, হয় জুপিটারের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করো নয়তো মরো, এটা ছিল খ্রিস্টানদের কাছে “হয় ধর্ম ত্যাগ করো, নয় মরো” টাইপের কথা।
ডেসিয়াসের আদেশ না মানায় বহু খ্রিস্টানের মৃত্যু, পলায়ন ও লুকিয়ে ধর্মপালন : খ্রিস্টধর্ম অনুসারে খ্রিস্টানদের জন্য রোমান দেবদেবীদের উপাসনা করা বা সম্রাটের প্রতিকৃতির সামনে ধূপ জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিল। তাই অনেক খ্রিস্টানরা সম্রাটের আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালো। অনেক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রােমের সেই ধর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার চেয়ে শহীদের মৃত্যুবরণ করাকে শ্রেয় মনে করলেন। কিছু বিশিষ্ট খ্রিস্টান, যেমন পোপ ফ্যাবিয়ান, ব্যাবাইলাস অফ অ্যান্টিয়ক ও আলেক্সান্ডার অফ জেরুজালেমকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়। অরিজেন ছিলেন ডেসিয়াসের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য, যাকে সম্রাটের ক্রোধের শিকার হতে হয়। তাকে সরাসরি হত্যা করা হয়নি। তবে এত গুরুতর আহত করে ফেলা হয়েছিল যে তিনি নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন। প্রচুর খ্রিস্টানকে এই আদেশ না পালন করার জন্য হত্যা করা হয়। রােমের, অ্যান্টিয়ক এবং জেরুজালেমের বিশপদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। এটা জানা যায়না যে, সকলের এই আদেশ মানছে কিনা তা কতটা পরিমাণে কর্তৃপক্ষ নজর রাখতে পেরেছিল, কিন্তু জানা যায় যে কার্থেজের বিশপ সিপ্রিয়ান সহ অনেক খ্রিস্টান সেই সময় লুকিয়েছিলেন। রােম শহরের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা লুকিয়ে লুকিয়ে ধর্মপালন করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা ঝােপেঝাড়ে, মাটির নিচের রাস্তায়, শহরের বাইরে কবরস্থানে একত্র হতে শুরু করল। এই জায়গাগুলােকে তারা নির্দিষ্ট দিনে চার্চের মতাে ব্যবহার করতে লাগল। এসব হয়ে দাঁড়ালাে তাদের গােপন ধর্মচর্চার গােপন মিলনস্থান। আবার প্রচুর খ্রিস্টান বাধ্য হয়েই সম্রাটের আদেশ পালন করেছিল।
খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ে এই আদেশের ফল : খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ে এই আদেশের ফল ছিল গুরুতর। অনেক খ্রিস্টানই যারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো তারা এর ফলে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। অনেকেই ধর্মত্যাগ করেছিল, কিন্তু এরা পরবর্তীতে পুনরায় খ্রিস্টধর্মে ফিরে আসতে চাইলে এদেরকে আর তার সুযোগ দেয়া হয়নি। ২৫১ সালে সম্রাট গথ নামক জার্মানিক ট্রাইবের আক্রমণে ডেসিয়াসের মৃত্যু হয়, আর তারপর থেকে তার এই আদেশ কার্যকর করাও বন্ধ হয়। সুতরাং খ্রিস্টানদেরকে খুব বেশিদিন এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি, আঠারোটা মাস তাদেরকে এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু কম সময়ের জন্য হলেও খ্রিস্টানদের কালেকটিভ মেমোরিতে এটি এতটাই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল যে এই সময়টা চার্চের জন্য একটি দানবীয় স্বৈরাচারের কাল হিসেবে আখ্যাত হয়। তবে ডেসিয়ানের নির্যাতনই খ্রিস্টানদের প্রতি শেষ নির্যাতন ছিলনা। পরবর্তীতে ২৫৭ সালে তারা সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের অধীনে নির্যাতনের শিকার হয়, আর ৩০৩ সালে সম্রাট ডিওক্লেশিয়ানের আমলে এই নির্যাতন আরও গভীরতর হয়।
গথদের আক্রমণ : সম্রাট ডেসিয়াসের সময় নতুন এক জার্মানিক ট্রাইব গথরা রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করল। তারা হঠাৎ করেই যেন সেখানে আবির্ভূত হলাে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে এরা সুইডেনের দিকে বাস করো, বাল্টিক সাগরের দক্ষিনপূর্ব দিকের একটি দ্বীপ এখনও গোটল্যান্ড নামে পরিচিত। অগাস্টাসের (খ্রি.পূ ২৭ – খ্রিস্টীয় ১৪ অব্দ) শাসনামলের আগে আগে তারা সম্ভবত দক্ষিণ দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছিল এবং বর্তমানে যে জায়গাটা আধুনিক পােল্যান্ড বলে পরিচিত, সেই জায়গাটা দখল করে রেখেছিল। তারপর ধীরে ধীরে পরের শতাব্দীগুলােতে তারা সফলভাবে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যারাক্যালার (২১১-২১৭ খ্রি.) শাসনামলে তারা কৃষ্ণসাগরের তীরে পৌঁছে গেল। তখন তারা দুটো পৃথক দলে ভাগ হয়ে গেল। একটি দল পূর্বদিকে রওনা দিয়েছিল। সেই সমভূমি যেখানে তারা আস্তানা গড়েছিল তাকে এখন বলা হয় ইউক্রেইন। এদেরকে বলা হয় পূর্বদিকের গথ বা অস্ট্রোগথ। (“অস্ট” মানে জার্মানির প্রজাতি বা পূর্বদিক অথাৎ ইস্টের প্রজাতি)। দ্বিতীয় দলটি পশ্চিমদিকেই থেকে গেল। তারা রােমান প্রদেশ ডেসিয়ায় প্রবেশের জন্য যুদ্ধ করতে লাগল। তাদের বলা হয় পশ্চিমা গথ বা ভিজি গথ। (“ভিজি” হয়তােবা পুরনাে কোনাে টিউটোনিক শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ “ভালাে”।) তাই এই নামের অর্থ দাঁড়াল দয়ালু অথবা ভালাে। (তারা নিজেদের প্রশংসা করতে গিয়ে নিজেরাই হয়তাে এই নামকরণ করেছে।)
গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ডেসিয়াসের মৃত্যু : ক্যারাক্যালা গথদের বিরুদ্ধে লড়েছিল ২১৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন তারা পুরােপুরি পরাস্ত হয়েছিল। কিন্তু রােমান বাহিনীর দুর্বলতার সুযােগ নিয়েই দিনে দিনে তাদের শক্তি আর সাহস বেড়ে গিয়েছিল। ডেসিয়ায় অবস্থানকারী রােমান সেনাবাহিনী গথ উপজাতির আক্রমণ থেকে রােমকে বাঁচানাের চেয়ে নিজেদের সিংহাসনের জন্য লড়াই আর বিদ্রোহ নিয়েই বেশিরভাগ সময়ে ব্যস্ত ছিল। এছাড়া রােম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে বাইরে থেকে আসা উপজাতিদের সংখ্যা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে তাদের মধ্যে রােমের কোনাে প্রদেশ দখল করে ফেলার গােপন ইচ্ছা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তারা এখানে সেখানে লুটপাট চালাত নির্দ্বিধায়। ডেসিয়াসের আমলে গথ উপজাতি স্রোতের মতাে ডেসিয়ায় প্রবেশ করতে লাগল। তারা রােমানদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছাড়া বাকি সব জায়গা থেকে বলতে গেলে উৎখাত করল। তারপর দানিয়ুবের তীরে পৌঁছে তারা নদীর অপর পাড়ে চলে আসে। উপজাতীয়দের আক্রমণ ছাড়াও কেবল নিজেদের মধ্যেই দেড়শ বছর ধরে লড়াই করে প্রদেশগুলাে যেমন ভাঙাচোরা হয়ে পড়েছিল, তা দেখে তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়। ডেসিয়াস তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিছুকিছু যুদ্ধে জয়ীও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে বাইরের শত্রুর হাতে সম্রাটের খুন হওয়ার ঘটনা ছিল রােমান সাম্রাজ্যে সেটাই প্রথম।
পরবর্তী শাসকদের সময়কার অরাজকতা
গ্যালাসের ক্ষমতা গ্রহণ (রা. ২৫১ – ২৫৩ খ্রি.), পুনরায় গথ আক্রমণ, সুযোগ পেয়ে অ্যালামনি ও ফ্রাঙ্কদের আক্রমণ : ডেসিয়াসের অধীন একজন কর্মচারী গ্যালাস (গেইয়াস ভিবিয়াস ট্রিবেনিয়ানাস গ্যালাস) তার জায়গায় সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তিনি গথদের ধনদৌলতের লােভ দেখিয়ে নিজের দলে ভেড়ানাের চেষ্টা করেন। তারা কিছুদিনের জন্য তাদের দখলের কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখে। কিন্তু তারপর আবার তাদের দখল আর যুদ্ধের নেশা পেয়ে বসে। তারা গ্রিস আর এশিয়া মাইনরে আক্রমণ চালায়। ২৬৭ খ্রিস্টাব্দে তারা রাজধানী এথেন্সে পর্যন্ত হামলা করে। গথ প্রজাতির হামলা রােমান সেনাবাহিনীকে এমন হুমকির মুখে রেখেছিল যে তারা কেবল দানিয়ুবের নিচের দিকে জড়াে হয়ে সীমান্ত রক্ষায় ব্যস্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যস্ততায় দানিয়ুবের উপরের দিকে আর রাইনের তীরের সীমানা হয়ে পড়েছিল খুবই অরক্ষিত। জার্মানির অন্যান্য উপজাতিরা এরই সুযােগ নষ্ট করেনি। দক্ষিণ জার্মানির অ্যালামানি প্রজাতি দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং উত্তর ইতালিতে চলে আসে। পশ্চিম জার্মানির একটি নতুন প্রজাতি, যারা নিজেদের নাম রেখেছিল “ফ্র্যাঙ্কস” (“ফ্রি ম্যান” বা “মুক্ত মানুষ”)। ২৫৬ খ্রিস্টাব্দে রাইন পেরিয়ে চলে যায়। তারা গাউলে আড়াআড়িভাবে দখল করতে করতে এগিয়ে যায় এবং স্পেন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাদের দলের কিছু অংশ আফ্রিকায় গিয়ে তবে থামে। সাম্রাজ্যের অরক্ষিত প্রদেশগুলাে বুঝতে পেরেছিল যে নিজেদের দখল হয়ে যাওয়া এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে ঠেকানাের মতাে শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা আর তাদের নেই। তাই নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করার জন্য চারদিকে দেয়াল গড়ে তুলতে লাগল, সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানাের জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
ভ্যালেরিয়ান (রা. ২৫৩ – ২৬০ খ্রি.) ও তার পুত্র গ্যালিয়েনাসের (রা. ২৫৩ – ২৬৮ খ্রি.) ক্ষমতা গ্রহণ, গথদের বিতাড়ন ও ম্যাক্রোম্যানিদের ইতালিতে প্রবেশ : এর মধ্যে গ্যালাস একটি যুদ্ধে একজন বিদ্রোহী জেনারেলের হাতে মারা পড়েন। ২৫৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেরিয়ানের (পাবলিয়াস লিসিনিয়াস ভ্যালেরিয়ানাস) সাহায্যে তিনি জয়ী হয়েছিলেন তবে সেবার ভ্যালেরিয়ান এসে পৌঁছতে এত দেরি করে ফেলেছিলেন যে তাকে আর বাঁচাতে পারেননি। ২৫৩ সালে ভ্যালেরিয়ান তার পুত্র গ্যালিয়েনাসকে (পাবলিয়াস লিসিনিয়াস গ্যালিয়েনাস) নিয়ে একসাথে সম্রাটের আসনে আসীন হন। দুজনে মিলে সাম্রাজ্যের তখনকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। এটা ছিল একটি অতিমানবিক কাজ। সাম্রাজ্যের উত্তর দিকের সীমানা এতটাই জীর্ণ অবস্থায় ছিল যেন স্থানে স্থানে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। যুগ্ম সম্রাট একসাথে হয়ে কোনােরকমে গথ প্রজাতির সাথে যুদ্ধ করে তাদের গাউল থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু জার্মানদের যতই ঠেলে দেয়া হােক না কেন, সামান্য সুযােগে ম্যাক্রোম্যানি নামে একটি জার্মানিক ট্রাইব ইতালিতে প্রবেশ করে বসে। দুজন সম্রাট যত তাড়াতাড়ি পারেন একটি দিক থেকে আক্রমণ করেন কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা আবার অন্য আরেকটি দিক থেকে আক্রমণ চালান। গ্যালিয়েনাসের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন নব্য প্লেটোনিক দার্শনিক প্লটিনাস। কিন্তু যুগ্ম সম্রাটেরা তখন যুদ্ধ এবং হামলা ঠেকানাে নিয়ে যে মহা ফ্যাসাদে পড়ে আছেন, কারও মনে হতেই পারে, এর মধ্যে দার্শনিকের কাজটা কী!
পারস্যের প্রথম শাপুরের আক্রমণ ও ভ্যালেরিয়ানের মৃত্যু : এই সমস্ত ডামাডােলের মধ্যে আবার পারস্য থেকে সুযােগ বুঝে আক্রমণ চালানাে হলাে। ১ম শাপুর তখনও পারস্যের রাজা ছিলেন। দশ বছর আগে তিনি তরুণ সম্রাট তৃতীয় গর্ডিয়ান এবং তার যুদ্ধপ্রেমী শ্বশুরের বিরুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছিলেন। কিন্তু তার পরেও রােম দশ দশটি ধ্বংসের বছর পার করেছে। এখন সময় এসেছে যে প্রথম শাপুর রােমে আবারও হামলা করতে পারে। এবারে তিনি আবার সিরিয়ায় আক্রমণ করলেন এবং রাজধানী অ্যান্টিওক দখল করে নিলেন। ভ্যালেরিয়ান কোনাে সময় নষ্ট না করে সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা দিলেন। তিনি সিরিয়া থেকে পারস্যের সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হলেন ঠিকই কিন্তু তার সেনাবাহিনী অসুখের প্রকোপে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ভ্যালেরিয়ান সেনাদের বিষয়ে সজাগ ছিলেন। তিনি পরবর্তী আক্রমণের আশঙ্কায় আগেভাগেই পারস্যের সাথে একটি শান্তিচুক্তিতে আসতে চান। ২৫৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সেনারা তাকে বন্দী করে ফেলে। তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে অনেকের অনেক মত। কারও মতে তিনি তার জীবনের বাকি দিনগুলােতে তিনি তাদের কাছে গৃহবন্দী হয়ে ছিলেন, আবার কারও মতে তাকে হত্যা করা হয়।
ভ্যালেরিয়ানের আমলে খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন ও রোমের উচ্চপদ সমূহে খ্রিস্টানদের প্রবেশ : ভ্যালেরিয়ানের আমলেও খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। সম্রাট ভ্যালেরিয়ান ২৫৩ সালে সিংহাসনে বসেন, কিন্তু এর পরের বছর থেকে তিনি পারস্যদের সাথে যুদ্ধ করতে রোমের বাইরে অবস্থান করেন। তিনি আর কখনও রোমে ফেরেননি, ২৬০ সালে তাকে বন্দি করা হয় এবং কয়েদী হিসেবে হত্যা করা হয়। ২৫৭ সালে তিনি সিনেটে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে দুটো চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রথমটিতে তিনি সকল খ্রিস্টান যাজকদেরকে রোমান দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে বলেন, এবং সমাধিস্থলে খ্রিস্টানদের সভা করা নিষিদ্ধ করেন। পরের বছর তিনি খ্রিস্টানদের সম্পর্কে সিনেটে আরেকটি চিঠি পাঠান, সেখানে তিনি লেখেন বিশপ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ চার্চ কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করতে হবে, এবং খ্রিস্টান সিনেটরদেরকে পদচ্যুত করতে হবে, তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে হবে, এবং তাদেরকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। সেই সাথে যেসব সরকারী কর্তকর্তা-কর্মচারী ও সম্রাটের স্টাফ ও হাউজহোল্ড দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে চাইবে না তাদেরকেদাস বানানো হবে ও ইম্পেরিয়াল এস্টেটে কাজ করতে পাঠানো হবে। ভ্যালেরিয়ানের এই চিঠিগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে সেই সময় রোমান সাম্রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রেই উচ্চপদস্থ খ্রিস্টানরা কাজ করতেন। কথা হলো ডেসিয়াসের নির্যাতন বন্ধ হয়েছিল ২৫১ সালে, আর তার এই নির্যাতন শুরু হয় ২৫৭ সালে। আর এই ৬ বছরের মধ্যেই খ্রিস্টানরা অনেক উচ্চপদস্থ আসলে আসীন ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায়, প্রথমত ডেসিয়াসের নির্যাতনের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদী ছিলনা, এবং খ্রিস্টানরা ধারাবাহিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হতেন না, যে সম্রাট ক্ষমতায় আছেন তার চিন্তাধারার উপর খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন নির্ভর করত। ভ্যালেরিয়ানের আমলে কার্থেজের বিশপ সাইপ্রিয়ান, রোমের বিশপ দ্বিতীয় সিক্সটাস এবং সেইন্ট লরেন্সের মতো বিশিষ্ট খ্রিস্টীয় যাজককে হত্যা করা হয়েছিল।
গ্যালিয়েনাসের শাসন, পশ্চিমাঞ্চল জেনারেলদের দখল ও পারস্য সম্রাট শাপুরের আক্রমণ : যাই হোক, গ্যালিয়েনাস বাবার বন্দীত্বের পরে সাম্রাজ্য চালানাে শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যমান নানান সমস্যার সাথে আরও এত বেশি বেশি উপজাতি হামলার সমস্যা শুরু হলাে যে সেই সময়টিকে বলা হয় “থার্টি টাইর্যান্টস” এর আমল। একই ভাবে অ্যাথেন্সের ইতিহাসেও সেই সময়টিকে অন্যায় অবিচারের আড্ডাখানা বলা হয়েছে। গ্যালিনিয়াস তার বাবার মতাে অত রাগী ছিলেন না। ডেসিয়ার লোকেরা খ্রিস্টানদের প্রতি তখন মারাত্মক অত্যাচার করছিল। তিনি তার বাবার মতাে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মােটামুটি সহনশীল থাকার একটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। ২৬০ খ্রিস্টাব্দটি রােমান সাম্রাজ্যের জন্য কোনাে সুফল বয়ে আনেনি। এক এক সময় এমনও মনে হয়েছিল যে সাম্রাজ্যটি ভেঙে পড়ছে কিংবা কিছুতেই আবার নতুন করে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। যুগ্ম সম্রাটদের মধ্যে একজন অসহায়ের মতাে বন্দী আর আরেকজন বােকার মতাে যুদ্ধ করেই চলেছে। পশ্চিম দিকের পুরােটা অঞ্চল, যা কিনা সাম্রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ, তা যেন ভেঙেই পড়ল। একজন জেনারেল গাউল, স্পেন আর ব্রিটেনসহ সেই পুরাে অঞ্চলটি দখল করে নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। গ্যালিয়েনাস সেই জেনারেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, যে যুদ্ধে সম্রাটের পুত্রের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের ওই প্রদেশগুলাে উদ্ধারের প্রচেষ্টা তাকে বাদ দিতে হয়। আর তারপর পারস্য সাম্রাজ্যও ১৪ বছরব্যাপী স্বাধীন থাকে।
পালমিরার অডেনাথাস ও পারস্যের পরাজয় : এর মধ্যে শাপুর, ভ্যালেরিয়ানকে বন্দী করে তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেব করতে লাগলেন। সিরিয়া তাে তার দখলেই ছিল, এবারে তিনি এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হলেন। সেদিকে যেতে যেতে তিনি মরুভূমির মধ্যে কোথাও গিয়ে পৌঁছেছিলেন। মরুভূমির মধ্যে যেখানে রাজ্য দখলের সীমানা করেছিলেন, সেটি আজও কোনাে ম্যাপে উল্লেখ করা হয়নি। সিরিয়ায়, অ্যান্টিয়কের ১৫০ কিলােমিটার দক্ষিণপূর্বে একটি শহর ছিল। ইহুদি প্রাচীন কাহিনী অনুযায়ী শহরটির পত্তন করেছিলেন রাজা সােলেমান বা সলোমন। শহরটির নাম রেখেছিলেন তাদামাের (“তাল গাছের শহর”)। গ্রিক আর রােমানদের মুখে মুখে এই নামটিই হয়ে দাঁড়ালাে পালমিরা। ভেস্পসিয়ানের সময়ে এই শহরটি রােমের অধীনে চলে আসে। অ্যান্টোনিনাসের সময় আসতে আসতে শহরটি বেশ ধনী হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি ছিল এমন একটি জায়গা যেখানে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মরুভূমি পার হওয়া ক্যারাভ্যানগুলাে একটু জিরিয়ে নিত। ক্রমে শহরটিতে ভিড়ভাট্টা বেড়ে গেল। হ্যাড্রিয়ান এই শহরটি দেখতে গিয়েছিলেন। আর যখন সেখানকার অধিবাসীরা রােমান নাগরিক হয়ে গেল, ক্যারাক্যালার আমলে নাগরিকত্বের সাথে সাথে তারা প্রত্যেকে রােমান নাম গ্রহণ করল। সেভেরাস আলেক্সান্ডার তার পূর্বদিকের অভিযানের সময়ে পালমিরা শহরে গিয়েছিলেন। তখন একজন নেতাগােছের পালমিরিন নাগরিক অডেনাথাসকে (সেপটিমিয়াস অডেনাথাস) তিনি সেখানকার সিনেটর হিসেবে নিয়ােগ দেন। সিনেটরের পুত্রকেও একই সমান সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ভ্যালেরিয়ানকে বন্দী করার সময়ে অডেনাথাস পালমিরার শাসনকার্যে বহাল ছিলেন। তিনি সেই এলাকার ক্ষমতা শক্ত হাতে ধরে ছিলেন আর পাশাপাশি ইতালি অনেক দূরে হলেও রােমে যেন শান্তি বজায় থাকে সে ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি পালমিরার স্বাধীনতা নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন ছিলেন। পারস্য ছিল খুব কাছে এবং রাজার শাসনে কঠোর একটা অবস্থান ছিল দেশের অভ্যন্তরে। তাই পালমিরা শহর থেকে আক্রমণ করলে সেই মুহুর্তের দুর্বল রােমের ওপরে না করে শক্তিশালী পারস্যের ওপরেই চালাতে চাইছিলেন। অডেনাথাস তাই পারস্যের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘােষণা করলেন। গ্যালিয়েনাস তখন ইউরােপে ব্যস্ত ছিলেন তাই এই যুদ্ধ সামাল দেয়ার মতাে অবস্থা তার ছিল না। এদিকে অডেনাথাস তার বাহিনী নিয়ে পারস্যের বেশ কয়েকটি বাহিনীকে পরাস্ত করে রাজ্যের ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত দখল করে নিলেন। দখলের নেশায় আর সাফল্যের জোশে তিনি আরও এগােতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরে গথদের মুখােমুখি হতে যখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, তার আগেই গথ উপজাতি সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়ে গেছে। গ্যালিয়েনাস যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি কিন্তু অডেনাথাসের এই সাফল্যে খুশি হয়ে তাকে পালমিরার ঐতিহ্যবাহী রাজাসহ পূর্বদিকের প্রদেশগুলাের প্রধান বানিয়ে দেন। কারণ অডেনাথাসের ঐকান্তিক ইচ্ছে ছাড়া সেদিকের প্রদেশগুলাে চিরশত্রু পার্সিয়ানদের কাছে হারাতেই হতাে রােমান সাম্রাজ্যকে। কিন্তু ২৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অডেনাথাসকে তার বড় ছেলেসহ বন্দী হতে হয়। অডেনাথাসের কুচক্রী স্ত্রী, সেপটিমিয়া জেনােবিয়া তার কাছ থেকে রাজ্যের শাসনভার ছিনিয়ে নেন। পালমিরার শাসনকার্য বেশ ভালােভাবেই চলতে থাকে।
গ্যালিয়েনাসের মৃত্যু ও সাম্রাজ্যের ত্রিধাবিভক্তি : ২৬৮ খ্রিস্টাব্দে, যখন গ্যালিয়েনাস তার বাহিনীর হাতে খুন হন, জেনােবিয়া এমন ভাব করেন যেন তিনি তার স্বামীর সূত্রে কেবল পালমিরার এবং পূর্বদিকের প্রদেশগুলাের শাসনের উত্তরাধিকারী নন, বরং তার ছােট ছেলের সূত্র ধরে তিনি সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর আসনেরও হকদার। তিনি ততদিনে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন। এবারে বাহিনী নিয়ে মিশর এবং এশিয়া মাইনরের উদ্দেশে রওনা দেন। ২৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেকে সম্রাজ্ঞী এবং তার ছােট ছেলেকে সম্রাট ঘােষণা করেন। এভাবে রােমান সাম্রাজ্য তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। পশ্চিম এবং পূর্বদিকে প্রদেশ ছিল পুরােপুরি স্বাধীন। আর ঠিক মধ্যভাগে ইতালি কেবল মাঝখানের প্রদেশকেই নিয়ন্ত্রণ করত। মধ্যভাগে ছিল ইতালি নিজে, এছাড়া ইলিরিয়া, গ্রিস এবং আফ্রিকা। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই দুর্দশাগ্রস্ত। সেখানকার জনসংখ্যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত কমে যাচ্ছিল। একটি প্রজন্মের নিজ হাতে ক্রমাগত ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় বিশাল সাম্রাজ্য দুর্বল একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। কোথাও এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোনাে উপায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না।
পরবর্তী সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস, অরেলিয়ান, ট্যাসিটাস, প্রোবাস ও ক্যারাসের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু
দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ (রা. ২৬৮ – ২৭০ খ্রি.), অ্যালামানি ও গথদের বিতাড়ন : আকস্মিকভাবে ইলিরিয়া থেকে এই প্রথম একটি রাজবংশের উদ্ভব হলাে। তারা যেন আকস্মিক ধ্বংসের গ্রাস থেকে সাম্রাজ্যকে ছিনিয়ে নিলেন। ২৬৪ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিয়েনাসের মৃত্যুর পরে সেনাবাহিনী মার্কাস অরেলিয়াস ক্লডিয়াসকে (রা. ২৬৮-৭০ খ্রি.) সম্রাট ঘােষণা করে। তিনি ইতিহাসে সাধারণত দ্বিতীয় ক্লডিয়াস হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইলিরিয়ান হয়ে জন্মানাের পরেও তিনি ডেসিয়াস, ভ্যালেরিয়ান এবং গ্যালিয়েনাসের অধীনে খুব সফলভাবে কাজ করে গেছেন। তারপর এখন সম্রাটের আসনে বসে তিনি প্রথমেই আক্রমণকারী উপজাতিদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য কোমর বেঁধে তৈরি হয়েছিলেন। ফলাফলও এলাে খুব ভালাে। উত্তর ইতালিতে তিনি অ্যালামানিদের পরাজিত করে আল্পস পর্যন্ত ঠেলে পাঠিয়ে দেন। তারপর তিনি মােয়েশিয়ার দিকে রওনা দেন, উদ্দেশ্য ছিল অপরাজিত হিসেবে খ্যাতি অর্জনকারী গথদের হটিয়ে দেয়া। ২৬৯ এবং ২৭০ খ্রিস্টাব্দব্যাপী যুদ্ধ করে তিনি গথদের শােচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেন। এই বিজয়ের পরে তার নাম হয় ক্লডিয়াস গথিকাস (সাম্রাজ্যে সুদিন বয়ে এনেছিলেন বলে, গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের উপাধিস্বরূপ তাকে এই নাম দেয়া হয়)। অরাজকতার সেই যুগে তিনিই ছিলেন একমাত্র সম্রাট যার মৃত্যু কোনাে ভয়ংকর ঘটনার ভেতর দিয়ে হয়নি। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি একজন সাধারণ রােমান নাগরিকের মতােই অসুখে ভুগে মারা যান। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি একজন যােগ্য উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করে দিয়ে সম্রাট হিসেবে তার শেষ দায়িত্ব পালন করেন। তার উত্তরাধিকারী ছিলেন তারই শিষ্য অরেলিয়ান (লুসিয়াস ডমিশিয়াস অরেলিয়ানাস)।
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড ও ভ্যালেন্টাইনস ডে : ক্লডিয়াস গথিকাসের আমলেই ভ্যালেন্টাইনস ডে এর সাথে সম্পর্কিত সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহিনী নিয়ে অনেক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে সাধারণ হিস্টোরিওগ্রাফি যা বর্ণনা করে তা অনেকটা এরকম – সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমের একজন যাজক ছিলেন, বা মধ্য ইতালির আম্ব্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর টার্নির প্রাক্তন বিশপ ছিলেন। বিচারক অ্যাস্টারিয়াসের অধীনে গৃহ-গ্রেফতার হয়ে থাকবার সময় তিনি অ্যাস্টারিয়াসের সাথে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন। তিনি তাকে যিশুর যথাযোগ্যতা, তার অলৌকিকতা সম্পর্কে বলেন। অ্যাস্টারিয়াস তাকে পরীক্ষা করার জন্য তার অন্ধ দত্তক কন্যাকে তার সামনে নিয়ে আসেন ও বলেন একে সুস্থ করে দিলে তিনি যা চাইবেন অ্যাস্টারিয়াস তাই করবেন। ভ্যালেন্টাইন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে শিশুটির চোখে হাত রাখলেন, শিশুটির দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো। অ্যাস্টারিয়াস বিনীতভাবে ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করলেন, এর বিনিময়ে তিনি কী চান। ভ্যালেন্টাইন অ্যাস্টারিয়াসকে বললেন তার নিজের বাড়ির আশেপাশের সকল মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেলতে, এরপর তিন দিনের উপবাস করতে ও তারপর চার্চে গিয়ে বাপ্টাইজড বা অভিসিঞ্চিত হতে। বিচারক অ্যাস্টারিয়াস তাই করলেন ও এরপর তার অধীনে থাকা সকল খ্রিস্টান কয়েদীদেরকে মুক্ত করে দিলেন। অ্যাস্টারিয়াসের পরিবারের ও দাস-দাসী সকলেই বাপ্টাইজড বা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। এভাবে রোমান নাগরিকদেরকে ধর্মান্তরিত করার জন্য ভ্যালেন্টাইনকে আবার গ্রেফতার করা হলো এবং সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাসের সামনে নিয়ে আসা হলো। ক্লডিয়াস তাকে পছন্দ করা শুরু করলেন, কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ক্লডিয়াসকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকে। ক্লডিয়াস তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন। তিনি ভ্যালেন্টাইনকে বলেন তাকে হয় তার ধর্মত্যাগ করতে হবে নাহয় তাকে গদা দিয়ে প্রহার করে শিরোশ্ছেদ করে হত্যা করা হবে। ভ্যালেন্টাইন ধর্মত্যাগ করতে অস্বীকার করে, ফলে ২৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে বলা হলো সেভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি অ্যাস্টারিয়াসের কন্যাকে একটি নোট পাঠিয়েছিলেন যেখানে তিনি সাক্ষর করার সময় লিখেছিলেন “from your Valentine”। এই কথাটি আজকের প্রেমবার্তাগুলোতে তুমুলভাবে ব্যবহৃত হয়। তার মৃত্যুদিন ১৪ই ডিসেম্বর আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে পরিচিত, দিনটি ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করে। ভ্যালেন্টাইনের এই কাহিনীগুলো মধ্যযুগের শেষ পর্বের ক্রনিকলগুলোতে পাওয়া যায়। তিনি যেহেতু একজন খ্রিস্টীয় শহীদ ছিলেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই লোকে মুখে ফিরতে ফিরতে তার কাহিনী বিভিন্ন দিকে ডালপালা ছড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু তারপরও যে ব্যাপারটাকে নিশ্চিত বলা যায় তাহলো সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাসের আমলেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
ক্ষমতায় অরেলিয়ান (রা. ২৭০ – ২৭৫ খ্রি.), অ্যালেমানি ও গথদের পরাজয়, রোমের চারপাশে দেয়াল নির্মাণ ও ডেসিয়া : যাই হোক, সম্রাটের মৃত্যুর পরে তার অর্ধসমাপ্ত কাজগুলাে স্বাভাবিকভাবেই উত্তরাধিকারী অরেলিয়ানের উপরে বর্তায়। উপজাতীয় দলগুলাে যারা ততদিনে ঝিমিয়ে পড়েছিল, নতুন সম্রাটের অধীনে তারা নতুন করে হামলা চালাবে বলে ঠিক করল। যেই বলা সেই কাজ, সাম্রাজ্যের দক্ষিণ দিকে উপজাতিরা আবার হামলা করল। অরেলিয়ান বিপুল বিক্রমে দ্বিতীয়বারের মতাে অ্যালেমানি এবং গথ উপজাতিদের ভয়াবহভাবে পরাজিত করলেন। এই বিজয় প্রমাণ করেছিল যে একজন যােগ্য সম্রাট আরেকজন যােগ্য উত্তরসূরি রেখে গেছেন। ম্রাজ্যের দক্ষিণ দিকের সীমানা যদিও দুর্বলভাবে সুরক্ষিত করা গেল, কিন্তু তারপর অরেলিয়ানের চোখ পড়ল পূর্বদিকে, যেখানে জেনােবিয়া একেবারে আসন গেড়ে বসে ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে পূর্বদিকে একটি অভিযান, দক্ষিণ দিক থেকে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে। ২৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অস্থির হয়ে রােমের চারদিকে দেয়াল তােলার কাজে হাত দিলেন। রােম ছিল সেরকম একটি শহর যার চারপাশে তার আগের পাঁচশ বছরেও কোনাে প্রতিরােধ দেয়াল ছিল না। তাই এই পদক্ষেপ সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ভেতরে ভেতরে রােমের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কত নাজুক হয়ে পড়েছে। অরেলিয়ান আবার রােমের কিছু গুচ্ছ বাহিনীকেও ডেসিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের তিনি দানিয়ুবের তীরে অবস্থান করতে বলেছিলেন। কিন্তু সেদিকে পুরােপুরি উন্মুক্ত একটি সীমানায় এভাবে পাহারা বসানাে আসলে অনেকটা বাড়াবাড়িই ছিল। গথ প্রজাতির হামলার হাত থেকে বাঁচার জন্যই ছিল এই প্রচেষ্টা। সীমানা জুড়ে সেনাবাহিনীকে প্রহরায় বসানাের খরচ ছিল অসামান্য কিন্তু তার ফলাফল ছিল খুবই হৃদয়বিদারক। কারণ ট্রাজানের বিজয়ের পরের দেড়শ বছর ডেসিয়া একইভাবে পড়ে ছিল, কোনাে কাজে লাগেনি।
পালমিরা সাম্রাজ্য দখল : এবারে অরেলিয়ান মনে করলেন পূর্বদিকে রওনা দেয়া দরকার। তিনি বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনরের দিকে রওনা দিলেন। পথে যেখানে যত বাধা পেলেন, সব শহর দখল করতে করতে এগিয়ে গেলেন। তিনি বাহিনীসহ সিরিয়ায় ঢুকে পড়লেন। অ্যান্টিয়কের কাছে পালমিরিনদের পরাজিত করলেন। তিনি পালমিরা শহরের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তিনি পালমিরা শহরের উপরে সামান্য কিছু বিধিনিষেধ বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন প্রথম প্রথম। কিন্তু পালমিরিনদের বিদ্রোহ এবং তাদের হাতে কিছু কিছু রােমানের মৃত্যু তাকে এমনভাবে রাগিয়ে দিয়েছিল যে তিনি ২৭৩ খ্রিস্টাব্দে পালমিরা শহরটিকে ধ্বংসের পরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন। পালমিরার উন্নতি সেখানেই চিরজীবনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে ধ্বংসস্তৃপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আজকের দিনে অল্প কিছু ইমারতের ধ্বংসপ্রাপ্ত, জীর্ণ অংশ শহরটির অতীত অস্তিত্ব জানান দেবার জন্য কোনােরকমে সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। অরেলিয়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল পশ্চিম দিকে অভিযান চালিয়ে সহজেই গাউল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া।
রোমে বিজয় উদযাপন ও পারস্য আক্রমণ করতে গিয়ে নিজের সেনাবাহিনীর হাতেই মৃত্যু : অরেলিয়ান ২৭৪ খ্রিস্টাব্দ শেষের আগেই রােমে ফিরে আসেন। তিনি ফিরে এসে একটি বিজয় উৎসবের আয়ােজন করেন। সেই উৎসবে জেনােবিয়াকে হাজির করা হয় শিকলে বাঁধা অবস্থায়। অরেলিয়ানকে সেই অনুষ্ঠানে “পৃথিবী পুনরুদ্ধারকারী” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আর এই কারণে সে বছর মুদ্রার গায়ে তার (“পুনরুদ্ধারকারী গােলক”) ছবি খুঁচিত হয়। তবে সাদা চোখে দেখলে অরেলিয়ান এবং তার উত্তরসূরী দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বাইরে থেকে আক্রমণকারী উপজাতিদের বিতাড়িত করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের পূর্বদিক এবং পশ্চিম দিকের সীমানা রক্ষা করেছিলেন। সম্রাট হিসেবে তার দায়িত্বের মধ্যে যেটি বাকি ছিল তা হলাে, পারস্যের, লােকদের একটি উচিত শিক্ষা দেয়া। সম্রাট বাহিনী নিয়ে সেই কথা মাথায় রেখেই পূর্বদিকে ধেয়ে যান। বহু যুগের অভিজ্ঞতা এবং অভ্যাসের কারণে আক্রমণের ক্ষেত্রে রােমান সম্রাটের একবিন্দু ভয় পাওয়ার কথা নয়। সেনারা একজন দুর্বল সম্রাটকে হত্যা করতেও যেমন সবার অজান্তে গােপনে ষড়যন্ত্র করে, একজন শক্তিশালী সম্রাটকে হত্যা করতেও একই রকম গােপন ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল। ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে অরেলিয়ানকে থ্রেস শহরে তার নিজেরই সেনাদের হাতে খুন হতে হলাে।
ট্যাসিটাসের ক্ষমতায় আরোহন ও মৃত্যু (রা. ২৭৫ – ২৭৬ খ্রি.) : মার্কাস ক্লডিয়াস ট্যাসিটাস, যিনি অরেলিয়ানের উত্তরাধিকারী ছিলেন, রাজ্যের এতদিনের নিয়মকানুনের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে ভড়কে গেলেন। তিনি ছিলেন ইতালিয়ান একজন বিশিষ্ট ধনী মানুষ যিনি (নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে) সিনেটের পিড়াপীড়িতে সম্রাটের আসনে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন। আশাতীত মানসিক শক্তি নিয়ে (ঐতিহাসিকেরা যে সম্রাটকে ভদ্র বলে বর্ণনা করেছেন) তিনি নার্ভার পথ অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন। তিনি সিনেটের হাতে কিছু ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখে আবার কিছু জায়গায় বেশ খানিকটা পরিবর্তনও আনেন। প্রকৃতপক্ষে সেই সময়টাতে কোনাে সম্রাটই জার্মান উপজাতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা না করে টিকতে পারছিলেন না। ট্যাসিটাসও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। গথ উপজাতিরা তখন আবার এশিয়া মাইনরের সীমানা অতিক্রম করে সাম্রাজ্যে প্রবেশ করছিল আর ট্যাসিটাস বাধ্য হয়ে বাহিনী নিয়ে তাদের তাড়া করেন। গথ জাতিরা পরাজিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ২৭৬ খ্রিস্টাব্দে ট্যাসিটাস মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মাত্র দেড় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। একটি সাধারণ ইতিহাসের সূত্র অবশ্য বলে যে তিনি তার সেনাদের হাতে খুন হয়েছিলেন। কিন্তু অন্য সব ইতিহাস অনুযায়ী যেটা বলা হয় সেটাই বেশ যৌক্তিক যে তিনি ছিলেন একজন বয়স্ক মানুষ এবং সাধারণভাবেই বয়সজনিত কারণে মারা যান।
প্রোবাসের ক্ষমতায় আরোহন, গথদের বিতাড়ন ও মিশরের খাল খনন করাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে মৃত্যু (রা. ২৭৬ – ২৮২ খ্রি.) : ট্যাসিটাসের অধীনে পূর্বদিকে নিয়ােজিত সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মার্কাস অরেলিয়াস প্রােবাস। ইলিরিয়ার উত্তরে প্যানােনিয়া প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অরেলিয়ানের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে খ্যাত হয়েছিলেন। যখনই সাম্রাজ্যের সিংহাসন শূন্য হয়ে গেল, সেনারা তৎক্ষণাৎ তাকে সম্রাট ঘােষণা করে ফেলল। তিনিও সাথে সাথে গুরুদায়িত্ব পালনের মতাে এশিয়া মাইনরে গথ উপজাতির পিছু ধাওয়া করলেন। যাই হােক, পূর্বদিকের সীমানায় আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। কিন্তু সম্রাট একটি ভুল করে বসলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল যে সমস্ত সেনারা গথদের হারাবার জন্য নিজের জীবন বাজী রাখতে পারে তারা নিশ্চয়ই শান্তি বজায় রাখার জন্য কিছুটা শ্রম দিতে অস্বীকার করবে না। মিশরের খাল পরিষ্কার করে চওড়া করা রােমে খাদ্য সরবরাহ অটুট রাখার জন্য খুবই জরুরি ছিল। সাম্রাজ্যকে দুর্ভিক্ষ থেকে দূরে রাখা অসভ্য উপজাতিদের হামলা থেকে দূরে রাখার মতােই প্রয়ােজনীয় কাজ ছিল। তাই সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস প্রােবাস সেনাদের মিশরের খাল পরিষ্কার করার কাজে নিয়ােজিত করলে, তারা বিরক্ত হয়ে ২৮১ খ্রিস্টাব্দে তাকে হত্যা করে।
ক্যারাসের ক্ষমতায় আরোহন, পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য ও পরে নিজ সেনাবাহিনীর হাতে মৃত্যু (রা. ২৮২ – ২৮৩ খ্রি.) : এবারে তিন নম্বর ইলিরিয়ানের পালা। মার্কাস অরেলিয়াস ক্যারাস, যিনি প্রােবাসের মতােই অরেলিয়ানের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম রােমান সম্রাট যিনি সিংহাসনে বসার ব্যাপারে সিনেটের অনুমােদনের কোনাে তােয়াক্কা করেননি। সিনেটের মাধ্যমে রাজ্যের বিভিন্ন দায়িত্ব বুঝে নেয়ার কোনাে প্রয়ােজনই বােধ করেননি। প্রকৃতপক্ষে সম্রাটের পক্ষে সিনেটের এসব রায় বা অনুমােদন বহু বছরব্যাপী এক ধরনের কাগুজে নিয়ম হয়েই দাঁড়িয়েছিল। নিজের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অনেক সিনেটরকে লােকদেখানাে অনুমােদন দিতে হতাে। কিন্তু এ সমস্ত অনুমােদন, নির্বাচন যতই সাজানাে নাটকের মতাে দেখাক না কেন, সে পর্যন্ত সমস্ত সম্রাট এবং সিনেটরই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই গেছেন। ক্যারাসের কাছে সাম্রাজ্যের সেসব নিয়মকানুন, সিনেটের সম্মান আর অগাস্টাসের নির্ধারণ করা নীতির প্রতি তেমন কোনাে টান ছিল না। ক্যারাস তার আগের সম্রাটের হত্যাকারীদের বন্দী করেন। কিন্তু দেশে শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারে তাকে তেমন কোনাে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। সেনারা যদি যুদ্ধ করতে চাইত তবে হয়তাে তিনি তাদের যুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারতেন। এরপর তিনি তাই করলেন। নিজের ছেলেকে রােমের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি ২৮২ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনী নিয়ে পারস্যের দিকে রওনা দিলেন। তিনি যেন অরেলিয়ানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। অরেলিয়ানের মৃত্যুর তখন সাত বছর হয়ে গেলেও তার অর্ধসমাপ্ত কাজ তখনকার সম্রাটের উপরেই বর্তেছিল। পারস্যে ক্যারাস ভীষণভাবে সফল হয়েছিলেন। ট্রাজানের মতাে তিনি আর্মেনিয়া এবং মেসােপটেমিয়া থেকে শত্রুদের বিতাড়ন করেন, তার ওপরে টেসিফোনেও তাদের কোণঠাসা করে ফেলেন। কিন্তু তারপরে ২৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেই সেনাদের হাতে খুন হন। এবারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন সেই ধরনের একদল সেনাদের হাতে যারা এত বেশি যুদ্ধ চাইছিল না।
সার্বিক অবস্থা : প্রকৃতপক্ষে এভাবে মৃত্যুই ছিল তখন এক পরিণতি যেখান থেকে কারও কোনাে মুক্তি ছিল না। সম্রাট যেমনই হােক না কেন, বয়স্ক বা তরুণ, যুদ্ধে আগ্রহী কি বিদ্বেষী, জয়ী বা পরাজিত, প্রত্যেকের কপালেই জুটেছে নিজস্ব বিশ্বস্ত লােকেদের হাতে করুণ মৃত্যু। তখন পঞ্চাশ বছরব্যাপী এমনই চলছিল আর সেই ধারা থামানাের জন্য কোনাে আকস্মিক ঘটনা ঘটেনি সে সাম্রাজ্যে। সেখানে দরকার ছিল একজন নতুন শাসকের, যিনি কিছু নতুন নিয়মনীতি নির্ধারণ করতে পারবেন। তাকে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল এবং সৃষ্টিশীল হতে হবে যেন তিনি বুঝতে পারেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী করে নীতি বদলে যেতে পারে। দেশের আইনকানুন আসলে তখন দেশের জন্যই ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। সেই সময়ে আরেকজন অগাস্টাসের প্রয়ােজন ছিল রােমান সাম্রাজ্যে। যতরকমের গৃহযুদ্ধ বাধানাের এবং বিদেশীদের আক্রমণ করার রীতি তারা অনুসরণ করছিল, নতুন সরকার গঠন করে এসব থামানের জন্য কেবল প্রয়ােজন ছিল অগাস্টাসের মতাে আরেকজন সম্রাটের। এমনটা সত্যিই হয়েছিল। আরেকজন অগাস্টাস এসেছিলেন সেই ধবংসপ্রাপ্ত সাম্রাজ্যে, তিনি হলেন চতুর্থ ইলিরিয়ান সম্রাট।
ডিওক্লেশিয়ান, টেট্রার্কি ও কনস্ট্যান্টিনিয়ান রাজবংশ (২৮৪ – ৩৬৩ খ্রি.)
ডিওক্লেশিয়ান (রা. ২৮৪ – ৩০৫ খ্রি.)
ক্ষমতায় আরোহন : সেই সময়ে আবির্ভাব হলাে ডিওক্লেশিয়ান নামের একজন মানুষের। তিনি এসেছিলেন হতদরিদ্র এক কৃষক পরিবার থেকে। গ্রিক শব্দের উচ্চারণে পাওয়া নামই বলে দেয় তিনি ছিলেন গ্রিক। তার জন্ম হয়েছিল ইলিরিয়ার সমুদ্র উপকূলের ছােট্ট গ্রাম ডিওক্লিয়ায়। ২৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অরেলিয়ান এবং প্রােবাসের অধীনে সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। ক্যারাসের মৃত্যুর সময়ে তার বয়স ছিল প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। তিনি ততদিনে একজন সাধারণ সেনা থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে রাজকীয় দেহরক্ষীদের প্রধান হওয়ার সুযােগ পেয়েছিলেন। ক্যারাসের মৃত্যুর সাথে সাথে ডিওক্লেশিয়ান তার অধীনদের সমর্থনে সম্রাট হিসেবে ঘােষিত হন। ক্যারাসের মতোই তার কাছেও সিনেটের সমর্থন নেয়াটা যৌক্তিক মনে হয়নি। | সম্রাট হবার পরে তার প্রথম কাজ ছিল যেসব সেনাপ্রধানেরা ষড়যন্ত্র করে পূর্ববর্তী সম্রাট ক্যারাসকে হত্যা করেছিল তাদের বন্দী করে বিচারের ব্যবস্থা করা। বিচারের পর ক্যারাস নিজের তত্ত্বাবধানে তাদের ফাঁসির আয়ােজন করেন। এই কার্যকলাপ প্রমাণ করেছিল যে তিনি সেই সারিতেই দাঁড়িয়ে আছেন যেখানে হত্যার শিকার হওয়া সম্রাটেরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার ক্ষমতায় আসার আগের পঞ্চাশ বছরে কোনাে সম্রাটই (যুগ সম্রাটেরা বাদে) গড়ে টেনেটুনে দুই বছরের বেশি রাজত্ব করতে পারেননি। ডিওক্লেশিয়ানের শাসনামলের শুরুতেই মনে হচ্ছিল তিনি তার চেয়ে অন্তত কিছুটা হলেও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে চান। সম্রাটের আসনে আসীন হওয়ার পরপরই ডিওক্লেশিয়ান তার রাজকীয় নাম গেইয়াস অরেলিয়াস ভ্যালেরিয়াস ডিওক্লেশিয়ানাস গ্রহণ০ করেন (যদিও তিনি ইংরেজিতে ডিওক্লেশিয়ান বলেই পরিচিত)।
রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র এশিয়া মাইনোরের নিকোমেডিয়ায় স্থানান্তর : ২৮৪ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১০৩৭ সালে) তিনি উত্তর পশ্চিম এশিয়া মাইনরের নিকোমেডিয়া শহরে প্রবেশ করেন। তার নিজের ইচ্ছেতে তিনি সেখানেই থাকা শুরু করেন এবং তার রাজত্বকালে এই শহরকে রােমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল। সম্রাটের এই পদক্ষেপ একটি বিষয় নিশ্চিত করেছিল। তা হলাে, ইতালি তখন আর রােমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রদেশ ছিল না এবং রােম ছিল না শাসনকাজ চালানাের কেন্দ্র। প্রকৃতপক্ষে তার মতামত ছিল যে আগের দিনের মতাে সম্রাট অগাস্টাস কিংবা সম্রাট অ্যান্টোনিনাস পায়াসের আমলে তারা যেরকম কেবল রােমেই বসে থাকতেন, সেটি ছিল নিতান্তই অবিবেচকের মতাে কাজ। রােমান সম্রাটের আসল দায়িত্ব হওয়া উচিত সাম্রাজ্যকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। তাকে এমন স্থানে থাকতে হবে যেন দূরের প্রদেশগুলােতে তিনি আক্রমণ ঘটার সাথেসাথে সেখানে পৌঁছতে পারেন। নিকোমেডিয়ায় অবস্থান করে ডিওক্লেশিয়ান দক্ষিণপূর্বে পারস্যের সীমানা এবং উত্তরপশ্চিমে গথিক সীমানার খুব কাছেই ছিলেন। যে কোনাে আক্রমণের খবর পেলে সেনাবাহিনী নিয়ে সেখান থেকে সেসব জায়গায় পৌঁছে যাওয়া সহজ হতাে। তবে নিকোমেডিয়ায় অবস্থানকালে তেমন কোনাে যুদ্ধের সাথে তাকে জড়াতে হয়নি।
আইন কানুন ও রীতিনীতির পুনর্বিন্যাস : সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান তার রাজত্বকালের পুরােটা সময়ব্যাপী কেবল রাজ্যের আইনকানুন, নিয়মনীতি, ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেলে সাজানাের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার প্রথম মনােযােগ ছিল সম্রাট হিসেবে যে মানুষটি এই সিংহাসনে বসে তাকে সুরক্ষিত করার জন্য আইন প্রণয়ন। অগাস্টাসের সময় তিনি যেমন “প্রথম শ্রেণির নাগরিক” হিসেবে উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু একেবারে সাধারণ একটি রােমান পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন তাই তার চলাফেরাও ছিল সাধারণের মতােই। তিনি এটা করতে পেরেছিলেন কারণ তখন ইতালিতে ছিল কেবল শান্তি এবং ইতালির মানুষ ছিল নিরস্ত্র। কিন্তু তার সময়ে একজন সম্রাট সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে থাকতেন। সেই সেনাবাহিনীর মধ্যে হাজারটা দল এবং মত। তখনকার দিনে সম্রাটকে কথায় কথায় বাইরের অসভ্য উপজাতিদের সাথে যুদ্ধে যেতে হতাে। তারা আবার সুযােগ পেলে আরও বেশি অসভ্য উপজাতিদের জুটিয়ে নিয়ে একযােগে আক্রমণ করে বসত। তখন সেই অবস্থায় রােমান নাগরিকদের মাঝখান দিয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হয়ে হেঁটে যাওয়া আর নিজের পেটের দিকে একটি ছুরিকে আহ্বান করার মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। তার আগের অর্ধ শতাব্দীতে দুই ডজন সম্রাট সেটি প্রমাণ করেছেন। পরে ডিওক্লেশিয়ান এসব বিষয়ে খুব সতর্ক হয়ে উঠলেন। তিনি নিজেকে কেবল একজন বিশিষ্ট বা প্রথম শ্রেণির নাগরিক মনে করেই আনন্দিত হননি, নিজেকে তিনি ঘােষণা করলেন “ডমিনাস” (“প্রভু”) হিসেবে। তিনি পূর্বদিকে প্রদেশগুলােতে যে আচার অনুষ্ঠানের নিয়মনীতি আছে সেগুলাে চালু করার চেষ্টা করলেন। মানুষ তাকে দেখামাত্র নিচের দিকে ঝুঁকে সম্মান দেখাবে। এছাড়াও আরও নানারকমের নতুন নিয়ম আমদানি করা হলাে যেসবের মাধ্যমে বােঝানাে যায় যে সম্রাট হলেন একজন অতিমানব এবং তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে অতি সামান্য এবং সাধারণ। এই ধরনের ছােটখাটো আচার ব্যবহার অরেলিয়ানের সময়েও কিছু কিছু প্রচলিত করা হয়েছিল তবে, এবারে ডিওক্লেশিয়ানের সময়ে সেটি একেবারে আইনের মতাে পালিত হতে লাগল। এসব ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে অগাস্টাসের তৈরি রােমান সাম্রাজ্যের নিয়মকানুন, যা কিনা তিনশ বছর ধরে একটু একটু করে নষ্ট হচ্ছিল, তা যেন একেবারেই ভেঙে পড়তে লাগল। এছাড়া ডিওক্লেশিয়ান নিজেকে কখনও রাজা বা সম্রাটও বলতেন না। তিনি বলতেন তিনি হলেন রােমান সাম্রাজ্যের একমাত্র অধিপতি। সিনেটের সদস্যরা তখনও রােমে সময়মতাে একসাথে মিলিত হতাে, তবে সেই মিলন একটি সামাজিক মিলন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
সময়ের সাথে যথোপযুক্ত আইন : অগাস্টাসের সময়ে যেমন তার নিয়মকানুন রােমের জন্য যথােপযুক্ত ছিল, ঠিক তেমনি ডিওক্লেশিয়ানের সময় তার নিয়মকানুন। সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান হয়ে পড়লেন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনাে মানুষ। এই অবস্থানের মানুষের জন্য সেনাদের মনে পবিত্র এক রকম শ্রদ্ধা এবং ভয়ের অনুভূতি কাজ করে। সম্রাটের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাদের কাছে শিঙায় ফু দেয়ার মতাে ক্রুদ্ধ এবং সেই পদক্ষেপগুলাে তাদের ভয়ে আর শ্রদ্ধায় আরও বেশি আড়ষ্ট করে ফেলে। নানান আচার এবং কুসংস্কারে নিমজ্জিত সেনাদের কাছে এরকম দেবতুল্য একজন সম্রাটকে হত্যা করা খুব কঠিন। এটাই হয়তােবা একটি কারণ হতে পারে যে ডিওক্লেশিয়ান শেষ পর্যন্ত ২১ বছর নির্বিঘ্নে শাসন করে যেতে পেরেছিলেন। দেড়শ বছর আগের অ্যান্টোনিনাস পায়াসের পরে এটিই ছিল কোনাে রােমান সম্রাটের সিংহাসনে টানা বসে থাকার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। এর বেশি আর কী, ডিওক্লেশিয়ানের শাসনামলের পরেও সাম্রাজ্যে নানা রকমের অসুবিধা ছিল তা ঠিক কিন্তু একের পর এক সম্রাট তার ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের হাতে খুন হওয়া এবং দ্রুত একজন উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করে তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়ার নিয়মটি অন্তত বদলেছিল। তখনকার অবস্থা দেখে এটুকু বলা যেত যে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে সাম্রাজ্যটি যেন তার নিজের পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল।
সেনাবাহিনী বৃদ্ধি ও তার জন্য করের পরিমাণ বৃদ্ধি : সাম্রাজ্যটি নড়বড়িয়ে হাঁটলেও সত্যিই নিজের পায়ের উপরে ফিরে এসেছিল। এতদিনের যে অগােছালাে রাজত্ব মানুষ দেখেছিল, তখন আর তার চেহারা দেখে কোনােমতেই তা বলা যেত না। অবশ্য মাহামারীতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়া আর উপজাতিদের আক্রমনে যে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন সাম্রাজ্যের আনাচেকানাচে লেগে ছিল সেসব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। একভাবে বলতে গেলে, বিদেশী আক্রমণের বিপক্ষে ডিওক্লেশিয়ানের কঠোর অবস্থান কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কুফলও বয়ে এনেছিল । ডিওক্লেশিয়ান এমন এক বিশাল সেনাবাহিনী পালতেন যা কিনা অগাস্টাসের সময়কার সেনাবাহিনীর চেয়েও বড় ছিল। সেই সময়কার পড়ে যাওয়া অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে রােমান সাম্রাজ্যের জন্য এটি ছিল এক ধরনের বিলাসিতা। ডিওক্লেশিয়ান এবং তার অনুসারীরা এই সেনাবাহিনীর জন্য বিপুল ভরণপােষণের খরচ যােগাতেন জনগণের উপরে অতিরিক্ত করের বােঝা চাপিয়ে। সাধারণ মুদ্রার প্রচলন ততদিনে কমে গিয়েছিল। মুদ্রার মূল্য কমে যাওয়াতে তখন বিভিন্ন জিনিসের মাধ্যমেও কর নেয়া হচ্ছিল। এক একটি অঞ্চলের পৌরসভার প্রধান সেই অঞ্চলের কর আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। কর যদি কম আদায় করা হতাে, তবে পৌরসভা প্রধানের দায়িত্ব ছিল নিজে থেকে সেই কমতিটা পুষিয়ে দেয়া। তাই তাদেরকে সময়ে সময়ে মানুষের প্রতি আর অধীন কর্মচারিদের প্রতি রূঢ় হতে হতাে। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ টানাপােড়েনের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিল। ছােটখাটো কৃষকেরা যেন কোনােভাবেই জীবিকা অর্জন করতে পারছিল না আর বড় বড় খামারের মালিকেরা ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছিল দারিদ্রের দিকে। বাণিজ্যে আগ্রহী এবং বিদ্যমান ব্যবসায়ীরা নতুন কোনাে ব্যবসায় হাত দেবার অনুমতি পেত না। তারা সবসময় সাম্রাজ্যকর্তৃক বসানাে নানান অন্যায় নিয়মে জর্জরিত হয়ে থাকত। যদিও তাদের ব্যবসার কারণে রাজ্যের অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠত কিন্তু তাদের ব্যবসা সবসময়ই হুমকির মুখে থাকত। সেই সময়কার অর্থনৈতিক নিয়মনীতি তাদের জন্য বিপুল কর দেয়ার পরে সামান্য আয়ে খুশি থাকার অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনতে পারেনি। তারা আবার আইন অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে যােগদান করতেও অপারগ ছিল। কারণ সেনাবাহিনী তখন বড় করা হচ্ছিল নতুন নতুন উপজাতিদের দলে টেনে এনে।
অধ্যাদেশের মাধ্যমে জনগণের অবস্থার উন্নয়নের ব্যর্থ প্রচেষ্টা : রাজত্বের শেষের দিকে এসে ডিওক্লেশিয়ান অনুধাবন করলেন যে অসহনীয় নিয়মকানুনের অত্যাচারে রাজ্যের জনগণ যারপরনাই অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ৩০১ খ্রিস্টাব্দে (১০৫৪ রােমান সালে) তিনি তার বিখ্যাত “ডিওক্লেশিয়ানের অধ্যাদেশ” জারি করেন। তিনি সেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজ্যে চলমান সমস্যা কিছুটা কমানাের চেষ্টা করেন। সেখানে সর্বোচ্চ দাম এবং সর্বোচ্চ বেতনের নিয়ম চালু করা হয়। এই অধ্যাদেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন বড় জমির মালিকের দ্বারা খাদ্য সংকটের সময় শুধু লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে শ্রমিকদের যথেচ্ছা ব্যবহার বন্ধ করা এবং একইভাবে যখন শ্রমিক সংকট হবে তখন সেই সুযােগে শ্রমিকরা যেন অতিরিক্ত লাভবান হতে না পারে। যদিও ডিওক্লেশিয়ান ছিলেন সাংঘাতিক চরমপন্থী এবং এই অধ্যাদেশ কেউ মানতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হবে বলে ঘােষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু সব ধরনের প্রচেষ্টার পরেও তখন উদ্দেশ্যটি সফল হয়নি। কোনাে কিছুই সাম্রাজ্যের অর্থনীতির ক্রমাগত অধঃপতন ঠেকাতে পারেনি।
সাধারণ জনতার রাজনৈতিক বিতৃষ্ণা ও দেশপ্রেমের অভাব : সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সে সময়ের সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় তারা খুবই সামান্য উপকৃত হয়েছিল। একটি যুদ্ধে যখন অসভ্য কোনাে জাতি অথবা খােদ রােমানরা জয়ী হয়, তখনইবা তাদের কী যায়-আসে? তাদের দৃষ্টিতে দুটি পক্ষই অসভ্য। একটি জায়গা নিজেদের দখলে রাখার ব্যাপারে দুটো পক্ষই সমান নিষ্ঠুর। দুই পক্ষই নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক নিচে নামতে পারে। রােমান সাধারণ নাগরিকদের চোখে যুদ্ধে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা দুটো দল আর তাদের উপরে চাপ প্রয়ােগে বেশি বেশি কর আদায় করার দায়িত্বে নিয়ােজিত মানুষেরা একই রকমের দুর্ধর্ষ। তাই সেই সময়ে নাগরিকদের মধ্যে রােমান সাম্রাজ্যের ব্যাপারে যে উদাসীনতা দেখা গিয়েছিল তা একবারেই অস্বাভাবিক ছিল না। তারা নিজেদের রােমান ভাবতেও বিরক্ত বােধ করত এবং দেশপ্রেম বলতে কোনাে বস্তু তাদের মধ্যে জন্মানো ছিল নিতান্তই বাহুল্য। অসভ্য জাতিগুলাের কোনাে একটির কাছে যদি রােমান সেনাবাহিনী পরাজিত হতাে, কিংবা রােমানদের হারিয়ে জার্মান উপজাতিদের দল যদি সীমান্তবর্তী অঞ্চল দখল করে নিত, এসবের কোনাে কিছুতেই সাধারণ রােমান নাগরিকদের কিছু আসত-যেত না। তাদের দিক থেকে কোনাে কিছুতেই কোনাে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত না। তাদের ভেতর থেকে কোনাে বিদ্রোহ, কোনাে সংগঠন, কোনাে কিছুই গড়ে ওঠেনি। এমনকি যখন সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে কিছু একটা প্রতিবাদ আসা প্রয়ােজন ছিল, তখনও আসেনি।
শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও সরকারের স্থিতিশীলতা : সে যাই হােক, সাম্রাজ্যের ভােগান্তি যত কঠিনই হােক না কেন, ডিওক্লেশিয়ানের আমলে দুটো জিনিসের নিশ্চয়তা ছিল। এক হলাে দেশের সেনাবাহিনী, যা কিনা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসের মর্যাদা অর্জন করেছিল। আরেকটি হলাে, সরকার, যা মানুষের প্রতি যতই রূঢ় হােক না কেন, অন্তত টিকেছিল। সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে যেভাবে রােমান সাম্রাজ্য হাজার বছর ধরে চলছিল, তার চেয়ে ডিওক্লেশিয়ানের হস্তক্ষেপে আরেকটু স্থির হয়ে উঠেছিল। আরেকটু দীর্ঘস্থায়ীত্বের সৌভাগ্য অর্জন করেছিল।
ডিওক্লেশিয়ান, ম্যাক্সিমিয়ান, গ্যালেরিয়াস ও প্রথম কনস্ট্যান্টিয়াসের টেট্রার্কি
ম্যাক্সিমিয়ানকে (রা. ২৮৬ – ৩০৫ খ্রি.) সহকর্মী হিসেবে গ্রহণ : ডিওক্লেশিয়ান সাম্রাজ্যে সুস্থ অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় যে পদক্ষেপগুলাে নিয়েছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে তার একার পক্ষে সেসব সামলানাে কঠিন। সমস্যাগুলাে সংখ্যায় এত বেশি আর এত গুরুতর ছিল, সাম্রাজ্য জায়গায় জায়গায় এতই জীর্ণ হয়ে পড়েছিল, কোথাও কোথাও সীমানা ছিল পুরােপুরি অরক্ষিত, অতগুলাে প্রকট সমস্যার মুখােমুখি হওয়ার জন্য একজন মাত্র শাসনকর্তা যেন খুব সামান্য হয়ে পড়েছিল। এইসব চিন্তাভাবনার মধ্যে ডিওক্লেশিয়ান নিজের দায়িত্বের ভার কিছুটা দেয়ার জন্য একজন সঙ্গী নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এরকম ঘটনা রােমান সাম্রাজ্যে আগেও ঘটেছিল। মার্কাস অরেলিয়াস লুসিয়াস ভ্যারাসকে যুগ্ম সম্রাট হিসেবে সাথে নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। সেবারে সাম্রাজ্যটি এরকম দ্বৈত শাসকের হাতে চলেছিল প্রায় আট বছরব্যাপী। তারপর থেকে অনেক সম্রাট নিজের সাথে পুত্র কিংবা অন্য কোনাে আত্মীয়কে নিয়ে শাসনকাজ চালানাের চেষ্টা করেছিলেন। এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলাে নেয়া হয়েছিল সময়ের প্রয়ােজনে, হঠাৎ করে। দাপ্তরিকভাবে এরকম সিদ্ধান্ত কখনও নেয়া হয়নি। কিন্তু এবারে ডিওক্লেশিয়ান এই সিদ্ধান্তকে সরকারি দপ্তরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রহণ করতে চাইলেন। ২৮৬ খ্রিস্টাব্দে (১০৩৯ সালে) তিনি একজন পুরনাে বন্ধু ম্যাক্সিমিয়ানকে (মার্কাস অরেলিয়াস ভ্যালেরিয়াস ম্যাক্সিমিয়ানাস) নিজের সহকর্মী হিসেবে নিয়ােগ দিলেন। ম্যাক্সিমিয়ানও ছিলেন ডিওফ্রেশিয়ানেরই সমবয়সী, একইরকমের কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তিনি প্যানােনিয়ায় জন্মেছিলেন। ডিওক্লেশিয়ানের মতােই তিনি সাধারণ সেনা থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে লিজিয়ন প্রধানের পর্যায়ে ওঠেন। কিন্তু ডিওক্লেশিয়ানের মতাে তিনি তত বুদ্ধিমান ছিলেন না। ডিওক্লেশিয়ান ম্যাক্সিমিয়ানকে পছন্দ করেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যার উপরে ভরসা করা যায় নির্দ্বিধায়, যিনি তার ইচ্ছায় সেনাবাহিনীকে যে কোনাে আদেশ মানতে বাধ্য করতে পারেন, যে কোনাে নির্দেশ তিনি কোনাে প্রশ্ন না তুলে সমাধা করতে পারেন কিন্তু ম্যাক্সিমিয়ানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুণ ছিল যে তিনি তার প্রভুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের মতাে যােগ্যতা রাখেন না।
দুজনের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ : ডিওক্লেশিয়ান নিজে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অর্ধেকটার শাসনব্যবস্থা দেখাশােনার ভার নিয়ে পশ্চিমদিকের অর্ধেকটা ম্যাক্সিমিয়ানের উপরে ছেড়ে দিলেন। উত্তর-দক্ষিণ দিকের সীমানা মাঝখানে সরু একটুকরাে সমুদ্রের অস্তিত্ব নিয়ে ইতালির পায়ের কাছে যেন উত্তর দিকে গ্রিসকে পৃথক করেছে। যুগযুগ ধরে বিভক্তিটা এমনই ছিল। তবে এবারের নতুন ব্যবস্থায় ২৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে একে বলা যায় “পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্য” এবং “পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য”। এটা অবশ্য কোনােভাবেই এমন কোনাে ইঙ্গিত দেয় না যে রােমান সাম্রাজ্য দুটো ভাগে বিভক্ত হতে যাচ্ছিল। ইতিহাসে আজীবনই রােমান সাম্রাজ্য এক এবং অটুট ছিল। এই ভাগাভাগি কেবল শাসনব্যবস্থার সুবিধার্থে করা হয়েছিল। এমনও মনে হতে পারে যে ম্যাক্সিমিয়ান ভালাে অংশটির কর্তৃত্ব পেয়েছে কারণ পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্য পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের তুলনায় বেশ বড় ছিল। আরও ভালাে যে, পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যে প্রচলিত ভাষা ছিল ল্যাটিন যেখানে ছিল খােদ ইতালি এং রােম শহর। যদিও এই ব্যবস্থা ছিল অল্প কিছু দিনের। পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য ছিল আয়তনে ছােট এবং গ্রিক ভাষাভাষীদের এলাকা। সেখানে রােমান সংস্কৃতিচর্চাও হতাে কম। কিন্তু সে যাই হােক, পূর্বদিকের অংশ ছিল অপেক্ষাকৃত ধনী। রােমের প্রতি আসলে মানুষের আবেগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না তখন কারণ রাজধানী বলতে তখন নিকোমেডিয়া। নিকোমেডিয়াই তখন শাসনকাজের কেন্দ্র। এমনকি ম্যাক্সিমিয়ান যখন পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি রােমকে রাজধানী হিসেবে চাননি। তিনি মেডিওলানুম শহরেই (আধুনিক মিলান শহর) রয়ে যান। এর মূল কারণ হয়তােবা সেখানে বসে রাইন আর দানিয়ুবের তীরবর্তী এলাকায় উপজাতিদের হামলা ঠেকানাে সহজ হতাে। (কিন্তু এত কিছুর পরেও কিছু কিছু নির্দিষ্ট ঐতিহ্যবাহী বিষয় রােমকেন্দ্রিকই থেকে গেল। আগের দিনের মতাে জনগণের জন্য বিনামূল্যে উৎসব, খাদ্য আর খেলাধুলার প্রতিযােগিতামূলক অনুষ্ঠান রােমে অনুষ্ঠিত হতাে। এই বিষয়ে নােম একসময় সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।)
গাউলের কৃষক বিদ্রোহ দমন ও ব্রিটেনের বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থতা : ওদিকে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্য যে কেবল নামমাত্রই রােমান সাম্রাজ্য হয়েছিল, তাও নয়। ম্যাক্সিমিয়ানেরও নানারকমের সমস্যার মুখােমুখি হতে হতাে। গউলের কৃষক সমাজ বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিল এবং তাদের একটি দল সাম্রাজ্যের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তারা বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর করছিল এবং জানাচ্ছিল যে এই সাম্রাজ্য তারা পুড়িয়ে ফেলতে চায় যেখানে তারা কেবল খেটেই মরছে কিন্তু সমাজের একটি বড় অংশ হয়েও বিনিময়ে কিছুই পাচ্ছে না। এই বিদ্রোহের সময়ে কৃষকরা কিছু ধনী লােকের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া ছাড়া নিজেদের জন্য আর কিছুই করতে পারেনি। এই বিদ্রোহের ফলস্বরূপ তারা তেমন কিছুই পায়নি। ম্যাক্সিমিয়ান তার উপজাতি নিয়ােগকৃত সেনাবাহিনী নিয়ে বিদ্রোহী কৃষকদের উপরে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। নিরস্ত্র, আবেগী কৃষকদের শেষ সদস্যটিকে পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হাতে খুন হতে হয়। ম্যাক্সিমিয়ান যখন ফরাসি কৃষকদের এক হাতে দমন করছিলেন তখন একইসাথে তিনি আবার ব্রিটেন আরেকদল বিদ্রোহীদের সাথে লড়ছিলেন। জার্মানের অসভ্য জাতিরা তখন সমুদ্র উপকূল ছিনিয়ে নিয়ে পুরাে দ্বীপ কজা করে ফেলেছে। ম্যাক্সিমিয়ান তখন একটি যুদ্ধজাহাজের বহর সাজাতে মনােনিবেশ করেন। তার চিন্তাটা ভালাের জন্যই ছিল তবে পরিকল্পনাটি তার দিকেই আঘাত হয়ে ফিরে আসে। যুদ্ধজাহাজের বহরের প্রধান হিসেবে যাকে নিযুক্ত করা হয়, তিনি নিজেই উপজাতিদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন এবং ব্রিটেনের সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব নেন। ম্যাক্সিমিয়ানকে আগেই এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তিনি যেন এরকম জরুরি অবস্থায় যে, কোনাে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এসব ভাবার আগে ডিওক্লেশিয়ানের সাথে তার আলােচনা করে সময় নষ্ট করার কোনাে প্রয়ােজন হতাে না। এত কিছু করার অধিকার থাকা সত্ত্বেও ম্যাক্সিমিয়ান কিছুই করতে পারলেন না। তিনি নিজের জন্য আরেকটি যুদ্ধজাহাজ সাজিয়ে নেন কিন্তু একটি ভয়ংকর ঝড়ের কবলে পড়ে সেই জাহাজের সলিল সমাধি হয়। তখন রাগে নিজের চুল ছেড়া ছাড়া তার অন্য কোনাে উপায় ছিল না।
দুজন সম্রাটের উত্তরাধিকারী ও সহকারী হিসেবে গ্যালেরিয়াস (রা. ৩০৫ – ৩১১ খ্রি.) ও প্রথম কনস্ট্যান্টিয়াস (রা. ৩০৫ – ৩০৬ খ্রি.) : ডিওক্লেশিয়ানের কাছে তখন মনে হয়েছিল যে, দুজন মানুষের শাসনও যেন এই বিশাল সাম্রাজ্যের জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠছে না। তাই ২৯৩ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১০৪৬ সালে) তিনি সংখ্যাটা দ্বিগুণ করে ফেলেন। তিনি তার এবং ম্যাক্সিমিয়ান দুজনের জন্যই অগাস্টাস উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, এবার দুজনেই সিজার উপাধিওয়ালা দুজন উত্তরাধিকারী গ্রহণ করলেন। এই ব্যবস্থা তাদের দুজনের জন্যই প্রয়ােজনীয় সহকারীর অভাব মেটালাে। এছাড়া তাদের পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকারী হিসেবে কারা সম্রাটের আসনে বসবে, সে সমস্যারও সমাধান হলাে। এই সিজারেরা ততদিনে ক্ষমতায় থেকে কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করবে এবং ক্ষমতায় বসার সুযােগ এলে অগাস্টাসের মতাে বিচক্ষণতা দেখাতে পারবে। ডিওক্লেশিয়ান নিজের জন্য সিজাররূপী যাকে খুঁজে বের করলেন তিনি হলেন গ্যালেরিয়াস (গেইয়াস গ্যালেরিয়াস ভ্যালেরিয়াস ম্যাক্সিমিয়ানাস)। তিনি সম্রাট ডিওক্লেশিয়ানের কন্যার স্বামী ছিলেন। খুব সহজেই তিনি হলেন সম্রাটের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। গ্যালেরিয়াসের বয়স তখন চল্লিশ পেরিয়েছে কেবল। তিনি দানিয়ুবের দক্ষিণে ইউরােপিয়ান প্রদেশের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন। তার জন্মস্থান প্রেস শহরের দায়িত্বও ছিল তার উপরে। আর ডিওক্লেশিয়ান এশিয়া আর মিশর নিজের মুঠির মধ্যে রেখেছিলেন। ম্যাক্সিমিয়ান যাকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাবেন, তার সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। তিনি হলেন ফ্লেভিয়াস ভ্যালেরিয়াস কনস্ট্যান্টিয়াস। ইতিহাসে তিনি কনস্টান্টিয়াস ক্লোরাস নামে পরিচিত। (এর অর্থ হলাে ফ্যাকাশে কনস্টান্টিয়াস। সম্ভবত তার গায়ের রঙের কারণে এরকম নামকরণ করা হয়েছিল তার।) তাকে এখানে প্রথম কনস্টান্টিয়াস হিসেবেও উল্লেখ করা যায় কারণ তার বংশের একজন দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস, যিনি কিনা দেড়শ বছর পরে রােমে শাসনকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই নামকরণের ফলে তাকে পৃথক করে বােঝা যায়।
রাইন পর্যন্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ব্রিটেন ও মিশরের বিদ্রোহ দমন এবং সমগ্র সাম্রাজ্যে সুরক্ষিত অবস্থা : কনস্ট্যান্টিয়াস ছিলেন আরেকজন ইলিরিয়ান যিনি তার নিজের অঞ্চলে বহুদিন ধরে কেবল দক্ষতার সাথেই নয়, মানবতা এবং তার সাথে শাসন করে আসছিলেন। সে সময়ে তার মতাে মানবিক শাসক প্রকৃতপক্ষে আর দেখা যায়নি।) কনস্টান্টিয়াসকে স্পেন, গাউল এবং ব্রিটেন প্রাথমিকভাবে শাসন করতে দেয়া হলাে। কারণ ইতালি এবং আফ্রিকা ম্যাক্সিমিয়ান নিজের হাতে রেখেছিলেন। চারজনের এই চতুর্ভুজ শাসনব্যবস্থা রােমান সাম্রাজ্যের মােড় ঘুরিয়ে দিলাে। কনস্ট্যান্টিয়াস ব্রিটেন আর গাউলে কিছু বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি রাইনের তীরবর্তী এলাকা নিরাপদ করে ফেললেন প্রথমে এবং তারপর মনােযােগ দিলেন ব্রিটেনের দিকে। আরেকটু চেষ্টা করে দেখার জন্য তিনি আরেকটি যুদ্ধ জাহাজের বহর সাজিয়ে নিয়ে ব্রিটেনের দ্বীপে গিয়ে থামলেন। ৩০০ খ্রিস্টাব্দের ভেতরে কনস্ট্যান্টিয়াস ব্রিটেন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হলেন। সেখানে রােমান রাজত্বের পুননির্মাণ করে সেই অঞ্চলকে সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে তৈরি করেছিলেন তিনি। সেখানে নিয়মনীতি ছিল অন্যান্য জায়গার চেয়ে কিছুটা শিথিল। এর মধ্যে ডিওক্লেশিয়ান মিশরের দিকে অভিযাত্রা শুরু করেন। সেখানে তিনি একজন বিদ্রোহী সেনাপ্রধানকে দমন করেন। এদিকে তিনি না থাকার সময়টাতে গ্যালেরিয়াসকে পারস্যের দায়িত্ব দিয়ে যান। দুদিকের দুটো কাজই সফলভাবে শেষ হয়েছিল। ৩০০ সালের ভেতরে সাম্রাজ্যের চারদিকে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত নিরাপদ হয়ে উঠল এবং সীমান্তবর্তী প্রতিটি অঞ্চল ছিল আশ্চর্যজনকভাবে সুরক্ষিত।
রোমে ডিওক্লেশিয়ানের হতাশা ও অতিমানব হয়ে ওঠা : ৩০৩ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১০৫৬ সালে) ডিওক্লেশিয়ান রােমে আসেন। তার সেখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল ম্যাক্সিমিয়ানকে একটি সংবর্ধনা দেয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি কোনাে সুখকর উৎসব হয়নি। ডিওক্লেশিয়ানের এতদিন পরে রােমে ফেরত এসে কিছুই ভালাে লাগছিল না। রােমের মানুষরাও তাকে পছন্দ করছিল না। ডিওক্লেশিয়ান নিজের নামে সেখানে যাদুঘর, পাঠাগার এবং হাম্মামখানা তৈরির উদ্যোগ নেয়া স্বত্ত্বেও জনগণকে খুশি করতে পারছিলেন না। আদিম শহরের অধিবাসীরা একদা নােম পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া সম্রাটকে নিয়ে কেবল সমালােচনা আর কটুক্তি করাতেই ব্যস্ত ছিল। ডিওক্লেশিয়ান তাদের ব্যবহারে এত আঘাত পান যে মাসখানেক থাকার পরেই রােম ছেড়ে চলে আসেন। তারপরের ষােল বছরের মধ্যে ডিওক্লেশিয়ান সত্যিই অতিমানবের মতাে সম্রাটের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তখনকার নিয়ােগ করা সম্রাটেরা কেন, তার পরের সম্রাটেরাও তার গুণগান গাইত। সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ তিনি যে রকম সুষ্ঠুভাবে বজায় রেখেছিলেন তা সত্যিই মনে রাখার মতাে। রােমান সাম্রাজ্য তখন চলছিল চারজন অতিমানবের দ্বারা। তাদের অতিমানব মনে করা হতাে কারণ তারা অতি মানবের মতােই মানবীয় হিংসা-বিদ্বেষের উর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন। চারটি ভাগ ছিল রােমান সাম্রাজ্যের। সেগুলাে হলাে, ১) ইতালির উত্তরপশ্চিমে ইউরােপিয়ান প্রদেশ, ২) ইতালি, মিশরের পশ্চিম দিকের আফ্রিকা, ৩) ইতালির পূর্বদিকে ইউরােপিয়ান প্রদেশ এবং ৪) এশিয়া ও মিশর। সাম্রাজ্যের প্রতিটি বিভাগ একজন মানুষের পক্ষে সামলানাের জন্য যথেষ্ট ছোট ছিল। সবাই নিজ নিজ এলাকা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে শাসন করতেন। তারপর প্রত্যেকের মত বা অমত সােজা সম্রাটের কাছে জানানাে হতাে এবং তারপর সেই মতাে ব্যবস্থা নেয়া হতাে। সেনাবাহিনীর দলগুলােকে স্বাধীন করে দেয়া হয়েছিল। তারা কেবল সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে সমান্তরালভাবে তাল মিলিয়ে চলত। প্রতিটি বাহিনীর একজন প্রধান ছিলেন যাকে বলা হতাে “ডাক্স” (অথবা “নেতা”) এরকম কোনাে নেতাকে আবার “কামস” (“সম্রাটের সঙ্গী”) নামে অভিহিত করা হতাে। সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার এই বিকেন্দ্রিকরণ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তার পরবর্তী প্রায় দশ বছরব্যাপী এভাবেই চলতে থাকে। যদিও চারজন মিলে সাম্রাজ্য একই তালে চালানাে এবং নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা সােজা কথা নয়, কিন্তু কিছু কিছু অংশে হাজার বছরেরও বেশি সময়ে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়। যদিও একসময় মনে হয়েছিল যে সাম্রাজ্যটি ঝুঝি ভেঙেই পড়ছে, কিন্তু এর শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সেখানে বড় ধরনের মাত্রা যােগ করেছিল। এই উদাহরণ আজকের দিনে পর্যন্ত কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে টানা যায়। রােমানরা যাকে “ডাক্স” বা “কামস” বলত তাকেই আজকের দিনে আমরা “ডিউক” আর “কাউন্ট” বলি। এছাড়া ডিওক্লেশিয়ানের অধীনে সাম্রাজ্যটি যে একটি প্রতিষ্ঠানের মতাে কাজ করছিল, তার উত্তরাধিকারীরা খ্রিস্টান চার্চকে সেভাবে গড়ে তুলেছিলেন। ক্যাথলিক চার্চে যেমন আজকের দিনে একজন বিশপ থাকেন, যার অধীনে চার্চের পুরাে এলাকার দায়িত্ব থাকে, যাকে বলা যেতে পারে “ডিওসিস” (ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ দেখাশােনা করা)। তিনি চার্চের “ভিকার” (আজকের দিনে যাকে বলে ভাইস প্রেসিডেন্ট) বা প্রতিনিধিও বটে।
বিশপদের মাধ্যমে চার্চের ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা ও ডিওক্লেশিয়ানের বিরোধিতা
খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হবার কারণ : ডিওক্লেশিয়ানের নতুন প্রণীত আইনকানুনই যে দেশে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, তা নয়। ডেসিয়াস এবং ভ্যালেরিয়াসের সময়ে নির্বিচারে খ্রিস্টান নিধন সত্ত্বেও প্রজন্মের পর প্রজন্মের চেষ্টায় খ্রিস্টানদের শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এখন ডিওক্লেশিয়ানের সময় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে মােট জনসংখ্যার শতকরা দশ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন খ্রিস্টানদের জন্য আর কী চাই, এই দশ শতাংশই তাদের জন্য বিরাট ব্যাপার। তারা ছিল খুবই সুসংগঠিত এবং নিজেদের বিশ্বাসে অনড়। একই সময়ে যেখানে কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা মনে হচ্ছিল যেন ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়েছে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। খ্রিস্টানদের এরকম ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার পেছনে নানান কারণও ছিল। যেমন একটি হলাে সাম্রাজ্যের ক্রমশ অবনতিতে সবার কাছে এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে উঠছিল যে পৃথিবীর সুদিন ফুরিয়ে আসছে এবং মৃত্যুর পরে যিশুর পুনরাগমনের দিন যেন ঘনিয়ে আসছে। যারা কঠোর বিশ্বাসী খ্রিস্টান ছিলেন তারা তাে ততদিনে জেনেই গেছেন যে এরকমটাই ঘটতে যাচ্ছে, আর যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন, তারা নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করতে লাগলেন। তখন ক্ষয়ে যেতে থাকা সমাজের উপরে দাড়িয়ে একজন পূজাপ্রেমী মানুষের জন্য পৃথিবীর বর্তমান কোনাে কিছু ভােগ করার চেয়ে পরকালের দিকে চাতকের মতাে তাকিয়ে থাকাকে শ্রেয় মনে হতাে। এই একটি বিষয় খ্রিস্টধর্মকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। খ্রিস্টধর্মে পরকালকে এত চমকপ্রদ করে বর্ণনা করা হয়েছিল যা তখন বিদ্যমান অন্য কোনাে ধর্মে করা হয়নি। সেই বর্ণনা শুনলে যে কোনাে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ত। আর তাছাড়া যখন সাম্রাজ্যে ছন্নছাড়া একটি অবস্থা চলছে তখন চার্চ যেন সরকার ব্যবস্থাপনার চেয়ে সাংগঠনিক দিক দিয়ে মানুষকে অনেক বেশি আশ্বস্ত করতে পেরেছে। তখন সমস্যাসংকুল ভয়াবহ পৃথিবীর বুকে খ্রিস্টধর্ম যেন শান্তির বাণী নিয়ে এসেছিল।
চার্চের বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় রীতিনীতি অনুযায়ী এর বিবর্তন ও প্রসার : অন্যদিকে চার্চ যেখানে কিনা দিনে দিনে সংখ্যায় বেড়েই যাচ্ছিল কিন্তু আবার নানান সমস্যায় জর্জরিতও হচ্ছিল। চার্চ তখন আর এমন কোনাে প্রতিষ্ঠান ছিল না যেটাকে আগে মনে হতাে একদল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের একটি আড্ডাখানা, যারা নাকি শহীদ হওয়ার জন্য উদগ্রীব। সব ধরনের পরিবার থেকে তখন পুরুষ এবং মহিলা নির্বিশেষে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা শুরু করেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই খুব সাধারণ মানুষ আর তারা কেবল একটি সাধারণ জীবনেরই স্বপ্ন দেখত। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা তখন মানুষের জন্য হয়ে পড়েছিল নেশার মতাে এবং অবশ্যই খুব “সম্মানজনক”। খ্রিস্টধর্মের যে বিবর্তনগুলাে আসছিল সেগুলাে মানুষকে আরও বেশি আকৃষ্ট করার পক্ষে ছিল অসাধারণ। আরও বেশি শ্রদ্ধা আর উৎসর্গের নেশায় মানুষ বিনত হয়ে পড়ছিল। একটি শান্ত, অবাস্তব, অদৃশ্য একেশ্বরবাদের মধ্যে আসলে তেমন কোনাে নাটকীয়তা নেই। তাই খ্রিস্টধর্মে যিশুর অসহায় মায়ের নারীত্বের উপরে আলােকপাত করে ক্রমেই নাটকীয়তা আনা হচ্ছিল। যুবতী মেরি এবং তার সাথে আরও যুক্ত হলাে অসংখ্য সিদ্ধপুরুষ এবং আত্মত্যাগী শহীদ। এমনকি খ্রিস্টধর্মের নিয়মকানুনের মধ্যে কিছু রীতিনীতি অন্য ধর্ম থেকেও এসে পড়ছিল। এটাও খ্রিস্টধর্মকে প্রসার পেতে সাহায্য করেছিল। নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে এভাবে প্যাগান ধর্মের সাথে খ্রিস্টধর্মের পার্থক্যও আসছিল কমে। এটা প্যাগান ধর্ম থেকে আস্তে আস্তে মানুষকে খ্রিস্টধর্মের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে।
অঞ্চলভেদে খ্রিস্টধর্মের বিচ্যুতির বৃদ্ধি ও চার্চের দ্বারা তার নিয়ন্ত্রণ : যেহেতু ধর্মপালনের রীতিনীতিগুলাে ধীরে ধীরে অনেক বেশি জটিল এবং বিস্তারিত হয়ে পড়ছিল এবং একই সাথে ধর্মপালনকারীর সংখ্যাও যাচ্ছিল বেড়ে, তাই রীতিনীতিগুলােকে ভেঙে ভেঙে নানান দলের জন্য নানাভাবে গড়া ছিল খুব সহজ। বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে এবং বিভিন্ন চার্চে আলাদা নিয়মে ধর্মটি পালিত হতে লাগল। এমনকি একই চার্চের আওতায় বিভিন্ন দলের কাছেও রীতিনীতির পার্থক্য দেখা যেত। একেকজনের একেকরকমের দৃষ্টিভঙ্গি আর একেকরকম অনুভূতির বিষয়টি তার ধর্মপালনের রেওয়াজের মধ্যে প্রতিফলিত হতাে। ধর্মপালনের রীতিনীতির এই ভিন্নতা অনেকের চোখে খুব বেশি পাত্তা দেয়ার মতাে কোনাে ব্যাপার মনে হতাে না। তারা নিজেদের থেকে আলাদা কিছু করতে গেলে বড়জোর কাঁধ ঝাঁকিয়ে উপেক্ষা করে চলে যেত। কিন্তু কেউ কেউ আবার মনে করত, কে কীভাবে প্রতিটি রীতি পালন করছে তার উপরে তার ধর্মবিশ্বাসের সুফল বা কুফল নির্ভর করবে। কেউ কেউ মনে করত নির্দিষ্ট করে দেয়া নিয়ম থেকে সামান্য বিচ্যুতিও তাদের পরকালে ভয়াবহ সমস্যায় ফেলবে। সেরকম মানুষেরা সামান্য এতটুকু পরিবর্তনকেও ভালাে চোখে দেখত না। সেখানে তারা কেবল জীবদ্দশা কিংবা পরকালের কথাই বলত না, বলত অনন্ত জীবন এবং অসীম পরকালের কথা। এই ধরনের ভিন্ন মত এবং রীতির উপস্থিতি একটি চার্চকে বিভক্ত করে ভেঙে ফেলতে পারত। এমনকি শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভেতর লড়াই হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু এমনটা কখনােই হয়নি। কারণ চার্চে একটি নির্দিষ্ট পদাধিকার ছিল প্রত্যেকের। নিজেদের পদের মর্যাদা প্রত্যেকে চরমভাবে বজায় রাখত এবং একইসাথে অন্যের অবস্থানের প্রতি উদারতা বা সম্মান। উপরের পদ থেকে যে প্রথা বলে দেয়া হতাে তা নিচের দিকে সবাই মানতে বাধ্য ছিল। এভাবে একটি চার্চের দায়িত্ব একটি এলাকার বিশপের উপরে দেয়া হতাে। ধর্মের আচারব্যবহার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনােরকমের বিতর্কের সৃষ্টি হলে তিনি তা মিটমাট করতেন। কিন্তু এক এলাকার একজন বিশপের সাথে আরেক এলাকার আরেকজন বিশপের বিতর্ক সৃষ্টি হলে, তখন? এমন যে হতাে না, তা নয়, প্রায়ই হতাে। কিন্তু তৃতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে এসে এই বিষয়গুলাে সমাধানের জন্য “সিনডস” (গ্রিক শব্দ “সিনড” এর অর্থ সভা) ডাকা হতাে। সেই সভায় বিশপেরা একসাথে বসতেন এবং যে বিষয়গুলাে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সেসব উত্থাপন করতেন। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে সেই সভায় আলােচনার মাধ্যমে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা সকল বিশপকে মানতে হবে। এভাবে পুরাে খ্রিস্টান সমাজ একটি নির্দিষ্ট আচার ব্যবহার এবং একই রকমের দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আসতে চেষ্টা করত। তাদের চিন্তাভাবনায় ছিল সবকিছুর সমষ্টি হিসেবে একটিমাত্র চার্চ যাকে তারা সর্বজনীন একটি আখ্যা দিতে চাইত। “সর্বজনীন” বা “ইউনিভার্সাল” ধারণাটি তাদের কাছে এসেছিল গ্রিক ধ্যানধারণা থেকে, যে চিন্তাকে তারা ক্যাথলিক চার্চে পরিণত করেছে।
পূর্ব ও পশ্চিমের বিশপদের অবস্থা : বিশপদের সম্মিলিত মতবাদ তখন অর্থোডক্সের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়াল। তাদের মতামতের বাইরে যে কোনাে ধারণাকে তখন নব্যতন্ত্র কিংবা বিরুদ্ধ মতবাদ বলে আখা দেয়া হতাে। নীতিগতভাবে সব বিশপদের গ্রহণযােগ্যতা ছিল সমান। কিন্তু বাস্তবচিত্রটা ছিল একটু অন্যরকম। যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি ছিল সেখানে বেশি বড় আকৃতির চার্চ থাকত এবং যত বড় চার্চ, তার প্রভাব তত বেশি ছিল। বেশি যােগ্য এবং খ্যাত খ্রিস্টানদের সেই বড় চার্চগুলােই আকৃষ্ট করত। অন্যদিকে বড় শহর, যেমন অ্যান্টিওক কিংবা অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার চার্চের বিশপকে মনে করা হতাে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের প্রভাব যেমন ছিল ধর্মের ক্ষেত্রে, তেমনই শিক্ষা, সাহিত্য এবং সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে। অবশ্য সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকের প্রদেশগুলােতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। সেসব জায়গায় বিশপদের নিজেদের মধ্যে প্রায়ই মতবিরােধ দেখা যেত। সত্যি কথা বলতে গেলে সাম্রাজ্যের পশ্চিমভাগে খ্রিস্টানরা সংখ্যায় কম এবং স্বাভাবিকভাবেই অল্প ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায়, ডিওক্লেশিয়ানের আমলের আগ পর্যন্ত তাদের মাত্র একজনই বড় বিশপ ছিলেন। তিনি হলেন রােমের বিশপ। সাধারণভাবে পশ্চিম সাম্রাজ্যে পূর্ব সাম্রাজ্যের চেয়ে শিক্ষার হার ছিল কম। তাই স্বভাবতই সেখানে দর্শনের ঐতিহ্য বা মতে বিভক্ত হওয়ার সুযােগও ছিল কম। প্রাচীন সেই সময়ে রােমের কোনাে বিশপই বড় লেখক কিংবা, সংগঠক হিসেবে পরিচিত হননি, তারা সবাই ছিলেন শান্ত স্বভাবের, ধর্মে কঠোর বিশ্বাস স্থাপনকারী মানুষ। তারা ধর্মের বিভিন্ন মতপার্থক্য নিয়ে কথা বলতেন না। তারা শুরু থেকেই নব্যতন্ত্র বা বিরুদ্ধবাদ থেকে নিজেদের যত্ন করে দূরে সরিয়ে রাখতেন। তাই শুরু থেকে শেষপর্যন্ত রােমের খ্রিস্টানেরা অর্থডক্স হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে রােমের কথা বলতে গেলে, রােম বলতেই মানুষ পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা বুঝত। রােম তখন ক্ষমতার কেন্দ্রীয় কার্যালয় হােক বা না হােক, মানুষের মনে রােমই ছিল শাসনের প্রতীক। আর রােমের বিশপ ছিল কারও কারও কাছে রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের মতােই ক্ষমতাবান। এই বিশ্বাসই ধীরে ধীরে এমন দৃঢ় হয়ে গেল যে মানুষ মনে করতে শুরু করল রােমের বিশপ পিটার হলেন যিশুর সবচেয়ে বড় শিষ্য বা ভক্ত। আর তাই যদিও প্রথম কয়েক শতাব্দীতে রােমের বিশপ তেমন আলােচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পৌঁছাননি, বিশেষ করে যদি অ্যালেক্সান্দ্রিয়া, অ্যান্টিওক বা কার্থেজ শহরের বিশপদের সাথে তুলনা করা হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে (অন্তত পৃথিবীর বেশিরভাগ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কাছে) খ্রিস্টধর্মের মহাগুরু হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে ডিওক্লেশিয়ান : ডিওক্লেশিয়ান তখন সাম্রাজ্যের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখেন, তার ক্ষমতার জোর যেন অন্য কারও ক্ষমতার কাছে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। সেই ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছে চার্চ থেকে। এটি তাকে মারাত্মকভাবে বিরক্ত করে ফেলেছিল। কোনাে কোনাে জায়গায় উল্লেখ আছে চার্চের ক্ষমতার এই ব্যাপক প্রসার ডিওক্লেশিয়ানের অধীন মানুষদের এবং তার উত্তরাধিকারীদেরও নানানভাবে অপ্রস্তুত করেছে। ৩০৩ খ্রিস্টাব্দে ডিওক্লেশিয়ান তার সহকর্মী গ্যালেরিয়াসকে নিয়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা শুরু করলেন। তার মূল আপত্তিটি ছিল চার্চ (যাকে ডিওক্লেশিয়ান মনে করত তার প্রতি হুমকিস্বরূপ) নিয়ে এবং সেইসব মানুষদের বিরুদ্ধে যারা সাম্রাজ্যের সরকারের চেয়ে চার্চের উপরে বেশি নির্ভর করা শুরু করেছে। কিছু কিছু চার্চ ধ্বংস করা হলাে, ক্রুশগুলো ভেঙে ফেলা হলাে বিশপদের অধীনে থাকা পবিত্র গ্রন্থগুলাে টেনে হিচড়ে কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হলাে। এই অবস্থায় প্যাগান ধর্মের মানুষেরা যখন খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে উদ্ভ্রান্তের মতাে জেগে উঠল তখন প্রচুর খ্রিস্টান হত্যা করল তারা। স্বাভাবিকভাবেই তখন খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা সমস্ত সরকারি দপ্তর থেকে চাকরিচ্যুত হলাে, সেনাবাহিনী থেকে হলাে বিতাড়িত, বিচারালয় থেকে বহিষ্কৃত এবং সাধারণভাবে সমাজের সব স্তরে হতে লাগল লাঞ্ছিত। এটাই ছিল রােমান সাম্রাজ্যে শেষ এবং সবচেয়ে ভয়ংকর খ্রিস্টান নিপীড়নের ঘটনা। তবে এটি পুরাে সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। কনস্টান্টিয়াস ক্লোরাস তখনকার চারজন রােমান শাসকদের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে ধৈর্যশীল এবং শান্তিপ্রিয়। তিনি নিজে খ্রিস্টান না হওয়া স্বত্বেও তার এলাকায় খ্রিস্টান নিধনের বা লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটতে বাধা প্রদান করেছেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন সূর্য উপাসনাকারী। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এই জোর অভিযান ডিওক্লেশিয়ানের শাসনামলের শেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তিনি হয়তাে রাজত্ব করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। রােমে সেবারের বিরক্তিকর ভ্রমণ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে প্রজাদের কাছে থেকে ভালােবাসার বদলে ঘৃণা পাওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে হতাশ করেছিল।
ডিওক্লেশিয়ানের মৃত্যু : রােম থেকে নিকোমেডিয়ায় ফিরে আসার পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বয়স তখন ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি ততদিনে রাজত্বের বিশ বছর পার করেছেন এবং তার জন্য সেটি ছিল যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। গ্যালেরিয়াস ছিলেন তখন সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী। গ্যালেরিয়াস তখন সিংহাসনে বসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, সম্রাটকে ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি নিতে অনুরােধও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৩০৫ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১৫৮ সালে) ডিওক্লেশিয়ান সেটাই করেন। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই অস্বাভাবিক একটি ঘটনা যে একজন ক্ষমতাধর নিজের অসুস্থতা এবং অপারগতার কারণে সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে সেখানে বসার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ব্যতিক্রমধর্মী হলেও ঘটনাটি ঘটেছিল রােমান সাম্রাজ্যে। সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান ছিলেন এর নায়ক। প্রাক্তন সম্রাট সালােনা শহরে অবসর গ্রহণ করেন যেখানে তিনি জন্মেছিলেন। সেখানে তিনি একটি বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং জীবনের শেষ আটটি বছর সেখানেই কাটান। সেই রাজপুরীটি পরবর্তীকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ডিওক্লেশিয়ানের শাসনামলের তিনশ বছর পরে যখন সালােনা শহরে অসভ্য উপজাতিরা আক্রমণ করে তখন তারা এটি গুঁড়িয়ে দেয়। পরে আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। রাজপুরীর চারদিকে বাসাবাড়ি গড়ে ওঠে। সেই নতুন শহরের নাম হয় স্প্যালাটাম। কালক্রমে শহরটি ইতালিয়ানদের কাছে স্প্যালাটো এবং যুগােস্লাভিয়ানদের কাছে প্লিট নামে পরিচিত হয়।
প্রথম কনস্ট্যান্টাইন (রা. ৩০৬ – ৩৩৭ খ্রি.)
কনস্ট্যান্টিয়াস ও গ্যালেরিয়াসের হাতে ক্ষমতা এবং গ্যালেরিয়াসের স্বজনপ্রীতি : চারজনের শাসন কী করে এক সুতােয় গাঁথা যায়, এ বিষয়ে ডিওক্লেশিয়ানের ছিল নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। যখন তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, তিনি তার সহ-সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। এর কারণ হলাে দুজন সিজার উপাধিধারী গ্যালেরিয়াস এবং প্রথম কনস্টান্টিয়াস যেন একযােগে নিজেদের মতাে করে শাসন ব্যবস্থা চালাতে পারেন। এভাবে দুজন অগাস্টাসই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালো, আর দুজন সিজার হয়ে উঠল দুজন নতুন অগাস্টাস। তার এর পরের পদক্ষেপ ছিল, নতুন দুজন সিজার উপাধিধারী শাসনকর্তা নিয়ােগ। যৌক্তিকভাবে ভাবলে দুজন ভালাে, অভিজ্ঞ সেনা, শক্তসমর্থ, যােগ্য, সমর্থনকারী ব্যক্তিকেই দায়িত্ব দেয়া উচিত। তাহলেই কেবল নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গ্যালেরিয়াস এবং কনস্ট্যান্টিয়াসের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠতে পারবে এবং পরে নিজেদের মতােই যােগ্য উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করবে। কিন্তু ডিওক্লেশিয়ানের এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা যদি কাজে লাগত তবে তারপরে রােমান সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে আর কখনও লড়াই হতাে না এবং সাম্রাজ্যটি পেতো একের পর এক যোগ্য সম্রাট। দুর্ভাগ্যবশত দুজন অগাস্টাস উপাধিধারী শাসক নিজেদের মধ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেন। তারা দুজনেই নিজেদের পরিবারের ভালাের কথা চিন্তা করে, বাইরের কোনাে মানুষকে না ডেকে, একজন করে আত্মীয়কে সিজার উপাধি দিয়ে উত্তরাধিকারী বানাতে চান। সেখানে অবশ্য ডিওক্লেশিয়ানের উত্তরাধিকারী ছিলেন গ্যালেরিয়াস, যিনি পূর্বদিকের রােমান সাম্রাজ্য শাসন করতেন। তিনিও নিজেকে ডিওক্লেশিয়ানের মতাে প্রধান শাসনকর্তা না ভেবে পারতেন না যেমন প্রাক্তন সম্রাট নিজেকে ভেবেছিলেন। তাই গ্যালেরিয়াস সেই সুযােগে নিজের আত্মীয়ের মধ্যে একজন ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীকে সিজার উপাধি দিয়ে ফেললেন। তিনি এই বিষয়ে কনস্ট্যান্টিয়াসের সাথে আলােচনা করারও প্রয়ােজন বােধ করেননি। (তখন এটাও মনে করা হতাে যে কনস্টান্টিয়াস হয়তােবা গ্যালেরিয়াসকে খ্রিস্টানদের পৃষ্ঠপােষকতা করার জন্য বেশ অপছন্দ করেন। পরে অবশ্য এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। গ্যালেরিয়াসের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের তার অংশে খ্রিস্টান নিধন ছিল সাধারণ ঘটনা এবং সেটি ঘটেই চলেছিল।)।
ম্যাক্সেন্টিয়াসের উত্তরাধিকারী হওয়া ও কনস্ট্যান্টাইনের সম্রাট পদ লাভ : নিজের উত্তরাধিকারী বানানাের জন্য গ্যালেরিয়াস তার ভাগ্নে ম্যাক্সিমিন ডাইয়াকে নির্বাচন করেছিলেন যেখানে কিনা কনস্ট্যান্টিয়াসের জন্য তিনি নির্বাচন করেছিলেন তার অধীনে কাজ করা একজন কর্মীকে। তার নাম ছিল সেভেরাস (রা. ৩০৬-৭ খ্রি.)। বৃদ্ধ যুগ্ম সম্রাট ম্যাক্সেমিয়ানের পুত্র ম্যাক্সেনটিয়াস (রা. ৩০৬-১২ খ্রি.) এসব বিষয়ে চুপচাপ ছিলেন। ম্যাক্সেনটিয়াস জানতেনই যে বাবার পরে উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্রাটের সিংহাসনটি তার। তিনি নিজেকে সম্রাট ঘােষণা করেও আবার পিতাকেই রাজ্য পরিচালনার আহ্বান করেন। (বৃদ্ধ ম্যাক্সিমিয়ান যিনি ডিওক্লেশিয়ানের আদেশে সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই মুহূর্তে ইচ্ছে না থাকলেও কিছু বলতে পারেননি, এবারে সিংহাসন ফিরে পাওয়াতে আনন্দিত হয়ে আবার রাজকার্য শুরু করলেন।) গ্যালেরিয়াসও খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি সেভেরাসকে সেনাবাহিনীর বহর নিয়ে ইতালিতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সেভেরাস পরাজিত হলেন এবং মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর ইতালির দায়িত্ব পেল ম্যাক্সেনটিয়াস। কনস্ট্যান্টিয়াস এই নতুন ব্যবস্থায় খুশি হননি। তার নিজেরও একটি ছেলে ছিল যার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনােরকমের পরিকল্পনা করা হয়নি। কোনাে সন্দেহ ছিল না যে কনস্ট্যানন্টিয়াসও ম্যাক্সিমিয়ানের মতােই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসাবেন, কিন্তু তিনি তখন ব্রিটেন উত্তরদিকের উপজাতিদের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় সেটি করতে পারছিলেন না। এরপর ৩০৬ খ্রিস্টাব্দে সেটি করার আগেই এবােরাকামে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, যেখানে এক শতাব্দী আগে মৃত্যু হয়েছিল সেপটিমিয়াস সেভেরাসের। যাই হােক, মৃত্যুর আগমুহুর্তে কনস্টান্টিয়াস তার পুত্র কনস্ট্যান্টাইনকে নিজের বাহিনীর প্রধান করে দিয়ে যান। সেই সময়ে কনস্ট্যান্টাইনের বয়স ছিল মাত্র মাত্র আঠারাে। তিনি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সাথে সাথেই সম্রাট ঘােষিত হয়ে যান। সম্রাট হিসেবে তার নামকরণ হয়েছিল প্রথম কন্সট্যান্টাইন (রা. ৩০৬-৩৭ খ্রি.), কারণ তার পরেও এই নামে আরও অনেক সমাট এসেছিলেন।
কনস্ট্যান্টাইনের বাল্যকাল, ক্ষমতাগ্রহণ, ম্যাক্সিমিয়ানের কন্যাকে বিবাহ ও গ্যালেরিয়াসের সংকট : কন্সট্যান্টাইনের জন্ম হয়েছিল ২৮৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তার বাবা ছিলেন ইলিরিয়ার গভর্নর। তার জন্মস্থানের নাম ছিল নেইসাস, আধুনিক যুগে যার নাম হয়েছিল নিশ। জায়গাটি যুগােস্লাভিয়ায়। তাই তিনি হলেন আরেকজন বিখ্যাত ইলিরিয়ান। তার জন্মের অবশ্য বৈধতা ছিল না কারণ তার মা ছিলেন একজন দরিদ্র হােটেল ম্যানেজার এবং কন্সট্যান্টাইনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। (কন্সট্যান্টিয়াস যেহেতু শেষের দিকে জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্রিটেন কাটিয়েছিলেন, তাই এরকম গল্প প্রচলিত হয়েছিল যে সেই মহিলা ছিলেন ব্রিটেনের রাজকুমারী, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।) কন্সট্যান্টাইন তার তরুণ জীবন কাটিয়েছিলেন ডিওক্লেশিয়ানের রাজপুরীর ভেতরে। সম্রাট তাকে এমনভাবে চোখে চোখে রাখতেন যেন তিনি কিছুতেই খারাপ কিছু শিখতে না পারেন। ডিওক্লেশিয়ান ক্ষমতা ছেড়ে দেবার পর কন্সট্যান্টাইন গ্যালেরিয়াসের যত্নে বেড়ে ওঠেন। যদিও দুইদিক দিয়েই সন্দেহের অনেক কারণ ছিল কিন্তু কন্সট্যান্টিয়াস বেঁচে থাকতে তার ছেলের কোনাে ক্ষতি হবে না এটাই তিনি ভাবতেন। কিন্তু কন্সট্যান্টাইনের কাছে যখন তার বাবার অসুস্থতার সংবাদ এসে পৌঁছল তখন তিনি বুঝেছিলেন যে গ্যালেরিয়াস এখন তাকে জীবিত না দেখে মৃত দেখলেই বেশি খুশি হবেন। কন্সট্যান্টাইন তখন দ্রুত নিজের নিশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ইউরােপ অতিক্রম করে, সঙ্গীসাথী ছাড়াই ব্রিটেন পৌঁছলেন। তিনি তার বাবার মৃত্যুর আগে তার কাছে পৌঁছে নিজেকে সম্রাট ঘােষিত করতে চেষ্টা করছিলেন। কন্সট্যান্টাইন, গ্যালেরিয়াসের বিপক্ষে নিজের অবস্থান পাকাপােক্ত করতে আরও কিছু পদক্ষেপ নিলেন। ৩০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বৃদ্ধ সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানের কন্যাকে বিয়ে করলেন। সাথেসাথেই তিনি একজন যুগ্ম সম্রাট হিসেবে ঘােষিত হলেন। গ্যালেরিয়াসের জন্য তখন সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে ছিল তিন তিনজন হুমকি। ম্যাক্সেমিয়ান, তার ছেলে ম্যাক্সেনটিয়াস এবং তার মেয়ের স্বামী কন্সট্যান্টাইন। তিনি ইতালিতে নিজের জায়গা করে নিতে চেষ্টাও করেন একবার কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়ে সরে যেতে বাধ্য হন। শেষপর্যন্ত ৩১০ খ্রিস্টাব্দে ডিওক্লেশিয়ানকে একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্য গ্যালেরিয়াস অনুরােধ করলেন।
সম্রাট হিসেবে লিসিনিয়াসের আগমন এবং ম্যাক্সিমিন ও ম্যাক্সেন্টিয়াসের দ্বারা গৃহযুদ্ধের সূচনা, পরাজয় ও মৃত্যু : শেষবারের মতাে ডিওক্লেশিয়ান কোনাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ম্যাক্সিমিয়ানকে কার্যালয় থেকে বিতাড়িত করলেন এবং সে জায়গায় লিসিনিয়াসকে (রা. ৩০৮-২৪ খ্রি.) বসালেন। লিসিনিয়াস হয়ে গেল পশ্চিম অংশের সম্রাট। কন্সট্যান্টাইন তার যুগ্ম সম্রাটের আসন পােক্ত হতে দেখেই খুশি ছিলেন। ম্যাক্সিমিয়ানকে এভাবে অপমানিত হতে হলাে দ্বিতীয়বারের মতাে। সাধারণভাবেই তার ভীষণ আপত্তি এবং প্রতিহিংসা ছিল। এইসব ঘটনার পরে নিজের শ্বশুরকে হত্যা করা ছাড়া তার কাছে আর কোনাে উপায় ছিল না। ৩১১ খ্রিস্টাব্দে (১০৬৪ সালে) গ্যালেরিয়াসের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ম্যাক্সিমিন ডাইয়ার (রা. ৩১০-১৩ খ্রি.) আবির্ভাব হয়। ম্যাক্সিমিন ডাইয়া খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের হত্যার ব্যাপারে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। এভাবে নিজের প্রতাপের পরিচয় দিয়ে তিনি ইতালিতে শাসনের অধিকারে বসা ম্যাক্সেনটিয়াসের সাথে একটি চুক্তিতে আসেন। এভাবে আরেকটি নতুন গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। ইতালিতে ম্যাক্সেনটিয়াস এবং এশিয়া মাইনরে ম্যাক্সিমিন ডাইয়া, গাউলে অবস্থানকারী কন্সট্যান্টাইন এবং দানিয়ুবের তীরবর্তী প্রদেশের লিসিনিয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কন্সট্যান্টাইন ৩১২ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে প্রবেশ করেন। এটা ছিল তৃতীয়বারের মতাে ম্যাক্সেনটিয়াসকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে কোনাে সেনাবাহিনীর ইতালিতে প্রবেশ। কিন্তু আগের দুবারের মতাে কন্সট্যান্টাইন পরাজিত হননি, তিনি ম্যাক্সেনটিয়াসকে হারিয়ে দিলেন এবারে। পাে উপত্যকার কাছে তাকে পরাজিত করে কন্সট্যান্টাইন রােমের দিকে রওনা দিলেন। এই যুদ্ধের আগে কন্সট্যান্টাইন (পরের খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী) আকাশে একটি উজ্জ্বল ক্রুশ দেখতে পান। এটিকে তারা বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে বর্ণনা করেন। এটি কন্সট্যান্টাইনকে সেনাদের ঢালের উপরে একটি করে ক্রুশচিহ্ন বসিয়ে দিতে উৎসাহিত করে। এরপরে সফলতার উদ্দেশ্যে তাদের যুদ্ধে ঠেলে দেন। ম্যাক্সেনটিয়াসের বাহিনীও মারা পড়েছিল এবং ম্যাক্সেনটিয়াসকেও হত্যা করা হয়। কন্সট্যান্টাইন পশ্চিমের অধিপতি হয়ে যান এবং সিনেটের মাধ্যমে সম্রাট ঘােষিত হন। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে লিসিনিয়াস ম্যাক্সিমিন ডাইয়াকে পূর্বদিকের প্রদেশে পরাজিত করেন। তাকেও হত্যা করা হয়।
কনস্ট্যান্টাইনের খ্রিস্টধর্মের উন্নয়ন, আইনসিদ্ধ ধর্মে পরিণত করা ও ধর্মান্তর : কন্সট্যান্টাইন মাথার ওপরে স্বর্গে যখন ক্রুশের ছবি দেখেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল তিনি হয়তাে খ্রিস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে গেছেন। হয়তােবা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন হয়নি। কন্সট্যান্টাইন আগাগােড়া বিচক্ষণ একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। সম্ভবত তিনি তখন টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্মই হবে প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তিনি এটি বুঝতে পারার পরই সিদ্ধান্ত নেন, যে দিকটা জনগণের মধ্যে এত প্রকট হয়ে উঠছে সে দিকটার কিছু উন্নতি বিধান তার করা উচিত। তিনি খ্রিস্টান নিধন বন্ধ করেন। তিনি বলতে গেলে খ্রিস্টানদের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু ধর্মান্তরিত হননি। তারপর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এলে যখন তিনি ভাবলেন যে এতে কোনাে সমস্যা নেই, তখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। (হাজার হলেও তার রাজত্বের প্রায় সমাপ্তি পর্যন্ত খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘুই ছিল।) কন্সট্যান্টাইন তার বাবার মতােই সূর্যদেবতার উপাসনা করতেন। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় তখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহ প্রকাশ করেন। ব্যাপ্টাইজেশনের মাধ্যমে তিনি জীবনের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান এবং মনে করেন যে সব শাস্তি থেকে তার মুক্তি ঘটুক যখন কিনা তার আর কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। লিসিনিয়াস ম্যাক্সিমিন ডাইয়াকে পূর্বদিকের প্রদেশে পরাজিত করে ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে (১০৬৬ রােমান সালে) কন্সট্যান্টাইনের সাথে মিলানে একটি সভার আয়ােজন করেন। সেখানে কন্সট্যান্টিয়ান এবং লিসিনিয়াস “মিলান চুক্তি” নামে একটি নিয়ম চালু করেন। তারা সাম্রাজ্যব্যাপী সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার আইন পাশ করেন। তারপর থেকে খ্রিস্টানেরা খােলামেলাভাবে তাদের উপাসনার কাজ চালিয়ে যেতে পারত। বস্তুত তখন থেকেই খ্রিস্টধর্ম একটি আইনসিদ্ধ ধর্মে পরিণত হলাে।
ডিওক্লেশিয়ানের মৃত্যু : সেই একই বছরে ডিওক্লেশিয়ান মৃত্যুবরণ করেন। তার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানাের পর থেকেই উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করতে গিয়ে সাম্রাজ্যে যেন তিনি গৃহযুদ্ধ লাগানাের নেশায় মেতে ছিলেন। আর খ্রিস্টানদের সাম্রাজ্য থেকে বিদায় করা হয়ে উঠেছিল তার আরেক নেশা। কিন্তু এর কোনাে কুফলই তাকে ছোঁয়নি। তিনি তার সুদৃশ্য রাজপ্রাসাদে জীবনের শেষ দিনগুলাে আনন্দেই কাটিয়েছেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ম্যাক্সিমিয়ান একটি চিঠিতে ডিওক্লেশিয়ানকে আহ্বান জানিয়েছিলেন যেন তিনি ফিরে এসে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং শান্তি আনার চেষ্টা করেন। তখন ডিওক্লেশিয়ান সে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “তােমরা কি একবার সালােনায় এসে আমার বাগানটা দেখে যেতে পার যেখানে আমি নিজ হাতে সবজি লাগিয়েছি? এই সাম্রাজ্যের ক্ষমতার কথা আমাকে আর বলাে না।” বুদ্ধিহীন, ক্ষমতালােভী ম্যাক্সিমিয়ান শেষ পর্যন্ত ভীষণ বেদনাদায়ক মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন যেখানে কিনা ডিওক্লেশিয়ান মারা যান পরম শান্তিতে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জ্ঞানী মানুষ হিসেবে মর্যাদায় আসীন ছিলেন।
ডোনাটিজম ও আরিয়ানিজমের বিকাশ, এদের বিরুদ্ধে ঘোষণা ও নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব
কনস্ট্যান্টাইনের বিরুদ্ধে লিসিনিয়াসের যুদ্ধ, পরাজয় ও মৃত্যু এবং একক ক্ষমতায় কনস্ট্যান্টাইন : প্রথম কন্সট্যান্টাইনের জন্য এক সময় সাম্রাজ্য বােঝা হয়ে দাড়াল। লিসিনিয়াস তার সাথে আলােচনায় বসলেন এবং ভাগ্যের পরিহাসে ভালাে একটা কোনাে ফলাফল এলাে না। শাসকেরা একে অন্যের প্রতি বৈরী হয়েই রইল। কন্সট্যান্টাইন যখন খ্রিস্টানদের প্রতি বেশি ঝুঁকে গেলেন, ঠিক তখন লিসিনিয়াস যেন তার বিরােধিতা করার জন্যই খ্রিস্টান বিরােধী আচরণ করা শুরু করলেন। ৩১৪ এবং ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায় পরপর দুবার। দুবারই লিসিনিয়াস পরাজিত হন। লিসিনিয়াসকে হত্যা করা হলাে, যেন কন্সট্যান্টাইন একাই পুরাে সাম্রাজ্যের উপরে কর্তৃত্ব করতে পারেন।
নতুন নিয়ম-কানুন প্রচলন : কন্সট্যান্টাইন তারপরে ডিওক্লেশিয়ানের পদানুসরণ করে রাজ্যে নতুন নতুন নিয়মকানুন প্রচলনের ব্যাপারে মনােযােগী হলেন। ডিওক্লেশিয়ানের বেশিরভাগ নিয়মগুলােকেই একটু এদিক-ওদিক করে তিনি চালু করার চেষ্টা করলেন। যেমন, কন্সট্যান্টাইন সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশগুলােতেও তার একচ্ছত্র এবং প্রত্যক্ষ শাসনের প্রমাণস্বরূপ ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে সব জায়গায় মুকুট চিহ্নিত মার্কাটি ছড়িয়ে দিলেন। সেটা ছিল একটি সরু, সাদা, মাথার ওপরে বাঁধার কাপড়ের টুকরাে যেটা কিনা পারস্যের সর্বোচ্চ সম্মানিত কার্যালয় থেকে দেয়া হতাে। এবারে উত্তরাধিকারী সম্রাটের গুনে সেই কাপড়ের টুকরােটিতে আরও জাঁকজমক এলাে। এটিকে এখন সত্যিই রাজকীয় বলা যেতে পারে। এর আগে সেটি ছিল হালকা বেগুনি, রাজকীয় রঙ যাকে বলে, আর তার ওপরে মুক্তো খচিত নকশা। কন্সট্যান্টাইন অবশ্য ডিওক্রেশিয়ানের কিছু নিয়মকানুনের ছােটখাটো পরিবর্তনও করলেন। বড় যে পরিবর্তনটি আনলেন তা হলাে, কৃত্রিমভাবে অগাস্টাস আর সিজার পদবী দিয়ে মানুষকে উত্তরাধিকারী বানানাের পদ্ধতি বন্ধ করে নিজের পুত্রকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হবার সুযােগ দেয়ার কথা ঘােষণা করলেন। অন্যান্য অসভ্য জাতি থেকে মানুষ এনে সেনাবাহিনীতে নিয়ােগের নিয়ম তিনি বহাল রাখলেন। পাশাপাশি যেসব স্থানে জনসংখ্যা খুবই কম, সেসব জায়গায় তাদের বসবাস করতে উৎসাহিত করলেন। সাধারণভাবে ভাবলেই বােঝা যায় যে, এই পদক্ষেপটি রােমের জন্য সফল বা সুখকর হতাে যদি না রােমের সংস্কৃতি এত অন্যরকম না হতাে। রােমের সংস্কৃতির এমন একটি মাত্রা ছিল যেখানে বাইরে থেকে চট করে কোনাে রীতিনীতি প্রবেশের কোনাে সুযােগ ছিল না। রােমের সংস্কৃতি কখনােই বাইরের মানুষের সংস্কৃতিকে স্বাগত জানায়নি।
খ্রিস্টানদের পক্ষে আইনগত পরিবর্তন, পৃষ্ঠপোষকতা ও বিশপদের জন্য বিচারালয় প্রবর্তন : কন্সট্যান্টাইনের সময়টা ছিল আইনগত কিছু পরিবর্তনের জন্য স্মরণযােগ্য। যতগুলাে পরিবর্তন তিনি এনেছিলেন বেশিরভাগই খ্রিস্টানদের পক্ষে গিয়েছিল। বন্দী এবং দাসদের প্রতি আইনের মনােভাব আগের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক হয়েছিল। কিন্তু অন্যদিকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাজকর্মের (বিশেষ করে যৌন) ওপর আগের চেয়েও কঠোর আইন করেছিলেন। তিনিই প্রথম রবিবারকে একটি বিশ্রামের দিন হিসেবে আইনত ঘােষণা দেন। কিন্তু আরেকদিকে ধর্ম অনুযায়ী রবিবার ছিল ঈশ্বরের জন্য বরাদ্দ। কন্সট্যান্টাইন নিজে খ্রিস্টান না হয়েও একজন খ্রিস্টানধর্মের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে কাজ করেছেন। একসময় তিনি চার্চে কী হয় না-হয় সেসব বিষয়ে জানতেও আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। আগে এক চার্চের সাথে আরেক চার্চের ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত। এক বিশপ আরেক বিশপকে নিয়মনীতির জন্য নানা চাপ প্রয়ােগ করতেন। স্বাভাবিকভাবেই যিনি তর্কে জিততেন তিনি অপর পক্ষকে তার ধারণা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করতেন। কন্সট্যান্টাইন একটি বিচারালয়ের প্রবর্তন করলেন যেখানে বিশপেরা এসে নিজনিজ মত প্রকাশ করতে পারবেন এবং উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে মাননীয় সম্রাট রায় দেবেন। তারপরে যে দল জিতে যাবে তারা অবশ্যই তাদের মত প্রতিষ্ঠা করার সুযােগ পাবে।
কার্থেজীয় চার্চের ডোনাটিজম নিয়ে বিতর্ক, তাদের বিরুদ্ধে কনট্যান্টাইনের মত, ইসলামের আগমন পর্যন্ত এদের অস্তিত্ব : কন্সট্যান্টাইনের রাজত্বের প্রথমদিকে আফ্রিকার তুলনামূলক অসভ্য খ্রিস্টানদের নব্যতন্ত্রের মাধ্যমে চার্চের নিয়মকানুন নানান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পর্যায়টিকে বলা হতাে ডােনাটাস। কার্থেজের বিশপ এজন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। কন্সট্যান্টাইন বিচারালয় স্থাপনের পর প্রথমেই যে বিচারটি করতে বাধ্য হন তা হলাে সাধারণ বিশপদের সাথে ওই ডােনাটাস বিশপের মতপার্থক্যজনিত কারণে সংগঠিত সমস্যা নিয়ে। সেখানে মূল বিষয় হিসেবে উঠে এলাে যে একজন অযােগ্য মানুষ কি ধর্মগুরু হতে পারবে কি না। ডােনাটিস্টরা ছিল আধুনিক। তারা মনে করত চার্চ একটি পবিত্র জায়গা, বিধায় একজন ধর্মগুরু ততক্ষণই সম্মানজনকভাবে অবস্থান করতে পারেন যতক্ষণ তিনি কোনাে অনৈতিক কাজে যুক্ত না হচ্ছেন। যেমন ডিওক্লেশিয়ান এবং গ্যালেরিয়াসের আমলে খ্রিস্টান নিধনের নামে চার্চে যে অত্যাচার চালানাে হয়েছিল, তখন অনেক ধর্মগুরু ছিলেন যারা নিজেদের জীবন বাঁচানাের তাগিদে তাদের অধীনে থাকা পবিত্র বইগুলাে পােড়ানাের জন্য দিয়ে দিতে বাধ্য হন। যখন সেই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের অবসান ঘটে, তারা নিজনিজ চার্চে ফিরে গিয়ে আবার ধর্মগুরুর আসনে বসতে চান। এখন প্রশ্ন হলাে, তারা কি তখন আর সেই কাজের উপযুক্ত? আধুনিক বিশপেরা মনে করেছিলেন যে ধর্মগুরু যিনিই হন না কেন, তিনি অবশ্যই একজন মানুষ। মৃত্যুর মুখে একজন মানুষ যেমন নিজেকে বাঁচানাের সর্বাত্মক চেষ্টা করেন, তিনিও করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এরকম একটি পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করারও নিয়ম ছিল। এছাড়া এরকম একজন পাপী মানুষকে দিয়ে যদি অহেতুক চার্চের মতাে একটি মহান প্রতিষ্ঠান চালানাে হয় তবে তার মাহাত্য ক্ষুন্ন হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তখন এরকম একটি নড়বড়ে প্রতিষ্ঠানের উপরে কি কেউ আস্থা রাখতে পারবে? কী করে একজন সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হতে পারবে যে চার্চের ধর্মগুরুটি যােগ্য? খ্রিস্টানেরা এভাবেই চার্চকে রক্ষা করতে লাগল যে এটি একটি পরম পবিত্র প্রতিষ্ঠান। আর এর আধ্যাত্মিক শক্তি এতই বেশি যে একজন সঠিক মানুষের পরিচালনায় না চললেও এর মহিমা এতটুকু কমে না। কার্থেজে আফ্রিকান নব্যতন্ত্রে বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের মধ্যে এই ধরনের কোনাে পরিবর্তন আনার মতাে কোনাে ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারা ছাড়া যারা পরিবর্তন চায়, তারা ৩১৬ সালে কন্সট্যান্টাইনের কাছে আবেদন করল। আদালত নব্যতান্ত্রিকদের বিরুদ্ধে রায় দিলাে। কন্সট্যান্টাইন নিজে উপস্থিত থেকে দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শােনার পরে এ সিদ্ধান্ত নিলেন। এটি কারও জন্যই ভালাে হলাে না। প্যাগান ধর্মানুসারী সম্রাটেরা যেমন খ্রিস্টানদের সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি, তেমনি খ্রিস্টান সম্রাটেরাও হাজার চেষ্টা করেও নব্যতন্ত্রের উৎপাটন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সংখ্যায় কমতে থাকল কিন্তু কখনােই পুরােপুরি উবে গেল না যতদিন পর্যন্ত আরবের ঔপনিবেশিক শক্তি এসে তাদের সার্বিকভাবে বিনষ্ট করেনি বা তাদেরকে ইসলামে অন্তর্ভূক্ত করেনি। তারা আফ্রিকার উত্তর দিকের নব্যতান্ত্রিকদের এবং প্রাচীনপন্থী খ্রিস্টানদের একইরকমভাবে উৎপাটন করেছিল।
সম্রাটের চার্চের প্রধান হয়ে ওঠা, চার্চের সাথে সরকারের সংমিশ্রণ : এছাড়াও তখন কন্সট্যান্টাইনের আদর্শ তেমনভাবে অনুসরণ করা গেল না বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। সম্রাট তখন চার্চের প্রধানের মতাে করে কাজ করতে শুরু করল এবং চার্চের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি মেনে নিলেন। এটাই ছিল চার্চ এবং বিদ্যমান সরকারের মধ্যে এক ধরনের মতপার্থক্য কিংবা মতৈক্যের অবস্থান যেটা তখন থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখনও চলছে। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্টাইন যখন সাম্রাজ্যে সকল মতের উর্ধ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছিলেন, তখন তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি তার সহানুভূতি বেশ জোরেসােরেই প্রকাশ করছিলেন। তিনি বিশপদের একসাথে ডেকে একটি সভা করেছিলেন যেখানে তাদের মধ্যে বিরােধ মিটিয়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বিশপদের অধীনে চার্চের পুরাে ব্যবস্থা ছেড়ে দেয়ার নিয়ম তখন পুরনাে হয়ে গেছে। আবার প্যাগান সম্রাটদের অধীনে এভাবে চাষ্ট্রে কার্যক্রম চালানােও কারও কারও জন্য নিরাপদ মনে হতাে না। তারা চার্চের মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের বিষয়টা নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারতেন না। এবারে অবস্থাটা বদলে গেল। সমস্ত বিশপদের অনুরােধ করা হলাে সাম্রাজ্যের সরকারি নিরাপত্তার আওতায় আসার জন্য। এটাই ছিল পৃথিবীব্যাপী চার্চের সাথে সরকারের সংমিশ্রণের প্রথম ধাপ।
ট্রিনিটির বিরুদ্ধে আরিয়ানিজম, নাইকিয়ার কাউন্সিলে তাদের বিরুদ্ধে রায় ও নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব : ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে বিশপেরা বির্থিনিয়ার নাইকিয়া শহরে জমায়েত হলেন। শহরটি ছিল ডিওক্লেশিয়ানের রাজধানী এবং তখন ছিল কন্সট্যান্টাইনের। এটা ছিল এমন একটি জায়গায় যেখান থেকে সহজেই অ্যালেক্সান্দ্রিয়া, আন্টিয়ক এবং জেরুজালেমে পৌঁছে যাওয়া যায়। পশ্চিম দিকটা নিয়ে কেউ ভাবত না কারণ সেসব জায়গা ছিল অনেক দূর আর স্পেনে তাদের জন্য অনেক বিশপ ছিল। তাদের সভার আলােচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল আরিয়ান নব্যতন্ত্র। অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট খ্রিস্টান ধারার নাম ছিল আরিয়ানিজম, ধর্মগুরু আরিয়াসের নাম অনুসারে। তখন প্রায় আগের দশক ধরে একনায়কের মতাে নিজস্ব মতামতে মানুষকে দীক্ষিত করে আসছিল। তার মতে একজনই মাত্র সৃষ্টিকর্তা আছেন এই মহাবিশ্বে এবং এখানকার সমস্ত কিছুই তার সৃষ্টি। তাদের মতে যিশুও সেই সৃষ্ট জিনিসগুলােরই একটি এবং তার অস্তিত্বও সীমিত। এই ভাষ্যমতে যিশু নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারেন না। এটাকে অন্যভাবে বললে, যখন যিশুর কোনাে অস্তিত্ব ছিল না, তখনও সেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে সেই সৃষ্টিকর্তার কিছু কিছু বিষয় ছিল যা যিশুর স্বভাবের সাথে মেলে কিন্তু কিছুতেই একবারে একভাবে তাদের বর্ণনা করা যায় না, অর্থাৎ ঈশ্বর ও যিশু এক ও অভিন্ন নয়। এই মতাদর্শের অনুসারীরা প্রথমে অ্যালেক্সান্দ্রিয়ায় এবং তারপর ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ল। এর বিরুদ্ধে যে দলটি ছিল তারা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করতো, এই দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আলকজান্দ্রিয়ার ডিকন অ্যাথানাসিয়াস। তারা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করতেন, তাদের মতে ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর “ফাদার”, যিশু বা “পুত্র” এবং মানুষের প্রকৃতিতে কার্যকর থাকা “হলি স্পিরিট” এই তিনে মিলে হলো ট্রিনিটি, এই ট্রিনিটির তিনটি অংশই ঈশ্বরের সমান তিনটি দিক, এই তিনটি অংশ কেবল একই নয়, সেই সাথে এরা সকলেই শাশ্বত বা নিত্য যাদের কখনও সৃষ্টি করা হয়নি, এবং এই তিনটি অংশ একে অপরের সাথে অভিন্ন। আরিয়ানের দল এবং অ্যাথানিয়াসের দলের মধ্যে মতপার্থক্য এতই বেড়ে গেল যে একদল বিশপ আরেকদল বিশপকে ক্রমাগত অভিশাপ দিতে লাগল। কন্সট্যান্টাইন এই বিষয়টিকে ভীষণ বিরক্তির সাথে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি যদি খ্রিস্টানদের চার্চের এই ক্ষমতা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন তবে সাম্রাজ্যে আরও বেশি প্রভাব খাটাতে পারতেন। কিন্তু সম্রাট হিসেবে তিনি চার্চে চার্চে এই বিবাদকে পুঁজি করে কিছুই করেননি। তিনি হয়তাে চেষ্টা করলে এই বিবাদ তখনই মিটিয়েও ফেলতে পারতেন। এই কারণে তিনি প্রথমে নাইকিয়া শহরে সভা ডাকলেন, ৩২৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত টানা সভা চলল। তারা শেষে অ্যাথানিয়াসের পক্ষে রায় দিলেন। এই মর্মে একটি সরকারি আদেশ জারি হলাে, যাকে বলে “নাইকিয়ার চুক্তি”। এই চুক্তি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে অ্যাথানিয়াসের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রভাবশালী বলে বর্ণনা করে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা এটি মেনে চলবে বলে ধারণা করা হয়। এটাই সব চার্চের ক্ষেত্রে একটি বাঁধাধরা নিয়ম হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এভাবেই অ্যাথানাসিয়ানদের অবস্থান পােক্ত হলাে। তখন থেকে এই ধারার খ্রিস্টধর্মকে নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্ম বলা হয়। ক্যাথোলিক চার্চ, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ সহ বিভিন্ন ধারার খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তি পরবর্তীতে এখান থেকেই হয়।
আরিয়ানদের শক্তিশালী হয়ে ওঠা, পশ্চিম ও পূর্ব দিকে যথাক্রমে নাইসিনীয় ও আরিয়ানীয় খ্রিস্টধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ : যদিও নাইকিয়ার চুক্তি সে সময় তেমন ভালাে কোনাে ফল বয়ে আনেনি। যারা এই দলে আরিয়ান হিসেবে যােগ দিয়েছিল তারা আরিয়ান হিসেবেই ছিল এবং তাদের নিজেদের অবস্থান বলতে গেলে জোর করেই টিকিয়ে রেখেছিল। অবশ্য কন্সট্যান্টাইন নিজেও একসময় আরিয়ানদের অবস্থান পােক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। অথবা অন্তত নিকোমেডিয়ার বিশপ ইউসেবিয়াস এবং আরেকজন আরিয়ানের নেতাসহ কন্সট্যান্টাইনদের উপরে তাদের প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করছিল। তখন অ্যাথানিয়াসদের জোর করে ফাঁসিতে ঝােলানাে হলাে। পূর্বদিকে এই বিতর্ক অর্ধশতাব্দী ধরে তেমনই চলতে লাগল। বিভিন্ন সম্রাটেরা নাইসিনীয়দের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আরিয়ানদের পক্ষে কথা বলে যেতে লাগল। এই অবস্থা সাম্রাজ্যের পূর্ব এবং পশ্চিম দিককে নতুন করে যেন দুই ভাগে বিভক্ত করে দিলাে। এমনিতেই পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে ভাষার পার্থক্যের জন্য আগে থেকেই দুটি ভাগ ছিল। পূর্বদিকে গ্রিক আর পশ্চিমে ল্যাটিন। এরপর আবার রাজনৈতিকভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে দুজন পৃথক সম্রাট ছিলেন। এখন সর্বশেষ বিভক্তির ধারক হিসেবে এলাে ধর্ম। পশ্চিম দিকের মানুষেরা কট্টরভাবে নাইসিনীয় রয়ে গেলেন, যখন কিনা পূর্বদিকে ব্যাপক হারে মানুষ নব্যতান্ত্রিক আরিয়ানদের পক্ষে যােগ দিলেন। এটাই ছিল ধর্মীয় মূল্যবােধের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভক্তির প্রথম ধাপ। এরপর ধীরে ধীরে পরের সাতটি শতক ধরে পূর্ব আর পশ্চিম দিকের খ্রিস্টধর্ম আরও পৃথক হয়ে গেল এবং তারা স্থায়ীভাবে আলাদা দুটো ধারা তৈরি করল।
কন্সট্যান্টিনােপল প্রতিষ্ঠা ও পূর্বের কনস্ট্যান্টিনোপল ও পশ্চিমের রোমের পেট্রিয়ার্কের দ্বন্দ
পূর্ব দিকের গুরুত্ব বৃদ্ধি ও রাজধানীর প্রয়োজনীয়তা : নাইকির চুক্তি বহাল থাকার সময়ে কন্সট্যান্টাইন এই বিষয়গুলাে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখতেন। যেখানে ডিওক্লেশিয়ান সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে স্বৈরাচারের একটি আদল দিয়েছেন, সেখানে রাজধানী বলতে সত্যিকারের রােমকে বােঝানাে হতাে না। সম্রাট যেখানে থাকতেন সে জায়গাই রাজধানীর মর্যাদা পেত। তাই সম্রাটের অবস্থান অনুযায়ী রাজধানীর অবস্থান বদলে যেত। এক প্রজন্ম পরেও তখন ডিওক্লেশিয়ান, গ্যালেরিয়াস এবং কন্সট্যান্টাইনের আমলের পরে রাজধানী যেন পূর্বদিকে প্রধানত নিকোমেডিয়ায়ই অবস্থান নিয়েছিল। পূর্বদিকই ছিল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী, ধনী এবং প্রধান অংশ। সে সময়ে সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল সবচেয়ে নড়বড়ে। ভাগ্যিস গথ আর পার্সিয়ানরা নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল তাই সম্রাটদের সেখানে উপস্থিত হতে হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও নিকোমেডিয়াই ছিল সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। কন্সট্যান্টাইন এই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছিলেন এবং তাই তিনি রাজধানীকে প্রাচীন শহর বাইজ্যান্টিয়ামে স্থানান্তরের কথা ভাবছিলেন। হাজার বছর আগে গ্রিকরা বাইজ্যান্টিয়াম শহর গড়েছিল (ইতিহাসে উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৭ সালে, রােমান ৯৬ সাল)। এই শহরের একটি জমজমাট অবস্থান ছিল একসময়। শহরটি ইউরােপের দিকে বসফোরাসের পাশে নিকোমেডিয়ার পঞ্চাশ মাইল পশ্চিমদিকে অবস্থিত ছিল। এটা ছিল সমুদ্রের একটি সরু অংশ, কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ধনী এবং জনবহুল দেশ গ্রিস, এশিয়া মাইনর এবং সিরিয়ায় বাণিজ্যের কারণে পৌঁছতে হলে সব জাহাজকেই সেই সরু নালা অতিক্রম করতে হতাে।
বাইজান্টিয়াম শহরের ইতিহাস : বাইজান্টিয়াম শহর হিসেবে গড়ে ওঠার পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ হিসেবে এর মূল্য বুঝতে পেরেছিল। তাই সেভাবে শহরটি উন্নতির দিকেও এগিয়েছিল। এই শহরটি হয়তাে আরও অনেক বেড়ে উঠত যদি না তার চেয়ে ক্ষমতাশালী বড় শক্তির আক্রমণের শিকার না হতাে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০ সাল পর্যন্ত, অ্যাথিনিয়ানদের উত্থানের সময়টাতে এথেন্স পুরােপুরিভাবে কৃষ্ণসাগর বেয়ে আসা খাদ্যসামগ্রীর উপরে নির্ভরশীল ছিল। তাই এথেন্স চাইল বাইজান্টিয়ামের কর্তৃত্ব; প্রথমে পারস্যের সাথে, তারপর স্পার্টার সাথে এবং সবার শেষে ম্যাসিডনের সাথে দ্বন্দ্বের জন্য। বাইজান্টিয়ামের সব সময়ে আক্রমণকারী শক্তিগুলাের মােকাবেলা করার শক্তি ছিল। এর একটি প্রধান কারণ এর অবস্থান। এর তিনদিকে সমুদ্র থাকায় একে একদিক থেকে আক্রমণ করে কোনাে সুবিধা করা যাচ্ছিল না। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ সালে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের পিতা ম্যাসিডনের ফিলিপ যখন সেখানে আক্রমণ করেছিল তখন বাইজান্টাইন খুব সহজেই তা প্রতিহত করেছিল। এটি ছিল ফিলিপের খুব অল্পকিছু পরাজয়ের একটি। বাইজান্টাইন প্রবল পরাক্রমশালী রােমান সাম্রাজ্যের দূরবর্তী একটি প্রদেশ হিসেবে যােগ দেয়। রােমানরা যখন পূর্বদিকে দাপটের সাথে শাসন করছিল তখন এটি একটি নিজস্ব পরিচালনায় সফল দেশ হিসেবে সাম্রাজ্যের সাথে যােগ দেয়। তখন ভেস্পাসিয়ানের শাসনামল চলছিল। ভেস্পাসিয়ান নিজস্ব দক্ষতায় পরিচালিত প্রদেশগুলাের শাসন নিজের হাতে তুলে নেন। তখন এশিয়া মাইনরের সাথে বাইজ্যান্টিয়ামও রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। কমােডাসের মৃত্যুর পরে বাইজ্যান্টিয়ামে কঠিন সময় আসে। এটি তখন নিগারদের বিরুদ্ধে সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের সংগঠিত যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে যায়। সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস ১৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই শহরটি দখলে নিতে সক্ষম হন।
বাইজান্টিয়াম শহর থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল : এরপর কন্সট্যান্টাইনের চোখ যখন এই শহরের উপরে পড়ে তখন এটি আবার নতুন করে তৈরি করা হয়। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে এটি তার হাতে পড়ে এবং তখন লিসিনিয়াসের সাথে তার যুদ্ধ চলছিল। এই শহরের কার্যকারিতা এবং সম্ভাবনা নিয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। নিইকিয়ার সভার পরপর কন্সট্যান্টাইন বাইজান্টিয়াম শহরকে বাড়ানাের কাজে মনােযােগ দেন। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক এবং স্থাপত্যবিদ এনে শহরটি ঢেলে সাজানাের কাজে মনােনিবেশ করেন। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। কন্সট্যান্টাইনের পছন্দমতাে কাজগুলাে করার জন্য সাম্রাজ্যের ভেতরে ততটা দক্ষ মানুষ এবং প্রয়ােজনীয় উপাদান পাওয়া যাচ্ছিল না যাতে করে শহরটিকে তিলােত্তমা করে গড়ে তােলা যায়। তাই কন্সট্যান্টাইনের কাছে এরপর যা সহজ মনে হয়েছিল তিনি তাই করেছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রাচীন শহর থেকে বিখ্যাত মূর্তিগুলাে উঠিয়ে নিয়ে বাইজান্টিয়ামে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করা শুরু করলেন। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দের (রােমান ১০৮৩ সাল) মে মাসের ১১ তারিখে এই শহরটি নতুন রাজধানী হিসেবে ঘােষিত হয়। এটির নামকরণ হয় “নােভা রােমা” (নতুন রােম) অথবা “কন্সট্যান্টিনাে পােলিস” (কন্সট্যান্টাইনের শহর)। পরের নামটিই ল্যাটিন ভাষায় কন্সট্যান্টিনােপলিস এবং ইংরেজিতে কন্সট্যান্টিনােপল নামে পরিচিত হয়। আদি রােমের মতাে সমস্ত নিয়মকানুনও এখানে বহাল ছিল। নানারকমের খেলাধুলার প্রতিযােগিতা, এমনকি জনগণের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ পর্যন্ত সেখানে চলছিল। তার দশ বছর পরে কন্সট্যান্টিনােপলে রােমের সিনেট বসানাে হয় যা আসলে ছিল আগের চেয়েও অকার্যকর।
কন্সট্যান্টিনােপলের বিকাশ, প্যাট্রিয়ার্করা ও তাদের ওপর কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রভাব : কন্সট্যান্টিনােপল খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। সম্রাটের বাসস্থান হিসেবে সেখানে বড় বড় সরকারি কর্মচারিদের আনাগােনায় শহরটি রমরমা হয়ে যায়। এটি তখন সাম্রাজ্যের সম্মানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠায় অনেক অভিজাত মানুষ রাতারাতি অন্যান্য প্রদেশ থেকে সেখানে গিয়ে থাকা শুরু করেন। এক শতকের মধ্যেই এটি রােমকে টেক্কা দিয়ে সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তী হাজার বছরের মধ্যে এটি ইউরােপের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বৃহৎ শহর হিসেবে পরিচিত হয়। কন্সট্যান্টিনােপলের উপস্থিতি চার্চের কার্যকলাপকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করত। কন্সট্যান্টিনােপলের সময়ের বিশপেরাও তাকে খুব মানত কারণ সম্রাটের একেবারে কাছাকাছি থাকত শহরটি। কন্সট্যান্টিনােপল তখন বিশাল শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। যার বিশপেরা অন্য সমস্ত বিশপদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য পেতেন। এই বিশপদের বলা হতাে “প্যাট্রিয়ার্ক” যার মানে হলাে “প্রধান ফাদার”। ততদিনে ধর্মগুরুদের “ফাদার” বলে সম্বােধন করার রীতি হয়ে গিয়েছিল। তখন পাঁচ জন প্যাট্রিয়ার্ক ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন জেরুজালেমের বিশপ। বাইবেলের ঘটনাপ্রবাহের সাথে জেরুজালেমের সম্পর্কের কারণে তাকে একজন বিশিষ্ট প্রধান ধর্মগুরু হিসেবে মানা হতাে। অন্য চারজন হলেন রােমান সাম্রাজ্যের আরও চারটি বড় শহরের বিশপ। শহরগুলাে হলাে, রােম, কন্সট্যান্টিনােপল, অ্যালেক্সান্দ্রিয়া এবং অ্যান্টিয়ক। অ্যান্টিয়ক, জেরুজালেম এবং অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্কেরা কন্সট্যান্টিনোেপলের প্রভাবের নিচে চাপা পড়ে মােটামুটি কষ্টেই দিন কাটাতেন। তারা এই বিষয়টি নিয়ে একটু অসন্তোষের মধ্যে ছিলেন। কন্সট্যান্টিনােপলের অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রতি বিরক্ত এবং হতাশ বােধ করে কিছু প্যাট্রিয়ার্ক নাইসিনীয় ভাবনা থেকে সরে এসে এরিয়ানিজমের সাথে যােগ দেন। এই ঘটনায় তাদের একত্র শক্তি আরও কমে যায়। এর পরপরই কন্সট্যান্টিনােপলের প্যাট্রিয়ার্ক কেবল মুখে মুখে নয়, বরং কাগজে কলমে পূর্বদিকের সমস্ত নাইসিনীয় চার্চের প্রধান হয়ে বসেন।
রোমের পেট্রিয়ার্ক, এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্কের সঙ্গে দ্বন্দ্ব :
রােমের প্যাট্রিয়ার্কের জন্য কন্সট্যান্টিনােপলের আইনকানুন মানা অত জরুরি ছিল না। কারণ ছিল দূরত্ব। এছাড়া রােমের প্যাট্রিয়ার্ক ছিলেন একমাত্র ল্যাটিন ভাষাভাষী প্যাট্রিয়ার্ক। পশ্চিম দিকের প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক বলতে ছিল রােমের। সাম্রাজ্যের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন যার নামের সাথে “রােম” শব্দটা উচ্চারিত হতাে। সম্রাট পুরনাে রােম থেকে নতুন রােমের দিকে যাত্রা করলেন বলে আরও বেশি ক্ষমতা, আরও বেশি প্রতিনিধি এবং আরও বেশি ধনদৌলতের সংস্পর্শে আসতে পারলেন। কিন্তু পুরনাে রােমে একটি ব্যাপার রয়েই গেল, তা হলাে রােমের বিশপ। তার পেছনে মদতদাতা হিসেবে ছিল সাম্রাজ্যের সত্যিকারের ধর্মীয় চেতনা, কঠোর নাইসিনীয় দর্শন। এসবকিছু নব্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেন রুখে দাঁড়াত সবসময়। পূর্বদিকের বিতর্কে পরিপূর্ণ অবস্থানের কাছে রােমের চার্চের মতবাদ তাদের কাছে একটি জাতীয়তাবাদের মতাে ভূমিকা রাখল একসময়। পূর্বদিকের গ্রিক মতবাদের মাধ্যমে যারা ধর্মপালন করতে চেয়েছিল তাদের স্থান রােম প্রায় পাঁচশ বছর আগে দখল করে নিয়েছিল। এখন তারাও রােমে এসে পশ্চিমা কায়দায় নিজেদের অবস্থান করে নিতে উৎসাহ পেল। এভাবে শত শত বছরব্যাপী খ্রিস্টধর্মের ধারক হিসেবে রােম আর কন্সট্যান্টিনােপলের বিশপদের মধ্যে লড়াই বেঁধে ছিল। এই লড়াই দিনে দিনে আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে কিন্তু কখনােই কোনাে দল জয়লাভ করেনি।
গথদের বিদ্রোহ দমন ও কনস্ট্যান্টাইনের মৃত্যু : কন্সট্যান্টাইন তার রাজত্বের শেষের দিকে বাধ্য হয়ে আরেকবার একটি অসভ্য জাতির আক্রমণ মােকাবেলা করেন। তৃতীয় শতাব্দীর অরাজকতার পরে সীমানার দিকে আর কোনাে হামলা হয়নি বললেই চলে। ডিওক্লেশিয়ান এবং কন্সট্যান্টাইনের রাজত্বে সেনাবাহিনী এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে তারা সীমানার দিকে কড়া নজর রাখতে সফল হয়েছিল। তখন একটি গৃহযুদ্ধ লেগে গেলেও সেনাবাহিনী সেটি প্রতিহত করতে পারত। ৩৩২ খ্রিস্টাব্দে গথ উপজাতি দানিয়ুবের তীরবর্তী সীমায় আবার আক্রমণ করল। কন্সট্যান্টাইনকে সেখানে ছুটে যেতে হলাে। এবারে কন্সট্যান্টাইন সফলভাবে তাদের প্রতিহত করেছিলেন। গথরা শােচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। তারা লজ্জিত হয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। কন্সট্যান্টাইনের শরীর ততদিনে ভেঙে পড়ছিল। তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সের দিকে স্বাস্থ্যবান ছিলেন কিন্তু তখন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলাে, কন্সট্যান্টিনােপলে তিনি জীবনের শেষ সময়গুলাে কাটাননি। তিনি বায়ু পরিবর্তনের জন্য তার জীবনের শেষ অবসর কাটিয়েছেন পুরনাে নিকোমেডিয়া শহরে। সেখানে একসময় তার শারীরিক অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। তখন তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে (১০৯০ রােমান সালে) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একত্রিশ বছর আগে তিনি ব্রিটেনে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অগাস্টাসের পরে আর কোনাে সম্রাট এত দীর্ঘসময় ধরে সাম্রাজ্যের হাল ধরে থাকেননি। কন্সট্যান্টাইনের সময় খ্রিস্টধর্ম, সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং কন্সট্যান্টাইনােপলকে সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ধরে নেয়া হয়। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকেরা এই অবস্থাকে সম্মান দেখিয়ে তাকে “কন্সট্যান্টাইন দ্য গ্রেট” বলে অভিহিত করেন। কিন্তু সম্রাট যতই পরাক্রমশালী হােক না কেন, রােমান সাম্রাজ্যের ধীর পতন কেউ ঠেকাতে পারেনি। কন্সট্যান্টাইনও ডিওক্লেশিয়ানের মতাে সাম্রাজ্যের পতনকে কিছুটা দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন বটে, তবে থামাতে পারেননি।
দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াস (রা. ৩৩৭ – ৩৬১ খ্রি.)
তিন ভাইয়ের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াসের একক ক্ষমতা গ্রহণ : কন্সট্যান্টাইন বেঁচেছিলেন তার তিন পুত্রের মাধ্যমে। তারা হলেন দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন (রা. ৩৩৭-৪০ খ্রি.), দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াস (রা. ৩৩৭-৬১ খ্রি.) এবং কন্সট্যান্স (রা. ৩৩৭-৫০ খ্রি.)। সাম্রাজ্যটি তাদের তিনজনের মধ্যে ভাগাভাগি করা হলাে। পূর্বদিকের পুরাে অংশটি মেঝাে ছেলে দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াসের অধীনে চলে গেল। পশ্চিম দিকের অংশকে দুই ভাগ করে বড় এবং ছােট ছেলে নিয়ে নিলেন। কন্সট্যান্টাইন পেলেন ব্রিটেন, গাউল এবং স্পেন। কন্সট্যান্স পেলেন ইটালি, ইলিরিয়া এবং আফ্রিকা। এই তিনজন ছিলেন প্রথম রােমান সম্রাট যাদের খ্রিস্টান মতে শিক্ষা দান করা হয়েছিল। এর ফলে সাম্রাজ্যের সব জায়গায় যদি একটি শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন আসত তাহলে খুব ভালাে হতাে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এটি হয়নি। কন্সট্যান্টাইনের ছেলেরা সবাই ছিল খুব নিষ্ঠুর এবং অসচেতন। যেমন বলা যায়, দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াসের ক্ষমতায় বসার পরে প্রথম কাজই ছিল তার দুজন আত্মীয়কে হত্যা করা। তিনি ধরে নিয়েছিলেন তারা সিংহাসন নিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত হতে পারে। অন্য ভাইদের মতাে দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন সবচেয়ে বড় হবার সুবাদে সম্রাটদের প্রধান হওয়ার দাবি জানালেন। কন্সট্যান্স যখন এই দাবি নাকচ করে দিলেন এবং সবার জন্য সমান সম্মান দেয়ার কথা বললেন, দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন ইতালিতে হামলা করলেন। কন্সট্যান্স জিতে গেলেন এবং দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন হেরে গিয়ে ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে হত্যার শিকার হলেন। কিছুদিন পর্যন্ত বাকি দুইভাই সাম্রাজ্য শাসন করলেন। কন্সট্যান্স পশ্চিমে এবং দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াস পূর্বদিকের অংশে। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্স বন্দী হলেন তারই একজন সেনাপ্রধানের মাধ্যমে যিনি সম্রাটকে বন্দী করে সিংহাসনে বসতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস পশ্চিমের দিকে অভিযান শুরু করলেন এবং সেনাপ্রধানকে হারিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এভাবে ৩৫১ খ্রিস্টাব্দে রােমান সাম্রাজ্য আবার একজন মাত্র সম্রাটের শাসনাধীনে এলাে, তিনি হলেন এই দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস। সেই সময়টা যে খুব শান্তির ছিল, তা নয়। একচ্ছত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তিনি পার্সিয়ানদের সাথে লড়তেই ব্যস্ত ছিলেন।
পারস্যের ক্ষমতায় দ্বিতীয় শাপুর ও আরবদের পরাজিত করে শান্তি স্থাপন : ২৯৭ খ্রিস্টাব্দে গ্যালেরিয়াস যখন পার্সিয়ানদের পরাজিত করে সেটা ছিল রােমানদের জন্য পার্সিয়ানদের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার একটি লম্বা সময়। সেবার প্রথম কন্সট্যান্টাইনের রাজত্বকাল পর্যন্ত পার্সিয়ানরা আর আক্রমণ করেনি। ৩১০ খ্রিস্টাব্দে পার্সিয়ার রাজা মৃত্যুবরণ করেন এবং পারস্যের কিছু অভিজাত মানুষ রাজার তিন পুত্রের দায়িত্ব নেন। তারা রানির গর্ভে থাকা একটি সন্তানের উপরে উত্তরাধিকারের অধিকার দিয়ে নিজেরা রাজ্য শাসনের ভার নেন। শিশুটি জন্মানাের পরে বাল্যকাল পেরিয়ে রাজ্য শাসনের উপযুক্ত হতে বহুবছর লাগবে এবং এর মধ্যে তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে নেয়ার সুযােগ পেয়ে যাবেন, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। সেই গর্ভের সন্তানটি জন্মানাের সাথে সাথেই রাজা হিসেবে ঘােষিত হয়ে গিয়েছিল। তার নামকরণ করা হয়েছিল দ্বিতীয় শাপুর (রা. ৩০৯-৩৭৯ খ্রি.)। তার অসহায় শিশুকালে পারস্য সেই অভিজাত পরিবারগুলাের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছিল। সে সময়ে আরবীয়দের আক্রমণ ঠেকাতে হয় তাদের। একগাদা অভিজাত মানুষের শাসনে এবং নিজেদের মধ্যে বিরােধিতার কারণে পুরাে রাজ্যের অবস্থা ছিল নাজেহাল। ইতিহাসে যে বিষয়টি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে তা সেই অভিজাত, শিক্ষিত মাথাগুলােতে একবারও ঢােকেনি। তারা দেশের সামগ্রিক ক্ষতিসাধন করে নিজেদের আখের গােছাতে ব্যস্ত ছিল। যাই হােক, ৩২৭ খ্রিস্টাব্দে শাপুর এত বড় হয়ে গিয়েছিলেন যে দেশের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তিনি ক্ষমতায় বসেই প্রথমে আরবে আক্রমণ করলেন এবং সেখানকার উপজাতীয় অধিবাসীদের যুদ্ধে পরাজিত করে শান্তি স্থাপন করলেন।
আর্মেনিয়ার খ্রিস্টীয় রাষ্ট্র হয়ে ওঠা, খ্রিস্টীয় রোমের পক্ষ গ্রহণ, পারস্যে খ্রিস্টধর্মের প্রসার, শাপুরের খ্রিস্টান নিধন ও রোমের সাথে যুদ্ধের সূচনা : ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কন্সট্যান্টাইনের মৃত্যু হলে রােমান সাম্রাজ্য দুর্বল হাতে চলে গিয়েছিল। সেই সুযােগে শাপুর রােমের পশ্চিম দিকে আক্রমণ করে বসে। পার্সিয়ার জন্য রােমে আক্রমণ করা নতুন কিছু ছিল না। বলতে গেলে সেটি তার আগের আট শতক ধরে চলছিল। তাকে এবারের যুদ্ধে আরও নতুন একটি বিষয় যুক্ত হয়েছিল, তা হলাে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে বিতর্ক। এত কিছুর পরেও খ্রিস্টধর্ম রােমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে সর্বজনীন ধর্মের মর্যাদা পায়নি। উৎসুক খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে চার্চ এবং মিশনারি গড়ে তুলতে তৎপর ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হলেন গ্রেগরি যাকে “দ্য ইলিউমিনেটর” বলে ডাকা হতাে। প্রাচীন ইতিহাসের হিসেবে তিনি পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রেগরির বাবা সন্তানের বাল্যকালেই মারা যান। একজন খ্রিস্টান সেবিকা শিশুটিকে এশিয়া মাইনরে নিয়ে আসেন এবং তাকে খ্রিস্টান হিসেবে মানুষ করেন। একই সাথে তিনি উত্তরপূর্ব দিকেও আর্মেনিয়ার উর্বর ভূমিতে সফর করেন। সেখানে এমনিতেই খ্রিস্টানদের আধিপত্য ছিল, গ্রেগরির আগমনে যেন ষোলকলা পূর্ণ হলাে। ৩০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি আর্মেনিয়ার রাজা টিরিডেটসকে ধর্মান্তরিত করে ফেলেন। তাকে সাথে নিয়ে প্যাগান ধর্মের শেষ বিন্দু পর্যন্ত শেষ করে ফেলেন এবং খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘােষণা করে দেন। এভাবে আর্মেনিয়া হয়ে গেল প্রথম খ্রিস্টধর্মের রাষ্ট্র। রােম নিজে তখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্যাগান ধর্মের অনুসারী ছিল। আর যে সময়ে আর্মেনিয়া খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল ঠিক তখনই ডিওক্লেশিয়ান এবং গ্যালেরিয়াসের নেতৃত্বে রােমে সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান নিধন কর্মসূচি চলছিল। প্রথম কন্সট্যান্টাইন যখন রােমকে খ্রিস্টধর্মের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন তখন ক্ষমতার অপব্যবহার যে মানুষকে বিমুখ করে রেখেছিল, তা কিছুটা কমল। আর্মেনিয়া চার শতক ধরে রােম আর পারস্যের (তারও আগে পার্থিয়ার) মাঝখানে দুলছিল। তখন কন্সট্যান্টাইনের হস্তক্ষেপে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী আর্মেনিয়া প্যাগান পারস্যকে ছেড়ে দিয়ে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রােমকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারল। অন্যদিকে পারস্যেও খ্রিস্টধর্ম কোনাে না কোনােভাবে প্রবেশ করতে লাগল। এখন যদি প্যাগান পারস্য আর খ্রিস্টান রােমের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে, তাে পারস্যের খ্রিস্টানরা কার পক্ষ নেবে? রাজা শাপুর তাই তার রাজ্যে খ্রিস্টান ধ্বংস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। এর পরবর্তী অবস্থায় রােমের সাথে পারস্যের যুদ্ধটা কেবল ভূমি দখলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না, এটি হয়ে উঠল ধর্মের জন্য যুদ্ধ।
রোম ও পারস্যের যুদ্ধ, উভয় রাষ্ট্রের সমস্যার কারণে অচলাবস্থা : দ্বিতীয় শাপুর এবং দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াসের মধ্যে প্রথম দীর্ঘ যুদ্ধটি লেগে থাকল প্রকৃতপক্ষে রােমের খ্রিস্টান শক্তি এবং পূর্বদিকের খ্রিস্টান বিরােধী শক্তির সাথে। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস পারস্যের তরুণ রাজার বিরুদ্ধে তেমন শক্তির পরিচয় দিতে পারলেন না। তিনি পারস্যের বাহিনীর কাছে ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকলেন। কিন্তু ওদিকে পারস্যের বাহিনীরাও এতটা ক্ষমতা দেখাতে পারেনি যে রােমে ঢুকে পড়ে রােমের কোনাে প্রদেশ দখল করে বসে থাকবে। বিশেষ করে মেসােপটেমিয়ার উপরের দিকে নিসিবিসের দুর্গ, যেটি অ্যান্টিয়কের তিনশ মাইল উত্তরপূর্ব দিকে, রােমের প্রবল শক্তির প্রতীক ছিল সেটি। শাপুর সেই প্রদেশ দখলের চেষ্টায় তিন তিনবার আক্রমণ করেছিলেন। তিনবারই তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তারপর কোনাে রাজাই যুদ্ধের ব্যাপারে আর ততটা আগ্রহী ছিলেন না। শাপুর অসভ্য উপজাতিদের বারংবার আক্রমণের কারণে রাজ্যের পূর্বদিকের খারাপ অবস্থা নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এটাই রােমের উপরে আক্রমণের সময়ে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছিল। অন্যদিকে কন্সট্যান্টিয়াস ধর্ম এবং বংশ নিয়ে বিচিত্র সমস্যায় পতিত ছিলেন।
জুলিয়ান (রা. ৩৬১-৬৩ খ্রি.)
কনস্ট্যান্টিয়াসের উত্তরাধিকারী গ্যালাস ও জুলিয়ান : কনস্ট্যান্টিয়াসের দুই ভাই কোনাে উত্তরাধিকারী না রেখেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কনস্ট্যান্টিয়াসের নিজেরও কোনাে সন্তান ছিল না এবং পরিবারের অন্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের তিনি হত্যা করেছিলেন। এখন একজন উত্তরাধিকারী খোঁজার জন্য তিনি কোথায় যাবেন? এমন কাউকে কি তিনি খুঁজে পাবেন যার সাথে রাজত্বের এই গুরুভার কিছুটা ভাগাভাগি করা যায় আর নিজের অবসরের সময়ে যার উপরে আস্থা রাখা যায়? তার আশেপাশে ছিল কেবল প্রথম কন্সট্যান্টাইনের পাতানাে ভাইয়ের দুই ছেলে। পাতানাে ভাইকেও কনস্ট্যান্টিয়াস ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। ভাইয়ের ছেলে সেই তরুণদ্বয় (যারা দুজন ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্মেছিলেন, তাই নিজেরা ছিলেন সৎ ভাই) ছিলেন কনস্ট্যান্টিয়াস ক্লোরাসের নাতি। তারা দুজন হলেন গ্যালাস এবং জুলিয়ান (রা. ৩৬১-৬৩ খ্রি.)। তাদের বাবার হত্যাকাণ্ডর সময়ে তারা ছিল কেবলই শিশু। কন্সট্যানিশিয়াস হয়তাে ভেবেছিলেন এই অবােধ শিশুদের মেরে ফেলে কোনাে লাভ নেই। গ্যালাস বেশ বড় ছিলেন তাই তাকে কন্সট্যান্টিনােপল থেকে বহিষ্কার করে কড়া প্রহরায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু জুলিয়ানকে (বাবার মৃত্যুর সময়ে মাত্র ছয় বছর বয়স হওয়াতে) কন্সট্যান্টিনােপলেই রাখা হলাে। তাকে নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস নামে শিক্ষকের অধীনে খ্রিস্টান মতে শিক্ষাদান করা হয়। ইউসেবিয়াস ছিলেন আরিয়ান বা নব্যতান্ত্রিক বিশপদের মধ্যে প্রধান একজন। (কনস্ট্যান্টিয়াস মানসিকভাবে নিজেও একজন এরিয়ানিস্ট ছিলেন।) গ্যালাস এবং জুলিয়ান কেউই জানত না যে কখন হঠাৎ করে কনস্ট্যান্টিয়াস তাদের মৃত্যুর পরােয়ানা জারি করবে, তাই তাদের তরুণ বয়সটি ছিল খুবই অস্বস্তিকর এবং অনিশ্চয়তায় ভরা।
গ্যালাস ও তার স্ত্রীর ষরযন্ত্র ও মৃত্যু : ৩৫১ খ্রিস্টাব্দে কনস্ট্যান্টিয়াস যুদ্ধের প্রয়ােজনে পশ্চিমদিকে চলে গিয়েছিলেন। তিনি সে সময়ে একজন সেনাপ্রধানের সাথে লড়ছিলেন যিনি কিনা তার ভাই কন্সট্যানসের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তখন পূর্বদিকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য তার একজনকে প্রয়ােজন ছিল। কারণ সেখানে ক্রমাগত নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। তিনি দেখলেন গ্যালাস তখন পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। সিদ্ধান্ত নিলেন তাকেই এই ভার দিয়ে যাবেন। যুবক গ্যালাস হঠাৎ জেলের বন্দীদশা থেকে নিজেকে অ্যান্টিয়কের ক্ষমতাধর উত্তরাধিকারীর আসনে আবিষ্কার করলেন। নিজের অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে তিনি কনস্ট্যান্টিয়াসের বােন কন্সট্যানশিয়াকে বিয়ে করলেন। গ্যালাস সেই কাজ দায়িত্বের সাথে পালন করেননি। গ্যালাস আর তার স্ত্রী কন্সট্যানশিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। তারা একাকি হয়তাে কন্সট্যানশিয়ার কোনাে ক্ষতি করতে পারতেন না কিন্তু জানা গিয়েছিল যে দুজনে মিলে কনস্ট্যান্টিয়াসকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনাও সফল হয়নি। কন্সট্যানশিয়ার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। আর তার মৃত্যুর পরে গ্যালাসকে বন্দী করা হয়। ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে গ্যালাসকে ফাঁসিতে ঝােলানাে হয়।
গাউলে জার্মানিক উপজাতির বিরুদ্ধে জুলিয়ানের জয় : গ্যালাস উত্তরাধিকারী হওয়ার পরই জুলিয়ানকে হঠাৎ করে বন্দী করা হয়েছিল। যাই হােক, পরের বছর কনস্ট্যান্টিয়াস জার্মানির উপজাতিদের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেললেন। তখন তিনি এই রাজ্য শাসনের দায়িত্ব কারও সাথে ভাগাভাগি করার প্রবল প্রয়ােজন বােধ করলেন। তখন বাকি বলতে ছিলেন কেবল জুলিয়ান। ৩৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে যােগদান করেন। তিনি সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কনস্ট্যান্টিয়াস তখন সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে পারস্যের বাহিনীকে সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন। জুলিয়ানের প্রধান কাজ ছিল গাউলকে নিয়ন্ত্রণ করা। সেখানে জার্মান উপজাতিরা, বিশেষ করে ফ্র্যাঙ্করা রাইনের তীর ধরে আক্রমণ করছিল। তারা রাইনের তীর অতিক্রম করে সাম্রাজ্যের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। প্রায় তরুণ জুলিয়াস সিজারের মতাে, তরুণ জুলিয়ান, যে কিনা তখন মাত্র বিশের কাছাকাছি, যুদ্ধে অংশগ্রহণের যার কোনাে পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না, ভয়ংকরভাবে জার্মানিদের আক্রমণ করে বসলেন। তার আক্রমণের ফলে জার্মানরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল এবং সাম্রাজ্যের দখলকৃত অংশটি পুনরুদ্ধার করলেন জুলিয়ান। এমনকি তিনি রাইন অতিক্রম করে তাদের তাড়িয়ে দিলেন তিন তিনবার। (যেখানে কিনা খােদ জুলিয়াস সিজার রাইন অতিক্রম করেছিলেন দুইবার।)
শাপুরের রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ, জুলিয়ানের সাথে কনস্ট্যান্টিয়াসের দ্বন্দ্ব ও কনস্ট্যান্টিয়াসের মৃত্যু : জুলিয়ান তার প্রধান কার্যালয় লুটেরিয়া শহরেই রাখলেন। সেখানেই একসময় কনস্ট্যান্টিয়াস ক্লোরাস উত্তরাধিকারী হওয়ার পরে থাকতেন। শহরটির পুরাে নাম হলাে লুটেরিয়া পারিসিওরাম (যার অর্থ হলাে পারিসিয়ানদের লুটেরিয়া)। এই শহরকে মাঝে মধ্যে প্যারিস বলা হতাে। জুলিয়ানের সময়ে এই নামটিই ঘুরেফিরে ব্যবহার করা হতাে। এভাবেই শহরটির নাম হয়ে গেল প্যারিস। পরবর্তী কয়েক শতকের মধ্যে শহরটি নানান কারণে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে উঠল। জুলিয়ান তার মানবিক বােধ এবং সামর্থ্যের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেন। সবচেয়ে বড় যে সফলতাটি পেলেন তা হলাে তিনি সেনাবাহিনীর প্রিয়পাত্র হয়ে গেলেন। বিষন্ন ও বিরূপ কনস্ট্যান্টিয়াস দূর থেকে জুলিয়ানের কার্যকলাপ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজের কাজিনের ভাইয়ের সাফল্যে অবাকও হয়েছিলেন, যেহেতু নিজে পারস্যের বাহিনীর সাথে বারংবার পরাজিত হয়েছেন। শাপুর নিজেও তার দেশের উপজাতিদের আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে নজিরবিহীন ত্রাসের সাথে রােমে উপস্থিত হন। রােমের শক্ত ভিত নড়ে ওঠে। ৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে নিসিবিসের উত্তরপশ্চিমে অ্যামিডা নামের দুর্গটি দখল করে নিয়ে দশ দিনব্যাপী লড়াই শেষ করেন শাপুর। কনস্ট্যান্টিয়াস এই ঘটনাকে জুলিয়ানের ব্যর্থতা হিসেবে জাহির করে পূর্বদিক থেকে তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যান। জুলিয়ান গাউলের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের ব্যাপারে দ্বিমত পােষণ করলেও শেষে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই তাদের প্রধানকে ছেড়ে সেখান থেকে নড়তে চাইল না। তারা জুলিয়ানকে চাপ দিতে লাগল নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করার জন্য। জুলিয়ান কিছুতেই এই দাবি পাশ কাটাতে পারলেন না। তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে কন্সট্যান্টিনােপলের দিকে অভিযানে চলে গেলেন। কনস্ট্যান্টিয়াস পশ্চিমদিকে সিরিয়া থেকে তার মুখােমুখি হওয়ার জন্য রওনা দিলেন। ঠিক তখনই শাপুর সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলার চিন্তায় মগ্ন। যদিও এরকমটা ঘটেনি। দুই সেনাবাহিনী মুখােমুখি হওয়ার আগেই কনস্ট্যান্টিয়াস টারসাসে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জুলিয়ান ৩৬১ খ্রিস্টাব্দে (১১১৪ রােমান সালে) সম্পূর্ণ রােমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন।
জুলিয়ানের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও খ্রিস্টধর্মের প্রতি তার আচরণ : জুলিয়ান রােমান সাম্রাজ্যের ভিন্নধর্মী একজন সম্রাট হয়ে ওঠেন এক দিক দিয়ে। তিনি খ্রিস্টান শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নিজে খ্রিস্টান ছিলেন না। শিক্ষা গ্রহণের পরেও খ্রিস্টধর্ম তাকে আকর্ষণ করেনি। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস তার পুরাে পরিবারকে হত্য করেছিলেন এবং জুলিয়ান সারাজীবন হত্যার আদেশের অপেক্ষায় ভয়াবহ দিন কাটিয়েছিলেন। এটাই যদি খ্রিস্টধর্মের প্রকৃত চেহারা হয়ে থাকে তবে এটি কী করে অন্য নিষ্ঠুর ধর্মগুলাে থেকে পৃথক বা শান্তির ধর্ম বলে গণ্য হবে? তাই তিনি দেখলেন যে প্যাগান ধর্মাবলম্বী (সাম্রাজ্যের অর্ধেক মানুষ তখনও প্যাগান ধর্মাবলম্বী ছিল) দার্শনিকরাই তাকে বেশি আকর্ষণ করে। সেইসব প্যাগান দার্শনিকদের মধ্যে তিনি বরং গ্রিসের প্রাচীন দার্শনিকদের প্রতিভার ছোঁয়া পেতেন, পেতেন তাদের চিন্তাধারার মতাে উদারতা। সাত শতাব্দীর সেই স্বর্ণযুগ তাকে মনে করিয়ে দিত সেইসব দার্শনিক এবং বােদ্ধাদের আদর্শ। মনে মনে জুলিয়ান একজন প্যাগান ধর্মাবলম্বী এবং গােপনে ইলিউসিনিয়ান আদর্শের অনুসারী হয়ে গেলেন। জুলিয়ান চাইতেন প্লেটোর সময়কার সেই চমৎকার সময়টা আবার নতুন করে সৃষ্টি করতে যখন একজন দার্শনিক শিক্ষকের মতাে করে শিষ্যদের শিক্ষাদান করতেন এবং অন্য দার্শনিকদের সাথে মত বিনিময় করতেন। অবশ্য সেই সময়টিও ছিল জুলিয়ানের আমলের মতােই নিষ্ঠুর এবং অস্থির। কিন্তু তারপরেও এমন একটা কিছু সে সময়ে মানুষের চিন্তাচেতনায় ছিল যা তখনও তাদের সেইদিকে টানত। তারা সেই অতীতের খারাপ দিকগুলাে উপেক্ষা করে কেবল ভালাে দিকগুলাে নিজেদের মনে জিইয়ে রেখেছিল। কনস্ট্যান্টিয়াসের মৃত্যুর পরে যখন জুলিয়ান সম্রাটের আসনে বসলেন, তিনি নিজেকে পুরােপুরি একজন প্যাগান হিসেবে ঘােষণা করলেন। এরপর থেকেই ইতিহাসে জুলিয়ান সম্পর্কে বলতে গিয়ে “ধর্মান্তরিত জুলিয়ান” (Julian the Apostate)। এই কথার মাধ্যমে এটাই বােঝানাে হতাে যে একজন যাকে সবাই এক ধর্মের বলে মনে করত, তিনি হঠাৎ করে নিজের সেই ধর্মটি ত্যাগ করে নিজেকে অন্য ধর্মের অনুসারী বলে ঘােষণা দেন। (তবে অবশ্যই আগের সম্রাট কন্সট্যান্টাইনকে কেউ ধর্মান্তরিত মনে করত না। কারণ তিনি প্রকাশ্যে ছিলেন প্যাগান এবং ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এটি বিশেষ করে নির্ভর করে সেই ঐতিহাসিকের উপরে যিনি ইতিহাসটি লিখছেন।)। জুলিয়ান খ্রিস্টধর্মকে ছােট করার কোনাে চেষ্টা করেননি। তার বদলে বরং তিনি সাম্রাজ্যে ধর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্যাগান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান সবার সাম্রাজ্যে ধর্ম পালন এবং প্রচারের সমান অধিকার নিশ্চিত করেন তিনি। এছাড়াও তিনি খ্রিস্টধর্মের ভেতরেই বিভিন্ন নব্যতান্ত্রিক শাখাগুলাের প্রতি সহনশীলতা বাড়ানাের জন্যও মানুষকে বােঝাতে থাকেন। এক একটি দল যে বিশপদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল তাদের তিনি পুনরায় কাজ করতে আদেশ দেন। এটি ছিল কেবলই তার নিজস্ব মতামত যে খ্রিস্টধর্মের বিশুদ্ধতা নিয়ে এই দলাদলি বন্ধ হােক। নাইসিনীয়বাদ, আরিয়ানিজম, ডােনেটিজমের মতাে আরও ডজনখানেক ধর্মীয় ধারা যখন নিজেদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল তখন খ্রিস্টধর্মের মতাে নব্য ধর্মের সুসংহত হওয়ার মতাে কোনাে স্থান ছিল না। এতগুলাে প্রতিযােগী ধর্মের মাঝখানে খ্রিস্টধর্ম পাত্তাই পায়নি। (সম্রাটের দূরদর্শিতা সঠিক ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়ও তেমনই ঘটছিল। জুলিয়ানের সাম্রাজ্যেও এটি অবাক হওয়ার মতাে কোনাে ঘটনা ছিল না।)। মানবিক গুণাবলীতে ভরপুর জুলিয়ান নিজস্ব জীবনে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ মেনে চলতেন। আইনকানুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুব হিসেবি, কোনাে বিষয়ে কোনাে উগ্রতা ছিল না তার, নীতির বাইরে যাওয়া ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। অনেকের মতে তিনি প্যাগান হলেও ছিলেন তার পূর্বের খ্রিস্টান রাজাদের চেয়েও বেশি খ্রিস্টানমনস্ক। তিনি প্যাগান ধর্মের মূল বিশ্বাসকেও খ্রিস্টধর্মের মতাে একেশ্বরবাদে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সে সময়ে খ্রিস্টান বিরােধীদের চেয়ে খ্রিস্টানেরাই জুলিয়ানকে বেশি সমর্থন করত। একজন কঠোর প্যাগান তাদের কাছে নিশ্চয়ই সমর্থনযােগ্য হতাে না।
পারস্যের বিরুদ্ধে বিজয় ও মৃত্যু : নিজেকে সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে স্থির করে তারপরে ধর্মের বিষয়টিও ফয়সালা করা হলে জুলিয়ান যুদ্ধের দিকে মনোযােগ দিলেন। জুলিয়ান তার সেনাবাহিনীকে সিরিয়ার দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে পারস্যের সেনাদের সাথে পুরনাে লড়াই নতুন করে শুরু করলেন তিনি। সেখানে তিনি তার দুঃসাহসিক লড়ার ক্ষমতা দেখানাের আরেকটি সুযােগ পাবেন বলে আশা করছিলেন। গাউলে থাকতে তিনি গ্রেট জুলিয়াসকে অনুকরণ করছিলেন। এখানে পূর্বদিকে এসে তিনি অনুকরণ করা শুরু করলেন গ্রেট ট্রাজানকে। তিনি ইউফ্রেটিস নদীর উপরে যুদ্ধ জাহাজের বহর সাজালেন এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে ট্রাজানের মতাে মেসােপটেমিয়ার তীর ধরে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি পারস্যের রাজধানী টেসিফোনে পৌঁছে গেলেন। তারপর টাইগ্রিস পেরিয়ে প্রতি লােকালয়ে পারস্যের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করলেন। যাই হােক, জুলিয়ান একটি বড় ভুল করে বসলেন। তার তারুণ্যে টগবগে সেনাবাহিনী তাকে এমন করে ঘিরে রেখেছিল যে তার মনে নিজেকে ট্র্যাজান মনে করার মতাে অহংকার হরহামেশা জেগে উঠত। এমনকি তিনি মনে করতেন তিনি আলেক্সান্ডারের চেয়েও কোনাে অংশে কম নন। তিনি টেসিফোন দখল করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু এবারে পারস্যের সেনাবাহিনীকে হাত করার পরিকল্পনা করতে লাগলেন, যেমনটা করেছিলেন আলেক্সান্ডার। কিন্তু জুলিয়ান জানতেন না যে ইতিহাসে আলেক্সান্ডার একজনই হয়। চতুর শাপুর রাজ্যের অনেক জায়গায় তার নিজস্ব সেনা দলকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তারা ছিল রােমান সেনাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পারস্যের সেনাবাহিনীরা পুরাে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জুলিয়ান নিজের সেনাদের সেখান থেকে প্রত্যাহার করে কমিয়ে নিতে আরম্ভ করেন। পারস্যের সেনাদের প্রতি পদক্ষেপে হারিয়ে দিয়ে তিনি সেই মরুভূমি আর প্রচণ্ড গরম রাজ্যটি থেকে যুদ্ধ বন্ধ করে ফিরে আসেন। জুলিয়ান যতদিন বেঁচে ছিলেন, রােমান সেনাবাহিনী প্রতিটি যুদ্ধেই জিতেছিল। কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধের পরে তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়ত। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের (রােমান ১১১৬ সাল) ২৬ জুলাই জুলিয়ানের শরীরে একটি বর্শা এসে বেঁধে। বর্শাটি কে বা কোথা থেকে ছুঁড়েছে তা কেউ বলতে পারেনি। এমন একটি গল্প শােনা যাচ্ছিল যে একজন পারস্যের সেনা বর্শাটি ছুঁড়েছে কিন্তু পরে বর্শাটি পরীক্ষা করে বলা হয়েছিল যে সেটি ছুঁড়েছে একজন রােমান খ্রিস্টান সেনা। বিশ মাস রাজত্ব করার পরে জুলিয়ান মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। একটি বিখ্যাত (কিন্তু সম্ভবত বানানাে) গল্প অনুযায়ী জানা যায় যে, সম্রাটের শেষ উচ্চারিত শব্দ ছিল “ডিকিস্তি, গ্যালিলি” (তােমার জয় হয়েছে, ওহ গ্যালিলিয়ান)। কিন্তু এটি যদি তিনি নাও বলে থাকেন তবু ধরে নেয়া যায় যে, তার জয় হয়েছিল।
শেষ প্যাগান শাসক, প্যাগান ধর্মের প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা, কনস্ট্যান্টিয়াসের বংশের সমাপ্তি : প্যাগান ধর্মকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল মনােভাব তৈরি করার যে ব্রত তিনি নিয়েছিলেন তাতে অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। তবে তার মৃত্যুর সাথে সাথেই সেসব প্রচেষ্টা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। আর কোনাে প্যাগান এভাবে রােমান সাম্রাজ্যের সিংহাসন ধরে থাকতে পারেননি। রােমান সংস্কৃতির দাপটের ভেতরে কোনাে প্যাগান সম্রাট এভাবে নিজের আদর্শ চাপিয়ে দিতে সফল হননি। প্যাগান দার্শনিকেরা তার পরের দেড়শ বছর ধরে এথেন্সে শিক্ষাদান করে যান। ২৯৩ খ্রিস্টাব্দে রােমান সাম্রাজ্যের চার জন শাসকের মধ্যে কনস্ট্যান্টিয়াস যখন থেকে একজন শাসক হয়েছিলেন, তারপর সত্তর বছর পার হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তার পাঁচজন বংশধর পুরাে সাম্রাজ্যে অথবা কিছু অংশে শাসন করে গেছে। জুলিয়ানের অবশ্য কোনাে সন্তান ছিল না। আর তার মৃত্যুর সাথে সাথেই কনস্ট্যান্টিয়াসের শেষ পুরুষ উত্তরাধিকারীর মৃত্যু হলাে।
ভ্যালেন্টিনিয়ান ও থিওডোসিয়ান রাজবংশের সূচনা
প্রথম ভ্যালেন্টিনিয়ান (রা. ৩৬৪ – ৩৭৫ খ্রি.) ও ভ্যালেন্স (রা. ৩৬৪ – ৩৭৮ খ্রি.)
জোভিয়ানের (রা. ৩৬৩-৬৪ খ্রি.) ক্ষমতা গ্রহণ, শাপুরের সাথে শান্তিচুক্তি, বিভিন্ন অঞ্চল ত্যাগ ও মৃত্যু : জুলিয়ানের মৃত্যুর সাথে সাথে সেখানকার সেনাবাহিনী জোভিয়ানকে (রা. ৩৬৩-৬৪ খ্রি.) সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করে দেন। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ সেনাপ্রধান তবে একজন নাইসিনীয় খ্রিস্টান। মানুষের মনে কোনাে সন্দেহ ছিল না যে, ধর্মের ক্ষেত্রে যে ভয়ংকর ওলটপালট করে জুলিয়ানের মৃত্যু হয়েছে, তার ঝাঁঝ তিনি পরকালে ভােগ করবেন। সেসময় একজন খ্রিস্টান সম্রাটের অধীনেই রোমান জনগণ নিরাপদ বােধ করছিল। জোভিয়ান প্রথমেই সফলভাবে দুটো কাজ করেছিলেন। প্রথমত তিনি জুলিয়ানের ধর্ম নিয়ে করা আইনকানুন নিষিদ্ধ করে কনস্ট্যান্টিয়াসের আমলের খ্রিস্টীয় আইন চালু করলেন। (তখন এসব করতে তাকে কোনাে প্যাগান-নিধনও করতে হয়নি।) দ্বিতীয়ত শাপুরের সাথে শান্তিচুক্তির নামে তিনি কনস্ট্যান্টিয়াসের এবং জুলিয়ানের আমলে করা সেনা আইনগুলাে প্রত্যাহার করলেন। তিনি আর্মেনিয়া এবং তার কাছাকাছি আরও কিছু জায়গা ছেড়ে দিলেন যেসব কিনা ডিওক্লেশিয়ানের আমল থেকে রােমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। বিশেষ করে যেটি খুব পরিতাপের সাথে উল্লেখ করা যায় সেটি হলাে তিনি নিসিবিসের দুর্গও ছেড়ে দিলেন যা কিনা শাপুর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেও দখল করতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে। জোভিয়ান এই শান্তি চুক্তির আওতায় এলেন কারণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি রােমকে একটি সুরক্ষা কবচের মধ্যে রেখে নিজে কন্সট্যান্টিনােপলে ফিরে যেতে পারেন। যাই হােক, ফিরে যাওয়ার সেই পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং ৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যানন্টিনােপলে যায় কেবলই তার মৃতদেহ।
ভ্যালেন্টিনিয়ান ও ভ্যালেন্সের ক্ষমতা গ্রহণ ও জনসাধারণের উন্নতির ব্যর্থ প্রচেষ্টা : জোভিয়ানের মৃত্যুর ফলে সৈন্যেরা আরেকজন সক্ষম সরকারি কর্মচারিকে সম্রাটের আসনে বসিয়ে দিলেন। তিনি হলেন ভ্যালেন্টিনিয়ান, যিনি প্যানােনিয়ায় জন্মেছিলেন। তিনি তার ভাই ভ্যালেন্সের সাথে মিলে একযােগে শাসনকার্য পরিচালনার কাজ করতে লাগলেন। ভ্যালেন্টিনিয়ান ছিলেন একজন নাইসিনীয় খ্রিস্টান, যেখান থেকে পরবর্তীতে ক্যাথোলিক খ্রিস্টধর্ম থেকে অন্যান্য মেইনস্ট্রিম খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব ঘটে। তবে তিনি তদকালীন খ্রিস্টধর্মের নব্যতন্ত্রের ব্যাপারে মােটামুটি সহনশীল ছিলেন। অন্যদিকে তার ভাই ভ্যালেন্স ছিলেন একজন ভয়ানক নব্যতান্ত্রিক বা এরিয়ানিস্ট। তাদের ধর্মানুভূতি এবং মেজাজমর্জি পুরােপুরি আলাদা হওয়া সত্ত্বেও দুই ভাই একসাথে মিলে বেশ ভালােই রাজ্য শাসন করছিলেন। ভ্যালেন্টিনিয়ান দুজনের মধ্যে কাজের ব্যাপারে বেশি সমর্থ ছিলেন। তার শিক্ষাদীক্ষা কম ছিল তাই অভিজাত শ্রেণির কাছে তিনি তেমন গ্রহণযােগ্য ছিলেন না। তবে সাধারণ মানুষ তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি বিধানে তৎপর ছিলেন। তবে তার সকল প্রচেষ্টাই পণ্ড হয়। সাম্রাজ্যের উন্নতিকল্পে তার নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপই ব্যর্থ হয় কারণ সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে দেশের সব সম্পদ সেই খাতেই চলে যাচ্ছিল।
ভ্যালেন্টাইনের গাউলে ও থিওডোসিয়াসের ব্রিটেনে বিজাতীয় উপজাতি বিতাড়ন ও উভয়েরই মৃত্যু : ভ্যালেন্স সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে ছিলেন। ভ্যালেন্টিনিয়ান তখন পশ্চিম দিকের অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মিলানে তার রাজধানী বানিয়ে বসেছিলেন। গাউল থেকে চার বছর আগে জুলিয়ান চলে যাওয়ার পর থেকে জার্মানির উপজাতিরা এতদিনে আবার রাইন নদী পেরিয়ে আক্রমণের সুযােগ নিলাে। কিন্তু ভ্যালেন্টিনিয়ান তখন জুলিয়ানের মতােই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন তাদের জন্য। আক্রমণের রাস্তা থেকে আবার তাদের সরে যেতে হলাে। আরেকবার রােমান সেনাবাহিনী বিপুল বিক্রমে রাইনের তীরে অবস্থান গ্রহণ করল। ভ্যালেন্টিনিয়ান তখন দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন। দানিয়ুবের উপরের দিকে তিনি আগের মতােই প্রবল শক্তি নিয়ে ধেয়ে যেতে লাগলেন। একই সময়ে তার ভয়ানক শক্তিশালী সেনাপ্রধান থিওডােসিয়াস ব্রিটেন একই রকমের যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তিনি সেখান থেকে রােমান দ্বীপগুলাের ওপরে অবৈধভাবে গেঁড়ে বসা সকল বিদেশী শক্তিকে সেখান থেকে উৎখাত করেন। দুর্ভাগ্যবশত ভ্যালেন্টিনিয়ান আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে তিনি বিভিন্ন উপজাতিগুলাের সাথে যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে শর্তাদি নিয়ে আলােচনায় ব্যস্ত ছিলেন। আর থিওডােসিয়াসের ভাগ্যে যা হয়েছিল তা হলাে, কিছু সরকারি কর্মচারি, যাদের দুর্নীতি তিনি জনসমক্ষে এনেছিলেন, তারা সকলে মিলে সে বছরেই তাকে ফাঁসিতে ঝােলালেন।
গ্রেশিয়ান (রা. ৩৬৭ – ৮৩ খ্রি.) ও দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের (রা. ৩৭৫ – ৩৯২ খ্রি.) ক্ষমতা লাভ, গথদের ওপর তুর্কি উপজাতি হানদের আক্রমণ ও হানদের পরিচয় : ভ্যালেন্টিনিয়ানের উত্তরাধিকারী হলেন তার বড় ছেলে গ্রেশিয়ান। তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন তার সৎ ভাই দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানকে সাথে নিয়ে। যেহেতু তার ভাই কেবল চার বছর বয়সী ছিল তাই গ্রেশিয়ান পশ্চিম দিকে শাসনকার্য পরিচালনা শুরু করেন। তবে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে নানারকম সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছিল। তখন প্রায় সােয়া একশ বছর ধরে দানিয়ুবের তীরের অংশে এবং কৃষ্ণসাগরের তীরে গথ উপজাতি বসবাস করছিল, এরা ছিল জার্মানিক ট্রাইব। তারা প্রায়ই রােমানদের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলত আর বেশিরভাগ যুদ্ধেই পরাজিত হতাে। তাদের বেশিরভাগ পরাজয়ই হয়েছে একের পর এক সক্ষম রােমান সম্রাটের হাতে। কিন্তু এবারে গথ জাতি রােমানদের চেয়েও ভয়াবহ এক ত্রাসের সম্মুখীন হলাে। সেই ত্রাস ধেয়ে আসছিল এশিয়া থেকে। মধ্য এশিয়ার ভূমি ছিল আদি ইতিহাসের জন্মস্থান। ঘােড়ার খুড়ের শব্দে সেখানকার বাতাস কাঁপত। সাধারণভাবে বলতে গেলে মধ্য এশিয়ায় ছিল যাযাবর শ্রেণির বাস। এরাই ছিল মধ্য এশিয়ার হান নামক তুর্কি উপজাতি। তারা ঘােড়ার পিঠেই চলাফেরা করত, খাওয়া দাওয়া করত, এমনকি ঘুমাতো! তারা যখন যেখানে ঘাস সুলভে পাওয়া যায়, দল বেঁধে সেদিকেই রওনা দিত। যে বছরগুলােতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল, তখন ঘােড়ার পিঠে দিনযাপন করা যাযাবর শ্রেণির মানুষ ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছিল। তারপর একবার যখন বহুদিন ঠিকমতাে বৃষ্টি হলােনা, ঘাস গজালাে না, তখন যাযাবর শ্রেণি বিপদে পড়ল। এতবড় জনগােষ্ঠীকে সুস্থ রাখার মতাে কিছুই ছিল না সেখানে। তখন ঘােড়ার পিঠে চড়ে যাযাবর শ্রেণি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তারা তাদের প্রয়ােজনীয় সমস্ত কিছু, তাদের দরকারী জিনিসপত্র, পরিবার, সব নিয়ে রওনা দিলাে। তারা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে পারত। সামান্য ঘােড়ার দুধ খেয়েও তারা খুশি থাকত। পরের বেলার খাবার কোথা থেকে আসবে, এ নিয়েও তারা ভাবত না। তাদের অসংখ্য ঘােড়ার বহরে যে কোনাে এলাকার মাটি ঢেকে যেত, বিশাল সেনাবাহিনীর মতাে তাদের দেখলে মানুষের চমকে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। তারা আসার আগেই বাতাসে ঘুরে ঘুরে তাদের শব্দ কানে আসত। সেই শব্দেই দূরের মানুষেরা কৌতুহলী হয়ে উঠত। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক থেকে চীনের উত্তর দিকে স্তেপের এই যাযাবর শ্রেণিরা বাসস্থান গড়ে তুলছিল। তারা জায়ংনু (Xiongnu) নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে (রােম যখন কার্থেজের সাথে যুদ্ধ করছিল) হান চাইনিজদের সাথে তাদের সংঘর্ষ ঘটে, এবং জায়ংনু জাতি ও চৈনিকদের অঞ্চলের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবেই চীনের মহাপ্রাচীরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধারণা করা হয় এই জায়ংনু জাতি থেকেই পরবর্তীতে তুর্কি হান জাতির উদ্ভব।
হানদের আক্রমণের কারণে গথদের রোমে আশ্রয়, রোমে নিগ্রহের শিকার হয়ে গথদের হানদেরকে সহায়তা : ৩৭৪ খ্রিস্টাব্দে সেই হান জাতি কৃষ্ণসাগরের উত্তর দিকে গথদের একটি অংশ অস্ট্রোগথের এলাকায় ঢুকে পড়ল। অস্ট্রোগথ জাতি তাদের কাছে পরাজিত হলাে। হানরা তখন দানিয়ুবের উত্তর দিকে গথদের আরেকটি জাতি ভিজিগথদেরকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। ভিজিগথরা যুদ্ধে লড়ার চাপে এতই ভীতু হয়ে পড়ল যে তারা দানিয়ুবের তীর ধরে পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে লাগল। ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে তারা তাদের পুরনাে শত্রু রােমানদের সাথে হাত মেলাতে চেষ্টা করল। রােমানরা তাদের সাম্রাজ্যে ঠাঁই দিলাে। কিন্তু গথদের জন্য তারা কঠিন শর্তাদি রাখল, গথদের অস্ত্রবিহীনভাবে রাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। গথ জাতির নারীদেরকে এশিয়া থেকে বন্দীর মতাে করে আনা হলাে। গথদের অন্য কোনাে উপায় ছিল না। দানিয়ুবের তীরে তারা হানদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হাজারে হাজারে স্রোতের মতাে রােমের দিকে যেতে লাগলো। সবকিছু ঠিকমতােই চলছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না রােমানরা গথিক শরণার্থীদের নিজেদের ইচ্ছেমতাে ব্যবহার করা শুরু করলো। গথদের কাছে জিনিসপত্র বিক্রি করা হতাে খুব চড়া দামে এবং তাদের সবসময় এমন একটি অনুভূতি দেয়া হতাে যে তারা রাজ্যে অবহেলিত জনগােষ্ঠী। বারবার মনে করিয়ে দেয়া হতাে যে দয়া করে তাদের থাকতে দেয়া হয়েছে। (সত্যি কথা বলতে কি ইতিহাস থেকে জানা যায়, তাদের এরকম নজরেই দেখা হতাে।) এমন অবস্থা চলতে চলতে একসময় তারা অস্ত্র জোগাড় করে ফেলল। তারা এমন করে রােমানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে উঠল যেন তারা শরণার্থী নয়। তারা আশ্চর্যজনকভাবে রােমানদের শায়েস্তা করার জন্য হানদের কাছে সাহায্য চাইল যে হানদের ভয়ে একসময় তারা রােমে পালিয়ে এসেছিল। হানরাও রােমানদের সম্পদ লুটপাট করার দোসর হিসেবে উৎসাহ নিয়ে তাদের ডাকে সাড়া দিলাে।
পারস্যের শাপুরের সাথে অনিচ্ছাকৃত শান্তিচুক্তি স্থাপন করে গথিক-হানিক বাহিনীর জন্য ভ্যালেন্সের যুদ্ধ প্রস্তুতি : এই সংবাদটি একসময় সিরিয়ায় অবস্থানরত সম্রাট ভ্যালেন্সের কাছে পৌঁছে গেল। সেখানে রােমান সেনাবাহিনী পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে বৃদ্ধ রাজা শাপুরের সাথে লড়ছিল। (২য় শাপুর তখন তার সত্তরতম জন্মদিনের দিকে ধাবিত এবং সারা জীবনই তিনি পারস্যে রাজত্ব করে গেছেন।) রােমানরা তাদের বিরুদ্ধে প্রায় সব যুদ্ধেই জয়ী হয়েছিল কিন্তু তখন বাধ্য হয়ে একটি অনিচ্ছাকৃত শান্তি চুক্তির আওতায় তাদের আসতে হলাে। কারণ সম্রাট হিসেবে ভ্যালেন্সের মূল দায়িত্ব তখন ছিল গথদের মােকাবেলা করা। ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্স কন্সট্যান্টিনােপল থেকে অভিযান শুরু করলেন গথ জাতিকে মােকাবেলা করার উদ্দেশ্যে। আড়াই শতাব্দী আগে সম্রাট হ্যাড্রিয়ান আড্রিয়ানোপল নামে যে শহরটির পত্তন করেছিলেন সেখানে তিনি গথদের সাথে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভ্যালেন্সের বাহিনী গথদের বাহিনীর তুলনায় ছােট ছিল। সম্রাট হয়তাে তার ভাগ্নে গ্রেশিয়ানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গ্রেশিয়ান তখন পূর্বদিকে বাহিনী নিয়ে দ্রুত ধেয়ে আসছিলেন সম্রাটকে সহায়তা করার জন্য। তিনি তখনও জানতেন না যে আরেকটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে।
অশ্বারোহী বাহিনীর পদাতিকদেরকে টপকে যাওয়া : ইতিহাসে সব জায়গায় এপর্যন্ত পদাতিক সেনাবাহিনীকেই বিজয়ী হতে দেখা গেছে। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের জন্য পূর্বদিকে প্রাণপণ যুদ্ধ করা ম্যাসিডােনিয়ান ফ্যালাঙ্কস বাহিনীও ছিল পদাতিক এক বিশাল বাহিনী। ভূমধ্যসাগরীয় যুদ্ধে রােমের পক্ষে যে বাহিনী যুদ্ধ করে বিজয় বয়ে এনেছিল সেই বিশাল সেনাবাহিনীও ছিল পদাতিক সেনার। সে সময়ে ঘােড়ার উপরে চলা সেনা এবং ঘােড়ার গাড়িও ছিল বাহিনীতে। কিন্তু সেসব ছিল সংখ্যায় কম এবং খুবই খরচের ব্যাপার। তাই গ্রিক এবং রােমান আমলে সেসব বিলাসিতাই ছিল বটে। তারা প্রকৃতপক্ষে পদাতিক সেনাদের যেন ঠিকঠাকমতাে ব্যবহার করা যায়, তাদের মধ্যে যােগাযোেগ ঠিকমতাে ঘটানাে যায় আর হঠাৎ করে কোনাে অতর্কিত হামলায় তারা যেন বিপদে না পড়ে সেসব দেখাশােনা করত। অবশ্য আগে থেকে আয়ােজন করা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ সম্মুখযুদ্ধে তারা পদাতিক সেনাদের সাথে সাথে অংশ নিত না। এর দু’একটি সম্ভাব্য কারণ অবশ্য হতে পারে প্রাচীন সেই সময়ে ঘােড়ার উপরে বসে থাকার শক্ত সিট বলে কিছু ছিল না আর পা রাখার নির্দিষ্ট জায়গাটিও বানানাে হয়নি তখন। প্রবল বেগে ধেয়ে আসা একজন সেনার সামনেই একজন ঘােড়সওয়ার অসহায় হয়ে পড়ত। লাঠির আঘাত কিংবা তলােয়ারের কোপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে গেলেই সে ঘােড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যেত। তারপর আর নিজেকে কোনােমতেই বাঁচাতে পারত না। এভাবে ঘােড়সওয়াররা মারা পড়তে পড়তে নিজেরাই বুদ্ধি বের করে এই অবস্থা বদলে দিলাে। বসার স্থানে একটি শক্ত সিট আর পা রাখার জায়গায় শক্ত পা-দানি বানিয়ে ফেলল। এবারে তাদের চট করে ঘােড়া থেকে ফেলে দেয়া আর ততটা সহজ ছিল না। কেউ লাঠি কিংবা তলােয়ার দিয়ে আক্রমণ করলেও তারা শরীরকে ঘােড়র উপরে শক্ত করে ধরে রেখে তা থেকে বাঁচতে পারত। আবার পরমুহূর্তে নিজেরাই তলােয়ার দিয়ে আক্রমণ করতে পারত। রােমান পদাতিক সেনাদেরও অসভ্য উপজাতিকে মােকাবেলা করার জন্য সীমাহীন কৌশল আয়ত্ত করতে হয়েছিল। তাদের যুদ্ধের পােশাক দিনদিন হালকা ওজনের কিন্তু কার্যকর করে বানাতে হয়েছিল যা তাদের চলাফেরায় সহজ হয় আবার আক্রমণ প্রতিহতও করতে পারে। প্রতি সন্ধ্যায় যেখানেই থাকুক না কেন, একসাথে হয়ে একটি সভার আয়ােজন করার নিয়ম বাতিল করা হয়েছিল। তলােয়ারের দৈর্ঘ্য বাড়ানাে হলাে আর বর্শার ব্যবহার শুরু হলাে। একজন পদাতিক সেনা যেন ঘােড়সওয়ার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, সেভাবে বর্শার দৈর্ঘ্য বাড়ানাের প্রয়ােজন ছিল। রােম সে সময়টায় নিজেদের সেনাবাহিনীর ব্যাপক পরিবর্তন আনায় ব্যস্ত ছিল। তারা তখন প্দব্রজে চলা সেনাদের সাথে সাথে অশ্বারােহী সেনাদের দলকে কী করে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে সে বিষয়ে নানান গবেষণা করছিল। একসময় এমন হলাে যে অশ্বারােহী সেনাদের ক্ষমতাও পদাতিক বিপুল সংখ্যার সেনাদের তুলনায় কোনাে অংশে কম ছিল না। কিন্তু যাই হােক, পদাতিক সেনারাই ছিল রােমের প্রধান শক্তি, যুদ্ধের সময়ে তারা যে বাহিনীর উপরে নির্ভর করত। তারাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবসময়ে রােমান সাম্রাজ্যের হয়ে নতুন এলাকা দখলের প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে।
গথিক-হানিক অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে রোমান পদাতিকদের পরাজয় ও ভ্যালেন্সের মৃত্যু : আদ্রিয়ানােপলে রােমান বাহিনী গথিক ও হানিশ অশ্বারােহী বাহিনীর মুখোমুখি হলাে। গথিক-হানিক বাহিনীরা তখন ছিল ঘােড়ার ওপরে বসে যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। রােমান বাহিনীর মূল অংশ ছিল পদাতিক সেনা। তারা অশ্বারােহী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হলাে। সম্পূর্ণ রােমান বাহিনী ধ্বংস হয়েছিল সেই যুদ্ধে। রােমান সম্রাট ভ্যালেন্স সেই যুদ্ধে ছিলেন। ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৩১ সালে) অ্যাড্রিয়ানােপলের সেই যুদ্ধের মাধ্যমে রােমান পদাতিক বাহিনীর ব্যবহার শেষ হলাে। যে বিশাল বাহিনীটি বছরের পর বছর ধরে রােমকে যুদ্ধে সহায়তা করেছে, সেটি পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। পরের এক হাজার বছর পুরাে ইউরােপে অশ্বারােহী বাহিনীই ছিল মনােযােগর কেন্দ্রবিন্দু, বন্দুক আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত এই ধারাটিই অব্যাহত থাকে। বারুদ আবিষ্কার হওয়ার পরে আবার পদাতিক সেনার কদর বেড়েছিল আগের মতাে।
প্রথম থিওডােসিয়াস (রা. ৩৭৯-৯৫ খ্রি.)
থিওডোসিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ : ভ্যালেন্সের মৃত্যুর পরে গ্রেশিয়ান প্রকৃতপক্ষে রােমের একক সম্রাট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। কারণ বালক সম্রাট ভ্যালেন্টিনিয়ানকে হিসেবের মধ্যে আনার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। কিন্তু একলা গ্রেশিয়ানের পক্ষে পুরাে সাম্রাজ্যের বােঝা টানাও ছিল বেশ শক্ত কাজ। তিনি ছিলেন মাত্র বিশ বছর বয়সী। তাই নিজের সাথে যুগ্মভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তিনি যােগ্য একজনকে খুঁজে বের করলেন। তার পছন্দ ছিল থিওডােসিয়াস, যার বয়স তখন ছিল তেত্রিশ বছর। তার পিতা একজন সফল সেনাপ্রধান ছিলেন যিনি ব্রিটেন বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন এবং কয়েক বছর আগে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার শিকার হন।
রোমান সেনাবাহিনীতে গথদের প্রবেশ, দানিউবের প্রদেশে তাদের বসবাসের অনুমতি দান : থিওডােসিয়াস বিজয়ী গথ বাহিনীকে ঘায়েল করে ফেললেন, তবে ভয়ংকর যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, বরং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মাধ্যমে (কারণ অ্যাড্রিয়ানােপলের যুদ্ধ এমনই ভয়ানক ছিল যে আরেকবার তেমন একটি যুদ্ধ বাঁধানাে কোনাে সাধারণ ব্যাপার হতাে না)। তিনি গথদের পরবর্তী আক্রমণের হাত থেকে মুক্ত হলেন তাদের ধ্বংস করে নয়, তাদের রােমান বাহিনীতে যােগদানের লােভ দেখিয়ে। তিনি গথদের দানিয়ুবের তীরে রােমান প্রদেশে কেবল কাগজে-কলমে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেখানে তারা থাকতে পারত তাদের নিজেদের আইনে, নিজেদের শাসকের অধীনে। এভাবে তিলতিল করে রােমান সাম্রাজ্যের সীমানা সুরক্ষিত করা হলাে, প্রদেশগুলােতে শান্তি স্থাপন করা হলাে, তবে এই সবই হলাে খুব উঁচু দামে। “অসভ্য” জার্মানিক ট্রাইবদের স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন হলাে রােমান সাম্রাজ্যের সীমানার মধ্যেই। তার সাথে সাথে রােমান সেনাবাহিনীও হয়ে পড়ল প্রায় জার্মানিক সেনায় ভরপুর। তখন রােমানরা নতুন রীতি অনুযায়ী অশ্বারােহী বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে যেত এবং তাদের বেশিরভাগেরই নির্ভর করতে হতাে ট্রাইবাল অশ্বারােহী সেনাদের উপরে। প্রদেশগুলােতে সেনাবাহিনীর উচ্চপদেও কিছু জার্মানিক জাতির লােক বসে গেল। এক পর্যায়ে এমন হলাে যেন শুধু সম্রাটই একজন মানুষ যিনি ওই অঞ্চলের আদি অধিবাসীদের উত্তরাধিকারী এবং অভিজাত পরিবার থেকে আগত। এমন যদি হতাে যে এই অবস্থা কোনাে দুর্বল সম্রাটের সময়ে সৃষ্টি হয়েছে, তবে হয়তাে পুরাে রোমান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বই চলে যেত কোনাে জার্মানিক জাতির আয়ত্তে। আর তখন মনে হচ্ছিল এমন সময়ই যেন ধেয়ে আসছে।
প্যাগানদের ধর্মান্তর, খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অ্যাম্ব্রোসের প্রভাবে প্যাগানদের বঞ্চনা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো, আরিয়ানদের বিলুপ্তি : গ্রেশিয়ান এবং থিওডােসিয়াসের আমলে শাসনের স্রোত শেষ পর্যন্ত প্যাগান ধর্মের বিরুদ্ধে বইতে লাগল। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানেরা তখন আরও বেশি সফল হতে লাগল। তখন স্রোতের মতাে মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে লাগল। খ্রিস্টান সম্রাটের অধীনে ধর্মান্তর যেন তাদেরকে নেশার মতাে পেয়ে বসল। এমন অবস্থায় কোনাে কোনাে প্যাগান ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টধর্মকে মুখে মুখে কটাক্ষ করলেও অন্তরে তেমন বিশ্বাস করত না। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা খ্রিস্টান স্কুলে পড়ত আর চার্চে গিয়ে দীক্ষা নিত। তাদের বড়মুখে কিছু বলার ছিল না, কারণ তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সত্যিকারের খ্রিস্টান হয়ে উঠছিল। এভাবেই গ্রিস আর রােমান সংস্কৃতির অন্তিম রাতগুলাে কাটছিল। প্যাগান ধর্মের মৃত্যুশয্যায় যারা আধিপত্য করছিলেন, তাদের মধ্যে প্রধান হলেন অ্যাম্ব্রোস (অ্যাম্ব্রোসিয়াস)। তিনি জন্মেছিলেন ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। তার পিতা ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি। তিনি নিজেও সরকারি চাকরিতে যােগদান করেন কিন্তু শুরুতেই মিলানের বৃদ্ধ বিশপের মৃত্যু নিয়ে নানান বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। নাইসিনীয় আর আরিয়ানদের তৈরি করা জটিলতার মধ্যে তিনি পুরােপুরি ফেঁসে যান। তারপর তিনি নাইসিনদের পক্ষে এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেন যে ৩৭৪ সালে তাকে বিশপ বানানাের জন্য নির্বাচনে দাঁড় করানাে হয়। ৪র্থ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের সম্রাটেরা যখন মিলানে তাদের বিচারালয় বসালেন তখন পশ্চিমের প্রদেশগুলাের মধ্যে সেই শহরের বিশপের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। অন্তত কিছুদিনের জন্য রােমের বিভিন্ন বিশপের গুরুত্বও ছাড়িয়ে গেল সে শহরটি। আর সেই সময়ে চার্চের সর্বেসর্বা পদে ছিলেন নির্ভীক, তীক্ষ্ম অ্যাম্ব্রোস। অ্যাম্ব্রোস তখন যেন গ্রেশিয়ানের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন। তিনি গ্রেশিয়ানকে সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার আইন পরিত্যাগ করতে বাধ্য করান। সাম্রাজ্যের যে ভাবমূর্তি প্যাগান ধর্মের ওপরে টিকেছিল তা এর ফলে গুড়িয়ে গেল। ৩৮২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেশিয়ান তার উপাধি “পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস” প্রত্যাহার করেন। এই উপাধির বলে তিনি সাম্রাজ্যের প্যাগান ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন। রােমান সিনেট থেকে প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও কমিয়ে দিলেন। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে যে “শিখা অনির্বাণ” জ্বালিয়ে রেখেছিল তাও তিনি নিভিয়ে দিলেন। বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন যে সাম্রাজ্যে প্যাগান ধর্মের লােকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। অ্যাম্ব্রোস যে কেবল সম্রাটের মন জয় করলেন তাই নয়, তিনি প্যাগান এবং আরিয়ানদের বিরুদ্ধেও এক ভয়াবহ শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হলেন। নাইকির সভার পুরাে অর্ধশতাব্দী পরে পূর্বদিকের সম্রাট থিওডােসিয়াস একজন কট্টর নাইসিনীয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। ঠিক সেই সময় থেকে সাম্রাজ্য থেকে নব্যতন্ত্র (আরিয়ান ধারা) বিলুপ্ত হতে শুরু করল। তখন সব ধরনের খ্রিস্টধর্ম নয়, কেবল নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মই সেখানে প্রধান হয়ে উঠল।
ম্যাগনাস ম্যাক্সিমাস কর্তৃক গ্রেশিয়ানের মৃত্যু ও থিওডোসিয়াসের প্রতিশোধ গ্রহণ : গ্রেশিয়ান তার জনপ্রিয়তা হারালেন। তিনি আসলে ক্ষমতার সাথে তার উপরে বর্তানাে দায়িত্ব পালনের চেয়ে ক্ষমতার সুযােগসুবিধা ভােগের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি জার্মানিক জাতিদের অশ্বারােহী শিকারী বাহিনীর সাথে যােগ করলেন। সেনাপ্রধানেরা তার এই ক্ষমতার অপব্যবহার সহ্য করেননি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গাউল দখল করে তাদের সেনাপ্রধান ম্যাগনাস ম্যাক্সিমাসকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করে। তারা ৩৮৩ সালে (রােমান ১১৩৬ সাল) গ্রেশিয়ানকে হত্যা করে। থিওডােসিয়াস তখনও পূর্বদিকে গথদের পরাজিত করে শান্তি স্থাপন করতে পারেননি। গ্রেশিয়ানের সৎ ভাই দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান তখন ইতালি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এই কাজ করার মতাে যােগ্যতা তখন তার ছিল না বলতে গেলে, কারণ তিনি তখন মাত্র বারাে বছর বয়সী বালক এবং মায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। তার মা ছিলেন একজন এরিয়ানিস্ট যিনি ইতালিতে এরিয়ানিজম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কয়েক বছর পরে ম্যাক্সিমাস যখন ইতালিতে আক্রমণ করেন তখন থিওডােসিয়াসের পালা আসে। তিনি তখন প্রথম ভ্যালেন্টিনিয়ানের কন্যা এবং দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান এর বােন গালাকে বিয়ে করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ওই পরিবারের একজন হয়ে গেছেন। তাই তখন গ্রেশিয়ানের মৃত্যুর প্রতিশােধ নেয়ার জন্য তিনি তৈরি হয়েছিলেন। থিওডােসিয়াসের তখন পারস্য নিয়েও সমস্যা চলছিল। তাই তাকে উত্তর ইতালির দিকে অভিযান চালাতে হয়। সেখানে তিনি ম্যাক্সিমাসকে পরাজিত করেন এবং ৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে তার বাহিনী ম্যাক্সিমাসকে হত্যা করে। থিওডােসিয়াস এবারে পুরাে সাম্রাজ্যের দখল নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি এই বিজয় রােমে উদযাপন করেন। তরুণ দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানকে তিনি একজন দক্ষ সেনাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে গাউলের শাসক নিযুক্ত করেন। সেই সেনাপ্রধান ছিলেন আর্বোগাস্ট যিনি গাউলে ম্যাক্সিমাসের বাহিনীর সাথে লড়েছিলেন। এটাই ছিল প্রথম উদাহরণ যে কোনাে রােমান সম্রাটের পেছনে মদদ দানকারি হিসেবে একজন জার্মান নাগরিককে নিযুক্ত করা হলাে। আর তারপরের শতাব্দী জুড়ে পশ্চিম দিকে এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান হত্যার মাধ্যমে একনায়ক থিওডোসিয়াস, নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মের বিজয় ও অলিম্পিক খেলার নিষেধাজ্ঞা : দিনে দিনে আর্বোগাস্ট বুঝতে পারলেন যে তরুণ সম্রাট দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা তত সহজ নয়। তরুণ সম্রাটের বয়স যত বাড়ছিল, ততই তার স্বেচ্ছাচারিতাও বেড়ে যাচ্ছিল। তাই ৩৯২ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১৯৪৫ সালে) থিওডােসিয়াস তাকে বন্দী করে হত্যা করেন। এভাবে পশ্চিমের যুগ্ম সম্রাটের জীবনের সমাপ্তি টানেন থিওডােসিয়াস। তিনি সফলভাবেই করেছিলেন সে কাজ। তিনি আর্বোগাস্টকেও পরাজিত করলেন। আর্বোগাস্ট আত্মহত্যা করলেন এবং পুরাে সাম্রাজ্য শেষবারের মতাে যেন এক হয়ে গেল, একটিমাত্র আইনের আওতায়। আর্বোগাস্টের সাথে থিওডােসিয়াসের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কোনাে শিক্ষা নেননি। জার্মানের লােকদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরানাে গেল না। আসলে তার আর কিছুই করার ছিল না। কেবল একদল সেনাবাহিনী সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, বিশেষ করে একজন তরুণ সম্রাটকে, যখন কিনা সেনাপ্রধানের পদে বসে আছেন একজন জার্মান নাগরিক। এটা ছিল খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। থিওডােসিয়াসের রাজত্বের শেষ সময় পর্যন্ত তার একজন বিশ্বস্ত কর্মচারি ছিলেন ফ্লেভিয়াস স্টিলিকো। তিনি ছিলেন ভ্যান্ডাল নামে (ইতিহাসে এমনই জানা যায়) একজন জার্মানের সন্তান, যার নেতৃত্বে একবার রােমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ হয়েছিল এবং অদূর ভবিষ্যতে তিনি আবারও আক্রমণ করবেন বলে ভাবছিলেন। কিন্তু স্টিলিকো তার পরেও সাম্রাজ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করেই ছিলেন। নব্যতান্ত্রিক আরিয়ানদের সাথে দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন, নাইসিয়ান থিওডােসিয়াস সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের দায়িত্ব পেয়ে যান; খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জন্য এটা ছিল এক অভূতপূর্ব বিজয় যা কিনা আরও অনেকদিন পর্যন্ত তাদের পক্ষে খুব সুন্দর একটি ব্যবস্থা বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। খ্রিস্টধর্মের প্রতি থিওডােসিয়াসের এই পৃষ্ঠপােষকতার কারণে চার্চের ইতিহাসবিদেরা তাকে “থিওডােসিয়াস দ্য গ্রেট” উপাধি দিয়েছেন। ৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে থিওডােসিয়াস গ্রিসের অলিম্পিক গেমসের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যা কিনা খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ সাল থেকে, অর্থাৎ বারাে শতাব্দী ধরে চলে আসছিল। এর পরের পনেরাে শতাব্দী একইভাবে থিওডােসিয়াসের আদেশ পালিত হয়ে এসেছিল।
থেসালোনিকিতে গণহত্যা সংগঠন ও থিওডোসিয়াসের ক্ষমতা চাওয়ার মাধ্যমে চার্চের ক্ষমতার প্রমাণ : থিওডােসিয়াসের আমলে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনাটি ঘটে ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে। যদিও সেরকম একটি সময়ে আর্বোগাস্ট এবং দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান গাউলে শাসন করছিলেন। সে বছর সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রিসের উত্তরপূর্বদিকে একটি শহর থেসালােনিকায় স্থানীয় গুরুত্বহীন একটি বিষয় নিয়ে ভয়াবহ ঝামেলা সৃষ্টি করেছিল। থিওডােসিয়াস ক্ষোভে আর রাগে হঠাৎ থেসালােনিকায় পাল্টা আক্রমণের আদেশ দেন। একটি সেনাবাহিনীতে আক্রমণের দায়িত্ব দেয়ায় তারা প্রায় সাত হাজার লােককে হত্যা করল। মিলানের বিশপ অ্যাম্ব্রোস এই ঘটনার কারণে থিওডােসিয়াসের উপরে এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে তিনি বললেন যে, জনসাধারণের সামনে এই নিয়ে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত থিওডোেসিয়াস আর চার্চের ব্যাপারে নাক গলাতে পারবেন না। থিওডােসিয়াস আট মাস যাবৎ বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার পরে শেষে ক্ষমা চেয়েছিলেন। চার্চ যে রাষ্ট্রের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পরােয়া না করে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়ার যােগ্যতা অর্জন করেছিল, এটাই ছিল তার প্রথম দৃষ্টান্ত। তবে এটি লক্ষণীয় ছিল যে এরকম ঘটনা সাম্রাজ্যের পশ্চিমদিকে ঘটছিল, পূর্বে নয়। শত শত বছরব্যাপী পশ্চিমের চার্চগুলাে রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী এবং স্বাধীন হয়ে উঠেছিল।
সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি : ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৪৮ সালে) থিওডােসিয়াস মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে তারপরেও সাম্রাজ্য ঠিকঠাকমতােই চলছিল। তার পরের দেড় শতাব্দীব্যাপী উত্তর দিক থেকে জার্মানিক জাতির হামলাও দক্ষতার সাথে ঠেকিয়ে আসছিল। বিভিন্নপর্বে সাম্রাজ্যটি পারস্যের সেনাবাহিনীর মােকাবেলাও করেছে এবং সেনাপ্রধানদের নিজেদের মধ্যে বাঁধা যুদ্ধও মিটিয়েছে। এর মধ্যে খ্রিস্টানদের সাথে প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের এবং খ্রিস্টানদের ভেতরেই দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য নিয়ে জমে ওঠা লড়াই সামলেছে। সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা এবং তারা দলে দলে অ্যাড্রিয়ানোপলে মৃত্যুবরণ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলাে, শাসন চলে গেছে জার্মানদের হাতে। কিন্তু তখনও সাম্রাজ্যের সকল সীমানা নিরাপদ এবং অবিকৃত ছিল। এর থেকেই বােঝা যায় যে আশেপাশের জার্মানিক জাতিরা আসলে সুসংগঠিত ছিল না। তারা কখনও একজন দক্ষ নেতার অধীনে একত্র হয়ে সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালাতে পারেনি। তারা ঝটিকা আক্রমণে অভ্যস্ত ছিল। রােম যখন ভেতরের গৃহযুদ্ধের ঝামেলায় জর্জরিত ছিল, তখনই কেবল এধরনের সামান্য হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যথেষ্ট যােগ্যতার সাথে সুসংগঠিত হওয়া ছাড়া রােমান সেনাবাহিনীর মােকাবেলা করা তাদের জন্য ছিল অসম্ভব একটি বিষয়। বলতে গেলে বাইরে থেকে কোনাে দল এসে রােমান সাম্রাজ্যের ভেতরে আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার চেয়ে রােমানদের নিজেদের হাতেই যেন সাম্রাজ্যটি নির্মূল হয়ে যাচ্ছিল। থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর সময়েও সাম্রাজ্যের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না, যা তার পরের দেড়শ বছরের মধ্যে দাঁড়ায়। কিন্তু সাম্রাজ্যের অবস্থা এতটা করুণ আগে কখনও হয়নি। দেড় শতাব্দী ধরে সম্রাট এবং সেনাপ্রধানদের সমস্ত চেষ্টা, তাদের অমানুষিক পরিশ্রম বলতে গেলে অরেলিয়ান, ডিওক্লেশিয়ান, কন্সট্যান্টাইন, জুলিয়ান, ভ্যালেন্টিনিয়ান এবং থিওডােসিয়াসের পরিবারের বংশগত ধারা অটুট রাখতেই ফুরিয়ে গেছে। পারস্য তখনও সিরিয়ার পথ নির্দেশনার জন্য বসে আছে, জার্মান জাতি দানিয়ুবের তীরে যখনই পারছে তখনই আক্রমণ করে চলেছে (হানরাও তাদের তাল দেয়ার জন্য সবসময় তৈরি আছে), অরাজকতা সৃষ্টির একটি সুযােগও কেউ হারায়নি। এরকম ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে, এমনকি ডিওক্লেশিয়ানের রাজত্বের পরের অর্ধশত শতাব্দীর অরাজকতা সত্ত্বেও, সাম্রাজ্যে এমনও জায়গা ছিল যেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে। মিশর এবং সিরিয়া বরাবরই সমৃদ্ধ ছিল। সেই অরাজকতার সময়ে সেই স্থানগুলাের ধনী মানুষেরা আরও ধনী হতে লাগল, আর দরিদ্ররা হয়ে পড়ল আরও বেশি দরিদ্র। মােটের ওপরে রাজকীয় আইনকানুনের জাহাজ যেন ডুবতে বসেছিল, প্রতি দশকে যেন আরও একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিল, বলতে গেলে কোনােরকমে ভেসে ছিল। জনসংখ্যা আরও দ্রুত কমে গেল। শহরগুলাে যতটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। শাসনব্যবস্থা দুনীতির চাপে পুরােপুরি অকার্যকর এবং অদক্ষ হয়ে পড়ল।
প্যাগান সাহিত্য ও দর্শনের সমাপ্তি, খ্রিস্টীয় ল্যাটিন সাহিত্যের বিকাশ, এবং খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব
প্যাগান সাহিত্যিক সিমাকাস ও আসোনিয়াস, ইহুদিদের শান্তিপূর্ণ ধর্ম পালনের অবসান ও দার্শনিকদের দার্শনিক চিন্তা বন্ধ : জ্ঞানী মানুষদের জীবনযাত্রার মানও সে সময় অনেক নেমে গিয়েছিল। প্যাগান সাহিত্য শেষবারের মতাে সামান্য ধপ করে জ্বলে উঠে যেন নিভে যাওয়ার উপক্রম হলাে। তাদের শেষ উল্লেখযােগ্য সাহিত্যিক ছিলেন কুইন্টাস অরেলিয়াস সিমাকাস যিনি ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্যাগান সাহিত্যে রােমের বিখ্যাত এবং প্রগতিশীল সাহিত্যিক। তিনি সরকারি উচ্চপর্যায়ে কাজ করেন এবং সততা আর মানবিকতার জন্য তার নামডাক হয়। প্যাগান ধর্মের বিষয়ে লেখালেখির পক্ষে তিনি ছিলেন নির্ভীক এবং খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক বিকাশের আগমুহূর্তে জনগণের উদ্দেশে উত্তরের আশা না করে তিনি অনেকগুলাে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তিনি প্যাগান সিনেটরদের প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া দলটির নেতৃত্ব দিতেন এবং গ্রেশিয়ান যখন সিনেট থেকে যুদ্ধজয়ের বেদিটি সরিয়ে ফেলেছিলেন, তখন সিমাকাস দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের কাছে একটি অভিযােগপত্র লিখেছিলেন। রােমের প্রাচীন ঐতিহ্যের বেদিটি আবার সেখানে সসম্মানে বসানাের জন্য তিনি দাবি জানিয়েছিলেন। এসব নিয়ে নানান ঝামেলা হলেও পরে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তিনি রােমে উচ্চপদেই চাকরিরত থাকেন। শেষে তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া রােমান কবি ডেসিমাস ম্যাগনাস অসােনিয়াস প্যাগান ধর্মের পক্ষে কিছু লেখালেখি করেছিলেন। তিনি ৩১০ খ্রিস্টাব্দে বুর্ডিগালায় (বর্তমান বাের্ডিওক্স) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শাস্ত্র শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবা ১ম ভ্যালেন্টিনিয়ানের নিজস্ব চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসক বাবার সন্তান ডেসিমাস তরুণ গ্রেশিয়ানকে শিক্ষাদানের কাজে নিয়ােজিত হন। অফিসে সবাই যেন তাকে মেনে নেন, সেজন্য সেখানে তিনি মুখে মুখে খ্রিস্টান সাজার চেষ্টা করতেন। গ্রেশিয়ানের শাসনামলে তিনি অনেক সম্মান এবং উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু গ্রেশিয়ানের মৃত্যুর পরে তিনি তার নিজস্ব শহরে গিয়ে থাকা শুরু করেন। তিনি আশি বছর বয়সে মারা যান এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত বেশ নিম্নমানের কিছু কবিতা রচনা করে যান। খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে বিভিন্ন স্থানে দলে দলে ইহুদিরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ধর্মীয় উপাসনা করতে পারত। খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে সেটি যেমন বন্ধ হলাে, কিছু গ্রিক দার্শনিকও তাদের চিন্তা চেতনা বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। ডায়োজেনিস এবং সাইনিক তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য।
খ্রিস্টান ল্যাতিন সাহিত্যিক জেরোমি ও ল্যাতিন ভাষায় বাইবেল ভালগেট : খ্রিস্টান ল্যাটিন সাহিত্য এর মধ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। মিলানের লেখক অ্যাম্ব্রোস প্রচুর লিখেছিলেন, তবে জেরােমির (ইউসেবিয়াস সফ্রোনিয়াস হিয়েরােনিমাস) লেখা ছিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জেরােমি ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ইলিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যদিও খ্রিস্টান পরিবারে জন্মান, কিন্তু প্যাগান শিক্ষা এবং সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাইবেলভিত্তিক রচনায় ল্যাটিন ভাষার এলােমেলাে আর দুর্বল ব্যবহার তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তিনি বাইবেলকে নির্ভুল ল্যাটিন ভাষায় লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই চিন্তা মাথায় রেখে তিনি পূর্বদিকে ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি কেবল গ্রিক শিখেছিলেন, তাই নয়, শিখেছিলেন হিব্রুও। একই সাথে তিনি বাইবেলকে ল্যাটিনের প্রকৃত রূপে অনুবাদ করেছিলেন। জ্ঞানী র্যাবিসের ভূমিকাও তিনি অস্বীকার করেননি। বাইবেলের যে প্রকাশনাটি “ভালগেট” নামে পরিচিত সেটি তার প্রচেষ্টার ফসল। (এর নামকরণের কারণ হলাে, “ভালগার” মানে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ভাষায়, অর্থাৎ সে সময়ে পশ্চিমে মানুষের মুখের যে ভাষা ছিল তা হলাে ল্যাটিন। তিনি বাইবেলের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ যে হিব্রু বা গ্রিকে রচিত হয়েছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসে তাকে একটি পরিপূর্ণ ল্যাটিন আকার দিতে সক্ষম হন। তখন থেকেই খ্রিস্টান নাইসিনীয় ও পরবর্তীতে ক্যাথোলিক চার্চগুলােতে “ভালগেট” ব্যবহৃত হয়ে আসছে।)। জেরােমি রােমে একবার ফিরে এসেছিলেন কিন্তু বেশিদিন থাকেননি। তিনি তারপরে আবার পূর্বদিকে যাত্রা করেন এবং বেথেলহামে ৪২০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব : সাধারণত উপাসনালয়ের পুরােহিতরা খুব আড়ম্বরবিহীন জীবনযাপন করতেন। এক দিক দিয়ে এছাড়া তাদের অন্য কোনাে উপায় ছিল না, কারণ বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানে জীবনের প্রয়ােজনীয় সবরকম সুযােগ সুবিধাও পাওয়া যেত না; অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের লােকালয়ে ছিল তাদের বাস। আবার তারা যেভাবে জীবনযাপন করতেন, তাতে বলতে গেলে স্বেচ্ছায় শরীর এবং মনের সকল চাহিদার উর্ধ্বে উঠে যেতেন। তারা মনে করতেন এভাবে নিজের সমস্ত ইচ্ছে থেকে মুক্ত হলেই তারা পুরােপুরি বিধাতার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করতে সক্ষম হবেন। শরীর এবং মনের কামনা-বাসনাকে অগ্রাহ্য করার এই পদ্ধতিকে তারা “সন্নাস ব্রত” (“অ্যাসেটিসিজম”) বলে উল্লেখ করেছেন যা গ্রিক শব্দ “অ্যাস্কেটিকস” থেকে এসেছে যার অর্থ গ্রিসে ছিল “শরীরচর্চা করা”। গ্রিক খেলােয়াড়রা যখন স্বাস্থ্য এবং প্রতিযােগিতার জন্য অনুশীলন করতেন তখন তাদের জীবনের যাবতীয় বিলাসিতা ভুলে যেতে হতাে। এছাড়া অন্য অর্থে “অ্যাসেটিক” বলতে, প্রশিক্ষণে রত কোনাে ব্যক্তিকে বােঝায়। প্রাথমিক পর্যায়ের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা বলতে গেলে কিছুটা সন্নাসী ধরনের ছিলেন। কারণ তারা রােমান সমাজের আরাম-আয়েস, আনন্দ উদযাপনের নিয়মরীতি বা প্রতিমা পূজাকে অনৈতিক মনে করতেন। যাই হােক, খ্রিস্টধর্ম যতই সফলতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তাদের আচার আচরণও তেমন সন্নাসীর মতাে হয়ে যাচ্ছিল। তখন বিষয়টি এমন হয়ে দাড়াল যে, কেবল খ্রিস্টান হওয়াই যেন যথেষ্ট নয়, সন্নাসী হতে হবে।
সন্ন্যাসী অ্যান্থনি ও সিমিওন : খ্রিস্টান সন্নাসীদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযােগ্য সন্নাসী হলেন অ্যান্থনি, যিনি ছিলেন মিশরের একজন নাগরিক। তিনি সম্ভবত একশ বছর বেঁচে ছিলেন, ২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৫০ সাল পর্যন্ত। মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মরুভূমির মাঝখানে একা, বিলাসবর্জিত জীবনযাপন শুরু করেন। পরবর্তীকালে লেখকেরা তাকে নিয়ে নানান নাটকীয় কাহিনী লিখেছিলেন। (যেমন অ্যানাসিয়াস লিখেছিলেন তাকে নিয়ে। লেখক এরিয়ানিস্টদের বিরুদ্ধে অ্যান্থনির আবেগী বিরােধিতা খুব উপভােগ করতেন।) অ্যান্থনি তার জীবনে সমস্ত ভােগ বিলাস থেকে অনেক দূরে থাকতেন। অ্যান্থনির কথা সে যুগে এবং পরেও অনেক উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেজন্যেই মিশরের মরুভূমি ছিল সন্ন্যাসীদের আখড়া। এর জনপ্রিয়তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সত্যিকারের ধার্মিকদের কাছে, এই সন্ন্যাসব্রত এবং তার পথে জীবনের সমস্ত ভােগ বিলাস ত্যাগের ব্রত অবশ্যই একটি আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। তারা মনে করতো এটাই পরকালে স্বর্গে যাওয়ার সহজ রাস্তা। সন্ন্যাসব্রত পালন করতে গিয়ে কেউ কেউ তার নিজস্ব পৃথিবীতে এমন ভাবে ডুবে যান যে তার বাইরের জগতের সাথে তার আর কোনাে সম্পর্ক রাখতেন না। বাইরের সবার কাছে এদের জীবনপদ্ধতি অনেক সময়ই খুবই অর্থহীন মনে হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সিমিওন নামে একজন সিরিয়ান সন্নাসীর কথা। তিনি ৩৯০ থেকে ৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং খুবই অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য এক সন্নাস জীবনযাপন করেছেন। তিনি উঁচু স্তম্ভ তৈরি করেন এবং তার উপরে বসবাস আরম্ভ করেন। তিরিশ বছরব্যাপী দিনে এবং রাতে, সব রকমের আবহাওয়ায় তিনি স্তম্ভের উপরেই ছিলেন, কখনও নেমে আসেননি। তাকে তার বসবাসের পদ্ধতি অনুসারে সিমিওন স্টাইলাইটস (গ্রিক ভাষায় স্টাইলাইটস শব্দের অর্থ স্তম্ভ) নামে ডাকা হতাে। তিনি যেরকম জীবন কাটান সেটি বেশিরভাগ মানুষের জন্যই চিন্তার অতীত।
সন্ন্যাসবাদের সমালোচনা ও বিশপ বেসিলের সংস্কারের মাধ্যমে বেসিলীয় সন্ন্যাসবাদীদের মানব কল্যানের নিমিত্তে সামাজিক কর্মে যোগদান : অবশ্যই বেশিরভাগ মানুষই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে যে, এ ধরনের একটি জীবনযাপন সত্যিকার অর্থে বিধাতাকে কতটুকু প্রসন্ন করতে পারে। এছাড়াও নিভৃতচারী একাকি সন্নাসীরা, যারা স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখছিলেন, তারা যেমন পৃথিবীর লােভলালসা পরিহার করতে পেরেছিলেন তেমনি আরেকভাবে ভাবলে তারা জীবনের দায়িত্ব এবং পরিশ্রমও পরিহার করেছিলেন। সমাজের প্রতি দায়িত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করে কেবল নিজের আত্মার শান্তির জন্য গ্রহণ করা এরকম সন্ন্যাসব্রতকে অনেকেই সমালোচনা করতে শুরু করলো। সিসারির বিশপ বেসিল তাই এই সন্নাস্বতের পাশাপাশি আরেকটি ধ্যানের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এশিয়া মাইনরের ক্যাপাডােসিয়ার রাজধানী ছিল সিসারি। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে বেসিল এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যারা চার্চের ইতিহাসে অনেক অবদান রেখেছেন। বেসিল ছিলেন সন্নাসীদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী। সচক্ষে তাদের জীবনাচরণ দেখার ইচ্ছে থেকে তিনি মিশর এবং সিরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মানুষের শক্তিকে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করার জন্য এর চেয়ে আরও গ্রহণযােগ্য পদ্ধতি আছে। এক্ষেত্রে একবারে একাকি থাকার চেয়ে একটি ছােট দল মানুষের মাঝখানে থাকা হয়তাে বেশি উপযুক্ত হতে পারে। তিনি একটি দল গঠন করেন। কিন্তু দেখা যায়, সেই পুরাে দলটিই জীবনের লােভ লালসা থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলেছে। অবশ্য তিনি সেই দলটিকে কেবল ধ্যানে মগ্ন হয়ে না থেকে সামাজিক কাজকর্ম এবং প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকতে বলেছিলেন। এছাড়া তিনি উল্লেখ করে দিয়েছিলেন যে, তারা যে কাজ করবে তা যেন কেবল বিধাতার প্রতি উৎসর্গের জন্য না করে, বরং তা করতে হবে মানুষের মানবিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে। এর অর্থ দাঁড়ায় সেই দলটিকে একটি লােকালয়ের মধ্যখানে বসবাস করতে হবে, যাতে করে তাদের ভালাে এবং মানব কল্যাণে করা কাজের ফসল সেখানকার মানুষ পেতে পারে। একই সাথে পৃথিবীতে পাপ পরিহারের সাথে সাথে সন্নাসীরা পৃথিবীর মানুষের জন্য ভালাে কিছু করে যেতে পারেন বলে তিনি মনে করতেন। যাই হােক, এই ধরনের বেসিলিয়ান (বেসিলের জীবনাচরণ অনুযারী) সন্ন্যাস সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে বেশি তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে ৫ম শতাব্দীতে এটি ইতালিতে জনপ্রিয় হয়।
আর্কাডিয়াস (৩৮৩-৪০৮ খ্রি.), অ্যানোরিয়াস (রা. ৩৯৩-৪২৩ খ্রি.) এবং রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব
আর্কাডিয়াস ও অ্যানোরিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ, এবং রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্তি : থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর পরে তার দুই তরুণ পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। আর্কাডিয়াস ছিলেন তার বড় ছেলে, যার বয়স তখন ছিল সতের। তিনি কন্সস্ট্যান্টিনােপােলে বসবাস করে সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে শাসন শুরু করেছিলেন। অনােরিয়াস ছিলেন ছােট ছেলে, যিনি মিলানে থাকতেন এবং পশ্চিম দিকের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। আর্কাডিয়াস এবং অনােরিয়াস ছিলেন বয়সে তরুণ, দুর্বল এবং অসমর্থ। তারা যখন ক্ষমতা হাতে নেন, থিওডােসিয়াসের আদেশ অনুয়ায়ী তারা ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতিরক্ষার আওতায়। গ্যালিক সেনাপ্রধান রুফিনাসের দায়িত্বে ছিলেন আর্কেডিয়াস এবং স্টিলিকো ভ্যান্ডালের দায়িত্বে ছিলেন অনােরিয়াস। সেই দুই সেনাপ্রধানের মধ্যে সবসময় বিরােধ লেগে ছিল। রুফিনাস পূর্ব ইলিরিয়া দখল করেন আর স্টিলিকো সেটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা তাদের বিরােধ নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিতে সক্ষম হননি। ডিওক্লেশিয়ানের শতাব্দীর পর থেকে, এটা সত্যি যে কাগজে কলমে সাম্রাজ্যকে এভাবে দুই ভাগে ভাগ করে শাসনকার্য চালানাে হচ্ছিল। বাস্তবে ছিল একই সাম্রাজ্য এবং যুগ্ম সম্রাট। যেমন ধরা যাক, কোনাে আইন যখন পাশ করা হতাে তখন, দুজন সম্রাটের সম্মতিতেই তা করা হতাে। কিন্তু অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ শতাব্দী থেকে রােমান সাম্রাজ্যে দুজন কনসল নির্বাচিত করার যে নিয়ম চলে আসছিল, তা তেমনই ছিল। একজন কনসল রােমে থাকতেন এবং আরেকজন থাকতেন কন্সট্যান্টিনােপলে। (এই নিয়ম ৫৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। তাই সবাই বলে যে এই প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার বছরেরও বেশি ধরে কার্যকর ছিল।)। বাস্তবে থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর পর থেকে সাম্রাজ্য পুরােপুরি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দুই অংশের মধ্যে ক্রমাগত গণ্ডগােল লেগে থাকে। এক অংশের প্রণীত আইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য অংশের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াত। এই ধরনের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সম্রাটেরা দুজনই নিজেদের দিকের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে ভালাে কিছু হাতিয়ে নিতেন। বিশেষ করে প্রাদেশিক বৈরী ভাব সাম্রাজ্যের দুই অংশের মধ্যে ঝামেলা আরও বাড়িয়ে তুলত। ইলিরিয়া ছিল পশ্চিম দিকের একটি শহর যা প্রকৃতপক্ষে পূর্ব আর পশ্চিম অংশের মাঝখানে সীমানা হিসেবে কাজ করত। অবশ্য কন্সট্যান্টিনােপলের শাসক এই অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রেখেছিলেন। এই ঘটনার কারণেই ইলিরিয়াকে নিয়ে দুই অংশের শাসকের মধ্যে শক্রতার সূত্রপাত হয়। এই শত্রুতা তাদের এমন পর্যায়ে নিয়ে গেল যে বাস্তবে সাম্রাজ্যটি দুই ভাগ হয়ে গেল। দুই অংশে দুই উচ্চাভিলাষী এবং অসহনশীল সম্রাট কেবল কাগজে কলমে নয়, সত্যিকার অর্থে সাম্রাজ্যকে দুই ভাগ করে ফেললেন।
পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিশপদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ ও জন ক্রিসস্টম : এছাড়াও সাম্রাজ্যের দুই ভাগের মধ্যে ছিল আরেক ধরনের দলাদলি (থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর সময়েও যা তেমন প্রকটভাবে দেখা যায়নি) তা অনেক বেশি মাথাচারা দিয়ে উঠল। এই দলাদলি ছিল ধর্মীয়। এভাবে পূর্ব এবং পশ্চিমের, অর্থাৎ রােম এবং কন্সট্যান্টিনােপলের বিশপদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়ে গেল। এই ধর্মীয় দলাদলি এতই তীব্র ছিল যে তা সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশকে একেবারে আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিলাে। জন নামের গ্রিক চার্চগুলাের ফাদারদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বিশপকে কেন্দ্র করে এই তর্কবিতর্ক চরমে পৌঁছে গেল। বিশপ জনকে ক্রিসস্টম (“সােনার মুখ”) নামে ডাকা হতাে। এরকম নামকরণের কারণ ছিল তার বক্তৃতা। অসাধারণ বাগ্মী এই বিশপের কথা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। জন ক্রিসস্টম ৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে অ্যান্টিয়কে একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতা দেখে সহজেই অনুমান করা যেত যে তিনি একজন অসাধারণ আইনজীবী হতে পারতেন। যাই হােক, ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের জন্য কর্ম স্থির করেন এবং নিভৃতচারী সন্ন্যাসী খ্রিস্টানে পরিণত হন। বছরের পর বছর তিনি নিজেকে অ্যান্টিয়কের পূর্বদিকের এক মরুভূমিতে লুকিয়ে রাখেন। সেখানে ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে সেখান থেকে স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয় কেবল অসুস্থতার কারণে। ফিরে এসে তিনি চার্চের ফাদার হয়ে যান। তিনি অসাধারণ দক্ষতায় বক্তৃতা দিতে পারতেন। তার জ্ঞান নয়, তার বলার মাধুর্যই তাকে জনপ্রিয় করেছিল। তিনি নিজের জীবন একটি আদর্শের উপরে চরমভাবে নির্ভর করে কাটিয়েছেন। নিজের সমস্ত ধনদৌলত তিনি হাসপাতাল, স্কুল স্থাপন করতে এবং দরিদ্রদের সেবায় ব্যয় করেছেন। এসবের মাধ্যমেই তিনি মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে, থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর তিন বছর পরে কন্সট্যান্টিনােপলের ধর্মগুরুর মৃত্যু হয়। জন ক্রিসস্টম সে জায়গায় মনােণীত হন। এরপরে তিনি তার প্রভাব আরও বেশি করে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন এবং তা বিস্তার লাভ করল। তার ধর্মোপদেশ, অমরত্ব এবং বিলাসিতার প্রতি বিরুদ্ধ উচ্চারণ দিনে দিনে বলিষ্ঠ হতে লাগল। তিনি ধর্মযাজকদের কৌমার্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বিশেষ করে একজন কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেননি তবে সকলেই তার ধাঁরালো নির্দেশের আওতায় পড়ত। (কখনও তার যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, তবে তা হয়েছে এই কারণে যে তিনি ছিলেন ভয়ানক বদরাগী) তাই স্বাভাবিকভাবে তার চার্চের ধর্মগুরুদের মধ্যেই কারও কারও সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল। বিশেষ করে যাদের ওপরে তার নিয়মের বােঝা পড়ল তারা ক্ষেপে গেলেন। যেমন অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ, থিওফিলাস ছিলেন বিলাসী। তাই ক্রিসস্টমের উপরে তিনি খুব ক্ষিপ্ত হলেন। ঘটনাক্রমে থিওফিলাস ছিলেন সম্রাজ্ঞী ইউডােক্সিয়ার প্রিয়, যিনি স্বামীকে সম্পূর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন। আবার ওদিকে ইউডােক্সিয়া ক্রিসস্টমকেও পছন্দ করতেন তার ভাষণের জন্য। ক্রিসস্টমের সমালােচনার তীরে বিদ্ধ হলেও ইউডােক্সিয়া অবশ্য মােটামুটি ভালােভাবেই তার জীবন কাটিয়েছেন।
জন ক্রিসোস্টমের নির্বাসন : ৪০৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশেষ সভা ডাকা হয়, যেখানে থিওফিলাস, জন ক্রিসস্টমকে অরাজকতার অভিযােগে অভিযুক্ত করেন। অপরাধের একটি বিচারকাজের ব্যবস্থাও সেখানে করা হয়। জন ক্রিসস্টম সেখানে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানান এবং সে কারণে তাকে আগেভাগেই ধর্মগুরুর পদ থেকে বহিষ্কার করে বন্দী করা হয়। মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে ইউডােক্সিয়া দুদিন পরে তাকে আবার ডেকে আনেন। সেটি অবশ্য ছিল মানুষের বিক্ষোভ শান্ত করার একটি চেষ্টামাত্র। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি সভা ডাকা হলাে যেখানে নাক গলানাের মতাে জার্মান লােকদের কন্সট্যান্টিনােপলে ডাকা হয়নি। কারণ তখন জন ক্রিসস্টম কিংবা থিওফিলাস, যেই জিতুক না কেন, সেনাদের তাতে কিছু আসতো-যেতো না। তারা কেবল জানত আদেশ প্রতিপালন করতে। সেই আদেশ যদি হয় নিরীহ মানুষকে হত্যা করার, তবে তাদের তাই করতে হতাে। জনগণ এই বিষয়ে আগে থেকেই জানত, তাই তাদেরও কিছু বলার ছিল না। দ্বিতীয়বারের মতাে বন্দীদশায় পড়লেন জন ক্রিসস্টম। কন্সট্যান্টিনােপল থেকে চারশ মাইল দূরে, এশিয়া মাইনর বাড়তে বাড়তে যেখানে পূর্বদিকের সীমানায় গিয়ে পৌঁছেছে, জন ক্রিসস্টমকে সেখানে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। যদিও সেখানে থাকার সময়ে সাম্রাজ্যের সকল অনুসারীর সাথে তিনি সবসময় যােগাযােগ রক্ষা করতেন। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার যে তিনি সেখানে বসে নির্ভীকভাবে রােমের বিশপের কাছে এবং পশ্চিমের সম্রাটের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি তাদের আবেদন জানিয়েছিলেন তার অপরাধটি আবার নতুন করে বিবেচনা করার জন্য। কন্সট্যান্টিনােপলের বিচারালয়ের গ্রহণযােগ্যতার পক্ষে এটি ছিল জঘন্যতম একটি কাজ। এই কাজের মাধ্যমে তিনি পশ্চিমের সম্রাটের বিশালতা প্রমাণ করেন এবং ধর্মীয় অঙ্গনে রােমের বিশপের সর্বোত্তম অবস্থানকে নিশ্চিত করেন।
জন ক্রিসোস্টমের মৃত্যু, তার সিদ্ধপুরুষে পরিণত হওয়া, কনস্ট্যান্টিনোপলের ধর্মীয় গুরুত্ব হ্রাস ও রোমের গুরুত্ব বৃদ্ধি : ইউডােক্সিয়া ততদিনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিন্তু বিচারালয়ে আর যারা ছিলেন, তারা অনুমান করেছিলেন যে এই ধাঁরালাে চিন্তার অধিকারী বৃদ্ধ মানুষটিকে কোনােভাবে চুপ করাতে হবে। তাকে আগের চেয়ে আরও দূরবর্তী স্থানে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। এবারে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলাে সাম্রাজ্যের উত্তরপূর্ব দিকের প্রান্তে। ৪০৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পরের বছর পশ্চিমের সম্রাট আর্কাডিয়াসও মৃত্যুবরণ করেন। তবে জনের মৃত্যুও কন্সট্যান্টিনােপলের মানুষদের ধর্মীয় পুরনাে চিন্তাধারা থেকে বের করে আনতে পারল না। জনের সমস্ত স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ নতুন কোনাে ধর্মগুরুকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় আর এটি করা ছাড়া অন্য কোনাে উপায় ছিল না। জনের মৃতদেহ তার মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে পূর্ণ সম্মানের সাথে কন্সট্যান্টিনােপলে ফেরত আনা হয়েছিল। তার সব অপরাধ যেন উল্টো হয়ে গেল। তাকে একজন ধর্মীয় সিদ্ধপুরুষ বলে ধরে নেয়া হলাে। ওদিকে আর্কাডিয়াস এবং ইউডােক্সিয়ার যে পুত্রসন্তানেরা তখন সিংহাসনে আসীন ছিলেন তারা পিতার অপকর্মের জন্য একটি প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান আয়ােজন করেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও তেমন কোনাে লাভ হলাে না। কন্সট্যান্টিনোেপলের ধর্মীয় গুরুত্ব কমতেই থাকল। অবশ্যম্ভাবীভাবে কন্সট্যান্টিনােপলের ধর্মীয় গুরুত্বও কমে গেল। এভাবে রােমের বিশপের গুরুত্ব গেল বেড়ে। পরেরটাই বলতে গেলে সত্য হলাে। পশ্চিমা ধর্মগুরুদের মধ্যে মিলানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার প্রতিযােগিতায় তখন এক বিরাট ওলটপালট হয়ে গেল।
ধীরে ধীরে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন ও বিভিন্ন রাজ্যসমূহের সৃষ্টি
ভিসিগথদের নেতা অ্যালারিক ও থিওডােরিক এবং ভিজিগথিক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা
উলফিলা, গথদের এরিয়ান খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা এবং নাইসিনীয় রোমানদের সাথে দ্বন্দ্ব : দেড়শ বছর আগে প্রথম যখন রােমান সম্রাট ডেসিয়াসকে হত্যার ত্রাসের মাধ্যমে রােমান সাম্রাজ্যের সীমানার মধ্যে তাদের যেরকমটা দেখা যায়, এসময় তারা আর ততটা অসভ্য ছিল না। বলতে গেলে তারা অনেকটা রােমানই হয়ে গিয়েছিল। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তারা ক্রমাগত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে লাগল। অবশ্য এর পেছনে একজন মানুষের অবদান ছিল যিনি নিজেও ছিলেন ভিসিগথ উপজাতির। তার নাম ছিল উলফিলা (ছােট্ট উলফ বা নেকড়ে)। রােমানদের কাছে তিনি উলফিলাস নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি দানিয়ুবের তীরে, যে জায়গাটি একসময় ডেসিয়া নামে পরিচিত ছিল, সেখানে ৩১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বিশ বছর বয়সের দিকে তিনি নতুন পত্তন হওয়া কন্সট্যান্টিনােপলে বেড়াতে গিয়েছিলেন হয়তাে গথদের কোনাে কাজে। সেখানে গিয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং কাজ শেষে সেই ধর্মের আদর্শ বয়ে নিয়ে যান তার স্বজাতির জন্য। তার বাকি জীবন তিনি গথদের মাঝে খ্রিস্টধর্মপ্রচারে ব্যয় করেছিলেন। ধর্মপ্রচারের প্রচেষ্টায় তিনি বাইবেলের বেশিরভাগ অংশ গথদের ভাষায় রূপান্তর করেছিলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি এক ধরনের বর্ণমালাও আবিষ্কার করেছিলেন যেটা আগে ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, তার হাতে বাইবেলের সেই রূপান্তর করা অংশ এখনও পাওয়া যায়। বিশেষ করে বাইবেলের নতুন অংশ, যেটি এখনও গথিক ভাষায় পাওয়া যায়। উলফিলাস সমস্ত গথ জাতিকে বদলে ফেলতে পারেননি তবে তিনি তাদের পরিবর্তনের শুরুটা করে দিয়েছিলেন। তিনি নিজের চারপাশে কিছু মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে ফেললে তাদের ক্ষমতা দিনদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। উলফিলা নিজে কন্সট্যান্টিনােপলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন বলে আরিয়ানদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অন্যদেরও আরিয়ানদের মতাে নব্যতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে সহায়তা করেন। তিনি কন্সট্যান্টিনােপলে ফেরত গিয়েছিলেন। ৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে নাইসিনীয় সম্রাট থিওডােসিয়াসের হাতে যখন আরিয়ান বিশপদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছিল, কন্সট্যান্টিনােপলে সেই সভায় তিনি হাজির হয়েছিলেন। তবে উলফিলা চরম কোনাে অবদান রাখার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। গথদের মিশনারি চিরকাল পেছনেই পড়ে রইল। এটি এরিয়ানিস্ট দল, তাদের শিষ্য এবং কিছু জার্মান উপজাতিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল। এরিয়ানিস্টদের জোর যখন সাম্রাজ্যের ভেতরে কিছুটা কমে এলাে তখন এর বাইরে আকস্মিক বিস্তৃতি পেতে লাগল। এই বিষয়টি গুরুত্ব নিয়ে ভাবার মতাে। এরপর যখন এমন সময় এলাে যে জার্মান যােদ্ধারা সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকটা নিয়ন্ত্রণ করছে, তখন এরিয়ানিজম ছিল তাদের ধর্ম। সেটাই তাদের অন্য মানুষদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করল। এরপর থেকে শুরু হয়েছিল জার্মান নব্যতান্ত্রিক বা এরিয়ানিস্ট শাসক এবং রােমান নাইসিয়ান শাসকদের মতপার্থক্য। এই লড়াই এতই গুরুতর ছিল যে জনগণের মধ্যেও দুটো ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এই বৈরীতা যেন ক্রমশই প্রাচীন সংস্কৃতিটিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিল।
সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের দ্বন্দ্বে আরিয়ানিস্ট ও গথিক নেতা অ্যালারিকের ব্যর্থ কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ : রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব চলছে তখন সেই দ্বন্দ্বের সুবাদে তাদের মধ্যে ভিসিগথরা নাক গলাতে সুযােগ পায়। অ্যাড্রিয়ানােপােলের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তখন প্রায় বিশ বছর, তারপরেও ভিসিগথরা মােয়েসিয়া প্রদেশ দখল করে বসে ছিল। থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর সময়ে নব্যতান্ত্রিক বা এরিয়ানিস্টদের নেতা ছিলেন অ্যালারিক। তিনি ছিলেন গথ জাতির নেতা যিনি দানিয়ুবের উৎসস্থলে ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন থিওডােসিয়াসের সেনাপ্রধানদের একজন। নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে তিনি তার গথিক সেনাদলকে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি নিজেকে রুফিনাস বা স্টিলিকোর চেয়ে সম্রাটের কাছের মানুষ বলে ভাবতেন। কিন্তু তাকে সেরকম কোনো পুরস্কার দেয়া হয়নি বলে তিনি এর প্রতিশােধে আইনত যা পাননি তাই জোর করে পেতে চাইলেন। পুরাে সাম্রাজ্য তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। ওই অবস্থায় অ্যালারিকের তেমন কিছু করার ছিল না। তার কাজটি আগের অনেকবারের মতাে একজন সেনাপ্রধানের গ্রহণ করা ভুলভাল পদক্ষেপের মতােই ছিল। অবশ্য তারও সুযােগ এলাে যখন সাম্রাজ্যের পূর্ব আর পশ্চিম দিকের মধ্যে মারাত্মক শক্রতা দেখা দিলাে। মিলান এবং কন্সট্যান্টিনােপলের উপরে তার বিশেষ প্রভাব ছিল। এই দুই শহরের সেনারাই চাচ্ছিল ইলিরিয়াকে দখল করতে। এই বিরােধিতার সুযােগ নিয়ে অ্যালারিক তাদের শত্রুতা আরও বাড়িয়ে তুললেন এবং রােমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথে জার্মানিক জাতির আক্রমণের ইতিহাসে প্রথম নাম লেখালেন। বিষয়গুলােকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবেই উপস্থাপন করলেন তিনি। তিনি তার বাহিনী নিয়ে সােজা কন্সট্যান্টিনােপলের দিকে যাত্রা করলেন এবং আশা করতে লাগলেন যে তার আগমনের খবরে যেন সেখানে একটি ত্রাসের আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। পূর্বদিকের শাসকেরা তাকে তাড়াতাড়ি জায়গা করে দিলাে। এটা সত্যি যে কন্সট্যান্টিনােপলের শাসকেরা থ্রেসে অ্যালারিকের হামলা ঠেকানাের চেয়ে ইলিরিয়া দখলে ব্যস্ত স্টিলিকোকে ঠেকানােতে ব্যস্ত ছিল। স্টিলিকো অ্যালারিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু কন্সট্যান্টিনােপলের শাসকেরা তাকে তার কাছে ভিড়তে দেননি। স্টিলিকো ব্যর্থ হয়ে ইতালিতে ফিরে আসেন কিন্তু প্রতিশােধের আগুনে জ্বলেপুড়ে শেষ পর্যন্ত রুফিনাসকে বন্দী করেন। এতে অবশ্য কোনাে লাভ হয়নি। অন্য অনেক মন্ত্রীরা, যারা এরকম একটি সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন, তাড়াতাড়ি কন্সট্যান্টিনােপলে গিয়ে ফাঁকা পদটি লুফে নিলেন। কন্সট্যান্টিনােপলের বিরুদ্ধে অ্যালারিকের মিথ্যাচারটি টিকলাে না।
অ্যালারিকের গ্রিসে আক্রমণ ও তদকালীন গ্রিসের অবস্থা : তিনি জানতেন সেখানে আর বেশি ঘাটাঘাটি করে কোনাে লাভ নেই। তাই কন্সট্যান্টিনােপল বাদ দিয়ে তিনি মােটামুটি দুর্বল গ্রিসের দিকে রওনা দিলেন। তিনি জানতেন সেখানে তাকে ঠেকানাের কেউ নেই। গ্রিস তখন অন্য কিছুর জন্য বিখ্যাত না হলেও প্রায় একশ বছর ধরে যে সেখানে শান্তি বজায় ছিল, সেটা সবাই জানত। গ্রিস তখন আগের সেই ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে এসেছে ঠিকই তবে তখনও সেই আগের দিনের বিলাসিতা আর প্রাচুর্যের স্বপ্নে বিভাের। বেশিরভাগ প্রাচীন মন্দির এবং মূর্তি বা স্মারক স্থাপত্য ভেঙে পড়েছিল সময়ের সাথে সাথে। কিছু কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এসবের কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ গ্রিসকে পাশ কাটিয়ে নতুন শহর কন্সট্যান্টিনােপলের দিকে ঝুঁকেছিল, আর কখনও বা নতুন খ্রিস্টান শাসকের সিদ্ধান্তও এর পেছনে কাজ করেছে। মন্দিরগুলাে জনশূন্য পড়ে ছিল, ডেলফি নিজেই যেন ভেঙেচুরে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। খ্রিস্টানদের হাতে তাদের স্বভাববিরুদ্ধ ইলিউসিনিয়ান ঐতিহ্য স্বাভাবিকভাবেই খুব হেলাফেলা করে দেখাশােনা করা হচ্ছিল। কিন্তু সে সময়ে গথিক জাতির দল অ্যালারিকের সাথে, তারা যদিও নব্যতান্ত্রিক বা এরিয়ানিস্ট খ্রিস্টানই ছিল, কিন্তু ইলিউসিস মন্দিরে ঢুকে পড়ল। ৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৪৯ সালে) সেরেসের পুরনাে মন্দিরটি ভেঙে পড়ল আর এভাবেই সেই প্রাচীন কীর্তিটির সমাপ্তি হলাে।
স্টিলিকোর কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণে অ্যালারিকের পালিয়ে যাওয়া, অ্যালারিকের ইলিরিয়ার গভর্নর হওয়া ও স্টিলিকোর হয়ে ওঠা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি : পশ্চিমদিকে অবশ্য স্টিলিকো আবার নতুন পদক্ষেপ নেয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন কন্সট্যান্টিনােপলের অবস্থা এমন হয়েছে যে সেখানকার কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। অ্যালারিকের দখল করা শহরে হামলা করলে অন্তত কোনাে ঝামেলা ছাড়া অর্ধেক শহর অনায়াসে দখলের আশা তিনি করেছিলেন। মহড়া বেশ ভালােভাবেই শুরু হয়েছিল। কন্সট্যান্টিনােপল দখলের প্রক্রিয়ায় তিনি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। বলতে গেলে অ্যালারিককে কোণঠাসা করে ফেললেন। কিন্তু তার বাহিনী যখন দ্রুত আক্রমণ করছিল তখন অ্যালারিক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কেউ কেউ ভেবেছিল যে স্টিলিকো সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে তার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অ্যালারিককে সাহায্য করবেন। কিন্তু তিনি উল্টো অ্যালারিককে ইচ্ছাকৃতভাবে পালিয়ে যেতে দিলেন এবং তাকে কন্সট্যান্টিনােপলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেন। এভাবে স্টিলিকো হয়ে উঠলেন সমগ্র সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট। এরকম হওয়া সত্ত্বেও সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ স্টিলিকোকে মানতে পারল না। বরং কন্সট্যান্টিনােপলের বিচারালয় অ্যালারিককে বিতর্কিত ইলিরিয়ার গভর্নর বানিয়ে দিলাে। খুব দূরদর্শী হয়ে না দেখলে এটা ছিল একটি বুদ্ধিমান পদক্ষেপ। অ্যালারিককে ক্ষমতা দেয়া একদিকে যেমন তাকে ঘুস দিয়ে শান্ত করার মতাে, অন্যদিকে তার শত্রু স্টিলিকোর হাত থেকে প্রদেশটিকে বাঁচানাে, যে প্রদেশকে স্টিলিকো বহুদিন ধরেই সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের সাথে যুক্ত করতে চাচ্ছেন।
অ্যালারিক ও স্টিলিকোর যুদ্ধ, অ্যালারিকের পরাজয় : তবে ভবিষ্যতের কথা ভাবলে, তখন থেকে অ্যালারিক আর স্টিলিকো যেন চিরশত্রু হয়ে গেল। যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, হলাে তার উল্টোটা। কিছুদিনের জন্য অ্যালারিক এবং স্টিলিকো দুজনেই চুপচাপ ছিলেন। দুজনেই অপেক্ষা করছিলেন সময়সুযােগ মতাে একে অন্যকে আক্রমণ করার জন্য। শেষপর্যন্ত ৪০০ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৫৩ সালে) অ্যালারিকের জন্য সে সুযােগ এসেছিল এবং তিনি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর ইতালিতে আক্রমণ করেছিলেন। স্টিলিকো ধীরে ধীরে এই আক্রমণের উত্তর দেয়ার জন্য তৈরি হলেন। তিনি বাহিনী নিয়ে ইতালির উত্তর দিকে অগ্রসর হলেন। তারপর একসময় পােলেনটিয়ায় দুই বাহিনী মুখােমুখি হলাে এবং তার দুটো বাহিনীই ছিল জার্মান। পােলেনটিয়া হলাে বর্তমান ইতালির উত্তরপশ্চিম দিক। ৪০২ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৫৫ সালে) ইস্টার সানডের দিনে স্টিলিকো আক্রমণ করলেন। অ্যালারিকের জন্য ছিল এটি একটি অতর্কিত আক্রমণ কারণ কেউ ভাবেনি ওরকম পবিত্র দিনে কেউ আক্রমণ করতে পারে। ফলাফল ছিল স্টিলিকোর দিকেই। কিন্তু তার পরে সেই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় পূর্বদিকে ভেরােনায় যুদ্ধ বেঁধে গেল। ৪০৩ খ্রিস্টাব্দে অ্যালারিক ইতালি ছাড়তে বাধ্য হলেন। এবং ইলিরিয়ায় গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
মিলানের দুরবস্থা, রোমের বিশপের হাতে ধর্মীয় ক্ষমতা : যাই হােক ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। মিলান শহর, যা কিনা একশ বছর ধরে সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের অংশের রাজধানী, গথ আর সরকারি কার্যকলাপের দ্বারা সে শহর প্রবল বিপদের মুখে পড়ল। সেখানে কিছুই যেন আর নিরাপদ ছিল না। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৫৭ সালে) তরুণ সম্রাট অনোরিয়াস তার ভাই আর্কেডিয়াসের মতােই হঠাৎ করে স্থান পরিবর্তন করে রাভিনা শহরে চলে গেলেন। শহরটি ২৮০ মাইল দক্ষিণপূর্বদিকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলে। সাড়ে তিনশ বছরব্যাপী জায়গাটি ইতালির ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতাে। রাজধানী মিলান থেকে এই পথটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন মিলানের বিশপ তার সর্বময় ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন এবং সেটি চলে গেল রােমের বিশপের কাছে।
ব্রিটেনের সেনাদের ইতালিতে আগমন ও জার্মানিকদের আক্রমণের ফলে ব্রিটেনের সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া : আশু বিপদের আশঙ্কায় দূরবর্তী এলাকার সেনাবাহিনীকে তলব করা হলাে। সেই বাহিনীগুলাে ব্রিটেন অবস্থান করছিল এবং গ্রেশিয়াসের বন্দী হওয়ার পর থেকে বেশ অসহায় এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই ঘটনার পরে কিছু ছােটখাটো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছাড়া তারা আর তেমন কোনাে কাজে আসেনি। সেনাসদস্যরা কেউ কেউ দ্বীপ ছেড়েছিল এবং আর কখনােই ফেরত আসেনি। বাকি যারা ব্রিটেন রয়ে গিয়েছিল তারা হ্যাড্রিয়ানের দেয়াল থেকে সরে এসেছিল। উত্তর ইতালিতে অ্যালারিকের আক্রমণের কারণে ইতালির বিভিন্ন জায়গায় যে বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাদের একযােগে ইতালিতে ডেকে পাঠানাে হলাে পােলেনটিয়ায় যুদ্ধ করার জন্য। কেউ কেউ পােলেনটিয়ার যুদ্ধের পরে আবার ব্রিটেন ফিরে এসেছিল। রােমান সেনাদের কাছে তাদের নিজেদের সেনাপ্রধানকে সম্রাট ঘােষণা করতে পারার চেয়ে বড় কোনাে বিনােদন আর ছিল না। ৪০৭ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৬০ সালে) বাহিনীটি স্থায়ীভাবে ব্রিটেন ছাড়ল। সাড়ে তিনশ বছর ধরে রােমান সভ্যতার আলােয় আলােকিত ব্রিটেন জার্মান হামলাকারীদের বদৌলতে আবার প্যাগান ধর্ম আর অরাজকতা স্থান করে নিলাে। ব্রিটেনের যতটা ক্ষতি হলাে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হলাে রােমান সাম্রাজ্যের। এটা ছিল রােমান সাম্রাজ্যের জন্য ডেসিয়ার মতােই একটি দূরবর্তী প্রদেশ। সাম্রাজ্যের পতনের মুখে এর অবস্থা ডেসিয়ার চেয়েও খারাপ হয়ে গেল। সাম্রাজ্য থেকে সমুদ্রের মাধ্যমে পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন ব্রিটেন চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
জার্মানিক জাতির সফল আক্রমণ, স্টিলিকোর মৃত্যু ও তার সেনাবাহিনীর গথদের অ্যালারিকের বাহিনীতে যোগদান ও ইতালিতে অ্যালারিকের প্রবেশ : সে সময়ে হয়তাে পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিক থেকে জার্মানদের ক্রমশ ধেয়ে আসাকে নতুন কোনাে উৎপাত হিসেবে কেউ আখ্যা দেয়নি। তখন অন্তত দুই শতাব্দী ধরে গাউলের উপরে ধারাবাহিক হামলার কারণে জার্মান সেনাদের অনুপ্রবেশ মানুষের গা সহা হয়ে গিয়েছিল। তবে এটা সত্যি যে এই অতর্কিত প্রবেশ রােমান সাম্রাজ্যকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলছিল। রােমানদের জন্য জার্মানদের উৎখাত করাটা সবসময়ই খুব কঠিন এবং ব্যয়বহুল ছিল। যদিও তারা অনেকবারই তা করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন তখন থেকে মাত্র অর্ধশতাব্দী আগে জুলিয়ানের তত্ত্বাবধানে মােটামুটি সম্মানের সাথে রােমানরা সেটি করতে পেরেছিল। তবে ৪০৬ সালের শেষ দিনে যে আক্রমণটি সংঘটিত হলাে সেটি ছিল কিছুটা অন্যরকম। কারণ এই আক্রমণ হয়ে দাঁড়ালাে স্থায়ী। এক জার্মান বাহিনী এর আগে আরেক জার্মান বাহিনীকে উৎখাত করেছিল কিন্তু সেবারে আর কেউ তাদের পেছনে লাগেনি। তারা সেখানে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। স্টিলিকো ক্ষমতায় থাকলে এমনটা হতাে না, এরকম ভাবা হয় অনেক সময়। তিনি প্রথমে ভিসিগথ এবং পরে উত্তর ইতালিতে সিউভিদের পরাজিত করেছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই জার্মান এবং স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু তিনি সে সুযােগ পাননি। তার শত্রুরা নিজের জায়গায়ই তাকে পরাজিত করেছে। অনোরিয়াসকে সবাই বলেছিল যে যুদ্ধপাগল মন্ত্রী স্টিলিকো তার নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসানাের জন্য প্রস্তুত করছেন। নির্বোধ অনােরিয়াস তাই বিশ্বাস করেছিলেন এবং তার সেনাপ্রধানের হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। আইনের মাধ্যমে এমন করে তাকে বন্দী করে হত্যা করা হয়েছিল যাকে কেবল খুনই বলা যায়। ৪০৮ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে স্টিলিকোর শিরােচ্ছেদ করা হয়। এটি ছিল একটি ভয়াবহ ভ্রান্তি, যার জন্য সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের ভাগ্য চিরকালের জন্য বদলে যায়। স্টিলিকোর সেনাবাহিনীর মধ্যে গথ উপজাতির সেনারা তখনও অনুগত ছিল। তাই তখন নতুন আবির্ভূত হওয়া নব্যতন্ত্র বা এরিয়ানিজম বিরােধী মন্ত্রীদের অধীনে তারা ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তখন গথ সেনারা একে একে ইতালির বাইরে হামলার পাঁয়তারা করা অ্যালারিক বাহিনীতে যােগ দিতে লাগল। এরপর আরেকবার অ্যালারিক বাহিনী নিয়ে ইতালির ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং এবারে তাকে ঠেকানাের মতাে সেখানে না ছিল কোনাে স্টিলিকো এবং না ছিল কোনাে সেনাবাহিনী। তিনি কোনােরকম বাধা ছাড়াই সােজা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে গেলেন। রােমান সরকারের স্টিলিকোর মতাে মানুষকে হত্যা করা যে আত্মহত্যার সামিল, সেটি প্রমাণ করতে তিনি রােমের তােরণে পৌঁছে গেলেন। ছয়শ বছরের মধ্যে প্রথম রােমান সাম্রাজ্য দেখল যে কোনাে বিদেশী বাহিনী সাম্রাজ্যের দেয়াল টপকেছে। হ্যানিবাল এবং কার্থেজের সময়ের পরে আর এমনটা ঘটেনি।
অ্যালারিকের কাছে রোমের আত্মসমর্পণ, তার আফ্রিকা গমন ও মৃত্যু : অ্যালারিকের অবশ্য রােমকে ধ্বংস করার কোনাে ইচ্ছে ছিল না। পশ্চিম সাম্রাজ্যের অবস্থা যে এতটাই পড়ে গিয়েছিল, এটা তারা আন্দাজ করতে পারেনি। সাম্রাজ্যটি এতই লম্বা সময় ধরে টিকেছিল যে মনে হচ্ছিল যেন কোনােদিনই ধ্বংস হবে না। সাম্রাজ্যটি যেন অমর। অ্যালারিক বলতে গেলে চাচ্ছিলেন সেই অমর সাম্রাজ্যের একটি অংশ হতে। তার ইচ্ছে ছিল, হয় কোনাে প্রদেশের গভর্নর হবেন, নয়তাে কোনাে সেনাবাহিনীর প্রধান অথবা সাম্রাজ্যে ইচ্ছেমতাে জমি এবং সম্পদের মালিক হওয়াও ছিল তার আরেকটি উদ্দেশ্য। অ্যালারিক দ্বিতীয়বারের মতাে রােমে আক্রমণ করে সরকারকে চাপের মুখে রেখে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যখন তাকে কোণঠাসা করে দেয়া হলাে তখন তিনি বাধ্য হয়ে তৃতীয়বারের মতাে রােমে আক্রমণ চালালেন। ৪১০ সালে করা এই তৃতীয় হামলাটিকে তিনি উত্তেজনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। অগাস্ট মাসে রােম তার কাছে আত্মসমর্পণ করল। এই ঘটনা ঘটেছিল স্টিলিকোর মৃত্যুদণ্ডের ঠিক দুই বছর পরে। তার আগে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালে (ঠিক আট শতাব্দী আগে) এক জার্মানিক জাতি রােমে আক্রমণ করে সাম্রাজ্য অকার্যকর করেছিল। তারপর থেকে এমন ঘটনা আর ঘটেনি যে বর্বর সেনারা স্কিপিও, সিজার এবং মার্কাস অরেলিয়াসের শহর রােমকে দখল করে নিলাে। অ্যালারিক সেবার রোম দখল করে রাখলেন কেবল ছয় দিনের জন্য। তারপর দক্ষিণ দিকে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। তার আক্রমণে রােমের উপরে যে অর্থের বােঝা পড়েছিল তা খুব সামান্য এবং রােম শহরে যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল সেটাও খুব বেশি নয়; কিন্তু রােমের মান সম্মানের উপরে যে আঘাত লেগেছিল সেটা সাংঘাতিক। রােমান সাম্রাজ্য বলতে মানুষের চোখের সামনে যে ত্রাসের সৃষ্টি হতাে, সেটি এক নিমেষে বিলীন হয়ে গেল। অ্যালারিক তার দক্ষিণের অভিযানের ভেতরে ভূমধ্যসাগরে যাত্রা করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকা দখল করা। এছাড়া সাম্রাজ্যের বাইরে দিয়ে সিউভি, অ্যালানি এবং ভ্যান্ডাল, এসব প্রদেশের দিকেও তার নজর ছিল। কিন্তু তার জাহাজ পড়ল ভয়ংকর ঝড়ের কবলে এবং ডুবে গেল। তিনি কোনােরকমে রক্ষা পেলেও দক্ষিণ ইতালিতে প্রবল জ্বরের কবলে মৃত্যুবরণ করলেন। মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারী হিসেবে এলেন তার ভগ্নিপতি অ্যাটাউল্ফ।
স্টিলিকোর জায়গায় কনস্ট্যান্টিয়াস এবং স্পেনে জার্মানিক আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাটাউলফ ও ওয়ালিয়া : অ্যালারিকের মতাে অ্যাটাউফেরও ইচ্ছে ছিল রােমান কোনাে উচ্চ পর্যায়ে পদ প্রাপ্তি। তার সাথে তিনি রােমান সাম্রাজ্যকে একটি গথিক সাম্রাজ্যেও পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তিনি দক্ষিণ গাউলে অভিযান চালিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তিনি অনােরিয়াসের সৎ বােন প্ল্যাসিডিয়াকে বিয়ে করেন। এই বিবাহ বন্ধন তাকে অভিজাত রাজকীয় পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করে এবং গাউলে রাজকীয়ভাবে থাকার সুযােগ করে দেয়। এর মধ্যে সাম্রাজ্যের বিচারালয় স্টিলিকোর জায়গায় বসানাের জন্য উপযুক্ত একজনকে খুঁজে পেল। তিনি ছিলেন একজন রােমান, যার নাম ছিল কন্সট্যান্টিয়াস। পশ্চিমে যে কয়েকজন সভ্য শাসক ছিলেন যারা সাধ্যমতাে সাম্রাজ্যের ভালাের জন্য কাজ করতেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। কনস্ট্যান্টিয়াস মনে করতেন জার্মান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার সবচেয়ে সহজ এবং সস্তা উপায় হলাে একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া। তিনি অ্যাটাউল্ফকে সে বিষয়ে উষ্কাতে লাগলেন। সম্রাটের বােনের স্বামী হিসেবে স্পেনে ভিসিগথদেরকে অন্যান্য জার্মানিক ট্রাইবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তােলার দায়িত্ব তার নেয়া উচিৎ। একরকম নির্দেশনা পাওয়ার মতােই এবং পরবর্তীকালে আরও লুটপাট করার উদ্দেশ্যে অ্যাটাউল্ফ তার গথিক বাহিনী নিয়ে স্পেইনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি হত্যার শিকার হলেন কিন্তু তার উত্তরাধিকারী ওয়ালিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তারা অ্যালানি জাতিকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল। সিউভি জাতি স্পেইনের উত্তর পশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করল সে সময়। একই সাথে ভ্যান্ডাল জাতির একটি দলও স্পেনের দক্ষিণ দিকের সমুদ্র দিয়ে ঢুকে পড়তে লাগল। ভিসিগথ তাদের যা করার করত এবং স্পেন থেকে সব সমস্যা দূর করত। কিন্তু এক শত্রুকে আরেক শক্রর বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়াটা এবং সেভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের বিষয়টা ততটা সােজা ছিল না। ভিসিগথদের জিততে দেয়ার ইচ্ছেও ছিলনা রােমানদের আবার তাদের কাজ শেষ না করে স্পেন থেকে চলে যেতেও বলতে পারছিল না।
স্পেন ও গাউলে স্বাধীন ভিজিগথিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা : ৪১৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়ালিয়া মারা গেলেন। তারপর এলাে তার উত্তরাধিকারীর পালা। সে সময়ে ভিসিগথরা স্পেন থেকে আরও বাড়তে বাড়তে গাউলে এসে পড়ল। যাই হােক, জার্মানদের বিরুদ্ধে এভাবে জার্মানদের লেলিয়ে দেয়ার ফল রােমানদের জন্য ভালাে হলাে না। থিওডােরিকের অধীনে ভিসিগথরা তখন গাউলের দক্ষিণপশ্চিম দিকে আস্তানা গেড়েছে। ৪১৮ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১৯৭১ সালে) তারা যে শহরটি স্থাপন করে তার নাম হয়েছিল টাউলুজ রাজ্য। রাজধানীর পরে যেখানে তারা তাদের ক্ষমতার প্রদর্শন করবে বলে ভেবেছিল। টাউলুজ হলাে পাইরেনিজ শহর থেকে দক্ষিণে ষাট মাইল দূরে। পরবর্তী একশ বছর ধরে সেটি ভিসিগথদের রাজার বাসস্থান ছিল। টাউলুজই জার্মানদের বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করার প্রথম রাজ্য। এর আগে জার্মানরা যেসব রাজত্বের পত্তন করেছিল সেসব জায়গায় যেমন ওপর থেকে ছড়ি ঘােরানাের রােমান শাসক ছিল, টাউলুজে তেমন ছিল না। এটা ছিল স্বাধীন জার্মান শক্তি। আর এই রাজ্য স্থায়ীভাবে জার্মান ক্ষমতার অধীনে, অর্থাৎ ভিসিগথদের ক্ষমতার অধীনে ছিল তার পরের তিনশ বছরব্যাপী। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এই রাজ্যটি রােমানদের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। যাই হােক ভিসিগথরা দক্ষিণপশ্চিম দিকের জমিগুলাের মালিক হয়ে গেল। পরের শতাব্দীগুলােতে ধীরে ধীরে ইউরােপের পশ্চিম দিকেও তাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। জমিজমার মালিক জার্মান এবং তাদের উত্তরাধিকারীরা কালক্রমে রােমান কৃষক এবং ভূমিহীন দরিদ্র শ্রেণির উপরে প্রভুত্ব করতে লাগল। ভিসিগথদের উত্থান খুবই উল্লেখযােগ্য। ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে তারা রােমান সাম্রাজ্যে ঢুকেছিল কেবল প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের নামে। দানিয়ুবের নিচের দিক থেকে নদী পেরিয়ে তারা সেখানে প্রবেশ করেছিল এবং হানদের চেয়েও এগিয়ে গিয়েছিল যারা কিনা অতীতে তাদের দাস বানিয়ে রেখেছিল। তখন ঠিক চল্লিশ বছর পরে দেখা গেল যে তারা রােমান সাম্রাজ্যের ভেতরে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করেছে এবং সম্রাটের মদদে বেশ বড়সড় ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে।
হিপোর অগাস্টিন, সম্রাট তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান (রা. ৪২৫ – ৫৫ খ্রি.) ও আফ্রিকায় গাইজারিকের ভ্যান্ডাল রাজ্য
আফ্রিকায় ক্ষমতায় ভ্যান্ডালরা : স্পেনের ভ্যান্ডালেরা ভিসিগথদের আগ্রাসনের কারণে কোণঠাসা হয়েছিল। দক্ষিণ দিকে প্রদেশগুলােতে নানান বাধা বিপত্তির মধ্যেও কোনােরকমে নিজেদের জন্য একটু জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেখানকার পরিস্থিতি ছিল তাদের অনুকূলে এবং নিজেদের জন্য তারা বেশ ভালাে অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সুবাদে তারা পরবর্তী একশ বছরব্যাপী ক্ষমতার চর্চা করতে পেরেছিল। স্থানটি ছিল রােমান সাম্রাজ্যে আফ্রিকার অংশ। আফ্রিকার উত্তর দিকের সমুদ্রতীর থেকে শুরু করে মিশরের পশ্চিমভাগ এবং কার্থেজের মতাে বড় শহর সেখানকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অগাস্টিন ও তারুণ্যে তার ম্যানিকিজমে ঝুঁকে পড়া : আফ্রিকা আগে থেকেই খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাদের অবদানের ব্যাপারে সমৃদ্ধ ছিল। বলতে গেলে পিউরিটান নব্যতন্ত্রের কেন্দ্রই ছিল আফ্রিকা। এছাড়া ছিল মন্টানিস্টস আর ডােনেটিস্টদের জন্মস্থান। প্রথমদিকের খ্রিস্টান লেখক টেরুলিয়ান আর সিপ্রিয়ানের মতাে মানুষরাও জন্মেছিলেন সেখানে। তখন ইতিহাসে রােমান সাম্রাজ্যের পতনের মুখে আফ্রিকা ছিল চার্চের ল্যাটিন ফাদার অগাস্টিনের (অরুলিয়াস অগাস্টিনাস) আবির্ভাবের স্থান। অগাস্টিন ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে, কার্থেজের ১৫০ মাইল পশ্চিমে একটি ছােট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন প্যাগান এবং তার মা ছিলেন একজন খ্রিস্টান। তিনি নিজে একসময় নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে ততটা স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলেন। তারপর তারুণ্যে পৌঁছে তিনি এক নতুন ধর্মের প্রতি ঝুঁকে যান, যার নাম ম্যানিকিজম।
ম্যানিকিজম উত্থান ও শীর্ষে পৌঁছনো : ম্যানিকিজম ধর্মের নাম হয়েছিল তার উদ্ভাবনকারী ম্যানির নামে। ২১৫ সালে পারস্যে মানি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি নতুন ধর্মীয় ধারা সৃষ্টি করেন যাতে প্রাচীন মিথ্রাইজম খুব জোরালােভাবে এসেছিল এবং একইসাথে এসেছিল কিছু পারস্যের ধ্যানধারণা। সেই ধর্মে আলাে এবং অন্ধকারের প্রভাব ছিল সমান অর্থাৎ একই সাথে ভালাে এবং মন্দ শক্তির সমান অস্তিত্ব ধরে নেয়া হতাে। (ইহুদিরাও পারস্যের শাসনামলে এই ধরনের দ্বৈত শক্তির প্রভাব মেনে নিয়েছিল। সেই সময় থেকেই সমস্ত মন্দ কাজের বাহক হিসেবে স্যাটানকে বলা হতাে “ অন্ধকারের দেবতা”। স্যাটান যেন ঠিক বিধাতার মতােই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল মানুষের কাছে। যদিও না ইহুদিরা, না খ্রিস্টানরা, কেউই কখনও স্যাটানকে বিধাতার সমান ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেনি।)। পারস্যে সবসময় এই দ্বৈত ক্ষমতার অস্তিত্ব থাকলেও ম্যানি ইহুদি ধর্ম এবং খ্রিস্টধর্ম থেকে যা পেয়েছিলেন তার মাধ্যমে নিজের সৃষ্টি করা ধর্মে খুব শক্তভাবে বিষয়টিকে বর্ণনা করলেন। যদিও পারস্যের ধর্ম এই ধর্মের মধ্যে অনেকটা প্রচ্ছন্নভাবে ছিল কিন্তু খ্রিস্টধর্ম রােমে প্রধান ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার আগে ম্যানির ধর্ম বেশ প্রচার পেয়েছিল। ডিওক্লেশিয়ানের চোখে ম্যানির ধর্ম ছিল খুবই সন্দেহজনক একটি সংস্কৃতি। তিনি মনে করতেন রােম দখল করার জন্য এটি পারস্যের একটি চাল। ২৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাই এই ধর্মকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে একটি প্রচারাভিযান চালান। এই ঘটনাটি ঘটেছিল তার খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালানাের একই ধরনের ঘটনার ছয় বছর আগে। বলা বাহুল্য, কোনাে প্রচারাভিযানই কোনাে কাজে আসেনি। আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা বলতে গেলে একদিক দিয়ে ম্যানির ধর্মের প্রচারের জন্য সুবিধাই বয়ে এনেছিল। খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সম্রাট তার হাত বাড়িয়ে দিলেন খ্রিস্টধর্মের একটি বিশেষ দলের প্রতি। সেটি ছিল নব্যতন্ত্র বা এরিয়ানিজম। পরে মূলধারার নাইসিনীয়রা সম্রাটের আনুকূল্য পেয়েছিল। যখন যে দলের প্রতি সম্রাটের বিরাগ ছিল তারাই অনিরাপদ বােধ করত এবং সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইত। তাই তখন দুই দলের খ্রিস্টান থেকেই প্রচুর মানুষ ম্যানির ধর্ম গ্রহণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভালাে আর মন্দ শক্তির মধ্যে যেন এক তুমুল লড়াই লেগে গেল। যারাই সেই ধর্ম গ্রহণ করেছিল, মনে করত আলাে এবং অন্ধকার জগতের মধ্যে যুদ্ধে তাদের জিততে হবে, কারণ পৃথিবীতে ইতিবাচক শক্তি কেবল তারাই। যারা তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতি বিরক্ত আর সন্দেহের চোখে তাকাত, তাদের কাছে ম্যানির ধর্ম এক ধরনের মুক্তি মনে হলাে। ম্যানির ধর্ম এভাবে শীর্ষে পৌঁছল অগাস্টিনের সময়ে।
অগাস্টিনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ ও তার চিন্তাধারা : অগাস্টিন নিজে ছিলেন নিও-প্লেটোনিজমের ভক্ত। তিনি প্লোটোনিয়াসের রচনা খুব মনােযােগ দিয়ে পড়তেন। ম্যানির ধর্ম এবং নিও-প্লেটোনিজম বলতে গেলে অগাস্টিনের উত্থানের জন্য দুটো বিশেষ ধাপ। তবে সত্য এবং আদর্শের জন্য তার ক্রমাগত অনুসন্ধান এবং তার মায়ের অনুপ্রেরণা এক পর্যায়ে তাকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি উৎসাহী করে তুলল। ৩৮৪ সালে তিনি মিলানে চলে গেলেন। (মিলান ছিল সে সময়ে পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের ধর্মীয় কেন্দ্র। বিশপ অ্যাম্ব্রোস তাকে ধর্মান্তরিত করেন। ৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাপ্টাইজড বা অভিসিঞ্চিত হন। তিনি আফ্রিকায় ফিরে আসেন। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিপাে রেজিয়াসের বিশপের পদে অধিষ্ঠিত হন। স্থানটি ছিল তার জন্মস্থানের উত্তরে একটি ছােট সমুদ্রবন্দর। এখন একে ডাকা হয় বােন বলে। শহরটি এখন আলজেরিয়ার একটি শহর। অগাস্টিন ২৪ বছরের জন্য সেখানে ছিলেন। অগাস্টিনের জন্যই শহরটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অগাস্টিনের পাঠানো চিঠি সাম্রাজ্যের আনাচে কানাচে পাঠানাে হয়েছিল। নানারকমের আফ্রিকান ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি সােচ্চার ছিলেন। তিনি চিঠি লিখে সকলকে জানিয়েছিলেন যে, প্রতিটি মানুষ এক জন্মগত পাপ নিয়ে জন্মায়। অ্যাডাম আর ইভ যখন সৃষ্টিকর্তার আদেশ অমান্য করে ইডেন গার্ডেন থেকে পৃথিবীতে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই সময় থেকেই মানুষ তার কাঁধে সেই পাপের বােঝা টেনে বেড়াচ্ছে। তাই মানুষ এর থেকে বাঁচতে চাইলে নিজেকে বাপ্টাইজড করতে পারে। তিনি সকলকে বােঝাচ্ছিলেন যে ব্যাপ্টিটাইজ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করা মানে নিজের অসীম জীবনের জন্য ভয়াবহ কুফল বয়ে আনা। তিনি পরকালে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন। তিনি মনে করতেন যে মানুষের ভাগ্য আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা আছে। বিধাতা নিজেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছেন। পৃথিবীতে এমন কিছুই ঘটে যা বিধাতার পরিকল্পনার বাইরে। বিশপ থাকা অবস্থায় শুরুর দিকে অগাস্টিন লিখিত বইয়ে নিজের দোষের কথা লিখে তা থেকে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। নিজের প্রাথমিক পর্যায়ের ভুলভ্রান্তি তিনি সেখানে গােপন করার কোনাে চেষ্টা করেননি। বইটি সবসময়ের জন্যই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল।
অগাস্টিনের চোখে রোম বিধাতার প্রিয় স্থান এবং প্যাগানদের বিরুদ্ধে তার খ্রিস্টীয় অ্যাপোলজি প্রদান : রােমে অ্যালারিকের হামলার পরে অগাস্টিন মনে করেছিলেন যে বিধাতার প্রিয় রাজ্যে যেন অসুরের হামলা হয়েছে। এটাকে তিনি খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে প্যাগানের হামলা হিসেবেই দেখতেন। প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা মনে করত যে রােম যে এত কাল ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মকে অবলম্বন হিসেবে নিয়ে আছে সেই কারণেই রােমের এই উত্থান। এখন যেহেতু রােমে খ্রিস্টধর্মের আগ্রাসন লক্ষ করা যাচ্ছে তাই প্রাচীন ধর্মের দেবদেবীরা রােমের মানুষের প্রতি রুষ্ট এবং সাম্রাজ্যটি ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। তারা আরও মনে করত যে খ্রিস্টধর্মের বিধাতা যদি মানুষকে রক্ষা করতে পারেই তবে সাম্রাজ্যের এই অবস্থা কেন? কেন তিনি অ্যালারিকের হামলার হাত থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করছেন না? অগাস্টিন তার বইয়ে তার জানা সমস্ত ইতিহাস আওড়েছেন। কী করে রােমান সাম্রাজ্য এবং রােম শহর কখন গড়া হয়েছে, কখন কার আবির্ভাবে ভেঙে পড়েছে, সব ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি বােঝাতে চেয়েছিলেন যে এই উত্থান এবং পতন যেন এই রাজ্যের ভাগ্যেই লেখা ছিল। কিন্তু অ্যালারিক যখন রােমে আক্রমণ করে তখন রােমের ধর্মের ওপরে তিনি কোনাে আঘাত করেননি। বরং রােমের ধর্মকে বেশ সম্মানের সাথে নাড়াচাড়া করেছেন। আর কখনই বা রােমের কোনাে ধর্মীয় বিধাতা কোনাে শহরকে অসভ্য জাতির আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছেন? সুতরাং যেদিক দিয়েই ভাবা হােক না কেন, রােম হলাে বিধাতার একটি প্রিয় স্থান যা হাজার আক্রমণের পরেও মাথা উঁচু করে টিকেছিল এবং থাকবে। রােমের ভাগ্যে যেন তেমনই লেখা। অগাস্টিনের একজন শিষ্যের নাম ছিল পলাস অরােসিয়াস। তিনি জন্মেছিলেন স্পেনের তারাগােনায়। অগাস্টিনের নির্দেশে তিনি পৃথিবীর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বইটির নাম ছিল, “প্যাগানদের বিরুদ্ধে যে ইতিহাস”। এই বইটি তিনি অগাস্টিনকেই উৎসর্গ করেন। তিনিও প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে রােমান সামাজ্য পড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলাে তার একের পর এক ভুল। খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং প্রসার রােমকে ধ্বংস করেনি, বরং রােমে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। অগাস্টিনের বিখ্যাত বইটি রচনা শেষ হয়েছিল ৪২৬ খ্রিস্টাব্দে। তারপর তার জীবনের বাকি বছরগুলােতে তিনি আগের চেয়ে ভালাে সময় দেখে যেতে পেরেছিলেন।
অনোরিয়াসে ও কনস্ট্যান্টিয়াসের মৃত্যু এবং তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের (রা. ৪২৫ – ৪৫৫ খ্রি.) ক্ষমতা গ্রহণ : রাভিনা শহরে ৪২৩ খ্রিস্টাব্দে অনােরিয়াসের মৃত্যু হয়। রােমান সাম্রাজ্যের ধ্বংস প্রক্রিয়ার ২৮ বছর তিনি দেখে যান। রােমে যে হামলা হয়েছে এবং রােম ভাগ করে আক্রমণকারীরা নিজেদের জন্য নিয়ে নিচ্ছে, এসব বিষয়ের প্রতি তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না। তিনি কেবল এর ক্ষমতায় নামমাত্র অবস্থান করছিলেন। তার সেনাপ্রধান কন্সট্যান্টিয়াস বিয়ে করেছিলেন তারই সৎ বােন গালা প্ল্যাসিডিয়াকে। গালা ছিলেন ভিসিগথ অ্যাটাউল্ফের বিধবা স্ত্রী। তিনি কয়েক মাসের জন্য তৃতীয় কন্সট্যান্টিয়াস হিসেবে পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েছিলেন। পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের দুর্ভাগ্য ছিল যে সেখানকার শাসকদের মধ্যে শক্তিশালীরাই মারা পড়েছে আর দুর্বলেরা অনেকদিন ধরে বেঁচে ছিলেন। তৃতীয় কন্সট্যান্টিয়াস (রা. ৪২১) মাত্র সাত মাস শাসন করার পরে ৪২১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এর দুই বছর পরে অনোরিয়াসও মারা যান। তৃতীয় কন্সট্যান্টিয়াস আর প্ল্যাসিডিয়ার পুত্র তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান (রা. ৪১৯-৪৫৫ খ্রি.) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন কেবল ছয় বছর বয়সী এক বালক। তিনি ছিলেন থিওডােসিয়াসের পৌত্র এবং মায়ের দিক থেকে ১ম ভ্যালেন্টিনিয়ানের প্রপৌত্র। তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান আসলে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করতেন। তিনি সবসময় বিচারালয়ের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তাকে সবচেয়ে বেশি দেখাশােনা করতেন তার মা প্ল্যাসিডিয়া। তাকে যারা দেখাশােনা করতে এসেছেন তাদের নিজেদের মধ্যেই বিতর্ক বেধে যেত। আর সেই বিরােধের মধ্যে প্রধান ভূমিকা থাকত তার মা প্ল্যাসিডিয়ার।
সম্রাটের বিরুদ্ধে জেনারেল ঈটিয়াস ও বনিফেসিয়াস, সম্রাটের বিরুদ্ধে বনিফেসিয়াসের ভ্যান্ডাল নেতা গাইজারিকের সাহায্য গ্রহণ : সম্রাট ভ্যালেন্টিনিয়ানকে দুই সেনাপ্রধান, ফ্লেভিয়াস ঈটিয়াস এবং বনিফিসিয়াসের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। তাদের দুজনের মধ্যে ঈটিয়াস সম্ভবত ছিল কোনাে জার্মানিক উপজাতির বংশধর, যে কোনােভাবে তিনি জীবনের কিছু সময় পার করেছিলেন অ্যালারিকের সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায়। আর বাকি সময় তিনি বন্দী ছিলেন হানদের হাতে। তাই জার্মান ও হান উভয় জাতি সম্বন্ধেই তার ধারণা ছিল পরিষ্কার। ৪২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক জার্মানিক জাতিরই একটি সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে ইতালিতে পৌঁছেন এবং তার পরের এক প্রজন্মেও তিনি সেই অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। (বলতে গেলে সে সময় সমস্ত সেনাবাহিনীই ছিল জার্মানিক জাতির সদস্য দিয়ে গঠিত।) বনিফেসিয়াস একজন সফল সেনাপ্রধান হলেও ঈটিয়াসের সামনে তেমন বলার মতাে কিছু ছিলেন না। বনিফেসিয়াসকে আফ্রিকার গভর্নরের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। কিন্তু তার এই পদোন্নতির ফলে তিনি রাভিনায় নিজের পদ হারালেন এবং সেখানে ঈটিয়াস ক্ষমতায় বসে গেল। তখন তার রানী মায়ের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলাে। আফ্রিকায় গিয়ে বনিফেসিয়াস তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং এই চিন্তা থেকে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। রাগের মাথায় তার এমন হলাে যে তিনি যে কোনাে একটি অস্ত্র উঁচিয়ে ইতালিতে গিয়ে তার শত্রুদের মােকাবেলা করতে পারেন। তখন সে অবস্থায় জার্মানিক জাতির একটি সেনাবাহিনীকে নিজের সাহায্যে ডেকে তিনি একটি ভয়াবহ ভুল করে ফেললেন। হাতের কাছে ছিল দক্ষিণ স্পেনের ভ্যান্ডাল জাতি। তাদের অবস্থান তখন বেশ শক্ত এবং সুদৃঢ়। তাই বনিফেসিয়াস মনে করেছিলেন তাদের সাহায্যে ডাকলে তারা তাে সাহায্য করবেই এবং পরে তারা তার দলে যােগ দিলে তিনি তাদের নেতা বনে যাবেন। কিন্তু বনিফেসিয়াস যেটি কল্পনা করতে পারেননি তা হলাে, তলে তলে তাদেরও একজন নেতা গজিয়ে যেতে পারে। ভ্যান্ডালরা ততদিনে একজন নতুন নেতা পেয়ে গিয়েছিল যার নাম ছিল গাইজারিক। তার বয়স ছিল তখন চল্লিশের কাছাকাছি। ৪২৮ খ্রিস্টাব্দে গাইজারিক, বনিফেসিয়াসের আহ্বানে সাড়া দেন। তিনি ৮০,০০০ ভ্যান্ডাল সেনাকে যুদ্ধ জাহাজের বহর দিয়ে সাহায্য করেন যার মাধ্যমে তারা সমুদ্রপথে আফ্রিকায় যায়। তবে সে যাই হােক, নিজেই যেখানে দখল করে নিতে পারে সেখানে ভ্যান্ডালদের জন্য কেবল অর্থের জোগানদাতা হিসেবে কাজ করার ইচ্ছে হয়তাে গাইজারিকের ছিল না।
গাইজারিকের কাছে আফ্রিকায় রোমানদের পরাজয়, তাদের অগাস্টিনের হিপো দখল, অগাস্টিনের মৃত্যু : মৌরিতানিয়া আর নামিবিয়ার পাহাড়ী আর জংলা জায়গার মানুষ কখনও সমুদ্রপথে জাহাজের বহরের সাথে ভেসে আসা রােমান আইনকানুনকে মেনে নিত না। এছাড়াও সেখানে ছিল ডােনেটিস্ট এবং অন্যান্য খ্রিস্টান ধারা যেগুলাের প্রধান ধর্মগুরু ছিলেন হিপাের বিশপ অগাস্টিন। তিনি সবসময়ই যে কোনাে নব্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাইসিনীয়দের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন রকমের যুক্তি নিয়ে তৈরিই থাকতেন। অনেক পরে বনিফেসিয়াস নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং বিচারালয়ের কাছে ক্ষমা চান (ঈটিয়াস তখন গাউলের বাইরে অবস্থান করছিলেন)। তবে যাই হােক, ততদিনে গাইজারিক আফ্রিকার বেশিরভাগ স্থান নিজের অধীনে নিয়ে নিয়েছেন। রােমান সাম্রাজ্যের হাতে বাকি ছিল কেবল কার্থেজ, হিপাে আর সিট্রা (হিপাের দক্ষিণে একশ মাইল দূরে)। এরপর গাইজারিক ধীরে ধীরে হিপােয় আক্রমণ চালালেন। সমুদ্রপথে যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় সরঞ্জাম আনতে হলাে বলে যুদ্ধটি সংগঠিত করতে করতে প্রায় দুই বছর লেগে গেল। সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশও একবার যুদ্ধের জিনিসপত্র টেনে নেয়ার জন্য কিছু যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে পশ্চিমকে সাহায্য করল। তবে তার পরেও কোনাে লাভ হলাে না। গাইজারিক পরপর দুবার বনিফেসিয়াসের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিলাে। ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে তারা হিপাে দখল করে নিলাে। অগাস্টিন অবশ্য এই দুর্ভাগ্য সচক্ষে দেখার জন্য জীবিত ছিলেন না। হিপােতে আক্রমণের শুরুর সময়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ঈটিয়াসের হাতে বনিফেসিয়াসের মৃত্যু, গাইজারিকের সাথে রোমানদের চুক্তি, এবং গাইজারিকের কার্থেজ দখল : বনিফেসিয়াস ইতালিতে ফিরে আসেন এবং তার দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী ঈটিয়াসের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। বনিফেসিয়াস যুদ্ধে জয়লাভ করেন কিন্তু ঈটিয়াসের আঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরপরই তার মৃত্যু হয়। ৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে গাইজারিক রাভিনার বিচারালয়ের সাথে একটি চুক্তিতে আসেন এবং যার মাধ্যমে ভ্যান্ডালদের রাজত্বের আইনত অনুমতি মেলে। নিজের অবস্থানটাও হয় সুদৃঢ়। রােমানরা এই ধরনের চুক্তির কারণে একটু ভড়কে যায় কারণ মিশর প্রথম থেকেই রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এবং আফ্রিকাই ছিল রােমের খাদ্যশস্য আহরণের একমাত্র স্থান। তাদের চোখে গাইজারিক ওই স্থান দখল করতে পারেন একমাত্র যদি রােমানদের খাদ্য সরবরাহ যথাযথভাবে চলার প্রতিশ্রুতি দেন, তবে। চুক্তির সময়ে গাইজারিক কার্থেজকে (যে স্থানটি তিনি তখনও দখল করেননি) আজীবন রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতে দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন। গাইজারিক অবশ্য যতদিন নিজের স্বার্থে কোনাে আঘাত লাগেনি ততদিনই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ৪৩৯ খ্রিস্টাব্দে (১১৯২ রােমান সাল) তিনি তার বাহিনী নিয়ে কার্থেজের দিকে অভিযানে নেমে পড়েন। তিনি নিজের নকশা করা নতুন সমুদ্রপথের কেন্দ্র হিসেবে কার্থেজ দখল করে নেন। এই বিজয় তাকে তার পরবর্তী বিশ বছরের জন্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ত্রাস হিসেবে টিকিয়ে রাখে।
হানদের নেতা অ্যাটিলার পরাজয়, ঈটিয়াস ও তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের মৃত্যু
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে নতুন করে হানদের আক্রমণ : ভ্যান্ডালরা যখন পশ্চিম সাম্রাজ্যের দক্ষিণদিকটা দখল করে নিলাে আর ভিসিগথরা পশ্চিম দিকে বেশ জেঁকে বসল, তখন উত্তর দিক থেকেও বিভিন্ন অসভ্য জাতির আক্রমণের চাপ আসছিল। হান জাতি ঠিক সেই সময়ে হামলার নীল নকশা তৈরি করে ফেলল। এটা ছিল তাদের পশ্চিম দিকে চালানাে অভিযানেরই অংশ। মাত্র একশ বছর আগে মধ্য এশিয়া পেরিয়ে উত্তরে সমতলভূমি বরাবর কৃষ্ণসাগরের তীর ঘেঁষে আসা হানদের আক্রমণের কারণে ভিসিগথরা রােমান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেছিল। এরপর তাদের উপর্যুপরি হামলায় সাম্রাজ্যের পশ্চিমের অংশ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। গথ আর ভ্যান্ডালরা যখন নিজেদের এলাকায় শক্ত কব্জা করে রেখেছিল, তখন হানরা মােটামুটি চুপচাপ ছিল। তারা এবারে রােমান সাম্রাজ্যের সীমানা বরাবর লুটপাট আরম্ভ করল। কিন্তু সেরকম বলার মতাে কোনাে হামলার আয়ােজন করতে পারল না। বিশেষভাবে দেখলে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অঞ্চলগুলাে পশ্চিমের চেয়ে বেশ ভালাে অবস্থায় ছিল।
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (রা. ৪০২-৪৫০ খ্রি.) ও পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য : ৪০৮ খ্রিস্টাব্দে আর্কাডিয়াসের মৃত্যুর পরে তার সাত বছরের পুত্র দ্বিতীয় থিওডােসিয়াস (কোনাে কোনাে সময় তাকে ছােট থিওডােসিয়াস বলেও ডাকা হতাে) সিংহাসনে বসেন। তিনি যখন তারুণ্যে পৌঁছান, তখন পিতার চেয়েও বেশি বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এছাড়া তার স্বভাবের মধ্যে এক ধরনের মায়া মমতা ছিল যেটি তাকে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তার চল্লিশ বছরের রাজত্বের সময়ে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অঞ্চল ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরে এসে যেন আবার নতুন করে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি কন্সট্যান্টিনােপল শহরকে আয়তনে আরও বড় করে ফেলেন। শহরটিকে নতুন একটি শক্তিশালী অবস্থান দেন। নতুন স্কুল খােলেন, সেখানে আর আইন নতুন করে ঢেলে সাজান, তার সম্মানে যে আইনের নাম হয় থিওডােসিয়ানের কোড। পারস্যের সেনাবাহিনী (নিত্য নতুন শত্রুর আগমনে যাদের রােমানরা প্রায় ভুলতেই বসেছিল) সেই সময়ে দুটো যুদ্ধ করতে বাধ্য করল রােমানদের। দুই যুদ্ধেই তারা মােটামুটি সফল হলাে। পশ্চিম দিকের সীমানা যখন টানাহেঁচড়ার মধ্যে ছিল, তখনও অবশ্য পূর্বদিক বেশ সুরক্ষিত ছিল।
অ্যাটিলার নেতৃত্বে হানদের মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ অভিযান এবং জার্মানি পর্যন্ত অগ্রসর : যাই হােক, ৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে অ্যাটিলা ও ব্লেডা দুই ভাই হানদের উপরে ছড়ি ঘােরাতে সক্ষম হন। অ্যাটিলা ছিলেন তাদের দুজনের মধ্যে নেতাগােছের। একসময় তিনি প্রায় বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। তিনি রােমের বিরুদ্ধে নিজের ভয়ংকর রূপটি প্রকাশ করলেন। তিনি থিওডােসিয়াসকে বাধ্য করলেন তাকে বছরে ৭০০ পাউন্ড সােনা দিতে এবং তার বদলে তিনি সাম্রাজ্যে শান্তি বজায় রাখবেন, এই শর্ত দিলেন। এরপর অ্যাটিলা শান্তি বজায় রেখেছিলেন অল্প কিছুদিনের জন্য। সেখানে পরিস্থিতি শান্ত রেখে তিনি সেই সময়টাকে কাজে লাগালেন অন্যদিকে। তিনি তার অশ্বারােহী বাহিনীকে উত্তরদিকে অভিযানে পাঠিয়ে দিলেন। ইউরােপের মধ্যভাগের পূর্বদিকে যেখানে কিছু আদিম জাতির বসবাস ছিল সেখানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাহিনীকে পাঠালেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাহিনীকে পশ্চিম দিকে আরও অগ্রসর হয়ে জার্মানি পর্যন্ত পাঠালেন। ৪৪৫ সালে (রােমান ১১৯৮ সাল) ব্লেডার মৃত্যুর পরে অ্যাটিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। অ্যাটিলা তখন ক্যাম্পিয়ান সমুদ্র থেকে রাইন নদী পর্যন্ত এবং উত্তরের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রােমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়ে গেলেন। কিন্তু তারপরও অ্যাটিলার মন ভরছিল না। তিনি পূর্বদিকের অংশে হামলা চালিয়ে বছরে এক টন সােনা আদায়ের কথা আদায় করে নিলেন।
জার্মানিক উপজাতিদের তদকালীন অবস্থা ও রোমান জেনারেল ঈটিয়াসের সাথে গাউলে তাদের যুদ্ধ : জার্মানির অবস্থা এমনিতেই পরপর অনেক যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত ছিল। পশ্চিম দিকের সেই অংশে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে মানুষের সংখ্যাও ছিল কম। আটিলার নেতৃত্বে হানরা জার্মান অঞ্চল সহ কাস্টপিয়ান সাগর থেকে রাইন পর্যন্ত অঞ্চল দখল করে নেয়াতে জার্মানিক উপজাতিদের অবস্থা –
- বার্গান্ডিয়ান ও স্যুভিয়ান : পশ্চিম দিকে হানদের আগ্রাসন জার্মান উপজাতিগুলােকে রাইন নদীর অপরদিকে গাউলের দিকে ঠেলে দিলাে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল বারগান্ডিয়ান, কেউ আবার প্রাচীন স্যুভিয়ানের বংশধর যারা গাউলে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। তখন ৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে আর তার পরের কয়েক বছরে বারগান্ডিয়ানদের আরও কিছু দল এসে গাউলে উপস্থিত হয়েছিল।
- ফ্র্যাঙ্ক : আরেকটি জার্মান উপজাতি হলাে ফ্র্যাঙ্ক, যারা হানদের চাপের মুখে গাউলে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তারা গাউলের উত্তরপূর্ব দিকটা দখল করে রেখেছিল। কিন্তু ঈটিয়াসের কাছে পরাজিত হওয়াতে সেই দখলও নড়বড়ে হয়ে পড়ল।
- অ্যাঙ্গেলস, স্যাক্সনস এবং জুটস : তারপরও কিছু জার্মান উপজাতি, যেমন অ্যাঙ্গেলস, স্যাক্সনস এবং জুটস ফ্র্যাঙ্কদের দখল করা জায়গার উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিকে দখল করে ছিল যে জায়গাগুলাে এখন ডেনমার্ক এবং পশ্চিম জার্মানি হিসেবে পরিচিত। ৪৪০ খ্রিস্টাব্দে তাদের তাড়িয়ে সমুদ্রের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই জার্মান উপজাতিরা ব্রিটেন হামলা চালায় এবং পুরাে ব্রিটেন দখল করে ফেলে। ৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে জুটসরা তাদের প্রথম স্থায়ী ঘাঁটি বানায় ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, যেখানে এখন কেন্ট শহর। তার পরের শতাব্দী জুড়ে “অ্যাংলাে স্যাক্সনস” ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে এবং উত্তর দিকে দখল চালিয়ে যায় এবং কেল্টিক ব্রিটনের মতাে ভয়ংকর জাতিকে মােকাবেলা করে। ব্রিটন জাতির কিছু কিছু যােদ্ধা দখল করতে করতে গাউলের উত্তর-পশ্চিম কোণ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। সেখানে তারা নিজেদের যে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তার নাম এখন ব্রিটানি।
- ঈটিয়াসের সাথে যুদ্ধ : তখন অন্ততপক্ষে এক প্রজন্ম ধরে গাউল যেন ঈটিয়াস (যার মাধ্যমে সম্রাটকে বােঝায়) এবং জার্মানদের বিভিন্ন জাতির মধ্যে যুদ্ধ এবং মােকাবেলার স্থান হয়ে উঠেছিল। ঈটিয়াস বিস্ময়করভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ভিসিগথদের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, বারগান্ডিয়ানদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, ফ্র্যাঙ্কদের উত্তর-পূর্ব দিকে এবং ব্রিটনদের উত্তর-পশ্চিম দিকে আটকে রাখেন এবং সাম্রাজ্যকে রাখেন সুরক্ষিত। গাউলের মধ্যবর্তী বিশাল অংশ রােমান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে থেকে যায়। অবশ্য ঈটিয়াসই রােমানদের শেষ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজয়ের নেতা যা সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের অংশের জন্য চূড়ান্ত সাফল্য বয়ে এনেছিল। তাই সম্মানের সাথে তাকে “শেষ রােমানদের একজন” হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
মার্সিয়ানের (রা. ৪৫০ – ৫৭ খ্রি.) ক্ষমতায় আরোহন ও অ্যাটিলার গাউলে আক্রমণ : ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২০৩) দ্বিতীয় থিওডােসিয়াস মৃত্যুবরণ করেন। উত্তরাধিকারী হিসেবে আসেন তার বােন ফুলসেরিয়া, থিওডােসিয়াসের নাতনি। তবে তিনি ক্ষমতায় বসেই বেসামাল পরিস্থিতি সামলাতে একটি পুরুষ নেতৃত্বের অভাব বােধ করেন। আর তাই সেনাপ্রধান মার্সিয়ানকে (মার্সিয়ানাস) বিয়ে করেন। মার্সিয়ান ছিলেন থ্রেসিয়ান বংশােদ্ভূত। তখন নিয়মকানুনের পরিবর্তন চট করেই চোখে পড়ল। অ্যাটিলা যখন তার ভাগের বার্ষিক সােনা পাওয়ার জন্য দাবি জানালেন তখন মার্সিয়ান তা এক কথায় নাকচ করে দিলেন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তৈরি আছেন এটা জানিয়ে দিলেন। অ্যাটিলা তার আহ্বানে সাড়া দিলেন না। ভাবলেন, খামাখা মার্সিয়ানের সাথে যুদ্ধে গিয়ে কী লাভ, যেখানে কিনা পশ্চিম দিকে দুর্বল শাসক, নিজেদের মধ্যে বিরােধিতায় লিপ্ত বিভিন্ন উপজাতি রয়েছে? মার্সিয়ানের সােনা দেয়ায় অস্বীকৃতি জানানাের প্রায় সাথেসাথেই অ্যাটিলা রাইন নদী পার হয়ে গাউলে আক্রমণ চালালেন।
ঈটিয়াস ও থিওডোরিকের ভিজিগথদের সাথে অ্যাটিলা ও তার অধীনের অস্ট্রোগথদের যুদ্ধ, অ্যাটিলা ও থিওডোরিকের মৃত্যু ও হানদের পরাজয় : কিন্তু তখন এমন হলাে, যে জার্মানরা বরাবর হানদের হাত থেকে পালাতে পারলে বাঁচে, সেই হানরাই পালানাের পথ খুঁজছিল। ৪৫১ খ্রিস্টাব্দে অ্যাটিলা এবং হানদের দল যখন রাইন নদী পেরিয়ে এলা তখন ঈটিয়াস, ভিসিগথ প্রথম থিওডােরিকের সাথে এক শর্তে একমত হয়ে গেল। তাই গাউলের জার্মানরা বিপদের গন্ধ পেল এবং বারগান্ডিয়ানরাও ঈটিয়াসের সাথে যােগ দিলাে। জার্মান উপজাতির দুই সেনাদল অ্যাটিলার সাথে যুক্ত হয়েছিল, যাদের আগে হানরা দখল করে নিয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রধান দল হলাে অস্ট্রোগথ। আর ঈটিয়াস তার শক্তিশালী ভিসিগথের ক্ষমতা নিয়ে গাউলের উত্তরে ক্যাটালাউনি নামে একটি জায়গায় তাদের মুখােমুখি হলাে। স্থানটি ছিল কেল্টিক উপজাতিদের দখলে। সেই পুরাে অঞ্চলটিকে বলা হতাে ক্যাটালাউনিয়ান সমভূমি। সেখানকার বড় শহর বলতে যা ছিল তাকে এখন বলা হয় চাওলােনস, যে শহরটি প্যারিস থেকে ৯০ মাইল পূর্বদিকে অবস্থিত। সেখানে সংঘটিত সেই যুদ্ধকে বলা হয় চাওলােনের যুদ্ধ বা ক্যাটালাউনিয়ানের যুদ্ধ। তবে সে যুদ্ধকে যে নামেই ডাকা হােক না কেন, তা ছিল গথের বিরুদ্ধে গথের লড়াই। ঈটিয়াস তার নিজের যােদ্ধাদের বামদিকে আর ভিসিগথ যােদ্ধাদের ডানদিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে দুর্বল যােদ্ধাদের রাখা হয়েছিল মধ্যখানে। ঈটিয়াস মনে করেছিলেন অ্যাটিলা যেহেতু যুদ্ধের সময়ে পুরাে দলের মাঝখানে অবস্থান করে তাই আক্রমণটা প্রথমে মধ্যখানেই হবে। হয়েছিলও তাই। হানরা ঠিক মধ্যখানে তাদের সবচেয়ে ভয়ংকর গােছের একটি আক্রমণ করে বসে এবং যােদ্ধা দলের একেবারে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর দুদিক থেকে ঈটিয়াসের সাজানাে দল ধেয়ে এসে তাদের ঘিরে ফেলে এবং নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। অ্যাটিলাকে হত্যা করা হয়। এমন শােচনীয় পরাজয়ের পর হানরা বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যাই হােক, ঈটিয়াস সেনাপ্রধান হলেও তার কূটনৈতিক বুদ্ধিও ছিল প্রবল। তিনি কখনােই হানদের হারিয়ে দেবার জন্য ভিসিগথদের এতটা প্রশ্রয় দেননি যে তারা আবার তার মাথার ওপরে ছড়ি ঘােরায়। ভিসিগথদের বৃদ্ধ রাজা থিওডােরিক এবং তার পুত্র অ্যালারিক সেই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। তার ফলে ঈটিয়াস তার সামনে সুযােগ দেখতে পান।
ঈটিয়াস ও তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের মৃত্যু : রােমান বিচারালয়ের চোখে ঈটিয়াস ছিলেন খুবই ভাগ্যবান। তিনি বনিফেসিয়াসের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন এবং অ্যাটিলার বিরুদ্ধেও জয়ী হয়েছিলেন। তার সেনাবাহিনী ছিল বাধ্য এবং তার প্রতি উৎসর্গীকৃত। তিনি যেখানেই যেতেন না কেন, তার সেনাবাহিনী তাকে অসভ্য উপজাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। তখন তার আগের সিকি শতাব্দী জুড়ে সিংহাসনে ছিলেন একজন অকর্মন্য সম্রাট যিনি তার ভীতু স্বভাবের জন্য ততদিনে বেশ দুর্নামও কুড়িয়েছেন। তিনি তার সেনাপ্রধানদের উপরে সবকিছুর জন্য নির্ভর করতেন এবং সেনাপ্রধানের ইচ্ছে অনুযায়ী পরিচালিত হতেন। বিরক্ত হলেও তিনি ঈটিয়াসের দাবির মুখে নিজের কন্যার সাথে ঈটিয়াসের ছেলের বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন। অর্ধ শতাব্দী আগে তার আংকল অনোরিয়াসকে সহজে বােঝানো গিয়েছিল যে স্টিলিকোই একমাত্র সিংহাসনের উপযুক্ত। আর এখন তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানকে সেই একই রকমের বিষয়ে ঈটিয়াসের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তােলাও সহজ হয়েছিল। আরেক দিক দিয়ে ভাবতে গেলে ঈটিয়াসের দুর্ব্যবহার আর দম্ভ তার চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল। ৪৫৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যালেন্টিনিয়ান যখন রােমে বেড়াতে আসেন, ঈটিয়াস তার সাথে দেখা করতে যান। ঈটিয়াস তখন তার মেয়ের সাথে ভ্যালেন্টিনিয়ানের ছেলের বিয়ের আয়ােজন প্রায় সম্পন্ন করে এনেছেন, যেটি ছিল সম্রাটের দৃষ্টিতে খুব সন্দেহজনক একটি কাজ। আকস্মিক কোমর থেকে তলােয়ার খুলে ভ্যালেন্টিনিয়ান ঈটিয়াসের উপরে চড়াও হন। বিচারালয়ের অন্য সবার উপস্থিতিতেই সম্রাট তাকে টুকরাে টুকরাে করে ফেলেন। তবে এটাই যে ভ্যালেন্টিনিয়ানকে বাঁচিয়ে দিলাে, তা নয়। এবং সমগ্র ইতালিতে সম্রাট জনপ্রিয়তা হারালেন, এই ঘটনার কারণে যেন ঈটিয়াসকে ঢাল বানিয়ে সব অসভ্য উপজাতির মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। বলতে গেলে ঘটনাটি ঘটানাে ছিল সম্রাটের জন্য একটি আত্মহত্যার সামিল। তাই তার অর্ধ বছর পরে ঈটিয়াসের ব্যক্তিগত দুজন দেহরক্ষী সম্রাটকে সুযােগমতাে পেয়ে আক্রমণ করে বসল। ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তারা ছুরি দিয়ে আঘাত করে ভ্যালেন্টিনিয়ানকে হত্যা করল। ভ্যালেন্টিনিয়ান ছিলেন প্রথম ভ্যালেন্টিনিয়ানের বংশের শেষ পুরুষ শাসক। তার বংশ টেনেটুনে এক শতাব্দী রাজত্ব করেছিল। এই বংশের শেষ শাসক ছিলেন ফুলসেরিয়া, যিনি পূর্বদিকের অংশে শাসন করেছিলেন। ফুলসেরিয়া ছিলেন সম্রাট মার্সিয়ানের স্ত্রী এবং ভ্যালেন্টিনিয়ানের কাজিন। ৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে লিওনিড বংশের উত্থান ও রোমে ভ্যান্ডাল নেতা গাইজারিকের ভ্যান্ডালিজম
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় প্রথম লিও (রা. ৪৫৭-৪৭৪ খ্রি.) ও লিওনিড রাজবংশের (৪৫৭-৫১৮ খ্রি.) উত্থান : সাম্রাজ্যের দুই অংশেরই তখন নতুন আইন কানুন তৈরি করার দায়িত্ব। কনস্ট্যান্টিনােপলে সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ তখন ছিলেন অ্যাসপার। তিনি ছিলেন একটি জার্মান অসভ্য জাতির যুদ্ধদলের প্রধান। তিনি রাজধানী শাসনের দায়িত্বে ছিলেন। হয়তাে সহজেই সম্রাটের আসনে বসতে পারতেন, কিন্তু তিনি ছিলেন এরিয়ানিস্ট। তিনি জানতেন যে ক্ষমতা হাতে নিলে ক্রমাগত বিপরীত পক্ষ হিসেবে ধর্মগুরুদের চাপের মুখে থাকতে হবে তাকে। সেই ঝামেলা মিটমাট করা সহজ হবে না। এর চেয়ে সহজ যােগ্য কোনাে নাইসিনীয়কে সিংহাসনে বসিয়ে নিজের হুকুমে রাজ্য পরিচালনা করা। অ্যাসপার ক্ষমতায় বসানাের জন্য প্রথমেই থ্রেস শহরের (নিজের জন্মস্থানের পাশের প্রদেশ) লিও নামে একজন বৃদ্ধ সেনাপ্রধানকে পছন্দ করলেন। লিও সিংহাসনে বসার পরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এলাে। একসময় সিনেটের সদস্যরা আইনের মধ্যে দিয়ে সম্রাটের আসনে বসতে পারত, তারপর একইভাবে সেনাবাহিনী থেকে আসতে লাগল, আর এবারে এলাে চার্চ থেকে। প্রথম লিওকে যিনি রাজ্যাভিষিক্ত করেছিলেন ছিলেন কন্সট্যান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্ক বা ধর্মগুরু, যার মাথার উপরে বেগুনি রঙের মুকুট আজীবন জ্বলজ্বল করত। এর আগে তার সাথে মার্সিয়ানও সম্রাট হয়েছিলেন, তবে প্রথম লিও তার চেয়ে ভালাে কিছু করেছিলেন সাম্রাজ্যের জন্যে। একটি বিষয়ে তিনি অ্যাসপারের হাতের পুতুল হতে অস্বীকৃতি জানালেন। লিও বেশ যত্নের সাথে অ্যাসপারের অবস্থানটা যে তার অধীনে, সেটা বুঝিয়ে দিতে চাইতেন। যেমন তিনি সম্রাটের জন্য জার্মান দেহরক্ষীর বদলে পূর্ব এশিয়া মাইনরের উপজাতি ইসাউরিয়ান দেহরক্ষী নিয়ােগ দিলেন। এই ধরনের পরিবর্তনের অর্থ হলাে, লিও যদি তার সীমা অতিক্রম করে সম্রাটকে অপমান করে তবে সম্রাট তার দেহরক্ষীদের মাধ্যমে লিওকে সহজে বন্দী করতে পারবেন না। তার চেয়ে বেশি হলাে, অ্যাসপার যদি তাকে বন্দী করতে চান এবং সেরকম কোনাে ভয়ংকর বিরােধ বেঁধে যায়, তবে তিনি জার্মানদের সাহায্য নিতে পারবেন। আর ইসাউরিয়ান জাতি থেকে গার্ড বেছে নেয়ার কারণ হলাে, ইসাউরিয়ান যােদ্ধাদের (যাদের গ্রিক নাম ছিল জেনাে) প্রধানের সাথে তিনি নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।
পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা ও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অটুট থাকা : এসবই ছিল পূর্ব আর পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিক। এসব বিষয়ের উপরে দুই অংশের রীতিনীতির পার্থক্যও পরিষ্কার হয়। প্রথম থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর পর থেকে দেড় শতাব্দী পর্যন্ত পুরাে সাম্রাজ্য যেন মৌখিকভাবে জার্মানদের হাতেই চলে গেল। এই আগ্রাসন ততদিন পর্যন্ত চলল যতদিন রােমানরা নিজের থেকে পুরােপুরি জার্মান সংস্কৃতি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি না জানাল। পূর্বদিকে বলতে গেলে জার্মানদের মারাত্মকভাবে ঠেকানাে হচ্ছিল। রুফিনাসের মৃত্যুর পর থেকে উচ্চতর পদে জার্মানদের বসানাের মানুষেরা নিজেদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার টানাপােড়েন অনুভব করছিল যতদিন না প্রথম লিওর নির্দেশে বেশিরভাগ নিয়ােগ হয়েছিল ইসাউরিয়ানদের মধ্যে থেকে এবং সেই প্রদেশে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে থেকে। নিজেদের লােকদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করা হলাে যেন তারা বাইরের শত্রুকে মােকাবেলা করতে পারে। এভাবেই পূর্বদিকের সাম্রাজ্যকে অটুট রাখার চেষ্টা চালানাে হচ্ছিল এবং সেটি অন্তত সংস্কৃতির দিক থেকে পরবর্তী কয়েক হাজার বছরেও অটুট ছিল।
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যে ক্ষমতায় পেট্রোনিয়াস ম্যাক্সিমাস (রা. ৪৫৫ খ্রি.) : পশ্চিম দিকে রােমান সেনেটর পেট্রোনিয়াস ম্যাক্সিমাস, তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের মৃত্যুর পর থেকেই সিংহাসনে আসীন হবার জন্য তৈরি হতে হচ্ছিল। বিষয়টি আরও পােক্ত করার জন্য পেট্রোনিয়াস, ভ্যালেন্টিনিয়ানের বিধবা স্ত্রী ইউডােক্সিয়াকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়ার পেছনে কারণ ছিল পেট্রোনিয়াসের বংশগত সম্মান অর্জন। ইউডােক্সিয়া এই প্রস্তাব নাকচ করার সিদ্ধান্ত নেন কারণ তিনি বয়স্ক পেট্রোনিয়াসকে বিশেষ পছন্দ করতেন না এবং কিছু শােনা কথার উপরে ভিত্তি করে তিনি নিজের প্রয়াত স্বামীর মৃত্যুর কারণও মনে করতেন তাকে। তাই তিনি নিজের অবস্থান থেকে পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজছিলেন।
আফ্রিকায় গাইজারিক ও তার কর্সিকা, সার্ডিনিয়া ও সিসিলির পশ্চিমাংশ নিয়ন্ত্রণ : সেই সময় পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন ভ্যান্ডাল জাতির গাইজারিক। তখন গাইজারিকের বয়স প্রায় ষাট। তিনি ততদিনে সিকি শতাব্দী ধরে আফ্রিকার প্রদেশে ভ্যান্ডাল সেনাদের দিয়ে শাসনকার্য চালাচ্ছেন। তার প্রভাব টিকেছিল সবচেয়ে বেশি দিন যাবৎ। সে সময় বলতে গেলে অন্যান্য অসভ্য জাতির যেসব নেতা ছিলেন, যেমন ভিসিগথদের মধ্যে থিওডােরিক, হানদের অ্যাটিলা, সবাই একে একে মারা পড়েছিলেন, কিন্তু ভ্যান্ডালের গাইজারিক তখনও বেঁচে ছিলেন তার বিপুল প্রতিপত্তি নিয়ে। আর কী চাই, তিনি একাই ৫ম শতাব্দীতে জার্মানিক সেনাদের নিয়ে একটি যুদ্ধ জাহাজের বহর তৈরি করলেন। আফ্রিকার মধ্যভাগে তার শাসন রােমান শাসনের মতাে শক্ত ছিল না। কারণ তখন সেখানকার আদি অধিবাসীরা উত্তর দিক থেকে এসে মৌরিতানিয়া এবং নিউমিডিয়ার কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু যে রকম যুদ্ধ জাহাজের বহর গাইজারিক তৈরি করেছিলেন তাতে করে আরও বেশি দূরে কোথাও আক্রমণ করতে পারতেন। তিনি কর্সিকা, সার্ডিনিয়া ব্যালিরিক দ্বীপ, এমনকি সিসিলির পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। বলতে গেলে তিনি উত্তর দিকের সমুদ্রতীর ধরে পূর্ব এবং পশ্চিমে যতদূর যাওয়া যায়, ততদূরব্যাপী হামলা চালিয়েছিলেন। গাইজারিকের হাত ধরে মনে হলাে যেন সমুদ্রের বুকে প্রাচীন শহর কার্থেজ নতুন করে জন্মগ্রহণ করল। রােম তাে এমন করে তার মুখােমুখি হচ্ছিল যেন সাতশ বছর আগে সেখানে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
ইউডোক্সিয়ার আমন্ত্রণে গাইজারিকদের আক্রমণ, লুণ্ঠন ও রোমে ভ্যান্ডালদের ভ্যান্ডালিজম : কিন্তু সাত শতাব্দী আগে রােমের অবস্থা যা ছিল, তখন তাে আর তা নয়। রােম যে কেবল আক্রমণের হাত থেকে শহরকে রক্ষা করতে অপারগ, শুধু তাই নয়, সম্রাজ্ঞী ইউডােক্সিয়াও অনিরাপদ বােধ করছিলেন। ইউডােক্সিয়া নিজেই গাইজারিককে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন রােমের দুর্বল হয়ে পড়ার কথা এবং গাইজারিক রােমে এলে যেভাবে চান সেভাবেই সফল হতে পারবেন, এ আশ্বাসও দিয়েছিলেন। ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে গাইজারিক টিবার নদীর তীরে তার যুদ্ধ জাহাজের বহর নিয়ে উপস্থিত হলেন। অ্যালারিকের আক্রমণের ৪৫ বছর পরে শহরটিতে আবারও দ্বিতীয় বারের মতাে বাইরে থেকে হামলা করা হলাে। এবারে কিন্তু অবস্থা ছিল আরও সঙ্কটাপন্ন কারণ শত্রুরা এসেছিল কার্থেজ থেকে। কারও কারও কাছে মনে হয়েছিল যেন একপাল মানুষখেকোর আবির্ভাব হয়েছে দেশে। পােপ লিও অ্যাটিলার সাথে মিলে গাইজারিককে ঠেকানাের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে ছিল না। অ্যাটিলা ছিলেন একজন প্যাগান, যিনি হয়তাে বা পােপের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার কথা মাথায় রাখতে পারেন কিন্তু গাইজারিক ছিলেন একজন নব্যতান্ত্রিক, যার কাছে নাইসিনীয় বিশপের তেমন কোনাে মূল্য ছিল না। কিন্তু যাই হােক, গাইজারিক ছিলেন দক্ষ একজন মানুষ। তিনি রােম শহরটিকে লুটপাট এবং ধ্বংস করতে এসেছিলেন একাই এবং নিজের বাহিনী নিয়ে একাই তা করে দেখিয়েছেন। টানা দুই সপ্তাহব্যাপী, উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এমন সমস্ত জিনিসপত্র তিনি কার্থেজের উদ্দেশ্যে জাহাজে ওঠানাের কাজ চালিয়ে গেলেন। এসব নিয়ে কোনাে মারামারি বা হাতাহাতি হলাে না। অ্যালারিকের আক্রমণের পরে রােম অনেকভাবে আবারও উঠে দাঁড়ানাের চেষ্টা করেছিল, দাঁড়িয়েও ছিল, কিন্তু সেবারে ভ্যান্ডালদের আক্রমণের পর পুরােপুরি গুঁড়িয়ে গেল। কোনাে আগুপিছু চিন্তা না করে যারা ধংসযজ্ঞ চালায়, তারাই ভ্যান্ডাল নামে অভিহিত হতে লাগল। এর পর থেকেই “ভ্যান্ডাল” শব্দটি অবিবেচক ধ্বংসকারীর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। শিল্পকর্মকে ধ্বংস করার প্রতিশব্দ হয়ে গেলো “ভ্যান্ডালাইজ করা”। অন্য সমস্ত জিনিসের সাথে গাইজারিক ইহুদিদের পবিত্র নৌকাগুলােও কার্থেজে নিয়ে যাবার জন্য জাহাজে ওঠানাের নির্দেশ দিলেন। চারশ বছর আগে জেরুজালেম থেকে মন্দির ধ্বংস করে টাইটাস একবার সেই নৌকাগুলােকে রােমে এনেছিলেন। এদিকে ইউডােক্সিয়ার যে দুরবস্থা ছিল তা হলাে, তিনি হয়ে পড়লেন সন্তানসম্ভবা। তার সম্ভ্রমহানি করে নিষ্ঠুর গাইজারিক তার সমস্ত গয়নাগাটি কেড়ে নিলেন। ইউডােক্সিয়া এবং তার দুই কন্যাকে বন্দী হিসেবে কার্থেজে নিয়ে যাবার জন্য জাহাজে তােলার আদেশ দিলেন তিনি।
অ্যাপোলিনারিস সিডোনিয়াসের দৃষ্টিতে কার্থেজের হাতে রোমের পতন : ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় সেই সময়ের রােম ছিল যেন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত একাকি সভ্যতার চিহ্ন। বিশেষ করে গেইয়াস সােলিয়াস অ্যাপােলিনারিস সিডােনিয়াসের বর্ণনায়। তিনি ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গাউলে জন্মগ্রহণ করেন এবং গাউলেই বসবাস করতেন। পশ্চিম সাম্রাজ্যে তিনি সাম্রাজ্যের পতনের শেষ সময় পর্যন্ত দেখে গেছেন। তার ইতিহাস বর্ণনায় তিনি রােমের পত্তনের প্রাচীন কাহিনীর উপরে আলােকপাত করেছিলেন। মুখে মুখে শােনা গল্পগুলাের মধ্যে শােনা যায় যে, রােমুলাস এবং রেমাস নামে দুইজন কোনাে একটা আলামত দেখার উদ্দেশ্যে সকাল বেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রেমাস দেখেছিলেন ছয়টি ঈগল (অথবা শকুন) আর রােমুলাস দেখলেন বারােটি। জানা যায় রােমুলাসই সব দিক দিয়ে ছিলেন বেশি সফল এবং তিনিই রােম শহরের পত্তন করেছিলেন। রােমান ইতিহাসের বর্ণনায় সব জায়গায় জানা যায় যে প্রতিটি ঈগল এক এক শতাব্দী সময়ের পরিচায়ক। প্রাচীন গল্পে আছে, রেমাস যদি রােমের পত্তনকারী হতেন তাহলে রােমান সাম্রাজ্য টিকত মাত্র ছয়শ বছর। সেই হিসেবে ছয় শতাব্দী পরে খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সালে (রােমান ৬০০ সালে) রােম সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে সময়টা ছিল যখন রােমান আগ্রাসনকারীদের হাতে কার্থেজ শহরটি পুরােপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, তখন। কিন্তু বিষয়টি কি এমন হতে পারে যে রেমাস রােমের পত্তন করেছিলেন এবং সেই ধ্বংসের বদলা নিতে আজ এতদিন পরে কার্থেজ থেকেই ধ্বংসকারীরা উদয় হয়েছে? কিন্তু শহরটি যেহেতু রােমুলাস পত্তন করেছিলেন তাই তা বারাে শতাব্দী ধরে অনায়াসে টিকেছিল, কারণ রােমুলাস ঈগল দেখেছিলেন বারােটি। ৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২০০ সালে) বারােশ বছর শেষ হয়েছিল। এটি কিন্তু গাইজারিকের রােমে আক্রমণের খুব বেশিদিন পরের কথা নয়। আর শহরটি ধ্বংস করতেও তারা এসেছিল কার্থেজ থেকে। সুতরাং আগে অথবা পরে, রােম তার ভাগ্যে যা নির্ধারিত ছিল তা কিছুতেই বদলাতে পারেনি। শেষে অ্যাপােলিনারিস সিডােনিয়াস লেখেন, “আহা রােম, তুমি আগেই জানতে তােমার পরিণতির কথা!”
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের আসল ক্ষমতায় স্যুভি নেতা রিসিমার ও ওডোয়াসেরের হাতে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যে এভিটাসের (রা. ৪৫৫-৫৬ খ্রি.) ক্ষমতায় আরোহন, স্যুভিদের অস্তিত্ব সংকট : রােমান সাম্রাজ্যের পশ্চিমের অংশে সামান্য যা কিছু পড়ে রয়েছিল তাই নিয়ে এবারে দুই সেনাপ্রধানের মধ্যে বিরােধ লেগে গেল। তারা দুজনেই ঈটিয়াসের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কাস মিসিলিয়াস এভিটাস, যিনি জন্মেছিলেন প্রাচীন গ্যালিক পরিবারে। অন্যজন হলেন রিসিমার, যিনি ছিলেন স্যুভিদের গােষ্ঠীপ্রধানের পুত্র। এভিটাস নিজের দেশ গাউলে ঈটিয়াসের নিয়মকানুন চালু করতে লাগলেন। তিনি জার্মানিক জাতিগুলােকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সংস্কৃতি প্রধান করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে উৎসাহী ছিলেন। কারণ তাহলেই একমাত্র রােমান সংস্কৃতিকে ধুয়েমুছে ফেলা সম্ভব। তিনি ভিসিগথদের রাজা দ্বিতীয় থিওডােরিকের সাথে একজোট হয়ে গেলেন। দ্বিতীয় থিওডােরিক গাউলে শান্তি স্থাপনের ছুতায় এলেও আসলে স্পেনের দিকে নজর দিয়ে রেখেছিলেন। দেখা গেল ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্যুভিদের ছত্রছায়ায় নিজের রাজত্ব বিস্তার করতে লাগলেন। এমনিতে সে ভাবে ভাবতে গেলে, পুরাে স্পেনই তখন ভিসিগথদের দখলে। ব্রিটানি থেকে জিব্রালটার, সব জায়গায়ই তখন ভিসিগথদের দৌরাত্ম। কিন্তু কেবল স্পেনের উত্তর দিকের পার্বত্য অঞ্চলের কিছু জায়গায় তখনও স্যুভি এবং সেখানকার আদিম জাতি বাস্কসদের বসবাস ছিল। তারা সেখানে ছিল স্বাধীন। এর মধ্যে গাইজারিকের রােমে আক্রমণ করার কথা এবং সম্রাটের স্থান শূন্য জেনে এভিটাসের ভীষণ লােভ হলাে। তার পেছনে ছিল শক্তিশালী থিওডােরিকের প্রশ্রয় এবং অন্যদিকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট মার্সিয়ানের সমর্থন। ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে অল্প কিছুদিনের জন্য এভিটাস (রা. ৪৫৫-৫৬ খ্রি.) পশ্চিম সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। তার বিরােধিতা করার জন্য অবশ্য একমাত্র ছিলেন রিসিমার। তিনি যেহেতু ছিলেন স্যুভি বংশের তাই যারা ভিসিগথদের দোসর তাদের কাছ থেকে সহানুভূতি বা সাহায্য পাওয়ার আশা ছিল তার জন্য অসম্ভব। এই কারণেই বস্তুত স্পেনে স্যুভি জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্তির দিকে চলে যায়।
রিসিমারের দ্বারা ম্যাজোরিয়ানের (রা. ৪৫৭-৬১ খ্রি.) সিংহাসন লাভ, গাইজারিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও পরাজয় : রিসিমারকেও হালকাভাবে নেয়ার কোনাে কারণ ছিল না অবশ্য। ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে রিসিমার ভ্যান্ডালদের একটি যুদ্ধজাহাজের বহরকে পরাজিত করেন। আর তখনকার দিনে যেই ভ্যান্ডালদের কোনাে ক্ষতি করেছে কী তাদের সাথে বিরােধিতা করেছে, সেই রােমানদের প্রিয় হতে পেরেছে। তাই রিসিমার যখন এভিটাসকে সিংহাসন থেকে নেমে যেতে আদেশ দিয়েছেন, এভিটাস তার কথা ফেলতে পারেননি। তারপর থেকে ষোল বছরব্যাপী রিসিমার ছিলেন রােমান সাম্রাজ্যের প্রকৃত শাসক। তিনি পরপর অনেককে রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের আসনে বসান এবং তার মাধ্যমে তিনি নিজের খেয়াল খুশিমতাে রাজ্য পরিচালনা করেন। সর্বপ্রথম তিনি সিংহাসনে বসিয়েছিলেন মাজোরিয়ানিকে (রা. ৪৫৭-৬১ খ্রি.), যিনি ঈটিয়াসের পক্ষে যােদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রতি প্রথম আদেশই ছিল ভ্যান্ডালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা। রােমের দক্ষিণপূর্ব দিকে ইতালির সমুদ্রতীরে ভ্যান্ডালদের যুদ্ধ জাহাজের বহরকে গুঁড়িয়ে দেয়া হলাে। রােমান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করল। এই জয়ের আনন্দে উৎসাহিত হয়ে মাজোরিয়ান নিজের থেকেই একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আফ্রিকায় আক্রমণ করতে চাইলেন। তিনি ভিসিগথদের রাজা দ্বিতীয় থিওডােরিককে সাহায্য করতে চাইলেন। দ্বিতীয় থিওডােরিক অবশ্য তখন তার প্রিয় এভিটাসকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দেয়ার জন্য একটু রুষ্ট ছিলেন। কিন্তু গাউলে রােমান একদল সেনার কাছে তার বাহিনী হেরে যাওয়াতে তিনি ভাবলেন দুই দলেরই সাধারণ শত্রু ভ্যান্ডালদের দমন করার জন্য হলেও তার রােমানদের সাথে হাত মেলানাে উচিত। ঠিক যেমন আট বছর আগে তার বাবা হানদের বিপক্ষে জেতার জন্য রােমানদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। রােমান এবং গথিক যুদ্ধ বহর স্পেনের কার্টাজিনায় একযােগে তৈরি হতে লাগলাে। কিন্তু গাইজারিক তাে আর ঘুমিয়ে পড়েননি। ৪৬০ খ্রিস্টাব্দে তার নিজস্ব যুদ্ধ জাহাজের তাণ্ডব আকাশে আকস্মিক বিদ্যুৎ চমকানাের মতাে তখনও পুরােপুরি তৈরি হওয়া রােমান আর গথিক জাহাজগুলাের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অসতর্ক মাজোরিয়ান তার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন এবং কোনােরকমে রােমে ফেরত চলে গেলেন। রিসিমার দেখলেন এই সম্রাট কোনাে কাজের না, তাই ৪৬১ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২১৪ সালে) তাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিলেন। তার ঠিক পাঁচদিন পরে মাজোরিয়ান মৃত্যুবরণ করলেন, সম্ভবত বিষ খেয়ে।
লিও ও রিসিমারের দ্বারা অ্যান্থেমিয়াসের (রা. ৪৬৭-৭২ খ্রি.) সিংহাসন লাভ, গাইজারিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও পরাজয় : রিসিমার যে সিংহাসনে বসানাের জন্য অন্য কারও নাম প্রস্তাব করবেন, তা করতে পারলেন না পূর্বদিকের সম্রাট প্রথম লিওর জন্য। প্রথম লিও চাচ্ছিলেন পূর্ব এবং পশ্চিম অংশ মিলিয়ে পুরাে সাম্রাজ্যকে এক করে তার হাতে তুলে নিতে। ঠিক যেমনটি ছিল এক শতাব্দী আগে প্রথম থিওডােসিয়াসের হাতে। এই ব্যবস্থা চালু করার প্রাক্কালে প্রথম লিও কাউকে খুঁজছিলেন যাকে তার হাতের পুতুল করে পশ্চিম দিকের অংশে সম্রাট হিসেবে বসাতে পারেন। অনেক আলােচনা পর্যালােচনার পরে প্রথম লিও এবং রিসিমার দুজনেই অ্যান্থেমিয়াসকে সিংহাসনে বসানাের ব্যাপারে একমত হলেন। অ্যান্থেমিয়াস ছিলেন সম্রাট মার্সিয়ানের কন্যার স্বামী, যে মার্সিয়ান কন্সট্যান্টিনােপলের সিংহাসনে লিওর আগে বসেছিলেন। ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে অ্যান্থেমিয়াস পশ্চিম দিকের অংশে সম্রাট হিসেবে ঘােষিত হন। তার এই অবস্থান আরও শক্তপােক্ত হলাে যখন রােমের প্রকৃত শাসক রিসিমার, অ্যান্থেমিয়াসের কন্যাকে বিয়ে করলেন। লিওর জন্য এর পরের পদক্ষেপ ছিল নিজের একটি যুদ্ধ জাহাজের বহর ভ্যান্ডালদের বিরুদ্ধে যাত্রা করানাে। তিনি প্রথমেই প্রমাণ করতে চাইলেন যে মাজোরিয়ান যা করতে পারেননি তিনি তাই করে দেখাবেন। বিশাল এক যুদ্ধ জাহাজের বহর তৈরি করা হলাে এবং সেনা সামন্তে পরিপূর্ণ করা হলাে। জাহাজের সংখ্যা ছিল ১১০০ এর উপরে এবং সেই হিসেবে মানুষের সংখ্যা ছিল ১০০,০০০ এর উপরে। ভ্যান্ডালদের হাত থেকে সার্ডিনিয়া দখল করে নেয়া হলাে। এবং আফ্রিকায় এক দল সেনাকে নামিয়ে দেয়া হলাে। কিছু সময়ের জন্য সত্তর বছর বয়সে উপনীত গাইজারিকের মনে হলাে, অবস্থা যেন সুবিধার নয়। তবে তিনি দেখলেন যে যুদ্ধ জাহাজের বহর সাজানাে হয়েছে অপূর্ব দক্ষতায় এবং সমুদ্রতীরে লােকের সমাগম বলে দিচ্ছে বিশাল এক লােভনীয় জয়ের সম্ভাবনা আছে। তবে জাহাজগুলাে যেন পাহারা দেয়া হচ্ছে খুবই অবহেলা নিয়ে। রাতের বেলায় অতর্কিতে সেই বিপুল জাহাজের বহরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে গাইজারিক সেনাসামন্ত পাঠালেন আরেক জাহাজের বহরে করে। রােমান রাজকীয় যােদ্ধাদের দল পালাতে পথ পেল না। লিওর যুদ্ধজাহাজের অভিযানের তােড়জোড় সেখানেই সমাপ্ত হলাে।
পশ্চিমে রিসিমারের দ্বারা ওলিব্রিয়াস (রা. ৪৭২ খ্রি.) ও লিওর দ্বারা নেপোস (রা. ৪৭৪-৭৫ খ্রি.), পূর্বে দ্বিতীয় লিও (রা. ৪৭৪ খ্রি.) ও জেনো (রা. ৪৭৪ – ৯১ খ্রি.) : লিও অবশ্য এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিজের দোষ ঢাকার ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু উল্লেখ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি এই ভয়াবহ ভরাডুবির দায়িত্ব পুরােপুরি তার সেনাপ্রধানের উপরে দিয়ে দিলেন। ৪৭১ সালে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে সেনাপ্রধান অ্যাসপারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলাে। এটাই ছিল সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে জার্মানদের হস্তক্ষেপের শেষ উদাহরণ। এদিকে পশ্চিমে রিসিমার ঘটনার দায় অ্যান্থেমিয়াসের উপরে চাপিয়ে দিলেন। তাকে ৪৭২ সালে (রােমান ১২২৫ সালে) বরখাস্ত করা হলাে। তিনি আবার একজন পুতুল শাসক খুঁজে বের করলেন, কারণ লিওর পক্ষে আর তাকে সাহায্য করা সম্ভব হলাে না কারণ লিও তখন তার অবস্থানে ছিলেন না। সেই পুতুল শাসক হলেন অ্যানসিয়াস ওলিব্রিয়াস (রা. ৪৭২ খ্রি.), যিনি প্ল্যাসিডিয়াকে বিয়ে করেছিলেন। প্ল্যাসিডিয়া ছিলেন তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের কন্যা তাই কিছুটা হলেও তার মধ্যে থিওডােসিয়াসের আভা লেগে ছিল। সে যাই হােক, ওলিব্রিয়াস এবং রিসিমার দুজনেই সেই একই বছরে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর আবার এলাে লিওর পালা। এবারে লিও খুঁজে বের করবেন কাকে পাওয়া যায় পশ্চিমে পুতুল শাসক হিসেবে বসানাের জন্য। তিনি নির্বাচিত করলেন জুলিয়াস নেপােসকে (রা. ৪৭৪-৮০ খ্রি.)। তিনি ছিলেন লিওর স্ত্রীর আত্মীয়। লিও মৃত্যবরণ করেন ৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে। তার নাতি, যিনি ইসাউরিয়ান দেহরক্ষীদের প্রধান ছিলেন, তিনি দ্বিতীয় লিও (৪৭৪ খ্রি.) হিসেবে তার উত্তরাধিকারীর আসনে বসলেন। তিনিও কিছুদিন শাসন করার পরে মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর আরেকজন ইসাউরিয়ান সেনাপ্রধান জেনাে (রা. ৪৭৪-৯১ খ্রি.), যিনি ছিলেন দ্বিতীয় লিওর এর পিতা। প্রথম লিওর মৃত্যুর সময়েও পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য একেবারে অটুট ছিল। এর সীমানা ছিল ঠিক সেই আশি বছর আগের থিওডােসিয়াসের শাসনামলের মতাে।
ভূতপূর্ব পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের তদকালীন অবস্থা : এককালে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য যা ছিল তা হ্রাস পেয়ে ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছিল, আর সেখানে উদ্ভব হয়েছিল নতুন নতুন রাজ্যের। ভূতপূর্ব পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের তদকালীন অবস্থা ছিল এরকম –
- স্পেন ও গাউলে ভিসিগথ জাতি : ৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভিসিগথদের রাজা দ্বিতীয় থিওডােরিক তার ভাই ইউরিকের হাতে নিহত হন। ইউরিকের হাতে সেই সাম্রাজ্য ক্ষমতার তুঙ্গে পৌঁছে যায়। ইউরিক তাদের নিজেদের আইনকানুনের মধ্যে কিছু রােমান আইনের প্রবর্তন করেন। সুতরাং তাদের নিয়মকানুনকে আর কোনােমতেই জার্মানিক জাতির নিয়মের সাথে তুলনা করা যাবে না। সে সময়ে গথরা বর্তমান স্পেন ও ফ্রান্সের ভূমির দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। রােমান ভূমির মালিকদের এজন্য মােটামুটি বিপদের মুখে রাখে তারা।
- গাউলের দক্ষিণ-পূর্বে বার্গান্ডি জাতি : তখন গাউলের দক্ষিণ-পূর্বদিকে বারগান্ডিয়ানদের দৌরাত্ম বেড়ে গেল সাংঘাতিকভাবে। তাদের সীমানা বাড়তে বাড়তে ভিসিগথদের সীমানার সাথে মিলে যায়।
- ব্রিটেনের দক্ষিণ-পূর্বে অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি : তখন দক্ষিণ-পূর্ব ব্রিটেন অ্যাংলাে-স্যাক্সনদের বেশ শক্ত অবস্থান ছিল।
- গাউলের উত্তর-পশ্চিমে স্বাধীন সয়সনস রাজ্য : গাউলের উত্তর-পশ্চিম দিকে সেখানকার গ্যালো-রোমানরা তখনও নিজেদের জায়গা দখল করে রেখেছিল। প্যারিসের থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে তারা তাদের নিজেদের রাজ্য পত্তন করেছিল সয়সনস শহরে। এর শাসক ছিলেন রোমান জেনারেল ঈজিডিয়াস ও তার পুত্র সিয়াগ্রিয়াস। সিয়াগ্রিয়াস একজন শেষ রোমান শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যদিও তিনি একসময় রােমান শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেও স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
- আফ্রিকায় গাইজারিকের অধীনে ভ্যান্ডাল জাতি : আফ্রিকায় গাইজারিক তখনও শাসন করছিলেন। ৪৭৭ খ্রিস্টাব্দের আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। সে সময় তিনি সাতাশি বছর বয়সে পৌঁছে গেছেন। তিনি আফ্রিকায় অর্ধ শতাব্দী ধরে শাসন করেছিলেন এবং সবসময় জয়ের মুখই দেখেছেন। সে পর্যন্ত যত অসভ্য জাতির যত নেতা রােমান সাম্রাজ্যকে দখল করে নিতে চেয়েছেন, গাইজারিক ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে সফল।
- ইতালি ও ইলিরিয়া নিয়ে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য : প্রকৃতপক্ষে তখন পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের যা কিছু বেঁচে ছিল, তা ছিল ইতালি এবং ইলিরিয়া।
রোমুলাস অগাস্টাসের ক্ষমতা গ্রহণ (রা. ৪৭৫ – ৭৬ খ্রি.) এবং ৪৭৬ সালে ওডোয়াসেরের হাতে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন : হিরুলিয়ান জাতির ওডােয়াসের রিসিমারের মৃত্যুর পরে পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ আরেকজন সেনাপ্রধান, অরেস্টেসের হাতে এলাে। তিনি ৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে জুলিয়াস নেপােসকে জোর করে নামিয়ে নিয়ে সেখানে নিজের সন্তান রােমুলাস অগাস্টাসকে (রা. ৪৭৫-৭৬ খ্রি.) বসিয়ে দিলেন। রােমুলাস অগাস্টাসের নামটি ছিল খুব ঈঙ্গিতবাহী। কারণ রােমুলাস রােমের এবং অগাস্টাস রােমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। যাই হোক সেটা অবশ্য শুভ কোনাে ইঙ্গিত ছিল না। সিংহাসনে বসার সময়ে রােমুলাস ছিলেন কেবল চৌদ্দ বছর বয়স্ক। তখনই তার নাম সংশােধন করে রােমুলাস অগাস্টাস (রােমুলাস নামের সম্রাট) রাখা হয়েছিল। ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত। রােমুলাস এক বছরেরও কম সময় সম্রাট ছিলেন। কারণ চারদিকে তখন জার্মানিক জাতির ভাড়াটে সেনাদের উৎপাত খুব বেড়ে গিয়েছিল। তারা মনে করত যে গাউল, স্পেন আর আফ্রিকায় তাদের স্বগােত্রীয় জার্মানরা আর রােমানদের কথামতাে চলছে না, বরং তারাই শাসন করছে। তাই ভাড়াটে সেনাদের দাপট এত বেড়ে গেল যে তারা ইতালির এক তৃতীয়াংশ স্থান দাবি করে বসল। বালক সম্রাটের পেছনে সত্যিকারের ক্ষমতা যার হাতে ছিল, সেই অরেস্টেস জার্মান ভাড়াটে সেনাদের ইতালিতে জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। সেই সেনাদলের একজন নেতা ছিলেন, যার নাম ছিল ওডােয়াসের (হিরুলিয়ান উপজাতির বংশােদ্ভূত)। এই জাতিটি জার্মান অন্যান্য জাতিগুলাের মধ্যে একটু কম জনপ্রিয় ছিল। ওডােয়াসের সিদ্ধান্ত নিলেন যেহেতু তাদের দাবি করা অংশ বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না তাই তারা পুরােটাই নিয়ে নেবেন। অরেস্টেসকে চাপের মুখে রেখে তারা উত্তর ইতালির টিসিনাম শহরটি (আধুনিক পেভিয়া) দখল করে নিলাে। দখলের পরে তারা অরেস্টেসকে হত্যা করল। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বরে রােমুলাস অগাস্টাসকে চিরকালের জন্য উধাও করে দেয়া হলাে। ওডােয়াসের নিজের কথামতাে চলার জন্য কোনাে পুতুল সম্রাট খোঁজার প্রয়ােজন মনে করলেন না। সেভাবে বলতে গেলে শত শত বছর ধরে পশ্চিম দিকে কোনাে সম্রাট শাসন করার তেমন সুযােগ পাননি। কেবল অগাস্টাস আর ট্রাজানের নাম ধার করে একের পর এক সম্রাট এসেছেন। এই সমস্ত কারণেই ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দকে (রােমান ১২২৯ সাল) “রােমান সাম্রাজ্যের পতনের সময়” বলে উল্লেখ করা হয়।
পূর্ব রোমান সম্রাটের অধীনস্ত হিসেবে ওডোয়াসের, ৪৮০ সালে নেপোসের মৃত্যুর পর তার ইলিরিয়া দখল ও সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের একক সম্রাট জেনো : অবশ্য এই উল্লেখটি সঠিক নয়। সেই সময়ে কেউই মনে করেনি যে রােমান সাম্রাজ্য পতিত হয়েছে। তখন অবশ্যই রােমান সাম্রাজ্য টিকেছিল এবং তখনও ইউরােপে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য হিসেবেই দাঁড়িয়ে ছিল। তখন এর রাজধানী ছিল কন্সট্যান্টিনােপল এবং সম্রাট ছিলেন জেনাে। যারা রােমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের সংস্কৃতি থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা পূর্ব অংশকে অবহেলার চোখে দেখেন। বস্তুত তারা রােমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না। এটা সত্যি যে কালস্রোতে রােমান কিছু প্রদেশ জার্মান শাসকদের হাতে চলে গিয়েছিল কিন্তু তখনও সেসব রােমান সাম্রাজ্যের অধীনেই ছিল। জার্মান শাসকেরা শাসন করেছেন কিন্তু করেছেন তাে রােমান সাম্রাজ্যের অধীনেই। জার্মানিক জাতিগুলাে থেকে কোনাে সেনাপ্রধান যখন রােমান সাম্রাজ্যের কোনাে আসনে বসেছে তখনই নিজেকে ধন্য মনে করেছে। জেনাে নিজেও রােমুলাস অগাস্টাসকে পশ্চিম দিকের অংশের সম্রাট হিসেবে কখনও স্বীকৃতি দেননি। পূর্ব দিকের অংশের সম্রাট হিসেবে তিনি রােমুলাসকে একজন সুদখাের এবং জুলিয়াস নেপােসকে কেবল একজন সহকর্মী বলে মনে করতেন। পূর্ব রোমান সম্রাট জেনো ওডোয়াসেরকে ইতালির প্যাট্রিশিয়ান পদ প্রদান করেছিলেন, ওডোয়াসেরও জেনোর অধীনস্ততা মেনে নিয়েছিলেন। তা ছাড়া ওডোয়াসের নিজেকে রোমান সম্রাট ভাবতেন না, ভাবতেন একটি জার্মান উপজাতির রাজা হিসেবে। জুলিয়াস নেপোসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার পরে তিনি রােম থেকে পালিয়ে যান এবং ইলিরিয়ায় গিয়ে থাকা শুরু করেন। সেখানেই তাকে পশ্চিম দিকের রােমান সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দেন জেনাে। পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্য আইনি কার্যকলাপ চালিয়েছে ৪৮০ খ্রিস্টাব্দ (রােমান ১২৩৩ সাল) পর্যন্ত, যখন জুলিয়াস নেপােসকে গুপ্তহত্যা করা হয়। কেবল তখন বিচারালয়ের দৃষ্টিতে পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের কন্সট্যান্টিনােপলে কোনাে সম্রাট বলে আর কেউ ছিলেন না। এর পরে পশ্চিম এবং পূর্ব দিকের অংশ মুখেমুখে আবার এক সাম্রাজ্য হয়ে গেল, ঠিক যেমনটি ছিল প্রথম কন্সট্যান্টাইন এবং প্রথম থিওডােসিয়াসের সময়ে। জেনাে একাই পুরাে সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে উঠলেন। ৪৮০ সালে ইলিরিয়ায় জুলিয়াস নেপােসকে গুপ্তহত্যার শিকার হলে ওডোয়াসের তার প্রতিশোধ নেবার অজুহাতে ইলিরিয়ায় যান, তিনি গুপ্তহত্যাকারীদের একজনকে হত্যা করেন। এরপর তিনি ইলিরিয়াকে তার অধীন রাজ্যে যুক্ত করেন। জেনাে তার এই ক্ষমতা খুব অস্বস্তি নিয়ে খেয়াল করছিলেন। তাই এরপর থেকে জেনাে তার বেসামাল দাপট কমানাের জন্য সূক্ষ্ম কৌশল নিয়ে ওডোয়াসেরকে পরিচালনা শুরু করলেন।
থিওডােরিকের অস্ত্রোগথিক রাজ্য ও প্রথম ক্লোভিসের ফ্র্যাঙ্ক রাজ্যের উদ্ভব
অস্ট্রোগথদের নিয়ে থিওডোরিকের ওডোয়াসেরের বিরুদ্ধে অভিযান, ওডোয়াসেরের মৃত্যু ও থিওডোরিকের ইতালি, ইলিরিয়া ও ইতালির পশ্চিম অঞ্চলের সম্রাট হয়ে ওঠা : জেনাের চোখ পড়ল অস্ট্রগথের উপরে। এক শতাব্দী আগে অস্ট্রগথ হানদের আইনের অধীনে চলত। ভিসিগথরা যখন রােমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকে অনুপ্রবেশ করছিল, তখন অস্ট্রগথরা তাদের মতাে রােমান সাম্রাজ্যে শরণার্থীর মতাে করে অবস্থান করতে চায়নি। অস্ট্রগথরা সেখানে সেভাবেই ছিল আশি বছর পর্যন্ত। ক্যাটালাউনিয়ান সমভূমির উপরে তারা হানদের হয়ে যুদ্ধে লড়েছে। অ্যাটিলার মৃত্যুর পরে এবং হানদের রাজ্য ভেঙে পড়ায় অস্ট্রগথরা আবার নিজেরাই নিজেদের মালিক হয়ে উঠল। তারা পূর্বদিকের সাম্রাজ্যে কয়েকবার হামলা চালালাে এবং দানিয়ুবের দক্ষিণ দিকে, কন্সট্যান্টিনােপলের রােষের মুখে অবুঝের মতাে ঘাঁটি গাড়ল। ৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রোগথরা শেষ পর্যন্ত একজন যােগ্য নেতা থিওডােরিকের অধীনে লড়ার সুযােগ পেল। জেনাের কাছে তখন মনে হয়েছিল যে তিনি দুটো পাখি একটি তীর দিয়ে ধ্বংস করেছেন। তিনি নিজেই ভেবেছিলেন যে থিওডােরিককে অস্ট্রগথদের দায়িত্ব নিতে এবং তাদের দলটিকে হিরুলিয়ানের ওডোয়াসেরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবেন। এভাবে তিনি হয়তােবা অস্ট্রোগথদের হাত থেকেও মুক্তি পাবেন; দুই জার্মান উপজাতি নিজেদের মধ্যে লড়াই করে নিজেরাই দুর্বল হয়ে যাবে। ৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২৪১ সালে) থিওডােরিক জেনাের সহায়তায় পশ্চিম দিকে অভিযানে যান। তিনি বাহিনী নিয়ে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীর পর্যন্ত চলে যান। ইতালির ভেতরে তিনি পরপর দুটি যুদ্ধে অডােয়াসেরকে পরাজিত করেন। ৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওডােয়াসেরকে র্যাভিনায় বন্দী করেন। থিওডােরিক তাকে বন্দী করার পরও ধীরে বিষয়টি নিয়ে এগােলেন। ৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২৪৬ সালে) র্যাভিনা শেষ পর্যন্ত দখল করা হলাে। থিওডােরিক ওডােয়াসেরকে জেনোর হাতে তুলে দেয়ার চুক্তি ভুলে গিয়ে নিজের হাতে তাকে হত্যা করলেন। র্যাভিনা দখল করে বসা থিওডােরিক তখন হয়ে উঠলেন ইতালি, ইলিরিয়া এবং ইতালির উত্তর ও পশ্চিম দিকের অঞ্চলগুলাের একমাত্র শাসক। প্রথম অ্যানাস্টাসিয়াস (৪৯১-৫১৮ খ্রি.) তার অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, কন্সট্যান্টিনােপলের নতুন সম্রাট জেনাের মৃত্যুর পরে ৪৯১ সালে সিংহাসনে উপনীত হন। থিওডােরিক প্রবল পরাক্রমসহ বহুদিন ধরে সম্রাট রয়ে গেলেন। তিনি এমন নীরবে, ক্ষমতা প্রদর্শন না করে ক্ষমতা রক্ষা করে গেছেন, যে তাকে বলা হয় “থিওডােরিক দ্য গ্রেট”।
ইতালি ও ইলিরিয়ায় অস্ট্রোগথিক রাজ্যের শাসন : ৬ষ্ঠ শতকের শেষ সিকিভাগ যে ইতালির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল, এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। অ্যালারিকের হামলার সময়কার দুঃস্বপ্নের সময়টার সাথে তুলনা করলে তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সেই সব কিছুর পরে থিওডােরিকের অধীনে ইতালিকে মনে হচ্ছিল স্বর্গ। তিন শতাব্দী আগে মার্কাস অরেলিয়াসের শাসনামলের পরে তেমন সময় আর আসেনি। এক একবার এমনও মনে হচ্ছিল যে রােমান সংস্কৃতি বােধ হয় আবার নতুন করে আত্মপ্রকাশ করছে।
- থিওডোরিকের উত্তরাধিকারী ক্যাসিওডোরাস : ক্যাসিওডােরাস ছিলেন থিওডােরিকের উত্তরাধিকারী। ক্যাসিওডোরাস ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। তিনি তার জীবন দান করেছিলেন দুটো উপাসনালয়ের ধর্মীয় গ্রন্থ সংগ্রহ এবং দেখাশােনা করতে। তিনি নিজেও ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ব্যাকরণ নিয়ে চর্চা করে কাটাতেন। তিনি নিজেও গথদের উপরে একটি মহামূল্যবান ইতিহাস লিখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
- দার্শনিক বোয়েথিয়াস : বােয়েথিয়াস (অ্যানিসিয়াস ম্যানলিয়াস সেভিরিনাস বােয়েথিয়াস) ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে শেষ দার্শনিক। তিনি ৫১০ খ্রিস্টাব্দে কনসলের দায়িত্বে ছিলেন এবং তার দুই পুত্রও ৫২২ খ্রিস্টাব্দে কনসল ছিলেন। বােয়েথিয়াস ছেলেদের ওরকম পদে অধিষ্ঠিত দেখে শান্তি পেয়েছিলেন কিন্তু তখন এমন একটা অবস্থা ছিল যে সকলকে নামমাত্রই কনসল হয়ে থাকতে হতাে। (দুর্ভাগ্যক্রমে বােয়েথিয়াসকে বন্দী করলেন বয়স্ক থিওডােরিক। কারণ থিওডােরিক দার্শনিকদের ভয় পেতেন। তিনি মনে করতেন পূর্ব দিকের সম্রাটের সাথে মিলে দার্শনিকেরা তার ক্ষতি করতে পারে। শেষে বােয়েথিয়াসকে তিনি ফাঁসিতে ঝােলান!)। বােয়েথিয়াস ছিলেন একজন খ্রিস্টান, তবে তার ধর্মের আদর্শের কথা কোনাে লেখায় প্রতিফলিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্যাগান রােমান রাজ্যের উপরে স্টয়সিজমের একটি প্রচ্ছন্ন ছায়া লেগেই ছিল। তিনি অ্যারিস্টটলের কিছু লেখা ল্যাটিনে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়াও সিসেরাে, ইউক্লিড এবং প্রাচীন কিছু দার্শনিকদের নিয়ে মন্তব্যধর্মী রচনাও লিখেছিলেন। এসব কাজ বেঁচে ছিল মধ্যযুগের মধ্যভাগ পর্যন্ত। প্রাচীন যুগের সেসব কাজগুলাে পরে হারিয়ে গেলেও বােয়েথিয়াসের লেখাগুলাে প্রাচীন যুগের শেষ আলােটুকু ছড়াতে পেরেছিল অনেকদিন।
নাইসিনীয় ও এরিয়ানদের ইন্টিগ্রেশনের অভাব এবং ফ্র্যাঙ্ক জাতির নেতা প্রথম ক্লোভিসের সয়সন্স জয় : এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের সময়টাতে রােম যদি জার্মানিক জাতিগুলাের সংস্কৃতিতে দীক্ষিত হতাে এবং জার্মানির আগ্রাসনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতাে তাহলে জার্মানি এবং রােম একত্রে মিলে রােমান সাম্রাজ্যের চেয়েও শক্তিশালী এক সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জার্মান নেতাগণ ছিলেন এরিয়ানিস্ট এবং রােমানরা নাইসিনীয়। তাই কোনােরকমে জার্মান এবং রােমানরা মিললেও মিলতে পারতেন, কিন্তু নাইসিনীয় আর এরিয়ানিস্টরা কখনও নয়। গাউলের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থানকারী ফ্র্যাঙ্ক জাতি তার আগের অর্ধ শতাব্দী ধরে চুপচাপ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তারা ক্লোভিস নামে একজন শক্তিশালী নেতা পেয়ে গেল। ৪৮১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি ক্ষমতায় এলেন। মাত্র পাঁচ বছর সেখানকার লােকদের শাসন করার পরপরই তিনি রাজ্যের আয়তন বাড়ানাের কাজে মনােযােগ দিলেন। ক্লোভিসের প্রথম লক্ষ্য ছিল সিয়াগ্রিয়াস। ৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২৩৯ সালে) সিওসনস সিয়াগ্রিয়াসকে আক্রমণ করে তিনি হত্যা করলেন। আর এভাবেই পশ্চিম দিকের রােমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা শেষ শাসকের সমাপ্তি হলাে। তারপর থেকেই সেখানকার স্থানীয় লােকদের হাতে চলে গেল সেখানকার শাসনব্যবস্থা।
পশ্চিমে রোমানদের অবসান এবং প্যারিস ভিত্তিক ফ্র্যাঙ্ক রাজ্যের হাত ধরে পশ্চিম ইউরোপের ঘুরে দাঁড়ানো : একটি দীর্ঘ যুগের সমাপ্তি ঘটছিল তখন। ১২৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে সেই সময়টার যখন টিবার নদীর তীরে ছােট্ট গ্রাম রােমের পত্তন হয়েছিল। রােম নিজেই যেন নিজেকে প্রাচীন কালের শ্রেষ্ঠ সভ্যতায় পরিণত করেছিল। শ্রেষ্ঠ জাতি হয়ে শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা। সেই সাম্রাজ্য হাজার হাজার মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার সুযােগ করে দিয়েছিল। উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে চালানাের অভিনব নিয়ম তারাই আবিষ্কার করেছিল। পূর্বদিকের ধর্ম তারা গ্রহণ করেছিল এবং কালক্রমে সেই ধর্ম ছড়িয়ে দিয়েছিল আরও বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর মধ্যে। কিন্তু তখন সেই ১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমের কোথাও এমন কোনাে শাসক ছিলেন যাকে সরাসরি রােমান শাসকদের উত্তরাধিকারী বলা যায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ ছিল তখনও অখণ্ড। সেখানে তখন কোনাে সম্রাট ছিল না কিন্তু বর্ধিত হয়ে তা যেন উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এক হয়ে যাচ্ছিল। নতুন সভ্যতার বিকাশে রােমান সভ্যতার হাত যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল পূর্ব সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের শেষ বিন্দুও যখন অবশিষ্ট ছিল, ইউরােপ তখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানাের চেষ্টা করল। এমন আর কে ছিল যে কিনা সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে নতুন সভ্যতার সূচনা করবে? ফ্র্যাঙ্কস আর গথরাই সেখানে উপস্থিত ছিল কেবল। লােম্বার্ডস, নর্থমেন, আরবীয়, আরও যাদের কথা উল্লেখ করা হয় না, তারা কেবল সেই দুই জাতিকে অনুকরণ করছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশও নতুন সভ্যতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকে ফ্র্যাঙ্করাই ছিল একমাত্র জাতি যারা তখন রােমান শাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার যােগ্যতা রাখত। সয়সন্সে ক্লোভিসের বিজয়ের মাধ্যমে ফ্র্যাঙ্কদের নতুন সভ্যতার আলাে উঁকি দিয়েছিল, একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সেই থেকেই ফ্র্যাঙ্ক সংস্কৃতির সূচনা এবং সমাদৃত হয়ে ওঠার ইতিহাসের শুরু। তবে সেই যাত্রা আর রােমকে কেন্দ্র করে শুরু হয়নি, হয়েছিল প্যারিসের হাত ধরে। প্রকৃতপক্ষে সেই গতিই যেন প্রাচীন যুগকে মধ্যযুগে এবং তারপর আজকের এই আধুনিক যুগে, আমাদের কাছে এনে উপস্থিত করেছে।
তথ্যসূত্র
- The Roman Republic, Isaac Asimov, Houghton Mifflin Harcourt (March 1, 1973)
- The Roman Empire, Isaac Asimov, Houghton Mifflin Harcourt (June 1, 1967)
Leave a Reply