Table of Contents
ভূমিকা
পূর্বের দার্শনিকগ্ণ মূলত নৈতিক সমস্যাবলির ওপরই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তবে নৈতিক সমস্যার প্রাধান্য স্বীকার করলেও এসব দার্শনিক বিশুদ্ধ দর্শন বা অধিবিদ্যার গুরুত্ব অস্বীকার করেন নি। তাঁদের দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার মূলে যে বিশ্বাসটি ক্রিয়াশীল ছিল তা এই যে, মানুষের বুদ্ধি যেকোনো সত্য আবিষ্কারে সক্ষম। অর্থাৎ জ্ঞান ও সত্য অনুসন্ধানের ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী ছিলেন। তাঁদের বিশ্বাসের মূল উৎস ছিল সক্রেটিস-উত্তর সেসব মহান দার্শনিক যাঁরা সংশয়বাদী আক্রমণ থেকে জ্ঞান ও সত্যের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে রক্ষা করেছিলেন, বিচারবুদ্ধির সার্বভৌমত্বে মানুষের বিশ্বাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই দেখা গেল যে, এপিকিউরীয় ও স্টোয়িক দর্শনের পাশাপাশি এক নতুন সংশয়বাদের উদ্ভব হলো। এর প্রবক্তা ও সমর্থকগণ জ্ঞানের অনপেক্ষ ভিত্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। অন্য যেকোনো সংশয়বাদের মতো তাঁদের মতও ছিল নঞর্থক।
তবে তাঁদের এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদার ও স্বাধীন দিকও ছিল। প্রাচীন কুসংস্কার, অপরীক্ষিত বিশ্বাস ও পক্ষপাতিত্ব থেকে মানবমনকে মুক্ত করায় প্রয়াসী ছিলেন সংশয়বাদীরা। এ ধরনের পরিষ্করণ ব্যতিরেকে যথাযথ দার্শনিক অনুসন্ধান সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করতেন। তাঁদের দৃষ্টিতে দার্শনিক কোনো উচ্চতর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী নন, এবং সত্তা সম্পর্কে তিনি কোনো বিশেষ প্রত্যাদেশ পান না। দার্শনিক আসলে সমকালীন প্রতিষ্ঠান ও প্রচলিত ধারণাবলির সমালোচক। অচল সংস্কার থেকে মনকে কী করে মুক্ত ও পরিষ্কার করা যায়, দার্শনিক তা-ই দেখাবার চেষ্টা করেন।
সংশয়বাদীদের এই সংস্কারধর্মী বৈজ্ঞানিক মনোভাব যদি স্থায়ী সমর্থনলাভ করতো, তা হলে তা নিঃসন্দেহে দর্শনকে পুনর্গঠিত করতে এবং সভ্যতার বিকাশে আরও বেশি অবদান রাখতে পারত। কিন্তু প্রাচীনকালের চিন্তায় সংশয়বাদ স্থায়ী হতে পারে নি। প্রাচীন দর্শনের ইতিহাসে এটি ছিল বিস্ময়স্বরূপ। আর এজন্যই দেখা যায় যে, বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক মতের উদ্ভবের ফলে তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গ্রিক সংশয়বাদকে তিনটি পৃথক পর্বে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্বে উল্লেখযোগ্য পাইরো ও টাইমন প্রমুখ দার্শনিকের রচনাবলি। একে বলা চলে সংশয়বাদের গঠনমূলক পর্ব। নৈতিক অনপেক্ষবাদের বিরুদ্ধেই ছিল এ সময়ের দার্শনিকদের সংগ্রাম। দ্বিতীয় পর্বের প্রভাবশালী সংশয়বাদীদের মধ্যে আর্কেসিলস ও কার্নিয়াডিসের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের দর্শনচর্চার কেন্দ্রভূমি ছিল প্লেটোর একাডেমি। এ সময় বিশেষ করে স্টোয়িকদের আক্রমণ করা হয় এবং সম্ভাব্যতার ধারণাকে একটি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সংশয়বাদের তৃতীয় পর্বের বৈশিষ্ট্য ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর গুরুত্ব আরোপ। এ সময়ে এনিসিডেমাস, এগ্রিপা ও সেক্সটাস এম্পিরিকাসের নেতৃত্বে সংশয়বাদ পরিপকৃতালাভ করে। এসব চিন্তাবিদের পর সংশয়বাদের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পায়। মধ্যযুগে সংশয়বাদের কোনো চিহ্নই ছিল না বলা চলে।
পাইরো (৩৬৫-২৭০ খ্রি.পূ.)
সংশয়বাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পিলপানিসাসের অন্তর্গত এলিস নগরের অধিবাসী পাইরো (Pyrrho of Elis, খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৫-২৭০)। পাইরোর নামানুসারেই সংশয়বাদ পরবর্তীকালে পাইরোবাদ (Pyrrhonism) বলে পরিচিত হয়ে ওঠে। আজকাল পাইরোবাদ সংশয়বাদের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাইরো ছিলেন এরিস্টটলের সমসাময়িক এবং মহাবীর আলেকজান্ডারের বন্ধু। কথিত আছে যে, তিনি আলেকজান্ডারের সৈন্যদলভুক্ত হয়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। যৌবনে তিনি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তখন থেকেই তিনি দর্শনে শিক্ষালাভ করেন। তাঁর শিক্ষকদের সাহায্যেই তিনি ডেমোক্রিটাস ও মেগারিকদের দর্শনের সঙ্গে পরিচয়লাভ করেন। তবে তিনি নিজে কিছুই লিখে যান নি। তাঁর মতাবলি তাঁরই এক ভক্ত টাইমন (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০-২৩০) লিপিবদ্ধ করেন। তা ছাড়া সংশয়বাদ সম্বন্ধে টাইমন বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল শ্লেষাত্মক কাব্যগ্রন্থ। তাতে তিনি থেলিস থেকে শুরু করে আর্কেসিলস পর্যন্ত সব অধ্যাত্মবাদীর সমালোচনা করেন।
দর্শনে সংশয়বাদ নুতন কিছু নয়; আর পাইরোও কোনো নতুন মত প্রচার করেন নি। দার্শনিক জ্ঞানের প্রামাণিকতা সম্পর্কে প্রাচীন দার্শনিকদের অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। যেমন : পারমেনাইডিস ও প্লেটো ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষণের প্রামাণিকতা অস্বীকার করেছিলেন। সোফিস্ট সম্প্রদায় জ্ঞানের সর্বজনীন মানদণ্ড আছে বলে বিশ্বাস করত না। জেনো ও এপিকিউরাস সত্তার প্রশ্ন এড়িয়ে চলতেন। আর পাইরো অনেকটা তাঁদের মতোই জ্ঞান ও সত্তার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, বাস্তবসত্তা বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু একে জানা যায় না, জানার কোনো উপায় নেই। কি ইন্দ্রিয়, কি বুদ্ধি এদের কোনোটিই সত্যের জ্ঞান দিতে পারে না। কোনো একটি ব্যপারে আমরা যে সিদ্ধান্তেই উপনীত হই না কেন, এর বিপরীত সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া সম্ভব। অতএব এসব অনিশ্চিত ব্যাপারে কোনো দৃঢ়মত পোষণ না করাই বাঞ্ছনীয়।
সংশয়বাদ অনুসারে সুখই জীবনের লক্ষ্য বা কাম্য। দর্শনচর্চার মাধ্যমে সুনিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় না। ফলে দর্শন মানুষকে সুখশান্তি না দিয়ে, দিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ। সুতরাং দর্শনচর্চা বা তত্ত্বানুসন্ধান শুধু অনাবশ্যকই নয়, অবাঞ্ছিতও বটে। প্রকৃতপক্ষে বস্তুতত্ত্ব বা অধ্যাত্মশাস্ত্র অনধিগম্য। বস্তুর প্রকৃত সত্তা বা স্বকীয় রূপ আমরা জানতে পারি না। আমরা যা জানি তা বস্তুর আসল রূপ নয়, প্রতিভাসমাত্র।
নৈতিকতার প্রশ্নেও পাইরো সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, একটি বিশেষ নৈতিক আচরণকে অন্য একটি আচরণের চেয়ে ভালো বলার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু তাই বলে আবার আমরা নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতায়ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। কোন্ আচরণ ভালো আর কোন্ আচরণ মন্দ, তা যখন সুনিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই, তখন সমাজের প্রচলিত প্রথা বা ধর্ম সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানকে মন্দ বলেও প্রমাণ করা চলে না। এমতাবস্থায় প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে মেনে চলাই উচিত।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, সংশয়বাদী মনোভাবের মূল ভিত্তি কী? পাইরো প্রথমেই সংশয়ের উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, জোর দিয়ে কোনোকিছু বলার চেয়ে অস্বীকার করা অনেক ভালো। যেকোনো জটিল দার্শনিক সমস্যার ব্যাপারে চট করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে বিষয়টির বিভিন্ন দিক ভালোভাবে তলিয়ে দেখা আবশ্যক। কোনো বিষয়ে নিশ্চিত মত প্রকাশ না করার ফলে মানুষের পক্ষে অবিচলিত থাকা ও সুখলাভ করা সম্ভব। সুতরাং কোনো নিঃশর্ত উক্তি না করে আমাদের উচিত সবসময় মনকে খোলা ও মুক্ত রাখা।
টাইমন (৩২০ – ২৩৫ খ্রি.পূ.) ও আর্কেসিলস
টাইমন (Timon of Phlius) ছিলেন পাইরোর ভক্ত, বন্ধু ও শিষ্য। রঙ্গালয়ের একজন নর্তক হিসেবে তাঁর জীবনের শুরু। কিন্তু এ কাজ ভালো না লাগায় পরে তিনি দর্শনচর্চায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমে তিনি মেগারিক দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু পরে যখন তাঁর এ ধারণা হয় যে, এ দর্শন নিতান্তই অপূর্ণ, তখন তিনি পাইরোর ভক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি দেশ পর্যটন করতে খুব আগ্রহী ছিলেন এবং মেসিডোনিয়া এথেন্স প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন। তিনি ভোগ-সুখের সমর্থক ছিলেন, এবং তাঁর চরিত্রে এপিকিউরীয় প্রভাব বর্তমান ছিল।
টাইমনের মতে, অনপেক্ষ সত্য বলে কিছু নেই। ‘সিলি’ (Silli) নামক এক গ্রন্থে তিনি গতানুগতিক দার্শনিক মতাবলির সমালোচনা করেন। শুধু পাইরো ও জেনোফ্যানিস ছাড়া অন্য সব দার্শনিকের তিনি সমালোচনা করেন। সংশয় পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা কী করে বিভিন্ন দার্শনিক বিতর্কের মীমাংসা করা যেতে পারে, আলোচ্য গ্রন্থে টাইমন তা দেখাবার চেষ্টা করেন।
আর্কেসিলস খ্রিস্টপূর্ব ৩১৫ অব্দে এওলিয়ার অন্তর্গত পিটেনিতে জন্মগ্রহণ করেন। বয়সে তিনি জেনো ও এপিকিউরাসের চেয়ে আনুমানিক বিশ বছরের ছোট ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। গণিত, সাহিত্য ও দর্শনে তিনি উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণ করেন। বিশেষ করে যুক্তিবিদ্যায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। ক্রেটিসের মৃত্যুর পর তিনি একাডেমির প্রধান নিযুক্ত হন। সৎ, নম্র ও ভদ্রস্বভাবের অধিকারী বলে সারা এথেন্সে তিনি ছিলেন একজন শ্রদ্ধার পাত্র। বিরুদ্ধ মতের যেসব দার্শনিককে তিনি কঠোর সমালোচনা করতেন তাঁর মধুর চারিত্রিক গুণাবলির জন্য তাঁরাও তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারতেন না।
আর্কেসিলস স্টোয়িক মতের সমালোচনা করেন। স্টোয়িকদের মতে, অনিবার্য সংবেদনের ভিত্তিতে সার্বিক জ্ঞানলাভ সম্ভব। স্টোয়িক দার্শনিক জেনোর মতে, ধারণার স্পষ্টতাই সত্যতার মাপকাঠি। স্টোয়িকরা আবার বিজ্ঞজন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন। তাঁদের মতে, বিজ্ঞজন সার্থক জ্ঞানের আর সাধারণ মানুষ শুধু লৌকিক বিশ্বাসের অধিকারী। আর্কেসিলস স্টোয়িকদের এসব মতের বিরোধিতা করেন। জ্ঞানের কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে কি? আর্কেসিলস বলেন : ‘না’। জ্ঞানমাত্রই অভিমত (opinion)-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। সত্যমিথ্যার কোনো সঠিক বা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নেই। যেমন : ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ নির্ভরযোগ্য নয়, কেননা ইন্দ্রিয় প্রায়শই আমাদের প্রতারণা করে। ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণও সময় সময় মনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে, প্রত্যক্ষকারীর মনে ভ্রম ও অলীক ধারণার সৃষ্টি করে। মিথ্যাকেও অনেক সময় সত্যের মতোই অকাট্য বলে মনে হয়, লৌকিক মত জ্ঞানের মতোই অনিবার্য বলে প্রতীয়মান হয়। এ জন্যই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণকে (তা যতই অনিবার্য হোক না কেন) সার্থক জ্ঞানের মানদণ্ড বলা চলে না। প্রত্যক্ষ যা দেয়, তা জ্ঞান নয়, অভিমতমাত্র। সুতরাং সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার কোনো মানদণ্ড আমাদের নেই। সত্য থেকে থাকলেও এর সম্পর্কে অসন্দিগ্ধ বা সুনিশ্চিত হবার উপায় নেই। অর্থাৎ সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ অসম্ভব। আসলে আমরা কিছুই জানি না, জানতে পারি না। আর আমরা যে কিছুই জানতে পারি না, তা-ও আমরা জানি না, জানা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্যতাই জীবনপথে চলার একমাত্র পাথেয়।
কার্নিয়াডিস (২১৩-১২৯ খ্রি.পূ.)
আর্কেসিলসের মৃত্যুর প্রায় পঁচাত্তর বছর পর পর্যন্ত একাডেমি থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য দার্শনিকের উদ্ভব হয় নি। এরপর অনেকটা আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হলেন কার্নিয়াডিস (খ্রিস্টপূর্ব ২১৩-১২৯)। সমসাময়িক দার্শনিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিচক্ষণ। তিনি স্টোয়িকদের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা এতই বেশি ছিল যে, তিনি তদানীন্তন আন্দোলনের মধ্যমণি বলে বিভিন্ন মহলের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। বস্তুত, সংশয়বাদী ভাবধারায় তিনি যে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন তার ফলে তাঁকে নব-একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
আর্কেসিলস ও পাইরোর ন্যায় তিনিও বেশিকিছু লিখে যান নি। ক্লিটোম্যাকাস নামক তাঁর এক শিষ্য তাঁর দার্শনিক মতের ওপর প্রায় চারশ’ গ্রন্থ রচনা করে তাঁর নাম স্মরণীয় করে রাখেন। কার্নিয়াডিস তাঁর পূর্বসূরিদের মতের বাইরে কোনো নতুন মত দেন নি। তিনি শুধু তাঁদের পদ্ধতির বিশদ ব্যাখ্যা দেন। আর্কেসিলস স্টোয়িকদের জ্ঞানতত্ত্বের যে সমালোচনা করেছিলেন কার্নিয়াডিস তার সম্প্রসারণ করেন এবং একে স্টোয়িকদের দার্শনিক মতবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। আবার সংশয়বাদীদের সম্ভাবনাবিষয়ক মতের তিনি উল্লেখযোগ্য পরিবর্ধন করেন।
স্টোয়িক জ্ঞানতত্ত্বের বিরোধিতা করে কার্নিয়াডিস বলেন, যতই সুদৃঢ় হোক-না কেন কনভিকশন বা দৃঢ়বিশ্বাসমাত্রই ভ্রমাত্মক। স্বপ্ন অধ্যাস অমূলপ্রত্যক্ষণ (hallucination) প্রভৃতিও অনেকসময় অকাট্য বলে প্রতীয়মান হয়, এবং তখন আমরা একথা ভাবতেও পারি না যে, আসলে এরা ভ্রমাত্মক। স্বপ্নভঙ্গ বা অধ্যাসমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা, এমনকি জাগ্রত জীবনের অভ্যাস আসলে ভ্রান্ত ও অবাস্তব। তথাকথিত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ধারণাবলির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের অনেকগুলোতেই যৌক্তিক হেত্বাভাস থাকে। আবার যৌক্তিক হেত্বাভাসমুক্ত হলেই যে সব ধারণা সঠিক ও বাস্তব হবে, এ কথাও হলফ করে বলা চলে না। যৌক্তিক দিক থেকে সমানভাবে সিদ্ধ দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী হতে পারে; আর তা-ই যদি হয়, তা হলে এ দুটির কোন্টি যে সত্য আর কোন্টি মিথ্যা, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় থাকে না। যেহেতু যুক্তির সাহায্যে পাওয়া নিশ্চয়তা সংবেদন ও অনুভূতিবিষয়ক সিদ্ধান্তের মতোই হেত্বাভাসযুক্ত, সুতরাং একথা বলা যায় যে, সত্যবিষয়ক জ্ঞান বলে কিছু নেই।
স্টোয়িক ধর্মতত্ত্বের অসারতা ও অসংলগ্নতা দেখাবার উদ্দেশ্যে কার্নিয়াডিস কিছু জোরালো যুক্তির অবতারণা করেন। প্রথমেই তিনি স্টোয়িকদের ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক যুক্তি খণ্ডন কনে। স্টোয়িকদের মতে, ঈশ্বরে বিশ্বাস সর্বজনীন। কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। স্টোয়িকদের উদ্দেশ্যবাদী যুক্তির মূল ধারণাকেও তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, জগৎ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের পেছনে এক বুদ্ধিমান সত্তার স্পর্শ আছে এবং মানুষের কল্যাণের জন্যই সেই বুদ্ধিমান সত্তা জগৎ সৃষ্টি করেছেন—এ ধারণা ভ্রান্ত । কারণ মানুষের নানারকম বিপদ ও ধ্বংসের বিভীষিকা থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, জগৎ মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি হয় নি। দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত পৃথিবীতে সৎ ও পুণ্যবানেরা শুধু যে অকারণে লাঞ্ছিত ও বিড়ম্বিত হচ্ছে তা-ই নয়, অন্যায়-অত্যাচার অনুষ্ঠানকারীদের উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতেও দেখা যাচ্ছে। তা হলে বিশ্বের একজন বিধাতা ও নৈতিক প্রভু আছেন বলে মনে করার পেছনে কোনো যুক্তি আছে কী?
তা ছাড়া জগৎকে সবদিক থেকে প্রজ্ঞাসম্মত ও শুভ বলা গেলেও এ কথা বলা চলে না যে, এ সবই একজন বুদ্ধিমান ও বদান্য ঈশ্বরের বহির্প্রকাশ; কারণ জাগতিক বিধি ও নিয়মানুবর্তিতা প্রাকৃতিক কারণ থেকেও সৃষ্ট হতে পারে। প্রাকৃতিক সত্তা ও ঘটনাবলিকেও আমরা উচ্চতর ও নিম্নতন বলে শ্রেণীবিভক্ত করতে পারি না। আবার এ ও বলতে পারি না যে, প্রজ্ঞাসম্মত সবকিছুই প্রজ্ঞাপরিপন্থী সবকিছুর চেয়ে উত্তম। প্রকৃতির মধ্যে হয়তো বা উচ্চতর বা নিম্নতন বলে দু’রকম আলাদা জিনিস থাকতে পারে; কিন্তু তবু কোন্টি যে উচ্চতর এবং কোন্টি যে নিম্নতন, তা জানার কোনো উপায় নেই; কারণ প্রকৃতির মানদণ্ড মানবিক মানদণ্ডের চেয়ে স্বতন্ত্র হতে পারে।
কার্নিয়াডিস আরও বলেন, স্টোয়িকদের ঈশ্বরবিষয়ক ধারণা ছিল স্ববিরোধী। একদিকে তাঁরা ঈশ্বরকে অনন্ত বলে ঘোষণা করেছেন, অন্যদিকে আবার ঈশ্বরের ওপর প্রাণ, চেতনা ও নৈতিক গুণাবলিসহ এমনসব বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন যেগুলোকে একমাত্র সসীম জীবেই আরোপ করা চলে। ঈশ্বর যদি সসীম হন, তা হলে তিনি জগতের অংশমাত্র, অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ বা পূর্ণব্রহ্ম নন। আর ঈশ্বর যদি অসীম হয়ে থাকেন, তা হলে তিনি অবশ্যই স্থান, কাল ও পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে থাকবেন। তখন প্রেম প্রীতি দয়া মায়া ইত্যাদি সসীম গুণ ঈশ্বরে আরোপ করা চলবে না। এ থেকে বোঝা যায় ঈশ্বর সসীম নন, অসীমও নন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই।
আবার ঈশ্বর যদি থাকেন, তা হলে হয় তিনি দেহধারী হবেন অথবা হবেন অশরীরী। দেহধারী হলে তিনি অবশ্যই পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল হবেন। তিনি যদি অশরীরী হন, তা হলে সংবেদন ও অনুভূতি বলে তার কিছু থাকতে পারে না। তিনি যদি শুভ হন, তা হলে বোঝা যাবে যে, তিনি নৈতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং তিনি সর্বময় কর্তা নন। তিনি যদি অশুভ হন, তা হলে তিনি মানুষের চেয়েও অধম। এ থেকে বোঝা যায় যে, কার্নিয়াডিসের মতে ঈশ্বর সসীমও নন, অশুভও নন। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, ঈশ্বরের ধারণা বিরোধপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য।
কার্নিয়াডিস স্টোয়িক ধর্মতত্ত্বের ন্যায় তাদের নৈতিক মতেরও বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, পূর্ণ ও চূড়ান্ত শুভ নৈতিক আচরণের অনপেক্ষ লক্ষ্য এবং শুভ মানেই প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলার উপায়—একই সঙ্গে এ দুটি উক্তি করে (অর্থাৎ পুণ্যকে লক্ষ্য ও উপায় হিসেবে বর্ণনা করে) স্টোয়িকরা স্ববিরোধিতার পরিচয় দিয়েছেন। কার্নিয়াডিসের মতে, নৈতিকতা জিনিসটাই কৃত্রিম প্রাকৃতিক নয়। আত্মস্বার্থের সিদ্ধি ও সংরক্ষণই মানুষের আচরণের মূল উদ্দেশ্য। ব্যক্তি যেন তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পেতে পারে, সে জন্যই আবিষ্কার করা হয়েছে আইন বা বিধি। সুতরাং কি ন্যায়পরতা, কি সাধুতা, তাদের কোনোটিরই স্বতঃমূল্য নেই। বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই তাদের প্রয়োগ ও অনুশীলন।
রাষ্ট্রের আইন ও নৈতিক মানদণ্ড স্থান ও কালভেদে বদলায়; আর পৃথিবীর বহু জাতি তথাকথিত অধিকারের চেয়ে শক্তির ওপর জোর দিয়েই বড় হয়েছে। সুতরাং একথা বলা যায় যে, নৈতিক বিধিনিয়মকে আত্মস্বার্থের প্রতিবন্ধক হতে দেয়া উচিত নয়, বিশেষ করে এ জন্য যে একটি নৈতিক উপদেশ বা বিধি ন্যায় ও শুভ কি-না, তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। এ থেকে কার্নিয়াডিস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে অকাট্য ও অনিবার্য সংবেদনলাভ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি স্পষ্ট ও অনিবার্য নৈতিক মানদণ্ড আবিষ্কারও অসম্ভব। এক কথায়, নিত্য ও নির্বিকার সত্যের সন্ধান যেমন অসম্ভব, তেমনি অনপেক্ষ পরমশুভ লাভও অসম্ভব ।
এতক্ষণ আমরা শুধু কার্নিয়াডিসের চিন্তার বিচারমূলক দিকটি নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন তার সম্ভাব্যতা বিষয়ক মতবাদের গঠনমূলক দিক নিয়ে আলোচনা করব। পাইরো ও আর্কেসিলসের ন্যায় তিনি বললেন যে, প্রকৃতপক্ষে সত্য কী বা শুভ কী, তা নিশ্চিতভাবে জানতে না পারার অর্থ এই নয় যে, আমরা কোনো কাজই করতে পারব না। সত্য ও মিথ্যা ধারণার পার্থক্য নির্দেশের কোনো নির্ভরযোগ্য বৌদ্ধিক মানদণ্ড না থাকলেও একথা ঠিক যে, কোনো কোনো ধারণা অন্যান্য ধারণার চেয়ে অধিকতর সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রতীতি বা বিশ্বাসের ওপর ভর করেই আমরা সাধারণত কাজ করে থাকি। এ থেকে কার্নিয়াডিস এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রতীয়মান সত্যতার মাত্রা পরিমাপের বা সম্ভাব্যতা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি আবিষ্কার সম্ভব।
কার্নিয়াডিস সম্ভাব্যতার নিম্নলিখিত তিনটি মাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন :
- প্রথমটিকে বলা চলে নিছক সম্ভাব্যতা। এখানে আমরা সদৃশ অবস্থাবলির তেমন কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ইন্দ্রিয় প্রতীতিকে তৎক্ষণাৎ সত্য বলে গ্রহণ করি। যেমন, দেখামাত্র যা বিড়াল বলে প্রতীয়মান হয়, সেটিকে আমরা বিড়াল বলেই মনে করি। এ জন্যই এখানে আমাদের ধারণাবলির সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ; কিন্তু তবু আমরা এ ধরনের ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করি এ জন্য যে, এগুলো সত্য হলে আমরা উপকৃত হব।
- দ্বিতীয় সম্ভাব্যতার নাম তর্কাতীত সম্ভাব্যতা। এখানে প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণের সাহায্যে আমরা জানি যে, অন্যান্য মানুষ বারবার এসব ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করে লাভবান হয়েছে; সুতরাং এদের গ্রহণ করলে আমাদেরও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এখানে আমরা সম্ভাব্য সত্যতার আপাতমূল্য এবং সংবেদনের নির্ভরযোগ্যতার সাথে সম্পর্কিত সব সংবেদন ও ধারণার সমর্থন পেয়ে থাকি।
- তৃতীয় প্রকারের সম্ভাব্যতাকে বলা হয় প্রতিপাদিত সম্ভাব্যতা। এখানে আমরা একটি ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করি এ জন্য নয় যে, এর সত্যতার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ, কিংবা উক্ত ধারণা তার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য ধারণা দ্বারা সমর্থিত, বরং এ জন্য যে, ধারণাটিকে আমরা পুরোপুরিভাবে অনুসন্ধান করে দেখেছি এবং এর সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও খুঁজে পেয়েছি। কার্নিয়াডিস বলেন : তাহলে দেখা যায় আমাদের কর্মের ভিত্তি ত্রিবিধ, যথা সম্ভাব্য, তর্কাতীত এবং প্রতিপাদিত।
মানব জীবনকে কার্নিয়াডিস তুলনা করেছেন খেলার সাথে। এখানে আমরা সম্ভাবনার ভিত্তিতে কাজ করে থাকি। যেখানে সাফল্য ও উন্নতির সম্ভাবনা বেশি, সেখানেই আমরা ঝুঁকি নিয়ে থাকি বেশি। তবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি এমন উচ্চ মাত্রার সম্ভাবনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত যেখানে ব্যর্থতার সম্ভাবনা খুবই কম।
কার্নিয়াডিস তাঁর সম্ভাব্যতাবিষয়ক মতবাদকে নৈতিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে প্রয়োগ করেছেন। তাঁর মতে জ্ঞানবিদ্যা ও অধিবিদ্যার ন্যায় নীতিশাস্ত্র কিংবা ধর্মতত্ত্বেও সুনিশ্চিত সত্য বলে কিছু নেই। সুতরাং সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য প্রভৃতির ব্যাপারে সম্ভাবনার ওপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়। মোটকথা, নিশ্চয়তা নয়, সর্বোচ্চ সম্ভাবনাই আমাদের কর্ম ও আচরণের ভিত্তি ও লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কার্নিয়াডিসের পর তাঁর শিষ্য ক্লিটোম্যাকাস এবং এরপর ল্যারিসার ফিলো একাডেমির প্রধান নিযুক্ত হন। ফিলোর সভাপতি থাকাকালীন তাঁর এক ছাত্র এন্টিওকাস কার্নিয়াডিসের সম্ভাবনাবিষয়ক মতবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। এর ফলে একাডেমিতে দুটি বিরোধী দলের সৃষ্টি হয়। কার্নিয়াডিসের মতের বিরুদ্ধে এন্টিওকাসের আপত্তির সারমর্ম ছিল এই : একদিকে সত্য ও মিথ্যা সংবেদনের কথা বলে, আবার অন্যদিকে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যনির্দেশের কোনো মানদণ্ড নেই বলে কার্নিয়াডিস স্ববিরোধিতার পরিচয় দিয়েছেন। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্দেশের মানদণ্ড যদি না-ই থাকে, তাহলে তিনি কী করে কম সম্ভাবনা থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সম্ভাবনাকে পৃথক করবেন? অনপেক্ষ সত্যকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার না করলে তিনি কী করে অধিকতর সত্যকে অপেক্ষাকৃত কম সত্য থেকে আলাদা করবেন? আবার, শুভ সম্পর্কে কোনো পূর্বধারণা ব্যতীত তিনি কেমন করে বুঝবেন যে, একটি বিশেষ কর্মপন্থা অন্য একটি কর্মপন্থা থেকে অধিকতর কাম্য বা শুভ?
এই আপত্তির মোকাবেলা করতে গিয়ে ফিলো স্বীকার করেন যে, অনপেক্ষ সত্য বলে এক পরমসত্য রয়েছে। তবে এই সত্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। ফিলোর এই মতের প্রত্যুত্তরে এন্টিওকাস বলেন, সত্যকে যদি আমরা জানতে না-ই পারি, তা হলে আমরা কীভাবে জানব যে, সত্য আছে? কীভাবেই বা বুঝব যে, সত্য অজ্ঞেয়? এই দার্শনিক বিতর্ক ও বাকবিতণ্ডার ফলে একাডেমীর শেষ দিনগুলোতে বেশ বিক্ততার সৃষ্টি হয় এবং ফিলোর মৃত্যুতে একাডেমির অবসান ঘটে। সংশয়বাদের মশাল তখন সমুদ্রপথে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যায়।
এনিসিডেমাস (খ্রি.পূ. প্রথম শতক)
মহাবীর আলেকজান্ডার কর্তৃক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দে স্থাপিত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরী তাঁর সেনাপতি টলেমীর (৩২৩-১৮১) উত্তরপুরুষদের শাসনকালে বিশ্বের একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও জ্ঞানবিজ্ঞানবিষয়ক নগরীতে পরিণত হয়। এখানেই দ্বিতীয় টলেমী (খ্রিস্টপূর্ব ২৮৫-২৪৭) সাত লক্ষ গ্রন্থের একটি লাইব্রেরিসহ এক বিরাট যাদুঘর স্থাপন করেন। টলেমীদ্বয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় আলেকজান্দ্রিয়া দ্রুত একটি দার্শনিক কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এনিসিডেমাসের সময় থেকে তা সংশয়বাদের কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
এনিসিডেমাসের (Aenesidemus) জীবন সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যায় না। এ নিয়ে ভাষ্যকারদের মধ্যে প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। সম্ভবত তিনি খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের প্রথম ভাগে অথবা পূর্ববর্তী শতকের শেষার্ধে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি ক্রিটের অন্তর্গত নোসাস নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরে আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বসবাস ও দর্শন চর্চা করেন। তিনি পাইরোবাদের ওপর আটটি গ্রন্থ রচনা করেন। যেসব কারণে পাইরো নিত্য ও অকাট্য সত্যকে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বলে প্রচার করেছিলেন এনিসিডেমাসের গ্রন্থে সেগুলোর বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাঁর দার্শনিক মতবাদে সংশয়বাদের যে রূপ পরিস্ফুট, এর সাথে অনেক আধুনিক ভাষ্যকার হিউম ও কান্টের মতের মিল খুঁজে পেয়েছেন।
এনিসিডেমাস সংবেদন ও লৌকিক মতের কিছু স্ববিরোধী বৈশিষ্ট্যের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, একই বস্তু বিভিন্ন ব্যক্তিতে, একই ব্যক্তি বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয়ে, এমনকি একই ইন্দ্রিয় বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তা ছাড়া, নৈতিক মানদণ্ড ও ধর্মীয় বিশ্বাস বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হয়ে থাকে। আবার দার্শনিক মতাবলি বিভিন্ন মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় যে, সচরাচর আমরা যেসব তত্ত্ব ও মতের সম্মুখীন হয়ে থাকি সেগুলো যথার্থ সত্তা নয়, অবভাসমাত্র; সত্য নয়, লৌকিক ধারণা বা অভিমতমাত্র।
ব্যক্তিমানুষের সংবেদন ও ধারণার বেলায়ই যে শুধু এসব বিরোধ লক্ষণীয় তা নয়, সম্প্রত্যয় বা সাধারণ ধারণাবলিও প্রায়শই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ সাধারণ ধারণাবলির প্রামাণ্যকে ভুল প্রতিপন্ন করে থাকে। এসব ব্যাপারের কোনো সন্তোষজনক সমাধান নেই; আর তা নেই বলেই তাদের কোনো যথার্থ মানদণ্ড আবিষ্কার করা যায় না। এ থেকে শুধু এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায় যে, আসলে সত্য বলে কিছু নেই ।
কার্যকারণ নিয়ম বিশ্লেষণ দ্বারাও এনিসিডেমাস তাঁর সংশয়বাদী সিদ্ধান্তের যথার্থতা ব্যাখ্যা করেন। তিনি কারণ অনুসন্ধানের দুটি বিকল্প উপায়ের কথা বলেন : কার্যকারণ নিয়ম বলতে কখনো কখনো আমরা বুঝি যে, একটি ঘটনা অন্য একটি ঘটনা দ্বারা সংঘটিত হয়, আবার কখনো কখনো আমরা এ-ও বুঝি যে, অভিজ্ঞতার জগতের ঘটনাবলি এমন এক অতীন্দ্রিয় প্রাজ্ঞিক সত্তার বহির্প্রকাশ, যার সাহায্যে বস্তু ও ঘটনাবলিকে ব্যাখ্যা করা যায়। এনিসিডেমাসের মতে, বস্তু ও ঘটনা ব্যাখ্যার এ দুই পদ্ধতির কোনোটিই ঠিক নয়। প্রথম পদ্ধতিটি অচল এজন্য যে, কার্যকারণ কথাটি খুবই দুর্বোধ্য ও দুরধিগম্য। একটি বস্তু বা ঘটনা কী করে অন্য একটি বস্তু বা ঘটনা সৃষ্টি করে, তা আমরা কখনো প্রত্যক্ষ করতে পারি না। কার্য ও কারণের যোগসূত্র অদৃশ্য; সুতরাং এ ধরনের কোনো সূত্র আদৌ আছে কি-না, তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। এনিসিডেমাসের এ মত আধুনিককালের হিউমের মতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিটির ব্যবহার হয়ে থাকে বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যায়। এ পদ্ধতিও হেত্বাভাসযুক্ত। অভিজ্ঞতার ঘটনাবলির মধ্যে যেমন কোনো আবশ্যিক কার্যকারণ সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি তাদের পরিচালনার জন্য কোনো অদৃশ্য অতীন্দ্রিয় সত্তা আছে, একথাও বলা যায় না । আর অভিজ্ঞতার জগতের পেছনে বা বাইরে এ ধরনের কোনো অতীন্দ্ৰিয় সত্তা থেকে থাকলেও স্ববিরোধী অভিজ্ঞতা সে সত্তার সন্ধান দিতে পারে না। এ যুক্তিতেই এনিসিডেমাস বলেন, দৃশ্যমান জগতে অদৃশ্য সত্তা বা বস্তুর কোনো ইঙ্গিত নেই। তবু যারা অদৃশ্য অতীন্দ্রিয় সত্তায় বিশ্বাস করেন, তারা আসলে প্রতীয়মান অধ্যাসকেই বাস্তবসত্তা বলে মনে করে থাকেন।
এনিসিডেমাসের নৈতিক মতবাদেও এই একই সংশয়বাদী মনোভাব বিদ্যমান স্টোয়িক মতের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, সুখ আনন্দ প্রজ্ঞা এদের কোনোটিই শুভ নয়। অনপেক্ষ পরমসত্য বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি অনপেক্ষ পরমশুভ বলেও কিছু নেই। সংশয়বাদী হয়েও এনিসিডেমাস একটি আধিবিদ্যক মত হাজির করেছিলেন। তিনি বায়ুকে জগতের আদি উপাদান বলে স্বীকার করেন। বিরুদ্ধভাবাপন্ন পদার্থের পৃথকীকরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে বায়ু থেকেই জগতের উৎপত্তি। প্রজ্ঞার স্বভাব সর্বজনীন; আর এ জন্যই প্রজ্ঞাবিশিষ্ট সব মানুষ সত্যের এক অভিন্ন মানদণ্ডের অধিকারী।
এসব খণ্ড বিবরণ থেকে এনিসিডেমাসের সামগ্রিক মতের গভীরতা বোঝা যায় না। তাঁর দার্শনিক মত সম্পর্কে নানারকম ভাষ্য পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, প্রথমে তিনি হিরাক্লিটাসপন্থী ছিলেন এবং পরে সংশয়বাদ গ্রহণ করেন। অন্য ভাষ্যকারদের মতে, তিনি তাঁর আধিবিদ্যক মতে হিরাক্লিটাসের মতের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, পরবর্তীকালে তা-ই তাঁর নিজস্ব মত বলে গৃহীত হয়। আবার কারো কারো মতে, তিনি পরবর্তীকালে তাঁর সংশয়বাদী মত পরিহার করেছিলেন।
এগ্রিপা (খ্রিস্টীয় ১ম শতক)
এনিসিডেমাসের মৃত্যুর পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে সংশয়বাদী চিন্তাধারা যে কোন্ খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল, এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ঐ সময় সংশয়বাদের যথেষ্ট বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটেছিল। আমাদের এই অনুমানের পেছনে যুক্তি এই যে, আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দে যে ব্যাপক নবজাগরণ দেখা যায়, তার জন্য নিশ্চয়ই দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। অবশ্য এ সবই অনুমানের ব্যাপার। তবে একমাত্র ছাড়া সে সময়ের অন্য কোনো বিশিষ্ট দার্শনিকের খবর জানা যায় না।
এগ্রিপার (Agrippa) মৌলিক দার্শনিক মত সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তবে তাঁর এবং তাঁর সমর্থকদের ওপর যেসব মত আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যদিয়ে প্রাচীন সংশয়বাদের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ মতে, চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা এক দ্বিকল্প সহানুমানের (dilemma) সম্মুখীন হয়ে থাকি। আমাদের হয় এই সংশয়বাদী সিদ্ধান্ত স্বীকার করতে হয় যে, অনপেক্ষ সত্য বলে কিছু নেই, আর থাকলেও একে আবিষ্কার করা যায় না; অথবা আমরা এ-ও মনে করতে পারি যে, সত্য আবিষ্কারে আমাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া উচিত। প্রথম সিদ্ধান্তটি যদি স্বীকার করা হয় (অর্থাৎ আমরা যদি মনে করি যে সত্য বলে কিছু নেই, আর থাকলেও একে জানা যায় না), তা হলে সত্যবিষয়ক আমাদের সব সিদ্ধান্তই স্থগিত রাখা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। আবার পরবর্তী কর্মপন্থাটি অবলম্বন করলেও (অর্থাৎ আমরা যদি মনে করি যে, সত্যের সন্ধান চালিয়ে যাওয়া উচিত) সিদ্ধান্ত স্থগিত না রেখে উপায় নেই।
বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমত, কার্যকারণ অনুক্রমের কোনো আদিকারণ আবিষ্কার এবং অভিজ্ঞতার জগৎব্যাখ্যার উপযোগী কোনো ব্যাখ্যানীতির সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। কারণ, যার নিজেকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, এমন কোনো সামগ্রিক ধারণায় পৌছানো অসম্ভব। অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রেই আমরা একটি অনবস্থা দোষে (infinite regress) জড়িয়ে পড়ি। আবার স্বতঃপ্রমাণ বা স্বয়ংসিদ্ধ সত্য বলতেও যে আসলে কিছু নেই, তা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার নানাবিধ প্রতারণা এবং দার্শনিকদের মতবিরোধ থেকেই সুস্পষ্ট। তা হলে পূর্ববর্তী দার্শনিকদের সুরে সুর মিলিয়ে আমাদেরও বলতে হয় যে, সত্য আবিষ্কার শুধু অসম্ভব নয়, বিভিন্ন নৈয়ায়িক অসুবিধার ফলে সত্যানুসন্ধান শুরুতেই নিরর্থক প্রমাণিত হয়ে যায়। যা জানা অসম্ভব বলে আমরা আগে থেকেই জানি, তাকে জানবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সময় অপচয় ও মানসিক শান্তি বিনষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। সুতরাং অহেতুক প্রশ্নের অবতারণা না করে, যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সংশয়বাদের বৈজ্ঞানিক দিকটি মেনোডোটাস (৭০-১৫০ খ্রিস্টাব্দ)-এর রচনায় বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। তিনি স্টোয়িকদের তীব্র সমালোচনা করেন। একাডেমীর সংশয়বাদ, বিশেষত এর সম্ভাব্যতা মতবাদের বিরুদ্ধেও তাঁর আপত্তি ছিল। তাঁর মতে, কোনো ধারণার পক্ষে অন্য কোনো ধারণার চেয়ে বেশি সম্ভবপর হওয়া অসম্ভব।
সেক্সটাস এম্পিরিকাস (খ্রিস্টীয় ২য় শতক)
সেক্সটাস ছিলেন প্রাচীন সংশয়বাদের সর্বশেষ দার্শনিক। তাঁর জীবন সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। তিনি ছিলেন জাতিতে গ্রিক। ২০০ ও ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সম্ভবত আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাস ও দর্শনচর্চা করতেন। তাঁর তিনটি গ্রন্থ আজও সংরক্ষিত আছে। এগুলোর একটি সংশয়বাদী সংক্রান্ত এবং অপরটি যথাক্রমে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ। এসব গ্রন্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। তবে সেক্সটাসের পূর্বসূরিদের প্রচারিত সংশয়বাদী যুক্তিতর্কের বাইরে কোনো অভিনব মত এসব গ্রন্থে নেই।
সেক্সটাস এনিসিডেমাসের মতের ওপর বেশ কিছুটা উন্নতিসাধন করেন। এনিসিডেমাসের মতে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে বহির্জগতের অস্তিত্ব অনুমান করা যায় না। এ মতের পরিবর্ধন করে সেক্সটাস বলেন, বিশেষ বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণ থেকে অভিজ্ঞতার জগতের সার্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুমানের প্রচেষ্টাও একইভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ, স্থান কালসহ গোটা জগৎটাকে তন্ন তন্ন করে না দেখে আমরা কী করে জানবো এর কোন্ বিশেষ বৈশিষ্ট্য সার্বিক? সুতরাং তথাকথিত সার্বিক রূপ, নিয়ম ইত্যাদি সবই তাদের স্থান-কাল এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতাসাপেক্ষ। এনিসিডেমাসের মতবাদ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সেক্সটাস আরো বলেন, শুধু কার্যকারণের ধারণাটিই যে দুর্বোধ্য তা-ই নয়, পদার্থ দেশ-কাল প্রভৃতির ধারণার অবস্থাও একই। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসবই হাড়ে হাড়ে স্ববিরোধী। এমনকি গণিতশাস্ত্র ও স্ববিরোধমুক্ত নয় ।
লজিক, পদার্থবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে যদি স্ববিরোধিতা থেকে থাকে, তা হলে নীতিবিদ্যা সম্পর্কে কী বলা যায়? শুভ কী, তা আবিষ্কার করা এবং শুভের সংজ্ঞা নির্দেশ করাই নীতিশবিদ্যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এখানেও বিভ্রান্তির শেষ নেই। শুভ সম্পর্কে নীতিবিদদের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মত এবং মানবজাতির নীতিবিষয়ক বিভিন্ন বিরুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান থেকে এটুকুই বোঝা যায় যে, আসলে সব মানুষের জন্য সমান কোনো একক প্রাকৃতিক শুভ বলে কিছু নেই। আবার কোনোকিছুকে পাওয়ার ইচ্ছা ও অনুশীলন থেকেই শুরু হয় অশান্তি ও অমঙ্গল। সেক্সটাস তাই অনুশীলন ও ইচ্ছাকে অশুভ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, এ সবের সাথে অসন্তোষ, হতাশা ও ভীতি জড়িত ইচ্ছার কোনো পরিতৃপ্তি নেই; বরং তা অনেক সময় আমাদের অবাঞ্ছিত পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। পুণ্যের পরিণতিও অশান্তি। প্রলোভন ও সংগ্রামই পুণ্যের ভিত্তি।
মোটকথা, নৈতিক জীবনে আমরা এই কূটাভাস (paradox)-এর সম্মুখীন যে, শুভ একইসঙ্গে অশুভও বটে। এ থেকে বোঝা যায় যে, আসলে শুভ বলে কিছু নেই। শুভ আবিষ্কার এবং মানুষকে শুভলাভের উপায় শিক্ষার যে প্রচেষ্টা নীতিবিদ্যায় করা হয়ে থাকে, তা একটি ছল ছাড়া আর কিছুই না। জ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় নীতিবিদ্যার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখাই সুস্থ মনোভাবের পরিচায়ক। তবে অন্যান্য সংশয়বাদীদের ন্যায় সেক্সটাসও বলেন যে, সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা মানে এই নয় যে, তাতে কাজকর্ম বন্ধ করে রাখা হবে। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রায়োগিক নিয়মাবলির ন্যায় জীবনের প্রায়োগিক নিয়মাবলিও বিশেষ বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এসব নিয়মের সমবায়েই গঠিত সহজবুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানের ইমারত।
প্রকৃতি আমাদের এক বিশেষ ধরনের জীবনের ইংগিত দেয়। পথনির্দেশক হিসেবে প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়, প্রবৃত্তি বিচারবুদ্ধি প্রদান করেছে। এ সবের সার্থক প্রয়োগই বিজ্ঞানের লক্ষণ। যে সামাজিক ব্যবস্থা ও পরিবেশে আমাদের জন্ম তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা বাঞ্ছনীয়। এসব ব্যাপারে অতিবর্তী বা আধিবিদ্যক বলে কিছু নেই। এদের সবই অভিজ্ঞতার তথ্যমাত্র। কোনো ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান ও চূড়ান্ত সত্যলাভ অসম্ভব এবং সর্বপ্রকার নির্বিচার উক্তি হাস্যকর হলেও প্রত্যক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা অনেককিছু শিখতে পারি। সদৃশ বস্তু ও ঘটনা পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা এমনসব সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে পারি যেগুলো যথেষ্ট উপকারী হতে পারে। এ ধরনের সুসংবদ্ধ ও পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষণের ফলেই উদ্ভব হয় শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের। আর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার নীতি অবমাননা না করেও সংশয়বাদী ব্যক্তি এসবের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে পারেন। আসলে চরম প্রশ্নাবলির ব্যাপারে নিশ্চয়তার অভাব এবং সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার প্রয়োনীয়তা কোনোমতেই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও অনুসন্ধিৎসাকে নিষ্ফল প্রতিপন্ন করে না।
চিকিৎসাশাস্ত্রের অনুশীলন সেক্সটাস এম্পিরিকাস ও তাঁর মতাবলম্বীদের এক নতুন সন্ধান দেয়। কারো কারো মতে, তাঁদের চিন্তায়ই বেকন কর্তৃক স্থাপিত ও উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল কর্তৃক সম্প্রসারিত আধুনিক বিজ্ঞানের আরোহ পদ্ধতির প্রথম সূত্রপাত হয়।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সংশয়বাদের ইতিহাসে কোথাও কোথাও দীর্ঘ ফাঁক রয়েছে। এসব ফাঁকে সংশয়বাদের অবস্থা যে ঠিক কেমন ছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তখন দার্শনিক চিন্তা বন্ধ ছিল। এ থেকে শুধু এটুকুই বোঝা যায় যে, সংশয়বাদী আন্দোলন তার অগ্রগতির পথে মাঝে মাঝে স্তিমিত হয়ে গিয়ছিল। সেক্সটাস এমপিরিকাসের সময়েও সংশয়বাদের পাশাপাশি এমন কিছু দার্শনিক ভাবধারা প্রবহমান ছিল যাদের সূত্রপাত হয়েছিল সংশয়বাদেরও বহু আগে। এসব চিন্তাধারা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম অব্দ থেকেই চালু ছিল, এবং সংশয়বাদী পরিবেশেও এরা এমনসব দার্শনিক সমস্যা নিয়ে আলোচনায় রত ছিল, যেগুলোর সমাধান সেক্সটাস ও তাঁর পূর্ববর্তী সংশয়বাদীদের মতে অসম্ভব। এই নবায়িত গঠনমূলক দার্শনিক চিন্তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন প্লেটো ও পিথাগোরীয় দার্শনিকরা, যারা হলেন নব্যপিথাগোরীয়বাদী ও নব্যপ্লেটোবাদীগণ।
তথ্যসূত্র
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদারস, ২০১৪
Leave a Reply