স্টোয়িক দর্শন ও রোমান দর্শন

স্টোয়িক দর্শন

ভূমিকা

এপিকিউরীয় দর্শনের ন্যায় স্টোয়িক দর্শনেও পূর্ববর্তী দর্শনের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। যেমন : হিরাক্লিটাসের মতে পদার্থমাত্রই পরিবর্তনশীল, তবে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া লোগোস বা প্রজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্টোয়িকরা এই লোগোস মতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা দেন এবং একে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার চেষ্টা করেন। হিরাক্লিটাস বিশ্বের মূলসত্তা ও আগুনকে সমানার্থক বলে মনে করতেন। স্টোয়িক চিন্তায় হিরাক্লিটাসের এ মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাঁরাও আগুনকে মৌল দ্রব্য বলে ঘোষণা করেন এবং আগুনের পরিবর্তনই জগতের বৈচিত্র্যের কারণ বলে মনে করেন। দর্শন সম্পর্কে হিরাক্লিটাস অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং অগভীর আদর্শ দ্বারা চালিত জনসাধারণকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। ঠিক একই মনোভাব আদি স্টোয়িকদের মধ্যেও লক্ষণীয়। তাঁরাও চিন্তাশীল ব্যক্তি ও জনগণের মধ্যে পার্থক্য করেন এবং যথার্থ জ্ঞান ও প্রচলিত অভিমতের মধ্যে সমন্বয়সাধন অসম্ভব বলে মনে করেন। স্টোয়িক দর্শনের অগ্রগতি ও বিবর্তনের সাথে সক্রেটিসের দার্শনিক শিক্ষারও মিল দেখা যায়। আত্মসংযম, পুণ্যের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ, অনাড়ম্বর জীবন, ঈশ্বরে বিশ্বাসসহ সক্রেটিস চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য স্টোয়িক দার্শনিকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা ও সমর্থনলাভ করে। তাঁদের দৃষ্টিতে সক্রেটিসের শিক্ষা ছিল এই যে, নৈতিক উৎকর্ষ শুধু একটি কথার কথাই নয়; এর একটি গভীর তাৎপর্য আছে। বাহ্যশক্তি দ্বারা মানুষ কখনও পরাজিত হয় না, হতে পারে না।

স্টোয়িক দর্শনে সক্রেটিসের চেয়েও সিনিকদের প্রভাব ছিল বেশি। সুখবাদের বিরুদ্ধে সিনিকরা ছিলেন রীতিমতো সোচ্চার। তাঁরা পুণ্যের পেশাগত শিক্ষক ছিলেন এবং নৈতিক বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাস করতেন। পরম্পরাগত সামাজিক আদর্শের প্রতি তাঁরা আস্থাশীল ছিলেন না। অবশ্য স্টোয়িক দর্শন সিনিক দর্শনের অন্ধ অনুকরণ—একথা ঠিক নয়। বিজ্ঞানের প্রতি সিনিকদের চেয়ে স্টোয়িকদের আকর্ষণ ছিল বেশি। বিশেষ করে পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরা অধিকতর স্পষ্ট ও গঠনমূলক সামাজিক আদর্শের উন্মেষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক অর্থে স্টোয়িকবাদকে সিনিকবাদের বিশ্বজনীন পরিমার্জিত রূপ বলা চলে।

স্টোয়িকবাদে প্লেটোর প্রভাবও অগ্রাহ্য করা চলে না। প্লেটো নৈতিকতার গুরুত্বের জোর সমর্থন করেন। তিনি পুণ্যকে আপেক্ষিক না ভেবে অনপেক্ষ বলে মনে করতেন। নিছক উপযোগিতার তাগিদে কাজ করাকেও প্লেটো অসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। প্লেটোর এই মতবাদ স্টোয়িকবাদের সমর্থনলাভ করে। তাছাড়া প্লেটোর শুভের ধারণা আর স্টোয়িকদের জাগতিক প্রজ্ঞার আদর্শ, এ দুটির অর্থও একই বলে মনে হয়। এসব সাদৃশ্য সত্ত্বেও প্লেটো ও স্টোয়িকদের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। যেমন : প্লেটোর চিন্তা ছিল দ্বৈতবাদী অথচ স্টোয়িকরা বাস্তবসত্তার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা পুরোপুরি একত্ববাদী।

এরিস্টটলের কাছেও স্টোয়িকরা যথেষ্ট ঋণী ছিলেন। মূলত এরিস্টটলের কাছ থেকেই তাঁরা তাঁদের বিশ্বতত্ত্বের ভিত্তি গ্রহণ করেছিলেন। এরিস্টটলের ন্যায় তারা পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্রস্থল বলে মনে করতেন এবং সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদকে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে ভ্রান্ত এবং ধর্মীয় দিক থেকে অপবিত্র বলে ঘোষণা করেন। এরিস্টটলের ন্যায় তাঁরাও ডেমোক্রিটাসের বিশ্বতাত্ত্বিক মত প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, গুণগত পরিবর্তনকে পরিমাণগত নিয়মে পরিণত করা যায় না। আবার এরিস্টটলের অনুকরণেই তাঁরা দু’রকম গতির কথা বলেন। এদের একটি ঋজুরেখ (rectilinear), যা পৃথিবীর ঘটনাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং অপরটি গোলাকার, যা নভোমণ্ডলের গতির সাথে জড়িত। অবশ্য স্টোয়িকরা এরিস্টটলের কারণচতুষ্টয়ের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। এরিস্টটলের চারটি কারণের স্থলে তাঁরা শুধু একটির কথা বলেন। এরিস্টটলের মতের কোনো কোনো দিককে প্রত্যাখ্যান করলেও স্টোয়িক চিন্তায় এরিস্টটলের বিজ্ঞানের মূলমর্মের প্রতিফলন দেখা যায়। স্টোয়িকরা জগতের যান্ত্রিক ব্যাখ্যার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁরা প্রাকৃতিক ডিজাইন বা পরিকল্পনার ধারণাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। এরিস্টটলের ন্যায় তাঁরাও বিবর্তনের প্রকৃতিবাদী ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবে তাঁরা প্রাণিকুল ও মানুষের স্বাতন্ত্র্যের ওপর জোর দেন এবং মানুষকে নিখিল বিশ্বের প্রভু বলে অভিহিত করেন।

স্টোয়িকরা ছিলেন এপিকিউরীয়দের প্রায় সমসাময়িক। তবে তাঁদের নৈতিক ও দার্শনিক মত ছিল এপিকিউরীয়দের মতের বিপরীত। তাঁদের মতে সুখ নয়, পুণ্য আত্মশৃঙ্খলা ও কর্তব্যপরায়ণতাই হওয়া উচতি মানবজীবনের আদর্শ। বিশ্বজনীন আদর্শের কাছে আত্মস্বার্থের সমর্পণ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রেরই জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। স্টোয়িকবাদের প্রথম পর্বের সূত্রপাত ঘটে জেনোর চিন্তায়। জেনো খ্রিস্টপূর্ব ৩৪২ অব্দে এক ভিনিসীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময় স্টোয়িক দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জন্মভূমি ছিল সাইপ্রাস দ্বীপের অন্তর্গত সিটিয়াম নগরে এবং পেশা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। কথিত আছে যে, বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে এথেন্সে যাওয়ার সময় তাঁর জাহাজ পানিতে ডুবে যায় এবং তাতে তাঁর সব মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনার পর তিনি সংসারের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন এবং দার্শনিক আলোচনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি সিনিক দার্শনিক ক্রেটিস, মেগারিক সম্প্রদায়ের স্টিল্‌পো এবং একাডেমির অধ্যাপক পলেমোর কাছে শিক্ষালাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে এথেন্সে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। কঠোর সংযম ও অনন্যসাধারণ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী জেনো খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২৭০ অব্দে আত্মহত্যা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এথেন্সবাসীরা তাঁর সম্মানে যে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করেন তাতে লেখা ছিল: “তাঁর জীবন ছিল তাঁর উপদেশের অনুরূপ।”

জেনোর মৃত্যুর পর স্টোয়িক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরই ছাত্র ক্লেথিস (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪-২৩২)। এপিকিউরীয়দের ও সংশয়বাদীদের আক্রমণের মোকাবেলা করার মতো গুণাবলি এই নতুন নেতার ছিল না বলে মনে হয়। তারপর আসেন টরপাসের ক্রিসিপাস (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০-২১০)। তিনি যথেষ্ট শ্রম দিয়ে স্টোয়িক দর্শনের প্রচার ও প্রসার করেছিলেন। তিনি প্রায় ৭০০ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে এসব গ্রন্থের একটিও এখন নেই। স্টোয়িকবাদের দ্বিতীয় পর্ব স্থায়ী ছিল প্রায় দুইশ’ বছর (২০০ খ্রিস্টপূর্ব-১ খ্রিঃ)। এ সময়ে স্টোয়িকবাদ রোম ও অন্যান্য দেশে বিস্তারলাভ করে। তখন স্টোয়িকবাদের নেতা ছিলেন সেলেউসিয়ার অধিবাসী ডায়োজিনিস। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫ অব্দে তাঁকে এথেনীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ দূত হিসেবে রোমে পাঠান। রোম এথেন্সের ওপর কিছু জরিমানা আরোপ করেছিল। এই জরিমানা মওকুফ করার আবেদনসহ অপর দুইজনের সঙ্গে ডায়োজিনিসকেও রোমে পাঠানো হয়। তাঁর আবেদন যখন রোমান কর্তৃপক্ষের বিবেচনাধীন, তখন তিনি সেখানে তাঁর দার্শনিক মত প্রচার শুরু করেন। আত্মসংযম মিতাচার প্রভৃতি গুণ চর্চার জন্য তিনি অল্পদিনের মধ্যেই প্রসিদ্ধিলাভ করেন এবং তাঁর বক্তৃতাও রোমে যথেষ্ট আবেদন সৃষ্টি করে।

তবে স্টোয়িকবাদকে স্থায়ীভাবে রোমে নিয়ে যান প্যানায়েটিয়াসপসিডোনিয়াস। প্যানায়েটিয়াস খ্রিস্টাপূর্ব আনুমানিক ১৮৯ অব্দে রোড্স-এর এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এথেন্সে পড়াশোনা কালে তিনি স্টোয়িক দার্শনিক ডায়োজিনিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রোমে গিয়ে তিনি একটি দার্শনিক গোষ্ঠী গঠন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১২৯ অব্দের দিকে তিনি স্টোয়ার প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন এবং এথেন্সে ফিরে গিয়ে জীবনের অবশিষ্ট বিশ বছর সেখানেই অতিবাহিত করেন। গ্রিক দর্শন সম্বন্ধে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল এবং তিনি প্লেটোর ভক্ত ছিলেন।

পসিডোনিয়াস রোড্স-এ খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১৩৫ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্যানায়েটিয়াসের একজন প্রতিভাবান ছাত্র। দীর্ঘদিন দেশভ্রমণের পর তিনি রোড্স- এ বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানেই খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দের দিকে মারা যান। তিনি তাঁর দার্শনিক রচনার মাধ্যমে রোমান স্টোয়িকদের ওপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি। শুধু দর্শন ও ইতিহাসেই নয়, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও তাঁর ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান ছিল। প্যানায়েটিয়াসের ন্যায় তিনিও প্লেটোর দার্শনিক শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

স্টোয়িকবাদের শেষপর্ব স্থায়ী ছিল আনুমানিক ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ পর্বের কেন্দ্র ছিল রোম। সেনেকা, এপিক্‌টেটাসমার্কাস অরেলিয়াস প্রমুখ চিন্তাশীল লেখকগণ স্টোয়িক মতবাদের শেষ পর্বের (রোমীয়) প্রবক্তা ও অনুসারী বলে খ্যাত।

এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, রোমান স্টোয়িকগণ মূলত নৈতিকতার সমস্যার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আদি স্টোয়িকদের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি যে আকর্ষণ লক্ষণীয়, তাদের মধ্যে তেমনটি ছিল না। রোমান দার্শনিকগণ নৈতিক নিয়মাবলিকে সামাজিক অবক্ষয়রোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাঁরা তাঁদের দর্শনকে মনে করতেন বিশ্বজনীন সাম্যের অভিব্যক্তি হিসেবে। তাই তাঁদের চিন্তায় সামাজিক শ্রেণীবিভেদ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। এপিকটেটাসের ন্যায় একজন ক্রীতদাস এবং মার্কাস অরোলিয়াসের ন্যায় একজন সম্রাটকে সমানভাবে দর্শন শিক্ষা দিতে দেখা যায়।

জ্ঞানতত্ত্ব

নৈতিক জ্ঞানের একটি যৌক্তিক ভিত্তি আবিষ্কার ছিল স্টোয়িক দর্শনের মূল লক্ষ্য। এপিকিউরীয়দের ন্যায় তাঁরাও বিশ্বাস করতেন যে শুভ বা কল্যাণের অর্থ উপলব্ধির জন্য সত্যের একটি মানদণ্ড এবং জগৎবিষয়ক একটি সুস্পষ্ট মতবাদ থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ, তাঁদের সত্য ও নীতিবিষয়ক জ্ঞানের জন্য যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার জ্ঞান আবশ্যক। স্টোয়িকরা দর্শনকে যুক্তিবিদ্যা পদার্থবিদ্যা ও নীতিবিদ্যা— এই তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। যুক্তিবিদ্যা বলতে তাঁরা বুঝতেন চিন্তা ও যুক্তিতর্ক বিষয়ক বিজ্ঞানকে। পদার্থবিদ্যা বলতে তাঁরা বুঝতেন ঈশ্বর, আত্মা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞানকে; আর নীতিবিদ্যা বলতে তাঁরা বুঝতেন শুভ জীবনবিষয়ক মতবাদকে। তাঁদের দৃষ্টিতে নীতিবিদ্যা নিছক একটি তাত্ত্বিক অধ্যয়নই নয়; এর একটি কার্যকর ব্যবহারিক দিকও আছে। নীতিশাস্ত্রের আদর্শ নিয়মাবলিকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে দেয়া যায়।

জ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে স্টোয়িকদের মত অভিজ্ঞতাবাদী। তাঁদের মতে, ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষণই জ্ঞানের মূল উৎস। প্লেটোর মতের বিরোধিতা করে তাঁরা বলেন, সহজাত ধারণা বলতে কিছু নেই। জন্মের সময় মন থাকে একটি অলিখিত কাগজের মতো। যাবতীয় জ্ঞান ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত। বাহ্যদ্রব্য মনের ওপর যে সংবেদন সৃষ্টি করে, সেই সংবেদন থেকেই জ্ঞানের সৃষ্টি। মনের ওপর বহির্জগতের প্রভাব একটি জিনিসের ওপর অপর একটি জিনিসের দাগ কাটার মতো। একে সীলমোহরের ছাপের সাথেও তুলনা করা চলে।

ক্রিসিপাসের মতে, সংবেদন মানেই চেতনার পরিবর্তন। সংবেদন থেকেই স্মৃতির উৎপত্তি; আর বিভিন্ন স্মৃতির সমবায়েই গড়ে ওঠে অভিজ্ঞতা। সংবেদন ও প্রতিকৃতি থেকেই উদ্ভব হয় সাধারণ ধারণার। আর সাধারণ ধারণা যখন অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই তাদের বলা হয় সাধারণ সংস্কার। এসব সংস্কার সব মানুষে একই, এবং তাদের কোনোরকম অধ্যাস বা ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে না। বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে সাধারণ সংস্কারের পার্থক্য এখানে যে, বৈজ্ঞানিক ধারণা ঐচ্ছিক চিন্তাভাবনার ফলশ্রুতি, এবং এরা সচেতন ও সংবদ্ধভাবে গঠিত। বিজ্ঞানের সাহায্যে সংস্কারের সত্যতা প্রতিপাদিত হয়। আবার নির্ভুল সংস্কারসৃষ্টির ব্যাপারেও বিজ্ঞান সাহায্য করে। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নির্ভুল; কেননা বিজ্ঞান প্রায়োগিক যুক্তিপ্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

স্টোয়িকদের মতে, মানুষের মন কখনো নিষ্ক্রিয় নয়। মন সবসময়ই গতিশীল ও সক্রিয়, এবং বহির্জগৎ থেকে তা যেসব সংবেদন পেয়ে থাকে, তাদের সমন্বয়বিধানের ক্ষমতা এর রয়েছে। এ ক্ষমতার ফলেই মন অনেকগুলো সদৃশ বিশিষ্ট ধারণা থেকে সাধারণ ধারণা ও সার্বিক অবধারণ গঠন করতে সক্ষম। মনের এই বিশেষ ক্ষমতাই হলো রিজন বা প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার সাহায্যেই বিশ্বব্যবস্থাকে জানা সম্ভব। সব মানুষের মধ্যে যেসব সত্য অভিন্ন, ঈশ্বরের বিশ্বাস ও পুণ্যের বিশ্বজনীনতা তাদের অন্তর্ভুক্ত।

স্টোয়িকদের জ্ঞানতত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে জ্ঞানের চারটি স্তর খুঁজে পাওয়া যায়। এরা হলো প্রতিরূপ সম্মতি ব্যাপ্তিবোধ এবং উপলব্ধি। প্রথমত, কোনো একটি বিষয়ের সংবেদন থেকে যখন স্মৃতির উদ্রেক হয়, তখন আমাদের মনে বিষয়টির একটি মানসিক প্রতিকৃতি বা প্রতিরূপ জন্মে। এরপর প্রতিরূপটি যদি সত্য হয়, তা হলে তা সত্য বলে গৃহীত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এ প্রতিরূপ থেকে যে সংস্কার জন্মে, তাকে সঠিকভাবে বোঝাকে ব্যাপ্তিবোধ বলে। ব্যাপ্তিবোধের পরবর্তী স্তর উপলব্ধি। এখানে বিষয়টিকে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা হয়। যেকোনো জ্ঞান-পরিস্থিতিতে আলোচ্য চারটি মানসিক ক্রিয়া লক্ষণীয়।

স্টোয়িকদের মতে, ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ এবং তাদের সমবায়ে গঠিত সাধারণ সংস্কার ও সম্প্রত্যয় থেকেই জ্ঞানের উৎপত্তি। মন নয়, যে বাহ্য দ্রব্য থেকে বেদন উৎপন্ন, তা-ই জ্ঞানের মূল কারণ। জ্ঞান সত্য হয় তখনই যখন বস্তুর সাথে ধারণার মিল বা সঙ্গতি থাকে। তবে বাহ্যবস্তু থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের সাথে আমাদের কল্পনাপ্রসূত প্রত্যয়ের সংমিশ্রণও সম্ভব। আর এ জন্যই প্রশ্ন ওঠে : কল্পনা থেকে জ্ঞানকে পৃথক করার উপায় কী? যথার্থ জ্ঞান ও মিথ্যাজ্ঞানের মধ্যে প্রভেদ কোথায়? উত্তরে স্টোয়িকগণ বলেন, সত্যজ্ঞানে প্রমাণ তার নিজের মধ্যেই বিদ্যমান। যথার্থ জ্ঞান তার অন্তর্নিহিত সত্যতা দ্বারা মনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, মন আপনা থেকেই তাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। যথার্থ জ্ঞানের সত্যতা সম্বন্ধে বিশ্বাস অনিবার্য। যে জ্ঞান তার যথার্থতা অনিবার্যভাবে মনে মুদ্রিত করে দেয় এবং তা স্বীকার করতে মনকে বাধ্য করে, সে জ্ঞানকে নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যথার্থ জ্ঞানকে জ্ঞান বলে স্বীকার করতেই হয়। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই এ জ্ঞানের যথার্থতা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, যথার্থ জ্ঞান জ্ঞাতার মনে যে কভিশন বা দৃঢ়বিশ্বাস সৃষ্টি করে, তা-ই সেই জ্ঞানের প্রামাণ্য।

সত্যসম্পর্কিত জ্ঞান বিজ্ঞান কিংবা দর্শনের একচেটিয়া সম্পদ নয়। সাধারণ ধারণার সাহায্যে সব মানুষই জ্ঞানলাভে সক্ষম। তবে বিচার-বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত যথার্থ জ্ঞানের সাথে যে দৃঢ়বিশ্বাস জড়িত, নিছক সাধারণ ধারণায় তা নেই। বিজ্ঞান হলো সত্য অবধারণের এক সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা। যৌক্তিক অনিবার্যতার ভিত্তিতে এক বচন থেকে অন্য বচন নিষ্কাশনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে বিজ্ঞান। তার মানে, নির্ভুল অনুমান ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুশীলন সত্য আবিষ্কারের বিশেষ উপায়। স্টোয়িকরা শেষ পর্যন্ত প্রতীকী যুক্তিবিদ্যা এবং বিশেষ করে সহানুমানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাদের মতে সহানুমানই প্রতীকী যুক্তিবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। স্টোয়িকরা এরিস্টটলের সহানুমান বিষয়ক মতবাদের কিছুটা উন্নতিসাধন এবং এরিস্টটলের ক্যাটেগোরিজ-এর তালিকার পরিবর্তন করেছিলেন।

জ্ঞান পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞতার সমর্থন করলেও এবং নিছক চিন্তার মাধ্যমে জ্ঞানলাভ অসম্ভব বললেও স্টোয়িকরা আসলে জ্ঞান প্রক্রিয়ায় চিন্তার ভূমিকা অস্বীকার করেন নি। বরং তাঁরা জোর দিয়ে বলেন যে, অভিজ্ঞতায় চিন্তার প্রয়োগ থেকেই, অর্থাৎ অভিজ্ঞতার দেয়া উপাদানসমূহের সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সম্প্রত্যয় গঠনের ওপরই জ্ঞানের উৎপত্তি ও অগ্রগতি নির্ভরশীল।

অধিবিদ্যা

স্টোয়িকদের অধিবিদ্যক মতবাদকে এরিস্টটলীয় মতের জড়বাদী ভাষ্য বলে বর্ণনা করা চলে। এরিস্টটলের ন্যায় তাঁরাও মনে করতেন যে, অস্তিত্বশীল পদার্থমাত্রই দুটি নীতির ফলশ্রুতি। এদের একটি নীতি হলো এমন যা কাজ করে, চলে এবং গঠন করে, আর অন্যটি এমন যার ওপর কাজ করা হয়, যা চালিত হয় এবং যা গঠিত হয়। এরিস্টটলের ন্যায় স্টোয়িকরা আরো মনে করতেন যে, এ দুটি নীতি স্বতন্ত্র নয়, একই সত্তার দুটি দিক। সুতরাং চিন্তায় পৃথক করা গেলেও বাস্তবে তাদের পৃথক করা যায় না।

অবশ্য সত্তার এ নীতিদ্বয়ের স্বভাব সম্পর্কে এরিস্টটলের সাথে স্টোয়িকদের মতের প্রভেদ আছে। তাঁদের মতে, যা ক্রিয়াশীল নয় কিংবা যার ওপর ক্রিয়া সম্পাদিত হয় না, তা বাস্তবও নয়। যেহেতু শুধুমাত্র পদার্থই সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়, সুতরাং শক্তি ও জড় এ দুটোই শরীরী বা দেহধারী। অবশ্য মাত্রাগতভাবে দুটোর দৈহিকতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। শক্তি মসৃণজাতীয় পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত, অথচ প্রকৃত জড় স্থূল, রূপহীন অনড়। আমরা আগেই বলেছি, দুয়ের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য : শক্তি ছাড়া কোনো জড়বস্তু নেই, আবার জড় ছাড়াও শক্তি থাকতে পারে না। সব অবস্থাতেই জড় শক্তি দ্বারা পরিচালিত। মানবাত্মা ও ঈশ্বরসহ জগতের সব পদার্থ দেহধারী। এমনকি গুণাবলিও দেহধারী।

স্টোয়িকদের এ মতের সাথে হিরাক্লিটাসের মতের বিশেষ সাদৃশ্য দেখা যায়। হিরাক্লিটাসের ন্যায় স্টোয়িকরাও আগুনকে শক্তির মূল কারণ বলে মনে করেন। তাঁরা বলেন, জগৎ এক সর্বব্যাপী হুতাশনের লীলাভূমি। এই হুতাশনের সাময়িক প্রজ্বলন ও প্রশমন থেকেই জগতের সৃষ্টি ও পরিবর্তন। স্টোয়িকগণ দেহধারী ঈশ্বরকে জগতের তাপের উৎস এক আগ্নেয় শক্তিরূপে কল্পনা করেছেন। এই আগুনই জগতের প্রাণ। এ আগুন থেকেই সব প্রাণের উৎপত্তি এবং এতেই বিলীন হবে সবকিছু।

ঈশ্বর জগতের সক্রিয় রূপ। জগৎ ঈশ্বরের দেহ; ঈশ্বর দেহী, জগতের আত্মা। জগতের স্বাধীন সত্তা নেই। জগৎ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মূলে রয়েছে ঈশ্বর। ঈশ্বর জগতের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ঈশ্বর সর্বদর্শী, সর্বত্র বিদ্যমান এবং মানুষের ভাগ্যবিধাতা। ঈশ্বর প্রেমময়; তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তবে মানুষের সুখ-দুঃখে তিনি অনাসক্ত। জগৎ ঈশ্বরেরই রূপ। সুতরাং তা অসম্পূর্ণ হতে পারে না। জগৎ পূর্ণতার প্রতিমূর্তি এবং অনিন্দ্যসুন্দর। জগতের পূর্ণতা থেকে বোঝা যায় যে, জগৎ এক কল্যাণকর মহান উদ্দেশ্যের অভিব্যক্তিস্বরূপ।

এখানে স্টোয়িকদের ঈশ্বরের সঙ্গে এরিস্টটলের ঈশ্বরের পার্থক্য সুস্পষ্ট। স্টোয়িকদের ঈশ্বর এরিস্টটলের ঈশ্বরের মতো জগতের বাইরে থেকে জগৎকে চালিত করে না। মানবাত্মা যেমন সারাদেহ জুড়ে বিদ্যমান, তেমনি স্টোয়িকদের ঈশ্বর জগতের সর্বত্র বিদ্যমান। অর্থাৎ স্টোয়িকদের মতে, জগৎ ও ঈশ্বরে কোনো প্রভেদ নেই। এখানে প্রশ্ন ওঠে : সবকিছুই যদি ঈশ্বরের প্রকাশ হয়ে থাকে, তা হলে আমরা জাগতিক অশুভ অমঙ্গল ব্যাখ্যা করব কী করে? অশুভের সমস্যা ব্যাখ্যায় স্টোয়িকরা দুটি সমাধান গ্রহণ করেছিলেন। এদের একটি নঞর্থক এবং অপরটি সদর্থক। নঞর্থক সমাধানে অশুভের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হয়। পৃথিবী শুভ ও পূর্ণ। আমরা যাদের অশুভ বলি তারা আসলে আপেক্ষিক অর্থেই অশুভ। বাদ্যযন্ত্রের একটি তার বেসুরে হলেও তা যেমন গোটা ঐকতানটিকে নষ্ট না করে বরং অধিকতর শ্রুতিমধুর করে তোলে, ছায়াসম্পাতে চিত্রের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস না পেয়ে যেমন বৃদ্ধিই পায়, ঠিক তেমনি অশুভের সমাবেশে সুখের মাধুর্যও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অন্যায়, অমিতাচার ও ভীরুতার পাশে ন্যায়, মিতাচার ও সাহস অধিকতর উজ্জ্বল দেখায়। অশুভ ব্যক্তিগত, তাতে সর্বজনীন সুখের হানি না হয়ে বৃদ্ধিই হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে কারো সুখ, কারো দুঃখ; কোনো কাজ হিতকর, কোনো কাজ অহিতকর, কিন্তু সমষ্টি হিসেবে দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্ব নেই।

সদর্থক সমাধানে রোগ শোক ইত্যাদি অশুভকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য ফলশ্রুতি এবং শুভলাভের প্রয়োজনীয় উপায় বলে ব্যাখ্যা করা হয়। স্টোয়িকরা আরও বলেন, একমাত্র মানবচরিত্রই স্বকীয় মূল্যের অধিকারী; আর বাহ্য অশুভ যেহেতু মানবচরিত্রের ক্ষতি করতে পারে না, সুতরাং একে সত্যিকার অর্থে অশুভও বলা চলে না। নৈতিক অশুভ সম্পর্কে তাঁরা বলেন, অশুভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে শুভের সন্ধান পাওয়া যায় না। অশুভের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই শুভ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আসল কথা হলো এই যে, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গোটা বিশ্বই একটি সুন্দর শুভ ও পরিপূর্ণ সত্তা, এবং এর প্রতিটি অংশেরই একটি বিশেষ স্থান ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের কোনোকিছুকেই কুৎসিৎ বা অশুভ বলে মনে হতে পারে না।

দেহ ও আত্মার সমন্বয়েই মানুষ। সমুদ্রের সাথে বারিবিন্দুর যে সম্বন্ধ, অনন্ত বিশ্বের সঙ্গে মানুষেরও সেই একই সম্বন্ধ। মানবদেহ বিশ্ব উপাদানেরই অংশ, এবং মানবাত্মা বিশ্বাত্মারই তপ্তশ্বাসবিশেষ। হৃৎপিণ্ড আত্মার প্রধান অংশ। প্রত্যক্ষণ অবধারণ অনুমান অনুভব কামনা বাসনা প্রভৃতি মানসিক ক্রিয়া হৃৎপিণ্ডেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। ধারণাগত চিন্তাশক্তি অর্জন করলেই তা প্রজ্ঞাসম্পন্ন হয়ে থাকে। যৌক্তিক চিন্তার কর্তা হিসেবে মানুষ স্বাধীন। ইতর প্রাণীর মতো মানুষ নিছক আবেগ-প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত নয়; চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে সে যা নির্বাচন করে, তার পেছনে প্রজ্ঞার সমর্থন থাকে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ স্বাধীন তখনই, যখন সে প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে, অর্থাৎ প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম অনুসারে চলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, বিজ্ঞজন যা করতে চান এবং প্রজ্ঞা বা প্রকৃতি যা করতে নির্দেশ দেয়, এ দুটির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। দার্শনিকমাত্রই সত্যের পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার অধিকারী। তিনি ঈশ্বরের মতোই স্বাধীন। স্বাধীনতা সম্পর্কে স্টোয়িকদের ধারণাকে প্রজ্ঞাসম্মত আত্মনিয়ন্ত্রণবাদ বলে অভিহিত করা যায়। স্বাধীন ক্রিয়া বলতে তারা বুঝেছেন মানুষের তথা বিশ্বের প্রজ্ঞাসম্মত প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যাবলিকে।

আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে স্টোয়িকদের মতে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তাদের কারো কারো মতে, জগৎ ধ্বংস হওয়ার সাথে আত্মাও ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার অন্যদের মতে, সাধারণের পক্ষে পরলোকপ্রাপ্তির আশা না থাকলেও অন্তত বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মা তাঁদের দেহবিনাশের ফলে বিনষ্ট হবে না। সাধারণ লোকের আত্মা ও পুণ্যবানদের আত্মা তাঁদের দেহবিনাশের ফলে বিনষ্ট হবে না। সাধারণ লোকের আত্মা জড়ীয়; সুতরাং দেহের অবসানেই তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মায় জড়ের প্রভাব কম, সুতরাং দেহবিনাশের পরও তাদের আত্মা টিকে থাকে। কিন্তু তবু একথা বলা চলে না যে আত্মা অমর। দেহ অবসানের পর দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও পরিণামে বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মারও বিনাশ ঘটে। যে অনন্ত জীবনপ্রবাহ থেকে আত্মার উৎপত্তি, পরিণামে তার সাথেই আত্মা মিলিত হবে।

নৈতিকতা ধর্ম ও সমাজ

স্টোয়িকদের নৈতিক মতবাদ তাঁদের মনোবিদ্যা ও অধিবিদ্যাবিষয়ক মতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত তাঁদের মতে, জগৎ কতকগুলো চিরন্তন নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। প্রজ্ঞা মানবপ্রকৃতির অপরিহার্য ধর্ম। জগৎকে একটি যান্ত্রিক কারণিক অনুক্রম বলে ব্যাখ্যা করা চলে না। প্রকৃতপক্ষে জগৎ একটি সুসংবদ্ধ বৌদ্ধিক বিধান, একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল সমগ্র। এই সমগ্রে তার প্রতিটি অংশের একটি বিশেষ স্থান ও ভূমিকা রয়েছে। এই সমগ্রের সব অংশই একটি অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই একটি সুসমঞ্জস একত্ব; এবং এর মূলে রয়েছে একজন বিধাতা। মানুষ বিশ্বের অংশবিশেষ। বলা চলে একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব। ক্ষুদ্র হলেও মানুষে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিফলন ঘটে। আর এ জন্যই মানুষের উচিত ব্যাপক বিশ্বের চরম লক্ষ্যের দিকে খেয়াল রেখে চলা, বৃহত্তর স্বর্গীয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে তার নিজস্ব উদ্দেশ্যের সমন্বয়সাধন করে পূর্ণতার সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হওয়া।

অবশ্য একাজ খুব সহজ নয়। এজন্য মানুষের প্রয়োজন তার আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রজ্ঞা গোটা বিশ্বকে যেভাবে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করছে, ঠিক একইভাবে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষকে। মানুষমাত্রেরই উচিত জাগতিক নিয়ম মেনে চলা, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে ব্যাপক বিশ্বইচ্ছার অনুগত করা এবং চেতনা ও বুদ্ধির যথার্থ প্রয়োগ দ্বারা স্বেচ্ছায় তার কর্তব্য করে যাওয়া। স্টোয়িকদের মতে, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলা এবং প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে কাজ করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। তাঁদের মতে, পুণ্যই সর্বোচ্চ শুভ, পুণ্যেই নিহিত পরম আনন্দ। একমাত্র পুণ্যবান জীবনই আনন্দময় জীবন। বেঁচে থাকার মানেই হচ্ছে আত্মসিদ্ধিলাভ; আর আত্মসিদ্ধির অর্থই হলো সর্বজনীন প্রজ্ঞার উদ্দেশ্যসাধন। স্টোয়িকদের নৈতিক আদর্শের মূলে মানুষের সমান অধিকার এবং সমান অধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্বজনীন সমাজের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁদের মতে, সব মানুষে একই প্রজ্ঞা বর্তমান, এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ একই বিশ্বাত্মার অংশবিশেষ।

এপিকিউপরীয় সুখবাদের বিরোধিতা করে স্টোয়িকগণ বলেন, প্রত্যেক প্রাণীই চায় তার নিজকে বাঁচিয়ে রাখতে। সুখ নয়, আত্মসংরক্ষণই মানুষের কর্মপ্রচেষ্টার লক্ষ্য। সুখ মানুষের কর্মপ্রচেষ্টার লক্ষ্য নয়, সহগামীমাত্র। প্রকৃতির প্রচলিত কর্মকাণ্ডের সাথে সুখের সংযোগ আপতিক। তবে আত্মসংরক্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাতেই মানুষের চেষ্টা সীমাবদ্ধ নয়। শুধু নিজেকে নয়, আপন জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির একটি। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সাথে মানুষ তার প্রকৃতির প্রজ্ঞাসম্মত দিকটিকে তার যথার্থ সত্তা বলে মনে করতে শিখে। আর তখন থেকেই সে বিবেকবুদ্ধির পূর্ণতাবিধান এবং বৌদ্ধিক উদ্দেশ্যসাধনে তৃপ্তি ও আনন্দ পেয়ে থাকে।

স্টোয়িকদের মতে, চিন্তার খাতিরেই চিন্তা বা প্রজ্ঞার জন্যই প্রজ্ঞার অনুশীলন মানুষের লক্ষ্য হতে পারে না। প্রজ্ঞাকে আমরা মূল্য দিই এ জন্য যে, তা আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দেয়। পুণ্যই একমাত্র শুভ, আর অধর্ম একমাত্র অশুভ। এ ছাড়া আর যা আছে, তাদের শুভ বলা চলে না, আবার অশুভও বলা চলে না। স্টোয়িকদের মতে স্বাস্থ্য সম্মান সম্পদ ক্ষমতা ইত্যাদি বাহ্য সম্পদের কোনো স্বকীয় মূল্য নেই। আবার মৃত্যু রোগ দারিদ্র্য ইত্যাদিকেও পরম অর্থে অশুভ বলা চলে না। অতএব এদের কোনোটিকেই নৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা চলে না। সুখ বা আনন্দ অর্জন করা তাদের আয়ত্তাধীন নয়। তবে এদের প্রতি বিশেষ মনোভাব পোষণ করা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এদের কীভাবে আমরা প্রয়োগ করি, আমাদের চরিত্রের ওপর এদের কী প্রভাব, তার ওপরই নির্ভর করে এদের মূল্য। তাছাড়া নিজস্ব বা স্বকীয় মূল্য বলতে এদের কিছু নেই। একমাত্র ধর্মই স্বকীয় মূল্যের অধিকারী; ধর্মই প্রকৃত শুভ। ধর্মের পক্ষেই মানুষকে যথার্থ আনন্দদান সম্ভব। বাহ্য সম্পদের অভাবে ধার্মিকের আনন্দের ব্যাঘাত ঘটে না। তথাকথিত বাহ্য অশুভ প্রকৃত অশুভ নয়। অধর্মই প্রকৃত শুভ।

স্টোয়িকদের মতে, ধর্মই যথার্থ সুখ বা আনন্দলাভের উপায়। তবে ধর্মকে নিষ্কাম হওয়া চাই। আবার শুধুমাত্র বাহ্য আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ধর্মসাধন হয় না। ধার্মিক কাজ বলতে স্টোয়িকরা বুঝেছেন সেসব কাজকে যেগুলো নৈতিক নিয়মাবলির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ কর্তার পক্ষে ধার্মিক আচরণ তা-ই, যা তিনি শুভ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে এবং পরম শুভকে অর্জনের ঐকান্তিক ইচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করে থাকেন। অচেতনভাবে বা অজ্ঞতাবশে কাজ করা পুণ্য বা ধর্ম নয়, হতে পারে না। ধর্মপালনে আত্মার ঐকান্তিক আগ্রহ না থাকলে অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না।

এদিক থেকে বিবেচনা করলে ধর্ম একটাই— সদিচ্ছাই ধর্মের মূল উৎস ও উপাদান। মানুষের হয় তা থাকবে, না হয় থাকবে না; এর মাঝামাঝি অন্যকিছু নেই। মানুষ হয় হবেন বিজ্ঞ, আর না হয় নির্বোধ। এদিক থেকে কোনো একটি বিষয়ে ধার্মিক হলে অন্য বিষয়ে অধার্মিক হওয়া অসম্ভব; কারণ এক ধর্মের উপস্থিতিতে অন্যান্য ধর্মও উপস্থিত থাকবে। ধর্মই সব আচার-অনুষ্ঠানের মূল। জ্ঞান মিতাচার সাহস ও ন্যায়পরতা—এই চারটি গুণ ধর্মকর্মের অপরিহার্য ফল। এদের একটিকে আয়ত্ত করা গেলে অন্যগুলোও আয়ত্তে আসবে। আবার এদের কোনো একটির অভাব হলে অন্যগুলোরও অভাব হবে। ব্যক্তিমাত্রই হয় সব বিষয়ে সৎ, না হয় সব বিষয়েই অসৎ। গোটা মানবজাতিকে সাধু ও অসাধু – এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়; তবে প্রকৃতপক্ষে এ দুই শ্রেণীর মধ্যেও মিশ্রণ দেখা যায়। যিনি দোষমুক্ত এবং সম্পূর্ণ সৎ, তিনিই প্রকৃত ধার্মিক। কেউ আংশিকভাবে সৎ হলেও তাকে ধার্মিক বলা চলে না। যার মধ্যে প্রজ্ঞার সামান্যতম অভাব রয়েছে, তিনিও অধার্মিক। যিনি কোনো রিপুর অথবা কোনো প্রবৃত্তির অধীন, অথবা কোনো দূষণীয় কাজ করেন, তিনি অধার্মিক। ধর্মকে হয় সামগ্রিকভাবে পেতে হবে, আর না হয় একেবারেই নয়। আংশিক ধর্ম বলে কিছু নেই। ধর্ম ও অধর্মের মাঝখানে কোনো ক্রমভেদ নেই, ধর্ম ও অধর্মের প্রভেদ অনতিক্রম্য।

স্টোয়িকদের এই মতবাদ থেকে বোঝা যায় যে, ধর্মাধর্ম বা পাপপুণ্যের কোনো মাত্রাভেদ নেই। আর তা-ই যদি না থাকে, তা হলে নৈতিক প্রগতি বা উন্নতির প্রশ্নও ওঠে না। এমতাবস্থায় একজনের পক্ষে পরিপূর্ণ নির্বুদ্ধিতা ও পাপাচার থেকে পরিপূর্ণ বিজ্ঞতা ও সাধুতায় রাতারাতি উত্তরণের সম্ভাবনা আছে ঠিকই, কিন্তু প্রথম অবস্থা থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় ক্রমিক উন্নয়ণের অবকাশ নেই। অর্থাৎ আমরা অশুভ থেকে শুভে পরিবর্তিত হই ঠিকই, কিন্তু সেই পরিবর্তনের গতি ধারাবাহিক নয়, তাৎক্ষণিক।

স্টোয়িকদের এ মত অনেকের কাছেই উগ্র ও অবাস্তব বলে মনে হয়েছে; আর এ জন্যই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনাও এসেছে যথেষ্ট। এসব সমালোচনার মুখে স্টোয়িকরা তাঁদের মত কিছুটা পরিবর্তন করেন। যেমন, ধর্মের একত্ব ও স্বয়ংসম্পূর্ণতায় বিশ্বাসে অটল থেকেও জেনো শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, সততা বা সাধুতা নামক একই ধর্ম মিতাচার সাহস জ্ঞান ও ন্যায়পরতা— এই চারটি ধর্মের রূপপরিগ্রহ করে থাকে। আবার প্রজ্ঞার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা সত্ত্বেও জেনো ও ক্লেনথিস দৈনন্দিন জীবনে আবেগ-অনুভূতি ও প্রবৃত্তির ভূমিকা অস্বীকার করেন নি। বলা বাহুল্য, মানুষ হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিই বিবেকবুদ্ধি ছাড়াও প্রবৃত্তি ও অনুভূতির অধিকারী। আর সে বাস করে এক সমাজবদ্ধ জড়জগতে। এ জন্যই স্টোয়িকরা তাঁদের প্ৰাজ্ঞিক নৈতিকতাবিষয়ক প্রারম্ভিক উগ্রমত বেশ কিছুটা সংশোধনের প্রয়োজনবোধ করেছেন। তাঁরা তা করলেন এ ভেবে যে, প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগ নৈতিকতাপরিপন্থী নয়। বিবেকবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হলে এগুলোর নৈতিক মূল্যও বৃদ্ধি পায়।

স্টোয়িক দর্শনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, তা আত্মকেন্দ্রিক নয়। একটু আগে আমরা উল্লেখ করেছি, স্টোয়িক মতে শুধু আত্মসংরক্ষণই মানুষের একমাত্র প্রবৃত্তি নয়, সামাজিক চেতনা বলেও মানুষের একটি বিশেষ প্রবৃত্তি রয়েছে। এই প্রবৃত্তিই তাকে ক্রমশ সামাজিক জীবনের দিকে চালিত করে। বিবেকবুদ্ধির আলোকেই সে তার সামাজিক প্রবৃত্তিসমূহকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলে। প্রজ্ঞার কল্যাণেই সে বুঝতে পারে যে, সব মানুষই প্রজ্ঞাময় জীবনের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশ্বসমাজের সদস্য। বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমরা সবাই ঈশ্বরের চোখে সমান।

স্টোয়িকরা নাগরিক ও বর্বরদের পার্থক্য অস্বীকার করেন। তাঁদের এই মনোভাবের সঙ্গে এরিস্টটলের মনোভাবের পার্থক্য সুস্পষ্ট। গ্রিক সংস্কৃতির প্রতিটি বিষয় গ্রহণে যারা নারাজ ছিলেন, এরিস্টটল তাঁদের অবজ্ঞার চোখে দেখেতেন। স্টোয়িকরা সব মানুষের সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁদের পরিকল্পিত বিশ্বসমাজ একটি বিশ্বজনীন রাষ্ট্রবিশেষ। এ রাষ্ট্রের একমাত্র আইন প্রাকৃতিক নিয়ম, একমাত্র অধিকার প্রাকৃতিক অধিকার। এই বিশ্বজনীন রাষ্ট্রে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করার একমাত্র মানদণ্ড হলো নৈতিকতা। এখানে দেবদেবী ও বিজ্ঞজনেরা বিশেষ সুবিধার অধিকারী, এবং যে-কেউ স্বেচ্ছায় তাদের সান্নিধ্যে আসতে পারে। সব মানুষের মধ্যে এক বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান, সবাই একে অপরের ভাই, একই বাবার সন্তান। তাদের উৎস এক, লক্ষ্যও অভিন্ন। তাদের সবার মধ্যে একই সর্বজনীন প্রজ্ঞা বিদ্যমান; তারা সবাই আইনের অধীন এবং একই রাষ্ট্রের নাগরিক। শত্রুরাও আমাদের সাহায্য ও ক্ষমার পাত্র। পরস্পরের প্রতি সুবিচার ও মানবোচিত ব্যবহারই আমাদের কর্তব্য। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি নয়, সর্বজনীন মঙ্গলকামনা এবং প্রয়োজনবোধে অপরের জন্য আত্মোৎসর্গ করা হবে আমাদের নৈতিক আদর্শ।

মানবজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার বিষয়টিকে স্টোয়িকরা রাষ্ট্রের মূলতত্ত্বের পরিপন্থী বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, বিশ্বব্যাপী একটিমাত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, একই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করা সব মানুষের কর্তব্য। কোনো একটি বিশেষ দেশকে স্বদেশ মনে করে অন্যান্য দেশকে বিদেশ মনে করা অনুচিত। স্টোয়িকদের বিশ্ববাসিত্বের (cosmopolitanism) এ ধারণা বিশ্বের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য অবদান। সংকীর্ণতা ও স্বাদেশিকতার সীমিত গণ্ডী অতিক্রম করে মানুষ যতই এ আদর্শের দিকে এগিয়ে যাবে, ততই তার মঙ্গল সুনিশ্চিত হবে।

রোমান দর্শন

ভূমিকা

প্যানায়েটিয়াসপসিডোনিয়াস যে স্টোয়িকবাদকে স্থায়ীভাবে এথেন্স থেকে রোমে স্থানান্তরিত করেন। এঁরা দুজন স্টোয়িকবাদে যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন, তা দ্রুত সচল ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ফলে এথেন্সের স্থলে রোম তখন স্টোয়িকবাদের কেন্দ্র বলে খ্যাতিলাভ করে। রোমের প্রভাবে স্টোয়িকবাদ ক্রমশ অধিকতর পরিপক্ক নম্র সহিষ্ণু এবং সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্টোয়িকবাদ তখন একটি সর্বজনীন ও মানবতাবাদী দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। রোমানদের ইহলৌকিক মনোবৃত্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাবোধই ছিল স্টোয়িকবাদের এই পরিবর্তনের মূলে। এ পরিবর্তনে রোমান সাম্রাজ্যের আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে। বিভিন্ন দেশের আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল এই সাম্রাজ্যের জনগণের মধ্যে। আর আন্তর্জাতিক পরিবেশের প্রভাবও পড়েছিল সব নাগরিকের মধ্যে। মূলত এ কারণেই রোমান স্টোয়িকবাদে নৈতিক ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত কোনো নির্বিচার দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারলাভ করতে পারে নি।

সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রি.পূ.)

যাই হোক, রোমে স্টোয়িকবাদের যে ক্রমবিবর্তন ঘটে, তার সঠিক ধারাবাহিক বর্ণনা দেয়া কিংবা এর সাথে জড়িত সব দার্শনিকের নাম উল্লেখ করা এক অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং আমরা কেবল এমন কয়েকজন রোমান দার্শনিকের মত আলোচনা করবো, যাঁরা হয় স্টোয়িক সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট সদস্য কিংবা এর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এঁদের অগ্রগণ্য ছিলেন সিসেরো। প্রাচীন একাডেমির অনুসারী হয়েও তিনি উদারপন্থী স্টোয়িকদের মতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। রোমান চিন্তায় যে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের সংমিশ্রণ দেখা যায় সিসেরোর দর্শন তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দার্শনিক মতে যে বিরোধ দেখা যায়, তা থেকে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আসলে দর্শনে কখনো নিশ্চিত সত্যলাভ করা যায় না। আর এজন্যই তিনি নিশ্চিতিকে নয়, সম্ভাব্যতাকে তাঁর দার্শনিক পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন দার্শনিক মতের সংযোগ ও সমন্বয়বিধান ছিল তাঁর দার্শনিক অভিযানের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। আর তাই তাঁর দার্শনিক মতে সংশয়বাদ, স্টোয়িকবাদ ও এপিকিউরীয়বাদের সংমিশ্রণ দেখা যায়।

সিসেরো ঈশ্বরের সহজাত ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং জগৎব্যাখ্যায় এপিকিউরীয়দের যান্ত্রিক মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। স্টোয়িকদের মতো তিনিও জগতের নিয়ন্ত্রণ ও শাসনকার্যে ঐশী উদ্দেশ্য আবিষ্কার করেন। কিন্তু তিনি ভবিষ্যৎকথনে বিশ্বাসী ছিলেন না, এমনকি জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধেও তিনি বিদ্রূপ করতেন। তিনি আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে জীবনের লক্ষ্য বলে স্টোয়িকদের ধারণা গ্রহণ করেন নি। তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর বাস্তববাদী। আর এ জন্যই তিনি মনে করতেন, যেকোনো বাহ্য শুভ মানুষের পূর্ণতাপ্রাপ্তির পক্ষে সহায়ক।

সিসেরো তাঁর রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বনাগরিকতার সমর্থন ও সুপারিশ করেন। তিনি প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর বিশেষ জোর দেন এবং প্রাকৃতিক নিয়মকে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি বলে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক নিয়মের ফলেই সব মানুষ কিছু অভিন্ন অধিকার ও সুবিধার অধিকারী। তিনি আরও মনে করতেন যে, নৈতিকতাই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি; সুতরাং রাষ্ট্রকে অবশ্যই নৈতিক ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রকার সরকারের মধ্যে তিনি রাজতন্ত্রের সমর্থন করেন। তাঁর মতে, শুভ সরকার হিসেবে রাজতন্ত্রের পরেই অভিজাততন্ত্রের স্থান। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর আদৌ কোনো সমর্থন ছিল না।

সেনেকা (৩ খ্রি.পূ. – ৬৫ খ্রি.)

সিসেরোর দর্শনের চেয়ে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সেনেকার (৩ খ্রিস্টপূর্ব-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) দর্শন। তিনি স্পেনদেশে জন্মগ্রহণ করেন। যৌবনে তিনি উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং স্টোয়িকবাদ পিথাগোরীয় দর্শন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। তাঁর বাবা ছিলেন অত্যন্ত ধনী, এবং তিনি নিজেও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তাঁর পারিবারিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন। তিনি চার বছর নির্বাসনদণ্ড ভোগ করেন। সেনেকার চরিত্রে কিছু অদ্ভুত বিরোধ দেখা যায়। যেমন, তিনি ছিলেন অঢেল সম্পদের মালিক, অথচ তিনি দারিদ্র্যের আশীর্বাদের ব্যাখ্যা ও সমর্থন করেন। তবে তিনি সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন এবং মানবতাবাদের নিয়মাবলি অনুশীলন করতেন।

তাঁর দার্শনিক কর্মের মধ্যে নির্বাসনের প্রথম বছরে মার কাছে লেখা একটি চিঠি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। ওই চিঠিতে তিনি তাঁর মাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, নির্বাসন জীবন তাঁর কাছে মোটেও বেদনাদায়ক ছিল না। সুতরাং তিনি (তাঁর মা) যেন তাঁর জন্য অনর্থক চিন্তা করে কষ্ট না পান। পার্থিব সম্পদের ক্ষণস্থায়ী সুখের ওপর নির্ভর না করে নিত্যপদার্থ থেকে কী করে যথার্থ আনন্দ পাওয়া যায়, তা-ও তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, অর্থনৈতিক উন্নতি যেমন কোনোদিন তাঁকে অভিভূত করতে পারে নি, তেমনি নির্বাসনও তাঁকে কাবু করতে পারে নি। বরং একদিক থেকে নির্বাসন ছিল তাঁর পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ; কারণ তাতে তিনি যে অবসর পেয়েছিলেন, তার ফলে তিনি জীবনকে গভীরভাবে দেখার সুযোগ পান।

মার কাছে লেখা ওই চিঠিতে সেনেকা আরও বলেন : অঢেল ধনসম্পদ নয়, সামান্য কিছুর মাধ্যমেই জীবনে আনন্দলাভ সম্ভব। কোনো বাহ্য সুবিধা বা অসুবিধার জন্য নয়, আত্মার কামনা-বাসনার ফলেই মানুষ গরিব বা ধনী হয়ে থাকে। তিনি তাঁর মাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আদি রোমানরা দরিদ্র ছিল, কিন্তু তাদের জীবন ছিল সাহসী। তিনি আরও বলেন, গণঅসম্মান বা অপমানের ভয়ে তিনি মোটেও ভীত ছিলেন না; কারণ তিনি জানতেন যে, তিনি নিজেই তাঁর কার্যাবলির বিচারক। এজন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি তাঁর মাকে আরও স্মরণ করিয়ে দেন যে, একাধিক উপায়ে মানুষ সান্ত্বনা পেতে পারে। আর এটুকু ভেবে তাঁর সান্ত্বনা পাওয়া উচিত যে, তাঁর ছেলে সুখী ও প্রফুল্ল আছেন। সুতরাং তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। অবশেষে তিনি তাঁর মাকে শোকচিন্তা ও মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে দর্শন পাঠের পরামর্শ দেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, দর্শন যেকোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে সক্ষম।

সেনেকার গ্রন্থাবলির মধ্যে, ‘অন এঙ্গার’ (On Anger), ‘অন দ্য ট্রাংকুইলিটি অব্ দ্য সোল’ (On the Tranquillity of the Soul), ‘অন ক্লেমেন্সি’ (On Clemency), ‘অন প্রভিডেন্স’ (On Providence) ও ‘অন এ হ্যাপি লাইফ’ (On a Happy Life) বিখ্যাত। সর্বশেষ গ্রন্থটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বৈষয়িক সুযোগ সুবিধার অনুসন্ধান আনন্দময় জীবনলাভের যথার্থ উপায় নয়— এ মতের ব্যাখ্যা থেকেই শুরু হয় এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়।

সেনেকার শিক্ষাবিষয়ক মতবাদে বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনীহা বিশেষভাবে পরিস্ফুট। অলঙ্কারাশাস্ত্রের প্রতিও তাঁর আদৌ কোনো আকর্ষণ ছিল না। সাহিত্যকর্মকেও তিনি নিতান্তই একটি একাডেমিক ব্যাপার বলে জ্ঞান করতেন। কিন্তু দর্শনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রগাঢ়। সেনেকা দর্শনকে নৈতিক, প্রাকৃতিক ও বৌদ্ধিক—এ তিনভাগে বিভক্ত করেন। তাঁর মতে, নৈতিক দর্শনের কাজ মানুষের আচার-ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা। প্রাকৃতিক দর্শন প্রাকৃতিক নিয়ম ও কার্যাবলির অনুসন্ধান করে, এবং বৌদ্ধিক দর্শন শব্দাবলি ও যুক্তিতর্কের বৈধতাবিষয়ক জ্ঞানের অনুসন্ধান করে। এছাড়া ভ্রান্ত ধারণা ও প্রতারণা থেকে সঠিক জ্ঞানকে ফারাক করার ক্ষমতাঅর্জনের ব্যপারেও বৌদ্ধিক দর্শন শিক্ষা দেয়। ঘটনা ও বস্তুর কারণ অনুসন্ধান প্রাকৃতিক দর্শনের, যুক্তিতর্ক বৌদ্ধিক দর্শনের এবং নৈতিক আচার-আচরণের মূল্যায়ন নৈতিক দর্শনের কাজ। নৈতিক দর্শন আবার দু’ভাগে বিভক্ত। এদের একটি সামাজিক সুবিচার এবং অপরটি মানুষের ভাবাবেগ ও আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। নৈতিক দর্শনের এসব শাখার সম্পর্ক খুবই নিকট; সুতরাং এদের একটিতে গোলযোগ দেখা দিলে সে গোলযোগ অন্যগুলোতেও বিস্তারলাভ করে। দেহধারী ও অশরীরী, এ দু’রকম সত্তা নিয়ে প্রাকৃতিক দর্শনের কাজকারবার। কার্য ও কারণের স্বরূপ নির্ণয় এবং কারণের কারণ অনুসন্ধান এর আলোচ্যবিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তিবিদ্যা ও অলঙ্কারাশাস্ত্র, এ দুটি বিষয়ের সমবায়ে বৌদ্ধিক দর্শন গঠিত। যুক্তিবিদ্যা নির্ভুল যুক্তির সাহায্যে জ্ঞানলাভের উপায় নিয়ে, আর অলঙ্কারাশাস্ত্র শব্দাবলি ও তাদের অর্থ নিয়ে আলোচনা করে।

সেনেকা আত্মপরীক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং একে একটি মূল্যবান সদ্গুণ বলে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, প্রতি রাতেই আমাদের নিজ আচরণ ও কার্যাবলির সমীক্ষা করা উচিত। আমরা যদি তা করি, তা হলে আমাদের পাপের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং পরিণামে আমরা মানসিক প্রশান্তিলাভ করতে সক্ষম হবো। সেনেকা ঈশ্বরকে পিতারূপে কল্পনা করেন এবং বলেন, ঈশ্বর তাঁর সন্তানদের ভালোবাসেন। ঈশ্বর যাদের ভালোবাসেন, তাদের প্রতি তিনি কড়া নজর রাখেন; আর অন্যদের তিনি দেখেন অনেকটা ক্রীতদাসের দৃষ্টিতে। শিক্ষক যেমন তার ভালো ছাত্রদের কঠিন পড়া দিয়ে থাকেন, ঈশ্বরও তেমনি ভালো মানুষদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। মানুষের দুর্ভোগ-দুর্ভাগ্য ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক নয়, মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতার নির্দেশক।

‘অন্ এ হ্যাপি লাইফ’ গ্রন্থের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সেনেকা ভোগবিলাসী ইন্দ্রিয় জীবনের কুফল বর্ণনা করেন। বৈষয়িক জীবনের প্রতি আত্যন্তিক আগ্রহ ও পুণ্যের প্রতি অবহেলার জন্য তিনি রোমানদের নিন্দা করেন। তাদের ইন্দ্রিয়-সেবাপরায়ণতার উল্লেখ করে সেনেকা বলেন, এর কুফল অনেক। এতে বিভিন্ন রোগসৃষ্টির ফলে দেহের সমূহ ক্ষতি হয়। ভোগবিলাসের ফলে মানুষ প্রথমে আতিশয্যের এবং পরে অসাধুতার দিকে পরিচালিত হয়ে পরিণামে ইন্দ্রিয়ের দাসে পরিণত হয়। অন্যের দোষত্রুটিকে বড় করে না দেখে নিজের ভুলত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য সেনেকা মানুষকে পরামর্শ দেন। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে মানুষ যেন সুশৃঙ্খল সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে পারে, তিনি এ আশা করেন। জাতীয় সীমান্তের কথা ভুলে গিয়ে ঈশ্বরের অধীনে সব মানুষ যেন সমান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারেন, এজন্য তিনি এক বিশ্বজনীন মানবসমাজের স্বপ্ন দেখেন।

এপিক্‌টেটাস (৫০-১৩০ খ্রি.)

এপিক্‌টেটাস (৫০-১৩০ খ্রিস্টাব্দ) একজন ক্রীতদাস। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তদানীন্তন রোমে ‘ক্রীতদাস’ কথাটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল। ক্রীতদাস বলতে তখন অশিক্ষিত পরিবারের অসহায় গরিব লোককে নির্দেশ করা হতো না। যুদ্ধের সময় পরাজিত জাতিসমূহের লোকজনই তখন ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাই দেখা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের এমন অনেক ক্রীতদাস ছিল যারা তাদের প্রভুদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ও বেশি সভ্য ছিল। তাদের কেউ কেউ দায়িত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং বিভিন্ন ব্যাপারে তাদের প্রভুদের পরামর্শ দিতেন, প্রভুদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষা দিতেন। অর্থাৎ প্রায় সব ব্যাপারেই এসব শিক্ষিত ক্রীতদাস ভৃত্য বলে বিবেচিত না হয়ে প্রভুদের বিশ্বস্ত সহচর ও বন্ধু বলেই বিবেচিত হতেন। এ ধরনের ক্রীতদাসদের তাদের কর্মদক্ষতা ও আনুগত্যের পুরস্কারস্বরূপ মুক্ত করে দেয়া হতো। তখন তাঁরা উচ্চ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হতেন।

এপিকটেটাস ছিলেন এ ধরনেরই একজন শিক্ষিত ক্রীতদাস। প্রথমে তিনি ছিলেন সম্রাট নীরোর ক্রীতদাস। নীরোই তাঁকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য মুসনিয়াসের কাছে পাঠিয়েছিলেন । শীঘ্রই তিনি একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তদানীন্তন স্টোয়িকদের মধ্যে খ্যাতিলাভ করেন। পরে তিনি দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। চল্লিশ বছর বয়সের আগেই তিনি এত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে, সম্রাট ডমেটিয়ান অন্যান্য বিশিষ্ট স্টোয়িকদের সঙ্গে তাঁকেও নির্বাসিত করেছিলেন। তিনি নিকোপোলিস চলে যান এবং ওখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেই স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।

এপিক্‌টেটাস এক সান্ত্বনার দর্শন প্রচার করেন। “কোনোকিছু সম্পর্কে বলবেন না যে, আমি এটি হারিয়ে ফেলেছি, বরং বলুন আমি একে প্রত্যর্পণ করেছি। আপনার শিশু কি মৃত? একে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। আপনার স্ত্রী কি মৃত? তাকে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। আপনার সম্পত্তি কি আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে? একেও কি প্রত্যর্পণ করা হয় নি? কিন্তু আমার কাছ থেকে যে তা ছিনিয়ে নিয়েছে সে একজন খারাপ লোক। দাতা তার দেয়া জিনিস কার হাত দিয়ে ফিরিয়ে নিয়েছে তাতে আপনার কী-ইবা যায় আসে?”

এপিক্‌টেটাসের মতে, মানবজীবন একটি নাটকবিশেষ। আর আমরা সবাই এ নাটকে অভিনয় করে চলেছি। তিনি আমাদের নিজ নিজ চরিত্রে ভালোভাবে অভিনয়ের উপদেশ দেন। জীবনে যদি আমরা বিচারক হয়ে থাকি, তা হলে আমাদের অবশ্যই সুবিচার করতে হবে। আমরা যদি শারীরিক দিক থেকে বিকল হয়ে পড়ি, তবু আমাদের নিজেদের অসুখী বলে অভিযোগ করা ঠিক নয়। ঈশ্বরই জগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আর আমরা জীবনে কোন কাজ করবো তা নির্বাচনের ভার আমাদের ওপর নয়, ঈশ্বরের ওপর। ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেকের সাথেই আছেন; সুতরাং ঐশী শক্তির মর্যাদা রক্ষায় আমাদের প্রত্যেকেরই সচেষ্ট হওয়া উচিত।

এপিক্‌টেটাসের নৈতিক মতবাদ অত্যন্ত চমৎকার। তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী ছিলেন। ক্ষমা প্রদর্শনের সুবিধার্থে তিনি আইন সংস্কারের ওপর জোর দেন। তিনি দাসত্বপ্রথার বিরোধী ছিলেন। তাঁর এই বিশ্বাস ছিল যে, প্রতিটি কাজে তিনি ঈশ্বর দ্বারা পরিচালিত।

মার্কাস অরেলিয়াস (১২১-১৮০ খ্রি.)

মার্কাস অরেলিয়াস (১২১-১৮০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন সম্রাট। তিনি জন্মগ্রহণ করেন রোমের এক প্রাচীন স্পেনদেশীয় পরিবারে। তিনি ছিলেন তাঁর ফুফা সম্রাট এন্টোনিয়াস পিয়াসের পোষ্যপুত্র ও জামাতা। শৈশবে তিনি উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। দর্শন বিষয়ে তিনি শিক্ষালাভ করেন তদানীন্তন রোমের অন্যতম স্টোয়িক জুনিয়াস রুস্টিকাসের কাছে। অনাড়ম্বর সাদাসিধা জীবনের সুফল সম্পর্কে তিনি বিশেষ শিক্ষালাভ করেছিলেন। ১৬১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি বর্বরদের বিদ্রোহ এবং পার্থিয়ার অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হন। নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে তাঁর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বগ্রহণ করতে হয়, এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি রোমান সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।

মার্কাস অরেলিয়াস তাঁর রাজত্বকালে বহু বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি ভূমিকম্প, মহামারী, দীর্ঘ ও মারাত্মক যুদ্ধ প্রভৃতি বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হন । যেমন : ক্যাসিয়াস নামক তাঁর এক বন্ধু সিংহাসনের লোভে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর স্ত্রী সম্পর্কেও নানারকম কুৎসিত গুজব রটেছিল। একটি সন্তান ছাড়া তাঁর পরিবারের সব সদস্য অকালে মারা যায়।

এসব অসুবিধা সত্ত্বেও মার্কাস অরেলিয়াসের ভাবাবেগকে কোনোমতেই ছোট করে দেখা চলে না। তাঁর ‘মেডিটেশন্‌স’ (Meditations) গ্রন্থে আমরা গভীর নীতিবোধসম্পন্ন একজন মহান ব্যক্তির চিত্র দেখতে পাই। অরেলিয়াস বলেন, অপ্রীতিভাজন কোনো লোক দেখে আমাদের ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই; কারণ আমাদের বোঝা উচিত যে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকা আবশ্যিক। “সকালবেলা মনে মনে একথা বলে কাজ শুরু করুন : আমি ব্যস্ত অকৃতজ্ঞ উদ্ধত প্রতারক ঈর্ষাপরায়ণ, অসামাজিক লোকের সাক্ষাৎ পাব। তাদের এসব খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূলে রয়েছে শুভ ও অশুভ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব। কিন্তু শুভ ও অশুভের স্বরূপ কী, অন্যায়কারীর স্বভাব কী, আমি নিজে যেহেতু তা জানি, সুতরাং তাদের কারো দ্বারা আমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি না। আবার আত্মীয় পরিজনদের প্রতি আমি রাগ বা ঘৃণাপোষণ করতে পারি না, কেননা হাত পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যেমন সহযোগিতা আছে, আমাদেরও তেমনি পারস্পরিক সহযোগিতা করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রবৃত্তি প্রকৃতিবিরুদ্ধ।”

মার্কাস অরেলিয়াস বলেন, যেকোনো মুহূর্তেই আমাদের মৃত্যু হতে পারে। চিন্তার নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায়পরতার সাথে কাজ করা আমাদের সকলেরই কাম্য। এটুকু ভেবে আমরা শান্তি পেতে পারি যে, আমাদের সুখসুবিধা দেখার জন্য দেবতারা আছেন। তিনি বলেন : জীবন সদাপরিবর্তনশীল, এবং আমাদের দেহও ক্রমশ ক্ষয় হয়ে চলেছে। যশ সৌভাগ্য ধনসম্পদ— এদের কোনোটাই আমাদের স্থায়ী শান্তি দিতে পারে না। একমাত্র দর্শনই মানুষের সার্থক সুখ তথা স্থায়ী মঙ্গলের আকর।

মার্কাস অরেলিয়াসের নৈতিক মত মরণোত্তর জীবনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বস্তুত, তিনি ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, মৃত্যু মানেই ব্যক্তিত্বের পরিসমাপ্তি। জন্মদান ও গর্ভধারণ, জন্ম ও বৃদ্ধি, যৌবন ও বার্ধক্য— এ সবের ন্যায় মৃত্যুও একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। একে কামনা করা বা ভয় করার কিছু নেই। অন্যান্য স্বাভাবিক ব্যাপারের মতো মৃত্যুকেও সহজভাবে গ্রহণ করা উচিত।

স্টোয়িকবাদের সমাপ্তি

মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুর পর স্টোয়িকবাদ ক্রমশ তার শক্তি ও আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এর পরও এ মতের কিছু সমর্থক ছিল; কিন্তু খ্রিস্টধর্মের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি ও প্রভাবের মুখে তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে নি। স্টোয়িকবাদের সমর্থক বলে পরিচিত লোকদেরও তাদের মত পরিবর্তন করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে দেখা যায়।

মানব সভ্যতার বিকাশে স্টোয়িকবাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। তাত্ত্বিক মতাবলি ছাড়াও স্টোয়িকবাদের এমন একটি ব্যবহারিক দিক ছিল যা প্রচলিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। স্টোয়িকবাদ প্রাকৃতিক নিয়মাবলিকে প্রজ্ঞাসম্মত নিয়ম বলে আখ্যায়িত করে এবং এর ভিত্তিতেই সব মানুষের সমতা ও সমান অধিকারের সমর্থন করে। স্টোয়িকবাদে আত্মসংযম নম্রতা মিতাচার মহত্ত্ব প্রভৃতি রোমান চরিত্রের স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে। দাসত্বপ্রথা ও সামাজিক আমোদপ্রমোদের প্রতি স্টোয়িকদের উদার মনোভাব রোমান চরিত্রকে মানবতাবাদী করে তোলে। স্টোয়িকবাদে প্রজ্ঞার সার্বভৌমত্বের জোর সমর্থন দেখা যায়। স্টোয়িকদের মতে, প্রাজ্ঞিক শক্তি ও কর্তব্যনিষ্ঠাতেই মানুষ তার নিজ সত্তাকে খুঁজে পায়। পরবর্তীকালে কান্ট তাঁর নীতিবিদ্যায় এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন। বস্তুত, কান্টের নৈতিক ভাববাদে স্টোয়িকবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল।

অবশ্য স্টোয়িকবাদের যে কিছু খারাপ লক্ষণ ছিল না, তা নয়। বিশেষ করে, বিজ্ঞানের প্রতি তাঁদের বিতৃষ্ণা সর্বজনবিদিত। সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের বিরোধিতা, কৃচ্ছতার ওপর আত্যন্তিক গুরুত্ব আরোপ, এ সবই ছিল যথার্থ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের পথে অন্তরায়স্বরূপ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এপিকিউরীয় দর্শন যে স্টোয়িক দর্শনের চেয়ে বেশি অগ্রসর ও গ্রহণযোগ্য ছিল, একথা বলাই বাহুল্য। যেমন, এপিকিউরীয়গণ জগতের এক সুসংবদ্ধ প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তবে এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দর্শন ও সভ্যতার বিকাশে স্টোয়িকদের অবদান অস্বীকার করা চলে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, এপিক্‌টেটাসমার্কাস অরেলিয়াস যে দরদ ও নিষ্ঠার সাথে তাঁদের নৈতিক মত প্রচার করেছিলেন, তার নজির দর্শনের ইতিহাসে বড় একটা দেখা যায় না। তাঁরা যেসব অমূল্য গ্রন্থে তাঁদের জীবনদর্শন ব্যক্ত করেছেন, সেগুলো রোমানদের স্বভাবসুলভ নীতিনিষ্ঠা ও রোমান সভ্যতার প্রতীক হিসেবে চিরদিন উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদারস, ২০১৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.