Table of Contents
ভূমিকা
এরিস্টটলের মৃত্যুর পর গ্রিক দর্শনের পতন শুরু হয়। তেমনি মহাবীর আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে খণ্ডিত হয়ে যায়। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দার্শনিক এরিস্টটল ও মহাবীর আলেকজান্ডারের মৃত্যু ঘটে। একদা যে সাম্রাজ্য গ্রিসকে একতাবদ্ধ করেছিল, এশিয়া মাইনরে হেলেনিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং সর্বোপরি এক নতুন আলেকজান্দ্রীয় সভ্যতার সাহায্যে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলনের বার্তা বহন করে এনেছিল, তা-ই খণ্ডিত হয়ে গেল কতিপয় বিবদমান ক্ষুদ্র রাজ্যে। আর এসব রাজ্যের ক্রমবর্ধমান যুদ্ধবিগ্রহ ডেকে আনলো রোমের আধিপত্য। অনুরূপভাবে এরিস্টটল যে এক সমন্বয়ধর্মী অখণ্ড দর্শনের পত্তন করেছিলেন, তা-ও ক্রমেই স্তব্ধ হয়ে গেল, এবং এর স্থলে উদ্ভব হলো কতিপয় ক্ষুদ্র দার্শনিক সম্প্রদায়ের। কিন্তু এসব দার্শনিক সম্প্রদায়ও দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। খ্রিস্টীয় মতের ব্যাপক প্রসারের আগেই এগুলো তিরোহিত হয়ে যায়।
এরিস্টটল-উত্তর রাজনীতি ও দার্শনিক মতবাদসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ সাদৃশ্য ছিল। তাদের দুটিই ছিল বিশ্বজনীন ও মিশ্রস্বভাবের। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটে, বিভিন্ন চালচলন ও আচার-অনুষ্ঠানের, নৈতিক ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবধারার বিনিময় ঘটে। এ দুই মতের কোনোটিতেই কোনো মৌলিকতা ছিল না। প্লেটো–এরিস্টটলের মতো, কিংবা তাদের কাছাকাছি মানের কোনো মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন নতুন দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে নি। এ জন্য এরিস্টটল-উত্তর এসব ভাবধারাকে হেলেনীয় সুবর্ণ যুগের অবসান এবং রৌপ্যযুগের সূচনার প্রতীক বলে অভিহিত করা হয়। এর প্রায় দীর্ঘ তিনশ’ বছর পর আবির্ভূত হয়েছিলেন এরিস্টটল উত্তর প্রাচীন গ্রিক দর্শনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক প্লোটিনাস।
এরিস্টটল-উত্তর দার্শনিকদের বিশেষত্ব এখানে যে, তাঁরা জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞানচর্চার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন এমন এক দর্শনের, যা কিনা মানুষকে দেখাবে সফল জীবনযাত্রার পথ ও মুক্তির উপায়। গ্রিক দার্শনিক চিন্তার এই যে ওলটপালট, তার পেছনে বেশ কতকগুলো কারণ ছিল। একথা অস্বীকার করা চলে না যে, ধর্মতত্ত্ব ও নীতিবিদ্যা থেকে একদিকে যেমন উৎপন্ন হয় বিশ্বাস, অন্যদিকে তেমনি জাগে সংশয়। গ্রিক ধর্মতত্ত্ব ও নীতিবিদ্যায়ও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে নি। গ্রিক দর্শনের জন্মভূমি আইওনিয়া ও ম্যাগনাগ্রেসিয়া ছিল স্বাধীন চিন্তার অনুসারী। জেনোফ্যানিসের সময় থেকেই সেখানে অলিম্পীয় দেবদেবীদের স্বাধীন নিরপেক্ষ সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে এশিয়া মাইনর ও ইতালির নগরগুলোতে দার্শনিকগণ দেবদেবীর প্রতি অন্ধবিশ্বাস ও আনুগত্য প্রদর্শন না করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মনোভাবের পরিচয় দেন।
দেবদেবীদের ব্যাপারে সোফিস্ট সম্প্রদায় যে মনোভাব পোষণ করেন তাকে রীতিমত অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) বলা চলে। গতানুগতিক নৈতিকতার পক্ষে সোফিস্টদের ধর্মমত ছিল একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল ধর্মের প্রতি নির্বিচার মনোভাবের পরিচয় দেন নি। এথেনীয়দের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও তাঁরা দেবদেবীদের গুরুত্ব ও মহিমাকে অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা করেন নি। বরং তাঁরা যে যুক্তিসম্মত নৈতিক পুনর্গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সেটি প্রচলিত নৈতিক মানদণ্ডের প্রতি তাঁদের অনাস্থারই নির্দেশক বলে মনে হয়।
এরিস্টটলের পর গতানুগতিক আচার ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংশয়বাদের প্রসার ঘটে। এই সংশয়বাদ প্রথমে শিক্ষিত মহলে এবং পরে জনসাধারণের মধ্যে বিস্তারলাভ করে। উল্লেখ্য যে, দেবদেবীদের সম্পর্কে ইউডেমাস যে মতবাদ দিয়েছিলেন তা ছিল প্রচলিত ধর্মমতের পক্ষে এক চরম আঘাতস্বরূপ। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, কোনো দৈব সূত্র থেকে নয়, অতীতের বিস্মৃত রাজ-রাজড়া ও দিগ্বিজয়ীদের রোমাঞ্চকর কাহিনী থেকেই দেবদেবীদের ধারণার উদ্ভব। তারও বেশ আগে এথেনীয়গণ একবার মেসিডনিয়ার রাজা ডেমেটরিয়াস পলিওরসেটিকে গানের মাধ্যমে সংবধর্না দিয়েছিলেন। উক্ত সংবর্ধনায় তাঁকে একজন প্রকৃত দেবতা বলে বর্ণনা করা হয় এবং এ ও বলা হয় যে, মামুলি দেবতাদের ন্যায় তিনি কাঠ ও পাথর দ্বারা গঠিত নন, এবং তিনি অন্যদের ন্যায় মানবসমাজের বাইরে নয়, মানুষের মাঝেই বাস করেন।
তবে প্রাচীন বিশ্বাস ও কল্পনার প্রতি আস্থা ক্রমশ হ্রাস পেলেও তখনও মানুষের নৈতিক ও ধর্মীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। এসব আশা আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত হতে না পেরে নতুন নতুন দার্শনিক ভাবধারার সাথে মিশে যায় এবং নতুন পথ খুঁজে পায়। দার্শনিক ভাবধারার পরিবর্তনের সাথে যে জিনিসটি বিশেষভাবে জড়িত ছিল তা হলো এই যে, দার্শনিকগণ আবার তাঁদের রাজনৈতিক মর্যাদা ফিরে পেলেন। আমরা জানি, প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকদের প্রায় সবাই তাঁদের নিজ নিজ নগরসমূহের সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সক্রেটিস ও প্লেটো যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে দর্শনচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন, তা ছিল নিতান্তই প্রতিকূল। আর যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও এরিস্টটল স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে তাঁর রাষ্ট্রনীতি প্রচার করতেন। কিন্তু এরিস্টটল-উত্তর যুগে দর্শনকে ধর্মীয় ব্যাপারে প্রয়োগের চেষ্টা শুরু হয় এবং দার্শনিকদেরই তখন ধর্মীয় যাজকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। যেকোনো ব্যাপারে পরামর্শ, সান্ত্বনা বা উৎসাহের জন্য মানুষ তখন দার্শনিকের শরণাপন্ন হতো।
এভাবে দার্শনিকগণ তখন পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বলাভ করেন এবং দেশ ও সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রাক্-সক্রেটিস দর্শনে জর্জিয়াস এবং অন্যদের যেমন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করতে দেখা যায়, ঠিক তেমনি জেনোক্রেটিস ও ক্রেটিস প্রমুখকেও বিশেষ দূত হিসেবে মেসিডনিয়ার দরবারে এবং পরে একাডেমি ও লাইসিয়ামের প্রেসিডেন্টকে রোমে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়। রাজনৈতিক দৃশ্যপটে দার্শনিকদের পুনরাবির্ভাবের ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানারকম অবস্থাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। যেমন : মেসিডনিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসনের আওতায় এথেনীয় গণতান্ত্রিক সরকার একসময় তাদের অনুমোদন ব্যতীত কোনো দার্শনিক সম্প্রদায় গঠন নিষিদ্ধ করে দেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা পেরিপেটিটিদের নির্বাসিত করেছিলেন। অবশ্য তাদের এই ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। অবস্থার চাপে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে দার্শনিকদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।
প্লেটোর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা একাডেমি চালু রাখেন; কিন্তু প্লেটোর আমলের সেই সজীবতা তখন আর ছিল না। প্লেটোনিক সম্প্রদায়কে সচরাচর প্রাচীন একাডেমি, মধ্য একাডেমি ও নব-একাডেমি— এই তিনটি পৃথক সময়কালে বিভক্ত করা হয়। প্রথমটিকে বলা হয় প্রাচীন একাডেমি। এর স্থায়িত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৭ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দ পর্যন্ত। এ সময়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে। প্লেটোর মৃত্যুর পর একাডেমি পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন তাঁর ভাগ্নে স্পেউসিপ্পাস। এরিস্টটল প্রসঙ্গে আলোচনার সময় আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে, এ ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়েই এরিস্টটল একাডেমি ত্যাগ করে লাইসিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বুদ্ধির জগৎ ও ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যে প্লেটো যে ফাঁক রেখে গিয়েছিলেন স্পেউসিপ্পাস অনেকটা এরিস্টটলের মতোই তা পূরণ করার চেষ্টা করেন। প্লেটোর মতো তিনি ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে নিরর্থক বলে মনে করতেন না।
জেনোক্রেটিস (৩৯৬-৩১৪ খ্রি.পূ.)
স্পেউসিপ্পাসের পর একাডেমির অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন জেনোক্রেটিস। দার্শনিক মতের দিক থেকে তিনি ছিলেন স্পেউসিপ্পাসের চেয়ে অধিকতর ধর্মঘেঁষা ও পিথাগোরীয়পন্থী। তাঁর মতে, শুধু অধিবিদ্যক ও গাণিতিক দিক থেকেই নয়, নৈতিক দিক থেকেও একত্ব ও বহুত্ব পরস্পরবিরোধী, এবং তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে শুধু সংখ্যাই নয়, আত্মারও সৃষ্টি। নৈতিক মতের ক্ষেত্রে স্পেউসিগ্লাস ও জেনোক্রোটিস, উভয়েই এরিস্টটলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। স্পেউসিপ্লাস যদিও সুখের নৈতিক : মূল্য সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন এবং শুভের ব্যাপারে সুখের কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করতেন। না, তবু তিনি এরিস্টটলের ন্যায় মনে করতেন, প্রকৃতি আমাদের যেসব বৃত্তি ও শক্তিতে ভূষিত করেছে, তাদের পরিপূর্ণ ও সুসমঞ্জস কার্যকলাপের মধ্যেই সিগ্ধ আনন্দ নিহিত। শুধু তা-ই নয়, স্বাস্থ্য সম্পদ প্রভৃতি বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধার ওপরও আনন্দ নির্ভরশীল । এরিস্টটলের ন্যায় স্পেউসিপ্পাস এ-ও বিশ্বাস করতেন যে, মানবিক উৎকর্ষ বা পুণ্য সুখলাভের উপায় এবং সুখের এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। জেনোক্রেটিস স্পেউসিপ্পাসের এসব মত গ্রহণ করেন এবং এদের এক ধর্মতাত্ত্বিক অর্ফিক রূপপ্রদান করেন।
পন্টাস নগরের হেরাক্লেডিস এবং রোডেসের ইউডোসাস্ ছিলেন সে সময়ের অন্য দু’জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। হেরাক্লেডিস মূলত তাঁর পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক মতাবলির জন্যই বিখ্যাত। পিথাগোরীয়দের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তাঁর বুদ্ধি থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলিক অণুর সমবায়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর মতে, ঈথারীয় পদার্থ থেকেই জীবাত্মার সৃষ্টি। একাডেমীর সদস্য হয়েও ইউডোসাস্ প্লেটোর মতের বিরুদ্ধে সিরেনাইকদের সুখবাদের সমর্থন করেন। পলেমো, ক্রেটিস এবং ক্রান্টরের পর প্রাচীন একাডেমীর পরিসমাপ্তি ঘটে। নতুন নৈতিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়েও এঁরা মোটামুটিভাবে স্পেউসিপ্লাস ও জেনেক্রোটিস প্রচারিত নৈতিক মতের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।
মধ্য একাডেমীর বিশেষত্ব নিহিত ছিল এর সংশয়বাদী মনোভাবে। এর বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন আর্সেলিয়াস ও কার্নিয়াডিস। এঁদের উভয়েই মনে করতেন যে, অনপক্ষে সত্য বলে কোনো সত্য নেই। এজন্যই তাঁরা সম্ভাবনার মানদণ্ড দ্বারা পরিচালিত ছিলেন। নব-একাডেমী আর্সেলিয়াস ও কার্নিয়াডিস প্রচারিত সংশয়বাদ পরিহার করে এবং প্লেটোর মূল মতবাদের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে। নব-একাডেমীর দার্শনিকদের মধ্যে ফিলো ও এন্টিওকাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এঁরা প্লেটোবাদের সাথে স্টোয়িক উপকরণের সংযোগসাধন করেন। এঁদের উভয়েরই উদ্দেশ্য ছিল আপাতবিরোধী মতাবলির সমন্বয়ের মাধ্যমে একথা প্রমাণ করা যে, আসলে বড় বড় দার্শনিকগণ অনেক বিষয়েই একমত ছিলেন।
থিওফ্রেস্টাস (৩৩১-২৮৭ খ্রি.পূ.)
এরিস্টটলের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের পতন সূচিত হয়। এ সময়ে লাইসিয়ামে যে কয়েকজন দার্শনিক প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে থিওফ্রেস্টাস, অন্যতম। এরিস্টটলের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই থিওফ্রেস্টাস লাইসিয়ামের প্রধান নিযুক্ত হন এবং পঁয়ত্রিশ বছরের অধিককাল পর্যন্ত উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি যুক্তিবিদ্যা অধিবিদ্যা পদার্থবিদ্যা প্রাকৃতিক ইতিহাস উদ্ভিদবিদ্যা প্রাণিবিদ্যা মনোবিদ্যা নীতিবিদ্যা রাষ্ট্রনীতি অলঙ্কারশাস্ত্র ললিতকলা এবং সংগীত বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সমসাময়িক অপর এক পেরিপেটেটিক দার্শনিক ইউডেমাসকে নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম সহানুমানকে প্রাকল্পিক (hypothetical) ও বৈকল্পিক (disjunctive)—এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এরিস্টটলীয় দর্শনের কয়েকটি দিকের তিনি যে সমীক্ষা ও পর্যালোচনা করেছেন, তা থেকেই চিন্তাবিদ ও সমালোচক হিসেবে তাঁর দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর উদ্ভিদবিদ্যাবিষয়ক গ্রন্থাবলিকে অনেকেই পদ্ধতি ও পরিসরের দিক থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের রচনা ও গবেষণার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট বলে মনে করেন। অবশ্য শেষের দিকে তিনি যেসব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে এরিস্টটলের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দর্শনের বাইরে নতুন কিছু পাওয়া যায় না।
এ কথাও ঠিক যে, থিওফ্রেস্টাস এরিস্টটলের যে সমালোচনা করেন তাতে জীবনের প্রতি মানুষের প্রাচীন মনোভাবের এক বিশেষ পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন, প্রকৃতির ঘটনাবলিতে নিয়মানুবর্তিতা ও উদ্দেশ্যের সংকেত রয়েছে বলে এরিস্টটল যে মত পোষণ করেন, থিওফ্রেস্টাস সে মত সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। তাছাড়া তিনি এরিস্টটলের চেয়েও জোরের সাথে আত্মাকে দেহের ওপর নির্ভরশীল বলে ঘোষণা করেন। এ সবই তাঁর প্রকৃতিবাদী মনোভাবের পরিচায়ক। নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রেও তিনি বাহ্য পরিস্থিতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। অবশ্য বাহ্য পরিস্থিতিকে তিনি আনন্দের আবশ্যিক উপকরণ বলে মনে করেন নি, বরং এদের তিনি সুখশান্তির পক্ষে উপদ্রব এবং উন্নত জীবনের পক্ষে প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন।
স্ট্র্যাটো (৩৩৫-২৬৯ খ্রি.পূ.)
লাইসিয়ামের পরবর্তী প্রধান ছিলেন ল্যাম্পসেকাসের স্ট্র্যাটো। থিওফ্রেস্টাসের ন্যায় তিনিও বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। তবে দক্ষতার দিক থেকে তিনি থিওফ্রেস্টাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এরিস্টটলের চিন্তায় যে প্রকৃতিবাদী মনোভাব প্রচ্ছন্ন ছিল, থ্রিওফ্রেস্টাসে তা কিছুটা প্রকাশ পায়, এবং স্ট্র্যাটোর চিন্তায় তা পরিপূর্ণ অভিব্যক্তিলাভ করে। এখানে এরিস্টটলের আদি চালকের স্থলে প্রকৃতিকে দাঁড় করানো হয়। অনেকটা ডেমোক্রিটাসের সুরে সুর মিলিয়ে স্ট্র্যাটো প্রকৃতিকে প্রয়োজনচালিত যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। অবশ্য ডেমোক্রিটাস যেমন পরমাণুর কথা বলেছিলেন, স্ট্র্যাটো তা বলেন নি। তিনি বরং উত্তাপ ও শৈত্যকে পদার্থের মৌল উপাদান বলে প্রচার করেন। এছাড়া সংবেদনশীল ও প্রাজ্ঞিক আত্মার মধ্যে এরিস্টটল যে পার্থক্য করেছিলেন, স্ট্র্যাটো তা অস্বীকার করেন। ‘ফিডো’ গ্রন্থে বর্ণিত প্লেটোর মতের তিনি যে সমালোচনা করেন, তা থেকে আত্মার অমরত্বে তাঁর বিশ্বাস ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁর মতে, আত্মা একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শক্তি; আর এই শক্তির অধিষ্ঠান দেহ। দেহকে বাদ দিয়ে আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
স্ট্র্যাটোর পর লাইসিয়ামের দ্রুত অবনতি ঘটে। এরিস্টটলের যেসব অনুসারী তখন লাইসিয়ামে দর্শনচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন, মৌলিক বা স্বাধীন চিন্তা বলতে তাদের কিছুই ছিল না। সুতরাং সময়ের অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তাঁরা ব্যর্থ হন। দার্শনিক জ্ঞানানুশীলন ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে তখন লাইসিয়াম তার অতীত মর্যাদা হারিয়ে শুধু অতীতের সঞ্চিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে টিকে থাকে।
তথ্যসুত্র
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, ১ম খণ্ড : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪
Leave a Reply