পাশ্চাত্য দর্শন-সার : প্রাচীন যুগ

Table of Contents

মিলেটিক স্কুল

থেলিস (খ্রি.পূ. ৬২৪-৫৪৬ অব্দ, মতান্তরে ৬৪০-৫৫০, ৬২৪-৫৪৭)

  • জীবনের সাথে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জল আছে ও জলের অভাবের সাথে প্রাণহীনতার সম্পর্ক আছে, তাই পরমসত্তা হল জল, জল থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, জলের মধ্যেই সব কিছু বিলীন হয়ে যায়।

অ্যানাক্সিমেন্ডার (খ্রি.পূ. ৬১১–৫৫৭ অব্দ)

  • অগ্নি, বায়ু, জল, মাটি এগুলো স্থুল বস্তু। এগুলোর যেকোন একটিকে পরমসত্তা বলা যায়না। (থেলিসের বিপরীতে)
  • জল বা আর্দ্রতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার বিপরীত সত্তা শুষ্কতাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিতে এই দুই বিপরীত সত্তার দ্বন্দ্ব কাজ করে, একটিকে আরেকটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া যায়না, তাই একটিকে পরম সত্তা বলা যায়না।
  • পরমসত্তা এমন এক সূক্ষ্মবস্তু যা থেকে এই স্থুলবস্তুগুলোর উদ্ভব ঘটেছে। এই আদিসত্তা হলো সীমাহীন, অনন্ত, অসীম, অবর্ণনীয় বস্তু যার থেকে সব কিছুর জন্ম হয়, ও সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। এটি আকারহীন, অনির্দিষ্ট ও সকল প্রকার বৈশিষ্ট্যবর্জিত, মানে এতে কোনরকম বৈশিষ্ট্য বা গুণ নেই। এর নাম ধরা হলো সীমাহীন বা বাউন্ডলেস।
  • সীমাহীন থেকে বিপরীত গুণগুলো যেমন পৃথক সত্তা লাভ করে, তেমনি সেই সব পৃথক বস্তু উপাদানগুলো আবার সীমাহীনে মিলিয়ে যায়।
  • সীমাহীন, স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ নিজে নিজের সৃষ্টি করেছে বা আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে, কোন কিছু থেকে আসেনি।
  • বাউন্ডলেসের বিনাশ নেই, এর গতি বা পরিবর্তন অনন্ত। গতির কারণেই সীমাহীন থেকে বিশেষ বিশেষ বস্তুর পৃথকীকরণ সম্ভব হয়। জগৎ গঠিত হবার মূলে রয়েছে একটি বিষয়ের বিপরীত বা বিরুদ্ধ বিষয়ে বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন হবার প্রক্রিয়া।
  • অবিশেষ, অনির্দিষ্ট, আকারহীন প্রাথমিক উপাদান গতির কারণে কোন এক অনিশ্চিত প্রক্রিয়ায় নিজেকে উষ্ণ ও শীতল এই দুইয়ে বিভক্ত করে, এরপর শীতল পরিণত হয় আর্দ্র ও সেঁতসেঁতে। এই আর্দ্র জড় উপাদান বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থিত পৃথিবীর রূপ গ্রহণ করে। উষ্ণ জড় উপাদান পৃথিবী বেষ্টনকারী অগ্নিমণ্ডলে পরিণত হয়। তরল পৃথিবী চারপাশের উত্তাপে পৃথিবীর জল ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসের আবরণ সৃষ্টি করে পৃথিবীকে বেষ্টন করে। উত্তাপের প্রভাবে সেই বাষ্প বিস্তৃতি লাভ করে অগ্নিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ও অসংখ্য চক্রাকৃতির খোসা রূপ গ্রহণ করে পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হতে থাকে ও সূর্য, চন্দ্র, তারকা ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্রে পরিণত হয়।
  • পৃথিবীতে সুনির্দিষ্ট পরিমাণে থাকা আগুন, জল ও মাটি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার অবিরাম প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার জন্য এক ধরণের অনিবার্য ও প্রাকৃতিক নিয়ম থাকায় যেখানে আগুন থাকে, সেখানে ভস্মও থাকে, যে ভস্ম হল পৃথিবী। ভারসাম্য বজায় রাখা ন্যায় বা জাস্টিস। অন্যদিকে একটি উপাদানের উপর অন্য উপাদানের অবৈধভাবে পদার্পন হলো অন্যায় (Injustice)। গ্রীষ্মকালে উষ্ণ উপাদান ও শীতকালে শীতল উপাদানের ইনজাস্টিস দেখা যায়। বাউন্ডলেসের মধ্যে মিশে গিয়ে এই বিশেষ উপাদানগুলোর ইনজাস্টিসের ক্ষতিপূরণ হয়।

অ্যানাক্সিমিনিস (খ্রি.পূ. ৫৮৮-৫২৪ অব্দ)

  • বিমূর্ত ও অবিশেষ কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আদিম তত্ত্ব তাই বিমূর্ত ও অবিশেষ হতে পারেনা, একে মূর্ত ও বস্তুজগতের বিষয় হতে হবে। (অ্যানাক্সিমেন্ডারের বিপরীতে)
  • অ্যানাক্সিমেন্ডার যেমন বলেছেন তেমনিভাবে আবার আদিম তত্ত্বকে সীমাহীন হতে হবে ও তার গতি নিরবিচ্ছিন্ন হতে হবে। গতিশীল ক্ষমতা বায়ুর অন্তর্নিহিত ক্ষমতা। তাই গতির দ্বারাই তার মতে বায়ু থেকে জগতের উৎপত্তি হয়েছে।
  • মানুষ বায়ু বা শ্বাস ছাড়া বাঁচেনা, বায়ু তাই আমাদের আত্মা হিসেবে আমাদের ধরে রাখে। একইভাবে বায়ু পৃথিবীর শ্বাস হিসেবে কাজ করে পৃথিবীকে ধরে রাখে। জগৎ জগতের বাইরের সীমাহীন পুঞ্জ বা বাউন্ডলেস মাস থেকে শ্বাস বা বায়ু গ্রহণ করছে। তাই এটি মূল উপাদান।
  • সব মিলিয়ে কেবল বায়ু এই ক্রাইটেরিয়াগুলো পুরণ করতে পারে, তাই আদিমতত্ত্ব বায়ু।
  • বায়ু থেকেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব বস্তুর উদ্ভব হয়েছে। অন্যান্য সব কিছু বায়ু থেকে তৈরি বস্তু থেকেই উৎপন্ন।
  • ঘনীভবন (condensation) ও সংকোচন (Rarefaction) এই দুটি প্রক্রিয়ায় বায়ু থেকে জগতের উদ্ভব হয়। প্রথমটি উষ্ণ হওয়া ও দ্বিতীয়টি শীতল হওয়া নির্দেশ করে। বায়ু সংকোচন হলে অগ্নির সৃষ্টি হয়, আগুন হল হালকা বায়ু। আবার বায়ু ঘনীভূত হলে প্রথমে জল, পরে মাটি ও আরও ঘনীভূত হলে পাথরে পরিণত হয়।
  • যথাসময়ে জগৎ তার আদিম উপাদান বায়ুতে প্রত্যাবর্তন করবে।
  • জগৎগুলো ধারাবাহিক, এক জগতের শেষের পর আরেক জগতের উৎপত্তি হবে, আর এভাবে জগতের সংখ্যা হবে অনন্ত ও অসীম। তবে তিনি ধারাবাহিক না হয়ে সমকালীন একাধিক জগৎ বোঝাতে পারেন।
  • অ্যানাক্সিমিনিস মনে করতেন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার শুরুতেই পৃথিবীর উৎপত্তি হয়, আর এটি একটি সমতল গোলাকার থালার মত, যা বাতাসের উপর ভাসমান। গ্রহ নক্ষত্রগুলোও বাতাসের উপরেই ভাসছে। সমতল পৃথিবীকে বায়ুই উপরে ধরে রেখেছে। এর থেকে উত্থিত বাষ্প সংকুচিত হয়ে আগুনে পরিণত হয়, যার অংশবিশেষ বাতাসের চাপে তারায় পরিণত হয়। এগুলোর আকার পৃথিবীর আকারের মত আর বাতাসের উপর ভেসে ভেসে পৃথিবীকে আবর্তিত হয়ে আছে।

পিথাগোরাস (খ্রি.পূ. ৫৬২ – ৪৯৩ অব্দ) পিথাগোরিয়ান স্কুল

  • অনুপাত, শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যকে ভিত্তি করে এই বিশ্বজগৎ দাঁড়িয়ে আছে যার মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে, যেগুলোকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। সংখ্যা ছাড়া প্রকৃতির শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যা করা যায় না। নির্ধারিত মাত্রা বা পরিমাণ কম-বেশী হলে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হতাে। জগতের এই মাত্রা বা পরিমাণ সংখ্যা দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়। তাই সংখ্যাই বস্তু। (মিলেটিক স্কুলের বিপরীতে)
  • সংখ্যাহীন জগতের কথা আমরা কখনও ভাবতে পারি না। তাই সংখ্যাই হল জগতের মূল উপাদান।
  • পিথাগোরীয় দর্শনে অদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদের পরষ্পরবিরোধিতা দেখা যায় –
  • অদ্বৈতবাদী পিথাগোরিয়ানিজম : এক্ষেত্রে সব কিছু সংখ্যা থেকেই উদ্ভুত
    • সংখ্যার উপাদান হল যুগ্ম বা জোড় ও অযুগ্ম বা বিজোড়। এদের মধ্যে জোড় হচ্ছে অসীম, আর বিজোড় হচ্ছে সসীম। এর মধ্যে ১ সংখ্যাটি অসীম ও সসীম উভয় থেকেই উদ্ভূত কারণ এটি জোড় ও বিজোড় উভয়ই। এই ১ সংখ্যা থেকেই সব সংখ্যা ও সমগ্র বিশ্বজগতের উদ্ভব।
    • সঙ্গীতের মধ্যকার সঙ্গতিকে গাণিতিক সূত্র দিয়ে প্রকাশ করা যায়, কারণ বাদ্যযন্ত্রে বিভিন্ন সুর বাজানোর সময় সুরগুলোর পার্থক্য নির্দিষ্ট সময়ে কম্পন সংখ্যা বা কম্পাঙ্কের পার্থক্য। সঙ্গীতে যেবিরাম বা মিউজিকাল ইন্টারভালের ব্যাপারটিও সংখ্যাগত অনুপাতের উপরে নির্ভর করে। এভাবে নির্দিষ্ট গাণিতিক অনুপাতের দ্বারা মিউজিকাল হারমোনি বা সঙ্গীতের সঙ্গতি নির্ধারিত হয়। এই বিশ্বজগতের সঙ্গতিই একধরণের সঙ্গীতের সঙ্গতি, তাই সঙ্গীতের সঙ্গতির মত বিশ্বজগতের সঙ্গতিকেও সংখ্যার সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। তাই জগতের মূলতত্ত্ব হল সংখ্যা, সংখ্যার থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি।
    • ১ হল বিন্দু, ২ হল রেখা, ৩ হল তল বা সারফেস, ৪ হল ঘন। তাই যখন বলা হয় সব কিছুই সংখ্যা, তখন এর অর্থ হচ্ছে সব বস্তুই স্থানে অবস্থিত বিন্দু বা এককের (units) দ্বারা গঠিত, যেগুলোকে সংযুক্ত করলে একটি সংখ্যা গঠিত হয়। এই বিন্দু, রেখা, তল ও ঘন নির্দেশক চারটি সংখ্যার যোগফল (১+২+৩+৪) বা ১০ সংখ্যাটি পবিত্র। নিচ থেকে উপরে এগুলোকে বিন্যাস করে, অর্থাৎ নিচে ৪টি বিন্দু, তার উপর ৩টি, তার উপর ২টি ও তার উপর ১টি বিন্দুকে সাহিয়ে যে পিরামিডের আকার তৈরি হয় তাও পবিত্র। এভাবে সংখ্যা জ্যামিতির সাথে সম্পর্কিত। আর জ্যামিতির সাথে জড়ের গঠনের সম্পর্ক রয়েছে। এভাবে সংখ্যার ধারণা প্রয়োগ করে জড় সত্তার বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। কয়েকটি বিন্দুকে পাশাপাশি রাখলে রেখা, কয়েকটি রেখাকে পাশাপাশি রাখলে তল, কয়েকটি তলকে পাশাপাশি রাখলে একটি বস্তুর সৃষ্টি হয়। তাই বিন্দু, রেখা, তল এসব বাস্তব একক, কাল্পনিক নয়, যার দ্বারা সব প্রাকৃতিক বস্তু গঠিত। এভাবে সব বস্তু হল সংখ্যা। তিনটি মৌলিক উপাদান বিন্দু, রেখা ও তল থেকে চতুর্থ পদ রূপে প্রতিটি জড়ের উদ্ভব বলে প্রতিটি জড় এই ৪ সংখ্যাটির প্রকাশ।
  • দ্বৈতবাদী পিথাগোরিয়ানিজম : এক্ষেত্রে সংখ্যা ছাড়াও জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়
    • সংখ্যা অ্যানাক্সিমেন্ডারের সীমাহীনে সীমা আরোপ করে তাকে আকার বা রূপ বা ফর্ম দান করে। সঙ্গীতে যেমন সংখ্যার অনুপাত বা নিয়ম আওয়াজকে রূপদানের মাধ্যমে সঙ্গীতের সৃষ্টি করে, তেমনি সংখ্যার অনুপাত বা নিয়ম সীমাহীনকে রূপদান করে বিশ্বজগতের সঙ্গতি তৈরি করে, তাই সংখ্যা সীমা বা লিমিট হিসেবে কাজ করে।
    • বস্তুগুলো হল সংখ্যা। সংখ্যা থেকে সব কিছু তৈরি হয়েছে। এই সংখ্যা জড় বস্তু নয়, এটা অতীন্দ্রীয় বা সুপারসেন্সুয়াল। সংখ্যা থেলিসের জল, অ্যানাক্সিমেন্ডারের সীমাহীন ও অ্যানাক্সিমিনিসের বায়ু সহ যেকোন রকমের জড় থেকে আলাদা। কিন্তু এটি জড়কে সীমিত করে তাকে রূপ বা আকার প্রদান করে। তাই এক্ষেত্রে পিথাগোরীয়রা সংখ্যাকে মূল উপাদান বললেও জড় যে পূর্ব থেকেই আছে তাকেও স্বীকার করে নেয়।

এলিয়াটিক স্কুল

জেনােফ্যানিস (আনু. ৫৭০-৪৭৮ খ্রিঃপূঃ)

  • সকল কিছুর ঐক্য রয়েছে, সবকিছু এক, এই এক হলো ঈশ্বর।
  • ঈশ্বর জগতের অতিবর্তী নন, জগতের সঙ্গে আঙ্গিক সম্পর্কে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ঈশ্বর জগতবহির্ভূত সত্তারূপে জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করেননা, অর্থাৎ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ মিথ্যা, ঈশ্বর ও জগত অভিন্ন, জগৎ ঈশ্বরেরই প্রকাশ। সবকিছুই ‘এক’ (all is one)’ এবং ‘এক’ ছাড়া অন্য কোন কিছুর বাস্তবতা নেই, সমগ্র জগৎ-সংসার এক ঈশ্বরেরই প্রকাশ। এটি সর্বেশ্বরবাদ
  • ঈশ্বর এক ও অপরিণামী নিত্যসত্তা, অর্থাৎ ঈশ্বরের কোন গতি বা পরিবর্তন নেই। তিনি নিশ্চল, এক জায়গায় অবস্থান করেন। গতি ঈশ্বরের একত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাই ঈশ্বর অনড়। তবে সমগ্র হিসেবে গতিহীন হলেও তার অংশগুলােতে গতি ও পরিবর্তন রয়েছে। ঈশ্বর অপরিণামী ও অপরিবর্তনশীল বলে এর থেকে কোন কিছু উৎপন্ন হয়না, ঈশ্বর কোন কিছু সৃষ্টি করেননা, বরং যা কিছু দেখা যায় সবই ঈশ্বরেরই প্রকাশ।
  • ঈশ্বর অনন্ত, তার শুরু বা শেষ নেই। তার পাশে কিছুই নেই। এদিক থেকে তিনি অসীম। আবার তিনি পূর্ণ ও নিখুঁত আকারবিশেষ, তাই তিনি সসীম, নিরাকার অসীম নন।
  • একক সত্তা হিসেবে ঈশ্বর অনাদি ও অবিনশ্বর, তার উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। একক হলাে এমন সত্তা যা অদ্বিতীয়। তাই অন্য কোন সত্তা তার সমসাময়িক থাকা সম্ভব নয়। তাই অন্য কোন সত্তা দ্বারা একক ঈশ্বরের সৃষ্টি হওয়ার সুযােগ নেই। আবার ঈশ্বরের মধ্যে যা আছে তা দিয়ে ঈশ্বর সৃষ্টি হয় — এমন ধারণা হাস্যকর। তাই ঈশ্বর অনাদি। তার ধ্বংস কল্পনা করা চলে না। কেননা ধ্বংস করার মতাে তার থেকে কোন উচ্চতর সত্তা নেই।
  • জগৎ হলাে ইন্দ্রিয়হীন এক সচেতন সত্তা ঈশ্বর। তবে ইন্দ্রীয় না থাকলেও তিনি সবকিছু দেখেন, সমগ্রকে অনুভব করেন, সবকিছু শােনেন।
  • আত্মা, পরকাল, পাপ-পুণ্য ইত্যাদির অস্তিত্ব আছে। ঈশ্বরভক্তি স্বীকার্য। জগতের ঐক্য, এবং ঈশ্বর ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্যতার ধারণার ওপর তার ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত।
  • ঈশ্বরের ইচ্ছায় এগুলো সহ জগতের সবকিছু হয়। তিনি কেবল ইচ্ছা করলেই সবকিছু হয়ে যায়। তার তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য স্থাপনে এটি বলা যায়, ঈশ্বরের ইচ্ছা তার চৈতন্যের অংশ, যার ফলে তিনি নিজে অপরিণামী ও অপরিবর্তনীয় হলেও তার অংশ হিসেবে জগতে পরিবর্তন হচ্ছে আর তার মাধ্যমেই জগতের বিভিন্ন বিষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে, যার মধ্যে প্রাণীজগৎ রয়েছে।
  • পাথরে সামুদ্রিক দ্রব্যের নমুনা থেকে অনুমান করা যায়, মানুষসহ সকল প্রাণী মাটি ও জল থেকে উদ্ভূত। জগতের প্রাথমিক পর্যায় সমুদ্র, সমুদ্রাবস্থা থেকে ক্রমশ বিশ্ব এই অবস্থা ধারণ করেছে। অতীতের কোনাে একসময় পৃথিবী সমুদ্রের সাথে যুক্ত ছিল। কালক্রমে তা পৃথক হয়ে যায়। ভবিষ্যতের কোনাে একসময় জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে ও পৃথিবী পুনরায় সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে কাদায় পরিণত হবে। কিন্তু আবারও সমুদ্র থেকে জগৎ জেগে উঠবে। সৃষ্টি হবে মানুষসহ সকল প্রকার জীব-জন্তু-উদ্ভিদ। আবার নতুন করে মনুষ্যজাতির সৃষ্টি হবে।
  • সূর্য একটি জ্বলন্ত বাষ্পকুন্ডলী, বিভিন্ন আগ্নেয় কণিকার সমবায়ে রােজ রােজ সূর্য গঠিত হচ্ছে। এটা সরল রেখায় চলে। সারাদিন চলতে চলতে এটা সন্ধ্যাবেলা বায়ুতে মিশে নিঃশেষ হয়ে যায়, অর্থাৎ বায়ু হয়ে যায়। পরের দিন আবার একটি নতুন সূর্য ওঠে। এভাবে সূর্যের সৃষ্টি ও বিনাস প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অর্থাৎ একই সূর্য প্রতিদিনই প্রাতঃকালে উদিত হয় না। সমুদ্রের বাষ্প থেকে নিত্যই একটি করে নতুন সূর্য তৈরি হয়। অর্থাৎ সূর্য, নক্ষত্র প্রভৃতি ঐশ্বরিক বস্তু নয়, বরং নশ্বর বস্তু ও ক্ষণস্থায়ী। উত্তপ্ত মেঘ থেকে নক্ষত্রপুঞ্জের উৎপত্তি। দিনের বেলায় এরা নিভে যায় এবং রাতের বেলায় পুনরায় প্রজ্বলিত হয়। তাদের উদয় ও অস্ত বলতে এভাবে প্রজ্বলিত ও নির্বাপিত হওয়াকে বোঝায়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সূর্য রয়েছে।

পারমিনাইডিস (৫১৪-? খ্রিঃপূঃ)

  • জগতের সব কিছু ক্ষণস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল বলে কোন কিছু সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায়না। কেবল স্থায়ী বিষয়ের যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায়।
  • যে বিষয়টি চিন্তা করা যায় বা জ্ঞান লাভ করা যায়, তার অস্তিত্ব আছে বলেই তা চিন্তা করা সম্ভব হচ্ছে। একমাত্র অস্তিত্বশীল কোন কিছুই তা নিয়ে চিন্তা করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ কেবলমাত্র অস্তিত্বশীল কিছু সম্পর্কেই আত্মায় জ্ঞানের উন্মেষ ঘটতে পারে। যা অস্তিত্বশীল নয়, অর্থাৎ শূন্যতা সেই বিষয়ে কোন চিন্তার উদ্ভব বা জ্ঞানের উন্মেষ সম্ভব নয়। তা আমরা যা নিয়েই চিন্তা করি বা করতে পারি তাই অস্তিত্বশীল। এক্ষেত্রে চিন্তনকে সংগতিপূর্ণ হতে হবে, স্ববিরোধীদোষে দুষ্ট চিন্তন চিন্তন নয়।
  • যা চিন্তা করা যায় তাই সত্তা, অর্থাৎ কেবলমাত্র সত্তারই যথার্থ অস্তিত্ব আছে, অর্থাৎ সত্তাই (Being) একমাত্র তত্ত্ব। সত্তা হল এক, সত্তা অস্তিত্বশীল। সত্তার প্রকৃতি যাই হােক না কেন, সত্তা আছে, সত্তা অস্তিত্বশীল, এর পক্ষে অস্তিত্বশীল না হওয়া অসম্ভব, কেননা এটি নিয়ে চিন্তা করা যায়। সত্তার সম্পর্কে প্রথম কথাই হল ‘এটি আছে’ (It is)। এখানে সত্তা সব অস্তিত্বশীল কিছুর সার্বিক নয়, বরং এটাই একমাত্র অস্তিত্বশীল বিষয়, যা কিছু আছে সবই সত্তার প্রকাশ। অস্তিত্বই সত্তার একমাত্র ভাববাচক বৈশিষ্ট্য, তাই সত্তা নির্গুণ। সত্তা ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই বলে সত্তা অনির্ভরশীল।
  • অ-সত্তা সত্তার বিপরীত, অস্তিত্বশীল কোন কিছুর অর্থই যদি সত্তা হয়, তাহলে অ-সত্তা মানে হলো শূন্যতা, যার কোন অস্তিত্ব নেই বা ‘কোন কিছু নয়’। সত্তার পরিণাম বা পরিবর্তন নেই। এটির জ্ঞান লাভ করা যায়না। তাই পরিবর্তন বলতে কিছু থাকতে পারেনা, তা অলীক বা মিথ্যা। যেহেতু চিন্তা করা যায় এমন বস্তু মাত্রই অস্তিত্বশীল তাই ধরে নিতে হবে যে পরিণাম বা পরিবর্তনশীলতা নিয়ে আমরা যে চিন্তা করি সেই চিন্তাটাই আসলে ভুল চিন্তা। পরিণাম নেই বলে সত্তা স্থির বা অচল। সচল হলে শূন্য দেশে সত্তাকে চলাচল করতে হতো, কিন্তু শূন্য দেশ নিজেই অ-সত্তা।
  • আমরা জগতের যে পরিবর্তন দেখি তা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য। কিন্তু পরিবর্তন অ-সত্তা, তাই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য বিষয়মাত্রই অ-সত্তা। অর্থাৎ আমরা যা দেখি তা আসলে অস্তিত্বহীন, অবভাস। কেবলমাত্র সত্তা, যা এক, অবিভাজ্য, অপরিণামী, তাই অস্তিত্বশীল। বিচারবুদ্ধির সাহায্যে সত্তাকে জানতে হয়। ইন্দ্রিয় ও বিচারবুদ্ধির পার্থক্য আছে। ইন্দ্রিয় মিথ্যা, অলীকতা, অবভাসের উৎস। সত্যতা কেবল বিচারবুদ্ধিতে। (জেনোফ্যানিসের বিপরীতে)
  • মানুষের বিচারবুদ্ধির সত্তাকে জানার ক্ষমতা আছে। মানুষ বিচারবুদ্ধির সাহায্যে, যে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা করতে পারে তাই অস্তিত্বশীল হয়।
  • উৎপত্তি বা বিনাশ হলো একরকম পরিণাম, সত্তার সেগুলোও নেই। সত্তার উৎপত্তি আছে – বক্তব্যের অর্থ সত্তা হয় সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বা অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। সত্তা যদি সত্তা থেকে উৎপন্ন হয় তাহলে সত্তা উৎপন্ন হয়েছে একথা বলা যাবে না, কেননা সেক্ষেত্রে সত্তা পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল, আর যা অস্তিত্বশীল তাই সত্তা। আর সত্তা অসত্তা থেকে উদ্ভূত হলে অ-সত্তাকে অস্তিত্বশীল কিছু বলে স্বীকার করে নিতে হয়, যা হতে পারেনা। অর্থাৎ অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বের সৃষ্টি হতে পারেনা, তাই সত্তা সবসময়ই অস্তিত্বশীল, অর্থাৎ সত্তা নিত্য।
  • সত্তা অপরিণামী বলে সত্তার সম্পর্কে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা বলা চলে না। এ হল এক অনাদি কালহীন বর্তমান (Eternal Timeless Present)।
  • সত্তা হল পরিপূর্ণ অখণ্ড সত্তা, এটি এক ও অবিভাজ্য। অবিভাজ্য বলে সত্তা নিরবচ্ছিন্ন।
  • সত্তার আদি অন্ত নেই বলে সত্তাকে অসীম ধরা যায়, কিন্তু দৈশিক দিক দিয়ে সত্তা সসীম, অর্থাৎ সব দিক দিয়েই সত্তা সমানভাবে অস্তিত্বশীল। সত্তা অসীম হলে তা নির্বিশেষ বা অনির্দিষ্ট হতো, কিন্তু সত্তা বাস্তব বলে নির্বিশেষ বা অনির্দিষ্ট হতে পারেনা। সত্তা সুনির্দিষ্ট, সবিশেষ ও পরিপূর্ণ। আর দৈশিক দিক দিয়ে সত্তা সমানভাবে অস্তিত্বশীল হওয়ায় সত্তা আকারের দিক দিয়ে গোলকাকার, যা কেন্দ্র থেকে সকল দিকে সমানভাবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত, কোন স্থানে কম-বেশি হতে পারেনা।

জেনো (৪৯৫-৪৩০ খ্রি.পূ.)

  • চিন্তাযোগ্য বিষয়ই অস্তিত্বশীল, এবং তা-ই সত্তা। কিন্তু চিন্তন কোন দোষে দুষ্ট হলে সেই চিন্তন অস্তিত্বশীল নয়। একক, অবিভাজ্য, ও অচল সত্তার অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বহুত্ব, শূন্য দেশ ও গতির অলীকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যেখানে বহুত্ব ঐক্য ও অবিভাজ্যতা-বিরোধী, শূন্য দেশ ও গতি অচলতা বিরোধী। (পারমিনাইডিস প্রভাবিত)
  • সত্তা এক ও অবিভাজ্য। সত্তা অনেক ও বিভাজ্য হলে সত্তাকে বহু বা বহুত্ব-চিন্তনের যোগ্য ধরতে হয়। কিন্তু এই বহুত্ব আসলে অলীক বা অসত্তা, কেননা বহুত্বের চিন্তন স্ববিরোধী দোষে দুষ্ট। কোন বহু অনেক একক দ্বারা গঠিত হবে। যদি ধরে নেই এককগুলোর একটি নির্দিষ্ট বিস্তার আছে তাহলে সেই বহু একক দ্বারা অন্তহীনভাবে বিভাজ্য হওয়ায় ও প্রতিটি এককের একটি বিস্তৃতি থাকায় সেই বহুর বিস্তার অসীম হবে, যা কখনও হতে পারেনা। আবার যদি বহুকে গঠন করা একককে বিস্তৃতিহীন ধরি তাহলে সেই এককের দ্বারা গঠিত বহুও বিস্তৃতিহীন হবে, তাহলে সেই বহু হবে অসীমতক ক্ষুদ্র, যা কখনও হতে পারেনা। তাই বহুত্বের চিন্তন স্ববিরোধী দোষে দুষ্ট হওয়ায় বহুত্ব অলীক। তাই সত্তা অবশ্যই এক ও অবিভাজ্য। বহুকে সবসময় গণনা করা যায় তাই তা অস্তিত্বশীল, গণনা করা যায়না এমন অনির্দিষ্ট কোন কিছু অস্তিত্বশীল হতে পারেনা, তাই বহু সসীম। আবার কোন বহু অন্তহীনভাবে বিভাজ্য হতে পারে তাই বহু অসীম। কিন্তু অসীম ও সসীম বিপরীতার্থক বলে একই সাথে একটি বিষয়ে সসীমত্ব ও অসীমত্বকে আরোপ করা যায়না। তাই বহুত্বের চিন্তন স্ববিরোধী দোষে দুষ্ট হওয়ায় বহুত্ব অলীক। তাই সত্তা অবশ্যই এক ও অবিভাজ্য।
  • সত্তা অচল ও স্থির। সত্তা অচল ও স্থির না হলে তাকে অস্তিত্বশীল শূন্য দেশেই চলাচল করতে হবে। কিন্তু শূন্য দেশের অস্তিত্ব থাকতে পারেনা, তা অলীক বা অ-সত্তা। যদি বস্তু কোন দেশ বা স্থানে থাকে, তাহলে সেই দেশ বা স্থানকেও কোন দেশ বা স্থানে থাকতে হবে, এভাবে অনবস্থা দোষ হবে, তাই শূন্য দেশের চিন্তন ভুল, তাই এটি অলীক বা অ-সত্তা, তাই সত্তার গতিশীলতাও অলীক, তাই সত্তা অচল ও স্থির।
  • সত্তার গতি বা পরিণাম নেই। গতির চিন্তন অলীক। কোন দূরত্ব অতিক্রম করতে হলে প্রথমে সেই দূরত্বের অর্ধেক অতিক্রম করতে হবে। অবশিষ্ট অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য বাকী থাকবে। তারপর অবশিষ্ট এই অর্ধেক দূরত্বের অর্ধেক অতিক্রম করতে হবে, আবার অর্ধেক অবশিষ্ট থাকবে। তার মানে সীমিত সময়ে অন্তহীন সংখ্যক দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, যা অসম্ভব। একিলিস এবং কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতা কচ্ছপকে যদি একিলিস কিছুটা দূরত্বে এগিয়ে দৌড় শুরু করতে দেয়, এবং তারপর যদি একিলিস দৌড়াতে শুরু করে তাহলে যেখান থেকে কচ্ছপ যাত্রা শুরু করছে সেই জায়গায় গিয়ে যখন একিলিস পৌছাবে, তখন কচ্ছপ আরও এগিয়ে গেছে অন্য একটি স্থানে, আবার সেখানে যখন একিলিস গিয়ে পৌঁছাবে, তখন কচ্ছপ অপর একটি স্থানে গিয়ে পোঁছবে, এইভাবে একিলিস ক্রমশ কচ্ছপের কাছাকাছি দূরত্বে এসে যাবে কিন্তু কখনও তাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। আরও পারবে না এই কারণে যে, একটি রেখা অনন্ত সংখ্যক বিন্দুর দ্বারা গঠিত এবং একিলিসকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এটা অবাস্তব। তাই গতি অলীক। তাই সত্তার গতি বা পরিণাম নেই।
  • কোন বস্তু একটি মুহূর্তে দুটি স্থানে অবস্থান করতে পারে না, এবং কোন একটি স্থানে অবস্থান করার অর্থ স্থির থাকা। নিক্ষিপ্ত তীর যে কোন মুহূর্তে নিজের দৈর্ঘ্যের সমান দেশে অবস্থান করবে এবং সে কারণে এটি স্থির থাকবে। অনন্ত সংখ্যক স্থিরতার অবস্থানের যোগফল কখনও গতি হতে পারে না। তাই নিক্ষিপ্ত তীরটি স্থির থাকে, গতিশীল থাকেনা। তাই তীরের গতিশীলতার কল্পনা অলীক বা মিথ্যা বা অ-সত্তা। তাই সত্তার গতি থাকতে পারেনা।

হেরাক্লিটাস (৫৩৫-৪৭৫ খ্রী.পূ.)

  • বস্তুর নিরন্তর পরিবর্তন, বিশেষ বস্তুর অস্থায়িত্ব নির্দেশ করে বিশ্বজগতকে সদা পরিবর্তনশীল এবং নিত্যনতুন পরিণামের অধীন। সকল কিছুই নিরন্তর পরিবর্তিত হচ্ছে, পুরাতন রূপ এবং আকার পরিত্যাগ করে নতুন রূপ এবং আকার পরিগ্রহ করছে। কোন কিছুই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। গতি ও পরিবর্তনই বিশ্বের ধর্ম, সকল কিছুই গতিশীল, স্রোতের মত প্রবাহমান এবং নিরন্তর পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের অর্থ হল একটি অবস্থার পর আর একটি অবস্থার উদ্ভব। জগতের যাবতীয় বস্তু সদা পরিণামী। এক নদীতে কেউ দুবার অবগাহন করতে পারে না, কেননা প্রথমবার অবগাহন করার পর নদী পরিবর্তিত হয়ে গেছে, নতুন জলের স্রোত প্রবাহমান। কোন মুহূর্তেই পূর্ববর্তী মুহুর্তের নদীর জলের সঙ্গে তার পরবর্তী মুহূর্তের জলের কোন সাদৃশ্য নেই। এ জগতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। (এলিয়াটিক স্কুলের বিপরীতে)
  • বস্তুর আপেক্ষিক স্থায়ীত্বের বিষয়টি অলীক। সব কিছুই মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে কোন কিছু এক মুহূর্ত থেকে অন্য মুহূর্তে অপরিবর্তিত থাকছে না। আমরা মনে করি, কোন একটি বস্তু অনেক মুহূর্ত ধরে অপরিবর্তিত থাকছে, কিন্তু বস্তুর এই ধরনের আপেক্ষিক স্থায়ীত্বের বিষয়টি ভ্রম প্রত্যক্ষ। জলের উপরিভাগ দিয়ে যে ঢেউ বয়ে যায় আপাতদৃষ্টিতে তাকে এক ঢেউ বলেই মনে হয়। কিন্তু আসলে ঢেউটি এক নয়, কেননা যে জল দিয়ে ঢেউটি তৈরি সেটি মুহুর্তে মুহুর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। বস্তুর মধ্যে সমপরিমাণ দ্রব্যের প্রবেশ ও নির্গমনই বস্তুর স্থায়ীত্বের ভাব মনে জাগিয়ে তােলে। এক সূর্য রােজ উদিত হচ্ছে বা অস্ত যাচ্ছে তা নয়, রােজই এক নতুন সূর্যের আবির্ভাব ঘটছে। কেননা সূর্যের অগ্নি নিজেকে দগ্ধ করে নিঃশেষিত করলেও সমুদ্রের বাষ্প থেকে তার ক্ষয়পূরণ হয়ে যাচ্ছে। (এলিয়াটিক স্কুলের বিপরীতে)
  • বস্তু যে শুধু মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে তা নয়, এক মুহূর্তও তারা এক অভিন্ন বস্তু থাকছে না। একটি বস্তু প্রথম মুহূর্তে এক রয়েছে, তার পরের মুহূর্তে অন্য কিছুতে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা নয়, একই সময়ে এটি আছে এবং নেই এই কথাই সত্য। ভবন (Becoming)-এর অর্থই হচ্ছে তাই একই সঙ্গে থাকা আর না থাকা। তাই সত্তা এবং অ-সত্তা উভয়ই সত্য। কারণ আসলে উভয়ে এক পথ নয়। ভবন হল সত্তা এবং অ-সত্তার অভেদ। ভবন হল বস্তুর উৎপত্তি এবং তাদের তিরােধান, তাদের শুরু এবং তাদের শেষ, তাদের উৎপত্তি এবং তাদের ধ্বংস। উৎপত্তি হল অ-সত্তার সত্তায় পরিণতি, ধ্বংস হল সত্তার অ-সত্তায় পরিণতি। কাজেই ভবন হল সত্তা ও অসত্তা এই দুই উপাদানের একটির আর একটিতে পরিণতি। সত্তা এবং অসত্তা একই সময়ে সব কিছুতে বর্তমান। ‘সত্তাই অ-সত্তা’, সত্তাতেই অ-সত্তা রয়েছে। জীবনের মধ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে মৃত্যু। তাই বস্তু আছে আবার নেই।
  • বিজ্ঞতা বহু বিষয়ের জ্ঞান নয়, কেবলমাত্র একটি বিষয়ের সুস্পষ্ট জ্ঞান। এই একটি বিষয় হলো এই যে, সত্তা ‘এক’ এবং এই এক সত্তা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, ভেদের মধ্যে অভেদ।
  • শুধু সত্তার মধ্যেই যে অ-সত্তা রয়েছে তা নয়, জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে রয়েছে তার যা বিরোধের অস্তিত্ব, প্রতিটি অস্তিত্বশীল বস্তু হল বিরােধী টানের এক ভারসাম্য। বিরােধী শক্তির সংঘাত বিশ্বের সর্বত্রই দ্রষ্টব্য। বস্তুত প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার বিরােধী নীতি। এই পরস্পরবিরােধী নীতির সংঘাতের মধ্যেই বস্তুর অস্তিত্ব, বস্তুর সত্তা নিহিত। প্রতিটি বস্তুর অন্তরে রয়েছে সংঘাত। বস্তুর মধ্যে যদি এই সংঘাত না থাকলে বস্তু ধ্বংস হয়ে যেত। বিরােধীসংঘাত একের অস্তিত্বের জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়ােজন। সংঘাতই সব কিছুর জনক। ঈশ্বর হলেন দিন এবং রাত্রি, গ্রীষ্ম এবং শীত, যুদ্ধ এবং শান্তি, ক্ষুধা এবং পরিতৃপ্তি।
  • সত্তা হল এক এবং এই একের অস্তিত্বের জন্য বিরুদ্ধধর্মী পদার্থের সংঘাত অবশ্যই প্রয়ােজন। আমরা অবশ্যই জানব যে যুদ্ধ সকল ক্ষেত্রেই বর্তমান এবং বিরােধ বা সংঘাতই ন্যায় সব বস্তুই সংঘাতের মাধ্যমেই সত্তাবান হয় এবং তিরােহিত হয়। হােমারের মানুষের মধ্য থেকে সংঘাত তিরােহিত হবার জন্য প্রার্থনা যদি পূরণ করা হত তাহলে সমস্ত বিশ্বজগতই ধ্বংস হয়ে যেত। মানুষ জানে না যে, যা সংঘাতপূর্ণ তা নিজের সঙ্গে কিভাবে সংগতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এ হল বিপরীত টানের (Tension) সমন্বয়বিধান, যা দেখা যায়, যখন ছড়ের আঘাতে বীণার তারে টান পড়ে এবং তার থেকে সুরের উৎপত্তি ঘটে।
  • কেবলমাত্র ভবনের (Becoming) অস্তিত্ব আছে। সত্তা, স্থায়ীত্ব, অভেদত্ব, এসব কিছুই অলীক, কেননা শুধু ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যই যে পরিবর্তিত হচ্ছে তা নয়, সমস্ত জগতই নিরন্তর গতিশীল ও পরিণামী। স্থিতিশীলতা, স্থিরতা – এ সবের কোন সত্যতা নেই। কাজেই সত্তা নয়, ভবনেরই একমাত্র সত্যতা রয়েছে। (এলিয়াটিক স্কুলের বিপরীতে)
  • বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অগ্নিই সবচেয়ে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। অগ্নি চিরচঞ্চল, এক মুহূর্তও পরিবর্তিত না হয়ে থাকতে পারে না। এই অগ্নি কখনও শিখারূপে ঊর্ধ্বে ধাবমান, কখনও ভস্মে পরিণত, আবার কখনও সেই ভস্ম থেকে উত্থিত ধূমরূপে ঊর্ধ্বে বিলীয়মান। তাই জগতের সব কিছুই এক মূল উপাদান বা পদার্থ থেকে উদ্ভূত। আবার অগ্নি দহন করে এবং বিজাতীয় বস্তুকে নিজের মধ্যে রূপান্তরিত করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে এবং আর একাধিক বস্তু থেকে উদ্ভূত হয়ে তাদের নিজেতে পরিণত করে এবং এই উপাদানের সরবরাহ ব্যতিরেকে এর ঘটবে মৃত্যু, এ হয়ে পড়বে সত্তাহীন। এই বিরােধ (Strife) এবং টান (Tension)-এর উপরই নির্ভর করছে অগ্নির অস্তিত্ব। তাই এই মূল উপাদান হল জল বা বায়ু থেকে অনেক সূক্ষ্ম পদার্থ। তা হল অগ্নি (Fire)। এই অগ্নি শুধু শিখা নয়, এটি সাধারণভাবে উষ্ণতা, এটি ঊর্ধ্বে ধাবমান বাষ্পশ্বাস। সবই অগ্নির দ্বারা গঠিত। এই জগৎ ঈশ্বর বা মানুষের দ্বারা নির্মিত নয়। এই জগৎ চিরকাল ধরেই এক আদি অন্তহীন প্রাণবন্ত অগ্নি। সব কিছুই অগ্নি থেকে উদ্ভূত হয়। অগ্নিতেই সব কিছুর লয়। অগ্নিই মূল উপাদান। বিশ্বের সব কিছুই অগ্নিরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা প্রকাশ। সব কিছুই অগ্নির বদলে বিনিময় হয় এবং অগ্নি সব কিছুর বদলে বিনিময় হয়। অগ্নি প্রথম বায়ুতে রূপান্তরিত হয়, তারপর বায়ু থেকে জলে এবং জল থেকে মৃত্তিকায় পরিণত হয়। এই পরিবর্তন হলো নিম্নগামী বা Downward Path. আবার মৃত্তিকা পরিণত হয় জলে, জল বাতাসে এবং বাতাস অগ্নিতে। এটি হলো ‘ঊর্ধ্বগামী পথ’ (Upward Path). সব পরিবর্তন ঘটে একটা নিয়মিত শৃঙ্খলা অনুসারে। উর্ধ্বগামী এবং নিম্নগামী উভয় পথই এক।
  • এই জগৎ এক সদা-জীবন্ত অগ্নি এর কিছু পরিমাণ প্রজ্বলিত হয় এবং কিছু পরিমাণ নির্বাপিত হয়। কাজেই অগ্নি যেমন বস্তু থেকে গ্রহণ করে, প্রজ্বলিত করে, তাদের নিজের মধ্যে রূপান্তরিত করে, তেমনি অগ্নি যতটুকু গ্রহণ করে ততটুকু দেয়। কাজেই যদিও প্রতি ধরনের জড়ের যে দ্রব্য (Substance), তার অনবরত পরিবর্তন ঘটলেও সেই জড়ের সমষ্টিগত পরিমাণ থেকে যাচ্ছে। অগ্নির বিভিন্ন পরিমাণে, কমবেশি সমান অনুপাতে, প্রজ্বলিত হওয়া এবং নির্বাপিত হওয়ার জন্যই বস্তুর আপেক্ষিক স্থায়ীত্ব রয়েছে। এই পরিমাণের বিষয়টি, বা ঘটনাটি উচ্চগামী এবং নিম্নগামী পথের ভারসাম্য। এটাই বিশ্বের লুক্কায়িত সমন্বয়বিধান। যা প্রকাশিত তার তুলনায় এটা অনেক ভাল। তাই এই বিশ্ব অনবরতই পরিবর্তিত হলেও, কোনক্ষণেই তা স্থির না থাকলেও আমাদের মনে কেন এই জগতে বস্তুর স্থায়ীত্বের ভাব জাগে।
  • একের অস্তিত্বের পক্ষে বিরােধের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী ও ‘এক’ হচ্ছে তার নিজেরই পার্থক্য এবং এই পার্থক্যগুলো নিজেরাই হচ্ছে ‘এক’। তারা একেরই বিভিন্ন দিক। এই পার্থক্যগুলো কখনও বিলুপ্ত হতে পারে না, তাহলে একেরই কোন অস্তিত্ব থাকে না। কাজেই একের এই বিভিন্ন দিক, উচ্চগামী পথ আর নিম্নগামী পথ কোনটাই বিলুপ্ত হতে পারে না। সুতরাং একের অস্তিত্বের পক্ষে এই বিরােধের অবিচ্ছেদ্যতাকে স্বীকার করে নিতেই হয়। একের বিভিন্ন মুহূর্তের স্বীকৃতিকে কোন মতেই অগ্রাহ্য করা চলে না। উপরের পথ আর নীচের পথ একই। আত্মার পক্ষে জলে পরিণত হওয়া এবং জলের পক্ষে মৃত্তিকায় পরিণত হওয়া, মৃত্যুরই সামিল কিন্তু জল মৃত্তিকা থেকে এবং জল থেকেই আত্মা আসে। একেতেই সব বিভেদের ঐক্য, সব পার্থক্যের সুসংগতি ও সব টানের (Tension) সমন্বয়বিধান সাধিত হয়। ঈশ্বরের কাছে সব কিছুই ভাল এবং সুন্দর এবং যথার্থ। কিন্তু মানুষই কিছু জিনিসকে ঠিক-বেঠিক মনে করে।
  • এই এক-ই হলো অগ্নি, প্রজ্ঞা (Logos) বা ঈশ্বর (God)। এই তিনটিই মূলে এক। ঈশ্বর সব এবং সবই ঈশ্বর। সর্বেশ্বরবাদ সত্য। ঈশ্বর হল এক সার্বিক বিচারবুদ্ধি, এক সার্বিক নীতি যা সব জিনিসের মধ্যে অন্তর্নিহিত থেকে সব বস্তুকে ঐক্যবদ্ধ করছে এবং এক সার্বিক নিয়মানুসারে বিশ্বের অবিরত পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
  • ইন্দ্রিয় এবং বিচারবুদ্ধি পৃথক। ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে সত্যকে জানা যায় না। একমাত্র বুদ্ধির দ্বারাই সত্যকে জানা যায়। ভবনই (Beeoming) যে সত্য, বুদ্ধির দ্বারাই এই নীতি বােধগম্য হয়। মানুষের বিচারবুদ্ধি সার্বিক বিচারবুদ্ধিরই একটি মুহূর্ত মাত্র। কাজেই মানুষের উচিত বিচারবুদ্ধির সাহায্যে সত্যকে উপলদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া, বিচারবুদ্ধির সাহায্যে সবকিছুর ঐক্যকে বুঝে নিতে চেষ্টা করা। বিচারবুদ্ধি এবং চেতনা মানুষের মধ্যে অগ্নিময় উপাদান। তারা হল মূল্যবান উপাদান।
  • আত্মা কোন অশরীরী বস্তু বা ভুত বা ছায়া নয়। আত্মা সবচেয়ে বাস্তব বস্তু এবং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হল চিন্তন বা বিজ্ঞতা। আত্মা যখন জেগে থাকে, তখনই আত্মা পরিপূর্ণভাবে সজীব। নিদ্রা হল জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থা। নিদ্রার সময় ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় এবং বাইরের অগ্নি শুধুমাত্র নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়েই আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। কাজেই নিদ্রার সময়ে আমরা বিচারবুদ্ধি শূন্য এবং অচেতন হয়ে পড়ি, জগতের সাধারণ জীবন থেকে নিজেদের নিজস্ব একটা ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে আসি। আত্মার উচিত নিদ্রার জগৎ থেকে জাগ্রত অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়া অর্থাৎ কিনা, চিন্তা এবং বিচার-বুদ্ধির জগতে উত্তীর্ণ হওয়া।
  • মানুষের আত্মা ঐশ্বরিক অগ্নির একটা অংশ। এই অগ্নি যত শুদ্ধ আত্মা তত উৎকৃষ্ট বা নিখুঁত। শুষ্ক আত্মাই বিজ্ঞতম এবং শ্রেষ্ঠ। আর্দ্র হওয়াটা আত্মার পক্ষে আনন্দকর হতে পারে, কিন্তু আত্মার পক্ষে জল হওয়া তার মৃত্যুরই সামিল।
  • আত্মা যখন দেহকে পরিত্যাগ করে, আত্মা নির্বাপিত হয় না, যে জগৎ-অগ্নি থেকে আত্মা এসেছিল, সে সেখানেই ফিরে যায়।
  • আত্মা যেহেতু অগ্নি, অন্য অগ্নির মতই সে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে এবং তার পরিপূরণের প্রয়ােজন হয়। এটি সে ইন্দ্রিয় এবং শ্বাসের মাধ্যমে জগতের সাধারণ জীবন এবং বিচারবুদ্ধি থেকে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ, চারপাশের পরিবেশ এবং সর্ব-ব্যাপক অগ্নি থেকে লাভ করে। এর মধ্যেই আমরা বাঁচি, নড়াচড়া করি এবং আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখি।
  • কোন মানুষেরই নিজস্ব আত্মা নেই। এটি হল এক সার্বজনীন আত্ম-অগ্নির অংশমাত্র। কাজেই এর সঙ্গে সংস্পর্শ বিনষ্ট হলে মানুষ বিচারবুদ্ধিশূন্য হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
  • বিশ্বের ঐশ্বরিক শৃঙ্খলায় বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয় সন্তোষ এবং এই সন্তোষই জীবনের পরমকল্যাণ।
  • মানবীয় জ্ঞানের সীমারেখা আছে। মানুষের ধারণা আপেক্ষিক।
  • মানুষের জগতেই নৈতিক মূল্যের যথার্থ আছে এবং অন্যান্য বস্তুর মত এদের বিরােধিতারও বিশ্বসঙ্গতিতে অর্থাৎ ঈশ্বরে সমন্বয় সাধিত হয়।

এম্পিডক্লিস (৪৯৪–৪৩৪ খ্রি.পূ.)

  • সত্তা হলো জড়াত্মক। সত্তার উৎপত্তিও নেই, ধ্বংসও নেই, সত্তা অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হতে পারে না, অ-সত্তাতে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে না। যা আছে তা বরাবরই তাই থেকে যায়। কাজেই জড়ের শুরুও নেই, শেষও নেই। জড় হল অবিনশ্বর, স্বয়ম্ভু। (পারমিনাইডিস প্রভাবিত, কিন্তু এখানে সত্তা জড়াত্মক)
  • জগতের বিভিন্ন বস্তু সব সময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনকে কোন মতেই অস্বীকার করা চলে না, বা নিছক ভ্রম প্রত্যক্ষণ বা অলীক বলে বাতিল করে দেওয়া যায় না। কিন্তু বস্তুর আবির্ভাব ও তিরােধান এরও ব্যাখ্যার প্রয়ােজন আছে। (হেরাক্লিটাস প্রভাবিত)
  • যখন বস্তুর পরিণাম বা পরিবর্তনের কথা বলা হয়, বস্তুর উৎপত্তি বা তার বিলুপ্তির কথা বলা হয়, তখন সমগ্র হিসেবেই বস্তুর উৎপত্তি এবং তার বিলুপ্তির কথা বলা হয়। কিন্তু বস্তু যে জড়কণার দ্বারা গঠিত, তাদের উৎপত্তি বা বিনাশ কিছুই নেই, তারা অবিনশ্বর।
  • যাকে সৃষ্টি এবং ধ্বংস বলে অভিহিত করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে অনাদি এবং অপরিণামী মূল দ্রব্যের সংযােগ ও বিয়ােগ।
  • মৌলিক উপাদান হল চারটি – ক্ষিতি (Earth), অপ (Water), তেজ (Fire), এবং মরুৎ (Air), যারা ‘সব কিছুর মূল’। এই চারটি উপাদান হল অপরিবর্তনীয় এবং মৌলিক। এদের পারস্পরিক মিশ্রণ থেকেই জগতের যাবতীয় মূর্ত বস্তুর উৎপত্তি। জড় হল ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ-এই চারটি উপাদানেরই কিছু কিছু অংশের একত্র মিশ্রণ। উপাদানগুলোর সংযােগ এবং বিয়ােগ থেকেই যাবতীয় বস্তুর উৎপত্তি এবং ধ্বংস। কিন্তু উপাদানগুলোর উৎপত্তিও নেই, ধ্বংসও নেই। তারা সব সময় অপরিণামী থেকে যায়।
  • শূন্য স্থান বলে কিছু নেই। শূন্য ঘন হল শূন্যতা, কিছুই নয়, অদৃশ্য। সব উপাদানই স্থান জুড়ে আছে। উপাদানগুলোর একটা সুনির্দিষ্ট বিস্তৃতি আছে এবং প্রতিরােধের শক্তি আছে।
  • রাগ ও দ্বেষ চারটি উপাদানকে একত্র করে বিভিন্ন জড়বস্তু গঠন করে। দ্বেষ বা সংঘাত (Strife) উপাদানগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে বস্তুর সত্তার বিনাশ সাধন করে। এই রাগ ও দ্বেষ হলো জগতে আকর্ষণ ও বিকর্ষণের যান্ত্রিক শক্তির ক্রিয়ার প্রকাশ।
  • জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস চক্রবৎ সংগঠিত হয়, এই অর্থে যে, নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে জগতের সৃষ্টি ও প্রলয় ঘটে। কাজেই এক হিসেবে জগতের পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোন আদি বা অন্ত নেই।
  • শুরুতে অর্থাৎ আদিম মণ্ডলে (Sphere) সমস্ত উপাদানগুলো, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ সম্পূর্ণভাবে একত্র মিশ্রিত বা ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিশেষ বিশেষ মূর্ত বস্তুর সৃষ্টির জন্য তখনও তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। মন্ডলের যে কোন অংশে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ – এর সমান পরিমাণেই অস্তিত্ব ছিল। আদিতে রাগ (Love) বা সঙ্গতি (Harmony) সমগ্র মন্ডলে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি হিসেবে ক্রিয়মান ছিল। সমগ্র মন্ডলটিকে বলা হত ‘পরমানন্দময় ঈশ্বর’ (Blessed God)। তখনও পর্যন্ত দ্বেষের আবির্ভাব ঘটেনি বলে সৃষ্টি ও শুরু হয়নি। দ্বেষ মন্ডলের বাহিরে সর্বক্ষণ অস্তিত্বশীল ছিল। দ্বেষ ক্রমশ পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে প্রবেশ করতে শুরু করলে উপাদানগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থা থেকে শিথিল হওয়ার বিষয়টি শুরু হয়ে গেল। সমজাতীয় উপাদানগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানগুলো পরস্পরের থেকে একেবারে পৃথক হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে লাগল। যেমন সব জলকণা এক জায়গাতে এবং সব অগ্নিকণাগুলো এক সঙ্গে জড় হল। বিচ্ছিন্ন হবার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হলে দ্বেষেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং রাগ সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হল। কিন্তু রাগ আবার তার কাজ শুরু করে দেয়। বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলোকে রাগ একত্রিত করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বজগৎ আবার তার পূর্বাবস্থায় উপনীত হয়। এরপর দ্বেষ আবার তার কাজ শুরু করে। এভাবে চক্রবৎ রাগ ও দ্বেষের ক্রিয়া চলতে থাকে।
  • আদিম গােলক এবং উপাদানগুলোর সমপূর্ণভাবে ঐক্যবন্ধন শিথিল হওয়া – এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থায় হল আমাদের এই জগৎ। দ্বেষ (Hate) ক্রমশ গােলকের মধ্যে প্রবেশ করে রাগকে বহিষ্কৃত করার জন্য সচেষ্ট হয়। এই গােলকের মধ্য থেকে যখন আমাদের এই জগৎ গঠিত হতে থাকে, তখন বায়ু হল প্রথম উপাদান যেটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তারপরে তেজ, তারপর ক্ষিতি। জগতের চক্রবৎ ঘূর্ণন বা আবর্তনের বেগের জন্যই তার থেকে জল নিষ্পেষিত হয়। আকাশের দুটি অংশ। এক অংশ অগ্নি এবং সেটিই হল দিন। অপর অংশ হল অন্ধকার জড় যার মধ্যে অগ্নি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং এই হল রাত্রি।
  • আত্মার জন্মান্তরবাদ বা দেহান্তরপ্রাপ্তি সত্য। আমি অতীতে একজন বালক, বালিকা, গুল্ম , পাখি এবং সমুদ্রে বসবাসকারি মৎস্য ছিলাম।
  • চিন্তন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য নেই। চিন্তন দেহেরই ক্রিয়া, যে দেহ উপাদানের দ্বারা গঠিত।
  • একই ধরনের পদার্থ দ্বারা একই ধরনের পদার্থ জ্ঞাত হয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে অবস্থিত উপাদানের সঙ্গে আমাদের বাইরে অবস্থিত উপাদানের মিলন ঘটে। আমাদের মধ্যে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ যথাক্রমে বাইরে অবস্থিত ক্ষিতি, অপ, তেজ: ও মরুৎকে জানে। চাক্ষুষ-প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে, যেহেতু চক্ষু অগ্নি এবং জলের দ্বারা গঠিত, চক্ষুর মধ্যে অবস্থিত অগ্নি এবং জলের প্রবাহ (Effluence) বাহ্য বস্তুতে অবস্থিত জল প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়।
  • ঈশ্বর পবিত্র, বাক্যের অতীত চিৎপদার্থ। এই পবিত্র চেতন সত্তা তার চিন্তার দ্বারাই সমস্ত জগতে ব্যাস্ত হয়ে আছেন এবং তার নীতিই সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ড গােলকের সঙ্গে অভিন্ন।
  • জগৎ ব্যাখ্যায় চারটি মৌলিক উপাদান এবং এর অতিরিক্ত রাগ ও দ্বেষের দরকার হচ্ছে, তাই বহুত্ববাদ সত্য।

অ্যাটোমিস্ট স্কুল – লিউসিপ্পাস ও ডিমোক্রিটাস (৪২০-৩৭০ খ্রি.পূ.)

  • জড়কে যদি ক্রমাগত বিভক্ত করা হয় তাহলে বিভক্ত করতে করতে এমন একটা অবস্থায় এসে উপনীত হতে হবে যখন আর তাদের বিভক্ত করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত অবিভাজ্য এককে উপনীত হওয়া যাবে, তারাই হল পরমাণু। কাজেই পরমাণু হল জড়ের অন্তিম উপাদান, জড়ের অবিভাজ্য অংশ। এরা সংখ্যায় অসংখ্য এবং এত ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এদের প্রত্যক্ষ করা যায় না।
  • সব জড় কণাই এক ধরনের। তাদের আকৃতি ও আয়তন ভিন্ন, কিন্তু তাদের কোন গুণগত পার্থক্য নেই। যাবতীয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুর গুণের উৎস হল পরমাণুর অবস্থান এবং বিন্যাস। (এম্পিডক্লিসের বিপরীতে)
  • পরমাণু অবিভাজ্য বলে পরমাণুর ঘনত্ব বা অভেদত্বের গুণ আছে।
  • পরমাণুগুলোর পারস্পরিক সংযুক্তি ও বিযুক্তির গতিশীলতার কারণে পরমাণুর অবস্থান এবং বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে বস্তুজগতের পরিবর্তন ঘটে।
  • পরমাণুগুলো পরস্পরের থেকে পৃথকভাবে অবস্থান অর্থাৎ এর পারস্পরিক পার্থক্যে এবং বস্তুর গুণ ও পরিবর্তনের ব্যাখ্যা হিসেবে পরমাণুগুলোর পারস্পরিক সংযুক্তি ও বিযুক্তির গতিশীলতা নির্দেশ করে যে শূন্য স্থান বা দেশের অস্তিত্ব আছে। এই শূন্যস্থান প্রকৃতই শূন্যগর্ভ স্থান বা ফাঁকা স্থান, যাতে কিছুই নেই। শূন্যস্থানের বাস্তব অস্তিত্ব আছে কিন্তু তাদের ভৌতিক অস্তিত্ব নেই। (এম্পিডক্লিসের বিপরীতে)
  • শূন্যস্থানে কোন ‘উপর নীচ’ বা ‘মধ্যস্থান’ নেই, এগুলো আমাদের কল্পনা, যার কোন অস্তিত্ব নেই।
  • সবকিছুর উৎপত্তি ও ধ্বংসের জন্য দরকারী পরমাণুর সংযােগ ও বিয়ােগের গতিশীলতা পরমাণুর ওজন থেকে আসে না, কারণ পরমাণুর ওজন নেই। সূর্য থেকে সূর্যরশ্মি যেমন এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনিভাবে পরমাণুগুলো এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে বা গতিশীলতা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ পরমাণুর সঙ্গে বিশৃঙ্খল গতি অন্তর্নিহিতভাবে যুক্ত ধরতে হয়, তাহলে গতি নিজে পরমাণূর আরেকটি গুণ হয়ে যায়। (অনেকের মতে এরা এই ব্যাখ্যা দেয়নি, তারা এর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।)
  • ভারী পরমাণুগুলো হাল্কা পরমাণুর তুলনায় শূন্যস্থানে দ্রুত পতিত হয়। ভারী পরমাণুগুলো দ্রুত হবার সময় হাল্কা পরমাণুগুলোকে আঘাত করে একপাশে এবং ঊর্ধ্বে সরিয়ে দেয়। পরমাণুগুলোর এই পারস্পরিক আঘাতের ফলে, অসমতল আকৃতিবিশিষ্ট পরমাণুগলি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, যার ফলে একটা ঘূর্ণি বা আবর্ত (Vortex)-এর সৃষ্টি হয় এবং একটি জগৎ সৃষ্টি হতে থাকে। দেশ অসীম এবং পরমাণু অন্তহীনভাবে পতিত হতে থাকে বলে সিদ্ধান্ত করতে হয় যে অনন্ত জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে আমাদের জগৎ একটি। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত পরমাণুগুলো পরস্পর থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আমাদের এই অস্তিত্বশীল জগৎও ধ্বংস হয়ে যায়। (অনেকের মতে এই ব্যাখ্যা এপিকিউরীয়দের সংযুক্তি।)
  • শুরুতে শূন্যস্থানে পরমাণু অবস্থান করত এবং তার থেকেই এই অভিজ্ঞতার জগতের সৃষ্টি। পরমাণুদের আদি-অন্তহীন গতিই জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সব গতি অনিবার্য বা অবশ্যম্ভাবী।
  • জগৎ কোন বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। জগতের সব ঘটনাই উদ্দেশ্যহীন যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
  • কঠোর নিয়ন্ত্রণবাদ সত্য, সব কিছুই জাগতিক নিয়মানুযায়ী ঘটে। কোন কিছু আকস্মিকতাবশত ঘটতে পারেণা। কোন কিছুই শুধু শুধু ঘটে না। যা কিছু ঘটে তার একটা হেতু আছে, একটা আবশ্যকতা আছে। জগৎ অস্তিত্বশীল হবার পর তার ভবিষ্যৎ বিকাশ যান্ত্রিক নিয়মের দ্বারাই অপরিবর্তনিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • জগতের উৎপত্তির বা জাগতিক ঘটনার ক্ষেত্রে আকস্মিকতা (Chance) কাজ করেনি, বরং এক আদি-অন্তহীন গতি কাজ করেছে। গতি আদি অন্তহীন এবং এই গতি চলতে থাকে।
  • পৃথিবী খঞ্জনীর মত বাতাসে ভাসমান।
  • ভয়ই মানুষের মনে দেব-দেবীতে বিশ্বাসের সূচনা করেছে। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, ধূমকেতু মনে যে ভীতির সঞ্চার করে তার জন্যই মানুষ দেব-দেবীতে বিশ্বাস করে। বায়ুতে মানুষের মতই জীব অবস্থিত, যারা মানুষের থেকে বৃহদাকার এবং দীর্ঘায়ু। এরাই মানুষের মনে দেবতার ধারণা সৃষ্টি করে।
  • আত্মা পরমাণুর দ্বারা গঠিত এবং চিন্তন হল একটি ভৌতিক প্রক্রিয়া। এই বিশ্বজগতে কোন উদ্দেশ্যের স্থান নেই, বিশ্বজগতে রয়েছে শুধু পরমাণু যেগুলো যান্ত্রিক নিয়মের দ্বারা চালিত হয়।
  • আগুনের উপাদান হল মসৃণ গােলাকার পরমাণু। আত্মা হল শুদ্ধ এবং সূক্ষ্ম অগ্নি। কাজেই আত্মার উপাদানও হল মসৃণ গােলাকার পরমাণু। মৃত্যুর অর্থ হল আত্মার উপাদান যে পরমাণু সেগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া। তাই পরজন্মে বা জন্মান্তরবাদ মিথ্যা।
  • বস্তু থেকে যে প্রভাব বা উদ্দীপনা দর্শনেন্দ্রিয়ে উপনীত হয় এই সব প্রভাব বা উদ্দীপনা হল পরমাণু, এরা হল প্রতিরূপ (Images) যেগুলো বস্তু থেকে অনবরত নির্গত হচ্ছে। ব্যক্তির বিশেষ ইন্দ্রিয়গুলো হল প্রবেশ পথ; এই প্রবেশ পথের মধ্য দিয়ে প্রতিরূপগুলো প্রবেশ করে। প্রতিরূপগুলো পরমাণুর তৈরি। বস্তু তাদের প্রতিরূপগুলো দেশে (Space) অভিক্ষিপ্ত করে। এই প্রতিরূপগুলো কোন একটি ইন্দ্রিয় পথে যেমন, দর্শনেন্দ্রিয় পথে প্রবেশ করে আত্মাতে প্রবিষ্ট হয়, যে আত্মাও পরমাণুর দ্বারা গঠিত। প্রতিরূপগুলো যখন বাতাসের মধ্য দিয়ে যায় তখন বাতাসের দ্বারা বিকৃত হতে পারে। সেকারণে খুব দূরের বস্তু আমাদের দৃষ্টিগােচর নাও হতে পারে। প্রতিরূপের স্থূলতা ও সূক্ষ্মতাই বর্ণ বৈষম্যের কারণ। শব্দমান বস্তু থেকে পরমাণুর স্রোত নির্গত হয়ে শব্দমান বস্ত এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের মধ্যবর্তী বাতাসে গতির সৃষ্টি করে যার ফলে শব্দ শুত হয়। স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ সবই অনুরূপভাবে কাজ করে। (এম্পিডক্লিস প্রভাবিত)
  • সাধারণত বস্তুর দু’ধরনের গুণের কথা বলা হয়ে থাকে – প্রাথমিক (Primary)-বস্তুর আকৃতি, আয়তন, ওজন এবং গৌণ (Secondary)-যেমন, বস্তুর বর্ণ , স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি। বিশেষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ সব সংবেদনই মিথ্যা, কেননা ঐসব সংবেদনের অনুরূপ কোন বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব নেই, উষ্ণতা, স্বাদ, বর্ণ প্রভৃতি গুণগুলো প্রকৃতপক্ষে বস্তুতে অবস্থিত নয়। অর্থাৎ আমাদের সংবেদন হল সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি সাপেক্ষ, যদিও তারা বাহ্য ও বাস্তব পরমাণুর দ্বারা সংঘটিত হয়। কিন্তু এই পরমাণুকে বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায় না। অন্ততঃপক্ষে বস্তুর গৌণ গুণগুলো বস্তুগত নয়, মনােগত। আমাদের ইন্দ্রিয়ের জন্যই সেগুলোর উদ্ভব। কিন্তু ওজন, ঘনত্ব প্রভৃতি গুণগুলো প্রকৃতই বস্তুতে অবস্থিত।
  • জ্ঞান দু’প্রকার – অ-জারজ (True Born) এবং জারজ (Bastard)। দর্শন, শ্রবণ, রাসণ, ঘ্রাণজ এবং স্পৰ্শন বিষয়ক জ্ঞান দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকার জ্ঞান দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু যেহেতু আত্মা পরমাণুর দ্বারা গঠিত এবং যেহেতু সব জ্ঞান হল বাইরে থেকে আসা এবং পরমাণুর সঙ্গে জ্ঞানকর্তার সংযােগ, সেহেতু ইন্দ্রিয় এবং চিন্তনের মধ্যে কোন চরম ভেদরেখা টানা সম্ভব নয়।
  • মানুষের আচরণের লক্ষ হল শান্তি বা আনন্দ এবং সুখ ও দু:খই শান্তি নির্ধারণ করে। মানুষের শান্তি জাগতিক ঐশ্বর্যের ওপর নির্ভর নয়। অধিক পরিমাণে আনন্দ পাওয়া এবং কষ্টকে যতদূর সম্ভব এড়ান – এই হবে মানুষের আচরণের লক্ষ।
  • ইন্দ্রিয় সুখ যথার্থ সুখ নয়। যা সত্য এবং কল্যাণকর, তা সকল মানুষের ক্ষেত্রে একই ধরনের, কিন্তু সুখ ব্যক্তিভেদে পৃথক। আমাদের মঙ্গল বা হিত লাভের জন্য, প্রফুল্লতা লাভের জন্য সচেষ্ট হতে হবে, যা আত্মার একটি অবস্থা। এই অবস্থা লাভের জন্য প্রয়ােজন বিভিন্ন ধরনের সুখকে ওজন করে, বিচার করে ও তাদের মধ্যে প্রভেদ করে দেখা। সঙ্গতি বা সামঞ্জস্যের নীতির দ্বারা আমাদের পরিচালিত হওয়া প্রয়ােজন। এই নীতির দ্বারা আমরা দেহের শান্তি-স্বাস্থ্য এবং আত্মার শান্তি প্রফুল্লতা লাভ করতে পারি। আত্মার সম্পদের মধ্য দিয়েই প্রধানত এই প্রশান্তি লাভ করা যায়। কাজেই মানুষের শান্তি জাগতিক সম্পদের উপর নির্ভর নয়, অন্তরের বা আত্মার সম্পদ অর্থাৎ আত্মার উপর নির্ভরশীল। সংযম এবং সরলতার মাধ্যমেই প্রশান্তি এবং প্রফুল্লতা লাভ করা যায়।

অ্যানাক্সাগোরাস (৫০০ – ৪২৮ খ্রি.পূ.)

  • সত্তা (Being)-এর উৎপত্তিও নেই, ধ্বংসও নেই, সত্তা অপরিবর্তনীয়। কোন কিছু উৎপন্নও হয় না, ধ্বংসও হয় না। যা আছে তাই সংযুক্ত হয়, বিযুক্ত হয়। জড় স্বয়ম্ভু এবং অবিনাশী। জড়ের আনুষঙ্গিক উপাদানের মিশ্রণ অমিশ্রণের দ্বারা বস্তুর উৎপত্তি এবং ধ্বংস ব্যাখ্যা করা যায়। উৎপত্তি এবং ধ্বংসের কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা কোন কিছুই উৎপন্ন বা ধ্বংস হয় না। পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল বা পূর্বস্থিত বস্তুর মিশ্রণ এবং অমিশ্রণই হল একমাত্র প্রক্রিয়া, যাদের যথাক্রমে সংযুক্তি এবং বিযুক্তি বলাই সমীচীন। (এম্পিডক্লিস প্রভাবিত)
  • অসংখ্য স্ব-নির্ভর উপাদান দ্বারা জড় গঠিত যারা হচ্ছে বীজ (Seeds)। ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎকে চারটি মূল উপাদান নয়, বরং যৌগিক বস্তু (Compounds)। (এম্পিডক্লিসের বিপরীতে)
  • সব জড়ই সমানভাবে মৌলিক এবং স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ অপরের থেকে উদ্ভূত নয়। স্বর্ণ, মৃত্তিকা, জল, কাঠ, সবই মৌলিক জড়। চুল যা চুল নয়, তার থেকে উদ্ভূত হতে পারে না, মাংস, যা মাংস নয়, তার থেকে উদ্ভুত হতে পারে না। এদের কোনটিই যেমন অপর কিছু থেকে উদ্ভূত হয় না, তেমনি অপর কিছুতে পরিবর্তিত হতে পারে না। (এম্পিডক্লিসের বিপরীতে)
  • জড় সকল অবস্থাতেই বিভাজ্য। সমগ্রের যে-কোন অংশ যা সমগ্রের সঙ্গে গুণের দিক থেকে এক জাতীয়, অবশ্যই মৌলিক এবং স্ব-নির্ভর হবে। (অ্যাটোমিস্টদের বিপরীতে)
  • জগতকে ব্যাখ্যা করতে হলে একটা মৌলিক বহুত্বকে স্বীকার করে নিতে হয়। তাই জগতের এমন একটা অবস্থা ছিল যেখানে সব জিনিস একত্র অবস্থান করছিল এবং তা সংখ্যা এবং ক্ষুদ্রতার দিক থেকে অন্তহীন ছিল। অর্থাৎ মৌলিক পদার্থ বা জড় অন্তহীনভাবে বিভাজ্য। তাই কোন অবিভাজ্য জড়কণার অস্তিত্ব ছিল না। শুরুতে সব ধরনের জড় অবিন্যস্তভাবে একত্র মিশে ছিল। তাই কাউকে তার ক্ষুদ্রতার জন্য অন্যের থেকে পৃথক করা সম্ভব ছিল না। সবই ছিল সমগ্রের মধ্যে। একইভাবে এখনও কোন জড়কণা অবিভাজ্য নয়, এটি সবসময় বিভাজ্য, এবং তার গুণ সবসময় সামগ্রিকের গুণ। (এটমিস্টদের বিপরীতে)
  • সব ধরনের জড়ের একত্র মিশ্রণ হলে এবং সমজাতীয় জড় সমজাতীয় জড়ের মধ্যে মিশ্রিত হলে অভিজ্ঞতাতে যে সব বস্তু দেখা যায় তাদের উৎপত্তি শুরু হয়। যেমন শুরুতে মৌলিক মিশ্রণে স্বর্ণের জড়কণা অন্য কণার সঙ্গে মিশে ছিল। কিন্তু যখন স্বর্ণের কণাগুলো একত্রিত হল, তখন সেখানে অন্য জড়কণা থাকলেও স্বর্ণের জড়কণার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে, তাকে স্বর্ণ বলেই চেনা যেতে লাগল। এভাবে সব অভিজ্ঞতায় দৃষ্ট বস্তুতে সব রকমের জড়কণা আছে, কিন্তু তারা এমনভাবে মিশ্রিত হয় যে, এক ধরনের জড়কণা প্রাধান্য লাভ করে এবং সেই জড়কণা অনুযায়ী বস্তুটির পরিচয় নির্দিষ্ট হয়। সব কিছুতেই অন্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে। প্রত্যেক কিছুকে সেই নাম দেয়া হয় যার মধ্যে সেই জিনিস অধিক পরিমাণে আছে।
  • যা মাংস নয় তার কাছ থেকে মাংস আসতে পারেনা, তাই তৃণ মাংসে পরিণত হলে তৃণের মধ্যে মাংসের কণার অস্তিত্ব ছিলই। আবার তৃণের মধ্যে তৃণকণার প্রাধান্য না থাকলে তাকে তৃণ বলে চেনা যায়না। তাই তৃণতে যখন মাংসের চেয়ে তৃণের প্রাধান্য বেশি ছিল তখন তাকে আমরা তৃণ বলে চিনি, আর এরপর সেখানে যখন মাংসের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে মাংসের প্রাধান্যের সৃষ্টি হয় তখন তাকে আমরা মাংস বলে চিনি। এভাবে তৃণতে থাকা মাংসের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে তৃণ মাংসে পরিণত হয়। এভাবেই সব কিছুর পরিবর্তন ঘটে। তাই পরিবর্তন অলীক বা অধ্যাস নয়, বরং বাস্তব। (পারমিনাইডিসএটমিস্টদের বিপরীতে)
  • সব কিছুর ঐক্যের অবস্থা থেকে পরে বহুত্বের অবস্থার প্রাপ্তির ব্যাখ্যার জন্য বা জগতে বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য অর্থাৎ বস্তুর মধ্যকার একটি উপাদানের অন্য উপাদানের উপর প্রাধান্য সৃষ্টির ব্যাখ্যার জন্য গতিশক্তির ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। গতিশক্তিরূপে যে রাগ ও দ্বেষ (Love and Hate) অবাস্তব এবং পরিপূর্ণভাবে ভৌতিক (Physical) শক্তি, তাই তা হতে পারেনা। আবার পরমাণুবাদে পরমাণুর অন্তর্নিহিত গুণ হিসেবে গতিকে যে সমপূর্ণভাবে জড়শক্তি বলা হয় তাও হতে পারেনা। গতি-শক্তি জড়শক্তি বা ভৌতিক শক্তি নয়, এই শক্তি হল অ-জড় বা অ-ভৌতিক শক্তি। জগতের বাহ্য পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, সঙ্গতি ও উদ্দেশ্যকে অন্ধ জড়-শক্তির দ্বারা যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা যায়না, তাই এগুলোকে ব্যাখ্যার জন্য জগৎ নিয়ামক বুদ্ধি উপযােগী। জগৎ বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত। জগতের দিকে লক্ষ করলে উপায় ও লক্ষ্যের মধ্যে অভিযােজনের (Adaptation) বহুবিধ দৃষ্টান্ত, জগৎ জুড়ে রয়েছে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা দেখা যায়। অন্ধ জড়শক্তি জড়-উপাদানের উপর ক্রিয়া করে গতি ও পরিবর্তন উৎপন্ন করলেও, সুশৃঙ্খল, সুসঙ্গতিপূর্ণ কোন জগৎ সৃষ্টি করতে পারে না। কেবল বুদ্ধি শৃঙ্খলা ও সঙ্গতি নিয়ে আসতে পারে। তাই জগতের এই গতিশক্তি হলো ‘নাউস’ (Nous) অর্থাৎ মন বা বুদ্ধি। বুদ্ধি বা বুদ্ধির নীতিই প্রথম একত্রে অবস্থিত জড় উপাদানে ক্রিয়া উৎপন্ন করে জগতকে গঠিত বা সুবিন্যস্ত করে। এই মন (Mind) বা বুদ্ধি (Intelligence) একই সাথে গতির উৎস এবং আমাদের মধ্যে জ্ঞানের উৎস। তাই কোন জগৎ নিয়ামক বুদ্ধি হিসেবে ‘Nous’ এর অস্তিত্ব আছে। জীবন যুক্ত বড় ছােট সব বস্তুর ওপর নাউসের ক্ষমতা আছে। (এম্পিডক্লিসএটমিস্টদের বিপরীতে)
  • মানুষ, ইতরপ্রাণী, উদ্ভিদ সহ সব জীবিত বস্তুতে নাউসের অবস্থান এবং সব কিছুতে এটি একই রকম। যাদের মধ্যে নাউস বর্তমান তাদের মধ্যে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা নাউসের জন্য নয়, বরং দেহের পার্থক্যের জন্য, যা নাউসের পরিপূর্ণ ক্রিয়া-শক্তিকে ক্ষেত্র বিশেষে বাধা দান করে বা ক্ষেত্র বিশেষে সহায়তা করে। মানুষের ক্ষেত্রে যে আপাত শ্রেষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয় তার কারণ মানুষ হস্তের অধিকারী , ইতর প্রাণীরা তা নয়। উভয়ের মধ্যে বুদ্ধিগত পার্থক্য দৈহিক পার্থক্য। সমগ্র আবর্তনের উপর নাউস এর ক্ষমতা ছিল বলে এটি শুরুতে আবর্তিত হতে আরম্ভ করে। সব জিনিসের মধ্যে নাউস-ই সঙ্গতি এনে দেয়।
  • সব মিলে জগতের ব্যাখ্যা প্রদানে দুটো বিষয়ের প্রয়োজন হচ্ছে – মূল উপাদান হিসেবে একাধিক রকমের ও বিভাজ্য সিড যা থেকে সব কিছুর উৎপন্ন হয়, এবং সিডস এর গতিশীলতার মাধ্যমে সুশৃঙ্খল জগৎ ও জীবনের সৃষ্টির জন্য নাউস। (দ্বৈতবাদ)

সোফিস্ট স্কুল

প্রোটাগোরাস (৪৮০-৪১০ খ্রি.পূ.)

  • কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রদত্ত বিবরণ বা একই ব্যক্তির বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বিবরণ ভিন্ন হয়; এই জাতীয় বিবরণের ভিত্তিতে সত্য নিরূপণ করা যায় না।
  • সব কিছুই পরিবর্তনশীল, স্থায়ী কোন কিছু নেই, ভবন (Becoming)–ই সত্য, স্থায়ীত্ব অলীক বা মিথ্যা, যা এই মুহূর্তে আছে, তা পরমুহূর্তে নেই, কোন কিছু আছে, এও যেমন সত্য, নেই, তাও তেমন সত্য। সত্য-মিথ্যা, নৈতিক মূল্য সহ অন্যান্য মূল্যের ব্যাপারেও এই স্থায়ীত্বের অলীকতার ধারণা সত্য। (হেরাক্লিটাস প্রভাবিত)
  • তাই, মানুষ সব কিছুর মাপকাঠি বা মানদণ্ড, প্রতিটি মানুষ নিজের কাছে যাকে সত্য বলে মনে করে, তাই সত্য। সবকিছুর পরিমাপ মানুষ নিজে, যা তােমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে, তা তােমার কাছে সত্য, যা আমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে, তা আমার কাছে সত্য। এই সত্য হবার বিষয়ে কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ নয়, বরং ভাল–মন্দ, সুন্দর, কুৎসিৎ, উচিত, অনুচিত এর মত মূল্যও অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। বস্তুগত সত্যতা অর্থাৎ সত্যের ব্যক্তি-নিরপেক্ষতা বলতে কিছু নেই। পরম সত্য-মিথ্যা বলে কিছু নেই। যা আমি সত্য বলে অনুভব করি তাই যদি সত্য হয়, সত্যতা আমার অনুভূতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, অর্থাৎ ব্যক্তির সংবেদন বা ব্যক্তির মনে যা কিছু ছাপ রেখে যায়, সেগুলোই তার কাছে সত্য। বস্তুগত সত্য বলে আর কিছু থাকে না। (পূর্বের সমস্ত দর্শনের বিপরীতে) (বস্তুগত সত্যের উদাহরণ – “পৃথিবী গোল”, মানুষ যাই মনে করুক, পৃথিবী সবসময় গোল, এটাই পৃথিবীর আকৃতি বিষয়ক বস্তুগত সত্য।)
  • ভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতা বলে কিছু নেই, যে বচনকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়, উপযুক্ত যুক্তি সহকারে তার বিরােধী বচনকেও সত্য বলে উপস্থাপিত করা যায়।
  • ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। একেক মানুষ একেক রকম, তাদের ইন্দ্রিয়-সংবেদন একেক রকম, তাই তাদের জ্ঞানও একেক রকম।
  • বস্তুগত সত্যতার যদি কোন অস্তিত্ব না থাকলে পরম-জ্ঞান সম্ভবপর হয়না। তাই পরম-জ্ঞান অসম্ভব।
  • নৈতিক অবধারণ আপেক্ষিক কেননা নৈতিক অভিমতের ক্ষেত্রে সত্য বা মিথ্যা হবার প্রশ্ন দেখা না দিলেও, কোন অভিমত অন্য অভিমতের তুলনায় বেশি উপযােগী হতে পারে। কাজেই কেউ ভ্রান্তভাবে চিন্তা করে না, এ কথা যেমন সত্য, আবার তেমনি কোন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী, এ কথাও সত্য। বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলো আপেক্ষিক, কেননা কোন আইন আবার অপর আইনের তুলনায় বেশি উপযােগী হতে পারে। রাষ্ট্র বা নগর সম্প্রদায় (City Community)-ই কোন আইন প্রণয়ন করবে, তা নির্ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তব নৈতিক অবধারণগুলো প্রকৃতির দিক থেকে আপেক্ষিক বলেই গণ্য হবে।
  • নৈতিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার কথা চিন্তা না করে কোন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তবে সব নৈতিকতা, নিয়ম তুলনামূলকভাবে যথার্থ, কেননা যে সমাজ সেগুলো প্রণয়ন করেছে কেবলমাত্র সেই সমাজের দৃষ্টিতেই সেগুলো যথার্থ বলে গণ্য করা হবে। পরম ধর্ম, নৈতিকতা, এবং ন্যায়পরায়ণতা বলে কিছুই নেই। বিভিন্ন জনসাধারণের প্রণীত সংবিধান, আইন, তাদের ভাষ্য এবং ধর্মীয় ধারণার মতই আপেক্ষিক। ব্যক্তি-নাগরিকদের উচিত হবে সম্প্রদায় প্রণীত নিয়মকানুন মেনে চলা, ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা, কেননা কোন নিয়মই অপরটির চেয়ে বেশি সত্য নয়।
  • শিক্ষার দ্বারা আত্মার অবস্থার উন্নতি সাধন করা যেতে পারে। মন্দ অনুভূতি, মিথ্যা অনুভূতির বদলে সুস্থ এবং সত্য অনুভূতিকে আত্মায় উপস্থাপিত করা যেতে পারে।
  • দেবতারা বা ঈশ্বর আছে কি নেই, তা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়না। তাই অজ্ঞেয়বাদী অবস্থান সঠিক।

প্রােডিকাস (আনু. ৪৬৫-৩৯৫ খ্রি.পূ.)

  • ধর্মের শুরুতে মানুষ সূর্য, চন্দ্র, নদী, হ্রদ, ফল প্রভৃতিকে অর্থাৎ, সেই সব বস্তুকে যাদের সে উপকারী মনে করত, তাদের দেবতারূপে উপাসনা বা পুজা করত এবং তাদের উদ্দেশ্যে খাদ্য উৎসর্গ করত। উদাহরণ মিশর দেশের নীল নদীকে কেন্দ্র করে ধর্মবিশ্বাস। ধর্মের এই আদিম স্তরের পরবর্তী এক দ্বিতীয় স্তরে কৃষি, ধাতুর কাজ, আঙুরের চাষ ইত্যাদির আবিষ্কার কর্তাদের ডিমিটার (Demeter), ডায়ােনিসাস (Dionysus), হেফেস্টাস (Hephaestus) প্রভৃতিকে দেবতার পূজা করা হত। সমাজে কিসে মানুষের উপকার হয় তার ভিত্তিতে মানুষের ধর্মভাবনার প্রকৃতি নির্ভর করে। এটা সমাজভেদে পাল্টায়। তাই ধর্ম বা ধর্মোপাসনার ক্ষেত্রে পরম সত্য বলতে কিছু হয়না। ধর্মোপসনা প্রয়ােজনহীন।

হিপ্পিয়াস (খ্রি.পূ. ৫ম শতকের শেষের দিক)

  • আত্মপরিতৃপ্তি হলো নৈতিক আদর্শ। নিজের জন্য যা প্রয়ােজন তা সংগ্রহ করে পর-নির্ভরতা থেকে নিজেকে মুক্ত করাই হলো এই আত্মপরিতৃপ্তি।
  • দেশের প্রচলিত আইন প্রাকৃতিক নিয়মের বিরােধী। প্রচলিত আইন প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা সংশােধিত হয়।
  • গ্রীক নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ সীমা উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ আকাঙক্ষা ও প্রত্যাশা সমন্বিত এক স্বাধীন মানব-সমাজ ও নাগরিকত্বের ধারণা দরকার।

জর্জিয়াস (৪৮৩ – ৩৭৫ খ্রি.পূ.)

  • যা কিছু অস্তিত্বশীল তাই আত্ম-বিরােধিতা দোষে দুষ্ট। তাই কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। (জেনো প্রভাবিত, কিন্তু জেনো নিজে পারমিনাইডিসের সত্তার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন)
  • কোন কিছুকে অস্তিত্বশীল হতে হলে তার একটা উৎপত্তি থাকবে, তার একটা শুরু থাকবে। সেটি সত্তা থেকে কিংবা অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। সত্তা থেকে উৎপন্ন হলে, এর শুরু আছে বলা যেতে পারে না, কারণ সেটা নিজেও সত্তাই হয়। আর যদি অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলা হয় তাহলে তা হবে অর্থহীন, কারণ নিছক শূন্যতা থেকে কোন কিছু উৎপন্ন হতে পারেনা। আর যদি একথা বলা হয়, যা আছে তা অনাদিকাল থেকে রয়েছে তাহলে তাকে অসীম হতে হবে। কিন্তু যা অসীম তা অন্য কিছুতে অস্তিত্বশীল হতে পারে না, বা নিজেতেই অস্তিত্বশীল হতে পারে না। কাজেই তা কোথাও অস্তিত্বশীল নয়। তার মানেই তা অস্তিত্বশীল নয়, বা তা সম্ভব নয়। কাজেই কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। (পারমিনাইডিসের প্রভাবে কিন্তু বিপরীতে)
  • যদি কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তাকে জানা যায় না। কারণ জ্ঞান হল ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ নির্ভর এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ যেহেতু ব্যক্তিভেদে পৃথক, এমনকি একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথক বস্তু সেহেতু তাকে জানা যায় না। (প্রোটাগোরাস প্রভাবিত)
  • যদি কোন কিছু অস্তিত্বশীল হয়, তাকে অপরের কাছে প্রকাশ করা যায় না, কারণ বস্তুর সংবেদন ব্যক্তিভেদে পৃথক, এবং তা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাকে অপরের কাছে ব্যক্ত করা যায়না। শব্দের সাহায্যে অপরকে বর্ণের জ্ঞান দেয়া যায়না, কেননা কর্ণ ধ্বনি শােনে, বর্ণ শোনে না। সত্তার একই ছাপ, দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই সময়ে কি বিদ্যমান নয়, কারণ তারা পরস্পর পৃথক।
  • বাগ্মিতার কলাকৌশলকে বিশ্বাস বা প্রত্যয় উৎপাদন বা নির্দিষ্ট কোন মতে কারও সমর্থন লাভের ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ কলাবিদ্যা। আর যেহেতু সত্য বলে কিছু হয়না তাই বাগ্মিতার মাধ্যমে নিজের পক্ষে লোককে টানা যায়, আর তা নেসেসারিলি অনৈতিক নয়। প্রতারণা নৈতিকভাবে সমর্থনযােগ্য (Justifiable Deception) হতে পারে। সৌন্দর্যবিদ্যাগত অর্থে বিয়ােগান্তক নাটক এমনই প্রতারণা। (প্রোটাগোরাস প্রভাবিত)
  • বুদ্ধিবৃত্তিসম্পৰ্কীয় ক্রিয়ার ভাল নৈতিক ফল আছে। সকল রকম পরিকল্পনা বা আবিষ্কারের ফলেই সভ্যতার প্রগতি ঘটে।

মেনো ও প্রক্সিনাস

  • জোর যার মুল্লুক তার। প্রকৃতির নিয়ম হল যারা দূর্বল তারা শক্তিমানের দ্বারা শাসিত হবে। (জর্জিয়াস প্রভাবিত)

এলসিডেমাস

  • সব মানুষই সমান। প্রাকৃতিক নিয়ম ক্রীতদাসের মুক্তির পক্ষে। ঈশ্বর সকলকেই স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতি কাউকেই ক্রীতদাস করেনি। (জর্জিয়াস প্রভাবিত)

সক্রেটিস ও সক্রেটিক স্কুলসমূহ

সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রি.পূ.)

  • বিশেষ ধারণাগুলোর (Particular Idea) সাদৃশ্য বা সাধারণগুলোকে নিয়ে, অমিলগুলো বাদ দিয়ে, এবং যে বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশেষ ধারণাগুলোকে এক শ্রেণীভূক্ত করা হচ্ছে তা নিয়ে সাহায্যে সার্বিক ধারণা (General idea) বা প্রত্যয় (Concept) গঠন করা যায়। এই পদ্ধতির নাম হলো আরোহ যুক্তি (Inductive Arguments)। এর মাধ্যমেই কোন বিষয়ের প্রত্যয় ও সংজ্ঞা নিরুপণ করা যায়। সংজ্ঞা নিরুপণ বা সংজ্ঞা গঠন বলা যায় কারণ শব্দের মাধ্যমে প্রত্যয়কে ব্যক্ত করাকে সংজ্ঞা বলে। তাই কোন বিষয়ের সার্বিক ধারণা এবং সংজ্ঞা (Definition) বা সার্বিক সংজ্ঞা (Universal Definition) অভিন্ন। বিশেষ বিশেষ বস্তুর সাধারণ গুণগুলো নির্ণয়ের মাধ্যমেই কোন একটি বস্তুর সার্বিক প্রত্যয় বা সংজ্ঞা নিরুপণ করা, এবং এভাবে বিষয়ের জ্ঞান লাভ সম্ভব। তাই মানুষের জ্ঞান প্রত্যয় নির্ভর, অর্থাৎ প্রত্যয় থেকে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। (প্রোটাগোরাসের বিপরীতে)
  • সার্বিক বা সামান্য প্রত্যয় যেমন— ‘মানুষ’, ‘বৃক্ষ’ সবসময়ই এক বা অভিন্ন থাকে। তার কোন পরিবর্তন নেই। এটি বস্তুনিরপেক্ষ বা মনোগত (Subjective) নয়। যেমন, ‘মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন প্রাণী’— মানুষের এই সংজ্ঞার কোন পরিবর্তন নেই। সব অবস্থাতেই এটি অপরিবর্তনীয়, এমন কি পৃথিবী থেকে সব মানুষের অস্তিত্ত্ব মুছে গেলেও ‘বুদ্ধি বৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী,’ মানুষের এই সংজ্ঞা অপরিবর্তিত থাকবে। সার্বিক ধারণা তাই স্থির এবং অপরিণামী। (প্রোটাগোরাসের বিপরীতে)
  • ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে বলে তাকে জ্ঞান লাভের উপায় ধরা যায়না। কিন্তু মানুষ প্রত্যয় থেকে জ্ঞান লাভ করে, আর এই কাজটা করায় মানুষের বুদ্ধি। বুদ্ধি সকল মানুষের ক্ষেত্রে একরূপ। নির্দিষ্ট প্রত্যয় থেকে জ্ঞান লাভের অভাব হলো বুদ্ধিরই অভাব। তাই বুদ্ধিতে যা সত্য বলে গৃহীত হবে তাই সত্য। তাই ইন্দ্রিয় সংবেদন নয়, বরং বিচারবুদ্ধিই জ্ঞানলাভের উপায়। প্রত্যয় স্থির বা অপরিণামী বলে এই লব্ধ জ্ঞান বা সত্যও স্থির, অপরিনামী, বস্তুগত ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ। (প্রোটাগোরাস প্রভাবিত কিন্তু বিপরীতে)
  • সততা ও জ্ঞান অভিন্ন, কারণ সততা বা নৈতিক কাজ করার জন্য কোনটা নৈতিক অর্থাৎ কিসে সকলের মঙ্গল সেই সম্পর্কে জ্ঞান আবশ্যক। (সমালোচনায় বলা হয় কিসে মঙ্গল তা জেনেও মানুষ অমঙ্গল কাজ করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বলা যায়, সে নিজে সমাজের অংশ বলে সমাজের অমঙ্গল হওয়ায় তার অমঙ্গল হতে পারে, আর মঙ্গল সম্পর্কে নিজের জ্ঞান বা আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে অসৎ কাজ করায় তার কগনিটিভ ডিজোনেন্সের কারণে তার ব্যক্তিগত ক্ষতি হতে পারে। তাই নিজের ভালর জন্য জেনেও অনৈতিক কাজ করাটা আসলে অজ্ঞানতা বা জ্ঞানের অভাব নির্দেশ করে।) এখান থেকে বলা যায় সব অন্যায় কাজই অজ্ঞতাপ্রসূত।
  • সততা বা নৈতিকতার জ্ঞানের সাথে কল্যাণ অর্জনের যথোচিত লক্ষ্য অর্জন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের বাসনা অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত। তাই নৈতিক জ্ঞানের উৎকর্ষ অন্য জ্ঞানের তুলনায় অধিকতর। কেননা নৈতিক জ্ঞানই হল একমাত্র জ্ঞান যা মানুষকে শান্তি লাভের জন্য সবরকম কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। সততার জ্ঞান বা নৈতিক জ্ঞান পেশাগত নৈপুন্যে জ্ঞান বা অন্যান্য জ্ঞানের থেকে উৎকৃষ্ট। কোন ব্যক্তির জীবনের যথোচিত লক্ষ্য হচ্ছে যা প্রকৃতপক্ষে সৎ ও কল্যাণকর তা অর্জন। এখন এই যথোচিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য একজনের কাছে সেই লক্ষ্যে অর্জনের সামর্থ্য থাকতে হবে, আবার সেই লাভের জন্য ইচ্ছা বা কামনা থাকতে হবে। এখন সততার জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে সেই অর্জনের জন্য সামর্থ ও সেই লক্ষ্যে যাবার কামনা চলে আসবে। তাই সততার জ্ঞান সেই যথোচিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য একই সাথে আবশ্যিক এবং পর্যাপ্ত হয়। অর্থাৎ সততার জ্ঞান না থাকলে যেমন যথোচিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় যেমন বলা যায়, একই সাথে এও বলা যায় যে যথোচিত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য কেবল সততার জ্ঞানই যথেষ্ট। কিন্তু পেশাগত নৈপুন্যের জ্ঞান লাভের মাধ্যমে যথোচিত লক্ষ্যে অর্জনের সামর্থ থাকলেও, তাতে সেই লক্ষ্য অর্জনের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের উপস্থিতি নাও থাকতে পারে। সেজন্য যথোচিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পেশাগত জ্ঞান আবশ্যিক হয়, কিন্তু পর্যাপ্ত হয়না। কারণ যথোচিত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য যে ইচ্ছা বা বাসনার দরকার হয় তা পেশাগত নৈপুন্যের জ্ঞান থেকে অনিবার্য বা নিশ্চিতভাবে আসে না, আসে কেবল সততার জ্ঞান থেকে। সততার জ্ঞানই মানুষের মধ্যে যথোচিত লক্ষ্য, অর্থাৎ মঙ্গল বা কল্যাণকর লক্ষে যাবার ইচ্ছা বা বাসনা তৈরি করতে পারে। আবার পেশাগত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্যের জ্ঞান বড় কথা নয়, লক্ষ লাভের দক্ষতাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে খারাপ দৌড়ায়, সে জানে তার লক্ষ হল প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করা কিন্তু তাকে অজ্ঞ বলে গণ্য করা হয় এই জন্য যে, লক্ষ সম্পর্কে অবহিত হয়েও সে খারাপভাবে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু সততার জ্ঞানে যথোচিত লক্ষ্যে পৌঁছনো গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই সততার জ্ঞান বা নৈতিক জ্ঞান পেশাগত নৈপুন্যে জ্ঞান বা অন্যান্য জ্ঞানের থেকে উৎকৃষ্ট।
  • নীতিতত্ত্বের সঙ্গে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। নীতি তত্ত্ব ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন। সমাজ ও নিজের মঙ্গলই এর ভিত্তি।
  • মিথ্যাচার, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি, মহানুভবতা, দয়া, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা ইত্যাদি একাধিক সদ্গুণের কথা শোনা গেলেও এইসব বিশেষ সদগুণের একটি মাত্র উৎস রয়েছে, তা হচ্ছে জ্ঞান। মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানই মানুষকে সব রকম সদ্গুণের দিকে নিয়ে যায়।
  • সক্রেটিস দু-ধরনের সততার মধ্যে পার্থক্য করেছেন— দার্শনিক সততা (Philosophic Goodness) এবং লৌকিক সততা (Popular Goodness)। প্রথমটি বুদ্ধিনির্ভর, দ্বিতীয়টি অভ্যাসনির্ভর। সোফিস্টদের সততা হলো লৌকিক সততা যা আসলে সততা নয় কেননা তা জ্ঞান-নির্ভর নয়, সোফিস্টরা যখন সততার শিক্ষা দেবার কথা বলেন তখন এই লৌকিক সততার শিক্ষা দেবার কথা বলেন, যার সাথে রাষ্ট্র ও সমাজের শেখানো বিধিনিষেধের ব্যাপার জড়িত। কিন্তু প্রকৃত সততা হলো দার্শনিক সততা যা কেবল জ্ঞান নির্ভরই হতে পারে। আর মানুষকে যেহেতু জ্ঞান দান করা যায়, তাই সততা বা নৈতিকতাও তাকে শেখানো যায়। এক্ষেত্রে সততার শিক্ষা হলো দার্শনিক সততার শিক্ষা। (প্রোটাগোরাসের বিপরীতে)
  • যে চিকিৎসকের চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই, কোন রোগী, চিকিৎসার জন্য সেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চাইবে না। তেমনি যারা রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তারা যদি শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হন তাহলে রাষ্ট্রের জনসাধারণ তাঁদের উপরে নির্ভর করে স্বস্তি পাবে না। সেকারণে রাষ্ট্রের যারা পরিচালক তাদের অভিজ্ঞতা যাচাই না করে তাদের নির্বাচন করা, বা অনভিজ্ঞ জনসাধারণের মাঝখান থেকে তাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করাও যুক্তিসঙ্গত নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসকবৃন্দকে অবশ্যই শাসন ব্যবস্থার জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। তাই তদকালীন এথেন্সের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সঠিক নয়।
  • আত্মা হল মানুষের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অংশ এবং মানুষের মধ্যে এই আত্মা হল তাই, যা ঈশ্বরের অংশ গ্রহণ করে।
  • আত্মা হল অ-ভৌতিক। দেহকে প্রত্যক্ষ করা যায়, কিন্তু আত্মা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়।
  • আত্মাতেই কেবলমাত্র বিচারবুদ্ধি অবস্থান করে। তাই আত্মা দেহকে নিয়ন্ত্রিত করে। কোন ব্যক্তির নৈতিক আচরণ হল তার আত্মার আচরণ, দেহের নয়, আর তা বিচারবুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত।
  • আত্মসংযম হল একটি প্রধান নৈতিক ধারণা যার অর্থ হলো আত্মার দেহের উপর কর্তৃত্ব। যে দেহে আত্মা অবস্থান করে সেই দেহে যে সুখের উৎপত্তি ঘটে সেগুলি আত্মাকে আত্মসংযম পরিহার করে যত শীঘ্র দেহের সুখভোগে প্রণোদিত করে। প্রতিটি মানুষের উচিত আত্মসংযমকে সব সৎগুণের ভিত্তি বলে গণ্য করা এবং সব কিছুর উপরে তাকে আত্মায় প্রতিষ্ঠিত করা। নৈতিক দিক থেকে যে ব্যক্তিকে সৎ বলা চলে, তিনি আত্মা সম্পর্কে যত্নবান হলে, আত্মনির্ভর হতে পারবেন। এই ধরনের ব্যক্তি স্বল্প জাগতিক সম্পদে সুখী হবে এবং দৈহিক সুখের ব্যাপারে সুদৃঢ় আত্মসংযমের অধিকারী হবে। কারণ দৈহিক সুখের ক্রীতদাসত্ব স্বীকার করার অর্থ আত্মাকে কলুষিত করা। খাদ্য, পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, যৌন সুখ, এগুলো দেহের বিষয় এবং সৎ ব্যক্তির উচিত এদের প্রতি কামনাকে সংযত করা। ব্যক্তির উচিত নয় তার দেহ, অর্থ, খ্যাতির জন্য লালায়িত হওয়া। তার উচিত হল সত্যতা ও বিজ্ঞতা লাভে এবং আত্মার উৎকর্ষ সাধনে যত্নবান হওয়া। নঞর্থক দিক থেকে বিচার করলে সৎ জীবন হল জাগতিক সম্পদ আহরণ এবং দৈহিক সুখভোগের ব্যাপারে মিথ্যাচার ও মিতব্যয়িতা, সদর্থক দিক থেকে বিচার করলে এই জীবন হল মানুষ নিজেকে যতখানি জ্ঞানী করা সম্ভব, ততখানি জ্ঞানী করে তোলার কঠিন সংকল্পে ব্রতী হওয়া।
  • আত্মা অপ্রতক্ষ্যগ্রাহ্য এবং ঐশ্বরিক, মানুষের একটি স্বতন্ত্র অংশ, এমন একটি সত্তা যা দেহ থেকে স্বতন্ত্র। দেহের তুলনায় আত্মার যত্ন সাধনকে সৎ লোকের লক্ষ। আত্মার যত্ন সাধন মানে হল, কল্যাণের যত্ন সাধন অর্থাৎ নিজের যত্ন সাধন। যখন কেউ নিজের আত্মার কল্যাণ সাধনে যত্নবান হয় তখন সে তার প্রকৃত আত্মার সম্পর্কে যত্নবান হয়।
  • অহং (Self)-এর সঙ্গে আত্মা অভিন্ন। মানুষ দেহ থেকে ভিন্ন। যেহেতু মানুষ দেহকে ব্যবহার করে, মানুষ দেহ হতে পারে না বা দেহ ও আত্মা উভয় হতে পারে না। কিন্তু মানুষ কিছুই নয় বা কিছু, এবং সেক্ষেত্রে মানুষ আত্মা ছাড়া কিছুই নয়।
  • দেহের বিনাশ সাধিত হলেও আত্মার বিনাশ সাধিত হয় না। মৃত্যু দুটি বিষয়ের মধ্যে একটি হবে – হয় কোন কিছুরই চেতনা থাকবে না, না হয় আত্মা এই জগৎ থেকে অন্য জগতে উত্তীর্ণ হবে।
  • বাহ্য জগতের মধ্য দিয়ে যেমন ঈশ্বরের প্রকাশ, তেমনি জীবের অন্তরেও তিনি বিরাজমান। মানুষের আত্মার যে বিচারবুদ্ধির কারণে মানুষ নৈতিক জ্ঞান প্রাপ্ত হয় সেই বিচারবুদ্ধি বিশ্ব-মন বা সার্বিক ধীশক্তির (Universal Reason) অংশ, অন্যভাবে বললে ঈশ্বরের অংশ। তাই মানুষের নৈতিক কর্তব্য ঈশ্বরের অনুমোদিত বা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা এবং অন্যায় কর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধী।
  • ঈশ্বর সত্য, সর্বজ্ঞ, সর্বমহানুভব ও মঙ্গলময়। দেবতারা ঈশ্বরের অধীন। দেবতাদের জ্ঞান সীমিত নয়, তারা সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ। দেবতারা কল্যাণ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন। তাই মানুষের উচিত দেবতার কাছে ধনসম্পদ প্রার্থনা না করে কল্যাণ (Good) প্রার্থনা করা।
  • এই জগতের বিন্যাসের ক্ষেত্রে যা কিছু ঐশ্বরিক তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এবং যা কিছু অসাধুজনিত, অন্যায় এবং কলঙ্কজনক তা থেকে মানুষের বিরত হওয়ার বাধ্যবাধকতা মানব জাতির প্রতি ঈশ্বরের সদয় তত্ত্বাবধানকে প্রতিবাদিত করে।
  • বিচারবুদ্ধি ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য। মানুষের আত্মা বা মন যেমন দেহের ওপর শৃঙ্খলা আনয়ন করে, তেমন ঈশ্বরের বুদ্ধি জগতের শৃঙ্খলা আনয়ন করে। তাই ঈশ্বরের বুদ্ধি ও জড় জগতের সম্পর্ক, মানুষের মন ও দেহের সম্পর্কের মত।
  • জগতের সব কিছুকে যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক (Mechanical Causation)-এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়না, কেননা জগতের সব কিছু আকষ্মিকভাবে বা দৈবে ঘটেনা। জগতে বরং পরিকল্পনা দেখা যায়। যেমন মানুষের ঋজু অঙ্গবিন্যাস, তার কথা বলার সামর্থ্য তার বুদ্ধি সবই তার কল্যাণ সাধনের উপযোগী, যেহেতু এগুলি তাকে সকল অবস্থায় রক্ষা করতে সমর্থ করে এবং তার শাস্তি বর্ধিত করে। এই প্রাকৃতিক জগতে যে শৃঙ্খলা দেখা যায় তাও কোন নিয়ন্ত্রণকারী বুদ্ধির দৃষ্টান্ত। এসব থেকে প্রতিপাদিত হয় যে জগতে ঐশ্বরিক পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য কাজ করে, তাই জগৎকে পরিণতিমূলক কার্যকারণ সম্পর্ক (Teleogical Causation) দিয়ে ব্যাখ্যা করা দরকার। সব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ সিদ্ধ হচ্ছে। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধি জন্য যে পরিকল্পনা দরকার তা এক নিয়ামক বুদ্ধির (Directing intelligence) প্রকাশ ও পরিণাম, দৈবের নয়। এই সব কিছুই এক বুদ্ধিমান স্থপতির অস্তিত্ব নির্দেশ করে, যিনি সমগ্র জগতকে ধারণ করে আছেন এবং তার শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন, এবং জগতের উপর তাঁর বুদ্ধিময় কর্তৃত্ব বর্তমান। আর এই বুদ্ধি হচ্ছে ঈশ্বরের বুদ্ধি।
  • মানুষ, বাতাস, অগ্নি, ঋতুর সুখ সুবিধা, অন্য প্রাণীকে তার প্রয়োজনে ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করে। সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়, বুদ্ধি, বাকশক্তির অধিকারী হওয়া এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বজ্ঞানের অধিকারী হওয়া মানুষের সুবিধাজনক অবস্থান প্রমাণ বহন করে। তাই বলা যায় ঈশ্বরের মানুষের প্রতি সদয় তত্ত্বাবধানের এবং মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য ঈশ্বর এই জগতের পরিকল্পনা করেছেন। এইসব সুবিধা ভোগ করার ফলে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর জীবনের তুলনায় তার জীবনকে অনেক উন্নত করে তোলে এবং এই সব সুবিধাগুলি যত বিকাশপ্রাপ্ত হয় মানুষ তত সুখী হয়।

সক্রেটিক স্কুলসমূহ

সিনিক স্কুল – অ্যান্টিস্থিনিস (৪৪৬-৩৬৬ খ্রি.পূ.), ডায়োজিনিস (৪১২/৪০৪ – ৩২৩ খ্রি.পূ.)

  • সুখের জন্য সততাই যথেষ্ট এবং সততার জন্য যা প্রয়োজন তা হল সক্রেটিসের শক্তির, আর কিছুর নয়, এ হল কাজের ব্যাপার। এর জন্য বেশি কথা বা বেশি বিদ্যার কোন প্রয়োজন নেই। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততাই হল জীবনের লক্ষ, সুখ-দুঃখের প্রতি পূর্ণ নির্বিকার ভাব ও কঠোর উদাসীনতা। কোন প্রবৃত্তির পরাধীন না হওয়াই নৈতিক জীবনের আদর্শ বা লক্ষ। যতটুকু পার্থিব প্রয়োজন জীবনের পক্ষে অপরিহার্য তার বেশি কিছুর ওপর নির্ভর করা চলবে না। তাহলেই স্বাধীনতা হারিয়ে পরাধীন হতে হবে। পরনির্ভরতা মানেই পরাধীনতা, আত্মনির্ভরতাই সেহেতু একমাত্র কাম্য, আত্মনির্ভরতা হচ্ছে কোনরকম ঘটনাচক্রের দাস না হওয়া বা পার্থিব প্রয়োজনের দ্বারা প্রলুদ্ধ না হওয়া। এজন্য আমাদের অভাবকে সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনকে বর্জন করতে হবে, প্রকৃতির মুক্ত উদার অঙ্গনে আমাদের বিহার করতে হবে, ঐশ্বর্য বা লালসা থেকে বিরত হতে হবে এবং সমাজের প্রশংসা বা নিন্দাকে তুচ্ছ করতে হবে। কাজেই সততা হল কামনারহিত হওয়া, অভাব থেকে মুক্ত হওয়া এবং পরিপূর্ণ স্বনির্ভরতা। (সক্রেটিস প্রভাবিত কিন্তু বিপরীতে)
  • বিশিষ্ট বস্তুর অস্তিত্ব আছে, সার্বিকের অস্তিত্ব নেই। বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর-ই (Individuals) শুধুমাত্র অস্তিত্ব আছে, এবং ভৌতিক এবং ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বিষয়ই বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু। বিশেষ বস্তুসমূহ আমাদের মনের ওপর যে ছাপ ফেলে, তথাকথিত সার্বিকগুলো তারই নামান্তর। অর্থাৎ সার্বিকের অধিষ্ঠান আমাদের মনে। এ ছাড়া মনোনিরপেক্ষ বাহ্য অস্তিত্ব বলতে তাদের কিছু নেই। (সক্রেটিসের বিপরীতে)
  • উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন বিধেয় আরোপ করা চলবে না। আমরা কোন বিশিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসূচক প্রকৃতিকেই বিধেয়রূপে ব্যবহার করতে পারি। কোন উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সেই উদ্দেশ্য থেকে পৃথক কোন বিধেয় প্রয়োগ করা অনুমোদনযোগ্য নয়। যা যৌগিক, যে উপাদানের দ্বারা তা গঠিত, তার উল্লেখ করেই তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে। যা সরল তাকে অপরের সঙ্গে তুলনা করে ব্যাখ্যা করা চলবে, তবে তার সংজ্ঞা দেওয়া চলবে না। (জর্জিয়াস প্রভাবিত)
  • কোন ব্যক্তি নিজের বিরুদ্ধতা করতে পারে না। কারণ যখন সে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের কথা বলে, তখন সে ভিন্ন বস্তুর কথা বলে। (পিথাগোরাস প্রভাবিত)
  • কেবলমাত্র সততাই কল্যাণ, পাপ হল অকল্যাণ। এই জগতের আর কোন কিছুই কল্যাণকর বা অকল্যাণকর নয়, ‘আর সব কিছুই সততা অসততা নিরপেক্ষ’। সম্পত্তি, সুখ, অর্থ, স্বাধীনতা, সৌভাগ্য, খ্যাতি, স্বাস্থ্য এরা নিজগুণে কল্যাণ নয়; দারিদ্র্য, দুঃখ, পীড়া, ক্রীতদাসত্ব, মৃত্যু, লজ্জা, এরাও নিজগুণের অকল্যাণকর নয়। কেননা প্রথমটিই যদি মানুষের প্রভু হয়ে দাঁড়ায় তাহলে মানুষকে সহজেই অধঃপতনের পথে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আর শেষেরটি মানুষকে সততা শিক্ষা দিতে পারে। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততাই স্বাধীনতা। ক্রীতদাস হওয়ার তুলনায় স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া শ্রেয় এমন কোন কথা নেই, কেননা ক্রীতদাসের যদি সততা থাকে, সে নিজেই স্বাধীন। আত্মহত্যা করা অপরাধ নয়। মানুষ তার জীবন ধ্বংস করতে পারে, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য নয়, বরং দেখাবার জন্য যে, জীবনের প্রতি সে উদাসীন। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততা এক ও অখণ্ড, তাকে ভাগ করা চলে না, পেতে হলে সবটুকুই পেতে হবে, কোন অংশকে নয়। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি হয় সৎ হবে, নয় অসৎ হবে। এই দুই-এর মাঝামাঝি কোন পথ নেই। জ্ঞানী ব্যক্তি সততাকে, সুখকে, পূর্ণতাকে পরিপূর্ণভাবে লাভ করে, আর মূর্খ ব্যক্তি লাভ করতে পারে অসততাকে, অকল্যাণকে এবং অপূর্ণতাকে। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততাই জ্ঞান এবং এই সততা শিক্ষালভ্য। এই সততা হল মূল্যের সংশোধনের জন্য পুননিরীক্ষণ (revision of values), উন্মাদনা থেকে মুক্তি এবং অধিকাংশ ব্যক্তি বস্তুর যে ভ্রমাত্মক মূল্যায়ন করে, তার থেকেও মুক্তি। মূল্যের যথাযথ তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারলেই মানুষ যথার্থ সুখের পথে নিজেকে চালিত করতে পারে এবং সেই যথার্থ সুখ হল রিপুর অধীনতা স্বীকার না করা এবং কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে য-নির্ভর জীবন-যাপন করা। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • শুধু একটি মাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। গ্রীকদের সর্বদেবতার মন্দির (Pantheon) রীতিগত বিষয়। সততাই হল দেবতার একমাত্র সেবা, মন্দির, প্রার্থনা, উৎসর্গ এসব অসার্থক। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দেবতা একাধিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেবতা একজনই।

সিরেনিক স্কুল – অ্যারিস্টিপাস (৪৩৫ – ৩৫৬ খ্রি.পূ.)

  • ইন্দ্রিয় সংবেদনই কেবলমাত্র আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান দান করে। (প্রোটাগোরাস প্রভাবিত)
  • ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার বিরোধী কোন নৈতিক নিয়ম নেই যা তার ওপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযুক্ত হতে পারে অর্থাৎ যা সে মেনে চলতে বাধ্য। (প্রোটাগোরাস প্রভাবিত)
  • মানুষের আচরণের লক্ষ হবে সুখজনক সংবেদন লাভের প্রচেষ্টা। সুখই মানবজীবনের চরম কাম্যবস্তু এবং পরম শ্রেয়। কোন কিছুই মন্দ নয়, যদি তা মানুষের সুখের বাসনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে। (প্রোটাগোরাস প্রভাবিত)
  • গতির মধ্যেই সংবেদন নিহিত। যখন এই গতি শান্ত তখন একটা সুখের অনুভূতি জাগে, যখন এই গতি অশান্ত বা স্থূল তখন ব্যথার সংবেদন বা অনুভূতি জাগে। আর গতি যদি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য না হয়, বা আদপেই যদি কোন গতি না ঘটে, তাহলে সুখ বা দুঃখ কোনটিরই অনুভূতি হয় না। প্রকৃতি নিজেই মানুষকে বলে দেয় যে, সুখই কেবলমাত্র মানুষের কাম্য। সুখ কল্যাণের সঙ্গে এবং মদ অ-কল্যাণের সঙ্গে অভিন্ন। সুখ দেহের মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া জনিত সংবেদন ছাড়া আর কিছুই নয়। সর্বাধিক পরিমাণ সুখলাভের উদ্দেশ্যেই মানুষের সব ক্রিয়া অবশ্যই চালিত হওয়া দরকার।
  • সুখের মূল্যায়নের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তির বিচার শক্তি থাকা চাই। জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তি, সুখ নির্বাচন করার সময় অবশ্যই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবেন। কাজেই সুখ কাম্য হলেও অসংযত মাত্রায় সুখভোগ পরিণামে দুঃখ আনয়ন করে, সেহেতু তাকে মানুষ বর্জন করবে। জনসাধারণের দ্বারা নিন্দিত হয় বা রাষ্ট্র কর্তৃক দণ্ডিত হয় এমন অসংযত ইন্দ্রিয়াচরণ থেকে মানুষ বিরত থাকবে। অনেক সুখকেই পেতে হলে বৃহত্তর দুঃখের মধ্য দিয়ে পেতে হবে। দৈহিক সুখের তীব্রতা ও স্থিতিকাল বেশি, কিন্তু এমন অনেক সংবেদন আছে দেহ থেকে যেগুলো উদ্ভূত হয় না। কাজেই জীবনের বিভিন্ন ধরনের সুখের মূল্যায়নের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তির বিচার শক্তি থাকা চাই। তা ছাড়া জ্ঞানী ব্যক্তিকে সুখভোগের ব্যাপারে কিছুমাত্রায় তার স্বাধীনতাকে সীমিত করতে হবে। যদি সে সুখের ক্রীতদাস হয়ে পড়ে, তাহলে সে সুখভোগ তো করতেই পারবে না, দুঃখে পতিত হবে। জীবনে ভোগের বস্তুকে কিভাবে ভোগ করতে হবে এটা বুঝে নিতে পারলে সুখ নষ্ট হবে না এবং নিজ কল্যাণে সবকিছুরই উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করা যাবে। এটাই হল সুখভোগের প্রথম শর্ত। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • বিশেষ বস্তুসমূহ আমাদের মনের ওপর যে ছাপ ফেলে, তথাকথিত সার্বিকগুলো তারই নামান্তর। অর্থাৎ সার্বিকের অধিষ্ঠান আমাদের মনে। এ ছাড়া মনোনিরপেক্ষ বাহ্য অস্তিত্ব বলতে তাদের কিছু নেই। (সিনিক প্রভাবিত, সক্রেটিসের বিপরীতে)
  • যেহেতু আমরা একে অন্যের সংবেদন ও চিন্তার সাথে সরাসরিভাবে পরিচিত নই, সুতরাং বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বস্তু থেকে একই সংবেদন পাচ্ছে-একথা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। যেমন, আমি যে বস্তুটিকে ‘লাল’ বলছি, তা আমার মনে যে বর্ণের সংবেদন সৃষ্টি করছে, অন্য একজনের মনেও যে তা একই সংবেদন সৃষ্টি করছে, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়না। আবার আমার দৃষ্টিতে যেসব গুণের কল্যাণে একজন মানুষ অন্যান্য জীবজন্তুর চেয়ে স্বতন্ত্র, অন্য একজনের দৃষ্টিতেও যে একই গুণাবলি মানুষের স্বাতন্ত্র্যের কারণ বলে বিবেচিত হবে, তা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। সক্রেটিসীয় সার্বিক এবং প্লেটোনিক প্রত্যয়সমূহের যে মনোনিরপেক্ষ বাহ্য অস্তিত্ব নেই তা-ই নয়, মানসিক ধারণা হিসেবে এরা সব মানুষের বেলায় একই অর্থ বহন করে কিনা তাও আমরা জানি না।  (সক্রেটিসের বিপরীতে)

মেগারিয়ান স্কুল – ইউক্লিড (৩০০ খ্রি.পূ.), ইউবুলাইডিস (খ্রি.পূ. ৪র্থ শতক), ডায়োডোরাস ক্রোনাস, স্টীলপো (৩৬০-২৮০ খ্রি.পূ.)

  • সত্যতা হল পরম সত্তার জ্ঞান। সততা হল এক, সততা হল জ্ঞান। এই জ্ঞান হল পরম সত্তার জ্ঞান বা কল্যাণের জ্ঞান। এই এক পরম সত্তাই (One Being) কল্যাণ, ঈশ্বর, মন এবং বুদ্ধি প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত। ভবন (Becoming), বহুত্ব, অকল্যাণ সত্তার বিপরীত যে অ-সত্তা (Not-Being) তারই ভিন্ন ভিন্ন নাম। কাজেই বহুত্ব অকল্যাণের সঙ্গে অভিন্ন এবং উভয়ই অলীক। অকল্যাণের প্রকৃতপক্ষে কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য প্রজ্ঞা ও জ্ঞান লাভ করা। (এলিয়াটিক স্কুলসক্রেটিস প্রভাবিত)
  • কল্যাণেরই বাস্তব অস্তিত্ব আছে। কল্যাণের বিপরীত কোন সত্তার অস্তিত্ব নেই, কারণ সেই সত্তা হবে বহুত্ব, যা অলীক বা মিথ্যা। (এলিয়াটিক স্কুল প্রভাবিত)
  • সততা হল এক, যা সত্তার জ্ঞান। মহানুভবতা, মিতাচার, বিজ্ঞতা (Wisdom) একই সততার ভিন্ন ভিন্ন নাম। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • চরিত্র-নীতির দিক থেকে যা ‘কল্যাণ’, প্রকৃতির দিক থেকে তাই ‘সত্তা’। সত্য এবং প্রজ্ঞা ভিন্ন অন্য সত্তার অস্তিত্ব নেই। মানুষের সর্বোত্তম অবস্থা তখনই পরিলক্ষিত হয়, যখন মানুষ তার ‘অন্তরস্থ সত্য ও প্রজ্ঞার অনুবর্তী হয়’।
  • বহুত্ব সম্ভব নয়। এক কণা শস্যকে স্তূপ বলা চলে না, তার সঙ্গে আর এক কণা শস্য যোগ করে দাও, তবু স্তূপ হয় না। এভাবে দেখা যায় বহুত্ব অলীক। (জেনো প্রভাবিত)
  • বাস্তবতাকেই সম্ভাব্যতার সঙ্গে অভিন্ন। কেবলমাত্র যা বাস্তব তাই সম্ভাব্য, আবার যা সম্ভাব্য তাই বাস্তব। (পারমিনাইডিস প্রভাবিত)

এলিয়ান-এরিট্রিয়াল স্কুল – ফিডো, মেনেডেমাস (৩৪৫/৪৪ – ২৬১/৬০ খ্রি.পূ.)

  • দর্শন আধ্যাত্মিক অকল্যাণের প্রতিকার ও প্রকৃত স্বাধীনতার পথনির্দেশক। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততা ও জ্ঞান এক। (সক্রেটিস প্রভাবিত)

প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রি.পূ.)

জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, পদার্থতত্ত্ব, মনোবিদ্যা

  • যথার্থ জ্ঞান হল নিত্য, সুসঙ্গত এবং সর্বকালে ও সর্বদেশে সত্য।
  • ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলে প্রতিটি ব্যক্তির কাছে যা সত্য বলে গণ্য হবে, ব্যক্তি তাকেই সত্য বলে গণ্য করবে। তাতে ভবিষ্যতের জ্ঞান সম্ভব হয়না, ভবিষ্যতে তা কল্যাণকর নাও হতে পারে, ব্যাধি সম্পর্কে তার জ্ঞান চিকিৎসকের জ্ঞানের চেয়ে বেশি বলে মনে হতে পারে ও তার মধ্য দিয়ে ক্ষতি হতে পারে। এই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্ববিরোধী হতে পারে কারণ একই বস্তু কাছে থেকে বৃহৎ এবং দূর থেকে ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। এটি হলে কোন ব্যক্তিই অপর ব্যক্তির তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী হতে পারে না, কারণ সবার কাছেই সব সত্য, তাতে তর্কের দ্বারা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়না। এটি হলে প্রত্যক্ষ করা ও জানার মধ্যে পার্থক্য করা যায়না, এক্ষেত্রে মানুষ প্রত্যক্ষ না করলেও পূর্বের প্রত্যক্ষ থেকে যাকে স্মরণ করতে সক্ষম তাকে জ্ঞান বলা যায়না। সব জ্ঞান প্রত্যক্ষের দ্বারা হয়না, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনেক জ্ঞানকেই বৌদ্ধিক মননের মাধ্যমে জানতে হয়, যেমন বুদ্ধি ছাড়া মরীচিকা সম্পর্কে জ্ঞান সম্ভব নয়, কারণ প্রত্যক্ষণ মরীচিকাকে বাস্তব বলে। কোন কিছুকে তখন জ্ঞান বলা যায় যখন তার অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতা, অপর বস্তুর সঙ্গে তার সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যের কথা জানতে পারি, এটি বুদ্ধি ছাড়া ঘটেনা। তাই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ জ্ঞান নয়, বুদ্ধির দরকার। (সক্রেটিস প্রভাবিত, প্রোটাগোরাসের বিপরীতে)।
  • জ্ঞান শুধুমাত্র সত্য বচন বা মত নয়। কেননা বিচারহীন বক্তব্যও সত্য প্রমাণিত হতে পারে কিন্তু তাতে জ্ঞান প্রতিপাদিত হয়না। আবার জ্ঞান সত্য বচন এবং তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ব্যাখ্যা মাত্র নয়। কারণ ব্যাখ্যা দেয়া বলতে সত্য বচনের বা বিশ্বাসের মৌলিক অংশগুলোর অর্থাৎ উপাদানগত অবয়বগুলোর গণনা বোঝালে তা জ্ঞান নয়, কারণ কোন একটি রেলওয়ে ওয়াগনের অংশগুলো, যেমন চাকা, অক্ষ প্রভৃতি গণনা করলেই বা কোন শব্দ বর্ণমালা যে বর্ণগুলোর দ্বারা গঠিত, সেগুলো ব্যক্ত করলেই যথাক্রমে রেলওয়ে ওয়াগনের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা শব্দ সম্বন্ধে ব্যাকরণসম্মত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করা গেছে বলা যায়না। আবার ‘ব্যাখ্যা’ বলতে কোন বিশেষ বস্তুর এমন কোন বৈশিষ্ট্যের বা চিহ্নের নামকরণ বোঝালেও তা যথার্থ জ্ঞান নয়, কারণ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আমার যথাযথ ধারণা রয়েছে, এই যথাযথ ধারণাকে জ্ঞানে পরিণত করতে হলে সেই ব্যক্তির কোন একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু দোষ-গুণ সম্পর্কে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ধারণা পূর্ব থেকে থাকলে আমার ব্যক্তিটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রয়েছে তা বলা যায়না। আর যদি ব্যক্তিটির যথাযথ ধারণা বলতে অপরের থেকে তার স্বাতন্ত্র্য নিরূপক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ধারণাও বোঝায় তাহলে ব্যক্তিটির যথাযথ ধারণার সঙ্গে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সংযুক্ত করা হল জ্ঞান – এ কথা বলা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
  • পারমিনাইডিস বলছেন অভ্রান্ত ও অস্তিত্বশীলের জ্ঞান হয়, অলীক ও মিথ্যার জ্ঞান হয়না। কেবল সত্তাই অস্তিত্বশীল, তা ছাড়া বাকি সব আপেক্ষিক, এবং এগুলোর জ্ঞান অসম্ভব। এটা ঠিক যে অভ্রান্ত ও অস্তিত্বশীলেরই জ্ঞান হয়, কিন্তু এটা ঠিক নয় যে এক মাত্র সত্তাই অস্তিত্বশীল এবং বাকি সব আপেক্ষিক, পরিণামী ও মিথ্যা ও সেগুলোর জ্ঞান অসম্ভব। বিশেষ বস্তু ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের দ্বারা জানা যায় ও সেই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বিষয়ই আপক্ষিক ও পরিবর্তনশীল হতে পারে, কিন্তু সার্বিক বা প্রত্যয় অবশ্যই অনপেক্ষ, অভ্রান্ত ও স্থির। তাই এর জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। (পারমিনাইডিসসক্রেটিস প্রভাবিত, পারমিনাইডিসের বিপরীতে)
  • হেরাক্লিটাস বলছেন সব বস্তুর অনবরত পরিবর্তন ঘটছে, কিন্তু এটা হলে ‘এটি শ্বেতবর্ণ’, এ কথা আমরা বলতে পারি না। কারণ যখন আমরা এটিকে শ্বেতবর্ণ বলেছিলাম তখন এটি শ্বেতবর্ণ থাকলেও আমাদের কথা শেষ হবার আগেই এটি আর শ্বেতবর্ণ থাকছে না। এটি হলে প্রত্যক্ষণকে অপ্রত্যক্ষণ না বলে প্রত্যক্ষণ বলা যায়না, তখন একই সাথে ‘প্রত্যক্ষণ’ হল জ্ঞান এবং ‘প্রত্যক্ষণ হল যা জ্ঞান নয়’ বলতে হয়। সব কিছু পরিণামী এ কথা বলা হলেও, শব্দের অর্থকে কিছুক্ষণের জন্য অবশ্যই স্থায়ী (Fixed) হতে হবে, তা না হলে কোন ঘােষণাই সুনির্দিষ্ট হবে না। কোন ঘােষণাকেই মিথ্যা না বলে সত্য বলা যাবে না। তাই কোন কিছু পরিণামী হলেও প্রতি মুহূর্তে তার পরিবর্তন ঘটেছে বলা যায়না। হেরাক্লিটাস বলছেন, সব ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বস্তু পরিণামী, আপেক্ষিক বা পরিবর্তনশীল এবং সে কারণে কোন কিছুই যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু নয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বস্তু পরিণামী, আপেক্ষিক বা পরিবর্তনশীল তাই তারা যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারেনা তা ঠিক আছে। কিন্তু এই বিষয়টি সার্বিক বা প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা বিশেষ বস্তুই কেবল ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণগ্রাহ্য হয়, সার্বিক হলো বুদ্ধিগ্রাহ্য। বিশেষ বস্তুই পরিণামী বা পরিবর্তনশীল হয়, কিন্তু সার্বিক অপরিণামী ও অপরিবর্তনশীল। তাই সার্বিকের জ্ঞান সম্ভব। (হেরাক্লিটাসসক্রেটিস প্রভাবিত, হেরাক্লিটাসের বিপরীতে)।
  • সার্বিকের বিশেষ বহির্ভূত একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, আর তাই তা স্থির, অনপেক্ষ ও অপরিণামী, এবং বিচারবুদ্ধি দিয়ে তার জ্ঞান প্রাপ্তি হয়। সার্বিক প্রত্যয়ের অবশ্যই সত্তা (Reality) আছে। সত্তা না থাকলে আমাদের চিন্তনের বিষয়বস্তু তারা হতে পারে না। তারা কেবল মনোগত বা বস্তু নিরপেক্ষ প্রত্যয় নয়। আমাদের মন তাদের সৃষ্টি করে না, আবিষ্কার করে মাত্র। সার্বিক গুণ যেমন মিষ্টত্ব, অম্লত্ব, সৌন্দর্য, কল্যাণের সত্তা আছে, তেমনি জাতিবাচক আকার যেমন অশ্ব, বিছানা, টেবিলের সার্বিক সত্তারও অস্তিত্ব আছে। অন্যদিকে বিশেষ এর অস্তিত্ব নেই, তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং পরিণামী বা পরিবর্তনশীল। বিশেষ বস্তুর জ্ঞান হল সবচেয়ে নিম্নস্তরের জ্ঞান এবং সার্বিক (Highest Universal)-এর জ্ঞান হল সবচেয়ে উচ্চস্তরের বা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। সার্বিককে ধারণা ও আকার (Form) বলা যায়। যুক্তিবিজ্ঞানের দিক দিয়ে সার্বিক, ধারণা বা আকার হলো বিশেষ বস্তুসমূহের একটি সার্বিক ধর্ম। যেমন বিভিন্ন অশ্বের একটি সার্বিক ধারণা হিসেবে “অশ্বত্ব” শব্দটির উল্লেখ করা যায়। আধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যার দিক থেকে সার্বিক ‘অশ্ব’ দ্বারা একটি আদর্শ অশ্বকে বোঝায়, যা যার একটি স্থির, অপরিণামী, সত্য ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, যার জ্ঞান লাভ করা যায়। এই আদর্শ অশ্বের প্রকৃতিতে অংশগ্রহণ করে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাদের এই অংশগ্রহণ ত্রুটিপূর্ণ, তাই প্রকাশও ত্রুটিপূর্ণ, তাই আমরা বিশেষ অশ্ব হিসেবে অনেক অশ্বের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করি, যারা ত্রুটিপূর্ণ। (পারমিনাইডিসহেরাক্লিটাস প্রভাবিত, সক্রেটিসের বিপরীতে)
  • ধারণা হল চিন্তন, কোন বস্তু নয়। কেননা, বস্তু হলেই সেটি বিশেষ হয়ে যাবে। তবে তারা কোন বিশেষ ব্যক্তিমনের চিন্তন নয়। তারা হল বস্তুগত ধারণা বা চিন্তন, যারা কোন বিশেষ মনের ওপর নির্ভর না করেও নিজ অধিকারে অস্তিত্বশীল।
  • ধারণাগুলো দেশে কালে অবস্থিত নয়, কেননা তাহলে তারা বিশেষ হয়ে পড়ে।
  • সার্বিক কেবল বিশেষ্য নয়, বিশেষণেও প্রযোজ্য। অনেক সুন্দর বস্তুর অস্তিত্ব থাকলেও সুন্দর বস্তুগুলোর একটি সার্বিক প্রত্যয় রয়েছে যা হচ্ছে সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য দ্বারা প্রতিটি ব্যক্তির মনে থাকা ব্যক্তিসাপেক্ষ সৌন্দর্য বোঝানো হয়নি, বরং সার্বিক প্রত্যয়কে সবসময় ব্যক্তিনিরপেক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে, বস্তুর স্বরূপ ধর্ম হতে হবে। সার্বিক হিসেবে সৌন্দর্য হল একটি আদর্শ সৌন্দর্য, আর প্রতিটি ব্যক্তির কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে সেই আদর্শ সৌন্দর্যের বিকৃতি বা প্রতিরূপ, মানুষের সৌন্দর্য যত বেশি আদর্শ সৌন্দর্যের কাছাকাছি হবে তার সৌন্দর্য তত বেশি নিখুঁৎ হবে।
  • সর্বনিরপেক্ষ বা পরম কল্যাণ (Absolute Good) এবং সর্বনিরপেক্ষ বা পরম সৌন্দর্য (Absolute Beauty)-এর স্বনির্ভর অস্তিত্ব আছে। এবং এরা অভিন্ন, অর্থাৎ যাই পরম কল্যাণ তাই পরম সৌন্দর্য।
  • মত ও জ্ঞান এক নয়। কোন ব্যক্তিকে ন্যায়পরায়ণতার স্বরূপ কি জিজ্ঞাসা করা হলে সে যদি কোন বিশেষ দেশের আইন নিয়ে বললে তা মত, কিন্তু তাতে ন্যায়পরায়ণতার আদর্শের প্রকাশ ঘটেনি বলে তা জ্ঞান নয়। মানুষের মনকে অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে উপনীত হতে হলে যে ক্রমবিকাশের স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। চারটি স্তরের মধ্য দিয়ে মত থেকে জ্ঞানে যেতে হয়। প্রথম দুটি স্তর মতের, পরের দুটি জ্ঞানের, প্রথম দুটি দৃশ্যমান জগৎ ও পরের দুটি জ্ঞানের জগৎ নির্দেশ করে। মতের সর্বনিম্ন স্তরে থাকে যা দৃশ্যমান তার প্রতিরূপ, আর মতের উপরের স্তরে রয়েছে দৃশ্যমান বস্তু। যেমন ন্যয়পরায়ণের সংজ্ঞা দিতে বললে এথেন্সের আইনকে ভুলভাবে বলা হলে তা হবে মতের নিম্নস্তরে, আর এথেন্সের আইনকে ঠিকভাবে বলা হলে তা হবে মতের ঊর্ধ্বস্তরের। দুটোই দৃশ্যমান জগতের বিষয় ও দুটোই মত। মতের উচ্চস্তরের পর আসে জ্ঞানের জগতের নিম্নস্তর। জ্ঞানের নিম্নস্তরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে কিন্তু এগুলোকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ও প্রকল্পের ভিত্তিতে যুক্তি গঠন করে। গণিত ও জ্যামিতিক বিষয় যেমন সংখ্যা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, জ্যামিতিক ক্ষেত্র প্রভৃতি এর বিষয়। যেমন ত্রিভূজ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, আবার কোন ত্রিভূজ এঁকে ত্রিভূজকে প্রকাশ করা যায়, কিন্তু তা ত্রিভূজের সংজ্ঞাকে নির্দিষ্ট করে না। তিনটি বাহু দ্বারা আবদ্ধ যেকোন সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রই ত্রিভূজ – এই জ্ঞানই হলো জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরের বিষয়, যেখানে এই সংজ্ঞাটি ত্রিভূজের সার্বিক বা প্রত্যয়কে নির্দেশ করে। এই সংজ্ঞাকে মেইন্টেইন করে যত ত্রিভূজ অঙ্কিত হবে সবই ত্রিভূজের সংজ্ঞার ছায়া বা বিশেষ ত্রিভূজ, যা জ্ঞানের নিম্নস্তর, কিন্তু দৃশ্যমান জগতের কোন ত্রিভূজাকার কোন বিষয় হবে মত। এভাবে মানুষ মতের নিম্ন স্তর থেকে জ্ঞানের উচ্চ স্তরে যেতে পারে। কিন্তু এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়না, উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারাই এই অন্তহীন সর্ব-নিরপেক্ষ সত্য এবং মূল্যকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হবে এবং মানুষ মিথ্যা, ভুল, সত্য এবং মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতার যে ছায়ার জগৎ তার থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।
  • পরমকল্যাণ-সার্বিক প্রত্যয়কে পরম সৌন্দর্যের সার্বিক প্রত্যয়ের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু অশ্ব-এর সার্বিক প্রত্যয়কে যদি মানুষের সার্বিক প্রত্যয়ের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা যায়না। তাই সমস্ত সার্বিকের একত্ব কল্পনার জন্য ঐক্যবিধায়ক সূত্রের দরকার, যেখানে সার্বিকগুলোকে একটি থেকে আর একটিকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় না রেখে একটি সর্বোপরি ঐক্যবিধায়ক সূত্রের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ করা যায়। একটি সর্বনিরপেক্ষ, সর্ব ত্রুটিহীন, পরম আধিবিদ্যক নীতি বা সূত্রের ধারণা দান করা দরকার। এই সর্বনিরপেক্ষ সত্তা বস্তুর অন্তর্বর্তী, কেননা বস্তু এই সত্তার প্রতিলিপি (Copy), তাতে অংশগ্রহণ করে, বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করে। এই সর্বনিরপেক্ষ সত্তা আবার বস্তুর অতিবর্তীও, কেননা এটি বাস্তবে অস্তিত্বশীল বস্তু যা সত্তাকেও অতিক্রম করে যায়।
  • কল্যাণ কেবল সার্বিক ধারণা নয়, এটি একটি ঐক্যবিধায়ক সূত্র, যা সকল সার্বিককে অন্তর্ভূক্ত করে। এই কল্যাণ খালি কল্যাণকে নয় সৌন্দর্যেরও উৎস। অর্থাৎ কল্যাণ ও সৌন্দর্যের অভিন্ন ধারণাটিই সকল সার্বিকের ঐক্যবিধায়ক সূত্র হিসেবে কাজ করে। সকল সার্বিক তার অস্তিত্বের জন্য কল্যাণ বা সৌন্দর্য প্রকাশক সেই ‘এক’ এর কাছে ঋণী।
  • কোন আপেক্ষিক নীতিবিদ্যা নেই, কেবল নিরপেক্ষ মানদণ্ড আদর্শ আছে। যেমন, ন্যায়পরায়ণের আদর্শ, মিতাচারের আদর্শ, সাহসিকতার আদর্শ ইত্যাদি। এগুলো সার্বিক, তাই বাস্তব, অপরিবর্তনশীল, এবং নৈর্ব্যক্তিক। এগুলো মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ বিশেষ মানুষের বিশেষ আচরণ কতটা নৈতিক তা এই আদর্শ বা সার্বিককে সেগুলো কতটা ধারণ করছে তার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষ ডায়ালেক্টিক বা দার্শনিক জ্ঞানের সাহায্যে এক সর্ব ব্যাপক আদর্শের সন্ধান পায়, অন্যসব বিশেষ আদর্শ যার অধীনস্থ। এই সার্বিক আদর্শ হল কল্যাণ (Good)।
  • কল্যাণ কেবল স্বরূপধর্ম নয়। মর্যাদা এবং ক্ষমতার বিচারের এটি স্বরূপ ধর্মকে (Essence) অনেকখানি অতিক্রম করে যায়। অপরপক্ষে, এটি কেবল সব জ্ঞানের বস্তুর বোধগম্যতার উৎস নয়, তাদের সত্তা এবং স্বরূপধর্মও বটে। কল্যাণের ধারণা সত্তার অতিবর্তী, কেননা সব দৃশ্যমান এবং বুদ্ধিগম্য বস্তুর উর্ধ্বে কল্যাণের ধারণা কাজ করে। আবার অপরদিকে এটি সর্বতোভাবে বাস্তব, প্রকৃত সর্বনিরপেক্ষ সত্তা। এটি সব বস্তুর সত্তা ও স্বরূপ ধর্মের উৎস। কাজেই ‘এক’ হল পরম সূত্র এবং আকারের জগতের উৎস।
  • দার্শনিক জ্ঞানের বা ডায়ালেকটিকের সাহায্যেই, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যেই এই ‘এক’ বা কল্যাণের ধারণা লাভ করা যায়।
  • ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জগৎ অধ্যাস (Illusion) বা অবভাস নয়। কিন্তু এই জগতে একটা অবাস্তবতার উপাদান রয়েছে। আকার বা ধারণার যথার্থ সত্তা আছে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর নেই। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, ধারণা এবং এই সত্তাতে অংশগ্রহণ করে। কাজেই তারা হল সত্তা এবং অ-সত্তার মাঝামাঝি।
  • আকারগুলোর ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ বা হায়ারার্কি রয়েছে। ‘এক’ হল সর্বোচ্চ এবং সর্বব্যাপক আকার। অন্যান্য আকার যেমন, শ্বেতত্ব, পীতত্ব, কৃষ্ণত্ব প্রভৃতি বর্ণের আকারের অধীনস্থ। আবার বর্ণ ও স্বাদের আকার গুণের আকারের অধীনস্থ। এভাবে আমরা সর্বশেষ আকার, ‘কল্যাণ’ (Good) এর আকারে উপনীত হই। আকারের ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে কোন আকার যত উচ্চ ততই সেটি ঐশ্বর্যবান (Richer)। কাজেই সেই দিক থেকে তার দৃষ্টিভঙ্গি অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত, কেননা অ্যারিস্টটলের মতে, কোন প্রত্যয় ধারণা যত বেশি অমূর্ত, তত বেশি সেটি নিঃস্ব (Poorer)।
  • জগতের উৎপত্তিতে দুটো কারণ জড়িত – ধারণার জগৎ এবং আকারবিহীন উপাদান যা বিশৃঙ্খলপুঞ্জ মাত্র। এই উপাদানের ওপর ধারণার প্রতিলিপি মুদ্রিত করলেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বিশেষ বস্তুর সৃষ্টি হয়। কাজেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সত্তা হিসেবে ধারণা এবং অ-সত্তা হিসেবে উপাদান উভয়েই অংশগ্রহণ করে, এবং এটি সত্তা ও অসত্তা কোনটাই নয়। ধারণাই যদি সব বস্তুর মূলীভূত হেতু হয় তাহলে প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া ধারণাগুলোর নিজেদের দ্বারাই সম্পাদিত হবার কথা, কিন্তু তা অসম্ভব, কারণ উৎপত্তি বা সৃষ্টি পরিবর্তন সূচিত করে। কিন্তু ধারণাগুলো অপরিণামী হওয়ায় ধারণাগুলোর পক্ষে কোন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এদিকে জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে তা নিত্য নয়, বরং অনিত্য, অর্থাৎ তার উৎপত্তির মূলে কোন নিমিত্ত কারণ (Efficient Cause) থাকবে। আর এই নিমিত্ত কারণ হচ্ছে ঐশ্বরিক কারিগর বা ডেমিয়ার্জ (Demiurge)। এই ডেমিয়ার্জ কিছু বিশৃঙ্খল দেখলেন তাতে তিনি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করলেন এবং ধারণার জগতের শাশ্বত আদর্শ অনুসারে তিনি জড়জগৎ সৃষ্টি করলেন। এক আদর্শ সজীব প্রাণীর নমুনা অনুসারে এই জগৎ হল আত্মা ও বুদ্ধি সমন্বিত একটি সজীব প্রাণী। ডেমিয়ার্জ চেয়েছিলেন যতদূর সম্ভব সব কিছু শাশ্বত ধারণার জগতের মত হােক। তিনি মনে করেছিলেন শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলার চেয়ে ভাল। বাহ্য উপাদান গ্রহণ করে তাকে কাজ করতে হয়েছিল। কাজেই উপাদানের দোষত্রুটির জন্য তার কাজ নিখুঁত হতে পারেনি। কিন্তু তিনি তার সাধ্যমত কাজ করেছিলেন যাতে সৃষ্ট জগৎ যতখানি সম্ভব ও নিখুঁত হতে পারে।
  • পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল উপাদান আকারহীন, অদৃশ্যমান, সর্বগ্রহণক্ষম (All-receiving), যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তার জননী এবং আশ্রয়, সব সৃষ্টির ধাত্রী। এটি এক ধরনের দেশ যেখানে সৃষ্টি সম্ভব হয়। এই দেশ হল চিরস্থায়ী, ধ্বংসশীল নয়; যা কিছু সৃষ্টি হচ্ছে দেশ তাকে স্থান যুগিয়ে দিচ্ছে। এই দেশ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, তবে বোধগম্য। দেশ থেকেই প্রাথমিক উপাদানগুলো সৃষ্টি হয় না, দেশেই তাদের আবির্ভাব ঘটে। তিনি এটি কোন ধরনের সত্তা নয়, কিন্তু এর অস্তিত্ব আছে। আবার শূন্য দেশ-এর মত এটা কিছুই নয় তা নয়। এটি অপরিণামী ধারণার বিপরীত সদাপরিণামী। জগৎ সৃষ্টির পূর্বে উপাদান এক অনিয়মিত গতিশীল অবস্থায় ছিল। এক প্রাকৃতিক অনিবার্যতাবশত উপাদানের অদৃশ্য ক্ষুদ্র কণাগুলো তাদের রকম অনুসারে একত্র সংযুক্ত হয় এবং চারটি পৃথক স্থানে চারটি উপাদান – অপ, ক্ষিতি, মরুৎ এবং অগ্নি বা তেজের সৃষ্টি হয়। ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ সদা পরিবর্তনশীল। তাই এদের দ্রব্যরূপে আখ্যাত করা যেতে পারে না। এরা হল গুণ, দেশে এদের আবির্ভাব এবং তিরোভাব লেগেই থাকে। তাহলে ডেমিয়ার্জ সৃষ্টির জন্য এই উপাদান থেকে দুটি বিষয় গ্রহণ করেছিলেন – অদৃশ্যমান, গুণবর্জিত, দুর্বোধ্য কিন্তু সর্বগ্রহণক্ষম আধার, এবং আধারে আবির্ভূত হওয়া প্রাথমিক গুণ যেগুলোকে আকারের নমুনা অনুসারে ডেমিয়ার্জ গঠন করতে থাকেন। জগৎ সৃষ্টির জন্য ডেমিয়ার্জ এই চারটি উপাদানকেই ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই কারণে জগতের কোন বার্ধক্য বা ব্যাধির কথা বলা যেতে পারে না। ডেমিয়ার্জ ছাড়া কেউ জগতকে ধ্বংস করতে পারে না। (এম্পিডক্লিস প্রভাবিত, কিন্তু বিপরীতে)
  • আকার এবং সংখ্যার দ্বারা গঠিত হওয়াই দৃশ্যমান জগতের মৌলিক প্রকৃতি। ডেমিয়ার্জ চারটি প্রাথমিক উপাদান-এর ওপর জ্যামিতিক আকার প্রদান করেন। আদি জ্যামিতিক আকার হল ত্রিভুজ। অর্ধ বর্গাকার এবং অপরটি অর্ধ সমবাহু ত্রিভুজাকার – দু রকম ত্রিভূজের উদ্ভব ঘটে, তারপর তা থেকে বর্গক্ষেত্র এবং ঘন পদার্থের সমপার্শ্ববিশিষ্ট পার্শ্বগুলো গঠিত হয়। এরপর ঘন পদার্থগুলো গঠিত হয়। পাঁচটি ঘন পদার্থের মধ্যে চারটি উপাদানের মৌলিক আকার – ক্ষিতির আকার ঘনক্ষেত্র (Cube), তেজের হল পিরামিড, মরুৎ-এর হল অষ্ট তলক, জলের বিংশ তলক। জগতকে সমগ্র হিসেবে পরিকল্পনা করার জন্য পঞ্চমটিতে ডেমিয়ার্জের প্রয়োজন হয়। এগুলো এত ক্ষুদ্র যে, এদের কোন একটিকে প্রত্যক্ষ করা যায় না, যদিও বেশ কিছু একত্রিত হলে প্রত্যক্ষ করা যায়। এই ক্ষেত্রগুলোকে আবার রেখাতে এবং রেখাগুলোকে বিন্দুতে পরিণত করা হয়। কণাগুলোকে এভাবে ক্ষুদ্র জ্যামিতিক ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার ফলে উপাদানগুলোর একটি আর একটিতে পরিবর্তন বা রূপান্তর সম্ভব হয়। (পিথাগোরাস প্রভাবিত)
  • ডেমিয়ার্জ প্রথমে বিশ্ব-আত্মা (World-Soul) সৃষ্টি করেন। তারপর ঐ একই উপাদান থেকে তিনি অবিনশ্বর আত্মার (Immortal Soul) সৃষ্টি করেন। বিশ্ব-আত্মা অ-ভৌতিক, কিন্তু এটি দেশে অবস্থান করে। বিশ্ব-আত্মা থেকে ডেমিয়ার্জ গ্রহ, নক্ষত্র, তারকা তৈরি করেন, এরাই স্বর্গীয় দেবতা। অবিনশ্বর আত্মা তো তৈরি হয়ে আছে, এই দেবতাদেরকে দিয়ে ডেমিয়ার্জ মানুষের আত্মার নশ্বর অংশ ও মানবদেহ সৃষ্টি করান। বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করার পর তিনি তাকে আরও আদর্শ বা ধারণার জগতের অনুরূপ অর্থাৎ জীবন্ত প্রাণীর মত করার চেষ্টা করেন। জীবন্ত প্রাণীর আদর্শটি হল নিত্য বা শাশ্বত বলে সৃষ্ট বস্তুগুলোকে আদর্শ বা আকার বা সার্বিকে পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত করা সম্ভব হয়না। তাই তিনি যা শাশ্বত বা নিত্য তার একটি গতিশীল প্রতিরূপ সৃষ্টি করেন। তিনি স্বর্গরাজ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন এবং গণনার অতীত নিত্যকালের এমন প্রতিরূপ সৃষ্টি করেন যাকে গণনা করা যায়। এই প্রতিরূপ হয় কাল (Time)। ডেমিয়ার্জ কাল পরিমাপের জন্য মানুষকে উজ্জ্বল সূর্য দেন যাতে এই উজ্জ্বলতার সাহায্যে মানুষ দিন-রাত্রির পার্থক্য করা যায়। অবিনশ্বর ও নশ্বর আত্মা একত্রে যুক্ত করে ডেমিয়ার্জ তাদেরকে নক্ষত্রে স্থাপন করে। সামগ্রিকভাবে আত্মা সংবেদন, ভালবাসা, ভয় এবং ক্রোধ ধারণ করে। তারা যদি এদের অতিক্রম করতে পারে, তারা সততার সঙ্গে বসবাস করতে পারে এবং যদি তাদের জয় করতে না পারে, তা হলে তা পারে না। যদি কোন ব্যক্তি ভালভাবে বসবাস করে, তাহলে সে মৃত্যুর পরে তার নক্ষত্রে ভালভাবে বাস করার জন্য ফিরে যায়। যদি সে খারাপভাবে বসবাস করে তাহলে সে নিম্নস্থানীয় জীবনে যায়, স্ত্রীলোক হয়ে জন্মানোর কথাও বলা আছে। এভাবে ডেমিয়ার্জ কিছু আত্মা পৃথিবীতে, কিছু আত্মা চন্দ্রে, কিছু আত্মা গ্রহ-নক্ষত্রে স্থাপিত করেন এবং দেবতাদের ওপর তাদের দেহ গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
  • আকার সম্পর্কীয় মতবাদ পুরোপুরিই উদ্দেশ্যমূলক (Teleological)। প্রতিটি ধারণা তার দিক থেকে পরিপূর্ণ (Perfect)। আবার প্রতিটি ধারণা তার অধীনস্থ বিশেষ বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বের হেতু (Ground of Existence) হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ সার্বিক এখানে বিশেষ বস্তুর কারণ বা ব্যাখ্যা। আমাদের যা সুন্দর মনে হয় তা কেন সুন্দর মনে হয় তার ব্যাখ্যা হচ্ছে এটি অন্য কিছুর চেয়ে বেশি পরিমাণে সৌন্দর্যের ধারণায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু প্রশ্ন যদি হয় এই সার্বিকের কারণ কী? তাহলে কেবল টেলিওলজিকাল বা উদ্দেশ্যমূলক কার্যকারণই পাওয়া যাবে, কেননা সার্বিক বা ধারণা তার দিক দিয়ে পরিপূর্ণ বা পারফেক্ট। এটার অন্য কোন রকম কারণ থাকতে পারেনা। কেবল এগুলোর উদ্দেশ্যমূলক কারণ থাকতে পারে যা এর উদ্দেশ্য বা কেন জগতে এর প্রতিরূপ সৃষ্টি হয় সেই উত্তর পাওয়া যায়। সার্বিকের শেষ পরিণতিই তাই এর কারণ নির্দেশ করে। এই শেষ পরিণতি বা এর টেলিওলজিকাল কজেশন বা উদ্দেশ্যমূলক কারণ হচ্ছে কল্যাণের ধারণা। সকল সার্বিকের সাথে কল্যাণের ধারণা যুক্ত, কল্যাণের জন্যই সার্বিক থেকে বিশেষ বস্তুর প্রতিরূপ তৈরি হয়, আর এই কল্যাণই সকল সার্বিকের ঐক্যবদ্ধ সূত্র হিসেবে ‘এক’ সত্তা হিসেবে কাজ করে যা সকল সার্বিকের অতিবর্তী হয়ে যায়, যেখান থেকে অন্যান্য সকল সার্বিক বিচ্ছিন্ন হয়। তাই সব ধারণা বা সার্বিক বা আকার এবং সমগ্র বিশ্বজগতের চরম ব্যাখ্যা কল্যাণেই খুঁজে পাওয়া যায়।
  • ঈশ্বর কল্যাণের হেতু হতে পারে না, কারণ তাতে ধারণা বা সার্বিকের প্রকৃতি নষ্ট হয়। ঈশ্বর তার অস্তিত্বের জন্য কল্যাণের উপর নির্ভরশীল হতে পারে না, কারণ তাতে ঈশ্বরের ঐশ্বরিকতার হানি ঘটে। ঈশ্বর এবং ধারণা উভয়ের পৃথক অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, কারণ তাতে হতাশাজনক দ্বৈতবাদের সৃষ্টি হয়। তাই কেবল ঈশ্বর ও কল্যাণকে অভিন্ন হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।
  • ফিলিবাসে বলা হয়েছে, যে মন (Mind) বিশ্বজগতে শৃঙ্খলা আনয়ন করে তা আত্মার (Soul) অধিকারী। কাজেই ঈশ্বর হবেন এক জীবন্ত ও বুদ্ধিগ্রাহ্য সত্তা। কাজেই এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ঈশ্বরকে (A Personal God) পাওয়া যায় যার মন হল আকারের আবাসস্থল এবং যিনি বিশ্বজগতে শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং এই বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানে মন বলতে ঈশ্বর বা কল্যাণের ধারণা ও তার আত্মার দ্বারা ধারণার জগৎ বা অন্যান্য সার্বিকের সমষ্টি ধরতে হবে। অন্যদিকে টাইম্যায়িয়ুসে আছে ডেমিয়ার্জই জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি, যিনি আকারের নকশা অনুসারে বিশেষ বস্তু গঠন করে। এই স্ববিরোধিতা মেটাবার জন্য ডেমিয়ার্জকে ঈশ্বরের বিচারবুদ্ধির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা যায়, যে বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে নিজের আত্মা বা আকারের নকশা অনুযায়ী বিশেষ বস্তুসমূহের গঠন করা হয়েছে। এই দাবি তোলা হয় কারণ গ্রন্থে ডেমিয়ার্জকে কোন স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে উল্লেখ না করে কেবল নিমিত্ত কারণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এরিস্টোটলের কারণতত্ত্ব অনুযায়ী পুরো বিষয়টি সামগ্রিকভাবে এই দাঁড়ায় যে জগৎ সৃষ্টিতে বিশৃঙ্খল উপাদানসমূহ উপাদান কারণ, ডেমিয়ার্জ বা ঈশ্বরের বিচারবুদ্ধি নিমিত্ত কারণ, ঈশ্বরের আত্মা বা আকার হলো আকার কারণ, আর ঈশ্বর বা কল্যাণ হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলক কারণ। তাই যদি হয় তাহলে কেবল কল্যাণকে ঈশ্বর বলা যায়না, কেননা এখানে সার্বিক বা ধারণার জগৎ হলো ঈশ্বরের আত্মা, আর ডেমিয়ার্জ হলো ঈশ্বরের বিচারবুদ্ধি। ঈশ্বরের আত্মা ও ঈশ্বরের বিচারবুদ্ধি ঈশ্বরের থেকে পৃথক হতে পারেনা, কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে বলতে হয় সার্বিকসমূহ ও ডেমিয়ার্জও কল্যাণের থেকে পৃথক নয়। কিন্তু তা প্লেটোর মতবাদের সাথেই সাংঘর্ষিক, তাই প্লেটোর মতবাদে ঈশ্বরের স্থান একটি অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি করে। তবে এরিস্টোটল তার কারণতত্ত্বে চারটি কারণকে দুটি কারণে পরিণত করেছিলেন। তিনি আকার, নিমিত্ত ও উদ্দেশ্যমূলক কারণকে এক আকার কারণে নিয়ে এসেছিলেন যার থেকে কেবল উপাদান কারণই আলাদা ছিল। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের ধারণার সমাধান হয় কিন্তু কল্যাণ, সার্বিক ও ডেমিয়ার্জের সমস্যার সমাধান হয়না। হয়তো এরিস্টোটল বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তাই প্লেটোর ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি তত্ত্বায়ন করেছেন। যাই হোক, এটা বলা যায় যে প্লেটোর রচনায় ঈশ্বরের অবস্থান নিয়ে অসামঞ্জস্যা পাওয়া যায়। তবে তার সেই অসামঞ্জস লেখাগুলোকে বাদ দিয়ে কল্যাণকে ঈশ্বর ধরা এবং ডেমিয়ার্জকে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে ধরে নিয়ে এগোনো যেতে পারে।
  • আকারগুলো পিথাগোরাসের সংখ্যা হিসেবে কাজ করে, সংখ্যাতে অংশগ্রহণ করেই বস্তু অস্তিত্বশীল হয় এবং সংখ্যাগুলো এক এবং বড় ও ছােটর দ্বারা বা অনির্ণেয় গুণের দ্বারা গঠিত। এখানে অনেক প্রশ্ন উত্থিত হয়। কপলস্টোন বলেন, আকারের সঙ্গে সংখ্যাকে অভিন্ন গণ্য করার পিছনে প্লেটোর উদ্দেশ্য হল রহস্যময় এবং অতীন্দ্রিয় আকারের জগতকে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলা। এই ক্ষেত্রে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলার অর্থ হল শৃঙ্খলার নীতির (The principle of order) সন্ধান করা।
  • ডায়েলেকটিক বা দার্শনিক জ্ঞানের সাহায্যেই ধারণাকে জানা যায়। ডায়েলেকটি হল জ্ঞানের চরম উৎকর্ষ। ডায়েলেকটিক হল সব ধারণার পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের জ্ঞান। ধারণাগুলো বৌদ্ধিক, অর্থাৎ কিনা, তাদের বুদ্ধির মাধ্যমেই জানা যায়। পরম সত্তা কোন স্বজ্ঞা (Intuition) বা অপরোক্ষ অনুভূতি বা কোন অতীন্দ্রিয় ভাবাবেগের মাধ্যমে জ্ঞাত হয় না, কেবলমাত্র বৌদ্ধিক জ্ঞান এবং শ্রমসাধ্য চিন্তনের মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়। মানুষের প্রকৃত জীবন হল দার্শনিক জীবন বা জ্ঞানের জীবন। কেবলমাত্র দার্শনিকই সত্তার বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পারে।
  • প্লেটোর ভালবাসা বা অনুরাগ সম্পর্কীয় মতবাদ অনুসারে ভালবাসার সঙ্গে সবসময়ই সৌন্দর্যের সম্পর্ক বর্তমান। আত্মা কোন বিশেষ বসুকে ভালবাসতে শিখে অন্য বস্তুকে ভালবাসে। তারপর আত্মা দেখে যে, এক সৌন্দর্যই সর্ববস্তুতে বর্তমান। ভালবাসা সৌন্দর্যের ধারণার জ্ঞানে পরিণতি লাভ করে। এর ফলে আকারের জগতের জ্ঞানলাভে আত্মা আগ্রহী হয়।

আত্মাতত্ত্ব

  • আত্মা স্বপ্রবর্তিত গতি বা গতির উৎস। আত্মা দেহের তুলনায় অনেক উন্নত, আত্মা দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে। অস্তিত্বশীল বস্তুর মধ্যে একমাত্র আত্মা বুদ্ধির অধিকারী এবং আত্মা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ-এর মত দৃশ্যগোচর নয়।
  • আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র হলেও দেহ আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারে। মন্দ শারীরিক শিক্ষা এবং মন্দ দৈহিক অভ্যাস আত্মার ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ব্যক্তির ওপর বংশের প্রভাবও থাকে। আত্মার অবনতির মূলে রয়েছে মাতাপিতার কাছ থেকে বংশসূত্রে পাওয়া দৈহিক কোন ত্রুটি, দোষদুষ্ট বা ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা বা পরিবেশ। স্বেচ্ছায় কোন ব্যক্তি মন্দ হয় না। দেহের মন্দ অভ্যাস, মন্দভাবে সন্তানের প্রতিপালিত হওয়া, ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই মন্দগুলো দেখা দিতে পারে, যদিও তা ব্যক্তির অভিপ্রেত নয়।
  • আত্মার তিনটি অংশ – প্রজ্ঞাংশ (The rational part), সাহসের অংশ (The courageous part) এবং ক্ষুধার অংশ (Appetitive Part)। আত্মার প্রজ্ঞাংশ হল আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ। প্রজ্ঞার সাহায্যেই মানুষ আকার বা সার্বিককে জানে। আত্মার এই অংশ অবিনশ্বর, অমর ও ঐশ্বরিক। আত্মার শৌর্যাংশ তার ক্ষুধার অংশের তুলনায় উন্নত। সাহস, খ্যাতির জন্য অনুরাগ এবং সাধারণভাবে সব মহৎ আবেগ এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। আত্মার হীন অংশের অন্তর্ভূক্ত মানুষের ইন্দ্রিয় ক্ষুধা। এই অংশটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির দিক। প্রজ্ঞাংশের স্থান মস্তিষ্কে, শৌর্যাংশের স্থান বক্ষে, ক্ষুধার অংশের স্থান দেহের নিম্নাংশে। আত্মার মধ্যে যে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব দেখা যায় তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মার তিনটি অংশের কথা স্বীকার্য।
  • মানুষের মূল্যের তুলনামূলক বিচার তার মূল্য সম্পর্কীয় মানদণ্ডের ও সর্বনিরপেক্ষ আদর্শের জ্ঞানকে নির্দেশ করে, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে দেখা যায় না। এটি নির্দেশ করে যে আত্মা বর্তমান জীবনের পূর্বের কোন জীবনে তা প্রত্যক্ষ করেছে। আর তাই বর্তমানে আত্মা যে সার্বিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে তা আসলে তার স্মরণ। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ অনিবার্য এবং সঠিক সত্যের জ্ঞান দিতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি কোন গাণিতিক জ্ঞানের অধিকারী নয়, সেও তার গাণিতিক জ্ঞানের পরিচয় দিতে পারে। এটিও নির্দেশ করে যে আত্মা পূর্বে ধারণার জগতে সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছে ও এখন কেবল স্মরণ করছে। এই স্মরণের দিকটি এও নির্দেশ করে যে আত্মা অমর।
  • বিপরীত থেকে বিপরীতের সৃষ্টি হয়, যেমন শক্তি থেকে দুর্বলতার, তেমনি জীবনের বিপরীত মৃত্যু। তাই জীবন থেকে মৃত্যুর উদ্ভব হলে মৃত্যু থেকে জীবনের উদ্ভব হবে।
  • এই পৃথিবীতে যা কিছু দেখা যায় তা হল অংশযুক্ত বা যৌগিক (Compound), সেহেতু নশ্বর, যেমন মানুষের দেহ। কিন্তু আত্মা যেহেতু অতীন্দ্রিয় আকার বা সার্বিককে প্রত্যক্ষ করতে পারে, দেহকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, সেহেতু আত্মা অযৌগিক এবং নশ্বর জড়বস্তু থেকে স্বতন্ত্র। আত্মা ঐশ্বরিক ও আধ্যাত্মিক সেহেতু অবিনশ্বর।
  • জাতি বা আকার তার মধ্যে তার বিপরীত আকারের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না। যেমন, আগুন উষ্ণ হলে শীতল হতে পারেনা। আত্মা জীবনের আকার গ্রহণ করাতে, মৃত্যুর আকার গ্রহণ করতে পারে না। আসলে আত্মার আধ্যাত্মিকতা স্বীকার করলে তার জীর্ণ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
  • কোন বস্তু তার অন্তর্নিহিত ত্রুটি ছাড়া ধ্বংস হতে পারে না। আত্মার ত্রুটি হল অজ্ঞতা, ভীরুতা, ন্যায়পরায়ণহীনতা, অসংযম। কিন্তু আত্মার এসব ত্রুটি যে আত্মাকে ধ্বংস করতে পারে না, তার প্রধান প্রমাণ হল যে, একজন ন্যায়হীন ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যত দীর্ঘ বাঁচে ততদিন তো বাচেই, তার থেকেও বেশি দিনও বাঁচে। কাজেই আত্মার অন্তর্নিহিত ত্রুটির দ্বারা যদি আত্মা বিনষ্ট না হয় তবে বাহ্য কোন ত্রুটির দ্বারা আত্মা ধ্বংস হয়, এমন সিদ্ধান্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়।
  • যে বস্তু অপরকে গতিশীল করে এবং অপরের দ্বারা গতিশীল হয়, তা বিনষ্ট হতে পারে। কিন্তু আত্মা নিজে নিজেই গতিসম্পন্ন, আত্মা গতির উৎস। কাজেই আত্মা যদি গতির উৎস হয় তাহলে আত্মা কোন কিছুর দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে না। কেননা আত্মা যদি অসৃষ্ট হয় তবে আত্মা অবিনশ্বর। আত্মা সকল গতির উৎস হয়ে যদি নশ্বর হয় তাহলে বিশ্বজগৎ এবং সব সৃষ্টিই ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি আত্মাকে গতির উৎস হিসেবে ধরে নেওয়া হয় তাহলে আত্মা সবসময়ই অস্তিত্বশীল।

নীতিবিদ্যা

  • মানুষের জীবনের লক্ষ হল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীবনযাপন এবং নৈতিক জীবন হিসেবে মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। এটি এমন একটি নৈতিক মতবাদ যা মানুষের সমগ্র প্রকৃতির পূর্ণতাকে নৈতিক আদর্শরূপে গণ্য করে এবং এই আদর্শ লাভের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে আনন্দ বা কল্যাণ। এই নৈতিক মতবাদকে কল্যাণবাদ বা আনন্দবাদ (Eudaemonism) নামে অভিহিত করা যেতে পারে।
  • কল্যাণময় জীবন কেবলমাত্র সুখী জীবন নয়, যে কারণে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সুখের জীবনকে সুখময় জীবন বলে অভিহিত করা যায় না। আবার মানুষের মনের সবচেয়ে বড় উপাদান তার বিচারবুদ্ধি হলেও শুধুমাত্র বিচার-বুদ্ধির জীবন যদি সুখ-বর্জিত জীবন হয় তাহলে তা মানুষের কাম্য হতে পারে না। কল্যাণময় জীবন বলতে বোঝায় বিজ্ঞতা যা বিচারবুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয় সুখ, এই দুই-এর সম্মিলিত জীবন, এটি শুধুমাত্র বিচারবুদ্ধি বা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়সুখের জীবন নয়। তাই কল্যাণময় জীবনে বৌদ্ধিক সুখ (Intellectual Pleasures) এবং ইন্দ্রিয় সুখের স্থান আছে। তবে ইন্দ্রিয় সুখ বলতে নির্দোষ সংযত ইন্দ্রিয় সুখকেই বুঝতে হবে। জ্ঞানের সঙ্গে সুখের সংমিশ্রণের অনুপাত হল খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কল্যাণ হল সুন্দরেরই একটি রূপ, তাই কল্যাণময় জীবনে কামনা-বাসনায় পরিমিত নির্দোষ পরিতৃপ্তিই কাম্য। কল্যাণময় জীবনের জন্য কল্যাণ বা সুখ লাভের বাসনা থাকবে।
  • কল্যাণময় জীবনের অধিকারীকে অবশ্যই যথার্থ জ্ঞান অর্থাৎ সার্বিক বা আকারের জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। তিনি জড় জগতের সাধারণ বস্তুর জ্ঞানেরও অধিকারী হবেন, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, সার্বিক বা আকারের জ্ঞানের তুলনায় জড়বস্তুর জ্ঞান মামুলি। অর্থাৎ কল্যাণময় জীবন-যাপনের জন্য জড় জগতের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হবার দরকার নেই, তবে স্বীকার করতে হবে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতই একমাত্র ও শ্রেষ্ঠ জগৎ নয়, বরং এটি আদর্শ জগতের একটি নকল। ঈশ্বরের জ্ঞান মানুষের পরম পুরুষার্থ বা পরম কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত। কারণ কল্যাণই ঈশ্বর। এই কল্যাণের সাথেই উদ্দেশ্যমূলক কারণ সম্পর্কিত থাকে যা অনুসারে জগৎ পরিণাম লাভ করে। সততা অনুশীলন করে আত্মা আনন্দ লাভ করতে পারে, এবং এর মাধ্যমে আত্মা কল্যাণ বা এক বা ঈশ্বরের জ্ঞান লাভ করতে পারে। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • জ্ঞান সততার সঙ্গে অভিন্ন। অসংযত বা অমিতাচারী ব্যক্তি, যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর তাই অনুসরণ করে কিন্তু সংযত ব্যক্তি যা কল্যাণকর এবং উপকারী তাই অনুসরণ করে। এখন যা ক্ষতিকর তা অনুসরণ করা মুর্খতা এবং যা যথার্থ কল্যাণকর তা অনুসরণ করা জ্ঞান। কাজেই সংযম এবং জ্ঞান পরস্পর সম্পর্ক শূন্য হতে পারে না। ‘কল্যাণ’ পদটি কোন আপেক্ষিক পদ না হয়ে সর্বনিরপেক্ষ এবং সত্য বা অপরিণামী কোন কিছু নির্দেশ করে বলেই তা জ্ঞানের বিষয় হতে পারে। কেউ জেনে শুনে স্বেচ্ছায় মন্দ বা অকল্যাণজনক কিছু সম্পাদন করে না। প্রকৃতই যা মন্দ বা অন্যায়, কোন মানুষ যদি তাকে নির্বাচন করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তাকে সে কল্যাণকর বা ভাল জেনেই কামনা করেছে, হতে পারে আসলে তা মন্দ। কিন্তু এখানে নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন চলে আসে। যে মানুষ জানে প্রকৃত কল্যাণ কি, সেও সাময়িকভাবে রিপুর তাড়নার বশবর্তী হলে তার বিচারশক্তি যথাযথভাবে ক্রিয়া করতে পারে না। এর ফলে যা আপাতঃদৃষ্টিতে কল্যাণকর তাই তার কাছে যথার্থ কল্যাণকর মনে হয়। কিন্তু সে যে তার বিচারবুদ্ধিকে রিপুর দ্বারা আচ্ছন্ন হতে দিয়েছে তার জন্য সে অবশ্যই দায়ী। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততা এক নয় বহু, আত্মার বিভিন্ন অংশ রূপে সততা বিভিন্ন কিন্তু এইসব বিভিন্ন সততা বহু হয়েও এক। কেননা তারা একই কল্যাণ ও অকল্যাণের জ্ঞানের প্রকাশ। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • সততা জ্ঞান বলে সততা শিক্ষা দেওয়া যায়। একমাত্র দার্শনিকেরই জানা আছে মানুষের যথার্থ কল্যাণ কী। তাই মানুষের কল্যাণ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হওয়াতে দার্শনিকই সততা শিক্ষাদানের ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তি। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • চারটি প্রধান সদ্‌গুণ হলো বিজ্ঞতা (Wisdom), সাহসিকতা, (Courage), মিতাচার (Temperance), ন্যায়পরায়ণতা (Justice)। আত্মার প্রজ্ঞা অংশের সৎ গুণ হল বিজ্ঞতা, সাহস আত্মার শৌর্যাংশ, মিতাচার হল প্রজ্ঞার নিয়ন্ত্রণাধীনে আত্মার শৌর্যাংশ এবং ক্ষুধাংশের মিলনের ফলে উৎপন্ন সদ্‌গুণ। বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংঘাত (Conflict) যদি সৎভাবে কার্য করার ব্যর্থতার পক্ষে একটি কারণ হয়; সততার কাজ হবে এই সংঘাত দূর করা এবং যদি সততার জন্য বিজ্ঞতার অংশের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে বিজ্ঞতার বা বিচার-বুদ্ধিজনিত নিয়ন্ত্রণ (Rational control)-এর জন্য সততার প্রয়োজন সংঘাত দূর করা। আত্মার বিভিন্ন অংশ যথাযথ সঙ্গতি বজায় রেখে তাদের যথােচিত কার্য সমাধান করলে যে সদগুণ হয় তার নাম ন্যায়পরায়ণতা। ন্যায়পরায়ণতা আত্মার কল্যাণ সাধন করে। আর পক্ষপাতীত্ব (Injustice) আত্মার অকল্যাণ সাধন করে।
  • কল্যাণকে সুখ এবং অকল্যাণকে দুঃখের সঙ্গে অভিন্ন বলা যায় না। অন্যায় ভােগ করার তুলনায় অন্যায় করা অধিক মন্দ, কেননা অন্যায় করা হল আত্মাকে অধঃপতিত করা এবং এটাই হল মানুষের জীবন সবচেয়ে বড় অকল্যাণ। অন্যায় করে শাস্তি না পেয়ে রেহাই পাওয়া খুবই খারাপ। শাস্তির ফলে মানুষের সংশােধন হতে পারে। তবে অন্যায় করে কেউ রেহাই পেতে পারে না। মৃত্যুর পরে হলেও তাকে অন্যায়ের শাস্তি ভােগ করতেই হবে। বন্ধুদের ভাল করতে হবে এবং শত্রুদের মন্দ করতে হবে এই নীতি প্লেটো স্বীকার করেন না। কারণ তার মতে শত্রুর মন্দ করা সকল সময়ই অকল্যাণকর কাজ।
  • ভাল মানুষ হলো বিচারক, বিচারক তারাই যারা যৌবনকালে কোন মন্দ বা অকল্যাণকর কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি তার চরিত্রকে কলঙ্কিত করেননি। এই জাতীয় ব্যক্তি নৈতিক মানদন্ডকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। সেই কারণেই তার বিচার হল নির্ভরযোগ্যতা। সকল রকম নৈতিক মূল্যায়নের প্রশ্নে তার বিচার গ্রহণযোগ্য। যাকে তিনি ভাল বলে বিচার করেন তাই ভাল। যাকে তিনি মন্দ বলে বিচার করেন তাই মন্দ। তার বিচার সাধারণ ব্যক্তির বিচারের মত খামখেয়ালির ব্যাপার নয়। সৎ নৈতিক চরিত্রের ব্যক্তি সব কিছুর পরিমাপ করতে পারেন। এই ধরনের ব্যক্তির উচিত-অনুচিতের ধারণা আছে। সাধারণ ব্যক্তির বিচার ক্ষমতা যেমন মন্দের সংস্পর্শে এসে কলুষিত হতে পারে, এ জাতীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে তেমনি ঘটে না। তার মধ্যে মানুষের প্রকৃতির সর্বোৎকৃষ্ট রূপটি পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া এক বিশেষ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি তার চরিত্রকে গঠন করে। যদিও সাধারণ ব্যক্তি নৈতিক বিচার সম্পর্কীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে কোন না কোন ধরনের অভিমত দিতে সক্ষম, তবু প্রকৃত নৈতিক বিচারক (Moral Judge) হলেন দার্শনিক, বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রের অভিভাবক।

শিক্ষাতত্ত্ব

  • আত্মা, যে জ্ঞানের অধিকারী নয় তার মধ্যে সেই জ্ঞান প্রবিষ্ট করানোকে শিক্ষা বলে অভিহিত করা যেতে পারে না। শিক্ষা হল আত্মার মধ্যে যে সব উৎকৃষ্ট গুণ প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সেগুলোকে প্রকট করে তোলা এবং আত্মাকে যথাযথ বিষয়ের দিকে চালিত করে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা। শিক্ষা হল শুধুমাত্র বুদ্ধিকে প্রদীপ্ত করা নয়, সমস্ত আত্মাকে যথাযথ পথে চালিত করা।
  • প্রতিটি ব্যক্তির আত্মা সত্য শিক্ষা করার প্রয়োজনীয় শক্তির অধিকারী এবং সত্যকে প্রত্যক্ষ করার ইন্দ্রিয়ও তার রয়েছে। শিক্ষার জন্য যে বিষয়টির প্রয়োজন, তা হল আত্মার পক্ষে পরিবর্তনশীল জাগতিক পরিবেশের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ না করে, পরমসত্তা বা কল্যাণকে উপলদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া। শিক্ষার প্রধান সমস্যা হল আত্মাকে তার যথাযথ পরিবেশে রাখা। সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাটি হবে এমন, যাতে আত্মা যা হতে চায় তার দ্বারা তাকে পরিবেষ্টিত রাখা যায়। সােজা কথায়, শিক্ষা হল আত্মার জন্য সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা।
  • মানুষের আত্মা বিশেষভাবে অনুকরণধর্মী। অপর ব্যক্তির কার্যকলাপ আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করে তা থেকেই এই অনুকরণ প্রবণতার দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ করতে পারি। সেই কারণে প্রয়োজন আত্মার পক্ষে মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে চিন্তা করা এবং যে দেবতাদের মানুষ উপাসনা করে তাদের সম্পর্কে মহৎ ধারণা পােষণ করা। আত্মার ওপর কলার প্রভাবও লক্ষণীয়, কেননা প্লেটোর মতে, সৌন্দর্যের ধ্যান করতে গিয়ে আত্মা সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারে। আত্মা বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে।
  • যে বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষাকার্য সম্পন্ন হবে তা হলো দেশের প্রচলিত আদর্শ সাহিত্য, কলার প্রাথমিক জ্ঞান, গঠিত ও জ্যামিতির জ্ঞান। এ ছাড়াও রয়েছে শরীর চর্চা বা ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা। প্রথম জীবনে, আত্মার মধ্যে প্রচ্ছন্ন সৎগুণগুলোকে প্রকট করে তোলার জন্য প্রয়োজন সাহিত্য, শিশুদের কাহিনী নিয়ে যার শুরু; তারপর কাব্য। দ্বিতীয় প্রয়োজন হল সঙ্গীত এবং তৃতীয় প্রয়োজন হল মৃন্ময়শিল্প, সূচিশিল্প , ভাস্কর্য প্রভৃতি কলার চর্চা। সব মিলে সাহিত্য, সঙ্গীত এবং প্রাথমিক গণিতের অনুশীলন আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত চলবে। তারপর ছাত্রকে সামরিক কাজের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে বিশেষ ধরনের ব্যায়াম চর্চার প্রয়োজন। আঠার বছর থেকে কুড়ি বছর পর্যন্ত শরীরচর্চা এবং সামরিক শিক্ষা চলতে থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তিতে একটি বাছাই পরীক্ষা হবে এবং এই পরীক্ষায় যারা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে তাদেরকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য সুযোগ প্রদান করা হবে। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত নির্বাচিত কেউ কেউ গণিত ও বিজ্ঞানের উন্নত শিক্ষাক্রমে অংশগ্রহণ করবে যাতে বিভিন্ন গণিতের মধ্যে সংযোগ এবং সত্তার সঙ্গে তাদের যোগ তারা উপলব্ধি করতে পারে। সর্বশেষে দর্শনের শিক্ষা। এরপর আবার এদের মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত ‘ডায়েলেকটিক’ শিক্ষা দিতে হবে। বিশেষ করে নৈতিকতার পর, কল্যাণের স্বরূপকে জানাই হবে এদের লক্ষ। পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সরকারি পদ গ্রহণ করে ব্যক্তিকে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে। পঞ্চাশ বৎসর বয়সে এদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তারা কল্যাণের স্বরূপ সম্পর্কে দৃষ্টির অধিকারী হবে। এরপর এরা দেশ শাসনে ও গ্রন্থাদি পাঠে নিজেদের নিয়োজিত করবে।
  • শিক্ষার এই ক্রম আত্মার বিকাশের স্তরের সাথে যুক্ত। আত্মার বিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষার প্রভাব এবং এই শিক্ষা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ের মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে। আত্মার বিকাশের বিভিন্ন স্তর ও আত্মার বিকাশের প্রথম স্তরে শিক্ষা কল্পনার মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে। দ্বিতীয় স্তরে শিক্ষা বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে এবং তৃতীয় স্তরে সত্যের প্রতি অনুরাগের মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার লক্ষ হল কল্যাণকে নানাভাবে আত্মার কাছে উপস্থাপিত করা, কেননা সৌন্দর্য এবং সত্যতা হল কল্যাণেরই রকমভেদ। সবচেয়ে প্রধান যে বিষয়টি মানুষ শিক্ষালাভ করতে পারে তা হল মানুষের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী এই বিশ্বজগতে বিচার বুদ্ধি এবং ঐশ্বরিক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা। যে কল্যাণকে আত্মা পরে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করবে, প্রথম জীবনের শিক্ষার লক্ষ হবে নানা ধরনের কল্পনার মধ্য দিয়ে সেই কল্যাণকে প্রত্যক্ষ করতে সহায়ক করা। এই বয়সের শিক্ষা শুরু হবে গদ্য বা কাব্যের মধ্যদিয়ে বর্ণিত গল্প বা কাহিনী ও শিক্ষার উদ্দেশ্য হল দেহ ও মনের বিকাশ।
  • শিক্ষা শুরু হবে ধর্ম দিয়ে, শিশুদের কাছে ঈশ্বরের চরিত্রকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে শিক্ষা-ব্যবস্থা শুরু হবে পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে এবং এসব কাহিনীগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কাহিনীর মাধ্যমে যদি দেবতাদের এবং বীরদের চরিত্র যথাযথভাবে অর্থাৎ কল্যাণকরভাবে প্রকাশিত না হয় তাহলে মহাকাব্য, গীতিকাব্য, নাটক যা-ই রচনা করা হােক না কেন তাতে, সেই সব কাহিনী শিশুদের মনের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। দেবতাদের চরিত্রকে সুন্দর করে চিত্রিত করতে হবে, কেননা, যা সুন্দর তা কখনও শিশুমনের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে না। দেবতাদের যেমন কল্যাণময় করে চিত্রিত করতে হবে তেমনি বীরপুরুষ ও মানুষের চরিত্রকেও তাদের সবচেয়ে উন্নতরূপে চিত্রিত করতে হবে। কোন মন্দ বা অকল্যাণকর কিছু দেবতারা সম্পাদন করছেন এভাবে দেবতাদের চিত্রিত করা যাবে না। যা ভাল তাকে মন্দের জন্য দায়ী করা চলবে না। দেবতাদের এমনভাবে চিত্রিত করতে হবে যাতে তারা কাজে এবং কথায় সরল ও সত্য বলে প্রতিভাত হন। দেবতারা হবে অপরিবর্তনীয়। কোন অবস্থাতেই দেবতারা কাউকে প্রতারিত করছে, এভাবে দেবতাদের চিত্রিত করা চলবে না। পৌরাণিক কাহিনী যে মূলত অবাস্তব সেই সম্পর্কে প্লেটো সচেতন ছিলেন, তবে অবাস্তব হলেও কোন কাহিনীতে দেবতা কোন মন্দ কার্য সম্পাদন করছেন, এভাবে তাদের চিত্রিত করা উচিত হবে না। যা কিছু ভাল, ঈশ্বর কেবলমাত্র তারই কারণ হতে পারেন। তা ছাড়া ঈশ্বর সত্যবাদী, অপরিণামী এবং অ-প্রতারক। ঈশ্বর এক হলেও লৌকিক ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন দেবতারা কার্য সম্পাদন করেছেন সেরূপ ভাষা ব্যবহারে সমস্যা নেই। কাহিনীর মাধ্যমে দেবতাদের প্রতি ও মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভাই-বোনদের প্রতি ভালবাসা জাগাতে হবে, এবং সাহসিকতা, সত্যবাদিতা এবং আত্মসংযম প্রভৃতি সৎ গুণগুলো যাতে তাদের মধ্যে উন্মােষিত হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুদের সামনে বীর চরিত্র উপস্থাপিত করে এই গুণগুলো তাদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করতে হবে।
  • সাহিত্যের বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সাহিত্যের আকার (Form) অর্থাৎ যে আকারে সাহিত্য আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকদের কাছে উপস্থাপিত হবে তাও সমান গুরত্বপূর্ণ। যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষা শিশুদের মনে কতকগুলো সরল ও সুনির্দিষ্ট নৈতিক গুণ প্রবিষ্ট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ, ততক্ষণ পর্যন্ত শিল্পসুলভ চেতনার প্রশ্ন দেখা দেয় না, সত্য কিভাবে উপস্থাপিত হল সেই প্রশ্ন জাগে না। কিন্তু শিক্ষার একটা বিশেষ স্তরে এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয়। অনুকরণের ধর্ম হল বাস্তব হওয়া। যদিও সব সাহিত্যই অনুকরণধর্মী তবু অনুকরণের মাত্রা এবং কিভাবে অনুকরণ করা হচ্ছে তার ব্যাপারে কোন একটি সাহিত্যের সঙ্গে অন্য একটি সাহিত্যের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কাব্য, নাটক, মহাকাব্য সকলেই অনুকরণ করে। কেবলমাত্র যে-সব মানুষ সাহসী, ধার্মিক, আত্মসংযত এবং উদার, তাদের চরিত্রই সাহিত্যে অনুকরণযোগ্য এবং সাহিত্যিক সেই সব চরিত্রই চিত্রিত করবেন। কবিরা জীবনকে বাস্তবভাবে চিত্রিত করতে সমর্থ। কবি এবং কাহিনীকার কেবলমাত্র উন্নত চরিত্রের লোকের আচরণ তাঁদের রচনায় চিত্রিত করবেন। কবি ভালও হতে পারেন, মন্দও হতে পারেন। মন্দ কবি হলেন তিনি, যিনি প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও সকল অবস্থায় সব ধরনের চরিত্র অঙ্কিত করেন। আর ভাল কবি কেবলমাত্র সৎ চরিত্র অঙ্কনের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করবেন। কোন মহান চরিত্রের দুর্বলতা, ত্রুটি বা অসাফল্যের চিত্র তিনি বিশদভাবে চিত্রিত করার জন্য সচেষ্ট হবেন না।
  • কলা মাত্রই চরিত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সেই কারণে কলা মাত্রকেই শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে হবে। সকল কলার ক্ষেত্রেই আত্মার সঙ্গে আত্মা কথা বলে। প্রত্যেক কলারই নিজস্ব ইন্দ্রিয় আছে এবং ইন্দ্রিয়ের মারফত আত্মা আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও সঙ্গীতবিদকে মনে করতে হবে যে, রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য আছে। সুরকে শব্দের সঙ্গে বা কথার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে চলতে হবে। সুর হবে কথার অধীন। চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, বয়নশিল্প , সূচিশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, আসবাব নির্মাণ শিল্প, অর্থাৎ যে-সব কলার একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার আছে, তা সুন্দর বা কুৎসিত হতে পারে এবং তা চরিত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকবলের জন্য এমন এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে যে-কোন দিক থেকেই তারা যা কিছু ভাল তাকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে, এবং যা কিছু কুৎসিত, নোংরা ও কদর্য তাকে পরিহার করতে পারে। চক্ষু ও কর্ণের মাধ্যমেই আত্মা বাহ্য জগতের সৌন্দর্যের সংস্পর্শে আসে। জগৎ সমগ্রভাবে সুন্দর, জগতের মধ্যে বুদ্ধি আছে, তাই জগৎ বুদ্ধিগম্য এবং জগতের এই বুদ্ধি সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েও নিজেকে প্রকাশ করে। শিল্পীর কাজ হল আমাদের এই জগতের সৌন্দর্য দেখানো এবং যে শিল্পীরা তা করতে সক্ষম তাদেরই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। সব রকম কলার ক্ষেত্রেই ছন্দ, তাল, সঙ্গতি বা আকারের ভালত্ব ও মলত্ব বর্তমান এবং যথাযথ ছন্দ বা আকার একাধারে এই জগতের মধ্যে যে বুদ্ধি রয়েছে এবং মানুষের মধ্যে যে বিচারবুদ্ধি রয়েছে তার সমগোত্রীয়।
  • কাব্যে এবং সঙ্গীতে শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে কেননা ছন্দ এবং সঙ্গীত আত্মার গভীরে প্রবেশ করে তার ওপর গভীর রেখাপাত করে, যার ফলে যে ব্যক্তি যথাযথভাবে লালিত-পালিত হয় তার মধ্যে দেহ ও সৌন্দর্যের সুষমা সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা মানুষকে প্রকৃতিতে বা যে-কোন কলার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও কোন দোষ বা ত্রুটিকে দ্রুত অনুধাবন করতে সমর্থ করে। সুন্দরকে অনুধাবন করে ব্যক্তি তেজোদীপ্ত হয়, কুৎসিত ও নোংরাকে সে ধিকৃত করে। এই অভিভাবকবৃন্দকে এমনভাবে শিক্ষিত করতে হবে যাতে তারা বাস্তব ও প্রতিবিম্বের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে, মিতাচারী, সাহসী, উদার এবং উন্নতমনা হয়। এদের এমন হতে হবে যাতে এরা উপরিউক্ত সৎ গুণগুলোর প্রয়োজনীয় আকারগুলোকে যেমন চিনে নিতে পারবে, তেমনি তাদের বিপরীত আকারগুলোকেও চটপট অনুধাবন করতে পারবে। এভাবে ব্যক্তি শিক্ষিত হবে তার কোনটি সুন্দর এবং কোন্‌টি কুৎসিত, সেই সম্পকে অন্তর্দৃষ্টি জাগবে, সে সুন্দরকে ভালবাসবে আর কুৎসিতকে ঘৃণা করবে, পরে সে কেন তাকে ভালবাসছে বা ঘৃণা করছে সেই সম্পর্কে তার মনে যুক্তি গঠন করতে পারবে। যে ব্যক্তির ওপর এই শিক্ষা যথাযথভাবে ক্রিয়া করবে, তিনি সর্বত্র সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবেন; তিনি দেহের সৌন্দর্যের তুলনায় আত্মার সৌন্দর্যকে অধিক মূল্য দেবেন। অত্যধিক রিপুর উত্তেজনা সৌন্দর্য অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সৌন্দর্যের বোধ যত গভীর, পশু উত্তেজনার সঙ্গে তা তত বেশি সঙ্গতিবিহীন। কাজেই কাব্য ও সঙ্গীতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি। সাহিত্য এবং কলার অনুশীলন মানুষের মধ্যে যে দার্শনিক বা শান্ত উপাদান রয়েছে তাকে প্রভাবিত করে। এর যথাযথ বিকাশ মানুষকে মিতাচারী বা আত্মসংযত করে তোলে। আবার যদি ঐ উপাদানকে অতিরিক্ত বিকশিত করে তোলা হয় তাহলে সে হবে অতিমাত্রায় কোমল পৌরুষহীন, অস্থির ও দুর্বলচিত্ত। শিক্ষার সমস্যা হল চরিত্রের এই দুটি দিকের সঙ্গতিসাধন করা।
  • আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকবৃন্দের শিক্ষার ক্ষেত্রে শারীরিক ব্যায়াম-চর্চার গুরুত্বপূর্ণ। শৈশব থেকেই এর প্রতি যত্নবান হতে হবে, যা সারা জীবন ধরে চলবে। সৎ নাগরিক, সৈন্য গঠনের জন্য উপযুক্ত শরীর চর্চা দরকার। শরীর চর্চার নামে পেশাদার মল্লবীর তৈরির উপযোগী শিক্ষা অনুমোদিত নয়। প্রথমত, এতে একটা ঝিমুনে ভাব গঠিত হয় এবং এই ধরনের শরীর চর্চা খাদ্য ও জলবায়ুর পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না। ঐ জাতীয় পরিবর্তন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে দেহ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আদর্শ রাষ্ট্রের যোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজন এক বিশেষ ধরণের শরীর চর্চা, যাতে তাদের চক্ষু ও কর্ণ সদাজাগ্রত থাকে। তারা যেন সকল রকম খাদ্য ও জলবায়ুর পরিবর্তন সহ্য করতে পারে, তারা হবে পানাহারে মিতাচারী। কাব্য ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন, এক্ষেত্রেও প্লেটো যে নীতি অনুসরণ করতে চান তা হল সরলতার নীতি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন বৈচিত্র্য আত্মায় উচ্ছলতার বোধ সৃষ্টি করে এবং সরলতা সংযম নিয়ে আসে, দেহের ক্ষেত্রেও তাই। দেহের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ব্যাধির সৃষ্টি করে, সরলতা সৃষ্টি করে সুস্থ দেহ। কাজেই ভাবী অভিভাবকবৃন্দ যদি যথাযথভাবে ব্যায়ামচর্চা করে তাহলে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তাদের শরীরকে নীরোগ করার জন্য ঔষধের প্রয়োজন হবে না। সাধারণ মল্লবীর ব্যায়ামচর্চা করে শারীরিক শক্তি অর্জন করার জন্য, কিন্তু ভাবী অভিভাবকবৃন্দ শরীরচর্চা করবে তাদের প্রকৃতিতে যে তেজের অংশ বা শৌর্যের অংশ আছে তাকে উদ্দীপিত করার জন্য। প্লেটো শারীরিক ব্যায়ামচর্চা পদটিকে দেহের সাধারণ বিজ্ঞান – এই ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহার করেছেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য সর্বক্ষেত্রেই আত্মার উন্নতি সাধন। সংস্কৃতির অবহেলা যেমন চরিত্রকে প্রভাবিত করে তেমনি শরীরচর্চার অবহেলাও চরিত্রকে প্রভাবিত করে। আত্মার উপাদানকে বিকশিত করার জন্য উভয়েরই প্রয়োজন। ব্যায়ামচর্চা ব্যক্তির শৌর্যাংশকে উদ্দীপিত করে। শরীরচর্চা যথাযথভাবে সম্পাদিত হলে সাহস ও পৌরুষের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু শরীরচর্চা করতে গিয়ে যদি আত্মার অন্যান্য উপাদানকে অবহেলা করা হয় তাহলে ব্যক্তির চরিত্রে কঠোরতা ও বর্বরতা প্রকাশ পায়।
  • প্লেটোর শরীরচর্চা সম্পর্কীয় শিক্ষা ভাবী অভিভাবকদের দেওয়া হলেও এই শিক্ষা যথার্থ শিক্ষা নয়, কেননা শরীরচর্চা শিক্ষার সম্পর্ক ধ্বংসমূলক বিষয়ের সঙ্গে, কেননা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ও হ্রাস পায়। সাহিত্য ও সঙ্গীত শিক্ষাও যথার্থ নয়, কেননা এ হল সুর ও ছন্দের মধ্য দিয়ে চরিত্রে এক ধরনের সঙ্গতি নিয়ে আসা। এই উভয় প্রকার শিক্ষার কোনটিই যথার্থ শিক্ষা পদবাচ্য নয়, কেননা অভিভাবকদের লক্ষ কল্যাণ (Good)-এর জ্ঞান লাভ করা। উপরিউক্ত শিক্ষা সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির পক্ষে সহায়ক নয়। কাজেই আত্মাকে কল্যাণের জ্ঞানের পথে চালিত করার জন্য বিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োজন। কোন কোন বিষয়ের জ্ঞান লাভ করতে গেলে দেখা যাবে যে, তাদের প্রকৃতিই এমন যে তারা আমাদের চিন্তাকে উদ্দীপিত করে, যেমন পাটীগণিত যা সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করে প্রতিটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু একাধারে এক এবং বহু। কাজেই, যেহেতু এক এবং বহু একই বস্তুতে সহাবস্থান করে, এককে প্রত্যক্ষ করা মানেই বহুকে এবং বহুকে প্রত্যক্ষ করা মানেই এককে প্রত্যক্ষ করা। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এককে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলোচনা শুধু প্রত্যক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, আত্মাকে প্রত্যক্ষণ থেকে, সত্তার চিন্তনের দিকে চালিত করে। তাই সংখ্যার বৈশিষ্ট্য মানুষকে সত্তার স্বরূপ উপলব্ধির দিকে চালিত করে বলে পাটীগণিতকে অভিভাবকদের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। এর মাধ্যমে তারা পরিবর্তনশীল জগতের উর্ধে যে শুদ্ধ সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে তাকে উপলদ্ধি করতে পারবে, শুদ্ধ চিন্তনের সাহায্যে সংখ্যার যথার্থ প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারবে, যুদ্ধের জন্য এবং অসৎ-এর জগৎ থেকে সৎ-এর জগতে উত্তীর্ণ হতে পারবে। সংখ্যার আলোচনা করতে হবে জ্ঞানের জন্যে, কোন ব্যবসাদারী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। পাটীগণিতের আলোচনা মনকে শুদ্ধ সংখ্যা সম্পর্কে যুক্তিতর্ক করতে শেখায়। সংখ্যাকে কেবল বুদ্ধির সাহায্যেই জানা যায়। কাজেই গণিতশাস্ত্রের আলোচনা শুদ্ধ চিন্তার প্রয়োগের দ্বারা বিশুদ্ধ সত্যতাতে উপনীত হতে মনকে বাধ্য করে। অভিভাবকবৃন্দকে জ্যামিতিও শিক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে এই বিদ্যার অনুশীলন যুদ্ধের নানা কাজের পক্ষে সহায়ক। তবে জ্যামিতি হল যা অনন্তকাল ধরে অস্তিত্বশীল তার জ্ঞান, এবং সেই কারণে এই বিদ্যার অনুশীলন আত্মাকে সত্যের দিকে চালিত করবে এবং জগতের দিকে চালিত না করে দার্শনিক বুদ্ধিকে ঊর্ধ্ব দিকে চালিত করবে। জ্যামিতির অনুশীলন অন্যান্য যেকোন বিদ্যার অনুশীলনের জন্য মনকে প্রস্তুত করে। অভিভাবকদের জ্যোতির্বিদ্যাও শিক্ষা করতে হবে। কৃষিকাৰ্য, নৌচালনাবিদ্যা। ছাড়াও সরকারি কাজে এর প্রয়োজনীয়তা আছে। তা ছাড়া জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা আত্মার বুদ্ধিকে তার যথাযথ কাজে লাগায়। সুরবিজ্ঞানও অভিভাবকদের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে সৌন্দর্য ও কল্যাণের জ্ঞানের মাধ্যম রূপে এর অনুশীলন করা হলে তবেই এর যথার্থ সার্থকতা। বিজ্ঞানগুলো শিক্ষা করতে গিয়ে মন ধীরে ধীরে কতকগুলো সূত্র বা সত্তার আকার অনুধাবন করতে পারে, যেগুলো তাদের কল্যাণের নীতিকে জানতে সহায়তা করে। প্রথমত, এই বিজ্ঞানগুলোর আলোচনা হল মানসিক ব্যায়াম এবং দ্বিতীয়ত, এই বিজ্ঞানগুলো কতকগুলো মৌলিক আকারে জ্ঞান দেয়, যে আকারে এই জগতের কল্যাণের উপস্থিতি প্রকাশিত হয়। এসব বিজ্ঞানের আলোচনা দার্শনিক জ্ঞানের পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ।
  • গণিতশাস্ত্র দশ বছর ধরে শিক্ষা গ্রহণ করার পর আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকবৃন্দকে ত্রিশ বছর থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত ‘ডায়েলেকটিক’ অনুশীলন করতে হবে। ইতোপূর্বে যে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে তার একটি প্রধান ত্রুটি হল এই যে, বিভিন্ন জ্ঞানের শাখাগুলো যে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত এক অখণ্ড সমগ্র— এভাবে তাদের না জানিয়ে তাদের পৃথক পৃথকভাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জ্ঞানের শাখাই কতকগুলো হেতুবাক্যকে বিনা প্রশ্নে স্বীকার করে নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সচেষ্ট হয়েছে। কাজেই প্রতিটি গাণিতিক বিজ্ঞান যে-কোন নিরপেক্ষ স্বপ্রকাশ এবং শর্তহীন নীতির সঙ্গে যুক্ত, তা জানা যায়নি। ডায়েলেকটিকের লক্ষ হল, অবশ্য যখন তাকে এই গণিতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, সব গাণিতিক জ্ঞান সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টি দান করা এবং সমগ্র সত্তার সঙ্গে তা কিভাবে যুক্ত দেখানো। ডায়েলেকটিক হল দার্শনিক জ্ঞান, বিচারবুদ্ধির সাহায্যে কল্যাণের নিজের স্বরূপটিকে উপলব্ধি করা। ডায়েলেকটিক পদ্ধতি ছাড়া, প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব স্বরূপ কী, তা অনুসন্ধান করার জন্য অন্য কোন পদ্ধতি নেই। ডায়েলেকটিক পদ্ধতি হল একমাত্র পদ্ধতি যা বিনা প্রমাণে কোন হেতুবাক্যকে স্বীকার করে নেয় না, এবং ধীরে ধীরে কিছুর আদি সূত্রে উপনীত হয়। প্রতিটি বস্তুর স্বরূপ-ধর্ম বা সারমর্মের বিবরণ দেওয়া ডায়েলেকটিকের মাধ্যমেই সম্ভব হয়। যে ব্যক্তি ডায়েলেকটিকের অনুশীলন করেছে সে কল্যাণের প্রকৃতিকে অন্যান্য আকারের প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র করতে পারে।

রাষ্ট্রতত্ত্ব, ন্যায়বিচার

  • রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ নৈতিক মতবাদের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজের মধ্য থেকেই মানষ তার কল্যাণময় জীবন-যাপন করতে পারে। তাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নৈতিকতা ভিন্ন নয়। এক সর্বনিরপেক্ষ নৈতিক নিয়ম সব ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের নৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই রাষ্ট্রের নৈতিক নিয়মের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। রাষ্ট্র নিজেই তার নৈতিক নিয়মের উৎস হতে পারে। একটি সৎ লোকের গুণ একটি সৎ নাগরিকের গুণের সঙ্গে অভিন্ন এবং সৎ মানুষ কেবলমাত্র সৎ রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে। কাজেই যা মানুষের পক্ষে ভাল কল্যাণকর, তা রাষ্ট্রের পক্ষেও কল্যাণকর। রাষ্ট্রের জীবন তার নাগরিকদের জীবনের মধ্যেই অস্তিত্বশীল। রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষের জাগতিক প্রয়োজনের পরিতৃপ্তি ঘটে। সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। সমাজ দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে প্রথমত, কোন মানুষই স্বনির্ভর নয়, এবং দ্বিতীয়ত, প্রথম বিষয়টির পরিপূরক বিষয়টি হল মানুষ মানুষের সাহচর্য চায়। মানুষের পক্ষে অপর মানুষের ওপর নির্ভর না করে স্বাধীন জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়। দৈনন্দিন জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের জন্য মানুষের পারস্পরিক সহায়তার প্রয়োজন হয়। তাই তারা সঙ্গী, বন্ধু এবং সাহায্যকারীদের একটা বাসস্থানে জড় করে এবং তার নাম দেয় নগর।
  • রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যেমন নরনারীর প্রয়োজনগুলো মেটাবার ব্যবস্থা করা; তেমনি সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্ম বিনিময়ের ব্যবস্থা করা। কাজেই প্লেটোর মতে, কোন সামাজিক চুক্তি থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেনি। সমাজে কর্ম-বিনিময় দুটি নীতি সূচনা করে শ্রমবিভাগ বা কর্ম বিভাগ এবং বিশেষ কোন কর্মে দক্ষতা। এই দুটি নীতি মানুষের মনস্তত্ত্বের দুটি মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত – (১) মানুষে মানুষে মনোভাবের দিক থেকে পার্থক্য আছে এবং কাজেই অপরের তুলনায় মানুষ কোন কোন কাজ ভালভাবে করতে পারে। (২) কোন ব্যক্তি দক্ষ কর্মী হতে পারে যদি যে কাজের জন্য সে স্বভাবত উপযুক্ত, সেই কাজ সে অবিচলিতভাবে সম্পাদন করতে পারে। কোন ব্যক্তি তার স্বাভাবিক ক্ষমতা অনুযায়ী যদি একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে তাহলে তার কাজের গুণগত ও পরিমাণগত উৎকর্ষ অনেক বেশি হয়।
  • মানুষের আত্মার তিনটি উপাদান ও রাষ্ট্র ব্যক্তির যান্ত্রিক সংগঠন না হয়ে এর একটি আঙ্গিক ঐক্য থাকায় (যেখানে প্রতিটি অংশেরই একটি ক্রিয়া আছে) রাষ্ট্র মানুষের মনের দ্বারা একটি সৃষ্টি বিষয়, তাই রাষ্ট্রেরও মানুষের আত্মার মত তিনটি উপাদান প্রয়োজন – অর্থনৈতিক, সামরিক এবং দার্শনিক। ক্ষুধার উপাদান খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতি প্রয়োজন সৃষ্টি করে। এর ফলে কোন সংগঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়, যা এই প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে। অর্থনৈতিক প্রয়োজন ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজন আছে। যেমন-কাব্য, সঙ্গীত, পােশাক পরিচ্ছদ, চিত্র ইত্যাদি। এসব প্রয়োজন মেটাবার জন্য একটি বৃহৎ জনসংখ্যার প্রয়োজন এবং এই বৃহৎ জনসংখ্যার বসবাসের জন্য একটি বৃহৎ এলাকা বা অঞ্চলের প্রয়োজন। এর পর দেখা দেয় যুদ্ধের সমস্যা এবং ঐ অঞ্চল বা রাজ্যকে রক্ষা করার প্রশ্ন। এর জন্য প্রয়োজন একটি সামরিক সংগঠনের, যেটি শৌর্যের উপাদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু প্লেটো বিশেষ কর্মদক্ষতার নীতিকে এবং কর্ম-বিভাগকে সমর্থন করেন, সেহেতু তিনি পেশাদার এবং সুশিক্ষিত সৈন্যদল গঠনের অনুমােদন করেছেন। এদের কাজ হবে শুধু যুদ্ধ ছাড়া অপর কিছু না করা। সবশেষে দেখা দেয় দার্শনিক উপাদান। রাষ্ট্রের সামরিক সংগঠন যখন কাজ করতে থাকে, বিচার-বুদ্ধির উপাদানও কাজ করতে থাকে। কেননা শৌর্যের উপাদান বিচার-বুদ্ধির উপাদানের সাহায্যকারী। বিচার-বুদ্ধির উপাদান দার্শনিক অভিভাবকদের ক্ষেত্রে, যারা রাষ্ট্র শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।
  • কর্ম-বিভাগের ফলে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী দেখা যায়, যেমন কৃষক, তাঁতী, মুচি, কর্মকার, ব্যবসায়ী, ছুতোর। ক্রমশ প্রয়োজন দেখা দেবে সঙ্গীতজ্ঞ, কবি, শিক্ষক, নার্স বা সেবিকা, নাপিত, রাধুনি। এবং আরও অনেক ব্যক্তির। রাষ্ট্রে আমরা তিনটি বিশেষভাবে দক্ষ শ্রেণী দেখা যায় – (১) শাসক শ্রেণী বা অভিভাবকবৃন্দ, (২) সৈনিক বা যোদ্ধাশ্রেণী বা সহায়ক শ্রেণী, (৩) উৎপাদক বা কারিগর শ্রেণী। আদর্শ রাষ্ট্রে এই তিন শ্রেণী থাকবে। সবচেয়ে নিচে কারিকর শেণী, তাদের উপরে যোদ্ধাশ্রেণী এবং সকলের উপরে অভিভাবকশ্রেণী। রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রের শাসনভার থাকবে এই শাসক শ্রেণীর ওপর। এদের প্রধান গুণ হল জ্ঞান। সহায়ক শ্রেণী বা সৈনিক শ্রেণীর প্রধান কাজ দেশ রক্ষাশান্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করা। সমাজের যারা সাহসী ও দৈহিক শক্তিসম্পন্ন তারাই এই শ্রেণীর উপযুক্ত সাহস ও বিক্ৰম তাদের গুণ। ‘সাহস’ বলতে শৌর্য না বুঝে কোন কিছুকে যথাযথ মনে করে তাতে লেগে থাকাকে বোঝায় যা সৈনিকদের সৎ গুণ। যোদ্ধশ্রেণী কারিকর শ্রেণী থেকে শক্তিশালী হলেও অত্যাচারী হবে না, তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে। দৈহিক পরিশ্রম দ্বারা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমৃদ্ধ উৎপাদক শ্রেণীর মূল দায়িত্ব। সংযম তাদের প্রধান গুণ। চাহিদা মেটানো ছাড়া রাজনৈতিক জীবনে এদের ভূমিকা থাকবে না। তবে মিথ্যাচারবিমুখিতা বা আত্মসংযমের অধিকারী শুধু কারিগর শ্রেণী না সকল শ্রেণীকেই হতে হবে। কোন বিশেষ শ্রেণীর কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র নয়, সকল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির কল্যাণময় জীবন-যাপনের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সার্থকতা। ন্যায়পরায়ণতা একাধারে রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির সৎ গুণ। ব্যক্তির মধ্যে থাকা তিন উপাদান বিচার-বুদ্ধি, শৌর্য এবং ক্ষুধা এই তিনটি উপাদান যথাযথভাবে তাদের ক্রিয়া সম্পাদন করলে ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ হয়, তেমনি রাষ্ট্রের তিন শ্রেণী যথাযথভাবে নিজ কর্ম সম্পাদন করলে রাষ্ট্র ন্যায়পরায়ণ হয়, তাই প্রত্যেকেই কেবল তাদের নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করবে। শাসকবর্গ এবং সৈনিকদের এই উদ্দেশ্যে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সৈনিকদল সর্বোতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে নিজেদের নিয়োজিত করবেন। এরা হবেন তেজস্বী, দার্শনিক দৃষ্টিসম্পন্ন, যার দ্বারা তারা অতি সহজেই নিরূপণ করতে পারবেন তাদের প্রকৃত শত্রু কারা।
  • রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো নয়, ন্যায়পরায়ণতার নীতি অনুসারে রাষ্ট্রের নাগরিক যাতে কল্যাণময় জীবনের অধিকারী হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্রের যারা অভিভাবক, তাদের শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আছে। এই শিক্ষা শুরু হবে সঙ্গীত, ব্যায়ামচর্চা ও কাহিনী শিক্ষার বিষয় দিয়ে। হেসিয়ড ও হোমারে বর্ণিত দেবতাদের মন্দ ক্রিয়াকলাপের বর্ণনাযুক্ত কাহিনী শৈশবে ভাবী অভিভাবকদের পড়তে দেওয়া হবে না, কারণ শিশুদের মনে ঈশ্বর মন্দের স্রষ্টা – এই ধারণা সৃষ্টি করা যাবে না। আদর্শ রাষ্ট্রে মহাকবি এবং নাট্যকাররা থাকতে পারবে না কারণ কবিদের ভাষার সৌন্দর্য, শব্দ চাতুর্য ও কল্পনা সত্য উপলব্ধিতে বাধা দেয়, এবং কবিরা অনেক ‘নীতি-বিগর্হিত’ চরিত্র চিত্রণ করেন। ব্যায়ামচর্চার শিক্ষা দরকার কারণ আদর্শ রাষ্ট্রে কবিতার ক্ষেত্রে কেবল গীতিকবিতাকে স্থান দেয়া যাবে। রাষ্ট্রের অভিভাবকবৃন্দ অলস ক্রীড়াবিদ হবেন না, তারা হবেন যোদ্ধা ক্রীড়াবিদ, যারা প্রহরী কুকুরের মত সজাগ থেকে সব কিছু দেখবেন এবং শুনবেন।
  • মানুষ শুধু পরিবারেই জন্মগ্রহণ করে না, সে একটি বৃহত্তর সংগঠনেরও সভ্য, তাই সমাজে সে সৎ জীবন-যাপন করবে এবং তার লক্ষ লাভে সচেষ্ট হবে। তার সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবেনা যাতে সে মনে করে যে, সমাজের মধ্যে সে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শুধু নিজের জন্যই বাস করছে। সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকলেই ব্যক্তির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা থাকে। রাজনৈতিক চেতনাহীন ব্যক্তির কাছে রাষ্ট্র অপরিচিত বস্তু, কিন্তু রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে রাষ্ট্র হল এমনই একটি সংগঠন যাতে তার একটা অংশ রয়েছে। তার কাছে এই বোধ থাকলে সে রাষ্ট্র সম্পর্কে একটা মতবাদ গঠন করার জন্য উৎসাহিত হবে।
  • আদর্শ রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষ এক। নারী ও পুরুষের ক্ষমতা সমান বলে দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান। উভয়ের লালন-পালন ও শিক্ষা দীক্ষা হবে সমান। পুরুষেরা যেমন শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও শরীরচর্চার অধিকার পাবে নারীরাও তা পাবে। এমনকি নারীরা পুরুষদের ন্যায় যুদ্ধ বিদ্যাও শিখতে পারবে অর্থাৎ প্লেটোর মতে, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য থাকবে না। যে শিক্ষা একজন পুরুষকে একজন যথার্থ অভিভাবক হিসেবে পরিণত করতে পারে সেই একই শিক্ষা একজন নারীকেও যথার্থ অভিভাবিকায় রূপায়িত করতে পারবে। নারী ও পুরুষদের মধ্যে যে পার্থক্য তা মাত্রাগত পার্থক্য, গুণগত নয়। পুরুষরা মেয়েদের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষে কোন বৈষম্য নেই। রাষ্ট্রের ঐক্য ও শক্তির স্বার্থে পুরুষের সাথে সাথে মেয়েরাও সমান এবং একই দায়িত্ব বহন করবে। নারী ও পুরুষদের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। আইনজীবী ও ম্যাজিস্ট্রেটগণ নারী পুরুষদের যোগ্যতা অনুসারে নির্বাচন করবেন কাকে কোন্ কাজ দেয়া হবে। অর্থাৎ কে হবে সৈনিক, কে হবে দার্শনিক, কে হবে শ্রমিক তা নির্ধারিত হবে আইনজীবী ও ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে। আইনজীবী এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক নির্বাচিত নারী পুরুষগণ একই সাথে থাকবে এবং একই সাথে খাবে, একই পরিবেশে প্রতিপালিত হবে। আর এভাবে একত্রে বসবাস করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি হবে। নারী-পুরুষ একই সাথে বসবাস করার ফলে যাতে করে মানবিক মূল্যবোধ না হারায় সেদিকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সতর্ক থাকতে হবে। আর এভাবে বসবাস করায় রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপিত হবে।
  • আদর্শ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের কর্ম ভালভাবে সম্পাদন এবং সুসন্তান লাভের জন্য রাষ্ট্র প্রজনন নীতির ভিত্তিতে উচ্চতর শ্রেণীর নরনারীর বিবাহ-সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করবে। সন্তানরা রাষ্ট্র পরিচালনাধীন ধাত্রীগৃহে লালিত-পালিত হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক বংশ বৃদ্ধির ব্যাপার নিয়ন্ত্রিত হবে, অনুসারে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত উপযুক্ত মা-বাবারই সন্তান হতে পারবে এবং সন্তান সংখ্যাও রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত নয় এমন কোন সন্তান হলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে না এবং তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হবে। যেসব নারীর বয়স ২০ থেকে ৪০ বছর তারাই কেবল সন্তানের মা হতে পারবে; আর যেসব পুরুষের বয়স ২৫ থেকে ৫৫ বৎসরের মধ্যে তারাই কেবল সন্তানের বাবা হতে পারবে। এই নির্ধারিত বয়সসীমার বাইরে যাদের সন্তান হবে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনে নারী-পুরুষদের মিলনের ফলে যে সন্তানের জন্ম হবে তা সকলের সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে একই সাথে রাখা হবে। সন্তানদের ওপর কারও ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না। রাষ্ট্রে একটি নারী কমিটি বিবাহের পর দশ বছর পর্যন্ত নব-দম্পতিদের তত্ত্বাবধান করবে। বিবাহের পর দশ বছরের মধ্যে কোন সন্তান না হলে দম্পতি বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারী হবে। পুরুষেরা ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ এবং নারীরা ষোল থেকে কুড়িতে বিবাহ করবে। দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাস ভঙ্গ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুরুষদের পক্ষে সামরিক বিভাগে কাজ করার বয়স কুড়ি থেকে ষাট। স্ত্রীলোকেরা সন্তানধারনের পর এবং পঞ্চাশ বছর হওয়ার আগে পর্যন্ত সামরিক বিভাগে যোগদান করতে পারবে। প্লেটো মনে করতেন, যেহেতু বিবাহিত নরনারীর কর্তব্য ভাল সন্তানের জন্মদান করা, সেহেতু রাষ্ট্র কর্তৃক বিবাহিত নর-নারীর সম্পর্কের তত্ত্বাবধান অবাঞ্ছিত মনে হলেও তাকে সমর্থন করা চলে।
  • আদর্শ রাষ্ট্রে কারিগর শ্রেণীর লোকেরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পারবে, কিন্তু উচ্চতর শ্ৰেণীগুলো রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে বা পারিবারিক জীবন-যাপন করতে পারবে না। ব্যক্তিগত জীবন যাপনের পরিবর্তে যৌথ জীবন ব্যবস্থা দরকার। অভিভাবক শ্রেণীর কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারবে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির চিন্তা মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। আর এরই ফলশ্রুতিতে অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, লোভ-লালসা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। আইনজীবী এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক নির্বাচিত নারী পুরুষগণেরও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু থাকবে না।
  • অভিভাবক শ্রেণীর মধ্য থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গে রাষ্ট্রের শাসকদের নির্বাচন করতে হবে। তারা তরুণ হবেন না, হবেন তাদের শ্রেণীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, বুদ্ধিমান, ক্ষমতাশালী, রাষ্ট্রের ব্যাপারে মনোযোগী। বিজ্ঞতার সারবস্তু বিবেচনাশক্তি যা স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়, তাই কেবল অভিভাবকরা বিজ্ঞতার অধিকারী, কেবল তারাই সমাজের সমষ্টিগত কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন, রাষ্ট্রকে ভালবাসেন এবং নিজের সুবিধার কথা চিন্তা না করে রাষ্ট্রের স্বার্থকেই নিজের স্বার্থ বলে ভাবেন। জন্ম বা সম্পদের ভিত্তিতে না হয়ে ব্যক্তিগত চরিত্র এ শাসনকার্যে দক্ষতার ভিত্তিতে ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে ও শাসককেও এই আইন মেনে চলতে হবে।
  • শাসনকর্তাকে অবশ্যই যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, তিনি হবেন দার্শনিক রাজা। তিনি স্বেচ্ছাচারী হবেন না, বরং ধারণা জগতের নকশা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। দার্শনিক রাজার সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, মিতাচার, কথা ও কাজে মিল দেখে জনতা তাকে গ্রহণ করবে। দার্শনিকরা সত্যের ওপর নিবদ্ধ থাকে, সাধারণ মানুষের মত ঈর্ষা, ঘৃণার বশবর্তী হয়ে কিছু করেন না, অপরিবর্তনীয় ও শৃঙ্খলাপূর্ণ এক জগতের উপর ভিত্তি করে তারা কাজ করেন। যেখানে বিচারবুদ্ধিই শাসন করে সেখানে কেউ অন্যায় করেনা। দার্শনিক জগতের স্বর্গীয় শৃঙ্খলার নিয়ত সাহচর্যে সেই শৃঙ্খলাকে নিজের আত্মাতে ফুটিয়ে তুলতে চায় এবং ঐশ্বরিক পূর্ণতাকে লাভ করার জন্য সচেষ্ট হয়। জীবনে খুঁত থাকলে দার্শনিক অপরের চরিত্রকে নিজের মত করে গঠন করতে এবং তার আদর্শের আলোকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনসাধারণের জীবনকে সুগঠিত করতে বাধ্য হয়। জনসাধারণ দার্শনিক-শাসনকর্তার এই পরিচয় পেলে তাকে আর অবিশ্বাস করবে না। তখন তারা বিশ্বাস করবে যে, রাষ্ট্রে সুখ তখনই আসতে পারে যখন স্বর্গীয় ছাঁচে শিল্পী তার চিত্রের রূপরেখাকে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হবে।
  • রাষ্ট্র হল একটা শিক্ষার সংহতি এবং সরকার হল তার প্রকৃতির ফল। কারণ এই সংহতি অবশ্যই জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং কেবলমাত্র যথার্থ জ্ঞান হল দর্শন হওয়ায় এটি অবশ্যই দার্শনিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। দার্শনিকরা রাজা বা শাসনকর্তা না হলে বা রাজা এবং যুবরাজ যদি দর্শনের মাধুর্য এবং ক্ষমতার অধিকারী না হয়, তাহলে নগর রাষ্ট্র কখনও অকল্যাণ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কেবলমাত্র এই ভাবেই অজ্ঞ এবং স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের অকর্মণ্যতা ও দলাদলিকে বন্ধ করা সম্ভব হবে। কেবলমাত্র এই ভাবেই রাষ্ট্র এমন শাসনকর্তা পাবে যারা বিজ্ঞতার সাহায্যে রাষ্ট্র শাসন করে কারণ তারা সত্যের সন্ধান পেয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তা থেকে তারা মুক্ত, তারা মনে করেন তাদের দায়িত্ব হল কঠিন কর্তব্য, যে দায়িত্ব জনসাধারণের কল্যাণের জন্য তাদের বহন করতে হবে।
  • দার্শনিক অধিপতিদের শাসন হবে রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্র। দার্শনিক শাসকরা কোন লিখিত আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন না, আবার স্বেচ্ছাচারীও হবেন না, বরং রাষ্ট্রের মূল নীতির প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে রাষ্ট্র শাসন করবেন। চারটি মূল নীতি হলো – (১) শাসকবর্গকে নজর রাখতে হবে যাতে দারিদ্র বা সম্পদ যেন রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে। (২) রাষ্ট্রের আকার যাতে খুব বড় বা খুব ছােটো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে, রাষ্ট্র হবে স্বনির্ভর। (৩) তারা ন্যায়ের শাসন চালাবেন এবং লক্ষ রাখবেন যাতে প্রতিটি নাগরিক তার জন্য নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত থাকে। (৪) সবশেষে তাদের সুনিশ্চিত হতে হবে যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে যেন কোন নতুন সংস্কার না সাধিত হয়। লিখিত আইন থাকা যাবে না কারণ রাজনীতিবিদরা আইনের অধীনে বাগ্মিতার সহায়তায় যে সরকার চালান দার্শনিক-শাসনকর্তাদের সরকার তার বিপরীত।
  • যারা ভবিষ্যতে শাসক হিসেবে নির্বাচিত-হবেন, তারা শুধু সঙ্গীত ও ব্যায়াম শিক্ষা করবেন না, গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান শিখবেন, যেগুলো ‘ডায়েলেকটিকস’ বা দর্শন শিক্ষার ভূমিকাস্বরূপ। ডায়েলেকটিকস্ শিক্ষার দ্বারা অভিভাবকবৃন্দ ইন্দ্রিয়ের সহায়তা ছাড়া বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সাহায্যে সর্বনিরপেক্ষ পরম সত্তাকে আবিষ্কার করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত তারা প্রজ্ঞামূলক দৃষ্টির সাহায্যে পরম কল্যাণ লাভ করতে পারবেন। কাজেই রাষ্ট্রের নির্বাচিত শাসকবৃন্দ বা অভিভাবকবৃন্দের পদের জন্য যাদের নির্বাচিত করা হবে তাদের দেহ ও মন উভয় দিক থেকেই পরিপূর্ণভাবে সুস্থ এবং সৎ হতে হবে। এঁদের ত্রিশ বছর বয়সকালে ডায়েলেকটিকস্ বা দর্শন শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করা হবে। পাঁচ বছর শিক্ষা লাভ করার পর তাদের সৈন্য বিভাগে বা সরকারি বিভাগে পনে শিক্ষানবিস করতে হবে। এই সময় তারা জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করতে সময় বোঝা যাবে যে, প্রলোভনের মুখে তারা অবিচলিত বা স্থির থাকতে পারেন কিনা। এইভাবে তাদের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে তখন তারা ধারণা বা সার্বিকের উৎস যে কল্যাণ (Absolute Good) তার জ্ঞান লাভ করবেন এবং এই জ্ঞানের আলো রাষ্ট্র ও ব্যক্তির কল্যাণ সাধনে ব্রতী হবেন।
  • আদর্শ রাষ্ট্রে বৃত্তিগুলোর একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সঙ্গতি, অভিযোজন বা যথাযথ আন্তর সম্পর্ক বর্তমান থাকে, কিন্তু আদর্শচ্যুত বা বিকৃত রাষ্ট্রে এই আন্তর সম্পর্ক কম বা বেশি ব্যাহত হয়। এই বিকৃতি চার রকম। আদর্শ রাষ্ট্র হবে অভিজাততান্ত্রিক (Aristocratic)। কিন্তু যদি উচ্চশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত লোকেরা নিম্নশ্রেণীর লোকদের সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয় এবং নিম্নশ্রেণীর লোকদের দাসশ্রেণীতে পরিণত করে, তখন অভিজাততন্ত্র টিমােক্রেসিতে (Timocracy) পরিণত হয়, যা কালক্রমে ধনিকতন্ত্রে (Oligarchy) পরিণত হয়। ধনিকতন্ত্রের বিকৃত রূপ হল গণতন্ত্র। ধনিক শ্রেণীর অধীনে এক দরিদ্র শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং সর্বশেষে এই দরিদ্রেরা ধনীদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবার টিমােক্রেসির (Timocracy) সৃষ্টি করে।
  • শাসনক সংখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র দু ধরণের – অনুসারী রাষ্ট্র (Law-States) এবং স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র (Arbitrary States)। আইন অনুসারী রাষ্ট্র যেহেতু আইন মেনে চলে তাই তারা আদর্শ রাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এবং স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র আইন মেনে না চলার জন্য আদর্শ রাষ্ট্র থেকে দুভাবে বিচ্যুত। রাষ্ট্রের ছয় রকম শ্রেণীবিভাগের করা যায় যার তিন ধরনের আইন অনুসারী রাষ্ট্র এবং তিন ধরনের স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র। আইন অনুসারী রাষ্ট্রে যদি একজনের শাসন দেখা যায় তাকে রাজতন্ত্র (Morarchy) বলে, কিছু লোকের শাসনকে অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) এবং বহুজনের শাসনকে পলিটি বলে। সুশৃঙ্খল বা আইন অনুসারী সরকারের কথা বলা হলে রাজতন্ত্রই সবচেয়ে ভাল। বহুজনের গঠিত সরকার নিকৃষ্টতম আর অল্প কিছুজনের পরিচালিত সরকার এই দুইয়ের মধ্যবর্তী। স্বেচ্ছাচারী বা বিশৃঙ্খল সরকারের মধ্যে স্বৈরতন্ত্র হল নিকৃষ্টতম সরকার। তারপর নিকৃষ্টতম হল অল্প কিছুসংখ্যক লোকের শাসন এবং নিকৃষ্ট হল বহুজনের শাসন। কাজেই প্লেটোর মতে, গণতন্ত্র বা বহুজনের দ্বারা পরিচালিত সরকার হল আইনানুগ সরকারের মধ্যে নিকৃষ্টতম এবং বিশৃঙ্খল সরকারের মধ্যে উৎকৃষ্টতম।
  • আইনের সার্বভৌমিকতা এবং জনগণের সম্মতির বিষয়টি স্বীকার্য। এবং রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মিশ্র সরকার রাজতন্ত্রের তুলনায় উত্তম। শাসকের বিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করা হবে শাসিতের স্বাধীনতা এবং এই সংযোগের ফলে ভ্রাতৃত্বের (Fraternity) উদ্ভব হবে। শাসকবর্গ সম্পত্তি ও পরিবারের অধিকারী হবে। যারা শাসিত তাদের নিজেদের শাসনকর্তা নির্বাচনের অধিকার থাকবে। আদর্শ রাষ্ট্র বাদ দিলে দ্বিতীয় সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্রে রাষ্ট্রকে আইনকেই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে স্বীকার করা উচিৎ। শাসক এবং শাসিত উভয়ই আইন মানতে বাধ্য। আইনই হল সভ্যতা। আইনের মাধ্যমেই কোন ব্যক্তিকে সামাজিক জীবনে যা সর্বোৎকৃষ্ট তাকে অনুসরণ করার জন্য বাধ্য করা যেতে পারে। আইনের মাধ্যমেই সমাজের সাধারণ কল্যাণের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করা যেতে পারে এবং উৎকৃষ্ট নাগরিকত্ব অর্জন করা যেতে পারে। কাজেই রাষ্ট্রকে ‘আইনের স্বর্ণসূত্রের’ সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। আইনের তত্ত্বাবধায়ক হবে সঁইত্রিশ জন ব্যক্তি, যাদের বয়স পঞ্চাশ বছরের কম হবে না এবং তাঁরা সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত তাদের কাজে নিযুক্ত থাকবে। রাষ্ট্রে ৩৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংসদ থাকবে, যার সদস্যরা নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত হবে। রাষ্ট্রে কয়েকজন মন্ত্রী থাকবে যাদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর পদ হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। রাষ্ট্রে শিক্ষাকে কখনও গৌণ বিষয় রূপে গণ্য করা চলবে না।
  • কৃষি, অপরাধীর শাস্তি, এই সকল বিষয়কে কেন্দ্র করেও আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি দেবার সময় তার মানসিক অবস্থা বিচার করা উচিত। ভিক্ষাবৃত্তি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্রের নাগরিক এবং রাষ্ট্রপ্রদত্ত শিক্ষালাভ করেছে এমন ব্যক্তি যদি সাধারণের অর্থ তছরূপ করে তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যকাল শেষ হলে তাদের হিসাবপত্র পরীক্ষা করার জন্য একটা বোর্ড গঠন করা হবে। রাষ্ট্রের অনুমােদন ব্যতীত কেউ বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবে না। রাষ্ট্রের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও আইন দরকার। নাস্তিকতা ও ধর্মবিরোধিতার অপরাধে অপরাধী-ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। অবস্থা বিশেষে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা প্রাণদণ্ড হতে পারে। চেতনাশূন্য ভৌগোলিক উপাদানের গতির ফলে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্ট হয়েছে, এইরূপ ধারণা করা নাস্তিকতা। গতির উৎস্বরূপে কোন স্বয়ং—গতিশীল নীতি হিসেবে মন বা আত্মাকে স্বীকার করতে হবে। ঈশ্বর মানুষের প্রতি উদাসীন এই ধারণা এক ধরনের ধর্মবিরোধিতা। আবার উৎকোচ দিলে ঈশ্বর অন্যায় কার্যকে ক্ষমা করেন এও ধর্মবিরোধিতার শামিল। দাস প্রথা সমর্থিত। ক্রীতদাস হল তার প্রভুর সম্পত্তি। ক্রীতদাসীর গর্ভজাত সন্তানের অধিকারী সকল সময়ই ক্রীতদাসীর মালিক বা প্রভু। গণতান্ত্রিক এথেন্সে দাস-দাসীরা যে স্বাধীন ও সহজভাবে জীবন-যাপন করে তা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু ক্রীতদাসের প্রতি নির্মম আচরণ করা যাবে না।
  • রাষ্ট্রের সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়া বাঞ্চনীয় কেননা কাছে থাকলে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। এর ফলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষমতা কলুষিত হবে। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক না কৃষিভিত্তিক হবে। বৃহৎ রাষ্ট্র উত্তম নয় কারণ তাতে রাষ্ট্রে অতিরিক্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়।
  • রাষ্ট্রের সুখ শান্তিই কাম্য বস্তু। কাজেই যুদ্ধের দ্বারা সেই শান্তি ব্যাহত হােক, কোন রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের তা আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হতে পারে না। যুদ্ধের জন্য যুদ্ধকে সমর্থন করা চলে না। কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই যুদ্ধকে সমর্থন করা যায়। অনেক যুদ্ধজয়ই বিজেতার পক্ষে আত্মহত্যার শামিল হয় কিন্তু শিক্ষা কখনও আত্মহত্যার শামিল হয় না।
  • ন্যায়বিচার হল আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা। আর আদর্শ রাষ্ট্র হল ন্যায়বিচারের বাস্তব প্রকাশ। ন্যায়বিচার হবে প্রাণ আর আদর্শ রাষ্ট্র হবে দেহ। তিনি মনে করেন প্রকৃত ন্যায়বিচার মানবাত্মা ও রাষ্ট্র দেহ উভয়ের মধ্যেই সমানভাবে বিরাজমান। কারণ রাষ্ট্র হল ব্যক্তি সত্তার বৃহত্তম অভিব্যক্তি। রাষ্ট্র ব্যক্তিসত্তার অভিব্যক্তি বলে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের ধারণা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। কারণ ছােট অক্ষরের পাণ্ডুলিপি অপেক্ষা বড় অক্ষরের পাণ্ডুলিপি অধিকতর স্পষ্ট।
  • মানবাত্মার তিনটি উপাদান আছে যথা—প্রজ্ঞা, তেজ ও প্রবৃত্তি। প্রজ্ঞার কাজ হল জানা ও শেখা। তেজ—এর কাজ হল মানুষকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করা আর বাসনা বা প্রবৃত্তির ফলে আত্মা ক্ষুধার্ত হয় তৃষ্ণার্ত হয়, ভালবাসা করে ও আকাঙ্ক্ষা করে। তাই ব্যক্তির ন্যায়বিচার হলো ব্যক্তির অন্তর্লোকে পরিপূর্ণ শৃংখলা রক্ষা করে ব্যক্তির অন্তরের উপাদানগুলো কখনও তাদের যথাযোগ্য কর্মসীমা অতিক্রম না করে নিজ নিজ কাজ করা।
  • মানবতার উপাদানগুলোর ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জনগণকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় – দার্শনিক রাজা, সৈনিক শ্রেণী ও উৎপাদক শ্ৰেণী। দার্শনিক রাজার কাজ হল রাষ্ট্র শাসন করা, সৈনিক শ্রেণীর কাজ হল রাষ্ট্রকে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ হতে রক্ষা করা এবং উৎপাদক শ্রেণীর কাজ হল দার্শনিক রাজা ও সৈনিক শ্রেণীকে প্রতিপালনের জন্য খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করা। রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের প্রত্যেক শ্রেণীর জনগণের তাদের যথাযোগ্য কর্মসীমা অতিক্রম না করে স্ব স্ব কর্তব্য পালন করা। প্রতিভা ও যোগ্যতার সাথে কর্ম সম্পাদন করা ন্যায়বিচার।
  • ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্য হলো – যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মবিভাগ, ব্যক্তি ও রাষ্ট্র অবিচ্ছেদ্যতা, শিক্ষণযোগ্যতা, রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক জীবনের অভিন্নতা, সামাজিক বন্ধন, চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ, সৎ মানুষে রূপান্তরযোগ্যতা, পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি, ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব, জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জনে সহায়তা, ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ, ব্যক্তি ও সমাজের অভিন্নতা, ব্যক্তি ও শ্রেণীসংঘাতহীনতা, শ্রম বিভাগের কর্ম বিশেষীকরণের ওপর নির্ভরশীলতা।

সৌন্দর্যতত্ত্ব ও ললিতকলা

  • সৌন্দর্য বস্তুগত, মনোগত নয়।
  • যদি কোন বাস্তব আদর্শ সৌন্দর্যের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সুন্দর বস্তু কম-বেশি তার অংশীদার হবে। অর্থাৎ যে বস্তু সেই আদর্শ সৌন্দর্যের যত বেশি অংশীদার হবে সেই বস্তু তত সুন্দর হবে, যে কম সে কম সুন্দর হবে।
  • সবচেয়ে সুন্দর বাঁদর একটি সুন্দর মানুষের তুলনায় কুৎসিৎ। আবার সুন্দরী নারী দেবতার তুলনায় কুৎসিৎ।
  • আদর্শ সৌন্দর্য সম্পর্কে আপেক্ষিকতাবাদ প্রযোজ্য নয়। আদর্শ সৌন্দর্য হল নিত্য সুন্দর, তার পক্ষে সুন্দর এবং কুৎসিৎ দুটোই হওয়া সম্ভব নয়। আদর্শ সৌন্দর্য অংশত সুন্দর বা অংশত কুৎসিৎ নয়, বা কোন এক সময় সুন্দর, অন্য সময়ে কুৎসিৎ, তাও নয়। কোন কিছুর সম্পর্কে আদর্শ সৌন্দর্য সুন্দর, কিন্তু অন্য কোন কিছুর সম্পর্কে কুৎসিৎ, যা কারও দৃষ্টিতে সুন্দর এবং অপরের দৃষ্টিতে কুৎসিৎ, আদর্শ সৌন্দর্য সম্পর্কে এই জাতীয় কোন অভিমতই গ্রহণযোগ্য নয়। আদর্শ সৌন্দর্য নিত্য বা শাশ্বত সুন্দর। আদর্শ সৌন্দর্য আপেক্ষিক নয়, নিরপেক্ষ এবং সব সৌন্দর্যের উৎস হওয়াতে কোন সুন্দর বস্তু নয়। সেই কারণে আদর্শ সৌন্দর্য জড়াত্মক হতে পারে না। আদর্শ সৌন্দর্য হল অতীন্দ্রিয় এবং অজড়াত্মক। আদর্শ সৌন্দর্য যদি হয় অতীন্দ্রিয়, তাহলে সুন্দর ললিতকলা, সাহিত্য জড়াত্মক হওয়াতে, সৌন্দর্যের আদর্শের খুব নিম্ন স্তরে অবস্থিত। সুন্দর বস্তুর আবেদন মানুষের ইন্দ্রিয়ের কাছে, কিন্তু আদর্শ বা নিরপেক্ষ সৌন্দর্যের আবেদন মানুষের বুদ্ধির কাছে।
  • যা প্রয়োজন সাধন করে, তা-ই সুন্দর। আদর্শ সৌন্দর্য ও আদর্শ কল্যাণ এক। একটিকে আর একটি থেকে পৃথক করা চলে না। সুন্দর বস্তু যেমন—সুন্দর আকৃতি, বর্ণ, শব্দ আমাদের আনন্দ দেয় তবে আদর্শ সৌন্দর্য সুখ দেয় না। পরিমিত এবং সামঞ্জস্য সর্বক্ষেত্রে সৌন্দর্য এবং সততাতে রূপান্তর লাভ করে। পরিমিত ও সামঞ্জস্য-এর মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত।
  • মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় এবং মানুষের প্রকাশের এই স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই ললিতকলার জন্ম।
  • ললিতকলা হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অনুকরণ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হল ধারণার অনুকরণ; তাই ললিতকলা হচ্ছে অনুকরণের অনুকরণ। ললিতকলা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অনুকরণ বলে সত্যতা থেকে অনেক দূরে সরে থাকবে।
  • চিত্রকর বা শিল্পী আবেগবশতই ক্রিয়া করেন, বিচারবুদ্ধিবশত নয়। কোন নিয়ম বা নীতি প্রয়োগ করে তিনি সুন্দরকে সৃষ্টি করেন না। কলা সৃষ্টির পরই সমালোচকবৃন্দ তার মধ্যে নিয়ম বা নীতি আবিষ্কার করেন। সমালোচকের আবিষ্কৃত নিয়মগুলো যে ভ্রান্ত তা নয়, তবে কলাবিদ সেগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা অজ্ঞাতসারেই অনুসরণ করেন। এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগই হল কলাবিদের কাজের অন্তরালে প্রেরণা। এই ধরনের প্রেরণা যেহেতু বিচার বুদ্ধি-ভিত্তিক নয় সেহেতু হীন এবং ঘৃণ্য। এই ধরনের প্রেরণাকে ঐশ্বরিক উন্মাদনা (Divine Madness); এই ধরনের প্রেরণা ঐশ্বরিক কেননা কলাবিদ সুন্দরের সৃষ্টি করেন কিন্তু এই প্রেরণা উন্মাদনার নামান্তর যেহেতু কলাবিদ নিজেই জানেন না, কিভাবে এবং কেন তিনি তা সৃষ্টি করেছেন। কবি অনেক সুন্দর জিনিসের বর্ণনা করেন। কিন্তু তিনি জানেন না কেন সেটি সুন্দর। তিনি অনুভব করেন কিন্তু কোন কিছু বোঝেন না। কাজেই তাঁর আবেগ বা প্রেরণা জ্ঞানের স্তরে অবস্থিত নয়, যথাযথ মত (Right Opinion) মাত্র। তিনি কোন কিছুকে সত্য বলে জানেন কিন্তু কেন, তা জানেন না।
  • ললিতকলা নীতি (Morals) এবং দর্শনের অধীন। কবিতা সুন্দর হলেই চলবে না, তা যদি কোন নৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ না করে তাহলে আদর্শ রাষ্ট্রে তার প্রবেশাধিকার নেই। দর্শন হল লক্ষ, ললিতকলা হল সেই লক্ষ লাভের উপায়। সব জ্ঞানের লক্ষ হল ধারণার বা আকারের জ্ঞান এবং বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, ললিতকলা, প্লেটোর মতে শিক্ষাসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে উপরিউক্ত লক্ষ সিদ্ধ করার জন্য, তাদের নিজস্ব কোন মূল্য নেই।
  • কোন কিছু নিছক সুখ বিধান করে, এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় যখন সে কল্যাণ বা সত্যের অনুকরণ না হয়। কিন্তু কলা বা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সে-কথা বলা যেতে পারে না। উৎকৃষ্ট সঙ্গীত হল তাই যা কল্যাণ ও সত্যের অনুকরণ। অনুকরণের সত্যতা বলতে বোঝায় যে অনুকরণের সময় বস্তুটির গুণ ও পরিমাণকে যথাযথভাবে অনুকরণ করতে হবে। বিভিন্ন ললিতকলার রাষ্ট্রে স্থান হবে যদি তারা শিক্ষামূলক কার্য সম্পাদন করতে পারে। এই ক্রিয়া হল লাভজনক আনন্দ বিধান বা সুখ প্রদান। ললিতকলার নির্দোষ আনন্দ বিধানের ক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায়না, কিন্তু তার শিক্ষামূলক এবং নৈতিক ক্রিয়ার গুরুত্ব আছে। ললিতকলা সুখ বা আনন্দ প্রদান করবে তবে সেই সুখ হবে লাভজনক সুখ।
  • ললিতকলায় তত্ত্বাবধান এবং তার অনুমােদনের জন্য রাষ্ট্রে সরকারি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমালোচককে দেখতে হবে ললিতকলার ক্ষেত্রে অনুকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা, অনুকরণ সুন্দরভাবে করা হয়েছে কিনা। তিনি ললিতকলা যে বিষয়ের অনুকরণ তার পরিচয়ও জানবেন।

অ্যারিস্টোটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.)

যুক্তিবিজ্ঞান

  • ন্যায় অনুমান বা সিলোগিজমের যুক্তির তিনটি অংশ – সাধ্য আশ্রয়বাক্য (Major Premise), পক্ষ আশ্রয়বাক্য (Minor Premise) এবং সিদ্ধান্ত (Conclusion)। যে আশ্রয় বাক্যে সাধ্যপদ ও হেতু পদের মধ্যে সম্বন্ধ প্রকাশ করা হয় তা সাধ্য আশ্রয় বাক্য বা প্রধান আশ্রয় বাক্য। যে আশ্রয় বাক্যে পক্ষপদ ও হেতুপদের মধ্যে সম্বন্ধ প্রকাশ করা হয় তা পক্ষ আশ্রয় বাক্য বা অপ্রধান আশ্রয় বাক্য। উদাহরণ যথাক্রমে সকল মানুষ হয় মরণশীল; সক্রেটিস হয় একজন মানুষ, সক্রেটিস হয় মরণশীল বাক্যগুলো। সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য পদকে পক্ষপদ (Minor Term), বিধেয় পদকে সাধ্যপদ (Major Term) বলে, এবং যে পদটি পক্ষপদ ও সাধ্য পদের মধ্যে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করে তাকে হেতুপদ (Middle Term) বলে। এখানে ‘সক্রেটিস’ পক্ষপদ, ‘মরণশীল’ সাধ্যপদ এবং ‘মানুষ’ হেতুপদ। হেতুপদ দুটি যুক্তিবাক্যকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। দুটি আশ্রয় বাক্যেরও দুটি ভিন্ন নাম আছে। পক্ষপদ, হেতুপদ এবং সাধ্যপদকে যথাক্রমে ‘S’ ‘M’ এবং ‘P’ এই তিনটি প্রতীক বর্ণের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়।
  • ন্যায় অনুমানের আশ্রয় বাক্য এবং সিদ্ধান্ত-এর তিনদিক থেকে পার্থক্য করা হয় পরিমাণ, গুণ এবং নিশ্চয়তা। পরিমাণ অনুসারে বচন তিন ধরনের – সার্বিক, বিশেষ এবং অনির্দিষ্ট (Indefinite) বা অনুক্ত, উদাহরণ যথাক্রমে ‘সব মানুষ হয় প্রাণী’, ‘কোন কোন লোক হয় জ্ঞানী এবং ‘সুখ হয় ভাল’। গুণ অনুসারে বচন দুই প্রকার-সদর্থক এবং নঞর্থক, উদাহরণ যথাক্রমে ‘ক সকল খ-এর অন্তর্ভুক্ত’ এবং ‘ক নয় কোন খ এর অন্তর্ভুক্ত’। পরিমাণ ও গুণ দুটোকে মিলিয়ে A, E, I, O – এই চার ধরনের বচন হয়, যেগুলো যথাক্রমে – (১) সার্বিক সদর্থক – ‘ক সকল খ-এর অন্তর্ভুক্ত। (২) সার্বিক নঞর্থক – ‘ক নয় কোন খ-এর অন্তর্ভুক্ত।, (৩) বিশেষ সদর্থক – ‘ক হয় কোন কোন খ-এর অন্তর্ভুক্ত।’ (৪) বিশেষ নঞর্থক – ‘ক নয় কোন কোন খ-এর অন্তর্ভুক্ত।’ নিশ্চয়তা অনুসারে বচন তিন প্রকার – ঘােষক (Assertoric), অনিবার্য (Apodetic) এবং সম্ভাব্য (Problematic), উদাহরণ যথাক্রমে – ‘ক হয় খ’, ‘ক অবশ্যই খ’ এবং ‘ক খ হলেও হতে পারে’।
  • যুক্তিবাক্য দুটিতে হেতুপদের অবস্থান অনুযায়ী অনুমানের তিনটি সংস্থান (Figures) হয় – (১) M হয় P. – প্রত্যেক মানুষ হয় মরণশীল, S হয় M. – প্রত্যেক দার্শনিক হয় মানুষ, S হয় P – সুতরাং, প্রত্যেক দার্শনিক হয় মরণশীল। (২)P হয় M – প্রতিটি মানুষ হয় দ্বিপদ জীব, S হয় না M – কোন ঘােড়া নয় দ্বিপদ জীব, S হয় না P – কোন ঘােড়া নয় মানুষ। (৩) M হয় P – প্রত্যেক মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, M হয় S – প্রত্যেক মানুষ হয় প্রাণী, S হয় P – সুতরাং, কোন কোন প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। অ্যারিস্টোটলের জ্ঞান বর্ধিত করে অন্যেরা ৪র্থ সংস্থান দিয়েছেন – সব P হয় M. কোন M হয় না S. সুতরাং কোন S হয় নয়-P। এগুলোর মধ্যে প্রথম সংস্থান বিশুদ্ধ (Perfect Figure)। অবশিষ্ট সংস্থানগুলো প্রধান সংস্থানে রূপান্তরিত করে তাদের শুদ্ধতা নিরূপণ করা যায়। প্রতিটি সংস্থানের ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি (Moods) আছে। আশ্রয় বাক্যের গুণ ও পরিমাণের ওপর এই মূর্তিগুলো নির্ভর। প্রথম সংস্থানের চারটি শুদ্ধ মূর্তি – (১) সকল মানুষ হয় মরণশীল, সকল গ্রীক হয় মানুষ, অতএব, সকল গ্রীক হয় মরণশীল। এই মূর্তিটির নাম BARBARA. (২) কোন মাছ নয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, সব তিমি হয় মাছ, সুতরাং কোন তিমি নয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। এই মূর্তিটির নাম CELARENT, (৩) সব মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, কোন কোন প্রাণী হয় মানুষ, সুতরাং কোন কোন প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। এই মূর্তিটির নাম DARII. (৪) কোন গ্রীক নয় কৃষ্ণাঙ্গ, কোন কোন মানুষ হয় গ্রীক, সুতরাং কোন কোন মানুষ নয় কৃষ্ণাঙ্গ। এই মূর্তিটির নাম হল FERIO. ন্যায় অনুমানের মূর্তিগুলো যথার্থ কিনা বিচার করার জন্য সূত্র – Dictum De Omni Et Nullo, এই সূত্রটির অর্থ- “কোন শ্রেণী সম্পর্কে যা স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়, সেই শ্রেণীর অন্তর্গত সকল কিছু সম্পর্কেই তা স্বীকার বা অস্বীকার করা যায়।”
  • সব অবরোহ অনুমানকে তার যথাযথরূপে প্রকাশ করলে তা ন্যায় অনুমানের রূপ গ্রহণ করবে। সব ধরনের বৈধ ন্যায়। অনুমানের রূপগুলো যদি নিরূপণ করা যায়, এবং কোন আলোচ্য যুক্তিকে যদি ন্যায় অনুমানের আকারে প্রকাশ করা যায়, তাহলে ন্যায় অনুমানের নিয়ম লঙ্ঘনজনিত সব রকম দোষ বা অনুপপত্তি (Fallacies)-কে এড়ানো যেতে পারে।
  • যুক্তি তিন প্রকার – (১) প্রমাণমূলক যুক্তি (Demonstrative Reasoning) যেখানে সব আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়, সেগুলো সত্য এবং প্রাথমিক (Primary)। (২) সাধারণত স্বীকৃত মতামতের ভিত্তিতে যুক্তি (Dialectical Reasoning), যেখানে আশ্রয়বাক্য হয় সকলের দ্বারা বা অধিকাংশের দ্বারা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা অর্থাৎ কিনা, সাধারণভাবে স্বীকৃত। এবং (৩) সাধারণভাবে স্বীকৃত নয় এমন মতামতের ভিত্তিকে যুক্তি (Contentious Reasoning), যেখানে আশ্রয়বাক্যে সাধারণভাবে স্বীকৃত মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়।
  • অবরোহ অনুমানের আশ্রয়বাক্যেরও প্রমাণের প্রয়োজন আছে। আবার প্রতিটি বচন বা সূত্রের প্রমাণ চাওয়া হলে অনবস্থা প্রক্রিয়া (Processus in Infinitum) দেখা দেবে এবং কোন কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। তাই এমন কিছু সূত্র আছে যেগুলোকে কোন প্রমাণ ছাড়াই আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সাক্ষাৎভাবে জানি। এই সূত্রগুলোর নিয়ম বা সূত্রটি (The Principle of Contradiction) সর্বপ্রধান। নিয়মটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল, একই সময়ে একই বস্তু সম্পর্কে দুটি পরস্পর বিরুদ্ধ গুণ কখনও সত্য হতে পারে না। সব চিন্তাই এই নিয়মটির অন্তর্ভুক্ত। চিন্তা করতে গেলে এই সূত্র বা নীতিটির সত্যতা আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে। কোন ব্যক্তি যিনি চিন্তা করছেন, তিনি এই নীতির সত্যতা সম্পর্কে কোনরূপ প্রশ্ন তুলতে পারেন না।
  • বৈজ্ঞানিক আরোহানুমান হলো পূর্ণ গণনামূলক আরোহানুমান (Induction by Complete Enumeration)। কেননা সব দৃষ্টান্তের গণনার ভিত্তিতেই আরোহানুমান প্রতিষ্ঠিত হয়। অপূর্ণ গণনামূলক আরোহ অনুমান (Induction by Incomplete Enumeration) প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হওয়াতে শুধুমাত্র বক্তাদেরই কাজে লাগে। আরোহের মাধ্যমেই, সার্বিককে আমরা জানি এবং এই আরোহের মাধ্যমেই আমরা অপরোক্ষ আশ্রয়বাক্য-স্বতঃসিদ্ধ সত্য (Axioms), সংজ্ঞার্থ (Definition) এবং প্রকল্প (Hypothesis)-কে জানি যার ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত।
  • যখন আরোহ অনুমান নির্দোষ (Perfect) বা পূর্ণ গণনামূলক (Complete Enumeration) আরোহ অনুমান হয় অর্থাৎ যখন কোন শ্রেণীর প্রতিটি সভ্যকেই গণনা করে নেওয়া হয়, তখন আরোহ অনুমানকে ন্যায় অনুমানের আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। উদাহরণ যদি মানুষ, অশ্ব, অশ্বতর ইত্যাদি প্রাণী (গ) দীর্ঘজীবি (ক) হয়, এবং মানুষ, অশ্ব, অশ্বতর প্রভৃতি (গ) পিত্তহীন (খ) হয় তাহলে, যদি ‘খ’ শ্রেণীটি ‘গ’ শ্রেণীর থেকে বৃহত্তর না হয় তাহলে এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, সব পিত্তহীন প্রাণী (খ) হল দীর্ঘজীবি (ক)।
  • আমরা বিশেষ (Particular)-কে জানতে পারি না, কেবলমাত্র সার্বিককে জানতে পারি। বিশেষের পরীক্ষার ভিত্তিতেই আমরা সার্বিককে জানতে পারি। প্রমাণমূলক যুক্তির আশ্রয়বাক্যগুলোর জ্ঞান সহজাত নয়, সেগুলোর জ্ঞান আরোহ অনুমানের মাধ্যমে লব্ধ হয়।
  • যখন আমরা কোন বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করি তখন কোন একটা বিধেয়কে ঐ বিষয় সম্বন্ধে প্রয়োগ করি। যে ধরনের পদকে বিধেয় রূপে ব্যবহার করা হয় তাকে কেটিগরিস বা বিধেয়ক বলে। ‘কেটিগরিস’ নির্দেশ করে আমরা বস্তু সম্পর্কে কিভাবে চিন্তা। উদাহরণস্বরূপ দ্রব্যে গুণ বিশেষিত করা। কিন্তু এছাড়াও বস্তু বাস্তবে যেভাবে অস্তিত্বশীল তাও নির্দেশ করে। এ বস্তু হল দ্রব্য এবং বাস্তবিকই দ্রব্যের আপতিক গুণ আছে। সেই কারণে কেটিগরিস-এর শুধুমাত্র যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত নয়, আধিবিদ্যক বা তাত্ত্বিক আলোচনারও প্রয়োজন আছে। ‘কেটিগরিস’ বা বিধেয়ক-এর সংখ্যা দশটি – ১. দ্রব্য (মানুষ, অশ্ব), ২. পরিমাণ (তিন হাত দীর্ঘ), ৩. গুণ (সাদা, লাল), ৪. সম্বন্ধ (দ্বিগুণ, অর্ধেক, বৃহত্তর), ৫. স্থান (Place)- (হাটে, বাজারে, প্রাসাদে), ৬. কাল (গতকাল, গত বছর), ৭. অবস্থান (Position)-(শােয়া, বসা), ৮. অবস্থা (State) (জুতো পায়ে, অস্ত্র সাজে), ৯. ক্রিয়া (Action)-(কাটা, পােড়া), ১০. প্রভাবিত হওয়া বা প্রতিক্রিয়া (Affection) – (কেটে যাওয়া, দগ্ধ হওয়া)।
  • সত্তাকে অস্তিত্বশীল হতে হলে দ্রব্যকে অস্তিত্বশীল হতেই হবে। অর্থাৎ কিনা দ্রব্য নিয়েই শুরু করতে হবে। মনের বাইরে যাদের অস্তিত্বশীল দেখি তারা হল বিশিষ্ট (Singular) বস্তু বিশিষ্ট বস্তুকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল হতে হলে তাকে অবশ্যই দ্রব্য হতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র দ্রব্য হিসেবে এটি অস্তিত্বশীল হতে পারে না। এর কোন একটা আপতিক রূপ (Accidental Form) থাকবেই। যেমন কোন অশ্ব অস্তিত্বশীল হতে পারে না যদি এর কোন বর্ণ না থাকে। আবার বর্ণ থাকতে পারে না যদি এর কোন পরিমাণ অর্থাৎ বিস্তৃতি না থাকে। আবার অশ্বটি অন্য অশ্বের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না হয়ে থাকতে পারে না, কারণ অশ্বটি অন্য অশ্ব থেকে আকারে ছােট বা বড় হবে। আবার এটি ভৌতিক দ্রব্য হিসেবে কোন দেশে, কোন কালে, কোন বিশেষ অবস্থায় অবস্থান করবে। আবার একটি অশ্ব যেমন অপরের ওপর ক্রিয়া করে তেমনি অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কাজেই কোন কোন কেটিগরি বা বিধেয়ক যেন বস্তুর মধ্যে থেকে তাকে নিরূপণ করে। আবার কোন কোন কেটিগরি যেন বাইরে থেকে তাকে নিরুপণ করে, অর্থাৎ অন্য জড়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাকে নিরূপণ করে। সব মিলে বলা যায়, যে নীতির উপর ভিত্তি করে কেটিগরিগুলোকে নিঃসৃত করা হয়েছে, সেই নীতি মােটেও এলোমেলো বিশৃঙ্খল নীতি নয়। কেটিগরি হল প্রাথমিক শ্রেণী, যা কিছু অস্তিত্বশীল বা বাস্তব তা তার অন্তর্ভুক্ত হবেই। ক্যাটিগরিসের উপযোগিতা এবং মূল্য কেবলমাত্র তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন অন্য আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি বস্তুর শ্ৰেণী বা পদের অর্থের মধ্যে পার্থক্য করতে একে প্রয়োগ করা হয়।
  • বিধেয়ক বা ক্যাটিগরি হল বিধেয়র সঙ্গে উদ্দেশ্যের বিভিন্ন ধরনের সম্বন্ধ – সম্পর্কের এই প্রকারভেদ অনুসারে বিধেয়ককে পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে : জাতি (Genus), প্ৰজাতি (Species), বিভেদক লক্ষণ (Differentia), উপলক্ষণ (Proprium), এবং আপতিক লক্ষণ (Accidents)। বিধেয়র সঙ্গে উদ্দেশ্যের সম্বন্ধ যদি এমন হয় যে, বিধেয় উদ্দেশ্যের সমব্যাপক, তাহলে হয় বিধেয় মারফত উদ্দেশ্যের সংজ্ঞার্থকে পাওয়া যায়, না হয় উপলক্ষণকে পাওয়া যায়। যেমন, ‘মানুষ হয় বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জীব’ (সংজ্ঞার্থ), ‘মানুষ হয় জীব যে তর্ক করতে পারে’ (উপলক্ষণ)। আর যদি বিধেয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে সমব্যাপক না হয়, তাহলে উদ্দেশ্যের সংজ্ঞার্থের অন্তর্ভুক্ত গুণাবলির অংশবিশেষকে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বিধেয় পদটি হবে উদ্দেশ্যের সম্বন্ধে জাতি, না হয় তার বিভেদক। যেমন, ‘মানুষ হয় প্রাণী’ (জাতি), ‘মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন’ (বিভেদক)। আর যদি বিধেয় উদ্দেশ্যের সমব্যাপক না হয় এবং বিধেয় যদি উদ্দেশ্যের সংজ্ঞার্থের অন্তর্ভূক্ত গুণাবলিকে নির্দেশ না করে, তাহলে বিধেয় হবে আপতিক গুণ। যেমন— ‘মানুষ হয় হাস্যপ্রিয় জীব।’
  • বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হল সার্বিকী থেকে বিশেষকে, আপেক্ষিক ঘটনাকে তার কারণ থেকে অবরোহের আকারে নিঃসৃত করা, যার ফলে আমরা, যে কারণটির ওপর ঘটনা নির্ভর, তাকে এবং ঘটনা ও কারণের মধ্যে যে অনিবার্য সম্পর্ক তাকে জানি। অর্থাৎ আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করি যখন আমরা কারণকে, যার ওপর ঘটনা নির্ভর, ঘটনার কারণ হিসাবে জানি এবং এও জানি যে ঘটনাটি অন্য রকম হতে পারত না। এই জ্ঞান আসে প্রতিপাদনের (Demonstration) মাধ্যমে যার একটা ন্যায় অনুমানের বা অবরোহের আকার আছে। কিন্তু যেহেতু ন্যায় অনুমানমূলক (Syllogistic) এই প্রতিপাদন শুরু হবে আশ্রয়বাক্যকে নিয়ে, এই আশ্রয়বাক্যগুলোর অবশ্যই কতকগুলো অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য থাকবে। এগুলো হবে সত্য, মৌলিক, অপ্রতিপাদক এবং অমাধ্যম, এই অর্থে যে, হেতুপদ ছাড়াও বিধেয় সরাসরি উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সব বচনই প্রতিপাদ্য এবং কোন বচনই প্রতিপাদ্য নয় – এই দুটো কথার একটিও সঠিক নয়। কোন কোন সিদ্ধান্ত আশ্রয়বাক্য থেকে প্রতিপাদিত করা যেতে পারে, যে আশ্রয়বাক্যগুলো অপ্রতিপাদ্য, কিন্তু সত্য বলে জ্ঞাত। আশ্রয়বাক্যের মধ্যে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিহিত থাকবে। অ্যারিস্টটল তিন প্রকার মৌলিক আশ্রয়বাক্যের কথা বলেছেন, স্বতঃসিদ্ধ সত্য (Axioms), সংজ্ঞার্থ (definitions) এবং প্রকল্প (Hypothesis)।
  • যুক্তিবিজ্ঞানের দিক থেকে বিচার করলে আশ্রয়বাক্যগুলো সিদ্ধান্তের পূর্বগামী, যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত পূর্বগামিতা এবং জ্ঞানগত পূর্বগামিতা এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। জ্ঞানগত দিক থেকে বিচার করলে মানুষের কাছে যে বস্তু তার ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থিত সেই বস্তুগুলোই পূর্বগামী। মানুষের জ্ঞান ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান দিয়েই শুরু অর্থাৎ বিশেষকে নিয়ে শুরু এবং এ বিশেষ থেকে আমরা সার্বিকে উপনীত হই। কাজেই প্রাথমিক আশ্রয়বাক্যগুলোকে আমাদের আরোহের মাধ্যমেই জানতে হয়। যে পদ্ধতির মাধ্যমে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ সার্বিককে প্রতিষ্ঠা করে তাও আরোহ। সব মানুষ হয় মরণশীল, সক্রেটিস হয় মানুষ, সুতরাং সক্রেটিস হয় মরণশীল – এই অবরোহ অনুমানে প্রধান আশ্রয়বাক্য ‘সব মানুষ হয় মরণশীল’। এই বচনটি ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অবশ্য স্মৃতিও এর সঙ্গে জড়িত। এটি প্রাথমিক নিয়ম নয়, যাকে স্বতঃসিদ্ধ বা প্রমাণ ব্যতিরেকে অপরোক্ষভাবে জানা যায়। এটি অবরোহ নির্ভর। ইন্দ্রিয় কখনও ভুল করে না। আমাদের অবধারণই সত্য বা মিথ্যা হয়। (সূর্যকে পৃথিবীর থেকে ছােট দেখাবার ব্যাপারে ইন্দ্রিয়ের কোন ভুল নেই, ভুল হয় যখন অবধারণ করা হয় যে সূর্য পৃথিবীর থেকে ছােট।)
  • বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হল বিষয়ের জ্ঞান, যে বিষয় যেমন, তার থেকে অন্যরকম হতে পারে না এই জ্ঞান। এটি সেই সম্পর্ক প্রমাণ করে যেগুলো সার্বিক। প্রথমত, গুণটি কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই উদ্দেশ্যের প্রতিটি দৃষ্টান্তের অন্তর্ভুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, এই গুণটির উদ্দেশ্যের সম্পর্কে আকস্মিকভাবে নয়, অপরিহার্যভাবে সত্য। তৃতীয়ত, এটি সুনির্দিষ্টভাবে উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাহলে উদ্দেশ্য এবং গুণের মধ্যে সার্বিক সম্পর্ক আছে বলা যায় যখন—(১) গুণটি উদ্দেশ্যের যে কোন দৃষ্টান্ত সম্পর্কে সত্য হয়। (২) উদ্দেশ্য হল ব্যাপকতম শ্রেণী যার সম্পর্কে এটি সত্য প্রমাণিত হয়। যেমন, দুটি সমকোণের সমান কোণের অধিকারী হওয়া হল ত্রিভুজের একটি সার্বিক গুণ, কোন ক্ষেত্রের গুণ নয় বা কোন সমদ্বিবাহু ত্রিভুজেরও নয়। এটি ক্ষেত্রের কোন সার্বিক গুণ নয় কেননা এটি কোন কোন ক্ষেত্র সম্পর্কে সত্য হলেও, যে কোন ক্ষেত্র সম্পর্কে সত্য নয়। আবার এটি কোন সমদ্বিবাহু ত্রিভুজেরও সার্বিক গুণ নয়, কেননা এটি সব সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ সম্পর্কে প্রমাণ করা গেলেও খেয়াল রাখতে হবে, এটি ত্রিভুজ বলেই বিষয়টি প্রমাণ করা যাচ্ছে, সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ বলে নয়। বস্তুত ‘ত্রিভুজ’ হল ব্যাপকতম শ্রেণী যার সম্পর্কে গুণটি সত্য প্রমাণিত হয়।

অধিবিদ্যা

  • যে জ্ঞানের লক্ষ কোন ফল উৎপাদন করা বা ব্যবহারিক জীবনের কোন উদ্দেশ্যে সিদ্ধ করা তা প্রজ্ঞা (Wisdom) পদবাচ্য নয়। প্রজ্ঞা হল কতকগুলো মূল বিষয় এবং সূত্রের বিচারবুদ্ধিসম্মত জ্ঞান। জানার জন্য জানা বা উদ্দেশ্যবর্জিত কৌতুক পরিতৃপ্তির জন্য জানাই হল শ্রেষ্ঠ জানা। যে শাস্ত্র শুধুমাত্র উদ্দেশ্য নিবৃত্তির জন্য কোন কিছু জানতে প্রয়াসী হয় না, শুধুমাত্র জানার জন্যই জানতে চায়, বা জ্ঞানলাভের জন্যই জ্ঞান লাভ করতে চায় অর্থাৎ যে শাস্ত্রের উদ্দেশ্য পরমতত্ত্বের মূল নীতিগুলোর জ্ঞান লাভ করা, সেই শাস্ত্রই হল শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা (Wisdom per Excellence), তাই হল অধিবিদ্যা। বিস্ময় থেকেই এই জাতীয় শাস্ত্রের উৎপত্তি। বিস্ময় থেকেই উদ্ভূত হয় জানার ইচ্ছা, বস্তুর বা ঘটনার ব্যাখ্যা লাভের ইচ্ছা, ঘটনার হেতু আবিষ্কারের ইচ্ছা। এই জানা থেকেই অধিবিদ্যার বা দর্শনের উদ্ভব। এই শাস্ত্র স্ব-নির্ভর এই অর্থে যে, অন্য শাস্ত্রের ওপর এই শাস্ত্র নির্ভর নয়। অধিবিদ্যা বস্তুর কারণ বা মূল সূত্র নিয়ে আলোচনা করে এবং সেহেতু এই জ্ঞান হল সার্বিক জ্ঞান, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান; কাজেই এই শাস্ত্র ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করার কথা বলে না, এই শাস্ত্র মননের (Reflection) দ্বারা পরমতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করার কথা বলে। আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নিয়ে শুরু করে, তারপর মননের সাহায্যে পরমতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করতে হয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য এই শাস্ত্র হল সবচেয়ে অমূর্ত বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন যেহেতু কঠিন মননের প্রয়োজন। অন্য শাস্ত্রের তুলনায় সবচেয়ে অমূর্ত হলেও অন্য বিদ্যা বা শাস্ত্রের তুলনায় অধিবিদ্যাই হল যথার্থ শাস্ত্র (The most exact of the sciences)।
  • অধিবিদ্যা তার কার্যকারণ তত্ত্বের ওপর বিশেষভাবে নির্ভর। কোন ঘটনার নিছক কারণ নির্দেশ করা হলে তার হেতু (Reason) সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না এবং তার ফলে ঘটনাটির যথাযথ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। ঘটনার যথাযথ ব্যাখ্যা, হেতু নিরুপণের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। মৃত্যু ব্যাধির জন্য ঘটেছে, জানা গেলেও এই বিশ্বজগতে মৃত্যু-রূপ ঘটনার অস্তিত্ব রয়েছে কেন, মৃত্যুর কারণ ব্যাধি—এর থেকে তা জানা যায় না। কারণ ও হেতুর এই পার্থক্যের বিষয়টি যদি স্বীকার করে নেওয়া যায় তাহলে বলা যেতে পারে যে, কার্যকারণ বিষয়ক তত্ত্বে কারণ ও হেতু উভয়েরই অন্তর্ভুক্তি লক্ষ করা যায়। কার্যকারণতত্ত্ব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারে; কারণ হেতু, ঘটনা এবং সূত্র সকল কিছুরই নির্দেশ করে।
  • কারণকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে চার ধরনের কারণ পাওয়া যায় – উপাদান কারণ (Material Cause), নিমিত্ত কারণ (Efficient Cause), আকারগত কারণ (Formal Cause), পরিণতি কারণ (Final Cause)। যে কোন বস্তুর অস্তিত্বের বা উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই চারটি কারণকেই যুগপৎভাবে ক্রিয়া করতে দেখা যায়। মানুষের গড়া বস্তু বা প্রকৃতির গড়া বস্তু, যে কোনটিতেই এই চারটি কারণের ক্রিয়া লক্ষ করা যেতে পারে। মানুষের গড়া একটি ব্রোঞ্জ মূর্তিতে উপাদান কারণ হল ব্রোঞ্জ, নিমিত্ত কারণ হলো মূর্তিকার, যিনি মূর্তিটি তৈরি করেছেন। আকারগত কারণ হল বস্তুটির দ্রব্য বা স্বরূপধর্ম (The substance and essence of a thing)। এটি হল বস্তুর ধারণা (idea of a thing)। প্লেটোর ধারণাগুলোই অ্যারিস্টটলের আকারগত কারণ রূপে (Formal Cause) আবির্ভূত হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতি কারণ হল, যে লক্ষ বা উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাস্কর মূর্তিটি গঠন করলেন। যখন একটি মূর্তি গঠন করা হয়, তখন এই গঠন রূপ ক্রিয়ার যেটি লক্ষ, সেটি হল মূর্তিটির সম্পূর্ণতা। যে কোন বস্তুর পরিণতি কারণ হল সাধারণভাবে সেই বস্তুটিই, বস্তুটির সম্পূর্ণ সত্তা।
  • শেষ পর্যন্ত আকারগত কারণ, নিমিত্ত কারণ এবং পরিণতি কারণ সবগুলোই একটিমাত্র কারণের রূপ গ্রহণ করেছে যা হল আকার (Form)। কেবলমাত্র উপাদানগত কারণকেই আকারে রূপান্তরিত করা যায় না। তাই উপাদান এবং আকারের বৈপরীত্যই টিকে থাকে।
  • পারমিনাইডিস যে পরিবর্তন বা পরিণামের সত্যতা অস্বীকার করেছেন তা করা যায়না। পরিবর্তনকে স্বীকার করলে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোন কিছু অন্য কোন কিছুতে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়, যেমন বীজ পরিবর্তিত হয়ে চারা গাছে পরিণত হয়, কাষ্ঠ থেকে শয্যা তৈরি হয়। কোন কিছুর মধ্যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিহিত থাকে, তারপর কোন নিমিত্ত কারণের তত্ত্বাবধানে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়। অর্থাৎ কোন কিছু যা অন্য কোন কিছুতে পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু তার একটা মূল আধার (Ultimate Substratum) থাকছে, যার নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নেই। এটা শুধু সম্ভাবনা বা অব্যক্ততা (Potentiality) ছাড়া কিছুই নয়। এটিই হলো প্রাথমিক উপাদান (Prime Matter), যা সব জড় বস্তুতেই দেখা যায় এবং এটাই পরিবর্তনের মূল ভিত্তি। প্রাথমিক উপাদান হল রূপ-গুণ বর্জিত উপাদান। নিমিত্ত কারণ (Efficient Cause) প্রত্যক্ষভাবে প্রাথমিক উপাদানের ওপর ক্রিয়া করে না। এটি সর্বদাই কোন নির্দিষ্ট বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে, যে নির্দিষ্ট বস্তু হল আধারের বাস্তবায়িত রূপ। যেমন, ভাস্কর যখন মার্বেল পাথরকে একটি মূর্তিতে পরিণত করে তখন এ মার্বেল পাথরই হল উপাদান। তিনি মার্বেল পাথরে যে পরিবর্তন সংঘটিত করেন সেই পরিবর্তনের আধার হল প্রাথমিক উপাদান, মার্বেল পাথর নয়। প্রাথমিক উপাদান হল জড় বস্তুর একটি বাস্তব উপাদান এবং জড় বস্তুর যে পরিবর্তন ঘটে তার প্রাথমিক ভিত্তি। (পারমিনাইডিসের বিপরীতে)
  • প্রাথমিক উপাদান আকারবিহীন। এটি হল সব বস্তুর মূল ভিত্তি। এর নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নেই। এটি অনির্দিষ্ট, এর কোন গুণ নেই। যা কিছু কোন কিছুতে নির্দিষ্টতা, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, গুণ আরোপ করে তাকে কোন একটি নির্দিষ্ট বস্তুতে পরিণত করে, তা হল আকার। উপাদানে আকার আরোপিত হলে, উপাদান যে কোন কিছুতে পরিণত হতে পারে। কাজেই উপাদান হল সব কিছুর সম্ভাবনা, যদিও আসলে এটি কিছু নয়, কাজেই আকার লাভ করেই এটি কোন কিছু বলে পরিগণিত হয়, অর্থাৎ প্রাথমিক উপাদান কখনও প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অস্তিত্বশীল হতে পারে না, সব সময়ই আকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অস্তিত্বশীল হয়। তাই আকার হল এমন কিছু যা বস্তুকে বৈশিষ্ট্য দান করে। তাই উপাদান ও আকার হল অবিচ্ছেদ্য, বাস্তবে যাদের বিচ্ছিন্ন করা যায়না, তাই উপাদান ও আকার হলো অমূর্ত (Abstruct) বিষয় যাদের অস্তিত্ব নেই। তাই প্লেটো যে আকার বা সার্বিকের অস্তিত্ব ধরেছেন তা ভ্রান্ত।
  • এখন আকার হলো এমন কিছু যা কোন জাতির সকল সদস্যের মধ্যে এক, তাই কোন জাতি বা সার্বিকের বিশেষ বস্তুসমূহের যে বহুত্ব দেখা যায় তা উপাদানের কারণেই হয়, বহুত্ব তাই উপাদানের ওপর নির্ভরশীল।
  • পরিবর্তন হল সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ণ, অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া। সম্ভাবনা বলতে বোঝায় যা হতে পারে কিন্তু এখনও হয়নি। তাই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় রয়েছে – দুটি ভাবাত্মক বিষয় – আকার ও উপাদান এবং তৃতীয় বিষয় অভাব (Privation)। অভাব কোন ভাবাত্মক বিষয় নয়, তবু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিলে অভাবকে স্বীকার করে নিতে হয়, কেননা সম্ভাবনা বা হতে পারে কিন্তু হয়নি এখানে অভাবের ধারণা চলে আসেই।
  • পারমিনাইডিস ও মেগারিক সম্প্রদায় অব্যক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করে বলে, যে বাস্তবে কোন কিছু তৈরি করছে না, সে তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ যার সম্ভাবনা আছে তারই অস্তিত্ব আছে, সম্ভাবনা আছে কিন্তু অস্তিত্ব নেই তা সম্ভব নয়, তাই সব কিছুই ব্যক্ত, অব্যক্ত কোন কিছু থাকতে পারেনা, তা হবে অভাব, শূন্যতা। উলটো করে বললে যা নেই তার সম্ভাবনাও নেই, তার চিন্তাও অলীক। কিন্তু এটা ভুল, অব্যক্ততা অভাব মাত্র নয়। কোন ব্যক্তি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকাকালীন চিন্তা করছে না সত্য, কিন্তু তাই বলে তার চিন্তা করার ক্ষমতা নেই—এমন কথা বলা যায়না। অব্যক্ততা অলীক নয়, বাস্তব। একটা চারা গাছের মধ্যে তার পরিপূর্ণরূপ লাভ করার অর্থাৎ একটা মহীরূহে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এই অব্যক্ততা অন্য বস্তুতে পরিবর্তন সংঘটিত করার শক্তিও হতে পারে বা নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করার শক্তিও হতে পারে। একটা চারাগাছ যখন মহীরূহে পরিণত হয় তখনই সে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করে। অব্যক্ততা হল অস্তিত্বহীনতা এবং ব্যক্ততা বা বাস্তবতার মধ্যবর্তী। উপাদান এবং আকারকে ব্যক্ত এবং অব্যক্ত রূপে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। অব্যক্ততা উপাদানের সঙ্গে অভিন্ন, ব্যক্ততা আকারের সঙ্গে অভিন্ন; উপাদান হল নিছক অব্যক্ততা, কারণ উপাদানের সব কিছুতেই ব্যক্ত হবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু যা তাকে ব্যক্ত করে তা হল তার আকার। অব্যক্ততা পূর্ববর্তী এবং ব্যক্ততা পরবর্তী, যেমন বৃক্ষের বীজ পূর্ববর্তী এবং ওক বৃক্ষ পরবর্তী, কিন্তু ওক বৃক্ষের বীজে ওক বৃক্ষ অব্যক্ত হয়ে না থাকলে, সেই বীজ থেকে ওক বৃক্ষ জন্মাতে পারে না। তাই ব্যক্ত অব্যক্তের পূর্ববর্তী। ব্যক্ত বা বাস্তবতা সব সময়ই অব্যক্ত থেকে উৎপন্ন হয়। কিন্তু বাস্তব বা ব্যক্তই সর্বদা অব্যক্ত বা সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করে, যেমন মানুষের দ্বারা মানুষের উৎপত্তি। এ অর্থে কালিক পারস্পর্যের দিক থেকে ব্যক্তকে অব্যক্তের পূর্ববর্তী বলা চলে। আবার ব্যক্ত যৌক্তিক দিক থেকেও অব্যক্তের পূর্ববর্তী। ব্যক্ত হচ্ছে পরিণতি, যার জন্য অব্যক্ত অস্তিত্বশীল। একটি বালক মানুষে পরিণত হয়। কালের দিক থেকে বালক মানুষের পূর্ববর্তী কিন্তু যৌক্তিক দিক থেকে তার মানুষ হওয়ার অবস্থাটি তার বালক অবস্থার পূর্ববর্তী, কারণ মানুষ হবার জন্যই তার বালক অবস্থার অস্তিত্ব। যা নিত্য তা অনিত্যের পূর্ববর্তী এবং যা নিত্য ও অবিনশ্বর তা পরম অর্থে ব্যক্ত বা বাস্তব। পারমিনাইডিসের মতে, পরিবর্তন অসম্ভব, কারণ কেননা নিছক শূন্যতা থেকে কোন কিছুর উৎপত্তি সম্ভব নয় বলে অসত্তা থেকে সত্তার উদ্ভব সম্ভব নয়। আবার সত্তা, সত্তা থেকে উৎপন্ন এ কথা বলা অর্থহীন কারণ সত্তা তো-পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল। বাতাস থেকে আগুন হতে পারে না কেননা বাতাস বাতাস, আগুন নয়। কিন্তু এটা ভুল কারণ যে বাতাসের আগুন হবার সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু এখনও আগুন হয়নি সেই বাতাস থেকে আগুন উৎপন্ন হতে পারে। অর্থাৎ একটি বস্তু তার অভাব থেকেই উৎপন্ন হয়। এখানে অসত্তা বা নিছক অভাব থেকে নয়, কোন বস্তুতে কোন কিছুর অভাব থেকেই সৎ-এর উৎপত্তি, আবার নিছক সৎ থেকে সৎ-এ উত্তীর্ণ হওয়া নয়, এটি সেই সৎ থেকে উৎপন্ন হচ্ছে, যে সৎ আবার অসৎ, অর্থাৎ এটি যা হচ্ছে সেই বস্তু নয়। তাই একে সৎ থেকে সৎ-এর উৎপত্তি বলা যেতে পারে না। উপাদান , আকার এবং অভাব (privation) বা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে—ক্রিয়া, অব্যক্ততা এবং অভাব – এই তিনটি বিষয় স্বীকার করতে হবে। (পারমিনাইডিসের বিপরীতে)
  • সত্তা ও অসত্তার ধারণা থেকে হেরাক্লিটাসের ভবনকে (Becoming) ব্যাখ্যা করা যায়না, কারণ অসত্তা থেকে সত্তার উদ্ভব হয়না, এবং সত্তার থেকে সত্তার উদ্ভব অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অ-সত্তা এবং সত্তার পার্থক্যের কোন অস্তিত্ব নেই। সত্তা ও অ-সত্তার বিপরীতে অব্যক্ত এবং ব্যক্ত পদ দুটি ব্যবহার্য, অব্যক্ত অ-সত্তার জায়গাটি দখল করবে। এতে ভবন (Becoming) সম্ভব হবে কারণ এটি চরম অ-সত্তা নয়। এটি কিছুই নয় বলে অ-সত্তা, কিন্তু এটির মধ্যে সত্তার সম্ভাবনা বিদ্যমান, তাই এটি অব্যক্ত সত্তা। তাই ভবন শূন্যতা থেকে কোন কিছুতে উপনীত হওয়া নয়, বরং অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া। সব পরিবর্তন, সব গতি হলো অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া, উপাদানের আকারে উত্তীর্ণ হওয়া। (হেরাক্লিটাস প্রভাবিত)
  • অধিবিদ্যায় সত্তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলো সত্তার একটি বিশেষ দিককে আলোচনার বিষয়রূপে নির্বাচন করে এবং সত্তার ঐ বিশেষ দিকটির গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু অধিবিদ্যার সত্তার কোন একটি বিশেষ দিক দিয়ে আলোচনা করা হয় না। এই বস্তুর বা ঐ বস্তুর সত্তা নিয়ে আলোচনা না করে অধিবিদ্যায় সাধারণ সত্তা বা সত্তা নিজে কি (Being itself), তাই নিয়ে এবং সত্তা হওয়ার জন্য তার যে গুণ, তাই নিয়ে আলোচনা করা হয়। কোন কিছু সত্তাবান বলার অর্থই হল এটি এক। কাজেই একত্ব (Unity) হল সত্তার একটি অনিবার্য গুণ এবং যেহেতু সব বিধেয়ক (Categories)-এর সত্তা রয়েছে কাজেই একত্ব সব বিধেয়কেই পাওয়া যায়। কল্যাণও সব বিধেয়কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ‘একত্ব’ এবং ‘কল্যাণ’ হল সত্তার অতীন্দ্রিয় গুণ। যেহেতু তারা সব বিধেয়কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কোন একটিমাত্র বিধেয়কেই তারা সীমাবদ্ধ থাকে না এবং তারা পরাজাতি নয়। মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়, মানুষ হল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী।
  • ‘বিচারবুদ্ধি’ সম্পর্কে ‘প্রাণিত্ব’ বিধেয় রূপে ব্যবহৃত হতে পারে না। অর্থাৎ বিভেদক লক্ষণ সম্পর্কে ‘পরাজাতি’ বিধেয় রূপে ব্যবহৃত হতে পারে না। কিন্তু ‘বিচারবুদ্ধি’ এবং ‘প্রাণিত্ব’ ‘উভয়ের সম্পর্কেই সত্তা বিধেয় রূপে প্রয়োগ করা যায়। কাজেই সত্তা পরাজাতি হতে পারে না।
  • সব অস্তিত্বশীল বস্তু সম্বন্ধে ‘সত্তা’ শব্দটি একই অর্থে বিধেয়রূপে আরোপিত হতে পারে না। দ্রব্য (Substance) এর সত্তা এবং দ্রব্যে যে গুণ থাকে, সেই গুণের সত্তা এক নয়। অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হল দ্রব্যের সত্তা. কারণ দ্রব্যের সত্তা হল মূল বা প্রাথমিক সত্তা। কারণ সব বস্তুই হয় দ্রব্য বা দ্রব্যের কোন প্রকার। কিন্তু দ্রব্য যেহেতু নানা ধরনের হতে পারে, অধিবিদ্যা অপরিণামী দ্রব্য নিয়ে আলোচনা করবে। যেহেতু অধিবিদ্যার কাজ হল সত্তার যথার্থ প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা এবং যেহেতু সত্তার যথার্থ প্রকৃতি তাতেই প্রকাশিত হয় যা অপরিণামী এবং স্ব-নির্ভর, কাজেই অপরিণামী বা নিত্য দ্রব্য যদি কিছু থাকে তাই নিয়ে অধিবিদ্যা আলোচনা করবে। কমপক্ষে এই রকম একটি অপরিণামী নিত্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করে পারা যায় না। একটি গতিশীল বস্তুর কারণ অপর একটি বস্তু যা তাকে গতিশীল করে। তার কারণ আবার অপর একটি বস্তু—এইভাবে চলতে থাকলে অনবস্থা দোষ দেখা দেবে। কাজেই সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, এমন একটি সত্তা আছে, যা অন্যকে গতিশীল করলেও নিজে অগতিশীল। এই সত্তাই হল অপরিণামী বা অনিত্য। এই সত্তার প্রকৃতি হবে আধ্যাত্মিক। এই নিত্য সত্তা বা দ্রব্য অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়।
  • গণিতশাস্ত্র হল তাত্ত্বিক বিজ্ঞান এবং গণিতশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় হল অপরিণামী বা অপরিবর্তনশীল বস্তু। কিন্তু এই বস্তুগুলোকে উপাদান থেকে পৃথকভাবে আলোচনা করা হলেও এরা উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। পদার্থবিদ্যা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সেগুলো উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না এবং সেগুলো গতিশীল। কেবলমাত্র অধিবিদ্যাই অপরিণামী নিত্যসত্তা নিয়ে আলোচনা করে। অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হল তাই, যা উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে এবং যা গতিহীন।
  • দ্রব্যকে পরিণামী এবং কখনও অপরিণামী—এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। আবার তিন ধরনের দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য করা যায় – (১) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং নশ্বর, (২) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং নিত্য, যেমন— সৌরজগতের গ্রহতারকা; (৩) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এবং নিত্য।
  • অধিবিদ্যা অতীন্দ্রিয় ও নিত্যদ্রব্য নিয়ে আলোচনা করে। এই নিত্যদ্রব্য প্লেটোর ‘ধারণা’ নয়। প্লেটোর ধারণা সম্পর্কিত মতবাদ ভ্রান্ত। কারণ – ধারণা বা আকার বস্তুর অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। যদি মেনেও নেওয়া যায় যে, শ্বেতত্ত্বের ধারণা বা আকারের অস্তিত্ব রয়েছে, আমরা বুঝে উঠতে পারি না তা কিভাবে শ্বেতবস্তু উৎপন্ন করে। এটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সম্ভাব্যতা স্বীকার করে ও ব্যাখ্যা করে, তাতে প্রমাণিত হয় এটি কাল্পনিক নয়, কিন্তু তার দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু (Individual) থেকে পৃথকভাবে ধারণা বা আকারের অস্তিত্ব থাকতে পারে। সব কিছুরই ধারণা বা আকার স্বীকার করলে অভাব (Negation) বা সম্বন্ধের (Relations) ধারণা স্বীকার করতে হয়। কিন্তু অভাব বা সম্বন্ধের ধারণার বা আকারের কথা চিন্তা করা যায়না। এটি অপ্রয়োজনীয়। জগতের বহুত্বের ব্যাখ্যা দর্শনের কাজ, এর জন্য বহুসংখ্যক ধারণার বা আকারের অস্তিত্ব স্বীকার প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুর প্রয়োজনহীন দ্বিত্বকরণ (Doubling) ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুর জ্ঞানের পক্ষেও এটি অপ্রয়োজনীয়, কারণ এটি বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে থাকে না, বিশেষ বস্তুর জ্ঞান লাভে তারা প্রয়োজনহীন। বস্তুর অস্তিত্ব এটির সাহায্যে ব্যাখ্যাত হলেও বস্তুর গতি ব্যাখ্যার ব্যাপারেও এটি অপ্রয়োজনীয়, কারণ ধারণাগুলো অপরিণামী এবং গতিহীন হওয়ায় এই বিশ্বজগত, ধারণার অনুকরণ প্রতিলিপি (Copy) হওয়াতে অবশ্যই গতিহীন হবে। কিন্তু এই জগতে পরিবর্তন, গতি, বস্তুর আবির্ভাব, তিরোভাব লেগেই রয়েছে। এটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে ব্যাখ্যা করে বলে হেতু ধারণা বা আকারও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়। আদর্শ মানুষ বা আকার মানুষ, সক্রেটিসের মতই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে। এই মতবাদের সম্ভাব্যতা স্বীকার করা চলে না। আকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর স্বরূপ ধর্ম (Essence) এবং আকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারলে সেই আকারে বস্তুর স্বরূপধর্ম থাকতে পারেনা। এদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার জন্য প্লেটোর “অংশগ্রহণ” (Participation), ‘অনুকরণ’ (Imitation) প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার যথাযথ নয়। প্লেটো আকারের স্বরূপ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে আকারও অন্যান্য বস্তুর মত বিশেষ বস্তু হয়ে পড়েছে। কিন্তু আসলে আকার হচ্ছে সার্বিক (Universal)। বিশেষ বিশেষ শ্বেতবস্তু ছাড়াও যখন শ্বেতত্ব বলে একটি স্বতন্ত্র বস্তু কল্পনা করা হয় তখন সেটাও নতুন একটি বিশেষ বস্তুই হয়ে যায়। ধারণাগুলোকে অতীন্দ্রিয় বলা হয়, কিন্তু ঘােড়া এবং ঘােড়ার ধারণার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি। ঘােড়া আসলে যা (initself) বা সাধারণ ঘােড়া (horse in-general) প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার এই পার্থক্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। ধারণা বা আকারগুলোকে প্লেটো লৌকিক ধর্মের, মানবিক গুণসম্পন্ন দেবতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে “এরা হল ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন মানুষ” দাবি করে। তাই ধারণা শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিরই বস্তু থেকে গেছে যা নিত্যতা লাভ করেছে। বস্তুকে বলা হয়েছে ধারণার নকল কিন্তু বস্তুতপক্ষে দেখা যায় ধারণাই বস্তুর নকল। আকার যদি সংখ্যা হয় তাহলে তারা কারণ (Cause) হতে পারেনা। আকার হল কারণ, কারণ অস্তিত্বশীল বস্তু হল অন্যান্য সংখ্যা (যেমন একটা সংখ্যা হচ্ছে ‘মানুষ’, আর একটি সংখ্যা হচ্ছে সক্রেটিস) তাহলে একদল সংখ্যা অন্যদল সংখ্যার কারণ হতে পারেনা। তা ছাড়া দু’ধরনের সংখ্যা কিভাবে থাকতে পারে। আকার সংখ্যা (form numbers) ছাড়াও যদি অন্য সংখ্যা (গাণিতিক বস্তু) স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে দুই ধরনের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্যের ভিত্তি থাকেনা। আমরা মাত্র এক ধরনের সংখ্যার কথা জানি, যে সংখ্যা নিয়ে গণিতবিদরা আলোচনা করেন। সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধিতা হচ্ছে হচ্ছে তৃতীয় মানুষের যুক্তি দিয়ে করা বিরোধিতা। সব মানুষের মধ্যে যেদিক থেকে মিল রয়েছে তা হল তারা মানুষের ধারণার বা সার্বিকের অনুকরণ। কিন্তু বিশেষ বিশেষ মানুষ আর মানুষের ধারণা (Idea of Man)-র মধ্যে একটা সাধারণ উপাদানের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে গেলে একটি তৃতীয় ধারণা অর্থাৎ কিনা, তৃতীয় মানুষের কথা ভাবতে হয়। আবার এই ‘তৃতীয় মানুষের ধারণাও ব্যক্তি মানুষ-এর মধ্যে সাধারণ উপাদান। হিসেবে অন্য আর একটি সাধারণ ধারণার কথা ভাবতে হবে, যার ফলে অবস্থা দোষ (Infinite Regress) দেখা দেবে। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • সার্বিক নিছক মনোগত প্রত্যয় নয়, কেননা মনে যে সার্বিকের অস্তিত্ব রয়েছে বস্তুতে সেই সার্বিকের অনুরূপ বিশেষ স্বরূপধর্ম (Specific Essence) রয়েছে, যদিও কোন অবস্থাতেই এই স্বরূপধর্ম বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে না। কেবলমাত্র মনের ক্রিয়ার দ্বারা মনেতেই তাকে পৃথক করা যায়। সামান্য বা সার্বিকই বিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়বস্তু। তাই সার্বিকের কোনভাবে সত্যতা না থাকলে, এর বস্তুগত সত্যতা (Objective Realities) মেনে নেয়া না গেলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সত্যতাকেও স্বীকার করে নেয়া যাবে না, কারণ বিজ্ঞান বিশেষকে তার আলোচনার বস্তু করে না। বিজ্ঞানের জন্য সার্বিকের (Universals) প্রয়োজন আছে। বিজ্ঞান বলতে বিজ্ঞতা বোঝায়। দার্শনিক বিশেষকে বিশেষ হিসেবে গ্রহণ করেন না, কারণ দার্শনিক যদিও কোন আপেক্ষিক সত্তা নিয়ে আলোচনা করেন, তিনি বিশেষ কোন আপেক্ষিক সত্তার কথা চিন্তা না করে, আপেক্ষিক সত্তার স্বরূপগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন। আপেক্ষিক সত্তা সম্পর্কে দার্শনিক এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চান যা সব আপেক্ষিক সত্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। তাই বিজ্ঞানের কাজ বস্তুর সার্বিক উপাদানকে নিয়ে। যেমন বিজ্ঞানী বিশেষ বিশেষ স্বর্ণখণ্ডে আগ্রহী নয়, তিনি আগ্রহী স্বর্ণের স্বরূপধর্ম নিয়ে অথাৎ সেই বিশেষ সাদৃশ্য নিয়ে, যা প্রতিটি বিশেষ বিশেষ স্বর্ণখণ্ডে দৃষ্ট হয়। একই কারণে বিশিষ্ট বস্তু নিয়ে সংজ্ঞাও দেয়া যায়না, সার্বিককে নিয়েই দিতে হয়। তাই সার্বিকের সত্যতা (Reality) বা অস্তিত্ব আছে; শুধুমাত্র মানুষের মনে নয়, বস্তুতেও এর অস্তিত্ব আছে। তবে বস্তুতে এর অস্তিত্ব মনেতে এর যে আকারগত সার্বিকতা (Formal Universality) আছে, তাকে অনুসৃত করে না। সার্বিক বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির (Individulity) মধ্যে মূর্ত এবং সার্বিক বিশেষের অতিবর্তী নয়, বিশেষের মধ্যে অস্তঃস্যুত। একই উপজাতির অন্তর্ভুক্ত বিশিষ্ট বস্তু হল অস্তিত্বশীল দ্রব্য, কিন্তু শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তুতে সংখ্যাগতভাবে অভিন্নরূপে বর্তমান এমন কোন বস্তুগত সার্বিকের তারা অংশীদার নয়। এই বিশেষ স্বরূপধর্ম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্তমান। অপরপক্ষে এটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্যের মধ্যে বিশেষভাবে একই। প্লেটোর মতে, সার্বিক হল অমূর্ত (Abstract), কিন্তু সার্বিক আসলে মূর্ত (Concrete)। (প্লেটো প্রভাবিত, প্লেটোর বিপরীতে)
  • বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুই হল যথার্থ দ্রব্য (Substance)। দ্রব্য হল তাই, যা স্বনির্ভর, যার সত্তার উৎস অন্য সত্তা নয়। তাদের যথার্থ দ্রব্য বলা যায় না, তারা গৌণ অর্থে দ্রব্য। বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তিই কেবলমাত্র উদ্দেশ্য যার সম্পর্কে কিছু বলা হয়, বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তি অপর কোন কিছু সম্পর্কে বিধেয় রূপে ব্যবহৃত হয় না। প্লেটোর সার্বিক দ্রব্য নয়, কারণ এটি একটি সাধারণ বিধেয় যা একটি শ্রেণীর বহু বস্তুর সঙ্গে যুক্ত থাকে, যেমন মানুষ – এই ধারণা বলতে আমরা বুঝি বহু ব্যক্তির মধ্যে যা সাধারণভাবে উপস্থিত। এই মানুষ হল মনুষ্যত্ব (Humanness)। মনুষ্যত্ব মানুষ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না। তাই সার্বিক দ্রব্য রূপে গণ্য হতে পারেনা। আবার নিছক বিশেষও (Absolutely Particular) দ্রব্য নয়। নিছক বিশেষের কোন অস্তিত্ব নেই। মনুষ্যত্ব যেমন বিশেষ বিশেষ মানুষ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না, তেমনি মানুষও মনুষ্যত্ব ছাড়া থাকতে পারে না। কাজেই সার্বিক দ্রব্য নয়, আবার নিছক বিশেষও দ্রব্য নয়, কেননা এদের কেউ একে অপরকে ছাড়া অস্তিত্বশীল হতে পারে না। দ্রব্য হল এই দুই-এর সমন্বয়। দ্রব্য সার্বিক আবার বিশেষ, এর অর্থ, দ্রব্য হল বিশিষ্ট বস্তু (Individual Object) অর্থাৎ মানুষ যাতে মনুষ্যত্ব রয়েছে। প্রাথমিক অর্থে দ্রব্য বলতে বিশিষ্ট বস্তুকে বুঝতে হবে, যা উপাদান এবং আকার-এর দ্বারা গঠিত। কিন্তু সার্বিক গৌণ অর্থে দ্রব্য, এক্ষেত্রে গৌণ অর্থে দ্রব্য হল আকারগত উপাদান (Formal Element) বা বিশেষ বা বিশিষ্ট স্বরূপধর্ম (Specific Essence), যা সার্বিক প্রত্যয়ের অনুরূপ। গণিতের বস্তুও গৌণ অর্থে দ্রব্য হবে।
  • ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশিষ্ট বস্তুর সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায় না, কেননা তাদের মধ্যে উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে। এই উপাদানের উপস্থিতির জন্য তারা নশ্বর এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও দুর্বোধ্য। অপরপক্ষে, দ্রব্য হল মূলত স্বরূপধর্ম যার সংজ্ঞা দেওয়া যায় বা বস্তুর আকার, যার জন্য এ উপাদান কোন একটি নির্দিষ্ট মূর্ত বস্তু হয়ে ওঠে। তাই দ্রব্য হল মুখ্যত আকার বা নিজে উপাদান বর্জিত। তাই বিশিষ্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুই দ্রব্য হলেও উপাদানহীন শুধু আকারই যথার্থ ও প্রাথমিক দ্রব্য হতে পারে। কিন্তু উপাদানের ওপর বাস্তবিকপক্ষে নির্ভর নয় এমন আকার হল কেবলমাত্র ঈশ্বর, জ্যোতিষ্কমণ্ডলে বিরাজ করে যে বুদ্ধি (The Intelligences of the Spheres) এবং মানুষের মধ্যে সক্রিয় বুদ্ধি। তাই এই আকারগুলোই হল প্রাথমিক দ্রব্য। (প্লেটো প্রভাবিত, প্লেটোর বিপরীতে)

ঈশ্বরতত্ত্ব

  • বিশ্বের যাবতীয় বস্তু যে বিশেষ ক্ৰমে বিন্যস্ত তার সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে ঈশ্বর। ঈশ্বর হলেন শুদ্ধ আকার। আকার ব্যক্ততা বলে ঈশ্বরই সর্বনিরপেক্ষ ব্যক্ত সত্তা, একমাত্র বাস্তব। অন্যান্য সব অস্তিত্বশীল বস্তু কম-বেশি অবাস্তব। ক্রমের যত উপরের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, ততই অধিকতর বাস্তবতা পাওয়া যায় কারণ তাতে আকারের অধিকতর মাত্রায় উপস্থিতি পাওয়া যায়। তাই সত্তার ক্রম বাস্তবতারও ক্রম। এদিকে আকারহীন উপাদান বা আদিম উপাদান পুরোপুরি অবাস্তব। সর্বনিরপেক্ষ বাস্তবতা ঈশ্বর এবং আকারহীন উপাদান – এই দুই-এর মাঝে অসীম ক্ৰমের (Infinite Gradations) অবস্থিতি।
  • আকার একই সাথে আকার, নিমিত্ত এবং পরিণতি কারণ (Final Cause) বলে ঈশ্বর এই সব কিছুই। আকারগত কারণ হিসেবে ঈশ্বর হলেন ধারণা (Idea)। ঈশ্বর হলেন বিশেষ করে চিন্তন, বুদ্ধি বা ধী-শক্তি। পরিণতি কারণ হিসেবে তিনি হলেন পরম লক্ষ। প্রতি সত্তারই নিজস্ব লক্ষ বা উদ্দেশ্য আছে, কিন্তু পরম উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যরূপে ঈশ্বর সব নিম্নতর লক্ষ্যকে নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন এবং প্রতিটি বস্তুর উদ্দেশ্য বা লক্ষ সেই বস্তুর সমগ্র পরিপূর্ণতা বলে পরম লক্ষ হিসেবে ঈশ্বর পরম পূর্ণতা। সর্বশেষে নিমিত্ত কারণ হিসেবে ঈশ্বর সব গতি এবং ভবনের চরম অন্তিম কারণ। ঈশ্বর হলেন প্রথম প্রবর্তক, কিন্তু তিনি নিজে অপ্রবর্তিত থাকেন। (প্লেটো প্রভাবিত, প্লেটোর বিপরীতে)
  • ঈশ্বর হলেন অপ্রবর্তিত প্রবর্তক (Unmoved Mover)। প্রথম প্রবর্তক যে অপ্রবর্তিত (Unmoval) থাকবেন তা পরিণতি কারণ থেকে তা অনিবার্যভাবে নিসৃত হয়। গতি বলতে বোঝায় কোন বস্তুর তার লক্ষ্যের দিকে উত্তরণ। পরম লক্ষ্যের নিজ ছাড়া অন্য কোন লক্ষ থাকতে পারে না বলে পরম লক্ষ্যের গতির কথা বলা যেতে পারে না। তা ছাড়া গতি বলতে উপাদানের আকারে উত্তরণ বোঝায়। সবনিরপেক্ষ বা অন্তিম আকারের কোন উচ্চতর আকারের দিকে অগ্রগতি লক্ষ করা যেতে পারে না বলে তা গতিহীন।
  • প্রতিটি গতির গতিশীল হবার অবস্থার, প্রতিটি অব্যক্তের ব্যক্ত হবার অবস্থার ব্যাখ্যার জন্য একটি ক্রিয়াশীল সূত্রের প্রয়োজন। এখন প্রতিটি পরিবর্তনকে, প্রতিটি গতিশীল বস্তুকে ব্যাখ্যা করার জন্য যদি একটি বাস্তব গতিশীল কারণকে স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে এ বিশ্বজগতেরও একটি আদি প্রবর্তকের (First Mover) প্রয়োজন আছে। একটি গতিশীল বস্তু আর একটি গতিশীল বস্তুর দ্বারা গতি লাভ করে। এখন প্রথম গতিশীল বস্তুও অপর আর একটি গতিশীল বস্তুর দ্বারা গতিশীল হয়ে থাকে। এভাবে একটি গতির সাহায্যে এবং তাকে অপর একটি গতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে গেলে এ ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া শেষ হবে না, অনবস্থা দোষ দেখা দেবে; প্রথম গতির কারণটি অব্যাখ্যাত থেকে যাবে এবং তার কোন যথার্থ কারণও নির্দেশ করা যাবে না। তাই আদি কারণ বা আদি প্রবর্তককে অপ্রবর্তিত বা গতিহীন হতে হবে। ‘আদি’ (First) কথাটিকে কালগত পারপর্যের দিক থেকে চিন্তা করা যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ কালের শুরুতে আদি প্রবর্তক, বস্তুতে গতি আরোপ করেছিলেন—এভাবে চিন্তা করলে ভুল হবে। ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ এবং যথার্থ নিমিত্ত কারণ হল পরিণতি কারণ (Final Cause)। ঈশ্বর পরিণতি কারণ হিসেবেই আদি প্রবর্তক। এ বিশ্বজগৎ এবং তার মধ্যে অবস্থিত গতি, কোনটিরই কোন আকার নেই। গতি নিত্য, কেননা গতিকে প্রবর্তিত করতে গেলে বা তাকে তিরোহিত করতে গেলে গতির প্রয়োজন হবে। কাজেই ‘আদি’ (First) শব্দটিকে প্রধান (Supreme) অর্থে গ্রহণ করতে হবে। আদি প্রবর্তক বা প্রথম প্রবর্তক হলেন নিত্য গতির নিত্য উৎস। আদি প্রবর্তক কোন স্রষ্টা-ঈশ্বর নন। কেননা জগৎ নিত্য, অনন্তকাল ধরে জগৎ অস্তিত্বশীল।
  • ঈশ্বর জগতের প্রথম কারণ বা আদি কারণ বলতে তিনি কোন যান্ত্রিক কারণ (Mechanical Cause) নন, যা জগতের সৃষ্টির পূর্বে অস্তিত্বশীল হয়ে জগতকে সৃষ্টি করেছে। ঈশ্বর হলেন উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতি কারণ (Teleological Cause), যিনি লক্ষ বা উদ্দেশ্যের দিক থেকে ক্রিয়া করছেন। সেই হিসেবে সব প্রারম্ভের বা শুরুর, তিনি যান্ত্রিক দিক থেকে (Logically) পূর্ববর্তী এবং আদি প্রবর্তক। কালের দিক থেকে জগতের কোন শুরু নেই, কোন শেষ নেই। বিশ্বজগতের পরিণতি হল চূড়ান্ত আকার (Absolute Form)। কিন্তু তাতে উপনীত হওয়া বিশ্বজগতের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আকার উপাদান ছাড়া অস্তিত্বশীল হতে পারে না। ঈশ্বর যদি গতি সংঘটিত করতেন তাহলে ঈশ্বর অপ্রবর্তিত না থেকে প্রবর্তিত বা গতিশীল হয়ে যেতেন। কেননা গতির কর্তার ওপর গতির প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। কাজেই পরিণতি কারণ হিসেবে ঈশ্বর তার দিকে জগতকে আকর্ষণ করবেন। ঈশ্বর হলেন পরিণতি কারণ বা লক্ষ যার দিকে জগতের গতি।
  • আদি প্রবর্তক বা ঈশ্বর পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত, তিনি অব্যক্ত নন। তিনি যদি অব্যক্ত হলে তার আবার পরিবর্তন থাকবে এবং তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আবার এ প্রবর্তক যদি শুদ্ধ আকার না হয়ে উপাদানযুক্ত হয়, তবে তাও পরিবর্তিত হবে এবং সেই পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। ফলে অনবস্থা দোষ দেখা দেবে। তাই এক আদি কারণ স্বীকার করতে হয় যা নিত্য, পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত, শুদ্ধ আকার এবং আদি কারণ প্রবর্তক হয়েও অপ্রবর্তিত। এ আদি-প্রবর্তক পরিবর্তন ঘটান, কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকে, এটাই ঈশ্বর। এ আদি কারণই বিশ্বের পরিণতি কারণ। এ আদি কারণ পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত (Pure Act) হওয়াতে উপাদানহীন (Immaterial) হবে। কেননা উপাদানযুক্ত হলে পরিবর্তিত হবার এবং উপাদানের উপর অন্য ক্রিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। আদি প্রবর্তক উপাদানবিহীন বলে একের অধিক হতে পারেন না কারণ কোন কিছুর বিশিষ্ট (Individual) বা বহু হওয়ার মূলে উপাদানের অস্তিত্ব কাজ করে।
  • আদি প্রবর্তক উপাদানবিহীন হওয়ার জন্য কোন শারীরিক কর্ম সম্পাদন করতে পারবে না। তার কাজ হবে শুদ্ধ আধ্যাত্মিক কাজ এবং সেহেতু বৌদ্ধিক। ঈশ্বরের কাজ হবে চিন্তন। ঈশ্বরের চিন্তার বিষয়বস্তু নিশ্চয়ই এমন কিছু নয়, যা পরিবর্তনের বা অভিনবত্বের সঙ্গে সংযুক্ত। ঈশ্বরের চিন্তা ঈশ্বর নিজেই। ঈশ্বর নিজেই চিন্তার কর্তা এবং চিন্তার বিষয়। এক অনন্ত আত্ম-সচেতনতারূপ ক্রিয়ার মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে জানেন। ঈশ্বর হলেন আত্ম-সচেতনতা, সর্বনিরপেক্ষ বিষয়-বিষয়ী। ঈশ্বর পরম লক্ষ বলে তার লক্ষ্যের বাইরে কোন কিছু থাকতে পারে না। তাই ঈশ্বর নিজেকে ছাড়া অন্য কোন কিছুকে চিন্তা করতে পারেন না। তাই ঈশ্বর হল ‘চিন্তার চিন্তা’ (Thought of Thought)। ঈশ্বরের চিন্তার বাইরে কোন চিন্তার বিষয় থাকতে পারে না, যদি থাকে তাহলে যে ঈশ্বর বা পরম লক্ষকে তার বাইরে লক্ষ্যের অস্তিত্বের কথা ভাবতে হয়। কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে ঈশ্বর সেহেতু শুধু নিজেকে জানেন।

আত্মাতত্ত্ব বা মনবিদ্যা

  • দেহ আত্মা হতে পারে না, কারণ দেহ প্রাণ নয়। দেহ ও আত্মার দ্বৈততা স্বীকার্য নয়, অর্থাৎ এরা দুটি পৃথক দ্রব্য নয়। আত্মা দেহের ‘Entelechy’ বা দেহের সংগঠনী শক্তি। দেহ ও আত্মা মিলে এক দ্রব্য।
  • দেহ ও আত্মার সম্পর্ক হলো উপাদান ও আকারের সম্পর্ক, অর্থাৎ দেহ হল আত্মার উপাদান আর আত্মা হল দেহের আকার। জড়দেহের আকার হিসেবে আত্মা অবশ্যই একটি দ্রব্য, যে জড়দেহের মধ্যে প্রাণ অব্যক্তভাবে বিদ্যমান। কিন্তু দ্রব্য হল বাস্তব এবং আত্মা হল দেহের বাস্তবতা বা ব্যক্ততা। যে দেহ প্রাণযুক্ত তার স্বরূপধর্ম (Essence) হিসেবে আত্মা দ্রব্য।
  • আত্মা ও দেহ যথাক্রমে আকার ও উপাদান হওয়ায় একটি ছাড়া আরেকটি থাকতে পারেনা, তাই পিথাগোরীয় সম্প্রদায় ও প্লেটো জন্মান্তরবাদ ও আত্মার অমরত্ব স্বীকার্য নয়। দেহের বিনাশের সাথে আত্মার বিনাশ ঘটে। (পিথাগোরিয়ান স্কুল ও প্লেটোর বিপরীতে)
  • আত্মা দেহের পরিণতি কারণ (Final Cause)। গতির উৎস হিসেবে, পরিণতি কারণ হিসেবে এবং প্রাণসমন্বিত বাস্তব দ্রব্য (অর্থাৎ আকারগত কারণ) হিসেবে আত্মা প্রাণ সমন্বিত দেহের কারণ এবং সূত্র।
  • মন আত্মা থেকে উচ্চস্তরের এবং দেহের সঙ্গে তার সংযোগ অপেক্ষাকৃত কম। মন একটা স্বাধীন দ্রব্য যা আত্মার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট এবং যা অবিনশ্বর। আত্মার বিভিন্ন অংশ আত্মা থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না। মনই কেবলমাত্র আত্মার অন্যান্য শক্তি থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে। মন আমাদের সেই অংশ যা গণিত এবং দর্শন অনুধাবন করতে পারে। মনের বিষয় হল কালাতীত, কাজেই মনকেও কালাতীত গণ্য করা হয়। আত্মা হল তাই যা দেহকে চালিত করে। আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু প্রত্যক্ষ করে। মনের কাজ হল চিন্তন। মনের সঙ্গে দেহ বা ইন্দ্রিয়ের কোন সম্পর্ক নেই। কাজেই মন অবিনশ্বর হতে পারে যদিও আত্মার অবশিষ্ট অংশগুলো তা হতে পারে না। যা কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীতে দ্রব্যত্ব আরোপ করে তাই হল আত্মা। কিন্তু মন হল অন্য কিছু। মন দেহের সঙ্গে কম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সম্ভবত এটি আত্মার অংশ কিন্তু অল্পসংখ্যক জীবিত সত্তাই এর অধিকারী।
  • আত্মার দুটি দিক — বৌদ্ধিক (Rational) এবং অ-বৌদ্ধিক (Irrational)। অ-বৌদ্ধিক দিকের দুটি অংশ বর্ধনমূলক (Vegetative) যা প্রতিটি জীবিত প্রাণীতে, এমনকি উদ্ভিদে বর্তমান এবং ক্ষুধামূলক (Appetitive) যা সব প্রাণীতে উপস্থিত। বৌদ্ধিক আত্মা দুই ভাবে সক্রিয়—এর বৈজ্ঞানিক চিন্তনের ক্ষমতা আছে এবং সুপরিকল্পিত চিন্তনের ক্ষমতা আছে। প্রথমটির উদ্দেশ্য হল সত্যতাকে সত্যতার জন্য লাভ করা। দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হল সত্যতাকে সত্যতার জন্য নয়, ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য লাভ করা। আত্মার সব ক্রিয়াই দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য এবং নশ্বর, কিন্তু বৌদ্ধিক আত্মা দেহের পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল এবং অবিনশ্বর। বৌদ্ধিক আত্মায় জীবন হল চিন্তনের জীবন, যা হল মানুষের পরিপুর্ণ সুখ, যাকে সম্পূর্ণভাবে লাভ করা যায় না। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যে পার্থক্য সেই পার্থক্য হল ব্যক্তির দেহ এবং অ-বৌদ্ধিক আত্মার জন্য। বৌদ্ধিক আত্মা হল ঐশ্বরিক এবং নৈব্যক্তিক।
  • মানুষের চেতনার বিভিন্ন স্তরগুলো আত্মার সাধারণত বৃত্তি। এ বৃত্তিগুলো হল পুষ্টিসাধন ও বংশরক্ষা, সংবেদন, কামনা, স্থানীয় গতি, কল্পনা, স্মৃতি এবং বিচারবুদ্ধি। এই বৃত্তিগুলোকে আত্মার বিভিন্ন অংশ রূপে গণ্য করা সমীচীন হবে না। স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে তারা কোন অংশ নয়, এগুলো আত্মার বিভিন্ন স্তর। মানুষের চেতনার নিম্নতর এবং উচ্চতর ক্রম আছে। আত্মা এক অবিভাজ্য সত্তা, কাজেই তার কোন অংশ নেই। আত্মার ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তি, একই অভিন্ন সত্তার ক্রিয়ার বিভিন্ন দিক। সব জীবিত প্রাণীই নিজের পুষ্টিসাধন করতে পারে এবং বংশরক্ষা করতে পারে। আত্মার এ পুষ্টিসাধক বৃত্তি প্রাণী এবং উদ্ভিদ সকলের মধ্যেই দেখা যায়। উদ্ভিদরা আত্মার এই একটিমাত্র বৃত্তিরই অধিকারী। প্রাণীদের আরও একটি বৃত্তি আছে সেটি হল সংবেদন। কিন্তু সব প্রাণীই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের অধিকারী নয়।
  • কামনা, স্থানীয় গতি (Locomotion) এবং কল্পনা, আত্মার এ তিনটি বৃত্তি পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কামনার বৃত্তি সংবেদনকে অনুসরণ করে অর্থাৎ যার সংবেদন আছে, তারই কামনা আছে। যার সংবেদন আছে সে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে এবং যে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করে তার ক্ষুধারও অভিজ্ঞতা হয়। কেননা ক্ষুধা হল যা মনোরম বা প্রীতিকর তার জন্য কামনা। সব প্রাণী, যাদের স্পর্শেন্দ্রিয় আছে তারা খাদ্য এবং পানীয় প্রত্যক্ষ করতে পারে এবং খাদ্য ও পানীয়ের জন্য কামনাকেই যথাক্রমে, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা নাম দেওয়া হয়ে থাকে। কামনা আত্মার অন্যান্য অংশ থেকে পৃথক নয় বলে কামনাকে একটি স্বতন্ত্র বৃত্তি হিসেবে গণ্য করতেই হবে – এমন নয়।
  • স্থানীয় গতি অন্যান্য বৃত্তি থেকে এটি একটি স্বতন্ত্র বৃত্তি। কিন্তু কামনা, কল্পনা ও বিচারবুদ্ধির সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক আছে। সব প্রাণী এ বৃত্তির অধিকারী নয়। কোন প্রাণী নিজেকে গতিশীল করে তুলতে সমর্থ কারণ তার কামনার বৃত্তি রয়েছে। কিন্তু কামনা কল্পনাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে নেয় এবং কল্পনা বৌদ্ধিক হতে পারে বা সংবেদনমূলক হতে পারে।
  • কল্পনা হল সেই শক্তি যার দ্বারা প্রতিটি ব্যক্তি মানসিক প্রতিরূপগুলো সৃষ্টি করে। কোন বস্তু ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করার পর যখন ইন্দ্রিয়ে সেই উত্তেজনা চলতে থাকে, তখন এটি ঘটে। সব প্রাণীই যেমন পিপীলিকা, মৌমাছি ইত্যাদি কল্পনার অধিকারী নয়। কল্পনা পূর্ব থেকেই সংবেদনকে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু কল্পনা সংবেদন থেকে পৃথক কারণ কোন কিছু প্রত্যক্ষ না করেও কল্পনা করা যায়, এবং কল্পনা হল ভ্রমপ্রবণ কিন্তু সংবেদন তা নয়। যখন আমাদের শ্বেতবর্ণের সংবেদন হয়, তখন তার ক্ষেত্রে ভ্রম দেখা দেয় না। ভ্রম তখনই দেখা দেয় যখন আমরা যা প্রত্যক্ষ করি, সেই সম্পর্কে অবধারণ গঠন করি (Form Judgments)। কল্পনা হল একটা গতি যা সংবেদনের দ্বারা উৎপন্ন হয়, যা সংবেদনেরই সদৃশ। কল্পনা সংবেদন থেকে উদ্ভূত হয়, কিন্তু কল্পনা সত্য ও মিথ্যা দুইই হতে পারে, যা সংবেদন পারেনা।কল্পনা স্মৃতির ভিত্তি কারণ মানসিক প্রতিরূপ ছাড়া স্মৃতি ঘটতে পারে না। ক্রিয়া ও গতির ক্ষেত্রে কল্পনা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে কারণ কল্পনা ছাড়া কামনা হয়না।
  • স্মৃতি কল্পনার সঙ্গে অভিন্ন, তবে প্রতিরূপের সঙ্গে এক্ষেত্রে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়, তা হল প্রতিরূপটিকে একটি অতীত ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার প্রতিলিপি বা নকল বলে চিনতে পারা। স্মরণ (Recollection) স্মৃতির তুলনায় উচ্চতর স্তরে অবস্থিত। স্মৃতিপ্রতিরূপ উদ্দেশ্যহীনভাবে মনে ঘােরাফেরা করে। স্মরণ হল ইচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতি প্রতিরূপগুলোকে মনে জাগিয়ে তোলা।
  • আত্মার দুটি জ্ঞানমূলক বৃত্তি হল সংবেদন এবং বিচারবুদ্ধি। যখন সংবেদন ঘটে, তখন ইন্দ্রিয় ‘প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার’ (Perceptible Form) গ্রহণ করে, বস্তুর উপাদানকে গ্রহণ করে না। সংবেদনের প্রাথমিক বস্তু হল বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি। প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই তার নিজস্ব প্রত্যক্ষ করার বস্তু রয়েছে, যেমন চক্ষুর বর্ণ। প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার এবং গ্রাহক-ইন্দ্রিয় একাঙ্গীভূত হয় এবং প্রত্যক্ষ করার সময় এক হয়ে যায়। ইন্দ্রিয় উপাত্তের (Sense Data) একটা মাত্রার মধ্যেই ইন্দ্রিয়টি ক্রিয়া করতে পারে, যেমন তীব্র আলোর ছটায় চক্ষু সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। সংবেদন হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকারের দ্বারা ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তা লাভ। তিন ধরনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু রয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিকভাবে যা আমরা প্রত্যক্ষ করি তা হল কোন বর্ণ, গন্ধ, শব্দ। ইন্দ্রিয়ের এসব বিশেষ বস্তুর সংবেদন সাধারণত ভ্ৰমমুক্ত হয়ে থাকে ও সংবেদনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেই ভুল হয়ে থাকে, মরিচীকা বাস্তব মনে করা। দ্বিতীয়ত, কতকগুলো সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় (Common Sensibles) আছে, যেমন-গতি, আকার, সংখ্যা। এগুলো কোন একটি মাত্র বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষিত হয় না, একাধিক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষিত হয়। যেমন, গতি দৃষ্টি ও স্পর্শ এ উভয় ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় রূপ বৃত্তি (Faculty of Sense) সমগ্রভাবে ক্রিয়া করে এ প্রত্যক্ষণকে সম্ভব করে তোলে। তৃতীয় ধরনের হন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হল যাকে আকস্মিকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। একটা টেবিল প্রত্যক্ষ করার সময় কিছু বর্ণ (Colour) বা বর্ণসমষ্টি দেখা যায়, কিন্তু আমরা সেই সাথে একটি একটি বিশেষ টেবিলও দেখি।
  • ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে কোন বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার সময় বস্তুর বিভিন্ন গুণ প্রত্যক্ষ হয়, গুণগুলোর ধারক হিসেবে অজ্ঞাত আধার আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে ধরা পড়ে না, উপাদান অজ্ঞাত থেকে যায়, গুণগুলো আকারের অংশ বলে কেবল আকারকে জানতে পারি। তাই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ ঘটে যখন আত্মা বস্তুর আকারকে নিজের মধ্যে মুদ্রিত করে দেয়।
  • আত্মার অন্য বৃত্তিগুলো দেহ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না, কিন্তু বিচারবুদ্ধি পারে। সংবেদনে উপাদানকে বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকারটিকে গ্রহণ করা হয়, আর বিচারবুদ্ধিতে উপাদানকে বাদ দিয়ে বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার (Intelligible Form) গ্রহণ করা হয়। প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার হল বর্ণ, গন্ধ, শব্দ ইত্যাদি। বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার হল কোন বস্তুর সারধর্ম বা স্বরূপধর্ম (Essence)। যেমন সংবেদন দিয়ে জীবদেহে উষ্ণতা ও শীতলতার মধ্যে পার্থক্য করা যায়, কিন্তু বিচারবুদ্ধির সাহায্যে জীবদেহের মাংস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। সংবেদনের ক্ষেত্রে তীব্র উত্তেজক ইন্দ্রিয়কে ধ্বংস বা বিনষ্ট করতে পারলেও বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে তা হয়না। যখন মন ‘পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাতব্য’ কোন বস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন মনের কোন বিনাশ ঘটে না বা ‘পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাতব্য নয়’ এমন বিষয়কে অনুধাবন করতে মন কোন অসুবিধা বোধ করে না। বরং মন তাদের আরও ভালভাবে জানতে পারে। মানুষের সংজ্ঞা-‘মানুষ হল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী’।
  • ইন্দ্রিয়ের মত বিচারবুদ্ধির তার বস্তুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা রয়েছে। প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকারের সঙ্গে এক হয়ে যায় তেমনি বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধি বস্তুর সঙ্গে এক হয়ে যায়। সংবেদন দেহের একটা অংশের ওপর নির্ভর করে, যেমন দৃষ্টির ক্ষেত্রে চক্ষুর ওপর। কিন্তু বিচারবুদ্ধি দেহের কোন ইন্দ্রিয় নয়। ইন্দ্রিয়ের বৃত্তির আবাসস্থল হচ্ছে হৃৎপিণ্ড, কিন্তু মানসিক কাজের আবাসস্থল মস্তিষ্ক নয়, বিচারবুদ্ধির কাজ দেহের উপর নির্ভর না করেই চলতে থাকে, এটি তাই আত্মার সাথে সম্পর্কিত।
  • বিচারবুদ্ধির দুটি স্তর – নিষ্ক্রিয় (Passive) এবং সক্রিয় (Active)। দৃষ্টির ক্ষেত্রে বস্তুগুলো হল প্রত্যক্ষগোচর আকার, চক্ষু আকারের গ্রাহক। কিন্তু আলো ছাড়া প্রত্যক্ষগোচর আকারগুলো প্রত্যক্ষিত হয় না বলে আলো হল প্রয়োজনীয় সাহায্যকারী অবস্থা বা প্রাক শর্ত। বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রেও বস্তু হল বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার, তাদের অনুধাবন করে নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি। কিন্তু এখানেও একটি তৃতীয় বিষয় হিসেবে সক্রিয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োজন, যা ছাড়া বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারগুলো জ্ঞাত হবে না। বাস্তবে চিন্তা না করলেও মনের চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। মনে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকা চিন্তা করার এ শক্তিকে নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি বলে। এক্ষেত্রে মন হল এক টুকরো পালিশ করা মােম, যার ছাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে কিন্তু যে এখনও পর্যন্ত ছাপ গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে বাস্তব চিন্তনের ক্রিয়াই হল সক্রিয় বিচারবুদ্ধি। নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি হল বিনাশশীল। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি নিত্য এবং অবিনশ্বর। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে এর বিনাশ ঘটে না। এর আদি-অন্ত নেই। বাইরে থেকে এটা দেহে আসে এবং মৃত্যুর পর দেহ থেকে বহির্গত হয়ে যায়। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারগুলোকে বাস্তবায়িত বা ব্যক্ত করে তোলে। যার মধ্যে বুদ্ধিগ্রাহ্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে তাকে বাস্তবে বৃদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলা হল এর কাজ। এরিস্টোটলের সক্রিয় বিচারবুদ্ধির ধারণা নিয়ে ভাষ্যকারদের মত মতভেদ আছে। অধিবিদ্যায় ঈশ্বর বা অপ্রবর্তিত প্রবর্তককে বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞা হিসেবে অভিহিত করাতে কেউ কেউ মনে করেন যে সক্রিয় বিচারবুদ্ধি মানবীয় নয়, ঐশ্বরিক। এদিকে সক্রিয় বিচারবুদ্ধিকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলে ঈশ্বর মানুষের অন্তর্বর্তী হন, যেখানে এরিস্টোটলের অপ্রবর্তিত প্রবর্তক জগৎ-অতিবর্তী সত্তা। ফলে অসঙ্গতির সৃষ্টি হওয়ায় অনেকে বলেন সক্রিয় বিচারবুদ্ধি প্রতিটি ব্যক্তিমানুষে বর্তমান। সক্রিয় বিচারবুদ্ধিকে মানুষের থেকে স্বতন্ত্র করা যায় বলে এটা ব্যক্তি মানুষের মধ্যে অস্তিত্বশীল হতে পারে। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি নিষ্ক্রিয় নয় এবং নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি বিনাশশীল বলে ব্যক্তি হিসেবে মানুষ সক্রিয় বিচারবুদ্ধির অংশীদার। আবার কেউ কেউ বলেন, এ দুই অভিমতের মধ্যে যথার্থ কোন বিরোধিতা নেই। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি সুনিশ্চিতভাবে নৈর্ব্যক্তিক এ অর্থে যে, এটি ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয়। আর সক্রিয় বিচারবুদ্ধি অজড়াত্মক বলে তা ব্যক্তির মধ্যে না বাইরে অবস্থিত সেই প্রশ্ন অবান্তর। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি অবিনাশশীল বলা হলে এটা বুঝতে হবে যে এখানে ব্যক্তিগত অমরত্বের প্রশ্ন ওঠে না।

পদার্থতত্ত্ব ও প্রকৃতিবিজ্ঞান

  • প্রকৃতির মধ্যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ বর্তমান থাকলেও, প্রকৃতি তার উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন অথবা জগৎবহির্ভূত কোন অস্তিত্বশীল চেতনা জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এমন সিদ্ধান্ত করা যায়না, কারণ ঈশ্বর কোন অস্তিত্বশীল চেতন ব্যক্তি নন আর প্রকৃতির পক্ষে নিজ উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া সম্ভব নয়। এ পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই হল একমাত্র সত্তা যে তার লক্ষ সম্পর্কে সচেতন। মনুষ্যেতর প্রাণী বুদ্ধিসম্মতভাবে ক্রিয়া করলেও আসলে তারা সহজাত প্রবৃত্তিবশতই তাদের লক্ষ্যকে লাভ করে। অজীব জড় এর অনেক গতিই উদ্দেশ্যমূলক, কিন্তু কোনমতেই সেগুলোকে সচেতন ক্রিয়া বলা যেতে পারে না। প্রকৃতি বুদ্ধিসম্মত ক্রিয়া সম্পাদন করলেও সেই ক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন নয়। উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধ হয়ে এবং সহজাতভাবেই প্রকৃতি ক্রিয়া করে চলে।
  • প্রকৃতির এ প্রক্রিয়ায় সব সময় আকার সম্মুখে চালিত করে। উপাদান বিলম্বিত করায় বাধা প্রদান করে। সমগ্র জগৎ প্রক্রিয়া হল আকারের উপাদানকে গঠন করার প্রচেষ্টা। কিন্তু উপাদানের মধ্যেই যেহেতু প্রতিরোধের ক্ষমতা নিহিত, জগৎ প্রক্রিয়ার কাজে বাধা দেখা দেয়। তাই আকার উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে না, কারণ উপাদানের ক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করে যাওয়া আকারের পক্ষে সম্ভব হয়। তাই উপাদানও সম্পূর্ণভাবে কখনও আকারে রূপ লাভ করে না। বিশ্বজগতে এজন্যই অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তাই স্বাভাবিক অবস্থা হলো আকার তার নিজ উদ্দেশ্যকে লাভ করার জন্য উপাদানের ওপরে কর্তৃত্ব করে।
  • যে সব বস্তু জড়াত্মক এবং গতির অধীন সেই সব বস্তুর সমগ্রতাই হল প্রকৃতি। প্রকৃতি হলো সেই সব বস্তু যারা পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে এবং তাদের একটা লক্ষে উপনীত করতে পারে, তাদের মধ্যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিহিত। একটা শয্যা নিজে নিজে গতিশীল হতে পারে না। শয্যা-বহির্ভূত কোন বাহ্য-কৰ্তাই তাকে গতিশীল করে। অর্থাৎ প্রাণহীন জড়বস্তুকে গতিশীল করার পিছনে থাকে সেই বস্তু বহির্ভূত কোন বাহ্য কর্তার ক্রিয়া। অজীব বস্তুর মধ্যে গতিশীল হবার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু গতি সংগঠিত করার সম্ভাবনা নেই।
  • সাধারণভাবে গতি হল প্রতিটি পরিবর্তন, যে কোন সম্ভাব্য পরিবর্তনের বাস্তব রূপায়ন বা অব্যক্ত শক্তির ব্যক্ত হওয়া। গতি হল উপাদানের আকারে উত্তরণ। গতি চার প্রকার – (১) দ্রব্যগত (Substantial)-এ গতি কোন বস্তুর দ্রব্যকে প্রভাবিত করে, এ হল উৎপত্তি এবং তিরোভাব। (২) পরিমাণগত—দ্রব্যের বৃদ্ধি এবং হাস; (৩) গুণগত—একটি দ্রব্যের অন্য দ্রব্যতে রূপান্তর এবং (৪) স্থানীয় গতি অর্থাৎ স্থান পরিবর্তন। প্রথম ধরনের গতি ব্যাপক অর্থে গতি এবং শেষের তিন ধরনের গতি সংকীর্ণ অর্থে গতি। অন্য সব ধরনের গতি স্থানীয় গতির দ্বারা নির্ধারিত হয়।
  • সব ধরনের গতির জন্যই দেশ (Space) এবং কালকে (Time) পূর্ব থেকে স্বীকার করে নিতে হয়। দুটি বিষয় দেশের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, প্রথমত, স্থানান্তরকরণ; দেশ আছে বলেই বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্ষিতি, অপ, তেজঃ ও মরুৎ-এই ভূতগুলো নিজ নিজ স্থানে অবস্থিতি। দেশ না থাকলে এ চারটি ভূতের অস্তিত্ব সম্ভব হতো না। দেশ শূন্যতা (Void) নয়, কারণ শূন্য দেশ সম্ভব নয়। তাই পিথাগোরাস ও প্লেটো যেমন ভূতকে জ্যামিতিক ক্ষেত্রের দ্বারা গঠিত বলেন তা ভুল। যন্ত্রবাদীদের প্রকল্প,-সব গুণের ভিত্তি পরিমাণ – এটিও ভুল, গুণের নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। দেশ কোন ভৌতিক বস্তু হলে একই সময়ে একই স্থানে যখন বস্তু ও দেশ উভয়ই প্রত্যক্ষিত সেক্ষেত্রে বলতে হতো সেই স্থানে দুটি বস্তু আছে যা অবাস্তব, তাই দেশ হলো কোন বস্তুর সীমা (Limit), যার দ্বারা বস্তুটি সীমিত হয়ে থাকে। তাই দেশ অসীমও নয়। এজন্য শূন্য দেশের বা বিশ্বজগতের বাইরে কোন দেশ থাকতে পারেনা। আধার ও দেশ এর পার্থক্য আছে। গতিশীল নদী নৌকার আধার, কিন্তু নদীর অগতিশীল সীমা হলো দেশ যেখানে নৌকা রয়েছে। তাই দেশ হলো আধারের (container) অগতিশীল সীমা (unmoved limit of the container)। তাই বিশ্বজগতের সব কিছু দেশে রয়েছে, কিন্তু বিশ্বজগতে কোন দেশ নেই। তাই গতি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া বোঝায় এবং তা দেশেই সম্ভব বলে বিশ্বের সম্মুখ গতির কথা বলা যায় না। বিশ্বজগতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন গতির কথা বলা যেতে পারে কিন্তু বিশ্বের বহির্গতির কথা বলা যায় না।
  • গতির পরিমাপ হল কাল, তাই কাল তার অস্তিত্বের জন্য গতির ওপর নির্ভরশীল। এ বিশ্বজগতে পরিবর্তন ঘটে বলে কালের প্রসঙ্গ আসে। কাল গতির গণনা বা পরিমাপ বলে গণনা মনের ওপর নির্ভরশীল। গণনা করার জন্য কোন মনের অস্তিত্ব না থাকলে কালের গণনা অপ্রাসঙ্গিক হতো। অনন্তকাল ধরে মানুষ ও প্রাণী অস্তিত্বশীল, কাল মনের ওপর নির্ভর না করেও অস্তিত্বশীল। কালের বিভিন্ন অংশগুলোর পরিমাপ মনের দ্বারাই হয়ে থাকে, কিন্তু তা বলে মনবহির্ভূত কোন অস্তিত্ব তাদের নেই – এমন কথা বলা যেতে পারে না।
  • কাল গতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে অভিন্ন নয়, কারণ গতি অনেক প্রকার, কিন্তু কাল এক। কাল গতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। কাল গতির মত অবিচ্ছিন্ন। কাল বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের দ্বারা গঠিত নয়। যেসব বস্তু গতিশীল বা যাদের মধ্যে গতির সম্ভাবনা রয়েছে তারাই কালে থাকে। যা নিত্য এবং গতির সম্ভাবনা যাতে নেই তা কালে থাকে না। গতি নিত্য কিন্তু স্থির না হওয়ার জন্য কালে থাকে। কালও নিত্য কারণ কালের শুরু বা শেষ নেই।
  • কাল পরিমাপ করতে হলে, আমাদের কাল পরিমাপের একটা মানদণ্ডের (Standard) প্রয়োজন। যে গতি স্বাভাবিক এবং একরূপ তাই কাল পরিমাপের মানদণ্ড গণ্য হতে পারে। স্থান সম্পর্কীয় গতির মধ্যে বিশেষ করে বৃত্তাকার গতি (Circular Motion) হল স্বাভাবিক ও একরূপ গতি যার প্রারম্ভ বা শেষ নেই। তাই কাল পরিমাপের মানদণ্ড হতে পারে সূর্যের গতির ভিত্তিতে কাল পরিমাপই কাল পরিমাপের যথাযথ ভিত্তি।
  • অসীম বস্তু সম্ভব নয়, কেননা প্রতিটি বস্তুই সীমিত। কোন বস্তুর অবস্থানের কথা ভাবতে গেলে ‘উপর নিচ’ এ জাতীয় অবস্থানের কথা চিন্তা করতে হয়। কোন অসীম বস্তর ক্ষেত্রে এ জাতীয় অবস্থানের কথা ভাবা যেতে পারে না। কোন অসীম সংখ্যারও অস্তিত্ব নেই কারণ সংখ্যা গণনা করা যায় এবং অসীম সংখ্যা গণনা করা যায় না।
  • অব্যক্তরূপে বা সম্ভাবনা রূপে অসীম অস্তিত্বশীল, বাস্তবে নয়। অর্থাৎ দৈশিক বিস্তৃতি বাস্তবে অসীম নয়, তবে অসীম ভাগে বিভাজ্য। একটি সরলরেখা বাস্তবে অস্তিত্বশীল অসীম সংখ্যক বিন্দুর একত্র সমাবেশ নয়, কিন্তু অসীম ভাগে বিভাজ্য হওয়ার সম্ভাবনা তার মধ্যে নিহিত। অর্থাৎ অসীম ভাগে বিভাজ্য হবার অবস্থাটি তার মধ্যে অব্যক্তভাবে বর্তমান। এভাবে জেনোর দেশ-কালের অসীম বিভাজ্যতাকে কেন্দ্র করে যে হেঁয়ালির সমাধান হতে পারে। (জেনোর বিপরীতে)
  • কালও বাস্তবে অস্তিত্বশীল অসীম নয়, কিন্তু অসীমতা কালের মধ্যে অব্যক্ত। কাল আনুক্রমিক আধার, এর অংশগুলো কখনও একসঙ্গে অবস্থান করে না। কিন্তু কাল অব্যক্তভাবে অসীম, কারণ অনন্তকাল ধরে কালের সঙ্গে কাল যোগ করা যেতে পারে। সংখ্যা কালের মত অব্যক্তভাবে অসীম, কারণ সংখ্যার যোগ অনন্তকাল ধরে চলতে পারে। কিন্তু দেশ ও কালের সঙ্গে সংখ্যার পার্থক্য হল সংখ্যা অসীম ভাগে বিভাজ্য নয়, কারণ সংখ্যার একটা নিম্নতম একক আছে।
  • সব স্বাভাবিক গতিই উদ্দেশ্যমূলক। এ উদ্দেশ্য হল অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া উপাদানের আকারে রূপান্তরিত হওয়া। যা নিম্ন তা উচ্চতরে বিবর্তিত বা বিকশিত হয়। এটি কালগত ক্রমবিকাশ বা কালগত প্রক্রিয়া নয়, এটি যৌক্তিক (Logical) প্রক্রিয়া। তাই এক্ষেত্রে ক্রমবিকাশ হল যৌক্তিক ক্রমবিকাশ, কারণ নিম্নতর অবস্থার মধ্যেই উচ্চতর অবস্থা অব্যক্তভাবে বিদ্যমান। আবার যা উচ্চতর তার মধ্যে নিম্নতর বাস্তব দিক থেকে বিদ্যমান। নিম্নতর অবস্থার মধ্যে যে আকার (Form) থাকে তা উচ্চতর অবস্থার মধ্যে নিজেকে উপলদ্ধি করে। নিম্নতর অবস্থা উচ্চতর অবস্থার ভিত্তিস্বরূপ, উচ্চতর হল আকার, নিম্নতর হল যার উপাদান। তাই সমগ্র জগৎ প্রক্রিয়া, কোন কালিক প্রক্রিয়া নয়। এক পরম তত্ত্ব, ঈশ্বর, বুদ্ধি, সর্বনিরপেক্ষ আকার, ক্রমবিকাশের প্রতিটি ক্রমেই অনন্তকাল ধরে নিজেকেই প্রকাশ করে চলেছে। কোন বস্তুর আকার হল তার সংগঠন (Organization), কাজেই ক্ৰমের উচ্চস্তরে অবস্থিত হওয়ার অর্থ হল অধিকতর সংগঠিত হওয়া। তাই ক্রমের সর্বনিম্ন রয়েছে প্রাণহীন উপাদান (Inorganic Matter) যার উদ্দেশ্য হচ্ছে তার অতিবর্তী। প্রাণহীন উপাদানের দৈশিক গতি ছাড়া কোন কাজ নেই, সপ্রাণ উপাদানের রয়েছে বৃদ্ধি। এ বৃদ্ধির অর্থ হল, যা অন্তর্নিহিত, তাকে বাহ্যত প্রকট করে তোলা, যা অব্যক্ত তাকে ব্যক্ত করে তোলা। প্রাণহীন উপাদানের স্তরে সপ্রাণ উপাদানের (Organic Matter) লক্ষ তার অন্তর্বর্তী। সপ্রাণ উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্তরে হল উদ্ভিদ, তার উপরের স্তরে প্রাণী, তার উপরের স্তরে মানুষ। সপ্রাণ উপাদানের ক্ষেত্রে আকারের সূত্রটি বাস্তব এবং সুনির্দিষ্ট, কারণ সেটি তার অভ্যন্তরীণ সংগঠন। এ অভ্যন্তরীণ সংগঠন হল সপ্রাণ উপাদানের প্রাণ, যা হলো আত্মা। মানুষের আত্মা তার দেহের সংগঠন। তাই আকারের সঙ্গে উপাদানের যে সম্পর্ক দেহের সঙ্গে আত্মার সেই সম্পর্ক, সপ্রাণ উপাদানের ক্ষেত্রেই আমরা সজীব আত্মার ধারণাতে উপনীত হই, কিন্তু এ সজীব আত্মার ক্ষেত্রে সত্তার উচ্চতর এবং নিম্নতর ক্রম বর্তমান। উচ্চতর সত্তার ক্ষেত্রে আকারের সূত্র বা তত্ত্বটির অধিকতর মাত্রায় রূপায়ণের বিষয়টি নিহিত রয়েছে। প্রাণী বা সজীব উপাদান নিজেকে উপলব্ধি করতে চায় এবং এ আত্মোপলদ্ধির বিষয়টির প্রকাশ ঘটে নিজের আত্মরক্ষার ও প্রজাতির আত্মরক্ষার মধ্য দিয়ে। তাই সপ্রাণ উপাদানের সর্বনিম্ন স্তরে সেইসব প্রাণ উপাদান যার একমাত্র কাজ হল নিজেদের পুষ্টি বিধান, বুদ্ধি এবং বংশবৃদ্ধি, এরাই হল উদ্ভিদ। উদ্ভিদের রয়েছে পুষ্টিসাধক আত্মা (Nutritive Soul), সত্তার ক্রমে উদ্ভিদের পরে আসে প্রাণী যেহেতু সত্তার ক্রমে, যা উচ্চতর তা নিম্নতরকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। প্রাণীদের উদ্ভিদের মতই রয়েছে পুষ্টিবিধানের এবং বংশবৃদ্ধির ক্রিয়া, কিন্তু প্রাণীরা উদ্ভিদের থেকে শ্রেষ্ঠ, কারণ প্রাণীদের সংবেদনশীল আত্মা রয়েছে, এই সংবেদন সুখকর বা অসুখকর হতে পারে। উদ্ভিদের পক্ষে সংবেদনের কোন প্রয়োজন নেই, কেননা তারা নিজে নিজে পুষ্ট হয়, এজন্য তাদের গতিশীল হতে হয়না। কিন্তু গতিশীল প্রাণীদের সংবেদন একান্ত প্রয়োজন, কারণ তারা সুখ-দুঃখের প্রতি সংবেদনশীল। সত্তার ক্রমে প্রাণীর পরে আসে মানুষ। মানুষের ক্ষেত্রে পুষ্টিবিধানের, গতিশীল হবার, বংশবৃদ্ধি করার, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অর্থাৎ নিম্নতর সত্তার সব বৈশিষ্ট্যই বর্তমান, কিন্তু এ ছাড়াও রয়েছে মানুষের মধ্যে বিচারবুদ্ধি, কাজেই আত্মা হল পুষ্টিসাধক, সংবেদনশীল এবং বৌদ্ধিক (Rational)। মানুষের মধ্যে বিশ্ব ধীশক্তি তার যথাযথ আকারে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সত্তার ক্রম হচ্ছে প্রথমে প্রাণহীন উপাদান, তারপর উদ্ভিদ, তারপর প্রাণী এবং তারপর মানুষ।
  • বিশ্ব দুটি লোকে বিভক্ত – অতি চান্দ্রলোক (The Superlunary) এবং অধঃচান্দ্রলোক (The Sublunary)। অতি চান্দ্রলোক অবিনশ্বর নক্ষত্রের অবস্থান। স্থানীয় গতি ভিন্ন অন্য কোন গতি নক্ষত্রের নেই, যে গতি হল বৃত্তাকার। ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরুৎ—এ চারটি উপাদান থেকে পৃথক এবং তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ অপর একটি উপাদান ব্যোম (Ether) দ্বারা নক্ষত্রগুলো গঠিত।
  • পৃথিবী বর্তুলাকার। বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থলে পৃথিবী স্থির হয়ে বর্তমান। চতুর্দিকে জল, বাতাস ও আগুনের বিভিন্ন স্তর। এগুলোকে অতিক্রম করে যেতে হবে স্বর্গলোকে (Heavenly Sphere)। স্বর্গলোকের বহির্ভাগ হল স্থির নক্ষত্রের লোক, যা আদি প্রবর্তক থেকেই তার গতি লাভ করে। স্বর্গলোকের যে বস্তু (Heavenly Bodies), তাদের ছাপান্নটি লোক আছে। নক্ষত্রগুলো গ্রহের বাইরে অবস্থিত।
  • সত্তার ক্রমে সর্বোচ্চ স্তরে মানুষ অবস্থিত নয়। মানুষের পরে আসছে স্বর্গলোকের বস্তু। অর্থাৎ গ্রহাদি, সূর্য, চন্দ্র যার অন্তর্ভুক্ত, যারা পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে। তারপর আসছে নক্ষত্র। নক্ষত্র এবং গ্রহ হল ঐশ্বরিক সত্তা। মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন বা প্রজ্ঞাবান হওয়াতে ঐশ্বরিক, কিন্তু স্বর্গলোকের বস্তুরা আরও বেশি ঐশ্বরিক। তারা মানুষের তুলনায় আরও অধিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সেহেতু সত্তার ক্রমে আরও উচ্চতর স্তরে অবস্থিত। এরা হল অনন্ত এবং অবিনশ্বর। কারণ অনন্ত ধী-শক্তির পরম উপলব্ধি তাদের মধ্যে ঘটেছে।
  • নক্ষত্রের পরে আসে সর্বশেষ স্তর উপাদানহীন আকারে, যা হল সর্বনিরপেক্ষ বা পরম আকার বা ঈশ্বর। আকারহীন উপাদান এবং উপাদানহীন আকার কোন অস্তিত্বশীল বস্তু নয় বলে ঈশ্বর দেশ-কালের জগতে অবস্থিত নয়, সবচেয়ে বাইরের লোকের (Outermost Sphere) বাইরে ঈশ্বর অবস্থিত। তাই ঈশ্বর দেশে অবস্থিত নয়। সব দেশ এবং কাল এ বিশ্বজগতের মধ্যে বলে দেশ সীমিত। ঈশ্বর পরম সত্তা বলে সবচেয়ে বাইরের লোকের বাইরে তিনি অবস্থিত হবেন।
  • বিবর্তন হলো উপাদানের আকারের দিকে গতি। যা বস্তুতে সুনির্দিষ্টতা আরোপ করে তাই আকার। উপাদান হল অনির্দিষ্ট আধার। আকার তাকে সুনির্দিষ্টতা দান করে। উচ্চতর সত্তার মধ্যে অধিকতর আকার থাকার জন্য তা অধিকতর সুনির্দিষ্ট। তাই উপাদান হল সম-সাত্ত্বিক এবং আকার হল বিষমসাত্ত্বিক। আকারই সদৃশ অবস্থায় বিসদৃশ অবস্থা প্রবর্তন করে। সুসংবদ্ধ অবস্থাই হল সংগঠন।

নীতিশাস্ত্র

  • প্রমাণ এবং সুনিশ্চয়তা গণিতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে উপযোগী হলেও নীতিশাস্ত্র এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুপযোগী। তাই নীতিশাস্ত্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান যথার্থ বিজ্ঞান নয়। এগুলোতে যতখানি সুনির্দিষ্টতা লাভ করা সম্ভব ততখানি সুনির্দিষ্টতা লাভ করতে হবে। তাই নৈতিকতা প্রথাগত (Conventional), যদিও উচিত এবং অনুচিত-এর পার্থক্য প্রথাগত নয় এবং তাদের প্রমাণের বিষয় করা যেতে পারেনা। উচিত এবং অনুচিতের পার্থক্য স্বাভাবিক (Natural) পার্থক্য। তবে নীতিশাস্ত্র চিকিৎসাশাস্ত্রের মত বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি নিয়ে আলোচনা করে। ব্যাধি সম্পর্কে যেমন সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, নৈতিক প্রশ্ন সম্পর্কেও করা যায়। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাকে বাতিল করা যেতে পারে না। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • সাধারণ মানুষের নৈতিক সততা অর্জনের ক্ষমতা আছে। সামগ্রিকভাবে নৈতিক প্রশ্নের বিচার করার সময় সাধারণ মানুষের অভিমতকে অগ্রাহ্য করাও সমর্থনযোগ্য নয়। নৈতিকতা অর্থাৎ সুখ ও সততা সম্পর্কে সত্য আবিষ্কারের জন্য লৌকিক ধারণা ও সাধারণ স্বীকৃত অভিমতের বিচারের প্রয়োজন আছে, তাই এগুলো পরীক্ষণ বা বিচারকার্য দিয়েই নৈতিক অনুসন্ধান শুরু হওয়া উচিত। আমাদের জ্ঞাত বিষয় নিয়ে আমাদের নৈতিক অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। এই কথার দুটো অর্থ হতে পারে – যা আমাদের জানা আছে আর যাকে পরিপূর্ণভাবে আমরা জেনেছি এবং যে বিশেষ বা আমাদের সংবেদনের কাছাকাছি তাকেই আমরা ভাল করে জানি। নৈতিক অনুসন্ধানকার্য প্রথমটি নিয়েই শুরু হবে।  (প্লেটোর বিপরীতে)
  • অভিজ্ঞতায় যা এলোমেলোভাবে দেওয়া আছে তাকে গ্রহণ করে, যুক্তির সাহায্যে, নীতি সম্পর্কিত বচন প্রতিষ্ঠা করার আরোহ পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের যথার্থ পদ্ধতি।
  • মানুষের প্রতিটি কাজের, প্রতিটি অনুসন্ধান ক্রিয়ার, প্রতিটি নির্বাচনের লক্ষ হল কল্যাণ লাভ করা, তাই মানুষের পরম কল্যাণ নীতিশাত্রের আলোচ্য বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানও মানুষের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করে। রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির কল্যাণ অভিন্ন। তবে ব্যক্তির কল্যাণের তুলনায় রাষ্ট্রের কল্যাণ ব্যাপকতর এবং মহত্তর। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • কল্যাণ হল তাই, যার দিকে সকল কিছুর লক্ষ। সুতরাং উদ্দেশ্যের ভিন্নতা অনুসারে কল্যাণও হয়ে পড়ে বহু ধরনের। যেমন চিকিৎসকের লক্ষ হল রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষা, এখানে স্বাস্থ্য রক্ষা চিকিৎসকের কল্যাণ। নাবিকের লক্ষ নিরাপদ সমুদ্রযাত্রা, এটা নাবিকের কল্যাণ, ব্যবসায়ীর লক্ষ অর্থ লাভ, এটা ব্যাবসায়ীর কল্যাণ। কোন কোন কল্যাণ ব্যাপকতর কোন কল্যাণের অধীনস্থ হতে পারে। যেমন, কোন ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য অর্থ লাভ, কিন্তু এই অর্থের সাহায্যে জীবনে সুখপ্রদ বস্তু আহরণ হলো তার ব্যাপকতর কল্যাণ, অর্থাৎ অর্থ লাভের কল্যাণ সুখ লাভের কল্যাণের অন্তর্গত। একইভাবে স্বাস্থ্য, শক্তি, খ্যাতি ইত্যাদি কল্যাণ বৃহত্তর সুখ লাভের কল্যাণের অধীনস্ত।
  • এই কল্যাণগুলো সুখ সহ বিশেষ কোন লাভের জন্য কামনা করা হচ্ছে, কল্যাণকে কল্যাণের জনই কামনা করা হয়না, অন্যান্য লাভের জন্য কামনা করা হয়, যার ফলে কল্যাণ হয়ে যায় সাপেক্ষ। তাই তা পরম কল্যাণ নয়।
  • পরম কল্যাণ কেবল সেই কাজে হয় যার অন্য কোন লক্ষ্য থাকেনা, সেই কাজ কেবল সেই কাজের জন্যই করা হয়, অর্থাৎ কাজটা করাই হয় কাজটা করার লক্ষ্য। এভাবে কাজের জন্যই কাজ করার লক্ষ্যটাই হলো পরম কল্যাণ। এটি অন্য কোন কাজের ওপর নির্ভর করবে না, এখানে কাজ যা লক্ষ্যও তা।
  • পরম কল্যাণ মানুষের চরম অভীষ্ট বা লক্ষ, এটিই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু, এটিই হলো আনন্দ।
  • আনন্দকে সুখ, খ্যাতি ইত্যাদি দাবি করে মতভেদ দেখা যায়। ব্যক্তি পীড়িত হলে স্বাস্থ্য আনন্দ, অভাবগ্রস্ত হলে অর্থ আনন্দ। কিন্তু এসব দাবি ভ্রান্ত।
  • আনন্দ নিজস্ব বিষয়, তাই খ্যাতি অন্যের থেকে লাভ করতে হয় বলে এটি এটি আনন্দ নয়।
  • আনন্দ বিচারবুদ্ধি-ভিত্তিক, সংবেদনভিত্তিক নয়, তাই ইন্দ্রিয়সুখ আনন্দ নয়। অ-মানব প্রাণীদের বিচারবুদ্ধি থাকেনা, কেবল সংবেদন থাকে, তাই তাদের আনন্দ সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়সুখ তাই মানুষের পরম কাম্য-বস্তুও হতে পারেনা।
  • আনন্দ সক্রিয়তা এবং দুঃখের বিনাশক, তাই নৈতিক সততা (Moral Virtue) আনন্দ নয়, কারণ নৈতিক সততার সঙ্গে নিষ্ক্রিয়তা এবং দুঃখ জড়িত থাকতে পারে। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • প্রতিটি জীবের কল্যাণ হল তার বিশেষ ক্রিয়ার যথাযথ সম্পাদন। কোন ভাস্করের কল্যাণ সেই ভাস্করের ভাষ্কর্য তৈরির কার্য সম্পাদনে নিহিত। সামগ্রিকভাবে মানুষের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। মানুষের ক্রিয়া হলো তার এমন ক্রিয়া যার দ্বারা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র করে দেখা যায়। সেই ক্রিয়া হল বিচারবুদ্ধির ক্রিয়া বা বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী ক্রিয়া। কিন্তু এই ক্রিয়াকে সৎ ক্রিয়া (Virtuous Activity) হতে হবে, অর্থাৎ সততার সাথে করতে হবে। অর্থাৎ সততা ও ক্রিয়া – দুইয়ে মিলে হয় কল্যাণ, আর সেই কল্যাণ বা ক্রিয়ার উদ্দেশ্য কেবল সেই ক্রিয়াই হলে তা হয় পরম কল্যাণ ও আনন্দ। তাই পরম কল্যাণ বা আনন্দও ক্রিয়া ও সততা মিলেই হয়।
  • আনন্দ মনের অবস্থা নয়, এটি হলো ক্রিয়া।
  • আনন্দের জীবন সুখের জীবন। আনন্দ হল সবচেয়ে ভাল, সবচেয়ে মহৎ এবং সবচেয়ে সুখের বিষয়। আনন্দের জীবন হল স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সততা ও সুখ উভয়ই এর অন্তর্গত।
  • শিশু ও নিম্নতর প্রাণীরা সততা অনুযায়ী ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না, তাই তারা আনন্দ লাভ করতে পারেনা।
  • মৃত্যুর মুখে পতিত হলে মানুষ আনন্দ লাভ করে – এই গ্রীক ধারণা বর্জনীয়, কেননা মৃত্যুর পর ক্রিয়া থাকেনা।
  • কেবল সততা থাকলেই আনন্দ হয়না, কারণ এটিও সম্ভব হতে পারে যে কোন সৎ ব্যক্তি তার সমস্ত জীবনটা ঘুমিয়ে বা আলস্যে কাটাল বা তাকে খুব দুঃখকষ্ট ভােগ করতে হল। এমন লোক সুখী হতে পারেনা।
  • কোন লোক সারা জীবনটা বিছানাতেই শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেয় এবং কখনও কোন সৎ কাজ না করে তবে তাকে সৎ ব্যক্তি বলা যাবেনা। তাই সততা হচ্ছে বিশেষ ক্রিয়া বা পেশা।
  • আনন্দ ও সততা উভয়ের মধ্যেই ক্রিয়া থাকে, কিন্তু দুই এর পার্থক্য হলো দুঃখ নিয়েও ব্যক্তি সৎ থাকতে পারে, কিন্তু দুঃখ নিয়ে ব্যক্তি আনন্দিত থাকতে পারেনা। আনন্দের জন্য সততার সাথে দুঃখের অভাবও প্রয়োজন।
  • তাই আনন্দের জন্য ক্রিয়া, সততা ও দুঃখাভাব দরকারী। কিন্তু সততাতেই ক্রিয়া থাকে। তাহলে বলা যায়, আনন্দের জন্য সততা ও দুঃখাভাব দরকারী।
  • মানুষ শুধুমাত্র বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব নয়, উদ্ভিদের মত তার ক্ষুধা আছে, প্রাণীদের মত সংবেদন আছে। ক্ষুধা, কামনা, আবেগের মত রিপুগুলো তার প্রকৃতির অংশ, তাই সততা দুই প্রকার – বুদ্ধিগত সততা ও নৈতিক সততা। বুদ্ধিগত সততা হল বিচারবুদ্ধির জীবন অর্থাৎ চিন্তার বা দর্শনের জীবন যাপন করা। বুদ্ধিগত সততা হলো ‘Dianoetic’। নৈতিক সততা হল আবেগ, কামনাবাসনাকে বিচারবুদ্ধির অধীনস্থ করা। বুদ্ধিগত সততাই হল শ্রেষ্ঠ সততা।
  • বাহ্য কল্যাণ সততার অনুসন্ধানে বা সততার অধিকারী হবার জন্য মানুষকে সাহায্য করে। দারিদ্র্য, ব্যাধি, দুর্ভাগ্য মানুষের সৎ হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাই বাহ্য কল্যাণ, কল্যাণ লাভের উপায়; তাই তাদের বর্জন করার প্রশ্ন ওঠে না। অর্থাৎ বন্ধু, সৌভাগ্য এসব আনন্দ নয় কিন্তু তারা আনন্দের অভাবাত্মক (Negative) শর্ত, অর্থাৎ এদের বাদ দিয়ে আনন্দ লাভ করা কঠিন, এরা থাকলে আনন্দ লাভ সহজতর হয়।
  • বন্ধুত্ব একটি সৎ গুণ এবং কল্যাণ ও আনন্দের অভাবাত্মক প্রাকশর্ত। বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে ভালবাসে। বন্ধুকে অর্থ দান করে বা খ্যাতির অধিকারী করে ব্যক্তি মহত্ত্ব লাভ করে ও এর মাধ্যমে সে নিজেকে ভালোবাসতে পারে। বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক নিজের সঙ্গে সম্পর্কের মতো, কারণ বন্ধু হল নিজ আত্মারই দ্বিতীয় রূপ, এখানে নিজের আত্মার বিস্তৃতি ঘটে যাতে বন্ধুরাও নিজের আত্মার অংশ হয়ে ওঠে, বন্ধুর সুখ, দুঃখ, জয়, পরাজয় নিজের বলে মনে হয়। ভালবাসা পাওয়ার থেকে ভালবাসা দেয়াতেই বন্ধুত্ব নিহিত। সৎ ব্যক্তির মধ্যেই নিখুঁত বন্ধুত্ব সম্ভব। নিজের থেকে উচ্চতর অবস্থায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়, কারণ যদি তিনি উচ্চতর সততার অধিকারী না হন, তাহলে তাকে যে শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে তার সমর্থন খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্রের মত অসম সম্বন্ধের ক্ষেত্রে পদমর্যাদায় যিনি উচ্চতর তাকেই বেশি ভালবাসা উচিত, তাই ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব নয় যেহেতু ঈশ্বর আমাদের ভালবাসতে পারেনা। ব্যক্তি সৎ হলেই কেবল নিজে নিজের বন্ধু হতে পারে, কারণ দুষ্ট ব্যক্তি প্রায়ই নিজেকে ঘৃণা করে। সৎ ব্যক্তির নিজেকে ভালবাসা উচিত, তবে তিনি মহৎভাবে নিজেকে ভালবাসবেন। বন্ধুরা দুর্ভাগ্যের সময় সান্ত্বনাস্বরূপ। বন্ধু সকল অবস্থাতেই কাম্য, শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যের সময় নয়, কেননা সুখী মানুষ বন্ধু কামনা করে যাতে সে তার সুখ, বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। বন্ধুত্ব তিন প্রকার – (১) প্রয়োজনভিত্তিক বন্ধুত্ব (বন্ধুত্বের উদ্দেশ্য প্রয়োজনসিদ্ধি, এ ধরনের বন্ধুত্ব মানুষের জন্য অনিবার্য, কারণ আর্থিক দিক থেকে মানুষ স্ব-নির্ভর নয়) (২) সুখ লাভের জন্য বন্ধুত্ব (মানুষ সমাজে অপরের সঙ্গ কামনা করে তার ভিত্তিতে এটি তৈরি হয়)। এই দুই শ্রেণীর বন্ধুত্বই স্বল্পস্থায়ী, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বা সুখলাভের ইচ্ছা যখন ক্ষীণ গেলে বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যায়। (৩) সৎ লোকের বন্ধুত্ব – এ জাতীয় বন্ধুত্বই শ্রেষ্ঠ এবং স্থায়ী হয়। বন্ধুত্ব অনুভূতি নয়, বরং একটা মানসিক অভ্যাস যা অনুশীলনের দ্বারা আয়ত্ত হয়।
  • আনন্দ আত্মার ক্রিয়া বলে তা দৈব-নির্ভর নয়, বরং মানুষের প্রচেষ্টা-নির্ভর, কিন্তু আনন্দের বা আনন্দ লাভের প্রাকশর্ত হিসেবে কোন কোন বাহ্য কল্যাণ দৈব-নির্ভর হতে পারে, যেমন কোন ব্যক্তি কিরকম বন্ধুত্ব লাভ করবে তা দৈব হতে পারে।
  • আনন্দ দার্শনিক মনন (Philosophic Contemplation)-এর সঙ্গে অভিন্ন।
  • সৎ চরিত্র লাভের শক্তি আমাদের মধ্যে নিহিত থাকে কিন্তু অভ্যাস বা অনুশীলনের দ্বারা তাকে বিকশিত করে তুলতে হবে। সৎ কার্য সম্পাদনের দ্বারাই সৎ চরিত্র লাভের শক্তিকে বিকশিত করে তুলতে হবে। সৎ কর্মসম্পাদন করে সৎ হওয়া যায় কিন্তু মানুষ সৎ না হলে সৎ কর্মের অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আমরা সৎকার্যকে সৎকার্য বলে না জেনে, বা সেভাবে তাদের নির্বাচিত না করে, সম্পাদন করি। পরে এই সৎ কাজ দিনের পর দিন সম্পাদন করতে করতে আমাদের মধ্যে সৎ কার্য সম্পাদনের অভ্যাস গড়ে ওঠে। তখন আমরা সৎ কর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হই এবং স্বেচ্ছায় সৎ কর্ম সম্পাদন করে থাকি। কোন মাতাপিতা তাদের শিশু সন্তানকে মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করলেন। সত্য কথা বলা সৎ, সেই সম্পর্কে অবহিত না হয়ে সে তার মাতাপিতার আদেশ মত সত্য বলা কথা বলে যায়। এভাবে সত্য কথা বলার অভ্যাস তার মধ্যে গড়ে ওঠে এবং কালক্রমে সে বুঝে উঠতে পারে যে, সত্য বলার জন্যই সত্য কথা বলা উচিত। তখনই সে সত্য কথা বলার ঔচিত্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে সত্য কথা বলতে থাকে। তাই এদিক থেকে কাজটিকে সৎ কাজ বলা যেতে পারে। সৎ কাজ দিনের পর দিন সম্পাদনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে সৎ কাজ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং এভাবে সৃষ্ট অভ্যাসবশত মানুষ স্বেচ্ছায় সৎ কাজ করতে থাকে। সততা এক ধরনের অভ্যাস, যে অভ্যাস এক বিশেষ ধরনের কাজ করার অনুশীলন থেকেই সৃষ্ট হয়।
  • সততা হল একাধারে আতিশয্য (Excess) এবং অপরদিকে অভাব (Defect), এ দুই চরম অবস্থাকে এড়িয়ে মধ্যপন্থা অনুসরণ করা। সততা হল, মাঝামাঝি পথ বেছে নেবার অভ্যাস। অবশ্য কোন ব্যক্তির পক্ষে কোনটি মাঝামাঝি পথ তা নির্ভর করছে ব্যক্তির সামর্থ্য এবং ব্যক্তি কোন বিশেষ অবস্থায় রয়েছে তার ওপর। এ মধ্যপন্থা হল আপেক্ষিক অর্থাৎ অবস্থাবিশেষের এবং মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভর। সমাজ জীবনের সাধারণ উন্নয়নের পক্ষে এ মধ্যপন্থা কতখানি উপযোগী তারই প্রেক্ষিতে এ মধ্যপন্থা সকল সময় নির্ধারণ করতে হবে। একদিকে আতিশয্য বা অতিরিক্ততা এবং অপরদিকে স্বল্পতা বা অভাব—এ দুই চরমের মাঝামাঝি বহু সৎ গুণের উপস্থিতি। যেমন, ‘সাহসিকতা’ এ সৎ গুণটি একদিকে ‘হঠকারিতা এবং অপরদিকে ‘ভীরুতা’–এ চরমের মধ্যবর্তী। অনুরূপভাবে ‘বদান্যতা’–এ সৎ গুণটিও একদিকে ‘অমিতব্যয়িতা’ এবং অপরদিকে ‘ব্যয়কুণ্ঠতা’—এ দুই চরমের মধ্যবর্তী। তবে এ মধ্যপন্থা সকল লোকের পক্ষে এক ধরনের নয়। এ মধ্যপন্থা ব্যক্তির সামর্থ্য এবং অবস্থাবিশেষের ওপর নির্ভর করে। এ মধ্যপন্থা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধি এবং অন্তদৃষ্টির কাছে এক সমস্যার বিষয়। যদিও সাহসিকতা ‘হঠকারিতা’ এবং ‘ভীরুতা’—এ দুই চরমের মধ্যপন্থা, তবুও কোন সৈনিকের ক্ষেত্রে এ সাহসিকতার ঝোক ভীরুতার তুলনায় হঠকারিতার দিকে বেশি হতে পারে।
  • সততা হল মিতাচার। কিন্তু এ মিতাচার সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়। এটি বিচারবুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয়। যা কোন ব্যক্তির পক্ষে মধ্যপন্থা, তা অপর ব্যক্তির পক্ষে হয়ত আতিশয্য বা কোন বিশেষ অবস্থায় যা মধ্যপন্থা তা ভিন্ন অবস্থায় চরম পন্থা। তাই সততা বা সৎ গুণকে অবস্থানিরপেক্ষভাবে নির্ধারণ করা চলে না। সেই কারণেই সততা হল মধ্যপন্থা নির্বাচনের অভ্যাস, যে মধ্যপন্থা আপেক্ষিক এবং বিচার-বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয় বা ব্যবহারিক বুদ্ধিসম্পন্ন। ব্যক্তি যেভাবে একে নির্ধারণ করে। এ মধ্যপন্থা নির্বাচনের জন্য প্রকৃত সৎ ব্যক্তির ব্যবহারিক বিজ্ঞতার প্রয়োজন, তাত্ত্বিক জ্ঞান এ ব্যাপারে খুব কার্যকর নয়।
  • এ মধ্যপন্থা গাণিতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরূপণ করতে হবে না। তাই এটি ‘আপেক্ষিক’। ব্যক্তি তার ব্যবহারিক বিজ্ঞতা বা অন্তদৃষ্টির সাহায্যে সেটি নিরূপণ করবেন।
  • সততা বা সৎগুণ হল দুটি বিপরীত অবস্থার এক সুষম সমন্বয়। অভাব এবং আতিশয্য দুই-ই মন্দ, মধ্যপন্থায় এ দুটিকে এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যেমন, সাহসিকতা, দুঃসাহসিকতা বা নিষ্ক্রিয় দূরদর্শিতা বোঝায় না, দুই-এর এক সাম্যাবস্থা বোঝায়, যার জন্য সাহসিকতা হঠকারিতায় বা ভীরুতায় পর্যবসিত হয় না।
  • অজ্ঞানতাবশত কার্য করলে কর্মচারীর কোন নৈতিক দায়িত্ব থাকে না। ব্যক্তির ঐচ্ছিক ক্রিয়াই হল নৈতিক কর্ম, নৈতিক গুণ তাতে উপস্থিত থাকে, যার জন্য ব্যক্তির ওপর নৈতিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া যায়। তাই ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিক বিচারের প্রাকশর্ত, অর্থাৎ ইচ্ছার স্বাধীনতাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে না নিলে নৈতিক বিচার সম্ভব হয় না। যদি কোন ব্যক্তি কোন কাজ করতে বাধ্য হয় বা অজ্ঞানতাবশত সে কার্যটি করে, তাহলে তার কোন নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে মনে করা যাবে না। তবে অজ্ঞানতাবশত কথাটির অর্থ ঠিকভাবে বুঝে নিতে হবে। কোন ব্যক্তি ক্রোধবশত মদ্য পান করার পর যদি কোন কার্য করে তাহলে সে অজ্ঞানতাবশত কার্যটি করেছে এ কথা বলা হয়। কিন্তু তা বলা যেতে পারে না, কেননা সেই অজ্ঞানতা, ক্রোধ বা মদ্য পানের দ্বারা সৃষ্ট।
  • চার ধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে – (১) কর্মকর্তা জেনে শুনে কাজের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত হয়ে যে কাজ করেন, (২) কর্মকর্তা সংকল্প করেই কোন কাজ করেন কিন্তু কাজের ফলাফল সম্পর্কে পূর্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে অবহিত থাকেন না। যেমন, কোন এক ব্যক্তিকে একটি পানীয় পান করতে দেওয়া হল যেটা পান করে ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ল। কিন্তু কর্মকর্তা পূর্ব থেকে বুঝে উঠতে পারেননি যে, ব্যক্তিটি অসুস্থ হয়ে পড়বে। (৩) কর্মকর্তা যে কাজ করার পরে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হন। (৪) কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় যে কাজ করেন না, যে কাজ করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ এ ধরনের কাজ বাধ্যতামূলক, কর্মকর্তার উদ্দেশ্য নিঃসৃত নয়। যেমন, কোন অত্যাচারীর অপর ব্যক্তিকে কোন কর্ম করতে বাধ্য করা। সব ঐচ্ছিক ক্রিয়ার কর্মকর্তার নির্বাচন (Choice)-এর ফল নয়। কারণ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিবেচনা (Deliberation) এবং নির্বাচন নৈতিক চরিত্র নির্দেশ করে। ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত কাজের জন্যই যে শুধু দায়ী তা নয়; তাদের নৈতিক চরিত্র বা মানসিক প্রবণতা যা তাদের লক্ষ্যের জন্য কামনা বা ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রিত করে, তার জন্যও দায়ী। কেননা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি থেকেই মানসিক প্রবণতার সৃষ্টি।
  • সততা ও জ্ঞান এক কিনা তা নিয়ে এরিস্টোটলের বক্তব্যে স্ববিরোধিতা দেখা যায়। একবার তিনি বলেন, সততা এবং অসততা ব্যক্তির আয়ত্তের মধ্যে। জেনে শুনে কেউ অসৎ কাজ করতে পারে না। যে ব্যক্তি অন্যায় করছে, অন্যায় করার সময় তিনি সেই কার্যের অসততা সম্পর্কে সচেতন থাকেন না বা তাকে অন্যায় বলে জানেন না। আবার তিনিই বলেছেন, মানুষের মনে নৈতিক দ্বন্দ্ব যে মাঝে মাঝে দেখা দেয় তা অস্বীকার করা চলে না এবং কখনও কখনও মানুষ জ্ঞাতসারে অসৎ কর্ম সম্পাদন করে।
  • অ্যারিস্টটল দু’ধরনের সৎ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন – বুদ্ধিগত সৎ গুণ (Intellectual Virtues) যেমন, বিজ্ঞতা (Wisdom) ও ব্যবহারিক বুদ্ধি (Practical Intelligence), এবং নৈতিক সৎ গুণ, যেমন বদান্যতা এবং মিতাচার। শিক্ষাদান থেকে বুদ্ধিগত সৎ গুণগুলোর এবং অভ্যাস থেকে নৈতিক সৎ গুণগুলোর উদ্ভব। দৃষ্টিশক্তি মানুষের মধ্যে যে অর্থে সহজাত, কোন সৎ গুণ সেই অর্থে সহজাত নয়। কিন্তু নৈতিক গুণগুলো সহজাত না হলেও তারা প্রকৃতির বিরোধী নয়। ব্যক্তির মধ্যে তাদের আবির্ভাব হয় কেননা প্রকৃতি তাদের গ্রহণ করার জন্য তাদের উপযোগী করে তুলেছে। কিন্তু অনুশীলন এবং অভ্যাসের দ্বারা তারা নিখুঁত হয়ে ওঠে। ব্যক্তি সৎ কার্য সম্পাদন করে সততা অর্জন করে বা সৎ গুণের অধিকারী হয়। সাহসের কার্য সম্পাদন করতে করতে ব্যক্তি সাহসী হয়। নৈতিক সততার মান খুবই উচ্চ। কিছু সাহসের কাজ সম্পাদন করাই যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে – (১) কর্মকর্তাকে অবশ্যই তার কাজের গুণ সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। তা না হলে নিম্নতর প্রাণীদেরও সাহসী বলতে হবে, (২) কার্যটি কর্মকর্তার নির্বাচনের ফলস্বরূপ হওয়া উচিত, (৩) এটি এমন একটা কাজ হওয়া উচিত যেটি কর্মকর্তার একটি সুদৃঢ় এবং স্থায়ী মানসিক প্রবণতা নির্দেশ করে।
  • নৈতিক সততা হল আবেগকে বিচারবুদ্ধির অধীনস্থ করা। কেবলমাত্র অনুশীলনের মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে। নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা, আত্মনিয়ন্ত্রণের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনের দ্বারাই রিপুগুলোকে বিচারবুদ্ধির নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাই সততার দুটি উপাদান, বিচারবুদ্ধি এবং কামনা-বাসনা, উভয়েরই উপস্থিতি প্রয়োজন। রিপুকে বশীভূত করতে হলে এদের অস্তিত্বকে বাতিল করা চলে না। তাই কামনা-বাসনাকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করে যে কৃচ্ছ্রবাদের আদর্শের কথা বলা হয় তা ভ্রান্ত। কামনা-বাসনা সততার উপাদান। বিচারবুদ্ধি সততার আকার। সততা বলতে কামনা-বাসনার নিয়ন্ত্রণ বোঝায়, তাদের নির্মূল করার কথা বোঝায় না। তাই দুটি চরম অবস্থাকে পরিহার করতে হবে – এক হল কামনা-বাসনা যা আবেগের উচ্ছলতা এবং অপরদিকে তাদের নির্মূলকরণ। এ দুই চরম অবস্থাকে পরিহার করে মধ্য পথ গ্রহণ করতে হবে। সততা হল পরিমিতি (Moderation)। এর থেকেই মধ্যপন্থার নীতিটি আসে।
  • প্লেটো যেমন নৈতিক সৎ গুণের কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা দিয়েছেন সেরকম দেয়া যায়না, নৈতিকতার ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই তা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা বিভিন্ন বলে জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অনুসারে সৎ গুণও অসংখ্য। তবে নৈতিক সৎ গুণ অসংখ্য হলেও কিছু কিছু নৈতিক সৎ গুণ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেমন সাহসিকতা, বদান্যতা, নম্রতা, মিতাচার, বিনয়, ভাল মেজাজ ইত্যাদি।
  • ন্যায়পরায়ণতা হলো যা আইনসম্মত এবং যা পক্ষপাতহীন এবং সমান। প্রথম ধরনের ন্যায়পরায়ণতা হলো সার্বিক বা সাধারণ ন্যায়পরায়ণতা (Universal Justice), এটি আইনের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে সমার্থক। তবে রাষ্ট্রের আইন মানুষের সমগ্র জীবনের ওপর বাস্তব অর্থে কার্যকর। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সৎকার্য সম্পাদনে প্রণােদিত করে, অবশ্য সৎকার্য বলতে জাগতিক দিক থেকে যাকে সৎ কার্য বলে অভিহিত করা যায়। সার্বিক ন্যায়পরায়ণতা সামাজিক দিক থেকে বিচার করা হলে, সততার থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়, উভয়কে সমার্থকই গণ্য করা যেতে পারে। বিশেষ ন্যায়পরায়ণতা (Particular Justice) দুধরনের- (ক) বণ্টনমূলক ন্যায়পরায়ণতা (Distributive Justice) – এ ন্যায়পরায়ণতা হল ব্যক্তির যোগ্যতা (Merit) অনুসারে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সুবিধা এবং অসুবিধা প্রদান করা। ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিকে সম্মান এবং পুরস্কার প্রদান হল বণ্টনমূলক ন্যায়পরায়ণতা। (খ) প্রতিকারমূলক ন্যায়পরায়ণতা (Remedial Justice) – শাস্তি দেওয়ার সঙ্গে এ ন্যায়পরায়ণতার সম্পর্ক। কোন ব্যক্তি যদি অসঙ্গতভাবে কোন সুবিধা গ্রহণ করে, তাহলে আনুষঙ্গিক একটা অসুবিধা তার ওপর আরোপ করে অর্থাৎ তাকে শাস্তি প্রদান করে, বিষয় দুটির মধ্যে সমতা আনতে হবে।
  • ন্যায়পরায়ণতা হল একটা সাধারণ নীতি এবং কোন সাধারণ নীতিই জীবনের জটিলতার সমান হতে পারে না।
  • ন্যায়পরায়ণতা হল অন্যায় আচরণ করা এবং অন্যায় ব্যবহার পাওয়া—এ দুই চরম অবস্থার মধ্যবর্তী পন্থা।
  • এমন অন্যায় কাজ করা হল যাতে অপরের ক্ষতি হল কিন্তু ক্ষতির কথা পূর্ব থেকে চিন্তা করা হয়নি বা তা অভিপ্রেত নয় এবং সাধারণ ঐ ধরনের কাজ করলে ক্ষতি হবার কথা নয়। আবার এমন অন্যায় কাজ করা হল যেখানে অপরের ক্ষতি হল, যে ক্ষতির কথা পূর্ব থেকে চিন্তা করা হয়েছে এবং যা কর্মকর্তার অভিপ্রেত এবং এ ধরনের কাজ করলে স্বাভাবিকভাবে ক্ষতি হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটলের মতে, এ দুই ধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে। এ পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে, ন্যায়পরায়ণতা হিসেবে সমদর্শিতা, আইনগত ন্যায়পরায়ণতার তুলনার উৎকৃষ্ট বলা যেতে পারে। আইনগত ন্যায়পরায়ণতা প্রতিটি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যেতে পারে, সেই হিসেবে সমদর্শিতার তুলনায় তা ব্যাপকতর।
  • ৫টি বুদ্ধিগত সৎগুণ আছে, যথা – (১) কলা (Art) – কলা হল কোন কিছু করার সামর্থ্যের তুলনায় কোন কিছু তৈরি করার সামর্থ্য। কিন্তু এটি একটি বুদ্ধিগত সৎ গুণ, যেহেতু এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি যথার্থ যুক্তি প্রক্রিয়া। কলা হল মানসিক প্রবণতা যার দ্বারা একটি যথার্থ নিয়মের সাহায্যে আমরা কিছু তৈরি করি। (২) বৈজ্ঞানিক জ্ঞান (Scientific Knowledge) – বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সম্পর্ক হল যা অপরিবর্তনীয় তাকে নিয়ে। এটা হল সেই মানসিক প্রবণতা যার দ্বারা আমরা অপরিবর্তনীয় ঘটনার রাজ্যে বিষয়বস্তুর মধ্যে সম্বন্ধ প্রমাণ করি। (৩) বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা (Rational Intuition) – বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা হল সেই বৃত্তি যার দ্বারা আমরা কতকগুলো বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে একটি সার্বিক সত্যের জ্ঞান লাভ করি এবং তারপর বুঝতে পারি যে, সার্বিক সত্যটি স্বতঃসিদ্ধ। বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা হল সেই বৃত্তি যার সাহায্যে আমরা মৌলিক নীতিগুলোর (First Principles) বা যেগুলো থেকে শুরু করে প্রমাণের কাজ শুরু হয় তার জ্ঞান লাভ করি। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা— এ দুইকে একত্রিত করে পাওয়া যায়। (৪) তত্ত্বীয় বিজ্ঞতা (Theoretical wisdom) – তত্ত্বীয় বিজ্ঞতা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বস্তু। শুধুমাত্র অধিবিদ্যার বস্তু নয়, গণিতের এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুও এ তত্ত্বীয় বিজ্ঞতার অনুধাবনের বিষয়। এ সব বস্তুর মনন মানুষের আদর্শ জীবনের অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞতা বা দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয় যে, এ হল বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা এবং বিজ্ঞানের সংযোগ (combination of intutive reason and science), সৃষ্ট মহৎ বস্তুর অনুধাবনের দিকেই এর লক্ষ। (৫) ব্যবহারিক বুদ্ধি (Practical Intelligence) – ব্যবহারিক বুদ্ধি ও ব্যবহারিক বুদ্ধি হল তাই যা আমাদের যথাযথ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যটি লাভ করার জন্য যথাযথ উপায় গ্রহণ করতে বলে। ব্যবহারিক বুদ্ধি হল ‘আত্মার চক্ষু’ (The Eye of the Soul)। এগুলোর মধ্যে ব্যবহারিক বুদ্ধি এবং বিজ্ঞতা নীতিবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করে।
  • সততা হল মধ্যপন্থা নির্বাচনে অভ্যাস, যে মধ্যপন্থা আপেক্ষিক এবং বিচার-বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয় বা ব্যবহারিক বিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি যেভাবে একে নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সাহস হল দৃঢ় বিশ্বাস বা আস্থার যথাযথ অনুভূতির অধিকারী হওয়া কিন্তু যথাযথ বস্তু সম্পর্কে, যথাযথ উদ্দেশ্যের দ্বারা চালিত হয়ে, যথাযথভাবে এবং যথাযথ সময়ে তার অধিকারী হতে হবে। কিন্তু এ সমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিবেচনা, কি অবস্থায় ব্যক্তিকে কাজ করতে হবে, সবই ব্যবহারিক বুদ্ধির অন্তর্গত। নৈতিক গুণ হল তাই যা আমাদের যথাযথ উদ্দেশ্য বা লক্ষটির দিকে দৃষ্টি দিতে বলে।
  • নৈতিক সৎ গুণ এবং ব্যবহারিক বুদ্ধি, এ দুইয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। নৈতিক সৎ গুণ যদি যথাযথ লক্ষ যুগিয়ে না দেয়, তাহলে তাকে বাদ দিয়ে ব্যবহারিক বুদ্ধি হল ধূর্ততার শামিল। আবার ব্যবহারিক বুদ্ধিকে বাদ দিয়ে নৈতিক সৎ গুণ হল খুব জোর ‘স্বাভাবিক সৎ গুণ’, একটা স্বাভাবিক স্বভাব বা মানসিক প্রবণতা, যার অধিকারী শিশু এবং নিম্নতর প্রাণীরাও হতে পারে, কিন্তু যাকে প্রকৃত সৎ গুণে বিকশিত করার জন্য শিক্ষা এবং যুক্তির প্রয়োজন। স্বাস্থ্য হল আমাদের একটি কাম্যবস্তু , কিন্তু সুস্বাস্থ্য লাভ কল্যাণপ্রদ, এ সম্পর্কে আমরা অবহিত হলেও, সেই অবহিতি কিভাবে সুস্বাথ্যের অধিকারী হওয়া যায় বা তাকে রক্ষা করা যায়, তা আমাদের নিরূপণে সাহায্য করে না। আমাদের জানা প্রয়োজন সেই উপায়গুলো যার দ্বারা নিরূপণ করা যাবে এবং ব্যবহারিক বুদ্ধির দ্বারাই তা নিরূপণ করতে হবে।
  • ব্যবহারিক বুদ্ধি হল ব্যবহারিক ন্যায় অনুমান (Practical syllogism), যেমন- ক হল লক্ষ্য, খ হল উপায়, সুতরাং ‘খ’ করা উচিত। অনেক লোক তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারেন, কোনটি যথার্থ কার্য যেটি সম্পাদন করা উচিত, যদিও সাধারণ নীতিগুলো সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট জ্ঞান তাদের নেই। তাই ব্যবহারিক ন্যায় অনুমানের। সিদ্ধান্তকে না জেনে সাধ্য আশ্রয়বাক্যকে জানার তুলনায়, সাধ্য আশ্রয়বাক্যকে না জেনে সিদ্ধান্তকে জানা ভাল।
  • সক্রেটিস সততাকে এক ধরনের বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতা বলেছেন, এটি আংশিক সত্য। বিচক্ষণতা ছাড়া সততার কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না, কিন্তু সব সততাই বিচক্ষণতা নয়, সততাই যথাযথ মনোভাব নয়। সততা হল সেই মানসিক প্রবণতা যা মানুষকে যথাযথ এবং যুক্তিসঙ্গত নির্বাচনের দিকে চালিত করে। যথার্থ সৎ ব্যক্তির পক্ষে বিচক্ষণতা প্রয়োজন। বিচক্ষণতা এবং চতুরতা অভিন্ন বিষয় নয়। চতুরতা হল সেই বৃত্তি যার দ্বারা মানুষ যেকোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য যথাযথ উপায় নিরূপণ করতে পারে। বিচক্ষণতার সঙ্গে সততা সম্পর্কযুক্ত এবং বিচক্ষণতা হল নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি। বিচক্ষণতার জন্য চাতুর্য দরকার, কিন্তু দুটো এক নয় কারণ বিচক্ষণতা নৈতিক গুণ। বিচক্ষণতা হল সেই চতুরতা যা মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্যই উপায় নিরূপণ করে, যেকোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার উপায় নিরূপণ করে না। নৈতিক সততাই মানুষকে যথার্থ লক্ষ্যটি নির্বাচন করতে সহায়তা করে। কোন মানুষ সৎ বা ভাল না হয়েও, যা তার করা উচিত তা করতে পারে। কিন্তু একটা লোককে সৎ বা ভাল বলা হবে যদি সে কাজটি ভাল জেনেই তা সম্পাদন করে বা তার ক্ৰিয়া নৈতিক নির্বাচন প্রসূত হয়। এর জন্য বিচক্ষণতা প্রয়োজন। কোন মানুষকে নৈতিক সৎ গুণের অধিকারী হতে হলে অবশ্যই বিচক্ষণ হতে হবে। কিন্তু কোন শিশু সাহসী হয়েও অশান্ত হতে পারে। অর্থাৎ স্বাভাবিক গুণের ক্ষেত্রে একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির অধিকারী হওয়া যায় কিন্তু নৈতিক গুণের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতাকে বাদ দিয়ে নৈতিক গুণের অধিকারী হওয়া চলে না। বিচক্ষণতা থেকে অন্যান্য সৎ গুণ অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়। (সক্রেটিসের বিপরীতে)
  • সক্রেটিসের মতে, সব সততাই কোন কোন ধরনের জ্ঞান। কিন্তু তা ভুল। আমরা সাহসী হতে চাই, সাহস কি তা জানতে চাই না। আমরা ন্যায়পরায়ণ হতে চাই, ন্যায়পরায়ণতা কি, জানতে চাই না। কোন ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণতা কি, তা জানলেই সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ হয় না। চিকিৎসকের নির্দেশ জেনেও অনেকে তা পালন করে না, তেমনি ন্যায়পরায়ণতা কি তা জেনেও অনেকে ন্যায়পরায়ণ হবার চেষ্টা করে না। (সক্রেটিসের বিপরীতে)
  • নৈতিক সততা এবং অসততার সঙ্গে সুখ-দুঃখের সম্পর্ক রয়েছে। এ সুখ-দুঃখের জন্যই আমরা অনেক সময় কোন কিছুকে ভাল জেনেও তার বিরুদ্ধাচরণ করি এবং সৎ শিক্ষার কাজ হল যা আমাদের ভােগ করা উচিত তাকে ভােগ করতে এবং যা আমাদের ভােগ করা অনুচিত তাকে অপছন্দ করতে শিক্ষা দেওয়া। তাই নীতিবিজ্ঞানে আনন্দের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সুখ (Pleasure) আনন্দের (Happiness) থেকে পৃথক, যদিও সুখ ছাড়া কোন আনন্দ হতে পারে না।
  • সুখ সম্পর্কে তিনটি অভিমত হচ্ছে (১) কোন সুখই ভাল নয়। (২) কোন কোন সুখ ভাল কিন্তু অধিকাংশ সুখই খারাপ। (৩) যদিও কোন কোন সুখ ভাল বা কল্যাণপ্রদ, সুখ মানুয়ের জীবনের পরম কল্যাণ বা পরম কাম্যবস্তু নয়। প্রথম অভিমত অস্বীকার্য। কষ্ট (Pain) সুনিশ্চিতভাবে মন্দ, তাই আনন্দ অবশ্যই ভাল। সুখ মাত্রই খারাপ নয়। কোন কার্য বিনা বাধায় সম্পাদিত হলে সুখ তাকে স্বাভাবিকভাবে অনুসরণ করে। তাই মানুষের লক্ষ হওয়া উচিত কাজ; কাজ থেকে যে সুখ হয়, সেই সুখ নয়। এমন অনেক কাজ আছে, যার থেকে সুখ হয় না, তবু আমাদের সেইসব কাজ সম্পাদন করা লক্ষ হওয়া উচিত। আবার সুখ মানুষের কাম্য হতে পারে না, কেননা, সুখ এমন অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত যেসব কাজ একান্তভাবেই কলঙ্কজনক। কোন কোন সুখ কলঙ্কজনক বলে সব সুখই খারাপ, এ সিদ্ধান্তও যুক্তিযুক্ত নয়। ভাল কাজ করলে যে সুখ পাওয়া যায় তা ভাল, আবার মন্দ কাজ করলে যে সুখ পাওয়া যায় তা মন্দ। তাই কর্ম অনুযায়ী সুখের পার্থক্য ঘটে। মন্দ সুখ (Bad Pleasure)-এর অস্তিত্ব আছে, যেগুলো ভাল লোকের কাছে সুখ নয়। এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলোকে সুখের থেকেও মূল্যবান মনে করা হয়। সুখজনক হলেও শিশুর বুদ্ধি নিয়ে কেউ সারা জীবন চলতে চাইবে না। প্রত্যেক প্রাণীরই তার যথাযথ সুখ রয়েছে এবং মানুষের যথাযথ সুখ তার বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
  • সুখই মানুষের পরম কল্যাণ – এটিও অস্বীকার্য। তবে সব প্রাণীই যেহেতু সুখ অনুসন্ধান করে, তাই স্বীকার করা যায় এটি অন্ততঃপক্ষে একটি কল্যাণকর বস্তু।
  • সুখ স্বাভাবিক ক্রিয়াকে পরিপূর্ণতা বা সম্পূর্ণতা দান করে। এর অর্থ এই নয় যে, ক্রিয়াটিই অসম্পূর্ণ। সুখ অতিরিক্তভাবে এসে পড়ে। ক্রিয়া নৈতিক গুণের দিক থেকে নীতিগতভাবে ভাল, মন্দ এবং নীতি নিরপেক্ষ। সুখের নৈতিক গুণের তারতম্য ঘটে। যেহেতু কি ধরনের কাজ কর্মকর্তা সম্পাদন করছে সেই কাজের ধরনের ওপর এ তারতম্য নির্ভর করে, অর্থাৎ যে কাজ করে সুখ হয় সেই কাজের প্রকৃতির দ্বারাই নির্ধারিত হয় সুখের নৈতিক গুণ, অর্থাৎ সুখ ভাল নাকি মন্দ সেটা।
  • ভাল লোকই কোনটি যথার্থ সুখ, তার বিচার করতে পারে। রুগ্ন ব্যক্তি, কোন্‌টি মিষ্টি, কোটি টক্, কোন্‌টি উষ্ণ, কোটি শীতল—এ সম্পর্কে ভ্রান্ত অভিমত ব্যক্ত করতে পারে, একমাত্র সুস্থ ব্যক্তি এগুলো সঠিকভাবে বিচার করতে পারে। নৈতিক দিক থেকে যিনি সাচ্চা লোক তিনিই কোনটি যথার্থ সুখকর, কোনটি নয়, তার মানদণ্ড যুগিয়ে দিতে পারেন। অন্যান্য সুখ, সুখ বলে প্রতিভাত হয় এবং সেই কারণেই অ্যারিস্টটল আপাতঃবিরোধী সিদ্ধান্ত করেছেন যে, কোন কোন সুখ যা মন্দ বা কলঙ্কজনক বলে স্বীকৃত, যথার্থ সুখ নয়; এগুলো যারা দুশ্চরিত্র বা নৈতিক দিক থেকে অধঃপতিত তাদের কাছেই সুখ। তাই কাজের গুণানুসারেই সুখ ভাল, মন্দ বা নিরপেক্ষ। কাজের এবং সুখের—এ দুইয়ের বিচারের সময় কোনটি প্রকৃত ভাল এবং যথার্থ সুখপ্রদ তার জন্য ভাল লোককে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
  • সুখ, দুঃখের অভাব (Negation) নয়। দুঃখ, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে যে অভাব সৃষ্টি করে, সুখ সেই অভাব পূরণ করে দেয় – এই মতবাদ ভ্রান্ত। এ কথা সত্যি, অভাব পূরণ হলে সুখ হয়। যেমন- ক্লান্তি দুঃখজনক, ক্লান্তি তিরোহিত হলে সুখ আসে। কিন্তু তাই বলে এ সিদ্ধান্ত করা চলে না যে, পূর্ববর্তী কোন অভাবের পূরণই হল সুখ। গণিত পাঠ করে বা আলোচনা করে সুখ হয়, এক্ষেত্রে কোন পূর্ববতী অভাবের বা দুঃখের প্রশ্ন ওঠে না। সুগন্ধ সুখ দেয়, এখানেও পূর্ববতী কোন দুঃখের কথা ভাবা যায়না। প্রত্যাশা এবং স্মৃতি সুখজনক এবং এদের সঙ্গে কোন পূর্ববর্তী দুঃখ জড়িত নয়। তাই সুখ কোন অভাবাত্মক অবস্থা নয়, ভাবাত্মক অবস্থা।
  • যে কাজের সঙ্গে সুখ জড়িত, সেই কাজের পার্থক্য অনুযায়ী সুখও পৃথক হয়। ভাল মানুষ যাকে সুখ বলে তাই যথার্থ সুখ, মন্দ ব্যক্তির সুখ যথার্থ সুখ নয়। সব সুখই দৈহিক সুখ নয়। সব বস্তুই আংশিকভাবে ঐশ্বরিক এবং তাই তার উচ্চতর সুখ প্রদানের ক্ষমতা আছে।
  • আনন্দ মানুষের কাজের ওপর নির্ভর করে এবং আনন্দ হল মানুষের আত্মার সততা অনুসারে কার্য সম্পাদন। আনন্দ যদি হয় সততা অনুসারে কার্য সম্পাদন, তাহলে এটা যুক্তিযুক্ত যে, আনন্দ হবে পরম সততা অনুযায়ী কার্য সম্পাদন। কিন্তু পরম সততা হল আত্মার শ্রেষ্ঠ অংশ অর্থাৎ বিচার-বুদ্ধি যার কার্য হলো মনন (Contemplation)। মানুষের পরম বা শ্রেষ্ঠ জীবন হল মননমূলক জীবন (Contemplative Life) বা দার্শনিকের জীবন (Life of the Philosopher)। এটি শুধু যে পরম বা শ্রেষ্ঠ জীবন তা নয়, এটি হল পরম আনন্দের এবং সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • পরম বা শ্রেষ্ঠ জীবন সম্পর্কে ধারণা মানুষের নিম্নতর বৃত্তিকে অগ্রাহ্য করে না। আত্মার বৃত্তি অনুসারে উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ এমনকি দেবতারা সকলেই একটি নিরবচ্ছিন্ন ক্রমে বিন্যস্ত। উদ্ভিদের রয়েছে পুষ্টিগত এবং বংশরক্ষামূলক আত্মা। প্রাণীদের সংবেদন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরও অতিরিক্ত কিছু, যেমন স্থানীয় গতি কামনা, কল্পনা ইত্যাদি। মানুষের এসব নিম্নতর বৃত্তি রয়েছে, তা ছাড়া রয়েছে বিচারবুদ্ধি। দেবতাদের সঙ্গে মানুষ এ বিচারবুদ্ধির অংশীদার। মানুষের পরম জীবন নির্ভর করে কিছু পরিমাণে আত্মার এ নিম্নতর বৃত্তির ক্রিয়া করার ওপর। যেমন মননশীল জীবন কাটাবার জন্য, অনুশীলন করার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য ভাল হওয়া দরকার। কিন্তু শ্রেষ্ঠ জীবনের ক্ষেত্রে সেই বৃত্তি প্রাসঙ্গিক যার জন্য মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক।
  • বিচারবুদ্ধির অনুশীলন হল শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া, কিন্তু বিচারবুদ্ধি, মানুষের তুলনায় ঐশ্বরিক। মানুষ বলেই যে মানুষ বিচারবুদ্ধির জীবন যাপন করবে, তা নয়। মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিক উপাদান রয়েছে বলেই মানুষ তা করবে না। ক্রিয়ায় জীবনের সঙ্গে যুক্ত সৎ গুণগুলো মানুষের বৈশিষ্ট্যসূচক ধর্ম। কিন্তু বিচারবুদ্ধির জীবন অতিমানবিক।
  • পরিপূর্ণ আনন্দ মননমূলক। মনন, যুদ্ধ অথবা রাজনীতি বা অন্য কোন ব্যবহারিক কর্মজীবনের থেকে শ্রেয়, কেননা, মননের ক্ষেত্রে অবকাশ (Leisure) রয়েছে। ব্যবহারিক সৎ গুণ এবং আনন্দের জন্য এ অবকাশ প্রয়োজন। ব্যবহারিক সৎ গুণ এক গৌণ ধরণের আনন্দ, মানুষের পরম আনন্দ বিচারবুদ্ধির অনুশীলনে নিহিত। মানুষ পরিপূর্ণভাবে মননশীল হতে পারে না কিন্তু যতখানি পারে তাতেই সে ঐশ্বরিক জীবনের অংশীদার হয়। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে অন্য ক্রিয়ার কথা বলা যেতে পারে না, তাই ঈশ্বরের ক্রিয়া হচ্ছে মননমূলক। দার্শনিক কাজ ঈশ্বরের মত মননমূলক এবং তাই দার্শনিক সবচেয়ে আনন্দের অধিকারী। ব্যক্তি তার বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ করে এবং তার অনুশীলন করে। মনে হয়, সে সবচেয়ে ভাল মানসিক অবস্থায় থাকে এবং দেবতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়। দার্শনিকও তা করে থাকেন, তাই দার্শনিক দেবতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং যে ব্যক্তি এরূপ, সে সবচেয়ে আনন্দ লাভের অধিকারী। তাই এদিক থেকেও, দার্শনিক অন্যের তুলনায় বেশি আনন্দের অধিকারী।
  • মানুষের শ্রেষ্ঠ আনন্দ যে বিচারবুদ্ধির ক্রিয়া এবং তাই মননের ওপর নির্ভরশীল কারণ – (১) বিচারবুদ্ধি মানুষের শ্রেষ্ঠ বৃত্তি এবং তত্ত্বীয় মননকার্য (Theoretic Contemplation) বিচারবুদ্ধির শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া। (২) দৈহিক ক্রিয়ার তুলনায় বিচারবুদ্ধির ক্রিয়াকে অধিককাল স্থায়ী করা যায়। (৩) সুখ আনন্দের একটা উপাদান এবং দর্শনের মধ্যে এ সুখের চরম প্রকাশ ঘটে। (৪) দার্শনিক অন্যান্য ব্যক্তির তুলনায় অনেক বেশি স্ব-নির্ভর। জাগতিক প্রয়োজনকে একেবারে বর্জন করা সম্ভব না হলেও তিনি নির্জনে তার মননক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারেন এবং অপরের সহায়তা ছাড়াও তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম, যদিও অপরের সহযোগিতা তার পক্ষে অভিপ্রেত বিষয়। (৫) দর্শনের প্রতি অনুরাগ দর্শনের জন্যই, দর্শন থেকে কোন ফল লাভ ঘটে তার জন্য নয়। দর্শন কোন লক্ষ লাভের উপায় নয়। তাই দার্শনিক, মননক্রিয়ার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ আনন্দের অধিকারী হন।
  • তাই মহৎ বস্তুকে কেন্দ্র করে বিচারবুদ্ধির অনুশীলনের মধ্যেই মানুষের পরিপূর্ণ আনন্দকে পাওয়া যায়। তবে এ অনুশীলন স্বল্পকাল স্থায়ী না হয়ে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে হবে। এ ধরনের জীবনই, মানুষের মধ্যে যে ঐশ্বরিক উপাদান আছে, তাকে প্রকাশ করে ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করে আমাদের উচিত বিচারবুদ্ধির জীবন যাপন করায়, কারণ যেহেতু বিচারবুদ্ধিই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপাদান। বিচারবুদ্ধি মানুষের আত্মার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও এর মূল্য এবং ক্ষমতা অপরিসীম। বস্তুত বিচারবুদ্ধিই মানুষের প্রকৃত আত্মারূপে গণ্য হতে পারে কারণ এটি সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং সকলের ওপরই এর প্রভুত্ব। তাই মানুষের উচিত তার প্রকৃত আত্মার জীবনকেই বেছে নেওয়া।
  • তত্ত্বীয় মননের বিষয়বস্তু হলো গণিতের এবং অধিবিদ্যার অপরিবর্তনীয় বস্তু। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে যে সব বস্তু অপরিবর্তনীয়, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। পদার্থবিদ্যা মননের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যদি পদার্থবিদ্যার আলোচ্য বিষয় যে পরিবর্তনশীল বস্তু, সেই পরিবর্তনশীল বস্তুর মধ্যে অপরিবর্তনীয় এবং অনিবার্য উপাদানগুলো নিয়ে পদার্থবিদ্যা আলোচনা করে।
  • অধিবিদ্যার পরম বস্তু হল ঈশ্বর। ঈশ্বরের পূজা ও মনন আদর্শ জীবনের পক্ষে অপরিহার্য।

রাষ্ট্রতত্ত্ব

  • রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিবিজ্ঞান বা নীতিশাস্ত্র থেকে কোন স্বতন্ত্র নয়, এটি হল একই বিষয়ের অপর একটি বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের নীতিবিজ্ঞান। সেই সাথে ব্যক্তির নৈতিকতা রাষ্ট্রের মধ্যেই তার লক্ষ্যকে খুঁজে পায় এবং রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তির নৈতিকতা সম্ভব নয়। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • রাষ্ট্র হল বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন এবং মানুষের পরমকল্যাণই রাষ্ট্রের লক্ষ। অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের মত রাষ্ট্রের একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ আছে। অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের লক্ষ যেমন কোন না কোন কল্যাণ, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ লক্ষ হল মানুষের পরম কল্যাণ, মানুষের নৈতিক এবং বুদ্ধিময় জীবন। নাগরিকের সৎ জীবনযাপন এবং আনন্দই হল রাষ্ট্রের লক্ষ, রাষ্ট্র ভিন্ন যেগুলো অন্য কোথাও নাগরিকদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • মানুষ স্বভাবত এক রাজনৈতিক জীব। মানুষ কথা বলার অধিকারী বলে এটি প্রমাণিত। কোন জীব সামাজিক না হলে তার এ অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। স্বভাবত রাজনৈতিক জীব বলতে বোঝায়, মানুষ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে তার জীবনের প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পাদন করতে পারে না। রাষ্ট্র হল আকার, ব্যক্তি হল উপাদান। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সততা শিক্ষা দেয় এবং সততার অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগের ব্যবস্থা করে দেয়। রাষ্ট্র ছাড়া মানুষ মানুষই হতো না, সে হতো একটি বন্য পশু।
  • আদিম সামাজিক সংগঠন হল পরিবার। পুরুষ এবং নারী, প্রভু এবং ক্রীতদাস- এ দুই মৌলিক সম্বন্ধের ওপর ভিত্তি করেই পরিবারের উদ্ভব। উভয় সম্বন্ধই স্বাভাবিক সম্বন্ধ। জীবনের জন্যই, মানুষের প্রাত্যহিক অভাব মেটাবার জন্যই পরিবারের অস্তিত্ব। যখন অনেকগুলো পরিবার একত্র যুক্ত হয় এবং নিছক দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও অন্য লক্ষ্যের প্রশ্ন এসে পড়ে, তখন গ্রামের আবির্ভাব ঘটে। যখন অনেকগুলো গ্রাম একত্রিত হয়ে একটি সামাজিক সংগঠনের সৃষ্টি হয় তখন নগর বা রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। রাষ্ট্র পরিবার বা গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। জীবনের নিছক প্রয়োজন থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কিন্তু কল্যাণময় জীবন যাপনের জন্যই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব। রাষ্ট্র পরিবার এবং গ্রাম থেকে শুধুমাত্র পরিমাণগত দিক থেকে নয়, গুণগত দিক থেকে এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে স্বতন্ত্র। রাষ্ট্রেই কেবলমাত্র মানুষ পরিপূর্ণ অর্থে কল্যাণময় জীবন-যাপন করতে পারে এবং কল্যাণময় জীবন যাপনই মানুষের স্বাভাবিক লক্ষ। রাষ্ট্র হল একটি স্বাভাবিক সমাজ। মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক অগ্রগতি রাষ্ট্রেই ঘটা সম্ভব, কেননা এ লক্ষ্যের উপযোগী অবস্থাগুলো রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে।
  • রাষ্ট্র পরিবার এবং গ্রামের নিছক যান্ত্রিক সমষ্টি নয়। কারণ কালের দিক থেকে যদিও রাষ্ট্র ব্যক্তি এবং পরিবারের পরে আসে, চিন্তার দিক থেকে এবং বাস্তবতার দিক থেকে রাষ্ট্র, ব্যক্তি এবং পরিবারের আগে আসে। রাষ্ট্র হল লক্ষ এবং লক্ষ যার লক্ষ, সব সময়ই তার পুর্ববতী। প্রকৃতিগত দিক থেকেও রাষ্ট্র পরিবার এবং ব্যক্তির পূর্ববতী। কারণ, কোন কিছু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলেই তাকে তার প্রকৃতি বলা হয়। মনুষ্য সমাজ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলেই রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং সমগ্র যে অংশের পূর্ববর্তী এ কথা অস্বীকার করা চলে না। রাষ্ট্র হল সমগ্র যা অবশ্যম্ভাবীভাবে অংশের পূর্ববর্তী, অংশ হল পরিবার এবং ব্যক্তি। রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাই ব্যক্তি হল সমগ্রের সম্পর্কে একটি অংশের মত। লক্ষ্যের সাহায্যে প্রারম্ভ বা শুরুকে ব্যাখ্যা করা যায়, তাই রাষ্ট্রের সাহায্যেই পরিবারের ব্যাখ্যা হতে পারে। রাষ্ট্র পরিবারের তুলনায় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত।
  • রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক সামাজিক সংগঠন, কেননা একটি পরিপূর্ণতা সভ্য জীবনের সম্ভাবনা রাষ্ট্রে নিহিত। যে মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী, এ সভ্য জীবন তারই লক্ষ্য। যে মানুষ রাষ্ট্র ছাড়া বসবাস করতে পারে সে হয় একজন পশু কিংবা ঈশ্বর। মানুষ তার কথা বলার ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী। এ ক্ষমতার জন্যই মানুষ ভাল এবং মন্দ, অন্যায় এবং ন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং মানুষের এ বোধই তাকে পরিবার এবং রাষ্ট্র গঠন করায়। এ কথা বলার ক্ষমতা আরও প্রমাণ করে যে, মানুষ অন্যান্য জীব থেকে অনেক বেশি সামাজিক।
  • রাষ্ট্রের প্রকৃতি যান্ত্রিক নয় আঙ্গিক, এটি ব্যক্তির যান্ত্রিক সমষ্টি নয়। রাষ্ট্র একটি জীবদেহ, যেখানে বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে আঙ্গিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি হাত যদি দেহের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, তাকে হাত বলা যেতে পারে না। একটি হাতের সংজ্ঞা দিতে গেলে তার উদ্দেশ্যের দ্বারাই সেই সংজ্ঞা দিতে হবে। সেই উদ্দেশ্য হল কিছু ধরা এবং এ কার্যটি হাতের পক্ষে করা সম্ভব যদি কোন সজীব দেহের সঙ্গে হাতটি যুক্ত থাকে। অনুরূপভাবে, কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের অংশ না হলে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে না। যে ব্যক্তি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি পরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ আইন ছাড়া মানুষ প্রাণীদের মধ্যে নিকৃষ্ট এবং আইন, তার অস্তিত্বের জন্য, রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে। পণ্য বিনিময় এবং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্র নিছক একটা সমাজ নয়। রাষ্ট্রের লক্ষ হল কল্যাণপ্রদ জীবন। শুধুমাত্র সাহচর্যের জন্য নয়, মহৎ কাজের জন্য রাজনৈতিক সমাজের অস্তিত্ব। অঞ্চল বা জনসংখ্যার দ্বারা রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় শাসনতন্ত্রের দ্বারা। শাসনতন্ত্র পরিবর্তিত হলেই রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়।
  • যারা রাষ্ট্রের সত্তা স্বীকার করেন, ব্যক্তির সত্তা স্বীকার করেন না, আবার যারা ব্যক্তির সত্তা স্বীকার করেন, রাষ্ট্রের সত্তা স্বীকার করেন না, এ দুই অভিমতেরই ভুল। রাষ্ট্র সম্পর্কে যান্ত্রিক মতবাদ ভুল, রাষ্ট্র ব্যক্তির নিছক যান্ত্রিক সমষ্টিমাত্র নয়। এ মতবাদ অংশের অর্থাৎ, ব্যক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং সমগ্রের অর্থাৎ রাষ্ট্রের সত্তা অস্বীকার করে। রাষ্ট্রের সত্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে যে ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র গঠিত তাদের বাস্তবতাকে অস্বীকার করাও ভ্রমাত্মক।
  • রাষ্ট্রের আনন্দের কথা তখনই বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র আনন্দে রয়েছে এমন লোকের দ্বারা গঠিত হয়। আনন্দ ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়েরই লক্ষ।
  • মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে কল্যাণময় জীবন যাপন করতে পারে বা আনন্দ লাভ করতে পারে এবং রাষ্ট্র কালগত না হলেও বাস্তব দিক থেকে ব্যক্তির ও পরিবারের অগ্রবর্তী।
  • ক্রীতদাসত্ব স্বাভাবিক। স্ত্রী, পিতা এবং সন্তানের মধ্যে যেমন স্বাভাবিক পার্থক্য আছে, তেমনি প্রভু এবং ক্রীতদাসের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। ক্রীতদাস হল প্রভুর জীবনের সাহায্যকারী একটি সজীব ক্রিয়াশীল যন্ত্রমাত্র। ক্রীতদাস প্রথার উপযোগিতা আছে এবং এটি সমর্থনযোগ্য। স্বাভাবিকভাবে ক্রীতদাস তার প্রভুর থেকে নিকৃষ্ট। জন্ম থেকেই কিছু লোক শাসিত হওয়ার জন্য চিহ্নিত হয় এবং কিছু লোক শাসন বা প্রভুত্ব করে। শাসক এবং শাসিতের মধ্যে পার্থক্য প্রকৃতির সর্বত্রই দৃষ্ট হয়। ব্যক্তি মানুষের মধ্যেও এ বিষয় পরিলক্ষিত হয়, যেখানে আত্মা শাসন করে এবং দেহ শাসিত হয়। এটা সুস্পষ্ট যে, কিছু লোক স্বভাবতই স্বাধীন এবং কিছু লোক পরাধীন এবং শেষােক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে ক্রীতদাসত্ব সুবিধাজনক এবং সঙ্গত। যে মানুষ স্বভাবতই তার নিজের নয়, অন্য ব্যক্তির, স্বভাবতই সে একজন ক্রীতদাস। যে সব প্রাণী পােষ মানে, তারা ভাল থাকে যখন মানুষ তাদের ওপর প্রভুত্ব করে। ঠিক তেমনি, যারা স্বাভাবিকভাবে নিকৃষ্ট, তারা ভাল থাকে যখন তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাদের ওপর প্রভুত্ব করে। যেসব ব্যক্তির স্বাভাবিকভাবে শাসিত হওয়ার কথা তারা যখন তাতে অসম্মতি জানায় তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা সমর্থনযোগ্য এবং কেবলমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই অর্থাৎ বিজিতদের মধ্য থেকে ক্রীতদাস নির্বাচন করা যুক্তিসঙ্গত।
  • ধন অর্জন বা সম্পত্তি লাভের স্বাভাবিক উপায় হল পশুচারণ, মৃগয়া, কৃষিকর্ম প্রভৃতি উপায়ের দ্বারা জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করা। দ্বিতীয় পদ্ধতি হল বস্তু ক্রয় করার জন্য অর্থ বিনিয়োগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিকে অস্বাভাবিক ও নিন্দনীয়। কোন বস্তুর দুই রকম ব্যবহার আছে, একটি উপযুক্ত এবং অপরটি অনুপযুক্ত। যখন জুতো পরিধান করা হয় তখন জুতোর যথাযথ বা উপযুক্ত ব্যবহার হয়। কিন্তু যখন জুতোর বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করা হয় তখন তার অনুপযুক্ত ব্যবহার হয়। যে মুচি জুতো তৈরি করে, জীবিকার জন্য অর্থের বিনিময়ে তা বিক্রি করে, তার কার্য নিন্দনীয়। অর্থ সংগ্রহ বা সম্পত্তি লাভের ব্যাপারে খুচরা বিক্রয় পদ্ধতি স্বাভাবিক পদ্ধতি নয়। কৃষিকর্ম, পশুচারণ প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন স্বাভাবিক পদ্ধতি এবং এভাবে যে অর্থ উপার্জিত হয় তার একটা সীমা আছে। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন সীমা নেই। তাই ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন ঘৃণ্য পদ্ধতি; কারণ এটা অস্বাভাবিক। তেজারতি কারবার বা সুদে টাকা ধার দেওয়ান পদ্ধতি হল টাকা থেকেই লাভ করা; টাকার যেটা স্বাভাবিক উদ্দেশ্য অর্থ কোন বস্তু ক্রয় করার জন্য অর্থের ব্যবহার, তার থেকে নয়। বিনিময়ের জন্যই অর্থের ব্যবহার সুপ্রযুক্ত, সুদে তার বৃদ্ধি অভিপ্রেত বিষয় নয়। যত রকমভাবে অর্থ রোজগার করা যায় এটি হল তার মধ্যে সবচেয়ে অস্বাভাবিক। গরু, ভেড়া এরা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অর্থ এভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে না। কোন বস্তু ক্রয় করলে তার বিনিময়ে অর্থ প্রদান, এ ছাড়া অর্থের কোন ব্যবহার নেই। বিনিময়ের মাধ্যমরুপে ব্যবহৃত হওয়াই অর্থের স্বাভাবিক উদ্দেশ্য। অর্থের বিনিময়ে কোন বস্তু গ্রহণ না করে এবং কোন রকম পরিশ্রম না করে, মানুষ যখন তার অর্থ বাড়াতে থাকে তখন তাকে অস্বাভাবিক পদ্ধতি বলতেই হয়। তাই এ পদ্ধতি ঘৃণ্য। বিনিয়োগ ও তেজারতি কারবারের মাঝামাঝি পদ্ধতি হল বিনিময় (Barter) পদ্ধতি। বিনিময় পদ্ধতিতে একটি বস্তুর যথাযথ বা উপযুক্ত ব্যবহার হয় না, তার থেকে পৃথক ধরনের ব্যবহার হয়। কিন্তু যেহেতু বিনিময় পদ্ধতির সাহায্যে জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করা যায়, তাই বিনিময় পদ্ধতি অর্থ উপার্জনের স্বাভাবিক উপায়।
  • রাষ্ট্রের অভিভাবকবৃন্দকে পারিবারিক জীবনযাপন করা থেকে বঞ্চিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। পরিবার একটি স্বাভাবিক সংগঠন, অভিভাবকবৃন্দকে তার থেকে বঞ্চিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। অভিভাবক শ্রেণীর সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে রক্ষণাগারও সমর্থনযোগ্য নয়। সেখানকার সন্তানরা অবহেলিত হতে বাধ্য। সন্তান তার স্বাভাবিক মাতাপিতার স্নেহ ভালবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ হবে—এ বিষয়টিই অভিপ্রেত, কারণ তাতেই শিশুর প্রকৃত কল্যাণ হয়। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • সমভোগবাদের ফলে অলস ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ক্রোধের সঞ্চার হবে এবং নানা ধরনের কলহ, বিতর্ক প্রভৃতির সৃষ্টি হবে। বরং প্রত্যেকেই যে যার কাজের প্রতি মনোযোগী হবে এটাই ভাল। অভিভাবকবৃন্দ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না – প্লেটোর এই ধারণা ভুল। সম্পত্তি ভােগের মধ্যে সুখ নিহিত, এ সুখভােগ থেকে অভিভাবক শ্রেণীকে বঞ্চিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। অভিভাবক শ্রেণীকে সম্পত্তি ভােগ করা থেকে বঞ্চিত করলে রাষ্ট্র সুখী হবে – এ যুক্তি অর্থহীন, কেননা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের পৃথক সুখের কথা বলা চলে না। সব সম্পত্তিকে রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে সম্পত্তির সমতা বিধান সমর্থনযোগ্য নয়, কেননা এ ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন নেই। ব্যক্তির নিজ নিজ সম্পত্তি ভােগের অধিকার থাকা উচিত, কিন্তু তাদের এমনভাবে শিক্ষিত করা উচিত হবে, যাতে সমষ্টিগত কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে তারা তাদের সম্পত্তি ভােগ করে। আর যদি শিক্ষার সাহায্যে তাদের মহানুভব করে তোলা না যায়, তা হলে রাষ্ট্রের উচিত, তাদের অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহে বাধা দান করা। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • সরকারকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত — ভাল এবং মন্দ। ভাল সরকারের লক্ষ সমাজের সমষ্টিগত কল্যাণ। মন্দ সরকার কেবল নিজের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী। তিন ধরনের সরকারকে ভাল বলা যেতে পারে : রাজতন্ত্র (Monarchy), অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) এবং জনতন্ত্র (Polity)। তিন ধরনের মন্দ সরকার হল স্বৈরতন্ত্র (Tyrrany), ধনিকতন্ত্র (Oligarchy) এবং গণতন্ত্র (Democracy)। শাসন ক্ষমতা যখন একজন ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত থাকে, যে ব্যক্তি অন্যান্য ব্যক্তির থেকে জ্ঞানে এমন উচ্চতর যে, তিনি স্বাভাবিকভাবেই শাসন করেন, তখন তা হল রাজতন্ত্র। রাজতন্ত্রের বিকৃত রূপ হল স্বৈরতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্র একজন মাত্র ব্যক্তির শাসন; কিন্তু ব্যক্তি তার বিজ্ঞতা এবং শাসন ক্ষমতার দিক থেকে অপরের থেকে শ্রেষ্ঠ বলে শাসন পরিচালনা করে না, বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করে। দ্বিতীয় ভাল সরকার হল অভিজাততন্ত্র। এ সরকারের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে স্বল্প কিছু জ্ঞানী এবং সৎ ব্যক্তির হাতে। এর বিকৃত রূপ হল ধনিকতন্ত্র; এক্ষেত্রে শাসনকার্য পরিচালনা করেন স্বল্প কয়েক জন ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তৃতীয় ভাল সরকার হল জনতন্ত্র। জনতন্ত্রে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে বহুজনের হাতে। এক্ষেত্রে সব নাগরিকই প্রায় সমান ক্ষমতার অধিকারী। এখানে বিশেষ কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর উপরে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে না, যার ফলে প্রায় সবাই বা অধিকাংশ ব্যক্তি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে। এরই বিকৃত রুপ হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে শাসনকার্য বহুজনের ওপর ন্যস্ত থাকলেও, এটি হল মূলত দরিদ্র ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত সরকার।
  • অভিজাততন্ত্র রাজতন্ত্রের তুলনায় এবং জনতন্ত্র অভিজাততন্ত্রের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। কোন রাষ্ট্রে এমন একজন ব্যক্তি যদি থাকেন যিনি সকল বিষয়ে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাহলে তিনিই হবেন স্বাভাবিক রাজা ও শাসক, এবং সেক্ষেত্রে রাজতন্ত্রই হবে আদর্শ সরকার। কিন্তু বাস্তবে সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ এমন ব্যক্তির দেখা পাওয়া কঠিন। তাই রাজতন্ত্রের তুলনায় অভিজাততন্ত্র শ্রেষ্ঠ। অভিজাততন্ত্রে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা নিজেদের যোগ্যতাবলে অপরকে শাসন করেন এবং শাসন করার সময় অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু সমসাময়িক রাষ্ট্রের পক্ষে অভিজাততন্ত্রের আদর্শ খুবই উচ্চ আদর্শ। তাই জনতন্ত্রকে অভিজাততন্ত্রের তুলনায় শ্রেয়। এ হল মধ্যবিত্তের শাসন এবং এ সরকার হল ধনিকতন্ত্র এবং জনতন্ত্রের মধ্যবর্তী সরকার। ধনীরা দরিদ্রদের এবং দরিদ্ররা ধনীদের বিশ্বাস করতে পারে না, কিন্তু উভয় শ্রেণীই মধ্যবিত্তদের বিশ্বাস করতে পারে। সে কারণে ধনী বা দরিদ্রদের শাসনের তুলনায় মধ্যবিত্তের শাসনকে ভাল। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • ভাল এবং মন্দ সরকারের পার্থক্য শাসনতন্ত্রের আকারের দ্বারা নয়, যাদের হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত তাদের নৈতিক গুণের দ্বারা নিরূপিত হবে।
  • ধনিকতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ভর করছে শাসনকার্য যাদের ওপরে ন্যস্ত তাদের অর্থনৈতিক মর্যাদার ওপরে। ধনিকতন্ত্রের সরকার হল সেই সরকার যে সরকারে ধনীরা দরিদ্রের কথা চিন্তা না করে শাসনকার্য চালায়। গণতন্ত্রের বেলায় যারা অভাবগ্রস্ত তাদের হাতেই শাসনকার্য ন্যস্ত থাকে এবং তারা ধনীর স্বার্থের প্রতি উদাসীন হয়।
  • যা সবচেয়ে ভাল সরকার তার বিকৃত রূপ হল সবচেয়ে খারাপ। সুতরাং স্বৈরতন্ত্রের থেকে ধনিকতন্ত্রের নিকৃষ্ট এবং ধনিকতন্ত্রের থেকে গণতন্ত্র নিকৃষ্ট।
  • বিপ্লবের কারণ হল ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে একদেশদর্শী ধারণা। যারা গণতন্ত্রী তারা মনে করেন যে মানুষ যেহেতু সমানভাবে স্বাধীন, তাই তারা সকল বিষয়েই সমান হবে। ধনতন্ত্রীরা মনে করে যে, যেহেতু ধনের দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য, তাই তারা সব দিকে পৃথক হবে। উভয়েরই ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে এক বিশেষ ধরণের ধারণা রয়েছে, যে ধারণাকে যথার্থ ধারণা বলা চলে না। তাই উভয় দলই যখন কোন সরকার গঠনে অংশীদার হয়, তখন ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ধারণার জন্য বিপ্লব দেখা দেয়। ধনিকতন্ত্রের তুলনায় গণতন্ত্রে বিপ্লব দেখা দেবার সম্ভাবনা কম, কেননা ধনিকতন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হতে পারে।
  • বিপ্লব নিবারণের তিনটি প্রকৃষ্ট উপায় হল— শিক্ষাগত, সরকারি প্রচার, খুব ছােটখাটো বিষয়েও আইনের প্রতি আনুগত্য এবং আইন ও প্রশাসনের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণতা। অর্থাৎ অনুপাত অনুযায়ী সমতা এবং প্রতিটি ব্যক্তির নিজ বিষয় ভােগ করা। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ সততার পরিমাপ করা হয় আয়ের দ্বারা। সব সামাজিক অসমতা হল আয় সম্পর্কীয় অসমতা। গণতন্ত্রীরা মনে করেন, অর্থ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ‘আনুপাতিক ন্যায়পরায়ণতার’ প্রশ্নের কখনও কোনও সমাধান মিলতে পারে না। ধনিকতন্ত্রের সমর্থকবৃন্দও মনে করেন যে, আয় সততার আনুপাতিক। সৎ লোকেরা তার নিজের যতটুকু আয় করা প্রয়োজন তাই করেন, তার বেশিও নয়, কমও নয়।
  • শাসনকর্তাদের পদাধিকার বলে নিজেদের জন্য অর্থ রোজগারের কোন সুযোগ না থাকা উচিত। শাসনযন্ত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য থাকা প্রয়োজন, তারা অবশ্যই প্রশাসন কার্যে দক্ষ হবেন এবং তাদের চরিত্রের সততা থাকা প্রয়োজন। কোন সরকারের উচিত নয় চরম সীমায় উপনীত হওয়া। কারণ গণতন্ত্র বা ধনতন্ত্র যদি চরম সীমায় উপনীত হয় তাহলে দলের মধ্যে অসন্তোয় পুঞ্জীভূত হয় এবং তার পরে বিপ্লব ঘটে।
  • যে সাধারণ নীতির দ্বারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার, সেই নীতিটি হল ‘আনুপাতিক সমতার নীতি’। গণতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক উভয় ধরনের ন্যায়পরায়ণতায় ভুল আছে। গণতান্ত্রিকরা সব নাগরিককে সমান মনে করেন, কারণ তারা জন্মসূত্রে স্বাধীন। ধনতান্ত্রিকরা অপরপক্ষে মনে করেন যে, নাগরিকদের মধ্যে কোন সমতা নেই তাই অর্থের দিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উভয় ধারণাই ভ্রান্ত কেননা, উভয় অভিমতই সমতা এবং অসমতা সম্পর্কে অত্যন্ত সংকীর্ণ ধারণাতে বিশ্বাসী। স্বাধীন জন্ম এবং ধনের দ্বারাই বিচার করা যেতে পারে না, দুটি মানুষ সমান কিনা। কেননা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সমতা ও অসমতার বিচার করতে গেলে আমাদের জন্ম এবং অর্থ ছাড়াও অন্য গুণাবলি, বিশেষ করে মানুষের নৈতিক এবং বুদ্ধিগত গুণগুলো বিচার করে দেখা প্রয়োজন।
  • প্রতিটি মানুষের যা প্রাপ্য তাকে তাই দেয়াই হল ন্যায়পরায়ণতা। কিন্তু যা তার প্রাপ্য, তা সকল ক্ষেত্রেই এক রকম হতে পারে না। সমগুণবিশিষ্ট লোক সমান অংশীদার হবেন কিন্তু যাদের গুণগত শ্ৰেষ্ঠতা রয়েছে তাদেরকে তাদের থেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এক করে দেখা যুক্তিসঙ্গত নয়। যা সরকারের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করে তা হল আনুপাতিক সমতা (Proportional Equality)।
  • রাষ্ট্রের লক্ষ সমগ্র সমাজের কল্যাণ করা। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শাসনতন্ত্র হল সেটি যেখানে প্রতিটি লোক, সে যেই হােক না কেন, সবচেয়ে ভালভাবে কাজ করতে পারে এবং আনন্দে বসবাস করতে পারে। কিন্তু আনন্দ সৎ কাজের ওপর নির্ভরশীল। তাই কতখানি আনন্দ মানুষ লাভ করবে তা নির্ভর করছে কতখানি সততা সে অনুশীলন করতে সক্ষম। নাগরিকই কেবলমাত্র রাজনীতিবিদ এবং দার্শনিকদের সৎ গুণগুলো অনুশীলন করতে পারে এবং সেই কারণে সে একাই পরিপূর্ণ আনন্দ লাভে সক্ষম। কিন্তু সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের লক্ষ হল তার সভ্যদের সততা অনুশীলনের জন্য তাদের বিভিন্ন ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে সমর্থ করা।
  • বড় রাষ্ট্র কখনও সুশাসিত হয় না। কেননা একটা বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য রাষ্ট্রের যতখানি বড় হওয়া দরকার, ততখানি বড় হওয়া উচিত, কিন্তু এতখানি বড় হওয়া উচিত নয় যাতে সুশাসন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সােজা কথায়, রাষ্ট্র ততখানি বৃহৎ হওয়া উচিত যাতে রাষ্ট্রের যেটি লক্ষ সেটি লাভ করা যেতে পারে। রাষ্ট্র ছােট হওয়া দরকার যাতে নাগরিকরা পরস্পরকে জানতে পারে, তা না হলে নির্বাচন এবং মামলা-মােকদ্দমার ক্ষেত্রে সুবিচার সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের জনসংখ্যা সীমিত হওয়া দরকার।
    অতিরিক্ত জনসংখ্যা দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, যা পরিণতিতে বিপ্লব ঘটায়। রাষ্ট্র ছােট হওয়া দরকার যাতে পর্বতের উপর থেকে তাকে নিরীক্ষণ করা যায়। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • নাগরিকরা কখন বিবাহ করবে এবং তাদের সন্তান হবে সেই সম্পর্কে আইন সাধারণ সীমা নির্ধারণ করে দেবে। অতিরিক্ত শিশু সন্তান সম্পর্কে তার বক্তব্য হল যে, যে শিশুর দেহ বিকৃত, এমন শিশুকে বাচিয়ে রাখা সমীচীন নয় এবং প্রয়োজনে গর্ভপাত সমর্থনযোগ্য। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • যেসব ব্যক্তি জীবিকার জন্য কাজ করে তাদের নাগরিকতায় কোন অধিকার থাকবে না। রাষ্ট্রে কৃষক, কারিগর প্রভৃতির প্রয়োজন আছে কিন্তু নাগরিকত্বে তাদের অধিকার থাকবে না। নাগরিকেরা মিস্ত্রি, কারিগরের পেশা গ্রহণ করবে না। কেননা এ ধরনের জীবন অসম্মানজনক এবং সৎ জীবন যাপনের পক্ষে ক্ষতিকর। নাগরিকেরা কৃষক হবে না, কেননা, তাদের অবসরের প্রয়োজন। যোদ্ধারাই হল পরিপূর্ণ অর্থে নাগরিক। এরা যৌবনে যোদ্ধা হবে, মধ্যবয়সে শাসনকর্তা এবং বৃদ্ধ বয়সে পুরোহিত হবে। নাগরিকের একখণ্ড জমি থাকবে নগরের কাছে এবং আর একখণ্ড জমি থাকবে রাষ্ট্রের সীমান্তে। এর ফলে সকলেরই রাষ্ট্রকে রক্ষা করার ব্যাপারে আগ্রহ জাগবে। এই জমির কাজ করবে এমন কোন ব্যক্তি যে নাগরিক নয়।
  • শিক্ষা শুরু হবে দেহকে কেন্দ্র করে এবং দেহের কামনা-বাসনা নিয়ে, কারণ আত্মার তুলনায় দেহ এবং তার কামনা-বাসনা বহু পূর্বে বিকশিত হয়। তবে আত্মার জন্যই দেহের এবং বিচারবুদ্ধির জন্যই কামনা-বাসনার শিক্ষণ প্রয়োজন। তাই শিক্ষা হল মূলত নৈতিক শিক্ষা, কেননা নাগরিক কখনও কারিগরের বৃত্তি গ্রহণ করে তার জীবিকা নির্বাহ করবে না। তাকে শিক্ষা লাভ হবে ভাল সৈনিক বা ভাল শাসনকর্তা হবার জন্য। যারা ক্রীতদাস, তাদের হয়ত রন্ধনকার্য বা অন্যান্য কাজ শেখানো যেতে পারে। কিন্তু এগুলো শিক্ষার কোন অঙ্গ নয়।
  • যে শাসনতন্ত্রের অধীনে শিশুরা থাকবে, সেই শাসনতন্ত্রের দিকে লক্ষ রেখেই তাদের শিক্ষিত করতে হবে। শাসনব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক, সেই অনুসারে শিক্ষারও হেরফের হবে। নাগরিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকার থাকবে। শিশুরা তাদের পক্ষে যা প্রয়োজনীয় তা শিক্ষা করবে কিন্তু এমন কোন কিছু শিক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হবে না যা তাদের দেহকে বিকৃত করে বা তাদের শুধু অর্থ রোজগারের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। তারা মল্লক্রীড়া অভ্যাস করবে তবে তার মাত্রা থাকবে। পেশাদারী দক্ষতা অর্জনে তাদের আগ্রহী হওয়া উচিত হবে না। শিশুরা চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করবে, ভাস্কর হবে, তবে তাদের এমন চিত্রাঙ্কন এবং ভাস্কর্য শিক্ষা করা উচিত, যা নৈতিক ধারণার প্রকাশক। তারা গান-বাজনা শিক্ষা করবে এমনভাবে, যাতে তারা সঙ্গীতের সমালোচক হতে পারে, কিন্তু খুব বেশি দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হওয়া সমীচীন হবে না। তারা অবশ্যই লিখতে ও পড়তে শিখবে যদিও চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, সঙ্গীত প্রভৃতির ব্যবহারিক উপযোগিতা রয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য সততা অর্জন, উপযোগিতা নয়।
  • যুদ্ধ এবং অপরের ওপর প্রাধান্য স্থাপন রাষ্ট্রের লক্ষ হতে পারে না। সৎ জীবনের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিকে যে নৈতিক নিয়ম মেনে চলতে হয়, রাষ্ট্রকেও একই নৈতিক নিয়ম মেনে চলতে হয়। একই বিষয় ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়ের পক্ষে শ্রেয়। আইনপ্রণেতা শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যেই তার সামরিক শক্তিকে কাজে লাগাবে। একমাত্র যুদ্ধের সময়ই সামরিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্থায়ী হয়, যুদ্ধ শেষ হলে তার পতন অনিবার্য। সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক সম্পদ বৃদ্ধির অভিলাষ সমর্থনযোগ্য নয়। (প্লেটো প্রভাবিত)

নন্দনতত্ত্ব ও ললিতকলা

  • যা নিছক ইন্দ্রিয় সুখপ্রদ তার সঙ্গে সৌন্দর্যের পার্থক্য রয়েছে। ‘প্রবলেম্যাটা’ গ্রন্থে তিনি কাম-সুখের জন্য কোন বিষয়কে যখন নির্বাচন করা হয় এবং সৌন্দর্যের জন্য যখন কোন বিষয়কে নির্বাচন করা হয়— এ দুই ধরনের নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি মনে করেন মানুষ তার কামনাকে পরিতৃপ্তি করতে যা উপযোগী তাকে সুন্দর দেখে, কিন্তু এ সুন্দরের সঙ্গে, যা প্রকৃত বস্তুগত সুন্দর, তার পার্থক্য আছে। তাই যা শুধুমাত্র মানুষের ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে সেই নিছক সুখপ্রদ বিষয় কখনও সুন্দর বলে আখ্যাত হতে পারে না।
  • সুন্দর হল সেই কল্যাণ যা সুখপ্রদ, কারণ এটি কল্যাণকর। সুন্দর এবং কল্যাণ অভিন্ন নয়। এটা গতিহীন বস্তু, যেমন একটা টেবিলও সুন্দর হতে পারে, কিন্তু কল্যাণ বা ভালত্বের সম্পর্ক শুধুমাত্র মানুষের আচরণের সঙ্গে।
  • শৃঙ্খলা, সঙ্গতি এবং সুনির্দিষ্টতা— এ তিনটি বৈশিষ্ট্যই কোন বস্তুতে সৌন্দর্য আরোপ করে। সৌন্দর্য হল আকার এবং শৃঙ্খলার বিষয়। একটি জীবনকে তখনই সুন্দর বলা যাবে যখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিণ্যাসের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা থাকে এবং যখন তার আকারের মধ্যেও একটা সঙ্গতি থাকে, অর্থাৎ আকারটি খুব ছােটও নয়, আবার খুব বড়ও নয়। যা সুন্দর তা মননের বস্তু, কামনার বস্তু নয়।
  • নৈতিকতা কাজের মধ্যেই নিহিত থাকে। ললিতকলা তার ক্রিয়ার মাধ্যমে যেটি সৃষ্টি করে, সেই বস্তুতেই নিহিত থাকে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে কর্মকর্তার উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, অনুভূতি এগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো নৈতিক ক্রিয়ারই অঙ্গ। কিন্তু ললিতকলার ক্ষেত্রে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। সৃষ্ট বস্তুটি কিভাবে সৃষ্ট হল ললিতকলার ক্ষেত্রে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যা সৃষ্ট হল , তার উৎকর্ষ থাকা প্রয়োজন, কেননা তার দ্বারাই ললিতকলার উৎকর্ষ নির্ধারিত হয়।
  • সজীব প্রাণী সন্তান-সন্ততির জন্ম দেয়। তাই, যেহেতু এখানেও সৃষ্টির ব্যাপার রয়েছে , তাই ললিতকলার সঙ্গে সৃষ্টির ব্যাপারে এর মিল রয়েছে। কিন্তু সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে জীব কেবল নিজেকেই সৃষ্টি করে। মানুষ মানুষ সৃষ্টি করে, নিম্নতর প্রাণী নিম্নতর প্রাণীর জন্ম দেয়, উদ্ভিদ উদ্ভিদ সৃষ্টি করে। কিন্তু ললিতকলার ক্ষেত্রে কলাবিদ নিজের থেকে পৃথক কিছু সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে কোন কাব্য, কোন চিত্র, বা কোন মূর্তি।
  • সাধারণভাবে কলা দুপ্রকার। এক ধরনের কলার উদ্দেশ্য প্রকৃতির কাজকে সম্পূর্ণ করা। আর এক ধরনের কলার উদ্দেশ নতুন কিছু সৃষ্টি করা। প্রথম ধরনের কলার উদাহরণ হল চিকিৎসাবিদ্যা। যেসব ক্ষেত্রে প্রকৃতি নীরোগ দেহ সৃষ্টি করতে পারেনি, চিকিৎসার দ্বারা রুগ্ন দেহকে নীরোগ করে তুলতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ চিকিৎসক প্রকৃতি যে কাজ শুরু করেছে তাকে সম্পূর্ণ করতে চায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কলা হলো অনুকরণমূলক কলা, এক্ষেত্রে কলাবিদ একটি কাল্পনিক জগৎ সৃষ্টি করে, যা বাস্তব জগতের অনুকরণ।
  • কলা হল মূলেরই অনুকরণ নকল। কলার বিষয়বস্তু কোন বিশেষ বস্তু নয়, বিশেষের মধ্য দিয়ে যে সার্বিকের প্রকাশ ঘটে, তাই কলার বিষয়বস্তু। বস্তুর আদর্শরূপকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হন কলাবিদ। বিশেষ বস্তুর একটা আদর্শরূপ শিল্পীর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। ভাস্কর কোন ব্যক্তি মানুষকে (Individual Man) মূর্তির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন না। তিনি তাকে এক চিরন্তন অস্থায়ী রূপায়ণ হিসেবে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ শিল্পীর কাজ বিশেষের মধ্যে সার্বিককে প্রত্যক্ষ করা। প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তু হল আকার এবং উপাদানের, বিশেষ এবং সার্বিকের সংমিশ্রণ। কলার কাজ হল তার মধ্যে যে সার্বিক আছে তাকে প্রদর্শিত করা। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • অনুকরণ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক এবং অনুকরণ ক্রিয়া থেকে আনন্দ পাওয়াও মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কোন কিছু শিল্পসুলভ হলে, তা দুঃখজনক হলেও, আমরা তা দেখে আনন্দ পাই।
  • কাব্য ইতিহাসের তুলনায় গভীরতর অর্থবহ এবং দার্শনিক ভাবসম্পন্ন। এর কারণ, কাব্যের কাজ সার্বিক বিবৃতি নিয়ে, ইতিহাসের কাজ বিশেষ বিবৃতি নিয়ে। সার্বিক বিবৃতি হলো এক ধরনের লোক স্বভাবত যা বলে বা অনিবার্যভাবে যা বলে থাকে। বিশেষ বিবৃতি বলতে কোন বিশেষ লোক কি বলে বা করে। কাব্য ও ইতিহাসে এখানেই পার্থক্য, বিষয়বস্তু কবিতায় লেখা হয়েছে বা গদ্যে লেখা হয়েছে – এটাই পার্থক্য নয়।
  • শিল্পীর কাজ হল টাইপ (Type) নিয়ে, যা আদর্শের সমজাতীয়। ইতিহাসের কাজ বিশেষ ঘটনা লিপিবদ্ধ করা আর কাব্যের কাজ সার্বিক সত্য নিয়ে। কবি ইতিহাস থেকে কোন ঘটনা নির্বাচন করতে পারেন কিন্তু তিনি যদি যা সম্ভব এবং সম্ভাব্য তারই বর্ণনা করেন, তাহলে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হলেও তিনি কবি বলে আখ্যাত হবেন। ইতিহাস বিশেষকে বিশেষ হিসেবেই প্রত্যক্ষ করে। এর কাজ যা ঘটেছে অর্থাৎ শুধু তথ্য নিয়ে। এর সত্যতা হল নির্ভুল হওয়া, সুনির্দিষ্ট হওয়া। এখানে কোন শাশ্বত সত্যের স্থান নেই, যা অস্থায়ী এবং নশ্বর তার স্থান আছে। কিন্তু কলার বিষয় হল বস্তু এবং ঘটনার মধ্যে নিহিত আন্তর সারধর্ম যার কোন বিকাশ নেই। তাই দর্শন, কলা এবং ইতিহাসের মধ্যে মহত্ত্ব এবং সত্য প্রকাশের দিক থেকে স্থান নিরূপণ করতে গেলে দর্শনের স্থান প্রথম, কলার স্থান দ্বিতীয় এবং ইতিহাসের স্থান তৃতীয়। কেননা, দর্শনের কাজ শুধু সার্বিককে নিয়ে। কলার স্থান দ্বিতীয় কেননা, কলার কাজ হল বিশেষের মধ্যে যে সার্বিক আছে তাকে নিয়ে। আর ইতিহাসের স্থান সর্বশেষে, কারণ তার কাজ শুধু বিশেষকে নিয়ে।
  • কাব্যের বিবৃতি বিশুদ্ধ প্রত্যয় নিয়ে নয়, কাব্য দর্শন নয়। কলার দর্শনকে অনুকরণ করা উচিত নয়, কারণ এ জগতে প্রত্যেকেরই তার যথাযোগ্য ক্রিয়া আছে যা সে সম্পাদন করবে। কবির উচিত হবে না তার কাব্যকে অমূর্ত চিন্তনের বাহন করে তোলা। কাব্যের কাজ বিশেষের মধ্যে যে সার্বিকের প্রকাশ তাকে নিয়ে, শুদ্ধ সার্বিক নিয়ে নয়।
  • পরমতত্ত্ব হল চিন্তন (Thought), বিচারবুদ্ধি (Reason) ও সার্বিক (Universal)। এ পরমতত্ত্বের মনন হল দর্শন এবং কলার বিষয়বস্তু। কলা পরমতত্ত্বের স্বরূপ যেমন, সেই ভাবেই তাকে প্রত্যক্ষ করে না, কিন্তু দর্শন (philosophy) তা করে। তাই দর্শন হল পরিপূর্ণ সত্য। তবে দর্শন কলার থেকে উচ্চতর বা শ্রেষ্ঠ হলেও, দর্শনের জন্য কলার অবদমন সমর্থনযোগ্য নয়। দর্শনের একটা বৈশিষ্ট্য হল উচ্চতর নিম্নতরকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং সমগ্রের ক্ষতি না করে নিম্নতরকে বাতিল করা চলে না। তাই দর্শন মানুষের আধ্যাত্মিক ক্রিয়ার পরম অবদান হলেও, কলার নিজ অধিকার রয়েছে এবং কলা নিজেই তার পরম লক্ষ। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • নাটকের কাহিনী ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ কলার যেটি উদ্দেশ্য, সার্বিক (Universal) -কে প্রদর্শিত করা, সেই কাজটি বাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেমন, কাল্পনিক ঘটনার মধ্য দিয়েও সম্পন্ন হতে পারে।
  • নাটক দুধরনের বিয়োগান্তক (Tragedy) এবং মিলনান্তক (Comedy)। বিয়োগান্তক নাটক হল এমন কাজের অনুকরণ যা গুরুত্বপূর্ণ, যার বিশালতা বা বিরাটত্ব আছে এবং যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিয়োগান্তক নাটকের অনুষঙ্গ হল সুখ। এটি বিবৃতিমূলক হবে না, নাটকের আকারে উপস্থাপিত হবে। এতে এমন ঘটনা সন্নিবিষ্ট হবে যা করুণা এবং ভয়ের উদ্রেক করে। বিয়োগান্তক নাটকে এ ধরনের আবেগের বিশােধন হয়। বিয়োগান্তক নাটকের বিষয় হবে গুরুত্বপূর্ণ, মহৎ, কল্যাণকর। বিয়োগান্তক নাটকের কাজ নয় যা বাস্তবে ঘটেছে তাকে বর্ণনা করা, যা ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা যায় তাকে বর্ণনা করা। তার অর্থ, এ নাটক যিনি রচনা করবেন তিনি বাস্তব অতীত ঘটনা বা নিজের মনের এলোমেলো কাল্পনিক ঘটনাকেও বিবৃত করবেন না। তিনি এমন ঘটনা বিবৃত করবেন যার ঘটবার সম্ভাবনা আছে। মহাকাব্যের সঙ্গে বিয়োগান্তক নাটকের এ দিক থেকে সাদৃশ্য আছে। মিলনান্তক নাটক এবং বিদ্রুপাত্মক রচনা (Satire)-র বিষয়বস্তু হল, কুৎসিত, নিকৃষ্ট এবং হাস্যকর বিষয়। তাই বিয়োগান্তক নাটকের সঙ্গে মিলনান্তক নাটক এবং বিদ্রূপাত্মক রচনার পার্থক্য আছে। বিয়োগান্তক নাটক হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর অর্থ হল, এর কাহিনীর মধ্যে থাকবে একটা ঐক্য এবং এর গঠনে থাকবে একটা আঙ্গিক ঐক্য। স্থান, কাল ও ক্রিয়া— এ তিনের ঐক্য থাকবে নাটকে। বিয়োগান্তক নাটকের অনুষঙ্গ সুখ, এর অর্থ হল বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে ছন্দ, ঐকতান (Harmony) এবং সঙ্গীত। বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে ছন্দবদ্ধ কথােপকথন এবং সঙ্গীত। বিয়োগান্তক নাটক বিবৃতিমূলক হবে না, হবে নাটকীয়। এখানেই মহাকাব্যের সঙ্গে বিয়োগান্তক নাটকের পার্থক্য।
  • বিয়োগান্তক নাটকের ছটি আকারমূলক উপাদান রয়েছে – কাহিনী, চরিত্র, ভাষা, চিন্তা, দৃশ্য এবং সুর। এ উপাদানগুলোর মধ্যে কাহিনীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা নাটকে কাহিনীর স্বার্থেই চরিত্র চিত্রণ। বিয়োগান্তক নাটক প্রধানত ব্যক্তির অনুকরণ নয়, কর্ম এবং জীবনের, সুখ এবং দুঃখের অনুকরণ। কাহিনীর পরেই চরিত্রের স্থান। বিয়োগান্তক নাটকে চিন্তা থাকবে। অর্থাৎ নাটকের বিভিন্ন চরিত্র যা বলছে তার একটা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু থাকবে। বিয়োগান্তক নাটকের ভাষা হবে গদ্য এবং পদ্য, এবং এতে সুর বা সঙ্গীত থাকবে। দৃশ্যপট বিয়োগান্তক নাটকের সর্বশেষ উপাদান। মানুষের মনকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা দৃশ্যপটের রয়েছে। তবে দৃশ্যপটের তুলনায় নাটকের কাহিনী এবং চরিত্র চিত্রণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিয়োগান্তক নাটকের সাফল্য নির্ভর করে আকর্ষণীয় কাহিনী ও সার্থক চরিত্র চিত্রণের ওপর।
  • কাহিনী খুব বড় হবে না, কারণ বেশি বড় হলে তাকে স্মৃতিতে ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। আবার এমন ছােট হবে না যাতে তাকে ক্ষুদ্র এবং অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। কাহিনীর ঐক্য বলতে কোন একজন ব্যক্তির কাহিনী বোঝায় না বা নায়কের জীবনের সব ঘটনার বিবৃতি বোঝায় না। কাহিনীর ঐক্য বলতে বোঝায়, ঘটনাগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে, একটিমাত্র ঘটনাকেও যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সমগ্রের সংযোগ ব্যাহত হবে। বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকবে এবং সম্ভাব্যতা বা অনিবার্যতার সঙ্গে একে অপরকে অনুসরণ করবে। বিয়োগান্তক নাটকের যে ঐক্য, তা হল কাহিনীর মধ্যে নিহিত যে ক্রিয়া তার ঐক্য, চরিত্রের ঐক্য নয়। ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’- তে এ ঐক্য দেখা যায় কারণ হােমার এমন কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা এক অখণ্ড সমগ্রতা এবং কোন ক্ষেত্রেই তিনি প্রধান চরিত্র একিলিস্ বা ওডিসিয়াস-এর সমগ্র ইতিহাসকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেননি।
  • বিয়োগান্তক নাটকে যে কর্মের কথা চিত্রিত হবে তা হবে এক সমগ্র- এর একটা শুরু থাকবে, একটা মধ্য থাকবে এবং একটা অন্ত থাকবে। শুরুর অর্থ হল এমন কিছু বা অন্য কিছুর অনিবার্য পরিণতি নয় বরং যাকে অন্য কিছু অনুসরণ করে। আর অন্ত বা শেষ হল যা অন্য কিছুকে অনুসরণ করে, কিন্তু যাকে আর কিছু অনুসরণ করে না। সুগঠিত কাহিনী খেয়ালখুশি মত শুরু বা শেষ হবে না। এটি হবে এক অখণ্ড সমগ্রতা। কাহিনী সরল এবং জটিল হতে পারে, জটিল কাহিনী সরল কাহিনীর থেকে শ্রেষ্ঠ। বিয়োগান্তক নাটকের কাহিনীর প্রকৃতি ও অ্যারিস্টটলের মতে, যে কাজ করুণা এবং ভয় উদ্রেক করে বিয়োগান্তক নাটক তার অনুকরণ। সেই কারণে তিন ধরনের কাহিনী বা আখ্যায়িকা বিয়োগান্তক নাটকের কাহিনী হতে পারে না। প্রথমত, সৎ ব্যক্তি সুখের অবস্থা থেকে দুঃখের অবস্থায় পতিত হচ্ছে, এমন ঘটনা বিয়োগান্তক নাটকের কাহিনীতে স্থান পাবে না, কেননা এ জাতীয় ঘটনা আমাদের বিরক্তি এবং ভীতির সঞ্চার করবে যার ফলে মনে করুণা জাগবে না। দ্বিতীয়ত, একজন অসৎ ব্যক্তি দুঃখের অবস্থা থেকে সুখের অবস্থায় উপনীত হচ্ছে, এমন ঘটনাও বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে না, কেননা এ জাতীয় ঘটনা আমাদের মনে করুণা বা ভীতি কোন আবেগই সৃষ্টি করে না। তৃতীয়ত, একজন অত্যন্ত অসৎ ব্যক্তি সুখের অবস্থা থেকে দুঃখের অবস্থায় উপনীত হতে চলেছে, এমন ঘটনাও বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে না, এ জাতীয় ঘটনা মানুষের মনে অনুভূতি জাগিয়ে তুললেও করুণা বা ভয় কোনটিই সৃষ্টি করবে না। কারণ যার দুঃখ পাওয়ার কথা নয়, সে দুঃখ পেলে আমাদের মনে করুণা জাগে বা আমাদের মত ব্যক্তি দুর্ভাগ্যে পতিত হলে মনে ভয় জাগে।
  • বিয়োগান্তক নাটকের চরিত্র ও বিয়োগান্তক নাটকে এমন চরিত্র চিত্রিত হবে দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে যার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তির দুর্ভাগ্য তার চরিত্রের অসততা বা নৈতিক চরিত্র কলুষিত হওয়ার জন্য নয়, তার কোন ভুলের জন্য। বিয়োগান্তক নাটক যে করুণা এবং ভয় মানুষের মনে জাগাবে, তা নাটকের ঘটনার দ্বারাই মানুষের মনে জাগাতে হবে। কোন ভয়ঙ্কর ঘটনার দ্বারা নয়, অর্থাৎ কিনা, রঙ্গমঞ্চে কোন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তা করা চলবে না।
  • বিয়োগান্তক নাটকের মনস্তাত্ত্বিক লক্ষ হল মানুষের মনে করুণা এবং ভয় জাগানো। তিনি এ দুই আবেগের রেচন (Catharsis) এর কথা বলেছেন। ‘রেচন’ দুপ্রকার – (১) রেচন হল করুণা এবং ভীতি নামক আবেগের বিশুদ্ধিকরণ (Purification)। (২) রেচন হল করুণা এবং ভীতির সাময়িক অপসারণ। দ্বিতীয় অভিমতই বর্তমানে গৃহীত। এ মতানুসারে বিয়োগান্তক নাটকের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য করুণা এবং ভীতি মানুষের মনে জাগিয়ে তোলা। নায়কের অতীত এবং বর্তমান দুঃখের জন্য করুণা এবং ভবিষ্যতে নায়কের যে সব দুঃখ ভােগের সম্ভাবনা আছে, তার জন্য ভীতি। বিয়োগান্তক নাটকের পরোক্ষ উদ্দেশ্য হল শিল্পকলার মাধ্যমে মন থেকে এই আবেগের নির্দোষ এবং সুখদায়ক বহির্গমন। করুণা এবং ভীতি এ আবেগ বা প্রক্ষোভগুলোর যখন আধিক্য ঘটে তখন তারা অবাঞ্চিত, কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তিই এ দুই আবেগের অধীন। তাই সময়ে সময়ে এ আবেগের উত্তেজনা এবং শিল্পকলার মধ্য দিয়ে তাকে স্তিমিত করার যে ব্যবস্থা তা ব্যক্তির পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং হিতকর। বিয়োগান্তক নাটকের কোন নীতিবিগর্হিত প্রভাব নেই, বরং এ হল এক নির্দোষ শিল্পকর্ম যা মানুষের আনন্দ বিধান করে।
  • সঙ্গীতের তিনটি উদ্দেশ্য আছে যার জন্য সঙ্গীত শিক্ষা করা দরকার – (১) শিক্ষা, (২) বিশুদ্ধিকরণ এবং (৩) বুদ্ধিগত আনন্দ উপভােগ, অবকাশ বিনোদন এবং পরিশ্রমের পর আমােদ-প্রমােদের দ্বারা চিত্ত বিনোদন। বিশুদ্ধিকরণ হল মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে মনকে হাল্কা করা। সঙ্গীতের সাহায্যে যে আনন্দ লাভ করা যায় তা মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে সাহায্য করে। এখানে ‘বিশুদ্ধিকরণ’ কথাটির কোন নৈতিক তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না।

এরিস্টোটল উত্তর দর্শন

স্পেউসিপ্পাস ও জেনোক্রেটিস (৩৯৬-৩১৪ খ্রি.পূ.)

  • শুধু অধিবিদ্যক ও গাণিতিক দিক থেকেই নয়, নৈতিক দিক থেকেও একত্ব ও বহুত্ব পরস্পরবিরোধী, এবং তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে শুধু সংখ্যাই নয়, আত্মারও সৃষ্টি।
  • প্রকৃতি আমাদের যেসব বৃত্তি ও শক্তিতে ভূষিত করেছে, তাদের পরিপূর্ণ ও সুসমঞ্জস কার্যকলাপের মধ্যেই সিগ্ধ আনন্দ নিহিত। শুধু তা-ই নয়, স্বাস্থ্য সম্পদ প্রভৃতি বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধার ওপরও আনন্দ নির্ভরশীল। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • মানবিক উৎকর্ষ বা পুণ্য সুখলাভের উপায় এবং সুখের এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)

হেরাক্লেডিস ও ইউডোসাস

  • ঈশ্বর তাঁর বুদ্ধি থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলিক অণুর সমবায়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। (পিথাগোরিয়ান স্কুল প্রভাবিত)
  • ঈথারীয় পদার্থ থেকেই জীবাত্মার সৃষ্টি।
  • সিরেনাইকদের সুখবাদ সঠিক। (সিরেনাইক স্কুল প্রভাবিত, প্লেটোর বিপরীতে)

থিওফ্রেস্টাস (৩৩১-২৮৭ খ্রি.পূ.)

  • সহানুমান প্রাকল্পিক (hypothetical) ও বৈকল্পিক (disjunctive)। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • প্রকৃতির ঘটনাবলিতে নিয়মানুবর্তিতা ও উদ্দেশ্যের সংকেত নাও থাকতে পারে। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • আত্মা দেহের ওপর নির্ভরশীল। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রেও বাহ্য পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাহ্য পরিস্থিতি আনন্দের আবশ্যিক উপকরণ নয়, বরং এগুলো সুখশান্তির পক্ষে উপদ্রব এবং উন্নত জীবনের পক্ষে প্রতিবন্ধক।

স্ট্র্যাটো (৩৩৫-২৬৯ খ্রি.পূ.)

  • এরিস্টটলের আদি চালকের জায়গায় প্রকৃতি কাজ করে। (ডেমোক্রিটাস প্রভাবিত, অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • ডেমোক্রিটাসের পরমাণু নয়, বরং উত্তাপ ও শৈত্য পদার্থের মৌল উপাদান। (ডেমোক্রিটাসের বিপরীতে)
  • সংবেদনশীল ও বিচারবুদ্ধিগত আত্মার মধ্যে পার্থক্য নেই। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • আত্মা একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শক্তি; আর এই শক্তির অধিষ্ঠান দেহ। দেহকে বাদ দিয়ে আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। (ডেমোক্রিটাস প্রভাবিত)

এপিকিউরিয়াস (৩৪২-২৮০ খ্রি.পূ.) ও এপিকিউরিয়ান স্কুল (আনু. ৩০৭ খ্রি.পূ. – খ্রিস্টীয় ৩য় শতক)

জ্ঞানতত্ত্ব

  • জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তি ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণই যথার্থ জ্ঞানের উৎস। আমরা যা শুনি দেখি অঘ্রাণ ও আস্বাদ করি, তা-ই বাস্তব ও সত্য। সংবেদন ছাড়া জ্ঞানের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যাকে অধ্যাস (illusion) বলি, তা ইন্দ্রিয়প্রতারণা নয়, ভুল অবধারণমাত্র। সংবেদনের যখন ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয় এবং এক বস্তুর সংবেদনকে যখন অন্য বস্তুতে আরােপ করা হয়, তখনই অধ্যাসের সৃষ্টি হয়। অবশ্য ইন্দ্রিয় প্রায়শই আমাদের বস্তু সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়ে থাকে। যেমন : পৃথিবী যে গতিশীল কিংবা দেশ ও কাল যে আপেক্ষিক – ইন্দ্রিয় আমাদের এ জ্ঞান দিতে পারে না। কিন্তু এজন্য আমরা ইন্দ্রিয়কে দোষারােপ করতে পারি না। বস্তুর অসতর্ক ব্যাখ্যাই এর কারণ। তবে আপন পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি ও অপরের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে নিজের পর্যবেক্ষণের তুলনা করে ভ্রান্ত অবধারণকে শুদ্ধ করা যায়। (ডেমোক্রিটাসপ্রোটাগোরাস প্রভাবিত, সক্রেটিস, প্লেটোঅ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • সংবেদনের প্রতীতি যেমন নিশ্চিত, সংবেদন থেকে প্রাপ্ত সাধারণ ধারণাবলিও তেমনি নিশ্চিত। (স্ট্র্যাটো প্রভাবিত)
  • প্লেটো ও এরিস্টটল যেসব এসেন্স বা অন্তঃসারের কথা বলেছেন, তাদের কোনাে বাস্তব অস্তিত্ব নেই। সাধারণ ধারণা অমূর্ত; আর বিশেষ বিশেষ বস্তু তাদের মূর্ত ও অস্তিত্বশীল রূপ। (প্লেটোঅ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • সংবেদন ও ধারণা ছাড়াও অনুমান করা ও অভিমত দেয়া সম্ভব; তবে এদের প্রতিপাদনের জন্য ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার সাহায্য নেয়া আবশ্যক। যেমন : ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা সাদা চোখে এটম বা পরমাণু প্রত্যক্ষ করতে পারি না। সুতরাং প্রত্যক্ষণের বিচারে পরমাণুর অস্তিত্ব একটি আনুমানিক ব্যাপার। পরমাণুকে বুঝে থাকি আমাদের সচরাচর অভিজ্ঞতার সাদৃশ্যানুমান (analogy) দ্বারা, এবং এই সাদৃশ্যানুমানের ভিত্তিতেই তাদের ওপর আমরা ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত গুণাবলি আরােপ করি। (ডেমোক্রিটাস প্রভাবিত)
  • জ্ঞান ও সত্যের মানদণ্ড সংবেদন। আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তাকেই জানি, এবং এ থেকে আমরা অনুমান করে থাকি যে, এখনও যা প্রত্যক্ষ করা হয়নি তার স্বভাবও হবে প্রত্যক্ষিত বস্তুর স্বভাবের মতাে। (ডেমোক্রিটাস প্রভাবিত)

অধিবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্ব

  • ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা শুধু জড়বস্তুকেই প্রত্যক্ষ করে থাকি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, শুধু জড়বস্তুই অস্তিত্বশীল। জড়বস্তুকে ধারণ ও পরিচালনার জন্য শূন্যদেশের অস্তিত্ব অপরিহার্য।
  • অনপেক্ষ সৃষ্টি ও অনপেক্ষ ধ্বংস বলে কিছুই নেই। পদার্থের উৎপত্তি বৃদ্ধি পরিবর্তন ও বিলােপের কারণ কতিপয় মৌল উপকরণের সংযােগ ও বিয়ােগ। এসব উপকরণ জড়পদার্থের সূক্ষ্মতম, অবিভাজ্য ও অপরিবর্তনীয় অণুবিশেষ।
  • অণুগুলাের স্বভাব পরিপূর্ণ। অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোনাে শূন্যদেশ নেই। এছাড়া তারা কঠিন ও অচ্ছেদ্য; সুতরাং তাদের ভেঙে বা কেটে ছােট করা চলে না। জড়ের সূক্ষ্ম অচ্ছেদ্য উপকরণ বলেই এদের পরমাণু বলা হয়।
  • পরমাণুগুলাের মধ্যে আকার, আকৃতি ও পরিমাণগত পার্থক্য রয়েছে, এবং এসব পার্থক্যের ফলেই এরা পরস্পর পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র।
  • পরমাণুরা নিয়ত পরিবর্তনশীল। এরা যেমন অসংখ্য, তেমনি এদের ধারণ করার জন্যও রয়েছে এক অনন্ত দেশ, এক অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
  • অনপেক্ষ আবশ্যিকতা ভুল, কারণ এ ধরনের নিয়ন্ত্ৰণবাদ মেনে নিলে নৈতিক শিক্ষার আর কোনাে অর্থই থাকে না। যেমন, আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম এক পূর্বনির্দিষ্ট ব্যবস্থার অধীন হলে মানুষ অদৃষ্টবাদই স্বীকার হবে। এতে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার কোনাে অবকাশ থাকে না; আর যেখানে স্বাধীন ইচ্ছা নেই সেখানে নৈতিকতার প্রশ্ন ওঠে না।
  • পরমাণুগুলাের যান্ত্রিকভাবে বা নিয়ন্ত্রণবাদী হয়ে কাজ করেনা, বরং এদের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে। এ জন্যই তারা চলার সময় তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। পরমাণুগুলাের মধ্যকার গতির ফলে যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়, তাতে তারা সংযুক্ত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন পৃথিবী গঠন করে। ভারি পরমাণুগুলাে হাল্কা পরমাণুর চেয়ে দ্রুততার সাথে নিচের দিকে পড়ে। নিয়ন্ত্রণবাদে বিশ্বাস করলে একথা স্বীকার করতে হবে যে, ভারি ও হাল্কা পরমাণুগুলাের মধ্যে সংযােগ সম্ভব নয়; আর পরমাণুগুলাের সংযােগ ব্যতিরেকে জগৎ গঠিত হতে পারে। কোনাে বাহ্য শক্তি দ্বারা পরিচালিত না হয়ে পরমাণুগুলাে স্বাধীনভাবে তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে বলেই বিশ্বের বিভিন্ন গ্রহের উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। (ডেমোক্রিটাসের বিপরীতে)
  • প্রকৃতিজগতের মত মানবিক ক্রিয়াকলাপেও তেমনি স্বাধীনতা বিদ্যমান।
  • দেবতারা অস্তিত্বশীল, যদিও তাদের নিবাসস্থল মানুষ থেকে বহু দূরে। দেবতারা মানুষের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। মানুষের সাথে দেবতাদের যােগাযােগ সার্বক্ষণিক, এ প্রচালিত। ধর্মমত ভুল। দেবতারা মানুষের ধার ধারেন না, মানুষের কোনাে ব্যাপারে হস্তক্ষেপও করেন না। দেবতাদের আকৃতি মানুষের মতো, তবে তারা মানুষের চেয়ে ঢের বেশি সুদর্শন। পুরুষ ও মহিলা উভয় জাতীয় দেবতা আছেন। তারা মানুষের ন্যায় পানাহার করেন এবং গ্রিক ভাষায় কথা বলেন। দেবতারা পরম শান্তিতে বসবাস করেন। অপূর্ণ কামনা বলতে তাদের কিছুই নেই। তারা পরম সুখী। তাদের রাগ দ্বেষ কামনা বাসনা নেই এবং মানুষের কোনাে দুর্বলতাই তাদের কাছে স্থান পায় না। সুতরাং তাদের পক্ষে পার্থিব কারে হস্তক্ষেপ করা অসম্ভব। তারা চিরশান্তিতে নিমগ্ন। সংসার থেকে বহু দূরে থাকায় মানুষের মানুষের দুঃখ-দৈন্য বা কাতরতায় তারা বিচলিত হন না। মানবজীবনের ওপর তাদের কোনাে আধিপত্য নেই। জগতে ভৌতিক ও অলৌকিক বলে যেসব ঘটনার উলেখ আছে সেগুলাের কোনােটিই সত্য নয়। দেবতাদের সাথে মানুষের কোনাে সম্বন্ধ নেই। সুতরাং দেবতাদের ভয়ে ভীত হয়ে মানুষের দুঃখের পরিমাণ বৃদ্ধি করার কোনাে যৌক্তিকতা নেই।

মনােবিদ্যা ও নীতিবিদ্যা

  • অন্যান্য পরমাণুর ন্যায় আত্মাও জড়পদার্থ দ্বারা গঠিত। তা না হলে আত্মার কর্মস্পৃহা ও সুখ-দুঃখের অনুভূতি বলে কিছু থাকত না। আত্মা যেসব পরমাণুর সমবায়ে গঠিত সেগুলাে মসৃণ, ক্ষুদ্র ও গােলাকার। আত্মাই দেহের সব সংবেদন ও অনুভূতির কারণ। আত্মা জড় থেকে উদ্ভূত বলে দেহবিনাশের সাথে আত্মাও বিনষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং মৃত্যুর পর নরকযন্ত্রণার আশঙ্কা নেই। মৃত্যু মানেই চেতনার বিলুপ্তি। এরপর আত্মার আবার জীবনলাভের প্রশ্ন ওঠে না। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়, মৃত্যুর কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়। আসলে এটি একটি কুসংস্কার। সুতরাং একে পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। দেবতা ও মৃত্যুভয় মানুষের পার্থিব সুখের প্রধান অন্তরায়। মরণােত্তর জীবনের ধারণা পরিহার করলেই মানুষ জীবনে সুখী হতে পারে; কেননা তখন সে বুঝতে পারে যে, মৃত্যু মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর কিছু নয়। মৃত্যুর পর দেহের সঙ্গে মানুষের সব সম্পর্কই লােপ পায় এবং তখন মানুষের কোনাে বােধশক্তিও থাকে না। আর তা থাকে না বলেই মৃত্যুর ভালাে-মন্দ কিছুই মানুষ বুঝতে পারে না। অর্থাৎ মৃত্যুর পর সবই ফুরিয়ে যায়। সুতরাং মৃত্যুকে ভয় করার কোনাে কারণ নেই।
  • মরণােত্তর জীবন বলে যদি কিছু না থাকে তাহলে মৃত্যুর ভয়ে আমরা সুখভােগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার মানে হয়না। মানুষের গােটা প্রকৃতিটাই সুখের ওপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু মানুষ নয়, ইতর প্রাণীরাও এক প্রবৃত্তিবশে জন্মমুহূর্ত থেকে সুখের সন্ধান ও দুঃখ পরিহারের চেষ্টা করে। সুতরাং সুখই পরম শুভ। সুখই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। সব সুখই শুভ, আর সব দুঃখই অশুভ। তবে সুখের মধ্যেও তারতম্য আছে। সিরেনিক স্কুলের এরিস্টিপাস যেমন ক্ষণিকের সুখকেই কাম্য বলেছেন তা ভুল, সারা জীবনব্যাপী স্থায়ী তৃপ্তিই প্রকৃত সুখ। যা জীবনের শুভ বা পুরুষার্থ বলে গণ্য, তা আপাতমধুর দৈহিক সুখ নয়। প্রকৃত সুখ স্থায়ী; প্রকৃত সুখ মানে মনের সুখ বা তৃপ্তি, এবং এতে উচ্ছৃঙ্খল জীবনের আবেগ-স্পন্দন নেই। মনের সুখ ইন্দ্রিয়সুখের চেয়ে বেশি কাম্য; কারণ মনের সুখ স্থায়ী, আর ইন্দ্রিয়সুখ ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃত সুখ দৈহিক নয়, আধ্যাত্মিক। অতীতের স্মৃতি ও ভবিষ্যতের আশার সাথে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সুতরাং ক্ষণিকের দৈহিক সুখ জ্ঞানীব্যক্তির কাম্য হতে পারে না। দৈহিক যন্ত্রণার মধ্যেও জ্ঞানীব্যক্তি সুখের সন্ধান পেতে পারেন। বস্তুত, কতকগুলো জিনিস আপাতকষ্টকর হলেও পরিণামে সুখকর। যেমন, অস্ত্রোপচার বেদনাদায়ক থেকে পরিণামে স্বাস্থ্যজনিত সুখের উৎপত্তি হয়। অতএব এ ধরনের কাজ কল্যাণকর।
  • সুখ সদর্থক ও নঞর্থক – দুই রকম। সদর্থক সুখ হলো সুখের বাস্তব অনুভূতি; আর নঞর্থক সুখ হলো সেই মানসিক অনুভূতি বা প্রশান্তি যা দুঃখের অনুপস্থিতি থেকে দূরে রাখে। কাম্য বা শুভ সুখ হলো নঞর্থক সুখ বা দুঃখের অভাব, এটিই প্রকৃত সুখ ও দুঃখ-কষ্টের অবসান। যথার্থ সুখলাভের জন্য মানুষের চেষ্টা করা উচিৎ।
  • সুখ (pleasure) ও আনন্দ (happiness) ভিন্ন। দৈহিক বা কামজ ক্রিয়াকলাপ বড়জোর ক্ষণিকের সুখ দিতে পারে, স্থায়ী আনন্দ নয়। আনন্দই জীবনের পরমশুভ বা পুরুষার্থ। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সমাজের উৎপত্তি। আত্মস্বার্থ নীতিই সামাজিক জীবনের ভিত্তি। আত্মরক্ষার জন্যই বিভিন্ন ব্যক্তি মিলিত হয়ে সমাজ গঠন করে। ন্যায়পরতা অধিকার দায়িত্ববােধ প্রভৃতি সামাজিক চুক্তির ফলশ্রুতি। অনপেক্ষ ন্যায়পরতা বলে কিছু নেই। আর তথাকথিত প্রাকৃতিক অধিকারসমূহও আসলে মানুষের প্রয়ােজন সিদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণীত আচরণবিধি ছাড়া আর কিছু নয়। কোনাে আইনকে যথার্থ বলা চলে তখনই যখন সে আইন সমাজের সব মানুষের নিরাপত্তাবিধানে সক্ষম হয় বা মানুষের কল্যাণের পক্ষে উপযােগী বলে বিবেচিত হয়। মানুষ ন্যায়পরায়ণ হয় কারণ তাতে মানুষের উপকার হয়। অশুভ বলে কিছু নেই; অন্যায়ের ফলেই অশুভের সৃষ্টি। কর্তৃপক্ষের শিকার না হওয়া, কিংবা শাস্তির ভয় থেকে অব্যাহতির উপায় অন্যায় অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকা। সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করাতে কোনাে স্থায়ী আনন্দ নেই। এজন্যই বিজ্ঞজন একে এড়িয়ে চলতে চান। অভিজ্ঞতার আলােকে কতকগুলাে বিধিনিয়ম সব মানুষের সামাজিক জীবনের পক্ষে উপযােগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এসব অভিন্ন নিয়ম সব সমাজে সমানভাবে প্রচলিত। এছাড়া পরিবেশ ও অবস্থার পার্থক্যের জন্যই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আইন প্রণীত হয়ে থাকে। উপযোগিতাই অধিকার ও ন্যায়পরায়নতার ভিত্তি। (সোফিস্ট প্রভাবিত, প্লেটোএরিস্টটলের বিপরীতে)

স্টোয়িক স্কুল (আনু. ৩০০ খ্রি.পূ. – খ্রিস্টীয় ৩য় শতক)

জ্ঞানতত্ত্ব

  • কল্যাণের অর্থ উপলব্ধির জন্য সত্যের একটি মানদণ্ড এবং জগৎবিষয়ক একটি সুস্পষ্ট মতবাদ থাকা আবশ্যক। তাই নীতিবিষয়ক জ্ঞানের জন্য যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার জ্ঞান আবশ্যক। (এপিকিউরিয়ান স্কুল প্রভাবিত)
  • দর্শন যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও নীতিবিদ্যা— এই তিন ভাগে বিভক্ত। যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে চিন্তা ও যুক্তিতর্ক বিষয়ক বিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা হচ্ছে ঈশ্বর, আত্মা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান; আর নীতিবিদ্যা হচ্ছে শুভ জীবনবিষয়ক মতবাদ।
  • নীতিবিদ্যা কেবল তাত্ত্বিক অধ্যয়ন নয়; এর একটি কার্যকর ব্যবহারিক দিকও আছে। নীতিশাস্ত্রের আদর্শ নিয়মাবলিকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে দেয়া যায়।
  • ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষণই জ্ঞানের মূল উৎস, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাবাদ সত্য। সহজাত ধারণা বলতে কিছু নেই। জন্মের সময় মন একটি অলিখিত কাগজের মতো থাকে। যাবতীয় জ্ঞান ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত হয়। বাহ্যদ্রব্য মনের ওপর যে সংবেদন সৃষ্টি করে, সেই সংবেদন থেকেই জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। (এপিকিউরিয়ান স্কুল প্রভাবিত, প্লেটোর বিপরীতে)
  • মানুষের মন সবসময় গতিশীল ও সক্রিয়। মন বহির্জগৎ থেকে সংবেদন গ্রহণ করে। মনে এই সংবেদনের প্রভাবে স্মৃতি গড়ে ওঠে। আমাদের মনে এ পর্যন্ত যত রকম স্মৃতি আছে সবই অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। যাই হোক, সংবেদনের ফলে যে স্মৃতি তৈরি হলো তা হলো বিশিষ্ট বস্তু সম্পর্কিত আমাদের ধারণা। আমাদের মন এরপর এখান থেকে প্রতিরূপ গঠন করে। এই প্রতিরূপ তৈরির মাধ্যমে আমরা মনে বিষয়টি নিয়ে একটি সাধারণ ধারণা তৈরি করি, এবং প্রতিরূপটি যদি সত্য হয় তবে আমরা একে সত্য বলে গ্রহণ করি বা সম্মতি দান করি। এরপর স্মৃতি ও প্রতিরূপ ইতিমধ্যে পূর্ববর্তী স্মৃতি থেকে তৈরি হওয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এগুলো নিয়ে আমরা একটি সাধারণ সংস্কার বা ব্যাপ্তিবোধ তৈরি করি। অনেক মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া সংস্কার একই রকমের থাকে। তবে বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে সংস্কারের পার্থক্য হলো বৈজ্ঞানিক ধারণা ঐচ্ছিক চিন্তাভাবনার ফলশ্রুতি, এবং এরা সচেতন ও সংবদ্ধভাবে গঠিত। বিজ্ঞানের সাহায্যে সংস্কারের সত্যতা প্রতিপাদিত হয়। আবার নির্ভুল সংস্কারসৃষ্টির ব্যাপারেও বিজ্ঞান সাহায্য করে। বিজ্ঞান প্রায়োগিক যুক্তিপ্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নির্ভুল। যাই হোক, এই সংস্কার বা ব্যপ্তিবোধের পরবর্তী স্তর হলো উপলব্ধি, যেখানে বিষয়টিকে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা হয়। এভাবে যেকোনো জ্ঞান-পরিস্থিতিতে প্রতিরূপ, সম্মতি, সংস্কার বা ব্যাপ্তিবোধ এবং উপলব্ধি – এই চারটি মানসিক ক্রিয়া লক্ষণীয়, এবং এই চারটিই জ্ঞানের স্তর। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ এবং তাদের সমবায়ে গঠিত সাধারণ সংস্কার ও সম্প্রত্যয় থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এই জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়ায় মন সংবেদনের ফলে স্মৃতি হিসেবে তৈরি বিশেষ বস্তু সমূহের ধারণাগুলো তৈরি করে অনেকগুলো সদৃশ বিশিষ্ট ধারণা থেকে সাধারণ ধারণা ও সার্বিক অবধারণ গঠন করে। মনের এই সমন্বয়বিধানের ক্ষমতা হলো রিজন বা প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার সাহায্যেই মন বিশ্বব্যবস্থাকে জানতে পারে। তবে মন নয়, যে বাহ্য দ্রব্য থেকে সংবেদন উৎপন্ন হয়, তা-ই জ্ঞানের মূল কারণ। (প্লেটোঅ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • এভাবে উৎপন্ন জ্ঞান দুই রকম – সত্য বা যথার্থ জ্ঞান ও মিথ্যা জ্ঞান। বাহ্যবস্তুর সাথে ধারণার সঙ্গতি থাকলে জ্ঞান সত্য হয়, না থাকলে মিথ্যা হয়। বাহ্যবস্তু থেকে মনের প্রজ্ঞা দ্বারা জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির কল্পনাপ্রসূত প্রত্যয়ের সংমিশ্রণের ফলেই এই অসঙ্গতির সৃষ্টি হয় যার ফলে মিথ্যা জ্ঞান তৈরি হয়।
  • সত্যজ্ঞানে প্রমাণ তার নিজের মধ্যেই বিদ্যমান। যথার্থ জ্ঞান তার অন্তর্নিহিত সত্যতা দ্বারা মনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, মন আপনা থেকেই তাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। যে জ্ঞান তার যথার্থতা অনিবার্যভাবে মনে মুদ্রিত করে দেয় এবং তা স্বীকার করতে মনকে বাধ্য করে, সে জ্ঞানকে নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যথার্থ জ্ঞানকে জ্ঞান বলে স্বীকার করতেই হয়। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই এ জ্ঞানের যথার্থতা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, যথার্থ জ্ঞান জ্ঞাতার মনে যে কভিশন বা দৃঢ়বিশ্বাস সৃষ্টি করে, তা-ই সেই জ্ঞানের প্রামাণ্য।
  • কেবল বিজ্ঞান বা দর্শন থেকেই সত্য সম্পর্কিত জ্ঞান পাওয়া যায় তা নয়, সাধারণ ধারণার সাহায্যে সব মানুষই জ্ঞানলাভে সক্ষম। তবে বিচার-বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত যথার্থ জ্ঞানের সাথে যে দৃঢ়বিশ্বাস জড়িত, নিছক সাধারণ ধারণায় তা নেই। বিজ্ঞান হলো সত্য অবধারণের এক সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা। যৌক্তিক অনিবার্যতার ভিত্তিতে এক বচন থেকে অন্য বচন নিষ্কাশনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে বিজ্ঞান। তার মানে, নির্ভুল অনুমান ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুশীলন সত্য আবিষ্কারের বিশেষ উপায়।
  • জ্ঞান পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞতা দরকার হলেও ও নিছক চিন্তার মাধ্যমে জ্ঞানলাভ অসম্ভব হলেও জ্ঞান প্রক্রিয়ায় চিন্তার ভূমিকা স্বীকার করতে হবে। অভিজ্ঞতায় চিন্তার প্রয়োগ থেকেই, অর্থাৎ অভিজ্ঞতার দেয়া উপাদানসমূহের সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সম্প্রত্যয় গঠনের ওপরই জ্ঞানের উৎপত্তি ও অগ্রগতি নির্ভরশীল।

অধিবিদ্যা

  • পদার্থমাত্রই পরিবর্তনশীল, তবে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া লোগোস বা প্রজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। (হেরাক্লিটাস প্রভাবিত)
  • অস্তিত্বশীল পদার্থমাত্রই দুটি নীতির ফলশ্রুতি। এদের একটি নীতি হলো এমন যা কাজ করে, চলে এবং গঠন করে, আর অন্যটি এমন যার ওপর কাজ করা হয়, যা চালিত হয় এবং যা গঠিত হয়। এ দুটি নীতি স্বতন্ত্র নয়, একই সত্তার দুটি দিক। সুতরাং চিন্তায় পৃথক করা গেলেও বাস্তবে তাদের পৃথক করা যায় না। যা ক্রিয়াশীল নয় কিংবা যার ওপর ক্রিয়া সম্পাদিত হয় না, তা বাস্তবও নয়। অর্থাৎ বাস্তবকে হয় ক্রিয়া সম্পাদন করতে হবে, নয় তার ওপর ক্রিয়া সম্পাদিত হতে হবে। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • শুধুমাত্র পদার্থই সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় বলে শক্তি ও জড় এ দুটোই শরীরী বা দেহধারী। মাত্রাগতভাবে শক্তি ও জড়ের দৈহিকতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। শক্তি মসৃণজাতীয় পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত, অন্যদিকে জড় স্থূল, রূপহীন অনড়। দুয়ের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শক্তি ছাড়া কোনো জড়বস্তু নেই, আবার জড় ছাড়াও শক্তি থাকতে পারে না। সব অবস্থাতেই জড় শক্তি দ্বারা পরিচালিত। মানবাত্মা ও ঈশ্বরসহ জগতের সব পদার্থ দেহধারী। এমনকি গুণাবলিও দেহধারী। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • কারণ চারটি নয়, বরং একটি। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • আগুন শক্তির মূল কারণ। জগৎ এক সর্বব্যাপী হুতাশনের লীলাভূমি। এই হুতাশনের সাময়িক প্রজ্বলন ও প্রশমন থেকেই জগতের সৃষ্টি ও পরিবর্তন। দেহধারী ঈশ্বর জগতের তাপের উৎস এক আগ্নেয় শক্তি। এই আগুনই জগতের প্রাণ। এ আগুন থেকেই সব প্রাণের উৎপত্তি এবং এতেই সব কিছু বিলীন হবে। (হেরাক্লিটাস প্রভাবিত)
  • ঈশ্বর জগতের সক্রিয় রূপ। জগৎ ঈশ্বরের দেহ; ঈশ্বর জগতের আত্মা। জগতের স্বাধীন সত্তা নেই। জগৎ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মূলে রয়েছে ঈশ্বর। ঈশ্বর জগতের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ঈশ্বর সর্বদর্শী, সর্বত্র বিদ্যমান এবং মানুষের ভাগ্যবিধাতা। ঈশ্বর প্রেমময়; তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তবে মানুষের সুখ-দুঃখে তিনি অনাসক্ত। জগৎ ঈশ্বরেরই রূপ। তাই তা অসম্পূর্ণ হতে পারে না। জগৎ পূর্ণতার প্রতিমূর্তি এবং অনিন্দ্যসুন্দর। জগতের পূর্ণতা থেকে বোঝা যায়, জগৎ এক কল্যাণকর মহান উদ্দেশ্যের অভিব্যক্তিস্বরূপ। এরিস্টটলের ঈশ্বরের মতো ঈশ্বর জগতের বাইরে থেকে জগৎকে চালিত করে না। মানবাত্মা যেমন সারাদেহ জুড়ে বিদ্যমান, তেমনি ঈশ্বর জগতের সর্বত্র বিদ্যমান। জগৎ ও ঈশ্বরে কোনো প্রভেদ নেই। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • জগতের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা ভুল, বিবর্তনের প্রকৃতিবাদী ধারণা ভুল। প্রাকৃতিক ডিজাইন বা পরিকল্পনার ধারণাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত, ডেমোক্রিটাসের বিপরীতে)
  • অশুভের সমস্যা ব্যাখ্যায় সমাধান দ্বিবিধ – নঞর্থক এবং সদর্থক। নঞর্থক সমাধানে অশুভের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। পৃথিবী শুভ ও পূর্ণ। যাদের অশুভ বলি তারা আসলে আপেক্ষিক অর্থেই অশুভ। বাদ্যযন্ত্রের একটি তার বেসুরে হলেও তা যেমন গোটা ঐকতানটিকে নষ্ট না করে বরং অধিকতর শ্রুতিমধুর করে তোলে, ছায়াসম্পাতে চিত্রের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস না পেয়ে যেমন বৃদ্ধিই পায়, ঠিক তেমনি অশুভের সমাবেশে সুখের মাধুর্যও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অন্যায়, অমিতাচার ও ভীরুতার পাশে ন্যায়, মিতাচার ও সাহস অধিকতর উজ্জ্বল দেখায়। অশুভ ব্যক্তিগত, তাতে সর্বজনীন সুখের হানি না হয়ে বৃদ্ধিই হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে কারো সুখ, কারো দুঃখ; কোনো কাজ হিতকর, কোনো কাজ অহিতকর, কিন্তু সমষ্টি হিসেবে দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্ব নেই। সদর্থক সমাধানে রোগ শোক ইত্যাদি অশুভকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য ফলশ্রুতি এবং শুভলাভের প্রয়োজনীয় উপায় বলে ব্যাখ্যা করা হয়। একমাত্র মানবচরিত্রই স্বকীয় মূল্যের অধিকারী; আর বাহ্য অশুভ মানবচরিত্রের ক্ষতি করতে পারে না বলে একে সত্যিকার অর্থে অশুভও বলা চলে না। অশুভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে শুভের সন্ধান পাওয়া যায় না। অশুভের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই শুভ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গোটা বিশ্বই একটি সুন্দর শুভ ও পরিপূর্ণ সত্তা, এবং এর প্রতিটি অংশেরই একটি বিশেষ স্থান ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের কোনোকিছুকেই কুৎসিৎ বা অশুভ বলে মনে হতে পারে না।
  • সমুদ্রের সাথে বারিবিন্দুর যে সম্বন্ধ, অনন্ত বিশ্বের সঙ্গে মানুষেরও সেই একই সম্বন্ধ। মানবদেহ বিশ্ব উপাদানেরই অংশ, এবং মানবাত্মা বিশ্বাত্মারই তপ্তশ্বাসবিশেষ। হৃৎপিণ্ড আত্মার প্রধান অংশ। প্রত্যক্ষণ অবধারণ অনুমান অনুভব কামনা বাসনা প্রভৃতি মানসিক ক্রিয়া হৃৎপিণ্ডেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।
  • ধারণাগত চিন্তাশক্তি অর্জন করলেই তা প্রজ্ঞাসম্পন্ন হয়ে থাকে। যৌক্তিক চিন্তার কর্তা হিসেবে মানুষ স্বাধীন। ইতর প্রাণীর মতো মানুষ নিছক আবেগ-প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত নয়; চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে সে যা নির্বাচন করে, তার পেছনে প্রজ্ঞার সমর্থন থাকে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ স্বাধীন তখনই, যখন সে প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে, অর্থাৎ প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম অনুসারে চলে। বিজ্ঞজন যা করতে চান এবং প্রজ্ঞা বা প্রকৃতি যা করতে নির্দেশ দেয়, এ দুটির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। দার্শনিকমাত্রই সত্যের পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার অধিকারী। তিনি ঈশ্বরের মতোই স্বাধীন। স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রজ্ঞাসম্মত আত্মনিয়ন্ত্রণবাদ এই সত্য। স্বাধীন ক্রিয়া হলো মানুষের তথা বিশ্বের প্রজ্ঞাসম্মত প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যাবলি।
  • আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে স্টোয়িকদের কারো কারো মতে, জগৎ ধ্বংস হওয়ার সাথে আত্মাও ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার অন্যদের মতে, সাধারণের পক্ষে পরলোকপ্রাপ্তির আশা না থাকলেও অন্তত বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মা তাদের দেহবিনাশের ফলে বিনষ্ট হবে না। সাধারণ লোকের আত্মা জড়ীয়; তাই দেহের অবসানেই তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মায় জড়ের প্রভাব কম, তাই দেহবিনাশের পরও তাদের আত্মা টিকে থাকে। কিন্তু তবু একথা বলা চলে না যে আত্মা অমর। দেহ অবসানের পর দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও পরিণামে বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মারও বিনাশ ঘটে। যে অনন্ত জীবনপ্রবাহ থেকে আত্মার উৎপত্তি, পরিণামে তার সাথেই আত্মা মিলিত হবে।
  • পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদকে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে ভ্রান্ত এবং ধর্মীয় দিক থেকে অপবিত্র। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • গুণগত পরিবর্তনকে পরিমাণগত নিয়মে পরিণত করা যায় না। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • গতি দুই রকম। একটি ঋজুরেখ (rectilinear), যা পৃথিবীর ঘটনাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং অপরটি গোলাকার, যা নভোমণ্ডলের গতির সাথে জড়িত। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)

নীতিশাস্ত্র

  • নৈতিক মতবাদ মনোবিদ্যা ও অধিবিদ্যাবিষয়ক মতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। জগৎ কতকগুলো চিরন্তন নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। জগৎ একটি সুসংবদ্ধ বৌদ্ধিক বিধান, সুন্দর সুশৃঙ্খল সমগ্র, যাকে যান্ত্রিক কারণিক অনুক্রম বলে ব্যাখ্যা করা চলে না। এই সমগ্রে তার প্রতিটি অংশের একটি বিশেষ স্থান ও ভূমিকা রয়েছে, এরা একটি অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। এটি একটি সুসমঞ্জস একত্ব যার মূলে ঈশ্বর আছেন। মানুষ জগতের অংশ, একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব। ক্ষুদ্র হলেও মানুষে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিফলন ঘটে, গোটা বিশ্বকে যে প্রজ্ঞা নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করে সেই প্রজ্ঞা মানবপ্রকৃতিরও অনিবার্য ধর্ম। তাই মানুষ তার প্রজ্ঞা অনুসারে চললে সে ব্যাপক বিশ্বের বা প্রকৃতির বা ঈশ্বরের ইচ্ছা, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অনুসারে চলে, যেটা তার করা উচিৎ। তাই মানুষকে প্রজ্ঞার বিধান অনুযায়ী চলা উচিৎ। তাহলে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা ব্যাপকতর বিশ্ব-ইচ্ছার সাথে মিলে যায়। প্রজ্ঞার বিধান মেনে চলার জন্য মানুষকে তার আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। (এপিকিউরিয়ান স্কুলের বিপরীতে)
  • পুণ্যই পরম কল্যাণ যাতে পরম আনন্দ নিহিত, তাই পুণ্যবান জীবনই আনন্দময় জীবন।
  • পুণ্য আপেক্ষিক নয়, অনপেক্ষ। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সাথে মানুষ তার প্রকৃতির প্রজ্ঞাসম্মত দিকটিকে তার যথার্থ সত্তা বলে মনে করতে শেখে। আর তখন থেকেই সে বিবেকবুদ্ধির পূর্ণতাবিধান এবং বৌদ্ধিক উদ্দেশ্যসাধনে তৃপ্তি ও আনন্দ পেয়ে থাকে।
  • বেঁচে থাকার মানে হচ্ছে আত্মসিদ্ধিলাভ; আর আত্মসিদ্ধির অর্থ হলো সর্বজনীন প্রজ্ঞার উদ্দেশ্যসাধন।
  • নৈতিক আদর্শের মূলে মানুষের সমান অধিকার এবং সমান অধিকারের ভিত্তিতে এক বিশ্বজনীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত। সব মানুষে একই প্রজ্ঞা বর্তমান, এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ একই বিশ্বাত্মার অংশবিশেষ।
  • সুখবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রত্যেক প্রাণীই তার নিজকে ও তার জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাই আত্মসংরক্ষণ ও নিজ জাতির সংরক্ষণই মানুষের কর্মপ্রচেষ্টার লক্ষ্য। সুখ কর্মপ্রচেষ্টার লক্ষ্য নয়, সহগামীমাত্র। প্রকৃতির প্রচলিত কর্মকাণ্ডের সাথে সুখের সংযোগ আপতিক। নৈতিক বৈরাগ্যবাদ ঠিক। (সিনিক স্কুল প্রভাবিত, এপিকিউরিয়ান স্কুলের বিপরীতে)
  • বাহ্যশক্তি দ্বারা মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে কখনও পরাজিত হয় না, হতে পারে না। (সক্রেটিস প্রভাবিত)
  • চিন্তার খাতিরেই চিন্তা বা প্রজ্ঞার জন্যই প্রজ্ঞার অনুশীলন মানুষের লক্ষ্য হতে পারে না। প্রজ্ঞা এজন্য মূল্যবান যে তা আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দেয়। পুণ্যই একমাত্র কল্যাণ, আর অধর্ম একমাত্র অকল্যাণ। অন্য কিছু কল্যাণ বা অকল্যাণ নয়। স্বাস্থ্য, সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা ইত্যাদি বাহ্য সম্পদের কোনো স্বকীয় মূল্য নেই। আবার মৃত্যু রোগ দারিদ্র্য ইত্যাদিও অকল্যাণ নয়। তাই এদের কোনোটিকেই নৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা চলে না। সুখ বা আনন্দ অর্জন করা তাদের আয়ত্তাধীন নয়। তবে এদের প্রতি বিশেষ মনোভাব পোষণ করা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এদের কীভাবে আমরা প্রয়োগ করি, আমাদের চরিত্রের ওপর এদের কী প্রভাব, তার ওপরই নির্ভর করে এদের মূল্য। তাছাড়া নিজস্ব বা স্বকীয় মূল্য বলতে এদের কিছু নেই। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • একমাত্র ধর্মই স্বকীয় মূল্যের অধিকারী; ধর্মই প্রকৃত কল্যাণ, যার পক্ষে যথার্থ আনন্দদান সম্ভব। বাহ্য সম্পদের অভাবে ধার্মিকের আনন্দের ব্যাঘাত ঘটে না। তথাকথিত বাহ্য অকল্যাণ প্রকৃত অকল্যাণ নয়। অধর্মই প্রকৃত কল্যাণ। ধর্মই যথার্থ সুখ বা আনন্দলাভের উপায় হলেও ধর্মকে নিষ্কাম হতে হবে। আবার শুধুমাত্র বাহ্য আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ধর্মসাধন হয় না। ধার্মিক কাজ হলো সেসব কাজ যেগুলো নৈতিক নিয়মাবলির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ কর্তার পক্ষে ধার্মিক আচরণ তা-ই, যা তিনি শুভ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে এবং পরম শুভকে অর্জনের ঐকান্তিক ইচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করে থাকেন। অচেতনভাবে বা অজ্ঞতাবশে কাজ করা পুণ্য বা ধর্ম হতে পারে না। ধর্মপালনে আত্মার ঐকান্তিক আগ্রহ না থাকলে অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না। তাই সদিচ্ছাই ধর্মের মূল উৎস ও উপাদান।
  • পরম্পরাগত সামাজিক আদর্শে আস্থাশীলতা ভুল। (সিনিক স্কুল প্রভাবিত)
  • নিছক উপযোগিতার তাগিদে কাজ করা অসম্পূর্ণ। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • মানুষের হয় সদিচ্ছা থাকবে, না হয় থাকবে না; এর মাঝামাঝি অন্যকিছু নেই। মানুষ হয় হবেন বিজ্ঞ, আর না হয় নির্বোধ। এদিক থেকে কোনো একটি বিষয়ে ধার্মিক হলে অন্য বিষয়ে অধার্মিক হওয়া অসম্ভব; কারণ এক ধর্মের উপস্থিতিতে অন্যান্য ধর্মও উপস্থিত থাকবে। ধর্মই সব আচার-অনুষ্ঠানের মূল। জ্ঞান, মিতাচার, সাহস ও ন্যায়পরতা—এই চারটি গুণ ধর্মকর্মের অপরিহার্য ফল। এদের একটিকে আয়ত্ত করা গেলে অন্যগুলোও আয়ত্তে আসবে। আবার এদের কোনো একটির অভাব হলে অন্যগুলোরও অভাব হবে। ব্যক্তিমাত্রই হয় সব বিষয়ে সৎ, না হয় সব বিষয়েই অসৎ। গোটা মানবজাতিকে সাধু ও অসাধু – এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়; তবে প্রকৃতপক্ষে এ দুই শ্রেণীর মধ্যেও মিশ্রণ দেখা যায়। যিনি দোষমুক্ত এবং সম্পূর্ণ সৎ, তিনিই প্রকৃত ধার্মিক। কেউ আংশিকভাবে সৎ হলেও তাকে ধার্মিক বলা চলে না। যার মধ্যে প্রজ্ঞার সামান্যতম অভাব রয়েছে, তিনিও অধার্মিক। যিনি কোনো রিপুর অথবা কোনো প্রবৃত্তির অধীন, অথবা কোনো দূষণীয় কাজ করেন, তিনি অধার্মিক। ধর্মকে হয় সামগ্রিকভাবে পেতে হবে, আর না হয় একেবারেই নয়। আংশিক ধর্ম বলে কিছু নেই। ধর্ম ও অধর্মের মাঝখানে কোনো ক্রমভেদ নেই, ধর্ম ও অধর্মের প্রভেদ অনতিক্রম্য। ধর্মাধর্ম বা পাপপুণ্যের কোনো মাত্রাভেদ নেই। আর তা-ই যদি না থাকে, তা হলে নৈতিক প্রগতি বা উন্নতির প্রশ্নও ওঠে না। এমতাবস্থায় একজনের পক্ষে পরিপূর্ণ নির্বুদ্ধিতা ও পাপাচার থেকে পরিপূর্ণ বিজ্ঞতা ও সাধুতায় রাতারাতি উত্তরণের সম্ভাবনা আছে ঠিকই, কিন্তু প্রথম অবস্থা থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় ক্রমিক উন্নয়ণের অবকাশ নেই। অর্থাৎ ব্যক্তি অশুভ থেকে শুভে পরিবর্তিত হই ঠিকই, কিন্তু সেই পরিবর্তনের গতি ধারাবাহিক নয়, তাৎক্ষণিক।
  • সততা বা সাধুতা নামক একই ধর্ম মিতাচার সাহস জ্ঞান ও ন্যায়পরতা— এই চারটি ধর্মের রূপপরিগ্রহ করে থাকে। আবার প্রজ্ঞার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা সত্ত্বেও দৈনন্দিন জীবনে আবেগ-অনুভূতি ও প্রবৃত্তির ভূমিকা অস্বীকার্য নয়। বলা বাহুল্য, মানুষ হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিই বিবেকবুদ্ধি ছাড়াও প্রবৃত্তি ও অনুভূতির অধিকারী। আর সে বাস করে এক সমাজবদ্ধ জড়জগতে। প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগ নৈতিকতাপরিপন্থী নয়। বিবেকবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হলে এগুলোর নৈতিক মূল্যও বৃদ্ধি পায়।
  • শুধু আত্মসংরক্ষণই মানুষের একমাত্র প্রবৃত্তি নয়, সামাজিক চেতনা বলেও মানুষের একটি বিশেষ প্রবৃত্তি রয়েছে। এই প্রবৃত্তিই তাকে ক্রমশ সামাজিক জীবনের দিকে চালিত করে। বিবেকবুদ্ধির আলোকেই সে তার সামাজিক প্রবৃত্তিসমূহকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলে। প্রজ্ঞার কল্যাণেই সে বুঝতে পারে যে, সব মানুষই প্রজ্ঞাময় জীবনের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশ্বসমাজের সদস্য। বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমরা সবাই ঈশ্বরের চোখে সমান।
  • নাগরিক ও বর্বরদের পার্থক্য নেই। মানুষের সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভ্রাতৃত্বই সমর্থনযোগ্য, যার মাধ্যমে বিশ্বসমাজ বা বিশ্বজনীন রাষ্ট্র তৈরি হবে। এ রাষ্ট্রের একমাত্র আইন প্রাকৃতিক নিয়ম, একমাত্র অধিকার প্রাকৃতিক অধিকার। এই বিশ্বজনীন রাষ্ট্রে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করার একমাত্র মানদণ্ড হলো নৈতিকতা। এখানে দেবদেবী ও বিজ্ঞজনেরা বিশেষ সুবিধার অধিকারী, এবং যে-কেউ স্বেচ্ছায় তাদের সান্নিধ্যে আসতে পারে। সব মানুষের মধ্যে এক বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান, সবাই একে অপরের ভাই, একই বাবার সন্তান। তাদের উৎস এক, লক্ষ্যও অভিন্ন। তাদের সবার মধ্যে একই সর্বজনীন প্রজ্ঞা বিদ্যমান; তারা সবাই আইনের অধীন এবং একই রাষ্ট্রের নাগরিক। শত্রুরাও আমাদের সাহায্য ও ক্ষমার পাত্র। পরস্পরের প্রতি সুবিচার ও মানবোচিত ব্যবহারই মানুষের কর্তব্য। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি নয়, সর্বজনীন মঙ্গলকামনা এবং প্রয়োজনবোধে অপরের জন্য আত্মোৎসর্গ করা হবে মানুষের নৈতিক আদর্শ। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)
  • মানবজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়া রাষ্ট্রের মূলতত্ত্বের পরিপন্থী। বিশ্বব্যাপী একটিমাত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, একই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করা সব মানুষের কর্তব্য। কোনো একটি বিশেষ দেশকে স্বদেশ মনে করে অন্যান্য দেশকে বিদেশ মনে করা অনুচিত।

রোমান দার্শনিকগণ

সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রি.পূ.)

  • দর্শনে কখনো নিশ্চিত সত্যলাভ করা যায় না। তাই নিশ্চিতি নয়, সম্ভাব্যতাই দার্শনিক পথপ্রদর্শক।
  • ঈশ্বরের সহজাত ধারণা সঠিক।
  • জগৎব্যাখ্যায় যান্ত্রিক মতবাদ ভুল। (এপিকিউরিয়ান স্কুলের বিপরীতে)
  • জগতের নিয়ন্ত্রণ ও শাসনকার্যে ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু তিনি ভবিষ্যৎকথন ও জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল।
  • আত্মার অমরত্ব আছে।
  • স্বয়ংসম্পূর্ণতা জীবনের লক্ষ্য নয়। (স্টোয়িক স্কুলের বিপরীতে)
  • যেকোনো বাহ্য শুভ মানুষের পূর্ণতাপ্রাপ্তির পক্ষে সহায়ক। (স্টোয়িক স্কুলের বিপরীতে)
  • বিশ্বনাগরিকতা সমর্থনযোগ্য। (স্টোয়িক স্কুল প্রভাবিত)
  • প্রাকৃতিক নিয়ম রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি। প্রাকৃতিক নিয়মের ফলেই সব মানুষ কিছু অভিন্ন অধিকার ও সুবিধার অধিকারী। (স্টোয়িক স্কুল প্রভাবিত)
  • নৈতিকতাই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি; তাই রাষ্ট্রকে অবশ্যই নৈতিক ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
  • বিভিন্ন প্রকার সরকারের মধ্যে রাজতন্ত্র সমর্থনযোগ্য। শুভ সরকার হিসেবে রাজতন্ত্রের পরেই অভিজাততন্ত্রের স্থান। গণতন্ত্র সমর্থনযোগ্য নয়। (অ্যারিস্টোটলের বিপরীতে)

সেনেকা (৩ খ্রি.পূ. – ৬৫ খ্রি.)

  • অঢেল ধনসম্পদ নয়, সামান্য কিছুর মাধ্যমেই জীবনে আনন্দলাভ সম্ভব। কোনো বাহ্য সুবিধা বা অসুবিধার জন্য নয়, আত্মার কামনা-বাসনার ফলেই মানুষ গরিব বা ধনী হয়ে থাকে। আদি রোমানরা দরিদ্র ছিল, কিন্তু তাদের জীবন ছিল সাহসী। দর্শন যেকোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে সক্ষম।
  • বৈষয়িক সুযোগ সুবিধার অনুসন্ধান আনন্দময় জীবনলাভের যথার্থ উপায় নয়।
  • দর্শন নৈতিক, প্রাকৃতিক ও বৌদ্ধিক—এ তিনভাগে বিভক্ত। নৈতিক দর্শনের কাজ মানুষের আচার-ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা। প্রাকৃতিক দর্শন প্রাকৃতিক নিয়ম ও কার্যাবলির অনুসন্ধান করে, এবং বৌদ্ধিক দর্শন শব্দাবলি ও যুক্তিতর্কের বৈধতাবিষয়ক জ্ঞানের অনুসন্ধান করে। এছাড়া ভ্রান্ত ধারণা ও প্রতারণা থেকে সঠিক জ্ঞানকে ফারাক করার ক্ষমতাঅর্জনের ব্যপারেও বৌদ্ধিক দর্শন শিক্ষা দেয়। ঘটনা ও বস্তুর কারণ অনুসন্ধান প্রাকৃতিক দর্শনের, যুক্তিতর্ক বৌদ্ধিক দর্শনের এবং নৈতিক আচার-আচরণের মূল্যায়ন নৈতিক দর্শনের কাজ। নৈতিক দর্শন দু’ভাগে বিভক্ত। এদের একটি সামাজিক সুবিচার এবং অপরটি মানুষের ভাবাবেগ ও আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। নৈতিক দর্শনের এসব শাখার সম্পর্ক খুবই নিকট; সুতরাং এদের একটিতে গোলযোগ দেখা দিলে সে গোলযোগ অন্যগুলোতেও বিস্তারলাভ করে। দেহধারী ও অশরীরী, এ দু’রকম সত্তা নিয়ে প্রাকৃতিক দর্শনের কাজকারবার। কার্য ও কারণের স্বরূপ নির্ণয় এবং কারণের কারণ অনুসন্ধান এর আলোচ্যবিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তিবিদ্যা ও অলঙ্কারাশাস্ত্র, এ দুটি বিষয়ের সমবায়ে বৌদ্ধিক দর্শন গঠিত। যুক্তিবিদ্যা নির্ভুল যুক্তির সাহায্যে জ্ঞানলাভের উপায় নিয়ে, আর অলঙ্কারাশাস্ত্র শব্দাবলি ও তাদের অর্থ নিয়ে আলোচনা করে।
  • আত্মপরীক্ষা একটি মূল্যবান সদ্গুণ। প্রতি রাতেই আমাদের নিজ আচরণ ও কার্যাবলির সমীক্ষা করা উচিত। আমরা যদি তা করি, তা হলে আমাদের পাপের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং পরিণামে আমরা মানসিক প্রশান্তিলাভ করতে সক্ষম হবো।
  • ঈশ্বর পিতা স্বরূপ, তিনি তার সন্তানদের ভালোবাসেন। ঈশ্বর যাদের ভালোবাসেন, তাদের প্রতি তিনি কড়া নজর রাখেন; আর অন্যদের তিনি দেখেন অনেকটা ক্রীতদাসের দৃষ্টিতে। শিক্ষক যেমন তার ভালো ছাত্রদের কঠিন পড়া দিয়ে থাকেন, ঈশ্বরও তেমনি ভালো মানুষদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। মানুষের দুর্ভোগ-দুর্ভাগ্য ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক নয়, মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতার নির্দেশক।
  • বৈষয়িক জীবনের প্রতি আত্যন্তিক আগ্রহ ও পুণ্যের প্রতি অবহেলার জন্য রোমানরা নিন্দার্হ। ইন্দ্রিয়-সেবাপরায়ণতার কুফল অনেক। এতে বিভিন্ন রোগসৃষ্টির ফলে দেহের সমূহ ক্ষতি হয়। ভোগবিলাসের ফলে মানুষ প্রথমে আতিশয্যের এবং পরে অসাধুতার দিকে পরিচালিত হয়ে পরিণামে ইন্দ্রিয়ের দাসে পরিণত হয়। মানুষের অন্যের দোষত্রুটিকে বড় করে না দেখে নিজের ভুলত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিৎ। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে মানুষ যেন সুশৃঙ্খল সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে পারে।
  • জাতীয় সীমান্তের কথা ভুলে গিয়ে ঈশ্বরের অধীনে সব মানুষ যেন সমান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারেন, এমন বিশ্বজনীন মানবসমাজ দরকার।

এপিক্‌টেটাস (৫০-১৩০ খ্রি.)

  • কোনোকিছু সম্পর্কে বলবেন না যে, আমি এটি হারিয়ে ফেলেছি, বরং বলুন আমি একে প্রত্যর্পণ করেছি। শিশু ও স্ত্রী সহ নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু আসলে প্রত্যর্পণ। সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়া হলেও সেটা প্রত্যর্পণ। যে ছিনিয়ে নিয়েছে সে খারাপ লোক হলেও আসলে যে ঈশ্বর দান করেছিলেন সেই দাতাই কারও হাত দিয়ে পূর্বে তার দেয়া জিনিসকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।
  • মানবজীবন একটি নাটকবিশেষ। আর আমরা সবাই এ নাটকে অভিনয় করে চলেছি। আমাদের নিজ নিজ চরিত্রে ভালোভাবে অভিনয় করতে হবে। জীবনে যদি আমরা বিচারক হয়ে থাকি, তা হলে আমাদের অবশ্যই সুবিচার করতে হবে। আমরা যদি শারীরিক দিক থেকে বিকল হয়ে পড়ি, তবু আমাদের নিজেদের অসুখী বলে অভিযোগ করা ঠিক নয়। ঈশ্বরই জগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আর আমরা জীবনে কোন কাজ করবো তা নির্বাচনের ভার আমাদের ওপর নয়, ঈশ্বরের ওপর। ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেকের সাথেই আছেন; সুতরাং ঐশ্বরিক শক্তির মর্যাদা রক্ষায় আমাদের প্রত্যেকেরই সচেষ্ট হওয়া উচিত।
  • মৃত্যুদণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। ক্ষমা প্রদর্শনের সুবিধার্থে আইন সংস্কার করতে হবে। দাসত্বপ্রথা সমর্থনযোগ্য নয়। প্রতিটি কাজে তিনি ঈশ্বর দ্বারা পরিচালিত।

মার্কাস অরেলিয়াস (১২১-১৮০ খ্রি.)

  • অপ্রীতিভাজন কোনো লোক দেখে আমাদের ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই; কারণ আমাদের বোঝা উচিত যে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকা আবশ্যিক। সকালবেলা মনে মনে একথা বলে কাজ শুরু করুন : আমি ব্যস্ত অকৃতজ্ঞ উদ্ধত প্রতারক ঈর্ষাপরায়ণ, অসামাজিক লোকের সাক্ষাৎ পাব। তাদের এসব খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূলে রয়েছে শুভ ও অশুভ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব। কিন্তু শুভ ও অশুভের স্বরূপ কী, অন্যায়কারীর স্বভাব কী, আমি নিজে যেহেতু তা জানি, সুতরাং তাদের কারো দ্বারা আমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি না। আবার আত্মীয় পরিজনদের প্রতি আমি রাগ বা ঘৃণাপোষণ করতে পারি না, কেননা হাত পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যেমন সহযোগিতা আছে, আমাদেরও তেমনি পারস্পরিক সহযোগিতা করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রবৃত্তি প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
  • যেকোনো মুহূর্তেই আমাদের মৃত্যু হতে পারে। চিন্তার নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায়পরতার সাথে কাজ করা আমাদের সকলেরই কাম্য। এটুকু ভেবে আমরা শান্তি পেতে পারি যে, আমাদের সুখসুবিধা দেখার জন্য দেবতারা আছেন। জীবন সদাপরিবর্তনশীল, এবং আমাদের দেহও ক্রমশ ক্ষয় হয়ে চলেছে। যশ সৌভাগ্য ধনসম্পদ— এদের কোনোটাই আমাদের স্থায়ী শান্তি দিতে পারে না। একমাত্র দর্শনই মানুষের সার্থক সুখ তথা স্থায়ী মঙ্গলের আকর।
  • ব্যক্তিগত অমরত্ব ভুল। মৃত্যু মানেই ব্যক্তিত্বের পরিসমাপ্তি। জন্মদান ও গর্ভধারণ, জন্ম ও বৃদ্ধি, যৌবন ও বার্ধক্য— এ সবের ন্যায় মৃত্যুও একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। একে কামনা করা বা ভয় করার কিছু নেই। অন্যান্য স্বাভাবিক ব্যাপারের মতো মৃত্যুকেও সহজভাবে গ্রহণ করা উচিত।

সংশয়বাদ

পাইরো (৩৬৫-২৭০ খ্রি.পূ.)

  • জ্ঞান ও সত্তার ব্যাপারে সংশয় আছে। বাস্তবসত্তা বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু একে জানা যায় না, জানার কোনো উপায় নেই। কি ইন্দ্রিয়, কি বুদ্ধি এদের কোনোটিই সত্যের জ্ঞান দিতে পারে না। কোনো একটি ব্যপারে আমরা যে সিদ্ধান্তেই উপনীত হই না কেন, এর বিপরীত সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া সম্ভব। অতএব এসব অনিশ্চিত ব্যাপারে কোনো দৃঢ়মত পোষণ না করাই বাঞ্ছনীয়।
  • সুখই জীবনের লক্ষ্য বা কাম্য। দর্শনচর্চার মাধ্যমে সুনিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় না। ফলে দর্শন মানুষকে সুখশান্তি না দিয়ে, অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ দিয়ে থাকে। তাই দর্শনচর্চা বা তত্ত্বানুসন্ধান শুধু অনাবশ্যকই নয়, অবাঞ্ছিতও বটে। প্রকৃতপক্ষে বস্তুতত্ত্ব বা অধ্যাত্মশাস্ত্র অনধিগম্য। বস্তুর প্রকৃত সত্তা বা স্বকীয় রূপ আমরা জানতে পারি না। আমরা যা জানি তা বস্তুর আসল রূপ নয়, প্রতিভাসমাত্র।
  • একটি বিশেষ নৈতিক আচরণকে অন্য একটি আচরণের চেয়ে ভালো বলার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু তাই বলে আবার আমরা নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতায়ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। কোন্ আচরণ ভালো আর কোন্ আচরণ মন্দ, তা যখন সুনিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই, তখন সমাজের প্রচলিত প্রথা বা ধর্ম সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানকে মন্দ বলেও প্রমাণ করা চলে না। এমতাবস্থায় প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে মেনে চলাই উচিত।
  • জোর দিয়ে কোনো কিছু বলার চেয়ে অস্বীকার করা অনেক ভালো। যেকোনো জটিল দার্শনিক সমস্যার ব্যাপারে চট করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে বিষয়টির বিভিন্ন দিক ভালোভাবে তলিয়ে দেখা আবশ্যক। কোনো বিষয়ে নিশ্চিত মত প্রকাশ না করার ফলে মানুষের পক্ষে অবিচলিত থাকা ও সুখলাভ করা সম্ভব। সুতরাং কোনো নিঃশর্ত উক্তি না করে আমাদের উচিত সবসময় মনকে খোলা ও মুক্ত রাখা।

টাইমন (৩২০ – ২৩৫ খ্রি.পূ.)

  • অনপেক্ষ সত্য বলে কিছু নেই।

আর্কেসিলস

  • অনিবার্য সংবেদনের ভিত্তিতে সার্বিক জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • ধারণার স্পষ্টতাই সত্যতার মাপকাঠি নয়। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • বিজ্ঞজন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য নেই, বিজ্ঞজন সার্থক জ্ঞানের আর সাধারণ মানুষ শুধু লৌকিক বিশ্বাসের অধিকারী – এমনটা নয়। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • জ্ঞানের কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। জ্ঞানমাত্রই অভিমত (opinion)-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। সত্যমিথ্যার কোনো সঠিক বা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নেই।
  • ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ নির্ভরযোগ্য নয়, কেননা ইন্দ্রিয় প্রায়শই আমাদের প্রতারণা করে। ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণও সময় সময় মনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে, প্রত্যক্ষকারীর মনে ভ্রম ও অলীক ধারণার সৃষ্টি করে। মিথ্যাকেও অনেক সময় সত্যের মতোই অকাট্য বলে মনে হয়, লৌকিক মত জ্ঞানের মতোই অনিবার্য বলে প্রতীয়মান হয়। এ জন্য ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ যতই অনিবার্য হোক না কেন, সার্থক জ্ঞানের মানদণ্ড নয়। প্রত্যক্ষ যা দেয়, তা জ্ঞান নয়, অভিমতমাত্র। সুতরাং সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার কোনো মানদণ্ড নেই।
  • সত্য থেকে থাকলেও এর সম্পর্কে অসন্দিগ্ধ বা সুনিশ্চিত হবার উপায় নেই। অর্থাৎ সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ অসম্ভব। আসলে আমরা কিছুই জানি না, জানতে পারি না। আর আমরা যে কিছুই জানতে পারি না, তা-ও আমরা জানি না, জানা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্যতাই জীবনপথে চলার একমাত্র পাথেয়।

কার্নিয়াডিস (২১৩-১২৯ খ্রি.পূ.)

  • যতই সুদৃঢ় হোক-না কেন কনভিকশন বা দৃঢ়বিশ্বাসমাত্রই ভ্রমাত্মক। স্বপ্ন অধ্যাস অমূলপ্রত্যক্ষণ (hallucination) প্রভৃতিও অনেকসময় অকাট্য বলে প্রতীয়মান হয়, এবং তখন আমরা একথা ভাবতেও পারি না যে, আসলে এরা ভ্রমাত্মক। স্বপ্নভঙ্গ বা অধ্যাসমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা, এমনকি জাগ্রত জীবনের অভ্যাস আসলে ভ্রান্ত ও অবাস্তব। তথাকথিত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ধারণাবলির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের অনেকগুলোতেই যৌক্তিক হেত্বাভাস থাকে। আবার যৌক্তিক হেত্বাভাসমুক্ত হলেই যে সব ধারণা সঠিক ও বাস্তব হবে, এ কথাও হলফ করে বলা চলে না। যৌক্তিক দিক থেকে সমানভাবে সিদ্ধ দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী হতে পারে; আর তা-ই যদি হয়, তা হলে এ দুটির কোন্‌টি যে সত্য আর কোন্‌টি মিথ্যা, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় থাকে না। যেহেতু যুক্তির সাহায্যে পাওয়া নিশ্চয়তা সংবেদন ও অনুভূতিবিষয়ক সিদ্ধান্তের মতোই হেত্বাভাসযুক্ত, সুতরাং একথা বলা যায় যে, সত্যবিষয়ক জ্ঞান বলে কিছু নেই। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • জগৎ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের পেছনে এক বুদ্ধিমান সত্তার স্পর্শ আছে এবং মানুষের কল্যাণের জন্যই সেই বুদ্ধিমান সত্তা জগৎ সৃষ্টি করেছেন—এ ধারণা ভ্রান্ত। কারণ মানুষের নানারকম বিপদ ও ধ্বংসের বিভীষিকা থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, জগৎ মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি হয় নি। দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত পৃথিবীতে সৎ ও পুণ্যবানেরা শুধু যে অকারণে লাঞ্ছিত ও বিড়ম্বিত হচ্ছে তা-ই নয়, অন্যায়-অত্যাচার অনুষ্ঠানকারীদের উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতেও দেখা যাচ্ছে। তা হলে বিশ্বের একজন বিধাতা ও নৈতিক প্রভু আছেন বলে মনে করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। তা ছাড়া জগৎকে সবদিক থেকে প্রজ্ঞাসম্মত ও শুভ বলা গেলেও এ কথা বলা চলে না যে, এ সবই একজন বুদ্ধিমান ও বদান্য ঈশ্বরের বহির্প্রকাশ; কারণ জাগতিক বিধি ও নিয়মানুবর্তিতা প্রাকৃতিক কারণ থেকেও সৃষ্ট হতে পারে। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • প্রাকৃতিক সত্তা ও ঘটনাবলিকেও উচ্চতর ও নিম্নতর বলে শ্রেণীবিভক্ত করা যায়না। আবার এও বলা যায়না যে, প্রজ্ঞাসম্মত সবকিছুই প্রজ্ঞাপরিপন্থী সবকিছুর চেয়ে উত্তম। প্রকৃতির মধ্যে হয়তো বা উচ্চতর বা নিম্নতর বলে দু’রকম আলাদা জিনিস থাকতে পারে; কিন্তু তবু কোন্‌টি যে উচ্চতর এবং কোন্‌টি যে নিম্নতর, তা জানার কোনো উপায় নেই; কারণ প্রকৃতির মানদণ্ড মানবিক মানদণ্ডের চেয়ে স্বতন্ত্র হতে পারে।
  • স্টোয়িকদের ঈশ্বরতত্ত্ব স্ববিরোধী। একদিকে তারা ঈশ্বরকে অনন্ত বলে ঘোষণা করেছেন, অন্যদিকে আবার ঈশ্বরের ওপর প্রাণ, চেতনা ও নৈতিক গুণাবলিসহ এমনসব বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন যেগুলোকে একমাত্র সসীম জীবেই আরোপ করা চলে। ঈশ্বর যদি সসীম হন, তা হলে তিনি জগতের অংশমাত্র, অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ বা পূর্ণব্রহ্ম নন। আর ঈশ্বর যদি অসীম হয়ে থাকেন, তা হলে তিনি অবশ্যই স্থান, কাল ও পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে থাকবেন। তখন প্রেম প্রীতি দয়া মায়া ইত্যাদি সসীম গুণ ঈশ্বরে আরোপ করা চলবে না। এ থেকে বোঝা যায় ঈশ্বর সসীম নন, অসীমও নন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার ঈশ্বর যদি থাকেন, তা হলে হয় তিনি দেহধারী হবেন অথবা হবেন অশরীরী। দেহধারী হলে তিনি অবশ্যই পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল হবেন। তিনি যদি অশরীরী হন, তা হলে সংবেদন ও অনুভূতি বলে তার কিছু থাকতে পারে না। তিনি যদি শুভ হন, তা হলে বোঝা যাবে যে, তিনি নৈতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং তিনি সর্বময় কর্তা নন। তিনি যদি অশুভ হন, তা হলে তিনি মানুষের চেয়েও অধম। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, ঈশ্বরের ধারণা বিরোধপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • পূর্ণ ও চূড়ান্ত শুভ নৈতিক আচরণের অনপেক্ষ লক্ষ্য এবং শুভ মানেই প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলার উপায়— স্টোয়িকদের এই উক্তি স্ববিরোধী। নৈতিকতা জিনিসটাই কৃত্রিম, প্রাকৃতিক নয়। আত্মস্বার্থের সিদ্ধি ও সংরক্ষণই মানুষের আচরণের মূল উদ্দেশ্য। ব্যক্তি যেন তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পেতে পারে, সে জন্যই আইন বা বিধি আবিষ্কার করা হয়েছে। সুতরাং কি ন্যায়পরতা, কি সাধুতা, তাদের কোনোটিরই স্বতঃমূল্য নেই। বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই তাদের প্রয়োগ ও অনুশীলন। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • রাষ্ট্রের আইন ও নৈতিক মানদণ্ড স্থান ও কালভেদে বদলায়; আর পৃথিবীর বহু জাতি তথাকথিত অধিকারের চেয়ে শক্তির ওপর জোর দিয়েই বড় হয়েছে। তাই নৈতিক বিধিনিয়মকে আত্মস্বার্থের প্রতিবন্ধক হতে দেয়া উচিত নয়, বিশেষ করে এ জন্য যে একটি নৈতিক উপদেশ বা বিধি ন্যায় ও শুভ কি-না, তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে অকাট্য ও অনিবার্য সংবেদনলাভ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি স্পষ্ট ও অনিবার্য নৈতিক মানদণ্ড আবিষ্কারও অসম্ভব। এক কথায়, নিত্য ও নির্বিকার সত্যের সন্ধান যেমন অসম্ভব, তেমনি অনপেক্ষ পরমশুভ লাভও অসম্ভব।
  • প্রকৃতপক্ষে সত্য কী বা শুভ কী, তা নিশ্চিতভাবে জানতে না পারার অর্থ এই নয় যে, আমরা কোনো কাজই করতে পারব না। সত্য ও মিথ্যা ধারণার পার্থক্য নির্দেশের কোনো নির্ভরযোগ্য বৌদ্ধিক মানদণ্ড না থাকলেও একথা ঠিক যে, কোনো কোনো ধারণা অন্যান্য ধারণার চেয়ে অধিকতর সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রতীতি বা বিশ্বাসের ওপর ভর করেই আমরা সাধারণত কাজ করে থাকি। প্রতীয়মান সত্যতার মাত্রা পরিমাপের বা সম্ভাব্যতা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি আবিষ্কার সম্ভব।
  • সম্ভাব্যতার তিনটি মাত্রা আছে – (১) নিছক সম্ভাব্যতা, যেখানে সদৃশ অবস্থাবলির তেমন কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ইন্দ্রিয় প্রতীতিকে তৎক্ষণাৎ সত্য বলে গ্রহণ করা হয়, যেমন, দেখামাত্র যা বিড়াল বলে প্রতীয়মান হয়, সেটিকে বিড়াল বলেই মনে করা হয়, তাই এখানে আমাদের ধারণাবলির সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ; কিন্তু তবু আমরা এ ধরনের ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করি এ জন্য যে, এগুলো সত্য হলে আমরা উপকৃত হব। (২) তর্কাতীত সম্ভাব্যতা, যেখানে প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণের সাহায্যে জানা যায় যে, অন্যান্য মানুষ বারবার এসব ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করে লাভবান হয়েছে বলে এদের গ্রহণ করলে আমাদেরও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এখানে সম্ভাব্য সত্যতার আপাতমূল্য এবং সংবেদনের নির্ভরযোগ্যতার সাথে সম্পর্কিত সব সংবেদন ও ধারণার সমর্থন পাওয়া যায়। (৩) প্রতিপাদিত সম্ভাব্যতা, যেখানে একটি ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করি কারণ ধারণাটিকে পুরোপুরিভাবে অনুসন্ধান করে দেখা হয়েছে এবং এর সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও খুঁজে পাওয়া গেছে। এভাবে আমাদের কর্মের ভিত্তি ত্রিবিধ, যথা সম্ভাব্য, তর্কাতীত এবং প্রতিপাদিত।
  • মানব জীবন খেলার সাথে তুলনীয়। এখানে মানুষ সম্ভাবনার ভিত্তিতে কাজ করে। যেখানে সাফল্য ও উন্নতির সম্ভাবনা বেশি, সেখানেই আমরা ঝুঁকি নিয়ে থাকি বেশি। তবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি এমন উচ্চ মাত্রার সম্ভাবনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত যেখানে ব্যর্থতার সম্ভাবনা খুবই কম।
  • জ্ঞানবিদ্যা ও অধিবিদ্যার ন্যায় নীতিশাস্ত্র কিংবা ধর্মতত্ত্বেও সুনিশ্চিত সত্য বলে কিছু নেই। সুতরাং সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য প্রভৃতির ব্যাপারে সম্ভাবনার ওপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়। নিশ্চয়তা নয়, সর্বোচ্চ সম্ভাবনাই আমাদের কর্ম ও আচরণের ভিত্তি ও লক্ষ্য হওয়া উচিত।
  • কার্নিয়াডিসের মতের বিরুদ্ধে এন্টিওকাসের আপত্তি – একদিকে সত্য ও মিথ্যা সংবেদনের কথা বলে, আবার অন্যদিকে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যনির্দেশের কোনো মানদণ্ড নেই বলে কার্নিয়াডিস স্ববিরোধিতার পরিচয় দিয়েছেন। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্দেশের মানদণ্ড যদি না থাকে, তাহলে কম সম্ভাবনা থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সম্ভাবনাকে পৃথক করা যায়না। অনপেক্ষ সত্যকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার না করলে অধিকতর সত্যকে অপেক্ষাকৃত কম সত্য থেকে আলাদা করা যায়না। শুভ সম্পর্কে কোনো পূর্বধারণা ব্যতীত একটি বিশেষ কর্মপন্থা অন্য একটি কর্মপন্থা থেকে অধিকতর কাম্য বা শুভ বলা যায়না। এই আপত্তির মোকাবেলা করতে গিয়ে তদকালীন অ্যাকাডেমির প্রধান ফিলো স্বীকার করেন যে, অনপেক্ষ সত্য বলে এক পরমসত্য রয়েছে। তবে এই সত্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। ফিলোর এই মতের প্রত্যুত্তরে এন্টিওকাস বলেন, সত্যকে যদি আমরা জানতে না পারি, তা হলে আমরা সত্য আছে সেটাও জানতে পারিনা, সত্য অজ্ঞেয় সেটাও জানতে পারিনা। এই দার্শনিক বিতর্ক ও বাকবিতণ্ডার ফলে একাডেমীর শেষ দিনগুলোতে বেশ বিক্ততার সৃষ্টি হয় এবং ফিলোর মৃত্যুতে একাডেমির অবসান ঘটে। সংশয়বাদ তখন অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়।

এনিসিডেমাস (খ্রি.পূ. প্রথম শতক)

  • একই বস্তু বিভিন্ন ব্যক্তিতে, একই ব্যক্তির বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয়ে, এমনকি একই ইন্দ্রিয় বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তা ছাড়া, নৈতিক মানদণ্ড ও ধর্মীয় বিশ্বাস বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হয়ে থাকে। আবার দার্শনিক মতাবলি বিভিন্ন মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। তাই সচরাচর মানুষ যেসব তত্ত্ব ও মতের সম্মুখীন হয়ে থাকে সেগুলো যথার্থ সত্তা নয়, অবভাসমাত্র; সত্য নয়, লৌকিক ধারণা বা অভিমতমাত্র।
  • ব্যক্তিমানুষের সংবেদন ও ধারণার বেলায়ই যে শুধু এসব বিরোধ লক্ষণীয় তা নয়, সম্প্রত্যয় বা সাধারণ ধারণাবলিও প্রায়শই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ সাধারণ ধারণাবলির প্রামাণ্যকে ভুল প্রতিপন্ন করে থাকে। এসব ব্যাপারের কোনো সন্তোষজনক সমাধান নেই; আর তা নেই বলেই তাদের কোনো যথার্থ মানদণ্ড আবিষ্কার করা যায় না। এ থেকে শুধু এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায় যে, আসলে সত্য বলে কিছু নেই ।
  • কারণ অনুসন্ধানের দুটি বিকল্প উপায় আছে – কার্যকারণ নিয়ম বলতে কখনো আমরা বুঝি যে, একটি ঘটনা অন্য একটি ঘটনা দ্বারা সংঘটিত হয়, আবার কখনো কখনো আমরা বুঝি যে, অভিজ্ঞতার জগতের ঘটনাবলি এমন এক অতীন্দ্রিয় প্রাজ্ঞিক সত্তার বহির্প্রকাশ, যার সাহায্যে বস্তু ও ঘটনাবলিকে ব্যাখ্যা করা যায়। বস্তু ও ঘটনা ব্যাখ্যার এ দুই পদ্ধতির কোনোটিই ঠিক নয়। প্রথম পদ্ধতিটি অচল কারণ কার্যকারণ কথাটি খুবই দুর্বোধ্য ও দুরধিগম্য। একটি বস্তু বা ঘটনা কী করে অন্য একটি বস্তু বা ঘটনা সৃষ্টি করে, তা কখনো প্রত্যক্ষ করা যায়না। কার্য ও কারণের যোগসূত্র অদৃশ্য, তাই এ ধরনের কোনো সূত্র আদৌ আছে কি-না, তা বলা যায়না। বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যায় দ্বিতীয় পদ্ধতিটির ব্যবহার হয়ে থাকে, এটাও হেত্বাভাসযুক্ত। অভিজ্ঞতার ঘটনাবলির মধ্যে যেমন কোনো আবশ্যিক কার্যকারণ সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি তাদের পরিচালনার জন্য কোনো অদৃশ্য অতীন্দ্রিয় সত্তা আছে, একথাও বলা যায় না। আর অভিজ্ঞতার জগতের পেছনে বা বাইরে এ ধরনের কোনো অতীন্দ্ৰিয় সত্তা থেকে থাকলেও স্ববিরোধী অভিজ্ঞতা সে সত্তার সন্ধান দিতে পারে না। তাই দৃশ্যমান জগতে অদৃশ্য সত্তা বা বস্তুর কোনো ইঙ্গিত নেই। তবু যারা অদৃশ্য অতীন্দ্রিয় সত্তায় বিশ্বাস করেন, তারা আসলে প্রতীয়মান অধ্যাসকেই বাস্তবসত্তা বলে মনে করে থাকেন।
  • সুখ আনন্দ প্রজ্ঞা এদের কোনোটিই শুভ নয়। অনপেক্ষ পরমসত্য বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি অনপেক্ষ পরমশুভ বলেও কিছু নেই। (স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • বায়ু জগতের আদি উপাদান। বিরুদ্ধভাবাপন্ন পদার্থের পৃথকীকরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে বায়ু থেকেই জগতের উৎপত্তি। (হেরাক্লিটাস প্রভাবিত)
  • প্রজ্ঞার স্বভাব সর্বজনীন; আর এ জন্যই প্রজ্ঞাবিশিষ্ট সব মানুষ সত্যের এক অভিন্ন মানদণ্ডের অধিকারী।

এগ্রিপা (খ্রিস্টীয় ১ম শতক)

  • চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা এক দ্বিকল্প সহানুমানের (dilemma) সম্মুখীন হয়ে থাকি। আমাদের হয় এই সংশয়বাদী সিদ্ধান্ত স্বীকার করতে হয় যে, অনপেক্ষ সত্য বলে কিছু নেই, আর থাকলেও একে আবিষ্কার করা যায় না; অথবা আমরা এ-ও মনে করতে পারি যে, সত্য আবিষ্কারে আমাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া উচিত। প্রথম সিদ্ধান্তটি যদি স্বীকার করা হয় তা হলে সত্যবিষয়ক আমাদের সব সিদ্ধান্তই স্থগিত রাখা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। আবার পরবর্তী কর্মপন্থাটি অবলম্বন করলেও সিদ্ধান্ত স্থগিত না রেখে উপায় নেই।
  • কার্যকারণ অনুক্রমের কোনো আদিকারণ আবিষ্কার এবং অভিজ্ঞতার জগৎব্যাখ্যার উপযোগী কোনো ব্যাখ্যানীতির সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। কারণ, যার নিজেকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, এমন কোনো সামগ্রিক ধারণায় পৌছানো অসম্ভব। অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রেই একটি অনবস্থা দোষ (infinite regress) চলে আসে। আবার স্বতঃপ্রমাণ বা স্বয়ংসিদ্ধ সত্য বলতেও যে আসলে কিছু নেই, তা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার নানাবিধ প্রতারণা এবং দার্শনিকদের মতবিরোধ থেকেই সুস্পষ্ট। তা হলে সত্য আবিষ্কার শুধু অসম্ভব নয়, বিভিন্ন নৈয়ায়িক অসুবিধার ফলে সত্যানুসন্ধান শুরুতেই নিরর্থক প্রমাণিত হয়ে যায়। যা জানা অসম্ভব বলে আমরা আগে থেকেই জানি, তাকে জানবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সময় অপচয় ও মানসিক শান্তি বিনষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। সুতরাং অহেতুক প্রশ্নের অবতারণা না করে, যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

মেনোডোটাস

  • কোনো ধারণার পক্ষে অন্য কোনো ধারণার চেয়ে বেশি সম্ভবপর হওয়া অসম্ভব।

সেক্সটাস এম্‌পিরিকাস (খ্রিস্টীয় ২য় শতক)

  • শুধু যে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে বহির্জগতের অস্তিত্ব অনুমান করা যায় না তাই নয়, বিশেষ বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণ থেকে অভিজ্ঞতার জগতের সার্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুমানের প্রচেষ্টাও একইভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ, স্থান কালসহ গোটা জগৎটাকে তন্ন তন্ন করে না দেখে আমরা জানতে পারি না যে কোন্ বিশেষ বৈশিষ্ট্য সার্বিক। তাই তথাকথিত সার্বিক রূপ, নিয়ম ইত্যাদি সবই তাদের স্থান-কাল এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতাসাপেক্ষ।
  • শুধু কার্যকারণের ধারণাটিই যে দুর্বোধ্য তা-ই নয়, পদার্থ দেশ-কাল প্রভৃতির ধারণার অবস্থাও একই। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসবই হাড়ে হাড়ে স্ববিরোধী। এমনকি গণিতশাস্ত্র ও স্ববিরোধমুক্ত নয়।
  • শুভ কী, তা আবিষ্কার করা এবং শুভের সংজ্ঞা নির্দেশ করাই নীতিশবিদ্যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এখানেও বিভ্রান্তির শেষ নেই। শুভ সম্পর্কে নীতিবিদদের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মত এবং মানবজাতির নীতিবিষয়ক বিভিন্ন বিরুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান থেকে এটুকুই বোঝা যায় যে, আসলে সব মানুষের জন্য সমান কোনো একক প্রাকৃতিক শুভ বলে কিছু নেই। আবার কোনোকিছুকে পাওয়ার ইচ্ছা ও অনুশীলন থেকেই শুরু হয় অশান্তি ও অমঙ্গল। তাই অনুশীলন ও ইচ্ছা অশুভ। এ সবের সাথে অসন্তোষ, হতাশা ও ভীতি জড়িত ইচ্ছার কোনো পরিতৃপ্তি নেই; বরং তা অনেক সময় আমাদের অবাঞ্ছিত পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। পুণ্যের পরিণতিও অশান্তি। প্রলোভন ও সংগ্রামই পুণ্যের ভিত্তি।
  • নৈতিক জীবনে আমরা এই কূটাভাস (paradox)-এর সম্মুখীন যে, শুভ একইসঙ্গে অশুভও বটে। এ থেকে বোঝা যায় যে, আসলে শুভ বলে কিছু নেই। শুভ আবিষ্কার এবং মানুষকে শুভলাভের উপায় শিক্ষার যে প্রচেষ্টা নীতিবিদ্যায় করা হয়ে থাকে, তা একটি ছল ছাড়া আর কিছুই না। জ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় নীতিবিদ্যার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখাই সুস্থ মনোভাবের পরিচায়ক। সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা মানে এই নয় যে, তাতে কাজকর্ম বন্ধ করে রাখা হবে। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রায়োগিক নিয়মাবলির ন্যায় জীবনের প্রায়োগিক নিয়মাবলিও বিশেষ বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এসব নিয়মের সমবায়েই গঠিত সহজবুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানের ইমারত।
  • প্রকৃতি আমাদের এক বিশেষ ধরনের জীবনের ইংগিত দেয়। পথনির্দেশক হিসেবে প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়, প্রবৃত্তি বিচারবুদ্ধি প্রদান করেছে। এ সবের সার্থক প্রয়োগই বিজ্ঞানের লক্ষণ। যে সামাজিক ব্যবস্থা ও পরিবেশে আমাদের জন্ম তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা বাঞ্ছনীয়। এসব ব্যাপারে অতিবর্তী বা আধিবিদ্যক বলে কিছু নেই। এদের সবই অভিজ্ঞতার তথ্যমাত্র। কোনো ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান ও চূড়ান্ত সত্যলাভ অসম্ভব এবং সর্বপ্রকার নির্বিচার উক্তি হাস্যকর হলেও প্রত্যক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা অনেককিছু শিখতে পারি। সদৃশ বস্তু ও ঘটনা পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা এমনসব সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে পারি যেগুলো যথেষ্ট উপকারী হতে পারে। এ ধরনের সুসংবদ্ধ ও পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষণের ফলেই উদ্ভব হয় শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের। আর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার নীতি অবমাননা না করেও সংশয়বাদী ব্যক্তি এসবের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে পারেন। আসলে চরম প্রশ্নাবলির ব্যাপারে নিশ্চয়তার অভাব এবং সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার প্রয়োনীয়তা কোনোমতেই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও অনুসন্ধিৎসাকে নিষ্ফল প্রতিপন্ন করে না।

নিওপিথাগোরিয়ান স্কুল

সাধারণ

  • পারমার্থিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণের চেয়ে অনুভূতি বা স্বজ্ঞাকেই অধিকতর ফলপ্রসূ। তবে জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বজ্ঞার সমর্থন করা সত্ত্বেও যুক্তিবিচারের বিরােধিতা কাম্য নয়।
  • যুক্তিবুদ্ধি যখন তার সীমিত শক্তিতে কতিপয় জটিল তত্ত্বীয় সমস্যা সমাধানে অপারগ বলে বিবেচিত হয়, তখনই শুধু পরমসত্তাকে জানার প্রচেষ্টায় বিচার-বিশ্লেষণের স্থলে অনুভূতির, প্রজ্ঞার স্থলে স্বজ্ঞার সাহায্য নেয়া হয়। এ পর্যায়ে জ্ঞাতা মরমি অভিজ্ঞতার সাহায্যে পরমসত্তার এমন এক অপরােক্ষ প্রতীতি লাভ করে যাকে জ্ঞান না বলে অনুভূতি বলাই সঙ্গত।
  • নেতারা দৈব শক্তিসম্পন্ন শিক্ষক, পিথাগােরাস সত্য ও জ্ঞানালােকের উৎস।
  • একত্ব ও বহুত্ব, যুগ্ম ও অযুগ্ম, সীমিত ও অসীমের মধ্যে যে পার্থক্য  এবং শুভ ও স্বর্গীয়কে উপরােক্ত বিরুদ্ধনীতিদ্বয়ের একটি এবং অশুভ ও জাগতিককে অপরটির নামান্তর। (পিথাগোরিয়ান স্কুল প্রভাবিত)
  • স্টোয়িকদের অনুসরণ করে তাদের কেউ কেউ ঈশ্বরকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মা বা প্লেটোর বিশ্বাত্মা বলে কল্পনা করেছিলেন। অন্যেরা আবার ঈশ্বরকে জগৎ থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন, এবং অনেকটা এরিস্টটলের মতো কিংবা প্লেটোর ‘টাইমীয়ুস’ এর মতো জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছিলেন। অন্য কেউ কেউ আবার ঈশ্বরকে পিথাগোরাস বর্ণিত এক বা মােনাড বলে কল্পনা করেন, সেক্ষেত্রে একত্ব ও বহুত্ব, যুগ্ম ও অযুগ্ম, রূপ ও উপাদান – এ সবই মােনাড থেকে উৎপন্ন। একে নিছক বিচারবুদ্ধির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা চলে না। জগতের পরিচালক হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর একদিকে যেমন রূপ ও উপাদানের সংযােগ-বিধান করেন, অন্যদিকে একত্ব ও দ্বিত্বের সৃষ্টি করেন।
  • নক্ষত্ররাজি দেবতা। জগৎ সুন্দর ও পূর্ণ।
  • জগৎ নিত্য এবং মানবজাতি অনাদি।
  • আত্মার প্লেটো বর্ণিত তিনটি অংশ রয়েছে।
  • আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। আত্মার প্রাক-জন্ম অস্তিত্ব আছে, কিন্তু পুনর্জন্মের ব্যাপারে তারা নীরব ছিলেন। (পিথাগোরিয়ান স্কুল প্রভাবিত)
  • সংবেদন থেকে অভিমতে এবং অভিমত থেকে বােধে (understanding) এবং বােধ থেকে বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার পর্যায়ে পৌঁছার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞানলাভ করা যায়। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • ইন্দ্রিয়-জগৎ প্রাজ্ঞিক জগতের জ্ঞানের অপূর্ণ রূপ। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • সংসার ও রক্তমাংসের দেহ আত্মার শত্রু। ইন্দিয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা তার স্বর্গীয় আদি নিবাসে প্রত্যাবর্তন করলে মুক্তি আসে। জীবন পরিশুদ্ধির জন্য দৈহিক আমােদ-প্রমােদ ও ভােগবিলাস বর্জন করা দরকার। তবে মাংসভক্ষণ ও মদ্যপান নিষিদ্ধ নয়, চিরকৌমার্য সমর্থনযোগ্য নয়, জৈবিক প্রয়ােজনের জন্য নয়, স্রেফ বংশবৃদ্ধির খাতিরেই যৌনক্রিয়া অনুমােদনীয়।

প্লুটার্ক (৪৮-১২০/২৫ খ্রি.)

  • একমাত্র ঈশ্বরই যথার্থ অস্তিত্বের অধিকারী। ঈশ্বর স্বয়ংসৃষ্ট, স্বচালিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিশুদ্ধ ও অবিভাজ্য একত্ব। ঈশ্বর মঙ্গলময় এবং তার মধ্যে ঈর্ষার কোনাে স্থান নেই। তিনি প্রজ্ঞাময় এবং সব জিনিসের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তবে এসব গুণ দ্বারা ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি আছেন তাই কেবল জানা যায়, কিন্তু আসলে তিনি যে কী, তা জানা যায়না, কারণ তার অধিষ্ঠান ইন্দ্রিয়জগতের বহু ঊর্ধ্বে, মানুষের সীমিত বুদ্ধির ধরাছোঁয়ার বাইরে।
  • ঈশ্বরের মতো এত উচ্চ ও পবিত্র সত্তাকে জগতের অশুভ ও অপূর্ণতার জন্য দায়ী করা যায়না। পাপ ও শাস্তি, প্রতিকূল প্রাকৃতিক কার্যকলাপ এবং ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা ও সর্বশক্তিমত্তার মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য স্টোয়িকদের চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য। ঐশ্বরিক সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনাে জড়ীয় নীতি বা শক্তির সাহায্যে জাগতিক অপূর্ণতাকে ব্যাখ্যা করা চলে না; কেননা জড় অনেকটা কুমােরের হাতের কাদার মতাে। জড় থেকে নয়, বরং জড়ের যখন যে রূপ দেয়া হয়, সেটি থেকেই মঙ্গল অমঙ্গলের উৎপত্তি। অর্থাৎ অমঙ্গলের স্বরূপ ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের অতিরিক্ত একটি দ্বিতীয় তত্ত্বের অস্তিত্ব স্বীকার্য। জড় ছাড়াও অশুভ জগদাত্মা বলে একটি পৃথক সত্তা রয়েছে। স্বভাবগতভাবেই এই অশুভ জগদাত্মা ঈশ্বরবিরােধী এবং জগতের যাবতীয় অন্যায়-অশুভের ভিত্তি। (প্লেটো ও পারস্য দর্শন প্রভাবিত, স্টোয়িকদের বিপরীতে, পারস্য দর্শনে আহুরা মাজদা (শুভ শক্তি) ও আহরিমান (অশুভ শক্তি) নামে বিপরীত শক্তি নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত আছে)।
  • জগৎ অসৃষ্ট ও নিত্য নয়। জগতের একটা সুনির্দিষ্ট শুরু রয়েছে এবং ঈশ্বরই একে কোনাে একসময় সৃষ্টি করেছেন। তবে এই সৃষ্টিকর্ম প্রত্যক্ষ নয়। নিজে সরাসরি সৃষ্টি না করে শুভ জগদাত্মার সাহায্যে ঈশ্বর জগৎসৃষ্টি করেছেন। (এরিস্টটলের বিপরীতে)
  • শুভ ও অশুভ জগদাত্মা ছাড়াও আরাে কিছু শুভ ও অশুভ সত্তা রয়েছে। নক্ষত্ররাজি পরিচালনার জন্য কিছু দেবতা রয়েছেন, এবং তাদের অধঃস্থন এমন আরাে কিছু দেবদূত রয়েছেন যারা ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী। তাদের মাধ্যমেই ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পরবর্তী দেবতাগণ জগতের নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন এবং তাদেরকেই পাপীদের শাস্তি ও পুণ্যাত্মাদের পুরস্কারপ্রদানের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এসব ডেমন বা দেবতাদের কেউ কেউ মানুষের মতােই স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, এবং মানুষের মতােই তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আবার ভালাে মানুষের পক্ষে দেবত্বলাভ সম্ভব। মানবাত্মা শুভ ও অশুভ জগদাত্মা থেকে যথাক্রমে শুভ ও অশুভ শক্তি পেয়ে থাকে। এসব শক্তি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মানবাত্মার নিজের। অশুভ জগদাত্মা থেকে আসে ইন্দ্রিয় ও দৈহিক কামনা বাসনা ইত্যাদি; আর শুভ জগদাত্মা থেকে আসে উচ্চতর প্রজ্ঞা, যা মানুষের মধ্যে দেবতাস্বরূপ।
  • নিম্নতর আত্মা বীর্য (spirit) ও অন্ন (appetition) – এ দু’ভাগে বিভক্ত। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • আত্মার অমরত্ব আছে। মৃত্যুতে আত্মার প্রজ্ঞাংশ দেবদূতের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয় এবং অনন্তকাল ধরে তাদের সঙ্গেই অবস্থান করে, কিংবা পূর্বজন্মের অশুভ কর্মের ফলে পুনরায় মানবদেহে প্রবিষ্ট হয়। দুষ্ট লােকের আত্মা পরবর্তী জন্মে ইতরপ্রাণীর রূপ নিতে পারে। (পিথাগোরাস প্রভাবিত)
  • স্বাধীন ইচ্ছা স্বীকার্য, নিয়ন্ত্রণবাদ ভুল। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী; তাই মানুষের যাবতীয় দুঃখ-ক্লেশের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। নিম্নতর প্রবৃত্তির চাপে মানুষ যা করার ইচ্ছা অনুভব করে, মানুষের উচ্চতর প্রজ্ঞার সাহায্যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে। যারা এই ক্ষমতার ব্যবহার করেন তারাই পুণ্যাত্মা, আর যারা তা না করে দৈহিক শক্তির চাপে কুকর্মে লিপ্ত হয়, তারাই পাপী।
  • একমাত্র সুখই শুভ নয়। তবে সুখ বাহ্যশুভ, এবং মানুষের আনন্দের সঙ্গে দৈহিক কার্যকলাপের কোনাে সম্পর্ক নেই – এই চিন্তা ভ্রান্ত। এসব জিনিস অনাবশ্যক নয় বলে এদের উপেক্ষা করে যথার্থ আনন্দ পাওয়া যেতে পারে না। শুভ ও উন্নত জীবনের পক্ষে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা আবেগ অনুভূতি ইত্যাদি প্রয়ােজনীয়; কেননা এগুলােও মানবপ্রকৃতির আবশ্যিক উপাদান। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত, স্টোয়িকদের বিপরীতে)
  • মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব। সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থেকে নয়, বরং এসব কাজে অংশগ্রহণ করেই মানুষ তার যথার্থ কর্মক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে। মানুষের মহৎ কাজ বা পেশার মধ্যে রাজনীতি অন্যতম। কর্তৃত্বের অধিকার যাদের দেয়া হয় তাদের দায়িত্বও অনেক। নিঃস্বার্থভাবে ও কায়মনােবাক্যে সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাওয়া তাদের কর্তব্য। বিভিন্ন প্রকার সরকারের মধ্যে রাজতন্ত্রই সর্বোত্তম। তবে রাজার পক্ষে ঈশ্বরের সেবক ও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা উচিত। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • নিছক শুভকর্মে নয়, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতায়ই মানুষের প্রকৃত শান্তি ও মুক্তি নিহিত। এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বা ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপর নাস্তিকতার প্রভাব নিতান্তই ধ্বংসাত্মক, নাস্তিকতা মানবপ্রকৃতির আধ্যাত্মিক দিকটিকে দেউলিয়া করে দেয়। নাস্তিকতার মতো কুসংস্কারের প্রভাবও ক্ষতিকর। প্রচলিত ধর্মতত্ত্বে বর্ণিত গল্প ও উপাখ্যানসমূহে ঈশ্বর ও দেবদেবীদের সম্পর্কে বহু কুসংস্কার বিদ্যমান।
  • প্রকৃত অর্থে ঈশ্বর এক। তিনি সব মানুষ ও সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা। তবে তিনি নিজেকে নানাভাবে ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন দেবদেবী ঈশ্বরেরই অভিব্যক্তি। জুপিটার, এপােলাে প্রভৃতি দেবতা একই ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম, এবং একই ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ। প্রচলিত ধর্মে বর্ণিত অতিপ্রাকৃত দৈববাণী ও সত্যকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা যখন ঘুমে বিভাের থাকি তখন আমাদের আত্মা দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে স্বর্গীয় জগৎ থেকে দৈববাণী পেতে পারে। জাগ্রত জীবনেও কৃত্রিম উপায়ে দেহ থেকে মুক্ত হয়ে আত্মার পক্ষে দৈববাণী পাওয়া সম্ভব। আর এই অবস্থায় ডেলফি ও অন্যান্য দৈববাণীপীঠের অধিষ্ঠাতা এক একজন ‘ডেমন’ তার নির্বাচিত পুরােহিতের মুখ দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন।

ম্যাক্সিমাস

  • এরিস্টটল যে বিশুদ্ধ প্রজ্ঞাকে দৈব সত্তার নির্যাস বলে বর্ণনা করেছেন তাই ঈশ্বর। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • অশুভ বিশ্বাত্মার অস্তিত্ব নেই, জড়ই বিশ্বের অশুভ ও অপূর্ণতার কারণ। প্রজ্ঞার বিধান অমান্য করে নিছক প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করা থেকেই পাপের সৃষ্টি। আত্মা স্বর্গীয় সত্তার স্ফুলিঙ্গবিশেষ। ক্ষণিকের জন্য দেহের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলেও সৎকার্যের ফলে পরিণামে আত্মা তার তার আদি স্বর্গীয় নিবাসে ফিরে যেতে পারে। (প্লুটার্কের বিপরীতে)
  • ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী বেশকিছু দেবদেবী রয়েছেন। তারা মানুষের স্বর্গীয় অভিভাবক ও ঈশ্বরের সেবকের ভূমিকা পালন করে থাকেন।

এপুলেইয়াস (১২৪-১৭০ খ্রি.)

  • ঈশ্বর ও জড়ের মাঝখানে শুধু দেবদেবীদেরই নয়, প্লেটোর প্রত্যয়সমূহ ও প্রজ্ঞাকেও আছে। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • দেহের পিঞ্জর ও জগতের শৃঙ্খল থেকে আত্মার মুক্তিতেই প্রকৃত পরিত্রাণ নিহিত।

আলবিনাস (খ্রিস্টীয় ২য় শতক)

  • ঈশ্বর ও জগতের মধ্যবর্তী দেবদেবীরা আছে। দেবদেবীদের সঙ্গে বিশ্বাত্মা ও প্লেটোনিক প্রত্যয়সমূহ সংযােজিত। বিশ্বসৃষ্টি ঈশ্বরের নয় অধঃস্থন দেবদেবীদের কাজ। ঈশ্বর জড়জগৎ থেকে বহুদূরে থাকেন; তাই তিনি জড়জগতের কোনাে কাজের সঙ্গেই সরাসরি জড়িত নন।
  • কোনাে বিশেষ সময়ে জগৎ সৃষ্ট হয় নি, জগৎ অনাদি ও অনন্ত। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত, প্লুটার্কের বিপরীতে)

আটিকাস (খ্রিস্টীয় ২য় শতক)

  • জগৎ এক বিশেষ সময়ে সৃষ্ট। (প্লুটার্ক প্রভাবিত)

নিউমেনিয়াস (খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষ ভাগ)

  • প্লেটো পয়গম্বর মোজেসের যমজ সহােদর।
  • প্লেটো ও যীশুর শিক্ষার প্রতিও শ্রদ্ধাশীলতা।
  • সমসাময়িক পিথাগােরীয়-প্লেটোবাদী সিলাস-এর সাথে তার পার্থক্য ছিল, সিলাস স্টোয়িক নিয়ন্ত্ৰণবাদ ও প্রকৃতিবাদ দ্বারা প্রভাবিত, এবং তিনি খ্রিস্টধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং প্লেটোর মতের এক অভাবনীয় অধঃপতিত সংস্করণ বলে নিন্দা করেন।
  • ঈশ্বর এরিস্টটলের প্রজ্ঞা, পিথাগােরীয়দের মােনাড এবং প্লেটোর শুভের ধারণার সমার্থক। ঈশ্বর এতই উচ্চস্থানীয় এবং এতই দূরবর্তী যে, জগতের সঙ্গে তার কোনাে সম্পর্কই থাকতে পারে না। জগতের কার্যকলাপে ঈশ্বরের কোনাে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই, এবং জগৎসৃষ্টিতেও ঈশ্বরের কোনাে হাত নেই। জগতের সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ এক অধঃস্থ দ্বিতীয় ঈশ্বরের কাজ। জগৎকে বলা চলে তৃতীয় ঈশ্বর। ঈশ্বরের সংখ্যা এক নয়, তিন। এরা হলেন : এক, পরমেশ্বর; দুই তারই সৃষ্ট সৃজনী ঈশ্বর; এবং তিন, সৃষ্ট জগৎ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঈশ্বরের স্বভাব দ্বৈত প্রকৃতির। বিশুদ্ধ স্পিরিট বা প্রজ্ঞা থেকে উদ্ভূত হলেও জড়ের সঙ্গে দ্বিতীয় ঈশ্বরের সংযােগ রয়েছে। এই দ্বিতীয় ঈশ্বরই হলেন জগতের অন্তর্নিহিত শুভ আত্মা। তৃতীয় ঈশ্বর স্বর্গীয় আত্মা ও জড়ের সংমিশ্রণ।
  • স্বর্গীয় আত্মার বিরােধী এক অশুভ শক্তি দ্বারা জড় পরিচালিত, এবং এ শক্তিই জগতের সব অপূর্ণতার জন্য দায়ী। সুতরাং তিনজন ঈশ্বরের সঙ্গে একজন ডেভিল বা অশুভ সত্তাকে যুক্ত করা আবশ্যক। মানুষ একাধারে আধ্যাত্মিক ও দেহধারী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাহীন বলে উভয় প্রকার (শুভ ও অশুভ) জগদাত্মার সঙ্গেই তার সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের সংগ্রাম অবিরাম চলছে, এবং এ নিয়েই তার নৈতিক জীবন গঠিত।
  • নৈতিক মতের কঠোরতা সমর্থনযোগ্য নয়। দৈহিক কার্যকলাপকে যেকোনাে অবস্থায়ই অশুভ বলা চলে না। প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত না হয়ে অযৌক্তিক ও অশুভ বিশ্বাত্মার শিকার হলেই কেবল তারা অশুভ। তবে এক উচ্চতর অবস্থা থেকেই আত্মার প্রজ্ঞাংশ দেহে প্রবিষ্ট হয়েছে। দেহের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে উচ্চতর স্বর্গীয় আদিআত্মায় প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই আত্মার মুক্তি বা পরিত্রাণ নিহিত। বিদেহী অবস্থা থেকে কয়েকবার দেহপ্রাপ্ত হওয়ার মাধমে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হয়েই মানুষ চূড়ান্ত মুক্তিলাভ করতে পারে। প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে কাজ করা এবং ঈশ্বরের সঙ্গে যােগাযােগ রাখাই আমাদের বর্তমান জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

হার্মেটিকগণ (খ্রিস্টীয় ১ম/৩য় শতক – চলমান)

  • হারমেটিকগণ ঈশ্বরকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসেন, যেখানে তিনি অনেকটা মরমিভাবাপন্ন হয়ে যান। কিন্তু তার মধ্যে প্রজ্ঞা ও ইচ্ছা আরােপ করে থাকেন।
  • সূর্য থেকে যেভাবে আলাের আগমন, ঠিক তেমনি ঈশ্বর থেকে প্রজ্ঞার আগমন। এই প্রজ্ঞা থেকেই আত্মার উৎপত্তি।
  • আত্মা ও জড়ের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রয়ােজন। বায়ু ও শ্বাসপ্রশ্বাসই এই মধ্যস্থতা করে থাকে। সে একটি নিষ্ক্রিয় ও আকারহীন শক্তি; কিন্তু তা স্বর্গীয় সত্তা দ্বারা এত সুন্দরভাবে গঠিত যে তাকে দ্বিতীয় ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরের পুত্র বলা চলে।
  • খ্রিস্টানদের জগৎকে উপেক্ষা ও তুচ্ছজ্ঞান করার মতবাদ সমর্থনযোগ্য নয়।
  • ঈশ্বর জগতের ঊর্ধ্বে, সুতরাং তিনি জগতের স্রষ্টা নন – এই মত সমালোচনাযোগ্য।
  • সব অশুভ-অমঙ্গলের মূলে রয়েছে জড়। আধ্যাত্মিক ও জড়ের, ঐন্দ্ৰিয়িক ও স্বর্গীয় সত্তার মধ্যে কোনাে সংযােগ সম্ভব নয়। মানুষের আত্মা ও প্রজ্ঞার উৎপত্তি স্বর্গীয় সূত্র থেকে, এবং পুণ্যকাজ অনুষ্ঠানের ফলে পরিণামে তারা তাদের আদিনিবাসে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন।
  • হারমেটিকগণ একদিকে তারা বাহ্যজগৎ ও ইন্দ্রিয় থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে ঈশ্বরের সঙ্গে অপরােক্ষ যােগাযােগ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, অন্যদিকে আবার বলেছেন যে, আমরা যে জগতে বাস করছি তাকে ঘৃণা ও উপেক্ষা করা অনুচিত। শুধু তাই নয়, উপদেশ দিচ্ছেন যে, প্রতিষ্ঠিত ধর্মের চর্চা এবং দেবদেবীদের মূর্তির উপাসনা করা মানুষের কর্তব্য।

ইহুদি দর্শন ও ফিলোজুডিয়াস (আনু. ২০ – ৫০ খ্রি.)

  • মুসার অকাট্যতা স্বীকার, ইহুদি পুরাণকে ঈশ্বরের প্রেরিত গ্রন্থ বলে বিশ্বাস।
  • শুধু প্লেটো ও নব-পিথাগোরীয়গণই নয়, পূর্ববর্তী সব চিন্তাবিদ, সমকালীন স্টোয়িকরা, এমনকি সংশয়বাদীরাও তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মশাস্ত্রে বিধৃত খাঁটি সত্যের অনুমান করেছিলেন। দার্শনিক ও পয়গম্বরগণ ভিন্ন উপায়ে একই সত্যের সন্ধান পান।
  • এমনকি বহুঈশ্বরদকেও (যার প্রতি গোঁড়া ইহুদিদের বিতৃষ্ণার অবধি ছিল না) মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। গ্রিক দেবতারা অশুভ শক্তি নয় ( হিব্রুরা গ্রিক দেবতাদের অশুভ বলে মনে করতেন), বরং অংশত প্রাকৃতিক ঘটনাবলির, আর কিছুটা প্রাচীন বীরপুরুষদের স্মৃতির ব্যক্তিত্ত্বায়িত রূপবিশেষ।
  • দৃশ্যমান জগতের প্রতীয়মান বস্তু ও ঘটনাবলি সংবেদনের লক্ষ্য। অপরপক্ষে বুদ্ধির কাজ জ্ঞানকে সংবদ্ধ করা ও জীবনের সারবস্তুর ধারণা দেয়া। সংবেদন চায় জড়বস্তুর জ্ঞান দিতে, আর বুদ্ধি চায় অজড় পদার্থের জ্ঞান দিতে। জ্ঞানপ্রক্রিয়ায় একটি ক্রমোন্নতির ধারা বিদ্যমান। এখানে আমরা দৈহিক সংবেদন থেকে শুরু করে ঐশ্বরিক জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয়ে থাকি। বুদ্ধি নয়, স্বজ্ঞাই জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ।
  • ঈশ্বর এত মহান এবং জগৎ থেকে তিনি এত দূরে অবস্থিত যে, সহজ অভিজ্ঞতা কিংবা বুদ্ধির সাহায্যে তাকে জানা অসম্ভব। তবে উপমা, উপাখ্যান ও রূপকের মাধ্যমে ঈশ্বর সসীমের মনে নিজেকে ব্যক্ত করে থাকেন। বাহ্য চেতনার স্তর অতিক্রম করে উচ্চতর ভাবসমাধির পর্যায়ে মানুষের পক্ষে দিব্যদর্শন বা ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভ সম্ভব। এ পর্যায়ে ঈশ্বরকে তার বিশুদ্ধ একত্বে দর্শন করা সম্ভব। বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও অনুশীলনের অবশ্যই একটি ভূমিকা আছে; তবে এর সাহায্যে ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভ করা যায় না। ঈশ্বরের স্বরূপের ন্যায় ঈশ্বরের জ্ঞানও অনির্বচনীয়। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষা কিংবা যুক্তিতর্কের সাহায্যে ঐশ্বরিক জ্ঞান বর্ণনা করা যায় না। ঐশ্বরিক জ্ঞানের সঙ্গে যে উচ্চতর অভিজ্ঞতা যুক্ত, তা আমাদের উচ্চতম চিন্তার নাগালের বাইরে।
  • ঈশ্বরের অতিবর্তন (transcendence) এবং জগৎ ও ঈশ্বরের মধ্যকার ব্যবধান সত্য। প্লেটোদর্শনে শুভের প্রত্যয়ের যেমন সংজ্ঞা নির্দেশ সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি ঈশ্বরের সংজ্ঞা নির্দেশও সম্ভব নয়। ঈশ্বর পরম সৌন্দর্য পবিত্রতা একত্ব প্রভৃতি সসীম গুণের অতীত ও ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর নির্গুণ ও নিরুপাধি। তিনি মানুষের মতো নন। ঈশ্বর আবার স্বর্গ বা মর্তের কোনো বস্তুর মতোও নন; কেননা এসব বস্তু সসীম ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অথচ ঈশ্বর অতীন্দ্রিয় ও মানবীয় বুদ্ধির অতীত। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবকিছুকে তিনি বেষ্টন করে আছেন ঠিক, কিন্তু নিজে কোনো বস্তু দ্বারা বেষ্টিত নন। তিনি স্বয়ং তিনিই। তিনিই সব।
  • আমরা শুধু জানি যে, ঈশ্বর আছেন; কিন্তু তিনি যে ঠিক কী, তা জানা অসম্ভব। এজন্যই তার নাম জেহোভা। তবে তিনি সদাসৃজনশীল এবং যাবতীয় সসীম পদার্থের পূর্ণতার উৎস ও কারণ। তিনি সব বস্তুর পরিণতিকারণ। শক্তি ও কল্যাণ তার দুটি স্বরূপগত গুণ। সর্বোত্তম কল্যাণসাধনেই তিনি তার শক্তি ব্যবহার করে থাকেন। ঈশ্বর এত উচ্চে এবং জগৎ থেকে এত দূরে অবস্থিত যে, তিনি সরাসরি কিছুই সৃষ্টি করেন না। সৃষ্টিকর্মের দায়িত্ব তিনি কিছু মধ্যবর্তী স্বর্গদূতের হাতে অর্পণ করেন, এবং এ ব্যাপারে তাদের প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করেন। এই শক্তিবলেই জগতের সৃষ্টি। (নিওপিথাগোরিয়ান প্রভাবিত)
  • কল্যাণ ও শক্তি ঈশ্বরের দুটি প্রধান গুণ। আর এ দুয়ের সমবায়েই লোগোস গঠিত। লোগোস বলতে ফিলো বুঝেছেন এমন এক সৃজনশীল শক্তিকে যার মাধ্যমে জগতের সৃষ্টি। ঈশ্বরের সঙ্গে লোগোসের সম্পর্ক সম্বন্ধে ফিলো স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। লোগোসকে তিনি কখনো ঈশ্বর থেকে পৃথক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সত্তা বলে, কখনো ঈশ্বরের দূত বলে, কখনো আবার ঈশ্বরের প্রথম পুত্র বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কখনো তিনি একে ঈশ্বরের গুণ, কখনো তার প্রত্যয় অথবা চিন্তা, কখনো আবার জগতে অনুস্যূত সার্বিক শক্তি ও প্রজ্ঞা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। (নিওপিথাগোরিয়ান প্রভাবিত)
  • ফিলো কোথাও কোথাও স্বর্গদূতদের ঈশ্বরের ভৃত্য ও অনুচর এবং ঈশ্বর ও জগতের মধ্যস্থতাকারী সত্তা বলে বর্ণনা করেন। আবার কখনো কখনো তাদের স্রেফ অলৌকিক মনের ধারণা ও ক্রিয়া বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু এ দু’রকম বর্ণনার মধ্যে তিনি সন্তোষজনক সামঞ্জস্যবিধান করতে পারেন নি। এসব শক্তি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ কি-না, ফিলো তা-ও স্পষ্ট করে বলেন নি। এ সব শক্তিকে তিনি লোগাসোর অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং লোগোসকে ঈশ্বরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বলে বর্ণনা করেছেন।
  • লোগোস ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও দূত, জগতের সৃষ্টি ও শাসনের যন্ত্র, স্বর্গদূতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরের প্রথম পুত্র এবং দ্বিতীয় ঈশ্বর। লোগোস জগতের প্যাটার্ন বা আদর্শ। জগতের সবকিছু তারই সৃষ্টি। লোগোসের অধীনস্থ অসংখ্য স্বর্গদূত ও উপদূত জগতের শাসন ও নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত। তাদের কেউ কেউ নক্ষত্ররাজিতে অবস্থান করে তাদের গতিপথ পরিচালনা করেন। কেউ কেউ আবার জগতের সংস্পর্শে এসে এবং ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে মানুষের দেহগ্রহণ করে এবং মানুষে পরিণত হয়। সুতরাং বলা চলে যে, প্রতিটি মানবাত্মা অলৌকিক সত্তার অংশবিশেষ, অলৌকিক মনের প্রতিচ্ছবি এবং তার উৎপত্তিস্থল থেকে বিচ্যুত ইন্দ্রিয় ও দেহের নিগড়ে সাময়িকভাবে আবদ্ধ ঈশ্বরের শক্তিবিশেষ। তবে লোগোসের অবতারনায় কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়, যার সমাধান করা হয়নি। লোগোস যদি ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র কোনো পুরুষ হয়ে থাকেন, তা হলে জগতে অনুষ্ঠিত তার কার্যকলাপ দ্বারা ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্কের ব্যাখ্যা হয় না। আবার লোগোস যদি ঈশ্বরের গুণই হয়ে থাকে, তা হলে জগতে তার ক্রিয়াকলাপ ঈশ্বরের ক্রিয়াকলাপেরই নামান্তর হয়ে যায়। (নিওপিথাগোরিয়ান প্রভাবিত)
  • জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হয়নি, তবে ঈশ্বর জগতের অতীত, এবং জগতের স্পর্শে ঈশ্বর কলুষিত নন— একথা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে জড়ের অবতারণা করা হয়। জগতের সব অন্যায় ও অশুভের মূলে রয়েছে জড়। জড় চিরদিনই ঈশ্বরের বিরোধী। জড় সবসময় লোগোসের কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। সব অকল্যাণের জন্য জড়ই দায়ী। ঈশ্বর যেহেতু শুভ, সুতরাং তিনি শুধু কল্যাণেরই কর্তা; আর এ জন্যেই ইন্দ্রিয়জগতের কোনো অন্যায় অশুভ কিংবা অন্য কোনো অপূর্ণতার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা চলে না। পূর্ব-অস্তিত্বশীল বিশৃঙ্খল জড় থেকে ঈশ্বর জগৎসৃষ্টি করেছিলেন। এদিক থেকে বলা চলে যে, জগতের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই।
  • জগৎ সক্রিয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত। (স্টোয়িক প্রভাবিত)
  • জড় অসৃষ্ট, আকারহীন, নিষ্ক্রিয় ও বিশৃঙ্খল অসত্তা। আবার জড় ভৌত বস্তুর উপাত্তপ্রদানকারী সত্তাবিশেষ। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • জড় প্লেটো বর্ণিত শূন্যদেশের নামান্তর নয়, বরং গুণসম্পন্ন। (স্টোয়িক প্রভাবিত, প্লেটোর বিপরীতে)।
  • নৈতিক জীবন ধর্মীয় জীবন থেকে মুক্ত নয়। নৈতিক জীবন ধর্মের প্রারম্ভিক পর্ববিশেষ। একই কারণে বুদ্ধি অনপেক্ষ নয়, এটি বিশ্বাসের চেয়ে নিকৃষ্ট। ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী; যশ সম্মান ইত্যাদি সবই দৈবাধীন। ধনসম্পদ আপতিক সৌভাগ্যের ব্যাপার। শুধু বিশ্বাসের কথা স্বতন্ত্র। বিশ্বাস মানুষকে যথাযথভাবে মহৎ করে তোলে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত এবং আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে।
  • বিশ্বাস মানুষের মনে বিষণ্নতা সৃষ্টি করে – মধ্যযুগের বিজ্ঞানীদের এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বাস মানুষের মনকে আশা প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ করে তোলে। একজন বিশ্বাসী মানুষের ধ্যান-ধারণা জীবনের ঘাত প্রতিঘাত দ্বারা বিঘ্নিত হতে পারে না, দুঃখকষ্টও তার আনন্দ কমাতে পারে না। পৃথিবীকে যিনি সঠিকভাবে বোঝেন, তিনি কখনো বিষণ্ন বা নৈরাশ্যবাদী হতে পারেন না। তার মন সর্বদা প্রশান্ত ও সুস্থির থাকে। প্রতি কাজেই তিনি থাকেন প্রফুল্ল। মোটকথা, বিজ্ঞজনের জীবন ঈশ্বরের ক্ষমতারই সাক্ষ্য বহন করে। মানুষ সর্বদাই অবাঞ্ছিত কামনার তাগিদ অনুভব করে। আমরা যেন আত্যন্তিক ভোগবিলাসের অপকারিতা সম্পর্কে সতর্ক থাকি। দৈহিক সুখ মানুষের শত্রুস্বরূপ। দৈহিক সুখে নিমগ্ন না হয়ে আমাদের উচিত আত্মিক আনন্দের দিকে মনোনিবেশ করা।
  • স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার থেকেই পাপের সৃষ্টি। প্রজ্ঞার নির্দেশ অমান্য করে দৈহিক সুখে নিমগ্ন হওয়ার অর্থই হলো স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করা এবং পাপে লিপ্ত হওয়া। দেহ আত্মার কবরস্বরূপ, দেহই যাবতীয় অশুভের আকর। দেহের প্রভাবেই পাপের সৃষ্টি। আমাদের সবার মধ্যেই আদিপাপ সংক্রমিত; কেননা আমরা সবাই দেহের অধিকারী। এমতাবস্থায় আমাদের সকলেরই উচিত প্রজ্ঞার নির্দেশ মান্য করা এবং ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। আমাদের উচ্চতর প্রকৃতির আদিনিবাস স্বর্গীয় জগৎ; আর প্রজ্ঞার অনুশীলন দ্বারা দেহের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই চূড়ান্ত মুক্তি নিহিত।
  • নির্মল অনুধ্যান এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মরমি সংযোগ জীবনের পরম লক্ষ্য। ব্যবহারিক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অগ্রাহ্য করে এ লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। সংসারবিরাগী সন্ন্যাসজীবন পুণ্য ও পবিত্রতালাভের একমাত্র উপায় নয়। সামাজিক জীবনের আচার-অনুষ্ঠান ও আদানপ্রদানে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ থেকে এবং জড়ীয় কামনায় সংযম অনুশীলন করে আমরা পুণ্যবান হতে পারি। অনুধ্যানী জীবনে প্রবেশ করার আগে আমাদের উচিত প্রচলিত সাধারণ গুণাবলির অনুশীলন করা। পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু যে ক’দিন আমরা এখানে আছি, সে ক’দিন আমাদের উচিত পার্থিব প্রয়োজনের তাগিদ মেটাবার চেষ্টা করা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা, সমাজের অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রাখা। মোটকথা, ঈশ্বরের সেবা করার আগে আমাদের উচিত মানুষের সেবা করা।
  • আদর্শ বিশ্বনাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই আমাদের সব কার্যকলাপ পরিচালিত হওয়া উচিত। ধর্ম দ্বারা পরিচালিত ঈশ্বরতন্ত্র (theocracy) আদর্শ সরকার। তার আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা মুসার বিধির (Mosaic Code) ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এটি প্যাগান দার্শনিকদের কল্পিত রাজ্যের চেয়ে উত্তম। হিব্রু আইন স্বয়ং ঈশ্বর দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট, তাই এই আইন অকাট্য এবং অন্য সব আইনের চেয়ে উৎকৃষ্ট। একে কোনোদিনই বাতিল করা যাবে না। কেননা তা ঈশ্বরের তরফ থেকে মানুষের জন্য একটি উপঢৌকনস্বরূপ।
  • সর্বোত্তম রাষ্ট্রের থাকবে একটি মিশ্র সংবিধান। ঐশ্বরিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি হবে এ রাষ্ট্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর বিশ্বের শুধু শাসকই থাকবেন না, মানুষের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিচালকও হবেন।
  • আদর্শ নতুন সমাজ সুবিচার ও শান্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সমাজে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা কোনো শোষণের অস্তিত্ব থাকবে না; সব জাতি সমানভাবে ঈশ্বরের গুণকীর্তন করবে।
  • মানবজাতি একদিন কুসংস্কার ও ভয় থেকে মুক্তিলাভ করবে। এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র চালাবে না, বরং সবাই আধ্যাত্মিক আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করবে।
  • গ্রিক ইতিহাসবিদদের অধিকাংশের মতে, ইতিহাস বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির উত্থান-পতনের ভাষ্য। থ্যুকিডাইডিস প্রমুখ ইতিহাসবিদ কোনো অতীন্দ্রিয় কারণের সাহায্য না নিয়ে ইতিহাসের এক প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী করে মানুষের প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে, তারা তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফিলোর মতে, ইতিহাস ঈশ্বর কর্তৃক পরিচালিত। এর একটি নির্দিষ্ট শুরু ও নির্দিষ্ট শেষ রয়েছে।

নিওপ্লেটোনিজম

প্লটাইনাস (২০৪/৫ – ২৭০ খ্রি.)

সাধারণ

  • ধর্মীয় ও মরমিভাবাপন্নতা। আধ্যাত্মিক সত্তা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিলাভই দার্শনিক চিন্তার মূল্য লক্ষ্য। সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত এবং কুসংস্কারবিহীন ও খেয়ালখুশিবিহীন মরমিবাদ ও ঈশ্বরভক্তি, যার ভিত্তি এমন এক সুসংবদ্ধ দর্শন যাতে মানুষের সঙ্গে জগৎ ও ঈশ্বরের সম্পর্কের এক সংহত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের সমর্থন, কিন্তু শুধু বিচার বিশ্লেষণের সাহায্যে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করা যায় না, ঐশ্বরিক জ্ঞানের শেষ পরিণতি অপরোক্ষ অনুভূতি। যে বিশ্লেষণী চিন্তা থেকে জ্ঞানপ্রক্রিয়ার উদ্ভব তাকে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত এগিয়ে না নিলে ঐশ্বরিক জ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় ভাবসমাধি (ecstasy) লাভ করা যায় না।
  • বিভিন্ন দেবতা উচ্চতর পর্যায়ের অপ্রাকৃত শক্তি। সাধারণ অপ্রাকৃত শক্তিসমূহ এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পৃথিবী প্রভৃতি সৌরজাগতিক অন্যান্য সত্তা – সকলেই বিশ্বাত্মার সৃষ্টি। এরা সকলেই চৈতন্য-জগতের নিম্নতর এক পরিমণ্ডলে অবস্থান করেন এবং তারা সকলে মূলত এক অথবা বলতে গেলে একই সকলের মধ্যে বিরাজমান। চন্দ্র অবস্থান করেন চৈতন্য-জগৎ এবং নিম্নতর জগতের সীমান্তরেখায়। চন্দ্র অপেক্ষা উধ্বতর যে কোনো সত্তাই দেবতা। বিভিন্ন অপ্রাকৃত এবং সৌরজাগতিক শক্তিসমূহ চৈতন্য জগতের নিম্নতর পরিমণ্ডলে অবস্থান করে। অপ্রাকৃত শক্তিসমূহ বিশ্বাত্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবীতে বাস করে। তারা চিরন্তন এবং চৈতন্যের উপাদানে তাদের দেহ গঠিত। তারা উধ্বস্থিত চৈতন্য-জগৎ দেখতে পান ; তাদের অনুভবশক্তি ও স্মৃতিশক্তি আছে এবং তারা মানুষের আবেদন শুনতে পান। এছাড়া তারা নিজেদের আগ্নেয় এবং বায়বীয় আচ্ছাদনে নিজেদের আবৃত করতে পারেন। সূর্য নক্ষত্ররাজি এবং পৃথিবী আমাদের প্রার্থনা শোনেন এবং ভবিষ্যৎ সংঘটনের পূর্বাভাষ দেন। কিন্তু তারা প্রাকৃতিক নিয়মানুগ বলে কোনো কার্য ঘটাতে পারে না। তবে তিনি প্রকাশ্য পূজা-অর্চনার প্রতি অনাসক্ত ছিলেন, প্রত্যেক মানুষের উচিত স্বর্গীয় করুণা লাভের জন্য ঊর্ধ্বাভিসারী প্রেমের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা; অবশ্য “দেবগণই আমাদের কাছে আসবেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে না।” মন্দির নয়, মানুষের হৃদয়ই দেবতাদের বাসস্থান।
  • প্লেটোর মত আধ্যাত্মিক প্রেমে বিশ্বাসী, প্লেটোর মরমিবাদ ও প্রত্যয়ের বাস্তবতা গ্রহণ করেন। তবে সার্বিকের ন্যায় বিশেষ বস্তুরও প্রত্যয় আছে। (প্লেটো প্রভাবিত ও বিপরীতে)
  • দার্শনিক রাজার সাহায্যে মানুষের সংস্কার সম্ভব নয়, তাই অধিবিদ্যার আদর্শাবলিকে রাষ্ট্রনীতিতে প্রয়োগ করা যায়না। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • পার্থিব জীবন স্বর্গীয় বিশুদ্ধতা থেকে বিকীর্ণ, এবং আত্মা অবশ্যই ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলিত হবে।

অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা

  • গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই এক অনন্ত সত্তার প্লাবনধারা। ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলনই এর উদ্দেশ্য। ঈশ্বর সব অস্তিত্বের, সব বিরোধ ও বৈপরীত্বের, দেহ ও মনের রূপ ও উপাদানের উৎস। তিনি সর্বত্র অর্থাৎ বহুত্বে বিদ্যমান, কিন্তু তিনি নিজে সর্বপ্রকার বহুত্বের ঊর্ধ্বে। তিনি সম্পূর্ণরূপে এক। সবকিছুই তার মহাএকত্বের অন্তর্ভুক্ত। তিনি সাধারণ অর্থে এক নন; তিনি মহাএকত্ব।
  • ঈশ্বর সম্পর্কে যাই বলা যায় তা-ই তাকে সীমিত করে। তাই তার ওপর সৌন্দর্য মহত্ত্ব চিন্তা বাসনা ইচ্ছা অভীপ্সা ইত্যাদি কোনো গুণ আরোপ করা যায়না, কারণ এসব গুণ সীমিত শক্তি ও অপূর্ণতার আকর। ঈশ্বর কী নন, শুধু তা-ই বলা যায়। তিনি আসলে কী, তা বলা সম্ভব নয়। তাকে সত্তা বলে বর্ণনা করা যায়না, কারণ সত্তা চিন্তনীয়। যা চিন্তনীয়, তাতে বিষয় ও বিষয়ীয় ধারণা রয়েছে। ঈশ্বর বিষয়-বিষয়ীর দ্বৈততার দ্বারা শৃঙ্খলিত নন, বরং তিনি এর বহু ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর সম্বন্ধে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, তিনি সব চিন্তার অতীত।
  • ঈশ্বর থেকেই সবকিছুর উদ্ভব। তার একত্ব সব বহুত্বের পূর্ববর্তী ও সব বহুত্বের ঊর্ধ্বে। জগৎ ঈশ্বর থেকে উদ্ভূত বটে; কিন্তু ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন নি; কারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য চেতনা ও ইচ্ছা আবশ্যক। ঈশ্বরে চেতনা বা ইচ্ছা আরোপ করা তাকে সীমিত করারই শামিল। ঈশ্বর জগৎসৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি, কিংবা জগৎ থেকে বিবর্তিতও হন নি; কেননা ঈশ্বর পরম পূর্ণসত্তা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বর থেকে নির্গত বা বিকীর্ণ হয়েছে। ঈশ্বর থেকে জগতের সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া হলো বিকিরণ (emanation)। সূর্যরশ্মি যেভাবে সূর্য থেকে নিঃসৃত হয়, আগুন যেভাবে তাপ বিকিরণ করে, স্বতঃসিদ্ধ থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত নিঃসৃত হয়, ঈশ্বর থেকেও বিশ্বজগৎ সেভাবে বিকীর্ণ হয়েছে। ঈশ্বর থেকে জগতের বিকিরণ কোনো একটি বিশেষ সময়ে সংঘটিত ব্যাপার নয়, বরং ঈশ্বরের প্রকৃতির অনিবার্য পরিণতি। বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি থেকে বিশ্বাত্মার বিকিরণ, জড়ের সৃষ্টি, বিভিন্ন বস্তুতে জড়ের বিভাজন ইত্যাদি সব মিলে একটি অবিরাম প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিমূর্ত চিন্তা এ প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু মূলত গোটা ব্যাপারটিই একটি নিত্য ও অবিভাজ্য ক্রিয়া।
  • ‘কারণ’ কখনো নিজেকে কার্যে হারিয়ে ফেলে না; কার্যও কারণকে সীমিত করে না। জগতের আদি কারণ হিসেবে ঈশ্বর জগতের ওপর নির্ভরশীল নন; বরং জগৎই ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। শিশুর জন্মের পরও যেমন জনক-জননী একইভাবে চলতে থাকে, তেমনি জগৎসৃষ্টির পরও ঈশ্বর অপরিবর্তিত থেকে যান। সৃষ্টির ফলে ঈশ্বরের পূর্ণতা বিঘ্নিত হয় না।
  • ঈশ্বর থেকে জগতের বিকিরণের তিনটি প্রধান স্তর রয়েছে: এক, বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি; দুই, আত্মা এবং তিন, জড়। প্রথম স্তরে ঈশ্বরের সত্তা বুদ্ধি ও প্রত্যয়, এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ ঈশ্বর চিন্তাকেই চিন্তা করেন; তিনি বিশুদ্ধ আদর্শ জগৎকে ধ্যান করে থাকেন। চিন্তা ও ধারণাবলি, বিষয় ও বিষয়ী এ পর্যায়ে একীভূত; অর্থাৎ তারা দৈশিক ও কালিকভাবে পৃথক নয়। স্বর্গীয় সত্তার চিন্তারত মন ও সে মনের চিন্তায় কোনো প্রভেদ থাকে না। ঈশ্বরের চিন্তা পরিপূর্ণ সত্য বলেই এমনটি হয়ে থাকে। ঈশ্বর তার নিজ চিন্তাসমূহকেই চিন্তা করে থাকেন; আর এসব চিন্তা তার সারধর্ম থেকেই উদ্ভূত। ঈশ্বরে চিন্তার কর্তা ও চিন্তা এক ও অভিন্ন। তবে ঈশ্বরের চিন্তা বিশ্লেষণী চিন্তা নয়; অর্থাৎ ঐশ্বরিক চিন্তা এক ধারণা থেকে অন্য ধারণায়, আশ্রয়বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে গমন করে না।
  • ঈশ্বরের চিন্তা এমন এক স্বাত্তিক স্থিরচিন্তা, যার মাধ্যমে প্রত্যয়সমূহকে একই সঙ্গে ধ্যান করা হয়ে থাকে। সহজ অভিজ্ঞতার জগতে যেমন অনেক বস্তু রয়েছে, তেমনি সে জগতে প্রত্যয়ের সংখ্যাও অনেক। বিশেষ বস্তুর সংখ্যা যত, প্রত্যয়ের সংখ্যা তত। এসব প্রত্যয় নিছক প্রত্যয়ই নয়, একইসঙ্গে গতিশীল শক্তির আধার। প্রত্যয়গুলোর মধ্যে প্রভেদ রয়েছে তবে প্রত্যয়গুলোর সমন্বয়ে একটি একক সিস্টেম গঠিত। প্রত্যয়ের এই সিস্টেমেই ঈশ্বরের পরম একত্ব প্রতিফলিত হয়ে থাকে। দৃশ্যমান জগতের প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তুর জন্য ঈশ্বরের মনে একটি করে প্রত্যয় রয়েছে। বিশুদ্ধ চিন্তার জগৎ দেশহীন ও কালহীন। এটি এমন একটি পূর্ণ, চিরন্তন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ, যা ইন্দ্রিয় জগতের মডেল বা আদর্শস্বরূপ। প্রত্যয়গুলো শুধু আদর্শই নয়, ক্রিয়াশীলও বটে। বিকিরণের প্রতিটি স্তরে তারা পরবর্তী স্তরের নিমিত্ত কারণ হিসেবে উপস্থিত থাকে।
  • বিকিরণের দ্বিতীয় স্তরে বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি থেকে নির্গত হয় আত্মা। আত্মার স্বভাব বুদ্ধির অনুরূপ ; তবে আত্মা বুদ্ধির চেয়ে দুর্বল। আত্মা বিশুদ্ধ চিন্তার বা বুদ্ধির প্রতিবিম্ব। আত্মা জড়জগৎ ও প্রত্যয় জগতের মধ্যবর্তী। উভয় জগতের স্বভাব আত্মায় বর্তমান। আত্মা অতীন্দ্রিয় জগতের অধিবাসী। বিশুদ্ধ চিন্তাস্থিত প্রত্যয়জগৎ আত্মার মধ্যেও বর্তমান। আত্মা নিজেও বিশুদ্ধ একটি প্রত্যয়। বিশুদ্ধ চিন্তার অবভাস হিসেবে আত্মা প্রাণস্বরূপ ও সক্রিয়, বিশুদ্ধ চিন্তার মতোই চিরন্তন ও কালাতীত। বিশুদ্ধ চিন্তার ক্রিয়া আত্মার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আত্মা যে কেবল জড়জগতের বাইরে অবস্থিত তা-ই নয়, জড়জগতের ওপর আত্মার কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই। আত্মার আত্মসংবিদ আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রতীতি, স্মৃতি ও ধ্যান নেই। এই আত্মা হলো বিশ্বাত্মা।
  • বিশ্বাত্মা থেকে এক দ্বিতীয় আত্মা বিকীর্ণ হয় যা হচ্ছে প্রকৃতি। ব্যক্তির আত্মা যেমন তার দেহের সঙ্গে যুক্ত, প্রকৃতিও তেমনি জগতের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বাত্মা ও প্রকৃতি থেকে অন্যান্য আত্মার উদ্ভব। প্রকৃতি হচ্ছে বিশ্বাত্মার সৃষ্টিশক্তি। প্রকৃতির শক্তি বিস্তার জড়কে আকার সমন্বিত করে বিচ্ছুরিত করে দেয়। প্রকৃতি-শক্তি যান্ত্রিক নয়, উদ্দেশ্যযুক্ত। সত্য কারণ একমাত্র উদ্দিষ্ট কারণ (Final Cause)। নিমিত্ত কারণ হচ্ছে আত্মা যে সকল বস্তু প্রয়োেগ করে তাদেরই অংশ।
  • বিশ্বাত্মার পদচিহ্ন প্রত্যক্ষজগতের মধ্যে পরিলক্ষিত। আত্মা এই জগতে যে সকল সামঞ্জস্য লক্ষ্য করে তা এই জগতের ওপর সেই বিশ্বাত্মা চিহ্নিত ‘আকার’ মাত্র। আত্মার নিচের স্তরে যখন ঐশ্বরিক শক্তি বিকীর্ণ হয়, তখন সৃষ্টি হয় ভৌত পদার্থের। ভৌত পদার্থই ঐশ্বরিক শক্তির ক্ষীণতম প্রকাশ। কোনো একটি উপায় বা উপলক্ষ ব্যতীত আত্মা তার শক্তিপ্রয়োগ করতে পারে না; এ জন্যই আত্মা সৃষ্টি করে জড়। আর এই জড়ই হলো বিকিরণের তৃতীয় ও সর্বনিম্ন স্তর। এমনিতে জড় এক অন্ধকারময় অতল গর্ভের মতো। প্লেটো এরই নাম দিয়েছিলেন অসত্তা। জড় সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয়। জড় যে আসলে কী, তা বোঝা কঠিন। কারণ তা সর্বপ্রকার রূপ, সীমাবন্ধন ও অবধারণের অতীত। অন্ধকারকে যেমন দেখা যায় না, তেমনি জড়েরও স্বরূপ নির্ণয় করা যায় না। অন্ধকারকে দেখা আর কিছুই না দেখা যেমন এক, তেমনি জড়ের ধারণা করা, আর কিছুই ধারণা না করাও এক। জড়ের একমাত্র স্বভাব এই যে, তা বস্তুর আশ্রয়। জড়ের কোনো বিশিষ্ট সত্তা নির্ণয় করা যায় না। জড় এমনই একটি বস্তু, যার স্বভাব কল্পনা করা না গেলেও এর অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয়।
  • জড়ের প্রভাব শুধু দেহেই নয়, বুদ্ধিতে ও আত্মাতেও বিদ্যমান। মন জড়ের চেয়ে যতই শ্রেষ্ঠ হোক না কেন, মন দেহের অধীন। মন দেহের প্রভাববর্জিত বা অপার্থিব বস্তু নয়। চিন্তা, ধারণা ও সংস্কারের সঙ্গে জড় অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
  • জড় পর্যায়ক্রমে রূপগ্রহণ করে, এবং বিশ্বাত্মা তার চলার সুবিধার্থে কালের সৃষ্টি করে। স্টোয়িকদের পর্যায়ক্রমিক পুনরাবির্ভাব মতবাদ সত্য, কিন্তু তার আর স্টোয়িকদের মতবাদের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান দেখা যায়নি। তিনি সম্ভবত বলতে চান যে, জগৎ সবসময় ছিল এবং সবসময়ই থাকবে। আর ইন্দ্রিয়জগতের অংশগুলো পরিবর্তনশীল হলেও সামগ্রিক অর্থে ইন্দ্ৰিয়জগৎ অনাদি। ‘কাল’ হচ্ছে একটি প্রতিরূপ (copy) যার সাহায্যে বিশ্বাত্মা অনন্তকে রূপান্তরিত করেন, যখন তিনি নিত্য সামান্যধারণাবলীকে (Ideas) প্রাকৃতিক নিয়মাবলীতে রূপান্তরিত করতে চান। তাই কাল একটি উদ্দেশ্যযুক্ত আকার (Category) এবং সেজন্য এটি জগৎ-অতিক্রান্ত উদ্দেশ্যাভিমুখী এক জাগতিক শক্তির দৃষ্টান্ত। কাল একটি আকার যার সাহায্যে বিশ্বাত্মার সৃষ্টিশক্তি সৃষ্টি ও জনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একরূপ থেকে অন্যরূপে প্রকাশিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রগতি চৈতন্যনিহিত সেই গতিরই প্রতিরূপ যা পরিবর্তনহীন, নিত্য এবং সামান্যধারণা বা ভাবজগতের। জগৎ-ব্যাপার সৌরমণ্ডলীয় পর্যায়ক্রমে বিবর্তিত হয় যতদিন পর্যন্ত সকল ব্যক্তির সৃষ্টি বিশ্বাত্মা সম্পন্ন না করে। তারপর সূত্রপাত হয় আরেক নুতন জগৎ-সংস্থার। তাই বিশ্বকে অনন্ত বলা যায় এই অর্থে যে এটি বিভিন্ন আদি মধ্যঅন্ত সমন্বিত সমীম জগৎ-সংস্থার অনন্ত পারম্পর্যধারা। এই প্রত্যক্ষজগতের বিভিন্ন আকার বা রূপ পরিকল্পনায় এরিষ্টটলের প্রভাব সুস্পষ্ট। উক্ত বিভিন্ন আকার হচ্ছে (১) জড়, আকার এবং উভয়ের সমাহার, (২) সম্পর্ক (৩) গুণ (৪) পরিমাণ (৫) দেশ (৬) কাল এবং (৭) গতি।
  • ধারণা বা প্রত্যয়ের জগৎ বা চৈতন্য-জগৎ হলো বিশ্বাত্মার উপরিপর্যায়ের সর্বোচ্চ পরম এক বা ঈশ্বর, ঈশ্বরের প্রতিরূপ, ঈশ্বরের নিজেরই প্রতিফলন। এটি ঈশ্বরেরই বিচ্ছুরিত আলোক যার সাহায্যে ঈশ্বর নিজেকেই দেখেন। ধারণার জগৎ হচ্ছে ভাবজগৎ, সামান্যধারণার জগৎ—এটি প্রত্যক্ষ জগতের আদর্শরূপ। ঈশ্বরের প্রতিরূপ বলে এটি সরচেয়ে উৎকর্ষ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এই ধারণার জগতে দেশের খণ্ডতা নেই, এবং এটি অনন্ত কেননা এটির মধ্যে কোন অতীত, ভবিষ্যৎ নেই, কেবল এক নিত্য বর্তমান আছে। ধারণার জগতে তিন জোড়া জ্ঞানের রূপ বা আকার (Categories) আছে – চৈতন্য এবং সত্তা (চিন্তা এবং বস্তু), ঐক্য এবং পার্থক্য, স্থিতি এবং গতি, ( অপরিবর্তনীয়তা এবং পরিবর্তন)। কিন্তু এই মত সত্ত্বেও অসঙ্গতভাবে প্লটাইনাস কখনও চৈতন্যের উল্লেখ করেননি, জ্ঞানের আকারগুলোর তালিকায় চৈতন্য ও সত্তা উভয়েরও উল্লেখ করেননি। তার দর্শনে ধারণার জগতের এই চৈতন্য পৃথক পৃথকরূপে সত্তা, স্থিতি এবং গতি প্রত্যেকটি জানতে পারে। এদেরকে জানা হলো চৈতন্যের নিজের সম্পর্কে জ্ঞান বা আত্মজ্ঞান। জানা একটি ক্রিয়া এবং ক্রিয়াই গতি বলে এই আত্মজ্ঞানের মধ্যেই গতি নিহিত। এই চৈতন্যের সাথে ধারণা জগতের সত্তা অংশের পার্থক্য আছে। চৈতন্য এর জানা একটি ক্রিয়া এবং এই জানা যেহেতু নিজেকে জানা, তাই বলা যায় এই ক্রিয়া হলো নিজের অভিমুখী। এই নিজের অভিমুখী ক্রিয়াতেই সত্তার ধারণা নিহিত। জানা-ক্রিয়া কোন সত্তা নয়, সত্তা হলো যা অস্তিত্বশীল বলে জানা যায় তা। নিজের অভিমুখে জানা ক্রিয়াটি কাজ করছে, এর অর্থ হচ্ছে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, এভাবে চৈতন্য থেকে জানা-ক্রিয়া বা আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে সত্তা প্রতিপাদিত হয় বা সত্তার ধারণা পাওয়া যায়। আবার যেহেতু জ্ঞান ক্রিয়া বা গতি, এবং এক গতি অন্য গতি থেকে উৎপন্ন বা শেষ হতে পারেনা, তাই বলা যায়, সেই জ্ঞানরূপ গতির অবশ্যই অন্য কোন উৎস ও লক্ষ্য আছে, যা সেই গতি থেকে ভিন্ন, বা বলা যায় চৈতন্য-জ্ঞান ছাড়াও কোন কিছু আছে যা চৈতন্য-জ্ঞান বা গতির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। চৈতন্য-জ্ঞানের এই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যই হচ্ছে সত্তা। তাহলে বলা যায় সত্তা থেকে চৈতন্য বা জ্ঞান বা ক্রিয়ার উদ্ভব হয় এবং সত্তাতেই তা শেষ হয়, তার মানে সত্তা হলো ক্রিয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু প্লটাইনাস আবার বলছেন সত্তা কেবল ক্রিয়া-সম্ভাবনা নয়, একই সাথে ক্রিয়াও, অর্থাৎ চৈতন্য-জ্ঞানের ক্রিয়া সত্তা। কিন্তু তা আবার পূর্বে আলোচিত বক্তব্যগুলোর বিরুদ্ধে চলে যায়। এখানেই প্লটাইনাস নিয়ে আসেন ঐক্য ও পার্থক্যের ধারণা। সত্তা ও চৈতন্যের মধ্যে প্রথমে আমরা পার্থক্য দেখলাম যেখানে চৈতন্য সত্তা থেকে উদ্ভুত ও শেষ হয়, আবার সত্তাকে যখন ক্রিয়া বলে বিবেচনা করা হয় তখন আমরা পাই ঐক্যের ধারণা। একইভাবে যখন চৈতন্য কাজ করে, আত্মজ্ঞান লাভ করে তখন পাই ক্রিয়া বা গতি, কিন্তু যখন এই ক্রিয়া সত্তায় মিশে যায়, সত্তাই ক্রিয়া হয় বা সত্তায় শেষ হয় তখন পাই স্থিতি। সব মিলে ধারণার জগতে এই তিন জোরা ক্যাটাগোরিজই বিদ্যমান হচ্ছে – চৈতন্য ও সত্তা, ঐক্য ও পার্থক্য, স্থিতি ও গতি।
  • চৈতন্য সরল নয়। চৈতন্যের অন্তর্নিহিত ভেদ আছে, নাহলে ধারণার জগতে বা চৈতন্য-জগতে বিভিন্ন চেতন সত্তা বা ধারণার মধ্যে সংযোগ এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকতো না। কিন্তু বিভিন্ন ধারণা কেবল পরস্পর ভিন্ন তাই নয়, তারা পরস্পর অভিন্নও বলা যায়। কেননা তারা একে অপরের মধ্যে বর্তমান। তারা একের মধ্যে বহু এবং বহুর মধ্যে এক, বহর সমন্বয়ে এক। সমস্ত বিশেষ ধারণা এক সর্বব্যাপক ধারণা বা চৈতন্যে বিধৃত। সেই সর্বব্যাপক ধারণা বা চৈতন্য স্ব-নির্ভর এবং বিশেষ ধারণা বা চেতনসত্তা সকলও স্ব-নির্ভররূপে থাকে, কিন্তু তবুও ঐ সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল উক্ত চেতন সত্তা বা ধারণাসমূহ আবার ধারণা বা চেতন সত্তাসমুহে বিধৃত সেই সর্বব্যাপক চৈতন্য। এভাবে প্রত্যেক বিশেষ ধারণা বা চেতন সত্তা একত্রে স্ব-নির্ভর এবং সর্বব্যাপক চৈতন্যে বা ধারণায় বিধৃত এবং সেই সর্বব্যাপক চৈতন্যও স্ব-নির্ভর এবং বিশেষ চেতনসত্তা সমূহে বিধৃত। সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণা হচ্ছে প্রকৃত বিদ্যমান সকল বিশেষ চেতন সত্তা বা ধারণাসমূহের সমষ্টি এবং তাদের প্রত্যেকটি নিহিত রূপে থাকে উক্ত সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণায়। ব্যক্তির চৈতন্য (spirit) সেই সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণার অন্তর্মুখী ক্রিয়ার ফল এবং ব্যক্তিআত্মা এটির বহির্মুখী ক্রিয়ার ফল। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • চৈতন্য এবং চৈতন্য-জগৎ দুইয়ের মধ্যে এক এবং একটি অপরটি ছাড়া থাকতে পারে না। এই দুইয়ের মধ্যে একত্ব উচ্চতর আর একটি ঐক্যকে নির্দেশ করে যা বিশুদ্ধ ঐক্য বা এক, যার মধ্যে কোন দ্বিত্ব নেই। এই দ্বিত্ব-বর্জিত ঐক্য হলো পরম এক, ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর এবং সেই ‘পরম এক’ এবং ‘পরম শ্ৰেয়ঃ’ (The Good) অভিন্ন। পরম এক সংখ্যা বাচক অর্থাৎ এক ও একে যে দুই হয় সেই এক নয, কারণ সংখ্যাবাচক একত্ব ও বহুত্ব পরস্পর সাপেক্ষ, কিন্তু ঈশ্বর অন্যকিছু সাপেক্ষ নন। তিনি উৎস-স্বরূপ যেখান থেকে একত্ব ও বহুত্ব উৎসারিত। তিনি সকল ক্রিয়ার উর্ধ্বে, চেতন সত্তা এবং ধারণার (Ideas) চৈতন্য-জগতের উর্ধ্বে আমরা বলতে পারি তিনি কী নন, কিন্তু তিনি কী তা বলতে পারি না, কারণ তিনি সকল গুণ এবং বর্ণনার উর্ধ্বে। এমন কি আমরা যদি অন্য নিরপেক্ষ রূপে নয় অন্য সাপেক্ষরূপে তাতে সর্বোচ্চ গুণাবলীও আরোপ করি তবে এছাড়া বলতে হবে যে এরাও যথেষ্ট নয়, এদের তুলনায় উচ্চতর গুণাবলী প্রযোজন। তিনি অসীম। জ্ঞাত জগৎ থেকে পৃথক তার কোন জ্ঞান নেই, কেননা তাতে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্পর্ক অতিক্রান্ত। তিনি কেবল সাধারণ চৈতন্যযুক্ত নন, তিনি মহত্তর চৈতন্য সম্পন্ন। কারণ তিনি সাক্ষাৎ দ্রষ্টা। তার জ্ঞান সাধারণ বিশ্লেষণ যুক্তির এমনকি চৈতন্যের স্বজ্ঞা-প্রত্যঙ্গের তুলনায় উচ্চতর। যদি ইচ্ছাশক্তি বলতে অবর্তমান কোনো বস্তুর আকাঙ্ক্ষা বোঝায় তবে তার ওপর ইচ্ছা শক্তিও আরোপ করা যায়না। কিন্তু তিনিই ইচ্ছাশক্তি এই অর্থে যে তিনি যা থেকে ইচ্ছা করেন তিনি তাই এবং তাতে এমন কিছু নেই যা তার ইচ্ছার পূর্ববর্তী। তিনি কোনো আবশ্যিকতার (necessity) অধীন নন, তাতে সবকিছুই অবশ্যিক। তিনি সর্বৈব মুক্ত, চৈতন্য-জগতের মুক্তির উৎস তিনি। যে উদ্দেশ্যময়তা বিবর্তনশীল জগতের লক্ষণ তিনি তার অধীন নন। তিনি আদি কারণ-স্বরূপ এবং পরম কল্যাণরূপে তিনি যা কিছু বর্তমান তার লক্ষ্য-কারণ। কিন্তু আদি ও লক্ষ্য-কারণরূপে তিনি যা কিছু ঘটান তার সাথে তিনি সমান নিত্য, কারণ তার উর্ধ্বে কিছু না থাকায় তিনি অন্যকিছুর অন্তর্গত নন-বরং তাতেই সকল কিছু বিধৃত। তিনি সকলের মধ্যে বিভক্ত নন অথচ সূর্য যেরূপ নিজে ক্ষয়িত না হয়ে আলোক ও উত্তাপ বিকিরণ করে সেইরূপ তিনিও অব্যয়রূপে সকল নিয়ে গঠিত। তিনি আদি ক্রিয়াস্বরূপ, অথবা আদি শক্তি, কারণ তিনি শক্তি ও ক্রিয়া এই দুইয়ের পার্থক্যের উর্ধ্বে। সেই পরম এক অথবা পরম কল্যাণ কেবল সাধারণ অর্থে কল্যাণ নন বরং সকল কল্যাণের উৎস। তিনি সৌন্দর্যসমন্বিত নন বরং তিনি সকল সৌন্দর্যের সৌন্দর্যস্বরূপ (Beauty)। তিনি আদি সৌন্দর্য, যা কিছু সুন্দর তার উৎস।

মনোবিজ্ঞান বা আত্মাতত্ত্ব

  • বিষয়-বিষয়ীর দ্বিত্ব নেই। পরম সত্য চিন্ময়, কিন্তু এটি কখনোই মানসসৃষ্ট কিংবা মনের বাইরে এবং মন-নিরপেক্ষ সত্তা নয়। মানে ঈশ্বর ব্যক্তির বাইরের সত্তা নয়, ভিন্ন নয়। জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয়, অহং এর কারণে ভিন্ন মনে হয়। আত্মচেতনার একত্বেই জ্ঞাত চিন্ময় জগৎ এবং জ্ঞান-বৃত্তির দ্বিত্ব চিন্তার বিষয়বস্তু এবং চিন্তনক্রিয়ার ভেদ নিহিত। কিন্তু আসলে যিনি চৈতন্যরূপে দর্শন করেন তিনি এবং চিন্ময় এই জগৎ পরস্পর সাপেক্ষ, একটি ছাড়া অপরটির কোনো অর্থ হয় না।
  • মানবাত্মা বিশ্বাত্মার অংশবিশেষ। আর এ জন্যই তা অতীন্দ্রিয় ও স্বাধীন। দেহ ধারণের আগে আত্মা অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিজগতের অধিবাসী ছিল, এবং তখন তা মরমি স্বজ্ঞার সাহায্যে চিরন্তন নওস বা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার ধ্যানে আবিষ্ট ছিল। ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আত্মা শুভের জ্ঞানলাভ করে। এরপর যখনই তা তার দৃষ্টি জগৎ ও জড়ের দিকে নিবদ্ধ করলো, তখনই সূচিত হয় তার পতন। অহংজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্রই আত্মা অনন্ত জীবনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বার্থান্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পতন বা অবনতির ফলেই আত্মার দেহপ্রাপ্তি ঘটে, এবং বর্তমান জীবনে আমরা যেসব দুঃখভোগ করি, সেগুলোর সবই এ অবনতির শাস্তিস্বরূপ। জীবদেহধারণ প্রথমে আত্মার ইচ্ছাধীন ছিল – আত্মা স্বেচ্ছায় দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাসনা যখনই কার্যে পরিণত হলো, অমনি আত্মার স্বাধীনতা লোপ পায়। আর তখন থেকেই আত্মা প্রকৃতির অধীন হয়ে যায়।
  • বিশ্বাত্মার ন্যায় মানবাত্মাও জড় ও বুদ্ধির সমবায়ে গঠিত। মানবাত্মা জড়দেহের মধ্যে আবদ্ধ বলে তা জড়জগতের নিয়মাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তার আদিনিবাস বুদ্ধির জগৎ, আর তাই জড়ের বন্ধনমুক্ত হয়ে আত্মা বুদ্ধির অভিমুখে অগ্রসর হতে চায়। বুদ্ধিজগৎ থেকে জড়জগতে অবতীর্ণ হলেও বুদ্ধির সাথে আত্মার সম্বন্ধ সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায় নি, মানবাত্মা বুদ্ধিজগৎ ও জড়জগতের সাথে যুক্ত। যে বুদ্ধির জগৎ থেকে পতনের ফলে আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে সেই জগতে প্রত্যাবর্তনই তার শেষ লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সে ব্যর্থ হলে বা আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধই থেকে গেলে মৃত্যুর পর তা তার কর্মফল অনুসারে অন্যকোনো ব্যক্তি, ইতরপ্রাণী কিংবা উদ্ভিদের দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়। তাই মানুষের উচিত সৎকাজের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন। ইন্দ্রিয়সংযম ও বৈরাগ্য অনুশীলন এ ব্যাপারে সহায়ক হতে পারে। কামনা বাসনাকে জয় করে নির্মল ভক্তিপূর্ণচিত্তে গভীর ধ্যানের সাহায্যেই কেবল আত্মা তার বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে। এভাবে মুক্তিলাভের পর পরিশেষে আত্মা শাশ্বত প্রত্যয়জগতে প্রত্যাবর্তন করে এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করে।
  • আত্মার পরিশুদ্ধি এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শুধু প্রবৃত্তি দমনই যথেষ্ট নয়, আত্মাকে অবশ্যই দৈহিক কামনা জয় করে বাসনার পর্যায় অতিক্রম করে পুরোপুরি বিশুদ্ধ হতে হবে। এর তিনটি পথ রয়েছে – ললিতকলা, প্রেম এবং তত্ত্বজ্ঞান। এ তিনটি পৃথক পথ নয়, বরং একই পথের তিনটি শাখা। সুন্দরের চিন্তা, সুন্দরের সংস্পর্শ এবং সুন্দর ও পবিত্রের জ্ঞানই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে সহায়ক। যিনি একবার পরম সুন্দরের দর্শন পেয়েছেন, তিনি অন্য কোনো আনন্দের আকাঙ্ক্ষা রাখেন না। যিনি এই অনন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছেন, তিনিই দার্শনিক। তার কাছে পার্থিব যেকোনো সৌন্দর্য তুচ্ছ। তিনি যে অব্যক্ত আনন্দের সন্ধান পান, এর জন্য তিনি যেকোনো পার্থিব সুখ সানন্দে বিসর্জন দিতে পারেন। এ আনন্দ থেকে যে আবেশের সৃষ্টি হয়, তা-ই মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগসূত্র।
  • যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নয়, উচ্চতর ভাবসমাধি অবস্থায় উন্নীত হয়েই আত্মা ঈশ্বরের সাথে সংযোগস্থাপন ও একাত্মবোধ করতে সক্ষম হয়। আত্মা ও ঈশ্বরের এ মিলনকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমাদের অভিজ্ঞতার কোনো মাধ্যমে এর সংজ্ঞা নির্দেশ সম্ভব নয়। শুধু নঞর্থকভাবে একে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা যেতে পারে। ভাবসমাধি অবস্থায় উত্তীর্ণ আত্মা আকারহীন, আত্মসংবিদহীন। এখানে আত্মা গতি ইচ্ছা আবেগ প্রজ্ঞা ও চিন্তাবিবর্জিত। এ অবস্থাকে দিব্যদর্শনও বলা চলে না। এটা বরং অন্য এক ধরনের ‘দেখা’ ও আত্মসমর্পণ। প্রচলিত অর্থে একে ঈশ্বরের সাথে মিলনও বলা চলে না; কেননা মিলন কথাটি দুটি স্বতন্ত্র জিনিসের একত্রে মিশ্রণকে নির্দেশ করে। কিন্তু আত্মা ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র নয়। দুটি এককেন্দ্রীয় বৃত্তের কেন্দ্র যেমন অভিন্ন, ঠিক তেমনি আত্মা ও ঈশ্বর অভিন্ন। আত্মা ও ঈশ্বর যে শুধু একত্রে অবস্থান করে তা-ই নয়, তারা অভেদ ও অভিন্ন। আত্মশুদ্ধিলাভের মাধ্যমে এবং পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা পুনরায় তার আদিনিবাসে প্রত্যাবর্তন করে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়। আত্মার মুক্তিপ্রচেষ্টার এটিই শেষ ও চূড়ান্ত ধাপ, এবং এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে জন্মান্তরবাদের। এখানে স্বাতন্ত্র্যবোধ নেই, দেশ কাল ও বহুত্বের চেতনা নেই। আত্মার পক্ষে এ অবস্থাপ্রাপ্তি সত্যিই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। দার্শনিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যেহেতু এই অবস্থার ব্যাখ্যা করা যায় না এবং আমরা যেহেতু এর সন্তোষজনক বর্ণনা দিতে পারি না, তাই এ সত্য মেনে নেয়া উচিত যে, মরমি অভিজ্ঞতা বৌদ্ধিক বোধের অতীত। যুক্তিনিষ্ঠ তর্কালোচনেই আত্মার প্রকৃষ্ট প্রকাশ। আত্মচৈতন্যই আত্মার আত্মজ্ঞান। যেরূপ একটি দর্পনের প্রতিবিম্বে “আমরা নিজেদেরই অমর বলে দেখি” সেইরূপ আত্নচেতনায় আত্মা বিম্বিত হয়। ব্যক্তির কাম্য, যেমন, সামাজিক ন্যায়, পরস্পরের সহানুভূতি প্রভৃতি আত্মিক জগতেরই অন্তৰ্গত; তার বাইরে এইরূপ কোন কাম্য নেই। আত্মা অপরাপর আত্মার সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে ব্যক্তিত্ব আত্মারই বৈশিষ্ট্য। আত্মা স্বরূপত ‘উদ্দেশ্যসাধক’ (teleological) এবং আত্মা ধারণা বা আদর্শাবলীকে মূর্ত করার জন্যই বেঁচে থাকে। আত্মার নিজস্ব বিশেষ কার্যাবলী আছে, কিন্তু যখন এটি ইচ্ছা করে এটির ঐচ্ছিক কার্য ওপর থেকে অনুপ্রাণিত হয়, যা এটির নীচে থাকে তাকে আত্মা প্রত্যক্ষ সৃষ্টি শক্তিদ্বারা পরিচালিত করে। ব্যক্তি-আত্মা উচ্চতর জীবন থেকে নিম্নতর জীবনে আগমন করে এবং পুনরায় উচ্চতর জীবনেই প্রত্যাবর্তন করে। এটি স্বেচ্ছায় নেমে আসে যাতে নিম্নতম পর্যায় অবধি এটির বৃত্তিগুলো সঞ্চারিত হয়। এই পদ্ধতিতে আত্মা নিজের শক্তি প্রকাশ করে এবং ভালমন্দের জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু এটি ক্ষতিগ্রস্তও হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেই এটির নিম্নতর জীবনে আগমন দোষজনক। যত স্বল্পস্থায়ী এই নিয়েগমন ততই ক্ষতি কম। অবশ্য এই নিম্নাগমন সত্বেও আত্মার মর্মকোষ সদা শুদ্ধই থাকে।
  • মানুষের দেহ, আত্মা ও চৈতন্য এই তিন অংশ পৃথক। মানুষের তৃতীয় অংশ চৈতন্য। এটি আত্মার মতই জীবন নিহিত সূত্র, কিন্তু তুলনামূলকভাবে উচ্চতর পর্যায়েই এটি নিহিত। যদিও আত্মা চৈতন্যের নিম্নস্তরে, তবুও চৈতন্যের জন্য এটির মধ্যে যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ কাজ করে, আত্মা চৈতন্যাপেক্ষী, চৈতন্যের স্পর্শ-সংস্কার গ্রহণ করে এবং সুন্দরতর হয়ে ওঠে, কারণ, চৈতন্য এবং চৈতন্যাগত বৃত্তিসকলই এটির প্রকৃত সৌন্দর্য। যখন আমাদের বিচারশক্তি চৈতন্যের স্পর্শ-চিহ্ন পায় তখন কেবল আমাদের সৌন্দর্যই বর্ধিত হয় না, আমরা নিজেরাই চৈতন্যের সাথে একাত্ম হয়ে যাই। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বিষয় আছে আমাদের নিম্নস্তরে, যুক্তি-বিচারের বিষয় থাকে আমাদের সমস্তরে; এবং চৈতন্যের বিষয় আমাদের উচ্চস্তরে; এবং এই শেষােক্ত বিষয় আমরা দেখতে পাই তখনই যখন চৈতন্যের আলোক আমাদের ওপর এসে পড়ে। চৈতন্যসদ্ভূত জ্ঞান বা চৈতন্য-প্রত্যঙ্গ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ এবং যুক্তি বিচার উভয় থেকে স্বতন্ত্র। এটি ধারণা বা আদর্শ জানার বৃত্তি এবং চৈতন্য এই ধারণাবলী জানার সময় নিজেকেই জানে। তাই যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে আত্মা অপর বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করে, চৈতন্য নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে। আত্মজ্ঞানই এটির স্বরূপ-বৃত্তি। চৈতন্যের স্বরূপ যেহেতু জ্ঞান, তাই এটির জ্ঞান এবং সত্তা অভিন্ন। চৈতন্য-প্রত্যক্ষের সকল বিষয় (ধারণাবলী) সর্বদাই একত্রে অর্থাৎ এক নিত্য বর্তমানে তাদের নিত্য স্বরূপ নিয়ে চৈতন্যে বিধৃত হয়ে আছে, কিন্তু এই বিষয়গুলো চৈতন্য-বহির্গত নয়। উক্ত বিষয়গুলো নিয়েই চৈতন্য, যেমন বিভিন্ন অংশকে নিয়ে সমগ্র। প্রতিটি সামান্যধারণাই চৈতন্যরূপ এবং সমগ্র চৈতন্য আসলে সামান্যধারণা। চৈতন্যের মধ্যেই সত্য এবং পরমতত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটি স্বীকৃত। পরম সত্য অপর কিছুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এটি নিজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি সৎ এবং এটির স্বরূপ কী তাও এটির অবহিত। তাই সত্তা, চৈতন্য-জ্ঞান এবং চৈতন্য এক এবং অভিন্ন। ফলত চৈতন্য, প্রকৃতজগতের জ্ঞান এবং প্রকৃত জগৎ অভিন্ন। তাদের পারস্পরিক পৃথক আলোচনা সম্ভব হলেও তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা পৃথক সত্তা নয়।
  • মানুষের ত্রি-অংশ বিভাগের অনুরূপ দিব্যতত্ত্বেরও ত্রিধাবিভাগ রয়েছে। বিশ্বাত্মা, দিব্যচৈতন্য এবং অদ্বৈতসত্তা বা পরমব্রহ্ম এই ত্রয়ী বিদ্যমান। যে বিজ্ঞান চেতন-জগৎ নিয়ে আলোচনা করে তা দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞান (Dialectic)। এই বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলোর উৎপত্তি চৈতন্য থেকে। মানবাত্মা এই বিজ্ঞান অনুশীলন করে, মানবাত্মা যে সূত্রাবলী গ্ৰহণ করতে সমর্থ চৈতন্য সেই সূত্রাবলী আত্মাকে দেয়। এই সূত্রাবলী গ্ৰহণ করে মানবাত্মা উক্ত বিজ্ঞান প্রদত্ত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে, সংগ্রথিত করে যতক্ষণ না চৈতন্য-জ্ঞানে এসে উপনীত হয়। যে অনুপাতে মানবাত্মা ঐ মূলসূত্রাবলী গ্ৰহণ করতে সমর্থ সেই অনুপাতে মানবাত্মাই চৈতন্যে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি একটি যৌক্তিক পদ্ধতি, কিন্তু এটি যুক্তিশাস্ত্রকে অতিক্রম করে স্বজ্ঞাস্তরে (intuition) উন্নীত হয়।
  • পরম এক, সকল কিছুর মূলাধার, আমাদের অজ্ঞেয়, এমনকি চৈতন্য যখন নিজস্ব স্বজ্ঞা (intuition) এবং চৈতন্যজগৎ নিয়ে ব্যাপৃত থাকে তখন একে জানতে পারে না। কিন্তু প্রেমাকাঙ্ক্ষায় যখন চৈতন্য নিজেকে অতিক্রম করে তখন সেই মুহুর্তের জন্য এটি পরম একে রূপান্তরিত হয়, (যাকে সে কখনও জানতে পারবে না)। এসব মুহূর্তে দ্রষ্টা এবং দৃষ্টের, অন্বেষণকারী এবং অম্বিষ্টের একাত্মতা এতই সম্পূর্ণ হয় যে এটি জ্ঞাতা-জ্ঞেয় পার্থক্য অতিক্রম করে যায় এবং ফলত জ্ঞানের বা জ্ঞানের সম্ভাবনার প্রশ্ন সেক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এইসকল মুহূর্ত তখনই আসে যখন আমরা সেই পরম একের প্রতি প্রদীপ্ত প্রেমে নিজেদের নিরাবরণ করে ফেলি, এমন কি চৈতন্য-জগতের সব কিছু যখন খলিত হয়ে যায়। কারণ পরম একের উপলব্ধি তখন অসম্ভব যখন আমরা ‘অপর’-কে নিয়ে বিব্রত থাকি। মানবাত্মা কোনো কিছুর জন্য এমন কি স্বর্গের স্বর্গলাভের পরিবর্তেও সেই পরম একের সাথে নিজের একাত্ম অবস্থা ত্যাগ করবে না। তখন আত্মা এত উন্নতশীর্ষে আরোহণ করে যে এটি পূর্বে যে চৈতন্য-স্বজ্ঞাকে (spiritual intuition) অতিমূল্যবান মনে করেছিল তাকে তুচ্ছ ভাবে। চৈতন্য চিন্তার মাধ্যমে চৈতন্য-জগতকে জানে। চৈতন্য কোনো কোনো মুহূর্তে পরম একের প্রেমে সেই একেই রূপান্তরিত হয়। মানবাত্মা এবং পরম এক দুটো যখন সমকেন্দ্রিক বৃত্তের মতো যখন পরস্পর মিলে যায় তখন তারা অভিন্ন এবং পৃথক হলেই দুই। আত্মা যখন পরম ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হয়ে যায় তখন এটির যে দিব্য প্রত্যক্ষ হয় (vision) তা এতই সাক্ষাৎ যে বর্ণনা করা যায় না, কেননা যা প্রত্যক্ষ হচ্ছে তা যদি প্রত্যক্ষকারীর সাথে অভিন্ন বলে প্রতিভাত হয় তবে তিনি তাকে আপন থেকে পৃথক বলে বর্ণনা করতে পারেন না। অপর ব্যক্তি যিনি নিজে সেই দিব্য প্রত্যক্ষের আনন্দ লাভ করেননি তাকে তা দেখানো যায়না। এইরূপ দিব্য-প্রত্যক্ষের সামর্থ্য যদিও সকল ব্যক্তিরই আছে তবুও অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই এটি কার্যে প্রয়োগ করতে পারেন।
  • আত্মার কল্পনাবৃত্তি দুই প্রকার : (১) ইন্দ্ৰিয়জ (২) বুদ্ধিগত। প্রথমটি হচ্ছে নিম্নতর বা মননহীন আত্মার ওপর বহিরাগত অভিঘাতের ফল এবং দ্বিতীয়টি উচ্চতর এবং মননশক্তিসম্পন্ন আত্মার ওপর বাইরের অভিঘাত সৃষ্ট। এটি সংবেদন এবং যুক্তি-চিন্তার মধ্যবর্তী। উন্নত হলে এটিই অভিমতে রূপান্তরিত হয়। স্মৃতি আত্মার অন্যতম শক্তি। স্মৃতি এবং পূর্বসংস্কারজ্ঞান পৃথক। স্মৃতি সর্বদা কাল সংশ্লিষ্ট এবং অভিজ্ঞতালব্ধ কোন বিষয় সম্পর্কিত। ধারণার (Ideas) সংস্কার জ্ঞান হয়। উচ্চ ও নিম্ন আত্মা উভয়েরই নিজস্ব স্মৃতি আছে। মৃত্যুর পর দুই আত্মা পৃথক হয়, কিন্তু একের মধ্যে যা ছিল তার অস্পষ্ট জ্ঞান অপরের মধ্যে সঞ্চিত থাকে। যদিও উচ্চতর আত্মা মূলত উচ্চতর অভিজ্ঞতারই স্মৃতি রাখে এবং মহৎ সামান্যধারণাবলীর সংস্কারই স্মরণ করে। বন্ধুবান্ধব দেশ, স্ত্রী, সস্তানসন্ততির স্মৃতি উচ্চ এবং নিম্ন উভয় আত্মায় বর্ধমান, কিন্তু যতই উচ্চতর আত্মা বিকাশ লাভ করতে থাকে সেইসকল স্মৃতি ততই হ্রাস পেতে থাকে এবং অবশেষে সম্পূর্ণ ম্লান হয়ে যায়।
  • সর্বোচ্চ আদর্শ হচ্ছে পরম কল্যাণ বা পরম ব্রহ্মের অনুধ্যান ও ক্রমশঃ তার সাথে একাত্মতায় উপনীত হওয়া এবং এই আদর্শ-অন্বেষায় যে পরিতৃপ্তি মানুষ পায় তা আত্মকেন্দ্রিক বা পরার্থে কাম্য সুখ নয়, কারণ সুখ পরম শ্রেয়ের সূচক নয়, তা আমাদের কল্যাণ বা আপেক্ষিক শ্রেয়সূচক। এই আপেক্ষিক অর্থে জড়ের কল্যাণ হচ্ছে আকার (form); আকারের কল্যাণ দেহ; দেহের কল্যাণ আত্মা; আত্মার কল্যাণ ধর্ম এবং ধর্মোপরি যে চৈতন্য আছে তা; এবং চৈতন্যের কল্যাণ সেই পরম কল্যাণ (The Good)। এভাবে অগ্রবর্তী এক জগতের দিকে, অন্য এক জগতের অর্থাৎ চৈতন্য-জগতের দিকে এবং তা অতিক্রম করেও সেই পরম একের অনিরপেক্ষ ঐক্য, যা সকল কিছুর আদি উৎস, তার দিকে বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে উন্নীত হওয়ার মধ্যেই সকলকিছুব কল্যাণ নিহিত। এই জগতাভিমুখিতা কৃচ্ছ্রতাবাদী এবং প্রাচীন খ্রীষ্টানদের মতের সাথে এক নয়, কারণ তারা অবিবাহিত জীবন যাপন সমর্থন করেন ও দেহগত সকল ব্যাপার বর্জন করতে বলেন। কিন্তু দাম্পত্যপ্রেম হচ্ছে পরম একের সাথে চৈতন্যের যে একাত্মতা তারই প্রতিচ্ছবি এবং হয়তো চৈতন্য-জগতাভিমুখে উন্নীত হওয়ার প্রথম সূত্রপাত। যদিও দেহের সাথে সংযোগ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তবুও দেহকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা উচিত নয়। মানুষ তার দেহকে যা কিছু প্রয়োজন এবং দেয়া সম্ভব দেবে যদিও সে নিজে অন্য এক জগতের অন্তর্গত। একজন সঙ্গীতজ্ঞ যেরূপ তার তার যন্ত্রটি ব্যবহার করে-যন্ত্রটি জীর্ণ হয়ে গেলেও সে যেরূপ বিনা যন্ত্রে গান গাহিতে পারে সেইরূপ মানুষও তার দেহের ব্যবহার করবে।
  • জড় হচ্ছে অকল্যাণ (evil) কিন্তু জড় থেকে মুক্তিলাভের জন্য স্টোয়িকগণ নির্দিষ্ট আত্মহত্যার আদর্শ সমর্থনযোগ্য নয়। এই মুক্তি লাভ করতে হবে জড়-কে আকারের (form) অধীন করে—জড়ত্বগ্রস্ত মানুষ ও তার দৈহিক কামনা ও আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চতর এক মানবসত্তা ও তার পৃদ্ধিবৃত্তির অনুগত করে। মানুষের সর্বাত্মক নৈতিক নীচতা সম্পর্কে নস্টিক (Gnostic) মতবাদ ভুল। নৈতিক অপরাধ সর্বদা কিছু না কিছু মঙ্গলের সাথে মিশে থাকে এবং কোনো মানুষই সম্পূর্ণত মন্দ না। দোষ-প্রবণতা চরিত্র থেকে আসে এবং চরিত্রের ভিত্তি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা। সর্বব্যাপক আত্মা স্বাধীনতা ও আবশ্যিকতা এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে।

সৌন্দর্যতত্ত্ব

  • সৌন্দর্য কেবল অনুপাত বা সুসঙ্গতিই (harmony) নয়; কারণ তা হলে সৌন্দর্য কেবল বিভিন্ন সমগ্রের মধ্যেই থাকবে, সমগ্রের কানো অংশে থাকবে না। সৌন্দর্য তা হলে সমভাবে কোনো কুশ্রী সমগ্রেরও গুণ থেকে পারে—যার হয়তো আভ্যন্তরিক অনুপাত আছে কিন্তু সৌন্দর্যের সাথে যার বিরোধ। সৌন্দর্য হচ্ছে প্রকৃতই বস্তুর গুণ আত্মা যা নিজ স্বরূপ অর্থাৎ চৈতন্যের সমধর্মীয় মনে করে এবং সুশ্ৰীত বস্তুর সেই গুণ যা আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপের অন্যধর্মীয় মনে করে। তাই বস্তু যেহেতু চৈতন্য-জগতের ভাব বা আকারে (forms) অংশ গ্রহণ করে, সৌন্দর্য জানতে গেলে আমরা এই আকারগুলো সম্পর্কেও অবহিত হই। কুশ্রী বস্তুতে যে পরিমাণে এই আকারের অভাব সেই পরিমাণে তা কুশ্রী এবং সুন্দর বস্তুর মধ্যে যে অনুপাতে এই আকার উপস্থিত সেই অনুপাতে তা সুন্দর। যা চরম কুশ্রী তা সকল আকার বর্জিত, সকল দিব্য তাৎপর্যহীন। এই আকারগুলো সকল অংশকে সংগ্রহিত ও একত্র করে এক একটি সমগ্র বা ঐক্য গড়ে তোলে এবং এভাবে সৃষ্ট সমগ্র সুন্দর; এটির অংশগুলোও সেইরূপ সুন্দর। বিদেহী বস্তুমাত্রেরই সৌন্দর্য নির্ভর করে এটির কলুষমুক্তির ওপর। কুশ্রী চরিত্র মলিন কামনাসক্তি, কলঙ্কিত। শুদ্ধ আত্মা একটি ভাব বা আকারে রূপান্তরিত হয়ে যায়। শ্রেয় এবং সুন্দর একই। পরম এক, পরম শ্রেয়ের সদৃশ হওয়াই আত্মার প্রকৃত সৌন্দর্য। যিনি সেই পরম এককে দেখেননি তিনি পরম কল্যাণরূপে তাকে কামনা করেন; যিনি দেখেছেন তিনি তাকে পরম সুন্দর বলে অভিনন্দিত করেন। ‘পরম কল্যাণ’ বা ‘পরম সুন্দর’ তাদেরই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে যারা একে ভাল বাসেন। যিনি দিব্য-দর্শন লাভ করতে ইচ্ছা করেন তার উচিত দেহী সৌন্দর্যের প্রতি চক্ষু বন্ধ করা। যদিও সত্য যে তিনি এই জগতের মহৎ বিষয় নিয়ে বিশেষত মহৎ কার্যাবলীর অনুধ্যান মাধ্যমে নিজেকে শিক্ষা দিতে পারেন এবং নিজে ক্রমশঃ সুন্দরতর হয়ে উঠতে পারেন। আত্মা নিজে সুন্দর হয়েই সৌন্দর্য দেখতে পায়। একজন শিল্পী সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করে অনুকরণ দ্বারা-এরিষ্টটলের এই অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে অনুকরণ নয় কল্পনা দ্বারাই শিল্পী সুন্দর সৃষ্টি করে এবং সেই শিল্পী অধিকতর জ্ঞানী স্রষ্টা। কেননা কেবল যা দেখা হয়েছে তারই প্রতিরূপ গড়তে পারে অনুকরণ কিন্তু কল্পনা যা দৃষ্ট হয়নি তাও সৃষ্টি করতে পারে। শিল্পী অনুপ্রাণিত হন চৈতন্য-জগতের ভাব বা আকার দ্বারা। অতএব তার ক্রিয়াশক্তি নিজেকে একাত্ম করে ফেলে সেই সৃজনশীল ‘পরম ক্রিয়াশক্তি’র (formative Activity) সাথে যে ক্রিয়াশক্তি সকল সৌন্দর্যের উৎস ও মূল। সেজন্যই শিল্পের মধ্যে যে স্বতস্ফূর্ততা দেখা দেয় তা কোনো কৃত্রিম দক্ষতার ফল থেকে পারে না কিংবা এমনকি চেষ্টিত কাজের মধ্যেও প্রকাশিত থেকে পারে না। প্রকৃতি সুন্দর কারণ এটি চৈতন্য-জগতের ‘ভাব’ বা ‘আকারে’ অংশ গ্রহণ করে।

ম্যালকাস বা পরফিরি (২৩২-৩০১ খি.)

  • মানুষ পরজন্মে পশুর পর্যায়ে অধঃপতিত হতে পারেনা। (প্লটাইনাসের বিপরীতে)
  • অ্যারিস্টোটলীয় জ্ঞানের আকার (Categories) স্বীকার্য। পাঁচটি যৌক্তিক ধারণা বা ‘বিধেযক’ (Prclicables) আছে। এই বিধেয়কগুলোর পার্থক্য সুস্পষ্ট করে তোলে যে ‘দ্রব্যত্ব’ বা ‘সত্তা (being) হচ্ছে সর্বোচ্চ ধারণা এবং এখানে থেকে দ্বি-কোটিক বিভাগের (Division by Dichotomy) ধারণা আসে। এই দ্বি-কোটিক বিভাগ সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ধারণা ‘দ্রব্য থেকে আরম্ভ করে ব্যক্তিমানুষ’ পর্যন্ত আসতে গেলে মধ্যবর্তী কয়েকটি ধারণা, যেমন, ‘পদার্থ, চেত-পদার্থ, ‘প্রাণী,’ এবং মানুষ, পরপর অতিক্রম করে আসতে হয়। (প্লটাইনাসের বিপরীতে)
  • সামান্য, উপজাতি, জাতি (Genus) প্রভৃতি কেবল মনোগত ধারণা কিংবা এদের মন-নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। পুনরায় যদি এদের বহির্জগতে অস্তিত্ব থাকে তা হলে জিজ্ঞাস্য হয় যে এদের স্বরূপ কি জড়বস্তুর মত অথবা এরা কি নিরবয়ব? যদি নিরবয়ব (incorporeal) হয় তাহলে এদের বস্তু-নিরপেক্ষ নিজস্ব সত্তা আছে না এরা বস্তুতেই নিহিত? (এই সমস্যাটি মধ্যযুগে দার্শনিক আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল।)
  • সুখমাত্রই পাপের আকর। ঘোড়দৌড়, যাত্রা-থিয়েটার, নাচ-গান, যৌনাচার প্রভৃতি যেকোনো অবস্থায়ই বর্জনীয়। মাংস খাওয়া একটি গর্হিত কাজ।
  • জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি কথায় ও কাজে ঈশ্বরের উপস্থিতি স্বীকার করতে হবে এবং ঈশ্বরকে সাক্ষী রাখতে হবে। সব শুভ কাজের জন্য যেন ঈশ্বরকেই কৃতিত্ব দেয়া হয়; কিন্তু সব অপকর্মের জন্য আমরা নিজেরাই যে দায়ী, একথা যেন মনে রাখি। ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। সব কাজকর্মে আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। সর্বোপরি আমাদের উচিত অধর্মকে এড়িয়ে চলা।
  • প্রচলিত ধর্মমতের ঘোর বিরোধিতা। পরস্পরবিরোধী গোত্রসমূহ যেসব দেবদেবীর উপাসনা করে, তারা প্রকৃত দেবতা নয়, ভূতপ্রেত। যারা সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী নয়, রূপকের সাহায্যে তাদের শিক্ষার জন্য দেবদেবীদের কল্পনা করা হয়। আর এজন্যই পশু-পাখি, এমনকি গাছ-পাথরকেও দেবতা বলে গণ্য করা হয়েছে। দার্শনিকের ধর্মই যথার্থ ধর্ম। দার্শনিক কোনোদিন তথাকথিত দেবতা বা শয়তানের উপাসনা করেন না। দার্শনিক পরম আধ্যাত্মিক সত্তার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন।

ইয়ামব্লিকাস (২৪৫-৩২৫ খ্রি.)

  • বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার চেয়ে প্যাগান দেবগোষ্ঠী, অপ্রাকৃত জাদু-রহস্যের প্রভাব এবং অলৌকিক বিভিন্ন শক্তি সম্পর্কিত বিশ্বাসকেই অধিক সমর্থন করেন।
  • তিনি এয়ী (Triad) সমন্বিত একটি যৌক্তিক পদ্ধতির পরিকল্পনা করেন, যার দ্বারা তিনি হোমার উল্লিখিত এবং অন্যান্য দেবতাবগের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দেন।
  • প্লটাইনাস কথিত ‘আত্মা’র ‘চৈতন্যে’ অংশ গ্রহণ এবং চৈতন্যের ‘পরম এক’-এ অংশগ্রহণ সম্পর্কিত পরিকল্পনা ভুল, কারণ সেই পদ্ধতি সেই অনির্বচনীয় এক-এর অন্যনিরপেক্ষ অদ্বয়সত্তার ব্যাঘাত ঘটায়। এই যুক্তিতে খ্রীষ্টীয় ‘মানুষ-ঈশ্বর’ তত্ত্বও ভুল। (প্লটাইনাসের বিপরীতে)
  • ঈশ্বরের অন্য নিরপেক্ষ অদ্বয়সত্তা থেকে গৌণ ত্রয়ী-সত্তা নির্ণয় করা যায়, যা থেকে তিন পর্যায়ের দেবতা – বুদ্ধিগ্রাহ্য, অতিপ্রাকৃত এবং জগৎ-নিহিত দেবতার আবির্ভাব ঘটে। প্রথমোক্ত দুই পর্যায়ের দেবতাগণ জগৎ-অতিক্রান্ত, তৃতীয় পর্যায়ের দেবতাগণ পিথাগোরাসের ‘সংখ্যা’, প্লেটোর সাপ্ত ধারণা বা অ্যারিসটোটলের ‘বিমূর্ত আকার’ ইত্যাদির সাথে অভিন্ন এবং তারাই আমাদের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করেন। আত্মা এবং চেতনসত্তা কেবল তৃতীয় পর্যায়ের দেবতাগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে কিংবা অংশগ্রহণ করতে পারে।
  • পিথাগোরীয় সংখ্যাতত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে এর সাহায্যেই ত্রয়ী সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। পরমেশ্বর সম্পূর্ণরূপে জগদতীত (transcendent)। ঈশ্বরে কোনো গুণ আরোপ করা চলে না। জীবজগতের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো যোগাযোগ নেই। এই পরমসত্তা থেকে উদ্ভূত হয় দ্বিতীয় এক একক সত্তা, যা জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং সংখ্যা ও বহুত্ব সৃষ্টিতে সক্ষম। অর্থাৎ জগৎ ও জীবসমূহ মূল একক সত্তা থেকে উদ্ভূত দ্বিতীয় সত্তার অংশবিশেষ। এই দ্বিতীয় একক সত্তা (যাকে বহুর মধ্যে এক বলা চলে) থেকে সৃষ্টি হয় তিন শ্রেণীর দেবতার। প্রথম শ্রেণীর দেবগণই কেবল বুদ্ধিবিশিষ্ট; দ্বিতীয় শ্রেণীর দেবগণ বিশ্বের বাইরে অবস্থান করেন, আর তৃতীয় শ্রেণীর দেবদেবীরা বিশ্বের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। তারাই সরাসরি আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমরা এসব দেবদেবীর সংস্পর্শে এসে থাকি। এরাই সত্যিকার দেবদেবী। এরাই আমাদের প্রার্থনার লক্ষ্যবস্তু, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপলক্ষ, এবং এদের জন্যই আমরা তৈরি করি যজ্ঞবেদী।
  • অশুভ ভূতপ্রেতের অস্তিত্ব সত্য। মানবাত্মা অসংখ্য ভূতপ্রেত দ্বারা পরিবৃত। মানুষ যতই ধর্মকর্ম করুক-না কেন, তার পক্ষে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ অসম্ভব। মানুষ কোনো অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়ের প্রভাব বা দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। মরণোত্তর জীবনেও মানুষ সহজে ইন্দ্রিয় ও দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। তিনি পরফিরির ন্যায় জাদুবিদ্যার কার্যকারিতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারী বলে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতিও ছিল, তিনি মৃতব্যক্তির প্রেতাত্মার সাথে তিনি যোগাযোগ ও আলাপ করতে পারতেন। (পরফিরি প্রভাবিত)
  • শুভ কাজের মাধ্যমে আত্মার পক্ষে ঈশ্বরের সাথে সংযোগস্থাপন সম্ভব নয়। মানবাত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে যে দূরত্ব, তা অনতিক্রম্য। আত্মা কোনোদিন নিজস্ব চেষ্টায় তার নিজস্ব শক্তিতেই অশুভ থেকে দূরে থাকতে এবং মোক্ষলাভ করতে সক্ষম পারে না। অশুভ প্রেতাত্মাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হলে আত্মাকে অবশ্যই দেবদেবীদের সাহায্য নিতে হয়। আর এ জন্য তাকে নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। (প্লটাইনাসের বিপরীতে)

প্রোক্লাস (৪২২-৪৮৫ খ্রি.)

  • বাহ্যবস্তুসকল আকার ও উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। (অ্যারিস্টোটল প্রভাবিত)
  • দেহ, আত্মা ও চৈতন্যের পার্থক্য রয়েছে। (প্লটাইনাস প্রভাবিত)
  • দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুশীলন দ্বারা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মধ্যে দু’ধরনের অভিজ্ঞতা খুঁজে পায়। এদের একটি ইন্দ্রয়গ্রাহ্য এবং অপরটি বুদ্ধিগ্রাহ্য। প্রথমটির লক্ষ্যবস্ত প্রকৃতিজগৎ আর দ্বিতীয়টির লক্ষ্যবস্তু বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ। প্রথমোক্ত জগতের যৌক্তিক অনুসন্ধানের পরিণতি শারীরবিদ্যা আর দ্বিতীয়টির পরিণতি ধর্মতত্ত্ব।
  • পরম এক থেকে বহুপদার্থের জগৎ পর্যন্ত পরিবর্তনের ধারাটি দ্বান্দ্বিক। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিটি এই সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে কার্য কারণ থেকে স্বতন্ত্র হলেও মূলত অভিন্ন; তাই কার্য সেই স্বতন্ত্র অবস্থা থেকে কারণে ফিরে যেতে চায়। তাই প্রত্যেক সংঘটনে তিনটি পর্যায় আছে। এরা হলো কারণের স্থায়িত্ব, ঘটনার উদ্ভব এবং তার স্থায়ী কারণে প্রত্যাবর্তন ও একাত্মতালাভ। সমগ্র পদ্ধতিটি এইরূপ বিভিন্ন ত্রয়ীর (triad) শৃঙ্খল। তত্ত্ববিদ্যাগত ধর্মশাস্ত্র তিনভাগে বিভক্ত এবং প্রত্যেক বিভাগে এই ত্রয়ীপদ্ধতি অনুসরণ করেন।
  • পরম একক সত্তা অনির্বচনীয়। ‘এক’-কে যেমন প্রাণ বা চেতনা বলা যায় না, তেমনি আবার একে চিন্তা ও সত্তাও বলা চলে না। ‘এক’ নিত্যতা ও দেবত্বের ঊর্ধ্বে। এর সম্পর্কে আমরা শুধু বলতে পারি যে, তা আমাদের জীবনের উৎস (এ দিক থেকে ‘এক’ বলাই সঙ্গত) এবং সর্বপ্রকার প্রয়াস প্রচেষ্টার লক্ষ্য (এ অর্থে একে বলা চলে পরম শুভ)। তবে আল্‌ফা ও ওমেগা, আরম্ভ ও পরিণতি একই সঙ্গে প্রবহমান, কেননা ঐক্যই শৃঙ্খলা আর শুভই ঐক্য। ‘এক’ সৃজনশীল, কিন্তু সৃজনশীলতা এর একত্বে ব্যাঘাত ঘটায় না। যাবতীয় পদার্থ ‘এক’ থেকেই বিকীর্ণ। (প্লটাইনাস প্রভাবিত)
  • এক থেকে প্রথম ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা বিকীর্ণ হয়নি। ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা নয়, সংখ্যার জগৎ ‘এক’-এর প্রথম বিকিরণ। এর প্রতিটি সংখ্যায়ই ‘এক’ প্রতিফলিত। সংখ্যা থেকেই ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার উদ্ভব। (পিথাগোরিয়ানিজম প্রভাবিত, প্লটাইনাসের বিপরীতে)
  • প্লটাইনাসের ত্রয়ী থেকে প্রোক্লাসের ত্রয়ী স্বতন্ত্র। প্রথমেই কল্পনা করতে হয় অনপেক্ষ ও অদ্বিতীয় এক এর, যাকে কেবল রূপকার্থে এক পরম শ্ৰেয়ঃ, পরম ব্ৰহ্ম এবং আদি কারণ বলা যেতে পারে। এই অদ্বিতীয় এক থেকে সৃষ্টি হয় সত্তা, জীবন ও বুদ্ধির। সেই পরম এক থেকে দিব্য উপাদানের প্রকাশস্বরূপ সত্তা (being), জীবন এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ চৈতন্য – এই তিনটি তত্ত্ব উদ্ভূত হয়। (১) সত্তার স্বভাব অনন্ত। অনন্ত সত্তা থেকে সান্ত বা সীমিতের উৎপত্তি। অর্থাৎ পুনরায় সত্তা থেকে উদ্ভূত হয় অসীম, আদর্শ (The end) এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ সসীম। (২) জীবন বলতে অব্যক্ততা ও অস্তিত্বকে বোঝায়। এ দুয়ের সম্মিলন থেকেই জীবনের উৎপত্তি। অর্থাৎ জীবন থেকে উদ্ভূত হয় সম্ভাবনা, অস্তিত্ব এবং তাদের ঐক্য বোধগম্য জীবন। (৩) বুদ্ধি বা চৈতন্য স্থির কিংবা চঞ্চল হতে পারে। বুদ্ধির এ দুই বৈশিষ্ট্যের মিলন থেকে সৃষ্টি হয় চিন্তা ও স্মৃতির। অর্থাৎ চৈতন্য থেকে উদ্ভূত হয় নিষ্ক্রিয় চিন্তা, সক্রিয় চিন্তা (প্রত্যক্ষ) এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ বিচারশীল চিন্তা। প্রথম ‘ত্রয়ী’ দিব্য উপাদানরূপে ঈশ্বরের পরিমণ্ডল। দ্বিতীয় ত্রয়ী অপ্রাকৃত শক্তিগুলোর এবং তৃতীয় ত্রয়ী চৈতন্য-জগতের পরিমণ্ডল।
  • এই তিনপ্রকার ত্রয়ীর সাহায্যে বহুদেববাদের একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নির্ণয় করা হয়। দিব্য উপাদানের এই দ্বান্দ্বিক পরিকল্পনাটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়। এই সমগ্ৰ পরিকল্পনাটি কেবল বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের সবরূপ প্রকাশের জন্যই রচিত। সেই অনির্বচনীয় হচ্ছেন অতিপ্রাকৃত এবং অতিপ্রাকৃত উপায় মাধ্যমেই তাকে পাওযা যায়। ধর্মীয় সত্য আবিষ্কার করা যায় অলৌকিক জাদুশক্তির সাহায্যে। ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা বিশ্বাত্মার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে থাকে; আর এই বিশ্বাত্মার মাধ্যমেই ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তা ও মঙ্গলময়তা ইন্দ্রিয়জগতে প্রতিফলিত হয়। ভৌত জগৎ বিশ্বাত্মার দেহস্বরূপ। বিশ্বাত্মা থেকেই তা বিকীর্ণ। বিশ্বাত্মার সাথে জগতের মিলন থেকেই প্রাণির সৃষ্টি। প্রকৃতির মাধ্যমেই বিশ্বাত্মা ও জগতের এই মিলন সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রকৃতিই যাবতীয় গতি ও পরিবর্তনের আকর। ঐশ্বরিক নির্দেশ অনুযায়ী প্রকৃতি নিরন্তর ইন্দ্রিয়জগতের যাবতীয় কার্যকলাপ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। বিশ্বাত্মা ও প্রকৃতির মধ্যে মূল পার্থক্য এখানে যে, বিশ্বাত্মার সব কার্যকলাপ প্রজ্ঞাসম্মত, অথচ প্রকৃতির কার্যকলাপ অংশত প্রজ্ঞা দ্বারা এবং কিছুটা জড় দ্বারা প্রভাবিত। এ জন্যই বিশ্বের গতিপ্রকৃতি উদ্দেশ্য ও আবশ্যিকতার সংমিশ্রণ।
  • প্লটাইনাসের মতকে স্বীকার করে বলেন, অনির্বচনীয় ঐক্য থেকে যা কিছু নিঃসৃত হয় সকলই দিব্য উপাদানের ক্রমাবনতি অথবা ক্রমক্ষয়, যাতে নিম্নতর পদার্থসমূহ সর্বদা উচ্চতর পদার্থসমূহের অধীন হয়। কিন্তু যখন তিনি বললেন যে অন্যান্য ত্রয়ীগুলোতেও চৈতন্যের তিনটি পর্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন তিনি অন্তত পরোক্ষভাবে এই অধীনতার সম্পর্ক অস্বীকার করে থাকতে পারেন।
  • জড়ের কোনো সংজ্ঞানির্দেশ সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়জগৎ ও বুদ্ধিজগতের ব্যাখ্যায় জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয়। তবে প্লটাইনাস যেমন বলেছেন জড় তেমন অশুভ নয়, আংশিকভাবে হলেও জড় সদ্গুণের অধিকারী, কোনো অশুভ সত্তা নয়, স্বয়ং ঐশ্বরিকদ্রব্যই জড়ের উৎপত্তির মূলে।
  • মানবাত্মার এক পা বুদ্ধির জগতে, অন্য পা ইন্দ্রিয়জগতে, তাই সে একদিকে যেমন চিন্তা করে, অন্যদিকে তেমনি অনুভবও করে। আত্মার প্রজ্ঞাংশকে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করাতেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতি নিহিত।
  • মানবাত্মার উদ্ভব বিশ্বাত্মা থেকে, তাই তার স্বভাব শুভ। আত্মা যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন সে পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না। আত্মা নিয়ন্ত্রণের এই স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। অন্যায়-অশুভের অনুষ্ঠান এর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপস্বরূপ। তাই অন্যায়-অশুভ অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা অপূর্ণ স্বাধীনতা। অপূর্ণতার ফলেই মানুষ তার স্বাধীনতাকে ভুলপথ নির্বাচনে ব্যবহার করে থাকে। ঐশ্বরিকসত্তা কখনো অশুভকে নির্বাচন করতে পারে না। অন্যদিকে, মানুষ অপূর্ণ বলে নিজ প্রকৃতি অনুসারে কাজ না করার ক্ষমতা তার থাকতেই হবে। আর এই ক্ষমতাই তাকে বাহ্যশক্তি ও কারণ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে বাহ্যশক্তির ক্রীড়নক করে তুলতে পারে। কিন্তু সে ইচ্ছা করলে শুভকে নির্বাচন করতে পারে বলে শুভকে বাদ দিয়ে অশুভের নির্বাচনের নৈতিক দায়-দায়িত্ব তাকেই গ্রহণ করতে হবে। তবে ব্যক্তিমানুষ অশুভের নির্বাচন করলেও ঈশ্বর এই অশুভ এবং জগতের সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এমনভাবে সামঞ্জস্যবিধান করেন যে, এসব অশুভ জগতের পূর্ণতার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আবার মানবাত্মা যেন বাহ্য অশুভ শক্তিসমূহের মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় তাই ঈশ্বর একে প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করেন। ঐশ্বরিক সাহায্য না পেলে মানবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ কখনো সম্ভব হতো না।
  • চূড়ান্ত মুক্তি বা মোক্ষলাভের জন্য মানুষের পক্ষে দেবতাদের সাহায্য অপরিহার্য। এ জন্যই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে দেবতাদের সন্তোষবিধান কাম্য। এ ব্যাপারে প্রার্থনা বা উপাসনার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর সাহায্যে মানুষ ঐশ্বরিক সত্তার দিকে অগ্রসর হতে এবং পরিণামে তার সাথে মিলিত হতে পারে।
  • নৈতিক দর্শন হচ্ছে সেই অনির্বচনীয় পরম একের দিব্যদর্শন। মানবাত্মা তখনই কেবল এটি লাভ করতে পারে যখন আত্মা নিজের অন্তরতম সবরূপে প্রবেশ করে যেখানে সেই পরম একের অবস্থিতি। যখন এটি ঘটে তখন আমরা দিব্যানন্দে অথবা ভাবোন্মত্ত অবস্থায় থাকি। কেবল এই অবস্থাতেই পরম একের সাথে একাত্ম হওয়া যায়, এবং এই একাত্মতার মধ্যেই পরম অভীষ্টে উপনীত হওয়া যায়। তিনি স্বর্গীয় শক্তি এবং অপ্রাকৃত শক্তিসমূহের করুণালাভের উপায়রূপে জাদু-কৌশল চর্চা এবং ধর্মসম্মত বিধি ও অভ্যাসাদি পালনেরও নির্দেশ দেন।

প্রাচীন যুগের বা প্রাচীন যাজকদের খ্রিস্টীয় দর্শন

সেন্ট পল (৫ – ৬৪/৬৫ খ্রি.)

  • খ্রিস্টধর্মের আবেদন কোনো বিশেষ জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। মুসার আইন নয়, খ্রিস্টের বিধানই খ্রিস্টধর্মের ভিত্তি।
  • আচার অনুষ্ঠান নয়, বিশ্বাসই ধর্মের মূল উপকরণ। (ইহুদি ধর্ম, ও প্রজ্ঞাভিত্তিক প্রাচীন দর্শনসমূহের বিপরীতে, ফিলো প্রভাবিত)
  • খ্রিস্ট ঈশ্বরের পুত্র- এ বিশ্বাস ছিল প্রত্যেক খ্রিস্টানের জন্য অপরিহার্য। আদমের পাপের ফলে মানবজাতির যে বিপর্যয় ঘটেছিল, সেটি থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য যিশু নিহত হয়েছিলেন।
  • বিশ্বাসের সাথে ঐশ্বরিক আদেশ গ্রহণ করার একটি সুনির্দিষ্ট মানসিকতা জড়িত। এ ধারণা মানুষের স্বাধীনতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক এক প্রেক্ষাপটের দরজা উন্মুক্ত করে। (প্রজ্ঞাভিত্তিক প্রাচীন দর্শনসমূহের বিপরীতে)
  • ঈশ্বরের কৃপা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির খেয়ালখুশির ন্যায় ঈশ্বরের কৃপাও এক অনিশ্চিত ব্যাপার।
  • ক্রীতদাসদের ক্রীতদাসই থাকতে দাও। খ্রিস্টানদের সম্রাটের আদেশ মেনে চলতে হবে। শীঘ্রই পরিবর্তন ঘটবে; কেননা যিশুখ্রিস্ট দ্বিতীয়বার আবির্ভূত হবেন।

নস্টিক সম্প্রদায় (খ্রিস্টীয় ১ম – ৪র্থ শতক)

  • ইহুদিরা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি নয়। ইহুদি পুরাণে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব ভুল। ইহুদিদের ইন্দ্রিয়বিলাস এবং বহুবিবাহ প্রথা নিন্দনীয়। (ইহুদি ধর্মের বিপরীতে)
  • যিশু ঈশ্বরের প্রথম এবং সর্বোত্তম বিকিরণ ও উপাস্য। (নব্যপ্লেটোবাদ প্রভাবিত)
  • যিশু যদি পৃথিবীতে অবতীর্ণ না হতেন, এবং বিভ্রান্ত মানুষকে ঈশ্বরের পথপ্রদর্শন না করতেন, তা হলে মানুষের পক্ষে মোক্ষলাভ অসম্ভব হত। (নব্যপ্লেটোবাদ প্রভাবিত)
  • জাদুবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের কার্যকারিতা রয়েছে। (নব্যপ্লেটোবাদ প্রভাবিত)
  • অশুভের নির্বাচনকে মানুষের অপূর্ণতার পরিচায়ক। অপূর্ণ হিসেবেই আদমের সৃষ্টি। সুতরাং আদমের (এমনকি গোটা বিশ্বের) সৃষ্টি ঈশ্বরের নয়, একজন অশুভ স্রষ্টারই কাজ।
  • (নব্যপ্লেটোবাদ, নিওপিথাগোরিয়ানিজম মিডল প্লেটোনিজম প্রভাবিত)

জাস্টিন মার্টার (১০০ – ১৬৫ খ্রি.)

  • “খ্রিস্টধর্মের বীজ” আসলে ইতিহাসে লোগোসের প্রকাশ রূপে খ্রিস্টের জন্মের আগেই প্রকাশ পেয়েছিল। আর তা হয় সক্রেটিস এবং প্লেটো সহ অনেক ঐতিহাসিক গ্রীক দার্শনিকের মাধ্যমে। তারা হলেন অজানা খ্রিস্টান (unknowing Christians) । যীশু খ্রীষ্ট হ’ল লোগোসের অবতার, যা তাকে এই প্রমাণের দিকে নিয়ে যায় যে, যে ব্যক্তিই কখনও যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন, এমনকি তারা যদি খ্রিস্টের পূর্বেও বাস করে থাকেন, তারাও খ্রিস্টের আকারে লোগোসের সাথে সংযুক্ত ছিলেন, আর তাই তারা এইভাবে খ্রিস্টানই ছিলেন।
  • তবে সেইসব দার্শনিকদের এই শিক্ষাগুলি কেবলমাত্র আংশিক সত্যকেই উপস্থাপন করে কারণ তারা সামগ্রিক লোগোসের কেবলমাত্র একটি অংশের সাথে যুক্ত ছিল। খ্রিস্টধর্ম সম্পূর্ণ সত্যের (লোগোস) প্রতিনিধিত্ব করে, যার অর্থ খ্রিস্টধর্ম কেবল একটি অর্থবোধক দর্শনই নয়, এটি জ্ঞান এবং যুক্তির সর্বোচ্চ স্তর অর্জনের জন্য পূর্বের চিন্তাগুলোকে পরিপূর্ণ ও সংশোধন করে। (স্টোয়িক দর্শন প্রভাবিত)
  • যারা অভিসিঞ্চিত বা বাপ্টাইজড হয় “তাদেরকে আমরা সেখানে নিয়ে আসি যেখানে জল আছে,” সেখানে “তাদের পুনর্জন্ম হয় যেমনটা আমাদের হয়েছিল”।
  • ট্রান্সাবস্ট্যানশিয়েশন শিক্ষার মাধ্যমে ইউক্যারিস্ট অনুশীলনে আমাদের শেখানো হয় যে, এই খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পার্থনাসূচকভাবে যিশুকে ধন্যবাদ দেয়া হয়, যেখান থেকে আমাদের রক্ত ও মাংস রূপান্তরের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়, সেই রক্ত ও মাংসের দ্বারাই যিশু অবতারপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
  • পতিত এঞ্জেল ও দানবরাই (Demon) ঈশ্বরের পুত্র ও ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সাড়া দেয়া ঈশ্বরের লোকদের বিরুদ্ধে এরকম ঘৃণাকে জাগিয়ে তোলে।  এই দানবরা হ’ল তাদের আত্মা যারা প্রলয়ের পূর্বে পতিত এঞ্জেল এবং নারীদের মিলনের মধ্য দিয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং যারা বন্যা বা প্রলয়ের ফলে ধ্বংস হয়েছিল। তারা যাদুকরী শিল্প, তর্পন এবং এরকম ভয়ঙ্কর ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে যা মানুষকে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। খ্রিস্টানরা যীশুর নামে তাদের থেকে এই দানবদের বহিষ্কার করে (exorcism)।
  • খ্রিস্টানরা এমন মানুষ যারা ঈশ্বর ও তার বাক্যকে (যীশু খ্রীষ্ট) ভালবাসেন।

আইরেনিয়াস (১৩০-২০২ খ্রি.)

  • নস্টিক ও অন্যান্য ধর্মবিরুদ্ধ মত গ্রহণযোগ্য নয়।
  • প্রত্যয় ও ইন্দ্রিয়জ বস্তুর মধ্যে প্লেটোদর্শনে যে দ্বৈততা বা দ্বৈতবাদ বর্তমান তা ঈশ্বরকে সীমিত করে এবং ঈশ্বর ও তার বিরুদ্ধ নীতিকে তৃতীয় এক ব্যাপকতর সত্তার অন্তর্ভুক্ত করে। এই তিনটি আবার চতুর্থ এক ব্যাপকতর সত্তার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে। ফলে এক অনবস্থা দোষের (infinite regress) সৃষ্টি হয়। (প্লেটোর বিপরীতে)
  • শয়তানের শক্তি ও এর ফলে মানুষের পতন বাস্তব। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ এবং খ্রিস্টের ওপর ব্যক্তিগত বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমেই কেবল এই অশুভ শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব।
  • খ্রিস্টের মৃত্যু ছিল একটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এতে শুধু ঈশ্বরের প্রতি খ্রিস্টের আনুগত্যই প্রমাণিত হয় নি, বরং তা শয়তানের বন্ধন থেকে আমাদের মুক্তও করেছে। খ্রিস্টকে গ্রহণ করার পর প্রত্যেকের উচিত ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাপন এবং খ্রিস্টধর্মের সমর্থন করা।

ক্লেমেন্ট (১৫০-২১৫ খ্রি.)

  • কঠোরতা ঠিক নয়। যাত্রা, নাটক ও অন্যান্য আমোদ-প্রমোদ নিন্দনীয় হলেও কঠোর সংযম সমর্থনযোগ্য নয়। আতিশয্য দ্বারা নয়, প্রাজ্ঞিক আদর্শ দ্বারাই নৈতিক জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত। স্যালভেশন বা পাপমুক্তির অধিকার সব মানুষেরই আছে; এর সাথে মানুষের সামাজিক পদমর্যাদার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের যাবতীয় কাজকর্মে তার আন্তর উদ্দেশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি ভোগ করাতে আপত্তিকর কিছু নেই; তবে এর ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া মঙ্গলজনক নয়। পার্থিব ধনসম্পদ সবাই মিলে ভোগ করা এবং মানুষের মুক্তির কাজে এদের ব্যবহার করাই আমাদের নৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। (ফিলো, মিডল প্লেটোনিজম ও নিওপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)
  • ঈশ্বরপিতার স্বরূপ অনির্বচনীয়; পুত্রই পিতার ঐশ্বরিক মন; পুত্রের মাধ্যমেই পিতা সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করেন; পুত্রের মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন হন। (মিডল প্লেটোনিজম ও নিওপ্লেটোনিজম, জাস্টিন মার্টার প্রভাবিত)
  • ইহলোক নয়, এক সুদীর্ঘ শুদ্ধিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ বিচারের দিন আত্মার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। (নিউপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)
  • শুভ-অশুভ নির্বাচন করতে গিয়ে মানুষ যখন তার স্বাধীন ইচ্ছা ও শক্তির অপব্যবহার করে, তখন সৃষ্টি হয় পাপ।
  • অশুভের নির্বাচনকে মানুষের অপূর্ণতার পরিচায়ক নয়। অপূর্ণ হিসেবে আদম ও জগতের সৃষ্টি হয়নি, আদমের (এমনকি গোটা বিশ্বের) সৃষ্টি ঈশ্বরেরই কাজ, একজন অশুভ স্রষ্টার নয়।আদিপাপ (original sin)-এর ধারণা ঠিক নয়। আদমের পতন মানবজাতিকে কলুষিত করতে পারে না। মানুষ পৃথিবীতে পূর্ণ হিসেবেই জন্মায়। মানুষের যাবতীয় দুঃখ-দুর্ভোগ তার নিজের কৃতকর্মের ফল, তার স্বাধীনতার অপব্যবহারের ফলশ্রুতি। (নিউপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)
  • মুক্তি একটি জাগতিক প্রক্রিয়া, এবং মানুষের পার্থিব জীবন সে প্রক্রিয়ারই একটি অধ্যায়বিশেষ।
  • পার্থিব জীবন কোনোমতেই আমাদের অনন্ত শাস্তি বা মুক্তি নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। শাস্তি ও মুক্তির গোটা ব্যাপারটিই অনিশ্চিত; আর এই অনিশ্চয়তা নিয়েই মানবাত্মা তার দেহত্যাগ করে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মানুষের চূড়ান্ত ভাগ্য আরও নির্ধারিত হয়ে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই অনুক্রম শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে।

টেরটুল্লিয়ান (১৫৫-২২০ খ্রি.)

  • ঈশ্বর জগতের শাসক। তার প্রতি অনুগত থাকাই মানুষের প্রধান পুণ্য। ঈশ্বরের ইচ্ছা অগ্রাহ্য করলে নরকের আগুন ভোগ করতে হবে।
  • ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের প্রতিটি অনুশাসন অন্যান্য অনুশাসনের চেয়ে উৎকৃষ্ট। (তবে জীবনের শেষ দিকে তিনি ক্যাথলিকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জাগতিকতা ও রাজনীতির আতিশয্য দেখে বিরক্ত হয়ে তিনি মোন্টানিস্ট সম্প্রদায়ে যোগদান করেন।)
  • ধর্মীয় প্রত্যাদেশ উদ্ভট হলেও সত্য। প্রত্যাদেশ গ্রহণের জন্য যুক্তি-প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন। বিশ্বাসের ভিত্তিতেই প্রত্যাদেশের সত্যতা গ্রহণ করতে হয়। ক্রুশে ঈশ্বরের নিজেকে উৎসর্গ করাটি বিশ্বাসযোগ্য, কেননা এটি উদ্ভট; এটি নিশ্চিত, কেননা এটি অসম্ভব।
  • ঐশ্বরিক জ্ঞানের নিশ্চিত উপায় ইনটুইশন বা স্বজ্ঞা। স্বজ্ঞার প্রামাণ্য যুক্তিপ্রমাণ, এমনটি খ্রিস্টীয় প্রত্যাদেশের চেয়েও অধিকতর নিশ্চিত।
  • পুত্র পিতারই সম্প্রসারণ। সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থেকেই তার নিজ আলোতে নিজেকে বিকীর্ণ করে থাকে। পুত্র ও পিতার পার্থক্যও রয়েছে এবং এরা একটি অপরটির অধীন। (এখানে প্লোটিনাসের মতের পূর্বাভাস পাওয়া যায়)
  • আত্মা সৃষ্ট, সুতরাং জড়ীয়, তাই আত্মার নিজের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য, শক্তি প্রয়োগের জন্য, জীবন ও আনন্দের সব সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারের জন্য তাকে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আসতে হয়। তাই আত্মা অশুভ নয়, বরং সম্পূর্ণ শুভ; আর একে অশুভ বলে নিন্দা করা স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের ওপর কটাক্ষ করারই নামান্তর। (স্টোয়িসিজম প্রভাবিত, নস্টিকদের বিপরীতে)
  • মৃত্যুর পরেও দেহের প্রয়োজন ও আবেদন চলতে থাকে। আর এ জন্যই পরিণামে দেহের পুনরুত্থান ও আত্মার সাথে দেহের পুনর্মিলন ঘটে।
  • ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও ঐশ্বরিক বুদ্ধি – এ দুয়ের মধ্যে কোনটি প্রথম ও প্রধান, ঈশ্বরের স্বরূপ কি তার ইচ্ছার ফল, নাকি তার ইচ্ছাই তার স্বভাবের ফল? – এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে  ঐশ্বরিক ইচ্ছাই প্রধান, ঈশ্বরের স্বরূপ তার ইচ্ছার ফল। তিনি ইচ্ছা করেন বলেই কোন কিছু শুভ।

ওরিজেন (১৮৫-২৫৩ খ্রি.)

  • প্লোটিনাস ও ক্লেমেন্টের উগ্র মরমিবাদের প্রতি তার সমর্থনযোগ্য নয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী সঠিক। স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে প্রাপ্ত দার্শনিক সত্যকে অগ্রাহ্য বা অবজ্ঞা করা অনুচিত। কোনো খ্রিস্টান চিন্তাবিদের পক্ষেই গ্রিক মনীষার অবদান উপেক্ষা করা উচিত নয়। (প্লোটিনাসের দর্শনের মতো মরমীবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে ও স্টোয়িকদের মতো প্রজ্ঞাভিত্তিক দর্শন প্রভাবিত)
  • ঈশ্বরের অতিবর্তন সঠিক, অর্থাৎ ঈশ্বরের স্বরূপ জানা যায়না, কিন্তু ঈশ্বর আমাদের অভিজ্ঞতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নয়। ঈশ্বরের স্বরূপ সরাসরি না জানতে পারলেও ঈশ্বরের কার্যকলাপের মাধ্যমে আমরা তার সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
  • ফিলোর লোগোস মতের আলোকে পুত্র এবং পিতার সম্পর্ক বর্ণনা করেন। পুত্র পিতার প্রজ্ঞাবিশেষ। আসলে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি শুধু তিনটি পৃথক ব্যক্তিতে প্রকাশিত। ঈশ্বরের এই তিন মূর্তি সহ-নিত্য (co-eternal)। অভিযোগ আছে তার মতে, সহ-নিত্যতা সৃষ্ট পৃথিবী পর্যন্ত সম্প্রসারিত। তিনি তিন মূর্তিকে সহ-নিত্য ভাবলেও সহ-সমান (co- equal) মনে করতেন কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। অভিযোগ করা হয় তার মতে, পুত্র পিতার অধীন বা তাবেদার। (ফিলো ও ক্লেমেন্ট প্রভাবিত)
  • সৃষ্টিকর্মে এবং খ্রিস্টীয় প্রত্যাদেশে ঈশ্বরের ইচ্ছা ও বুদ্ধি ব্যক্ত হয়।
  • পবিত্রাত্মার সহায়তায়ই মানবাত্মা খ্রিস্টীয় সত্য গ্রহণ করে এবং পরিণামে পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। (পবিত্রাত্মার ওপর ক্লেমেন্টের চেয়ে বেশি মনোনিবেশ করেন।)
  • ঈশ্বর পূর্ণ ও নিত্য বলে এমন কোনো অতীত কালের কল্পনা করা যায় না, যখন ঈশ্বরের সৃজনীকর্ম চালু ছিল না। তাই এমন কোনো সময়ের কথা ভাবা যায় না যখন সৃষ্টি বর্তমান ছিল না। তাই বিশ্ব ঈশ্বরের মতোই নিত্য। ঈশ্বর নিজেও এ নিয়মের কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারেন না; কারণ পরিবর্তনমাত্রই ঐশ্বরিক শক্তি ও ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার নিত্যতা ও পরিপূর্ণতার পরিপন্থী। জগৎ যদি অনন্ত না হয়ে থাকে, তাহলে জগৎসৃষ্টির পূর্ববর্তী সময়ে ঈশ্বরের সৃজনীশক্তি অনাবশ্যক ছিল বলতে হয়, যা ঈশ্বরকে সীমিত করে। (নিওপ্লেটোনিজম প্রভাব)
  • যে প্রক্রিয়ায় ‘এক’ থেকে স্বর্গীয় প্রজ্ঞা ও বিশ্বাত্মার সৃষ্টি, বিশ্ব ও জড়ের সৃষ্টি সেই একই প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণমাত্র এই (নিওপ্লেটোনিক মত) ভুল। মানবাত্মা ও জড়জগৎ উভয়েই একই স্বর্গীয় দ্রব্যের নিম্নতল স্তর। তাই স্বর্গীয় দ্রব্যের সাথে তাদের কোনো মৌলিক গুণগত পার্থক্য নেই। পুত্র তৈরি নয়, বরং সন্তান হিসেবে উৎপন্ন, পবিত্রাত্মা তৈরি নয়, গতিশীল। মানবাত্মা ও জড়জগৎ উৎপন্ন নয়, আবার গতিশীলও নয়, বরং তৈরি। এরা ঐশ্বরিক সত্তা থেকে বিকীর্ণ নয়, ঈশ্বরের সৃষ্টি, তবে যে দ্রব্যের সমবায়ে এদের সৃষ্টি, তা ঈশ্বরিক দ্রব্যের চেয়ে পরিমাণগত ও গুণগতভাবে স্বতন্ত্র। (নব্যপ্লেটোবাদের বিপরীতে, এটি ক্লেমেন্টরও মত)
  • সৃষ্টজগৎ ও জীবের স্বভাব নিত্য, তাই মানবাত্মাও নিত্য এবং জন্মের আগেই তা অস্তিত্বশীল ছিল। পূর্বঅস্তিত্ব স্বীকার্য কিন্তু পুনর্জন্মে স্বীকার্য নয়।
  • মুক্তি একটি জাগতিক প্রক্রিয়া, এবং মানুষের পার্থিব জীবন সে প্রক্রিয়ারই একটি অধ্যায়বিশেষ। (ক্লেমেন্ট প্রভাবিত)
  • পুত্রের মাধ্যমে পিতা সৃষ্টি করেছিলেন একটি পূর্ণ ও নিখুঁত পৃথিবী, আর সেই পৃথিবীতে বসবাস করতে স্বাধীনইচ্ছার অধিকারী আত্মাদের সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের কেউ কেউ সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করল (যেমন করেছিল লুসিফের) এবং তাতে তাদের এমনই পতন হলো, যার পর তাদের আর মুক্তিলাভ সম্ভব হলো না। যারা তাদের স্বাধীনতাকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের কাজে ব্যবহার করেছে, তারাই স্বর্গীয় ক্রমবন্ধন গঠন করতে পেরেছে। আবার যারা আংশিকভাবে পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, অথচ ঈশ্বরের প্রেম থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয় নি, তারাই দেহ গ্রহণ করে পৃথিবীতেমানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে । তাই পাপ জিনিসটা আদি, আর মানবদেহে আত্মার উপস্থিতিই তার পতনের প্রতীক। এক অর্থে আদম থেকেই মানবদেহের সূত্রপাত হওয়ায় তা আদম থেকেই প্রাপ্ত, যার স্বর্গচ্যুতির পর তার দেহ থেকেই পরবর্তীকালে মানবদেহের উৎপত্তি। (ক্লেমেন্তের বিপরীতে)
  • স্বর্গচ্যূতির পরও মানুষের স্বাধীনতা পূর্বাপর অক্ষুণ্ণ রয়েছে ও তা ঈশ্বরের পূর্বনিয়ন্ত্রণের আওতার বাইরে। মানুষ কীভাবে তার স্বাধীনতা ব্যবহার করবে, তা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত নয়। মানুষের যাবতীয় পুণ্য কাজে ঐশ্বরিক নির্দেশ ও সমর্থন থাকলেও ঈশ্বর পুণ্যকর্মে মানুষকে বাধ্য করেন না।
  • পার্থিব অশুভ মানুষের নিজেরই কর্মফল এবং মানুষের সব দুঃখ-কষ্ট তার পাপের পরিণতি। তবে আমাদের পার্থিব জীবন কোনোমতেই আমাদের অনন্ত শাস্তি বা মুক্তি নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। শাস্তি ও মুক্তির গোটা ব্যাপারটিই অনিশ্চিত; আর এই অনিশ্চয়তা নিয়েই মানবাত্মা তার দেহত্যাগ করে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মানুষের চূড়ান্ত ভাগ্য আরও নির্ধারিত হয়ে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই অনুক্রম শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে। এর পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যেক আত্মারই যিশুকে গ্রহণ করা না করা এবং নিজ মুক্তির পথ সুগম করা না করার স্বাধীনতা রয়েছে। শেষ বিচারের দিন মুক্তিপ্রাপ্ত সব আত্মা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞা হিসেবে তাদের আদি অবস্থায় ফিরে যাবে। পরিণামে পুণ্যের জয় হবে, এবং অশুভ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। (ক্লেমেন্ট)

সিপ্রিয়ান (২১০-২৫৮ খ্রি.)

  • চার্চের বাইরে অন্য কোনো উপায়ে মুক্তিলাভ অসম্ভব।

পেলাজিয়াস (৩৫৪-৪১৮ খ্রি.)

  • “আদমের পতন গোটা মানব জাতির পাপের ফল, এই পাপময় অবস্থায়ই আমাদের জন্ম ও মৃত্যু এবং এর জন্য আমাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়, একমাত্র যিশুর কৃপা আমাদের উদ্ধার করতে পারে।” – এই খ্রিস্টীয় মত ভুল। মৃত্যু পাপের শাস্তি নয়, একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, এর সাথে আদমের পতনের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ পাপ নিয়ে জন্মায় না। জন্মকালে প্রতিটি মানবাত্মাই থাকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। নিজের কার্যকলাপের ফলেই সে পাপী হয়ে ওঠে। খ্রিস্টধর্মের সাহায্য ছাড়াই মানুষ পাপ থেকে বিরত থাকতে এবং পবিত্রতা রক্ষা করতে সক্ষম, তাই খ্রিস্টের আবির্ভাবের আগেও অনেকেই সৎ ও ধর্মানুরাগী জীবনযাপন করে মুক্তিলাভ করেছে, এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত না হয়ে মারা গেলেই নরকে যেতে হবে – এমনটা বলা অযৌক্তিক। দীক্ষিত না হয়ে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে, কিন্তু তাই বলে এরা নরকে যাবেনা। (ক্লেমেন্ট প্রভাবিত)

অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রি.)

  • বুদ্ধি ও বিচারমূলক চিন্তার স্থলে বিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
  • মানুষ ও তার সম্ভাবনার স্থলে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব বেশি কাজ করে। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোনো বাস্তবসত্তা (reality) নেই, থাকতেও পারে না। ঈশ্বর থেকে পৃথক হওয়া মাত্রই মানুষ চির অভিশাপে নিপতিত হয়। কিন্তু ঈশ্বরকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে নির্মল প্রশান্তি লাভ করে। (নিওপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)
  • শুধু ঈশ্বরকে জানাই যথেষ্ট নয়, ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্য ঐশ্বরিকপ্রেম ও ভক্তি অপরিহার্য।
  • ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সত্য, শিব ও সুন্দরের অনুসন্ধানে আমরা যে ধারণা দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকি, তাই সত্য শিব ও সুন্দর নিঃশর্ত বা অনপেক্ষভাবে বিদ্যমান। আপেক্ষিক মানদণ্ডমাত্রই অনপেক্ষ মানদণ্ডের নির্দেশক। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে এই অনপেক্ষ মানদণ্ড নিরর্থক হয়ে যায়। তাছাড়া আদিকারণের আবশ্যিকতা, বিশ্বের বুদ্ধিসম্মত রূপ ও বৈশিষ্ট্য, ঈশ্বরের অস্তিত্বে সর্বজনীন বিশ্বাস প্রভৃতিও ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এসব ধারণা সত্য বলেই তারা আবশ্যিক ও অপরিবর্তনীয়ও বটে। তাই যে সত্তা থেকে এসব ধারণার উৎপত্তি, এবং এরা যার নির্দেশক, তাও সমানভাবেই আবশ্যিক ও অপরিবর্তনীয় হতে বাধ্য। তাই আবশ্যিক ও অপরিবর্তনীয় স্বভাবের একটি সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে, যা ঈশ্বর।
  • বুদ্ধির সাহায্যে ঈশ্বর সম্পর্কে যা জানা যায় তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য মানবীয় অভিজ্ঞতা, শক্তি ও অন্যান্য কলাকৌশলের মাধ্যমেই ঈশ্বরের অন্তঃসারকে জানা যায় না। তবুও ন্যায় শুভ প্রজ্ঞা সর্বশক্তিমত্তা সর্বজ্ঞতা প্রভৃতির ধারণা ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আংশিকভাবে হলেও ইঙ্গিত করে। (নিওপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)
  • এসব গুণ তথা ঈশ্বরের প্রজ্ঞাসম্মত বৈশিষ্ট্য মূর্ত ও প্রকাশিত হয় পুত্রের (লোগোস) ব্যক্তিত্বে। ঈশ্বর পুত্রের মাধ্যমে প্লেটোর প্রত্যয় (Ideas)-এর কথা পরিকল্পনা করেন। এসব প্রত্যয় বিশ্বের ‘প্যাটার্ন’ বা আদর্শ হিসেবে কাজ করে। আবার পুত্রের মাধ্যমেই এবং প্রত্যয়সমূহের অনুকরণেই ঈশ্বর ইন্দ্রিয়জগৎ সৃষ্টি করেন। এই প্রত্যয়জগৎ শুধু সার্বিকেরই নয়, বিশেষ প্রত্যয়ের উৎসস্থল। এসব প্রত্যয় মিলে একটি সুসংহত সমগ্র সৃষ্টি করে। এই সুসংবদ্ধ ও বুদ্ধিসম্মত বিধানের অনুকরণে যে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করা হয়, তা স্বাভাবিক কারণেই সুন্দর ও শুভ হয়ে থাকে।
  • সৃষ্টিবিষয়ক মতবাদে অগাস্টিন ক্লেমেন্ট ও ওরিজেন প্রচারিত রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় মতবাদের সমর্থন করেন।
  • ঈশ্বরের পাশাপাশি পূর্ব-অস্তিত্বশীল জড় থেকে বিশ্বের সৃষ্টি নয়। (প্লেটোর বিপরীতে, ক্লেমেন্টওরিজেন প্রভাবিত)।
  • কাল (time)-সৃষ্টির আগে বিশ্ব-ঈশ্বর থেকে বিকীর্ণ হয় নি, তাই বিশ্ব ঈশ্বরের সহ-নিত্য হতে পারে না। সৃষ্টির আগে কালেরই অস্তিত্ব ছিল না। জগৎ সৃষ্টির সঙ্গেই কালের সৃষ্টি হয়। ঈশ্বর চিরন্তন বা নিত্য – এর দ্বারা বুঝতে হবে যে তিনি কালের অতীত। এমন কোনো কাল ছিল না যখন ঈশ্বর ছিলেন না। (নিওপ্লেটোনিস্ট প্লোটিনাসের বিপরীতে)
  • বিশ্ব কোনো চিরন্তন সৃষ্টিক্রিয়ার চিরন্তন অভিব্যক্তিও নয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে শূন্য থেকে এ জগতের সৃষ্টি। ওই বিশেষ মুহূর্তটিই ছিল প্রথম মুহূর্ত। তাই জগৎ ও কালের সৃষ্টি একই সঙ্গে হয়। তাই জগৎ যদি অনন্ত না হয়ে থাকে, তাহলে জগৎসৃষ্টির পূর্ববর্তী সময়ে ঈশ্বরের সৃজনীশক্তি অনাবশ্যক ছিল বলতে হয়, যা ঈশ্বরকে সীমিত করে – এই আপত্তিটি আর কাজ করেনা, কেননা শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টির সময় থেকেই কালের অস্তিত্ব আর সেটাই প্রথম মুহূর্ত। আবার মুহূর্তের খেয়ালখুশির বশবর্তী হয়েই ঈশ্বর জগৎসৃষ্টি করেছিলেন – এই যুক্তিও কাজ করেনা, কারণ জগৎ সৃষ্টির পূর্বে সময়ের অস্তিত্বই ছিলনা। জগৎ সৃষ্টি ঈশ্বরের মুহূর্তের খেয়ালখুশি নয়, বরং এক সুচিন্তিত পরিকল্পনারই ফলশ্রুতি। জগৎ সৃষ্টির এবং অন্য কোনো জগৎ সৃষ্টি না করে এই জগৎ সৃষ্টির ঐশ্বরিক সংকল্প ঈশ্বরের নিজের মতোই অনন্ত। (ওরিজেনের মতের বিরুদ্ধে)
  • জ্ঞানের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা স্বীকার্য নয়। আমরা কখনো আপেক্ষিক মানদণ্ড দ্বারা পরিচালিত হতে পারি না। বস্তুত, নিছক সম্ভাব্যতার সাহায্যে সত্য আবিষ্কার করা যায় না। চিরন্তন সত্য প্রাপ্তির উপায় দুটি – (১) বাহ্যবস্তু পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষণ, কেননা এতে ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ পায়; (২) আত্ম-ধ্যান, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের মধ্যে থাকা স্বর্গীয় শক্তিকে উপলব্ধি করতে পারি।
  • নিজ অস্তিত্বের ধারণা থেকে সংশয় শুরু করে দেখা যায়, সংশয় বিশ্বাসকে প্রতিপাদন ও প্রমাণ করে। কোনোরকম উদ্ভট কল্পনা ছাড়াই জানা যায় যে, আমি ‘আমি’ হিসেবেই আছি, আমি জানি এবং ভালোবাসি। আমি জানি যে, যদিও ভুল করলেও আমি আমি-ই থেকে যাই। কারণ যার কোনো অস্তিত্ব নেই, সে ভুল করতে পারে না। তাই আমার ভুল আমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। ‘আমি’ বা আমার আত্মার অস্তিত্ব সন্দেহ করার অর্থ হলো আত্মাকে স্বীকার করা, কেননা সন্দেহকারীকে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে, আর চিন্তা করতে হলে তাকে অবশ্যই অস্তিত্বশীল হতে হবে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমরা চিন্তাশীল সত্তা বা আত্মা। (ডেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০)-এর মতের পূর্বাভাস)
  • আত্মা একটি অজড়ীয় আধ্যাত্মিক সত্তা। চিরন্তন ও অজড়ীয় সত্তাকে যে আত্মা অনুধাবন করতে পারে, তাই আত্মার অজড়ত্ব ও অমরত্বের প্রমাণ। (টেরটুল্লিয়ানের বিপরীতে)
  • আত্মার প্রাক-জন্ম অস্তিত্ব নেই। আত্মা ঈশ্বর থেকে বিকীর্ণ নয়। জড়জগৎ ও আত্মা উভয়েই একই সময়ে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট, তবে সন্তানসন্ততির আত্মা কি মাবাবার আত্মা থেকে প্রাপ্ত, না সরাসরি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট ও তারই নির্দেশে পৃথিবীতে আগত প্রতিটি নতুন দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট তা নিয়ে অগাস্টিন নিশ্চিত নন। (প্লেটো ও ওরিজেন প্রভাবিত) (প্রত্যেক আত্মার আকস্মিক সৃষ্টিবিষয়ক মতবাদ রক্ষণশীল মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এটি ধর্মবেত্তাদের মধ্যে আলোচিত ছিল।)
  • প্রত্যেক আত্মাই অনন্য। বুদ্ধি, ইচ্ছা ও স্মৃতি – এই তিনটি বৃত্তির কল্যাণে আত্মায় ঈশ্বরের প্রকৃতি প্রতিফলিত। তবে চেতনার সব উপাত্ত বাইরের জগৎ থেকে আসে। ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার উৎস ইন্দ্রিয়জগৎ। প্রত্যয় জগতের জ্ঞান আমরা ঐশ্বরিক আলোর সাহায্যে এবং প্রাকসিদ্ধ উপায়ে, অভিজ্ঞতা- নিরপেক্ষভাবে পেয়ে থাকি। পরিবর্তনশীল ও ভ্রান্তিপ্রবণ মানবমন ঐশ্বরিক আলোর সাহায্যেই সার্বিক সত্যের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে। এই ঐশ্বরিক আলোই মানুষের জ্ঞানে নিশ্চয়তা প্রদান করে। প্রত্যেক মানুষই এই আলো পেতে পারে। এর সাহায্যেই মানুষ চিরন্তন প্রত্যয় এবং সত্যমিথ্যা, শুভাশুভ প্রভৃতির জ্ঞান লাভ করে। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • সার্বিকের দ্রব্যাত্মক স্বরূপ ও অস্তিত্ব স্বীকার্য নয়, সার্বিকসমূহ আসলে বাস্তব নয়, সম্ভাব্য সত্তাবিশেষ-এমন সম্ভাব্য সত্তা যেগুলো বিশেষ মূর্ত বস্তুতে প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। (প্লেটো, নিওপ্লেটোনিস্ট ও অতিবাস্তববাদী খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিকদের বিপরীতে)
  • ভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা আদমের পতনের ফলশ্রুতি। আদম ও ইভ পাপ করেছিলেন বলেই তাদের বংশধর সব মানুষ পাপী। পতনের ফলে প্রজ্ঞার আলোক স্তিমিত হয়ে যায় এবং এর ফলে আমরা আর আমাদের আন্তর্শক্তির সাহায্যে প্রত্যয়ের সন্ধান পেতে পারি না। তাই যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব এবং গোটা মানবজাতির মঙ্গল ও মুক্তির জন্য তার মধ্যে সত্যের প্রত্যাদেশ। একমাত্র যিশুই মানুষের পাপমোচনে এবং ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভে মানুষকে সাহায্য করতে পারেন। ঐশ্বরিক জ্ঞান শুধু বৌদ্ধিক নয়, নৈতিক কার্যকলাপেরও লক্ষ্য। ঐশ্বরিকজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ স্থায়ী আনন্দ ও শান্তি লাভ করে, এর আন্বেষা মানুষকে ঈশ্বরের নগরের সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই অন্বেষাকে গভীরভাবে না নিয়ে খেয়ালখুশির বিষয় হিসেবে নিলে ব্যক্তি পার্থিব নগরের সদস্য থেকে যান, যাদের জন্য ঐশ্বরিক কৃপা অত্যাবশ্যক।
  • জ্ঞান ও পুণ্যের অগ্রগতি সমানভাবে সাধিত হওয়া উচিত। তাই নৈতিক জীবনকে সুখলাভের উপায় হিসেবে গণ্য না করে ঐশ্বরিক জ্ঞানপ্রাপ্ত জীবনের প্রতীক হিসেবে (যেমন বলেছিলেন) নৈতিক জীবন নিজেই একটি লক্ষ্য। (স্টোয়িসিজম প্রভাবিত, এরিস্টটলএপিকিউরীয়গণের বিপরীতে)
  • ঈশ্বরই পরম শুভ। সর্বপ্রকার প্রেম ও ইচ্ছাকে এই পরমশুভ, অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রেম ও ইচ্ছায় পরিণত করাই হওয়া উচিত নৈতিক কার্যকলাপের লক্ষ্য। (প্লেটো প্রভাবিত)
  • মানুষের উচ্চতর ও নিম্নতর প্রকৃতির মধ্যে এই বিরোধ ও সংঘাত প্রসঙ্গে অগাস্টিন তার ‘ঈশ্বরের নগর’ গ্রন্থে মানব ইতিহাসের এক দর্শন রচনা করেন। মানুষকে ঈশ্বর নিষ্পাপ হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন, স্বর্গে থাকতে দিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা ও শক্তির অপব্যবহার করে স্বর্গচ্যুত হয়। এভাবেই পৃথিবীতে পাপ ও অশুভ প্রবেশ করে ও তখন থেকেই স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত মানুষের মধ্যে আদি পাপ সংক্রমিত হয়। তাই মানুষ অভিশপ্ত। কিন্তু ঈশ্বর কৃপাবশত মানুষকে পাপমুক্ত করার সংকল্প গ্রহণ করেন এবং হিব্রুদেরকে মানুষের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে নির্বাচিত করেন। তবু মানুষ ক্রমশ ঈশ্বরকে ভুলে যায় ও দুর্নীতি-অপকর্মে লিপ্ত হয়। শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর বন্যা পাঠান, যার ফলে নূহ নবী ও তার পরিবারবর্গ ছাড়া গোটা মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তবু নূহের বংশধরেরা পূর্বপুরুষের ন্যায় পাপাচারে পুনরায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক মহৎ লোক সৎ জীবনযাপন করতে থাকে। অসংখ্য পাপী লোক অধ্যুষিত শয়তানের নগরের পাশাপাশি তারা একটি ঈশ্বরের নগর গড়ে তোলে। এসব পূণ্যবান ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন ইহুদি পুরাণে বর্ণিত সেসব নবী-পয়গম্বরগণ, যারা সমসাময়িক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, মানুষের মুক্তির পথ সুগম করেছিলেন। যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের পর যারা তাকে গ্রহণ করল এবং তার উপদেশ অনুসারে কাজ করল, তারাই মুক্তি পেল, ঈশ্বরের নগরের অধিবাসী হওয়ার সুযোগ পেল। এরপর মানুষের ইতিহাসের এক অবিরাম সংঘাত সূচিত হলো। ঈশ্বরের নগর ও পাপীতাপীদের নিয়ে গঠিত পার্থিব নগরের মধ্যে এই সংঘাত চললো। এ দুই নগরের বাহ্য ও দৃশ্যমান অভিব্যক্তি একদিকে চার্চ, যা ঈশ্বরের কৃপার বাহন ও বিশ্বস্তদের আবাসভূমি, অন্যদিকে সব পার্থিব ও অধার্মিক কার্যকলাপ, যেগুলো আধ্যাত্মিক ও খ্রিস্টীয় জীবনের পরিপন্থী। ঈশ্বরের নগর ও শয়তানের নগরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব ও শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে। তখনই মানুষের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যেসব পুণ্যবান মানুষ যিশুকে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেদের পাপের জন্য অনুশোচনা করে ঈশ্বরের পথে পরিচালিত হয়েছিলেন, তখন তারা তাদের পুরস্কার পাবেন এবং অনন্তকাল ধরে পরম গৌরবের সাথে ঈশ্বরের নগরে বাস করতে থাকবেন। অন্যদিকে যারা যিশুকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পাপকার্যে লিপ্ত হয়েও কোনোরকম অনুশোচনা করে নি, তারা হবে অভিশপ্ত এবং চিরদিন নরকের নির্যাতন ভোগ করবে।
  • “আদিপাপ ভুল, মৃত্যু পাপের শাস্তির বদলে স্বাভাবিক ব্যাপার, খ্রিস্টধর্মের সাহায্য ছাড়াও মানুষ পাপ থেকে বিরত থাকতে ও মুক্তিলাভ করতে সক্ষম।” – এসব চিন্তা ভুল। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ বলে বিশ্বসৃষ্টির আগেই তিনি আদমের পাপ ও পাপের পরিণতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাই আগে থেকেই ঈশ্বর কিছু মানুষকে পাপমুক্ত এবং অন্যদের অভিশপ্ত করার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। (পেলাজিয়াসের বিপরীতে) (এর ফলে নিয়ন্ত্রণবাদ বনাম মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বিতর্কের জন্ম হয়, যা খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে এখনো বর্তমান)।
  • ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও ঐশ্বরিক বুদ্ধি – এ দুয়ের মধ্যে কোনটি প্রথম ও প্রধান, ঈশ্বরের স্বরূপ কি তার ইচ্ছার ফল, নাকি তার ইচ্ছাই তার স্বভাবের ফল? এই প্রশ্নের উত্তরে অগাস্টিন ঐশ্বরিক বুদ্ধির পক্ষে। ঈশ্বর যা ইচ্ছা করেন তা শুভ, তবে তিনি ইচ্ছা করেন বলেই যে তা শুভ নয়, বরং তা আসলেই শুভ বলেই তিনি তা ইচ্ছা করেন। শুভ ও অশুভ ঈশ্বরের নির্দেশে সংঘঠিত হয় না; বরং শুভ ও অশুভই ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অনুপ্রাণিত করে। (টেরটুল্লিয়ানের বিপরীতে)

ছদ্ম ডাইওনিসিয়াস (আনু. ৪০০ – ৫০০ খ্রি.)

  • ‘এক’-এর অনির্বচনীয়তা, মানবাত্মা ও বিশ্বজগৎ পর্যন্ত বিকিরণ-এর সম্প্রসারণ, সব জিনিসের ত্রয়ী গঠন সত্য। (নিওপ্লেটোনিজমের প্লোটিনাস ও প্রোক্লাস প্রভাবিত)
  • ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য প্রজ্ঞার বদলে মরমীবাদ জরুরি। (নিওপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)
  • সর্বেশ্বরবাদ সত্য ও গোঁড়া বা অর্থোডক্স মত ভুল। (নিওপ্লেটোনিজম প্রভাবিত)

বিথিয়াস (আনু. ৪৮০-৫২৪ খ্রি.)

  • পৃথিবী পরিচালনা ও শাসনের মূলে রয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর, সুতরাং সবকিছুই পরিণামে ভালো। ব্যক্তি তার মন্দ ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে এর অর্থ হবে এই যে, প্রকৃত শুভ ও প্রকৃত আনন্দ কিসে নিহিত তা তিনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকৃত শুভ ও প্রকৃত আনন্দ পার্থিব ধন-সম্পদ বা বিষয়-বৈভবে নিহিত নয়। ঐশ্বরিক প্রেম ও ঐশ্বরিকজ্ঞানই এদের উৎস ও আকর। পার্থিব কোনকিছুই তা দিতে পারে না, আবার নিয়েও যেতে পারে না। আবার আপাত অশুভ ও অমঙ্গলের অস্তিত্ব ঈশ্বরের পরম মঙ্গলময়তা ও ন্যায়পরতায় বিশ্বাসের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। মন্দ লোকেরা কখনো প্রকৃত উন্নতি অর্জন করতে পারে না। হীনতা ও পাপাচার তাদের স্থায়ী মঙ্গল অর্জন থেকে বঞ্চিত করে। নিজেদের কৃতকর্ম দ্বারাই তারা তাদের সত্যিকারের সত্তাকে ধ্বংস করে দেয়। বাহ্য দৃষ্টিতে তাদের সমৃদ্ধশালী বলে মনে হলেও আসলে তারা সমৃদ্ধশালী নয়। দৈহিক দিক থেকে জীবিত হলেও আধ্যাত্মিক দিক থেকে তারা মৃত। তারা দুষ্কর্মে যতই কৃতকার্য হয়, তাদের যন্ত্রণা ততই দীর্ঘায়িত হয়। মৃত্যুর পর তারা শাস্তিভোগ করবে, অথবা এক যন্ত্রণাদায়ক পাপমোচন প্রক্রিয়া ভোগ করবে। সবকিছুই ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও ঐশ্বরিক পরিকল্পনা অনুসারে সংঘটিত হয়। অদৃষ্টও ঐশ্বরিক ইচ্ছার অভিব্যক্তি। অদৃষ্ট এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে ঐশ্বরিকবুদ্ধি ঐশ্বরিক পরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করে এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু ও ঘটনাকে আমাদের কাছে লক্ষ্যহীন ও বিশৃঙ্খল মনে হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের দৃষ্টিতে জগতের আদর্শ সুস্পষ্ট এবং তার কার্যকলাপ সামঞ্জস্যপূর্ণ। (স্টোয়িসিজম প্রভাবিত)
  • ঈশ্বর অদৃষ্টের মাধ্যমে সবকিছুকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করলেও তাতে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হয় না। ঈশ্বর সবকিছুই আগে থেকে দেখেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, এ তিনটি কালকেই ঈশ্বর যুগপৎ প্রত্যক্ষ করেন এবং বিশ্বের নিত্যতাকে তিনি একটি চিরন্তন ঘটনা হিসেবে দেখে থাকেন। তবে ঈশ্বরের এই পূর্ব- জ্ঞানের অর্থ এই নয় যে, তিনি সবকিছুকে আগে থেকে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন। আমরা ঠিক কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা প্রয়োগ করবো, কোন পরিস্থিতিতে আমরা কী নির্বাচন করব, তা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তবে আমরা কখন কী করছি, ঈশ্বর তা দেখতে পাচ্ছেন বলে যে বিশ্বাস, তা আমাদের কুপথ থেকে ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
  • সার্বিকের দ্রব্যাত্মক স্বরূপ ও অস্তিত্ব স্বীকার্য নয়, সার্বিকসমূহ আসলে বাস্তব নয়, সম্ভাব্য সত্তাবিশেষ-এমন সম্ভাব্য সত্তা যেগুলো বিশেষ মূর্ত বস্তুতে প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। (প্লেটো, নিওপ্লেটোনিস্ট ও অতিবাস্তববাদী খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিকদের বিপরীতে, অগাস্টিন প্রভাবিত)

সার্বিক নিয়ে মত

  • আদি খ্রিস্টান অতিবাস্তববাদী দার্শনিকগণ : সাধারণ সম্প্রত্যয়ের স্থান ও গুরুত্ব রয়েছে, সার্বিকসমূহ এক ধরনের বাস্তব অতীন্দ্রিয় সত্তা, এবং এগুলো ব্যক্তিমন বা বিশেষ বস্তুর বাইরে স্বাধীনভাবে বিরাজমান। এসব সত্তা অসৃষ্ট ও স্বয়ং-অস্তিত্বশীল নয়, বরং ঈশ্বরই তাদের স্রষ্টা, তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। (প্লেটো, নিওপ্লেটোনিস্ট দ্বারা প্রভাবিত)
  • অগাস্টিন ও বিথিয়াস : সার্বিকের দ্রব্যাত্মক স্বরূপ ও অস্তিত্ব স্বীকার্য নয়, সার্বিকসমূহ আসলে বাস্তব নয়, সম্ভাব্য সত্তাবিশেষ-এমন সম্ভাব্য সত্তা যেগুলো বিশেষ মূর্ত বস্তুতে প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। (প্লেটো, নিওপ্লেটোনিস্ট ও অতিবাস্তববাদী খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিকদের বিপরীতে)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.