পোপতন্ত্রের উত্থান
পূর্বদেশীয় চার্চগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা ও রোমের বিশপের স্বাধীনতা ও অদ্বিতীয়তা : মধ্যযুগে খ্রিস্টান জগতের সর্বত্র ধর্মের প্রসার এবং ব্যাপক প্রভাব স্বাভাবিক কারণেই ধর্মগুরু পোপ এবং রোমান চার্চের উত্থান সম্পর্কে মানুষের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। প্যাগান ইউরোপ কর্তৃক খ্রিস্টের শরণাগত হওয়া এবং প্রায় সমগ্র মহাদেশে কনস্টান্টিনোপলের চার্চকে অতিক্রম করে রোমান চার্চের অবিসংবাদিত নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠার কারণ খ্রিস্টধর্মের বিকাশের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। সুদীর্ঘকাল ধরে পোপের নেতৃত্বাধীন রোমান চার্চ শুধু যে লাতিন খ্রিস্টান রাজ্যের প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল তাই নয়, পশ্চিম ইউরোপের অন্তর্নিহিত ঐক্য গড়ে উঠেছিল তাকেই কেন্দ্র করে। ছোটবড় রাজ্যগুলোর উপর, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পোপতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হয়ে উঠেছিল প্রায় নিয়তির মতোই অমোঘ। অথচ আদিতে পোপ ছিলেন অন্য অনেক বিশপের মতোই একজন বিশপ এবং শুরু থেকে সম্রাটের সমর্থনপুষ্ট এবং পৃষ্ঠপোষকতা ধন্য হবার সৌভাগ্যও তার হয়নি। অবশ্য প্রথমাবধি রোমের বিশপের একটি ঈর্ষণীয় বিশেষ সুবিধা ছিল। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের দায়িত্ব অ্যান্টিয়োক, আলেকজান্দ্রিয়া এবং কনস্টান্টিনোপল এর পেট্রিয়ার্কদের উপর সমভাবে ন্যস্ত ছিল (যদিও রাজধানীর প্রধান পুরোহিত হিসেবে কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক বিশেষ মর্যাদা দাবি করতেন)। এঁদের রেষারেষি, বলা বাহুল্য, পূর্বদেশীয় চার্চের সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। কিন্তু রোমের চার্চ প্রেরিত-শিষ্য পিটারের স্মৃতিজড়িত ও আশীর্বাদপুষ্টরূপে বিবেচিত হওয়ায় তার সমমর্যাদাসম্পন্ন অপর কোনও চার্চের আবির্ভাব ঘটেনি, রোমের বিশপ প্রথম থেকেই হয়ে থাকেন অদ্বিতীয়, সমস্ত মধ্যযুগে তার মহিমা ক্ষুণ্ণ করার ধৃষ্টতা দ্বিতীয় কোনও বিশপ দেখাননি।
পূর্বের প্রভাব ও বর্বরদের আক্রমণের কারণে রোমের ভাগ্য বিড়ম্বনা : আনুমানিক ৩১২ সালে সম্রাট কনস্টানটাইনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ এবং ৩৯১ সালে সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস কর্তৃক তাকে রোমান সাম্রাজ্যের বৈধধর্মরূপে স্বীকৃতি দান সমস্ত ইউরোপে এই ধর্মের প্রসারের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু এই ধর্মের বিস্ময়কর ব্যাপ্তির থেকেও অনিশ্চয়তা এবং প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রোমান চার্চ ও পোপের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠতার প্রতিষ্ঠা অধিকতর বিস্ময়াবহ। প্রাচ্যের পুরোনো এবং প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোর প্রভাব প্রগাঢ় ছিল নবোদিত খ্রিস্টধর্মের উপর। এই ধর্মের বৈধতা স্বীকৃত হবার পর বেশ কয়েক শতাব্দী, বর্বর আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত, চার্চ ছিল পূর্বঘেঁষা। ধর্মচর্চা এবং প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে তখন প্রাচ্যের কেন্দ্রগুলো, বিশেষ করে অ্যান্টিয়োক এবং আলেকজান্দ্রিয়া ছিল প্রধান। ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে প্রচণ্ড ‘বর্বর’ আক্রমণের আঘাতে পশ্চিম ইউরোপের অবস্থা যখন শোচনীয় হয়ে যায় এবং পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অগৌরবের মৃত্যু ঘটে তখন প্রতীচ্যের সদ্যোদীক্ষিত খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের অবস্থাও বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। ‘শাশ্বত নগরী’ রোমকে তখনও ইউরোপের হৃৎপিণ্ড বলে উল্লেখ করলেও অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক বিচারে সে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টধর্মের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে রোমের অস্তিত্ব তাই প্রথম থেকেই ভাগ্য বিড়ম্বিত।
চার্চের রোমান সাম্রাজ্যের শাসন কাঠামো গ্রহণ, হায়ারার্কির উদ্ভব, রোম ও কনস্ট্যান্টিনোপলের বিশপদের ক্ষমতাবৃদ্ধি : খ্রিস্টধর্মের প্রসারের শুরুতে বলা বাহুল্য, কোনও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটেনি। বিক্ষিপ্ত, দীন, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তৈরী কয়েকটি চার্চ নিয়েই আরম্ভ হয়েছিল খ্রিস্টের অনুরাগীদের ধর্মীয় জীবন। খ্রিস্টীয় ২য় শতক থেকে খ্রিস্টান চার্চ রোমান সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার কাঠামো অনুসরণ করতে আরম্ভ করে এবং প্রথমদিকে তা ছিল সম্পূর্ণরূপে নগরকেন্দ্রিক। বিশপগণ সাধারণত নগরেই বাস করতেন এবং খ্রিস্টান নাগরিক এবং আশেপাশের খ্রিস্টানদের ধর্মীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ তারই দায়িত্বে ছিল। প্রথমে বিভিন্ন নগরের বিশপগণকে সম-মর্যাদা সম্পন্ন বলে মনে করা হলেও ধর্মীয় বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং ভ্রান্ত ব্যাখ্যার হাত থেকে খ্রিস্টীয় উপদেশামৃত বাঁচাবার জন্য ক্রমশ যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ অনিবার্য হয়ে উঠল। এরপর প্রয়োজন অনুসারে যখন ধর্মীয় সম্মেলন আহূত হয়েছে তখন অধিবেশনের স্থান নির্বাচিত হয়েছে কোনও রোমান প্রদেশের কেন্দ্রে। এ জাতীয় ঘটনায় স্বাভাবিক কারণে সেখানকার বিশপের সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে, কখনো-বা তিনি আর্চ বিশপের মর্যাদা লাভ করেছেন। এভাবেই ক্রমশ রোম এবং কনস্টান্টিনোপল এর বিশপগণ অতুলনীয় প্রতিপত্তি ও সম্মানের অধিকারী হয়ে ওঠেন। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের দুই রাজধানীর বিশপদ্বয় সম-মর্যাদা লাভ করলেও ক্রমশ নানা ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কারণে ‘ইন্টারন্যাল সিটি’র বিশপই হয়ে উঠেছিলেন প্রধান, সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।
প্রৈরিতিক পারস্পর্য নীতি ও সেইন্ট পিটারের উপর ভিত্তি করে রোমান চার্চের বিশেষ মর্যাদা : রোম এবং তার বিশপের এই অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের মূলে ছিল প্রৈরিতিক পারস্পর্য নীতি (doctrine of Apostolic Succession)। চার্চ প্রতিষ্ঠার আদিযুগে বিশপদের শুধু যে সাধারণ অর্থে প্রেরিত শিষাবৃন্দের (apostles) উত্তরসূরী বলে মনে করা হতো তাই নয়, সুনির্দিষ্ট ধর্মশাস্ত্রের অভাবে, সুব্যাখ্যাত নিয়মাবলীর অনুপস্থিতিতে, মৌখিকভাবে, শিষ্যপরম্পরা বিশদের মাধ্যমেই মানবপুত্রের উপদেশামৃত বা সুসমাচার বাহিত হয়ে আসছিল বলেও তারা প্রকৃত অর্থে পুণ্য ঐতিহ্যের বাহক হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া কখনো কখনো যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে মতদ্বৈততা দেখা দিলে ‘প্রেরিত’ শিষ্যবৃন্দ প্রতিষ্ঠিত বা তাদের স্মৃতি-বিজড়িত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না; কেনন৷, সকলের বিশ্বাস ছিল – প্রকৃত সত্য সেখানেই বিরাজমান। ১৭৮ সালে ইরেনিয়াস (Ireneus) এবং তারপর তার্তুল্লিয়ান (Tarltullian) (লিয়ঁর বিশপ) ঘোষণা করেছিলেন যে যিশু তার শিষ্যদের কাছে যা উদ্ঘাটিত করেছিলেন এবং যা প্রকৃতধর্ম তার একমাত্র ভাণ্ডারী তার ‘প্রেরিত’ শিষ্যবৃন্দের স্থাপিত চার্চগুলো। তারা বলেন, যিশু পিটারকে স্বর্গের চাবিকাঠি তুলে দিয়েছিলেন, জনকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে ধন্য করেছিলেন এবং একমাত্র তার কাছে জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার কথা আগেই বলেছিলেন, তাই তাদের কাছে খ্রিস্টের জীবন ও বানীর কোনও অংশই ‘অনালোকিত’ থাকতে পারে না। ইরেনিয়াস রোমানচার্চের শ্রেষ্ঠত্ব এবং শিষবৃন্দের মধ্যে পিটারের বিশেষ স্থানের প্রতি ইঙ্গিত করলেও এই ঐতিহাসিক তথ্যও স্মরণীয় যে সেন্ট পিটার শুধু রোমেই চার্চ প্রতিষ্ঠা করেননি। অন্য অনেক চার্চের সঙ্গে অ্যান্টিয়োক ও আলেকজান্দ্রিয়াতেও তিনি খ্রিস্টের ভজনালয় স্থাপন করেছিলেন। রোমের যাজক সম্প্রদায় কিন্তু রোমের প্রাধান্যের কারণ হিসেবে যিশু কর্তৃক পিটারের উপর বিশেষ আস্থা স্থাপন এবং তার সঙ্গে রোমের চার্চের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের উপর বেশি গুরুত্ব দিতেন। ৩৮১ সালে কনস্টান্টিনোপলে আহূত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (ecumenical council) এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে কনস্টান্টিনোপলের বিশপের স্থান রোমের বিশপের ঠিক পরেই। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীকে ‘নবরোম’ আখ্যাও দেওয়া হয় এই সম্মেলনে। এর উত্তরে পোপ প্রথম ড্যামাসাস (৩৬৬-৮৪) সগর্বে ঘোষণা করেন যে রোমের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অনন্যতা কোনও সম্মেলনের সিদ্ধান্তনির্ভর নয়। যিশু পিটারকে যে ক্ষমতা দান করেছিলেন তার থেকেই উৎসারিত রোমের বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য। পোপ বনিফেস (৪১৮-২২) কনস্টান্টিনোপলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি কটাক্ষ করে বলেছিলেন, মানবদেহে মস্তিষ্কের যে স্থান, পৃথিবীর অন্যান্য চার্চের উপর রোমান চার্চ অনুরূপ আসন গ্রহণ করে আছে।
পিটারের ভিত্তিতে পোপের ক্ষমতার দাবি, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি ও জাস্টিনিয়ানের চার্চকে সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টার ফলে সমস্যা : পোপ প্রথম লিওর সময়েই খ্রিস্টান জগতে পোপের স্থান সম্পর্কে এই মতবাদ প্রচলিত হয় যে পোপকে অস্বীকার করার অর্থ পিটারকে অস্বীকার করা, আর পিটারকে অগ্রাহ্য করলে খ্রিস্টকেই অস্বীকার করা হয়। কিন্তু এ জাতীয় দাবি সত্ত্বেও সমস্ত খ্রিস্টান জগতে পোপের অবিসংবাদিত প্রাধান্যের বাস্তব স্বীকৃতি ছিল সময়সাপেক্ষ। অ্যান্টিয়োক, আলেকজান্দ্রিয়া, বিশেষ করে বর্ধিষ্ণু এবং সমৃদ্ধ কনস্টান্টিনোপল রোমের বিশপের এ দাবি অস্বীকার করার মতো অবস্থায় ছিল। ইউরোপের পশ্চিমাংশের সাম্রাজ্য তখনও অবলুপ্ত, আর পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তখন সুসময়ের শীর্ষে। তাছাড়া মধ্যযুগের একটা সময়ে এ বিশ্বাস বহুল প্রচলিত ছিল যে চার্চের সর্বোচ্চ ক্ষমতা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের (ecumenical council) উপরই ন্যস্ত থাকা উচিত। রোমান চার্চ এবং পোপের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথে সব থেকে বড় বাধা এসেছিল যখন সম্রাট জাস্টিনিয়ান প্রতিষ্ঠিত ধর্মরাজ্যে (theocracy) চার্চকে সম্পূর্ণরুপে সম্রাটের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার প্রচেষ্টা হয়েছিল। এ প্রয়াস সফল হলে অনায়াসে পোপের শ্রেষ্ঠত্বের অবসান ঘটতো। কিন্তু কয়েকটি ঘটনার ফলে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। লাতিন খ্রিস্টান জগত রোমের প্রভাবাধীনেই রয়ে গিয়েছিল।
পূর্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে পোপের সম্পর্কের বিচ্ছেদ : রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে বিভেদ অতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকের ‘বর্বর’ আক্রমণের ফলে এবং ৭ম শতকের মুসলমান অভিযানগুলো ধর্মকেন্দ্র হিসেবে অ্যান্টিয়োক, আলেকজান্দ্রিয়া ও জেরুসালেমের কর্মতৎপরতা স্তব্ধ করে দেয়ার পরিণামে। এর পর থেকে খ্রিস্টের ধর্ম প্রচারের মাত্র দুটি কেন্দ্রই অবশিষ্ট থাকে-রোম ও কনস্টান্টিনোপল এবং এ দুটি নগরীর মধ্যেও সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। ৬৬৩ সালে শেষবারের মত কোন রোমান সম্রাট রোম পরিদর্শন করেছিলেন এবং প্রথম কনস্টানটাইনই শেষ পোপ যিনি ৭১০ সালে কনস্টান্টিনোপলে আসেন। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর থেকে বহুকাল পর্যন্ত পোপগণ কনস্টান্টিনোপলকেই রাজধানী রূপে দেখতেন এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যই তাদের বিচারে ছিল ‘সভ্য জগৎ’ যার নাগরিক বলে তারা গর্ব বোধ করতেন। ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সম্রাট জাস্টিনিয়ান কর্তৃক ইতালীর কিছু অংশ বিক্রিত হলে রাভেনা অধিকৃত অঞ্চলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত হয়। এই সময় বেশ কয়েকজন গ্রীক পোপ নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে পোপ তখনও সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন নি। কিন্তু আভ্যন্তরীণ মতদ্বৈততা (Iconoclastic Controversy বা প্রতীক, প্রতিমা, স্মৃতিচিহ্ন পূজা-সংক্রান্ত বাদবিসংবাদ), লোম্বার্ডদের ইতালীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব এবং এই নতুন বিপদ থেকে ইতালীকে ত্রাণ করার ব্যাপারে বাইজানসিয়ামের ব্যর্থতা এবং অবশেষে ‘বর্বর’ ফ্রাঙ্কদের পোপের সহায়রূপে আবির্ভাব – এই কার্য সিদ্ধ করে দেয়।
বর্বর আক্রমণের পর খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টানদের কাছে চার্চই রোমান সংস্কৃতির প্রধান ধারক : ইতিমধ্যে পশ্চিম ইউরোপে ‘বর্বর’ আক্রমণের ফলে মানুষের জীবনে, খ্রিস্টীয় সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। উপযুক্ত শাসকের অবর্তমানে ধ্রুপদী সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং অবশ্যই, খ্রিস্টধর্ম রক্ষার প্রায় সমস্ত দায়িত্ব চার্চের উপর এসে পড়েছিল। এই অস্থির, দ্রুত পরিবর্তনশীলতার মধ্যে ধর্ম ও সংস্কৃতির একমাত্র রক্ষক হিসেবে মানুষ পোপেরই শরণাপন্ন হয়েছে। চোখের সামনে-ভেঙ্গে-পড়া পৃথিবীতে একমাত্র রোমান চার্চকেই তাদের কাছে স্থায়ী এবং সুস্থির বলে মনে হয়েছে। আর নবাগত ‘অখ্রিস্টানরা’ও শুধু রোমান সভ্যতা ধ্বংস করতেই আসেনি, এর অংশীদার হবার বাসনাও ছিল তাদের। সুতরাং এই সব ‘বর্বরদের’ চোখে রোমের গরিমা এবং রোমের ধর্ম ও সংস্কৃতির আকর্ষণ কম ছিল না। ফ্রাঙ্ক এবং অ্যাংলো-স্যাক্সনদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ এই কারণে হয়তো সহজতর হয়েছিল। ‘বর্বর’ আক্রমণের ফলে রোমান রাষ্ট্র-ব্যবস্থার যখন প্রায় আর কিছুই ছিল না, স্থানীয় শাসন বা বিচার ব্যবস্থা, স্থানিক শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা – সব কিছুর দায়িত্ব গিয়ে পড়েছিল যাজকদের উপরেই। মেরোভিঞ্জীয় গল থেকে ভেনান্টিয়াস ফরচুনেটাস (Venantius Fortunatus) নাঁতে (Nantes)-এর বিশপ ফেলিক্সকে (Felix) লিখেছিলেন “আপনিই আপনার স্বদেশ-ভূমির ত্রাতা”। ইতালীর বিভিন্ন অঞ্চলে, রোম এবং তার প্রত্যন্ত প্রদেশে আরও ব্যাপকভাবে এই দায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে দেখা গেছে একাধিক পোপকে। হান দলপতি ইতালী-আক্রমনোদ্যত এটিলাকে নিবৃত্ত করেছিলেন পোপ প্রথম লিও (৪৫২) এবং লোম্বার্ড আক্রমণের বিরুদ্ধে রোম রক্ষার দায়িত্ব পালনে অগ্রণী হয়েছিলেন পোপ প্রথম গ্রেগরী (৫৯০-৬০৪), ধর্ম শাস্ত্রজ্ঞ, দক্ষ প্রশাসক ও সঙ্গীত বিশারদ রূপে যাঁর খ্যাতি ছিল দূর বিস্তৃত। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যেও তার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কেউই প্রায় সন্দিহান ছিলেন না।
পোপ প্রথম গ্রেগরী ও তার পার্থিব কর্তৃত্ব পালনে পরবর্তী পোপদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ইঙ্গিত : মধ্যযুগের পোপদের মধ্যে ‘শ্রেষ্ঠ’ বলে বন্দিত প্রথম গ্রেগরী সমস্ত জীবনব্যাপী এই সম্মানের অধিকারী হবার সাধনাই করেছিলেন। তার সময় থেকেই পোপগণ ‘ঈশ্বরের সেবকদের সেবক’ এই বিশেষণে ভূষিত হতে শুরু করেছিলেন। রোমান চার্চের আধিপত্য বিস্তার নয়, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে পোপের ক্ষমতা মুক্ত করার প্রচেষ্টা নয়, মানব-ত্রাণই ছিল গ্রেগরীর একমাত্র সাধনা। তবে অন্য আরো অনেক বিশপের মতো গ্রেগরীকেও প্রয়োজনের খাতিরে রোম এবং সন্নিহিত রোমান চার্চের অধীনস্ত এলাকায় (Patrimony of St Peter রূপে অভিহিত) পার্থিব কর্তৃত্ব পালনের দায়িত্বও বহন করতে হয়েছিল দীর্ঘকাল। পোপের এই ভূমিকাতেই হয়তো অন্তর্নিহিত ছিল পরবর্তী কালের পোপদের রাজনৈতিক শক্তি রূপে আবির্ভাব। ইংরেজ ঐতিহাসিক মস (H. St. L. B. Moss) লিখেছেন, ‘একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রূপে, বিচারক রূপে, পিটারের হাতে তুলে দেওয়া স্বর্গের চাবিকাটির রক্ষকরূপে, ইতালীর বিভ্রান্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের সামনে তিনি (গ্রেগরী) অলৌকিক শক্তির অধিকারী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বহু দূরে অবস্থিত পূর্ব রোমান সম্রাটের কর্তৃত্ব তাদের কাছে ছিল অর্থহীন, র্যাভেনাতে সম্রাটের প্রতিনিধিকে তারা অক্ষম শাসক ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি।’
পশ্চিম ইউরোপে সম্রাটের ক্ষমতার অভাবের কারণে সেখানে গ্রেগরীর উদ্যোগে পোপতন্ত্রের বিকাশ : পোপতন্ত্রের বিকাশে গ্রেগরী দ্য গ্রেট বা প্রথম গ্রেগরীর (৫৯০-৬০৩) অবদান সযত্ন-স্মরণযোগ্য। পোপের পদ অলঙ্কৃত করার আগে গ্রেগরী কনস্টান্টিনোপলে রোমান চার্চের প্রতিনিধি হিসেবে অবস্থানকালে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তার ভিত্তিতেই তার কাছে এ তথ্য পরিষ্কার হয়ে যায় যে শাসক ও ধর্মরক্ষক রূপে সম্রাটের শক্তি ও অস্তিত্বের ভিত্তি অনাক্রমনীয়। এর বিরুদ্ধাচরণে রোমান চার্চের যে কোনও লাভই হবে না তাও বুঝতে তার দেরী হয়নি। সে জন্য পোপের ক্ষমতা বিকাশ ও প্রসারের জন্য গ্রেগরী এমন ক্ষেত্রই বেছে নিয়েছিলেন যেখানে বাইজানটাইন সম্রাটের কর্তৃত্বের লেশমাত্র ছিল না। তাই পোপ ব্রিটেন এবং গলে (আধুনিক ফ্রান্স) ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করেন, এবং সেখান থেকে যাজকগণ উত্তর ও মধ্য ইউরোপকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার ব্রতে আত্মনিয়োগ করেন। এই সব অঞ্চলে পোপ এবং সম্রাটের ক্ষমতার সীমারেখা সংক্রান্ত কোনও বিরোধের সম্ভাবনা ছিল না। গ্রেগরীর এই বাস্তব বুদ্ধিই মধ্যযুগে পোপতন্ত্রকে বাইজানটাইন সম্রাটের কর্তৃত্বের বাইরে নির্বিঘ্নে বিকশিত হবার সুযোগ দিয়েছিল, তার এই নীতিই জন্ম দিয়েছিল লাতিন ইউরোপের। রোমান চার্চই যে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও জাতিগুলোর জননী-স্বরূপ এবং ধর্মগুরু পোপই যে তাদের লৌকিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের অদ্বিতীয় সহায় – এ ধারণা সৃষ্টি গ্রেগরী কৃতিত্বের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের শাসকবর্গের সঙ্গে তার মত বিনিময়ের সময় পাথিব শক্তি যে সর্বাংশে এবং সর্বক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক শক্তির অধীন তা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি ভোলেন নি। পোপের অনুশাসন ও নির্দেশাবলী অগ্রাহ্য করার শাস্তি সমাজচ্যুতি এবং তা যাজক ও গৃহী উভয় শ্রেণীর বিরুদ্ধেই যে প্রযুক্ত হতে পারে সে তথ্য প্রচারেও গ্রেগরী ছিলেন অক্লান্ত। যাজকদের তিনি পোপের আজ্ঞাবাহকের বেশি মনে করতেন না। চার্চের মধ্যে ক্রমোন্নত শ্রেণী বিভাগ, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম ও দায়িত্ব অর্পণ বিষয়েও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ্যণীয়। তিনিই প্রথম খ্রিস্টান সমাজকে Society of Christian Commonwealth Societas republical Christianae-রূপে অভিহিত করেন এবং সেন্ট পিটারের উত্তরসূরী পোপই যে অধীনস্থ যাজকবৃন্দের সহায়তায় এই সমাজ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী তা গ্রেগরী দ্য গ্রেটের সংগঠন প্রতিভার ফলে একটি সুবিদিত তত্ত্বের রূপ নেয়। গ্রেগরীর অসীম কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে তার অসামাণ্যতা প্রমাণিত হয়। তারই প্রচেষ্টায় স্পেনে ভিসিগথদের চার্চ রোমান চার্চ দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত খ্রিস্টীয় মতবাদ এরিয়ানবাদ ধর্মের প্রভাবমুক্ত হয়, ইতালীর বিধর্মী লোম্বার্ডগণ খ্রিস্টেরধর্ম গ্রহণ করে এবং ৫৯৭ সালে তার প্রতিনিধিরূপে সেন্ট অগাস্টাইন ‘প্যাগান’ ইংলন্ডকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন।
সদ্যোদীক্ষিত জার্মানদের ধর্মীয় আবেগের প্রভাব : অল্পকালের মধ্যেই চার্চ সংগঠনে ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিভাগ-পোপ, আর্চ-বিশপ, বিশপ ইত্যাদি – পশ্চিম ইউরোপের বহু অঞ্চলেই সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। ধর্মকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনা, তাকে একটি প্রগাঢ় অনুভূতিতে পরিণত করার প্রবণতা ছিল সদ্যোদীক্ষিত জার্মান জাতিগুলোর মধ্যে। সন্তদের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরার ব্যাকুলতা তাদের এই বিশ্বাস সুদৃঢ় করে দিয়েছিল যে, সজীব ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা কেবল চার্চই ঘোষণা করতে পারে, এ কারণে প্রেরিত-শিষ্যরাও অমর। তারা মনে করত, রোমে সমাধিস্থ পিটার মৃত নন, তিনি তার প্রতিনিধি (Vicar) পোপের মধ্যেই বেঁচে আছেন, তার মাধ্যমেই তিনি কর্মরত। এই বিশ্বাসের ফলেই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে পোপের আধিপত্য অতি সহজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুদূর পূর্ব ইউরোপের ধর্মগুরুর প্রতি তাদের কোনও আকর্ষণই ছিল না। রোম এবং সেন্ট পিটারই তাদের কাছে বরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।
পোপের সাথে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সম্পর্কের পূর্ণ বিচ্ছেদ ও ফ্রাঙ্করাজের সাথে মৈত্রীর মাধ্যমে পোপতন্ত্রের শক্তিশালী হয়ে ওঠা : ৭২৬ সালে যখন খ্রিস্টান সমাজ প্রতীকপূজা, স্মৃতিচিহ্ন প্রচলন বা বর্জনের প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ল, তখন পোপ পূর্ব রোমান চার্চের বিরোধিতা করেন, ফলে পূর্ব রোমান সম্রাট দক্ষিণ ইতালী এবং সিসিলিতে সেন্ট পিটারের ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেন। তা ছাড়া অন্যান্য বহু অঞ্চলে রোমান বিশপের অনুগামী আর্চবিশপের অধীনস্থ প্রদেশ কনস্টান্টিনোপলের ধর্মগুরুর (Patriarch) অধীনে ন্যস্ত করা হয়। রোমকে সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতা-ধন্য চার্চের প্রধান কেন্দ্রের সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়, এভাবে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে পোপের কর্তৃত্বের অবসান হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে ঠিক এই সময়েই ইতালীতে লোম্বার্ড আক্রমণের সম্মুখীন হলে পোপের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। তবে রোমান চার্চ বা তার পোপের ভাগ্য ভাল যে, ৭৫১ সালে লোম্বার্ডরা র্যাভেনাতেও বাইজানটাইন সরকারের শেষ চিহ্নটুকু মুছে দেয়। এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কনস্টান্টিনোপলের কাছে আর কোনও রকম সাহায্য পাওয়ার আশা না থাকায় পোপ দ্বিতীয় স্টিফেন ৭৫৪ সালে ফ্রাঙ্ক নৃপতি পিপিনের শরণাপন্ন হন। এভাবেই সূচিত হয় পোপ এবং ফ্রাঙ্কশাসকদের মধ্যে মৈত্রী-বন্ধন, যার প্রগাঢ় প্রভাব সুদীর্ঘকালের জন্য সমস্ত ইউরোপের ইতিহাসে ছড়িয়ে পড়ে।
ফ্রাঙ্করাজদের পৃষ্ঠপোষকতায় পোপতন্ত্রের বিকাশ : পূর্ব দেশীয় গ্রীক চার্চের সঙ্গে বিযুক্ত হয়ে পশ্চিম ইউরোপের জার্মান জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী শাখা ফ্রাঙ্কদের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা-পুষ্ট হয়ে, স্বর্গদ্বারের চাবিকাঠির একক-রক্ষক রূপে পোপ ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে আরম্ভ করলেন। ফ্রাঙ্করাজ লোম্বার্ডদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে হস্তক্ষেপ করার পর র্যাভেনাকে কেন্দ্র করে বাইজানটাইন চার্চের যে ভূসম্পত্তি গড়ে উঠেছিল তা সেন্ট পিটারের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। এর থেকেই শুরু হয় পোপের নিজস্ব রাজ্যের গড়ে ওঠা। শার্লমান এই রাজ্যের সীমানা কিছু সঙ্কুচিত করলেও তার অস্তিত্বকে সমর্থন করেন। ১৯শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সমস্ত মধ্য ইতালী জুড়ে পোপ-শাসিত অঞ্চল একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সমস্ত ইউরোপের ইতিহাসে যে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল এই হলো তার জন্মকাহিনী। স্বাভাবিকভাবেই পোপের কর্তৃত্বাধীন রোমান চার্চের এই অভ্যুদয় মধ্যযুগের অতি বিখ্যাত একটি দলিল- Donation of Constantine-এর পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ একটি ঘটনা বলে মনে হতে পারে। মূলত-জ্বাল এই দলিলের ভিত্তিতে পরবর্তীকালের পোপ-পক্ষীয়গণ দাবি করেছিলেন যে সম্রাট কনস্টান্টাইন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবার পর রোমের ল্যাটেরান (Lateran) প্রাসাদ (দলিলের এই অংশ খাঁটি) সহ সমস্ত রোম, ইতালীর সমস্ত প্রদেশ, জেলা ও নগর এবং পশ্চিমাঞ্চলের বহু স্থানের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার পোপ প্রথম সিলভেস্টারকে দান করেন। ইতিহাসের অনন্যসাধারণ একটি বিকৃতি এবং ‘রোমান-ধর্ম-রাজ্যের স্বপ্ন’ রূপে আখ্যাত এই দলিলের মধ্যে ৮ম শতকে গোট৷ পশ্চিম ইউরোপের উপর পোপের রাষ্ট্রনৈতিক অধিকারের দাবি প্রতিফলিত হয়েছে এবং এই ইঙ্গিতও অতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে রোমে সীজারগণের উত্তরসূরী মহামান্য পোপ। খ্রিস্টান পুণ্যভূমিতে পার্থিব-অপার্থিব সকল শক্তির আধার ধর্মগুরু পোপ ছাড়া আর কেউ নন। প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্র নৈতিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে হস্তান্তরিত করার বা মনোনীত ব্যক্তির উপর তা অর্পণ করার অধিকার পোপের আছে – এই দাবির বাস্তব রূপায়ণের জন্যই হয়তো ৮০০ সালের পোপ তৃতীয় লিওর উদ্যোগ ও আগ্রহে শার্লমানের সম্রাট রূপে অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। সুখ্যাত এই ঘটনার মধ্যে নিহিত ছিল মধ্যযুগের দ্বন্দ্ব। দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর এক অধ্যায় – সম্রাট ও পোপের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপনের দ্বন্দ্ব। ৮০০ সালের খ্রিস্টের জন্মোৎসবের যে নাটকীয় ঘটনাকে সৎ ও শুভবুদ্ধি চালিত বলে মনে হয়েছিল, তার অনিবার্য পরিণতি ছিল দম্ভ ও অত্যুগ্র উচ্চাভিলাষের মূর্ত-প্রতীক সপ্তম গ্রেগরী, তৃতীয় ইনোসেন্ট এবং অষ্টম বোনিফেসের জীবনেতিহাস। এভাবে পোপের মর্যাদাকে অতুলনীয় ও অভূতপূর্ব স্তরে উন্নীত করার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের ধ্বংস সাধনও যেন একটি স্থির লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল।
মঠজীবনবাদ (Monasticism) ও বেনিডিক্টীয় সম্প্রদায়
মঠ সমূহের ঐতিহ্য : মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে মঠবাসী খ্রীস্টান সন্ন্যাসীদের অবদানের অতুলনীয়তা সর্বস্বীকৃত। লাতিন খ্রীস্টান রাজ্যগুলিতে অসংখ্য মঠকে কেন্দ্র করে ধর্মানুশীলন, সমাজ সেবা, বিদ্যাচর্চা, চার্চের বহু বিচিত্র কর্মপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত এবং অব্যাহত রাখার যে সুদীর্ঘ এবং সুপ্নিদ্ধ ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছিল ইতিহাসে তার নজির পাওয়া কঠিন। স্বর্গ-মর্তে সেতু রচনার দুরূহ ব্রত পালনে, ফ্রঁস্টের বাণী পরাক্রান্ত রাজার প্রাসাদ থেকে দীন-দরিদ্রের কুটিরে পৌঁছে দেবার কাজে, চার্চের কাছে অপরিহার্য ছিল ত্যাগ ও সেবার প্রতীক এই মঠগুলি। মঠজীবনবাদের আদর্শ, বৈচিত্র্য এবং ব্যাপকতার জন্যই হয়তো মধ্যযুগীয় প্রতিষ্ঠান হলেও মঠের প্রয়োজন মানুষের কাছে এখনে৷ ফুরিয়ে যায় নি। ইউরোপের বহু অঞ্চলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ হিশেবে মঠজীবনবাদের অস্তিত্ব আজও অটুট। বৈরাগ্য-অনুপ্রাণিত হলেও প্রবহমানতায় ভূষিত এবং সময়-উপযোগী হয়ে ওঠার শক্তিতে প্রাণবন্ত বলে মঠজীবনবাদ কালজীর্ণ বা অপ্রয়োজনীয় বলে পরিত্যক্ত হয়নি, খ্রীস্টান সমাজে নিঃশেষ হয়ে যায়নি তার আকর্ষণ ও আবেদন।
প্রাথমিক পর্যায়ে কৃচ্ছতাবাদী খ্রিস্টানগণ : মঠজীবনবাদ রূপ পরিগ্রহণ করেছিল খ্রীষ্টপূর্বকালে এবং এর আবেদন নির্দিষ্ট কোনও মহাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না, যদিও প্রাচ্যের দেশগুলিতেই এই আদর্শের দেখা প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। Monk শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক — monakos (Solitary/ নিঃসঙ্গ ) থেকে। অবশ্য পরবর্তীকালে যারা ধর্মীয় প্রেরণায় একটি প্রতিষ্ঠানে অঙ্গীভূত হয়ে নিভৃত নির্জনতায়, কৃচ্ছ্রতাসাধনের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসজীবন যাপন করতেন তাঁরাই এই নামে চিহ্নিত হতেন। সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রস্টিধর্মে দীক্ষিত হবার আগে থেকেই পূর্বাঞ্চলের চার্চের বহু খ্রীষ্টভক্ত আলেকজান্দ্রিয়া, অ্যান্টিয়োক প্রভৃতি কোলাহল-মুখর, বিষয়াসক্ত নগর পরিত্যাগ করে ঈশ্বরের আরাধনা ও আত্মশুদ্ধির জন্য মিশর ও সিরিয়ার মরুপ্রদেশের নিঃসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে আশ্রয় নিতেন। শুধু বিষয়-নগ্ন সমাজের স্পর্শ থেকে অব্যাহতির জন্যই এঁরা আকুল হননি, সমাজের আবশ্যিক এবং অপরিহার্য অঙ্গরূপে গড়ে ওঠা চার্চের থেকেও দূরে থাকতে চাইতেন বৈরাগী এই খ্রীস্টভক্তগণ। খ্রীস্টধর্ম বৈধ বলে স্বীকৃতি পাবার পর স্বাভাবিক কারণেই বৈরাগ্য সাধনে মুক্তির আশায় সমাজ-সংসার ত্যাগীর সংখ্যা স্ফীততর হতে শুরু করে। সমাজবদ্ধ মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধান নয়– আত্মশুদ্ধি, জনহীন প্রান্তরে ‘দুঃখের মন্থন বেগে’ অমৃত সৃষ্টির সাধনা, কঠোর থেকে কঠোরতর কৃচ্ছ্রতা সাধন—খ্রীষ্টান সন্ন্যাসীদের এই ছিল আদর্শ। কিন্তু এদের আত্মনিগ্রহ ক্রমশ উন্মত্ততার স্তরে গিয়ে পৌঁছেছিল, প্রব্রজ্যা পরিণত হয়েছিল সহ্য-শক্তির প্রমাণ প্রতিষ্ঠার এক অশুভ প্রতিযোগিতায়। সহজাত পাপবোধ থেকে আত্মাকে নির্মল করার এক প্রাণান্তকর ( কখনো বা হাস্যকর ) প্রচেষ্টা সন্ন্যাসীদের দৃষ্টির স্বচ্ছতা দিয়েছিল নষ্ট করে। সেইন্ট সিমন স্টাইলাইট (St Symon Stylite) অপরিসর এক স্তম্ভের উপর তেত্রিশ বছর কাটানোর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা তাঁরই শিষ্য সেন্ট ড্যানিয়েল কর্তৃক অনুসৃত হয়েছিল। শিষ্য অবশ্য আরও কিছু বেশী কাল অতিবাহিত করেছিলেন সংকীর্ণতর স্তম্ভে। ধর্মোন্মাদনার এই আতিশয্য কিন্তু সকলকেই স্পর্শ করেনি। ৩১৫ সালে মিশরের সেন্ট অ্যান্টনী ধর্মানুশীলনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি আশ্রম, সেন্ট প্যাকোমিয়াসও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন অনুরূপ আদর্শে। ধীরে ধীরে প্রতীচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল আলোকিত হয়ে উঠল পুণ্য আদর্শের বাস্তব রূপায়ণে, বনভূমির নৈঃশব্দ্য মুখরিত হয়ে উঠল প্রার্থনাসঙ্গীতে। পঞ্চম শতকের শেষার্ধে জ্যোতির্ময় আবির্ভাব হলো নাসিয়ার সেইন্ট বেনিডিক্ট (St Benedict)-এর—মঠজীবনবাদের উদ্গাতা রূপে সর্বযুগের এবং সর্বস্তরের মানুষ যাঁকে শ্রদ্ধা ও ভক্তির অঞ্জলি দিয়ে এসেছে।
নিঃসঙ্গতা পরিহার করে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন ও সেইন্ট বেনিডিক্টের আগমন : খ্রীস্টীয় ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ শতকের এই মুক্তি-সাধকদের দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত দেখা যায় : সন্ন্যাসী (Anchorites) ( যাঁরা নিভৃত নিঃসঙ্গতার মধ্যে অধ্যাত্ম জীবন যাপনে বদ্ধ পরিকর ) এবং সিনোবাইটস্ (Cenobites) ( যাঁরা সমাজ ত্যাগ করলেও— যৌথভাবে ধর্মানুশীলনেই মুক্তি—এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন)। বলা বাহুল্য আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণ বা যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতায় এরা কেউই বিশ্বাসী ছিলেন না। কালক্রমে অ্যাঙ্কোরাইট সম্প্রদায়ভুক্তরাও নিঃসঙ্গতা পরিহার করে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের পথ ধরলেন। সন্ন্যাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হলো এদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা। পুণ্যাত্মা প্যাকোমিয়াস এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হলেও পূর্বাঞ্চলের মঠবাসী সন্ন্যাসীদের জন্য নিয়মাবলী রচনায় খ্যাত হয়ে আছেন সেইন্ট বেসিল (St Basil)। পশ্চিম ইউরোপে এ বিষয়ে একই সঙ্গে পথিকৃৎ এবং শ্রেষ্ঠরূপে সম্মানিত হয়ে আছেন সেইন্ট বেনিডিক্ট। আনুমানিক ৪৮৯ সালে মধ্য ইতালীর স্পোলেতোর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। খ্রীস্টান জগতের মহামূল্যবান এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণসঞ্চারে আমৃত্যু সাধনা করেছিলেন সেইন্ট বেনিডিক্ট। তাঁরই প্রয়াসে নির্জনতায় স্বেচ্ছা-নির্বাসনে, সুকঠোর তপস্যার মধ্য দিয়ে মুক্তি অর্জনের আত্ম কেন্দ্রিকতার পরিবর্তে ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে, সেবা ও বিদ্যানুশীলনের সঙ্গে ধর্মানুশীলনের আদর্শ সঞ্চারিত হলো মঠবাসীদের মধ্যে। লক্ষ্য রইল অভিন্ন, পরিবর্তিত হলো শুধু পথ।
বেনিডিক্টের আদর্শ ও বিধানের অনুসরণ : সম্ভবত ৫২৯ সালে আশ্রমিকদের জন্য সেন্ট বেনিডিক্ট যে বিধানাবলী রচনা করেছিলেন তা খ্রীস্টান জগতে সর্বাধিক প্রচারিত এবং সব থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসৃত। বেনিডিক্ট-এর অনুগামী ছাড়া ভিন্ন সম্প্রদায়-ভুক্ত বহু সন্ন্যাসীও (যেমন কাথুসিয়ান / Carthusian) মূলত তাঁরই নিৰ্দ্দেশ মেনে চলতেন। ক্লুনিমঠের আবাসিকরাও ছিলেন সেইন্ট বেনিডিক্ট-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত। তা ছাড়া তাঁর নীতিতে বিশ্বাসী বহু খ্রীস্টান সন্ন্যাসী (অগাস্টিনিয়ান ক্যানন গোষ্ঠী রূপে পরিচিত ) মধ্যযুগের ধর্মীয় ও সমাজ জীবনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিশ্বাসের সমাহিতি, ব্রহ্মচর্য এবং কঠোর নিয়মানুবর্তিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত সর্বস্বত্যাগী এই সন্ন্যাসীগণ ভূলোকের জীবন পরিশ্রুত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও অনন্তজীবনের জন্য প্রস্তুত করতেন। মার্সেই (Marseilles)-এর পরমধার্মিক রূপে সর্বজনশ্রদ্ধেয় জন ক্যাসিয়ান (John Cassian) অকপটে স্বীকার করেছিলেন : আমাদের পরমার্থ অনন্ত জীবন, কিন্তু সে পরম প্রাপ্তি সম্ভব হবে না যদি না ইহলোককে পরিশ্রুত করা যায়, যদি না পার্থিব সমস্ত ভোগ, সুখ, সম্মান অকাতরে পরিত্যাগ করে নির্মল করা যায় হৃদয়কে। আর এই জন্যই প্রয়োজন নির্জনতা, উপবাস ও প্রার্থনাস্নিদ্ধ জীবন, প্রেমবোধে আপ্লুত সত্তা। অনুরূপ কারণেই কৃচ্ছ্রতাসাধন এবং ধর্মগ্রন্থের গভীরে নিরন্তর অবগাহন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। পুণ্যাত্মা জন ক্যাসিয়ানের উপলব্ধির মধ্যেই পাওয়া যায় সেন্ট বেনিডিক্ট-এর বিধানের পূর্বাভাস। বেনিডিক্টও বলেছিলেন “মঠজীবনের আপাতরিক্ততাকে সাগ্রহে বরণ করে ঈশ্বর-আরাধনায় অচঞ্চল থাকা মঠবাসীর পবিত্র কর্তব্য, খ্রীষ্টের অতুলনীয় দুঃখ-বেদনার অংশীদার হওয়াই এই পথের পাথেয়। “If any one wish come after one, let him deny himself.” নববিধানের (New Testament) এই বাণী বার বার অনুগামীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সেইন্ট বেনিডিক্ট। কাথবার্ট বাটলার তাঁর ‘বেনিডিক্টাইন মনাস্টিসিজম’ (Cuthbert Butler : Benedictine Monasticism) গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘এই সম্প্রদায়, মানব হিতে নিবেদিত প্রাণ এই সমস্ত সন্ন্যাসীগণ হয়তে। ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউরোপের ধর্মীয়, সামাজিক এবং বৈষয়িক জীবনে ভাঙন রোধ করার জন্য। পরবর্তীকালে যে সমস্ত নবীনতর জাতি খ্রীষ্টান রাজ্য গড়ে তুলে ছিল তাঁদের এ রাই দীক্ষা দিয়েছেন, উদ্ধদ্বুদ্ধ করেছেন খ্রীস্টধর্মের পবিত্র আদর্শে, এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিতও করে তুলেছেন। আত্মকেন্দ্রিক মুক্তি-সাধনার পরিবর্তে একই নিয়মাবদ্ধ সন্ন্যাসী সম্প্রদায় সৃষ্টি করে, একই আদর্শে তাঁদের উদ্বোধিত করে মধ্যযুগের পবিত্র হৃদয় এই মহাপুরুষ ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে অর্থহীন, অকারণ আতিশয্য বিলুপ্ত করেছিলেন।
বেনিডিক্টের আদর্শানুযায়ী জীবনধারা : সেন্ট বেনিডিক্ট-এর আদর্শে বিশ্বাসী সন্ন্যাসীদের তিনটি পবিত্র শপথ গ্রহণ করতে হতো (Three Substantials) : নিঃশর্ত আত্মবিলোপ, দারিদ্র্য এবং ব্রহ্মচর্য। এই তিনটি ব্রত আজীবন পালনের অঙ্গীকার থেকে কাউকে মুক্ত করতে স্বয়ং পোপও অক্ষম ছিলেন। অক্ষমার্হ ছিল সামান্যতম বিচ্যুতি, শপথ ভঙ্গকারী আশ্রম থেকে বিতাড়িত হয়ে নিক্ষিপ্ত হতেন লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের ভীড়ে। নীতি এবং শৃঙ্খলার এই কঠোরতার পিছনে ছিল বিধান প্রণেতার এই দৃঢ় ধারণা যে নিঃসংশয় বিশ্বাস, নিয়মানুবর্তিতা এবং দীনতা ছাড়া তপশ্চর্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বরের বাণী পৌঁছে দেন মঠাধ্যক্ষ, সন্ন্যাসীদের কাছে তিনিই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। সুতরাং আপন স্বাধীন অভিমত ত্যাগ করে তাঁর নির্দেশ পালন ছিল মঠজীবনের সংহতি ও পবিত্রতা রক্ষার অলিখিত কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্য শর্ত। সেইন্ট বেনিডিক্ট-এর বিধানে অত্যাশ্চর্য, অলৌকিক ছিল না কিছুই, এতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ঈশ্বরচিন্তা, প্রার্থনা-আরাধনার উপর (Opus Dei)। সর্বসাধারণের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রত্যহ শতবার, এমন কি গভীর নিশীথেও, দীর্ঘকাল প্রার্থনা করা বেনিডিক্টাইন সন্ন্যাসীদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো। শারীরিক পরিশ্রমও (Opus Manuum) অবহেলিত হয়নি। কৃষিকাজ, আর্তরাণ, অসুস্থ ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত থাকতে হতো সন্ন্যাসীদের। প্রসঙ্গত এ তথ্য স্মর্তব্য যে দৈহিক-শ্রমকে তপশ্চর্যার সঙ্গে সমান প্রাধান্য দিয়ে, আশ্রমিকদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার বিধি প্রবর্তিত করে নার্সিয়ার বেনিডিক্ট শুধু যে শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন তাই নয়, সচেতন ভাবে না হলেও, উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবনব আবিষ্কার, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের পথও প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। বহু শতাব্দী পরে কৃষিকাজ এখন থেকে আর শুধু অজ্ঞ, অশিক্ষিত, নিরুৎসাহী কৃষকদের মধ্যেই আবদ্ধ রইলো না। বুদ্ধিমান, শিক্ষিত আশ্রমিকগণও এর সঙ্গে যুক্ত হলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মঠজীবনবাদ পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক জীবনে প্রগতির সূচনার জন্য কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। আশ্রমিকদের তৃতীয় কর্তব্য ছিল ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও অনুশীলন এবং ধ্যান। অবশ্য অশিক্ষিত সন্ন্যাসীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম বাধ্যতামূলক ছিল না। অতি সরল এই বিধানগুলি বিশ্লেষণ করলে এ তথ্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সন্ন্যাস জীবনের সঙ্গে মানুষের সেবা, বৈষয়িক বিষয়ের (সদর্থে) সঙ্গে বিযুক্ত না হয়েও পরমার্থ চিন্তায় নিমগ্ন থাকা, চারিপাশের আর্ত অসহায় ও অজ্ঞ মানুষ যে সহস্ৰ বন্ধন নিরন্তর তৈরী করছিল তারই মধ্যে থেকে সন্ন্যাসীদের পরম মুক্তির সন্ধানে নিযুক্ত হওয়া—এই ছিল পুণ্যাত্মা বেনিডিক্ট এর বিধানের মর্মবাণী। মর্তের ধূলি কণায় এভাবেই তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ঈশ্বরের রাজ্য। তাঁর নিয়মা বলীতে এই সুষম সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন বলেই নার্সিয়ার সন্তের এই অভূতপূর্ব সাফল্য। আধ্যাত্মিকতায়, জ্ঞানে ও বাস্তবে এক সুবিন্যস্ত জীবনের আদর্শ তিনিই সর্বপ্রথম তুলে ধরে ছিলেন ইউরোপের অগণিত বিভ্রান্ত মানুষের সামনে।
বেনিডিক্টের খ্যাতি ও পরম্পরা : সেইন্ট বেনিডিক্ট মণ্টিক্যাসিনোতে প্রতিষ্ঠিত তাঁর মঠের আশ্রমিকদের জন্যই এই নিয়মাবলী প্রণয়ন করেছিলেন কিন্তু প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের গৌরব এগুলি সঙ্গে সঙ্গে অর্জন করে নি। পোপ প্রথম গ্রেগরী বা তাঁর অনুগামী সেইন্ট অগাস্টাইন কেউই সমর্থন করেন নি বেনিডিক্ট-এর বিধান। বহু পরে, শার্লমানের রাজত্বের শেষের দিকে তা অতি দ্রুত জনপ্রিয় হতে আরম্ভ করে। ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ – এই দীর্ঘ তিন শতাব্দী সেইন্ট বেনিডিক্ট প্রণীত বিধানবলীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খ্রীস্টান জগতের সকল আশ্রমিকের জীবন নিয়ন্ত্রিত করেছিল। ১২শ শতকে বহু নতুন সন্ন্যাসীসম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটলেও তারা কেউই অগ্রাহ্য বা অতিক্রম করতে পারে নি তাঁর বিধান। ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন সিস্টারসিয়ান সম্প্রদায় কর্তৃক) সেইন্ট বেনিডিক্ট-এর আদি ও অপরিবর্তিত নিয়মাবলীই অনুসৃত হয়েছিল। এই সুদীর্ঘকালে অসংখ্য মানুষ, মহাপরাক্রান্ত নৃপতি থেকে অতি দীন সাধারণ কৃষক – সকলেই সেইন্ট বেনিডিক্ট-এর অনুগামী সন্ন্যাসীদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। সেইন্ট বেনিডিক্ট নিৰ্দ্দেশিত পন্থার অভাবনীয় সাফল্যের কারণ সম্পর্কে কার্ডিন্যাল নিউম্যান লিখেছেন : ‘প্রকৃত সন্ন্যাস জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য নির্জনতা আর হয়তো মানব সভ্যতার শৈশব অবস্থার সরল জীবনের উপর গুরুত্ব আরোপ তাঁর অবিস্মরণীয় সাফল্যের মূল। বেনিডিক্ট বুঝেছিলেন আশ্রমিকদের এমন কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে না যে প্রয়োজন মেটাবার মতো উপকরণ তাঁদের হাতের কাছে থাকবে না। আশা-নিরাশা বর্জিত, নিস্তরঙ্গ হবে তাঁদের জীবন। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে, দিনের আহার সেই দিন সংগ্রহ করে, নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে তাঁকে অতিবাহিত করতে হবে সমস্ত জীবন। যে দিনটি অতিবাহিত হলো আগামী দিনের সঙ্গে থাকবে না তার কোনও পার্থক্য। তিনি কেবল এই বিশ্বাসে স্থিত থাকবেন যে অতিক্রান্ত দিনটি তাঁর সাধনধন পরম-শান্তির দিকে তাঁকে আরও এগিয়ে দিল। মানুষের মনে ধর্ম বিশ্বাস দৃঢ়তর করে, অনন্ত জীবনের সম্ভাবনা নিশ্চিততর করে এবং তার জন্যে মানুষের আকুলতা তীক্ষ্ণতর করে, অনুতাপ ও প্রার্থনা দিয়ে পাপবোধ মুছে ফেলে সেন্ট বেনিডিক্ট দিব্য জীবনের যে ভিত্তি রচনা করেছিলেন, তাকে সবল করেছিল আশ্রমিকদের লোকহিতে-রত থাকার সংকল্প, আর্ত ও সন্তপ্তের বেদনার উপশম করার পুণ্যব্রত। সেবার উচ্চ আদর্শকে আপন আচরণে উদ্ভাবিত করার মধ্য দিয়ে যুগের একটি প্রয়োজনও সিদ্ধ করেছিলেন বেনিডিক্ট-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত আশ্রমিকগণ।
শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চায় ভূমিকা : ক্রমশ সফল এই সম্প্রদায়ের কর্ম-পরিধি বিস্তৃততর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রকৃতিও বদলাতে আরম্ভ করে। ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করার বাসনায়, ক্রমবর্ধমান সন্ন্যাসীদের আবাস নির্মাণের জন্য ভক্তদের আনুকূল্যে নির্মিত হতে শুরু করল সুদৃশ্য ক্যাথিড্রাল, প্রাসাদোপম মঠগৃহ। স্বাভাবিকভাবেই স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সংযোজনে সমৃদ্ধতর এবং শ্রীমণ্ডিত হয়ে উঠল এই সব অট্টালিকা। অবশ্য দৈনন্দিন কার্যতালিকাভুক্ত হওয়ায় ধর্মগ্রন্থাদি পঠন পাঠন, পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও সংরক্ষণ, প্রার্থনা ও সঙ্গীত চর্চা সযত্নে এবং ঐকান্তিকতায় আগের মতোই সম্পন্ন হতে থাকে। আর এভাবেই নিভৃতে ধর্মানুশীলনের ব্রতে দীক্ষিত সন্ন্যাসীবৃন্দের অবদানে ইউরোপীর শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণ-প্রবাহ অব্যাহত ছিল। Bede এর কালের নর্দাম্ব্রিয়া, শার্লমানের শাসনাধীন ফ্রাঙ্কিয়া (Francia) সহ সমস্ত লাতিন খ্রীষ্টান জগতে বেনিডিক্টাইন মঠগুলি আধ্যাত্মিকতা ও শিক্ষা সংস্কৃতির সজীব ও সৃষ্টিশীল কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অগাস্টাইন এবং অ্যাকুইনাসের মধ্যবর্তীকালে পাণ্ডিত্যে, বিশুদ্ধ সংস্কৃতি-চর্চায় সবচেয়ে উজ্জ্বল দুই মনীষী—বিড্ এবং অ্যানসেল্ম ছিলেন বেনিডিক্ট-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত। এদের সমতুল্য না হলেও অসংখ্য খ্যাত, স্বল্পখ্যাত খ্রীষ্টান সন্ন্যাসীর নিরলস সাধনায় বাইবেল, আদি-আচার্যগণের রচনার নির্ভুল পাণ্ডুলিপিগুলিই শুধু অনাগতকালের জন্য সংরক্ষিত হয়নি, ইউরোপীয় দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, আইন এবং গণিত শাস্ত্র ও মৌলিক রচনায় সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। ধর্মানুশীলনকে বিদ্যাচর্চার থেকে পৃথক রাখার অপচেষ্টা মঠবাসী সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রায় কখনোই দেখা যায় নি। নর্মান্ডির প্রখ্যাত সংস্কৃতি কেন্দ্র বেক (Bec)-এর অ্যাবট হারলুইন (Herluin) ১৩শ শতকের মধ্যভাগে ঘোষণা করেছিলেন ‘of what use is a man who is ignorant of letters and of the commandments. of God?’ বিদ্যাচর্চার কেন্দ্ররূপে বেক-এর খ্যাতি এমনি বিস্তার লাভ করে যে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্যার্থীগণ এখানে এসে ভীড় করতেন। প্রথমে ল্যানফ্রাঙ্ক (Lanfranc ), পরে আনূসেল্ম (Anselm) বেক্-এ শিক্ষক রূপে অতুলনীয় খ্যাতির অধিকারী হন। এ তথ্য স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে ডোমিনিকান (Dominican) সন্ন্যাসীদের মতো বেনিডিক্টাইন সম্প্রদায় ভুক্তগণও বিদ্যাবত্তায় উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ধর্মানুশীলনের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ তাঁরাও আবশ্যিক বলে মনে করতেন। ফলে শিক্ষা সংস্কৃতির ধারাটি কখনো আধ্যাত্মিকতার বিশুষ্ক আবহাওয়ায় শুকিয়ে যায় নি। সে কালের বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ সাগ্রহে সংযুক্ত হতেন খ্যাত অখ্যাত এই সব মঠের সঙ্গে।
রাজকার্যে পরামর্শদাতা ও সামাজিক কাজে সন্ন্যাসীদের অংশগ্রহণ : সাংসারিক বন্ধন ত্যাগ মঠজীবনবাদের প্রাথমিক শর্ত হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের অহরহ প্রয়োজন হতো এই সব বিদগ্ধ মানুষদের। এরাও দেশ ও দশের প্রয়োজনের প্রতি উদাসীন থাকতে পারতেন না। সে কারণে বেনিডিক্টীয় সন্ন্যাসীদের বহু ক্ষেত্রেই দেখা যেতো রাজকার্যে পরামর্শদাতার ভূমিকায়। চার্চ সংস্কার করার সঙ্গে সঙ্গে এরা বহু সামাজিক কাজেও আত্মনিয়োগ করতেন। ডান্স্টান, ল্যান্ফ্রাঙ্ক, আনুসেল্ল্ম ( এরা প্রত্যোকই ক্যান্টারবেরীর আর্চবিশপের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন ) এবং ক্লুনির বহু অ্যাবট পশ্চিম ইউরোপের সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন। ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রীষ্টাব্দ—এই তিনশো বছরে খ্রীস্টান সন্ন্যাসী বলতে সেইন্ট বেনিডিক্ট-এর শিষ্যদেরই বোঝাতো। ইউরোপীয় সভ্যতার এক তমসাবৃত ও সঙ্কটময় মুহূর্তে এই মঠগুলি ছিল কল্যাণ ও শুভ প্রচেষ্টার প্রতীক, বিভ্রান্ত মানুষের আশা-ভরসার কেন্দ্র। নবাগত দুদ্ধর্ষ বিধর্মীদের খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত করা, লাতিন সভ্যতার দীপ্তিতে তাঁদের স্থূল জীবন আলোকিত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজে মধ্যযুগের প্রথমার্ধের এই সন্ন্যাসীদের অবদান তুলনারহিত। তা ছাড়া পূত চরিত্র এই সন্ন্যাসীদের প্রয়াস শুধু অধর্ম ও অজ্ঞানতা জয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। ঊষরতা, অনুর্বরতার বিরুদ্ধেও তাঁদের কর্মোদ্যোগ পরিচালিত হয়েছিল। যে সমস্ত অঞ্চলে তাঁদের আশ্রম গড়ে উঠছিল সেখানে শস্য উৎপাদনে সহায়তা করতেন আশ্রমিকগণ কেন না দৈহিক্ শ্রম, নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা ছিল বেনিডিক্ট্রীয় সন্ন্যাসীদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। মঠের নীতি ও প্রয়োজন এভাবেই মরু বিজয়ের কেতন উড়িয়ে ইউরোপের অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়তা করেছিল।
সন্ন্যাসীদের ওপর সামন্ততন্ত্র ও আঞ্চলিক শাসনের প্রভাব, অর্থ-ক্ষমতা লাভ, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ : ক্রমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে পরমশ্রদ্ধেয় এই সন্ন্যাসীদের উদ্যমের জন্য কৃতজ্ঞ মানুষের দানে ভরে উঠেছিল মঠগুলি। যে বৈভব ও বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা ত্যাগ করে মঠবাসীর সন্ন্যাসজীবন শুরু হতো তা-ই অযাচিতভাবে, অবিরল ধারায় তাঁদের জীবনে আসতে শুরু করেছিল। মাত্রাতিরিক্ত দানে উচ্ছ্বলিত হয়ে উঠল দীন আশ্রমগুলি। শুধু বিশাল ভূসম্পত্তি নয় তার সঙ্গে বিচিত্র পাথিব দায়দায়িত্বে আকীর্ণ হয়ে উঠল আশ্রমিকদের শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন। ইতিমধ্যেই ইউরোপের মাটিতে সামন্ততন্ত্র স্পষ্ট আকার নিয়েছিল, ফলে মঠগুলিকে উৎসর্গ করা এই সমস্ত ভূসম্পত্তির অধিকাংশই সামন্ততান্ত্রিক বিধি অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করল। জমির পরিবর্তে সেবার (service) শর্তে ক্রমবর্ধমান এই ভূসম্পত্তি সামন্তবর্গের মধ্যে বণ্টিত হওয়ায় মঠের পরিচালকবর্গকে ঊর্ধ্বতন প্রভুর (overlord) সামরিক প্রয়োজনে সাহায্য দানেও বাধ্য হতে হলো। গীর্জার উপাসনা ও প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে যোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলায় ও আঞ্চলিক শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব পালনে বাধ্য হলেন একদা-সংসার বিমুখ সন্ন্যাসীবৃন্দ। ক্রমশ নতুনতর দায়িত্বে ভারাক্রান্ত হতে শুরু করল সদাচারী আশ্রমিকের সরল জীবন। তাদের বিদ্যাবত্তা, তাঁরা যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেগুলির খ্যাতি তাঁদের বিশেষভাবে নিয়োজিত করতে লাগল শাসন বিভাগের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে। সমসাময়িককালের রাজতন্ত্র ইহলোক এবং পরলোক – উভয় বিষয়ের দারিত্ব বহন করায় এই ধরনের নিয়োগ অতি ব্যাপক হয়ে উঠল। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীরাও রাজপ্রতিনিধিরূপে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। আবার, মঠগুলি পূতচরিত্রের খ্রীস্ট-ভক্তদের স্মৃতি জড়িত হওয়ায় অ্যাবটগণ অথবা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা এগুলির আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না। সমস্ত লাতিন খ্রীস্টান রাজ্যে বেনিডিক্টীর মঠগুলি এভাবে, অতি অল্প কালের মধ্যে প্রভূত বিত্ত, ক্ষমতা এবং স্বায়ত্তশাসনের উৎসে পরিণত হয়েছিল। সমাজের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করে যাদের সৃষ্টি তারা সমাজের অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রূপান্তরিত হলো। মণ্টিক্যাসিনোর মঠে সেন্ট বেনিডিক্টকে কেন্দ্র করে যে অনাড়ম্বর, সহজ-সরল ধর্মীয় জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল তার থেকে বহুদূরে সরে এসেছিলেন ১১শ শতকের এই আশ্রমিকগণ। পিছনে ফেলে আসা নির্ভার নিষ্পাপ জীবনের পুনরুদ্ধার আর সম্ভব ছিল না যদিও বেনিডিকটএর বিধানের আক্ষরিক অমর্যাদার দোষে দুষ্ট ছিলেন না তারা। হয়তো এই কারণে একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বৈভব ও পার্থিব শক্তির সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ সন্ন্যাস জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়৷ স্বরূপ এবং মঠজীবনবাদের আদর্শ নতুন করে প্রতিষ্ঠার জন্য বহু নতুন খ্রীস্টান সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল। নতুন এইসব সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলি একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্দেশে পরিচালিত হতো, সেইন্ট বেনিডিক্টের আদর্শে বিশ্বাসী মঠগুলির মতো এই আশ্রমগুলি স্বয়ম্ভর ছিল না। ক্লুনির প্রখ্যাত মঠ ও তার শাখা-প্রশাখাগুলো ছাড়া নতুন এই প্রতিষ্ঠানগুলি প্রেরণা এবং আদর্শের জন্য সেন্ট বেনিডিক্টের শরণাপন্ন হলেও দৃঢ়তর গঠনতান্ত্রিকতার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিল। কালক্রমে বেনিডিক্টীয় মঠগুলিও এই প্রভাব অতিক্রম করতে না পেরে, স্বাতন্ত্র এবং বিশিষ্টতা বিসর্জন দিয়ে মধ্যযুগের অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অন্যতমে পরিণত হয়েছিল। মণ্টি ক্যাসিনোতে সেইন্ট বেনিডিক্ট-দৃষ্টান্তিত শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ আশ্রম-জীবন ক্রমশ ধূসর হয়ে আসা স্মৃতিতে রূপান্তরিত হলো।
তথ্যসূত্র
- মধ্যযুগের ইউরোপ, প্রথম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক, কলকাতা, ১৯৮৪
Leave a Reply