৫৩৫-৩৬ সালের এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্ট ও লেইট অ্যান্টিক লিটল আইস এইজ

লেইট অ্যান্টিক লিটল আইস এইজ

লেইট অ্যান্টিক লিটল আইস এইজ (Late Antique Little Ice Age বা LALIA) ছিল খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের একটি কুলিং পিরিয়ড বা শীতল কাল, যা লেট এন্টিকুইটি নামে পরিচিত ছিল। ৫৩৫-৫৩৬ এর চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি ছিল শতাব্দীব্যাপী বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা হ্রাসের প্রাথমিক ঘটনা। একটি গবেষণায় বলা হয়, এই সময়ে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) হ্রাস পেয়েছিল। ২০১৫ সালেই একটি তত্ত্ব হিসাবে একটি শীতল কালের অস্তিত্ব প্রস্তাব করা হয় এবং পরবর্তীতে এই শীতলকালকে ৫৩৬ থেকে প্রায় ৬৬০ খ্রিস্টাব্দের সময়কাল হিসাবে নিশ্চিত করা হয়।

বেলফাস্টের কুইনস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেনড্রোক্রোনোলজিস্ট মাইক বেইলির ট্রি রিং বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে ৫৩৬ সালে আইরিশ ওক এর মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে সামান্য বৃদ্ধি এবং একটি আংশিক পুনরুদ্ধারের পরে ৫৪২ সালে আরেকটি তীক্ষ্ণ ড্রপ হয়েছিল। গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকার আইস কোরগুলি প্রায় ৫৩৪±২ সালে যথেষ্ট পরিমাণে সালফেট জমার প্রমাণ দেখায়, যা একটি বিস্তৃত অ্যাসিডিক ধূলিকণার পর্দার প্রমাণ। অর্থাৎ কোন কারণে সেই সময় বায়ুমণ্ডল এসিডিক ধূলিকণায় ছেয়ে গিয়েছিল, যার অন্যতম সম্ভাব্য উৎস হচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। আন্তর্জাতিক PAGES (Past Global Changes) নামক প্রোজেক্ট এর Euro-Med2k ওয়ার্কিং গ্রুপ আলতাই পর্বতমালার ট্রি রিং মেজারমেন্ট নিয়ে একটি টেম্পারেচার রিকনস্ট্রাকশনের কাজ করেছে, যা গত দুই শতকে আল্পসের তাপমাত্রার সাথে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখায়। এই টেম্পারেচার রিকনস্ট্রাকশন থেকে এই বিষয়ে আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।

ঐতিহাসিক বিবরণে এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্টের বর্ণনা

শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো নয়, ঐতিহাসিক বিবরণগুলোতেও এই সময়ে শৈত্যের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিক বিবরণগুলোতে দেখা যায় ৫৩৫-৩৬ সালের চরম আবহাওয়া ঘটনা বা এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্টের ভয়াবহতা –

  • ১। প্রোকোপিয়াসের বর্ণনা : বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিক প্রোকোপিয়াস (Procopius) ৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ভান্ডালদের বিরুদ্ধে রোমানদের যুদ্ধের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি সেক্ষেত্রে লেখেন, “এই বছরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। এই বছরে সূর্য কোন আলো ছাড়াই কীরণ দেয়… এবং একে দেখে গ্রহণ লাগা সূর্য বলে মনে হয়, আর সূর্যের আলোও স্পষ্ট ছিলনা।” ৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে রোমান স্টেটসম্যান ক্যাসিওডোরাস (Cassiodorus) তার একজন অধস্তন ব্যক্তির কাছে ২৫ নং চিঠিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বর্ণনা করেন :
    • ১। সূর্যের রশ্মি দুর্বল ছিল, এবং এটি একটি “নীলাভ” রঙ প্রদর্শন করছিল।
    • ২। দুপুরের দিকে, মানুষের কোনও ছায়া মাটিতে দেখা যায়নি।
    • ৩। সূর্যের তাপ কম ছিল।
    • ৪। চাঁদ, এমনকি যখন পূর্ণচন্দ্র ছিল, “সৌন্দর্যহীন”
    • ৫। “ঝড় ছাড়া শীতকাল, মৃদুতা ছাড়া বসন্ত, এবং তাপ ছাড়া গ্রীষ্ম”
    • ৬। দীর্ঘস্থায়ী তুষারপাত এবং অনিয়মিত খরা
    • ৭। ঋতুগুলি “মনে হচ্ছে সব একসাথে জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে”
    • ৮। আকাশকে “অজানা উপাদানগুলির সাথে মিশ্রিত” হিসাবে বর্ণনা করা হয়, ঠিক মেঘলা আবহাওয়ার মতোই, কিন্তু এটি ছিল দীর্ঘস্থায়ী। এটি এতটাই প্রসারিত ছিল যে গোটা আকাশই “এর পেছনে লুকিয়ে পড়ে” এবং এটি সূর্যের উষ্ণতা ও সাথে সূর্য ও চাঁদের “সত্যিকারের রঙ”-কে আড়াল করে দেয়।
    • ৯। ফসল কাটার সময় ফ্রস্ট দেখা যায়, যা আপেলকে শক্ত করে তোলে এবং আঙ্গুরকে টক করে তোলে।
    • ১০। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য সঞ্চিত খাবার ব্যবহার করা প্রয়োজন।

পরবর্তী চিঠিগুলিতে (নং ২৬ এবং ২৭) ব্যাপক দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

  • ২। মাইকেল দ্য সিরিয়ানের বর্ণনা : সিরিয়াক অর্থোডক্স চার্চের একজন পেট্রিয়ার্ক মাইকেল দ্য সিরিয়ান (১১২৬-১১৯৯) রেকর্ড করেছেন যে ৫৩৬-৫৩৭ সালের মধ্যে সূর্য দেড় বছর ধরে দুর্বলভাবে আলো দিয়েছিল।
  • ৩। গ্যালিক আইরিশ অ্যানালস : গ্যালিক আইরিশ অ্যানালসে (Gaelic Irish Annals) নিম্নলিখিতগুলি রেকর্ড দেখা যায় :
    • “৫৩৬ সালে ব্রিডিং বা প্রজননে ব্যর্থতা” – উলস্টারের অ্যানালস
    • “৫৩৬-৫৩৯ সাল থেকে প্রজননে ব্যর্থতা” – ইনিসফলেনের অ্যানালস
  • ৪। অ্যানালেস ক্যাম্ব্রি : ১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দের অ্যানালেস ক্যাম্ব্রি (Annales Cambriae) রেকর্ডে দেখা যায়, তখন ক্যামলানের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে আর্থার ও মেদ্রাউটের পতন ঘটে এবং ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডে ব্যাপক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
  • ৫। স্বাধীন উৎস : বেশ কয়েকটি স্বাধীন সমসাময়িক উৎস দ্বারা আরও ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে :
    • নিম্ন তাপমাত্রা, এমনকি গ্রীষ্মকালে তুষারপাত (চীনে আগস্টে তুষারপাত হয়েছিল বলে জানা গেছে, যার ফলে সেখানে ফসল কাটতে দেরি হয়েছিল)
    • ব্যাপক ফসল ফলনে ব্যর্থতা
    • মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও ইউরোপে ‘ঘন, শুষ্ক কুয়াশা’
    • পেরুতে খরা, যা মোচে (Moche) সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল

এই সময়ের সাথে সম্পর্কিত সাক্ষ্য-প্রমাণের অন্যান্য উৎসও রয়েছে। মধ্যযুগীয় পণ্ডিত মাইকেল ম্যাককর্মিক লেখেন, “এটি (৫৩৬ সাল) যদি সবচেয়ে খারাপ বছর নাও হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে এটি ছিল বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে খারাপ বছর।”

৫৩৫-৩৬ সালের এক্সট্রিম ওয়েদার এফেক্টের কারণ 

এটি অনুমান করা হয়েছে যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পরে আগ্নেয়গিরিজাত শীতকাল বা ভলকানিক উইন্টার নামে পরিচিত একটি ঘটনার ফলে এই পরিবর্তনগুলো ঘটে বা ধূমকেতু বা উল্কাপিণ্ডের প্রভাবের পরে বাতাসে নিক্ষেপ করা ছাই বা ধূলিকণার কারণে এই পরিবর্তনগুলি ঘটে। অর্থাৎ ৫৩৬ সাল এবং তৎপরবর্তী জলবায়ুর শীতল হয়ে যাবার কারণ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে মোট ৩টি কারণকে – (১) ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানা উল্কাপিণ্ড বা মেটিওরাইট, (২) ধূমকেতুর টুকরোসমূহের উপরের দিকের বায়ুমণ্ডল বা আপার অ্যাটমস্ফিয়ারে বিস্ফোরণ, ও (৩) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ভলকানিক উইন্টার বা আগ্নেয়গিরিজাত শীতকাল।

  • (১) ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানা উল্কাপিণ্ড বা মেটিওরাইট : এটি একটি প্রস্তাবিত কারণ বটে, কিন্তু এখানে একটি সমস্যা হল যে, ল্যান্ড এরিয়া বা সি-বেডে অনুসন্ধানের পরও এই সময়ে পৃথিবীতে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে যে ক্র্যাটার বা গর্তের সৃষ্টি হয় তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, যদিও এমনকি স্থল এলাকা এবং সমুদ্রের বিছানাগুলিও প্রমাণের জন্য ভালভাবে জরিপ করা হয়েছে।
  • (২) ধূমকেতুর টুকরোসমূহের উপরের দিকের বায়ুমণ্ডল বা আপার অ্যাটমস্ফিয়ারে বিস্ফোরণ : কোন ধূমকেতুর অর্ধ কিলোমিটারের টুকরো বায়ুমণ্ডলে বিষ্ফোরিত হয়ে এর যে ধ্বংসাবশেষগুলো তৈরি হয় তা পৃথিবীতে সেগুলোর একটি প্লিউম তৈরি হতে পারে, এবং বায়ুমণ্ডলীয় শীতলতার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ২০০৯ সালে, নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজার্ভেটরির ডালাস অ্যাবট গ্রিনল্যান্ডের বরফের কোর থেকে কিছু প্রমাণ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, ধূমকেতুর একাধিক আঘাতের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে সেই কুয়াশার ন্যায় অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে (যা সূর্যের আলোকে ক্ষীণ করে দিয়েছিল)। বরফের মধ্যে পাওয়া স্ফেরিউল বা ক্ষুদ্র গোলকগুলো কোনও ধূমকেতুর আঘাতের ফলে বায়ুমণ্ডলে বের হওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ভূত হতে পারে।
  • (৩) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ভলকানিক উইন্টার বা আগ্নেয়গিরিজাত শীতকাল : তবে এই সময়কালটি ৫৩৫/৫৩৬, ৫৩৯/৫৪০ এবং ৫৪৭ সালের তিনটি বড় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সাথে মিলে যায়। বেশিরভাগ সাক্ষ্যপ্রমাণ, ৫৩৬, ৫৪০ এবং সম্ভবত ৫৪৭ সালে ঘটা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের দিকে ইঙ্গিত করে, যদিও আগ্নেয়গিরিগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করা হয়নি। বরফ কোরে সালফেট জমার প্রমাণ দৃঢ়ভাবে আগ্নেয়গিরি হাইপোথিসিসকে সমর্থন করে; ৫৩৬ সালের সেই সালফেট স্পাইকটি ১৮১৬ সালের জলবায়ু বিচ্যুতির সালফেট স্পাইকটির চেয়েও তীব্র, ১৮১৬ সাল জনপ্রিয়ভাবে “গ্রীষ্মছাড়া বছর” (“Year Without a Summer”) নামে পরিচিত, যা সুম্বাওয়ার (Sumbawa) আগ্নেয়গিরি মাউন্ট তাম্বোরার (Mount Tambora) অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ঘটে। অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে পাপুয়া নিউগিনির তাভুরভুর (Tavurvur) বা রাবাউল (Rabaul), এল সালভাদরের ইলোপাঙ্গো (Ilopango) এবং ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকাতাউয়ের (Krakatau) মতো স্থানগুলিকে প্রস্তাব করা হয়েছে।

অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাব্য উৎস

  • ১। তাভুরভুর বা রাবাউল : ১৯৮৪ সালে, আর.বি. স্টোথার্স অনুমান করেছিলেন যে পাপুয়া নিউগিনির বর্তমান নিউ ব্রিটেনের আগ্নেয়গিরি রাবাউলের কারণে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
  • ২। ক্রাকাতোয়া : ১৯৯৯ সালে, ডেভিড কিজ পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরি সেই সময়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল এবং সেই কারণেই এই পরিবর্তনগুলো ঘটে। জাভানিজ বুক অফ কিংস বলছে, ৪১৬ সালে ক্রাকাতোয়ায় অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল, কিন্তু প্রস্তাব করা হয় যে, সেই অগ্ন্যুৎপাত আসলে ৫৩৫-৫৩৬ সালে সংঘটিত হয়েছিল, ৪১৬ সালে এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের অন্য কোনও প্রমাণ নেই।
  • ৩। ইলোপাঙ্গো : ২০১০ সালে, রবার্ট ডুল, জন সাউথন এবং সহকর্মীরা মধ্য এল সালভাদরের ইলোপাঙ্গো আগ্নেয়গিরির টিয়ারা ব্ল্যাঙ্কা জোভেন (TBJ) অগ্ন্যুৎপাত এবং ৫৩৬ ইভেন্টের মধ্যে একটি সম্পর্কের প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন। যদিও পূর্বে প্রকাশিত রেডিওকার্বন প্রমাণগুলি অগ্ন্যুৎপাতটি ঘটার সময়ের ৪০৮ থেকে ৫৩৬ সালের পরিসীমা প্রস্তাব করে (যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু মন্দার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ), ৫৩৬ সাল এবং ইলোপাঙ্গোর মধ্যে সংযোগটি ততক্ষণ পর্যন্ত স্পষ্টভাবে তৈরি করা যায়নি যতক্ষণ না স্টেফেন কুটারলফ এবং তার সহকর্মীরা মধ্য আমেরিকান প্যাসিফিক মার্জিন সামুদ্রিক সেডিমেন্ট কোরগুলির উপর গবেষণা করে দেখেন, ফ্রেটোপ্লিনিয়ান টি.বি.জে. অগ্ন্যুৎপাতটি পূর্বে যতটুকু বিশাল ছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল তারচেয়ে অনেক বড় ছিল। অ্যাক্সিলারেটর মাস স্পেকট্রোমেট্রি ব্যবহার করে বিস্তারিতভাবে পরিমাপ করা হয় যে, একটি টি.বি.জে. পাইরোক্লাস্টিক ফ্লো বা টি.বি.জে. এর অগ্ন্যুৎপাতের কারণে একটি একটি একক বৃক্ষের ধারাবাহিক বৃদ্ধি বা গ্রোথ ইনক্রিমেন্ট (ডিওএক্টিভ কার্বন-১৪ দ্বারা চিহ্নিত) বন্ধ হয়ে যায়, অর্থাৎ বৃক্ষটি মারা যায়। ট্রি রিং ভিত্তিক এই পরিমাপের ফলটি নির্দেষ করে যে বৃক্ষটি ৫৩৬ সালে মারা গিয়েছিল, অর্থাৎ ৫৩৬ সালেই অগ্ন্যুৎপাতটি ঘটেছিল। এই টি.বি.জে. ঘটনাটির টেফরা ভলিউম রক্ষণশীলভাবেও গণনা করে দাঁড়ায় প্রায় ৮৪ ঘনকিলোমিটার, যা ৬+ ইভেন্ট এবং ৬.৯ এর মাত্রার একটি বিশাল ভলকানিক ইভেন্টকে নির্দেশ করে। ফলাফলগুলি পরামর্শ দেয় যে ইলোপাঙ্গো টি.বি.জে. অগ্ন্যুৎপাতের আকার, অক্ষাংশ এবং বয়স লারসেন এট আলের বরফ কোর সালফেট রেকর্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরবর্তী গবেষণায় প্রস্তাব করা হয় যে, এই অগ্ন্যুৎপাত ৫৩৯/৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ঘটেছিল। কিন্তু অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আরও সম্প্রতি হওয়া একটি গবেষণা বলছে, অগ্ন্যুৎপাতটি ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়। তাই ব্যাপারটা এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই অগ্ন্যুৎপাত (অবস্থান যাই হোক না কেন) ১৮১৫ সালে তাম্বোরা পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতের চেয়ে বায়ুমণ্ডলে অধিক পরিমাণে অ্যারোসল ছড়িয়ে দিয়েছিল। ১৮১৫ সালের তাম্বোরা অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সেই বছরে কোন গ্রীষ্মকাল আসেনি, তাহলে অগ্ন্যুৎপাতটি যখন ঘটে তখন তার ফলে ১৮১৫ সালের ঘটনার চেয়েও বেশি শৈত্যের সৃষ্টি করে তা ধরে নেয়া যায়।
  • ৪। উত্তর আমেরিকার আগ্নেয়গিরিসমূহ : ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় “৫৩৫ বা ৫৩৬ সালের প্রথম দিকে” একটি বড় অগ্ন্যুৎপাতের তত্ত্বকে সমর্থন করে। আর সেক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকার আগ্নেয়গিরিগুলিকে অগ্ন্যুৎপাতটির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করা হয়। এটি ৫৩৯-৫৪০ সালে দ্বিতীয় অগ্ন্যুৎপাতের সংকেতগুলিকেও চিহ্নিত করেছিল, যা সম্ভবত ক্রান্তীয় অঞ্চলে ঘটেছিল, যার ফলে প্রায় ৫৫০ পর্যন্ত কুলিং এফেক্ট বা শৈত্য প্রবাহ বজায় ছিল।
  • ৫। আইসল্যান্ডে আগ্নেয়গিরি : ২০১৮ সালে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রকাশ করেছিলেন যে, সুইজারল্যান্ডের হিমবাহ বা গ্লেশিয়ার থেকে প্রাপ্ত বরফের কোর নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এবং এরপর সেই কোরের গ্লাস পার্টিকেলগুলোর সাথে আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির শিলাগুলির সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। এর ফলে ৫৩৬ সালের অগ্ন্যুৎপাতের জন্য আইসল্যান্ড হয়ে উঠেছে একটি সম্ভাব্য অঞ্চল। এই অগ্ন্যুৎপাতটি ঘটেছিল ৫৩৬ সালের প্রথম দিকে। যাইহোক, গবেষণার লেখক বিজ্ঞান ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন যে এই ঘটনাটির প্রমাণগুলো উত্তর আমেরিকার হাইপোথিসিসটি বাতিল করার জন্য যথেষ্ট নয়।
  • ৬। অজানা অগ্ন্যুৎপাত : ৫৪৭ সালে আরেকটি অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল, যার অবস্থান অজানা।

ক্রাকাতোয়া, ইলোপাঙ্গো ও রাবাউল ক্যাল্ডেরার বিস্তারিত

ক্রাকাতোয়া ক্যাল্ডেরা

একটি গুরুতর অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আগ্নেয়গিরির মুখ ভেঙ্গে গিয়ে কোন বিশাল ভলকানিক ক্র্যাটার তৈরি করলে তাকে ক্যাল্ডেরা বলে। ক্রাকাতোয়া (Krakatoa) বা ক্রাকাতাউ হলো ইন্দোনেশিয়ার ল্যাম্পুং (Lampung) প্রদেশের জাভা এবং সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সুন্দা প্রণালীতে অবস্থিত একটি ক্যালডেরা। এই ক্যালডেরাটি চারটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত আগ্নেয়গিরি-দ্বীপগোষ্ঠী বা ভলকানিক আইল্যান্ড গ্রুপের (ক্রাকাতোয়া দ্বীপপুঞ্জ) একটি অংশ। লাভার অগ্ন্যুৎপাত, টেফরা, পাইরোক্লাস্টিক ফ্লো, লাহার ও সম্পর্কিত ভলকানিক ডেপোজিটগুলো নিয়ে আগ্নেয়গিরির প্রধান অংশটিকে বলা হয় ভলকানিক এডিফিস। ক্রাকাতোয়া দ্বীপপুঞ্জের চারটি দ্বীপের মধ্যে ল্যাং (Lang) এবং ভার্লাটেন (Verlaten) একটি পূর্ববর্তী ভলকানিক এডিফিসের অবশিষ্টাংশ যা ১৮৮৩ সালের বিখ্যাত অগ্ন্যুৎপাতের অনেক পূর্বের কোন অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। আরেকটি দ্বীপ হচ্ছে রাকাতা (Rakata)। এটি হচ্ছে তুলনামূলকভাবে একটি বিশাল দ্বীপের অবশিষ্টাংশ যা ১৮৮৩ সালের অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। চতুর্থ দ্বীপটি হচ্ছে আনাক ক্রাকাতাউ (Anak Krakatau)। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে “ক্রাকাতাউ এর সন্তান”। এর এই নামটি দেয়া হয়েছে কারণ ১৮৮৩ সালে যে ক্যাল্ডেরাটির সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকে ১৯২৭ সালে এই দ্বীপটির জন্ম হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে এখানে নতুন অগ্ন্যুৎপাতের ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়। এই নতুন অগ্ন্যুৎপাতগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল ভাঙ্গন, যার ফলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি মারাত্মক সুনামি ঘটে।

প্রাগিতিহাসের কোন এক সময়ে ক্যাল্ডেরা গঠনের মত একটি অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল, যার ফলে ভার্লেটান, ল্যাং, পুলশে হোয়েড (Poolsche Hoed) এর অবশিষ্টাংশ ও রাকাতার ভিত্তি গঠিত হয়। পরবর্তীতে পারবোয়েওয়াতান (Perboewatan) ও দানান (Danan) নামে অন্তত আরও দুটো কোন বা শঙ্কু গঠিত হয়, এবং এগুলো একসময়ে রাকাতার সাথে যুক্ত হয়ে ক্রাকাতোয়ার প্রধান দ্বীপটি গঠন করে। ১৮৮৩ সালের অগ্ন্যুৎপাতের সময় দেখা যায়, ক্রাকাতোয়া গ্রুপটি ল্যাং, ভার্লাটেন এবং ৯ কি.মি দ্বৈর্ঘ ও ৫ কি.মি. প্রস্থের ক্রাকাতোয়া দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এছাড়াও এখানে ছোট ছোট কিছু দ্বীপও আছে। ক্রাকাতোয়া দ্বীপে তিনটি ভলকানিক কোন বা আগ্নেয়গিরি-শঙ্কু আছে – দক্ষিণে রাকাতা, মধ্যাঞ্চলে দানান ও উত্তরে পারবোয়েওয়াতান।

পুস্তক রাজা (Pustaka Raja) নামে জাভার রাজাদের নিয়ে একটি গ্রন্থ আছে, যা ইংরেজিতে দ্য জাভানিজ বুক অফ কিংস (The Javanese Book of Kings) নামে পরিচিত। গ্রন্থটির ৩৩৮ শকাব্দ, অর্থাৎ ৪১৬ খ্রিস্টাব্দের একটি বিবরণ বলছে, “বাতুওয়ারা (Batuwara) পর্বত থেকে একটি বজ্রপাতের শব্দ শোনা গিয়েছিল, যার একইরকম প্রত্যুত্তর এসেছিল বান্টামের পশ্চিমে অবস্থিত কাপি (Kapi) থেকে। (বাতুওয়ারা পর্বত হচ্ছে সুন্দা প্রণালীর নিকট অবস্থিত বান্টামের (Bantam) একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি যা বর্তমানে পুলোসারি (Pulosari) নামে পরিচিত। আর বান্টাম বা বান্টেন হলো জাভার পশ্চিমতম প্রদেশ, তাই এটি ইঙ্গিত দেয় যে ক্রাকাতোয়া বোঝানো হয়েছে।) এক বিশাল জ্বলন্ত আগুন আকাশ অব্দি পৌঁছে যায়, আর তা কাপি পর্বত থেকে বেরিয়ে আসে। সমগ্র বিশ্ব ব্যাপকভাবে কেঁপে উঠেছিল, সহিংস বজ্রপাত হচ্ছিল, সেই সাথে ভারী বৃষ্টিপাত ও ঝড় হচ্ছিল। কিন্তু এই ভারী বৃষ্টিপাত কাপি পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতের আগুনকে তো নেভালই না, বরং আগুনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। শব্দটা ছিল ভয়ংকর, শেষ পর্যন্ত কাপি পর্বতটি একটি প্রচন্ড গর্জনের সাথে টুকরো টুকরো হয়ে পৃথিবীর গভীরতম অঞ্চলে ডুবে যায়। সমুদ্রের জল উত্থিত হয় এবং ভূমিকে প্লাবিত করে, বাতুওয়ারা পর্বতের পূর্ব দিকের অঞ্চল পর্যন্ত, রাজাবাসা পর্বত (সুমাত্রার সবচেয়ে দক্ষিণ আগ্নেয়গিরি) পর্যন্ত এলাকা সমুদ্র দ্বারা প্লাবিত হয়ে যায়; সুন্দা অঞ্চলের উত্তরাংশ থেকে রাজাবাসা পর্বত পর্যন্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা ডুবে যায় এবং তাদের সমস্ত সম্পদ নিয়ে ভেসে যায়।… জল কমে যায়, কিন্তু কাপি যে ভূমিতে দাঁড়িয়েছিলো তা সমুদ্রে পরিণত হয় এবং জাভা এবং সুমাত্রা দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।”

৪১৬ খ্রিস্টাব্দে ঘটেছিল এমন এই আকারের ক্রাকাতোয়া অগ্ন্যুৎপাতের কোনও ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই; এই বর্ণনাটি সেই ভূমির হারানোকে বর্ণনা দিতে পারে যা পূর্বে সুন্দা প্রণালীর সংকীর্ণ পূর্ব প্রান্ত জুড়ে সুমাত্রার সাথে জাভাকে যুক্ত করেছিল। অথবা হতে পারে এখানে উল্লিখিত তারিখটি ভুল, হতে পারে এটি ৪১৬ সালের কোন ঘটনাকে নয় বরং পরবর্তীতে ক্রাকাতোয়ায় ঘটা ৫৩৫ সালের অগ্ন্যুৎপাতের বর্ণনা দিচ্ছে, যার জন্য কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।

ডেভিড কিজ, কেন ওহলেটজ (Ken Wohletz) এবং অন্যেরা অনুমান করেছেন যে ৫৩৫ সালে ক্রাকাতোয়ায় একটি সহিংস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘিটে যা ৫৩৫-৫৩৬ সালের বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ছিল। কিজ তার গ্রন্থ “Catastrophe: An Investigation into the Origins of the Modern World”-তে উল্লেখ করেছেন যে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে সংঘটিত এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের একটি সুদূরপ্রসারী ও আমূলসংস্কারমূলক প্রভাব ছিল। সেই অগ্ন্যুত্পাতটি ক্রাকাতোয়ার ১৮৮৩ সালের অগ্ন্যুৎপাতের চেয়ে আরও বেশি হিংস্র ছিল বলে মনে করা হয়, যা ক্রাকাতোয়ার মূল ক্যালডেরাটি তৈরি করেছিল, যার ফলে ভার্লাটেন দ্বীপ এবং ল্যাং দ্বীপ তৈরি হয়েছিল। তবে ৫৩৫-৩৬ সালের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যান্য ব্যাখ্যা রয়েছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে মধ্য আমেরিকার এল সালভাদরে ইলোপাঙ্গোর অগ্ন্যুৎপাত।

লেইক ইলোপাঙ্গো

একটি ভলকানিক ক্রেটার লেইক বা আগ্নেয় ক্রেটার হ্রদ হচ্ছে একরকম হ্রদ যার উদ্ভব ঘটে কোন অগ্ন্যুৎপাতের ফলে কোন বিষ্ফোরণ-ক্রিয়া বা ভাঙ্গনের মাধ্যমে। এল সালভাদরের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত ইলোপাঙ্গো হ্রদ এমনই একটি ৮ বাই ১১ কিলোমিটার আকারের ক্রেটার হ্রদ যা দেশটির সান সালভাদর, লা পাজ এবং কাসকাতান বিভাগের সীমানায় অবস্থিত। ইলোপাঙ্গো আগ্নেয়গিরির একটি অগ্ন্যুৎপাতকে ৫৩৫-৩৬ সালের এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্ট বা চরম আবহাওয়া ঘটনার সম্ভাব্য উৎস বলে মনে করা হয়।

ইলোপাঙ্গো হ্রদের টিয়েরা ব্ল্যাঙ্কা জোভেন অগ্ন্যুৎপাত ছিল খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঘটা এল সালভাদরের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত যার ভলকানিক এক্সপ্লোসিভিটি ইনডেক্স ছিল ৬। অগ্ন্যুৎপাতটি প্রায় ৪৩.৭ কিউবিক কিলোমিটার ঘন শিলা সমতুল্য বা ডেন্স রক ইকুইভ্যালেন্ট বের করে দেয়, এর থেকে নির্গত টেফরা ছিল ৮৩ কিউবিক কিলোমিটার। এটি ১৮৮৩ সালের ক্রাকাতোয়া অগ্ন্যুৎপাত বা ১৯৯১ সালের মাউন্ট পিনাতুবো অগ্ন্যুৎপাতের চেয়ে বড় ছিল, এবং সম্ভবত এটিকে ১৮১৫ সালের মাউন্ট তাম্বোরার অগ্ন্যুৎপাতের সাথে তুলনা করা যায়। অগ্ন্যুৎপাতটি রেকর্ডকৃত ইতিহাসে অর্থাৎ গত ৭,০০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বৃহত্তম আগ্নেয়গিরির ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। প্রথম দিকে গবেষকগণ অগ্ন্যুৎপাতের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত একটি উদ্ভিদের রেডিও কার্বন ডেটিং এর উপর ভিত্তি করে এই অগ্ন্যুৎপাতকে ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ৪১০ থেকে ৫৩৫ সালের মধ্যে সংঘটিত বলে বর্ণনা করেছিলেন। পরে একটি গবেষণায় অনুমান করা হয় যে এটি ৫৩০ বা ৫৪০ এর দশকে সংঘটিত হয়। সেক্ষেত্রে এই অগ্ন্যুৎপাতকে ৫৩৫-৩৬ সালের চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি বা এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্টগুলির একটি সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আরও সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ডের বরফের কোর থেকে নেওয়া আগ্নেয়গিরির শার্ড, অ্যান্টার্কটিকা থেকে বরফের কোরগুলিতে রেকর্ড করা সালফারের মাত্রা এবং আগ্নেয়গিরির ছাই এর ডেপোজিটে প্রাপ্ত একটি পোড়া গাছের রেডিওকার্বন ডেটিং একটি গবেষণায় দেখা যায় এটির সময়কাল ছিল ৪৩১±২ খ্রিস্টাব্দ। এর থেকে বোঝা যায় যে এটি গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জের একশো বছর আগেই সংঘটিত হয়েছিল, তার মানে সেই গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জে এর প্রভাব সামান্যই হবার কথা। এই অগ্ন্যুৎপাতে গুরুতর পাইরোক্লাস্টিক ফল হয়ে ও বিশাল পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহ ঘটে, যা ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার স্থানকে ২০ ইঞ্চিরও বেশি পুরু পিউমিস ও ছাইয়ে আবৃত করে। এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আগ্নেয়গিরির চারপাশের ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়, এতে এই অঞ্চলে পরের কয়েক দশক ধরে যেমন কৃষি অসম্ভব হয়ে যায়, তেমনি মায়ান শহরগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। এও তত্ত্বায়ন করা হয় যে, এই অগ্ন্যুৎপাতের কারণে পরে যে ওয়েদার ইভেন্ট ও কৃষির ব্যর্থতার ঘটনা ঘটে তার সাথে তিওতিহুয়াকানের (Teotihuacan) মূল অধিবাসীদের সেই অঞ্চলটি পরিত্যাগ করার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তিওতিহুয়াকান হচ্ছে মেক্সিকোর উপত্যকায় অবস্থিত প্রাচীন মেসোআমেরিকান শহর।

রাবাউল ক্যাল্ডেরা

রাবাউল ক্যালডেরা বা রাবাউল আগ্নেয়গিরি হচ্ছে পাপুয়া নিউ গিনির পূর্ব নিউ ব্রিটেনের গাজেল উপদ্বীপের প্রান্তে অবস্থিত একটি বড় আগ্নেয়গিরি, যার নামকরণ করা হয়েছে ক্যালডেরার অভ্যন্তরে রাবাউল শহর অনুসারে। ক্যালডেরাটির অনেকগুলি সাব-ভেন্ট রয়েছে, এদের মধ্যে তাভুরভুর (Tavurvur) রাবাউলের উপর তার বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাতের জন্য সবচেয়ে সুপরিচিত। সর্বোচ্চ শৃঙ্গের বাইরের ফ্ল্যাঙ্কগুলি ও ৬৮৮-মিটার-উচ্চ একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ পাইরোক্লাস্টিক শিল্ড পুরু পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহের ডেপোজিট দ্বারা গঠিত হয়।

রাবাউল ক্যাল্ডেরায় দুটো স্ট্র্যাটোভলকানো ও একটি পিউমিস কোন আছে। স্ট্র্যাটোভলকানো দুটো হলো তাভুরভুর (২২৩ মি.) এবং রাবালানাকাইয়া (৮৮ মি.) এবং পিউমিস কোন হলো ভালকান (২৪৩ মি.)। ভলকানো দুই রকম হয় – স্ট্র্যাটোভলকানো ও শিল্ড ভলকানো। স্ট্র্যাটোভলকানোর আরেক নাম হলো কম্পোজিট ভলকানো বা যৌগিক আগ্নেয়গিরি। এটি হলো একটি শঙ্কু আগ্নেয়গিরি যা শক্ত লাভা এবং টেফ্রার অনেকগুলি স্তর (স্তর) দ্বারা নির্মিত হয়। এই আগ্নেয়গিরিগুলো বেশি খাড়া হয়, চুড়ায় ক্র্যাটার থাকে, এর অগ্ন্যুৎপাতগুলো হয় বিষ্ফোরণমূলক। এটার শীর্ষের ক্র্যাটার ভেঙ্গে পড়লে ক্যাল্ডেরা গঠিত হয়। অন্যদিকে শিল্ড ভলকানো নামে আরেকরকম আগ্নেয়গিরি আছে, যা মাটিতে পড়ে থাকা একজন যোদ্ধার ঢাল বা শিল্ডের অনুরূপ, এটি অত্যন্ত তরল (কম সান্দ্রতা) লাভার অগ্ন্যুৎপাত দ্বারা গঠিত হয়, যা আরও দূর অব্দি ছড়িয়ে যায়, এবং কোন স্ট্রাটোভোলকানো থেকে উদ্ভূত আরও সান্দ্র লাভার চেয়ে পাতলা প্রবাহ গঠন করে। তাভুরভুর একই সাথে ক্যাল্ডেরাটির একটি সাবভেন্ট ও একটি স্ট্র্যাটোভলকানো। পিউমিস কোন হলো একরকম ভলকানিক কোন বা আগ্নেয়গিরি শঙ্কু। ভলকানিক কোন বা আগ্নেয়গিরি শঙ্কু হলো সরলতম আগ্নেয়গিরির ল্যান্ডফর্মগুলির মধ্যে একটি। এগুলো গঠিত হয় একটি আগ্নেয়গিরির ভেন্ট থেকে নির্গত ইজেক্টা থেকে। যেগুলো ভেন্টের চারদিকে শঙ্কু বা কোন আকারে স্তূপিকৃত হয় এবং যার কেন্দ্রে একটি ক্রেটার থাকে। ভালকান একই সাথে রাবাউল ক্যাল্ডেরার একটি সাবভেন্ট ও একটি পিউমিস কোন। জার্মান কলোনিয়ালাইজেশনের সময় ভালকানের অস্তিত্ব ছিল না। ১৯০০ সালের দিকে এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, এবং ১৯২০ সালে এটি এতই বাড়ে যে একে একটি নাম দেয়া হয়।

তাভুরভুর হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, যা অনবরত ছাই নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। ১৯৩৭ সালে ভালকান ও তাভুরভুর একত্রে অগ্ন্যুৎপাত হয়, আর তার ফলে ৫০৭ জন মারা যায়। এই ঘটনার পর রাবাউল ভলকানো অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠা করা হয় যা পাপুয়া নিউ গিনি এর অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরিকে পর্যবেক্ষণ করে। ১৯৯৪ সালে এটি এবং এর পার্শ্ববর্তী আগ্নেয়গিরি ভালকান রাবাউলকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এরকম বিপর্জয়ের জয় পরিকল্পনা থাকায় নগরের লোকেরা প্রস্তুত ছিল, এবং তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছিল বজ্রপাতের ফলে, যা ভলকানিক অ্যাশ ক্লাউড বা আগ্নেয়গিরির ছাই এর মেঘের একটি বৈশিষ্ট্য। ২০০৮ সালে মার্চে কয়েক দিন ধরে এর একটি অগ্ন্যুৎপাত হয় যা ছাই ও বাষ্পের একটি প্ল্যুম রিলিজ করে এবং সেটি বিসমার্ক সাগরের উপর দিকে উত্তর-পশ্চিমে চলে যায়। ২০১৪ সালের ২৯শে আগস্টে তাভুরভুরে সাম্প্রতিকতম অগ্ন্যুৎপাতটি ঘটে।

৫৩৫ সালে রাবাউলে একটি বিশাল অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এটি হতে পারে বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের সময়ের ক্রোনিকলে যে এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্ট নথিভূক্ত করা হয় তার কারণ। কিন্তু এটি নিশ্চিত নয়, কেননা এর অন্যান্য সম্ভাব্য উৎসও থাকতে পারে যেগুলোর মধ্যে মধ্য আমেরিকার ইলোপাঙ্গো একটি।

৬৮৩±২ সালে রাবাউলে ৬ মাত্রার ভলকানিক এক্সপ্লোসিভিটি এনডেক্সের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল। যা কারেক্টেড রেডিওকার্বন দ্বারা প্রমাণিত হয়। এই মত আছে যে এই অগ্ন্যুৎপাতের কারণে রাবাউল ক্যালডেরার সি-ইনলেটটি তৈরি হয়েছে।

ভলকানিক উইন্টারের আগমন

অগ্ন্যুৎপাতের উৎস যাই হোক না কেন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে ঘটনাটি ঘটে তা হচ্ছে ভলকানিক উইন্টার বা আগ্নেয়গিরিজাত শীত। ৫৩৬ সালের ভলকানিক উইন্টারে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রায় ২.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস (৪.৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট) পর্যন্ত নেমে গেছিল, যা ইউরোপে স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কম ছিল। (নরমাল বলতে গবেষকরা ১৯৬১-১৯৯০ সালের কালের গড় তাপমাত্রা বোঝেন)। ৫৩৬ সালের সেই ভলকানিক উইন্টারের প্রভাবটি আরও বৃদ্ধি পায় যখন ৫৩৯-৪০ সালের দ্বিতীয় অগ্ন্যুৎপাতের ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ইউরোপের নরমাল থেকে ২.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস (৪.৯ ডিগ্রী ফারেনহাইট) হ্রাস পায়। এই অগ্ন্যুৎপাত ও ৫৪১ সালের জাস্টিনিয়ানের প্লেগের ফলে ক্রপ ফেইলিউর বা ফসল নষ্ট ও লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়, সেই সাথে এটি লেইট অ্যান্টিক আইস এইজের উদ্ভব ঘটায় যা ৫৩৬ থেকে ৬৬০ সাল পর্যন্ত বর্তমান ছিল। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফিডব্যাক এফেক্টে মহাসাগরের আইস কাভারও বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ মহাসাগর আরও বেশি বরফে ঢেকে যায়। সেই সাথে ৬০০ এর দশকে সোলার এক্টিভিটিও ব্যতিক্রমভাবে সর্বনিম্ন স্তরে চলে যায়। এগুলো ভলকানিক উইন্টারকে আরও বৃদ্ধি করে ও এর সময়কালও বাড়িয়ে দেয়।

৫৩৬ সালের ভলকানিক উইন্টার বা আগ্নেয়গিরিজাত শীতকাল ছিল গত ২,০০০ বছরের মধ্যে উত্তর গোলার্ধের জলবায়ুর শীতলতার সবচেয়ে তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী পর্ব। অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ভলকানিক উইন্টার ঘটে, আর এক্ষেত্রে অগ্ন্যুৎপাতের জন্য কয়েকটি উৎসকে প্রস্তাব করা হয়েছে। ভলকানিক উইন্টারটি সম্পর্কিত সমসাময়িক বেশিরভাগ সূত্র পাওয়া যায় তদকালীন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের লেখকদের লেখায়, যদিও এই নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাব ইউরোপকে ছাড়িয়ে যায়। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে ৫৩৬ সালের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে সালফেট অ্যারোসল ছড়িয়ে গিয়েছিল, যার ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানো সূর্যের আলোর পরিমাণ হ্রাস পায়, এবং বেশ কয়েক বছর ধরে বায়ুমণ্ডলকে শীতল করে রাখে। ৫৩৬ সালের মার্চ মাসে কনস্ট্যান্টিপলের লোকেরা আকাশে আঁধার ঘনিয়ে আসতে দেখে, আবহাওয়াকে শীতল হতে অনুভব করে।

৫৩৫-৩৬ এর এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্টের কারণে পৃথিবী জুড়ে এর প্রভাবসমূহ

  • আরব উপদ্বীপে উর্বরতা বৃদ্ধি ও তার ফলে আরবদের ও ইসলামের সম্প্রসারণ : বার্মেন্সডর্ফের (Birmensdorf) সুইস ফেডারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি দলের গবেষণা অনুসারে, তাপমাত্রা কমার ফলে আরব উপদীপ বা অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলায় উর্বরতা নাটকীয় বৃদ্ধি পায়। আরব অঞ্চলে এর ফলে খাদ্যের সাপ্লাই প্রচণ্ড বেড়ে যায়, যা এই উপদীপের বাইরে ইসলামিক বিজয়ের সময় আরব প্রসারণে ভূমিকা রাখে।
  • বাইজান্টাইন ও সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যকার টানাপোড়েন : এই শৈত্যকালের ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সাসানিদ সাম্রাজ্যের মধ্যকার টানাপোড়েনও বৃদ্ধি পায়, যা লেভান্ত, মিশর ও পারস্যের মুসলিম বিজয়কে সহায়তা করে।
  • ইজরায়েলের নেগেভের এলুসা শহরে জনসংখ্যা হ্রাস : ইসরায়েলি গবেষকদের একটি গবেষণা অনুসারে ৫৪০ সালে নেগেভ মরুভূমির এলুসা নগরের জনসংখ্যা ও শহরে উৎপন্ন হওয়া বর্জ্যের পরিমাণ প্রচুর পরিমাণে হ্রাস পায়। এলুসায় এর সমৃদ্ধির কালে হাজার হাজার মানুষ বাস করত। এই নগরে জনসংখ্যার গুরুতর হ্রাস ঘটে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামঝি সময়ে, ইসলামিক বিজয়ের প্রায় এক শতক পূর্বে। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে এই লেইট অ্যান্টিক লিটল আইস এইজ।
  • জাস্টিনিয়ানের প্লেগ : এই শৈত্যকালটি ৫৪১ সালে ঘটা জাস্টিনিয়ানের প্লেগের সাথে মিলে যায়, যদিও প্লেগ ও অগ্ন্যুৎপাতের মধ্যকার সম্পর্ক এখনও অস্পষ্ট।
  • লম্বার্ড ও স্লাভদের অভিপ্রায়ণ : এই শৈত্যকাল ইতালি ও বলকানের রোমান অঞ্চলে লম্বার্ড ও স্লাভদের অভিপ্রায়ণে ভূমিকা রাখে।
  • স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অভিজাতদের সোনার মজুদ : ৫৩৬-এর ঘটনা এবং তৎপরবর্তী দুর্ভিক্ষকে মাইগ্রেশন পিরিয়ডের শেষে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অভিজাতদের দ্বারা স্বর্ণের মজুদ জমা করার একটি ব্যাখ্যা হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। সোনা সম্ভবত দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য এবং সূর্যের আলো ফিরে পাওয়ার জন্য একটি উৎসর্গ ছিল।
  • নর্স পুরাণে এই ঘটনার প্রভাব : ফিম্বুলউইন্টার (Fimbulwinter) এবং রাগনারোকের (Ragnarök) মতো পৌরাণিক ঘটনাগুলি এই অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক স্মৃতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
    • র‍্যাগনারক : র‍্যাগনারকের প্রসঙ্গে বলা যায়, হিলডা এলিস ডেভিডসন (Hilda Ellis Davidson) তত্ত্বায়ন করেন, দেবতাদের মৃত্যুর পর ঘটা ভলুস্পা (Völuspá) এর ঘটনাগুলি (সূর্যের কালো হয়ে যাওয়া, বাষ্প উদীয়মান, আগুনের শিখা এর আকাশ-কে স্পর্শ করা ইত্যাদি) আইসল্যান্ড এর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারে। আইসল্যান্ড-এ অগ্ন্যুৎপাতের বিবরণ ভলুস্পায় বর্ণিত ঘটনা এর সিকুয়েন্সের সাথে শক্তিশালী সাদৃশ্য দেখায়, বিশেষ করে ১৭৮৩ সালে ঘটা লাকি-তে ঘটা অগ্ন্যুৎপাত এর সাথে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। বার্থা ফিলপটস (Bertha Phillpotts) তত্ত্বায়ন করেন, সুর্ত্র (Surtr) এর চিত্র আইসল্যান্ডিক অগ্ন্যুৎপাত এর দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল, এবং এটি একটি আগ্নেয়গিরি দৈত্য ছিল। সুর্ত্র (Surtr) এর নাম কোন আইসল্যান্ডীয় স্থান নাম এর মধ্যে পাওয়া যায়, এবং এর মধ্যে লাভা টিউব সুর্তশেলির (Surtshellir), এবং আইসল্যান্ড এর আগ্নেয়গিরি কেন্দ্রীয় অঞ্চল এর অনেকগুলো অন্ধকার ক্যাভার্নগুলোর (caverns) এর নাম রয়েছে।
    • ফিম্বুলউইন্টার : আর ফিম্বুলউইন্টার (Fimbulwinter) হচ্ছে কঠোর শীত যা বিশ্বের শেষ এর পূর্বে আসে, এবং পৃথিবী এর জীবনের সমাপ্তি টানে। ফিম্বুলউইন্টার হচ্ছে তিনটি ধারাবাহিক শীতকাল এর সমাহার, যখন সব দিক থেকে তুষার আসে, কোন মধ্যবর্তী গ্রীষ্ম ছাড়াই, আর এর পর অসংখ্য যুদ্ধ শুরু হয়। এই ঘটনাকে প্রাথমিকভাবে পোয়েটিক এড্ডা-তে বর্ণনা করা হয়েছে। Vafþrúððnismál কাব্যে ওডিন ভাফুরুনিরকে (Vafúrúnir) প্রশ্ন করেন, মানবজাতির মধ্যে কে ফিম্বুলউইন্টারে বেঁচে থাকবেন, Vafúúúðnir উত্তরে বলেন, Líf ও Lífífífþrasir বেঁচে থাকবে, এবং তারা হডমিমিস হল্ট (Hodmímis holt) এর জঙ্গলে করবে। এই পৌরাণিক কাহিনী ৫৩৫-৩৬ সালের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, যার ফলে উত্তর ইউরোপ জুড়ে তাপমাত্রা এর উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটে। পৌরাণিক কাহিনীর এই বিশেষ অংশটি প্রায় ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে হওয়া নর্ডিক ব্রোঞ্জ এজ এর শেষের দিকে নর্ডিক অঞ্চলে ঘটা জলবায়ু পরিবর্তন এর সাথে সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ধারণা আছে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ও অন্যান্য নর্ডিক দেশে ফিম্বুলউইন্টার শব্দটিকে ওল্ড নর্স থেকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর দ্বারা একটি অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা এবং কঠোর শীতকালীন বোঝানো হয়, তবে সুইডেনে আরেকটি সাধারণ শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা হচ্ছে “ভার্গাভিন্টার” (“নেকড়ে-শীত বা wolf winter”)।
  • কামলানের যুদ্ধ ও রাজা আর্থার সম্পর্কিত ঘটনায় প্রভাব : ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু ব্রিজ (Andrew Breeze) একটি সাম্প্রতিক গ্রন্থে (২০২০) যুক্তি দেন যে ক্যামলানের যুদ্ধ সহ রাজা আর্থারের কিছু ঘটনা ঐতিহাসিক, যেগুলো ৫৩৭ সালে তার পূর্ববর্তী বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত দুর্ভিক্ষের ফলে ঘটেছিল।
  • মেসোআমেরিকায় নগরের পতন : তত্ত্বায়ন করা হয় যে, ইলোপাঙ্গো এর অগ্ন্যুৎপাত এবং তৎপরবর্তী ওয়েদার ইভেন্ট ও কৃষির ব্যর্থতা ছিল মেসোয়ামেরিকার বৃহৎ নগরগুলোর অন্যতম তেওতিহুয়াকান (Teotihuacán) এর মূল আধিবাসীদের নগর ত্যাগের প্রত্যক্ষ কারণ। অর্থাৎ নগরটির পতনকে এই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত খরা এর সাথে সম্পর্কিত করা হয়, সেই সাথে সেখানে দুর্ভিক্ষ ও নাগরিকদের বিক্ষোভের সাক্ষ্য-প্রমাণও পাওয়া যায়।

ডেভিড কিজ ও তার সিক্সথ সেঞ্চুরি ক্যাটাস্ট্রফি থিওরি

ডেভিড কিস (David Keys) হচ্ছেন লন্ডনের দৈনিক পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রত্নতত্ত্ব সংবাদদাতা, পাশাপাশি ঐতিহাসিক জলবায়ু পরিবর্তনের উপর একজন লেখক, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলির উপর টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলিতে একজন অবদানকারী। তিনি ২০০০ সালে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর জলবায়ু বিপর্যয়ের উপর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন Catastrophe: An Investigation into the Origins of the Modern World (বিপর্যয় : আধুনিক বিশ্বের উদ্ভব নিয়ে একটি তদন্ত) নামে, যা অ্যাকাডেমিয়ায় মিশ্র অভ্যর্থনা লাভ করেছিল। বইটিতে বলা হয়েছে যে, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ খ্রিস্টীয় অঞ্চলসহ সমগ্র বিশ্বে পরিবর্তন ঘটায়, যা প্রাচীন সভ্যতার সমাপ্তিতে অবদান রাখে এবং একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটায় যা এখন মধ্যযুগ নামে পরিচিত। বইটিতে অনুমান করে বলা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনগুলি বিভিন্ন পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন উন্নয়নেই অবদান রেখেছে, যেমন জাস্টিনিয়ানের প্লেগের উত্থান (৫৪১-৫৪৯), আভারদের পতন, পশ্চিমে মঙ্গোলিয়ান উপজাতিদের অভিবাসন, সাসানীয় সাম্রাজ্যের সমাপ্তি, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন, ইসলামের উত্থান, তুর্কি উপজাতির সম্প্রসারণ, এবং টিওটিহুয়াকানের (Teotihuacán) পতন। ২০০০ সালে, একটি 3BM টেলিভিশন প্রযোজনা সংস্থা (WNET এবং Channel Four এর জন্য) কীজের বইকে ব্যবহার করে “Catastrophe! How the World Changed” (বিপর্যয়! কিভাবে বিশ্ব পরিবর্তিত হয়েছিল) নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে। পিবিএস এর সিক্রেটস অফ দ্য ডেড সিরিজের অংশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি সম্প্রচারিত হয়েছিল।

কিজ এর কাজটি মাইক বেইলি এর লেখা ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ Exodus to Arthur : catastrophic encounters with comets এর সম্প্রসারণ ছিল। এক্সোডাস টু আর্থার গ্রন্থে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের ঘটনার প্রাইমারি এভিডেন্স হিসেবে ডেন্ডোক্রোনলজি (৫৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বৃক্ষের প্রস্থচ্ছেদে সরু রিং), গ্রিনল্যান্ডিক আইস কোরে অ্যাসিডিটি (যা ভলকানিক এক্টিভিটি নির্দেশ করে), সেই সাথে সূর্যের ক্ষীণ হয়ে আসা সহ জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত জন অফ এফিসাস, প্রোকপিয়াস ও ক্যাসিওডোরাসের বিবরণকে সামনে আনা হয়। ডেভিড কিজ এগুলোকে গ্রহণ করেন, এবং সেই সাথে পূর্ব এশিয়া থেকে তথ্যগুলো গ্রহণ করেন এবং সেই থিওরিটির একটি নিজস্ব সংস্করণের বিকাশ ঘটান। এই ঘটনার কারণ হিসেবে তিনি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে দায়ী করেন যা সম্ভবত ক্রাকাতোয়ায় সংঘটিত হয়।

কিজের বইটি মিশ্র পর্যালোচনা লাভ করে, এবং মূলধারায় কিজের লেখার গ্রহণযোগ্যতার অভাব দেখা যায়। পাবলিশার্স উইকলি বইটির সমালোচনা করে লিখেছে যে “বড় দাবির জন্য বড় প্রমাণের দরকার হয়, তবুও কিজ তার থিসিসের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ইতিহাসকে পুনরায় একত্রিত করেছেন, কারণগুলোর ব্যাখ্যাদানকারী ক্ষমতা নিয়ে অবিরাম ওভারওয়ার্ক করে গেছেন, বিষয়টি ভেলিকোভস্কির (Velikovsky) তত্ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে বলা হয়েছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি ধূমকেতু পৃথিবীতে আঘাত করেছিল।” ম্যালকম ডাব্লিউ. ব্রাউনের দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউতে বইটির প্রধানত একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা প্রদান করে। তাতে বলা হয়, “তবুও, এই বইটি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা উচিত, কেবল একটি রিমাইন্ডার বা অনুস্মারক হিসাবে যে, সত্যিকারের বিপদের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন আমাদের এই পৃথিবীটিতে বেঁচে থাকাটা খুব সরু সুতোয় ঝুলন্ত অবস্থায় আছে”। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ কেন ডার্ক মন্তব্য করেছেন যে “বইটিতে উপস্থাপিত আপাত প্রমাণের বেশিরভাগই অত্যন্ত বিতর্কিত, এগুলো নিম্নমান বা ভুল উৎসের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। […] তবুও, বইটিতে যেভাবে বৈশ্বিক পরিসরের দিকটি নিয়ে আসা হয়েছে, এবং ব্যাপক পরিবর্তনের সময়কাল হিসেবে যেভাবে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতককে জোর দেয়া হয়েছে সেই দিকগুলো উল্লেখযোগ্য, সেই সাথে বইটিতে বেশ কিছু অস্পষ্ট তথ্য রয়েছে যেগুলো অনেকের কাছেই নতুন হবে। কিন্তু বইটি তার কেন্দ্রীয় থিসিসটি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বইটি তাতে আলোচিত হওয়া অনেক পরিবর্তনেরই কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেনি।” প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্রায়ান এম. ফাগান এটিকে “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা” এবং “একটি আকর্ষণীয় এবং, কখনও কখনও, বাধ্যতামূলক বা আমাদেরকে মানতে বাধ্য করে এমন আখ্যান (এবং ভাল টেলিভিশন শো)” হিসাবে উল্লেখ করেছেন, এবং উপসংহার টেনে বলেছেন যে, “স্বল্পমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে কিজ সঠিক, কিন্তু, আমাদের জ্ঞানের বর্তমান অবস্থায়, এরকম নির্ধারক এবং কিছুটা চাঞ্চল্যকরভাবে লিখিত বিপর্যয়ের ধারণাটি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।”

তথ্যসূত্র

Volcanic winter of 536, Late Antique Little Ice Age, David KeysKrakatoa, Lake Ilopango, Tierra Blanca Joven eruption, Rabaul caldera, Tavurvur, Vulcan (volcano)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.