সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রি.পূ.) এবং সক্রেটিস প্রভাবিত সিনিক, সিরেনিক, মেগারিয়ান ও এলিয়ান-এরিট্রিয়াল সম্প্রদায়

ভূমিকা

সক্রেটিসের আবির্ভাবকালের বৈশিষ্ট্য : গ্রীসে সক্রেটিসের আবির্ভাবকাল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সূচনা করে। গ্রীকদর্শনে সোফিস্টদের অবদানের কথা যেমন অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন, তেমনি সোফিস্টরা যে তাঁদের কূটতর্কের ফলে সত্যতা ও নৈতিকতার আদর্শের ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছিল, এই বিষয়টিও প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। দার্শনিক সক্রেটিস সত্যতা ও নৈতিকতার আদর্শকে তাদের স্বীয় মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে, মানুষের চিন্তার রাজ্যে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল তাকে দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সক্রেটিসের আত্মানুসন্ধান এক নতুন বিষয়ের অনুসন্ধান : সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তাধারা গ্রীক দর্শন-চিন্তার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিল। ‘সত্তা কি’-গ্রীক দার্শনিক থেলিস্ এই প্রশ্নের যে উত্তর দিয়েছিলেন সেই উত্তর গ্রীক চিন্তাবিদদের তাঁর চারপাশের জগৎ-এর স্বরূপকে জানার ও সেই সম্পর্কে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তাঁদের উদ্যোগী করে তুলেছিল। এর ফলে পদার্থবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, যুক্তিবিজ্ঞান এবং প্রাণীবিদ্যার বিকাশ সাধিত হয়েছিল। অনেক প্রশ্নের অনেক বাস্তব উত্তর পাওয়া গিয়েছিল। সক্রেটিসের প্রশ্ন, ‘আমি কে?’ –এক নতুন অনুসন্ধানের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সক্রেটিস উপলব্ধি করেছিলেন যে, কি বৈজ্ঞানিক, কি সোফিস্ট সম্প্রদায়, কি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন এথেন্সবাসী, কেউ মানুষের আত্মার মরূপের যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তিনি নৈতিক অনুসন্ধানকার্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ও তাদের অনুশীলনের বিষয়ে প্রেরণা জাগিয়েছিলেন। গ্রীক দার্শনিকরা এক নতুন সমস্যার সম্মুখীন হলেন। সেই সমস্যা হল একটিমাত্র সত্তার সংহতির মধ্যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং মানবীয় মূল্যের সমন্বয় সাধন কিভাবে করা যায়।

গ্রীক দর্শন-প্রাক-সক্রেটিস এবং সক্রেটিস যুগ : এটা খুবই স্বাভাবিক যে গ্রীক দর্শনকে প্রাক-সক্রেটিস এবং সক্রেটিস পরবর্তী যুগে বিভক্ত করা হয়। কেননা সক্রেটিসের পরে গ্রীক চিন্তাবিদরা সক্রেটিসের প্রশ্ন—‘আমি কে?” এই প্রশ্নটিকে ভুলতে পারেননি। ‘সত্তা কি?’ –যে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে একদিন গ্রীক চিন্তার শুরু ঠিক সেই প্রশ্নের মতই কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্ন হল, ‘আমি কে’—একদিন গ্রীক দেশের চিন্তাবিদদের মনে এক সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিল।

ব্রামব-এর মন্তব্য : এই প্রসঙ্গে গ্রীক দর্শনের লেখক ব্রাম্ব যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “মানুষের আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে সক্রেটিসের চিন্তা, নাগরিকদের ছেলেমেয়েদের ধনী না করে কিভাবে তাদের অধিকতর সৎ করে তোলা যায় সেই সম্পর্কে তার আপ্রাণ চেষ্টা, রাজনীতিবিদ এবং সোফিস্ট যারা মনে করত তারা জানে সততা কি এবং কিভাবে তা শিক্ষা দেওয়া যায়, সক্রেটিসের সেই সম্পর্কে সমালোচনা, দার্শনিকদের মনোযোগকে জগৎ থেকে জগতের প্রত্যক্ষ কর্তা যে মানুষ তার দিকে ধাবিত করেছিল।”

সক্রেটিসের চরিত্র ও জীবনী

সক্রেটিসের চরিত্র

খ্রি : পূ : ৪৬৯ অব্দে এথেন্সে সক্রেটিসের জন্ম হয়। তাঁর পিতা সফোনিষ্কাস ছিলেন একজন ভাস্কর এবং তাঁর মাতা ফিনারেট ছিলেন একজন ধাত্রী। অবশ্য তাঁর পিতার পৈশা ভাস্কর্য ছিল কিনা এ সম্পর্কে টেলার, বার্নেট প্রমুখ লেখকবৃন্দ ভিন্ন অভিমত পোষণ করেন।

সক্রেটিসের পেশা : সক্রেটিসের মাতা ধাত্রী হলেও ধাত্রীগিরি তাঁর পেশা ছিল বলে অনেকে মনে করেন না। সক্রেটিসের প্রথম জীবন এবং তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কারও কারও মতে, সক্রেটিস তাঁর পিতার পেশা অর্থাৎ ভাস্কর্যই গ্রহণ করেছিলেন, অবশ্য যদি তাঁর পিতা ঐ পেশাই গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু অনেকের মতে, সক্রেটিস পিতার পেশা গ্রহণ করেননি। পরবর্তী সময়ে এথেন্সের আর্কোপোলিস্-এ যে মূর্তিগুলি প্রদর্শিত হয়েছিল, সেগুলি সক্রেটিসেরই পূর্ববর্তী কোন ভাস্করের তৈরি বলে তারা মনে করেন। জেলারের মন্তব্য হলো, যদি মনে করা যায় যে, সক্রেটিস তাঁর পিতার পেশাই গ্রহণ করেছিলেন, তাহলে যৌবন অতিক্রান্ত হবার পূর্বেই তিনি ভাস্করের কাজ পরিত্যাগ করে দর্শনের আলোচনায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। তাঁর সমস্ত জীবনই এথেন্সে অতিবাহিত হয়। কেবলমাত্র তিনবার স্বল্পকালের জন্য তিনি সামরিক কার্যে এথেন্সের বাইরে গিয়েছিলেন। তিনি কারও কাছ থেকেই কোন শিক্ষা গ্রহণ করেননি। যে অপরিসীম জ্ঞানের তিনি অধিকারী ছিলেন, সেই জ্ঞান তিনি নিজের চেষ্টাতে অর্জন করেছিলেন। জেলার-এর মতে, পরবর্তী লেখকবৃন্দ প্রাচীন দার্শনিকের সঙ্গে তাঁর সংযোগ প্রতিষ্ঠার জন্যই তাঁকে আরকিলাস (Archelaus)-এর ছাত্র হিসেবে বর্ণনা করেন।

সক্রেটিসের দেহাকৃতি ও পোশাক : সক্রেটিস দেখতে মোটেও সুদর্শন ছিলেন না বরং তাকে কুৎসিতই বলা চলে। তিনি ছিলেন বেঁটে, তাঁর দেহ ছিল খুল, উদর স্ফীত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথায় টাক পড়তে থাকে। তাঁর নাসিকা ছিল চ্যাপ্টা ও অবনত। এক অয়াভাবিক ভঙ্গিতে তিনি হাঁটতেন এবং তাঁর চোখ দুটিকে অদ্ভুত কায়দায় ঘোরাতেন। রাসেল বলেন, তিনি ছিলেন, ‘স্যাটারিক নাটকের সকল সাইলেনাসেসদের অপেক্ষা কুৎসিত।’ (Xenophon, Symposium)। জীর্ণ মলিন বস্ত্র পরিধান করে তিনি নগ্নপদে নগর পরিভ্রমণ করতেন। বাহারি পোশাক-পরিচ্ছদের বা বেশভূষার দিকে তাঁর মোটেও নজর ছিল না। তিনি ছিলেন অসীম ধৈয্যশক্তির অধিকারী। পানাহার ও ভোগবিহারে সক্রেটিস সংযমী ছিলেন, কিন্তু ইচ্ছা করলে তিনি অধিক মাত্রায় পান করতে পারতেন।

সক্রেটিস এক দৈববাণীর দ্বারা সকল কার্যে পরিচালিত হতেন : যৌবনের পর থেকেই সক্রেটিস মনে করতেন তিনি এক দৈববাণীর দ্বারা তাঁর জীবনের সকল কার্যে পরিচালিত হচ্ছেন। তিনি তাকে ‘দৈব নিদর্শন’ বা ‘daimon’ নামে উল্লেখ করেছেন। সক্রেটিসের মতে, এই দৈববাণী তাঁকে অনেক কার্য করতে নিষেধ করেছে কিন্তু কখনও কোন কার্য করতে তাঁকে আদেশ করেনি। যেহেতু এই দৈববাণী তাঁকে কাজের ভাল-মন্দ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে, সেহেতু এই দৈববাণীর নির্দেশ অমান্য করার জন্য কখনও আগ্রহী হননি।

সক্রেটিসের আনমনা ভাব : প্লেটোর ‘Sympostum’ থেকে জানা যায় যে, তিনি কখনও কখনও দীর্ঘ সময় ধরে আনমনা থাকতেন। অনেক সময় একদিন একরাত এইভাবেই কেটে যেত। অধ্যাপক টেলর এই আনমনা অবস্থাকে ভাবাবেশ বা আচ্ছন্ন হয়ে থাকার অবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও কপলস্টোনের মতে, কোন বিশেষ সমস্যার প্রতি তাঁর গভীর মনোযোগ নিবন্ধ হওয়ার জন্যই, এই আনমনার ভাব তাঁর মধ্যে দেখা দিত।

মানুষের আলোচনাতে আগ্রহ : সক্রেটিসের যখন মাত্র কুড়ি বছর বয়স তখন থেকেই তিনি আয়োনিয়ার দার্শনিকদের সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক আলোচনা থেকে বিরত হয়ে মানুষের আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। একথা ঠিক যে, তিনি সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক মতবাদগুলি আলোচনায় প্রথমে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন কিন্তু বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে অনৈক্য লক্ষ করে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক আলোচনা বর্জন : কিন্তু অ্যানাকসাগোরাসের দার্শনিক রচনায় মনের উল্লেখ লক্ষ করে, বিশেষ করে আলোচনার যে অংশে তিনি মনকে সব প্রাকৃতিক নিয়ম এবং শৃঙ্খলার কারণরূপে অভিহিত করেছেন, তা পাঠ করে, তিনি যেন এক নতুন আলোর রেখা দেখতে পেলেন। এই বিশ্বে মন কিভাবে ক্রিয়া করে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে, তার একটা বর্ণনা অ্যানাকসাগোরাসের দার্শনিক রচনায় তিনি দেখতে পাবেন আশা করেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন যে, অ্যানাকসাগোরাস একটা বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যই মনের উল্লেখ করেছেন, তার ক্রিয়া সম্পর্কে কোন বিশেষ বর্ণনা দেননি; তখন তিনি একান্তভাবে হতাশ হয়ে সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক আলোচনা বর্জন করলেন। তিনি দেখলেন যে, প্রাকৃতিক দর্শন কোন সুসঙ্গত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে না, কেবলমাত্র পরস্পর বিরোধী অভিমতে উপনীত হয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কাজেই সক্রেটিস দার্শনিক অনুসন্ধানকার্যে নিজ পথেই অগ্রসর হবার স্থির সংকল্প গ্রহণ করলেন।

সক্রেটিস-দর্শনে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন : সক্রেটিস কোন নতুন দর্শনের প্রবর্তন করেননি। তিনি ছিলেন দর্শনে একটি নতুন ধারার এক নতুন পদ্ধতির প্রবর্তক। তিনি তাঁর দার্শনিক অভিমত কখনও লিপিবদ্ধ করে যাননি। কথোপকথনের মধ্য দিয়েই তিনি দর্শন আলোচনা করতেন। এথেন্সের হাটে-বাজারে প্রচুর লোকসমাগম হত। তিনি সেখানে সমবেত লোকদের সঙ্গে দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। জীবন কি মৃত্যু কি এইসব গভীর সমস্যা নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনায় ইচ্ছুক এমন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করতেন, সে ব্যক্তি ধনী, দরিদ্র, যুবক, বৃদ্ধ, পরিচিত, অপরিচিত, যেই হোক না কেন। সোফিস্টদের মত তিনি সরাসরি কোন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন না বা শিক্ষাদানের জন্য কোন দক্ষিণা গ্রহণ করতেন না।

সক্রেটিসের আলোচনা পদ্ধতি : শুধু তাই নয়, সোফিস্টদের মত তিনি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন না বা বক্তৃতার মাধ্যমে নিন্দা বা তিরস্কার করাও তার অভ্যাস ছিল না। স্বগতোক্তি করতে তিনি ভালবাসতেন না। কথোপকথনের সময় অপরপক্ষকে বলার সুযোগ না দিয়ে একটানা নিজের বক্তব্য বলে যাওয়ার অভ্যাস তাঁর ছিল না। তিনি অপর পক্ষকে বলার সুযোগ দিতেন। আলোচনার সবটুকু অংশ তিনি একাই জুড়ে বসে থাকতেন না। সক্রেটিস আলোচনার মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, মন্তব্য করে, আলোচনাকে একটা বিশেষ পথে চালিত করতেন। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই কথোপকথন এগিয়ে চলত। আলোচনার মাঝে সক্রেটিস গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রতিপক্ষের বক্তব্য তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতেন। বক্তব্যগুলি শুনে তিনি সেগুলি সংশোধন করতেন, কখনও বা ভ্রান্ত জেনে তাকে খন্ডন করতেন, কখনও বা বক্তব্য বিষয়কে আরও স্পষ্ট করে তুলতেন।

প্রতিপক্ষের ভুলভ্রান্তি, দোষত্রুটি ধরিয়ে দেবার কারণ : প্রশ্ন হল, সক্রেটিস এইভাবে প্রতিপক্ষের বক্তব্যের ভুলভ্রান্তি দোষত্রুটি ধরিয়ে দিতেন কেন? এর কারণ সক্রেটিস মনে করতেন যে, তাঁর কর্তব্য হল তাঁর সহ-নাগরিকদের জীবনের অর্থ এবং তাদের নিজেদের পরম কল্যাণ সম্পর্কে যাতে তারা চিন্তা করে, তার জন্য তাদের প্রণোদিত করা। মানুষের মধ্যে এক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সৃষ্টি করাই ছিল তাঁর লক্ষ বা কর্তব্য। তাঁর দর্শন, তাঁর ঈশ্বর সেবা সক্রেটিস মনে রতেন, তাঁর এই কার্য ঈশ্বর তাঁর উপর আরোপ করেছেন। তাছাড়া ডেলফি মন্দিরের দৈববাণীও তাঁকে এই কার্যে যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছিল। প্লেটোর Apology থেকে সক্রেটিসের এই উদ্দেশ্যের বিষয় জানা যায়।

ডেলফি মন্দিরের দৈববাণী ঘটনা : ডেলফি মন্দিরের দৈববাণীর ঘটনাটি এক সুবিখ্যাত ঘটনা। সক্রেটিসের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু একবার ডেলফি মন্দিরের দৈববাণীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, এমন কোন জীবিত ব্যক্তি আছে কিনা যিনি সক্রেটিসের চেয়েও বিজ্ঞতর। উত্তরে তাকে বলা হয় যে সক্রেটিসের চেয়ে বিজ্ঞতর কেউ নেই। এই উত্তর শুনে সক্রেটিস দৈববাণীর সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞ বলে খ্যাত এমন রাজনীতিবিদ, কবি ও কারিগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে সক্রেটিস তাঁদের বিজ্ঞতার কোন পরিচয় পেলেন না। সক্রেটিস অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁদের অজ্ঞতা দেখিয়ে দিলেন। ফলে তাঁর শত্রুসংখ্যা বাড়তে লাগল। সক্রেটিস ডেলফির দৈববাণীর অর্থ করলেন এইভাবে যে, ঈশ্বরই যথার্থ জ্ঞানী। মানুষের জ্ঞানের কোন মূল্য নেই এবং মানুষের মধ্যে তিনিই বিজ্ঞতম যিনি তার অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন। দৈববাণীতে সক্রেটিসের নাম উল্লিখিত হয়েছে কারণ সক্রেটিস তাঁর নিজের অজ্ঞতার কথা স্বীকার করতেন। এই দৈববাণী শোনার পর সক্রেটিস মনে করলেন এরপরে তাঁর কর্তব্য হবে শ্বাশ্বত ও সুনিশ্চিত সত্যের, যথার্থ জ্ঞানের অনুসন্ধান করা এবং তাঁর কথা শুনতে চাইবে এমন যে কোন ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করা। বিজ্ঞতার বড়াই করে বেড়ায় এমন ব্যক্তিদের জ্ঞানাভিমান চূর্ণ করে ডেলফির দৈববাণীর সত্যতা প্রতিপন্ন করা সক্রেটিস তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।

জ্ঞানাভিমানী ব্যক্তির জ্ঞানের অভিমান চূর্ণ করতেন : কিন্তু এই কর্তব্য সম্পাদন করতে গিয়ে সক্রেটিসের শত্রুসংখ্যা দিনের পর দিন বাড়তে লাগল। যে কোন রকম আলোচনা করতে গিয়ে সক্রেটিস সেই বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞতার ভাণ করতেন এবং তাঁর সঙ্গে আলোচনায় যোগদানকারী ব্যক্তির জ্ঞান ঐ বিষয়ে কতদূর তা জানবার জন্য সচেষ্ট হতেন। আসলে তিনি যে অজ্ঞতার ভান করতেন তা নয়। তিনি প্রকৃতই বিশ্বাস করতেন যে শুধু তাঁর নয়, প্রায় অধিকাংশ লোকেরই সত্য, শিব ও সুন্দর, অর্থাৎ যেগুলির স্বরূপ সম্পর্কে মানুষের সত্যই জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, সেই জ্ঞান নেই। আসলে জ্ঞানাভিমানী ব্যক্তিরা জ্ঞানের যে অভিমান করে থাকেন, তাহল তাদের নিজেদের অজ্ঞতাকে ঢেকে রাখার একটা প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। সক্রেটিস এইসব জ্ঞানাভিমানীদের জ্ঞানের অভিমান যে কতই অসার তা প্রমাণ করে দিতেন। আলোচনার শুরুতে সক্রেটিস নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে আলাপে যোগদানকারী ব্যক্তির কাছ থেকে শিক্ষা করার বাসনা প্রকাশ করতেন। ঐ ব্যক্তিও জ্ঞানদান করার অতিরিক্ত আগ্রহবশত এমন অনেক বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করত, যা বিতর্কমূলক। সক্রেটিস দু-একটি বিষয় ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না, এই কথা বলে, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এমন কয়েকটি প্রশ্ন করতেন যার উত্তর দিতে গিয়ে আলাপে যোগদানকারী ব্যক্তির জ্ঞানাভিমানের অসারতা অত্যন্ত নিলর্জভাবে আত্মপ্রকাশ করত। এথেন্সের যুবকরাই বিশেষ করে সক্রেটিসের চারপাশে জড় হত, কারণ তাদের চোখে সক্রেটিস কেবল একজন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না, বুদ্ধি সংক্রান্ত ক্রিয়ায় অনুশীলনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।

সক্রেটিসের চরিত্র : সক্রেটিস ছিলেন এক মহান চরিত্রের ব্যক্তি। তিনি অত্যন্ত সরল জীবন-যাপন করতেন। জাগতিক ভোগ্যবস্তুর প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। সাধারণ মানুষের কামনা বাসনা ও প্রয়োজনের অনেক উর্ধ্বে থেকে তাঁর মন কেবলমাত্র আকাঙ্ক্ষা করত জ্ঞান ও সত্যতা অর্জন করতে। জাগতিক সুখভোগের প্রতি অনিচ্ছা থাকলেও, জাগতিক সুখভোগের প্রতি বীতরাগকে তিনি কখনও কৃচ্ছতায় পরিণত হতে দেননি। তিনি অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। কি শান্তির সময়, কি যুদ্ধের সময় তিনি অবিচলিতভাবে তাঁর কর্তব্য করে যেতেন। তিন-তিনবার তিনি সামরিক কাজে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে তাঁর নীতিই ছিল রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যখন তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তেন, তিনি অবিচলিত থাকতেন। তিনি অগাধ দৈহিক সহ্যশক্তি এবং মানসিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। পেলোপোনেশিয়ার যুদ্ধে যখন তিনি সৈন্যদলে কাজ করতেন তখন তিনি তাঁর সাহসিকতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও সহাশক্তির জন্য তাঁর সতীর্থদের কাছে এক বিস্ময়ের বস্তু ছিলেন। দু-দুবার নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি তাঁর দুজন সঙ্গীকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলেন।

সক্রেটিসের চরিত্রে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের বিস্ময়কর সংমিশ্রণ : মানুষের মানসিক প্রকৃতি থেকে যে সব সমস্যার উদ্ভব, সেই সব সমস্যার দিকেই তাঁর অদম্য আগ্রহ ছিল। তাঁর চরিত্রে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের এক বিস্ময়কর সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়, যেমন— বিচারমূলক বিচক্ষণতার সঙ্গে গভীর ধর্মীয় মনোভাবের এবং সংযত বুদ্ধিবাদের সঙ্গে অলৌকিক বিশ্বাসের সংমিশ্রণ। জেলার মন্তব্য করেন যে, পরস্পর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের এই যে সংমিশ্রণ তার মূল ছিল এক ও অভিন্ন বিষয়ে অর্থাৎ এক পরম ও সর্বনিরপেক্ষ সত্যকে লাভ করার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা, যাকে তিনি মনে করতেন বুদ্ধির সাহায্যে অনুধাবন করা যায়। এই সত্য নৈতিক আচরণের মানদণ্ডরূপে ক্রিয়া করতে পারে এবং এই শক্তিকে মনে করতেন এমন এক পক্ষপাতশূন্য শক্তি যা জাগতিক ঘটনাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। জেলার বলেন, “স্বয়ংসম্পূর্ণতা, পবিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততার আদর্শরূপে এবং মানবসুলভ দয়া ও সামাজিক মনোহারিত্বে পরিপূর্ণ সংস্কৃতিসম্পন্ন বুদ্ধিমান ব্যক্তিরূপে, অফুরন্ত কৌতুকরসবোধসম্পন্ন অচঞ্চল প্রশান্তির অধিকারী হিসেবে তিনি বিভিন্ন পদমর্যাদা এবং চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে শ্রদ্ধার বস্তু হয়ে উঠেছিলেন।”

সক্রেটিসের শত্রু, অভিযোগ, বিচার ও মৃত্যু

সক্রেটিসের শত্রুদের অভিযোগ : কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এরূপ একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ, বিজ্ঞব্যক্তিরও শত্রুর অভাব ছিল না। সক্রেটিস প্রচলিত কুসংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে ব্রতী হয়েছিলেন এবং তিনি মনে করেছিলেন যে দেশের উন্নতিসাধনের প্রকৃষ্ট উপায় হল দেশের যুবকদের শিক্ষিত করে প্রচলিত কুসংস্কার ও দুর্নীতি সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলা। কিন্তু তখন তিনি বুঝে উঠতে পারেননি যে, তাঁর এই প্রচেষ্টাই তাঁকে অনেক রক্ষণশীল ব্যক্তির শত্রু করে তুলবে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এনিটাস, মেলিটাস এবং লাইকন নামে তিনজন ব্যক্তি সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আদালতে তিনটি অভিযোগ নিয়ে এলেন। তখন সক্রেটিসের সত্তর বৎসর বয়স। এই অভিযোগগুলি হল—

  • (১) রাষ্ট্রে যেসব দেবতাদের উপাসনা করা হয় তিনি সেইসব দেবতাদের উপাসনা করেন না।
  • (২) তিনি নিজস্ব দেবতার উপাসনা করেন এবং নতুন ও অপরিচিত উপাসনা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন এবং
  • (৩) দেশের যুবকদের কুশিক্ষা দিয়ে তিনি বিপথে চালিত করেছেন।

অভিযোগ ভিত্তিহীন : প্রশ্ন হল, এই সব অভিযোগ কি সত্য? উত্তরে বলা যেতে পারে, এইসব অভিযোগগুলি মূলত ভিত্তিহীন। প্রথম অভিযোগের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, সক্রেটিস জাতীয় ধর্মের প্রতি মোটেও অশ্রদ্ধাভাজন ছিলেন না এবং রাষ্ট্র যে সব দেবতাদের উপাসনার কথা বলত, তিনি তাঁদের অসম্মানও করতেন না। সক্রেটিস নিজে কোন গ্রন্থ রচনা করেননি কিন্তু তাঁর শিষ্য জেনোফোনের রচনা থেকে সক্রেটিস সম্পর্কে অনেক কথাই জানা যায়। জেনোফোনের মতে, তিনি একাধিক দেবতা এবং মানুষের জীবনের নিয়ামক ও পরিচালকরূপী এক জগৎস্রষ্টা ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য করতেন। জেনোফোনের রচনা থেকে জানা যায় যে, সক্রেটিস আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছিলেন যে, দেবতাদের নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার অর্থ তাঁদের অস্তিত্বে অবিশ্বাস করা নয়। দ্বিতীয় অভিযোগও ভিত্তিহীন। এই অভিযোগের কারণ হয়ত এই যে, সক্রেটিস এক দৈবনিদর্শন বা daimon-এ বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু সক্রেটিস নিজেই স্বীকার করেন যে, এই দৈবনিদর্শনে বিশ্বাস নতুন দেবতায় বিশ্বাস সূচনা করে না। যুবকদের বিপথে চালিত করার তৃতীয় অভিযোগও ভিত্তিহীন। সক্রেটিসের অন্যতম প্রিয় শিষ্য এলসিবিয়েডিস বিশ্বাসঘাতকতা করে এথেন্সবাসীদের চোখে সক্রেটিসকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন।

অভিযোগের মূলে আসল কারণ : তাহলে প্রশ্ন হল, এইসব অভিযোগের মূলে আসল কারণটি কি?

  • প্রথমত, সক্রেটিসের অনেক ব্যক্তিগত শত্রু ছিল। দৈনন্দিন বাদানুবাদের সময় সক্রেটিস অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তির অজ্ঞতার তীব্র সমালোচনা করতেন, যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে প্রচার করত। এইসব ব্যক্তিই ক্রোধবশত মেলিটাস, লাইক ও এনিটাসের মত অতি সাধারণ ব্যক্তিকে মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছিল।
  • দ্বিতীয়ত, যদিও সক্রেটিস রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন না, কিন্তু তিনি এথেন্সে যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার কঠোর সমালোচনা করতেন। নির্দিষ্ট অল্পসংখ্যক ব্যক্তির দ্বারা রাজ্য শাসনেরও পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বিশেষের অধিকার তিনি সমর্থন করতেন না। তাঁর মতে, যাঁরা জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ, সৎ, বিচক্ষণ এবং শাসনকার্যের জন্য উপযুক্ত, তাঁদের উপরই রাষ্ট্রের শাসনভার ন্যস্ত হওয়া উচিত। সাধারণ লোক সক্রেটিসের এই অভিমত সমর্থন করত না। তিনি নিজে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতেন না। যে যুবকদের উপর একদিন দেশের শাসনভার নাস্ত হবে, সেই যুবকদের নিজের প্রভাব ও উপদেশের দ্বারা শিক্ষিত করে তোলার কথাই তিনি চিন্তা করতেন।
  • তৃতীয়ত, সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের অপর একটি কারণ আছে বলে অনেকে মনে করেন, যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণটি হল যে, যদিও সক্রেটিস আদতেই সোফিস্ট ছিলেন না এবং সোফিস্টদের জীবনধারা ও চিন্তাধারার সঙ্গে কোন দিক থেকেই যদিও তাঁর মিল ছিল না, তবু সাধারণ লোক তাঁকে সোফিস্ট বলে মনে করত। এর কারণ অ্যারিস্টোফেনিস তাঁর “The Clouds” নামক নাটকে সক্রেটিসকে সোফিস্টদের প্রধানরূপে চিত্রিত করেছিলেন, যা করা তার পক্ষে উচিত হয়নি। কথা হল, লোকে সক্রেটিসকে সোফিস্টরূপে গণ্য না করলে তিনি তাঁর নাটকে সক্রেটিসকে সোফিস্টদের প্রধানরূপে চিত্রিত করতে পারতেন না। এই সময় এথেন্সে সোফিস্টদের বিরুদ্ধে জনসাধারণ অত্যন্ত বিদ্বেষভাবাপন্ন ও ক্ষুব্ধ ছিল। এর কারণ হল, সত্যতা ও সততার প্রচলিত আদর্শকে তারা উপেক্ষা করত এবং তাদের বিনষ্ট করার জন্য তারা উদ্যোগী হয়েছিল। সোফিস্টদের প্রতি জনসাধারণের এই রোষাগ্নিতেই সক্রেটিসকে আত্মাহুতি দিতে হল। সোফিস্ট না হয়েও জনসাধারণের ক্রোধের বলি হলেন তিনি।

বিচারকবৃন্দ সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন : অভিযোগকারীরা মনে করেছিলেন যে, সক্রেটিস বিচারের অপেক্ষা না করে স্বেচ্ছায় নির্বাসনদণ্ড গ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি বিচারালয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সংকল্প করলেন। বিচার চলাকালীন বিচারালয়ে তিনি যথেষ্ট মর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি মিষ্ট কথায় অভিযোগকারীদের তুষ্ট করা বা তাদের করুণা ভিক্ষা করার কথা চিন্তাই করেননি। বরং তিনি যতটা না আত্মপক্ষ সমর্থনে সচেষ্ট হলেন তার বেশি তিনি তাঁর বিচারক এবং এথেন্সের জনসাধারণের দুর্নীতি অসততার জন্য তাদের কাঠোর সমালোচনা করে তাদের আচরণের কৈফিয়ৎ তলব করলেন। সক্রেটিসের এই মনোভাবই তাঁর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবার কারণ। বিচারকদের অধিকাংশের মতে, তাঁর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়াতে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। সক্রেটিস ইচ্ছা করলে নিজের জন্য অন্য দণ্ড অর্থাৎ নির্বাসন প্রস্তাব করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সামান্য কিছু জরিমানার প্রস্তাব করলেন। বিচারকেরা তাঁর এই দাম্ভিক আচরণে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। পূর্বের তুলনায় আরও অধিক সংখ্যক বিচারক তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করল। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তাকে দণ্ডিত করার কারণ নিরূপণ করতে গিয়ে জেলার বলেন, “এই অভিযোগ ও দণ্ডদানের গভীরতম কারণ হল, আধুনিক জ্ঞানদান করার বিরুদ্ধে এথেসের অধিকাংশ জনসাধারণের, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দলের বিরোধিতা।” সক্রেটিসের দণ্ডাজ্ঞা কার্যকর হতে এক মাসের মত বিলম্ব হয়েছিল। সক্রেটিসের বন্ধুরা তাঁকে পালাবার পরামর্শ দিল এবং ঐ সময় এথেন্সে এটা খুব কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু এই জাতীয় কার্য সক্রেটিসের দৃষ্টিতে নীতি-বিরুদ্ধ কাজ ছিল। তিনি মনে করতেন মৃত্যু ভয়ে পলায়ন ভীরুতার লক্ষণ। তাছাড়া আইনকে মান্য করা দরকার। সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জেলার বলেন, “আইনগত এবং নৈতিক দিক থেকে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হল বিচারকবৃন্দের দ্বারা সম্পাদিত এক হত্যাকান্ড এবং ইতিহাসের দিক থেকে এক স্পষ্ট কালাসঙ্গতি।”

সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিনটির বিবরণ : এই পৃথিবীতে সক্রেটিসের জীবনের শেষের দিনটির বিবরণ প্লেটোর “Phaedo”-তে লিপিবদ্ধ হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবার তিরিশ দিন পরে তাঁর হাতে হেমলক বিষের পাত্র তুলে দেওয়া হল এবং অবিচলিত মনোভাব ও দার্শনিক প্রশান্তি নিয়ে, তিনি বিষের পাত্র হাতে তুলে নিয়ে পান করলেন। সক্রেটিস তাঁর মৃত্যুর দিনটিতে তাঁর দুই বন্ধুর সঙ্গে আত্মার অমরতা সম্মন্ধে আলোচনা করছিলেন। বিষপানের পর যখন তিনি মৃত্যু প্রতীক্ষারত তখন তাঁর শেষ কথা হল “ক্রিটো, আমরা এসকুলেপিয়াসের কাছে একটা মোরগ ধারী এটা দিয়ে দিও, এটাকে অবহেলা করো না।” যখন বিষ তাঁর হূৎপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছল, তখন একবার তিনি কেঁপে উঠলেন, তারপর মারা গেলেন। এই দেখে ‘ক্রিটো’ তাঁর মুখ এবং চোখ বন্ধ করল। এইভাবে শেষ হয়ে গেল একটি মানুষের জীবন, যিনি, ছিলেন তাঁর সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সবচেয়ে জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ। সক্রেটিসের মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জেলার বলেন, ‘সক্রেটিসের মৃত্যু তাঁর উদ্দেশ্যের চরম জয়, তাঁর জীবনের পরম সফলতা, দর্শন এবং দার্শনিকের মহিমা। ”

সক্রেটিসের দর্শন

সক্রেটিসের দর্শনের উৎস

সক্রেটিস নিজে কোন গ্রন্থ রচনা করে যায়নি। তাই সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তাধারা সঠিক ভাবে নিরূপণ করার ব্যাপারে একটা সমস্যা দেখা দেয়। যেসব গ্রন্থ থেকে আমরা সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি, সেইসব গ্রন্থে সক্রেটিসকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।

সক্রেটিস সম্পৰ্কীয় বিভিন্ন রচনা : কাজেই প্রশ্ন দেখা দেয়, সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হবার ব্যাপারে কোন গ্রন্থ বা গ্রন্থগুলি নির্ভরযোগ্য? সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কে আমাদের পরিচিত উৎসগুলি হল জেনোফোন (Zenophone)-এর সক্রেটিস সম্পর্কীয় দুটি রচনা, প্লেটোর ডায়ালগস, অ্যারিস্টটলের বিভিন্ন বিবৃতি, অ্যারিস্টোফেনিসের ক্লাউসৎ নামক রচনা। এইসব গ্রন্থ থেকে সক্রেটিসের দার্শনিক পরিচয় পেতে গেলে আমরা সক্রেটিসের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় লাভ করি। যেমন জেনোফোন এর রচনা পাঠ করলে আমাদের ধারণা হবে যে সক্রেটিস নীতি দর্শন নিয়েই আলোচনা করেছেন এবং অধিবিদ্যার সমস্যা নিয়ে তিনি তেমন কোন আলোচনা করেন নি। আবার প্লেটোর ডায়লগ বা কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে যদি সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কে ধারণা করতে হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত করতে হবে যে তিনি ছিলেন এক অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা; যিনি মানুষের আচরণের ভালত্ব-মন্দত্বে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। এক অতীন্দ্রিয় বা আধিবিদ্যক জগতে আকার (Form) বা সার্বিক ধারণার (Concept) অস্তিত্ব আছে – সক্রেটিসই এই মতবাদ প্রতিপাদন করেছেন, এমন ধারণাই আমরা লাভ করব প্লেটোর ডায়লগ পাঠ করলে। আবার অ্যারিস্টটলের সক্রেটিস সম্পর্কীয় বিবৃতি থেকে এই ধারণাই হবে যে, সক্রেটিস দার্শনিক মতবাদে আগ্রহী ছিলেন না তা নয়, তবে সার্বিক ধারণা সম্পর্কীয় গুরুত্বপূর্ণ মতবাদটির প্রবর্তক প্লেটো, সক্রেটিস নন্।

বিভিন্ন রচনার নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে মতবাদ : আসলে উপরে উল্লিখিত সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কীয় বিভিন্ন রচনার মধ্যে কোন্‌টি নির্ভরযোগ্য, সেই সম্পর্কে গ্রীক দর্শনের লেখকবৃন্দের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। জেনোফোন সক্রেটিসকে খুব সাধারণভাবে চিত্রিত করেছেন, এই হল সাধারণের অভিমত। তবে এর কারণ নিরূপণ করতে গিয়ে বলা হয় যে, এই বিষয়টি তাঁর ইচ্ছাকৃত নয়। জেনোফোন ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিক। তাঁর মধ্যে দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি এবং আগ্রহের অভাব ছিল। তিনি সক্রেটিসের চরিত্র এবং ব্যক্তিত্বের প্রতি সমধিক আকর্ষণ বোধ করেছিলেন। দার্শনিক সক্রেটিসকে সবিশেষভাবে জানার আগ্রহ তাঁর ছিল না। তাই জেনোফোন সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তার যথাযথ রূপটি উদ্ঘাটিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

স্টেইসের মতে, জেনোফোনের রচনা নির্ভরযোগ্য : তবু কোন কোন গ্রীক দর্শনের লেখক যেমন স্টেইস মনে করেন যে, জেনোফোনের ‘Memorabilia’-তে সক্রেটিসের জীবন ও দার্শনিক চিন্তা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।

কারও কারও মতে প্লেটোর রচনা নির্ভরযোগ্য : অপরদিকে সক্রেটিস সম্পর্কে প্লেটোর রচনার নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কেও মতভেদ লক্ষ করা যায়। কোন কোন গ্রীক দর্শনের লেখকের মতে, প্লেটো তাঁর প্রথম দিকের রচনা (Apology) ছাড়া অন্য সব ডায়লগ্-এ নিজ বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সক্রেটিসকেই মুখপাত্র রূপে ব্যবহার করেছেন। কাজেই সক্রেটিসের মুখ দিয়ে যে সব মতবাদের কথা তিনি বলেছেন, তার অধিকাংশই হল প্লেটোর মতবাদ, যার কথা হয়ত সক্রেটিস কোন দিন মনে মনে চিন্তাই করেননি। কাজেই প্লেটোর কথোপকথনের উপর নির্ভর করে সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তা সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য বিবরণ সংগ্রহ করা কঠিন। কিন্তু অনেকে মনে করেন যে, প্লেটোর ‘ডায়লগ্’ থেকে সক্রেটিসের দর্শনের সারমর্ম এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণ সংগ্রহ করা যেতে পারে।

বার্নেট-টেলর-এর অভিমত : জেলার মনে করেন যে, সক্রেটিসের দর্শনের নির্ভরযোগ্য উৎস হল প্লেটোর Apology, তাঁর প্রথমদিকের ডায়লগগুলি এবং Symposium-এ এলসিবিয়াডেসের উক্তি। জেনোফোন এবং অ্যারিস্টটলও সক্রেটিস দর্শনের উৎস, যদি না তারা প্লেটোর বর্ণনার বিরোধিতা করে। বার্নেট (Burnet) এবং টেলর (Taylor) মনে করেন যে, প্লেটোর সক্রেটিস হল ঐতিহাসিক সক্রেটিস। তাঁদের মতে, প্লেটো তাঁর ডায়লগ-এর সক্রেটিসের মুখ দিয়ে যে দার্শনিক চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন তা সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তা। তাছাড়া তাঁদের মতানুসারে যে দার্শনিক চিন্তাধারা সক্রেটিসের নয়, সেই দার্শনিক চিন্তাধারা সক্রেটিসের মুখ দিয়ে প্লেটো ব্যক্ত করতে যাবেন কেন? এছাড়াও তাঁরা বলেন যে, প্লেটোর পরবর্তীকালের ডায়লগগুলিতে সক্রেটিসের তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই এবং ‘Laws’-এ তিনি একেবারেই অনুপস্থিত। যা থেকে এই অনুমান করা যেতে পারে যে, পরবর্তীকালের ডায়লগগুলিতে প্লেটো তাঁর নিজস্ব মতবাদ ব্যক্ত করার জন্য সক্রেটিসকে বাদ দিয়েছিলেন এবং যে সব ডায়লগ্-এ সক্রেটিস উপস্থিত সেই সব ডায়লগে সক্রেটিসের মুখ দিয়ে যে সব দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে তা সক্রেটিসেরই মতবাদ। বার্নেট, টেলর-এর অভিমত মেনে নিলে সার্বিক ধারণা মতবাদের প্রবর্তক সক্রেটিস, প্লেটো নয়, স্বীকার করে নিতে হয়।

কপলস্টোনের অভিমত : গ্রীক দর্শনের লেখক কপলস্টোন, বার্নেট ও টেলর এর অভিমত যে একেবারেই অগ্রাহ্য করতে চান তা নয়, প্লেটোর ডায়লগ থেকে ঐতিহাসিক সক্রেটিস সম্পর্কে কোন পরিচয়ই পাওয়া যায় না, এ জাতীয় সিদ্ধান্তও কপলস্টোন করতে চান না। তবে তিনি অ্যারিস্টটলের বিবৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যে বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, সার্বিক ধারণা মতবাদ বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ (The Theory of Forms)-এর প্রবর্তক প্লেটো, সক্রেটিস নন। অ্যারিস্টটল কুড়ি বৎসর ধরে একাডেমীতে ছিলেন, কাজেই অ্যারিস্টটলের পক্ষে ভুল করার সম্ভাবনা কম। কপলস্টোন, জেনোফোন এবং প্লেটোর রচনার তুলনায় অ্যারিস্টটলের রচনাকেই সক্রেটিসের দার্শনিক পরিচয় লাভের পক্ষে অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন, যদিও তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, তিনি তার স্পষ্ট যুক্তি দিয়েছেন মাত্র, অপরকে বাতিল করার কথা তিনি বলছেন না।

সক্রেটিস সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের রচনা কতটা নির্ভরযোগ্য : সক্রেটিস সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের রচনা কতখানি নির্ভরযোগ্য যে সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে নরমেন গ্যালে (Norman Gulley) বলেন যে, সক্রেটিস সম্পর্কে অ্যারিস্টটল প্রদত্ত বিবরণ খুবই স্বল্প। দার্শনিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ এই বিবরণের অংশগুলি হল প্রধানত, (ক) Metaphysics গ্রন্থের কয়েকটি অংশ যেখানে প্লেটোর আধিবিদ্যক মতবাদ গঠনে সক্রেটিসের প্রভাবের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এবং (খ) নীতিবিদ্যা সম্পর্কীয় রচনার কয়েকটি অংশ যেখানে সক্রেটিসের নৈতিক মতবাদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এই অংশগুলিতে অ্যারিস্টটলের নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সক্রেটিসের চিন্তা উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু স্বল্পতা এবং দার্শনিক পক্ষপাতিত্বের অসুবিধা সত্ত্বেও নরমেন গ্যালে মনে করেন যে, অ্যারিস্টটলের প্রদত্ত বিবরণ খুবই মূল্যবান। তার কারণ অ্যারিস্টফেনিস, জেনোফোন এবং প্লেটো সক্রেটিসের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন সেই চিত্রের সঙ্গে যে নাটকীয় বা আত্মপক্ষ সমর্থন সম্পর্কীয় উদ্দেশ্য যুক্ত, তার থেকে অ্যারিস্টটল প্রদত্ত বিবরণ মুক্ত। অন্যান্য দার্শনিকদের চিন্তা থেকে স্বতন্ত্র করার জন্য দার্শনিক হিসেবে সক্রেটিসের চিন্তনের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন এবং কোন এক ধরনের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তাকে উপস্থাপনের জন্য অ্যারিস্টটল সচেষ্ট হয়েছেন। যদিও স্বল্প, দার্শনিক পদ্ধতি এবং নীতিবিদ্যার, উভয় ক্ষেত্রে সক্রেটিসের অবদানের মৌলিকতা নির্দেশ করার ব্যাপারে এটি যথেষ্ট।

সিদ্ধান্ত : প্রশ্ন হল, সক্রেটিসের দার্শনিক পরিচয় লাভের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য কোন উৎসকেই উপেক্ষা না করাই হবে যুক্তিসঙ্গত। সব উৎসগুলির মধ্য থেকেই সত্যের অনুসন্ধান করতে হবে। সবদিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ মতবাদটিই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

জ্ঞানতত্ত্ব

সক্রেটিসের দর্শন একান্তভাবেই নীতিমূলক। মানুষের আচরণতত্ত্ব বা চরিত্র নীতিতেই তিনি সমধিক আগ্রহী ছিলেন। মানবজীবনের উদ্দেশ্য কি, সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর করণীয় কি, সততা (Virtue)-এর স্বরূপ কি, এইগুলিই ছিল মূখ্যত তাঁর আলোচনার বিষয়। মানুষ এবং মানুষের কর্তব্যের প্রশ্নেই সোফিস্টরা ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। সক্রেটিসও ছিলেন তাই। সৃষ্টিবাদ, জগতের উৎপত্তি, জগতের স্বরূপ, পরমতত্ত্বের স্বরূপ প্রভৃতি সমস্যা ছিল প্রাচীন দার্শনিকদের কাছে প্রধান সমস্যা। এই সব সমস্যার সমাধানে তাঁরা বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সক্রেটিস এইসব সমস্যার সমাধানে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিলেন না। গণিত, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রকে তিনি মূল্যবান শাস্ত্র বলে গণ্য করতেন না। মানবচরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ। জীবনের অর্থ কি, মানুষের পক্ষে শ্রেয় কি, কিসে মানুষের কল্যাণ হয়– এইসব প্রশ্নের সমাধানেই সক্রেটিস বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। মানুষের চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন সক্রেটিসের লক্ষ হলেও, এই উৎকর্ষ সাধন জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জ্ঞানের দ্বারাই মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। জ্ঞানের ভিত্তির উপর চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তাই সক্রেটিসের নীতিতত্ত্বের ভিত্তি হল তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব, সেই কারণে সক্রেটিসের নীতিতত্ত্বের আলোচনার পূর্বে তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা দরকার।

মানুষ প্রত্যয় থেকে জ্ঞান লাভ করে, জ্ঞান প্রত্যয় নির্ভর : সক্রেটিসের এই জ্ঞানতত্ত্ব সরল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। খুব সহজ সরলভাবে এই জ্ঞানতত্ত্বকে ব্যক্ত করতে গেলে বলতে হবে, মানুষের সব জ্ঞানই প্রত্যয়ের মাধ্যমে জ্ঞান। প্রত্যয় (Concept) কাকে বলে? আমরা একটা বিশেষ ধারণা (Particular Idea) এবং সার্বিক ধারণার (General idea) মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। যখন আমরা বলি, সক্রেটিস, প্লেটো, তখন বিশেষ কোন মানুষের কথা বলি। আর যখন আমরা বলি ‘মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন প্রাণী’ তখন কোন বিশেষ মানুষকে না বুঝিয়ে সব মানুষকে বুঝি, অর্থাৎ সমগ্র মনুষ্য শ্ৰেণীকে বুঝি। এই সমগ্র মনুষ্য জাতির ধারণা হল সার্বিক ধারণা। কোন প্রত্যয় বা সার্বিক ধারণা গঠন করার সময় যে ধারণার দিক থেকে কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত সব বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সাদৃশ্য থাকে সেই ধারণাগুলিকে একত্রিত করা হয় এবং যেসব ধারণার দিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকে সেগুলিকে আগ্রাহ্য করা হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা বিষয়ের পার্থক্য দেখা যায়, কোন মানুষ সাহসী, কোন মানুষ ভীরু, কেউ উদার, কেউ অনুদার, কিন্তু মানুষ, বৃক্ষ, ত্রিভুজ প্রভৃতি সার্বিক ধারণা। সব মানুষই বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। কাজেই মানুষ হল সার্বিক ধারণা। সেই রকম গরু, ঘোড়া, বৃক্ষ, গৃহ, নদী, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ প্রভৃতি হল সার্বিক ধারণা বা প্রত্যয়ের উদাহরণ।

সার্বিক ধারণা এবং সংজ্ঞা অভিন্ন : একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, সার্বিক ধারণা এবং সংজ্ঞা (Definition) অভিন্ন বিষয়। স্থির প্রত্যয় কিভাবে লাভ করা যায়, এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সক্রেটিস সার্বিক সংজ্ঞা (Universal Definition) নিয়েই আলোচনা করেছেন। কোন কিছু অনিবার্যভাবে এবং সার্বিকভাবে বৈধ হতে পারে, তা সোফিস্টরা স্বীকার করতে নারাজ, কারণ তাঁদের মতে, সব কিছুই আপেক্ষিক। কিন্তু সক্রেটিস মনে করতেন সার্বিক বা সামান্য প্রত্যয় যেমন— ‘মানুষ’, ‘বৃক্ষ’ সবসময়ই এক বা অভিন্ন থাকে। তার কোন পরিবর্তন নেই। বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত পরিবর্তনশীল, কিন্তু সংজ্ঞা অপরিবর্তনীয়। যেমন, ‘মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন প্রাণী’— মানুষের এই সংজ্ঞার কোন পরিবর্তন নেই। সব অবস্থাতেই এটি অপরিবর্তনীয়, এমন কি পৃথিবী থেকে সব মানুষের অস্তিত্ত্ব মুছে গেলেও ‘বুদ্ধি বৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী,’ মানুষের এই সংজ্ঞা অপরিবর্তিত থাকবে।

সার্বিক প্রত্যয় মনোগত নয় : কোন কোন চিন্তাবিদ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সার্বিক প্রত্যয় (Universal Concept) হল বস্তুনিরপেক্ষ বা মনোগত (Subjective)। কিন্তু এই অভিমতের সমালোচনা করে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, বাস্তবে একটা ভিত্তি না থাকলে এই ধরনের সার্বিক প্রত্যয় গঠন করা কি ভাবে সম্ভব আর কেনই বা মানুষ এই ধরনের প্রত্যয় গঠন করতে বাধ্য হবে? সার্বিক ধারণা বা প্রত্যয়ের কোন বস্তুগত বা আধিবিদ্যক (Metaphysical) ভিত্তি আছে কিনা সে প্রশ্নের আলোচনা থেকে আপাতত বিরত হয়ে এখন শুধুমাত্র এইটুকুই বলা যেতে পারে যে, সার্বিক ধারণা তার বৈশিষ্ট্যের জন্যই, পরিণামী বিশেষ ধারণার তুলনায়, স্থির এবং অপরিণামী।

সংজ্ঞা হল শব্দের মাধ্যমে প্রত্যয়কে ব্যক্ত করা ও সার্বিক সংজ্ঞার গুরুত্ব : সার্বিক ধারণা যে ভাবে গঠন করা হয়, সংজ্ঞাও একই ভাবে গঠন করা হয়। অর্থাৎ কোন এক শ্রেণীর বস্তুর সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলিই সংজ্ঞা বা সার্বিক ধারণাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যে গুণের দিক থেকে এক শ্রেণী বস্তুর সভ্যদের মধ্যে অমিল, সেই গুণকে সার্বিক ধারণা বা সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ‘সংজ্ঞা হল শব্দের মাধ্যমে একটি প্রত্যয়কে ব্যক্ত করা। এখানে প্রশ্ন হল, সক্রেটিস সার্বিক সংজ্ঞা (Universal Definition)-র উপর এতখানি গুরুত্ব দিতে গেলেন কেন? সংজ্ঞা নিরূপণের এমন কি গুরুত্ব আছে? দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর প্রথমে দেওয়া যেতে পারে। সংজ্ঞা নিরূপণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা সত্যতার বস্তুগত মানদণ্ড লাভ করি। যেমন, কোন কিছু খাঁটি সোনা কিনা আমরা নিরূপণ করতে পারি, যদি খাঁটি সোনার যে সার্বিক সংজ্ঞা, সেটি বিশেষ কোন সোনার ক্ষেত্র কতদূর পর্যন্ত কার্যকর বা প্রযোজ্য হয়েছে নিরূপণ করতে পারি। অর্থাৎ কিনা, খাঁটি সোনার সংজ্ঞা বিশেষ সোনার যে টুকরো তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে কি হয়নি, নিরূপণ করতে পারি। সৌন্দর্যের একটা বস্তুগত সংজ্ঞা স্বীকার করে না নিলে কোন বস্তু কম সুন্দর বা বেশি সুন্দর কি ভাবে বলা সম্ভব? ত্রিভুজের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে পারলেই আমরা একটি জ্যামিতিক ক্ষেত্র ত্রিভুজ কি, ত্রিভুজ নয়, বলতে পারি। এবার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, সক্রেটিস আগ্রহী ছিলেন নৈতিক আচরণের ভালত্ব মন্দত্বে। তিনি চাইলেন, সোফিস্টদের আপেক্ষিকতা মতবাদে দিশেহারা মানুষকে কিভাবে সত্যের একটা বস্তুগত মানদণ্ডের সন্ধান দেওয়া যেতে পারে। আপেক্ষিক নীতিতত্ত্ব অনুসারে ন্যায়-এর (Justice) কোন বস্তুগত মানদণ্ড নেই। ন্যায় সম্প্রদায়ভেদে, নগরভেদে, রাষ্ট্রভেদে পৃথক। কিন্তু ন্যায়-এর যদি সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায়, যে সংজ্ঞার মাধ্যমে ন্যায়-এর অন্তর প্রকৃতি ব্যক্ত হয় এবং সব মানুষের ক্ষেত্রে সংজ্ঞাটি প্রযোজ্য হয় তখন ন্যায়-এর সার্বিক সংজ্ঞা প্রযোজ্য হচ্ছে কি হচ্ছে না, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যক্তি বিশেষের আচরণ বিচার করতে সক্ষম হব। আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের নৈতিক নিয়মও বিচার করতে সমর্থ হব। অর্থাৎ কিনা, বিচার করতে পারব রাষ্ট্রের এইসব নৈতিক নিয়ম ন্যায়-এর সার্বিক সংজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অনুরূপভাবে সততা (Virtue)-র সংজ্ঞা নিরূপণ করতে পারলে, কোন ব্যক্তির বিশেষ কাজ সৎ কিনা, সেই ব্যক্তির কাজকে সততার সংজ্ঞার সঙ্গে তুলনা করে নির্ধারণ করতে পারব। ব্যক্তির সংবেদন জ্ঞান নয়, তাই যদি হত সত্যতা ব্যক্তিভেদে পৃথক হত, সত্যতা অপরিণামী হত না, তার একরূপতা (Uniformity) স্বীকৃত হত না। কোন বস্তু প্রকৃত যা, তাই তার জ্ঞান এবং প্রত্যয়ের জ্ঞানই সেই জ্ঞান। সোফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদ নীতি অনুসারে সততা ব্যক্তিভেদে পৃথক। ‘আমি যাকে সৎ মনে করি, তাই সৎ। কিন্তু ‘সততার’ সংজ্ঞা নিরূপিত হলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে আর বলা চলবে না যে, আমি যা সৎ মনে করি, তাই সৎ।

আরোহ যুক্তি : অ্যারিস্টটলের মতে, সক্রেটিসই আরোহ প্রণালীর উদ্ভাবক। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, তিনি যুক্তিবিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে আলোচনা করেছেন। সক্রেটিস দার্শনিক আলোচনার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন সেটিকেই অ্যারিস্টটল যুক্তিবিদ্যার দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। কাজেই এমন সিদ্ধান্ত করা সমান হবে না যে, যুক্তিবিজ্ঞানের দিক থেকে আরোহ মতবাদের সুস্পষ্ট বিকাশ সাধন করেছেন সক্রেটিস।

প্রত্যয় গঠনের পদ্ধতি হল আরোহ পদ্ধতি : সক্রেটিসের প্রত্যয় গঠনের পদ্ধতি হল আরোহ পদ্ধতি। আরোহ পদ্ধতি হল বিশেষ থেকে সার্বিকে উপনীত হবার পদ্ধতি। সর্বজনস্বীকৃত সৎ আচরণের দৃষ্টান্ত তিনি সংগ্রহ করতেন। এই আচরণগুলির সাধারণ গুণটি এবং যে বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের সকলকে এক শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। সেটি নিরূপণের জন্য তিনি সচেষ্ট হতেন এবং তার ভিত্তিতে ‘সততার’ প্রত্যয়টি গঠন করতেন। তারপর যে প্রত্যয়টি গঠিত হল, নতুন নতুন দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে সেই প্রত্যয়টির সঙ্গে দৃষ্টান্তগুলির সঙ্গতি আছে কিনা লক্ষ করতেন। অসঙ্গতি দৃষ্ট হলে নতুন উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সংশোধন করতে সচেষ্ট হতেন।

আরোহমূলক যুক্তি বলতে সক্রেটিস কি বুঝতেন? : অ্যারিস্টটলের মতে, আরোহমূলক যুক্তি (Inductive Arguments) প্রয়োগ সক্রেটিসের পদ্ধতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সংজ্ঞার্থ নিরূপণের উপায় রূপে সক্রেটিস এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আরোহমূলক যুক্তি বলতে অ্যারিস্টটল মনে করেন সেই যুক্তি যা মনকে একটি সাধারণ বা সার্বিক সত্য এবং তার মধ্যে যে বিশেষ দৃষ্টান্তগুলি রয়েছে সেগুলি নির্দেশ করে, সেই সাধারণ বা সার্বিক সত্যকে অনুধাবন করার জন্য টেনে নিয়ে যায়। সার্বিক সত্যের দিকে প্রতিপক্ষকে টেনে নিয়ে যাবার জন্য সক্রেটিস কয়েকটি বিশেষ দৃষ্টান্ত থেকে একটি সাধারণ বচনে বা কতকগুলি সাধারণ বচন থেকে ব্যাপকতর সাধারণ বচনে সার্বিকীকরণ করতেন। কখনও কখনও এই সার্বিকীকরণ ছিল প্রকট বা সুস্পষ্ট। সময় সময় যুক্তিতে এটি প্রচ্ছন্ন থাকত।

নানা ক্ষেত্রে আরোহমূলক যুক্তির প্রয়োগ : সক্রেটিস নানা ব্যাপারে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন। তিনি কোন প্রস্তাবিত সংজ্ঞার্থ বা অন্যান্য বচনকে খণ্ডন করতে বা সংশোধন করতে, অর্থের দুর্বোধ্যতা প্রকাশ করতে, কোন সংজ্ঞার্থকে সমর্থন করতে, ব্যবহারিক নৈতিক সত্যকে ব্যাখ্যা করতে, অসঙ্গতি এবং অনিয়মকে প্রকাশ করতে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, অভিজ্ঞতার ব্যাপক ও বিচিত্র ক্ষেত্র থেকে আনুষঙ্গিক দৃষ্টান্ত এবং নীতি মনে জাগিয়ে তুলে যে, কোন স্তরে যুক্তিকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করা এবং তাকে সুনির্দিষ্ট করে তোলার জন্য পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হত।

আরোহমূলক যুক্তির উদাহরণ : অ্যারিস্টটল তাঁর Rhetortic-এ সক্রেটিসের আরোহমূলক যুক্তির একটি উদাহরণ দিয়েছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, এই আরোহ পূর্ণগণনামূলক আরোহ অনুমান (Perfect Inducion) নয়, কেননা এক্ষেত্রে সকল দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে সার্বিকীকরণ করা হচ্ছে না এবং একটি বিশেষ দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রে সার্বিকীকরণকে প্রয়োগ করা হয়। কেউ হয়ত যুক্তি দিয়ে দেখাতে চায় যে ভাগ্য পরীক্ষার দ্বারা বা লটারীর উপর নির্ভর করে শাসক নির্বাচন করা উচিত নয়। এই ব্যক্তি উদাহরণের সাহায্যে দেখতে পারেন যে, নৈপুণ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে নির্বাচন না করে ভাগ্যপরীক্ষার দ্বারা যদি (যেমন ব্যায়ামবীর বা চালক) নির্বাচন করা হয় তবে তা হবে এক অসঙ্গত বিষয়। তারপর এই সাধারণ নীতিকে শাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সক্রেটিসের আরোহ যুক্তি প্রয়োগের দক্ষতার একটি প্রয়োজনীয় অংশ হল বিভিন্ন বিশেষ দৃষ্টান্তের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সাদৃশ্যের বিষয়গুলি বেছে নেওয়া। তাছাড়া বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মধ্যে যেগুলির অবশিষ্টের সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে অমিল রয়েছে, তাদের মধ্যে পার্থক্য করা। বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মধ্যে নঞর্থক এবং সদর্থক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে তিনি প্রায়ই যুক্তির ব্যবহার করেছেন। নৈতিক আচরণ এবং পেশাগত দক্ষতার অনুশীলন এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর উপরিউক্ত দক্ষতা প্রকাশ করেন।

আরোহ পদ্ধতির প্রয়োগ কতখানি সুসংহত : অনেকেই মনে করেন যে সক্রেটিস তাঁর দার্শনিক পদ্ধতির এক প্রধান অংশরূপে আরোহ পদ্ধতির সুসঙ্গত প্রয়োগ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল তাঁর আরোহ পদ্ধতির প্রয়োগ কতখানি সুসঙ্গত হয়েছে? কারও কারও মতে, এই প্রয়োগ সুসঙ্গত হয়নি। কেননা সক্রেটিস এলোমেলো, অবিন্যস্ত, সংশয়পূর্ণ, অপ্রাসঙ্গিক উপাত্তের উপর নির্ভর করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা তাঁর হঠকারিতার পরিচায়ক। জনৈক সমালোচক মনে করেন যে, এই ধরনের সমালোচনা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। কেননা সক্রেটিসের কোন কোন সার্বিকীকরণ এবং তাঁর কিছু তুলনামূলক যুক্তি হয় স্বল্পপরিসর থেকে সংগৃহীত দৃষ্টান্ত বা অনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের উপরে প্রতিষ্ঠিত। সময় সময় তিনি এমন দৃষ্টান্ত বেছে নিয়েছেন যা দেখে মনেও সুসঙ্গত সুদৃঢ় যুক্তি প্রতিষ্ঠা করার তুলনায় তিনি কথোপকথনকারীকে ফাঁকি দিতে সচেষ্ট। জনৈক সমালোচকের মতে, সক্রেটিসের আরোহ যুক্তি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, তবে যারা মনে করেন যে, এই ধরনের যুক্তি গঠনে সক্রেটিস বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেননি এবং খেয়ালখুশীমত দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাঁদের সেই সমালোচনা যুক্তিসঙ্গত নয়। সক্রেটিসের পদ্ধতির একটি বৈশিষ্ট্য হল যে, এটি যে কোন যুক্তিরূপে উপস্থাপিত বিষয়কে শর্তাধীন বা সাময়িক গণ্য করে, যেটি সবসময়ই সংশোধন এবং পরিবর্তনের অপেক্ষা রাখে। নরমান গ্যালের মতে, এই ধরনের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্রেটিসের মৌলিকতা অনস্বীকার্য এবং এই মৌলিকতার একটি বৈশিষ্ট্য হল যে তাঁর যুক্তিগুলি প্রতিপক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সঞ্চার করত যখন তাঁরা দেখত যে তাদের উপস্থাপিত যুক্তিগুলি কতখানি তুচ্ছ এবং অপ্রাসঙ্গিক।

সক্রেটিসের কথোপকথনের পদ্ধতি আরোহ পদ্ধতি : সক্রেটিসের তর্ক পদ্ধতি বা ব্যবহারিক পদ্ধতিও এক হিসেবে আরোহ পদ্ধতি। সক্রেটিসের পদ্ধতি ছিল কথোপকথনের পদ্ধতি। সক্রেটিসের এই তর্ক পদ্ধতিকে তাঁর নামানুসারে সক্রেটিক পদ্ধতি (Socratic Method) নামে অভিহিত করা হয়। এই পদ্ধতির দুটি দিক আছে— নঞর্থক (Negative) এবং সদর্থক (Positive)। নঞর্থক পদ্ধতি সক্রেটিস শ্লেষ (Socratic Irony) নামেও পরিচিত। কোন একটি বিষয় সম্পর্কে কোন ব্যক্তির ধারণা কি, সেটি তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা না করে সক্রেটিস তার সঙ্গে এই বিষয়ে কথোপকথনে রত হতেন। ধরা যাক আলোচ্য বিষয় হল, ন্যায়পরায়ণতা। সক্রেটিস ‘ন্যায়পরায়ণতা’ কাকে বলে সেই সম্পর্কে অজ্ঞতার ভাণ করতেন এবং অপর ব্যক্তি সেই সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে পারেন কিনা, তাকে জিজ্ঞাসা করতেন। সেই ব্যক্তি ‘ন্যায়পরায়ণতা’ সম্পর্কে তার বক্তব্য বলতে গিয়ে ঐ সম্পর্কে কোন সংজ্ঞা বা বর্ণনা দিলে সক্রেটিস তাঁর আলোচনার দু-একটি বিষয় তাঁর কাছে বোধগম্য হচ্ছে না, এই কথা বলে, তার প্রদত্ত সংজ্ঞা সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। এই প্রশ্নের মধ্য দিয়েই সক্রেটিস প্রমাণ করে দিতেন যে, ব্যক্তির প্রদত্ত সংজ্ঞা যথার্থ নয়। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের ত্রুটি প্রদর্শন করে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে, প্রতিপক্ষ যে বাস্তবিক অজ্ঞ, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে সে যে কিছুই জানে না, এটা তিনি প্রমাণ করে দিতেন। এই ছিল তাঁর তর্কপদ্ধতির নঞর্থক দিক। তখন ব্যক্তিটি আবার নতুন সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করলে, সক্রেটিস আবার তাঁকে প্রশ্নজালে বিব্রত করে তার প্রদত্ত সংজ্ঞার অযৌক্তিকতা প্রদর্শন করতেন। সক্রেটিসের এই কথোপকথনের পদ্ধতি কম সঙ্গতিপূর্ণ থেকে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ সংজ্ঞার দিকে, বা বিশেষ উদাহরণ থেকে সার্বিক সংজ্ঞার দিকে অগ্রসর হত। অবশ্য সবক্ষেত্রেই যে কোন সুনির্দিষ্ট ফললাভ ঘটত তা নয়, তবে লক্ষ থাকত একটা সার্বিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা এবং যেহেতু যুক্তি বিশেষ থেকে সার্বিকের দিকে অগ্রসর হত, এটিকে আরোহ পদ্ধতি বলে স্বীকার করার ব্যাপারে কোন বাধা নেই। সাধারণত, যে বিষয়গুলির সংজ্ঞা নিরূপণে সক্রেটিস আগ্রহী ছিলেন সেগুলি হল— সাধুতা এবং অসাধুতা, ন্যায় এবং অন্যায়, সাহসিকতা এবং ভীরুতা।

সত্য আবিষ্কারই ছিল সক্রেটিসের লক্ষ, অপরকে হেয় করা নয় : এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, এই কথোপকথনের মাধ্যমে যে সব ব্যক্তির অজ্ঞতা প্রকাশ হয়ে পড়ত, তারা খুব অপ্রতিভ হত এবং নিজেদের লোকচক্ষে খুব হেয় মনে করত। কিন্তু অপরকে অপ্রতিভ বা হেয় করা সক্রেটিসের লক্ষ ছিল না। ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে যে, সক্রেটিসের তর্কপদ্ধতির একটা সদর্থক দিক আছে। তাঁর লক্ষ ছিল সত্য আবিষ্কার করা, সত্যের জন্য সত্য আবিষ্কার করা নয়, উত্তম জীবনযাপনের জন্য সত্য আবিষ্কার করা। ভাল কাজ করার জন্য অবশ্যই জানা প্রয়োজন ভাল জীবন কি? কপলস্টোন বলেন, সক্রেটিস আত্মার মূল্য গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন কারণ এই আত্মা হল চিন্তন ও ইচ্ছার কর্তা এবং যদি আত্মার যথাযথভাবে তত্ত্বাবধান করতে হয় তিনি দেখলেন, তাহলে জ্ঞানের এবং যথার্থ বিজ্ঞতার গুরুত্বকে স্বীকার করে নিতে হয়। সক্রেটিসের কাছে প্রধান প্রশ্ন হল মানবজীবনের যথার্থ মূল্যগুলি কি, যেগুলি মানুষের আচরণে ফুটিয়ে তোলা দরকার। সক্রেটিস তাঁর পদ্ধতিকে ধাত্রীবিদ্যা বলে অভিহিত করতেন। ধাত্রীর কাজ প্রসবকালে সন্তানের পৃথিবীতে আবির্ভূত হতে সহায়তা করা। সক্রেটিস-ও তাঁর সদর্থক তর্কপদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানের প্রসবে অর্থাৎ তর্ককালে প্রতিপক্ষের মনে জ্ঞানের আবির্ভাবে সাহায্য করতেন। তিনি প্রতিপক্ষের মন থেকে ভ্রান্ত ধারণাগুলি দূর করে তার মুখ দিয়েই অজ্ঞাত সত্যগুলি প্রকাশ করাতেন। প্রতিপক্ষের ধীশক্তি যাতে যথার্থ সত্য উদ্ভাবনে সমর্থ হয় ধাত্রীর মত সক্রেটিস তাতে সহায়তা করতেন। এই ব্যাপারে সক্রেটিস আরোহ প্রণালীর আশ্রয় নিতেন। এই আরোহ প্রণালীর লক্ষ ছিল যুক্তিসম্মত সংজ্ঞার (Logical Definition) উদ্ভাবন। এই কারণেই সক্রেটিস সংজ্ঞার প্রতি অতখানি মনোযোগী হয়েছিলেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, জীবনের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের জন্য, ব্যবহারিক লক্ষ সিদ্ধ করার জন্য সত্যের সুস্পষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। নিছক জ্ঞানের জন্য সত্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়া তাঁর লক্ষ ছিল না। তিনি সংজ্ঞার আকারে (In the form of definition) যথার্থ ধারণা উৎপন্ন করতে চেয়েছিলেন।

কথোপকথনের পদ্ধতি কেন গুরুত্বপূর্ণ? : কেন সক্রেটিস কথোপকথনের পদ্ধতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, তার কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অপরের নৈতিক এবং বৌদ্ধিক কল্যাণ সাধন করা, এটা তিনি করতেন তাদের অভিমতের মধ্যে যে অসঙ্গতি বর্তমান সেটি প্রদর্শন করে। কাজেই যে পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তি তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজের উত্তরের এবং স্বীকৃতির মাধ্যমে নিজের অভিমতের ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হয় সেই পদ্ধতিকে মূল্যবান মনে না করার কোন কারণ নেই। পদ্ধতির অপরোক্ষ প্রয়োগ এবং তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ব্যক্তির অভিমতের বিশ্লেষণ— এই দুই বৈশিষ্ট্য সক্রেটিসকে প্রণোদিত করেছিল তাঁর পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে সমষ্টির কল্যাণ সাধন। পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধে এথেন্‌সে বিচার বুদ্ধি সংক্রান্ত বিতর্কের একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এই বুদ্ধি সংক্রান্ত বিতর্কের একটা বৈশিষ্ট্য হল একটি যুক্তির বিরুদ্ধে অপর একটি যুক্তিকে খাড়া করা। এই আবহাওয়া সৃষ্টির ব্যাপারে সোফিটদের বিশেষ অবদান রয়েছে। সোফিস্ট এবং সক্রেটিস উভয়েই প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি অবলম্বন করলেও, এ ব্যাপারে সক্রেটিসের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সোফিস্টদের অবলম্বিত পদ্ধতিকে প্লেটো বিতর্কমূলক (Eristic) বলে অভিহিত করেছেন এবং সক্রেটিসের অবলম্বিত পদ্ধতিকে দ্বান্দ্বিক (Dialectic) নামে অভিহিত করেছেন। প্রথম পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হল সত্য আবিষ্কারের দিকে লক্ষ না রেখে যে কোন মতে যুক্তির দ্বারা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে জয়লাভ করা। অনেক সময় সোফিস্টরা বাগ্মিতামূলক বা আলঙ্কারিক যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে বা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে কোন একটি বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে কথোপকথনকারীর ধারাবাহিক বক্তব্যের মধ্যে আত্ম বিরোধিতার দোষ দেখিয়ে নিজেদের কার্য সিদ্ধি করত। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগে লিখিত একটি প্রবন্ধ যার নাম (The Dissoi Logoi অর্থাৎ Two fold Arguments), বাগ্মিতাসূচক বিতর্কমূলক (Eristical) যুক্তির একটি প্রতিনিধিত্বস্থানীয় প্রবন্ধ, অর্থাৎ যেখানে একটি বিশেষ বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে ধারাবাহিকভাবে কতকগুলি যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। উপরে যে প্রবন্ধটির নাম করা হয়েছে সেখানে পর পর কতকগুলি নির্দিষ্ট মানের বিষয়ের দুটি বিরোধী পক্ষের যুক্তি উপস্থাপিত করা হয়েছে যেমন, ‘ভাল ও মন্দ একই বিষয় এবং তারা পৃথক বিষয়’, “বিজ্ঞতা ও সততা শেখানো যায় এবং তাদের শেখানো যায় না’, ইত্যাদি। বিতর্ক সংক্রান্ত (Eristical) যুক্তির দ্বিতীয় ধরনটি হল প্রশ্ন এবং উত্তরের কৌশল। সোফিস্টরা এই পদ্ধতি প্রয়োগ করত এবং তাদের লক্ষ ছিল প্রতিপক্ষের বক্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার দোষ প্রদর্শন করা এবং এটা তারা করত শব্দের অর্থের দ্ব্যর্থকতার উপর মনোনিবেশ করে। এক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর হত খুব সংক্ষিপ্ত এবং প্রশ্নগুলি এমনভাবে তৈরি হত যে উত্তরদানকারীকে দুটি বচনের যে কোন একটিকে গ্রহণ করতে হবে। কিংবা তাকে হয় ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ উত্তর দিতে হবে। উত্তরদানকারীকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার বা উত্তরকে নিজের মত করে বলার কোন সুযোগ দেওয়া হত না। আসল উদ্দেশ্য, উত্তরদানকারীর উত্তর পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে দেখিয়ে যুক্তির বলে জয়লাভ করা। সক্রেটিস মনে করতেন যে সোফিস্টদের এই ধরনের যুক্তি হল ধ্বংসাত্মক এবং আত্মহননমূলক। সক্রেটিসের পদ্ধতির উপর সোফিস্ট পদ্ধতির প্রভাব : সক্রেটিসের পদ্ধতির উপর প্রোটেগোরাস ও অন্যান্য সোফিস্টদের প্রভাবের কথা একেবারে অস্বীকার করা চলে না –

  • প্রথমত, তারা নীতিবিদ্যাকে একটি অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হিসেবে তার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে চিন্তনের অসঙ্গতি প্রকাশিত হতে পারে।
  • দ্বিতীয়ত, তারা শব্দের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কীয় সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর যুক্তির প্রয়োজনীয়তার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সক্রেটিস যখন নীতিবিদ্যার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন তখন প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর নিজের পদ্ধতির লক্ষ বা উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য তিনি এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। প্লেটো সক্রেটিস অনুসৃত প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিকে দ্বান্দ্বিক (Dialectic) এবং তার থেকে পৃথক করার জন্য সোফিস্ট অনুসৃত প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিকে বিতর্কমূলক (Eristic) বলে অভিহিত করেছেন।

প্লেটো মনে করেন যে দ্বান্দ্বিক প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির দুটি প্রধান লক্ষ আছে।

  • প্রথমত, এর লক্ষ হল সত্য আবিষ্কার করা, বিশেষ করে সেই সত্য যা সংজ্ঞার্থের (Definition) আকারে প্রকাশিত হয়।
  • দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতি সত্য আবিষ্কার করার জন্য অপরকে শিক্ষা দেয়। প্লেটো মনে করেন এই লক্ষ লাভের ব্যাপারে এই পদ্ধতি সম্ভাব্য পদ্ধতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি এবং তাঁর মতে, এই লক্ষ দার্শনিক দিক থেকে প্রশংসনীয় লক্ষ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ হল জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করা।

প্লেটো সোফিস্টদের বিতর্কমূলক পদ্ধতির তীব্র নিন্দা করেছেন, বিশেষ করে সত্যের প্রতি এর উদাসীনতার জন্য। প্লেটোর মতে, সোফিস্টদের বিতর্কমূলক পদ্ধতির কোন প্রকৃত বৈজ্ঞানিক লক্ষ ছিল না এবং এর শিক্ষাগত লক্ষ ছিল মূল্যহীন। কাজেই তাঁর মতে, এই মতবাদের বিশেষ কোন দার্শনিক মূল্য ছিল না।

সোফিস্টদের ও সক্রেটিসের পদ্ধতির পার্থক্য : প্লেটো তাঁর ‘Dialogues’-এ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে বলেন যে, বিতর্কমূলক প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তার উদ্দেশ্য হল প্রতিপক্ষকে পরস্পর বিরোধিতার ফাঁদে জড়িয়ে ফেলা। প্রতিপক্ষের লক্ষ হবে, যে কোন ভাবে এই ফাঁদকে এড়িয়ে চলা, তার প্রদত্ত উত্তর, সে বিশ্বাস করে, তাকে প্রকাশ করুক বা না করুক। অপরপক্ষে, সক্রেটিস তাঁর অনুসৃত পদ্ধতির ক্ষেত্রে যাকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন তা হল যে, প্রতিপক্ষ যদি কোন বচনকে বিশ্বাসযোগ্য মনে না করে তাহলে সে যেন কোনমতেই তাতে স্বীকৃতি না দেয়। সক্রেটিসের মতে, শুধুমাত্র অসঙ্গতিকে এড়াবার জন্য যদি কোন বচনে স্বীকৃতি জানান হয়, যাতে প্রতিপক্ষের বিশ্বাস নেই, তাহলে সেটা হবে যা সত্য তাকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রচেষ্টা তার ধ্বংসসাধন করা। প্লেটোর মতে, দ্বান্দ্বিকের বিজ্ঞানসম্মত লক্ষ সোফিস্টদের পদ্ধতির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এটি সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যগ্র নয়, যেকোন প্রকারে জয় লাভের জন্য বাগ্র। এছাড়া সোফিস্টদের পদ্ধতির অন্য কোন গ্রহণযোগ্য লক্ষ আছে বলে প্লেটো মনে করেন না। সোফিস্টরা অবশ্য দাবী করেন যে, তাদের পদ্ধতির একটা শিক্ষাগত লক্ষ আছে, যা হল সততা বা নৈতিক উৎকর্ষ শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু ঠিক কি ধরনের উৎকর্ষ তারা শিক্ষা দিতে চায় তার কোন সুনির্দিষ্ট বিবরণ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না, তারা শুধু প্ররোচনামূলক যুক্তি উপস্থাপনের দক্ষতা শিক্ষা দেয়। সোফিস্টরা যা শিক্ষা দেয় তা হল কথা বলার দক্ষতা বা নৈপূণ্য, কিন্তু কোন বিশেষ বিষয় সম্পর্কে কথা বলার দক্ষতার প্রশ্ন উত্থাপন করা হলে দেখা যাবে যে, সে রকম কোন বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই প্লেটোর মতে, সোফিস্টদের পদ্ধতি হল অনুর্বর বা নীরস। প্লেটো সমালোচনার উত্তরে কেউ কেউ বলেন, যে প্লেটোর এই নিন্দাকে সমর্থন করা চলে না, কেননা প্লেটো সোফিস্টদের কোন কোন দার্শনিক যুক্তি ও মতবাদের প্রতি এতখানি আগ্রহ দেখিয়েছেন যে, সেই আগ্রহের সঙ্গে তাঁর এই নিন্দার কোন সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া প্লেটো যে সোফিস্টদের পদ্ধতিকে অনুর্বর বলে অভিহিত করেছেন তাও পুরোপুরি সমর্থন করা যায় না, কেননা যে পদ্ধতি অসঙ্গতির সন্ধান করে এবং সময় সময় দার্শনিক আগ্রহ সঞ্চার করে এমন সমস্যা উত্থাপন করে, তাকে একেবারে অনুর্বর বা শূন্যগর্ভ বলে অভিহিত করা চলে না। তাহলেও একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, দার্শনিক বিশ্লেষণের পদ্ধতির বিকাশের পক্ষে সোফিস্টদের অনুসৃত পদ্ধতি ক্ষতিকর। সোফিস্টদের অনুসৃত পদ্ধতির দ্বারা অসঙ্গতি ও পারস্পরিক বিরোধিতা হয়ত প্রশমিত হয়, কিন্তু তাদের সমাধানের কোন প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় না, কেননা যে পদ্ধতি তাদের প্রকাশ করে, সেই পদ্ধতি তাদের সম্ভাব্য সমাধানের প্রতি উদাসীন। তার কারণ, এই পদ্ধতি সত্য প্রতিষ্ঠায় উদাসীন। প্রশ্নোত্তরের পদ্ধতিকে প্লেটো ‘দ্বান্দ্বিক’ নামে অভিহিত করেছেন এবং এই পদ্ধতিকে বিশ্লেষণের ব্যাপারে আদর্শ দার্শনিক পদ্ধতিরূপে (Ideal philosophical method of analysis) গণ্য করেছেন। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (Dialectic) অর্থাৎ কিনা প্রশ্ন ও উত্তরের সাহায্যে জ্ঞান লাভ করার পদ্ধতি সক্রেটিসের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়নি। পারমিনাইডিসের শিষ্য জেনোই সর্বপ্রথম সুসঙ্গতভাবে এই পদ্ধতির অনুশীলন করেন। তবে সক্রেটিসও যে এই পদ্ধতির বিকাশ সাধন ও অনুশীলন করেন, সেই বিষয়টি অনুমান করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সমালোচনা : এই পদ্ধতির সমালোচনা করতে গিয়ে রাসেল বলেন যে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কয়েকটি প্রশ্নের ব্যাপারে যেমন উপযোগী, তেমনি কয়েকটি প্রশ্নের ব্যাপারে অনুপযোগী। উদাহরণস্বরূপ অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানের উল্লেখ করা যেতে পারে। প্লেটোর রচনাতে সক্রেটিস সবসময়ই বলেছেন যে, যে ব্যক্তিকে তিনি প্রশ্ন করছেন, তার মধ্যে যে জ্ঞান প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান তাকে তিনি প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকট করে তুলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে, কোন জীবাণুর মাধ্যমে রোগের বিস্তার, যেসব ক্ষেত্রে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে এই জ্ঞান প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে কোন অজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে নি :সৃত করা যেতে পারে বলে কখনই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে না। সক্রেটিসের পদ্ধতির সাহায্যে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি উপযোগী সেগুলি হল, সেইসব বিষয়, যেগুলি সম্পর্কে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে, কিন্তু চিন্তার বিভ্রান্তি বা বিশ্লেষণের অভাবের জন্য আমরা যা জানি তার যৌক্তিক ব্যবহারের ব্যাপারে এই পদ্ধতি কার্যকর হয়নি। ন্যায়পরায়ণতা কাকে বলে, এই প্রশ্নটিই ধরা যাক্। আমরা সবাই ‘ন্যায্য’ এবং ‘অন্যায্য’ শব্দ দুটি ইচ্ছামত ব্যবহার করি এবং কিভাবে আমরা তাদের ব্যবহার করি সেটা পরীক্ষা করে দেখার পর আমরা আরোহের সাহায্যে একটা সংজ্ঞাতে উপনীত হই। এখানে যা প্রয়োজন তা হল, কি ভাবে শব্দ দুটি ব্যবহার করি তার জ্ঞান। কিন্তু আমাদের অনুসন্ধান কার্য সমাপ্ত হলে আমরা যা দেখতে পাই তা হল আমরা একটা ভাষা সম্বন্ধীয় বিষয় আবিষ্কার করেছি, কোন নীতি সম্বন্ধীয় বিষয় আবিষ্কার করিনি। যখন তর্কবিতর্কের বিষয় যৌক্তিক (Logical), ঘটনা বিষয়ক (Factual) নয়, সত্য নিষ্কাশনের ব্যাপারে আলোচনা হল একটি উত্তম পদ্ধতি। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি যৌক্তিক সংগতি (Logical Consistency) সৃষ্টির ব্যাপারে উপযোগী কিন্তু নতুন ঘটনা আবিষ্কারের ব্যাপারে একেবারেই নিষ্ফল।

বিচারবুদ্ধিই জ্ঞানলাভের উপায় : সক্রেটিসের মতে, প্রত্যয়ের মাধ্যমেই আমরা সব জ্ঞান লাভ করি। এইকথা বলার অর্থ সক্রেটিস বিচারবুদ্ধিকেই জ্ঞান লাভের উপায় বলে মনে করতেন। কাজেই সোফিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য সহজেই বুঝতে পারা যায়। সোফিস্টদের মতে, জ্ঞানের উৎস হল ইন্দ্রিয় সংবেদন, প্রত্যক্ষই জ্ঞানের ভিত্তি। কিন্তু প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয় সংবেদন একরূপ নয়। প্রত্যক্ষ ব্যক্তিভেদে, কালভেদে পৃথক হয়, আমার কাছে যা সত্য বলে প্রত্যক্ষ হয়, তা আমার কাছে সত্য। কাজেই সোফিস্টরা জ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদ স্বীকার করে। সোফিস্টদের মতে, সব কিছুর পরিমাপ মানুষ নিজে’, ‘যত মানুষ তত মন’। মানুষের প্রত্যক্ষণ ব্যক্তিভেদে পৃথক, মানুষের ধারণার মধ্যে কোন মিল নেই। যথার্থ জ্ঞান সম্ভব নয়। সব জ্ঞানই যদি ব্যক্তিভেদে পৃথক হয়, তাহলে জ্ঞানের কোন ব্যক্তিনিরপেক্ষ ভিত্তি স্বীকার করা চলে না, ব্যক্তি নিরপেক্ষ বা বস্তুগত সত্যতা বলেও কিছু স্বীকার করা চলে না। এমন কোন সত্যতা স্বীকার করা চলে না যা সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, সকলেই যাকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু সক্রেটিস সোফিস্টদের জ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদকে স্বীকার করে নিতে পারলেন না। সক্রেটিস তাই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের উৎস বলে স্বীকার না করে, বুদ্ধিকেই জ্ঞানের উৎস বলে মেনে নিলেন। তিনি দেখলেন, বুদ্ধি সকল মানুষের ক্ষেত্রে একরূপ। বুদ্ধিতে যা সত্য বলে গৃহীত হবে তাই সত্য। সক্রেটিস জ্ঞানকে প্রত্যয়ের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলেন, বুদ্ধি প্রত্যয়ের মাধ্যমেই সত্য নিরূপণ করে। সক্রেটিস জ্ঞানের একটা ব্যক্তি নিরপেক্ষ বা বস্তুগত ভিত্তির অস্তিত্বে মানুষের বিশ্বাসকে পুনপ্রতিষ্ঠিত করলেন। সত্যের বস্তুগত মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করে তিনি জ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদকে অস্বীকার করলেন। সত্যের মানদণ্ডের সঙ্গে কোন ব্যক্তির জ্ঞানের সঙ্গতি থাকলেই জ্ঞান সত্য। ব্যক্তি কোন জ্ঞানকে সত্য মনে করলেই যে সেই জ্ঞান সত্য হবে তা মেনে নেওয়া যায় না।

নীতিবিদ্যা

প্রারম্ভিক আলোচনা

সক্রেটিসের যে জ্ঞানতত্ত্ব উপরে আলোচনা করা হল, সেই জ্ঞানতত্ত্ব সক্রেটিস জ্ঞানতত্ত্বের খাতিরেই উপস্থাপিত করেননি, ব্যবহারিক উদ্দেশ্য বা লক্ষ সিদ্ধ করার জন্যই ঐ জ্ঞানতত্ত্ব উপস্থাপিত করেছিলেন। নৈতিকতাতেই সক্রেটিসের ছিল সমধিক আগ্রহ। অ্যারিস্টটল সুস্পষ্টভাবেই বলে গেছেন যে, সক্রেটিস নৈতিক বিষয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। সক্রেটিস প্রতিটি ব্যক্তিকে বোঝাতে চাইতেন যে তিনি তার ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা করার পূর্বে সততা এবং জ্ঞান সন্ধান করবেন। সক্রেটিস মনে করতেন যে, ডেলফির দেবতা কর্তৃক তাঁর উপর আরোপিত নির্দিষ্ট কাজ হল মানুষকে তার মহৎ অধিকার সম্পর্কে যত্নবান হতে প্রণোদিত করা, সেই মহৎ অধিকার হল তাদের আত্মা।

সততা অর্জনের মধ্য দিয়ে আত্মা সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে : জ্ঞান এবং সততা অর্জনের মধ্য দিয়ে সেই আত্মা সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে। পণ্ডিতগিরি করা সক্রেটিসের উদ্দেশ্য ছিল না, ধ্বংসমূলক সমালোচনায় আত্মনিয়োগ করাও তাঁর লক্ষ ছিল না। ঈশ্বর নির্দিষ্ট এক মহৎ কাজ সম্পাদন করাই ছিল তাঁর লক্ষ। আলাপ আলোচনা বা বিতর্কের সময় তিনি প্রতিপক্ষের ভাসা ভাসা বা অন্তসারশূন্য অভিমত এবং বিনা বিচারে গৃহীত প্রকল্পের কঠোর সমালোচনা করতেন। পাণ্ডিত্য দেখাবার অভিপ্রায়ে তিনি তা করতেন না। তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল আলাপ-আলোচনায় যোগদানকারী ব্যক্তিদের মঙ্গল সাধন করা এবং নিজেও শিক্ষা করা।

নীতিবিদ্যা সম্পর্কে অভিমতে সোফিস্টদের বিরোধিতার প্রভাব : একজন বিশিষ্ট সমালোচকের মতানুসারে সক্রেটিস তাঁর যুক্তির পদ্ধতি বিকাশের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি নীতিবিদ্যা সম্পর্কীয় অভিমতের ক্ষেত্রেও, সোফিস্টরা পথিকৃৎ হিসেবে যে কাজ করে গেছে। সোফিস্টদের বিরোধিতা করতে গিয়ে সক্রেটিস যেসব সিদ্ধান্ত টানেন তার ওপর ভিত্তি করেই সক্রেটিসের নীতিবিদ্যা গড়ে উঠেছে। সোফিস্টদের শিক্ষায় সক্রেটিসের বিরোধিতার কথা আলোচনা করতে গিয়ে সক্রেটিসের নিজের নৈতিক শিক্ষার দুটি লক্ষ পাওয়া যায়। প্রথমটি হল, কয়েকটি মৌলিক নৈতিক নীতি প্রতিষ্ঠা করা, যেগুলি সংশয়াতীতভাবে সত্য হবে। সক্রেটিসের অভিমত হল যে, নৈতিক বিবৃতি হল ব্যক্তিগত বিবৃতি এবং তাদের মধ্যে কোন কোন বিবৃতিকে সত্য বলে জানা যায়, দ্বিতীয় লক্ষ হল, নীতিবিদ্যায় কোন সদর্থক মতবাদ উপস্থাপনের ভূমিকাষরূপ প্রশ্নোত্তর বা জেরা করার পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রীকদের নৈতিক পারিভাষিক শব্দের ব্যাখ্যা করা। দুটৈ সোফিস্টদের বিরোধিতা থেকেই আগত –

  • সংশয়াতীতভাবে সত্য মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠা : সোফিস্টরাই সর্বপ্রথম নীতিবিদ্যার সমস্যা নিয়ে সুবিন্যস্ত ভাবে চিন্তা করেছিল এবং তাদের সমালোচনামূলক সংশয়বাদ এবং তাদের প্ররোচনামূলক সদর্থক মতবাদ, তারা যে সব সমস্যার উত্থাপন করেছিল, সেগুলিকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটা তাৎক্ষণিক উদ্দীপনা যুগিয়ে দিয়েছিল। সক্রেটিসের প্রতিক্রিয়া ছিল বিরোধিতার প্রতিক্রিয়া। সক্রেটিস নীতিবিদ্যায় যে পদ্ধতির মাধ্যমে অনুসন্ধান কার্য চালিয়েছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল না, যে-কোন ভাবে জয়লাভ করার পদ্ধতি, বরং এটা ছিল যা সত্য তাকে প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি, যাকে নিরপেক্ষভাবে বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে গ্রহণ করা যেতে পারে। তাঁর সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তিনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করছেন তা, যা সুনিশ্চিতভাবে সত্য, তা প্রদান করতে পারে। এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি প্রোটেগোরাসের নৈতিক বস্তুনিরপেক্ষবাদ (Moral Subjectivism), জর্জিয়াসের সংশয়বাদের বিরোধিতা করেছিলেন। সত্যকে অবহেলা ও অশ্রদ্ধা করে সোফিস্টরা যা প্রতিষ্ঠা ও অনুমোদন করতে চায় সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্ররোচনামূলক যুক্তিকৌশল প্রয়োগের যে সাধারণ প্রবণতা সোফিস্টদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল, তিনি তারও বিরোধিতা করেছিলেন।
  • গ্রীকদের নৈতিক পারিভাষিক শব্দের ব্যাখ্যা প্রদান : সক্রেটিসের বিরোধিতার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। সক্রেটিসের পদ্ধতি রচিত হয়েছিল নীতিবিদ্যার ব্যবহারিক সিদ্ধান্তের ঔপপত্তিক সুনিশ্চয়তা (Demonstrative Certainty) প্রদান করার জন্য, কিন্তু ভাষাগত বিশ্লেষণের এটি ছিল একটি মূল্যবান পদ্ধতি। নৈতিক কুটাভাস (যা আপাতবিরোধী মনে হলেও সত্য, Moral Paradoxes) উপস্থাপিত গিয়ে সক্রেটিস যা করেছিলেন তা হল মৌলিক নীতিবিষয়ক পদগুলির অর্থের উপর আলোকপাত করা এবং বিশ্লেষণের সাহায্যে তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধের নির্দেশ করা। এই সব পদের প্রয়োগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। সেটি হল নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে এবং পেশাগত নৈপুণ্য অনুশীলনের ক্ষেত্রে ‘ভাল’ ‘উৎকর্ষ’ ‘জ্ঞান’ প্রভৃতি পদের প্রয়োগের পার্থক্য। এই পার্থক্য আলোচনা করার সময় তাঁর লক্ষ ছিল এই পদগুলির নৈতিক প্রয়োগের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা এবং নৈতিক আচরণ এবং পেশাগত নৈপুণ্য অনুশীলনকে সদৃশ মনে করার প্রবণতার সংশোধন করা। সততা (Virtue)-র শিক্ষক হিসেবে সোফিস্টরা ভালত্বের ভিত্তি হিসেবে বাগ্মিতার নৈপুণ্যের উপর অত্যাধিক আস্থা স্থাপন করেছিল এবং সোফিস্টদের উদ্দেশ্য ছিল নৈতিক আচরণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা। কিন্তু সেগুলিকে তারা অবহেলা করেছিল।

নৈতিক ক্রিয়া হল লক্ষ, জ্ঞান সেই লক্ষ লাভের উপায় : সক্রেটিস সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতেন তবে তখনকার দিনে কোন গ্রীক নগর রাষ্ট্রের সভ্যের পক্ষে তাঁর নৈতিক চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক আগ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব হত না। সক্রেটিস নিজেই বলেছেন যে, কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের স্বার্থের দিকে তাকাবার আগে যেন রাষ্ট্রের দিকে তাকান। যে কোন গ্রীক নাগরিককে ভাল জীবন কাটাতে হলে নগর রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই তা করতে হবে। কাজেই যে কোন গ্রীক নাগরিককে ভাল জীবন কাটাতে হলে জানতে হবে রাষ্ট্র কি? রাষ্ট্র কি, এবং ভাল রাষ্ট্র কি না জানলে, আমরা রাষ্ট্র সম্পর্কে যত্নবান হতে পারি না। কাজেই সক্রেটিসের মতে, নৈতিক ক্রিয়া হল লক্ষ, জ্ঞান হল সেই লক্ষ লাভের উপায়যরূপ।

সক্রেটিসের নৈতিক শিক্ষাগুলি : সক্রেটিসের নৈতিক শিক্ষার বিবৃতিগুলোকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। – (১) সততা ও জ্ঞান অভিন্ন, (২) সততা হলো এক, ও (৩) সততাকে শেখানো যায়। এক এক করে এই তিনটি বিবৃতি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হবে –

সততা (Virtue) এবং জ্ঞান অভিন্ন

সক্রেটিসের মতে, জ্ঞান এবং সততা হল একই বিষয়। সততার অধিকারী হওয়া এবং যা সৎ তা সম্পাদন করার আবশ্যিক এবং পর্যাপ্ত শর্ত হল সততার জ্ঞান। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, যদি কোন ব্যক্তি ‘যথোচিত’ (Right) কি, না জানে, অর্থাৎ ‘যথোচিত’ এই প্রত্যয়টির জ্ঞান যার না থাকে সেই ব্যক্তি যথোচিতভাবে কার্য করতে পারে না। জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি ‘যথোচিত’ কি তা জানেন, উচিত মনে করে কাজ করেন। অন্য কথায়, জেনে শুনে কেউ মন্দ করে না, জেনে শুনে কেউ মন্দটাকে নির্বাচন করে নেয়না। সক্রেটিসের মতানুসারে জ্ঞানের উপরই নৈতিক ক্রিয়ার ভিত্তি এবং নৈতিক ক্রিয়া অবশ্যই জ্ঞান থেকে উদ্ভুত হবে। সক্রেটিসের মতে, নৈতিক জ্ঞান হল প্রধানত সাধারণ সংজ্ঞার্থের মাধ্যমে জ্ঞান এবং এই জ্ঞান হল সব নৈতিক সত্যতার ভিত্তি। সক্রেটিস শুধু এই কথাই বলেননি যে, কোন মানুষের জ্ঞান না থাকলে সে উচিতমত কাজ করতে পারে না, তিনি একথাও ঘোষণা করলেন যে, যদি কোন ব্যক্তি জ্ঞানের অধিকারী হয়, সে অন্যায় করতে পারে না।

সব অন্যায় কাজই অজ্ঞতা প্রসূত : সব অন্যায় কাজই অজ্ঞতাপ্রসূত। যদি কারও জানা থাকে কোনটা যথোচিত, সে অবশ্যই এবং অনিবার্যভাবে যা যথোচিত, তাই সম্পাদন করবে। সক্রেটিস মনে করেন ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ অনুচিত কার্য সম্পাদন করে না। কোন ব্যক্তি যদি কোন মন্দ কাজ করে তাহলে বলতে হবে সে মন্দ জেনে মন্দ কাজ করছে না। সে কাজটি ভাল জেনেই করেছে। এর কারণ হল যদি মন্দকে মন্দ জেনে কাজ করে তাহলে সেটা হবে নিজের পক্ষে ক্ষতিকারক, এমন কাজ করা এবং এটা হল নিজেকে দুঃখী এবং অসুখী হবে জেনেও তা সম্পাদন করা। কিন্তু কেউ অসুখী হতে চায় না। সুতরাং কোন ব্যক্তি যাকে মন্দ বলে জানে, তা সম্পাদন করতে পারে না। ‘সততা হল জ্ঞান’-এর অর্থ হল যে, ব্যক্তির কামনার বস্তু হল যা প্রকৃতপক্ষে ভাল অর্থাৎ কিনা, যে ব্যক্তি জানে কি উচিত বা ভাল সে অনিবার্যভাবে তার ইচ্ছানুসারে কাজ করে এবং সেহেতু অনিবার্যভাবে যা প্রকৃতপক্ষে ভাল তা সম্পাদন করে। যে ব্যক্তি কোন কিছুকে অন্যায় বলে জানে সে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় কাজ সম্পাদন করে না। এখানে একথা বলা হচ্ছে না যে, প্রকৃত অন্যায় কাজ বলে কিছু নেই এবং সেগুলি ঐচ্ছিক নয়। এখানে যা বলা হচ্ছে তা হল কর্মকর্তা যাকে যথোচিত বলে মনে করে, তার বিরোধী ঐচ্ছিক ক্রিয়া আছে। অর্থাৎ কর্মকর্তা যথোচিত জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে তার বিরোধী কাজ সম্পাদন করছে।

‘সততা হল জ্ঞান’ : এই বিষয়টির ব্যাখ্যার জন্য সক্রেটিস পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্য (Professional Skills)-র সঙ্গে তাকে তুলনা করেছেন। ‘প্লেটোর’ Euthydemus-এ সক্রেটিস এ বিষয়টির আলোচনা করেছেন। তাঁর যুক্তি হল পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্যের সফল অনুশীলনের ক্ষেত্রে যেমন জ্ঞান হল একটি শর্ত তেমনি নৈতিক আচরণের যেটি লক্ষ অর্থাৎ কিনা, ‘শান্তি’ (Happiness), তাকে পাবার জন্য নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে জ্ঞান হল একটি শর্ত, যে জ্ঞান তাকে তার জাগতিক সম্পদ, দৈহিক সামর্থ্য ইত্যাদিকে সুবিধামত প্রয়োগ করে লক্ষ লাভে সমর্থ করে।

নৈতিক জ্ঞান ও পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্য অনুশীলনের পার্থক্য : কিন্তু এই উপমার ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে –

  • প্রথমত, নৈতিক জ্ঞানের উৎকর্ষ অন্য জ্ঞানের তুলনায় অধিকতর। কেননা নৈতিক জ্ঞানই হল একমাত্র জ্ঞান যা মানুষের সবরকম কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে যা সঠিকভাবে কাম্য, সেই লক্ষ অর্থাৎ শান্তি লাভে সমর্থ করে। সেই কারণে নৈতিক জ্ঞানের পরিসর ব্যাপকতর এবং এই জ্ঞান প্রভূত্বব্যঞ্জক।
  • দ্বিতীয়ত, পেশা সংক্রান্ত নৈপুণ্যের জ্ঞানের সঙ্গে নৈতিক জ্ঞানের আর একটি বিশেষ পার্থক্য হল এই যে, নৈতিক জ্ঞান এই বিশ্বাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করে যে, সততার জ্ঞান শান্তি লাভের পক্ষে শুধুমাত্র আবশ্যিক নয়, একটি পর্যাপ্ত শর্ত। পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্যের জ্ঞানের সঙ্গে নৈতিক জ্ঞানের তুলনার একটা বিশেষ অসুবিধা রয়েছে। পেশাগত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে জ্ঞান আবশ্যিক হলেও পর্যাপ্ত শর্ত নয়। বিষয়টা বুঝে নেওয়া যাক্‌— পেশাগত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যকে ‘যথোচিত (Right) মনে করা হয়, ব্যক্তির সেই লক্ষ লাভের সামর্থ্য থাকলেও ব্যক্তি যে তাকে লাভ করার জন্য ইচ্ছা করে বা কামনা করে, ব্যক্তির সামর্থ্য সেই বিষয়টি প্রতিপাদিত করে না। ব্যক্তি কোনটি যথোচিত ‘লক্ষ’ তা জেনেও তাকে লাভ না করার জন্য ইচ্ছুক হতে পারে। যথোচিত লক্ষ্যকে লাভ করার জন্য, সক্রেটিসের মতে, সামর্থ্য আবশ্যিক হলেও পর্যাপ্ত নয়। নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে যথোচিত লক্ষ্যকে লাভ করার সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয় তাকে লাভ করার বাসনা। কাজেই যখন বলা হয় সততা হল জ্ঞান, তখন ‘যথোচিত’ লক্ষ্যকে লাভ করার জন্য জ্ঞান একাধারে আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত। নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে জ্ঞানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত থাকে সামর্থ্য (Ability) এবং যা সৎ তাকে লাভ করার বাসনা (the desire to achieve what is Good) যথোচিত লক্ষ হল যা প্রকৃতপক্ষে সৎ বা কল্যাণকর (Good)। পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে সামর্থ্যের বিষয়টি ছাড়াও একটি বাহ্য বাধ্য-বাধকতার প্রশ্ন এসে পড়ে। কিন্তু যখন বলা হয় সততা হল জ্ঞান তখন তার অর্থ হল সব ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যা সৎ, তা সম্পাদনের ব্যাপারে জ্ঞান হল আবশ্যিক এবং পর্যাপ্ত শর্ত।
  • তৃতীয়ত, নৈতিক আচরণের সঙ্গে পেশাগত নৈপুণ্যের অনুশীলনের আর এক বিষয়ে পার্থক্য আছে। এটি হল, যেভাবে জ্ঞানের প্রয়োগ করা হয় তার প্রকৃতি নিয়ে। পেশাগত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্যের জ্ঞান বড় কথা নয়, লক্ষ লাভের দক্ষতাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে খারাপ দৌড়ায়, সে জানে তার লক্ষ হল প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করা কিন্তু তাকে অজ্ঞ বলে গণ্য করা হয় এই জন্য যে, লক্ষ সম্পর্কে অবহিত হয়েও সে খারাপভাবে দৌড়াচ্ছে। নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে যথোচিত লক্ষ্যের জ্ঞান হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, লক্ষ লাভের উপায়ের জ্ঞান বড় কথা নয়। সেই কারণেই সক্রেটিস অন্য প্রশ্নের তুলনায় ‘ভালত্ব’ কি তার উপরে সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোনটা উচিত জানেনা বলেই ব্যক্তি অনুচিত কার্য সম্পাদন করে।

পরকাল নয় কল্যাণের জন্য নৈতিকতা ও তাতে জ্ঞানের গুরুত্ব : তাঁর নীতিতত্ত্বের সঙ্গে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। সক্রেটিস তাঁর নীতি তত্ত্বকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিলেন। তাঁর নীতিতত্ত্ব স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। সক্রেটিস মনে করতেন যে, সংসারে প্রকৃত দুর্ভাগ্য হল মন্দ করা এবং প্রকৃত সুখ হল কল্যাণ করা। যেহেতু কোন ব্যক্তি সেচ্ছায় দুর্ভাগ্যকে পেতে চায় না বা নিজের ক্ষতি করতে চায় না, সেহেতু কেউ স্বেচ্ছায় মন্দ করে না। ভাল কি তা যে জানে, সে অবশ্যই ভাল কাজ সম্পাদন করবে। অবশ্য ভালকে জানা বা ভালর জ্ঞান বলতে সক্রেটিস শুধুমাত্র শুদ্ধ তাত্ত্বিক জ্ঞানের কথা বোঝেননি, যে জ্ঞান অর্জন করলেই কাজ হয়ে যাবে। তিনি জ্ঞান বলতে বুঝেছেন, জীবনে যা যথার্থ মূল্যবান তার সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত এক অবিচল দৃঢ় প্রত্যয়, সক্রেটিস নিজে যার অধিকারী ছিলেন। যা কল্যাণকর বা ভাল তার জ্ঞানের বিপরীত জ্ঞান হল আত্মপ্রতারণা। কাজেই কোন অবস্থাতেই মন্দ বা অন্যায় করা চলবে না, তার জন্য যে কোন কষ্ট, এমনকি মৃত্যুকেও বরণ করে নেওয়া যেতে পারে। যা নৈতিক, অর্থাৎ নীতিবিগর্হিত নয়, তা শর্তহীন এবং সব অবস্থাতেই একরূপ। প্রকৃত নৈতিকতা এক শক্তি, মন্দ লোকের তুলনায় সৎ লোক শক্তিশালী। মন্দ লোক তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। সততাই সততার পুরস্কার, মৃত্যুর পরে কোন নতুন জীবনে উত্তীর্ণ হওয়া সততার পুরস্কার নয়। সক্রেটিস বলেন, “কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় অনুচিত কার্য করে, সেই ব্যক্তি, যে অনিচ্ছায় অনুচিত কার্য সম্পাদন করে, তার থেকে ভাল। কেননা, প্রথম ব্যক্তির মধ্যে সততার প্রয়োজনীয় শর্তটি উপস্থিত অর্থাৎ সততার জ্ঞান তার মধ্যে আছে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির মধ্যে সততার জ্ঞানের অভাব থাকার জন্য দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির তুলনায় নিকৃষ্ট।”

স্বেচ্ছাকৃত অনৈতিকতার ভিত্তিতে সক্রেটিসের সততা ও জ্ঞানের অভিন্নতা দাবির সমালোচনা : 

  • কপলস্টোনের মতে, সক্রেটিসের এই নৈতিক বুদ্ধিবাদ প্রথম দর্শনেই বোঝা যায়। যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। কেননা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জানি যে, অনেক ক্ষেত্রে অনুচিত জেনেও আমরা স্বেচ্ছায় অনুচিত কার্য সম্পাদন করি। কোন কোন মন্দ কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব যখন আমরা কোন ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিই তখন কি আমরা মনে করি না যে, ব্যক্তিটি মন্দ জেনেও কার্যটি করেছে। যদি আমরা মনে করি যে, কাজটা অনুচিত বলে তার জানা ছিল না, সেক্ষেত্রে সেই কার্য সম্পাদনে নৈতিক দায়িত্ব তার আছে বলে আমরা মনে করি না। সক্রেটিস মনে করেন যে, নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে, পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে যেমন, নৈতিক জ্ঞান অনিবার্যভাবে কর্মকর্তা যা সম্পাদন করতে চায়, তার জন্য তাকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা বা সামর্থ্যের অধিকারী করে। জনৈক সমালোচকের মতে, এক্ষেত্রে সক্রেটিস যা অনুমান করা দরকার, তার বেশি অনুমান করেছেন। বস্তুতপক্ষে তিনি অনুমান করেছেন যে, ব্যক্তি যাকে যথোচিত বলে জানে অনিবার্যভাবে তাই সম্পাদন করবে ইচ্ছা করে এবং কোন বিশেষ ক্ষেত্রে এই ইচ্ছাটাই তার মধ্যে অনিবার্যভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ইচ্ছা। তা হলে সক্রেটিস সেই সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে চাইছেন যে, কোন ব্যক্তি কোন কিছুকে যথোচিত জেনেও তার বিপরীত কাজ করছে। কাজেই ইচ্ছার দুর্বলতার ক্ষেত্র যে রয়েছে তা তিনি অস্বীকার করতে চাইছেন। এক্ষেত্রে সক্রেটিসের বক্তব্যের সমালোচনা করা যেতে পারে। জ্ঞানকে সাধারণ নৈতিক নীতির বৌদ্ধিক উপলব্ধির সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা হয়েছে।
  • বিচারবুদ্ধিসম্মত দৃঢ় বিশ্বাস (Intellectual Conviction) ইচ্ছাকে অনিবার্যভাবে নিয়ন্ত্রিত করে না। সক্রেটিস যেমন মনে করেন, বিচারবুদ্ধির দিক থেকে ব্যক্তি যাকে অন্যায় বলে জানে, ব্যক্তি তা সম্পাদন করার ইচ্ছা করতে পারে। কাজেই সক্রেটিস নৈতিক আচরণ এবং পেশাসংক্রান্ত নৈপুণ্য— এই দুই–এর মধ্যে তুলনা যথাযথভাবে করতে পারেননি। যা অন্যায় তাকে সমর্থন করার জন্য যদি যথোচিত জ্ঞানের অভাবকে টেনে নিয়ে আসা হয়, তা হলে সেই সমর্থনের ব্যাপারকে খুব জোরালো মনে করা যেতে পারে না।
  • অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের মতবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, সক্রেটিস মানুষের আত্মার অ-বুদ্ধিজনিত উপাদান বা অংশগুলি (Irrational Parts ) কে উপেক্ষা করেছেন। অধিকাংশ মানুষই যে আত্মার অ-বুদ্ধিজনিত অংশ, অর্থাৎ কামনা বাসনা, আবেগ প্রভৃতির দ্বারা প্রণোদিত হয়ে ক্রিয়া করে, সক্রেটিস সেই বিষয়কে ভুলে গেছেন। মানুষকে রিপুর অধীনতা স্বীকার করে নিয়েও কার্য করতে হয়। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে নৈতিক দুর্বলতা আছে, যে দুর্বলভাবশত সেই অনুচিত জেনেও কোন কোন কার্য করে, সেই বিষয়টি সক্রেটিস উপেক্ষা করেছেন।
  • স্টেইস মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের যে সমালোচনা করেছে, তার কোন জবাব নেই। কেননা অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, মানুষ যেচ্ছাকৃতভাবে অনুচিত কার্য সম্পাদন করে। উচিত কি, তা জেনেও মানুষ অনুচিত কার্য সম্পাদন করা থেকে বিরত হয় না।

জ্ঞান ও সততাকে অভিন্ন গণ্য করার কারণ : কেন সক্রেটিস জ্ঞান ও সততাকে অভিন্ন গণ্য করলেন? তাঁর এই সিদ্ধান্তে উপনীতি হবার কারণ কি? সমালোচকবৃন্দ এর কারণ আবিষ্কারের জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁদের মতে, সক্রেটিস নিজেকে দেখেই এই সিদ্ধান্ত করেছিলেন। সক্রেটিস নিজে ছিলেন নৈতিক আচরণের ব্যাপারে মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। তিনি রিপুর দ্বারা চালিত হতেন না, বুদ্ধির দ্বারা চালিত হতেন। সক্রেটিস নিজে কোন কিছুকে উচিত বলে জানলে অবশ্যই তা সম্পাদন করতেন। তিনি বুঝে উঠতে পারতেন না যে, মানুষ উচিত জেনেও অনুচিত কাজ করে কিভাবে। মানুষ অসদাচারে লিপ্ত হয় কারণ সক্রেটিস মনে করেন তারা কোন্‌টা উচিত জানে না। কাজেই অ্যারিস্টটলের সমালোচনা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সক্রেটিসের মতবাদকে একেবারে অগ্রাহ্য করলে চলবে না। আসলে সক্রেটিস যখন জ্ঞানকে সততার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন তখন তাঁর মনে বিশেষভাবে যে বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করেছিল তা হল তার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস যে, মানুষের যদি যথোচিতের জ্ঞান থাকে সে অনুচিত কার্য করতে পারে না। কিন্তু স্টেইস বলেন যে, যে মানুষেরা প্রতিদিন গীর্জায় যায় তারা সেখানে প্রার্থনা করার সময় বলে যে জাগতিক ধনসম্পদের তুলনায় আধ্যাত্মিক সম্পদ অনেক বড়। তাদের জিজ্ঞাসা করলে বলবে যে, তারা তাই বিশ্বাস করে যদিও বাস্তব জীবনে তারা জাগতিক ধনসম্পদকে জীবনের পরম কল্যাণ মনে করে সেগুলিই শুধু অনুসন্ধান করতে চায়। কাজেই এই সব ব্যক্তি যা বিশ্বাস করছে তা অনুসরণ করছে না এবং সত্যই যদি তারা আধ্যাত্মিক সম্পদের শ্রেষ্ঠতা সম্পর্কে অবহিত হত তাহলে তারা জাগতিক সম্পদের জন্য লালায়িত হত না।

অ্যারিস্টোটলের সততার সাথে তার সততার তুলনা : সক্রেটিস এই কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, সবাই নিজ কল্যাণ কামনা করে, কিন্তু কল্যাণের প্রকৃতি বা স্বরূপ কি জানে না। সক্রেটিসের বক্তব্যের মধ্যে যে সত্যতা নেই তা নয়। তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, মানুষ স্বেচ্ছাকৃতভাবে অন্যায়কে অন্যায় জেনেও তা সম্পাদন করে। সক্রেটিস বলেন, সততা হল জ্ঞান, অ্যারিস্টটল বলেন, সততা হল অভ্যাস। আসলে সততা হল জ্ঞান এবং অভ্যাস দুই-ই। কর্তব্যের জ্ঞানও যেমন প্রয়োজন, নিয়মিত, কর্তব্য করার অভ্যাসও ততোধিক প্রয়োজন, যার ফলে সততা অর্জন করা সম্ভব হয়। এই প্রসঙ্গে আর একটি প্রশ্ন দেখা দেয় যে, সক্রেটিস যথোচিত (Right) বলতে কি বুঝেছেন? সক্রেটিসের মতে, সেই কাজই যথোচিত, যা মানুষের প্রকৃত উপকার সাধন করে, অর্থাৎ কিনা— মানুষের যথার্থ সুখ উৎপাদন করে। প্রত্যেকেই নিজের ভাল বা কল্যাণ কামনা করে। কিন্তু যে-কোন কাজ যত মনোরমই মনে হোক না কেন, মানুষের যথার্থ সুখ সব সময় উৎপাদন করে না। কোন মাতাল অবিরত মদ পান করে আনন্দ পেতে পারে, কিন্তু এই মদ্যপান তার পক্ষে যথার্থ কল্যাণকর নয়। যদি সে মনে করে এতেই তার পরম কল্যাণ তাহলে সে অজ্ঞতাবশত ভুল কাজ করছে এবং তার প্রকৃত কল্যাণ কি, উপলব্ধি করতে পারছে না। সক্রেটিস হয়ত বলবেন যে, ব্যক্তিটি যদি প্রকৃতই জানত যে মদ্যপান না করা তার প্রকৃত কল্যাণ ও মুখলাভের পক্ষে একান্তই প্রয়োজন তাহলে সে কখনও মদ্যপান করত না। অবশ্য অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে সক্রেটিসের সমালোচনা করা যেতে পারে যে, কোন ব্যক্তি মদ্যপান তার পরমশান্তি লাভের পক্ষে সহায়ক নয় জেনেও মদ্যপানে আসক্ত হতে পারে। এটা সত্য, অ্যারিস্টটলের সমালোচনাকে অস্বীকার করা যায় না, তবে একথা বলা যেতে পারে যে-কোন ব্যক্তির মদ্যপানের কুফল সম্পর্কে যদি প্রকৃতই ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস জাগে, তাহলে সে মদ্যপানে আসক্ত হবে না, বা আসক্ত হলেও আসক্তি থেকে মুক্ত হবার জন্য নিজেকে মদ্যপান থেকে নিবারিত করবেন। কপলস্টোন বলেন যে, সক্রেটিসের অতি-বৌদ্ধিক মনোভাব যেমন গ্রহণ করা চলে না, তেমনি নৈতিক দূর্বলতা একটা বাস্তব সত্য, অ্যারিস্টটলের এই অভিমতও স্বীকার করে নেওয়া যায় না, যাকে সক্রেটিস অগ্রাহ্য করেছেন। তবু সক্রেটিসের নীতিতত্ত্ব অবশ্যই মানুষের কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। নৈতিক নিয়ম অবশ্যই মানুষের প্রকৃত কল্যাণের প্রকাশক হবে। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, সক্রেটিস কল্যাণ বলতে কি বোঝেন? যে-কোন গ্রীক যেমন মনে করতেন তেমনি সক্রেটিসও কল্যাণ বলতে বুঝতেন শান্তি (Happiness)”। সক্রেটিসের কৃতিত্ব হল এইখানে যে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, নৈতিক মূল্য হল অপরিণামী (Constant) এবং এই নৈতিক মূল্যগুলিকেই তিনি সার্বিক বা সামান্য সংজ্ঞার মধ্যে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, যেগুলিকে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে পথ-প্রদর্শক এবং আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে।

সততা হল এক

সততা যে এক, জ্ঞান ও সততার অভিন্নতা থেকেই তা নির্ভূত হয়। আমরা একাধিক সততা বা সদগুণের কথা বলে থাকি। যেমন, মিথ্যাচার, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি, মহানুভবতা, দয়া, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা ইত্যাদি। সক্রেটিস মনে করতেন এইসব বিশেষ সদগুণের উৎস একটিমাত্র। সেটি হল জ্ঞান। কাজেই জ্ঞানই হল একমাত্র সদ্‌গুণ, অন্য সদ্‌গুণগুলি যার অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র এক সততার অস্তিত্ব আছে, যার ধর্ম উপলব্ধি করলে দেখা যাবে যে, তাই মানুষের সত্যিকারের মঙ্গলের কারক, তাই মানুষের আত্মার স্বাস্থ্য ও সামঞ্জস্য রক্ষার পক্ষে যথার্থ উপযোগী। ‘সব সৎগুণ হল এক’ – সক্রেটিসের এই মতবাদ নীতিবিদ্যায় সক্রেটিসের বুদ্ধিবাদের চরম প্রকাশ লক্ষ করা যায়। নৈতিক আচরণ নিরূপণের ব্যাপারে বুদ্ধির প্রাধান্য প্রদর্শনের চরম প্রচেষ্টাও এক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। ‘সততা হল জ্ঞান’, এই মতবাদে বুদ্ধিবাদের প্রকাশ ঘটেছে এবং এই মতবাদই দ্বিতীয় মতবাদটির উৎস যে, সব সদগুণ হল এক (all the virtues are one)। সক্রেটিস দেখতে চান যে, যে কোন একটি বিশেষ সদগুণের অধিকারী হতে হলে কল্যাণের জ্ঞান হল আবশ্যিক শর্ত। ‘সততা হল জ্ঞান’ এরই ভিত্তিতে তিনি বলেন যে, কল্যাণের জ্ঞান যেকোন বিশেষ সৎগুণের অধিকারী হবার ব্যাপারে আবশ্যিক এবং পর্যাপ্ত শর্ত। তিনি সিদ্ধান্ত করলেন যে, প্রতিটি সৎগুণের সংজ্ঞার্থ দিতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে, এটি হল কল্যাণের জ্ঞান। কাজেই কোন সৎগুণ অন্য সৎগুণ থেকে স্বতন্ত্র নয়। সব সৎগুণই হল এক।’

মানুষের কাজের লক্ষ হল শান্তি : ‘সততা হল এক’– এই বচনটির ভিত্তি হল সক্রেটিসের ‘কল্যাণ’ (Good) সম্পর্কে ধারণা। সক্রেটিসের মতে, মানুষের কাজের লক্ষ হল শান্তি (Happiness) এবং এই হল কল্যাণ। কোন কাজ তখনই ভাল যখন সেটি সেই লক্ষ লাভ করার উপযোগী। সেহেতু শান্তি বা কল্যাণ হল মানুষের কাজের একটিমাত্র বিশিষ্ট লক্ষ, যেক্ষেত্রে এই লক্ষ সব নৈতিক সৎ আচরণের ঐক্যকে স্বীকার করে নেয়। অর্থাৎ সব নৈতিক সৎ আচরণ হল মাত্র এক ধরণের বিশিষ্ট আচরণ বা চরিত্রের এক বিশিষ্ট অবস্থা যা শান্তিলাভের উপযোগী। নৈতিক দিক থেকে মানুষের সেই কাজই প্রশংসনীয় যদি সেটি উপরিউক্ত নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে লাভ করার উপযোগী হয়। বিশেষ বিশেষ সদ্‌গুণগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, সেটি হল তাদের প্রত্যেকেই একটি বিশিষ্ট লক্ষ লাভের উপায় স্বরূপ। দ্বিতীয়ত, এই বিশেষ বিশেষ গুণগুলির যথাযথ প্রয়োগের জ্ঞান অর্থাৎ সঠিক সময়, কিভাবে তাকে প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদের প্রয়োগের বিষয়বস্তু কি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই জ্ঞান মানুষের কাজের অন্তিম লক্ষ্যের জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। লক্ষ্যের সংজ্ঞার্থ হল সক্রেটিসের মতে, কল্যাণ কি, তার বর্ণনামূলক বিশদ বিবরণ। কাজেই কোন একটি বিশেষ সৎগুণের বিশদ বিবরণের জন্য প্রয়োজন কল্যাণ কি, তাকে জানা। সক্রেটিসের মতে, ‘কল্যাণের জ্ঞান প্রতিটি সৎগুণের অধিকারী হবার পর্যাপ্ত শর্ত। সক্রেটিস সিদ্ধান্ত করেন যে, প্রতিটি সৎগুণের সংজ্ঞার্থের জন্য কল্যাণের জ্ঞান হল পর্যাপ্ত শর্ত। কাজেই সব সৎগুণ হল এক, কেননা সংজ্ঞার্থের দিক থেকে বিচার করলে তারা সমতুল্য। সক্রেটিসের মতে ‘সততা হল জ্ঞান এবং বিশেষ বিশেষ সংগুণের প্রতিটিই হল জ্ঞান (Each of the particular virtues is Knowledge)। অর্থাৎ কিনা কোন বিশেষ সৎগুণের জ্ঞান অন্য কোন বিশেষ সৎগুণের সমতুল্য। যে-কোন একটি বিশেষ সৎগুণকে জানতে হলে কল্যাণ কি জানলেই যথেষ্ট।

আপাত বিরোধিতা : সব সৎগুণ হল এক, এর পক্ষে সক্রেটিসের প্রদত্ত যুক্তি খুব জোরালো নয় বলেই সমালোচকেরা মনে করেন। সব সৎগুণ হল এক— সক্রেটিসের এই মতবাদ, সক্রেটিস যে চরিত্র এবং অনুভূতিকে কোন আমল দেননি, সেই সমালোচনাকে আরও জোরালো করে তোলে। তবে জনৈক সমালোচকের মতে, সক্রেটিস এই মতবাদ উপস্থাপিত করতে গিয়ে নৈতিক চরিত্র এবং অনুভূতির প্রতি উদাসীন ছিলেন, এমন কথা বলা হলে তা হবে অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট। আসলে এই মতবাদের মধ্যে একটা আপাত-বিরোধিতার ভাব রয়েছে। প্রাথমিক বিষয় হিসেবে যেটি সক্রেটিস দেখাতে চান সেটি হল কল্যাণ বা শান্তি লাভের জন্য কল্যাণের জ্ঞান হল পর্যাপ্ত এবং সেই কারণে এই উদ্দেশ্যের জন্য বিশেষ বিশেষ সৎগুণের পার্থক্য অনুমান করে নেবার কোন প্রয়োজন নেই বা শান্তিকে লাভ করার জন্য বিশেষ বিশেষ সৎগুণের পারস্পরিক পার্থক্যকে একটা শর্ত হিসেবে গণ্য করার প্রয়োজন নেই। তাঁর সিদ্ধান্ত হল প্রতিটি কল্যাণের জ্ঞান হিসেবে প্রতিটি সৎগুণের সংজ্ঞার্থ দেওয়া যায় এবং সেহেতু তথাকথিত অন্য সৎগুণ থেকে তাকে প্রভেদ করা চলে না। এই বিষয়টির সমগ্র মতবাদে একটি আপাতবিরোধিতার ভাবের সৃষ্টি করছে। কিন্তু সক্রেটিস একথা কখনই স্বীকার করে নেবেন না যে, কল্যাণের জ্ঞান যে কোন বিশেষ সৎগুণের সম্পূর্ণ সংজ্ঞার্থ, যেমন তিনি মনে করেন না যে, সততা হল জ্ঞান এই বিবৃতির ক্ষেত্রে জ্ঞানই হল কল্যাণের সংজ্ঞার্থ।

অ্যারিস্টটলের অভিমতের সঙ্গে সক্রেটিসের অভিমতের পার্থক্য : এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করা যেতে পারে যে, অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের সঙ্গে একমত যে, নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার অর্থ সব সৎগুণের অধিকারী হওয়া। অবশ্য নৈতিক জ্ঞান সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণা সক্রেটিসের ধারণা থেকে স্বতন্ত্র। সক্রেটিসের মতে, নৈতিক জ্ঞান চরিত্রের সততার একটি আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত। অ্যারিস্টটলের মতে, চরিত্রের সততা পর্যাপ্ত না হলেও নৈতিক জ্ঞানের একটি আবশ্যিক শর্ত। তারাই নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী যারা সৎ চরিত্রের অধিকারী। চরিত্রের সততা বা উৎকর্ষ সব নৈতিক সৎগুণকে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। কাজেই অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের ‘সততা হল এক’ বা ‘সব সৎগুণ হল এক’— এবং ‘সততা হল জ্ঞান’ এই মতবাদ গ্রহণ করলেও তাঁর নিজের নৈতিক জ্ঞান সম্পৰ্কীয় অভিমতের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে তাকে পরিবর্তিত করে নিয়েছেন। সক্রেটিসের যে বক্তব্য তিনি স্বীকার করে নিতে পারেননি তা হল, সততার জ্ঞানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত রয়েছে, যা সৎ তা সম্পাদন করার ইচ্ছা। অ্যারিস্টটলের মতে, এই ধরণের অনুমানে ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ে দেওয়ার মত অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। নৈতিক আচরণের পথনির্দেশক হিসেবে বিচারবুদ্ধির ফলপ্রসূতায় সক্রেটিসের যে অবিচল বিশ্বাস ছিল, কি অ্যারিস্টটল বা প্লেটো, কারও সেই বিশ্বাস ছিল না।

সততা শেখানো যায়

এই বচনটিও ‘সততা জ্ঞানের সঙ্গে অভিন্ন’— এই জ্ঞান থেকে নিসৃত হয়। সোফিস্টরাও মনে করতেন যে সততা শিক্ষণীয়, সততাকে শেখানো যেতে পারে। তবে এখানে ‘সততা’ বলতে সোফিস্টরা কি বুঝেছে সেটা আমাদের জানা দরকার। সোফিস্টরা সততা বলতে রাষ্ট্র এবং পরিবারকে যথাযথভাবে চালিত করার কৌশলকে বুঝত, সততা ছিল দক্ষতা বা কলাকৌশলের ব্যাপার। সততা হল দলগত চক্রান্ত করার কলাকৌশল। কিন্তু সক্রেটিস সততা বলতে তা বোঝেননি। সক্রেটিসের মতে, সততা কোন দক্ষতা বা কলাকৌশলের ব্যাপার নয়। সক্রেটিস দু-ধরনের সততার মধ্যে পার্থক্য করেছেন— দার্শনিক সততা (Philosophic Goodness) এবং লৌকিক সততা (Popular Goodness)। প্রথমটি বুদ্ধিনির্ভর, দ্বিতীয়টি অভ্যাসনির্ভর। প্রথমটিই শেখানো যায় কেননা এটিই কেবলমাত্র জ্ঞান এবং জ্ঞান ছাড়া আর কোন কিছুই শেখানো যায় না। সোফিস্টরা যখন বলেন যে, সততা শেখানো যায় তখন কিন্তু তারা ভুল সিদ্ধান্ত করছেন না। তাদের ভুল তখনই হচ্ছে যখন, যে সততা শেখানো যায় বলে তারা বলছে, তা যে আদপে সততা নয়, সেটা তারা বুঝছেন না এবং সেই কারণে তা মোটেই শেখান যায় না। যা প্রকৃত সততা পদবাচ্য, যা কেবলমাত্র জ্ঞান এবং যাকেই কেবলমাত্র শেখান যায়, তাকে সোফিস্টরা অগ্রাহ্য করেছে। সক্রেটিসের মতে, সততা হল এমন কিছু যা যে আত্মা তার অধিকারী, সেই আত্মার প্রকৃতিহেতুই তার অন্তর্ভুক্ত (Something that belongs to the very nature of the soul that possesses it)। সোফিস্টরা সততার কলাকৌশল শিক্ষা দেওয়ার কথা বলত। কিন্তু তাদের থেকে সক্রেটিসের পার্থক্য হল এই যে, সক্রেটিসের নৈতিক অনুসন্ধানের কার্য সার্বিক এবং অপরিণামী নৈতিক আদর্শের দিকে পরিচালিত। যদিও সক্রেটিসের পদ্ধতি ছিল কথোপকথনের পদ্ধতি, বক্তৃতা দেওয়ার পদ্ধতি নয়, তবু তিনি যে জ্ঞান এবং সততাকে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন, তার থেকেই অনিবার্যভাবে নিসৃত হয় যে সততা শিক্ষণীয়। সততা শিক্ষণীয় একথা বলা হলেও, এটা মনে করা সমীচীন হবে না যে, গণিত যেমন শেখানো যায় সততাকেও অনুরূপভাবে শেখানো যায়। সততা অনেক উপাদানের উপর নির্ভর করে, এইসব উপাদানের মধ্যে মানুষের জন্মগত প্রবণতা, বংশগতি, পরিবেশ প্রভৃতির উল্লেখ করা চলে, যা শিক্ষা, অনুশীলন এবং অভ্যাসের দ্বারা কিছু মাত্রায় পরিবর্তিত হয়। তাছাড়া আমরা মনে করি যে মানুষের চরিত্রকে বিশেষ পরিবর্তিত করা যায় না। অভ্যাস, অনুশীলন এবং আত্মসংযমের দ্বারা মানুষ তার চরিত্রের কিছুটা উন্নতি সাধন করতে পারে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য ধরনের কিছু উন্নতি সাধন সে করতে পারে না। কিন্তু সক্রেটিসের মতে, সততা জ্ঞান নির্ভর এবং যেহেতু জ্ঞান অপরকে প্রদান করা চলে, সেহেতু তার থেকেই এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, সততা শিক্ষণীয়। সক্রেটিস মনে করেন যে, আসল অসুবিধা হল উপযুক্ত শিক্ষকের। কেননা তিনিই শিক্ষা দিতে পারেন যিনি ‘সততা’ এই প্রত্যয়টির তাৎপর্য ভালভাবে জানেন। সততার জ্ঞান নি :সন্দেহে মূল্যবান জ্ঞান। এই জ্ঞান কোন দার্শনিক আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি, যা আবিষ্কার হলে মানুষকে শিক্ষা দেওয়া যাবে এবং মানুষও সঙ্গে সঙ্গে সৎ হবে। এই প্রসঙ্গে কেউ কেউ সততার দুটি রূপের মধ্যে পার্থক্য করেছেন সততার বৌদ্ধিক জ্ঞান, যা শেখানো যায় এবং সততাই (Virtue itself), যা শেখানো যায় না। সক্রেটিস শেখানো বলতে ধারণাগত শিক্ষাদানকে কখনও বোঝেননি, শেখানো বলতে তিনি মনে করেন, মানুষের মধ্যে প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করা। তবে বিজ্ঞতা (Wisdom) বলতে যদি বোঝায় ব্যক্তির প্রকৃত ব্যক্তিগত ধারণা বা বিশ্বাস (Real personal Conviction) এবং যদি তা শেখানো যায়, তাহলে সততাও শেখানো যেতে পারে।

সক্রেটিসের নীতিতত্ত্বের সমালোচনা : সক্রেটিসের নীতিতত্ত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ তাঁর নীতিতত্ত্ব অতি বৌদ্ধিকতা দোষে দুষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। সক্রেটিস মনে করেন যে, চিকিৎসক যেমন তাঁর চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করেছেন তেমনি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিও যা ন্যায় তা শিক্ষা করেছেন।

রাষ্ট্রনীতিতত্ত্ব

সক্রেটিসের সময় এথেন্সে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, সক্রেটিসের বুদ্ধিবাদ সক্রেটিসকে তার প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করতে দেয়নি। যে চিকিৎসকের চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই, কোন রোগী, চিকিৎসার জন্য সেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চাইবে না। তেমনি যারা রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তারা যদি শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হন তাহলে রাষ্ট্রের জনসাধারণ তাঁদের উপরে নির্ভর করে স্বস্তি পাবে না। সেকারণে রাষ্ট্রের যারা পরিচালক তাদের অভিজ্ঞতা যাচাই না করে তাদের নির্বাচন করা, বা অনভিজ্ঞ জনসাধারণের মাঝখান থেকে তাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করাও যুক্তিসঙ্গত নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসকবৃন্দকে অবশ্যই শাসন ব্যবস্থার জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। জাহাজ পরিচালনার ব্যাপারে যার কোন জ্ঞান নেই এবং জাহাজকে কোন পথে চালিত করতে হবে সেই সম্পর্কে যিনি অবহিত নন তার উপর জাহাজ পরিচালনার দায়িত্বভার যেমন অর্পণ করা চলে না, তেমনি রাষ্ট্রশাসন সম্পর্কে এবং রাষ্ট্রের প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কে যার কোন জ্ঞান নেই তাকে রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা কখনও যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

ধর্মতত্ত্ব

ঈশ্বর ও দেবতা সম্পর্কে সক্রেটিসের ধারণা : সক্রেটিস কোন নতুন ধর্মমতের প্রতিষ্ঠা করেননি। গ্রীকদের ধর্মমতের সংস্কার সাধনের অভিপ্রায়ও তাঁর ছিল না। দেবতার কথা বলতে গিয়ে তিনি গ্রীকদের বিভিন্ন দেবতার কথাও বলেছেন। তবে গ্রীক বর্ণিত দেবতাদের গ্লানিকর কাহিনীতে তাঁর ঠিক বিশ্বাস ছিল না। গ্রীক বর্ণিত দেবতাদের ধারণার তুলনায় তাঁর দেবতা সম্পর্কীয় ধারণা ছিল উন্নততর। তিনি মনে করতেন, দেবতাদের জ্ঞান সীমিত নয়, তাঁরা সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ। দেবতারাই সবচেয়ে ভাল জানেন, কল্যাণ কি? কাজেই মানুষের উচিত দেবতার কাছে ধনসম্পদ প্রার্থনা না করে কল্যাণ (Good) প্রার্থনা করা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর সত্য ও মঙ্গলময়। বাহ্য জগতের মধ্য দিয়ে যেমন তাঁর প্রকাশ, তেমনি জীবের অন্তরেও তিনি বিরাজমান। দেবতারা ঈশ্বরের অধীন, এই ধরনের ধারণাতেও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, তবে বহুদেববাদ এবং একেশ্বরবাদের সমস্যার সমাধানে তিনি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। সমস্ত বিশ্বজগতের মধ্যে উদ্দেশ্য নিহিত, এবং এই উদ্দেশ্য প্রত্যক্ষ করে তিনি বুদ্ধিমান জগতকর্তা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই ঈশ্বর সর্বজ্ঞ এবং সর্বমহানুভব। দ্বিতীয়ত, তিনি একটি নৈতিক যুক্তিও দিয়েছেন। সেটি হল মনুষ্য জাতির প্রতি ঈশ্বরের সদয় তত্ত্বাবধান, এই জগতের বিন্যাসের ক্ষেত্রে যা কিছু ঐশ্বরিক তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এবং যা কিছু অসাধুজনিত, অন্যায় এবং কলঙ্কজনক তা থেকে মানুষের বিরত হওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রতিপাদিত করে।

ঈশ্বর, নৈতিকতা ও মনের সম্পর্ক : ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাঁর বিচারবুদ্ধি এবং ঈশ্বরের যে বুদ্ধি, শৃঙ্খলা আনয়ন করে এবং যে জড় জগতে এই শৃঙ্খলা তিনি আনেন – এই দুই–এর দ্বৈতকে সক্রেটিস, মন এবং দেহের দ্বৈতের উপমার মধ্য দিয়ে ধারণা করেছেন। সক্রেটিসের কাছে এর নৈতিক তাৎপর্য হল, যা কিছু ঐশ্বরিক তার প্রতি মানুষের সাধারণ বাধ্যবাধকতা প্রতিপাদিত করে যে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে দেহ ও মনের যে দ্বৈত, তার ক্ষেত্রে দেহের তুলনায় মনের উপরেই অধিকতর মূল্য আরোপ করবে। মানুষের এবং ঐশ্বরিক বুদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক হল এই যে, এটি যে বিষয় প্রতিপাদিত করে তা হল মানুষের মন বা আত্মাই (Mind or soul) সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপাদান কারণ, মানুষের মন বা আত্মা ঈশ্বরের অংশ গ্রহণ করে। সততা মনের বিষয়, দেহের নয়। মানুষের আত্মা বুদ্ধির অধিকারী, সেই কারণে মানুষের কাজে সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্য আরোপ করা যেতে পারে। ঈশ্বর-চিন্তা তাঁর সমগ্র জীবনে অনুপ্রবিষ্ট ছিল। তিনি মনে করতেন যে, নৈতিক কর্তব্য ঈশ্বরের অনুমোদিত এবং অন্যায় কর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধী। সক্রেটিস যখনই কর্তব্য অকর্তব্যের আলোচনা করেছেন তখন সেই আলোচনায় ঈশ্বরের আলোচনা এসে পড়েছে। নৈতিকতায় অত্যধিক আগ্রহ থাকার জন্য সক্রেটিস ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয় তাঁর পরিণামমূলক যুক্তিকে একটি নৈতিক আদর্শের ভিত্তি হিসাবে দেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন। কাজেই সক্রেটিসের ধর্মতত্ত্বের মৌলিকতা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে শুধুমাত্র নতুন যুক্তির প্রবর্তন করা নয়, সেই পরিণতিমূলক যুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নৈতিক তাৎপর্য প্রদান করা। প্রশ্ন হল, সক্রেটিসের ধর্মতত্ত্ব কি ধরণের নৈতিক আদর্শ প্রতিপাদিত করে? এটি হল-ঈশ্বর সবচেয়ে ভাল জানেন কি বিষয় কল্যাণকর এবং ঈশ্বর তাঁর বিজ্ঞতা এবং মহানুভবতাবশত মানুষকে এমন সামর্থ্য ও সুবিধা দিয়েছেন যা তাকে শান্তি লাভ করতে সমর্থ করে।

উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টিতত্ত্ব : সক্রেটিসের মতে, মানুষের দেহ জড় জগতের উপাদানের দ্বারা সৃষ্ট, কিন্তু মানুষের বিচার-বুদ্ধি বিশ্ব-মন বা সার্বিক ধীশক্তি (Universal Reason)-র একটা অংশ। প্রকৃতির মধ্যে উদ্দেশ্যের অস্তিত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন। সক্রেটিস তাঁর সমসাময়িক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের মতবাদের মূল্য স্বীকার করলেও, তাঁদের মতবাদে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, সব কিছুকে যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক (Mechanical Causation)-এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁরা ভুল করেছেন, তাঁদের উচিত ছিল পরিণতিমূলক কার্যকারণ সম্পর্কের (Teleogical Causation) সাহায্যে ব্যাখ্যা করা। পরিণতিমূলক কার্যকারণ সম্পর্ক, সব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ সিদ্ধ হচ্ছে, এই বিষয়টিকে স্বীকার করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, “মানুষ যেমন কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য উপায় অবলম্বন করে, তেমনি জগতের বিভিন্ন অংশের গঠনে ও সন্নিবেশ সেরূপ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপায় অবলম্বনের প্রমাণ আছে।” সক্রেটিস জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে কোন বুদ্ধিমান সত্তার কর্তৃত্বে বিশ্বাস করতেন। জীবন-দেহের গঠনে ও তার বিভিন্ন অঙ্গের সংস্থানে প্রয়োজন সাধনের উদ্দেশ্য রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তির সাধ্যআশ্রয় বাক্যটি হল, যা কিছু কোন প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী, তা বুদ্ধির, দৈবের পরিণাম নয়। ‘যদি আমরা জীবদেহের দিকে তাকাই আমরা দেখতে পাব যে, বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের যে সূক্ষ্ম গঠন সেগুলি মানুষের প্রয়োজন এবং কল্যাণ সাধনের উপযোগী। যেমন মানুষের ঋজু অঙ্গবিন্যাস, তার কথা বলার সামর্থ্য তার বুদ্ধি সবই তার কল্যাণ সাধনের উপযোগী, যেহেতু এগুলি তাকে সকল অবস্থায় রক্ষা করতে সমর্থ করে এবং তার শাস্তি বর্ধিত করে। কাজেই কোন বুদ্ধির পরিকল্পনা হিসেবে মানুষ হল এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু এছাড়াও এই প্রাকৃতিক জগতে যে শৃঙ্খলা দেখা যায় তাও কোন নিয়ন্ত্রণকারী বুদ্ধির দৃষ্টান্ত। যাহোক, সমগ্র জগতের গঠন দৈবের নয়, বুদ্ধির পরিণতি, সর্বত্রই এক নিয়ামক বুদ্ধির (Directing intelligence) প্রকাশ। এই সব কিছুই এক বুদ্ধিমান স্থপতির অস্তিত্ব নির্দেশ করে, যিনি সমগ্র জগতকে ধারণ করে আছেন এবং তার শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন, এবং জগতের উপর তাঁর বুদ্ধিময় কর্তৃত্ব বর্তমান, যেমন মানুষের মন তার দেহের উপর কর্তৃত্ব করে।

আর্গুমেন্ট ফ্রম ডিজাইন : এক ঐশ্বরিক সত্তার কর্তৃত্বের অস্তিত্বের পক্ষে সক্রেটিস যে সাধারণ পরিণতিমূলক যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন, তার মধ্যে তিনি আরও একটি মতবাদ বিবৃত করেছেন সেটি হল, এই যে সমগ্র জগতের মধ্যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপায় অবলম্বনের যে প্রকৃতি বা স্বরূপ লক্ষ করা যায় সেটি এই ধরনের যে, মানুষের জন্যই জগৎ যেমন, সেরকমই পরিকল্পিত হয়েছে। জগতের বিন্যাস ও গঠনে মানুষের যে একটা বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থা রয়েছে তার অজস্র প্রমাণ আছে, যেমন— মানুষ, বাতাস, অগ্নি, ঋতুর সুখ সুবিধা, অন্য প্রাণীকে তার প্রয়োজনে ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করে। সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়, বুদ্ধি, বাকশক্তির অধিকারী হওয়া এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বজ্ঞানের অধিকারী হওয়া মানুষের সুবিধাজনক অবস্থান প্রমাণ বহন করে। কাজেই ঈশ্বরের মানুষের প্রতি সদয় তত্ত্বাবধানের এবং মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য ঈশ্বর যে এই জগতের পরিকল্পনা করেছেন, তা যুক্তিযুক্তভাবে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া সক্রেটিস এর মধ্যে একটা নৈতিক তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন। এইসব সুবিধা ভোগ করার ফলে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর জীবনের তুলনায় তার জীবনকে অনেক উন্নত করে তোলে এবং এই সব সুবিধাগুলি যত বিকাশপ্রাপ্ত হয় মানুষ তত সুখী হয়। সক্রেটিসকে উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি (Teleologic Argument or Argument from Design)-র প্রবর্তক বলে গণ্য করা হয়। জেনোফোন লিখেছেন যে, সক্রেটিস বিশ্বজগতে যে উদ্দেশ্য প্রতীয়মান হয় তার ভিত্তিতে প্রজ্ঞাবান বা বিজ্ঞ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতেন।

আত্মাতত্ত্ব

সক্রেটিস-পূর্ব আত্মা সম্পৰ্কীয় বিভিন্ন মতবাদ সক্রেটিসের ওপর তার প্রভাব : সক্রেটিসের দুই শতাব্দী পূর্বে গ্রীকদের আত্মা সম্পৰ্কীয় ধারণার নানা বিকাশ সাধিত হয়েছে। হোমারের মতে, আত্মা হল প্রাণ বা জীবিত মানুষকে মৃত থেকে স্বতন্ত্র করে। দর্শন-বহির্ভূত সাহিত্যে আত্মাকে কতকগুলি অনুভূতি ও আবেগ যেমন— দুঃখ, ভালবাসা, ক্রোধ, সাহস ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। দার্শনিক সাহিত্যে ‘আত্মা’ শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের জড় মতবাদে আত্মার প্রাথমিক অর্থ জীবন বা প্রাণ (Life)-ই বজায় রাখা হয়েছে এবং তার অর্থকে আর প্রসারিত করার কোন চেষ্টা করা হয়নি। কতকগুলি বিশেষ ক্ষেত্র হল ব্যতিক্রম, যেখানে আত্মাকে বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত করা। হয়েছে। যেমন— আমরা হেরাক্লিটাসের দর্শনে দেখতে পাই। সোফিস্ট জর্জিয়াস এর মতে, বিজ্ঞতা হল আত্মার গৌরব। জর্জিয়াসের মতে, আত্মা বিচার-বুদ্ধিসম্মত ক্রিয়া এবং আবেগ উভয়েরই পীঠস্থান। আত্মাকে বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করার যে নতুন প্রবণতা তা এপোলেনিয়ার ডায়োজিনিস (Diogenes)-এর মধ্যেও দেখা যায়। তাঁর মতে, আত্মারূপ জড় দ্রব্য হল বাতাস এবং এই বাতাস হল তাই ‘যার বুদ্ধি আছে’। কাজেই আত্মার ক্রিয়ার মধ্যে বুদ্ধির ক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ডায়োজিনিস আত্মার আর একটি ব্যাখ্যা দিলেন। আত্মা হল মানুষের মধ্যে ‘প্রাণ’ এবং ‘শ্বাস’ এবং প্রাকৃতিক জগতের সব প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত যে প্রাণ এবং গতি তার সঙ্গে যুক্ত। আত্মাতে জাগতিক বৈশিষ্ট্যের আরোপ অ্যানাক্সিমিনিসে প্রতীয়মান। ডায়োজিনিসের মধ্যে যখন এই ভাবনার আবির্ভাব হল তখন এই জাগতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত হল প্রাণ এবং গতির নীতি হিসেবে বুদ্ধির ধারণা। সক্রেটিস-পূর্ব জড়ের ঐতিহ্যের মধ্যে এটিই হল আত্মার ধারণার বিকাশের চরম পরিণতি। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আর একটি নতুন ভাবধারা। সেটি হল, মানুষের মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বের বিষয়। মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মার বিনাশ সাধিত হয় না। এই প্রসঙ্গে পিথাগোরাসের আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তি মতবাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেহের কারাগারে বন্দী হয়ে আত্মার শাস্তি লাভ করার বিষয়, যার উল্লেখ করেছেন দার্শনিক প্লেটো। সক্রেটিস এই সব ধারণা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাঁর ধর্মসম্পর্কীয় ধারণা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি ডায়োজিনিসের অভিমতের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর ধর্মসম্পর্কীয় মতের মধ্যে যে দ্বৈতবাদ পরিলক্ষিত হয় তার থেকে বোঝা যায় যে, তিনি অরফিক এবং পিথাগোরাসের আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। সক্রেটিসের চিন্তার ক্ষেত্রে পিথাগোরাসের ধর্মসম্পর্কীয় অভিমতের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল এরূপ ধারণা করলে ভুল হবে। পিথাগোরাসের যেটুকু প্রভাবে কথা বলা চলে তা হল, আত্মার সঙ্গে নৈতিক আচরণকে যুক্ত করার ধারণা এবং সক্রেটিসের নৈতিক বুদ্ধিবাদ, তাঁকে স্বাভাবিকভাবে বৌদ্ধিক ক্রিয়ার সঙ্গে আত্মাকে যুক্ত করতে প্রণোদিত করেছিল।

সক্রেটিসের আত্মার ধারণার মৌলিকতা : সক্রেটিসের উপরে এইসব প্রভাবের কথা স্বীকার করে নিলে, সক্রেটিসের আত্মা সম্পর্কীয় ধারণার মৌলিকতা কোথায়?

  • সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ, ঈশ্বরের অংশ, অভৌতক, প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয় : সক্রেটিসের মতে, আত্মা হল মানুষের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অংশ এবং মানুষের মধ্যে এই আত্মা হল তাই, যা ঈশ্বরের অংশ গ্রহণ করে। তাঁর মতে, আত্মা হল অ-ভৌতিক। দেহকে প্রত্যক্ষ করা যায়, কিন্তু আত্মা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়।
  • বিচারবুদ্ধির পীঠস্থান : আত্মা দেহকে নিয়ন্ত্রিত করে। আত্মা যে কারণে এটি করতে সমর্থ হয় সেটি হল, আত্মা বিচারবুদ্ধির পীঠস্থান। কেননা আত্মাতেই কেবলমাত্র বিচারবুদ্ধি অবস্থান করে। তাছাড়া কোন ব্যক্তির নৈতিক আচরণ হল তার আত্মার আচরণ, দেহের নয়। যে-সব ক্রিয়া যথার্থই আত্মার অন্তর্ভুক্ত সেগুলি হল যা আমাদের করা উচিত সেগুলি সম্পাদন করা এবং যেগুলি থেকে বিরত থাকা উচিত, সেগুলি থেকে বিরত থাকা। দেহ থেকে আত্মাকে পৃথক করতে গিয়ে সক্রেটিস বলেন, ‘এটি হল আমাদের মধ্যে সেই জিনিস, সেটা যাই হোক না কেন, যার সঙ্গে উচিত-অনুচিত কার্য করার প্রশ্ন রয়েছে।’ দেহ ও মনের দ্বৈতকে সক্রেটিস আত্মসংযমের ধারণার সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত করেছেন। আত্মসংযম হল সক্রেটিসের কাছে একটি প্রধান নৈতিক ধারণা এবং এই আত্মসংযম বলতে তিনি বোঝেন আত্মার দেহের উপর কর্তৃত্ব। সক্রেটিস বলেন যে, যে দেহে আত্মা অবস্থান করে সেই দেহে যে সুখের উৎপত্তি ঘটে সেগুলি আত্মাকে আত্মসংযম পরিহার করে যত শীঘ্র দেহের সুখভোগে প্রণোদিত করে। তিনি সুখের ক্রীতদাসত্বের কথাও বলেছেন। সক্রেটিস বলেন যে, প্রতিটি মানুষের উচিত আত্মসংযমকে সব সৎগুণের ভিত্তি বলে গণ্য করা এবং সব কিছুর উপরে তাকে আত্মায় প্রতিষ্ঠিত করা।
  • দেহ ও মনের দ্বৈত : দেহ ও মনের দ্বৈত সক্রেটিসের পক্ষে একটি অতিরিক্ত ভিত্তি যার জন্য তিনি মনে করেন যে, আত্মা অপ্রতক্ষ্যগ্রাহ্য এবং ঐশ্বরিক, মানুষের একটি স্বতন্ত্র অংশ, এমন একটি সত্তা যা দেহ থেকে স্বতন্ত্র। দেহ ও মনের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আত্মসংযম সম্পর্কে যা বলেন তাকে তার দ্বৈতবাদী অভিমতের সমর্থনে মনোবিজ্ঞান সম্পর্কীয় যুক্তিরূপে গণ্য করা চলে এবং সক্রেটিস এই যুক্তিকে একটি নৈতিক আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত করেন, যেটি দেহের তুলনায় আত্মার যত্ন সাধনকে সৎ লোকের লক্ষ হিসেবে গণ্য করে। সক্রেটিস মনে করেন যে, আত্মার যত্ন সাধন মানে হল, কল্যাণের যত্ন সাধন অর্থাৎ কিনা, নিজের যত্ন সাধন। যখন কেউ নিজের আত্মার কল্যাণ সাধনে যত্নবান হয় তখন সে তার প্রকৃত আত্মার সম্পর্কেই যত্নবান হয়।
  • অহং (Self)-এর সঙ্গে আত্মা অভিন্ন : সক্রেটিসের মতে অহং (Self)-এর সঙ্গে আত্মা অভিন্ন। মানুষ দেহ থেকে ভিন্ন হয়। মানুষ দেহ হবে কিংবা আত্মা হবে, কিংবা উভয়ই, কিন্তু যেহেতু মানুষ দেহকে ব্যবহার করে, মানুষ দেহ হতে পারে না বা দেহ ও আত্মা উভয় হতে পারে না। তাহলে সিদ্ধান্ত করতে হয়, মানুষ কিছুই নয় বা কিছু। এবং সেক্ষেত্রে মানুষ আত্মা ছাড়া কিছুই নয়। আত্মাই হল মানুষ। প্লেটো তাঁর ‘Phaedo -তে সক্রেটিস এই ধরনের অভিমত পোষণ করেন, এইভাবে সক্রেটিসকে চিত্রিত করেছেন।
  • আত্মার অমরত্ব : সক্রেটিস মনে করেন যে, দেহের বিনাশ সাধিত হলেও আত্মার বিনাশ সাধিত হয় না। প্রশ্ন হল, প্লেটো Phaedo-তে ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাসের বিষয়টি যে সক্রেটিসের ক্ষেত্রে আরোপ করছেন, তাকে কি সক্রেটিসের ব্যক্তিগত অভিমত রূপে আমরা গ্রহণ করতে পারি? কেউ কেউ মনে করেন যে, সক্রেটিস আত্মা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন তাঁর ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাস অর্থাৎ কিনা, মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্বের ধারণাও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি মনে করতেন যে, আত্মা হল ঐশ্বরিক, অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য এবং অ-শরীরী সত্তা এবং এই আত্মাই হল মানুষের প্রকৃত অহং। আত্মাকে এইভাবে চিন্তা করার অর্থ হল আত্মা, যে জাগতিক নিয়ম বস্তুর আবির্ভাব ও তিরোভাব নিয়ন্ত্রণ করে, তার অধীন নয়। ব্যক্তির যথার্থ অহং (True Self) বলতে যা বোঝায় তা এই সব নিয়মের অধীন নয়। কাজেই যে অর্থে দেহ বিনাশশীল সেই অর্থে ব্যক্তির আত্মা বিনাশশীল নয়। এই সব বিশ্বাসের ভিত্তিতে সক্রেটিসের এই প্রত্যাশা ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর আত্মা স্থায়ী হবে। তবে এটা প্রত্যাশা মাত্র, কোন সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়। সক্রেটিসের বিচারের শেষে প্লেটো Apology-তে তাঁর যে উক্তির কথা বিবৃত করেছেন, তার থেকে উপরিউক্ত ধারণা করা যেতে পারে। সক্রেটিস বলেন, “মৃত্যু দুটি বিষয়ের মধ্যে একটি হবে – হয় কোন কিছুরই চেতনা না থাকার ব্যাপার কিংবা কোন এক ধরনের পরিবর্তন, আত্মার এই জগৎ থেকে অন্য জগতে উত্তীর্ণ হওয়া এবং তিনি বলেন যে, যদি শেষোক্ত বিকল্পটি সত্য হয় তাহলে তিনি অনেকবার মৃত্যুকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত।
  • প্লেটোর সম্প্রসারণ : ‘Phacdo’-তে প্লেটো সক্রেটিসের আত্মা সম্পর্কীয় ধারণাকেই সমর্থন করেছেন। এবং সক্রেটিস যতখানি না করেছেন তার তুলনায় আরও বিশদ তাত্ত্বিক ভিত্তিতে সমর্থন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্লেটো শীঘ্রই আত্মা সম্পর্কে অতিরিক্ত মাত্রায় বুদ্ধিবাদী ধারণাকে বর্জন করেন। কারণ তিনি ব্যক্তির ‘অহংকে’ দ্রব্যরূপী আত্মার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করার পর আত্মার বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপের বাইরেও আত্মার ধারণাকে প্রসারিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। প্লেটো উপলব্ধি করেছিলেন যে, এমন সব অ-বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপ আছে যেগুলিকে ব্যক্তির ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তবে আমরা দেখতে পাই যে, প্লেটোর Phaedo সক্রেটিসের আত্মা সম্পর্কীয় ধারণার সন্তোষজনক তাত্ত্বিক সমর্থন যুগিয়ে দিতে না পারলেও তার দার্শনিক প্রভাব ও গুরুত্বের বিষয়টিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে।
  • আত্মার যত্ন ও নৈতিক জীবন : একটি বিষয় যেটির উপরে Phaedo. এবং সক্রেটিস নিজেই গুরুত্ব আরোপ করেছেন সেটি হল, আত্মার এবং দেহের সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যবহারিক নৈতিক গুরুত্বের বিষয়টির উপলব্ধি। সক্রেটিসের আদর্শ ‘আত্মার যত্ন’ বিধান করা একটি নৈতিক আদর্শ। এই একই আদর্শ তাঁর ধর্মীয় অভিমতের দ্বারা প্রতিপাদিত হয়েছে। সক্রেটিসের মতে, নৈতিক দিক থেকে যে ব্যক্তিকে সৎ বলা চলে, তিনি আত্মা সম্পর্কে যত্নবান হলে, আত্মনির্ভর হতে পারবেন। এই ধরনের ব্যক্তি স্বল্প জাগতিক সম্পদে সুখী হবে এবং দৈহিক সুখের ব্যাপারে সুদৃঢ় আত্মসংযমের অধিকারী হবে। কারণ দৈহিক সুখের ক্রীতদাসত্ব স্বীকার করার অর্থ আত্মাকে কলুষিত করা। খাদ্য, পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, যৌন সুখ, এগুলো সম্পর্কে সক্রেটিসের বক্তব্য হল যে, এগুলো দেহের বিষয় এবং সৎ ব্যক্তির উচিত এদের প্রতি কামনাকে সংযত করা। সক্রেটিসের বক্তব্য হল যে, ব্যক্তির উচিত নয় তার দেহ, অর্থ, খ্যাতির জন্য লালায়িত হওয়া। তার উচিত হল সত্যতা ও বিজ্ঞতা লাভে এবং আত্মার উৎকর্ষ সাধনে যত্নবান হওয়া। নঞর্থক দিক থেকে বিচার করলে সৎ জীবন হল জাগতিক সম্পদ আহরণ এবং দৈহিক সুখভোগের ব্যাপারে মিথ্যাচার ও মিতব্যয়িতা, সদর্থক দিক থেকে বিচার করলে এই জীবন হল মানুষ নিজেকে যতখানি জ্ঞানী করা সম্ভব, ততখানি জ্ঞানী করে তোলার কঠিন সংকল্পে ব্রতী হওয়া। সক্রেটিস যে আত্ম-সংযমের কথা বলেছেন, যেটি তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ধারণা সেটিকে তাঁর ‘সততা হল জ্ঞান’ এই বচনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে, তিনি বিজ্ঞতার (Wisdom) সঙ্গে সমার্থক গণ্য করেছেন।

দর্শনে সক্রেটিসের অবদান

সক্রেটিসের গুরুত্ব নিয়ে বিতর্ক ও সোফিস্টদের সাথে মিল : সক্রেটিস কোন গ্রন্থ রচনা করেননি, কোন সুস্পষ্ট দার্শনিক মতবাদ তিনি প্রচার করেননি। কোন সুসংহত সক্রেটিক দর্শনের কথাও কদাচিৎ বলা যেতে পারে। মানুষ যাতে নিজে নিজে চিন্তা করতে পারে, মানুষকে তাই শিক্ষা দেওয়াতেই সক্রেটিস নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। এই সব কারণে দর্শনে যখন তাঁর স্থান নিরূপণের প্রশ্ন দেখা দেয়, তখন তাঁর সঠিক স্থান নিরূপণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবু তাঁর গুরুত্ব অস্বীকার করা চলে না। জেলার বলেন, যিনি দার্শনিক তিনি মানুষের জ্ঞানের সীমারেখার কথা স্বীকার করে নিয়েও সত্যের অনুসন্ধান করেন, সেই অর্থে সক্রেটিসও একজন দার্শনিক ছিলেন। আরোহ প্রণালী, সংজ্ঞা এবং নীতিবিদ্যার উদ্ভাবকের কৃতিত্ব অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের ওপর অর্পণ করেছিলেন, যদিও অ্যারিস্টটল সক্রেটিসকে কোন সুসংহত দার্শনিকরূপে কল্পনা করেননি। সোফিস্টদের সঙ্গে সক্রেটিসের অনেক ব্যাপারে মিল দেখা যায়।

  • প্রথমত, যা কিছু গতানুগতিক তার প্রতি সমালোচকের মনোভাব,
  • দ্বিতীয়ত, মানুষকেই চিন্তার বিষয়বস্তু করা, যে মানুষ সামাজিক জীব, যে মানুষ জানছে, ক্রিয়া করছে।
  • তৃতীয়ত, সোফিস্টদের মত সক্রেটিসও দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে সব সময়েই অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করেছেন। কিন্তু সোফিস্টদের জ্ঞানের বস্তুনিরপেক্ষতা এবং আপেক্ষিকতায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। নৈতিকতার অন্তরালে তিনি যথার্থ নৈতিকতার, প্রচলিত আইনের অন্তরালে ন্যায়পরায়ণতার অস্তিত্বশীল রাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্তরালে মানুষের সামাজিক জীবনের স্থায়ী নীতি এবং দেবতাদের অন্তরালে তিনি সন্ধান করেছিলেন ঐশ্বরিকতার। এই সব সমস্যা তাঁর কাছে তাত্ত্বিক সমস্যা ছিল না, এগুলি ছিল ব্যবহারিক সমস্যা— যেগুলি একটিমাত্র প্রশ্নে বিধৃত ছিল। এই প্রশ্নটি হল, যথাযথভাবে মানুষ কিভাবে বাঁচতে পারে?

সক্রেটিসের শিক্ষার দুটি দিক আছে—

  • (১) জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদ অর্থাৎ প্রত্যয়ের মাধ্যমেই আমাদের সব জ্ঞান আমরা লাভ করি। স্টেইসের মতে, এই মতবাদই হল সক্রেটিসের দর্শনের বৈজ্ঞানিক দিক।
  • (২) নৈতিক শিক্ষা।

সোফিস্টদের বিরুদ্ধে সক্রেটিসের প্রত্যয় সম্পর্কে মতবাদ বা বুদ্ধিবাদী মতবাদ : এখন, এই উভয় বিষয়ের মধ্যে প্রত্যয় সম্পর্কে সক্রেটিসের বৈজ্ঞানিক মতবাদই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিসের স্থান নিরূপণের ব্যাপারে সক্রেটিসের প্রত্যয় সম্পৰ্কীয় মতবাদেরই অপরিসীম গুরুত্ব। সক্রেটিসের নৈতিক তত্ত্ব যে একেবারে উপেক্ষার বস্তু, তা নয়। তবে ঐ মতবাদ অতি বুদ্ধিবাদের দ্বারা দোষদুষ্ট। কেননা ঐ নৈতিক তত্ত্ব, যে ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা হল, মানুষ কেবলমাত্র বিচারবুদ্ধির ধারাই চালিত হয়। সেই কারণে দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিসের নীতিতত্ত্বের প্রভাব তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু সক্রেটিসের প্রত্যয় সম্পর্কীয় মতবাদ দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা করেছিল। এই মতবাদ পরবর্তী দার্শনিকবৃন্দের হাতে আরও বিকাশপ্রাপ্ত হয়। প্লেটোর সমগ্র দর্শন সক্রেটিসের প্রত্যয় সম্পর্কীয় মতবাদের এক উন্নত রূপ এবং প্লেটোর দর্শনের মাধ্যমে অ্যারিস্টটলের দর্শন এবং পরবর্তী সব ধরনের ভাববাদ সক্রেটিসের প্রত্যয়বাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সক্রেটিসের প্রত্যয় সম্পর্কীয় মতবাদের অব্যবহিত ফল হল সোফিস্টদের শিক্ষার ধ্বংস সাধন। সোফিস্টদের মতে, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষই সত্য জ্ঞান লাভের প্রণালী। একই বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রত্যক্ষণ ভিন্ন হয়। তার থেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে, ব্যক্তির প্রত্যক্ষণই সভ্যতার মাপকাঠি। এর অনিবার্য পরিণতি হল সত্যতার বস্তুগত মানদণ্ডকে অস্বীকার করা, কোন বস্তুগত সত্যের অস্তিত্বে অবিশ্বাস। একই যুক্তির ভিত্তিতে নৈতিক নিয়মের বস্তুগত সত্যতায়ও অবিশ্বাস সূচিত হল। সক্রেটিসের কৃতিত্ব হল যে, তিনি সত্যতা ও নৈতিকতার বস্তুগত অস্তিত্বে বিশ্বাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সোফিস্টদের ভ্রান্ত শিক্ষার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সক্রেটিস সোফিস্টদের মূল ধারণাগুলোকে খণ্ডন করে তাদের অসত্যতা প্রমাণে সচেষ্ট হলেন। প্রত্যক্ষণ থেকেই জ্ঞানের উদ্ভব, সোফিস্টদের এই মতবাদের বিরুদ্ধ মতবাদ হিসেবে সক্রেটিস উপস্থাপিত করলেন আর এক মতবাদ, সেটি হল প্রত্যয় থেকেই জ্ঞানের উদ্ভব। যেহেতু বুদ্ধির সাহায্যেই প্রত্যয় গঠিত হয়, সেহেতু প্রত্যয়ের মাধ্যমেই জ্ঞান লব্ধ হয় এ কথা বলা, আর জ্ঞানকে বুদ্ধির যথার্থ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা, একই কথা। এর দ্বারা জ্ঞান বস্তুনিরপেক্ষ বা মনোগত বিষয় না হয়ে বস্তুগত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ জ্ঞানের একটা বস্তুগত মানদণ্ডকেও স্বীকৃতি জানানো হয়।

প্রাক-সোফিস্ট যুগের থেকে দর্শনে অগ্রসতি সাধন : কিন্তু এই প্রসঙ্গে আর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন গ্রীক দর্শনের লেখক স্টেইস। সত্যতার বস্তুগত মানদণ্ডে বিশ্বাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সক্রেটিস কি প্রাক-সোফিস্ট যুগের বুদ্ধিবাদী দর্শনেই প্রত্যাবর্তন করলেন? তাহলে কি সক্রেটিস-দর্শন দর্শনের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি সূচনা করে না? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, সক্রেটিক দর্শন নিঃসন্দেহে অগ্রগতি সূচনা করে। প্রাক-সোফিস্ট যুগে যে সত্যতা ও সততার আদর্শকে বিনা বিচারে বস্তুগত মনে করে লোকে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করত, সক্রেটিস দেখালেন যে, এই সব আদর্শ বিচার-বুদ্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সোফিস্টরা মনে করত যে, সত্যতা হল ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়, কেননা, ব্যক্তি যাকে সত্য বলে মনে করে তা-ই সত্য। সক্রেটিস দেখলেন যে, সত্যতার ভিত্তি বিচারবুদ্ধিতে, যেহেতু বিচারবুদ্ধি সার্বিক সেহেতু সত্যতা ব্যক্তির নিজস্ব ব্যক্তিগত সত্যতা নয়, সার্বিক সত্যতা, যা সকল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই বৈধ। কাজেই সত্যতার সংবেদন-নিরপেক্ষ বস্তুগত সত্তা আছে, তার সত্তা মনোগত নয়। সত্যতা ব্যক্তির খেয়ালখুশি বা ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইচ্ছা-নির্ভর নয়।

গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগের অবসান এবং দ্বিতীয় যুগের শুরু : সক্রেটিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল এই যে, বিচারবুদ্ধির শ্রেষ্ঠতা ও প্রাধান্যকে অস্বীকার করা চলে না। বিচারবুদ্ধিকে অতিক্রম করে অন্য কোন চেতন প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দান করার পরিণতি অনিবার্যভাবে সংশয়বাদে এবং সত্যতা ও নৈতিকতার বাস্তবতার অস্বীকৃতিতে পর্যবসিত হতে বাধ্য। সক্রেটিসের আবির্ভাবের সঙ্গে গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগের অবসান এবং দ্বিতীয় যুগের আরম্ভ। প্রাক-সক্রেটিস দর্শনের আলোচনার বিষয় ছিল জগতের উৎপত্তি ও স্বরূপ সম্পৰ্কীয় বিভিন্ন সমস্যা। সক্রেটিস জড় জগতের আলোচনাকে বর্জন করে আত্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং তার আলোচনাতেই নিজেকে নিয়োজিত করেন। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের ওপরে সক্রেটিসের প্রভাবের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে জনৈক সমালোচক বলেন যে, পরবর্তীকালের গ্রীক নীতিবিদ্যার ওপরে সক্রেটিসের নৈতিক আদর্শের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। এর একটি কারণ হল নৈতিকতার অনুশীলনে তাঁর আস্থা, যদিও এ জন্য তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই তাঁদের মানবীয় সততার আদর্শকে জীবনে প্রত্যক্ষ করার ব্যাপারে সক্রেটিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে তাদের নৈতিক আদর্শ গঠনের তুলনায় তাঁদের চিন্তার ওপর সক্রেটিসের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। তিনি অনেকাংশে তাদের দার্শনিক অনুসন্ধান কার্য কোন দিকে ধাবিত হবে তা নিরূপণ করেছিলেন এবং তাঁর পদ্ধতিতে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল প্রত্যক্ষ করেছিলেন ফলপ্রসূ দার্শনিক বিশ্লেষণের একটি ধারা।

সক্রেটিস প্রভাবিত দার্শনিক সম্প্রদায়সমূহ

অপ্রধান বা গৌণ দর্শন সম্প্রদায় বলতে আমাদের মনে করা উচিত হবে না যে, সক্রেটিস কোন নির্দিষ্ট দর্শন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে তাঁরই মত, অপর ব্যক্তিরা মানুষের মনকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রণোদিত হবেন। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর চারপাশে একদল শিষ্যকে জড় করেননি। কিন্তু অনেক চিন্তাবিদ যাঁরা সক্রেটিসের শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন, তাঁরা সক্রেটিসের প্রচারিত নীতির কোন-না-কে একটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। অবশ্য অন্য সূত্র থেকে পাওয়া কিছু কিছু অভিমতও যে তাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত করতেন না, তা নয়। এইসব চিন্তাবিদ সক্রেটিসের শিক্ষার কয়েকটি দিককেই আলোচনার বিষয়বস্তু করেছিলেন তা ঠিক নয়। বরং এমন কথা বলা যেতে পারে যে, কোন একটি বিশেষ দিকে প্রতিটি চিন্তাবিদ সক্রেটিসের চিন্তাধারাকেই যেন টেনে নিয়ে যাবার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। তবে এ কথাও বলা অযৌক্তিক হবে না যে, প্রাচীন দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে তাঁরা যেটুকু গ্রহণ করেছিলেন তাকে সক্রেটিস প্রচারিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার জন্য পরিবর্তিত করতেও তাঁরা দ্বিধা করেননি। কাজেই অপ্রধান বা গৌণ সক্রেটিস দর্শন সম্প্রদায় বলতে এ কথাটাই বুঝে নিতে হবে যে, এই সব দর্শন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত চিন্তাবিদদের সক্রেটিসের সঙ্গে সম্পর্কটা তেমন গভীর ছিল না।

প্রাচীন সিনিক সম্প্রদায় (The Early Cynic School)

অ্যান্টিস্থিনিস (৪৪৬-৩৬৬ খ্রি.পূ.) : সিনিক সম্প্রদায়ের নামকরণের ব্যাপার নিয়ে দুটি অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। প্রথম অভিমত অনুসারে সিনিক সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দের প্রচলিত রীতিনীতি বর্জন করে অদ্ভূত জীবনধারার জন্যই সম্প্রদায়ের ঐ নাম হয়েছে। দ্বিতীয় অভিমত অনুসারে সিনোসারজেস (Cynosarges) নামে ব্যায়ামাগারে সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্টিস্থিনিস (Antisthenes) তাঁর সমর্থকবৃন্দকে উপদেশ দিতেন বলেই ঐ স্থানের নামানুসারে সম্প্রদায়ের নাম সিনিক সম্প্রদায় হয়েছে। সিনিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অ্যান্টিস্থিনিস (Antisthenes)। তিনি এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন এথেন্সের অধিবাসী, কিন্তু তাঁর মা ছিলেন থ্রেসিয়ার একজন ক্রীতদাসী, সে কারণে অ্যান্টিস্থিনিস পূর্ণ নাগরিক ছিলেন না। অ্যান্টিস্থিনিস একাধিক পুস্তক রচনা করেন। এসব পুস্তকের মধ্যে হেরাক্লিস (Heracles), সাইরাস (Cyrus), এলসিবিয়েডিস (Alcibiades), আরকিলাস (Archelaus), পলিটিকাস (Politicus), সেথোন (Sathon) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। হেরাক্লিস নামক গ্রন্থেই সিনিক সম্প্রদায়ের জীবনের আদর্শ, আত্মবিশ্বাস এবং দৈহিক কষ্টসহিষ্ণুতা, প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমকে উজ্জ্বলভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।

সক্রেটিসের চরিত্রের স্ব-নির্ভরতার ভিত্তিতে মতবাদ নির্মাণ : সক্রেটিসের জীবনের যে বিষয়টি অ্যান্টিস্থিনিসের বিশেষ প্রশংসা লাভ করেছিল এবং যাকে তিনি অনুকরণযোগ্য মনে করেছিলেন তা সক্রেটিসের বিচারবুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা দার্শনিক প্রতিভা নয়, তা হল, সক্রেটিসের চরিত্রের স্ব-নির্ভরতা। সক্রেটিস অপরের অভিমতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাস ও ধারণা অনুযায়ী কার্য করতে দ্বিধা করতেন না। তিনি যা উচিত মনে করতেন তাকেই অনুসরণ করতেন, তার জন্য যেকোন মূল্যই তাঁকে দিতে হোক না কেন। গ্রীক দর্শনের লেখক স্টেইস যথাযথভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, এই চারিত্র্যিক স্বাধীনতা বা স্ব-নির্ভরতার বিষয়টি ছিল সক্রেটিসের জীবনের একটা উপবস্তু (By-product)। অর্থাৎ কিনা, একটা বৃহত্তর লক্ষ বা আদর্শ লাভের জন্য একটি উপায় মাত্র। সক্রেটিস জাগতিক সম্পদ এবং লোক-প্রশংসার প্রতি একান্ত উদাসীন ছিলেন, কেননা তিনি ছিলেন বৃহত্তর সম্পদ বা কল্যাণ অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (True Wisdom) লাভের প্রত্যাশী। কিন্তু অ্যান্টিস্থিনিস সক্রেটিসের স্ব-নির্ভরতা ও অত্যধিক আত্মবিশ্বাসের আদর্শকেই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আদর্শ বলে ভুল করলেন। তাই অ্যান্টিস্থিনিসের দৃষ্টিতে সততা (Virtue) হয়ে উঠল নিছক জাগতিক সুখ ও সম্পদের প্রতি বাসনা-নিরপেক্ষতা। বস্তুত, এটি একটি নঞর্থক বা অভাবাত্মক প্রত্যয়-ত্যাগ, কৃষ্ণ, স্বয়ং সম্পূর্ণতা। কাজেই সক্রেটিসের জীবনের যেটি নঞর্থক বা অভাবাত্মক দিক সেটিকেই, কপলস্টোনের ভাষায়, অ্যান্টিস্থিনিস পরিণত করলেন একটা সদর্থক বা ভাবাত্মক লক্ষ বা আদর্শে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা কলাকৌশলের দক্ষতার প্রতি সক্রেটিস কখনও সরাসরি উপেক্ষা প্রদর্শন করেননি, কিন্তু সক্রেটিস নৈতিক জ্ঞান লাভের ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, তাকে অতিরঞ্জিত করে, অ্যান্টিস্থিনিস বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও কলাকৌশলের প্রতি একটা অনীহার ভাব মানুষের মনে জাগ্রত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। অ্যান্টিস্থিনিস বলতেন, “সুখের জন্য সততাই যথেষ্ট এবং সততার জন্য যা প্রয়োজন তা হল সক্রেটিসের শক্তির, আর কিছুর নয়, এ হল কাজের ব্যাপার। এর জন্য বেশি কথা বা বেশি বিদ্যার কোন প্রয়োজন নেই।” সিনিক সম্প্রদায়ের সততার আদর্শ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট গ্রীক দর্শনের লেখকবৃন্দ যে কথা বলেছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। সক্রেটিস যে অপরের মতামতের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ করতেন না বা লৌকিক মতামতের প্রতি উদাসীন ছিলেন তার কারণ, তাঁর ছিল নিজের নীতি ও ধারণার প্রতি গভীর আস্থা, যাকে বর্জন করা তিনি সত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার সমতুল্য মনে করতেন। সক্রেটিস যাকে ভাল বলে মনে করতেন, অবিচলিত আস্থা নিয়ে তাকে অনুসরণ করতেন, অপর লোক কি বলাবলি করছে তার তোয়াক্কা করতেন না। কিন্তু লৌকিক মতামতের প্রতি তাঁর এই উদাসীনতা কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ আদর্শ ছিল না। লৌকিক মতামতকে শুধুমাত্র লৌকিক গণ্য করে উপেক্ষা করার পক্ষপাতী সক্রেটিস ছিলেন না, বিশেষ করে ডায়োজিনিস (Diogenes) যেটা করে থাকতেন।

সিনিক সম্প্রদায়ের মতানুসারে সততার অর্থ : সততা বলতে সিনিক সম্প্রদায় কি বুঝেছেন? সিনিক সম্প্রদায়ের মতে, সততাই হল জীবনের লক্ষ, সুখ-দুঃখের প্রতি পূর্ণ নির্বিকার ভাব ও কঠোর উদাসীনতা। কোন প্রবৃত্তির পরাধীন না হওয়াই নৈতিক জীবনের আদর্শ বা লক্ষ। যতটুকু পার্থিব প্রয়োজন জীবনের পক্ষে অপরিহার্য তার বেশি কিছুর ওপর নির্ভর করা চলবে না। তাহলেই স্বাধীনতা হারিয়ে পরাধীন হতে হবে। পরনির্ভরতা মানেই পরাধীনতা, আত্মনির্ভরতাই সেহেতু একমাত্র কাম্য, আত্মনির্ভরতা হচ্ছে কোনরকম ঘটনাচক্রের দাস না হওয়া বা পার্থিব প্রয়োজনের দ্বারা প্রলুদ্ধ না হওয়া। এজন্য আমাদের অভাবকে সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনকে বর্জন করতে হবে, প্রকৃতির মুক্ত উদার অঙ্গনে আমাদের বিহার করতে হবে, ঐশ্বর্য বা লালসা থেকে বিরত হতে হবে এবং সমাজের প্রশংসা বা নিন্দাকে তুচ্ছ করতে হবে। কাজেই সততা হল কামনারহিত হওয়া, অভাব থেকে মুক্ত হওয়া এবং পরিপূর্ণ স্বনির্ভরতা। সিনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই বাড়ির বা কোন বাসস্থানের মালিক হতে চাইতেন না, ভবঘুরে বা ভিক্ষুকের জীবনযাপনে আগ্রহী ছিলেন।

সিনিক সম্প্রদায়ের দর্শন সক্রেটিসের জীবনের কোন একটি দিকের অতিরঞ্জন : সেই কারণে এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত হবে যে, ‘সিনিক সম্প্রদায়ের দর্শন, সক্রেটিসের জীবনের এবং মনোভাবের কোন একটি বিশেষ দিকে অতিরঞ্জন ছাড়া কিছুই নয়, যে দিকটি নঞর্থক বা সদর্থক দিকে ফলস্বরূপ বা অনুগামী বিষয়।’ সক্রেটিস কোন দিনই তার চরিত্রের স্বনির্ভরতার বৈশিষ্ট্যকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেননি, যার অর্থ হল, লৌকিক মতামতকে আঘাত করা। কিন্তু সিনিক সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দ লৌকিক মতামতের প্রতি উদাসীনতা দেখাবার প্রচেষ্টায় জনমতকে বিদ্রূপ করতে দ্বিধা করত না এবং প্রায়ই বিরক্তিকর ও আপত্তিজনক অশালীন আচরণ প্রদর্শন করত।

বিশিষ্ট বস্তুর অস্তিত্ব আছে, সার্বিকের অস্তিত্ব নেই : অ্যান্টিস্থিনিস প্লেটোর সামান্য ধারণা মতবাদ (Theory of Ideas)- এর বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর-ই (Individuals) শুধুমাত্র অস্তিত্ব আছে, এবং তার দ্বারা, জেলার-এর মতে, নিঃসংশয় ভাবে তিনি পরবর্তীকালে স্টোয়িকদের মতই যা ভৌতিক এবং ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য তাকেই বুঝতেন। কথিত আছে যে, তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘ওহে প্লেটো, আমি একটি ঘোটক দেখছি, কিন্তু আমি ঘোটকত্ব দেখি না।’ এ ছাড়াও তিনি বলতেন যে, প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র তার নামই প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেমন ‘ঘোটক হয় ঘোটক’ ‘কাল হয় কাল’ কিন্তু ‘ঘোটক হয় কাল’ বলা চলবে না। তার থেকে তিনি জেলারের অভিমতানুসারে, সোফিস্ট জর্জিয়াসকে অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত করলেন যে, উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন বিধেয় আরোপ করা চলবে না। এর তাৎপর্য হল, একটি বিশেষ মতবাদকে স্বীকার করে নেওয়া। এই মতবাদটি হল, আমরা কোন বিশিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসূচক প্রকৃতিকেই (Its own individual nature) বিধেয়রূপে ব্যবহার করতে পারি। বিশিষ্ট বস্তুটি কোন একটি শ্রেণীর সদস্য (Member of a class) এই বিষয়টি নির্দেশ করছে, এমন বিধেয় উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে আরোপ করা চলবে না। সোজা কথা, কোন উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সেই উদ্দেশ্য থেকে পৃথক কোন বিধেয় প্রয়োগ করা অনুমোদন যোগ্য নয় (It is not permissable to apply to a subject a predicate different from itsell)। এ হল সার্বিক ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ বর্জন করা। কাজেই কোন লক্ষণের সাহায্যে সংজ্ঞা প্রদান করার পদ্ধতির তিনি বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। যা যৌগিক, যে উপাদানের দ্বারা তা গঠিত, তার উল্লেখ করেই তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে। যা সরল তাকে অপরের সঙ্গে তুলনা করে ব্যাখ্যা করা চলবে, তবে তার সংজ্ঞা দেওয়া চলবে না।

আত্মবিরোধিতার অসম্ভাব্যতা : অ্যান্টিস্থিনিসের অপর একটি যুক্তিবিদ্যাসম্মত মতবাদ হল আত্মবিরোধিতার অসম্ভাব্যতা বিষয়ক মতবাদ। তিনি পিথাগোরাসের সঙ্গে একমত হয়ে ব্যক্ত করলেন যে, কোন ব্যক্তি নিজের বিরুদ্ধতা করতে পারে না। কারণ যখন সে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের কথা বলে, তখন সে ভিন্ন বস্তুর কথা বলে। এই প্রসঙ্গে জেলার মন্তব্য করেন যে, ‘এইভাবে তিনি সক্রেটিসের চিন্তাকে সম্পূর্ণভাবে সোফিস্ট-সুলভ চিন্তাধারায় রূপান্তরিত করেছিলেন।

সততাই কল্যাণ, পাপ হল অকল্যাণ : জেলার বলেন যে, অ্যান্টিস্থিনিসের নীতি-সম্পর্কীয় চিন্তাধারার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। তাই তাঁর নীতিতত্ত্ব অত্যন্ত সরল রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাঁর নীতিতত্ত্বের প্রধান ধারণাটি যে বাক্যের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে সেটি হল ‘কেবলমাত্র সততাই কল্যাণ এবং পাপ হল অ-কল্যাণ’। এই জগতের আর কোন কিছুই কল্যাণকর বা অকল্যাণকর নয়, ‘আর সব কিছুই সততা অসততা নিরপেক্ষ’ (Everything else indifferent)। সম্পত্তি, সুখ, অর্থ, স্বাধীনতা, সৌভাগ্য, খ্যাতি, স্বাস্থ্য এরা নিজগুণে কল্যাণ নয়; দারিদ্র্য, দুঃখ, পীড়া, ক্রীতদাসত্ব, মৃত্যু, লজ্জা, এরাও নিজগুণের অকল্যাণকর নয়। কেননা প্রথমটিই যদি মানুষের প্রভু হয়ে দাঁড়ায় তাহলে মানুষকে সহজেই অধ :পতনের পথে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আর শেষেরটি মানুষকে সততা শিক্ষা দিতে পারে। অ্যান্টিস্থিনিস বলেছেন যে, কামনার শিকার হওয়ার চেয়ে তিনি উন্মাদ হওয়াও শ্রেয় মনে করেন।

সততাই স্বাধীনতা, সততা এক ও অখণ্ড : ক্রীতদাস হওয়ার তুলনায় স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া শ্রেয় এমন কোন কথা নেই, কেননা ক্রীতদাসের যদি সততা থাকে, সে নিজেই স্বাধীন। আত্মহত্যা করা অপরাধ নয়। মানুষ তার জীবন ধ্বংস করতে পারে, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য নয়, বরং দেখাবার জন্য যে, জীবনের প্রতি সে উদাসীন। সততা এবং অসততার মধ্যে সীমারেখা সুনির্দিষ্ট। তেমনি সীমারেখা রয়েছে জ্ঞানী ও মূর্খের মধ্যে, সব লোকই এই দুই শ্রেণীর কোন একটির অন্তর্ভুক্ত। সততা এক ও অখণ্ড, তাকে ভাগ করা চলে না, পেতে হলে সবটুকুই পেতে হবে, কোন অংশকে নয়। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি হয় সৎ হবে, নয় অসৎ হবে। এই দুই-এর মাঝামাঝি কোন পথ নেই। জ্ঞানী ব্যক্তি সততাকে, সুখকে, পূর্ণতাকে পরিপূর্ণভাবে লাভ করে, আর মূর্খ ব্যক্তি লাভ করতে পারে অসততাকে, অকল্যাণকে এবং অপূর্ণতাকে।

সততাই জ্ঞান : অ্যান্টিস্থিনিসের মতে, সততাই জ্ঞান এবং এই সততা শিক্ষালভা। এই সততা হল মূল্যের সংশোধনের জন্য পুননিরীক্ষণ (revision of values), উন্মাদনা থেকে মুক্তি এবং অধিকাংশ ব্যক্তি বস্তুর যে ভ্রমাত্মক মূল্যায়ন করে, তার থেকেও মুক্তি। মূল্যের যথাযথ তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারলেই মানুষ যথার্থ সুখের পথে নিজেকে চালিত করতে পারে এবং সেই যথার্থ সুখ হল রিপুর অধীনতা স্বীকার না করা এবং কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে য-নির্ভর জীবন-যাপন করা।

রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও আইনকে উপেক্ষা, একেশ্বরবাদ ও সততাই একমাত্র সেবা : সক্রেটিস রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং তার প্রণীত আইনকে কখনও উপেক্ষা করার কথা চিন্তা করেননি কিন্তু অ্যান্টিস্থিনিস করেছিলেন। তিনি প্রচলিত ধর্মকেও বর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন। শুধু একটি মাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। গ্রীকদের সর্বদেবতার মন্দির (Pantheon) রীতিগত বিষয়। সততাই হল দেবতার একমাত্র সেবা, মন্দির, প্রার্থনা, উৎসর্গ এসব অসার্থক। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দেবতা একাধিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেবতা একজনই।

ডায়োজিনিস (৪১২/৪০৪ – ৩২৩ খ্রি.পূ.) সম্প্রদায়ের অন্যতম দার্শনিক ছিলেন : অ্যান্টিস্থিনিসের শিষ্য ডায়োজিনিস (Diogenes) অ্যান্টিস্থিনিসের থেকেও অধিক খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যাংকের মালিক। স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়াতে তিনি এথেন্সেই তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। যদিও তিনি কোরিম্থ (Corinth)-এ মারা যান, তিনি বড়াই করে নিজেকে ‘কুকুরটি’ (The dog) বলে অভিহিত করতেন এবং ইতর প্রাণীর জীবনকেই মানুষের অনুকরণযোগ্য আদর্শ বলে নির্দেশ করতেন। ডায়োজিনিস মনে করতেন যে, অ্যান্টিস্থিনিস যা শিক্ষা দিতেন, অনুশীলন করার সময় শিক্ষার সঙ্গে তার সামঞ্জস্য লক্ষ করা যেত না। অ্যান্টিস্থিনিস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলতেন যে, তিনি হলেন একটা ভেরী যে নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই শোনে না।’ আসলে গুরুর উপরে শিষ্যের ক্ষোভের কারণ হল যে, গুরু তাঁর নীতিকে বাস্তবে অনুসরণ করেন না। কাজেই ডায়োজিনিস অবিচলিত সংকল্প নিয়ে গুরুর তত্ত্বকে অনুসরণ করার জন্য ব্রতী হয়েছিলেন। ব্যাধিগ্রস্ত মানব সমাজের চিকিৎসক হওয়ার সংকল্প তাঁর ছিল না। তিনি হতে চেয়েছিলেন একটা ‘অসভ্য কুকুর’। তাঁর প্রধান গ্রন্থের নাম ছিল “দি পেন্থার’ (The Panther)। তিনি বলতেন, তাঁর লক্ষ হল প্রচলিত মূল্যগুলোর পুনর্মূল্যায়ন (Recoining of Current Values)। রচনার মধ্য দিয়ে প্রভাবিত করার তুলনায় নিজে কাজ করে সেই দৃষ্টান্তের দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। সমাজে প্রচলিত পরম্পরাগত প্রথা’ তিনি বর্জন করেছিলেন। খাদ্য, পরিধেয়, বাসস্থান, আচরণ সব ব্যাপারেই তিনি চলিত প্রথা বর্জন করে চলতেন। যা সকলের দৃষ্টির অন্তরালে সম্পাদন করা উচিত, তা তিনি সর্বসমক্ষে সম্পাদন করতে দ্বিধা করতেন না। কথিত আছে, তিনি একটা কাঠের টব বা গামলায় কুকুরের মত বসে থাকতেন এবং ভারতীয় সন্ন্যাসীর মত ভিক্ষা করতেন। সভ্যতা মানব জীবনে যে জটিলতা সৃষ্টি করেছে, তার প্রতি তাঁর গভীর ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ছিল। সভ্য জগতে যে সব বাহ্যবস্তুর ব্যবহার হয় অ্যান্টিস্থিনিস সেগুলোর প্রতি উদাসীন ছিলেন। ডায়োজিনিস আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে স্বনির্ভরতা বা স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে চরম কৃচ্ছ অবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন। সততা লাভের জন্য তিনি গভীর আগ্রহী ছিলেন। সততার তুলনায় জাগতিক সম্পদকে তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হওয়াকেই তিনি সততা ও নৈতিক স্বাধীনতা বলে গণ্য করতেন। মনিমাস, ওনিসিক্রিটাস, ফিলিস্কাস, থিবসের ক্রেটস প্রমুখ ব্যক্তিগণ ছিলেন ডায়োজিনিসের শিষ্য।

সিরেনিক সম্প্রদায় (The Cyrenaic School)

অ্যারিস্টিপাস (৪৩৫ – ৩৫৬ খ্রি.পূ.), সংবেদন ও সোফিজম দ্বারা প্রভাবিত সুখবাদ : সিরেনিক সম্প্রদায়ের মতবাদ সিনিক সম্প্রদায়ের মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। সিরেনিক অ্যারিস্টিপাস (Aristippus) এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। খ্রি : পূ : ৪৩৫ অব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সিরেনিক অ্যারিস্টিপাস সম্ভবত প্রোটেগোরাসের দার্শনিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এথেন্সে সক্রেটিসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। প্রোটেগোরাস এবং সোফিস্টদের চিন্তাধারা অ্যারিস্টিপাসের চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রোটেগোরাস সততার ব্যক্তিনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করেছিলেন এবং সোফিস্টদের মধ্যেও অনেকে একই মতবাদ নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। সোফিস্টরা যেমন মনে করতেন যে, সংবেদনই কেবলমাত্র আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান দান করে, অ্যারিস্টিপাসও তাই মনে করতেন। সংবেদন স্বরূপত বস্তু (Things in Themselves) সম্পর্কে কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান বা অপরের সংবেদন সম্পর্কে কোন জ্ঞান দিতে পারে না। সোফিস্টদের মতে, ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার বিরোধী কোন নৈতিক নিয়ম নেই যা তার ওপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযুক্ত হতে পারে অর্থাৎ যা সে মেনে চলতে বাধ্য। নৈতিক নিয়ম ব্যক্তিভেদে যতন্ত্র, অ্যারিস্টিপাস সোফিস্টদের এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিয়ে তাকে তাঁর প্রচারিত সুখবাদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। কেননা মানুষের ব্যক্তিগত সংবেদনই হল তার ব্যবহারিক আচরণের ভিত্তি। কিন্তু কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংবেদন যদি তার ব্যবহারিক আচরণের ভিত্তি হয়, তাহলে অ্যারিস্টিপ্‌পাস সিদ্ধান্ত করলেন যে, মানুষের আচরণের লক্ষ হবে সুখজনক সংবেদন লাভের প্রচেষ্টা। অ্যারিস্টিপাস সুখকেই মানবজীবনের চরম কাম্যবস্তু এবং পরম শ্রেয় বলে নির্দেশ করলেন। তাঁর মতে, কোন কিছুই মন্দ নয়, যদি তা মানুষের সুখের বাসনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে।

গতির মধ্যেই সংবেদন নিহিত : অ্যারিস্টিপ্‌পাসের মতে, গতির মধ্যেই সংবেদন নিহিত। যখন এই গতি শান্ত তখন একটা সুখের অনুভূতি জাগে, যখন এই গতি অশান্ত বা স্থূল তখন ব্যথার সংবেদন বা অনুভূতি জাগে। আর গতি যদি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য না হয়, বা আদপেই যদি কোন গতি না ঘটে, তাহলে সুখ বা দুঃখ কোনটিরই অনুভূতি হয় না। অ্যারিস্টিপাস বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতি নিজেই মানুষকে বলে দেয় যে, সুখই কেবলমাত্র মানুষের কাম্য। সুখ কল্যাণের সঙ্গে এবং মদ অ-কল্যাণের সঙ্গে অভিন্ন। সুখ দেহের মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া জনিত সংবেদন ছাড়া আর কিছুই নয়। এইভাবে অ্যারিস্টিপাস তাঁর নীতিতত্ত্বের প্রধান নীতিটি আবিষ্কার করলেন। এই নীতিটি হল সর্বাধিক পরিমাণ সুখলাভের উদ্দেশ্যেই মানুষের সব ক্রিয়া অবশ্যই চালিত হওয়া দরকার।

সক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পার্থক্য : সক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অ্যারিস্টিপ্‌পাসের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটুকু বুঝে নেওয়া যাক— সক্রেটিসের মতে, সুখলাভের একমাত্র পথ হল সততা, সততা অনুশীলনের জন্য সুখকে উদ্দেশ্যরূপে নির্দেশ করতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। কিন্তু তাই বলে সুখই মানবজীবনের একমাত্র কাম্যবস্তু এ কথা সক্রেটিস বলেননি। সক্রেটিস এমন কথাও বলেননি যে, সততার জন্যই সততা অনুশীলন করা চলবে না। তাছাড়া সক্রেটিস যা বলতে চেয়েছেন তার অন্তর্নিহিত অর্থ হল, সুখ লাভের একটি পথ হল সততা অনুশীলন। কিন্তু অ্যারিস্টিপাস সক্রেটিসের শিক্ষার সমগ্র দিকটি গ্রহণ না করে, তার বিশেষ একটা দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, সিদ্ধান্ত করলেন যে, সুখই মানব জীবনের একমাত্র কাম্য বস্তু। স্টেইসের মতে, সক্রেটিস সুখ ছাড়া সততার বা নৈতিকতার অন্য কোন ভিত্তি সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ করতে পারেননি বলে অ্যারিস্টিপাস সক্রেটিসের শিক্ষার একটা বিশেষ দিককেই একটা যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে টেনে নিয়ে গেলেন।

অ্যারিস্টিপাস ও এপিকিউরাসের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য : অ্যারিস্টিপাসের মতে, সুখই মানব জীবনের একমাত্র কাম্যবস্তু। কিন্তু প্রশ্ন হল, তিনি কোন ধরনের সুখের কথা বলেছেন? পরবর্তী সময়ে এপিকিউরাস (Epicurus) সুখকে নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছেন। সুখ বলতে এপিকিউরাস বুঝেছেন দৈহিক দুঃখ ও মানসিক অশান্তির অভাব। তাঁর মতে, সুখ হল এমন একটা মানসিক অবস্থা যা আনন্দ ও দুঃখ উভয়ের প্রতি সমানভাবে উদাসীন। জীবনের লক্ষ হল ঐ উদাসীন মনোভাবের অধিকারী হওয়া। ভোগের জন্য তীব্র অনুভূতি নয়, বরং অনুভূতির বিরতি। সুতরাং ভোগের বা ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির মধ্যেও সুখ নেই। সুখ হল দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ এবং নির্লিপ্ত মানসিক মনোভাব। অ্যারিস্টিপাস সুখ অর্থে বোঝেন প্রত্যক্ষভাবে আনন্দ উপভোগ, কেবলমাত্র দুঃখকে পরিহার করা নয়। যে কোন উপায়ে সুখভোগ করাই মানুষের একমাত্র লক্ষ হওয়া উচিত। তাঁর মতে, দেহের সুখ বা ইন্দ্রিয় সুখ মানসিক সুখের তুলনায় অধিকতর কাম্য। কেননা ইন্দ্রিয় সুখের তীব্রতা এবং প্রখরতা মানসিক সুখের তুলনায় অধিক। তাঁর মতে, বিভিন্ন ধরনের সুখের মধ্যে কোন গুণগত পার্থক্য নেই, তবে পরিমাণগত প্রভেদ আছে। যে সুখ বেশি তীব্র এবং যার স্থিতিশীলতা বেশি, সেই সুখই কাম্য।

সুখের মূল্যায়নের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তির বিচার শক্তি থাকা চাই : উপরিউক্ত মতবাদের পরিণতি হল ইন্দ্রিয় সুখের জন্য অতিরিক্ত আকুলতা। কিন্তু সিরেনিক সম্প্রদায় সক্রেটিসের মতবাদের মধ্যে সুখবাদের উপাদানকে গ্রহণ করে ঘোষণা করলেন যে, জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তি, সুখ নির্বাচন করার সময় অবশ্যই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবেন। কাজেই সুখ কাম্য হলেও অসংযত মাত্রায় সুখভোগ পরিণামে দুঃখ আনয়ন করে, সেহেতু তাকে মানুষ বর্জন করবে। জনসাধারণের দ্বারা নিন্দিত হয় বা রাষ্ট্র কর্তৃক দণ্ডিত হয় এমন অসংযত ইন্দ্রিয়াচরণ থেকে মানুষ বিরত থাকবে। সিরেনিকরা সুখের বিভিন্ন মাত্রার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেননি এবং এ কথাও অস্বীকার করেননি যে, অনেক সুখকেই পেতে হলে বৃহত্তর দুঃখের মধ্য দিয়ে পেতে হবে। দৈহিক সুখের তীব্রতা ও স্থিতিকাল বেশি, কিন্তু তাঁরা এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, এমন অনেক সংবেদন আছে দেহ থেকে যেগুলো উদ্ভূত হয় না। কাজেই জীবনের বিভিন্ন ধরনের সুখের মূল্যায়নের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তির বিচার শক্তি থাকা চাই। তা ছাড়া জ্ঞানী ব্যক্তিকে সুখভোগের ব্যাপারে কিছুমাত্রায় তার স্বাধীনতাকে সীমিত করতে হবে। যদি সে সুখের ক্রীতদাস হয়ে পড়ে, তাহলে সে সুখভোগ তো করতেই পারবে না, দুঃখে পতিত হবে। জীবনে ভোগের বস্তুকে কিভাবে ভোগ করতে হবে এটা বুঝে নিতে পারলে সুখ নষ্ট হবে না এবং নিজ কল্যাণে সবকিছুরই উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করা যাবে। এটাই হল সুখভোগের প্রথম শর্ত।

উপসংহার : অ্যারিস্টিপাস তাঁর জীবনে যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন সেটি হল যতদূর সম্ভব জীবনকে ভোগ করা। কিন্তু তাঁর মতে, মানুষের উচিত হবে সর্ব অবস্থাতেই নিজের এবং পরিবেশের ওপর কর্তৃত্ব করা, প্রতিটি পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করা এবং সব কিছুর মধ্যে যা শ্রেয়তর তাকে লাভ করা। তা ছাড়া অ্যারিস্টিপ্‌পাসের যুক্তিপূর্ণ অভিমত হল, জ্ঞানী ব্যক্তি তার মনের স্ফূর্তি এবং সন্তোষ বজায় রাখার জন্য তার কামনাকে সীমিত করবে।

মেগারিয়ান সম্প্রদায় (The Megarean School)

মেগারার ইউক্লিড (Euclid, ৩০০ খ্রি.পূ.) এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন সক্রেটিসের প্রাচীনতম শিষ্যদের মধ্যে একজন। সক্রেটিসের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করার মধ্যে বিপদ আছে জেনেও তিনি সক্রেটিসের সান্নিধ্য লাভ করতে চাইতেন। সক্রেটিসের মৃত্যু সময়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো এবং অন্যান্য ভীতিগ্রস্ত সক্রেটিস অনুগামীবৃন্দ মেগারার ইউক্লিডের শরণাপন্ন হন। মেগারিয়ান সম্প্রদায়ের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে –

  • ইউক্লিডের দার্শনিক চিন্তাধারায় সক্রেটিস ও এলিয়াটিক দর্শনের সংমিশ্রণ : সম্ভবত, সক্রেটিসের অনুগামী হবার পূর্বে মেগারার ইউক্লিড এলিয়ার দার্শনিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করেছিলেন। সেই কারণে ইউক্লিডের দার্শনিক চিন্তাধারায় সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তাধারা এবং এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের দর্শনের সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। এলিয়ার দার্শনিক পারমিনাইডিসের মতই মেগারিয়ান সম্প্রদায় এক সর্বনিরপেক্ষ পরম সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সকল রকম বহুত্ব, সব ধরনের গতিকেই অলীক বা মিথ্যা মনে করতেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের কোন বাস্তব সত্যতা নেই, কেবলমাত্র সত্তা (Being)-এরই অস্তিত্ব আছে। সক্রেটিক দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হল কল্যাণ (Good) এবং পারমিনাইডিসের দর্শনে সত্তা। ইউক্লিড সক্রেটিসের নীতিবিদ্যার প্রভাব বশত এক (One)-কেই কল্যাণের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলেন।
  • সত্যতা হল পরম সত্তার জ্ঞান : ইউক্লিডের মতে, সততা হল এক, সততা হল জ্ঞান। কিন্তু প্রশ্ন হল, কিসের জ্ঞান? ইউক্লিডের মতে, এই জ্ঞান হল পরম সত্তার জ্ঞান বা কল্যাণের জ্ঞান। এখানেই ইউক্লিডের ওপরে এলিয়ার দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ইউক্লিড এক পরম সত্তাকেই (One Being) কল্যাণ, ঈশ্বর, মন এবং বুদ্ধি প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। ভবন (Becoming), বহুত্ব, অকল্যাণ সত্তার বিপরীত যে অ-সত্তা (Not-Being) তারই ভিন্ন ভিন্ন নাম। কাজেই বহুত্ব অকল্যাণের সঙ্গে অভিন্ন এবং উভয়ই অলীক। অকল্যাণের প্রকৃতপক্ষে কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
  • কল্যাণেরই অস্তিত্ব আছে : কল্যাণেরই বাস্তব অস্তিত্ব আছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কল্যাণের বিপরীত কোন সত্তার অস্তিত্ব তিনি অস্বীকার করেছেন। কেননা সেই সত্তা হবে বহুত্ব, যা এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের মতে অলীক। কাজেই পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, ইউক্লিডের ওপরে সক্রেটিস দর্শনের প্রভাব সত্ত্বেও তিনি এলিয়াটিক দর্শনের একজন অনুগামী ছিলেন।
  • সততা এক : ইউক্লিডের মর্তে, সততা হল এক, যা সত্তার জ্ঞান। মহানুভবতা, মিতাচার, বিজ্ঞতা (Wisdom) একই সততার ভিন্ন ভিন্ন নাম। ইউক্লিড সিনিক এবং সিরেনিক অভিমতের সমন্বয় সাধনের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। কারণ তাঁর মতে, চরিত্র-নীতির দিক থেকে যা ‘কল্যাণ’, প্রকৃতির দিক থেকে তাই ‘সত্তা’। সত্য এবং প্রজ্ঞা ভিন্ন অন্য সত্তার অস্তিত্ব নেই। মানুষের সর্বোত্তম অবস্থা তখনই পরিলক্ষিত হয়, যখন মানুষ তার ‘অন্তরস্থ সত্য ও প্রজ্ঞার অনুবর্তী হয়’। সিনিক সম্প্রদায়ের মতে, ত্যাগ অর্থাৎ ভোগাকাঙ্ক্ষা বর্জন এবং বিষয়বিমুখ আত্মনির্ভরতাতেই সততা নিহিত। সিরেনিক সম্প্রদায়-এর মতে, সততা হল সুখ অন্বেষণ করা। মেগারিয়ান সম্প্রদায়-এর মতে, সততা হল সত্তার জ্ঞান।
  • বহুত্ব সম্ভব নয় : এলিয়াটিক দর্শন যেমন জেনোর হাতে, তেমনি মেগারিয়ান দর্শন ইউক্লিড পরবর্তী অনুগামীদের হাতে, বিশেষ করে ইউবুলাইডিস (Eubulides, খ্রি.পূ. ৪র্থ শতক) এর হাতে শূন্যগর্ভ বিতর্কবিদ্যায় পরিণতি লাভ করল। এরা অদ্ভুত অর্থহীন যুক্তি উদ্ভাবনেই আনন্দ লাভ করত। এলিয়ার দার্শনিক যেমন যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, গতি সম্ভব নয়, তেমনি এরাও প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, বহুত্ব সম্ভব নয়। তাঁদের উদ্ভাবিত যুক্তিটা এই ধরনের, ‘এক কণা শস্যকে স্তূপ বলা চলে না’ তার সঙ্গে আর এক কণা শস্য যোগ করে দাও, তবু স্তূপ হল না। তাহলে স্তূপের শুরু কোথা থেকে? এই ধরনের যুক্তি উদ্ভাবন করার অর্থ বহুত্বকে অসম্ভব প্রমাণ করার প্রচেষ্টা।
  • যা বাস্তব তাই সম্ভাব্য : জেনো দেখিয়েছিলেন যে, বহুত্ব এবং গতি শুধু যে অবাস্তব তা নয়, দুই-ই অসম্ভব। কেননা তারা স্ব-বিরোধী। মেগারিয়ান সম্প্রদায়ের জনৈক দার্শনিক ডায়োডোরাস ক্রোনাস (Diodurus Cronus) বাস্তবতাকেই সম্ভাব্যতার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলেন। কেবলমাত্র যা বাস্তব তাই সম্ভাব্য (only the actual is possible), আবার যা সম্ভাব্য তাই বাস্তব। যা এখনও পর্যন্ত অস্তিত্বশীল নয়, এই রকম কোন কিছু সম্ভাব্য হতে পারে না। ক্রোনাসের প্রদত্ত যুক্তিটা হল যা সম্ভাব্য, তা অসম্ভব হতে পারে না। কেননা দুটো পরস্পর বিরুদ্ধ বিষয়ের একটা অস্তিত্বশীল হলে আর একটা অস্তিত্বশীল হতে পারে না। অপরটি অসম্ভব। কাজেই কোন কিছু যদি পূর্বে সম্ভাব্য ছিল, তাহলে অসম্ভব সম্ভব থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে বলতে হবে। তাহলে অবশ্যই এটা পূর্বে সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ কিনা, কেবলমাত্র যা বাস্তব তাই সম্ভব।
  • স্টীলপোর দার্শনিক অভিমত : মেগারিয়ান সম্প্রদায়ের একজন খ্যাতনামা সভ্য ছিলেন স্টীলপো (Stilpo, ৩৬০-২৮০ খ্রি.পূ.)। তিনি কিছু সময় এথেন্সে বসবাস করেছিলেন, কিন্তু ধর্মের প্রতি তাঁর বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি নির্বাসিত হন। স্টীলপোর জন্য মেগারিয়ান সম্প্রদায়ের খ্যাতি চতুর্দিকে বিস্তার লাভ করে। তাঁর মতে, জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য প্রজ্ঞা ও জ্ঞান লাভ করা। তিনি দৈহিক কল্যাণের তুলনায় মানসিক কল্যাণকে ঊর্ধে স্থান দিতেন। কল্যাণের জ্ঞানের সঙ্গে যা সম্পর্কবিহীন তার প্রতি তিনি উদাসীন ছিলেন। আত্মনির্ভরতার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং অনীহা তত্ত্বের (Theory of Apathy) প্রচারের দ্বারা তাঁর শিষ্য জেনো প্রবর্তিত স্টোয়িক নীতিবিদ্যার পথ সুগম করে তুলেছিলেন।

এলিয়ান-এরিট্রিয়াল সম্প্রদায় (The Elan-Eretrial School)

এলিয়ার ফিডো (Phaedo) এবং এরিট্রিয়ার মেনেডেমাস (Menedemus, ৩৪৫/৪৪ – ২৬১/৬০ খ্রি.পূ.)-এর নাম অনুসারেই উপরিউক্ত সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়। ফিডো ছিলেন সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্যদের অন্যতম। তিনি দর্শনকেই আধ্যাত্মিক অকল্যাণের প্রতিকাররূপে, প্রকৃত স্বাধীনতার পথনির্দেশকরূপে গণ্য করতেন। মেনেডেমাস ফিডোর শিষ্য প্লিসটেনাস্ (Pleistanus)-এর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে এরিট্রিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারা নৈতিক বুদ্ধিবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তিনি সততা ও জ্ঞানের ঐক্য স্বীকার করতেন। নীতিবিদ্যার আলোচনাতেই তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন।

তথ্যনির্দেশ

  • E. Zeller: Outlines of the History of Greek Philosophy.
  • Norman Gulley: The Philosophy of Socrates.
  • B. Russel : History of Western Philosophy
  • F. Copleston : A History of Philosophy
  • John Burnett : Early Greek Philosophy

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.