Table of Contents
ভূমিকা
বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ধর্মীয় মূলতত্ত্বের অর্থকে কেন্দ্র করে একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রায়শই নানারকম মতভেদ দেখা দেয়, এবং এসব মতভেদের কারণে একই ধর্মের আওতায় গড়ে ওঠে একাধিক সম্প্রদায়। ধর্মের কেন্দ্রীয় বাণীর প্রতি আস্থাশীল থেকেই এসব সম্প্রদায় তাদের ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব ও আচারের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে এবং তাতেকরেই তারা ক্রমশ রচনা করে এক বর্ণাঢ্য ধর্মীয় সভ্যতা বা সংস্কৃতি। খ্রিস্টধর্মের ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট শাখা, বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের মহাযান ও থেরবাদ সঙ্ঘ, হিন্দুদের শৈব ও বৈষ্ণব মতবাদ প্রভৃতি সবই ধর্মের মূল মর্মের বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যাপ্রসূত মতবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
ইসলাম পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর সর্বশেষ ধর্ম এবং এ ধর্ম ব্যাপ্তি লাভ করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশের মানুষের মধ্যে। আর এজন্যই অন্যান্য যে-কোনো ধর্মের মতো এ ধর্মের মূলবাণীর ব্যাখ্যায় যে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যাবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একথা মনে রাখা দরকার যে, মহানবীর জীবদ্দশায় ইসলাম ছিল তার বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে এবং এর প্রয়োগের দিকটিও তখন ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। যে-কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোরানের নীতিমালা এবং মহানবীর ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা ও নির্দেশই তখন ছিল যথেষ্ট। এ কারণেই তখন ধর্মীয় প্রশ্নাবলি নিয়ে মতবিরোধের তেমন কোনো অবকাশ ছিল না। এ ছাড়া ইসলামের প্রারম্ভিক পর্যায়ে মুসলমানরা তাদের নতুন ধর্মের প্রচার নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে, তখন ধর্মীয় বিধি-বিধানের চুলচেরা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সময় তাদের বড় একটা ছিল না।
কিন্তু মহানবীর পরলোকগমনের পর নতুন নতুন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেখা দিতে থাকে এমনসব জটিল সমস্যা, যেগুলোর সুস্পষ্ট সমাধান কোরানে ছিল না এবং যার অকাট্য সমাধান দেয়ার জন্য মহানবীও তখন উপস্থিত ছিলেন না। এসব কারণে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে দেখা দেয় ক্রমবর্ধমান মতবিরোধ। ইসলামের প্রতি এতটুকু অনাস্থাশীল না হয়েও নানা প্রসঙ্গে তারা একের সঙ্গে অন্যের বিরোধ লক্ষ্য করে এবং শেষ পর্যন্ত এসব ভিন্নমত তাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে দেয়।
প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধের সূত্রপাত সেটি হলো ইমামের স্বরূপ। মহানবীর তিরোধানের পর তার সহচররা (সাহাবা) নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে খলিফা নির্বাচিত করতে চান। এ খবর যখন হজরত আবুবকরের কানে যায়, তখন তিনি অভিমত দেন যে, খলিফাকে অবশ্যই কুরাইশ বংশের হতে হবে। এটি খোদ মহানবীরই অভিপ্রায় ছিল বলে তিনি জানান। অবশেষে হজরত আবুবকর খলিফা নিযুক্ত হন। আবুবকর ও তার পরবর্তী খলিফা হজরত ওমরের সময়ও এ নিয়ে কোনো বড়রকমের গোলযোগ দেখা দেয়নি। গোলযোগের সূত্রপাত ঘটে হজরত ওসমানের খলিফা হওয়ার পর, এবং এর পরিণতিতেই তিনি নিহত হন।
ওসমান হত্যাকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র গোলযোগ ও হানাহানি। সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিদের মতে তিনি ছিলেন একজন সৎ ও মহান ব্যক্তি এবং যারা তাকে হত্যা করেছে তারা গুরুতর অপরাধে অপরাধী। সমাজের অপর অংশ এ অভিযোগ অস্বীকার করে, এবং এ নিয়ে সেদিন যে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে তা আজও অমীমাংসিত। হজরত আলী খলিফা মনোনীত হওয়ার পরও এ ধরনের মতবিরোধ অব্যাহত থাকে। কেউ কেউ তার নেতৃত্বের বিরোধিতা করে; অন্য কেউ কেউ আবার নিজেদের এ বিতর্ক থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আরো কেউ কেউ তার জোর সমর্থন করতে থাকে। আজও এ বিতর্কের অবসান ঘটেনি। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ছিলেন উমাইয়া বংশজাত। উমাইয়ারা নানাভাবে মহানবীর বিরোধিতা করেছিলেন। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া ওসমান হত্যার প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিলেন এবং হযরত আলী খলিফা হওয়ার পর মুয়াবিয়া তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মুয়াবিয়ার সঙ্গে আলী সন্ধি করতে বাধ্য হন। এই সন্ধি ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে পূর্বপরিকল্পিত, এবং তা শেষ পর্যন্ত আলীর বিরুদ্ধে যায়।
খারেজি সম্প্রদায় (Kharijite Sect)
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে খারেজিগণ প্রথম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়। হজরত আলীর অনুসারীদের মধ্যে যে দলটি সন্ধির বিরুদ্ধে ছিল তারা খারিজি নামে পরিচিত। তাদের মতে, সন্ধি বা আপোস ঈশ্বরের বিরুদ্ধে একটি দ্রোহিতামূলক কাজ। কারণ, একমাত্র ঈশ্বরই চূড়ান্ত বিচারক; এবং শুধু তিনিই আপোসরফা বা সন্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। ঈশ্বরের এ রায় মানুষ জানতে পারে গোটা সমাজের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে। খারিজিদের মতে, যথাযোগ্য গুণাবলির অধিকারী হলে যে কোনো ব্যক্তি, এমনকি একজন আবিসিনীয় ক্রীতদাসও খলিফা হতে পারেন। নেতৃত্ব কোনো বংশ মর্যাদার ব্যাপার নয়; নেতৃত্বের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো চারিত্রিক বিশুদ্ধতা, চিন্তায় ও আচরণে সততা ও পবিত্রতা।
তাদের মতে, বড়রকমের পাপ অনুষ্ঠানকারী যে-কোনো মুসলমান তার সেই পাপাচারের কারণে পৌত্তলিকের অবস্থায় অধঃপতিত হয়ে যায় এবং এর জন্য তাকে কঠোর শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া যেতে পারে। খারিজিরা ঈশ্বরের বিশুদ্ধ অনপেক্ষ একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের মতে, কোরান ঈশ্বরের সৃষ্ট বাণী এবং এজন্যই একে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতে হবে, রূপক অর্থে নয়। ধর্মানুশীলনের ব্যাপারে খারিজিরা সর্বাত্মক বিশুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং নামাজের আগে আনুষ্ঠানিক ওজুর ওপর বিশেষ জোর দেন। শুধু তা-ই নয়, তারা এ-ও মনে করেন যে, অসৎ কথাবার্তা, মিথ্যাচার, পরনিন্দা প্রভৃতি আচরণ ধর্মীয় পবিত্রতা বিনাশ করে এবং মানুষকে নামাজের জন্য অনুপযুক্ত করে দেয়।
এসব কঠোর মত অবলম্বনের ফলে হজরত আলীর সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে তারা আলী থেকে সরে যায় এবং মুয়াবিয়ার তীব্র বিরোধিতা করে। তারা ছিল গণতান্ত্রিক নীতির সমর্থক, এবং এজন্যই সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট অনেকেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, উমাইয়া শাসকদের বিরোধী বারবাররা তাদের মতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। উত্তর আফ্রিকার খারিজিরা আজও আবেদি বা ইবাদি নামে পরিচিত। আলজেরিয়ায় তারা তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথকভাবে রয়েছে। নিজেদের বাইরে তারা বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে আগ্রহী নয়। নিজেদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানসমূহকে তারা নিষ্ঠার সঙ্গে সংরক্ষণ করে চলেছে। সৌদি আরবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ওহাবি সম্প্রদায়ের ওপর খারিজিদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
খারেজি শব্দটি আরবি। এর অর্থ পৃথক হয়ে যাওয়া বা দল ত্যাগ করা। খারেজিগণ হযরত আলীর সমর্থক বা অনুগামী ছিল। ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ খেলাফত প্রশ্নে আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে দুমাত-উল-জান্দালে একটি সালিশি বসে। সালিশি রায় মনঃপুত না হওয়ায় আলীর অনুগামীদের মধ্য থেকে একটি দল খারিজ বা পৃথক হয়ে যায়। সেই সময় থেকে এরা ইসলামের ইতিহাসে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রদায় নামে পরিচিতি লাভ করে। P. K. Hitti তার History of the Arabs গ্রন্থের ১৮২ পৃষ্ঠায় বলেন, “It alienated the sympathy of a large body of his own followers. These Kharijites (secenders) as they were called the earliest sect of Islam, proved his deadly foes. (আলী তার অনুগামীদের একটি বৃহৎ অংশের (প্রায় ৪০০০) সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হল। যাদেরকে বলা হয় খারেজি বা বিন্নিতাবাদী। এরা ছিলেন ইসলাম ধর্মের একেবারে গোড়ার দিককার এক সম্প্রদায়। ক্রমে তারা আলীর মারাত্মক শত্রুতে পরিণত হয়।) খারেজিগণ প্রথমে হারুবিয়্যা এবং পরে নাহওয়ারানে ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে খারেজিরা কয়েকটি শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকশত বছর তারা নিজেদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করে। তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাকাসে হয়ে এলেও বিভিন্ন সময়ে তাদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।
খারেজিদের উৎপত্তি
১৭ জুন ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান একদল বিদ্রোহী দ্বারা নিজ গৃহে শহীদ হন। তার হত্যাকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে বিচারের সম্মুখীন করার ব্যাপারে তৎকালীন নেতৃস্থানীয় তথা হযরত মুয়াবিয়া ও হযরত আলীর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়। তার হত্যা ইস্যুর সঙ্গে আরো অন্যান্য ইস্যু যুক্ত হয়ে ৩৭ জুলাই ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলীর সাথে মুয়াবিয়ার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে চূড়ান্ত রায় হওয়ার পূর্বমুহূর্তে চতুর সেনানায়ক আমর ইবন আল আস এর পরামর্শে মুয়াবিয়া একটি দুর্দান্ত কৌশলের আশ্রয় নেন। কোরানের পাতা বর্ষাফলকে উত্তোলন করে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, কোরানের আলোকে উভয়ের বিবাদ মীমাংসা করা হবে। সরল হৃদয়ের আলী অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার প্রস্তাব মেনে নেন।
আল মদিনা ও দামেস্কের মাঝামাঝি দুমাত-উল-জান্দাল (আজরুহ) নামক স্থানে উভয় পক্ষে অন্তত ৪০০ জন সাক্ষীর সম্মুখে জানুয়ারি ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে সালিশি বৈঠকে বসে। আপসসূত্র অনুযায়ী আলী আবু মুসা আল আশয়ারিকে ব্যক্তিগত প্রতিনিধি মনোনীত করেন। অপরদিকে চতুর আমর ইবন আল আসকে প্রতিনিধি মনোনীত করেন মুয়াবিয়া। দুই প্রতিনিধি আলোচনা সাপেক্ষে আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে পদচ্যুত করতে সম্মত হন। দুই প্রতিনিধির মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ আবু মুসা আল আস আরি সম্মেলনে উঠে ঘোষণা করেন ‘আমি হযরত আলীকে খেলাফত হতে পদচ্যুত করলাম।’ এরপর আমর ইবন আল আস দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি আলীর পদচ্যুতি অনুমোদন করলাম এবং তদস্থলে মুয়াবিয়াকে নিযুক্ত করলাম।’ এই রায় শোনার পর হযরত আলীর অনুগামীগণ রায় প্রত্যাখ্যান করেন। আলীর পক্ষের যেসব সেনাগণ যুদ্ধবিরতি দিতে সম্মত ছিলেন না তাদের অধিকাংশ রাগে ক্ষোভে আলীর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাব ইবন ওয়াহাব আর রাসিবী তাদের নেতা নির্বাচিত হন। ইসলামের ইতিহাসে তারা খারেজি নামে পরিচিত। আবার কুফার অনতিদূরে হারুবিয়া নামক গ্রামে বসবাস করার কারণে খারেজিরা হারুবিয়া নামেও অভিহিত হয়।
খারেজি নামকরণের ব্যাখ্যা
খারেজিদের নামকরণের ব্যাপারে কয়েকটি মত পাওয়া যায় –
- ১ হযরত আলীর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার জন্য তাদের খারেজি নামে অভিহিত করা হয়।
- ২ মুমিনদের দল ত্যাগ করার দরুন তাদের এ ধরনের নামকরণ হয়।
- ৩ কুফা থেকে চলে যাওয়া থেকেই তাদের নামকরণ হয়েছে খারেজি।
- ৪ পরবর্তীতে খারেজিদের অনুসারীরা ‘আশ শুরাত’ নাম ধারণ করে।
খারেজিদের বিভিন্ন উপদল
খারেজিরা বিভিন্ন অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
- ক. ইবাদিয়া : আব্দুল্লাহ ইবন ইবাদিল মুররীত তামীমীর নামানুসারে খারেজিদের এই শাখার নামকরণ হয় ইবাদিয়া। এই সম্প্রদায়ের অন্যান্য নামের মধ্যে ‘শুরাত’ নামটি বিশেষরূপে পরিচিত। অন্য মুসলিমদের মতামত গ্রহণ করার ব্যাপারে ইবাদিয়ারা যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিল। বর্তমানে ওমান, পূর্ব আফ্রিকা, ত্রিপোলিতানিয়া ও দক্ষিণ আলজিরিয়ায় ইবাদিয়া সম্প্রদায়ে বসবাস করে।’
- খ. সাফারিয়া : এই শাখার নেতা ছিলেন জায়েদ বিন আফছার। এরা ছিল অত্যন্ত গোঁড়া। নিজেদের মতামতের বাইরে ভিন্ন মতাবলম্বীদের তারা অবিশ্বাসী বলে আখ্যায়িত করতো।
খারেজিদের রাজনৈতিক মতবাদ
খেলাফত সম্পর্কে খারেজিদের মতামত ছিল সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক। তাদের মতে, সমগ্র মুসলিম জাতি কর্তৃক খলিফা নির্বাচিত হতে হবে। খেলাফত বা ইমামতের জন্য কোন বংশ বা গোত্রের অগ্রাধিকার থাকবে না, নির্বাচনে যদি একজন দাসও জয়লাভ করে, তবে তাকে মান্য করতে হবে। (তবে শর্ত এই যে, তাকে একজন প্রকৃত মুসলিম হতে হবে।)
নারী নেতৃত্ব মানতে খারেজিদের আপত্তি ছিল না। খলিফা তার যোগ্যতা ও কার্যাবলীর দ্বারা যতদিন জাতির আস্থাভাজন থাকতে পারবেন, ততদিন তিনি খেলাফতে অধিষ্ঠিত থাকবেন। অন্যথায় তাকে পদচ্যুত করতে হবে আর পদচ্যুতিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে তাকে হত্যা করতে হবে।
প্রথম দুই খলিফা ছাড়া খারেজিরা তৃতীয় ও চতুর্থ খলিফাকে খলিফা হিসেবে স্বীকার করেন না। স্বজনপ্রীতির জন্য সত্য ও ন্যায়পথ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ার কারণে তারা হযরত ওসমানের হত্যাকেও ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন। সালিশির আশ্রয় নিয়ে অন্যায় করার কারণে তারা হযরত আলীকে খলিফা বলে স্বীকার করেন না।
খারেজিদের রাজনৈতিক মতবাদ নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ছিল কিন্তু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে তারা হত্যাকাণ্ডের ওপর গুরুত্বারোপ করতো। এজন্য ইসলামের প্রথম ধর্মীয় রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও তারা স্বীকৃতি পায় নি। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সাথে তাদের গৃহীত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দর্শন সামঞ্জস্য ছিল না।
খারেজিদের ধর্মীয় মতবাদ
ধর্মীয় ব্যাপারে খারেজিদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যেমন-
- ১. তারা মনে করে যে, ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ যেমন কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত অমান্যকারী কাফির হয়ে যাবে এবং ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। তাদের মতে, পরিবারবর্গসহ তাকে হত্যা করা উচিত।
- ২. তাদের মতে, তওবা না করে কবিরা গুণাহকারী চিরদিন জাহান্নামে যাবে।
- ৩. একটি মাত্র কবীরা গুনাহ ইসলামচ্যুত করতে যথেষ্ট – এ হলো তাদের মত।
- ৪. তাদের মতে, ইমান ও ইসলাম এক ও অবিভাজ্য। শৌখিন ইমানে তারা বিশ্বাসী ছিল না। ইমান ও আমলের উপর তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়।
- ৫. গান, বাজনা, জুয়াখেলা, মদ্যপান, ধূমপান, নেশাজাতীয় দ্রব্যসেবন ইত্যাদিকে তারা হারাম বিবেচনা করে।
- ৬. অনারব মুসলিমদের আরব মুসলিমদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে তারা মনে করে।
- ৭. ইবাদিয়া খারিজিগণের মতে, কেবলমাত্র তারাই প্রকৃত মুসলিম। মিথ্যা বলা যাবে না এবং পবিত্রভাবে জীবনযাপন করতে হবে। মৃত্যুর জন্য কান্না নিষিদ্ধ।
- ৮. তারা কোরানকে একমাত্র আইনের নির্ভরযোগ্য উৎস বলে মনে করেন। তারা কোরান ও হাদিস ভিত্তিক জীবনযাপন করার মতবাদ প্রচার করতো। এজন্য তারা বিশুদ্ধতাবাদী নামে পরিচিত হয়।
খারেজিদের সম্পর্কে ঐতিহাসিক খোদাবক্স মন্তব্য করেন, “The Kharigites were the puritans of Islam. Fanatical in religion and democratic in politics.” অর্থাৎ, খারেজিরা ছিল ইসলামের বিশুদ্ধবাদী, ধর্মে গোঁড়া, রাজনীতিতে গণতন্ত্রী। তাদের গৃহীত নীতি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সাথে অসামঞ্জস্য হওয়ার কারণে তাদের আন্দোলন গণ গন্দোলনে প্রতিভাত হয়েও স্থায়িত্ব লাভ করেনি। তাদের অনেক মতবাদই উন্নত চিন্তাধারার ফসল। ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন, “মুসলিম ধর্মতত্ত্বের ক্রমবিবর্তনে খারেজি মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”
শিয়া সম্প্রদায় (The Shia)
ভূমিকা
মুসলমানদের বেশ কয়েকটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক দলের মধ্যে শিয়া একটি অন্যতম সম্প্রদায়। মুহম্মদের পরলোকগমনের পর মুসলিম জাতির পরিচালক ও নেতা হিসেবে তার উত্তরসূরি কে হবেন-এ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অভিমত দেন যে, মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব ন্যস্ত থাকা দরকার মুহম্মদের পরিবারে। এ যুক্তিতেই তারা হজরত আলীকে ঘোষণা করেন রসুলুল্লাহর যথার্থ উত্তরাধিকারী বলে। এ থেকে তারা পরিচিত হয়ে ওঠেন আলীর পক্ষাবলম্বী (শিয়া) বলে। অন্যদিকে মুসলমানদের অপর একটি বড় অংশ আবু বকরকে মনোনীত করেন খলিফা হিসেবে। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, মুহম্মদ তার উত্তরসূরি মনোনয়নের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দিয়ে যাননি, এবং এজনাই তারা আবুবকরকে মনোনীত করেন হাদিসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের মতৈক্যের (আহলে আস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ) ভিত্তিতে। এভাবে যারা হজরত আলীকে ইমাম হিসেবে সমর্থন করলেন তারা শিয়া নামে এবং যারা হজরত আবুবকরকে সমর্থন করলেন তারা সুন্নি নামে পরিচিত। আলী ছিলেন নবী মুহম্মদের এর খুড়তুতো বা চাচাত ভাই, মুহম্মদের জীবিত কন্যা ফাতেমা এর স্বামী এবং ইমাম হাসান ও হুসাইনের পিতা। শিয়াদের মতে, মনোনয়ন বা গণসমর্থনের ভিত্তিতে নয়, আহলুল বায়ত (নবী পরিবার) অর্থাৎ, আলী ও ফাতেমা এর বংশোদ্ভূতগণই ইমামতের (পার্থিব ও আধ্যাত্মিক প্রধান) অধিকারী। পূর্ববর্তী ইমাম তার উত্তরাধিকারী পরবর্তী ইমামের মনোনয়ন দান করবেন। শিয়াতু আলী থেকে শিয়া নামের প্রচলন হয়।
সুন্নিদের সাথে শিয়াদের ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্য
এখানে উল্লেখ্য যে, শিয়া ও সুন্নিদের এ মতবিরোধ নিছক কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নয়, তার চেয়েও আরো গভীর। অর্থাৎ এর সঙ্গে ধর্মতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক প্রশ্নও জড়িত। সুন্নিরা মুহম্মদের উত্তরাধিকারীকে দেখেছেন একটি নবপ্রতিষ্ঠিত জাতির খলিফা হিসেবে আর শিয়ারা বিশ্বাস করতেন যে এই উত্তরাধিকারী শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, বরং একই সঙ্গে তাকে হতে হবে আধ্যাত্মিক গূঢ়জ্ঞানের অধিকারী এবং ধর্মবিজ্ঞানের উপযুক্ত ব্যাখ্যায় সমর্থ একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি (ওয়ালি)। এজন্যই শিয়া ও সুন্নি পার্থক্যকে নিছক রাজনৈতিক পার্থক্য হিসেবে না দেখে, দেখা উচিত একই সঙ্গে ধর্মীয় পার্থক্য হিসেবে। কারণ, এখানে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব, এ উভয় প্রশ্নই জড়িত।
তবে এ প্রসঙ্গে এ-ও উল্লেখ করা দরকার যে, শিয়া ও সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ই ছিল ইসলামের রক্ষণশীল ব্যাখ্যার পক্ষপাতী এবং উভয়েই ইসলামের আদি রক্ষণশীল ধর্মমতের অবিচ্ছিন্ন অংশস্বরূপ। এ দুটি সম্প্রদায়ের কোনোটিই প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল ধর্মমতের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা পরবর্তীকালের কোনো আন্দোলন নয়, এবং তা নয় বলেই এ দুয়ের কোনটিকেই খ্রিস্টধর্ম কিংবা ইহুদি ধর্মের সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা সংগত নয়। উভয় সম্প্রদায়ই ইসলামের আদি অকৃত্রিম ঐক্যে বিশ্বাসী, যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় তত্ত্ব ও আচার সম্পর্কে তাদের মত সব ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। উভয় সম্প্রদায় একই ধর্মীয় সত্যের দুটি দিকের বা দুটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক, সেই ধর্মের ঐক্যবিনাশী কোনো প্রতিকূল শক্তির নয়। তাই উভয়ে ‘শাহাদাহ’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বাণীর প্রতি আস্থাশীল, যদিও এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উভয়ের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন নয়।
শিয়া মতে, আলী ছিলেন প্রথম বৈধ খলিফা এবং এরপর খেলাফত হস্তান্তরিত হয়েছে তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে। আবু বকর, ওমর ও ওসমান – এ তিনজন খলিফা ছিলেন ক্ষমতার জবরদখলকারী। শিয়ারা ‘খলিফা’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইমাম’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষাপাতী। সাধারণত ইমাম বলতে বোঝায় এমন একজন ব্যক্তিকে যার অবস্থান প্রথম সারিতে, এবং সে কারণেই যিনি নেতৃত্ব দেন জামায়াতের নামাজে। প্রাত্যহিক জীবনের ভাষায় শিয়া ও সুন্নি উভয় মহলে কথাটা এ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইমাম বলতে আবার বোঝায় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে। এই সম্মানসূচক অর্থেই চারটি আইন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাদের এবং গাজালির মতো অনন্যসাধারণ ধর্মীয় পণ্ডিতদের ইমাম বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। কিন্তু শিয়ামহলে ইমাম কথাটি প্রযুক্ত হয়ে থাকে এক বিশেষ অর্থে।
শিয়াদের মতে, ইমাম জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নন, বরং ঈশ্বর-প্রেরিত এমন একজন শাসক ও শিক্ষক, যিনি মুহম্মদের বার্তাপ্রচারের যথার্থ উত্তরাধিকারী। তিনি এমন কিছু অতিমানবিক গুণ ও শক্তির অধিকারী, যেগুলো মুহম্মদের মাধ্যমে আদম থেকে বিকীর্ণ। তারা বিশ্বাস করেন যে, জগৎসৃষ্টির আগে ঈশ্বর তার নিজস্ব আলোর একটি রশ্মি সংরক্ষিত রেখেছিলেন, যা কিনা মুহম্মদের আলো বা মুহম্মদের নুর নামে পরিচিত। এই সংরক্ষিত আলোই মূর্ত রূপ লাভ করেছিল মুহম্মদের ব্যক্তিত্বে। মুহম্মদের এই পূর্ব-অস্তিত্বের ধারণা সুন্নি মহলেও প্রচলিত, যদিও সুন্নি মতে তা শিয়া মতের ন্যায় অতটা স্পষ্ট রূপায়ণ লাভ করেনি। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, মুহম্মদ থেকে এই আলো প্রথমে হস্তান্তরিত হয় আলীর কাছে এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে তার বংশধর ইমামদের কাছে। এ অর্থে ইমামরা মানুষের অকাট্য পথপ্রদর্শক এবং সত্যের উৎস। তারা এমন কিছু অতিমানবিক জ্ঞানের অধিকারী যার সাহায্যে তারা রোজ কেয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে তার সঠিক খবর রাখেন। তাদের পক্ষে ভুল করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কোরানের ব্যাখ্যার জন্য তারাই উপযুক্ত পাত্র। তারা পরম সত্যের উৎস, এবং তাদের মাধ্যমেই মানুষ সন্ধান পেতে পারে যথার্থ দিগ্দর্শন ও চূড়ান্ত মুক্তির। তারা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ, এবং সে কারণেই মানুষের শর্তহীন আনুগত্যের সুযোগ্য পাত্র।
এ তত্ত্ব ইমাম হোসেনের শাহাদাতবরণের কাহিনীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শিয়া মতে ইমাম হোসেনের মতো একজন মহান ব্যক্তির পক্ষে এভাবে কারবালায় প্রাণ না দিলেও হতো। কিন্তু বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের উদাত্ত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি স্বেচ্ছায় বরণ করেছিলেন মৃত্যুকে। তার এই আত্মোৎসর্গকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী গড়ে উঠেছে। এর পরও আরো কয়েকজন ইমামকে মুখোমুখি হতে হয় অস্বাভাবিক মৃত্যুর। ইমামদের সবাই বিখ্যাত ছিলেন তাদের অকৃত্রিম ধর্মানুরাগ ও অসাধারণ জ্ঞানবুদ্ধির জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল নানারকম অভিযোগ ও চক্রান্তের। প্রথম দিকে তারা মদিনায় অবস্থান করা পছন্দ করতেন এবং পরবর্তীকালে শিয়া সমর্থনের কল্যাণে ক্ষমতায় আরোহণ করলেও আব্বাসীয় খলিফারা শিয়াদের অধিকাংশকে সতর্ক দৃষ্টিতে অনেকটা অন্তরীণ রেখেছিলেন বাগদাদে কিংবা সামারায়।
শিয়া ধর্মবেত্তাদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী, তারা কার্যকর ছিলেন মঙ্গোলীয় এবং তার চেয়েও বেশি সাফাভিদ শাসনামলে (১৫০২-১৭৩৬)। এ সময়েই শিয়াদের প্রধান প্রধান মত স্বীকৃতি লাভ করে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে। আজকের ইরানেও শিয়া ধর্মমত বিশেষভাবে প্রবল।
শিয়াদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
৮ জুন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ মৃত্যুবরণ করেন। খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে চারটি দলের উদ্ভব হয়। দলগুলো হলো (১) মুহাজির, (২) আনসার, (৩) কুরাইশ বংশ ও (৪) আলী এর একনিষ্ঠ সমর্থকগণ। প্রত্যেক দল নিজ নিজ পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। সর্বসম্মতিক্রমে বয়স, সম্মান ও পদমর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করে আবু বকর ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। মুসলিম জগত তার প্রথম সমস্যা থেকে রক্ষা পায়। কারণ P. K. Hitti পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলেন, “The Caliphate is therefore the first problem Islam had to face” অর্থাৎ, খেলাফত প্রশ্নই ছিল ইসলামের প্রথম সমস্যা।
আবু বকর এর মৃত্যুর পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত হন ওমর। ওমরের মৃত্যুর পর ছয় সদস্যবিশিষ্ট পরিষদের উপর তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের ভার পড়ে। এই ছয় জনের মধ্যে উপস্থিত পাঁচজনের (তালহা তখন মদিনায় উপস্থিত ছিলেন না) মধ্যে ভোটাভুটি হয়। পাঁচ জনের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আওফ খলিফা হওয়া ও ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকেন। বাকী চারজনের মধ্যে প্রাপ্ত ভোটে দেখা যায় ওসমান তিনটি এবং আলী দুইটি ভোট লাভ করেন। (ওসমান সর্ব জুবায়ের, সা’দ ও আলীর ভোট এবং আলী জুবায়ের ও ওসমান এর ভোট লাভ করেন।) সে যাই হোক ওসমান ইসলামের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। ১৭ জুন ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে ওসমান এক দল বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হন। ওসমান হত্যার ফলে খেলাফতের পবিত্রতা ও মর্যাদা নষ্ট হয়। ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেন, “The Murder of Othman was signal for civil war’ (ওসমান এর হত্যা ছিল গৃহযুদ্ধের বিপদ সংকেতস্বরূপ)। বিশৃঙ্খলা এবং সন্ত্রাসেরকারণে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কেউই ইসলামের চতুর্থ খলিফা হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। অবশেষে ওসমান হত্যার ৫ম দিবসে মিশরীয় বিদ্রোহী দলের নেতা ইবনে সাবাহ আহলে বায়ত এর উল্লেখ করে আলীর নাম প্রস্তাব করেন। বসরা ও কুফার বিদ্রোহীগণ এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। মদিনার বিশিষ্ট নাগরিকগণও খেলাফতের দায়িত্ব নিতে আলীকে অনুরোধ করেন। ইসলামের খাতিরে ৬৫৬ সালের ২৩ জুন আলী খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একে একে সকলেই তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন।
পি. কে. হিটি, সৈয়দ আমীর আলী, মাসউদি প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে, আলী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে দুর্নীতিপরায়ণ প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অপসারণের নীতি গ্রহণ করেন। আলী মুয়াবিয়াকে পদচ্যুত করেন কিন্তু মুয়াবিয়া তার আদেশ অমান্য করেন। মুয়াবিয়া ওসমান হত্যার বিচার সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু প্রচার করে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। এ মতবিরোধ নিয়ে ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে সিফফিন নামক স্থানে উভয়ের মাঝে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষের সম্মতিতে কোরানের বিধান মতে, সমঝোতায় আসার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। ৬৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চে মদিনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী দুমাতুল জন্দল (আজরূহ) নামক স্থানে সালিশি মজলিশ বসে। মজলিশে বিতর্কিত রায় ঘোষিত হয়। আলী ও মুয়াবিয়া উভয়ে তাদের পূর্বপদে বহাল থাকেন। ২৭ জানুয়ারি ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ (১৭ রমজান ৪০ হিজরিতে) আলী মৃত্যুবরণ করেন। আলীকে আল কুফার যে স্থানে সমাহিত করা হয়, সে স্থানটি বর্তমানে আল মাশহাদ আলী নামে পরিচিত এবং পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে উন্নীত হয়। আলীকে নিয়ে বহু কবিতা, প্রবাদ, কাহিনী রচিত হয়। মুহম্মদ এর উপহার দেওয়া তরবারি নিয়ে বহু প্রবাদ তৈরি হয়। মধ্যযুগের বহু আরবীয় তরবারিতে খোদাই করা হতো, “লা-সাইফা ইল্লা যু-আল-ফাকারি অ-লা কাতা ইল্লা” অর্থাৎ, “কোন তরবারিই যু-আল-ফকুর এর সমকক্ষ নয়। কোন যোদ্ধাই আলীর সমকক্ষ নয়। জনসাধারণের একটি অন্যতম গোষ্ঠী তাকে মনে করতেন আদর্শবাদী অপাপবিদ্ধ ও ভ্রান্তিহীন।” P. K. Hitti বলেন, “To his shiite partisans the fourth caliph soon became preeminently the saint of the sect, the wali (friend and vicegerent) of Allah, just as Muhammad had been the Prophet of Islam and the Messenger of Allah, “Ali dead proved more effective than ‘Ali living.” অর্থাৎ, চতুর্থ খলিফা আলী দিনে দিনে জনগণের কাছে মুসলিম মহাপুরুষ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। শিয়া জনগণের কাছে তিনি বিখ্যাত ‘ওয়ালি’ (অর্থাৎ ঈশ্বরের বন্ধু ও প্রতিনিধি) যেমন মুহম্মদ ছিলেন ঈশ্বরের রাসূল। জীবিত আলীর চেয়ে মৃত আলীই বেশি ক্ষমতাধর এবং সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হন। পিতার মৃত্যুর পর ইমাম হাসান কুফাবাসী কর্তৃক খলিফা নির্বাচিত হন।
সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের কাছ থেকে খেলাফত ছিনিয়ে নিতে তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। ইমাম হাসান সৈন্যদের দু’দলে বিভক্ত করেন। একটির সেনাপতি কায়েস ও অন্যটির সেনাপতি মনোনীত হন ইমাম হাসান স্বয়ং। কিন্তু সেনাপতি কায়েসের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে ইমাম হাসানের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করা না করা, এমনকি ইমাম হাসানকে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় পরবর্তী খেলাফত ইমাম হুসাইনের উপর ন্যস্ত করা হবে এমন শর্তে ইমাম হাসান তার খেলাফত মুয়াবিয়ার কাছে অর্পণ করে। ৬৭৯ সালে ইমাম হাসানের সাথে সম্পাদিত সন্ধি অমান্য করে মুয়াবিয়া তার পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। ঐতিহাসিক মুইর বলেন, “The accession of Muawiyah to the throne at Damascus heralded the end of the Caliphate and the beginning of kingship.” (মুয়াবিয়ায় দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ খেলাফতের সমাপ্তি এবং রাজতন্ত্রের সূচনা করে।)
৬৮০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে ইয়াজিদ সিরিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইরাকিগণ ইমাম হুসাইনকে মুসলিম জাহানের খলিফা হওয়ার প্রস্তাব দেন। ইমাম হুসাইন ইরাকীদের প্রস্তাবের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য খুড়তুতো বা চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকীলকে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম বিন আকীল কুফাবাসীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানান। ইমাম হুসাইন কাফেলা নিয়ে কুফায় আসার পথে কারবালায় ইরাকের শাসনকর্তা (মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ এর প্রেরিত বাহিনী তাদের (কাফেলাকে) বাধা দেয়। ১০ অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে সীমারের আঘাতে ইমাম হুসাইন শাহাদত বরণ করেন। ঐতিহাসিক গিবন বলেন, “In a distant age and climate the tragic scene of the death of Husayn will awaken the sympathy of the coldest reader.” (দূরবর্তী সময়ে এবং আবহাওয়ায় হুসাইনের মৃত্যুর দৃশ্য নিতান্ত নিরাসক্ত পাঠকের ও সহানুভূতির উদ্রেক করবে।)
আলীর মৃত্যুর পর আলী পরিবারের উপর জনসাধারণের যে সহানুভূতি তৈরি হয়, তাতে একটি নতুন গোষ্ঠী (শিয়া সম্প্রদায়) তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। ১০ অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম আল হুসাইনের শাহাদতের মাধ্যমে শিয়া সম্প্রদায়ের সুসংগঠিতভাবে আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত হয়। ইমাম হুসাইনের বীরোচিত সংগ্রাম ও যুদ্ধক্ষেত্রে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গভীর আবেগময় পুনরাভিনয় করা হয়। এতে শিয়া সম্প্রদায়ের শোকাবেগ সঞ্চারী অনুষ্ঠান তাজিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। P. K. Hitti History of the Arabs গ্রন্থের ১৯১ পৃষ্ঠায় বলেন, “The blood of Al-Husayn, even more than that of his father, proved to be the seed of the shiite ‘church’ shiism was born on the tenth of Muharram.” অর্থাৎ, তার পিতার চেয়ে আল হুসাইনের রক্তাদানই আলাদা মতবাদ গড়ার ব্যাপারে শিয়া সম্প্রদায়কে অনেক বেশি প্রেরণা দিয়েছিল। মুহররমের ১০ম দিবসে শিয়া মতবাদের জন্ম হয়।
উমাইয়া আমলে শিয়ারা সম্প্রদায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয় নি। উমাইয়া শাসনের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও শিয়া সম্প্রদায় সফল হতে পারে নি। ফলে আব্বাসীয় আমলে এই সম্প্রদায়ের আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। P. K. Hitti একই গ্রন্থে বলেন, “Another religious movement that took its final form under the Abbasids and developed offshoots that played decisive roles in the history of Islam and the caliphate was the shiah.” (আব্বাসীয় বংশের শাসনামলে আর একটি ধর্মীয় আন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছিল, সেটি হলো শিয়া ভাবাদর্শ। এই ভাবাদর্শের শাখা-প্রশাখাগুলো ইসলাম ধর্ম ও খেলাফতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।)
প্রথম আলী বংশীয় স্বাধীন রাজ্য ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোতে হাসান বংশীয় প্রথম ইদ্রিস ইবন আবদুল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে রাজ্যের অধিবাসীরা ছিল সুন্নি। আলী বংশীয় শাসনকর্তাদের অধীনে যে কয়টি রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ইয়ামেনের ইমাম ছিলেন শিয়া। এভাবে ইরাক থেকে শিয়া সম্প্রদায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য গঠনের চেষ্টা করে। ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী উত্তর আফ্রিকায় এবং আল মুইজ মিশরে ফাতেমীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে ইরাকে ও ইরানে সর্বাধিক শিয়া বসবাস করে। P. K. Hitti বলেন, “Of all the lands of Islam al- Iraq proved the most fertile sailf for the germination of Alid doctrines and to the present day persia with its fifteen millions is the bulwork of the shiah.” (ইসলামের সকল এলাকার মধ্যে আলী মতবাদের উৎপত্তির জন্য ইরাক সবচেয়ে অধিক উর্বর স্থান বলে প্রমাণিত হয়েছিল এবং বর্তমান কালে ইরান তার ১৫ মিলিয়ন অধিবাসীসহ শিয়াদের একটি দুর্ভেদ্য ব্যুহ।)
ক্রমশ শিয়া সম্প্রদায় অনেকগুলো উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পারসিক ভাবধারা ও অন্যান্য বৈদেশিক প্রভাব শিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদের মূলে প্রবেশ করায় শিয়াদের মধ্যে বিভিন্ন উপ-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এই বিভাজন প্রধানত সংঘটিত হয়েছে যথার্থ বৈধ ইমাম কারা?—এ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের ওপর। এসব উপ-সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। শিয়াদের এসব উপসম্প্রদায়ের মধ্যে ইসনা আশারিয়া বা ইমামিয়া বা বারোপন্থী, ইসমাইলিয়া বা সার্বিয়া বা সাতপন্থি এবং জায়েদিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ইসনে আশারিয়া বা বারোপন্থী শিয়া
ইসনে আশারিয়া সম্প্রদায়কে বারোবন্থী শিয়া নামে অভিহিত করা হয় এজন্য যে তারা বারোজন ইমামের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তাদের মতে ইমামত নবী মুহম্মদ থেকে আলী ও তার বংশধরদের কাছে স্থানান্তরিত হবে। তাদের রাজনৈতিক মতবাদ তিনটি নীতির (Precepts) উপর প্রতিষ্ঠিত।
- (১) ঐশী অধিকার বলে আলী ও ফাতেমা এর বংশধরদের মধ্যে ইমামত সীমাবদ্ধ থাকবে।
- (২) সকল ইমাম পাপমুক্ত ও
- (৩) দ্বাদশ ইমাম মাহদীর প্রত্যাবর্তন।
তাদের মতে, শাসককে, যিনি একাধারে ইমাম, তাকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রধান ক্ষমতাচ্যুত করা যায় না এবং তার শাসনকার্যে ও ধর্মীয় ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপও করা যায় না। শিয়াপন্থিরা বিপদ, বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সম্মুখীন। এই বলে নিজেদের সান্ত্বনা দেন যে, ইমাম মাহদী অবশ্যই আসবেন তার মাধ্যমে সবধরনের অত্যাচার, অনাচার, যন্ত্রণা, বিপর্যয়, দুর্ভোগ ও অন্যায়ের বিলুপ্তি ঘটবে।
প্রথম ইমাম ছিলেন হজরত আলী। এরপর হাসান, হোসেন এবং তারপর হোসেন থেকে জনৈক মোহাম্মদ পর্যন্ত বংশানুক্রমিকভাবে এসেছেন আরো ন’জন। এই মোহাম্মদ ইমাম হয়েছিলেন অপরিণত বয়সে এবং ক্ষমতায় আরোহণের অব্যবহিত পরেই ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি তিরোহিত হয়ে যান। এরপর প্রায় ৭০ বছর ধরে তার ‘ওয়াকিল’ (এজেন্ট) বা ‘বাব’ (দরজা) হিসেবে কাজ করেছিলেন অন্য চারজন। এ চারজন বাব-এর চতুর্থজন তার মৃত্যুর সময় উত্তরাধিকারী মনোনয়নে অসম্মতি জ্ঞাপন করার ফলে ৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় ইমামের আত্মগোপনের সময়। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, ইমাম আজও বেঁচে আছেন এবং তিনি তার শিষ্যদের এখনো পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন। পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কালক্রমে পুনরাবির্ভূত হবেন মাহদি (পরিচালক) হিসেবে। সুন্নিরাও মাহদির অবির্ভাবে বিশ্বাসী; কিন্তু তারা কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে মাহদি বলে চিহ্নিত করেন না।
বারোপন্থী শিয়ারা যেসব ধারণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন (এবং এ বিষয়ে সাতপন্থীরা তাদের সঙ্গে একমত) সেগুলোর মধ্যে বাহ্য বা এক্সোটেরিক (exoteric) ও গূঢ় বা এসোটেরিক (esoteric) জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য প্রধান। যে কোনো প্রকাশ বা অভিব্যক্তি কোনোকিছুর অভিব্যক্তি। প্রত্যেক প্রতিভাস নিশ্চয়ই এমন একটা বাস্তবসত্তার ইঙ্গিত বহন করে যা প্রতিভাসিত হচ্ছে। যে-কোনো মূর্ত বাস্তবতার একটি বাহ্য ও একটি অভ্যন্তরীণ দিক আছে। এ সত্তা শুধু প্রকৃতিজগৎকেই অন্তর্ভুক্ত করে না, একই সঙ্গে নির্দেশ করে সেই অভিব্যক্তির, যা প্রকৃতির মতোই স্বর্গীয় উৎস থেকে উদ্ভূত।
বারোপন্থি শিয়ারা ধর্মীয় তত্ত্ব ও জ্ঞানের বাহ্য (জাহের) ও গূঢ় (বাতেন)—এ দুটি দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এদিক থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ। বাতেনকে বাদ দিয়ে জাহের থাকতে পারে না; কারণ বাতেন যদি না থাকত, তা হলে মূর্ত অস্তিত্ব নিয়ে প্রকাশিত বা অভিব্যক্ত (জাহের) হবার মতো কিছুই থাকত না। আর জাহেরের অনুপস্থিতিতে বাতেনও সুযোগ পেত না নিজেকে মূর্ত অস্তিত্বের আঙ্গিকে অভিব্যক্ত করার। জাহের ও বাতেনের এই সম্বন্ধের মধ্যেই নিহিত ইমামের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার রহস্য। ধর্মীয় নবী স্বর্গলোক থেকে আইন নিয়ে আসেন মানুষকে পরিচালনার জন্য। তার অন্তর্ধানের পর অবসান ঘটে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের এবং এরপর মানুষের নির্ভর করতে হয় সেই আইনব্যবস্থার ওপর, যা-কিনা নির্ভরশীল প্রত্যাদেশের বাহ্যিক দিকের ওপর। এ অবস্থায়ই এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে যারা আইনের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং প্রত্যাদেশের গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যায় সক্ষম।
ইসলামে নবুয়তের সমাপ্তি ঘটে মুহম্মদে এসে। তিনি ছিলেন বাহ্য ও গূঢ় উভয় ধরনের ঐশী প্রত্যাদেশের বাহন। কিন্তু তার পরে এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব আবশ্যক যারা তার এই গূঢ়শক্তির উত্তরাধিকারী, এবং সেই সুবাদেই নিয়োজিত থাকবেন স্বর্গীয় আইনের গূঢ় অর্থ ব্যাখ্যার দায়িত্বে। ঈশ্বরের আইন বয়ে আনার ব্যাপারে নবীদের দায়িত্বকে যেমন বলা হয় ‘নুবুয়াহ’ তেমনি সেই আইনের গূঢ়ার্থ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা এবং প্রত্যাদেশের উৎসের সঙ্গে সংরক্ষণ করাকে শিয়া মতে বলা হয় “উইলায়াহ’। আর এই অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বলা হয় ‘ওয়ালিঈশ্বর’, অর্থাৎ ঈশ্বরের বন্ধু। কিন্তু শিয়া মতের বিশেষ প্রেক্ষিতে তা শুধু সাধু-সজ্জনকেই বোঝায় না, বোঝায় স্বর্গীয় আইন ও প্রত্যাদেশের গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যার সেই শক্তিকে যা কেবল ইমামদেরই আছে। শিয়া মতে, প্রথম ইমাম হজরত আলী ছিলেন এ ধরনের একজন ওয়ালিঈশ্বর।
ইমাম উইলায়াহ এর দায়িত্ব পালন করেন এবং ধর্মীয় আইনের বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে তৎপর থাকেন। একজন নবীর সঙ্গে একজন ইমামের পার্থক্য এখানে যে, নবী স্বর্গীয় আইনের প্রত্যাদেশ গ্রহণ ও প্রচার করেন এবং এরপর পৃথিবী ত্যাগ করেন। ফলে এমন সময়ও থাকে যখন পৃথিবীতে কোনো নবী উপস্থিত থাকেন না। কিন্তু ইমাম সদাবিদ্যমান। পৃথিবী কখনো ইমামবিহীন থাকতে পারে না, যদিও ইমাম কখনো আত্মগোপন করে কিংবা অজ্ঞাত অবস্থায় থাকতে পারেন। ইসলামের নবী যখন পৃথিবী ত্যাগ করলেন তখন তার স্থলাভিষিক্ত হলেন ইমাম। নবীজির তরফ থেকেই ইমাম ব্যাখ্যা ও প্রচার করেন ধর্মীয় গূঢ়জ্ঞান এবং তার পক্ষ থেকেই সমর্থন ও সংরক্ষণ করেন ইসলামি আইন ও মূল্যবোধকে। সংক্ষেপে বলতে গেলে মহানবীর প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম জাতিকে শাসন করা, ধর্মীয় আইন ও বিজ্ঞানসমূহকে (বিশেষত তাদের গভীর অর্থ) মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা এবং মানুষকে সঠিক আধ্যাত্মিক জীবনে পরিচালিত করা—এই তিনটি ইমামের কর্তব্য। ইমামের মধ্যে মুহম্মদের আলো আছে বলেই তিনি এসব গুরুদায়িত্ব যথার্থভাবে পালনে সক্ষম।
আত্মিক স্বরূপের দিক থেকে ইমাম তার আলোকের উৎস নবী মুহম্মদের মতোই বিশুদ্ধ। প্রথম ইমাম আলীর স্ত্রী হিসেবে ফাতেমা ইমামদের মাস্বরূপ। তিনিও পবিত্র স্বভাবের অধিকারী। এজন্যই মুহম্মদ, ফাতেমা এবং বারোজন ইমাম, এদের সকলকে একসঙ্গে অভিহিত করা হয় চৌদ্দজন বিশুদ্ধ ব্যক্তি বলে। মুহম্মদের আলো বহন করেন বলেই ইমাম মুক্ত থাকেন সবরকম ভুলত্রুটি ও পাপতাপ থেকে। ইমামের একাধিক সন্তানের মধ্যে কেবলমাত্র একজনই ইমাম হয়ে থাকেন। এক ইমামের কাছ থেকে যখনই এই আলো অন্য ইমামের কাছে হস্তান্তরিত হয় (আধ্যাত্মিকভাবে), তখনই ইমাম হয়ে যান বিশুদ্ধ (মাসুম) এবং তখনই তিনি অর্জন করেন ঐশী আইনের সংরক্ষক ও ব্যাখ্যাতার কর্তৃত্ব। ইমামরা ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীস্বরূপ। জীবনে তাদের সহায়তা প্রার্থনার অর্থই হলো ঈশ্বরের সেই সম্ভাবনার শরণাপন্ন হওয়া, যা তিনি মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন মানুষকে তার আছে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টায় সক্ষম করার জন্য। এদিক থেকে ইমামমাত্রই মহানবীর ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণস্বরূপ।
ইসমাঈলী বা সাতপন্থী শিয়া
সাতপন্থী (সাবিয়া) বা ইসমাঈলী শিয়াদের মতবাদ বারোপন্থীদের মতবাদের অনুরূপ। কিন্তু তাদের মতে সপ্তম ইমাম আত্মগোপন করেছিলেন। তাদের প্রথম ছ’জন ইমামের তালিকা বারোপন্থীদের প্রথম ছ’জন ইমামের তালিকার অনুরূপ। কিন্তু বিতর্ক দেখা দেয় সপ্তম ইমাম মুসা আল কাজিমকে নিয়ে। ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস-সাদিকের ছিল দুই পুত্র। বড় ছেলের নাম ছিল ইসমাঈল এবং ছোট ছেলের নাম মুসা। বারোপন্থীদের মতে, জাফর তার ছোট ছেলে মুসাকে ইমাম নিযুক্ত করেছিলেন এজন্য যে, ইসমাঈল ছিল বিতর্কিত চরিত্রের লোক। কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করেন সাতপন্থীরা। তারা ইসমাঈলকে সপ্তম ইমাম বলে ঘোষণা করেন এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। এজন্য এরা সাতপন্থী শিয়া হিসেবে আখ্যায়িত হয়। আবার তারা ইসমাঈলের প্রতি অনুগত বলে তাদের আবার ইসমাঈলী বলেও আখ্যায়িত হয়। কোরানের আক্ষরিক অর্থের চেয়ে অন্তর্নিহিত অর্থের উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করার কারণে তারা বাতেনিয়া নামেও পরিচিত। এছাড়া তাদেরকে তালিমিয়া নামেও অভিহিত করা হয়, কেননা তারা এমত পোষণ করে যে, কেবল ইমামই সত্যিকার ধর্ম শিক্ষা দিতে পারেন। এই সম্প্রদায়ের মতে, ঐশী অধিকার বলে মনোনীত ও প্রাপ্ত ইমামত ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তান্তরিত হতে পারে না। দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসীদের ন্যায় তাদের মতেও প্রকৃত রাষ্ট্র হচ্ছে ধর্মরাষ্ট্র। যার প্রধান হবেন ইমাম। ইমামতের ধারাবাহিকতায় তারা বিশ্বাস করে। দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে ইসমাঈলীয়রা উত্তর আফ্রিকাতে প্রাধান্য অর্জন করেন এবং পরিশেষে এদের কারমাতীয় অংশ মিশরে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এ সাম্রাজ্য ফাতেমীয় সাম্রাজ্য নামে পরিচিত।
বারোপন্থীদের ন্যায় সাতপন্থীরাও সব জিনিসের বাহা ও গূঢ় অর্থের পার্থক্য স্বীকার করেন। তারা নবী ও ওয়ালি, এ দুয়ের মধ্যেও পার্থক্য করেন। তাদের মতে, নবী আইনের এবং ‘ওয়ালি’ সেই আইনের গূঢ়ার্থের প্রতিনিধি স্বরূপ। তবে বারোপন্থীরা যেখানে বাহা ও গূঢ় অর্থের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখেন, সাতপন্থীরা সেখানে বাহ্য অর্থের চেয়ে গূঢ় অর্থের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। গূঢ়তত্ত্ব বা ‘বাতেন’-এর ওপর এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন বলে সাতপন্থীদের আবার অভিহিত করা হয় বাতেনিয়া বলে। ধর্মের বাতেন বা গূঢ়ার্থের দিকটাকে তারা ব্যাখ্যা করেন হিকমাহ (থিওসফি) বলে, এবং একে আবার তারা (বিশেষত ইরানে) অভিহিত করেন দ্বীন-ই-হক্ক (সত্যের ধর্ম) বলে। ইসমাঈলীদের মতে, ধর্মের বাতেনি দিকে যে তত্ত্ব বা দর্শন নিহিত, তা-ই মানুষকে পরিচালিত করে সেই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মে (উইলদাতা-ই-রুহানি) যার ফলে মানুষ রূপান্তরিত হয় এক স্থায়ী সত্তায়।
ইসমাঈলীদের অধিবিদ্যা ও বিশ্বতত্ত্ব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অধিবিদ্যায় তারা ঈশ্বরের একত্বের ওপর বিশেষ জোর দেন। তাদের মতে, সবকিছুর উৎপত্তি বিশুদ্ধ সত্তা থেকে নয়, বরং এমন এক বাস্তবসত্তা থেকে যা বিশুদ্ধ সত্তার অতিবর্তী। এই পরম বাস্তবসত্তাকেই বলা হয় ‘মুবদি’, অর্থাৎ সেই ‘তিনি’ যার আদিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে সত্তার অনুক্রম। সাধারণত মুসলিম দর্শনের শুরু হয়েছে সত্তা দিয়ে, এবং তাতে আলোচনাও করা হয় ঈশ্বরের স্বরূপ বা বিশুদ্ধ সত্তা হিসেবে জগতের উৎপত্তি। তবে সুফি অধিবিদ্যায় ঐশী অন্তঃসার (আল-ধাত)-কে দেখা হয় এমন একটি অনপেক্ষ ও অসীম কিছু হিসেবে, যা সবরকম সংজ্ঞার, এমনকি সত্তার ঊর্ধ্বে। এদিক থেকে ইসমাঈলী অধিবিদ্যা সুফি অধিবিদ্যার অনুরূপ। সুফিদের ন্যায় ইসমাঈলীরাও পরম নীতিকে একাধারে সত্তা ও সত্তার ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। এর আদিক্রিয়া থেকেই সৃষ্ট হয়েছে সার্বিক অস্তিত্বের ক্রম।
এই সৃষ্ট ক্রমের প্রথম সত্তা হলো আদিবুদ্ধি বা সার্বিক বুদ্ধি। এটিই দৈববাণীর প্রতীক। এটি এমন একটি বাস্তবসত্তা যা একাধারে গোপন ও অভিব্যক্ত করে পরম নাম ‘ঈশ্বর’-কে । এই উচ্চতম আধ্যাত্মিক সত্তা থেকে সৃষ্ট হয় দ্বিতীয় বুদ্ধি এবং দ্বিতীয় বুদ্ধি থেকে আবার সৃষ্ট হয় তৃতীয় বুদ্ধি। ইসমাঈলী মতে, এই তৃতীয় বুদ্ধিই হলো আধ্যাত্মিক আদম (আদম-ই-রুহানি)। এটিই মানবতার স্বর্গীয় রূপ। এটিই হলো স্বর্গীয় ইমাম। এবং এটিই পার্থিব আদম, তথা সব মানুষের আদর্শস্বরূপ। তৃতীয় বুদ্ধি, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক আদম তার ঊর্ধ্বতন স্বর্গদূতদের ক্রমবন্ধন (hierarchy) অনুসরণ না করেই হাজির হতে চেয়েছিলেন পরমনীতি ও সত্তার সামনে। এটি ছিল তার পক্ষে একটা অযথার্থ পদক্ষেপ, এবং এর ফলেই তিনি নিপতিত হলেন এক বিস্মৃতির অবস্থায়। এরপর সংবিৎ ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উপলব্ধি করলেন যে, শাস্তিস্বরূপ ঈশ্বর তাকে তৃতীয় বুদ্ধি থেকে দশম বুদ্ধির মর্যাদায় অবনত করেছেন এবং আদি স্বর্গীয় নিবাস সাতটি আধ্যাত্মিক জগতের নিচে সরিয়ে দিয়েছেন। এই সাতটি জগৎ বর্তমান জগতেরই আদর্শ রূপ। এজন্যই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সাতের চক্র দ্বারা। মানুষকে তার হৃত অবস্থা পুনরুদ্ধারে সক্ষম করা এবং পার্থিব ছায়াসমূহ থেকে মুক্ত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল বর্তমান জগৎ। এ জগৎ তার স্বর্গীয় আদর্শের অনুকরণে সৃষ্ট বলেই তা সাতটি আকাশ, সাতটি জগৎ, সাতটি নবুয়তের চক্র এবং সাতজন ইমামের সমবায়ে গঠিত।
ইসমাঈলীদের থেকে বিভিন্ন সঙ্ঘের সৃষ্টি হয়েছিল যেমন –
কারমাতীয় সঙ্ঘ
সাতপন্থী বা ইসমাঈলীরা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে নয়, দশ ও এগারো শতক ধরে। বিশেষত এগারো শতকে তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে উত্তর আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম জাহানের সর্বত্র। ন’শতকের শেষপাদে ইসমাঈলীরা হামাদান কারমাতের নেতৃত্বে একধরনের সামাজিক-ধর্মীয় প্রচারণা শুরু করে এবং তারই নামানুসারে ‘কারমাতি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ইরাকের কুফার অদূরে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব স্থাপন করেন এবং তার অনুসারীদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন।
এটি ছিল একটি গুপ্ত সংগঠন। চাঁদা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই চালানো হতো এ সংগঠনকে। কিছুদিনের মধ্যেই এ করব্যবস্থার স্থলে প্রবর্তন করা হয় ইমামের নেতৃত্বে একধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় যৌথ সম্পত্তি ও যৌথ বিবাহের অনুমোদন ছিল। কারমাতীয়রা অন্যান্য মুসলমানের প্রতি ছিল বৈরীভাবাপন্ন, এবং তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও নাশকতামূলক কার্যকলাপেরও অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে জনমনে গভীর ভীতি ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানা যায়। যাই হোক, এর জন্য তাদের নিজেদেরও অনেক দুর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। অবশেষে তারা সামাজিক দৃশ্যপট থেকে তিরোহিত হয়ে যায়।
কারমাতীয় আন্দোলনের সূত্র ধরেই অগ্রসর হয় ফাতেমীয় নামে পরিচিত ইসমাঈলীদের অপর একটি শাখা। কারমাতীয় ধ্বংসাবশেষের ওপরই ফাতেমীয়রা মিশর ও উত্তর আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করে ফাতেমীয় খিলাফত। এ শাসন বলবৎ ছিল প্রায় দুই শতাব্দীকাল। ১১৭১ সালে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রা. ১১৭৪-১১৯৩ খ্রি.) ।
হাশশাশীন বা গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় (The Assassin)
হাশানশিন বা গুপ্তঘাতক সঙ্ঘ (Assasins) নামক ইসমাঈলীদের আরেকটি শাখার নামও এখানে উল্লেখ্য। আব্বাসীয় খলিফা আল মুকতাদির (রা. ১০৭৫-১০৯৪ খ্রি.) আমলে সেলজুক সুলতান মালিক শাহের (রা. ১০৭২-১০৯২ খ্রি.) রাজত্বের শেষ ভাগে ইসলামের ইতিহাসে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাসান ইবন সাব্বাহ, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘পর্বতের বৃদ্ধলোক’ নামে। কথিত ক্রুসেডার বা খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন বিভীষিকাস্বরূপ। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি তার ও তার অনুসারীদের আগ্রহ ছিল সুগভীর। তেরো শতকে তারা মঙ্গোলদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিল।
হাসান ইবনে সাব্বাহ্ ইরানের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বংশমর্যাদা লাভের জন্য তিনি নিজেকে দক্ষিণ আরবের হিমারীয় রাজবংশোদ্ভূত বলে দাবি করেন। তার পিতা ‘কুম’ শহরে হিযরত করেন। ১০৭২ সনে তিনি ফাতেমীয় খলিফা আল মুসতানসিরের রাজদরবার কায়রোতে গমন করেন। ১০৭৮ সনে ইরান, মেসোপটেমিয়া এবং সিরিয়া ভ্রমণ শেষে তিনি মিশরে উপনীত হন। এরপর তিনি ১০৯০ সনের কিছু পূর্বে মিশর থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে নব্য ইসমাঈলীয় সম্প্রদায়ের সমর্থকদের সুসংগঠিত করেন। ১০৯০-৯১ সনে হাসান ইবন সাব্বাহ কর্তৃক ইরানের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আলামত গিরিদুর্গ বিজয় করে সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করেন, যেখান থেকে হাশশাশীনের ইতিহাস শুরু। সিরিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বিভিন্ন গিরিদুর্গ দখলে রেখে গুপ্ত হত্যা দ্বারা তাদের শত্রু নিপাত করতো তার জন্য তাদের নামকরণ হয় হাশশাশীন (যেখানে থেকে ইংরেজিতে অ্যাসাসিন (Assassin) শব্দটি আসে)। আলামুত গিরিদুর্গকে প্রধান ঘাঁটি নির্বাচিত করে তিনি বসবাস শুরু করেন এবং গুপ্ত ঘাতকের জন্য নির্দেশায় নিতে থাকেন। পর্বতে অবস্থানের জন্য তিনি Shaikh-al-Jibal, Old Man of the Mountain বা পর্বতের বৃদ্ধলোক নামে পরিচিতি লাভ করেন।
নিজেদের ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানো এবং উগ্র ইসমাঈলীয়া মতবাদ প্রচারের জন্য এই সম্প্রদায় রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার নীতি গ্রহণ করে। বিখ্যাত উজির নিজামুল মুলক ছিলেন তাদের প্রথম শিকার (১০৯১ খ্রিঃ)। মালিক শাহের মৃত্যুর পর আব্বাসীয় রাজদরবারে মালিক শাহের উত্তরাধিকার নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। এছাড়া ক্রুসেডারগণ ইসলামি দেশগুলো আক্রমণ করলে হাশশাশীনদের (গুপ্তঘাতক) সুবিধা হয়। এই সম্প্রদায় প্রায় ৬৬ বছর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ আলামুত দুর্গের শাসনকর্তা ছিলেন –
- হাসান ইবন সাব্বাহ (১০৯০-১১২৪ খ্রিঃ)
- বুজুর্গ উম্মীদ রূদবারী (১১২৪-১১৩৮ খ্রিঃ)
- মুহাম্মদ ইবন বুজুর্গ উম্মীদ (১১৩৮-১১৬২ খ্রিঃ)
- হাসান ইবন মুহম্মদ (১১৬২-১১৬৬ খ্রিঃ)
- নুরুদ্দীন মুহম্মদ (১১৬৬-১২১০ খ্রিঃ)
- জালালুদ্দীন হাসান ইবন মুহাম্মদ (১২১০-১২২০ খ্রিঃ)
- আলাউদ্দিন মুহম্মদ (১২২০-১২৫৫ খ্রিঃ)
- রুকনুদ্দীন ইবন মুহাম্মদ (১২৫৫-১২৫৬ খ্রিঃ)
রুকনুদ্দীন ইবন মুহম্মদ সবেমাত্র নেতৃত্বের মর্যাদা লাভ করেছেন, এমন সময় মোঙ্গল নেতা হালাকু খান (রা. ১২৫৬-১২৬৫ খ্রি.) আলামুত দুর্গের বিরুদ্ধে ১২৫৬ সালে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। রুকনুদ্দীন আত্মসমর্পণ করলে তাকে প্রধান খানের নিকট নিয়ে যাওয়ার পথে ফাঁসি দেওয়া হয়। তবে হাশশাশীনদের শেষ আঘাত হানার গৌরব যায় মামলুক সুলতান বাইবার্সের (রা. ১২৬০-১২৭৭ খ্রি.) কাছে। বাইবার্স এই ভীতিপ্রদ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক শক্তির সমাপ্তি ঘটান। তবে নুসায়বীয়দের পর্বতমালায় এবং ইরানে হাশশালীন দলের বংশোদ্ভূত কিছু ইসমাঈলীয় ছিল এবং এখনো আছে।
ড্রুজ সঙ্ঘ
ড্রুজ নামে পরিচিত ইসমাঈলীদের আরেকটি শাখা আজও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে, বিশেষত সিরিয়া ও লেবাননে বিদ্যমান আছে। তাদের ড্রুজ নামকরণের মূলে ছিলেন ডারাজি (মৃ. ১০১৯) নামক এক ব্যক্তি। তিনি ষষ্ঠ ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিমের (৯৯৬-১০২১) দৈবতা (divinity) দাবি করেছিলেন। তাকে কি হত্যা করা হয়েছিল, নাকি তিনি অন্য কোনোভাবে অদৃশ্য হয়েছিলেন, একথা নিশ্চিত বলা যায় না। তবে এই মর্মে গুজব রটেছিল যে, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছেন। এবং যথাসময়ে পুনরাবির্ভূত হবেন। খলিফা হাকিমের প্রতি আনুগত্যের কারণে ভুজদের আবার ‘হাকিমিয়া’ বলেও অভিহিত করা হয়।
ড্রুজরা ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাস করে এবং এজন্যই নিজেদের পরিচয় দেয় ‘মুয়াহহিদুন’ (এক ঈশ্বরয় বিশ্বাসী) বলে। তাদের মতে, সৃষ্টির সময় ঈশ্বর আগে থেকেই আত্মার সংখ্যা চিরতরে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। সুতরাং আত্মার অধিকারী কোনো একজন ড্রুজ যখন মারা যায়, তখন তার স্থলে জন্ম হয় আরেকজন ড্রুজের। তখন পূর্ববর্তী ব্যক্তির আত্মা প্রবেশ করে নবজাতক ব্যক্তির দেহে। ড্রুজরা পূর্বনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ তাদের মতে জগৎ ও জীবনের সবকিছুই পূর্বনিয়ন্ত্রিত। মানুষ কিছুই পরিবর্তন করতে পারে না, এবং এজন্যই তাকে সবকিছু গ্রহণ করে নিতে হয় সবিনয়ে। তারা নিজেদের আবার পরিচয় দেয় ‘ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণকারী মানুষ’ (আহলে আল-মারুফ) বলে।
গুপ্তসংঘের সদস্য হিসেবে ড্রুজদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহায়তার এক সুদৃঢ় বন্ধন বিদ্যমান। তারা যে কোনো বিপদে, বিশেষত আগন্তুকদের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা বেশ কিছু ধর্মীয় গূঢ়তত্ত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু মুষ্টিমেয় ঋষিব্যক্তি (উক্কাল) ব্যতীত সাধারণ ড্রুজরা এসব তত্ত্ব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায় না।
ইখওয়ানুস সাফা বা পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘ (The Brotherhood)
পরিচয়
ইখওয়ানুস সাফা বা পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘ ছিল একটি গুপ্ত দার্শনিক-ধর্মীয় সঙ্ঘ। ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ইরাকের বসরা নগরীতে ইখওয়ানুস সাফা বা পবিত্র ভাতৃসঙ্ঘের উদ্ভব ঘটে। সমাজের প্রগতিশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এ সঙ্ঘ গঠিত হয়। এরপর এ সঙ্ঘের একটি শাখার বিকাশ ঘটে বাগদাদে। তাদের উদ্ভব ঘটে শিয়া সম্প্রদায়ের সেসব ইসমাঈলিপন্থীর মধ্য থেকে যারা ৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তাদের ইমামের মৃত্যুর পর থেকে গোপন রাজনৈতিক তৎপরতায় নিয়োজিত ছিল’। এ তৎপরতা ও প্রচারপ্রক্রিয়ায় পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘ ইসমাঈলি ও কারমাতিয় ধ্যান-ধারণায় নতুন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রাণশক্তির সংযোজন ঘটান। তারা যেসব গুপ্ত সভা-সম্মেলনের আয়োজন করতেন তাতে দার্শনিক ও ধর্মীয় বিষয়ে প্রবন্ধপাঠের ব্যবস্থা থাকত। এ সংঘের পুরো নাম ছিল ইখওয়ানুস সাফা ওয়া মুল্লাবুল ওয়াফা ওয়া আহলুল হামদ ওয়া আবনা উল মাজদ। এ নামটি তাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আল মুকাদ্দিসী নামে পরিচিত আবু সুলায়মান মুহাম্মদ ইবন মাশার আল বুসতি, আবুল হাসান আলী ইবন হারুন আল যানজানি, আবু আহমদ মুহাম্মদ আল মিহরাজনী আল আওফি ও প্রখ্যাত পণ্ডিত ও সংগঠক জায়েদ ইবন রিফা প্রমুখ ছিলেন ইখওয়ানুস সাফার অন্যতম সদস্য।
এ সঙ্ঘের সদস্যগণ একটি নৈতিক আধ্যাত্মিক (Ethico-spiritual) সঙ্ঘ বা সম্প্রদায় এজন্য গঠন করেন যে, মুসলিম সমাজের মতের সম্ভ্রান্ত ও মননশীল ব্যক্তিবর্গ ধর্মীয় সম্মেলন, জাতীয় সমাজ স্বয়ং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত সংগ্রাম থেকে পরিত্রাণ পেয়ে সেখানে একটা নিরাপদ আশ্রয় পেতে পারেন।
এই পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘ শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী হলেও সত্যিকার ঐতিহাসিক অর্থে তারা কোন সম্প্রদায়ের বা দলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। সাধারণ লোকের আবেগের উপর সুচতুররূপে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে তারা শিয়া মত গ্রহণ করে। কুসংস্কারমুক্ত চরিত্র, বিশুদ্ধতম নীতিবোধ, জ্ঞান ও মানবতার প্রতি অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত ভ্রাতৃসঙ্ঘ উন্নততর সমাজ ব্যবস্থার আদর্শ ছিল। এ সঙ্ঘকে সমাজের পঙ্কিলতা ও শঠতা থেকে মুক্ত রাখার জন্য এ সঙ্ঘের সদস্যগণ চার স্তরে বিভক্ত ছিল।
- ১ প্রথম স্তরে ছিল ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের যুবকগণ। তারা বয়োজ্যোষ্ঠদের সিদ্ধান্ত মেনে চলতেন।
- ২. ২য় স্তরের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩০ হতে ৪০ বছর বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ। এ স্তরের সদস্যগণ গবেষণা ও অন্যান্য শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকতেন।
- ৩. তৃতীয় স্তরের সদস্যগণ ছিলেন ৪০ হতে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে এবং
- ৪. চতুর্থ স্তরের সদস্যগণ ছিলেন ৫০ বছরের উর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিগণ।
ইখওয়ানুস সাফা দলের পক্ষ থেকে বহু পত্র রচিত হয়। দশ শতকে রচিত আল-সিজিস্তানির প্রজ্ঞার পাত্র (Vessel of Wisdom) এবং পরবর্তীকালের ভাষ্যকারদের মতে, পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘের যেসব সদস্য বাহান্নটি দার্শনিক পত্র (Epistles) ও একটি সংক্ষিপ্তসার (Compendium) রচনার মূলে ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু সুলায়মান আল-বুস্তি, আবুল হাসান আল-জানজানি, আবু আহমেদ আল-নাহারাজুরি, আল-আতফি এবং যায়েদ বিন রিফা। আল-সিজিস্তানির মতে, এসব বিজ্ঞ সদস্যের সমবায়ে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সভা-সম্মেলনেই রচিত হয়েছিল পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘের পত্রাবলি। এসব পত্রের সমবায়েই সংকলিত হয়েছিল দশ শতকে বহুল প্রচলিত একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ, যা ‘রাসাইল’ ইখওয়ানুস সাফা (Epistles of the Ikhwanus Safa) নামে পরিচিত। এ বিশ্বকোষে প্রধান স্থান অধিকার করেছিল গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্র। ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে সংকলনের কাজ শেষ হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক ডি বয়ার বলেন, ‘আজও তাদের বিশ্বকোষের প্রভাব মুসলিম জাহানে বিদ্যমান রয়েছে।” ঐতিহাসিক ব্রাউন বলেন, “এ ভাতৃসঙ্ঘ ছিল আল-কিন্দী ও আল ফারাবীর উত্তরাধিকারী এবং ইবনে সীনার পূর্বসূরি যার প্রচেষ্টায় দর্শন প্রাচ্যে এক বিশেষ লক্ষ্যে উপনীত হয়।”
এ সঙ্ঘের গঠনতন্ত্র ও লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘের ধর্মমত শীর্ষক চুয়াল্লিশ-সংখ্যক পত্রে। ওখানকার বর্ণনা অনুসারে, ভ্রাতৃসঙ্ঘ সত্যানুসন্ধানে নিয়োজিত এমন একটি সঙ্ঘ যার সদস্যরা সম্মিলিত হন সবরকম জাগতিক প্রলোভনের প্রতি অভিন্ন বিতৃষ্ণা ও বিরাগ এবং সত্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ থেকে। তাদের আকর্ষণ ও অনুরাগের প্রথম ও প্রধান বিষয় স্বর্গীয় বিজ্ঞান বা ধর্মতত্ত্ব। পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভেজাল আস্থার মাধ্যমে অর্জিত আত্মার মুক্তির পথ অনুসন্ধান করাও তাদের ঘোষিত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। গ্রীক দার্শনিক মহামতি প্লেটোর পর তারাই নাকি প্রথম এ দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন যে, দর্শন পাঠ ও অধ্যয়ন দ্বারা আত্মাকে কলুষমুক্ত ও পবিত্র করা সম্ভব। আত্মার পবিত্রতা বিষয়ে এহেন মত পোষণ করতেন বলেই তাদের পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘ বলা হয় বলে কোনো কোনো পণ্ডিতব্যক্তি ও ইতিহাসবিদের ধারণা। নিকোলসন ও লেভির মতে, ভ্রাতৃসঙ্ঘের সমসাময়িক ধর্মীয় আইন (শরিয়া) যখন অজ্ঞতাপ্রসূত ভ্রান্তি ও কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়, তখন এই সঙ্ঘ দর্শনচর্চাকে আইনকে বিশুদ্ধ ও কলুষমুক্ত করার একমাত্র উপায় বলে ঘোষণা করেছিলেন। যাই হোক, ইসলামের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নবজাগরণের জন্য দর্শনানুশীলনের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরায় তারা যে আন্তরিকভাবেই প্রয়াসী ছিলেন, এসব বিবরণ থেকে তা সুস্পষ্ট।
ধর্মীয় মতের দিক থেকে ভ্রাতৃসঙ্ঘের সমর্থন ছিল মুতাযিলা ও শিয়াদের প্রতি। আর দার্শনিক মতের দিক থেকে তারা ছিলেন নব্য-পিথাগোরীয় ও নব্য-প্লেটোনিক ভাবাপন্ন। স্বভাবতই তাদের দর্শন ছিল পল্লবগ্রাহী ও মিশ্রধর্মী। কেউ কেউ অবশ্য অভিযোগ করে বলেছেন যে, এ সঙ্ঘের আসল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক স্বভাবের। বলা হয়ে থাকে যে, এ সঙ্ঘের সদস্যরা আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইসমাঈলি প্রচারকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এবং তাদের মিশ্রধর্মী ভাববাদে প্রতিফলন ঘটেছিল ফাতেমীয়, কারমাতীয় প্রভৃতি এমন কিছু ধ্বংসাত্মক মতের, যেগুলোর লক্ষ্য ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের অবসান ঘটানো।
ভ্রাতৃসঙ্ঘের মোট বাহান্নটি পত্রের সমবায়ে বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনসংবলিত আরবি ভাষায় রচিত যে বিশ্বকোষটির কথা বলা হলো, সাহিত্যের জগতে সম্ভবত তা ছিল এ জাতীয় প্রথম রচনা। দশ শতকের মুসলিম জাহানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছিল, এ গ্রন্থে তার একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। এতে প্রায় সব বিষয়ই আলোচিত হয়েছে। চৌদ্দটি প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে লজিক, দশটিতে অধিবিদ্যা, এগারোটিতে মরমিবাদ, জ্যোতির্বিদ্যা ও ম্যাজিক এবং সতেরোটিতে ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, নৃতত্ত্ব, আবহাওয়াতত্ত্ব, সংগীত প্রভৃতি প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিষয়। বিশ্বকোষটি ছিল প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের জন্য এক প্রভূত আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয়। কারণ তাতে জোয়ার-ভাটা, ভূমিকম্প, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, শব্দতরঙ্গ, উল্কা, বজ্র, বৃষ্টি, শিশির, বরফ, রংধনু, আবহাওয়া, জলবায়ু, ঋতু, জৈব বিবর্তন প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা রয়েছে। অবশ্য একথা ঠিক যে, এসব ব্যাখ্যাকে আজকের দিনের অগ্রসর বৈজ্ঞানিক মতবাদের আলোকে বিবেচনা করা সংগত নয়।
সংখ্যাতত্ত্ব
ভ্রাতৃসঙ্ঘের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পিথাগোরীয়দের ন্যায় সংখ্যার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। তাদের পত্রাবলিতে সংখ্যাতাত্ত্বিক মরমিবাদ লক্ষণীয়। যেমন, এক-কে তারা প্রকৃত এক ও রূপক এক, এ দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। তাদের মতে, প্রকৃত এক বস্তুর সমার্থক। প্রকৃত এক বলতে বোঝায় এমন একককে যার কোনো অংশ নেই, অর্থাৎ যা অবিভাজ্য। আর অবিভাজ্য বলেই তা প্রকৃত অর্থে এক। অপরদিকে রূপক এক বলতে বোঝায় বস্তুর এমন সমষ্টি বা সংগ্রহকে যাকে একক বলে ধরা হয়, যেমন একশো, একটি স্তূপ, একটি শ্রেণি ইত্যাদি। একের ক্রমিক যোগের ফলেই উদ্ভব ঘটে সংখ্যা বা বহুত্বের। এজন্যই এককে বলা হয় সংখ্যার আদিনীতি। সংখ্যার মধ্যে ‘চার’ বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। শুধু গণিত বা পাটীগণিতই নয়, গোটা বিশ্বের গঠনে চারের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যবহ। কারণ, চারটি মৌল উপকরণ, চারটি মুখ্য গুণ, চারটি ধাতু, পৃথিবীর চারটি কোণ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুকে ঈশ্বর চারের সমবায়ে সৃষ্টি করেছেন। শুধু যে প্রাকৃতিক বস্তুর বেলায়ই চার সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, অতিপ্রাকৃত জগতেও চারের গুরুত্ব স্বীকৃত। যেমন ঈশ্বর, সার্বিক প্রজ্ঞা, সার্বিক আত্মা, আদি জড়-এ চারটি অতিপ্রাকৃত সত্তা চারের গুরুত্বের প্রতীক।
মিশ্রধর্মিতা
পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘের দর্শন যে সম্পূর্ণ মৌলিক নয় বরং মিশ্রধর্মী। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের দার্শনিক মতে জরথুস্ত্রীয়, খ্রিস্টীয়, হিব্রু, হিন্দু, আরবীয়, গ্রীক প্রভৃতি বিভিন্ন চিন্তার প্রভাব রয়েছে। তাদের চিন্তায় এরিস্টটলের, বিশেষত তার যুক্তিবিদ্যার ও মনোবিদ্যার প্রভাব লক্ষণীয়। তবে তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন পিথাগোরীয়, প্লেটোনিক ও নব্য-প্লেটোনিক মতবাদ দ্বারা। তারা সাধারণভাবে বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মের মধ্যে কোনো মৌলিক বিরোধ নেই, এবং তা নেই বলেই এদের যোগসূত্র অনুসন্ধানের জন্য তারা মুক্তবুদ্ধি বা স্বাধীন চিন্তার ওপর বিশেষ জোর দেন। একই কারণে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের একত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সেই জ্ঞানের সমবায়ে গড়ে তোলেন একধরনের মিশ্রধর্মী দর্শন।
পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘের দার্শনিক মতের সুস্পষ্ট ধারাবাহিক ব্যাখ্যাপ্রদান সত্যিই এক কঠিন ব্যাপার। এর কারণ তাদের দর্শনের মিশ্রধর্মী রূপ ও উৎস। বলা বাহুল্য, যেকোনো মিশ্রধর্মী দর্শনই কমবেশি অসংবদ্ধ ও অগোছালো হতে বাধ্য। এ সত্ত্বেও ভ্রাতৃসঙ্ঘের দার্শনিক মতাবলিকে মোটামুটিভাবে জ্ঞানতত্ত্ব, বিশ্বতত্ত্ব ও নীতিবিদ্যা-এই তিনটি শিরোনামে আলোচনা করা যাক।
জ্ঞানতত্ত্ব
ভ্রাতৃসঙ্ঘের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ বিকাশ লাভ করে প্রধানত প্লেটোবাদী ধারায়। এ মতবাদ মূলত প্রতিষ্ঠিত ছিল আত্মার ও দেহের দ্বৈততার ধারণার ওপর। আত্মা বলতে তারা বুঝাতেন মানুষের প্রাজ্ঞিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে। তাদের মতে, জ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আত্মাকে ঐন্দ্রিয়িক পর্যায় থেকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে, মূর্ত থেকে বিমূর্ত পর্যায়ে স্থানান্তরিত করা, এবং সেইসঙ্গে একে পরিষ্কৃত করা। জড়বস্তুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় দৈহিক ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। অন্যদিকে যুক্তি, বিমূর্ত নিয়মাবলি এবং গণিতের স্বতঃসিদ্ধবিষয়ক জ্ঞান পাওয়া যায় আত্মার প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা স্বজ্ঞা থেকে। এ ধরনের জ্ঞানের জন্য দৈহিক ইন্দ্রিয়ের কোনো সহায়তার প্রয়োজন হয় না।
এ থেকে বোঝা যায় যে, আত্মা দেহের অধীন তো নয়ই, বরং সম্পূর্ণরূপে দেহনিরপেক্ষ এবং দেহের প্রভাবমুক্ত। আত্মার প্রকৃত উৎস ও গন্তব্য ইন্দ্রিয়জগৎ নয়, বরং বিকারহীন ও শাশ্বত অতীন্দ্রিয় বুদ্ধির জগৎ। ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্যরা বিশ্বাস করতেন, যে, এই অতীন্দ্রিয় বুদ্ধির জগতেই অধিষ্ঠিত থাকে প্লেটোর সার্বিকসমূহ (universals), যুক্তিবিদ্যার নিয়মাবলি, গণিতের স্বতঃসিদ্ধসমূহ এবং সবরকম মূল্যমান ও মূল্যবোধ। জড়জগতে আগমন ও জড়দেহে প্রবেশের আগে আত্মা বুদ্ধি ও চিদাত্মার জগতেই অধিষ্ঠিত ছিল। আর এজন্যই পার্থিব জীবনে দেহে আবদ্ধ অবস্থায় যখনই তার অতীতের সেই বৌদ্ধিক জীবনের কথা মনে পড়ে, তখনই সে বিচলিত বোধ করে, অনুভব করে দেহ থেকে মুক্ত হয়ে আদি নিবাসে প্রত্যাবর্তনের এক প্রবল বাসনা। সক্রেটিসের ন্যায় ভ্রাতৃসঙ্ঘও মনে করতেন যে, যথার্থ জ্ঞান সবসময় ব্যক্তির আত্মায় একটি সম্ভাবনা হিসেবে সুপ্ত থাকে। শিক্ষকের ভূমিকাকে তুলনা করা যায় একজন ধাত্রীর ভূমিকার সঙ্গে। ধাত্রী যেমন কোনো নতুন শিশু সৃষ্টি করে না, বরং মায়ের গর্ভ থেকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ায় সহায়তা করে, তেমনি নতুন শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনে কোনো নতুন ধারণা সৃষ্টি করেন না, বরং পরিষ্কৃত ও পরিস্ফুটিত করেন সেই সত্যকে যা আগে থেকেই মনে উপস্থিত ছিল সুপ্ত অবস্থায়।
আত্মার বিশুদ্ধি অর্জনের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে যুক্তিবিদ্যা ও গণিতের মতো সব বিমূর্ত বিজ্ঞান নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অধ্যয়ন করা আবশ্যক। তবে বিশেষ থেকে সার্বিক, মূর্ত থেকে বিমূর্ত এবং ঐন্দ্রিয়িক থেকে অতীন্দ্রিয় জগতে আত্মার অগ্রগতি একটি ক্রমিক প্রক্রিয়া। এখানে প্রথমেই ব্যক্তিকে শৃঙ্খলা সহকারে আয়ত্ত করতে হবে অপেক্ষাকৃত কম বিমূর্ত বিজ্ঞানসমূহকে এবং এরপর ধীরস্থির গতিতে অগ্রসর হতে হবে অধিক থেকে অধিকতর বিমূর্ত বিজ্ঞানসমূহের দিকে। যেমন, বিশুদ্ধ গণিত অধ্যয়নের আগেই অধ্যয়ন করতে হবে জ্যামিতি; কারণ এ বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম বিমূর্ত। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, ভ্রাতৃসঙ্ঘের মতে যুক্তিবিদ্যা ও গণিত যদিও বিজ্ঞান হিসেবে কাছাকাছি, তবু গণিতের স্থান যুক্তিবিদ্যার ঊর্ধ্বে; কারণ, ঐন্দ্রিয়িক পর্যায় থেকে এর অবস্থান যুক্তিবিদ্যার চেয়েও বেশি দূরবর্তী। যুক্তিবিদ্যার অবস্থান পদার্থবিদ্যা ও অধিবিদ্যার মধ্যবর্তী। পদার্থবিদ্যায় আমরা আলোচনা করি জড়পদার্থ নিয়ে, আর অধিবিদ্যায় আলোচনা করি বিশুদ্ধ চিদাত্মা বা চিন্তা নিয়ে। অধিবিদ্যার ধারণাবলি এবং আত্মায় পদার্থবিদ্যার বিষয়াদির প্রতিফলন-এ দুটি বিষয় যুক্তিবিদ্যার আলোচ্য। যুক্তিবিদ্যার চেয়েও গণিতের গুরুত্ব বেশি বলে ভ্রাতৃসঙ্ঘের যে দাবি, তা আধুনিক গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, এবং তাতে পিথাগোরাসের প্রতি তাদের বিশেষ অনুরাগের লক্ষণটিও সুস্পষ্ট।
এখানে প্রশ্ন ওঠে, আত্মার বিশুদ্ধি যদি যুক্তিবিদ্যা ও বিশুদ্ধ গণিতের কঠোর শৃঙ্খলার ওপর নির্ভরশীল হয়, তা হলে যেসব ব্যক্তির এসব বিমূর্ত বিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষমতা নেই, তাদের আত্মার কী হবে? আত্মার বিশুদ্ধি ও মুক্তির সব আশা কি তা হলে তারা পরিত্যাগ করবে? না, পবিত্র ভ্রাতৃসঙ্ঘ এ ধরনের নৈরাশ্যবাদে বিশ্বাসী নন। আত্মার বিশুদ্ধির জন্য তারা সদাচরণ ও সততাপূর্ণ ধর্মীয় জীবনাচরণের ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাদের মতে, সাধারণ মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবেই নবী-পয়গম্বরগণ সাধারণ মানুষকে এসব সহজতর বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
ভ্রাতৃসঙ্ঘের মতে, মানুষের আত্মজ্ঞান বহির্জগতের জ্ঞানের প্রারম্ভ ও পূর্বশর্তস্বরূপ। আত্মজ্ঞান ব্যতিরেকে অন্য যে-কোনো জ্ঞানের প্রচেষ্টা নিরর্থক। নিজেকে না জেনে বহির্জগৎকে জানার প্রচেষ্টা অরেকটা একশো কেজি বহন করতে না পেরেও একহাজার কেজি বহনের কিংবা হাঁটতে না শিখেই দৌড়াবার দুঃসাহসিকতা স্বরূপ। এ থেকে বোঝা যায় যে, ভ্রাতৃসঙ্ঘের মতে যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, বিশ্বতত্ত্ব, তথা জ্ঞানের সব শাখার আগেই আসে জ্ঞানতত্ত্বের কথা।
বিশ্বতত্ত্ব
ভ্রাতৃসঙ্ঘের অধিবিদ্যক মতবাদে নব্য-প্লেটোবাদী শিক্ষার প্রভাব লক্ষণীয়। প্লোটিনাসের ন্যায় তারা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর সব জ্ঞানের এবং মানবীয় চিন্তার সব ক্যাটেগরির ঊর্ধ্বে। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরকে কখনো একটি বিমূর্ত একত্ব হিসেবে দেখতে পারে না; কারণ ঈশ্বরকে ভাবতে গিয়ে সে তার গতানুগতিক ঐন্দ্রিয়িক বাহন পরিহার করতে পারে না। কিন্তু আধ্যাত্মিক বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে দার্শনিক ঈশ্বরকে ভাবতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত এ ধরনের ঐন্দ্রিয়িক ধারণা ও রীতি-নিয়ম পরিহার করার প্রয়োজন বোধ করেন। ঈশ্বর সব সত্তার প্রধান পরমসত্তা। তার অবস্থান চলমান বস্তুজগৎ ও মনোজগতের সবরকম ভেদ ও বিরোধের ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর থেকেই এ জগৎ ও তার অগণিত ঘটনা ও বস্তুরাশির উদ্ভব। তবে ঈশ্বর তাদের কোনোটিকেই সরাসরি সৃষ্টি করেননি; এদের সবই ঐশ্বরিক সত্তা থেকে বিকীর্ণ অপরকিছু মধ্যবর্তী সত্তার মাধ্যমে। এসব মধ্যশক্তির সমবায়ে রচিত হয়েছে এক আধ্যাত্মিক ক্রমবন্ধন (hierarchy)। সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় বিকিরণের যেসব স্তর জড়িত ভ্রাতৃসঙ্ঘ সেগুলোকে বিন্যস্ত করেছে এভাবে – এক, আদিবুদ্ধি; দুই, বিশ্বাত্মা; তিন, আদি জড়; চার, প্রকৃতি; পাঁচ, দৈশিক জড়; ছয় জ্যোতিষ্কের জগৎ; সাত, পার্থিব জগতের উপকরণাদি; আট, খনিজদ্রব্য এবং নয়, উদ্ভিদ ও প্রাণী। এগুলোকে ভ্রাতৃসঙ্ঘ অভিহিত করেছেন এমন আটটি মৌল নির্যাস বা উপকরণ বলে যেগুলোর সমবায়ে ঈশ্বর তার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন।
এ জগতের বস্তুরাশি খনিজদ্রব্য, উদ্ভিদ ও প্রাণী-এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। তবে জগতের সবকিছুকে শেষ পর্যন্ত বাষ্প ও কাদা-এ দুটি মূল দ্রব্যে বিশ্লেষণ করা যায়। সূর্য ও গ্রহসমূহের প্রভাবে জল যখন বাষ্পীভূত হয়, তখন তা পরিণত হয় শিশিরে, এবং এ দুটি তখন পরিণত হয় মেঘে। মেঘ আবার পরিবর্তিত হয় বৃষ্টিতে। সেই বৃষ্টি মাটির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পরিণত হয় কাদায়; আর কাদা থেকেই শেষপর্যন্ত গড়ে ওঠে খনিজদ্রব্য, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল। সৃষ্টির সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে খনিজজগৎ; আর খনিজদ্রব্যের উচ্চতম পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে উদ্ভিদ জগতের, এবং উদ্ভিদ জগৎ একইভাবে যুক্ত থাকে প্রাণীজগতের সঙ্গে। মানুষ অবস্থিত প্রাণিকুলের শীর্ষে, এবং পৃথিবীতে সে ঈশ্বরের প্রতিনিধিস্বরূপ।
স্টোয়িকদের অনুকরণে ভ্রাতৃসঙ্ঘ মানুষকে বর্ণনা করেছেন অতিকায় জগতে (macrocosm) অন্তর্গত একটি অণুজগৎ (microcosm) বলে। তাদের মতে, মানুষের দেহ গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রতম রূপ। জগতের ভিত্তি ও গঠনমূলে যে ন’টি গোলক রয়েছে, তাদের অনুরূপ মানুষের দেহেও রয়েছে অস্থি, মজ্জা, মাংস, শিরা, রক্ত, স্নায়ু, ত্বক, চুল ও নখ-এ ন’টি উপকরণ। আগুন, বায়ু, পানি ও মাটি-এ চারটি উপকরণের অনুরূপ মানুষের দেহে রয়েছে মাথা, বুক, পাকস্থলী ও উদর।
পদার্থবিদ্যা, মনোবিদ্যা ও নীতিবিদ্যা
ভ্রাতৃসঙ্ঘের পদার্থবিদ্যাবিষয়ক মতবাদ এরিস্টটলীয় মতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। জড় আকার স্থান গতি প্রভৃতির আলোচনায় তারা এরিস্টটলের অনুসারী। এরিস্টটলের যুক্তির অনুকরণেই তারা শূন্যস্থানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। যুক্তিটি এরকম: শূন্যস্থান বলতে যদি এমন একটি স্থানকে বোঝায় যেখানে কিছুই নেই, তা হলে এ ধারণার মধ্যে একটি যৌক্তিক বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। জগতের বাইরে শূন্য বা পূর্ণ বলে কিছুই নেই। এ ধরনের কিছু আছে বা থাকতে পারে বলে আমাদের ধারণা নিতান্তই কাল্পনিক ও ভ্রান্তিকর। প্রতিটি সৃষ্টবস্তু যে সসীম এবং কোনো পদার্থিক বস্তু যে পৃথিবীর বাইরে থাকতে পারে না, তা দর্শন ও প্রত্যাদেশ উভয়েই সমর্থন করে। এই সুস্পষ্ট সত্যটিকে যিনি অস্বীকার করতে চান, তাকে অবশ্যই উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ দিতে হবে।
ভ্রাতৃসঙ্ঘের মতে আত্মার উৎস স্বর্গীয়; এবং তা ফিরে যাবে স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে। ব্যক্তি-আত্মাসমূহ বিশ্বাত্মার অংশস্বরূপ, এবং বিশ্বাত্মার কাছে তারা মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন করবে পরিশোধিত হয়ে। আবার বিশ্বাত্মাও ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে শেষ বিচারের দিন। প্রতিটি ব্যক্তি-আত্মা জড়দেহের সঙ্গে যুক্ত, এবং এজন্যই একে ক্রমশ মুক্ত করতে হয় জড়ের দূষণীয় প্রভাব থেকে। এর জন্য আত্মার যেসব বৃত্তি রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনুধ্যানিক ও ধর্মীয় বৃত্তিটি প্রধান। এদের কল্যাণেই মানুষ অধিকারী হয়েছে দর্শন ও ধর্মের। ঈশ্বরের অনুকরণে আত্মার পরিশোধন ও উন্নতিবিধান সব ধর্ম ও দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
ভ্রাতৃসঙ্ঘের দার্শনিক মতের ভিত্তিমূলে রয়েছে একটি নৈতিক মতবাদ। এ মতে, নীতিবিদ্যার অনুশীলনের মাধ্যমেই বিশুদ্ধ বা পরিষ্কৃত করা যায় মানবাত্মাকে। বলা বাহুল্য, তাদের নৈতিক মতবাদ আধ্যাত্মিকধর্মী, এবং এখানেও তাদের পল্লবগ্রাহিতা সুস্পষ্ট। ভ্রাতৃসঙ্ঘের মতে যা আধ্যাত্মিক, তা-ই প্রাজ্ঞিক (rational)। মানুষের আত্মার অন্তঃসার ও স্বরূপ নিহিত তার প্রজ্ঞায়। মানুষের সেসব কর্ম ও আচরণই যথোচিত যেগুলো সম্পন্ন করা হয় মানুষের স্বরূপ, অর্থাৎ তার প্রাজিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখে। প্রাজ্ঞিক বিবেচনাপ্রসূত কর্মই নৈতিক দিক থেকে মূল্যবান ও প্রশংসনীয়-ভ্রাতৃসঙ্ঘের এ অভিমতে কান্টেরর নৈতিক মতের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
তাদের মতে, মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তা জাগ্রত হয় তখনই, যখন সে ঈশ্বরপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্য কামনা করে। এ ঈশ্বরপ্রেমই সর্বোচ্চো পুণ্য বা সদ্গুণ (virtue)। কারণ, যে ব্যক্তি তা অর্জন করে তার মধ্যে এমন একধরনের ধর্মীয় ধৈর্য ও কোমলতা সৃষ্টি হয়, যা সব মানুষের পক্ষেই কল্যাণকর। ঈশ্বরপ্রেম মানুষের মনে সৃষ্টি করে আত্মিক প্রশান্তি ও হৃদয়ের মুক্তির এক অনুপম অনুভূতি। অধিক থেকে অধিকতর বিশুদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে আত্মা ক্রমবর্ধমানভাবে উপলব্ধি করে শাস্ত্রীয় বাণীর নিহিতার্থ, তথা শাস্ত্র ও ধর্মের মধ্যকার সংগতি। প্রকৃত প্রস্তাবে এবং শেষ বিশ্লেষণে ধর্ম ও দর্শনে কোনো বিরোধ নেই, কারণ উভয়ের লক্ষ্য অভিন্ন। এ সত্ত্বেও ধর্ম ও দর্শনকে ফারাক করার যে প্রবণতা কোনো কোনো মহলে লক্ষ্য করা যায়, তা দুটি বিষয়ের অগভীর জ্ঞানের ওপরই প্রতিষ্ঠিত, যথার্থ জ্ঞানের ওপর নয়।
শুধু ধর্ম ও দর্শনের মধ্যেই নয়, বিভিন্ন প্রত্যাদিষ্ট (revealed) ধর্মের মধ্যেও কোনো মৌলিক বিরোধ নেই বলে ভ্রাতৃসঙ্ঘ মনে করেন। তাদের এই উদার মনোভাব পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে খ্রিস্টধর্মের মৌল নীতিমালার প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থনে। সেদিনের কোনো কোনো মুসলিম চিন্তাবিদ ও লেখক খ্রিস্টধর্মের বাণীসমূহের বৈধতা অস্বীকার করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, কোরান যেহেতু ঈশ্বরের সর্বশেষ প্রত্যাদিষ্ট ধর্মগ্রন্থ, সেকারণেই বলা যায় যে, বাইবেলসহ কোরান-পূর্ববর্তী সব শাস্ত্র ও প্রত্যাদেশ অনাবশ্যক। একথাও অবশ্য ঠিক যে, মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রায় সবাই যিশুকে একজন পুণ্যবান ও পবিত্র পুরুষ বলে মনে করতেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ভ্রাতৃসঙ্ঘ শুধু যিশুর পবিত্রতারই সমর্থক ছিলেন না, বরং আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে তারা বাইবেলে উক্ত মৌল বাণীসমূহকেও বৈধ বলে অনুমোদন করেন। যিশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা, বিভিন্ন স্থানে তার পর্যটন ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটন প্রভৃতি সম্পর্কে গস্পেলে যেসব ঘটনা বর্ণিত ভ্রাতৃসঙ্ঘ সেগুলোকে বর্ণনা করেছেন অপরিমেয় আধ্যাত্মিক শিক্ষার উৎস বলে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ধর্ম ও দর্শনের মধ্যকার গজদন্ত মিনার চূর্ণ করার এবং অধিবিদ্যা ও বিজ্ঞানকে বিশুদ্ধ ধ্যান-অনুধ্যানের উচ্চমার্গ থেকে হাসি-কান্নার পৃথিবীতে নামিয়ে আনার ব্যাপারে ভ্রাতৃসঙ্ঘের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। আল-কিন্দি থেকে ইবনে রুশদ পর্যন্ত দার্শনিকবৃন্দের এবং ওয়াসিল বিন আতা থেকে আল-আশারি পর্যন্ত ধর্মতাত্ত্বিকদের চেয়ে অনেক বেশি শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে তারা চেষ্টা করেছেন একদিকে ধর্ম ও দর্শন এবং অন্যদিকে অধিবিদ্যা ও বিজ্ঞানকে কাছাকাছি আনার ও সমন্বিত করার।
ভ্রাতৃসঙ্ঘের আবির্ভাব ঘটে এমন এক সময়ে (দশ শতক) যখন ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণবাদ (pre-destination) ছিল প্রবল। ধর্মকে তখন পরমতঅসহিষ্ণুতা ও সর্বাত্মক গোঁড়ামির দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা চলে। নিজেদের মত সম্পূর্ণ ঠিক এবং অন্যদের মত কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়-এই যখন ছিল সেদিনের অধিকাংশ ধর্মগোষ্ঠির মনোভাব, তখনই ভ্রাতৃসংঘ এগিয়ে এসেছিলেন এক উদার ও সহনশীল মতবাদ নিয়ে। এ মতে, ধর্মবিষয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পার্থক্য নিতান্তই স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষ, এবং এজন্যই তুচ্ছ। এ পার্থক্য কোনোমতেই সত্যের একত্ব ও সর্বজনীনতাকে ব্যাহত করে না, করতে পারেও না। কারণ, সত্য স্বরূপতই অনপেক্ষ ও নির্বিকার। আর তাই সর্বপ্রকার ভেদ ও বিশিষ্টতার মধ্যে তা থেকে যায় অটল ও অপরিবর্তিত।
জায়েদিয়া সম্প্রদায়
জায়েদিয়া সম্প্রদায় বলতে বোঝায় শিয়াদের সেই শাখাটিকে যার নামের মূলে রয়েছেন কারবালায় নিহত ইমাম হোসেনের পৌত্র ও চতুর্থ ইমাম জায়েদ-বিন-আলী (জয়নুল আবেদীন ৬৮০-৭১২ খ্রিঃ)। তাদের মতে, মুহম্মদ আল বাকের (৭১২-৩১ খ্রিঃ) এর নিকট নয়, জায়েদের নিকট ইমামত হস্তান্তরিত হয়েছে। কারবালার সেই বিয়োগান্ত ঘটনার পর জায়েদই ছিলেন আলীর প্রথম বংশধর যিনি ঈশ্বরের কালাম, রসুলুল্লাহর সুন্নাহ এবং সবরকম অবৈধ অভিনবত্বের (বিদা) বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কুফার তীব্র আক্রমণের মুখে জায়েদকে পরাজিত ও নিহত হতে হয়। এরপর একই পরিণতি ঘটে তার পুত্রের বেলায়। মতবাদের দিক থেকে জায়েদীয়া সম্প্রদায় সুন্নিদের মতবাদের প্রায় কাছাকাছি। ইমামতের উত্তরাধিকার নীতির সঙ্গে তারা নির্বাচন নীতিকেও স্বীকার করেন। বিশেষ পরিস্থিতির বিবেচনায় তারা ইসলামের প্রথম দুই খলিফাকে সমর্থন করেন। ইয়ামেনে জায়েদিয়া উপসম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে।
জায়েদিয়া সম্প্রদায় শিয়া সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদারপন্থী। অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায়ের তুলনায় তাদের তাই বলা চলে মধ্যপন্থী। মতবাদের দিক থেকে এ সম্প্রদায়টি এতই নমনীয় যে, কখনো তা নিজেকে চারটি সুন্নি মজহাবের পর পঞ্চম মজহাব (আল-মজহাব আল-খামিস) বলে প্রকাশ করে। বস্তুত, সুন্নি মতের সঙ্গে তাদের মতের কোনো গভীর বিরোধ নেই। আসল প্রভেদটাই ইমাম পদপ্রার্থীদের নিয়ে। তারা প্রথম তিন খলিফাকে বৈধ বলে মনে করে বলে কেউ কেউ তাদের স্থান দিতে চান শিয়া মতের বাইরে।
অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, নিরাপত্তার কারণে প্রয়োজন হলে যে কেউ তার ধর্মীয় মত গোপন করতে কিংবা অন্য মতের সমর্থনের ভান করতে (তাকিয়া) পারে। কিন্তু জায়েদিয়ারা এই ‘তাকিয়া’ মতবাদের বিরোধী। তারা ফলাফল যাই হোক না কেন, যে-কোনো অবস্থায় যা ভালো তা প্রকাশ্যে অনুশীলনের এবং যা মন্দ তা প্রকাশ্যে পরিহারের পক্ষপাতী (আল-আমর বিল মারুফ ওয়াল নাহী আন আল-মুনকার)। জায়েদ নিজে পূর্বনিয়ন্ত্রণবাদের, মেহেদির আবির্ভাবের এবং ইমামদের অলৌকিক ঘটনা সংঘটনের শক্তি (মাজেজা) প্রভৃতি মতবাদের বিরোধী ছিলেন বলে মনে করা হয়ে থাকে। তবে সুন্নি মতের বিরুদ্ধে এবং ইমামি ও অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায়ের সুরে সুর মিলিয়ে জায়েদিয়ারা বলেন যে, ঈশ্বরের বাণী (অর্থাৎ কোরান) একটা বিশেষ সময়ে সৃষ্ট। এ বিষয়ে জায়েদিয়াদের সঙ্গে মুতাযিলাদের মতের মিল রয়েছে। এর একটা কারণও আছে বটে। জায়েদিয়া মতের প্রতিষ্ঠাতা জায়েদ নাকি মুতাযিলা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াসিল-বিন-আতার ছাত্র ছিলেন, এবং এ কারণেই হয়তো তার মতের ওপর শিক্ষকের মতের কিছুটা প্রভাব পড়েছিল।
জায়েদের মতে, আলীই ছিলেন রসুলুল্লাহর সবচেয়ে সুযোগ্য (আফজল) উত্তরসূরি, এবং তার তুলনায় আবু বকর ছিলেন অনেক কম যোগ্য (মাফদুল)। কিন্তু এ সত্ত্বেও প্রথম দুই খলিফা আবুবকর ও ওমরের প্রতি আনুগত্য (বায়া) প্রদর্শন বৈধ ছিল। তবে জায়েদিয়ারা এ দু’জন খলিফাকে স্বীকার করেন নিছক বৈধ শাসক হিসেবে, ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ইমাম বলে নয়। ওসমান সম্বন্ধেরও তাদের মনোভাব খুবই নমনীয়। এ দিক থেকে জায়েদিয়া মত সুন্নি মতের ঘোর বিরোধী নয়, যদিও ওসমানের খেলাফত প্রসঙ্গে বারোপন্থি ও সাতপন্থি শিয়ামতের সঙ্গে তাদের মতের পার্থক্য দুস্তর। অন্য শিয়াদের সঙ্গে জায়েদিয়াদের আরো একটি পার্থক্য এখানে যে, অন্য শিয়াদের মতে, আলী ও তার বংশধরদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে মুহম্মদ একটি লিখিত উইল (নাস) করেছিলেন। জায়েদিয়ারা এ ধরনের লিখিত উইলের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তবে তারা এটুকু স্বীকার করেন যে, লিখিতভাবে না হলেও আকারে-ইঙ্গিতে মুহম্মদ আলীকেই তার উত্তরাধিকারী স্থির করেছিলেন। তাদের মতে, আলী ও ফাতেমার যে-কোনো বংশধর বৈধভাবে ইমামত গ্রহণ করতে পারেন, যদি তার সেই যোগ্যতা থাকে এবং বিশ্বাসীরা যদি তাকে সমর্থন করে। অন্য শিয়াদের সঙ্গে তাদের আর একটি পার্থক্য এই যে, তারা হজরত আলীর পর জায়েদকে পঞ্চম ইমাম বলে বিশ্বাস করেন। তারা একসঙ্গে দুইজন ইমামের সহঅবস্থানে বিশ্বাস করেন এবং মনে করেন যে, তাদের ইমাম আজও পৃথিবীতে প্রকাশ্যেই (অন্যান্য শিয়া-ইমামের মতো লুক্কায়িত নন) আছেন।
মুরজিয়া সম্প্রদায়
মুরজিয়াদের পরিচয়
ইসলামি দর্শনের প্রারম্ভে যে সকল ধর্মতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় মুরজিয়া সম্প্রদায় তাদের মধ্যে অন্যতম। শিয়া ও খারেজি সম্প্রদায়দ্বয়ের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মুরজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব। খারিজিরা মনে করতো, কোন মুসলিম কবিরা গুনাহ করলে কাফির হয়। অপর দিকে মুরজিয়াদের মতে, পাপ করলে কোন মুসলিম ইমান হারায় না। উমাইয়া শাসন বিরোধী শিয়া ও খারেজিদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মুরজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলেও কালক্রমে তারা ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। কোন কোন চিন্তাবিদ এদেরকে ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক বলে অভিহিত করেন আবার কেউ কেউ এদের উৎপত্তির ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেন। বর্তমানে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্ব নেই; কিন্তু এ সত্ত্বেও রক্ষণশীল ইসলামে এ সম্প্রদায়ের প্রভাব অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী।
মুরজিয়া শব্দটি আরবি ‘আরজা’ শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এর অর্থ মুলতুবি বা স্থগিত রাখা। সুতরাং অনেকের মতে মুরজিয়া সম্প্রদায় বলতে এমন চিন্তাবিদদের বোঝায় যারা শেষ বিচারের দিনে ঈশ্বরের বিচারের পূর্বে পাপী মুসলমানদের বিচার স্থগিত রাখতে উপদেশ দেয়। কোরানে বর্ণিত ৯:১০৬ আয়াতে উল্লিখিত ইরজা থেকে মুরজিয়াগণ তাদের মতবাদ শিক্ষা দেয়, এজন্য তাদের বলা হয় মুরজিয়া অর্থাৎ আশাবাদী সম্প্রদায়। মুরজিয়া মতে, ঈশ্বরই চূড়ান্ত বিচারের মালিক, এবং এজন্যই অন্যান্য মুসলমানদের সম্পর্কে যে-কোনো রায় শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত স্থগিত রাখা উচিত। শুধু শেষ বিচারের দিনই সব হৃদয়ের সব গোপন তথ্য প্রকাশিত হবে। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা ছিলেন উদার ও সহনশীল। তারা অপরের পাপকে দেখতেন উদার দৃষ্টিতে এবং মনে করতেন যে একমাত্র বহুঈশ্বরে বিশ্বাসই অমার্জনীয় পাপ। ধর্মীয় ব্যাপারে যা প্রয়োজনীয় তা হলো বিশ্বাস। একমাত্র বিশ্বাসকেই অভিহিত করা যায় একটি স্বকীয় সত্তা বলে। কোনো পাপাচার এ বিশ্বাসকে বিনাশ করতে পারে না। তাদের মতে, চৌর্যবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ প্রভৃতি গৌণ পাপ ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাসী মুসলমানকে স্বর্গ থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
কোনো বড় (কবিরা) পাপের কারণে একজন মুসলমানকে পৌত্তলিক বলা যাবে না। ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাসী মুসলমান পাপ করলেও মুসলমান থেকে যায়। কোনো ব্যক্তি পাপ করে যদি অনুশোচনা করে তাহলে ঈশ্বর তাকে মাফ করে দেবেন। এসব ইসলামি মতবাদের মূলে মুরজিয়াদের সুস্পষ্ট অবদান রয়েছে। খারিজিরা যখন ঘোষণা করে যে, পাপের পরিণতি নরকের আগুন, তখন তাদের বিরুদ্ধে মুরজিয়ারা এগিয়ে আসেন তাদের উদারনৈতিক মত নিয়ে।
অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়ের ন্যায় মুরজিয়াদের উৎপত্তি ঘটে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। উমাইয়া শাসন আমলে চরমপন্থী খারেজী ও শিয়া সম্প্রদায় চরমভাবে উমাইয়া শাসনের বিরোধিতা করে। বিভিন্ন ধর্মতান্ত্রিক বিষয়েও রাজনৈতিক পদক্ষেপে তারা উমাইয়াদের তীব্র সমালোচনা ও বিদ্রুপ করে, এমনকি কখনও কখনও উমাইয়াদেরকে এরা অমুসলিম বলতে দ্বিধা করেনি। এরকম একটি অবস্থায় ইসলামের কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে উমাইয়া এবং খারেজী মতবাদের মধ্যস্থতাকারী মতবাদ নিয়ে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। তারা উমাইয়া রাজবংশের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, উমাইয়ারা মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন এবং তারা ঈশ্বরের একত্বে ও মহানবীর নবুয়তে বিশ্বাসী মুসলমান। সুতরাং মুরজিয়াদের যুক্তিতে নিষ্ঠাবান ও সৎ মুসলমানদের উচিত শিয়া ও খারিজিদের প্রণোদিত যুদ্ধ থেকে দূরে থাকা।
খারেজী ও শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুরজিয়ারা ঘোষণা করেন যে, কোন মুসলমানের উচিত নয় অন্য মুসলমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা। উমাইয়ারা যেহেতু মুসলমান কাজেই তারা যদি কোন অপরাধ করে তার বিচারের ভার ঈশ্বরের কাছেই ন্যাস্ত করা উচিত। অধ্যাপক ‘Macdonald’ এ সম্প্রদায়ের উৎপত্তির কারণ হিসেবে বলেন, মুসলমানেরা এক সময় অদৃষ্টবাদের আড়ষ্টতায় ভুগছিল। তাদের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে, ঈশ্বরের শাস্তি খুব মারাত্মক, তা থেকে রেহাই পাওয়া বড়ই দুষ্কর। তাই সর্বক্ষণ এক অহেতুক ভীতি মুসলমানদের মনে বিরাজ করত। মুরজিয়া চিন্তাবিদগণ ঈশ্বরের করুণা ও দয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ইসলামের কঠোরতার বিরুদ্ধে তারা উদারপন্থী মতবাদ প্রচার করেন। তাদের মতে, যে ব্যক্তি ঈশ্বরের ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে সে ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে নিপতিত থাকবে না। অনুশোচনা ও ক্ষমাভিক্ষার মাধ্যমে মানুষ শাস্তি থেকে রেহাই পাবে।
মুরজিয়াদের উত্থানের ইতিহাস
ইসলামে সর্বপ্রথম খারেজি ও শিয়া সম্প্রদায় ধর্মীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা উমাইয়া খলিফাদের অস্বীকার করতেন এবং তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করতেন। এই দু’ই সম্প্রদায়ের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে একদল লোক সহনশীলতার নীতি নিয়ে মুরজিয়া নামে আবির্ভূত হয়। তারা ঘোষণা করেন যে, উমাইয়া খলিফাগণকে হেয় প্রতিপন্ন করা ঠিক নয়। তাদের কাফির বা মুশরিক আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মুসলিমদের উচিত নয়। উপরন্তু শেষ বিচারের দিন চূড়ান্ত বিচার সাপেক্ষে উমাইয়া খলিফাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করা মুসলিমদের কর্তব্য। প্রচারিত নীতির কারণে মুরজিয়াগণ উমাইয়া সরকারের আনুকূল্য লাভ করেন। আব্রাহাম হালকীন মন্তব্য করেন যে, যেহেতু তারা উমাইয়া শাসক চক্রের পক্ষে সমর্থন যোগায়, সেহেতু তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অধ্যাপক ম্যাকডোনাল্ড এর মতে, নৈরাশ্যবাদী ভাবধারার বিরোধিতা করতে গিয়ে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে।
মুরজিয়াদের সাধারণত রাজনৈতিক অনুগামী ব্যক্তিবর্গ (Political Conformists) বলে গণ্য করা যায়। এ মত পোষণ করা হয় যে, উমাইয়াদের রাজনৈতিক দাবির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় হিসেবে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। এখানে মুরজিয়াদের তিনটি বিষয় লক্ষণীয়-
- ১. ইমান হারায় না
- ২. পাপীদের প্রতি করুণা প্রদর্শনের মনোভাব
- ৩. পরকাল সম্বন্ধীয় বা শেষ বিচারের দিন মুক্তির আশা
মুরজিয়াদের আন্দোলন ইসলামের প্রগতিশীল মতে প্রথম পদক্ষেপ। তাদের সম্পর্কে P. K. Hiti তার History of Arabs artছ বলেন, “In general Murji’ite influence was on the side of tolerance.” অর্থাৎ, সাধারণত মুরজিয়া মতবাদ পরমত সহিষ্ণুতার উপর প্রতিষ্ঠিত। হানাফী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (রা) আল বাতীর নিকট একটি পত্র লেখেন (পত্রটি কায়রো গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে)। তাতে দেখা যায় তিনি মুরজিয়াদের সাধারণ মত সমর্থন করতেন।
মুরজিয়াদের মতবাদ
মুরজিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদরা যেসব বিষয়ে যুক্তি নির্ভর মত দিয়েছেন তার মধ্যে নিম্নলিখিত তিনটি মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ –
- ১. উদারতা ও সহনশীল মতাদর্শ: মুরজিয়া চিন্তাবিদরা মূলত উদারপন্থী মতবাদের প্রবক্তা। উমাইয়া ও খারেজীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসানের লক্ষ্যে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের প্রথম চিন্তাবিদ একটি কবিতার মাধ্যমে বলেন, “সন্দেহমূলক বিষয়ে রায় স্থগিত রাখা অবশ্য করণীয়। যারা নিজেদের মুসলমান বলেন তারা মুসলমান! বিভ্রান্ত ও অবাধ্যদের সম্পর্কে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অবশ্যই পালনীয়। শুধু আত্মরক্ষার ব্যাপারেই মুসলমানের রক্তপাত করা যেতে পারে। ঈশ্বরের বিধানে যা আছে তা কিছুতেই নাকচ হতে পারে না। (Syed Abdul Hai, Muslim Philosophy. page-56)
- ২. ঈমানের প্রকৃতি সম্পর্কে মতবাদ: মুরজিয়া চিন্তাবিদরা ঈমানের প্রকৃতি সম্পর্কে এক নতুন সংজ্ঞা প্রদান করেন। কোন কোন মুরজিয়া মনে করেন যে, বিশ্বাস অন্তরের বিষয়, এক্ষেত্রে কোন বাহ্যিক অনুষ্ঠান অপরিহার্য নয়। মধ্যপন্থী মুরজিয়ারা মনে করেন যে, বিশ্বাস হৃদয়ের ধারণা এবং সে মোতাবেক কার্য করাই হলো ধর্মের মূল কথা। তবে তারা খুব বেশী অনুষ্ঠানাদিকে ঈমানের পরিপন্থী বলে মনে করেন।
- ৩. কবিরা গুনাহ ও সগীরা গুনাহ সম্পর্কে মতবাদ: মুরজিয়া চিন্তাবিদরা কবিরা ও সগীরা গুনাহ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য মতবাদ দিয়েছেন। চরমপন্থী খারেজীরা মনে করতেন কোন মুসলমান যদি কবিরা গুনাহ করে তাহলে সে আর মুসলমান থাকে না এবং যদি কোন মুসলমান শিরক করে তবে জাহান্নামের আগুন থেকে তার আর মুক্তি নেই। মুরজিয়া চিন্তাবিদগণ এ সম্পর্কে একটি মধ্যস্থতা মতবাদ প্রদান করেন। তাদের মতে, কোন মুসলমান যদি কোন কবিরা গুনাহ করে তবে সে কাফের হয়ে যায় না। তওবার মাধ্যমে এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহে সে মুক্তি লাভ করতে পারে। শিরকের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার কার্যকর, মুরজিয়ারা মনে করেন, ঈশ্বর শুধু ন্যায়বিচারক এবং কঠোর শাস্তি বিধানকারী নন, তিনি পরম দয়ালু এবং ক্ষমাশীল।
সংক্ষেপে মুরজিয়া মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো হচ্ছে –
- ১. কোন মুসলিম ঈশ্বর ও তার রাসূলের প্রতি ইমান আনার পর সে যত গুনাহই করুক না কেন, তাকে কাফের বলা যাবে না।
- ২. সকল সম্প্রদায় বা মাজহাবের মুসলমান একই সমাজের অন্তর্গত। একজন মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে সংঘর্ষ করবে না।
- ৩. তারা সকল খলিফাকে স্বীকার করেন।
- 8 তাদের মতে, উমাইয়া শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া মুসলমানদের কর্তব্য। তবে কেউ অমান্য করলেও তাকে কাফির বলা যাবে না। উমাইয়াদের পাপের বিচার শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।
- ৫. কোন কোন চরমপন্থি মুরজিয়া এমনও বিশ্বাস করে যে, বিশ্বাস অন্তরের ব্যাপার। এতে মৌখিক স্বীকৃতি ও বাহ্য অনুষ্ঠান অপরিহার্য নয়। তাদের মতে, ঈমান থাকলে পাপ কোন ক্ষতি করতে পারে না।
- ৬. তাদের মতে, কবিরা গুনাহ যদি শিরকের পর্যায়ভুক্ত না হয়, তবে কোন মুসলমান চিরদিন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে না। সগীরা গুনাহ, তওবার কারণে মাফ হয়ে যেতে পারে।
- ৭. তারা ঈশ্বরের প্রতি ভীতির পরিবর্তে ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেন।
- ৮. মুরজিয়াদের মতে, তাওবা দ্বারা এবং পাপকার্য পুনরায় না করার প্রতিশ্রুতি দ্বারা কোন মুসলমান তার পাপমোচন করতে পারেন।
খারেজি ও মুরজিয়াদের মধ্যে পার্থক্য
- ১. রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে খারেজি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব কিন্তু মুরজিয়ারা রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে উদ্ভূত না হয়ে খারেজি ও শিয়াদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আত্মপ্রকাশ করে থাকতে পারে।
- ২. ধর্মীয় ব্যাপারে খারেজিরা চরমপন্থা অবলম্বন করে, অন্যদিকে মুরজিয়ারা সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেন।
- ৩. খারেজিদের মতে, কোন মুসলমান কবিরা গুনাহ করলে, কাফির হয়ে যাবে। খারেজিদের মতে, ইমান থাকাকালীন কোন মুসলিম কবিরা গুনাহ করলে কাফির হবে না।
- ৪. খারেজিরা বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেয় কিন্তু মুরজিয়ারা আধ্যাত্মিক বিষয়ের ওপর জোর দেয়।
- ৫. খারেজিরা উমাইয়া বিরোধী কিন্তু মুরজিয়রা উমাইয়া শাসনের সমর্থক।
- ৬. খারেজিগণ তৃতীয় ও চতুর্থ খলিফাকে স্বীকার করেন না, মুরজিয়াগণ চার খলিফাকেই স্বীকার করেন।
- ৭. খারেজিদের মতে, পাপীকে শাস্তি প্রদান করা উচিত, মুরজিয়াদের মতে, শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানের কর্তা ঈশ্বর।
- ৮. খারেজিদের মতে, খারেজির মতবাদ-বিরোধীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা যায় কিন্তু মুরজিয়াদের মতে, শুধু আত্মরক্ষার ব্যাপারেই মুসলমানদের রক্তপাত করা যেতে পারে।
মুরজিয়া সম্প্রদায় ইসলামের ইতিহাসে একটি প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়। ইসলামের প্রগতি ও অগ্রগতির ইতিহাসে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টাকে একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ঈশ্বরের ভয়ে ভীত ও হতাশাবাদীদের নিকট মুরজিয়াদের বাণী জীবনকে সার্থক করে তোলার প্রয়াস পাবে। ন্যায়ের প্রতি আদেশ ও অন্যায়ের প্রতি নিষেধ মতবাদ প্রকৃতপক্ষে মানুষকে সৎভাবে জীবনযাপন করতে অনুপ্রাণিত করে। বস্তুত “The Murji’ite movement was the first step in the rational and progressive views of Islam.” অর্থাৎ, মুরজিয়া আন্দোলন ছিল ইসলামের যুক্তি ও প্রগতি ভাবাপন্ন মতবাদের প্রথম পদক্ষেপ।
মুরজিয়ারা রাজনৈতিক সমর্থনবাদী কিনা
মুরজিয়া চিন্তাবিদদেরকে অনেক ঐতিহাসিক, ধর্মতান্ত্রিক ও দার্শনিক রাজনৈতিক সম্প্রদায় বলে মনে করেন। তাদের মতে, চরমপন্থী খারেজীদের হাত থেকে উমাইয়া শাসকদের রক্ষা করবার কৌশল হিসেবে তারা উমাইয়া শাসকদের সুবিধা অনুযায়ী মতবাদ প্রচার করেন। তবে একথা সত্য যে তাদের মতবাদ দ্বারা উমাইয়া শাসকগণ পরোক্ষভাবে হলেও উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু অনেকের মতে, প্রকৃত বিচারে একথা বলা যায় না যে, মুরজিয়াদের মূল লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক সমর্থন দান। তাদের মতে, মুরজিয়াদের কখনোই কোন রাজনৈতিক অভিপ্রায় ছিলো না। খারেজী ও শিয়া সম্প্রদায়ের মত মুরজিয়ারা কোন দল গঠন করেন নি এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে ব্যাপক কোন পরিবর্তন আনার জন্য সক্রিয় হননি। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামের কঠোরতা সম্পর্কে শিয়া ও খারেজীদের প্রভাবে যে ভীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করত তার দূরীকরণ এবং অহেতুক রক্তপাত থেকে ইসলামি রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। তাই মুরজিয়াদের রাজনৈতিক সমর্থনবাদী বলা চলে না। এদেরকে প্রকৃতপক্ষে মীমাংসাকারী বা মধ্যস্থতাকারী বলা যেতে পারে।
জাবরিয়া সম্প্রদায় (Jabriyya)
ভূমিকা
মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের একটি রক্ষণশীল অংশ জাবরিয়া নামে পরিচিত। আরবী ‘জবর’ শব্দ থেকে জাবরিয়া শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘জবর’ শব্দের অর্থ হল : নিয়তি, অদৃষ্ট, বাধ্যবাধকতা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। নিয়তি বা অদৃষ্টের প্রতি অতিমাত্রায় আস্থা স্থাপন করে সপ্তম শতাব্দির গোড়ার দিকে যে ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে মুসলিম দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাসে সেই সম্প্রদায় জাবরিয়া নামে পরিচিত। তারা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং সারা বিশ্বের নিরঙ্কুশ শাসক। তার ইচ্ছার বাইরে সসীম মানুষের কোনো স্বতন্ত্র স্বাধীন ইচ্ছা নেই, থাকতে পারে না। তৎকালীন সময়ের এই নিয়তিবাদী বা নিয়ন্ত্রণবাদী (fatalist/determinist) তাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের প্রারম্ভিক নেতা ছিলেন জাহম বিন সাফওয়ান (মৃত্যু ৭৪৫)।
এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তৎকালীন আরবীয় সমাজের প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনেকটা প্রভাব বিস্তার করে। সেই সময়ে আরবের অধিকাংশ মানুষ ছিল অদৃষ্টবাদী এবং নিয়ন্ত্রণবাদী। তাদের অনেকেরই এমন বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বর যে কেবল ভাগ্যের লিখন লেখেন তাই নয়; বরং তিনি মানুষের সকল প্রকার কর্ম এবং ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সপ্তদশ শতকের প্রারম্ভের এই কট্টর নিয়ন্ত্রণবাদী অদৃষ্টবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি দার্শনিক সম্প্রদায় হল এই জাবরিয়া সম্প্রদায়।
জাবরিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
প্রাক ইসলামি যুগে আরবদের অনেকে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী ছিল। ইসলামি যুগে তাদের অনেকে ঈশ্বরের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সংক্রান্ত আয়াতগুলো দলিল হিসেবে গ্রহণ করে এবং অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। যেমন কোরানের সুরা আল বাকারার ২৮৪ নং আয়াতে আছে, “তিনি (ঈশ্বর) যাকে খুশি ক্ষমা করেন এবং যাকে খুশি শাস্তি দেন। কারণ তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।” সূরা আল ইমরানের ২৬ নং আয়াতে আছে, “তিনি যাকে ইচ্ছা সুপথে পরিচালনা করেন।” আবার সূরা বাকারার ২৭২ নং আয়াতে আছে, “তিনি (ঈশ্বর) প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার ভাগ্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।” এই আয়াতসমূহ ও অনুরূপ আয়াতসমূহের ভিত্তিতে জাবরিয়া মতবাদ গড়ে ওঠে।
জাহম ইবন সাফওয়ান আবু মুহরিজ ছিলেন জাবরিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান প্রবক্তা। ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে তিনি কিছুটা স্বাধীন মত পোষণ করতেন। তার নামানুসারে তার অনুসারীদের জাহমিয়াও বলা হতো। এই দলটি একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল এবং তারপরে আশয়ারী দলভুক্ত হয়ে যায়।
শিয়া ও খারেজি মতবাদ প্রসার লাভ করার পর জাবরিয়া মতবাদ দানা বাধতে শুরু করে। উমাইয়া শাসনামলে শিয়া ও খারেজিরা উমাইয়া শাসকদের অস্বীকার করতে শুরু করলে জাহম ইবন সাফওয়ান (মৃত্যু ৭৪৫ খ্রিঃ) এর নেতৃত্বে জাবরিয়া মতবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এ সময়ে জাবরিয়াগণ অদৃষ্টবাদের ব্যাপারে একই মতাবলম্বী হয়ে থাকলেও ছোটখাটো ব্যাপারে তারা জাহমিয়া, নাজারিয়া ও জাবরিয়া এ তিনটি প্রধান দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
জাহম ইবন সাফওয়ান বলেন, প্রকৃতপক্ষে মানুষ কাজ করে না, তবুও রূপকভাবে বলা হয় যে, মানুষ কাজ করে, যেমনভাবে বলা হয় যে, সূর্য কিরণ দেয় ও যন্ত্রের চাকা ঘোরে। (Man does not work really, yet it is sard alligorically that man works as it is said that the sun shines and the machine move.)
জাবরিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস
জাবরিয়াদের মতে তাদের মৌলিক বিশ্বাসগুলো হচ্ছে –
- ১. প্রত্যেক কাজ ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে। কাজেই মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী নয়। মানুষের কোন কাজ করার শক্তি কিংবা ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নেই।
- ২. মানুষ সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের সার্বভৌম শক্তির অধীন। মানুষের পুরস্কার ও শাস্তি ঈশ্বরের সার্বভৌম শক্তির অধীনে।
- ৩. ঈশ্বর যাকে ইচ্ছা পুরস্কার দেন, আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করেন।
শাহরিস্তানী জাবরিয়াদের দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ
- ১. গোঁড়া জাবরিয়া- এ দলের মতে, কোন অর্থেই মানুষ কাজ করে না, অথবা মানুষের কাজের শক্তি আছে বলা যায় না।
- ২. মধ্যপন্থি জাবরিয়া- এ দলের মতে, মানুষের ইচ্ছা শক্তি আছে কিন্তু সে শক্তি মানুষের কাজের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করে না।
জাবরিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ইসলামের স্বাভাবিক জীবন ধারায় এক চরমপন্থি চিন্তা-চেতনা সঞ্চার করে। বিরোধীদের মতে, মানুষকে ঈশ্বর বিবেক দান করেছেন এবং তার উপর কিছু কাজ ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত করেছেন। জাবরিয়া সম্প্রদায় সেগুলোকে অস্বীকার করে ইচ্ছাধীন জীবনযাপনের পক্ষপাতী।
ইচ্ছার স্বাধীনতা
জাবরিয়া সম্প্রদায় যে সকল দার্শনিকতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন তার মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষকরে এই বিষয় সম্পর্কিত আলোচনাই এই সম্প্রদায়কে দর্শনের ইতিহাসে আলোচিত করে রেখেছে।
জাবরিয়ারা ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। মানুষের সর্বপ্রকার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, কর্ম ভাগ্য বা নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ঈশ্বর পার্থিব জগতের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। তার হুকুম ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। মানুষ ভালো-মন্দ যে কাজই করুক না কেন তা ঈশ্বরের দ্বারাই অর্থাৎ তার নির্দেশ দ্বারাই ঘটে থাকে। ঈশ্বর সর্বক্ষেত্রেই পূর্ণ ক্ষমতাবান, এবং তিনি সেই ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগও করেন। এর ফলে তিনি মানুষকে যেমন ইচ্ছা তেমন পরিচালনা করেন। তাছাড়া মানুষের সর্বপ্রকার কর্ম এবং প্রাপ্তি ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। সবই ভাগ্যের লিখন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ সেই ভাগ্যের বাইরে আসতে পারে না। সুতরাং মানুষ তার কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়।
জাবরিয়া সম্প্রদায়ের দার্শনিকগণ তাদের উপযুক্ত মতের সমর্থনে কোরান থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেন। তারা পবিত্র কোরানের যে সকল উক্তিকে তাদের মতের সমর্থনে দলিল মনে করেন সে সকল উক্তিগুলো হচ্ছে :
- “তিনি প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সূরা ২৫, আয়াত ২২)
- “ঈশ্বরই যাকে ইচ্ছা সৎ পথে আনেন ও তিনিই ভালো জানেন কারা সৎ পথ অনুসরণ করে।” (সূরা ২৮, আয়াত ৫৬)
- “ঈশ্বর যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি সরল পথে স্থাপন করেন।” (সূরা ৬, আয়াত ৩৯)
- “এভাবে ঈশ্বর যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন ও যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ দেন।” (সূরা ৭৪, আয়াত ৩১)
- “আর আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই ঈশ্বরের এবং কর্মবিধানে ঈশ্বরই যথেষ্ট।” (সূরা ৪, আয়াত ১৩২/১৭১)
জাবরিয়া সম্প্রদায়ের দার্শনিকগণ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে খণ্ডন করার জন্য কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেন, যুক্তিগুলো হল:
- এক. যদি মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় তবে একথা মেনে নিতে হয় যে, মানুষ যেমন ইচ্ছা তেমন কর্ম করতে পারে। কিন্তু তা মেনে নিলে ঈশ্বরের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরই সকল প্রকার কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। তাই মানুষের ইচ্ছার কোন ভূমিকা নেই।
- দুই. মানুষের যদি জাগতিক কর্ম ও ঘটনার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব থাকতো তাহলে জগতে যত মানুষ আছে তত কৰ্তৃত্বশীল সত্তা বিরাজমান থাকতো। কিন্তু তাতে করে বহু কর্তা বা নিয়ন্ত্রকের আবির্ভাব ঘটতো। জগতের ঘটনাবলীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতো। মানুষ তার ইচ্ছামত জগত-সংসার নিয়ন্ত্রণ করতো। জাগতিক ঘটনাবলী এক ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে ভাবলেই জগতের সর্বত্র শৃঙ্খলা ব্যাখ্যা করা যায় এবং ঈশ্বরর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকেও সীমিত করা হয় না। তাই মানুষকে কর্মের প্রকৃত কর্তা বা ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রক ভাবা সঙ্গত নয়। সে কারণে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে হয়।
- তিন. শরিয়ত অনুসরণে মানুষের ভাগ্য বা অদৃষ্টকে মেনে নেওয়া উচিত। কিন্তু মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা বা যেমন খুশি তেমন কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা ভাগ্য বা নিয়তির ধারণার পরিপন্থি। তাই মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা স্বীকার করা যায় না বলে জাবরিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ মনে করেন।
- চার. মানুষকে পুরস্কার ও শাস্তিদানের ক্ষমতা ঈশ্বর কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। ঈশ্বর যাকে ইচ্ছা পুরস্কার ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দানের ক্ষমতা রাখেন। তাই যদি হয় তাহলে মানুষের স্বাধীনভাবে বা দায়িত্বপূর্ণভাবে কর্ম করার কোন আবশ্যিকতা থাকে না।
- পাঁচ. জাবরিয়া সম্প্রদায়ের কেউ কেউ এরকম মতও উপস্থাপন করেন যে, মানুষকে যদি কর্ম সম্পাদনকারী ভাবাও হয় তা-ও একটি রূপক অর্থে বা পরোক্ষভাবে ভাবা যেতে পারে। কেননা, ঈশ্বরই সকল কর্ম ও ইচ্ছার শক্তি দাতা ও অনুমোদনকারী একমাত্র সত্তা। তার দেওয়া শক্তি এবং তার অনুমোদন সাপেক্ষেই মানুষ কোন কিছু করে বলে ভাবা যেতে পারে। যেমন জাবরিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা জাহম বিন সাফওয়ান বলেন: “মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাজ করে না। কেবল রূপক অর্থেই যেমন বলা চলে সূর্য কিরণ দেয়, মিলের চাকা ঘুরে অনুরূপভাবে মানুষও কাজ করে। (“Man does not really act. It is only metaphorically that he is said to act in the same way as the sun is said to shine, mill wheel to turn.”) এই উক্তির মাধ্যমে বোঝা যায় যে, সূর্য কিরণ দিলেও সূর্যের এ কাজ ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, এমনকি পূর্ব নির্ধারিত। মিলের চাকা নিজে ঘোরে মনে করলেও তা একটি যান্ত্রিক সিষ্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পূর্বনির্ধারিত। মানুষও তেমনি যত রকম কর্ম করে বলে মনে করা হয় সে সকল কর্ম ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত। তাই মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোন ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই।
পর্যালোচনা
ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কিত জাবরিয়াদের এই মত অনিয়ন্ত্রণবাদ বলা যায়। অনিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে মানুষের কোন ইচ্ছা বা কর্মের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছা ও কর্ম তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জাবরিয়াগণ ঈশ্বরর কর্তৃত্ব দ্বারা মানুষের সকল প্রকার ইচ্ছা ও কর্মকে নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করেন। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মুসলিম দার্শনিকগণ তাদের এই মতবাদ পর্যালোচনা করে যে সকল ত্রুটি লক্ষ্য করেন তা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:
- ১। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা না থাকলে কোন নৈতিক দায়-দায়িত্ব তার ওপর আরোপ করা যায় না। মানুষ যদি নিজের ইচ্ছায় কাজ না করে তাহলে ভালো কাজ-মন্দো কাজের জন্য মানুষকে দায়িত্বপূর্ণ বলে দাবী করা চলে না। ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিকতার একটি স্বীকার্য সত্য। একে অস্বীকার করে জাবরিয়া চিন্তাগোষ্ঠী প্রকারান্তে নৈতিক দায়-দায়িত্বকেই অস্বীকার করেছেন। আর নৈতিক দায়-দায়িত্ব অস্বীকারের অর্থই হচ্ছে ভালো-মন্দের ধারণাকে অস্বীকার করা। এটা সমাজের জন্য শুভ নয়।
- ২। ইচ্ছার স্বাধীনতা অস্বীকার করা হলে পাপ-পুণ্যের ধারণাও ভিত্তিহীন পড়ে। মানুষ যদি নিজের ইচ্ছার কোন কাজ না করে, কাজ বা কোন আচরণ করতে যদি সে বাধ্য হয় তাহলে সে পাপ করেছে না পুণ্য করেছে তা বিচার করা চলে না। আর পাপ-পুণ্যের ধারণা অস্বীকার করা হলে ধর্মীয়ভাবেও মানুষকে বিচার করার কোন মানদণ্ড থাকে না।
- ৩। ঈশ্বর যদি কেবলমাত্র তার ইচ্ছামতো মানুষকে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করেন তাহলে বিচার দিনের কার্যকারিতা থাকে না। ঈশ্বরকে ন্যায়বিচারক হিসেবেও স্বীকার করা চলে না। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিতে ঈশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক।
- ৪। ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতার উৎস- সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অর্থ এই হতে পারে না যে, তিনি মানুষকে কোন স্বাধীনতা দেন নি। ঈশ্বরকে একজন স্বৈরশাসকের সাথে তুলনা করা শোভনীয় নয়। ঈশ্বর মানুষকে কর্ম নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করার শক্তি প্রদান করেছেন। ভালো-মন্দ যাচাই করার বিবেক দিয়েছেন। পথপ্রদর্শক দিয়েছেন। তবে যে কর্মই মানুষ ঘটাক না কেন তাও ঈশ্বরের অনুমোদন সাপেক্ষ। তাই এতে করে ঈশ্বরর চূড়ান্ত কর্তৃত্বের ধারণার সাথে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব হতে পারে না।
- ৫। ভাগ্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপন ইসলামি মূলনীতি বা শরিয়তের অংশ হলেও চূড়ান্ত বিচারে ভাগ্যের মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না। ঈশ্বর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দ্রষ্টা। মানুষ যা করে বা করবে তার সবই ঈশ্বরের জানা। তাছাড়া মানুষ ঈশ্বরের কাছে তার কৃতকর্মের দ্বারা নিজের অবস্থার পরিবর্তন তথা ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে বলে ইসলামে স্বীকার করা হয়। কোরানে ঈশ্বর বলেছেন : “ঈশ্বর কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।” আল্লামা ইকবাল তাই বলেছেন: খুদিকে (আত্মাকে) এমনভাবে বিকশিত কর, যেন স্বয়ং ঈশ্বর ভাগ্য লিখনের সময় জিজ্ঞাসা করবেন ‘বান্দা তোমার আর কী চাই?’
- ৬। ইচ্ছার স্বাধীনতা অস্বীকার করা প্রায়োগিক দিক থেকেও অশুভ। মানুষ কোন কর্মের জন্য স্বাধীন না বা মানুষের কোন কর্ম নির্বাচনের স্বাধীনতা নেই বা মানুষ ইচ্ছা করে কোন কিছু করে না- এমন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সমাজে অরাজকতা দেখা দিতে পারে । কেননা মানুষ মন্দ কাজ করেও বলবে যে, এটা তার দোষ নয়; সেতো এটা করতে বাধ্য।
- ৭। জাবরিয়াগণ ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে গিয়ে কোরান থেকে সেই সকল আয়াতকেই উল্লেখ করেছেন- যে সকল আয়াতে আপাতভাবে ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই বলে মনে হয়। কিন্তু এই সকল আয়াতসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য বা তাফসীর তারা যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পরেননি বলেই মনে হয়। তাছাড়া কোরানের বহু আয়াত রয়েছে যা ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে ঈশ্বরের সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করে; জাবরিয়াগণ এ সকল আয়াত এড়িয়ে গিয়েছেন।
উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে অনেকে বলেন, জাবরিয়াদের ইচ্ছার স্বাধীনতা সংক্রান্ত মতবাদ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। এটা মূলত একটি অপ্রগতিশীল সমাজ ও স্বৈরাচারী শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে বলে মনে হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাবরিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ উমাইয়া শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, এবং উমাইয়াগণও জাবরিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। চরম অদৃষ্টবাদিতার আবরণে উমাইয়াগণ তাদের অনেক কু-কর্ম ঢেকে রাখার চেষ্টা করতো। জাবরিয়াগণ এক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে উমাইয়াদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। এজন্য তারা উমাইয়া শাসকদের নিকট প্রিয়পাত্র ছিলেন। জাবরিয়াগণ ক্ষমতাসীন উমাইয়া শাসকদের সবরকম কার্যকলাপকে, এমনকি শোষণ-নির্যাতনকে যুক্তিযুক্ত করার প্রয়াস পান। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, এসব কর্মকাণ্ড পূর্বনির্দিষ্ট, সুতরাং এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা অর্থহীন।
কাদরিয়া সম্প্রদায় (Qadariyyah)
ভূমিকা
ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে জাবরিয়াদের সাথে বিতর্ক থেকেই উদ্ভব ঘটে স্বাধীন ইচ্ছার সমর্থক বলে সুপরিচিত কাদরিয়া সম্প্রদায়ের। তারা কোরানের কিছু বাণী উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার এবং ভালো-মন্দ ও ঠিক-বেঠিক নির্ধারণের ক্ষমতার অধিকারী। এ মতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাবাদ আল জুহানি (মৃ. ৬৯৯)। এর অন্যান্য প্রবক্তার মধ্যে রয়েছেন গাইলান আল দিমেস্কি (মৃ. ৭৪৩), ওয়াসিল বিন আতা (মৃ. ৭৪৮), ইউসুফ আল আসয়ারি, আমর বিন ওবাইদ (মৃ. ৭৬২) এবং হাসান আল-বসরি (মৃ. ৭২৮)। (Cf. M. Watt. Free Will and Predestination in Early Islam, pp. 40f.)। আরবী ‘কদর’ শব্দ থেকে কাদরিয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘কদর’ শব্দের অর্থ ‘শক্তি’ বা ‘ক্ষমতা’। মানুষের কার্য নির্বাচনের শক্তি বা ক্ষমতায় বিশ্বাসী একদল মুসলিম চিন্তাবিদদের কাদরিয়া বলে আখ্যায়িত করা হতো। এই সম্প্রদায়ের আবির্ভাবকাল সপ্তম শতাব্দির গোড়ার দিকে। অর্থাৎ এরা ছিলেন জাবরিয়াদের সমসাময়িক এবং জাবরিয়াদের মতের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদকারী। তবে জাবরিয়াদের বিরোধিতা করতে গিয়ে এদের আবির্ভাব ঘটেছে- এমন কথা বলা চলে না। মূলত উমাইয়াদের বিরোধিতা করতে গিয়েই তাদের আবির্ভাব ঘটে।
কাদরিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
শিয়া ও খারেজি সম্প্রদায়ের উদ্ভবের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জাবরিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে জাবরিয়া মতবাদ জনপ্রিয় হতে শুরু করে উমাইয়া আমলে। জাবরিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কাদরিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। কারণ জাবরিয়া সম্প্রদায়ের বিরোধী মতবাদ হলো কাদরিয়া সম্প্রদায়ের।
কাদরিয়া মত যখন ঘোষিত হয়, তখন ছিল উমাইয়া শাসনামলের প্রথম দিক। সময়টি ছিল খুবই কঠিন। উমাইয়ারা তাদের সংগঠিত ও সংহত করার জন্য তখন চালাতে থাকে নানারকম নির্যাতন ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ফলে জনসাধারণের মনে সৃষ্টি হয় ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভ। স্বাধীনচেতা ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তখন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায় কিছু প্রশ্নের সদুত্তর। যেমন, এ ধরনের নৃশংসতা আপনারা সংঘটিত করছেন কেন? এসব কি ইসলামের মর্মবিরোধী নয়? আপনারা কি মুসলমান নন? – এসব ছিল সেদিনের বহুল উচ্চারিত প্রশ্নাবলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। আর এসব প্রশ্নের উত্তরে সরকারি পক্ষ বলার চেষ্টা করেন : “আমরা করি, তার জন্য আমরা দায়ী নই। স্বয়ং ঈশ্বরই সবকিছু করেন। ভালো-মন্দ সবকিছুর মূলে শক্তি হিসেবে কাজ করেন স্বয়ং ঈশ্বর।” উমাইয়া শাসকগণ ছিলেন এমনই অদৃষ্টবাদী। তারা মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতেন। তাদের সর্বপ্রকার অপকর্ম তথা হত্যা, নির্যাতন, দুঃশাসনকে তারা নিয়তির লিখন বা বিধাতার লীলা-খেলা বলে চালিয়ে দিতেন। তাদের এই ধরনের কর্ম এবং এহেন প্রচারে তৎকালীন কিছু আলেম বিতশ্রদ্ধ ছিলেন। তারা এর প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন। ইসলামি শাসনের নামে মুসলিম হত্যা বা নরহত্যা, ভাগ্যের পরিহাস বলে জনসাধারণের ওপর নির্যাতন এই আলেমগণ মেনে নিতে পারলেন না। তারা এগুলোকে ইসলাম পরিপন্থি, মানবতা বিবর্জিত এবং সর্বোপরি ইসলামের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করলেন। কথিত আছে যে, একবার তৎকালীন যুগের বিখ্যাত আলেম মা’বাদ আল জুহানী তার সুযোগ্য সাথী ওয়াসিল বিন আতা সহ তদানিন্তন শ্রেষ্ঠতম সুফি সাধক হাসান আল বসরি -এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : “হে আবু সাঈদ, এসব শাসক মুসলমানদের রক্তপাত করে, নানারকম জঘন্য কাজ করে এবং বলে যে, তাদের সব কাজ ঈশ্বরের নির্দেশেই হচ্ছে।” উত্তরে নাকি হাসান আল বসরী বলেছিলেন: “তারা ঈশ্বরের শত্রু, তারা মিথ্যাবাদী।” এই মন্তব্য তৎকালীন আলেম সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। এবং মা’বাদ আল জুহানী, ওয়াসিল বিন আতা প্রমুখ চিন্তাবিদগণ আলেমদের সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন উমাইয়া শাসকদের চরম অদৃষ্টবাদী অবস্থানের বিপক্ষে তারা মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও কর্মের দায়-দায়িত্বের ধারণা প্রচার করেন। এতে করে উমাইয়া শাসকগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এর ফলশ্রুতিতে ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আব্দাল মালেকের (রা. ৬৮৫-৭০৫) নির্দেশে হাজ্জাজ কর্তৃক কাদরিয়া সম্প্রদায়ের সাহসী প্রচারক মা’বাদ আল জুহানী-কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে গায়নান আল দিমাশূকি-কেও অনুরূপ মত প্রচারের জন্য হত্যা করা হয়। কিন্তু এই আন্দোলন থেমে থাকে নি। ওয়াসিল বিন আতা সহ বিভিন্ন আলেম চিন্তাবিদগণ কাদরিয়া মতাদর্শকে মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেন।
কাদরিয়াদের মতে, মানুষ তার সব অশুভ কর্মের জন্য দায়ী। এগুলোর দায়িত্ব ঈশ্বরের ওপর আরোপ করা ঠিক নয়। এ মত পরিচিত ছিল কদরবাদ নামে; এবং এ থেকেই আদি মুতাযিলাদের বলা হতো কাদরিয়াপন্থী, অর্থাৎ ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের সমর্থক। মানুষকে তার নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়ী করে তারা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের সমর্থন করেন। জাবরিয়াদের নিয়ন্ত্রণবাদী মতের বিরোধিতা করে কাদরিয়ারা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তার সঙ্গে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার কোনো বিরোধ নেই বলে ঘোষণা করেন। নিজেদের এ মতের সমর্থনে তারা কোরানের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত করে দেখান। মাবাদ আল জুহানি প্রকাশ্যে এসব মত প্রচার করেন, এবং এজন্যই উমাইয়া খলিফা ইবনে আবদুল মালেকের (৬৮৫-৭০৫) নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। মাবাদ আল জুহানির পর গাইলান আল-দিমেস্কি অনুরূপ মত প্রচার করেন। তিনি এ-ও প্রচার করেন যে, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত মানুষকে ন্যায়কর্ম করার এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া। গাইলানের এ নতুন মত উমাইয়া শাসনের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি বলে বিবেচিত হয়, এবং এ অজুহাতে খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালেকের (রা. ৭২৪-৭৪৩) আদেশে তাকেও হত্যা করা হয়। মাবাদ ও গাইলানের মৃত্যু তাদের প্রচারিত মতাদর্শকে আরো পরিচিত করে তোলে এবং এসব মত ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। কথিত আছে যে, উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (রা. ৬৮৩-৮৪) ও তৃতীয় ইয়াজিদ (রা. ৭৪৪) কাদরিয়া মতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও উমাইয়া শাসনামলে কাদরিয়া আন্দোলন প্রসার লাভ করেনি, করতে পারেনি। কাদরিয়াদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের আক্রমণের শক্তি বৃদ্ধি পায় বিশেষত এ অভিযোগের পর যে, তাদের মতের পেছনে গ্রীক ও খ্রিস্টীয় চিন্তা কার্যকর ছিল। আল-শাহরাস্তানির মতে, ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় বিষয়াদি (উসুল) নিয়ে সাত শতকের শেষের দিকের ধ্যান-ধারণা গ্রীক দার্শনিকদের ধারণাবলি দ্বারা প্রভাবিত।
পরিশেষে বলা দরকার যে, স্বাধীন ইচ্ছা প্রসঙ্গে কাদরিয়া-জাবরিয়া বিতর্ক বিষয়ে খুব বেশি প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায় না। আর এজন্যই এ বিতর্ক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা সমর্থনের ফলে কাদরিয়াদের কেউ কেউ প্রাণ হারান এবং অন্যান্য অনেকে পরবর্তী প্রধান সম্প্রদায় মুতাযিলাদের সঙ্গে মিশে যান।
কাদরিয়াদের মতবাদসমূহ
কাদরিয়া সম্প্রদায় বেশ কিছু মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। তাদের মতবাদসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
- ক. মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী: কাদরিয়া চিন্তাবিদদের মতে, মানুষ তার সকল কাজ নিজে করে। মানুষ এক ঐচ্ছিক সত্তা, তার ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। মানুষ নিজেই তার কর্মের নিয়ন্তা এবং তার কর্মের জন্য সে নিজেই দায়ী। ঈশ্বরতায়ালা সরাসরি কোন মানুষের কর্ম তৈরি করে দেন না, তবে তিনি মানুষকে কার্যক্ষমতা দান করেন।
- খ. ঈশ্বরের পবিত্রতা সম্পর্কিত বক্তব্য: কাদরিয়া দলের মত হল মন্দ ইচ্ছা ও কর্মের সম্পর্ক ঈশ্বরের প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে না। এর সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে। ঈশ্বর মানুষকে কিছু করা ও না করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করেছেন। তবে মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য জ্ঞান রয়েছে।
- গ. ভিন্ন কাদরিয়াদের অভিমত: কাদরিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় ভিন্নপন্থি চিন্তাবিদ মাঝে মাঝে মানুষের শক্তিকে অতিরঞ্জিত করে দু’একটি ঐশী শক্তিও প্রদান করেছেন কিন্তু মানুষের জ্ঞান সীমিত, এ বিষয়ে তারা ভুলে গেছেন বা এড়িয়ে গেছেন।
ইচ্ছার স্বাধীনতা
কাদরিয়া সম্প্রদায় ইচ্ছার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাদের মতে, মানুষের কর্ম নির্বাচনের ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ যা করে তা তারই কর্ম। সুতরাং সেই কর্মের জন্য তাকেই দায় দায়িত্ব নিতে হবে। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার বা শাস্তি তাই মানুষেরই প্রাপ্য। কাদরিয়াদের মতে, কর্ম নির্বাচনের এবং কর্মে অংশগ্রহণের ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে প্রদান করেছেন। এই ক্ষমতা কে কিভাবে ব্যবহার করলো তার ভিত্তিতেই ঈশ্বর মানুষের বিচার করবেন।
কাদরিয়াদের মতে, ঈশ্বর যেহেতু ন্যায়বিচারক তাই তিনি মানুষকে এমন কাজের জন্য দায়ী করতে পারেন না যে কাজ মানুষ স্বেচ্ছায় করে না; বরং ঈশ্বরই ঘটান। ঈশ্বর মানুষকে কার্যক্ষমতা প্রদান করেছেন এবং তিনি ভালো-মন্দের পার্থক্যও করে দিয়েছেন। সে কারণেই ঈশ্বর মানুষের কর্মকাণ্ডের হিসাব গ্রহণ করবেন- বিচার করবেন। মানুষ পাপ-পুণ্য, নৈতিক-অনৈতিক সর্বকাজের জন্যই নিজে দায়ী। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর যেমন কার্যক্ষমতা, নির্বাচন ক্ষমতা দিয়েছেন, তেমনি মানুষের মধ্যে নীতিবোধ বা বিবেকবোধও রয়েছে। ঈশ্বরই মানুষকে উচিত-অনুচিত বোধ প্রদান করেছেন। এবং কোরানের মাধ্যমে, নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ভালো-মন্দ, উচিত অনুচিত সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও প্রদান করেছেন। তবে এসব দিকনিদের্শনা এবং বিবেকের নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে মানবসত্তা স্বাধীন। তাই মানুষ কৃতকর্মের জন্য নৈতিকভাবেও দায়বদ্ধ। কাদরিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ তাদের মতবাদের সমর্থনে পবিত্র কোরানের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ উদ্ধৃত করেন :
- “ওদের দু’বার পুরস্কৃত করা হবে, কারণ ওরা ধৈর্যশীল, আর ওরা ভালো দিয়ে মন্দ দূর করে এবং আমি ওদেরকে যে-জীবনের উপকরণ দিয়েছি তার থেকে ব্যয় করে। ওরা যখন অসার কথা শোনে তখন ওরা তা এড়িয়ে চলে ও বলে, “আমাদের কাজের জন্য আমরা দায়ী, আর তোমাদের কাজের জন্য তোমরা। তোমাদের সালাম। আমরা জাহেলদের (অজ্ঞদের) সঙ্গ চাই না।” (সূরা ২৮ কসাস, আয়াত: ৫৩-৫৫)
- “ঈশ্বর অণুপরিমাণও জুলুম করেন না। অণুপরিমাণ পুণ্যকর্ম হলেও ঈশ্বর তাকে দ্বিগুণ করেন এবং ঈশ্বর তার নিকট হতে মহাপুরস্কার দান করেন।” (সূরা ৪ নিসা, আয়াত ৪০)
- “যে পাপ কাজ করে, সে নিজের জন্যই করে। নিশ্চয়ই, ঈশ্বর মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা ৪ : নিসা, আয়াত ১১১)
- “হে রাসুল, আপনি বলেন, ‘ঈশ্বর লজ্জাকর কাজের আদেশ করেন না’…” (সূরা ৭ : আরাফ, আয়াত ২৮)
- “নিশ্চয়ই জেনো, যতদিন পর্যন্ত কোনো জাতি তাদের অন্তর প্রকৃতির পরিবর্তন না করে, ততদিন পর্যন্ত ঈশ্বর তাদের পার্থিব অবস্থার পরিবর্তন করেন না।” (সূরা ১৩ : রাদ, আয়াত ১৯)
- “…ঈশ্বর প্রত্যেক কৃতকর্মের প্রতিফল দেবেন। নিশ্চয়ই, ঈশ্বর হিসাব গ্রহণে তৎপর।” (সুরা ১৪ : ইব্রাহিম, আয়াত : ৭-৮)
- “… যারা সাবধানতা অবলম্বন করে ও যারা সৎকর্মপরায়ণ, ঈশ্বর অবশ্যই তাদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা ১৬ নাহল, আয়াত ১২৮)
- “ঈশ্বর তার দাসত্বের ওপর জুলুম করেন না।” (সূরা ২২ হজ্ব, আয়াত: ১০)
- “আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করিনা…।” (সূরা ২৩ মোমিনূন, আয়াত ৬২)
- “যে কেউ সৎকাজ করে সে তার কাজের চেয়ে বেশি ফল পাবে, আর যে মন্দ কাজ করে সে তো কেবল তার কাজের অনুপাতে শাস্তি পাবে।” (সূরা ২৮ কসাস, আয়াত: ৮৪)
- “যে সৎকর্ম করে সে নিজের ভালোর জন্যই তা করে, আর কেউ মন্দকর্ম করলে তার প্রতিফলও সে-ই ভোগ করবে। তোমাদের প্রতিপালক তার দাসদের ওপর কোন জুলুম করেন না।” (সূরা ৪১ : হা-মীম-সিজদা, আয়াত: ৪৬)
- “…মানুষ চেষ্টার অতিরিক্ত ফল পাবে না।” (সূরা ৫৩ : নাজম, আয়াত ৩৮)
- “… ঈশ্বর যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তার চাইতে অধিক বোঝা তিনি তার ওপর চাপিয়ে দেন না।” (সূরা ৬৫ তালাক, আয়াত : ৭)
- “কেউ পরমাণু পরিমাণ সৎ কাজ করলে তা দেখবে ও কেউ পরমাণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে তাও দেখবে।” (সূরা ৯৮ বায়ইয়ানা, আয়াত ৭-৮)
কাদরিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এক শ্রেণীর চরমপন্থী কাদরিয়া আছেন যারা কেবল কর্ম নির্বাচন ক্ষমতা বা ইচ্ছার স্বাধীনতাই নয়; বরং কর্মশক্তির ক্ষেত্রেও মানুষকে সার্বভৌম মনে করেন। এক্ষেত্রে তারা মানুষের সীমাবদ্ধতাকেও যেন ভুলে যান।
পর্যালোচনা
কাদরিয়া সম্প্রদায় ইসলামি দর্শন তথা ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে চরমপন্থী উমাইয়াদের অদৃষ্টবাদী গালগল্প এবং জাবরিয়াদের তাত্ত্বিকভাবে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকারের দর্শনকে মোকাবেলা করার জন্য কাদরিয়াগণ যথেষ্ট সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। দার্শনিক যুক্তিবাদিতার দিক থেকে মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে কাদরিয়াদেরই প্রথম সম্প্রদায় বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। (পি. কে. হিট্টি, আরব জাতির ইতিহাস, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা ১৯৯৯, পৃ. ২৭৭)
ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে কাদরিয়া চিন্তাবিদগণ যে মত দিয়েছেন তা দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে তারা অনেকটা জেহাদী ভূমিকা পালন করেছেন। উমাইয়াদের মুখোশ উন্মোচনে তারা তৎপর হয়েছিলেন। অন্যদিকে দার্শনিক দৃষ্টিতে তারা নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে যুক্তিযুক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেন।
তবে কাদরিয়াদের মধ্যেও চরমপন্থী লক্ষ করা যায়। কোন কোন কাদরিয়া চিন্তাবিদ মানুষের সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে মানুষের কর্মক্ষমতাকে স্বকীয় বলে ঘোষণা করেছেন। অনেকের মতে এটা বাড়াবাড়ি, কেননা তাদের মতে, ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সর্বপ্রকার মানবিক ক্ষমতাই ঈশ্বরের করুণা মাত্র।
কাদরিয়ারা মানুষকে অদৃষ্টবাদ তথা অনপেক্ষ বা চূড়ান্ত (Absolute) নিয়ন্ত্রণবাদের অক্টোপাস থেকে যুক্ত করে ইচ্ছার ও কর্মের স্বাধীনতার কথা বলে মানুষকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছেন। মানুষ যে তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী, তা সুন্দরভাবে কাদরিয়াদের মতবাদে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। তবে কাদরিয়া ও জাবরিয়া উভয় মতবাদই একমুখী ও চরমপন্থি। কাদরিয়া ও জাবরিয়াগণ পরস্পর পরস্পরের বিপক্ষের দালিলিক আয়াতগুলো উপেক্ষা করেছেন। অনেকের মতে, ইসলাম ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কীয় বিতর্কের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করার কথা বলে।
তথ্যসূত্র
- ইসলামি দর্শনের রূপরেখা, ডঃ মোঃ গোলাম দস্তগীর, ডঃ মোঃ শওকত হোসেন, তিথি পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১১
- মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৯
- ইসলামের ইতিহাস পরিক্রমা, মোঃ মাহমুদুল হাছান, মোঃ শামছুল ইসলাম জোহা, গ্রন্থ কুটির, ঢাকা, ২০১৬
Leave a Reply