দক্ষিণ ভারতে কালাভ্র, পল্লব ও চোল আমলের ধর্মীয় ইতিহাস

কালাভ্র রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ৩য় – ৬ষ্ঠ শতক)

কালাভ্রদের ধর্মীয় সম্পৃক্ততা অজানা। পিটারসন তত্ত্ব অনুসারে, কালাভ্ররা শ্রমণ ধর্মগুলিকে (বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, আজিবিক) পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। পিটারসন বলেন, বিশেষ করে কালাভ্ররা জৈন ধর্মের দিগম্বর সম্প্রদায়কে সমর্থন করয়ে থাকতে পারেন এবং “অনুমান করা হয়” তারা বৈদিক-হিন্দুধর্ম ধর্মকে দমন করেছিলেন যা খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীতে তামিল অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।

খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীতে বুদ্ধদত্ত কাবেরী নদীর তীরে বসে বিনয়বিনিক্ষা এবং অভিধন্মাবতারের মতো তার কিছু ম্যানুয়াল লিখেছিলেন। তার লেখা থেকে স্পষ্ট যে, কালাভ্রদের যুগে তামিল অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ঘটে। কালাভ্ররা প্রথম দিকের চোল রাজধানী কাবেরীপট্টিনম ও ভূতমঙ্গলমের মতো জায়গায় বৌদ্ধ মঠ নির্মাণে উৎসাহিত করেছিলেন। বিনয়বিনিচ্চয়ের নিগমনগাথায় বুদ্ধদত্ত বর্ণনা করেছেন যে ভূতমঙ্গলম শহরে কাবেরী নদীর তীরে ভেনহুদাস (বিষ্ণুদাস) নামক একজনের নির্মিত মঠে থাকার সময় তিনি কীভাবে লেখাটি লিখেছিলেন। তিনি তার পৃষ্ঠপোষককে কালাম্ব পরিবারের গর্ব, অমর আক্কুতাভিক্কান্তে (পালিতে Accut’ Accutavikkante Kalambakulanandane) বলে উল্লেখ করেছিলেন। বুদ্ধদত্ত রাজধানী কাবেরিপট্টনমকে খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। তিনি লেখেন, “মনোরম কাবেরীপাট্টানা ছিল পবিত্র পরিবারগুলোর পুরুষ ও মহিলাদের ভিড়ে ঠাসা, সেখানে নদীতে স্ফটিক-স্বচ্ছ জল প্রবাহিত হয়, অঞ্চলটি সমস্ত ধরণের মূল্যবান পাথরে ভরা, এখানে অনেক ধরণের বাজার রয়েছে, একে অনেক বাগান দ্বারা সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে, কাহ্নদাস দ্বারা নির্মিত একটি সুন্দর এবং মনোরম বিহার রয়েছে, আছে কৈলাসের মতো উঁচু প্রাসাদে সজ্জিত এবং বাইরের দেওয়ালে বিভিন্ন ধরণের সুন্দর এন্ট্রেন্স-টাওয়ারও আছে, আমি একটি পুরনো প্রাসাদে থাকতাম এবং এই লেখাটি লিখেছিলাম।”

এফ ই হার্ডির মতে, কালাভদ্রের প্রাসাদ উৎসবগুলো কোন বিষ্ণু বা মায়ন (কৃষ্ণ) মন্দিরের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল। এটি এই তত্ত্বকে সমর্থন করে যে তারা শৈব ও বৈষ্ণব হয়ে থাকতে পারে। তাদের শিলালিপিগুলির মধ্যে হিন্দু দেবতা মুরুগানকে পাওয়া যায়। রাজা অচ্যুত বৈষ্ণব তিরুমালের উপাসনা করতেন। বুদ্ধদত্তের ম্যানুয়াল বিনয়ভিনিচ্চয়ের গান্ধিপদাবমন অনুসারে, অচ্যুত ছিলেন একজন পৃষ্ঠপোষক রাজা, যিনি নারায়ণ উপাধি ধারণ করেছিলেন।

তামিলদের প্রথম দিকের দুটো মহাকাব্য হচ্ছে সিলাপ্পাটিকারাম ও মনিমেকলাই। প্রথমটি জৈন ও পরেরটি বৌদ্ধ। উভয়ই কালাভ্রদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়। পটারসনের মতে, কালাভ্রদের পৃষ্ঠপোষকতারসময় জৈন পণ্ডিতগণ মাদুরাইতে একটি অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করে ও সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ও তামিল ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে তিরুক্কুরাল-এর মত ক্লাসিক রয়েছে যেখানে মাংসভোজনের নিন্দা করা হয়েছে। এটি ছিল হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে জৈনদের রচিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা, কেননা সঙ্গম সাহিত্যে কপিলারের মত ব্রাহ্মণ কবিরা মাংস খেতেন। জৈনরা সেই অ্যাকাডেমিতে বিভিন্ন তামিল মহাকাব্য, ছোট ও বড় স্তোত্রও লিখেছিলেন। পিটারসনের মতে, এই রচনাগুলোর মধ্যে কোন কোনটি তামিল অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মগুলোর লোকেদের মধ্যকার কথোপকথন ও পারস্পরিক সহনশীলতার চিত্রকে তুলে ধরে। অন্যান্য পণ্ডিতেরা আবার এগুলি যে জৈন গ্রন্থ, বা এই গ্রন্থগুলির লেখকরা যারা বেদ, ব্রাহ্মণ, হিন্দু দেবতা এবং দেবীদের প্রশংসা করেন তারা যে জৈন ছিলেন সেই ব্যাপারে একমত নন।

কালাভ্রদের সময়ে যেমন তামিল অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের একটি শক্তিশালী প্রভাব দেখা যায় পল্লব শাসনামলে এসে তা আর দেখা যায়না, এই সময়ে বৌদ্ধধর্মের তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। সেসময় বৌদ্ধধর্ম তামিল অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হতে শুরু করে অন্যদিকে বৈষ্ণব ও শৈবধর্ম সেখানে পুনরুজ্জীবিত হয়। তবে চোলদের সময়ে তামিল অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের কিছুটা পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। অন্যদিকে চোলদের সময়ে বৌদ্ধধর্মের কিছুটা পুনরাগমন দেখা যায়। পরে পাণ্ড্যদের সময় থেকে তাও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

পল্লব রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক – ৮৯৭ খ্রি.)

শুয়েন চাঙ

৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোন এক সময় শুয়েন চাঙ নরসিংহ বর্মার শাসনকালে পল্লব রাজ্য ভ্রমণ করেন। তিনি অবশ্য নরসিংহবর্মার নাম উল্লেখ করেননি, কোনও রাজ নৈতিক তথ্যও পরিবেশন করেননি। চিনা পরিব্রাজক ত-লো-পি-ত নামে যে অঞ্চলের উল্লেখ করেছেন সেটি নিঃসন্দেহে নরসিংহবর্মার রাজ্যভুক্ত তোণ্ডমণ্ডলম বা তোণ্ডৈমণ্ডলম। তার উল্লিখিত কন-চি-পু-লো অবশ্যই পল্লব রাজধানী কাঞ্চীপুরম। কাঞ্চীপুরমের উল্লেখ প্রসঙ্গে শুয়েন চাঙ বলেন, শহরটির পরিধি প্রায় ৩০ লি বা ১.৬৫৪ কি. মি. দশ সহস্রাধিক থেরবাদী শ্রমণ অধ্যুষিত এই শহরটিতে শতাধিক বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছে। শহরের দক্ষিণ সীমান্তের অনতিদূরে অবস্থিত এক বিশাল বৌদ্ধবিহারে বহু বিদ্বজ্জন অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় নিরত। এই বিহারটিকেই সম্ভবত মহেন্দ্রবর্মা তার ‘মত্তবিলাস’ প্রহসনে রাজবিহার নামে উল্লেখ করেছেন। কাঞ্চীপুরম সম্পর্কে চিনা শ্রমণ কিছু কাল্পনিক কাহিনিরও অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন, বুদ্ধদেব প্রায়ই এই শহর পরিদর্শন করতেন, রাজা অশোক বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিতে অনেক স্তূপ নির্মাণ করেছেন। বলা বাহুল্য, এসব তথ্য অনৈতিহাসিক। চিনা শ্রমণ প্রমাদবশত কাঞ্চীপুরমকে এক সামুদ্রিক বন্দররূপে বর্ণনা করেছেন। তোণ্ডমণ্ডলমের অধিবাসীদের সম্পর্কে শুয়েন চাঙের মন্তব্য, লোকেরা সাহসী, বিশ্বাসভাজন, পরোপকারী ও জ্ঞানানুশীলনে আগ্রহী।

শৈবধর্ম

এ পর্বে দক্ষিণ ভারতে শৈবধর্মের বিস্তারে নায়নার সাধকদের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। ঈশ্বরে নিবেদিতপ্রাণ এই সাধকেরা শিবের আরাধনায় ভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করেন। তারা ঘোষণা করেন, ভক্তজনের অতলান্ত ভক্তি বা একনিষ্ঠ অনুরাগেই ঈশ্বর প্রসন্ন হন। ঈশ্বর দয়াময়। ভক্তের বৈদগ্ধ্যে বা পারিবারিক কৌলিন্যে নয়, তার প্রেমের গভীরতায় তিনি আকৃষ্ট হন। ভক্তিই ঈশ্বরের সাযুজ্যলাভের শ্রেষ্ঠতম পথ। অসংখ্য ভক্তিগীতি রচনা ও পরিবেশন করে নায়নার সাধকেরা গ্রাম-গ্রামান্তরে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। শৈব সাধকদের রচিত এই ভক্তি গীতি তামিল সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। পদলালিত্যে, ভারমাধুর্যে ও ঈশ্বরপ্রেম উদ্দীপনে এই গীতি বা স্তোত্রগুলির তুলনা মেলা ভার। খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের প্রারম্ভিক পর্বে শৈব সাধক নম্বি আণ্ডার নম্বি এসব ভক্তিগীতি একাদশ খণ্ডে বিভক্ত তিরুমুরৈ নামক এক বিশাল তামিল স্তোত্রগ্রন্থে সংকলিত করেন। এসব শৈব সাধক ও শিবভক্ত নায়নারদের জীবন-বৃত্তান্ত পরিবেশিত হয়েছে পরবর্তিকালের রচনা পেরিয়পুরাণম গ্রন্থে। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নায়নার সাধকেরা সংখ্যায় ৬৩ জন ছিলেন। চার সহস্রেরও বেশি স্তবক সন্নিবেশিত বৃহদায়তন এই গ্রন্থখানিতে কল্পনা ও বাস্তবের সমন্বয় ঘটেছে। গ্রন্থটিতে উল্লিখিত শৈব সাধকদের অনেকেই সম্ভবত পল্লবপর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন। রাজন্য, অমাত্য, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, বেড়াড় (বেল্লাল) বা কৃষক, মেষচারক বা রাখাল, কুম্ভকার, তাতি, নিষাদ, জেলে, রজক, তিলি, তালরস সংগ্রাহক, হরিজন প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণ ও জাতির লোক ছিলেন এই সাধকেরা। অবশ্য ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ভুক্ত নায়নারেরাই সংখ্যাগুরু ছিলেন। নায়নারদের মধ্যে তিলকবতিয়ার, পুনিতবতিয়ার, মঙ্গৈয়রক্করশিয়ার প্রভৃতি কয়েকজন মহিলা সাধকও ছিলেন।

তিরুমুরৈ সংকলনের প্রথম সাতটি খণ্ড একত্রে তেবারম নামে পরিচিত। এই খণ্ডগুলিতে সম্বন্দর, অপ্পর ও সুন্দরমূর্তি বা সুন্দররের মতো তিনজন প্রখ্যাত নায়নারের রচিত ভক্তিগীতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেড়্ড়া‌র জাতিভুক্ত অপ্পরের প্রকৃত নাম ছিল তিরুনাবুক্করশু। তিনি সম্বন্দর অপেক্ষা বয়সে অনেক বড় ছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ সম্বন্দর নিম্নজাতিভুক্ত এই শিব ভক্তকে শ্রদ্ধাবশত পিতা বলে সম্বোধন করতেন। পিতা কথাটির তামিল প্রতিশব্দ হল অল্প বা অপ্পর। কালক্রমে অঙ্কর নামেই এই শিবভক্ত জনসমাজে পরিচিতি লাভ করেন। তামিল সমাজে একটি প্রবচন সুপ্রচলিত। শিব যেন বলছেন, সম্বন্দরের গান আত্মপ্রশংসাব্যঞ্জক, সুন্দরর অর্থের জন্য আমার ভজন রচনা করেছেন, কিন্তু অপ্পর তার গীতিকবিতায় নিষ্কামভাবে আমার প্রশক্তি গেয়েছেন। ৩৮৪ স্তোত্রে সংকলিত এই সপ্তখণ্ডের তেবারম ‘পদিগল’ নামেও পরিচিত। তেবারম তামিল বেদ নামেও খ্যাত। তামিলনাড়ুর বিভিন্ন শিবমন্দিরে বেদপাঠের সঙ্গে সঙ্গে এ সকল শিবস্তোত্রও নিত্যগীত হয়ে থাকে। তিরুমুরৈ-এর অষ্টম খণ্ড ‘তিরুবাচকম’ অর্থাৎ ‘শ্রীবাক্য’ নামে প্রসিদ্ধ। এই সংকলনের সকল গীতিকবিতা মাণিকবাচকর কর্তৃক রচিত। তামিল শৈবদের নিকট এই সংকলন উপনিষদের পর্যায়ভুক্ত। নবম খণ্ড তিরুইশৈল্পা নামে খ্যাত। এতে বিভিন্ন নায়নারদের রচিত গীতি সন্নিবেশিত হয়েছে। এর কয়েকটি স্তোত্র চোলরাজ প্রথম রাজরাজের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ কণ্ডরাদিত্যের রচনা বলে অনুমিত হয়। দশম খণ্ডটি সিদ্ধযোগী তিরুমূলরের ভক্তিগীতির সংকলন। একাদশ বা সর্বশেষ খণ্ডে সংকলিত হয়েছে নব্বীরর, নম্বি আণ্ডার নম্বি প্রভৃতি সাধকদের রচিত ভক্তিগীতি।

নায়নার সাধকদের মধ্যে তিরুমূলর, অপ্পর, সম্বন্দর, মাণিকবাচকর, সুন্দরর বা সুন্দরমূর্তি ও নব্বীররের নাম সমধিক উল্লেখযোগ্য। তিরুমূলর সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে আবিভূর্ত হন। দশম খণ্ড বা তিরুমন্দিরম সংকলনে তার রচিত তিন হাজার ভক্তিগীতি সন্নিবেশিত হয়েছে। তিনি ভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন আবার ভক্তের মোক্ষলাভের জন্য সদগুরুর প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন। সময়াচার্য অপ্পর আবির্ভূত হন সম্ভবত ৬০০-৮১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি জন্মসূত্রে বেড়্‌ড়াড় বা কৃষিজীবী ছিলেন। অঙ্কুরের মতো সম্বন্দর, মাণিকবাচকর ও সুন্দররও সময়াচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। সম্বন্দরের জীবনকাল আনুমানিক ৬৪৪-৬০ খ্রিস্টাব্দ। বর্ণে ব্রাহ্মণ এই সাধকের কৈশোরেই দেহাবসান হয়। তার পুরো নাম তিরুজ্ঞানসম্বন্দর। এর অর্থ, দিব্যজ্ঞানী মানব। মাণিক্কবাচকরও বর্ণে দ্বিজ ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি জনৈক পাণ্ড্যনৃপতির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু পরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। অনুমিত হয়, তিনি ৯ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বা ১০ম শতকের প্রথম ভাগে আবির্ভূত হন। সময়াচার্য সুন্দরর মাত্র ১৮ বছর জীবিত ছিলেন। তার রচিত কয়েক সহস্র গীতিকবিতার মধ্যে মাত্র এক হাজার ভক্তিগীতি সংরক্ষিত হয়েছে। নিরহঙ্কার এই সাধক নিজেকে সকলের দাস বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি দাস ঈশ্বরের, ভক্ত জনের, ধর্মপিপাসুদের, সর্বজনের। তার জন্ম দক্ষিণ আর্কট জেলায়; আবির্ভাবকাল খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর প্রথমার্ধ। তিনি বর্ণে ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু জাতি বৈষম্য অস্বীকার করেন। তার এক পত্নী স্থানীয় শিবমন্দিরের নর্তকী ছিলেন। অন্য পত্নী বেড়্‌ড়াড় জাতিভুক্ত ছিলেন।

নায়নার সাধকদের ভক্তিবাদ থেকেই কালক্রমে এক বিশেষ মতবাদ গড়ে ওঠে। এই মতবাদ শৈব সিদ্ধান্ত নামে পরিচিত। শৈব সিদ্ধান্তবাদীদের মতে ঈশ্বর যেমন সত্য, তার সৃষ্ট জগৎও সেরূপ সত্য। ঈশ্বর স্বেচ্ছায় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার করেন। সকল প্রকার পরিণাম বা রূপান্তরের উৎস তিনি কিন্তু নিজে পরিণামের অধীন নন। কুম্ভকার যেমন ঘটাদি পাত্র নির্মাণ করেন ঈশ্বরও তেমনি জগৎ সৃষ্টি করেন। মৃত্তিকা যেমন ঘটাদি নির্মাণের উপাদান কারণ, মায়াও তেমনি জগৎ সৃষ্টির উপাদান কারণ। মায়া দু’প্রকার। শুদ্ধ মায়া ও অশুদ্ধ মায়া। আণব ও কর্মের সংস্রবে মায়া অশুদ্ধ মায়ায় পর্যবসিত হয়। ঈশ্বর প্রত্যক্ষভাবে মায়ার ওপর ক্রিয়া করেন না, তিনি চিৎশক্তির মাধ্যমে ক্রিয়া করেন। ঈশ্বর কর্তৃক চালিত হয়ে মায়া নিজ থেকেই তত্ত্বসমূহ সৃষ্টি করে এবং সেই তত্ত্বসমূহ প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটিয়ে জগৎ সৃষ্টি করে।

জীবের মুক্তি আসে ভক্তিপথে। ভক্তিপথের চারটি স্তর। প্রথম স্তর চর্যা। এই পর্যায়ে সাধক নিজেকে ঈশ্বরের দাস মনে করেন, তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করেন। দ্বিতীয় স্তর ক্রিয়া। এই পর্যায়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য নিবিড়তর হয় এবং ভক্ত নিজেকে ঈশ্বরের সৎপুত্ররূপে অনুভব করেন। তৃতীয় বা যোগ পর্যায়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য ঘনিষ্ঠতর হয় এবং ভক্ত ঈশ্বরের সখারূপে অনুভূত হন। সর্বশেষ স্তর জ্ঞান। এই পর্যায়ে ভক্ত পরিপূর্ণতা লাভ করেন, তার শিবত্বে উত্তরণ হয়। শিবত্বে উত্তরণই মুক্তি বা মোক্ষ। প্রথম স্তর সালোক্য, দ্বিতীয় স্তর সামীপ্য, তৃতীয় স্তর সারূপ্য. সর্বশেষ স্তর সাযুজ্য।

এ সময় শিবপত্নী উমা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গারূপেও পূজিত হতেন। বিভিন্ন লেখে নানারূপ ধারিণী পার্বতীর স্তুতি আছে। দেবী দুর্গার সন্তোষ বিধানের জন্য আত্মবলিদান প্রথা প্রচলিত ছিল। বিনায়ক বা গণেশ এবং সুব্রহ্মণ্য বা কার্তিকেয় জনপ্রিয় দেবতারূপে স্বীকৃতি অর্জন করেন। অবস্তীসুন্দরীকথাসারে রাজা রাজসিংহের এক পত্নীর উল্লেখ আছে। তিনি কার্তিকেয়ের উপাসিকা ছিলেন। কম্পবর্মার রাজত্বকালীন মল্লাম প্রস্তরলেখে এক কার্তিকেয় মন্দিরের উল্লেখ আছে।

বৈষ্ণবধর্ম

পল্লবরাজ্যে বৈষ্ণবধর্ম বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ পর্বে নির্মিত বৈষ্ণব মন্দির সংখ্যায় সুপ্রচুর। বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তার মূলে আড়বার বা আঢ়বার সাধকদের অবদান অবিস্মরণীয়। নিমগ্ন অর্থাৎ বিষ্ণুভক্তিরূপ আনন্দসাগরে নিমগ্ন, এই অর্থে আড়বার। বিষ্ণুপ্রেমে আত্মহারা এই সাধকেরা মোক্ষ বা ঈশ্বরের সাযুজ্যলাভে ভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করেন। দর্শন বা জ্ঞানের চোখে নয়, অচলা ভক্তির দৃষ্টিতে তারা তাদের আরাধ্য দেবতাকে ভজনা করেছেন, অনুভব করেছেন। তারা শত শত ভক্তিগীতি রচনা করেছেন। তাদের অনেকেই ছিলেন সুকণ্ঠী, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে তারা সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন, জনমানসে ভক্তিরসের সঞ্চার করেছেন। তারা হৃদয়ঙ্গম করেছেন, বিষ্ণু প্রেমময়, করুণাঘন, তার প্রসন্নতা লাভের জন্য যাগ যজ্ঞ, আচার আচরণ, মন্ত্র-তন্ত্রের প্রয়োজন নেই, ভক্তের একনিষ্ঠ অনুরাগে, তার আত্মনিবেদনে তিনি প্রসন্ন হন, ভক্তের নিকট প্রত্যক্ষীভূত হন।

বৈষ্ণব পরম্পরা অনুসারে আড়বার সাধকগণ খ্রিস্টের জন্মের বহু পূর্বে আবির্ভূত হন। এই পরম্পরায় পোয়কৈ আড়বার (সরোযোগী), ভূতত্তার (ভূতযোগী), পেয়াঢ়বার (মহযোগী বা ভ্রান্তযোগী) এবং তিরুমডিশে (ভক্তিসার) আড়বারদের আবির্ভাবকাল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দে, নম্নাঢ়বার (শঠকোপ), মধুরকবি আড়বার, কুলশেখর আড়বার, তিরুপ্পান আড়বার ও তিরুমসৈ আড়বারের জীবনকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে ধার্য হয়েছে। কিন্তু আড়বারদের আবির্ভাবকাল সম্পর্কে বৈষ্ণব পরম্পরার সাক্ষ্য আধুনিক গবেষকদের নিকট গ্রহণযোগ্যরূপে বিবেচিত হয়নি। তাদের অভিমত, এই সাধকেরা ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। স্পষ্ট প্রমাণ আছে, তিরুমড়িশৈ আড়বার পল্লবরাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মার সমকালবর্তী ছিলেন। তিরুমঙ্গৈ আড়বার ছিলেন দ্বিতীয় নন্দিবর্মার সমকালীন। আড়বারদের সকলেরই জন্ম তামিলনাড়ু ও সন্নিহিত অঞ্চলে। পোয়কৈ আড়বার, ভূতত্তার, পেয়াঢ়বার ও তিরুমড়িশৈ আড়বার পল্লব অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, তোগুরডিগ্লোড়ি আড়বার (ভক্তলখ্রিরেণু), তিরুপ্পান (যোগী বাহন) আড়বার ও তিরুমঙ্গৈ আড়বার চোল ভূখণ্ডে ভূমিষ্ঠ হন, কুলশেখর চের অঞ্চলে জন্ম লাভ করেন এবং নম্মাঢ়বার, আণ্ডাল প্রভৃতি অন্যান্য আড়বারদের জন্ম হয়েছিল পাণ্ড্য অঞ্চলে। এ থেকে অনুমিত হয়, বৈষ্ণব ভক্তিবাদের উন্মেষ ঘটে পল্লব অঞ্চলে, চোল ভূখণ্ডে ভক্তি বাদ বিস্তৃতি লাভ করে আর তিরুনেলভেলিতে এর চরম বিকাশ হয়। তিরুনেলভেলিই ছিল প্রখ্যাত আড়বার নম্মাঢ়বারের কর্মভূমি। বিভিন্ন বর্ণ এবং জাতির লোক ছিলেন ওই আড়বার সাধকেরা। পেরিআড়বার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, কুলশেখরের জন্ম হয় এক অভিজাত রাজপরিবারে। নম্মাঢ়বার ছিলেন বেল্লাল বা কৃষক পরিবারের সন্তান। তিরমঙ্গৈর জন্ম হয়েছিল এক দস্যু পরিবারে। কিন্তু তারা পঙ্কজ, অপাপবিদ্ধ, আপন মাহাত্ম্যে গরীয়ান। তামিল নাড়ু ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বৈষ্ণর মন্দির চত্বরে তাদের প্রতিমা আজও সযত্নে ও সমাদরে রক্ষিত হচ্ছে।

এই দ্বাদশ আড়বারদের একজন মহিলা। সেই মহিয়সী রমণীর নাম আণ্ডাল। আড়বার পেরিআঢ়বারের পালিতা কন্যা তিনি। তিনি নিজেকে কৃষ্ণের এক গোপীরূপে কল্পনা করতেন, প্রেমিকরূপে নির্বাচন করেছিলেন শ্রীরঙ্গম মন্দিরের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা বিষ্ণু রঙ্গনাথকে।

প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক শ্রীনাথমুনি আড়বারদের রচিত ভক্তিগীতিগুলিকে নালায়ির প্রবন্ধম নামে একখানি সুবৃহৎ গ্রন্থে সংকলিত করেন। গ্রন্থখানিতে চার হাজারেরও বেশি ভক্তিগীতি সন্নিবেশিত হয়েছে। গ্রন্থটি চারটি সমখণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডটির নাম তিরুমোড়ি। এই খণ্ডে পেরিআঢ়বার, আণ্ডাল, কুলশেখর, তিরুমড়িশৈ, তোওরডিপ্লোড়ি, তিরুপ্পান ও মধুরকবি রচিত এক হাজার ভক্তিগীতি সন্নিবেশিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ড পেরিঅ তিরুমোড়ি নামে পরিচিত। এই খণ্ডের সবগুলি গীতিকবিতা তিরুমঙ্গৈ রচিত। তৃতীয় খণ্ডের নাম ইয়ল্লা। এই খণ্ডে পোয়কৈ, ভূতত্তার, পেয়াঢ়বার, তিরুমলিশৈ, নম্রাঢ়বার ও তিরুমঙ্গৈর গীতি স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ খগুটি তিরুবায় মোড়ি। নম্মাঢ়বারের গীতি নিয়েই এই খণ্ডটি সংকলিত। পরবর্তিকালে এসব গীতি কবিতার উপর বিস্তর টীকা-টিপ্পনী লেখা হয়েছে। আড়বারদের রচিত সুমধুর ভক্তিগীতি আজও তামিলনাড়ু ও সন্নিহিত অঞ্চলের বৈষ্ণব মন্দিরগুলিতে সমাদরে পরিবেশিত হচ্ছে।

যুগের প্রয়োজনেই ঈশ্বরপ্রেমী নায়নার ও আড়বার সাধকদের আবির্ভাব ঘটেছিল। তখন শঙ্করাচার্য ও তার শিষ্য-প্রশিষ্যরা অদ্বৈতবাদমায়াবাদ প্রচার করছেন, ভক্তিবাদ কুঠারবিদ্ধ। সেই মুহূর্তে ভক্তিবাদের মাহাত্ম্য প্রচার করতে ও জনমানসে ঈশ্বরপ্রেম জাগ্রত করতে নায়নার ও আড়বার সাধকেরা দেবদূতের মতো আবির্ভূত হলেন। আঞ্চলিক ভাষায় সহজ ও সুন্দর ভক্তি মূলক গীতি রচনা ও পরিবেশন করে জনমানসে তারা প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর ভক্তের ভগবানরূপে প্রতিভাত হলেন।

চোল রাজবংশ (৮৪৮-১২৭৯ খ্রি.)

শৈবধর্ম

চোল রাজারা প্রধানত শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন। রাজাদের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় শৈবধর্ম চোলরাজ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এ সময় রাজ্যের বহুস্থানে ছোট বড় অসংখ্য শিবমন্দির নির্মিত হয়। তঞ্জাবুরের রাজরাজেশ্বর এবং গঙ্গৈকোণ্ড চোলপুরমের বৃহদীশ্বর দু’টিই শিবমন্দির। প্রথম রাজরাজ এবং প্রথম রাজেন্দ্রচোল এই শিবমন্দির দু’টি প্রতিষ্ঠা করে চোলরাজ্যে শৈবধর্মের প্রসারের পথ প্রশস্ত করেন। এ সময় চোলরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বহু শৈবমঠও স্থাপিত হয়। এসব মঠে শৈবসাধু-সন্তরা বাস করতেন, ভক্তজনদের সমাগম ঘটত সেখানে। শৈবধর্মের প্রসারে এসব মঠের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। চোল রাজাদের আমন্ত্রণে বহু শৈব আচার্য তামিলনাড়ুতে আগমন করেন ও প্রতিষ্ঠিত হন। প্রথম রাজেন্দ্র গাঙ্গেয় ভূখণ্ড থেকে বহু শৈবাচার্যকে চোলরাজ্যে আনয়ন করেন। শৈবধর্মের প্রচারে এসব শৈবাচার্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শৈবধর্মের প্রচারে নায়নার সাধকেরাও মহত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এই শিবভক্তগণ তাদের মাতৃভাষা তামিলে ভক্তিমূলক গীতি কবিতা রচনা করে তামিলনাড়ুর শহর-গ্রাম-গঞ্জে শিবের মাহাত্ম্য প্রচার করেন।

নায়নারদের রচিত ভক্তিরসাত্মক শিৱস্তোত্র এ সময় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও শৈব শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। মন্দিরে মন্দিরে এই শিবস্তোত্র সুর, তাল ও লয় সহযোগে ভক্তি সহকারে গীত হত। স্তোত্রসঙ্গীত-শিল্পীদের উৎসাহদানের জন্য মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। নম্বি-আণ্ডার-নম্বি একাদশ খণ্ডের এক বৃহৎ সংকলনে শিবস্তোত্রগুলিকে বিন্যস্ত করেন। এই সংকলনে নম্বি-আণ্ডার নম্বির নিজস্ব গীতি এবং করুবৃরদেবরের মতো সাধকদের রচিত সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্তিতে প্রমাণিত হয়, নম্বির তিরোভাবের পরও এই সংকলনের কার্য অব্যাহত থাকে। নম্বির সংকলনে বহু স্তোত্র বাদ পড়ে গেছে। তার আবির্ভাবের পূর্বেই বহু মূল পাণ্ডুলিপি বিনষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছে। সেসব পাণ্ডুলিপির স্তোত্রগুলি চিরতরে অবলুপ্ত হয়েছে।

সমকালীন লেখমালায় শিবযোগী, পাশুপত, কাপালিক, কালামুখ ইত্যাদি বিভিন্ন শৈব সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। শেষোক্ত অতিমার্গিক সম্প্রদায় দু’টি সাধারণত পাশুপত বা লাকুল সম্প্রদায়ের শাখারূপে বিবেচিত হয়। রামানুজ কাপালিকদের সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। এ বর্ণনা তামিলনাড়ুর সমকালীন কাপালিক সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রামানুজের মতে কাপলিকেরা ছয়টি মুদ্রা অঙ্গে ধারণ করেন এবং যোনিদেশে অধিষ্ঠিত পরমাত্মায় চিত্ত নিবিষ্ট করেন। মুদ্রা ছয়টি হল কণ্ঠহার, অলংকার, কুণ্ডল, শিরোমণি, ভস্ম ও যজ্ঞোপবীত। কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটকে কাপালিকদের সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এই নাটকে বলা হয়েছে, কাপালিকেরা নর-অস্থি দিয়ে কণ্ঠহার ও অলংকার নির্মাণ করেন, নরমাংস, কপাল, হৃৎপিণ্ড প্রভৃতি দিয়ে হোমাগ্নি প্রজ্বলিত রাখেন, নরবলি ও নররক্তে দেবতাদের তুষ্টিবিধান করেন, নরকপাল থেকে আহার্য গ্রহণ করেন, মৃতদেহের ভস্মে সর্বাঙ্গ লিপ্ত করেন; দণ্ড ধারণ করেন এবং কারণে (মদ্য) অধিষ্ঠিত ঈশ্বরকে পূজা সমর্পণ করেন। মাধব বিরচিত শঙ্কর-দিগ্বিজয় কাব্যে এক কাপালিক গুরুর সঙ্গে শঙ্করাচার্যের বিতর্কের উল্লেখ আছে। ভবভূতির মালতীমাধবে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈল বা শ্রীপর্বতনিবাসী কাপালিকদের বর্ণনা আছে।

নিবিষ্টচিত্তে শিবের ধ্যানই ছিল শিবযোগীদের ধর্ম-কর্ম। তাদের মতে ধ্যানই হচ্ছে সংসার বন্ধন মোচনের শ্রেষ্ঠ উপায়। তারা যখন অনুভব করতেন মৃত্যু সমাসন্ন, তখন তারা দেহ ভস্মে অনুলেপন করতেন, শিবমন্ত্র আবৃত্তি করতেন, বক্ষদেশে লিঙ্গ স্থাপন করে তার ধ্যানে নিমগ্ন হতেন। লেখে শিবযোগীদের অনুকূলে বহু বৃত্তিদানের উল্লেখ আছে। কালামুখরা মহাব্রতী নামেও পরিচিত। তারা নরকরোটিতে আহার্য গ্রহণ করতেন, সর্বাঙ্গ মৃতদেহের ভস্মে আচ্ছাদিত করতেন, সর্বদা মদ্যপাত্র বহন করতেন। কারণ মধ্যে অধিষ্ঠিত দেবতাকে পূজা নিবেদন করতেন তারা। রামানুজ এই অতিমার্গিক শৈব সম্প্রদায়ের নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের উপর কতিপয় রাজা ও জনসাধারণের একাংশের সহানুভূতি ছিল। তাদের অনুকূলে কয়েকটি মঠ স্থাপিত হয়, তাদের জন্য বৃত্তিরও ব্যবস্থা হয়। উত্তর আর্কট জেলার মেলপাডি গ্রামে এরূপ একটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে মঠের অধ্যক্ষ ছিলেন লকুলীশ্বর পণ্ডিত নামে জনৈক সাধক। তিরুবোররিয়ূর গ্রামে এ ধরনের আর একটি কালামুখ মঠ স্থাপিত হয়। সে মঠের অধ্যক্ষ ছিলেন চতুরানন পণ্ডিত। কেরলের এক বিত্তশালী পরিবারে চতুরাননের জন্ম হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এই ব্যক্তি রাজ দরবারে উচ্চপদ অলংকৃত করেন। কিন্তু শেষে সর্বস্ব ত্যাগ করে সন্ন্যাসজীবন নির্বাচন করেন। ৯৬০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ এক অভিলেখে এই কালামুখ সন্ন্যাসীর জীবন বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। খ্রিস্টীয় নবম, দশম ও ১১শ শতকে কালামুখ সম্প্রদায় তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণ ভারতে বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করে।

চোলপর্বে আরও দু’টি শৈব সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এদের একটি শৈব-সিদ্ধান্তী সম্প্রদায়, অন্যটি আগমান্ত শৈব সম্প্রদায়। শৈব-সিদ্ধান্তীদের পবিত্র শাস্ত্রের নাম সিদ্ধান্তশাস্ত্র। সিদ্ধান্তশাস্ত্র চতুর্দশসংখ্যক। সিদ্ধান্তশাস্ত্র প্রণেতারা সন্তান আচার্য নামে পরিচিত। এই শাস্ত্র মূলত শৈবতত্ত্ব ও দর্শনমূলক। সন্তান-আচার্যগণের মধ্যে চারজন সমধিক প্রসিদ্ধ। তারা হলেন মেকণ্ডদেবর, অরুডুনন্দি, মরই জ্ঞান-সম্বন্দর এবং উমাপতি। এঁদের সময়কাল ১২২৩ থেকে ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দ। মেকণ্ডদেবরের শিবজ্ঞানবোধম, অরুড়নন্দির শিবজ্ঞানসিন্ধিয়ার, মরই-জ্ঞান সম্বন্দরের শৈবসময়নেরি ও উমাপতির শিবপ্রকাশম এই সম্প্রদায়ের চারটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

নায়নার সাধকদের রচিত ভক্তিমূলক শিবস্তোত্রগুলির সঙ্গে সিদ্ধান্তশাস্ত্রের সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। স্তোত্রাবলিতে যেসব দার্শনিক তত্ত্ব সহজ ও সরলভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার এবং অন্যান্য গভীরতর শৈবদর্শনের যুক্তিতর্ক-সমৃদ্ধ ব্যাখ্যাই উপস্থাপিত হয়েছে এসব সিদ্ধান্ত শাস্ত্রে। এই ব্যাখ্যায় বেদান্ত এবং ন্যায়-বৈশেষিক-সাংখ্য দর্শনও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। সিদ্ধান্তবাদীরা পতি, পশু ও পাশ, এই ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করেন, পতি বা ঈশ্বর বা শিব স্বেচ্ছায় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ সাধন করেন। পতি বা ঈশ্বর সকল প্রকার পরিণাম বা রূপান্তরের উৎস কিন্তু নিজে অপরিণামী। ঈশ্বর যেন কুম্ভকার। কুম্ভকার যেমন ঘটাদি নির্মাণ করেন ঈশ্বরও তেমনি জগৎ সৃষ্টি করেন। মৃত্তিকা যেমন ঘটাদি সৃষ্টির উপাদান কারণ, তেমনি মায়া হল জগৎ সৃষ্টির উপাদান কারণ। ঈশ্বর সাক্ষাৎভাবে মায়ার উপর ক্রিয়া করেন না, তিনি চিৎশক্তির মাধ্যমে ক্রিয়া করেন। এভাবে ঈশ্বর কর্তৃক চালিত হয়ে মায়া নিজ থেকেই প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটিয়ে জগৎ সৃষ্টি করে। সিদ্ধান্তিগণ বিশ্বাস করেন, ঈশ্বরের সাযুজ্য লাভ অর্থাৎ মুক্তির জন্য চতুস্তর সাধনার প্রয়োজন। এই স্তর চতুষ্টয় হল চর্যা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞান। এক একটি স্তরে সাধকের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে যথাক্রমে সালোক্য, সামীপ্য, সারূপ্য ও সাযুজ্য লাভ হয়। জ্ঞানমার্গে পূর্ণতালাভের সঙ্গে সঙ্গে সাধকের শিবত্বের উপলব্ধি হয়, তার আত্মার মুক্তি হয়।

আগমান্ত শৈব সম্প্রদায় : খ্রিস্টীয় ১১শ, ১২শ শতক থেকে আগমান্ত শৈব সম্প্রদায় দক্ষিণ ভারতে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আগমান্ত শৈবাচার্যদের আদি নিবাস ছিল গোদাবরী নদীর তীরবর্তী মন্ত্রকালী গ্রাম। এই গ্রামে মন্ত্রকালেশ্বর শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে আমর্দক প্রমুখ চারটি শৈবমঠ স্থাপিত হয়। সে সময় আমদক শৈবমঠের সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই মঠের বহু শাখা স্থাপিত হয়। চোলরা গাঙ্গেয় ভূখণ্ডে বিজয়াভিযানকালে কয়েকজন শৈবাচার্যের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের সসম্মানে চোলরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। অবশ্য এই নবাগত শৈবাচার্যদের তামিলনাড়ুতে আগমনের পূর্ব থেকেই চোলরাজ্যে আগমান্ত শৈবাচার্যদের বাস ছিল। এদের একজন ছিলেন উত্তর ভারতাগত সর্বশিব পণ্ডিত শিবাচার্য। রাজেন্দ্রচোলের পিতা প্রথম রাজরাজ সর্বশির পণ্ডিত শিবাচার্যকে তঞ্জাবুরের বৃহদীশ্বর মন্দিরে প্রধান পুরোহিত পদে নিযুক্ত করেন। রাজরাজের নির্দেশ ছিল, ভবিষ্যতে আর্য, মধ্য ও গৌড়দেশীয় শৈবাচার্যদের শিষ্য-প্রুশিষ্যরাই বৃহদীশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিতপদে অভিষিক্ত হবেন। চোল রাজাদের অনেকেই এই আগমান্ত শৈবাচার্যগণকে ধর্মগুরুর পদে বরণ করেন। এই শৈবাচার্যদের মধ্যে সর্বশিব পণ্ডিত শিবাচার্য ছাড়া অঘোর শিবাচার্য, ত্রিলোচন শিবাচার্য ও নিগম জ্ঞানদের প্রভৃতির নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অঘোর শিবাচার্য রচনা করেন ক্রিয়াকর্মদ্যোতিনী, ত্রিলোচন শিবাচার্য প্রণয়ন করেন সিদ্ধান্তসারাবলী, আর নিগম জ্ঞানদেব রচনা করেন জীর্ণোদ্ধারদশকম। প্রথম গ্রন্থখানি খ্রিস্টীয় ১২শ শতকের রচনা। গ্রন্থ তিনখানি আগমান্ত শৈবদের নিকট প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে স্বীকৃত।

আগমান্ত শৈব সম্প্রদায় বেদ-উপনিষদের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন না, তারা গুরুত্ব আরোপ করেন অষ্টাবিংশতিসংখ্যক আগমশাস্ত্রের উপর। তারা মনে করেন, আগমশাস্ত্র বেদাদি অপেক্ষা পবিত্রতর, শ্রেষ্ঠতর। তাদের যুক্তি, বেদাদির উৎপত্তি হয়েছে, ব্রহ্মের নিঃশ্বাস থেকে (যস্য নিশ্বসিতং বেদাঃ) কিন্তু আগমশাস্ত্র উচ্চারিত হয়েছে স্বয়ং ভগবান মহাদেবের শ্রীমুখ থেকে। মহাদেব পঞ্চবক্ত্র। তার পাঁচটি মুখের নাম সদ্যোজাত, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ ও ঈশান। মহাদেবের এই পাঁচটি মুখ থেকে আটাশটি আগমশাস্ত্র ঘোষিত হয়েছিল বলে আগমান্ত শৈবগণ বিশ্বাস করেন। কামিকাগম, বিজয়াগম, রৌরবাগম, কিরণাগম, বাতুলাগম ইত্যাদি অষ্টাবিংশতি আগমশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। কিংবদন্তি যাই বলুক না কেন, বেশির ভাগ শৈবাগম গ্রন্থ খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের মধ্যে সংকলিত হয়। এগুলি প্রায় নাগরী অক্ষরে কিন্তু তামিল, তেলুগু, কন্নড় প্রভৃতি ভাষায় রচিত। ফলে আগমশাস্ত্র প্রধানত দক্ষিণ ভারতেই রচিত হয়, এরূপ অনুমানই সঙ্গত বোধ হয়।

আগমান্ত শৈবরা জাতিভেদ প্রথা স্বীকার করতেন না। এ কারণে অপরাপর সম্প্রদায় তাদের অপমাগী, নাস্তিক, শূদ্র বলে নিন্দা করতেন। এঁদের প্রতি কুমারিলভট্টের মনোভাবও ছিল অশ্রদ্ধার। সদ্গুরুকরণ ও দীক্ষাগ্রহণ তারা অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করতেন। তারা মনে করতেন, দীক্ষায় যোগ্যতা লাভ করতে হলে সংসার ত্যাগ করতে হবে, দেবীর প্রসাদ পেতে হবে। দেবীর কৃপালাভকে শক্তিপাদম্ বলা হয়েছে।

দীক্ষা ছিল তিন প্রকার সময় দীক্ষা, বিশেষ দীক্ষা ও নির্বাণ দীক্ষা। যারা আধ্যাত্মিকতার পথে অনগ্রসর ছিলেন তাদের জন্যই ছিল সময় ও বিশেষ দীক্ষা। যে শিষ্যরা ছিলেন অগ্রসর তাদের উদ্দেশ্যে ছিল নির্বাণ দীক্ষা। সময় দীক্ষায় দীক্ষিত ব্যক্তিগণ আমৃত্যু প্রত্যহ গুরু ও শিবাগ্নির পূজা করতেন, নিজেদের ঈশ্বরের ভৃত্যরূপে গণ্য করতেন। বিশেষ দীক্ষায় দীক্ষিতরা পুত্রক নামে অভিহিত হতেন, ক্রিয়া ও যোগের অধিকারী ছিলেন তারা। বিশেষীরা দেবপূজার অধিকারী ছিলেন কিন্তু সময়ীরা পুষ্প, পত্র, মাল্যাদি পুজোপকরণ সংগ্রহ করতেন। নির্বাণ দীক্ষায় দীক্ষিতদের সর্বজ্ঞত্ব, পূর্ণকামত্ব, অনাদি জ্ঞান, অপরাশক্তি, পূর্ণ স্বাধীনত্ব প্রভৃতি ঐশী শক্তির অধিকারী বলে মনে করা হত। তারা সর্বপ্রকার পাশ থেকে বিমুক্ত এবং পবিত্রতায় ইষ্টদেবতা শিবেরই প্রায় সমকক্ষ, এরূপও ভাবা হত। আগমান্ত শৈবরা সিদ্ধান্তীদের মতো পতি, পশু ও পাশ, এই ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাস, পতি বা ভগবান শিব কিছু পরিমাণে পশু বা জীবের কর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সৃষ্টিকার্য সম্পাদন করেন। তাদের মতে ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও মলাদি পাশযুক্ত হলেও কর্মনিরপেক্ষ নন। আগমান্ত শৈবদর্শনে মুক্ত জীবের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। মুক্ত জীব বহুলাংশে শিবের স্বারূপ্যযুক্ত। আধ্যাত্মিক শক্তিভেদে পশু বা জীব প্রধানত তিন প্রকার বিজ্ঞানাকল, প্রলয়াকল ও সকল। বিজ্ঞানাকল জীব সর্বোৎকৃষ্ট। এ শ্রেণির জীব আবার দুই প্রকার—সমাপ্তকলুষ ও অসমাপ্তকলুষ। সমাপ্তকলুষ জীব বিদ্যেশ্বর নামে পরিচিত। পাশ চার প্রকার—মল, কর্ম, মায়া ও রোধশক্তি। মল জীবের জ্ঞান ও ক্রিয়া আচ্ছন্ন করে রাখে। ফল কামনাবিশিষ্ট কার্যই কর্ম। জগতের উপাদান কারণের নাম মায়া। বোধশক্তি শিবপ্রদত্ত এক বিশেষ ক্ষমতা। এই ক্ষমতার প্রয়োগে জীব পাশ বা বন্ধন হতে মুক্তি লাভ করে।

আগমান্ত শৈব সম্প্রদায় আচার-অনুষ্ঠানে আস্থাবান। দীক্ষা, মন্ত্রসাধন, পূজা, জপ, হোম, অষ্টসিদ্ধি লাভের নানা প্রক্রিয়া, প্রাণায়াম, ধ্যান, সমাধি, ষটচক্র ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়া তাদের ক্রিয়াকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত (অষ্টসিদ্ধি বলতে বোঝায় অণিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকামা ঈশিত্ব, বশিত্ব ও কামাবসায়িত্ব। কোনও কোনও গ্রন্থে অষ্টসিদ্ধির তালিকায় কামাবসায়িত্বের স্থলে গরিমা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।)। পাশুপত সম্প্রদায় ও সিদ্ধার্থীদের মতো আগমান্ত শৈবরা মনে করেন, জীব ও ঈশ্বর বা জীবাত্মা ও পরমাত্মা পৃথক দু’টি সত্তা; তিন সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করেন, মায়াই জড় জগতের উপাদান কারণ। পাশুপত মতে মুক্ত জীব জ্ঞান ও অলৌকিক কর্মশক্তির অধিকারী এবং শিবের অনুগ্রহে তিনি মহাগণপতিত্ব লাভ করেন। আগমান্ত ও সিদ্ধান্ত শৈবমতে মুক্ত জীব মহাগণপতিত্বের সঙ্গে তার ইষ্টদেবতার সারূপ্যের অধিকারী হন, ইষ্টদেবতার সৃজন শক্তি ছাড়া অপরাপর সকল শক্তিই তার করায়ত্ত হয়।

শুদ্ধশৈব সম্প্রদায় : এ সময় শুদ্ধশৈব সম্প্রদায় নামে আর একটি শৈব সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য। তার সময় সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে মতদ্বৈধ আছে। শুদ্ধশৈব মতবাদে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রভাব পড়েছে। এ কারণে তাকে রামানুজের পরবর্তী বলে মনে করা যায়। তিনি সম্ভবত ১৩শ শতকে আবির্ভূত হন। শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য রচিত ব্রহ্মমীমাংসা বা ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যই এই সম্প্রদায়ের প্রামাণ্য শাস্ত্র। শ্রীকণ্ঠ বলেন, জীবাত্মা ও জড়জগতের আণবিক উপাদানসূমহ ভগবান শিবের চিৎশক্তিবশে তাতেই সঞ্জাত হয় এবং এই শক্তি বলেই তার দ্বারা জগতের সৃষ্টি হয়।

এই মতবাদে ধ্যানের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। শিবই ব্রহ্ম। ধ্যানের মাধ্যমেই তাকে উপলব্ধি করা যায়। শিরোপলব্ধি বা ব্রহ্মোপলব্ধিরই এক নাম ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার। বন্ধনমুক্ত জীব ধ্যান সাধনার প্রথম স্তরে নিরাম্বয় উপাসক নামে পরিচিত হন। ধ্যান সাধনার অগ্রগতির ফলে তিনি ঐশী শক্তির অধিকারী হন। পর্যায়ক্রমে তার ঘটবে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার ও মুক্তি। কর্মসমূহ পরিপক্ক হবার পরই জীবের মুক্তি আসবে।

শৈব ভাস্কর্যের সাক্ষ্য : শৈব ভাস্কর্যের সাক্ষ্যেও এ পর্বে শৈবধর্মের জনপ্রিয়তা প্রমাণিত। এ পর্বে শিবের বিভিন্নরূপী বহু মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। চোলযুগের বিভিন্ন শিবপ্রতিমার মধ্যে রয়েছে কিরাতাজুনীয়, ভিক্ষাটন, কল্যাণসুন্দর, উমা সহিত, নটরাজ, দক্ষিণামূর্তি, লিঙ্গপুরাণদেব, পঞ্চদেহা ও শ্রীকণ্ঠমূর্তি। তত্ত্বাবুর ও গঙ্গৈকোও চোলপুরমের বৃহদীশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে বিশাল আয়তনের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। বোঝা যায়, এ সময় শিবলিঙ্গই পূজার মুখ্য বস্তু ছিল, শিবের মনুষ্কমূর্তি ছিল গৌণ।

বৈষ্ণবধর্ম

চোলরাজ্যে জনপ্রিয়তায় শৈবধর্মের পরই ছিল বৈষ্ণবধর্মের স্থান। এ সময় বহু সংখ্যক বিষ্ণুমন্দির নির্মিত হয়। প্রথম রাজরাজের ভগিনী কুন্দবৈ (কুন্দবা) এরূপ একটি বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি রাজরাজপুরম বা আধুনিক দাদাপুরমে অবস্থিত ছিল। শ্রীরঙ্গমের সুবিখ্যাত রঙ্গনাথস্বামী মন্দির এ পর্বেই নির্মিত হয়।

আড়বার সাধকদের রচিত ভক্তিরসাত্মক বিষ্ণুস্তোত্রাবলি জনমানসে বিষ্ণুপ্রেমের উন্মাদনা সঞ্চার করে। সমকালীন লেখমালার সাক্ষ্যে আছে, বৈষ্ণব লিতে এসব সঙ্গীত নিয়মিত পরিবেশিত হত। খ্রিস্টীয় ১১শ শতকে আচার্য নাথমুনি বা রঙ্গনাথাচার্য এই বিষ্ণুস্তোত্র গুলিকে চারটি খণ্ডে সংকলিত করেন। প্রতি খণ্ডে রয়েছে কিঞ্চিদধিক এক সহস্র স্তোত্রের সংকলন। সমগ্র সংকলনটি নালাইর প্রবন্ধম নামে পরিচিত। নাথমুনি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের প্রারম্ভে বীরনারায়ণপুর বা বর্তমান মন্নরগুড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় শ্রীরঙ্গমে অতিবাহিত হয়। তিনি আড়বারদের রচিত ভক্তিস্তোত্রগুলিকে মূল ভিত্তিরূপে গ্রহণ করে ঔপনিষদিক তত্ত্বের সাহায্যে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। তার রচিত গ্রন্থখানি ন্যায়তত্ত্ব নামে প্রসিদ্ধ। গ্রন্থখানি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। নাথমুনির ধর্মমতকে কেন্দ্র করে এক নতুন বৈষ্ণব ধর্মসম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। এই সম্প্রদায় শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায় নামে খ্যাত। নাথমুনি বৈষ্ণবধর্মে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন। তারই প্রতিষ্ঠিত শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায় তার পৌত্র যামুনাচার্য ও তদ্‌পরবর্তী আচার্য রামানুজের ঐকান্তিক প্রয়াসে এক শক্তিশালী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।

রামানুজ খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীর প্রথম পাদে জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর ও যুবা বয়সে তিনি কাঞ্চীপুরমে বাস করতেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন অদ্বৈতবাদী দার্শনিক যাদবপ্রকাশের শিষ্য। কিন্তু গুরু-কৃত শাস্ত্রব্যাখ্যা তার বিশেষ মনঃপুত না হওয়ায় তিনি যামুনাচার্যের শিষ্য মহাপূর্ণের নিকট শ্রীবৈষ্ণবমতে দীক্ষিত হন। যামুনাচার্যের তিরোধানের পর তিনি শ্রীরঙ্গমে আসেন এবং পরমগুরুর অভিপ্রায় অনুসারে সম্প্রদায়ের আচার্য পদ গ্রহণ করেন। শ্রীবৈষ্ণব ধর্মের উন্নতি ও সম্প্রসারণেই তার বাকি জীবন অতিবাহিত হয়। তিনি বেদান্তসার, বেদার্থ-সংগ্রহ ও বেদান্ত-দীপ নামে তিনখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং ব্রহ্মসূত্র ও ভগবদ্গীতার উপর প্রামাণ্য ভাষ্য রচনা করেন। দীর্ঘজীবী ছিলেন রামানুজ। তার জন্ম আনুমানিক ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে, তিরোধান আনুমানিক ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে।

রামানুজ পুরুষোত্তম বা বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রীবৈষ্ণবধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করেন। শঙ্কর বলেছিলেন, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, তিনি ঘোষণা করেছিলেন, জীবই ব্রহ্মা, উপাস্য-উপাসকে ভেদ নেই। কিন্তু ৰামানুজ বলেন, ব্রহ্ম যেমন সত্য, জীব ও জগৎও সমান সত্য। তার মতে জীব ও ব্রহ্ম্যে স্বরূপগত ভেদ নেই, আছে স্বগত ভেদ। জীব উপাসক, ব্রহ্ম উপাস্য। মুক্ত জীব ও ব্রহ্ম ভিন্নাভিন্ন, মুক্ত জীব পুরুষোত্তমের দাস, সেবক, ব্রহ্মসদৃশ। রামানুজ মনে করেন, জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক অনেকটা বৃক্ষ এবং তার শাখা-প্রশাখা ও পত্র-পুষ্পের সম্পর্কের মতো। কোনও বৃক্ষের শাখা প্রশাখা পত্র-পুষ্প, সেই বৃক্ষ নিরপেক্ষ নয়। তারা বৃক্ষেরই অংশ, বৃক্ষের সত্তার উপরই তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে। অথচ শাখা-প্রশাখা, পত্র-পুষ্প প্রভৃতিকে বৃক্ষ বলা যায় না। সুতরাং বৃক্ষ ও তার অংশ স্বরূপ শাখা-প্রশাখা ইত্যাদি বৃক্ষ থেকে ভিন্ন ও অভিন্ন দুই-ই। শঙ্করের মতে, শুদ্ধ জ্ঞানই মুক্তির উপায়। কিন্তু রামানুজের মতে, শুধু শুদ্ধ জ্ঞান মোক্ষের উপায় নয়, মোক্ষের জন্য ভক্তিরূপ জ্ঞান একান্ত আবশ্যক। তাছাড়া, মুক্তির জন্য পুরুষোত্তমের শরণ, গুরুর আশ্রয় ও ঈশ্বর কৃপাও চাই। চাই পুরুষোত্তমের পাদপদ্মে পরিপূর্ণ আত্মনিবেদন ও তার শরণ বা প্রপত্তি।

রামানুজ ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর বা বিষ্ণুর একটি রূপও কল্পনা করেছেন। বিষ্ণু চতুর্ভুজ, শঙ্খ-চক্র গদা-পদ্মধারী। তার ভীষণ ও মধুর দুই রূপ। মধুররূপে তিনি লক্ষ্মীর সান্নিধ্যে বৈকুণ্ঠে বিহার করেন। ভক্তবৎসল নারায়ণ ভক্তের সভক্তি তুলসীপত্র ও জল নিবেদনেই সন্তুষ্ট হন। ভক্তের রক্ষার জন্যই তিনি ভীষণরূপে অসুর বা পাপীর বিনাশ করেন।

বড়কলই ও তেনকলই : রামানুজের তিরোভাবের পর সম্ভবত ১৩শ শতকে শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায় দু’টি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়। তামিল ভাষায় এ দু’টি ভাগের নাম বড়কলই (উত্তর দেশীয় বিদ্যা) এবং তেনকলই (দক্ষিণদেশীয় বিদ্যা)। এ দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য দু’টি উপমার সাহায্যে বোঝানো যায়। বড়কলই শ্রীবৈষ্ণদেবের অভিমত, মর্কটশাবক যেমন তার মাতৃবক্ষ প্রাণপণে আশ্রয় করে থাকে এবং তার মা অনায়াসে শাখা থেকে শাখান্তরে লাফ দিলেও শাবক মাতৃবৃক্ষ থেকে বিচ্যুত হয় না, ভক্ত তেমনি প্রাণপণে ঈশ্বরকে অবলম্বন করলেই ঈশ্বর তার মোক্ষসাধন করেন। ভক্তের মোক্ষলাভের এই পথ মর্কট-ন্যায়। তেনকলই শ্রীবৈষ্ণবগণ মর্কট ন্যায়ের যৌক্তিকতা স্বীকার করেন না। তারা বলেন, এতে জীবের প্রতি পরমেশ্বরের অশেষ করুণা ও অপার মহিমার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। তাদের অভিমত, মার্জার শাবককে তার মা মুখে করে স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে যায়। এ সময় শাবকটি সম্পূর্ণরূপে তার মায়ের উপর নির্ভর করে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকে। সেরূপ ভক্তও ঈশ্বরের নিকট একান্তভাবে আত্মনিবেদন করে তার প্রপন্ন বা সম্পূর্ণ শরণাগত হবেন। ঈশ্বর নিজ করুণা ও মহিমায় তার প্রপন্ন ভক্তের মুক্তি সাধন করবেন। এ পথ মার্জার-ন্যায় বা প্রপত্তিমার্গ।

জৈনধর্ম

চোলরাজ্যে জৈনধর্ম যথেষ্ট সমাদৃত ছিল। রাজন্যবর্গ ও জনসাধারণ এ ধর্মের পৃষ্ঠ পোষকতা করেছেন। জৈনসংঘ ও সাধুদের অনুকূলে এ সময় বহু জমি পল্লিচ্চন্দমরূপে প্রদত্ত হয়। প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালীন উদয়েন্দিরম তাম্রশাসনে দিগম্বর সাধুদের অনুকূলে ২ পট্টি পরিমাণ জমি পল্লিচন্দমরূপে দানের উল্লেখ আছে। প্রথম রাজরাজের রাজত্বকালে দক্ষিণ আর্কট জেলায় অবস্থিত একটি জৈন বিহারকে জমি প্রদান করা হয়। জৈনসংঘের অনুকূলে আরও জমি প্রদানের উল্লেখ আছে সমকালীন লেখে। তৎকালীন একটি লেখে দক্ষিণ আর্কট জেলায় একটি পার্শ্বনাথ মন্দিরের কথা আছে। সে মন্দিরে নিয়মিত জৈনশাস্ত্র আলোচিত হত। প্রথম পরাস্তকের রাজত্বকালে তিরুপ্পানমলৈতে একটি জৈন উপনিবেশ গড়ে ওঠে। জৈন সন্ন্যাসিনীদের বসবাসের জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামে একটি বাসগৃহ নির্মিত হয়। প্রথম রাজরাজের ভগিনী কুন্দবৈ (কুন্দরা) তিরুমলৈ (উত্তর আকর্ট জেলা), তিরুমলবাড়ি, (তিরুচিরাপল্লী জেলা) ও দাদাপুরমে তিনটি জৈন মন্দির নির্মাণ করেন।

চোলরাজ্যভুক্ত কর্ণাটকের বহু স্থানে প্রাচীন জৈন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নিদর্শনগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে ১৩শ শতকীয়। কাঞ্চীপুরমের উপকণ্ঠে আজও একটি প্রাচীন জৈন মন্দির দৃষ্টিগোচর হয়।

তৎকালীন যুগের জৈন সাধ্বীদের মধ্যে যে কখনও কখনও বিরোধ দেখা দিত, তার উল্লেখ আছে একটি লেখে। সাধ্বীরা উত্তর আর্কট জেলার বেডাল গ্রামে অবস্থিত জৈনসংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক পক্ষে ছিলেন জনৈকা সাধ্বী ও তার অনুগামী পাঁচশো শিষ্যা। অন্য পক্ষে ছিলেন সংঘের পাঁচশো সন্ন্যাসিনী। শেষে স্থানীয় উপাসকদের হস্তক্ষেপে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়।

বৌদ্ধধর্ম

চোললেখে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ অপেক্ষাকৃত কম। তবু চোলরাজ্যে বৌদ্ধধর্মের একটা প্রতিষ্ঠা ছিল। বৃহত্তর লাইডেন তাম্রশাসনে শৈলেন্দ্ররাজ চূড়ামণিবর্মা এবং মারবিজয়োত্তুঙ্গ বর্মার নাগপট্টিনমে প্রথম রাজরাজের অনুমোদনক্রমে একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণের উল্লেখ আছে। রাজরাজের রাজত্বের একবিংশ বৎসরে এই বিহারটি নির্মিত হয়। প্রথমোক্ত শৈলেন্দ্ররাজের নামানুসারে শৈলেন্দ্রচূড়ামণিবর্মবিহার নামে বিহারটির নামকরণ হয়। চোলরাজ এই বিহারের অনুকূলে আনৈমঙ্গলম নামে একটি গ্রাম দান করেন। ক্ষুদ্রতর লাইডেন তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, পরবর্তিকালে সমকালীন শৈলেন্দ্রনৃপতির অনুরোধে প্রথম কুলোত্তুঙ্গ এই বিহারের অনুকূলে আরও জমি দান করেন। জনশ্রুতি আছে, তিরুমঙ্গৈ আড়বার শ্রীরঙ্গমের বঙ্গনাথস্বামী মন্দির নির্মাণকল্পে এই বৌদ্ধবিহার থেকে বুদ্ধদেবের একটি সুবর্ণমূর্তি অপহরণ করেন। কাঞ্চীপুরমে বৌদ্ধধর্মের অনেক প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। অনুমিত হয়, চোলপর্বে এখানে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ বাস করতেন। মালাবার উপকূলবর্তী শ্রীমূলবাসম বৌদ্ধধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।

চোল আমলে ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য

সমকালীন ধর্মীয় জীবনের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য তখনকার দিনে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। রাজারাও ধর্ম বিষয়ে উদার মনোভাব পোষণ করতেন, বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি তারা ছিলেন সশ্রদ্ধ। সকল ধর্মেরই তারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। প্রথম রাজরাজ তঞ্জাবূরের বৃহদীশ্বর মন্দিরগাত্রে শৈবধর্মের পাশাপাশি বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু দৃশ্য উপস্থাপিত করেছেন। রাজরাজের ভগিনী কুন্দবৈ (কুন্দবা) রাজরাজপুরমে শৈব, বৈষ্ণব ও জৈন সম্প্রদায়ের জন্য তিনটি পৃথক মন্দির নির্মাণ করেন, মন্দির তিনটির অনুকূলে তিনি বহু জমিও দান করেন। সে সময়কার বহু দেবায়তনে যুগপৎ শিব ও বিষ্ণুমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। চিদম্বরমের মন্দিরে বিষ্ণুপ্রতিমার উপস্থাপনা এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য।

ধর্মীয় সংঘর্ষ যে হত না তা নয়, তবে তা সচরাচর ঘটত না। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার একটি ঘটনার উল্লেখ আছে ১১৬০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ একটি লেখে। লেখটি থেকে জানা যায়, একবার এক মহাসভা নির্দেশ জারি করে, যে মাহেশ্বর বা শৈব বৈষ্ণবদের সংস্পর্শে আসবেন তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। দ্বিতীয় কুলোত্তুঙ্গ একজন গোড়া শৈব ছিলেন। তিনি চিদম্বরমের মন্দির থেকে বিষ্ণুমূর্তি অপসারণে সচেষ্ট হন। বৈষ্ণব আচার্য রামানুজও জনৈক চোলরাজের হাতে নিগৃহীত হন। এসব ছিল নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

তীর্থযাত্রা ধর্মের অঙ্গরূপে বিবেচিত হত। দেবস্থান ও আড়বার নায়নারদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে নিয়মিত ভক্তজনের সমাগম হত। ধার্মিক ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ তীর্থযাত্রীদের আহার ও বাসস্থানের সংস্থানের জন্য বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

এ সময় বৈদিক যাগ-যজ্ঞ অপেক্ষা মন্দির-মঠ প্রতিষ্ঠা ও দান-ধ্যানের প্রতিই লোকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। সমকালীন লেখে বৈদিক যাগযজ্ঞের উল্লেখ স্বল্প, পক্ষান্তরে মন্দির-মঠের অনুকূলে জমি ও মূল্যবান সামগ্রী দানের উল্লেখ সুপ্রচুর। প্রথম রাজরাজ তার রাজত্বের ২৯ বছরে বৃহদীশ্বর মন্দিরের অনুকূলে প্রচুর স্বর্ণ ও বহুমূল্য অলংকার দান করেন। যে স্বর্ণ তিনি দান করেন তা ওজনে ৪১,৫০০ কলঞ্জু ছিল। তখন প্রতি কলঞ্জুর ওজন ছিল আনুমানিক ৬৮-৭২ গ্রেন। (K. A. Nilakanta Sastri, The Colas, পৃষ্ঠা ৬২৪)। যে অলংকার প্রদত্ত হয় তার মূল্য ছিল ১০,২০০ সুবর্ণ কাশু মুদ্রা। এই মন্দিরের অনুকূলে তিনি যে বিশাল ভূখণ্ড দান করেন তা তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকে তো বটেই, এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও বিস্তৃত ছিল। শুধু রাজা-মহারাজেরা নন, সাধারণ ব্যক্তিও দানাদি কার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

চোলদের পর পাণ্ড্যদের আমল (৫৬০-১৬১৮ খ্রি., ইম্পেরিয়াল পাণ্ড্য ১৩শ-১৪শ শতক) শুরু হয়। এই ইম্পেরিয়াল পাণ্ড্যদের সময়কালকে মন্দির-কেন্দ্রিক অভিজাত ঘরানার হিন্দুধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা একটি জনপ্রিয় ভক্তিবাদী ধর্ম ছিল, সেই সাথে হিন্দুধর্মের একটি স্থানীয় আকারও এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল। এই সময়ে হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তির মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত ছলনা। অভিজাতগণ সাধারণত বিষ্ণু ও শিবের পূজার পৃষ্ঠপোষণ করতেন। ভক্তিবাদী আন্দোলন ভগবান ও ভক্তের মধ্যকার গভীর ও পারস্পরিক আবেগীয় সম্পর্কে জোর দেয়। পাণ্ড্য অঞ্চলে মাদুরাই এর মীনাক্ষি মন্দিরের মত অনেক পরিচিত মন্দির ছিল। মন্দিরগুলোই ছিলদেশটির অন্যতম বৃহত্তম এমপ্লয়ার ও ল্যান্ডওউনার, তাই মন্দিরগুলো তামিল অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল। মন্দিরগুলোই সাধারণত ব্যাংক, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় ও গরিবদের থাকার জায়গা হিসেবে কাজ করত, আর এভাবে এগুলো বিভিন্ন রকম সামাজিক ফাংশনে জড়িত ছিল। পাণ্ড্য রাজবংশের বড় বড় দেয়ালযুক্ত টেম্পল কমপ্লেক্সগুলোতে বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যালয় ও বাজার থাকত। পাণ্ড্যদের মধ্যে হিন্দুধর্মই প্রধান হলেও কোন কোন পাণ্ড্যরাজারা কিছু কালের জন্য জৈনধর্ম পালন করেছিল।

তথ্যসূত্র

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে, ২য় খণ্ড, সাহিত্যলোক, ২০১৯
  • ডঃ এম মতিউর রহমান, ডঃ রমা চৌধুরী-র বেদান্ত দর্শন
  • উইকিপিডিয়ার সংশ্লিষ্ট নিবন্ধসমূহ

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.