Table of Contents
ভূমিকা
বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে উদ্ভুত হয়, এরপর সেখানে এর প্রসার ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে, আর প্রায় খ্রিস্টীয় ১২শ শতকে ভারতে এর সমাপ্তি ঘটে। লার্স ফগেলিনেরমতে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের এহেন বিলুপ্তি কোন একক কারণে ঘটেনি, বরং এটি ঘটেছিল কয়েক শতক ব্যাপী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। বৌদ্ধ ধর্মের পতনের জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হয়েছে, বিশেষ করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৩২০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) অবসানের পরে ভারতের আঞ্চলিকীকরণ এর একটি অন্যতম কারণ ছিল, যার ফলে ভারতীয় রাজবংশগুলি হিন্দু ব্রাহ্মণদের পরিষেবার দিকে ঝুঁকে পড়ে, আর তার ফলে বৌদ্ধ ধর্ম তার পৃষ্ঠপোষকতা এবং অনুদান হারায়। আরেকটি কারণ ছিল হুন, শ্বেতহুন, মুসলিম তুর্ক-মঙ্গোল, আরব ও পারস্যের মতো বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা উত্তর ভারতে আক্রমণ এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংস এবং ধর্মীয় নিপীড়ন। হিন্দুধর্ম এবং পরবর্তী ইসলামের সাথে ধর্মীয় প্রতিযোগিতার ব্যাপারটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। বাংলার ইসলামিকরণ এবং মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি দ্বারা বিক্রমসিলা এবং ওদন্তপুরী ধ্বংসের মাধ্যমে দিল্লি সালতানাতের সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলনকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করেছেন বলে মনে করা হয়, যেখানে পূর্বে পাল সাম্রাজ্য সহ বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে বৌদ্ধধর্ম শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। ২০১০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে মোট বৌদ্ধ জনসংখ্যা – শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ভুটান ব্যতীত – প্রায় ১০ মিলিয়ন ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৭.২% বাংলাদেশে, ৯২.৫% ভারতে এবং ০.২% পাকিস্তানে বাস করত।
বৌদ্ধধর্মের বৃদ্ধি
বুদ্ধের মৃত্যুর পরবর্তী কয়েক শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়, বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে অশোকের অধীনে মৌর্য সাম্রাজ্যের সমর্থন ও রাজকীয় সমর্থন পাওয়ার পর এটির বিপুল প্রসার ঘটে। এমনকি এটি ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে মধ্য এশিয়া এবং চীনেও ছড়িয়ে পড়ে। বুদ্ধের যুগে শুধু নগরায়নই নয়, কেন্দ্রীভূত রাজ্যগুলির সূচনাও হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মের সফল সম্প্রসারণ সেই সময়ের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির উপর নির্ভর করেই হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ছাড়াও পরিবর্তনে সক্ষম বর্ধিত কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক সংগঠনগুলিও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে সহায়ক ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম প্রাচীন ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন অব্যাহত ছিল। সন্ন্যাসী সংগঠনের একীকরণ বৌদ্ধ ধর্মকে ভারতের ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পর কণ্ব রাজবংশে চারজন বৌদ্ধ রাজা ছিলেন।
গুপ্ত বংশ (খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতক)
ধর্মীয় উন্নয়ন : গুপ্ত রাজবংশের সময় (৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দী) মহাযান বৌদ্ধধর্ম আরও আচার-অনুষ্ঠানমূলক হয়ে ওঠে, অন্যদিকে বৌদ্ধ ধারণাগুলি হিন্দু স্কুলগুলো কর্তৃক গৃহীত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে পার্থক্য ঝাপসা হয়ে যায়, এবং ব্রাহ্মণরা রাষ্ট্রের সাথে একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তুললে বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম এবং অন্যান্য হিন্দু ঐতিহ্য ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থা বাড়ার সাথে সাথে বৌদ্ধ মঠগুলি ধীরে ধীরে ভূমি রাজস্বের নিয়ন্ত্রণ হারায়। সমান্তরালভাবে, গুপ্ত রাজারা কুশিনগরে বৌদ্ধ মন্দির এবং নালন্দার মতো সন্ন্যাসী বিশ্ববিদ্যালয় বা বিহারগুলি নির্মাণ করেছিলেন, যা ভারতে তিনজন চীনা দর্শনার্থীর রেখে যাওয়া রেকর্ড দ্বারা প্রমাণিত।
হুন আক্রমণ (৬ষ্ঠ শতাব্দী) : ফা হিয়েন, জুয়ানজাং, ইজিং, হুই-শেং এবং সুং-ইউনের মতো ৫ম থেকে ৮ম শতাব্দীর মধ্যে এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকারী চীনা পণ্ডিতরা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বৌদ্ধ সংঘের পতনের কথা বলতে শুরু করেন, বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া থেকে হুন আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে। জুয়ানজাং লিখেছিলেন যে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অসংখ্য মঠ হুনরা ধ্বংস হয়ে গেছে। হুন শাসক মিহিরাকুলা উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং উত্তর ভারত) ৫১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শাসন করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মকেও দমন করেছিলেন। তিনি আধুনিক প্রয়াগরাজের মতো দূরবর্তী মঠগুলি ধ্বংস করেছিলেন। যশোধর্মন এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসকরা, প্রায় ৫৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং পরে, মিহিরাকুলার অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং মিহিরাকুলা যুগের সমাপ্তি ঘটান। পিটার হার্ভের মতে, ৭ম শতাব্দীতে এই আক্রমণ থেকে ধর্ম ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হয়, “দক্ষিণ পাকিস্তানের বৌদ্ধ ধর্ম শক্তিশালী থাকে”। পাল রাজবংশের রাজত্বকালে (৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী) নালন্দার মতো বিভিন্ন বৌদ্ধ কেন্দ্রকে সমর্থনকারী পালদের রাজকীয় সমর্থনের কারণে উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম পুনরুদ্ধার করতে দেখা যায়। কিন্তু, ১১শ শতাব্দীর মধ্যে পাল শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
সমাজ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ধর্মীয় প্রতিযোগিতা
গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৩২০-৬৫০ হ্রি.) সমাপ্তির পর ভারতের আঞ্চলিকীকরণের ফলে বৌদ্ধ ধর্মে পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুদানের ক্ষতি হয়। এ এল বাশামের ক্লাসিক স্টাডিতে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বলা হয়, ধর্মটির পতনের মূল কারণটি ছিল একটি প্রাচীন হিন্দু ধর্মের উত্থান, যা শিব এবং বিষ্ণুর মতো দেবতাদের উপাসনার উপর মনোনিবেশ করেছিল ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম মঠের জীবনে মনোনিবেশ করার ফলে তা সাধারণ মানুষের জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেই সাথে ধর্মটি সাধারণ মানুষের রিচুয়ালগুলো থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল, যা তখন খালি হিন্দু ব্রাহ্মণরাই নিয়ন্ত্রণ করত।
ধর্মীয় প্রতিযোগিতা
হিন্দুধর্মের নতুন রূপের বৃদ্ধি (এবং কিছুটা হলেও জৈন ধর্ম) ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের একটি মূল উপাদান ছিল, বিশেষত বৌদ্ধ মঠগুলিকে লেইটি (সাধারণের অনুদান) এবং রয়্যালটি (রাজকীয়দের অনুদান) থেকে আর্থিক সহায়তা হ্রাস করার ক্ষেত্রে। কানাই হাজরার মতে, ব্রাহ্মণদের উত্থান এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের প্রভাবের কারণে বৌদ্ধ ধর্ম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। রান্ডাল কলিন্স, রিচার্ড গম্ব্রিখ এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে, বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান বা পতন ব্রাহ্মণ বা বর্ণব্যবস্থার সাথে যুক্ত নয়, যেহেতু বৌদ্ধ ধর্ম “বর্ণব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল না”, কিন্তু যারা এর সন্ন্যাসী ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছিল ব্রাহ্মণরা তাদের পরিত্রাণের লক্ষ্যে ছিল।
কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বিভাজনের ফলে ধর্মীয়তা এবং ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঞ্চলিকীকরণও হয়েছিল। হিন্দুধর্মের মধ্যে শৈবধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, ভক্তি ও তন্ত্রে গ্রামীণ ও ভক্তিমূলক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, সেইসাথে বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের অসংখ্য সম্প্রদায়ের সাথে ও। সামন্ততান্ত্রিক রাজ্যে ক্ষমতার এই বিভাজন বৌদ্ধ ধর্মের জন্য ক্ষতিকারক ছিল, কারণ রাজকীয় সমর্থন অন্যান্য সম্প্রদায়ের দিকে স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং ব্রাহ্মণরা ভারতীয় রাজ্যগুলির সাথে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে ৭ম ও ৮ম শতাব্দীর পরে উদ্ভূত নতুন ভারতীয় রাজবংশগুলি হিন্দুধর্মকে সমর্থন করার দিকে ঝুঁকেছিল, এবং এই ধর্মান্তরণ নির্ণায়ক প্রমাণিত হয়েছিল। এই নতুন রাজবংশগুলির সবগুলোই হিন্দুধর্মকে সমর্থন করেছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে “উত্তরের কার্কোটা ও প্রতিহারা, দাক্ষিণাসিকরাষ্ট্র, এবং দক্ষিণের পাণ্ড্য ও পল্লব” (পাল রাজবংশ এগুলির একমাত্র ব্যতিক্রম)। এই ধর্মান্তরণের অন্যতম কারণ ছিল ব্রাহ্মণরা স্থানীয় প্রশাসনে সহায়তা করতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম ছিল এবং তারা কাউন্সিলার, প্রশাসক এবং ক্লারিক্যাল কর্মী সরবরাহ করেছিল। উপরন্তু, ব্রাহ্মণদের সমাজ, আইন এবং রাষ্ট্রশিল্প সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল (এবং অর্থশাস্ত্র এবং মনুস্মৃতির মতো গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন) এবং তারা বৌদ্ধদের চেয়ে বেশি বাস্তববাদী হতে পারতেন, যেখানে বৌদ্ধদের ধর্ম সন্ন্যাস ও ত্যাগের উপর ভিত্তি করে ছিল এবং তাদের এমন কোন বিশেষ যোদ্ধা শ্রেণী ছিলনা যা প্রয়োজনে সহিংসতাকে ন্যয্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। জোহানেস ব্রঙ্কহোর্স্ট যেমন উল্লেখ করেছেন, বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের প্রতিক্রিয়ায় “খুব কম” ব্যবহারিক পরামর্শ দিতে পারে এবং বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি প্রায়শই রাজা এবং রাজকীয়তা সম্পর্কে খারাপ কথা বলে। ব্রঙ্কহোর্স্ট উল্লেখ করেছেন যে ব্রাহ্মণদের কিছু প্রভাব এই সত্য থেকে উদ্ভূত যে তাদেরকে শক্তিশালী হিসাবে দেখা হয়েছিল, কারণ তাদের ইনক্যান্টেশন এবং মন্ত্র এবং সেইসাথে জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র, ক্যালেন্ড্রিক্স এবং ডিভাইনেশনের মতো অন্যান্য বিজ্ঞানের ব্যবহার। অনেক বৌদ্ধ এই ধরনের “বিজ্ঞান” ব্যবহার করতে অস্বীকার করে এবং সেগুলোকে ব্রাহ্মণদের উপর ছেড়ে দেয়, ফলে ব্রাহ্মণরাই ভারতীয় রাজ্যগুলির (পাশাপাশি কম্বোডিয়া এবং বার্মার মতো জায়গায়) বেশিরভাগ আচার অনুষ্ঠানও সম্পাদন করে।
লার্স ফোগেলিন যুক্তি দেখান যে নালন্দার মতো বড় সন্ন্যাসী কমপ্লেক্সে সংঘগুলোর কনসেন্ট্রেশন হওয়াটা বৌদ্ধধর্মের পতনের অন্যতম কারণ ছিল। তিনি বলেন যে এই বৃহৎ সন্ন্যাসী প্রতিষ্ঠানগুলির বৌদ্ধরা “সাধারণ জনতার সাথে দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারা কেবল সেই সব জমিদারদের সাথেই মিথোস্ক্রিয়া করতেন যাদের মনাস্টিক প্রোপার্টি বা সন্ন্যাসী সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছিল।” পদ্মনাভ জৈনী আরও উল্লেখ করেছেন যে বৌদ্ধ সাধারণ জনতা বৌদ্ধ সাহিত্যে তুলনামূলকভাবে অবহেলিত ছিল, বৌদ্ধ সাহিত্যে পার্থিব জীবন নিয়ে কেবল একটি রচনাই তৈরি করা হয়েছে, তাও ১১শ শতকের পূর্বে নয়। অন্যদিকে জৈন সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ নিয়ে জৈন সাহিত্যে প্রায় পঞ্চাশটি গ্রন্থ রয়েছে।
এই কারণগুলির জন্য ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্ম এবং জৈন ধর্ম দ্বারা ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিস্থাপন ঘটতে থাকে। ফোগেলিন বলেছেন যে. “যদিও কিছু ছোট বৌদ্ধ কেন্দ্র এখনও ১১শ ও ১২শ শতাব্দীতে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে অব্যাহত ছিল, বেশিরভাগ অংশে সন্ন্যাসীদের এবং সাধারণ মানুষের বৌদ্ধ ধর্ম উভয়ই প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে হিন্দু ধর্ম এবং জৈন ধর্ম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।” বৌদ্ধ উৎসগুলিতে হিন্দু ব্রাহ্মণ ও রাজাদের দ্বারা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। হাজরা উল্লেখ করেছেন যে ৮ম ও ৯ম শতাব্দীতে “দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধধর্মের প্রতি ব্রাহ্মণীয় শত্রুতা” দেখা গেছে।
রিলিজিয়াস কনভারজেন্স এবং এবজর্পশন
বৌদ্ধ ধর্মের স্বাতন্ত্র্যও হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্থানের সাথে সাথে হ্রাস পেয়েছিল। যদিও মহাযান লেখকরা হিন্দুধর্মের বেশ সমালোচক ছিলেন, তবে মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের ভক্তিমূলক সংস্কৃতিগুলি সাধারণের কাছে সদৃশ বলেই মনে হয়েছিল এবং উভয় ধর্ম থেকে বিকশিত তন্ত্রও একই রকম ছিল। এছাড়াও, হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় তন্ত্রেরই “ক্রমবর্ধমান রহস্যবাদী বা এসোটেরিক প্রকৃতি” এগুলোকে ভারতবর্ষের জনগণের কাছে দুর্বোধ্য করে তোলে। এর ফলে হিন্দু ভক্তিবাদ এবং পার্থিব শক্তি-ভিত্তিক নাথ সিদ্ধরা সাধারণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিকল্প হয়ে ওঠে। বৌদ্ধ ধারণাগুলো, এমনকি স্বয়ং বুদ্ধও, অর্থোডক্স হিন্দু চিন্তাধারায় শোষিত এবং অভিযোজিত হয়ে যায়।
মধ্যযুগীয় হিন্দুধর্ম এই সময়ে যে উপাদানগুলি গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে ছিল নিরামিষবাদ বা ভেজিটেরিয়ানিজম, পশু বলির সমালোচনা, সন্ন্যাসবাদের একটি শক্তিশালী ঐতিহ্য (শঙ্করের মতো ব্যক্তিত্বদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) এবং বিষ্ণুর অবতার হিসাবে বুদ্ধকে গ্রহণ করা। বর্ণালীর অন্য প্রান্তে, বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে আরও বেশি করে “ব্রাহ্মনাইজড” বা ব্রাহ্মণীয় হয়ে ওঠে, প্রাথমিকভাবে রাজসভায় বৌদ্ধরা তাদের স্বার্থ রক্ষার উপায় হিসাবে সংস্কৃতকে গ্রহণ করে, তার মধ্য দিয়েই বৌদ্ধদের ব্রাহ্মনাইজেশনের সূত্রপাত। ব্রঙ্কহর্স্টের মতে, সংস্কৃত সাংস্কৃতিক জগতে বৌদ্ধদের এই যাত্রার পদক্ষেপটি তাদের মধ্যে অসংখ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী রীতিনীতিও নিয়ে এসেছিল যা সেই সময় সংস্কৃত বৌদ্ধ সংস্কৃতি দ্বারা গৃহীত হয়েছিল (একটি উদাহরণ হল কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থে উপস্থিত ধারণা যে বুদ্ধ একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন যিনি বেদ জানতেন)। ব্রঙ্কহর্স্ট উল্লেখ করেছেন যে সময়ের সাথে সাথে, এমনকি বর্ণ ব্যবস্থাও ভারতীয় বৌদ্ধদের দ্বারা “ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে” ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল (এটি নেপালের নেওয়ার বৌদ্ধদের মধ্যে টিকে আছে)। ব্রঙ্কহর্স্ট উল্লেখ করেছেন যে, শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের অতীতকে ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর নির্ভরশীল এবং এটি ব্রাহ্মণ্যবাদের সেকেন্ডারি – এরকমভাবে দেখার একটি প্রবণতা বিকশিত হয়েছিল। ব্রঙ্কহর্স্টের মতে, এই ধারণাটি “সম্ভবত ট্রোজান হর্সের মতো কাজ করে এই ধর্মকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেয়।”
সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাও কতিপয় বৌদ্ধকে তাদের মতবাদ ও অনুশীলন পরিবর্তন করতে পরিচালিত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, পরবর্তী কিছু গ্রন্থ যেমন মহাপরিনির্বাণ সূত্র এবং সর্বদুর্গতিপরিষোধন তন্ত্র বৌদ্ধ শিক্ষারক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে শুরু করে এবং এই কারণে প্রয়োজন হলে হত্যার অনুমতি দেওয়া হয়। পরে বৌদ্ধ সাহিত্যেও রাজাদের বোধিসত্ত্ব হিসাবে দেখা শুরু হয় এবং তাদের কর্মগুলি ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হিসাবে দেখানো শুরু হয় (দেবপাল এবং সপ্তম জয়বর্মণের মতো বৌদ্ধ রাজারাও এটি দাবি করেছিলেন)। ব্রঙ্কহর্স্ট আরও মনে করেন যে খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম দ্বারা অ্যাপোট্রপিক আচার-অনুষ্ঠান (রাষ্ট্র ও রাজার সুরক্ষার জন্য সহ) এবং মন্ত্র (মন্ত্র) এর ব্যবহার বৃদ্ধিও ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং শৈব প্রভাবের প্রতিক্রিয়া। এর মধ্যে অগ্নি-উৎসর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা বৌদ্ধ রাজা ধর্মপালের শাসনামলে (রা. আনু. ৭৭৫-৮১২) সঞ্চালিত হয়েছিল। অ্যালেক্সিস স্যান্ডারসন দেখিয়েছেন যে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম রাজকীয় চিত্রে পূর্ণ, যা মধ্যযুগীয় ভারতের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে, এবং কোন উপায়ে তাকে বিশ্বকে পবিত্র করার উপায় ধরা হয়েছে। সম্ভবত এই পরিবর্তনগুলোর কারণে, বৌদ্ধধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারা এবং অনুশীলনের কাছে ঋণী হয়, এবং এর বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির বেশিরভাগ অংশকে গ্রহণ করে। ব্রঙ্কহর্স্ট দাবি করেন যে, এই তীব্র পরিবর্তনগুলি বৌদ্ধধর্মকে এর প্রথম শতকের অবস্থান থেকে একে অনেক দূরে নিয়ে যায়, এবং এতকাল ধরে বৌদ্ধরা যাদেরকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্কৃতি বলে মনে করে এসেছিল তারা তাদের রীতিনীতিকেই গ্রহণ করে চলেছিল।” এই পরিবর্তনগুলি বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল, এবং শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মকে হিন্দু ধর্মে শোষিত করা অনেক সহজ করে তুলেছিল।
পৃষ্ঠপোষকতা
প্রাচীন ভারতে রাজ্যগুলো স্ব স্ব রাজাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়কে তুলনামূলকভাবে সমানভাবে দেখতো। এই সমান আচরণের মধ্যে রয়েছে মঠ ও ধর্মীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, ভিক্ষুদের সহায়তার জন্য গ্রামের আয়ের মতো সম্পত্তি দান করা এবং দান করা সম্পত্তিকে কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া। অনুদানগুলি প্রায়শই ধনী ব্যবসায়ী এবং রাজকীয় পরিবারের মহিলা আত্মীয়দের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা করা হত, তবে এমন সময় ছিল যখন রাষ্ট্রও ধর্মকে সুরক্ষা দিয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে, এই সমর্থনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এর উচ্চ স্তরের সংগঠন এবং সাধারণের থেকে আসা অনুদানের উপর ভিক্ষুরা নির্ভরশীল ছিল। বৌদ্ধধর্মের উপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার রূপ ছিল ভূমি অনুদান।
ভারতের অসংখ্য তাম্রলিপি এবং তিব্বতী ও চীনা গ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে মধ্যযুগীয় ভারতে বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ মঠগুলির পৃষ্ঠপোষকতা যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়কালে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল, তবে খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে সাধারণ যুগের শুরু থেকে হিন্দু রাজ্যগুলো ব্যাপকভাবে বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষকতা করত। গুপ্ত রাজারা কুশিনগরের মতো বৌদ্ধ মন্দির এবং নালন্দায় সন্ন্যাসী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তৈরি করেছিলেন, যা ভারতে তিনজন চীনা দর্শনার্থীর দ্বারা রেখে যাওয়া নথি দ্বারা প্রমাণিত।
অভ্যন্তরীণ সামাজিক-অর্থনৈতিক গতিশীলতা
লারস ফোগেলিনের মতো কিছু পণ্ডিতের মতে, বৌদ্ধধর্মের পতন অর্থনৈতিক কারণের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। এখানে বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো, বৌদ্ধ মঠগুলোর অ-বস্তুগত বা নন-মেটারিয়াল প্রকৃতির সাধনা, মঠগুলির সমাজ-বিচ্ছিন্নতা, সংঘের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার ক্ষতি এবং মঠগুলোর নিজস্ব জমিগুলো দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হওয়া। হিন্দু ধর্ম ও জৈন ধর্মের প্রতি ক্রমবর্ধমান পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সাথে বৌদ্ধ মঠগুলিও ধীরে ধীরে ভূমি রাজস্বের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
তুর্কি আক্রমণ ও বিজয় (১০ম থেকে ১২শ শতাব্দী)
আক্রমন
পিটার হার্ভের মতে, “৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তুর্কিরা আফগানিস্তান থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আক্রমণ শুরু করে এবং ১১শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পশ্চিম ভারতকে লুণ্ঠন করে। জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, এবং মূর্তিপূজা প্রতি ইসলামে অপছন্দের বিষয় বলে বৌদ্ধ চিত্র-ভাষ্কর্যগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমরা ভারতের ‘মূর্তি’-কে “Budd” বলেই অভিহিত করত, শব্দটি বৌদ্ধধর্ম থেকেই এসেছিল।”
মুসলিমদের ভারতীয় উপমহাদেশের বিজয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের প্রথম “মহান মূর্তিধ্বংসকারী আক্রমণ” (the first great iconoclastic invasion)। ৮ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে আরব বিজয়ীরা বর্তমান পাকিস্তান আক্রমণ করেছিল। দ্বিতীয় তরঙ্গে, ১১শ থেকে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত, তুর্কি, তুর্কি-মঙ্গোলিয়ান এবং মঙ্গোলিয়ানরা উত্তর ভারতীয় সমভূমিকে অতিক্রম করেছিল। পারস্য ভ্রমণকারী আল বিরুনির স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় যে, ১১শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গজনি (আফগানিস্তান) এবং মধ্যযুগীয় পাঞ্জাব অঞ্চল (উত্তর পাকিস্তান) থেকে বৌদ্ধ ধর্ম অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ১২শ শতাব্দীর শেষের দিকে মধ্যযুগীয় উত্তর-পশ্চিম এবং পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশে (বর্তমানে পাকিস্তান এবং উত্তর ভারত) মঠ ও স্তূপধ্বংসের সাথে সাথে বৌদ্ধধর্ম আরও অদৃশ্য হয়ে যায়। শাহাবুদ্দিন ঘোরির বাহিনীর ইতিহাসবিদ তাদের দ্বারা সন্ন্যাসী ও ছাত্রদের উপর আক্রমণ এবং অমুসলিম কাফেরদের বিরুদ্ধে বিজয় সম্পর্কে উৎসাহীভাবেই নথিভূক্ত করেন। বৌদ্ধধর্মের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মুসলিম সেনাবাহিনীর উত্তর ভারতে প্রবেশের সরাসরি পথ। সম্পদ ও অ-মুসলিম ধর্মের কেন্দ্র হিসেবে তাই তারাই পরিণত হয় টার্গেটে। বৌদ্ধ সূত্রগুলি এই মূল্যায়নের সাথে একমত। তারানাথ ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দের ভারতে তাঁর বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে প্রধানত পূর্ব ভারতে বৌদ্ধধর্মের শেষ কয়েক শতাব্দীর একটি বিবরণ দিয়েছেন। মহাযান বৌদ্ধধর্ম পাল রাজবংশের সময়কালে তার শিখরে পৌঁছেছিল।
উইলিয়াম জনস্টনের মতে, গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে ১২শ এবং ১৩শ শতাব্দীতে মুসলিম সেনাবাহিনী শত শত বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির ধ্বংস করেছিল, বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। ইসলামী আগ্রাসনের ফলে সম্পদ লুণ্ঠন করা হয় এবং বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করা হয়।
প্রাচীরযুক্ত ক্যাম্পাসের কারণে নালন্দার বৌদ্ধ বিহারগুলোকে মুসলিম আক্রমণকারীরা দুর্গ বলে ভুল করেছিল। যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মিনহাজ-ই-সিরাজের মতে তাদেরকে ব্রাহ্মণ বলে ভুল করা হয়েছিল। প্রাচীরযুক্ত শহর, ওদান্তপুরি মঠকেও মুসলিম বাহিনী জয় করেছিল। সুম্পা ১২০০ সালে মগধে থাকা সাক্যশ্রীভদ্র নিয়ে লেখেন, “ওদান্তপুরি এবং বিক্রমশিলার বৌদ্ধ বিহার কমপ্লেক্সগুলিও ধ্বংস করা হয়েছিল এবং ভিক্ষুদের হত্যা করা হয়েছিল।” মুসলিম-বাহিনী ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বহুবার আক্রমণ করেছিল। অনেক জায়গা ধ্বংস করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১১৯৭ সালে মোহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার দ্বারা ওদন্তাপুরির মঠগুলি ধ্বংস করে শহরটির নতুন নামকরণ করেছিলেন। একইভাবে, বিক্রমাশিলা ১২০০ সালের দিকে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাহিনী দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের পরিণতি এড়াতে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু নেপাল, তিব্বত ও দক্ষিণ ভারতে পালিয়ে যান। তিব্বতি তীর্থযাত্রী চোজেপাল (Chöjepal) (১১৭৯-১২৬৪) ১২৩৪ সালে ভারতে এসেছিলেন। তাকে একাধিকবার অগ্রসরমান মুসলিম সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল, কারণ তারা বৌদ্ধ স্থানগুলি ধ্বংস করছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশগুলি ইসলামী নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, এবং এর ফলে বৌদ্ধ মঠগুলি তাদের ভরনপোষণের উদ্দেশ্যে থাকা জমিগুলোও হারিয়ে ফেলে। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং জনসাধারণের ওপর নতুন করের ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জনসাধারণের পৃষ্ঠপোষকতাও হ্রাস পায়। সকল মঠ মুসলিম আক্রমণের ফলে ধ্বংস হয়নি, যেমন সোমাপুর, ললিতগিরি, উদয়গিরি। তবে এই বড় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কমপ্লেক্সগুলি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বলে সেই পৃষ্ঠপোষকতাটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে মঠগুলোও সংঘ দ্বারা পরিত্যক্ত হয়।
লারস ফোগেলিন বলেছেন, মধ্যযুগীয় ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে, হিমালয় অঞ্চল, সেইসাথে মধ্য এশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে বৌদ্ধধর্ম একসময় বাণিজ্য সম্পর্ককে সহজতর করেছিল। ইসলামী আগ্রাসন ও সম্প্রসারণ, এবং মধ্য এশীয়রা ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে, বাণিজ্য পথ থেকে আসা আর্থিক সহায়তার উৎসগুলোরও পতন ঘটে, অর্থাৎ বৌদ্ধ মঠগুলির অর্থনৈতিক ভিত্তিও দুর্বল হয়ে যায়, কেননা এটির উপর ভিত্তি করেই বৌদ্ধধর্মের টিকে ছিল ও বিকশিত হয়েছিল। ইসলামের আগমন বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসী ঐতিহ্যের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে সরিয়ে দেয় এবং একই সাথে বৌদ্ধদের দীর্ঘদূরত্বের বাণিজ্যের উপায়ও স্তব্ধ হয়।
ইসলামী শাসনের অধীনে পতন
ভারতে মুসলিম বিজয়ের পর বৌদ্ধধর্ম মূলত ভারতের বেশিরভাগ অংশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, এটি কেবল হিমালয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ ভারতে বেঁচে থাকে। আবুল ফজল বলেছিলেন যে বৌদ্ধদের কোনও চিহ্ন খুব কমই অবশিষ্ট ছিল। ১৫৯৭ সালে যখন তিনি কাশ্মীর সফর করেন, তখন তিনি বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী কয়েকজন বৃদ্ধের সাথে দেখা করেন, তবে তিনি “জ্ঞানীদের মধ্যে কাউকেই দেখেননি”।
র্যান্ডাল কলিন্সের মতে, খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর মধ্যে ভারতে বৌদ্ধধর্ম ইতিমধ্যে হ্রাস পেয়েছিল, কিন্তু আক্রমণকারীদের লুণ্ঠনের সাথে সাথে এটি ১২০০-এর দশকে ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্রেইগ লকার্ড লেখেন, ১৩শ শতাব্দীতে ভারতের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ইসলামী নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তিব্বতে পালিয়ে যায়; পিটার হার্ভে লেখেন, পশ্চিম ভারতের ভিক্ষুরা দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু রাজ্যগুলিতে চলে গিয়ে নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
১২৩০-এর দশকে মুসলিমদের বিজয়ের পর ধর্মস্মভিমের এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণে উল্লেখ আছে, পরিত্যক্ত বিহারগুলিকে তুরুক্ষরা (Turukshahs, তুর্কী বোঝাতে) শিবির হিসাবে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে তারানাথের মতো ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলি কিংবদন্তী উপকরণগুলির সাথে মিশ্রিত হয় এবং সংক্ষেপে বলা হয় যে “তুরুক্ষরা সমগ্র মগধ জয় করেছিল এবং অনেক মঠ ধ্বংস করেছিল এবং নালন্দায় অনেক ক্ষতি করেছিল, যেমন অনেক সন্ন্যাসী বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল” যার ফলে বিহারগুলির ধ্বংসের সাথে সাথে বৌদ্ধধর্মের মৃত্যু ঘটে।
বৌদ্ধবিহারগুলি উচ্ছেদ করা হলেও, সামান্য বস্তুগত মূল্যযুক্ত মন্দির এবং স্তূপগুলি টিকে ছিল। সন্ন্যাসী বৌদ্ধধর্মের পতনের পর বৌদ্ধ স্থানগুলি অন্যান্য ধর্মীয় অর্ডার দ্বারা পরিত্যক্ত বা পুনর্দখল করা হয়েছিল। বিহার এবং গ্রন্থাগারগুলোর অনুপস্থিতিতে শিক্ষামূলক বৌদ্ধধর্ম এবং এর অনুশীলনকারীরা হিমালয়, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। সেই সময় কৃষির ধ্বংসের ফলে অনেক সাধারণ মানুষও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন করতে অক্ষম ছিল। এই বৌদ্ধভিক্ষুরা সহজেই সনাক্তযোগ্য ছিল এবং দুর্বলও ছিল। বেশ কয়েকটি অঞ্চলে সংঘ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছি, এবং পুনরুজ্জীবনের শক্তির জন্য যথেষ্ট সন্ন্যাসী এর ছিলনা। পিটার হার্ভে উপসংহার টেনেছেন, “এক দিকে ছিল নিজেদের বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য “পবিত্র যুদ্ধকে” ন্যায্য বলে মনে করা মুসলিমরা, অন্যদিকে ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে চিহ্নিত এবং অধিকতর সুদৃঢ় সামাজিক মাত্রার হিন্দুরা, এই উভয়ের মধ্যে পিষ্ট হয়ে বৌদ্ধরা তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। সাধারণ বৌদ্ধরা বৌদ্ধধর্মের লৌকিক ধারা নিয়ে টিকে থাকে আর ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মে মিশে যায় বা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। তাই বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে তার মাতৃভূমি ভারতেই ফ্রিঞ্জ গ্রুপ হয়ে যায়, যদিও ভারতবর্ষের বাইরে এটি ছড়িয়ে পড়ে।”
ফগেলিন আরও উল্লেখ করেছেন যে বৌদ্ধ সংঘের কিছু উপাদান হিমালয়, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছিল, অথবা তারা ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার জীবনে ফিরে আসতে পারে বা ভ্রান্ত তপস্বী হয়ে উঠতে পারে। এই পরিবেশে, মঠ এবং তাদের নিজস্ব শিক্ষাকেন্দ্র ছাড়াই, বৌদ্ধ তপস্বী এবং সাধারণ ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় ভারতের ধর্মীয় জীবনে শোষিত হয়ে গিয়েছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্মের টিকে থাকা
বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলি ইসলামী আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত পূর্ব ভারতে টিকে ছিল। বৌদ্ধধর্ম এখনও বড়ুয়াদের মধ্যে বেঁচে আছে (যদিও তারা বৈষ্ণব উপাদানগুলি অনুশীলন করে)। এরা হলো বাঙালি মগধ বংশোদ্ভূত একটি সম্প্রদায় যারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম নেপালের নেওয়ারদের মধ্যেও বেঁচে আছে, নেওয়ার বৌদ্ধধর্ম নামে পরিচিত বজ্রযানের একটি অনন্য রূপ। ওড়িশার কটক জেলার ম্যানিয়াবান্ধা এবং নুয়াপাটনা গ্রামের তাঁতিদের মধ্যেও বৌদ্ধধর্ম অনুশীলিত হয়, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন ছিল।
বিহার ও বাংলায়, অনেক বৌদ্ধ শ্রাইন এবং মন্দির অক্ষত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ব্রাহ্মণ্য দেবতা হিসাবে উপাসনা করা হচ্ছে। নালন্দার আশেপাশের এলাকায়, বৌদ্ধ স্তূপের অবশিষ্টাংশগুলি শিব লিঙ্গ হিসাবে পূজা করা হয়। তেলহারা গ্রামে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধের একটি চিত্র রাম নবমীর সময় হনুমান হিসাবে পূর্ণাঙ্গ পুজা গ্রহণ করে। কুমিল্লার গুনাইঘরে বুদ্ধের একটি ভাস্কর্য বাসুদেব হিসেবে পূজিত হয়।
যদিও নালন্দার মতো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কেন্দ্রগুলি ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু বুদ্ধগয়ার মত তীর্থস্থানগুলো, বিভিন্ন মন্দির ও স্তূপ টিকে গিয়েছিল। বুদ্ধগয়া মহাবিহারের শেষ মঠকর্তা ছিলেন সারিপুত্র, যিনি ভারত ছেড়ে নেপালে যাওয়ার আগে ১৪শ ও ১৫শ শতাব্দীতে সেখানে কাজ করেছিলেন। বুদ্ধগয়ার শিলালিপিগুলি দেখায় যে, ১৪শতক পর্যন্ত মহাবোধি মন্দিরটি কিছুটা ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৭শ শতাব্দীর তিব্বতি লামা তারানাথের ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস অনুসারে, মন্দিরটি ১৫শ শতকে একজন বাঙালি রানী দ্বারা পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল, পরে এটি একটি জমিদারের কাছে চলে যায় এবং শৈবকেন্দ্রে পরিণত হয়। বুদ্ধগয়ার শিলালিপিতে বৌদ্ধদের পতনের সময়জুড়ে বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা এটি পরিদর্শন করার কথা উল্লেখ করেছেন –
- ১৩০২–১৩৩১ – সিন্ধু থেকে বেশ কয়েকটি দল
- ১৫শ বা ১৬শ শতাব্দী – মুলতান থেকে একজন তীর্থযাত্রী
- ১৫শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ – দক্ষিণ ভারত থেকে আসা সন্ন্যাসী বুধগুপ্ত
- ১৬শ শতক – নেপাল থেকে আসা অভয়রাজ
- ১৭৭৩ – তিব্বত থেকে পঞ্চেন লামার প্রতিনিধি ট্রুং রামপা, বারাণসীর মহারাজা তাকে স্বাগত জানান
- ১৮৭৭ – রাজা মিন্ডন মিন কর্তৃক প্রেরিত বার্মিজ মিশন
মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারী আবুল ফজল বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুস্তানে তাদের (বৌদ্ধদের) কোনো চিহ্নই ছিল না। ১৫৯৭ সালে যখন তিনি কাশ্মীর সফর করেন, তখন তিনি বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী কয়েকজন বৃদ্ধের সাথে দেখা করেন, তবে তিনি ‘বিদ্বানদের মধ্যে কাউকেই দেখতে পাননি’। এটাও দেখা যায় যে, ফতেহপুর সিক্রিতে আকবরের ইবাদতখানায় আসা জ্ঞানী ঐশ্বরিকদের মধ্যে বৌদ্ধ যাজকরা উপস্থিত ছিলেন না।
সিকান্দার বুটশিকানের মতো সুলতানদের দ্বারা কাশ্মীরের ইসলামীকরণের পরে, হিন্দুধর্মের বেশিরভাগই সেখান থেকে বিলুপ্ত হয়, তবে সেখানে বৌদ্ধধর্ম কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। ফজল লিখেছেন, “তৃতীয়বার যখন লেখক সম্রাটের সাথে কাশ্মীরের মনোরম উপত্যকায় গেলেন, তখন তিনি বৌদ্ধধর্মের কয়েকজন বৃদ্ধের সাথে দেখা করলেন, কিন্তু বিদ্বানদের মধ্যে কাউকেই দেখতে পাননি।”
আব্দ আল-কাদির বাদা’ইউনি উল্লেখ করেছেন, “অধিকন্তু, সামানি এবং ব্রাহ্মণরা মহারাজের সাথে ঘন ঘন ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ পায়।” এখানে Samani শব্দটি সংস্কৃত শ্রমণ (Sramana) থেকে আসা প্রাকৃত সমন (Samana) থেকে এসেছে। এর দ্বারা কোন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে বোঝায়। ইরফান হাবিব বলেন, উইলিয়াম হেনরি লোয় কতিপয় সামানিদের বৌদ্ধ ভিক্ষু বলে মনে করেন, কিন্তু তারা আসলে জৈন তপস্বী ছিলেন।
তারানাথের ইতিহাস তাঁর সময়কালে ভারতের কিছু অঞ্চলে বৌদ্ধ সংঘের বেঁচে থাকার কথা উল্লেখ করে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে কোঙ্কন, কলিঙ্গ, মেওয়াড়, চিত্তোর, আবু, সৌরাষ্ট্র, বিন্ধ্য পর্বতমালা, রত্নগিরি, কর্ণাটক ইত্যাদি। গুণকীর্তি (১৪৫০-১৪৭০) নামে একজন জৈন লেখক ধর্মামৃত নামে একটি মারাঠি গ্রন্থ লিখেছিলেন, সেখানে তিনি ১৬টি বৌদ্ধ অর্ডারের নাম উল্লেখ করেছিলেন। ডঃ জোহরাপুরকর উল্লেখ করেছেন যে তাদের মধ্যে, সাতাগারে, ডোঙ্গারে, নবঘর, কবিশ্বর, ভাসানিক এবং ইচ্ছাভোজনিক নামগুলি এখনও মহারাষ্ট্রে পারিবারিক নাম হিসাবে বেঁচে আছে।
১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশ শাসনামলের সময় বৌদ্ধ ধর্ম কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন ধর্মটি কেবল হিমালয় অঞ্চল, পূর্ব এবং ভারতের অভ্যন্তরের কিছু বিছিন্ন অঞ্চলেই টিকে থাকে। ব্রিটিশ ভারতের ১৯০১ সালের জনগণনা বা আদমশুমারি (যার মধ্যে আধুনিক বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা এবং পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত ছিল) অনুসারে সেখানকার মোট জনসংখ্যা ছিল ২৯৪.৪ মিলিয়ন, এদের মধ্যে মোট বৌদ্ধ ছিল ৯.৫ মিলিয়ন। ১৯০১ সালে বার্মার প্রায় ৯.২ মিলিয়ন বৌদ্ধ কে বাদ দিয়ে, এই ঔপনিবেশিক যুগের আদমশুমারিতে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের ব্রিটিশ ভারতীয় সময়ে বৌদ্ধদের সংখ্যা ছিল মাত্র ০.৩ মিলিয়ন বা ৩ লক্ষ, যা সমগ্র জনসংখ্যার ০.১%।
১৯১১ সালের জনগণনা বা আদমশুমারি অনুসারে বার্মা ব্যতীত ব্রিটিশ ভারতে প্রায় ৩৩৬,০০০ বা প্রায় ০.১% বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল।
পুনর্জাগরণ
১৮৯১ সালে, শ্রীলংকার (সিংহলি) অগ্রগামী বৌদ্ধ কর্মী ডন ডেভিড হেওয়াভিতারানে পরে অনাগরিকা ধর্মপাল নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ভারত সফর করেন। হেনরি স্টিল ওলকট এবং ম্যাডাম ব্লাভাটস্কির মতো আমেরিকান থিওসোফিস্টদের সহযোগিতায় তাঁর প্রচারাভিযানটি মহা বোধি সোসাইটি এবং মহা বোধি জার্নাল গঠনের পাশাপাশি বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলির পুনরুজ্জীবনের দিকে পরিচালিত করে। তার প্রচেষ্টা সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং ব্রিটিশ ভারতে বৌদ্ধ পবিত্র স্থানগুলি যেমন ভারতের বুদ্ধগয়া এবং বার্মার সদৃশ স্থানগুলোর পুনরুদ্ধারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে।
১৯৫০-এর দশকে, বি আর আম্বেদকর দলিতদের জন্য ভারতে দলিত বৌদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন (পূর্বে “অস্পৃশ্য” হিসাবে পরিচিত ছিল)। ডঃ আম্বেদকর, ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর নাগপুরে তার ৩৬৫,০০০ অনুসারী সহ বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। এই জাতীয় আরও অনেক গণ-রূপান্তর অনুষ্ঠান অনুসরণ করা হয়েছিল। অনেক ধর্মান্তরিত দলিত বৌদ্ধ আন্দোলনকে মনোনীত করার জন্য “নবযান” শব্দটি (“আম্বেদকরীয় বৌদ্ধধর্ম” বা “নব্য বৌদ্ধধর্ম” নামেও পরিচিত) ব্যবহার করে, যা আম্বেদকরের ধর্মানতের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এখন মারাঠি বৌদ্ধরা ভারতের বৃহত্তম বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
১৯৫৯ সালে, চতুর্দশ দলাই লামা তেনজিন গিয়াতসো অসংখ্য তিব্বতী উদ্বাস্তুর সাথে তিব্বত থেকে ভারতে পালিয়ে আসেন এবং ভারতের ধর্মশালায় নির্বাসিত তিব্বত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, যা প্রায়শই তিব্বতের রাজধানী শহরের অনুকরণে “লিটল লাসা” নামে পরিচিত। কয়েক হাজার তিব্বতী নির্বাসিতরা তখন থেকে এই শহরে বসতি স্থাপন করেছে। এই নির্বাসিতদের বেশিরভাগই আপার ধরমশালা বা ম্যাকলিওড গঞ্জে বাস করে, যেখানে তারা মঠ, মন্দির এবং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। শহরটি বিশ্বের বৌদ্ধধর্মের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
ভারতে, বিপাসসানা আন্দোলনের (Vipassana movement) সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিনিধি হলো এস এন গোয়েঙ্কা (১৯২৪-২০১৩) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিপাসসানা রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যিনি আধুনিক ও অ-সাম্প্রদায়িক পদ্ধতিতে বৌদ্ধ বিপাসনা ধ্যানকে উন্নীত করেছিলেন। বৌদ্ধ ধ্যানের এই রূপটি প্রধানত অভিজাত এবং মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের দ্বারা অনুশীলন করা হয় এবং বিপাসসানা আন্দোলন ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ের উপকণ্ঠে গ্লোবাল বিপাসসানা প্যাগোডার নির্মাণ কাজ শেষ হয়। দশ দিনের বিপাসসানা ধ্যান কোর্সগুলি নিয়মিতভাবে ধম্ম পত্তন মেডিটেশন সেন্টারে বিনামূল্যে পরিচালিত হয় যা গ্লোবাল বিপাসসানা প্যাগোডা কমপ্লেক্সের অংশ।
১৯০১ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে ভারতের আধুনিক কালে জন্মের হার এবং ধর্মান্তরের কারণে বৌদ্ধ জনসংখ্যা ২২.৫% হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা হিন্দু ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং শিখ ধর্মের বৃদ্ধির হারের মতোই, কিন্তু খ্রিস্টধর্মের চেয়ে দ্রুততর (১৬.৮%), এবং ইসলামের চেয়ে ধীর (৩০.৭%)।
২০১০ সালের পিউ অনুমান অনুসারে, ব্রিটিশ ভারত থেকে তৈরি হওয়া দেশগুলিতে মোট বৌদ্ধ জনসংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৭.২%, ভারতে ৯২.৫%, এবং পাকিস্তানে ০.২% বসবাস করে।
তথ্যসূত্র
Anand, Ashok Kumar (1996), “Buddhism in India”, Gyan Books, ISBN 978-81-212-0506-1
Akira Hirakawa; Paul Groner (1993). A History of Indian Buddhism: From Śākyamuni to Early Mahāyāna. Motilal Banarsidass. pp. 227–240. ISBN 978-81-208-0955-0.
Berkwitz, Stephen C. (2012), South Asian Buddhism: A Survey, Routledge
Bhagwan, Das (1988), Revival of Buddhism in India and Role of Dr. Baba Saheb B.R. Ambedkar, Dalit Today Prakashan, Lucknow -226016, India. ISBN 8187558016
Bronkhorst, Johannes (2011). Buddhism in the Shadow of Brahmanism. BRILL.
Charles Higham (2014). Encyclopedia of Ancient Asian Civilizations. Infobase. pp. 121, 236. ISBN 978-1-4381-0996-1.
Chandra, Satish (2004). Medieval India: from Sultanat to the Mughals – Part One: Delhi Sultanat (1206–1526). New Delhi: Har-Anand Publications. p. 41.
Collins, Randall (2000). The Sociology of Philosophies: A Global Theory of Intellectual Change. Harvard University Press. ISBN 0-674-00187-7.
Craig Lockard (2007). Societies, Networks, and Transitions: Volume I: A Global History. Houghton Mifflin. p. 188. ISBN 978-0618386123.
Damien Keown (2004). A Dictionary of Buddhism. Oxford University Press. pp. 208–209. ISBN 978-0-19-157917-2.
Dhammika, S. (1993). The Edicts of King Ashoka (PDF). Kandy, Sri Lanka: Buddhist Publication Society. ISBN 978-955-24-0104-6. Archived from the original (PDF) on 22 December 2013.
Doniger, Wendy (2000). Merriam-Webster Encyclopedia of World Religions. Encyclopædia Britannica. p. 1378. ISBN 978-0-87779-044-0.
Elverskog, Johan (2011), Buddhism and Islam on the Silk Road, University of Pennsylvania Press, ISBN 978-0812205312
Fogelin, Lars (2015). An Archaeological History of Indian Buddhism. Oxford University Press. ISBN 978-0-19-994823-9. ISBN 978-0-19-994822-2. (p. 219) (p. 223)
Gregory Schopen (1997). Bones, Stones, and Buddhist Monks: Collected Papers on the Archaeology, Epigraphy, and Texts of Monastic Buddhism in India. University of Hawaii Press. pp. 259–278. ISBN 978-0-8248-1870-8.
Gina Barns (1995). “An Introduction to Buddhist Archaeology”. World Archaeology. 27 (2): 166–168. doi:10.1080/00438243.1995.9980301.
Govind Chandra Pande (1994). Life and thought of Śaṅkarācārya. Motilal Banarsidass Publ. ISBN 978-81-208-1104-1, ISBN 978-81-208-1104-1.
Hartmut Scharfe (2002). Handbook of Oriental Studies. BRILL. p. 150. ISBN 90-04-12556-6.
Harvey, Peter (2013). An Introduction to Buddhism: Teachings, History and Practices. Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-85942-4.
Inden, Ronald B. (2000), Imagining India, C. Hurst & Co. Publishers
Irfan Habib (1997). Akbar and His India. Oxford University Press. p. 98.
Jaini, Padmanabh S. (1980): “The disappearance of Buddhism and the survival of Jainism: a study in contrast”. Studies in History of Buddhism. Ed. A. K. Narain. Delhi: B. R. Publishing. pp. 81–91. Reprint: Jaini, 2001: 139–153.
Kanai Lal Hazra (1995). The Rise And Decline of Buddhism in India. Munshiram Manoharlal. pp. 371–385. ISBN 978-81-215-0651-9.
Kishori Saran Lal (1999). Theory and Practice of Muslim State in India. Aditya Prakashan. p. 110.
McLeod, John, The History of India, Greenwood Press (2002), ISBN 0-313-31459-4, pp. 41–42.
McKeown, Arthur P. (2018). Guardian of a Dying Flame: Śāriputra (c. 1335-1426) and the End of Late Indian Buddhism. Harvard University Press. pp. 463 pages. ISBN 9780674984356.
Michaels, Axel (2004), Hinduism. Past and present, Princeton, New Jersey: Princeton University Press
Muhammad ibn Ahmad Biruni; Edward C. Sachau (Translator) (1888). Alberuni’s India: An Account of the Religion, Philosophy, Literature, Geography, Chronology, Astronomy, Customs, Laws and Astrology of India about AD 1030. Cambridge University Press. pp. 253–254. ISBN 978-1-108-04720-3.
Murthy, K. Krishna (1987). Glimpses of Art, Architecture, and Buddhist Literature in Ancient India. Abhinav Publications. p. 91. ISBN 978-81-7017-226-0.
Nakamura, Hajime (1980). Indian Buddhism: A Survey With Bibliographical Notes. Motilal Banarsidass Publications. p. 146. ISBN 8120802721.
Queen, Christopher S.; King, Sallie B. (1996). Engaged Buddhism: Buddhist Liberation Movements in Asia. State University of New York Press. ISBN 978-0-7914-2844-3.
Ramesh Chandra Majumdar (1977). Ancient India. Motilal Banarsidass. pp. 242–244. ISBN 978-81-208-0436-4.
Richard Gombrich, A Global Theory of Intellectual Change. Harvard University Press, 2000, p. 205.
Richard Gombrich (2012). Buddhist Precept & Practice. Routledge. pp. 344–345. ISBN 978-1-136-15623-6.
Robert Stoddard (2010). “The Geography of Buddhist Pilgrimage in Asia”. Pilgrimage and Buddhist Art. Yale University Press. 178: 3–4.
Saunders, Kenneth (1947). A Pageant of India. Oxford: Oxford University Press. pp. 162–163.
Sanyal, Sanjeev (15 November 2012). Land of seven rivers: History of India’s Geography. Penguin Books Limited. pp. 130–131. ISBN 978-81-8475-671-5.
Wendy Doniger (1999). Merriam-Webster’s Encyclopedia of World Religions. Merriam-Webster. pp. 155–157. ISBN 978-0-87779-044-0.
White, David Gordon (2012), The Alchemical Body: Siddha Traditions in Medieval India, University of Chicago Press
Willemen, Charles; Dessein, Bart; Cox, Collett (1998). Sarvastivada Buddhist Scholasticism. Brill Academic Publishers. ISBN 978-9-004-10231-6.
William M. Johnston (2000). Encyclopedia of Monasticism: A–L. Routledge. p. 335. ISBN 978-1-57958-090-2.
Wink, André (2004), “Al-Hind, the Making of the Indo-Islamic World”, BRILL, ISBN 90-04-10236-1
“Historical Development of Buddhism in India – Buddhism under the Guptas and Palas”. Encyclopædia Britannica. Retrieved 12 September 2015.
“BUDDHISM IN ANDHRA PRADESH”. metta.lk. Archived from the original on 18 May 2011. Retrieved 27 June 2006.
Religion population totals in 2010 by Country Pew Research, Washington DC (2012)
“Population by religion community – 2011”. Census of India, 2011. The Registrar General & Census Commissioner, India. Archived from the original on 25 August 2015.
“Vipassana pioneer SN Goenka is dead”. Zeenews.india.com. 30 September 2013. Retrieved 30 September 2013.
ইত্যাদি
Leave a Reply