রুচি বা টেস্টের সমাজতত্ত্ব

ভূমিকা

সমাজবিজ্ঞানে, রুচি বলতে বোঝায় কোন ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠীর খাদ্যাভাস, ডিজাইন, কালচারাল এবং/অথবা অ্যাস্থেটিক প্যাটার্ন ইত্যাদি সম্পর্কিত বিষয়ভিত্তিক পছন্দ বা বাছাইকে। সমাজে রুচি প্রকাশ পায় বিভিন্ন বিষয় যেমন সুস্বাদুু খাবার/ পানীয়, ফ্যাশন, সঙ্গীত, শিষ্টাচার, পণ্য, শিল্পকর্মশৈলী ইত্যাদিত সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ভোক্তা পছন্দ কনজিউমার চয়েসগুলিতে পার্থক্যের মাধ্যমে। মানুষ কিভাবে কোন কিছুকে সুন্দর, ভাল বা মূল্যবান বলে জাজ করছে তার ভিত্তিতেই মানুষের রুচি বোঝা যায়, আর কোন সামাজিক গোষ্ঠীর মানুষ এগুলোকে কিভাবে জাজ করছে তা দেখে বোঝা যায় সেই সামাজিক গোষ্ঠীর রুচিকে। তাই মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক এবং গতিশীলতার সাথে এই রুচি সম্পর্কিত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাগুলি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তাই সামাজিক রুচির ধারণাকে সমাজতাত্ত্বিক ধারণাগুলি থেকে পৃথক করা যায়না। মানুষের মধ্যে ক্রিয়াকলাপে প্রকাশিত রুচিকে জানা না গেলে অনেক সামাজিক ঘটনাকে বোঝা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নান্দনিক পছন্দ এবং উপস্থিতি শিক্ষা এবং সামাজিক উৎসের সাথে যুক্ত। বিভিন্ন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন রুচি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সমাজে বিভিন্ন রকম রুচি দেখা যায়, আর এর অন্যতম কারণ হলো সেই সমাজে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী বা সোশ্যাল ক্লাসের উপস্থিতি।

নান্দনিকতার সাথে সম্পর্ক

নান্দনিকতার ধারণাটিতে প্লেটো, হিউম এবং কান্টের মতো দার্শনিকদের আগ্রহ ছিল, যারা নান্দনিকতাকে বিশুদ্ধ কিছু হিসাবে বুঝতেন এবং সৌন্দর্যের সারাংশ অনুসন্ধান করতেন, যাকে নান্দনিকতা অ্যাস্থেটিক্সের অনটোলজি বলা যায়। তারা নান্দনিকতার বিশুদ্ধতা, সার নিয়ে চিন্তা করতেন, কিন্তু সমাজের সাথে এর সম্পর্ক, কিভাবে সমাজে এর পরিবর্তন হয়, মানুষের সোশ্যাল ডাইনামিক্সের সাথে এর সম্পর্ক কী তা নিয়ে তা চিন্তা করেননি। উদাহরণ হিসেবে কান্টের ক্রিটিক অফ জাজমেন্ট (১৭৯০) গ্রন্থটির কথা বলা যায়। সেখানে নান্দনিক সার্বজনীনতার একটি নন-রিলেটিভিস্টিক ধারণা দেয়া হয়েছিল, যেখানে ব্যক্তিগত আনন্দ এবং বিশুদ্ধ সৌন্দর্য উভয়ই সহাবস্থান করেছিল। কিন্তু তাতে শ্রেণীরুচির মতো ধারণা যা মূলত রুচি এবং নান্দনিকতার সমস্যার সমাজতাত্ত্বিক উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা শুরু করে, তেমন কিছু ছিলনা। ১৯শ শতাব্দীর প্রথম দিকের সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞান শুরুর আগে নান্দনিকতার সাথে সমাজের সম্পর্কের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, নান্দনিকতার সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং পরিবর্তনকে নান্দনিক চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এর পর থেকেই অ্যাস্থেটিক্সের ফোকাস সাধারণ এস্থেটিকাল ভেল্যু এর ওপর মেটাফিজিকাল ও স্পিরিচুয়াল ইন্টারপ্রিটেশন থেকে সরে গিয়ে আর্টিস্টিক টেস্ট বা ফ্যাশনের সাথে সামাজিক সামাজিক গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কের দিকে চলে যায়।

কান্ট তার নান্দনিক দর্শনে গুড টেস্টের যে কোন স্ট্যান্ডার্ডকেই অস্বীকার করেছিলেন। তার মতে মেজোরিটির টেস্ট বা কোন সামাজিক গোষ্ঠীর টেস্ট কখনও ভাল রুচির মানদণ্ড হতে পারেনা। ক্রিটিক অফ জাজমেন্টে তিনি বলেন, সৌন্দর্য কারও সম্পত্তি নয়, বরং এটি হচ্ছে সাবজেক্টিভ ফিলিং এর ভিত্তিতে তৈরি হওয়া অ্যাস্থেটিক জাজমেন্ট। একটি জেনুইন গুড টেস্টের অস্তিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তাকে পরীক্ষা করে নির্ণয় করা যায় না। কোন স্ট্যান্ডার্ড বা জেনারেলাইজেশন দিয়েই উত্তম রুচি খুঁজে বের করা সম্ভব নয়, আর কোন শিল্পবিচারের বৈধতা কোন বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠী বা মেজোরিটির সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নয়। রুচি একই সাথে ব্যক্তিগত এবং যুক্তির ঊর্ধ্বে, আর তাই রুচি নিয়ে বিতর্ক কখনই সার্বজনীনতা লাভ করতে পারেনা। কান্ট এও বলেন, আমরা যা সাধারণত পছন্দ করি, সেই পছন্দগুলো কখনই আমাদের বিচার বা জাজমেন্টকে জাস্টিফাই করেনা। তার মতে, রুচির যে কোন জাজমেন্ট বা বিচারই এক ধরণের সার্বজনীন রুচিবোধ, বা রুচিবোধ নিয়ে সার্বজনীন ঐক্যমত্যকে ধরে নেয়। কিন্তু সেরকম সার্বজনীনতার তো কোন অস্তিত্ব নেই। এই অস্তিত্ববিহীন ঐকমত্যই আমাদের মধ্যে রুচির বিচার তৈরি করে, আর সেই সাথে রুচির উদ্ভবও ঘটায়। কিন্তু সকলে মেনে নিলেও এখানে কোন বিচারকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরা যায়না। যাই হোক, কান্ট তার এই নান্দনিক ধারণায় ফ্যাশনকে অন্তর্ভূক্ত করেননি, যাকে কেবল এম্পিরিকাল ফর্ম অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমেই বিচার করা যায়, সমাজে যে বস্তুর ভোগের চল দেখা যায়, যাকে নতুন ট্রেন্ড হিসেবে দেখা যায় তাই ফ্যাশন। আইডিয়াল কনসেন্সাসের সাথেও ফ্যাশনের সম্পর্ক নেই, কারণ এটি বারবার বদলায়। আর বর্তমানে কান্টের এই নান্দনিকতার সার্বজনীনতার অভাবও আজ প্রশবিদ্ধ। রুচিতে সবসময়ই একটি বিশ্বজনীন কমিউনাল ভয়েস দেখা যায়, যা মানুষের মধ্যকার শেয়ারড ফিলিংকে টারগেট করে।

পিয়েরে বোর্দো এই বিশুদ্ধ নান্দনিকতার কান্টিয়ান যুক্তির বিরোধিতা করে বলেন, শাসক শ্রেণীর রুচিই হচ্ছে সমাজের বৈধ রুচি। আর তিনি এও বলেন যে কান্ট যে জেনুইন গুড টেস্টের অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছেন তারও কোন অস্তিত্ব থাকতে পারেনা, কারণ এই বৈধ রুচি কেবলই একটি ক্লাস টেস্ট বা শ্রেণীরুচি। গিওর্গ সিমেলও এই ধারণাটি প্রস্তাব করেন, যিনি বলেন, আপার ক্লাসই ফ্যাশন সৃষ্টি করে, আর লোয়ার ক্লাস সেটাকে অ্যাডপ্ট করে নিলে আপার ক্লাস সেই ফ্যাশনকে ত্যাগ করে। কান্টিয়ান সেন্সে ফ্যাশন হচ্ছে একটি অ্যাস্থেটিক ফেনোমেনা, আনন্দের উৎস্য। তার কাছে সমাজে ফ্যাশনের ফাংশন কেবলই সামাজিক পার্থক্য বা সোশ্যাল ডিস্টিংকশনের একটা উপায়, যার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের মধ্যকার পার্থক্যের সৃষ্টি করে। পিওর অ্যাস্থেটিক্স থেকে তিনি ফ্যাশনকে বাদ দিয়েছিলেন কারণ এর প্রকৃতিটা যাদৃচ্ছিক, যখন তখন এর পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু গিওর্গ সিমেল সামাজিক কনটেক্সটে ফ্যাশনের গুরুত্ব খুঁজে পান। তিনি বলেন ফ্যাশন কোন একক বস্তুতে থাকে না, এটা গোটা সমাজের সাথে সম্পর্কিত, এটা একটা ফ্যাশন প্যাটার্নকে নির্দেশ করে। ফ্যাশন হচ্ছে ইন্ডিভিজুয়েশন, সোশ্যাল ডিস্টিংকশন, এমনকি ক্লাস ডিস্টিংকশনের একটা টুল, যা না উইটিলিটেরিয়ান বা উপযোগবাদী আর না অ্যাস্থেটিকাল বা নান্দনিক ক্রাইটেরিয়ায় পড়ে। তবে কান্ট আর সিমেল উভয়ই স্বীকার করেছিলেন যে ফ্যাশনের বাইরে থাকাটা পয়েন্টলেস।

ভোগ

রুচি এবং ভোগ একসাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত; নির্দিষ্ট ধরণের পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্যের পছন্দ হিসাবে রুচি সরাসরি বাজারে ভোক্তাদের পছন্দকে প্রভাবিত করে। রুচি এবং ভোগের মধ্যে কার্যকারণ যোগসূত্রটি ঘটনাগুলির সরাসরি শৃঙ্খলের চেয়ে বেশি জটিল যেখানে রুচি চাহিদা তৈরি করে, যেখানে রুচি ডিমান্ড বা চাহিদা তৈরি করে, আর এর মাধ্যমে এটি সাপ্লাই বা জোগান তৈরি করে। রুচি নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে, বিশেষত অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এগুলো নিয়ে কাজ হয়েছে।

এর ধ্রুপদী অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভোগ বা কনজাম্পশনকে একটি উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, তা হচ্ছে “সাপ্লাই তার নিজস্ব ডিমান্ড তৈরি করে।” অন্যকথায় মার্কেট গুডসের প্রোডাকশন থেকে নিজে নিজেই ভোগ বা কনজাম্পশন তৈরি হয়। মানে হলো বাজারে যা আসবে, মানুষ তাই ভোগ করবে। কিন্তু ভোগের এই সংজ্ঞাটা রুচির সাথে সম্পর্কবিধানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। থর্নস্টেইন ভেবলেন প্রদত্ত অধিকতর টেস্ট ও কনজাম্পশন নিয়ে জটিল ইকোনমিক মডেলে তিনি মানুষকে কেবলই তার প্রয়োজন অনুসারে ভোক্তা হিসেবে দেখতে নারাজ, এর বদলে তিনি সেই মানুষের মধ্যে টেস্ট বা রুচির সৃষ্টি ও তার ভোগ করার প্যাটার্ন সম্পর্কিত বিবেচনাকে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেন। তিনি ইকোনমিক সিস্টেমের ডিমান্ডের গুরুত্বকে অস্বীকার করলেন না, কিন্তু তিনি প্রিন্সিপাল অফ ইউটিলিটি-ম্যাক্সিমাইজেশনকে ঠিকই বাতিল করলেন। আর বললেন ক্লাসিকাল ইকোনমিক্সে আমরা যে ডিমান্ড ও সাপ্লাই নিয়ে পড়েছি, তাকে অবশ্যই রুচিকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

তার মতে মানুষ ছিল একটি প্রাণী যার মধ্যে টিকে থাকার জন্য অন্যদেরকে নকল করার একটা শক্তিশালী প্রবণতা রয়েছে। আমাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস আমাদের নিজেদের সম্পত্তির দ্বারাই অন্তত আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয় বলে, মানুষ সমাজের উচ্চ মর্যাদার লোকেরা যা যা ভোগ করে সেও তাই তাই ভোগ করতে চায়। টেস্ট ও মডার্ন কনজাম্পশনের ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়, রুচি আসলে অনুকরণ করার একটা প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষেরা একে অপরকে অনুকরণ করে, যার ফলে নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস ও প্রিফারেন্স তৈরি হয়, যা একসময় একটি নির্দিষ্ট পছন্দের পণ্য বা সেবার ভোগে অবদান রাখে। তিনি তার এই ধারণাটি নিওক্লাসিকাল হাইপোথিসিজ অফ ননস্যাশিয়েটির সাথে মার্জ করেন, যা বলে, মানুষ কখনই তার ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনা। তাই যাদের বিলাসিতা করবার সামর্থ আছে, তারা অন্যদের থেকে অধিকতর উন্নত সামাজিক পরিস্থিতিতে যেতে বাধ্য, কারণ সংজ্ঞা অনুসারেই বিলাস দ্রব্যের ভোগ তাকে একটি ভাল সামাজিক মর্যাদা দান করে। এটি নির্দিষ্ট কিছু লেইসার দ্রব্যের ওপর ডিমান্ড তৈরি করে, কিন্তু নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেনা। কিন্তু বেশিরভাগ ধনি ব্যক্তির বর্তমান রুচির কারণে এটি একসময় প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়।

একেক সময়ে ভোগ ও তার সামাজিক ফাংশন একেক রকম ছিল। ১৪শ শতকে ইংল্যান্ডে ভোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পলিটিকাল এলিমেন্ট ছিল। এসময় রাজতন্ত্র মুল্যবান বিলাস দ্রব্যের অভিজাত টেস্ট তৈরি করেই তার উচ্চ মর্যাদাকে লেজিটিমাইজ করত, আর রাজকীয়দের অনুকরণ করে অভিজাতগণ উচ্চতর সামাজিক মর্যাদার জন্য প্রতিযোগিতা করত। এই কনজাম্পশনের এই এরিস্টোক্রেটিক নকশার ইতি ঘটে যখন শিল্পবিপ্লবের পর কমোডিটিগুলোর রোটেশন দ্রুততর হয় আর এগুলোর দাম করে যায়, এর ফলে পূর্বে যাকে বিলাসদ্রব্য ধরা হতো তা আর আগের মত সামাজিক মর্যাদাকে নির্দেশ করে না, আর এই নির্দেশ না করার দিকটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। দ্রব্যের প্রোডাকশন ও কনজাম্পশনের স্কেল বড় হতে থাকলে, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কমোডিটির মধ্যে পছন্দ মত কোনটিকে বাছাই করার সক্ষমতা তৈরি হয়। আর এর ফলেই ফ্যাশনের বাজারের সৃষ্টি হয়। এই মাস কনজাম্পশনের যুগ নিয়ে এলো এক নতুন রকমের কনজাম্পশন ও টেস্ট প্যাটার্নকে। ১৮শ শতকের শুরু থেকেই এই সময়কালকে কনজাম্পশন বা ভোগের বৃদ্ধি ও ফ্যাশনের জন্ম দ্বারা বিশিষ্টায়িত করা যায়, যাকে কেবল সামাজিক মর্যাদা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না। এই সময়ে মানুষ আর তার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি বা উচ্চতর ক্লাসে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আর ভোগ করত না, ভোগ করত কেবলই ভোগের জন্য, ভোগবাদী হয়েই। এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ কখনই সন্তুষ্ট হয়না ঠিকই, কিন্তু সে বারবার অধিকতর অর্থ বা সুযোগের অনুসন্ধান করে যা দিয়ে সে তার ভোগের অতৃপ্ত কামনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। এই অবস্থায় টেস্ট বা রুচিকে এমন কিছু হিসেবে দেখা হয় যাকে কনজাম্পশন বা ভোগের পূর্বেই মেনে নিতে হয়, এমন কিছু যা কনজিউমার চয়েসের পূর্বেই অস্তিত্বশীল থাকে। অন্য কথায়, রুচিকে একজন ভোক্তা বা একটি সামাজিক গোষ্ঠীর প্রোপার্টির একটি গুণ হিসেবে দেখা হয়। এই এট্রিবিউটিভ টেস্টের ক্রিটিকাল একটি অল্টারনেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, স্বাধ কোন সম্পদ বা এট্রিবিউট হিসেবে অস্তিত্বশীল হয়না, বরং এটি নিজেই একটি এক্টিভিটি।

এদিকে অনেক দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেই ভোগকে, বিশেষ করে মাস কনজিউমারিজমকে সমালোচনা করা হয়েছে। ভোগকে পরিবেশগতভাবে অসমর্থনযোগ্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, একে খারাপ রুচির লক্ষণও বলা হয়েছে। অনেক সমালোচক সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী বিভেদ হ্রাসের ভয়ে গণসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, দাবি করা হয় যে ম্যাকডোনাল্ডসের মতো ফাস্ট ফুড প্লেসে একই হ্যামবার্গার পাওয়ার সুবিধা ঐতিহ্যগত রন্ধন-অভিজ্ঞতায় ভোক্তাদের আগ্রহ হ্রাস করতে পারে। কনজিউমারিজমের পশ্চিমা সংস্কৃতিকে এর ইউনিফর্মিতি বা অভিন্নতার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে। সমালোচকরা যুক্তি দেখান, যদিও কালচার ইন্ডাস্ট্রি ভোক্তাদের নতুন অভিজ্ঞতা এবং দুঃসাহসিক এডভেঞ্চারের প্রতিশ্রুতি দেয়, আসলে এখানে মানুষকে দ্রুত কিন্তু অস্থায়ী পরিপূর্ণতার একই প্যাটার্ন খাওয়ানো হয়। এখানে প্রস্তাব করা হয়, এখানে রুচিকে দমন বা রিপ্রেশনের একটি উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হয়; রুচিকে এখানে শাসক গোষ্ঠী বা মাস কালচার দ্বারা ঠিক করে দেওয়া হয়, আর তারাই এর দ্বারা প্রভাবিত হয় যারা ইচ্ছার সন্তুষ্টিমূলক এবং বিস্তৃত মতাদর্শ থেকে বঞ্চিত। এই সমালোচনা জোর দিয়ে বলে যে, জনপ্রিয় পশ্চিমা সংস্কৃতি মানুষকে নান্দনিক এবং সাংস্কৃতিক সন্তুষ্টিতে ভরিয়ে দেয় না।

সামাজিক শ্রেণী এবং ইমিটেশন ও ডিসটিংকশন

তর্কাতীতভাবে, রুচির প্রশ্নটি বিভিন্নভাবে সম্প্রদায়ের অন্তর্নিহিত সামাজিক বিভাজনের সাথে সম্পর্কিত। সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং পণ্যের পছন্দগুলিতে বিভিন্ন আর্থসামাজিক স্থিতির গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তারতম্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার দ্বারা প্রায়শই নির্দিষ্ট ধরণের শ্রেণীর রুচি সনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়াও, রুচি সম্পর্কিত অনেক তত্ত্বের মধ্যে, ক্লাস ডাইনামিক্সকে রুচির গঠন এবং পরিশীলন ও অশ্লীলতার ধারণাগুলির উদ্ভবের একটি প্রধান প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হয়।

সমাজতাত্ত্বিকরা সাজেস্ট করেন, একজন মানুষ প্রতিদিন কী ভোগ করছে তা তা বলে দেয় তার রুচি কেমন, আর তার রুচি বলে দেয় সোশ্যাল হায়ারার্কিতে তার অবস্থানটা কী। নির্দিষ্ট কনজিউমার গুড, এপিয়ারেন্স, ম্যানার ইত্যাদিতে তার পছন্দ তার স্ট্যাটাস সম্পর্কে নির্দেশ করে। আবার ক্লাস স্ট্রাকচারই ঠিক করে দেয় ব্যক্তির রুচির প্যাটার্ন কেমন হবে। রুচিকে স্ট্যাটাস কম্পিটিশনের ফাংশন হিসেবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সোশ্যাল এম্যুলেশনের মডেলে একে ইন্টারপ্রেট করা হয়। ধরে নেয়া হয়, প্রথমত, মানুষ সোশ্যাল হায়ারার্কিতে নিম্ন মর্যাদার লোকেদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে চায়, আর দ্বিতীয়ত, মানুষ তার উচ্চতর অবস্থানের লোকেদেরকে অনুকরণ করতে চায়। জার্মান সমাজতাত্ত্বিক গিওর্গ সিমেল (১৮৫৮-১৯১৮) এই ফ্যাশনের ফেনোমেননকে পরীক্ষা করেন, যেখানে রুচির দ্রুত পরিবর্তনের একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছিল। সিমেলের মতে, ফ্যাশন হচ্ছে সোশ্যাল ক্লাসগুলোর একতাকে শক্তিশালী করার আর তাদেরকে ডিস্টিংক্ট করার উপায়। আপার ক্লাসের লোকেরা তাদের সুপিরিয়রিটিকে বোঝাতে চায়, আর তাই তারা নতুন ট্রেন্ডের সূচনাকারী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আপার-ক্লাস টেস্টকে দ্রুত মিডল ক্লাস অনুকরণ করে। এভাবে দ্রব্য, এপিয়ারেন্স, ম্যানার ইত্যাদিকে যা প্রথমে হাই-ক্লাস হিসেবে পরিচিতি পায় তা জনপ্রিয় হয় ও সাধারণ লোকদের দ্বারা চর্চিত হয়। এর ফলে যেসব দ্রব্যের ফাংশন বা কাজ ছিল আপার ক্লাসকে ডিফারেনশিয়েট করা বা তাদেরকে নিচের ক্লাসগুলো থেকে ভিন্ন করে সুপিরিয়রিটি তৈরি করা সেগুলো তার সেই ফাংশনটিকে হারিয়ে ফেলে। এর ফলে আপার ক্লাস এবার আরও বেশি স্টাইলিস্টিক ইনোভেশন সামনে আনে, নতুন ট্রেন্ড তৈরি করে, আর এভাবেই নতুন নতুন ফ্যাশনের সৃষ্টি হয়।

এরপর অর্থনীতিবিদ থর্নস্টেইন ভেবলেন (১৮৫৭-১৯২৯) আপার ক্লাসের এই বিশেষ টেস্ট নিয়ে আরও বিশ্লেষণ করলেন। তিনি বললেন, নিজেদেরকে প্রোডাক্টিভ লেবরের হার্ডশিপ থেকে আলাদা করাটা সবসময়ই উচ্চ সামাজিক মর্যাদার কনক্লুসিভ সাইন ছিল। তাই লোয়ার ক্লাস যেসব জিনিসকে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করে সেগুলো দিয়ে আপার ক্লাস টেস্টকে কখনও নির্ণয় করা যায়না। নিজেদের নন-প্রোডাক্টিভিটিকে দেখানোর জন্য তথাকথিত লেইসার ক্লাস একই সাথে প্রচুর সময় ও দ্রব্যের অপচয় করে। এদিকে তার নিচু স্তরের লোকেরা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে আপার ক্লাসের এই নন-প্রোডাক্টিভ লাইফস্টাইলকে অনুকরণ করে, যদিও তাদের কাছে আপার ক্লাসকে ধরার মত উপায় নেই।

শ্রেণী-ভিত্তিক রুচি নিয়ে যেসব তাত্ত্বিক কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বোর্দো (১৯৩০-২০০২), যিনি বলেছিলেন, সামাজিক শ্রেণীগুলোর টেস্ট সামাজিক কর্মের সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কিত মূল্যায়নের ভিত্তিতে গঠিত। কিছু পছন্দ সবার পক্ষে সমানভাবে সম্ভব নয়। সীমাবদ্ধতাগুলি কেবল এই কারণে নয় যে বিভিন্ন শ্রেণীর সদস্যদের কাছে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থনৈতিক সম্পদ রয়েছে। বোর্দো বলেন, উল্লেখযোগ্য অ-অর্থনৈতিক সম্পদ ও তাদের বিতরণও সামাজিক স্তরায়ন এবং বৈষম্যকে প্রভাবিত করে। এই ধরনের একটি সম্পদ হল সাংস্কৃতিক মূলধন বা কালচারাল ক্যাপিটাল, যা মূলত শিক্ষা এবং সামাজিক উৎসের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটি সাংস্কৃতিক পার্থক্য করার জন্য সঞ্চিত জ্ঞান এবং দক্ষতা নিয়ে গঠিত। কালচারাল ক্যাপিটালের অধিকারী হওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি সামাজিক কর্মের জন্য সম্ভাব্য সুবিধা, শিক্ষার প্রমাণপত্রাদি, পেশা এবং সামাজিক সম্পৃক্ততায় প্রবেশাধিকার লাভ করে।

ভোগের ধরন এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূলধন বিতরণের মধ্যে সম্পর্ক মূল্যায়ন করে বোর্দো ১৯৬০ এর দশকের ফরাসি সমাজের মধ্যে স্বতন্ত্র শ্রেণীর রুচি চিহ্নিত করেছিলেন। উচ্চশ্রেণীর রুচি পরিশোধিত এবং সূক্ষ্ম পার্থক্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, এবং এটি নান্দনিক অভিজ্ঞতার উপর অভ্যন্তরীণ মূল্য স্থাপন করে। এই বিশেষ ধরণের রুচি ফরাসি সমাজে “ভাল রুচির” বৈধ ভিত্তি হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিল, অন্যান্য শ্রেণীও তা স্বীকার করেছিল। ফলশ্রুতিতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে উচ্চশ্রেণীর আচার-আচরণ ও জীবনধারাকে অনুকরণের একটি “সাংস্কৃতিক সদিচ্ছার” অনুশীলন দেখা যায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রুচি উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মত নান্দনিকতার অথেনটিক এপ্রিসিয়েশন দিয়ে নির্ধারিত হয়না, বরং তা নির্ধারিত হয় সামাজিক মর্যাদায় প্রতিযোগিতা করার আকাঙ্ক্ষার দ্বারা। অন্যদিকে বিপরীতে, শ্রমিক শ্রেণীর পপুলার টেস্ট তৈরি হয় “প্রয়োজনীয় বিষয়কে নির্বাচন” করার বাধ্যবাধকতা থেকে। সেক্ষেত্রে নান্দনিকতার উপর খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। হতে পারে তাদের এই রুচি গঠিত হয় তাদের তাদের আসল বস্তুগত অভাবের ওপর ভিত্তি করেই, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ছাড়া আর সবকিছুকে তারা বাদ দিয়ে দেয়। কিন্তু এর পেছনে আরেকটা কারণ হচ্ছে তাদের অভ্যাস, যা কালেক্টিভ ক্লাস এক্সপেরিয়েন্স থেকে তৈরি হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র যেমন খাদ্য, পোশাক, শিল্প, রসিকতা, এমনকি ধর্মের ক্ষেত্রেও এই ক্লাস-ভিত্তিক রুচি ধরা পড়ে।

রুচির তত্ত্বগুলো যেগুলো স্ট্যাটাস কম্পিটিশন ও সোশ্যাল এম্যুলেশনের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা হয়েছে। প্রথমত, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকলাপকে স্ট্যাটাস কম্পিটিশনে নিয়ে আসা যুক্তিসঙ্গত নয়; চিহ্নিত করা এবং দাবি করা স্ট্যাটাস একটি শক্তিশালী প্রণোদনা হলেও মানুষের অন্যান্য অনুপ্রেরণাও রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটা অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত নয় যে রুচি এবং জীবনধারা সর্বদা উচ্চশ্রেণী থেকে নীচের দিকে ছড়িয়ে যায়, এবং কিছু পরিস্থিতিতে রুচির বিচ্ছুরণ বিপরীত দিকে যেতে পারে। এটাও যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে সামাজিক শ্রেণী এবং রুচির মধ্যে সম্পর্ক আর আগের মতো শক্তিশালী নয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকরা দাবি করেছেন যে গণ সাংস্কৃতিক পণ্যের প্রসার পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণীগত পার্থক্যকে অস্পষ্ট করে দিয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর সদস্যদের দ্বারা নিষ্ক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত পণ্যগুলি কার্যত একই, এদের মধ্যে কেবল ব্র্যান্ড এবং ঘরানা সম্পর্কিত উপরি উপরি পার্থক্যই থাকে। অন্যান্য সমালোচনা উত্তরআধুনিক সংস্কৃতির অ-শ্রেণীভুক্ত প্রভাবের উপর মনোনিবেশ করেছে; এগুলো বলছে ভোক্তার রুচি এখন ঐতিহ্যগত সামাজিক কাঠামো দ্বারা কম প্রভাবিত হয়, এবং তারা যে দ্রব্যকেই আনন্দদায়ক বলে মনে করে তা নিয়ে চীরকালব্যাপী নিজেদেরকে রিডিফাইন করার জন্য ভাসমান সিগ্নিফায়ারের সাথে খেলায় জড়িত থাকে।

খারাপ রুচি

খারাপ রুচি বা ব্যাড টেস্ট (যার মধ্যে অশ্লীল রুচিও অন্তর্গত) বলতে সাধারণত যেইসব বিষয়ের রুচি বোঝায়, যে বিষয়টি ব্যক্তির নরমাল সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পড়েনা। এটা একেক সমাজে, একেক সময়ে একেক রকম হয়। একে সাধারণত নেতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখা যায়, কিন্তু সেটাও ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। এলিজাবেথিয়ান বা জ্যাকোবিন পিরিয়ডে প্রচুর পরিমাণে ড্রামেটিক ভার্সের ব্যবহারকে গুড টেস্ট ধরা হতো, কিন্তু আজ তাকে বোম্বাস্ট বা আড়ম্বরপূর্ণতার জন্য ব্যাড টেস্ট বলা হবে, কেননা আজকের দিনের লোকেদের কাছে সেগুলো হচ্ছে হাই সুন্ডিং ল্যাংগুয়েজ যেগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ খুব কম।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.