Table of Contents
বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা
বসতি : রাখাইন জনগোষ্ঠী সুদীর্ঘকাল হতে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করে আসছে। বর্তমানে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলা এবং বরিশাল (বাকেরগঞ্জ) বিভাগের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় রাখাইন জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। রাখাইনদের ৮০% বাস করে কক্সবাজার জেলায়। কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলাসমূহ কয়েক শতাব্দী পূর্ব হতে রাখাইনদের আবাসভূমি ছিল। ঐ সকল এলাকাসমূহ রাখাইন জনগোষ্ঠীর জাতীয় উত্থান-পতনের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে। একসময় এ এলাকাগুলো রাখাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই জেলার উত্তরে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে বান্দরবান ও নাফ নদী (মায়ানমার সীমানা)। পটুয়াখালী সাবেক বাকেরগঞ্জ জেলার একটি মহকুমা ছিল। ১৯৬৯ সালে ১ জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলা গঠিত হয়। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা এবং কলাপাড়া উপজেলায় রাখাইন জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বরগুনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। রাখাইন জনগোষ্ঠী বরগুনা সদর এবং আমতলী এই দুটি উপজেলায় বসবাস করছে।
জনসংখ্যা : ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে রাখাইনদের জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৭,০০০। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত একটি তথ্য অনুসারে রাখাইনদের জনসংখ্যা ৩৫,৫১০ জন। (কারিতাস বাংলাদেশ প্রণিত দ্বিতীয় এশিয়া প্যাসিফিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্প ১৯৯৫ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ স্মরণিকা ‘সংহতি প্রত্যাশায় আদিবাসী/উপজাতি’, পৃ. ৫)। বাংলাদেশের রাখাইন জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় করা কঠিন ব্যাপার। তবে যতটুকু সম্ভব এলাকা ভিত্তিক সংগৃহীত তথ্যাদিসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত কক্সবাজার (কক্সাবাজার সদর, রামু, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ), পটুয়াখালী (কলাপাড়া, গলাচিপা) ও বরগুনা (বরগুনা সদর, আমতলী) এই তিনটি জেলাসহ চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় বসবাসরত রাখাইনদের জনসংখ্যা (২০০৪-২০০৯) হচ্ছে প্রায় ২৫,৫১০। (উইকিপিডিয়া)। উল্লেখ্য যে, সরকারি আদমশুমারির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের রাখাইনদের জনসংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। রাখাইনদেরকে নিয়ে অদ্যাবধি গ্রহণযোগ্য কোনো ধরনের আদমশুমারি পরিচালনা করা হয়নি বলে রাখাইনদের জনসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক রয়েছে। তবুও বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে এটাই বলা যায় যে, রাখাইনরা এদেশের একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং দেশের সমগ্র রাখাইন ক্রমশ: ভিটাহীন ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে চলেছে। বাংলাদেশের রাখাইনরা সমতলের এই তিন জেলা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায়ও সুপ্রাচীন কাল হতে বসবাস করে আসছে। এ ছাড়াও আরাকান ভূখণ্ডে বর্মী আগ্রাসনের সময় ব্রিটিশ আমলে অনেক রাখাইন পার্বত্য এলাকাসমূহে আশ্রয় নেয়। আবার পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে সমতল তিন জেলার রাখাইনদের মধ্যে পার্বত্য জেলাসমূহে বসতি স্থাপনের প্রবণতা দেখা দেয়। ফলে তিন পার্বত্য জেলায় রাখাইনদের জনসংখ্যাও কম নয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি
জাতির উৎপত্তি : পণ্ডিতমহলের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৪০০০ সময়ে যথাক্রমে নেগ্রিটো এবং দ্রাবিদিয়ান জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিল আরাকান। পরবর্তীকালে আর্য ও মঙ্গোলিয়রা এখানে বসবাস শুরু করে আগন্তুক দ্রাবিদিয়ানরা প্রথম জনগোষ্ঠী নেগ্রিটোদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। দ্রাবিদিয়ানদেরকে আবার তুলনামূলকভাবে অগ্রসর আর্য ও মঙ্গোলিয়রা বিতাড়ন করতে থাকে। পরবর্তীতে আর্য ও মঙ্গোলিয়দের সংমিশ্রণে রাখাইন জাতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ইতিহাসে সাক্ষ্য মেলে। ‘রক্ক্ষপুরী’ বা ‘রক্ক্ষ বংশ’ হতে ‘রাখাইন’ নামকরণ এবং ‘রক্ক্ষ’ বা ‘আরক্ক্ষ’ শব্দ হতে ‘আরাকান’ নামটি উৎপত্তি হবার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে অনেকে মনে করেন। মানব সমাজের উত্থান-পতন এবং হাজার বছরের বিবর্তনের মাঝেও রাখাইন সমাজ স্বকীয় নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি ও সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মকে রক্ষা করে রক্ষ বংশের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তৃতীয় ধান্যবতী যুগের (৫৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-৩৪০ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠাতা চান্দাসূরীয় রাজার একান্ত অনুরোধে বুদ্ধ সশরীরে উপস্থিত হয়ে রাখাইন জাতিকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ফলে ধান্যবতী রাজ্য (আরাকান) তৎকালীন জম্বুদ্বীপে (ভারতবর্ষ) বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী দেশসমূহের মাঝে অন্যতম প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নেয়ায় এই বঙ্গভূমির সাথে নিঃসন্দেহে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. উ টিং হ্লাছ তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভে বৈশালী যুগে (৩২০-৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ) আরাকান সাম্রাজ্যের পরিসীমা বর্ণনায় ‘পশ্চিমে ভাগীরথি নদী, উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, উত্তর-পূর্বে ছাংটয় নদী, পূর্বে ইরাবতী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর’ বলে উল্লেখ করেন। সুতরাং এ বাংলার ভূ-খণ্ডে রাখাইনদের পদচারণা সুদীর্ঘ সহস্রাধিক বছরের ইতিহাস। ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাখাইন মহা রাজাওয়েন ক্রী’ (রাখাইন মহান ইতিহাস) এর বিবরণ মতে, মগধের রাজা ‘মগধদেব’-এর পৌত্র রাজকুমার সাগর নতুন রাষ্ট্র কায়েম করার লক্ষে দশ হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে গুরু মুণিবরকে সঙ্গে করে অভিযানে বের হলে কচ্চুপ নদীর বাম তীরে এক নিম্ন বনভূমিতে উপস্থিত হন। বনের লতাপাতা ও ফলমূল মধুর ন্যায় মিষ্টি এবং সুস্বাদু হবার কারণে মুণিবর উক্ত স্থানে নগর প্রতিষ্ঠা করতে রাজকুমারকে নির্দেশ করেন। বুধ ও রাহু গ্রহের সংক্রান্তির দিনক্ষণ কালীন নগরের ভিত্তি স্থাপিত হয়। উত্তরাভিমুখে এসে মধুময় সুস্বাদু ফলমূলভরা ভূমিতে নগর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নগরটি ‘উত্তরা মধুনগর’ নামকরণ করা হয় এবং বুধ ও রাহু গ্রহের প্রভাবে নগরটি স্থাপন করে রাজ্য কায়েম হওয়ায় দেশের নাম ‘রাক্ক্ষাপুরী’ এবং জাতির নাম ‘রাক্ক্ষাইন’ নামকরণ হয়েছে। বুধ বা রাহু গ্রহের প্রভাবে রাক্ক্ষাপুরী ও রাক্ক্ষাইন জাতির উৎপত্তি হয়েছে বিধায় বুধবার রাখাইন জাতির জন্মদিন হিসেবে বুধবারে অমঙ্গলসূচক কার্যকলাপ হতে বিরত থাকে এবং বুধবার দিনে রাখাইনরা মরদেহ সৎকার করে না। অদ্যাবধি নিয়মটি প্রচলিত আছে। উত্তরা মধুনগর স্থাপিত হবার কাল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর। এরপর দ্বারবতী ও বৈশালী নগর কায়েম হয়। তখন নরখাদক রাক্ষসগণের উৎপাত্তের জন্য জনসাধারণের মনে অশান্তি দেখা দেয়। এমতাবস্থায় বৈশালীর শেষ রাজা ব্রহ্মসিদ্ধির রাক্ষসদের হাতে মৃত্যু হয়। কপিলাবস্তুর রাজা অর্জুন সন্ন্যাসবাদ গ্রহণ করে শান্তির অন্বেষণে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। বনে বনে ঘুরতে তিনি একদিন ইন্দামায়ু নামক একজন নারীর দেখা পান এবং তার সেবাযত্ব গ্রহণ করেন। কালক্রমে ইন্দামায়ু দেবীর সাথে তার প্রণয় ঘটে। ফলে পুত্র সন্তান মারায়ু কুমারের জন্ম হয়। এলাকার ম্রো গোত্রের প্রধান ‘ঙাঅংলা’এর লালন পালনে মারায়ু বড় হন। তিনি বড় হলে গোত্র প্রধানের কন্যার সাথে বিয়ে দিয়ে মারায়ুকে তাদের রাজা করা হয়। রাজা মারায়ু ঐ সকল রাক্ষসকে হত্যা করে বৈশালী নগরীকে দখল করে নেন এবং রাজকন্যা রুচিমালাকে বিয়ে করে বৈশালীর রাজা হিসেবে অভিষেক গ্রহণ করেন। রাক্ষসগুলোকে হত্যা করে বৈশালী নগর দখল নেওয়া হয়েছে বলে নগরের নাম ‘রাক্ষাপুরী’ করা হয়েছে। পরবর্তীতে রাক্ষসদের উৎপাতে বৈশালী নগরী বিভীষিকাময় নগরীতে রূপান্তরিত হয়ে অপবিত্র ও অমঙ্গলজনক হয়ে যায় বিধায় রাজা মারায়ু বৈশালী নগরকে ত্যাগ করে ‘ধান্যবতী নগর’ স্থাপন করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ অব্দে। প্রবাদ আছে যে, রাখাইন জাতির উৎপত্তি হয়েছে রাজা মারায়ু হতে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫-১৫০০ পর্যন্ত ছিল প্রথম ধান্যবতী যুগ। রাজা মারায়ু হতে আরম্ভ করে তার ৫৭ জন উত্তরসূরি বংশ পরম্পরায় ১৮২৫ বছর যাবৎ আরাকান সাম্রাজ্য শাসন করেন। প্রথম ধান্যওয়ার্দী যুগ আরম্ভ হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ হতে এবং মারায়ু যুগের শেষ ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫,০০০ বছর অধিক কাল ধরে রাখাইন সমাজে শাসন করেছেন মোট ২২৯ জন রাজা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর পূর্বে ‘উত্তরা মধুনগর’ স্থাপিত হবার সময় প্রাগৈতিহাসিক যুগে রাক্ষাপুরী ও রাখাইন জাতির নামকরণ হয়েছে। উক্ত নামকরণের ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ অব্দে প্রথম ধান্যবতী যুগের জন্মলগ্নে রাক্ষাপুরী বা রাখাইন নামকরণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। অদ্যাবধি সুদীর্ঘ আট হাজার বছরের বেশি কাল যাবৎ প্রচলিত আছে। সুতরাং এক অর্থে রাখাইন মানে রক্ষণশীল জাতি অর্থাৎ যে জাতি বা গোষ্ঠী স্বকীয় জাতীয় পরিচয়, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় কৃষ্টিসমূহকে অক্ষুণ্ণভাবে রক্ষা করে।
বসতি স্থাপনের ইতিহাস : খ্রিস্টপূর্ব কাল হতে বঙ্গদেশের সাথে রক্ক্ষাপুরীর (আরাকান) রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যোগসূত্র ছিল। বঙ্গদেশ এবং আরাকান পাশাপাশি ভূখণ্ড এবং স্থল ও জল পথে যোগাযোগের কোনো অসুবিধা ছিল না। এ সকল সুযোগ সুবিধার কারণে বঙ্গভূমির উপর আরাকান রাজারা শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রভূত্ব বিস্তার করে আসছে। রাখাইন জনগোষ্ঠী চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে এসেছে। নিম্নে এর ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করা হলো –
- বৈশালী যুগ (৩২০-৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ) : এ সময় থেকে রাখাইনদের পদচারণা এ বঙ্গদেশ পর্যন্ত ব্যাপৃত ছিল বলে ধারণা করা যায়। কারণ এ সময়ে কুমিল্লা অঞ্চলের শাসকচক্র গুপ্ত ও পাল বংশের সাথে আরাকানে বৈশালী যুগের চন্দ্রবংশের শাসকদের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়। ঐ যুগে নির্মিত বিভিন্ন দ্রব্যাদির সাথে আরাকানের তৎকালীন নির্মিত দ্রব্যাদির সাথেও সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ১৯৬৯ সালে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. উ টিং হ্লাছ এর পিএইচডি গবেষণাকর্মে বৈশালী যুগে আরাকান সম্রাজ্যের পরিসীমা বর্ণনায় পশ্চিমে ভাগীরথী নদী, উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, উত্তরপূর্বে ছাংটয়ংনদী, পুর্বে ইবাবতী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বলে উল্লেখ করেন।
- ম্রাউকউ (Mrauk) দ্বিতীয় স্বর্ণালী যুগ (১৫৩১-১৬৩৮ সাল) : ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের সিংহাসনে ‘মাঙবাগ্রী’ রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে তিন লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে পূর্ববঙ্গে আক্রমণ চালিয়ে ১২টি শহর অধিকার করে নেন। অতপর তিনি মুর্শিদাবাদ নগরকে আরাকান সাম্রাজ্যভুক্ত করে সেনাপতি মানুহাকে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সমেত মুর্শিদাবাদের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন। এ রাজা আরাকান সাম্রাজ্যের সীমানা ঘোষণাকালে বলেন, রাজশক্তি বলে রাহ্মাপুরার সীমানা বিস্তৃত হয়েছে কুমিল্লা নগর অবধি, দক্ষিণ পশ্চিমে রংপুর শহর আর পশ্চিমে সিলেট পর্যন্ত। (১৯৯৪ সালে রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের প্রকাশিত “দি রাখাইন রিভিউ’ ১ম খণ্ড)। রাজা মাঙরাজাগ্রী ১৫৯৩ সালে আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি পার্শ্ববর্তী টংঙু রাজার আবেদনের প্রেক্ষিতে আরাকানের দীর্ঘকালের শত্রু হংসবতীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে হংসবতী দখল করে নেন এবং বিজিত রাজা আরাকান রাজার নিকট বশ্যতা স্বীকার স্বরূপ রাজকন্যা খিংমানংকে (সাংহনং) অজস্র মূল্যবান রত্নাদির সাথে উপঢৌকন হিসেবে নিবেদন করেন। পরে মাঙরাজাগ্রী হংসবতীর রাজকুমারী খিংমানংকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং খিংমানং-এর ভ্রাতা রাজকুমার মংচপ্যাইংকে চট্টগ্রাম এলাকায় শাসক হিসেবে পাঠিয়ে দেন। বোমাং সার্কেলের চিফ বর্তমান বোমাং রাজাদের পূর্বপুরুষ হলেন এই মংচপ্যাইং (ঞোম্রা, ডিসেম্বর ১৯৯৭, ‘কুঙ: বঙ হ্রাপুঙদ’, ম্রাবতী চাবেদই, আঙঃজিঙঃ, ম্রোহ্নে, রেঙ্গুন)। ১৬১২ সালে (৯৪৭ রাখাইন অব্দ) মাঙরাজাগ্রী চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ১. মাবোথং, ২ ফালেংথং, ৩. রেক্রেথং, ৪ প্যারেথং, ৫. ম্রুং থং, ৬. ক্যাউমাছাথং, ৭. ঙা খোয়েথং, ৮. রিপা চোয়েথং, ৯. কুংচোয়েথং, ১০ ক্যাউ ফ্যাথং, ১১ টালাৎ ছংথং, ১২ নেন ট্যাৎ থং ইত্যাদি স্থাপন করেন। প্রতি এক হাজার পরিবার নিয়ে এক একটি ‘থং’ গঠিত হয়। ‘থং’সমূহের বাসিন্দাদেরকে ‘থং ছা’ নামে গণ্য করা হতো এবং নদীর তীর ঘেঁষে যারা থাকতো তাদেরকে ১. পেংছারি খ্যাং, ২. ছ্যাংখ্যাং, ৩. রেপঅ্ খ্যাং, ৪, ঝে, ৫. খ্যং, ৬. ম্রো ছাই খ্যং ইত্যাদিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে আরাকানে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বৃত্ত জনসাধারণকে নিয়ে ১. টালাৎ ছেইথং, ২. লহিংথং, ৩. রূপথং, ৪ বেইছংথং, ৫ মিন্থং, ৬ টেন ছেই থং, ৭ মারোঃ থং, ৮. ঈালাৎ থংসমূহ নির্মাণ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেন।
- ম্রাউক উ তৃতীয় যুগ (১৬৩৮-১৭৮৪ সাল) : ১৬২২ সালে আরাকান সিংহাসনে শ্রীসুধর্ম রাজা সিংহাসনে আরোহণ করার পর আরাকানের লংক্রাৎ প্রদেশের শাসক ঙাকুছালা এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরাকানাধিপতি শ্রীসুধর্মরাজাকে হত্যা করেন। তিনি ‘নরপতি’ নাম ধারণ করে নিজেকে আরাকানের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে সমগ্র আরাকানে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরূপ অনিশ্চিত পরিবেশের কারণে রাজ পরিবারের সদস্যবর্গ, মন্ত্রী, পণ্ডিত এবং শীর্ষ স্থানীয় পুরোহিতগণ প্রাণ রক্ষার্থে অসংখ্য অনুগামীকে সাথে করে কর্ণফুলি, শংখ, মাতামুহুরি, বাকখালী নদীসমূহের তীরবর্তী এলাকায় এসে জনপদ গড়ে তোলে। মূলত এ সময়কাল থেকেই আরাকানের বিপর্যয় শুরু হয়। আরাকানে বিশৃঙ্খলা, অনৈক্য আর ক্ষমতার লড়াই নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ১৬৬৬ সালে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খানের আক্রমণ থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। মোগল বাহিনী দুই সহস্রাধিক রাখাইন সৈন্যকে আটক করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। অসংখ্য রাখাইন প্রাণ বাঁচানোর জন্য মূল আরাকানে পালিয়ে গেলেও অধিকাংশই মোগল বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হন। আরাকানে পালিয়ে আসা রাখাইনদেরকে তৎকালীন আরাকান রাজা ‘চান্দা সুধর্মারাজা’ লেম্রো নদীর তীরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। আর অবশিষ্টরা চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল ও পার্বত্যাঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৭০৯ সালে আরকানের রাজা হিসেবে ‘চান্দা বিজয়’ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর শাসনামলে চট্টগ্রামকে পুনরুদ্ধারের জন্যে একবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ঐ সময় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে পুনর্বাসনের জন্য ১৭১১ সালে ১ ছাৎপ্রেক্যাথং, ২.কাইকাটেংথং, ৩. লেম্রোছাথং ও ৪.উয়েইনছা থং-সমূহ নির্মাণ করা হয়। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজা বোদ মংওয়েইং আরকানের রাজা থামাদাকে হত্যা করে সমগ্র আরাকান দখল করে নেন। দখলদার বর্মী বাহিনী আরাকানবাসীদেরকে হত্যা, লুট ও নির্যাতনের মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ গড়ে তোলে। এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাবার আশায় এবং স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নিমিত্তে অসংখ্য রাখাইন এককালে নিজেদের সাম্রাজ্যভুক্ত এবং তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক শাসিত দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৭৯৪ সালের মধ্যেই আরাকানে দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক স্বদেশের মায়া ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যায়। শুধু উক্ত বৎসরেই ১০,০০০-এরও বেশি সংখ্যক রাখাইন চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসে। ক্যাপ্টেন হিরেম কক্স তাঁর রক্ষিত ডায়েরিতে ‘ক্ষুধা ও অসুখে দৈনিক ২০ জন করে রাখাইন শিশুর মৃত্যুবরণ, নাফ নদীতে ভেসে থাকা অসংখ্য রাখাইন মৃতদেহ, আরাকান-চট্টগ্রাম সড়কে অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং মৃত মাতার বুক থেকে দুধ পানরত অসহায় শিশুদের’ করুণ কাহিনী বিবৃত করেন। ১৭৯৩ সালে দশ সহস্রাধিক রাখাইন চকরিয়া হারবাং অঞ্চলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৮০১ সালে জানুয়ারি মাসের পূর্ণিমা দিনে (বুধবার) নব্বই হাজারাধিক রাখাইনকে নিয়ে রাখাইন বিপ্লবী নেতা বোশাংব্যেন (কিংবেরিং) চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসেন। ১৮১৩ সালে রামু শহরে ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের অধিকর্তা ক্যাপ্টেন ফুগো তাঁর প্রতিবেদনে রামুর পার্শবর্তী ১২ মাইলের ভিতর লক্ষাধিক রাখাইনের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। ১৮২০ সালের (রাখাইন ১১৯২ অব্দ) ডিসেম্বর মাসে ৭৪টি পরিবারের মোট পাঁচ শতাধিক সদস্য বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে ‘বালিয়াতলী’ দ্বীপে চলে আসে। ১৮২২ সালে আরও ৬০টি পরিবারের তিন শতাধিক সদস্য আরাকানের ধান্যবতী হতে বাকেরগঞ্জ এলাকায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ ছাড়াও ১৭৮৪ সালে আরাকানের স্বাধীনতা লুপ্ত হয়ে যাবার পর দখলদার বৰ্মী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন, হত্যা ও আটক করে বার্মায় নিয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় দুই লক্ষের অধিক রাখাইন ভারতের ত্রিপুরা ও মণিপুর রাজ্যে চলে যায়। এভাবে সুদীর্ঘকাল হতে এই ভূখণ্ডে রাখাইনরা বসতি স্থাপন করে এসেছে। (রাখাইন রিভিউ, ১ম খণ্ড)। বর্মী সৈন্যদের অত্যাচার ক্লিষ্ট আরকানিদের (রাখাইন) চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বাখেরগঞ্জ (পটুয়াখালী, বরগুনা) জেলার দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণের নেপথ্যে নিম্নোক্ত কয়েকটি কারণ ক্রিয়াশীল ছিল –
-
- ক. ভৌগোলিক দিক থেকে চট্টগ্রামাঞ্চল ছিল আরাকান সন্নিহিত;
- খ. বার্মা নিকট প্রতিবেশী দেশ হলেও আরাকান বর্মীদের জন্য ছিল শত্রুরাজ্য;
- গ. চট্টগ্রামাঞ্চলের সাথে ছিল আরাকানের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ;
- ঘ. বিদ্রোহ পূর্বকালে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল ছিল আরাকানি উপনিবেশ;
- ঙ. চট্টগ্রাম ছিল অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট, শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিদ্যমান, ব্রিটিশ অধিকৃত ভূখণ্ডে রাজস্ব যুক্তিযুক্ত এবং একজন লোক পরদিন প্রত্যুষে কোনো না কোনো কর্মচারীর আদেশে তার প্রাণদণ্ড হবে – এ আশংকা ছাড়াই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে;
- চ. চট্টগ্রামকে আশ্রয় করে ভবিষ্যতে বর্মীদের কবল থেকে নিজেদের রাজ্য উদ্ধারের জন্য আক্রমণ করা;
- ছ. পতিত জমিকে জনবহুল আবাদি করে তোলার অভিপ্রায়ে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় রাখাইনদের একটি দল সরাসরি আরাকান অথবা চট্টগ্রাম থেকে বাকেরগঞ্জ তথা বৃহত্তর পটুয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় লাভ করে।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে রাখাইন আদিবাসীদের ভূমিকা : বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাখাইন জনগোষ্ঠীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য উ. সুয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার নিবাস হচ্ছে পটুয়াখালী জেলায় কলাপাড়া থানা সদরে। কলাপাড়ায় আরেকজন সংগ্রামী রাজনীতিক থৈনঅংজাই মাস্টার পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। উক্ত দুজন ব্যক্তি পরবর্তী কালে বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ (ন্যাপ) সাথে সম্পৃক্ত হন এবং এলাকায় নেতৃত্ব প্রদান করেন। তৈনজাই মাস্টার স্বাধীনতা সংগ্রামকালে কলাপাড়া ও আমতলী থানা সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে রাখাইনরা বরগুনা জেলার তালতী এলাকায় রাখাইনপাড়ায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। রাখাইন যুবকগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করে। রাখাইন পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখাইনরা সকলে মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা তালতলী থানার আগাঠাকুর পাড়াতে শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারকে স্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। স্থানীয় পাড়ার লোকজনসহ বিহারাধ্যক্ষ উ ক্যাহ্রাসা মহাথেরো মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিক সহযোগিতা প্রদান করেন। এভাবে শুধু বরগুনা জেলার তালতলীতে নয়, প্রতিটি প্রতিটি রাখাইন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রদান করে খাওয়াদাওয়া ও টাকাপয়সার ব্যবস্থা করে রাখাইনরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, আরো একটি অজানা কথা জানা আবশ্যক। বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পলাতক অবস্থায় কক্সবাজার জেলা সার্কিট হাউজ পাহাড় সংলগ্ন বাহারপাড়া বৌদ্ধ বিহারে বেশ কয়েকদিন যাবৎ আত্মগোপন করেছিলেন। বিহারাধ্যক্ষ উ চান্দিমা মহাথেরো (প্রয়াত) বিশেষ সতর্কতার সাথে বঙ্গবন্ধুকে সেবাযত্ন করে শত্রু থেকে আড়াল করে রাখেন। এছাড়া কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলার বাসিন্দা সিংহ্লামোং, আবিও, শহীদ মংছিয়েন ও আক্যমং প্রমুখ ব্যক্তিগণ মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এদের মধ্যে মংছিয়েন পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ২১ বছরের যুবক। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন কক্সবাজার ও পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন স্থানে এবং পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে। তাকে মহেশখালি দ্বীপেই সমাহিত করা হয়েছিল। মহেশখালি দ্বীপবাসীদের আরো একটি করুণ অভিজ্ঞতা হলো, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দুদেরকে আশ্রয়দান ও সাহায্য-সহযোগিতা করার কারণে হানাদার পাক-সেনারা দক্ষিণ রাখাইনপাড়ার বৌদ্ধ মন্দিরটি পুড়িয়ে দেয় এবং ঠাকুরতলা বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষ উ তেজেন্ত ভিক্ষুকে ৩ জন শিষ্যসমেত গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া বরগুনা জেলার তালতলা উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের উসিট মং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী। তার পিতা থয়চাঅং মাচ্চীরও ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, তার আরো দুইজন ছেলে অংসিট ও অংথান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও কক্সবাজার জেলার টেকনাফের প্রিনছা খেঁ (ছদ্মনাম) নামক একজন রাখাইন নারী মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একটি মেডিকেল টিমের সদস্য। বরিশালে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বন্দি অবস্থায় তাকে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এক পর্যায়ে তিনি পাক সেনা সদস্যদের সাথে কৌশলে ভাব জমান এবং তাদের খাবারে বিষ প্রয়োগ করে। অনেকজনকে হত্যা করেন। (মুক্তিযুদ্ধে রাখাইনদের অবদান জানতে দেখুন মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী, আইয়ুব হোসেন ও চারু হক, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০; অসাগরে মিলিত প্রাণ, মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও চা-জনগোষ্ঠী, মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ ফেরদৌসী, জুন ২০০৮, উৎস প্রকাশন, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০; মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য নারী, জোবাইদা নাসরীন, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, শব্দশৈলী, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০।)
সামাজিক সংগঠন
পরিবারের ধরন : রাখাইন জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসন পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও পালন করে থাকে। মঙ্গলসূত্রে নির্দেশ আছে ‘মাতা-পিতার সেবা করা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণ এবং সৎভাবে জীবিকার্জন করা উত্তম মঙ্গল।’ অতএব যৌথ পরিবার সংখ্যা রাখাইন সমাজে বেশি এবং মাতৃ বা পিতৃ উভয়সূত্রের সমন্বয়ে পারিবারিক ব্যবস্থাপনা হয়ে থাকে। পিতা-মাতার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্পত্তির ভাগবণ্টনের রেওয়াজ নেই। কিন্তু আজকাল কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই নিয়মের নিয়ম ব্যতিক্রম হয়। রাখাইনদের নারী-পুরুষের অধিকার সমান হলেও পরিবারের নেতৃত্ব বেশির ভাগ সময় পুরুষের দ্বারা পরিচালিত হয়।
ব্যক্তির জীবনচক্র :
- ক. জন্ম : বর্তমানে একজন গর্ভধারিণী মা তার গর্ভের সন্তানের জন্য বাড়িতে বসে যে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে তার একশতাংশও আগেকার মায়েরা পেত না। সন্তান প্রসবের মুহুর্ত এবং প্রসবের পরে কত মা ও কত নবজাতক শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে তার ইয়ত্তা ছিল না। তখনকার গ্রাম্য ধাত্রী এবং কবিরাজ-বৈদ্যদের উপর গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাসহ নবজাতকের জীবন-মরণ নির্ভর করত। ঐ রাখাইন ধাত্রী, কবিরাজ এবং বৈদ্যগণ আদি রাখাইন চিকিৎসা শাস্ত্রের পারদর্শিতা লাভ করে থাকে। রোগীর লক্ষণ দেখে তারা সঠিক দিনক্ষণ বলে দিত। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে অনুরূপ বিজ্ঞ নির্ভরযোগ্য ধাত্রী, কবিরাজ বা বৈদ্য সংখ্যায় অল্প হবার কারণে অনেক গর্ভবতী মা ও প্রসূতিসহ নবজাতকের জীবন বিনা চিকিৎসায় ঝরে পড়েছে। বর্তমানে রাখাইন প্রসূতি মায়েরা উক্ত অভিশাপ হতে মুক্তি পেয়েছে। শিশুর জন্মের পর ঐ নবজাতকসহ প্রসূতিকে আঁতুরঘরে বিশেষ সতর্কতায় সেবাযত্ন সহকারে সাতদিন অবস্থান করতে হয়। প্রসূতির আঁতুরঘর হতে বের হবার পর প্রায় একবছর যাবৎ নিজ এবং নবজাত শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য তাকে খাবারদাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এভাবে একজন রাখাইন মাতা নিজ গর্ভজাত শিশু সন্তানের জন্য সবদিকে সতর্কতা অবলম্বনের দ্বারা লালনপালন করে থাকে
- খ. শিশুর কান ফোঁড়ানো, চুল কাটা ও নামকরণ : অধিকাংশ নবজাত শিশুর বয়স ২/৩ মাসের মধ্যে সোনা-রূপা প্রভৃতি দিয়ে সূঁচ তৈরি করে কান ফোঁড়ানো হয় এবং হাতে পায়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সোনা বা রূপা অথবা লোহার বালা পরানো হয়। রাখাইন শিশুদের নামকরণ করা হয় জন্মের দিন-ক্ষণের উপর ভিত্তি করে। গণক অথবা গুণীজ্ঞানী ঠাকুরের দ্বারা কোষ্ঠীনামা তৈরি করে শিশুসন্তানের নাম রাখা হয়। নবজাতকের কান ফোঁড়ানো, চুল কাটা এবং নাম রাখার সময় আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শিদের দ্বারা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয় এবং মিষ্টান্ন ও কৃষ্টিগত নানা প্রকার পিঠা পরিবেশন করা হয়।
- গ. প্রবজ্যা গ্রহণ : শিশুর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হলে লেখাপড়া শেখার জন্য বৌদ্ধবিহার অথবা গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করা হয় এবং বয়স সাত বছর পূর্ণ হলে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রবজ্যা গ্রহণ করানো হয়। পুরুষ মাত্র সাত বছর হতে যে কোনো বয়সে শ্রমণ হতে পারে। জীবনে একবার শ্রমণ হতেই হবে নচেৎ জীবনের একটি অঙ্গ অপূর্ণ থেকে যায়। রাখাইন সমাজে জীবনে অন্তত একবার ভ্রমণ না হলে সে পুরুষের বিয়ে হওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। পুরুষদের অন্তত একবার শ্রমণ (প্রবজ্যা) হতে হয় কিন্তু মহিলাদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। সাধারণত শৈশব কৈশোরে অভিভাবকগণ নিজ বা অপরের পুত্রকেও শ্রমণ (প্রবজ্যা) হিসেবে দীক্ষিত করে পুণ্য করে থাকেন। প্রবজ্যা গ্রহণ করে চীবর পরে কমপক্ষে সাতদিন সাধনার পর ঐ বেশ পরিবর্তন করতে পারে।
- ঘ. বিবাহ : সামন্তযুগে রাখাইন রাজাগণ অধিক বিবাহ করে থাকেন। কিন্তু বর্তমান যুগে সে রীতি আর নেই। যার ঘরে দুইজন স্ত্রী থাকে রাখাইন সমাজ তাকে ঘৃণা করে এবং একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে। রাখাইন বিবাহ চুক্তিভিত্তিক নয়, সামাজিক স্বীকৃতির দ্বারা হয়। রাখাইনদের মাঝে কুলগত অর্থাৎ কাজিন ভাই বোনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ। তবে মামাতো ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হতে পারে। এ বিয়েতে অবশ্য ধর্মীয় ও আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তথাপি পারিবারিক দিক থেকে এটাকেও নিরুৎসাহিত করা হয়। রাখাইনদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে তালাক দেয়া ও পুনঃবিবাহ হয় না। স্ত্রী থাকা অবস্থায় সহোদর কোনো বোনকে বিয়ে করা যায় না। স্ত্রীর অবর্তমানে শালীকে বিয়ে করা গেলেও স্ত্রীর বড়বোনকে বিয়ে করা যায় না। নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও প্রথাগত রীতিনীতি যুগযুগ ধরে সংরক্ষিত হয়ে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এরূপ ব্যতিক্রমী বিয়ে হলে সমাজের কটূক্তি ও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। শ্রেণী বিভক্ত ধনতান্ত্রিক সমাজ বলে সম্পদের অসমতা ও সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য রয়েছে। অন্য জাতি ও অন্য ধর্মাবলম্বী এবং একই গোষ্ঠীভুক্ত রক্ত সম্পর্কের নিষিদ্ধজনের সঙ্গে বিয়ে না হবার কারণে প্রেমের সম্পর্ককে কঠিন অনুশাসনের মধ্যে রাখা হয়। আর রাখাইন যুবক যুবতীরা এ বিষয়ে সচেতন থেকেই সম্পর্ক গড়ে তোলে। রাখাইনদের মাঝে বিবাহ বন্ধন তিন রকম হয়ে থাকে – প্রথমত বাবা-মা অথবা আত্মীয়স্বজনের পছন্দের মতো পাত্র-পাত্রী বাছাই করে বিয়ে করা হয়। দ্বিতীয়ত পাত্র-পাত্রীর নিজ পছন্দের ভিত্তিতে অভিভাবকরা প্রথাগতভাবে বিয়ে দেয়। বর্তমানে এ নিয়মটি বেশি প্রচলিত। তৃতীয়ত বর কনের প্রেমঘটিত কারণে অভিভাবকদের অজ্ঞাতে অথবা সম্মতি ছাড়া বিবাহপর্ব সম্পাদিত হয় আইনের আওতায় অথবা বন্ধু-বান্ধব বা পাড়াপড়শিদের সহযোগিতায়। সামাজিকভাবে এ প্রথাটির গ্রহণযোগ্যতা কম হলেও একবিংশ শতাব্দীর এই পরিবর্তনশীল সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। পূর্বকালে রাখাইন সমাজে বাল্য বিবাহ ছিল কিন্তু বর্তমানে সেটি নেই। রাখাইনদের কাছে বিয়ের অনুষ্ঠানটি সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের সাথে জীবনের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, খাওয়া-পরা, মাটি ও ফসলের সম্পর্ক এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বলে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস। প্রচলিত সামাজিক প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে বর কনের পক্ষদ্বয়ের দেখা সাক্ষাৎ ও পাত্রপাত্রীর কোষ্ঠীনামা মেলানোর পর কোষ্ঠীর গণকের নির্দেশ মোতাবেক দিন-তারিখ নির্ধারণ করে বরপক্ষ কনের হাতে অথবা গলায় স্বর্ণালংকার সাজিয়ে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। নির্দিষ্ট দিন-তারিখে মেয়ের বাড়িতে বিবাহের অনুষ্ঠান সম্পাদন করা হয়। বিয়ের সাতদিন পর নব দম্পত্তি কৃষ্টিগত পিঠা মিষ্টান্ন ও পূজার অর্থ্যাদি নিয়ে বন্ধুবান্ধবের সমাবেশে বরের বাড়িতে রওনা হয় এবং বরের মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি ঐ সকল পিঠা, মিষ্টান্ন ও পূজার অর্থ্যাদি দিয়ে প্রণাম করত সুখ শান্তি, উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। নির্দিষ্ট সময়ে নবদম্পতি বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বুদ্ধ বন্দনাপূর্বক ভিক্ষুর নিকট পূজার সামগ্রী দান করে এবং পঞ্চশীল গ্রহণের দ্বারা আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়। ছেলের বাড়িতে ন্যূনতম তিনদিন অবস্থানের পর কন্যার বাড়িতে ফিরতে হয় এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা মোতাবেক উভয় পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে ঐ দম্পতির স্থায়ী বসতি নির্ধারণ করা হয়। পূর্বকালে পাত্রপক্ষের তরফ থেকে পাত্রীর মূল্যায়ন স্বরূপ আলোচনা সাপেক্ষে স্বর্ণের গয়না দেয়া বাধ্যবাধকতা ছিল । কিন্তু বর্তমানে ঐ প্রথাটি আর তেমন গুরুত্ব বহন করে না। পটুয়াখালী ও বরগুনা অঞ্চলের রাখাইনদের মাঝে এখনও ‘রওয়াওয়েন খা’ বা পাড়ার প্রবেশ ফি দেওয়া-নেওয়া প্রচলন আছে। কিন্তু এই নিয়মের খারাপ দিক হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পাড়ার যুবাগণের অতিরিক্ত ফি দাবির জন্য কোনো কোনো সময় প্রস্তাবিত বিয়ের অনুষ্ঠান ভেঙে যায়। উক্ত নিয়মটি অবশ্যই সংশোধন করে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনা উচিত।
- ঙ. বৃদ্ধাবস্থা : পিতা-মাতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হয় তখন সন্তানদের সংসারে থাকে এবং সন্তানদের লালন পালনের দ্বারা ধর্ম-কর্ম করে বাকি দিনগুলো কেটে যায়। এটাই রাখাইন সমাজের চলমান পদ্ধতি যা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে রক্ষিত হয়ে হাজার হাজার বছর ধরে বিদ্যমান রয়েছে। সন্তান-সন্ততিরা জ্বরাগ্রস্ত পিতামাতাকে সেবাশুশ্রূষা দ্বারা লালন পালন করে। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করা এবং তাদের আত্মার শান্তির জন্য ধর্ম-কর্ম-পূজা-অর্চনা সম্পাদন করা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের দিক দিয়ে সন্তানদের অলঙ্ঘনীয় নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব রাখাইনদের সংস্কৃতির রূপ ধারণ করে অতি প্রাচীনকাল হতে পালিত হয়ে এসেছে।
- চ. মৃত্যু ও সৎকার : রাখাইনদের মৃত্যুর পর সৎকার পদ্ধতি মৃত্যুর ধরনের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। যেমন— স্বাভাবিক মৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যু, পাড়ার ভিতর নিজ বসতবাড়ির মধ্যে মৃত্যু, পাড়ার বাইরে মৃত্যু এবং বৌদ্ধভিক্ষুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসমূহ ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পাদন করা হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মরদেহকে সাবান দিয়ে স্নান করে নতুন কাপড়-চোপড় দিয়ে সাজিয়ে কফিনের ভিতর ভরিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আমন্ত্রণ করা হয়। এরপর মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দানীয় বস্তুসমূহ দান পূর্বক ধর্মকর্ম সম্পাদন দ্বারা তার আত্মার শান্তি কামনা করা হয় এবং প্রয়োজন বোধে আত্মীয়স্বজনের অপেক্ষায় ২-৩ দিন কফিনটি সুগন্ধি আগরবাতি জ্বেলে যথাস্থানে রাখা হয়। ঐ কয়েকদিন উপস্থিত পাড়াপড়শি ও আত্মীয়স্বজনের খাওয়াদাওয়া, চা-নাস্তা ইত্যাদি দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে কৃষ্টিগত নিয়মকানুন মোতাবেক কফিনের মাথা ঘরের দিকে এবং পায়ের দিক গন্তব্য স্থানের দিক বরাবর রেখে যুবকরা কফিনটি বহন করে শ্মশানে নিয়ে যায়। কফিনের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে ন্যূনতম আড়াই হাত গভীর মোইনান (কবর বা সমাহিত স্থান) খনন করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোইনান খনন হবার পর যথাস্থান হতে কফিনটি বহন করে নিয়ে খননকৃত স্রোইনানের পূর্বপার্শ্বে রাখা হয়। কফিন বহন করার জন্য কফিনে বাঁধা বাঁশের টুকরাগুলো ছেড়ে খননকৃত সমাহিত স্থানের গর্তের উপর আড়াআড়িভাবে রাখা হয়। কফিনটি তার উপর রেখে কফিনের ঢাকনা খুলে মাথার দিকে মরদেহে ঢাকা কাপড়ের অংশ বের করে বৌদ্ধ ভিক্ষু মন্ত্র পাঠ করেন। এরপর মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতম স্বজন ঐ বস্ত্রখণ্ডের উপর দিয়ে খননকৃত কবরের মাটির উপর পানি ঢেলে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদিত হয়েছে মর্মে বসুন্ধরাকে প্রতি সাক্ষী রেখে মেইনান স্থানের ভূমির উপর পানির ফোঁটা সেচন করা হয়। অতঃপর কফিনটি শক্তভাবে আটকে খননকৃত গর্তে স্থাপন করত কফিনটি পশ্চিম দিকে সামান্য কাত করে সর্বপ্রথম ঘনিষ্ঠতম স্বজন মাটি দেয়ার পর উপস্থিত সকলে কবরে মাটি দিয়ে থাকে। পাড়ার মধ্যস্থ গৃহে মৃত ব্যক্তিকে পাড়ার শ্মশানে মোইনান দেয়া হয় এবং পাড়ার বাইরের যেকোন মৃত ব্যক্তিকে আগম্ভক (অতিথি) শ্মশানে কবর দেয়া হয়। রাখাইনদের মৃতদেহ সৎকারে মোইনান দেয়া ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পোড়ানো হয়। যেমন—প্রবীণ ব্যক্তি এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বেলায় পোড়ানো হয়। ধনবান প্রবীণ ব্যক্তিদের এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাহন হিসেবে রথ, নৃত্য রথ এবং টানা রথ (বাঁশ এবং রঙিন কাগজে তৈরি) তৈরি করে ২-৩ দিন যাবৎ উৎসব মুখর অনুষ্ঠান দ্বারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। গুণীজ্ঞানী প্রবীণ বৌদ্ধভিক্ষু বা মহাথেরদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জাতীয় পর্যায়ে সম্পাদন করা হয়, এতে নানা কারুকার্যখচিত বাহন রথ, নৃত্যরথ টানারথ, দোলনা রথ এবং প্রাসাদতুল্য ভৃস্থিতি রথ নির্মাণ করে অত্যন্ত জাঁকজমক ও গাম্ভীর্য সহকারে বাজি নিক্ষেপের মাধ্যমে অগ্নি সংযোগ করে সৎকার কাজ সম্পাদন করা হয়। তাদের দেহ ভস্ম মানমন্দির স্থাপন করে রাখা হয়। অস্বাভাবিকভাবে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি এবং গর্ভবতী অবস্থায় মৃত মহিলাদের ক্ষেত্রে দেয়া হয় না এবং উক্ত মরদেহ সৎকারে কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা হয় না। উক্ত মরদেহ মূল শ্মশানে মোইনান দেয়ার অধিকার নেই, আগন্তুক (অতিথি) শ্মশানে মোইনান দেয়া হয়। গলায় দড়ি দিয়ে মৃত্যুবরণকারীর মরদেহ লম্বালম্বি শোয়ানো অবস্থায় কবর দেয়ার নিয়ম নাই, মাথার দিকটা উঁচু রেখে সামান্য খাড়া অবস্থায় কবর দেয়া হয়। মরদেহ সৎকারের স্থানটি পাড়ার মাতব্বরের দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, রাখাইনরা মরদেহ বুধবার সৎকার করে না। পাড়ার বাইরের মরদেহ পাড়ার ভিতর ঢুকানো হয় না। বৌদ্ধ ভিক্ষু, শ্রমণ এবং সাধু সন্ন্যাসীদের মরদেহ সাধারণত ভিন্নস্থানে সৎকার করা হয়। যেহেতু তারা সংসারত্যাগী ও শীল সমাধিতে সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্বে, সেহেতু পাড়া বা আগন্তুক শ্মশানে মোইনান দেওয়া বা মানমন্দির করা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে।
ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতিষ্ঠান : রাখাইন সমাজ পাড়াভিত্তিক বসবাস করে আসছে এবং পাড়ার নামকরণ ও গঠন প্রণালী প্রতিষ্ঠাতার নাম ও জন্মের দিন-তারিখের উপর নির্ধারিত হয়। ঐ প্রতিষ্ঠাতার নামে অধিকাংশ রাখাইন পাড়ার নামকরণ হয়ে থাকে। পাড়ার প্রতিষ্ঠাতাই পাড়ার মাতব্বর হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় এবং বংশানুক্রমে মাতব্বরের মর্যাদায় পাড়ার ভালো-মন্দ ও বিচারাচার কার্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয় যখন মাতব্বর বংশের কোনো যোগ্য ব্যক্তির উত্তরাধিকারী না থাকে তখন পাড়াবাসীগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মতে একজন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে পাড়ার মাতব্বর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাড়ার মাতব্বরই ঐ পাড়ার হর্তাকর্তা। রাখাইন ভাষায় তাদের বলে ‘রোওয়াসুগ্রী’। কোনো পাড়ায় সমস্যা সৃষ্টি হলে পাড়ার জনগণকে নিয়ে মাতব্বর বৈঠক বসে সমাধান করা হয়। সেটা সম্ভব না হলে এলাকায় পাড়াসমূহের মাতব্বরসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সমস্যার সমাধান করা হতো। বর্তমানে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে মেম্বার, চেয়ারম্যান, থানা-পুলিশ এবং কোর্টকাচারির আশ্রয় নিয়ে সমস্যাটি আরও জটিল আকার ধারণ করে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। রাখাইন সমাজের অধিকাংশ অন্তর্কলহ সৃষ্টি হয় বাঙালিদের অনুপ্রবেশের কারণে। তারা নিজ স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে রাখাইনদের মাঝে কুপরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত রাখাইনদের বিষয়-সম্পত্তি বাঙালিদের হাতে চলে যাওয়ায় সম্বলহীন রাখাইনরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
অর্থনৈতিক সংগঠন
আর্থসামাজিক অবস্থা : এককালে স্বাধীন আরাকানে একমাত্র অধিবাসী রাখাইনগণ রাজ্যবিস্তার, ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে খ্রিস্টিয় ৪র্থ শতাব্দী থেকে এ বঙ্গদেশে আসতে আরম্ভ করে। পরবর্তীতে ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজা বোদপায়া আরাকান দখল করে দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি করলে অসংখ্য রাখাইন প্রাণরক্ষার্থে এদেশে আসতে থাকে। এছাড়া হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে শ্বাপদসংকুল দুর্গম গিরিপথ এবং বিস্তীর্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে নাফ নদী ও বাকখালী নদীর তীর এবং সুন্দরবন অঞ্চলের জনমানবহীন দ্বীপগুলোতে এসে ব্যপকভাবে জনবসতি গড়ে তোলে। এ দ্বীপাঞ্চলে ও পাহাড়ি পরিবেশে রাখাইনগণ পরিণত হয় কৃষি ও মৎস্যজীবী হিসেবে। ইংরেজ শাসনামলে কক্সবাজার অঞ্চলে রাখাইনদের প্রধান অর্থনৈতিক অবলম্বন ছিল ব্যবসা এবং পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলে (বরিশালের দক্ষিণাঞ্চল) রাখাইনদের প্রধান অর্থনৈতিক অবলম্বন ছিল কৃষি। বর্তমানেও জীবিকার উপায় হিসেবে রাখাইনরা কৃষি, মৎস্য শিকার, ব্যবসা ও তাঁত বুননের উপর নির্ভর করে আছে। তার পাশাপাশি বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি, রেডিও, টেলিভিশন, ঘড়ি, জল ও স্থলযানের যন্ত্র মেরামত, স্বর্ণ ও রৌপ্য অলংকার এবং পোশাক তৈরির কাজেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাখাইন নিয়োজিত রয়েছে। একশভাগ জমির উপর নির্ভরশীল থেকেও পটুয়াখালীর রাখাইন পরিবারগুলো পঞ্চাশের দশকের পদপ্রান্ত পর্যন্ত মোটামুটি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল বলে জানা যায়। তথাপি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানি যে ঘটতো না, তা নয়। তবে তা তারা তাদের সঞ্চয় থেকে মোটামুটিভাবে পুষিয়ে নিতে পারতো। এ কারণে ছেচল্লিশের মহামন্বন্তরেও রাখাইনরা মারাত্মকভাবে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েনি। পরবর্তীকালে পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালি মুসলমানদের আগমন, তাদের জমির উপর একশ্রেণীর চক্রান্তকারী ও সুযোগ সন্ধানী বাঙালির আগ্রাসী মনোভাব, পঞ্চাশ ও ষাট দশক জুড়ে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, অনাবৃষ্টি, মহামারি ইত্যাদি কারণে তাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী জীবনে ছেদ পড়ে ও বিপর্যস্ত হয়। যদিও সত্তরের দশকে উপকূলবর্তী এলাকায় বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করে মিঠে পানি ধরে রেখে সেচ সুবিধার বন্দোবস্ত সরকার করেছে, কিন্তু পর্যাপ্ত কৃষি উপকরণ ও সরঞ্জামের অভাব ছিল। তদুপরি রক্ষণশীল ও আধুনিকায়নে অনাগ্রহী রাখাইনদের উন্নয়নে আগ্রহ সৃষ্টিতে সরকার ব্যর্থ হয়। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ যথাযথ ছিল না বলেই জানা যায়। এ ছাড়াও ভূমি লুণ্ঠনকারীরা প্রশাসনের আনুকূল্য তাদের জমি থেকে রাখাইনদেরকে উৎখাত করে। ফলে জমি হারানোর বেদনায় আপ্লুত এই জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং ক্রমাগতভাবে প্রান্তিক চাষি, ভূমিহীন ও বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৭৮৪ সালে রাখাইনরা বরিশালের সর্ব দক্ষিণাঞ্চল উপকূলীয় এলাকায় পদার্পণের পূর্বে এলাকাটি জনমানবহীন হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল গভীর বনভূমি ছিল। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের আনুকূল্যে এই অঞ্চলকে তারা চাষযোগ্য আবাদিভূমিতে রূপান্তর করে। যার দ্বারা যতটুকু ভূমি দখলে আসে সরকারিভাবে তা দখলীয় স্বত্বে মালিকানা সৃষ্টি করে দেয়া হয়। ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার ও জি ই হার্ভের সমসাময়িক তথ্যেও পরিদৃষ্ট হয় ১৮ শতকের শেষপ্রান্তে ব্রিটিশ সরকার জঙ্গল পরিষ্কার ও ভূমি পুনরুদ্ধারকল্পে রাখাইনদের সুন্দরবন অঞ্চলে পুনর্বাসিত করে। বর্তমান পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার গলাচিপা, কলাপাড়া, আমতলী ও বরগুনায় এভাবে ধীরে ধীরে জঙ্গলাকীর্ণ উপকূলীয় পলিসঞ্চিত ভূমিতে রাখাইনরা বসতি বিস্তার করে। রাখাইনদের দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার ও পতিত জমি আবাদে উৎসাহিত করার জন্যে ব্রিটিশ সরকার ভূমি আবাদকারীর প্রথাগত অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সর্বপ্রথম খেপুপাড়ায় একজন কলোনিজেশন অফিসার নিযুক্ত করেন। তখন সমগ্র কলোনিজেশন এলাকার নাম ছিল ‘দি বাখরগঞ্জ সুন্দরবন কলোনিজেশন।” ঐ কলোনিজেশন এলাকায় প্রায় ২৩৭টি রাখাইন গ্রাম গড়ে উঠেছিল। সেগুলোর প্রত্যেকটি ছিল নিজ হাতে জঙ্গল কেটে আবাদ করা জমির উপর। প্রথম জঙ্গল আবাদ করার পর বিনা খাজনায় পাঁচ থেকে দশ বছর চাষ করে ফসল ফলাতে পারত। পরবর্তীকালে সি এস সেটেলমেন্ট নামে ‘সার্কেল সেটেলমেন্ট’-এর মাধ্যমে প্রথম দশ বছরের জন্য খাজনা ধার্য করা হয়। ঐ সময় কালের মধ্যে অর্থাৎ ১৯০৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সময়টা কলোনিজেশন এর স্বর্ণযুগ বলা যায়। কারণ ঐ সময়ে রাখাইন জনগোষ্ঠীর প্রধানগণ এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার ও অবকাঠমোগত উন্নয়নের জন্য অনেক ঐতিহ্যময় বৌদ্ধ স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে এ অঞ্চলকে একটি সমৃদ্ধি সম্পন্ন রাখাইন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৫-১৯৫০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সার্ভে ও সেটেলমেন্ট অপারেশনে এ অঞ্চলে ৮৫% রায়তদের (Tenure holder) অধীন এবং জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে আবাদকারীরা (Tenure holder) অধিক বিদ্যমান ছিল। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে পটুয়াখালীর রাখাইনদের বাখেরগঞ্জের ‘মগ’ অভিধায় আদিবাসীরূপে স্বীকার করে ভূমির হস্তান্তর বিষয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে উক্ত আইনের ৯৭ ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। আনুমানিকভাবে ১৭৮৪-১৯০০ সালের দিকে বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ৫০,০০০ জন রাখাইন বসবাস করত। ১৯০০-১৯৪৮ সালে এই সংখ্যা হয় ৩৫০০০ জন, ১৯৪৮-১৯৯০ সালে ছিল ৪০০০ জন, ১৯৯৪-২০০৪ সালে ৪৫০০ জন এবং ২০০৪-২০০৯ সালের সময় রাখাইনদের সংখ্যা হচ্ছে আনুমানিক ৪,৩১০ জন। উপর্যুক্ত পরিসংখ্যান হতে প্রতীয়মান হয়, অত্র দক্ষিণাঞ্চলের রাখাইন জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে বর্তমানে কী পর্যায়ে অবস্থান করছে। এরকম জনবসতি হ্রাসের কারণ হলো –
- ক. ১৮৭৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের দ্বারা যুগপৎ বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উক্ত বন্যায় ও বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে কলাপাড়া এবং গলাচিপা থানার কিছু রাখাইন পাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। এরপর ১৯১০, ১৯৪০, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৫ এবং ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের জন্য রাখাইন জনপদ ২৩৭টি পাড়া হতে বর্তমানে মাত্র ৪৭টি পাড়ায় উপনীত হয়েছে।
- খ. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে কলাপাড়া, আমতলী, বরগুনা এবং গলাচিপা এর অফিস-কাছারিসমূহ হতে রাখাইনদের ভূ-সম্পত্তির রেকর্ড, পর্চা ও দলিলাদি এবং রাখাইনদের বাড়িঘরে সংরক্ষিত ভূমি সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি ভেসে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একশ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্বেষী বাঙালি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের সাথে হাত করে জাল কাগজপত্র তৈরি করে রাখাইনদের বহু ভূসম্পত্তি আত্মসাৎ করে নেয়। এ কারণে অনেক রাখাইন পরিবার বাঙালিদের সাথে মামলা মোকদ্দমায় জড়িত হয়ে শেষ পর্যন্ত সম্বলহীন অবস্থায় এলাকা ত্যাগ করে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে অথবা বার্মায় দেশান্তর হয়েছে এবং এ ধরনের ঘটনার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে।
- গ. অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা এবং রোগ-ব্যাধি ও পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে পূর্বকালে শত শত একর ধান্য জমি উজাড় হয়ে যাওয়ায় সরকারি ঋণ ও ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ করতে অক্ষমতার কারণে রাখাইনদের জমিজমা কৌশলে নিলামে ক্রয়-বিক্রয়ের দ্বারা দখল করে নেওয়া হয়। এভাবে অধিকাংশ রাখাইন পরিবার ভূমিহীনে পরিণত হয়ে দেশান্তর হয়ে গিয়েছে।
- ঘ. ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবার ফলে অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে চলে যেতে থাকায় এর দেখাদেখি অত্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ পরিবার ও পরিবারের সদস্যগণ বার্মায় দেশান্তরিত হয়ে গিয়েছে। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় শুধু বরিশাল (পটুয়াখালী, বরগুনা) রাখাইনরা নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম (কক্সবাজারসহ) ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাখাইনরাও একই অবস্থায় দেশান্তরিত হয়েছে।
পটুয়াখালীর রাখাইন উপজাতি গ্রন্থে গবেষক মুস্তাফা মজিদ-এর গবেষণার জরিপ (জরিপকাল ১৯৮২-৮৮) অনুসারে দেখা গেছে, বৃহত্তর পটুয়াখালীর কৃষককুল রাখাইন জনগোষ্ঠীর শতকরা ৩৭ জন মাত্র ভূমির অধিকারী, বাকি ৬৩ জন ভূমিহীন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মাঝে ২৫ বছর পর বর্তমান রাখাইনদের ভূ-সম্পত্তির মালিকানা আরও ক্রম নিম্ন গতিতে হ্রাস পেয়ে বৃহৎ কৃষক শ্রেণী লোপ পেয়ে মধ্য কৃষক শ্রেণীর পর্যায়ে এবং পরবর্তীর ২৫ বছর পর মধ্য শ্রেণী হতে প্রান্তিক কৃষক শ্রেণীর পর্যায়ে পৌঁছবে। তার কারণসমূহ হলো –
- আদিবাসীদের জন্য ভূমি সংরক্ষণের আইন আছে কিন্তু যথাযথভাবে প্রয়োগ বা কার্যকরী করা হচ্ছে না।
- ভূমি সমস্যা সংবলিত মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘসূত্রতা।
- বহিরাগত বাঙালিদের ভুয়া দলিল দস্তাবেজ সৃষ্টি করে রাখাইনদের তথা আদিবাসীদের জমাজমি জবর দখল করা।
- রাখাইনদের অথবা আদিবাসীদের ভোগ দখলকৃত জমাজমি সরকার অন্যায়ভাবে ভূমিহীন বাঙালিদের পুনর্বাসনের জন্য বন্দোবস্ত প্রদান করা। • রাখাইনদের অথবা আদিবাসীদের ভূ-সম্পত্তি অন্যায়ভাবে শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত করে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা।
- রাখাইন বা আদিবাসীদের জমাজমি সরকারি নিলামে বিক্রয়ের নামে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয়ে ঘনিষ্ঠ বাঙালিদের নিকট হস্তান্তর করা।
- প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে রাখাইনদের বা আদিবাসীদের ভূ-সম্পত্তি নির্বিচারে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করা।
- রাখাইনদের অথবা আদিবাসীদের যে কোনো সমস্যায় নিরপেক্ষ ও সঠিক তদন্ত না করে চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের কথামতে অথবা পক্ষপাতযুক্ত স্থানীয় বাঙালিদের সাক্ষীর উপর ভিত্তি করে রাখাইনদের অভিযোগ লঘুকরণ এবং বাঙালিদের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে বিমাতাসুলভ আচরণের প্রবণতা।
উপর্যুক্ত কারণগুলোর ফলে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সমাধান করা না হলে রাখাইন বা আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা ও প্রথাগত অধিকার লোপ পেতে পেতে তারা ক্রমশ ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর পর্যায়ে উপনীত হবে।
উত্তরাধিকার আইন ও সম্পত্তির মালিকানা : উত্তরাধিকার আইন অনেক ব্যাপক। অত্র রাখাইন সমাজে সাধারণত বার্মিজ বুডিডস্ট আইন (ব্রিটিশ সরকার আমলে আইনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করত ১৯২৭ খ্রি. প্রথম প্রকাশিত Eastern Law House (Private) Ltd Culcutta অনুসরণ করে উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে সাধারণত রাখাইনদের মাঝে ছেলে এবং মেয়ে পৈতৃক সম্পত্তির সমান অধিকারী এবং স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর যতটুকু অধিকার স্ত্রীর সম্পত্তির উপরও স্বামীর ততটুকু অধিকার আছে। অর্থাৎ স্বামীর লোকান্তরে স্ত্রী এবং স্ত্রীর লোকান্তরে স্বামী সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক। পিতামাতা উভয়েরই লোকান্তরে সন্তানরা ওয়ারিশ হিসেবে অবশিষ্ট সম্পত্তি আইনানুগ ভাগবণ্টন করে নিতে পারে। কিন্তু পিতামাতার জীবদ্দশায় সম্পত্তির ভাগবণ্টনের এখতিয়ার সন্তানদের থাকে না। জীবিত পিতা বা মাতা স্বেচ্ছায় ভাগবণ্টন করে সন্তানদের দিতে পারে – সেক্ষেত্রে আইনের প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু টেকনাফ অঞ্চলে রাখাইনরা কোনো আইন অবলম্বন করে ওয়ারিশান সম্পত্তির ভাগবণ্টন করে বোঝা যাচ্ছে না। মংবাঅং-এর বাংলাদেশ রাখাইন সম্প্রদায়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (পৃ. ২০৬), ‘টেকনাফ অঞ্চলে রাখাইনরা সম্পত্তি বিভাজন বিষয়ে যে নীতি গ্রহণ করছে তা এ রকম— স্বামী মারা গেলে স্ত্রী ১ ভাগ, পুত্র ২ ভাগ ও কন্যা ১ ভাগ অর্জন করে। আবার পরবর্তীতে মা মারা গেলে মা’র সম্পত্তির ২ ভাগ পুত্র ও ১ ভাগ কন্যা অর্জন করে। তবে বসতবাড়ি সাধারণত পরিবারের কনিষ্ঠ ছেলের নামে রেখে দেয়া হয়। উল্লিখিত নীতিটি রাখাইন সমাজের সাধারণত ব্যবহৃত আইন বার্মিজ বুড্ডিস্ট আইন এবং Manugye Dhammathat-এর কোনো ধারার মধ্যে নেই।
পেশার প্রকারভেদ : পটুয়াখালী ও বরগুনা এলাকার রাখাইনরা জীবন ধারণের অবলম্বন হিসেবে কৃষিকাজের উপর প্রাধান্য দিয়ে আসছে। সুন্দরবন অঞ্চলকে আবাদযোগ্য ভূমিতে রূপান্তর করার প্রবণতাই পটুয়াখালী রাখাইন জনগোষ্ঠীকে কৃষি নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে কক্সবাজার এলাকার রাখাইনরা কিছুটা কৃষি নির্ভরশীল এবং বেশির ভাগ মৎস্যশিকার, ব্যবসা বাণিজ্য ও তাঁত বুননের উপর নির্ভর করছে। তার পাশাপাশি বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি, চুরুট তৈরি, শুঁটকি মাছ ও নাপ্পি তৈরি, স্বর্ণ-রূপার অলংকার তৈরি, পোশাক তৈরি, কাঠ ও ইমারতের মিস্ত্রি, ওয়ার্কশপের নানাবিধ ইঞ্জিন বা মেশিনারি মেকানিজ, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী মেরামতের কাজে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিয়োজিত আছে। বর্তমানে রাখাইনদের মধ্যে শিক্ষিতের হার বাড়তে থাকায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে চাকরি করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গ্রাম হতে নগরমুখিতা অনেকাংশে বাড়ছে। দেশের প্রচলিত ব্যবসায়িক ও সামাজিক পরিবেশে রাখাইন জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণগুলো হলো—১. ভাষাগত কারণ, ২. মূলধনের স্বল্পতা, ৩. ভূ-সম্পত্তি বেদখল হওয়া, ৪ কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা, ৫. কারিগরি জ্ঞানের অভাব, ৬ উৎপাদিত পণ্য বিপণনের সমস্যা, ৭. মাছ আহরণ ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা, ৮. পরিবেশগত সমস্যা এবং ৯ একতাবোধের অভাব। এ সকল কারণে অত্র রাখাইন সমাজ দারিদ্র্যের রাহুগ্রাসে তলিয়ে যাচ্ছে।
বাসস্থানের ধরন : রাখাইনরা সমষ্টিগতভাবে পাড়ায় বসবাস করে। কোনো কোনো পাড়ায় শতাধিক ঘরবাড়ি আছে। ঘরবাড়িগুলো পাশাপাশি বা সারিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয় এবং বাড়িগুলো লোক চলাচলের রাস্তার দিকে মুখ করে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি পাড়ায় সর্বজনীন বৌদ্ধমন্দির, পাঠশালা, রিজার্ভ পুকুর এবং শ্মশানভূমি সুনির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করা হয়। রাখাইন বসতবাড়ি সাধারণত দ্বিতল বিশিষ্ট হয়ে থাকে। সাধারণত মাচা পেতে ঘর তৈরি করা হয়। শ্রেণীভেদে ঘরবাড়ি ছোট-বড় বা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে কিন্তু লম্বা খুঁটির উপর মাচা (পাটাতন) বানানোর ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত মিল থাকে এবং বাড়ির নিচের দিকটা সাধারণত খোলামেলা থাকে। সেখানে তাঁত বোনার কাজ করা হয়। আর লোকজন বসার জন্য চেয়ার টেবিল পাতানো থাকে। বাড়ির ছাউনিতে টিন অথবা গোল পাতা ব্যবহৃত হয় এবং বেড়া টিন অথবা বাঁশ দিয়ে করা হয়ে থাকে। বর্তমানে নিরাপত্তার জন্য অধিকাংশ রাখাইনের ঘরবাড়ির নিচের দিকটা বেড়া দিয়ে আটকানো থাকে।
ধর্মীয় অবস্থা
ধর্ম ও ধর্মীয় গোষ্ঠী : রাখাইন জাতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং থেরবাদী অর্থাৎ হীনযান বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে রাখাইনরা জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদে বিশ্বাসী। কর্মবাদী ও কর্মের ফলাফলকে ভাগ্য হিসেবে মেনে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার নজির নেই।
ধর্মীয় উৎসব : নিয়ে বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবের বর্ণনা করা হলো –
- বুদ্ধ পূর্ণিমা (বৈশাখী পূর্ণিমা) : এটি গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ—এই ত্রিবিধ স্মৃতিবিজড়িত সর্বশ্রেষ্ঠ পর্ব।
- বর্ষাবাস (আষাঢ়ী পূর্ণিমা) : এটি গৃহত্যাগ সন্ন্যাস গ্রহণ বুদ্ধত্ব লাভের পর সারনাথে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুর প্রতি ধর্মচক্র প্রবর্তনের দ্বারা প্রথম ধর্মপ্রচার ত্রিবিধ ঘটনার সাথে বিজড়িত। এই পূর্ণিমা থেকে ভিক্ষুরা বর্ষাবাসব্রত আরম্ভ করেন।
- আশ্বিনী পূর্ণিমা : আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমায় পরিসমাপ্তি ঘটে। পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজের কৃত অপরাধ পাপ করে পরিশুদ্ধ হয়। তাই এই পূর্ণিমা প্রবারণা নামেও খ্যাত হয়। এই তিথিতে বৌদ্ধরা আকাশে ফানুস বাতি উড়িয়ে পুণ্য সঞ্চয় করে।
- কঠিন চীবর দান উৎসব : প্রবারণা পূর্ণিমা অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমার পরবর্তী পূর্ণিমা দিনের মধ্যে কঠিন চীবর দান উৎসব হয়। দানের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে কঠিন চীবর দান। রাখাইন মহিলারা তাঁত স্থাপন করে। ১২ থেকে ভোর ৬ টার মধ্যে চীবর করে সংঘের নির্বাচিত ভিক্ষুকে চীবর দান করে থাকে। ত্রিচীবর হলো- সংঘটি, উত্তর এবং অন্তরবাসক। প্রকার চীবর একদিনে বুনে তৈরি দান করা হয় বলে চীবর দান উৎসব নামকরণ হয়েছে। উপর্যুক্ত ধর্মীয় উৎসবগুলোকে রাখাইন সমাজে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উদযাপন করা হয়।
বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান : রাখাইনরা বিশ্বাস করে চন্দ্রসূর্য, ও গ্রহনক্ষাদ্রির পরিক্রমায় মহাজাগতিক ক্রিয়া পরিচালিত হয়। এ কারণে রাখাইনরা দিনক্ষণ সময়ের বিচার করে কাজ সূচনা করে। রাখাইনরা পঞ্জিকার নির্দেশনা মোতাবেক শুভ অশুভ যাচাই করে কাজ করে শুভ কাজের যাত্রা থাকে। সাধারণত পূর্ণিমা অমাবস্যার পরের দিন যাত্রা বা কোনো কাজের সূচনা করে শনিবার দুষ্ট দেবতাদের প্রভাব আছে বলে দিনটিকে অশুভ করা হয় এবং বুধবার দিনটি রাহু প্রভাবিত দিনে অশুভ মনে করা হয় এবং বুধবার রাখাইনরা সৎকার করে না। যাত্রা পাথে সাপ পড়লে আর যাত্রা করে না। যাত্রাকালে হোঁচট খেলে সে যাত্রা অশুভ হয়। যাত্রাকালে খালি কলসি সফল উপরিভাগ নড়াচড়া করলে শুভ লক্ষণ ও নিম্নভাগ নড়াচড়া করলে অশুভ লক্ষণ বলে ধরে নেয়া হয়। রাখাইনরা এখনো আদিকাল হতে বংশানুক্রমে প্রচলিত কিছু আচার অনুষ্ঠান করে থাকে। যেমন— অশুভ গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব ও দুষ্টদেবতার নজর থেকে মুক্ত হবার জন্য বসতবাড়ি অথবা পাড়ার মাঝে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের প্রতি আপ্যায়ন করে পিওসহ দানীয় বস্তু দান পূর্বক পরিত্রাণ সূত্রটি পাঠ করে বাড়িঘর অথবা পাড়ার চতুর্দিকে ব্যূহচক্র রচনা করা হয়। রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রত্যেক বাড়িঘরে গৃহদেবতার (চুন্মলে নেৎ) অর্চনা করা হয়, যাতে বাইরে থেকে অশুভ দেবতা এবং প্রেতাত্মাগণ বাড়িতে প্রবেশ করে লোকজনকে ক্ষতি করতে না পারে। প্রত্যেক রাখাইনপাড়ায় একটি করে পূজার গাছ অথবা একটি ছোট দেবালয় থাকে প্রতিবছরের প্রারম্ভে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি হতে একজন করে সকলে সমবেতভাবে পূজার গাছ অথবা দেবালয়ে উপস্থিত হয়। পাড়ার অধিপতি দেবতাকে পূজার সামগ্রী (একবাতি হলুদ মাখা চাল) চাল এবং এক টুকরো সোনালি কাগজ দ্বারা পুজা করত পাড়ার শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য এবং পাড়ার বাসিন্দাদের সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত রাখার জন্য সুদৃষ্টি প্রার্থনা করা হয়। সোনালি কাগজের টুকরাটি পূজার গাছ অথবা দেবালয়ে লাগানো হয় এবং পূজার বেদিতে কলাপাতা বিছিয়ে কিছু চাল রেখে সকলে প্রণাম পূর্বক প্রার্থনা করা হয়। বাটির অবশিষ্ট চাল বাড়িতে এনে ঘরের ভিতরে-বাইরে ছিটানো হয়। পাড়ার অধিপতি দেবতার পূজার সময় পাড়ার বাইরের লোক ভিতরে এবং ভিতরের লোক বাহিরে আসা-যাওয়া করা নিষিদ্ধ। তদ্রুপ বাড়ির লোকজনেরও ঘরের বাইরে আসা-যাওয়া করা নিষিদ্ধ। পূজার পর্ব সেরে বাড়িতে উপস্থিত হলে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় তিনবার প্রশ্ন করতে হয়, বাড়ির লোকজন কি সুস্থ আছেন— ভালো আছেন?’ তখন বাড়ির উপর থেকে ‘হ্যাঁ, সুস্থ আছি, ভালো আছি’—বলে তিনবার উত্তর দিতে হয়। তারপর চালের বাটিসহ বাড়ির উপরে এসে চতুর্দিকে চাল ছিটিয়ে দিতে হয়। এতে অশুভ প্রভাবগুলো মুছে যায়।
সামাজিক উৎসব
রাখাইন সমাজে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক উৎসব রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি উৎসবের আলোচনা করা হলো –
নবান্ন উৎসব : রাখাইন সমাজে বিশেষ করে যারা কৃষিকার্যে জড়িত, তাদের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। পটুয়াখালী ও বরগুনার রাখাইনরা বিগত দিনে পাড়ার লোকজন সম্মিলিতভাবে নবান্ন উৎসব পালন করত। ক্ষেতের ধান পাকার আগে অর্ধ কাঁচা অবস্থায় ধান কেটে ঐ ধান দিয়ে চিড়া তৈরি করা হয়। চিড়া তৈরি করতে পাড়ার যুবকরা নির্দিষ্ট দিন-তারিখে এসে সহযোগিতা করত। কোনো এক চাঁদনি রাতে পাড়ার মাঝে খোলা জায়গায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঢেঁকি বসানো হয় এবং ঐ অনুপাতে চুল্লি খনন করা হয়। চুল্লিতে আগুন জ্বেলে দুইজন করে যুবতী বা প্রৌঢ় মহিলা চুল্লিতে বসানো কড়াইয়ের ভিতর অর্ধ সের পরিমাণ কাঁচা ধান দিয়ে একটি নারিকেল ছোবড়া বাঁধা শক্ত কাঠির দ্বারা নাড়া দিতে থাকে যে পর্যন্ত উক্ত ধান ফোটা আরম্ভ করে। কড়াই এর ধান ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে একজন ঐ ধান নির্দিষ্ট ঢেঁকিতে ঢেলে দেয় এবং সাথে সাথে ঐ ঢেঁকির জন্য নিয়োজিত দুইজন কর্মী তাদের হাতে ধরা ঢেঁকির গাছ দিয়ে পরপর পিষতে থাকে, যে পর্যন্ত ধান চ্যাপ্টা হয়ে চিড়াতে পরিণত হয়। এভাবে ১০/১২টি ঢেঁকি দ্বারা সারারাত যুবক ও যুবতীরা পালা দিয়ে চিড়া তৈরি করে এবং প্রৌঢ় পুরুষ মহিলারাও সহযোগিতা থাকেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ চিড়া তৈরি করা হলে নির্ধারিত তারিখে বৌদ্ধভিক্ষুদের ভোজনের পর বিভিন্ন পাড়া হতে আগত অতিথিদের প্রতি নবান্নের চিড়া দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। চিড়া খাবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নারিকেল এবং গুড় প্রয়োজন হয়। নবান্ন উৎসব অনেক ব্যয়বহুল। চিড়া তৈরি করতে কাঁচা কচি ধান, জ্বালানি কাঠ, ঢেঁকি ও ঢেঁকির গাছ, কড়াই, একটি ঢেঁকির জন্য চারজন কর্মী এবং চিড়া পরিবেশনের জন্য নারিকেল ও গুড় ইত্যাদি প্রয়োজন। বর্তমানে চিড়া-নবান্ন উৎসব করা সবখানে আর সম্ভব হয় না। তবে পটুয়াখালী এলাকার রাখাইনরা এখনও কিছু কিছু পালন করে এবং চিড়া তৈরি করে পাড়ায় প্রতিটি ঘরে বিতরণ করে থাকে। শুধু চিড়া দ্বারাই নবান্ন উৎসব করা হয় তা নয়, বিন্নি ভাত ও রকমারি পিঠা পরিবেশনের দ্বারা এবং নতুন চাউলের ভাত পরিবেশনের দ্বারাও নবান্ন উৎসব পালন করা হয়।
সাংগ্রেং : রাখাইনদের বহুবিধ উৎসবের মধ্যে সাংগ্রেং (বর্ষবরণ) উৎসব ও রাখাঃ (রথ) যাত্রা উল্লেখযোগ্য সাংগ্রেং পোওয়েঃ সাধারণত এপ্রিল ১৪ হতে ১৭ তারিখ পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমন হচ্ছে সাংগ্রেং উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষে রাখাইন সমাজে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি, নৌকা বাইচ, ক্যানপোয়েঃ (বলীখেলা) প্রভৃতি হয়ে থাকে। বর্তমানে উল্লিখিত অনুষ্ঠাদির মধ্যে একমাত্র পানিখেলা ছাড়া অন্য অনুষ্ঠানগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠান এ সমাজ হতে উঠে গেছে।
ভাষা ও বর্ণমালা
ভাষা পরিচয় : রাখাইনরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার সাধারণ উত্তরাধিকার নিয়েই বাংলাদেশে বসতি গড়ে তুলেছে। বাঙালিদের সাথে দীর্ঘকাল ব্যাপী সংস্পর্শ বজায় রেখেও রাখাইনরা স্বকীয়তা ও স্বীয় পরিচয় হারিয়ে ফেলেনি। বরং সাম্প্রতিককালে পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠীর ক্রমাগত চাপের মুখে এবং তাদের সাথে সন্নিবেশিত থেকেও রাখাইনরা নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগত অধিকার সংরক্ষণে আগ্রহী। পটুয়াখালী ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা ব্যাপকভাবে তাদের সনাতন জীবন ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ভাষা (উপ-ভাষা), পোশাক, খাদ্য এবং বাসগৃহ নির্বাচনে সংরক্ষণশীল। বিস্ময়করভাবে প্রতিভাত হয়েছে দুটি নৃগোষ্ঠী বছরের পর বছর পরস্পর সন্নিহিত থাকা সত্ত্বেও তাদের ভাষাগত আচরণে কোনো সম্মিলনের কোনো উল্লেখযোগ্য চিহ্ন পরিস্ফুট হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ০.৫% কৌম জনসংখ্যার বৃহদাংশের প্রতিনিধিত্বকারী রাখাইনরা ৯৯.৫% বিশাল বাঙালি জনসংখ্যার অভ্যন্তরে বা প্রান্তে থেকেও সেভাবে প্রভাবিত হয়নি। রাখাইন ভাষা মঙ্গোলিয় স্রোতধারার ভাষা ভোট ব্রহ্ম। এই ভাষা ইন্দো-আর্য বা দ্রাবিড়িয় আর্য ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে কারণে বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি ও দক্ষিণ ভারতের ভাষার সঙ্গে এই ভাষার খুব একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মঙ্গোলিয় উপভাষার স্রোতে বহমান বাংলাদেশে অবস্থানরত রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষার ব্যবহার নিয়ে নানা প্রভেদ রয়েছে, যদিও তাদের লিখিত ভাষার রূপ এক ও অভিন্ন। এই প্রভেদ সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান উল্লেখ করেন, পটুয়াখালীতে দুটি প্রধান উপভাষা প্রচলিত ক. র্যামব্র্যে ও খ. মারৌও। এই উপভাষা দুটি নানা দিক থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। উপভাষা দুটি উচ্চারণে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিলেও তাঁর লিখিত রূপ একটাই। অর্থাৎ লিখিত মাধ্যমে এই দুটি উপভাষার মধ্যে পার্থক্য থাকে না। বর্মী বুলির সঙ্গে এই র্যামব্রে উপভাষার একটা মিল আছে। যদিও এই মিল অতি সামান্য। এরা বর্মী বুলি বুঝে, যদিও বর্মীরা এদের কথা বোঝে না, ব্যবহারও করে না। আরাকানের রাখাইনদের ভাষার একটা প্রভাব বর্মীদের উপর স্পষ্ট। একথা ওদের মধ্যে গর্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। এই উপভাষীরা নিজেদের মাতৃভাষায় ৯৯% শিক্ষিত। ওরা বার্মা থেকে সকল মিডিয়া বা মাধ্যমে প্রচারিত বর্মী ও রাখাইন ভাষা পড়তে বা শুনে বুঝতে পারে। তারা নিজেদের মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে থাকে। যাই হোক র্যামব্র্যে এবং মারৌও উভয় উপভাষা-ভাষীরাই দীর্ঘকাল বাংলা ভাষাভাষী পরিবেশে বাস করা সত্ত্বেও এবং চিরকাল প্রাকৃতিক দুরবস্থা তথা সমুদ্রোপকূলবর্তী দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শিকার হয়ে থেকেও এরা আপন ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত এমনকি বিকৃত পর্যন্ত হতে দেয়নি। এদের ভাষা সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ভাষা সংরক্ষণই শুধু নয়, ভাষার উন্নতিকরণ ও আধুনিকীকরণের মধ্যেও এখন এদের সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। রাখাইনরা দ্বি-ভাষী নয়। (মুস্তাফা মজিদের ‘বাংলাদেশ রাখাইন (রাখাইন) জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)’ গ্রন্থের ৯৬-৯৭ নং পৃষ্ঠার উদ্ধৃতাংশ।)
বর্ণমালার উৎপত্তি : রাখাইন ভাষা অতিপ্রাচীন একটি ভাষা। খ্রিস্টপূর্ব কাল হতে রাখাইন জাতির ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুঁথিগতভাবে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব না হলেও শিলালিপির আকারে, স্মৃতিস্তম্ভ, গুহার দেয়ালে, মন্দিরের দেয়ালে, বুদ্ধমূর্তির পদমূলে এবং মাটির পাত্র, তামার ঘণ্টা, রৌপ্য মুদ্রার গায়ে লেখাসমূহ খোদিত ছিল। সেগুলো থেকে গুণীজ্ঞানী ঐতিহাসিকদের গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, রাখাইন বর্ণমালার উৎপত্তি হয়েছে উত্তর ব্রাহ্মী লিপি থেকে। যুগে যুগে ব্রাহ্মীলিপির রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমান রাখাইন বর্ণমালার পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছে। উল্লেখ্য, ধান্যবতী ও বৈশালী (৩৩২৫-১০১৮ খ্রিস্টাব্দ) যুগসমূহের সংস্কৃত ও পালিভাষায় উৎকীর্ণ লিপিও উদ্ধার করা হয়েছে। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আরাকানে (রক্ষাপুরী) সাহিত্যিকরা খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক হতে খ্রিস্টাব্দ ৩য় শতক পর্যন্ত ব্রাহ্মীভুক্ত লিপি ব্যবহার করতেন, যা ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় ব্রাহ্মী অক্ষরের অনুরূপ আরাকানে খ্রিস্টিয় ৪র্থ শতক হতে ৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত ব্রাহ্মীভুক্ত অন্যান্য বর্ণমালাও ব্যবহার করা হতো। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পর ব্রাহ্মী অক্ষরের বদলে দেবনাগরী অক্ষর বহুলভাবে প্রচলিত হয় এবং খ্রিস্টিয় ৮ম শতকের দিকে এসে আরাকানে ব্রাহ্মী ও দেবনাগরী থেকে বিবর্তিত এক প্রকার বর্ণমালা সৃষ্টি হয়, সেটাই রাখাইন বর্ণমালা হিসেবে অদ্যাবধি প্রচলিত হয়ে আসছে। ১৯৯৫ সালে থাইল্যান্ড হতে প্রকাশিত আরাকান ইতিহাস গবেষণা সমিতির সাময়িকী ‘রাখাইন আঃ মান ১’ (পৃ. ২-৩) এ ‘রাখাইন বর্ণমালার মূলধারা ও বিবর্তন’ শীর্ষক প্রদর্শিত নকশাটি –
উপরে উল্লিখিত নকশার প্রদর্শিত কলাম ১ ও ২ এর বর্ণমালাগুলো ধান্যবতী যুগে আরাকানে ব্যবহৃত রাখাইন অক্ষর ব্রাহ্মী এবং এগুলো উত্তর ভারতের ব্রাহ্মী বর্ণমালার সাথে সম্পূর্ণ এক। প্রদর্শীত কলাম-৩ অনুসারে, ১ম বৈশালী যুগে রাখাইন অক্ষর ব্রাহ্মী কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হলেও এগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থেকে গেছে। কলাম-৪ এ প্রদর্শিত বর্ণমালাগুলো ২য় বৈশালী যুগে এসে বিশেষ কিছু পরিবর্তিত না হলেও তালপাতার ওপর লেখার পদ্ধতি চালু হওয়ায় আকৃতির সামান্য পরিবর্তিত হয়। প্রদর্শিত কলাম ৫-এর নমুনায় লেম্রো যুগের বর্ণমালার অর্থবহ পরিবর্তনের দ্বারা বর্তমান রাখাইন বর্ণমালার উৎপত্তি। পরবর্তীতে ম্রাকঊ যুগের বর্ণমালা পূর্ণাঙ্গ রূপান্তর লাভ করে। রাখাইন বর্ণমালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (প্রদর্শিত কলাম ৬)। (ধান্যবতী যুগের ব্রাহ্মী লিপির (কলাম-২) (চান্দা সূর্যের সময়কাল, ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩য় শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত) সাথে উত্তর ভারতের মূল ব্রাহ্মী লিপির (কলম-১) সাথে হুবহু মিল রয়েছে। বৈশালী যুগের স্ক্রিপ্ট (কলম-৩) (খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৭ম শতক) কিছু পরিবর্তন হয়েছিল, কিন্তু মৌলিক ফর্ম স্টাইল রয়ে গেছে। দ্বিতীয় বৈশালী যুগের (৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ১০ম শতাব্দী) লিপিগুলির খেজুর পাতায় লেখার অভ্যাসের কারণে আকারে কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। লেম্রোর লিপি (কলাম-৪) (দশম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত) প্রশংসনীয়ভাবে বর্তমান রাখাইন বর্ণমালা গঠনে পরিবর্তিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ম্রাউক-উ সময়ের স্ক্রিপ্টগুলি (কলাম-৬) এখন পর্যন্ত রাখাইন বর্ণমালার একটি সম্পূর্ণ রূপ।) (অনুদিত। বর্তমানে বাংলাদেশের রাখাইন ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা শিক্ষার সুযোগ লোপ পাচ্ছে। স্কুলে বাংলা ভাষায় শিক্ষার পাশাপাশি রাখাইন ভাষা শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রাখাইন ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ হারাচ্ছে। ভাষা ও সংস্কৃতি হচ্ছে জাতীয় অস্তিত্বের ভিত্তিমূল। সুতরাং রাখাইন ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষার সাথে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা প্রাথমিক পর্যায়ে চালু করা আবশ্যক। বাংলাদেশে রাখাইন ভাষা উন্নয়নের জন্য রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
লোক-সংস্কৃতি ও সাহিত্য
নৃত্যকলা : রাখাইনদের হাজার বছরের স্বর্ণালি যুগগুলোতে গান, নাটক, নৃত্য বিকাশ লাভ করেছিল। ঐ সকল সাংস্কৃতিক অংশ নৃত্যকলার কৌশল ও আনুষঙ্গিক বাদ্যযন্ত্রাদির ব্যবহার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য ২য় ম্রাউক যুগের প্রতিষ্ঠাতা মাঙবাগ্রী (১৫৩১-১৫৭১ খ্রি.) একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করে ৮০ হাজার বুদ্ধমূর্তিসহ দেবদেবীর আকৃতি এবং বিভিন্ন ধরনের পোশাকে সেজে নারী পুরুষের নৃত্য-কলাকৌশল ও আনুষঙ্গিক বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি খোদাই করে রেখে গিয়েছেন। মন্দিরটি ‘রাংঅংজেয়া সাইত্যোং ফারা’ নামে বিখ্যাত, যা আরাকানের রাজধানী ম্রাউক উ শহরে বিদ্যমান রয়েছে। ঐ মন্দিরের দেয়ালে খোদিত নৃত্য-কলাকৗশলসমূহ রাখাইন নৃত্য বিশারদগণের গবেষণার ফলে উদ্ভাবিত হয়েছে কালজয়ী রাখাইন নৃত্য। রাখাইনদের জীবনাচারে ধর্মীয় ও সামাজিক আঙ্গিকে বিভিন্ন পর্বের নৃত্য পরিবেশিত হয়ে থাকে। এমনকি কোনো পূজনীয় ব্যক্তি অথবা গুণীজনের মৃত্যুতেও শবদেহকে বহন করে নৃত্যের মাধ্যমে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকে। নিম্নে কয়েকটি রাখাইন নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –
- বৌদ্ধ প্রদীপ-পূজা নৃত্য : এটি এক প্রকার প্রদীপ হাতে তরুণীদের দলবদ্ধ নৃত্য। আরাকান রাজা মাঙবাগ্রী আমল হতে এ নৃত্য প্রচলিত হয়ে আসছে।
- নেৎ নৃত্য : বৌদ্ধ ধর্মে সর্বভুত অন্তর্ভুক্ত আছে। ‘সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্তু’- এটাই বুদ্ধের আশীর্বাদ বাণী। ঐ ধারাকে অনুসরণ করে রাখাইন জাতি দ্বীপদেবতা, পাড়াদেবতা, আমদেবতা, নগরদেবতা, গৃহদেবতা ইত্যাদিকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকে। এককালে প্রত্যেক এলাকায় বর্ষারম্ভে এসব দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পূজার অর্থ্যাদিসহ নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
- সেইংডেইং নৃত্য, আজিংজিকে নৃত্য, আরাছামাংগ্রী নৃত্য, হেংনৃত্য, জেং নৃত্য, য়েইং নৃত্য, সাংগ্রেং নৃত্য, রাঠাছোয়ে হেং নৃত্য : ১২ থেকে ৩৬ জন রাখাইন তরুণী দলবদ্ধ হয়ে আধুনিক ব্যালে নাচের ন্যায় এ নৃত্যসমূহ পরিবেশন করা হয়। এ নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রায় রাখাইনদের ব্যক্তি জীবনের জন্ম, বাল্যকাল ও বয়ঃপ্রাপ্তি, বিভিন্ন খেলাধুলা ও উৎসব পার্বণসমূহকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
- কিনারা নৃত্য, টোঃ নৃত্য, ছেংটাউপোঃ নৃত্য, সেছাড়া উক্রিম্যাঃ নৃত্য, রওছে নৃত্য : খ্রিস্টিয় ৯ম শতাব্দী হতে প্রচলন হয়ে আসছে এ নৃত্যসমূহ। কাল্পনিক মূর্তি তৈরি করে ভিতরে মানুষ ঢুকে এ নৃত্যগুলো পরিবেশন করা হয়।
- রাজকন্যা পোওয়া নৃত্য : এটি ঐতিহাসিক ঘটনাভিত্তিক যুবতীর একক নৃত্য।
- নাগনৃত্য : তাঁতের কাপড় দ্বারা নাগের অবকাঠামো তৈরি করে ১০/১৫ জন যুবক মিলে ধর্মীয় শোভাযাত্রার পুরোভাগ থেকে এ নৃত্য পরিবেশন করে এগিয়ে চলে এবং মিছিলের সামনে থাকে ঋষির বেশধারী ঘণ্টাবাদক এক যুবক। হাজার বাকবিশিষ্ট ব্যূহচক্র (ওয়াংকাবা) অনুষ্ঠানে এ নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
- ঙাচে নৃত্য : এটি রাখাইন লোককাহিনী ও ইতিহাসের ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত এক প্রকার গীতিনৃত্য।
- জং নৃত্য, ছেইং নৃত্য : পূজনীয় গুণীজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন স্বরূপ শবদেহ কাঁধে নিয়ে তরুণ যুবকরা এ নৃত্য পরিবেশন করে থাকে।
সাহিত্য : নিজ ভাষা সংস্কৃতি ও লোকাচার অর্থাৎ জাতি ও ধর্মকে সযত্নে লালনপালনের দ্বারা সংরক্ষণ করার কারণে রাখাইন নামকরণ হয়েছে। রাখাইনদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের ধারায় পরিপুষ্ট সাহিত্যেও অনুষঙ্গসমূহকে অদ্যাবধি রাখাইন জনগোষ্ঠী অতি আগ্রহের সাথে অনুশীলন করছে। অতিপ্রাচীন কাল হতে রাখাইন সাহিত্যিকগণ আরাকানে ব্যবহৃত বর্ণমালাসমূহকে ধাপে ধাপে উন্নত করে বর্তমানে প্রচলিত রাখাইন বর্ণমালাতে রূপান্তর করেছেন। তারা ভাষা ও সাহিত্যের ধারাকে নতুন প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে রেখে গিয়েছেন। বিগত ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে বৈশালীর এক রাজকন্যা চোপ্রেঞো (সুবর্ণ দেবী) তার প্রেমিক রাজকুমার সিংগা চন্দ্রের নিকট লেখা তিন খণ্ড বিরহ গীতিকা (রাকান) “সিংকান মীনত্ব্যেন বর্তমানে বার্মায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। এবং বৈশালী যুগের শেষ রাজা চুলাচন্দ্র-এর প্রধানমন্ত্রী ধম্মাজেয়-এর বর্ণমালার তেত্রিশটি বর্ণের উপর ভিত্তি করে লেখা গীতিকা ‘হলে ট ছেং’ রাখাইন সাহিত্যে এক অনুপম সৃষ্টি। ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে যুদ্ধে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির জন্য নৌযোদ্ধারা এ গীতকে কোরাস গেয়ে রণসংগীত হিসেবে ব্যবহার করত। রাখাইন ইতিহাসে অনেক গুণী জ্ঞানী কবি সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন, যাদের সাহিত্যকর্ম রাখাইন জাতির ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা এবং পাশাপাশি বর্মী সাহিত্য অঙ্গণকেও তা সমৃদ্ধ করেছে। আদিকাল হতে এ সব বর্ণমালায় রচিত সাহিত্যের মধ্যে কাব্য, গীতিকাব্য, ছড়াগান, স্তুতিগাথাসমূহই প্রধান। তন্মধ্যে চোপ্রেঞো (সুবর্ণ দেবী)-এর তিন খণ্ড রাকান এক অমর সাহিত্য সৃষ্টি হিসেবে এখনও গুরুত্ব বহন করে। রাখাইন জনগোষ্ঠীর কালজয়ী কবি সাহিত্যিকগণ ধর্মীয় অনুশাসন, নীতিকথা, কল্পকাহিনী, সূত্র, গাথা, ছড়া, শ্লোক, পদ্য, কাব্য, কবিতা, শ্লোগান, খনার বচন, গীতি, নাটক, উপন্যাস রচনা করেছেন। রাখাইন ভাষায় সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানগুলো প্যো, রাদু, রাগান, লাংকা, ছেংপাউ, চাকাজেং, ঈসাং, চাখ্রাং, লোয়খ্রাং, টেইখ্রাং, ধেম্মাছেট (Dhammathat), ছেংসেং, ওয়েথু, রাজওয়াং, কাব্যা, প্রাজেট্ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ঐ সকল প্রাচীন রাখাইন সাহিত্যকর্ম মায়ানমারের (বার্মার) সাহিত্য অঙ্গণকে সমৃদ্ধ করছে। চোপ্রেঞো রাদু রাকান (খ্রি. ৭ম শতক), চেইন্দ্ৰা বোয়ে (খ্রি. ৮ম শতক), রাখাইন মাংসামিংএখ্রাং (খ্রি. ১৫ শতক), উক্কা বোং রাদু (খ্রি. ১৭ শতক), মহা পঞাক্যো মাংথু (১৬ শতাব্দী) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আধুনিককালে অনেক রাখাইন লেখক, কবি ও গবেষকগণ নানা আঙ্গিকে লিখছেন। দুই শতাব্দীর অধিককাল বর্মীদের শাসনের ফলে রাখাইন চর্চা ও প্রসার লাভে বাধাগ্রস্ত হলেও বর্তমানে বার্মার বাইরে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত রাখাইন সাহিত্য সেবকগণ পূর্ণাঙ্গ রাখাইন মাতৃভাষায় লেখালেখি ও সাহিত্য চর্চার সুযোগ করে নিচ্ছেন।
পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার : রাখাইন পুরুষরা সাধারণত লুঙ্গি ও শার্ট পরিধান করে থাকে। শার্টের উপর লুঙ্গি পরা হয় এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করতে হলে শার্টের উপর প্রাংখেং (ওভার কোট জাতীয়) চাপিয়ে নিজদের গাম্ভীর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বয়স্করা মাথায় সাদা বা রঙিন পাতলা কাপড়ের পাগড়ি বেঁধে থাকে কিন্তু বর্তমানে এর প্রচলন কমে গেছে। পূর্বকালে বয়স্কদের মাথায় মহিলাদের ন্যায় লম্বা চুল ও খোঁপা বাঁধত এবং কানে স্বর্ণরৌপ্যের ফুল পরা হতো। এটি পঞ্চাশ বছর পূর্বেও পটুয়াখালী ও বরগুনার রাখাইনদের মাঝে প্রচলন ছিল। তখনকার দিনে রাখাইন পুরুষের কান ফুটিয়ে কানের ফুল পরা জাতীয় কৃষ্টির অঙ্গ ছিল বিধায় রাখাইন পুরুষদের প্রতি ‘নাঃ ফাউ চাঃ ম্যো’ (কান ফোটা গোষ্ঠীর সন্তান) মর্মে সম্বোধন করা হতো। রাখাইন মহিলারা সাধারণত ‘থামিং’ (লুংগি) ও ‘আংজ্যি (হাতাওয়ালা ব্লাউজ) এবং বক্ষবন্ধন পরে। অনুষ্ঠানাদি বা সামাজিকতার জন্য অন্যত্র যেতে হলে টাংপাই (ওড়না) ব্যবহার করে থাকে। আগেকার দিনে মহিলারা সেলাইকরা থামিং ব্যবহার করত না, সেলাই ছাড়া লম্বা চার হাতি থামিং পরত। একটি পাতলা কাপড়ের পাত বুকের বন্ধনী হিসেবে ব্যবহার করত এবং কোমরে চার হাত লম্বা কোমর বাঁধন (থাক্রো) দ্বারা শক্ত করে জড়িয়ে রাখা হয়। থাকোর উপরে সাধারণত কোমর বাঁধন এক গোছা রৌপ্য চেইন (চোক্রো) ব্যবহার করে থাকে। হাতে চুড়ি (লাইখ্রাং) ও হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুরী (লাই চৈয়), পায়ে বলয় (থ্রী খ্রাং), কানে দুল (নাঃ দুয়) অথবা ফুল (নাঃবৈন), খোঁপায় পাথর বসানো স্বর্ণ-রৌপ্যের খোঁপা বন্ধন এবং গলায় চেইন বা হার ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে ঐ সকল পোশাক পরিচ্ছদ এবং অলংকার ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক ছেলেমেয়ে, যুব-যুবা, প্রৌঢ় পুরুষ-মহিলাদের মাঝে আচার-আচরণে, চলাফেরায়, কথাবার্তায় এবং খাওয়া দাওয়ায় অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
আসবাবপত্র, তৈজসপত্র ও খাদ্যাভাস : আগেকার দিনে অবস্থা সম্পন্ন রাখাইনদের ঘরবাড়িতে সেগুন কাঠের তৈরি বড়বড় বাক্স এবং আলমিরা ব্যবহার করা হতো। নানা আকারের ঘুমাবার খাট, টেবিল চেয়ার এবং খাবার টেবিল (৯-১২ পরিমাণ উচ্চ) ব্যবহার করা হতো। বর্তমানেও ধনী-দরিদ্র প্রত্যেক ঘরে খাবার টেবিল থাকে, পাটাতনে বা মাটিতে ভাতের থালা রেখে ভাত খেতে রাখাইনরা অভ্যস্ত নয়। বিগত দিনে কাঁসার থালা, পাতিল, বাতি ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে ঐ সকল তৈজসপত্রের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সাধারণত যা ব্যবহার করে রাখাইনরাও সেটাই ব্যবহার করছে। পূর্বে রাখাইনদের দু বেলা (দুপুর+সন্ধ্যা) ভাত খাওয়ার অভ্যাস ছিল। বর্তমানে বাঙালিদের দেখাদেখি পরিবেশগত কারণে অধিকাংশ পরিবারে তিনবেলা ভাত খাওয়ার প্রচলন হয়েছে। বিগত পঁচিশ বছর পূর্বেও এ অভ্যাস রাখাইনদের মাঝে ছিল না। সকালে উঠে হালকা নাস্তা (বিন্নি ভাত, পিঠা ইত্যাদি) করে কেটলি ভরা গরম গরম রং চা খেয়ে নিজ নিজ কাজে চলে যেত এবং দুপুর ১২টার পূর্বে ভাত খাওয়া হয় আর সন্ধ্যার আগে খাওয়া হতো। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন রাখাইনদের খাবার মেনু ও খাওয়ার সময়কাল বাঙালিদের মতো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রং চা খাওয়া ও নাপ্পি (চিংড়ি মাছের আচার) খাওয়ার সংস্কৃতি এখনও ধরে রাখতে পারছে।
রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা : রাখাইন সমাজে ঐতিহ্যবাহী অনেক খেলাধুলা প্রায় উঠে গেছে। বিগত দিনে রাখাইনদের ইনডোর ও আউটডোর অনেক খেলা প্রচলিত ছিল। অনেক খেলা নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে খেলতে পারত। ইনডোর খেলাধুলার মধ্যে ১. পাশাখেলা, ২. দাবা খেলা, ৩ নির্বান খেলা, যা লুডু খেলার মতো কিন্তু অনেক উন্নত ও ধর্মীয় গাম্ভীর্যপূর্ণ, ৪. অবৌত্বোনধেং, ৫. কুড়িচি কাউতেং, ৬. বান ত্বাঃধেং ইত্যাদি খেলা রাখাইন সমাজে প্রচলিত ছিল। আউটডোর খেলার মধ্যে ১. অংলু ছিং-ধেং, ২. চিঃ ঠো ধেং, ৩. খ্রাং লুং কাজেৎতেং, ৪. তেং খুং ধেং (ধাং ব্রাউ খুং ধেং), ৫. ঈউনাঃ তারাঃ হোওয়া ধেং, (ঈউনা-তে ঈ এর নিচে হ্রস-উ কার) ৬. বুচি সংমা কাজেৎতেং, ৭. টাইবু টাইবু কাজেৎতেং, ৮. চক্রা ওয়েন বেং, ৯. ক্রাইশে লাই তেং, ১০. ডো থো ধেং, ১১. আথৌশে পেই তেং, ১২. ডোঃ কাজেৎতেং ইত্যাদি রাখাইন ছেলেমেয়ে উভয়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যুবক প্রৌঢ়দের মধ্যে শুকনো দিনগুলোতে বিকাল বেলা খ্রেংলুন খাৎতেং (বেতের তৈরি বল) খেলা হতো এবং মাঠে ফুটবল খেলা হতো। কিন্তু আজকাল এ খেলাধুলাসমূহ বাংলাদেশি রাখাইন জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত নয়। তবে কষ্টের কারণ হলেও রাখাইনদের এসকল ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাসমূহ রাখাইন সমাজের সংরক্ষণ করা আবশ্যক। নচেৎ এ জাতীয় কৃষ্টিগত খেলাধুলাসমূহ বিলুপ্তির সাথে রাখাইনদের সাংস্কৃতিক উপাদানের একটা সমৃদ্ধশালী অংশ হারিয়ে যাবে। এখানে ‘আফোঃ আফোঃ জাতুঃ রে লে’ খেলার নমুনা দেয়া হল। এটি খেলার সময় মুখ থেকে এই ছড়া আবৃত্তি করতে হয় – “আফোঃ আফোঃ জা তুঃ রে লে? (দাদু দাদু কী খনন কর?)/ সোওয়ে ঙোওয়ে তুঃ রে। (সোনা রূপা খনন করি।)/ সোওয়েনে ঙোওয়েনে ফাফোলাঃ? (সোনার সাথে রূপার বদল করবে কি?)/ মাফা (করবই না।)/ আফোঃ জা রোয়া মা নিরে? (দাদু তুমি থাকো কোন গ্রামে?)/ নেংদারাছি রোয়ামা নিরে (থাকি আনারস গ্রামে)/ নেংদারাছি তালুং পিঃ ফোলাঃ? (দেবে কি আনারস একটি?)/ মাপিঃ (দেব না।)/ মাং গংথাৎমা ক্রাৎসি, (তোমার মাথার উপর মুরগির বিষ্ঠা)/য়াৎপালাই, (ফেলে দাও।)/ মায়াৎ। (দেব না।)/ চাঃ কাঃ চাঃ লি, সিঃ মাপাউ কেঃ। (খাও তো খাও, পায়ু বুদ ফাটিও না।)/ভূ ভূ ভূ ভূ। (ভূ ভূ ভূ ভূ)।” এক দল ছেলে মেয়ে তাদের ভেতর থেকে একজনকে দাদু বানিয়ে এক কোণায় বসিয়ে রেখে উপর্যুক্ত ছড়া আবৃত্তি করার পর সবাই পালিয়ে যায়। যাকে সর্বপ্রথম দাদু স্পর্শ করতে পারবে তাকেই পরবর্তীতে দাদুর ভূমিকা পালন করতে হবে। এটি এক ধরনের দৌড়ের খেলা এবং ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য গঠনে সহায়ক।
রূপকথা ও লোককাহিনী : রাখাইন সমাজ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ ধর্মের সূত্র পিটকে গৌতম বুদ্ধের অতীত জীবনের কাহিনী বর্ণিত আছে ‘জাতক’ হিসেবে। এতে বোধিসত্ত্বের ৫৫০টি জীবনকাহিনীর উল্লেখ আছে। তাছাড়া বৃদ্ধবংস, থেরগাথা, থেরীগাথা, পেতবত্থু ও বিমান বত্থু – এ ছয়টি গ্রন্থে হাজার হাজার ঘটনার উপর আলোকপাত করে বুদ্ধ উপদেশমূলক দেশনা দান করেছিলেন। ঐ সকল কাহিনীসমূহ রাখাইন বৌদ্ধদের সামাজিক অঙ্গনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
প্রবাদ-প্রবচন : রাখাইন সমাজে নানা প্রকার প্রবাদ প্রবচন প্রচলিত আছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো –
- ১. অলো ক্রীগে অরা নেঃরে (অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।)
- ২. চিয়াং ম্রাংয়াং আওয়ান নেক (জেনে শুনে জিদ ধরা।)
- ৩. ম্যাহ্না ক্রীরা হাংফেৎপা (বড় মাছের কাঁটাও ভালো।)
- ৪. ঙরে মাহিলো ম্যাই চোয় রে (উলুবনে মুক্তা ছড়ানো।)
- ৫ অগ্রোমনাইং নাৱোওক কাইং (শিং ধরতে না পারলে কান ধরো।)
- ৬. ক্রিজাই ক্রীকে রান রারে (মশকরাতে ঝগড়া হয়।)
- ৭. আচা মাকোং আন্যোহ মচোশা (নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।)
- ৮ আলো হিবা স্ত্রী কাই আলো/ব্রীগে ছানু কাইন (কাজের সময় কাজি কাজ ফুরালে পাজি)
- ৯. লেঃরামা ফি থোং (মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।)
- ১০. লোভাক্রীগে লোকান্দ্রা ছাইতে (অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি।)
- ১১. আঘু কেংতুঃ আথু রিচাও (কালনেমির লঙ্কা রোগ।)
- ১২ ক্রোনথ্রী গাচ প্ৰাতাই মীলোং (তিলে তাল হয়।)
- ১৩. আচাঃ ক্রীগে আচীলোং (বেশি খেলে গলায় বাজে।)
- ১৪. মাকোং চাদেং আনে রোঅং (মন্দ খবর বাতাসের আগে চলে।)
এছাড়াও কয়েকশত বছর পূর্ব হতে লোকের মুখে মুখে কখন কী হবে তার ভবিষ্যতবাণীমূলক প্রবাদপ্রবচনের প্রচলন রয়েছে পটুয়াখালী ও বরগুনার রাখাইনসমাজে। যেমন ‘ছেগ্রী ছেকে মানিলীগে সংগ্রী মংগ্রী টিংলীমে।/ ত্ব্যেন ফো মাহৌ বরাবৌনেহ লাঃলীমে।/ আনাউমাহ ত্ব্যেন্ফ্যু, আরেহ মাহ্ ডাঃজা।/ ত্বেনফ্যু মাহ মল্যুলীগে চুয়েন ফ্রাইলীমে।/ ডাঃজাকো নেলোঃলাঃলী শানত্যালীমে।’ এর বঙ্গাৰ্থ হচ্ছে, “বড় বাঁধ নির্মাণ হলে বড় খাল নদী ভরাট হবে। সেখানে আর বসবাস করো না। জাহাজ নয় সমুদ্রগামী পালের বড় নৌকা যোগে যেতে হবে। পশ্চিমে পাতানো চাটাই, পূর্বে শাণিত ঢাল তলোয়ার, শাণিত তলোয়ার ঢালের পাড়া দিয়ে যাবে, শান্তি হবে। কিন্তু চাটাই-এর উপর হেলান দিয়ে আরাম করলে দুঃখ পাবে।” এই প্রবাদ প্রবচনটি ছোট শিশুদের ঘুমপাড়ানো ও ভুলানোর জন্য রচিত হয়নি। লোকের মুখে মুখে আপনাআপনি উচ্চারিত হয়ে প্রবাদ বচনে পরিণত হয়েছে। শত বছর পূর্বে কেউ জানত না এবং এটি চিন্তার বাইরে ছিল যে, এখানে খাল নদী-নালার উপর দিয়ে দু পাড়ে বড় বাঁধ হবে, সেখানে নাব্যতা কমে গিয়ে খাল নদী-নালার ভরাট হবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, উল্লিখিত পটুয়খালীর রাখাইন প্রবাদ প্রবচনটি যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়েছে। হাজার হাজার রাখাইন পরিবার জাহাজে বা ট্রলারে নয়, সামুদ্রিক মাছ শিকারের পাল তোলা বড় নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে দুঃখ যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে পৈতৃক ভূমি আরাকানে। যেভাবে বিগত দুই শতাব্দী বছর পূর্বে তাদের পূর্ব পুরুষেরা এখানে এসেছিলো বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে। বর্তমানে এখানে যারা রয়েছে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন। অনেক দুঃখ বেদনায় ও সংকটময় জীবনযাত্রায় সংশয় জাগছে এ মাতৃভূমিতে আর কতদিন রাখাইনদের স্থায়িত্ব থাকবে। যদি প্রবাদের শেষ পর্ব যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে কি ঘটবে রাখাইনদের অস্তিত্বের বিলুপ্তি?
সংস্কার : রাখাইন জাতি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক হতে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জাতীয় আচার আচরণে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং বহুলাংশে বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসন মোতাবেক তাদের জাতিগত বৈশিষ্টসমূহের সংস্কার সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা কর্মবাদী। তারা বিশ্বাস করে, মানুষ কর্মের অধীন, কর্মই মানুষের সখা।’ সকল জীবজগৎ কর্মের অধীনে বিবর্তিত হচ্ছে। ‘সব্বেসত্তা সুখীতা হোন্ত’ এই মর্মবাণীর দ্বারা সর্বভূতের সুখ-শান্তি কামনা করা হয়। ফলে রাখাইন বৌদ্ধ সমাজে দেব-দেবী, ভূত-প্রেতাত্মাদের সন্তুষ্টির প্রক্রিয়াও প্রচলিত আছে। সুত্ত (সূত্র) পিটকের কাহিনীর বর্ণনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেবদেবীর সম্পৃক্ততা আছে। সুতরাং কৃষ্টিগত ধারাবাহিকতায় রাখাইনদের মাঝে দেবদেবী, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব হতে মুক্তির উপায় হিসেবে বহু প্রকার কার্যক্রম পালন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক পরিবর্তন আসছে।
আদিবাসী জ্ঞান :
- কৃষিবিজ্ঞান : রাখাইন আদিবাসীদের কক্সবাজার অঞ্চলের কিছু অংশ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনা অঞ্চলের গোটা জনগোষ্ঠীর কৃষিকার্যে সম্পৃক্ততা ছিল। যারা কৃষিকার্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তারাই অরণ্যভূমিকে সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা আবাদি ভূমিতে রূপান্তর করেছে। এটাই রাখাইনদের কৃষিভিত্তিক জ্ঞানের পরিচায়ক। পূর্বে রাখাইনদের জমা-জমিতে নাড়া কাটা হতো না এবং গো-মহিষের গোবর তোলা হতো না। এতে ঐ নাড়া এবং গোবর সময়কালে জৈব সারে পরিণত হয়ে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত। কিন্তু বর্তমানে জমির ধান কেটে নেওয়ার সাথে সাথে বাঙালিরা ক্ষেত্রের নাড়া কেটে নেয় এবং গোবর যদি মাঠে পড়ে তাও তুলে নিয়ে যায়। এতে জমির উর্বরতা কমে যায়, ফলে রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়া উপায় থাকে না। পূর্বকালে রাখাইনদের জমাজমির সংলগ্ন মুকশ ভূমিতে গো-মহিষের চারণক্ষেত্র হিসেবে ঘাস জন্মানো হতো। কিন্তু বর্তমানে মুকশ ভূমি আর নেই। রাখাইনদের জমাজমির মধ্যে ছোট ছোট খাল বিল পর্যন্ত সরকার ভূমিহীন বাঙালিদের বন্দোবস্ত দিয়ে রাখাইন বনাম বাঙালির মধ্যে ভূমি সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। মামলা মোকদ্দমায় অনেক রাখাইন পরিবার ভূসম্পত্তির মালিক হতে ভূমিহীনে পরিণত হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। সাধারণত রাখাইনরা মহিষের হালে ভূমি কর্ষণ করত এবং বাঙালিদের কৃষির সরঞ্জাম হতে তাদের সরঞ্জাম আলাদা এবং উন্নত। বর্তমানে গো-মহিষের চারণক্ষেত্র নেই এবং নিজ উদ্যোগে চাষাবাদ করতে জনবল নেই। এতেও বাঙালি কামলাদের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন দুর্যোগ আক্রান্ত হয়ে রাখাইনদের ভূসম্পত্তি কমে যাওয়ায় জমাজমি চাষাবাদের উপর রাখাইনদের অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে।
- চিকিৎসা ও ওষধি বিজ্ঞান : আদিকাল হতে রাখাইনদের চিকিৎসা ও ওষধি বিজ্ঞানের প্রচলন ছিল। তাদের চিকিৎসা ও ওষুধি (বনজ ও খনিজ) সংক্রান্ত অনেক শাস্ত্র আছে যার গবেষণামূলকভাবে সংরক্ষণ ও সংস্কার করা হলে দেশ, জাতি ও মানব সমাজের, এমনকি প্রাণী জগতের মঙ্গল সাধিত হতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞান চরম শিখরে এসেও কয়েকটি কঠিন রোগের চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে। যেমন—ক্যান্সার, ডায়বেটিকস ইত্যাদি। এগুলো রাখাইন কবিরাজি ওষুধ প্রয়োগে নিরাময় করা সম্ভব। যেসব রোগের আধুনিক চিকিৎসায় ছেঁড়া-কাটার প্রয়োজন হয় এবং অত্যধিক ও ব্যয়বহুল, তা রাখাইন কবিরাজি চিকিৎসায় বিনা অপারেশনে নিরাময় করা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগের সঠিক অবস্থা নির্ণয় করার জন্য রোগীকে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু রাখাইন চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে রোগীর নাড়ি এবং শারীরিক লক্ষণ দেখে রাখাইন বিচক্ষণ কবিরাজ বা বৈদ্যরা রোগের অবস্থা জানতে পারে এবং সে অনুপাতে ওষুধ প্রয়োগ করে নিরাময় করতে পারে।
- বনসম্পদ : বনসম্পদ রাখাইন সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বন ছায়া দেয়, পরিবেশ সংরক্ষণ করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায়। বন রাখাইনদের প্রতি যেন ইশারায় ডাকে, কেননা বনের নানা রকম লতাপাতা, ফলমূল ও শেকড়-বাকড় ভেষজ ওষুধি হিসেবে সকল জীবজগতের জীবনী শক্তি যোগান দেয়। বৌদ্ধ ধর্মের সাধু সন্ন্যাসী মহাজনরা সাধনার জন্য নির্জন অরণ্যে আশ্রয় নেয়। সুতরাং বন ছাড়া রাখাইনদের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব না। আগেকার দিনে রাখাইনরা গ্রামের পাশে। সমষ্টিগতভাবে বন সংরক্ষণ করতো। গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার, প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ, গো-চারণ ভূমি ইত্যাদি বন সংরক্ষণ ছিল অত্যাবশ্যক। বাঙালিদের আগমনে সর্বত্র বন উজাড় হয়ে চলেছে। ফলে আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগে রক্ষার কোনো উপায় নেই। কৃত্রিম বনে রাখাইনদের প্রয়োজনীয় বনজ ওষুধি ও তরিতরকারি পাওয়া অসম্ভব সে হিসেবে প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ করা একান্তই আবশ্যক এবং সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
- কারিগরি বিদ্যা : জাতিগতভাবে রাখাইনরা কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী। যেমন ধান ভাঙার কল (রাইস মিল) উদ্ভাবনের পূর্বকাল হতেই রাখাইনগণ কাঠ ও বেতের তৈরি হস্ত চালিত যন্ত্র দ্বারা ধান ভেঙে চাল তৈরি করত এবং ঐ চাল ঢেঁকিতে প্রয়োজন মোতাবেক শোধন করে নিতো। কোনো কোনো এলাকায় ঐ ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত আছে। এ প্রক্রিয়ায় চাউলের আসল স্বাদ-গন্ধ ও গুণাগুণ থেকে যায়। কিন্তু রাইস মিলে ঐ গুণাগুণ অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। নির্মাণ ক্ষেত্রে রাখাইন কারিগররা বিগত দিনে জড়ার সংযোজন বিনা পেরেকে জড়া দিত। তাদের ঘরবাড়ির নির্মাণ কৌশল এখনও বাঙালি কারিগরদের তুলনায় উন্নত ও ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রেও রাখাইন কারিগররা নিজ শৈলীতে পারদর্শী। ৪৫০ বছর পূর্বে আরাকানের রাজধানী ম্রাউক উ এ নির্মিত ‘রানঅংজেয়া সাইত্যোং ফারা’ বৌদ্ধ মন্দিরটি বড় বড় পাথর খাপ কেটে জড়া দিয়ে বিনা সুরকি বা বালি সিমেন্ট ব্যতিরেকে স্থাপন করা হয়েছে। মূলত এটি পৃথিবীর একটি আশ্চর্য নির্মাণশৈলী । বর্তমানে রাখাইনদের কারিগরি বিদ্যা বিকাশ লাভের জন্য সরকারির পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে রাখাইনদের এ স্বকীয় নির্মাণ শৈলীসমূহ বিকশিত হয়ে আধুনিক নির্মাণ শিল্পকে আরও আকর্ষণীয় ও অর্থবহ করে তুলতে পারে।
শিক্ষা
আদিকাল থেকে রাখাইনরা নিজেদের ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও ঐতিহ্য-ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন। রাখাইন ছেলেমেয়েদের ৫ বছর বয়সে মাতৃভাষায় শিক্ষা শুরু হতো গ্রাম্য পাঠশালায় অথবা বৌদ্ধ বিহারে। অভিভাবকরা মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়ায় অনেকে বাড়িতে অক্ষর জ্ঞান পেয়ে যায়। বাধ্যতামূলক না হলেও পাকিস্তান আমল পর্যন্ত রাখাইনরা নিজদের মাতৃভাষা (রাখাইন) নিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করত। মাতৃভাষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পর অন্যান্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা হয়। শহরে বসবাস করা ছেলেমেয়েদের জন্য এ ধরনের শিক্ষা আবশ্যিক না হলেও গ্রামাঞ্চলে আবশ্যিক ছিল। মূলত মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। এক সময় রাখাইনদের মাতৃভাষার জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিতের হার ৯৯% জন ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাতৃভাষা শিক্ষায় শিক্ষিতের হার আনুমানিক ৭০% হতে পারে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষায় শিক্ষার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত। কেননা মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য তারা সময় দিতে পারে না। অনেক ছেলেমেয়ে স্কুল হতে এসে আবার প্রাইভেট পড়ার জন্য চলে যায়। এভাবে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য রাখাইন অধ্যুষিত প্রাইমারি স্কুলসমূহে রাখাইন ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা সরকারিভাবে গ্রহণ করা একান্তই আবশ্যক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারাবিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ এই দিবস পালন করছে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে রাখাইন ছেলে মেয়েরা রাখাইন ভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবার কোনো কারণ থাকতে পারে না। যে রাখাইন রাজদরবারে বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে অতি সমাদরে সাহিত্য চর্চার সুযোগ দেয়া হতো আজ এ বাংলার মাটিতে রাখাইন ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষায় শিক্ষা হতে বঞ্চিত হতে পারে না। রাখাইনরা চায় প্রাথমিক শিক্ষা অঙ্গনে রাখাইন ভাষায় শিক্ষাদান পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক। রাখাইন শিক্ষার হার কত সে সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ কোনো সরকারি তথ্য পাওয়া যায় না। রাখাইনদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতের হার আনুমানিক ৭০%। এদের মধ্যে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাস ২৫%, ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাস ১৫%, ৮ম থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পাস ১০%, এইচএসসি পাস ১০%, ডিগ্রী পাস ৮% ও মাস্টার্স পাস ২%। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাখাইনদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় বলা যায়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে রাখাইনদের নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অর্থনৈতিক দৈন্যতা, উচ্চ শিক্ষা ভর্তির পর্যাপ্ত কোটার অভাব, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বৃত্তির অভাব ইত্যাদি। রাখাইনদের উচ্চ শিক্ষা লাভে বাধা কাজ করছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সমস্যার কারণে অনেক রাখাইন ছেলে মেয়ে কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ রাখাইনদের জন্য উক্ত সরকারি বিদ্যাপীঠ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কোনো নির্দিষ্ট কোটা নেই। হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রীর মাঝে একজন রাখাইন ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠার কথা নয়। প্রতিযোগিতায় ঝরে পড়া একজন রাখাইন ছাত্রের জন্য উচ্চশিক্ষা লাভের আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ অনুন্নত রাখাইনদের জন্য যদি কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকে তাহলে ঐ ঝরে পড়া রাখাইন ছাত্রছাত্রীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। রাখাইনরা বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী হতে আলাদা। যেহেতু রাখাইনরা বাংলা ভাষাভাষী নয় তাই বাংলা ভাষার প্রতি বাংলা ভাষাভাষীদের ন্যায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। এই দুর্বলতার জন্য রাখাইনরা পিছিয়ে আছে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাখাইনদের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট কোটার প্রয়োজন আছে।
নারীর অবস্থান
সমাজে রাখাইন নারীর অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় ও মর্যাদাপূর্ণ। রাখাইনদের মাঝে লিঙ্গ বৈষম্য নেই। উভয়েই সমমর্যাদা পেয়ে থাকে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও ছেলে ও মেয়ে সমান অধিকারী এবং পারিবারিকভাবেও স্বামী-স্ত্রীর সমমর্যাদা, প্রভাব ও প্রভুত্ব রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী যেন দুটি দেহ এক সত্তা। কোনো কোনো সময় স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হলেও সহিংসতার সৃষ্টি হয় না। এ কারণে রাখাইন স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে শত সমস্যা হলেও বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া খুবই কঠিন ব্যপার।
রাজনৈতিক সংগঠন
স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে রাখাইনদের সম্পৃক্ততা আছে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে স্থানীয়ভাবে এলাকাভিত্তিক রাখাইনদের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। পঞ্চায়েত গঠনের সময় স্থানীয়ভাবে রাখাইন জনগোষ্ঠী হতে একজন সম্ভ্রান্ত ও বিজ্ঞ ব্যক্তিকে পঞ্চায়েতে নিযুক্ত করা হতো এবং পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র চালু হবার পর ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ও চেয়ারম্যান হিসেবে রাখাইনদের অনেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এলাকার প্রশাসনিক কার্যের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রাখাইন অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালিদের অনুপ্রবেশ ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রাখাইনরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়াতে স্থানীয়ভাবে মেম্বার ও চেয়ারম্যান হওয়া আর সম্ভবপর হয় না। এজন্য স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাসমূহে আদিবাসীদের আসন সংরক্ষিত হওয়া উচিত রাখাইনরা দাবি জানিয়ে আসছে। বিগত সময় হতে জাতীয় রাজনীতিতে কিছু কিছু রাখাইন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি সম্পৃক্ত হয়ে আসছে। বর্তমানে অধ্যাপিকা এথিন রাখাইন বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদে কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য হিসেবে দ্বিতীয়বার পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। বিগত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রার্থী হিসেবে উ সৈয়বাচার কলাপাড়ার আমতলী নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন করেছিলেন। এভাবে রাখাইনদের কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আসছেন বা বর্তমানেও আছেন। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো রাখাইনদের প্রধান সমস্যা ভূমি হারানোর সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের একটি ভূমি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও তৎক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখাশোনার জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীন বিশেষ কার্যাদি রয়েছে। কিন্তু এ বিভাগে অন্যান্য আদিবাসীদের মতো রাখাইনদের অংশীদারিত্বের কোনো সুযোগ নেই। এ বিভাগের উন্নয়ন কার্যক্রমে আদিবাসীদের সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালনের কোনো ক্ষেত্র নেই। তাই আদিবাসী জনগণের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষে সমতল অঞ্চলের প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠী থেকে প্রতিনিধি নিয়ে এ বিভাগে একটি উপদেষ্টা কমিটি বা পরামর্শক কমিটি গঠন করা অত্যাবশ্যক বলে রাখাইনরা মনে করে। অথবা রাখাইনসহ সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। পটুয়াখালী এবং কক্সবাজার ২টি জেলায় একজন করে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্পেশাল ওয়েলফেরার অফিসার নিয়োগ করে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা মোতাবেক আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তরের বিধিনিষেধ পূর্ণভাবে কার্যকরী করার ক্ষমতা দিতে হবে।
তথ্যসূত্র
- ১। শ্রদ্ধেয় উঞান মহাথের মএর ধানাবতী রাজাওয়েন ছেই, খণ্ড-১,২।
- ২। পোহ্লাঅং; রাখাইন নাইগেং ছামাই।
- ৩। সাইফউদ্দিন, মোঃ, বাকেরগঞ্জ জেলার ইতিহাস।
- ৪। বাংলাদেশ জেলা গেজেটীয়ার, পটুয়াখালী (পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা পুনর্বিন্যাসের পূর্ব বিবরণ)।
- ৫। মজিদ, মুস্তফা, পটুয়াখালীর রাখাইন উপজাতি।
- ৬। মজিদ, মুস্তফা, বাংলাদেশের রাখাইন।
- ৭। মংবাঅং (মংবা), বাংলাদেশের রাখাইন সম্প্রদায় (ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা)।
- ৮। মংবাঅং (মংবা), রাখাইন জাতিসত্তা ও বাংলাদেশ।
- ৯। মংবাঅং (মংবা), সম্পাদিত, মারমা জাতিসত্তা
- ১০। মজিদ, মুস্তফা সম্পাদিত, মারমা জাতিসত্তা।
- ১১। খান, আবদুল মাবুদ, বান্দরবান জেলার মারমা সম্প্রদায়।
- ১২। ইসলাম, মোঃ সিরাজুল, ইঙ্গ-বর্মী সম্পর্ক (১৬৪৭-১৮৮৫)।
- ১৩। আবদুল জলিল, মুহাম্মদ, বঙ্গে মগ-ফিরিঙ্গি ও বর্গীর অত্যাচার।
- ১৪। Rakhaing Buddhist Welfare Association, The Rakhaing Review, vol. 1, 1994.
- ১৫। Rakhaing Buddhist Welfare Association, The Rakhaing Review, vol-11,1995
- ১৬। Rakhaing Development Foundation, The Thungran (a souvenir of Rakhaing new year festival 67′ vol-1, 2005
- ১৭। Arakanese Research Society of Bangladesh (ARSB), Cox’s Bazar, Arakanene Research Journal, vol-11, 2003
- ১৮। Rakhine Students Organasation of Bangladesh (RSOB), the Voice of Rakhine 2nd vol, September, 1989 Arakan Historical Research Association (AHRA), Thailand,
- ১৯। Rakhaing AA min, journal -I, 1995
- ২০। All Arakan Students and Youngmen Council (ASSYE), Thailand, Voice Ordadauk drum, Journal-II, 2003
- ২১। মজিদ, ড. মুস্তফা, ‘রাখাইন জাতিসত্তা, ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি, মূল প্রবন্ধ, জাতীয় সেমিনার (National Semmmer on Promotion and Preservation of Rakhaing Language, Culture and Society)
- ২২। তাহান, পটুয়াখালীর রাখাইন।
- ২৩। ক্যথিংজং, অধ্যক্ষ, কক্সবাজার সিটি কলেজ, বাংলাদেশে রাখাইনদের ভূমি অধিকার।
- ২৪। আবদুল মাবুদ খান, ‘পটুয়াখালী জেলার বৌদ্ধ সম্প্রদায়’।
- ২৫। Ushit maung, chairman, Rakhine Development Foundation (RDF), ‘Racism A case Study on the Rakhine Community in Bangladesh & Burma’
- ২৬। ডোনাল্ড রেজেটি, গবেষক, সিডিআই, কারিতাস বাংলাদেশ, “রাখাইন সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট’, ২০০২।
- ২৭। Dr. Muhammad Samad & Donald Rossette, Caritas Development Institute, Dhaka, Bangkadesh, A study on the Rakhine Community in Bangladesh, 2002.
- ২৮। The Indigenous People Thurst for solidarity, comdeca- 1995, Caritas, Bangladesh. সংহতি প্রত্যাশায় আদিবাসী/উপজাতি, দ্বিতীয় এশিয়া প্যাসিফিক কমিউনিটি ডেবেলপমেন্ট ক্যাম্প, ১৯৯৫ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ স্মরণিকা।
- ২৯। Dr Abdul Mabud Khan, Associate Proffessor, Department of History, Rajshahi University, Bangladesh, The Magh: A study of community migration”.
- ৩০। ঞোমা, ডিসেম্বর ১৯৯৭, ‘কুঙ বঙ হ্রাপুগুদ’, ভ্রাবতী চাবেদই, আঙঃজিঃ ম্রোহ্নে, রেঙ্গুন।
- ৩১। দি রাখাইন রিভিউ, প্রথম খণ্ড ১৯৯৪।
- ৩২। মংবা অং (মংবা), বাংলাদেশের রাখাইন সম্প্রদায় (ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা) এবং রাখাইন জাতিসত্তা ও বাংলাদেশ।
- ৩৩। Chitagong District Gazetteer, 1971
প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিয়ে যারা সহযোগিতা করেছেন –
- ১। মি. উসিটমং, চেয়ারম্যান রাখাইন ডেভেল্যাপমেন্ট ফাউন্ডেশন (RDE), ঢাকা
- ২। মি. উঃ ক্যোথিন অং, অধ্যক্ষ, সিটি কলেজ কক্সবাজার,
- ৩। মি. উঃ মংছালু চৌধুরী, রাখাইন প্রবীণ নেতা, খারাংখালী, নিহ্লা।
- ৪। মি. উঃ মংরী ফ্র রাখাইন ডেভেল্যাপমেন্ট ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও সমাজসেবক, মহেশখালী
- ৫। মি. উঃ মংওয়েন, রাখাইন নেতা, চৌফলদণ্ডী, কক্সবাজার
- ৬। মি. মিংমং চিনথান, সাঃ সম্পাদক ও
- ৭। মি. উঃ বাতেন মং কোষাধ্যক্ষ, রাখাইন সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, তালতলী, বরগুনা।
- ৮। যাদের গবেষণামূলক ও তথ্যবহুল লেখাগুলো এ প্রবন্ধে সংযোজন করা হয়েছে তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক ড. মাবুদখান, গবেষক ড. মুস্তাফা মজিদ এবং রাখাইন লেখক মংবাঅং (মংবা) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Leave a Reply