বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

Table of Contents

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, তখন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভার-এ জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মওলানা মওদুদীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি আওয়ামী লীগের নিন্দা করে বলেন, কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যারা শাসনতন্ত্র তৈরি করতে যাচ্ছেন, তাদের এ কথা জানা দরকার যে তেমন কোন শাসনতন্ত্র সফল হবে না এবং সেজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকেই দায়ী থাকতে হবে। (পাকিস্তান অবজারভার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধন অভিযান শুরু করলে জামায়াতে ইসলামির প্রাদেশিক আমীর গোলাম আযম ৪ এপ্রিল তারিখে নুরুল আমীনের নেতৃত্বে জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। ৬ এপ্রিল গোলাম আযম পৃথকভাবে টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানান যে, ‘ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাত করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১)। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতাদানের উদ্দেশ্যে ১০ এপ্রিল গঠিত ‘শান্তি কমিটি’তে জামায়াতে ইসলামী প্রধান ভূমিকা পালন করে। ১৫ এপ্রিল তারিখে গঠিত প্রাদেশিক শান্তি কমিটির তিন নম্বর সদস্য নির্বাচিত হন গোলাম আযম। আহ্বায়ক ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়েরউদ্দিন। শান্তি কমিটির মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধবিরোধী তৎপরতাকে সর্বাত্মক করার জন্য একই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীও গড়ে তোলে। ৯৬ জন জামায়াত কর্মীর সমন্বয়ে খুলনার খান জাহান আলী রোডের আনসার ক্যাম্পে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে রাজাকার বাহিনীর প্রথম দলটি গঠন করেন জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা এ কে এম ইউসুফ। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে এই রাজাকার বাহিনী হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধকে নস্যাত করার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযোগ্য আরেকটি প্রচেষ্টা ‘আলবদর’ নামক সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। এই বাহিনী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন গোলাম আযম এবং প্রকাশ্য নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মতিউর রহমান নিযামী। এছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বিশেষত নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দখলদার পাক বাহিনীকে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনায় সহায়তা করে। (মাওলানা আবদুল আউয়াল জামাতের আসল চেহারা, পৃ. ৬৭)।

বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সালাত আদায়ের আনুষ্ঠাকিতা শুরু হয় ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা-উত্তর এই মসজিদে জাতীয় মসজিদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মসজিদ অভ্যন্তরে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত (১৯৬১ খ্রি.) ‘ইসলামিক একাডেমি’কে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামান্তর করে এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্ম জনগণের মাঝে তুলে ধরার জন্য ঢাকায় একটি সিরাত মজলিস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সিরাত মজলিসের উদ্যোগে ও তাঁর উপস্থিতিতে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল মাসে বৃহত্তর আঙ্গিকে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করা হয়। উমহাদেশে এটাই ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের প্রথম ঘটনা। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছর পক্ষকালব্যাপী ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করে আসছে। পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন।

অবিভক্ত ভারতে ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে এতদঅঞ্চলের হজযাত্রীদের সমুদ্র পথে (বম্বে-কলম্বো-এডেন-জেদ্দা) জাহাজ চলাচলের সুবিধা ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে হাজিদের সমুদ্র পথে (চট্টগ্রাম-কলম্বো এডেন-জেদ্দা) স্বল্প ব্যয়ে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সৌদি অনুদানে ‘হিজবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। পরে বিমান চলাচলের সুবিধা সম্প্রসারিত হওয়ায় জাহাজে ক্রমশ যাত্রী সংকট দেখা দেয়, সেই সাথে অন্যান্য সমস্যার কারণে সমুদ্র পথে হজগমনের সুবিধা থেকে হযযাত্রীরা বঞ্চিত হন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তী সরকার এই জাহাজটিকে ‘প্রমোদ তরী’ হিসেবে ব্যবহার করে।

বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করে এই উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে সোহওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরবর্তী প্রায় পাঁচ হাজার একর সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। সেই সাথে কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণ করে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের আবাসন ও ইসলামি দাওয়াতি কাজে সফররত তাবলিগ কর্মীদের কার্যপরিচালনার জন্য সুব্যবস্থা করে দেন। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং খাদ্য সামগ্রীসহ মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি সম্মেলনে তিনি মুসলিম উম্মার সপক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন।

জিয়াউর রহমানের শাসনামল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত সংবিধানের প্রধান চারটি মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি হয়েছিল নিষিদ্ধ। যদিও সংবিধানের এই মূলনীতি নিয়ে নানাজনের নানা মত। ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞা প্রধান করা হয়েছিল, তা কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ তা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থকে বিকৃত করেছিল। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হলে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল ঘটে। উক্ত ঘটনার ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান ‘৭২-এর সংবিধানে পরিবর্তন ঘটান। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার’, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এবং সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ যুক্ত করেন। সেই সাথে সংবিধানে সংযোগ করেন ‘বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রহিম’। কিন্তু জনগণ এতে কোন রহম পায় নি। ক্ষমতায় এসে তিনি ‘দালাল আইন’ (Collaboration Act 1972) প্রত্যাহার করেন এবং সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেন। সংবিধানের এই পরিবর্তন সম্পর্কে প্রাবন্ধিক ফরহাদ মযহার বলেছেন, “খোদ রাষ্ট্রটিই সাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্র যদি সাম্প্রদায়িক হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতা কী করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে, এই যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। যদি আমরা সত্যি সত্যিই একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চাই, তাহলে আমাদের মনোযোগ ধাবিত হবে সংবিধানের দিকে।” প্রকৃতপক্ষে এ সময় থেকে জামায়াতে ইসলামী সহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার অধিকার লাভ করে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ‘নরঘাতক’ গোলাম আযমকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অস্থায়ী ভিসা প্রদান করা হয়। কিন্তু ভিসার মেয়াদকাল উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও গোলাম আযম অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে গোপনে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতে থাকেন। অসুস্থ মা-কে দেখার অজুহাতে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে ইসলামি ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামক মোর্চা গঠনপূর্বক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলি আওয়ামী লীগ আমলে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া তারা নিজেরা সচেতনভাবে জারী করেছিল তারই পরিণতি ঘটেছিল জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের পুনরাবির্ভাবে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়। এই সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে।

এরশাদের স্বৈরশাসন আমল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে এক পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ মার্চ তাঁকে গদিচ্যুত করে সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে সাত দল ও পনের দলের যুগপৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন জামায়াতে ইসলামীও বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে অবস্থান নিয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে, বিশেষত ১৫ দল ও ৭ দলীয় জোট গঠনের পর থেকে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয় অন্যদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে শরীক হয়।

উল্লেখ্য যে, এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে (১৯৮১-১৯৯০) বিরোধী দলগুলি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও ইসলামী দলগুলি তাদের স্বার্থ আদায়ে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করে। এ সময় এরশাদ কর্তৃক ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ঘোষণা, বেতার ও টেলিভিশনে আজান প্রচার প্রবর্তন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশে ইমাম প্রশিক্ষণ ও কওমী মাদরাসাসমূহে ঈর্ষণীয় অর্থ বরাদ্দসহ, সিরাতমিশন ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলির সাথে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এরশাদের শাসনামলেই (৩ জানুয়ারি, ১৯৮৩ খ্রি.) বাংলাদেশে মসজিদ-মন্দির উপাসনালয় করমুক্ত ঘোষিত হয়। নিজে রাষ্ট্রপতি পদ মর্যাদায় অতৃপ্ত হয়ে আরো অধিক মর্যাদা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এক পর্যায়ে ‘কবি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ফলে স্বগোত্রীয় কবিরা যারা তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ অভিধায় ভূষিত করেছিল তারাই আবার স্বস্বার্থে এই ‘ভণ্ড ইসলামী চিন্তাবিদ ও কবি’ বনাম রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে জমির প্লট বরাদ্দসহ নানাবিধ সুবিধা হাতিয়ে নেয়।

খালেদা জিয়ার আমল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১৮টি আসন পেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। পরবর্তীকালে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ তারিখে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানী নাগরিক ঘাতক গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি এবং অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এই কমিটির ব্যানারে ২৬ মার্চ ১৯৯২ বেলা ১১-৩০ মিনিটে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের মাধ্যমে পাকিস্তানী নাগরিক একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং ১২টি সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনকালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশও সে আন্দোলনে শরীক হয়।

শেখ হাসিনার আমল (১৯৯৬-২০০১) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী মাত্র ৩টি আসন লাভ করে। উক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সরকারবিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ইত্যাদি ধর্মভিত্তিক দলগুলোও শরীক দল হিসেবে উক্ত আন্দোলনে যোগদান করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টি (না-ফি), জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোটের একটি মোর্চা গঠিত হয় যা ‘চারদলীয় জোট’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উক্ত চারদলীয় জোট সর্বমোট ২১৪টি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৫৮টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

চারদলীয় জোট সরকার (২০০১-২০০৬) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ১০ অক্টোবর সরকার গঠন করে। জোটের শরীক দল হিসেবে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর (কৃষি মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়; পরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে শিল্প মন্ত্রণালয়) লাভ করতে সক্ষম হয়। জোটের শরীক অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো কোন মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্বভার না পেলেও সংসদীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, যারা চারদলীয় জোট-বহির্ভূক্ত এবং অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তারাও বিরোধী দল হিসেবে সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৭ অক্টোবর ২০০৫ তারিখে বাংলাদেশে জঙ্গি ধর্মীয় সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী’-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠি জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে জেএমবি’র বোমা হামলায় দু’জন সিনিয়র সহকারী জজ নিহত ও আরও তিনজন ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। উক্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ঝালকাঠি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত কর্তৃক সিদ্দিকুর ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ সাতজন শীর্ষ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অপর পাঁচজন হলেন আতাউর রহমান সানী, আবদুল আউয়াল, ফারুক হোসেন খান ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ, সুইসাইড বম্বার ইফতেখার হাসান আল মামুন এবং আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৯) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেকে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২২ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর জনাব ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে নতুন কিছু মেরুকরণ দেখা দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে ‘ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) নামে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে। দলটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মাওলানা শেখ আবদুস সালাম। এছাড়া নাম সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায় চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী শাসনতন্ত্র (ইশা) আন্দেলন। দলটির নতুন নাম রাখা হয় ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’। দলটির জন্য প্রতীক বরাদ্দ করা হয় ‘হাতপাখা’। পাশাপাশি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশও এ আমলে নিবন্ধন পায়। মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন দলের আরেকটি অংশও নিবন্ধন পায়। এই অংশের নাম রাখা হয় খেলাফত মজলিশ। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-কে তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হয়। দলের নামও পরিবর্তন করতে হয়। দলের নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। তাছাড়া চার দলীয় জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) সময়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শায়খ আবদুর রহমানসহ ৬ জন জঙ্গীর ফাঁসি ২৯ মার্চ ২০০৭ তারিখে কার্যকর করা হয়।

শেখ হাসিনার আমল (২০০৯-২০১৪) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পরপরই ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাশ করা হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার। সে লক্ষ্যে নবনির্বাচিত সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে The International Crimes (Tribunals) Act, 1972 (Act No. XIX of 1973) এর ৬ ধারা অনুযায়ী ২৫ মার্চ ২০১০ খ্রি. তারিখে একজন চেয়ারম্যান ও দুই জন সদস্যের সমন্বয়ে প্রথম এবং ২২ মার্চ ২০১২ খ্রি. তারিখে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য একজন চীফ প্রসিকিউটরসহ মোট ২৪ জন প্রসিকিউটর এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা তদন্তের জন্য একজন কো-অর্ডিনেটরসহ মোট ২২ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ঢাকা বিভাগে ১১২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৬৬টি, খুলনা বিভাগে ১৮৪টি সিলেট বিভাগে ৫০টি, বরিশাল বিভাগে ৫১টি, রংপুর বিভাগে ৩০টি সর্বমোট ৫৭৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এ সকল মামলার মধ্যে এই সময়কালে উভয় ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সর্বমোট ১০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। তার মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীগণ হলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী ও চৌধুরী মঈনদ্দিন। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন হলেন, জামায়াত ইসলামীর প্রাক্তন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপি নেতা কাজী আবদুল আলীম। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন। গোলাম আজম আমৃত্যু কারাভোগরত অবস্থায় এবং এ কে এম ইউসুফ বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এ সময় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়। এ সরকারের মেয়াদে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ৫ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের সংগঠন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আত্মপ্রকাশ করে। আত্মপ্রকাশের সময় থেকে গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে।

ক্রমশ এই কর্মসূচিগুলিতে সমমনা প্রায় সকল রাজনৈতিক দল তথা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী-নেতৃবৃন্দের সমর্থন-অ গ্রিহণ বাড়তে থাকে। পশ্চিমবঙ্গসহ বিদেশে অবস্থানরত সহমতের প্রায় সকলেই এতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। এক পর্যায়ে দেখা যায়, ‘জাগরণ’-এর অন্যতম নেতা ডা. এমরান এইচ সরকার বিভিন্ন মহলের প্রলোভন প্ররোচনায় নিমজ্জিত হয়ে ‘জাগরণের’ যাত্রা লক্ষ্যভ্রষ্টে নিপতিত হয়। এক পর্যায়ে “জাগরণের’ এই জনসমর্থন ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক অনেকটা ‘অধিগ্রহণ করার কায়দায় ‘জাগরণের’ জনপ্রিয়তা নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেয়। অতপর ‘জাগরণের’ জনপ্রিয়তা ক্রমশ বিড়ম্বনার বিস্ময় সৃষ্টি করে এবং জনমনে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখেই বিলুপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার আমল (২০১৪-২০১৫) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপর্যুপরি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এ সময় যুদ্ধাপরাধ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পূর্বের অবস্থান ও ভূমিকা অব্যাহত রাখে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সভাপতি করে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পূর্বের মেয়াদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় যথাক্রমে ২১ নভেম্বর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আখ্যায়িত করে তা মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আজ আমরা সবচেয়ে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যার একটি সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদ, এটি বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নেই, সীমানা নেই। সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ তবে এতকিছুর পরও আমরা লক্ষ্য করি জঙ্গিবাদ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জই থেকে যায়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা সর্বাধিক আলোড়িত ঘটনা। এই নিষ্ঠুর হামলায় দেশী বিদেশী বাইশ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।

তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার আমল (২০১৮-) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও উপর্যুক্তপরি তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনে নিবন্ধনপ্রাপ্ত প্রায় সকল প্রতিনিধিই অংশগ্রহণ করে। কেউ একক, কেউ-বা বড়ো দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, কেউ-বা স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সাংগঠনিক দুর্বলতা, সর্বোপরি বিজয়ী হলে সরকার প্রধানের পদ চূড়ান্তকরণের অমীমাংসা ইত্যাদি বহুমুখী জটিলতার কারণে আওয়ামী লীগের প্রশাসনিক শক্তির সহায়তার কাছে হেরে যায়। ভোটার উপস্থিতির সংখ্যাল্পতার এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৫৭টি, জাতীয় পার্টি ২২টি, বিএনপি ৬টি, ওয়াকার্স পার্টি ৩টি, স্বতন্ত্র ৩টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ২টি, গণফোরাম ২টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১টি ও জাতীয় পার্টি জে পি ১টি আসন লাভ করে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনে নিষ্ক্রীয়ভাবে হেরে যাবার পরে এই দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামিক দলগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিশেষত আল্লামা আহমেদ শফী’র নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের সাথে যুক্ত অপরাপর স্বগোত্রীয় ইসলামী দলগুলো সরকারের সাথে সখ্যতা বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়। এই সখ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে তাঁরা ‘কওমী মাতা’র খেতাব প্রদান করে। সেই সাথে সৌদি সরকারের অনুদানে নির্মিতব্য প্রত্যেক উপজেলায় ৫৬০টি ‘মডেল মসজিদ’ প্রকল্পে নীতি নির্ধারণী ভূমিকায়ও যুক্ত হয়।

উপসংহার

যেহেতু বাঙালির ধর্মবোধে প্রজ্ঞাপূর্ণ জ্ঞান প্রচ্ছন্ন নয়- সরল বিশ্বাস’ এর সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্তি সংযোগ ঘটাতে পারলে ধর্মবিশ্বাসীদের পরিতুষ্ট ও শান্ত করা সহজ হয়। এই সহজলভ্য ‘ছলনাময়ী’ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক বিকাশ ঘটে প্রজ্ঞার পরাজয় ‘অদ্ভুদ আঁধারে নিমজ্জিত হয় সমাজ। এই ‘অদ্ভুদ আঁধার থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘সূচেতনা’কে রাজনীতিতে ফিরে আসতে হয়। এতদ্ভিন্ন নির্বোধের ধর্মবোধতাড়িত ও সুবিধাভোগী দুর্বৃত্তায়নসম্পৃক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে, ধর্ম যখন দুর্বল হয় তখন সে রাজনীতিতে আশ্রয় নেয় আর রাজনীতি যখন দুর্বল হয় তখন সে ধর্মের আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ উভয়ের দুর্বলতায় একে অপরের পরিপূরকের ভূমিকা পালন করে। এমতাবস্থায় ধর্ম ও রাজনীতি উভয়েই স্বধর্মচ্যুত তথা মূল স্বভাব বৈশিষ্ট্য হারায় এবং প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। একারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক পোষকতায় পক্ষপাতী। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সুবচন এখনো নির্বাসনে আছে। তাই ধর্ম ও রাজনীতির পারস্পরিক প্রভাব এবং তার প্রয়োগ অপপ্রয়োগের যে-ইতিবৃত্ত এখানে উপস্থাপিত হয়েছে তাতে পাঠক তার প্রত্যাশিত সঠিক চিন্তা সম্প্রসারণে সহায়তা পাবেন। যেহেতু মানবকল্যাণে ধর্মের মূল আদর্শের ব্যবহার আর ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্ম বিশ্বাসকে ব্যবহার একই অর্থে মান্যতা পেতে পারে না। কেননা বিশ্বাস হিসেবে ধর্ম’ আর ‘মতাদর্শ হিসেবে ধর্ম’ একই তাৎপর্য বহন করে না। ধর্মদর্শনের এই মৌলিক পার্থক্য বিচারে অক্ষম মানুষের চিন্তার বিচ্যুতিই রাষ্ট্রীয় সর্বমানবিক বোধকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শাসকের স্বধর্মের সপক্ষে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের পদক্ষেপ প্রতিহত করতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্ত করার সকল অন্তরায় সুনিশ্চিতভাবে দূরিভূত করতে হবে।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

  • Muhammad Abdur Rahim, The Principles of Mohammedan Jurisprudence, Lahore, 1968
  • M. H. Quresh, Islamic Jurisprudence, Karachi, 1970 Thomas Scott, The Global Resurgence of Religion and the study
  • of World Politics, Millenium, 24/2, 1995
  • Mohammad Hasim Kamali, Principles of Islamic Jurisprudence, Islamic Texts Society, UK, 2003.
  • Mohamed El. Awa, Punishment in Islamic Law, American Trust
  • Publication, Nyrk, 2000 Dr. Hasan Zaman, Political Secience and Islam Islamic Foundation Bangladesh, Dhaka, 1986
  • Stainly Woolpart, Jinnah of Pakistan, Oxford University Press, 1984
  • Aesha Jalal, The Sole Spoke Man The Muslim League and Demand for Pakistan, Cambridge University Press, Karachi, 1985
  • Anita Indor Shing, The Origin of Partition of India (1936-1947))
  • Oxford University Press, Delhi, 1987 Joya Chatariee, India Divided, University Press Limited, Dhaka, 1991
  • Henry Campbell Black, Black’s Law Dictionary. (6th edition) St.
  • Paul Minn, West Publishing Co. London, 1990
  • J. Carbon and E. Owens (eds.), The Sacred and the Sovereign
  • Religion and International Politics, Washington DC Georgetown University Press, 2003. D F. Mullah, Principles of Hindu Law, Tripathi, Bombay, 1982 স্যার আবদুর রহীম, ইসলামী আইনতত্ত্ব (অনু গাজী শামছুর রহমান); ইসলামিক
  • ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮০
  • অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক, কুরআনের রাষ্ট্রনীতি; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৬
  • হারুনূর রশীদ, রাজনীতিকোষ; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৯
  • আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪ মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম তালুকদার, ধর্মদ্রোহী ব্ল্যাসফীমার ফৌজদারী ও মুরতাদ আইন; সজিব ল’ বুকস্, ঢাকা, ২০০৭
  • বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অনন্যা, ঢাকা ২০১০ সা’দ উল্লাহ, ধর্ম, রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা; অনন্যা, ঢাকা, ২০১০ শাহরিয়ার কবির, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মের নামে সন্ত্রাস: অনন্যা, ঢাকা, ২০১১ শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা; অনন্যা, ঢাকা, ২০১১ শাহেদ ইকবাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি; প্রকাশনা সুবর্ণ, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৬
  • আকবর আলি খান, অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি; প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৭ পিনাকী ভট্টাচার্য, মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম, প্রকাশনায়: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন, চতুর্থ সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৮
  • মিখাইল বাকুনিন, ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র (অনু.) অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.