Table of Contents
ভূমিকা
ব্রিটেনের উপর ফ্রান্সের পরাজয়ের পর বিপদ ঘনিয়ে আসে। তখনকার পরিস্থিতি শাসক মহলগুলাের ভেতর থেকে মিউনিখ নীতি অনুসরণকারী ব্যক্তিদের পৃথকীকরণে ও ব্রিটিশ জনগণের শক্তিসমূহের সংহতি সাধনে সাহায্য করেছে। ১৯৪০ সালের ১০ মে নেভিল চেম্বারলেনের সরকারের পতন ঘটে এবং উইনস্টন চার্চিলের সরকার তার স্থলাভিষিক্ত হয়। এই সরকারটি অধিকতর ফলপ্রসূ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগঠনের কাজে হাত দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও ধীরে ধীরে তার বৈদেশিক নীতি পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করল। মার্কিন সরকার ১৯৪১ সালের বসন্তে গ্রীনল্যান্ডে আর গ্রীষ্ম কালে আইসল্যাণ্ডে সামরিক ঘাঁটি গড়ে ওখানে সৈন্য মােতায়েন করে।
১৯৪০ সালের ১৬ জুলাই হিটলার ব্রিটেন আক্রমণের নির্দেশপত্র স্বাক্ষর করে। ওটার সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘সাগরের সিংহ’। জার্মানদের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল – ইংল্যান্ডকে আক্রমণের আশঙ্কার মধ্যে রাখা এবং একই সঙ্গে, আর এটাই হচ্ছে প্রধান, সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণের আরব্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারটি গােপন করা। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান-ফ্যাসিস্ট বিমান বাহিনী ব্রিটিশ শহরগুলাের উপর ব্যাপক বােমাবর্ষণ আরম্ভ করে এবং ১৯৪১ সালের ১১ মে অবধি তা চলতে থাকে। ওই একই সময়ে আটলান্টিক মহাসাগরেও নাৎসি নৌ বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠে। তবে সােভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণের জন্য বিপলাকারে আরব্ধ প্রস্তুতি নাৎসি নেতাদের ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা পুরােপুরিভাবে ত্যাগ করতে বাধ্য করে। অধিকন্তু, সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল জার্মানি, ইতালি ও জাপানের জোট সুদৃঢ়করণের প্রশ্নটি এবং সেটা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৪০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে স্বাক্ষরিত বার্লিন চুক্তিতে।
ইংল্যান্ডের জন্য লড়াই
ইংল্যান্ডের জন্য লড়াইকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্যায়টির (১৯৪০ সালের ১৩ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত), এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্তরীক্ষে আধিপত্য অর্জনের জন্য জার্মান সেনাপতিমণ্ডলীর প্রচেষ্টা। এ থেকেই ব্রিটিশ বায়ুসেনার বিমান ঘাঁটিগুলাের উপর হামলার অত্যধিক প্রবলতা (২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১,০০০-১,৮০০ বিমান-উড্ডয়ন) এবং অন্তরীক্ষে কঠোর লড়াই।
দ্বিতীয় পর্যায়ের (১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত) প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল জনগণকে সন্ত্রস্ত করার ও তাদের মনােবল ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্যে লন্ডন এবং অন্যান্য বড় বড় ব্রিটিশ শহরের উপর বােমাবর্ষণ। ৭ সেপ্টেম্বর জার্মান বােমারগলাে রাত আটটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত লন্ডনের উপর অবিরাম বােমাবর্ষণ করে এবং সে রাতে প্রায় ৩০০ টন উগ্র বিস্ফোরক বােমা ও ১৩ হাজার আগুনে বােমা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। শহরের বিমানবিরােধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল ছিল বলে জার্মানরা অনেকগুলাে বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর পর থেকে সময় সময় লন্ডনের উপর হামলা ঘটত। তবে বিমান ঘাঁটিগুলাের উপর আর বেশি বােমাবর্ষণ না করে জার্মানরা যখন লন্ডনের উপর বােমাবর্ষণে মনোেযােগী হল তখন ইংরেজরা ফাইটার বিমানগুলাে হারানাের দরুন যে ক্ষতি হয় তা কিয়দপরিমাণ পুরণ করার ও নাৎসিদের প্রতি প্রতিরোধ প্রবলতর করার সুযোেগ পেল। ১৪ সেপ্টেম্বর রাত্রে লন্ডনের উপর হামলায় অংশগ্রহণ করে সহস্রাধিক জার্মান বিমান শহরের উপর শুরু হয় কঠোর বায়ুযুদ্ধ। ব্রিটিশ রাজধানীর নিকটে নিয়ে আসা ফাইটার বিমান বাহিনী ও বিমানধ্বংসী কামানগুলাে ফ্যাসিস্ট হামলাকারীদের প্রবল প্রতিরােধ দেয়। এর ফলে জার্মানরা ৬০টি বিমান হারায়, আর ইংরেজরা – ২৬টি। (বাটলের জ,, গুয়াইয়ের জ.। বৃহৎ রণনীতি। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪১ সালের জুন পর্যন্ত। ইংরেজী থেকে অনুবাদ। – মস্কো , ১৯৫৫, পৃঃ ২৭৫।) এই হামলার পর থেকে লন্ডনের উপর বােমাবর্ষণের প্রবলতা হ্রাস পেতে শুরু করে। ইংরেজদের মনোবল অক্ষম থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ে (১৯৪০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ১৯৪১ সালের মে পর্যন্ত) জার্মান-ফ্যাসিস্ট সেনাপতিমণ্ডলী তাদের বিমান বাহিনীর রণকৌশল বদলাতে বাধ্য হয়। তারা দিবাকালীন হামলার সংখ্যায় তীব্র হ্রাস ঘটিয়ে নৈশ হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেয়, এবং তখন আঘাতের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয় দেশের প্রধান শিল্প কেন্দ্রগুলাে : বামিংহাম, লিভারপুল, ব্রিস্টল, কভেন্ট্রি ও অন্যান্য শহর। সময় সময় লন্ডনের উপরও হামলা চলতে থাকে। ব্রিটিশ শিল্পের কাজ ব্যাহত করাই ছিল এই সমস্ত বােমাবর্ষণের উদ্দেশ্য।
ইংল্যান্ডের জন্য লড়াইয়ে জার্মান বিমান বাহিনী সর্বমােট ৪৬ সহস্রাধিক বিমান-উন্ডয়ন করে এবং ইংল্যান্ডের উপর প্রায় ৬০ হাজার টন বােমা ফেলে। জার্মানরা ১,৭০০-র বেশি বিমান হারায়। ইংরেজরা হারিয়েছিল ৯১৫টি বিমান ও ৫ শতাধিক বৈমানিককে। বােমাবর্ষণের দরুন বেসামরিক লােকজনের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক : ৮৬ সহস্রাধিক লােক, যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার নিহত। ১০ লক্ষাধিক বাড়ি নষ্ট হয়, অনেকগুলাে শহর ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।
তবে ফ্যাসিস্ট জার্মানির আসল উদ্দেশ্য – ব্রিটেনকে যুদ্ধ থেকে বার করে দেওয়া সিদ্ধ হল না। তার শিল্প বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি এবং সে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধের অবস্থায়ই থাকে। যে-ব্যাপারটি ইংরেজদের সাফল্যে সহায়তা করেছিল তা হল এই যে ওই সময় নাৎসিদের প্রধান কাজ ছিল সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি, সে উদ্দেশ্যেই তারা পশ্চিম থেকে সবচেয়ে যুদ্ধক্ষম বেশি সংখ্যক বিমান ইউনিটকে পূর্বে পাঠিয়ে দিয়েছিল। হিটলার ঠিক করল যে সে প্রথমে সােভিয়েত ইউনিয়নকে বিনাশ করবে, এবং কেবল তারপরই বিশ্বাধিপত্য লাভের পরবর্তী পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়িত করবে। ১৯৪০ সালের ৩ জুলাই তারিখে জেনারেল গাল্ডের এই প্রসঙ্গে তার ডায়েরিতে লিখেছিল যে সর্বাগ্রে দুটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে: একটা ব্রিটিশ সমস্যা, অন্যটা পূর্ব সমস্যা। ৩১ জুলাই ফিউরেরের সদরদপ্তরে সােভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণের পরিকল্পনাটি এবার আলােচিত হয় আশু কতব্য হিশেবে। জার্মান-ফ্যাসিস্ট নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল : রাশিয়া যদি পরাস্ত হয় তাহলে ইংল্যান্ড তার অন্তিম আশাটিও হারিয়ে ফেলবে। (গাল্ডের ফ.। সামরিক ডায়েরি, খণ্ড ২, পঃ ৮১।) সুতরাং, ইংল্যান্ডের অদৃষ্ট নির্ভর করছিল পূৰ্বাভিমুখে অভিযানের ফলাফলের উপর। সেই দিনই, ৩১ জুলাই, গাল্ডের লিখেছিল : ‘আচ্ছাদন: স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, ইংল্যান্ড।’ (ঐ ৮২)।
সামরিক দষ্টিকোণ থেকে জার্মান বিমান বাহিনীর বােমাবর্ষণ তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে নি অনেকটা এই কারণে যে ইংরেজরা ধীরে ধীরে শত্রুর বিমান আঘাত প্রতিহত করার পদ্ধতিগুলাে প্রস্তুত করছিল। এতে তাদের বিশেষ সহায়তা দেয় নবােদ্ভাবিত র্যাডার। ১৯৪০ সালেই তা ব্রিটেনের বিমানবিরােধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়েছিল।
আটলান্টিকের জন্য লড়াই (১৯৩৯ সালের সেলের থেকে ১৯৪১ সালের জুন পর্যন্ত)
আটলান্টিকের জন্য লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশগুলাে থেকে ইংল্যান্ডের সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত করা এবং অবরােধের দ্বারা তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা। গােড়াতে উভয় পক্ষ থেকে সামুদ্রিক যােগাযােগ পথগুলােতে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল সামান্য শক্তি। কিন্তু এরপ পরিস্থিতিতেও জার্মান ডুবাে জাহাজগলাে ফলপ্রসূতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল, এবং তা সম্ভব হয়েছিল ব্রিটিশ সাবমেরিনবিরােধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে।
১৯৪০ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নাৎসি সেনাপতিমণ্ডলী আটলান্টিক মহাসাগরে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে : ডুবাে জাহাজ আর ভাসমান জাহাজগুলাের সঙ্গে বিমান বাহিনীও লড়াইয়ে লিপ্ত হল। তাতে ব্রিটিশ নৌ-বহর শােচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আটলান্টিকের জন্য লড়াই চলা কালে, ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪১-এর জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে, মিত্র শক্তিসমূহের এবং নিরপেক্ষ দেশগুলাের মােট ৭৬ লক্ষ টনের মালবাহী জাহাজ ও যুদ্ধ-জাহাজ জলমগ্ন করা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে শতকরা ৫৩.৪ ভাগ জার্মান ডুবাে জাহাজ দ্বারা, ১৮.৭ ভাগ বিমানের বােমাবর্ষণের ফলে এবং প্রায় ১২ ভাগ ভাসমান যুদ্ধ-জাহাজের আক্রামণে জলমগ্ন করা হয়েছ। নাৎসি জার্মানি ওই সময়ের মধ্যে ৪৩টি ডুবাে জাহাজ হারিয়েছিল।
এই ভাবে, ব্রিটেনের বাণিজ্যিক নৌ-বহরের ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ও জাহাজ চলাচল পুরােপুরিভাবে বিঘিাত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সরকারী ব্রিটিশ ইতিহাসে বলা হয়েছে, ‘শত্রু, যদি অন্তত আরও কিছুকাল আঘাতের প্রাথমিক শক্তিটি টিকিয়ে রাখতে পারত তাহলে আমাদের অবস্থা বিপর্যয়কর হত।” (গুয়াইয়ের জ., বাটলের জ.। বৃহৎ রণনীতি… পৃঃ ২৫।)
সামরিক ও বাণিজ্যিক নৌ-বহরগুলাের কর্মীরা এবং ইংল্যান্ডের মেহনতী মানুষ তাদের শ্রমের দ্বারা দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদঢ়করণের কাজে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখে। এ ছাড়া, ব্রিটিশ সেনাপতিমণ্ডলী নতুন কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করেন: ফাইটার বিমান দিয়ে কনভয়গুলােকে আড়াল দেওয়া হত, বাণিজ্য পােতগুলােকে অস্ত্র-সজ্জিত করা হত, সময় সময় কনভয়গুলাের গমনাগমনের পথ পরিবর্তন করা হত, ঘাঁটিতে জার্মান ডুবাে জাহাজ ও ভাসমান জাহাজগুলাের অবরােধ সুদৃঢ় করা হত। ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর ক্রিয়াকলাপের ফলে ফ্রান্সের ব্রেস্ত বন্দরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জার্মান যুদ্ধজাহাজ ‘শার্নগােস্ট’ আর ‘গ্নেইজিনাউ’। আর ২৭ মে ব্রিটিশ নৌ-বহর বৃহত্তম জার্মানি যুদ্ধ-জাহাজ ‘বিসমার্ককে’ ডুবিয়ে দেয়। এই যুদ্ধ-জাহাজের জল-সমাধি জার্মান সামরিক নৌ-বহরের পক্ষে ছিল অতি শোচনীয় ক্ষতি। এ সমস্ত কিছু ইংল্যান্ডকে সাগর-মহাসাগরে আশঙ্কিত বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করেছে।
তথ্যসূত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ভিক্তর মাৎসুলেনকো
Leave a Reply